৩. গণেশ খন্ড

গণেশ খন্ড

১.

নারায়ণ নারদকে এমন এক আশ্চর্য উপাখ্যান বললেন–যা সকল বিপদ, শোক, তাপ দূর করে। এই উপাখ্যান শুনলে মানুষের সবদিক দিয়ে মঙ্গল হয়। পুরা কালে সতী স্বামীর নিন্দায় যোগবলে শরীর ত্যাগ করেন। মেনকার গর্ভে জন্ম নিলেন। হিমালয় খুব আনন্দের সঙ্গে শিবকে নিজ কন্যা পার্বতীকে দান করলেন। মহাদেব নদীতীরে কোন এক ফুলের বাগানে ফুলে সাজানে চন্দন মাখানো রতির উদ্দীপক এক বিছানা তৈরী করে পার্বতীর সাথে রমন করেছিলেন। পার্বতী ও মহাদেব উভয়ের স্পর্শে কামাসক্ত হয়ে পড়েছিল। তাদের রতি দেখে দেবতারা চিন্তিত হয়েছিল। এবং ব্রহ্মাকে সামনে রেখে নারায়ণের কাছে এলেন। দেবতাদের প্রার্থনায় মহাদেব রতিক্রীড়া ছেড়ে দিতে চাইলেও পার্বতীর ভয়ে ছাড়তে পারলেন না। শেষে কণ্ঠলগ্ন পার্বতীকে ছাড়লেন। এবং লজ্জায় তাড়াতাড়ি উঠতে গেলে তার বীর্য মাটিতে পড়ল। তার থেকে জন্মান স্কন্ধ কার্তিক।

২.

দেবতারা পার্বতীর শাপের ভয়ে পালিয়ে গেল। মহাদেবও ভীত হলেন। দেবী দেবতাদের বীর্য নিষ্ফল হবার শাপ দিলেন। দেবীর রাগ দেখে দেবাদিদেব তাঁকে নিজের বুকের ওপর বসালেন এবং বললেন–তাঁর দোষ যেন দেবী ক্ষমা করে দেন। দেবী তখন ক্রুদ্ধ অথচ মিষ্ট ভাবে হরকে বললেন, যে মেয়েদের সকল সুখ ও সম্পদের মধ্যে প্রধান সুখ হল নির্জন স্থানে সৎ লোকের সাথে রমণ সুখ অনুভব করা। কিন্তু প্রথমে তার রতিভঙ্গ হওয়ার দুঃখ, দ্বিতীয়ত অন্যত্র বীর্যপাত হেতু গর্ভ না হওয়ার দুঃখ, তৃতীয়ত সন্তান না হওয়ার দুঃখ। সুপুত্র স্বামীর অংশ, সুতরাং স্বামীর মতই সুখ দেয়। স্বামী আপন স্ত্রীর গর্ভে নিজ অংশরূপে জন্মগ্রহণ করে। আমি পুত্র লাভের জন্য কি করব তা উপদেশ করুন।

৩.

হর তাঁকে বললেন–হরির নাম নিয়ে এক বছর পুণ্যক নাম ব্রত কর। নারীদের মধ্যে যেমন গঙ্গা, দেবতাদের মধ্যে হরি, প্রাণীর মধ্যে মানুষ, দৈত্যদের মধ্যে যেমন বলি, তেমন সকল বস্তুর সার হল এই পুণ্য ব্রত। যে লোক হরি ভক্ত সে নিজের ভাই, চাকর, বন্ধু, স্ত্রী প্রভৃতিদের উদ্ধার করে নিজে হরির চরণে লীন হয়। মহাদেব পার্বতীর সঙ্গে গঙ্গা তীরে গিয়ে আনন্দের সঙ্গে তাকে সুন্দর হরি মন্ত্র, স্তব ও কবচ দান করলেন এবং পুজা অনুষ্ঠানের নিয়মগুলি বলে দিলেন।

৪.

দেবী হরের কাছে থেকে ব্রতের সকল নিয়ম অনুষ্ঠান পদ্ধতি জানতে চাইলেন। কোন ফল আর কোন জিনিস ব্রতের উপযুক্ত। শ্রেষ্ঠ পুরোহিত, ফুল, তোলার ব্রাহ্মণ ও জিনিসপত্তর আনার জন্য একজন চাকর দিন। স্বামী তার প্রিয় স্ত্রীকে ছেলের হাতে ছেড়ে দিয়ে সুখ পায়। যে স্ত্রীকে এই তিনজন বন্ধু যাথাক্রমে পালন করে। ভক্তিভরে হরিকে অর্ঘ্য দিয়ে তাড়াতাড়ি ঘরে আসবে। নিজের রূপের জন্য প্রতিদিন একশো আটটা পরিজাত ফুল বিঝুঁকে দান করবে। নিজের বর্ণের সৌন্দর্য লাভের জন্য ভগবান হরিকে ভক্তিভরে সুন্দর এবং অক্ষত এক লক্ষ সাদা চাপা ফুল দেবে। নখের সৌন্দর্যের জন্য এক লক্ষ সাদারঙের সবোকৃষ্ট মণি কৃষ্ণকে দান করবে। সুন্দর হাসির জন্য এক লক্ষ অক্ষত মালতী ফুল শ্রীকৃষ্ণকে দান করবে। সন্তান লাভের জন্য শ্রীহরিকে কুমড়ো, নারকেল, বাতাবি এবং শ্রীফল দেবে। ব্রতের সময় দিনরাত একশো রত্ন প্রদীপ ও আগুন জ্বালিয়ে রাখবে এবং রাতের বেলায় কুশাসনের উপর বসে জেগে থাকবে। হরির উপর অচল ভক্তিতে এই ব্রতে পুত্র লাভ হয়, সৌন্দর্য, স্বামী সৌভাগ্য, ঐশ্বর্য এবং বিপুল ধনসম্পদ লাভ হয়। প্রত্যেক জন্মে সমস্ত বাঞ্ছিত সিদ্ধির মূল কারণ লাভ করা যায়।

৫.

মহাদেব বললেন–মনুর পত্নী শতরূপা পুত্রসন্তান না হওয়ার জন্য দুঃখ পেয়ে ব্রহ্মার কাজে গেলেন এবং ব্রহ্মাকে বললেন–কিভাবে বন্ধ্যার পুত্র হয়। শক্তির স্ত্রী এই ব্রত করে পরাশর নামে পুত্র লাভ করেন। এই ব্রতের ফলে গোপীদের স্বামী ও সকল দেবতার ঈশ্বর নারায়ণ তোমার পুত্র হিসাবে জন্ম গ্রহণ করবেন।

৬.

নারায়ণ নারদকে বললেন–মহাদেব ব্রতের কথা ও নিয়ম বলে তপস্যা করতে চলে গেলেন। পার্বতী স্বামীর আদেশে কিঙ্কর ও ব্রাহ্মণদের ব্রতের কাজে নিযুক্ত করলেন। এই ব্রতের উপযুক্ত সকল জিনিস যোগাড় করে ভাল সময় দেখে ব্রত শুরু করলেন। ব্রহ্মার পুত্র ভগবান সনকুমার সেখানে এলেন। ব্রহ্মা স্ত্রীর সঙ্গে ব্রহ্মালোক থেকে এলেন। শিব শীঘ্র সেখানে উপস্থিত হলেন। চতুর্ভুজ, শ্যামবর্ণ ভগবান বিষ্ণু, লক্ষ্মী ও অনুচর সহ সেখানে উপস্থিত হলেন। সে সময় শিব কৈলাসের সমস্ত লোককে পুজো করে ছিলেন আর খুব উঁচু সিংহাসনে বসেছিলেন। এই ব্রতে একশো লক্ষ অমৃতের কুন্ত এবং মিষ্টি ও চিনির লক্ষ লক্ষ রাশি তৈরী হয়েছিল। লক্ষ্মী নিজে সমস্ত রান্না করলেন। নারায়ণ সকল দেবর্ষিদের নিয়ে খেতে বসলেন। একলক্ষ ব্রাহ্মণ তাদের পরিবেশন করলেন। এতে সকলে সন্তুষ্ট হলেন।

৭.

মহাদেবের আদেশে ভগবতী সন্তুষ্ট হয়ে সেই মঙ্গলকর ব্রতে মঙ্গলবাজনা বাজাতে বললেন। পার্বতী নানা রত্নে সঞ্জিত হয়ে রত্নাসনে বসে রত্ন সিংহাসনে থাকা মুনিদের পুজো করলেন। মঙ্গলঘটে আরাধ্য কৃষ্ণকে আবাহন করে ভক্তি ভরে ষোল উপাচার দিয়ে পুজো করলেন। এক বছর ধরে সাবধানে সকল ব্রতের কাজ করলেন। শিব পার্বতীকে বললেন–হে দেবী! আমি ধর্মের কথা বলছি। ধর্মানুসারে কাজ করে নিজের ধর্ম রক্ষা কর। নিজ ধর্ম রক্ষা করলে সকলের ধর্মই রক্ষা করা হয়।

৮.

পার্বতীর স্তব শুনে ভগবান কৃষ্ণ সুদুর্লভ পার্বতীকে নিজের রূপ দেখিয়েছিলেন। যে মূর্তির পরনে ছিল আগুনের মত পবিত্র পীত বস্ত্র, হাতে বাঁশী, গলায় বনমালা, বিচিত্র তার বেশবাস। পার্বতী ফুল ও চন্দনে সুসজ্জিত হয়ে কস্তুরী ও কুঙ্কুম মেখে, শ্রেষ্ঠ রত্ন দুগ্ধকে ননির সুন্দর শয্যায় শুয়ে পড়লেন স্বামীর সঙ্গে। সুরসিক পার্বতী কৈলাস পর্বতের এক প্রান্তে স্বামীর সঙ্গে বিহার করেছিলেন। অনেকক্ষণ বিহারের পরে যখন বীর্যপাত ঘটবে সে সময়ে বিষ্ণু নিজের মায়ায় এক ব্রাহ্মণের রূপ ধরে সেই ঘরে গিয়ে উপস্থিত হলেন।

এই ভারতবর্ষে যে লোক ভক্তিভরে অতিথির পুজো করে, তার পুজোর মধ্য দিয়ে এই পৃথিবীকে সকল মহাদান করা হয়ে থাকে। সেই অতিথি যার বাড়িতে পুজো না পেয়ে ফিরে যায়, সেই বাড়ী থেকে দেবতারা ও পিতৃপুরুষরাও পুজো না নিয়ে চলে যান।

নিজের কামনার জন্যই লোকে কাজ করে এবং কর্মের থেকেই ভোগ হয়। ভোগ দুরকমের–শুভ ও অশুভ। তাই সুখ ও দুঃখের কারণ। নিজের কাজের ফলে সুখ ও দুঃখ আসে। যে হরিভক্ত সে চিরজীবী হয়। যার কানে গুরু মন্ত্র দিয়ে দেন, পুরাবিদরা তাকেই তীর্থপুত্র বলে থাকেন। যে লোক প্রকৃত ভক্ত তার সমস্ত তীর্থে যাওয়া ও সব যজ্ঞে দীক্ষিত হওয়ার ফল লাভ হয়। শ্রীকৃষ্ণ গণেশ হয়ে দেবীর সন্তান রূপে জন্ম গ্রহণ করেন। ঈশ্বর অদৃশ্য হয়েই বালকের রূপ ধরে ঘরের ভেতরে পার্বতীর বিছানায় চলে এলেন। শিবের বীর্য সঙ্গে সঙ্গে মিশে গিয়ে সদ্যজাত শিশুর মত ঘরের উপরের দিকে চাইতে লাগলেন। বাচ্চাটি বিছানায় শুয়ে হাত পা ছুঁড়তে লাগল।

৯.

হরি অদৃশ্য হয়ে গেলে পরে দূর্গা ও শিব সেই ব্রাহ্মণকে ঘরের চারদিকে খুঁজতে লাগলেন। অতিথি যদি বাড়ী থেকে পুজো না নিয়ে চলে যায় তবে সে গৃহস্থের জীবন বৃথা। যাঁকে বৈষ্ণবরা এবং ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর প্রভৃতি দেবতারা সবসময় ধ্যান করেন, ভক্তদের অনুগ্রহ করার জন্য দেহধারণ করেন, সেই মুক্তিদাতা পুরুষকে নিজের ছেলে হিসেবে প্রত্যক্ষ করুন। দুর্গা নিজের ঘরে এসে বাচ্চাটাকে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখলেন। দেখলেন বাচ্চাটা স্তন পান করার জন্য উমা উমা শব্দ করে কাঁদছে। শিব ঘরে ঢুকে বিছানায় উজ্জ্বল সোনার রং-এর ছেলেকে দেখলেন। দুর্গা বিছানা থেকে সেই ছেলেকে তুলে নিজের বুকের উপর রাখলেন এবং অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে তাকে চুমা খেতে খেতে বললেন– বাছা, হঠাৎ শ্রেষ্ঠ সম্পদ লাভ করে গরীবের মন যেমন অপার আনন্দে ভরে ওঠে, সেরকম অমূল্য রত্ন স্বরূপ তোমায় পেয়ে আমার মনও আনন্দে ভরে উঠেছে। মারাত্মক বিপদে ভয়ঙ্কর সমুদ্রের মধ্যে পড়ে গেলে মানুষের যে অবস্থা হয় এবং সে অবস্থায় যদি নাবিক সমেত কোনো নৌকো সে পায়, সামনে দারুন খাবার দেখে অনেকদিনের উপোসীর মন যেমন পূর্ণ হয়। তেমন অবস্থা হয় এই শিশুকে দেখলে। শিব আনন্দের সঙ্গে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিলেন এবং গালে চুমো খেয়ে বেদের ভাষায় আশীর্বাদ করলেন।

১০.

হর পার্বতী ছেলের মঙ্গল কামনায় নানা বস্তু ব্রাহ্মণদের দান করলেন। হিমালয় ব্রাহ্মণদের লক্ষ রত্ন, হাজার হাজার শ্রেষ্ঠ হাতী, তিন লক্ষ ঘোড়া, দশলক্ষ গোরু, পাঁচলক্ষ সোনা, শ্রেষ্ঠ মণিমুক্তো, মানিক্য ও অন্যান্য জিনিস, কাপড়, অলংকার আর ক্ষীর সমুদ্র থেকে যে রত্ন উঠেছিল তা সবই দান করলেন। সাগরকন্যা লক্ষ্মী আনন্দের সঙ্গে হাজার হাজার পরশ, রচক, কৌস্তুভ, হীরে, মানিক্য রত্ন, ব্রাহ্মণদের দান করলেন। সরস্বতী অসাধারণ সুন্দর এক হার দান করলেন। শিবের পুত্রোৎসবে সবাই ব্রাহ্মণদের নানা দান করলেন। সরস্বতী বললেন, হে পুত্র! তোমার আমার মত সুকবিত্ব, চিন্তাশক্তি, স্মৃতিশক্তি ও বিবেচনাশক্তি হোক। পার্বতী বললেন, তুমি তোমার বাবার মত মহাযোগী সিদ্ধ সিদ্ধিদাতা, শুভ মৃত্যুঞ্জয়, ঐশ্বর্যসম্পন্ন ও সমস্ত শাস্ত্রে পন্ডিত হও। গণেশের বৃত্তান্ত শুনলে পুণ্য লাভ করা যায়। এই শুভ অধ্যায় যার ঘরে রাখা যাবে তার সব সময় ভাল হয়– এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। যে লোক যাবার সময় বা কোন ভাল দিনে শান্ত হয়ে এই কাহিনী শোনে গণেশের দয়ায় সে তার মনের মত ফল পায় এতে কোন সন্দেহ নেই।

১১.

হরি তাঁকে আশীর্বাদ করে দেবতাদের মাঝে দেবতা ও মুনিদের সঙ্গে শ্রেষ্ঠ রত্ন সিংহাসনে বসলেন। তার ডানে শিব, বাঁয়ে প্রজাপতি ব্রহ্মা। নর্তকীরা নাচ করতে লাগল, গন্ধর্ব ও কিন্নররা গান করতে লাগল। সকল বেদ তাদের মূল হরিকে বেদের শ্রেষ্ঠ কথায় স্তব করতে লাগলেন। শনি মাথা নিচু করে রত্ন সিংহাসনে বসা পার্বতীকে নমস্কার করলেন। পার্বতীকে তার পাঁচজন সখী অনবরত শ্বেতচামর দুলিয়ে বাতাস করছিল। গায়ে তাঁর দামী অলংকার। পার্বতীর প্রশ্নের উত্তরে শনি বললেন– সবাই ফল ভোগ করে নিজের কর্মের ফলে। কর্মের ফলে মানুষ ইন্দ্র, ব্রহ্মা ও সুর্যের ঘরে জন্মায়। কর্ম ফলে সে স্বর্গে বা নরকে যায়। কর্মের ফলেই কেউ সুন্দর, কেউ বা জরাগ্রস্থ হয়, কেউ অধিকারী হয় অসংখ্য ধনসম্পদের, দারুণ গরীব হয় অনেকে, কেউ নিঃসন্তান হয়। কেউ কুৎসিৎ শ্রী লাভ করে, শ্রী হীন হয় কেউ। শনি বললেন–তিনি ছেলেবেলা থেকেই কৃষ্ণভক্ত। সব সময় কৃষ্ণের ধ্যান করেন। তার স্ত্রী ছিলেন অত্যন্ত পতিব্রতা, তেজস্বী ও সবসময় ধ্যানমগ্ন। কোন সময় সেই মুনি মানসমোহিনী চঞ্চল নয়না, ঋতুস্নান করে সাজগোজ করে, নানা অলংকার পরে আমার কাছে এলেন। কিন্তু তার দিকে না তাকিয়ে ধ্যানমগ্ন হয়ে থাকলে তিনি অভিশাপ দিলেন। সেই থেকে নিজের চোখ দিয়ে কোন কিছু দেখিনা এবং সেই দিন থেকে আমি প্রাণী হিংসার ভয়ে মাথা নীচু করে থাকি। হে মুনি! গ্রহরাজ শনির কথা শুনে পার্বতী হাসলেন। নর্তকীরাও হেসে উঠল।

১২.

দূর্গা শনিকে বললেন–তার ছেলের দিকে তাকাতে। পার্বতীর কথায় শনি ভাবলেন তিনি বাচ্চাকে দেখলে বাচ্চার ক্ষতি হবে। তাই তিনি ধর্মকে সাক্ষী করে ছেলেকে দেখতে চাইলেন। কিন্তু তার তালু সব শুকিয়ে গেল। শনি তাকাতেই শিশুর মাথা খসে পড়ে গেল। সেই মাথাহীন বালক পার্বতীর কোলে চলে গেল, আর মাথা শ্রীকৃষ্ণে প্রবেশ করল। পার্বতী অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। তাঁকে মূৰ্ছা যেতে দেখে হরি গরুড়ের পিঠে চেপে উত্তর দিকে পুষ্পভদ্র নদীতে চলে গেলেন। নদীর তীরে বনের মধ্যে গজেন্দ্রকে হস্তিনীর সাথে শুয়ে থাকতে দেখলেন। হাতী নিজের বাচ্চাকে উত্তরে মাথা রেখে মহানন্দে সুরতশ্রমে অজ্ঞান হয়ে রয়েছে। বিষ্ণু সুদর্শন দিয়ে তার মাথা কেটে তা নিয়ে গরুড়ে চেপে বসলেন। হস্তিনী সকলকে সান্ত্বনা দিল ও কাঁদতে লাগল। হস্তিনী হরির স্তব করতে লাগল। নারায়ণ ব্রহ্মজ্ঞান দিয়ে হাতাঁকে বাঁচিয়ে দিলেন। হরি পার্বতীর কাছে এসে বাচ্চাকে নিজের বুকের ওপর রেখে সেই হাতীর মুন্ডুর রক্ত বার করে বালকের দেহের সঙ্গে যোগ করে দিলেন। শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে বাঁচিয়ে তুললেন।

ইন্দ্র নিজের কর্মবশে কীট যোনিতে জন্মগ্রহণ করতে বাধ্য হন এবং কীটত্ত আগের কর্মফলে ইন্দ্র হয়ে জন্মায়। ভাল কাজ করলে সুখ ও আনন্দ হয়। বাকি সবই পাপকাজের ফল। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর যে পুরুষের অংশস্বরূপ যার প্রত্যেক লোমকূপে এক একটা জগৎ বর্তমান। সেই মহাবিরাট তার অংশ স্বরূপ মাত্র, পার্বতী সন্তুষ্ট হয়ে কৃষ্ণকে প্রণাম করে বালককে স্তন দিলেন। বিষ্ণু শিশুর গলায় কৌস্তুভমণি পড়িয়ে দিলেন। ব্রহ্মা মুকুট আর ধর্ম অলংকার দান করলেন। ছেলেকে বেঁচে উঠতে দেখে হর পার্বতী ব্রাহ্মণদের দান করলেন কোটি রত্ন। পার্বতী শনিকে অঙ্গহীন হবার অভিশাপ দিলেন। এর ফলে সূর্য– কশ্যপ ও যম রেগে বাড়ী ছেড়ে চলে যেতে চাইলেন। তাদের ঠান্ডা করার জন্য বিষ্ণু ব্রহ্মাকে পাঠালেন। কশ্যপ বললেন, শনি দূর্গার অনুমতি নিয়েই শিশুকে দেখেছিলেন। ব্রহ্মা বললেন, মাতৃ মমতায় দূর্গা শাপ দিয়ে ফেলেছেন। তিনি দূর্গাকে বললেন, যে শনি অতিথি তার অমর্যাদা না করতে, পার্বতী তখন তাকে চিরজীবী হওয়ার আশীর্বাদ দিলেন ও বললেন–যে, যেহেতু তিনি শাপ দিয়েছেন তাই শনি কিছুটা খোঁড়া হবে। শনি তখন সন্তুষ্ট হয়ে পার্বতীকে প্রণাম করে দেবতাদের কাছে চলে গেলেন।

১৩.

বিষ্ণু এসে গণেশকে উপহার দিয়ে পূজা করে গেলেন। তিনি নাম দিলেন– গণেশ, বিঘ্নেশ, হেরম্ব, গজানন, লম্বোদর। ধর্ম দিলেন সিদ্ধ আসন। ব্রহ্মা কমন্ডলু। ইন্দ্র দিলেন রত্নসিংহাসন। কুবের মুকুট দিলেন। শৈলেশ্বরী, শৈলরাজ, শৈলকন্যা, শিলরাজের পুত্র এবং শৈলরাজের প্রিয় মন্ত্রীরা হিমালয় কন্যার ছেলে গণেশের পূজা করলেন ও তাকে প্রণাম করলেন। যে লোক এক মনে বিষ্ণুর সৃষ্ট গণেশের স্তব সকাল, দুপুর এবং সন্ধ্যায় ভক্তি ভরে পাঠ করে, ভগবান গণেশ তার মনোবাসনা পূরণ করেন। স্বপ্ন দেখার পর এই স্তব করলে পরে ভালো স্বপ্ন দেখে। ভয়ঙ্কর গ্রহপীড়া নাশ হয়। নিত্য বিঘ্ন নাশ হয়। নিত্য সম্পদ বাড়ে, বংশ পরম্পরায় তার ঘরে লক্ষ্মী অচলা থাকেন। ইহলোকে সবরকম ঐশ্বর্য লাভ করে। মরণের পরে বিষ্ণুর চরণে লীন হন। সে নিশ্চয়ই গণেশের অনুগ্রহে সকল তীর্থের সকল যজ্ঞের ও মহাদানের ফল পায়।

সংসার সমুদ্র থেকে উদ্ধারকারী কবচের কথা শুনতে চাইলেন নারদ। শনিদেব ভয়ে বিষ্ণুকে বললেন, তাঁর দুঃখমোচন করার জন্য। তার স্বরূপ ব্যাখ্যা করতে বললেন, ও গণেশের কবচ ধারণ করতে চাইলেন। বিষ্ণু বললেন, গণেশের কবচ এই ত্রিভুবনে দুর্লভ। পুরাণগুলিতে এই কথা খুব গোপনভাবে বলা হয়েছে। দশ লক্ষ বার জপ করলে এই কবচ সিদ্ধ হয়। যার কবচ সিদ্ধ হয় সে মৃত্যুক জয় করতে পারে। কোন ত্রুর স্বভাবের লোক এই কবচ পরলে তার মৃত্যু হয়। এই কবচের ঋষি হলেন প্রজাপতি ছন্দ, বৃহতী ও স্বয়ং গণেশ দেবতা। ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ হল এই কবচের বিনিয়োগ ‘ওঁ গৌং সং শ্রীগণেশায় স্বাহা’ মন্ত্রে আমার মাথা রক্ষা করুন আগের বত্রিশ অক্ষরের মন্ত্র আমার কপাল, ওঁ হীং ক্লীং শ্রীং’ মন্ত্র আমার চোখ এবং বিঘ্ননাশকারী গণেশ আমার তালু রক্ষা করুন। ঠিকমত গুরু পূজা করে যে এই কবচ গলায় বা ডান হাতে বাধে, সে এক হয় বিষ্ণুর সাথে। হাজার অশ্বমেধ ও শত বাজপেয় যজ্ঞ এই কবচের ষোল কলার এক কলার যোগ্য নয়। এই কবচ না জেনে যে গণেশের ভজনা করে, একশো লক্ষবার জপ করলেও তার সে মন্ত্র সিদ্ধ হয় না।

১৪.

বিষ্ণুর মহোৎসব দেখে সকল দেবতা গন্ধর্ব ও মুনিরা খুব আনন্দ পেয়েছিলেন। দূর্গা সেই দেবতাদের মাঝে প্রণাম করে দেবেশ্বর বিষ্ণুকে বললেন– তাঁর স্বামীর আমোঘ বীর্য রক্ষা করতে পারেন নি। সেই বীর্য কেউ চুরি করেছে। বিষ্ণু যেন তা তদন্ত করেন। বিষ্ণু দেবতাদের বললেন–কে এই কাজ করেছে। দেবতারা ভয়ে কাঁপতে লাগলেন। মহাদেব বললেন–যে তার বীর্য গোপন করে রেখেছে তার পুজোর কোন অধিকার থাকবে না। একাদশী ব্রত থেকে বঞ্চিত হবে এই পাপ কাজকারী লোক। যম বললেন, যে এই বীর্য চোর তার পূর্ব কর্মের পাপ হবে। এই বীর্য চোর কারো ভরণ পোষণ করতে পারে না। যারা বীর্য চোর তার পুত্রহীন ও গরীব হোক। ধর্ম বলেন, শিব বীর্য রেখে গিয়ে যখন রতিক্রীড়া ছেড়ে ওঠেন, তখন তার বীর্য যে পৃথিবীতে পড়েছিল তা সকলে জানেন, পৃথিবী সেই মহাভার বীর্য ধারণ করতে না পেরে তা সে আগুনে ছুঁড়ে ফেলে। অগ্নি বলল, সে তা শরবনে ছুঁড়ে ফেলে। বায়ু বললেন, শরবনে পড়ামাত্রই এক সুন্দর বালকে পরিণত হয়েছে। চাঁদ বললেন–সে সময় কৃত্তিকার দল সেপথ দিয়ে যাচ্ছিল তারা বাচ্চাটাকে কাঁদতে দেখে তাকে বদরিকাশ্রমে আপনার ঘরে নিয়ে গেছে। জল বললেন–সূর্য থেকে বেশী উজ্জ্বল জ্যোর্তিময় ঈশ্বরের সেই কান্না দেখে ছেলেকে এনে কৃত্তিকা স্তন দিয়ে বড় করেছে। সন্ধ্যা দুজন বললেন, সেই বালক কৃত্তিকার পোষ্য পুত্র হয়েছে। এজন্য তারা স্নেহ ভরে তার নাম রেখেছে কার্তিক। কৃত্তিকারা এখন সেই বালককে আর চোখের আড়াল করে না। এখন তাদের কাছে তাদের প্রাণের থেকেও প্রিয় হয়েছে। দিন বললেন– এই ত্রিভুবনে যে সব জিনিস দুর্লভ স্বাদু ও ভাল তারা সব জিনিস আনিয়ে তাকে খাওয়ায়। তারা সেখানে দেব সভায় আনন্দে হরিকে জানিয়ে বললেন, এবং মধুসূদন হরি সেকথায় সন্তুষ্ট হলেন। পার্বতী ছেলের খবর পেয়ে মহানন্দে ব্রাহ্মণদের কোটি রত্ন ও অসংখ্য ধনদান করলেন। লক্ষী, সরস্বতী, মেনকা, সাবিত্রী, স্ত্রীরা ওবিষ্ণুও প্রভৃতি দেবতারা ব্রাহ্মণদের ধন্যদান করলেন।

.

১৫.

বীরভদ্র, বিশালাক্ষ, শঙ্কুকর্ণ, কবন্ধক, নন্দীশ্বর, মহাকাল, বজ্ৰদন্ত ভনন্দন, প্রভৃতি দূতদের বিষ্ণু পাঠালেন তাদের সন্তানের খোঁজে। দূতেরা কৃত্তিকাদের বাড়ীর দিকে এগিয়ে গেল কৃত্তিকারা ভয় পেয়ে ব্রহ্মতেজে জলিত কাৰ্ত্তিকেয়কে বলল, তখন কার্ত্তিক তাদের অভয় দিলেন। নন্দীকেশ্বর তাদের বললেন, যে তাকে হর পাঠিয়েছেন। তার সুখবর শুনুন। কৈলাস পর্বতে গণেশের জন্ম মঙ্গললাৎসব সব উপলক্ষ্যে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব প্রভৃতি দেবতারা এক সঙ্গে রয়েছেন। সেখানে পার্বতী জগতের পালক বিষ্ণুকে সম্মোধন করে তোমার খোঁজার ব্যাপারে অভিযোগ করলেন। বিষ্ণু তখন তোমার খোঁজ পেয়ে আমাদের পাঠালেন। কৃত্তিকারা তোমাকে লাভ করেছে, তুমি আমাদের সঙ্গে এস। বিষ্ণু সকল দেবতাদের সঙ্গে তোমাকে সেনাপতি করবে। পন্ডিতই হোক আর বোকাই হোক, কর্মফলানুসারে যারা সেখানে বাস করে, বিষ্ণুমায়ায় মুগ্ধ হয়ে সেই স্থানকেও শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে। কার্ত্তিক নদিকেশ্বর বললেন–কৃত্তিকারা ও তার মা, পার্বতীও তার মা, তবে তিনি হিমালয় কন্যার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেনি। কৃত্তিকারা যেমন তার ধর্ম তাই ধর্ম সম্মত। বেদে বলা হয়েছে মানুষের ষোল রকম মায়ের কথা। এরা হলেন –স্তন দানকারী, গর্ভ ধারণকারী, যে খাওয়ায়, গুরুর স্ত্রী, ইষ্টদেবের স্ত্রী, বাবার স্ত্রী, মেয়ে, ছেলের বউ, মা, মায়ের মা, বাবার কোন ভাইয়ের বউ, মায়ের বোন ও মামার স্ত্রী। কৃত্তিকারা ত্রিলোক পূজনীয় ও ব্রহ্মার মেয়ে, এরা কোন মতেই সামান্য নয়। কার্ত্তিক নন্দীকেশ্বর এর সাথে যেতে রাজি হলেন কেননা তাকে মহাদেব পাঠিয়েছেন।

১৬.

কার্ত্তিক তখন কৃত্তিকাদের মা বলে তাদের নীতিকথা শোনালেন। তিনি বললেন–সকল জগৎ, ভাল কাজ, দৈব থেকে শক্তিশালী আর কেউ নেই। কৃষ্ণের অধীন সেই দৈব, একমাত্র কৃষ্ণই দৈবশক্তির বাইরে থাকেন। তাই জ্ঞানীরা সর্বদা জগদীশ্বর পরমাত্মা কৃষ্ণের ভজনা করে। কৃষ্ণ পারে দৈবের বল বাড়াতে ও কমাতে। অবলীলাক্রমে ভক্তও বশ হয় না দৈবের। যে সুখ ও মোক্ষ দান করে, জন্ম ও মৃত্যু দূর করে। আর দুঃখের কারণ মোহকে ছাড়া। ঈশ্বরের ইচ্ছানুসারেই হয়ে থাকে পরস্পরের যোগাযোগ। পণ্ডিতরা ব্রহ্মান্ডকে ঈশ্বরের অধীন ও এক বলে মনে করে। জলের বুদবুদের মত এই ত্রিভুবন অনিত্য, বোকারা মায়ার বশেই অনিত্য বস্তুকে মায়া করে মাত্র।

যাদের মন শ্রীকৃষ্ণে আসক্ত তারা সংসারে বায়ুর মত নির্লেপ হয়ে অবস্থান করে। সুতরাং তাকে যেন মায়েরা বিদায় দেন। কার্তিক মনে মনে হরিকে স্মরণ করে শিবের অনুচরদের সাথে যাত্রা শুরু করলেন। সে সেখানে পার্বতীর পাঠানো ও শিবের অনুচরে ঘেরা একখানা সুন্দর রথ দেখতে পেলেন। শ্রেষ্ঠ রত্ন দিয়ে বিশ্বকর্মা সে রথ বানিয়েছে। এই রথের চাকা একশো আর এর গতি মনের মতো। এই রথে কার্তিককে চড়তে দেখে অজ্ঞান হয়ে গেল কৃত্তিকারা। এবং জ্ঞান ফিরে এলে কার্তিককে নিয়ে বিলাপ করতে লাগলেন, কৃত্তিকারা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে পুত্র বিচ্ছেদ বেদনার কথা ভেবে পুনরায় অজ্ঞান হয়ে গেলেন।

শেষে কার্তিক তাদের সঙ্গে নিয়েই রওনা হলেন। যাওয়ার সময় ভরা কলস, ব্রাহ্মণ, বেশ্যা, সাদাধান, আয়না, দই, ঘি, মধু, খই, ফুল, দুধ, আতপচাল, ষাঁড়, হাতী, ঘোড়া, জ্বলন্ত আগুন সোনা, পান, নানা পাকা ফল, স্বামী পুত্র সমেত স্ত্রী, প্রদীপ, মুক্তা, ফুলের মালা, সদ্যমড়া পশুর মাংস, চন্দন ইত্যাদি মঙ্গলময় বস্তু দেখলেন। বাঁয়ে শেয়াল, নেয়ুল, ভরা কলস, প্রভৃতি শুভ জিনিস আর ডানে রাজহংস, ময়ূর, ঘোড়া, শুক, কোকিল, পায়রা, শঙ্খচিল, চখা, কৃষ্ণসার, সুরভি, চমরী, সাদা চামর, বাচ্চা সমেত গরু, পতাকা, এইসব নানা জিনিস দেখলেন। তাছাড়া শুনলেন, মঙ্গল ধ্বনি, হরিনাম শাঁখ ও ঘণ্টার শব্দ। এভাবে শুভ জিনিস দেখে ও শুনে সেই রথে চড়ে কার্তিক বাবার বাড়ি গেলেন। তারপর কৈলাস পর্বতে গিয়ে অক্ষয় বটের মূলে আগে কৃত্তিকা ও পার্ষদদের সাথে কিছুকাল অতিবাহিত করলেন। পার্বতী পুরীর চারদিকে রাজপথ, পক্ষরাগ ও ইন্দ্রনীল মণি দিয়ে সাজিয়ে, পাটের সুতোর অখণ্ড পল্লবের মালা গেঁথে পূর্ণপত্র ও ফল দিয়ে ভর্তি করে চন্দনের জলে স্নান করে, রত্ন প্রদীপ ও মণি দিয়ে সাজিয়ে নর্তক ও বেশ্যাদের সঙ্গে নিয়ে এবং বন্দী ও ফুলদুর্বা হাতে ব্রাহ্মণদের সঙ্গে নিয়ে এলেন।

সপুত্র সতীনারীরা ছিল তাঁর সঙ্গে। এদের সঙ্গে লক্ষ্মী, সরস্বতী, গঙ্গা সাবিত্রী, তুলসী, রতি, অরুন্ধতী, অহল্যা, দিতি, তারা, মনোরমা, অদিতি, শতরূপা, শচী, সন্ধ্যা, রোহিনী, অনসূয়া, স্বাহা, সংজ্ঞা, বরুণের স্ত্রী, আকুতি, প্রসূতি, দেবভূতি, মেনকা, এক পটলা, একপর্ণা, মৈনাকের স্ত্রী, বসুন্ধরা ও মনসা। রম্ভা, তিলোত্তমা, মেনকা, ঘৃতাচী, মোহিনী, ঊর্বশী, রত্নামালা, সুশিলা, ললিতা, কলা, কদম্ব, সুরমা, বর্ণমালা, সুন্দরী প্রভৃতি সব অপ্সরারা মনোরম সাজগোজ করে হাসিমুখে হাত তালি দিয়ে নীচগান করতে করতে মহানন্দে সেখানে গেল। সবাই মহানন্দে কুমারকে অভ্যর্থনা করার জন্য সেখানে গেল। মহাদেব নিজে বাদক নিয়ে নানা বাজনা বাজাতে বাজাতে রুদ্র, পাদ, ভৈরব ও ক্ষেত্রপালদের সঙ্গে গেলেন। কার্তিক পার্বতীকে কাছে দেখে খুব খুশি হয়ে রথ থেকে তাড়াতাড়ি নেমে মাথা দিয়ে মাটি ছুঁয়ে প্রণাম করলেন। পার্বতী আদর করে মুনি স্ত্রীদের ভক্তি ভরে শিব প্রভৃতি দেবতার অনুমতি নিয়ে কার্তিকের মুখ দেখলেন ও কোলে করে চুমো খেলেন। সকলে একে একে কার্তিককে শুভ আশীর্বাদ করলেন।

কার্তিক মহাদেবের অনুচরদের সাথে তার বাড়িতে এসে সভার মধ্যে ক্ষীরোদশায়ী বিষ্ণুকে দেখলেন। তিনি তখন রত্নলংকারে সজ্জিত হয়ে রাসনে উপবিষ্ট। তাকে ঘিরে রয়েছেন ধর্ম ব্রহ্ম ইন্দ্র, চন্দ্র, সূর্য, অগ্নি, বায়ু প্রভৃতি দেবতারা। ভক্তানুগ্রহকারী সেই দেবতার মুখ তখন মৃদু হাস্যযুক্ত, মুনীন্দ্র ও দেবেন্দ্ররা তার স্তব করছেন ও সাদা চামর দুলিয়ে তাঁকে বাতাস করছেন। সেই জগন্নাথ বিষ্ণুকে দেখে ভক্তিতে তার কাধ নীচু হয়ে এল। সারা দেহে রোমাঞ্চও দেখা দিল। মাটিতে মাথা রেখে তাঁকে প্রণাম করলেন। তারপর ব্রহ্ম, ধর্ম ও উপস্থিত অন্য দেবতা ও মুনিদের একে একে প্রণাম করে তাদের শুভ আশীর্বাদ নিলেন এবং সকলকে সাদর সম্ভাষণ করে সোনার সিংহাসনে বসলেন। শিব তখন পার্বতীর সঙ্গে ব্রাহ্মণদের প্রচুর ধনদান করলেন।

১৭.

জগৎপতি বিষ্ণু মনের আনন্দে একটি ভাল সময় দেখে সুন্দর রত্নাসনে কার্তিককে বসালেন। তখন নানা বাজনা ও যন্ত্র বাজাতে বললেন–এবং বেদমন্ত্র পাঠ করে সকল তীর্থের জলে ভর্তি রত্নের তৈরি শত শত কলস দিয়ে তাঁকে স্নান করালেন। শ্রেষ্ঠ রত্নসারাংশ দিয়ে তৈরি মুকুট, চূড়া আর মূল্যবান রত্ন দিয়ে তৈরি নানা অলংকার, দৈব অগ্নির মত পবিত্র কাপড়, ক্ষীরোদসম্ভারের চমকে উৎপন্ন কৌস্তভ মণি বনমালা এবং চক্র মহানন্দে তাকে দান করলেন। ধর্ম দান করলেন উৎকৃষ্ট ধর্মমতি এবং সকল জীবে দয়া। মহাদেব দান করলেন শ্রেষ্ঠ মৃত্যুঞ্জয় জ্ঞান এবং সমস্ত শাস্ত্রে অভিজ্ঞতা, নিত্যসুখের উপযুক্ত তত্ত্বজ্ঞান, যোগতত্ত্ব সিদ্ধি তত্ত্ব মহাদুর্লভ ব্রহ্মজ্ঞান শূল, পিনাক, পরশু, শক্তি, পাশুপত, ধনু, প্রভৃতি সংহারকারক অস্ত্রের প্রয়োগ এবং ধ্বংস, জলের দেবতা বরুণ দিলেন শ্বেতছত্র ও রত্নমালা, ইন্দ্র শ্রেষ্ঠ হাতী এবং সুধানিধি চন্দ্র তাকে সুধাকলম দান করলেন। সূর্য মনের গতি সম্পন্ন রথ ও মনোহর কবচ দান করলেন। যম যমদণ্ড ও অগ্নি মহাশক্তি দান করলেন। কামদেব দান করলেন কামশাস্ত্র। ক্ষীরোদসাগর অমূল্যরত্ন ও রত্ন নুপূর দান করলেন। আর পার্বতী হাস্যমুখে মহানন্দে মহাবিদ্যা, সুশীলা বিদ্যা, মেধা, দয়া, স্মৃতি, নির্মল বুদ্ধি, শান্তি, তুষ্টি, পুষ্টি, ক্ষমা, কৃতি অচলা হরিভক্তি, হরির দাসত্ব দান করলেন। পণ্ডিতরা যাকে শিশুপালিকা মহাষষ্ঠী বলে থাকে সেই সুন্দর বিনয়ী সচ্চবিত্র দেবসেনাকে রত্নালংকারে সাজিয়ে বেদমন্ত্র পড়ে তার সঙ্গে বিয়ে দিলেন। সকল দেবতা, মুনি ও গন্ধর্বরা কার্তিকের অভিষেক শেষ করে জগৎপতি শিব প্রভৃতিকে প্রণাম করে যে যার নিজ স্থানে গেলেন। মহাদেব, ব্রহ্মা, বিষ্ণুও ধর্মের স্তব করলেন। এবং হিমালয় নিজের অনুচরদের নিয়ে নিজের জায়গায় চলে গেলেন। এরপর যে যেখান থেকে এসেছিল, সে সেখানে চলে গেল। শিব পার্বতীর সাথে কিছুকাল আনন্দে কাটিয়ে আবার সেই দেবতা মুনি প্রভৃতিদের নিজের কাজে ডাকিয়ে এনে পুষ্টির সঙ্গে মহাত্মা গণেশের খুব ধূমধামের সঙ্গে বিয়ে দিলেন। এভাবে পার্বতী মহানন্দে তাঁর দুই ছেলে ও পরিবারের সাথে ভগবানের সেবা করে কাল কাটাতে লাগলেন। সুতরাং কার্তিকের অভিষেক বিয়ে ও পূজো ও গণেশের বিয়ে সবই বলা হল। পার্বতীর সন্তান লাভ ও দেবতাদের মিলিত হওয়ার কথাও বলা হল। এখন বল তুমি কি শুনতে চাও।

১৮.

নারদ জানতে চাইলে যে, গণেশ দেবতাদের অধিপতি মহাত্মা শঙ্করের পুত্র, নিজে স্বয়ং বিঘ্ন দূর করেন ও ঈশ্বরের অবতার, তার আবার বিঘ্ন কেন? পরিপূর্ণতম পরাৎপর পরমাত্মা গোলোকপতি আপনার অংশে পার্বতীর পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করেছেন। কিন্তু কেন সাক্ষাৎ ভগবান শনির দৃষ্টিমাত্রই যে মাথা খসে পড়ল, তার কারণ জানতে চাইলেন। নারায়ণ বললেন– সূর্য কোন এক সময় মালী ও সুমালী নামে দুই শিব ভক্তকে হত্যা করতে গেলে ভক্তবৎসল শিব অত্যন্ত রেগে সূর্যকে শুলাঘাত করেন। সূর্যদেব তাতে আহত হয়ে অজ্ঞান হয়ে যান এবং রথ থেকে খসে পড়েন। কশ্যপ পুত্রকে এই অবস্থায় দেখে কাঁদতে লাগলেন। দেবতারা ভয়ে ঘন ঘন কান্না শুরু করলেন। সকল জগৎ অন্ধকারে ঢাকা পড়ে অন্ধের মত হল। কশ্যপ তখন ব্রহ্ম তেজে জ্বলছেন। তিনি শিবকে শাপ দিয়ে বললেন, তার ছেলের। মাথাও কাটা যাবে। হর তখন সূর্যকে বাঁচিয়ে দিলেন। সূর্য তাদেরকে প্রণাম করলেন। তারপর কশ্যপের শাপের কথা শুনে কশ্যপের উপর অসন্তুষ্ট হলেন। বললেন–তিনি বিষয় সুখ চান না। ঈশ্বর বিনে সবই তুচ্ছ। পরমেশ্বরকে বাদ দিয়ে অশুভ বিষয় সুখ ভোগ করতে চায় না। ব্রহ্মা সূর্যর কাছে এসে তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বিষয়াসক্ত করে তুললেন। শিব, ব্রহ্মা এবং কশ্যপ সূর্যকে আশীর্বাদ করে মনের আনন্দে যে যার নিজ স্থানে চলে গেলেন, সূর্যও নিজ রাশিতে গেলেন। শ্বিত্র রোগে আক্রান্ত হল মালী ও সুমালী, সারা দেহ গলে পড়তে লাগল। তারা শক্তিহীন ও নিস্তেজ হল। সূর্যের কোপে যে তাদের এ অবস্থা ব্রহ্মা তা বললেন, ব্রহ্মা তাদের সূর্যের কবচ, স্তোত্র ও পূজার নিয়ম বলে ব্রহ্মলোকে চলে গেলেন। তারপর তারা পুষ্কর তীর্থে গিয়ে তিনবার স্নান করে ভক্তি ভরে সূর্যের মন্ত্র জপ করে সূর্যের আরাধনা শুরু করল, পরে সূর্যের বর পেয়ে স্বাভাবিক যে রূপ ছিল তা ফিরে পেল। এবার নারায়ণ জানতে চাইলেন যে, নারদ আর কি শুনতে চায়।

১৯.

এবার নারদ সূর্যের স্তব ও বর দানের কথা বলেছিলেন। সব রকম পাপ ও রোগ যাতে ধুয়ে মুছে যায়, তার জন্য মালী, সুমালী শিব মন্ত্রের প্রসাদক ব্রহ্মাকে স্মরণ করল। ব্রহ্মা বৈকুণ্ঠে গিয়ে কমলাপতি হরির সামনে বসে থাকা শিবের কাছে জানতে চাইলেন–কেন তারা রোগগ্রস্থ। বিষ্ণু বললেন–পুষ্কর তীর্থে একবছর ধরে আমার অংশস্বরূপ যে সূর্যদেব এবং যিনি সকল রোগ দূর করেন, তার সেবা করলেই রোগমুক্তি ঘটে। শিব ব্রহ্মাকে বললেন, তাদের ব্যাধিনাশক মহাত্মা সূর্যের কল্পতরুর অভিপ্রেত ফলদায়ক সর্বোৎকৃষ্ট স্তব কবচ ও মন্ত্র দান করতে, হরি নিজে সব কিছু দান করেন, সূর্য রোগ দূর করেন, যার যা বিষয়ে সে তাই করে। তারপর সেই দৈত্যদের কাছে গেলেন ব্রহ্মা ও নারায়ণ শিবের অনুমতি নিয়ে। ব্রহ্মা তাদের গলিত অসাড় আহারশূন্য এবং পূর্য ও দুর্গন্ধময় দেহ দেখে বললেন–বাছারা, তোমরা আমার কবচ, স্তব মন্ত্র ও পূজোর নিয়ম জেনে পুষ্করে গিয়ে বিনীত ভাবে সূর্যের উপাসনা কর।

ব্রহ্মা বললেন–ত্রিসন্ধ্যা স্নান করে যে মন্ত্র বলছি সেই মন্ত্রে ভক্তিভরে সূর্যের সেবা করলে তোমরা নীরোগ হবে। সেই সূর্য কবচ আমি তোমাদের দিচ্ছি। অহল্যাকে চুরি করার পাপে। গৌতমের শাপে, ইন্দ্রের গায়ে হাজার ক্ষত চিহ্ন দেখা দিয়েছিল, তখন বৃহস্পতি সন্তুষ্ট হয়ে ইন্দ্রকে এই কবচ দান করেছিলেন। যে কবচ ধারণ করে ভারতে মুনিরা পরম পবিত্র হয়ে জীবন্মুক্ত হয়েছেন, আমি সেই পরম অদ্ভুত কবচের কথা বলছি, সাপেরা যেমন ভয় পায় গরুড়কে তেমনই রোগও ভয় পায় কবচধারীকে। এই কবচ বিশুদ্ধভাবে গুরুভক্ত যারা তারা নিজের শিষ্যকেই শুধু দেবে। তার মৃত্যু ঘটবে যে দুষ্টু স্বভাবের অপরকে এই কবচ দেবে। এর নাম জগদ্বিলক্ষণ। এই কবচের ঋষি প্রজাপতি, ছন্দ গায়ত্রী এবং সূর্য দেবতা।

এর প্রয়োগ ঘটে সকল রোগ নিরাময় ও সৌন্দর্য লাভের জন্য। এটি ধারণের সাথে সাথেই পবিত্রতা লাভ হয়। যা সকল পাপ দূর করে। ওঁ ক্লীং থ্রীং ক্রীং শ্রীং সূর্যায় স্বাহা’ এই মন্ত্র আমার মাথা রক্ষা করুক, আমার কপাল রক্ষা করুক–আঠারো অক্ষরের মন্ত্র। ওঁ থ্রীং হ্রীং শ্রীং সূর্যায় স্বাহা’ এই মন্ত্র আমার নাক রক্ষা করুক, আমার চোখ রক্ষা করুক সূর্য। বিতগুণ চোখের তারা রক্ষা করুক, অধর রক্ষা করুন ভাস্কর, দাঁত রক্ষা করুক দিনকর, গলা ও কান রক্ষা করুন মাতন্ড ও প্রচণ্ড, মিহির কাধ, পূষণ জঙঘা দুটো, রক্ষা করুণক ও সূর্য নিজে সবসময় আমার নাভি রক্ষা করুন। সববেদনমস্কৃত সবসময় আমার কঙ্কাল, ব্রহ্মা হাত ও প্রভাকর পা রক্ষা করুন।

বিভাকর সর্বাঙ্গ রক্ষা করুন। আগে পুষ্করতীর্থে পুলস্ত্য মনুকে এই কবচ দিয়েছিলেন। আমি তা তোমাকে দান করলাম। তুমি কাউকে এই কবচ দিও না। এতে কোন সন্দেহ নেই এই কবচের কল্যাণে তুমি নীরোগ ও শ্রীমান হবে। এতেও কোন সন্দেহ নেই যে লক্ষ বছর হবিষ্য পালনের ফল পাবে এই কবচ ধারণ করলে। যে বোকা এই কবচ না মেনে সূর্যের উপাসনা করে, দশ লক্ষ বার জপ করলেও তার মন্ত্র সিদ্ধ হয় না।

ব্রহ্মা বললেন–এই কবচ ধারণ করে সূর্যের স্তব করে নিশ্চয়ই রোগ মুক্ত হবে। সামবেদে বলা হয়েছে, সূর্য দেবের স্তব সব রোগ থেকে মুক্তি দেয়। এই স্তব দূর করে সকল পাপ। সর্বোৎকৃষ্ট আনন্দ ও আরোগ্য দেয়। ব্রহ্মা বললেন, সেই ব্ৰহ্মজ্যোতি স্বরূপ সনাতন ও ভক্তদের অনুগ্রহ কর। ত্রিলোকের চক্ষু স্বরূপ, লোকনাথ, পাপ দূর করে, তপস্যার ফলদান কর ও পাপিদের দুঃখ দাও। তুমি সর্বকর্মের বীজ ও দয়ার আধার। তুমি কর্ম ও ক্রিয়া স্বরূপ। তুমি সুখ, মোক্ষ, ভক্তি ও সকলের অভীষ্ট দান কর। তুমি সারাৎসার, সকলের ঈশ্বর, সর্বস্বরূপ ও সকলের কর্মের সাক্ষী।

২০.

তুমি সবার অতীন্দ্রীয়। তুমি রস সৃষ্টিকারী, রস দান কর, সিদ্ধি দান কর। সিদ্ধি স্বরূপ, সিদ্ধদের পরমগুরু। গোপন অপেক্ষাও গোপনতর। যে প্রত্যেকদিন ত্রিসন্ধ্যা এ স্তব পড়ে, সকল রোগ মুক্ত হয়। যার কুষ্ঠ হয়েছে, দেহ গলে পড়ছে, চোখ নেই, যার মুখে ব্রণ, যক্ষারোগী, মহাশূল রোগী ও নানা রোগগ্রস্থ লোকেরা যদি একমাস ধরে হবিষ্য পালন করে এই স্তব শোনে –তার রোগ মুক্তি ঘটবেই এবং সে সকল তীর্থ স্নানের ফল লাভ করে এতে সন্দেহ নেই। সুতরাং তোমরা তাড়াতাড়ি পুষ্কর তীর্থে যাও এবং সেখানে গিয়ে ভাস্করের উপাসনা কর। এরকম উপদেশ দিয়ে মনের আনন্দে চলে গেলেন ব্রহ্মা। দৈত্যরা সূর্যের উপাসনা করে নীরোগ হল।

নারদ জানতে চাইলেন, কেন গণেশের মাথায় হাতির মুখ লাগানো হল। নারায়ণ বললেন, এই কাহিনি সব মঙ্গলের মঙ্গল, সুখদায়ক, মোক্ষদায়ক এবং চতুর্বর্গ ফলদায়ক, লক্ষ্মীচরিত এই কাহিনির অর্ন্তগত। আমি পুরানো ইতিহাস বলছি যা পাদ্মকল্পে রহস্য যমের কাছ থেকে শোনা। ইন্দ্র একদিক কামার্ত হয়ে রাজলক্ষ্মীর মত সেজে পুঞ্জভদ্র তীরে গিয়েছিলেন। সেখানে এক সুন্দর ফুলের বাগান দেখলেন। জীবজন্তু শূন্য দুর্গম বনের মধ্যে চন্দ্রলোক থেকে সুরত কর্মের ও বিশ্রামের জন্য আসা কামদেবের অনুরাগিণী রম্ভাকে দেখেছিলেন। রম্ভা রতি ক্রীড়ার কথা চিন্তা করে কামদেবের ওপর একাগ্র চিত্ত হয়ে কামদেবের কাছে যাচ্ছিল। অপূর্ব সুন্দরী ও সুগঠিত শরীরের অধিকারীণি ছিল রম্ভা। পরন তার পবিত্র কাপড়, অলংকার, কপালে সিঁদুর, চোখ তার নীল পদ্মাভ, নয়নদ্বয় উজ্জ্বল কাজলে রাঙান। স্তন তার উঁচু ও কঠিন, তার পোশাক পরিচ্ছন্ন, সুন্দরী অপ্সরাদের মধ্যে রম্ভা অত্যন্ত সুন্দরী। সকলের মনোহারিণী। তাকে দেখে ইন্দ্র কামাতুর হলেন ও বলতে লাগলেন– তুমি কোথায় যাচ্ছ সুন্দরী? এখন কে তোমার প্রিয়পাত্র?

দুতের মুখে শুনে এখানে তোমায় খুঁজতে এসেছি। ভাল জল খেতে চেয়ে কেউ ঘোলা জল খায় না। যে চন্দন চায় সে কখনও পাঁক নেয় না। খারাপ খাবার যে কখন খেতে চায় না সে ভাল খাবার খায়। ভালো শয্যা ছেড়ে কণ্টক অস্ত্রশয্যায় কেউ শোয় না। পদ্ম ফুল ছেড়ে কেউ শাপলা নেয় না। যে সবসময় পণ্ডিতদের সঙ্গে সময় কাটায় সে কখনও মুখের সঙ্গে থাকতে চায় না। রত্নলংকার ছেড়ে লোহার অলংকার পড়তে চায় না। এখন কে এমন বোকা যে তোমাকে আলিঙ্গন না করে অন্যের স্ত্রীকে পেতে চায়। কোন বুদ্ধিমান লোক গঙ্গা ছেড়ে অন্য নদীতে স্নান করতে চায় না, যারা সুখে কাটায় ইহকাল তারা ইন্দ্রিয়ের সুখ পুরণ করার বরই চায়।

রম্ভার সামনে এসে ইন্দ্র দাঁড়ালেন। রম্ভা আনন্দে অল্প হাসল। তার বিলোল কটাক্ষ, স্তন ও উরু দেখে এবং কামনায় উত্তেজক কথাবার্তায় ইন্দ্রের চৈতন্য লোপ পেল। রম্ভা বলল, তার যেখানে খুশি সেখানে যাচ্ছে। মিথ্যা কথা বলে সন্তুষ্ট কোরো না। ধূর্তদের কেবল যতক্ষণ চোখাচোখি ততক্ষণই বন্ধুত্ব। ফুলের মধু যেমন মৌমাছি খায় তেমনি মৌমাছির মত লম্পট লোকেরা যেখানে পায় সেখানে যায়। গাছের আই যেমন তার ডালপালা, সুপুরুষরা তেমন নারীদের অঙ্গ। কিন্তু কাক যেমন গাছের ফল খেয়ে উড়ে যায়, তেমন লম্পটরা স্ত্রীসঙ্গ লাভ করেই উড়ে যায়। সরোবরের জল শুকালে তেমন জীবরা আর আসে না, লম্পটরা যেমন কার্যসিদ্ধি না হওয়া পর্যন্ত সহবাস করতেই থাকে।

দেবতাদের অধিপতি ইন্দ্র, নারীদের পরম প্রার্থিত বস্তু, রসিক স্ত্রী সর্বদা রসিক পুরুষকে পেতে চায়। কামিনীয় যুবক, রসিক, শান্ত, সুবেশ, সুন্দর, প্রিয় গুণীগণ ধনী ও পরিচ্ছন্ন স্বামী চায়। নারীরা বদ চরিত্র পুরুষ কখনই চায় না। রম্ভা বলল, সে তখন ইন্দ্রের অনুগত দাসী। কামশাস্ত্রে অভিজ্ঞ ইন্দ্র মদন পীড়িত রম্ভার উদ্দেশ্য বুঝে ফুলের শয্যায় নিয়ে তার সঙ্গে বিহার করতে থাকলেন। রম্ভা তার ঠোঁটে চুম্বন করলে, ইন্দ্র, সুভগ, শ্রেষ্ট রম্ভার পাকা বিম্বফলের মতো স্তন দুটোতে চুমো খেতে লাগলেন। তারপর ইন্দ্র নিজেই শৃঙ্গারের রূপ ধরে নানাভাবে বিপরীত শৃঙ্গার করতে লাগলেন। তখন দুজনেই কামার্ত হয়ে একে অপরের কথা চিন্তা করতে করতে বাহ্য জ্ঞান হারালেন এবং তাদের কামনার ফলে কখন দিন রাত্রি হল বুঝতে পারলেন না।

তাঁরা জল বিহারের জন্য পুষ্পভদ্রার জলে নামলেন। বারবার স্থলে ও জলে বিহার করতে লাগলেন। মুনি দুর্বাসা সেসময় শিষ্যদের নিয়ে শিবের কাছে যাচ্ছিলেন। তাঁকে দেখে ইন্দ্র এসে প্রণাম করলে দুর্বাসা তাকে আর্শীবাদ করেন ও ইন্দ্রকে পারিজাত ফুলের মালা দেন এবং ফুলের অপূর্ব মাহাত্ম্য ব্যাখ্যা করতে থাকেন। এই ফুল সকল বিপদ দূর করে, তার জয় হয় সব জায়গায় যার মাথায় এই ফুল থাকে। মহালক্ষ্মী তার সঙ্গে সর্বদা থাকেন ছায়ার মতো। ইন্দ্র এরপর সেই ফুল মালা নিয়ে রম্ভার কাছে নিয়ে তার হাতী ঐরাবতের মাথায় রাখেন। অসতী স্ত্রী অত্যন্ত অধম ও চঞ্চল সে উপযুক্ত পুরুষকেই পেতে চায়। অতএব ইন্দ্রকে শ্রীহীন দেখে স্বর্গে চলে গেলেন রম্ভা। আর ইন্দ্রকে ছুঁড়ে ফেলে মহাশক্তিশালী হাতী গভীর বনে চলে গেলো। এক হস্তিনীকে সকলে উপভোগ করতে লাগল। হস্তিনী তার বশে এল। কারণ স্ত্রী হাতি সুখ চায়। তাদের অনেক সন্তান হল ঐ বনে। তখন হরি তার মাথা কেটে বালকের কাঁধে জুড়লেন।

২১.

নারদের প্রশ্নের উত্তরে নারায়ণ বললেন–তা মন্দবুদ্ধি ইন্দ্র সম্পদ খুইয়ে অর্থাৎ ঐরাবত ও লক্ষ্মীকে হারিয়ে অমরাবতীতে এসে উপস্থিত হলেন। ইন্দ্র দেখলেন, সমস্ত স্বর্গপুরী আনন্দহীন, শত্রু আক্রান্ত, দারিদ্রগ্রস্ত ও বন্ধুশুন্য, পরে দূতের কাছ থেকে সব ঘটনা শুনে মন্দিরে গিয়ে গুরু ও দেবতাদের সঙ্গে ব্রহ্মলোকে এসে দেবরাজ ইন্দ্র ব্রহ্মাকে প্রণাম করে ভক্তি ভরে বেদোক্ত স্তব করতে লাগলেন। ব্রহ্মা তখন তাঁকে বললেন–তুমি লক্ষ্মীর মতো শচীর স্বামী। তবুও তোমার পরনারীতে লোভ। সেই ব্যক্তির শ্রী ও যশ নষ্ট হয়, যে পরস্ত্রী রমণ করে। রম্ভার প্রতি কামাসক্ত হওয়ায় তুমি দুর্বাসার দেওয়া ফুল ঐরাবতের মাথায় রেখেছ। এর ফলে তুমি লক্ষীহীন হয়েছ। এখন নারায়ণ ভজনা কর, লক্ষীকে পাওয়ার জন্য। ব্রহ্মা তখন ইন্দ্রকে কবচ ও স্তব মন্ত্র দান করলেন। ইন্দ্র গুরু ও দেবতাদের সঙ্গে আকাঙ্খিত মন্ত্র ও কবচ নিয়ে পুষ্কর তীর্থে গিয়ে হরিকে স্তব করলেন। লক্ষ্মীকে পাবার জন্য একবছর ধরে না খেয়ে কমলাকান্তকে সেবা করলেন ইন্দ্র। হরি প্রসন্ন হয়ে ইন্দ্রকে বর দান করলেন এবং লক্ষীকে জয় করে স্বর্গ লাভ করলেন। দেবতারাও নিজ জায়গায় ফিরলেন।

২২.

ইন্দ্র পুষ্কর তীর্থে তপস্যা করে সেখানে বিশ্রাম করছিলেন, সেখানে শ্রীহরি তাঁকে ক্লিষ্ট দেখে আবির্ভূত হয়ে বললেন–মনের মত বর চাও। ইন্দ্র তখন লক্ষ্মীকে চাইলেন। আনন্দিত চিত্তে ইন্দ্রকে বর দিলেন হরি। ইন্দ্রকে বললেন–তুমি সকল দুঃখ দূরকারী ও শনিধনকারী এই কবচ নাও, এই কবচ গ্রহণ করলে তোমার সকল সম্পদ লাভ ঘটবে। বিধাতা এই কবচ ধারণ করে জগতের শ্রেষ্ঠ ও সকল ঐশ্বর্য লাভ করেছেন। মুনিরা এর দ্বারা সমগ্র সম্পদ লাভ করেছেন। এই সম্পদদায়ক এই কবচের ঋষি বিধাতা, পংক্তি ছন্দ, স্বয়ং লক্ষ্মীদেবী। এই কবচের প্রয়োগ হয় সিদ্ধি, ঐশ্বর্য ও জয়ের জন্য। এই কবচ ধারণ করলে সর্বত্র জয় লাভ হয়। পদ্ম মাথা, হরিপ্রিয়া গলা, লক্ষ্মী নাক ও কমলা চোখ রক্ষা করুন। কেশবকান্তা চুল, কমলালয়া কপাল, জগৎ প্রসবিনী গাল ও সম্পদপ্রদা কাঁধ রক্ষা করুন। যে গুরুপুজো করে গলায় বা ডান হাতে এই কবচ বাঁধে তার জয় সর্বত্র হয়। লক্ষ্মী তাঁর গৃহত্যাগ করে না। তার সাথে ছায়ার মত থাকেন প্রতি জন্মে। লক্ষ্মীকে না জেনে যে কেবল ভজনা করে তার সিদ্ধিলাভ হয় না। একশো বার লক্ষ্মী মন্ত্র জপ করলে ও তার সিদ্ধিলাভ হয় না।

জগৎপতি সন্তুষ্ট হয়ে ইন্দ্রকে জগতের কল্যাণকর কবচ ও ‘ওং হীং ক্রীং শ্রীং ক্লীং নমো মহালক্ষৈহরি-প্রিয়ায়ৈ স্বাহা’ মন্ত্র দান করলেন। সামবেদে বলা আছে মঙ্গলবার ধ্যানের কথা, শরৎ শশীর মত সৌন্দর্য ও সাদা চাপা ফুলের মতো তার রং, অগ্নিশুদ্ধ কাপড় তার পরনে, নানা রত্নালংকারে সজ্জিত ও সর্বদা খুশিময়। তাঁর শোভা বাড়াচ্ছিল উজ্জ্বল রত্ন কুন্ডল, মালতী ফুল তার খোঁপায়। তিনি উপবিষ্ট হাজার পাপড়িবিশিষ্ট পদ্মে। তিনি গুণান্বিত বিভিন্ন গুণে। তিনি মুগ্ধ করেন সকলের মনকে, সৃষ্টি করেন সমগ্র জগৎকে। তিনি হরিকান্তা লক্ষীকে ভজনা করবে ও মনহারিণী লক্ষীকে ধ্যান করে ষোল উপাচার দেবে। এই স্তবে তাঁকে প্রণাম করে বরলাভ করে সুখ পাবে। ইন্দ্রকে এবার তিনি গোপন ও সুখকর ত্রিলোকের স্তব বললেন। দুধের শিশুর কাছে তার মা ছাড়া সমস্ত বস্তু যেমন অবস্তু এবং মা থাকলে সকল বস্তু যথার্থ বলে মনে হয়, তেমন আপনি বিনা সকল জগৎ অবস্তু। আপনি বেদজ্ঞদের জননী। বিপন্ন হয়ে আপনার আশ্রয় নিলাম, প্রসন্ন হয়ে আপনি রক্ষা করুন। আপনি জ্ঞান, বুদ্ধি দান করেন। আপনি দান করেন হরিভক্তি, মুক্তিদান করেন ও সর্বজ্ঞদের সকল বস্তু দান করেন। কুপুত্র যদিবা হয় কুমাতা কখন নয়। পুত্রের দোষ কোন মা দেখেনা, তুমি আমাদের দেখা দাও দয়া করে। শুভ, সুখ ও মোক্ষদায়ক সারময় ও সম্পদকারী এই হল লক্ষ্মীর স্তব। এই মহাপুণ্যকর স্তব পূজা সময় যে পাঠ করে, লক্ষ্মী কখন তার ঘর ছাড়েন না, সেখানেই অদৃশ্য হলেন হরি, পরে ইন্দ্র তাঁর আদেশে ক্ষীরসাগরে গেলেন।

২৩.

কবচটা নিয়ে নিজের গলায় ঝোলালেন ইন্দ্র। লক্ষ্মীকে পাবার জন্য গেলেন ক্ষীরসাগরের তীরে। সকল দেবতারা ভক্তিভরে নত মস্তকে দেবী লক্ষ্মীর স্তব করতে লাগলেন। শরতের চাঁদ সম যার সৌন্দর্য এবং যাতে সকল জগৎ ব্যপ্ত, সেই লক্ষ্মী তাদের স্তব শুনে এসে উপযুক্ত সারগর্ভ ও হিতকর কথা বলতে শুরু করলেন। তিনি বললেন–যে, ব্রহ্মশাপে শ্রীহীন আমি। কারণ আমি ভীত ব্রহ্মশাপে, তার প্রাণ ও পুত্রের থেকেও বেশি প্রিয় ব্রাহ্মণরা। আমাদের জীবন চলে ব্রাহ্মণদের দানে। সেই ব্রাহ্মণ ও তপস্বীরা আমাকে পুজো নাও করতে পারেন। দৈবাৎ দুর্ভাগ্যের অধিকারীরা ব্রাহ্মণ, গুরু, দেবতা ও ভিক্ষুর দ্বারা অভিশপ্ত হয়। সকলের কারণ সবার সনাতন, ভগবান নারায়ণ ও ব্রহ্মশাপকে ভয় পান।

এমন সময়ে ব্রহ্মতেজে উজ্জ্বল ব্রাহ্মণরা মনের আনন্দে হাসতে হাসতে সেখানে এলেন। অঙ্গিরা, প্রচেতা, ক্রতু, ভৃগু, পুলহ, পুলস্ত, মরীচি, অত্রি, সনক, সনন্দ, সনাতন, সনৎকুমার, ভগবান কপিল, আসুরি, পঞ্চশিখ, দুর্বাসা, কশ্যপ, অগস্ত, গৌতম, এবং কণ, নর ও নারায়ণ, কাত্যায়ন, কণাদ, মার্কণ্ডেয়, লোমশ, বশিষ্ট এবং ব্রাহ্মণরা নানা বস্তু দিয়ে সুরেশ্বরীকে পূজা করতে লাগলেন। মুনিরা ভক্তি ভরে তার স্তব করে মনের আনন্দে তার পূজা করলেন। সে মিথ্যাবাদী বলে ঈশ্বর নেই, যার নেই সত্ত্বগুণ, যার চরিত্র খারাপ তাদের ঘরেও যাবনা আমি। যে গচ্ছিত সম্পদ চুরি করে, মিথ্যে সাক্ষ্য দেয়, বিশ্বাসঘাতক এবং কৃতঘ্ন তার ঘরে থাকি না, যে সর্বদা ভীত, অনেক শত্রু যার, যে অত্যন্ত পাপী, । ঋণী ও কৃপণ, সেই পাপীদের ঘরে যাব না। যার দীক্ষা হয়নি, সর্বদা শোকগ্রস্ত, যার বুদ্ধি মন্দ, স্ত্রৈণ্য যার স্ত্রী, বেশ্যা ও যার মা বেশ্যা — তাদের ঘরেও যাব না।

সে খারাপ কথা বলে, সর্বদা ঝগড়া করে, যে ঘরে স্ত্রী সর্বেসর্বা, তার ঘরে যাব না। যে হরি পুজা ও তার গুনকীর্তন করে না এবং হরির প্রশংসা করার কোন ইচ্ছে নেই তার ঘরে যাব না। যে কিপটে হয়, বাবা, মা, স্ত্রী, পুরুষ, গুরুজন, অনাথ বোন, মেয়ে ও আশ্রয় শূন্য বন্ধুদের ভরণপোষণ না করে টাকা পয়সা জমায় তাদের সেই নরকের ঘরে যাব না, পায়খানা কারী লোককে দেখে, যে ভেজা পায়ে শোয়, তার ঘরেও যাব না। যে পা না ধুয়ে শোয়, উলঙ্গ হয়ে শোয়, সন্ধ্যায় শোয়, দিনে শোয়, তার ঘরে যাব না। যে আগে মাথায় ও পরে শরীরে তেল মাখে, যে নখ দিয়ে ঘাস কাটে ও মাটি খোড়ে, যার গায়ে ও পায়ে ময়লা থাকে। যে জেনেশুনে নিজের দেওয়া বা পরের দেওয়া বৃত্তি চুরি করে তার ঘরে যাব না। যে মন্ত্র ও বিদ্যার বিনিময়ে জীবিকা রোজগার করে, যে গ্রাম বাজী ডাক্তার, রান্না করে এবং পুজারী ব্রাহ্মণ তার ঘরে যাব না। যে বিয়ে বা অন্য কোন ধর্মকাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে, দিনের বেলায় মৈথুন করে তার ঘরে যাব না। এই বলে দেবী অদৃশ্য হলেন।

দেবতারাও মর্ত্যলোকের দিকে তাকালেন। দেবতারা প্রণাম করে মনের আনন্দে শত্রুশূন্য ও বন্ধুবান্ধবে ভর্তি ঘরে এলেন। স্বর্গে দুন্দুভি বাজল, ফুল ঝড়ল আকাশ হতে, দেবতারা সবাই নিজের রাজ্য ও লক্ষীলাভ করলেন। লক্ষীর এই সুখকর, মোক্ষদায়ক সারযুক্ত, উত্তম চরিত্র বললাম।

২৪.

নারায়ণ এরপর গণেশের একটা দাঁতের ব্যাপারে বলতে আরম্ভ করলেন। সমস্ত মঙ্গলের পুরোনো ইতিহাসের মত একটা মাত্র দাঁত থাকার কাহিনী। কাৰ্ত্তবীৰ্য্য একসময় মৃগয়ায় গিয়ে অনেক হরিণ মেরে অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে যান। অরণ্যে ইতিমধ্যে সন্ধ্যা নেমে আসে। রাজা সেই নিশীথে অরণ্য মধ্যে নির্গমনের পথ হারিয়ে ফেলেন। তারপর ক্ষুধা, তৃষ্ণায় কাতর রাজা লোকমুখে জানতে পারলেন কাছেই আছে জমদগ্নিমুনির আশ্রম। রাজা মুণিকে প্রণাম করে আশ্রয় ও খাদ্য প্রার্থনা করলেন। জগদগ্নিমুনির আশ্রমে ছিল কল্পতরু কামধেনু মা কপিলা। রাজার উপোসের কথা জেনে মুনি তাঁকে আশ্রমে নেমন্তন্ন করলেন। মুনি নিজের ঘরে গিয়ে মা কামধেনুকে ঘটনা বললেন, মা তাকে অভয় দিলেন।

কপিলা স্বর্ণ ও রোপ্য পাত্রে ভাল সুগন্ধি খাবার ভরে, অসংখ্য খাবার থালা ও রান্নার পাত্র দিলেন। নানা স্বাদু পাকা আম, নারকেল, রাশি রাশি লাড়ু, আটার পিঠে, রান্না করা খাবার, পোলাও, দুধ, দই, ঘি দান করলেন। চিনির মিষ্টি, পিষ্টক, ভাল চালের ভাত, কর্পূরের তাম্বুল, কাপড় ও অলংকার দান করলেন। এই বিপুল খাদ্য সম্ভার, স্বর্ণ ও রৌপ্যের বাসন পাত্রের উজ্জ্বল্যে রাজা বিস্মিত হলেন। তার আদেশে মন্ত্রী সর্বত্যাগী মুনির ধনসম্পদের উৎস জানতে আগ্রহী হলেন। পুরো আশ্রম নিজ চক্ষে পরিদর্শন করে রাজাকে তিনি বললেন– মুনির ঘরে যে সব জিনিস দেখলাম –মুনির ঘর অগ্নিকুন্ড, যজ্ঞকাঠ, কুশ, ফুল, ফল, কৃষ্ণসার চামড়া, বহু যজ্ঞপাত্র ও শিষ্যতে ভর্তি। তার সোনার বাসন, শস্য, টাকা পয়সা নেই। তার স্ত্রীর কোন গয়না নেই, গাছের ছাল পরনে।

ছেলেদের পরনেও গাছের ছাল ও মাথায় জটা, যদিও ঘরের একপাশে লক্ষ্মীর মত সুন্দরী এক কপিলা আছে। চাঁদের মত রং, লালপদ্মের মত চোখ, নিজের তেজেই নিজে উজ্জ্বল, সকল সম্পদ ও গুণের আধার স্বরূপ। রাজা একথা শুনে সেই কপিলাগাভীকেই চাইলেন। সব লোক পুন্যের ফলে স্বর্গভোগের পর পবিত্র স্থানে জন্মগ্রহণ করেও পাপের ফলে নরকভোগের পর খারাপ জায়গায় জন্মায়। জীবের নিস্কৃতি চাই কর্ম বর্তমান থাকতে, তাই পন্ডিতরা শীঘ্র কর্মক্ষয় চান। তিনিই প্রকৃত গুরু, বন্ধু, বাবা, মা ও ছেলে। জীবের দারুণ রোগ হয় ভালমন্দ কর্মের ফলস্বরূপ। সেই রোগকে দূর করে বিষ্ণুভক্ত বৈদ্য তার কৃষ্ণভক্তি রূপ ওষুধ দিয়ে। যে প্রত্যেক জন্মে বুদ্ধিদাতা জগদ্ধাত্রী পরমা মায়াকে সেবা করে, মহামায়া তার উপর সন্তুষ্ট হয়ে ভক্তকে মোহের কারণ মায়া দান না করে বিবেক দান করে ও বিষ্ণুভক্তি দান করেন।

মায়ায় মুগ্ধ রাজা যত্ন করে মুনিকে এনে ভক্তিভরে জোড়হাতে বিনয়ের সঙ্গে বললেন–ওহে ভক্ত শ্রেষ্ঠ, আপনি কল্পতরুর মত, ভক্তকে অনুগ্রহ করেন। আপনি আমাকে কামদাতা ঐ কামধেনু ভিক্ষা দিন। কিছু নেই না দেওয়ার মত জগতে আপনার মত দাতাদের। দেবতাদের নিজের হাড় দান করে ছিলেন দধিচী মুনি। আপনি তপস্যায় রাশি স্বরূপ। অনেক কামধেনু সৃষ্টি করতে পারেন আপনি চোখের পলকে।

মুনি বললেন–তুমি প্রবঞ্চক। আমি ব্রাহ্মণ হয়ে ক্ষত্রিয়কে দান করব কিভাবে? ব্রহ্মাকে কামধেনু দান করেছিলেন গোলোকপতি কৃষ্ণ। ব্রহ্মা প্রিয় পুত্র ভৃগুকে দান করেন সেটি। ভৃগু আবার আমাকে দান করেন। এটি আমার কাছে প্রাণের চেয়েও প্রিয়। পরে জমদগ্নি কামধেনুর কাছে গিয়ে শোকে জ্ঞান হারিয়ে সকল ঘটনা ব্যক্ত করলেন ও দেখলেন যে লক্ষ্মী কাঁদছেন। পরস্পরের সম্বন্ধে কেবল কালই যোজনা করেছেন। যতক্ষণ পরস্পরের সম্বন্ধ থাকে, ততক্ষণই থাকে পরস্পরের ক্ষমতা। একথা কেবল মনই জানে সেই বস্তু বিচ্ছেদ মনে দুঃখ দেয় যতক্ষণ সে বস্তু নিজের অধিকারে থাকে। কামধেনু সূর্যের মত উজ্জ্বল, নানা অস্ত্রশস্ত্র ও সৈন্য সৃষ্টি করতে লাগলেন। তিন কোটি পুরুষ তার মুখ থেকে খড়গ হাতে, নাক থেকে শূলাধারী পাঁচকোটি, কপাল থেকে দন্ত হাতে তিন কোটি, বুক থেকে তিনকোটি শক্তি অস্ত্রধারী সৈন্য ও পিঠ থেকে গদা হাতে একশোকোটি পুরুষ বেরিয়ে এল। হাজার বাদ্যযন্ত্রর আওয়াজ। বেরোল পায়ের তলা থেকে, তিনকোটি রাজপুত্র বেরোল জঙঘা থেকে। তিনকোটি ম্লেচ্ছ জাতির সৃষ্টি হল গুহ্যদেশ থেকে। সব প্রসব করে মুনিকে সৈন্য দিয়ে অভয় দিলেন ও বললেন–এ সকল সৈন্যরা যুদ্ধ করুক তুমি যেও না। এদেরকে পেয়ে মুনি সন্তুষ্ট হলেন। রাজা ব্যর্থকার্য হয়ে মনের দুঃখে নিজের দেশ থেকে দূত পাঠিয়ে আরও সৈন্য আনালেন।

২৫.

রাজা ক্রুদ্ধ হয়ে হরিকে স্মরণ করে মুনির কাছে দূত পাঠালেন। দূত মুনির কাছে গিয়ে বলল– আমার প্রভুর আদেশ শুনুন, তিনি বলেছেন –আমি আপনার চাকর ও বিশেষ করে অতিথি। আমাকে আমার প্রার্থনামত কামধেনু দান করুন। মুনি দূতের কথা শুনে তাকে বললেন– রাজাকে ক্ষুধার্ত দেখে আমি তাকে যথাসাধ্য খাইয়েছি, কিন্তু রাজা আমার প্রাণের চেয়ে প্রিয় কপিলাকে নিয়ে যেতে চাইছে, তাই আমি যুদ্ধ করব।

দূত রাজাকে মুনির সব কথা বললেন। এদিকে কপিলাকে মুনি বললেন, কুশলী সেনাপতি ছাড়া সৈন্যদের অবস্থা মাঝি বিনে নৌকার মতো। কপিলা তখন মুনিকে নানা অস্ত্রশস্ত্র যুদ্ধের উপদেশ ও যুদ্ধের উপযুক্ত সন্ধান দিয়ে তাকে জয়ী হওয়ার আশীষ দিলেন এবং বললেন, অমোগ অস্ত্র বিনে তার মৃত্যু হবে না।

মুনি সমস্ত সৈন্য সাজিয়ে যুদ্ধে গেলেন। রাজাও মুনিকে প্রণাম করে যুদ্ধে এলেন। কপিলার সৈন্য অতি সহজেই রাজার বিচিত্র রথ ভেঙে ফেলল। রাজার ধনুক ও বর্ম কেটে ফেলল। রাজা কপিলসেনাদের জয় করতে পারলেন না। তারা তীরবৃষ্টি করে রাজাকে অস্ত্রশূন্য করে ফেলল। রাজা কাতর হয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ল। সৈন্যদের অনেকে মারা গেল। রাজাকে অজ্ঞান দেখে দয়াপরবশ হয়ে তার সৈন্যদের বিসর্জন করলেন, কপিলার কৃত্রিম সৈন্যরা কপিলার দেহে মিলিয়ে গেল। রাজাকে পায়ের ধুলো দিয়ে আর্শীবাদ করলেন। এবং তার জ্ঞান ফেরালেন কমুন্ডলের জল দিয়ে। রাজা তখন ভক্তিভরে মুনিকে প্রণাম করলেন। মুনি প্রসন্ন হয়ে আবার তাকে যত্ন করে স্নান করিয়ে খাওয়ালেন। রাজা মুনির আশ্রমে গিয়ে বললেন, আপনি আমার প্রার্থিত ধেনু দান করুন কিংবা যুদ্ধ করুন।

২৬.

নারায়ণ বললেন–মুনিশ্রেষ্ঠ জমদগ্নি, রাজার কথা শুনে হরিকে স্মরণ করে, ভাল, সত্য ও নীতিপূর্ণ কথা বললেন– রাজা তুমি ঘরে গিয়ে সনাতন ধর্ম রক্ষা কর। তার সকল সম্পদ সম্পত্তিও স্থিরভাবে থাকে, যার ধর্ম সর্বদা স্থির থাকে। তুমি অসহায় অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়ে অসতের মত কথা বলছ। রাজা মুনির কথা শুনে তাকে বলল অন্য রথে চড়ে যুদ্ধ করতে। কপিলার দেওয়া অস্ত্রে রাজাকে নিরস্ত্র করলেন মুনি। রাজা পুনরায় জ্ঞান হারালেন এবং জেগে আবার যুদ্ধ শুরু করলেন। রাজা মুনিকে আগ্নেয়াস্ত্র ছুড়লেন মুনি বরুণাস্ত্র দিয়ে তা আটকালেন। রাজা রায়ব্য অস্ত্র দিয়ে বরুণাস্ত্র ঠেকালেন। মুনি গান্ধর্বণ দিয়ে রাজার বায়ব্য অস্ত্র আটকালেন। রাজার নাগপাশকে মুনি গরুড় অস্ত্র দিয়ে কেটে ফেললেন। রাজা শৈব অস্ত্র দিয়ে দশদিক উজ্জ্বল করে ছুঁড়ে মারলে মুনি মহাশক্তিশালী বৈষ্ণব অস্ত্র দিয়ে তা নিবারণ করলেন। মুনি নারায়ণ অস্ত্র ছুঁড়লেন মন্ত্রচ্চারণ করে। রাজা তখন মুনির শরণাপন্ন হলেন, রাজাকে এ অবস্থায় দেখে অস্ত্র আকাশে ঘুরে অদৃশ্য হলো।

মুনি তখন জম্বনাস্ত্র ছুঁড়লেন যার প্রভাবে রাজা মরার মত নিশ্চল ভাবে পড়ে রইলেন। ঘুমন্ত রাজাকে মুনি অর্ধ চক্রবান দিয়ে রাজার সারথি, ধনুক, বাণ, মাথার মুকুট, ধারাল অস্ত্র দিয়ে ছাতা, কবচ ও অন্যান্য অস্ত্র দিয়ে যাবতীয় অস্ত্র, তুণীর ও ঘোড়াকে মেরে ফেললেন। মুনি নাগপাশ দিয়ে রাজার মন্ত্রীদের যুদ্ধক্ষেত্রে বেঁধে রাখলেন। মুনি নিজের মন্ত্রপ্রভাবে রাজার জ্ঞান ফিরিয়ে এনে তার মন্ত্রিরা বাঁধা পড়ে আছে –তা দেখালেন এবং তাঁদের বাঁধন খুলে দিয়ে রাজাকে আশীর্বাদ করে বললেন–যুদ্ধে কাজ নেই, বাড়ী যাও। ক্ষত্রিয় রাজা যুদ্ধক্ষেত্রে উঠে দাঁড়িয়ে রেগেমেগে শূলঅস্ত্র মুনির দিকে ছুঁড়ে মারলে মুনি তক্ষুনি শক্তি অস্ত্র দিয়ে রাজাকে আঘাত করলেন।

তখন ভগবান ব্রহ্মা যোগবলে রাজা ও মুনির যুদ্ধের ঘটনা জেনে যুদ্ধক্ষেত্রে এসে নানা নীতি বলে রাজা ও মুনির মধ্যে সন্ধি ঘটিয়ে দিলেন, মুনি ব্রহ্মাকে প্রণাম করে স্তুতি করলেন, রাজাও মুনি ও ব্রহ্মাকে নমস্কার করে নিজের বাড়ির দিকে চললেন। মুনি নিজের আশ্রমে ফিরে এলেন এবং বিধাতাও দুজনের যুদ্ধ ক্ষান্ত করে নিজের আশ্রমে ফিরে এলেন। নারায়ণ তোমার কাছে জমদগ্নি মুনি ও রাজা কাৰ্ত্তবীর্যাজুনের যুদ্ধের কাহিনি বললাম।

২৭.

কার্ত্তবীর্য ঘরে গিয়ে ঋষির শক্তির কথা স্মরণ করে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে থাকলেন, কিন্তু হেরে যাবার অপমান সহ্য করতে না পেরে হরিকে স্মরণ করে জমদগ্নি মুনির আশ্রমে আবার চললেন। চারলক্ষ রথ, দশ লক্ষ রথী, অসংখ্য ভাল ভাল ঘোড়া, বিরাট বিরাট সব হাতী, পদাতিক সৈন্য ও হাজার হাজার শ্রেষ্ঠ শক্তিশালী সৈন্যদের নিয়ে ত্রিভুবন জয়ের ক্ষমতা অভিলাষে নিয়ে মহানন্দে জাঁকজমকের সঙ্গে জমদাগ্নি মুনির আশ্রম ঘিরে ধরলেন। রাজা কাৰ্ত্তবীর্য রথে চড়ে নিজে আশ্রমের কাছে এলেন। কুবুদ্ধি লোকেরা আশ্রমের কুটীরে এসে আশ্রমের সামনে থাকা কপিলা কামধেনুকে চুরি করে নিয়ে যেতে লাগল। রাজা হরিকে স্মরণ করে দত্তাত্রেয় মুনিকে প্রণাম করে বর্ম না পরে তীর ধনুক হাতে নিয়ে একা যুদ্ধ করতে নির্ভীকভাবে এগিয়ে গেলেন। যাবার আগে আশ্রমের লোকেদের সান্ত্বনা দিয়ে গেলেন, পরে মুনির আশীর্বাদ নিয়ে আনন্দে রথে চড়ে বসলেন। মুনির ছোঁড়া জ্বম্ভন অস্ত্রে রাজা কাৰ্ত্তবীর্য ও অন্যান্য রাজারা মূচ্ছিত হয়ে পড়লেন। শোকে কাতর কপিলাকে আশ্বস্ত করে মুনি মনের আনন্দে আশ্রমের দিকে চলতে লাগলেন। হঠাৎ রাজা জ্ঞান ফিরে তীরধনুক নিয়ে মুনিকে যেতে বাধা দিলেন।

কপিলাও ভয়ে গোয়ালে চলে গেল। মুনি দিব্য অস্ত্র দিয়ে রাজার তীর ধনুক, রথ সারর্থী ও দুর্ভেদ্য কবচ ছিন্ন করে ফেললেন, রাজা রেগে গিয়ে একপুরুষনাশিনী শক্তিকে সামনে দেখতে পেলেন। দত্তাত্রেয় মুনিকে উৎসাহ দিয়ে শতশত সূর্যের মত তেজস্বী শক্তি নিয়ে ঘুরতে লাগলেন। নারায়ণ বলল–মন্ত্রচ্চারণ করে অস্ত্রের মধ্যে সমস্ত দেবতা-শিব-ব্রহ্মা ও বিষ্ণুমায়ার তেজ আবাহন করলেন। ভগবান বিষ্ণু কপিলাকে ব্রহ্মার কাছে দান করেন। ব্রহ্মা ভৃগুমুনিকে দান করেন আর মহর্ষি ভৃগু পুষ্কর তীর্থে কপিলাকে সন্তুষ্ট করে জমদগ্নি ঋষিকে দান করেছিলেন। কপিলা কামধেনুদের নমস্কার করে দুঃখ পেয়ে গোলকধামে গেল, পুষ্কর তীর্থ থেকে যোগীশ্রেষ্ঠ ভার্গব পরশুরাম মনের গতিতে খুব তাড়াতাড়ি মায়ের কাছে কাৰ্ত্তবীর্যের সঙ্গে যুদ্ধের ব্যাপার এবং মুনির শোকে কপিলা কামধেনুর গোলকধামে চলে যাওয়া শুনে– ‘হায় মা, বাবা বলে দুঃখ করলেন। রেণুকা ও পরশুরামের কাছে পরলোকের পক্ষে উপকারী বেদের সব কথা তুলে বললেন–তুমি জন্মেছ আমার বংশে, কেন কাঁদছ? জ্ঞানী হয়েও স্থাবর বা অস্থাবর যা দেখছ এই সংসারে সবই বুদবুদের মত ক্ষণস্থায়ী, যথার্থ সত্যবস্তুর আধার সেই সনাতন বিষ্ণুকে চিন্তা কর।

প্রাণিদের ভাগ্যের থেকে যে সব কাজ হয় তা সত্য, তা কেউ আটকাতে পারে না। জগদীশ্বরের ঠিক করা ঘটনাও খণ্ডন করা যায় না, এই শরীর জগদীশ্বরের মায়া থেকে উৎপন্ন হয়েছ অজ্ঞানীদের পৃথিবীতে। শরীরের ক্ষিদে, ঘুম, দয়া, শান্তি, ক্ষমা, ক্লান্তি প্রাণ, মন, ও জ্ঞান– সব দেহের পরমাত্মা। জগতে কোন লোকই কারুর বাবা বা কারুর সন্তান নয়। প্রাণীরা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর এই দুস্তর সংসার সাগরে নিজের ভাল বা মন্দ কাজের মত ঢেউয়ে আন্দোলিত হয়ে এখানে সেখানে ঘুরে বেরাচ্ছে। কখনই কান্না করে না বুদ্ধিমান লোকেরা আত্মীয়স্বজনের বিরহে, মৃত ব্যক্তির অধঃপতন হয়, বউ ছেলে মেয়ের চোখের জল পড়লে, কেবল মোহের জন্য আত্মীয় মারা গেলে বন্ধুরা কান্না করে।

একশো বছর ধরে কাঁদলেও তাকে আর ফিরে পাওয়া যাবে না। দেহের মধ্য থেকে পরমাত্মা চলে গেলে দেহের মধ্যে পৃথিবীর অংশ, জলের অংশ, আকাশের অংশ, বায়ুর অংশ একে অপরে মিলে যায়। বন্ধুদের শোক আর কান্না শুনে তারা আর ফিরে আসেনা। বাবার পরলোকের সুখ চেয়ে শাস্ত্রের নিয়মমত ঔদ্ধদেহিক শ্রদ্ধাতৰ্পণ প্রভৃতি সকল কাজ কর। পরশুরাম ভৃগু মুনিরা সান্ত্বনাবাক্যে স্থির হয়ে ‘এখন দুঃখ করা ঠিক না’ এরকম মনে করে দুঃখ আর করলেন না। পতিব্রতা ধার্মিক রেণুকা ভৃগুমুনিকে জিজ্ঞেস করতে আরম্ভ করলেন।

২৮.

ভৃগুমুনি রেণুকাকে বললেন–তুমি আজই তোমার স্বামীর সঙ্গে যাও, মেয়েরা ঋতুর চারদিন নিজের স্বামীর ব্যাপারে সমস্ত কাজ করার অধিকারী হয়, তার প্রমাণ বলছি, শোন। মেয়েরা ঋতুর চারদিনের দিন যে কাজ করতে পারে না, পঞ্চম দিনে তার সেই কাজে অধিকার হয়। যেমন গর্ত থেকে সাপকে তুলে আনে সাপুড়েরা তেমন সতী নারীরাও স্বামীকে স্বর্গ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে। সতী নারীরা নিজেদের পুণ্যের দ্বারা পাপী স্বামীকেও স্বর্গে নিয়ে যেতে পারে। রেণুকাকে মুনি বললেন–যে ছেলে বাবা মার উপর ভক্তিবান সেই প্রকৃত পুত্র, আর প্রকৃত নারী হলো পতিব্রতা নারী। যথার্থ বন্ধু হল যে অসময়ে দান করে জীবন রক্ষা করে, যে শিষ্য গুরুকে সেবা করে সেই প্রকৃত শিষ্য। যে লোককে বিপদে রক্ষা করে সেই অভীষ্ট দেবতা, প্রকৃত রাজা সেই যে যথার্থ প্রজাপালন করে।

প্রকৃত স্বামী সেই যে স্ত্রীকে ধর্ম বিষয়ে বুদ্ধি দেন, যে গুরু শিষ্যকে হরিভক্তি দান করেন প্রকৃত গুরু তিনিই। চার বেদ ও পুরাণগুলিতে এসকল লোকেদের প্রশংসা করা হয়েছে। রেণুকা জানতে চাইলেন ভারতের কোন্ কোন্ স্ত্রী স্বামীর সহগমন করতে পারে আর কেই বা পারে না। আমাকে ব্যাখ্যা করে বলুন তপস্বী। যে স্ত্রীর গর্ভ লক্ষণ হয়েছে, ঋতুকাল হয়নি, যে স্ত্রী ঋতুমতী, যে স্ত্রী ব্যভিচার করে, যে স্ত্রী আক্রান্ত কুষ্ঠ প্রভৃতি মহারোগে, স্বামীর সেবা করেনি যে স্ত্রী, যার স্বামীর প্রতি ভক্তি নেই, যে স্ত্রী সব সময় স্বামীকে কটু কথা বলে, এই স্ত্রীরা যদি কখনও খ্যাতি লাভ করার জন্য স্বামীর সহগমন করে, তবে তারা মারা গিয়েও মৃত স্বামীর কাছে যেতে পারে না।

চিতায় শায়িত স্বামীকে আগুন দিয়ে নিজেরা স্বামীর অনুগমন করে পুণ্যের ফলে প্রতি জন্মে নিজের স্বামীকে পায়, পতিব্রতা স্ত্রী যে কোন জায়গায় বিষ্ণুভক্ত নিজ স্বামীর সঙ্গে সহমরণ করলেই পরলোকে নিজের স্বামীর সঙ্গে বৈকুণ্ঠ ধামে গিয়ে গোলকপতি বিষ্ণুর কাছে থাকার অধিকার লাভ করে। মুক্তি ও ভক্তি লাভ করতে চেয়ে বিষ্ণুভক্তের যে কোন জায়গায় মৃত্যু হলে তার ফল সমান হয়। ভৃগু বললেন, যে লোক ভগবান নারায়ণের উপাসনা করে মহাপ্রলয়েও ঐ স্ত্রী ও পুরুষ বৈকুণ্ঠ থেকে চলে যায় না। ভৃগু এরপর পরশুরামকে সেই সময়ের উপযুক্ত বেদের ক্রিয়া বলতে শুরু করলেন। সজ্ঞানে এবং অজ্ঞানে পাপকাজ করে মৃত্যুর সময় উপস্থিত হওয়ায় পঞ্চভূতের এই মৃতদেহে পার্থক্য দেখা দিয়েছে, এ দেহ আশ্রয় করে জীব পুণ্য ও পাপ করেছে। এই দেহই লোভমোহ প্রভৃতি রিপুর বশে ছিল –আমি পুড়িয়ে দিচ্ছি সেই দেহের সমস্ত অংশ।

রেণুকা চিতায় শুয়ে পড়বার পরে পরশুরাম তার ভাইদের সাথে চিতার চারপাশে আগুন জ্বালিয়ে দিলেন। তিনি তাঁর ভাইয়েরা ও বাবার শিষ্যরা সবাই মিলে খুব কান্নাকাটি করলেন। রেণুকা ছেলের সামনেই পুড়ে ছাই হয়ে গেলেন। রেণুকার মুখে রাম নাম শুনে বিষ্ণুর দূতরা সেখানে উপস্থিত হল। তাদের চার হাত, কালো গায়ের রং, হাতে শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম। গলায় বনফুলের মালা, মুকুট মাথায়, কানে কুন্তল, পরণে কুশের পীত রংয়ের কাপড়, তারা রথে চড়ে জমদগ্নি মুনিকে নিয়ে বিষ্ণুর সামনে হাজির করল। পরশুরাম তার বাবা-মায়ের দাহ কাজ শেষ করে ভৃগুমুনির কথামত ব্রাহ্মণের দেওয়া বিধানানুসারে বাবামায়ের শ্রাদ্ধশান্তি করে অসংখ্য ব্রাহ্মণকে প্রচুর ধনদৌলত, গরু, সোনা, কাপড়, বিছানাপত্তর, সেই সঙ্গে চার রকম খাবার, ঠান্ডা জল, সুগন্ধি চন্দন, রত্নের দীপ, রূপোর পাহাড়, মূল্যবান সোনার আসন, সোনার পাত্রের সঙ্গে কর্পূর মেশানো তাম্বুল, ছাতা, খড়ম, নানা ফলমূল, ফুলের মালা, মিষ্টি খাবার দাবার ও দক্ষিণা বাবদ অনেক ধন দান করলেন।

তিনি শ্রাদ্ধকৰ্ম করার পর ব্রহ্মালোকে গেলেন। পরশুরাম দেখলেন সেখানে গিয়ে, ব্রহ্মলোক সোনায় ভর্তি, আর তার পাঁচিলের ইটগুলিও সব সোনা দিয়ে গাঁথা। দরজার বাইরে সোনার কলসি শোভা পাচ্ছে। আর দেখলেন ব্রহ্মা নিজের তেজে অসাধারণ শোভা ধারণ করে রত্ন সিংহাসনে বসে আছেন। ব্রহ্মার সারা গায়ে দামী অলংকার। তার চারপাশে সিদ্ধরা, দেবর্ষিরা ও শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণরা রয়েছেন। বিদ্যাধারীরা নাচছেন। আর ভগবান ব্রহ্মা তা দেখছেন। কিন্নরদের গান শুনছেন, চন্দন, অগরু, মৃগনাভি, প্রভৃতির সৌরভে সেই স্থান আমোদিত হচ্ছে।

যারা গোপন যোগশাস্ত্র সম্বন্ধে জানতে চাইছেন তাদের কাছে সেসব উপদেশ দিচ্ছেন। তার কীর্তি অক্ষয় হয়। পূর্বজন্মের কর্মানুসারে মানুষ স্বামী, স্ত্রী গুরু এবং অভীষ্ট দেবতা লাভ করে, আগের জন্মে যার ঐসব থাকে। আবার পরের জন্মে সে তাই হয়ে নিজের থেকে এসে উপস্থিত হয়। এতে কোন সন্দেহ নেই। মহাদেবের কাছ থেকে ত্রিলোক্য বিজয় কবচ নিয়ে এই পৃথিবীকে একুশবার ক্ষত্রিয় শূন্য করতে পারবে। শ্রেষ্ঠ দাতা ভগবান শঙ্কর তোমাকে অসাধারণ শক্তি সম্পন্ন পাশুপত অস্ত্র দান করবেন। তুমিও মহাদেবের দেওয়া মন্ত্র বলে ক্ষত্রিয়দের সংহার করতে পারবে।

২৯.

ভৃগু বংশের শ্রেষ্ঠ সন্তান পরশুরাম বিধাতার উপদেশ শুনে জগতের পিতা ব্রহ্মাকে নমস্কার করে তার কাছ থেকে বর লাভ করে খুব খুশি হয়ে শিবলোকে চললেন। শিবলোকের ডানদিকে বৈকুণ্ঠপুরী, বাঁদিকে গৌরীলোক এবং নীচে সব লোকের শ্রেষ্ঠ ধ্রুবলোক অবস্থিত। এই সকল লোকের উপর পঞ্চাশ কোটি যোজন জায়গা জুড়ে গোলোকপুরী, আর কোনো লোক নেই এই গোলোকের উপর। সেখানে গিয়ে এত সুন্দর ঐ লোক যে তার সঙ্গে আর কারুর তুলনা হয় না। সিদ্ধবিদ্যায় বিখ্যাত কোটি কাল ধরে তপস্যা করায় পবিক্রমন, পুণ্যবান শ্রেষ্ঠ যোগীরা চারদিকে রয়েছেন। এই শিবলোক অসংখ্য কামধেনু চারদিকে মৌমাছিদের মধুর গুঞ্জন ও কোকিলের স্বরে আমোদিত।

যোগিশ্রেষ্ঠ মহাদেব যোগবলে নিজের ইচ্ছায় সৃষ্টি করেছেন। এ এতই অসাধারণ লোক যে শিল্পীশ্রেষ্ঠ বিশ্বকর্মা স্বপ্নেও তা ভাবতে পারেন না। পদ্মফুল শোভা পাচ্ছে চার দিকে, আর আছে অসংখ্য সুন্দর সরোবর। পারিজাত ফুলের বাগানে সুসজ্জিত এই শিবলোক। সুন্দর রাজপথ আরো সুন্দর দেখাচ্ছে শিবলোকের ভেতর।পরশুরাম দেখলেন যে শিবলোকের মাঝে অত্যন্ত সুন্দর শঙ্করের মন্দির। যার চার পাশ সুন্দর মণিমানিক্যর পাঁচিলে ঘেরা। আকাশ ছোঁয়া সেসব ঘর। সাদা ক্ষীরের মত, মূল্যবান রত্নের তৈরি ষোল দরজা, রত্নময় সিঁড়ি, দরজা-জানলা, স্তম্ভ সবই। রত্নের মধ্যে শোভিত হীরে-মণি-মানিক্য, পরশুরাম দেখলেন হরের গৃহের সামনে রত্নে তৈরি কবাট সমেত সিংহদরজা।

ভয়ঙ্কর দুই দারোয়ান দরজা পাহারা দিচ্ছে। ব্রহ্মতেজে জ্বলন্ত এ দুজনকে দেখে ভীত পরশুরাম বিনয়ের সঙ্গে নিজের কথা বললেন। তাদের কাছ থেকে ঢোকার অনুমতি নিয়ে হরিনাম করতে করতে শিবালয়ে প্রবেশ করলেন। প্রথমেই দেখলেন পারিজাত ফুলের ভর্তি এক অসাধারণ সভা যা শ্রেষ্ঠ মহর্ষিতে ভর্তি ও সিদ্ধদ্বারা আবৃত। তিনি দেখলেন হর রত্নসিংহাসনে উপবীষ্ট। নানা দামী অলংকার তার গায়ে।

মাথায় তাঁর চাঁদ, হাতে ত্রিশূল ও পটিশ, তিনি মঙ্গলের নিদান ও আশ্রয়, তিনি নিজেই পরমাত্মা স্বরূপ। তিনি ভক্তের মনোবাঞ্ছা পূরণ করেন। তার কোটি সূর্যের মত তেজ। তাঁর মুখ সর্বদা প্রসন্ন অল্প হাসিতে। তার মাথায় স্ত্রী দক্ষকন্যা সতীর হাড় দিয়ে তৈরী মালা। তিনি ফলদান করেন মুনিদের তপস্যানুরূপ। নন্দী প্রভৃতি অনুচররা সাদা চামর দিয়ে তাকে বাতাস করছে। তিনি পরিপূর্ণতম, স্বেচ্ছাধীন, সত্ত্ব, রজ ও তম এই তিন গুণের অতীত, তিনি দূর করেন ভক্তদের জরাও মৃত্যুভয়। তিনি পরমানন্দরূপী, সকলের আদি ও প্রকৃতি থেকে অতিরিক্ত পরম ব্রহ্ম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ধ্যান করছেন। ধ্যান করার মহানন্দে তাঁর সমগ্র শরীর রোমাঞ্চিত। তিনি অজ্ঞান হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণের গুনগান করতে করতে। তার চোখ জলে ভরে যাচ্ছে। তার চারপাশে ঘিরে রয়েছে এগারো জন রুদ্র ও ক্ষেত্রপালরা। মহাদেবকে দেখামাত্র পরশুরাম মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে মহানন্দে তাকে প্রণাম করল।

তিনি দেখলেন মহাদেবের বাঁয়ে কার্তিক, ডানে সিদ্ধিদাতা গণেশ, সামনে নন্দীকেশর ও মহাকালরূপী বীরভদ্র, তার কোলের একদিকে রয়েছেন কালী ও অন্য দিকে হিমালয় কন্যা গৌরী। পরশুরাম মহানন্দে তাদের দেখামাত্র পরম ভক্তি ভরে মাথা নীচু করে নমস্কার করলেন। জমদগ্নি মুনির পুত্র পরশুরাম সকলের শ্রেষ্ঠ সারাৎসার মহাদেবকে দেখার পর স্তব করতে চাইলেন, কিন্তু মুখ থেকে কথা স্তব করতে লাগলেন গদগদ স্বরে। চোখ ভরে গেল জলে। পরশুরাম অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে করুণস্বরে হাতজোড় করে শান্তভাবে বাবামায়ের শোকে দুঃখিত হয়ে মহাদেবের স্তব করতে লাগলেন।

চার বেদ যার স্তব করতে পারে না, সেই মহাদেবকে কে পারবে স্তব করতে? হে পরমেশ্বর! আপনি বুদ্ধি, বাক্ ও মনের অগোচর, এজগতের শ্রেষ্ঠ সার পদার্থ ও সমস্ত উৎকৃষ্ট পদার্থেৰ মধ্যে উৎকৃষ্টতম। আপনি লোকের জ্ঞান ও বুদ্ধির অতীত। আপনার সেবা করছে সিদ্ধ লোকেরা সব সময়। আপনি সব জায়গা জুড়ে আছেন আকাশের মতো। আপনার আদি নেই, অন্ত নেই, বিনাশ নেই, নিজের ইচ্ছায় কখনও জগতের অধীন কখনও বা অধীনতা শূন্য, কখনও বা স্বাধীন। আপনিই তন্ত্রশাস্ত্রের উৎপত্তি স্থান। আপনাকে ধ্যানের দ্বারা সাধনা করা হয়। আপনার আরাধনা করা অত্যন্ত কঠিন। অতি সাধনার দ্বারাই আপনার সাধনা করা যায়। আপনি কৃপা সমুদ্র। হে করুণাসাগর! হে দীনদুখী বন্ধু! আমি অত্যন্ত দুর্দশাগ্রস্ত, আমাকে উদ্ধার করুন। আজ সার্থক হল জন্ম ও আমার জীবনধারা। ভক্তরা যাঁকে স্বপ্নেও দেখতে সমর্থ হয় না, আমি মানুষের চোখ দিয়েই দেখলাম তাকে। ভাগ্যের আর কি আছে এর থেকে? হে দেব! যা মহাদেবের অংশ থেকে ইন্দ্র প্রভৃতি লোকপালেরা উৎপন্ন হয়েছেন এবং সকল চরাচর পৃথিবী যাঁর কলার অংশ, সেই জগদীশ্বর শিবকে নমস্কার করি আমি।

যে দেবাদিদেব মহাদেব ভাস্কর হিসাবে কাল বিভাগ করে জগতের মঙ্গল করছেন। চন্দ্ররূপে সুধাদান করছেন। অগ্নিরূপে রান্না প্রভৃতি কাজ করে জগতের উপকার করছেন, বায়ু হিসাবে সবার প্রাণ রক্ষা করছেন। সেই দেবকে নমস্কার। যে দেবতা নিজেই কখনও স্ত্রী, কখনও ক্লীব, কখনবা পুরুষ রূপ ধারণ করে সৃষ্টি বিস্তার করে চলেছেন, যিনি আধার স্বরূপ সকল বস্তুর এবং সকল বস্তুস্বরূপ হয়ে অবস্থান করেন, সেই মহাদেবকে নমস্কার, সকল লোকের কল্পতরু হয়ে যিনি সবাইকে তার মনের মত ফল দান করেন। যিনি ভক্তের কাছে অল্প সময়ের মধ্যেই সন্তুষ্ট হন। এবং ভক্তের প্রতি স্নেহপ্রবণ সবসময়ই, নমস্কার করি মহাদেবকে। আবার অল্প সময়ের মধ্যেই খুব সহজেই যিনি ভয়ঙ্কর কালাগ্নিরূপ ধারণ করে এই বিরাট পৃথিবী ধ্বংস করে থাকেন।

আমি-নমস্কার করি সেই মহেশ্বরকে, কালস্বরূপ যে দেবতা কালের কাল যিনি, যে দেবতার থেকে কালের চাকার চলার শুরু, কালের বীজস্বরূপ যিনি। যে দেবতা দৈত্যদের ধ্বংস করার জন্য নানারূপ ধরে আসেন এবং সকল কিছু জুড়ে রয়েছেন, প্রণাম সেই মহেশ্বরকে। পরশুরাম ভৃগু বংশের শ্রেষ্ঠ সন্তান, মহাদেবকে স্তব করে তার পায়ে পড়ে রইলেন। শঙ্কর ভগবান পরশুরামের উপর সন্তুষ্ট হয়ে আর্শীবাদ দিলেন। ভক্তি ভরে যে লোক পরশুরামের করা মহাদেবের এই স্তব পড়ে, তার সমস্ত পাপ দূর হয় ও সে কৈলাসধামে যেতে পারে।

৩০.

মহাদেব পরশুরামের ওপর সন্তুষ্ট হয়ে জানতে চাইলেন–তুমি কে, কার সন্তান, কেন আমার স্তব করছো, এখন সে কেন অভিলষিত কাজ করবে? মহাদেবের কথা শেষ হলে পার্বতী বলল –তোমাকে অত্যন্ত শোকগ্রস্ত দেখছি, তুমি অন্য মনস্ক সবসময়ই, কেনই বা অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে রয়েছ? তোমার যা বয়স দেখছি, অত্যন্ত বালক তুমি, তবু তুমি অত্যন্ত শান্ত প্রকৃতির, তুমি গুণীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কারণ তোমার অনেক গুণ রয়েছে।

হরপার্বতীর কথা শুনে পরশুরাম নিজের কথা বললেন। আমি জমদগ্নি মুনির ছেলে, ভৃগুবংশের জন্ম আমার, মহা পতিব্রতা রেণুকা দেবী আমার মা, আমার নাম পরশুরাম, আপনার দাস আমি, বিদ্যারূপ পণ্য বিক্রি করে আমাকে কিনুন। আমি আপনার শিষ্য হে দীনবৎসল! আপনার শরণাগত আমি। আমায় রক্ষা করুন, আমার কথা বলছি শুনুন– রাজা কাৰ্ত্তবীর্যাজুন মৃগয়া করতে বনে গিয়ে কিছু খেতে না পেয়ে আমার বাবার আশ্রমে এলে, আমার বাবা নিজের কামধেনু কপিলার দেওয়া দুধ, ঘি দিয়ে ঐ রাজার সেবা করেন।

দুর্বুদ্ধি যুক্ত ঐ রাজা কপিলার লোভে মুগ্ধ হয়ে আমার বাবাকে যুদ্ধক্ষেত্রে মেরে ফেলেছে, কপিলাও বাবাকে মরে যেতে দেখে তাঁর শোকে অস্থির হয়ে গোলোকধামে চলে গেছে। আমার বাবাকে অনুগমন করেছেন মা সতীশ্রেষ্ঠ রেণুকা।

এখন আমি প্রভুশূন্য হয়ে পড়েছি। বাবা-মা কেউই না থাকাতে আমি বাবা-মায়ের শোকে বিহ্বল হয়ে আমি এমন এক কঠিন প্রতিজ্ঞা করেছি যা কোনভাবেই আমার দ্বারা করা সম্ভব নয়। পৃথিবীকে একুশবার ক্ষত্রিয়শূন্য করব, আর সেই পিতৃহন্তা কাৰ্ত্তবীর্যাজুনকে যুদ্ধক্ষেত্রে মারব। ভগবান শিব ব্রাহ্মণ বালকের প্রতিজ্ঞার কথা শুনে পার্বতীর মুখের দিকে তাকিয়ে মুখ নীচু করলেন, দারুণ চিন্তায় তার গলা, ঠোঁট ও তালু শুকনো হল। পার্বতী বললেন–ওহে ব্রাহ্মণবংশের তপস্বীবালক, তুমি রাগে জ্ঞানশূন্য ও ক্ষত্রিয়শূন্য করতে চাও পৃথিবীকে, দারুণ সাহস তোমার।

তোমার না আছে শস্ত্র না, অস্ত্র, তুমি তপস্বী, তবুও তুমি সেই রাজা কাৰ্ত্তবীর্যাজুনকে অন্য হাজার হাজার রাজা সমেত বিনাশ করতে চাও। কাৰ্ত্তবীর্যাজুন কেবল ভূভঙ্গী করেই রাজা রাবণকে হারিয়ে দিয়েছে। দত্তাত্রেয় মুনির কাছে শ্রীহরির দেওয়া বর্ম ও অব্যর্থ শক্তি অস্ত্রলাভ করেছে এবং শক্তির আঘাতে তোমার বাবাকে হারিয়ে দিয়েছে। রাজা হরিমন্ত্র জপ করেন দিনরাত, হরির স্তব ও ধ্যানে নিমগ্ন রয়েছে। পৃথিবীতে এই সেই যোদ্ধা কে যে তাকে হারাবে। তুমি তপস্বী বালক কোন অস্ত্র নেই, কোন ক্ষমতা নেই তোমার। এমন কোন বীরই দেখছি না যে রাজাকে হারাতে পারে। তুমি ঘরে ফিরে যাও, এ ব্যাপারে কি করবেন মহাদেব, আমার অনুচর অন্য সব রাজারা, তাদের ভয় কি আমি থাকতে। ভদ্রকালী বললেন–ওহে বোকা ব্রাহ্মণ বালক! তুই এই পৃথিবীকে কি রাজাশূন্য করতে চাস, বামন হয়ে আকাশের চাঁদকে পেতে চাওয়ার মত অবস্থা, অতএব থাম। শঙ্করের সাহায্যে পরাস্ত করতে চাস আমার ভৃত্যদের, এরা নানারকম যাগযজ্ঞ এবং পুণ্যকর্ম করে। আর এরা মহাবলশালী। পরশুরাম পার্বতী ও ভদ্রকালীর কথা শুনে অত্যন্ত দুঃখে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে তক্ষুনি মহাদেবের সামনে প্রাণ ত্যাগ করার জন্য উদ্যত হলেন।

দয়ালু শিব ভক্তবৎসল, তিনি ব্রাহ্মণ বালকের কান্না দেখে অত্যন্ত সদয় হলেন। গৌরী ও ভদ্রকালীকে খুব রেগে যেতে দেখে খুব মিষ্টিমধুর কথায় তাদের দুজনের রাগ থামালেন, পরে তাঁদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে পরশুরামকে বলতে লাগলেন –আজ থেকে তুমি আমার পুত্রের মত হলে। এই জগতে সর্বতোভাবে গোপনীয় ও দুষ্প্রাপ্য যে মন্ত্র এবং আশ্চর্য কবচ, তা তোমায় দান করছি। তুমি আমার আশীবাদে অনায়াসে তাকে বধ করতে পারবে, আর পৃথিবীকে ক্ষত্রিয় শূন্যও করতে পারবে একুশবার।

তোমার অদ্ভুত কাজ দেখে তোমার যশ ছড়িয়ে পড়বে এই জগতে। একথার পর হর এ জগতে দুষ্প্রাপ্য মন্ত্র, আশ্চর্য ত্রৈলোক্যবিজয় কবচ, অদ্ভুত স্রোত্র, পূজার নিয়মকানুন, পুরশ্চরন করার নিয়ম ও মন্ত্র সিদ্ধি করার প্রকরণ সব কিছু নিয়মমত পরশুরামকে শিখিয়ে দিলেন। ভগবান শঙ্কর মন্ত্রসিদ্ধির স্থল ও জায়গা পরশুরামকে নির্দেশ করে দিলেন। তাঁকে পাঠ করালেন চারবেদ ও তার ছয় অঙ্গ। যা অন্য লোকে পায় না এমন মহাদেব তাকে অস্ত্র দিলেন। যেমন নাগপাশ, শিব অস্ত্র, ব্রহ্মাস্ত্র, আগ্নেয় অস্ত্র, অসাধারণ শক্তিশালী শূল, অন্য নানারকম অস্ত্রশস্ত্র। এ সব অস্ত্র ছোঁড়ার নিয়ম ও মন্ত্র শিখিয়ে দিয়ে এমন এক অক্ষয় ধনু দিলেন যাতে সব বাণ যোজনা করা থাকে। আর শিখিয়ে দিলেন কিভাবে আত্মরক্ষা করতে হবে। শেখালেন কিভাবে যুদ্ধে জিততে হয়। নানা মায়া যুদ্ধ, মন্ত্র পড়ে কোথায় হুঙ্কার দিয়ে শত্রুপক্ষের সৈন্যদের হারিয়ে দিতে হবে, কিভাবে নিজের সৈন্যদের রক্ষা করতে হবে, কিভাবে ধ্বংস করতে হবে। যুদ্ধে বিপদ এলে কি করে যুদ্ধ করতে হবে — সে সকল কৌশল এবং জন্ম-মৃত্যুর ভয় দুরকারী জগৎসংসার মোহকারী নারায়ণী বিদ্যা পরশুরামকে শেখালেন।

পরশুরাম শিবলোকে মহাদেবের কাছে অনেক দিন থেকে তার দেওয়া অস্ত্র, মন্ত্রের নানা কৌশল স্তব, কবচ ও সকল বিদ্যা ভালভাবে শিখে, তীর্থে গিয়ে মন্ত্রসিদ্ধি লাভ করে সেই সব অস্ত্রশস্ত্র ও মন্ত্রগুলোকে নমস্কার করে নিজের বাড়িতে ফিরে এলেন।

৩১.

অত্যন্ত অদ্ভুত ক্ষমতাবান ত্রৈলোক্য বিজয় নামের কবচ এবং মহাদেবের বিভূতি যোগ থেকে উৎপন্ন পবিত্র শ্রেষ্ঠ স্তব মহাদেব পরশুরামকে দিয়েছিলেন। স্বয়ংপ্রভা নদীর তীরে রত্ন পাহাড়ের উপত্যকায় পারিজাত গাছের বনের মধ্যে এক আশ্রমে গোলোকপতি কৃষ্ণের সামনে সকল বাঞ্ছা পূরণ কল্পতরু নামে যে বিখ্যাত মন্ত্র তাই মহাদেব পরশুরামকে দিয়েছিলেন। পরশুরামকে তিনি বললেন–ভৃগু বংশের শ্রেষ্ঠ সন্তান আমি তোমাকে পুত্রসম স্নেহ করি। এই কবচ তুমি নাও। পৃথিবীর সকল কবচের মধ্যে এই কবচ হচ্ছে অত্যন্ত আশ্চর্য শক্তিসম্পন্ন কবচ। এর নাম ত্রৈলোক্যবিজয়। এর উপাস্য দেবতা কৃষ্ণ। এটি পাঠ করলে যুদ্ধে জয়লাভ হয়।

কৃষ্ণ নিজে এই কবচ গোলোকের বৃন্দাবনে রাধার নিকুঞ্জ বনে রাসমণ্ডলে দিয়েছিলেন, এই তত্ত্ব অত্যন্ত গোপন, সকল মন্ত্রের মূর্তির মত এই কবচ। পবিত্র যত কবচ আছে তাদের মধ্যে সব থেকে পবিত্র ও শ্রেষ্ঠ হচ্ছে এই কবচ। এই কবচ তোমায় দিলাম কারণ তোমায় অত্যন্ত স্নেহ করি সেজন্য। এই কবচ ধারণ করে ও পাঠ করে পার্বতী যিনি মূল প্রকৃতি ও জগতের ঈশ্বরী, তিনি নিশুম্ভ, মহিষাসুর, রক্তবীজ প্রভৃতি অসুরদের নিধন করেছিলেন।

এই কবচ ধারণ করে আমি সকলের তত্ত্ব জানতে পেরেছি ও সংহারকর্তা হয়েছি। যে ত্রিপুরাসুরকে কেউ বধ করতে পারেনি তাকে বধ করেছি। ব্রহ্মাও এই কবচ ধারণ ও পাঠ করে জগতকে সৃষ্টি করতে পেরেছেন। ভগবান অনন্তদেবও পৃথিবীকে ঘিরে রাখতে পেরেছেন। এই কবচ ধারণ করে পৃথিবীর ভার সহজেই বহন করেছে কুর্মাবর্তার। সূর্যদেব তেজস্বী হয়ে ত্রিভুবন আলোকিত করেছেন। দেবী বসুন্ধরা স্থাবর, জঙ্গম প্রভৃতি সকল পদার্থ ধারণ করতে পেরেছেন। ধার্মিক শ্রেষ্ঠ সবার ভালো মন্দ কাজের সাক্ষী হয়ে রয়েছেন। এই কবচ ধারণ করে দেবী সরস্বতী সকল বিদ্যার অধিপতি হয়েছেন। অগ্নি তেজস্বী রূপ ধারণ করে পবিত্রভাবে যজ্ঞের ঘি বহন করেছেন। যে মহাত্মা ও কৃষ্ণের ভক্ত, তাকেই এই কবচ দান করবে। প্রবঞ্চক বা অন্যের শিষ্যকে এই কবচ দান করলে সে মারা যাবে। ত্রৈলোক্যবিজয় নামে এই কবচের ঋষি হলেন প্রজাপতি, ছন্দ গায়ত্রী, কৃষ্ণ এর দেবতা ও ত্রিলোকের বিজয় কামনাতে এর প্রয়োগ।

গোবিন্দ প্রত্যহ বায়ুকোণে আমায় রক্ষা করুন, রসিক শ্রেষ্ঠ শ্রীকৃষ্ণ আমায় উত্তরে রক্ষা করুন, বলির দর্পচূর্ণকারী অত্যন্ত শক্তিশালী শ্রীকৃষ্ণ আমায় সর্বদা রক্ষা করুন, আমার উপরের দিক রক্ষা করুন শ্রীকৃষ্ণ। নৃসিংহদেব, হিরণ্যকশিপু হত্যাকারী আমায় জলে, স্থলে ও অন্তরীক্ষে রক্ষা করুন। সকল মন্ত্রের মূর্তিস্বরূপ আশ্চর্য ত্রৈলোক্যবিজয় নামক কবচ, শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে আমি শুনেছি। যে এই কবচ পূজো করে গলায় বা ডানহাতে ধারণ করে সে বিষ্ণুর সমান হয়।

লক্ষ্মী ও সরস্বতী নিজেদের ঝগড়া ভুলে যায়। যেখানে এই কবচ ধারণকারী বাস করে, কোটি বছর কৃষ্ণ পূজায় যে ফল পাওয়া যায়, লোকে সেই ফল পায় এই কবচের ফলে। হাজার হাজার রাজসূয় যজ্ঞ শয়ে শয়ে বাজপেয় যজ্ঞ, লক্ষ অশ্বমেধ যজ্ঞ ও নরমেধ যজ্ঞ, অন্নমেরু প্রভৃতি নানা ধরনের মহাদান ও সসাগরা পৃথিবীকে ঘুরে আসলে যে ফল হয় এই কবচের ষোলো ভাগের একভাগও হতে পারে না।

চান্দ্রায়ণ ব্রত, একাদশীতে উপোস করা, নখ লোম ধারণ করা, বেদ অধ্যয়ন, মহাভারত পাঠ, তপস্যা ও সকল তীর্থে স্নান –কোনকিছুই এই কবচের যোগ্য হবে না। দশলক্ষবার এই কবচ পাঠ করলে সিদ্ধিলাভ হয়। যে সিদ্ধ কবচ ধারণ করবেন, সে সর্বজ্ঞ হবে। স্থূলবুদ্ধি সম্পন্ন লোক এই কবচ না জেনে কৃষ্ণের উপাসনা করে, কোটি কল্প ধরে জপ করলেও তার মন্ত্রসিদ্ধি হয় না। পরশুরাম এই কবচ কাউকে দেবে না।

৩২.

নারদ এবার শ্রীকৃষ্ণের স্তব, মন্ত্র ও পূজোর নিয়ম জানতে চাইলেন। মহাদেব বললেন– ওঁ শ্রীং নমঃ শ্রীকৃষ্ণায় পরিপূর্ণতময় স্বাহা’ এই মন্ত্রে গোপীদের ঈশ্বর জগৎপ্রভু কৃষ্ণের উপাসনা কর, সকল মন্ত্রের মধ্যে সতেরো অক্ষরের মন্ত্রই প্রধান। এর নাম মন্ত্ররাজ, পাঁচলক্ষ বার জপ, পঞ্চাশ হাজার বার হোম, পাঁচ হাজার তর্পণ, পাঁচশো বার অভিষেক, পাঁচশো ব্রাহ্মণ ভোজন করালে এই মন্ত্রের পুনশ্চরণ হয়। এর দ্বারা মন্ত্র সিদ্ধি হয়। এই মন্ত্র যার সিদ্ধ সকল জগৎ সংসার তার হাতের মুঠোয়। সে খেয়ে ফেলতে পারে চার সমুদ্রের জল। সে এ জগত ধ্বংস করতে পারে ও সশরীরে স্বর্গে যেতে পারে। সামবেদ অনুযায়ী জগদীশ্বর কৃষ্ণের ধ্যানের বিবরণ হল –ঐ ধ্যান দান করে ভক্তি ও মুক্তি। তার গায়ের রং নতুন মেঘের মত। নীল পদ্মের মত তার চোখ দুটো।

এই ধ্যানে সেই কৃষ্ণকে চিন্তা করে ষোলোরকম উপাচার দিয়ে ভক্তিভরে পূজো করলে সর্বজ্ঞ হতে পারে। যে দেবতা অংশের সাহায্যে বিভিন্ন মূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করে চারমুখ বিশিষ্ট ব্রাহ্মণরূপে জগতের সৃষ্টি করেছেন এবং চারহাত বিশিষ্ট বিষ্ণুরূপে জগতকে পালন করেছেন এবং পাঁচমুখবিশিষ্ট মহাদেব রূপে জগতকে ধ্বংস করেছেন।

যিনি তেজস্বী পদার্থের মধ্যে সবচেয়ে তেজস্বী, যিনি সকল বর্ণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বর্ণ ব্রাহ্মণের মতো, নক্ষত্রদের মধ্যে চাঁদের মত, যে রুদ্র-জ্ঞানী ও বৈষ্ণবদের মধ্যে মহাদেবের মত, সকল ঋতুর মধ্যে যিনি বসন্ত ঋতু, মাসের মধ্যে মার্গশীর্ষ মাস এবং তিথির মধ্যে একাদশী তিথি, যিনি জলাশয়ের মধ্যে মহাসাগরের মত, পর্বতের মধ্যে হিমালয় পর্বতের মত, সেই সৰ্বরূপী নারায়ণকে আমি প্রণাম করি। যিনি সকল পাতার মধ্যে তুলসী পাতার মত, সকল কাঠের মধ্যে যিনি চন্দনকাঠের মত, গাছের মধ্যে যিনি কল্পতরু, সেই নারায়ণকে ভজনা করি। সকল ফুলের মধ্যে তিনি পারিজাত ফুলের মতো, শস্যের মধ্যে ধানের মত, খাদ্যের মধ্যে অমৃতের মত, তাঁকে আমার প্রণাম। সকল হাতির মধ্যে যিনি ঐরাবত, পাখির মধ্যে গরুড়, গরুর মধ্যে কামধেনু, সেই সৰ্বরূপী নারায়ণকে প্রণাম।

সকল ধাতুর মধ্যে যিনি সোনা, ধনসম্পদের মধ্যে ধান, পশুর মধ্যে সিংহ, সকল জাতির মধ্যে প্রধান, সেই নারায়ণকে প্রণাম, যে সকল শাস্ত্রের মধ্যে বেদস্মৃতি চার বেদস্বরূপ, শাস্ত্রজ্ঞদের মধ্যে সকল শাস্ত্রের অধিষ্ঠাত্রী দেবী সরস্বতী এবং পনের অক্ষরের প্রথম অক্ষর অকার –যিনি উপাস্য দেবতাদের মধ্যে প্রধান সেই নারায়ণকে প্রণাম। শ্রেষ্ঠ মন্ত্রের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বিষ্ণুমন্ত্র, পৃথিবীর সকল তীর্থের মধ্যে ত্রিলোক উদ্ধারকারী ভাগীরথী গঙ্গা, সেই সর্বশ্রেষ্ঠ নারায়ণকে প্রণাম। গরুজাত সকল পদার্থের মধ্যে যিনি দুধের মত, পবিত্র বস্তুর মধ্যে আগুনের জলের মত পুণ্য পদার্থের মধ্যে, সমস্ত ঘাসের মধ্যে কুশের মত, শত্রুর মধ্যে রোগের মত, মানুষের গুণের মধ্যে শান্তি গুণের মত, সেই নারায়ণকে প্রণাম।

দেবতা চারজন যাঁকে ভাষায় ব্যক্ত করতে পারেন না, জ্ঞানীরা যাঁর স্তব করতে অপারগ, চার বেদ যাঁর স্তুতি করতে পারে না, বাগদেবী সরস্বতী যাঁর স্তব করতে গিয়ে নীরব হয়ে গেছেন, বাক্য ও মন যাঁর যথার্থ নিরূপণ করতে পারে না, তার স্তব কে করতে পারবে?

জ্যোতিঃস্বরূপ, সেই মেঘবরণ শ্রীকৃষ্ণকে আমার প্রণাম। দুই হাত বিশিষ্ট মুরলী বাদক, আনন্দময় কিশোর কৃষ্ণ ও সদা হাস্যময় হরিকে প্রণাম। যিনি কখনও শতশৃঙ্গ পাহাড়, কখনও গোলোকধামে, কখনও রত্ন পাহাড়ের কাছে এবং কখনও বিরজা নদীর তীরে অবস্থান করেন, সেই দেবশ্রেষ্ঠ কৃষ্ণকে প্রণাম। যিনি পরিপূর্ণতম ও শান্তিগুণের আধার, অত্যন্ত সুন্দর পুরুষ রাধার প্রিয়তম। এ জগতে অবতীর্ণ হয়েছেন সত্যরূপে। তিনি ব্রহ্মা থেকে অভিন্ন সেই কৃষ্ণকে প্রণাম, যে স্তব করে সে সিদ্ধি পায়। সব রকম শান্তি গুণ লাভ করে, মহাদেব বললেন– বাছা পরশুরাম! এবার তুমি পুষ্করতীর্থে গিয়ে মন্ত্রসিদ্ধি কর, তারপর তুমি মনের মতো বর পাবে।

৩৩.

শিব ও তার অনুচর দুজনকে প্রণাম করে মহানন্দে পুষ্কর তীর্থে গিয়ে মন্ত্রসিদ্ধি করলেন ভৃগু বংশের বংশধর পরশুরাম। ভক্তিভরে ধ্যান করতে করতে শ্রীকৃষ্ণের পাদুটো একমাস উপোস করে বায়ুশুদ্ধি করলেন, তারপর চোখ মেললেন ও এক রত্নময় রথ দেখতে পেলেন। শ্রীহরি তাকে প্রার্থনা অনুসারে মনের মতো বর দিয়ে-অদৃশ্য হলেন। এরপর পরশুরাম বাড়ী ফিরে এসে সকলকে সমস্ত ঘটনা বলার পর তাদের সঙ্গে নানা শলাপরামর্শ করে যুদ্ধে যাবার এক ভালো সময় দেখে শিষ্য ও ভাইদের সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধ করতে বেরিয়ে পড়লেন। তিনি জয়ের শুভ শব্দ শুনতে পেলেন। দৈববাণী হল –”ভৃগুকুমার তোমার জয় হবে। যেতে যেতে দেখতে পেলেন মৃতদেহ, শিয়াল, জলভরা কলস, ময়ূর, হাতী, গন্ডার, চাতক, বক, মেঘের মধ্যে বিদ্যুৎ, প্রবাল, দই, খই, সাদা ধান, নতুন পাতা, আয়না, বাছুর সমেত গরু, চিনি, মধু, এসব শুভ জিনিস ডানদিকে দেখলেন।

আর শুনতে পেলেন ব্রাহ্মণদের আশীর্বাদ। সূর্যাস্তের পর নর্মদানদীর তীরে গেলেন, সেখানে সৈন্যদের সাথে রাত কাটালেন। গাছের গোড়ায় পরশুরামকে তার দাসেরা সেবা করল এবং তিনি ফুলের শয্যায় শুলেন। শোয়ামাত্র ঘুমিয়ে পড়লেন। স্বপ্নের মধ্যে দেখলেন মন্দিরের মধ্যে বসে ব্রাহ্মণ শিবের মূর্তি ও কৃষ্ণ মূর্তি পূজো করছেন এবং তোমার জয় হোক’ এরকম আশীর্বাদ করছেন। দেখলেন পায়রা, শুকপাখী, চখাপাখী, বাঘ, সিংহ ঘুরে বেড়াচ্ছে সামনে। স্বপ্ন দেখার পর ভোর হয়েছে বুঝে হরিনাম স্মরণ করতে করতে জেগে উঠলেন। ভালস্বপ্ন দেখছেন বলে পরশুরাম মনের আনন্দে প্রাতঃকৃত্য সেরে মনে মনে ভাবলেন তিনি নিশ্চয় শত্রুদের হারাতে পারবেন।

৩৪.

তিনি এর পর রাজার কাছে দূত পাঠালেন। দূত রাজসভায় ঢুকে রাজাকে বলতে লাগল– নর্মদা নদীর তীরে অক্ষয় বটগাছের নীচে পরশুরাম তাঁর ভাই ও বন্ধুদের নিয়ে উপস্থিত। আপনিও সেখানে পৌঁছে তার সঙ্গে যুদ্ধ করুন। পৃথিবীকে একুশবার ক্ষত্রিয় শূন্য করার প্রতিজ্ঞা করেছেন পরশুরাম। রাজা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে লাগলেন। তাঁর স্ত্রী মনোরমা তাঁকে বারণ করতে লাগলেন। রাজা স্ত্রীকে বললেন–আমি ভীত, কারণ এক দারুণ খারাপ স্বপ্ন দেখেছি। আমি স্বপ্নে দেখেছি তেলমাখা শরীরে জবাফুলের মালা পড়ে সারা শরীরে রক্তচন্দন মেখে লাল কাপড় পরিধান করে, লোহার অলংকার পরে নেভানো কয়লা দিয়ে খেলা করতে করতে হাসিমুখে গাধার পিঠের ওপর চড়ে বসেছি।

এ পৃথিবী জবাফুলের মালায় ঢাকা পরে ছাই চাপা পড়েছে, আকাশে চাঁদ, সূর্য নেই। এক বিধবা নারী পরনে লাল কাপড়, নাক কাটা গেছে, আলুথালু বেশে নাচ করছে, আর শ্মশানে চিতায় মরা আছে কিন্তু আগুন নেই। আবার দেখলেন ভস্ম বৃষ্টি হচ্ছে, রক্তবৃষ্টি হচ্ছে, অঙ্গারবৃষ্টি হচ্ছে। নিজের হাত থেকে ভরা কলস পড়ামাত্র ভেঙ্গে গেল। আকাশ থেকে চাঁদ খসে পড়ছে। সূর্য খসে পড়ছে। উল্কাপাত হচ্ছে। চাঁদ ও সূর্যের গ্রহণ হচ্ছে। আবার দেখলাম এক ভয়ঙ্কর উলঙ্গ পুরুষ মুখ হাঁ করে আমার সামনে আসছে।

কাপড় ও অলঙ্কারে সেজে বারো বছরের এক মেয়ে বেগে আমার ঘর ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। আবার ব্রাহ্মণ সন্ন্যাসী গুরুজন সবাই মিলে অভিশাপ দিচ্ছে, ঘরের ভিটাতে অদ্ভুত রকমের পুতুলরা মনের আনন্দে নাচছে। শকুন, কাক ও মহিষরা অধীর হয়ে একে অন্যকে আঘাত করছে। ঘরে ঘরে শিয়াল কুকুর কাঁদছে। রাজার কথা শুনে মনোরমা কাঁদতে কাঁদতে ধরা গলায় রাজাকে বললেন– পরশুরাম মহাদেবের অংশে জন্মেছে ও অত্যন্ত শক্তিশালী। রাজা আপনি কি দত্তাত্রেয় মুনির দেওয়া উপদেশ ভুলে গেছেন? ক্ষত্রিয়রা ব্রাহ্মণদের দাস, বৈশ্যরা ক্ষত্রিয়দের দাস, আর ব্রাহ্মণ; ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যেদের দাস হল শূদ্রজাতি। ব্রাহ্মণরা সন্তুষ্ট হলে দেবতারা সন্তুষ্ট হন।

পতিব্রতা নারীর কাছে তাদের স্বামীর প্রতি স্নেহ ছেলের থেকেও একশো গুণ বেশি হয়। রাজা তখন রানিকে বললেন–মহাকাল ভীতু লোকের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এ জগতে সকল স্থাবর পদার্থ পাহাড় পর্বত স্থির ভাবে দাৰ্ডান, আর চলমান পদার্থ বায়ু ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তির অকীর্তি লাভ করা থেকে মৃত্যুবরণ অনেক ভাল জানবে। বাজনাদারদের বাজনা বাজাতে বললেন, ও যুদ্ধে যাওয়ার জন্যে যে সকল শুভ কাজ তা করতে শুরু করলেন। রাজা নিজে যুদ্ধের জন্য বর্ম পরে ধনুক হাতে নিয়ে যুদ্ধে যাচ্ছেন–এ দেখে মনোরমা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন, তারপর নিজের স্বামীকে যুদ্ধ থেকে ফেরাতে ব্যর্থ হয়ে শোবার ঘরে ঢুকে কার্তবীর্যকে কিছুক্ষণ বুকে ধরে তার মুখ দেখতে দেখতে বারবার চুমো খেতে লাগলেন।

৩৫.

মনোরমা নিজের ছেলেদের আত্মীয় স্বজন ও চাকরবাকরদের সামনে আনিয়ে হরির চরণকমল স্মরণ ও সংসারকে সারশূন্য করে যোগক্রিয়া অবলম্বন করে নিজের শরীরে ছয় চক্রভেদ করলেন। রাজা স্ত্রীকে মারা যেতে দেখে শোকে যুদ্ধের পোশাক খুলে তাকে বুকে ধরে বললেন– ওঠো প্রিয়া, আমি যুদ্ধে যাবো না। সুন্দরী চলো আমরা মলয় পর্বতে যাই। রাজার কান্না দেখে দৈববাণী হল–মনোরমা লক্ষ্মীর অংশ, তাই তিনি আবার লক্ষীতে বিলীন হয়েছেন। পরে মনের দুঃখে রাজা যুদ্ধে গেলেন।

পরশুরামের ভাইয়েরা তাঁর আদেশে ধারালো সব অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করতে শুরু করলেন। তখন মঙ্গলময় অত্যন্ত শক্তিমান মৎস্যরাজও যুদ্ধ শুরু করলেন ও তাদের বাধা দিতে লাগলেন। রাজার গলায় দুর্বাসা মুনির দেওয়া দিব্যশিবকবচ যা না খুললে তাঁকে বধ করা যাবে না।

নারায়ণ এবার এই কবচ সম্বন্ধে বলবেন বললেন। অক্ষয় জয় মন্ত্র সমেত এই কবচ মৎস্যরাজকে দুর্বাসা মুনি দিয়েছিলেন। এই কবচ ধাবণ করে দুর্বাসা মুনি জগৎ শ্রেষ্ঠ ও পুজ্য হয়েছেন। এই অদ্ভুত কবচ তোমায় দিলাম, দশলক্ষ বার এই কবচ জপ করলে নিশ্চয়ই সিদ্ধি লাভ হবে। আর যার এই কবচ সিদ্ধ, সে শিবের সমান হয়, তোমার প্রতি স্নেহ বশতঃ এই কবচ দিলাম। এই কবচের গূঢ় রহস্য না জেনে কোটিবার শিব মন্ত্র জপ করলেও সিদ্ধি হয় না।

৩৬.

পরশুরামের ভাইয়েরা ভয়ঙ্কর ধারালো অস্ত্র দিয়ে রাজার অক্ষৌহিনী সেনাদের আক্রমণ করলেন। পরশুরাম তিন দিন যুদ্ধ করে কুড়াল দিয়ে অক্ষৌহিনী সেনা ধ্বংস করলেন। মহারথী ভার্গব শিবের শূল দিয়ে লক্ষ রাজাকে হত্যা করলেন। কুড়াল দিয়ে বারো অক্ষৌহিনী সেনাকে ধ্বংস করলেন। যে লোক সংযমের সাথে পরশুরামের করা কালীর স্তব পাঠ করে, সে অনায়াসে ভয় কাটিয়ে উঠতে পারে ও ত্রিলোকে পূজা পায়।

৩৭.

রাজা দশলক্ষ বার জপ করে মন্ত্র সিদ্ধ ও পাঁচ লক্ষবার জপ করে ঐ কবচ সিদ্ধ করলেন। সিদ্ধ কবচ নিয়ে অযোধ্যায় এলেন ও কবচের গুণে সবকিছু পৃথিবীর অধিকার করেন। পূবদিকে মহাকালী, অগ্নিকোণে রক্ত দণ্ডিকা, দক্ষিণে চামুন্ডা ও নৈঋত কোণে কালিকা পশ্চিমে শ্যামা, বায়ু কোণে চন্ডিকা, উত্তরে বিকটাস্য ও ঈশাণ কোণে অট্টহাসিনী আমায় রক্ষা করুন। এই কবচ থেকেই লোমশ ও প্রচেতা সিদ্ধ হয়েছিলেন। এই কবচ থেকেই সৌভরি ও পিপুলামন যোগীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হয়েছিলেন। যে এই কবচের সিদ্ধ হবে, তার সব বিষয়ে সিদ্ধি হবে। সকল রকম মহাদান, তপস্যা ও ব্রত এই কবচের ষোলো ভাগের এক ভাগও না।

৩৮.

পরশুরামের ভাইরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে এলেন। রাজা পুষ্কর তাঁদের বাণে আচ্ছন্ন করে ফেললেন। পরশুরাম পুষ্করকে বধ করার জন্য রাগের সঙ্গে কুড়াল ছুঁড়ে মারলেন। নারায়ণ এবার পরশুরামকে বললেন, যে পুষ্করাক্ষর-এর গলায় আছে মহালক্ষ্মী কবচ। আর তার ছেলের ডানহাতে আছে দূর্গার কবচ যার গুণেই বাবা ও ছেলে বিশ্বজয় করতে পারবে। বিষ্ণু ব্রহ্মাকে এই কবচ দিয়েছিলেন, ব্রহ্মা এই কবচ পেয়ে বিষ্ণুর নাভিপদ্ম থেকে জগৎ সৃষ্টি করেছেন, এই কাজের গুণে, দক্ষ প্রজাপতি হয়েছেন ধর্ম হয়েছেন, কর্মের সাক্ষী ও রক্ষাকর্তা, কশ্যপ এই কবচ ধারণ করে সেই ঐশ্বর্য যুক্ত হয়।

৩৯.

নারদ এবার দুর্গার কবচের কথা জানতে চাইলেন। এই কবচ গোলোকে ব্রহ্মাকে কৃষ্ণ দিয়েছিলেন। মহাদেব গৌতমকে, গৌতম পদ্মাকে দিয়েছিলেন। ব্রহ্মা ঐ কবচ ধারণ ও পাঠ করে জ্ঞানী ও শক্তিমান হয়েছেন। এই কবচে ঋষি, প্রজাপতি, ছন্দ, গায়ত্রী, দেবী দুর্গা এই ব্রহ্মাণ্ডবিজয়তেই এই কবচের যথার্থ প্রয়োগ। যে লোক কাপড়, অলংকার ও চন্দন দিয়ে গুরুকে নিয়মিত পূজো করে গলায় বা ডানহাতে এই কবচ ধারণ করে সে সকল যজ্ঞে ও তীর্থে স্নানের ফল লাভ করে। অত্যন্ত গোপনীয় ও দুর্বল এই কবচ কাউকে দেবে না।

৪০.

রাজা পুষ্করা ও তার ছেলে কবচ ছাড়াই এক সপ্তাহ ধরে যুদ্ধ করার পর পরশুরামের ছোঁড়া ব্রহ্মাস্ত্রে মারা পড়লেন। পুষ্করাক্ষকে মারা যেতে দেখে মহাবীর কার্তবীর্য দুইলক্ষ অক্ষৌহিনী সৈন্য নিয়ে শ্রেষ্ঠ রত্ন ও সোনার রথে চড়ে নিজে যুদ্ধে এলেন ও চারিদিকে বাণ ছুঁড়তে লাগলেন। রাজা কার্তবীর্য বরুণ অস্ত্র ছুঁড়লে পরশুরাম নাগাস্ত্র নিক্ষেপ করলেন। রাজা ব্রহ্মা প্রভৃতি দেবতাদের স্তব করলেন। ভক্তবৎসল ভগবান ব্রহ্মা দত্তাত্রেয় শিষ্য রাজাকে রক্ষার জন্য সেখানে এলেন। তাঁকে দেখে পরশুরাম পাশুপত অস্ত্র ছুঁড়ে মারলেন। এমন সময় দৈববাণী হল যে-’দত্তাত্রেয়ের দেওয়া পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণের কবচ শ্রেষ্ঠ রত্নগুটিকার মধ্যে করে রাজার ডান হাতে বাধা আছে।

মহাদেব ব্রাহ্মণদের রূপ ধরে ভিক্ষা করে ঐ কবচ চেয়ে এনে পরশুরামকে দিলেন। রাজা বললেন–মনোরমা ছিলেন তাঁর সতী সাধ্বী স্ত্রী, লক্ষীর অংশে তাঁর জন্ম। তাঁর প্রাণের সমান ছিলেন। তিনি ছিলেন যজ্ঞের ব্যাপারে পত্নী, স্নেহের ব্যাপারে মায়ের মত আর ক্রীড়ার ব্যাপারে সহচরী। তাঁকে ছাড়া এখন তিনি নির্বিষ সাপের মত প্রাণহীন হয়েছেন। আমার প্রথম, দ্বিতীয় ও শেষ দুঃখ ব্রাহ্মণের হাতে আমি মারা পড়লাম। এমন সময়ও আসে যখন সিংহ শিয়ালকে, শিয়াল সিংহকে, হরিণ বাঘ ও হাতাঁকে মাছি, মহিষকে ও সাপ গরুড়কে বধ করতে পারে। কোন সময় আবার কৃষ্ণ দেহে লীন হন প্রকৃতি দেবীও, কালে লয় প্রাপ্ত সকল কিছুই হয়। কিন্তু কালকে কেউ অতিক্রম করতে পারে না।

কিন্তু একমাত্র কৃষ্ণই কালের কাল, স্রষ্টারও স্রষ্টা, সংহারকেরও সংহত্তা, পালকেরও পালক, মহান থেকেও মহান, স্কুল থেকেও স্থূলতম ও সূক্ষ্ম থেকেও সূক্ষ্মতম। তিনিই কালকে ভাগ করেন। তার প্রত্যেক লোমেই এক বিশ্বসংসার সৃষ্ট হয়, সেই বিরাট মহাপুরুষ কৃষ্ণের ষোলো ভাগের এক ভাগ হলো একটি পৃথিবী। সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা নিজে তার নাভিপদ্ম থেকে উৎপন্ন হয়ে ঐ নাভিপদ্মের দণ্ডের লক্ষ বছর ঘুরে শেষ খুঁজতে না পেয়ে নিজের জায়গায় ফিরে গেছেন। সেখানে লক্ষ বছর বায়ু খেয়ে তপস্যা করছেন। সৃষ্টি ধ্বংসকারী শিব ঐ স্রষ্টার কপাল থেকে উৎপন্ন হয়েছেন।

এই সৃষ্টির কারণ ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের অংশজাত হয়ে সকল বিশ্বেই অবস্থান করছেন। দেবতারা সকলে প্রকৃতি থেকে উৎপন্ন। মহাবিরাটও উৎপন্ন প্রকৃতি থেকে। আদ্যা প্রকৃতি থেকেই সবাই উৎপন্ন হয়েছেন। শ্রীকৃষ্ণই প্রকৃতির অতীত, কুমোর যেমন মাটি ছাড়া ঘট, স্বর্ণকার যেমন সোনা ছাড়া কুন্তল তৈরী করতে পারে না, তেমন প্রকৃতি ছাড়াও সৃষ্টি হয় না।

সৃষ্টির সময় ঐ প্রকৃতি শক্তি ঈশ্বরের ইচ্ছানুসারে রাধা, লক্ষ্মী, সাবিত্রি, সরস্বতী ও দুর্গা এই পাঁচ ভাগে বিভক্ত হন, যিনি মঙ্গলময় ঐশ্বর্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ও পরমানন্দ রূপিণী তিনিই লক্ষ্মী। যিনি বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী যাকে পাওয়া পরমেশ্বরের পক্ষেও দুষ্কর, যিনি বেদ ও যোগশাস্ত্রে জননী তিনিই সাবিত্রী, নারীরা প্রকৃতির ও পুরুষেরা পুরুষের অংশজাত, সৃষ্টির সময় মায়া ছাড়া সংসার হয়নি। প্রত্যেক বিশ্বেই সবসময় ব্রহ্মা থেকেই সৃষ্টি হয়। বিষ্ণু তা পালন করেন ও মঙ্গলময় শিব তার ধ্বংসকর্তা। কার্তবীর্য এই কথা বলে পরশুরামকে নমস্কার করে তীর ধনুক নিয়ে হাসিমুখে রথে চড়লেন।

সারা জগতে পরশুরামের পুণ্যকীর্তি ছড়িয়ে পড়ল। সবাই পরশুরামকে শুয়ে পড়ে প্রণাম করলেন। তখন ব্রহ্মা থেকে শুরু করে সবাই ‘বাছা’ বলে তাঁকে কোলে তুলে নিলেন। কান্থশাখায় যে সর্বসম্মত ও সম্পৎদায়ক সত্য কথা বলা হয়েছে তা বলছি। জন্মদান ও প্রতিপালন করার জন্য তাকে সকল পূজ্য ব্যক্তির শ্রেষ্ঠ জনক ও পিতা বলা হয়। ইষ্টদেবতা রেগে গেলে গুরুদেব রক্ষা করেন, গুরুদেব রেগে গেলে কেউ রক্ষা করেনা। গুরুই হরিভক্তি দান করেন। আর যিনি হরিভক্তি দান করেন তার থেকে প্রিয় কে হতে পারে? যে লোক গুরুকে দরিদ্র, পতিত বা ক্ষুদ্র দেখে তার সঙ্গে মানুষের মত আচরণ করে, সে তীর্থে স্নান করলেও–অশুচি থাকে কোনও কাজে তার অধিকার থাকে না। প্রকৃতিদেবী লক্ষবার তপস্যা করার পর তার মনে সে কমনীয় ঈশ্বরকে প্রিয়পতি হিসাবে লাভ করেছেন। সেই দেহ শিবের শরণাগত হয়। কমলযোনি ব্রহ্মা একথা বলে মুনিদের সঙ্গে চলে গেলেন।

৪১.

হরির কবচ নিয়ে পরশুরাম পৃথিবীকে ক্ষত্রিয়শূন্য করে গুরু মহাদেব ও গুরুপত্নী মাতা শিবাকে নমস্কার করে ও গুরুপুত্র কার্তিক, গণেশকে দেখার জন্য কৈলাসে গেলেন। এই দুই পুত্র গুণে নারায়ণের সমান। পরশুরাম সেখানে গিয়ে এক খুব সুন্দর শহর দেখতে পেলেন। শহরের কপাটগুলি মণি দিয়ে, সিঁড়ি গুলি মণি দিয়ে তৈরী, সেখানে দিব্য শতকোটি যক্ষভবন, ঐ সকল ঘরে রত্ন, সোনা, দিব্যসোনার কলসে ভর্তি। সেখানে যক্ষরা শ্বেতচামর হাতে করে দাঁড়িয়ে আছে, সুন্দরীরা রত্নালংকারে সেজে, ছেলেমেয়েরা খেলার পুতুল নিয়ে সবসময় খেলা করছে। মন্দাকিনীর কূল পারিজাত গাছ ও ফুলের গন্ধে আমোদিত এই শহর। পুণ্যবান সিদ্ধরা কামধেনু ধন্য কল্পতরুর নীচে রয়েছেন। এই বনে রয়েছে অসংখ্য ডালপালা সমেত অক্ষয় বটগাছ যা তিনলক্ষ যোজন উঁচু, চওড়াও একশো যোজন। একশো কঁধওয়ালা পাখিরা সেখানে রয়েছে, খুব সুন্দর সুন্দর শব্দ হচ্ছে সেখানে, কখনও বা কাঁপছে, অসংখ্য ফল ধরে রয়েছে, সুগন্ধি বায়ু, হাজার ফুলের বাগান, একশো সরোবর ও লক্ষ মুনিদের সিদ্ধ শ্রেষ্ঠদের সেখানে রত্নের বাড়ি রয়েছে।

ঐ নগর দেখে পরশুরাম খুশী হলেন ও সামনে মহাদেবের আশ্রমও লক্ষ্য করলেন। ঐ আশ্রম বিশ্বকর্মা একশো পুরু সোনার রঙের রত্ন দিয়ে বানিয়েছেন। এর চওড়া চার যোজন, উচ্চতা পঞ্চাশ যোজন ও চারিদিক সমান। এর দেওয়াল সুন্দর ও চার কোণওয়ালা, নানা ছবি সমেত এর দরজা রত্ন দিয়ে তৈরি। দরজার দক্ষিণ দিকে ষাঁড়কে, বাঁয়ে সিংহকে ও নন্দীশ্বর কটা চোখ ভয়ঙ্কর মহাকালকে ও বিশালাক্ষ, বাণ, বিরুপাক্ষ, মহাবল, বিকটাক্ষ, ভাস্করাক্ষ, রক্তাক্ষ, বিকটোদর, সংহার ভৈরব, ভয়ঙ্কর, কাল ভৈরব, রুদ্র ভৈরব, ব্রহ্মরাক্ষস, বেতাল, দানব, যোগীন্দ্র, জটাধারদের বিদ্যাধরদের ও কিন্নরদের দেখলেন। পরশুরাম তাদের সাথে কথা বলে নন্দিকেশ্বরের আদেশে মনের আনন্দে ভেতরে ঢুকে অমূল্য রত্ন তৈরি কলস, হীরের তৈরি কপাট, গোরোচনা যুক্ত, মনিময় হাজার স্তম্ভ, খনিখচিত সিঁড়ি দেখলেন। তার পাশে কার্তিক, ডানে গণেশ, আর প্রধান পার্ষদ ক্ষেত্রপালকে। রত্নালংকারে সজ্জিত অবস্থায় রত্ন সিংহাসনে বসে থাকতে দেখলেন।

পরশুরাম বললেন– হে ভাই, আমি ঈশ্বরকে প্রণাম করতে যাচ্ছি। তারপর মাকে ভক্তিভরে প্রণাম করে তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে যাব। যার দয়ায় আমি পৃথিবীকে ক্ষত্রিয়শূন্য করেছি একুশবার। বধ করেছি কার্তবীর্য ও সুচন্দ্রকে। তার কাছে নানা বিদ্যা ও শাস্ত্রজ্ঞান লাভ করেছি। তিনি ভক্তদের প্রতি অনুগ্রহ করার জন্য দেহ ধারণ করেন, তিনি সত্য, সত্যস্বরূপা সনাতন ব্রহ্মজ্যোতি: ইচ্ছাধীন, দয়ার সাগর, দীনবন্ধু, মুনিদের ঈশ্বর। শিবের প্রশস্তি গেয়ে পরশুরাম গণেশের সামনে দাঁড়ালেন। তখন গণেশ মিষ্টি কথায় বললেন–হে ভাই, একটু অপেক্ষা কর। স্ত্রীর সঙ্গে নির্জনে আছে এমন কোন পুরুষকে দেখবে না।

জিতক্রোধ শুদ্ধ সত্ত্বস্বরূপ গণেশ পরশুরামের কথা শুনে হেসে বললেন–যে লোকের জ্ঞান নেই, সে জ্ঞানীর কাছ থেকে জ্ঞান লাভ করে থাকে। যখন সত্ত্বগুণ ও তমোগুণের অতীত ঈশ্বর সংসার সৃষ্টি করতে চান না তখন তিনি শক্তিশূন্য হন, কিন্তু সেই নির্গুণ পুরুষ যখন সৃষ্টি করতে চান তখন তিনি শক্তি সম্পন্ন সগুণ হন। ভোগের উপযুক্ত যত দেহ আছে, কৃষ্ণের শরীর ছাড়া সবই প্রকৃতি থেকে। উৎপন্ন। যখন যোগিরা ঐ জ্যোতির্ময় বিভুর জ্যোতির মধ্যে দুই হাত বিশিষ্ট বংশীবদনরত হাসিমুখ পীতবস্ত্রধারী শ্রীকৃষ্ণকে অমূল্য রত্ন সহকারে সজ্জিত অবস্থায় দেখেন, তখন তাঁরা তাঁর ইচ্ছায় দাসে পরিণত হয়। তাই যোগ বা তপস্যা হরির দাসত্বের ষোলোভাগের এক ভাগেরও সমান হতে পারে না। যখন তিনি সৃষ্টি করতে চান, তখন তিনি আনন্দে প্রকৃতিকে সৃষ্টি করেন। পরে প্রকৃতির গর্ভে বীর্যাধান করেন।

শ্রীকৃষ্ণের মুখ থেকে যে বিন্দু বেরিয়ে আসে, তা থেকে হরির সামনে হঠাৎ জলরাশির সৃষ্টি হয়। সেই জলে প্রকৃতির বীর্যের ডিম থেকে সহসা বিশ্বের আধার মহা বিরাটের আবির্ভাব হয়। তার গায়ে যত লোম আছে, তত ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি হয়, ভগবান বায়ু, শ্রীহরির নিঃশ্বাস বায়ু থেকে উৎপন্ন মহাবিষ্ণুও তাঁর অংশ, তার থেকেই ক্ষুদ্র বিরাট হয়েছেন, তার নাভিপদ্ম থেকে ব্রহ্মা ও কপাল থেকে মহাদেবের আবির্ভাব ঘটেছে। সকল শক্তির আধার দুর্গা স্বভাবত পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়েছেন।

রাধা, লক্ষ্মী, সাবিত্রী, দুর্গা ও সরস্বতী এই পাঁচ প্রকার কৃষ্ণের প্রকৃতি। যিনি জ্ঞান প্রসূ, সকল শক্তিযুদ্ধ ও বুদ্ধির অধিষ্ঠাত্রী দেবী, তিনিই দেবী দূর্গা, মহাদেবের প্রেয়সী। দেবতারা তার থেকে জন্মেছেন, মহাবিরাট তার ষোলো ভাগের এক ভাগমাত্র। তার থেকেই স্থূল সূক্ষ্ম প্রভৃতি সকল বিশ্ব উৎপন্ন হয়ে আবার তার মধ্যেই মিলে যায়। গোলোকধামে ঐ বৈকুণ্ঠে পঞ্চাশটি যোজন ঊর্ধ্বে, আর কোন লোক নেই তার ওপরে। কৃষ্ণ থেকে শ্রেষ্ঠ প্রভুও আর কেউ নেই। মহাদেব এখন সুরত কাজে উন্মুখ হয়ে আছেন।

৪৩.

নারায়ণ বলতে শুরু করলেন। গণেশের কথা শুনে নির্ভয়ে তাড়াতাড়ি যাবার জন্য প্রস্তুত হলেন। পরশুরাম। গণেশ উঠে তাঁকে বিনয়ের সাথে বারণ করলেন, তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি ও হাতাহাতি হতে শুরু হল। পরশুরাম তাকে ফিরিয়ে দিলেন। পরশুরাম কুড়াল ছুঁড়ে মারতে উদ্যত হলে গণেশ তাঁকে বুঝিয়ে বললেন, কেন তিনি গুরু সমান গুরুপুত্রকে বধ করার কথা ভাবছেন। পরশুরামের চোখে রাগ উদ্যত হয়ে উঠল। গণেশ তাঁকে কুড়ল ছুঁড়তে বাধা দিলে তিনি আবার গণেশকে লক্ষ্য করে কুড়ল ছুঁড়ে ফেললেন। গণেশ শান্তভাবে তাকে বারবার বোঝাতে লাগলেন। গণেশ বললেন, আপনি অতিথি, আমার ভাই ও ঈশ্বরের প্রিয় শিষ্য, তাই আমি সব সহ্য করছি। আপনি জানেন আমি বিশ্বম্ভরের পুত্র, আমি একটু বাদে আপনার সাথে ঈশ্বরের কাছে যাব। পরশুরাম তখন মহাদেব ও হরির উদ্দেশে কুড়াল ছুঁড়ে মারতে উদ্যত হলেন। তখন গণেশ আপন শুড়কে বড় করে একশো পাকে বেঁধে ফেললেন পরশুরামকে। তারপর উঁচুতে তুলে অল্প ক্ষণের মধ্যে সাতদ্বীপ, সাতসাগর, সাতপাহাড় ও সোনার নগর দেখালেন, গণেশ পরশুরামকে ক্রমশ ভূর্লোক, ভবলোক, স্বলোক, জনলোক, তপোলোক, ধ্রুবলোক, গৌরীলোক ও শঙ্কুলোক দেখালেন। ও নিজে সাত সাগরের জল খেয়ে ফেললেন।

সেই জল আবার জলচর প্রাণী সমেত উগরিয়ে ফেললেন ও সেই জলে পরশুরামকে ছুঁড়ে ফেললেন। পরে তাঁকে গোলোকধামে বিরজা নদী, বৃন্দাবন, শতশৃঙ্গ পাহাড়, রাসমণ্ডল ও গোপ গোপীদের সঙ্গে দুহাত বিশিষ্ট বংশীধারী শ্যামসুন্দর শ্রীকৃষ্ণকে দেখালেন। পরশুরামকে বারবার ঘুরিয়ে তাঁর গর্ভ হত্যা প্রভৃতি সকল পাপ দূর করলেন। পাপের নাশ হয় না ভোগ ছাড়া। কিছুক্ষণ পরে পরশুরামের জ্ঞান ফিরল ও তার গণেশের করা স্তম্ভ দূর হল। পরশুরাম এরপর জগতগুরু মহাদেবকে স্মরণ করলেন ও তেজে মহাদেবের সমান ও গ্রীষ্মের দুপুরের সূর্য থেকেও একশো গুণ তেজস্বী বা অব্যর্থ পরজ অস্ত্র ছুঁড়ে মারলেন। গণেশ ঐ অস্ত্র বাঁ হাত দিয়ে নিলেন, বাবার দেওয়া বলে। গণেশ রক্তাক্ত দাঁত নিয়ে ঈষৎ লাল স্ফটিক পাহাড়ের মত শব্দ করে মাটিতে পড়ে গেলেন। তাতে হর ও পার্বতীর ঘুম ভেঙে গেল। তখন দুজনেই গণেশকে দেখতে পেলেন। পার্বতী সব শুনে রাগে মহাদেবকে ডাকলেন।

৪৪.

পার্বতী বললেন, দুর্গা আপনার দাসী। ঘাস থেকে পাহাড় সবই ঈশ্বরের কাছে সমান। তাই আপনি বিচার করুন গণেশ না শিষ্য পরশুরাম কে দোষী। হরকে বললেন–যে, তিনি দুজনের দোষগুণ বুঝতে পারছেন। কিন্তু তাঁর স্পর্ধা নেই বিচার করার। সদবংশজাত পতিব্রতা নারীর কাছে স্বামীই হলেন শত পুত্রেরও বেশি। যে বাবা মায়ের দোষেই স্বামীকে অবহেলা করে সে দুশ্চরিত্রা ও অজ্ঞান। সদ্বংশজাত নারী স্বামী যেমনই হোক তাকে বিষ্ণুর মত মনে করে। সকুলের মেয়েদের কাছে বাবা, ছেলে, বন্ধু কেউ স্বামীর সমান নয়। এই কথা বলে পরশুরাম দুর্গা দেখলেন মহাদেবের পদসেবা করছেন। দুর্গা জানতে চাইলেন, তিনি এত সদবংশজাত হয়েও কি করে এমন উদ্ধত হলেন। তিনি বললেন–যে সে গণেশকে হারিয়ে তাদের সামনে রয়েছে, সেজন্য কল্যাণযুক্ত হয়ে ত্রিলোকে পুজো পাবেনা। অনেক কষ্টে দেবী গণেশকে পেয়েছেন তাই তিনি পরশুরামকে হত্যা করতে উদ্যত হলেন। পরশুরাম তখন কৃষ্ণকে স্মরণ করলেন। দেবী এক ব্রাহ্মণ বালককে দেখলেন, যাঁর তেজ কোটি সূর্যের মত। তার সাদা দাঁত, সাদা কাপড় ও পৈতা, তিনি হাসছেন বিভিন্ন রত্নে সজ্জিত হয়ে। তাঁর পায়ে নূপুর, মাথায় রত্ন মুকুট, গলায় কুণ্ডল। তাকে দেখে মহাদেব ছেলে ও চাকরদের সঙ্গে তাকে প্রণাম করলেন। ষোলো উপাচার দিয়ে মহাদেব তাঁকে পূজা করলেন। বললেন, হে ব্রহ্মা, আজ আমার জীবন সফল ও সার্থক হল। তিনি পরিপূর্ণ কৃপাময় শ্রীকৃষ্ণ, লোককে উদ্ধারের জন্যই এই পূণ্যক্ষেত্র ভারতে অংশরূপে অবতীর্ণ হয়েছেন। অতিথিকে যে পুজো করে তার প্রতি ভগবান হরি সবসময় সন্তুষ্ট থাকেন। সকল তপস্যা ও প্রতিদিন নানা কাজ করার জন্য যে ফল হয় –তা ঐ অতিথি সেবার ফলের বোল ভাগের এক ভাগও না। যে ব্রাহ্মণ স্ত্রী হত্যা, গোহত্যা, ভূণহত্যা করে, বা গুরুপত্নীতে গমন করে বা গুরুজনকে নিন্দা করে বা নরহত্যা করে, সন্ধ্যা জপ করেনা, অশ্বথ গাছ কাটে, সত্যকথা বলে না, হরিকে নিন্দা করে, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়, বন্ধুর অপকার করে, যে ব্রাহ্মণ বৃষকে বয়ে নিয়ে যায়, গ্রামে পুজো করে না, শূদ্র নারীর কাছে যায় বা শূদ্রের অন্ন বা শ্রাদ্ধের অন্ন খায়, কি শূদ্রের শ্রাদ্ধেই খায় বা কন্যাকে বিক্রি করে বা হরিনাম বিক্রি করে বা লাক্ষা, মাংস লোহা, রস, তিল ও লবণ এবং গরু, ঘোড়া বিক্রি করে কিম্বা যে ব্রাহ্মণ একাদশীর দিন কৃষ্ণ সেবা না করে, তাদের সবাই নিন্দা করে ও এরা মহাপাতকী হয়। এদের কালসূত্র নরকে থাকতে হয় ব্রহ্মার একশো বছর পর্যন্ত। মহাদেবের কথা শুনে জগৎপতি হরি সন্তুষ্ট হয়ে মেঘের মত গম্ভীর স্বরে বললেন–হে মহাদেব, আমি তোমাদের গন্ডগোল শুনে কৃষ্ণভক্ত পরশুরামকে রক্ষার জন্য শ্বেতদ্বীপ থেকে এখানে এসেছি। কখনও এরকম কৃষ্ণভক্তদের অমঙ্গল হয় না। যখন তার ওপর রেগে যান গুরুদেব কিন্তু তাকে রক্ষা করতে পারি না।

সকল পাপের থেকেও ভয়ানক গুরুর অপমান, যে তোক গুরুর সেবা না করে, তার মতো পাপী আর নেই। মানুষ জগৎ দেখে জন্মদাতার কল্যাণে তাই জনক সব থেকে বেশি মাননীয় ও পূজনীয়। তিনি জগৎকে জন্ম দেওয়ার জনক। যে বোকা বিদ্যা বা ধনের অহঙ্কারে অন্ধ হয়ে গুরুকে ভজনা না করে, তার ব্রহ্মহত্যার পাপ হয়। গুরু দরিদ্র, পতিত বা যত ছোট হোন না কেন যে তার সঙ্গে মানুষের মত আচরণ করে–সকল তীর্থে স্নান করলেও কাজে তার অধিকার হয় না, সে মহাপাপী, যে সক্ষম হয়েও ছলনা করে বাবা, মা স্ত্রী, গুরু ও গুরুপত্নীকে ভরণ পোষণ না করে। গুরুই ব্রহ্মা, গুরুই বিষ্ণু, গুরুই শিব, গুরুই পরব্রহ্ম। তিনি সূর্য, চন্দ্র, বায়ু, বরুণ ও অগ্নিস্বরূপ তিনিই স্বয়ং সর্বরূপ ভগবান পরমাত্মা। বেদের থেকে শ্রেষ্ঠ শাস্ত্র আর নেই, কৃষ্ণ থেকে কেউ শ্রেষ্ঠ নয়, সন্তানের থেকে প্রিয় কেউ না।

পার্বতী সতীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, গণেশ শক্তিমানদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। সেই গুরুর পুত্র ও স্ত্রীর প্রতি পরশুরাম যে অবহেলা করেছে সেই দোষ কাটাবার জন্য আমি তোমার কাছে উপস্থিত হয়েছি। হে ঈশ্বরী! সামবেদ তোমার পুত্রের করা স্তব আমি বলছি, মন দিয়ে শোন। গ শব্দের অর্থ জ্ঞান, ন শব্দের অর্থ মুক্তি — যিনি এই দুটো দিতে পারেন সেই গণেশকে প্রণাম। হে শব্দের অর্থ দীন, রম্ব মানে পালক, তাই তিনি দীনের পালক, বিঘ্ন মানে বিপদ, নাশক মানে যিনি দূর করেন, সেই বিঘ্ননাশককে প্রণাম। তার মাথায় বিষ্ণুর ফুল রয়েছে। ইনি কার্তিকের আশ্রমে আবির্ভূত হয়েছেন বলেই সকল দেবতার আগে পুজো পান। অতএব গুহাগ্রজ, এঁকে প্রণাম, যে লোক অর্থসমেত এই আট নামের স্তব প্রতিদিন। যে সন্ধ্যায় পাঠ করে সে সুখী ও বিজয়ী হয়। যে স্ত্রী চায় সে সুন্দরী স্ত্রী ও অত্যন্ত জড়লোক ও এই বিদ্যার প্রভাবে কবিত্ব লাভ করে।

৪৫.

বিষ্ণু পার্বতী কে সান্ত্বনা দিয়ে পরশুরামকে হিতকর ও পরিণামে সুখকর গুণকথা বলতে লাগলেন। পরশুরামকে, গণেশের ও দুর্গার স্তব করতে বললেন। কৃষ্ণ রেগে গেলে বুদ্ধিশূন্য হবেন। ইনিই শক্তিস্বরূপ, এঁর থেকেই সকল জগৎ শক্তি পায়, কৃষ্ণও এঁর থেকে শক্তিমান হন। ব্রহ্মার সাহায্য ছাড়া এই শক্তি সৃষ্টি করতে পারেন না। আগে দেবতাদের সঙ্গে ভয়ঙ্কর যুদ্ধে অসুররা আক্রান্ত হলে এই সতী সকল দেবতাদের তেজে আবির্ভূত হয়ে শ্রীকৃষ্ণের আদেশে অসুরদের হত্যা করে দক্ষের তপস্যার বলে দক্ষপত্নীর গর্ভে জন্মালেন। ভগবান কৃষ্ণই পার্বতীর পুত্র হয়ে জন্মেছেন। সকল বিঘ্ন নাশন ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষের কারণ বিষ্ণুর করা স্তবে দুর্গার স্তব করতে লাগলেন। কৃষ্ণ প্রাণাধিক রাধা হলেন কৃষ্ণের প্রাণের অধিষ্ঠাত্রী দেবী।

শাস্ত্রজ্ঞ লোকেরা তাকে সরস্বতী বলেন, তিনি রাসেশ্বর কৃষ্ণের কাছে রাধা। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের সৃষ্টি, পালন ও ধ্বংসের যে তিনরকম শক্তি আছে সেই শক্তি তিনি। পরশুরাম তাঁকে জগৎ মাতা বলে সম্বোধন করে বললেন–সবদিক দিয়ে তুমি আমায় রক্ষা কর, ক্ষমা কর আমার অপরাধ, মা শিশুর অপরাধে কখনই রেগে যান না। তাঁকে প্রণাম করে কাঁদতে লাগলেন পরশুরাম। দুর্গা বললেন, মহাদেবের করুণায় সর্বত্র তোমার জয় হবে। পার্বতী সন্তুষ্ট হয়ে পরশুরামকে শুভ আর্শীবাদ দিয়ে অন্তঃপুরে গেলেন তখন হরিধ্বনি শোনা গেল। শত্রু যাকে আক্রমণ করেছে, মারাত্মক রোগে যে আক্রান্ত, সেই লোক এই স্তব স্মরণ করার সাথে সাথেই বিপদ থেকে মুক্ত হয়। সে তার মনের মত ফল লাভ করে এই স্তব স্মরণ করে। দুর্ভাগা নারী এই স্তব দুমাস শুনেই সৌভাগ্য লাভ করে, ভক্তি ভরে নমাস ধরে এই স্তব করলে কাকবন্ধ্যাও পুত্র লাভ করবে। যে নারীর পুত্র হয় না, কেবলই কন্যা সন্তান হয়, সে ঘটে দুর্গাকে পূজো করে এই স্তব পাঁচ মাস শুনলে নিশ্চয়ই পুত্র সন্তান লাভ করবে।

৪৬.

পরশুরাম নানা নৈবেদ্য, ধূপ, দীপ, গন্ধ ও তুলসী ছাড়া অন্য ফুলাদি দিয়ে ভক্তিভরে গণেশের পূজা করলেন।

একদিন নবযৌবনা ভক্ত তুলসী তপস্যার জন্য নানা তীর্থে ঘুরে গঙ্গাতীরে অতীব সুন্দর যৌবনকান্তি গণেশকে দেখতে পেলেন। তিনি গণেশের মাথায় জল ছিটিয়ে তাঁকে আঙুল দিয়ে ঠেললেন। তখন গণেশের ধ্যান ভাঙল। গণেশ সম্মুখে তুলসীকে দেখে তাঁর কাছে জানতে চাইলেন– কে তুমি মা? কেন তুমি আমার ধ্যান ভাঙালে? তুমি জানো, তপস্বীদের ধ্যান ভঙ্গ করা মহাপাপ। তুলসী বললেন– আমি ধর্মধ্বজের কন্যা, যৌবনেই তপস্বী হয়েছি। স্বামীর জন্য তপস্যা করছি। তাই প্রভু যেন তার স্বামী হন। গণেশ বললেন, বিয়ে করলে কেবলই দুঃখ হয়, সুখ হয় না। তপস্যা নষ্ট করে, বারবার গর্ভধারনের কারণ, তত্ত্বজ্ঞান নষ্ট করে, সংসারের আধার, সাধুর দুস্ত্যজ, সকল মায়ার আধার ও হঠকারিতা প্রভৃতি নানা দোষের আশ্রয়। কামুকের সঙ্গে কামুকীর সঙ্গমে প্রশংসার হয়। সতী তুলসী, গণেশের কথায় রাগ করে, তাকে অভিশাপ দিয়ে বলেন –তোমার নিশ্চয়ই বিয়ে হবে। গণেশও তাঁকে শাপ দিয়ে বললেন–যে, কোন মহাজনের শাপে গাছ হয়ে যাবে। তুলসী একথা শুনে আবার কাঁদতে লাগলো, তখন গণেশ তাকে শান্ত করে বলল, হে সুন্দরী তুমি সকল ফুলের মধ্যে প্রধান।

কিন্তু আমি সবসময় তোমায় পরিত্যাগ করব। তুলসীও তখন পুষ্পতীর্থে গিয়ে না খেয়ে লক্ষ বছর তপস্যা করলেন। তুলসী পরে মুনীন্দ্র ও গণেশের শাপে বহুকাল ধরে শঙ্খচূড়ের পত্নী হিসাবে ছিলেন। শেষে তুলসী নারায়ণের প্রিয়া হলেন। পরশুরাম শিব ও পার্বতীকে প্রণাম করে গণেশ পূজো করে তপস্যা করতে বনে চলে গেলেন। মুনীন্দ্রদের ও দেবেন্দ্রর কাছ থেকে গণেশ হরপার্বতীর কাছে গেলেন। কোন মহাবন্ধ্যা নারী যদি কাপড়, অলংকার ও চন্দন দিয়ে গণেশ পূজো করে তবে তার পুত্র লাভ হয়। দুষ্ট নারীও নির্দোষ পুত্র লাভ করে। তোক বিপদ দূর করার জন্য যত্নের সঙ্গে গণেশখন্ড শুনে, পাঠক ব্রাহ্মণকে সোনা, যজ্ঞসূত্র, সাদাছাতা, মালা, ঘোড়া, স্বস্তিক, তিলের নাড়ু এবং নানাদেশ ও নানা সময়ের পাকা ফল দান করবে।