০৪. শিব-দুর্গার পাশাখেলা

শিব-দুর্গার পাশাখেলা

নারদ একদিন হর দ্বারে পৌঁছোনে শিব দর্শনে যাতারপর ধ্যানযোদ্ধবি ছিলেন

নারদ একদিন হর গৌরীকে দর্শনের অভিপ্রায়ে কৈলাসে গেলেন। গন্ধমাদনের অপূর্ব শোভা দেখতে দেখতে কৈলাসের দ্বারে পৌঁছোলেন। দ্বারে বিশ্বকর্মার তৈরি দুজন কৃত্রিম দ্বারপাল দাঁড়িয়ে ছিল।

দেবর্ষি নারদ বললেন– আমি শিব দর্শনে যাব, পথ ছেড়ে দাও। কিন্তু কি আশ্চর্যের বিষয় তারা কেউ কোনো উত্তর দিল না। ঋষি বিস্মৃত হলেন। তারপর ধ্যানযোগে সব বুঝতে পারলেন। তারপর কোনো কথা না বলে পুরীতে প্রবেশ করলেন। আরো অনেক মুনি ঋষি ছিলেন সেখানে। সবাই প্রণাম করলেন তাঁকে। আশ্চর্যবোধ করলেন তিনি। আরও এগিয়ে গেলেন।

দেখতে পেলেন একই আসনে শিব আর দুর্গা বসে আছেন। সর্পরাজ শঙ্খ শিবের পদসেবা করছেন। তক্ষাকাদি নাগগণ তার নানা সেবায় যুক্ত। বাসুকী তার কণ্ঠে অপূর্ব শোভা বিস্তার করছে। তার পাশে বসে আছেন শিবসীমন্তিনী সতী। মহাভক্ত নারদ প্রীতিভরে তাঁদের বন্দনা করলেন।

তারপর নারদের স্তবস্তুতি শুনে ভগবান শিব পরিতুষ্ট হয়ে বললেন—হে নারদ, তোমার কৈলাস পুরীতে কিসের জন্য আগমন? সার্বিক কুশল তো–এখন বল, তোমার জন্য আমাকে কি করতে হবে?

নারদ ঠাকুর বললেন– হে বিভো, আপনার দর্শন পেয়েই আমার হৃদয় পরিতুষ্ট। এখানে আমি এমনিই ক্রীড়ার জন্যই এলাম। কোনো উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য নয়। দেবর্ষি নারদের কথা শুনে পার্বতী বললেন– হে মুনি, আপনি কেমন ক্রীড়ার পক্ষপাতী?

তখন নারদ বললেন– দেবী জগতে নানারকম স্নাতক্ৰীড়া দেখা যায়। দুজন ন্যূতক্রীড়ায় মত্ত থাকলে সর্বসুখ লাভ করতে পারে। জগতে এমন সুখ আর কোনো ভাবেই হয় না। দেবর্ষি নারদের কথা শুনে দেবী বললেন– দ্যুতক্রীড়া জ্ঞান বুদ্ধি ধননাশক, তাহলে হে মুনি, আপনি কেমন করে বলছেন ‘দূতক্রীড়া প্রসিদ্ধ সুখদায়ক।

দেবী বললেন– হে নারদ, আমি আপনার সামনেই নাথের সঙ্গে দূত খেলব, আপনি দেখতে থাকুন।

এই কথা বলে দেবী সখীদের সঙ্গে নিয়ে শিবের সঙ্গে পাশাখেলার সামগ্রী এনে খেলতে লাগলেন। নারদঠাকুর দেখে খুব আনন্দ পেলেন। দুতখেলার নিয়ম অনুসারে পণ রাখতে হয়। প্রথমবার শিব ছল করে দেবীকে পরাজিত করলেন, এরপর নারদ ও শিব দুজনে দেবীকে উপহাস করে কথা বললেন। এমন উপহাসে দেবী ভীষণভাবে কূপিতা হয়ে নারদকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিলেন। তারপর শিবকে বললেন– আমি পণে হেরেছি, এবার বল তুমি কি পণ রাখবে?

শিব বললেন– আমার চন্দ্রলেখা, দুই কানের কুণ্ডল এই খেলায় পণ রাখলাম। দেবী তুমি আমাকে জয় করে এইসব স্বচ্ছন্দে নিতে পার।

আবার খেলা শুরু হল। এবার দেবীর জয় হল, শিবের প্রতি দেবী হাসতে হাসতে বললেন– নাথ, এবার আমি তোমাকে পরাজিত করেছি, কাজেই পণ অনুসারে ভূষণগুলো আমাকে দাও।

তখন শঙ্করও হাসতে হাসতে বললেন– দেবী তুমি বিচার করে দেখ, আমি কখনও হারি না। এ জগতে আমি অজেয়। কাজেই এমন কথা তুমি বলো না, আবার তুমি খেলতে শুরু কর, দেখবে আমিই জিতব। দেবী বললেন–আমি যে তোমাকে জয় করেছি, তাতে অবাক হবার কিছুই নেই। আসলে আজ তোমারই জয় হয়েছে।

এইভাবে হর-পার্বতী উভয়েই হাসতে হাসতে বিবাদ করতে লাগলেন, এতক্ষণ নারদ দূরে দাঁড়িয়ে তাদের দ্বন্দ্ব শুনছিলেন, তারপর আর থাকতে না পেরে তাঁদের কাছে এগিয়ে গিয়ে হাসতে হাসতেই বললেন– আমার একটি শান্তিপূর্ণ কথা আপনারা শুনুন। হে দেবী, এই দেবশঙ্কর মহাভাগ্যশালীদের বরেণ্য। তাকে আপনি কখনই জয় করতে পারেন না। ইনি ত্রিভুবনের অজেয়, আপনি নারী জাতি, তাই শিবকে ঠিকঠাক ভাবে জানতে পারেন নি।

নারদের ওই কথা শুনে দেবী ভীষণভাবে কুপিতা হয়ে বললেন– হে ব্রহ্মার পুত্র, আপনাকে নমস্কার। আপনি চাপল্যবশে আর কিছু বলবেন না। আপনার কথায় আমি বড় ভীত, তাই আপনি চুপ করে থাকুন।

অগত্যা নারদ চুপ করলেন। কিন্তু ভৃঙ্গী এবার মুখ খুললেন– হে ভামিনি, আপনি পুনরায় এরূপ বাক্য আর বলবেন না, আমার প্রভু শিব অজেয়। আপনি পূর্বে মদনের সাহায্যে শঙ্করকে লাভ করেছেন, পূর্বে এই শূলপানি যা যা করেছেন, আপনার কি মনে নেই? ভৃঙ্গীর কথায় ভবানী ভীষণভাবে রেগে গিয়ে বললেন– হে ভৃঙ্গী, তুমি অযৌক্তিক কথা বলছ। এটা তোমার পক্ষপাতিত্ব। কেমন করে তুমি আমাদের মধ্যে ভেদ দেখলে?

তখন ভৃঙ্গী বললেন– পিতা দক্ষের যজ্ঞে আপনি শিবনিন্দা শুনে প্রাণ ত্যাগ করেছিলেন, আর এখন কি বলছেন? এখন দেখছি শিবের প্রতি আপনার প্রেমভক্তি নাই। আপনি শিবপ্রিয়া, তাই আপনাকে এ সকল কথা বললাম। এখন আপনি শিবের সেবা করুন। শিব সর্বেশ্বর, ভৃঙ্গীর এমন কথা শুনে দেবী বললেন– ভৃঙ্গী তুমি চুপ কর। তা নাহলে এখান থেকে দূর হও। তোমার কোনো ভাল-মন্দ জ্ঞান নাই। পিশাচের মত কথা বলছ। আমি কে, আর এই শিব কে? তোমার ভেদবুদ্ধি দ্বারা সে তত্ত্ব জানতে পারবে না। আমি তোমাকে অভিশাপ দিচ্ছি। তোমার দেহ মাংসহীন হবে।

দেবী ভবানী এই কথা বলে সকোপে শম্ভুর দেহ থেকে তাঁর অলঙ্কার সকল খুলে নিলেন। চন্দ্রকলা, উত্তম পেটিকা, কর্ণভূষণ, দুই কুণ্ডল, বাসুকা, হার প্রভৃতি সকল ভূষণই হাসতে হাসতে কেড়ে নিলেন। সবশেষে কৌপীণটুকুও রাখলেন না তিনি। তাই দেখে প্রমথগণ ও পার্বতীর সখীগণ লজ্জায় মুখ ফেরালেন।

তখন ভৃঙ্গী, চণ্ড, মুণ্ড, প্রভৃতি গণেরা খুব দুঃখিত হলেন। সেই অবস্থা দেখে শিব লজ্জিত ও ক্রোধিত হয়ে দেবীকে বললেন– হে দেবী, তুমি এ কি করলে? ঋষিগণ সকলেই উপহাস করছেন। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, ইন্দ্রাদি দেবতাগণ সকলেই উপহাস প্রিয়। হে ভবানি, তুমি সদকুলে জন্মে আজ এমন কাজ কেন করলে? যদি সত্যিই আমাকে তুমি জয় করে থাক, তাহলে আমার সকল ভূষণ নিতে পার, কিন্তু কৌপীন ফিরিয়ে দাও।

মহেশের কথা শুনে দেবী হাসতে হাসতে বললেন– হে শম্ভু, তোমার কৌপীণে কি কাজ? তুমি তো দিগম্বর হয়ে দারুবনে ঘুরে বেড়িয়েছিলে, তা দেখে মুনি পত্নীগণ মোহিত হয়েছিলেন। তোমার কৌপীণ তখন কোথায় ছিল? তাই বলছি তুমি পাশাখেলায় যা হেরেছ, তাতে তোমার কোনো অধিকার নেই। দেবীর মুখে এই কথা শুনে মহেশ্বর রুদ্র মূর্তি ধারণ করে তৃতীয় নয়নে দেবীর দিকে তাকালেন। তখন প্রমথগণেরা সকলেই ভয় পেলেন, কিন্তু দেবী সবার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে মহেশ্বরকে বললেন– হে ভব, তুমি তৃতীয় নয়নে আমাকে এভাবে দেখছো কেন? আমাকে ভস্ম করবে? আমি কাল নই, ত্রিপুর বা অন্ধকও নই, তুমি এভাবে আমায় দেখলেও আমার কিছুই হবে না।

দেবী এইভাবে অনেক কথা বলার পর, শিব সেখান থেকে চলে যাওয়ার কথা ভাবতে লাগলেন। বাস্তবপক্ষে বিজন বনই আমার পক্ষে শুভ। যে একা সব ত্যাগ করে নির্জনে বাস করে সেই সুখী, সেই পণ্ডিত।

শিব এমন স্থির করে কোনো এক অদ্ভুত কথা বলে চলে গেলেন। তখন কৈলাসবাসী সকল প্রমথগণ তার পেছনে পেছনে চললেন, ভৃঙ্গী একটি ছাতা নিয়ে তার মাথায় উপর ধরে চলতে লাগলেন। নন্দীও চললেন চামর ব্যাজন করতে করতে। শঙ্করের বৃষ আগে আগে চলল।

এদিকে এসব দেখে দেবী পার্বতী অন্তঃপুরে খুব দুঃখ পেলেন। তিনি তখন অন্তরে মহেশ্বরের ধ্যান করতে লাগলেন। তাই দেখে সখী বিজয়া দেবীকে বললেন– হে সতি, তুমি বহু সাধনার পরে শিবকে লাভ করেছে। তাহলে তুমি তার সঙ্গে কেন পাশা খেলতে গেলে? তুমি নিশ্চয় জানো পাশাখেলা উচিত না। তার কাছে গিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করো। যদি এমন না করো তাহলে পরে আরও দুঃখ পেতে হবে।

বিজয়ার কথা শুনে দেবী হাসতে হাসতে বললেন– ওই নির্লজ্জ মহাদেবকে আমিই বিভূতি-যোগে হরণ করেছি। এখন আমার কিছুই করার দরকার নেই। আমাকে ছাড়া ওনাকে বিরূপ হয়ে থাকতে হবে। আমি শিবকে রূপবান করেছি। তাই এখন আর অন্য কিছু বলল না। আমার সঙ্গে শিবের যোগ বা বিয়োগ কখনই ঘটে না। হে বিজয়া, এমন তুমি আমার খেলা দেখ।

দেবী এই কথা বলে এক শবরীর রূপ ধারণ করে শিবের উদ্দেশে চলে গেলেন। হাতে ধনুর্বান, তার চারদিকে অনেক সখী, মহেশ্বরের কাছাকাছি গিয়ে তাকে দেখতে লাগলেন।

দূর থেকে শিবও শবরীকে দেখলেন, কামে ব্যাকুল চিত্তে আসন ছেড়ে উঠে মহেশ এগিয়ে যেই তাঁর হাত ধরতে গেলেন তখনই দেবী অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

সবার যিনি ভ্রান্তি নাশ করেন, তিনিই আজ ভ্রান্তচিত্তে সেই অপূর্ব সুন্দরী শবরীর খোঁজ করছেন। যিনি স্বয়ং কামদেবকে ভস্ম করেন, আজ নিজেই কামাসক্ত হয়ে পড়লেন।

এইভাবে শিব যখন উন্মত্তপ্রায়, তখন দেবী আবার সেই রূপেই তাঁকে দেখা দিলেন। তখন শিব বললেন– হে সুন্দরী, তুমি আগে আমার কথা শোন, তারপর যা বুঝবে করবে। কে তুমি? তুমি কার? কিসের জন্য এই বনে এসেছ?

দেবী বললেন–আমি স্বতন্ত্র, পতির সন্ধানেই বেরিয়েছি।

দেবাদিদেব বললেন– আমিই তোমার পতি হতে চাই।

দেবী বললেন– হে দেব, মহা তপস্যা করে যে রমণী, তোমাকে পতিত্বে বরণ করেছে, তুমি তাকে ত্যাগ করেছ, বনে চলে এসেছ। তাই বুঝলাম, তুমি সদা সকল প্রাণীর দুরারাধ্য, অতএব তুমি এখন যা বললে, তা আর আমার কাছে বলল না।

শিব বললেন– হে শোভনে, তুমি এমন কথা বলো না, আমি সেই পত্নীকে ত্যাগ করিনি, আমি যদি তাকে ত্যাগই করব, তাহলে কি এমন কথা বলতে পারি?

তার উত্তরে দেবী বললেন– তুমি সন্ন্যাসী, তুমি সংসার বিরাগী। তুমি মদনকে দগ্ধ করেছ। তোমাকে আমি কিছুতেই পেতে পারি না, অতএব তুমি আমাকে পূর্বে যা বলেছ, আর বলো না।

শবরীরূপিণী শঙ্করীর এমন বাক্য শুনে শিব বললেন– তুমি আমার পত্নী হও।

এই কথা বলেই শিব শিবার হাত ধরলেন। তখন দেবী হাসতে হাসতে বললেন– আমাকে ছেড়ে দিন, আপনি মুনি, আপনার দ্বারা এমন কাজ মানায় না। আমার বাবা আছেন, তার কাছে গিয়ে আমাকে চেয়ে নিন।

শিব বললেন– তোমার বাবার বাড়ি কোথায়?

তখন দেবী শিবকে সঙ্গে নিয়ে পিতার ভবনে গিয়ে হিমালয়কে দেখিয়ে দিলেন, শিব তখন হিমালয়কে প্রণিপাত করে বললেন– হে মহামতে, আপনার কন্যাকে আমায় দান করুন। এরপর শম্ভুর প্রকৃত জ্ঞান লাভ হল, হাসলেন তিনি, তারপর বললেন– নারীগণের সঙ্গ মাত্রেই নরগণের পতন অবশ্যম্ভাবী। নারীর মোহে পড়ে আমি পিশাচবৎ আচরণ করছি। এই কথা বলে তিনি গন্ধমাদন পর্বত ছেড়ে বনে চলে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। নারদাদি ঋষিগণ তার বহু স্তবস্তুতি করে পুনরায় তাকে গন্ধমাদন পর্বতে ফিরিয়ে আনলেন।