৫. সৌধর তীর্থের মাহাত্ম

সৌধর তীর্থের মাহাত্ম

তখন ত্রেতাযুগ। কলিঙ্গ রাজা পরম ধার্মিক ছিলেন। তার কিছুর অভাব ছিল না। তার একটা মাত্র দুঃখ ছিল, তিনি অপুত্রক ছিলেন। ভগবানের কৃপায় প্রৌঢ় বয়সে তার একটি পুত্র হল। রাজা ও রানি খুব আনন্দিত হলেন। অতি যত্নে আদরে বড় হতে লাগল রাজকুমার। বড় হয়ে সে নানা শিক্ষা গ্রহণ করল। রূপে গুণে সে সবার মন জয় করে নিল।

কাঞ্চী রাজার একটা কন্যা ছিল, সে রূপে স্বর্গের অপ্সরীদের মতো ছিল। সে খুব গুণবতী ছিল। সুশিক্ষিতা লজ্জাশীলা, সৎস্বভাবা, ভক্তিমতী ছিল সে। ধীরে ধীরে কন্যাটি যৌবনপ্রাপ্ত হল।

কাঞ্চী রাজার চিন্তা হতে থাকে। এতো গুণবতী কন্যার জন্য উপযুক্ত পাত্র কোথায় পাবেন। দূতের মুখে তিনি জানতে পারেন কলিঙ্গ রাজার পুত্র রূপে গুণে অতুলনীয়। তখন সেই ছেলের সঙ্গেই তার কন্যার বিয়ে দেবেন। তিনি ঘটক পাঠালেন কলিঙ্গ রাজার কাছে। তিনি তখন দূতের দ্বারা খোঁজ নিলেন কাঞ্চীরাজের কন্যার বিষয়ে। দূত জানালো কন্যার কোনো খুঁত নেই। তারপরেই মহাসমারোহে বিয়ে হয়ে গেল কলিঙ্গ রাজপুত্রের সঙ্গে কাঞ্চীরাজকন্যার।

ভোগবিলাসে নবদম্পতি দিন কাটাচ্ছে। একদিন রাজকন্যা রাজকুমারকে বলল স্বামী তোমার কাছে আমার একটা নিবেদন আছে।

রাজকুমার অবাক হয়ে বললেন, তুমি কি কথা বলছ? তুমি কি আমার কাছে আবেদন করবে। দাবি করতে পার। তুমি হলে এই রাজ্যের ভাবী রাজরানি। তোমার মুখে এই আবেদন-নিবেদন কথাগুলো ভাল শুনায় না। তোমার মনের বাসনা আমি পূর্ণ করব না এমন চিন্তা তুমি করলে কিভাবে? কি চাই বল।

রাজকন্যা বলল–আমি যা চাইব তুমি কি তা দেবে?

রাজকুমার বললেন–তুমি এমন করে বলছ কেন? তোমাকে আমার অদেয় কি আছে?

রাজকন্যা বলল তিন সত্যি করে বল।

সত্যি, সত্যি, সত্যি এবার বল, তোমার কি আর্জি? বলল রাজকুমার।

রাজকন্যা বলল–আমি একটা ব্রত করব ঠিক করেছি।

এই কথা, ঠিক আছে এটা তো খুব ভাল কথা। তার জন্য আমাকে ত্রি-সত্য করালে।

রাজকন্যা বলল–সেজন্য তোমাকে তিন সত্য করাইনি। এই ব্রতটি কঠোর। আজ পর্যন্ত কেউ এই ব্রতের নাম শোনে নি। শয়ন ব্রত। কি? শুনেছ কখন? আমি যতক্ষণ নির্জন ঘরে শুয়ে থাকব, ততক্ষণ আমার কাছে কেউ থাকবে না। এমনকি আমার দাসীরাও না। কেমন করে শুয়ে আছি, কেউ দেখবে না। এমনকি তুমিও দেখবে না।

রাজকুমার স্ত্রীর কথা শুনে অবাক হল। ভাবল এমন ব্রতের কথা তো কোনও শাস্ত্রে নেই। এ আবার কেমন ব্রত। তারপরে বলল ঠিক আছে তাই হবে।

রাজকন্যা ব্রত আরম্ভ করল। নিষ্ঠার সঙ্গে সে ব্রত করে চলল। যখন সে শয়ন কক্ষে থাকবে, কেউ তাকে দেখবে না। যখন বাইরে আসবেন তখন কোনো অসুবিধা নেই। রাজকুমার তার সত্য পালন করে চলেছেন।

বৃদ্ধাবস্থায় কলিঙ্গরাজ রাজকুমারকে রাজপদে অভিষিক্ত করলেন। সে রাজা হয়ে সুশাসনে রাখল প্রজাদের, সবাই খুব খুশি। ক্রমে-ক্রমে তার আটাত্তর বছর বয়স হলো। এখনকার হিসেবে বেশি মনে হলেও ত্রেতাযুগের মানুষের গড় আয়ু ছিল দশ হাজার বছর। সে তুলনায় আটাত্তর বৎসর কিছুই নয়। ইতিমধ্যে পাঁচটি পুত্রের বাবা হলেন রাজা। রানির শয়ন ব্রত, কিন্তু তখনও নির্দিষ্ট নিয়মেই চলছে।

একদিন রাজা ভাবলেন প্রতিটি ব্রতের শেষ আছে। কিন্তু রানি এমন কী ব্রত করছেন যার শেষ নেই। কী এমন ব্রত? রানি কার কাছে থেকে এমন ব্রতের বিধান পেল? ভাবতে ভাবতে রাজার মনে কৌতূহল হল। তিনি ঠিক করলেন ব্যাপারটা লুকিয়ে দেখবেন। মনে পড়ে গেল তিন সত্যর কথা। যদি ধরা পড়ে যায়? তাহলে রানির কাছে লজ্জিত হতে হবে। আর যদি ধরা না পড়ে তাহলে আর কি?

তিনি প্রজাবৎসল রাজা ছিলেন। তার সঙ্গে প্রজারা রোজ দেখা করতে আসেন। এমনকি সামান্য অসুবিধা হলেও তারা রাজার কাছে আসেন। রাজা তাদের সবাইকে খুশি করেন।

একদিন রাজা মন্ত্রীকে বললেন–আগামীকাল কেউ যেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে না আসে। আগামীকাল তিনি নির্জনে রাজপ্রাসাদের মধ্যেই থাকবেন। কেউ যেন তাকে না দেখে।

মন্ত্রী রাজার কথামতো সেই কথা রাজ্যে প্রচার করে দিলেন। আগামীকাল কেউই রাজার সাক্ষাৎ পাবে না।

পরের দিন রাজা সেই ঘরে ঢুকলেন, যে ঘরে রানি শয়নব্রত করছিল। খাটের তলায় গিয়ে চুপ করে পড়ে রইলেন। তারপরে রানি এসে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে দুহাতে মাথাটি চেপে ধরে কাঁদছেন। আর বলছেন হায় আমার কি দুর্ভাগ্য। চুপ করে এই মাথার যন্ত্রণা সহ্য করতে হচ্ছে। সৌকর তীর্থে কি আমি কোনদিন যেতে পারব না? স্বামীর সঙ্গে কপটতা করে এই অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করে এখানেই মরতে হবে আমাকে।

রানির বিলাপ শুনে রাজা স্থির থাকতে পারলেন না। তিনি খাটের তলা থেকে বেরিয়ে এলেন। রানিকে বললেন, আমি তিন সত্য ভেঙেছি। সেজন্য তুমি আমাকে ক্ষমা কর। এবার বল তুমি কেন মাথার যন্ত্রণা সহ্য করছ। আর এমন ছলনার আশ্রয় নিলে কেন। বৈদ্য ডেকে কি এর চিকিৎসা করা যেতো না?

রানি বললেন–আমার এই রোগ সারানোর সাধ্য বদ্যির নেই।

রাজা রানিকে বললেন–তুমি কাঁদতে কাঁদতে সৌকর তীর্থের কথা বলছিলে, শুনেছি সেই তীর্থে গেলে মানুষ মুক্তি লাভ করে। সেখানে তোমার মন যেতে চাইছে, তাহলে আমাকে বলনি কেন?

রানি বললেন–আমি ভয়ে তোমাকে বলি নি। তুমি যদি কষ্ট পাও।

রাজা বললেন–কষ্ট পাব কেন? তুমি আমার স্ত্রী। স্ত্রীর কোনো অসুবিধা হলে সে তো তার স্বামীকে অবশ্যই বলবে তাতে কি কোনও স্বামী কষ্ট পাবে।

রানি বললেন–তার জন্য চিন্তা কি? আমার পাঁচ পুত্রের জ্যেষ্ঠকে সিংহাসনে বসিয়ে আমরা দু’জনে চলে যাব।

রাজার কথা শুনে রানি খুব আনন্দিত হলেন।

রাজা একদিন মন্ত্রীকে ডেকে বললেন–আমি আমার স্ত্রীর সঙ্গে তীর্থে যাব কবে ফিরব তার ঠিক নেই। তাই আমার জ্যেষ্ঠপুত্রকে রাজসিংহাসনে বসিয়ে দিয়ে যেতে চাই।

মন্ত্রী রাজার আদেশমত সব ব্যবস্থা করল। আর নির্দিষ্ট দিনে রাজা তার জ্যেষ্ঠপুত্রকে রাজছত্র দান করলেন। তার পর বেরিয়ে পড়লেন সৌকর তীর্থের উদ্দেশ্যে, সঙ্গে শুধু রানি নয়, যারা যারা রাজাকে ভালবাসত, তারও বেরিয়ে পড়ল সৌকর তীর্থ দর্শনের জন্য।

সবার থাকার জন্য উপযুক্ত বাসস্থান তৈরী হল। জমজমাট হয়ে উঠল সৌকর তীর্থ। রাজা রানিকে বললেন–এবার বল, তোমার সৌকর তীর্থে তো এসেছি। আর তো তোমার কোনো আপত্তি নেই বলার।

রানি বললেন–বলব কিন্তু আমাদের দুজনকে এর আগে তিন দিন উপবাস করতে হবে।

রাজা ও রানি দুজনেই উপবাস করলেন তিনদিন। চতুর্থ দিনে রানি রাজার হাত ধরে ডেকে নিয়ে গেলেন এক নির্জন স্থানে। তারপর বললেন–স্বামী গত জন্মে এখানেই আমার মৃত্যু হয়েছিল। আমি তখন শৃগাল ছিলাম। কলিঙ্গনগরের রাজকুমার সোমদত্ত একদিন মৃগয়ায় এলেন। তিনি সারাদিন কোন শিকার না পেয়ে আমাকেই হত্যা করল। রাজকুমারের তির আমার মাথায় এসে লাগে। আমি ছটফট করতে করতে মারা যাই।

এই তীর্থের গুণে আমি শৃগালী থেকে রাজকন্যারূপে জন্মলাভ করি। এতোদিন সেই যন্ত্রণা ভোগ করছি। আজ এখানে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেলাম।

রাজা রানির সব কথা শুনে বললেন–আমি তোমায় আমার গোপন কথা বলছি। আমি গতজন্মে শকুন ছিলাম। সেই সোমদত্তর তিরের আঘাতেই মারা যাই আমি। সোমদত্ত আমার ডানা দুটো কেটে নেয়, তিরের পেছনে বাধবে বলে। এই সৌকর তীর্থের গুণে আমিও এ জন্মে রাজপুত্র হলাম। আর আজকেই আমার মুক্তি হল। তারপর রাজা ও রানি দুজনেই সৌকর তীর্থে দেহত্যাগ করলেন। তাদের সঙ্গে যেসব প্রজারা গিয়েছিল তারা কিন্তু সেখানে থেকে গেল।