পশারিণী

পশারিণী

সেই সময় সে এসে দাঁড়াল।

যখন চৈত্রের দুপুর ঝিমোচ্ছিল। যখন কলকাতা থেকে মাইল বারো দূরে উত্তরের এই স্টেশনটাও ঝিমোচ্ছিল এই দুপুরের মতোই। অবসন্ন, হাত পা এলিয়ে দেওয়া চোয়াল নাড়া, ল্যাজে মাছি না তাড়ানো অবসাদগ্রস্ত চোখ বোজা জানোয়ারের মতো।

যখন দক্ষিণের হাওয়াটা উঠছিল এলোমেলো হয়ে, আড় মাতলার মতো টিন শেডের কানায় ঘা খেয়ে হঠাৎ দমকা নিশ্বাসের মতো শব্দ তুলে যাচ্ছিল হারিয়ে।

যখন বড় গাছগুলির মাথা দুলছিল, স্টেশনের পুবের ঘন ঘন ঘাস কাঁপছিল আর আকাশ যেন উত্তাপের ভয়ে পাখা মেলা চিলগুলি-সহ হঠাৎ নেমে আসছিল খানিকটা। যখন স্টেশনটা যাত্রীহীন, প্ল্যাটফর্মের ঘুমন্ত কুকুরটা হঠাৎ ঘাড় তুলে কীসের গন্ধ শুঁকছিল বাতাসে, কুলিটা উঁকি মেরে দেখছিল দূরের সিগন্যাল, স্টেশনমাস্টার নাকের ডগায় চশমা নিয়ে তাকিয়ে ঘুমোচ্ছিলেন আপিসে। যখন বয়স ও অবয়বহীন, ব্যাগ ও ছোটখাটো কাঠের বাক্স জড়ানো একটা মানুষের দলা স্তূপাকার দেহপিণ্ডের মতো পড়েছিল ওয়েটিংরুমের কোণে, ডাউন প্ল্যাটফর্মের লোহার বেড়ায় হেলান দিয়ে। পুবের ফোর্থ লাইনে অপেক্ষমাণ এঞ্জিনের কালো ধোঁয়ারাশি যখন ঝাঁপিয়ে পড়ছিল ওদের গায়।

তখন সে এল। ধীরে এসে দাঁড়াল আপ প্ল্যাটফর্মের কিনারে।

একবার দেখল উত্তরে আর একবার দক্ষিণে। তারপর পুবে, ডাউন প্ল্যাটফর্মের ওই স্তূপাকার দেহপিণ্ডের দিকে। সেইদিকে সে তাকিয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত, একটু বেশি কৌতূহল নিয়ে।

চেহারা দেখে তার বয়স অনুমান করা কঠিন। হতে পারে আঠারো কিংবা বাইশ, নয়তো আরও দুবছর বেশি। হতে পারে এমনও, সে পঞ্চদশী বা ষোড়শী। রোগা রোগা গড়ন, সেজন্যে একটু লম্বা মনে হয়। একটু লম্বা, যেন হঠাৎ ছোট একটা মেয়ে কিছুটা বেড়ে উঠেছে। মাজা মাজা রং। ফিতাহীন এলো-খোঁপার রুক্ষ গোছাটা এত বড় যেন ওটার ভারে সে নুয়ে পড়ছে। দেহের সমস্ত গড়নটা যেন তার চুলেই কেন্দ্রীভূত। চোখ-মুখ বলার মতো কিছু না, অথচ একটা না বলার শান্ত দৃঢ়তার ছাপ তার মুখে। হাতে-কাঁচা একটা মোটা নীল শাড়ি সাদাসিদেভাবে তার পরনে, গায়ে সাদা জামা। পায়ে রোদে-জলে ধোয়া পোড়া মান্ধাতার আমলের স্যান্ডেল। কাঁধে একটা ছিটের ব্যাগ। ব্যাগটা নতুন। হাতে গোটা কয়েক কাঁচের চুড়ি। নাম তার পুষ্প–পুষ্পবালা। পুষ্পর চোখগুলি বড় বড় কিন্তু করুণ। তাকে দেখলেই মনে হয় যেন, অনেক ঝড়ঝঞ্ঝা দুর্যোগের রাত্রি পেরিয়ে একটু গোছগাছ করে এসে দাঁড়িয়েছে প্রসন্ন সকালে। দাঁড়িয়েছে আশা ও সংশয় নিয়ে।

ওভারব্রিজের উপর দিয়ে সে এল ডাউন প্ল্যাটফর্মে। এসে বসল একটা বেঞ্চিতে। বেঞ্চিটার দু-তিন হাত দূরেই, একটা মাল-ঠেলা ট্রলির উপর গায়ে গায়ে লেপটে পড়েছিল সেই মানুষগুলি। ট্রলির নীচেও দু-একজন। কয়েকজন রেলিংয়ে হেলান দিয়ে রয়েছে। কোলে বগলে কাঁধে তাদের ব্যাগ, বয়াম, কাঠ অথবা টিনের ছোট বাক্স। মনে হচ্ছিল, সব মিলিয়ে দেহস্তূপটা নিশ্চল, নিঃশব্দ।

কিন্তু তা নয়। লক্ষ করলে দেখা যায়, স্তূপটা নড়ছে। কান পাতলে শোনা যায় চাকের মৌমাছির মতো একটা চাপা গুঞ্জন। একটা গোঙানি।

পুষ্প দেখল সেদিকে আড়চোখে, বসল অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে। কান পেতে রইল ওই গোঙানি স্বরের মধ্যে যেন কোনও গোপন কথা শুনছে, এমনি কৌতূহল তার বড় বড় চোখ দুটিতে। কোলের উপর টেনে দু-হাতে জড়িয়ে ধরল ব্যাগটা।

মনে হচ্ছিল গোঙানি। গোঙানি নয়, কথা। পুষ্পর পুরনো স্যান্ডেলের খসখসানিতে কথাটা থামল। তারপর, চাপাস্বরে কেউ বললে–যেন পুষ্প শুনতে না পায়, কে রে বাইরন ওয়াটার?

কিন্তু একাগ্রভাবে কান পাতায় শুনতে পেল পুষ্প। কিন্তু বাইরন। এমন নাম শোনেনি জীবনে। তারপরের সব নামগুলিই আরও অদ্ভুত। বোধ হয় বাইরনেরই গলা শোনা গেল, একটা মেয়ে।

আইবুড়ো?

 বোঝা যাচ্ছে না।

কীরে নিমের মাজন?

সম্ভবত জবাব দিল নিমের মাজন, কী জানি। ভিকসকে জিজ্ঞেস কর। ওসব বোঝে ও।

ভিকস বলল, কেন বাবা মরটনকে জিজ্ঞেস করো না, বিক্রি বেশি, মানুষ চেনে।

মরটন বলল, তোমাদের যেমন শালা কথা। আজকাল আইবুড়ো আর নাইবুড়ো বোঝা যায়?

তবে ভদ্দরলোক বলে মনে হচ্ছে।

আবার প্রথম গলাটাই শোনা গেল, এই জন্যেই তো বলছিলাম। দ্যাখ না, দু-পয়সার মাল যদি বিকোয় দুপুরের ঝোঁকে। কই রে দার্জিলিঙের নেবু।

বোধ হয় এবার জবাব দিল লেবুই। লেবু খাওয়ার মতো চেহারা মনে হচ্ছে না–তারপর যা বলছিলি তার কী হল বল।

ঢিপঢিপ করছিল পুষ্পর বুকের মধ্যে। এত জোরে টিপটিপ করছিল যে, বুকের কাছে আঁচলটা কষে টেনে দিতে হল তাকে। চোখে ত্রাসের ছায়া। তবু কৌতূহল, আর তার মাজা-মাজা মুখে হাসি লজ্জা ও ভয়ের মিলিত বিচিত্র ছাপ পড়ল।

আবার একটা ভাঙা ও চাপা উৎসুক গলা শোনা গেল, তারপর কী হল হরেন, থুড়ি, পারিজ সুইট? সুইটি না কী?

জবাবে আবার সেই গোঙানিটা শোনা গেল, তারপর আবার কী, ম্যাট্রিকটা পাশ করে ফেললুম। মেদিনীপুর কলেজে ভর্তিও হয়েছিলাম মাইরি। কেঁচে গেল।

কী করে?

যেমনি করে কেঁচে যায়। পয়সা নেই। বাবা বললে, খুব হয়েছে। এবার একটা চাকরি-বাকরি দেখে নিগে যা। ম্যাট্রক পাশ হয়েছিস, বংশে এই প্রথম। আবার কী! শালা!…

শালা কেন?

কে দেবে চাকরি। ভিকসও তো ম্যাট্রিক পাশ করেছে। কীরে কেষ্ট, বল না তোর চাকরির কথা।

ভিকস ভেংচে উঠল, কেন আবার কেষ্ট কেন, ভিকস বলা যায় না? ম্যাট্রিক পাশ আবার কীসের? সে তো করেছিল কেষ্ট রায়। মরে ভূত হয়ে গেছে কবে। এখন ভিকস! সর্দি, কাশি, মাথা ধরা…এই চাপাস্বরের গোঙানির মধ্যেই সমবেত গলার একটা হাসি বেরিয়ে আসবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু চাপা পড়ে গেল। যেন পোড়ো বাড়ির রুদ্ধ অন্দরে দমকা হাওয়া পাক খেয়ে মুখ গুঁজে হারিয়ে গেল।

আবার, হ্যাঁ ওই যে কালি বিক্কিরি করে চশমাওয়ালা ছোঁড়াটা, ও নাকি গেজেট।

কে, দার্জিলিঙের নেবু বুঝি? গেজেট কী রে শালা। বল গ্রাজুয়েট।

দার্জিলিঙের লেবু তাতে লজ্জা পেল না। বলল, কী জানি। মুখে না এলে, জিভটা তো আর আঙুল দিয়ে নাড়া যায় না!

পাগল! কিন্তু আসামের লেবু তো দার্জিলিঙের ঠিক বলতে পারিস?

হ্যালহেলে গলায় হেসে জবাব দিল, তো ব্যাওসা চালাতে হলে…। যা বলছিলুম, গেজেটও শালা হকারি করে! আর কী রকম ভদ্দরলোক দেখিছিস ছোঁড়াটাকে। নির্ঘাত কেটে পড়বে একদিন।..

কথাগুলি যেন গিলছিল পুষ্প। সে বসেছিল পশ্চিমদিকে মুখ করে। কিন্তু চোখে তার ওদেরই কথার ছায়া। সব মিলিয়ে তার শিশুর মতো মুখে কৌতূহল ও চাপা হাসি ছড়িয়ে পড়েছে। বিষাদে ভরা চোখ দুটিতে তার চাপা হাসির আলো পড়ে দুষ্টু মেয়ের ভাব হয়ে উঠেছে।

আবার একটা নতুন গলা শোনা গেল, আমিও শালা কেলাস এইট অবদি পড়েছিলাম।

মাইরি?

কেন, বিশ্বাস হয় না বুঝি?

না, বলি কোন ইস্কুলে?

কেন, ঢাকা শহরের হাইস্কুলে।

বটে? তোরা তো আবার বিক্রমপুরের জমিদার ছিলি না?

চিবিয়ে চিবিয়ে বলল আর এক জন, হ্যাঁ জমিদার। এখন চানাচুরদার হয়েছে।

আবার একটা চাপা হাসি ও ক্রুদ্ধ গলার গুঞ্জন উঠল। চানাচুরদারই বলে উঠল, আমি জমিদার ছিলাম না, আমার মেসোমশায়?

ও-ই হল। মায়ের বোনের বর তো। আ হা হা উঠছিস কোথায়?

না হয় শালা এইট অদিই পড়েছিস। হল তো? বোস এখন।

আর একটা নতুন গলা, আমি তো শালা জীবনে বই ছুঁইনি।

আমিও না।

আমি তো বই দেখলে কেটেই পড়ি শালা!

আর মেয়ে দেখলে জমে যাস।

আবার হাসি। তারপর শান্ত গম্ভীর গলায় একজন বলল, থাম থাম।

হরেন তারপর?

হরেন বলল, তারপর আবার কি? বিয়াল্লিশে দেশ স্বাধীন করতে গেলুম। গুলি খেয়ে ঠ্যাংটা গেল। তারপর লাঠি বগলে দিয়ে নরক ঘুরতে ঘুরতে এই ট্রেনের হকারি। ক্ষণিক নিঃশব্দ। শুধু ফোর্থ লাইনের এঞ্জিনটার সোঁ সোঁ।

তারপর আবার, মাইরি, আমাকে আবার লোকে গলায় মালা দিয়েছিল, যখন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছিলুম। আর এ লাইনের পুরনো হকাররা প্রথম প্রথম পাছায় লাথি মারত।

পুষ্পর শান্ত মুখের হাসিটুকু হঠাৎ উধাও হল। ব্যাকুল অথচ চাপা ব্যথায় ভরে উঠল মুখটা। ফিরে তাকাতে গিয়েও পারল না। শুধু কাত হয়ে পড়ল তার মাথার চেয়ে বড় খোঁপাটা।

কে আর একজন বলল, আমার বউটা মরে গেল তাই। নইলে—

একটা বিদ্রুপাত্মক কচি গলায় শোনা গেল, আমার তো বাপ মা সবই মরে গেল দাঙ্গায়।

বউ, গেলে বউ হয়। বাপ মা—

আমার গ্লাস ফ্যাক্টরির চাকরিটা খেয়ে দিল শালা পালবাবু!

হঠাৎ সমস্ত দেহস্তূপটা থেকে অভাব, অভিযোগ, ব্যথা, ব্যর্থতা ও ক্রুদ্ধ একটা মিলিত গুঞ্জন উঠতে লাগল। যেন একনাগাড়ে উড়ে চলেছে এঞ্জিনের কালো ধোঁয়া। তারা কেউ বাপ মা বউ হারিয়েছে, জমি ছাড়া হয়েছে, ছাঁটাই হয়েছে কারখানা থেকে বিতাড়িত হয়েছে ঘর থেকে। কাউকে খাওয়াতে হয় গাদা গাদা পোষ্যদের, জোগাতে হয়, নয়তো স্রেফ শালা সিনেমা আর নেশা, মাইরি!

পুষ্পর চাপা বুকটার মধ্যের কী যেন কলরব করে উঠল ওদের মতো। চুপি চুপি ফিসফিস করে আর্তনাদ করে উঠল, তার বুকের মধ্যে ; বুড়ি মা, ছোট ছোট ভাই বোন, অনাহার, পীড়ন, অপমান। বিয়ে, বর, ঘর ও শান্তির স্বপ্ন! একটু ভালবাসা, এক ছিটে সোহাগ…

একটা তীব্র বিদ্রূপের হাসি চমকে দিল চৈত্রের দুপুরের ঝিম-ধরা স্টেশনটাকে। যেন গলা টিপে ধরল সমবেত গোঙানি-স্বরটা। চাপা পড়ে গেল ইঞ্জিনের সোঁ সোঁ শব্দ। তারপর শোনা গেল হাসির চেয়েও তীব্র শ্লেষভরা কথা, এই, এই হয়েছে। সব ব্যাটার সর্দি ধরে গেছে। লাও, ভিকস।

ভিকস দোস্ত, ভিকস। সর্দি, কাশি, মাথা ধরা।

আর এক জন, আই কিওর, আই কিওর। লাগাও, চোখের জল আর পড়বে না, মাইরি বলছি।

আবার সাড়া পড়ল হাসির। আটকে-পড়া ঘূর্ণি জলের আবর্ত ছাড়া পেল। এবার কড়া হাসি চড়ল আরও। নিরাশার পাগলা হাওয়া সঙ্গী পেল অনেকগুলি।

আশ্চর্য! পুষ্পর চাপা-পড়া অস্থির বুকটাতেও হুস করে হাওয়া লাগল একটু। সে শান্ত হল, বিপথ থেকে পথে ফিরল হৃদয়। একটু হাসিও যেন দেখা দিল চোখে। খুলে পড়েছিল শুধু চুলের গোছাটা। সেটাকে বাঁধল আবার টেনে। কী যে চুল!

দূর থেকে ভেসে এল ট্রেনের হুইশল। মাল-ঠেলা ট্রলিটা খালি করে ভেঙে গেল দেহস্তূপটা। যেন চাকের মৌমাছি সব খালি করে ছড়িয়ে পড়ল।

প্রথমে ক্রাচ ঠুকে ঠুকে সামনে এল হরেন, পারিজ সুইট। একটা বুক খোলা, গায়ে-ছোট জামা আর সরু পাজামা। দূরে তাকিয়ে দেখল গাড়ি, তারপরে মহিলা প্যাসেঞ্জারের চেহারাটা। অর্থাৎ পুষ্পকে। যদি দুটো পারিজ লজেন্স কাটে। কিন্তু না, কোনও আশা নেই। চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, আঁচল গড়ের মাঠ। কেবল তার খোঁড়া চেহারাটার দিকেই মেয়েটা হাঁ করে তাকিয়ে আছে। যেন জীবনে আর খোঁড়া দেখেনি কোনওদিন। নেহাত ভদ্রলোকের মেয়ে।

চোখাচোখি হতেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল পুষ্প। তারপর আর একজন। একজন একজন করে সবাই দেখল মাত্র একটি প্যাসেঞ্জারকে। বায়রন ওয়াটার, ভিকস, মরটন, চানাচুর, পানবিড়ি, ফাউন্টেন পেন…সকলে। এই দুপুরের ঝোঁকে যখন অনেক দেরিতে দেরিতে আসে ফাঁকা গাড়ি, তখন ছুটকো খদ্দেরকে তারা এমনি শিকারি বাজপাখির মতো দেখে তাকিয়ে তাকিয়ে। কিন্তু মস্ত চুপড়ির মতো খোঁপাওয়ালা মেয়েটা যে কিছু কিনবে, এমন আশা হল না তাদের।

ইতিমধ্যে এল আরও দু-একজন প্যাসেঞ্জার। এল গাড়ি। দুপুরের লোকাল ট্রেন। অধিকাংশ দরজাগুলি খোলা, কামরাগুলি ফাঁকা। ভিখিরি অন্ধ আর খঞ্জরাই একমাত্র যাত্রী। পড়ে পড়ে ঘুম দিচ্ছে দেদার। সাধারণ যাত্রীর সংখ্যা নগণ্য। তারাও ঝিমুচ্ছে, ঘুমোচ্ছে, বিড়ি ফুঁকছে। কেউ বই পড়ছে নয়তো গান ধরেছে গুনগুন করে। এর মধ্যেই কোনও কামরা থেকে ভেসে আসছে একঘেয়ে গল্প, ‘অন্ধ হয়ে ভাই কত দুঃখ পাই’। সে নিশ্চয় খাঁটি অন্ধ। নইলে-চেঁচাত না ফাঁকা গাড়িতে। আর কামরায় কামরায় হকারদের চিৎকার নেই, দলে দলে গুলতানি চলছে।

কে একজন চিৎকার করে বলল, কইরে, প্রগতিশীল কাগজ-বিক্রেতা বসে রইলি যে?

জবাব এল, প্যাসেঞ্জারই নেই, কী হবে এখন গিয়ে?

প্যাসেঞ্জার কি আকাশ থেকে পড়বে? ছুটির সময় হল, শিয়ালদা চল। চল যাই।

প্রত্যেকটি কথা কান পেতে শুনল পুষ্প। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল প্রত্যেকটি হকারের চেহারা। প্রত্যেকের চলা বলা হাসি, তাদের কথার ভঙ্গি। তারপর দ্বিধাজড়িত পায়ে এগিয়ে একটা কামরার হাতল ধরল। ধরে উঠবে গাড়িতে, তেমন শক্তিটুকুও যেন নেই হাতে। এখান থেকে শিয়ালদা, মাত্র বারো মাইল যার দূরত্ব। তবু সে যেন কতদূর। কত দুঃসাহসের যাত্রা। বুকের মধ্যে ভয়ের ধুকপুকুনি, ধড়ফড়ানি। আর এই মানুষগুলি, উশকো-খুশকো চুল, এবড়ো-খেবড়ো মুখ, ছেড়া ময়লা জামা। কাঁধে বগলে যাদের চলন্ত দোকান ছুটন্ত ট্রেনের সংকীর্ণ পাদানির বিপজ্জনক পথে পথে চলেছে ছুটে। এত শক্তি কোথায় পুষ্পর দেহে।

কিন্তু সময় নেই ভাববার। বাঁশি বাজাল গার্ড। বাঁশি বাজল গাড়ির।

তারপর কয়েক মুহূর্তের থেমে যাওয়া চাকাগুলি একটা তীব্র আর্তনাদ করে এগিয়ে চলল। যেন পুষ্পর সমস্ত সংশয় ও ভয়ের দড়িটাকে ছিঁড়ে দিয়ে টেনে নিয়ে গেল তাকে শব্দটা। স্টেশনটা আবার ঝিমুতে লাগল পেছনে।

যেতেই হবে। এই পথের যাত্রা ছাড়া জীবনে আর কোনও যাত্রা নেই। জীবনের সমস্ত যাত্রা আজ ঠেলে দিয়েছে এই পথে। মানুষের জীবনে তার পেছনটা শুধু ঝিমোয়, ওই ফেলে আশা স্টেশনটার মতো। পুষ্পর পেছনটা কেবলি তাড়া করে। কখনও দারুণ অভাবের বেশে, অপমানের বেশে। কখনও ঘৃণ্য লোভের মূর্তিতে, দুরন্ত কান্নার বন্যায়। সুদীর্ঘ, বিরলযাত্রী কামরার এক কোণে জড়োসড়ো হয়ে বসল পুষ্প। খোলা দরজা দিয়ে দুর্বার হাওয়া এসে বিস্রস্ত করে দিল তার শাড়ির আঁচল আর চুলের গোছা। দু-হাতে ব্যাগটি বুকের কাছে নিয়ে নিশ্চল হয়ে তবু বসে রইল পুষ্প। পুষ্পবালা, ঢাকা জেলার কাছে বজ্রহাটের নিরাপদ মাস্টারের মেয়ে। তবু তার বুক চাপা ভয়ের পাথর, ব্যাকুল সংশয়। সে পারবে কি? পারবে তো?

চোখের উপর ভেসে উঠল বিধবা মায়ের মুখ। সে মুখ মেয়ের প্রতি নির্দয়, অথচ মমতাময়ী। সেই মুখটি চোখে ভাসল আর মন বলল, পারব। অপোগণ্ড ভাইবোনগুলির মুখ মনে পড়ল, আর মন বলল, পারব। তার নিজের ক্ষুধাকাতর পুষ্ট ও অপুষ্টতায় মেশা এই দেহ ও মন দাঁড়াল তার সামনে, মন বলল, পারব পারব। তার এই সুদীর্ঘ চুলের গোছা যতই এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে পড়তে লাগল, ঝাপটা মারতে লাগল, ততই তার শিরদাঁড়া থেকে পায়ের দিকে একটা অদৃশ্য শক্তি নুয়ে-পড়া দেহটাকে সোজা করে দিয়ে ছুটে এল পারব পারব বলে।

ওই তো কয়েকজন যাত্রী অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে তার অতিকায় চুলের দিকে। চুলের ওইটুকুই তার রূপ। তার সুখ দুঃখ অপমান। বাবা বলত আদর করে, আমার এলোকেশী। এই চুল একদিন আদর দিয়েছে, সোহাগ কেড়েছে। হাতিয়ে সুখ, আঁচড়ে দিয়ে সুখ, বেঁধে দিয়ে আনন্দ। অনেক সঙ্গিনী শুধু খেলার জন্যে দশটা করে বিনুনি বেঁধে চুড়ো বেঁধে দিয়েছে শিবের মতো! সাপের জটার মতো দিয়েছে জড়িয়ে। আজও এ চুল মন টানে, চোখ টানে। আর পুষ্প ভাবে, এ চুল গলায় বেঁধে ঝোলা যায় না কড়িকাঠে? এ চুলে একটি দিয়াশলাইয়ের কাটি জ্বালিয়ে দিলে দরকার হবে না চিতার কাঠ সাজানোর।

তবু তো এ চুল মুড়িয়ে দিতে হাত উঠেও ওঠেনি। আগুন জ্বালাতে নিভে গেছে দীপশলাকা। প্রাণটাকে টিপে শেষ করতে গিয়েও থাবা গুটিয়ে এসেছে আপনি। মৃত্যু যে বাসা বাঁধেনি মনের কোথাও। সে তাকে ঠেলে দিয়েছে এই পথে। সে পারবে না কেন?

এই গরমের দুপুরবেলা যখন আপনার গলা শুকিয়ে আসছে। কিশোর গলা শুনে চমকে উঠল। পুষ্প দেখল একটা ছেলে, কামরার মাঝখানে দাঁড়িয়ে যতটা সম্ভব পরিষ্কার স্বরে চিৎকার করছে। যখন আপনার ঘুম আসছে আর শরীরটা ভার লাগছে, তখন মুখে পুরে দিন এক শ্লাইজ মরটনের টকমিষ্টি লজেন্স। মুখ ভরে উঠবে রসে, নতুন এনার্জি আপনাকে ফ্রেশ করে তুলবে, না হলে পয়সা ফেরত। এক শ্লাইজ দু-পয়সা, দুশ্লাইজ চার পয়সা, ছ-শ্লাইজ দশ পয়সা। বলুন কোন দাদাকে দেব, বলে ফেলুন।

কিন্তু যাত্রীরা নির্বিকার। কেউ এক আধবার তাকিয়ে দেখল, শুনল কেউ কেউ, ঝিমোতে লাগল অধিকাংশ। দুপুরের যাত্রী, ছাত্র কেরানির ভিড় নেই। খুচরো ব্যবসাদার, বেকার, উমেদার আর ভিক্ষুকের ভিড়।

এই যে, এখানে একটা দাও।

ছেলেটা ফিরে তাকাল আর হাসির রোল পড়ল একটা। আর একজন মরটন লজেন্সেরই হকার তাকে ডাকছে। বলল, দে না একটা, কেউ তো নেবে না, আমিই নিই।

দেখা গেল, মরটন, পারিজ, বায়রন, প্রগতিশীল কাগজ, ফাউন্টেন পেন, চানাচুর, সব একসঙ্গে ঠাঁই নিয়েছে কামরার আর এক কোণে।

ছেলেটাও হাসল। তবু বলল, বলুন আর কারও চাই। শুধু শুধু ঝিমুবেন না, তেষ্টায় কষ্ট পাবেন। এক শ্লাইজ আধঘণ্টা আপনার গালে থাকবে।

একজন ফিরে তাকাল। বোধহয় বুড়ো উমেদার। ছেলেটা বলল, আধঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা স্বাদে গন্ধে ভরে রাখবে আপনার মুখ।

এক ঘণ্টা? লোকটি বলল, দেখি একটা।

ছেলেটি বলল, দুটো দিই?

একঘণ্টা থাকে তো গালে?

ছেলেটা বলল, না চিবুলে সোয়া ঘণ্টা থাকবে। পাথর দাদা পাথর।

 লোকটি কিনে ফেলল দুটো।

আর কারও চাই, বলুন?

সে আবার লজেন্সের গুণগান আরম্ভ করল। আরও সুন্দর ভাষায়, জোরালো ভাষায়। আরও তিনটে বিক্রি হল।

পুষ্প জানে না, অজান্তেই তার মুখে একটু হাসির আভাস দেখা দিয়েছে। সে ভারী খুশি হয়েছে ছেলেটার কৃতকার্যতায়। হঠাৎ ছেলেটা তাকেই জিজ্ঞেস করছে, আপনাকে দেব এক শ্লাইজ দিদিমণি, মরটনস সুইট।

বিস্মিত লজ্জায় চমকে পুষ্প ঘাড় কাত করে ফেলল। ছেলেটা কয়েক লাফে হাজির হল তার কাছে। পুষ্পর বুকের মধ্যে ঢাক বাজছে। পয়সা? পয়সা আছে তো? আছে। সাত পয়সা আছে। পয়সা বার করতে গিয়ে পুষ্প বারবার ছেলেটাকেই দেখছে। বোতামহীন, হাট করে খোলা জামার ফাঁকে হৃৎপিণ্ডটা থরথর করে কাঁপছে ছেলেটার। ঢোঁক গিলছে, কাশছে আর পিচ পিচ করে থু থু ফেলছে খোলা দরজা দিয়ে। ছোট মুখটিতে উত্তেজনা, বিন্দুবিন্দু ঘামে ভরা। আর হলদে চোখ দিয়ে দেখছে পুষ্পর চুলেরই গোছা। সমীহ করে দেখছে, দিদিমণি বলে ডাকছে। পুষ্প ওদের খরিদ্দার।

সব মিলিয়ে যেন অনেকগুলি পোকা কুরে কুরে খেতে লাগল তার বুকের মধ্যে। কেন, কেন পুষ্পকে ওরা ওদের সমগোত্রীয় ভাবতে পারে না। পুষ্প যে ওদেরই মতো এসেছে ব্যাগ কাঁধে ট্রেনের মধ্যে। দু-পয়সা দিয়ে লজেন্সটা ঘামে-ভেজা মুঠির মধ্যে নিয়ে হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসল সে, সারাদিনে কত বিক্রি হয়?

ছেলেটা একটু অবাক হল। একে খরিদ্দার তায় মেয়ে। ছেলেটা হঠাৎ দয়ার প্রত্যাশায় করুণ হয়ে উঠল। পুষ্প বুঝল না, ছেলেটা করুণার জন্যে তাকে মিছে কথা বলল। বলল, কিছু না।

সারাদিনে খেটে কিছু পাই না, জানেন। কয়েক পয়সা হয়।

হতাশা ঘিরে আসতে লাগল পুষ্পর মনে। জিজ্ঞেস করল, তোমরা এমনি করে ঘোরো, রেল কোম্পানি কিছু বলে না?

কী আর করবে। মাঝে মাঝে ধরে নিয়ে যায়, হাজতে পুরে রাখে। কেঁপে উঠল পুষ্পর বুকের মধ্যে। বলল, টিকিট কাটলে হয় না?

ছেলেটা বলল, কীসের টিকিট? মান্থলি? মান্থলি তো প্যাসেঞ্জারের। আমাদের লাইসেন্স চাই, ভেন্ডারস লাইসেন্স। কোথায় পাব। গরমেন্ট তো দেয় না আমাদের।

মান্থলি থাকলেও ধরে নিয়ে যায়। আর একটা লজেন্স দেব আপনাকে?

 চমকে উঠল পুষ্প। বলল, অ্যাঁ? না আর চাই না।

ছেলেটা চলে গেল। আর পুষ্প চটকাতে লাগল লজেন্সটা হাতের মধ্যে। তবে? লজেন্সটা পড়ে গেল হাত থেকে। থাক। তবে? পুলিশ হাজত ও অপমান?

এ অপমান। কিন্তু তার যৌবন ও হৃদয়ের অপমান? সেই ভয়ংকর ঘোর অন্ধকারের রাক্ষসটা? অদৃশ্যে যে রেখেছে তাকে চোখে চোখে? তবুও পারল না পুষ্প। শুধু তার বড় বড় চোখ দুটো মেলে দাঁড়িয়ে রইল শিয়ালদা স্টেশনের জনাকীর্ণ প্ল্যাটফর্মে। ব্যাগটিকে দু হাতে বুকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু দেখল। তার পশরার ব্যাগ। থরে থরে এনেছে সাজিয়ে। আর হকারের দল তাদের পশরা দেখিয়ে সেধে সেধে গেল তাকে তার মূঢ় মুখের সামনে।

সন্ধ্যাবেলা একটা ভিড়বহুল কামরাতে উঠে পড়ল পুষ্প। আপিসফেরতা মানুষের ভিড়ে গিজ গিজ করছে সমস্ত কামরাটা। ব্যাগের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিল পুষ্প। বুকটা কাঁপছে থরথর করে। কাঁপুক। তবু, বলবে, দেখাবে তার পশরা। দেখুক সকলে, সে একজন মেয়ে হকার।

হঠাৎ একটি যুবক কেরানি উঠে দাঁড়াল। চশমা-পরা চোখের মুগ্ধ দৃষ্টি তার পুষ্পর চুলের দিকে। একটু বিরক্তও হল বোধ হয়। কণ্ঠে কিছু সমীহ। বলল, বসুন আপনি।

চমকে উঠল পুষ্প। হকার নয়, যাত্রিনী। মহিলা-যাত্রীর সম্মান ও কষ্ট লাঘব করা। পারল না, বসে পড়ল পুষ্প। বসে রইল মাথা নিচু করে। নারীর সম্মান। কিন্তু জীবন এমনই শক্ত চিড়ে যে, সে শুধু সম্মানের জলে ভেজে না। ক্রাচ বগলে সেই পারিজ সুইট হরেন তখন বলছে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলে গেছে স্যার। হাওয়া ঠাণ্ডা না হতেই, আবার ড্রাম বাজানো হচ্ছে। আপিসে এখনও অনেক হিসাব কষতে হবে। মাথা ঠাণ্ডা রাখুন, ভাবুন, পারিজ সুইট মুখে রাখুন। পারিজ কোকো সুইট, চার পয়সা শ্লাইজ, বাট ইকোয়েল টু ওয়ান কাপ কোকো। ….

কে একজন বলল, এম-এল-এ-রাও নাকি অবাক হয়ে হকারদের বক্তৃতা শোনে। আর একজন যোগ করল, প্রফেসররাও হার মানে।

ততক্ষণে অসহ্য যন্ত্রণায় বোবা বুকটা ফেটে পড়তে চাইছে পুষ্পর। নিজের স্টেশনে নেমে, ঝাপসা চোখে অন্ধকার গলি পথে বাড়ির দিকে চলল সে।

.

কিন্তু আবার এল তার পরদিন। আবার দেখা হল সেই দলটার সঙ্গে। ওরা আবার বলাবলি করল নিজেদের মধ্যে। বোধ হয় কিছু জুটেছে মেয়েটার কলকাতায়। মেয়ে হলেই নাকি শালা। একটা কিছু জুটে যায়, মাইরি।

তারপর সন্ধ্যাবেলা, শিয়ালদহের যাত্রী ও হকারদের দল অবাক বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। সবাই দেখল, ভিড়াক্রান্ত গাড়িতে একটা মেয়ে, অল্পবয়সী ভদ্রলোকের মতো দেখতে একটা মেয়ে, কী যেন বলছে। হরেন ক্রাচ বগলে বক্তৃতা দিতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। সঙ্গে তার ভিকস, দার্জিলিং-এর কমলালেবু, মরটন, বাইরন, প্রগতিশীল মাসিক বিক্রেতার দল।

তারা সবাই মিলে হাঁ করে রইল।

কেবল ভিকস বলল, নিঘাত ভিক্ষে চাইছে। ভেংচে বলল চাপা গলায়, দেখুন, আমার স্বামী মারা গেছেন, ছেলেপুলে নিয়ে–

পুষ্পর হাতে তখন ছোট ছোট কয়েকটা ন্যাকড়ার পুতুল জুলজুল করে নুলো দোলাচ্ছে। আর একটা চাপা সরু মেয়েলি গলা : আমার নিজের হাতের তৈরি, ন্যাকড়া আর তুষের তৈরি, উপরে রংকরা। দাম দু-আনা করে…

গলাটা কাঁপছে। কাঁপতে কাঁপতে স্থির হয়ে আসছে, একটু বা চড়ছেও। যাত্রীদের শুধু বিস্ময়টুকু কেটে গিয়ে, বিস্ময়, লজ্জা, বিরক্তি করুণা ও হাসির মধ্যে একটা গুঞ্জন উঠতে লাগল।

ছি ছি, কী কাণ্ড!

এ সব কী হচ্ছে আজকাল? একটা অতবড় মেয়ে।…

এখনই কী, আরও কত দেখতে হবে।

উঃ কী অবস্থা ভাই দেশের।

বিবাহিতা!

নাঃ! কী জানি, হবে হয়তো! কিন্তু সিঁদুর তো নেই।

 কেবল দার্জিলিঙের লেবু হরেনের কাছে চাপা হুংকার দিয়ে উঠল, ওরে শালা, এ যে হকারনি দেখছি।

হরেন বলল, তাই তো।

মরটন বলল, সর্বনাশ করেছে।

কে একজন বলল, কোনও তেল কোম্পানির শো কেসে বসে থাকলে চুল দেখিয়ে মাইনে পেত।

সত্যিই সর্বনাশ! এমন একটা মেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীর কল্পনা করেনি তারা কোনওদিন। প্রতিদ্বন্দ্বী অনেক রকম হতে পারে। কিন্তু, এ রকম একটা মেয়ে। মেয়ে হকার। সত্যি সর্বনাশ। আর সেই সর্বনাশের আশঙ্কায় তাদের মুখগুলি এঁকে বেঁকে দুমড়ে কেমন নিষ্ঠুর হয়ে উঠল। মলম মাজন, রেলেঘোরা আজব ডাক্তার ডেন্টিস্ট থেকে শুরু করে সবাই দেখল মেয়েটাকে, অনাগত এক পথ-দ্রষ্টাকে। তাদের সকলেরই মুখগুলি বিরূপ হয়ে উঠল।

হরেন বিধিয়ে বিঁধিয়ে বলল, সেই মেয়েটা।

চানাচুর বলল, নিশ্চয়ই সাত-ঘাটের-জল-খাওয়া মেয়ে।

আর একজন মন্তব্য করল, নইলে আর রেলে এসেছে হকারি করতে।

কতবড় বুকের পাটা।

মাজন প্রায় চেঁচিয়েই বলল, বুকের পাটা আবার কীসের? বুকের বালাই শালা কবেই খেয়ে বসেছে। কোনদিন দেখব, ছুঁড়িটাই মাজন বিকোচ্ছে।

ওইটিই বোধহয় সবচেয়ে বড় ভয়। ওই নজরেই তারা দেখে সমস্ত ঘটনাটা। নতুনেরা পুরনোদের কাছে অনেক লাথি ঘুষি খেয়েছে। পরে তারা একত্রিত হয়েছে। বাধ্য হয়েছে পরস্পরে হাত মেলাতে। আর এই মেয়েটা এসেছে আজ খদ্দেরদের মন ভোলাতে। তাদের হাত থেকে কেড়ে নিতে। খদ্দেরের মন আর মেয়েমানুষ। এই ভেবেই তাদের বিবেক, বুদ্ধি, মন কুঁকড়ে গিয়ে হঠাৎ প্রতিশোধের জন্য ভয়ংকর হয়ে উঠতে চাইল।

কেরানি ও ছাত্রদের সন্দেহপরায়ণ মন দেখল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের মাঝে দুলতে লাগল সকলের মন। দোলার ঝোঁকটা অবিশ্বাসের দিকেই যেন বেশি। গরিব? হ্যাঁ গরিবই মনে হচ্ছে আটপৌরে শাড়ি আর কাঁচের চুড়ি ক-গাছা। চুলগুলিই সবচেয়ে দ্রষ্টব্য।

কিন্তু না, মেয়েটা ভাল হওয়া তো সম্ভব নয়। একেবারে রেলে হকারি।

যা দিনকাল। বয়সও তো নেহাত কাঁচা। যাকে বলে উঠতি বয়স। এই বয়সে একেবারে পথে, গাড়িতে, ভিড়ের মধ্যে! কেমন যেন ঝাপসা লাগছে ব্যাপারটা।

মাথাটা উঠছে আস্তে আস্তে পুষ্পর। একটা আত্মপ্রত্যয়ের ভাব ফুটছে গলায়। চোখের দৃষ্টিটা কিন্তু আধা অন্ধ। কেবল ভিড়ের উপর দিয়ে ঘুরে যাচ্ছে, পরিষ্কার দেখছে না কাউকে। বলছে, ন্যাকড়াটা বেশ মোটা আর শক্ত। ছিড়বে না সহজে। বাড়ির ছেলেপুলেরা…বলছে, দেখছে শুনছে সবাই, কিন্তু কেউ নিচ্ছে না। যেন নিতে পারাটাই একটা মস্ত ব্যাপার। চাকরি ব্যবসা করে না, অথচ রোজগার করে, এরকম এক শ্রেণীর ভদ্রলোকের মতো যাত্রীও দু-একজন ছিল। তারা টিপ্পনী কাটল, অর্থপূর্ণ গলায় বলল, মন্দ নয়, কী বলিস। তবু শালা দেখতে দেখতে সময় কেটে যাবে।

শুধু একজন হাত বাড়িয়ে একটা পুতুল নিল। পরনে ময়লা হাফ প্যান্ট, তেলকালি-মাখা নীল জামা। মুখও তেলমাখা। গোঁফজোড়াটা বিরাট। কোনও তেলকলের মিস্তিরি মজুর হবে হয়তো। অনেকক্ষণ নেড়েচেড়ে দেখল গম্ভীর মুখে। দেখে পয়সা দিল।

অমনি পুষ্পর সঙ্গে ওই মানুষটাও দ্রষ্টব্য হয়ে উঠল একটা। শোনা গেল, হুঁ, বুঝলুম! কিন্তু মানুষটি নির্বিকার।

পরমুহূর্তেই একটা চিৎকার, ভিকস। ভিকস স্যার। আপনার মাথা সাফ হয়ে যাবে, জাম ছেড়ে যাবে।

আই কিওর স্যার, চোখের গণ্ডগোল কাটবে,…

অ্যান্ড পারিজ সুইটস! আজেবাজে চিন্তা থেকে আপনার মনকে একমুখো করুন!…

দার্জিলিঙের নেবু!…চানাচুর!..সাড়েচার ভাজা!…ধূপ!…বায়রনের জল!…কে, পি. দের মলম। …

গুলি! সিসের নয়, তানসেনের।

কামরাটার চারদিকে একটা প্রচণ্ড হট্টগোল পড়ে গেল। ডুবে গেল পুষ্পর গলা। সে অবাক হয়ে তার ভীত করুণ চোখ মেলে দেখতে লাগল চারদিকে। একটা কামরাতে এতগুলি হকার! একসঙ্গে? কেন?

কাছ থেকেই কে একজন কেশো গলায় হেসে বলে উঠল, ওই দেখুন যারা চেনে আর জানে, তারা ঠিক ব্যবস্থা করছে। দু-দিনে তাড়িয়ে ছাড়বে মশাই…

শোনার দরকার ছিল না। তার আগেই বুঝল পুষ্প। সমস্ত চিৎকারগুলি তার কানে আর বুকে এসে বিঁধিয়ে পিটিয়ে ক্ষত বিক্ষত করতে লাগল। অন্ধকার হয়ে এল চোখের দৃষ্টি। তাকে ওরা তাড়িয়ে দিতে চায়। সেই মানুষগুলি।

গাড়ি ছাড়ল। স্টেশনে নেমে নেমে সে যে কামরায় গেল, একই চিৎকার। চিৎকার আর ক্রুদ্ধ। বিদ্রুপাত্মক কটাক্ষে পুষ্পকে খুঁচিয়ে মেরে দিশেহারা করে তুলল।

বাড়ি ফেরার পথে, মফস্বলের অন্ধকার গলিটাতে থমকে দাঁড়াল পুষ্প। বুকে মুঠিকরা হাতে। একটি দু-আনি, একটি পুতুলের দাম। সেটিকে বুকে চেপে সে আচমকা ফুঁপিয়ে উঠল নিঃশব্দে। বহু ভয় ও সংশয় পেরিয়ে সে এসেছিল। কিন্তু এমন ভয়ংকর বাধার কথা মনেও আসেনি। না, সে পারবে না, পারবে না।

.

তবু আবার এল পরদিন। দূরের এই স্টেশনটা আজও ঝিমোচ্ছিল। কিন্তু সে আসবামাত্র ডাউন প্ল্যাটফর্ম থেকে একটা চিৎকার ভেসে এল, পুতুলের মা এসেছে রে।

দেখতে দেখতে সকলেই দাঁড়াল উঠে। সর্বাগ্রে ক্রাচ বগলে হরেন। একজন বলল, পুতুলগুলি মরা না জ্যান্ত, জিজ্ঞেস কর।

আর একজন বলল, জিজ্ঞেস কর তো কার পুতুল?

 না, নিজেরগুলো ঘরে রেখে এসেছে।

সেগুলোকেও নিয়ে এলেই হত।

 পুষ্পর বুকটা ছিঁড়ে গেল ওদের ইঙ্গিতে। তার জ্যান্ত পুতুল। পুতুলের মা! তার সারা শরীরের মধ্যে একটা দুর্বোধ্য যন্ত্রণায়, অনেকদিন কারা চিৎকার করে বেরিয়ে আসতে চেয়েছে। অনেকদিন অজান্তে তার বুকে ঠোঁটে অসহ্য বেদনায় ও আনন্দে বিচিত্র শিহরনের স্পর্শে তারা মাতাল করে গেছে পুষ্পকে। সে ছিল যৌবনের স্বপ্ন। আঠারো বছরের পূর্ণ যৌবনে সে পুতুলের মা, হকারনি। মেয়ে নয়। শাঁখা সিঁদুরের আবির্ভাব ঘটেনি। পুতুলের জন্মদাতা আসেনি কোনওদিন ঘরদোর-আশ্রয়ের ঢোলক-কাঁসি বাজিয়ে।

রাগ হল না। বিষণ্ণভাবে হাসল পুতুলের মা পুষ্প। পুতুলের মা-ই। তার নিজের হাতের পুতুল। কিন্তু সে ভয় পেল না। পেলে তাকে ফিরে যেতে হবে নরকে। পঙ্ক-অঙ্কে নিতে হবে আশ্রয়। তার সে মরণের পর কেউ পুতুলের মা বলেও বিদ্রূপ করবে না।

মাথা তুলে ফিরে তাকাল সে ওদের দিকে। কিন্তু ওরা টিটকিরি ও বিদ্রূপের জেদি ও চাপা চিৎকারে ভেঙে পড়ল। শোনা যায় না, তাকানো যায় না ওদের ছেঁড়া জামা আর রোদে পোড়া নিষ্ঠুর মুখগুলির দিকে।

অথচ এই হরেন বিয়াল্লিশের গুলি-খাওয়া মানুষ। ভিকসও নাকি ছেচল্লিশে জেল খেটেছে। ওদের অনেকের পিছনে অনেক ইতিহাস।

শুধু পুষ্পর মধ্যে এক কলঙ্কিনী শত্রু-মেয়ে ছাড়া ওরা আর কিছু খুঁজে পায়নি। লাইন পেরিয়ে পুষ্প অনেকখানি দূরে গিয়ে দাঁড়াল।

কেবল প্রগতিশীল কাগজ বিক্রেতা, গোঁফ মুচড়ে শান্ত গলায় বলল, শত হলেও মেয়েমানুষ।

 হরেন খ্যাঁক করে উঠল, তার কী করতে হবে?

না, দেখ, আজকাল দেশের এই অবস্থায় নারী জাতির–সে খুব গম্ভীর গলায় আরম্ভ করেছিল। হরেন ভেংচে উঠল, আর থাক, তোমার আর পেগতিছিল বক্তিমে দিতে হবে না। শালা, আজ একটা মেয়ে যদি আঁচল উড়িয়ে, চোখ ঘুরিয়ে, কাগজ নিয়ে ওঠে গাড়িতে, তবে আর তোমাকে পয়সা দিয়ে চাল কিনে খেতে হবে না, বুঝেছ?

কাগজ বিক্রেতা বিমূঢ় গলায় বলল, অ্যাঁ?

ভিকস বলল, অ্যাঁ নয়। হ্যাঁ। ব্যাটা, শোঁক শোঁক, ভিকস শোঁক, মাথাটা সাফ কর।

কিন্তু কাগজ বিক্রেতার গোঁফজোড়া বেয়াড়ারকম বেঁকে রইল, না রে, কথাটা বোধ হয় ঠিক নয়।

 মরটন বলে উঠল, এ যে পুতুলের সাক্ষাৎ বাপ এল দেখছি।

তাই না বটে! সবাই তিক্ত গলায় হেসে উঠল।

বিদ্রূপ ও চিৎকারে যেন পুষ্পকে ওরা তাড়া করে নিয়ে এল শিয়ালদায়। তারপর সেই একই ব্যাপারের পুনরাবৃত্তি। পুষ্প মুখ খোলবার আগেই সেই বহু পশরার বিজ্ঞাপনের কলরোলে ডুবে গেল তার গলা। তেমনি করেই আবার তাকে তাড়িয়ে নিয়ে এল তার স্টেশনে।

দেবে না, তাকে ওরা কোনও অধিকার দেবে না। আইনের অধিকার দেওয়ার মালিক যারা, তাদের মুখোমুখি কোনওদিন দাঁড়াতে হবে কি না কে জানে। কিন্তু আসল অধিকারীরাই বিরূপ।

শুধু এই চলল। তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া, আর তাড়িয়ে নিয়ে আসা। প্রতিবাদী যাত্রী হয়তো কেউ কেউ ছিল। তারা সংখ্যায় নগণ্য। অধিকাংশ শুধু মজাই দেখে যেতে লাগল।

কেবল, পুষ্প প্রতিদিন থমকে দাঁড়ায় বাড়ি ফেরার পথে, অন্ধ গলি পথটায়। যেন ছায়ালোকের কোনও অভিশপ্ত আত্মা। কখনও চুলের গোছা দিয়ে চোখ দুটো চেপে ধরে। কখনও শক্ত মুঠিতে চেপে ধরে বুকের কাপড়।

ওরা চেয়েও দেখল না, মেয়েটা দিন দিন শুকোচ্ছে। চুলগুলো জট পাকাচ্ছে। সেই একই অধৌত জামাকাপড় ধূলিমলিন হয়ে উঠছে। ওরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ মারামারি করে, কিন্তু বন্ধুত্বে কখনও ফাটল ধরে না। কেবল পুষ্পকে ওরা তাড়া করে। শুনিয়ে শুনিয়ে বলে নানান কথা।

কোনওদিন বলে, পুলিশের সঙ্গে নিশ্চয়ই খুব জমজমাটি। নইলে আর বেমালুম পুতুলের মা হয়ে রেলে ঘুরছে?

অথচ সেপাইগুলি চোখ ঘোঁচ করে গোঁফ পাকায় তার দিকে চেয়ে।

কোনওদিন বলে, রেলের বাবুদের কাছেও যাওয়া আসা আছে, সেইজন্যেই অত সাহস।

সত্যি, এ যে কোন সাহস ঠেলে দিয়েছে তাকে এই পথে, পুষ্প নিজেও ভালভাবে টের পায় না।

কখনও লোকের ভিড়ে রেলের পা-দানিতে চোখাচোখি হয় হরেনের সঙ্গে। হয়তো হরেন তখন বিপজ্জনকভাবে ক্রাচসহ চলন্ত ট্রেনে কামরা বদলাচ্ছে। কখনও ভিকসের ক্ষুধাকাতুর চোখের সঙ্গে, অদম্য কাশিক্ষুব্ধ মরটনের সঙ্গে, রুগণ তানসেনের গুলির সঙ্গে।

যেন কিছু বলতে চায় পুষ্প। কিন্তু ওদের চোখের দিকে তাকিয়ে বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না তার। মুখ ফোটে না, অপমানে ধিক্কারে ঘৃণায় জ্বলে যায় বুকের মধ্যে।

একদিন শিয়ালদায় কে তার কানের কাছে বলে উঠল, পুতুলের মার ক-বিয়ে? ফিরে দেখল পুষ্প, অদূরে দার্জিলিঙের লেবুর বাঁকা চোখজোড়া। আর তার সামনে একটি নতুন বর আর কনে বউ। কনে বউ, কানে দুল, নাকে নাকছাবি, গলার, হাতে চুড়ি নিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে পুষ্পর দিকে। পুষ্পর চুলের দিকে।

হকারনি নয়, স্বপ্ন নেমে এল হঠাৎ আঠারো বছরের এক বাঙালি মেয়ের চোখে। যেন হঠাৎ চুলকে উঠল তার নাকের ও কানের খোলা ছিদ্রগুলি। ছোটকালে বিঁধিয়েছিল বাপ-মা শখ করে। একদিন সোনা পরবে বলে। বাপ-মা না পারুক বরের সোনা পরবে বলে। ওই বেশে একদিন সাজবে বলে। আজন্ম শুভ্র সিঁথি একদিন লাল হবে বলে।

সত্যি, কত বিয়ে করেছে পুষ্প মনে মনে? শৈশবের সেই বিয়ের যে সংখ্যা নেই। দার্জিলিঙের লেবুকে বলবে কী করে সে কথা?

কনেবউটি দিব্যি জিজ্ঞেস করল, অসুখ করেছে ভাই?

না তো?

তবে অমন ধুকছ যে?

পুষ্প হেসে বলল, এমনি।

তাই তো, পুষ্প অবাক হয়। বৈশাখ এসে পড়েছে। চৈত্র চলে গেছে তাই এত বিয়ের হিড়িক। বর-কনেরা বেরিয়েছে পথে। আর এতদিন মাত্র সাতটি পুতুল বিক্রি করতে পেরেছে পুষ্প। অনেক বাধা মাড়িয়ে পেরেছে।

কিন্তু তাতে আশা বাড়েনি, বিপদ বেড়েছে। ঘরে অবিশ্বাস, অবিশ্বাস বাইরে। কোথাও সে কিছু পেল না, দিতেও পারল না। এবার তাকে যেতে হবে পথে ফেরি করতে : পুতুল, হাতে-গড়া পুতুল নেবেন?

আবার কানে এল, পুতুলের মা অনেক বিয়ে বিয়ে খেলেছে। এবার পুতুলের বিয়ে দেবে।

আহা! আজকে ওরা কী কথাগুলিই বলছে! সত্যি, কত বিয়ে বিয়ে খেলেছে। কিন্তু সেই পুতুল নিয়ে খেলা তো তার আজও শেষ হল না। একদিন শেষদিন মনে করে এল সে। আজকে শিয়ালদহ স্টেশন পেরিয়ে চলে যাবে কলকাতার পথের ফেরিতে।

কিন্তু যেতে পারল না। আজ আইনের অধিকারীরা স্টেশনের চারপাশে জাল ছড়িয়ে বসেছিল। বেটন ও বন্দুকধারী পুলিশের বেশে ব্যুহ রচিত হয়েছিল বেআইনি হকারবৃত্তি নিবারণের স্পেশাল কোর্টের। যারা ছিল কাছেপিঠে, তারা ধরা পড়েছে অনেকেই। দুপুরের ঝোঁকে যারা বাইরে মফস্বলে চলে যায়, ফিরে আসে বিকালে, এবার আক্রান্ত হল তারা।

হঠাৎ পুলিশের আক্রমণে, চিৎকারে, গণ্ডগোলে, যাত্রীদের অকারণ ঠেলাঠেলি হুড়োহুড়িতে একটা শ্বাসরুদ্ধ দৃশ্যের অবতারণা হল।

ধ্বক করে উঠল পুষ্পর বুকের মধ্যে। পুলিশ দেখে নয়। সে দেখল হরেনের একটা ক্রাচ ছিটকে পড়েছে অনেক দূরে, আর তাকে ঘাড় ধরে নিয়ে যাচ্ছে সেপাই। ক্রাচটা তুলে নেওয়ার জন্যে অগ্রসর হতেই তাকে বিশালকায় এক মহিলা এসে শক্ত হাতে ধরল। আর পুলিশের চড় খেতে খেতে একটা পানবিড়িওয়ালা ছোট্ট ছেলে কুড়িয়ে নিল হরেনের ক্রাচটা।

কিছু বলবার অবকাশ মিলল না। গলায় সোনার চন্দ্রহার, আর হাতে কঙ্কণ ও ঘড়িপরা মহিলাটি পুষ্পকে এনে হাজির করল টেবিলের সামনে। একটা খেঁকুড়ে গম্ভীর গলা শোনা গেল, লাইসেন্স আছে?

না।

পঞ্চাশ টাকা ফাইন বার কর।

 পঞ্চাশ টাকা?

পুষ্পর মনে হল, তাকে বুঝি ঠাট্টা করেছে। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

অনাদায়ে সাতদিন হাজতবাস।

মহিলাটি তার কাঁধ থেকে পুতুলের ব্যাগটা ছিনিয়ে নিল। নিয়ে ঠেলে দিলে পুলিশের ঘেরাওয়ের মধ্যে। সেখানে আর কেউ নেই, শুধু সে। পুষ্পবালা ঢাকার বজ্রহাটের অমুক মাস্টারের মেয়ে।

সেখান থেকে পুষ্প দেখল, পারিজ সুইট হরেন, ভিকস, বায়রন, মরটন, চানাচুর, প্রগতিশীল কাগজ বিক্রেতা, দার্জিলিঙের লেবু সকলেই রয়েছে, আর একটা ঘেরাওয়ের মধ্যে। ঘর্মাক্ত ধুলোমাখা, উশকো-খুশকো ওদেরই মতো জড়ো হয়েছে একটা টেবিলে ওদের মালগুলি।

কে বলে উঠল, আরে শত হলেও হকারনি। তারা রাত্রে ঠিক ছেড়ে দেবে দেখিস।

হয়তো দেবে। যদি না দেয়? যদি না দেয়, তবে মা ভাববে, সন্দেহ এতদিনে কাটল। সর্বনাশী শেষে সর্বনাশ করে পালিয়েছে। কিন্তু পালাতে পারেনি তো এতদিন। তারপর চালান দিয়ে দিল সবাইকে হাজতে!

.

সাতদিন পর।

বেলা দশটায় কোর্ট খুলল। বেলা এগারোটায় ছাড়া পেল হকারেরা। সকলেই গিয়ে জড়ো হল, ভিড়ের বাইরে, পুবের রেল হাসপাতালের কাছে।

এঃ শালা, চানাচুরগুলো সব সাবাড় করেছে ধর্মপুত্তুর সেপাইরা।

আমার একটা লজেন্সও নেই মাইরি।

দার্জিলিঙের লেবু সব ফাঁক।

 মাইরি আমার কাগজগুলোও কমে গেছে। ওরা কি প্রগতিশীল কাগজও পড়ে!

 পড়ে, ধার দেখবার জন্যে।

হ্যাঁরে, সেই মেয়েটাকে ছেড়ে দিয়েছে না?

তারপর হাসি আর গালাগালির একটা ঝড় বইতে থাকে। হরেন চেঁচিয়ে উঠল, আমার অনেকগুলি মাল আছে।

মাইরি?

 মাইরি। আয়, সব হাজত-খাটাকে এক করে দিই, তারপর নতুন করে আবার আরম্ভ করা যাবে।

বলতেই সবাই ঘিরে এল তাকে, সে একটা করে লজেন্স দিতে লাগল সবাইকে।

হঠাৎ চাপা গলায় ভিকস ডাকল, এই হরেন!

হরেন বলল, কী?

 ওই দ্যাখ!

সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল, পুতুলের মা। কোর্টের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে। চুলগুলি জড়ানো কিন্তু জট পাকিয়ে আরও বড় হয়ে উঠেছে। স্যান্ডেল নেই, খালি পা। কাপড়টা কুঁকড়ে পায়ের থেকে উঠে গেছে অনেকখানি। চোখের কোলগুলি বসে গেছে। গাল দুটো গেছে চড়িয়ে। ঝুঁকে পড়েছে নীচের দিকে। কাঁচের চুড়িগুলি হলহল করছে হাতে। ব্যাগটা ঝুলছে কাঁধে।

ওরা সকলে হেসে উঠতে যাচ্ছিল। কিন্তু, একসঙ্গেই সকলের গলায় হাসিটা কী রকম আটকে গেল। একজন বলল, হাজতে ছিলরে।

হ্যাঁ, কীরকম দেখাচ্ছে, না?

 হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল হরেন। খটখট করে খানিকটা গিয়ে, খ্যাঁকারি দিয়ে ডেকে উঠল, পুতুলের মা!

পুষ্প দাঁড়াল থমকে। ঠিক এমনি সুরের ডাক তো কখনও শোনেনি সে ওদের কাছ থেকে। তবুও নতুন অপমানের জন্যে শক্ত হয়ে দাঁড়াল সে। আজ শুধু অপমান নয়, শোধও নেবে।

পেছনে সকলেই ভ্রূ কুঁচকে, চোখ তুলে নিঃশব্দে চেয়ে রইল। আর ঠকঠক করে হরেন এসে দাঁড়াল পুষ্পর সামনে। পুষ্পর চোখের দিকে তাকিয়ে চোখ নামাল হরেন। কৌটো থেকে একটা লজেন্স বের করে হরেন বলল, মানে, যারা হাজত খেটেছে, তাদের সকলেরই একটা করে পাওনা হয়েছে। তা আপ…আপ…মানে তোমার একটা আছে। নিতে হবে কিন্তু ভাই।

কী শুনছে, এ কী শুনছে পুষ্প! হরেনেরা, হকাররা তাকে তাদের সঙ্গিনী করে নিচ্ছে? তাদের পুতুলের মাকে।

ততক্ষণে সকলেই ভিড় করে এসেছে। আর পুষ্পর শিশুর মতো মুখে হাসির নিঃশব্দ ঝরনা, সেই সঙ্গে আচমকা চোখ ফেটে জল এসে পড়ল তার। সে লজেন্সটা নিল।

হরেন ফিসফিস করে বলল, সত্যি, মানে কেঁদে কিছু হয় না, তুমি কেঁদো না। বলতে বলতে তারও গলাটা আটকে এল। আর সবাই নিঃশব্দে ঢোঁক গিলছে।

তারপরে বলল, চানাচুরের শেষ প্যাকেটটা তুমি খাও।

দেখা গেল সকলেই, তাদের অবশিষ্ট মালটুকু পুষ্পর হাতে তুলে দিতে ব্যস্ত।

এই নাও, একটা কাগজও দিলুম, পড়ো।

কাগজটা কী তা বললি না?

হেসে উঠল সকলে। চোখের জলে ও হাসির আলোছায়ায় অন্ধ হয়ে এল পুষ্পর চোখ। সে দেখল শুধু, তাকে ঘিরে ওদের হাজত-খাটা উশকো-খুশকো চেহারার ভিড়। সেই ভিড়ের মধ্যে সে একাত্ম।

1 Comment
Collapse Comments

khub vlo legeche

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *