১৬-২০. গা গোলানো গোঁফ

শুয়োপোকাটা…মানে ভিজিনির সেই গা গোলানো গোঁফটা নেই!

জ্যানকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে লোকটা জিজ্ঞাসা করল, কোনও সমস্যা?

তোমার গোঁফ। কামিয়ে ফেলেছ!

চেয়ার থেকে উঠে, একরাশ গন্ধ ছড়িয়ে ওর কাছে চলে এলো লোকটা। তোমার পছন্দ হয়েছে?

পছন্দ বা অপছন্দের ব্যাপার না। গোঁফ ছাড়া তোমাকে দেখতে অদ্ভুত মনে হচ্ছে। এই আর কী।

কথাটা একদম সত্যি। গোঁফ ছাড়া নতুন এক মানুষ বলে মনে হচ্ছে। পরিচালককে। তবে অন্য সব কিছু সেই আগের মতোই আছে। মনে হচ্ছে, সুগন্ধীর বোতলে ডুব দিয়ে এসেছে লোকটা। চলার ভঙ্গিমা, কথার ভঙ্গিমা এসবেও কোনও পরিবর্তন আসেনি। নিজ হাতকে লোকটার স্পর্শ থেকে বাঁচাবার জন্য ইচ্ছা করেই ধরে থাকা স্ক্রিপ্টটা ফেলে দিল জ্যান।

ইস, পড়ে গেল! বলতে বলতে এক পা পিছিয়ে ওটাকে তুলে নেবার জন্য ঝুঁকে গেল সে।

শান্ত হও। বলল ভিজিনি। আমি কামড়াই না। হলদেটা দাঁতগুলো বের করে হাসল।

স্ক্রিপ্টের বেকে যাওয়া উপরের অংশ সোজা করার চেষ্টা করতে করতে জ্যান বলল, একসাথে পড়ার ব্যাপারে একটা কথা

এক সাথে পড়া? হাসি মিলিয়ে গেল ভিজিনির। গোঁফ নেই বলে, ঠোঁটগুলো মোটা বলে মনে হচ্ছে।

মঙ্গলবার বিকাল তিনটায় আসতে বলেছিলে, বলল মেয়েটা। আমি এসে পড়েছি।

হাতের তালু দিয়ে কপাল চাপড়ালো ভিজিনি। অথচ এমন নাটুকেপনা ওর কোনও অভিনেতা বা অভিনেত্রী করলে আর দেখতে হতো না। ওহ হো! ধুমসী। মাগি লিভাকে নিয়ে আর পারি না। আজ সকালেই বলেছিলাম

সমস্যা হয়েছে কোনও?

পল মরগ্যান। ও রিহার্সেলের জন্য আসতে চায়। পার্লারের দৃশ্যটা দেখাতে বলেছে।

ওই দৃশ্যে তো আমিও আছি। একসাথে করলে ক্ষতি কী?

আমিও তো তাই বলেছিলাম। উত্তরে পল বলল, সে নাকি একা একা কাজ করতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।

বুঝতে পেরেছি। বলল জ্যান। স্টারদের মনের মতো চলা!

স্টার? নাহ। কিন্তু তার মনের মতো চলতে হয় বৈকি। একটা গোপন কথা শুনবে? ছেলে হয়ে মেয়ের পোশাক পরে অভিনয় করার ব্যাপারটা তাকে খুব একটা আকর্ষণ করতে পারছে না। আসলে ব্যাপারটা ওর ইমেজের সাথেই যায় না। তাই ওকে যতটা সম্ভব, সাহায্য করতে হবে।

আর আমার কী হবে? বিরক্তি গোপন করার সর্বোচ্চ চেষ্টাটা করল জ্যান। আমারও কিছু প্রশ্ন ছিল–

কথা দিলাম, উত্তর পাবে। হাত নাড়িয়ে যেন সুগন্ধী ছড়িয়ে দিল ভিজিনি। এই সপ্তাহেই আমি তোমার সাথে বসব। লিন্ডা তোমাকে তারিখটা জানিয়ে দেবে। মেয়েটার কাঁধে হাত রেখে ওকে অফিসের দরজা দেখিয়ে দিল পরিচালক। বিশ্বাস করো, ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানো মাত্রই তোমার সব দুশ্চিন্তা হাওয়া হয়ে যাবে। আমি নিজের অন্তরাত্মাকে বিশ্বাস করি। তোমাকে যখন মেরির চরিত্রে নেই, তখন-ই বুঝে গিয়েছিলাম যে তুমি আমাকে হতাশ করবে না।

বিক্ষিপ্ত, সেই সাথে ক্ষুব্ধ মনে ফিরে চলল জ্যান। পড়ন্ত বিকালের আর্দ্র বাতাসে চলতে চলতে মেয়েটা সিদ্ধান্ত নিল, আরেকবার স্ক্রিপ্টটা পড়ে দেখবে। কনি অ্যাপার্টমেন্টে নেই, তাই মনোযোগ দিয়ে পড়তেও কোনও বাঁধা নেই।

পোশাক পরিবর্তন করে, উন্মাদিনীর স্ক্রিপ্ট নিয়ে লিভিং রুমের সোফায় বসল ও। আগেই ওর লাইনগুলো সবুজ কালি দিয়ে রঙ করে রেখেছে। সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, শুধু সেগুলোই পড়বে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই দেখা গেল, পুরো স্ক্রিপ্টটাই পড়তে শুরু করে দিয়েছে! আগেও পড়েছে। বরাবরের মতো এবারও, চিত্রনাট্যের ওজন আর কাহিনী ওকে বিভ্রান্ত করে তুলল। কে খুন করেছে-এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা চলচ্চিত্রটার মুখ্য বিষয় না। থেকে থেকে চমকে ওঠার জন্য, বাতাস থেকে নানা দৃশ্যের অবতারণাও করা হয়নি। এক কথায় বলতে গেলে, ডকুমেন্টারির আদলে লেখা পুরোটা, দেহে শিহরণ জাগিয়ে তোলে। হিংস্রতায় পূর্ণ!

তবে জিনিসটা ওকে সবচেয়ে বেশি খোঁচাচ্ছে সেটা হলো, এই চিত্রনাট্য রয় অ্যামেসের হাত থেকে বেরিয়েছে। কয়েকদিন আগে রয়ের আচমকা খেপে ওঠাটাও ওকে খোঁচাচ্ছে। ওই ঘটনার আগ পর্যন্ত, রয়ের প্রতি এক ধরনের আকর্ষণ বোধ করত ও। লোকটার হাতে ধরা দিতেও প্রস্তুত ছিল। কিন্তু এখন

ফোন বেজে ওঠায়, চিন্তার সুতো ছিঁড়ে গেল মেয়েটার। হ্যালো!

কথা বার্তা শুরু করার জন্য, দারুণ তো বাক্যটা! বলল রয় অ্যামেস।

শয়তানের নাম নিলাম, আর শয়তান হাজির! ভাবল জ্যান। কিন্তু ফোন রেখে না দিয়ে, ধরে রইল। ক্ষমা চাইল রয়। জ্যান জানাল, ও ক্ষমা করে দিয়েছে। সেই সাথে সেপার্টসম্যানস লজে রাতে খাবার দাওয়াতও গ্রহণ করে নিল। আমাকে নিতে আসার দরকার নেই। সরাসরি ওখানেই আমি দেখা করব। ঠিক আটটায়। কথা হবে সাক্ষাতে।

ফোন রেখে দিল জ্যান। দাওয়াত গ্রহণ করেছে বটে, কিন্তু কাজটা ঠিক হলো কিনা তা নিয়ে নিঃসন্দেহ নয়।

নাহ, এখন লোকটাকে ক্ষেপিয়ে তোলার কোনও অর্থ হয় না। হাতে রাখাই ভালো। কিছুক্ষণ ভেবে সিদ্ধান্ত নিল ও। বুক কেসে রেখে দিল স্ক্রিপ্টটা। এখন আর দেখার সময় নেই, আজ অন্য এক চরিত্রে অভিনয় করতে হবে ওকে… মোহনীয় নারীর চরিত্রে।

রাতে কোন পোশাকটা পরবে, সেটা নিয়ে অনেকক্ষণ চিন্তা করল জ্যান। রয় অবশ্য বেশ কয়েকটা ইঙ্গিত দিয়েছে। ক্ষমা প্রার্থনা করে বুঝিয়েছে, ওর আচরণটা খারাপ ছিল। আর দাওয়াত দিয়ে বুঝিয়েছে, সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। এখন জ্যানের উচিৎ হবে, দলিত পক্ষের চরিত্র অভিনয় করে, ছেলেটাকে পুরোপুরি হাতে নিয়ে আসা।

পোর্টসম্যানস লজে যখন প্রবেশ করল জ্যান, তখন ওর ভেতর একটু আগের বিভ্রান্তির ছায়া মাত্র নেই! আটটা বাজার কিছুক্ষণ আগেই পৌঁছেছে মেয়েটা। কিন্তু রয়কে হারাতে পারেনি। এসে দেখে, ছেলেটা ওর জন্য অপেক্ষা করছে। ডিনার অর্ডার করার আগে মাত্র দুইটা মার্টিনি নিল সে। ভালো সংবাদ। এটা সেটা নিয়ে কথা বলতে শুরু করল দুজনে। কিন্তু উন্মাদিনী নিয়ে কোনও কথা হলো না। জ্যানের মনে হলো, রয় ইচ্ছা করেই প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু জ্যান তো সেটা হতে দিতে পারে না। আজকের এই নাটকে সে অভিনয় করছেই রয়কে নিজের দলে নিয়ে আসার জন্য। কিছুটা অন্যমনস্কভাবে ছেলেটার কথা শুনল ও, চলচ্চিত্রটার প্রসঙ্গ তোলার সুযোগ খুঁজল। স্টেক আসার ঠিক আগ মুহূর্তে পেয়েও গেল তা। স্বীকার করতে খারাপ লাগছে, বলল ও। কিন্তু অন্যজনকে না করে দিয়েছি বলে এখন ভালো লাগছে।

হাত থেকে কাঁটা চামচ নামিয়ে রেখে, চোখ তুলে তাকাল রয়। মুখে হাসি নিয়ে ওর চোখে চোখ রাখল জ্যান। ভিজিনি বলেছিল, রাতের খাবারটা ওর সাথে খেতে। উন্মাদিনী নিয়ে কী সব কথা আছে নাকি!

বদ লোক কোথাকার। রয়ের কাছ থেকে এমন তীব্র আচরণ আশা করেনি জ্যান। ওর সাথে বেশি না মেশাই ভালো। আমার আসলে এতে নাক গলানো ঠিক হচ্ছে না, তবে–

ঠিক বলেছ। আমার ব্যাপারে তোমার নাক গলানো ঠিক না। হাসতে হাসতেই বলল মেয়েটা। আমি জানি লোকটা জঘন্য। কিন্তু সে আমার পরিচালকও বটে। ওকে নিজের দলে টানতে পারাটা নিজের জন্যই ভালো হবে হয়তো।

সাবধানে না থাকলে তোমার দলের পাশাপাশি, তোমার ভেতরে থাকারও চেষ্টা করবে ভিজিনি। বলল রয়। ওর ব্যাপারে তোমাকে আর কী বলব! পয়সা না থাকলে, এতো দিনে জেলে পচে মরতে হতো ওকে। যৌন বিকৃতির সবগুলো ধরণই মনে হয় ওর মাঝে আছে। হিংস্রতা ভিজিনির দেহের প্রতিটা কোষে কোষে বাস করে।

তোমার চিত্রনাট্যটা পড়তে পড়তে, বিড়বিড় করে বলল জ্যান। আমারও সেই একই শব্দ প্রথমে মনে এসেছিল। হিংস্র।

লেখার সময় আমার মানসিক অবস্থা ভালো ছিল না। যাক, বাদ দাও।

নাহ! বলে ফেলো।

আমার অবস্থাটা একটু ভেবে দেখো, স্টেক ভর্তি প্লেটটা ঢেলে সরালো রয়। আগেও অনেক ভূতুড়ে কাজ করেছি আমি। চলচ্চিত্রে না হলেও, টেলিভিশনের জন্য তো করেছি! ড্রিসকল সেজন্যই আমাকে এ কাজের জন্য নিয়েছে। ভ্যাম্পায়ার আর মায়ানেকড়েদের নিয়ে লেখার সময় কোনও অসুবিধা হয়নি আমার। মনে হয়েছে, রূপকথার গল্প লিখছি। জানতাম, এই দানবদের আসলে অস্তিত্ব নেই। কিন্তু উন্মাদিনীর ব্যাপারটা আলাদা। ওখানে যা লিখেছি, সেসব কিছু আসলেই ঘটেছে! নরম্যান বেটসের মতো দানবের অস্তিত্ব আছে এই দুনিয়ায়! আমার উপর প্রভাব ফেলেছে!

কীভাবে?

তুমি তো অভিনেত্রী, ভালো করেই জানো যে কোনও চরিত্রকে সফলভাবে ফুটিয়ে তুলতে হলে সেই চরিত্রে প্রবেশ করতে হয়। কফিতে চুমুক দিল রয়। লেখকও সেই কাজটাই করেন। যে চরিত্রটাকে নিয়ে লেখেন, তার ভেতরে প্রবেশ করেন। স্ক্রিপ্টটা লেখার সময়, কীভাবে কীভাবে যেন নরম্যানে পরিণত হয়ে গিয়েছিলাম আমি। যেভাবে ও ভাবে, সেভাবেই ভেবেছিলাম। যেভাবে ভাবে, অনুভব করে, আমি সেভাবেই ভাবছিলাম…অনুভব করছিলাম।

কাজটা সহজ ছিল না, কিন্তু কোনও না কোনওভাবে কাজগুলো ঠিকভাবেই করেছি। একটা কথা তোমাকে বলি, মন দিয়ে শোন। নরম্যানের মাথার মতো ওই জঘণ্য জায়গাটায় প্রবেশ করার পর মুহূর্ত থেকেই, আমার মাঝে কেবল একটা চিন্তাই কাজ করেছে। কত তাড়াতাড়ি এখান থেকে পালানো যায়! নরম্যানকে কত তাড়াতাড়ি ভুলে যাওয়া যায়!

কিন্তু বুঝতে পারিনি যে, নরম্যানকে আমি ছাড়তে চাইলেও, নরম্যান তো আমাকে ছাড়বে না! যখন চিত্রনাট্যটা লিখছিলাম, তখন লোকটা ছিল আমার নিজের কাঁটাচামচ নামিয়ে রাখল জ্যান। তোমার অনুভূতিটা বুঝতে পারছি। নরম্যান আমাকেও ভয় পাইয়ে দেয়। তবে তাই বলে চলচ্চিত্রটা বাতিল করা কি ঠিক হবে? লাভ হবে তাতে কোনও? আর তাছাড়া, নরম্যান মারা গিয়েছে। আজকের কাগজগুলো পড়নি? সবগুলোতেই মোটামুটি একই কথা লেখা ছিল। ওরা প্রায় নিশ্চিত যে ভ্যানের বিস্ফোরণের সাথে নরম্যান মারা গিয়েছে।

প্রায় নিশ্চিত। সামনের দিকে ঝুঁকে এলো রয়। যদি ওদের ভুল হয়ে থাকে।

গতকাল স্টুডিওতেও একই কথা বলেছ। স্র গলায় বলল জ্যান। কেন? তুমি কী এমন কিছু জানো যা আমি জানি না?

আমি কি জানি, তাতে কিছু যায় আসে না… বলতে বলতেই থেমে গেল রয়। জ্যানের মনে হলো, হঠাৎ করে কেমন যেন পরিবর্তন চলে এসেছে ছেলেটার মাঝে। হাসিখুশী ভাবটা নেই, এমনকিছু একটা বলতে চাচ্ছে সে যা শব্দে পরিণত করতে পারছে না। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, নরম্যান এখনও বেঁচে আছে।

অপেক্ষা করছে!

অপেক্ষা করছে? কেন? আমি জানি না। মুখ কুঁচকে ফেলল রয়। আমি নিজেকেই বুঝতে পারছি না, নরম্যানের মনের কথা বুঝব কী করে?

বিভ্রান্ত দেখালো ছেলেটাকে। কষ্ট পাচ্ছে ও, অনেক বেশি কষ্ট। যেটুকু বিতৃষ্ণা ছিল জ্যানের মনে, তা-ও হাওয়া হয়ে গেল। সে বুঝতে পারল, ওর সামনে যে বসে আছে, সে বিপক্ষ দলের কেউ না। এ এমন এক ছেলে, যে মানসিক টানাপোড়নে প্রতি মুহূর্তে ছিন্ন-ভিন্ন হচ্ছে।

হেসে উঠল জ্যান। ভাবল, এই মুহূর্তে হাসির মাধ্যমেই ছেলেটাকে সহজ করা যাবে। খারাপ খবর! তোমার তো দেখি পাগলের ডাক্তার দেখানো দরকার।

নড করল রয়। দেখাবো তো।

মানে?

তুমি জানো না? প্রশ্নের চাইতে বিস্ময়ের ছাপ বেশি রয়ের কণ্ঠে। এখানে আসার ঠিক আগে আগে ড্ৰিসকল ফোন করেছিল। আগামীকাল আমাদের সাথে নরম্যান বেটসের মনোবিদের মিটিং আছে।

.

১৭.

বুধবার সকালটা জ্যানের ভালোই কাটল। সকাল সকাল স্টুডিওতে পৌঁছে গিয়েছিল সে। অগণিত কর্মচারীর গাড়ির পিছু পিছু, পায়ে হাঁটা গতিতে এগোচ্ছিল ওর টয়োটা। যখন উইন্ডশিল্ডে লাগানো স্টিকারটা গার্ডের নজরে পড়ল, তখন হাত নেড়ে ওকে এগোবার অনুমতি দিল লোকটা। অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে কিনা, তা কেউ জানতে চাইল না। কপাল ভালো, কেননা অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল না ওর।

তাই জ্যানকে ড্ৰিসকলের বাইরের অফিসের সামনে দেখতে পেয়ে, অনিতার অবাক হওয়াটা একদম স্বাভাবিক। ওকে দেখেই পোকার চোখের মতো দেখতে চোখজোড়া নোটপ্যাডের দিকে চলে গেল। আপনাকে তো এখানে দেখছি না। বলল মিস কেজি। মি. ড্ৰিসকল কয়টার সময় আসতে বলেছিলেন?

বলেনি, হাসল জ্যান। এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, তাই ভাবলাম দেখা করে যাই।

হতভম্ব অনিতার মুখ হাঁ হয়ে গেল। দেখা করে যাই? অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া কেউ প্রযোজকের সাথে দেখা করতে পারে না। ভ্যাটিক্যানে গেলেই কী আর পোপের দেখা যাওয়া যায়?

আসলে তিনি এই মুহূর্তে বড় ব্যস্ত আছেন, কিছুক্ষণ পর সেক্রেটারি বলল। আমি অবশ্য তাকে জানাতে পারি যে আপনি এসেছেন।

থাক, উত্তরে বলল জ্যান। জরুরী কিছু না।

ঘড়ির দিকে তাকাতে তাকাতে মেয়েটা ভাবল, জরুরী না তো বলছি, কিন্তু আসলে এরচেয়ে জরুরী কিছু আমার জীবনে হয়নি। নয়টা পঁয়তাল্লিশ বাজে। রয় মিটিঙটা ঠিক কখন হবে তা বলেনি। সন্দেহ উদ্রেক হবে ভেবে, ও-ও জিজ্ঞাসা করেনি। তবে দশটার দিকে হওয়ার কথা।

সুন্দর করে পরিকল্পনা করে এসেছে জ্যান। ঠিক করেছে, ড্ৰিসকলের অফিসে ঢুকে, পোশাক বা এমন কোনও তুচ্ছ ব্যাপারে আপত্তি তুলবে। ডা. ক্লেইবর্ন যখন মিটিং এর জন্য আসবে, তখন তাই ওখানে উপস্থিত থাকার একটা অজুহাত দিতে পারবে। মিটিঙটায় অংশ নিতে পারবে বলে মনে হয় না। কিন্তু এক দর্শন দেখে নিতে তো পারবে লোকটাকে! কে জানে, কেন এসেছে সেই ব্যাপারে একটা ধারনাও পেতে পারে। ডাক্তার সাহেব ওর পক্ষে না বিপক্ষে, সেটা জানা জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তবে এতো পরিকল্পনা কোনও কাজে আসবে না। কেননা এই মুহূর্তে ফিরে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়েছে জ্যান। হঠাৎ অনিতা পেছন থেকে ওকে ডেকে বসল, মিস হার্পার–

বলুন।

আমার একটা উপকার করবেন? আমার একটু বাইরে যাওয়া দরকার। কিন্তু মি, ড্রিসকল ডেস্ক ছেড়ে যাওয়াটা পছন্দ করেন না। গেলে অন্তত যেন ফোন কল ধরার মতো কেউ থাকে, সেই ব্যবস্থা করে যেতে হয়।

যান, যান। কোনও সমস্যা নেই। আমি কিছুক্ষণ আছি।

ধন্যবাদ। বলে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল সেক্রেটারি।

মেয়েটাকে দরজা বন্ধ করে দিতে দেখে হাসল জ্যান। কপালটা বড়ই ভালো। যাচ্ছে। এই সুযোগটাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে হবে। আশেপাশে কেউ নেই, নিশ্চিত হয়ে নিয়ে, দরজার কাছে চলে গেল ও। ইন্টারকমের সুইচটা চেপে ধরে। শুনতে লাগল।

প্রথমেই শোনা গেল মাটি ডিসকলের কণ্ঠে। সহজ কথায় আপনাকে বোঝাই ডাক্তার সাহেব। আমি এরিমাঝে অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছি। মৌখিক চুক্তি করা শেষ, অনেকগুলো চুক্তিপত্রে তো সইওও করে ফেলেছি। একদিন দেরি হলো, শুধু তার সুদ কত টাকা হবে জানেন? আপনার একটা আন্দাজের কারণে

আন্দাজ না, বলল রয় অ্যামেস। পেশাগত মত বললেই ভালো হয়।

ডা. স্টাইনারও তো একজন মনোবিদ, নাকি? তিনি তো তোমাদের সাথে একমত না। পুলিশও না।

ওদের কথা বাদ দাও। এই মানুষটা সরাসরি নরম্যান বেটসের থেরাপিস্ট ছিল। কেউ কিছু বুঝতে পারলে, ইনিই পারবেন। নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে ডাক্তার সাহেব আমাদেরকে সাবধান করতে এসেছেন!

আমি সেজন্য কৃতজ্ঞ। কিন্তু এখন তর্ক করে লাভ নেই। দেখুন, ডাক্তার সাহেব, আপনার সময় নষ্ট করার জন্য আমি দুঃখিত।

হয়তো পুরোপুরি নষ্ট হয়েছে বলাটা ঠিক হবে না। জর্জ ওয়ার্ড বিড়বিড় করে বলল। আমরা তো এমনিতেই রয়কে ফেয়ারভিলে পাঠাতে চেয়েছিলাম, তাই

।হ্যাঁ। কিন্তু স্টাইনার না করে দিয়েছিল।

স্টাইনার লোকটার সাথে কথা বলে লাভ কী? আমাদের দরকার ছিল আসলে ডা. ক্লেইবনকে। আর তিনি নিজে এসে হাজির হয়েছেন। কয়েক দিনের জন্য নাহয় আমরা ওকে পরামর্শক হিসেবে দেখে দেই–

দারুণ বুদ্ধি দিয়েছ! ড্ৰিসকল বলে উঠল। চিত্রনাট্যটাও নিখুঁত হবে, আবার ছবিটার বিজ্ঞাপনও–

আপনার চলচ্চিত্রের বিজ্ঞাপন করার জন্য আমি আসিনি। ভরাট কণ্ঠস্বরটা ডা. ক্লেইবর্নের না হয়ে যায় না। আমি এসেছি আপনাদেরকে সাবধান করে দেবার জন্য। প্রেস এই ব্যাপারে আমার যে কথাটা শুনতে পাবে, তা হলো-এই চলচ্চিত্র বানানো একটা বিশাল বড় ভুল হতে যাচ্ছে।

লোকটা কোন দলে আছে, তা জ্যানের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। ইন্টারকমের সুইচ ছেড়ে দিল ও। যদি আসলেই ক্লেইব প্রেসের সামনে অমন কথা বলে, তাহলে খবর আছে। পেছন থেকে পায়ের শব্দ ভেসে এলো। সম্ভবত অনিতা ফিরে আসছে। কিছু করতে চাইলে এখনই করতে হবে।

ব্যক্তিগত অফিস ঘরের দরজাটা একটানে খুলে ফেলে ভেতরে প্রবেশ করল জ্যান। ভেতরের সবাই অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। তার মুখের হাসিটা সবার জন্যই, কিন্তু নজর পড়ল ড্ৰিসকলের ডেস্কের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লম্বা লোকটার দিকে। ওই লোকটাই ডা. ক্লেইবন।

হাই, বলল জ্যান। বিরক্ত করলাম না তো?

কী চাই? গর্জে উঠল ড্ৰিসকল। আমরা একটা মিটিং এ আছি—

শুনলাম।

শুনলাম মানে?

ড্ৰিসকলের রাগ পাত্তাই দিল না জ্যান। কে যেন ইন্টারকমের সুইচটা চালু করে রেখেছে।

অনিতা কই?

একটু বাইরে গিয়েছে, আমাকে থাকতে বলল। ড্রিসকল তার সেক্রেটারি ডাকার জন্য, ডেস্কের ইন্টারকমের দিকে হাত বাড়ালেন।

ওকে বকাবকি করো না। তাড়াতাড়ি বলে উঠল জ্যান। দোষ আমার। আড়ি পাতা উচিৎ হয়নি।

রাগান্বিত ভাবটা প্রযোজকের চেহারা থেকে বিদায় না নিলেও, হাত সরিয়ে নিল সে। বুঝলাম। তুমি শুনেছ, তাতে কী? ভেতরে এসেছ কেন?

রয় আর জর্জও ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে আছেন। কিন্তু তাদেরকে অগ্রাহ্য করল জ্যান। অগ্রাহ্য করল ড্ৰিসকলকেও। নজর এখন পুরোপুরি ডাক্তার ক্লেইবর্নের দিকে। লোকটাকে বয়স্ক মনে করেছিল সে। কিন্তু নাহ, যুবক বলা চলে। দেখতে খুব সুদর্শন না হলেও, আকর্ষণ রয়েছে।

ডা. ক্লেইবন? বলল মেয়েটি। আমি জ্যান হার্পার।

নড করলেন ক্লেইবর্ন। জ্যানের হাসির উত্তরে হাসি দিয়ে বললেন। আপনার ছবি আমি দেখেছি।

তুমি করে বলবেন। তাহলে তো জানেন যে আমি মেরি ক্রেনের চরিত্রে অভিনয় করছি।

কী হচ্ছে এসব? আবারও গর্জে উঠল ড্ৰিসকল। জরুরী কিছু বলার না থাকলে

বলার আছে। লোকটাকে থামিয়ে দিল জ্যান। আমার আপনার সাহায্য দরকার।

সাহায্য? ক্লেইবনকে দেখে মনে হলো, বোকা বনে গিয়েছেন। কী রকম সাহায্য? কী সমস্যা তোমার?

কী না, কে। আপনি আমার সমস্যা।

বুঝতে পারলাম না।

ছবিটার ব্যাপারে কথা বলছি। আপনার সাহায্য আমার…নাহ, আমাদের সবার দরকার।

আমি তো এ ব্যাপারে আমার মনোভাব আগেই বলে দিয়েছ—

শুনলাম, কিন্তু আপনার মনোভাব পাল্টাতে হবে।

কেন?

কেননা এই ছবিটাকে দিনের আলো দেখাতেই হবে। জ্যান এখন পরিস্থিতি বুঝে কথা বলতে শুরু করেছে। আপনি কি চিত্রনাট্যটা পড়েছেন?

নাহ, পড়িনি। জোরালো কণ্ঠে উত্তর দিলেও, নজর নিচের দিকে সরিয়ে নিলেন ক্লেইবন।

এরকম একটা সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল জ্যান, চেপে ধরল তাই। তাহলে পড়ে নিনি। অসাধারণ লিখেছে রয়। চোখের কোণা দিয়ে সে দেখতে পেল, ড্ৰিসকল আর জর্জ কোনও কথা না বলে শুধু শুনছে। এখন ওই দুজনের কেউ ওকে বাঁধা দেবার চেষ্টাও করবে না। পরিস্থিতি পুরোপুরি জ্যানের দখলে। আমি লেখনীর কথা বলছি না। বলছি এতে ভাব অন্তর্নিহিত আছে, তার কথা। আর দশটা হরর ছবির মতো না এটা। এখানে নরম্যানকে দেখে মনে হবে, সেও অন্য সবার মতোই মানুষ। আমাদের মতোই তার আশা, আকাঙ্ক্ষা, ভয় আছে। কিন্তু এমন এক বাতিক ওকে পেয়ে বসেছে, যার হাত থেকে ছাড়া পাচ্ছে না। ও যা করেছে, তা অবশ্যই ভয়ানক। কিন্তু কারণটা সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ছবিতে। দেখা শেষ হলে দর্শক উপলব্ধি করতে পারবে, নরম্যান বেটসও অন্যদের মতোই এক ভিক্টিম। আমাদের সামাজিক ব্যবস্থার ভিক্টিম।

ডা. ক্লেইবর্ন হাসছিলেন। অসাধারণ এক বক্তৃতা দিলে। কবার প্রাকটিস করে এসেছ?

একবারও না। নিষ্কল্প চোখে তার দিকে তাকিয়ে সত্য কথাটা বলল জ্যান। প্রাকটিস করে আসলে আপনাকে অন্য কিছু বলতাম। বলতাম, এই ছবিটা আমার জন্য কত জরুরী। কত শত মানুষের চাকরী এর সাথে জড়িয়ে আছে। কিন্তু… এক মুহূর্ত অপেক্ষা করল জ্যান। শব্দ গুলো যেন আপনা থেকে ওর মুখে এসে ধরা দিচ্ছে। কিন্তু এই ছবিটার আবেদন অন্য জায়গায়। আপনি একজন ডাক্তার। নরম্যানকে কাছ থেকে দেখেছেন, ওর সমস্যাগুলো আপনার চাইতে ভালো আর কেউ জানে না। আপনি কি চান না, মানুষ…আমি…আপনি…আমরা, একবারের জন্য হলেও সেই সমস্যাগুলো উপলব্ধি করি? বোঝার চেষ্ট করি?

উপায়টা কিন্তু আপনার সামনেই রয়েছে। চিত্রনাট্যটা পড়ে দেখুন, কোথায় কী ভুল হলো সেটা আমাদেরকে বলুন। যেন আমরা সারা বিশ্বকে আসল নরম্যানের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারি। আমাদের জন্য না করতে চাইলে অন্তত নিজের জন্য, আপনার রোগীর জন্য করুন।

ইতস্তত করলেন ডা. ক্লেইবন। প্রথমে মনে হলো বিরুদ্ধাচারণ করবেন। কিন্তু হার মেনে নিলেন। ঠিক বলেছ। কিন্তু ব্যাপারটা এতো সহজ না। আমি এখানে উপস্থিত সবাইকে বোঝাতে চাইছিলাম যে, নরম্যান বেটস এখনও বেঁচে আছে। আর তাই এই ছবিটা করা হবে সবার জন্য বিপদজনক।

আমি একমত, বলল রয়। দেখ, জ্যান আমিও একমত, ছেলেটাকে কথা বলার সুযোগ দিল না ও। কিন্তু মি. ড্ৰিসকল সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন যে, কাজ চালিয়ে যাবেন। সেজন্য আমাদের আরও বেশি করে ডা, ক্লেইবনকে দরকার। আবারও লম্বা যুবকটার দিকে ফিরল জ্যান। নিজের কথা বলি। যদি আপনি ঠিক হন, যদি নরম্যান বেটস এখনও বেঁচে থাকে, তাহলে আপনাকে পাশে পেয়ে আমি নিরাপদবোধ করব।

এক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন ক্লেইবর্ন। এরপর যখন মুখ খুললেন, তখন কথা বললেন জর্জ ওয়ার্ডকে উদ্দেশ্য করে। আমি রবিবার পর্যন্ত ফাঁকা আছি। পরামর্শকের কাজটা একটু বুঝিয়ে দিন তো।

.

১৮.

রয় অ্যামেসের সামনের টেবিলে বসে আছেন ক্লেইবর্ন। লাঞ্চ করার জন্য আগত লোকজনের ভিড়ে ভর্তি হয়ে গেছে ক্যান্টিন। হই হুল্লোরের মাঝে অ্যামেসের কথা শোনা-ই দায় হয়ে পড়েছে।

তিনি আসলে ওর কথা শুনতে খুব একটা আগ্রহীও নন। ড্ৰিসকলের অফিস ছেড়ে বেরিয়ে আসার পর থেকে, ভেতরে ঘটা ঘটনাগুলো তার মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।

তিনি রাজি হলেন কী করে? এটা কি তার অসতর্কতার ফল? মানতেই হবে, পরিস্থিতিটা খুব সহজেই ধরে ফেলেছিল মেয়েটা। আর যুক্তি আছে তার কথায়। অন্তত, অন্যদের মতো উপহাস করে তো আর বিপদের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়নি জ্যান। অবশ্য এই মুহূর্তে তার সামনে বসে থাকা রয়ও কাজটা করেনি।

তবুও, এটা তার এখানে থেকে যাওয়ার আসল কারণ নয়। সম্ভবত মেয়েটির কথায় প্রভাবিত হননি তিনি, হয়েছেন তার শারীরিক উপস্থিতিতে। জ্যান হার্পারের ছবি প্রথমবার দেখে নিজের কী রকম প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, সেকথা মনে পড়ে গেল। ক্লেইবর্নের। কিন্তু সামনাসামনি সাক্ষাতটা তার মধ্যে এমন একটা প্রভাব ফেলেছে, যেটার জন্যে প্রস্তুত ছিলেন না তিনি।

সহসা আবিষ্কার করলেন, সেকথাই বলছেন রয় অ্যামেসকে! তার কথা শুনে মাথা ঝাঁকাচ্ছে করছে লেখক।

ঠিক। এজন্যই ওকে বাছাই করেছে ভিজিনি। জ্যান দেখতে একদম মেরি ক্রেন এর মতো।

আমার তা মনে হয় না, ওয়েট্রেস এসে তাদের হাতে মেনু ধরিয়ে দিতে একটু বিরতি নিলেন তিনি। হ্যাঁ, চেহারায় মিল আছে। কিন্তু হুবহু মিল নেই।

আপনি কি সত্যিই বিশ্বাস করেন যে বেটস বেঁচে আছে?

নড করলেন ক্লেইব। তোমারও কি তা মনে হয় না?

হ্যাঁ। তবে তা শুধুই একটা অনুভূতি। ব্যাখ্যা করতে পারব না, কেন এমনটা মনে হচ্ছে আমার। ভেবেছিলাম, আপনার আরও কিছু বলার আছে। এমন কিছু, যা মিটিং-এ ওদেরকে বলেননি।

এই মুহূর্তে ওসব নিয়ে কথা বলতে চাই না।

মানে আমাকেও বিশ্বাস করতে পারছেন না?

ঠিক জানি না, অনিশ্চিত ভঙ্গিতে আশপাশের টেবিলগুলোর দিকে তাকালেন ক্লেইবর্ন, তার মুখে এক চিলতে হাসি। এখনও এখানকার কারও সাথে ঠিকমতো পরিচিতও হইনি।

এই প্রথম কোনও স্টুডিওতে এসেছেন?

হ্যাঁ।

ঠিক আছে, জায়গাটা তাহলে আপনাকে চিনিয়ে দেই, অ্যামেস বলল। ওখানকার লোকগুলো ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে আছে। জিন্স আর লিভাই পরা লোকগুলোর কাছে বোকা বনে যাবেন না। ওরা উঁচু শ্রেণীর আমলা। এই টিমের একজন আপনি। নোংরা কাপড়চোপড় পরবেন, সাধারণ কর্মচারীর মতো কাজ করবেন। কিন্তু স্টুডিও থেকে যখন বাইরে যাবেন, সবাইকে দেখিয়ে পঁচিশ হাজার ডলারের গাড়িতে চড়বেন। দাঁত বের করে হাসল সে। স্বমেহনকারী এক সমাজে বাস করি আমরা।

ক্লেইবন হাসলেন। রয় অ্যামেস বোধহয় এই বাক্য এবারই প্রথম ব্যবহার করেনি। এবার জানালার পাশের টেবিলে বসে থাকা আরেক দল লোকের উদ্দেশ্যে নড করলেন ক্লেইবর্ন। এই লোকগুলোর পরনে কালো স্যুট, সাদা শার্ট, আর গলায় সযত্নে বাঁধা নেকটাই। ওই লোকগুলো কারা?

তার দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকে তাকাল রয় অ্যামেস। অতিথি। টিভি চ্যানেলের হয়ে কাজ করে নতুন আইডিয়ার খোঁজে ম্যাড অ্যাভিনিউ থেকে আসে। চুরি করতে। তবে সাধারণত নিয়ে যায় পুরনো সব আইডিয়া!

আইলের ওপারে এক দল রুক্ষ চেহারার যুবকের দিকে ইশারা করলেন ক্লেইবন। আর এই বাচ্চাগুলো?

গান বাজনা। এখন অবশ্য ওদেরই দিন। একটা গোল্ড রেকর্ড এক টন অস্কারের সমান।

একটা লোক তাদের পাশ কাটিয়ে পাশের টেবিলের সামনে থামল। লোকটার বিশাল ভুড়ি ছাপিয়ে তার তামাটে তরূণ মুখটা দৃষ্টি আকর্ষণ করে। টেবিলে বসে থাকা লোকগুলোর উদ্দেশ্যে কিছু একটা বলে উচ্চস্বরে হেসে উঠল সে। তারপর সরে গেল ওখান থেকে।

টেবিল-হপার, রয় অ্যামেস জানাল। কোনও অভিনেতাকে যদি হাসতে দেখেন, তাহলে নিশ্চিত ধরে নেবেন, সে বেকার। ক্লান্ত, চেহারার নিশ্ৰুপ লোকগুলো কাজের মাঝে থাকে।

ক্রেইবন নড করে, মেনুর দিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। কী খাওয়া যায়?

লাঞ্চ অন্য কোথাও খাওয়া যাবে, হাসল অ্যামেস। তবে যতক্ষণ এখানে আটকে আছেন, একটা স্যান্ডউইচ দিয়ে চালিয়ে দিন।

অদ্ভুত। আমি আশা করেছিলাম, এখানকার খাবার ভালো হবে।

একসময় ভালো ছিল, অন্তত সেরকমই শুনেছি। এখন কেউ আর গা করে না। হাত থেকে মেনুটা নামিয়ে রাখল অ্যামেস। পুরনো প্রবাদটা জানেন নিশ্চয়ই। আপনি যা খান, আপনি ঠিক তা-ই? যদি তাই হয়, তাহলে বেশিরভাগ মানুষই বিষ্ঠা খায়।

ওয়েট্রেস এসে তাদের অর্ডার নিয়ে গেল। লেখকের মন্তব্যটা মনে মনে নেড়েচেড়ে দেখলেন ক্লেইবর্ন। কেন জানি মনে হলো, এই লাইনগুলো আগেও ব্যবহার করেছে। ছেলেটা। রয় অ্যামেস টেবিল-হপার না, তবে সে ঠিকই তাকে খুশি করতে চাইছে।

কফি দিও, ওয়েইট্রেস মেয়েটা চলে যাওয়ার সময় ওকে বলল অ্যামেস। তারপর ফিরে তাকাল সঙ্গীর দিকে। ছবির অন্য কারও সঙ্গে দেখা করেছেন?

না। পল মরগান নরম্যানের চরিত্রে অভিনয় করছে, তাই না?

সম্ভবত। এখন পর্যন্ত অন্য রকম কোনও চরিত্রে অভিনয় করেনি ও। কফি চলে আসায় একটু থামল অ্যামেস। সব সময় অস্বাভাবিক পুরুষালী সব চরিত্রে অভিনয় করেছে।

তাহলে সে এই চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেল কীভাবে?

ভিজিনি-কে জিজ্ঞেস করুন। কফির কাপটা তুলে নিল অ্যামেস। এ-ও হতে পারে, ও এসব নিয়ে ভাবেইনি। ভিজিনি আজকাল সাসপেন্স মুভি বানায় না হিজিবিজি সব মুভি বানায়। এখনকার বাচ্চারা এসবই চায়। স্পেশাল ইফেক্টের কারিকুরি, গাড়িতে গাড়িতে সংঘর্ষ আর মার্ডার সিনের সময় পাঙ্ক মিউজিকের ছড়াছড়ি। পুরনো দিনের রোমের মতো অবস্থা-সিংহ যখন খ্রিস্টানদের খেতে শুরু করে, তখনই উচ্চস্বরে সঙ্গীত বাজানো শুরু হয়।

সামনে ঝুঁকলেন ক্লেইবন। তাহলে চিত্রনাট্য লিখলেন কেন আপনি? টাকা। অ্যামেস ত্যাগ করল। না, সত্যি হলো না কথাটা। কিংবা বলতে পারেন, অর্ধসত্য। এ চলচ্চিত্রে কিছু একটা দেখেছি আমি। সস্তা জনপ্রিয়তা আর অশ্লীলতা ছাড়া দর্শকদের কাছে পৌঁছানোর একটা সুযোগ আছে এ সিনেমায়। হয়তো চিত্রনাট্যটা পড়ার সময় আপনিও বুঝতে পারবেন।

চেষ্টা করব, কথা দিলেন ক্লেইবর্ন।

দুপুরে, মোটেলে, ঠিক তা-ই করলেন তিনি।

প্রচন্ড ভ্যাপসা গরম পড়েছে। এয়ার কন্ডিশনারও কোনও কাজে আসছে না। কিন্তু এসবের দিকে নজর নেই ক্লেইবর্নের, কারণ রুমের ভেতরে নেই তিনি।

চিত্রনাট্যে ডুবে গিয়েছেন তিনি। দুই হাজার মাইল দূরের ও বিশ বছর আগের এক পৃথিবীতে চলে গিয়েছেন।

লেখনী খুব একটা শক্তিশালী না, জায়গায় জায়গায় মান উঠানামা করেছে। বাগাড়ম্বরের পরও সস্তা…জনপ্রিয় দৃশ্যগুলো বাদ দেয়নি রয় অ্যামেস। অনেকগুলো চমকে দেবার মতো দৃশ্য আছে চিত্রনাট্যে। তাছাড়া অনুপ্রেরণার বদলে খুনের ওপর ই বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এতে।

তবে শেষ কথা হলো, চিত্রনাট্যটা সফল। সহজ-সরল মেয়েটা আর চতুর পাগল লোকটার চরিত্র গত্বাঁধা হলেও, মানিয়ে গিয়েছে। আজকালকার মেয়েরা হয়তো এতো সহজ-সরল না, তবে পাগল পুরুষগুলোও আগের চেয়ে বেশি চালাক হয়েছে। সিনেমার প্রতিটি বিষয়ই খবরের কাগজের শিরোনাম হয় নিয়মিত। কয়েকজন সিরিয়াল কিলারের নাম পড়ে গেল ক্লেইবর্নের, মিডিয়া যাদের নায়ক বানিয়ে ছেড়েছে। কিন্তু, লোকগুলোর অবস্থা বা কাজে তো জমকালো কিছু নেই। বদ্ধ উন্মাদগুলো একটার পর একটা খুন করেই যাচ্ছে।

রয়ের বাগাড়ম্বরগুলো মনে পড়ে গেল তার। ফাঁদে পড়ে যাচ্ছেন তিনি, চিত্রনাট্যকার মনে হচ্ছে নিজেকে। তার কাজ হচ্ছে সংলাপ থেকে সস্তা বাগাড়ম্বও হেঁটে ফেলা। বাস্তবতা আর বাইরের ঠাটবাট নিজেদের হয়েই কথা বলুক।

সূর্য ডুবে গেছে। বাতি জ্বেলে ব্রিফকেস থেকে একটা প্যাড বের করলেন তিনি। তারপর নোট নেয়া শুরু করলেন।

এয়ার কন্ডিশনারের ঝির ঝির আওয়াজে, মাথার উপর জ্বলতে থাকা মিটমিটে আলোতে অন্য এক সময়, অন্য এক পৃথিবীতে হারিয়ে গেলেন তিনি…

…নরম্যানের পৃথিবীতে।

দরজায় করাঘাতের শব্দ তাকে বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনল।

কে? গলা চড়িয়ে জানতে চাইলেন তিনি।

আমি, টম পোস্ট।

দরজা খুলে দিলেন ক্রেইবর্ন। তার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসি দিল বুড়ো। আপনি ব্যস্ত নাকি?

না। মাথা নাড়লেন ক্লেইবর্ন।

বেজন্মা শালা কী চায়?

আপনার ঘরের লাইট জ্বালানো দেখলাম। তাই ভাবলাম আপনার সঙ্গে দুই পেগ বিয়ার মেরে দিলে মন্দ হয় না। বাঁ হাতে ধরে রাখা বিয়ার দেখিয়ে নড করল পোস্ট। তারপর মুখ টিপে হাসল।

এক মুহূর্তের জন্য দ্বিধা করলেন ক্লেইবর্ন। কিন্তু তার বহু বছরের অভিজ্ঞতা বলে, পোস্টের হাসিটায় এমন একটা বার্তা আছে, যা উপেক্ষা করা যায় না। ফুর্তির চোটে নার্ভাস হাসিটা দেয়নি বুড়ো-কিছু একটা লুকানোর চেষ্টায় দিয়েছে। কী লুকাচ্ছে টম পোস্ট?

ভেতরে আসুন। দরজা থেকে সরে দাঁড়ালেন ক্লেইবর্ন। বাথরুমে পরিষ্কার কোনও গ্লাস পাওয়া যায় কিনা দেখছি।

গ্লাস না হলেও চলবে। একটা চেয়ারে বসতে বসতে বলল টম। বিয়ারের ক্যানগুলো টেবিলে রেখে একটা নিজের জন্য নিয়ে আরেকটা বাড়িয়ে দিল ক্লেইবর্নের দিকে। চিয়ার্স।

ধন্যবাদ। এক ঢোক বিয়ার গলায় চালান করে দিলেন ক্লেইবর্ন।

এমন আবহাওয়ায় বিয়ার ছাড়া জমে না। আবারও মৃদু একটা হাসি দিল টম। তবে বুড়োর চোখ দুটো সারা ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, অবশেষে টেবিলের ওপর এসে স্থির হলো।

সিনেমার স্ক্রিপ্ট? ক্লেইবর্নের কাছে জানতে চাইল। ভেবেছিলাম আপনি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সাথে জড়িত নন।

ঠিকই ভেবেছেন। এক বন্ধুর অনুরোধে স্ক্রিপ্টটায় চোখ বুলাচ্ছিলাম।

আচ্ছা। বলল সে। গল্পটা কী নিয়ে? নাকি আমাকে বলা যাবে না?

তা যাবে। বৃদ্ধের বলিরেখা পড়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন ক্লেইবন। ব্যাপারটা ভেবে দেখুন, আপনার কাছে ইন্টারেস্টিং মনে হতে পারে। প্রধান চরিত্র নরম্যান বেটস।

কী বলছেন! হাসি বন্ধ হয়ে গেছে টম পোস্টের। গতকালের খবরে অবশ্য দেখেছি যে, রনেট ওই কেসটা নিয়ে একটা সিনেমা বানাচ্ছে। টেবিলের ওপর পড়ে থাকা চিত্রনাট্যটার দিকে তাকাল লোকটা। আমার ধারণা এটাই সেই সিনেমাটার স্ক্রিপ্ট।

ঠিক ধরেছেন। সহজ হয়ে এসেছে ক্লেইবর্নের গলার সুর। আপনিও তো চিত্রনাট্য লিখতেন এক সময়। চোখ বুলাবেন নাকি একবার?

তাকে আশ্চর্য করে দিয়ে মাথা নাড়ল লোকটা। সময় নষ্ট। আজকালকের সিনেমাগুলো আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। যৌণ উত্তেজক দৃশ্যে ভর্তি সব সিনেমা। নায়ক-নায়িকা যেভাবে গড়াগড়ি আর জড়াজড়ি করে, তাতে যে কারও কোমর ভেঙে যাওয়া খুব স্বাভাবিক। আর কিছুক্ষণ পর চাদরের নীচ থেকে যখন নায়ক বের হয়ে আসে তখন কী দেখা যায়? নায়কের পরনে বক্সার! যত্তসব ফালতু কাজকারবার! আমাদের সময়ে এমন ছিল না। হাসিটা ফিরে এসেছে বুড়োর মুখে। সময় বদলে যায়। বিয়ারের ক্যানে থাকা শেষ তরলটুকু গিলে ফেলল। ফালতু খাবার, ফালতু সিনেমা। আজকাল লেখকদের অনেক ক্ষমতা।

আমার বন্ধুর কাছ থেকে কিন্তু অন্যরকম কথা শুনেছিলাম। ক্লেইবর্ন বললেন।

আমি শুধু সিনেমার কথা বলিনি। খালি বিয়ারের ক্যানটা ছুঁড়ে ফেলল পোস্ট। কিন্তু একটা কথা ভেবে দেখুন। কিছু রাজনীতিবিদ বক্তৃতা দেয়। প্রতিপক্ষরা সেই বক্তৃতার প্রতিবাদে পাল্টা বিবৃতি দেয়। তারপর টিভি রিপোর্টার দুই পক্ষের বিবৃতি পাল্টা বিবৃতির ব্যাখ্যা করে সংবাদ পড়ে! এইসব বিবৃতি-পাল্টা বিবৃতি-ব্যাখ্যার সব কিছুই লিখে অজ্ঞাত কোনও লেখক। আর একেই আমরা খবর বলি।

দশ দিন বা দশ মাস বা দশ বছর পর, অন্য একজন লেখক একটা বই লিখে দাবি করে এসবই মিথ্যে ছিল। তখন আমরা তাকে ইতিহাস বলি। তাই আসল কথা হলো গিয়ে, সব লেখকই পেশাদার মিথ্যুক। যাক গে ওসব কথা, আরেক রাউন্ড বিয়ার চলবে?

না, ধন্যবাদ। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালেন ক্লেইবন। বাইরে খেতে যাব আমি।

আপনার সঙ্গে যেতে পারলে ভালো হতো, পোস্ট বলল। সন্ধ্যা বেলাতেই খেয়ে ফেলেছি। বাড়ি থেকে দূরে এসে একা খেতে ভালো লাগে না নিশ্চয়ই।

আমি একা খেতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি।

 বিয়ে করেননি?

না। উঠে পড়লেন ক্লেইবন। ক্লজিট থেকে জ্যাকেট নিয়ে বেরোবার জন্য উদ্যত হলেন।

লাইটের সুইচ অফ করে দিয়ে তার পিছু নিল টম পোস্ট। আশেপাশে অনেকগুলো রেস্টুরেন্ট আছে, বলল সে। তবে সুপারমার্কেট থেকে খাবারদাবার কিনে ঘরের রেফ্রিজারেটরে রাখতে পারেন। তাহলে দরকারের সময় ঝটপট ব্রেকফাস্ট বানিয়ে নিতে পারবেন নিজেই।

পরামর্শের জন্য ধন্যবাদ। দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন ক্লেইবন।

এক ব্লক দূরের ছোট স্টেক-হাউসটায় ঢুকে পড়লেন তিনি। জায়গাটা কয়লার উত্তাপ, পিঁয়াজের ঝাঁজ, মাংস ভাজার গন্ধে এক বিশ্রী রূপ ধারণ করেছে। বুড়ো পোস্ট ঠিকই বলেছে। মোটেলেই খাবার নিয়ে খেতে হবে। এই পরিবেশে খাওয়া দাওয়া করা অসম্ভব।

তার কেবল পোস্টের নার্ভাস হাসির কথা মনে পড়ছে। চোখ বন্ধ করতেই মনে পড়ে গেল, ব্যাটা কীভাবে তার ঘরের দরজায় উঁকিঝুঁকি মারছিল। বুড়ো ধাড়ি বেজন্মা শয়তান।

উঁকিঝুঁকি। তবে ওই হাসি আর আগ্রহের পিছনে অন্য কোনও মতলব লুকিয়ে আছে। পেপাস্টের কাছে নিশ্চয়ই ডুপ্লিকেট চাবী আছে। ব্যাটা হয়তো এখন তার রুমে ঢুকে তার জিনিসপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করছে…অথবা চিত্রনাট্যটা। বুড়োকে স্ক্রিপ্টটার প্রতি বেশ আগ্রহী মনে হয়েছে। আর কাহিনী শোনার পর, ওটার বিষয়বস্তু বদলাতে আরও বেশি আগ্রহ দেখিয়েছে। কেন?

ভাবো, নিজেকে তাগাদা দিলেন ক্রেইবর্ন। নিশ্চয়ই কোনও কারণ আছে। বুড়োটা হাসির মাধ্যমে বলতে চায়, দেখো, আমি কোনও হুমকি নই। তোমার সঙ্গে কথা বলার জন্য আমার ওপর রেগে যেও না।

প্রায় বাতিল হয়ে যাওয়া এক মোটেলে দিনের পর দিন বসে থাকতে হলে, যে কারও জীবন থেকেই আনন্দ নামক জিনিসটা উধাও হয়ে যাবে। ক্লেইবনই এই মুহূর্তে মোটেলের একমাত্র ভাড়াটে। তাই টম পোস্ট যদি নিঃসঙ্গতা কাটাতে তার রুমে এসে বিয়ার গিলতে চায়, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। বুড়ো লোকটা নিঃসঙ্গ।

লোকটা হয় নিঃসঙ্গ নয়তো শঠ। সব লেখক পেশাদার মিথ্যেবাদী বলে সে কী বুঝিয়েছে?

রয় অ্যামেসও লেখক। ক্লেইবর্নের মনে পড়ে গেল, রয়ের চটকদার কথাগুলো আগেও কোথায় যেন শুনেছেন তিনি। টেবিল-হপারের মতো ওর রসিকতাগুলোও দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই বলা।

কিন্তু কেন? কী লাভ দৃষ্টি আকর্ষণ করে? ছবি বাতিলের ব্যাপারে দুজনের মনোভাব এক। তাহলে ছেলেটা কেনও তাকে খুশী করার চেষ্টা করেছে? তার চাইতে বড় কথা, নিজে কেন আগে আরও প্রবলভাবে চেষ্টা করল না?

একদিক থেকে চিন্তা লে, চিত্রনাট্যের নরম্যান রয় অ্যামেসের সৃষ্টি। নিজের হতাশা, রাগ ঢুকিয়ে দিয়েছে সে চরিত্রটার ভেতর। যদি এটা ক্যাথার্সিস না হয়, অন্তত ক্যাথেসিস তো বটেই। ব্যাপারটা যেকোনও মুহূর্তে বিপদজনক রূপ ধারণ করতে

সব লেখক পেশাদার মিথ্যুক। লেখকদের সম্পর্কে আরেকজন লেখকের মন্তব্য। তার মানে এ-কথাটিও মিথ্যা। কিন্তু সবাই-ই তো মিথ্যে বলেছে। এদের মাঝে তার রোগীরাও আছে। রোগীদের সমস্যা হচ্ছে, ওরা শুধু ক্রেইবর্নের সঙ্গেই মিথ্যে বলে না, মিথ্যে বলে নিজেদের সঙ্গেও। এক অর্থে ওরা সবচেয়ে পেশাদার মিত্যুক। আর তিনি, ক্লেইবর্ন, একজন পেশাদার সত্যসন্ধানী।

সত্যান্বেষী, নিজেকে শুধরে দিলেন ক্লেইবর্ন। তবে তার এই অনুসন্ধান সবসময় সফল হয় না। যেমনটি হয়নি নরম্যানের বেলায়।

খাওয়াদাওয়া শেষ করে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এলেন ক্লেইবর্ন। বুলেভার্ড ধরে হাঁটতে শুরু করলেন। নিজের অজান্তেই নরম্যানকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন তিনি। তার চোখ দুটো আশেপাশে এমন কাউকে খুঁজছে, যার এখানে থাকার কথা না।

তার পাশ দিয়ে হুশহাশ করে গাড়ি, মোটরসাইকেল চলে যাচ্ছে। ঘড়ির দিকে তাকালেন ক্লেইবর্ন সবে নয়টা বাজে। অথচ এরই মাঝে ফাঁকা হয়ে গেছে রাস্তা। তিনি ছাড়া আর কেউ নেই।

অনেক বেড়েছে গ্যাসোলিনের দাম। তবুও সবার নিজস্ব গাড়ি চাই-ই চাই। রাতবিরেতে শহরের রাস্তায় হেঁটে বেড়ানো খুব ঝুঁকিপূর্ণ। পুলিশরাও গাড়িতে বসে টহল দেয়। পুলিশের সন্দেহ তার মতো উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ানো লোকজনের ওপর।

অন্ধকার দোকানগুলোর সামনে দিয়ে যাওয়ার সময়, বিল্ডিঙগুলোর প্রায়ান্ধকার। প্যাসেজওয়েতে উঁকি মারছেন ক্রেইবর্ন। যদিও তিনি জানেন, যে আশায় উঁকিঝুঁকি মারছেন, তা একেবারেই উদ্ভট। প্যাসেজওয়েগুলোর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসবে না নম্যান। এখানে নেই সে। নাকি আছে?

যত নষ্টের গোড়া ওই চিত্রনাট্যটা। ওটা পড়ার পরই অদ্ভুত সব চিন্তা পেয়ে বসেছে তাকে।

পুরো ব্যাপারটা একটা ভ্রম। নরম্যান যদি তাকে এখানে টেনে আনত, তাহলে ওই স্টুডিওতেই ওকে পেয়ে যেতেন। কিন্তু তিনি জানেন, সবকিছুই মিথ্যে: নরম্যান মৃত। কেবল চিত্রনাট্যটাই আবার ওকে জীবিত করে তুলেছে।

তারপরও ক্লেইবন আবিষ্কার করলেন, বাঁয়ের শপিং মলগুলোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। পার্কিং এরিয়ার দিকে ঘুরলেন তিনি। লাইট, শব্দ, আর মানুষজনের ভিড় স্বাগতম জানাল তাকে।

পার্কিং লটে ঢুকে পালটে গেল তার মনোভাব। একজন মানুষ যা খায়, সে ঠিক ই, রয় অ্যামেস বলেছিল। আসলে মানুষ যেভাবে ড্রাইভ করে, সে ঠিক তেমনই, বললেই মানাত বেশি। কারও কারও গাড়ি চালানোর ধরন দেখেই বলে দেয়া যায় সে আসলে কেমন।

পার্কিং লটে একের পর এক প্রবেশ করতে থাকা বাহনগুলোর ওপর নজর বুলালেন ক্লেইবর্ন। যত্রতত্র গাড়ি পার্ক করে রাখা হয়েছে। এমনকি নো পার্কিং জোনেও দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলো গাড়ি। প্রাণোচ্ছল তরুণদের চিৎকার-চেঁচামেচিতে কান পাতা দায়।

মার্কেটেও একই অবস্থা। প্যাসেজওয়ে বন্ধ করে শপিং-কার্ট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বৃদ্ধ মহিলারা। আশেপাশে ভিড় জমিয়েছে খদ্দের।

সোয়া লিটার দুধ কিনলেন ক্লেইবন। তৈরি খাবার বিক্রি হয় যে কাউন্টারে, সেখান থেকে কিনলেন শুকনো মাংস। তারপর এক প্যাকেট পনির নিয়ে ডিম কেনার জন্য এগোলেন। কিন্তু কাছে গিয়েই বাঁধা পেলেন। এক মধ্যবয়স্ক মহিলা গলগল করে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ডিমের কার্টন গুনছে। সিগারেটের ধোঁয়া সহ্য করতে না পেরে সেখান থেকে সরে এলেন ক্লেইবর্ন। ব্যাপার না, ডিম ছাড়াই চলবে তার। এখন তার একটা জিনিসই দরকার-বিশ্রাম। দীর্ঘ, ক্লান্তিকর একটা দিন পার করেছেন তিনি। কোলাহলে…লোকজনের সঙ্গে কথা বলে ক্লান্ত তিনি। দুচোখ ভেঙে ঘুম আসছে।

বেকারির সামনে এসে দাঁড়ালেন ক্লেইবন। ভেতর থেকে উচ্চ নিনাদে ভেসে আসা গানের দিকে বিষদৃষ্টিতে তাকালেন তিনি।

ফিরে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়ালেন ক্লেইবর্ন। ঠিক তখনই বেকারির একটা আয়নার দিকে নজর পড়ল তার। আয়নাটা লাগানো হয়েছে যেন দোকানের সামনের দিক থেকে দোকানিকে দেখা যায়। কিন্তু এই মুহূর্তে দোকানি, অন্য একজনকে দেখা যাচ্ছে। সেই আয়নার ভেতর দিয়ে। লোকটা এদিকে তাকাতেই চেহারাটা স্পষ্ট দেখতে পেলেন ক্লেইবর্ন।

নরম্যান বেটস…

.

১৯.

শপিং-কার্টটা একপাশে সরিয়ে রেখে দোকানের সামনের দিকে ছুটলেন ক্লেইবর্ন। ক্রেতাদের ধাক্কা মেরে জায়গা করে নিয়ে এগোতে হচ্ছে তাকে। ফলে তার দিকে বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে তারা। কিন্তু সেদিকে ক্ষেপ করার সময় কই!

কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নরম্যানের মুখটা কেবল-ই চোখে ভাসছে। দ্রুত সামনে চলে এলেন ক্লেইবর্ন।

কিন্তু উধাও হয়ে গেছে নরম্যান।

থমকে দাঁড়ালেন ক্লেইবর্ন। চারপাশের অপরিচিত মুখগুলোর ওপর চোখ বুলালেন। তারপর ভিড় ঠেলে এগোলেন কাউন্টারের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা সোনালী-চুলো মেয়েটার দিকে।

কোথায় ও?

তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল মেয়েটি।

তোমার সর্বশেষ খদ্দের। এই এক মিনিট আগেও এখানে দাঁড়িয়ে ছিল সে।

শ্রাগ করল মেয়েটি, চোখ দুটো আপনাআপনি চলে গেছে বের হবার নিকটতম দরজার দিকে। মুহূর্ত মাত্র দেরি না করে সেদিকে ছুটলেন ক্লেইবর্ন।

এক মিনিটের মাঝে পার্কিং লটে চলে এলেন তিনি। পার্কিং লটটা এখন কানায় কানায় পূর্ণ। গাড়ি যাচ্ছে-আসছে। পরিচিত একটা মুখের খোঁজে পুরো জায়গাটার ওপর চোখ বুলালেন ক্লেইবন। লটের দিকে এগোলেন-উদ্দেশ্য বেরিয়ে যেতে উদ্যত গাড়িগুলো খুঁজে বের করা। ২৯s=p

তিন…চার…আরেকটা গাড়ি বেরোচ্ছে। গাড়িটা ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো বেরিয়ে এল উন্মুক্ত লেনে। গাড়িটার দিকে ছুট লাগালেন ক্লেইবন। ফ্লাডলাইটের আলোয় উইন্ডশিল্ডের পেছনে একজন মহিলার চেহারা দেখতে পেলেন। তার পাশে একটা দরজার হাতলের মতো দেখতে শিশুর মাথার ছায়ামূর্তি।

হর্নের তীব্র আওয়াজে সম্বিত ফিরল ক্লেইবর্নের। ঝট করে একপয়াশে সরে দাঁড়ালেন তিনি। আরেকটু হলেই গাড়ির নিচে চাপা পড়তে যাচ্ছিলেন।

হাঁপাতে হাঁপাতে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সামনের দিকে। এত কষ্ট বৃথা গেল! উড়ে গেছে পাখি। তার হাত ফস্কে আবারও পালিয়েছে নরম্যান।

কিন্তু পালিয়ে গিয়েছেটা কোথায়?

যেহেতু শপিং করতে মার্কেটে এসেছে সে, তার মানে ধারে কাছেই কোথাও আস্তানা গেড়েছে সে। কে জানে, রাস্তার পাশের কোনও মোটেলেও হতে পারে। সবগুলোতে খোঁজ নেয়ার কোনও ব্যবস্থা করা যাবে কী? বড় বড় হোটেল বাদ দিলেও, কয়েক ডজন থাকার জায়গায় আছে এখানে। তার উপর নরম্যান নিশ্চয় নিজের নামে ঘর ভাড়া নেবার মতো বোকামি করবে না!

অসম্ভব, একা একা খোঁজ নেয়া তো একেবারেই সম্ভব না। পুলিশকে কাজে লাগালেও সহজ হবে না। আর তাছাড়া, পুলিশ নিশ্চয় শুধু তার মুখের কথায় কাজে নেমে পড়বে না। প্রমাণ দেখাতে হবে, নিরেট…অকাট্য প্রমাণ।

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ক্লেইবর্ন। মার্কেটে ফিরে গিয়ে জিনিসপত্রের দাম চুকিয়ে দেয়া ছাড়া করার মতো আর কোনও কাজ নেই। করলেনও তাই। মোটেলের ফেরার মতে, বারবার তার নজর এদিক ওদিক ছুটে যাচ্ছিল। তিনি নরম্যানকে দেখেছেন, সন্দেহ নেই। কিন্তু নরম্যান তাকে দেখেছে কি? এই মুহূর্তে তাকে অনুসরণ করে আসছে না তো?

মোটেলের ঘরে প্রবেশ করে অবাক হয়ে লক্ষ করলেন, স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসছে তার ভেতর থেকে। চাবী দিয়েই খুলতে হয়েছে তালা। ভেতরে কেউ আছে বা তার অবর্তমানে কেউ ঢুকেছিল বলে মনে হচ্ছে না। নরম্যান যদি তার ঠিকানা না জেনে থাকে, তাহলে আপাতত এখানে থাকতে কোনও বাঁধা নেই।

আর তাছাড়া, ডা. ক্লেইবর্নের ভুলও তো হতে পারে। কোলাহল, আলো, ক্লান্তি, দুশ্চিন্তা-সব মিলিয়ে হয়তো তার ভ্রম হয়েছে। পুলিশ সেকথাই তাকে বোঝাবার চেষ্টা করবে। আসলে কোনও রোগী যদি তার কাছে এসে এসব বলত, তাহলে তিনিও রোগীকে অমন কথাই বলতেন। তাই এ ব্যাপারে ডিসকল বা অন্য কারও সাথে কথা বলেও লাভ নেই। প্রমান ছাড়া কেউ মেনে নেবে না। আপাতত চুপচাপ থাকাই ভালো। অপেক্ষা করা যাক নরম্যানের। তবে নিরাপত্তায় আরও জোর দিতে হবে। নরম্যান এখানে থাকলে, তার উপস্থিতি জানান দেবেই বের।

নরম্যান এখানে থাকলে…

কিনে আনা জিনিসগুলো গুছিয়ে রেখে, বিছানায় শুয়ে পড়লেন ক্লেইবন। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, তিনি থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। অন্তত সবার উপরে নজর তো রাখতে পারবেন, নিরাপত্তা দিতে পারবেন।

ঘুমের অতলে হারিয়ে যাবার আগমুহূর্তে প্রশ্নটা এল তার মনে।

সবার নিরাপত্তা না হয় তিনি নিশ্চিত করলেন, কিন্তু তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে কে?

.

২০.

রয় অ্যামেস আর ড্ৰিসকলের অফিস একই ভবনে। কিন্তু দুটোর মাঝে বিন্দুমাত্র মিল নেই। লেখকের অফিসটা মনে হয় প্রযোজকের অফিসের টয়লেটেই এঁটে যাবে। সাজসজ্জার কথা নাহয় বাদই দেয়া গেল।

ভেতরে প্রবেশ করেই ক্লেইবর্ন দেখতে পেলেন, অ্যামেস তার ডেস্কের পেছনে বসে আছে। ছোট জায়গায় তার কোনও অসুবিধা হয় বলে মনে হচ্ছে না। সমস্যা থাকতে পারে ছেলেটার, কিন্তু ক্লাস্ট্রোফোবিয়া নেই। একমাত্র জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে থাকা সূর্যের আলো চোখে পরায়, সেদিকে পিট পিট করে তাকালেন ক্লেইবন। এরপর চিত্রনাট্যের কপিটা ডেস্কের উপরে রেখে দিলেন। অ্যামেস চোখে আগ্রহ নিয়ে তার দিকে তাকাল।

কেমন লাগল?

জানতে চাইল সে। ইতস্তত করলেন ক্লেইবর্ন, গত রাতের ঘটনাটা বলা ঠিক হবে কিনা তা বুঝে উঠতে পারছেন না। বেশ কিছু ক্ষণ চিন্তা করার পর ঠিক করলেন, ঝুঁকি নিয়ে লাভ নেই। রয় হয়তো ওকে বিশ্বাস করবে না। আর এমনিতেও, এই মুহূর্তে চিত্রনাট্যটির গুরুত্বই সবচাইতে বেশি।

কিছু কিছু জিনিস লিখে এনেছি। বললেন ক্লেইবর্ন। যদি চাও তো একদিনেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে দুজনের মাঝে।

চাই মানে! অবশ্যই চাই।

ব্রিফকেস খুলে হলদেটে কাগজগুলো বের করে আনলেন ক্লেইবন। আশা করি, আমার হাতের লেখা পড়তে তোমার কোনও অসুবিধা হবে না।

হলো না। দ্রুত গতিতে লেখার উপর চোখ বুলালো অ্যামেস। চেহারায় অনুভূতির কোনও ছাপ না পড়লেও, ছেলেটার মনের মাঝে কী চলছে তা পরিষ্কার বুঝতে পারলেন ডাক্তার। অনেকদিন আগেই, মুখের নড়াচড়া দেখে মনের কথা বুঝে নেয়ার বিদ্যা শিখে নিয়েছিলেন তিনি।

প্রথম প্রথম উপরের ঠোঁটটা কিছুক্ষণ বাঁকা হয়ে রইল। যেন কোনও প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ, কোনও বাচ্চা ছেলের দুষ্টুমি দেখে হাসছে। আস্তে আস্তে মিলিয়ে এল হাসিটা। শেষ পর্যন্ত –কুঁচকে গেল। ক্লেইবর্ন বুঝতে পারলেন, এবার নাক গলাবার সময় হয়েছে। একটা কথা মনে রেখ, বললেন তিনি। আমি তোমার লেখনীর সমালোচনা করছি না। ভেতরে যে নৃশংসতা আছে, তার সমালোচনা করছি।

আমরা এখন আর ওই শব্দ ব্যবহার করি না। চোখ তুলে বলল অ্যামেস। বলি বক্স-অফিসে ধুম ফেলান।

জানি। ভেবেছিলাম, তুমি গতবাঁধা কাজ করতে আগ্রহী নও। ঠিক বলেছেন, অনেকটা অরক্ষার সুরে বলল ছেলেটা। আপনার আপত্তির যে যে জায়গা দেখছি, সেগুলো ভিজিনির ঢোকানো। ড্ৰিসকলও আপত্তি করিনি।

তাহলে তো আমি আমার সময় নষ্ট করছি কেবল। বললেন ডাক্তার। পরামর্শক হিসেবে আমার পরিবর্তন করার অধিকার আছে বলেই জানতাম।

পরামর্শক, হ্যাঁ। পরিবর্তনের কথা বলার অধিকার? সেটাও আছে। কিন্তু ক্ষমতা পুরোপুরি ভিজিনির হাতে। চিত্রনাট্যে পরিবর্তন, অভিনেতা নির্বাচন, সবকিছুতে ওর কথাই শেষ কথা। বলেছিলাম না, কেবলমাত্র মেরি ক্রেনের মতো দেখতে বলেই জ্যানকে সে বেছে নিয়েছিল?

ওটাও আমার আরেকটা সমস্যার জায়গা। মেয়েটার দৃশ্যগুলোর ব্যাপারে আমার মন্তব্য পড়েছ?

পড়লাম তো।

এই চরিত্রটা আমার কাছে বড় দুর্বল মনে হয়েছে। মনে হয়েছে, চরিত্রটা : একদম এক পাক্ষিক। একটু বেশিই সাধারণ–

আপনার চোখেও ধরা পড়েছে দেখি। শ্রাগ করল অ্যামেস। ইচ্ছা করেই ওরকম রেখেছি। জ্যানের অভিজ্ঞতা কম, ভারী কোনও চরিত্রের জন্য এখনও প্রস্তুত নয় সে। তাই ওকে রক্ষা করতে চেয়েছি। দেখে বা কথা বলে মনে হতে পারে যে মেয়েটা খুব শক্ত। কিন্তু মিশলে বুঝতে পারবেন, সেই শক্ত আবরণের আড়ালে নরম কিছু একটা আছে।

মেশার সুযোগ পাব বলে মনে হচ্ছে। বললেন ক্লেইবর্ন। আসলে এইমাত্র পার্কিং লটে ওর সাথে দেখা হলো। আজকে রাতে খাবার নিমন্ত্রণ জানিয়েছে সে।

উত্তর দিল না অ্যামেস, কিন্তু ছেলেটার নীরবতা যেন চিৎকার করে তার মনের খবর জানিয়ে দিল। কী দরকার ছিল কথাটা জানাবার? নিজেকেই বকলেন ক্লেইবর্ন। মেয়েটাকে যে এই যুবক পছন্দ করে, সেটা তো পরিষ্কার। তোমার দরকার ছিল এক মিত্রের। একমাত্র যে মানুষটার তা হবার সম্ভাবনা ছিল, এই মাত্র তুমি তাকে শত্রু বানিয়ে দিলে।

তবে সেটা জরুরী কোনও ব্যাপার না, ঘটনাটাকে হালকা করার প্রয়াস পেলেন ডাক্তার। আপাতত চলো, চিত্রনাট্য নিয়ে মাথা ঘামাই। যে যে জায়গায় দাগ দিয়ে দিয়েছি, সেগুলো যদি এদিক ওদিক করা হয়

দাগ দিয়ে দিয়েছেন? বৈরিতা লুকাবার বিন্দু মাত্র চেষ্টা করল না রয়। অস্থিরচিত্ততা, গোপন মনোভাব, অবচেতন মনের চাহিদা-এসব তো মেডিকেল রিপোর্টে মানায়, চিত্রনাট্যে না!

দুঃখিত, আসলে আমি চেয়েছিলাম কী–

কী চেয়েছিলেন তা আমিই বলে দেই, মাথা নাড়ল অ্যামেস। আপনি যে ডাক্তার, তা বোঝাতে চেয়েছিলেন। মনোবিদরা আসলে কী জানেন? অর্থনীতিবিদ, নৃতত্ত্ববিদ আর ভূ-তত্ত্ববিদের মতোই আন্দাজে ঢিল ছোঁড়া মানুষ। অল্প কিছুদিনের মাঝে দেখবেন, মানব মনোবিদদের জায়গা দখল করে নিয়েছে। কম্পিউটার।

আমার তাতে কোনও আপত্তি নেই। মাথা ঠান্ডা রাখলেন ক্লেইবন। কিন্তু এখন ওসব কথা আমাদের কোনও উপকারে আসবে না। জ্যানের চরিত্রটা যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছ, সেভাবেই থাক। আমাদের কাজ করতে হবে এই নৃশংসতার মাত্রা কমিয়ে আনার জন্য।

সেটা সম্ভব না। বললাম না, ওগুলো ভিজিনির ঢোকানো?

শ্রাগ করলেন ক্লেইবন। তাহলে চিত্রনাট্যের মূলভাবে পরিবর্তন আনতে হবে।

মানে?

চলচ্চিত্র জগতের আসল সমস্যা কিন্তু নৃশংসতা নিয়ে না। আসল সমস্যা হলো, নৃশংসতাকে এখানে যেভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়, তা নিয়ে। নায়ক বলো আর ভিলেন, দুপক্ষই আইন নিজের হাতে তুলে নেয়। দেখানো হয়, শেষ পর্যন্ত সবাইকে নৃশংতার-ই আশ্রয় নিতে হয়। এখানে নরম্যানকে যেভাবে রেখেছ, সেভাবেই থাকুক। শুধু সেটাকে সঠিক প্রমাণের চেষ্টা করব না। অ্যামেসকে মনোযোগ দিয়ে শুনতে দেখে, বলে চলল ক্লেইবর্ন। সত্যটাকেই বড় করে তুলব আমরাঃ খুন-খারাবী কোনও কিছুর সমাধান করতে পারে না। এর মাঝে বীরোচিত কিছু নেই। আসলে তোমাকে এজন্য বেশি একটা খাটতেও হবে না। অল্প কিছু পরিবর্তন আনলেই চলবে। দেখাতে হবে, নরম্যান এই জঘন্য কাজগুলো করে আনন্দ পাচ্ছে না। বরং অসুস্থ এক চিন্তার হাতে বন্দী সে।

এই আপনার সমাধান? কাষ্ঠ হাসি হাসল রয়। ঘড়ির কাঁটাকে পঞ্চাশ বছর পেছনে নিয়ে গিয়ে সবাইকে জানানো-অপরাধে লাভ নেই?

কেন, ক্ষতি কী তাতে? আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে এতো খুন খারাবী ছিল না। যা হতো, তাও অপরাধীদের মাঝেই হতো। আর আজ দেখ, বাচ্চারাও খুন হচ্ছে…খুন করছে। কেন? কারণ আমাদের চলচ্চিত্র, আমাদের টিভি, আমাদের বই জানাচ্ছে-অপরাধ করলে, পুরষ্কার মেলে!

তা তো জানাবেই। আজকালকার দিনে এসবই চলে। লোকে খায়!

সবাই কিন্তু তা করে না। দেখো, আমি খুব একটা ধার্মিক মানুষ নই। কিন্তু জানি, বাইবেল এখনও বিশ্বের সর্বাধিক বিক্রিত বই।

দীর্ঘক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে রইল অ্যামেস। এখন আর ঈর্ষান্বিত প্রেমিকের দৃষ্টি নেই ওর চোখে। ছেলেটার সব চিন্তা এখন প্রতিটা লেখকের প্রেমাস্পদের দিকে ন্যস্তঃ হাতের কাজটার দিকে। বুঝতে পেরেছি। আপনি চাইছেন, বাজে বা জঘন্য সবকিছু থাকুক ছবিতে। কিন্তু সেই সাথে সেগুলোর ফলাফলও থাকুক। আর আসলেই কাজ কম করতে হবে আমাকে, নরম্যানের উল্লসিত বাক্যগুলোকে দুঃখী মানুষের সদোগক্তিতে পরিণত করলেই চলবে। একটু বিরতি নিল সে। তবে আগে একটা কথা বলুন আমাকে, নরম্যান কি আসলেই দুঃখী ছিল?

নড করলেন ক্লেইবন। আমার জীবনে এর চাইতে দুঃখী কাউকে দেখিনি।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে চিত্রনাট্যটা হাতে তুলে নিল রয় অ্যামেস। কাজে লেগে পড়ি। কোথাও আটকে না গেলে, কালকের মাঝে কয়েক পাতা দিতে পারব মনে হয়।

আটকে গেলে ফোন দিও, দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন ক্লেইবন। আমি এখন যাই।

অফিস থেকে বেরিয়ে হলে আসতে আসতে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি। গতরাতের পর এই প্রথম তিনি আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন। অন্তত তার একটা কাজ তো শেষ হয়েছে, চিত্রনাট্যটার অনেক উন্নতি হবে এখন। রয়। অ্যামেসের বন্ধুত্বও হারাতে হবে না, যেমন ভাবে তিনি হারিয়ে ফেলেছেন নরম্যানের বন্ধুত্ব।

একবার…একবার সামনা সামনি বসে কথা বলতে পারলে, সব কিছু সহজ হয়ে আসত। চিত্রনাট্যটার ব্যাপারে বুঝিয়ে বলতে পারতেন তিনি। বলতে পারতেন, ভয় পাবার বা চলচ্চিত্রটাকে ঘৃণা করার কোনও কারণ নেই। হয়তো…হয়তো…নরম্যানকে শান্ত করতে পারবেন তিনি।

তবে সেজন্য আগে তাকে খুঁজে তো পেতে হবে। কোথায় পাওয়া যাবে লোকটাকে? খড়ের গাদায় সুই খুঁজে পাওয়াটাও এর চাইতে সোজা হবে। তবে…

আচমকা বুদ্ধিটা এল তার মাথায়। খড়ের গাদা থেকে সুই বের করতে হলে, গাদায় খুঁজে সময় নষ্ট করার তো কোনও দরকার নেই। দরকার কেবল একটা চুম্বক নিয়ে আসা। সেটাই সুইটাকে নিজের দিয়ে টেনে নিয়ে আসবে। স্টুডিও স্ট্রিটে দাঁড়াবার সাথে সাথে ক্লেইবন বুঝতে পারলেন, এ ক্ষেত্রে এই স্টুডিওটাই হলো সেই চুম্বক। যেটা নরম্যানকে তার দিকে টেনে নিয়ে আসবে।

খোঁজাখুঁজির কোনও দরকার নেই। নরম্যান নিজে থেকেই স্টুডিওতে আসবে। এখন পর্যন্ত কিছু ঘটেনি, কারণ সে স্টুডিওতে এসে পৌঁছাতে দেরি করেছে। তবে এখন যেহেতু এসে পড়েছে, দ্রুতই ঘটতে থাকবে সব ঘটনা। সদর দরজার দিকে চলে গেল ক্লেইনের দৃষ্টি। গার্ড লোকটা ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে, গাড়ির আসা যাওয়ার দিকে কড়া নজর রাখছে। অবশ্য স্টুডিওতে প্রবেশ করার পথ আছে আরও অনেকগুলো। ওগুলোও একইরকমভাবে প্রহরা দেয়া হয়।

তাতে অবশ্য কিছু যায় আসে না। নরম্যান কোনও দরজা দিয়ে প্রবেশ করার চেষ্টাও করবে না। ঘুরে দাঁড়িয়ে পার্কিং লটের দিকে রওনা দিলেন ক্লেইবন। যেতে যেতে স্টুডিওর দেয়ালের দিকে নজর পড়ল।

নিরেট পাথরের তৈরি দেয়ালগুলো পুরু আর অনেক উঁচু। অবশ্য পুরুত্বে কিছু যায় আসে না, নরম্যান তো আর দেয়ালে ফুটো করে ভেতরে ঢুকবে না। আর দড়ি বা মই ব্যবহার করলে, উঁচু দেয়াল পার হওয়াও কোনও ব্যাপার না। অন্ধকারে যে কেউ অন্য কারও নজরে না পড়েই কাজটা করতে পারবে। আর একবার দেয়ালের উপরে উঠতে পারলে, সাবধানে নিচে নামাটা তো একেবারে ছেলের হাতের মোয়া। এরপর স্টুডিওর ভেতরে কোথাও লুকিয়ে থাকলেই হলো।

এবার তার নজর গিয়ে পড়ল সারি বেঁধে থাকা কংক্রিটের অফিস, গ্যারাজ, ওয়ারড্রোব আর মেকাপ-এর জায়গাগুলো। দালানগুলোর সাথে লাগানো আছে। ট্রাক, ট্রেলার আর সেমি গুলো। তারও পরে রয়েছে বিশাল সাউন্ড স্টেজ আর প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। পার্কিং লটে যাবার পথে, এক জায়গায় ডানে মোড় নেয়া মাত্র দেখতে পান, ওখানে অনেকগুলো পরিত্যক্ত সেট ফেলে রাখা। ওয়েস্টার্ন ছবির বার, সদর রাস্তা, আস্তাবল, হোটেল, ব্যাঙ্ক, শেরিফের অফিস, ইত্যাদি। তার পেছনে সাদা রঙের অনেকগুলো বাড়ি। ওগুলোরও পেছনে বড় শহরের রাস্তা আর দুইপাশে অগণিত দোকান পাট। লুকাতে চাইলে, হাজারও জায়গা খুঁজে পাওয়া সম্ভব।

একবার দেয়াল টপকাতে পারলে, নরম্যানের কাজ হবে কেবল ক্ষণে ক্ষণে লুকাবার জায়গা পরিবর্তন করা। তাহলেই হবে, পুলিশ হাজার খুঁজেও ওকে পাবে না। আর কে বলতে পারে! ওসব সাদা বাড়ির কোনও একটায় হয়তো গত রাত কাটিয়েছে নরম্যান!

ভয় পাবার মতো কিছু হয়নি, নিজেকে বোঝালেন ক্লেইবর্ন। এখন আমি ভয় পেলে, আমার দেখাদেখি অন্যান্যরাও ভয় পেয়ে যাবে। বলার মতো কিছু না পেলে, এ ব্যাপারে মুখ খোলাই উচিৎ হবে না।

ঘুরে দাঁড়িয়ে উল্টো পথে চলতে শুরু করলেন তিনি, সাউন্ড স্টেজের কাছে এসে থামলেন। বা দিকের সাত নাম্বার স্টেজটার দরজা এখনও খোলা। অনেকটা কৌতূহলী হয়েই, দরজা দিকে উঁকি দিলেন তিনি।

হালকা আলোয়, ভেতরের দলা পাকিয়ে পড়ে থাকা তারগুলোকে সাপ বলে মনে হচ্ছিল। এছাড়া ভেতরের দিকটায় ঘন, কালো অন্ধকার ছেয়ে আছে। ভেতরে প্রবেশ করলেন ডা. ক্লেইবর্ন, চোখ দুটোকে সয়ে আসার জন্য একটু সময়। দিলেন। এর আগে, চলচ্চিত্রের ব্যাপারে বানানো চলচ্চিত্র ছাড়া এসব কখনও দেখেননি তিনি।

চোখে অন্ধকার সয়ে এলে, গোলাকার ছাদটা তার নজরে পড়ল। বিশাল এই স্টেজটা যে আসলে কতোটা বিশাল, তা আজকের আগে উপলব্ধি করতে পারেননি। তার মনে হচ্ছিল, জায়গাটা যেন কোনও বিশাল উপাসনালয়, অন্ধকারের কোনও দেবতাকে অর্ঘ্য দেবার জন্য বানানো হয়েছে এটাকে। তবে পুরো এলাকাটা অন্ধকার না। হালকা একটা আলো দেখা যাচ্ছে। মাথার উপরে একটা কর্ড থেকে ঝুলছে সেটা। যে এলাকায় আলো ফেলছে, সেটা অন্যান্য দেয়ালের কারণে দেখা যাচ্ছে না। ক্লেইবর্ন এগিয়ে গেলেন, ডান পাশে দেখতে পেলেন অনেকগুলো ভ্রাম্যমান ড্রেসিং রুম। দরজাগুলো বন্ধ, ওগুলোর নীচ থেকেও কোনও আলো আসছে না।

লুকাবার হাজারও জায়গা আছে এখানে! একদম কাছের ড্রেসিং রুমের দিকে এগোলেন তিনি। কিন্তু দরজার কাছে যাওয়ামাত্র গতি কমে গেল। যদি তার ধারনা সত্যি হয়? আসলেই যদি নরম্যান ওসব দরজার কোনও একটার ওপাশে লুকিয়ে থাকে? ইতস্তত করলেন তিনি।

অপেক্ষা কীসের? কীসের এতো ভয়? নরম্যানকে ধরার জন্যই তো এখানে এসেছ, নাকি? তাহলে কাজে নেমে পড়।

আস্তে আস্তে দরজার সামনের কাঠের সিঁড়িটার সবচেয়ে নিচের ধাপে পা রাখলেন ক্লেইবন। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। নরম্যান যদি এখানে থেকেও থাকে, তাহলে অবশ্যই খুব আতঙ্কিত হয়ে আছে।

ঠিক তার নিজের মতো!

নরম্যান যখন আতঙ্কিত হয়ে পড়ে, তখন আর তার আচরণ স্বাভাবিক থাকে না। বুনো জন্তু হয়ে যায় সে!

তবে ভয়ের কিছু নেই, লোকটা নেই এখানে। হাজার হাজার লুকাবার জায়গা থাকতে সে এখানে এসেই বা কেন লুকাবে?

দরজার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন ক্লেইবর্ন, ঠিক তখনই শুনতে পেলেন আওয়াজটা। একদম হালকা আওয়াজ। কেমন যেন ঘষ ঘষ শব্দ। সেই সাথে একটু ক্যাঁচ ক্যাঁচ। কিন্তু আওয়াজটা দরজার ওপাশ থেকে আসেনি। এসেছে। আলোকিত জায়গাটা থেকে। ঘুরে দাঁড়িয়ে, নিচে নেমে এলেন ক্লেইবন।

আওয়াজটা হবার প্রায় সাথে সাথেই আবার নেমে এসেছে নীরবতা। কেবল মাত্র তার নিজের পায়ের আওয়াজটাই শোনা যাচ্ছে। তবে সতর্কতার সাথে ধীরে ধীরে তিনি এগোচ্ছেন বলে, সেই আওয়াজটাও হচ্ছে থেকে থেকে।

যেখানে ছাদ থেকে বাতিটা ঝুলছিল, সেটার পাশে চলে এলেন তিনি। একটু থমকে দাঁড়িয়ে, ঘাড় বাঁকিয়ে উঁকি দিলেন। আলোর নিচে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। সেটটা একদম খালি বলে মনে হচ্ছে।

আস্তে আস্তে সামনে এগোতে শুরু করলেন তিনি। সামনেই একটা চতুর্ভুজাকৃতি ঘর। ওখানে ঢোকা মাত্র যেন ভিন্ন এক পৃথিবীতে চলে এলেন তিনি। পায়ের নিচে কার্পেট দেখা গেল। পুরাতন আর বিবর্ণ, কিন্তু কার্পেট তো বটে। পুরনো দিনের বাড়িগুলোতে এগুলো ব্যাবহার করা হয়। এই মুহূর্তে অমন কোনও পুরনো বাড়িতে আছেন বলেই মনে হচ্ছে তার। যেখানে সময় থমকে গিয়েছে।

পুরাতন ড্রেসার আর তার ওপরে রাখা জিনিসগুলোর দিকে তাকালেন ক্লেইবন। সবগুলোই পুরনো। একটা গিল্টি করা ঘড়ি, পিন-কুশন, ছোট আয়না, সেন্টের বোতল। জিনিসগুলো আর সেই সাথে একটা খোলা ক্লজিট থেকে ঝুলতে থাকা পোশাক তাকে জানান দিল, এক মহিলার শোবার ঘরে আছেন তিনি। এর জন্য খাটটা দেখারও প্রয়োজন পড়ল না।

ডান দিকের কোনায় পাতা হয়েছে খাটটা। পাশেই রাখা আছে একটা উঁচু রকিং চেয়ার। সামনে এগোলেন তিনি। বিছানার চাদর, জানালার পর্দা এসব দেখছেন। দক্ষ হাতে এয়ভারি করা হয়েছে ওগুলোতে। তবে কাছে এসে বুঝতে পারলেন, বিছানার চাদর অপটু হাতে জাজিমের নিচে গুঁজে রাখা। চাদর ভেদ করে বালিশ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কেন যেন নিচু হয়ে চাদরটা সরিয়ে দিলেন তিনি। বালিশের উপর বাদামী চুল দেখা গেল। মাঝখানের নিচু হয়ে থাকা অংশটা জানাচ্ছে, কিছুক্ষণ আগেই এখানে কেউ শুয়েছিল। তবে গভীরতা দেখে মনে হচ্ছে, অনেকক্ষণ এই বালিশ মাথার স্পর্শ পেয়েছে।

ক্লেইবন বুঝতে পারছেন, ঠিক কোথায় আছেন তিনি। আগে কখনও জায়গাটা দেখেননি, কিন্তু এতোবার এর কথা শুনেছেন…এতোবার কাগজে পড়েছেন যে চিনতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হচ্ছে না।

এই জায়গাটা নরম্যানের মায়ের শোবার ঘর!

এখানেই নরম্যান মমি করে রেখেছিল মিসেস বেটসের লাশটাকে। অনেক অনেক বছর পড়ে ছিল ওই বিছানায়। অথচ বাইরের দুনিয়া জানত, মহিলা জীবিত। পঙ্গু, হাঁটতে চলতে পারে না, একটু পাগলাটেও। কিন্তু জীবিত।

নাহ, কী সব যে ভাবছেন! এটা তো সেই ঘর না। এই ঘর আসলে সেই ঘরের আদলে বানানো একটা সেট মাত্র।

ক্লেইবর্ন চাদরটা স্পর্শ করলেন, বালিশের গর্তটা ঢেকে দিলেন সুন্দর করে। কিন্তু কাজটা করতে গিয়ে, ঘেন্নায় তার গা শিহরিয়ে উঠল। এরকম একটা বালিশেই শুয়ে থাকত মিসেস বেটসের লাশ। একটা চিন্তা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল তার মনে। মাত্র কয়েক মিনিট এই নকল সেটে কাটিয়েই যখন তার এই অবস্থা, তখন বছরের পর বছর আসল বাড়িটায় নরম্যান থেকেছে কী করে? রাতে নিশ্চয় আসল শোবার ঘরে বসে একটা মমিকে উদ্দেশ্য করে কথা বলেছে সে।

মমি…মামি…মাম্মি…

আবার শব্দটা শুনতে পেলেন ক্লেইবন। ঘুরে দাঁড়ালেন তিনি, সেই সাথে যেন নড়ে উঠল ছায়াগুলোও। বড়-সড় রকিং চেয়ারটা থেকে আসছে কাঁচ ক্যাঁচ শব্দটা। জানালার দিকে মুখ করা আছে বলে, ওতে কেউ বসে আছে কিনা তা এতোক্ষণ বোঝা যাচ্ছিল না।

আর ঘষ ঘষ শব্দটার উৎপত্তি হয়েছে, রকিং চেয়ার থেকে মহিলাটার উঠে দাঁড়ানোয়। বাতাসে যেমন প্রেজ্ঞা নিঃশব্দে ভাসে, তেমনি নিরবে ক্লেইবর্নের দিকে এগিয়ে এল সে। অন্ধকার থেকে আলোর নিচে চলে এল, ধূসর চুলগুলো উড়ছে, মুখটা শয়তানী হাসিতে ভর্তি। হাত দুটো উঁচু হয়ে আছে। মাথা স্পর্শ করে, উইগ খুলে আনল একটা হাত।

ক্লেইবর্ন টের পেলেন, হাস্যরত একটা চেহারা তার দিয়ে তাকিয়ে আছে। বড় পর্দায় অগণিত বার এই চেহারাটা দেখেছেন তিনি।

পল মরগ্যানের চেহারা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *