১০. ধ্বনির মাহাত্ম্য প্রসঙ্গে বীরসেনের উপাখ্যান

ধ্বনির মাহাত্ম্য প্রসঙ্গে বীরসেনের উপাখ্যান

সিন্ধুদেশের মহারাজ বীরসেন যেমন বুদ্ধিমান, তেমনি বীর্যবান। গুরু আর গুরুজনগণের সেবা তার নিত্যকর্ম, সারা পৃথিবীতে যত রাজা, সকলেই তাঁর বশ্যতা স্বীকার করলেন।

কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, সেই রাজা বীরসেন রাজা শনির কোপে পড়ে খুব দুঃখ-দুর্দশা ভোগ করলেন। গুপ্তভাবে তার শত্রুগণ তাকে আক্রমণ করে রাজত্বসহ সব কেড়ে নিল। তখন রাজা বীরসেন প্রাণভয়ে রাজসিংহাসন ছেড়ে পালিয়ে গেলেন পাঞ্চালনগরে। পাঞ্চালরাজ প্রথমে তাকে চিনতেই পারলেন না, তারপর ভাল করে দেখে বললেন, কে মিত্র! তোমার এই বেশ কেন? অমিত বিক্রম বীরসেন ইন্দ্রতুল্য যাঁর খ্যাতি, তার কিনা এই অবস্থা!

বহুদিন পর বন্ধুকে দেখে খুব আদর আপ্যায়ন করলেন, তাঁর দুরাবস্থার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। রাজা বীরসেন অশ্রুসজল নয়নে বললেন–হে সখা, আমার দুর্ভাগ্যই আমাকে আজ এই অবস্থায় ফেলেছে। একদিন আমার শত্রুগণ আমার কাছে এল জীবিকার জন্য। গুপ্তভাবে এসেছে, আমি বুঝতেই পারিনি। তাদের গুণরাশি বিচার করে নানা পদে নিয়োগ করলাম।

তারপর তারা আমাকে নিরন্তরভাবে কুমন্ত্রণা দিতে আরম্ভ করল, তাদের কথা শুনতে শুনতে আমার ন্যায়জ্ঞান হারালো, বিচারশক্তি হারিয়ে ফেললাম।

তখন আমার পূর্বের যেসব মন্ত্রী আর বন্ধুবর্গ ছিল তারা আমার ব্যবহার দেখে খুব দুঃখ পেতে লাগল। এইরূপ চিন্তা করে তারা অতি দুঃখে আমাকে ছেড়ে যে যার নিজের ঘরে চলে গেল। শত্রুদের মনোবাসনা পূর্ণ হল, আমার ধনৈশ্বৰ্য্য কেড়ে নিয়ে সিংহাসন থেকে তাড়িয়ে দিল

আমাকে। তখন আমাকে রক্ষা করবার কেউ নেই, তাই রাত্রিবেলা গোপনে অতিকষ্টে তোমার কাছে। এলাম। এখন বন্ধু তুমিই আমাকে রক্ষা কর। বীরসেনের দুঃখের কাহিনি শুনে পাঞ্চালরাজ খুবই মর্মাহত হলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বন্ধুকে আশ্বাস দিয়ে বললেন, সখা কালের বিচিত্র গতি। তুমি এখন বিপদে পড়েছ, একদিন অবশ্যই তোমার শুভদিন আসবে। তবে ততদিন ধৈর্য ধরে আমার এখানেই থাক।

পাঞ্চাল রাজ্যে বীরসেন রয়ে গেলেন, কিন্তু ভাগ্য তার প্রতিকূল, তার সুখ, শান্তি কখনও হবে না। একদিন এক স্বর্ণকার পাঞ্চাল রাজের কাছে একটি সুন্দর কারুকার্য করা রত্নহার নিয়ে এল। সেইদিন রাজসভায় যত সভাসদ ছিল সকলেই সেই হারের প্রশংসা করল। রাজা বীরসেনও দেখলেন সেই হার। মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দিলেন। ইন্দ্রের সমান যাঁর ঐশ্বর্য ছিল–সে কিনা আজ দীন কাঙালের মত অন্যের আশ্রয়ে কালযাপন করছে। এদিকে পাঞ্চালরাজ বীরসেনকে বিষণ্ণভাবে বসে থাকতে দেখে নিজেই সিংহাসন থেকে উঠে তার কাজে গিয়ে তার হাত ধরে বললেন, সখা, এই হার তোমার গলায় সুন্দর মানাবে।

এই কথা বলে তিনি নিজে সেই রত্নহার পরিয়ে দিলেন সিন্ধুরাজ বীরসেনের গলায়। সভাসদগণ সবাই অবাক, পাঞ্চাল রাজের বহু প্রশংসা করল সকলেই, একেই বলে প্রকৃত সখ্যতা।

কিন্তু যারা অসৎ লোক, সিন্ধুরাজের সৌভাগ্য দেখে জ্বলতে লাগল –যে হার রানির জন্য আনা হল আর তার গলায় মানাবেও ভাল, তাকে না দিয়ে দেওয়া হল কিনা এক হতভাগ্যের গলায়! পাঞ্চাল রাজের এমন মিত্ৰতা দেখে সিন্ধুরাজও খুবই আশ্চর্য হলেন। তারপর বীরসেন বন্ধুকে বললেন–সখা, ত্রিভুবনে এমন বন্ধুপ্রীতি কখনও কোথাও শুনিনি। এবার আমার কথা রাখ–এই হার তুমি রানির গলায় পরাও, তাহলে আমি খুব খুশি হব।

তখন পাঞ্চালরাজ হাসতে হাসতে বললেন–সখা, তুমি একি বলছ? সামান্য একটা হার তোমাকে দিতে পারি না? তোমার জন্য আমি আমার সমগ্র রাজ্য দিতে পারি, যে হার তোমাকে দিলাম, তা আমি কখনও ফিরিয়ে নিতে পারি না। আমি তোমার জন্য বনেও যেতে পারি, এমনকি তোমার জন্য প্রাণও দিতে পারি।

এই কথা বলে পাঞ্চালরাজের সজল নয়নে অশ্রুধারা ঝরতে লাগল। সিন্ধুরাজ তাঁর বসন দিয়ে তার চোখের জল মুছিয়ে দিলেন। এমন সময় সঞ্জয় নামে সিন্ধুরাজের এক ভৃত্য যে প্রভুর একান্ত অনুগত, তাঁরই সঙ্গে লুকিয়ে এসেছে পাঞ্চালরাজ্যে, সব সময় বীরসেনের কাছেই থাকত, সহসা এসে বলল–মহারাজ, এক অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটল এইমাত্র। এখুনি আমাকে যে হারটা রাখতে দিলেন, সেটা আমি দেওয়ালে পোঁতা গজদন্তের উপর ঝুলিয়ে রাখলাম। আর তখনই সেই দেওয়ালে আঁকা একটি ময়ুর সহসা জীবন্ত হয়ে উঠল আর সেই হারটিকে খেয়ে নিল। তারপর যেমন ময়ুর মূর্তি, তেমনিই হয়ে গেল। হে মহারাজ, এ এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। আপনার চরণ ছুঁয়ে আমি শপথ করে সত্যই বলছি। সঞ্জয়ের কথা শুনে পাঞ্চালরাজ স্তম্ভিত হলেন। তারপর বীরসেনকে বললেন, হে সখা, এই যে অদ্ভুত কাণ্ড শুনলাম, এ বিষয়ে তোমার কি অভিমত বল। সঞ্জয় যা বলল তা যদি সত্যি হয়, তাহলে খেদ করার কিছুই নেই। তুমি দুঃখ কোরো না।

বন্ধুর কথা শুনে বীরসেন কাঁদতে কাঁদতে বললেন, এ বিষয়ে ভৃত্যের কোন দোষ নেই। আমার ভাগ্য এখন প্রতিকূলে তাই এমন সব ঘটনা ঘটেছে। কাল বিধিই ময়ূরের মূর্তি ধরে সেই রত্নহার গ্রাস করল। আমার এই ভৃত্য কখনই মিথ্যা কথা বলতে পারে না। মহা ধার্মিক এই ভৃত্য। বিধির বিড়ম্বনার জন্য এমন ঘটছে।

এইভাবে কথা বলে বীরসেন বিলাপ করতে লাগলেন। তখন পাঞ্চালরাজ বললেন, দুঃখ কোরো না বন্ধু, তুমি আমার কথা শোন। আমি প্রতিজ্ঞা করছি, যারা অহং শঠতাকারে আমার সখার রাজ্য হরণ করল, সেই দূরাচারদের আমি বিনাশ করব।

তারপর তিনি সেনাপতিদের যুদ্ধের আয়োজন করার জন্য আদেশ করলেন। সহসা আশ্চর্যভাবে এক আকাশবাণী হল–শোন পাঞ্চালেশ্বর, তুমি প্রকৃত ক্ষত্রিয়, কিন্তু আমার একটি কথা শোন। আগামীকাল প্রভাতে তুমি মন্ত্রী-সেনাপতিদের নিয়ে মৃগয়া করবার জন্য বিন্ধ্যাগিরি বনে যাবে। সিন্ধুরাজও যাবে। সেখানে দেখতে পাবে কিরাত জাতির লোকজন আছে। তাদের মুখে শনির মাহাত্ম্য শুনবে, আর তার পূজা করবে। তাতে সিন্ধুরাজের কল্যাণ হবে। কিরাতরাজের সঙ্গে তার মিলন হবে। এইভাবে আমার আদেশ যদি পালন কর, তাহলে সিন্ধুরাজ তার রাজ্য ফিরে পাবে।

পরদিন আকাশবাণীর উপদেশমত সবাই বেরিয়ে পড়ল সৈন্য সামন্ত নিয়ে। বিন্ধ্যগিরি বনে শিবির পাতলেন, কিছু মৃগয়াও করলেন। রাজা ফিরে এলেন শিবিরে, শিপ্রা নদীর তীরে শিবির নির্মাণ করে বিশ্রাম করছেন। এমন সময় কিরাতরাজ কয়েকজন লোক সঙ্গে নিয়ে তাঁদের সামনে এসে দাঁড়াল হাতজোড় করে। দুই রাজা তো অবাক, কে ইনি? কিরাতরাজের এক অনুচর তার পরিচয় দিয়ে বললেন–ইনি কিরাতরাজ। ইনি পরম ধার্মিক মহাবীর, তখন পাঞ্চালরাজ ও সিন্ধুরাজ আসন ছেড়ে উঠে কিরাতরাজের কুশলাদি জিজ্ঞাসা করে আলিঙ্গন করলেন।

তারপর কিরাতরাজের কিছু অনুচর সিন্ধুরাজের দিকে তাকিয়ে, সহসা তাঁর চরণে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল–হে নাথ, আপনাকে বহুকাল পরে দেখতে পেলাম। আপনি আমাদেরকে পিতার সমান পালন করতেন। এই দাসগণকে ছেড়ে আর যাবেন না।

মহারাজ বীরসেন দেখলেন, তাঁরই সব সামন্তরাজগণ তাঁর পদতলে পড়ে এমনভাবে কাঁদছে। তখন তিনিও অঝোর নয়নে কাঁদতে লাগলেন। তারপর ধৈর্য্য ধরে বললেন, বড়ই আশ্চর্য দৈবগতি, আমরা তার কিছুই বুঝি না। ভাগ্যে আরও কী ঘটবে কে জানে। তোমরা আমার সামন্তরাজা, সবাই মহাবীর, তথাপি কতই কষ্ট ভোগ করছ, জানি না আমার কপালে আর কি আছে, আমার যখন তোমাদের সঙ্গ ত্যাগ হল তারপর তোমরা এতদিন কোথায় ছিলে? আমার যেসব দক্ষ সেনাপতি ছিল তারা এখন কোথায়? আমার প্রভুভক্ত যেসব সৈন্য ছিল তারাও এখন কোথায় আছে? তাদের জীবিকা কেমন করে চলছে?

এখন সব নানাবিধ প্রশ্ন করে মহারাজ বীরসেন কাঁদতে লাগলেন। তখন সেইসব সামন্ত রাজগণ সিন্ধুরাজকে বললেন, এই যে আপনার সামনে কিরাতরাজ, ইনি মহাবীর্যবান, পরম দয়ালু সত্যগন্ধ পরোপকারী।

হে মহারাজ, আপনি যখন শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলেন, আমরা সৈন্য নিয়ে আপনাকে সাহায্য করতে গেলাম কিন্তু যখন শুনলাম আপনার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না, তখন আমরা ভগ্ন মনোরথে ফিরে এলাম, তারপর আমরা সিন্ধুদেশ ছেড়ে গোপনে বনে বাস করতে লাগলাম। তারপর ভাবলাম, সিন্ধুরাজ সাধারণ পুরুষ নয়, নিশ্চয় তিনি কোথাও আছেন, আমরা গোপনে খোঁজ করতে লাগলাম। বহু দেশ ঘুরতে ঘুরতে এলাম এই কিরাতনগরে, কিরাতরাজ আমাদের বিষণ্ণ দেখে আমাদের পরিচয় জানতে চাইলেন।

তারপর পরিচয় জেনে খুব যত্নে পুত্রবৎ আমাদের পালন করতে লাগলেন, আমরা খুব সুখে আছি। কিন্তু আপনার জন্য সবসময় চিন্তা হত। আর একটা কথা, আমরা যখন বনে পালিয়ে যাই, তখন পথে মহারানির সঙ্গে আমাদের দেখা হয়, তাকেও আমরা সঙ্গে করে নিয়ে এলাম এই কিরাতের ভবনে। তিনি আপনার বিরহে সর্বদা কাতর। আমরা আপনার পুত্রের সমান, রানিমাকে সবসময় সান্ত্বনা দিই, কিরাতপতি তাঁকে যত্নে রেখেছেন, তাকে মায়ের মতন শ্রদ্ধা করেন, আপনার দর্শন পাবেন এই আশাতেই রানিমা এখনও জীবনধারণ করে আছেন।

তারপর কিরাতরাজ হাতজোড় করে সিন্ধুরাজ ও পাঞ্চালরাজকে বললেন, আমি দুজনের শরণ নিলাম। এই অধীনের ঘরে আপনারা আসুন।

কিরাতরাজের কথা শুনে সিন্ধুরাজ বীরসেন আপন রানির চন্দ্রমুখ দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়লেন। রাজাকে নিয়ে কিরাতনগরে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে চলল সকল সৈন্য সামন্ত।

তারপর কিরাতরাজ তার সেনাপতিকে আদেশ করলেন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে। সৈন্যরা সকলে যেন উপস্থিত হন।

এদিকে বীরসেনের মহিষী দূতমুখে স্বামীর আসার খবর পেয়ে তাকে দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন। এমন সময় বীরসেন প্রবেশ করলেন। উভয়ের দৃষ্টি বিনিময় হল দীর্ঘকাল পরে। রাজরানির হৃদয়ে শান্তি দান করলেন।

তারপর রানি রাজাকে বললেন, হে মহারাজ, তুমি ভক্তিভরে শনিদেবের পূজা কর, মার্কণ্ডেয় মুনির মুখে আমি শনি পূজার বিধি শুনেছি।

এই বলে রানি রাজাকে পূজার বিধান জানিয়ে দিলেন। তখন মহারাজ বীরসেন একান্ত অন্তরে বিধি অনুসারে শনিবারে শনিদেবের পূজা করলেন, শনিদেবের অনেক স্তব স্তুতি করলেন।

সূর্যের পুত্র শনি সেই পূজায় তুষ্ট হয়ে দিব্যমূর্তি ধরে রাজাকে দেখা দিলেন। সেই মূর্তি দেখে রাজা আনন্দে মাটিতে পড়ে প্রণাম করলেন।

শনিদেব রাজা বীরসেনের পূজায় সন্তুষ্ট হয়ে বর দিলেন। বীরসেন তুমি তোমার “হারানো রাজ্য ফিরে পাবে।” তারপর তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন। কিরাতরাজ সিন্ধুরাজের বরলাভের বিষয় জেনে তাকে বললেন–গ্রহরাজ যখন সন্তুষ্ট হয়েছেন তাহলে আপনার মনোরথ নিশ্চয় সিদ্ধ হবে। এই বলে কিরাতরাজ নিজের সৈন্যদের নিয়ে পাঞ্চালরাজের সৈন্যদের সাথে মিলন করিয়ে দিলেন। এবং সিন্ধুনগরে উপনীত হলেন। রাজপুরী থেকে এক ক্রোশ দূরে তারা শিবির গঠন করলেন।

সিন্ধুরাজকে পরাজিত করে নিষ্ঠুর যবনরাজ সিংহাসন অধিকার করে বসেছিলেন। এখন চরমুখে খবর পেয়ে কিরাত ও পাঞ্চাল রাজের আক্রমণ রুখতে নিজেদের সৈন্যদলকে সংঘবদ্ধ করে বাধা দেবার চেষ্টা করলেন। শুরু হল যুদ্ধ। অগ্নিসম শত্রুগণ মহাতেজ ধরে সহস্র বছর রণক্ষেত্রে মহাবল ক্ষত্রিয়দান যবনগণকে নানাভাবে বিধ্বস্ত করল।

এমন সময় দিব্যরূপা ষোড়শী, মুক্তকেশী, নীলাম্বর পরিধান করে দানবদলনী চণ্ডী সেই যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হলেন। তারপর দিব্য ধনুকের সাহায্যে বাণ মেরে অসংখ্য যবন সৈন্যকে বিনাশ করলেন। তা দেখে যবন সৈন্যরা ক্রোধভরে দেবীকে বিনাশ করবার জন্য ঘন ঘন শর মারতে লাগল। তখন পাঞ্চাল আর কিরাত সৈন্যগণ যবন সৈন্য নাশে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে ভীষণভাবে যুদ্ধ করতে লাগলেন। প্রলয়ে ধরণী যেমন কাপে সেইভাবে রণক্ষেত্র কাঁপতে লাগল এই যুদ্ধে। সেই পরমা সুন্দরী বদনা চণ্ডী আসলে কিরাতরাজের কন্যা, যুদ্ধক্ষেত্রে রমণীকে দেখে যবনরাজ কামার্ত হয়ে বললেন, হে সুন্দরী, তোমাকে যোদ্ধার বেশে মানায় না। আমার প্রাসাদে অন্তঃপুরস্থ সব সুন্দরীর থেকে তুমি সুন্দরী, আমার কাছে। এস।

যবনরাজের কথা শুনে সিন্ধুরাজ বীরসেন ভীষণভাবে ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁর দিকে বাণ ছুঁড়তে লাগলেন। এখন সমস্ত যবন সৈন্য এক হয়ে সিন্ধুরাজকে বিনাশ করবার চেষ্টা করল।

এদিকে কিরাতকন্যা যবনরাজের কথা শুনে রাগে অপমানে বক্ষশির অস্ত্র ছুঁড়ে মারলেন তাঁর উপর। যবনরাজ সেই বাণের তেজে ভস্মীভূত হয়ে গেল।

যবনরাজের পতনের পর তার ভাই এল যুদ্ধক্ষেত্রে। ভ্রাতৃহত্যার রাগে কিরাতরাজের দিকে এগিয়ে নানা বাণ ছুঁড়ল। কিরাতরাজও রথ নিয়ে তার কাছে এলেন, তখন যবন একটা বিশাল গদা ছুঁড়ে মারলেন কিরাতরাজের দিকে, কিরাতরাজ অতি সহজেই সেই গদা হাতে ধরে নিলেন আর ছুঁড়ে মারলেন যবনের দিকে। যবনের সেনাপতি মরল সেই আঘাতে, কিন্তু যবনরাজের ভাই মরল না। দেখে কিরাতের কন্যা একটা শূল ধরে মন্ত্রপুত করে ছুঁড়ে দিলেন, মেঘের মত গর্জন করে সেই শূল পড়ল যবনের মাথায়, রক্তবমি করতে করতে মারা গেল সে, সিন্ধুরাজ রাগে খড়গ দিয়ে তার মাথাটা কেটে ফেললেন।

যবন সৈন্য অল্প কিছু বেঁচে ছিল, তারা এই অবস্থা দেখে যে যেদিকে পারল ছুটে পালিয়ে গেল। ক্ষত্রিয়গণ পিছু ধাওয়া করে সকলকেই মেরে ফেলল।

জয় হল সিন্ধুরাজের। কিরাতরাজকে আলিঙ্গন করলেন, তারপর পাঞ্চালরাজকেও আলিঙ্গন করলেন।

কিরাতরাজের কন্যা যুদ্ধক্ষেত্রে এমনভাবে যুদ্ধ করল যে কিরাতরাজ অবাক হয়ে গেলেন।

মেয়ে কোথায় শিখল এমন যুদ্ধ? গর্বিত পিতা জিজ্ঞাসা করলেন, এমন যুদ্ধ তুমি কোথায় শিখলে? তোমার যুদ্ধ দেখে মনে হল এ কোন মানবীর পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু একটা কথা বলি যখন সিন্ধুরাজ আমার অন্তঃপুরে আসেন রানিকে দেখবার জন্য, তখন তুমি তাকে দেখে অনুরক্তা হয়েছিলে, এখন আমার ইচ্ছা তোমাকে সেই সিন্ধুরাজের হাতে তুলে দিই।

কন্যা আর কি বলবে? লজ্জায় মাথা নত করে থাকল, তারপর কিরাতরাজ সিন্ধুরাজকে সব কথা জানিয়ে কন্যার সঙ্গে বিয়ে দিলেন মহা ধুমধামে।

তারপর সিন্ধুরাজ দুই পত্নীকে নিয়ে সবার কাছে বিদায় নিয়ে সিংহাসনে বসলেন। সকল সামন্তরাজাগণ নতশিরে তাঁকে রাজপদে বন্দনা করলেন, সিন্ধুনগরী আনন্দে মুখরিত হল।

সিন্ধুরাজ বীরসেন কুলগুরুর কাছে শনি মন্ত্র গ্রহণ করে প্রতি শনিবারে গ্রহরাজের পুজো করতে লাগলেন।