২. কোকক্ষেত্রের মাহাত্ম্য

কোকক্ষেত্রের মাহাত্ম্য

আনন্দপুরে এক রাজা ছিলেন, তাঁর নাম শক। তাঁর একটিমাত্র পুত্র। সেই রাজকুমার দেখতে যেমন অপূর্ব সুন্দর ছিলেন, তেমনি গুণবানও ছিলেন এবং বিক্রমশালীও ছিলেন।

কোশলরাজের এক কন্যা ছিল। সে খুব সুন্দরী। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে সেই রাজকন্যা মনে মনে ভাবত আমার স্বামী যেন আমার থেকেও সুন্দর হয়। তাই সে বিষ্ণুর ধ্যান করত এবং প্রার্থনা করত গুণবান, সৎচরিত্র ও অপরূপ স্বামী যেন তার হয়।

সেই রাজকন্যা শ্ৰহরীর কৃপায় স্বামীরূপে লাভ করল শক রাজার পুত্রকে। মহা ধুমধামে বিয়ে হল তাদের। তারা দুজনেই এই বিয়েতে খুব খুশি হল।

বিয়ের কয়েকদিন পরে রাজকুমারের মাথায় যন্ত্রণা দেখা দিল। বৈদ্যকে ডাকা হল, বৈদ্য ওষুধ দিলেন। সাময়িকভাবে উপশম হল বটে কিন্তু আবার কয়েকদিন পরে সেই ব্যথা ফিরে এলো। ভীষণ যন্ত্রণা, বৈদ্য এসে আবার ওষুধ দিলেন। যন্ত্রণা কমল কিন্তু পুরোপুরি সেরে গেল না।

একদিন রাজকুমারকে কোশলরাজকন্যা জিজ্ঞেস করল–তোমার এ রোগ কত দিনের?

কুমার বলল–ছোটাবেলা থেকেই এই রোগটি আছে। ওষুধ খেয়ে মাঝে মাঝে ঠিক থাকে। কিন্তু একেবারে এটি সেরে যায়নি।

রাজকন্যা বলল–এই রোগ সারানোর উপায় কী? এই রোগের কারণ কী?

রাজকুমার বলল–এ রোগ সারবার নয়। আর এই রোগের কারণ আমি জানি। কিন্তু এখানে বলা উচিত হবে না। একথা যদি বলতেই হয় তবে আমাদেরকে যেতে হবে কোকক্ষেত্রে।

কোকক্ষেত্র তো একটি তীর্থস্থান। রাজকন্যা অবাক হল।

রাজকুমার বলল–তুমি চেন সেই তীর্থস্থান। চল আমরা দুজনে মিলে একদিন সেই কোকক্ষেত্রে যাই। আমার মনে হয় সেখানে গেলেই আমার রোগ সারতে পারে।

রাজকুমারের কথা শুনে রাজকন্যা বলল–তাহলে কালবিলম্ব না করে সেখানে আমাদের যাওয়া উচিত।

কুমার স্ত্রীর কথার উত্তরে বলল–যাব বললেই যাওয়া যায় না, মা-বাবার অনুমতি নিতে হবে। গোপনে যদি চলে যাই তাহলে তাঁরা দুঃখ পাবেন।

স্ত্রী বলল–ঠিক আছে। আমরা তাঁদের অনুমতি নিয়েই যাব। এই কথা বলেই রাজকন্যা রাজা রানির কাছে গিয়ে কোকক্ষেত্রে যাবার অনুমতি চাইল।

রাজা বললেন–কোকক্ষেত্রের কথা শুনেছি কিন্তু তা চোখে দেখিনি। আমাদের বয়স হয়েছে। আমরা এখন যাই তীর্থ করতে। তোমরা পরে যাবে।

বধূমাতা বলল–বাবা আমরা শুধু তীর্থ দর্শনের জন্য যাচ্ছি না, আপনার পুত্রের মাথায় যে যন্ত্রণা হচ্ছে, সেটিতে বৈদ্যমহাশয় নির্মূলভাবে সারাতে পারছেন না। ওই তীর্থে গেলে তার রোগ সারতে পারে বলে সে মনে করে। তাই আমরা ওখানে যেতে চাই।

তাঁরা মনে করলেন–সত্যিই তো বহু চিকিৎসা করেও একমাত্র পুত্রের রোগ সারানো সম্ভব হচ্ছে না, তাহলে তীর্থক্ষেত্রে গিয়ে একবার দেখুক, যদি রোগটা সেরে যায়। তাই তারা অনুমতি দিলেন।

রাজকুমার তার স্ত্রীর সঙ্গে কোকতীর্থে উপস্থিত হল। রাজকন্যা স্বামীকে জিজ্ঞেস করল–এবার বল স্বামী তোমার রোগের কারণ কী?

কুমার বলল–আজকের রাতটা চলে যাক, আগামীকাল সকালেই তোমাকে সব গোপন কথা বলব।

রাজকন্যার মনে কৌতূহল জন্মাল। কিন্তু তবুও সে স্বামীর কাছে আর আপত্তি করল না। রাত শেষে ভোর হতেই স্বামীর কাছে আবার সেই প্রশ্ন রাখল।

রাজকুমার বললস্নান করে এসে বলব। রাজকন্যার কৌতূহল আরও বাড়তে লাগলো, কুমার বলল–বিষ্ণুমন্দিরে গিয়ে পুজো দিয়ে আসি। উভয়েই যথাবিধি মতো ষোড়শোপচারে পুজো করল শ্রীবিষ্ণর।

রাজকন্যা আর ধৈর্য্য ধরতে পারল না। এবার তাকে বলতেই হবে ব্যাধির কারণ। রাজকুমার স্ত্রীকে নিয়ে চলল এক সরোবরের ধারে। বলল–দেখ, ওখানে কতগুলো মাছের কাটা পড়ে আছে। ওগুলো আমার পূর্বজন্মের মাছের অস্থি।

রাজকন্যা অবাক হল। রাজকুমার বলল–পূর্বজন্মে আমার জন্ম হয়েছিল মাছের যোনিতে। এই সরোবরে আমার বাস ছিল। একদিন একটি শিকারি এলো এই সরোবরে। সে এক বঁড়শিতে আমাকে ধরে ফেলল। আমি ভীষণ ভাবে ছটফট করতে লাগলাম। ছিঁড়ে গেল তার বঁড়শির ডোর। ভাবলাম শিকারির হাত থেকে মুক্তি পেলাম। কিন্তু ঠিক সেই সময়ে একটি বাজপাখি এসে তার নখের সাহায্যে আমাকে আকাশে তুলে নিয়ে গেল। আমি তার নখে আবদ্ধ থাকলাম এবং খুব ছটফট করতে লাগলাম। তাই সে আমাকে বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারলো না। আমি পড়ে গেলাম মাটিতে এবং আমার মাথায় আঘাত লাগে। যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে আমার দেহ থেকে প্রাণবায়ু বেরিয়ে যায়।

কোকক্ষেত্রের মাহাত্মের জন্য আমি মৎস্য যোনি থেকে একেবারে মানুষ হয়ে জন্মালাম। রাজার ঘরে রাজপুত্র হলাম। মানুষ হয়ে জন্মালেও আগের লাগা মাথার আঘাতের জন্য আমার মাথায় ব্যথা থেকেই গেল। পূর্বজন্মের এই কারণের জন্যই আমার যন্ত্রণা কেউ সারাতে পারছে না। একমাত্র এই ক্ষেত্ৰই পারে আমাকে এই রোগ থেকে মুক্তি দিতে।

রাজকুমারের কথা মন দিয়ে শুনছিলেন রাজকন্যা। সে হঠাৎ বলে উঠল–আমারও এই মুহূর্তে পূর্বজন্মের কথা মনে পড়ছে।

রাজকুমার কৌতূহলী হল এবং বলল তোমারও পূর্বজন্মের কথা আছে নাকি? তাহলে এক্ষুনিই বল তোমার কথা।

রাজকন্যা বলল–পূর্বজন্মে আমি চিল ছিলাম। একদিন আকাশের খুব উঁচুতে উড়ে যাচ্ছিলাম। দেখলাম এক ব্যাধিনী গাছের নীচে বসে আছে, এবং সেখানে প্রচুর শিকার করে নিয়ে একটি ব্যাধ এলো। মাংসের ঝোলাটা রেখে দিয়ে ব্যাধ বনের মধ্যে গেল শুকনো কাঠের সন্ধানে। ব্যাধিনী তখন পশুদের ছাল ছাড়ালো। ব্যাধ কাঠ এনে আগুন জ্বালাল। সেই আগুনে মাংসগুলো তারা ঝলসালো এবং মনের আনন্দে খেতে লাগলো।

আমার খুব খিদে পেয়েছিল। ওদের খেতে দেখে আমার লোভ হলো। কিন্তু কীভাবে ওই মাংস খাব। সুযোগ খুঁজতে লাগলাম। দেখলাম–ব্যাধিনী খেতে খেতে উঠে গেল, ব্যাধ তখন একা বসে মাংস খাচ্ছিল। সে চোখ বুজে মাংস খাচ্ছে, সেই সুযোগে আমি গাছের ডাল থেকে নেমে খানিকটা মাংস ছোঁ মেরে আবার গাছের ডালে এসে বসলাম এবং মনের আনন্দে খেতে লাগলাম।

কিছুক্ষণ পরে ব্যাধ চোখ খুলল এবং দেখল তার সামনে মাংস নেই। এদিক ওদিক দেখতে লাগলো। তখন সে আমাকে দেখতে পায়। আর সঙ্গে সঙ্গেই তির ছুঁড়ে মারল আমার দিকে। আমি পালাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না। সেই শরের আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম। তারপরেই আমার এই জন্ম রাজার ঘরে রাজকন্যারূপে। সবই এই তীর্থের মাহাত্ম্য, বহু যোনি পার হয়ে তবে মানব জন্ম পায়। কিন্তু এই তীর্থের মাহাত্মের জন্য একেবারে মানুষ হয়ে জন্মালাম।

ওই দেখ স্বামী, এখনও আমার অস্থিগুলো ওখানে পড়ে আছে।

তারপর তারা দুজনে থেকে গেল কোকক্ষেত্রে। শ্রীবিষ্ণুর মন্দিরে নিত্য পূজার্চনা করতে থাকল। তারা। তারা আর রাজধানীতে ফিরে এল না। তাদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে, রাজা-রানি বহু চেষ্টা করলেন কিন্তু রাজকুমার তার মাথার যন্ত্রণার কথা স্মরণ করিয়ে দিল অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে তারা পিতামাতাকে রাজধানীতে ফেরৎ পাঠিয়ে দিল।