কিমলিস

কিম্‌লিস

সন্ধ্যা হয় হয়, তবু হয়নি। এখনও আকাশ ভরে নামেনি তার কালো ছায়া। পশ্চিম দিকের রাবিশ ও ঘেঁষ ফেলা চওড়া সড়কটার মোড়ে দাঁড়ালে দেখা যায়, গঙ্গার স্বচ্ছ জলে পড়েছে পড়ন্ত বেলার আকাশের ছায়া। আকাশেরই ছায়া, কারণ সূর্য ডুবে গিয়েছে। নির্মেঘ আকাশের কোলে গাঢ় লালিমা। ওপারের কারখানাটার পেছনে এই মাত্র ডুবেছে সূর্য। আকাশের প্রতিবিম্ব জলে পড়ে গঙ্গাকে দেখাচ্ছে যেন তাতানো ইস্পাতের মতো। ঢালাই ইস্পাতের জুড়িয়ে আসার মতো গঙ্গার পুব কোল জুড়ে নীলচে ঝিলিক দিচ্ছে।

শীতকাল। মাঘ মাস। জনশূন্য গঙ্গার ধার। দু-চারটে নৌকো মন্থর গতিতে উত্তরে কিংবা দক্ষিণে চলেছে। জেলে নৌকো নয়, ব্যবসায়ী। সড়কটার ডান পাশ জুড়ে একটা সুদীর্ঘ বস্তি। ছিটে বেড়ার গায়ে মাটির প্রলেপ। মাথায় খোলা ছাওয়া। দূর থেকে দেখলে বোঝা যায়, সমস্ত বস্তিটা পশ্চিম দিকে ঝুঁকে পড়েছে। যেন হেলান দিয়ে রয়েছে। বস্তিটার সামনে কতগুলি ছেলেমেয়ে খেলা করছে ন্যাংটো হয়ে খালি গায়ে। ওদের শীত নেই।

এমন সময় সে এসে দাঁড়াল বস্তিটার সামনে। তার আপাদমস্তক দেখে মনে হয়, এ বস্তির বাসিন্দা সে কখনওই নয়। তার মাথার চুল হাল আমলের ছোকরাদের মতো মাপজোখ করে ছাঁটা, গোঁফ দাড়ি কামানো পরিষ্কার মুখ। রংটা অবশ্য কালো। গায়ে শার্টের উপর উলের সোয়েটার, সাদা জিনের ফুল প্যান্ট। পায়ে ইংলিশ বুট। এক হাতে একটা চামড়ার সুটকেশ ও আর এক হাতে বেডিং।

চেহারাটাও তার দেখতে শুনতে নেহাত মন্দ নয়। নাকটা একটু মোটা, আর ঠোঁট দুটো একটু পুরু। তার সেই ঠোঁট চাপা হাসিতে ছুঁচলো হয়ে উঠেছে, আর নাকটা কুঁচকে গিয়ে ফুটো দুটো দেখাচ্ছে একটু বড় বড়।

বাইরের আলো নেই বস্তিতে। সেখানে ইতিমধ্যেই সন্ধ্যার গাঢ় ছায়া নেমে এসেছে। ঘরে ঘরে জ্বলছে উনুন। ধোঁয়ায় ঢেকে গিয়েছে বস্তির ভেতরটা। উঠানের উপরে কেউ কেউ কাপড় কাচছে, দু-একটি ঝি বহুড়ি জল তুলে এনে স্নান করতে বসেছে। তারই কাছাকাছি খাঁটিয়াতে বসেছে। পুরুষদের বৈঠক। সারাদিনের পর এ সময়েই তাদের যত কথা গান হাসি ঝগড়া। ছুটির পর ছাড়া সময়ই বা কোথায়!

সে ভেতরে এসে সবাইকে একবার খুব গম্ভীরভাবে ভারিক্কি হাসিতে ঘাড় নেড়ে সোজা গটগট করে এসে দাঁড়াল পুবদিকে বানোয়ারীর ঘরের কাছে।

বুড়ো বানোয়ারী আর তার বউ রামদেই তখন সবেমাত্র কারখানা থেকে এসে পা ছড়িয়ে বসেছে। ঘরের দাওয়ায়। তাদের ঘিরে বসেছে একপাল অপোগণ্ড, তাদেরই ছেলেমেয়ে।

অদূরেই উনুনে আগুন দিয়ে হাওয়া দিচ্ছে একটি ষোলো-সতেরো বছরের বউ। তার অযত্নের জটধরা পিঙ্গলবর্ণের খোঁপা ভেঙে পড়েছে ঘাড়ের কাছে, ধোঁয়া লেগে চোখে এসেছে জল।

এদের সঙ্গে বস্তির প্রায় সকলেই এই ফিটফাট পাতলুন-পরা আগন্তুকের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। বানোয়ারী বেচারি তো কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে বার দুয়েক কপালেই হাত ঠেকিয়ে ফেলল। তার গোঁফের ফাঁকে সংশয়ের হাসি। একে অপরিচিত, তায় রীতিমতো বাবু। সংশয়ের মধ্যে তার ভয়ও ধরেছিল।

রামদেইয়ের অবস্থাও তাই। বাচ্চাকাচ্চাদের সঙ্গে বউটি একেবারে উনুনের ধোঁয়াচ্ছন্ন অন্ধকার কোণে গিয়ে ঢুকেছে। হায় রাম! এ আবার কে?

আগন্তুকের গাম্ভীর্য আর টিকল না। তার পুরু ঠোঁটের ফাঁকে বেরিয়ে পড়ল বড় বড় উঁচু দাঁতের সারি। কোনও কথা না বলে হাতের বোঝা দুটো নামিয়ে ফেলে, ঘাড়টা একটু তুলে, হাত দুটো ঝাড়তে লাগল।

সন্ধ্যার অন্ধকারে কালো কালো ছায়ার মতো বস্তির মেয়ে পুরুষ দূরে দূরে ঘিরে দাঁড়িয়ে রীতিমতো একটা ব্যুহ তৈরি করে ফেলল। কয়েক মুহূর্তের জন্যে অখণ্ড নিস্তব্ধতা নেমে এল বস্তিতে। এমন কী বাচ্চাগুলিও চিৎকার করতে ভুলে গেল।

বানোয়ারী হাত জোড় করে আর না জিজ্ঞেস করে পারল না, আপ–

এবার সে হা হা হি হি নানান বিচিত্র স্বরে দরাজ গলায় হেসে উঠল। বুকে হাত দিয়ে ভাঙা ভাঙা হেঁড়ে গলায় বলল, আরে হম, হম বেচন, তুমহারা লেড়কা।

বেচন! বানোয়ারীর ছেলে বেচন! অমনি ছায়ারা সব মূর্তি ধরে একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়ল বেচনের গায়ের উপর। একটা স্বস্তির নিশ্বাস সকলের পড়ি পড়ি করেও পড়তে চায় না। ইচ্ছেটা, গায়ের চামড়া খুঁটিয়ে না দেখা পর্যন্ত যেন বিশ্বাস নেই। চটকলের স্পিনার, গোরক্ষপুরের কাহারের ব্যাটা, নিজের নাম বলতে বাপের নাম বলে, সেই হাবাগোবা বেচন এটা?

এ বলে, হায় রাম! ও বলে, হে ভগবান! সে বলে, কাঁহা যাই?

বেচনের মা রামদেই তো এক মুহূর্ত হাঁ করে দেখেই, বেড়ায় মুখ গুঁজে ডুকরে উঠল, ই হামার কা ভইল হো!

উনুনের পাশে বেড়ার কোণে বউটির বুকের মধ্যে ভয়ে ধুক ধুক করছে। সেই পাঁচ বছর বয়সে তার বিয়ে হয়েছে। তারপর দেড় বছর আগে গাওনা করে বেচন আর তার শ্বশুর তাকে মুলুক থেকে নিয়ে এসেছে। বেচন তার কাছে ছিল মাত্র দেড় মাসের মতো। তার পরেই চলে গিয়েছিল। সেই বেচনের একটা মূর্তি এঁকে রেখেছিল সে। কিন্তু আজ একী সর্বনাশ হল তার। এ কোন দেশি আজব মরদ। এ তো তার সে মানুষটা নয়।

প্রথমে সে ফুঁপিয়ে উঠে একেবারে শাশুড়ির সঙ্গে গলা মিলিয়ে চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিল।

বেচন পড়ল মুশকিলে। খানিকটা অপ্রতিভের হাসি হেসে সে বলতে গেল, আরে তুমলোগ রোতা কেঁউ? কিন্তু তার আগেই বানোয়ারী চেঁচিয়ে উঠল, আরে শুয়ারকা বাচ্চা, ইয়ে হম কেয়া দেখতা? তু কেয়া জেহেলসে আতা?

বেচনের হাসি ততক্ষণে উবে গেছে। তবু যথেষ্ট সপ্রতিভভাবে বলল, হাই লাও, গালি বকতা। জেহেলসে আতা নহি তো কেয়া ময়দান সে আতা!

চোপ! চোপ রহো হারামজাদা!

চিৎকার করে বানোয়ারী মারতে আসে আর কী। এখন সেরীতিমতোবাঘা বাপ। বাঘা বাঘের মতোই ব্যাটাকে শাসন করতে উদ্যত। বেচনের জামা কাপড় দেখিয়ে বলল, আরে তু তো বানোয়ারী কাহার কা লেড়কা, কাঁহাসে সাহাব বকে আয়া, আঁ? লিখাপঢ়ি নহি জানত, আরে গোরক্ষপুরকা চুহা, চুতিয়া বানোয়ারী নন্দন, ইসব তু বদন পর ক্যা চঢ়ায়া, আঁ? কাঁহাসে চোরায়া?

চোরায়া? চুরি? বেচন হাসবে কি কাঁদবে ভেবে পেল না। একটু হাসি হাসি বোকা বোকা, করুণ চোখে তাকিয়ে, হতাশাভরে সে বলল, হাই লাও, চোরি হম্‌ কাহে করেগা?

সেই জবাবের আগেই ভিড় ঠেলে অলগু এসে বলল বানোয়ারীকে, বানোয়ারী, তুমকো জলদি বাড়িওয়ালা বোলাতা।

বানোয়ারী তৎক্ষণাৎ ভিড় ঠেলে চলে গেল। বাড়িওয়ালা শুধু বাড়িওয়ালাই নয়, একটা ডিপার্টের সর্দার, দেশ গাঁয়ের ব্রাহ্মণ, একটা মোড়ল গোছের লোক। তার উপরে, সুদ কিস্তিবন্দির কারবারি, ধার দেনা দেয়। অর্থাৎ দোষ, বিচার, জান-প্রাণ, সব তার হাতে। সব ফেলে আগে তার কথা শুনতে যেতেই হয়।

বেচন আর কী করে। তার এত সাধের সাজগোজ, প্রাণে ঠাসা এত আজব অবাক কথা, সর্বোপরি নিজেকে একটা মানুষের মতো মানুষ বলে জাহির করা, সব তত বেঘাটে গেলই উপরন্তু আর একটা শোরগোলের সুত্রপাত হল বস্তি জুড়ে।

তখনও সবাই তাকে ঘিরে রয়েছে, ছেলে মেয়ে জোয়ান বুড়োর দল। দেখছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। কথা বলছে নানারকম। আর ওদিকে মড়া কান্না জুড়েছে মা আর বউ, ভাই আর বোন।

বেচন জেলে গিয়েছিল। দেড় বছর ধরে জেলে ছিল সে। না, চুরি বাটপাড়ি করে যায়নি, কারখানার রেশন হরতালে, যাকে বলে সে একেবারে দলপতি হয়ে উঠেছিল। কম আর খারাপ রেশন, অতিরিক্ত দাম, কোম্পানি তাও বন্ধ করে দেওয়ার ফিকিরে ছিল। আর দশজনের সঙ্গে বেচনও এ অবিচারটা সহ্য করতে পারেনি। সে ব্যাপারটা নিয়ে রীতিমতো কাণ্ড বাধিয়ে বসেছিল। এমনকী তার এই বাপ; ঘিরে-ধরা এই সব পাড়াপ্রতিবেশীরা বেচনের কথায় একেবারে হল্লায় মাতিয়ে তুলেছিল কারখানা, ঘেরাও করেছিল ম্যানেজার সাহেবকে। সারা এলাকা জুড়ে যে হরতাল কমিটি হয়েছিল, বেচন সেই কমিটির মেম্বর পর্যন্ত হয়েছিল। একটা যা-তা কথা নয়।

হ্যাঁ, নিজের প্রাণের কাছে তো আর সত্যি কথা স্বীকার করতে আপত্তি নেই। কোত্থেকে তার প্রাণে এত তেজ ও ঘৃণা জন্মেছিল সে কিছুতেই ঠাওরাতে পারেনি। কিন্তু শুধু পদাধিকার নয়, কারখানার সকলের মুখে মুখে খালি বেচন, এমনকী লেবার অফিসার ও ম্যানেজারের মুখেও বেচন নামটা শুনে, তার প্রতি সকলের নজর দেখে গোপনে গোপনে সে একরকম অভিভূত হয়ে পড়েছিল। নিজের জানটাই তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল। হয় এসপার নয় ওসপার। হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই বেচন বক্তৃতা পর্যন্ত দিয়েছিল। বাপ অবশ্য কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছিল তার সঙ্গে। মাও তাই। বহু, মানে বউ তো তখনও বাপের ঘর থেকে গাওনা শেষ করে এখানে আসেইনি।

তাদের দাবি তো মঞ্জুর হল, কিন্তু সেই দিনই ম্যানেজার তাকে ডেকে পাঠাল কথা বলার জন্যে। কথা বলতে গিয়ে, যাকে বলে বাকডোর দিয়ে দারোগা সাহেব তাকে থানায় নিয়ে যাবার নাম করে একদম কলকাতা চালান করে দিল। বোঝে ব্যাপারটা! সে জিজ্ঞেস করেছিল দারোগাবাবুকে, বাবু আপ্ হমকো কাঁহা লিয়ে যাচ্ছেন?

দারোগাবাবু তার দিকে চেয়ে, মুখে সিগারেট নিয়ে, হেসে বলেছিল, আসলি কারখানামে, যাঁহা পুরা রেশন মিলবে, আর পুরা হরতাল কমিটি হাজির আছে।

দারোগাবাবুর প্রতি একবার অবিশ্বাস এসে গিয়েছিল, সে জন্যে সে বিশ্বাস করতে পারেনি। কিন্তু জেলে গিয়ে সে দেখল, সত্যি, একজন বাদে, পুরো হরতাল কমিটিই হাজির হয়ে গেছে। দেখে সে গম্ভীর হয়ে তাদের বলেছিল, তুমলোগ আয়া ইয়ে হম পহলেসেই জানতা।

আর সেখানে সে কী ছিল? না, রাজবন্দি? মানে? মানে ডেটিউন।

কথাটা মনে হতেই সে আবার গা ঝাড়া দিয়ে উঠল তার অপ্রতিভতা ছেড়ে। শার্টের কলারটা ঠিক করে নিল, বার দুয়েক প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। সকলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল বেশ সৌজন্য সহকারে, কেয়া তুমলোগ সব আচ্ছা হ্যায় তো?

কেউ হাসল, কেউ কৌতুকে ও সংশয়ে চুপ করে রইল। কেবল একজন অল্পবয়সী ছোকরা, বেচনেরই সমবয়সী বলল, হাঁ আচ্ছা-ই হ্যায়। ভাই বেচন পুলিশ তুমকো বহুত মার মারা?

মার? অবিকল একটা শরীফ আদমির মতো হেসে ফেলল বেচন। তারপর হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, চেষ্টা করেছিল বইকী। আজেবাজে নানা রকম প্রশ্ন করেছিল ওকে–এই বাবু কোথায় থাকে? ওই বাবু কবে এসেছে? বোমা কোথায় তৈরি হয়। একেবারে আজেবাজে প্রশ্ন সব। তা ও আর কী বলবে? বলল, ও কিছুই জানে না। এতে ভয় দেখাল ওরা, বলল, জান নিকেশ করে দেবে। তা ও আর কী করতে পারে বলো?

বলতে বলতে তার গলার স্বর এক পদা চড়ে গেল। বাদবাকি সকলের চোখগুলি বড় হয়ে উঠল। আধা অন্ধকারে একদল কালো কালোলোক ভূতের মতো ঔৎসুক্যে বিস্ময়ে জ্বল জ্বল করতে লাগল। এমনকী রামদেই ও বউয়ের কান্নার স্বরটাও স্তিমিত হয়ে এসেছে।

বেচন বলল, বোলা জানসে মার ডালো। যো হম নহি জান্তা ও কেয়সে বাতায়েগা? বোকর হম একদম চুপ হো গয়া। উসকে বাদ হহারা ফটো খিচা, টিপসহি লিয়া ঔর ভেজ দিয়া জেহেলমে। তার চোখে ফুটে উঠল হৃদয়ের চাপা বীরত্ব। আর সকলে তাদের বেচনেরই এই অভাবিতপূর্ব দুঃসাহসিক কাহিনী শুনে কয়েক মুহূর্ত থ মেরে রইল। ব্যাপারটা যদি তেমন কোনও বাঙালি বাবুর হত, কিংবা বাবু সাহেবদের কোনও দিগজ ছেলের হত তা হলে বিস্ময়ের কিছুই ছিল না। এ তো তাদের বানোয়ারীর ব্যাটা বেচন কিনা!

বেচনের এবার আর এক মূর্তি। গম্ভীরভাবে একটু ঘাড় হেলিয়ে জিজ্ঞেস করল কারখানার হালচাল কীরকম।

সেই ছো দোস্ত বলল, হালচাল? শালা রোজানা খিচ্‌ খি। ইসকে লিয়ে ছাঁটাই, উসকে লিয়ে চারসিট, বোনিং। ইয়ে তো রোজানা হোতা।

হাঁ? বেচন বুক ফুলিয়ে জ্বলন্ত চোখে সকলকে একবার দেখে রীতিমতো বক্তৃতার ঢঙে বলতে আরম্ভ করল, হ কালহি কারখানা যায়েগা। দেখো ভাই, জিসকো বোলতা মজদুর তুম ওহি হ্যায়। তুমকো সব একাই রহেগা, একসাথ লড়েগা তো কোম্পানি কা

থামতে হল, স্বয়ং সর্দার বাড়িওয়ালা হাজির তার বাপের সঙ্গে। একজন একটা খাঁটিয়া এগিয়ে দিল। তিনি বসলেন। গোঁফের ফাঁকে বিরক্তি ও হাসি। মোটা ভুর তলায় সংশয়ান্বিত অপ্রসন্ন তীক্ষ্ণ চোখের দৃষ্টি বেচনের দিকে।

সকলেই আবার চুপচাপ। যেন পঞ্চায়েত বসেছে। কাঠগড়ার বন্দির মতো এতগুলি লোকের মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম বেচন। বিচিত্র মানুষের মতো দাঁড়াল সে। তারপর স্তব্ধতা ভেঙে, সে-ই প্রথম বলে উঠল, নমস্তে বাবু সাহেব।

নমস্তে! হুঁ! আর রাম রাম নয়। মৃদু মৃদু ঘাড় নাড়ল সর্দার বাড়িওয়ালা কালিকাপ্রসাদ। অর্থাৎ ছোঁড়ার রোগ ধরেছে ভাল জায়গায়, এটাই বুঝল।

প্রচণ্ড শীত। তবু কেউ ঘরে যাচ্ছে না ভিড় ছেড়ে। কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশের দীপ্তিহীন তারাগুলি আদ্যিকালের ছানিপড়া বুড়োর চোখ দিয়ে তাকিয়ে আছে যেন। উঠোনের উপর নিম গাছটার পাতা নেই। এই ঘিরেধরা মানুষগুলির মধ্যে মনে হচ্ছে সেও এদের একজন।

ঘরে ঘরে কাজকর্ম একরকম বন্ধই। তবুও পিদিম লম্ফ জ্বলেছে ঘরে ঘরে। অবুঝ উৎসাহী বাচ্চারা আলোচনাটা নিজেদের মধ্যে টেনে নিয়েছে। অন্যান্যেরা একবার দেখছে কালিকাপ্রসাদকে

আর একবার বেচনকে। কালিকাপ্রসাদ বলল, বেচন, বেটা, তুই জেহেলসে আতা?

বেচনের বোধ হয় কালিকাপ্রসাদের উপর মনটা একটু বিরূপ। নয়তো এতক্ষণে সে সত্যি খানিকটা বিরক্ত হয়ে উঠেছে। জবাব দিল, জরুর। হম কেয়া ঝুট বোলতা?

জবাবের ধরন দেখে বানোয়ারীর হাত নিশপিশ করে উঠল। কালিকাপ্রসাদ কিন্তু মোলায়েম গলায় বলল, নহি নহি ও বাত নহি। তো ইয়ে সব বঢ়িয়া চীজ তুঝে জেহেলসে দিয়া?

নহি তো হম চোরি কিয়া? বলে বেচন সাক্ষী মানতে গেল সবাইকে। অন্য সবাই তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে নিল তার দিক থেকে।

বানোয়ারী যথেষ্ট শান্তভাবেই ধমকে উঠল, চোপ, বাবুসাহাব যো পুছতা ঠিকসে জবাব দো। তু জেহেল কোম্পানিকা লেড়কা নহি, হমকো। হাঁ! এহি বানোয়ারীকো, হাঁ!

সে সব দিকে বেচনের কোনওই খেয়াল নেই। সে ততক্ষণে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাত তুলে কথা বলতে আরম্ভ করেছে। তার চোখেমুখে ছড়িয়ে পড়েছে এক অপূর্ব দীপ্তি। তাতে মনে হচ্ছে, সে যেন ভীষণ রেগে উঠেছে। সে বোঝতে আরম্ভ করল, সে কী ছিল। জেলে সে কীভাবে থাকত, কী খেত। সরকার তাদের কী দিত। তারপরে সে আরও জোরে গলা চড়িয়ে বলল, মগর কাহে? না, হম ডেটিউন লোগ ফায়েট কিয়া। হাঁ, ফায়েট, ঔর চালিশ রোজ সিরিফ ভুখা রাহা।

ভুখা? চল্লিশ দিন? বানোয়ারীর ধৈর্যের বাঁধ একেবারে ভেঙে গেল। রাগে খাড়া হয়ে উঠল তার পাঁশুটে গোঁফ জোড়া। চেঁচিয়ে উঠল, চোপ্ হারামজাদ, ফির ঝুটা বাতয়েগা তো জুতি সে মু তোড় দেগা।  

সে চেঁচানিতে বেচনের হাত পা শক্ত হয়ে উঠল। সাবধানের মার নেই। তবু সে হাত তুলে বোঝাতে গেল। কিন্তু তার আগেই বানোয়ারী সবাইকে সাক্ষী মেনে আরও জোরে চেঁচিয়ে উঠল, আরে ভাই, শুনিয়ে বাবুসাহাব, হম সাত রোজ ভুখ তখলিফ সে সব ছোড়কর ভাগ আয়া বাঙ্গালমে, ঔর ইয়ে লেড়কা চালিশ রোজ ভুখা রাহা ওহি পাতলুন কা খাতির?

জিভ দিয়ে একটা অধৈর্যের ও বিরক্তির শব্দ করে বেচন বাপের দিকে হাত নাড়িয়ে বলল, হাই লাও—

বাধা দিতে বানোয়ারীও রেগে উঠল, হাই লাও কেয়া রে শালা?

বেচন এবার পালিশ করা মুখ বিকৃত করে, রীতিমতো বেঁকে কোমরে হাত দিয়ে বলল, তুম আপনা লেড়াকাকো শালা বোলতে হো?

বোধ হয় অপরিসীম বিস্ময়ের ঝোঁকেই এক মুহূর্ত কথাই বেরুল না বানোয়ারীর মুখ দিয়ে। খালি গোঁফ জোড়া কাঁপতে লাগল। তারপর চতুগুণ জোরে সে প্রায় লাফিয়ে উঠে চেঁচিয়ে উঠল, ইয়ে কেয়া আজ নয়া বোলতা, আঁ? তু যব দুনিয়া নহি দেখা তব সে বোলতা, ঔর আজ তু হমকো সমঝানে আয়া?

বলে কালিকাপ্রসাদের দিকে ফিরে বলল, বাবুসাহাব, ইসকো হম্‌ খুন করেঙ্গে আজ।

কিন্তু খুনোখুনি সম্ভব হল না। কেননা বানোয়ারীর ততখানি অগ্রসর হওয়ার সাহস ছিল না। সে যতটা এগিয়েছিল, ততটা পেছিয়ে এল। হাঁপাতে লাগল জোরে জোরে।

কালিকাপ্রসাদ এতক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছিল বেচনকে, মনোযোগ দিয়ে শুনছিল তার কথা। এবার সে স্থির বিশ্বাসে, গোঁফ মুচড়ে বলল, বেচন তু কিলিস বনকর আয়া, কেঁও ঠিক হ্যায় না?

এই অভূতপূর্ব প্রশ্নে সকলেই উৎসুক চোখে তাকাল বেচনের দিকে, তার জবাবের প্রত্যাশায়। কথাটার সঠিক অর্থ সকলে জানে না আর সুখের হোক দুঃখের হোক, অনেকে শোনেওনি।

প্রথমটা একটু বেকুব হয়ে গেল বেচন। তার চাঁছাছোলা মুখটা আর দশটা মুখের মধ্যে মিশে গেল যেন। কিন্তু পরমুহূর্তেই পুরু ঠোঁটের ফাঁকে তার ঝকঝকে বড় বড় দাঁত বেরিয়ে পড়ল, ও কিলিস, মানে জিসকো বোলতা কামনিস, ঠিক হ্যায় না? উয়ো তো ভারী ক্রান্তিকারী লোগ কানিস হোতা? মগর…।

বলে সে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল। বোধহয় তার জেল জীবনের কথাগুলি একবার গুছিয়ে নিল মনের মধ্যে। তারপর বলল, এক বাত, টাইম যব আ যায়েগা ক্রান্তিকারী সব হো যায়েগা একদম ঠিকসে তব কামনিস বন যায়েগা। হাঁ, কোই রোজ বন যায়েগা।

কথাটা সে এমনভাবে বলল, যেন খুব একটা গর্বের ব্যাপার এবং সে জন্যে জীবনে অনেক কাঠখড় পোড়াবার দরকার আছে। বলা বাহুল্য, কালিকাপ্রসাদ তার কথাটা একেবারেই বিশ্বাস করল না। একে তো বেচন কারখানায় হরতাল করিয়ে দিয়েছিল। তারপর দেড়বছর জেল খেটে এল, চল্লিশ দিন না খেয়ে ছিল, তার উপর ছোকরার চেহারাই বদলে গিয়েছে। এমনকী কথার ধরনও। সুতরাং ও নিশ্চয়ই কিলিস হয়ে গেছে, কিন্তু গোপন করছে। কালিকাপ্রসাদ ভাবল, ঠিক আছে, আমিও কালিকাপ্রসাদ সর্দার। ওকে আমি ঠিক শায়েস্তা করব। তবে বস্তির লোকদের একটু সামলে রাখতে হবে আর ম্যানেজারকে খবরটা দিয়ে দিতে হবে। বেগতিক দেখলে ভাগাতে কতক্ষণ। সে বানোয়ারীকে ডেকে নিয়ে আড়ালে বলে দিল, খুব হুঁশিয়ার, তুমহারা লেড়কা বহুত ভারী কিলিস্ বন কর আয়া। উসপর নজর রানা হোগা, কিলিস্ পাট্টি উসকো ছোড়ানে হোগা, সমঝা? নহি তো, বেমারি বাঢ় যায়েগা!

যাই হোক, বানোয়ারী মোদ্দা বুঝল যে, তার ছেলে চুরি করেনি এবং ভগবানই জানে জেলে ওকে কী তুক করেছিল যে, চল্লিশ দিন ও না খেয়েছিল সত্যি। অবশ্য পুরো বিশ্বাস সে কোনওদিনই করতে পারবে না। আর একটা ঘোড়ারোগ নিয়ে এসেছে হারামজাদা, অর্থাৎ কিমলিস হয়ে এসেছে। কালিকাপ্রসাদ তাকে এও বুঝিয়েছে, লাল ঝাণ্ডা শিউলূজনবাবুর আছে, কামতাপ্রসাদ শেঠের আছে, নওরিনবাবুরও আছে, কিন্তু কিমলিস এক আলাদা জিনিস। মুসলিম কিরিস্তান তো মানেই না, বোমা গুলি-গোলা সর্বদা ওদের পকেটে পকেটে ঘোরে।

অতএব, বানোয়ারী বুঝেছে, তার ব্যাটা এক ভয়াবহ জীব।

নগিনা মুচির ছেলে পাতলুন পরে, টেরি বাগায়, কিন্তু আসলে সেটা সিঁদেল চোর। ওকে পুলিশ উঠতে বসতে লাথি মারে। বছরে এক মাস বাইরে থাকে। রাজিন্দরের ব্যাটাও ফুটানি করে, আসলে গুণ্ডামি ওর পেশা। আর বেচন, কিমলিস। হায় রাম!

কিন্তু তবু সে আসল কথাটা চিৎকার করে জানিয়ে দিল, যো ভি হো, হপ্তা মে হমকো দশ রুপেয়া দেনে হোগা, ফোকটমে খানা নহি মিলে গা, এ পহলেহি বোল দেতা।

বেচন তখন তার মা বুড়ি রামদেইকে বোঝাচ্ছে কী রকম তার জীবনটা কেটেছে। কাঁদবার কিছু নেই, সে মানুষ হয়ে এসেছে। কথাটা, কথার আড়ে ও চোখ ঠেরে তার বউ ঝুনিয়াকে জানান দিচ্ছে।

তার মা কান্না ছেড়ে, রাগের অছিলায় অন্যদিকে মুখ করে শুনছে। কিন্তু থুতনি ঝুলে জিভটা বেরিয়ে পড়েছে তার বিস্ময়ে। রেখাবহুল মুখে পাটের ফেঁসো লেগে দেখাচ্ছে যেন রং ওঠা ময়লা প্রতিমার মুখের মতো। বউও শুনছে আটা মাখতে মাখতে। ভাইবোনগুলি গালে হাত দিয়ে শুনছে। খালি গা, ন্যাংটো তারা। শীত থাকলেও গায়ে জামা নেই।

শুনছে আরও কিছু জোয়ান ছেলে। বাদবাকিরা শুনছে বটে, কিন্তু যে যার ঘরের দোরে বসে। অনেকের একটা কৌতূহল আছে, ওই মন ভোলানো চামড়ার পেটিটাতে কী আছে। হতে পারে, বানোয়ারীর কপাল ঘুরিয়ে দেবে বেচনের ওই পেটিটা।

কালিকাপ্রসাদ যে খাঁটিয়াতে বসেছিল, সেই খাঁটিয়াতেই ঠ্যাং ফাঁক করে পা ছড়িয়ে বসেছে বেচন। বলছে, হাঁ, জেহেলকা ডাগডর, ভুখা হরতালকে টাইমমে জোরসে দুধ পিলানে আতা রাহা। তো কেয়সে পিলায়েগা? একঠো রাবারকা নল নামে পেটকা অন্দর ঘুসা দেতারাহা, ঔর চুক চুক দুধ ডাল দেতা। মগর হমলোগ থোড়াই পিতা। রোজ মারপিট হোতা রাহা।

এ অভিনব পন্থার কথা শুনে সকলের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। একেবারে অবিশ্বাস করল বানোয়ারী। আবার তার রাগটা চড়তে লাগল।

কিন্তু সে কিছু বলবার আগেই বেচন চট করে পকেট থেকে ঝকঝকে পরিষ্কার একটা রুমাল বার করে নাক ঝেড়ে সকলের সামনে মেলে ধরল। সবাই কৌতূহলী হয়ে উঁকি দিয়ে দেখেই চমকে উঠল। এ যে রক্ত!

বেচন কিন্তু পুরু ঠোঁট উলটে হেসে বলল, ঘাও হো গয়া, শুখা নহি অব।

এবার বানোয়ারী সকলের সঙ্গে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। দেখতে লাগল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তার ছেলেকে। না, খুশি সে কিছুতেই হতে পারছে না। একে তো মরদ হয়ে বেচন গোঁফ জলাঞ্জলি দিয়েছে, যেন অওরতের পালিশ করা মুখ। চৈতন, অর্থাৎ টিকি, সেটাও জেল কোম্পানিকে বিকিয়ে এসেছে আর কথাও বলছে ঠেট হিন্দীতে।

যাই হোক, সারা বস্তির দারুণ কৌতূহল ও ঔৎসুক্যের মধ্যেই সারাদিনের খাটুনির পর শীতের রাত নেমে এল তার গাঢ় ঘুম নিয়ে। চোখের পাতা আপনি বুজে এল সকলের। এক ইঞ্চিও ফাঁক না দিয়ে ঘুমন্ত মানুষে ঠাসাঠাসি দাওয়া ও ঘর। বেচন জামা কাপড় ছেড়ে, রোজকার জেল জীবনের মতোই পায়জামা পরে, মুখ হাত-পা ধুয়ে খেতে বসল। খেতে দিল তার মা আর বউ।

তারপর রাত্রে শুতে গিয়ে আবার এক কাণ্ড।

ঘরের বাইরেই উনুনের ধারে একটা খাঁটিয়া পড়েছে বেচনের শোয়ার জন্যে। বাইরের থেকে আড়াল করার জন্যে একটা চট চালার সঙ্গে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ঝুনিয়াকে বেচনের সঙ্গে রাত্রে শুতে দেওয়ার ব্যাপারে বানোয়ারীর ঘোরতর আপত্তি ছিল। কিন্তু রামদেই অর্থাৎ মা সেটা হতে দিল না, কারণ মরদ ঘরে থাকলে অওরতের একা শোয়া খারাপ। কেন? না, বরহমদেও কিংবা অন্য কোনও অশরীরী জিন-প্রেতের হাওয়া লাগতে পারে। মরদ থাকলে তারা সুবিধে করতে পারে না।

সুতরাং বানোয়ারীর দরজা বন্ধ হল আর ঝুনিয়া বেচারি এক কোণে মুখ ঢেকে পল গুনতে লাগল। ভয়ে সে আজ কিছু মুখে তুলতে পারেনি।

প্রথম কথা, গাওনা করে যেদিন তাকে বেচন নিয়ে এল, যাকে সে তার কিশোরী প্রাণ ও মন সঁপে দিয়েছিল, সেই খোঁচা খোঁচা চুল, হলদে রঙের ছোপানো ধুতি আর কামিজ পরা গাইয়ে বকবকে লোক তো এটা নয় ; এর অন্য নাম-ধাম হলেও সে বিস্মিত হত না। অর্থাৎ এর কিছুই সে চেনে না। এমনকী এর গা ও জামাকাপড় থেকে যে গন্ধটা বেরুচ্ছে, সেটাই শুধু অপরিচিত নয়, তার মনে জেগে উঠেছে এক অপরিচয়ের দূরত্ব, ভয় ও কিছুটা বা সমীহ। তারপর খাঁটিয়ার বিছানাটা এত নরম, ঝকঝকে ও বিচিত্র গন্ধযুক্ত যে, তার জীবনে ওরকম বিছানায় শোয়া দূরের কথা, কাছেও ঘেঁষেনি। সে জন্যে তার শরীরও সিঁটিয়ে রয়েছে।

তা ছাড়া সে শুনেছে একটা দুর্বোধ্য অদ্ভুত বিশেষণ –লোকটা কিমলিস।

ঝুনিয়ার মনে হচ্ছে, অন্য একটা মরদ তাকে ছিনিয়ে নিতে এসেছে। কিন্তু বেচনের সে সব খেয়াল থাকলে তো। মানুষের মুক্তির একটা দারুণ আনন্দ আছে। বেচন সেই মুক্তির নেশায় পাগল। সে দিব্যি গুনগুন্ করছে বিচিত্র সব গানের কলি। কখনও, হৃদয়ের চাপা আবেগে সুর। বেসুর হয়ে কেঁপে যাচ্ছে। তারপর সে ঝুনিয়াকে বোঝাতে আরম্ভ করল, সে কী হয়েছে। সে পরিষ্কার জানিয়ে দিল, ইয়ে জান চলা যায়, তাওভি মালিক কা জুলুম খতম করনে হোগা। কেয়সে? না, লড়নে হোগা। ইস লিয়ে লিখাপঢ়ি করনে হোগা জরুর। হমকো জেহেলমে ইউ-পিকে রহনেওয়ালা এক ভারী বাবু বহুত কুছ শিখায়া। হম্‌ অভি কিতাব পড়নে সাকতা। তুমকো ভি শিখায়েগা।

বলে সে বড় বড় চোখে উজ্জ্বল দৃষ্টিতে তাকাল হাত মুখ গুঁজে বসে থাকা ঝুনিয়ার দিকে। আবার বলল, দুনিয়ামে বহুত অওরত মরদকো সাথ কাম করতা, তুমকো ভি হমহারা সাথ লে লেগা।

বলে সে ঘাড় সোজা করে দৃপ্ত ঘোষণার ভঙ্গিতে তাকাল ঝুনিয়ার দিকে। কিন্তু ঝুনিয়া একেবারে নিশ্চুপ। এমনকী নড়েও না।

আরও খানিকক্ষণ এ সব কথা বলে ঝুনিয়ার দিকে তাকিয়ে সে থেমে গেল। তারপর বলল, খাঁটিয়া পর চলা আও, কাহে ওহা বয়ঠা। হম তো নয়া আদমি নহি।

বলে সে ঠোঁট কুঁচকে হাসল। কিন্তু ঝুনিয়া এল না। বেচন বুঝল, অনেকদিন পর ঝুনিয়ার শরম হচ্ছে। হবেই তো। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল গাওনার পর সেই স্বল্প দিনের জীবনের মধুর ছবি। প্রেমবতী কিশোরী ঝুনিয়ার সেই অবোধ চাউনি। হাসিতে টলটল, অভিমানে ছল ছল সেই চোখ, টকটকে কথা, ফিকফিকে হাসি, হৃদয় যেন রংবাহারি ঝরনায় একেবারে স্নান করে উঠত। হ্যাঁ, জেলে থাকতে ওই মুখ মনে করে তার বিনিদ্র রাত্রি নিঃশব্দে বোবার মতো গুমরে মরত। খাঁ খাঁ। করত বুকের মধ্যে আর নিশীথে প্রহরীর বুটের শব্দ বিধত হৃৎপিণ্ডে। তখন মুক্তির জন্যে পাগল হয়ে উঠত সে। সমস্ত বাইরের জীবন তাকে তখনি ডাকত হাতছানি দিয়ে। সে সব ভুলে অন্ধকার সেলের মধ্যে অভিশপ্ত অশরীরীর মতো চার দেওয়ালের দিকে দিশেহারা চোখে তাকাত।

আজ সে মুক্ত। আজ সে বস্তিতে। মন তার আজ সাফ হয়ে গেছে। আর ওই তো ঝুনিয়া। ভাবতে ভাবতে কী হল জানি না, বোধ হয় আবেগ-অন্ধ ভালবাসায় নিজেকে আর সামলে রাখা দায় হল তার। সে আরও কয়েকবার ডেকে যখন সাড়া পেল না, তখন হাসতে হাসতে গিয়ে হাত ধরে টান দিল।

ঝুনিয়া ওই সব লেখাপড়া ও বেচনের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করতে যাওয়ার বক্তৃতা শুনে ভয়ে এমনিতেই নিঃশব্দে কাঁদছিল। এবার হাত ধরতে ভয় তার দ্বিগুণ হয়ে উঠল। বুকের মধ্যে নিশ্বাস তার আটকে এল।

কিন্তু বেচন সেটা বুঝল না। অন্ধ প্রেমাবেগে ঝুনিয়াকে দু-হাতে সাপটে ধরে তার মুখে একটা চুমু এঁকে দিল।

কিন্তু বিপাকে ব্যর্থ ঝুনিয়ার গলা দিয়ে রুদ্ধ কান্নাটা আচমকা হাউমাউ শব্দে বেরিয়ে এল। কেননা, লোকটা যে এমন আচমকা তাকে এরকম করবে, এটা সে মোটেই ভেবে উঠতে পারেনি।

কান্না শুনেই ঘরের ভেতর থেকে বানোয়ারী, কা ভইল, কা ভইল বলে চিৎকার করে উঠল। সেই সঙ্গে রামদেইয়ের গলাও। সঙ্গে সঙ্গে পাশের ঘর থেকেও লোকজন চড়া গলায় সাড়া দিয়ে উঠল, জেগে উঠল বস্তি। এরকম হঠাৎ শব্দে কুকুরগুলিও ঘেউ ঘেউ শুরু করল।

বেচনের হাত পা এলিয়ে পড়ল। আর তার মুখ দিয়ে খালি বেরিয়ে এল, হাই লাও!

এই হাই লাও কথাটাই একমাত্র ঝুনিয়ার পরিচিত। ওই একটা কথাতেই সে পুরোপুরি অবিশ্বাস করতে পারছে না। মনে হচ্ছে যে, এ বেচন সে বেচনই আছে।

কিন্তু ততক্ষণে বানোয়ারী বেরিয়ে এসেছে। রামদেইও এসেছে, তা ছাড়া অন্যান্য দু-চারজন।

সকলের প্রশ্নের সামনে বেচনকে মনে হল যেন অপরাধী ধরা পড়ে দাঁড়িয়ে আছে। তবু বোকার মতো হেসে সে বলে ফেলল, ইয়ে ডর গয়ি।

তখন বানোয়ারী দুষল রামদেইকে, তুমকো হম কেয়া বোলা? এ লেড়কা কেয়া না কেয়া বনকে আয়া, তো অওরত কেয়সে রহেগা?

রামদেই বুঝল অন্যরকম। সে খিচিয়ে উঠল বানোয়ারীকে, ওইসা হোতাই করতা। জিন্দিগীভর ইকো ইয়ে মরদকো সাথ রহনে পড়েগা কেয়া নহি? মরদ যো ভি হো, কিমলিস্ হো, ডাকু হে ইয়া চুহা হো। ছোড়ো, তুম ঘর চলা আও।

বলে সে বানোয়ারীকে নিয়ে ঘরে চলে গেল। অন্যান্যেরা কৌতুকের চেয়েও বেশি বিস্ময় নিয়েই ফিরে গেল।

ঝুনিয়া দাঁড়িয়ে রইল তেমনি, মুখ ঢেকে। সে এখন নিঃশব্দে কাঁদছে। ব্যাপারটার জন্যে নিজেকে অপরাধী ভেবে সে বড় অপ্রতিভ হয়ে পড়েছে। কিন্তু সে যে নিরুপায় হয়েছিল।

আর বেচন। অভিমানে বুক ভরে উঠল তার। মহব্বত ভুলে গেছে ঝুনিয়া। বেজায় মন খারাপ করে সে শীতের মধ্যে বাইরে বেরিয়ে গেল। বাইরে আসতেই আবার তার মনটা চাঙ্গা হয়ে উঠল। কতদিন বাদে সে আবার নিশীথ রাত্রে আকাশের তলায় দাঁড়িয়েছে। বস্তির পুরনো কুকুরটা তাকে ঠিক চিনে এসে গায়ে পড়ছে, পা চেটে আদর কাড়াচ্ছে। ওই তো গঙ্গা, একটা অদৃশ্য গহ্বর থেকে যেন ধোঁয়ার মতো কুয়াশা উঠছে। ওই তো শহরের বড় রাস্তার বিজলী বাতি, কারখানার চিমনি। মনে মনে বলল, সব ঠিক হো যায়েগা, হাঁ! ঝুনিয়া, বাপ-মা, পড়শী আর কারখানার মজুর, সব ঠিক হয়ে যাবে।

কী করে? না বেচন তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে।

ওই এক চিন্তায় সে মশগুল হয়ে রয়েছে। জীবনে এখন তার একটাই কর্তব্য, যেমন করে তোক, একটা খাঁটি কামনিসের মতো মজদুরদের জিন্দিগী বদলে দিতে হবে। সে কামনিস হতে চায়। কেননা সঠিক না বুঝলেও একটা বিচিত্র ঝাপসা শুভদিনকে সে কামনা করছে।

কিন্তু এর পরে সকলের কাছে সে এবং তার কাছে সকলে একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। পরদিন ভোরবেলা যখন সে টুথপেস্ট ও ব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজছে, কারখানায় বেরুবার মুখে বাপের সঙ্গে তার আবার ঝগড়া লাগল। শুধু বাপ কেন, সারা বস্তির লোক হাঁ করে তাকিয়ে তার রাজকীয় কায়দায় দাঁত মাজা দেখল। তাদের মতো মানুষেরা চিরকাল ছাই দিয়ে নয়তো দাঁতন দিয়ে দাঁত মাজে। আর এ যে বুরুশ। বানোয়ারী বলে গে বিলাইতি বুরুশসে দাঁত বানাতা! ঠাহর যা শালা কারখানাসে আ কর–

বেচন এ সব কথায় কানই দিল না। সে যেমন কাল সকালেও দাঁত মেজেছিল, তেমনি মাজতে লাগল। বরং মনটার মধ্যে নেই বন্দি জীবনের অবসাদ।

যাই হোক কারখানা থেকে এলেও সেদিন এবং আরও কয়েকদিন ঝগড়া বিবাদটা চাপা রইল কারণ বেচন এক জোড়া নতুন ধুতি তার বউকে আর মাকে দিয়েছে, বাপকে দিয়েছে একটা ধুতি আর কামিজ। তা ছাড়া খান তিনেক আস্ত কামিজ ও পায়জামা দান করেছে সে তার সমবয়সী বস্তির বন্ধুদের। অবশ্য তারা সকলেই স্পিনার, পুরনো সহকর্মী।

এতেও বানোয়ারী বলতে ছাড়ল না, বড়া তালুকদার আইলান। আধা পয়সাকে বাচ্চা নহি, চাঁদিকা বাপ বা হ্যায়। শোনা যায়, বেচন হয়তো তখন ঠ্যাং ফাঁক করে দাঁড়িয়ে কাউকে বোঝাচ্ছে, হাঁ হাঁ, ভাই হম্‌ বোঝা, ইস্ ঘড়ি মজদুরকো রাজ জরুর হোনা চাহিয়ে। আঁ? কেয়সে? আচ্ছা, ঠাহরো।

বলে কখনও তার জেল থেকে নিয়ে আসা তিনটে কেতাব ঘাঁটতে বসে নয়তো বলে, আচ্ছা কাল বাতায়েগা।

কিন্তু কিছু একটা বাতলায় ঠিকই তার পরদিন। তার শ্রোতারা অবশ্য দু-একবার বড় বড় জলসাতে, ওই মজদুর রাজ কথাটা শুনেছে, কিন্তু তার অর্থ বোঝেনি। ভেবেছে উপর থেকে একটা কিছু হতেও পারে। কিন্তু বেচনের মুখ থেকে কথাটা শুনে সত্যি তারা বিস্মিত হয়। সংশয় ও অবিশ্বাস্য রকমের একটা ভাবের উদয় হয় তাদের। কেউ কেউ স্রেফ হাসে, গালাগাল দেয় কেউ। কেউ। অর্থাৎ বেচনের প্রতি দু-চারজনের মনে রীতিমতো সম্মান আছে। বেশি সংখ্যক সংশয়ান্বিত, অনেকে ভীত আর অবিশ্বাসী, আবার বিদ্বেষীও কিছু কিছু আছে।

তারপর এসব জামা কাপড়ের ব্যাপার না মিটতেই বেচনের দাড়ি কামানোর সরঞ্জাম, তেল, সাবান, চুল-গোঁফহীনতা ও পোশাক নিয়ে নিত্যই বানোয়ারীর সঙ্গে মারামারির উপক্রম হতে লাগল। এর একটা চূড়ান্ত ঘটনা ঘটল সেদিন, যেদিন বেচন পাতলুন আর কামিজ পরে একেবারে কারখানার মধ্যে গিয়ে ঢুকল। এমনকী সে ডিপার্টের মধ্যেও ঢুকে পড়েছিল। খবর পেয়ে গোরা ম্যানেজার, ইঞ্জিনিয়ার, কালা লেবার অফিসর, বড় সর্দার আর দুটো দারোয়ান একযোগে তাকে তাড়া করে এল। সে যত তাদের বোঝাতে যায়, সিরিফ মোলাকাত করনে আয়া কিন্তু কেউ বিশ্বাস করল না। তখন সে রেগে চিৎকার করে জানিয়ে দিয়ে এল, কিন্তু বাইরে সে মোলাকাত করবেই। এই বেইমান ম্যানেজার সাহেব তাকে ধোঁকা দিয়ে ধরিয়ে দিয়েছিল, এর জন্যে একবার তাকে সাজা জরুর নিতে হবে। ততক্ষণ তাকে ঠেলে বাইরে বার করে দেওয়া হয়েছে।

কালিকাপ্রসাদ বানোয়ারীকে খালি টুকে দিল, কেয়া বোলা রহা হম? তুমহারা লেড়কাকো ঘরসে ভাগানে হোগা। নহি তো বঢ়ি হুজ্জত মচেগা।

বানোয়ারী বস্তিতে ঢুকেই প্রথম পট করে ভেঙে ফেলল বেচনের টুথব্রাশটা। তেলের শিশিটা ফেলতে গিয়ে দেখল তেল নেই। তবু ফেলে দিল। ফেলে দিল সাবানের বাক্স। তারপর হাতের কাছে চট করে কিছু না পেয়ে চিৎকার করে উঠল, কাঁহা গয়া, লে আও শালা জেহেলকা বাচ্চাকো।

কিন্তু সেই জেলের বাচ্চা, তখন কোম্পানির লাইনের মজুরদের বলছে, দেড় সাল কেয়া, জিন্দিগী ভর রহনে সাকতা জেহেলমে, মগর কামিয়াব হোনা চাহিয়ে।

তারপর বস্তিতে ঢুকতে না ঢুকতেই বানোয়ারী তাকে তাড়া করে এল। কিন্তু গায়ে হাত তুলতে গিয়েই থমকে গেল এবং ঘুষি বাগিয়ে মার খাওয়ার জন্যে ডাকতে লাগল।

বেচন শান্ত গম্ভীর গলায় বলল, দিমাগ ঠিক রাখো। কাহে? না, তুম মজদুর হো!

রাগের চোটে অজ্ঞান হয় আর কী বানোয়ারী। শেষটায় চামড়ার সুটকেশটা টেনে এনে বেচনের পায়ের কাছে দিয়ে বলল, অভি নিকলো, নহি তো দেখেগা কেতনা বড়া কিমলি বনা।

কিন্তু বেচন অপ্রতিভ অথচ নির্বিকারভাবে দাঁড়িয়ে রইল খানিকক্ষণ। তারপরে বলল, আচ্ছা, থোড়া দিন বাদ চলা যায়েগা।

টুথব্রাশ কিংবা তেল এ সব নিয়ে বেচনের ভাবনা ছিল না। কেননা, খালি ব্রাশ থাকলে তো হবে না, মাজন চাই। কিন্তু পয়সা নেই। সুতরাং তেল সাবান মাখা তার এমনই বন্ধ হয়ে গেল। জামা কাপড়ে সাবান না পড়ে সেগুলিও ময়লা হয়ে গেছে। চাকচিক্য কমে গেছে তার। এমনকী, ব্লেড নেই, পয়সা নেই, তাই গোঁফও রীতিমতো কামানো হয় না। খোঁচা খোঁচা দাড়ি এখন প্রায় সব সময়েই তার মুখে দেখা যায়। একটা কাজের খোঁজে সে রোজই এদিকে ওদিকে যায়। কিন্তু এখানকার কোনও কারখানা তাকে কাজে নিতে রাজি নয়। সেই এক কথা, কামনি।

শরীরটাও তার ভাঙতে আরম্ভ করেছে। কোটরে ঢুকেছে চোখ। তাহলেই বা কী। সে ঠিক দুপুর বেলা নিয়মিত ওই কেতাব তিনখানি নিয়ে বসবে, আর বাচ্চা পড়য়ার মতো চেঁচিয়ে পড়বে : দুশমন হরবখত নজর রাখতা হ্যায় কি হমারা সংগঠন কি স্কুপ কাঁহা ঢিলা হ্যায়। জেয়সে কি বামপন্থা ঔর দকছিন পন্থা–

থামতে হয়। বাম ও দক্ষিণের ব্যাপারটা মাথার মধ্যে গণ্ডগোল পাকায়। ছোটে নারাইনবাবুর কাছে। তিনি নাকি কামনিস। কিন্তু যা বলেন, বেচনের মাথায় তার চার ভাগের এক ভাগও যদি ঢোকে। সুতরাং কিছুটা তাকে মনগড়া ভাবতেই হয়।

কেতাব তিনখানি ছাড়া তার সুটকেশে কাগজ চাপা আরও দুটি বস্তু ছিল। একটি হিমানীর নতুন কৌটো আর একটা পাউডার। ব্যাপারটা অবশ্য খুবই গোপনীয়। বস্তু দুটি সে ঝুনিয়ার জন্যে। রেখেছিল। কিন্তু ঝুনিয়ার সঙ্গে তার প্রেমের সন্ধি আজও হয়ে ওঠেনি। অবশ্য কান্নাকাটি সে আর করে না। কিন্তু সে ভালবাসা আর নেই। সে দেখে, ঝুনিয়া একেবারে নিস্পৃহ, বরং তার বাপ। মায়ের কথা শুনে শুনে, বেচনের উপর যেন বিরক্ত। এমনকী একদিন বলেও ফেলেছিল, কাহে তু কিমলিস্ বন্ গেইলান? বোঝাতে তো বেচন পারেইনি, উপরন্তু ঝুনিয়া আরও দূরে সরে গেছে। বস্তু দুটি বেচন তাকে দিয়েছিল সে নেয়নি। বলে দিয়েছে, মরে গেলেও ও সব সে মাখতে পারবে না কেননা ততখানি খারাপ অওরত সে নয়। প্রেম অথবা বিরহের বেদনা প্রকাশের ভাষা নেই বেচনের, তাই চুপ করে থাকে। আর বুকের মধ্যে তার টনটন করে। কিন্তু সে টনটনানির অনুভূতিটা তার কাছে মোটেই পরিষ্কার নয়।

যাক, এখন কাজ খোঁজা আর পড়া এবং সেই সঙ্গে কোম্পানির লাইন ও বস্তিতে গিয়ে সবাইকে তার কথাটা বলাই একমাত্র কাজ। ইতিমধ্যে শীত চলে গেছে। বসন্তও বিদায় নিয়েছে। গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদে আকাশ মাটি তেতে রয়েছে। সব জ্বলছে। এখনও জ্বলছে গঙ্গার ধারে কৃষ্ণচূড়ার লাল ফুল।

এতদিন পরে একটা কাজ পেল বেচন। লালা সাহেবের কুড়িটা রিকশাওয়ালাকে রোজ খুঁজে খুঁজে পয়সা আদায় করার কাজ। ভাল কাজ। দায়িত্বপূর্ণ কাজ।

কিন্তু হলে কী হবে। রিকশাওয়ালাদের সে বোঝাতে আরম্ভ করল, লালা সাহেব তাদের সিরিফ ঠকাচ্ছে, তারা সবাই একদিন লড়ে যাক। কথাটা লালা শুনেই তাকে বিদায় করে দিল।

তারপরে এক বড়লোকের গদিতে তার চাকরের কাজ পেল। সেই বড়লোকটি মাতাল আর রসিক! এমনকী সে বেচনের সঙ্গেও রসিকতা করত। সুযোগ বুঝে বেচন তাকেও জেলের কথা এবং মজদুর রাজ বোঝাতে গেল। ব্যস্! মাতালের রসপূর্ণ ঢুলুঢুলু চোখ একেবারে ছানাবড়া। ভাবল, বুঝি বরবাদ হল তার গদি। গেল কাজটা।

দেখে শুনে বানোয়ারীর আর সহ্য হচ্ছিল না। বেচনের লাইনে বস্তিতে যাওয়া নিয়ে কালিকাপ্রসাদ তাকে রোজ মুখ খিচোয়, ভাগিয়ে দিতে বলে।

বানোয়ারীর মাথার ঠিক থাকে না। সবচেয়ে রাগ হল তার ওই কেতাব তিনটের উপর। চাবি লাগানো সুটকেশ ভেঙে সে একদিন বার করে ফেলল কেতাব তিনটে। নিজে পড়তে পারে না, নিয়ে গেল কালিকাপ্রসাদের কাছে। কালিকাপ্রসাদ ব্রাহ্মণ বটে, সেও পড়তে জানে না। চৌরাস্তার। মোড় থেকে ডেকে নিয়ে আসা হল নারদ পণ্ডিতকে।

নারদ পণ্ডিত দেখল, একটা বইয়ের নাম, কমিউনিজম। ভেতরে একটা দাড়িওয়ালা লোকের ছবি, নীচে লেখা রয়েছে ঋষি কার্ল মার্কস্। আর একটা বইয়ের নাম, মাকস্বাদী শিক্ষা। ভেতরে ছোট ছোট দাড়ি ও গোঁফওয়ালা, টাকওয়ালা মানুষের ছবি। চাউনিটা চোখা। নীচে লেখা মহামতি লেনিন। তৃতীয়টা ভুখা মজদুর লেখক—রামনরেশ গুপ্তা।

দেখেই নারদ পণ্ডিত বই কটা বিষবৎ মাটিতে ফেলে দিয়ে বলল, ইয়ে ঠুনেসে পাপ হোতা। তুমহারা লেড়কা একদম জাহান্নমমে গয়া।

কালিকাপ্রসাদ বলল, পণ্ডিত, কিমলিস কিতাব হ্যায় না?

পণ্ডিত বলল, উসূসে ভি খারাপ।

বানোয়ারীর তো গায়ে কাঁটা দিল। বলল, কেয়া, মুসলমানি কিতাব?

ছবিগুলি দেখে ওইরকম অর্থই সে করেছে। পণ্ডিত বলল, উসে খারাপ। ঈশ্বর কো গালি লিখা হ্যায়। লেড়কা একদম বিগড় গয়া।

আর বলার দরকার ছিল না। রাগে গোঁফ ফুলিয়ে বানোয়ারী বই কটা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলল। তারপর হাঁটু মুড়ে বসল যেন সে এত দিনে সত্যিই বেচনকে শায়েস্তা করেছে।

ব্যাপারটাতে দু-একজনের আপত্তি ছিল। কিন্তু পণ্ডিত আর কালিকাপ্রসাদের সামনে বলতে সাহস পেল না।

সে সময়েই এল বেচন। একমুখ দাড়ি, নোংরা পাতলুন, ছেড়া জামা। মুখের হাড় বেরিয়ে পড়েছে। গলা ছেড়ে গান গাইতে গাইতে আসছিল সে :

একবার হো খাড়া হিম্মতসে
কিস্মত লুটো দুনিয়াসে।

 কিন্তু লোকজন দেখে থেমে গেল। তারপর ব্যাপারটা বুঝে সে কিন্তু খেপল না। ছেড়া কাগজগুলি দেখিয়ে বানোয়ারীকে জিজ্ঞেস করল, কৌন ফাড়া, তুম?

বানোয়ারী একটা হাতাহাতির আশঙ্কায় উঠে দাঁড়িয়ে বলল, হাঁ, তুমহারা বাপ।

ইয়ে তো সহি বাত। বলে বেচন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তীব্র গম্ভীর গলায় হাত নেড়ে নেড়ে বলল–তুম গলতি কিয়া। কাহে, না মজদুর কো এক বহুত হামদরদী, এক মহাক্রান্তিকারকো কিতাব তুম ফাড় দিয়া। দেখো আজ দুনিয়ামে—

বানোয়ারী চেঁচিয়ে উঠল, চোপ। চোপ রহো।

বেচন তখন নারদ পণ্ডিতের দিকে ফিরে হাত জোড় করে নমস্তে জানিয়ে বলল, পণ্ডিতজী শুনিয়ে, আপ সমঝিয়েগা।

পণ্ডিত লাফ দিয়ে উঠে খেঁকিয়ে উঠল, খবরদার, সমঝায়গা তো আচ্ছা নহি হোগা, হাঁ।

 বেচন অবাক হয়ে বলল, হাই লাও!

বানোয়ারী ভেংচে বলল, কেয়া লেগা রে? তু পণ্ডিতজী কো সমঝানে মাংতা? অভি নিকলো শালা, নিকলো।

শালা কথাটার প্রতিবাদের ইচ্ছা থাকলেও করল না বেচন। কেননা সে ভীষণ ক্লান্ত আর ক্ষুধার্ত। কিন্তু এ সময় খেতে চাইলেও পাওয়া যাবে না। সে তার কোটরগত বুভুক্ষু চোখে তাকিয়ে দেখল, ঝুনিয়া রুটি সেঁকছে। রুটি সেঁকতে সেঁকতে ঝুনিয়া এদিকেই তাকিয়েছিল। বেচনের চোখ পড়তেই, চোখ সরিয়ে নিল সে।

আর কোনও কথা না বলে, পকেটে হাত ঢুকিয়ে বেচন ধীরে ধীরে চলে গেল। এবং সত্যিই কিছুদিন বস্তিমুখো হল না। তার কারণ ছিল। কারখানায় জনা চল্লিশ লোককে ছাঁটাই করার কথা চলেছে। সে গিয়ে সেখানে ভিড়েছে। তাদের নিয়ে পড়েছে। শিউলূজনবাবু, কামতাপ্রসাদ, নওরিনবাবুও এসেছেন। তা হলেও বেচন ব্যাপারটাকে তো আর এমনি ছেড়ে দিতে পারে না।

ছাঁটাইয়ের মধ্যে তার মায়ের নামও ছিল। সে জন্যে সে একদিন পথে তার মাকে ধরেছিল, ব্যাপারটা বোঝাবার জন্যে। কিন্তু বানোয়ারী তাকে ইট নিয়ে তাড়া করেছিল। বলেছিল, শালা, কিমলিসপনা দিখানে আয়া? ফের শালা শুনে খানিকটা অভিমান করেই চলে গিয়েছিল বেচন।

এখন বেচনের চেহারাটা হয়েছে যেন ভবঘুরে পাগল ও ক্ষুধার্ত ভিখিরির মতো। বিশ্বাস করাই দায়, একদিন শীতের সন্ধ্যায় সে বেশ ফিটফাট ধোপদুরস্ত হয়ে এসেছিল। তার দোস্ত ইয়াররা অবশ্য তাকে খাওয়ায়, যেমন চা আর পান। কোনও কোনও সময় দুটো লেড়ো বিস্কুট কিংবা দু-পয়সার মুড়ি।

কিন্তু ব্যাপারটা এমনিই যে গত রেশন স্ট্রাইকের সাফল্য এবং তার পরবর্তী জীবনের অভিজ্ঞতা ও আকাঙ্ক্ষা তাকে সব ভুলিয়ে দিয়েছে। ছাঁটাইয়ের ব্যাপারে তাকে একটা কিছু করতেই হবে।

কিন্তু শ্রমিকরা সব সময় তার কথা শোনে না ; অবশ্য বেচনকে তারা একেবারে ফালতু মনে করে তাও নয়। তবে শিউপূজন কিংবা নওরিনবাবু অর্থাৎ নরেনবাবুর বুদ্ধির কাছে কোম্পানি হার। মানলেও মানতে পারে।

বেচন এখানে সেখানে মজুরদের ধরে ঠেট হিন্দিতে পরিষ্কার গলায় জিজ্ঞেস করে, কেয়া, তুমলোগ মধ পিনে মাংতা ইয়া নহি? মাংতা? তব, ইয়ে ভি খেয়াল রাখো, ছত তোড়নে হোগা, তকলিফ উঠানে হোগা, সমঝা?

বোঝাতে গিয়ে অনেকে দুর্বোধ্য নজরে চেয়ে থাকে। কেননা আর যা হোক, মৌমাছির হুল যদি জেল কোম্পানির গেট হয় তাহলে তো বড় ফ্যাসাদ। তা সে জেল থেকে বেচন যাই হয়ে আসুক। সুতরাং ভয়ও হয় তাদের।

কখনও দেখা যায়, নওরিনবাবু বা কামতাপ্রসাদের সঙ্গে সে রীতিমতো তর্ক জুড়েছে এবং হঠাৎ আজ দুনিয়ামে মজদুর লড়াইকা রাস্তা দেখাতে শুরু করেছে।

ওদিকে কালিকাপ্রসাদ তো রোজই বানোয়ারীকে ধমকাচ্ছে যে, সে যেন অবিলম্বে তার ছেলেকে এলাকা থেকে বার করে দেয়। বার করবে কী করে? হারামজাদাকে তো সে কাছেই পাচ্ছে না। আর সুটকেশ ও বেচনের ময়লা হয়ে যাওয়া বিছানা ছাড়া প্রতিশোধ তোলার আর কোনও বস্তুই নেই।

এদিকে একদিন সকাল বেলা গণ্ডগোল লেগে গেল। যাকে বলে হই হই পড়ে গেল। অর্থাৎ ছাঁটাই নোটিশ জারি হয়ে গেছে।

বেচন তখন রেল সাইডিং-এর গুমটি ঘরের বারান্দায় ঘুমোচ্ছ, যেন রাতজাগা লোম ওঠা ক্ষুধার্ত একটা নেড়ি কুকুর।

সাইডিং-এর গেটম্যান রামু তাকে ডেকে বলল, কা হো মহারাজ, আজ দুনিয়ামে ছাঁটাই নোটিশ গির গয়া।

হাঁ। বেচন লটপট করতে করতে কারখানা গেটের কাছে এসে হাজির। কিন্তু কারখানার গেটের কাছে কেউ নেই।

বেচন উঁকি দিতে গেল, দারোয়ান তেড়ে এল।

সে বারকয়েক পায়চারি করে মাথা নেড়ে ফের দাঁড়িয়ে পড়ল। যেন তার বউ প্রসব ব্যথায় ভেতরে কাতরাচ্ছে আর সে ছটফট করছে অকর্মার মতো।

একটু পরেই শিউপূজনবাবু কারখানা থেকে বেরিয়ে এল। কিন্তু বেচন তাকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ভীষণ ব্যস্তভাবে সে অন্যদিকে পা চালিয়ে দিল। এ তো বড় মুশকিল! তা হলে কীভাবে কাজ হবে?

তারপর টিফিনের সময় মজুররা সব বেরিয়ে এল। সেই সঙ্গেই বেরিয়ে এল চল্লিশজন ছাঁটাই মেয়ে ও পুরুষ। তার মধ্যে বেচনের মা-ও ছিল! তারা সব বুক চাপড়ে কোম্পানির পিতৃ-পিতামহ তুলে গালাগাল দিচ্ছে।

বেচন মনে মনে বলল, ইয়ে বুজদিললোগ কাহে গালি বকতা?

সে একে তাকে ডাকতে লাগল। কিন্তু কেউই তার কথায় কান দিচ্ছে না।

তখন সে কারখানার সামনে, মাইল পোস্টের ছয় ইঞ্চি জায়গার উপর কোনওরকমে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠল, আরে ভাগ কাঁহা তু লোগ? আঁ, হমকো পচানতা নহি?

চেনে বইকী। কিন্তু চিনে কী করবে? জনারণ্যের স্রোত বেরিয়েই চলল। বেচন একবার বলল, হাই লাও। সংকীর্ণ জায়গায় তার পা দুটো টলে গেল। তারপর আবার সোজা হয়ে সে চিৎকার করে উঠল, হম বেচন। হম্‌ বোলতা, তুলোগ ঠাহর যা। ছাঁটাই জরুর বন্দ করনে হোগা। দেখো ভাই, তুলোগ মজদুর হ্যায়। তেরা তাগদ ম্যানেজারসে জায়দা হ্যায়। হাঁ, আজকে দুনিয়ামে..

জনারণ্যের স্রোত দ্বীপের মতো এখানে ওখানে থমকে গেল। ভিড়ের মধ্যে বানোয়ারীর হাত নিশপিশ করছে। শুয়ারের বাচ্চাটার চুলের মুঠি ধরে না নামলে চলবে না দেখছি। খুব কিলিসপনা হচ্ছে। হারামজাদার পকেটে বোমা নেই তো?

বেচন বক্তৃতা ছেড়ে মাঝে একবার বলে উঠল, নাথুনি, মত্ যাও। কাহে? না, তু এক বুঢ়া মজদুর।

কামতাপ্রসাদ আর নওরিনবাবু দূর থেকে তাকে তারিফ করছে, এটা বেচন দেখতে পেল। ফলে তার গলা আরও চড়ল। সে এক পায়ে দাঁড়িয়েছিল। পা বদলে বলল, হম বেচন, জেহেলমে গয়া। কাহে? না রেশনকা হরতাল কিয়া। তু লোগ উস বা ভুল গয়া?

এক পশলা বৃষ্টির পর কাঠফাটা রোদে সবাই নাক মুখ কুঁচকে, দাঁত জিভ বের করে দাঁড়িয়ে পড়েছে। সবাই ঘিরে ধরেছে তাকে। সে ঘামছে। গায়ের মধ্যে কী যেন কুটকুট করছে।

কিন্তু সব ভুলে সে বলেই চলল, উস ঘড়িকে বাত ইয়াদ করো। ছাঁটাই নোটিশ আপিসকে। টেবিল পর জমা কর দো। কাহে? মজদুর তু খানা বিনা মর জায়েগা তো জমানা কৌন বদলেগা!

একটা সমর্থনসূচক ধ্বনি উঠল। বেচন ঘাম মুছে আবার বলবার উপক্রম করতেই কী একটা ঘটে গেল। সবাই শুনল, একটা চাপা আর্তনাদ হাই লাও! আর ঠিক একটা কাটা কলা গাছের মতো বেচন ঝরে পড়ল মাইল পোস্টের গায়ে।

চারদিকে একটা রব উঠল, খুন খুন হো গয়া। অনেকে পালাতে লাগল কেউ কেউ দিকভুল করে ছুটোছুটি করতে লাগল।

কিন্তু রামদেইয়ের বিকট চিৎকার একটা স্তব্ধতা এনে দিল। বুড়ি রামদেই ছুটে এসে বেচনকে তার। কোলে টেনে তুলে নিল। বেচনের তখন চৈতন্য নেই, সে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। ফাটা মাথায়। রক্তের ফিনকি ছুটেছে। রামদেইয়ের রেখাবহুল মুখটা কুঁচকে আটার দলার মতো ছোট হয়ে এল আর অন্ধ হয়ে গেল চোখ। বলল, ইয়ে তু কেয়সা বুজদিল কিমলিসোয়া বনকে আয়া, আঁ? জেহেল কোম্পানি তুঝকো কেয়া বনা দিয়া।

যাই হোক, কামতাপ্রসাদ বলল, ডাক্তারখানায় যেতে হবে।

বানোয়ারী অবাক বোকার মতো দাঁড়িয়ে তার বউ আর ছেলের দৃশ্য দেখছিল। তাকে খেঁকিয়ে উঠল রামদেই, আরে এ বুজদিল বুড়া, তু খাড়া হোকে কা দেখতা, বেটাকো উঠাও।

কাকে? বেচনকে? যেন এ অভাবিতপূর্ব কথা বানোয়ারী কখনও শোনেনি। এমনকী তার লজ্জা হতে লাগল। তবু দু-হাতে তুলে নিল বেচনকে।

তারপর ডাক্তারখানা থেকে মাথা সেলাই করে বেচনকে নিয়ে বস্তিতে এল তারা। তাদের সঙ্গে অনেক লোক, তারা কেউই আজ কারখানায় যায়নি।

কালিকাপ্রসাদ দেখল এতেও কিছু হল না। তখন সে বানোয়ারীকে ডেকে খেঁকিয়ে উঠল, কেয়া, তুম ভি কিমলিস বন্ গয়া?

বানোয়ারী বলল, আরে রাম রাম।

কালিকাপ্রসাদ বলল রাম রাম কেয়া! উসকো কাহে লে আয়া?

 বানোয়ারী অপ্রতিভভাবে মাথা চুলকে চাপা গলায় বলে ফেলল, বাবুসাহেব যো কুছ হো হম তো কিমলিসকা বাপ হ্যায়…

কালিকাপ্রসাদের রাগের চোটে কথাই বেরুল না মুখ দিয়ে। বুড়োটার মনেও এই ছিল?

গল্প যদি কিছু বলা হয়ে থাকে, তবে তা এখানেই শেষ। তবু আইন ভঙ্গ করে আর দুটি কথা লিখছি।

রাত কিছু হয়েছে। কয়েক পশলা বৃষ্টির পর মেঘলা ভাঙা জ্যোৎস্না ছড়িয়ে পড়েছে দিক। দিগন্তে। বর্ষার গঙ্গা জোয়ারের তীব্র স্রোতে ছুটে চলেছে উত্তরাভিমুখে। গঙ্গা যেন ঝকমকে সোনার পাত

বস্তিতে অনেক লোক এখানে সেখানে তখনও বসে আছে। তারা খবর পেয়েছে যে কোম্পানি আপাতত ছাঁটাই বন্ধ করেছে। কিছুক্ষণ আগেই বেচনের জ্ঞান হয়েছে। তার কাছে বসে আছে। পাশাপাশি রামদেই আর বানোয়ারী। মাটিতে শুয়ে আছে ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলি। অদূরে। ঝুনিয়া চোখে জলের দাগ নিয়ে বিহ্বলভাবে বসে আছে। পিঙ্গলবর্ণের ভেঙে পড়া খোঁপা ও ময়লা ঘাড়ের কাছে চাঁদের আলো এসে পড়েছে। রামদেইয়ের চোখ দিয়ে জল পড়ছে। সে ফিসফিস করে বলল, তু কিনা বড়া কিলিস বন গয়া! তু চলা যানেসে, কিস্কা যায়েগা। ইয়ে রামদেইকা কি নহি?

বানোয়ারীর গলাটা কেঁপে উঠল কথা বলতে গিয়ে। তবু যুক্তিপূর্ণভাবে উত্তর দিল, হমকো তুমহারা সাথ জোড় লেও। উসকো কেয়া বোর্তা, হাঁ হতো কিমলিসকে বাপ বন গয়া! আরে রাম রাম। গলার স্বরটা যেন টুপ করে ডুবে গেল অতলে।

বেচন কথা বলতে গেল। কিন্তু পারল না। তার বুকের কাছে কী যেন ঠেলে এল, আর চোখ। দুটো ভিজে উঠল। এটা যে কী ব্যাপার, সেটা ঠিক বুঝে ওঠার আগেই বেচন বলে ফেললে, অভি কাঁহা বন্ চুকা। কোই রোজ বন্ যায়েগা।

বলে সে দেখলে ঝুনিয়া ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর খাঁটিয়ার উপর বেচনের বুকের কাছে হাতটা এসে পড়েছে। আরও আশ্চর্য হয়ে দেখল বেচন, ঝুনিয়ার ময়লা গায়ে মুখে গাদা গাদা কী সব লেগে রয়েছে চুনের মতো। ও! হিমানীর কৌটোটা বোধ হয় সবটুকু মেখেছে আর তারই গন্ধ বেরুচ্ছে। বেচনের মুখ থেকে আর কথাই বেরুল না।

অনেকক্ষণ পর সে বলল, দেখো, আজকালকি দুনিয়ামে এক মজদুর আওরত রোনেসে–

বানোয়ারী বলে উঠল, ব্যস্ করো। বিমারকে টাইমমে উসব বাত নহি বোলেগা, বোল দেতা হ্যায়।

বেচন বাধা পেয়ে বলল হাই লাও!

কথাটা শুনে ঝুনিয়ার কান্না দ্বিগুণ হয়ে উঠল। কেননা আজ আর তার কোনও সন্দেহ নেই। অবাক জ্যোৎস্না রাত মায়ের মতো কেমন যেন বিষণ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *