১১. দেবীর দেহাভ্যন্তরে শিবের অদ্ভুত দর্শন

দেবীর দেহাভ্যন্তরে শিবের অদ্ভুত দর্শন

একদিন হর-পার্বতী নানা কথায় আনন্দ উপভোগ করছেন, মহাদেব একবার পার্বতীকে বললেন, দেবী, তোমাকে আমি আজও বুঝতে পারিনি, আমি কত দৈত্যকে সৃষ্টি করেছি। আবার তাদের দেখে ভয়ও পেয়েছি। এই তো কিছুদিন আগে এক দৈত্যকে সৃষ্টি করে তার তেজ দেখে ভয় পেয়ে আমি তোমার মধ্যে লুকিয়ে গেলাম। তোমার দেহের মধ্যে অদ্ভুত সব দৃশ্য দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম।

আমি আগে কখনও এমন দেখিনি। কারো মুখে শুনিওনি। দেখলাম তোমার দেহের মধ্যে কোটি। কোটি ব্রহ্মাণ্ড বিরাজ করছে। কত ব্রহ্মা, কত বিষ্ণু, কত মহেশ্বর! আবার এক একজন ব্রহ্মার কোটি কোটি মাথা, অষ্টসিদ্ধির সঙ্গে কত যে মহেশ্বর তার সংখ্যা গণনা করা সম্ভব নয়। এইসব তোমার দেহের মধ্যে দেখে আমি তো ভয়ে বিহ্বল হয়ে পড়লাম। আমি যে কে তাও ভুলে গেলাম; কি ছিলাম, কি হলাম তাও বুঝতে পারলাম না।

এইভাবে কোটি বছর ঘুরতে ঘুরতে তোমার হৃদয়ে উপনীত হলাম। সে হৃদয়পাশে অতি অপরূপ একটি পদ্মফুল দেখলাম। দিব্যতেজে আলোকিত, সেই আলোকে দেখলাম রসনার মাঝে সুন্দর রসপুঞ্জ। সেখানে ব্রহ্মজ্ঞানও দেখতে পাই। সর্বজ্ঞানময় সর্বপুণ্যময়, ব্রহ্মানন্দময় সবই দেখলাম। মনে খুব আনন্দ হল। অন্তরের মলিনতা দূর হল। তারপর ষটপুজোর মাঝে মনোহর সর্ববেদও দেখলাম। চারি বেদ পাঠ করলাম।

তারপর দেখলাম সনাতন কালীকে, তিনি ব্রহ্মাস্বরূপিণী। তার চারিদিকে যযাগিণীগণ আনন্দে নৃত্য করছে। তখন এক আশ্চর্য জিনিস দেখতে পেলাম। যোগিণীদের সাথে দেবীও নাচছেন, তার চিবুক থেকে দুইটি ঘামের বিন্দু ঝরে পড়ছে।

সেই দুই ঘর্মবিন্দু থেকে ব্রহ্মা আর হরির জন্ম হল। তারা জন্মে দেবীকে দেখে ভয়ে পালাবার চেষ্টা করলেন। ব্রহ্মা দেবীর পিলিতে আর হরি ঈড়াতে আটকে গেলেন। তখন দুজনেই কাঁদতে শুরু করলেন। তারপর আমি বিষ্ণুর পাশে গিয়ে জ্ঞানমন্ত্র দান করলাম, তাতে বিষ্ণু আমার মতই হয়ে গেলেন। ব্রহ্মার কাছে গিয়ে তাঁকে মন্ত্রও দিলাম। তিনিও আমার মত হলেন।

এখন হরি আমার বামদিকে আর ব্রহ্মা আমার ডান দিকে বসলেন।

এদিকে কালীর নাচ আর থামে না। এভাবে শতকোটি বছর কেটে গেল। চারদিকে যোগিণীরা আর, শিবগণও নাচছে। নানা বাদ্য বাজছে। তখন আমি, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, কালিকার বহু স্তব-স্তুতি করলাম। প্রথমে ব্রহ্মা এককোটি বছর স্তব করলেন। দেবী বললেন, হে বিধাতা, তুমি সর্বশাস্ত্র জেনেছ, কাজেই তুমি সৃষ্টিকর্তা হরে।

তারপর কোটি বছর ধরে বিষ্ণু স্তব করলেন। তখন দেবী বললেন, হে বিষ্ণু, আমার আদেশ তুমি বিশ্বকে পালন কর।

সবশেষে আমি বিশ কোটি বছর ধরে স্তব করলাম। দেবী বললেন, হে শিব, তুমি আমার আজ্ঞায় সংহার করো। তারপর আমি আবার পাঁচ কোটি বছর স্তব করবার পর দেবী সন্তুষ্ট হয়ে আমাকে বললেন, হে সদাশিব, আমি তোমার স্তবে খুশি হয়েছি, তুমি বর চাও।

তখন আমি প্রার্থনা করলাম, হে দেবী, তোমার চরণে যেন আমার মতি থাকে।

আমার প্রার্থনা শুনে কালী বললেন, শুনুন সদাশিব, তোমার দেহ থেকে ঘোর দৈত্য জন্মাল, সেই দৈত্যকে আমি বধ করলাম। সেই দানব আমার সঙ্গে এমন যুদ্ধ করল, তার কোটি ভাগও আমার সঙ্গে যুদ্ধ করতে কারও শক্তি নেই।

সেই দৈত্য আবার মহিষরূপে আমার সঙ্গে যুদ্ধ করবে, তখন আমি ভদ্রকালীরূপে তাকে বিনাশ করব। তখন আমার বামাঙ্গুষ্ঠ তোমার হৃদয়ে রাখা থাকবে। তখন তুমি শবরূপ ধারণ করবে তোমার ওপরেই আমার আসন হবে।

দেবীর এমন কথা শুনে আমি তার পায়ের তলায় পড়ে গেলাম শবরূপে। এইভাবে লক্ষ বছর কেটে গেল। ব্রহ্মা আর বিষ্ণু নতশিরে সেই দেবীর বন্দনা করল। লক্ষ বছর পরে আমি যখন উঠে দাঁড়ালাম তখন দেবীকে কোথাও দেখতে পেলাম না। আমি বিষাদগ্রস্ত হয়ে কাঁদতে লাগলাম পাঁচ লক্ষ বছর ধরে। তবুও যখন দেবীর দেখা পেলাম না, তখন আরও জোরে কাঁদতে লাগলাম।

সেই কান্না শুনে দেবী অদৃশ্য থেকে বললেন–তোমাদের কোনো ভয় নেই। আমি সবার কাছে সবসময়ই থাকি। পূর্বে আমার যে নির্মম রূপ দেখেছ, সেই রূপ হৃদয়মাঝে চিন্তা করে আমার মন্ত্র জপ করো। তাহলে সবার মঙ্গল হবে।

তারপর মহাদেবী বিষ্ণুকে বললেন–হে বিষ্ণু, তুমি এখন ব্রহ্মার শরীরে প্রবেশ করো। যতক্ষণ জ্ঞান ক্রিয়াময়ী সৃষ্ট না হয় ততদিন তুমি সেখানে থাকবে।

তারপর মহাদেবী আমাকে বললেন–হে পশুপতি, তুমিও ব্রহ্মার দেহে প্রবেশ কর। যতদিন ব্রহ্মার দেহে বিষ্ণু থাকবে, তুমিও থাকবে ততদিন। তারপর মহাদেবী আনন্দভরে তিনজনকে তিন শক্তি দিলেন। ইচ্ছাশক্তি দিলেন বিষ্ণুকে, ক্রিয়াশক্তি দিলেন ব্রহ্মাকে আর জ্ঞানশক্তি দিলেন আমাকে।

এইভাবে আমরা শক্তি লাভ করে খুব খুশি হলাম। দেবী তারপর মধুর বাক্যে বললেন, আমি তোমাদের ছেড়ে কোথাও যাব না। এমন কথা বলে দেবী তিনজনের দেহের মধ্যে প্রবেশ করলেন। আমি বিধাতার দেহে প্রবেশ করলাম। তখন বিধাতার জ্ঞান লাভ হল। বিষ্ণুও ব্রহ্মার দেহে প্রবেশ করলেন। তাতে ব্রহ্মও জ্ঞানলাভে খুব আনন্দ পেলেন।

তারপর কালীর উদ্দেশ্যে বিধাতা হোম করলেন। পরে ব্রহ্মা চিন্তা করলেন–এবার কি করবে? তারপর মহা জলরাশি সৃষ্টি করলেন। সেই জলে ত্রিভুবন পরিব্যপ্ত হল। স্বর্ণবর্ণ বীর্য তাতে ফেলল। তা বুদ্বুদ আকারে উঠল। সেটাই হলো ব্রহ্মাণ্ড। এই রূপে আরও অনেক ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি হল। তখন আমি রুদ্রমূর্তি ধরে সেইসব ব্রহ্মাণ্ডকে রক্ষা করলাম। আবার আমিই সংহার করতে লাগলাম। হে দেবী, বিষ্ণু তোমার আদেশে ব্রহ্মাণ্ড পালন করলেন। আর বিধাতা প্রত্যেক ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে প্রবেশ করে সৃজন কার্য শুরু করলেন।

হে পার্বতী, তুমিই আদ্যাশক্তি। এইসব ঘটনা ঘটেছে বহু পূর্বে এখন তোমাকে জানালাম। তোমার মায়াতেই বিশ্বের সৃষ্টি, পালন আর সংহার, তুমি যার প্রতি তুষ্ট থাক, তার ভবের বন্ধন ঘুচে গিয়ে মোক্ষ লাভে গতি হয়।