১৫. শিবপুরাণ মার্কণ্ডেয় মুনির অমরত্ব লাভ

শিবপুরাণ মার্কণ্ডেয় মুনির অমরত্ব লাভ

মুকাণ্ডু নামে সত্যধর্মপরায়ণ এক ঋষি ছিলেন। তিনি জিতেন্দ্রিয় ছিলেন, তার একটি দুঃখ ছিল তিনি পুত্রহীন। তিনি ঠিক করেন তপস্যা করবেন এবং ব্রহ্মার কাছ থেকে পুত্র প্রাপ্তির জন্য বর চেয়ে নেবেন।

একুশ হাজার বছর ধরে তিনি কঠোর তপস্যা করলেন, ব্রহ্মা তুষ্ট হয়ে তাকে বর দিতে এলেন। বললেন, “হে মুকাণ্ডু, তুমি পুত্র কামনায় তপস্যা করছ। তোমার অসংখ্য পুত্র হবে, কিন্তু তারা অধার্মিক হবে। আর যদি একটি পুত্র চাও তাহলে সে হবে ধার্মিক, তবে তার পরমায়ু হবে সাত বৎসর। এই দুটি বরের মধ্যে যে, কোন একটি নিতে পারো।”

মুকাণ্ডু ভেবে দেখলেন অধার্মিক অসংখ্য পুত্র বংশ ধ্বংসের কারণ হবে। তার চেয়ে পুত্রহীন থাকা ভাল। কিন্তু এক পুত্র যদি ধার্মিক হয় তাহলে বংশের গৌরব বাড়বে। সেই পুত্রের পিতারও গৌরব বাড়বে। হে ব্রহ্মা, আমি একটি পুত্র চাই।

ব্রহ্মা তখন তাকে বর দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। বর লাভ করে মুনি খুব খুশি হলেন। কিছুকাল পরে তার একটি অপূর্ব সুন্দর পুত্র হল। তিনি একদিকে আনন্দিত কিন্তু অন্যদিকে পুত্রের কম পরমায়ু নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। তিনি ভাবতে লাগলেন কি করে পুত্রের আয়ু বাড়ানো যায়। ভাবলেন পুনরায় তপস্যা করে ব্রহ্মার বরে পুত্রের আয়ু বাড়ানো যেতে পারে।

এই ভাবনা নিয়ে তিনি তপস্যা শুরু করলেন। কখন উপর দিকে পা তুলে, কখনও চারিদিকে আগুন জ্বালিয়ে, কখনো গাছের ডালে ঝুলে, কখনও জলের মধ্যে ডুবে। না খেয়ে তপস্যা করলেন। তাঁর তপস্যার তেজে দেবতা স্থির থাকতে পারলেন না। ব্রহ্মাকে তারা সকল কথা মানিয়ে ঋচণ্ড ঋষির কাছে এলেন।

ব্রহ্মা বললেন, পুত্রের দীর্ঘ আয়ু ভিন্ন আমার আর কিছুর প্রয়োজন নেই। পুত্রে দীর্ঘ আয়ু ছাড়া অন্য যে-কোনো বর প্রার্থনা কর।

ঋষি বললেন, আমার বর প্রয়োজন নেই। আমি চাই আমার পুত্রের দীর্ঘ পরমায়ু।

ঋষির কথা শুনে ব্রহ্মা রেগে গেলেন। বললেন, তোমাকে আগেই বলেছিলাম ভেবে-চিন্তে বর চাইতে, এখন পাল্টাতে গেলে আগের বর মিথ্যা হয়ে যাবে।

বর না দিয়েই ব্রহ্মা চলে গেলেন। তখন মুকাণ্ড বিষ্ণুর আরাধনা করলেন।

শুরু হল বিষ্ণুর আরাধনা। তুষ্ট হলেন নারায়ণ। চতুর্ভুজ মূর্তিতে বর দিতে এলেন। অপরূপ মূর্তি দেখে ঋষি হাতজোড় করে প্রণাম জানালেন।

বিষ্ণু বললেন, হে ঋষি, তুমি কিজন্য তপস্যা করছ।

ঋষি বললেন, বিধাতার আশীর্বাদে আমি পুত্র লাভ করেছি কিন্তু তার পরমায়ু সাত বছর, আমি চাই আপনি আমার পুত্রকে দীর্ঘজীবী করুণ।

জনার্দন বিপাকে পড়লেন। তিনি কি করবেন বুঝতে পারলেন না। তিনি বললেন, আমি ঐ বর দিতে অক্ষম। বিধাতার বিধান অন্যথা করার আমার ক্ষমতা নেই।

বিষ্ণু চলে গেলেন। বিষণ্ণ মন নিয়ে ঋষি আশ্রমে ফিরে এলেন। পিতার এমন অবস্থা দেখে, পাঁচ বছরের সন্তান তার মাকে জিজ্ঞাসা করে, বাবা সবসময় কাঁদে কেন? কি হয়েছে বাবার?

মা পুত্রকে বললেন, সে কথা বলতে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। বহুকাল আমরা পুত্রহীন ছিলাম। তারপরে বিধাতার বরে তোমাকে পাই। তোমার পরমায়ু মাত্র সাত বছর। এই জন্য আমরা তোমাকে হারাবার কথা ভেবে বিষণ্ণ থাকি। তোমার আয়ু বাড়ানোর জন্য তোমার বাবা চেষ্টা করছেন, কিন্তু তিনি ব্যর্থ হলেন।

মায়ের কথা শুনে পুত্র বললেন, মাগো, মৃত্যু থেকে মুক্তি পেতে জগতে কেউ কি পেরেছে? যখন জীবের জন্ম হয়, তখন তার মৃত্যুর দিনও ঠিক করা হয়ে যায়, কর্মানুসারে অল্পায়ু দীর্ঘায়ু হয়। কর্মের দ্বারা মানুষ স্বর্গে যায়, আবার নরকেও যায়। আমি তপস্যা করার জন্য বনে যাই, আমাকে অনুমতি দাও।

পাঁচ বছর বয়সে পুত্রের মুখে এই কথা শুনে মা অবাক হয়ে যান এই বালক এখন শিশু সে তপস্যার কি মানে জানে? বোধ করি কোন দৈব ভর করেছে, যদি তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করে তো ভালো, না হলে যা হবার তাই হবে।

মা অনুমতি দিলেন। তাকে বিদায় দিতে গিয়ে মা কেঁদে উঠলেন। বালক চলল তপস্যায়। মহর্ষি পুলহের আশ্রম পুণ্যক্ষেত্র হরিক্ষেত্রে ঋষিপুত্র তার কাছে গেলেন এবং তাঁকে প্রণাম জানালেন।

এই শিশুটিকে দেখে মহর্ষি পুলহ জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কে? তোমার নাম কি? তুমি কেন এসেছ? বালক উত্তরে বলল, আমার নাম মার্কণ্ডেয়, ঋষি মুকার পুত্র। বিধাতার বরে পিতা আমাকে পেয়েছেন, আমার পরমায়ু মাত্র সাত বছর হওয়ায় আমার পিতা-মাতা খুবই দুঃখিত। এখন পিতা মাতার দুঃখ দূর করার জন্য আমাকে উপায় বলে দিন, যাতে আমি চিরজীবী হতে পারি।

মহর্ষি পুলহ বললেন, জগতের গুরু মহেশ্বর। ভক্তি ভরে তার তপস্যা কর, তিনি যদি প্রসন্ন হন তাহলে তুমি চিরজীবী হবে, দক্ষিণ সাগর তীরে কুণ্ডু নামে একজন মুনি আছেন, তার কাছে যাও। এবং তার উপদেশ নাও। ভক্তি ভরে লিঙ্গপূজা কর। একমাত্র তবেই মহেশ্বরের কৃপায় মৃত্যুকে জয় করতে তুমি সমর্থ হবে।

মার্কণ্ডেয় মুনির কাছে গিয়ে প্রণাম জানালেন। মুনির প্রশ্নের উত্তরে মার্কণ্ডেয় সব কথা বললেন।

শিশুটির কাছে সব জেনে কণ্ডু ঋষি মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র দান করলেন তাকে। মন্ত্র পেয়ে মার্কণ্ডেয় খুব খুশি হয়। গুরুর চরণ বন্দনা করে সে চলে যায় সাগর তীরে। মাটি দিয়ে তৈরি করে এক শিবলিঙ্গ। সে নানা রকমের বনফুল তুলে শিবের পূজা করল। তারপর প্রণাম করে গুরু দত্ত মন্ত্র জপ করতে লাগল।

এইভাবে দু-বছর কেটে গেল। মৃত্যুর সময় উপস্থিত হল। ধর্মরাজ যম মৃত্যুকে তলব করলেন। বললেন–বিধির বিধানে মার্কণ্ডেয়ের কাল পূর্ণ হয়েছে। তাকে মৃত্যুপুরীতে নিয়ে আসতে হবে।

যমের আজ্ঞা পেয়ে যমদূতগণ চললেন, তাদের সবার মূর্তি ভয়ংকর। তখন সাত বছরের বালক তপস্যা করছে। কিন্তু মৃত্যুর অন্তরে কোন দয়া নেই। যখন তারা খড়গ তুলল, তার প্রাণ নেবার জন্য, তখন মৃত্যুর সামনে উপস্থিত হলেন পঞ্চানন। হাতে তার ত্রিশূল। সেই শঙ্করের তেজে মৃত্যু অজ্ঞান হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে তাদের জ্ঞান ফিরলে তারা আবার শিশুটিকে মারতে উদ্যত হল।

এই অবস্থায় মৃত্যুকে দেখে মহেশ্বর রেগে গেলেন, তিনি মৃত্যুর মাথায় আঘাত করলেন। সে আঘাতে মৃত্যুর শিরচ্ছেদ হয়ে মাটিতে পড়ে গেল।

এইসব ঘটনাসমূহ দূরে দাঁড়িয়ে যমের এক দূত দেখছিল। মৃত্যুর মৃত্যু দেখে সে যমের কাছে চলে যায়, এবং সেখানে সব কথা বলে। সেসব ঘটনাবলি শুনে যম ভয় পেয়ে যায়। ব্রহ্মলোকে গিয়ে ব্রহ্মাকে জানায় সকল কথা। নমস্কার করে বললেন– হে ব্রহ্মদেব, মার্কণ্ডেয়ের সাত বছর পরমায়ু যা আপনিই নির্ধারণ করেছেন, মৃত্যু তাকে আনতে গেলে তার নিজেরই মৃত্যু হয়েছে শিবের হাতে। আপনার আজ্ঞা পালন করতে গিয়ে এই অবস্থা, এখন বলুন কি করব?

ব্রহ্মা সকল কথা শুনে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তিনি সব দেবতাদের নিয়ে শিবের কাছে গেলেন। ব্রহ্মাদিসহ সমস্ত দেবতাগণ ত্রিশূল হাতে দাঁড়িয়ে থাকা শিবকে প্রণাম জানালেন।

ব্রহ্মা করজোড়ে বললেন, হে ভগবান আপনি সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়ের কর্তা, পূর্বে মুকাণ্ডু ঋষি ঘোর তপস্যা করলে আমি তাকে সপ্তবর্ষ পরমায়ু যুক্ত পুত্র বর দিই। এখন আমার বাক্য যাতে সত্য হয় সেই ব্যবস্থা করুন।

ব্রহ্মার কথা শুনে মহেশ্বর ক্রোধিত হয়ে বললেন, মুকাণ্ডু নন্দন আমার পরম ভক্ত, আমি তার প্রভু, তুমি কখনই তার প্রভু হতে পারবে না। নারায়ণও তার প্রভু হতে পারবে না। এখন শমন তার কাছে যেতেই পারবে না। তোমরা এখন সবাই ফিরে যাও নিজের স্থানে।

ব্রহ্মা শিবের কথা শুনে চুপ করে গেলেন। তারপরে তিনি শিবকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে বেদবাক্যে শিবের স্তব করলেন-হে দেব, তোমার বরে মুকাণ্ডু কুমার আয়ু লাভ করবে। তোমার রোষে মৃত্যুর মৃত্যু হল। তোমার মহিমা আমি হানতে পারি না। তাহলে মৃত্যু জানবে কি করে, তাই মৃত্যুকে বাঁচিয়ে দিন।

ব্রহ্মার স্তুতি শুনে শিব খুশি হলেন বললেন–হে ব্রহ্মা, তোমার কমণ্ডলুর জল মৃত্যুর দেহে ছিটিয়ে দাও, সে বেঁচে উঠবে।

এই কথা বলে শিব চলে গেলেন। ব্রহ্মা তার কমণ্ডলুর জল ছিটিয়ে মৃত্যুকে বাঁচালেন। যম একটা শিবলিঙ্গ নির্মাণ করে পূজা করলেন, যমের দ্বারা স্থাপনের জন্য নাম হল যমেশ্বর শিবলিঙ্গ। তারপর ব্রহ্মা ফিরে গেলেন ব্রহ্মলোকে। দেবতারাও ফিরে গেলেন দেবলোকে। যমরাজ ফিরে গেলেন যমপুরীতে।

শিবের বরে মার্কণ্ডেয় অমরত্ব লাভ করলেন।