২৬-৩০. গোধুলীকে সঙ্গী করে

গোধুলীকে সঙ্গী করে, পাহাড়ের ঢালে নেমে এসেছে কুয়াশা। নীরবে…অনেকটা সাপের মতো বুকে হেঁটে হেঁটে এসে উপস্থিত হয়েছে সে। রাস্তাগুলো কখন যে দখল করে নিয়েছে, বোঝাই যায়নি! আস্তে আস্তে ঘন হয়ে এখন গিলে নিতে চাইছে আকাশ আর তারাগুলোকে। জানালা দিয়ে বাইরের পরিবেশ দেখতে দেখতে ফোনে জ্যান বলল, বুঝতে পারছি না। এক ঘন্টা আগেই হাতে পেয়েছি নতুন লেখা কাগজগুলো। আর এখন কিনা তুমি বলছ-

ওই পাতাগুলোর কথা ভুলে যাও। বলল স্যান্টো ভিজিনি। ভুল হয়েছে। আমাদের। চিত্রনাট্যে কোনও ধরনের পরিবর্তন আসবে না।

ভুল?

তেমন গুরুতর কিছু না। কাল রিহার্সালে যখন আসবে, তখন সব বুঝিয়ে বলব।

কখন আসব?

সন্ধ্যার দিকে এসো। পলের সাথে কাজ শেষ হয়ে যাবে। আমি ফোন করব। ঠিক আছে, কিন্তু তুমি কি নিশ্চিত যে- থেমে গেল মেয়েটি, বুঝতে পারছে যে পরিচালক ফোনের লাইন কেটে দিয়েছে। রিসিভার নামিয়ে রাখার সময়, হঠাৎ আওয়াজ শুনতে পেল একটা। তবে আওয়াজটা বাইরে থেকে এসেছে। কাঁদছে। কেউ একজন!

জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল জ্যান। ঘন কুয়াশা যেন চারপাশটা গিলে নিয়েছে। না কোনও অবয়ব পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, আর না কোনও ছায়া। কিন্তু কান্নার শব্দটায় কোনও বিরাম নেই। কুয়াশায় পথ হারানো কোনও বাচ্চা না তো? সদর দরজা খুলে, বাইরে বের হলো ও। কোনার বাতিটা থেকে আবছা আলো ভেসে আসছে, তবে সেই আলোতে দেখা যাচ্ছে না কিছুই। এমনকি কোনও শব্দও নেই। আছে কেবল শীতল নিস্তব্ধতা।

সব দোষ ভিজিনির। একথা-ওকথা শুনিয়ে ওকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। গুরুতর কিছু না? যদি তাই হবে তো ওকে ফোন করল কেন? চিত্রনাট্যে যদি কোনও পরিবর্তন না-ই আসবে, তাহলে স্টুডিও থেকে ওকে নতুন পাতাগুলো পাঠানো হলো কেন?

একসাথে অনেক কিছু ঘটতে শুরু করেছে। আগুন লাগল স্টুডিওতে, এদিকে আবার ক্লেইবর্ন লোকটা নাকি নরম্যানকে দেখেছে! আতঙ্ক যে জ্যানকে পেয়ে বসবে, তাতে আর আশ্চর্য কী! আর কনিটাও যে কী না! মাঝে মাঝে দু-এক রাত বাসায় থাকলে এমনকী হয়? এই মুহূর্তে কোনও মানুষের সঙ্গের জন্য মুখিয়ে আছে জ্যানের মন।

আচ্ছা, রয় কে ফোন দিলে কেমন হয়? সদর দরজা বন্ধ করে ঘরে ঢোকামাত্র বাজতে শুরু করল ফোন। কী যেন বলে একে? টেলিপ্যাথি?

তবে না, ভুল হয়েছে ওর। ফোন রয় করেনি, করছেন অ্যাডাম ক্লেইবর্ন। বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। বললেন ডাক্তার। নতুন করে লেখা পাতাগুলো পেয়েছ কিনা, সেটা জানার জন্য ফোন করেছি।

পেয়েছি।

কী মনে হয়?

ভিজিনির সাথে হওয়া কথোপকথনটুকু জানাল জ্যান।

মানে সে চিত্রনাট্যের পরিবর্তন মানতে রাজি নয়? এমন সুরে জানতে চাইল ক্লেইব যে জ্যান নিজেই অস্বস্তিবোধ করতে শুরু করল।

হচ্ছেটা কী বলো তো! জানতে চাইল সে, কখন যেন ক্লেইবনকে তুমি বলতে শুরু করেছে। কেউ আমাকে সব কথা খুলে বলছে না কেন?

এক মুহূর্তে চুপ করে রইলেন ক্লেইবন। আসলে হয়েছে কী, ব্যাপারটার সাথে অনেককিছু জড়িত-

জড়িত তো আমিও। বলে উঠল জ্যান। এক কাজ করো, খুব ব্যস্ত না হলে আমার এখানে চলে এসো। ড্রিংকের আমন্ত্রণ রইল।

ইতস্তত করলেন ক্লেইবর্ন। তার ইতস্ততভাবটা বুঝতে পেরে কাতর কণ্ঠে জ্যান অনুরোধ করল, প্লিজ এসো। আমার জানা খুব দরকার।

ঠিক আছে, আসছি।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রিসিভার নামিয়ে রাখল জ্যান। ঠিক সেই মুহূর্তে আবার শুনতে পেল কান্নার আওয়াজ। ঘরের ভেতরে বসে খুব বেশি কানে লাগছে। কান্নাটার মাঝে এমন একটা জরুরীভাব আছে যে অনেকটা বাধ্য হয়েই সে পেছনের দরজার কাছে চলে গেল। আওয়াজটা ওপাশ থেকেই আসছে। কৌতূহল রুখতে না পেরে, খুলে দিল দরজা। আর তখনই দেখতে পেল বিড়ালটাকে।

ছোট খাটো হলদে একটা বলের মতো গুটি পাকিয়ে শুয়ে আছে ওটা। দরজা খোলা মাত্র সবুজাভ চোখে তাকাল জ্যানের দিকে। কোলে তুলে নেবার সময় মেয়েটার মনে হলো, যেন কোনও হালকা পালক তুলছে। নিরাপদ আশ্রয় পেয়ে, গরগর করে উঠল বিড়াল। কোত্থেকে এসেছ সোনা? হারিয়ে গিয়েছ? আহা বেচারা। একদম ভিজে গিয়েছ দেখছি!

র‍্যাক থেকে একটা ডিশ মোছার তোয়ালে তুলে নিয়ে, ভেজা পশমগুলো ঘষতে শুরু করল জ্যান। প্রথম প্রথম কাঁপছিল প্রানিটা, বেশ কিছুক্ষণ পর শান্ত হলো। এই তো হয়েছে। এখন ভালো লাগছে না? তোয়ালেটা সিঙ্কের উপর রেখে দিল ও। খিদে পেয়েছে?

রাও, উত্তর দিল যেন বিড়াল বাবাজী।

দেখি তাহলে, কিছু পাওয়া যায় কিনা। বিড়ালটাকে কোল থেকে নিচে নামিয়ে দিল জ্যান। চুপচাপ…পাথরের মূর্তির মতো বসে রইল ওটা। কিন্তু সবুজ চোখ জোড়া ঠিক জ্যানের উপর নিবদ্ধ। ফ্রিজ খুলে এক কার্টন দুধ নিয়ে আসতে দেখল মেয়েটাকে।

কাপ বোর্ড থেকে একটা পিরিচ বের করে তাতে দুধ ঢেলে আপেক্ষমান। অতিথির দিকে এগিয়ে দিল ও। ঠিক তখনই এসে উপস্থিত হলো তার অন্য অতিথি।

চাইমের শব্দ শোনা মাত্র তাড়াতাড়ি লিভিং রুমের দিকে এগোল জ্যান। তবে এবার আগে বাইরের বাতি জ্বালিয়ে, পিপ-হোল দিয়ে দেখে নিল আগন্তুককে। তারপর দরজা খুলল।

ভিজে একসা হয়ে যাওয়া অ্যাডাম ক্লেইবর্ন ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলেন।

তাড়াতাড়িই এসেছ। বলল জ্যান। আমার মোটেলটা কাছেই। ভেঞ্চুরায়। জানালার দিকে চলে গেল ক্লেইনের নজর। তবে আরেকটু হলেই পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম। এমনকী রাস্তার পাশে লাগানো সাইনগুলোও দেখতে পাচ্ছিলাম না। এখানে মানুষ একা থাকে কী করে?

আমি একা, তা তোমাকে কে বলল? দুষ্টুমি করল জ্যান। রান্নাঘরের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। বিড়ালটার গোলাপী জিহ্বা এখনও দুধ চেটে চেটে খাচ্ছে।

হাসলেন ক্লেইবর্ন। তোমার বন্ধু নাকি? বন্ধু না, বান্ধবি। আশা করি। এই কয়েক মিনিট আগে দেখা হলো। বান্ধবি? এই বিড়াল যে মেয়ে, তা কী করে বুঝলে?

মেয়েদের মন, অনেক কিছু বুঝতে পারে। বিড়ালটাকে কোলে তুলে নিল জ্যান। খাওয়া হয়েছে সোনামনি? এবার আমাদের খেতে দাও।

রাও। বলে জ্যানের কোলেই শুয়ে রইল প্রানিটা।

বিড়ালটাকে কোলে নিয়েই লিভিং রুমে ঢুকল মেয়েটি, পিছু পিছু ক্লেইবনও। প্রানিটাকে নামিয়ে রাখবে, এমন সময় ছোট ছোট থাবা দিয়ে ওটা আঁকড়ে ধরল জ্যানের সোয়েটার। অনেক চেষ্টা করেও ছাড়াতে পারল না জ্যান।

ছাড় রে বাবা! কিছুটা বিরক্তির সাথেই বলল সে।

অসুবিধা নেই, বলে বারের দিকে এগিয়ে গেলেন ক্লেইবন। আমিই করছি। স্কচ অ্যান্ড রকস চলবে?

চলবে মানে! দৌড়াবে। বলতে বলতে সোফায় বসে পড়ল জ্যান, কোলে। শোয়া বিড়ালটা গরগর করছে। প্রানিটার উষ্ণ মাংসে ঘোরাফেরা করছে ওর হাত। এমনকী ভেতরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নড়াচড়াও পরিষ্কার বুঝতে পারছে। কী নাজুক একটা দেহ! অবচেতনমনেই জ্যানের হাত চলে গেল বিড়ালটার গলায়। এই তো নড়ছে, রক্তবাহী নালিকা থেকে থেকে লাফিয়ে উঠে জানান দিচ্ছে প্রাণের উপস্থিতির! আসলে আমরা সবাই…সব প্রানিই এক। নাজুক…স্পর্শকাতর। মাত্র এক ইঞ্চির এক ভগ্নাংশ পুরুত্বের চামড়া আমাদেরকে রক্ষা করে চলছে–

পেনি।

চোখ তুলে ক্লেইবর্নের দিকে তাকালো জ্যান। ডাক্তারকে একটা গ্লাস ওর দিকে বাড়িয়ে থাকা অবস্থায় দেখতে পেল। মানে?

তোমার চিন্তা আমায় শোনালে, পয়সা পাবে। মুচকি হেসে বললেন ক্লেইবর্ন।

ওহ, নাহ। তেমন কিছু না। গ্লাসটা হাতে নিতে নিতে বলল ও।

তাহলে টাকা দেই? মুদ্রাস্ফীতির এই যুগে পয়সা দিয়ে কিছু হয় না। মেয়েটার পাশে বসে পড়লেন ক্লেইবন। পিটপিট করে তাকাল বিড়াল, ডাক্তারকে দেখে যেন ভয় পেয়েই কার্পেটে নেমে পড়ল।

এই মাত্র কাকে নিয়ে ভাবছিলে? সত্যি করে বলো তো!

 মেরি ক্রেন। নামটা উচ্চারণ করার আগে নিজেও বুঝতে পারেনি যে অনেক বছর আগে খুন হওয়া মহিলাকে নিয়েই ভাবছিল ও।

মেরি ক্রেনের কোন ব্যাপার নিয়ে?

আসলে ঠিক ওকে নিয়ে না, আমাকে নিয়েই ভাবছিলাম। ক্লেইবর্নের তীক্ষ্ণ চোখে তাকাতে সাহস হলো না জ্যানের। পেশাগত বিড়ম্বনা বলতে পার। আস্তে আস্তে আমরা চরিত্রের সাথে এক হয়ে যাই।

আর যা-ই করো, এই কাজটা করো না।

ক্লেইবর্নের চোখে চোখ রাখল জ্যান, লোকটার মুখ থেকে হাসি উধাও হয়ে গিয়েছে।

আমার হওয়া উচিৎ, হাজার হলেও আমি ওই চরিত্রেই অভিনয় করছি।

উঁহু, ভুল করবে।

গ্লাসের তরলটুকু গলায় ঢেলে দিল জ্যান। কিন্তু জিনিসটা পেটে গিয়ে যেন ওর রাগ আরও বাড়িয়ে তুলল। লোকটার সরল ব্যবহারে, চলচ্চিত্র নিয়ে তার বাতিকের কথা ভুলতেই বসেছিল ও। কিন্তু না, মেজাজ হারালে চলবে না।

প্লিজ, গলার স্বর নিয়ন্ত্রণে এনে বলল ও। আগেও অনেকবার এই ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করেছি। ভিজিনি পরিবর্তিত চিত্রনাট্য মানবে না বলেই…

আরও কিন্তু আছে। বললেন ক্লেইবর্ন। আজকে বিকালেই ঘটেছে ঘটনাটা।

আরাম করে বসে, ডাক্তারের কথা শুনতে শুরু করল জ্যান। প্রথমে শুনল ভিজিনির সাথে মিটিঙটার কথা। এ-ও জানল পরিচালক দেখতে অনেকটাই নরম্যান বেটসের মতো। রয় আর ড্ৰিসকলের সাথে দেখা করার কথাও শুনল। আগুনের ব্যাপারে প্রযোজকের ব্যাখ্যা আর ভিজিনির ব্যাপারে ক্লেইবর্নের সন্দেহের কথাও শুনল।

এই সব? কথা শেষ হতে বলল মেয়েটা।

চোখ ছোট ছোট হয়ে এলো ক্লেইবর্নের। আরও লাগবে?

গ্লাস নামিয়ে রাখল জ্যান। বিশ্বাস করা একটু কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

আমাকে বিশ্বাস না হলে, রয় অ্যামেসকে জিজ্ঞাসা করে দেখতে পার।

কীভাবে তোমার কথা বিশ্বাস করব, বলো? প্রথমে বললে, নরম্যান বেঁচে আছে। এখন বলছ ও মৃত আর ভিজিনি স্টুডিওতে আগুন ধরিয়েছে!

নরম্যানের ব্যাপারে আমি এখনও নিশ্চিত নই। মানছি, ভিজিনির ব্যাপারেও আমার হাতে কোনও প্রমাণ নেই। কিন্তু ও যে নিজেকে নরম্যানের সাথে এক করে ভাবছে, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। তাই মেরি ক্রেনের মতো করে নিজেকে ভাবার ব্যাপারে না করছি।

কখন যেন বিড়ালটা এসে জ্যানের পায়ে গা ঘষতে শুরু করেছে। প্রানিটাকে আদর করল ও।

আমি তো এই বিড়ালের মাঝেও নিজেকে খুঁজে পাই। কারণ কী জানো? কারণ আমি একজন অভিনেত্রী।

প্রায় সবাই তাই করে। কিন্তু একটা নির্দিষ্ট মাত্রা বজায় রেখে।

প্রায় সবাই? সোজা হয়ে গেল জ্যান। শুধু মনোবিদরা বাদে, তাই না? ওরা সব ধরনের মানসিক দূর্বলতার উর্ধ্বে।

রাও। বিড়ালটাও যেন মেয়েটার সাথে একমত।

তবে ভ্রূ কুঁচকে তাকালেন ক্লেইবর্ন। আমাকে মনোবিদ হিসেবে না দেখে, মানুষ হিসেবে দেখ। বললেন তিনি। আমরা কোনও কিছুর উর্ধ্বে বা নিতে না। তবে আমাদের অভিজ্ঞতা সাধারণ মানুষের চাইতে অনেক বেশি। আমরা জানি, যিশু খ্রিষ্ট বা অ্যাডলফ হিটলার, কারও মাঝেই নিজেকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করা ঠিক না

চোখে চ্যালেঞ্জ নিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল জ্যান। তুমি কার মাঝে নিজের ছায়া দেখতে পাও?

সবার মাঝে। শ্রাগ করল ক্লেইবন। অন্তত চেষ্টা করি। নরম্যানকে বুঝতে চেষ্টা করেছি-আমি ওর আবদ্ধ মনোভাব বা ওর ঘৃণা বুঝতে পারি। মার্টি ড্ৰিসকলের উচ্চাকাঙ্ক্ষা আমার মাঝেও আছে। রয় অ্যামেসের মতো আমিও লেখক হতে চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম নরম্যানকে নিয়ে একটা বই লিখতে।

জ্যানের মনে পড়ল ক্লেইবর্নের সাথে কাটানো গত সন্ধ্যাটার কথা। হঠাৎ করে অযাচিত কিছু অনুভূতি ভরে তুলল ওর মনটাকে। মনের কেমন একটা উত্তাপ…আস্তে আস্তে বেড়ে উঠতে থাকা একটা রাগ অনুভব করছে সে। ক্লেইন কি বলছে, সেটা খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ না। কিন্তু ওর কন্ঠ…সেই ভারী কণ্ঠটা কেন জানি ওকে উত্তপ্ত করে তুলছে। ক্লেইবন অভিনয় করছে, সে আসলেই চায় ওকে বোঝাতে। হঠাৎ ক্লেইবনকে সপর্শ করতে উদগ্রীব হয়ে উঠল তার মন। কিন্তু না, নিজেকে সামলে নিল সে। শারীরিক সম্পর্শের চাইতে, শব্দের ব্যবহার অনেক বেশি নিরাপদ।

পল মরগ্যান? জানতে চাইল জ্যান।

নড করল ক্লেইবর্ন। ওর সব আচরণ আমার পছন্দ হয় না। কিছুটা নিচতা আছে তার মাঝে। কিন্তু তার মতো আমিও হীনমন্যতায় ভুগি। নিজের ইমেজ নিয়ে চিন্তা করি। ভিজিনির ক্ষেত্রেও তাই। হয়তো বা আরও বেশি। কেননা আমিও এক এতিম।

তুমি?

নম্র গলায় কথা বলে উঠল ক্লেইবর্ন। হ্যাঁ। এমনকী আমার বাবা-মার নামটা পর্যন্ত জানি না। আমার আসল নামটাও না। পার্থক্য কেবল একটা। ওর মতো আমি এতিমখানা থেকে পালাইনি। একটু বিরতি নিল সে। তোমার ছোট বোনের কথা যখন বললে, তখন মনে হচ্ছিল সব কিছু যেন আমার চোখের সামনেই ঘটছে। হয়তো আমার মা…আমার মার অবস্থা হয়েছিল তোমার বোনের মতোই। মনে হচ্ছিল, আমি আর তোমার বোনের বাচ্চা যেন জমজ! চোখ তুলে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে হাসলেন তিনি। বুঝতে পারছ তো। অন্যের মনে কী চলছে, তা বোঝার জন্য তোমার নিজের ছায়া তার মাঝে খুঁজে বের করার কোনও দরকার। নেই। একটু মনোযোগ দিয়ে দেখলে, সবার মাঝেই নিজেকে খুঁজে পাবে।

নড করল জ্যান। আমিও মেরি ক্রেনের মাঝে নিজেকে খুঁজে পাই। কিন্তু চেহারার মিল থাকার জন্য মাঝে মাঝে মনে হয়…আমি আসলেই মেরি ক্রেন। মনে হয়, যদি আমি ভালো অভিনয় করি, তাহলে হয়তো মেরিকে আবার বাঁচিয়ে তোলা হবে

যদি এর মানে হয়, তোমার নিজের জীবনের সমাপ্তি, তাহলে? সামনের দিকে ঝুঁকে এলেন তিনি, হাতে হাত রাখলেন। আমি জানি, এই চরিত্রটা তোমার কাছে কতোটা দামি। কিন্তু মনে রেখ, মেরি ক্রেন কেবল মাত্র একটা চরিত্র। সে মারা গিয়েছে, তুমি বেঁচে আছ। তোমার কী হলো, এখন সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।

ক্লেইবর্নের চোখে চোখ রাখল মেয়েটা। বুঝতে পারল, লোকটা আসলে মন থেকেই বলছে কথা গুলো। জ্যানের কী হলো না হলো, তাতে ওর অনেক কিছু যায় আসে। নিজের হাতে লোকটার হাতের ঘর্মাক্ত পর্শ টের পেল সে। লোকটা ওকে উষ্ণ করে তুলেছে, ব্যাপারটা অবশ্য ভালো। কেননা এতে অন্যান্য সব চিন্তা ওর মন থেকে দূরে সরে থাকছে। নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়েছে জ্যান, কিন্তু ভয়টা এখনও আছে। তাই এখন আর এই মুহূর্তে, এই স্পর্শ আর অনুভূতির মাঝে ডুবে থাকতে চায় ও।

ক্লেইবর্নের আলিঙ্গনের মাঝে নিজেকে ডুবিয়ে দিল জ্যান, ঠোঁট দিয়ে খুঁজল লোকটার ঠোঁট। এতক্ষণ মনে হচ্ছিল কেবল ওদের হৃদস্পন্দন একে অন্যের সাথে মিলে গিয়েছে। এখন সেই সাথে যোগ হলো ওদের দেহও। বুকে পুরুষালী আঙুলের স্পর্শ টের পেল জ্যান, কোমরে লোকটার হাত। নামছে, আরও নিচে নামছে ওটা-কিন্তু পরক্ষণেই তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল ক্লেইবন।

চোখ খুলে তাকাল জ্যান। কী হয়েছে?

জ্যান, আমার কথা শোন। ক্স কণ্ঠে বললেন লোকটা। আমি জানি তুমি কী করতে চাইছ। কিন্তু তাতে কাজ হবে না। তোমার নিরাপত্তা গুরুত্বপূর্ণ, ক্যারিয়ার। চুলোয় যাক। এভাবে আমাকে চুপ করিয়ে দিয়ে কোনও লাভ নেই।

ঝট করে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল জ্যান। ওকে উঠতে দেখে ভয় পেয়ে লাফ দিল বিড়ালটাও। চুপ করিয়ে দিয়ে মানে? হারামজাদা, কী ভাবিস তুই নিজেকে

আমি দুঃখিত। উঠে দাঁড়াচ্ছেন ক্লেইবর্ন। আমি ওভাবে বলতে চাইনি। আমি তোমাকে চাই, সেটা তুমিও জানো। কিন্তু এভাবে…এই পরিস্থিতিতে-

গালে জ্যানের থাপ্পড় খেয়ে চুপ করে গেলেন তিনি। এভাবে মানে? তুমি নিজে নিজে ঘটনা বানাচ্ছ। কিন্তু না, আর না। অনেক হয়েছে। বের হয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে, আমার জীবন থেকে! ঘুরে দাঁড়িয়ে সদর দরজার কাছে চলে গেল জ্যান, হ্যাঁচকা টানে খুলে ফেলল ওটা।

বোকামী করো না, বললেন ক্লেইবর্ন। তোমার বুঝতে হবে

রাগে যেন জ্যানের কান কাজ করা বন্ধ করে দিল, কিছু শুনতে পাচ্ছে না ও। এমনকি ক্লেইনকে ঠিকমতো দেখতেও পাচ্ছে না। লোকটা যখন ওর কাছে এসে দাঁড়াল, এক ঝটকা দিয়ে সরে গেল সে। স্পর্শ করতে দিতে চায় না। বেরিয়ে যাও বলছি!

নেমে এল ক্লেইবর্নের হাত, নত মুখে বেরিয়ে গেলেন তিনি। দরজা বন্ধ করার সাথে সাথে যেন সব শক্তি হারিয়ে ফেলল জ্যান। নিজেকে সামলাতে দরজার সাথে হেলান দিয়ে বসল, কাঁপছে। গাড়ির ইঞ্জিন চালু আর আস্তে আস্তে দূরে যাওয়ার শব্দ শোনার আগে, অনেক কষ্ট করেও স্বাভাবিক হতে পারল না। ঠিক হয়ে এল দৃষ্টি আর শ্রবণ শক্তি।

সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, লিভিং রুমের চারপাশে নজর বুলালো ও। একদম খালি, এমনকী বিড়ালটাও নেই।

শোনার মতো কোনও শব্দও নেই।

এমনকী মিউ মিউ পর্যন্ত না!

.

২৭.

দুই ঘন্টা আর সাত গাস স্কচ শেষ করারও পরও, ঘুম ধরছে না জ্যানের। একা একা বিছানায় শুয়ে, মনে মনে ক্লেইবর্নের মুন্ডু চিবাচ্ছে সে। অবশ্য থেকে থেকে নিজের উপরেও রাগ হচ্ছে ওর। দোষটা তো অনেকটাই ওর। প্রথমে মেজাজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। এরপর হারিয়েছে ক্লেইবনকে। এমনকী বিড়ালটাও ভয় পেয়ে ওকে ছেড়ে গিয়েছে। অথচ সত্যি কথাটাই বলেছেন ডাক্তার। নিজের করে। লোকটাকে পেতে চেয়েছিল জ্যান, কিন্তু শারীরিক আকর্ষণটাই একমাত্র কারণ ছিল না। ডাক্তারের ভেতর থেকে চলচ্চিত্রটার প্রতি বৈরিতাও সরিয়ে ফেলতে চেয়েছিল। উন্মাদিনী-নামটা এখন মনে হচ্ছে ওর ক্ষেত্রেও খাটে।

পাগল ছাড়া অন্য যে কেউ বুঝতে পারত ক্লেইবর্নের আসল উদ্দেশ্য। তিনি আসলেই ওকে নিরাপদে রাখতে চেয়ে কথাগুলো বলেছেন। কিন্তু কোন বিপদের হাত থেকে? আন্দাজ তো আর প্রমাণ হতে পারে না। হয়তো কিছু কথা ওর কাছ থেকে গোপন করে রাখা হয়েছে। রয়কে জিজ্ঞাসা করে দেখবে নাকি?

যা ভাবা সেই কাজ। বিছানার পাশের বাতিটা জ্বালিয়ে, ফোনের দিকে হাত বাড়াল ও। রয়ের নাম্বার ডায়াল করল, কিন্তু কেউ ধরল না। রিসিভার রেখে দিয়ে, বাতি বন্ধ করে দিল আবার। কাঁধ পর্যন্ত কম্বল তুলে নিতে নিতে ভাবল, রয় ফোন ধরেনি, ভালোই হয়েছে। সম্ভবত সে-ও একই কথা বলত। উন্মাদিনী তে অভিনয় না করানোর জন্য রাজি করাবার চেষ্টা চালাত। জ্যান পাগল হতে পারে, কিন্তু এতোটা পাগলও না। শুধু কথায় চিড়ে ভিজবে না। ওকে রাজি করাতে হলে, শক্ত প্রমাণ লাগবে।

গত পাঁচটা বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে আজ এখানে এসে পৌঁছেছে ও। বয়স তো দিন দিন কমে না, বরং বাড়ে। তাই এতো বড় সুযোগ এতো সহজে ছাড়বে না জ্যান।

***

আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে মার্টি ড্ৰিসকল। সাধারণত, প্যাটিওর সামনে লাগানো কাঁচের দরজা দিয়ে আকাশের তারা আর নিচের উপত্যকা দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু আজ তারার কোনও হদিস নেই। সত্যি বলতে কী, বাইরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কেউ যেন ধূসর একটা দেয়াল খাড়া করে রেখেছে। মুখ কুঁচকে ফেলল ড্ৰিসকল, নিজেকে হঠাৎ করে বড় বেশি বুড় মনে হচ্ছে।

বর্তমান যুগ, যৌবনের যুগ। দুধের বাচ্চারা এখন চলচ্চিত্র ব্যবসার হর্তা-কর্তা বিধাতা। বয়স্ক যে দু-চারজন আছে, তারাও নিজেদের আসল বয়স কমিয়ে বলতেই পছন্দ করে। এই উপলব্ধি যখন হলো মার্টির, তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। মাথায় কলপ লাগিয়ে বা আলগা চুল লাগিয়ে ঘোরাফেরা করার দিন শেষ। এখন ওসব পরে ঘুরলে, লোক হাসবে। এখন ওর হাতে মাত্র একটা উপায় অবশিষ্ট আছে…এই মুহূর্তে বোকা বনে থাকাই, বুদ্ধিমানের মতো আচরণ।

একদম অভব্য আর গেঁয়ো আচরণ করে ড্ৰিসকল। নিজেকে উপস্থাপন করে অন্য সব প্রযোজকের মতো করেই-রুচিহীন, প্রতিভাহীন একজন এক নায়ক হিসেবে। প্রিন্সটনের ডিগ্রী আছে না নেই, তা নিয়ে এখানকার কারও কোনও মাথা ব্যথা নেই। যেমন মাথা ব্যথা নেই চলচ্চিত্রের মান নিয়ে। দরকার শুধু বক্স অফিসে হিট করার, গুনগত মান চুলোয় যাক।

কাজে দিয়েছে বুদ্ধিটা। আর সেজন্যই ড্রিসকল এই মুহূর্তে নিজের বিশাল এক বাড়িতে বসে আছে। যেখান থেকে নিচের দিকে তাকালেই পরিষ্কার দেখা যায় স্টুডিওটাকে। আসলে ওর সর্বশেষ লক্ষ্য সম্ভবত সেটাই ছিলঃ সব আঙ্গিক থেকে স্টুডিওকে পায়ের নিচে দেখা।

স্টুডিওর ওরা ভাবে, ড্ৰিসকল মিয়া কালপা আর মিয়া ফারো-এর মাঝে পার্থক্যই করতে পারে না। এমনকী ওর স্ত্রীও এই রহস্যটা ধরতে পারেনি। ডেব্রাহ-এর ধারনা, মার্টি এক মোটা সোটা টাকার কুমির মাত্র। বাচ্চাদেরকে নিয়ে এক সপ্তাহের জন্য বেড়াতে গিয়েছে সে। আসলে বেড়াতে না, ওর কাছ থেকে দূরে থাকতে। কিন্তু প্রতিদিন একবার ফোন করে, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট রূপী স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ভুল করে না। আচ্ছা, ড্ৰিসকল যে দেনার সাগরে ডুবে আছে, এ কথা জানলে মেয়েটা কী করবে? এই বাড়ি আর ঝর্ণার পাশে কেনা। আরেকটা বাড়ি দ্বিতীয়বার বন্দক রাখা। বিল-টিলের কথা নাহয় বাদই থাক।

অবশ্য ড্ৰিসকলের কপাল ভালো থাকলে, এসব খবর ডেবরাহ কোনওদিন জানতেই পারবে না। কপাল-কপালটাই আসল। গত তিনটা চলচ্চিত্র ভালো ব্যবসা করতে পারেনি। তিন নাম্বারটা বেরোবার পর, শুরু হয়েছে বাড়ি বন্দুক রাখা।

কিন্তু উন্মাদিনী নিয়ে যখন ভিজিনি ওর সাথে দেখা করতে এল, তখন থেকে আবার ফিরতে শুরু করেছে ওর কপাল। তবে কপালের কথা কী আর বলা যায়? নরম্যানের পলায়ন আর ওর হাতে পাঁচ জন মানুষ খুন হবার পর, আবারও ভাগ্য ওকে ছেড়ে যেতে শুরু করেছে। নিউ ইয়র্কের ওরা তো পুরো প্রজেক্টটাই বাতিল করতে চেয়েছিল। রুবেন সেরকমই জানিয়েছে ওকে। ওদের ধারনা, এই ঘটনা পুরো ছবিটাকেই পুরাতন ইতিহাস বানিয়ে দিয়েছে। অনেক কষ্টে রুবেনকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কয়েকদিন সময় চেয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিল সে। তবে আগামীকাল সকালে আবার নতুন করে বসবে নিউ ইয়র্কের হোমরা-চোমরারা। মিটিং-এ নেয়া হবে শেষ সিদ্ধান্ত।

সেই সাথে আবার যোগ হয়েছে ক্লেইবর্ন লোকটা। এখন পর্যন্ত রয় অ্যামেসকে সামলাতে পেরেছে সে। কিন্তু ক্লেইবর্ন ঝামেলার জন্ম দিয়েছে। আস্তে আস্তে আরও গাঢ় হচ্ছে তা। উন্মাদিনী থেকে যে কিছু লাভ তুলে আনবে, সে সম্ভাবনা হাওয়া : হয়ে গিয়েছে প্রায়। আর আজ বিকালের কথা আর কী বলবে! স্যান্টো ভিজিনিকে মানসিক ভারসাম্যহীন বলা সহজ, কিন্তু তার অর্থ তো এই না যে ওকে আগুন লাগাবার অভিযোগে অভিযুক্ত করা যাবে। ড্রিসকল একটা সিগার ধরাল।

উচিৎ হয়নি, কেননা সিগারের আগুন ওকে অনেক কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। কয়েকদিন আগের কথা, প্রোডাকশনের বীমা সংক্রান্ত নিয়মগুলো পড়ার সময় একটা বিশেষ লাইনে আটকে যায় ওর চোখ। যদি কোনও অ্যাক্সিডেন্ট ঘটে, তাহলে সংশ্লিষ্ট সবাই পূর্ণ পারিশ্রমিক পাবে। যেমন প্রধান অভিনেতা বা অভিনেত্রীদের মৃত্যু বা আহত হওয়া অথবা আগুনে পুড়ে সেট বা অভিনয়ের সরঞ্জামাদি নষ্ট হওয়া। কপাল ফিরছে বলে মনে হয়েছিল ওর। শুধু শুধু ঝুঁকি নেবার কী দরকার! টাকাটা তো চাইলে এখনই নিতে পারে সে। প্রযোজক হিসেবে স্টুডিও থেকে যে ফি-টা পাবার কথা ছিল সেটা। যত টাকা এখন পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছে বলে দেখাতে পারত, তার পুরোটা ফেরত পেত! ঈশ্বরের ইচ্ছার উপর তো আর মানুষের হাত চলে না। এই টাকাগুলো পেলে, শোধ হয়ে যেত সব ধার।

পরিকল্পনা একদম সহজ ছিল। গ্যাসোলিনের ক্যানটা সেটে নিয়ে যেতে কোনও কষ্ট-ই হয়নি। ভুল করে ফেলেছে গ্যাসোলিন ছড়িয়ে দেবার আগে বিছানার চাদরে আগুন ধরিয়ে। শিখাটুকু আর্ডের মনে সন্দেহ জাগাতে যথেষ্ট ছিল। বিছানার নিচে ক্যানটা ঠেলে দেবার সময় পেয়েছিল সে কেবল। এরপর পড়িমরি করে পাশের দরজা দিয়ে পালায়। অফিসে ফেরার পথেও কেউ দেখেনি ওকে। কিন্তু আসল কাজটার সময়-ই ভাগ্য পক্ষ নিল না।

নিজের চামড়া বাঁচাবার জন্য বাধ্য হয়েই ক্লেইবর্নকে ওই বানানো গল্প শোনাতে হয়েছে ওকে। দিন দুয়েকের মাঝে চলে যাবে ওই মনোবিদ, রুবেনদের মিটিং-ও শেষ হয়ে যাবে। জর্জ ওয়ার্ড উন্মাদিনীর প্রচারণা নিয়ে যে কথা বলছে, সেটা ওদেরকে বোঝানো কষ্টই হয়ে যাবে।

তবে তাতে কিছু যায় আসে না। মার্টি ড্রিসকল কষ্ট করে এতদূর এসেছে, সামনেও কষ্ট করেই চলবে। রাতের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে পায়চারী করছে সে। বাতির আলো ঢেকে দিয়েছে কুয়াশা, কিন্তু আগামীকাল আবার জ্বলবে সেটা। বিশ্রাম নেয়া দরকার…দরকার আর মাত্র একটা দিন। যদি এগিয়ে যাবার নির্দেশ আসে, তাহলে অন্যরা কোন চুলোয় গিয়ে মরল, তাতে ওর কিছু যায় আসে না। খ্যাপাটে লেখক, মাথা নষ্ট মনোবিদ, বোকা মেয়েটা, প্রায় উন্মাদ পরিচালক আর নিজের প্রেমে মত্ত নায়ক-সবাই চুলোয় যাক।

.

২৮.

রাতের অন্ধকারে ভিজিনির মনে হলো, মৃতরা ওর সামনে এসে উপস্থিত হয়েছে। মনে হলো, হট-টাবের বুদবুদ ভেদ করে উঠে আসছে ফুসকুড়ি পড়া দেহ আর মাংসহীন সব মুখাবয়ব। কিন্তু এখানে তো কোনও হট-টাব নেই!

এই মুহূর্তে ঠিক কোথায় আছে সে, তা-ও জানে না। জায়গাটা কুয়াশা দিয়ে ঢাকা, ও নিজেও তাই। কুয়াশা, বাষ্প না। ঠান্ডা, গরম না। পাহাড় ধরে। শিকারীর মতো হাসছে সে, জানে আজকে নেশা করা উচিৎ হয়নি। এ-ও জানে, আজ বাড়িতে থাকলেই ভালো করত। কুয়াশা আর রাতের চাদরে ঢেকে দিতে হতো অদ্ভুত এই চিন্তাগুলোকে। কিন্তু এই চিন্তাগুলোর যন্ত্রণাতেই পিল খেতে বাধ্য হয়েছে ভিজিনি। আর পিল ওকে বাধ্য করে ঘর ছেড়ে বেরোতে। নাহ, ভুল হলো। চিন্তা নয়, স্মৃতি…স্মৃতি ওকে টেনে এনেছে এখানে। যে স্মৃতিগুলোর হাত থেকে পালাতে চায় ও। মৃতদের যে স্মৃতিগুলো ওকে তাড়িয়ে বেড়ায়। মামা মিয়া হ্যাঁ, মামা মিয়ার স্মৃতি। যে দিন তার গ্রামে সৈন্যরা এসেছিল, সেদিনের স্মৃতি।

সেদিন মামা মিয়া ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়েছিল টাউন স্কয়ারে। রবিবারের লম্বা বিকাল বেলায় ওখানে পিকনিক করতে যেত ওরা। চমৎকার সব সুর বাজাতো ব্যান্ড দল। তবে সেদিন ব্যান্ড দল ছিল না। যেখানে দাঁড়িয়ে গান করত লোকগুলো, সেই জায়গাটাও ভেঙে ফেলা হয়েছিল। সুর বলতে কিছু ছিল না, ছিল পাথরের উপর বুটের আওয়াজ। চতুর্দিক থেকে স্কয়ারকে ঘিরে ফেলেছিল সৈন্যরা। প্রথমে মদের নাগাল পেয়েছিল তারা, এবার মেয়েদের। মামা যখন লোকগুলোকে দেখে পালাবার প্রয়াস পেল, তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। ছোট ভিজিনিকে একটা টেবিলের নিচে লুকিয়ে রাখতে পেরেছিল শুধু। তার পরেই ধরা পড়ে সৈন্যদের হাতে।

পাঁচ-ছয় জন ছিল তারা, বেশিও হতে পারে। নাকি অন্যরা পরে এসে যোগ দিয়েছিল? জানে না ভিজিনি। কেননা সেই মুহূর্তে ও ছিল টেবিলের নিচে। নিজের কান্না, সৈন্যদের উল্লাস আর মামার চিৎকার ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছিল না। আচমকা বার বার একটা শব্দ হতে শুরু করল-ব্যাম, ব্যাম, ব্যাম। সেই সাথে নড়ছিল টেবিলটা। ভিজিনির পুরোটা দুনিয়া তখন শব্দময় হয়ে গিয়েছিল-ব্যাম, ব্যাম, ব্যাম। উধাও হয়ে গিয়েছিল চিৎকার, উধাও হয়ে গিয়েছিল হাসি। ছিল শুধু ব্যাম, ব্যাম, ব্যাম। আর ছিল গুঙিয়ে ওঠার আওয়াজ, মামা মিয়ার গোঙানি। টেবিলের সামনে লেগে গিয়েছিল লম্বা একটা লাইন। অনেকক্ষণ পর পর এক জোড়া বুট পরা পা সরে যাচ্ছিল ভিজিনির চোখের সামনে থেকে। সেখানে এসে দাঁড়াচ্ছিল একই রকম বুট পরা অন্য এক জোড়া পা। ময়লা, কাঁদায় মাখামাখি হয়ে ছিল ওগুলো। আর পঞ্চম…নাকি পঞ্চদশ বুট জোড়ায় ছিল লালচে আভা। ওগুলো যে রক্ত, তা বুঝতে পেরেছিল ভিজিনি। কিন্তু মাথার ভেতরে, আর মাথার উপরে হতে থাকা শব্দের হাত থেকে বাঁচার জন্য সেদিকেই তাকিয়ে ছিল।

সেই তখন থেকে ওর মাথার ভেতরে জায়গা করে নিয়েছিল শব্দটা-ব্যাম, ব্যাম ব্যাম। পিল ছাড়া যার হাত থেকে কোনও রেহাই নেই।

সেদিন অনেক…অনেকক্ষণ পর বন্ধ হয়েছিল শব্দটা। হাসতে হাসতে বিদায় নিয়েছিল সৈন্যরা। চারপাশ ফাঁকা হয়ে গেলে, বেরিয়ে এসেছিল ভিজিনি। টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হা করে সবকিছু দেখছিল। মাত্র পাঁচ বছর বয়স ছিল তার, আর জীবনে সর্বপ্রথম যে নগ্ন নারীদেহ দেখেছিল, তা ছিল ওর মায়ের। সারা দেহ অসংখ্য ক্ষতে ভর্তি, রক্ত ঝরছিল। ওকে দেখতে পেয়ে ফিসফিস করে মামা বলেছিল। স্যান্টো! পুরোপুরি উচ্চারণ করতে পারেনি। দুই ঠোঁটে মাঝখান থেকে রক্তমাখা একটা বুদবুদ বেরিয়ে এসেছিল কেবল।

অজ্ঞান হবার আগে, সেটাই ছিল তার শেষ স্মৃতি।

হয়তো ঠিক তখনই মারা গিয়েছিল মামা মিয়া, হয়তো পরে। ভিজিনি জানে।, কারণ ওর পরবর্তী স্মৃতি কাতানিয়ার এক হসপিটালে জেগে ওঠা। ওর মামা মিয়ার কী হয়েছিল, তা কেউ জানত না অথবা তাকে বলেনি। ভিজিনি, যে। শহরের নামে ওর নাম, সে শহরে আর কখনও পা রাখেনি সে। এতিমখানার কেউ ওর পদবীর কথা জানত না বলে, স্যান্টো ভিজিনি-ই হয়ে গিয়েছিল ওর নাম।

আচ্ছা, সিসিলিয়ান মায়ের তাদের ছেলের এমন নাম রাখে কেন? অ্যাঞ্জেলো, স্যালভাতোর, স্যান্টো? নামে কী যায় আসে? তেরো বছর বয়সে যখন ও পালের্মোতে পালিয়ে আসে, তখন অ্যাঞ্জেলো নামের একজন ওকে নিজের দলে ভিড়িয়ে নিয়েছিল। শিখিয়েছিল কীভাবে চুরি করতে হয়। হ্যাঁ, ওকে অনেককিছু শিখিয়েছে লোকটা। কিন্তু দেব-দূতের সাথে এই অ্যাঞ্জেলোর ছিল যোজন যোজন দূরত্ব। তবে হ্যাঁ, নাপোলিতে থাকার সময় এক স্যালভাতোর আসলেই ওর উদ্ধারকর্তা হয়ে এসেছিল। কারাবিনিয়ারি যখন ভিজিনিদের ছোট অপারেশনটা বরবাদ করে দেয়, তখন স্যালভাতোর বাঁচিয়েছিল ওকে। কিন্তু যে মাদক ব্যবসা করত ওরা, সেই মাদকের হাত থেকে বাঁচায়নি।

স্যান্টো নিজেও তো কোনও সেইন্ট বা সাধু ব্যক্তি না। কোনও সাধুর পক্ষে রোমা, মিলান আর মার্সেইতে যা হয়েছে, তা থেকে বেঁচে ফেরা সম্ভব না। যখন নগ্নতাকেই অশ্লীলতা ধরা হতো, তখন কোনও সাধু কী পারত স্নাফ ফ্লিম বানাতে?

উপরে উঠতে গিয়ে হোঁচট খেল ভিজিনি। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে এখন। কুয়াশা এতটাই ঘন যে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না ও, সাইনপোস্ট পড়া তো দূরে থাক। এখন কোথায় আছে সে? ভাবছিল, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে পায়ের নিচে শক্ত রাস্তা পেয়ে বুঝতে পারল। পাহাড়ের শীর্ষে এসে পৌঁছেছে। নাহ, ভুল হলো। পাহাড়ের শীর্ষে না, সারা দুনিয়ার শীর্ষে। পকেটে একটা পিল এখনও আছে। পানি ছাড়াই সেটা গিলে ফেলল ও।

সবকিছু ভুলে যাওয়ায় ভালো। মনে রেখে লাভ কী? মামা মিয়ার কথা ভুলে যাও, ভুলে যাও আমাকে বড় করে তোলা যাজিকাদের কথা। আরাফ ফিল্মের ওই কুত্তিটার কথা মনে রেখেই বা লাভ কী? ওই কুত্তিটার যা প্রাপ্য ছিল, তাই পেয়েছে। মরাই উচিৎ ছিল তার। ছুরিটা বের করার আগ পর্যন্ত হাসছিল সে। গুঙিয়ে উঠছিল থেকে থেকে…থেকে থেকে করছিল শীকার।

আচ্ছা মামা-মিয়ারও কি ভালো লাগছিল তখন? ব্যথা পেয়ে গুঙিয়ে ওঠা আর আনন্দে গুঙিয়ে ওঠার মাঝে পার্থক্য কী? পাঁচ বছরের এক বাচ্চার সেটা বোঝার কথা না। আর এখন নিশ্চিত হবার কোনও উপায় আছে কি। ঝোঁপের আড়ালে যখন এক নামহীন পুরুষের সাথে গড়াগড়ি করছিল সে, যখন ভিজিনিকে পেটে ধরার প্রক্রিয়া সমাধা করছিল, তখন নিশ্চয় খুব ভালো লেগেছিল মামা মিয়ার!

বাকি রইল নরম্যান বেটসের মা-কামিয়ে ফেলা গোঁফের জায়গায় আঙুল বুলালো ভিজিনি। নরম্যানের চরিত্রে কিন্তু তাকে খুব মানাত। কেননা ভিজিনি নরম্যানকে বোঝে। কিন্তু না, চরিত্রটা পেল কে? পল নরম্যান। অথচ নরম্যানের ব্যাপারে তার কোনও ধারনাই নেই। আসলে কারওই ধারনা নেই, এমনকি ডাক্তারদেরও না। শুধু আছে ওর, স্যান্টো ভিজিনির।

গত বছর ফেয়ারভিলে গিয়েছিল ও। হোটেলের ধ্বংসাবশেষ, বাড়িটা-সব দেখে এসেছে। ভেবেছিল একদম আসলের মতো করে বানাবে উন্মাদিনী। সফল হবে চলচ্চিত্রটা।

ডিসকল এসব বোঝে না, লোকটা শুধু টাকা চেনে। তার দরকার শুধু অ্যাকাউন্টে টাকা জমা হওয়া, গুনগত মান চুলায় যাক। কিন্তু ভিজিনির মতো একজন আর্টিস্টের কাছে মানটাই আসল। এমন এক দুনিয়ায় আছি আমরা, যেখানে মেয়েরা তাদের সব নগ্ন রহস্যগুলো স্কার্টের আড়ালে লুকিয়ে রাখে। তাই এই দুনিয়ায় দরকার ওর মতো…নরম্যানের মতো মানুষদের। গোপন রহস্যটা বের করার জন্য, অশুভকে প্রকাশ করে শাস্তি দেবার জন্যই ওদের জন্ম। মেরি ক্রেনের সাথে সেটাই করেছে নরম্যান…যেমনটা ও করবে জ্যানের সাথে।

পিট পিট করে তাকাল ভিজিনি, কুয়াশা ভেদ করে দেখার প্রয়াস পাচ্ছে। পিলের সংখ্যাটা একটু বেশিই হয়ে গিয়েছে। বাইরের মতো, ওর মাথার ভেতরেও

কুয়াশা ভর করে আছে। তবে কেন এখানে এসেছে, তা এখনও ভুলে যায়নি।

জ্যান, মেরি ক্রেনের মতো দেখতে মেয়েটা। এই একটামাত্র কারণেই ওকে বেছে নিয়েছে ভিজিনি। তবে শুধু দেখলেই তো হবে না, ওকে মেরি ক্রেনের মতো আচরণ করা শেখাতে হবে। বেচারা নরম্যানের দিকে নিজেকে ছুঁড়ে দিয়েছিল চোরটা। জ্যান হার্পারের ভেতর থেকে বাড়তি সবকিছুকে সরিয়ে ফেলতে হবে ওর। এমনভাবে কাজটা করতে হবে, যেন ওর শুধু মাংসটুকুই অবশিষ্ট থাকে। এরপর শাওয়ারে যে মেরি ক্রেন ছিল, ঠিক ওর মতো বানাতে হবে জ্যানকে।

আচমকা পরিষ্কার হয়ে গেল কুয়াশা। মনের চোখে ভিজিনি দেখতে পেল। জ্যানকে। নগ্ন মেয়েটা চরম পুলকে শীকার করছে। আসল চরম পুলক কখন হয়, জানে কি মেয়েটা? যখন মৃত্যু আসে।

নরম্যানকে পছন্দ করি আমি। মেরি ক্রেনকে নিশ্চয় সে বুঝিয়ে দিয়েছে, বুঝিয়ে দিয়েছে কে আসল পুরুষ। ভিজিনিও তাই করবে। জ্যানের সাথে…

.

…গুঙিয়ে উঠল জ্যান। বিছানায় দারুণ খেল দেখাচ্ছে রয়। অসাধারাণ! ছেলেটার চেহারার দিকে তাকিয়ে তার আদর উপভোগ করতে আরও ভালও লাগছে। আচমকা রয়ের চেহারা হয়ে গেল ক্লেইবর্নের চেহারা। ওর দেহের উপর শুয়ে আছে ডাক্তার, ঠিক যেমনটা ও চেয়েছিল। কিন্তু বেশিক্ষণ এক রইল না চেহারাটা। এই যে এখন…পল মরগ্যান সঙ্গম করছে ওর সাথে! চোখ বন্ধ করে ফেলল জ্যান, নিষেধ করছে ওকে। কিন্তু আবার যখন চোখ খুলল তখন বুঝতে পারল, কোথাও কোনও সমস্যা আছে। পলের চেহারা উধাও হয়ে গিয়েছে। এখন তার স্থান নিয়েছে স্যান্টো ভিজিনি।

পরিশ্রমে হাঁপাচ্ছে লোকটা, বগল থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ছে সুগন্ধিযুক্ত ঘাম।

উঠে বসল জ্যান, হাত দিয়ে ভিজিনির চেহারা খামচে ধরার প্রয়াস পেল। কিন্তু এখন ওই দেহটার কোনও চেহারা নেই। চেহারার জায়গা কেমন যেন ধোয়াশে হয়ে আছে। কিন্তু জ্যানের অন্তরাত্মা জানে, লোকটা নরম্যান বেটস না হয়ে যায় না। এতক্ষণ ধরে দেখা চেহারাগুলো আসলে মুখোশ। এখন লোকটার আসল চেহারা বেরিয়ে এসেছে। আচমকা সেই চেহারাটা দেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠল ওর মনে।

ঠিক সেই মুহূর্তে তীব্র চিৎকারে আসলেই চোখ খুলে তাকাল সে, ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছে। প্রথম প্রথম শোবার ঘরের অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই নজরে পড়ল না। কিন্তু আবার হলো সেই চিৎকার, সেই সাথে দরজায় দমদম ঘুষির শব্দ। দেহের ওপর থেকে চাদর সরিয়ে, বাতি জ্বালাল ও। বিছানা ছেড়ে স্লিপার পায়ে গলাতেও বেশিক্ষণ লাগল না। দৌড়ানোর মাঝেই হাতে তুলে নিল রোবটা।

আমাকে ঢুকতে দাও- দরজার ওপাশ থেকে কনির আওয়াজ ভেসে এল।

দরজা খোলার পর জ্যান দেখতে পেল, মেয়েটা প্রচণ্ড শীতে কাঁপছে! কুয়াশার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায়, চোখ দিয়ে পানি ঝড়ছে ওর।

কী হয়েছে?

কেবল বাসায় এলাম। বাচ্চাদের মতো বেঁকে গেল ক্রন্দনরত চেহারাটা।

নড করল জ্যান, বুঝতে পেরেছে। জানতে চাইল, তোমার চাবী কই?

পার্সে-খুঁজে পাচ্ছি না। লোকটা দাঁড়িয়ে ছিল ওখানে।

লোকটা? কোন লোকটা?

কনি হাত দিয়ে কুয়াশাচ্ছন্ন রাস্তার দিকে ইশারা করল। গাড়ি থেকে বের হয়ে দেখি, গাছের নিচে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল…মনে হচ্ছিল আমাকে ধরতে এসেছে।

কাঁপতে থাকা মেয়েটার ঘাড়ের উপর দিয়ে উঁকি দিল জ্যান। আমি তো কাউকে দেখতে পাচ্ছি না।

আমার চিৎকার শুনে পালিয়েছে হয়তো। কিন্তু আসলেই কেউ ওখানে ছিল। আমি দেখেছি

রোবটা গায়ের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে, রাস্তার দিকে এগোতে শুরু করল জ্যান।

সাথে সাথে ঘুরে দাঁড়িয়ে ওকে বাঁধা দিতে চাইল কনি। না! যেও না! কিন্তু জ্যান ততক্ষণে গাছগুলোর কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে। নিচু হয়ে ছোট বিড়ালটাকে তুলে নিল ও। বাঁধা দিল না বিড়ালটা, এমনকী নড়লও না এক

নড়বে কীভাবে?

ওটার গলা যে কেউ একজন প্রবল আক্রোশে কেটে ফেলেছে!

.

২৯.

অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছেন ক্লেইবর্ন, কিন্তু নিজেকে তার বড় ক্লান্ত মনে হচ্ছে। মনের মধ্যে অনেক কিছু চলছে, হিসাব মিলাতে হচ্ছে অনেক কিছুর। উঠে দাঁড়িয়ে কামিয়ে নিলেন তিনি। পোশাক পরার অবকাশে গত চব্বিশ ঘন্টার ঘটনাবলী আরেক বার মনে করে নিলেন। ভিজিনির মুখোমুখি হওয়া, ড্ৰিসকলের সাথে দেখা হওয়া, এমনকী জ্যানের সাথে তর্কাতর্কিও বাদ পড়ল না।

তর্কাতর্কি? শুধু তর্কাতর্কি বললে, কমই বলা হয়। একবার যদি মেয়েটাকে বোঝাতে পারতেন সব কিছু! জ্যানের নিরাপত্তা তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা জ্যান নিজে তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পারেননি বোঝাতে। একেবারে ব্যর্থ হয়েছেন। শনিবার আজ, সময় আর বেশি নেই হাতে। তাড়াতাড়ি ফোনের কাছে গিয়ে স্টাইনারকে কল করলেন তিনি।

হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, বলল ক্লারা। বৃহস্পতিবার রাতে তাকে কাউন্টি জেনারেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ধারনা করা হচ্ছে যে তার নিউমোনিয়া হয়েছে। সারা সপ্তাহ এখানে বৃষ্টি হয়েছে

মেয়েটাকে বকবক করার সুযোগ না দিয়ে, বেশ কয়েকটা প্রশ্ন করলেন তিনি।, ডা. স্টাইনারকে নিবিড় পরিচর‍্যা কেন্দ্রে নেয়া হয়নি। কিন্তু কোনও ফোন বা অতিথির সাথে দেখা করার অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। সামনের কয়েক দিনে দেয়াও হবে না। আর না, করোনারের অফিস থেকেও তেমন কিছু জানাইনি। যতদূর সে জানে, সোমবারের আগে জানা যাবেও না। ততদিনে অবশ্য আপনি এখানে ফিরে আসবেন। আপনিও নেই, ডা, স্টাইনারও নেই। হাসপাতালে যে কী চলছে–

ক্লারাকে কথা শেষ করার সুযোগ না দিয়ে, ফোন রেখে দিলেন তিনি। কয়েকদিন হলো এখানে এসেছেন, অথচ বলতে গেলে কোনও কাজই করতে পারেননি। ঠিক বলেছিলেন স্টাইনার, ক্লেইন গোয়েন্দা নন। তার উপর মনোবিদ হিসেবে যে কাজটা করা তার একদম উচিত হয়নি, সেটাই করে বসেছেন, মানুষের প্রতি এতোটা আগ্রহী হয়ে পড়েছেন যে এই মুহূর্তের সমস্যার দিকে নজর দেননি।

বিছানায় বসে পড়লেন তিনি; এখন কী করা যায় আর কোন পথে এগোনো যায়, সেটা নিয়ে মাথা ঘামানো শুরু করলেন। কী ভেবে আবার ফোন তুলে নিলেন হাতে। দুটো নাম্বারে কল করলেন তিনি। এরপর বাথরুমে গিয়ে, মাথা রাখলেন পানির ট্যাপের নিচে। জানেন যে এখন আবার চুল আঁচড়াতে আর শার্ট বদলাতে হবে, কিন্তু ঠান্ডা পানির স্পর্শ বেশ ভালো লাগল। পকেটে চাবী আছে নিশ্চিত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লেন তিনি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেন, অনেক আগেই বারোটা বেজে গিয়েছে। অথচ এখনও নাস্তা করা হয়নি তার। এখন অবশ্য সময় নেই আর। আর যা শুনলেন, তার পর–

হ্যালো। টম পোষ্ট তার অফিসের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। কফি চলবে নাকি?

একটু ব্যস্ত আছি। একজনের সাথে দেখা করতে হবে—

দেরি হবে না। বানানোই আছে।

পোষ্ট পথ দেখিয়ে তাকে অফিস ঘরে নিয়ে এসে বসাল। ভেতরে বসে আরাম করেই খাই।

ঘরটাকে আরামদায়ক বলা যায়, অন্তত এককালে ছিল। আসবাব পত্র তখন নতুন ছিল নিশ্চয়। এখন ধুলো পড়েছে ওতে, স্যাঁত স্যাঁতে হয়ে গিয়েছে পরিবেশ। ল্যাম্পের আলোতে কেবল দেয়ালে ঝোলানো ছবিগুলো এখনও চকচক করছে।

বুড়ো লোকটা কফি ঢালার কাজে ব্যস্ত হলে, ক্লেইবর্ন দেয়ালের দিকে নজর দিলেন। বাইরের অফিসের দেয়ালের মতো এখানকার ছবিগুলোও কোনও অভিনেতা বা অভিনেত্রীর। তবে একজনকেও চিনতে পারলেন না তিনি। টম পোস্ট এগিয়ে এসে তার হাতে কফির কাপ ধরিয়ে দিল। ক্রিম আর চিনি লাগবে?

নাহ, কালো কফিই ভালো। ধন্যবাদ।

ঠিক সেই মুহূর্তে ক্লেইবন বুঝতে পারলেন, এমন কিছুর অপেক্ষাতেই ছিলেন তিনি। কালো কফি, ঠান্ডা পানির চাইতে অনেক বেশি জাদু দেখাল।

গরম পড়েছে সকালে, বলল পোস্ট। তবে রাতে কুয়াশা এসে সব ঠান্ডা করে দেবে। এই সময়টায় সাধারণত এরকমই হয়। দেয়ালের দিকে চলে গেল তার নজর। চেনা যায় কাউকে?

নাহ।

অবাক হলাম না। এরা যখন বিখ্যাত ছিল, তখন সম্ভবত আপনি ছায়াছবি দেখা শুরুও করেননি। একটা সরু আঙ্গুল দিয়ে ছবির দিকে নির্দেশ করে আবার বলল, এ সল মরিস। করনেট স্টুডিওস এর প্রধান ছিল। আর এ হচ্ছে- একে একে সবার সাথে ক্লেইবর্নকে পরিচয় করিয়ে দিল টম। দেয়ালে ঝোলানো ছবিগুলো শেষ হলে, ঘরের অন্ধকার কোনার দিকে চলে গেল পোস্ট। একদম একা, সবার থেকে আলাদা হয়ে ঝুলতে থাকা ছবির উপরের বাতিটা জ্বালাল।

অসাধারণ আর অভিজাত। তৈলচিত্রটাকে এরচেয়ে কম কোনও বিশেষণে অভিহিত করা যায় না। ছবির মেয়েটা বয়সে তরুণী আর চোখ ধাঁধানো সুন্দরী। মেয়েটার চোখ আর হাসিও খুব পরিচিত বলে মনে হলো। ডন পাওয়ারস। হাসল বৃদ্ধ। এই মোটেলের নামটাও তার নামানুসারে।

আমি সম্ভবত এই নায়িকার ছবি দেখেছি। বললেন ক্লেইবন। অভিনেত্রী ছিলেন নিশ্চয়?

হ্যাঁ। কিন্তু সাইলেন্ট ছবিতে অভিনয় করেছেন শুধু। ইতিহাসের সেরা অভিনেত্রী হবার যোগ্যতা আর সম্ভাবনা, সবই ছিল তার। শেষের দিকে আবেগে যেন মুদে এল টম পোস্টের গলা।

চকিতে লোকটার দিকে তাকালেন ক্লেইবন। প্রেমে পড়েছিলেন নাকি মেয়েটার?

এখনও পড়ে আছি।

কী হয়েছিল তার ভাগ্যে?

শ্রাগ করল পোস্ট। কিছু না। এই ইন্ডাস্ট্রির বাইরের একজনকে বিয়ে করে ছিল। অনেক আগেই মারা গিয়েছে। বাতি বন্ধ করে, ক্লেইবর্নের দিকে তাকাল সে। এই যতজনের ছবি দেখলেন, তারা আর কেউ এখন নেই। অতি দ্রুত আমিও থাকব না। হয়তো সেটাই সবার জন্য ভালো হবে। আমার জন্যও।

এতো তাড়াহুড়োর কী আছে! এখনও স্বাস্থ্য আপনার ভালো।

যখন খারাপ হতে শুরু করবে তখন? মাথা নাড়ল পোস্ট। আমি নার্সিং হোমগুলো স্বচক্ষে দেখেছি। ওখানে মানুষ থাকে নাকি?

ক্লেইবন কফির খালি কাপটা নামিয়ে রেখে বললেন। যেতে হয়—

মাফ করবেন, অনেক বক বক করে ফেলেছি।

ক্ষমা চাওয়ার কিছু নেই। আমার ভালোই লেগেছে।

ধন্যবাদ। মুচকি হাসল পোস্ট।

ক্লেইবন এগিয়ে যেতে, অনুসরণ করল সে-ও। একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে ভুলে গিয়েছিলাম। আপনি একটা ছবির কথা বলছিলেন, উন্মাদিনী। ওটার কী খবর?

সে এক লম্বা কাহিনী।

শুনতে আপত্তি নেই। পোস্ট দরজা খুলে ধরলে, বেরিয়ে গেলেন ক্লেইবর্ন। আপনি যদি ছয়টার দিকে ফ্রি থাকেন, তাহলে রাতের খাবারটা আমার সাথেই খান না কেন? আমি বিশ্ব সেরা রাঁধুনি নই। তবে যা রাঁধি, তা মুখে তোলা যায়।

কোনও অসুবিধা নেই। বলল ক্লেইবন। বিকালেই ফিরে আসব। তখন জানাই?

আমি এখানেই থাকব। আবারও হাসল পোস্ট।

গাড়িতে উঠে বেশ কিছুদূর এগিয়ে আসার পরও যেন হাসিটা বাজছিল ওর কানে। টমের এই আন্তরিক ব্যবহারের কারণটা কি শুধুই একাকীত্ব আর কৌতূহল? যতদূর মিশেছে, তাতে তো লোকটাকে দিন-দুনিয়ার উপর বীতশ্রদ্ধ বলে মনে হয়। অন্ধকারে দিনের পর দিন একা একা বসে থাকা, অতীতকে আঁকড়ে ধরে থাকা, মৃতকে জীবিত করার চেষ্টা করা-এসব তো নরম্যানও করত। বেটস মোটেল নামে একটা মোটেলও ছিল ওর।

নাহ, একটু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে। পোস্টের মধ্যে তার মা সংক্রান্ত কোনও জটিলতা নেই, আর মহিলার মৃতদেহও লুকিয়ে রাখেনি। শুধু ভালোবাসত, এমন এক মেয়ের ছবি ঝুলিয়ে রেখেছে অফিসে। তবে মেয়েটা মৃত-এমন এক মৃত মেয়ে যার হাসি আর চোখ অন্য একজনের কথা মনে করিয়ে দেয়। অনেক আগে দেখা একটা ফটোগ্রাফ…মেরি ক্রেনের ফটোগ্রাফ। সেই হাসি…সেই চোখ।

ধুর ছাই, কী সব ভাবছে এগুলো। দুনিয়াতে মোট সাইত্রিশ ধরনের চেহারা আছে। অন্য সব চেহারা সেই সাইত্রিশটারই সংযোজন বা বিয়োজন। ক্রেন মেয়েটার মতো হাসি বা একই রকম চোখ, এরকম মেয়ে খুঁজলে হাজারটা পাওয়া যাবে। এই যেমন জ্যান হার্পার।

মেয়েটার কথা মনে পড়তেই, মাথা নাড়লেন ক্লেইবন।

চাইলেই তুমি মেয়েটাকে গত রাতে পেতে পারতে। তাহলে এই সাধু গিরি কেন?

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ক্লেইবর্ন। এই কেনর উত্তরটা তিনি জানেন। তিনি মেয়েটাকে চান, তবে একরাতের জন্য না। চান অসীম কালের জন্য। যদি মেয়েটা ওকে মাফ না করে, বা মেয়েটার কিছু হয়ে যায়-একটু আগে করা ফোনকল দুটোর কথা মনে পরে গেল ওর। এই প্রথম, সন্দেহ ছাড়াও দেখাবার মতো কিছু প্রমাণ আছে তার হাতে। মার্টি ড্ৰিসকলকে পেলে, সেটা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতেও পিছ পা হবে না ও।

কিন্তু পার্কিং লটে গাড়ি রেখে যখন তিনি প্রাশাসনিক ভবনের দিকে এগোলেন, তখন দেখতে পেলেন, ড্ৰিসকলের অফিস তালা দেয়া। এমনকী মিসেস কেজিও শনিবার বিকালে কাজ করেন না। আসলে তার ফোন করে আসা উচিত ছিল। তবে কপাল ভালো থাকলে, রয় অ্যামেসকে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।

অ্যামেসের কিউবিকলটার দরজা খোলা, কেউ নেই ভেতরে। তাহলে কি এখনও লটেই আছে ও।

খালি রাস্তায় ফিরে গিয়ে, স্টেজ সেভেনের দিকে এগোলেন তিনি। আজকে না জ্যানের রিহার্সালের জন্য আসার কথা? ভিজিনিও থাকবে সম্ভবত। হয়তো রয়। ওখানেই গিয়েছে।

কেউ একজন আছে ওখানে, কেননা দরজাটা হা হয়ে আছে। কিন্তু ভেতর থেকে কোনও আওয়াজ বা আলো আসছে না বললেই চলে। হালকা একটা আভা

মতো কিছু প্রমান কথা মনে পরে গেলটীর কিছু হয়ে যায়লির জন্য। যদি ভেসে আসছে বেডরুম থেকে, আগুন যেখানে ধরেছিল। সেখানেই তিনি দেখেছিলেন বেটস মোটেলের ছয় নাম্বার স্টলের বাথরুম আর স্টল।

নিজে অবশ্য স্বচক্ষে ওটা কখনও দেখেনি। নরম্যান তার রোগী হবার অনেক আগেই জায়গাটা আগুনে পুড়ে গিয়েছিল। তবে নরম্যানের মুখ থেকে শোনা গল্পে, খুব পরিচিত মনে হতো জায়গাটাকে। লোকটার বর্ণনায় বাদ পড়েনি ওখানকার টাইলস করা দেয়াল, পোর্সেলিনের জিনিসপত্র, উজ্জ্বল ফসেট আর শাওয়ারের ভারী পর্দা। অপরাধ সংগঠন স্থল। এক মুহূর্তের জন্য অপরাধ সংগঠনের মুহূর্তটাও চোখের সামনে পরিষ্কার দেখতে পেলেন তিনি। দেয়ালে লেগে আছে লাল লাল ছোপ, স্টলের মেঝেতে পরে থাকা দেহটাকে ঘিরে আছে গোলাপী রঙের পানি। অন্য অবয়বটা দাঁড়িয়ে আছে লাশটার পাশে।

কিন্তু না, এটা সেই অকুস্থল না। এটা ছবির জন্য ব্যবহৃত একটা সেট। আর অন্য অবয়বটা রয় অ্যামেস।

আপনি এখানে কী করছেন? জানতে চাইল রয়।

তোমার খোঁজেই এসেছি। বললেন ক্লেইবর্ন। কাল রাতে ফোন করেছিলাম। কই ছিলে?

এখানেই। নড় করল লেখক। নিরাপত্তা বলতে কিছু নেই পুরো স্টুডিওতে। সেটাই প্রমাণ করতে চাইছিলাম। হয়তো কুয়াশা ছিল বলে কাজটা সহজ হয়েছে। কিন্তু সত্যি কথা হলো, যে কেউ ওই দেয়াল ভেদ করে এপাশে চলে আসতে পারবে। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে জ্যান আজকের রিহার্সেলটা বাতিল করেছে।

বাতিল?

আজ সকালেই কথা হলো। গত রাতের ঘটনাটার ধাক্কা এখনও সামলে উঠতে পারেনি। রয়ের কণ্ঠে অভিযোগ না থাকলেও, লোকটার চোখে চোখ রাখতে পারলেন না ক্লেইবর্ন। রয় আসলেই মেয়েটাকে ভালোবাসে, নিজেকে বললেন তিনি। ধ্যাত্তেরি, অন্যদের জীবনে কেন যে নাক গলাই আমি। রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে বললেন, আমাদের মাঝে কথা কাটাকাটি হয়েছিল বটে। কিন্তু তাই বলে-

নাহ, সেই ঘটনার কথা বলছি না। বলে বিড়ালটার ব্যাপারে জানাল অ্যামেস। শুনতে শুনতে ছোট হয়ে এল ক্লেইবর্নের চোখ। ছোট্ট একটা প্রানির গলা কাটা!

আচমকা ভিজিনি আর ছোরার কথা মনে পরে গেল তার। কিন্তু কেন–?

জ্যানের অনিচ্ছার কারণ বুঝতে পারলেন?

হ্যাঁ।

কী হয়েছে বলে মনে হয়?

ভাবতে দাও। বললেন ক্লেইবর্ন। আগে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে নেই।

বলুন।

আজ দুপুরে আমি কয়েক জায়গায় ফোন করেছিলাম। প্রথমে করি এখানকার নিরাপত্তা বিভাগে। যে লোকটা দায়িত্বে আছে, তাকে চেয়েছিলাম।

মানে, ট্যালবটকে?

হ্যাঁ। লোকটা আজ অফিসে আসেনি। তবে এখান থেকে তার বাড়ির নাম্বার নিয়ে ওখানে ফোন করেছিলাম।

কোনও বিশেষ কারণ?

গতকাল আগুন ধরার পর, মার্টি ড্ৰিসকলের সাথে ওর যে কথা হয়েছে সে প্রসঙ্গে আর গ্যাসোলিনের ক্যানে যে আঙ্গুলের ছাপ পাওয়া গিয়েছে সে ব্যাপারে জানতে চেয়েছিলাম।

নতুন কিছু জানতে পারলেন?

কয়েকটা জিনিস জেনেছি। নড করলেন ক্লেইবর্ন। প্রথমত, ট্যালবট ক্যানটা পরীক্ষা করেনি। সে গত বৃহস্পতিবার থেকে লাস ভেগাসে আছে। আস সকালে এসে পৌঁছেছে। তার মানে, সে গতকাল স্টুডিওতে আসেইনি।

তাহলে যে লোকটা আগুন ধরাল। লয়েড পার্সনস? ও নামে কেউ স্টুডিওতে কাজ করে না। ট্যালবটের মতে, কেউ কখনও করেনি।

ড্রিসকল মিথ্যা বলেছে। জ্ব কুঁচকে ফেল অ্যামেসের। ভিজিনির অপরাধ ঢাকতে চাইছে?

হয়তো…আস্তে আস্তে সব কিছু খাপে খাপে মিলে যেতে শুরু করেছে।

জানি, শুনতে অবিশ্বাস্য শোনায়–

আর বিড়ালের ব্যাপারটা… বললেন ক্লেইবন। ভেবে দেখ, জ্যানের চুল সোনালী। বিড়ালের দেহের রঙ হলুদ। হয়তো জ্যানকে হাতের কাছে না পেয়ে, তার জায়গায় বিড়ালটাকে হত্যা করেছে।

হায় ঈশ্বর! ভিজিনি এমন কাজ করবে!

আমি জানি না, ত্যাগ করলেন ক্লেইবন। কিন্তু নরম্যান হলে করত।

কী বোঝাতে চাইছেন?

আগের কাজ আগে। এখন দরকার ড্ৰিসকলের সাথে কথা বলা। ওর বাড়ির নাম্বার আছে?

হ্যাঁ। আমার অফিসে আছে।

তাহলে ওখান থেকেই ফোন করবে। এবার আর ওকে এড়িয়ে যেতে দিব না। হয়তো সে উন্মাদিনী বানানো বন্ধ করবে, আর নয়তো আমরা পুলিশের কাছে যাব।

দুজনের কেউই জানে না, অন্ধকারে অগোপন করে থাকা একজন ওদের সব কথা শুনছে!

.

৩০.

পুলিশ!

স্যান্টো ভিজিনি টের পেল, অদ্ভুত এক আক্রোশ ওর ভেতর মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। আক্রোশটা যেন তিতা কোনও বস্তু, কেননা এই মুহূর্তে ওর মুখের ভেতরটা কেমন এক তেতো স্বাদে ভরে উঠেছে। কিন্তু কোনও কথা না বলে, চুপ করে রইল সে। আগে যখন স্টেজে এসে আরেকটু হলে ধরা পড়তে নিয়েছিল, তখনও নিরবতা ওকে রক্ষা করেছে। এখনও করবে। অ্যামেস আর ক্লেইবনকে বেরোতে দেখে, অন্ধকারের মাঝে ডুবিয়ে দিল নিজেকে। অন্য পাশের খোলা জায়গা দিয়ে বেরিয়ে, উপস্থিত হলো স্টুডিও স্ট্রীটে। এরপর কী মনে করে যেন পিছু নিল দুজনের।

প্রশাসনিক ভবনের ভেতরে অ্যামেস আর ক্লেইবন অদৃশ্য হয়ে গেলে, আর অন্ধকারের আড়াল প্রয়োজন হলো না ভিজিনির।

হলে প্রবেশ করে সে টের পেল, রাস্তার মতো ওটাও ফাঁকা। ভালো তো, সৌভাগ্য এখনও ওকে ছেড়ে যায়নি। অ্যামেসের কিউবিকলের দরজাটা খোলা, ওটার পাশের অফিসটার দরজাতেও তালা দেয়া নেই। ভিজিনি সাবধানতার সাথে দরজাটা খুলে, দেয়াল ঘেষে দাঁড়াল।

অ্যামেস ফোনে কথা বলা শুরু করে দিয়েছে। এখান থেকে সব শুনতে না পারলেও, টুকরো টুকরো কথা ঠিক শোনা যাচ্ছে। নাহ, ফোনে ওসব কথা হবে না। দেখ, আমি তর্ক করতে চাচ্ছি না। তুমি শুনতে না চাইলে, পুলিশকে খবর দিব। পুলিশ, আবারও সেই আক্রোশ জন্মদানকারী শব্দ! অবশ্যই আমি সিরিয়াস! এখন সবকিছু তোমার হাতে। তোমাকে শেষ একটা সুযোগ দিচ্ছি…কখন? তার আগে পারবে-ই না? ঠিক আছে, তাহলে সেই সময়টাতেই আমরা থাকব। ফোন রেখে দিল অ্যামেস।

ক্লেইবর্নের কথা শুনতে পেল ভিজিনি। কী বলল?

একঘন্টা পর একটা মিটিং-এ বসবে ড্ৰিসকল। রুবেন, বার্নি ওয়েনগার্টেন আর নিউ ইয়র্ক অফিসের কয়েকজনের সাথে। তার পর, আজ রাত আটটার দিকে আমাদের সাথে দেখা করতে পারবে।

তোমার কী মনে হয়, পারবে?

পারতে হবে। আমার তো মনে হয়, ওকে ভয় পাইয়ে দিয়েছি। তেড়িবেড়ি করবে না।

ঠিক আছে। আজ রাতে আমার মোটেল মালিকের সাথে খাবার খাওয়ার কথা। আমাকে ঠিকানাটা দিয়ে দাও। আমি সরাসরি ওখানেই চলে যাব।

লোক দুজনকে বেরোতে দেখে, আরও ভালো করে নিজেকে লুকিয়ে ফেলল ভিজিনি।

ঠিকানা একদম সহজ। ওর বাড়িটা ভেঞ্চুরার অন্য দিকে। ভাইনল্যান্ড ধরে এগিয়ে- আর কোনও কথা শোনা গেল না।

মিটিং! আটটার সময়! শক্ত হয়ে গেল ভিজিনির চোয়াল। সবাই ওর সাথে তেড়িবেড়ি করছে। প্রথমে জ্যান রিহার্সেল বাতিল করে দিল। এখন ড্ৰিসকল মিটিং করছে। নিশ্চয় উন্মাদিনী বাতিল করে ওকে ঠকাবার ফন্দি করছে সবাই। নিউ ইয়র্কের লোকগুলোর ব্যাপারে কিছু করতে পারবে না ও। তবে জ্যান…

জ্যান মেয়েটাকে হাতের মুঠোয় আনতে একদম কষ্ট হবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *