০৯. ত্রিপুর নাশন

ত্রিপুর নাশন

শিবপুত্র কার্তিকের দ্বারা তারকাসুরের বিনাশ হল, তারকের তিন পুত্র বিদ্যুশালী, তারকাক্ষ আর। বামলাক্ষ। তারা মহাধার্মিক, শক্তিতেও কম নয়। তারা মাটিতে এক পা আর উপরের দিকে এক পা রেখে হাজার বছর কেবল বাতাস খেয়েই কঠোর তপস্যা করল। ব্রহ্মা বর দিতে এলেন তাদের কাছে।

তিন অসুরই এক সঙ্গে বলল–আমরা কারো দ্বারা বধ হবনা, এই বর দিন।

ব্রহ্মা বললেন–তা কখনও হয় না, এমন বর দেওয়া যাবে না, অন্য বর চাও।

অসুররা বলল–সোনা, রূপা আর লোহার দ্বারা তৈরি তিনটি পুরী আমাদের দান করুন, আর সেই তিনটি পুরী কেবল একটি বাণের দ্বারাই বিনষ্ট হবে। ব্রহ্মা সেই বরই দিলেন। ব্রহ্মা ময়দানবের দ্বারা তিনটি পুরী তৈরি করালেন। তারপর স্বর্গপুরে রাখলেন সোনার পুরী, আকাশে রাখলেন রূপার পুরী আর পৃথিবীতে রাখলেন লোহার পুরী। প্রত্যেকটি পুরীই অপূর্ব সুন্দর। তারকাক্ষ নিল সোনার পুরী। বামলাক্ষ নিল রূপার পুরী আর বিদ্যুশালী বাস করল লোহার পুরীতে।

খাওয়া-দাওয়া, ঘুমান, নাচ-গানের আসর, পানশালা, সভাগৃহ কোনো কিছুরই অভাব নেই কোনো পুরীতে। গন্ধর্ব, চারণ, সিদ্ধ প্রভৃতি সকলেই সেথায় আমোদ-প্রমোদে মেতে থাকল, আর যত প্রকারের ধর্ম আছে সবই সেই তিনপুরীতে।

এইভাবে সেই তিন দৈত্যের কারণে দেবতারা জ্বলেপুড়ে মরছে, ব্রহ্মার কাছে গিয়ে দুঃখের কথা জানালেন।

দেবতাদের কথা শুনে শিব বললেন–দেবতাগণ, তোমাদের দুঃখ আমি বুঝি, কিন্তু যাদের পুণ্য সবসময়েই বাড়ছে তাদেরকে বিনাশ করব কেমন করে? আর তা উচিতও নয়। তবে তোমরা শ্রীহরির কাছে যাও, তিনি কোনো উপায় বলে দিতে পারেন।

তখন দেবতাগণ শ্রীহরির কাছে গিয়ে সব কথা বলল, গোবিন্দ উত্তরে বললেন–সনাতন ধর্ম যেখানে থাকে, সেখানে দুঃখ কখনই স্থান পায় না।

শ্রীহরির কথা শুনে দেবতাগণ বিষণ্ণ হলেন। তারা বললেন–ত্রিপুর থাকলে আমরা কেমন করে বাস করব?

তখন শ্রীহরি বললেন–বহু পাপ করেও যদি কেউ শিবের পূজা করে তাহলে তার সমস্ত পাপ নষ্ট হয়ে যাবে। দৈত্যরা লিঙ্গ পূজা করে পাপহীন হয়ে ভোগী হয়েছে। তাদের ধর্ম বিঘ্ন না হলে, তাদেরকে ধ্বংস করা যাবে না, তাই আমি আমার মায়াবলে তাদের ধর্ম নাশ করে তিন দৈত্যকে বিনাশ করব।

হরির মুখে আশ্বাস পেয়ে দেবতাগণ ফিরে গেল যে যার নিজের স্থানে। শ্রীহরি দৈত্যদের বিনাশের জন্য মায়াময় মানব সৃষ্টি করলেন। তার মাথা নেড়া, গায়ে মলিন বসন। তারপর ভগবান তাকে মায়াময় শাস্ত্র শিক্ষা দিয়ে বললেন–তুমি ত্রিপুরে গিয়ে সবাইকে এই শাস্ত্র শিখাবে।

তখন সেই পুরুষ হরিকে প্রণাম করে চলে গেলেন ত্রিপুরে। একটি বনের ধারে গিয়ে তিনি বসলেন, সে তাকে দেখল এবং মায়ামুগ্ধ হয়ে গেল। সবাই তার কাছে দীক্ষা নিল। তারপর তারা বিদ্যুন্মালীর কাছে গিয়ে বলল–আমরা পূর্বে অনেক ধর্ম শুনেছি কিন্তু এমন সনাতন ধর্ম কখনো শুনিনি। এক ধর্মপরায়ণ সন্ন্যাসী এসেছেন, সেই ধর্ম প্রচার করতে। আমরা তার কাছে সকলেই দীক্ষা নিয়েছি। হে রাজা আপনিও তার কাছে দীক্ষা নিতে পারবেন।

তখন বিদ্যুন্মালী সেই পুরুষের কাছে গিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেল। দীক্ষাও নিতে চাইল। সেই পুরুষ তখন বললেন–হে দানব রাজ, আমি যা আদেশ করব, তোমাকে তা বিনা দ্বিধায় পালন করতে হবে। আগে বল, তা পারবে কিনা?

তখন দানবরাজ তার মায়ায় পড়ে স্বীকার করল, তার সকল কথাই পালন করবে। সেই সন্ন্যাসী তখন দানবকে নির্জনে নিয়ে গিয়ে যাতে তার ধর্ম নাশ হবে এই উপদেশ দিলেন। এইভাবে সেই পুরুষের কাছে সবাই দীক্ষিত হয়ে ধর্মচ্যুতি হল, শিবপূজা, যজ্ঞ, স্নান, দানাদি সকল কর্মই নাশ হল। তখন ত্রিপুরে অলক্ষী প্রভাব বিস্তার করল, আর লক্ষ্মী তাদেরকে ছেড়ে চলে গেলেন।

দানবগণ এইভাবে দুরাচারী হলে শ্রীহরি আনন্দে দেবতাগণকে সঙ্গে নিয়ে শিবের কাছে গিয়ে তার বহু স্তব স্তুতি করলেন। তখন মহেশ্বর খুব খুশি হয়ে শ্রীহরিকে আলিঙ্গন করে বললেন–আমি ত্রিপুর নাশ করব। আর তোমাদের কোনো চিন্তা নাই, যে যার স্থানে ফিরে যাও।

তারপর শিব বিশ্বকর্মার দ্বারা এক দিব্যময় রথ সৃষ্টি করলেন। অপূর্ব সেই রথ। সোনার তৈরি। তার ডানদিকে সূর্যচক্র, বামদিকে চন্দ্রচক্র, সেই রথের সারথি হলেন স্বয়ং পিতামহ ব্রহ্মা। তারপর মহেশ্বর নানাবিধ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অপূর্ব যুদ্ধ সাজে সজ্জিত হয়ে সেই বিচিত্র রথে চড়ে বসলেন। ত্রিপুরের দিকে চললেন সবেগে। দেবতারাও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে শিবের পেছনে পেছনে চললেন। তারপর সকলেই তুমুল হর্ষধ্বনি করলেন, তখন শিব তার পিনাক ধনুতে পাশুপাত অস্ত্র যোজনা করলেন, একমাত্র বাণেই ত্রিপুর ধ্বংস হয়ে গেল। যে দৈত্যগণ তখনও পর্যন্ত শিবের পূজা করছিল, তারা শিবের প্রভাবে গাণপত্য লাভ করল। তারপর ভক্তিভরে দেবতাগণ ত্রিপুরারি মহেশ্বরের স্তব-স্তুতি করলেন।