৪. শ্রীকৃষ্ণ জন্ম খণ্ড

শ্রীকৃষ্ণ জন্ম খণ্ড

১.

নারায়ণ জানালেন, তিনি ব্রহ্মার কাছে এই সুন্দর উপাখ্যান শুনেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ খন্ড তিনি এবার শুনতে চান। এটি শুনলে জন্ম-মৃত্যু দুর হয়। এটি সর্বজ্ঞানের আলোর মত, হরিভক্তি দান করে, যা ভবসাগর পার হবার একমাত্র উপায়। সকল অংশে পূর্ণতম ঈশ্বর হলেন শ্রীকৃষ্ণ। ভারতে লোকে হরির সম্বন্ধে সবকথা শুনে জন্মসফল করে। যে হরিভক্ত তার বিপদ হয় না বা আয়ুক্ষয় হয় না। যমও তার কাছে আসতে পারে না। সুদর্শনচক্র তার প্রহরায় দিনরাত্রি ঘুরে বেড়ায়। মৃত্যু ভয়ে মৃত্যুও আসে না তার কাছে। যে লোক স্ত্রী, পুত্র সবাইকে মনেপ্রাণে হরির ভক্ত বলে মনে করে, তাকে ভক্ত বলেন পণ্ডিতরা। সেইই প্রকৃত ভক্ত ও জ্ঞানী যে মিষ্ট কিছু হরিকে নিবেদন করে আনন্দিত হয়ে ওঠে। বৈষ্ণবভক্ত সর্বদা নিজের আগের পুরুষ ও পরের সাতপুরুষ, মাতামহ, বোন, মা, স্ত্রী, কন্যা, বন্ধু, পিতা, দৌহিত্র, সকলকে উদ্ধার করে। বৈষ্ণবদের স্পর্শে সকল পাপ নষ্ট হয়। যারা পাপিষ্ঠ বৈষ্ণবের স্পর্শে মুক্ত হয় ও মধুসূদন তার পাপ নষ্ট করেন। এবার কৃষ্ণের জন্মলীলা বৃত্তান্ত বিবৃত করা হবে।

২.

কৃষ্ণের ব্রজে আসা, গোপবেশে যে কারণে রাধা গোপিকা, এখন সেই কৃষ্ণলীলা বলছি শোন। পূর্বে গোলোকধামে রাধিকার সঙ্গে শ্রীদামের ঝগড়া হয়। রাধার শাপে শ্রীদাম শঙ্খচূড়রূপে জন্মায়, রাধাকে সেও শাপ দেয় যে-রাধা ব্রজে মানুষ হয়ে জন্মাবে। রাধা কৃষ্ণকে সে কথা জানালেন। শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে বুকে টেনে নিয়ে ভয় দূর করে বললেন–আমি বরাহ কল্পে পৃথিবীতে যাব। নারায়ণ শ্রীরাধার সাথে শ্রীদামের ঝগড়ার কারণ নারদকে জানালেন। নারায়ণ বললেন–একদিন হরি গোলকে নির্জন বনে রাসমন্ডলে বিহার করছিলেন। রাধা জানতে পারেনি কিন্তু কৃষ্ণের প্রিয়া বিরজা হরিকে দেখতে পেলেন।

তিনি নানা রত্নালংকারে সেজে পাতলা কাপড় পরে উদগ্রীব হয়ে আছেন। তার বয়স ষোলো। কামাতুর এই বিরজার সঙ্গে হরি ফুলের শয্যায় বিহার করলেন। রাধার কাছে সখীরা সেকথা জানালে, রাধা রেগে শুয়ে পড়লেন। রাধা সখীদের বললেন, তাঁকে বিরজার সাথে কৃষ্ণকে দেখাতে। রাধা রথে চড়ে তেষট্টিশোকোটি গোপীর সাথে বিরজার মণ্ডপে গেলেন, রত্ন বিছানা, রত্ন-পাত্র সমেত সোনার বেদীও কুঙ্কুমের মত লাল, রত্নের কোটি সিঁড়ি, যুথিকা ফুলের কোটিমালা, নানা সরোবর, কানন এবং শৃঙ্গারের উপযুক্ত এককোটি বিছানা। বিরজার মণ্ডপের দরজার গোড়ায় শ্রীকৃষ্ণের প্রিয়সখা শ্রীদামকে দেখলেন। রাধা তাকে দূর হতে বললেন। রাধার সখীরা শ্রীদামকে জোর করে মণ্ডপের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। কৃষ্ণ ভয়ে পালিয়ে যাবার ফলে বিরজা দেহত্যাগ করলেন। তাঁর শরীর নদীতে পরিণত হল এবং তা নানা রত্নের আকার হল।

৩.

শ্রীকৃষ্ণ বিরজাকে নদী হতে দেখে কাঁদতে লাগলেন। বিরজা তখন রাধার মত সুন্দরী ও পীত কাপড় পরে এসে হরির সামনে হাজির হল। তিনি সুন্দরীদের মধ্যে ধন্য ও মান্য হলেন। তার হাতে রত্ন। কাকন, রত্নকেয়ূর ও সুন্দর শঙ্খ। হরিও তখন নানাভাবে বিপরীত শৃঙ্গার করলেন। বিরজা একদিন হরির সাথে আবার বিহার করছেন, তখন তাঁর ছোট ছেলে এসে আশ্রয় নিল মায়ের কোলে, হরি বিরজাকে ত্যাগ করলেন। বিরজা তখন নিজ ছেলেকে লবণ সমুদ্র হবার শাপ দিলেন। আর অন্য ছেলেদের শাপ দিলেন পৃথিবীতে যাবার। এরপর সাতভাই সাত দ্বীপে অবস্থান করতে লাগল। তারা হল– লবণ, আখ, সুরা, সাপ, দধি, দুগ্ধ ও জল। এদের জন্ম হল কেবলমাত্র শস্যের জন্য।

বিরজা পুত্রশোকে কান্না শুরু করলেন। হরি তাঁকে দেখা দিলে তিনি কামাতুর হয়ে হরিকে কোলে নিয়ে বিহার করতে লাগলেন। রাধা তখন হরিকে বললেন, বিরজা নদী হয়েছেন। নদীর সাথে নদকেই মানায়, তাই হরির নদ হওয়া উচিত। রাধা রাগে হরিকে কুবাক্য বললেন–শ্রীদাম তাকে বললেন, মা তুমি কেন প্রভুকে খারাপ কথা বলছ? রাধা শ্রীদামের কথায় রেগে গিয়ে তাঁকে শাপ দিয়ে বললেন–যে–তুই অসুর হয়ে জন্মাবি। শ্রীদামও তখন রাধাকে শাপ দিল মানুষ হয়ে জন্মাবার জন্য এবং বললেন–হরির সাথে তার বিভেদ হবে একশো বছরের। পরে প্রভুকে পেয়ে গোলোকে আসবেন। শ্রীদাম কৃষ্ণকে সব জানালে, কৃষ্ণ তাঁকে বলে দিলে সে অসুরশ্রেষ্ঠ হবে। শঙ্করের শূলের আঘাতে তার মৃত্যু হবে। বরাহকল্পে রাধা হরির সঙ্গে পৃথিবীতে এলেন ও গোকুলে বৃষভানুর ঘরে জন্ম নিলেন।

৪.

বরাহকল্পে পৃথিবী ভারাক্রান্ত হওয়ায় দেবতারা শোকার্ত হয়ে ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলেন। ব্রহ্মলোকে উপস্থিত হয়ে তাঁরা ব্রহ্মাকে দেখলেন। তখন ঋষীন্দ্র, মুনীন্দ্র ও সিদ্ধেন্দ্ররা তাকে সেবা করছেন। দেবতারা ব্রহ্মাকে বললেন–যে, পৃথিবী ভারাক্রান্ত হয়েছে। ব্রহ্মা পৃথিবীকে সে কথা জিজ্ঞেস করলে পৃথিবী জানাল যে–অবলা স্ত্রীজাতিকে পিতা বা স্বামী বা পুত্ররা রক্ষা করে। আমি কৃষ্ণের নিন্দাকারীদের ভার বইতে অক্ষম। ঐকথা শুনে ব্রহ্ম অন্যান্য দেব বৈকুণ্ঠধামে গেলেন। হরি তাঁদের বললেন, তিনি গোকুলে যাবেন। দেবতারা সুন্দর রাসমণ্ডলকে দেখে বন থেকে বেড়িয়ে পড়লেন, এবং দেখতে পেলেন বৃন্দাবন। ঐ গোলোকধামের চারদিকে রত্ন পাঁচিল, চার দরজা, দরজা পাহারা দিচ্ছে। গোপালকরা। তারা তার কিছুদুর গিয়ে রাধার রমণীয় আশ্রম দেখলেন। এর সৌন্দর্য কথায় প্রকাশ করা যায় না। দেবতারা সেখানে সুন্দর নাচ দেখলেন ও গান শুনে মোহিত হয়ে গেলেন। এই গোলোক ব্রহ্মাণ্ডের বাইরে এবং সর্বলোকের উপরে অবস্থিত। যার উপরে আর কোন লোক নেই। সেখানে কেউ যেতে পারে না। তার নীচে আছে জল আর অন্ধকার, সেটা দেখা যায় না।

৫.

এই গোলোকধাম দেখে দেবতারা রাধার আলয়ের মূল দরজায় গেলেন। সেখানে বীরভানু নামে একজন পাহারা দিচ্ছিল। নানা ছবি আঁকা সেই দরজায় এসে দেবতারা সেই ভবনের অভ্যন্তরে প্রবেশের ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন। দেবতারা দ্বারীকে সম্ভাষণ জানিয়ে ভবনের দ্বিতীয় দরজায় এসে উপস্থিত হলেন। কৃষ্ণের চাঁদের মত সুন্দর মুখ, শরৎকালের ফোঁটা পদ্মের মত সৌন্দর্য, ঠোঁটদুটো পাকা বিম্বফলের মতো। দেবতারা সেখানে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণের তেজে তেজোময় হয়ে স্তব করলেন। ব্রহ্মা, শিব ও ধর্মের করা শ্রেষ্ঠ স্তব হরির পুজোর সময় যে পড়ে সে হরির নিশ্চল ও দুর্লভ ভক্তি লাভ করে। দেবতা ও মুনিরা যা পায় না সেই হরির দুর্লভ দাসত্ব প্রভৃতি চার রকম মুক্তি লাভ করে। তার যশে সকল জগৎ পূর্ণ হয়। সে পুত্র, কবিতা, বিদ্যা ও অক্ষয় সম্পদ লাভ করে, তার স্ত্রী সতী হয়। পুত্র-পৌত্রে সংসার পূর্ণ থাকে। সে কৃষ্ণের কাছে বাস করে মৃত্যুর পর।

৬.

কৃষ্ণের তেজের সামনে কিছুক্ষণ থেকে দেবতারা সেই তেজের মধ্যে অবস্থিত তার সুন্দর শরীর দেখতে পেলেন। তিনি সকলকে প্রসন্ন দৃষ্টিতে দেখলেন। দেবতারা সেখানে রাধাকেও দেখতে পেলেন। প্রত্যেকের মনের বাসনা পূরণ হল। দেবতারা তাদের যুগলের উদ্দেশে নানা স্তব করতে লাগলেন। শিব বললেন– মাছের মত আমার মন এই সংসার সমুদ্রে ডুবে সবসময়ই সংসার কূপে ঘুরছে। দয়া করে আপনি সৃষ্টি ধ্বংস রূপ এই সব নিন্দনীয় বিষয় থেকে আমাকে মুক্ত করে আপনার চরণপদ্মে ভক্তি দান করুন।

ব্রহ্মা হরির সামনে দাঁড়িয়ে খুব বিনয়ের সঙ্গে জোড় হাতে বললেন– কে কোথায় জন্মাবেন আদেশ করুন। শ্রীকৃষ্ণ বললেন–কামদেব রোহিণীর ছেলে হয়ে জন্ম নেবেন। রতি মায়াবতী নামে শঙ্করের ঘরে জন্ম নিয়ে ছায়ারূপে থাকবেন। তুমি মায়াবতীর গর্ভে রোহিনীর ছেলের ছেলে হয়ে জন্ম নেবে। নাম হবে অনিরুদ্ধ। ভারতী জন্ম নেবেন শোণিতপুরে বানের মেয়ের হয়ে। দেবকীর গর্ভে জন্ম নেবেন কৃষ্ণ, পরে তাঁর গর্ভ থেকে যোগমায়াকে আকর্ষণ করে নিজ গর্ভ রাখবেন। হরি দেবতাদের বললেন, যে যার কাজ করার জন্য নিজের ঘরে ফিরে যাও, পার্বতী ছেলে ও স্বামীকে নিয়ে কৈলাসে যাও।

তাঁর কথা অনুযায়ী গণেশ ছাড়া সকল দেবতাই পৃথিবীতে অবতীর্ণ হলেন। স্বামীর নিরূপিত স্থান দেবতাদেরও দুর্লভ। কৃষ্ণ রাধাকে বললেন–আগে গোপ-গোপীদের সঙ্গে বৃষভাণুর ঘরে যাও। রাধা হরিকে সাতবার ঘুরে প্রণাম করে পৃথিবীতে আসবার জন্য প্রস্তুত হলেন। গোপীদের ডেকে তাদের নিজের কাজে নিযুক্ত করে জগন্নাথ মনের মত শীঘ্রগামী রথে চড়ে মথুরায় গেলেন। আগে বসুদেব ও দেবকীর যে ছয়জন সন্তান জন্মেছিল তাদের সবাইকে কংস বধ করেছিলেন। সপ্তমগর্ভ হরির আদেশে মায়া আকর্ষণ করে রোহিণীর গর্ভে স্থাপন করেন।

৭.

যদুবংশের আহুকের পুত্র শ্রীসম্পন্ন জ্ঞানসিন্ধু দেবক নামে এক রাজা ছিলেন। তার মেয়ে হয়ে জন্মায় দেবকী। বাসুদেবের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয় ও তাঁর একে একে ছয় পুত্র জন্মায়, তাদের কংসের হাতে তুলে দেন বসুদেব। কংস তাদের বধ করেন। এরপর দেবকী অষ্টমবার গর্ভবতী হন। তাঁর গর্ভ পূর্ণ হল বায়ুতে। তিনি মনে মনে হরিকে ডাকতে লাগলেন। রাতের দুই প্রহর কেটে গেলে সম্পূর্ণ আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে পড়ল, আটরকম বায়ু বইতে লাগল। দেবতারা সকলে পুষ্পবৃষ্টি করতে লাগলেন। যে ঘুম থেকে উঠে ভগবানের বত্রিশটি নাম পাঠ করে, তার হরির প্রতি অচলা ভক্তি ও কাঙ্খিত দাসত্ব লাভ হয়।

দেবকী তখন মাটিতে পড়ে গেলেন। তার গর্ভ থেকে সমস্ত বায়ু বেরিয়ে গেল। শ্রীকৃষ্ণ দিব্যরূপ ধারণ করে দেবকীর হৃৎপদ্মকোষ থেকে আবির্ভূত হলেন।

কৃষ্ণ বললেন–কশ্যপের অংশে বসুদেবরূপে জন্ম নিয়ে তার পিতা হয়েছেন, দেবমাতা অদিতির অংশে দেবকীরূপে জন্ম নিয়েছেন। পূর্বে তিনি অদিতির গর্ভে বামন রূপে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।

৮.

জন্মাষ্টমী ব্রত হল, সপ্তমীর দিন সংযত হয়ে হবিষ্য করবে, পরের দিনও তাই। অষ্টমীতে সূর্য ওঠার সাথে সাথে বিছানা ছেড়ে প্রাতঃকৃত্য করে স্নান করে সঙ্কল্প করবে। ব্রত উপবাস কেবল কৃষ্ণের আনন্দের জন্য। মন্বন্তর দিনে স্নান ও হরি পূজা করে যে ফল খায়, ভাদ্র মাসের অষ্টমী তিথিতে স্নান ও পূজো করে সেই ব্যক্তি কোটিগুণ ফল পায়।

দেবকীর পুত্র রোহিণী নক্ষত্রে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিথি কেটে গেলে হরিকে স্মরণ করে পুজো করে পারণ করবে। যা অত্যন্ত পবিত্র এবং পুরুষদের সকল পাপ দূর করে। যা শুভ ফলদায়ক ও শুদ্ধির কারণ। যদি কোন লোক উপোস করতে না পারে, অন্তত একজন ব্রাহ্মণকে খাওয়াবে। অথবা অন্নের দ্বিগুণ পরিমান ধন ব্রাহ্মণকে দেবে।

৯.

শ্রীহরির এই লীলা কাহিনি অমৃতসমান। বৈকুণ্ঠে ও গোকুলে শ্রীকৃষ্ণ নিজেই পরিপূর্ণতম। তিনিই বৈকুণ্ঠে রূপভেদে চারহাত বিশিষ্ট কমলাকান্ত।

একদিন দ্রোণ ও ধরা পুণ্যক্ষেত্র ভারতবর্ষে গন্ধমাদন গোষ্ঠতমের আশ্রমের কাছে এসে সুপ্রভা নদীর তীরে কৃষ্ণের দেখা পাওয়ার জন্য অযুত বছর ধরে তপস্যা করলেন, তবুও কৃষ্ণের দর্শন না পেয়ে অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দিয়ে মরার জন্য তৈরি হলেন। আর সেই সময়ই দৈববাণী শুনে মনের আনন্দে বাড়ি চলে এলেন। পরে তাঁরা ভারতে জন্ম নিয়ে হরির দর্শন পেলেন।

কশ্যপ রুদ্রের সাথে ক্রীড়ায় আসক্ত হয়েছেন এবং সব সময় তাঁর বুকেই রয়েছেন, শুনে অদিতি স্বামীকে শাপ না দিয়ে রুদ্রকে অভিশাপ দিলেন, মানুষ হয়ে জন্মাবার।

১০.

দেবকীর সপ্তম গর্ভ প্রসব হয়নি, তা নষ্ট হয়েছে–একথা মিথ্যা। মায়া তাকে জঠরে রেখেছে। তাতে জন্ম হয়েছে বলদেবের। তারা দুজনে নন্দের গৃহে বড় হয়ে উঠছিল। কংস পুতনাকে পাঠালেন নন্দের বাড়ি। সেখানে পুতনা সুন্দরীর বেশে পৌঁছালো। মায়াবী পুতনা সেই নন্দ আলয়ে ঢুকে পড়ল। গোপীরা তাকে ঢুকতে দেখেও খারাপ কিছু মনে করল না। তারা ভাবল, লক্ষী কি দুর্গা কৃষ্ণকে দেখার জন্য এসেছে। পুতনা তাদের বলল, তিনি এক ব্রাহ্মণের পত্নী। সেই কথায় যশোদা আনন্দের সঙ্গে কৃষ্ণকে কোলে দিলেন। পুতনা কৃষ্ণকে স্তন্য পান করাতে লাগল।

কিন্তু কৃষ্ণ সেই বিষাক্ত স্তনকে অমৃতের মত পান করতে লাগল। পুতনা বিকট চিৎকার করে মুখ থুবড়ে পড়ে মরে গেল। কংস তা শুনে অত্যন্ত অবাক হলো। যশোদা তখন বাচ্চাকে কোলে তুলে স্তন পান করালেন। পুতনার আসল পরিচয় হল সে বলিরাজার কন্যা যজ্ঞমালা। তার বাবার যজ্ঞের সময় বিষ্ণুর বামন অবতারের সুন্দর রূপ দেখে পুত্র স্নেহে কাতর হয়ে পড়ে, আর মনে ইচ্ছা প্রকাশ করে যদি এ আমার ছেলে হত তবে তাকে আমার স্তন পান করাতাম। এর ফলেই কৃষ্ণের আশীর্বাদে পুতনা তাকে স্তন্য পান করাল। পরে মুক্তি লাভ করল।

১১.

এরপর বায়ুরূপ তৃর্ণাবর্ত এলে হরি অত্যন্ত ভারী হলেন। যশোদা তাঁকে কোল থেকে নামিয়ে দিলেন। অসুর হরিকে নিয়ে একশো যোজন দূরে নিয়ে চলে গেল ও গোকুলে অন্ধকার নেমে এল। এই অসুর আগে পান্ড্যদেশীয় রাজা ছিল, দুর্বাসার শাপে অসুর হয়েছিল। কৃষ্ণের পায়ের ছোঁয়ায় মুক্তি লাভ করল।

পান্ড্যদেশের রাজা কামনায় জর্জরিত হয়ে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে নির্জনে ঘুরে বেড়াতে লাগল। দুর্বাসা তাকে শাপ দেন তিনি যেন অসুর হয়ে জন্মান এবং হরির পাদস্পর্শে মুক্তি লাভ করে গোলকে যাবেন।

১২.

যশোদা একদিন কৃষ্ণকে স্তন্য দান করছিলেন। এমন সময় কয়েকজন গোপ বয়স্ক ও যুবতী নন্দের বাড়িতে এলে কৃষ্ণের স্তন্যপান পরিতৃপ্ত না হওয়া সত্ত্বেও যশোদা মা অতিথি অপ্যায়নে সচেষ্ট হলেন। কৃষ্ণ খিদেয় কাঁদতে কাঁদতে তাঁর পা বড় করে ফেললেন। আর যখনই তার পা পুরানো রথের ওপর পড়ল তখনি তা ভেঙে চুরমার হল। রথ ভেঙে কাঠের টুকরোগুলো নানা স্থানে পড়ল, আর রথের মধ্যে রাখা দুধ, দই, ঘি, ননী, মধুর মধ্যে পড়ে শিশুটি গড়াগড়ি খেতে লাগলো। যশোদা সেগুলি সরিয়ে তাঁকে বার করলেন।

যে বুদ্ধিমান লোক কৃষ্ণের দেওয়া কবচ সোনার গুটিকাতে করে গলায় ডানহাতে পরিধান করবেন তাঁকে জলে, স্থলে, আকাশে সেই কবচ রক্ষা করবে। অনন্ত এই কবচ ধারণ করে পৃথিবীকে ফুলের মত মাথায় করে রেখেছেন।

১৩.

একদিন এক ব্রাহ্মণ গোকুলে এলে যশোদা তাকে প্রণাম করলেন ও কৃষ্ণকে আশীর্বাদ করতে বললেন। সেই গর্গ মুনি নন্দ, যশোদা ও কৃষ্ণকে নিয়ে এক ঘরের মধ্যে ঢুকলেন। গর্গ তাঁদের জানালেন বাসুদেব কী কারণে তাদের পাঠিয়েছেন। তিনি বললেন–যে, এই পুত্ৰই বিষ্ণু তিনি কলিতে কৃষ্ণ বর্ণ নিয়ে জন্ম নিয়েছেন তখন কৃষ্ণের স্তব করতে লাগলেন গর্গ।

মুনি সব বলে কৃষ্ণকে নন্দর হাতে দিতে আজ্ঞা চাইলেন। নন্দ ও যশোদা বালককে বুকে করে সুখে, বাস করতে লাগলেন। ধীরে ধীরে কৃষ্ণ ও বলরাম হাঁটতে শুরু করলেন।

১৪.

যশোদা একদিন স্নানে গেলে কৃষ্ণ মাখন, ননী প্রভৃতি দেখতে পেলেন। সে সব খেয়ে ফেললেন। যশোদা তা দেখে বেত হাতে ছেলের পেছনে দৌড়লেন। কিন্তু তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। তখন কৃষ্ণ মায়ের সামনে এসে দাঁড়ালেন। মা যশোদা এই হয়রানির জন্য বিরক্ত হয়ে কৃষ্ণকে গাছের সাথে বেঁধে মারতে লাগলেন। সেই গাছ এক দিব্যরূপধারী গৌরবর্ণ কিশোর হয়ে রথে চড়ে স্বর্গে চলে গেল।

১৫.

কৃষ্ণের সঙ্গে নন্দ একদিন বৃন্দাবনের কাছে ভ্রান্তীর বনে গরু চরাতে গেলেন। গরুদের সেই সরোবরে সুস্বাদু জল খাওয়ালেন, আর নিজেও খেলেন। সেখানে দশদিক উজ্জ্বল করে দেবী রাধা এলেন। নন্দ তাঁকে দেখে অবাক হলেন। গর্গের কাছে শুনে নন্দ তাঁকে লক্ষী বলে চিনতে পারলেন।

ব্রহ্মা রাধার স্তব করলে রাধা তাকে বললেন–মনের মত বর চাইতে। ব্রহ্মা বললেন–আমার যেন আপনাদের দুজনের পাদপদ্মে অবিচল ভক্তি থাকে। রাধা বললেন–তবে তাই হোক। কৃষ্ণ রাধার হাত ধরে নিজের বুকে স্থাপন করে চার রকম চুমো খেয়ে তার কাপড় হাল্কা করে দিলেন। প্রিয় সঙ্গমে রাধার সকল অঙ্গ পুলকিত হল। কৃষ্ণ, আট প্রত্যঙ্গ দিয়ে রাধার প্রত্যঙ্গ আলিঙ্গন করে আট রকম শৃঙ্গার করলেন। তার হাত ও নখ দিয়ে সর্বাঙ্গ ক্ষত বিক্ষত করলেন। রাধা প্রতিদিন রাসমণ্ডপে হরির সঙ্গে রতিক্রীড়া করতে লাগলেন।

১৬.

মাধব একদিন খাওয়াদাওয়া করে শিশুদের নিয়ে গোধন সমেত খেলার জন্য শ্রীবনে গেলেন। মধুবনে। গিয়ে তাঁরা জল খেলেন। তখন এক সাদা রঙের দৈত্য সেখানে হাজির হল। তার নাম বকাসুর। সে কৃষ্ণ সহ সবাইকে গিলে ফেলল। কৃষ্ণ তাঁর তেজে দৈত্যর অঙ্গ প্রত্যঙ্গ পুড়িয়ে দিলে সে বমি করে মারা গেল। এরপর প্রলম্ব নামে এক অসুর ষাঁড়ের রূপ ধরে সেখানে এসে উপস্থিত হল এবং হরিকে শিং-এ ধরে আকাশে ঘোরাতে লাগল। কৃষ্ণ তাকে বধ করে ভাণ্ডারী বনে গেলেন। সেখানে দৈত্যরাজ কেশী তাঁকে আক্রমণ করলে সে কৃষ্ণের তেজে পুড়ে মারা গেল।

১৭.

বৃন্দাবনে গোপ-গোপীরা রাতের বেলায় শুয়ে পড়লে কৃষ্ণ মায়ের বুকে শুয়ে পড়লেন। বৃন্দাবনে বিশ্বকর্মা এলেন সকলের জন্য সুন্দর গৃহ ও আশ্রম নির্মাণ করলেন। তিনি যত্ন সহকারে কলাবতীর ঘর তৈরি করলেন। এই কলাবতী লক্ষীর অংশ স্বরূপ। রাজা ভালন্দনের মেয়ে তিনি, বৃষভানু তাঁর উপযুক্ত স্বামী।

নারায়ণ রাধার ষোলো নাম বললেন–রাধা, রাসেশ্বরী, রাসবাসিনী, রসিকেশ্বরী, কৃষ্ণপ্রাণাধিকা, কৃষ্ণপ্রিয়া, কৃষ্ণস্বরূপিনী, কৃষ্ণসমাংশস্তৃতা, পরমানন্দরূপিনী, কৃষ্ণা, বৃন্দাবনী, বৃন্দা, বৃন্দাবন বিনোদিনী, চন্দ্রাবলী, চন্দ্রকান্তা, শতচন্দ্রনিভানো।

১৮.

নারায়ণ নারদের অনুরোধে পরমেশ্বরের অদ্ভুত চরিত লীলা বর্ণনা করলেন। কৃষ্ণ একদিন বলদেব ও বালকদের সাথে যমুনাতীরে গেলেন। সেখানে পৌঁছে তাঁরা ক্ষুধার্ত হয়ে পড়লে কৃষ্ণ তাঁদের বললেন, ব্রাহ্মণীদের কাছে খাবার চাইতে। তাঁর কথায় বালকরা ব্রাহ্মণীদের কাছে খাবার চাইলে তার বালকদের পরিচয় জানতে চাইল। ব্রাহ্মণীরা কৃষ্ণের কথা শুনে নানা থালায় নানা খাবার সাজিয়ে কৃষ্ণের কাছে যাবার জন্য প্রস্তুত হলো। ব্রাহ্মণীদের নিজের পায়ের ওপর পড়ে থাকতে দেখে কৃষ্ণ তাদেরকে বর চাইতে বললেন। তারা তখন বলল, তারা কোনো বর নেবে না, কেবল তারা বিষ্ণুর চরণপদ্মই প্রার্থনা করবে।

১৯.

কৃষ্ণ একদিন বলদেব ছাড়া অন্যান্য বালকদের সাথে যমুনাতীরে এসে উপস্থিত হলেন ও যমুনার জল পান করলেন। গরুগুলি বিষজল পান করে বিষের জ্বালায় অস্থির হয়ে তক্ষুনি মারা গেল। কৃষ্ণ তাদের বাঁচিয়ে তুলে একশোহাত উপরে লাফিয়ে কদম্বগাছে উঠে জলের মধ্যে সাপের ঘরে কঁপ দিলেন। জলের মধ্যে মানুষ দেখে কালীয় সাপ তাকে গিলে ফেলল। কিন্তু ব্রহ্মতেজে উদ্বিগ্ন হয়ে বমি করে আবার বের করে দিল। রক্ত বমি করতে করতে অজ্ঞান হয়ে পড়ল। সাপের স্ত্রী সতী সুরলা হরির সামনে কাঁদতে লাগল। নাগেশ্বরী ভক্তিতে মাথা নীচু করে স্তব করে কৃষ্ণের পা জড়িয়ে ধরলো। যে তিন সন্ধ্যায় নাগপত্নীর করা স্তোত্র পাঠ করে, তার সকল পাপ নাশ হয়। সে মৃত্যুর পরে হরিমন্দিরে যায় এবং ইহকালে হরিভক্তি লাভ করে ও পরে হরির দাসত্ব লাভ করে।

হরি-নাগেশ্বরীকে ছেড়ে দিয়ে বর চাইতে বললেন। তিনি আদেশ করে বললেন–স্বামী ও পরিবারসহ সবাইকে নিয়ে সে যেন কালিন্দী হ্রদ ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। গরুড়কে ভয় না পেয়ে এই হ্রদ থেকে বেরিয়ে দ্রুত রমণক দ্বীপে যেতে হবে।

কালীয় নাগকে কৃষ্ণ বর চাইতে বলে বললেন, যে লোক তার বংশের কোন সাপকে হত্যা করবে তার ব্রহ্মহত্যার সমান পাপ হবে। যে তার পাদপদ্মচিহ্ন লাঠির আঘাত করবে তার ব্রহ্মহত্যার দ্বিগুণ পাপ হবে। লক্ষ্মী তার ঘর ত্যাগ করবে। কালীয় তাকে বললে সে যেন জন্মে জন্মে তার চরণে স্মৃতি ও ভক্তিতে থাকে।

সকল সাপেরা প্রতি বছর কার্তিকী পূর্ণিমার দিন অনন্ত দেবতার আদেশে ভয়ে গরুড়ের পূজো করে। দুষ্কর মহাতীর্থে স্নান করে ভক্তিভরে ফুল ধূপ দ্বীপ নৈবেদ্য ও অন্য নানা উপাচার দিয়ে ঐ পূজো করবে।

একদিন বনের মধ্যে হঠাৎ আগুন জ্বলে উঠল, তাতে সাধারণ গোকুলবাসী সমেত সবাই ঘেরাও হয়ে পড়ল। সবাই কৃষ্ণের স্তব করতে লাগল। কৃষ্ণের অমৃত দৃষ্টিতে দাবাগ্নি দূর হলো। এভাবে স্তোত্রপাঠ করে সকলে বিপদমুক্ত হল।

২০.

একদিন মাধব, বালক ও বলদেবের সাথে পানভোজন করে পরিতৃপ্ত হয়ে বৃন্দাবনে গেলেন। ভগবান তাঁদের সাথে খেলা করতে করতে কৃষ্ণের প্রভাব জানার জন্য বাছুর সমেত গরু ও বালকদের চুরি করলেন। কৃষ্ণ ব্রহ্মার উদ্দেশ্য বুঝতে না পেরে, যোগবলে সকল কিছু সৃষ্টি করলেন। এভাবে শ্রীকৃষ্ণ এক বছর প্রতিদিন গরু, বলদেব ও বালকদের সাথে যাতায়াত করলে ব্রহ্মা তাঁর প্রভাব বুঝতে পেরে ভাণ্ডারী বনে এসে হরির দর্শন করলেন। তাঁকে বারবার দর্শন করে ব্রহ্মা বিস্মিত হয়ে প্রণাম করলেন। তিনি সবকিছু কৃষ্ণময় দেখে বিস্মিত হলেন ও তাঁর চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এল। পরে যোগবলে যত্ন করে পড়া, সুষুম্মা, মেধ্য, পিঙ্গলা, নলিনী ও বুধা এই ছয় নাড়ী ও মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ ও আজ্ঞা এই ছয়চক্রকে নিরুদ্ধ করলেন। পরে বায়ুকে এনে মেধার সঙ্গে যোগ করলেন।

কৃষ্ণের নেত্র ও হৃদয়ে যে রূপ দেখলেন, বাইরেও সেই পরমাশ্চর্য রূপ দেখে আগে হরি যে স্তোত্র দান করেছিলেন সেই স্তবেই কৃষ্ণের স্তব করতে লাগলেন। নারায়ণ জানালেন জগৎকারণ ব্রহ্মা ব্রহ্মলোকে চলে গেলে পরমেশ্বর কৃষ্ণ বালকদের সঙ্গে নিজের মন্দিরে ফিরে এলেন। তখন সকল গরু, বাছুর ও বালকেরা একবছর পরে ঘরে ফিরেও কৃষ্ণের মায়ায় তা একদিনের বলে মনে করল। গোপগোপীরাও এ ব্যাপারে কোনই তর্ক করতে পারল না। কারণ, যোগীদের করা সকল পদার্থই নতুন বা পুরনো বলে ঠিক করা অসাধ্য। হে ব্রাহ্মণ! এই তোমার কাছে সুখ, দ্বারা সৃষ্ট মোক্ষ ও পুণ্যদায়ক সকল মানুষের সুখের কারণ মঙ্গলময় শ্রীকৃষ্ণচরিত বর্ণনা করলাম।

২১.

গোপরাজনন্দ একদিন ইন্দ্রযোগ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে দুন্দুভি বাজালেন এবং বললেন–এই নগরে যত গোপগোপী, বালক-বালিকা এবং ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র যে যে আছে, সবাই যেন দই, ক্ষীর, ঘি, গুড় ও মধু দিয়ে ইন্দ্রের পূজা করে। বিশাল সুন্দর জায়গায় তিনি সানন্দে ইন্দ্ৰধ্বজ পুঁতলেন, সেই ধ্বজ সুন্দর মায়াজালে জড়িয়ে আছে। পরে স্নান শেষে ধোওয়া কাপড় পরে ও পা ধুয়ে ভক্তি ভরে আহ্নিক শেষ করে সোনার আসন পীঠে বসলেন। সেখানে যজ্ঞের পাত্র আনা হল, তখন নগরবাসীরা নানারকম উপাচার নিয়ে সেখানে এল। ব্রহ্মতেজে প্রজ্বলিত বেদবেদাঙ্গ, পারদর্শী শান্ত প্রকৃতির গর্গ, বাৎস্য, কাত্যায়ন, সৌভরি, বামদেব, যাজ্ঞবল্ক্য, পাণিনি, ঋষ্যশৃঙ্গ, গৌরমুখ, ভরদ্বাজ, বামন, কৃষ্ণদ্বৈপায়ন শৃঙ্গী, সুমন্ত, জৈমিনি, কট, পরাশর, মৈত্রেয় ও বৈশম্পায়ন মুনিরা শিষ্যদের সাথে সেখানে এলেন। আর এলেন নানা ব্রাহ্মণ, ভিখারী, বন্দি, ক্ষত্রিয় বৈশ্য ও শূদ্ররা। পরে পাকপ্রজ্ঞ ব্রাহ্মণদের আদর করে ডেকে এনে রান্নার আদেশ দিলেন।

নানা ফুল, মালা, নৈবেদ্য, তিলের নাড়ু, স্বস্তিকপূর্ণ ভল্লক, হাজার কলস চিনি, ব্রাহ্মণের ঘি মাখা শ্ৰেষ্ঠ যব ও গমের আটা, লাড্ডভরা কলসী, গাছপাকা সুন্দর ফল, লক্ষ ক্ষীরের কলসী, লক্ষ দইয়ের কলস, একশো মধুর কলস, হাজার কলস ঘি, একশো কলস ননী, তিন লক্ষ কলস তক্র, পাঁচলক্ষ গুড়ের খই, তেলভর্তি হাজার কলস, আরও অনেক ভোগের জিনিসপত্র, নানা বাদ্যযন্ত্র আনা হল। সেই ধ্বজের কাছে সোনার সিংহাসন আনা হল। পৃথিবীতে ব্রাহ্মণরাই দেবতা এবং সবার পূজো থেকে ব্রাহ্মণের পূজোই ভাল। একথা বেদে বলা হয়েছে। জনার্দন সাক্ষাৎ ব্রহ্মরূপী। বেদে বলা আছে পাপী ব্রাহ্মণের ছোঁয়ায় মুক্ত হয় এবং তার দেখা মাত্রই পাপ থেকে নিষ্কৃতি লাভ করে। ব্রাহ্মণ মাত্রই বিষ্ণুরূপী। যে ব্রাহ্মণ প্রত্যহ হরিকে অন্নদান করেন ও সেই অন্ন খান। তাঁর উচ্ছিষ্ট ভোজনে মানুষ হরির দাসত্ব লাভ করে। সেই খাদ্য মলমূত্রের সমান হয় যে হরিকে দান না করে খায়, হরিভক্ত শূদ্র যদি নৈবেদ্য খাবার জন্য আগ্রহী হয় তবে হরিকে সামান্য নিবেদন করে তা রান্না করে খাবে।

অন্য জীব অপেক্ষা মানুষকে দান করলে আট গুণ ফল লাভ হয় এবং তার থেকে বিশিষ্ট কোন শূদ্রকে দান করলে তার দ্বিগুণ ফল লাভ হয়। বৈশ্যকে দান করলে তার আটগুণ, ক্ষত্রিয়দের দান করলে তার দ্বিগুণ, ক্ষত্রিয় অপেক্ষা ব্রাহ্মণকে অন্নদান করলে একশোগুণ ফল লাভ হয়ে থাকে। যে লোক গোস্পদের মাটি দিয়ে তিলক তৈরি করে, সে তক্ষুনি তীর্থস্নানের সমান পুণ্য অর্জন করে এবং প্রত্যেক পদে সে অভয় লাভ করে। ইন্দ্রের ছেচল্লিশ নাম জপ করলে সব শাপ নাশ হয়। যে কৌসুম শাখায় বলা এই সকল নাম প্রত্যহ পাঠ করে, ইন্দ্র তাকে মহাবিপদের সময় ও বর্জ হাতে রক্ষা করেন।

২২.

একদিন কৃষ্ণ বলদেব ও বালকদের সাথে তালবনে গেলেন। সেই কাননে প্রচুর পরিপক্ক সুমিষ্ট ফল ছিল। ঐ তালবনের রক্ষাকর্তা ছিল ধেনুক নামক এক দৈত্য। বালকরা তালবন দেখে আনন্দ পেল। বালকরা দৈত্যর ভয় পেলে কৃষ্ণ তাদের অভয় দান করেন। তিনি তাদের আদেশ দেন, গাছের মাথায় উঠে নানা মিষ্টি ফল পাড়তে। এমন সময় বিকট শব্দে দৈত্য এলে বালকেরা দৈত্যের ভয়ে হরিকে স্মরণ করলে, কৃষ্ণ ও বলরামকে দেখে তাদের ভয় দূর হল। কৃষ্ণ বললেন, এই দানব বলিরাজার ছেলে, তার নাম সাহসিক, দুর্বাসার শাপে গর্দভের রূপ ধারণ করেছিল। দৈত্যরাজ কৃষ্ণকে গ্রাস করল। অতঃপর কৃষ্ণের তেজে পুড়ে গিয়ে বমি করে তাঁকে বার করে দিল। কৃষ্ণকে দেখামাত্র তার পূর্বজন্মের সবকথা মনে পড়ে গেল।

দৈত্যরাজ কৃষ্ণের স্তব করতে লাগল এবং শ্রীহরির সামনে দাঁড়িয়ে রইল। কৃষ্ণ তার প্রতি সন্তুষ্ট হলেন। তিনি প্রতিদিন ভক্তিভরে দৈত্যরাজের করা স্তব পাঠ করে, সে সহজেই হরির সালোক্য, সাষ্ঠি ও সামনে থাকার সুযোগ পায়; ইহকালে তার হরিভক্তি, মৃত্যুর পর হরির দাসত্ব এবং বিদ্যা, স্ত্রী, সুকবিত্ব, পুত্র, পৌত্র ও যশলাভ করে থাকে।

২৩.

একদিন সাহসিক নামে মহাশক্তিমান বলিরাজের পুত্র নিজ শক্তিতে দেবতাদের পরাজিত করে গন্ধমাদন পর্বতে উপস্থিত হয়ে রত্নসিংহাসনে বসলেন। সেই সময়ে অপ্সরাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠা তিলোত্তমা নানা বেশভূষা করে সেই পথে যাচ্ছিল। নবযৌবনা সেই কামিনীকে দর্শনমাত্র কামানলে জর্জরিত হয়ে পড়লেন সহায়িক। অপ্সরা চলেছেন আস্তে ধীরে। সেসময় যুবক সাহসিক, হঠাৎ বাতাসে তার কাপড় উড়তে থাকায় সেই অপ্সরার স্তন, উরু, চাঁদমুখ দেখে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। তিলোত্তমাও সেই অসাধারণ সুন্দর, প্রফুল্লমালতীমালায় সজ্জিত, নব-যৌবনযুক্ত, শরৎকালের পূর্ণচন্দ্রের মত মুখমন্ডলযুক্ত ঈষৎ হাস্যময় বলিপুত্রকে দেখামাত্র কামার্ত হয়ে অল্প হেসে কটাক্ষ করতে লাগল।

সেই কামুকী খেলার জন্য চন্দ্রলোকে যাচ্ছিল। কিন্তু বলিপুত্রের সাথে শৃঙ্গারের জন্য কোন ছল করে সেখান সে রয়ে গেল। তখন সে হেসে বাঁকা চোখে বারবার তার মুখ দেখতে লাগল আর কাপড় দিয়ে নিজের বুক ঢাকতে লাগল। কামার্ত নারীর দেহ পুলকিত হল, সারা শরীরে ঘাম দেখা দিল। বলিপুত্রের প্রতি এতই আকৃষ্ট হল যে শশধরকে ভুলে গেল। যে লোক গণিকাকে বিশ্বাস করে সে বিধিবিড়ম্বিত, তার ধন ও যশ নষ্ট হয় সবংশে। মনের মত নতুন কাউকে পেলে গণিকার আর পুরোনোতে মন উঠে না। গণিকা নরঘাতীর থেকেও ভয়ঙ্কর, যতদিন চন্দ্র, সূর্য থাকবে ততদিন গণিকার কোন মুক্তি নেই। গণিকার রান্না করলে সেই খাদ্যেও সাথে সব পাপ এসে মেশে, সেই খাবার এবং তাদের প্রদত্ত জল পিতৃকার্য ও দৈবকার্যে ব্যবহার করা যায় না। বলিপুত্র জ্ঞান লাভ করে গণিকা তিলোত্তমাকে দেখে কামাতুর ও পাগল হয়ে তার কাছে গেলেন। তিলোত্তমা লজ্জায় কাপড় দিয়ে মুখ ঢাকলেও কাপড়ের ফাঁক দিয়ে বলিপুত্রকে দেখতে লাগল। তুমি নির্জনে লতার মতো তোমার হাত দুটি দিয়ে জড়িয়ে ধর। তার সকল অঙ্গের দর্শন করতে চাইলেন বলিপুত্র। এই সাহসিকের কথা শুনে সে আপন মান হারিয়ে বলতে লাগল –আপনার মত পতিকে সকল কামিনীরাই মনে চায়।

আপনি ধার্মিক, রূপবান, গুণবান, শৃঙ্গার পটু, শান্ত ও কামশাস্ত্রে বিশেষজ্ঞ। এরূপ ব্যক্তিকেই পতি হিসাবে পেতে চায় কামিনীরা, যে সুবেশ, সুন্দর, শান্ত, কমনীয়, দান্ত, আরোগী, গুণবান, যুবক, রসিক, দয়ালু, বলিষ্ঠ, সাধু, ক্ষমতাশালী ও অনুরক্ত। সেইসব গুণই আপনার মধ্যে অতি মাত্রায় বর্তমান। যে কামিনীরা আপনাকে চায় না তারা অবশ্যই বোকা ও বঞ্চিত। চন্দ্রগৃহ থেকে ফিরে এসে সে তার ইচ্ছা পূরণ করবে। চন্দ্রের জন্য আজ সে সাজ করেছে কারণ আজ সে চন্দ্রের কামিনী। যে নারীকে চাঁদ আলিঙ্গন করেনি সে বোকা, পুরুষরসে বঞ্চিত হয়ে মায়ের গর্ভেই লুকিয়ে থাকে। সে রতিকার্যে বঞ্চিত।

তার মন সবসময়ই তাদের লীলার কথা চিন্তা করে থাকে। এদের মধ্যে রতিকার্যে বিশেষ পারদর্শী কামদেবই। অমৃত অপেক্ষাও সঠিক মনোজ্ঞ চন্দ্রের আলিঙ্গন। আমার মন তাতেই পড়ে আছে কারণ আজ তার রতিদিন। বলিপুত্ৰ তিলোত্তমার কথা শুনে হেসে পুলকিত ও কামাতুর হয়ে সেই নির্জন জায়গায় তাকে বললেন–হে তিলোত্তমা, ব্রহ্মা পরম কৌতুকে তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, তুমি অপ্সরাদের মধ্যে চতুর, বিধাতা সুন্দ ও উপসুন্দদৈত্যকে নাশ করার জন্য সব রকমের চেষ্টা করে তোমাকে সকল গুণের আধার হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। সুরতকার্যে তুমি দারুণ অভিজ্ঞা, এখন ব্যক্ত কর তোমার মনের ইচ্ছা। সাহসিকের কথা শুনে তিলোত্তমা অল্প হেসে বাঁকা চোখে তার দিকে তাকিয়ে কাপড়ে মুখ ঢাকল। সে বলল –পণ্ডিতরা বেদ বেদান্ত শাস্ত্রেরও শেষ জেনেছেন, কিন্তু তারা নারী মনের শেষ কথা জানতে পারেননি।

দুর্মূল্য রত্ন দিলেও নারীর কাছে তারা বিষের থেকে অপ্রিয় আর যুবক যদি সর্বস্বহারাও হয় তবুও সে প্রাণের চেয়েও প্রিয়। সুন্দরযুবক দেখলে গণিকার যোনি ভিজে যায় ও চুলকাতে থাকে। সে কামানলে দগ্ধ হয়। নির্জনে তার প্রতি বাঁকা চোখে তাকায়। আপন অঙ্গ প্রদর্শন করে তাকে মনের ভাব বোঝায়। নায়ককে বশ করা দুঃসাধ্য জেনেও গণিকা আজীবন দুঃখ পায়। তারা সর্বদা নতুন নতুন পুরুষের কথা চিন্তা করে। গন্ধর্বদের মধ্যে কামশাস্ত্রে পারদর্শীও রতিতে নিপুণ কোন যুবক বিশেষ প্রিয় নয়। কামই বেশি প্রিয়। তার সমান প্রিয় আর কেউ হতে পারে না। চাঁদের কাছ থেকে ফিরে যে বলিপুত্রের বাসনা পূর্ণ করবে।

বলিপুত্র হাসলে সে তার সুন্দর পীনোন্নত গোল ও কোমল স্তন দুটি, সুন্দর শ্রোণিদেশ যা রম্ভাকেও হার মানায়, তা দেখাতে লাগল। তার সারা দেহ রোমাঞ্চিত হল। বলিপুত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে সূক্ষ্ম কাপড়ে মুখ ঢাকতে লাগল। কামুক বলিপুত্র তাকে বলল, নারীকে বলাৎকার করা ধার্মিকের উচিত নয়। তুমি রতিশূরের কাছে এসে শৃঙ্গার সুখ দান কর। তার কথা শুনে গণিকার গলা শুকিয়ে গেল। সে বলল, আপনাকে ফিরিয়ে চাঁদের কাছে যেতে পারব না। যে স্ত্রীকে অপমান করে চলে যায় সতী পার্বতী তার বিপদ ঘটায়। বলিপুত্র তখন তার হাত ধরে গাঢ় আলিঙ্গন করে সেই পদ্মের মত সুন্দর মুখে গভীর চুম্বন করলেন। গন্ধমাদনের গহ্বরে গিয়ে রমণের স্থান তৈরি করে শুয়ে পড়লেন। নানা শৃঙ্গার করলে তিলোত্তমা তাকে কামদেব অপেক্ষা বিচক্ষণ মনে করল।

তিলোত্তমা তাকে আপন স্তনে ধারণ করল এবং বলল আপনি আর কিছুক্ষণ থেকে আবার গাঢ় আলিঙ্গন করুন। এরপরই তারা আবার দারুণ সঙ্গমসুখে মূৰ্ছিত হল। দৈত্যরাজ কুলটার আলিঙ্গনে কামাতুর হলেন। তিনি আট রকম শৃঙ্গার ও নয় রকম চুমু খেলেন। চুড়ি ও নুপূরের শব্দ হতে থাকলে দুর্বাসার ধ্যান ভেঙ্গে গেল। তারা কেউ তাঁকে দেখতে পায়নি। দুর্বাসা চোখ খুলে তাদের কামাতুর অবস্থায় দেখলেন ও ক্রুদ্ধ হলেন। তার চোখ লাল হয়ে উঠল। তিনি রেগে বললেন– বলিরাজের পশুর সমান কুপুত্র। কেবলমাত্র পশুজাতিরই কোন লজ্জা নেই। পশুর মধ্যে খরজাতিরই কোন বিশেষ লজ্জা নেই। তুই খর যোনিতে জন্মা। আর তিলোত্তমাকে বললেন–দানব হয়ে জন্মাতে, তখন তাঁরা ভয়ে ও লজ্জায় তার স্তব করতে লাগলেন– –হে করুণানিধি, আপনি আমাদের অপরাধ ক্ষমা করুন, তিনিই সাধু যিনি কেবল লোকের অপরাধ ক্ষমা করেন।

দাঁতে ঘাস কাটতে কাটতে দৈত্যরাজ মুনির পায়ে পড়ে জোরে জোরে কাঁদতে লাগলেন। বিধাতার সৃষ্টি স্ত্রী জাতি অত্যন্ত বোকা, তার মধ্যে গণিকারা বেশি মত্ত ও কামুক। কামুকের নেই লজ্জা ও ভয়। এরকম শোনা যায় যে বিপদে না পড়লে জ্ঞান হয় না। তাদের কাতর প্রার্থনায় মুনির দয়া হলে তিনি বললেন–প্রাণীরা আচমকা কারো বর বা শাপ লাভ করে থাকে। সবকিছু নিশ্চয় পূর্বজন্মের কর্মফলে হয়। তুমি বলির পুত্র, সকুলে তোমার জন্ম। তোমার বাবার থেকেও তুমি বেশি বিষ্ণুভক্ত। পুত্রের মধ্যে পিতার স্বভাব বর্তমান থাকে। তার বড় প্রমাণ কালীয়নাগের মাথায় শ্রীকৃষ্ণের পায়ের ছাপ। তুমি গাধা হয়ে জন্মলাভ করে মুক্তি পাবে। পূর্বজন্মের করা পূজোর ফল অন্তকালে লোপ পায় না। এখন ব্রজের কাছে বৃন্দাবনের নলবনে যাও। পরে হরিচক্রে প্রাণত্যাগ করে মুক্তি লাভ করবে। আর তিলোত্তমাকে বললেন–তুমি নলরাজার কন্যা হয়ে জন্মে কৃষ্ণের পৌত্রের সাথে মিলিত হয়ে এখানে আসবে।

২৪.

দুর্বাসার কি করে স্ত্রী সংযোগ হয়েছিল নারদ তা জানতে চাইলেন। জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তিরও খারাপ সংসর্গে খারাপ দোষ দেখা দেয়। মুনির মনে সুরতস্পৃহা জেগে উঠলে তিনি কামাসক্ত হয়ে তপস্যা ফেলে নারীর চিন্তা করতে লাগলেন। মহামুনি ঔর্ব তাঁর কন্যার সাথে সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। ঐ কন্যা ঔর্বের জানু থেকে জন্মায় বলে তার নাম হয় জানুদ্ভবা। সে প্রার্থনা করে, দুর্বাসাকে, অন্য কাউকে তার প্রতিরূপে চাই না। তারা দুর্বাসার সামনে এসে দাঁড়ালেন। ঔর্ব দুর্বাসা আলিঙ্গন করে তাঁকে মেয়ের মনের কথা বললেন। এই মেয়ে অযোনিসম্ভবা ও সকল রূপ গুণের আধার। এমনকী ত্রৈলোক্যকেও মোহিত করে রাখতে পারে। কিন্তু এ অত্যন্ত ঝগড়াটে ও মুখরা। কিন্তু এতে তার সকল গুণ নষ্ট হয় না। দুর্বাসা আনন্দের সঙ্গে কন্যাকে দেখলেন। এমন অপরূপ সুন্দরী কন্যাকে দেখার সাথে সাথে দুর্বাসা কামাতুর হয়ে পড়লেন ও বললেন–নারীরা সকল পথে বাধাদায়ক। এটাই সবথেকে ভয়ংকর শিকল। শঙ্করাচার্যও তাকে ছেদন করতে পারে না। আবার স্ত্রী যদি ভাল হয়, স্বামী যতদিন স্ত্রীর সঙ্গে থাকে ততদিন তার জন্মের খন্ডন হয় না। পূর্ব জন্মের কোন কাজের ফলে যে হরির চরণ-কমল ধ্যান করার সময় আমার বিঘ্ন ঘটাল তা আমার জানা নেই।

গণিকার সাথে দৈত্যর শৃঙ্গার দেখে তাঁর মন কামাসক্ত হয়েছে। স্ত্রীর খারাপ কথা সহ্য করা নিন্দার ব্যাপার। যে স্ত্রীর পরাগত তাকে সাধুরা বেশি নিন্দা করেন। আপনার মেয়েকে আমি গ্রহণ করব। কোন গণিকাকে যদি ধর্মের ভয়ে কোন জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তি ত্যাগ করে তবে তারও নরকে স্থান হয়।

পিতা কন্যাকে বললেন–একমাত্র নিজ স্বামীই ইহলোক ও পরকালের শ্রেষ্ঠ বন্ধু। স্বামী থেকে প্রিয় ও পরম গুরু কেউ নেই কুলনারীদের কাছে। পতিভক্ত নারীর কোন কিছুর প্রয়োজন হয় না। ধার্মিক যে নারী স্বামীকে কটু কথা বলে তার সাত জন্মের পুত্র নষ্ট হয়ে যায়। ঔর্ব কন্যাদান করে সান্ত্বনা দিয়ে চলে গেলেন। দুর্বাসা স্ত্রীর সাথে সুখে বাস করতে লাগলেন। তিনি কামাসক্ত হয়ে সম্ভোগের ইচ্ছা করা মাত্রই কামিনীকে পেয়ে গেলেন।

দুর্বাসা রতিশয্যা তৈরি করে প্রিয়াকে নিয়ে শুয়ে পড়লেন ও নানা রূপ শৃঙ্গার করতে লাগলেন। নন্দিনী নতুন সঙ্গ মাত্রেই মূৰ্ছা গেল। তিনি মহানন্দে প্রত্যহ সঙ্গম করতে লাগলেন। মুনি ক্রমে তপস্যা ছেড়ে গৃহী হলেন। কন্দলি ঝগড়া করলে মুনি যুক্তি নীতি দিয়ে তাকে বোঝালেন। কন্দলি কথার প্রভাবে জগৎ ভয়ে কাঁপতে থাকে। মুনিও রাগে কাঁপতে থাকেন। কন্দলিকে সান্ত্বনা দিলেও সে শান্ত হয় না। এদিকে খারাপ কথা একশো ছাড়িয়ে গেল, তাঁর মন পুড়তে লাগল স্ত্রীর কথায়।

স্ত্রীর কাছে স্বামী প্রাণের থেকেও বেশি প্রিয়, আবার স্ত্রীও স্বামীর কাছে অধিক প্রিয়। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই শত্রুতা আরম্ভ হল। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই দুর্বাসার অভিশাপে কন্দলি ছাই হয়ে যায়। দুর্বাসা বুঝতে পারলেন, কর্মের ফলে যা হবার হয়েছে। মহামুনি দুঃখে জ্ঞান হারালেন। জ্ঞানী লোকেদের স্ত্রী বিচ্ছেদ সকল শোকের থেকে ভয়ংকর। মুনি যোগাসন করে প্রাণত্যাগ করতে যাবেন তখন সেখানে এক ব্রাহ্মণ বালক এসে হাজির হল। তার হাতে লাঠি, ছাতা, পরনে লাল চেলী ও কপালে তিলক। বৈদজ্ঞদের গুরু ও মহাজ্ঞানী এই অল্পবয়সী বালক। দুর্বাসা তাকে ভক্তি করে পুজো করলেন। এই বালকের আশীর্বাদে মুনির মনের সকল দুঃখ দূর হল। সে দুর্বাসাকে নীতির কথা বলল।

সে গুরু মন্ত্রের প্রভাবে সবকিছু জানতে পেরেছিল। তার কাছে কোন কিছু অজানা নেই। ব্রাহ্মণদের তপস্যাই একমাত্র ধর্ম। তপস্যার সাধ্য তিন জগত। আপনার স্ত্রী ছিল মুখরা। তাই অল্পকালের মধ্যেই অদৃশ্য হয়েছে। বসুদেবের মেয়ের নাম একনংশা, সম্পর্কে হরির বোন। তার জন্ম পার্বতীর অংশে, সে অত্যন্ত সুশীলা। সে আপনার পত্নী হবে। কন্দলী পৃথিবীতে গিয়ে কলা গাছ হয়ে জন্মাবে। একবার জন্ম লাভ করে কেউ শুভকল দান করতে পারে না।

কলি অন্য কল্পে আপনার পত্নী হবে। বেদে বলা আছে অতি গর্বিতের দমন হওয়াই উচিত। মুনি ভুল বুঝতে পেরে তপস্যায় মন দিলেন। দৈত্য তাল বনে গিয়ে গর্দভ আকার ধারণ করল। তিলোত্তমা বানের মেয়ে হয়ে জন্মালেন। দৈত্যরাজ বিষ্ণুর চক্রে প্রাণত্যাগ করে সেই শ্রীহরির চরণ কমলে ঠাঁই পেলেন। যে হরির চরণ দুর্লভ ও মুনিরাও কামনা করে থাকেন। বাণের মেয়ে তিলোত্তমার কৃষ্ণের পৌত্রের আলিঙ্গন লাভের বাসনা পূর্ণ হয়ে গেলে আবার আগের মত তিলোত্তমা রূপ ধারণ করে সে নিজের জায়গায় ফিরে এলো।

২৫.

নারদ এবার জানতে চাইল যে, দুর্বাসার শাপে ঔবমুনির কন্যা মারা গেলে মুনি কিভাবে ঘটনাটি গ্রহণ করেছিলেন। সে সময় সরস্বতীর তীরে তপস্যা রত ছিলেন মুনি। মাথায় কাপড় প্রবল বাতাসে মাটিতে পড়ে গেল, মুনি ধ্যানে ধ্যানস্থ হয়ে তপোবনে কন্যার বিপদ জানতে পারলেন। তিনি শোকাবিষ্ট হয়ে সত্ত্বর আশ্রমে গেলেন। বিপ্রবর ওর্বর, জামাইয়ের আশ্রমের কাছে গিয়ে আকুল হয়ে “কন্দলি কন্দলি’ বলতে লাগলেন। দুর্বাসা তখন ভয়ে তাঁর পায়ে আছড়ে পড়লেন।

ঔর্ব বললেন, তোমার বাবা মহর্ষি জমদগ্নি অত্যন্ত গুণবান এবং তোমার মা তো সাধ্বী গুণবতী। তাদের পুত্র যে এরূপ নির্দয় রাগী হতে পারে তা আশ্চর্য। বেদ বোঝা মহা কঠিন। কর্কশভাষী স্ত্রীকে ত্যাগ করাই তার যোগ্য শাস্তি, কিন্তু তুমি অল্প দোষে একাজ করেছ, তোমার পরাজয় হল। দুর্বাসা বারবার প্রিয়াকে মনে করে কাঁদলেন ও পরে ভুল বুঝতে পেরে তপস্যায় মন দিলেন।

সূর্য বংশের এক রাজা অম্বরীষ সর্বদা কৃষ্ণের ধ্যান করতেন। তিনি একবার একাদশী ব্রত ও কৃষ্ণপূজায় নিমগ্ন ছিলেন। তিনি সকল কর্মের ফল কৃষ্ণকে দান করতেন। একদিন রাজা একাদশী ব্রত করে দ্বাদশীর দিন স্নান করে নিয়মমতো হরি পূজা করলেন যখন ও ব্রাহ্মণদের খাইয়ে। খেতে বসেছেন, ঠিক তখন ক্ষুধার্ত এক তপস্বী শুকনো গলায় উপস্থিত হলেন। তিনি স্বয়ং দুর্বাসা। রাজা তাঁকে পাদ্য অর্ঘ ও সোনার সিংহাসন দান করলেন।

দুর্বাসা তাঁর কাছে খাবার চাইলেন। কিন্তু রাজাকে অপেক্ষা করতে বলে অঘমর্ষণ মন্ত্র জপ করতে লাগলেন। দ্বাদশী তিথি কেটে গেল ব্রতী যদি ত্রয়োদশী তিথিতে পারণ করেন, সেই পারণ উপাবসের ফলকে নষ্ট করে। এর পরিণামে একাদশীর উপবাসীর ব্রহ্মহত্যার সমান পাপ হয়। তার সকল খাদ্য দ্রব্য মদের মত হয়। যদি কোন বোকা লোক অতিথিকে না খাইয়ে ক্ষুধার জ্বালায় নিজে খেয়ে নেয় সে কুম্ভী পাক নরকে গিয়ে চণ্ডাল হয়ে জন্মায়। প্রতি জন্মে দরিদ্র ও রোগী হয়। তাই রাজা তার শ্রীকৃষ্ণ অর্চনার চরণামৃত পান করে উপবাসের ফল রক্ষা করলেন। জলপান করা উপপাসের সমাণ এতে কোন অতিথি সৎকারের ক্ষতি হবে না। রাজা কৃষ্ণের পাদপদ্মের ধ্যান করে চরণামৃত পান করলেন।

দুর্বাসা তপস্যা বলে সব জানতে পেরে খড়গ হাতে নিজে রাজাকে হত্যা করতে হাজির হলেন। হরি তখন কৃষ্ণভক্ত রাজাকে বাঁচাতে সুদর্শন চক্র দ্বারা ব্রাহ্মণকে হত্যা করতে উদ্যত হলেন। দুর্বাসা তখন বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র থেকে বাঁচবার লক্ষ্যে ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলেন। ব্রহ্মার কাছে বাঁচাও, বাঁচাও বলে চিৎকার করতে লাগলেন।

ব্রহ্মা সব শুনে বললেন–তুমি কার তেজে হরির দাসকে বধ করতে গেলে? হে ব্রাহ্মণ! যে বোকা বিষ্ণুর প্রাণের সমান প্রিয় বৈষ্ণবদের হিংসা করে তাকে হরি সংহার করে থাকেন। হরি নিজের গুণাগুণ শুনে তৃপ্তি লাভের জন্য ভক্তদের সাথে ছায়ার মতো সব সময় ঘুরে বেড়ান। ব্রাহ্মণদের থেকেও ভক্তরা তাঁর কাছে বেশি প্রিয়।

হরির স্মরণ করলেই সকল বিপদ দূর হবে। শীঘ্র বৈকুণ্ঠে যাও, বৈকুণ্ঠই তোমার শরণ। হরি তোমাকে নিশ্চয়ই অভয় দেবেন। দয়ারসাগর শিব দুর্দান্ত চক্র দেখে পার্বতীর সাথে মনের আনন্দে ব্রাহ্মণকে আশীর্বাদ করলেন যেন ব্রাহ্মণ বিপদ থেকে উদ্ধার পায়।

দুর্বাশা পরে মনের গতিতে বৈকুণ্ঠ ভবনে গিয়ে সেখানেও তার পশ্চাৎ ধাবিত সুদর্শন চক্রকে দেখে দেখে হরির আশ্রমে ঢুকে পড়লেন এবং দেখলেন হরি রত্ন সিংহাসনে বসে আছেন। বাদ্যযন্ত্র সহযোগে ভক্তরা তাঁর নাম গান করছে, দুর্বাসা স্তব-স্তুতি করে বললেন– আপনি দীনজনশরণ্য আমাকে ত্রাণ করুন। আপনি বিপদ হরণকারী।

শ্রীহরি দুর্বাসা স্তোত্র শ্রবণে অমৃত তুল্য মধুর বচনে মুনিকে আশ্বাস দিয়ে বললেন, তোমাকে বর দিচ্ছি, তোমার কল্যাণ হবে। তিনি বললেন, হে মুনি! রাজা অম্বরীষ অহিংস্র করুণাময় সকল প্রাণীর প্রতি সদয় তাকে বধের অভিপ্রায়ে কেন নিমগ্ন হলে? তুমি অম্বরীষের আলয়ে যাও, সে ছাড়া কেউ তোমাকে রক্ষা করতে পারবে না।

অম্বরীষের কাছে গিয়ে রাজার প্রতি প্রীতি উৎপাদন করুন। দুর্বাসা এক বছর ধরে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ালেন। রাজা তখনও সস্ত্রীক অনশনে দিন কাটাচ্ছেন।

স্তন্যপায়ী শিশু দেখলে মা যেমন আহার করে না, তেমন উপবাসী ভক্তের জন্য হরিও অনাহারে রয়েছেন। শ্রী দেবীও আগে ভক্তদের না দিয়ে আমায় কোন কিছু দিতে পারেন না। তুমি রাজগৃহে যাও।

মনের তুল্য দ্রুত বেগে হরিধাম ত্যাগ করে মুনি প্রস্থান করলেন। মুনিকে দেখে সিংহাসনের থেকে উঠে শ্রদ্ধা সহকারে তাকে প্রণাম করলেন রাজা অম্বরীষ।

মুনিকে মিষ্টি খাইয়ে উপবাস ভঙ্গ করলেন। মুনি প্রীত হয়ে নিজ নিকেতনে গমন করলেন।

২৬.

যত রকম ব্ৰত আছে তার মধ্যে দুষ্প্রাপ্য হলো এই একাদশী ব্রত। মঞ্জুরীর মধ্যে যেমন তুলসী, মাসের মধ্যে যেমন মার্গশীর্ষ, গন্ধর্বদের মধ্যে যেমন চিত্ররথ, রাক্ষসদের মধ্যে যেমন সুমালী, রূপসীদের মধ্যে যেমন অপ্সরা রম্ভা, সমুদয় ব্রতের মধ্যেও তেমনি একাদশী ব্রত সর্বোত্তম। যেহেতু এই ব্রত নিত্য সেহেতু ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র- এই চতুর্বর্ণের পালনীয়। আর সন্ন্যাসী, ব্রাহ্মণ ও বৈষ্ণবদের এই ব্রত অবশ্য পালনীয়।

কৃষ্ণব্রতের কালে ব্রহ্মাহত্যার মতো গর্হিত কর্মও অন্নকে আশ্রয় করে থাকে তাই একাদশীতে অন্নভোজন করলে ব্রহ্মহত্যা যদি হয় আর তার ফলে কুম্ভীপাক নামক নরকগামী হতে হয়। দ্বাদশী পালন না করলে যা দোষ হয় তা আগেই বলেছি।

দশমী, একাদশী ও দ্বাদশী তিথির ব্রত যেদিন থাকে, সেই দিন আহার করে পরের দিন অনশনে থেকে ব্রত উদযাপন করা কর্তব্য। দ্বাদশীতে ব্রত এবং ত্রয়োদশীতে ব্ৰতজনিত উপসের পর প্রথম ভোজন করলে দ্বাদশী লঙঘন দোষ হয় না।

ব্রতচারী দিনমানের প্রথমাংশ অর্থাৎ মধ্যাহ্নের পূর্ববর্তী কালে আতপ চালের ভাত তৎসহ সিদ্ধ ব্যঞ্জন ও ঘৃত গ্রহণ করে, সেদিন আর জল পান না করে কুশতৃণের শয্যায় একলা শয়ন করবে। নিত্য পূজা সম্পন্ন হলে ব্রতের উপাদান সামগ্রী যথা- আসন, পরিধেয় বস্ত্র, গন্ধ, স্নানের উপকরণ ইত্যাদি, ষোড়শোপচারের সামগ্রী দিনেরবেলায় সংগ্রহ করে ব্রতী রাতে ব্রত করবে। যারা ভক্ত নয় তাদের কাছে এই জটিল দুজ্ঞেয় রহস্যময় ধ্যান বৃত্তান্ত গোপনীয়। এই ধ্যান ভক্তদের জীবনের তুল্য প্রিয়।

২৭.

গোপিনীরা অত্যন্ত কামবিষ্টা হয়ে, কার্তিক মাসে ব্রত শুরু করে সারামাস চিত সংযম করে, রকমারি ফল ও মণি-মুক্তো দ্বারা নানা ধরনের তরঙ্গ সৃষ্টি করে দেবীর পূজো করবে। এবং বলবে নন্দের নন্দনকে আমাদের স্বামীরূপে দান কর। প্রণত হয়ে বলবে সর্বমঙ্গলের মঙ্গল্যস্বরূপা শঙ্করপ্রিয়ে দেবী মনোবাঞ্ছা পূরণ করো।

একার্ণবকালে চন্দ্র সূর্যের অগোচরহেতু জগৎ যখন ঘন তমিস্রায় আচ্ছন্ন হয় এবং কাজল কালো জলরাশিতে প্লাবিত হয় তখন ভাসমান হরি ব্রহ্মাকে এই স্তব প্রদান করে জলে শায়িত হয়েছিলেন।

দুর্গার আটনাম নাভিকমলে স্থিত ব্রহ্মাকে দান করে নারায়ণ শায়িত হয়েছিলেন। মধুকৈটভ ব্রহ্মাকে বধ করতে প্রবৃত্ত হলে ব্রহ্মা নিদ্ৰাস্তব করলে দূর্গা তাকে সর্বক্ষণ নামক স্বর্গীয় কৃষ্ণ কবচ দান করেছিলেন।

এই কবচ পেয়ে ব্রহ্মা নিভকি হয়েছিলেন। ত্রিপুরাসুরের সঙ্গে সংগ্রামরত মহাদেব রথসহ ভূপতিত হলে ব্রহ্মা প্রদত্ত এই দিব্য কবচ পাঠে শিবের পরিত্রাণ এবং তার জয় সুনিশ্চিত করার জন্য মহাশক্তি দুর্গার সঙ্গে বৃষরপে আবির্ভূত হয়ে শ্রীকৃষ্ণ রথসহ শিবকে মাথায় করে উত্তোলিত করে সাহস সঞ্চার করেছিলেন। অতঃপর শিব মহানিদ্রা ও শ্রীহরিকে স্মরণ করে কবচ প্রভাবে ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগে ত্রিপুরাসুরকে বধ করেন। সর্বমঙ্গলা স্তোত্র পাঠ করলে সমুদয় বিঘ্ন দূর হয়। স্থানচ্যুতি ও বিত্তনাশে, জাতি ভ্রষ্টে শোকে, মনোভঙ্গে কপট ব্যক্তির হাত থেকে পরিত্রাণে, সর্পের বিষক্রিয়ায় এই স্তবের স্মরণমাত্র মুক্তি লাভ হয়।

২৮.

নারদ বৃন্দাবন ও রাসলীলা সম্পর্কে জানতে চাইলেন। নারায়ণ বললেন, চৈত্রমাসের শুক্ল ত্রয়োদশীর রাতে আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠলে শ্রীহরি বৃন্দাবনে গিয়ে মুগ্ধ হলেন। ভ্রমরের গুঞ্জন, কোকিলের কুহুতান দারুণ পরিবেশ রচনা করেছে। রাস মণ্ডল রচনা হয়েছে। সেই রাসমণ্ডল প্রত্যক্ষ করে সস্মিত মধুসূদন কামাতুরা সম্ভোগ অভিলাষী হয়ে গোপিনীদের আকর্ষণের করার জন্য বাঁশি বাজান।

মন যখন কোন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়ে তন্ময় হয়ে পড়ে। তখন ক্রিয়াবিহীন হয়ে যায় অন্য চার ইন্দ্রিয়। বাঁশির সুরে রাধার বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত হয়েছিল, তিনি সুরের অনুসরণে ছুটে চললেন তাতে অগণিত গোপালনরা যোগ দিলেন। তারা পূর্ণ যৌবনা। তারা কৃষ্ণের অনুগামিনী হল। দশ হাজার গোপিনী ললনার অনুগমন করল দশ হাজার গোপী।

রতির সঙ্গেও দশ হাজার গোপাঙ্গনা, চোদ্দ হাজার গোপিনী চন্দনার সঙ্গে গেল। তারা কেউ মালা হাতে, কেউ চন্দন নিয়ে, কেউ চামর হাতে, কেউ কস্তুরী হাতে, কেউ কুধুম হাতে, কেউ স্বর্ণ ও বস্ত্রাদি বয়ে নিয়ে এল। কৃষ্ণ সখী– পরিবৃতা রাধাকে দেখে অত্যন্ত প্রীত হলেন।

সালংকৃতা রাধা উত্তম পরিধেয় বস্ত্রে শোভিতা। তারা উভয়ের দর্শনে চেতনা হারালেন। চেতনা ফিরে এলে কামাতুর কৃষ্ণ রাধাকে চুম্বন করলেন। তাদের কামাসক্তি অত্যন্ত বৃদ্ধি পেল। কৃষ্ণের চর্বনীয় তাম্বুল রাধা সানন্দে খেলেন। পরিশেষে রতিশয্যায় শায়িত হলেন।

রতিমন্দিরে কৃষ্ণ রাধিকার সঙ্গে সঙ্গমলিপ্ত হলেন। — তাঁদের সম্ভোগেচ্ছা কিছুতেই মেটে না। হরিও নানা রূপ ধরে গোপিনীদের সাথে রাসমণ্ডলে নৃত্য করেছেন। অবাধ উদ্দাম লীলায় তাদের দেহে শ্রান্তি ঘনিয়ে এল।

নিরাবরণ শরীরে তারা জল থেকে উঠে এসে আয়নায় নিজেদের মুখ দেখলেন ও বস্ত্র পরিধান করলেন। কৃষ্ণও কখনও কখনও গোপিনী বসন কেড়ে নিয়ে তাকে নগ্না করলেন।

রাধাকে মালতি মালা পরিয়ে চুম্বন করলেন। তিনি গোপিনীদের সাথে যৌনলীলায় মত্ত হলেন। কৃষ্ণ তাদের স্তনে, শ্রোণী দেশে গভীর নখক্ষত সৃষ্টি করলেন। রাসমণ্ডলের যৌনলীলা দেখে দেবতাদের শরীরও রোমাঞ্চিত হল। মিলন দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে স্মিতাননা সতীর দেহে কামনার সঞ্চার হলো, তারা সবাই যৌন কামনার চঞ্চল হলেন।

কৃষ্ণ অনাবৃত রাধিকাকে বুকে চেপে ধরলেন। কুপিতা রাধা তাঁর বাঁশি নিয়ে জলে ফেলে দিলেন। জলকেলী শেষ হয়ে উভয়ে বস্ত্র প্রার্থনা করলেন উভয়ের কাছে, তাঁরা বস্ত্র পরিধান করলেন। রাধাকে উষ্ণ আলিঙ্গনে ঘন ঘন চুম্বন করলেন কৃষ্ণ। পুনরায় কামাতুর হয়ে রাসমণ্ডলে গমন করলেন। তাদের কামপ্রবৃত্তি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেল। যৌবন মদমত্ত দেবীরা ভারতবর্ষীয় রাজগৃহে জন্মগ্রহণ করলেন।

২৯.

পরিণতবয়স্কা গোপিণীদের আত্মসম্মান থাকলেও তাঁরা প্রত্যেকে কৃষ্ণকে পতিরূপে কামনা করেছিলেন। কেউ তাঁকে কোলে বসাতে বললেন, কেউ মালা বা কেউ টিপ পড়াতে বললেন। আকারে ইঙ্গিতে তাঁরা কামোদ্বেগ প্রকাশ করলেন। গোপাঙ্গনাদের কামোত্মত্ততা অবলোকন করে কৃষ্ণ রাধাকে নিয়ে নির্জন স্থানে গিয়ে সম্ভোগরত হলেন। কৃষ্ণ রাধাকে নিয়ে সরোবরে স্নান করলেন।

কিছুটা দূরে গিয়ে কৃষ্ণ একটা বিরাট বটগাছ দেখলেন। সেখানে কেয়াবন রয়েছে। তিনি দেখলেন এক কৃষ্ণবর্ণ সর্বাবয়ব বক্র মুনি হরির অঙ্গরূপ লাবণ্য দেখে এগিয়ে আসছেন। তিনি অষ্টাবক্র মুনি। তিনি শ্রীহরির পাদপদ্মে প্ৰণত হলেন, তার দেহ থেকে বহ্নির তেজ নিঃসৃত হয়ে অতল, বিতল, সুতল, মহাতল, তলাতল, রসাতল, পাতালে পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে সংকুচিত হয়ে কৃষ্ণের চরণকমলে লীন হয়ে গেল। যিনি ভোরে ঘুম থেকে উঠে অষ্টাবক্র স্তোত্র পাঠ করেন নিঃসংশয়েই তিনি মোক্ষলাভ করেন।

৩০.

মুনির মৃত্যুতে কৃষ্ণ সত্ত্বারের ব্যবস্থা করে শিশুর মতো কেঁদে উঠলেন। মুনির শব থেকে ভস্ম নির্গত হল। কারণ তিনি ষাট হাজার বছর নিরঙ্কু উপবাস করায় জঠরানলে দগ্ধ হয়েছিলেন, ফলে তাঁর রক্তমাংস বলে কিছু ছিল না। তাঁর বাহ্য জ্ঞান লুপ্ত হয়েছিল।

এর কিছুকাল পরে বিধির পুত্র প্রচেতার অসিত নামে এক পুত্র জন্মাল। তিনি মুনি শ্রেষ্ঠ ছিলেন। অসিত পত্নীর সঙ্গে হাজার বছর কঠোর তপস্যা করলেন। কিন্তু অসিত পুত্র-প্রাপ্তির পরম সুখে বঞ্চিত হলেন। তিনি প্রাণ বিজর্সন দিতে উদ্যোগী হলে দৈববাণী হল, শঙ্করের কাছে দীক্ষিত হয়ে যে মন্ত্র পাবে সেই মন্ত্রের অধিষ্ঠাত্রী দেবী তোমার মনস্কামনা পূরণ করবেন।

দৈববাণী শুনে, স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে তিনি শিবলোকে গেলেন। ব্রহ্মকে প্রচেতা এবং প্রচেতা আত্মজ অসিতকে স্তোত্র প্রদান করলেন।

স্নেহশীল মহাদেব অসিতকে বললেন, অচিরেই সে রূপে গুণে তার অনুরূপ এক পুত্র লাভ করবে। শিবের অংশে অসিতের এক পুত্র জন্ম নিল। তার নাম দেবল, সুযজ্ঞরাজতনয়া পরমা সুন্দরী রত্নমালাবতীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়।

একদিন শয়নকালে তার সুতীব্র বৈরাগ্য জাগায় তিনি তপস্যার জন্য গন্ধমাদন পর্বতের গুহায় গমন করলেন। বিচ্ছেদ কাতর রত্নমালাবতী আহার ত্যাগ করে মৃত্যুবরণ করলেন। একদিন রম্ভা কামাতুর হয়ে মুনিকে আহ্বান করে বললেন–আমার কথা শোন। অসীম এই নির্জনতার মাঝে আমার সঙ্গে যৌন সংসর্গে রত হও। সংযতেন্দ্রিয়ের যে ব্যাক্তি এহেন শান্ত নির্জন পার্বত্য ভূমিতে নারীর ললিত যৌবন উপভোগ করে না, সে কুম্ভীপাক নরক যন্ত্রণাভোগ করে। যে সঙ্গমে তাকে তৃপ্ত না করে বেশ্যা তাকে বধ করতেও কুণ্ঠিত হয়না। জনশূণ্য মনোরমা এই প্রদেশে আমার সঙ্গে যৌন সম্ভোগে লিপ্ত হয়ে স্বর্গসুখ লাভ কর। মুনি তখন ভীত হয়ে তাকে নীতি কথা বললেন– ব্রাহ্মণ গার্হস্থ্য আশ্রমে স্বীয় স্ত্রীর সঙ্গে রতিক্রীড়া রত হয় সে ইহলোকে এবং পরলোকে পূজ্য বলে বিবেচিত হয়। কিন্তু পরস্ত্রী উপভোগে সে লক্ষীছাড়া হয় এবং একশো বছর নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়।

ব্রহ্মা স্ত্রী সংসর্গে রত হয়েছিলেন। তাই নারীর প্রতি বিতৃষ্ণা না জাগতে পারে কিন্তু আমি তপস্বী এবং সর্বতোভাবে রমণী সঙ্গত্যাগ করেছি–সে ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র আমি। আমাকে পরিত্যাগ করে তুমি মাতঃ কামাতুরা অন্য কোন কামাতুর যুবকের কাছে যাও।

রম্ভা তা শুনে রুষ্ট হয়ে বললেন। কামাতুরা অঙ্গরা তোমাকে ছাড়া কোনোভাবেই বাঁচতে পারবে না। আমাকে সম্ভোগের মধ্যে দিয়ে অবিলম্বে তৃপ্ত কর। তুমি আমার কামনার তেজ না মেটালে তোমায় শাস্তি দেব।

মুনি তাতে ভ্রূক্ষেপ না করে পুনরায় ধ্যানমগ্ন হলে রম্ভা স্বরূপ শাস্তি বলেন, তুমি ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণ হবে, তোমার সারা শরীর বেঁকে যাবে। তপস্যা লব্ধ ফল বিনষ্ট হবে।

রম্ভা অদৃশ্য হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্রীহরির পাদপদ্ম তাঁর চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হল। শোকার্ত মত মুনি প্রাণ বিসর্জনে উদ্যত হলে শ্রীকৃষ্ণ তাকে বর দিলেন। তারপর মুনি শান্ত ও তৃপ্ত হলেন। এবং অষ্টাবক্র নাম নিলেন। বহুকাল পরে মুনি নিরাহারে থেকে কঠোর তপস্যা করেছিলেন বলে জঠরাগ্নিতে তাঁর দেহ দগ্ধ ও ভস্মাচ্ছাদিত হয়েছিল।

৩১.

ব্রহ্মা কোন গণিকা দ্বারা অভিশপ্ত হয়েছিলে–নারদ তা শুনতে চাইল। সুচন্দ্র নামে রৈবত মন্বন্তর যুগে একজন রাজা ছিলেন। তিনি মলয় পর্বতে হাজার বছর ধরে হরির আরাধনা করেন। তার শরীর অত্যন্ত শীর্ণ হলো ও সর্বাঙ্গ বল্মীকাচ্ছদিত হলো। ব্রহ্ম তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে রাজাকে বর চাইতে বললেন।

রাজা বললেন–কৃষ্ণের ভক্ত ও দাস হয়ে থাকতে চান। ব্রহ্মাও তাঁকে তাঁর আকাঙিক্ষত বর দিলেন। ব্রহ্মাকে দেখে মোহিনী কামাতুরা হল। রম্ভা কামপীড়িতা সখীকে দেখে বললেন–ত্রিলোক তোমার রূপ যৌবনে মুগ্ধ যার সঙ্গে যৌন-মিলনের জন্য তুমি উন্মুক্ত হয়েছ সেও তোমাকে পাবার জন্য উন্মুক্ত। মোহিনী লজ্জিত হয়ে বলল–রম্য উদ্যানে ব্রহ্মাকে দেখে আমার এ অবস্থা।

এখন আমি কি প্রাণ বিসর্জন দেব? না লজ্জা ও সংকোচ ত্যাগ করে যৌন কামনা নিবৃত্তির জন্য প্রিয়গামিনী হব। রম্ভা তাকে বললেন, তুমি পুষ্কর তীর্থে গিয়ে কামদেবের পূজা কর। মোহিনী সেখানে গিয়ে তপস্যা করে বহুদিন পরে কামদেবের দেখা পেল। কামদেব তাকে নিয়ে ব্রহ্মলোকে গেলেন। মোহিনী নাচ ও গান শুরু করল। তাতে ব্রহ্মা সমাহিত হলো। নানা ভাবে মোহিনী তার লোভনীয় অঙ্গের সঙ্গে ব্রহ্মার পরিচয় সাধনে রত হলে পদ্মযোনি মোহিনীর অভিপ্রায় বুঝতে পেরে মাথা নত করলেন, এবং পরে শ্রীহরিকে স্মরণ করে মোহিনীর গান শ্রবণ থেকে বিরত হলেন।

৩২.

মোহিনীর স্তোত্রে প্রীত হয়ে পুষ্পকেতন ব্রহ্মার প্রতি মন্ত্রপুত অব্যর্থ শর নিক্ষেপ করলেন। ব্রহ্মাও কামাতুর হলেন। তাঁর চিত্তচাঞ্চল্য হরির পাদপম স্মরণে শান্ত হলো। তিনি বুঝলেন এ সব মদনের কাজ। তিনি কামদেবকে অভিশাপ দিয়ে বললেন, অচিরেই তোমার অহংকার ধূলায় লোটাবে, মোহিনীকে বললেন–তিনি– যে, পুরুষ পতিতার প্রতি অনুরক্ত তুমি তার কাছে যাও। বেশ্যার প্রতি যে আসক্ত হয় তার সর্বনাশ অবশ্যম্ভাবী। তুমি উপযুক্ত সুন্দরী; তাই উপযুক্ত পুরুষের সঙ্গে যৌনমিলনের আনন্দ উপভোগ কর। পৃথিবীতে তোমার মিলনযোগ্য পুরুষের অভাব নেই। নারায়ণ স্ত্রী জাতিকে প্রকৃতির অংশ রূপে সৃজন করেছেন। যাঁরা সতী তাঁরা সকলের শ্রদ্ধা অর্জনে সফলকাম হন আর অসতী কন্যা নিন্দাভাগিনী হয়। মোহিনী ছলে-বলে-কৌশলে আপন দেহের স্পর্শ কাতর অংশগুলি একে একে ব্রহ্মাকে দেখাতে শুরু করে কাম এসে ব্রহ্মাকে পঞ্চশর নিক্ষেপ করে। ব্রহ্মার চিত্ত চঞ্চল হয়ে উঠল ও সর্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত হলো। কিন্তু তিনি হরিকে স্তব করে তাঁর চরণ স্মরণ করতে লাগল।

৩৩.

ব্রহ্মা হরির বরে কামকে বশ করলে মোহিনী তাকে ব্যঙ্গ করে বলে যে কাম পীড়িতা রমণীর ইঙ্গিতে সাড়া দিয়ে সম্ভোগে লিপ্ত হয় সেই শ্রেষ্ঠ পুরুষ। যে রমণীর দ্বারা প্রকাশ্যে প্রার্থিত হয়ে অবশেষে যৌন মিলনে রত হয় সে মধ্যম পুরুষ, আর যে যে কামিনীকে পেয়েও ভোগ করে না সে ক্লীব। ব্রহ্মা বললেন–রমণীর সংকোচ পরিহার করা অনুচিত। তুমি কামনা তৃপ্তকারী পুরুষের সন্ধান কর।

শ্রীকৃষ্ণ বললেন–নারীজাতি প্রকৃতিরই অংশ, তারা জগতের বীজস্বরূপা। কোন মিলনমদির কামিনীকে সংযেতন্দ্রিয় ব্যক্তি ত্যাগ করলে রমণী তাকে শাপ দেয়। কোন কামার্ত রমণী পুরুষের কাছে এলে তার সঙ্গে সঙ্গম হওয়া বাঞ্ছনীয়।

৩৪.

বিষ্ণুর সভায় বৃষারূঢ় মহাদেব এলেন। শঙ্কর ব্রহ্মাকে প্রণাম করে প্রফুল্ল বদনে উপবিষ্ট হলেন। গঙ্গাধিষ্ঠাত্রী দেবী তাঁর ভবনে এলেন সুরগণের শরীর থেকে উদ্ভূত হওয়ার তার নাম হল সুরনিমঙ্গা। ভগীরথ গঙ্গাকে মর্তে এনেছিলেন, তাই গঙ্গার অপর নাম ভাগীরথী। জাহ্নমুনি একবার ক্রুদ্ধ হয়ে গঙ্গাকে পান করেছিলেন এবং পরে মুনির জানু থেকে নির্গমণ হওয়ায় তাঁর নাম হয় জাহ্নবী।

তিনি ত্রিপথগামিনী তিনি স্বর্গগামিনী। তাঁর প্রধান ধারা স্বর্গে প্রবাহিত ও মন্দাকিনী নামে পরিচিত। মন্দাকিনী উচ্চ তরঙ্গ যুক্তা এবং নদীর জল পবিত্র, নির্মল। অসংখ্য মুনি-ঋষি গঙ্গার তীরে বাস করে।

দ্বিজাতির শবদেহের বাহক যদি শূদ্র হয় সেই দ্বিজাতিকে পদক্ষেপ পরিমিত বছর নরকবাসী হতে হয়। পরে গঙ্গা তাদের মুক্তি দেন। পাপী যদি অন্য কোন কাজে বেরিয়ে মূল বিষয়ের সঙ্গে গৌণ ভাবে সংশ্লিষ্ট গঙ্গায় অবগাহন করে, ও পুনরায় পাপে লিপ্ত না হয় তবে তার পাপমুক্তি হয়। পাতাল গামিনী গঙ্গার ধারা ভোগবতী নামে খ্যাত। অনেক মণি-মুক্তো এবং মহার্ঘ রত্ন সমূহের আকর গঙ্গার এই পবিত্র ধারা।

৩৫.

হরিকে প্রণাম করে ব্রহ্মা নির্জনে মোহিনীর সঙ্গে মিলনরত হলেন। অনেকক্ষণ ধরে সঙ্গমের অনির্বচনীয় আনন্দ অনুভব করে অবশেষে ব্রহ্মলোকে ফিরে এলেন। ব্রহ্মলোকের বাসিন্দারা দেখলেন পরমাসুন্দরী, গৌরবর্ণা ভারতী ব্রহ্মলোকে বিরাজ করছেন। তার নিতম্ব ও স্তনযুগল স্কুল এবং দৃষ্টি মনোরম। এখানে এসে ব্রহ্মা ভারতীর সঙ্গে দিনরাত সুখ সম্ভোগে মিলিত হলেন। শ্রীরাধিকা নারায়ণকে বললেন–সকল ফলের দানকর্তা ব্রহ্মা স্বয়ং স্বেচ্ছায় দেহ দান করতে উপস্থিত বেশ্যাকে কেন প্রত্যাখান করলেন। কামতপ্ত কামিনীকে প্রত্যাখান করাও বিধেয় নয়।

ব্রহ্মতেজে দীপ্ত ব্রহ্মা মানসপুত্রদের সৃষ্টি করলেন। আনন্দের আতিশায্যে একটি পুত্র ও একটি কন্যা সৃষ্টি করলেন। পুত্রটি হলেন কামদেব, কন্যাটি ধীরে ধীরে বড় হল। কামদেব শরগুলির কার্যকারিতা বিষয় নিঃসংশয় হবার জন্য মনে মনে স্থির করলেন, ব্রহ্মা কামদেবের শর নিক্ষেপে কামাতুর হয়ে চেতনা হারালেন।

চেতনা ফিরে পেয়ে ব্রহ্মা দেখলেন তার সামনে ভরা যৌবনা কন্যা দন্ডায়মানা। কামনা নিবৃত্তিই তখন ব্রহ্মার পরমকাম্য নিজ কন্যার প্রতি আসক্ত হওয়ায় ব্রহ্মার পুত্ররা বললেন– বেদে বলা হয়েছে কন্যা মাতৃস্থানীয়া, আপনি বিশ্বের প্রভু হয়ে স্বীয় কন্যার সঙ্গে যৌন মিলন আকাঙ্ক্ষায় অস্থির হয়ে উঠেছেন। পিতা বলে আপনাকে ক্ষমা করছি। না হলে ভস্ম করতাম।

দেব নির্দেশে ব্রহ্মা প্রাণ ত্যাগ করলেন এবং কন্যাও পিতাকে দেখে প্রাণ ত্যাগ করলেন। নারায়ণের বরে তারা প্রাণ ফিরে পেলেন। রমণীর নিতম্ব, স্তনযুগল ও মুখশ্রী কামদেবের আবাসস্থল, তাই ধর্মাত্মারা নারীদের দিকে তাকার না। পরস্ত্রীতে যাদের রতি, তাদের ধর্ম, সম্মান, প্রতিষ্ঠা সাধনা বিদ্যা-বুদ্ধি ও জ্ঞান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। পরকালে তাকে নরকযাতনা ভোগ করতে হয়।

দৈবক্রমে পরস্ত্রীর দর্শনে হরির পাদপদ্ম স্মরণ করা বিধেয়। যারা বেদবিহিত আচরণ করে তারা নিন্দ্য। সৎপথে যাদের বিচরণ তারা সকলের প্রশংসা অর্জন করে, যারা কুপথগামী ঘাতকেরাও তাদের ঘৃণা করে। পরদ্রব্যে ও পরস্ত্রীতে তোমার আসক্তি হবেনা হরির বরে। তোমার কন্যার নাম হবে রতি ও রতি কামদেবের পত্নী হবে।

৩৬.

ব্রহ্মার তপস্যায় তুষ্ট হয়ে নারায়ণ তাকে বর দেন। সৃষ্টি কার্যে আত্মনিয়োগ করতে ও বিধাতা নামে অভিহিত হতে। নারায়ণ কেবলমাত্র ব্রহ্মার নয়, শিব-পার্বতী চন্দ্র-সূর্য অগ্নি-দুর্বাসা-ধন্বন্তরি প্রভৃতিরও গর্ব খর্ব করেছেন। অহংকারের সঞ্চার হলেই হরি তা দমন করেন। হরির সমান হবার জন্য শিব ষাট হাজার বছর কঠোর তপস্যা করে ছিলেন।

সাধনার তেজে তিনি উজ্জ্বল, কোটি সূর্যের মত তার প্রভা সততই প্রবহমান তিনি ভক্তের মনোবঞ্ছা পূরণ করলেন। তিনি নিজেকে ঈশ্বর মনে করে সকলকে তাদের অভীষ্ট প্রদান করতে লাগলেন। বৃক নামে এক দৈত্য এক বছর ধরে দিন রাত শিবের তপস্যা করলে শিব প্রীত হন এবং তাঁর কাঙ্খিত বর দান করার জন্য তাঁর সমীপে উপনীত হন। অসুর বর গ্রহণ করতে চায় না।

বৃকাসুর আন্তরিক ভক্তিতে শিবকে পূজো করে। শিব তাকে সকল ঐশ্বর্য দান করলেও সে শিবের চরণ ধ্যান করতে থাকে। আবেগপ্রবণ দেবাদিদেব তাঁর প্রতি নিষ্কাম প্রেম বিহ্বলতা লক্ষ্য করে অশ্রু মোচন করতে থাকেন। শঙ্করের রোদন ধ্বনিতে বৃকাসুরের ধ্যান ভেঙ্গে গেল। বৃক শিবকে সামনে দেখে বর চাইল যে, সে যার মাথায় হাত দেবে তৎক্ষণাৎ সে ভস্মীভূত হবে।

বর প্রদান করার পর শিব যেতে উদ্যত হলে বৃক তাকে অনুসরণ করল। শিবের মনে ভস্মীভূত হওয়ার ভয়ের সঞ্চার হওয়াতে তিনি দ্রুত যেতে গেলে তার ডুগডুগি ও বাঘছাল খসে পড়ল। দৈত্যের ভয়ে তিনি তখন নিরাবরণ দেহে দশ দিকে ধাবমান হলেন। শিব নিজেকে আশ্বাস দিতে পারলেন না। তিনি শ্রীহরিকে স্মরণ করতে লাগলেন। তাঁর মুখ শুকিয়ে গেল।

হরি মায়া বিস্তার করলেন। ফলে নিজের মাথায় হাত দিয়ে তৎক্ষণাৎ ভস্মীভূত হল। এভাবে শিবের অহংচূর্ণ করলেন হরি। শিব একবার ত্রিপুরাসুরের বিনাশে প্রয়াসী হন। অসুরকে সামান্য ভেবে তিনি হরির দেওয়া শূল ও কবচ ফেলে তার সঙ্গে সংগ্রামে রত হন। কিন্তু শিব ত্রিপুরাসুরকে হারাতে পারলেন না। শিব তাঁর রথসহ ভুতলে পতিত হলে শঙ্কিত দেবতারা নিবিষ্টচিত্তে হরিকে আহ্বান করতে লাগলেন। হরি তখন বরাহরূপ ধারণ করে শৃঙ্গ দ্বারা শিবকে ধারণ করে আবার কবচ ও শূল তাঁর হাতে তুলে দিলেন।

পরমাত্মাস্বরূপ শিব সতীদেহ কাঁধে নিয়ে এক বছর নগর পরিক্রমা করেছিলেন। সতীর অঙ্গ প্রত্যঙ্গ যে সকল পূতস্থানে পতিত হয়েছিল সেখানে এক একটি সিদ্ধপীঠ গড়ে উঠেছে। শবের অবিশষ্টাংশ বুকে নিয়ে শঙ্কর সংজ্ঞা হারিয়ে সিদ্ধপীঠে পতিত হয়েছিলেন। তখন ক্রোড়ে বসিয়ে হরি তাকে শান্ত করলেন ও পরবর্তীকালে অন্য মূর্তিতে সতীকেই লাভ করলেন।

তপস্যা করার সময় তিনি জটা ধারণ করেন যা আজও রয়েছে। যোগাভ্যাসের জন্য বসনে তাঁর আকর্ষণ লিপ্ত হয়েছে। গরুড়ের ভয়ে ভীত সাপেরা তাঁর স্মরণাগত হলে তাদের তিনি শরীরে ধারণ করেন। ত্রিপুরাসুরকে বধ করার সময় বৃষের উদ্ভব বলে বৃষই তার বাহন। ধুতরো ফুল, বেল গাতা, বেলকাঠের প্রলেপ, নির্গন্ধ ফুল, বাঘছাল তার অত্যন্ত প্রিয়। জনশূন্য শ্মশানের নির্জনতা তাঁর ভীষণ প্রিয়। ব্রহ্মার পতন হলেও শিবের বিনাশ নেই। তাই পৃথিবীতে শঙ্করের চেয়ে একনিষ্ঠ ভক্ত আমার আর কেউ নেই।

৩৭.

একদিন সনকুমার গোলোকে গমন করে ভোজনরত নারায়ণকে প্রত্যক্ষ করলেন। তিনি নারায়ণকে নত মস্তকে প্রণাম করে তার স্তব করতে লাগলেন। নারায়ণ তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে উচ্ছিষ্ট প্রসাদরূপে দান করলেন। তিনি দুষ্প্রাপ্য প্রসাদ মিত্রদের জন্য কিছুটা রেখে দিলেন। সনৎকুমার সিদ্ধাশ্রমে গমন করলেন ও তাঁর পরম আরাধ্য গুরুদেব শম্ভুকে সেই দুর্লভ বস্তু দান করলেন।

তা খেয়ে দেবাদিদেব আনন্দে নাচতে লাগলেন। তার হাত থেকে খসে পড়ল ডমরু, কটিদেশ থেকে বাঘছাল। তিনি সংজ্ঞা হারালেন। সংজ্ঞা ফিরলে তিনি কাঁদতে কাঁদতে পুনরায় ভূতলে পতিত হলেন। দুর্গা সেখানে এসে প্রভুর এইরূপ অবস্থার কারণ কী সনৎকুমারকে বলতে বললেন। তিনি কৃতাঞ্জলি পুটে ঘটনার আদ্যপ্রান্ত বিবরণ দিলেন। দুর্গা সব শুনে শিবের উপর ক্রুদ্ধ হলেন।

তিনি শংকরকে অভিসম্পাত দিতে উদ্যত হলেন। শম্ভু তখন দেবীর মনোরঞ্জনের জন্য তার স্তব করতে লাগলেন। রুদ্র দেবীর ভয়ে কাঁপতে লাগলেন। জগজ্জননী দুর্গার আয়তলোচন মুখমণ্ডল ক্রোধে রক্তপদ্মের মতো লাল হয়ে উঠলো।

দেবী বললেন–প্রভু, সুদীর্ঘ কঠোর তপস্যার দ্বারা আমি তোমাকে পতিরূপে লাভ করেছি। তুমি প্ৰসাদ আমাকে না দিয়ে ভক্ষণ করলে। পর্বতরাজ তনয়া পতির সন্মুখে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। হর তার চোখের জল মুছিয়ে দিলেন। শিব তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। তিনি বললেন– হে চন্ডিকা, তুমি চিরন্তনী-অনুগ্রহ করে ক্রোধ সংবরণ কর। তুমি গোলোক পতির নিত্য সহচরী। তুমি সাকার ও নিরাকার। কৃষ্ণের শ্রীচরণে অচলাভক্তি তো তোমার কৃপার আপেক্ষিক, আমি কিভাবে তোমায় হরির নৈবেদ্য প্রদান করব। তুমি দেহত্যাগ করে সেই নিগুণের কাছে যাও।

কৃষ্ণ বললেন–সুন্দরী পার্বতী পতির অঙ্গীকার শ্রবণে সন্তোষ লাভ করে মন্দাকিনীতে স্নানের জন্য গমন করলেন। স্নান সেরে ইষ্ট দেবতার আরাধনা করলেন। শিবস্তোত্র উচ্চারণ করে তাকে প্রণাম করলেন।

৩৮.

দেবতাদের তেজে দেবী দুর্গা কামিনীর রূপ ধরে অসুর নিধন করে দেবকুলের ত্রাণ করে ছিলেন। সতী শিবের সাথে পিতৃগৃহে যেতে চাইলেন। পতিকে তিনি অনুনয় বিনয় করলেন, অনেক করে বোঝালেন। শিব সম্মত হলেন না। শিবের শাপে তার দর্পচূর্ণ হলো। দক্ষ সতীকে দেখে আর কোনো কথা বললেন না।

উমা নিজেকে সজ্জিত করলেন। দর্পণে তিনি আপন রূপমাধুরী দেখে সযতনে কপালে কস্তুরী ও সিদুরের টিপ দিলেন। ঈষৎ আয়তলোচনে কাজল পরলেন, তার দন্ডরাজি মুক্তোর মত ঝলমল করছিল। তার বুক থেকে তপ্ত কাঞ্চনের আভা ঠিকরে বেরোচ্ছিল।

৩৯.

শিবের যৌবন প্রত্যক্ষ করে কোনো কোনো রমণী কামাতুর হয়ে উঠল। কোনো কোনো কামিনী পতির নিন্দায় মুখর হয়ে উঠল। কামার্ত হয়ে কেউ বা অন্য স্ত্রীকে আলিঙ্গন করল। কেউ আবার মনে করল সংসারে আর কাজ নেই। পরকালে শিবকে পতিরূপে পাবার কামনা নিয়ে অগ্নিতে প্রাণ বিসর্জনই শ্রেয়। দুর্গার মত সুভাগা পুণ্যশীলা আর কেউ নেই মনে করে শিবের পরিষেবায় তারা তাকে দেবাদিদেবের কাছে পাঠাল।

পার্বতী সখীদের মধ্যে শিবকে দর্শন করে সাতবার তাঁকে প্রদক্ষিণ করে তাঁকে প্রণাম করলেন। শিব তাঁকে আশীর্বাদ করে বললেন– তুমি শ্রেষ্ঠ পতি লাভ কর, তুমি স্বামী এবং পুত্রে সৌভাগ্যবতী হবে। ত্রৈলোক্যে সর্বাগ্রে তোমার পুজা অনুষ্ঠিত হবে। বিশ্বে তুমিই শ্রেষ্ঠা রূপে প্রতিপন্ন হবে।

পার্বতী তার পিত্রালয়ে গমন না করে সখীদের অনুরোধ, নিষেধকে অগ্রাহ্য করে কঠোর তপস্যার জন্য বনগমন করলেন। গঙ্গাতীরে নিবিড় অরণ্যে বহুকাল তপস্যা করে শেষে তিনি চিরকাঙ্ক্ষিত শংকরকে পতিরূপে লাভ করে ধন্য হলেন।

৪০.

নারীরা আগুনের জ্বালা ও বিষের তীব্র যন্ত্রণা সহ্য করতে পারে, কিন্তু সইতে পারে না পতির বিচ্ছেদ। শিব অক্ষয় বটের মূলে তার তপস্যার স্থল ছেড়ে চলে গেলেন তখন হিমালয় মেনকার অনুরোধ উপেক্ষা করে পার্বতী দুশ্চর অরণ্যে সুকঠোর তপস্যার নিমিত্তে গমন করলেন। জগজ্জননী এক বছর ধরে শিবমন্ত্র জপ করে ধ্যান মগ্ন হলেন। প্রখর তপন তাপকে অগ্রাহ্য করে তিনি চারধারে আগুন জ্বালিয়ে, প্রাবৃটকালে শিলাবৃষ্টি ও অপরিচ্ছন্ন ধারাপাতে, শ্মশানে যোগাসনে উপবিষ্ট হয়ে, শীতে তুষারপাতে বিচলিত না হয়ে জলমধ্যে নিয়ত অবস্থান করলেন। শঙ্করের চিত্তে করুণার সঞ্চার হলে তিনি খর্বাকৃতি এক বালক ব্রাহ্মণের রূপ ধারণ করলেন। হাতে তার ছত্র ও লাঠি, মাথা ভর্তি জটা, গলায় উপবীত এবং পরিধানে শুক্লবসন। নির্জন অরণ্যে ছেলেটিকে দেখে পার্বতীর মনে স্নেহের সঞ্চার হলো। তার মুখে হাসি ফুটল। শঙ্কর তখন বললেন– আমি তপস্বী। আমি অবাধে সর্বত্র বিচরণ করে থাকি।

দেবী তখন বললেন– পূর্ব জন্মে আমি ছিলাম দক্ষরাজ নন্দিনী। শিবের সঙ্গে আমার বিবাহ হয়েছিল, পিতার মুখে পতির নিন্দা শুনে আমি যোগবলে দেহত্যাগ করেছিলাম। এইজন্মে আমি পিতৃগৃহ ত্যাগ করে এই অরণ্যে উপস্থিত হয়ে আমার প্রিয় দেবতার তপস্যায় মগ্ন হলাম। বেদে বলা হয়েছে, প্রতি নারীই অভিযাচিত পতির সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য যদি জন্মগ্রহণে অভীক্ষু হয়, জন্ম জন্মান্তরে নারী একই পতিকে লাভ করে। শিব বললেন, তোমার তপস্যা লব্ধ শক্তির পরিচয় পেয়ে আমি মুগ্ধ হয়েছি। কিন্তু তুমি বুদ্ধিহীনা।

আগুন তোমাকে দগ্ধ করতে পারল না, পতিকেও তুমি পেলেনা। সংহার কর্তাকে যে পতিরূপে কামনা করে বলতে বাধ্য হচ্ছি, সে নির্বোধ। তাকে লাভ করার জন্য তুমি যদি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে থাক, তবে তুমি লাভ করবে ভয়ংকর রুদ্রকে। তুমি গমন কর পর্বতরাজের আলয়ে। তোমার কঠিন তপস্যার ফলে আমার বরে তুমি অপ্রাপনীয় শংকরের দর্শন পাবে। হিমালয় অনিচ্ছাতেও কন্যা সম্প্রদান করে ভারতেই বিরাজ করুন আর না হলে মহেশ্বরকে কন্যাদান করে সারূপ্য মুক্তি লাভ করবেন। অতঃপর অরুন্ধতীসহ সপ্তর্ষিরা গিরিরাজের আলয়ে গিয়ে আশ্বাস দান করলেন। পার্বতীও শিববিনা অন্য কাউকে বিবাহ করবে না আর তাই যতই অনিচ্ছা থাক না কেন হিমালয় তাঁর কন্যাকে শিবের সঙ্গে বিবাহ দিতে বাধ্য হলেন।

৪১.

মহেশ্বরকে গিরিরাজ কন্যা দান করলে নিঃসন্দেহে তিনি মুক্তি লাভ করবেন। শংকর হাস্যোজ্জ্বল মুখে দেবতাদের আশ্বস্ত করলেন এবং শৈলরাজ গৃহে গমন করলেন। দেবতারা আনন্দে আপন গৃহে ফিরলেন, গিরিরাজ মিত্র ও পার্বতী সহ সভামধ্যে অত্যন্ত আনন্দে বিরাজ করতে লাগলেন।

সভায় ব্রাহ্মণদের বাক্য শ্রবণ করে মেনকা জল ভরা চোখে হিমালয়কে বললেন– তুমি বরং তোমার বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে মন্ত্রণা করে দেখ, শিবকে কন্যা সম্প্রদান করা শ্রেয় কিনা? অরুন্ধতী মেনকার কাছে গিয়ে দেখলেন, তিনি শোকে মূহ্যমান হয়ে মুছিতপ্রায় এবং মাটিতে শুয়ে আছেন। স্বর্ণপীঠে অরুন্ধতাঁকে বসিয়ে পাদ্য অর্ঘ্য দান পূর্বক মেনকা তাঁকে মিষ্টি দিলেন। অরুন্ধতী শিব ও পার্বতীর বিবাহ সম্পর্কে অনেক নীতি কথা বললেন। তারকাসুর বধের নিমিত্ত এই পরিণয়ও একান্ত কাম্য এবং ব্রহ্মা এ বিষয়ে তাকে অবহিত করিয়েছেন। পিতা যদি উপযুক্ত পাত্রে কন্যা সম্প্রদান না করেন তাকে একশো বছর ভোগ করতে হয় নরক যন্ত্রণা।

৪২.

অনরণ্য তনয়া পতিব্রতাপদ্মা এক দিন মন্দাকিনীতে স্নান করতে গিয়ে ছিলেন। মায়াবলে রাজার রূপধারী ধর্ম তাকে দেখতে পেলেন। তিনি বললেন–আমি কামশাস্ত্রে নিপুণ, কামপীড়িত রমণীর যৌন কামনা মেটাতে আমার তুল্য আর কে আছে? ধর্ম রথ থেকে নেমে তাকে আলিঙ্গনে উদ্যত হলে পদ্মা তাঁকে বললেন– পাপী! এক পা এগোলেই তুমি ভস্ম হবে। পদ্মার শাপে ভীত হলেন ধর্ম। তিনি বললেন–তোমাকে পরীক্ষা করতে গিয়ে আমি অভিশপ্ত হলাম। পদ্মা যখন জানলেন তিনি ধর্ম, তখন শ্রদ্ধাসহকারে তাকে বললেন–আপনাকে না জেনে সতীত্ব রক্ষার্থে ক্রোধের বশে শাপ দিয়েছি। সতীর শাপ কোনদিন ব্যর্থ হয় না। কিন্তু আপনার বিনাশ আমি কামনা করিনা।

আপনি সত্যযুগে পূর্ণিমার চাঁদের মত পূর্ণরূপে বিরাজ করবেন। ক্রেতা, দ্বাপর ও কলিতে আপনার এক পাদ, দ্বিপাদ ও ত্রিপাদ ক্ষয় হয়ে কলির অন্তিমে আপনার এক পাদ সমাচ্ছন্ন হবে। সত্যযুগে আপনার অস্তিত্ব সর্বব্যাপী হবে এবং সত্যেতর যুগে আপনার মহিমা সর্বত্র প্রকাশমান না হয়ে কোনো কোনো স্থানে প্রকাশিত হবে। মন্দিরে, তীর্থে, সাধুর আলয়ে, যেখানে বেদ বেদাঙ্গের আলোচনা হয় সেখানে, যেখানে কৃষ্ণের নাম গান হয় সেখানে, ব্রত, অর্চনা, ন্যায় ও যজ্ঞস্থলে আপনি নিয়ত অধিষ্ঠিত থাকবেন।

দীক্ষা, পরীক্ষা, অঙ্গীকার, গোস্পদ, গোশালা এবং গোষ্ঠে আপন বিরাজ করবেন। পতিতালয়ে, খুনির গৃহে, নীচ, অদক্ষ ও ক্রুর ব্যক্তিতে দেব-দ্বিজ-গুরু-পুণ্যবানদের সম্পত্তিহরণকারী চোরেদের, দূতাক্রীড়া স্থলে, রাজায় রাজায় যেখানে কলহ হয় সেখানে, যেখানে শালগ্রামশিলা সাধুসন্ন্যাসী, তীর্থ, পুরাণাদি নেই, দস্যু অধ্যুষিত অঞ্চলে, অহংকারী ব্যক্তিতে, অসিজীবী, পূজারী ব্রাহ্মণ, গ্রাম্য পুরোহিত, বৃষবাহক, স্বর্ণকার ব্যাধ, পতিনিন্দা পরায়ণা স্ত্রৈণ, বিষ্ণুভক্তিবিহীন ব্রাহ্মণ, স্ত্রী, কন্যা, শালগ্রাম শিলা, দেবপ্রতিমা গ্রন্থ, ভূমি বিক্রেতা, মিত্রের সঙ্গে যে বিশ্বাসঘাতকা করে, শরণাগতকে যে আশ্রয় দান করে না সেই সব স্থলে আপনার ক্ষীণতা প্রকাশ পাবে।

এভাবে আপনার প্রতি আমার শাপের ভার হ্রাস পাবে। এখন আমি গৃহে ফিরছি পতিদেবতার সেবার উদ্দেশে, আপনি নিজ নিকেতনে গমন করুন। অনরণ্য তনয়া একথা বললে ধর্ম বললেন–তুমি সাধ্বী রমণী। আশীর্বাদ করি, তোমার কল্যাণ হোক। তুমি ত্রাণের পথ দেখিয়েছ, আমাকে বল কী বর চাও। আমি বর দিচ্ছি, তোমার স্বামী জরা ত্যাগ করে নবযৌবন সম্পন্ন মনোহর, কুবেরের মত ধনবান, মার্কণ্ডেয় তুল্য দীর্ঘজীবী, ইন্দ্র তুল্য ঐশ্বর্যশালী, শিবের মত বিষ্ণু ভক্ত, কপিলের তুল্য দীর্ঘজীবী হবেন। যাবজ্জীবন সৌভাগ্যবতী হবে স্বামীসহ, স্বামীর চোখে অধিকতর রূপগুণ সম্পন্ন পুত্রের জননী হবে তুমি।

পতিব্রতা পদ্মা ধর্মকে প্রণাম ও প্রদক্ষিণ করে ঘরে ফিরেলেন। তাঁকে আশীর্বাদ করে, ধর্মও গৃহাভিমুখী হলেন। সর্বত্রই তিনি সাধ্বী স্ত্রীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন। বাড়ি ফিরে পদ্মা দেখলেন, তার স্বামী স্থির যৌবনের অধিকারী হয়েছেন। তিনি পিপ্পলাদের সঙ্গে নির্জনে রতিক্রিয়ায় মিলিত হয়ে পুলকিত হলেন এবং জননী হলেন। যথাসময়ে রূপ গুণ সম্পন্ন বহু পুত্রের জননী হলেন। অনরণ্য তার মেয়েকে পিপ্পেলাদ মুনির হাতে সমর্পণ করে যেভাবে স্বীয় সম্পত্তি রক্ষা করেছিলেন অনুরূপ ভাবে তুমি ও দেবাদিদেবকে পার্বতী সম্প্রদান করে স্বীয় সম্পত্তি স্বজন ও মিত্রদের রক্ষা কর।

লগ্নের অধিপতিঐদিন লগ্নস্থ হবেন। আজ থেকে সাতদিন পরে চরম সুসময় আসবে। বুধের সঙ্গে চন্দ্রও লগ্নস্থ ও রোহিণীযুক্ত হয়ে পরিশুদ্ধ হবেন। অগ্রহায়ণ মাসের পূর্ণিমা বিশিষ্ট সোমবার সর্বকলঙ্ক মুক্ত অত্যন্ত শুভক্ষণ। ঐ দিনে পরিণীতা হলে কন্যা পুণ্যবান পতি ও সৎপুত্র লাভ করে। এই লগ্নে জন্ম জন্মান্তর পত্নী সভর্তৃকা হয় এবং দম্পতির মাঝে গভীর প্রণয়ের সঞ্চার হয়। এই লগ্নে সকল দেবতার তেজঃস্বরূপ, ঈশ্বরী মূল প্রকৃতি কন্যাকে পরমেশ্বর শিবের উদ্দেশ্য প্রদান কর। দেবীর ব্যক্তিত্বে, ভয়ংকর প্রভাবে কেউ নগ্ন হয়ে ছিল, কেউ বিস্ময়াদি জড়ীভূত হয়েছিল, দেবীর দয়াতেই, দক্ষ তাঁর কন্যাকে শিবের হাতে সমর্পণ করেন।

দেবসভায় শিবের শ্বশুরের সঙ্গে দারুণ বিবাদ হয়। শিবকে যজ্ঞ ভাগ দান করলেন না দাম্ভিক দক্ষ, পিতার অশোভন আচরণে সতী খুব ক্রদ্ধ হলে। সতী পিতার পরাজয়, যজ্ঞভঙ্গ, মুনি ও পর্বতদের পলায়ন, শিবের জয়, যোগবলে উদ্ভব, শিবের সঙ্গে তার পুনরায় পরিণয়ের পূর্বাভাস দিয়ে প্রসূতি এবং স্বীয় ভগিনীদের নিষেধ অগ্রাহ্য করে শোকাহত হয়ে নিষ্ক্রান্ত হয়ে ছিলেন। জাহ্নবী তীরে সকলের অলক্ষ্যে পরমা সতী স্নান করে হরের অর্চনা করে পতির চরণ স্মরণ করে দেহত্যাগ করলেন এবং গন্ধমাদন স্থিতা দেবীর শরীরে প্রবেশ করলেন। দেবতারা শোক কাতর হলেন। দক্ষযজ্ঞ পণ্ড করে শিবের অনুচরেরা দুঃখে কাতর হয়ে শিবকে আনুপূর্বিক বিবরণ দিলেন। শংকর অজ্ঞান হলেন। জ্ঞান ফিরলে মন্দাকিনী তীরে গেলেন।

৪৩.

মন্দাকিনীর তীরে হর সতীর শায়িত দেহ দেখলেন। সতীকে দেখে শিব বিচ্ছেদে কাতর হলেন। সমুদয় তত্ত্বে অভিজ্ঞ যিনি তিনিও শোকে জ্ঞান হারালেন। সতীকে কি যেন বলতে গেলেন চেতনা ফিরে পেয়ে। তার মুখ দেখা মাত্রই সব ভুলে স্থাণুর মত নিশ্চল হয়ে সেখানে বিরাজ করতে লাগলেন। এবং বললেন– তুমি ছাড়া আমি শবতুল্য। তোমার শক্তিতে আমি শক্তিমান। যিনি জানেন না শক্তি কী, তিনিই পরিত্যাজ্য তিনিই শক্তির নিন্দা করে থাকেন। ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং আমি যখন তোমার সাধ্যভূত তখন সুস্মিত মুখে আমার দিকে তাকাও। অমৃত মধুর কণ্ঠে আমায় কিছু বল। আমার বিরহ জ্বালা দূর হতে পারে কেবল তোমার মধুর বাক্য ও দৃষ্টি নিক্ষেপে। তোমার বিরহে আমি কাঁদছি, তুমি দেখতে পাচ্ছনা। পরমেশ্বরী, তুমি যে প্রাণের আধার। একবারও কি নয়ন মেলে দেখবেনা ক্রন্দনরত শিবকে। রোদনপরায়ণ শিব মৃতদেহকে বুকে নিয়ে বার বার চুম্বন ও আলিঙ্গন করলেন। কিন্তু বারবার চুম্বন ও আলিঙ্গন করার পরও শিব পুনরায় মূৰ্ছিত হলেন। প্রজ্ঞাবানদের গুরুর গুরু স্থানীয় হলেও শংকর চন্দ্রাবিষ্টের মতো আচরণ করতে লাগলেন।

সেই সুবর্ণ প্রতিমাকে বুকে নিয়ে শিব সপ্তদ্বীপ, সাত সাগর, পুণ্য ভারতের পর্বতশৃঙ্গে, জম্মুদ্বীপের অক্ষয় বটমূলে, নদীতীরে ভ্রমণ করতে লাগলেন। নেত্র সরোবরের সৃষ্টি হল তার ত্রিলোচন নিঃসৃত অশ্রুতে। নেত্র সরোবরে মুনি-ঋষিরা নিয়তই তপস্যা করেন। এই সরোবরে বিস্তার চারক্রোশ। সেই সরোবরে স্নান করলে পুনর্জন্ম রহিত হওয়া যায়। মূহুর্তেই বিদূরিত হয় পূর্ব জন্মের পাপ। বিরহানলে দগ্ধ শকর একবছর ধরে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করলেন। সতীর বিগলিত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ যেখানে যেখানে পড়ল যেখানে সিদ্ধপীঠ গড়ে উঠল।

সতীদেহের অবশিষ্টাংশ শিব সৎকার করলেন। স্বীয় কণ্ঠে ধারণ করলেন অস্থিমালা। তিনি অঙ্গে লেপন করলেন সতীর চিতাভস্ম। তিনি পরমাত্মাকে পর্যন্ত ভুলে গেলেন। এক সময় সতীর বিরহে কাতর হলেন। শিবকে বটমূলে শুয়ে থাকতে দেখে বিস্ময়াবিষ্ট দেবতারা তার কাছে এলেন। যাঁর চরণ বন্দনা করেন লক্ষী দেবী সেই নারায়ণ রত্ননির্মিত রথে পরিষদ সমভিব্যহারে সেখানে আগমন করলেন। রত্নালঙ্কারে সম্যকরূপে অলংকৃত পীতাম্বর, চতুর্ভূজ নারায়ণের মুখ প্রসন্ন এবং সুস্মিত আনন। তিনি শোভিত ছিলেন বনমালায়।

হরি সংজ্ঞাহীন শংকরকে বুকে নিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, সাধারণ মানুষের মত কেন শোকে চঞ্চল হয়ে উঠেছ? মনযোগ সহকারে শ্রবণ কর যা বলছি, তবেই দূর হবে তোমার শোক তাপ। তুমি সর্বজ্ঞ, অজানা নয় তোমার আধ্যাত্মবিদ্যা, তোমাকে তবুও বলছি আধ্যাত্মিকবিদ্যা অভ্রান্ত। কেন না সংকট কালে অজ্ঞান ব্যক্তিও প্রাজ্ঞ ব্যক্তিকে উপদেশ পরামর্শ ও প্রবোধ দিয়ে থাকেন। বিপদে মানুষের দুঃখ সুখ উৎপন্ন হয় মায়ামিশ্রিত গুণগুলিতেই।

শক্তিশালী বিষ্ণুমায়া সবসময়ই গুণাশ্রিত মানুষকে নির্যাতন করে। যখন মানুষের দুর্দিন আসে তখন বিষাদ, শোক, দুঃখ, ভয় পীড়িত করে। দুর্দিনের মেঘ কেটে সুখ ইত্যাদি বৃদ্ধি পায়। প্রাজ্ঞ ব্যক্তি তাই এসব স্বপ্নের মত মনে করেন। এগুলির উদয় ও বিলয় মূহুর্তেই, স্বপ্ন ছাড়া আর কীই বা হতে পারে এগুলি? শ্রীহরির বাক্য শুনে শিব চোখ মেলে তাকালেন। হরির নয়ন নির্গত অশ্রুধারায় সিক্ত হলেন শিব। হরি হরের অনীরে পুণ্য সলিল তীর্থের উদয় হল। অতঃপর শ্রীহরি দেবতা এবং মুনি ঋষিদের সামনে শিবকে পুনরায় অধ্যাত্মবিষয়ক উপদেশ দিলেন। তুমি জ্ঞান ভুলে গেছ শোকাধিক্য হেতু। সংসারে সুখ-দুঃখ ঘোরে চাকার মত আর তাই কখনও সুদিন, কখনও দুর্দিন আসে।

নিজের কর্ম থেকেই সুদিন দুর্দিনের উৎপত্তি হয়। সেই কর্ম তপঃসাধ্য আর মঙ্গল এবং অমঙ্গলজনক কার্যগুলি সেই কর্মসাধ্য, স্বভাবের দ্বারাই সাধ্য তপস্যা। মন হলো পাপ পুণ্যের কারণ। মনের উৎপত্তি আমারই অংশে। আমি তুমি কিংবা ব্রহ্ম সকলের পিতা। ব্রহ্মা একমেবাদ্বিতীয়। গুন ও মূর্তিভেদে আখ্যাত হয়ে থাকেন। হে শিব, ব্রহ্মা স্বগুন এবং নির্গুণ। ভগবান স্বেচ্ছায় সবকিছু সৃজন করেন। তার ইচ্ছা শক্তি হলো প্রকৃতি। সমগ্র জগতের তিনি প্রসবিনী।

ব্রহ্মাকে কেউ শাশ্বত ব্রহ্মাজ্যোতিস্বরূপ মনে করেন। যাঁরা বলেন সর্বকারণ স্বরূপ ব্রহ্মা এক এবং অদ্বিতীয় তাদের মত ব্রহ্মা প্রভৃতি পুরুষের অতীত। ব্রহ্মা থেকেই প্রকৃতি পুরুষের সৃষ্টি হয়েছে। একই ঈশ্বর স্বইচ্ছার দ্বিবিধ হয়েছেন। সবকিছুর প্রসবিনী প্রকৃতি সেই শক্তি। পরমব্রহ্মা ইচ্ছাশক্তিতে সহলিপ্ত হলে সগুণ শরীরী ও প্রাকৃত বলে খ্যাত হন, নিষ্ঠুন স্বেচ্ছাচারী রূপে ব্যক্ত হন সংসক্ত না হলে। সবকিছুর আধার অবিনশ্বর সেই পরমাত্মা। তিনি সকল বিষয়ের ফলদাতা ও সকল স্থানেই তার অবস্থিতি। তাঁর নিত্য চিরস্থায়ী ও প্রাকৃত শরীর অচিরস্থায়ী।

বিনাশ নেই আমার ও তোমার শরীরের, আমাদের অংশজাত যারা তারা নাশশীল ও প্রাকৃত। তোমার অংশজাত দশ রুদ্র। বিষ্ণুরূপী পুরুষরা আমার অংশজাত। আমার রূপ দ্বিবিধ ত্রিভুজ ও চতুর্ভুজ। চতুর্ভুজরূপে লক্ষী এবং সভাষদদের সঙ্গে বৈকুণ্ঠ বাস করি আর দ্বিভূজরূপে গোলোকে অবস্থান করি। ব্রহ্মার উভয় রূপ যারা মেনে নেন তাঁদের মতে পুরুষ ও প্রকৃতি চিরঞ্জীব। তাঁরা এই জগতের জনক জননীর তুল্য ও সম্পৃক্ত। তারা স্বেচ্ছায় দেহধারণ করেন, আবার হয়ে থাকেন নিরাকারও। তাদের ইচ্ছার আপেক্ষিক নামারূপ ধারণ করাটা।

পুরুষ এবং প্রকৃতির স্তব আমি দুর্বাসাকে বলেছিলাম। কাম্বশাখোক্ত স্তবে জগৎ-প্রসবিনী প্রকৃতির পূজা কর। আমি তোমায় আশীর্বাদ করছি তোমার পত্নী বিয়োগ দুঃখ দূর হোক, মঙ্গল হোক তোমার সর্বাঙ্গীন। শ্রীহরি উপদেশ ও পরামর্শ দিলে মহেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ ও ব্রহ্মাকে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে প্রণাম করে প্রকৃতির স্তব করতে লাগলেন। ঈশ্বরী আনন্দ দায়িনী। ব্রহ্মাস্বরূপিণী দেবী আমার প্রতি সন্তুষ্ট হও, দূর্গতিনাশিনী, তুমি অসুরনাশিনী, তুমি বিশ্বময়ী, বিশ্বরূপা, যোগেশ্বরী, তুষ্ট হও। ত্রিপুরের সঙ্গে যুদ্ধে আমি যখন আকাশ থেকে মাটিতে পতিত হই তখন তুমি বিষ্ণুর সঙ্গে মিলিতভাবে আমায় ত্রাণ করেছিলে।

এখন আমি তোমার বিচ্ছেদ বেদনায় সাতিশয় কাতর। শিব এই স্তোত্র সমাপ্ত করলেন তখন তিনি দেখলেন আকাশ থেকে মহার্ঘ রত্ন নির্মিত রথে দশভূজা উপস্থিত হলেন। দেবীকে প্রত্যক্ষ করে বিরহানলে দগ্ধ শংকর রোদন করতে করতে দুঃখের কথা জানালেন এবং পরে স্বীয় অঙ্গের অস্থিমাল্য ও ভস্মালংকার দেখিয়ে পুনরায় তার স্তব করতে লাগলেন। সকলে মিলে দেবীর কাছে শিবের স্থৈর্য। এবং শান্তি কামনা করলেন। তারাও দেবীর স্তব করতে লাগলেন। সম্মিলিত সংগীতে তিনি সাতিশয় প্রসন্ন হয়ে শিবকে বললেন– প্রিয়তম, তুমি পরমাত্মা স্বরূপ, যোগীন্দ্র, তুমিই আমার স্বামী, হিমালয় পত্নী মেনকার গর্ভে পুনরায় জন্ম নিয়ে তোমার পত্নী হব। আর হাহাকার কোরোনা আমার বিরহে।

শিবকে সান্ত্বনা দিয়ে তিনি অন্তর্হিত হলেন। শিবকে আশ্বস্ত করে যে যাঁর আলয়ে ফিরে গেলেন। মহাদেব কৈলাসে সানন্দে প্রত্যাবর্তন করে অনুচরদের সঙ্গে মহানন্দে নৃত্যরত হলেন। যিনি শিবের এই প্রকৃতি স্তোত্র পাঠ করেন, জন্ম জন্মান্তরেও তাঁর স্ত্রীর সাথে বিচ্ছেদ ঘটে না। সকল প্রকার ঐহিক সুখ ভোগ করে জীবন শেষে তিনি শিবলোকে স্থান পেয়ে ধন্য হন।

৪৪.

বশিষ্ঠের কথা শুনে সকলে অবাক হলেন, পার্বতীর মুখ রমণীয় হয়ে উঠল। ক্ষুধাতুর মেনকাকে অরুন্ধতী নানা খাদ্য খাওয়ালেন এবং নিজেও খেলেন। সানন্দে শুভানুষ্ঠানের আয়োজনে রত হলেন। গিরিরাজ পত্ররচনা করে দূরদূরান্তে পার্বতীর পরিণয়ের বার্তা পাঠালেন। শিবকে মঙ্গলপত্রিকা প্রেরণ করলেন। বিভিন্ন বাদ্য বাজানোর জন্য নিয়োজিত করলেন বিপুল সংখ্যার বাদকবৃন্দকে। মহিলারা পরিণয় সংস্কারানুযায়ী পার্বতীকে স্নান করিয়ে পতি মিলনের উপযোগী বস্ত্রে, রত্নাভারণে সাজালেন এবং তাঁর হাতে দিলেন দুর্বাক্ষতযুক্ত দর্পণ।

শৈলরমণীরা আলতা পরালেন পার্বতীর পায়ে। চোখে দিলেন কাজল, রমণীয় করে তুললেন কুন্তল নব মালতীর মালার। রত্ন রথে দেবতারা শিবকে নিয়ে গিরিরাজের আলয়ে উপস্থিত হলেন। শৈলরাজ দেবতাগণ বিপদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য আত্মীয়দের প্রেরণ করলেন। নগর প্রাঙ্গনে কলাগাছ, ফল, পল্লব, সজ্জিত করা হল এবং চন্দন, অগরু, চারিদিকে শোভা পেতে লাগল। দেবতাদের প্রণাম করলেন হিমালয় এবং তাদের উপবেশনের নিমিত্ত ভৃত্যদের দ্বারা রত্ন সিংহাসন এনে দ্রুত আয়োজন করলেন। নারায়ণ এবং অন্যান্য দেবতাগণ সভাসদদের সঙ্গে সভায় গিয়ে আসন গ্রহণ করলেন। তাকে চামর দিয়ে বাতাস করতে লাগলেন পারিষদেরা। তাঁর মুখ পদ্মের মত সুন্দর হয়ে উঠল।

সকলে প্রফুল্ল হয়ে হিমালয় গৃহে আসলেন। দেবকন্যা, ঋষিকন্যা, নাগতনয়া, গন্ধর্বকন্যা, শৈলনন্দিনী এবং রাজকন্যারাও সমবেত হলেন। মেনকা বরকে প্রত্যক্ষ করলেন। জামাতার রূপ দেখে মেনকার শোক মুহূর্তেই নির্বাপিত হল এবং তার সকল মন আনন্দে ভরে উঠল। কোনো কোনো রমণী শিবের দিকে অনিমেষ নেত্রে তাকিয়ে রইলেন। কেউ মূৰ্ছিত হলেন তার রূপ দেখে।

৪৫.

শিব অগ্নি প্রস্তুত করে তার বামে পার্বতীকে রেখে যজ্ঞে আত্মনিয়োগ করলেন। যজ্ঞ শেষে দ্বিজ জনকে একশত স্বর্ণমুদ্রা দান করলেন। কেউ বলল, পরস্পরকে খাইয়ে দাও। কেউ বলল দেবীর কেশ পরিচর‍্যা কর। রতিদেবী কাঁদতে লাগলেন এই বলে যে পার্বতীকে গ্রহণের সাথে সাথে আপনার ভাগ্য প্রসন্ন হলো, এখন বলুন, বিনা কারণে আমার পতিদেব তাকে ভস্মীভূত করেছিলেন কেন? তাকে পুনর্জীবন দান করে আমার বিরহানল প্রশমিত করুন।

বাসর জাগার পর দেবাদিদেব এবার শয্যা ত্যাগ করে স্ত্রীকে নিয়ে কৈলাস অভিমুখে যাত্রা শুরু করলেন। মেনকা ক্রন্দনরত অবস্থায় বললেন, আমার মেয়ের সহস্র ত্রুটি মার্জনা কর। রোদনরতা পার্বতী মা বাবা ও গুরুদেবের চরণে প্রণত হলেন। দেবতারা দ্রুত গতিতে শিবালয়ে উপস্থিত হলেন। তারা হর-পার্বতীকে রত্ন সিংহাসনে বসালেন। দেব সতীকে বললেন, মনে পড়ে দেবী, এখান থেকেই তুমি পিত্রালয়ে যাত্রা করেছিলে। শিব দেবদের সাদরে ভোজন করালেন। হিমালয় ও মেনকা একদিন পুত্র মৈনকাকে ডেকে বললেন, তুমি কৈলাসে যাও ও শিব পার্বতীকে এখানে নিয়ে এস। পার্বতী আসলে সকলে মেয়ে জামাইকে অভিনন্দন জানালেন। পার্বতী গুরুজনদের প্রণাম করলেন। শিব স্বীয় পত্নীর সঙ্গে ষোড়শোপাচারে অর্চিত ও সম্মানিত হয়ে শ্বশুরালয়ে অবস্থান করলেন।

৪৬.

কামাতুর রতি পতিকে ফিরে পেয়ে বাসর ত্যাগ করে নিজ নিকেতনে উপনীত হলেন। যৌন মিলনের উদগ্র কামনায় সখীদের বললেন, তারা যেন সযত্নে তাদের মিলন সাজে সজ্জিত করে দেয়। তাঁরা মনোহর পরিবেশে মিলনের আনন্দে মেতে উঠলেন। তাঁরা যৌন লীলায় এতটুকুও ক্লান্তি অনুভব করলেন না। পারস্পরিক কামোত্তেজনায় নখের আঁচড়ে, দন্তের দংশনে, তাপে দেহ ক্ষত বিক্ষত হলো। শ্রীকৃষ্ণ ও রাধাকে নিয়ে চন্দন বনে এসে উপস্থিত হলেন। এখানে এসে চিত্তচাঞ্চল্য জাগাটাই স্বাভাবিক, যৌনকামনায় রাধাকৃষ্ণ উভয়েই চঞ্চল হয়ে মিলিত হলেন। মিলনের শুরুতেই তাঁরা তৃপ্তিতে মূৰ্ছিত হলেন।

৪৭.

কৃষ্ণ বললেন–এরপর ইন্দ্রের দর্পচূর্ণের ইতিবৃত্ত বর্ণনা করবেন। গুরু বৃহস্পতি ইন্দ্রকে স্বয়ং দীক্ষা দেন। তিনি গুরুর শব্দের অধিকারী হন। ইন্দ্র একদিন গুরুকে দেখা সত্ত্বেও তাঁকে প্রণাম করলেন না। তখন বৃহস্পতি অত্যন্ত অপমানিত হলেন। ইন্দ্রের সভা ত্যাগ করে গৃহে ফিরলেন। ইন্দ্র গুরুপত্নী তারার স্মরণে গেলেন।পরে দেবরাজ স্বীয় পুত্রের উপর রাজ্যভার ন্যস্ত করে শচী ও রাজলক্ষীকে ত্যাগ করে বনে চলে গেলেন। শচীদেবী গুরুকে স্মরণ করলেন।

৪৮.

সূর্য একদিন উঠেই অস্ত গেল, মালী, সুমালী নামক দুই দৈত্য কিরণ দিতে উদ্যত হলো। দৈত্যদের। সূর্যদেব বধ করলেন। শিব ক্রুদ্ধ সূর্যকে নাশ করতে এগিয়ে এলেন। সূর্য ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলেন। শ্রেষ্ঠ মুনি ঋষিরা আপনারই সেবায় তপস্যার ফল লাভ করেন। আপনিই তপস্যার ফলদান করেন, নিজেই তপস্যাস্বরূপ ও নিজে তপস্যার অতীত। ব্রহ্মা ভক্তিভরে সূর্যকে সঙ্গে নিয়ে ভক্তবৎসল শিবের কাছে হাজির হলেন। শিব সূর্যকে আশীর্বাদ ও ব্রহ্মাকে প্রণাম করে হাসিমুখে নিজের আশ্রমে ফিরে এলেন। যে লোক বিপদে বিধাতার করা এই স্তব পাঠ করে তার ভয় দূর হয়।

৪৯.

অগ্নিদেব কোন এক সময় শত সহস্র ভয়ানক শিখা বিস্তার করে একাই ত্রিভুবন ধ্বংস করতে উদ্যত হলেন। তিনি অহঙ্কারে ভৃগুর শাপে রেগে গিয়েছিলেন। বিষ্ণু অগ্নির সামনে উপস্থিত হয়ে তার দাহিকা শক্তি হরণ করে নিলেন। মায়া বলে জনার্দন শিশুর রূপ ধরে ভক্তিতে মাথা নীচু করে বিনয়ের সাথে অগ্নিদেবকে বললেন, ভগবান আপনি কেন রাগ করছেন? ভৃগু আপনাকে শাপ দিয়েছে, আপনি তাঁকেই দমন করুন। আর যদি চান তো বিশ্বের রক্ষাকর্তা হরিকে জয় করুন। আগুন শুকনো শরপাতা দেখে যেমন লোলুব্ধ হয়, মেঘ যেমন চাঁদকে ঘিরে থাকে, সে রকম শিখা দিয়ে ব্রাহ্মণকে ঢেকে রাখলেন। কিন্তু শুকনো পাতার বা পিণ্ডুর একটি নোমও পুড়ল না দেখে তাঁর দর্পচূর্ণ হল।

৫০.

দুর্বাসা রুদ্রের অংশ। অম্বরীষ একদিন দ্বাদশী ব্রত অনুষ্ঠান করে বহু ব্রাহ্মণদের খাইয়ে সবেমাত্র উপবাস ভঙ্গ করে জল পান করতে চলেছেন, সেই মুহূর্তে দুর্বাসা ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত হয়ে সেখানে এসে বললেন, আমাকে খেতে দাও। তিনি খাবারে চুল পেলে আগুনের মতো ভয়ংকর পুরুষের রূপ ধারণ করে রাজাকে হত্যা করতে উদ্যত হলেন। রাজা ভয়ে হরির শরণাপন্ন হলেন ও হরির কৃপায় তাঁর বিপদ দূর হল এবং তিনি হরির স্তুতি করতে আরম্ভ করলেন। ভক্তদের রক্ষার্থে হরি এভাবেই সুদর্শন চক্রকে কাজে লাগান।

৫১.

ধন্বন্তরি হলেন স্বয়ং নারায়ণের অংশ ও মহান। পূর্বে সমুদ্র মন্থনের সময় তিনি উঠে আসেন। ধন্বন্তরি এক দাম্ভিক শিষ্য তক্ষককে ধ্বংস করে, এবং ধন্বন্তরি মনসার সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। মনসা তাকে নাগদেশে ছাড়লে, ধন্বন্তরি গরুড়কে স্মরণ করে তাদের ঠোঁট দিয়ে খেয়ে ফেলল। ধনন্তরি পরাজিত হয়ে শঙ্করকন্যা মনসাকে প্রণাম করলেন। পরে সাপেরা মহানন্দে ফণা দুলিয়ে চলে গেল। পরে আস্তিক মুনি মাতাকে যথাবিধি ভক্তি করলেন, আর জগৎগৌরীও সেই মুনি পুত্রের উপর তুষ্ট হলেন। যে ভক্তি যুক্ত হয়ে মহাপুণ্য স্তোত্র পাঠ করে, তাদের বংশধরদের নিঃসন্দেহে সাপের ভয় থাকে না।

৫২.

কৃষ্ণ রাধাকে ছেড়ে যেতে উদ্যত হলে, রাধা বিরহিণীর মতো ক্রন্দনরতা হয়ে দেহত্যাগ করতে উদ্যত হলেন। কামশাস্ত্র বিশারদ কৃষ্ণ কৌতুকবিষ্ট হয়ে কামিনী রাধার সাথে পুনরায় শৃঙ্গার ও ক্রীড়া করলেন।

৫৩.

কৃষ্ণ রাধার সাথে মিলিত হয়ে রাসমণ্ডলে রাসক্রীড়া করে সেখান থেকে যমুনার তীরে গেলেন। যমুনার নির্মল জলে স্নান করে এবং জল পান করে, গোপিনীদের সাথে জল ক্রীড়া করতে লাগলেন। ক্রীড়া সাঙ্গ হলে বাসন্তী বনে গিয়ে রমণ করতে লাগলেন। কৃষ্ণ রাধার সঙ্গে আসব মদ্য পান করলেন। তাম্বুল খেলেন ও পরক্ষণেই মনের আনন্দে ঘুমিয়ে পড়লেন।

৫৪.

কংস ধনমুখ নামক শঙ্কর যজ্ঞ আরম্ভ করে, ভগবানকে নিমন্ত্রণ করলে, ভগবান সেখানে যান। কৃষ্ণ কুজার সাথে শৃঙ্গার করে তাকে গোলোকে পাঠালেন এবং সুদামা মালাকারকে দয়া করে মুক্ত করলেন। পরে ভীষণ সংগ্রামে ভূমিপুত্র নরকাসুরকে হত্যা করে, ষোলো হাজার নারীকে বিয়ে করলেন। জগৎপতি আবার রাধার সাথে এসে রাসমণ্ডলে বাস করতে লাগলেন।

৫৫.

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সকলের আত্মা ও সকল পুরুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, তিনি সকলের আরাধ্য ও সুখদায়ক। তিনি ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, ধর্ম, চন্দ্র, সূর্য, অগ্নি, দুর্বাসা ও কামদেবের দর্পচূর্ণ করেছেন।

৫৬.

শ্রীকৃষ্ণ চরিত অত্যন্ত শ্রুতিমধুর। কবির মুখ থেকে শোনা গেলে তা আরো শ্রুতিমধুর হয়। কৃষ্ণ ব্রাহ্মণের ছেলের মৃত্যুতে, তার স্ত্রীদের হরণে ও কর্ণের সাথে যুদ্ধে অর্জুনের দর্প নাশ করেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ উষা হরণের ব্যাপারে বাণ রাজার হাত কেটে দিয়ে তার দর্প চূর্ণ করেন এবং দক্ষযজ্ঞে ভৃগুর দর্পনাশ করেন। শিবপ্রিয়া মহানন্দে ত্রিভুবনের সকল দেবীদের মধ্যে পূজ্য বন্ধনীর দ্বারা স্তুত হন। স্ত্রীহীন ব্যক্তি এই স্তোত্রপাঠ করার ফলে বিনয়ী, সুসতী, সতী সুশীলা, কুলজা, কোমলা ও শ্রেষ্ঠ স্ত্রী লাভ করে থাকে।

৫৭.

সতী মহালক্ষ্মী দেবতাদের স্তব শুনে তাদের ওপর সন্তুষ্ট হয়ে কান্না থামিয়ে বললেন– আমি রাগ করে দেহ ত্যাগ করছি না। যে নারী স্বামীর প্রেম লাভ করতে পারে না তার জন্ম নিরর্থক। যে নারীর প্রিয় স্বামীতে ভক্তি থাকে না, সে অশুচি। ধর্মহীন কোন কাজে তার অধিকার থাকে না। স্ত্রীর কাছে স্বামী সকল দেবতা, স্বামীই দেবতুল্য শুচি। দেবতারা ভগবান জগদীশ্বরকে প্রণাম করে নিজেদের স্থানে চলে গেলেন।

৫৮.

নারদকে নারায়ণ বললেন, আগে তিনিই সবার আশ্রয় ছিলেন। পৃথিবীর একটা দর্প হয়েছিল। ভগবান পৃথুকে দিয়ে হরি তার সেই অহংকার চূর্ণ করেন। আবার দেবমাতা অদিতির যখন দর্প হল হরি তখন অদিতির পুত্রদের অদৃশ্য করে তার দর্প চূর্ণ করেন। তিনি নির্বাণ দান করেন। গঙ্গার দর্প হল যখন, জহ্ন মুনিকে দিয়ে ব্রহ্মা সেই দর্প চূর্ণ করেছিলেন। দুর্গাকে দিয়ে চূর্ণ করান হয় মনসার দর্প। রাধা কৃষ্ণকে বিরজাতে উপগত জেনে রেগে তাকে ভৎর্সনা করেন এবং কৃষ্ণ ও যখন রাস ঘরে ঢুকেছিলেন, তখন সদর্পে গোপীদের দিয়ে বাধা দিয়ে ছিলেন আর দ্বারীদের দিয়ে বেতের আঘাত করিয়ে ছিলেন। শ্রীকৃষ্ণের ইচ্ছায় শ্রীকৃষ্ণের নিজের ভক্ত শ্রীদামের দ্বারা রাধাকে অভিশাপ দিয়েছিলেন।

রাধা দৈবাৎ গোলোক থেকে এসে বৃষভাণুর স্ত্রী কলাবতীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। শ্রীকৃষ্ণ ও রাধার অনুরোধে কংসের ভয়ে নন্দের মন্দিরে যান, এজন্যই তাকে নন্দ-নন্দন বলা হয়, পরে শ্রীদামের শাপে বিচ্ছেদ পালনের জন্য ব্রহ্মা আবার মথুরায় গিয়েছিলেন। একথা ব্রহ্মা বলেছেন। এছাড়া কৃষ্ণের অন্য উদ্দেশ্য আর কেউ জানে না। কৃষ্ণের জন্মকথা, মথুরা থেকে গোকুলে আসার কথা সবই বলা হয়েছে। এবার অন্য কাহিনি হল–নন্দনন্দন যখন নন্দের কাছ থেকে মথুরায় যান তখন নন্দ ও। যশোদা শোকাকুল হয়েছিলেন।

শ্রীকৃষ্ণের বিরহে গোপ, গোপী, গাভী প্রভৃতি সবাই বৃন্দার সঙ্গে বৃন্দাবনের বনে বন্য প্রাণীর কাছ থেকে যে রকম দুঃখ পেয়েছিলেন, বন্য জন্তুরা তার কিছুটা জানে। রাধাও তখন বন, বন্য ও বন্যপদ ত্যাগ করে এবং কখনও বনে কখনও শ্মশানে ঘুরে বেড়িয়ে ছিলেন। এভাবে কৃষ্ণের ওপর রাগ প্রকাশ করেন দুঃখী রাধা। কখনও রাগশূন্য হয়েছেন, কখনও সজ্ঞান, কখনও অজ্ঞান হয়েছেন, আবার কখনও পেতে চেয়েছেন কৃষ্ণকে। তার গভীর নিশ্বাস পড়ছিল। মাঝে মাঝে জ্ঞান হারাচ্ছিল। কখনও বিছানায় শুয়েছেন, কখনও বিপন্ন হয়ে বিছানা ছেড়ে কেবলই কেঁদেছেন।

৫৯.

এরপর ইন্দ্রের দর্প নাশের পুরো ব্যাপারটা বললেন–নারায়ণ। একদিন ইন্দ্র রত্নসিংহাসনে বসে আছেন, সেখানে সেসময় এলেন দেবগুরু বৃহস্পতি। তাঁকে দেখেও অহঙ্কার বশত ইন্দ্র প্রণাম এবং সম্মান প্রদর্শন করলেন না। অত্যন্ত, রুষ্ট হয়ে অপমানিত বোধ করে সেখান থেকে উঠে গেলেন গুরু বৃহস্পতি, তবুও ধার্মিক বৃহস্পতি তাকে স্নেহবশত কোন অভিশাপ দেননি। ইন্দ্রের কিন্তু দর্পনাশ হয়েছিলো। তিনি এটা নিশ্চিত, যে কোন ধার্মিক, যদি ভালবেসে সেই পাপীকে অভিসম্পাত না করে তাহলেও পাপীকে পাপের ফল ভোগ করতে হয়।

তাকে শাস্তি দেয় ধর্ম। হিংস্র অপরাধীকে ধার্মিক যদি রাগ করে অভিশাপ দেয় অপরাধীর তবে বিনাশ হয়। নষ্ট হয়ে থাকে ধার্মিকের ধর্মও। গুরুকে অপমান করার অপরাধে, অধর্মের জন্য ইন্দ্রের ব্রহ্মা হত্যাজনিত পাপ হয়। ইন্দ্র ভয়ে নিজের রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে যান বিষ্ণু সরোবরে, পরে পদ্মসূত্রের মধ্যে সূক্ষ্মরূপে অবস্থান করতে লাগলেন। পবিত্র বিষ্ণু সরোবরে যেতে পারে না ব্রহ্ম হত্যাকারী। তপস্বীদের তপস্যার প্রধান স্থান ভারতবর্ষের বিষ্ণু সরোবর। অনেকে সেই স্থানকে পুষ্কর বলে থাকেন।

পুরাবিদ পণ্ডিতরা বলেন নহুষ নামক ধার্মিক হরিভক্ত কোন এক রাজা ইন্দ্রকে রাজ্যভ্রষ্ট হতে দেখে জোর করে চুরি করেন তাঁর রাজ্য। বরারোহা অনপাত্যা সুন্দরী শচীদেবী দুঃখিত মনে মন্দাকিনীতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় রাজেন্দ্র নতুন সেই নবযৌবনা। রত্নালংকার ভূষিতা ও সুকোমলাঙ্গী, যুবতী, ক্রন্দনরতা শচীকে দেখে কামাসক্ত হয়ে মূৰ্ছা গেলেন, পরে তার সামনে দাঁড়িয়ে চাকরের মত বিনীত ভাবে বলতে লাগলেন। জ্ঞানীরাও বুঝতে পারে না বিধাতার লীলা কি বিচিত্র। ইন্দ্র সর্বাঙ্গে যোনি চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছেন।

যার স্ত্রী এরকম সুন্দরী, তার মনও পরস্ত্রীতে আসক্ত হয়! তাঁর কাছে রম্ভা, উর্বশী, তিলোত্তমা, ঘৃতাচী, রত্নমালা, কলাবতী, সুন্দরী, কালিকা, ভদ্রাবতী ও চম্পাবতী বা কে? এই সকল অপ্সররা তার ষোলো ভাগের এক ভাগের এক ভাগেরও যোগ্য নয়। দুর্মতি ইন্দ্র এরকম স্ত্রীকে ছেড়ে অন্য নারীর কাছে কিভাবে গেলেন? আমাদের স্ত্রীরা তার চেড়ীর তুল্যও কিনা সন্দেহ, তুমি খুশি হয়ে আমার ভজনা কর, কারণ আমি তোমার দাস। কৃষ্ণের বুকে যেমন গোলাকবাসী রাধা রয়েছেন, লক্ষ্মী ও সরস্বতী যেমন বৈকুণ্ঠনাথের বুকে, ব্রহ্মলোকে ব্রহ্মার বুকে যেমন ব্রাহ্মণী, শঙ্করী যেমন কৈলাসে শংকরের বুকে, সুন্দর, শ্বেতদ্বীপে ক্ষিরোদসাগরে বিষ্ণুর বুকে যেমন ভাগ্যবতী মর্তলক্ষ্মী সিন্ধুকন্যা, ধর্মের বুকে যেমন মহা সাধ্বী মূর্তিদেবী, অনন্তদেবের বুকে পাতাললক্ষ্মী বাসন্তী, পুষ্টি গনেশের বুকে, দেবসেনা কার্তিকের তাঁর প্রিয়া বুকে, বরুণানী বরুণের বুকে, স্বাহা অগ্নির বুকে, রতি কামদেবের বুকে, দিনেশ্বরের বুকে সংজ্ঞা, বায়ুর বুকে তাঁর স্ত্রী, চন্দ্রের বুকে রোহিনি, কশ্যপের বুকে দেবমাতা অদিতি, হিমালয়ের বুকে মেনকা, লোপামুদ্রা অগস্ত্যের বুকে, তাঁরা বৃহস্পতির বুকে।

দেবহৃতি কর্দমের বুকে, অরুন্ধতি বশিষ্ঠের বুকে, মনুর বুকে শতরূপা ও নলের বুকে দময়ন্তী যেমন থাকেন, আমার বুকে থাকবে তেমনি তুমি। আমি অনায়াসে হাজার ইন্দ্রকে খণ্ড করতে পারি। স্বামী অপেক্ষা শক্তিশালী পুরুষকে উপপতি হিসাবে পেতে চায়। আমি দুর্গম অথচ নির্জন সুমেরু পর্বতের চূড়ার, চন্দন বায়ুতে সুরভিত সুন্দর কমনীয় মলয় পর্বতে কিম্বা নন্দনকাননে এবং কখনও শত শৃঙ্গ যুক্ত পাহাড়ের ধারে, পুষ্পভদ্রা নদীর তীরে, কখনও ঠান্ডা বায়ু বিশিষ্ট গোদাবরী নদীর তীরে জলের কাছে, কখনও শ্মশানে বা অতিশশ্মনে, কখন ও সুরম্য কখনও গঙ্গার তীরে সুন্দর চম্পক বনে আমার প্রিয়াকে পেতে চাই।

নির্জন পাহাড়ে পাহাড়ে, কখনও নির্জনে, বন্দরে বন্দরে, কখনও অতি দুর্গম দ্বীপে, কখনও নদীতে বা সমস্ত জন্তু পরিত্যক্ত সুন্দর সমুদ্র তীরে তোমার সাথে বিহার করব। নির্জন স্থানে সঙ্গম অত্যন্ত সুখের হয়ে থাকে। নিজে ফুল চন্দন চর্চিত হয়ে হে সুন্দরী তুমি নিজে ফুল চন্দন যুক্ত বিছানায় আমাকে নিয়ে রতি সুখ অনুভব কর। আমি ব্রহ্মার বরে জন্ম মৃত্যুহীন ও সুস্থির যৌবনযুক্ত ও সুবেশ সুন্দর, বীর ও কামশাস্ত্রবিশারদ, আমার মুখে শরতের পূর্ণ চাঁদের শোভা, কারণ আমার জন্ম চন্দ্র বংশে। অতএব সুন্দরী তুমি পতি হিসাবে আমাকে বরণ কর। উর্বশী আজ নিজে এসে আমাকে প্রার্থনা করে ছিলেন। আমার পরস্ত্রী সঙ্গমে কোন ইচ্ছা নেই বলে আমি তাকে পরিত্যাগ করেছি। কিন্তু তোমাকে দেখা মাত্র আমার মন চঞ্চল হয়ে পড়েছে। আমার স্ত্রী যে রত্নাভূষণে সজ্জিত তাদের আমি পরিত্যাগ করব তোমার জন্য। তাদের তুমি দাসী করে রাখতে পার। আমি যুদ্ধে অত্যন্ত তেজ সম্পন্ন ব্রহ্মাস্ত্র দিয়ে বরুণকে জয় করে তার শ্রেষ্ঠ রত্নমালা তোমাকে দেব।

তুমি আদেশ দাও এই দাসকে, আজই দুর্বল অগ্নিকে পরাজিত করে বহ্নি শুদ্ধ কাপড় তোমাকে দেব। আমি আজই দেবজননী অদিতির শ্রেষ্ঠ মনি নির্মিত ঘরের আকারে কুন্ডল তোমাকে দেব। দুর্বল চন্দ্রকে হারিয়ে রোহিনীর অমূল্য রত্ন নির্মিত রত্নালংকার দুটি তোমাকে দেব। যক্ষারোগী অত্যন্ত রোগা চাঁদ ভয় পেয়ে বিনা যুদ্ধে তোমাকে তা দেবে। কৃপা করে দান ও করতে পারে আমার পূর্ব পুরুষ বলে। আমি ভিক্ষা করে তোমাকে দেব পার্বতীর পায়ের নুপূর। দুটি সেই আশুতোষ স্তবের বশীভূত, ভক্তদের প্রতি কৃপাময় ও সকল সম্পত্তির দাতা। তিনি পরম কল্পতরুস্বরূপ, সুতরাং আমার প্রার্থনা অবশ্যই পূরণ করবেন। আমি যুদ্ধ করে গঙ্গার অমূল্য রত্ন তৈরি দুর্লভ কেয়ুর দুটো তোমায় দেব। কামদেবকে পরাজিত করে কামের স্ত্রীর অমূল্য রত্নের পরিষ্কার আয়না এনে দেব।

নারায়ণের কাছে লক্ষ্মীর ক্রীড়া কমল চেয়ে এনে দেব। ব্রহ্মার তপস্যা করে এনে দেব সাবিত্রীর অতি দুর্লভ আংটিগুলি। বাণীর বীণায় আপনি মূছনা ও বেদের গীতালাপ হয়ে থাকে যে তা তোমার হাতে দেব। বিশ্বকর্মার স্ত্রীর পায়ের আঙ্গুলের অলংকার তোমায় দেব।

এইসব নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে শচীর পায়ে লুটিয়ে পড়ল নহুষ। শচীদেবীর তখন গেল গলা, ঠোঁট তালু শুকিয়ে। ভয় পেয়ে হরির ও গুরুদেবের পাদপদ্ম স্মরণ করলেন। সেই রাজাকে বললেন–বৎস। মহারাজ! ভয় দূরকারী রাজা সবাইকে শাসন ও রক্ষা করে থাকেন। আপনি স্বর্গের রাজা হবেন। চন্দ্র এখন রাজ্যভ্রষ্ঠ। যে রাজা সেই প্রজাদের, পিতা, ও রক্ষাকর্তা এতে কোনো সন্দেহ নেই। গুরুপত্নী, রাজপত্নী, দেবপত্নী, ভূত্যপত্নী পুত্রবধূ, মাসী, পিসি, পিতা, মাতা, বোন, শিষ্যপত্নী, ভাইয়ের স্ত্রী শাশুড়ী, বোন, কন্যা পুরুষের মা বলা হয়। গর্ভধারিণী ও ইষ্ট দেবী এই ষোল জনকে। যদি মাতৃ গমনের ইচ্ছা হয় তবে দেবমাতা অদিতির কাছে যাও। মাতৃগামীর কোন নিস্তার নেই।

ব্রহ্মার আয়ুষ্কাল পর্যন্ত তাদের কুম্ভীপাক নরকে অশেষ দুঃখ ভোগ করতে হয়। পরে বহুকাল বেশ্যার যোনিকট হয়ে থেকে সাতকল্প কৃমি হয়। এরপর তারা এককল্প ব্রণকৃমি, সাতকল্প মাথার কৃমি ও এককল্প শস্যকৃমি হয়। তারপর জন্মায় কুষ্ঠ রোগী ও ছাগল হয়ে, শূকর হয়ে জন্মায় পরে।

প্রত্যেক জন্মে ক্লীব হয়ে জন্মায়। ব্রহ্মা নিজে বলেছেন তাদের কোন নিস্তার নেই।

৬০.

বৃহস্পতি বলেছেন ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রেরও ব্রাহ্মণী গমনে এমন ফলভোগ করতে হয়। তাদের নিস্তারের কোন উপায় নেই। নিশ্চয়ই সংসারীদের স্বর্গ সম্পত্তি ভোগ সুখের হয়ে থাকে। কিন্তু মুমুক্ষুর মোক্ষ্য, তপস্বীর তপস্যা, ব্রাহ্মণের ব্রাহ্মণত্ব, মুনির মৌনতা, বৈদিকের বিদ্যাভ্যাস, কবির কাব্যবৰ্ণনা ও বৈষ্ণবের বিষ্ণুর দাসত্ব ও বিষ্ণুভক্তি রসই পরম পদার্থ।

ভক্তি ছাড়া মুক্তি পেতে চান না বিষ্ণুর ভক্তরা। চন্দ্র বংশীয় রাজা পদ্ম প্রকাশের জন্য অতি তেজস্বী, গ্রীষ্মের দুপুরে সূর্যের মতো আর্বিভূত হন। নিতান্ত কর্তব্য মহাদ্ব্যসির ধর্ম পালন করা। যশের মত সকল আশ্রমেই ধর্ম পালন করা। ত্রিসন্ধ্যা হরির অর্চনা, ও সুখাদিক হরির পাদোদক ও নৈবেদ্য খাওয়াই ব্রাহ্মণের নিজের ধর্ম। বিষ্ণুকে নিবেদন করা হয়নি যে অন্ন ও জল তা মূত্র স্বরূপ ব্রাহ্মণরা তা খেলে। শূকর হয়ে জন্মায়।

ব্রাহ্মণরা আজীবন হরিকে নিবেদন করা বস্তু খায়। একাদশী, কৃষ্ণের জন্মদিন, শিবরাত্রি, শ্রীরামনবমী ও অন্যান্য পূণ্যদিনে সযত্নে উপোস করা ব্রাহ্মণদের স্বধর্ম। পরমব্রত ও তপস্যা পতিব্রতা নারীর ধর্ম। নারীর ধর্ম হল পরের স্বামীকে পুত্রের মতো দেখ। প্রজাদের নিজ পুত্রের মতো প্রতিপালন করা রাজাদের কর্তব্য।

ক্ষত্রিয়দের এই ধর্ম বলে নির্দেশ করেন ব্রহ্মা। বাণিজ্য করা বৈশ্যের ধর্ম, শূদ্রদের ব্রাহ্মণ সেবাই পরম ধর্ম। শ্রীকৃষ্ণের সকল কাজের ফল আত্মস্থ করাই সন্ন্যাসীর ধর্ম। একমাত্র লাল কাপড় পরবে সন্ন্যাসী, ধারণ করবে লাঠি ও কমল, ভিক্ষু ব্যক্তি দৈবাৎ কাউকে বিদ্যা মন্ত্র দান, থাকার জন্য বাসস্থান বা কোন বস্তু কামনা করবে না।

সন্ন্যাসী হবেন নির্মোহ নিঃসঙ্গ। খাবেন না কোন সুস্বাদু খাবার। দৈবক্রমেও কোন স্ত্রীর মুখ দেখবেন না। কোন সঞ্চিত বস্তু চাইবেন না গৃহস্থের কাছে। সবার কার্যের কথাই বলেছেন তিনি। শচী পথের মাঝে এই কথা বলে থামলে, রাজা নপুষ মাথা নীচু করে শচীকে বলল–হে দেবী! আমি তোমাকে বেদোক্ত কথা বলছি শোন।

স্বর্গ, পাতাল বা অন্য দ্বীপে অনুষ্ঠিত সকল কার্যের কাল ভোগ করতে হয় না,–এতো বেদ স্বীকৃত। হিমালয় থেকে সমুদ্র পর্যন্ত জায়গার নাম পুণ্যক্ষেত্র ভারত, যা মুনিদের তপস্যার ক্ষেত্র। যা সকল জায়গার মধ্যে শ্রেষ্ঠ। পুণ্যবান লোকেরা স্বর্গে গিয়ে স্বর্গকন্যাদের সাথে চিরকাল আনন্দ লাভ করে।

পুণ্যবান লোক মানুষের দেহ ত্যাগ করে স্বর্গে আসে। আমার পুণ্যবল দেখ, কারণ আমি এসেছি সশরীরেই। স্বর্গ ভোগের স্থান। সকল কিছু ভোগের পর নারী সম্ভোগ সার। ভোগের জায়গায় ভোগ্যবস্তু ছেড়ে দেওয়া প্রশংসার কাজ না।

তুমি ভোগীদের যথার্থ ভোগ্য, তুমি ভাবানুরক্ত ও রসিক। যে হেলায় ভোগ্যবস্তুকে ছেড়ে দেয় সে অস্বাভাবিক। তাতে কোন সন্দেহ নেই। যে সেই অবিরাম সুখ ত্যাগী দুর্বোধ লোক যে পশু, তাতে সন্দেহ নেই। তোমায় ভিক্ষে করে এনে দেব লক্ষ্মীর বুকের অমূল্য রত্নমালা।

মহাদেবের মাথায় অলংকার, জন্ম, মৃত্যু ও রোগদূরকারী ও শিবের উৎকৃষ্ট ক্রীড়াকর বস্তু, ত্রিভুবনে দুষ্প্রাপ্য ও বিশ্বপূজ্য। ভক্তিভরে সূর্য ব্রতকরে তোমায় দেব ত্রিভুবন দুর্লভ সূর্যের শ্রেষ্ঠমণি স্যমন্তক। এই মণি প্রত্যহ আট ভরি সোনা প্রসব করে থাকে। মদন দেবের জন্মমৃত্যুহর এই অমূল্য রত্নলিখিত মধুপূর্ণ রত্নপাত্র তোমায় এনে দেব।

লক্ষ্মীর যে পদ্মাসন অমূল্য রত্নখচিত যাতে গোলাকার এবং শ্রেষ্ঠ মণি বসানো হয়েছে এবং লক্ষ হাত পরিমাণ যার পরিধি এবং যা তেজে সূর্যের সমান–লক্ষ্মীর প্রিয় সেই পদ্মাসন আমি তোমায় নিশ্চয় দেব। পথ আটকে দিয়ে রাজা নহুষ শচীর পায়ে বারবার পড়তে লাগল। শচী গুরুদেব ও হরিকে স্মরণ করে বলেন– মধুমাতাল ও মদমাতাল থেকে কামে উন্মত্ত লোক বেশি অজ্ঞান হয়।

কামনায় হতচেতন হলে মানুষ নিজের মৃত্যুকেও পরোয়া করে না। সত্য বলছি, আজ আমার ঋতুর প্রথম দিন। রজঃস্বলা স্ত্রীর, ঋতুর প্রথম দিন চণ্ডাল, দ্বিতীয় দিন ম্লেচ্ছ ও তৃতীয় দিন কেবল মাত্র নিজের স্বামীর কাছেই শুদ্ধ, কিন্তু দৈব ও পিতৃকার্যে সে অশুদ্ধ থাকে। অন্যের কাছে ঐ দিন শূদ্রের মতো অসৎ। রজঃস্বলা নারীর উপর উপগত হয় যে তার ব্রহ্ম হত্যার পাপ হয়, সে লোকের পিতৃকার্যে অধিকার থাকে না।

দ্বিতীয় দিনের উপগত ব্যক্তির গো হত্যার পাপ হয়। তার আর ব্রাহ্মণদের ও দেবতাদের পূজোর কোন অধিকার থাকে না। সে হয় অমানুষ, অযশস্বী ও বিদ্যাহীন। শূদ্রের চূণ হত্যার পাপ হয়। তৃতীয় দিনের উপগত ব্যক্তি পতিত হয় সমাজে। চতুর্থ দিনে হয় অসৎ শূদ্রের সমান। সুতরাং কোন বুদ্ধিমান লোক তাতে উপগত হয় না। সেদিন তুমি আসতে পাবে যে দিন আমি ঋতুশূন্য হব।

দেবতাদের স্ত্রীর ঘুমানো, খাওয়া সব কাজ সব সময়ই পবিত্র, অপবিত্র হয় না কখনই। ঐ কর্মক্ষেত্রে ও বেদে বলা যে সব ভালমন্দ কথা বলা হয়েছে তাও ব্রহ্মতেজে প্রজ্জ্বলিত বৈষ্ণবদের পক্ষে ক্ষতিকর হয় না। জ্বলন্ত আগুনে যেমন সবকিছু পুড়ে, ছাই হয়ে যায় তেমনি, সকল অপবিত্রতা ভালো হয়ে যায় বৈষ্ণবের কাছে।

বৈষ্ণবরা তেজ আগুন সূর্য ও ব্রাহ্মণের থেকেও বেশি। তারা বিষ্ণুচক্রে রক্ষা পায়। নিজের পূর্ববর্তী সাত পুরুষকে পাপ থেকে রক্ষা করে। বৈষ্ণবদের কর্মফল বিচারে ও ভোগ করতে হয় না।

সামদেবের কৌথুম শাখায় বলা আছে এমন কথা। চন্দ্রবংশীয় বৈষ্ণবরা সেই সত্য জানে, তাই হরি ছাড়া অন্য কোন দেবতার উপাসনা করে না। বিষ্ণুমায়া থেকে বঞ্চিত হন স্বত্ত্ব গুণ সম্পন্ন ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয়। তোমার কোন ক্ষতি হবে না। ঋতুর জন্য যদি ক্ষতি হয় তা আমারই হবে। রাজা নহুষ এই বলে হাসি মুখে রত্ননে করে নন্দনকাননে গেল। বৃহস্পতি কুশাসনে বসে ছিলেন। বৃহস্পতি তারাদেবী তার পদসেবা করেছেন। তিনি পরমেশ্বর নিষ্ঠুন পরব্রহ্ম শ্রীকৃষ্ণের জপ করছেন। শচী জল ভরা চোখে বৃহস্পতিকে মাথা নুইয়ে প্রণাম করলেন।

শচী পরে ব্রক্ষিষ্ট কৃপানিধির স্তব করতে লাগলেন। শচী বললেন, আমাকে রক্ষা করুন ও দাসকে নিজের জায়গায় এনে তাকে পদধুলি ও শুভ আর্শীবাদ করুন। জন্মদাতা শ্রেষ্ঠ, কিন্তু সকল গুরুর থেকে এবং যা তা অপেক্ষা আরো বেশি শ্রেষ্ঠ। মায়ের থেকে আবার বিদ্যদাতা, মন্ত্রদাতা, জ্ঞানদাতা ও হরিভক্তি দাতা, শতগুণে পূজ্য, বন্দনীয় ও সেবার যোগ্য। পণ্ডিতরা তাকে গুরু বলেন, যে মন্ত্র উচ্চারণ করে। যে জ্ঞান রূপ আলোর সাহায্যে অজ্ঞান রূপ অন্ধকারে আচ্ছন্ন অনুব্যক্তির চোখ ফোঁটান সেই গুরুদেবকে প্রণাম করি আমি।

কিছুতেই নিস্তার নেই অশিক্ষিত মুখের। তার অধিকার থাকে না কোন কাজেই। নরকই সেই পশুর স্থান। ঘোর সংসার থেকে নিস্তার পায় না জন্মদাতা, অন্নদাতা, মা, বা অন্য গুরুই, কেবল বিদ্যা মন্ত্র ও জ্ঞানদাতাই সংসার সাগর পার করে দিতে পারে।

শিষ্যকে উদ্ধার করতে পারে না অন্য কোন গুরু, গুরুই বিষ্ণু, ব্রহ্ম, দেব, মহেশ্বর, ধর্ম, অনন্তদেব, এবং সেই নির্গুণ সর্বাত্মা পরমেশ্বর সকল তীর্থ ও দেবতার আধার গুরু। সকল দেবতাস্বরূপ গুরু। গুরু রূপে বিরাজ করেন স্বয়ং হরি।

অভীষ্ঠ দেবতা রুষ্ট হলে গুরু রক্ষা করতে পারেন কিন্তু গুরু রুষ্ট হলে অভীষ্টদেব রক্ষা করতে পারেন না। যার উপর গুরু রুষ্ট হবেন তার ওপর সকল গ্রহ, দেবতা ও ব্রাহ্মণরা রুষ্ট হন। গুরুসেবা অপেক্ষা তপস্যা সত্যও কোনরূপ পুন্যজনক কাজই শ্রেয় না। গুরুর থেকে বড় শাসনকর্তা বা বন্ধু আর কেউ না।

শিষ্যের কাছে গুরুই একমাত্র দেবতা। রাজা ও শাসনকর্তা, মন্ত্র ও বিদ্যা, গুরু ও দেবতা, পতি এরা প্রত্যেক জন্মেই অনুসৃত হয়। সবাই শ্রেষ্ঠ, পিতা রূপ গুরু যে জন্মে জন্ম দান সেই জন্মেই তিনি পুজ্য। এক জন্মে পূণ্য পিতা ও মাতা। প্রত্যেক জন্মেই পুণ্য কিন্তু মন্ত্রদাতা গুরু। আপনি ব্রাহ্মণদের মধ্যে শ্ৰেষ্ঠ তপস্বীদের গুরু, সমস্ত ধার্মিকদের মধ্যে প্রধান এবং পরম ব্রাহ্মণ।

সকল দেবতারা তুষ্ঠ থাকবেন আপনি তুষ্ট থাকলে। শচীতে কাঁদতে দেখে তারাদেবীও কান্না শুরু করলেন। স্বামীর পায়ে পড়ে কাঁদতে লাগলেন তারা। বৃহস্পতি বললেন, তারা ওঠ তাতে শচীর মঙ্গল হবে। তাড়াতাড়ি স্বামীকে ফিরে পাবে শচী। বৃহস্পতি তারাকে বুকে ধরে নানা অধ্যাত্বিক কথা বলে স্বান্তনা দিলেন।

গুরু ও অভিষ্ট দেবতা প্রতিজন্মে তার উপর তুষ্ট থাকেন যে লোক পূজার সময় শচীর স্তব পাঠ করে। তুষ্ট থাকে বন্ধু বান্ধবরা সবাই। সে লোক যাবতীয় বাঞ্ছিত বস্তু লাভ করে। কোন সময়ই তার দুঃখ হয় না। যে পুত্র যে স্ত্রী চায় সে গুণবতী পুত্রবতী স্ত্রী, যে রোগ থেকে মুক্তি চায় সে রোগ মুক্তি, ও যে বন্ধন থেকে মুক্তি চায় সে বন্ধন মুক্তি লাভ করে। যার যশ নেই সে যশ, ও যে মূর্খ সে মহাজ্ঞান লাভ করে, তার বন্ধু বিচ্ছেদ হয় না। এই স্তব পাঠ করলে সে সন্তান সন্ততি ও সম্পদ লাভ করে ইহকালে সকল সুখ ভোগ করার পর শেষে বৈকুণ্ঠে যায়। হরির দাসত্ব লাভ করে সে আর জন্ম নেয় না। কেবল সর্বদা শান্তিগুণ অবলম্বন করে জন্ম, মৃত্যু, জরা, ব্যাধি, শোক ও দুঃখ দূর করে বিষ্ণু ভক্তি লাভ করে।

বৃহস্পতি শচীকে নির্ভয় হতে বললেন। কারণ তাঁর কাছে কচের স্ত্রী যেমন স্নেহ পায় শচীও তেমনই পায়। ব্রহ্মা বলেছেন পুত্র যেমন আগুন দান করে, শিষ্যও সেরকম আগুন দান করতে পারে। ব্রহ্মা বলেছেন বাবা-মা-গুরু-স্ত্রী-শিশুপুত্র ও অনাথ বান্ধব এদের সবাইকে পুরুষ অবশ্যই পালন করবে। শিব বলেছেন, সে মৃত্যুর পর অশুচি ও দৈব পিতৃকাজে তার কোন অধিকার থাকে না। যে লোক বাবা-মা ও গুরুকে সাধারণ মানুষ বলে মনে করে তাঁর সর্বত্রই অখ্যাতি ও পদে পদে বিপদ হয়, তার সর্বনাশ হয় যে লোক অল্প সময়ের মধ্যে ধন সম্পদে মত্ত হয়ে গুরুকে অপমান করে। ইন্দ্র তাকে সম্মান না দেওয়ার ফল তাড়াতাড়ি পেয়েছেন।

আমি তাকে বিপদ থেকে মুক্ত ও তোমাকে রক্ষা করব। তাকেই গুরু বলা উচিত, যিনি শাসন ও রক্ষা করতে পারেন। যে কখনই অসতী হয় না, যে নারীর মন পবিত্র, তার ধর্ম নষ্ট হয়, যার মনে সংশয় থাকে। হে সতী! তুমি রোহিনীর মত স্বামীর স্বাপেক্ষ, ভারতীর সমান পূজ্য ও সাবিত্রীর সমান পূজ্য পবিত্র ও নিরুপমা হবে। বৃহস্পতির কথার সময় নহুষ-এর দূত সেখানে এসে উপস্থিত হল। সে বলল, দেবীকে নির্জন নন্দনকাননে ক্রীড়ার জন্য রাজা নহুষের কাছে যেতে। বৃহস্পতি চোখ লাল করে দূতকে বলে যে রাজাকে গিয়ে বলতে যে শচীকে উপভোগের বাসনা থাকলে যেন রাতে সুন্দর কোন রথে চড়ে আসে।

সুন্দর সাজ পোশাক পরে সপ্তর্ষিদের কাঁধে পালকি চাপিয়ে তাতে চড়ে আসাই তার যোগ্য কাজ। দূত নহুষকে সে কথা বললে রাজা হেসে তাকে বলে, তাড়াতাড়ি গিয়ে সপ্তর্ষিদের নিয়ে আসতে। দূতের কথায় সপ্তর্ষিরা সানন্দে রাজার কাছে এলেন। নারায়ণ বললেন, ব্রহ্মা বিষ্ণুর প্রার্থনায় ত্রেতাযুগে দশরথের ঘরে মনের আনন্দে কৌশল্যার গর্ভে জন্মান এবং কৈকেয়ীর গর্ভে রামের মত গুণবান ভরত, আর সুমিত্রার গর্ভে গুণী লক্ষ্মণ ও শত্রুঘু জন্ম নেন। রাম বিশ্বামিত্রে উপদেশে সীতাকে নেওয়ার জন্য লক্ষ্মণের সাথে সুন্দর নগর মিথিলায় যান।

রাম বনের মধ্যে পাষাণ রূপী নারীকে দেখে বিশ্বামিত্রের কাছে তার কারণ জানতে চান। বিশ্বামিত্র রামের কথা শুনে তার কাছে গোপন সকল ব্যাপার বললেন। রাম সব শুনে পাদস্পর্শে পাষাণীকে পদ্মিনী করলেন। অহল্যা রামকে আশীর্বাদ করে স্বামীর কাছে ফিরে গেলে মহামুনি গৌতম স্ত্রীকে ফিরে পেয়ে রামকে শুভ আর্শীবাদ করলেন। পরে রাম মিথিলায় গিয়ে হরধনু ভঙ্গ করে। সীতাকে বিয়ে করলেন।

তাঁরা অযোধ্যায় ফিরলে নানা কৌতুক ও মঙ্গলচারণ হয়। রাজা দশরথ রামকে সিংহাসনে বসানোর জন্য সাত তীর্থের জল কলস ভরে এনে মুনি শ্রেষ্ঠদের রাজসভায় আনলেন। রামের অভিষেকের সময় কৈকেয়ী রাজাকে প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণ করালে রাজা শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। রাম তাদের দেখে প্রণাম করে বলেন, অপনারা ব্রহ্মার পুত্র, নারায়ণপরায়ণ ও শুদ্ধ সত্ত্বস্বরূপা ও নারায়ণের সমান শক্তিশালী।

এই বলে রাজ নহুষ তাদের প্রণাম করে কাঁদতে লাগল। রাজাকে কাতর দেখে পরমহিতৈষী ঋষিরা বললেন–যা তুমি চাও সবই আমরা দিতে পারি, আমাদের অসাধ্য কিছু নেই। আমরা তোমায় সব দান করে তপস্যা করতে যাবো। কৃষ্ণের ভজনা ছাড়া আমরা এক মুহূর্ত কাল অতিবাহিত করি না। তা আমাদের কাছে এক লক্ষ্য যুগ বলে মনে হয়। সেই দিনই দুর্দিন যে দিন হরির ধ্যান ও সেবা করা হয় না।

সে নিজের বিপদের জন্য অমৃত ছেড়ে বিষ পান করে যে হরির প্রার্থনা ছাড়া অন্য কিছু প্রার্থণা করে। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, ধর্ম, গনেশ সূর্য, অনন্ত ও সনক ঋষিরা দিনরাত যে হরির চরণ ধ্যান করেন এবং যাতে তাদের জন্ম, মৃত্যু, জরা, ব্যাধি দূর হয় আমরা তারই অভিলাষী।

মায়ায় মুগ্ধ হয়ে রাজা ঋষিদের কথা শুনে লজ্জিত ভাবে মাথা নিচু করে বললে, ভক্তবৎসল ও সকল প্রাথিত বিষয় দান করতে পারেন, এখন শচী দান করে আমার বাসনা পূরণ করুন। শচী সপ্তর্ষি বাহন কাণ্ডের অভিলাষিণী, ঋষিরা নহুষের কথা শুনে কৌতুকভরে জোরে হেসে উঠলেন। মুনিরা নহুষের পালকি কাঁধে তুললেন, তাদের দেরী দেখে তাদের ভৎর্সনা করার জন্য অগ্রগামী দুৰ্বসা রেগে গিয়ে নহুষকে শাপ দিলেন।

তুমি বিশাল অজগর হয়ে পৃথিবীতে জন্ম নেবে ও পরে ধর্ম পুত্রের দর্শনে তোমার মুক্তি ঘটবে। ব্যর্থ হবে না তোমার কর্ম। সাপের দেহ ত্যাগ করে রত্নরথে চড়ে বৈকুণ্ঠে গিয়ে নারায়ণের সেবা করবে। শাপ দিয়ে মুনিরা হাসতে হাসতে চলে গেলেন। রাজাও দুর্বাসার অভিশাপে সাপ হয়ে গভীর বনে ঢুকে পড়ল। শচী ঘটনা শুনে গুরুদেবকে প্রণাম করে স্বর্গে চলে গেল। সরোবরের কাছে গিয়ে হাসি মুখে বৃহস্পতি ইন্দ্রকে ডেকে বললেন–আমি থাকতে তোমার কোন ভয় নেই, নির্ভয়ে তুমি আমার কাছে এস। গুরুর গলার আওয়াজ চিনতে পেরে ইন্দ্র সূক্ষ্মরূপ ছেড়ে নিজের রূপ ধারণ করে ভক্তি করে গুরু দেবের পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করলেন।

ইন্দ্রকে ভীত দেখে বৃহস্পতি তাকে বুকে টেনে নিলেন। সোমযাগ করালেন প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য এবং সুন্দর রত্ন সিংহাসনে বসালেন। ইন্দ্রের সম্পত্তি চারগুণ বাড়িয়ে তুললেন তিনি। শচী ইন্দ্রকে ফিরে পেয়ে নিজের ঘরে ফুলের বিছানায় সুখে কাল কাটাতে লাগলেন। নারদ এবার সোমযোগের নিয়ম জানতে চাইলেন।

ব্রহ্মহত্যার–শান্তি সোমযাগের ফল। এই যজ্ঞ করলে যজমানকে মনের আনন্দে একবছর সোমলতার রস পান, ফল ও জল খেয়ে থাকতে হয়। এভাবে তিনবছর কাটালে ও ব্রত করলে সকল পাপ নাশ হয়। যে লোকের চাকর মাইনের তিন বছরের বা তার বেশি ধান সংগ্রহ করা থাকে, সে সোমরস পান করতে পারে। দেবতা বা মহারাজারাই কেবলমাত্র এই যজ্ঞ করতে পারে, এতে অনেক টাকা পয়সা ও দক্ষিণার প্রয়োজন।

৬১.

নারায়ণ বললেন–সমুদ্র মন্থনের পর দৈত্যদের পরাজিত করে অমৃত রস পান করে ইন্দ্রের অত্যন্ত দর্প হয়েছিল। কৃষ্ণ বালিরাজকে দিয়ে তার দর্পচূর্ণ করান। রাজ্যহারা হল ইন্দ্র সমেত সকল দেবতারা। বৃহস্পতির স্তবে ও অদিতির ব্রতে তুষ্ট হয়ে অদিতির গর্ভে বিষ্ণু বামন হিসাবে জন্ম গ্রহণ করেন।

পরে ছলনা করে বালিরাজার কাছে রাজ্য প্রার্থনা করে। ইন্দ্রের রাজ্য ফিরিয়ে দেন। দুর্বাসাকে দিয়ে ইন্দ্রের সম্পদ চুরি করিয়ে নেন। ইন্দ্রের দর্প চূর্ণ হলে পরে কৃষ্ণ ইন্দ্রকে তা দান করেন। ধন সম্পদে গর্বিত হয়ে ইন্দ্র গৌতমপ্রিয়াকে চুরি করেন। পরে গৌতম মুনির শাপে সকল দেহে হাজার যোনি চিহ্ন যন্ত্রণা ভোগ করেন। ইন্দ্র হাজার বছর সূর্যের আরাধনা করে তাঁর বরে গায়ের সেই হাজার যোনিচিহ্ন হাজার চোখে পরিণত হল। তার নাম হল সহস্রাক্ষ। তারা হরণ করার জন্য চাঁদের কলঙ্ক রেখার মত তার চোখগুলি কলঙ্কের মত রইল। যাকে পৃথিবীর সবাই পুজো করেন, যিনি জগতকে পবিত্র করেন, সেই নারায়ণ বললেন–অহল্যা একদিন তীর্থযাত্রা উপলক্ষে পুষ্করে আসেন। ইন্দ্র তখন তাঁকে দেখেন।

পীনোন্নত স্তন, হাসি খুশি সুদতীশান্ত অহল্যাকে দেখে ইন্দ্র অজ্ঞান হয়ে যান। পরদিন অহল্যা নগ্ন অবস্থায় মন্দাকিনীতে একাকী স্নান করছিলেন। অহল্যার বিশাল শ্রেণি ও স্তনদুটি দেখে ইন্দ্র কামনায় পীড়িত হয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। কিছুপরে জ্ঞান ফিরে পেয়ে অহল্যার কাছে গিয়ে খুব বিনীত ভাবে বললেন, হে সুন্দরী! তোমার অসাধারণ রূপ, অল্প বয়স! শরতের চাঁদ অপেক্ষা বেশি সুন্দর তোমার মুখ, সুন্দর কুটিল ভুভঙ্গিমা দেখামাত্রই মন আকৃষ্ট হয়।

পদ্মের সৌন্দর্যকেও হার মানাচ্ছে তোমার চোখ দুটি, তোমার গতি হার মানায় হাতি ও খঞ্জনার গতিকেও। তোমার লোভনীয় কথাবার্তা অমৃত অপেক্ষাও মিষ্টি ও দুর্লভ। মুনিদেরও মন হরণ করে তোমার বিশাল শ্রোণি। তাকে কামের আধার মনে হয়। তোমার স্তনদুটি ত্রিলোকে সবার মন হরণ করে, তা কঠিন সুন্দর বেলের মতো, গৌতম তপস্যা করেই এই সুন্দরী স্ত্রীকে লাভ করেছেন।

দুর্গা ও কমলার আরাধনা করে লক্ষ্মীর মত ঐরকম পদ্মমুখী সুকোমলাঙ্গী পবিত্র সুদতী শীতে সুখোষ্ণ এবং গরমে সুখ শীতল উজুল সোনার মত কঠিন স্তন বিশিষ্ট বিশাল নিতম্ব সরু কোমর বিশিষ্ঠ পদ্মিনী স্ত্রীকে লাভ করেছেন। কামশাস্ত্র বিশারদ কামদেব বা কামুক চাঁদ তোমার মত নারীকে কিভাবে রমণ করতে হয় তা তারা জানেন, কিন্তু গৌতম কি তা জানেন? শচীকে তোমার দাসী করে দেব হে সুন্দরী।

অহল্যার চরণে ইন্দ্ৰ কামুক হয়ে লুটিয়ে পড়লে মহামতী অহল্যা তাঁকে উপযুক্ত বেদের কথা শোনাতে লাগলেন। বললেন, ইন্দ্র তুমি কশ্যপের কু সন্তান। তোমার দ্বারা কি তার পিতা মহামুনি মারীচি ও তার পিতা ভগবান ব্রহ্মারও দুর্ভাগ্য প্রকাশে পেয়েছে। নারীতে আকৃষ্ট হয় যার মন তার কাছে জপ, মৌনব্রত, দৈবপূজা ও তীর্থসেবা কিছুই ফলজনক হয় না। নারীর রূপ সকল মায়ার আধার বিশেষ, মানুষের কর্ম পথের বাধা, তপস্যায় বিঘ্নের কারণ ও সকল দোষের আধার। কঠিন বন্ধনের মত তা সংসারে আবদ্ধ ব্যাক্তির কাছে, তাদের সকল কাজই নিষ্ফল হয় যাদের মন পরস্ত্রীতে আকৃষ্ট।

পরস্ত্রী ভোগকারী ইহকালে সুখ্যাতি ও পরকালে ঘোর নরকগামী হয়। মহামতী অহল্যা এই বলে কামুক ইন্দ্রকে ছেড়ে বাড়ি ফিরে এলেন। গৌতম মুনি ইন্দ্রের চরিত্রের কথা চিন্তা করে হাসতে লাগলেন। গৌতম শিবের কাছে গেলে ইন্দ্ৰ গৌতমের রূপ ধরে অহল্যাকে সম্ভোগ করলেন। সর্বজ্ঞ মুনি এদিকে সমস্ত কিছু জানতে পেরে হঠাৎ দরজার কাছে এলেন এবং ইন্দ্রকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে দেখে পীন শ্রেনি পায়ে ধরা অহল্যাকে নির্জনে মগ্ন হয়ে থাকতে দেখে রেগে গিয়ে ইন্দ্রকে ‘ভগাঙ্গি হও’ আর স্ত্রীকে কাঁদতে দেখে ও ভয় পেতে দেখে অভিশাপ দিলেন- “তুমি, এই বনের মধ্যে পাষাণ হয়ে থাক’ বলে অভিশাপ দিলেন।

অহল্যা শোকার্ত হয়ে স্বামীকে জিজ্ঞেস করলেন কেন, তিনি তাঁকে ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। গৌতম বললেন, তুমি পতিব্রতা হওয়া সত্ত্বেও আমি তোমায় পরিত্যাগ করব কারণ তুমি অন্যের বীর্য গ্রহণ করেছ। অনিচ্ছায় শৃঙ্গার করলে উপপতির সঙ্গে সংসর্গ হওয়ার জন্য নারীর কোন দোষ হয় না। নিজের ইচ্ছায় অপরের ভোগ্য হলে সে দোষের ভাগী হয়। ইন্দ্রকে স্বামী বিবেচনা করে ইচ্ছা করে তার সঙ্গে সম্ভোগ করেছে, তখন তোমার নিশ্চয়ই দোষ হয়েছে। অহল্যা তুমি গভীর বনে গিয়ে পাষাণে পরিণত হও। পরে রামের ছোঁয়ায় পবিত্র হবে। সেই পুণ্যে আমাকে আবার ফিরে পাবে, এখন বনে যাও। মুনি তপস্যা করতে চলে গেলেন। তোমার কাছে ইন্দ্রের দর্পনাশের ব্যাপার এবং তিনি যে ভাবে গুরুর কৃপায় লক্ষ্মীকে পেয়েছিলেন তা বলিনি।

৬২.

রাম কিভাবে অহল্যাকে উদ্ধার করেছিল নারদ তা জানতে চাইলেন। সরোবর দানে তার বেশি ফল লাভ হয়, কান্তাদানে বেশি ফল লাভ হয় বাপীদানের থেকে, একবার যজ্ঞ করলে বেশি ফল লাভ হয়। কান্তাদানে বেশি ফল লাভ হয় বাপীদানের থাকে। একবার যজ্ঞ করলে বেশি ফল লাভ হয় দশকন্যা দানের থেকেও। সত্য অপেক্ষা বড় বন্ধু ও মিথ্যা থেকে নিকৃষ্ট পাতক, গঙ্গার সমান তীর্থ ও কেশবের থেকে পরম দেবতা আর কেউ নেই, ধর্ম থেকে বড়, বন্ধু আর কেউ নেই। কোন কিছুই প্রিয় নয় ধর্ম অপেক্ষা ধন ও প্রিয়।

চেষ্টা করে নিজের ধর্মকে রক্ষা করুন। ধর্মকে রক্ষা করলে সর্বদা সব জায়গায় মঙ্গল যশ সুপ্রতিষ্ঠা। লাভ করে। সে পুজো পায় সর্বত্র। ঘরের সুখ ছেড়ে বনবাসী হয়ে বনে বনে থাকবে। আপনার সত্য পালন না করার জন্য চন্দ্র, সূর্য যতদিন থাকবে, ততদিন সে কুম্ভীপাক নরকে নরক যন্ত্রণা ভোগ করার পর সাতজন্ম বোবা ও কুষ্ঠ রোগী হয়ে জন্মাতে হয়। রামচন্দ্র জটা ও বাকল পরে ও সীতাকে নিয়ে বনবাসে চললেন। রাজা দশরথ পুত্রশোকে প্রাণ ত্যাগ করলেন। পিতৃসত্য পালনের জন্য রামও বনে বনে ঘুরতে লাগলেন। রাবণের বোন শূর্পনখা কিছুদিন পরে ভাইয়ের সাথে মনের আনন্দে ভয়ঙ্কর বনে বেড়াতে এসে রামকে দেখল। সে তখন রামের প্রতি কামাসক্ত ও পুলকিত হয়ে পড়ল। রামের কাছে গিয়ে বলল, তোমার প্রতি আমি আসক্ত হয়েছি, এই নির্জন বনে আমাকে তোমার স্ত্রী করে নাও, রাম তার কথা শুনে ধর্মকে স্মরণ করে অভিশাপের ভরে মিষ্টি ভাবে বলেন, মা! আমার স্ত্রী আছে, আমার ভাইয়ের স্ত্রী নেই তুমি তার কাছে যাও। রামের কথা শুনে রাক্ষসী মনের আনন্দে লক্ষণের কাছে গিয়ে মঙ্গল চিহ্ন সহ শান্ত লক্ষ্মণকে দেখে বলল, আমাকে গ্রহণ কর।

কিন্তু লক্ষ্মণ তাকে বলল, আমার স্ত্রী সীতার দাসী ও আমি নিজেও সীতার দাস। তুমি যাও রামের কাছে। তবেই তুমি হতে পারবে প্রভুর পত্নী। আমি সীতার পুত্র, তোমারও আমি পুত্র হব।

শূর্পনখা বলল–ওরে নির্বোধ! যদি আমাকে পরিত্যাগ কর, তবে তোমাদের সবারই বিপদ ঘটবে। মোহিনীকে ছেড়ে দেবার জন্য ব্রহ্মার শাপে। পৃথিবীর কোথাও দক্ষের পূজা হয় না। দক্ষের ব্রহ্মার শাপে ছাগলের মাথা হয়েছে।

উর্বশীর শাপে স্বর্গের বৈদ্যের যজ্ঞে কোন অংশ নেই। মেনকার শাপে কুবের হয়েছেন রূপহীন। মাধ্যন্দিন শাখায় বলা আছে যে, ধর্ম ভীরুর সামনে যদি নিজে থেকে কোন কামাসক্ত যৌবনবতী স্ত্রী আসে তবে তাকে পরিত্যাগ না করা উচিত।

এই অধর্ম আরো যে করে সেই বিপদগ্রস্ত ও দেহান্তে নরকগামী হয়। ধারালো অর্ধচন্দ্র ছুরিকা দিয়ে লক্ষ্মণ শূর্পনখার নাক কেটে দিল। তার দুই ভাই খড় ও দূষণ সৈন্য নিয়ে লক্ষ্মণের সঙ্গে যুদ্ধে এসে মারা পড়ল।

তখন শূর্পনখা রাবণকে সবকিছু বলল। নিজে পুষ্কর তীর্থে নিয়ে তপস্যারত অবস্থায় প্রাণ বিসর্জন দিয়ে কুজা হয়ে জন্মাল। রাবণ এদিকে সীতাহরণ করল।

রাম সীতার অদর্শনে জ্ঞান হারালেন। অনেক অনুসন্ধানের পর সুগ্রীবের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হল। রাম প্রতিজ্ঞা পালনের জন্য বালীকে হত্যা করে বন্ধু সুগ্রীবকে রাজ্য দান করেন।

সুগ্রীব চারিদিকে দূত পাঠাল দেবী সীতাকে খোঁজার জন্য। হনুমানকে নিজের আংটি দিয়ে রাম তার দেওয়া সংবাদ সীতাকে দেবার জন্য হনুমানকে লঙ্কায় পাঠলেন। সেখানে অশোক বনে ক্ষীনকায়া সীতাকে দেখে তাঁকে প্রণাম করে রামের রত্ন আংটি তাঁকে দিলেন।

হনুমান বললেন–মা! রাম লক্ষ্মণ সুগ্রীবের সাথে বাস করছেন। রাম আমার মুখে আপনার মঙ্গল সাগর বন্ধন করে শীঘ্ন এসে পড়বেন। রাবণকে নাশ করে আপনাকে উদ্ধার করবেন। আমি লঙ্কাকে পুড়িয়ে ছাই করব। হনুমান বলল যে লঙ্কাকে বানরীর ডিমের মত, সমুদ্রকে মূত্রের মত ও পৃথিবীকে মরার মত মনে করে।

হনুমান সীতাকে আশ্বাস বাণী শুনিয়ে লঙ্কাপুরী পোড়ালেন। হনুমান এরপর সীতাকে সান্ত্বনা দিয়ে রামকে গিয়ে সমস্ত কথা বললেন।

রাম কাঁদতে লাগলেন, তা দেখে লক্ষ্মণ ও সুগ্রীবসহ বানররাও কেঁদে উঠল। রাম সৈন্যদের সাহায্যে সমুদ্রে সেতু নির্মাণ করে লঙ্কায় এলেন। ভয়ংকর যুদ্ধ করে রাবণকে সবংশে নিহত করে শুভক্ষণে সীতা উদ্ধার করলেন। রাম সীতাকে পুষ্পক রথে বসিয়ে অযোধ্যায় নিয়ে এলেন এবং রাম সীতাকে বুকে নিয়ে মনের সুখে কাল কাটাতে লাগলেন।

দুজনের বিরহ জ্বালা দূর হল। সপ্তদীপের রাজা হলেন রাম। সমস্ত পৃথিবী অধিব্যাধি শূন্য হল। রামের লব কুশ নামক দুই ধার্মিক পুত্র জন্মাল। তাদের থেকেই সৃষ্টি হয়েছে সূর্যবংশীয় রাজাদের। এই রামচরিত সকল কিছুর সার ও সংসার-সাগর পার হবার নৌকা স্বরূপ।

৬৩.

নারায়ণ জানালেন, এই দুঃস্বপ্ন দেখার পর কংস দারুণ ভয়ে খাওয়া দাওয়া ত্যাগ করল। পরে পাত্র মিত্র, বন্ধু, ও বান্ধব ও পুরোহিতকে ডেকে তাঁর স্বপ্নের কথা শোনালেন। এক লোল জিহ্বা ভয়ংকর কালো রঙের এক বুড়ী নগরের মধ্যে নাচতে নাচতে চলেছে। তার পরনে রক্তবস্ত্র, তার দুহাতে ভয়ংকর তীক্ষ্ণ দুই খাঁড়া। এক এলোকেশী নাককাটা কালো রঙের বিধবা মহাশূদ্রী যেন তাকে জড়িয়ে ধরতে চায়। অন্য আর এক মলিন শুকনোচুল নারী পরণে যার চেলী তার কপালে ও বুকে তিলক এঁকেছে। আর এক কুচেলধারী বিকটাকার রুক্ষক্ষেপ ম্লেচ্ছ যেন, ভোরে তাকে ছিন্নভিন্ন কাপড়ের টুকরো দান করছে। এক পতিপুত্রবতী নারী দারুণ রেগে বারবার শাপ দিয়ে আস্ত কলস ভেঙে ফেলেছে। এক ব্রাহ্মণও দারুণ রেগে তার রক্ত চন্দন মাখা জবাফুলের মালা দান করছে, তার নগরে থেকে থেকে ছাই বৃষ্টি হচ্ছে। বিকটাকারের বানর, কাক, কুকুর, ভালুক, শুয়োর, ও গাধারা ভয়ংকর চিৎকার করছে।

ভোরে সূর্য ওঠার সময় শুকনো কাঠের ছাই, কাজল কৰ্পর ও কাটা নখ, সবাই নজরে এল। এক সতী নারী রুষ্ট হয়ে তাকে শাপ দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। তার পরণে ছিল পীতরঙা কাপড়। হাতে খেলার জন্য পদ্মফুল। আমার শহরে এলোকেশী বিকটাকারের উলঙ্গা নারীরা সব সময় সব ঘরে হাসিমুখে নাচছে, তা লক্ষ্য করেছি। ছিন্ননাক ভয়ংকর এক দিগম্বরী মহাশূদ্রী বিধবাকে দেখলাম আমার সারা গায়ে তেল মাখিয়ে দিতে।

খুব ভোরে নিভে যাওয়া কাঠের ছাইয়ে ভর্তি ভয়ংকর চিতা দেখেছি। ঐ চিতার পাশে লাল কাপড় পড়ে অবিন্যস্ত চুলে লোকেরা আনন্দে নাচ গান করছে। কেউ রক্ত বমি করছে, কেউ ভয়ংকর নাচ নাচছে। কেউ শুয়ে আছে। রাতে আকাশে রাহুগ্রস্ত চাঁদও সূর্যের পূর্ণগ্রাস দেখেছি। দেখলাম প্রবল বাতাসে গাছের ডাল পালা সব ভেঙে হাওয়ায় উড়ছে।

সকল পাহাড় যেন পৃথিবীতে ভেঙে পড়েছে। এক ভয়ংকর লোক যার মাথা নেই সে সব বাড়িতে নেচে চলেছে। পুরোহিত সত্যক এই স্বপ্নের বৃত্তান্ত শুনে নিশ্চিত বুঝতে পারল যে কংসের বিনাশ অবশ্যম্ভাবী। আর বোঝা মাত্র কংস জ্ঞান হারাল। তখন কংসের বাবা, মা ও পত্নীরা তাদের বিনাশ কাল উপস্থিত বুঝে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল।

৬৪.

শুক্রের বুদ্ধিমান শিষ্য পুরোহিত সত্যক বললেন, তিনি থাকতে কংসের ভয় পাবার কোন কারণ নেই। এখন সকল শত্রু নাশী মহাদেবের যজ্ঞের আয়োজন করতে হবে। এই যজ্ঞে অনেক টাকা পয়সা ও দক্ষিণা প্রয়োজন। এই যজ্ঞে নাশ করে দুঃস্বপ্ন ও শত্রুভয়। এই যজ্ঞ দূর হয় ভৌতিক, আধিদৈবিক ও আধিবৈজ্ঞানিক এই তিন বিপদ। এই যজ্ঞ সম্পূর্ণ করতে পারলে সকল সম্পদদাতা মহাদেব নিজে দেখা দেন ও জন্ম-মৃত্যু দূরকারী বর দেন। পূর্বে রাজা বান, পরশুরাম ও বলী ভল্ল এই যজ্ঞের আয়াজন করেছিলেন। মহাদেব নন্দীকে প্রথমে এই ধনুক দান করেন।

বাণরাজাকে নন্দী তা দান করেন। বাণ আগে তা পরশুরামকে দান করেন, পরশুরাম দয়া করে তা আপনাকে দান করেছেন। ঐ ধনুক মহাদেবের ইচ্ছানুসারে তৈরি হয়েছে। এর দৈর্ঘ্য হাজার হাত ও প্রস্থ দশ হাত। মহাদেব দৈত্য সংহার করেন। এই ধনুকে দুর্দান্ত পাশুপত অস্ত্রযোগ করে। নারায়ণ ছাড়া কেউ ভাঙতে পারে না ঐ ধনুক।

ধনুক ও শিবের পূজো করতে হবে। এই যজ্ঞে যদি কোন ভাবে ধনুক ভাঙা যায় তবে নিশ্চয় যজমানের বিনাশ হবে। আর ধনুক ভাঙ্গা গেলে নিশ্চয়ই যজ্ঞও ভঙ্গ হবে। কাজ করা না গেলে ফলদান কে করবে। এই ধনুক গোড়ায় ব্রহ্মা এবং নারায়ণ নিজে, মধ্যে ও সামনে মহাশক্তিমান মহাদেব রয়েছেন, শ্রেষ্ঠ রত্নে তৈরি বিকারহীন ঐ ধনুক গ্রীষ্মকালের দুপুরের সূর্যের মত তেজকেও ম্লান করেছে। তাকে নত করতে পারেনি অনন্তদেব সূর্য ও কার্তিক। পূর্বে ত্রিপুরারি ঐ ধনুক দিয়েই ত্রিপুরাসুরকে নিহত করেছেন।

এখন নির্ভয়ে স্বচ্ছন্দে শুভ কাজ আরম্ভ করুন। যিনি চন্দ্র বংশকে বর্ধিত করেছেন সেই সত্যকের কথা শুনে রাজা কংস ভাল ভাল কথা সত্যককে বলতে লাগল। বলল, নন্দের ছেলে যে আমাকে বধ করবে সে এখন বসুদেবের ঘরে জন্ম নিয়ে সেখানে বড় হচ্ছে। সে পুতানাকে বধ করেছে। এক হাতে গোবর্ধন পাহাড় ধরে রেখে ইন্দ্রকেও হারিয়ে দিয়েছে। সে কৃত্রিম রাখাল ছেলে ও বাছুর প্রস্তুত করে সকল পৃথিবী ব্রহ্মময় দেখিয়েছে। এখন সেই শক্তিমান বালককে হত্যার বুদ্ধি দিন। সে ছাড়া আর কোন শত্রু নেই। যেসব রাজা রয়েছেন সবাই আমার বন্ধু আর ব্রহ্মা এবং স্বয়ং মহাদেব মহাতপস্বী ও সর্বাত্মা, সনাতন বিষ্ণু সব কিছুকেই সমান দেখেন। তাদের বিপক্ষ হওয়া সম্ভব না।

নন্দের সেই ছেলেকে মারতে পারলেই সকল ত্রিভুবনের সার্বভৌম রাজা হতে পারব। দুর্বল ইন্দ্রকে হারিয়ে নিজেই ইন্দ্ৰ হব। সত্যক কংসের কথা শুনে সেই সময়ের উপযুক্ত সত্য ও হিতকর কথা বললেন। অত্রুর, উদ্ধব অথবা বসুদেবকে নন্দের ব্রজে পাঠান। কংস সত্যকের কথা শুনে বসুদেবকে ডাকল। বসুদেব বলল–আপনি নন্দের নন্দন কৃষ্ণের বাড়ি নিয়ে বৃষভানু; নন্দ, কৃষ্ণ, বলরামসহ সকল গোকুলবাসীদের বসুদেব শীঘ্র এই যজ্ঞস্থলে নিয়ে আসুন ও সকল দূত, রাজা ও মুনিদের জানানোর জন্য খবর নিয়ে চারিদিকে বেরিয়ে পড়ুন। রাজার কথায় বসুদেবের গলা, ঠোঁট ও তালু শুকিয়ে গেল।

সে বলল, এখন নন্দ ও নন্দের ছেলেকে জানানোর জন্য ব্রজে যাওয়া আমার ঠিক হবে না। নন্দের ছেলে এই মহোৎসবে এসে অবশ্যই তোমার সঙ্গে তার বিরোধ হবে। আর আমি তাকে ডেকে এনে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেব তা তার পক্ষে ভাল হবে না। তা হলে হয় তোমার নয় তার বিপদ হবে। সকলে বলবে যে কৃষ্ণের বাবা কৃষ্ণকে ডেকে এনে তার ক্ষতি সাধন করল বা বসুদেব পুত্রকে দিয়ে রাজার মরণ ঘটাল।

এতে দুজনের মধ্যে একজন অবশ্যই মারা যাবে। বসুদেবের কথায় রাজা ক্রুদ্ধ হল। সে খঙ্গ দিয়ে বসুদেবকে মারতে উঠল। তখন মহা শক্তিশালী উগ্রসেন হাহাকার করে পুত্র কংসকে থামালেন। কংস আকুরকে ব্রজে পাঠাল।

তখন সনক, সনন্দ, পঞ্চ শিখ, কপিল, আসুরি পুলহ, পুলস্ত্য, ভৃগু অঙ্গিরা, মরীচি, কশ্যপ দক্ষ, অত্রি, ভরদ্বাজ, ব্যাস, গৌতম, প্রচেতা, বশিষ্ঠ, যাজ্ঞবল্ক্য, উতথ্য, সৌভরি, পর্বত, দৈবল, জৈমিনী, বিশ্বামিত্র, শাকল জাজলি, লাঙ্গলি, শিলানিক জগকারু, দুর্বাসা, বামদেব, বিভন্তক, কবি, পথ, কৌশিক পাণিনি, বাল্মীকি, লোমশ, মার্কণ্ডেয়, পরশুরাম, অগস্ত্য ঋষি নর ও নারায়ণে ও অন্যান্য ব্রাহ্মণরাও এলেন। বিভিন্ন রাজারা এলেন, তখন সত্যক যজ্ঞের দিন ও শুভক্ষণ ঠিক করলেন।

৬৫.

অক্রুর কংসের কথা শুনে মনের আনন্দে উদ্ধবকে বলতে লাগলেন–আজ রাত কেটে গেছে, পরম শুভদিন এসে উপস্থিত। আজ আমার গুরু, ব্রাহ্মণ ও দেবতারা সবাই তুষ্ট হয়েছেন। আমার কর্মান্ধতা আজ ছিন্ন হোল, সংসার রূপ কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে আজ আমি বৈকুণ্ঠে যাব।

কংসের রাগ আজ আমার কাছে দেবতার আশীর্বাদের মতো হলো। আমি ব্রজরাজকে সংবর্ধনা জানাবার জন্য ব্রজধামে গিয়ে নবশ্যাম কৃষ্ণকে দর্শন করব। হয়ত তিনি সারা গায়ে ননী মেখেছেন বা বাঁশি বাজিয়ে সবার মন চুরি করে নিয়েছেন, কিম্বা গরু চরাচ্ছেন বা শুয়ে আছেন, নিজের চোখে অন্যভাবে দেখব।

ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব প্রভৃতি দেবতারা কৃষ্ণের চরণ পদ্ম ধ্যান করেন, সরস্বতী নিজেই ভয়ে জড় হয়ে যান যার স্তব করতে গেলে।

যাঁর দাসীর কাজ করেন স্বয়ং মহালক্ষ্মী, যাঁর চরণকমল থেকে সত্ত্বসরূপিনী গঙ্গা দেবী আর্বিভূতা হয়েছেন, যাঁর দেখা ও ছোঁয়া পেলেই মানুষের জন্ম-ব্যাধি-মৃত্যুভয় দূর হয়, সকল পাপতাপ, আর যে হরির চরণকমল, ত্রিলোকজননী দুর্গতিনাশিনী মূলপ্রকৃতি পরমেশ্বরী দুর্গা সর্বদা ধ্যান করেন ও স্থূল থেকে সুলতর মহাবিষ্ণুর লোমকূপে অসংখ্য বিশ্ব বিরাজ করছে–সে কৃষ্ণের ষোলো ভাগের একভাগ মাত্র–সেই কৃষ্ণকে দর্শন করতে যাব আমি। এই বলতে বলতে অত্রুরের সারা গায়ে তখন রোমাঞ্চ দেখা গেল, চোখ থেকে বেরোতে লাগল আনন্দ অশ্রু।

৬৬.

সেই রাসেশ্বর রাসেশ্বরীর সঙ্গে রমণ করতে ইচ্ছে করে রমণ করতে শুরু করলেন। রাধা ঘুম থেকে জেগে উঠলেন এক দারুণ দুঃস্বপ্ন দেখে। বললেন, স্বামী আপনি তাড়াতাড়ি আমার কাছে আসুন, আমি আপনাকে বুকে ধরি, রাধা এই বলে প্রিয়কে আপন বুকে ধরে দুঃস্বপ্নের কথা বলতে লাগলেন।

রাধা বললেন–হে স্বামী! আমি যে রত্নছবি ধরে সিংহাসনে বসে আছি, এমন সময় কোন এক ব্রাহ্মণ রেগে গিয়ে আমাকে অভিশাপ নিল। দুর্বল, বলে আমাকে ভয়ংকর গভীর সাগরে ছুঁড়ে ফেলল। সেই স্রোতে পড়ে শোকার্ত ও ব্যাকুল হয়ে বার বার মহাতরঙ্গ বেগে ভাসতে লাগলাম।

‘বাঁচাও’ বলে চিৎকার করেও যখন তোমার দেখতে পেলাম না, তখন দেবতাদের কাছে উদ্ধারের জন্য প্রার্থনা করলাম। সেই ঢেউয়ের মধ্যে ডুবে গিয়ে দেখলাম চাঁদ আকাশ থেকে মাটিতে পড়ে গিয়ে একশো টুকরো হয়ে গেল।

সূর্যেরও একই দশা হলো। আবার দেখলাম, চাঁদ ও সূর্যকে রাহু গিলে ফেলেছে ও সারা পৃথিবী অন্ধকারময় হয়ে যাচ্ছে। পরে দেখলাম দীপ্তিমান এক ব্রাহ্মণ ক্রোধভরে আমার কোলে রাখা অমৃতের ভাণ্ড ভেঙে ফেলল।

পরে সেই ব্রাহ্মণ দারুণ রেগে আমার চোখের সামনে কোনও একটা লোককে ধরে নিয়ে চলে গেল। হাত থেকে পড়ে খণ্ড খণ্ড হয়ে গেল আমার হাতের ক্রীড়াকমল। শ্রেষ্ঠ রত্নে তৈরি আয়না হঠাৎ হাত থেকে পড়ে টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল।

গলার হার ছিঁড়ে মলিন পদ্মরূপে মাটিতে পড়ল। দেখলাম সকল পুতুলগুলি কখনও নাচছে, কখনও হাসছে, কখনও চিৎকার করছে, কখনও গান করছে বা কাঁদছে। ভয়ঙ্কর এক কালোরঙের চক্র যেন সারা আকাশ জুড়ে মুহুর্মুহু ঘুরে বেড়াচ্ছে।

আমার প্রাণধিষ্ঠাতা দেবতা যেন অন্তর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন–হে রাধা! আমায় বিদায় দাও। আমি চলে যাচ্ছি, আবার দেখলাম কালো কাপড় পরে কোনও এক নারী আমায় জড়িয়ে ধরে চুমো খেল। স্বপনে এর উল্টো ঘটনাও লক্ষ্য করেছি। আমার ডান চোখ নাচছে, প্রাণ কেঁপে উঠছে, সকল মন শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। এই বলতে বলতে রাধার গলা, ঠোঁট, তালু শুকিয়ে গেল ও ভয়ে শোকগ্রস্ত হয়ে শ্রীকৃষ্ণের পায়ে লুটিয়ে পড়লেন। জগন্নাথ কৃষ্ণ স্বপ্নের ঘটনা শুনে দেবীকে নিজের বুকে জড়িয়ে সান্ত্বনা দিলেন।

৬৭.

দুজনে ক্রীড়া সরোবরে গেলেন। চাঁদ যেমন নতুন মেঘে শোভা পায়, রাধাও তেমনি কৃষ্ণের বুকে শোভা পাচ্ছিলেন। রাধার সাথে তিনি বিহার করতে শুরু করলেন। সেই বিহার মন্দিরে শ্রেষ্ঠ রত্ননির্মিত রত্নপ্রদীপ জ্বলতে লাগল, তিনি সুন্দর রসসাগরের তৈরি শয্যাতে শুয়ে মনের আনন্দে রত্নালংকার সজ্জিত সাক্ষাৎ রত্ন স্বরূপ রাধার সাথে রমণ করতে লাগলেন।

তাঁদের সুরক্রীড়া থামলেও ইচ্ছা থামল না। রাধা তখন রাসমণ্ডলস্থ, শ্রীকৃষ্ণকে বলতে লাগলেন- হে কমলাকান্ত! আপনার অদর্শনে ও আমি ম্লান ও মৃতের মতো পড়ে ছিলাম। আপনার দর্শনে আমার তেমন অবস্থা হয় যেমন চন্দ্রের হয়। সূর্য অস্ত গেলে পৃথিবীতে যেমন গাঢ় অন্ধকার নেমে আসে সেরকম আপনি চলে গেলে, চিন্তা আমায় গ্রাস করে। পাঁচ প্রাণবায়ুর সমান আপনি মার কাছে।

সনৎকুমার ও অনন্তদেবও অনেক কাল ধরে তপস্যা করে তার কাছে যোগের কিছুটা জানতে পেরেছেন। কৃষ্ণ রসিকা যোগিনী রাধাকে বুকে টেনে নিয়ে তাঁকে বললেন–হে জাতিস্মর; তুমি নিজেকে স্মরণ কর।

শ্রীদামের অভিশাপের জন্য তোমার সাথে আমার কিছু দিনের জন্য বিচ্ছেদ ঘটবে, কিন্তু পুনরায় মিলন হবে। আমি সকলের অন্তরাত্মা, সকল কার্যে উদাসীন ও সকল জীবের মধ্যে থেকেও সব জায়গায় অদৃশ্য ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছি।

বায়ু যেমন কোন কিছুতে লিপ্ত হয় না, সব জায়গায় সকল প্রাণীর মধ্যে থাকে, তেমন আমিও নির্লিপ্ত অথচ সকাল কাজের সাক্ষী। যে জীবাত্মা সব সময় সকল জীবের মধ্যে থাকে তা আমার ছায়া মাত্র।

সেই জীবাত্মাই সর্বদা কর্মের অনুষ্ঠান ও ভাল-মন্দ কাজের ফল ভোগ করে। চাঁদ-সূর্যের ছায়া, যেমন পড়ে জলভর্তি ঘটে আবার সেই ঘট ভেঙে গেলে সেই ছায়াও চাঁদ ও সূর্যে সংশ্লিষ্ট হয়।

দেহ বিনষ্ট হলে ছায়াস্বরূপ জীবও আমার মধ্যে বিলীন হয়। আমি ভাল করেই জানি, সকল কিছুই নশ্বর, কোথাও আমার আর্বিভাব কম, কোথাও বেশি। কোন কোন দেবতা কলার অংশের অংশ, কেউ আবার তারও অংশ। আমার অংশজাত সূক্ষ্ম প্রকৃতি দেবী। পাঁচ মূর্তিতে বিভক্ত এই প্রকৃতি দেবী।

যারা জন্মায় প্রকৃতি থেকে তারাই প্রাকৃতিক কল্পে নষ্ট হয়। যে বিরাট পুরুষের লোমকূপের মধ্যে সকল বিশ্ব রয়েছে, সৃষ্টির সময়ে আমিই সেই বিরাট পুরুষ হয়ে থাকি এবং তুমিও যে আমার অংশ থেকে সৃষ্ট।

যাঁর নাভি কমল থেকে সকল বিশ্বের সৃষ্টির কারণ ব্রহ্মা উদ্ভূত হয়েছেন, এই ক্ষুদ্র বিরাটও আমি এবং আমিই বিষ্ণু শিব–কারণ সকলেই আমার অংশ থেকে উৎপন্ন হয়েছে। তুমিও নিজের অংশে সব সময় সেই ক্ষুদ্র বিরাটের মঙ্গলদাত্রী বিরাট শ্রীরূপা পত্নী হয়ে থাক।

প্রতেক বিশ্বেই এরকম আলাদা আলাদা ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর এরা আলাদাভাবে বর্তমান। চতুর্ভুজ মুর্তিতে আমি-ই বৈকুণ্ঠে ও তুমি মহালক্ষ্মী রূপে বিরাজ করছ। সেই বৈকুণ্ঠ গোলকের মত বিশ্বের বাইরের উপরে দিকে রয়েছে। শিবারূপিনী তুমিই দুর্গ নামক অসুরকে বধ করে সকল দুর্গতি নাশিনী দুর্গা নামে অভিহিত হয়েছে। পরে কৈলাসে পার্বতী নামে বিখ্যাত হও।

আবার তুমি নিজের অংশে সিন্ধুকন্যা হয়ে ক্ষীর সমুদ্রশায়িত বিষ্ণুর বুকে রয়েছ। তুমিই লক্ষ্মী শিবা, ধাত্রী ও গোলোকে রাসেশ্বরী রাধা, বৃন্দাবনে বৃন্দা, বিরজাতটে বিরজা–আলাদা রূপে প্রকাশ পেয়েছ।

শ্রীদামের শাপে এই ভারতবর্ষ ও বৃন্দাবন ধামকে পবিত্র করার জন্য ভারতে এসেও, সকল নারীরাই তোমার কালাংশের অংশ কলায় উৎপন্ন, আমি অংশ বিশেষে অগ্নিরূপী হলে তুমিও নিজের অংশে স্বাহা নামে দাহিকাশক্তিররূপে আমার প্রিয়া হয়েছ। তোমার বিহনে আমি সম্পূর্ণ অক্ষম।

আমি দীপ্তমানদের মধ্যে সূর্যরূপে প্রকাশিত হলে তুমিও প্রভারূপে আমার সঙ্গে মিলিত হয়েছ। তোমার মিলন ছাড়া আমি দীপ্তিমান হতে পারিনা। পূর্বে পদ্মকল্পে পদ্ম যেদিন, ব্রহ্মা পুষ্কর তীর্থে একশো ইন্দ্রের পতন পর্যন্ত কঠোর তপস্যা করাতে করুণাসাগর কৃষ্ণ লক্ষ করলেন যে সে রোগা নিশ্চেষ্ট ও অস্থি চর্মসার হয়েছে। এই দেখে সাদরে সেই যোগের কিছু অংশ তার কাছে প্রকাশ করেন, পূর্বে করুণাসাগর ধর্মকেও সিংহক্ষেত্রে চৌদ্দজন ইন্দ্র পর্যন্ত তপস্যা করার জন্য রোগা হলে আমার কাছে কিছুটা বর্ণনা করেছেন।

সনকুমার ও অনন্তদের অনেক কাল তপস্যা করে তার কাছে ঐ যোগের কিছুটা জানাতে পেরেছেন ও ভক্তবৎসল শ্রীকৃষ্ণ, হিমালয়ে তপস্বী কপিল দেব ও পুষ্করে সূর্যদেব বহুঁকার ধরে তপস্যার জন্য তাদের কাছে ভক্তশ্রেষ্ঠ প্রহ্লাদ ও পরম তপস্বী দুর্বাসা ও ভৃগুর কাছেও কিছুটা ব্যক্ত করেছেন। যোগীদের গুরু শ্রীকৃষ্ণ রসিকা যোগিনী নিয়ে তাঁর কাছে কিছুটা আধ্যাত্মিক বিষয় বললেন।

৬৮.

ক্রীড়া শেষে কৃষ্ণ ফুলশয্যা থেকে উঠে প্রাণাধিক প্রিয় রাধাকে সান্ত্বনা দিলেন। তাঁর মুখ পরিষ্কার কাপড়ের আঁচল দিয়ে মুছিয়ে শান্ত ভাবে মিষ্টি কথায় বললেন, যে হেতু তাকে বৃন্দাবনে যেতে হবে, সেহেতু সে রাসের অধিষ্ঠাত্রী দেবী তার রাসমণ্ডলে থাকতে হবে। গ্রামে দেবতারা যে ভাবে থাকে সেভাবে থাকতে হবে।

কৃষ্ণ রাধার কাছে বিদায় চাইলেন। অকুরের আসার খবর জানতে পেরে কৃষ্ণ রাধাকে জড়িয়ে ধরে চলে যেতে প্রস্তুত হলেন রাধা। শ্রীকৃষ্ণকে চলে যেতে দেখে ব্যাকুল হয়ে বললেন, আমার ওপর আপনার ভালবাসা ও আমার সৌভাগ্য সব কি শেষ হয়ে গেছে? আপনি এই বিরহ কাতর দুঃখী অবলা কে গভীর শোক সাগরে ফেলে কোথায় যাবেন? আমি ঘরে যাব না আপনাকে ছেড়ে।

দিন রাত ‘কৃষ্ণ কৃষ্ণ’ বলে আমি বনে সময় কাটাব। আমি আগে গর্গমুনির কাছে আপনার খবর শুনে আপনাকে জেনেও আপনার মায়ায় মুগ্ধ হয়ে ব্রহ্মার রোষানলে প্রেম বা ভক্তিভরে কোনো কথা বলতে পারিনি। আপনি আমায় ত্যাগ করলে আমার কলঙ্ক হবে। বিনাশ ঘটবে আপনার সন্তান সন্ততিদের। রাধা এই বলে শোকার্ত হয়ে মাটিতে পড়ে জ্ঞান হারালেন।

দয়াময় কৃষ্ণ রাধাকে অজ্ঞান হতে দেখে তাকে চেতনা সম্পন্ন করলেন ও বুকে তুলে ধরলেন। দুঃখহারক যোগের কথা বলে তাকে নানা সান্তনা দান করলেও তার শোক দূর হল না। মানুষের সামান্য বস্তুর বিয়োগও শোকের কারণ হয়, তখন দেহ ও আত্মার বিচ্ছেদ কার ভাল লাগে? কৃষ্ণ ব্রজে না গিয়ে রাসের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। রাধা তখন ফুল ও চন্দনে সেজে সেই নির্জনে চন্দনমাখা ফুলের বিছানায় স্বামীর অপেক্ষাতে বসে রইলেন।

৬৯.

কৃষ্ণ পুনরায় কামার্ত হয়ে বিদগ্ধ রাধার সাথে রমণে প্রবৃত্ত হলেন। পিতৃগণের মানসী কন্যা পাণ্ডুর প্রিয় শিষ্য ধন্য মান্য মালিনী, জ্ঞানী শতকল্পজীবী বেদ বেদাঙ্গ শাস্ত্রে নিপুণ, শ্রেষ্ঠ সিদ্ধ যোগিনী, নানারূপধারী, প্রসিদ্ধ, সাধ্বী রাধামাতা কলাবতী যেমন চৌষট্টী কলায় আসক্ত, কামশাস্ত্রে নিপুণ, বিদগ্ধ, রসিকেশ্বরী স্থিরযৌবন তাঁর মেয়ে রাধার মধ্যেও সেইসব গুন বর্তমান এবং সব দিক থেকে মায়ের মত কামুকী ও সুশীলা।

বিহার সময়ে রাধাও স্বামীর প্রতি নানা কামভাব প্রকাশ করতে লাগলেন। কৃষ্ণ রাধার সাথে রাসে চৌষট্টি কলার সাহায্যে বিহার করতে লাগলেন। কৃষ্ণের নখের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হল রাধার শ্রোণি ও স্তন। সুখ সম্ভোগে নিমগ্ন নগ্না মূৰ্ছিতা রাধার দেহে পুলক সঞ্চারিত হল, রাধা ঘুমিয়ে পড়লেন।

কৃষ্ণ বুকে করে নিয়ে তাঁকে চুমো খেলেন। এবং অতি সূক্ষ্ম মূল্যবান দুর্লভ কাপড় পড়িয়ে খোলা চুল কবরীবদ্ধ করলেন। তাঁর গায়ে কুমকুম, চন্দন, গলায় অমূল্য রত্নহার ও সিঁদূর দিলেন। গলায় নানা চিত্রবিচিত্র পত্রাবলি রচনা করে পাদপদ্মে রজ্ঞিত রত্ননূপুর পরিয়ে পায়ের আঙ্গুলের নখে আলতা মাখালেন।

মোহের বসে গাঢ় আলিঙ্গন করলেন। বিরহে কাতর হয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে বার বার চুমো খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। ব্রহ্মা ও শিব সেখানে বসে এই প্রেমময় কার্যাবলি দেখে সামবেদোক্ত স্তব রলেন। ব্রহ্মা বললেন, আপনার চরণ প্রার্থনা করি। আপনি শরণাগতকে রক্ষা করেন ও ভক্তবৎসল বলে সব সময় ভক্তদের অনুগ্রহ করার জন্য ব্যস্ত থাকেন। জগৎপালক কৃষ্ণকে এ ভাবে স্তব করে ব্রহ্মা বারবার তাকে প্রণাম করে অত্যন্ত প্রেমবশতঃ মূৰ্ছিত হলেন। ব্রহ্মার করা স্তব যে এক মনে শোনে–তার মনের সকল বাসনা পূর্ণ হয়। পুত্র হীন পুত্র পায়, প্রিয়াহীন প্রিয়া পায়, ধনহীন ধন পায়। ব্রহ্মা আবার বলতে লাগলেন, হে দেবশ্রেষ্ঠ, পরমানন্দ নন্দনন্দন, হে নিত্যানন্দ, আপনাকে প্রণাম, আপনি একশো বছর ব্যাপী শ্রীদামের শাপ স্মরণ করে বৃন্দাবন ছেড়ে এখন নন্দের বাড়ী যান।

ভক্তের শাপের অনুরোধে একশো বছর প্রিয়াকে ত্যাগ করুন। পিতৃগৃহে গিয়ে মান্যগমণ্য পরম বৈষ্ণব অতিথি পিতৃব্য অক্রুরকে দান করুন। মধুপুরীতে গিয়ে মহাদেব ধনুক ও শত্রুদের নাশ করুন। দুরাত্মা ও কংসকে বধ করে পিতামাতাকে সান্ত্বনা দিন এবং দ্বারকাপুরী তৈরী ও পৃথিবীর ভার লাঘব করুন। আপনি পুড়িয়ে দিন মহাদেবের বারাণসী, ইন্দ্রকে দমন করুন, বান যুদ্ধে শিবের জম্ভন, বাণ রাজার হস্তছেদন, রুক্মিণীকে হরণ, নরকাসুরকে হত্যা ও ষোলো জন স্ত্রীর পাণি গ্রহণ করুন। প্রাণপ্রিয়াকে ত্যাগ করে এখন ব্রজে চলুন। রাধা জাগার আগে আপনি যাত্রা করুন। আপনার মঙ্গল হবে।

এদিকে রাধা ঘুম থেকে উঠে হরির অদর্শনে ‘নাথ, প্রাণবল্লভ’ বলে কাঁদতে লাগলেন। পরে মালতী বনে গিয়ে উপস্থিত হলেন। ভূমিতে মৃতবৎ পড়ে রইলেন। শত সহস্র গোপী পাখা বা চন্দনগোলা নিয়ে সেখানে উপস্থিত হল। রাধার এক সখী তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। জলসমেত পদ্ম পাঁকের উপর রেখে তার ওপর নিশ্চল রাধাকে স্থাপন করলেন। সখীরা সাদা চামরের বাতাস করতে লাগল। কৃষ্ণ শেষে রাধার কাছে এসে তাঁকে কোলে করে জ্ঞান ফিরিয়ে আনলেন। রাধারও বিরহ, বেদনা দূর হল। নারীর বন্ধুদের মধ্যে বাবা, মা ও ভাই হল তার প্রিয়। তাদের থেকে বেশি প্রিয় পুত্র। তার চেয়েও বেশি প্রিয় হল স্বামী, সতী নারীর কাছে স্বামীই শ্রেষ্ঠ। বিদূষী নারীর কাছে স্বামী অপেক্ষা প্রিয় আর কেউ নেই। এই সংসারে দম্পতির প্রীতি ও সমতা হলেই পরম প্রেম ও সৌভাগ্য হয়।

আর সেখানে সম্প্রীতি নেই সেখানে লক্ষী বাস করে না। মনের মত স্বামীর থেকে বিচ্ছেদ নারীর পক্ষে ভীষণ দুঃখজনক এবং তা শোক সন্তাপের কারণ। নারীর কি স্বপ্ন, কি জাগরণ, সকল অবস্থাতেই পতি-প্রাণস্বরূপ। রাধা জ্ঞান হারিয়ে ঘাসময় মাটিতে পড়েছিলেন। রাধার, সকল শরীর বিরহানলে দগ্ধ লৌহশলাকার মত উত্তপ্ত ও আগুনের মত অস্পৃশ্য হয়ে উঠল। পরে সজল পদ্মফুল পাঁকে বিন্যস্ত করে সেই শয্যায় বিরহ কাতর রাধাকে শোয়ান হলো। কিন্তু শ্রীদামের শাপে আমরা না চাইলেও অবশ্যই বিচ্ছেদ ঘটবে।

জেগে থাকা অবস্থায় আমাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটবে। কিন্তু আমার বরে ঘুমন্ত অবস্থায় সব সময় মিলন হবে। তাতেই তার শোক দূর হবে। এখন রাধাকে সান্তনা দেয়। তোমার মঙ্গল হবে।

কৃষ্ণ চলে গেলে সখীরা রাধাকে সান্ত্বনা দিতে থাকলেন। কৃষ্ণ বাড়ি গিয়ে বাবাকে-মাকে প্রণাম করে মায়ের কোলে উঠে ননী খেয়ে বালচাপল্য দেখাবার জন্য মহা আনন্দে মায়ের দেওয়া তাম্বুল মাকে ফিরিয়ে দিলেন।

৭০.

অক্রুর নিজের বাড়িতে গিয়ে ভালো খাবার দাবার খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। পরে ঠান্ডা জল পান করে কর্পূর মিশ্রিত তাম্বুল খেয়ে মনের সুখে ঘুমিয়ে পড়লেন। অক্রুর শেষ রাতে এক সুস্বপ্ন দেখলেন।

তিনি দেখলেন শ্যামদেহ কিশোর এক ব্রাহ্মণ সন্তান। তার এক হাতে বাঁশী, পরণে পীত বসন, গলায় বনমালা, তার সকল দেহ চন্দন, মালতীমালা ও শ্রেষ্ঠ রত্নলংকারে তার শোভা বাড়িয়ে তুলেছে। মাথায় তার ময়ূর পেখম। এক সুন্দরী সতী নারীকে দেখতে পেলেন। তার পরণে পীতবসন, সকল দেহ রত্নলংকার, সেই মুখে ঈষৎ হাসি, তার এক হাতে প্রদীপ, অন্য হাতে সাদা ধান। পরে দেখলেন, এক সাদা সাপ ফণা তুলে দংশন করতে উদ্যত।

নিজে কখনও পাহাড়ে, কখনত্ত গাছে, কখনও হাতীতে, কখনও নৌকায় বা কখনও ঘোড়ায় উঠেছেন। পরে আপনি কখনও বীণা বাজাচ্ছেন, কখনও পায়েস খাচ্ছেন, কখনও বা দুধ ক্ষীর সমেত অন্ন পদ্ম পাতায় রেখে খাচ্ছেন। অঙ্কুর এই শুভ স্বপ্ন দেখে উঠে, আহ্নিক শেষ করে, উদ্ধবকে সকল ঘটনা বললেন।

উদ্ধবের আদেশে গরুকে অর্চনা করে, মনে কৃষ্ণের ধ্যান করে যাত্রা শুরু করলেন। পথে বেরিয়ে মঙ্গল জনক ইষ্টফলদায়ক সুন্দর সকল বিষয় লক্ষ্য করলেন। বাঁদিকে মরা, শিবা, পূর্ণ কলস, নকুল, চাতক পাখি দিব্য অলংকারে সজ্জিত পতিপুত্রবতী সতী নারী, সাদা ফুল ও তার মালা, ধান, খঞ্জনা পাখি, ডানদিকে জলন্ত আগুন, ব্রাহ্মণ, হাতী, সবৎসাগাভী, হরিণ, কৃষ্ণসার, ফল, খই, সাদা সরষে, শুক ও সারস প্রভৃতি লক্ষ্য করলেন।

শ্রীহরিকে স্মরণ করে পবিত্র বৃন্দাবনে ঢুকলেন ও রাসমণ্ডল দেখতে পেলেন। তার প্রবেশদ্বারে কলাগাছ রয়েছে। তার নীচে মঙ্গলঘটে সুতোয় বাঁধা বিচিত্র আমের পল্লব। সেখানে তিনকোটি রত্নমান্দির শোভা বিস্তার করেছে। বিশ্বকর্মা ঐ নন্দালয় শ্রেষ্ঠ মণি দিয়ে তৈরি করেছিলেন।

সেখানে ছিল রত্নস্তম্ভ, আর নানা বিচিত্র রত্নপ্রাচীর। অক্রুর নন্দের বাড়ির সামনে এসে হাজির হলেন। আসার খবর পেয়ে গোপরাজ নন্দ অত্যন্ত আহ্লাদিত হয়ে কৃষ্ণ, বলরাম, বৃষভানু প্রভৃতি আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে পূর্ণ কলস, শ্রেষ্ঠ হাতী ও সাদা ধান দিয়ে ও কালো গরু, মধুপর্ক পাদ্য ও রত্নাসন প্রভৃতি নিয়ে সাদরে হাসিমুখে দরজায় এলেন।

নন্দ তাঁকে দেখে জড়িয়ে ধরলেন এবং গোপিরা অক্রুরকে প্রণাম করে তাঁর আর্শীবাদ নিলেন। অক্রুর কিছুক্ষণ কৃষ্ণকে দেখলেন। পরক্ষণেই তিনি দেখলেন সেই কৃষ্ণ দেব ত্রিলোচন পঞ্চবক্ত শুদ্ধস্ফটিকসংকাশ নাগরাজ বিরাজিত পরম ব্রহ্ম দিগম্বররূপে তার কোলে রয়েছেন, তার দেহ ভস্ম মাখা। মাথায় জটা, তিনি জপমালা নিয়ে ধ্যান করছেন। অক্রুর তাকে দেখে প্রণাম ও স্তব করে বললেন। আপনি সকল দেবতাদের ঈশ্বর ও সকল দেবতাদের মত ও তাঁদের অধিদেবতা। আপনি রাধার আরাধ্য দেবতা। অক্রুর স্তুতি করে কৃষ্ণপ্রেমে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন। সেই পরমাত্মা পরমেশ্বরকে হৃদয়ের মধ্যে ও বাইরে শ্যামরূপে বিরাজ করতে দেখলেন, ফলে সকল বিশ্বই তাঁর কাছে কৃষ্ণময় বলে মনে হল।

৭১.

গোপিনীরা ও রাধা সেই সুন্দর বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে রাত তিন প্রহর কেটে গেলে শুভ তারাও অমৃত যোগ সমন্বিত এক শুভক্ষণে ও শনৈশ্চরের দৃষ্টিসম্পন্ন পাপগ্রহের দৃষ্টিশূন্য বুধলগ্নে হরি নিজে গাত্রোত্থান করে যশোদাকে ডেকে তুলে মঙ্গলাচরণ করলেন। পরে কাপড় পরে পা ধুয়ে চন্দন মাখা জায়গায় বসলেন। পরে গুরুর দেওয়া মঙ্গলময় দুর্বাকাণ্ড, ফুল ও শুক্ল ধান নিয়ে নিজে মাথায় রাখলেন। তারপর সর্বত্র মঙ্গলময় মঙ্গলরূপ ধ্যান করে সুন্দর ডান পা মাটিতে রাখলেন। পরে ভগবান, মধ্যমা দিয়ে নাকের ডানফুটো দিয়ে ইষ্টবায়ু রেচন করলেন। নিত্যানন্দ মহানন্দে নন্দের বাড়িতে উপস্থিত হলেন। তিনি নিত্যবীজ নিতঙ্গ্যভূত, প্রেম নিত্য, নতুন ও প্রাপ্তি সৌভাগ্য নিত্য নতুন। তার বাক্য অমৃত থেকেও মিষ্ট। কৃষ্ণ অক্রুরও বান্ধবদের নিয়ে কিছুক্ষণ থাকার পর, যশোদা মায়ার বশে তাঁকে বাঁ দিকে আলিঙ্গন করলেন। পরে কৃষ্ণকে সানন্দে নন্দ বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বন্ধুরা মিষ্টি কথা বলল, বাবা, মা তাকে চুমো খেলেন।

৭২.

শ্রীকৃষ্ণ গুরুকে প্রণাম করে নন্দের গৃহ থেকে বেরিয়ে দিব্যযানে চড়ে মথুরার উদ্দেশে যেতে লাগলেন। অক্রুর ও স্বজনের সঙ্গে অমরাবতীর থেকে সুন্দর রমণীয় মথুরা পুরীতে গিয়ে দেখলেন, বিশ্বকর্মার তৈরি ওই পুরীতে সাজানো রয়েছে অমূল্য রত্নময় কলস, সেখানে আছে শত শত রাজপথ। ঐ রাজপথের স্থানে স্থানে চন্দ্রের আকারের চন্দ্রকান্ত মণি শোভা পাচ্ছে। আর মধ্যে মধ্যে বণিকদের দোকানে শ্রেষ্ঠ মণি নির্মিত পণ্য সম্ভারে পূর্ণ। রতিবাস বিশারদ কামাসক্ত সেই নারীদের শ্রেণি ও স্তন অত্যন্ত মাংসল, কোমর সরু ও অঙ্গ অত্যন্ত কোমল। নগরীর ফুলের বাগান ফুলে পরিপূর্ণ।

দারুণ মনোরম হয়ে উঠেছে স্থানটি। সেখানে মৌমাছি যুগলরা সব ফুল উড়ে বেড়াচ্ছে। বিশ্বকর্মার তৈরি উৎকৃষ্ট বিচিত্র রত্ন তিন কোটি অট্টালিকা সেই নগরীর শোভা বাড়িয়ে দিয়েছে। কমললোচন হঠাৎ মথুরার এই রকম শোভা দেখতে দেখতে যাওয়ার সময় পথে এক বৃদ্ধ কুজো মহিলাকে দেখলেন। চলার সময় তার গায়ের লাল চামড়া ঝুলে পড়ছে। বুড়ি হঠাৎ কৃষ্ণকে দেখে হাত জোড় করে ভক্তি ভরে মাথা নুইয়ে প্রণাম করে কৃষ্ণের শ্যামদেহে, সেই সোনার পাত্রের চন্দন মাখিয়ে দিল। পরে তাঁর সাথীদের গায়েও ঐ রূপ চন্দন মাখিয়ে কৃষ্ণের চারিদিকে ঘুরে বারবার প্রণাম করতে লাগল। পরে সেই কুঁজোর দিকে কৃষ্ণের নজর পড়া মাত্র সে লক্ষ্মীর সমান রূপ লাভ করল। তখন সে অগ্নি শুদ্ধ কাপড় ও রত্নলংকারে সজ্জিত হয়ে সুন্দরী ধন্য বারো বছরের মেয়ের মত সৌন্দর্য ধারণ করল।

তার গলার শোভা পেল অমূল্য রত্নের হার, পায়ে রত্ন নুপূর, গতি হল গজরাজের মতো ধীর, খোঁপায় মালতী মালা শোভা পেল। রতি কাজে পারদর্শিনী কুঁজো বুড়ি রত্নদর্পণ হাতে নিয়ে দাঁড়াল তার চঞ্চল চোখের চাহনিতে কৃষ্ণের প্রীতি জন্মাল। কৃষ্ণ তাকে আশ্বাস দিয়ে অন্য জায়গায় চলে গেল। কৃষ্ণ পথে এক সুন্দর মালাকারকে সুন্দর মালা নিয়ে রাজমন্দিরে যেতে দেখলেন। কৃষ্ণকে দেখে সে সকল মালা তাঁকে দান করল। এরপর কৃষ্ণ যৌবন মদমত্ত এক ধোপাকে দেখলেন। সে অনেক কাপড় নিয়ে যাচ্ছিল। কৃষ্ণ তার কাছে কাপড় চাইলে সে বহু কথা বলতে লাগল। সে বলল, এইসব কাপড় রাজাদের জন্য গোপালকদের জন্য নয়।

সদ্ গুণময় শ্রীকৃষ্ণ এক চড়ে সেই ধোপাকে বধ করে তার সকল কাপড় নিয়ে সাথীদের পরিয়ে দিলেন। সেই রজক স্থির যৌবনযুক্ত, জরা-মৃত্যু-শূণ্য, পীতবসনধারী সস্নিত শ্রেষ্ঠদিব্য দেহ ধারণ করে কৃষ্ণের সহচরদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে গোলোকধামের উদ্দেশে যাত্রা করলেন। সূর্য অস্ত গেলে অক্রুর নিজের বাড়ি ফিরে গেলেন। কৃষ্ণ কুবিন্দ নামে কোনো এক বৈষ্ণবের ঘরে মহানন্দে নন্দ, বলদেব ও অন্যান্য রাখাল বালকদের সঙ্গে মিলিত হলেন। কুবিন্দ কৃষ্ণকে প্রণাম ও পূজা করলে শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে ব্রহ্মা প্রভৃতিরও দুর্লভ নিজের দাস্য রূপ বর দিলেন। সকলে খাওয়া দাওয়া করে পালঙ্কে শুয়ে ঘুমালে কৃষ্ণ সেখানে গিয়ে কুজীর ঘুম ভাঙলেন।

তিনি বললেন–যে, পূর্বজন্মে সে ছিল শূর্পনখা। তাই সে রামকে না পেলেও এখন যেন কৃষ্ণের প্রাপ্তির জন্য ভজনা করে। কৃষ্ণ তখন কুমারী কুঁজীকে বুকে ধরে নগ্ন করে শৃঙ্গার উপভোগ করতে লাগলেন। ক্ষতবিক্ষত হল তার স্তন, শ্রোণি ও ঠোঁট, কৃষ্ণ বীর্য দান করলে কুঁজী সম্ভোগ সুখে মূচ্ছা যায়। কুঁজী অগ্নিশুদ্ধ কাপড় পরে রত্ন ভূষণে সজ্জিত হয়ে গোলক থেকে আসা রত্ন রথে চড়ে গোলোকে যাত্রা করলেন। কংস এদিকে এক মৃত্যুসূচক দুঃস্বপ্ন দেখল। সে দেখল, সূর্য আকাশ থেকে নেমে চার টুকরো হয়ে মাটিতে পড়েছে, চাঁদ আকাশচ্যুত ও মাটিতে পড়ে দশ টুকরো হয়েছে, আর বিকট আকারের পুরুষরা বজ্র হাতে দাঁড়িয়ে আছে।

এক উলঙ্গ নাকহীন শূদ্ৰপত্নী তার নজরে এল। যার জিভ লাল, হাতে খাঁড়া, পরনে সাদা কাপড়। পরে গাধা, মোষ, ষাড়, শুয়োর, ভাল্লুক, কাক, কুমীর, ছাইয়ের গাদা, শশ্মনের পোড়াকাঠ ও এক দুষ্ট লোক উলঙ্গ শূদ্রকে দেখল। তাছাড়া দেখল কোন কবন্ধ লাঠি নিয়ে দৌড়াচ্ছে, দেখল যেন গুরু ব্রাহ্মণ রেগে গিয়ে অভিশাপ দিচ্ছেন এবং ভিখারী যোগীও বৈষ্ণব পুরুষ তার উপর অত্যন্ত রেগে রয়েছেন। এমন দুঃস্বপ্ন দেখে কংস বিছানা ছাড়ল। সকলের কাছে স্বপ্নের ঘটনা প্রকাশ করল। তার স্ত্রী কাঁদতে লাগল। কংস সভায় মঞ্চ তৈরি করে, মূল হাতাঁকে দরজায় রেখে, যুদ্ধ অভিজ্ঞ মল্লযোদ্ধাদের মঙ্গলাচরণ ও ব্রাহ্মণদের দিয়ে মঙ্গলকর পুণ্য স্বস্ত্যয়ন করিয়ে সযত্নে উপযুক্ত পুরোহিতদের যজ্ঞে নিয়োগ করল।

ধারালো খড়গ নিয়ে মঞ্চে এসে পারদর্শী যোদ্ধাদের যুদ্ধে নিয়োগ করল। গোবিন্দ বলদেবের সঙ্গে সেখানে এসে ধনুগৃহে প্রবেশ করে সেই ধনুক ভেঙে ফেললেন। তার শব্দে মথুরার লোকেরা কালা হয়ে গেল। কৃষ্ণ দরজায় দাঁড়ানো হাতী ও মল্লযোদ্ধাকে হত্যা করে সভায় এসে উপস্থিত হলেন। তখন সকল যোগী পুরুষরা সেই পরমাত্মা কৃষ্ণকে হৃদয়ের মধ্যে ও বাইরে একরূপ দর্শন করতে লাগলেন।সবাই বাসুদেব ও দেবকীর সন্তানই বালককে দেখতে লাগলেন। কামিনীর রূপ কোটি কর্পের লাবণ্যের আধার রূপে তাকে দেখতে লাগল, কংস তাকে দেখল কালপুরুষ রূপে। কংসের বন্ধুরা তাঁকে দেখল শত্রুরূপে।

৭৩.

কৃষ্ণ বলরাম দুঃখে বাবা নন্দকে আধ্যাত্মিক প্রভৃতি দিব্যযোগ বলে সান্তনা দিতে লাগলেন। তাকে কাঁদতে দেখে কৃষ্ণ বললেন, শুনুন পিতা, আমি পূর্বে পুষ্কর তীর্থে ব্রহ্মা, অনন্ত, গণেশ, কামদেব, সূর্য মুনীন্দ্র ও যোগীন্দ্রদের যে জ্ঞান দিয়েছি তারা তাদের কর্মফলের তারতম্যের জন্যই বিভিন্ন জায়গায় জ্ঞান লাভ করে। সকলে আমার মায়ার প্রভাবেই বিষয় ভোগে আনন্দ লাভ করে ও ধন সম্পদের হানিকে মৃত্যুর মতো মনে করে বিষাদগ্রস্ত হয়। কেবলমাত্র বোকারাই শোক পায়, আর যারা আমাকে ভজনা করে সজিতেন্দ্রিয়, তারা পবিত্র ভক্তিমান, তারা কোন সময়ই শোক তাপ পায় না। আমার ভয়ে বায়ু বয়ে চলেছে, চন্দ্র সূর্য ঠিক সময়ে কিরণ দিচ্ছে, বিভিন্ন সময়ে ইন্দ্র বৃষ্টি দান করেছেন, আগুন পোড়াচ্ছে, মৃত্যু বিচরণ করছে সকল জীবের মধ্যে।

সকল গ্রহের আধার আর ব্রহ্মাণ্ড ছাড়া বৈকুণ্ঠ নিরাধার। সেই বৈকুণ্ঠের পঞ্চদশ কোটি যোজন উপরে শ্রেষ্ঠ রত্নে তৈরি নিরাধার গোলোকধাম অবস্থিত। সেখানে আছে সাত দরজা, সাত সাগর ও সাত পরিখা, লক্ষ পাঁচিল ও বিরজা নদী, তাকে ঘিরে আছে শত শৃঙ্গ নামে এক সুন্দর রত্ন পাহাড়।

ঐ পর্বতে অমূল্য রত্ন নির্মিত চাঁদের ছাওয়ার মতো গোল অযুত যোজন চওড়া রাসমণ্ডল আছে। সেখানে আছে একশো সুন্দর ফুলের বাগান।

সেখানে আছে তিন কোটি রত্নভবন, রত্নপ্রদীপ ও রত্নকলস। ঐ শিবিরে মোট ষোলোটি ঘর যার প্রত্যেক দরজায় ষোলো লক্ষ গোপিকা ইতস্ততঃ বেড়াচ্ছে। তাদের পরনে অগ্নিশুদ্ধ কাপড় ও সকল অঙ্গ রত্ন ভূষণে উজ্জ্বল।

ঐ প্রাঙ্গনে ফুল-ফল-পাতা সমেত রত্নময় মঙ্গলকলস রত্নবেদী শোভিত ঘর শোভা পাচ্ছে, কোথাও অমূল্য রত্ন-দর্পণ, কোথাও অমূল্য রত্নে তৈরি অলঙ্কার দেখা যাচ্ছে। রত্ন শোষকের সাজে সজ্জিত রাধাকে সখীরা সাদা চামর দুলিয়ে বাতাস করছে।

রাধা শ্রীদামের শাপে বৃষভানুর কন্যা হয়ে জন্মেছে এবং শাপের ফলেই আমার সাথে তার একশো বছর ধরে বিচ্ছেদ ঘটবে। এখন তোমার সাথে এবং যশোদা, গোপগোপী, বৃষভানু ও তার স্ত্রী কলাবতী ও বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে সেই গোলোকে মিলব। প্রকৃতি আমার থেকে আলাদা অথবা আমিই সেই প্রকৃতি। সাদা রঙ আর দুধ-এর মধ্যে যেমন কোনো পার্থক্য নেই সে রকম আমাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, যেমন জল ও তার শীতলতার মধ্যে, পোড়বার ক্ষমতার মধ্যে আগুন, আকাশ ও শব্দের মধ্যে, সূর্য ও কিরণের মধ্যে এবং আত্মা ও জীবের মধ্যে কোনো ভেদ নেই, সেইরূপ রাধা ও আমার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। তুমি রাধার মধ্যে গোপিকাবুদ্ধি ও আমার মধ্যে পুত্রবুদ্ধি পরিত্যাগ কর– কারণ আমি আদিপুরুষ ও রাধা সর্বেশ্বরী প্রকৃতি।

এখন সানন্দে আমার সেই সুখকর বিভূতির কথা শোন। আমি অক্ষরের মধ্যে অ-করে আবার বেদের মধ্যে সামবেদ। দিকের মধ্যে ঈশান। খাদ্যের মধ্যে অমৃত। গাব্যের মধ্যে ঘি। নদীর মধ্যে গঙ্গা। বিদ্যার মধ্যে বীজ। শস্যের মধ্যে ধান। বনস্পতির মধ্যে অশ্বত্থা। প্রজাপতিদের মধ্যে কশ্যপ।

শিল্পীর মধ্যে বিশ্বকর্মা। মৃগের মধ্যে মৃগরাজ। বৃষের মধ্যে শিবের বাহন, হাতীর মধ্যে ইন্দ্রের ঐরাবত, মন্ত্রের মধ্যে গায়ত্রী, অপ্সরার মধ্যে ঊর্বসী, সমুদ্রের মধ্যে জলসমুদ্র, পর্বতের মধ্যে সুমেরু, দেবীর মধ্যে লক্ষ্মী। প্রিয়ার মধ্যে রাধা, সাধ্বী নারীর মধ্যে বেদমাতা সাবিত্রী, দৈত্যের মধ্যে প্রহ্লাদ। বানরের মধ্যে হনুমান, পাণ্ডবদের মধ্যে অর্জুন, নাগ কন্যার মধ্যে মনসা, বসুর মধ্যে দ্রোন, মেঘের মধে দ্রেনামেঘ, সুন্দরীদের মধ্যে রম্ভা, রাক্ষসের মধ্যে বিভীষণ, রুদ্রের মধ্যে কালগ্নিরুদ্র ও ভৈরবীদের মধ্যে সংহার ভৈরব, বলিষ্ঠদের মধ্যে রাজা বলি।

বনের মধ্যে বৃন্দাবন, শঙ্খের মধ্যে পাঞ্চজন্য, ইতিহাসের মধ্যে মহাভারত, নগরীর মধ্যে কাশী, বনের মধ্যে চন্দন বন, পার্ষদের মধ্যে শ্রীদাম ও বন্ধুর মধ্যে উদ্ভব।

আমি গাছের ক্ষেত্রে তার অঙ্কুরের মত। সকল বস্তুতেই তার আকার হিসাবে থাকি, আমিও সব সময় সকল বস্তুতে আমি ও আমাতেও সকল বস্তু বিদ্যমান। আমিই সকলের ঈশ্বর। আমিও সবাইকে পালন করে থাকি কিন্তু আমার পালনকারী কেউ নেই।

আমিই কারণ ও কার্য। মনীষীরা আমাকে সর্বেশ্বর সর্বজয়ী বলে থাকেন। সকল পাপীরা আমার মায়ায় এতই মোহিত হয়ে থাকে যে তারা আমাকে জানতেই পারে না। পাপীরা দুর্বুদ্ধিবশতই সকল জন্তুর অন্তরাত্মাস্বরূপ আমাকে আদর না করায় ফলত নিজের আত্মাকেই অনাদার করে থাকে।

যেখানে আমি থাকি ক্ষুধা-তৃষ্ণা প্রভৃতি আমার যে সব শক্তি সেগুলিরও প্রকাশ সেখানেই হয়ে থাকে। ব্রজরাজ নন্দ কৃষ্ণের কাছে জ্ঞান লাভ করে, গোপালকদের সাথে ব্রজধামে গিয়ে নারীপ্রধান রাধা ও যশোদার কাছে সেই জ্ঞানগর্ভ উপদেশ বর্ণনা করলেন।

৭৪.

ক্ষিতি, অপ, তেজ, বায়ু ও আকাশ এই পাঁচটি পদার্থকে বেদে পঞ্চভূত বলা হয়েছে। সব জীবের দেহ এই পাঞ্চভৌতিক পদার্থ থেকে উদ্ভূত। তাই জীবদেহ হল পঞ্চভৌতিক। কর্মফলানুসারে কেউ স্বর্গে কেউ বা ব্রহ্মগৃহে, কেউ বা ব্রাহ্মণের ঘরে, কেউ ক্ষত্রিয়ের গর্ভে, কেউ বৈশ্যের ঘরে, কেউ শূদ্র জাতিতে জন্মায়। কেউ নিজের কর্মফলে নীচ যোনিতে বা পশু যোনিতে বা পাখি যোনিতে কেউ বা বিষ্ঠায় কৃমি হয়ে জন্মায়। যুগ হল চারিটি। সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি। এক মনুর পতন হয় এমন পঁচিশ হাজার যুগের অবসান হলে। ব্রহ্মার একদিন হল চোদ্দজন ইন্দ্রের জীবনকাল। কাল ও বছর হয় দিনানুসারে, একশো বছর হয় ব্রহ্মার পরমায়ুর। কিন্তু আমার নিমেষমাত্রে ব্রহ্মার পতন হয়। ব্রহ্মা থেকে আরম্ভ করে একটু টুকরো ঘাস পর্যন্ত সকল পদার্থেই মিথ্যা আর একমাত্র আমি ভক্তদের অনুগ্রহ করার জন্য শরীর ধারণ করেছি, এই সত্য। অমঙ্গল হয় না আমার ভক্তদের। তাদের সবদিক থেকে রক্ষা করে সুদর্শন চক্রই। এরপর কৃষ্ণ নন্দের কথা শুনে নিজে বেদাতীত আহ্নিকাকৃত্য বর্ণনা করতে লাগলেন।

৭৫.

মুক্তি পথের বাঁধা স্বরূপ ভ্ৰমমায়াময়ী কুলটা নারীকে কখনই বিশ্বাস করা উচিত নয়। হরিভক্তি বিনাশের মূল কথা। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আমার ভক্ত গৃহীরা বাসি কাপড় ছেড়ে গুরুদেবকে চিন্তা করে প্রাতঃকৃত্য সেরে পরিষ্কার জলে স্নান করবে। কোনো রকম সংকল্প করবে না। বুদ্ধিমান ভক্ত কর্মের বন্ধন থেকে মুক্ত হতে চাইলে স্নান করে হরিচিন্তা করে সন্ধ্যা বন্দনা করে ঘরে ফিরে যাবে। হাত পা ধুয়ে কাঁচা কাপড় পরে ঘরে ঢুকবে। তারপর গোষ্ঠ বা চন্দনের তৈরি অর্কদল পদ্মে মুক্তির কারণ পরমাত্মা আমাকে পুজো করবে।

পরে সেই সাধক শ্রীদাম, সুদাম, বসুদাম, বীরভানু ও শূরভানু এই পাঁচ গোপ, আর কার্তিক ও গণেশের পূজা করবে। বিঘ্ননাশের জন্য গণেশের, ব্যাধি নাশের জন্য সূর্যের, অভীষ্ট প্রাপ্তির জন্য বহ্নির মোক্ষের জন্য বিষ্ণুর, জ্ঞান লাভের জন্য শিবের ও বুদ্ধি মুক্তির জন্য পার্বতীর পূজো করবে। আত্মশুদ্ধির জন্য কর্তব্য কর্ম করবে, ব্যাধির কারণ স্বরূপ বিষ্টা ও ঘোর নরক কারণ ব্যাধিবীজ স্বরূপ মূত্র ও লিঙ্গ ও দুঃখ দরিদ্রের কারণ যোনি। নারীর উরু, মুখ ও স্তন কটাক্ষ ও হাসি দেখবে না জ্ঞানী লোক। বিপদের হেতু ও ধ্বংসের কারণ নারীর রূপও।

আকাশে এক তারা দেখলে চোখ ও কানের রোগ হয়, ব্রাহ্মণ গোরু ও বিশেষ বৈষ্ণবদের হিংসাকর বা কোন হানিকর কাজ করবে না, করলে সর্বনাশ হয়। যে লোক নিজের দেওয়া অপরের দেওয়া ব্রহ্মার ধন চুরি করে, সে ষাট হাজার বছর বিষ্ঠার কৃমি হয়ে থাকে। ব্রহ্ম সম্পত্তি চুরি করার অপরাধে একশো জন্ম ভালুক, লক্ষ জন্ম শেয়াল ও বহুকাল জলের পোকা হয়ে থাকতে হয়। ব্রাহ্মণদের দিয়ে কাজ করিয়ে যদি কোনো দক্ষিণা না দেয় তবে একরাত পরে দ্বিগুণ দান করতে হয়। একমাস অতীত হলে একশো গুণ, দুমাস গত হলে হাজার গুণ, ও একশো বছরের মধ্যে না দিলে দাতা নরকগামী হয়। ব্রাহ্মণকে হিংসাকারী লোক বংশহানির শিকার হয় ও ভিখারী হয়ে দিন কাটায়। স্বামীকে হরি হিসাবে দেখে না যে নারী তার কুম্ভীপাক নরকে স্থান হয়। স্বামীর প্রতি রূঢ় বাক্য প্রয়োগকারী বানর হয়ে জন্মায়। খারাপ কথা বললে কুকুর ও খারাপ দৃষ্টিতে দেখলে অন্ধ হয়ে জন্মায়। পতিব্রতা নারী স্বামীর সাথে বৈকুণ্ঠে যায়। রৌরব নরকে স্থান মহামূর্খ নারীর। বাবা, মা, ছেলে, সতী স্ত্রী, গরু আর অনাথ মেয়েকে অন্ন না দিলে নরকে যায়। ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র যাবতীয় লোকেদের যদি ব্রাহ্মণদের উপর ও হরির ওপর ভক্তি প্রবৃত্তি না থাকে তবে তারা নরক যন্ত্রণা ভোগ করবে। কোন ব্রাহ্মণ যদি পিতৃদেবের উদ্দেশ্যে নিবেদিত মাংস ভক্ষণ করে তবে সে অপবিত্র হয়ে যায় না। কিন্তু বৃথা মাংস ভোজন করলে তাকে যেতে হয় রৌরব নরকে।

কামের বশে মাছ খেলে ব্রাহ্মণের তিনরাত উপোস করার পর চাময় ব্রত পালন করে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। সে সর্বদাই অশুচি যে জ্ঞান কম হওয়ার জন্য কামনার বশে মাছ খায়। তার পূর্বের সকল পুণ্য নষ্ট হয়ে যায়। যে লোক মাছ, মাংস ত্যাগ করে প্রতিদিন বিষ্ণুর উচ্ছিষ্ট খেয়ে থাকে তার নিশ্চয়ই প্রতিপদে অশ্বমেধ যজ্ঞের সমান ফল লাভ হয়। একশো জন্মের পাপ নাশ হয় যারা একাদশী ও কৃষ্ণা জন্মাষ্টমী ব্রত পালন করে। যে লোক শিবরাত্রি ও শ্রীরাম নবমীর দিন উপোস করে না সে মহারৌরব নরকে যায়। চতুর্দশী ও অষ্টমীতে তেল মাংস সেবন করা লোক চন্ডাল হয়ে জন্মায়। প্রত্যেকেরই অনুচিত রবিবারে মাছ, মাংস আদা, লালশাক খাওয়ার। সকলের অনুচিত কাঁসার থালায় আহার করা, করলে কুম্ভীপাক নরকে যেতে হবে।

রজঃস্বলার দেওয়া খাবার যে ব্রাহ্মণ ভোজন করে, বেশ্যার দেওয়া খাবার ও অবীরার অন্ন খায় সে নিশ্চয়ই বিষ্টা ভোজন করে এবং সে নিত্যই অশুচি। যাবজ্জীবন তার এই অশৌচ, প্রত্যেক দিন সমস্ত কাজ করেও কোন কিছুর ফল পায় না। কোনো নারী অন্য পুরুষের কাছে যায়, সে বেশ্যা। যে ব্রাহ্মণ শূদ্রের শ্রাদ্ধের দিন সেই শ্রাদ্ধের খাবার খায়, সে ব্রাহ্মণ পরমায়ু পর্যন্ত কুম্ভীপাক নরকে যন্ত্রণা ভোগ করে। শূদ্রের শ্রাদ্ধের দিন শূদ্রের কথা অনুযায়ী অন্য জায়গায় খেলেও তাকে সকল ধর্ম থেকে বহিস্কার করা হয়। কলম দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করে, শূদ্রের শবদাহ করে ও যারা শূদ্ৰাপতি ব্রাহ্মণ । তাদেরও শূদ্রের মত সকল ব্রাহ্মণের কাজ থেকে বহিস্কার করা উচিত।

সন্ধ্যাবন্দনা যে করে না, তার কোনো কাজে অধিকার থাকে না। ব্রাহ্মণ যদি বিষ্ণু পূজো না করে, চন্ডালের সমান হয় ও নারী মন্ত্রের উপাসনা করলে নরকগামী হয়। জ্ঞানী লোক নদীর বুকে, দেবতার কাছে, শস্যক্ষেত্রে মল ত্যাগ করবে না। যে দিনের বেলায় ও উভয় সন্ধ্যায় সময়ই ঘুমায়, বা স্ত্রী সম্ভোগ করে, সে সাতজন্ম গরীব হয়। যাদের আমি ভালবাসি তাদের মধ্যে সব থেকে প্রিয়। ব্রাহ্মণ, আর তার থেকেই বেশি প্রিয় হল রাধা। রাধার থেকেও ভক্ত এবং ভক্তের থেকে বেশি প্রিয় শিব। যারা মহাদেবের নাম উচ্চারণ করে, তাদের নাম শোনার জন্য আমি তাদের পিছু ছুটি, আমার মন ভক্তের কাছে, প্রাণ রাধার কাছে ও আত্মা শিবের কাছে থাকে।

যে আদ্যাশক্তি সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয় ঘটায়, যার দ্বারা জগৎ সৃষ্টি হয়েছে আমি সেই শক্তি শিবকে দান করেছি। বৈকুণ্ঠে তিনি মহাসতী লক্ষীরূপে, গোলকে সতী রূপে ও ক্ষীরোদ সাগরে মরু লক্ষীরূপে বিরাজ করছেন, দুর্গার স্বপ্নের লক্ষ্মী হয়ে ইন্দ্র প্রভৃতি দেবতাদের ঘরে ঘরে রয়েছেন। দুর্গাই আমাদের রাজলক্ষ্মী, ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে তাদের লাভ ও সংসার সমুদ্র পারের তত্ত্ব ও জ্ঞানবানদের সদবুদ্ধি ও মেধাশক্তি। বেদের তিনি ব্যাখ্যা শক্তি ও দাতাদের দানের শক্তি। ব্রাহ্মণের প্রতি ভক্তি ও সতীদের স্বামী ভক্তি। তোমার কাছে আমি সব বললাম এখন তুমি কোন্ বিষয়ে শুনতে চাও।

৭৬.

লোক যদি সৎ ব্রাহ্মণ তীর্থ, বৈষ্ণব, ও দেবতার প্রতিমার দেখে তবে তীর্থ স্নানের ফল লাভ করে, ভক্তি ভরে সূর্য, সতী, নারী, সিংহ, সাদা ঘোড়া, ময়ূর, সোনা, মণি, মুক্তো, হীরে, তুলসী ও সাদা ফুল দেখলে পাপ নাশ হয়। মানুষ যদি সাদা ধান, ফল, দই, ঘি, মধু, পূর্ণকলসী, সাদা ফুলের মালা দেখে তবে পুণ্য হয়। সরোবর ও ফুলময় বাগান দেখলেও পুণ্য হয়। পতাকা, দেবতাকে দেওয়া শুভ অক্ষয়বট গাছ, মন্দির ও দেবস্থান দেখলে মানুষের পুণ্য হয়। শাঁখ ও দুন্দুভির শব্দ শুনলেও মানুষের পুণ্য হয়। তপস্বীদের স্নিগ্ধ মন্ত্র শোনা এবং সমুদ্র, কালোহরিণ দর্শনে মানুষের পুণ্য হয় পাকা শস্যের ক্ষেত্র দেখলেও পুণ্য হয়।

আশ্বিন মাসের শুক্লাপক্ষের অষ্টমী তিথিতে দুর্গা প্রতিমা দর্শন করলেও পুনর্জন্ম হয় না। দ্বাদশীর দিন সকালে স্নান করে কাশীধামে অন্নপূর্ণা দর্শন করলে জন্ম নিতে হয় না। রামনবমীর দিন অযোধ্যার রামরূপীকে পূজা ও দর্শন করলেও পুনর্জন্ম হয় না। পুণ্য বৃন্দাবনে যে গোবিন্দরূপী আমাকে দুলতে দেখে তারও সংসার বন্ধন মুক্ত হয়। যে মাঘী পূর্ণিমাতে চন্দ্রভাগা নদীর তীরে রাধামূর্তির সাথে আমার মূর্তি বসিয়ে দেখে তারও সংসার বন্ধন দূর হয়। স্বর্গের বিদ্যাধরীরা যেখানে এসে নাচে ও মহাদেবকে দেখার জন্য বিভীষণ আসেন ও কিন্নররা রাতে সুন্দর গান করে। যে লোক উপোস করে সকলে আমাকে পূজো করে ও দর্শন করে প্রণাম করে ও দই খেয়ে প্রণাম করে, তার শেষ হয় সংসার বন্ধন।

আমার ও পার্বতীর মূর্তিতে প্রাণ সঞ্চার করে পূজা করলে পুনর্জন্ম হয় না। আর জন্ম নিতে হয় না। যে লোক ফুলের বাগান, সেতু, ঘাত, সরোবর স্থাপন করে, যে ব্রাহ্মণের জীবন ধারনের উপায় বলে দেন, সে জীবন্মুক্ত হন এবং ইহকালে অচলা শ্রী ও মৃত্যুর পর চার রকম মুক্তি পান। যে লোক অনাথ দরিদ্র সুপণ্ডিত ব্রাহ্মণের বিবাহ দেয়, তার মোক্ষ নিশ্চিত হয়। সাদা ঘোড়া দানের ফল আর হাতী দানের ফল সমান হয়। বস্ত্র দান করলে তার যত সুতো থাকে, তত বছর সে সুন্দর চন্দ্রলোকে ও বরুণ লোকে আনন্দ ভোগ করে। যে ক্ষুধার্ত ব্রাহ্মণকে অন্ন দান করে সে পুত্রপৌত্র বৃদ্ধিকারী অচলা সম্পদ লাভ করে। এখন ব্রজে যাও ও ব্রাহ্মণদের ভোজন করাও। সেখানে তোমার তাড়াতাড়ি যাওয়া কর্তব্য।

৭৭.

রাতের প্রথম প্রহরে স্বপ্ন দেখলে সারা বছরে, দ্বিতীয় প্রহরে দেখলে আট মাসে, তৃতীয় প্রহরে দেখলে তিনমাসে, চতুর্থ প্রহরে দেখলে অর্ধেক মাসে ও সূর্য ওঠার সময় স্বপ্ন দেখলে দশদিনের মধ্যে তার ফল পাওয়া যায়। আর সকালে স্বপ্ন দেখে জেগে উঠলে তার ফল তখুনি পাওয়া যায়। মূত্র বা পুরীষে জড়ীভূত ভয়াকূল, উলঙ্গ বা মুক্তকেশ পুরুষের স্বপ্ন ফলে না। কশ্যপগোত্রের কারো কাছে স্বপ্নের বর্ণনা করলে তা ফলে না। স্বপ্ন দেখার পর ঘুমিয়ে পড়লে শোক ও পণ্ডিতদের কাছে বললে মনোমত ফল পাওয়া যায়। পণ্ডিত কাশ্যপগোত্রীয় হলে তার কাছে সুস্বপ্ন ব্যক্ত করা কঠিন।

মানুষ, গোরু, হাতী ঘোড়া, অট্টালিকা, পাহাড় ও গাছে চড়া ও খাওয়া, ক্রন্দন এমন স্বপ্ন দেখলে ধন লাভ হয়। বীণা নিচ্ছে এমন স্বপ্ন দেখলে শস্য পূর্ণ ভূমি লাভ হয়। অর্থ লাভ হয় কৃমি বিষ্টা ও রক্ত দেখলে। তার স্ত্রী লাভ হয় যে স্বপ্নের মধ্যে স্বর্গে গমন করে, যে মূত্রসিক্ত শুক্র পান করে, নগরে প্রবেশ করে বা রক্ত সমুদ্র বা সুধা পান করে সে বিপুল অর্থ ও ভাল খবর পায়। ক্ষীর ও ঘি দেখলে প্রার্থিত বস্তু ধন ও পুণ্য লাভ হয়। সে রাজা হবে যে দেখবে পদ্ম পাতায় পায়েস, দই, দুধ, ঘি, মধু ও মিষ্টান্ন খাচ্ছে সে। স্বপ্নে সমুদ্র, কুকুরী দেখলে তার স্ত্রী লাভ হয়। স্বপ্নে পীত মালা গলায় পীত কাপড় পরা নারীকে আলিঙ্গন করে তবে তার মঙ্গল হয়, যে লোক কোন দিব্য স্ত্রীকে ঘরে এসে মলত্যাগ করতে দেখে তার দরিদ্র দূর হয় ও অর্থ লাভ লাভ ঘটে।

৭৮.

জ্ঞানশূন্য দুর্বল মানুষই সব সময় মায়ায় মুগ্ধ হয়ে সকল কাজে লোভ, মোহ, কাম ও ক্রোধের শিকার হয়। চন্দ্র সপ্তমস্থ, জন্মস্থ, দ্বাদশস্থ ও দশমস্থ থাকলে রাহুগ্রস্ত চন্দ্র সূর্যকে পণ্ডিতরা দর্শন করবেন না এবং জন্ম নক্ষত্র বর নিধনক্ষেত্রে অবস্থান করলে ও চতুর্থ রাশিতে থাকলেও রাহু গ্রস্থ চন্দ্র-সূর্য অজর অদৃশ্য হবে। চন্দ্র অশুদ্ধি থাকে, ভাদ্র মাসের উভয় পক্ষের চতুর্থী তিথিতেই। তাই তা দেখেন না পণ্ডিতরা। মানুষ অনিচ্ছায় দৈবাৎ ঐ চাঁদ দেখে ফেললে সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রপূত জল খেয়ে নেবে, তবেই সে পবিত্র ও কলঙ্ক মুক্ত হয়ে পৃথিবীতে থাকতে পারবে।

৭৯.

কোনো সজ্জন ব্যক্তির ছিদ্র আর কারুরই গোপন কথা মনীষীরা বলেন না। নন্দ বললেন–তাকে বঞ্চনা করো না। রাহুগ্রস্থ হলে পুণ্য দায়ক চন্দ্র সূর্যের দর্শন নিষিদ্ধ হয়। একদিন মহাত্মা যমদগ্নি প্রিয়া রেণুকার সাথে কৌতূহল ভরে নর্মদা তীরে যান। সদ্য বিবাহিতা যুবতী সুন্দরী রেণুকার সাথে বিহার করতে থাকেন। রেণুকা স্তন ভারে ঈষৎ অবনতা, শ্রোনিভারে জড়। সুন্দরী তখন যমদাগ্নির প্রতি কটাক্ষ করতে লাগলেন। রেনুকা সতত সম্ভোগ সুখে রোমাঞ্চিত হয়ে মূর্ছা গেল। সেই নির্জন বনে কোকিলের কুহুস্বর, মৌমাছির গুঞ্জন মিলিয়ে সুন্দর পরিবেশ রচনা করেছিল। সূর্যদেব মুনিকে বললেন, বেদে দিনের বেলায় মৈথুন কাজ পরিত্যাজ্য। রেনুকাও লজ্জা পেয়ে কাপড় পড়ে নিলেন। মুনি তখন ক্রুদ্ধ হয়ে লজ্জায় মুখ লাল করে বলতে লাগলেন কে আপনি পন্ডিতাভিমানী। আপনার কি ধারণা আপনার মতো পণ্ডিত আর কেউ নেই? অজ্ঞানী ব্যক্তিরা সর্বদা নিজের কাজে জড়িত থাকে। আর আগুনের কাছে যেমন কোনো কিছুর দোষের না, তেমন তেজস্বী কোনো লোকের কোন কিছুই দোষের না। বাসুদেবের ভক্তদের কখনই অশুভ হয় না, হরির সুদর্শন চক্র সর্বদা বৈষ্ণবদের রক্ষা করে, ব্রহ্মা সূর্যদেবকে এরকম বলে শাপ পরাজিত লজ্জা ক্রোধ যুক্ত বিনয়ী যমদাগ্নিকে সান্তনা দিয়ে বললেন– তুমি এখন নিজরে ঘরে যাও। নিঃসন্দেহে তুমি হরির বংশজাত ক্ষত্রিয় কাত্তবীয্যাৰ্জুন তোমাকে পরাজিত করবে ও তার হাতে মারা যাবে। পৃথিবীতে তোমার মৃত্যু ও যশের কারণ হবে। ব্রহ্মা এই বলে চলে গেলে যমদাগ্নি ও সূর্য যে যার জায়গায় চলে গেলেন। হে পিতা! এই আমি আপনার কাছে কোন কারণে রাহুগ্রস্ত সূর্য অদৃশ্য সে কথা বললাম।

৮০.

পূর্বে বৃহস্পতির যুবতী সতী স্ত্রী তারা সুন্দর পাতলা পোশাক ও রত্নলংকারে সজ্জিত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন নারীদের মধ্যে অতুলনীয়া। তিনি একদিন স্বর্গের মন্দাকিনী তীরে স্নান করে ভিজে কাপড়ে স্বামীর চিন্তায় বিভোর হয়ে ঘরের দিকে যাচ্ছিলেন। চন্দ্র তাঁকে দেখে কামার্ত হয়ে জ্ঞান হারালেন। চন্দ্র সেই কামুকীতে গাঢ় আলিঙ্গনে ও চুমো খেয়ে শৃঙ্গারে উদ্যত হলেন। তিনি বললেন, আমি ব্রাহ্মণী, তার উপর আবার তোমার গুরুপত্নী। তুমি পুত্র আমি মাতা, আর তুমি যদি আমাকে বল প্রয়োগ করে ভোগ করতে চাও তবে স্ত্রী হত্যার পাপ হবে। কামদেবকে চন্দ্র অভিশাপ দিয়ে বললেন, কোন তেজস্বী পুরুষ তোমাকে ভস্মীভুত করবেন। বৃহস্পতি ব্রহ্মার গোত্রে এবং দেবাদিদেবের গুরু পুত্র, তুমি তাই তাঁর হস্তে তারাকে অর্পণ কর। গুরুপত্নীতে গুরুর হাতে অর্পণ করে পাপমুক্ত হলেন। চন্দ্রকে বহ্নি পরিশুদ্ধ দুটি বস্ত্র, বরুণ রত্নমালা এবং পবনদেবের রত্নছত্র উপহার দিলেন। চন্দ্র তাঁকে প্রণামান্তে সবকিছু বললেন। এবং তাঁর শরণাগত হলেন।

৮১.

শুক্রাচার্য যুদ্ধের উপযোগী অস্ত্র ধারী দেবসেনাদের আকাশ পথ থেকে অবতরণ করতে দেখলেন। সেই দেবসেনাদের দর্শন করে শুক্রাচার্য একটুও ভয় পেলেন না। শুক্রাচার্য পুষ্করিণীর অক্ষয়বটের নীচে মঙ্গলময় পরম কারুণিক বৃষভারুঢ় শিবকে প্রত্যক্ষ করলেন। ব্রহ্মাকেও শুক্রাচার্য রত্নময় সিংহাসনে উপবেশন করালেন ও শ্রদ্ধাবনতচিত্তে তাঁকে প্রণাম করলেন। তখন স্বর্গ-মর্ত-পাতালের বিধান কর্তা দৈত্যগুরুকে বললেন, চূন্দ্রের বেদ বিগর্হিত ক্রিয়া বর্ণনা করছি শোন। তাঁরা যখন স্নান করে সিক্ত বস্ত্রে নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন করছিলেন তখন দুর্নীতিপরায়ণ চন্দ্র তাকে অপহরণ করলেন, শিব বললেন–চাঁদকে এখানে আনন। আমি ত্রিশুলে তার শিরচ্ছেদ করব। দেবাদিদেবের কথা শুনে শুক্রাচার্য বললেন–আপনি সর্বেশ্বর, আপনার সুর অসুর জ্ঞান থাকা উচিত নয়। আপনি গদা হাতে বলির দ্বারে অবস্থান করছেন। আমার যত পাপই হোক না কেন আশ্রিত চন্দ্রকে আমি ত্যাগ করতে অপারগ।

শিব ও ব্রহ্মার নির্দেশে চন্দ্র ক্ষীরোদ সাগর অবগাহন ও প্রায়শ্চিত্ত করে নিজেকে শুদ্ধ করলেন। মহাদেব চাঁদকে দ্বিখন্ডিত করে অর্ধেক নিজ ললাটে স্থান কার দেবার জন্য তার অপর নাম চন্দ্রশেখর। ব্রহ্মা ও শিব চন্দ্রের অভিষেকে আত্মনিয়োগ করলেন। মহাদেব বললেন–শ্বশুরের পাপে তোমায় রাজযক্ষায় আক্রান্ত হতে হবে। সতীর শাপ ব্যর্থ হবার নয়। তুমি রোগ মুক্ত হবে আমার আশিষে। তারাকে বললেন, চন্দ্রের ঔরসে তুমি অন্তঃসত্ত্বা হলে গর্ভমোচন অন্তে স্বীয় পতির সঙ্গে মিলনে পরিশুদ্ধ হও। পতিব্রতা স্ত্রীকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বলাৎকার করলে সেই রমণীকে পাপ স্পর্শ করতে পারে না। যদি কামনার বশে পরপুরুষে সঙ্গম করে তবে নরকবাস করতে হয়। তাঁরা বললেন, তিনি গর্ভবতী। তা শুনে মুনিরা হাসলেন। মহাদেব বৃহস্পতির হাতে তারাকে সম্প্রদান করলেন। তারার গর্ভের পুত্রকে চন্দ্র সাদরে গ্রহণ করে ব্রহ্মা ও শিবের চরণে প্রণত হয়ে সে স্থল ত্যাগ করলেন। মনে আর কোনো দুঃখ স্থান না দিয়ে প্রফুল্ল মনে বাড়ি ফিরে যান।

৮২.

স্বপ্নাবস্থায় যে ব্যক্তি কালো কাপড় পরা কামিনীকে আলিঙ্গন করে তার মৃত্যু হয়। যে স্বপ্নে হরিণ, মৃত মানবকে দর্শন করে তার বিপদ হয়! ঘি, ক্ষীর, মধু, ঘোল-এর স্বপ্ন দেখলে রোগভোগ সুনিশ্চিত। মৃত নর-নারীর স্বপ্ন, কৃষ্ণকায়, যবনের দ্বারা আলিঙ্গন বদ্ধ হওয়ার স্বপ্নে মৃত্যু হয়। কোনো খল যার মাথা থেকে সবলে ছাতা ছিনিয়ে নিচ্ছে এহেন স্বপ্ন দেখে তার মহাগুরু নিপাত হয়। স্বপ্নে আবির্ভূত যমদূত বা যবন তাকে দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে গেলে স্বপ্নদ্রষ্টার মৃত্যু ত্বরান্বিত। স্বপ্নে যেসব পুরুষ বিরোধিতা করে বা কাক, কুকুর, ভাল্লুক যার গায়ে এসে পড়ে তার মৃত্যু আসন্ন। পূর্বে মুখ করে পণ্ডিত ব্যাক্তির কাছে স্বপ্নের বিষয় বলতে হয়। কে কী স্বপ্ন দেখেছ তা অজ্ঞ ব্যক্তির কাছে প্রকাশ করা অবিধেয়।

৮৩.

নন্দ বললেন–বৎস! তুমি চতুর্বেদ ও ব্রহ্মাদি দেবগণের হেতু। আমি তোমার সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল কামনা করি। বেদে বলা হয়েছে, দেবতার উদ্দেশে প্রসাদ নিবেদন করা হয় মাত্র কিন্তু গুরুকে নিবেদিত আহার্য গুরু স্বয়ং গ্রহণ করেন। গঙ্গাজল অপেক্ষা শালগ্রাম স্নাত জল দশগুণ শ্রেষ্ঠ, বিপ্রয়াদি ঐ পুণ্যোদক পান করেন তবে ভববন্ধন মুক্ত হয়ে দেবতাদের সমগোত্রীয় হন।

সতীপত্নী স্বামীর সঙ্গে কখনও দুর্ব্যবহার করেনা। পতি ক্ষুধার্ত হলে স্ত্রী তাকে খেতে দেবে। স্বামীর সারাদেহ চন্দন লিপ্ত করে কণ্ঠে মালা পরিয়ে তাঁর আরাধনা করবেন। স্বামীর অনুমতি নিয়ে পতিব্রতা স্ত্রী আহার করবেন।

৮৪.

যে গৃহী অতিথি সেবা করে না, সে শুচিতা হারায়। তৃষিত যেমন তৃষ্ণা নিবারণে জলাশয়ের দিকে ধাবিত হয় তেমনি পিতৃ ও দেবতারা গৃহীর কাছে আসেন। যে মাতৃহীন ও যার স্ত্রী পরপুরুষগামিনী তার অরণ্যচারী হওয়া উচিত। অতিথি আশাহত হয়ে ফিরে গেলে দেবগণ এবং পিতৃগণ অতিথির সঙ্গে সে গৃহ ত্যাগ করেন। পতিব্রত্যে প্রোজ্জ্বল গৃহিণী ভোর বেলায় ঘুম থেকে উঠে স্বামী এবং দেবতাদের প্রণাম করে গৃহাঙ্গণে গোবর জল নিকিয়ে গৃহের কাজ কর্ম শেষে অবগাহন করবেন। পূজা শেষে স্বামীকে খেতে দেবেন। পিতা যদি পুত্রকে এবং গুরু যদি শিষ্যকে কোনো কাজ করতে বলেন তাহলে পুত্র এবং শিষ্য বিনা বাক্যব্যয়ে, নিদ্বিধায় সে কাজ করবে।

গোলোকধামের পাহাড় গুলি বড়ই মনোরম। কোটি যোজন সেগুলির উচ্চতা, দৈর্ঘ্যে শতগুণ, প্রস্থে পঞ্চাশ কোটি যোজন বিস্তৃত। শত শৃঙ্গ পর্বতগুলি এতই সুন্দর যে চতুর্বেদও সেগুলির বর্ণনা দিতে পারেন না। তা হীরকমাল্যে শোভিত। চন্দনতরু, কল্প ও মন্দার বৃক্ষে বেষ্টিত বৃন্দাবন যেন পটে আঁকা ছবি। ভ্রমরের গুঞ্জনে, কোকিলের কুহুতানে বনভূমি মুখরিত। সেখানের আরেকটি আকর্ষণ বহুযোজন বিস্তৃত অক্ষয় বট এবং গোপিণীদের অভীষ্ট ফলপদ কল্পতরু।

৮৫.

বেদে বলা হয়েছে মধুর সঙ্গে ঘি, তেল, গুড় এবং আদার সঙ্গে গুড় খেতে নেই। জ্ঞানী ব্যক্তি পীতাঙ্গ তলানি জল, মাঘমাসে মূলা, পুঁইশাক পরিহার করেন। রূপার পাত্রে রাখা কর্পূরও পরিত্যাজ্য, পরিবেশনকারী যদি যে আহার করছে তাকে স্পর্শ করে তাহলে তার পরিবেশিত অন্ন নিঃসন্দহেই ত্যজ্য, বেদে বলা হয়েছে পিঁপড়ে ধরা মধু, গোজাত দ্রব্য, গূঢ় অভক্ষ্যা। শূদ্রের তৈরী ঘৃত ও তৈলপক্ক মিষ্টান্ন ব্রাহ্মণের খেতে নেই। স্বেচ্ছায় শুদ্র হত্যা করলে ব্রাহ্মণ যদি এক লক্ষ বার গায়ত্রী জপ করে তাহলে সে পাপ মুক্ত হয়।

শাস্ত্র জ্ঞানী দৈবজ্ঞ যদি লোভের বশে মিথ্যা বলে তবে তাকে দীর্ঘকাল টিকটিকি ও সাত জন্ম বাঁদর হয়ে কাটাতে হয়। পাপী অধার্মিক ব্যক্তি কঠোর তপস্যার মধ্য দিয়ে পরিশুদ্ধ ধর্মপ্রাণ ব্রাহ্মণ হয়ে পুণ্যভারতে জন্ম নেয়। সব নদীর মধ্যে যেমন ভাগীরথী, পুণ্য তীর্থের মধ্যে যেমন পুষ্কর, পুরীর মধ্যে যেমন বারাণসী, প্রাজ্ঞের মধ্যে যেমন দেবাদিদেব, বৃক্ষের মধ্যে অশ্বত্থ, সাধনার মধ্যে শ্রীহরির আরাধনা, ব্রতের মধ্যে অনশন চতুর্বণের মধ্যে তেমনই ব্রাহ্মণই শ্রেষ্ঠ। কর্মবিপাক শ্রবণে ব্রাহ্মণ কে সোনা রুপো, গুড়, বস্ত্র ও পান দিলে আমি প্রীত হই।

৮৬.

 সৃষ্টির পূর্বে ব্রহ্মার পুত্র এক মনুর আবির্ভাব হয়। তাঁর নাম স্বয়ম্ভব। তাঁর স্ত্রী শতরূপ নারীদের মধ্যে সুভগা এবং সন্মানাহা, উত্তানপাদের পুত্র হল ধ্রুব। ধ্রুবের পুত্রের নাম বৎসরাণের পুত্র বৎসরাণ। কেদার ছিলেন পরম ভক্ত বৈষ্ণব ও সপ্তদ্বীপের রাজা। কেদার রাজাকে সততই রক্ষা করত সুদর্শন চক্র। কেদার রাজার এক লক্ষ পাঁচক এবং দুলক্ষ পরিবেশন কারী ব্রাহ্মণ ছিলেন। সকাল থেকে শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্রাহ্মণ এবং গরীব দুঃখীদের ভোজন করানো হতো এবং ধন দান করা হোত। এক পাঁচক কেদার রাজাকে বলেছিল, ব্রাহ্মণদের আহার যোগানোর জন্য মাত্র একলক্ষ গাভী অবশিষ্ট আছে। রাজার যজ্ঞকুন্ড থেকে কমলার অংশ সস্তৃতা অগ্নিশুদ্ধ বস্ত্র এবং অলংকার শোভনা এক কন্যা আবির্ভূত হয়। কামাতুরা কুমারী বলল, আমি আপনার তনয়া, তার নাম বৃন্দা। তার তপস্যার স্মৃতিবাহী বলে স্থানটির নাম হয় বৃন্দাবন। বৃন্দা তার পতিরূপে ব্রহ্মার কাছে আমাকে কামনা করেন। ব্রহ্মা তাকে বলেন, কিছুদিন পরে তাঁর মনস্কামনা পূর্ণ হবে। সুবেশ ধর্মরাজকে তিনি বৃন্দার কাছে পাঠালেন। কেদাররাজ তনয়া যুবা ধর্মকে দেখে বিস্মিত হলেন। ধর্মরূপী বিপ্র বললেন, লক্ষ্মী সরস্বতীই কেবল তার যোগ্য সহধর্মিনী হতে পারেন।

৮৭.

বেদে অভিজ্ঞ পণ্ডিতেরা, ব্রহ্মা, মহেশ্বর, অনন্ত, মুনি ঋষি, সিদ্ধাচার্যেরা কেউ তোমায় পরিপূর্ণভাবে জানতে পারেননি। শ্রীকৃষ্ণ বসেছিলেন ঠিক মাঝে। তিনি সকলের সাথে কুশল বিনিময় করলেন। সেই সনৎ কুমারের সৌন্দর্য, পাঁচ বছরের এক নিরাবরণ গৌরবর্ণ শিশুর মত পবিত্র। কৃষ্ণের কুশল জিজ্ঞাসা করা অবশ্য অর্থহীন কেন না তিনি সমুদয় শুভের বীজ স্বরূপ। সনৎকুমার বললেন, আমি গোলোকে গিয়ে শ্রীকৃষ্ণকে দেখতে পেলাম না। সেখানে চুতর্ভুজের দেখা পেলাম না। বিরাটাকার রাঘব নামক এক মাছ তাকে জল থেকে বিতাড়িত করেছে। কচ্ছপটিকে বললাম তুমি ধন্যা। সে তখন বলল, মহামুনি ধন্যবাদ আমার প্রাপ্য নয়–ক্ষীরোদ সাগরেরই প্রাপ্য।

বেদ নারায়ণ তুল্য, কেননা বেদের ব্যবস্থা হেতুই আমরা পূজা পেয়ে থাকি। বেদ থেকেই সকল শাস্ত্রগ্রন্থের উৎপত্তি। আমি ধর্মালয়ে তাঁকে দেখতে না পেয়ে তাকে দেখবার জন্য মথুরায় এলাম। ব্ৰহ্মাণকে সময়মতো দক্ষিনা না দিলে, এক রাত্রি হলে তার দ্বিগুন, একমাস অতিবাহিত হলে একগুন, দুইমাস অতীত হলে বিধিসম্মত দক্ষিনার সহস্র গুন অবশ্যই দেয় আর সারা বছর কেটে গেলে দাতাকে নিঃসন্দেহেই নরকগামী হতে হয়।

৮৮.

বিষ্ণুমায়া সকল প্রকার মোহের বিনাশ করে ও মুক্তি প্রদান করেন। ত্রিপুরাসুরের সঙ্গে মহাসমরে শিব ভয় পেয়ে মহামায়ার স্তব করে দুর্দান্ত অসুরকে হত্যা করেন। দেবাদিদেব মুহূর্তেই বিষ্ণু ও দুর্গাকে স্মরণ করে ত্রিপুরাসুরকে বধ করলেন। দেবতারা মহাদেবের স্তুতিতে মুখর হয়ে উঠলেন ও পুষ্পবৃষ্টি হতে থাকল। দৈত্যত্রাসে কম্পিত মহাদেবকে ওই স্তোত্র আমার আদেশক্রমে ব্রহ্মা দান করেছিলেন। সাধারণ মানুষ যদি এই স্তব কোটিবার জপ করে তাহলে স্তোত্রসিদ্ধির মধ্যে দিয়ে সে সর্বসিদ্ধি লাভ করে থাকে। স্তোত্রে সিদ্ধিলাভ করেছে এমন ব্যক্তি অগ্নি-জল-ভূমন-স্তম্ভাদি সাধনে তৎপর হয়। আমার প্রাণস্বরূপ এই মহাস্তোত্র আপনাকে অর্পণ করলাম। এখনই আপনি এবার এই স্তোত্র আবৃত্তি করুন। কৃষ্ণের কথায় নন্দ এই স্তোত্রে পার্বতীর স্তব করলে পার্বতী অত্যন্ত প্রীত হয়ে তাকে তার কাঙ্খিত বরদান করলেন।

৮৯.

মাতা যশোদা, গোপিণী, গোপালক বিশেষ করে শ্রীরাধিকাকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাবেন। পরমসুখ ইহলোকে ভোগ করে অন্তে আপনাদের গোলক প্রাপ্তি হবে। তোমাদের যাত্রাকালে গোলক থেকে শত শত রত্ননির্মিত হীরক খচিত, মুক্তার মালায় সুশোভিত সুকান্ত আমার পারিষদেরা থাকবে। দিব্য দেহ ধারণ করে গোপ গোপিণী পরিবৃত হয়ে গোলোকধামে আপনাদের উত্তরণ হবে। আযোনিসম্ভবা শ্রীরাধিকার জননী কলাবতী একই রথে আপনাদের সহ্যাত্রিণী হবেন। কলাবতী, সীতা পার্বতীর জননী ধন্য, আপনাকে গোপনতত্ত্ব সমূহ জানিয়েছি, স্বয়ং পার্বতী আপনাকে বর দিয়েছেন। অতঃপর নন্দ শ্রীকৃষ্ণের কথা শুনে বললেন–চারযুগের সম্বন্ধে আমি বিশেষভাবে জানতে চাই, কলি যুগের শেষে পৃথিবীর ধর্ম এবং প্রাণীদের কি হবে, আমায় তা বল। নন্দের বাক্য শ্রবণ করে কৃষ্ণ শ্রুতিসুখকর বিচিত্র ইতিবৃত্ত বলতে শুরু করেন।

৯০.

পুরাণে বর্ণিত শ্রুতিমধুর মনোজ্ঞ কাহিনি– সত্যযুগে সত্যের পুনর্বিকাশ পরিলক্ষিত হয়। তখন সকলেই ধর্মানুসরণ করে এবং সহৃদয়তা, সহমর্মিতার পরিচয় দেয় ও দয়ালু হয়। ব্রাহ্মণেরা নিয়ত বেদপাঠ ও তপস্যা করেন, তারা নারায়ণের প্রতি আসক্ত থাকেন। পুরুষেরা ঋতুকালে স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হয়, কেউ বহুনারীগামী হয় না, পরস্ত্রীর প্রতি কোনো আকর্ষণ অনুভব করে না। কলির অন্তিমলগ্নে মানুষ লিঙ্গ ও উদর সর্বস্ব হয়ে ওঠে। মানুষের নিত্যসঙ্গী হয় অসুস্থতা, বিদায় নেয় সৌন্দর্য ও কমণীয়তা। দেশ আচ্ছন্ন হয় অরাজকতায় এবং দুর্নীতিতে। স্বামী-স্ত্রী নিয়তই কলহে লিপ্ত হয় তারা অত্যন্ত কুরূপ হয়, পুষ্করিণীতে পদ্ম ফোঁটানো নারীদের সন্তান ধারণ ক্ষমতা অত্যন্ত হ্রাস পায়। কলিযুগে ফল-অন্ন-জলে স্বাদুতা কমে আসে। জগজ্জননী যে জ্ঞান বিতরণ করেছেন সেই জ্ঞানবলে তুমি ।মোহমুক্ত হও। নন্দ বললেন, পুত্র! একবার বৃন্দাবন, মিলন মধুর মহোৎসব, গোকুল, রমণীয় যমুনাতীর ও গাভীদের কথা ভেবে দেখ। তোমার মনোরম রাসমন্ডল, গোপবালক, যশোদা, রোহিণীর কথা মনে পড়ছে কি? নন্দ কৃষ্ণকে কোলে তুলে নিলেন। তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে অদম্য এক কম্পোচ্ছ্বাসে। অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে চোখ দুটি, কৃষ্ণ ও অনির্বচনীয় আনন্দে নন্দকে পুনরায় বলা শুরু করলেন।

৯১.

শ্রীকৃষ্ণ বললেন–-কর্মফল হেতু মিলন ও বিচ্ছেদ ঘটে। এ রোধ করা যায় না। উদ্ধবকে শীঘ্রই বৃন্দাবনে পাঠাচ্ছি। আমার বৃন্দাবনে না যাওয়ার কারণ তার কাছ থেকেই জানতে পারবে। উদ্ধব, যশোদা রোহিণী রাধিকা গোপবালক গোপিণীদের সান্ত্বনা দেবে। এই বালকই তোমার ও আমার মধ্যে সুদৃঢ় সখ্যতার সেতু বন্ধন করেছে, অতঃপর গৃহে গমন কর মোহমুক্ত হয়ে। সে তোমারও পুত্র, খুব একটা বেশি না মথুরা ও গোলকের দুরত্ব। কৃষ্ণকে অবশ্যই কাছে পাবে কোন আনন্দ অনুষ্ঠানে। দৈবকী বললেন, নন্দরাজ! শোকে আপনি কেন এত অভিভূত হচ্ছেন। কৃষ্ণ কেবল আমাদের নয় আপনারও পুত্র। দীর্ঘ এগারো বছর তো সে আপনার আলয়ে বলদেবের সঙ্গে চরম সুখে কালতিপাত করেছে। আপনি বরং মথুরায় চলুন ও কৃষ্ণের সাথে কাল অতিবাহিত করুন। ভগবান বললেন, উদ্ধব হে! বিলম্ব না করে তুমি গোকুলে যাও। তুমি আনন্দের সঙ্গে সেখানে গিয়ে যশোদা, রোহিনী, রাধিকা, গোপিনীদের দুঃখ দূর কর। তাদের শোক প্রশমন কর আধ্যাত্মিক উপদেশ দান করে। মাতা যশোদাকে বলবে যে, মার আদেশে নন্দরাজ আমাদের আলয়ে কিছুদিন থাকবে। অতঃপর কৃষ্ণ! বাবা, মা, বলদেব ও অকুরের সঙ্গে স্বগৃহে, গমন করলেন। হে নারদ! উদ্ধব সে রাতটা মথুরাতেই থেকে গেলেন। সকাল হলে তিনি বৃন্দাবনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন।

৯২.

কৃষ্ণের বার্তাবহ উদ্ধব সিদ্ধিদাতা গণেশ, নারায়ণ, শিব, লক্ষ্মী দিবাপালদের প্রণাম করে শুভক্ষণে বৃন্দাবনের উদ্দেশ্যে নিষ্ক্রান্ত হলেন। বিপদের আশীর্বাদে অভিস্নাত হয়ে উদ্ভব পথ চলছেন। শুভংকর দ্রব্য দেখতে দেখতে উদ্ভব কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃন্দাবনে পৌঁছে গেলেন। প্রথমেই অক্ষয় বট দেখলেন ঘেঁটু বনের মধ্যে। যার পাতা চিকন ও লালচে। সুশোভন বেশে রাখাল বালকদের দেখলেন। তারা শোককাতর কৃষ্ণবিরহে। ‘হাঁ কৃষ্ণ’, ‘হা বলরাম’, ধ্বনিতে তাদের আর্ত ক্রন্দনোচ্ছ্বাসে বৃন্দাবনের আকাশ-বাতাস মথিত হচ্ছে। কিছুটা এগোতেই বিশ্বকর্মার শিল্পকীর্তির নিদর্শন, মনি ও রত্নময় নন্দশিবির দৃষ্ট হলো। শিবিরের দ্বারগুলি বৈচিত্র্যমন্ডিত। যশোদা ও রোহিনী ছুটে এলেন। উদ্ভবকে জল, গোরু ও মধুপর্ক প্রদান করে অভ্যর্থনা জানালেন। যশোদা ও রোহিনী উভয়ের একই প্রশ্ন। উদ্ভব সকলের মঙ্গল সংবাদ পরিবেশন করে বললেন–যে নন্দরাজ কৃষ্ণ এবং বলরামের সঙ্গে সুখেই অবস্থান করছেন। আমি মথুরায় গিয়ে আপনাদের শুভ সংবাদ দেব আর বলব, আমার কাছ থেকে আপনাদের শুভ সংবাদ শ্রবন করে যশোদা ও রোহিনী ব্রাহ্মনদের রত্ন, সোনা ও বস্ত্র প্রদান করেছেন।

আরও বলব যে আমাকে আপনারা নানা রকমের ভালো মিষ্টি খাইয়ে মনি-রত্ন দিয়েছেন। একে একে নানা মঙ্গলজনক অনুষ্ঠান শুরু হল। ব্রাহ্মন ভোজন, বেদপাঠ, অর্ঘ্য, কুসুমধূপ-দীপ-চন্দন নববস্ত্র, তাম্বুল-মধুপর্ক-ঘৃত প্রভৃতি উপাচারে দেবাদিবের অর্চনা। ষোড়শোপচারে ভবানী মার পূজা নানাবিধ বলি একশত মহিষ, একহাজার ছাগল, দশ হাজার ভেড়া নিয়ে উক্ত দেবীর আরাধনা ইত্যাদি। কৃষ্ণের কল্যাণ কামনায় ব্রাহ্মণদের শত সুবর্ণ এবং শত ধেনু দান করে তারা উদ্ধবকেও পূজা করলেন। উদ্ভভ যশোধা রোহিণী গোপিণীদের আশ্বস্ত করে চন্দ্র মন্ডলের মতো নয়নাভিরাম রাসমণ্ডলে গিয়ে দেখলেন সেখানে পটসূত্রে সচন্দন আম্রপল্লব এবং মালা ঝুলছে, কলাগাছগুলি স্তম্ভের মতো দাঁড়ানো, কৃষ্ণের লীলাভূমি দই খই ফল সিংহাসন ফুল দুর্বা চন্দন অগরু মৃগনাভি ও কুঙ্কুমে পুত। সেখানে মিলন মন্দির তিন লক্ষ রতিমন্দির অবস্থিত, তিন কোটি সুন্দরী গোপিনী সেই রতিমন্দির গুলিকে বেষ্টন করে আছেন। লক্ষ গোপ শ্রীকৃষ্ণের প্রতীক্ষায় সেখানে সমবেত হয়েছেন। তারপর উদ্ধব একে একে যমুনা, চন্দন-চাপা-কেয়া-মাধবী-বকুল-অশোক-পলাশ-সোঁদান বনে ঘুরলেন। তাল হিন্তাল বনসমূহও বাদ গেল না। আম-কাঁঠাল মন্দার বন বাঁ দিকে রেখে কুঞ্জবনে গেলেন। কুহুতান, ভ্রমরের গুঞ্জনে সেই বন মুখরিত হচ্ছে। মধুমন্দ বাতাসে বইছে ফুলের গন্ধ। রমণীয় সে অরণ্য অতিক্রম করে উদ্ধব রাজপথে এলেন। সহসা তার চোখে পড়ে লাল টুকটুকে একটি ফল। কলা বাগানে নীরব নিভৃত স্থানে পরিখা আর দুর্গঘেরা শ্রীরাধিকার আশ্রম। মিত্রদের কাছে অতি সুগম শত্রুদের কাছে সেটি দুর্গম। প্রাসাদ শীর্ষে বায়ুপ্রবাহে আন্দোলিত হচ্ছে পতাকা। সিংহদ্বারটিও রত্নখচিত, দ্বারে প্রবেশ করে উদ্ধব বৃন্দাবনের সেই প্রফুল্ল নীপ কানন দেখলেন। বেত হাতে লক্ষ লক্ষ রূপসী গোপিনী দ্বারে পাহারা দিচ্ছে, উদ্ধব একে একে প্রণাম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম দ্বার অতিক্রম করে ষষ্ঠ দ্বারে উপস্থিত হলেন। বিষ্ণুর দশাবতারের চিত্র দেখে তিনি মুগ্ধ হলেন। কত নিপুণ ভাবেই না বিশ্বকর্মা রাসমণ্ডল আর যমুনা নদীতে জলক্রীড়ার দ্যুতি এঁকেছেন।

গোপঙ্গনার সতর্ক প্রহরায় সে স্থান অতি সুরক্ষিত। তাদের পরিধেয় থেকে মণিমাণিক্যের দ্যুতি ঠিকরে বেরুচ্ছে। প্রধান মাধবী উদ্ধবের কাছ থেকে কুশলবার্তা শুনে অত্যন্ত খুশী হয়ে রাধিকার সখীদের আনন্দসংবাদ দিতে গেল। রাধার গৃহে নিয়ে গেল। তাঁর নিকেতন মহার্ঘ রত্নে নির্মিত। পদ্মপাতায় অমাবস্যার চাঁদের মতো কৃষ্ণ বিরহে কাতর মূৰ্ছিত প্রায় নিরাভরনা রাধা শুয়ে আছেন। অপরিচ্ছিন্ন ধারায় অনির্গত হওয়ায় তাঁর চোখ লাল হয়ে উঠেছে। তাঁর শ্রীঅঙ্গ কালো মলিন হয়েছে। তিনি নতমস্তকে শ্রীরাধিকাকে প্রণাম করে বললেন, ব্রহ্মাদি দেবগণ বন্দিতা যে রাধার জয়কীর্তনে ত্রিভুবনে পবিত্র হয়ে ওঠে, আমি তাঁকে প্রণাম করে ধন্য হলাম। আপনিই ধীশক্তি এবং প্রজ্ঞাপ্রদায়িনী, সত্যযুগে দেবতাদের ছিলেন তেজ, আপনিই প্রকৃতি আপনাকে প্রণাম। আপনি লজ্জা, ধৃতি এবং চেতনা রূপিণী আপনাকে প্রণাম। আপনিই সকলের শক্তি, জগজ্জননী, আপনি বহ্নির দাহিকা শক্তি, পূর্ণচন্দ্র স্বরূপা আপনাকে প্রণাম।

দেবী! দুগ্ধ এবং তার ধবলতায়, ভূমি এবং সৌরভে, জল এবং তার শৈত্যে, আকাশ এবং শব্দে, সূর্য এবং তার দীপ্তিতে কোনো ভেদ নেই। রাধা কৃষ্ণও অভিন্ন। আপনার মূৰ্ছা অপনোদিত হোক। আপনি আমার সঙ্গে কথা বলুন। রাধার এইরূপ স্তুতি করে উদ্ধব বার বার তাকে শ্রদ্ধানত চিত্তে প্রণাম করলেন। উদ্ধবের এই রাধা কীর্তন ভক্তিসহকারে যে পাঠ করে সে ঐহিক সুখলাভ করে মৃত্যুর পরে শ্রীহরির আলয়ে আশ্রয় পায়। সে রোগ-শোক মুক্ত হয়, জীবনে তার বন্ধুবিচ্ছেদ হয় না। যে স্ত্রী প্রবাসী স্বামীর বিরহে বেদনায় চঞ্চল সে এই স্তোত্র পাঠে অচিরেই পতির সঙ্গে মিলিত হয়। অনুরূপভাবে, স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদে যে স্বামী কষ্ট পাচ্ছে পত্নীর সঙ্গে তার মিলন হয়। এই স্তোত্র পাঠে নিঃসন্তান পুত্রের মুখ দেখে, দরিদ্র ধন লাভ করে, ভূমিহীন নিরাশ্রয় ব্যক্তি ভূমি ও আশ্রয় লাভ করে –নিয়ত, শঙ্কিত ব্যক্তি নিভকি হয়। বদ্ধ মুক্তিলাভ করে, কীর্তিহীন যশস্বী হয়।

৯৩.

উদ্ধবের স্তুতিতে শ্রীরাধিকার নয়ন উন্মীলিত হলো। দুঃখ ভারাক্রান্ত চিত্তে তিনি প্রশ্ন করলেন, বৎস! তুমি কে? কে, কেন, কোথা থেকে তোমাকে এখানে পাঠিয়েছে? শোককাতরা শ্রীরাধিকার কথা শুনে উদ্ধব বললেন, ।বরাঙ্গনা। আমি ক্ষত্রিয় কুলোদ্ভব উদ্ধব। আপনার ধারণা অভ্রান্ত, আমি শ্রীহরির পারিষদ। আমার মাধ্যমে তিনি তার কুশল সংবাদ প্রেরণ করেছেন আর সেই উদ্দেশ্যেই আমার আগমন।

কৃষ্ণ, বলরাম এবং নন্দ বর্তমানে মথুরায় সুখেই কালাতিপাত করছেন। রাধিকা বললেন, বৎস! সুনীল যমুনার অনুপম বেলাভূমি, সৌরভমন্থর বাতাস নীপবনে ছায়াবীথি, কোকিলের মধুর কূজন, মদনের নিয়ত আনাগোনা, রাসমন্ডলের সে উজ্জ্বল রত্নদীপ, মিলন মন্দির, গোপিণী, স্নিগ্ধ চন্দ্র কিরণ–সবই তো আগের মতোই রয়েছে।

আজও তো রয়েছে, চন্দন লিপ্ত কুসুম শয্যা, কর্পূর সুবাসিত তাম্বুল, মনোহর মালতীর মালা, নয়নের তৃপ্তিদায়ক শ্বেত চামর, দর্পণ, হীরক হারে বর্ণ বিকিরণ, আলো করে ফুটে ওঠা নানা বর্ণের ও গন্ধের অসংখ্য পুষ্প, পূর্ণ প্রস্ফুটিত পদ্ম, কিন্তু আমার প্রিয়তম কোথায়? বিচ্ছেদ কাতরা শ্রীরাধিকার মনোবেদনায় উদ্ধবও কষ্ট পেলেন। বিরহাতুরা রাধার দুঃখে কেউ বা কাঁদছে, কেউ বা তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে।

সেই সেই বনতপ্তা কোনো গৌরবর্ণা গোপিনী কামনা মদির শ্রীরাধিকার সন্তাপ দূর করার জন্য স্নিগ্ধ পেলব পদ্মপত্রে শয্যা রচনা করে তাকে শুইয়ে দিচ্ছে। অসীম শক্তির আকার মূলা প্রকৃতি। শ্রীদামের অভিসম্পাতে, গোলোক কামিনী হয়ে আপনার মর্তে আগমন। বসুদেব চান কৃষ্ণের উপনয়ন পর্যন্ত নন্দ সেখানে থাকুন, শুভানুষ্ঠান শেষ হলে নন্দ, কৃষ্ণ এবং বলরাম পুনরায় গোকুলে ফিরে আসবেন।

কৃষ্ণ বৃন্দাবনে এসে প্রথমে তার যশোদা মাকে প্রণাম করেন। স্বর্ণচাপা চন্দনের গন্ধ ছড়িয়ে মণিমুক্তোয় নিজেকে অলংকৃত করে আপনি অতঃপর রত্নপালঙ্কে শয়ন করুন। সহেলীর শ্বেত চামর দিয়ে বাতাস করুক। সখীরা আপনার পদ সেবা করুক। সাজগোজ সেরে স্বচ্ছ দর্পণে একবার নিজের সুন্দর মুখটা দেখতে ভুলবেন না যেন। একথা বলে উদ্ধব রাধার শোভনীয় চরণমূলে প্রণত হলেন।

উদ্ধবের কথায় শ্রীরাধিকার মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। খুশি হয়ে তিনি উদ্ধবকে দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা নির্মিত পীতবর্ণের রত্নখচিত দীপের মতো দীপ্ত মহামূল্যবান একটি অঙ্গুরীয় উপহার দিলেন। তাছাড়াও তিনি কুন্ডল অন্যান্য আভরণ, বরুণদেব কৃষ্ণকে যে রত্ন নির্মিত ক্রীড়াপদ্ম দিয়েছিলেন সেটি, দিমিনি কৃষ্ণকে যে স্যমন্তক মণি প্রদান করেছিলেন এবং দেবরাজ যে রত্নসিংহাসন দিয়েছিলেন সেগুলিও উদ্ধবকে উপহার করলেন।

উপরন্তু উদ্ভবের ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকায় তিনি রাধিকার কাছে থেকে ব্রহ্মা প্রদত্ত রাসমন্ডলের শ্রেষ্ঠ মুক্তা মাণিক্য হীরা খচিত হার, চিত্ৰকমল শোভিত রত্নদর্পণ, গোলোক রাসমন্ডলে শ্রীহরি যে জ্ঞান প্রদান করেছিলেন সেই জ্ঞান সেই সঙ্গে তার অধস্তন শতপুরুষ পর্যন্ত বিদ্যা-ঐশ্বর্য-যশ-সিদ্ধি লাভ করে শ্রীহরির পাদপদ্মে অচলা অটুট থাকুক এইসব দুর্লভ বর প্রদান করলেন। উদ্ধবের কাছে কৃষ্ণের কুশল সংবাদে সখীরাও প্রীত হয়ে তাঁকে অনেক উপহার দিলেন।

রাধা চিন্তায় আকুল হলেন। উদ্ধবের কাছে জানতে চাইলেন, যে তাঁর বলা কথা সত্য কিনা। শত কূপের চেয়ে যেমন পুষ্করিণী, শত পুষ্করিণীর চেয়ে যজ্ঞ, শত যজ্ঞ থেকে পুত্র, ও সত্য শ্রেষ্ঠ। উদ্ভব বললেন, তিনি এক বর্ণও মিথ্যা বলেন নি। আপনি শীঘ্রই হরিমুখ দেখবেন। আপনি চিন্তা মুক্ত হোন। শাস্ত্রপাঠে প্রাজ্ঞ ব্যক্তি নারী চরিত্র সম্পর্কে সামান্যই অবগত হতে পারেন।

কখন সূর্য উঠছে, অস্ত যাচ্ছে, তা জানতেও পারছি না। তার কুশল বার্তা স্মরণ করে আমি চেতনা ফিরে পেলাম। মনের চোখে ভেসে উঠেছে তাঁর সুন্দর মুখ। কানে আসছে শ্রুতি মধুর বংশীধ্বনি। কুল-লাজ-ভয় ত্যাগ করে সতত হরির পাদপদ্ম স্মরণ করি। মায়ায় আচ্ছন্ন ছিলাম বলে তাঁকে পেয়েও তার স্বরূপ অবগত হতে পারিনি। যতদিন তিনি ছিলেন ততদিন আমি ভক্তি সহকারে তাঁর পাদপদ্মে সেবা করেছি।

তার গুণ-কীর্তনের মাঝে মগ্ন থেকেছি, মানসিক প্রশান্তিতে আমার আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে। আমি আজ অসহায় তার অনুপস্থিতিতে, আর কোনো আসক্তি নেই কোনো কিছুতে। হৃদয়ে প্রেমের উৎস গেছে শুকিয়ে, আমার সৌভাগ্য রবি অস্তমিত। যমুনানদীতে, ক্রীড়া- সরোবরে কৃষ্ণ এবং সখীদের সঙ্গে আর কি আমি সুখাবহ জলক্রীড়ার সুযোগ পাব? কোথায় আমার প্রাণের মাধব? উদ্ধবকে এসব কথা বলে রাধা কাঁদতে লাগলেন এবং পুনরায় সংজ্ঞা হারালেন।

৯৪.

নারায়ণ বললেন, সংজ্ঞাহীন রাধাকে দেখে উদ্ধব যুগপৎ ত্রস্ত এবং বিস্ময়াবিষ্ট হলেন। রাধার জ্ঞান ফেরাতে প্রয়াসী হলেন। জ্ঞান ফিরে আসার পর উদ্ধব পুনরায় বলতে শুরু করলেন। জগজ্জননী রাধার চরণে শতকোটি প্রণাম। আপনি শীঘ্রই কৃষ্ণের দর্শন পাবেন। বেদ এবং সনক সব সময়ই আপনার জয়গান করেন। আপনি দান করেন হরিভক্তি, মঙ্গল প্রদান করেন, সকল বাধা বিঘ্ন দূর করেন। একজন গোপিনী উদ্ধবকে পিছন ফিরতে বলে সংজ্ঞাহীন। রাধার সামনে দাঁড়িয়ে তার উদ্দেশ্যে। বললেন– তুমি কি কৃষ্ণের রূপ লাবণ্য, সুবেশ ও তার সাথে মিলিত হবার কথা মনে করছ। মনে রেখো ইনি একজন সামান্য গোপবালক। তাকে স্মরণ করে তুমি মিথ্যা কষ্ট ভোগ করছ। আত্মার চেয়ে প্রিয়তম কিছু নেই। তোমার কর্তব্য আত্মাকে রক্ষা করা। মালতী বলল, তোমার লজ্জা শরম নেই। তুমি ধুলায় মিলিয়ে দিচ্ছ নারী জাতির সম্মান। বিরত হও কৃষ্ণকে অন্তরে পতি রূপে বরণ করার ধারণা থেকে। যারা সাধু তারা কার্য ও কাল সম্পর্কে অবহিত হয়ে সবকিছু সম্পাদন করেন।

শত্রু প্রথমে ঐশ্বর্য হরণ করে, পরে পুরুষ বাক্য প্রয়োগে দুঃখ দিয়ে শেষে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। তার জন্য তুমি কুলত্যাগিণী হয়েছ। তিনি তোমায় শোকের সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। বিচ্ছেদ ব্যথায় কাতর হয়ে মূচ্ছা যাচ্ছো। তুমি সত্যিই বোকা। তাই দুঃখ ভুলে আত্মরক্ষায় ব্রতী হও। বড়োই ক্ষণস্থায়ী কপটের প্রেম, বিদ্যুতের চমক ও জলের দাগ। খলকে বিশ্বাস করবে না শাস্ত্রে বলা আছে।

যমুনা তীরে কৃষ্ণ তোমায় কটাক্ষ করলেন আর তুমিও তার মুখ দেখে গুরুজনের ভয়, কুলমান সব জলাঞ্জলি দিয়ে কৃষ্ণানুরাগিণী হলে। কৃষ্ণ রয়েছেন মথুরায় আর তুমি রয়েছ গোকুলে তুমি প্রাণ বিসর্জন দিলেও। তিনি তোমার কাছে আসবেন না। চন্দ্রমুখী নামক অপর এক সখী বলল, কর্মফল হেতুই মানুষ সুখ-দুঃখ ভোগ করে। তাই কৃষ্ণ নিন্দায় কোনো ফল হবে না।

তাঁর স্তুতিতে আত্মনিয়োগ কর। তার নাম এবং স্তুতি শ্রবণেই রাধিকা সংজ্ঞা ফিরে পাবেন। লক্ষ্মী সরস্বতী যাঁর স্বরূপ জানেন না। তুমি তাকে জানবে কেমন করে? তোমায় পূর্বের কথাই ঠিক। পৃথিবীর ভার মোচনের নিমিত্তই মোহন বেশে, মধুস্বরূপ সেই মন্দাকিনী ধারাকে রমণীয় রূপ ধারণ করে তিনি আবির্ভূত হয়েছেন।

দেবাদিদেব তাঁর চরণকমলে মস্তক ধারণ করেছেন। জগৎ সংসারে অনাসক্ত ত্যাগী মহেশ্বর অসন বসন-ভূষণ ত্যাগ করে নৃত্যসহ পঞ্চমুখে সর্বদাই যাঁর নাম কীর্তনে মগ্ন থাকেন। তাকে জানা কি এতই সহজ? ব্রহ্মা তো শ্রী হরিকে সেবা করেই জন্ম দায় থেকে মুক্ত হয়েছেন। সুশীলা বললেন, সেই পরম পুরুষ তুলনা রহিত। কৃষ্ণের রূপের কাছে চন্দ্র এবং অশ্বিনকুমারদ্বয়ের সৌন্দর্যও ম্লান হয়ে যায়।

সীতা ও ধন্যা উভয়েই অযযানিসম্ভবা। দেবতাত্মা হিমালয়ের পত্নী দূর্গা-জননী মেনকাও দুর্গার মতোই অযযানি সম্ভবা, নিত্যই তিনি ব্রতানুষ্ঠানরতা। আমি বৃষভানুর স্ত্রী ও রাধার মা। রাধা ও আমি দুজনেই অযোনিজা। আমরা শ্রীদামের শাপে পৃথিবীতে এসেছি। ক্ষীরোদ সাগরে সুন্দর একটা শ্বেত দ্বীপ আছে –সেখানে বিষ্ণুর বাস। সেখানে আমরা তিন বোন বিষ্ণুকে দেখতে পাই।

একদিন যোগীশ্রেষ্ঠ সনৎকুমার সেখানে এলেন। তাঁকে আমরা শ্রদ্ধা প্রদর্শন করিনি। তাতে তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে আমাদের মর্ত্যে জন্ম নেবার অভিশাপ দেন। তার ক্রোধ প্রশমনের চেষ্টা করলে তিনি শান্ত হলেন ও বরদান করে বললেন– মেনকা তুমি জ্যেষ্ঠা, ধরায় অবতীর্ণ হয়ে বিষ্ণুর অংশজাত গিরিরাজ হিমালয়ের পত্নী হবে, পার্বতী তোমার জ্যেষ্ঠা কন্যা হবেন।

ধন্যা, তুমি যোগীন্দ্র জনকরাজার রানি হবে, লক্ষ্মীদেবী তোমার কন্যা সীতারূপে পরিচিত হবেন। কলাবতী তুমি ছোট। দুর্বাসা মুনির অনুগ্রহধন্য বৃষভানুর সঙ্গে তোমার বিবাহ হবে। দ্বাপরের অন্তিম লগ্নে শ্রীদামের শাপে রাধা তোমার কন্যা রূপে জন্ম নেবে। তখন দেবাদিদেব ও অনন্তদেবের আরাধ্য কৃষ্ণও ভারতবর্ষে আবির্ভূত হবেন।

সেই শুভক্ষণে তোমরা কন্যাসহ জীবন্মুক্ত হয়ে পুনরায় পরমানন্দে নিজ স্থানে ফিরে যাবে। মানসী কন্যা আমরা আমাদের পিতৃগণের দ্বারা অনুগৃহীত। আমাদের কাল কেটেছে স্বর্গে স্বর্গীয় সুখে। দেবতারা যেমন সভায়, শিবের অনুগমন করেন, তেমনি জীবগণও পরমাত্মার শরনে সব সময়েই আত্মার অনুসরণ করে।

যোগীরা পরম নিষ্ঠার সঙ্গে তার ধ্যান করে থাকেন। কালিকা বললেন, আবালবৃদ্ধবনিতা দেবগণ সিদ্ধাচার্যেরা সকলেই তাকে জানেন। আর বিলম্ব না করে রাধিকার জ্ঞান ফেরানোর জন্য তৎপর হওয়া উচিত। উদ্ভব বললেন, আপনি চেতনা ফিরে পেয়ে চোখ মেলুন। মা! বলদ যেমন বাহকের দ্বারাই চালিত হয়, এ জগৎ সেইরকম তার ইচ্ছাতেই পরিচালিত হয়।

৯৫.

উদ্ধবের কথায় রাধার চেতনা ফিরল ও ধীরে ধীরে উঠে তিনি রত্নসিংহাসনে বসলেন। তখন সাতসুন্দরী গোপিনী চামর দিয়ে তাকে হাওয়া করতে লাগলেন। তিনি উদ্ধবকে মথুরা গমনের অনুমতি দিলেন। বললেন, আমার মানসিক ও শারীরিক অবস্থার কথা তাকে জানিয়ে আমার কাছে প্রেরণ কর। তার মতো পতিলাভ করেও বিচ্ছেদ হয়েছে– আমার মত হতভাগিনী আর কেউ নেই।

শোকের আমি তলিয়ে যাচ্ছি সাগরে। কোনোভাবে নিজেকে সংযত করতে পারছি না। আমার মত অসহায় ও অস্থির আর কেউই নেই। সকল যুবতীর মধ্যে আমি ছাড়া কেউ জানেনা হরির সাথে বিচ্ছেদের কথা। আমার মত হতভাগিনী রমণীকুলে কেউ নেই। আমার পাপের পরিমাপ করা সম্ভব নয়।

আমি কল্পতরুসদৃশ পতিলাভ করেও বিধাতার নির্দয় বিধানে অনিঃশেষ যাতনা ভোগ করছি, আর বঞ্চিত হচ্ছি পতিসঙ্গ লাভে। যার রূপে স্বর্গ, মর্ত, পাতাল অভিভূত তাকে ভুলব কি করে। স্বপ্নেও যে একবার তাঁর অমেয় রূপরাশি প্রত্যক্ষ করেছে, সেও সকল বিষয় সম্পত্তির প্রতি অনাসক্ত হয়ে তার চরণে জীবন উৎসর্গ করে।

যার ভয়ে বায়ু প্রবাহিত হচ্ছে, সূর্য কিরণ বিতরণ করছে, ইন্দ্র বৃষ্টিতে ধরণী সিক্ত করছে, বহ্নি সবকিছু দগ্ধ করছে, সর্বভূতের অন্তিম পরিণতিও যাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন, যাঁর দাক্ষিণ্যে উপযুক্ত সময়ে বৃক্ষ পল্লবিত হচ্ছে, যিনি স্রষ্টারও স্রষ্টা, যিনি কারো অধীন নন।

তার বিচ্ছেদ বেদনা ভোলার ক্ষমতাই যখন নেই, তখন প্রবোধ দান নিরর্থক। আমাকে কেউ সান্ত্বনা দিতে পারবে না। স্থিতিরও গতি সম্ভব–কিন্তু যেখানে পথ নেই সেখানে গতির কথা অচিন্তনীয়। কালের গতিরোধ করা সম্ভব নয়। তুমি স্বচ্ছন্দে মথুরায় গমন কর। উদ্ধবের চোখও জলে ভরে উঠল।

৯৬.

উদ্ধব মথুরার উদ্দেশে যাত্রার জন্য প্রস্তুত হলে রোদনরতা প্রেমময়ী মাধবী বিরহিনী রাধার দুঃখে কাতর হয়ে উদ্ধবকে বললেন, অপেক্ষা কর। তোমাকে দুর্লভ জ্ঞানে জ্ঞানিত করতে চাই। কর্মফলহেতু প্রাণী জন্মগ্রহণ করে আর কর্মফল হেতুই তাকে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়। তাকে সুখ-দুঃখ ভোগ করতে হয় কর্মফল হেতুই।

প্রারব্ধ কর্মের অবশিষ্টাংশের ফলভোগের জন্য প্রাণীকে পুনর্বার জন্ম নিতে হয়। সুর-মনুষ্য পিতৃগণের ব্রহ্মালোক ও তার ঊর্ধ্বলোকের কালগতি সম্পর্কে আমি জানতে চাই। আমার অভীষ্ট, কালকে অতিক্রম করে হরির পাদপদ্ম লাভ। উদ্ধবের কথায় রাধার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কালের কাল জগৎপতির সাধনায় যাঁরা নিয়ত রত এবং সদাত্মা ব্যতিরেকে যাঁদের নাশশীল দেহ সদ্যপাতী হয়, তারা কৃষ্ণের সেবায় সমর্পিত প্রাণ হয়ে কালের গতি থেকে পরিত্রাণ লাভে সক্ষম হন।

সূর্য কৃষ্ণভক্ত ছাড়া অন্যসকলের আয়ু নাশ করেন। তাঁরা চিন্তা করে না বেদ-বেদাঙ্গের বিষয়, তাঁরা নিষ্পাপ ও হরির দাস হতে পেরে নিজেদের ধন্য বলে মনে করে। মৃকর পুত্র মাত্র দশ বৎসর আয়ু লাভ করে ব্রহ্মতেজে ভাস্বর হয়ে উঠেছিলেন পরে হরির সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। কেতু, পঞ্চশিখ, লোমক ও আসুরী শতকল্পান্তজীবী হয়েছেন কেবল মাত্র-হরিসেবায় আত্মনিয়োগ করে।

আবার দৈত্যকুলের প্রহ্লাদ হরিবিদ্বেষী পিতার হরিভক্ত পুত্র হিসাবে স্মরণীয় হয়ে আছেন। রোমকূপে যাঁর অগণিত বিশ্বের স্থিতি, সর্বধার, সর্বব্যাপী, স্থূলতম ও অন্যদিকে পরমায়ু অপেক্ষা সূক্ষ্ম সেই পরমাণুই সকল কালের সূচনাত্মক ও পরমাণুদ্বয়ে দ্ব্যনুক, ত্রিদ্বনুকে ত্রিসরেণু আবার ত্রিত্রসরেণুতে এক ত্রুটি। একশতে ত্ৰুটিতে একবেধ, একালব হয় তিনবেধে তিনলবে এক নিমেষ, তিন নিমেষে একক্ষণ, পঞ্চক্ষণে এক কাষ্টা, দশ কাষ্ঠার এক লম্বু, পনের লম্বুতে একদন্ড, চার আঙুল মাপের চার স্বর্ণমাসের সরু ছিদ্র দিয়ে নিঃসৃত জলে ছয় পল পরিমান জলপাত্র পূরিত হলে এক দন্ড এবং দুই দন্ড মিলে এক মূহূর্ত হয়।

আট দন্ডে এক প্রহর, চার প্রহরে রাত ও দিন হয়। পঞ্চদশ তিথি হলো এক পক্ষ। শুক্ল ও কৃষ্ণ দুই পক্ষ। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত এই ছয় ঋতু। বৎসর পাঁচ প্রকার। বারো মাসে এক অব্দ হয়, মাস হলো বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ন, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন, ও চৈত্র, চৈত্র হল শেষ মাস।

প্রতিপদ থেকে পূর্ণিমা শুক্ল পক্ষ। পূর্ণিমা অন্তে অমাবস্যার শেষ পর্যন্ত গণনা করা হয়। কৃষ্ণপক্ষ। অনুরূপ পদ্ধতিতে এভাবে শুক্লপক্ষ গণনা করা হয়। চন্দ্রের সাতাশ জন স্ত্রী হলো– অশ্বিনী, ভরণী, কৃত্তিকা, রোহিনী, মৃগশিরা, আদ্রা, পুনর্বসু, পুষ্যা, অশ্লেষা, মঘা, পূর্ব ফাল্গুনী, উত্তর ফাল্গুনী, চিত্রা, স্বাতী, বিশাখা, অনুরাধা, জ্যোষ্ঠমূলা, পূর্বষাঢ়া, উত্তরাষাঢ়, শ্রবণা, অভিজিৎ, ধনিষ্ঠা, শতভিষা, পূর্বভাদ্রপদ, উত্তর ভাদ্রপদ ও রেবতী। অভিজিতের কোনো স্বতন্দ্র অস্তিত্ব নেই সে শ্রবণার ছায়া।

চন্দ্র একবার শ্রবণার সাথে দিনরাত মিলনানন্দে অতিবাহিত করায় চিত্রা ক্ষুব্ধ হয়ে, চাঁদকে ছায়ায় আবৃত করে পিতার কাছে গেল ও সেখানে নিয়ে এসে ভাগ করে দিল। মানুষের একমাসে পিতৃগণের এক দিন-রাত হয়– শুক্লপক্ষে হয় রাত, মানুষের এক বৎসরে দেবতাদের এক দিন-রাতে হয়। উত্তরায়ণে দিন ও দক্ষিণায়ণে রাত হয়। এক মন্বন্তর হলো পঁচিশ হাজার পাঁচশ ছয় যুগ। এক ইন্দ্রের পতন হয় এই সময়ে।

এই কালের ভিতর ইন্দ্র মনুর পতন সূচিত হয়। বৈকুণ্ঠের এক দিন, এক রাত্রি বিধাতার পতনের অপেক্ষিক। সে সময় বৈকুণ্ঠ ও গোলোকধামে সূর্য গতিহীন হয়ে পড়েন, তখন নিশ্চল হয়ে পড়ে চন্দ্র ও গ্রহগুলিও। শ্রীহরির এষনার পরিক্রমায় রাশিচক্রও স্তব্ধ হয়। তিনি নিজ নিকেতনে গমন করেন বলে নিষ্প্রভ হন। কালের স্রোত প্রবাহিত বিষ্ণুলোকেও।

বিধাতাই কাল স্বরূপ দিনরাতের অস্তিত্ব অনুভব করে পাতালবাসীরা আকারে ইঙ্গিতে, সাপের মাথার মণি জ্বললে দিন হয় ও দ্যুতিহীন হলে রাত হয়। সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি চার যুগ। সত্যযুগের কাল পরিধি দেব পরিমাণে চার হাজার আটশ বছর। এক মনুষ্য পরিমাণে বারো লক্ষ ছিয়ানব্বই হাজার বছর ধরে বিরাজ করে ত্রেতা যুগ। কাল সংখ্যা বিষয়ে যেমন শুনেছিলাম বললাম।

৯৭.

উদ্ধব মথুরার দিকে রওনা হলে রাধা বিষাদাচ্ছন্ন হল। যাত্রা শুভ হবার জন্য আয়না, পল্লব, ফল, গন্ধদ্রব্য, প্রদীপ, সোনা, রুপো তাকে দেখিয়ে বললেন– তুমি শ্রীহরির কাছে সম্যক জ্ঞান অর্জন কর। কৃষ্ণের সেবক হও ও তার প্রতি অচলা ভক্তি রাখ। সমগ্র বিশ্ব পরিক্রমা সকল তীর্থোদকে স্নান, নাম, যজ্ঞ ও ব্রতপালক, বেদ, বেদাঙ্গ পাঠ যা অপরকে দিয়ে পাঠ করানো আর্ত ব্যক্তির ত্রাণ, শ্রেষ্ঠ জ্ঞান বিতরণ, শরণাগতকে রক্ষা করা, পিতা মাতার প্রতি ভক্তি, তাদের শ্রদ্ধার সাথে সকার, পুন্যার্জনের পথ প্রশস্ত করে।

দেবীকে প্রণাম করে উদ্ধবের চোখ অশ্রুসিক্ত হল। উদ্ধব বললেন– পৃথিবীতে সকল দ্বীপের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হল জম্বুদ্বীপ। এটি ভারতবর্ষে অবস্থিত। পবিত্র ভারতেই রাধা-কৃষ্ণের দর্শন মানসে ব্রহ্মা পুষ্করে ষাট হাজার বছর কাঠোর তপস্যা করেছিলেন। পরম পরিতাপের বিষয় তিনি নিষ্ফল হলেন। বরাহ কল্পে ভারতের বৃন্দাবনে রাস উৎসবের পবিত্র মুহূর্তে রাসমন্ডলে স্থিত রাধা-কৃষ্ণেকে দেখতে পাবে।

ব্রহ্মা তপস্যা না করে গৃহাভিমুখী হলেন। তিনি যুগল মূর্তি দর্শন করে ধন্য হলেন এবং ভাবলেন গোপ-গোপীনীদের ভাগ্য কতই না সুপ্রসন্ন– কেননা নিয়তই তাঁরা রাধা-কৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হবার দুর্লভ সুযোগ পায়। কৃষ্ণের প্রিয়তমা রাধিকাকে যারা অপবাদ দেয় তাদের বিষাক্ত এবং বীভৎস কীটে পরিপূর্ণ তমসাচ্ছন্ন উত্তপ্ত তৈলে নিক্ষিপ্ত হয়ে চুতদশ ইন্দ্রের আয়ত্তাধীন কাল পর্যন্ত সপ্ত পিতৃগণের সঙ্গে অবর্ননীয় যাতনার মাঝে বাস করে।

তারা একবার শূকর-যোনিতে জন্মায়, দিব্য সহস্র বৎসর বিষ্ঠা-কীটরূপ প্রাপ্ত হয়। উদ্ধবকে রাধা বললেন–মথুরায় গিয়ে তুমি মাধবকে সব কথা খুলে বলবে আর আমার যাতে পুনরায় তার শ্রীমুখের দর্শন সুখ থেকে বঞ্চিত না হই সেরূপ ব্যবস্থা করবে। রাধা আবার কাঁদতে কাঁদতে পুনরায় ভক্তিভরে প্রনাম করে যশোদা ভবনে গেলেন।

উদ্ধব চলে গেলে রাধা সংজ্ঞা হারালেন এবং অচৈতন্য অবস্থাতেও কৃষ্ণের ধ্যানে মগ্ন হলেন। গোপিনীরা অতঃপর স্নিগ্ধতা প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে সপঙ্ক-সজল পদ্মের পর্ণশয্যায় তাকে শুইয়ে দিলেন। রাধার নয়ন থেকে তখন অবিরল ধারায় অশ্রু নির্গত হচ্ছিল। কৃষ্ণের বিরহ জ্বালায় এবং কামনায় তপ্ত রাধাকে সেই শয্যায় শোয়ানোর সাথে তা ভস্মে পরিণত হল। উদ্ধবের বিরহে রাধা শোকাহতা হয়েছিলেন। রাধা বলে উঠলেন, বৎস উদ্ধব! তুমি এবার মথুরায় গমন কর ও অসহনীয় কষ্টের কথা হরির পাদপদ্মে নিবেদন কর।

৯৮.

উদ্ধব যশোদাকে প্রণাম করে যমুনায় গেলেন। স্নান ও আহার সেরে মথুরায় গিয়ে বটগাছের নীচে কৃষ্ণকে দেখলেন। উদ্ধবকে তিনি সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন। উদ্ধবকে কৃষ্ণ নানা প্রশ্ন করলে তিনি বললেন–যে– ভারতে জন্মে সে নিজেকে ধন্য বলে মনে করে। আমি বৃন্দাবনের নয়নভিরাম রাসমন্ডলে গিয়েছি। গোলোকবাসিনী গোপিনীদের এবং গোপকন্যার মধ্যে শ্রেষ্ঠা সকল সৌন্দর্যের সারভৃতা শ্রীরাধিকাকে দর্শন করেও আমি পুণ্যসঞ্চয় করেছি।

রাধা অসন-বসন-ভূষণ ত্যাগ করে নিরিবিলি কদলীবনে চন্দন প্রলিপ্ত সপঞ্চ সজল শয্যায় শুয়ে আছেন। সখীরা তাঁকে শ্বেত চামরে বাতাস করছে। যে কামদেব দেবাদিদেবের ভয়ে সদা ত্রস্ত আপনি সেই শঙ্করেরও পূজিত কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার আপনাকে পতিরূপে লাভ করেও তিনি মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করছেন।

তাই কর্মের চেয়ে বড়ো আর কিছুই নেই এবং কর্ম অনিবারণীয়, বাসন্তিক জ্যোৎস্না রাধাকে দগ্ধ করছে, মৃদু মন্দ সমীরণ তাঁকে পীড়া দিচ্ছে। তপ্ত কাঞ্চনের মতো তিনি উজ্জ্বল গৌরবর্ণা কিন্তু বিরহব্যথায় অধুনা তার বর্ণ কালিমায় লিপ্ত। তার কেশকলাপও পূর্বের সে সৌন্দর্য হারিয়েছে। বিধাতা, যোগীশ্রেষ্ঠদের পরমগুরু শঙ্কর, সনৎকুমার, গনেশ এবং অগণিত মুনি ঋষি আপনার ভক্ত, রাধার তুল্য আপনার একনিষ্ঠ ভক্ত আর কেউ নেই।

উদ্ধবের আকুতি শুনে শ্রীকৃষ্ণ মৃদু হেসে তাকে বেদোক্তরাণী যা চিরকাল হিতসাধন করে থাকে, তা বললেন। উদ্ধবকে কৃষ্ণ বললেন, যে তিনি যখন তার প্রিয়তমাকে কথা দিয়ে এসেছে তাঁর অঙ্গীকার মিথ্যে হতে দেবেন না। উদ্ধব নিশ্চিন্ত হয়ে বাড়ি ফিরে গেল। হরি স্বপ্ন হয়ে সুপ্ত রাধার স্বপ্নে ভেসে উঠলেন ও তাকে আশ্বাস দিলেন। সুপ্ত যশোদাকে জাগ্রত করে স্তন্য পান করলেন।

৯৯.

গর্গবমুনি সিংহাসনে বসলে বসুদেব তাকে মধুপর্ক, কামধেনু, অগ্নিশুদ্ধ পরিধেয়, গন্ধদ্রব্য, পুষ্পমাল্য প্রদান করে তার আরাধনা করলেন। তাকে নানা মিষ্টান্ন, পিঠা ও পায়েস খাইয়ে তাঁকে সুরভিত তাম্বুল দিলেন। গর্গ কৃষ্ণকে স্মরণ মাত্র দর্শন করে মনে মনে তাকে প্রণাম করলেন। পরে তিনি বসুদেব ও দেবকীকে বলেন, কৃষ্ণ ও বলদেবের উপনয়নের সময় হয়েছে।

দুজনের মধ্যে কৃষ্ণ বয়সে ছোটো। আপনি যদুকুলের প্রণম্য পুরোহিত। তাদের উপনয়নের শুভ দিনক্ষণ স্থির করবেন আপনি। গর্গ বললেন, বসুদেব! ঐশ্বর্যে তুমি কুবেরের তুল্য। তোমার মিত্র পরিজনদের নিমন্ত্রণ পত্র প্রেরণ কর। আজ থেকে তৃতীয় দিবসে চন্দ্র-তারা অত্যন্ত অনুকূল। এর চেয়ে শুভদিন আর নেই।

বসুদেব সেই উপনয়নে শ্রদ্ধাঘনচিত্তে সকলকে অভ্যর্থনা জানালেন। দেবতাদের স্তবগান করলেন। তিনি বললেন, আমার মতো নগণ্য এক ব্যক্তির আলয়ে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর উপস্থিত হয়েছেন। সবচেয়ে সুন্দর যে সিংহাসন তাতে তিনি সিদ্ধি দাতা গণেশকে বসালেন। পঞ্চামৃত ও সাগরজলে যথাবিহিত মন্ত্রোচ্চারণে তিনি গনেশের পূজা করলেন। বসুদেব পারিজাতের মালা, মহার্ঘ রত্নালঙ্কার, বাহন, শ্বেতবস্ত্র, সচন্দন গন্ধ কুসুম এবং আংটি দিয়ে গণেশকে বরণ করলেন এবং সিদ্ধিদাতার স্তব করতে লাগলেন।

১০০.

এবার সকলে মিলে পার্বতীকে রত্নময় সিংহাসনে বসিয়ে তাকে মাল্য, বস্ত্র, রত্নালংকারে সজ্জিত করলেন। দৈবকী জগন্মাতার চরণে দেবরাজের আনা রমণীয় পারিজাত কুসুমের অঞ্জলি দিলেন। বিশ্বজননীর চরণ তিনি আলতায় রঞ্জিত করলেন এবং শুভ্র চামর ব্যঞ্জন করে তার সেবায় আত্মনিয়োগ করলেন।

তিনি সুন্দরী রাজকন্যা-দেবকন্যা-নাগকন্যা-মুনিকন্যাদের সাদর অভ্যর্থনা জানালেন। তিনি মথুরা নগরীর গ্রাম্য দেবতা ভৈরবী এবং ষষ্ঠী মঙ্গলচন্ডী ও অন্যান্য দেবীদের ষড়োশোপচারে আরাধনা করলেন। বৈদিক ব্রাহ্মণদের বেদপাঠ করতে বললেন। কৃষ্ণ ও বলরাম রম্যবস্ত্র পরিধান করে এবং অলংকারে ভূষিত হয়ে দেবতা এবং মুনি-ঋষিরা অলংকৃত পবিত্র সভায় আগমন করলেন। সকল মুনি-ঋষিরা একে একে কৃষ্ণের স্তব করতে লাগলেন। ব্রহ্মা বললেন–ভক্তদের প্রীতির উদ্দেশ্যে আপনি অবর্ণনীয় রূপ ধারণ করেন।

আপনার গুণকীর্তন করার শক্তি বেদেরও নেই। কোনো কিছুতেই আপনার কোনো আসক্তি নেই এবং আপনি সকল কর্মের সাক্ষী। নীরে শায়িত মহাবিষ্ণুর রোম বিবরে সংখ্যাগণনার অতীত কৃত্রিম ব্রহ্মান্ডের অবস্থান। আপনি অনন্ত কোটি ব্রহ্মাণ্ডের কারণ স্বরূপ। প্রতি বিশ্বে আপনার অংশসস্তৃত ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শঙ্করদি বেদগণ, পবিত্র তীর্থসমূহ সব মিলে ভারতের স্থিতি।

এক ব্রহ্মাণ্ডে অধিষ্ঠিত শীর্ণ নাগরূপী আমাকে আপনি শ্রেষ্ঠ হস্তির উপর অতি ক্ষুদ্র একটি মশকের মতো অধিষ্ঠিত করেছেন। এ পৃথিবীতে পরমাণুর চেয়ে সূক্ষ্ম এবং মহাবিষ্ণুর চেয়ে বিরাট আর কিছু নেই বলে আমরা মনে করি। আপনি মহাবিষ্ণু অপেক্ষাও বিরাট এবং সূক্ষ্ম পরমাণুর চেয়েও, মহাবিষ্ণুর জলাধার, স্থাবর গোলকরূপেও জলের আধার। মহাবায়ু আপনার শ্বাস প্রশ্বাসজাত, আপনি সর্বাধার।

আমাকে কৃপাতিশয্যে আপনি অনেক সুখ দিয়েছেন। কিন্তু ঐকান্তিক ইচ্ছা থাকলেও আমি তা পারছি না, কেননা আপনি আমায় প্রজ্ঞা দেননি। অনন্তদেব, ব্রহ্মা ও বিষ্ণুও আপনার স্তুতি করতে অসমর্থ। আপনার স্তুতিতে আত্মনিয়োগ করলে সরস্বতীর জিহ্বাও জড়তা প্রাপ্ত হয় — সংযতেন্দ্রিয়, নির্মল হৃদয় যে ব্যক্তি এই পুণ্যাদায়ক স্তব পাঠ করেন তিনি কৃষ্ণের কৃপায় চতুবর্গ ফল লাভ করেন। এবং প্রয়াণোত্তর কালে রত্ননির্মিত রথ নেমে এসে তাঁকে গোলোকধামে নিয়ে যায়।

১০১.

মুনিরা নিবিড় ধ্যানযোগেও শ্রীকৃষ্ণের দেখা পেলেন না, নন্দের প্রাঙ্গনে পীতাম্বর কৃষ্ণের নয়নাভিরাম রূপ প্রত্যক্ষ করলেন। তার ললাটে মৃগনাভি সুরভিত গোলাকার চন্দনবিন্দু মেঘমালার মধ্যে অবস্থিত কলঙ্কচিহ্ন যুক্ত চন্দ্রের মতো শোভা পাচ্ছিল। শ্যামল শোভন কৃষ্ণের মুখে মৃদু হাসি। তার দেহধারণ ভক্তের কৃপার জন্যই। রত্ননির্মিত বাহুর অলংকার, বলয় এবং নুপূর প্রভৃতিতে অলংকৃত হয়ে বলদেবের সঙ্গে পিতার কোলে বসেছিলেন।

তিনি শ্রদ্ধায় সমাদরে বিপদের শত সুবর্ণ দান করলেন, দেবতা, মুনি এবং পুরোহিতদের প্রণাম করলেন, গণেশ-সূর্য-অগ্নি-বিষ্ণু-শিব ও পার্বতীকে ষোড়শপচারে পূজো করেন। বৈদিক মন্ত্রে পুত্রদ্বয়ের শুভকার্যের পূর্বে গন্ধমাল্যাদি দ্বারা সংস্কার সাধন করলেন। দেবতা, দিকপাল, নবগ্রহ এবং ষোড়শ মাতাদের পঞ্চোপচারে আরাধনা করে মাঙ্গলিক এবং বেদ নির্দেশিত শুভকর্মের পূর্বকৃত্য সম্পন্ন করলেন।

কালই মানুষের সুখ-দুঃখ, বিচ্ছেদ-মিলনের কারণ। পিতা নন্দকে আমি সুদুর্লভ তত্ত্বের কথা বলেছি। অতঃপর কৃষ্ণ বসুদেবের কাছে সন্দিপনি মুনির গৃহে যাত্রার অনুমতি প্রার্থনা করলেন। দেবকী নন্দকে মনি, মুক্তা, সোনা, হীরে সুন্দর পরিধেয় বস্ত্র প্রদান করলেন। বিপ্রগণ, দেবকী প্রভৃতি রমণীরা, অক্রুর-উদ্ধব প্রভৃতি মিত্রেরা, নন্দ ও যশোদা সমভিব্যাহারে যাত্রা করেন।

১০২.

কৃষ্ণ বলদেব সহ সন্দীপন মুনির আলয়ে উপস্থিত হয়ে গুরুপত্নীকে সশ্রদ্ধ চিত্তে প্রণাম করলেন। গুরু ও গুরুপত্নীর আশীর্বাদ লাভে তাঁরা ধন্য হলেন। সন্দীপন কৃষ্ণের অর্চনা করলেন এবং তার অভিলষিত বিদ্যা প্রদানে আনন্দিত চিত্তে সম্মত হলেন। তিনি তাদের মধুপর্ক, চন্দন, সুরভিত বস্ত্র প্রদান করলেন। মিষ্টান্ন ভোজন করালেন ও তাম্বুল দিলেন।

মুনিপত্নী বললেন, মায়াবলে আপনি বালকের রূপ পরিগ্রহ করেছেন। পৃথিবীর ভার মোচনের উদ্দেশ্যেই আপনি আবির্ভূত হয়েছেন। আপনি মায়াবশেই বালকরূপ ধারণ করে উপনয়নান্তে পতিদেবতার কাছে বেদাধ্যয়নের নিমিত্ত আগমন করেছেন। আপনার কৃপায় নির্মোহ দূর হল। তিনি সজল নয়নে কৃষ্ণকে কোলে তুলে নিলেন এবং দেবকীর মতো পুত্র জ্ঞানে তাকে স্তন্য পান করালেন।

১০৩.

বলদেবের সঙ্গে কৃষ্ণ মথুরায় ফিরে এলেন।–বাবাকে প্রণাম করে বটগাছের তলায় গিয়ে গরুড়, লবণ-সাগর, কৌমোদকী, পাঞ্চজন্য, বৈকুণ্ঠধামের কথা মনে করলেন। গোপালকের বেশ বর্জন করে রাজার মূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করলেন। কৃষ্ণের হস্তগত হলো সুদর্শন চক্র। কৃষ্ণ বললেন, হে সমুদ্র! শতযোজন পরিমিত স্থান দান কর। সুদর্শন চক্ৰ কৃষ্ণের নিত্যসঙ্গী হয়ে রয়ে গেলেন।

শ্রীকৃষ্ণ মহামহিম, মহাশক্তিশালী কংসের জনক উগ্রসেনকে সেই পুরের রাজ সিংহাসনে বসালেন। যদুগণ ও তঁদের সেবকদের নিমিত্ত মরুগুলিও যেন উৎকৃষ্ট হয়। রাজা উগ্রসেনের রাজভবন। পুনরায় নির্মাণ করতে হবে আর পিতা বসুদেবের ভবনটি যেন সব দিক থেকে সুখপ্রদ হয় সে দিকেও দৃষ্টি রাখতে হবে। শিবির নির্মাণের জন্য কোন কোন কাঠ ব্যবহার করব আমাকে অনুগ্রহ করে জানান।

শ্রীকৃষ্ণ তখন বিশ্বকর্মাকে বললেন, হে দেবশিল্পী! গৃহাশ্রমের ঈশাণ কোণে নারকেল গাছ ধন বিতরণ করে, শিবিরের পূর্বদিকে রোপন করলে পুত্ৰপদ হয়ে থাকে। যে সব গাছ দেখতে সুন্দর সেগুলি যে কোনো স্থানেই পোঁতা যেতে পারে। দক্ষিণ এবং পশ্চিমে সুপারি গাছ আনন্দ দেয় আর ঈশাণ কোণে বা অন্যান্য দিকে প্রোথিত হলে হয়ে থাকে সুখদায়ী।

নগরের কিংবা গ্রামে কার্পাস, মুসুর এবং সরিষা গাছ বর্জনীয় নয়, আবার প্রশস্তও বলা যায় না। প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা সূত্রধর, তৈলকার, স্বর্ণকার, হীরার ব্যবসায়ীদের বসতির কাছে গৃহ নির্মাণ করবেন না।

ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় বৈশ্য, সৎশূদ্র, বৈদৰ্তও, স্তুতিপাঠক, বৈদ্য ও মালাকাররা সেখানে অবস্থান করে–সেখানে বাস করাই শ্রেয়। শিবিরের চারিদিকে একশ হাত গভীর এবং প্রস্থেও একশ হাত পাঁচিল গাঁথা দরকার। পাঁচিল এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে বন্ধুরা সহজেই অভ্যস্তরে প্রবেশ করতে পারে, শত্রুরা অনেক চেষ্টা করেও ভেতরে আসতে পারে না।

পণ্ডিতরা বজ্রাহত বৃক্ষ লাগাতেও নিষেধ করেছেন। দ্বারাবতী রত্নাদি নির্মিত হবে তাই এ পুরী সম্পর্কে কাঠের প্রশ্ন অবান্তর। শ্রীকৃষ্ণকে প্রণাম করে গরুড়কে সঙ্গে নিয়ে বিশ্বকর্মা সাগরের নিকটে রমণীয় বটমূলে গিয়ে রাতের বেলাটা সেখানেই ঘুমিয়ে কাটালেন। গরুড় নিশীথ রাতের স্বপ্নে দ্বারাবতী নগরীর সুন্দর স্বপ্ন দেখলেন।

শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকাপুরীর যেমন ছবি বিশ্বকর্মার মনে এঁকে দিচ্ছিলেন ঠিক সেইরকম গরুড় নগর প্রত্যক্ষ করে বিস্মিত হলেন। পুর নির্মাতা প্রথিতযশা শিল্পীরা বিশ্বকর্মাকে এবং সে অঞ্চলের পাখিরা গরুড়কে উপহাস করছে এদৃশ্যও তিনি ঘুমঘোরে দেখেছিলেন। ঘুম ভাঙতেই পক্ষীরাজ শতযোজন ব্যাপী মনোহর দ্বারকাপুরী নির্মাণ করে বিশ্বকর্মাকে স্তম্ভিত করলেন। ব্রহ্মলোকের সৌন্দর্যও দ্বারকার সৌন্দর্যের কাছে ম্লান হয়ে যাচ্ছে।

১০৪.

সকলে নব নির্মিত দ্বারকাপুরী প্রত্যক্ষ করার জন্য বটমূলে সমবেত হলেন। যাঁরা আকাশে বাস করেন তারা বিমান থেকে দ্বারকাপুরীর সৌন্দর্য অবলোকন করে মুগ্ধ হলেন। বর্তুলাকারে শত যোজন ব্যাপী দ্বারকা মুক্তা-মাণিক্য হীরা দ্যুতিতে ভাস্বর হয়ে বিরাজ করছে। নগরকে ঘিরে রেখেছে সাত পরিখা। রাজপথগুলি অত্যন্ত প্রশস্ত, মধ্যাহ্ন সূর্যের দীপ্তি ভাস্বর রত্নের ঔজ্জ্বল্যে দ্বারকায় ঐশ্বর্যে রমণীয়তায় দেবতারা বিস্ময়ে অভিভূত হলেন।

শ্রীকৃষ্ণ উগ্রসেনকে অতঃপর দ্বারকাপুরীতে বাস করার নির্দেশ দিতেই ভয়ে তাঁর মুখ শুকিয়ে গেল। তিনি বললেন, মথুরা তার পৈতৃকভূমি। পিতার খোঁড়া গর্তের জলে স্নান করলেও গঙ্গাস্নানের ফল পাওয়া যায়। দেবতারা যেমন ইন্দ্রকে কর দেন, জম্বুদ্বীপের নৃপতিরাও তেমন আপনাকে রাজকর দেবেন।

উগ্রসেনের তুল্য রাজা পূর্বেও আবির্ভূত হননি, ভবিষ্যতে হবেনও না। উগ্রসেন পাঁচ লক্ষ সারথি শতকোটি সেবক পরিবেষ্টিত, রত্নবীথিতে ভাস্বর সুধর্মা সভায় প্রবেশ করতেই শাঁখ বেজে উঠল, বাদকেরা দুন্দুভি বাজাতে লাগল। কৃষ্ণ অপরাপর দেবতা, তপোবন গর্গ এবং মুনিদের আদেশে অমিত শক্তির অধিকারী উগ্রসেন রাজসিংহাসন অলংকৃত করলেন।

শ্রীকৃষ্ণ রাজাকে বরুণ প্রদত্ত অগ্নিশুদ্ধ মনোহর দুইটি বস্ত্র দিলেন। বলদেব দিলেন পারিজাতের মালা, রত্নলংকার এবং রত্নছত্র। নন্দ সুরভিত কামধেনু দান করলেন। সাতজন কিঙ্কর সেবিত অত্রুর শ্রীকৃষ্ণের আদেশে ও প্রভুভক্তির নিদর্শন স্বরূপ উগ্রসেনের মাথায় রাজছত্র মেলে ধরলেন। শ্রীকৃষ্ণের সহায়তায় রাজসিংহাসনে উপবিষ্ট নৃপতি রত্নদর্পণ এবং সুখ ও সমৃদ্ধিশালী আদর্শ রাজ্য দর্শন করে ধন্য হলেন। দেবতারা ও ব্রাহ্মণরা তাকে আশীর্বাদ করতে লাগলেন। উগ্রসেনও শ্রদ্ধা সহকারে শত শত রত্নদান করলেন। শ্রীহরির সভাসদেরা বিদায় নিলেন।

১০৫.

ভীষ্মক বিদর্ভ দেশের নৃপতি ছিলেন। রাজার রমণীকুল শ্ৰেষ্ঠা মহালক্ষ্মী স্বরূপিণী অতিশয় সুন্দরী রুক্মিণী নামে এক কন্যা ছিলেন। তপ্তকাঞ্চন বর্না উদ্ভিন্ন যৌবনা রুক্মিণী অলংকৃত হওয়ায় মনে হচ্ছিল তার সারা শরীর দিয়ে যেন সৌন্দর্য ঠিকরে বেরচ্ছিল। রাজার মনে হল কাল বিলম্ব না করে রুক্মিণীর বিবাহ দেওয়া উচিত। তিনি রাজসভাশ্রিত পুরোহিত ও বিগণকে জিজ্ঞেস করলেন, কার সাথে তার পুত্রীর বিয়ে দেওয়া উচিত।

তাঁর কন্যা নব যৌবনের সৌন্দর্যে বিকশিত হচ্ছে। তাই বরণীয় পাত্রের জন্য আমি অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়েছি। তাঁর কথা শুনে গৌতম মুনির সুযোগ্য পুত্ৰ কুলপুরোহিত শতানন্দ বললেন– ব্রহ্মা, মহেশ্বর যাঁর স্তুতিতে সদা মুখর, প্রকৃতি নির্লিপ্ত পরমাত্মা, সকল কর্মের নীরব প্রত্যক্ষকারী। পৃথিবীর ভারমোচনের জন্য বসুদেবের পুত্ররূপে আবির্ভূত হয়েছেন, তাঁকে কন্যা সম্প্রদান করে গোলোক যাত্রার পথ সুগম ও পুনর্জন্ম রোধ কর।

শ্রীকৃষ্ণকে আনার জন্য দ্বারকায় দূত প্রেরণ কর। ভক্তেরা অনন্যমনা হয়ে ধ্যানযোগে তার দর্শন পায় এবং পুনর্জন্ম রহিত হয়, কর্মফল মুক্ত হয়। চতুর্বেদ, দেবতারা, মুনীন্দ্র এবং সিদ্ধাচার্যেরাও তার স্বরূপ অবগত নন, দেবতারাও যাঁর স্তব করতে অসমর্থ, যোগীরাও যাঁকে ধ্যান যোগে জানতে পারেন না, আমি তো কোনো শিশু, আমি কিভাবে তাকে বর্ণনা করব?

উগ্রসেন আনন্দাতিশয্যে শতনন্দকে বুকে চেপে ধরলেন এবং বিবিধ রত্ন, সোনা, মূল্যবান পরিচ্ছদ, গজ, অশ্ব, মণিনির্মিত রথ, অপরিমেয় ঐশ্বর্য, নিরন্তর ব্যতীতই যে ভূমি শস্য উৎপাদন করে সেরূপ ভূমি, পবিত্র জমি, সুখ্যাতি আছে এমন গ্রাম দান করলেন। রুক্মিণী সব শুনে এবং প্রত্যক্ষ করে উত্তেজনায় কাঁপতে লাগলেন। তাঁর মুখ লাল হয়ে সারা শরীর ঘেমে উঠল।

কৃষ্ণ অত্যন্ত হীন, কেননা অন্যকে দিয়ে কালযবনকে হত্যা করে তার ঐশ্বর্য আত্মসাৎ করেছেন। যবনের বিত্তে দ্বারকায় অতুল ঐশ্বর্যের অধিকারী হয়েছে কৃষ্ণ। রুদ্রতুল্য বলশালী শিশুপালকে রুক্মিণী সম্প্রদান করুন। যোগ্য পাত্রেই কন্যা সম্প্রদান করা বিধেয়। দেশ বিদেশের রাজাদের, মুনি-ঋষিদের নিমন্ত্রণ লিপি প্রেরণ কর। পূর্ণিমায় গ্রাম্য দেবীর কাছে দশ লক্ষ ছাগল ও চল্লিশ লক্ষ ভেঁড়া বলি দেবার ব্যবস্থা করা হোক। এই মাংস এবং ব্যঞ্জনাদি দ্বারা অতিথি আপ্যায়ন করা হোক।

রাজা ভীস্মক পুত্রের কথা শুনে রাজপুরোহিতদের সঙ্গে নির্জন স্থানে মন্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হলেন এবং অনেকক্ষণ ধরে পরামর্শ করে বিশ্বস্ত এক ব্রাহ্মণকে দ্বারকায় পাঠালেন। শুভলগ্ন স্থির করে রাজা সত্ত্বর পরিণয়ের উপাদান সামগ্রী সংগ্রহ করলেন। নিমন্ত্রণ লিপি পাঠালেন পুত্রের অনুরোধে দেশ বিদেশের রাজাদের।

এদিকে ভীস্মকের প্রেরিত সেই ব্রাহ্মণ, সুধর্মা সভায় গিয়ে উগ্রসেনকে কল্যাণ পত্রিকাটি দিলেন। সেই পত্রের বিষয়বস্তু শুনে উগ্রসেন অতিশয় আনন্দিত হলেন ও বিপ্রদের শত শত সুবর্ণ দান করলেন। প্রীতিভোজের অনুষ্ঠানে যোগ দিলেন। দেবতারা, নৃপতিরা, রাজার আত্মীয় স্বজনেরা, বন্ধুরা, বৈতালিকেরা উগ্রসেন ত্রিলোকদুর্লভ বেশে শ্রীকৃষ্ণকে সজ্জিত করালেন এবং শুভলগ্ন সমাগত হলে বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণ পূর্বক তাকে বিবাহের উদ্দেশ্যে পাঠালেন।

বলদেব, বসুদেব, উদ্ধব, নন্দ, অক্রুর, সাত্যকি, গোপালকেরা এবং যাদবেন্দ্রগণও রত্ননে গমন করলেন। রথে উঠলেন কুরু-পাণ্ডবেরা। ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য, শকুনি সকলেই খুব খুশী হয়েছেন। বরযাত্রায় অংশ নিলেন তিন কোটি চারণ, শত কোটি বিপ্র, হাজার সন্ন্যাসী ও রিপুজয়ী দু হাজার অবধূত! হাজার হাজার মালাকর পদ্ম ও আরও অনেক ফুল নিয়ে, বৈতালিকেরা স্তুতি করতে করতে, বাদকেরা বাজনা বাজাতে, নর্তকেরা নাচতে নাচতে, গায়কেরা গাইতে গাইতে কৃষ্ণের অনুগমন করল।

নারদ! তুমি সেকল্পে একজন গন্ধর্ব ছিলে আর তোমার নাম ছিল উপবর্হন, পঞ্চাশজন গোপিনীর সঙ্গে তুণি কৃষ্ণের সঙ্গী ছিলে। একলক্ষ বিদ্যাধরী অপ্সরা, তিনলক্ষ কিন্নরী এবং এক লক্ষ গন্ধর্ব অর্জিত বিদ্যার নৈপুণ্য দেখাতে দেখাতে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে যাত্রা করল।

১০৬.

বলবান কুকুদ্বানরাজ, স্বীয় তনয়ার জন্য যোগ্য পাত্রের সন্ধানে ব্রহ্মালোক থেকে সেখানে এলেন। চিরযৌবনা মূল্যবান পরিচ্ছদ-শোভিতা রেবতী নামে তাঁর কন্যার সঙ্গে বলদেবের বিবাহ সম্পন্ন হলো। রেবতীর বয়স সাতাশ সত্যযুগ অতিক্রান্ত হলেও তার রূপ যৌবনের ক্ষয় নেই। অতঃপর রাজা তাঁদের সঙ্গে রত্নরথে কুন্ডিনপুরে গমন করলেন।

বসুদেবের স্ত্রী ব্রাহ্মণদের সুস্বাদু আহার্য পরিবেশন করলেন। সানন্দে তাঁদের ধনরত্ন দান করলেন। দেবতা, মুনি ও নৃপতিগণ কুন্ডিননগরে গেলেন। সাত পরিখা প্রাচীর বেষ্টিত শতদ্বারে অলংকৃত বিশ্বকর্মা নির্মিত রত্নশোভিত সেই নগরী দেখে মুগ্ধ হলেন। বরযাত্রীরা বহ্নিগরী প্রত্যক্ষ করলেন।

রুক্মিণী মহাবল, দন্তবক্র, শাম্ব শ্রীকৃষ্ণের সৈন্য দেখে অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে অস্ত্রসজ্জিত হয়ে রনোন্মত্ত হয়ে উঠল। রুক্মিণী দেবতা মুনি ও রাজাদের অপমান করার জন্য কটু বাক্য প্রয়োগ করে। নন্দের নন্দন, রুক্মিণীকে গ্রহণ করতে দেব ও মুনিবেষ্টিত হয়ে অগ্রসর হচ্ছে যে গোপীদের উপপতি, রাখালদের উচ্ছিষ্ট ভোজী, যার বালাই নেই জাতপাতের নির্বিচারে যে যৌন মিলনে রত হয় সেই অজ্ঞ পুরুষটি আবার মুনিগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ! বৈশ্যের অন্নভোজী বসুদেব তনয় ক্ষত্রিয় হয়ে।

সেই স্ত্রীকে অপহরণ করল যাকে বধ করলে পঞ্চবিধ মহাপাপ স্পর্শ করে বাল্যকালে। যৌন সহবাসে কুব্জাম্রকে বধ করে পরিচ্ছদের জন্য রজকের শিরচ্ছেদনেও কুণ্ঠিত হলো না কী দুঃসাহস। ব্রহ্মহত্যার পাপ ভোগ করতে হয় যে রাজাকে হত্যা করে। সে মথুরায় নিধন করেছেন ধর্মী কংসকে। রুক্মিণীর কথা যে মিথ্যা নয় তা শাম্ব বললেন।

রুক্মিণীর সাথে পরিণয়ে আবদ্ধ হতে চায় নন্দের রাখাল। শিশুপাল বিস্মিত হচ্ছে এই ভেবে যে, ব্রহ্মাদি দেবতারা, ব্রহ্মপুত্র ঋষিরা মানুষের আহ্বানে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছেন। দন্তবক্র বলল, ব্রাহ্মণেরা লোভের বসে সব কাজ করে থাকে, দেবতারা, ভক্তবৎসল হন আর তাই তাদের আগমনকে মেনে নেওয়া যেতে পারে কিন্তু নন্দের নন্দনের আদেশে তারা কেন এখানে এলেন?

১০৭.

বলদেব উত্তেজিত হয়ে হলদ্বারা রুক্মিণীর রথ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেন ও তাকে বিনাশ করার জন্য বেগে গমন করলেন। রুক্মিণী তীর ছুঁড়ে বলদেবকে নিবৃত্ত করে তাকে বন্ধন করবার জন্য নাগাস্ত্র প্রয়োগ করলে বলদেব গরুড়াস্ত্রপ্রয়োগ করে নাগস্ত্র নিবারণে সক্ষম হলেন। রুক্মিণী মাটিতে পড়ে ঘুমাতে থাকে শুকনো একটা গাছের মতো। শাম্ব তাকে ঘুমাতে দেখে শত শত বাণ নিক্ষেপ করতে লাগলেন বৃষ্টির মতো।

ভীষ্মক শ্রীহরির সুবেশ রচনায় আত্মনিয়োগ করলেন। তিনি পুরোহিতদের বেদ মন্ত্র আবৃত্তির আদেশ দিলেন। ভাট, বিপ্র এবং ভিক্ষুকদের তিনি উপাদেয় আহার্য, মণিমানিক্য উপহার দিলেন। দেবতা-মুনি- ব্রাহ্মণ সমভিব্যহার কৃষ্ণ ভীষ্মকরাজের প্রাঙ্গনে উপস্থিত হলেন। তার আত্মীয় স্বজন তাকে অনুসরণ করলেন।

সেখানে মৃদু মন্দ বাতাস বইছে। প্রদীপের প্রজ্বলিত শিখায় চারদিক অলোকিত ও ধূপের গন্ধ বিতরণ করছে। স্থানটিকে রমণীয় করে তুলছেন শিল্পী ও মালাকার। যিনি জগৎ সৃষ্টি করেছেন, যিনি সকল ঐশ্বর্য দান করে থাকেন, আমার মতো সাধারণ মানুষ স্বপ্নেও যাঁর চরণ-কমল দর্শনের উপযুক্ত নয়, আজ আমার কী অসীম সৌভাগ্য সেই পরমাত্মাকে আমার প্রাঙ্গণে প্রত্যক্ষ করছি।

মহাবিষ্ণুর চেয়ে স্কুল ও পরমাণু অপেক্ষা সূক্ষ্ম আর কিছুই নেই। কর্মশীলের কর্মপ্রবাহের ও কারণকূটের আদি কারণ আপনি। সাগর পরমাত্মা ছাড়া কারুর অঙ্গ থেকে কি জ্যোতি নির্গত হয়! ইন্দ্র পারিজাত মাল্য পাঠিয়েছিলেন– তা জামাতার কণ্ঠে দিলেন ভীষ্মক। ভীষ্মক বস্তু ও ধূপদীপ দিয়ে শ্রীকৃষ্ণের পূজা করলেন।

১০৮.

রুক্মিণী সভায় এলেন। তাঁর কবরী মনোহর। তার দেহ চন্দন চর্চিত। গৌরবর্ণ দেহ চন্দন রাগে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। তার কণ্ঠে মালতীর মালা। রুক্মিণী পতিদেবতাকে সাতবার প্রদক্ষিণ করে তাকে সচন্দন পল্লবদ্বারা শীতল জল সেচন করে প্রণাম করলেন। ভীষ্মক রাজ বেদোক্ত মন্ত্রে শ্রীকৃষ্ণকে রুক্মিণী সম্প্রদান করলেন। শিব যেমন পার্বতীকে গ্রহণ করেছিলেন, তেমন কৃষ্ণ রুক্মিণীকে পত্নীরূপে গ্রহণ করলেন। শুভকর্ম সম্পন্ন হলে ভীষ্মক কন্যাকে বুকে নিয়ে কাঁদতে লাগলেন। কৃষ্ণের প্রতি কন্যার ভার সমর্পণ করে তিনি ধন্য হলেন।

১০৯.

শচী বললেন, যৌবনবতী রুক্মিণী তোমাকে কামনা করছেন। সাবিত্রী বললেন, বিধাতা গুণশালী বরের সাথেই গুণবতী কন্যার মিলন সাধন করেছেন। রুক্মিণী দূর থেকে যদি তাকে প্রণাম করেন তবে তিনি রুক্মিণীর সঙ্গে কথঞ্চিত তুলনীয় হবেন। রুক্মিণী সকলকে ভোজন করালেন। গান-বাজনায় চারিদিক মুখরিত হয়ে উঠল। সকাল হলে কর্মব্যস্ত ব্রহ্মা, মহেশ, অনন্ত দেবতারা নিজ নিজ যানে আরোহণ করলেন, উগ্রসেন ও বসুদেব রুক্মিণীর পতিগৃহে যাত্রার আয়োজনে প্রয়াসী হলেন।

রুক্মিণী জননী মেয়েকে বুকে চেপে ধরে আসন্ন বিচ্ছেদ বেদনায় রোদন করতে লাগলেন। ভীষ্মকও উচ্চ স্বরে রোদন করতে লাগলেন। দেবকী, রোহিনী, যশোদা, অদিতি, দিতি এবং উদ্ভব বাসিনীরা মঙ্গলকর্ম সম্পাদনে তৎপর হলেন। খাওয়া– দাওয়া সেরে বৈতালিক বিপ্রগণ ধনরত্নের উপহার গ্রহণ করে নিষ্ক্রান্ত হলেন।

১১০.

নন্দ যশোদাকে নিয়ে কদলীবনে গমন করলেন ও সেখানে সুপ্তিমগ্না, উপবাস কৃশ শুক্ল বস্ত্রপরিহিতা রাধাকে দেখতে পেলেন। তার সখীরা চামর দুলিয়ে তাকে বাতাস করছেন। বেত্রধারিণী শত কোটি গোপবালা তাঁর তত্ত্বাবধানে সতত নিযুক্ত।

রাধার এ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে নন্দ ও তাঁর স্ত্রী বিস্ময়াবিষ্ট হলেন। তারা ভক্তিসহ তাঁকে প্রণাম করলেন। গোপিরা যশোদাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কে? যশোদার কাছে শ্রীকৃষ্ণের মঙ্গলবার্তা শুনে রাধা লুপ্ত চেতনা ফিরে পেয়ে আনন্দিত হলেন। অতঃপর তিনি শ্রুতিসুখকর বাক্যে ভক্তিযোগের উপদেশ দিলেন।

১১১.

কুযোগের অধিকারী কোনো ব্যক্তি সাময়িকভাবে গোলোকধামে উপনীত হলেও তার অধঃপতন অনিবার্য। শ্রীকৃষ্ণকে পুত্ররূপে না দেখে তাকে ব্রহ্মরূপে ধ্যান করুন। কর্মের জাল ছিন্ন হলে শত শত জন্মের পিতৃ ও পিতামহ সেই অক্ষয় ধান লাভ করবেন। কুযোগী পাপীদের ‘নারা’ শব্দটি বোধ জন্মাতে সহায়তা করে। বেদ ব্যতীত, অর্থেও ‘মধুসূদন’ শব্দটি সাধুরা প্রয়োগ করে থাকেন। ‘মধু’ শব্দটি ক্লীবলিঙ্গ। ফুলের মধু ও শুভাশুভ কর্ম বোঝাতেও শব্দটি প্রয়োগ করা হয়।

দেবতাদের নাম তিন হাজার বার উচ্চারণ করলে যে ফল হয় একবার কৃষ্ণ নাম উচ্চারিত হলে সেই ফল প্রাপ্তি হয়ে থাকে। যারা বেদ পাঠ করেন মনোযোগ দিয়ে তার কাছে কৃষ্ণনামের চেয়ে উত্তম আর কিছুই হতে পারে না। মহাবিষ্ণু হলেন তিনি যাঁর প্রতিটি রোপকূপে বিরাট এ বিশ্ব শোভমান। বৃষভানু কৃষ্ণের সভাসদদের মধ্যে প্রধান। কলাবতী জনয়িতাগণের মানসী তনয়া। আমার জননী ও আমি অযোনিসম্ভবা, অন্তে লীন হবো হরিচরণে।

১১২

রুক্মিণী কৃষ্ণকে প্রণাম করলেন, শুভ মুহূর্তে কৃষ্ণ তাঁর সঙ্গে সঙ্গমরত হলেন। রুক্মিণী দেহমিলনের আনন্দে সংজ্ঞা হারালেন। সহবাসের চরম পুলকের ক্ষণে মহাদেব কর্তৃক ভস্মীভূত মদন যেন পুনরাবির্ভূত হলেন, অসুরকে বধ করেই প্রেমময়ী রতির কামদেবের সঙ্গে পুনর্মিলন হয়েছিল। কৃষ্ণ উৎসবের আনন্দে মেতে উঠলেন। অতঃপর তিনি বেদ নির্দেশিত শুভদিনে কালিন্দী, সত্যভামা, সত্যা, নাগ্নজিতী, সতী, জাম্ববতী ও লক্ষণার সঙ্গে স্বতন্ত্রভাবে সহবাস করলেন, উক্ত রমণীদের প্রত্যেকের গর্ভে দশটি করে পুত্র জন্মাল।

১১৩

দুর্বাসা মহেশ্বরের সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়ে দ্বারকাপুরী ছেড়ে কৈলাসের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। সেখানে তিনি ও তাঁর শিষ্যরা শ্রদ্ধা সহকারে শিব-দুর্গাকে প্রণাম করে হরি বৃত্তান্ত’ নিবেদন করলেন। যে স্বামী তাঁর সদ্বংশজাত পত্নীকে ত্যাগ করে সন্ন্যাসীর জীবন যাপন করে, বা যে ব্যক্তির ব্যবসার নিমিত্ত বা অন্য কোনো কারণে চিরদিনের জন্য বিদেশবাসী হয় সে মোক্ষলাভ করতে পারে না।

জ্ঞানেই হোক বা অজ্ঞানেই হোক, বাল্যে-কৌমার্যে-বার্ধক্যে, কৃত হরিনামে পাপ ধুয়ে মুছে যায়। তাঁর পদরেণুর স্পর্শেই কোনো স্থান তীর্থে পরিণত হয়। যে দ্বিজ কৃষ্ণের প্রসাদ পায় যে জল, অগ্নি ও বায়ুর চেয়ে পবিত্র তার সংস্পর্শে পৃথিবী পবিত্র হয়ে ওঠে। যে গুরু শিষ্যের অন্তরিন্দ্রিয়ে কৃষ্ণভক্তি জাগাতে পারেন না তিনি তাঁর আশ্রিত শিষ্যের শক্রস্বরূপ। চতুর্দশ মনু, সপ্তর্ষি চারিবেদ, সৃষ্টি দিকপাল, গ্রহেরা আপনার অংশ, কেউবা আপনার অংশে অংশ।

আপনি মন্ত্রী আর জগত প্রপঞ্চ আপনার মন্ত্র। হে মাধব! আমি নির্বোধ, পাপী, আমায় আপনার ক্ষমা দৃষ্টি থেকে বঞ্চিত করবেন না, শিশুপালের স্তুতিতে সমবেত সকলে জানতে পারলেন পূর্ণ ও চিরন্তন ঈশ্বর শ্রীকৃষ্ণই। রাজসূয় যজ্ঞ শেষে ব্রাহ্মণ ভোজন করিয়ে শ্রীকৃষ্ণ কুরুপাণ্ডব যুদ্ধ করালেন।

পৃথিবীর ভার কামানোর পর তিনি অনেকদিন হস্তিনাপুরে অবস্থান করলেন। তারপর শুভদিনে ধর্মপুত্রের মত নিয়ে দ্বারকায় গেলেন। জনৈক ব্রাহ্মণ পত্নীর প্রয়াত পুত্রদের পুনরুজ্জীবিত করলেন। এই আশ্চর্য ঘটনা দেখে দেবকী তার মৃত পুত্রদের জীবিত করতে বললেন। ভগবান তার ভক্ত সুদাম বিপ্রের চাউল কণামাত্র গ্রহণ করে অধঃস্তন সাত পুরুষ ভোগ করার মত ঐশ্বর্য দান করলেন। সেই দ্বিজ কুবের তুল্য ধনী হলেন এবং ইন্দ্রপুরীর মতো তাঁর রাজ্যও সমৃদ্ধ হলো। তাকে অচঞ্চল হরিভক্তি প্রদান করলেন কৃপানিধি কৃষ্ণ। ইন্দ্রের সৌরভজাত গর্ব খর্ব করলেন স্বর্গের পারিজাত অপহরণ করে। ভগবান সত্যাকে তার স্পৃহনীয় পুণ্যক ব্রত পালনে সহায়তা করলেন। পুণ্যকব্রতে সনৎকুমার তার প্রাপ্যরূপে আত্মদান করলেন।

উক্ত ব্রতে তিনি সানন্দে ব্রাহ্মণদের ভোজনে আপ্যায়িত এবং মহার্ঘ রত্নদান করলেন। কৃষ্ণ রুক্মিণী সহ অন্যান্য স্ত্রীদের সৌভাগ্য বৃদ্ধি করলেন। চারদিকে বৈষ্ণব, ব্রাহ্মণ এবং দেবতাদের প্রাত্যহিক পূজা জাঁকজমক সহকারে পালন হতে থাকল, উদ্ধবকে তিনি আধ্যাত্মিক জ্ঞান এবং পার্থকে কোটি হোম এবং শুভ ফলপ্রসূ কার্যে প্রাণিত করলেন।

তিনি পার্বতীর মনোরঞ্জনের বিবিধ নৈবেদ্যের আয়োজন করলেন। এবং নয়নলোভন রৈবত পর্বতে মহামূল্যবান রত্নদীপিত দেবালয়ে সিদ্ধিদাতা গণেশকে পূজো করে তাঁকে পাঁচ লক্ষ তিলের নাড়ু, নানা মিষ্টি ও অগ্নিশুদ্ধ বস্ত্রের নৈবেদ্য দিলেন। হোম যজ্ঞান্তে ব্রাহ্মন ভোজন করিয়ে গণেশকে পুজো করে তার স্তুতি করা হলো। সূর্যদেব তুষ্ট হয়ে শাম্বকে বর দিলেন।

১১৪

যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত অনিরুদ্ধ একদিন নিভৃত স্থানে সচন্দন পুষ্পলংকৃত পালঙ্কে শুয়ে ফুল শয্যায় শায়িতা সুস্মিতা নব যৌবনা এক সুন্দরীর স্বপ্ন দেখলেন। রত্নলংকারে রমণীর তার লোভনীয় দেহ। যে চঞ্চল যৌন কামনায়। নিজের যৌবনবতী শরীরের দিকে তাকিয়ে সে তার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণে সচেষ্ট। তার চরণ রঞ্জিত কুঙ্কুম আর আলতায়।

কামাতুর অনিরুদ্ধ চম্পকবর্ণা নব বিবাহিতা কামনা লোলুপ সেই রমণীকে বললেন, কে তুমি? সে বলল, সে যৌন কামনায় চঞ্চল। কামাতুরাকে তৃপ্তি দিতে আমার জুড়ি নেই। কামকী, রমণাভিলাষী নীরোগ যুবককেই কামনা করে। অগ্নিসাক্ষী করে যে বিবাহ সংঘটিত হয় তা নিয়তই বরণীয়া। গুপ্ত প্রণয়িনীর সঙ্গে মিলন নিঃসন্দেহেই সুতীক্ষ্ণ আনন্দ বিতরণ করে, সে প্রণয়ান্তে নরকামনের পথ প্রশস্ত করে।

সে নিন্দনীয় যে একবার পাপ করার পর প্রায়শ্চিত্ত করে। সাধ্বী নারী কোনো অবস্থাতেই স্বাধীন নয়। উপযুক্ত পাত্রেই পিতা কন্যা দান করে থাকেন। লক্ষ্মীশাপে অভিশপ্ত হয় সেই পুরুষ যে কামাতুরা রমণীকে ত্যাগ করে। সকল দুঃখ দূর হয় দুর্গার ধ্যান করলে। আহার নিদ্রা ত্যাগ করে অনুক্ষণ সেই স্বপ্ন সুন্দরের চিন্তায় মগ্ন হলো।

অহংকারের বশবর্তী হয়ে যে অপরকে যাতনা দেয় সে যে চতুর্গুণ কষ্ট পেয়ে থাকে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কোনো কামিনী যৌবনোচ্ছল কোনো পুরুষকে দেখলে যৌন কামনায় অস্থির হয় ঠিকই, কিন্তু ধর্ম সংস্কার হেতু ইচ্ছা থাকলেও ভীত হয়ে কষ্ট পায়, কুলটা রমণী কোনো সুরূপ যুবককে দেখলে আহার, নিদ্রা, স্বামী, পুত্র, ঐশ্বর্য এমনকি গৃহত্যাগিনী হয়ে থাকে।

জ্ঞানী ব্যক্তিরা তাই যুবতী স্ত্রীকে সযত্নে লালন পালন করে। এক প্রকার অসম্ভব নারীদের চরিত্র জানা। চিত্রলেখা কাল বিলম্ব না করে দ্বারকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করুক। সেখান থেকে অনিরুদ্ধকে কৌশলে এখানে নিয়ে আসুক।

চিত্রলেখা সবার অলক্ষে দ্বারকাপুরীতে গিয়ে সুপ্তিমগ্ন অনিরুদ্ধকে রথে করে শোণিতপুরে উপনীত হলেন। অনিরুদ্ধকে না পেয়ে দ্বারকার নারীদের আর্তনাদের আকাশ মুখরিত করে তুলল। চিত্রলেখা আগে সেখানে পৌঁছে অনাহার শীর্ণা নিদ্রিতা ঊষাকে দেখল। ঊষাকে স্নান করিয়ে চন্দন, পুষ্পমালা, সিঁদুর এবং রত্নময় অলংকারে সজ্জিত করে মিলন ঘটাল অনিরুদ্ধের সঙ্গে।

১১৫

ঊষা স্বেচ্ছায় বিবাহ করেছেন শুনে বাণ দুঃখ পেলেন। গর্হিত সান্নিধ্য শোকের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই পরিণয়ে দূতী হলো চিত্রলেখা, রূপবান ঊষার স্বামী অতনুর চেয়েও। কামনা মদির উচ্ছল যুবক। দিবারাত্রি সম্ভোগরত ঊষা গর্ভবতী হলো হওয়ায়, মা তার ছেলেকে যেমন অহিত কার্য সাধনে বাধাদান করেন, তেমন কার্তিক, গণেশ, দুর্গা, ভৈরবী, ভদ্রকালী, যোগিনীর অষ্ট ভৈরব, একাদশ রুদ্র, ভূত-প্রেত, বেতাল, গ্রামদেবী বাণকে যুদ্ধ করতে বারণ করলেও তাকে নিবৃত্ত করা গেল না।

শম্ভু তাকে শুভফলপ্রদ উপদেশ দিলেন। তিনি বললেন–তোমার পিতা যিনি দৈত্যদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ তিনি বামনদেব কর্তৃক এক নিমেষেই সুতলে গৃহীত হয়েছিলেন। সেই বামন শ্রীহরির অংশ। সকলের হৃদয়ে সন্নিবিষ্ট। তাকে কে রক্ষা করে যাকে নারায়ণ বিনাশ করে। উত্তেজিত রোষিত রক্তচক্ষু বাণ শরাসন হাতে যমরাজের মতো বললেন, মা দুর্গা! পিতা দেবাদিদেবের! আমার বক্তব্য শুনুন। প্রারব্ধকে রোধ করার ক্ষমতা কারুর নেই। নারায়ন বললেন, মাতৃস্বরূপা কোট্টরীর কথায় ক্রুদ্ধ বাণ রথে চড়ে অনিরুদ্ধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন।

একাদশ রুদ্র বাণের শুভ কামনায় তাকে আশীর্বাদ করলেন। ঊষা ভীত হয়ে দুর্গতিনাশিনীকে স্মরণ করলেন। শিশুপাল ও দন্তবক্র গোলোক কৃষ্ণের দৌবারিক জয় ও বিজয়। সনকুমারের অভিশাপে তারা তিন জন্মে মর্তে জন্ম নিচ্ছে। ভাল্লুকতনয়া জাম্ববতী শ্রীদুর্গারই অংশ। পরিস্যার বলে জাম্ববতাঁকে পত্নীরূপে গ্রহণ করেছেন।

পতির আদেশে কুন্তীর ক্ষেত্রজ পুত্র হয়। অর্জুনকে শিব শানদে পাশুপত অস্ত্র উপহার দেন। ক্ষেত্রজ পুত্রোৎপাদনের কারণ হলো অশ্বমেধ, দক্ষিণে মাতুল কন্যার সঙ্গে বিবাহ নিন্দনীয় নয়–কিন্তু অন্যত্র এরূপ বিবাহ নিষিদ্ধ। স্বয়ং ব্রহ্মা একথা বলেছেন। শিবের বরেই পঞ্চপান্ডবের সঙ্গে দ্রৌপদীর পরিণয় হয়।

১১৬

শ্রীরাম বললেন– হেমন্তে জল অনাবিল ও স্বাদু হয়, অন্নব্যঞ্জনও লোভনীয় হয়। অগ্নি রামের কাছে এসে ভবিষ্যতে কী ঘটতে চলেছে তার বিবরণ দিলেন। অগ্নি বললেন, শুনে তুমি দুঃখ পাবে–অপ্রিয় হলেও তোমাকে বুলি, সাত দিনের মধ্যেই রাবণ সীতাকে হরণ করবে। সীতার কায়া নয়, ছায়া আমার কাছে থাকুক।

রামের অবস্থা অনুযায়ী সীতা সদৃশ তার ছায়া তাঁর কাছে রইলেন। রাবণ ছায়া সদৃশ সীতাকে হরণ করল। দ্রৌপদী হলেন সীতা ছায়া। সত্যযুগে তিনি বেদবতী, ত্রেতায় ছায়া সীতা, দ্বাপরে দ্রৌপদী আর তাই তার একটি নাম ত্ৰৈকালিকা বা ত্রিহায়নী। শিবের বরে আর মায়ের আদেশে দ্রৌপদীর পাঁচজন স্বামী।

বিরহ-তাপিতা ছায়া-সীতা শিবের কাছে পাঁচবার স্বামীকে কামনা করে। চতুর্দশ ইন্দ্রের মধ্যে পঞ্চপাণ্ডব হলেন পাঁচজন ইন্দ্র। মা রতি শিবকে তিরষ্কার করেন আর তাই মহাদেব তাঁকে শাপ দেন–রতি, আমার শাপ ব্যর্থ হবার নয়।

রণক্ষেত্রে সুভদ্র হত হলে বীর্যবাণ অনিরুদ্ধের দিকে একশটি তীর ছুঁড়ল। অগ্নিবাণ ব্যবহার করে প্রদ্যুম্ন তনয় সেই শত শরকে পুড়িয়ে ফেললেন। তাঁর ব্রহ্মাস্ত্র বাণের ব্রহ্মাণকে নিষ্ক্রিয় করল। কার্তিকের গদার আঘাত মুহূর্তেই তা বিনাশপ্রাপ্ত হলে অনিরুদ্ধ আপন অপরিমেয় শক্তি প্রয়োগ করে দেবসেনাপতির গদা ছিনিয়ে নিলেন। অনিরুদ্ধকে কার্তিক তাঁর বলিষ্ঠ হাতে টেনে এনে মাটিতে ফেললেন। অনিরুদ্ধ মাটি থেকে উঠে পুনরায় আক্রমণে উদ্যোগী হবার পূর্বেই গণেশের হস্তক্ষেপে উভয়ের যুদ্ধ বন্ধ হলো। কার্তিক নিজ গৃহের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন আর অনিরুদ্ধও উষ্ণ ভবনে গেলেন।

১১৭

গণেশ শিবের কাছে গিয়ে বাণ অনিরুদ্ধ সমরের আনুপূর্বিক বিবরণ করলেন, সব শুনে দেবাদিবের রাখালের বেশে মনোহর। বিরজার নদীতটে গোপ-গোপী এবং কামধেনু পরিবৃত হয়ে বাঁশি হাতে ঘুরে বেড়ান।

বৈকুণ্ঠে এবং বৃন্দাবনে সমভাবেই বিরাজিত শ্রীরামও ছিলেন পরিপূর্ণতম কিন্তু ব্রহ্মশাপে তিনি যে কে তা ভুলে গেছেন। সেই পূর্ণের পৌত্র হলেন অনিরুদ্ধ। তার তুলনা মেলাই ভার শৌর্ষে-বীর্যে। অনিরুদ্ধ বাণের যুদ্ধে আমি তাই কার্তিককে পাঠিয়েছিলাম। কার্তিক না থাকলে বাণ বেচারা মৃত্যুবরণ করত।

আবার কার্তিক অনিরুদ্ধের যুদ্ধ থামিয়েছে। অনিরুদ্ধের পরাক্রম এমনই যে অষ্টভৈরব, একাদশ রুদ্র, অষ্টবসু, সপার্ষদ, বাণ, প্রাণীগণ কেউই তাঁকে পরাজিত করতে পারবে না। তিনি ব্রহ্মা। প্রদ্যুম্ন, মঙ্গলময় ও সিদ্ধিদাতা।

১১৮

কোট্টরী সিংহাসনে থেকে উত্থিত হয়ে দেবাদিদেবকে প্রণাম করলেন। ভক্তদের প্রতি করুণাবশতঃ পরমাত্মা কৃষ্ণ দেহ ধারন করেছেন। কৃষ্ণের চেয়ে প্রিয় আমাদের কেউ নেই। কার্তিক গনেশের চেয়েও আপনাকে আমি ভালোবাসি। কৃষ্ণ আমার প্রিয়তম, সেবকদের মধ্যে বান প্রিয়। বৈকুণ্ঠে আমিই মহালক্ষ্মীই গোলোকে শ্রীরাধা, শিবলোকে শিবানী ও ব্রহ্মালোকে সরস্বতী।

পূর্বে দক্ষ তনয়া সতীরূপে আমি আপনার পানিগ্রহণ করেছিলাম। রক্তবীজ যুদ্ধে কালী মূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করি। আমি সাবিত্রী বেদমাতা, জনকতনয়া সীতা এবং দ্বারকানগরীতে ভীষ্মক রাজের কন্যা রুক্মিনী। শ্রীদামের শাপে বৃন্দাবনে রাধা হয়ে আবির্ভূত হই।

১১৯

বিশ্বমাতা পরমা প্রকৃতি ঈশ্বরী দুর্গাকে শিব বললেন, তুমি যা বললে সত্যের শুদ্ধিতে তা ভাস্বর ও বেদানুগত। বাণ তার কন্যা ঊষাকে অলংকারে সজ্জিত করে অনিরুদ্ধকে দান করুক, পরিণামে মঙ্গল হবে তবে। বৈষ্ণব বায়ু, অগ্নি ও সমুদয় তীর্থ অপেক্ষা পবিত্র। তাকে দেখে শঙ্কিত হন দেবতারাও। মহাবল বলি শিবের চরণে প্রণত হলেন ও প্রিয়পুত্রকে আশীর্বাদ করে যেখানে নররূপী পরমাত্মা বিরাজ করেন সেখানে গেলেন।

সামবেদে বর্ণিত স্তবে ভগবান কৃষ্ণের আরাধনা করে বললেন, অদিতির প্রার্থনায় ও ব্রত পালনের পর বামনের রূপ ধরে আপনি আমায় প্রবঞ্চিত করেছেন। অনিরুদ্ধ বাণকে বধ করতে গিয়েছিলেন। কার্তিকের মধ্যস্থতায় তিনি তাকে বধ করতে পারেন নি।

শত সূর্যের প্রভায় উজ্জ্বল আপনার সুদর্শন চক্রকে প্রতিহত করেন এমন কোনো দেবতাই নেই। আপনি পরমেশ্বর, আপনার অস্ত্রও তেমন আমোঘ। শিব ও বিষ্ণু সত্ত্বগুণের, ব্রহ্মা রজোগুণের, আর কালাগ্নি রুদ্র তমোগুণের আধার, যে ভগবান যোগনিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে ব্রহ্মাণ্ডে জলাশায়ী তিনি ‘বাসু’ নামে অভিহিত, তাই আপনি বাসুদেব।

কলাকমলাংশে তিনি স্থাবর ও জন্ম সকল জীব। তিনি বিনাশহীন, নির্লিপ্ত ও চিরন্তন। আপনি শ্রেষ্ঠতম কেমনে আপনার স্তুতিতে মুখর হব। আমি প্রাজ্ঞ নই ভক্তের ভগবান পরমাত্মা কৃষ্ণ তখন বলিকে বললেন– বৎস! তুমি নিজ নিকেতনে প্রত্যাবর্তন কর। ব্রহ্মা সনৎকুমারকে সামবেদ নির্দেশিত স্তব করতে বলেছিলেন।

আবার করুণাময় শঙ্কর সূর্যগ্রহণের ক্ষণে পবিত্র তীর্থে সিদ্ধাশ্রমে প্রিয় শিষ্য গৌতমকে স্তব প্রদান করেছিলেন। বিরজা সৈকতে তিনি শিব ও ব্রহ্মাকে উক্ত স্তবের কথা বলেছিলেন। এই স্তব পাঠ করলে সকল সম্পদ লাভ করা যায়, গর্ভযন্ত্রণা দূর হয়, রোগ থাকে না। থাকে না কোনো বন্ধন। উপরন্তু যে ব্যক্তি এই স্তব পাঠ করেন তার সমুদয় তীর্থ স্থানের ব্রতের ফললাভ হয়ে থাকে।

১২০

শ্রীকৃষ্ণ উদ্ধব ও বলদেবের সাথে পরামর্শ শেষে ভদ্রকালী উগ্রচণ্ডা এবং কোট্টরীর কাছে দূত পাঠালেন। বাণ-ঊষা- অনিরুদ্ধ সহ তাঁর আশ্রয় কামনা করুন। দূতের কথা শুনে দুর্গা বললেন, বৎস বাণ! যথাসর্বস্ব যৌতুকসহ তোমার সুভাগা কন্যাকে সম্প্রদান করে ভগবান কৃষ্ণের শরণাগত হও। অনেকেই তাকে শান্ত ও নিরস্ত হতে বললেন। তার শরীর ক্রোধ ও উত্তেজনায় কাঁপতে লাগল।

করুণাময় মহেশ্বর বাণ রাজাকে বুকে নিয়ে কাঁদতে লাগলেন। দেবাদিদেবের নয়ন থেকে নিঃসৃত অশ্রু এক জলাশয়ের সৃষ্টি করল। তিনি বাণের জ্ঞান ফিরিয়ে যেখানে কৃষ্ণ বিরাজ করছেন সেখানে তাকে নিয়ে গেলেন। ব্রহ্মা ও লক্ষ্মী যাঁর শ্রীচরণ সেবা করেন, মহেশ্বর বাণকে সেই চরণ কমলে স্থাপন করে বলিরাজ যে স্তোত্রে শ্রীহরিকে তুষ্ট করেছিলেন, সেই স্তব করতে লাগলেন।

দয়াময় শ্রীহরি বাণ রাজাকে মৃত্যুঞ্জয় জ্ঞান প্রদান করলেন এবং স্বীয় পাদপদ্ম তার গায়ে ঠেকিয়ে তাঁকে অমরত্ব দান করলেন। বাণ মনোহর সূক্ষ্ম অগ্নিশুদ্ধ বস্ত্র, তাম্বুল পাত্র, মধুপাত্র ও স্বীয় তনয়াকে হরির পাদপদ্মে নিবেদন করে বার বার ক্ষমা প্রার্থনা করে রোদন করতে লাগলেন। শ্রীহরি বাণের সেই নবযৌবনা সুন্দরী বিবাহিতা কন্যাকে রুক্মিণী ও দৈবকীকে প্রদান করলেন। শুভকাজ সম্পন্ন হলে ব্রাহ্মণদের দান সামগ্রী উপহার দিলেন।

১২১

প্রতারক কৃষ্ণ সর্বদাই বলশালীদের সঙ্গে দুর্বলের বিবাদ বাধিয়ে দুর্বলদের বিনাশ করে। কৃষ্ণ নিজে শিশুপাল, সুর নামক অসুরকে ছলে বলে কৌশলে বধ করেছে। কৃষ্ণ শৈশব থেকেই শঠ। তিনি নাকি স্বয়ং নারায়ণ। কৃষ্ণ তার শরণাতীত না হলে নিমেষেই তিনি দ্বারকাপুরী ধ্বংস করবেন।

তিনি মুহূর্তেই সপার্ষদ কৃষ্ণ ও বলদেবকে বধ করতে পারেন। কৃষ্ণ চরিত্রহীন, কামুক, গোকুলে রাধার বশীভূত আর এখন সত্যভামা প্রমুখ রমণীদের ভৃত্যস্বরূপ। কৃষ্ণ অট্টহাস্য করে উঠলেন ব্রাহ্মণের মুখে এরূপ কথা শুনে। শ্রী হরি বললেন, আগে তুমি আমায় প্রহার কর আর তারপরে আমি তোমার সঙ্গে সংগ্রামরত হব। তুমি সহর্ষে গোলোকে বিষ্ণুধামে গমন কর।

শৃগালরাজ শ্রীকৃষ্ণের প্রতি দশ বাণ নিক্ষেপ করল। সেই তীরগুলি কৃষ্ণকে প্রণাম জানিয়ে আকাশের মাঝে লীন হয়ে গেল। এবার শৃগাল প্রলয়াগ্নি সদৃশ গদা নিক্ষেপ করলেন। কিন্তু কৃষ্ণকে স্পর্শ করেই তা টুকরো হয়ে গেল। কৃষ্ণের অশ্রু বিন্দুতে বিন্দু সরোবরের সৃষ্টি হলো। সেই সরোবরের পবিত্রোদকে স্নান করলে জীবন্মুক্ত হওয়া যায়, তার দেহ থেকে বিচ্ছুরিত জ্যোতি ব্রহ্মাণ্ড লক্ষ্মী আরাধিত হরির পাদপদ্মে বিলীন হয়ে গেল।

১২২

ভগবান বললেন, পূর্বে ভাদ্রমাসের শুক্লপক্ষের চতুর্থী তিথিতে চন্দ্র তারাকে অপরহণ করে কৃষ্ণপক্ষের চতুর্থীতে তাকে পরিত্যাগ করলে গুরু তাঁকে বরণ করে নিলেন। তখন তিনি চন্দ্রের ঔরসে অন্তঃসত্ত্বা। গর্ভবতী তারাকে গুরু তিরষ্কার করলেন। তারার কথা শুনে চাঁদ নারায়ণ সরোবরে গিয়ে অনন্যমনে নারায়ণের পূজা করলেন ও পাপমুক্ত হলেন। তিনি চাঁদকে বললেন, কলঙ্কের হাত থেকে সে নিষ্কৃতি পাবে।

ভাদ্রমাসের শুক্ল এবং কৃষ্ণপক্ষের চুতর্থীতে সম্যকরূপে উদিত চন্দ্রকে দেখা অবিধেয়। এক সূর্যভক্ত ছিলেন সত্রাজিৎ নামে। তিনি কঠোর তপস্যা করেছিলেন পুষ্করতীর্থে। তাই সূর্য তাঁকে, স্যমন্তক মণি দান করেন, যা প্রত্যহ স্বর্ণপ্রসব করত, সেটি কৃষ্ণকে দিতে গেলে ধূর্ত প্রসেন তা দিতে না দিয়ে নিজে নিয়ে বারাণসী গমন করেন।

ভাল্লুকরাজ জাম্ববান সিংহকে বধ করলে মণিটি তাঁর করায়ত্ত হয়। ব্রহ্মা বলেন, বেদের নিন্দাকারী যদি নষ্ট চন্দ্র প্রত্যক্ষ করে, তবে সে কলঙ্কী হয়। কৃষ্ণ সেই বালকের কাছ থেকে স্যমন্তক মণি নিয়ে নিলে ধাত্রী অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে ভাল্লুককে গিয়ে বলল। জাম্ববান কৃষ্ণকে দেখে অত্যন্ত প্রীত হলো। কৃষ্ণ দ্বারকায় আনীত স্যমন্তক মণিটি যাদবদের দেখালেন ও তিনি কলঙ্ক মুক্ত হলেন।

১২৩

পুরানে বর্ণিত গণেশ পূজার চিত্তাকর্ষক ও দুষ্প্রাপ্য কাহিণী ব্ৰহ্মার মুখ থেকে অল্প কিছুটা শুনেছি। দ্বারকায় অধিবাসীদের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ নন্দ গোপ সিদ্ধাশ্রমে এসেছিলেন। রাজেন্দ্র গণেশ পূজার জন্য সেখানে সমবেত হয়েছিলেন। রাধা গণেশের ধ্যানরতা হয়ে স্বীয় মস্তকে ফুল দিয়ে অঙ্গ শোধন। করলেন।

কৃষ্ণের প্রাণাধিকা রাধিকা গণেশকে চব্য, চোষ্য, লেহ্য-পেয়, তিলের নাড়ু, গমের পিঠে, কলা, পায়েস নিবেদন করলেন। রাধা আত্যন্তিক শ্রদ্ধা সহকারে যখন গজানন স্তোত্র পাঠ করছিলেন। তখন তার সারা শরীর ক্ষণে ক্ষণে রোমাঞ্চিত হচ্ছিল।

১২৪

গণপতি রাধার ভক্তিতে অত্যন্ত প্রীত হলেন। শ্রদ্ধা সহকারে ভক্তিমন্ত্র জপ করলেন আপনার পাদপদ্মে স্থিত হয়ে এবং তিনি মুহূর্তের জন্যও বৃথা কাল যাপন করেন না। পার্বতী রাধাকে বুকে চেপে ধরে বলল, রাধা তুমি সর্ববিধ শুভের আধার। তোমার ভক্তেরা যদি আমার নিন্দা করে আর আমার ভক্তেরা যদি তোমার নিন্দা করে, তবে তাদের কুম্ভীপাক নরকে তীব্র যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে।

শ্রীরাধা রাসেশ্বরী আর কৃষ্ণ শ্রেষ্ঠ রসিক। রসিক ও রসবতীর যৌন মিলনই সার্থক বলে বিবেচিত হয়। কৃষ্ণ বললেন, শ্রীদামের শাপে রাধার সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ ঘটেছিল। তাই সে অনেক কিছুই বিস্মৃত হয়েছিল। কামিনী রাধা নিয়তই কৃষ্ণের চরণ-কমল ধ্যান করেন। তিনি ধন্যা প্রিয়তমের প্রতি শ্রদ্ধা ভক্তিতে।

পুণ্যাতীর্থ ভারতে তিনি বৃষভাণুর কন্যারূপে পরিচিত। তার চরণ-কমল বন্দনা করেন মুনি ঋষিরাও। ব্রহ্মা পর্যন্ত পরমেশ্বরী রাধাকে প্রত্যক্ষ করে তার স্তব করেন। স্বচক্ষে কেন স্বপ্নেও তোমার চরণকমল লাভ করতে পারিনি।

এভাবে দেবতা, মুনি, ঋষি সকলেই শ্রদ্ধাবনত চিত্তে রাধা স্তুতিতে আত্মনিয়োগ করলেন। রুক্মিণী প্রভৃতি রমণীরা লজ্জাবনতা হয়ে রত্নদর্পণে নিজের মুখ দেখতে লাগলেন এবং তাদের নিঃশ্বাসে আরশি কেবল ঝাপসা হয়ে গেল। কৃশোদরী, উপবাসকৃশ সত্যভামা মন থেকে অভিমান মুছে ফেললেন।

১২৫

এক ব্রহ্মা ও অষ্টশতাধিক দশলক্ষ ইন্দ্রের পতনে শ্রীহরির চোখের পাতা ফেলতে যে সময় লাগে, সেই অত্যল্পকাল হয়ে থাকে। বসুদেব শিবের আদেশে যজ্ঞের উপকরণ সংগ্রহ করে, শুভলগ্নে রাজসূয় যজ্ঞ করলেন। সনকুমারের মন্তব্যে এবং কৃষ্ণের নির্দেশে বসুদেব যথা সর্বস্ব দান করলেন।

রজনীর সর্বগ্রাসী আঁধারে সস্ত্রীক দেবতা ও মুনিরা সেখানে সঙ্গমানন্দে মত্ত হলেন। সকাল হলে কৃষ্ণের অনুমতি নিয়ে সকলে প্রস্থান করলেন। যাদবেরা রুক্মিণীকে প্রত্যক্ষ করে মূল্যবান রত্নের আকর কৃষ্ণের স্মৃতিধন্য দ্বারকার উদ্দেশ্য যাত্রা করলেন।

১২৬

শ্রীহরি ও গণপতির পুজো করে যাদবেরা সিদ্ধাশ্রমে রয়ে গেলেন। রাধা বললেন, আজ তার জন্ম সার্থক হলো। স্ত্রী পুরুষের বিরহ বাস্তবিক দুঃসহ। অতঃপর রাধা পরমেশ্বরের স্তব করে তাঁকে রত্নখচিত আসনে বসিয়ে তার পাদপদ্ম পূজা করলেন। সস্মিত কৃষ্ণ নিজের পাশে রাধাকে বসালেন।

রসিকা, কামাতুরা স্ত্রী সম্ভোগকালেই পতির পরিচয় হয়ে থাকে। শালি ধানের স্বাদ পায় ভোক্তা–ধান্যক্ষেত্র নয়। যে ঘ্রাণ নেয় একমাত্র সেই বোঝে চন্দনের সৌরভ, চন্দন পাত্র নয়। শ্রীকৃষ্ণ বললেন, ক্ষীরোদ আর শ্বেতদ্বীপে আমি চতুর্ভুজ ও মর্ত্যলক্ষ্মীর হৃদয় বল্লভ। আমি সিদ্ধিদাতা সতীপতি কপিল এবং ব্যক্তিভেদে আমি বিভিন্ন রূপ ধারণ করি।

গোলোকেও গোকুলে তুমি রাধা, আবার বৈকুণ্ঠে তুমি লক্ষ্মী ও সরস্বতী। তুমি ক্ষীরোদসমুদ্রে শায়িত ভগবানের প্রিয়তমা মর্ত্যলক্ষ্মী, ধর্ম তনয়ের কামিনী শ্রীরূপিনী শান্তি। পবিত্র ভারতবর্ষে তুমি কপিল প্রিয়া পতিব্রতা সতী ও দ্বারকাতে মহালক্ষ্মী।

রাবণ তোমাকে অপহরণ করেছিল। নিজ অংশে তুমি বিবিধ রূপে অধিকারিণী। শ্রীদামের অভিসম্পাতে তোমার-আমার বিচ্ছেদ ঘটেছিল। তুমি আমায় দেখতে পাওনি ঠিকই, তোমাকে সব সময়ই অবলোকন করেছি। দেবতাদের মধ্যে দেবদিদেবকে আমি সবচেয়ে ভালোবাসি আর দেবীদের মধ্যে তুমিই আমার প্রিয়তমা। সতী রাধা! সব গূঢ় আধ্যাত্মিক তত্ত্ব তোমায় পরিবেশন করলাম।

১২৭

রাধা অপাঙ্গ দৃষ্টিতে কৃষ্ণের দিকে তাকালেন। কামনায় চঞ্চল হয়ে উঠলেন। প্রিয়তমকে জড়িয়ে ধরে তাঁর মুখ চুম্বন করতে লাগলেন। যৌন মিলনের তীব্র আনোন্দাচ্ছ্বাসে যুগবৎ রোমাঞ্চিত হয়ে শ্রান্ত হয়ে পড়লেন। নিজের কোমল বাহুলতায় তাকে বেষ্টন করে বললেন, চল আমরা বৃন্দাবনের রাসমণ্ডলে যাই।

মাধব অনেক বুঝিয়ে তাঁকে নিবৃত্ত করলেন। রথের চারদিকে ঝলমল করছে নানা মূল্যবান রত্ন। রয়েছে লক্ষ রথে রয়েছে লক্ষ গোপ পরিবেষ্টিত সচন্দন কুসুম শয্যা। শ্রীকৃষ্ণ আসছেন শুনে নন্দ যশোদা, বৃদ্ধ গোপ, বৃদ্ধা গোপীদের চোখ দিয়ে আনন্দাশ্রু ঝরে পড়ল। কেবল ব্রহ্মনত্বের দ্যোতকরূপে গলায় একগাছি উপবীত থাকবে। পরে যজ্ঞসূত্রটি আর সমাবেশ অবশিষ্ট।

এমনকি উপপতির যারা মিত্র তাদের প্রতিও কামিনীদের ভালবাসা শতগুণ বর্ধিত হবে। উপপতিই তাদের রতি ও গতি। কলিকালে দশ হাজার বৎসর পর্যন্ত আমার পূজার প্রচলন থাকবে। তারপর আর কেউ আমায় পুজো করবে না। দুর্ভিক্ষ ও ঋণভারে জর্জরিত হয়ে লোকে বনবাসী হবে। ক্ষুধার তাড়নায় গৃহস্থেরা কুকুরের মতো হয়ে যাবে।

তারা চিত্র বিচিত্র রত্নশোভিত বিরজা নদী লঙঘন করে, নানা মণি দীপ্ত রাসমণ্ডল অতিক্রম করে, শতশৃঙ্গ পর্বতে উপস্থিত হলেন। বট বৃক্ষটির দৈর্ঘ্য ত্রিশতযোজন এবং প্রস্থ শতযোজন, রাধা রথ থেকে অবতরণ করলেন এবং রাধার সঙ্গে কথা বলতে বলতে বৃন্দা স্বীয় গৃহে প্রবেশ করলেন।

কক্ষে শোভা পাচ্ছিল হীরক মালিকা সুশোভিত এক রত্ন সিংহাসন। সাতজন সখী চামর দিয়ে তাকে বাতাস করতে শুরু করে। বৃন্দা নন্দের জন্য পরমেশ্বরী রাধার জন্য পৃথক পৃথক বাসস্থানের ব্যবস্থা করলেন। রাধা গোপিনীর সঙ্গে অতিমনোরম নিজকক্ষে প্রবেশ করলেন।

১২৯

দেবাদিদেব বললেন, ভগবান অনন্ত, ধর্ম ও দুর্গতিনাশিনী দুর্গার সঙ্গে দেবাদিদেব ভাভীর বনে উপস্থিত হলেন। ব্রহ্মার প্রার্থনায় পৃথিবীর ভার মোচনের জন্য আপনি আবির্ভূত হয়েছিলেন। এখন আপনি সস্থানের উদ্দেশ্যে প্রস্থানোন্মুখ, স্বর্গ-মর্ত-পাতালের মধ্যে পৃথিবী আপনার চরণ স্পর্শে কৃতার্থ হয়েছে।

সত্যভামা পঞ্চগোপাল গোলোকে গমন করলেন। অযযানিসম্ভূতা মহালক্ষ্মী রুক্মিণীর সশরীরে বিষ্ণুধাম গোলোকে উত্তরণ ঘটল, ভূতলে ও জাম্ববতী দুর্গতিনাশিনী বিশ্বমাতা পার্বতীর শরীরে অনুপ্রবেশ করলেন। পাপীরা তোমার পবিত্রোদকে অবগাহনে যে পাপ বিসর্জন করবে, বৈষ্ণবদের সান্নিধ্যে পাপসমূহ লয়প্রাপ্ত হবে।

১৩০

নারায়ণ বললেন, গতজন্মে তোমার পঞ্চাশজন পত্নী ছিল, তুমি একজন, গন্ধর্ব ছিলে। তোমার নাম ছিল উপবন। এখন তুমি ব্রহ্মার পুত্র। সনৎকুমার নারদকে আশীর্বাদ করে পরম পুরুষকে প্রত্যক্ষ করার জন্য গোলোকের উদ্দেশ্যে নিষ্ক্রান্ত হলেন।

কৃতমালা নদীতটে তার সঙ্গে দেবাদিদেবের সাক্ষাৎ হলো। তিনি প্রণাম করলেন শঙ্করকে। পরমাত্মা কৃষ্ণ বৈকুণ্ঠধামের রাসমণ্ডলে ব্রহ্মাকে, ধর্মকে এবং আমাকে পরম মন্ত্রদান করেছিলেন। মুনিবর নারদ অনন্য চিত্তে শ্রীহরিকে সাধনায় তুষ্ট করে দেহত্যাগ করলেন ও শ্রীহরির শ্রীচরণ পদ সেবা করলেন।

১৩১

শৌণক বললেন, বৈষ্ণব সান্নিধ্যে জন্ম সার্থক হয়। গণপতির জন্ম উপাখ্যান শ্রবণে গর্ভবাস ও কর্মাঙ্কুরের সমূলে বিনাশ সাধিত হয়, হরির শ্রীচরণে দাস্যভক্তি লাভ করা যায়। পারস্পরিক সম্বোধন ও কুশল বিনিময়ের পর তারা বিষ্ণুর সভায় সুরম্যরত্ন সিংহাসনে উপবেশন করলেন।

মধুসূদন বললেন, কামাতুর নর্তকীদের কঠিন শ্রোণী ও পীন স্তন দেখে ব্রহ্মার যে বীর্যপাত হয়েছিল, ব্রীড়াবনত ব্রহ্মা তা ক্ষীরোদ সাগরে নিক্ষেপ করেছিলেন। ব্রহ্মার রেত থেকেই বালকের উৎপত্তি তাই সে ব্রহ্মা তনয়। শিব যা বললেন, বিষ্ণু তা সানন্দে মেনে দিয়ে তাকে দগ্ধ করার শক্তি দান করলেন।

বরুণ বালকটিকে কোলে নিয়ে তাকে চুম্বন করে ব্রহ্মাকে সম্যকরূপে অর্পণ করলেন। অতঃপর তিনি ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরকে প্রণাম করে নিজের আলয়ে ফিরে গেলেন। একদিন দেবতারা ইন্দ্রের সভায় সমবেত হয়েছেন, অপ্সরারা নাচ গান করছিল।

রম্যশ্রোণী রম্ভাকে দেখে অগ্নি, যৌন কামনায় চঞ্চল হয়ে ওঠেন। তারও বীর্যপাত হলে তিনি পরিধেয় বস্ত্রে তা আবৃত করেন। তার থেকেই উৎপন্ন উজ্জ্বল স্বর্ণ আবরণ ভেদ করে বর্ধিত হতে থাকে। কালে তা সুমেরু পর্বতের রূপ নেয়। আর তাই প্রাজ্ঞজনেরা অগ্নিকে ‘হিরণ্যরে বলে অভিহিত করেন। এখন বল তুমি আর কী শুনতে চাও?

১৩২

ব্রহ্মার আদেশ নারদের নারায়ণের আশ্রমে যাত্রা ইত্যাদি বিষয়ের আনুপূর্বিক বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। লক্ষ্মী, সরস্বতী, রাধা, সাবিত্রী প্রভৃতি অনেকের চরিতাবলী আলোচনা করা হয়েছে। বিশেষত এই খণ্ডের উপাখ্যানগুলি আমাদের মুগ্ধ করে। জন্ম-মৃত্যু-জরা-ব্যাধি-বন্ধন মুক্তি প্রদর্শক, হরিদাস্য প্রদ, শ্রুতিসুখকর শ্রীকৃষ্ণ জন্ম খণ্ড বর্ণনা করছি শোন।

শ্রীকৃষ্ণের জন্মখন্ড বড়ই চিত্তহারী, চিরনূতন, উপাখ্যানে পূর্ণ। কৃষ্ণ জন্মখণ্ড বৈষ্ণবদের প্রাণস্বরূপ এই খণ্ডের সূচনায় নারদের নারায়ণের কাছে প্রশ্ন, নারায়ণের উত্তর, বিষ্ণু ও বৈষ্ণবদের সাধুবাদ, শ্রীদাম ও রাধার দ্বন্দ্ব, পারস্পরিক অভিশাপ প্রদান, বিরজার দেহত্যাগ, পরে নদীরূপে বিরজার আত্মপ্রকাশ, কৃষ্ণের সম্ভোগ ও সপ্ত সাগরের উৎপত্তি নানা বিষয়ে অতি সুন্দর ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

বৃন্দাবনে রাখাল বালকদের সঙ্গে ক্রীড়া, ব্রাহ্মণী প্রদত্ত অন্ন গ্রহণ, বস্ত্রহরণ, স্বর্গের বিবরণ, গোপিণীদের কৃষ্ণের ও পার্বতীর বরদান, কাত্যায়ণী ব্রত, কৃষ্ণের তাল ভক্ষণ, কৃষ্ণ রাধিকার পরিণয় ও মিলন, রাসমণ্ডলে কৃষ্ণের সোড়শ প্রকারের মৈথুন, শ্রীরাধিকার সঙ্গে মলয় পর্বতে বিহার।

বৃন্দাবনে কৃষ্ণের পুনরাবির্ভাব, পরম পুরুষ কৃষ্ণকে অবলোকন করে গোপিণীদের উচ্ছ্বাস, রাসলীলা প্রত্যক্ষ করে দেবীদের অনির্বচনীয় আনন্দ, শ্রীকৃষ্ণের মথুরা গমন, রজক এ কালযবন বধ, কুজার সঙ্গে যৌন মিলন, কুবিন্দের প্রতি করুণা, মাতঙ্গ ও কংস নিধন এবং তাঁর পিতাকে রাজ্যদান।

নিরিবিলিতে রাধার গৃহে উদ্ধবের উপস্থিতি, কৃষ্ণের উপনয়ন, গুরুগৃহে শিক্ষা, জরাসন্ধ দমন। দ্বারকাপুরী নির্মাণ, বিশ্বকর্মার দর্পহরণ, উগ্রসেনের আক্ষেপ, রুক্মিণী ও ঊষা হরন। দেবলোক থেকে পারিজাত হরণ, কুরু-পাণ্ডবের মহাসমর, বাণরাজার ভুজচ্ছেদ, অনিরুদ্ধের বীরত্ব, রাধা-যশোদা কাহিণী, শৃগালের অদ্ভুত মুক্তি, গণেশ পূজা, শৌনক, ব্রহ্মের অভিশাপে যদুবংশ ধ্বংস, পাণ্ডবদের ভববন্ধন থেকে নিষ্কৃতি।

শ্রীহরির নিজ নিকেতনে গমন, নারদ পরিণয়। অগ্নি ও স্বর্গের উদ্ভব, ইত্যাদির নাতিদীর্ঘ বিবরণ দিলাম। চারটি খণ্ডে বিভক্ত ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে এইসব গূঢ় ও চিত্তরঞ্জিনী বিষয় সমূহের আলোচনা করা হয়েছে। এখন বল, তুমি আর কী শুনতে চাও।

১৩৩

শৌনক বললেন, আজ আমার জীবন সার্থক, কেননা পুণ্য ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের অমৃতোপম কাহিনী আমি শুনলাম। ভয় দূর করে আমায় রবাভয় দান কর। সূত বললেন, নির্ভীক হন। আপনার কী কী জ্ঞাতব্য আমায় তা জানান। শৌনক বললেন, বৎস! পুরাণের লক্ষণ, সংখ্যা এবং পুরাণ ফল সম্পর্কে আমি জানতে চাই।

সূত বললেন, হে মহামান্য। শাস্ত্রের আলোকে আমি পুরাণ, ইতিহাস, সংহিতা এবং পঞ্চরাত্র বিষয়ে আলোচনা করছি। পুরাণে সৃষ্টি, জগতের ধ্বংস, চন্দ্র এবং সূর্যাদি বংশের ক্রমানুযায়ী চতুর্দশ মনুর আধিপত্যের বর্ণনা অবশ্যই থাকবে। মহাপুরানের বিষয় হলো সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয়, প্রতিপালন, কর্ম, কামনা, চতুর্দশ মনুর নামকরণ, প্রলয়ের বিবরণ।

মুক্তি নির্ণয়, শ্রী হরির স্তুতি, ভিন্ন ভিন্ন ভাবে দেবতাদের গুণকীর্তন এইসব লক্ষণ থাকবে। এবার আমি পুরাণে সংখ্যার উল্লেখ করছি। ব্রহ্মাপুরাণ, পদ্মপুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ, শিবপুরাণ, শ্রীমদ্ভাগবত, নারদ পুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ, ভবিষ্যপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, লিঙ্গপুরাণ এবং বরাহপুরাণে যথাক্রমে দশহাজার, পঞ্চাশ হাজার, চব্বিশ হাজার, আঠার হাজার কৃষ্ণের মাহাত্ম বর্ণিত হয়েছে। এটি গৌতম ও সনকুমার রচিত।

এই পুরাণে প্রাণীদের আত্মস্বরূপ, কর্মলিপ্ত মানুষের সকল প্রকারের কর্মের সাক্ষ্মী হিসাবে পরম ব্রহ্মাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। দেবীদের মধ্যে যেমন দুর্গতিনাশিনী দুর্গা, কৃষ্ণ সখীদের মধ্যে যেমন রাধা, ঈশ্বরীসমূহের মধ্যে যেমন লক্ষ্মী, বিদ্যাদায়িনীদের মধ্যে যেমন সরস্বতী, তেমনি পুরাণ সমূহের মধ্যে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণই শ্রেষ্ঠ। আর তাই এই পুরাণ সম্বন্ধে মন্তব্য করা হয়েছে– যজ্ঞানুষ্ঠান, তীর্থ পরিক্রমা, তপস্যা, চতুর্বেদ পাঠ এবং গুরু সঙ্গে যে ফললাভ হয়, তার চেয়েও বেশি পুণ্যদায়ক এই পুরাণ পাঠ ও শ্রবণ, নিঃসন্তান ব্যক্তি যদি শ্রদ্ধাবনত চিত্তে এই পুরাণ পাঠ করেন, তাহলে তিনি সুশীল, বিদ্যাবিশারদ বৈষ্ণব পুত্র লাভ করেন। অনন্যমনা হয়ে যিনি ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের শ্রবণ করেন পাপ তাকে স্পর্শ করতে পারে না।

আমি গুরুর কাছে যেমন শ্রবণ করেছি তোমায় তা বললাম। এখন আমি তোমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নারায়ণের আশ্রয়ে গমন করব। ব্রাহ্মণদের দর্শন ও প্রণামের নিমিত্ত আমি এখানে এসেছিলাম আর আপনার অনুরোধে আমি ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ শুনিয়েছি। কায়মনোবাক্যে নিয়ত শাশ্বত সত্য। পুরাণ স্রষ্টা বেদব্যাসকে প্রণাম, পরিশেষে দুর্গতিনাশিনী দুর্গাদেবীকে প্রণাম। শৌনক! আপনাদের পূত চরণ কমলে প্রণাম জানিয়ে, এখন আমি গণপতি অধ্যুষিত সিদ্ধাশ্রমের উদ্দেশ্যে যাত্রা করছি।