১. নর্মদা বা রেবা-মাহাত্ম্য

পদ্ম মহাপুরাণ (পৃথ্বীরাজ সেন)
অষ্টাদশ পুরাণ সমগ্র অখণ্ড সংস্করণ
উপদেষ্টা– শ্রী নরেশচন্দ্র শাস্ত্রী
সম্পাদনা • পরিমার্জনা • গ্রন্থনা– পৃথ্বীরাজ সেন

সাত্ত্বিক পুরাণগুলির মধ্যে শ্রীমদ্ভাগবতের পরেই শ্রেষ্ঠত্বের দাবী রাখে এই পদ্মপুরাণ। এই পুরাণখানি সুবিশাল। এই পুরাণের ছয়টি খণ্ড বর্তমানে পাওয়া যায়। স্বর্গ, ভূমি, পাতাল, ব্রহ্মা, ক্রিয়াযোগ ও উত্তর। বৈষ্ণবদেব কাছে বহুতত্ত্বে পূর্ণ এই পুরাণটি অতি আদরের গ্রন্থ। বহু কাহিনী সম্বলিত এই পুরাণ। বিশেষ করে শ্রীরামচন্দ্রের অশ্বমেধ যজ্ঞের কাহিনী পাতাল খণ্ডে সুবিস্তৃত। জাম্ববান কথিত পুরাকল্পীয় রামায়ণ, একদশীর কাহিনি প্রভৃতি।

.

নর্মদা বা রেবা-মাহাত্ম্য

প্রমোহিনী, সুশীলা, সুস্বরা, সুরারা আর চন্দ্রিকা এই পাঁচজন গন্ধর্ব-কুমারী পরস্পর পরস্পরকে খুব ভালবাসত। তারা যেন পাঁচ বোন। সকলেই রূপবতী। তারা ভাব-নৃত্য এবং বেণু-বীণাদি বাদ্যযন্ত্র বাদনে সকলেই দক্ষা। একেবার বৈশাখ মাসে দেবী গৌরীর আরাধনা করবার ইচ্ছায় পঞ্চসখী মিলিতা হল। নানা পুষ্প চয়ন করতে করতে বনে ভ্রমণ করে অবশেষে তারা অচ্ছেদ সরোবরে উপস্থিত হল। তারপর মাটি দিয়ে গৌবীর মূর্তি গড়ে সোনা-মুক্তো দিয়ে ভূষিত করে গন্ধ চন্দন পুষ্প দিয়ে দেবীর পূজা করে বিভিন্ন কৌশলে নৃত্যও করল তারা। তারপর পাঁচসখী মধুর স্বরে গান শুরু করল।

যখন তারা সঙ্গীতের রসে একেবারে নিমগ্ন, এমন সময় মুনিবর বেদনিধির জ্যেষ্ঠ পুত্র তীর্থপ্রবর স্নান করবার জন্য অচ্ছেদ সরোবরে এসে উপস্থিত হল। মদনকেও যেন হার মানায় তার রূপ। তীর্থ প্রবরকে দেখে পাঁচ গন্ধর্ব কুমারী মনে মনে ভাবছে–এই ব্যক্তি বোধ হয় আমাদের অতিথি হবে। তখন তারা নৃত্য-গীত ছেড়ে এসে আরও ভালভাবে এই যুবককে দেখাবার জন্য উৎসুক হল। কারও চোখের যেন পলক পড়ছে না। তারা মনে মনে বিচার করছে এই পুরুষ কি রতিপতি মদন। আবার ভাবছে, যদি মদন হত তাহলে তার সঙ্গে নিশ্চয় রতি থাকতো। অশ্বিনীকুমার যুগলও নয়। তারা সবসময় যুগ্মচারী, অর্থাৎ কেউ তারা একা একা হয়ে থাকে না। তাহলে এ যুবক নিশ্চয় কোনও গন্ধর্ব, কিন্নব, সিদ্ধ অথবা কোন কামরূপধারী হবে। কোন ঋষিপুত্রও হতে পারে।

গন্ধকুমারীগণ ভাবছে–গৌরী আমাদের পূজায় সন্তুষ্ট হয়ে, আমাদের জন্য এই রূপবান বরকে পাঠিয়েছেন। তখন পাঁচ কুমারীই এই বাক্য উচ্চারণ করল–”আমি একে বরণ করলাম।”

ঋষিপুত্র তীর্থপ্রবর স্নান, তর্পণ, মাধ্যাহ্নিক ক্রিয়া সমাপন করে সেই কুমারীদের কথা শুনে মনে মনে চিন্তা করল–কি আশ্চর্য! ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, প্রভৃতি দেবগণ, যোগাবলম্বী মুণিগণ ও রমণীদের নীলাদ্বারা বিমোহিত হন। ধর্মরক্ষণের চেষ্টা করেও আমি তাদের দ্বারা মোহিত হচ্ছি। আমার এখন কর্তব্য হচ্ছে এরা আমার কাছে আগে আমার গৃহে ফেরা উচিত।

এই চিন্তা করে ঋষিকুমার যোগবলে হঠাৎ অদৃশ্য হল। এই দৃশ্য দেখে পাঁচকুমারী শূন্যহৃদয়ে দশদিক অন্ধকার দেখতে লাগল। তারা তখন পরস্পর বলাবলি করল–এ নিশ্চয় ইন্দ্রজাল অথবা মায়াজাল। নচেৎ এই তো দেখলাম, তাহলে আবার অদৃশ্য হল। কেমন করে? হায়! কি কষ্ট। বিধাতা কেনই বা তোমাকে দেখালেন, আর এখানেই বা আনলেন কেন? তোমার চিত্ত কি দয়াহীন? আমাদের প্রতি কি তোমার মন নেই? কি নিষ্ঠুর তুমি। আমাদের মনহরণ করে তুমি কি আমাদের পরীক্ষা করছ? হে হৃদয়েশ্বর, যদি তোমার আর দেখা না পাই, তাহলে আমরা আর বাঁচব না। তুমি আবার ফিরে আসবে এই আশায় এখনও আমার জীবিত আছি। যেখানে তুমি আছ, সেখানেই আমাদের কে নিয়ে চল।

কন্যাগণ এইভাবে বিলাপ করেও যখন ঋষিপুত্রের আর দেখা পেল না, তখন নিজ নিজ পিতার ভয়ে তারা নিজেদের গৃহের দিকে যেতে শুরু কর। অপরাহ্নে সকলেই গৃহে ফিরলে, তাদের মা নিজ নিজ কন্যাকে জিজ্ঞাসা করল–এত দেরী হবার কারণ কি?

তার উত্তরে তারা বলল–অচ্ছেদ সরোবরে কিন্নরীগণের সঙ্গে খেলা করতে করতে এত বেলা হয়ে গেছে বুঝতে পারে নি। কারোরই যেন কথা বলবার ইচ্ছা নেই। কখন তারা মাটিতে শয়ন করল। জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়াল। কখন বা বিছানায় পড়ে কাঁদল। আহারে তাদের রুচি নেই। এইভাবে জ্বরাক্রান্তের মতো সেই রাত্রিটি কোনমতে ধৈর্য্য ধরে কাটাল। রাতে কারো চোখের ঘুম আসে না। যেই মুহূর্তে পূর্বাকাশে সূর্যোদয় লক্ষ্য করল, আর ঘরে মনে থাকল না। নিজ নিজ মায়ের কাছে অনুমতি নিয়ে আবার তারা গৌরী পূজার জন্য বেরিয়ে পড়ল। সেই সরোবরে স্নান করে আগের মতো ধূপদীপ দিয়ে গৌরী পূজা করে নৃত্যগীত শুরু করল।

সেই ঋষিকুমার আগের দিনের মতো স্নানের জন্য অচ্ছেদ সরোবরে উপস্থিত হলে সেই কন্যাগণ অতি আনন্দের সঙ্গে তাড়াতাড়ি কুমারের কাছে গিয়ে পরস্পরের হাত ধরাধরি করে এক বেষ্টনী তৈরী করে তাকে বন্ধন করল। তারপর বলল–প্রিয়, আগের দিন তুমি চলে গিয়েছ। কিন্তু আজ আর যেতে পারছ না। আমরা তোমাকে হরণ করেছি।

তখন ঋষিকুমার বলল–ভাল কথাই তোমরা বলেছ, কিন্তু আমি ব্রহ্মচারী। বিদ্যাশিক্ষা লাভের জন্য গুরুকুলে বাস করি। তোমাদেরকে আমি যদি বিবাহ করি, তাহলে আমার ধর্ম নষ্ট হবে। যে আশ্রমে যেমন ধর্ম বিহিত আছে, পণ্ডিতগণের তা পালন করা উচিত। তাই আমি এই বিবাহ ধর্ম বলে মণি করি না।

ঋষিকুমারের এই কথা শুনে সেই কন্যাগণ বলল–ধর্ম থেকে অর্থ, অর্থ থেকে কাম এবং কাম থেকে সুখরূপ ফল সৃষ্টি হয়। তোমার ধর্ম বাহুল্য প্রযুক্ত সেই কাম সামনে উপস্থিত। তাই নানাবিধ ভোগসহ তার সেবা কর।

ঋষিকুমার বলল–সত্য বটে তোমাদের বাক্য। কিন্তু আমি আবশ্যক ব্রত সমাপন করে গুরুদেবের অনুমতি নিয়ে তবেই বিবাহ করব। এর অন্যথা কখনো করতে পারব না।

তার উত্তরে কন্যাগণ বলল–তুমি সুন্দর, কিন্তু মূর্খ। বেদজ্ঞ সুধী ব্যক্তির সিদ্ধ ঔষধ, সিদ্ধ রসায়ন, সিদ্ধ নিধি, সকুলসস্তৃতা বারাঙ্গনা, সিদ্ধ মন্ত্র, সিদ্ধ রস–এই সবই ধর্মতঃ সেব্য। কাৰ্য্য যদি দৈববশতঃ সিদ্ধিলাভ করে, তবে নীতিজ্ঞ ব্যক্তি তাতে উপেক্ষা করে না। কারণ উপেক্ষা কখনই ফলপ্রদ হয় না। তাই আর দেরী করা উচিত নয়, বিষ থেকেও অমৃত গ্রহণ করা উচিত। অপবিত্র স্থান থেকেও কাঞ্চন গ্রহণ করা কর্তব্য, নীচের কাছ থেকেও উত্তমা বিদ্যা শিক্ষণীয়, এক নীচকুল থেকেও স্ত্রীরত্ব গ্রহণ করা উচিত। একএই সব কারণে তুমি এই মঙ্গলকর্ম স্বীকার কর, এখন গান্ধর্ব বিবাহ ছাড়া আমাদের বাঁচবার আর কোন উপায় নেই।

কুমারীদের এমন কথা শুনে ঋষিকুমার বলল–অর্থ, মোক্ষ, কাম, ধর্ম–এই চারটি যথাক্রমে উপাসিত হলে ফলপ্রদ হয়। তার বিপরীত হলে নিষ্ফল হয়। আমি ব্রতী, অকালে দার পরিগ্রহ করব না। যে জন ক্রিয়াকাল জানে না, সে ক্রিয়াফল পায় না।

ঋষিকুমারের এখন কথা শুনে প্রমোহিনী হাত ছেড়ে দিয়ে ঋষিকুমারের পদযুগল ধরল। সুশীলা ও সুস্বরা তার দুই বাহু ধরল। সুস্বরা তাকে আলিঙ্গন করল। আর চন্দ্রিকা তার মুখে চুম্বন করতে লাগল।

তবুও সেই ঋষিকুমার নির্বিকার। কিন্তু পরে সেই ব্রহ্মচারী প্রচণ্ড ক্রোধে পাঁচ কুমারীকে অভিশাপ দিল–তোরা আমার সঙ্গে পিশাচীর মত ব্যবহার করলি, তাই তোরা পিশাচী হবি।

এই অভিশাপ শুনে কুমারীগণ অতি ক্ষোভের সঙ্গে বলল–তোর হিতের জন্য আমরা চেষ্টা করলাম, আর তুই কিনা আমাদের অভিশাপ দিলি, আমরাও তোকে অভিশাপ দিচ্ছি, তুই ও পিশাচ হবি।

এইভাবে পরস্পর শাপ প্রদানের ফলে পাঁচ কুমারী আর ঋষিকুমার পিশাচত্ব লাভ করল। তারা তখন দারুণ ক্লেশে কান্নায় ভেঙে পড়ল। তাদের সবার পিতামাতা তাদের এই দশা দেখে গভীর শোকে মুহ্যমান হল। পরে এই পিশাচ-পিশাচীরা সেই সরোবরের তীরে আহার সন্ধানের জন্য ইতস্ততঃ ছোটাছুটি করে অতি দুঃখে বাস করতে লাগল।

এই ভাবে বহুকাল কেটে যাবার পর সদৃচ্ছ বিচরণকারী মহর্ষি লোমশ সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। তখন তাকে ভক্ষণ করার জন্য সেই পিশাচ-পিশাচীগণ তার দিকে ধাবিত হল। কিন্তু মুনিবরের তেজে তাদের সকলের গা পুড়ে যাচ্ছিল, তাই কেউ তার কাছে যেতে পারল না। সকলে দূরেই দাঁড়িয়ে রইল কিন্তু সেই ঋষিকুমার পূর্বজন্ম প্রভাবে মুনিবরের চরণে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম জানিয়ে বলল–হে বিপ্র মহাভাগ্যের ফলে সাধুসঙ্গ লাভ হয়।

তারপর সেই পিশাচ কিভাবে ব্রহ্মচারী থেকে পিশাচত্ব লাভ করল, সবকিছুই লোমশ মুনিকে বলল। লোমশ মুনি সব কথা শুনে বললেন–তোমরা সবাই আমার সঙ্গে রেবা নদীতে স্নান কর, সকলকে অবশ্যই রেবা নদী শাপমুক্ত করবে। রেবা স্নানে সকলের পাপ নাশ হয়, এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস। পণ্ডিতগণ যে পাপের প্রায়শ্চিত্ত দেখতে পান না, সেই সমস্ত পাপ নর্মদা অর্থাৎ নদীতে স্নানের ফলে বিনষ্ট হবেই হবে। নর্মদা স্নানের ফলে মানব আর গর্ভবাস করে না, মুক্তিলাভ করে।

তখন সেই পিশাচ-পিশাচীরা মুনির সঙ্গে নর্মদার তীরে গিয়ে উপস্থিত হলে এক প্রচণ্ড বায়ু প্রবাহের দ্বারা সেই নর্মদার জলকণা তাদের অঙ্গ স্পর্শ করল। আর সঙ্গে সঙ্গেই তাদের পিশাচত্ব দূর হয়ে গেল। তারা দিব্য দেহ ধারণ করে বহু প্রশংসা করল নর্মদার। তারপর মহর্ষি লোমশের আদেশ অনুসারে ঋষিকুমার ঐ গন্ধর্বকুমারীদের বিবাহ করে নর্মদার তীরেই বসবাস করতে লাগল। আর নর্মদাকে অর্চনা করে তারা বিষ্ণুলোকে গমন করল।