০১. শিব কর্তৃক মদন ভস্ম

দেবর্ষি নারদ ঢেঁকিতে চড়েন। ঢেঁকিতে চেপে চৌদ্দ ভুবন ঘুরে ঘুরে বেড়ান। বহু শিবলিঙ্গ দেখে পর পর পূজা করলেন। তারপর তার মনে মহাত্মা শিবের তত্ত্ব জানবার ইচ্ছা হলো। মহেশ্বরের রূপ মনে করতে করতে ব্রহ্মার কাছে নিয়ে এবং মনোবাসনা নিবেদন করলে প্রজাপতি ব্রহ্মা পাপবিনাশকারী শিবতত্ত্ব প্রকাশ করলেন।

পরবর্তীকালে সেই তত্ত্ব দেবর্ষি নারদ তার শিষ্য মহামুনি বেদব্যাসকে শিক্ষা দেন। শিষ্য সূত মুনিকে তিনি সেই তত্ত্ব কথা অবগত করান। সূত মুনি পরবর্তীকালে নৈমিষারণ্যবাসী মুনিগণের প্রশ্নের উত্তরে দেবাদিদেব মহেশ্বরের সব বিচিত্র লীলা কীর্তন করেন।

জগতে কিরূপে নির্গুণ মহেশ্বর সগুণ হলেন? জগৎ সৃষ্টির আগে জগতের স্থিতিকালে আর প্রলয় হলে তিনি কিভাবে থাকেন? তিনি কিভাবে প্রসন্ন হন, প্রসন্ন হলে কেমন ফলদান করেন? এইসব প্রশ্নের উত্তর এবং নানা তত্ত্বকথা এই শিব পুরাণে বর্ণিত হয়েছে।

.

শিব কর্তৃক মদন ভস্ম

সতী প্রাণত্যাগ করেন পিতা দক্ষ রাজার যজ্ঞ সভায়। প্রাণপ্রিয়া পত্নীর আত্মাহুতির সংবাদে পত্নীবিরহ কাতর শিব উন্মত্ত হয়ে ধ্বংসলীলায় মেতে ওঠেন। শিব উন্মত্ত হয়ে তারপরে বসে পড়েন তপস্যায়।

তারকাসুর এদিকে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে, দাপিয়ে বেড়াচ্ছে স্বর্গমর্ত, রসাতল। তাকে কিছুতেই দেবতারা দমন করতে পারছেন না। ব্রহ্মা জানিয়ে দিয়েছেন যে একমাত্র শিবের পুত্র ছাড়া আর কেউ তারকাসুরকে বিনাশ করতে পারবে না।

দেবতারা চিন্তায় পড়ে গেলেন। সতী এখন নেই। শিবের পুত্র তাহলে হবে কী করে?

হিমালয়ের কন্যারূপে জন্ম নিয়েছেন। তার নাম পার্বতী। তিনি শিবকে স্বামীরূপে পাওয়ার জন্য তপস্যা করেছেন। তখন শিবও পরম ব্রহ্মের তপস্যায় মগ্ন।

তখন দেবতারা চিন্তা করলেন, শিবের ধ্যান যে করেই হোক ভাঙাতে হবে। কিন্তু কেমন করে? শিবের ধ্যান ভাঙলে তিনি যদি ক্রুদ্ধ হন তাহলে ত্রিভুবন ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। তখন দেবরাজ ইন্দ্র সব দেবতাকে বললেন– একমাত্র মদনই পারে এই কাজটি করতে।

দেবরাজ সঙ্গে সঙ্গে মদনকে স্মরণ করলেন। তখন মদন এবং তার স্ত্রী রতি স্বর্গসভায় এসে হাজির হলেন। হাত জোড় করলেন এবং ইন্দ্রের প্রতি বললেন–দেবরাজ, আমাকে স্মরণ করার কারণ কি? আমাকে কি করতে হবে?

মদনের কথায় ইন্দ্র খুব খুশি হন। মদনের বহু প্রশংসা করলেন এবং বললেন–মদন, আমার অনেক বন্ধু আছে কিন্তু তোমার মত কেউ নয়। পরমেশ্বর দুটি অস্ত্র তৈরি করেছেন, আমার জন্য একটি বজ্র, তার দ্বারা হিংসা প্রকাশ পায়। আর একটি অস্ত্র হলে তুমি, খুব সুখকর। তুমিই শ্রেষ্ঠ। বজ্র কখনো কখনো নিষ্ফল হয়, কিন্তু তুমি সর্বদাই সফল।

–শোন মদন অনেকদিন ধরে আমার মনে একটি দুঃখ আছে। সেই দুঃখ তুমি ছাড়া আর কেউ দূর করতে পারবে না। তাই তোমাকে ডাকলাম। তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। আমার একার জন্য সেই কাজটি নয়, দেবতাদের মঙ্গলের জন্য ও ত্রিভুবনের সুখের জন্য সেই কাজ করবে।

দেবরাজের মুখে প্রশংসা বাক্য শুনলেন মদন। তাতে তার অহংকার একটু বেড়ে গেল। গর্ব করে বললেন–হে দেবরাজ, যদি কোনো দেবতা, দানব কিংবা কোনো ঋষি বা রাজা আপনার পদ অধিকারের জন্য ঘোর তপস্যা করে তাহলে আমার পত্নী রতি তাদের সেই তপস্যা ভঙ্গ করে দেবে। আর যদি কোনো মানুষকে পতিত করতে হয়, তার কাছে সেটা অতি তুচ্ছ ব্যাপার। অন্যের কথা আর কি বলব, স্বয়ং মহাদেবেরও ধৈৰ্য্যচ্যুতি করতে পারি।

কামদেবের এইসব গর্বভরা কথা শুনে ইন্দ্র মনে মনে খুশি হন। তিনি মদনদেবকে বললেন–মদন, তুমি আমার মনের কথাই বলেছ। তোমাকে যে কাজের জন্য ডেকেছি তা শোন। ব্রহ্মার কাছে বর পেয়ে তারক নামে এক দৈত্য ত্রিভুবনকে কষ্ট দিচ্ছে। সাধারণ উপায়ে তার মৃত্যুও সেখানে সম্ভব নয়।

মহাদেবের পুত্রের হাতেই সেই অসুরের মৃত্যু হবে। কিন্তু মহাদেব এখন ধ্যানমগ্ন। দেবী পার্বতী তাকে স্বামীরূপে পাওয়ার জন্য কঠোর তপস্যায় রত। পার্বতীর প্রতি শঙ্করের যাতে কামভাব জাগে তারই ব্যবস্থা করতে হবে। ত্রিভুবনে আপনার যশ ঘোষণা হবে, আপনি এই কাজে সফল হলে, আমাদের সবার দুঃখের অবসান হবে।

ইন্দ্রের কথা শুনে মদনদেব গর্ব করে বললেন, এটা কোনো ব্যাপারই না। আমি এক্ষুনিই যাচ্ছি সেই কাজ করতে। এই কথা বলে মদন চলে গেলেন। রতিকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন হিমালয় শিখরে। সেখানে তপস্যা করছেন শিব। শিবের বাম পাশে মদন রতির সঙ্গে পুষ্প ধনুতে সম্মোহন বাণ যোগ করে অপেক্ষা করতে লাগলেন।

সেই সময় পার্বতী নানা ফুলের অলংকারে আভূষিত হয়ে তার দুই সখীর সঙ্গে শিবের কাছে। গেলেন তাকে পূজা করার জন্য।

মহেশ্বরের সামনে দেবীকে দেখেই মদন বাণ ছুঁড়ল। কি আশ্চর্য ব্যাপার যে, সেই বাণ পুনরায় তার নিজের কাছে চলে এল। তখন পার্বতী মহাদেবকে প্রণাম করলেন এবং পূজাও করলেন।

মহাদেব তখন ধীরে ধীরে চোখ খুললেন। গৌরীকে সামনে দেখে আশ্চর্য হলেন। বললেন, একি! এমন সুন্দর রূপ কি কারোর হয়। এতে মুখ নয়, চাঁদ। এই চোখ তো চোখ নয়, পদ্মফুল। এই ভ্রূকুটি যেন কন্দর্পের ধনুক। অধর যেন পক্ক বিম্বফল। আর নাসিকা শুকপাখির ঠোঁটের মত। কোকিলের স্বরের মত এর কণ্ঠস্বর। এর গতি আর রূপের বর্ণনা দেওয়া প্রায় অসম্ভব। এই পৃথিবীতে যতকিছু সুন্দর আছে তা সবই এই রমণীর সঙ্গে আছে।

এমন অপরূপ রূপ দেখে যাঁর ধ্যান ভেঙ্গে যায় তার কি ধ্যানে আর মন বসে? তখন তিনি পার্বতীর শাড়ির আঁচল ধরার জন্য হাত বাড়ালেন। পার্বথী লজ্জাবশতঃ একটু দূরে সরে দাঁড়ালেন। কিন্তু অপ্সরারা নানা হাবভাব প্রকাশ করে মহাদেবের দিকে তাকালেন।

পার্বতীর অভিসন্ধি বুঝতে পারলেন শঙ্কর। তখন তিনি মোহগ্রস্থ হলেন। আর মনে মনে ভাবলেন–এই রমণীর আলিঙ্গন সুখ অনুভব করব কিভাবে?

এইরকম কিছুক্ষণ চিন্তা করে তিনি ভাবলেন আমি কি মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েছি, আমি ঈশ্বর হয়ে পরনারী সঙ্গ কামনা করলাম? সাধারণ মানুষকে তাহলে কি আর দোষ দেবো?

চিন্তা করতে করতে মহাদেব আবার আসনে বসলেন। ধ্যান করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু কিছুতেই তিনি তা করতে পারলেন না। তখন চিন্তা করতে লাগলেন এরকম হবার কারণ কি? এর কোনো কারণ নিশ্চয় আছে। কারণ ছাড়া কোনো কিছু ঘটতে পারে না। এই চিন্তা করে তিনি তার চারদিকে তাকাতে লাগলেন। তখন তিনি দেখতে পেলেন তাঁর বামপাশে মদনদেব তাঁকে উদ্দেশ করে সম্মোহন বাণ মারার চেষ্টা করছেন।

তাকে দেখে শঙ্কর ভীষণভাবে রেগে গেলেন। আমি এমন দুর্ধর্ষ হয়েও মদনের কাছে হেরে গেলাম।

তখন তার তৃতীয় নয়ন থেকে ভয়ঙ্কর আগুন বেরোতে লাগল। আর সেই আগুনে জ্বলতে লাগল রতি ও মদন।

সেদিন রতির সঙ্গে দেবতারাও এসেছিলেন। শিবের এই ক্রোধ দেখে তারা চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ক্ষমা করুন, রক্ষা করুন। কিন্তু বলতে না বলতেই সব শেষ। মদনদেব পুড়ে ছাই হয়ে গেলেন। মদনের মৃত্যু দেখে দেবতারা দুঃখী হলেন। মহেশ্বর সেই আশ্রম ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে গেলেন। পার্বতীও তার সখীদের সঙ্গে পিত্রালয়ে চলে গেলেন।

রতি তার স্বামীকে পুড়তে দেখে অজ্ঞান হয়ে যান। তারপর জ্ঞান ফিরতে তিনি কাঁদতে থাকেন এবং কি করবেন, কোথায় যাবেন ভাবতে থাকেন। দেবতা আমার স্বামীকে ডেকে এনে এ কি করলেন হে প্রিয়? তুমি কোথায়? একবার তুমি দেখা দাও, আমার সঙ্গে কথা বল। তোমাকে ছাড়া, আমি বাঁচব কি করে?

রুদ্ররোষ কামদেবের এই পরিণতিতে রতি কাঁদতে কাঁদতে নিজের মাথায় চুল ছিঁড়তে লাগলেন। তারপর বললেন, আমারই কর্মফলে ব্রহ্মা আমাদের স্ত্রী-পুরুষের যোগ সহ্য করতে পারলেন না। তারপর ভাবলেন এ সংসারে কেউ তোমাকে দুঃখ দিতে পারবে না। কেউ কাউকে সুখও দিতে পারবে না। সকলকেই নিজের নিজের কর্মফল ভোগ করতে হয়।

রতির কান্নায় দেবতারা কাতর হয়ে পড়লেন। এবং ভাবলেন তাঁদেরই বুদ্ধিদোষে মদনদেবের এই করুণ পরিণতি হয়েছে। রতির দুঃখ সহ্য করা যাচ্ছে না এই কথা বলে তারা শিবের কাছে গেলেন। সেখানে গিয়ে তারা বহু স্তব স্তুতি করলেন। তারপর বললেন, হে প্রভু, কামদেব তার নিজের জন্য এই কাজ করেননি। তারকাসুরকে বিনাশ করার জন্যই এমন কাজ সে করেছে। এবং আমরাই তাকে এই কাজ করতে বলেছি। এখন রতি বিলাপ করছেন। হে শঙ্কর, তার প্রতি আপনি প্রসন্ন হোন। সতী পরজন্মে হিমালয় কন্যা রূপে জন্মেছে। এই গিরিরাজের গৃহেই তো সকল দেবতার সকল তীর্থই তো। তুমি এখানেই তপস্যা কর। শিবের কাছে গিয়ে কি লাভ? তোমার দেহ খুব কোমল। আর তপস্যা বেশ কঠিন। তাই তুমি গৃহেই থাক এবং এখানে যা সুলভ তাই কর।

মাতা মেনকার সব কথা শুনলেন পার্বতী। এইসব কথা শুনে তিনি লজ্জাশীলা হয়ে কিছু বলতে পারলেন না।

শেষ পর্যন্ত মাতা তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে অনুমতি দিলেন। পার্বতী আনন্দে দুই সখীকে নিয়ে পিতা ও মাতাকে প্রণাম করলেন। তারপরে হিমালয়ের এক নির্জন শৃঙ্গে চলে গেলেন তপস্যা করতে। পার্বতী তখন সূতীবস্ত্র ছেড়ে মোটা কর্কশ গাছের ছাল পরলেন। তারপর কঠিন তপস্যা শুরু করলেন।

একদিকে যখন সূর্যের প্রখর উত্তাপ, তখন চারদিকে আগুন জ্বালিয়ে সেই সূর্যের দিকে তাকিয়ে পার্বতী তপস্যা করতে লাগলেন। বর্ষার সময় মাটিতে বসে তপস্যা করলেন। শীতকালে জলের মধ্যে বসে তিনি কঠোর তপস্যা করতে লাগলেন।

যখন তিনি তপস্যা করছিলেন, তখন তিনি মাটিতে কতগুলি গাছ লাগালেন এবং তপ্তদিনে তাতে জল দেন। ক্রমে ক্রমে সেই গাছুগলি বড় হল এবং তাতে ফলও হল। সেই ফল দিয়ে উমা অতিথিদের সেবা করতে লাগলেন। উমা শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা কোনো কিছুকেই গ্রাহ্য করলেন না। তিনি তার কঠোর তপস্যা চালিয়ে গেলেন।

উমার সেই কঠিন তপস্যার কথা শুনে মুনি-ঋষিগণ অবাক হলেন। উমা কেমন তপস্যা করছে দেখার জন্য তারা গেলেন উমার কাছে। সবকিছু দেখে বললেন, অন্যেরা যে তপস্যা করে তা এর কাছে। কিছুই নয়।

পার্বতীর আশ্রমে নানা হিংস্র পশু যেমন বাঘ সিংহ ছিল তারা তার তপস্যার প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে হিংসা ভুলে যায়। তারা কেউ কাউকে কষ্ট দিত না। হিমালয়-এর শৃঙ্গটির নাম হল গৌরীতীর্থ।

দেবতাগণ ও দেবর্ষি নারদ মহাদেবের কাছে গেলেন। এবং নানা স্তব স্তুতি করতে লাগলেন। তারপর তাঁরা বললেন, হে মহাদেব, পার্বতী খুব কঠিন তপস্যা করছেন। সেই তপস্যা দেবদানবের দুর্লভ। আপনি সন্তুষ্ট হন এবং তপস্যার ফলদান করুন।

মহাদেব তখন বললেন, দেবতারাও কঠিন তপস্যা করে আমার দর্শন পান না। কিন্তু আমি পার্বতীর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়েছি। আপনাদের কথা আমি নিশ্চয় রাখবো। আপনারা এখন যান।

দেবতারা মহাদেবের কথা শুনলেন। তারপর প্রসন্নচিত্তে শঙ্কর বললেন–যা হবার তা হয়ে গেছে। তবে যতক্ষণ না রুক্মিণী পতি দ্বারকায় পুত্র উৎপাদন না করেন, ততকাল মদন অনাত্ম হয়ে থাকবে অর্থাৎ দেহহীন অবস্থায় থাকবে। তারপরে রুক্মিণীদেবীর গর্ভে মদন জন্মগ্রহণ করবে। তখন তার নাম হবে প্রদ্যুম্ন।

মারাসুর তাকে হরণ করে সমুদ্রের মাঝে এক নগরে নিয়ে যাবে। সেই নগরে রতি বাস করবেন। পরে কামদেবের সঙ্গে তার মিলন হবে। সাম্ব রাক্ষসকে বধ করে প্রদ্যুম্ন রতিকে নিয়ে ফিরে আসবে। শিব এই বলে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। দেবতারা রতির কাছে এলেন এবং মহাদেবের ভবিষ্যৎবাণী শুনিয়ে

তাকে আশ্বস্ত করলেন। তারপর রতি নগরে গেলেন। স্বামীর প্রতীক্ষা করতে লাগলেন।