০৬-১০. চামড়া দিয়ে হাতল মোড়ানো

ডা. স্টাইনারের চামড়া দিয়ে হাতল মোড়ানো চেয়ারে বসার আগে, ডা. অ্যাডাম ক্লেইবর্ন টেরও পাননি যে তিনি কতটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। মুহূর্তের জন্য যে আরামটা সারা দেহে ছড়িয়ে পড়েছিল, সেটার জায়গায় স্থান করে নিল বিরক্তি। কেননা নিজ অফিসের প্লাস্টিকের চেয়ার আর প্লাইউডের আসবাবের কথা মনে পড়ে গিয়েছে তার। ক্লান্ত না হয়ে উপায় কী! প্রতি দিন দুই শিফটে কাজ করতে হয় তাকে। আর এদিকে স্টাইনার কেবল বসে বসে আদেশ দিয়েই খালাস। দীর্ঘশ্বাস ফেলে রিসিভারের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন তিনি। এখন ওসব ভাবার সময় না।

হ্যালো, ডা. ক্লেইবন বলছি। দেরি করার জন্য দুঃখিত।

অসুবিধা নেই। ভরাট, উঁচু কণ্ঠে জবাব এলো। আমি মাৰ্টি ড্ৰিসকল, এন্টারপ্রাইজ প্রোডাকশন থেকে বলছি। ছায়ছবিটার ব্যাপারে কথা বলা জন্য ফোন করেছি।

ছায়াছবি?

হুম, চলচ্চিত্র। স্টাইনার আপনাকে বলেননি?

না তো!

আজব, আমি তো বৃহস্পতিবারেই ওর সাথে কথা বললাম। প্যাকেজটা পাননি?

প্যাকেজ? কোন প্যাকেজ?

দেরি যেন না হয়, সেজন্য তো রেজিস্ট্রি করে শুক্রবার সকালেই জিনিসটা পাঠালাম!

তাহলে তো পেয়ে যাবার কথা। নড় করতে করতে বললেন ক্লেইবন। সাথে সাথে তার মনে হলো, কথা তো হচ্ছে ফোনে! তাহলে নড় করে কী লাভ! এমন কাজ এখানকার কোনও অতিথির শোভা পায়। এখানে কাজ করতে হলে, নিজেকেও অল্প বিস্তর পাগল হতে হয় আরকী!

আমি প্যাকেজের ব্যাপারে কিছু জানি না। বললেন তিনি। তারপরই যোগ করলেন, একটু দাঁড়ান।

ডেস্কের অন্য পাশে একটা বড় বাদামী রঙের এনভেলপ পড়ে আছে। সেটা নিজের দিকে টেনে এনে, উপরে লেখা ঠিকানাটা পড়লেন ক্লেইবন। আপনার প্যাকেজ এসেছে, ডেস্কেই ছিলো।

ডা. স্টাইনার কী খুলেছেন?

পরীক্ষা করে দেখল ক্লেইবর্ন। হ্যাঁ।

তাহলে কিছু জানালেন না যে? স্ক্রিপ্টটা পড়ার পর, সাথে সাথে জানাবার কথা  আরও কিছু কথা বললেন মার্টি, কিন্তু বজ্রপাতের আওয়াজে তা ঢাকা পড়ে গেল।

কষ্ট করে আরেকবার বলবেন? আমাদের এখানে প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে।

চিত্রনাট্যের কথা বলছিলাম। কণ্ঠ উঁচু করে বললেন ড্ৰিসকল। ভেতরে আছে নিশ্চয়। একটু দেখুন তো। অধৈৰ্য্য শোনাল গলাটা।

ক্লেইবর্ন এনভেলপটা খুলে, ভেতরের সবকিছু টেবিলে ফেললেনঃ তিনটা আট বাই দশ আকৃতির ছবি, সেই সাথে চামড়ায় বাঁধানো অনেকগুলো কাগজ।

চামড়ার বইটার কাভারে, টাইপরাইটারে লেখা শব্দটা পড়লেন তিনি। উন্মাদিনী।

ওটাই। নাম পছন্দ হয়েছে?

খুব একটা না।

স্টাইনারেরও পছন্দ হয়নি। ড্রিসকল আমুদে কণ্ঠে বলল। চিন্তা করবেন না, নাম এখনও চূড়ান্ত হয়নি। হয়তো আপনি আর অ্যামেস এক হয়ে আরও ভালো কোনও নাম নির্বাচন করতে পারবেন।

অ্যামেস?

রয় অ্যামেস। আমার লেখক। ভাবছি, কয়েকদিনের মাঝেই ওকে আপনাদের সাথে দেখা করতে পাঠব। ঠিকঠাকভাবে সব কিছু লিখল কিনা, তা সরেজমিনে দেখে আসুক। সেই সাথে যদি বেটসের সাথে কথা বলার সুযোগ মেলে–

আমি বুঝতে পারছি না। আপনি কী নরম্যান বেটসের কথা বলছেন?

হ্যাঁ।

কিন্তু তার সাথে চিত্রনাট্যের কী–

ওহ হো, ডাক্তার সাহেব, ভুলেই গিয়েছিলাম। মুচকি হাসল ড্ৰিসকল। আপনি যে ওটা পড়েননি, তা একদম মনে ছিল না। আমরা বেটসের কাহিনীর উপর নির্ভর করে একটা ছবি বানাচ্ছি।

ক্লেইবর্নের হাত থেকে চামড়ায় বাঁধানো বইটা ডেস্কে পড়ে গেল। উন্মাদিনী লেখাটার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন তিনি।

ডক-শুনতে পাচ্ছেন?

হ্যাঁ।

কিছু তো বলুন। আপনার কী মত?

আমার পেশাগত মত শুনতে চাচ্ছেন?

হ্যাঁ, হ্যাঁ।

তাহলে কান খুলে শুনুন, আমার ধারনা-আপনার মাথায় সমস্যা আছে।

ড্ৰিসকল হাসিতে যেন ফেটে পড়ল। ক্লেইব কিছু শুনে তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ঠাট্টা করছি না। নরম্যান বেটসকে নিয়ে ছবি বানাবার কথা একমাত্র পাগলই ভাবতে পারে।

আইনগত দিক থেকে কোনও বাঁধা নেই। আমরা চেক করে দেখেছি-

আপনি বুঝতে পারছেন না-

কিন্তু ড্ৰিসকলের তার কথায় মন নেই। ধরুন যদি বসন্তের শেষের দিকে রিলিজ দেয়া যায়, সবার মাথা ঘুরে যাবে!

খেলো একটা কাজ করতে যাচ্ছেন আপনারা—

খেলো! কী যে বলেন না! প্রচুর টাকা ঢালতে যাচ্ছি আমরা। কম করে হলেও, দেড় মিলিয়ন তো হবেই।

আমি পয়সার কথা বলছি না।

ঠিক, বলে অবশ্য লাভও নেই। ওসব আমার মাথা ব্যথা।

আর আমার মাথা ব্যথা হলো রোগীর ভালো মন্দ।

এতো দুশ্চিন্তা করবেন না তো! আমরাও আপনার রোগীর ভালো চাই। সেজন্যই তো আগে আগে আমাদের লেখককে পাঠিয়ে দিচ্ছি। যদি কোথাও কোনও ভুল-ভ্রান্তি হয়ে থাকে।

পুরো ব্যাপারটাই তো একটা ভুল।

আহ হা, ডক, আপনি তো এখনও চিত্রনাট্য পড়েই দেখেননি। আগে দেখে নিন। আর মনে রাখবেন, যদি কোথাও কোনও পরিবর্তন করতে হয়, তাহলে এই সোমবারের এক সপ্তাহের মাঝেই করতে হবে। আপনার একটু সাহায্য দরকার শুধু। যদি মনে করেন যে অ্যামেস আসলে ভালো হবে, তাহলে বলুন শুধু। আমি সাথে সাথে ওকে পাঠিয়ে দিব।

ভা, স্টাইনার কী এই ছবির ব্যাপারে কোনও আপত্তি জানিয়েছেন?

বলেছিলেন, পড়া শেষ হলেই আমাকে জানাবেন। ভালো কথা, তিনি ফিরে এলে যদি আমাকে একটু কষ্ট করে জানান–

জানাব।

ধন্যবাদ। আপনার সাথে কথা বলে ভালো লাগল। দিনটা ভালো কাটুক। ফোন রেখে দিল ড্ৰিসকল।

রিসিভার নামিয়ে রেখে আরাম চেয়ারে দেহ এলিয়ে দিলেন ক্লেইবর্ন। দিনটা ভালো কাটুক! ভালো তো মার্টি ড্ৰিসকল আর ওর মতো লোকদের কাটে। এই ফোনটাও সম্ভবত কোনও রৌদ্রজ্জ্বল পরিবেশ থেকে করেছে।

এখানে নেই রোদের কোনও লক্ষণ, আছে কেবল অন্ধকারের রাজত্ব। নেই কোনও গান, আছে শুধু বজ্রপাত আর বৃষ্টির আওয়াজ। স্টাইনারের কথাও একবার ভাবলেন তিনি। লোকটা নিশ্চয় এখন তার ফার্স্ট ক্লাস সীটে বসে নাক ডাকাচ্ছে। যাবার আগে লোকটা ওকে এই চিত্রনাট্যের কথা বলে গেলেন না। কেন? এর গুরুত্ব কি তিনি ধরতে পারেননি?

আসলে ম্যান বেটসের কী হলো না হলো, তাতে ডা, স্টাইনারের কিছু যায় আসে না। তার দরকার সেন্ট লুইসের মিটিঙটা ভালোয় ভালোয় শেষ হওয়া।

এসব ভাবতে ভাবতেই, হতাশ হয়ে মাথা নাড়লেন। তুমি কিছু না জেনেই, ডা. স্টাইনারের উদ্দেশ্যের ব্যাপারে মন্তব্য করে বসেছ, বললেন নিজেকে। আগে অন্তত চিত্রনাট্যটা তো পড়ে দেখ।

চামড়া মোড়ানো পান্ডুলিপিটাকে টেনে নিলেন ক্লেইবন। কিন্তু নজর ছবি তিনটার উপর পড়ামাত্র থমকে গেলেন। প্রথমটা হাস্যরত এক লোকের বুক পর্যন্ত ছবি। চিনতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হলো না তার, পল মরগ্যান। বর্তমান সময়ের স্টার লোকটা। একে নরম্যানের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য বেছে নেয়া হয়েছে নাকি!

অন্য দুই ছবিতে যেহেতু শুধু দুজন মেয়েকেই দেখা যাচ্ছে, তাই ধারনাটা আরও পোক্ত হলো তার মনে। অবশ্য এই দুই মেয়েকে তিনি চেনেন না, নাকি চেনেন?

হাস্যরত, বড় বড় চোখের চেহারাটাকে যে খুব পরিচিত মনে হচ্ছে!

নিজের চোখও বড় বড় হয়ে গেল ক্লেইনের। এই চেহারাটা যে অনেক আগে তিনি খবরের কাগজে দেখেছিলেন। এরপর আবার নরম্যান বেটসের ফাইলেও দেখেছেন। এ যে মেরি ক্রেন!

কিন্তু তা কী করে সম্ভব! মেরি ক্রেন তো মৃত! নরম্যান ওকে নিজ হাতে শাওয়ার স্ট্যান্ডে খুন করেছে।

তাহলে মেয়েটার মতো দেখতে একজনকে খুঁজে বের করেছে স্টুডিও!

ডা. ক্লেইবন! ওটিস দরজার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ওকে ডাকছে। হাঁপাচ্ছে। লোকটা।

চোখ তুলে চাইলেন ডাক্তার, হাত থেকে ছবি গুলো ডেস্কের উপর পড়ে গেল। কী হয়েছে?

তাড়াতাড়ি আসুন…লাইব্রেরিতে…লাইব্রেরিতে একটা অঘটন-

অঘটন! শব্দটা চমকে দিল ডাক্তারকে। দৌড়ে এগোলেন তিনি। তাড়াহুড়োয় লিফটের জন্য অপেক্ষা না করে, সিঁড়ি বেয়েই উপরে ওঠা শুরু করে দিলেন।

কী হয়েছে? জানতে চাইলেন তিনি।

আমি জানি না, ওখানে ছিলাম না—

ছিলাম না মানে? ওদেরকে একা রেখে গিয়েছিলে?

ঝড় হচ্ছিল, সি ওয়ার্ডে গিয়ে ওখানকার রোগীদের যার যার ঘরে ঢুকিয়ে দিচ্ছিলাম। ওখানে অন্য কারও ডিউটি নেই আজ- হাঁপাচ্ছে ওটিস।

.

০৭.

বো কেলার কম করে হলেও, আধ ঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছে, তা-ও আবার এমন হতচ্ছাড়া বৃষ্টিতে! এতোক্ষণে মাত্র দুটো গাড়ি এসেছে এ রাস্তায়, থামেনি একটাও। তাড়াহুড়ো ছিল, নাকি ভয় পেয়ে-তা নিয়ে সন্দেহ আছে ওর। হয়তো ওর এলোমেলো চুল-দাঁড়ি আর মাথার কিম্ভুতকিমাকার হাটটা দেখে আর থামার সাহস পায়নি। কে জানে, পাগলও ভেবে বসতে পারে।

দুই বছর আগের কথা, টুলসার অ্যাঞ্জেল গ্যাঙের সাথে ঘুরত তখন বো। সমস্যা হলো, ওর নিজের তখন কোনও বাইক ছিল না। বাইকার গ্যাঙের সদস্য, আর তার কিনা বাইক নেই! তাই কী হয়! এই ছোটখাট বিচ্যুতিটুকু ঠিক করার জন্য একদিন রেকি করে এল হোন্ডার ডিলারের দোকান। ঠিক করল লেবার ডে তে সবাই যখন ছুটিতে থাকবে, তখন কাজ সারবে।

পেছনের দরজার তালাটা মনে হয় দুধের শিশুও খুলে ফেলতে পারত। ভেতরে ঢুকে ঘরের সবচাইতে বড় বাইকটা নিজের জন্য পছন্দ করে ফেলেছিল বো। অসাধারণ ছিল যন্ত্রটা, চলার জন্য যেন কুঁসছিল। কিন্তু ডিলার হারামজাদা যে নিঃশব্দ অ্যালার্মের ব্যবস্থা করে গিয়েছিল, তা কে জানত? ব্যস, দুই বছরের জন্য। সোজা জেল!

কেঁপে উঠে গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়াল ও, কার্ডবোর্ড দিয়ে বানানো সাইনটা শুকনো রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু এই বৃষ্টিতে চেষ্টায় কোনও ফল হবে বলে মনে হচ্ছে না। আসলে বোকামিটা ওর-ই, বাসে চড়া উচিত ছিল। গতকাল ছাড়া পেয়েছে, আর ছাড়া পাবার সাথে সাথে একটা বাসের টিকিটও দেবার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল ওকে। কিন্তু তা না করে, নগদ টাকা নিয়েছিল। অবশ্য তাতে খুব একটা ক্ষতিও হয়নি, ছয়টা গাঁজার স্টিকে দম দিতে পেরেছে। নারী মাংসের স্বাদ নিতেও ভোলেনি।

সকালের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল, লিফট চেয়ে চেয়েই পুরো রাস্তাটা পার করে দিতে পারবে। রাস্তায় নামার সাথে সাথে একটা বড় তেলবাহী ট্রাকে লিফট পেয়ে। গিয়েছিল। ড্রাইভার বলেছিল, ফেয়ারভিলের ঠিক মাঝ দিয়েই যাবে ওর গাড়ি। চাইলে বো-কে একদম জ্যাকের বাড়ির সামনেই নামিয়ে দিতে পারবে।

কিন্তু ঝড় শুরু হয়ে গেলে, ভয় পেয়ে যায় লোকটা। দুঃখিত, বন্ধু, ঝুঁকি নিতে চাইছি না। ঝড় না থামা পর্যন্ত এই বুক সেন্টারেই পার্ক করে থাকব। তাই আবার দুই পায়ের উপর ভরসা করে পথে নেমে যেতে হয়েছিল বো-কে।

সমস্যা হলো, আজ রাতেই ফেয়ারভিলে পৌঁছাতে হবে ওকে। কেননা জ্যাক আগামীকালই বেরিয়ে পড়বে বাইরে। অন্তত গত মাসে তো তেমনটাই জানিয়েছিল। জ্যাক ওর কাছে কিছুটা হলেও কৃতজ্ঞ, হয়তো সাথে করে নিয়ে যাবে। আসলে জ্যাক ছাড়া ওকে নিয়ে ভাববার মতো কেউ নেই। পয়সাও নেই পকেটে।

এখন ভুগতে হচ্ছে, এতো জোরে বাতাস বইছে যে বৃষ্টি সরাসরি না পড়ে তির্যকভাবে পড়ছে! গাছের আড়ালে দাঁড়িয়েও লাভ হচ্ছে না। আত্মরক্ষার প্রয়াসে সাইনটা মুখের সামনে তুলে ধরল ও।

কিন্তু তাতে কী আর কাজ হয়! এখন বোর দরকার একটা ছাতা। নাহ, ভুল হলো। তার চাইতে বেশি দরকার পয়সা কামাবার কোনও ফন্দি। কেননা ফেয়ারভিলে গেলে যে জ্যাক ওকে আশ্রয় দেবেই, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই।

হঠাৎ ভান দিক থেকে এক টুকরা আলো ভেসে এলো। নাহ, বিদ্যুৎ চমক বলে মনে হলো না। অনেকক্ষণ ধরে জ্বলছে। গাড়ি, অবশেষে একটা গাড়ি ঢুকেছে। এই রাত! সাথে সাথে গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে রাস্তায় চলে এলো বো, সাইনা তুলে ধরেছে। আলোটা আরও কাছে এলে বুঝতে পারল, ওটা একটা ভন।

থাম, থাম শালা-আসলেই থেমে গেল বাহনটা!

কালক্ষেপণ না করে প্যাসেঞ্জার সীটের দরজার কাছে চলে গেল বো। জানালার ওপাশ থেকে ওর দিকে উঁকি দিল চালক। লিফট দরকার নাকি?

লিফট না লাগলে, এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাল ছিঁড়ছি নাকি গর্দভ?

মনে মনে বললেও, মুখে বলার ভুলটা করল না সে। ফেয়ারভিলে যাচ্ছেন?

হ্যাঁ।

সাইনটা ফেলে দিয়ে, ভ্যানে চড়ে বসল বো। দরজা লাগিয়েছে কী লাগায়নি, চলতে শুরু করল গাড়ি। ভেতরটা বেশ আরামদায়ক। উষ্ণ আর শুষ্ক। আরামে গা এলিয়ে দিয়ে, চালকের দিকে তাকাল সে। প্রথম দেখায় নিজের চোখের উপর-ই সন্দেহ জন্মাল ওর মনে। কেউ ড্রাকুলার মতো এমন বড় আলখেল্লা আর মাথা ঢাকার ওড়না নিয়ে ভ্যান চালায় নাকি? পরমুহূর্তেই বুঝতে পারল, চালক আসলে একজন নান!

ঈশ্বরে খুব একটা বিশ্বাস নেই বোর। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে হুট করে ঈশ্বরে বিশ্বাস জন্মালেও, কেউ ওকে দোষ দিতে পারবে না। একজন একাকী নান…একটা ভ্যান…এমন নির্জন রাস্তায় চালাচ্ছে! আচ্ছা, ভ্যানের মালিকানা বদল করা যায় না? নানের একটা ব্যবস্থা করলেই তো…

তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই, ধীরে সুস্থে কাজ করো…

এক মুহূর্তের জন্য চালিকা ওর দিকে তাকাল। অন্ধকারে তার চেহারা বুঝতে পারল না বো। তবে চালিকাকে উদ্দেশ্য করে হাসতে ভুলল না। কে জানে, হয়তো ওর পোশাক দেখে বেচারি ভয় পেয়ে যেতে পারে!

নানের দৃষ্টি অবশ্য অধিকাংশ সময় রাস্তার দিকেই রইল। তবে এরমাঝেও যে কয়েকবার মহিলা ওর দিকে তাকিয়েছে, তা পরিষ্কার বুঝতে পারল বো। একদম হঠাৎ করেই খসখসে কণ্ঠে কথা বলতে শুরু করল নান।

ফেয়ারভিলে থাকেন নাকি?

না, সিস্টার। এমনি যাচ্ছি, আমার কয়েক বন্ধু থাকে ওখানে।

শহরটাকে তো তাহলে ভালমতোই চেনেন?

কিছুটা তো চিনিই। আপনি কি ওখানে জন্মেছেন?

নড করল নান। বড়ও হয়েছি ওখানকার কাছেই একটা জায়গায়। তবে অনেকদিন হলো যাওয়া হয়নি।

কনভেন্টে ঢুকলে সম্ভবত খুব একটা ঘোরাফেরার সুযোগ মেলে না, তাই না? খিলখিল করে হাসল নান, হাসির আওয়াজটা অশ্লীল শোনালো বোর কানে। একজন নানের মুখে এমন হাসি মানায় না। তা ঠিক বলেছেন।

খুব একটা কিছু মিস করেছেন বলে মনে হয় না। বলল বো। আমার তো মনে হয়, ফেয়ারভিল আপনি ছেড়ে যাবার সময় যেমন ছিল, তেমনি আছে।

বৃষ্টির বেগ অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে, নানের সব মনোযোগ এখন রাস্তার দিকে। ফেয়ারভিলে বন্ধু-বান্ধব আছে বললেন?

হ্যাঁ।

ভাবছিলাম যে, তাদের একজন মি. লুমিস না তো? স্যাম লুমিস?

আমার বন্ধু না, তবে নাম পরিচিত মনে হচ্ছে। হার্ডওয়্যার স্টোরের মালিক নাকি?

লোকটা তাহলে এখনও ফেয়ারভিলেই আছে?

নড করল বো। বললাম না, খুব একটা পরিবর্তন ফেয়ারভিলে আসেনি।

ফেয়ারভিলে পরিবর্তন না আসলেও, এখানে আসবে…এখুনি আসবে। কথা বলতে বলতেই একটা পরিকল্পনা করে ফেলেছে ও। কিন্তু শেষ প্রশ্নটা একটু বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে ওকে। স্যাম লুমিসের নাম কে না শুনেছে? ওই হতচ্ছাড়াটা অনেক বছর আগেরকার একটা খুনের কেসে জড়িয়ে পড়েছিল। বেটস মোটেল না কী যেন নাম ছিল জায়গাটার…ওখানে কে জানি খুন হয়েছিল। মোটেলটা এখন আর নেই, তবে ওখানে যাবার পার্শ্ব রাস্তাটা এখনও আছে।

হাইওয়ে হবার পর, ও রাস্তার ছায়াও কেউ মাড়ায় না এখন। আর আজ এই বৃষ্টিত রাতে তো কেউ যাবে বলে মনেই হয় না। আচ্ছা, কতক্ষণ ধরে চলছে গাড়িটা? সামনেই সেই পার্শ্ব রাস্তার প্রবেশমুখ। উইন্ডশীল্ডের বাইরের দৃশ্য দেখার জন্য, পিটপিট করে তাকাল ও। কিন্তু এমন হারে বৃষ্টি পড়ছে যে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তবে কপাল ভালো, বিদ্যুৎ চমকের আলোতে মুহূর্তের জন্য পরিষ্কার হয়ে গেল চারপাশ। কাক্ষিত প্রবেশমুখটা দেখতে পেল ও। সাবধানে এগোতে হবে এখন। সিস্টার?

বলুন।

সামনের ছোট রাস্তাটা দেখতে পাচ্ছেন? ডানের ওই রাস্তায় ঢুকে পড়ন। শহরে যাবার শর্টকাট ওটা।

ধন্যবাদ।

বোর মনে হলো, নান বেচারি যেন আবারও অশ্লীলভাবে হাসল। তবে সেটা ওর ভুলও হতে পারে। হয়তো কেশে উঠেছে মহিলা। ঠান্ডা লেগেছে নাকি?

মাথা নাড়ল সিস্টার। নাহ, স্বাস্থ্য আমার ভালোই আছে।

আসলেই মহিলা হ্যবতী! গায়ে-গতরে বোর প্রায় সমানই হবে। তবে চিন্তা নেই, সামলাতে পারবে সে। ভালমতো একটা বাড়ি বসাতে পারলেই হলো, অজ্ঞান দেহটাকে রাস্তার পাশে ফেলে, গড়িটা নিয়ে সোজা অন্য স্টেটের দিকে ছুটবে। হতচ্ছাড়া ফেয়ারভিল চুলোয় যাক!

রাস্তাটা এবড়ো খেবড়ো। বোর ভয় হলো, বাজে রাস্তায় আনার জন্য নান আবার কিছু বলে না বসে। কিন্তু দেখা গেল, ভয়টা অমূলক। কিছুই বলল না মহিলা। এদিকে ঝড়টাও কমে আসতে শুরু করেছে। এখন কায়দা করে সিস্টারকে ভ্যান থামাতে বাধ্য করতে পারলেই…কেল্লা ফতে। সামনেই গাছের সারি দেখা যাচ্ছে। মোটামুটি বড়…অন্ধকার…একেবারে নিখুঁত জায়গা। কাজে নেমে পড়তে হয়।

কিন্তু যখন কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুলল, মনে হলো ওর গলা তলোয় ভরে আছে। কথা বেরোতে চাচ্ছে না। তীরে এসে তরী ডুবাস নে, নিজেকেই বকল। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে এগিয়ে দিল সিস্টারের দিকে। ধুমপান করলে কি খুব অসুবিধা হবে?

এমনভাবে আঁতকে উঠল সিস্টার যে বোর মনে হলো, কোনও বাজে কথা বলে বসেছে! কিন্তু হাল্কা আলোয় বুঝতে পারল, সিস্টার হাসছে!

ম্যাচ আছে আপনার কাছে? জানতে চাইল মহিলা।

হায় যিশু, কী বোকার মত প্রশ্ন! কথা না বলে, সরাসরি বের করে দেখিয়ে দিল ও। একটু যদি গাড়ির গতি কমাতেন, তাহলে আগুন ধরাতে সুবিধা হতো

অবশ্যই। বলে একদম গাছ ঘেঁষে গাড়ীটা থামাল নান। অসাধারণ সৌভাগ্য যাকে বলে!

আরেকবার মনে মনে কর্মপন্থা গুছিয়ে নিল বো কেলার-প্রথমে আগুন ধরাতে হবে, এক-দু টান দিয়েই মহিলার মুখের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে হবে শলাটা। চমকে সরে যেতে চাইবে সিস্টার, এমনকি আত্মরক্ষার্থে হাতদুটো সামনেও নিয়ে আসতে পারে। ঠিক তখন পাকস্থলীর ওপর একটা বিরাশি সিক্কা বসিয়ে দিতে হবে। ব্যথায় যখন দূর্বল হয়ে আসবে মহিলার প্রতিরক্ষা, ঠিক তখন শেষ আঘাতটা হানবে চোয়ালে।

জলবৎ তরলং।

হাত দিয়ে আড়াল করে, আগুন ধরালো বো। আগুনের ঝলসানিতে এক মুহূর্তের জন্য চোখ ধাধিয়ে গেল ওর। সিস্টারকেও তাই দেখতে পেল না। জানে না, ঠিক সেই মুহূর্তে একটু আগের শান্ত শিষ্ট নান দুই পায়ের ফাঁকে হাত গলিয়ে লোহার একটা রড তুলে এনেছে…

.

০৮.

সময়ের হিসাব হারিয়ে ফেলেছেন ক্লেইবর্ন। মনে হচ্ছিল, যুগ যুগ পর এসে উপস্থিত হলো হাইওয়ে পেট্রোল। ততক্ষণে অবশ্য বৃষ্টি পড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তিন জনের একটা দল এসেছে। ড্রাইভারকে গাড়িতে রেখে নেমে এল অন্য দুজন। ক্লেইবনকে সদর দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সেদিকেই এগোল। অল্প কথায় সারা হলো পরিচয়-পর্ব। বিশালদেহী, ধূসর চুলের লোকটা নিজের নাম জানালো ক্যাপ্টেন বেনিং, আর অন্য জনকে পরিচয় করিয়ে দিল নোভতনি বলে।

বেনিং লোকটাকে যথেষ্ট দক্ষ বলেই মনে হলো ক্লেইনের। লবিতে প্রবেশের আগেই, প্রশ্নবাণে তিনি জর্জরিত করে ফেললেন ক্লেইবর্নকে। নোভতনিকে বলেছেন সে যেন রিসিপশনিষ্ট, মানে ক্লারার সাক্ষাৎকার নিয়ে ফেলে। বেনিং আর ক্লেইবন সরাসরি এলিভেটরের কাছে চলে গেলেন।

দেরি করার জন্য দুঃখিত। এলিভেটরে উপরে উঠতে উঠতে বললেন বেনিং। অ্যাক্সিডেন্টের খবর শুনেছেন?

অ্যাক্সিডেন্ট? কোন অ্যাক্সিডেন্ট?

বাস অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, মনট্রোসের ঠিক বাইরে। এখন পর্যন্ত সাত জন মারা গিয়েছে, আরও বিশ জনের মতো হয়েছে আহত। এই কাউন্টির সব গুলো ইউনিট এখন ওখানে-শেরিফের ডিপার্টমেন্ট, অ্যাম্বুলেন্স, আমাদের লোক, সব ওখানে। তার উপর ঝড়ের কারণে বিদ্যুৎ খালি আসছে আর যাচ্ছে। আমাদেরকে। যে পেয়েছেন, তাই আপনার কপাল!

মন দিয়ে শুনলেন ক্লেইবর্ন, জায়গামতো মাথাও দোলালেন। কিন্তু ক্যাপ্টেনের কথা কেন যেন উপলব্ধি করতে পারছিলেন না। তার কাছে এই মুহূর্তে এই লাইব্রেরি আর ওতে থাকা লাশটা ছাড়া আর কোনও কিছুর গুরুত্ব নেই।

জিজ্ঞাসাবাদের পর্বটাও ওখান থেকেই শুরু হলো। ক্লেইবর্নের আদেশে ওটিস একটা চাদর এনে লাশটাকে ঢেকে রেখেছিল। এখন বেনিং তাদের দুজনকেই জিজ্ঞাসাবাদ করা শুরু করে দিলেন। জিজ্ঞাসাবাদের মাঝামাঝি এসে, ওটিসকে তিনি পাঠিয়ে দিলেন অ্যালেনকে ডেকে আনার জন্য। লোকটা এসে জানাল, পুরো হাসপাতাল এরিয়া ভালমতো খুঁজে দেখা হয়েছে। ক্লেইবর্নের আদেশ অনুসারে, পুরো চিরুনি অভিযান চালানো হয়েছে ভেতরে!

শুধু শুধু সময় নষ্ট হয়েছে। বললেন বেনিং। আপনার রোগী এই ভিক্টিমের পোশাক পরে, সদর দরজা দিয়েই বেরিয়ে গিয়েছে। সম্ভবত সিস্টাররা যে ভ্যানে এসেছে, সরাসরি ওটার দিকেই গিয়েছে।

কিন্তু সিস্টার কুপারটাইনও তো ভ্যানে করেই চলে গিয়েছেন, বললেন ক্লেইবর্ন। তার তো অন্তত বুঝতে পারার কথা।

ক্যাপ্টেন- আরেক উর্দিপড়া অফিসার এসে বেনিংকে ডাকল। গাড়িতে রয়ে গিয়েছিল যে লোকটা, সে-ই এসেছে।

কী হয়েছে? জানতে চাইলেন ক্যাপ্টেন। একটু আড়ালে চলে গেলেন ওরা দুজন।

নতুন আসা অফিসারের উত্তরটা পরিষ্কার শুনতে পারলেন না ক্লেইবন। কিন্তু বেনিং-এর প্রতিক্রিয়া একদম পরিষ্কার শোনা গেল। জেসাস এইচ. ক্রাইস্ট!

ক্লেইবন তার কাছে গিয়ে জানতে চাইলেন, কী সমস্যা?

ভ্যানটা পাওয়া গিয়েছে, জ কুঁচকে জবাব দিলেন বেনিং। একটা পার্শ্ব রাস্তার মুখে পরিত্যক্ত পড়ে আছে ওটা। এক ভ্রাম্যমান সেলসম্যান ওটা দেখতে পেয়ে ফায়ার ডিপার্টমেন্ট ফোন দিয়েছে

ফায়ার ডিপার্টমেন্ট? কেন, ফায়ার ডিপার্টমেন্টে ফোন দিল কেন?

আমি যখন জানতে পারব, উত্তর দিলেন বেনিং। তখন নাহয় আপনাকে জানাব।

আমি কি আপনার সাথে আসতে পারি? জানতে চাইলেন ক্লেইবন। গাড়ি বাইরেই আছে।

ইচ্ছা হলে আসতে পারেন। বললেন বেনিং।

দুজন অফিসারকে রেখে যাওয়া হলো বাকিদের সাক্ষাৎকারের পালা শেষ করার জন্য। সেই সাথে সিস্টার বারবারার লাশ নিয়ে যাবার জন্য একটা অ্যাম্বুলেন্সও ডাকা হলো।

ভেজা, পিচ্ছিল রাস্তায় বেশ কিছুক্ষণ গাড়ি চালাবার পর, উদ্দিষ্ট লক্ষ্যে এসে পৌঁছালেন ক্লেইবন। ফায়ার ডিপার্টমেন্ট কেন ডাকা হয়েছে, তা আর তাকে বলে দেবার কোনও দরকার রইল না। বৃষ্টির পর, সচারচর হাইওয়ের বাতাস পরিষ্কার আর ঠান্ডা থাকে। কিন্তু আজকে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে পোড়া গন্ধ। সামনে তার উৎসও দেখা যাচ্ছে। দুটি গাড়ির আলোতে দেখা যাচ্ছে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে তৃতীয় আরেকটা গাড়ি। দেখার সাথে সাথে ভ্যানটাকে…নাহ, ভুল হলো…ভ্যানটার ধ্বংসাবশেষকে চিনতে পারলেন ক্লেইবর্ন। উইন্ডশীল্ড বলতে কিছু অবশিষ্ট নেই। ক্যাবের পোড়া ছাদে ইয়া বড় একটা গর্ত। দরজাগুলো আস্ত নেই। পেছনের দরজা মাটিতে ঠাঁই নিয়েছে। সামনের হুডটা যেন অস্বীকৃতি জানিয়েছে, সে আর ইঞ্জিনকে রক্ষা করতে পারবে না। অবশ্য ইঞ্জিনের মাঝে রক্ষা করার মতো কোনও কিছু অবশিষ্ট নেই। গল গল করে ধোয়া বেরোচ্ছে ওখান থেকে।

গাড়ী পার্ক করে ভ্যানের পাশে এসে ক্লেইবর্ন দেখতে পেলেন, বেনিং ভ্যানের সামনের দিক থেকে ফিরে আসছেন।

গ্যাস ট্যাঙ্ক বিস্ফোরিত হয়েছে। ডাক্তারের কাছে এসে বললেন তিনি।

অ্যাক্সিডেন্ট?

বলা মুশকিল, তবে ইচ্ছা করেও আগুন লাগানো হতে পারে। ফায়ার ডিপার্টমেন্ট নিশ্চিত করে বলতে পারবে, যদি এখানে আসার সুযোগ পায় আরকী!

টায়ার পোড়া দূর্গন্ধ নাকে যেতেই, ক্লেইবর্নের পাকস্থলী বিদ্রোহ করে উঠল। আপনার কী মনে হয়?

কোথাও কোনও গোলমাল আছে। আগুন যখন ধরে, তখন ভ্যানটা পার্ক করা ছিল। ব্রেকটা তখনও রিলিজ করা হয়নি। তাছাড়া দেখে মনে হচ্ছে, আগুনটার সূত্রপাত হয়েছিল সামনের দিকে। তাহলে এর আরোহীরা ট্যাঙ্ক ফাটার আগেই বেরিয়ে পড়ল না কেন?

শক্ত হয়ে গেলেন ক্লেইবন। আরোহীরা? সামনের দিকে যাবার জন্য পা ফেললেন তিনি, কিন্তু বেনিং হাত তুলে বাঁধা দিলেন।

দেখে লাভ নেই, বলে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে সেলসম্যানের দিকে ইঙ্গিত করলেন ক্যাপ্টেন। বেচারা ক্রমাগত বমি করে চলছে। ওর মতো অবস্থা হবে।

আমার জানা দরকার।

ঠিক আছে, ডক। যান তাহলে। হাত সরিয়ে নিলেন বেনিং। কিন্তু পরে বলবেন না যে আমি সাবধান করে দেইনি।

ভ্যানের সামনের সীটের দিকে উঁকি দিয়ে তাকালেন ক্লেইবন। সীট থেকে চামড়া গলে খসে পড়েছে। পোড়ার গন্ধটা এখানে অনেক তীব্র। তবে সেই সাথে আরও একটা গন্ধ আছে…মাংস পোড়ার গন্ধ!

গন্ধের উৎসটাও দেখতে পেলেন। মেঝেতে কালো রঙের একটা চাই পড়ে আছে, দুই পাশে দুটো প্রবর্ধিত অংশ সাথে নিয়ে। প্রবল কল্পনাশক্তি না থাকলে, ওটাকে কেউ মনুষ্যদেহ বলে ভুল করবে না। চোখ নেই, নাক নেই, নেই কোনও চুল বা চামড়ার বিন্দুমাত্র অংশ! একদা যেখানে মুখ ছিল, এখন সেখানে শুধুই একটা গর্ত…জিহ্বাহীন। যেন মৃত্যুর আগ মুহূর্তে চিৎকার করার জন্য মুখ খুলেছিল এই কালো চাই রূপী দেহটার মালিক।

এবার সীটের পেছন দিকে চাইলেন তিনি, এখানেও আরেকটা কালো চাই ছায়ার মাঝে শুয়ে আছে। গরুর একপাশ বারবিকিউ করলে যেমন হয়, তেমনটা দেখাচ্ছে এই লাশটাকে। মাথা অনুপস্থিত, ট্যাঙ্কের বিস্ফোরণ ওটাকে জায়গামতো থাকতে দেয়নি। কেবলমাত্র একটা নিদর্শন দেখে বোঝা যাচ্ছে, ওটা কোনও মহিলার পোড়া দেই- যোনীপথের পোড়া গর্ত।

বড় বড় শ্বাস নিতে নিতে পিছিয়ে এলেন ক্লেইবন। বেনিং যে ওর দিকে জ্ব কুঁচকে তাকিয়ে আছেন, তা পরিষ্কার টের পাচ্ছে। ঠিক বলেছেন। অনেক কষ্টে নিজের উপর কিছুটা নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়ে বললেন তিনি। দেখে একদম লাভ নেই। ময়না তদন্ত দরকার।

সময় লাগবে ওতে। ওই অ্যাক্সিডেন্টের কারণে, করোনার এই লাশগুলো ধরার সময় আপাতত পাবে না। কিন্তু এখানে আসলে কী ঘটেছে, তা সম্ভবত বুঝতে পারছি। চিবুক ঘষলেন ক্যাপ্টেন। সিস্টার কুপারটাইনকে হয় খুন করে, নয়তো অজ্ঞান করে ভ্যানের পেছনে ফেলে রাখা হয়েছিল। এরপর নরম্যান ভেবেছিল, হাইওয়ে থেকে কোনও পুরুষকে তুলে নিয়ে–

দাঁড়ান, দাঁড়ান, এবার ক্লেইবর্নের ভ্রু কুঁচকাবার পালা। একটু আগে বললেন, এই বীভৎস দৃশ্যের কারণ স্বেচ্ছায় আগুন দেয়া না অ্যাক্সিডেন্ট, তা আপনি জানেন না। এখন বলছেন, এখানে একটা খুন হয়েছে!

খুন যে হয়েছে, তাতে এক বিন্দু সন্দেহ নেই। বেনিং উত্তর দিলেন। পেছনে দেহটা দেখেই তা বোঝা যায়। মারা না গেলে বা অন্তত অজ্ঞান না হলে, সিস্টার কুপারটাইন বেরোবার চেষ্টা করতেন না?

কিন্তু ট্যাঙ্কের বিস্ফোরণ কেন হলো, তা আমরা কেউ জানি না। আচমকা হতে পারে না? বললেন ক্লেইবর্ন।

নিচে ঝুঁকে একটা ধাতব সিলিন্ডার তুলে ধরলেন বেনিং। এই যে আপনার প্রশ্নের উত্তর। একটু আগে গ্যাসোলিনের এই ক্যানটা রাস্তার উপরেই খুঁজে পেয়েছি। ইচ্ছা করেই আগুন লাগানো হয়েছে এখানে। সম্ভবত প্রমাণ ধ্বংসের জন্য। কিন্তু কাজ ঠিকভাবে সারার আগেই কোনও সমস্যা হয়ে যায়। নিজেকে ভ্যানের সামনে রেখেই, নরম্যান বেটস আগুন ধরিয়ে দেয়।

তার মানে…সামনের ওই কালো চাইটা আসলে নরম্যান! ক্যাপ্টেন বেনিং-এর কথা অনুসারে, তাই তো দাঁড়ায়।

না!

মানে? উত্তর না দিয়ে একদৃষ্টিতে বেনিং-এর দিকে তাকিয়ে রইলেন ডাক্তার। কেননা দেবার মতো কোনও উত্তর নেই তার কাছে। কী বলবেন? বললেন যে, এতোগুলো বছরের পেশাগত অভিজ্ঞতা, রোগীর সাথে মেলামেশা করার অনুভুতি তাকে অন্য কোনও সত্যের দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে?

হতাশ হয়ে মাথা নাড়লেন বেনিং। খাপে খাপে মিলে যায় কিন্তু, ডক। আমরা জানি, নরম্যান এই ভ্যানে চড়ে পালিয়েছিল। এ-ও জানি যে সিস্টার কুপারটাইন সে সময় তার সাথে ছিলেন। বোঝাই যাচ্ছে, প্রথমে ছদ্মবেশী নরম্যানকে চিনতে পারেননি তিনি। যখন পারেন, তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। লোকটা তাকে আঘাত হেনে অজ্ঞান করে বা মেরে ফেলে। এরপর ভুল করে গ্যাসোলিনের সিলিন্ডারে আগুন ধরিয়ে ফেলে। এছাড়া আর কী হতে পারে?

আমি… বললেন ক্লেইবন। আমি জানি না।

তাহলে আমার কথাই সত্য বলে ধরে নিন। বেটস মারা গিয়েছে—

সাইরেনের তীব্র শব্দে ক্যাপ্টেনের বাকি শব্দ গুলো চাপা পড়ে গেল। দূর থেকে জ্বলতে-নিভতে থাকা আলো এদিকেই এগিয়ে আসছে। কিছুক্ষণের মাঝেই এসে উপস্থিত হলো ফায়ার ট্রাক।

ঘুরে দাঁড়িয়ে সেদিকেই রওনা দিলেন বেনিং।

ইতস্তত করলেন ক্লেইবর্ন, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফায়ার ডিপার্টমেন্টের লোকদের জ্বলন্ত গাড়ির পাশে গিয়ে দাঁড়ানো দেখছেন। ক্যাপ্টেন বেনিং-এর সাথে সাথে এগিয়ে গেল সেলসম্যান লোকটাও, সদ্য আগত দলের নেতার সাথে আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

এখন প্রচুর কথা আর আলোচনা চলবে, কেননা এছাড়া আর কার-ই বা কী আর আছে! সত্ত্বর একটা অ্যাম্বুলেন্স এসে সরিয়ে নিয়ে যাবে লাশ দুটোকে, কিন্তু অর্থহীন আলোচনা চলতেই থাকবে। ক্লেইবর্নের তা আরেকবার শোনার কোনও দরকার নেই। জবানবন্দী দেয়া শেষ, তার উপস্থিতি আর প্রয়োজনীয় নয়। ময়নাতদন্তের কাজটা নাহয় করোনারের জন্যই তোলা থাক। গাড়িতে উঠে ইঞ্জিন চালু করেন দিলেন। কেউ তার এই আচমকা বিদায় নেয়াটা লক্ষ্য করবে বলে মনে হলো না।

হাইওয়েতে উঠে কিছু দূর এগোতেই মিলিয়ে গেল পোড়া গন্ধটুকু। তবে চোখের সামনে থেকে পোড়া, কালো দুটো মরদেহের দৃশ্য গেল না। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ময়না তদন্ত নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। কিন্তু মনে মনে নিজের ময়না

তদন্ত ঠিক চলতে লাগল। এতক্ষণ নিজেকে নিষ্পাপ মনে করছিলেন, আর পারলেন না। কেননা, নরম্যান মারা গিয়েছে। আর সে জন্য এক হিসেবে তিনিই দায়ী! কেন তিনি সিস্টার বারবারাকে নরম্যানের সাথে দেখা করার অনুমতি দিয়েছিলেন? ভুল করে ফেলেছেন। আর সেই ভুলের প্রায়শ্চিত করতে হয়েছে ওই দুজনকে মারা গিয়ে। এমনকী সিস্টার কুপারটাইনের মৃত্যুর জন্যও তিনি দায়ী।

তবে সবচাইতে বড় আফসোসের কথা হচ্ছে, নরম্যানকে হতাশ করেছেন তিনি। ডাক্তার হিসেবে তার রোগ নির্ণয় আর তার প্রতিকারের অদক্ষতার কারণেই এই ঘটনাটা ঘটেছে।

হাইওয়েতে উঠার পর থেকে অনেকটা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই চলছে গাড়ি। নির্মল বাতাস কিছুটা হলেও ক্লেইবর্নের মাথাকে শান্ত করে তুলেছে। ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে পারছেন তিনি। আসলেই ওই ভ্যানে নরম্যানের মৃত্যু হয়নি, হয়েছে তার নিজের মৃত্যু। তার স্বপ্নের, তার আশা-আকাংখার। বই লেখার চিন্তাটা এখন শুধু তা-ই হয়ে রইল, কেবল-ই এক চিন্তা। তিনি জানতেন, নরম্যানের কেসটা এই একটা কারণেই এতোটা গুরত্ব দিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। চেয়েছিলেন ওটা নিয়ে একটা বই লিখতে। যে বইয়ের হাত ধরে আসবে নাম, যশ, খ্যাতি আর অর্থ। মুক্তি মিলবে স্টাইনারের হাত থেকে, একঘেয়ে এই জীবনের হাত থেকে। এক হিসেবে, নরম্যানের মতো তিনিও ছিলেন ওই হাসপাতালের বন্দি। বইটা তাকে মুক্ত করে দিতে পারত।

খুব কাছাকাছি এসেও গিয়েছিলেন সেই মুক্তির। অনেক দিন লোকটার সাথে কাজ করেছেন তিনি। ভেবেছিলেন, নরম্যানকে বুঝতে পেরেছেন। এমন ভুল কেন করলেন তিনি! গর্ব…অহংকার…বিজ্ঞানের প্রতি অগাধ বিশ্বাস…।

ভুলটাও হয়েছে সেখানেই, মাঝে মাঝে বিজ্ঞানের উপরে অনুভূতিকে স্থান দিতে হয়। যেমন এখন তার মনে হচ্ছে, নরম্যান এখনও বেঁচে আছে!

অন্য কারও কাছে কথাটা হাস্যকর বলে মনে হতে পারে। কিন্তু বেনিং-এর ব্যাখাটাও কি হাস্যকর নয়? ওই লোকটার মাঝেও গর্বের ছায়া দেখতে পেয়েছেন। ডাক্তার ক্লেইবর্ন। তর্কের খাতিরে নাহয় ধরে নেয়া গেল যে, নরম্যানই ভ্যানে গ্যাসোলিন ঢেলেছে। কিন্তু তাই বলে আগুন ধরাবার আগে সে ড্রাইভিং সীটে কেন গিয়ে বসবে? নরম্যান বোকাও না, আত্মহত্যাপ্রবণও না। অন্য কোনও ব্যাখ্যা নিশ্চয় আছে পুরো ঘটনাটার।

আচ্ছা, তৃতীয় কোনও পক্ষ জড়িত নেই তো এখানে? নাহ, তৃতীয় পক্ষ আবার কোত্থেকে আসবে! বোকার মতো ভাবছি, নিজেকেই বললেন ক্লেইবর্ন। নাকি এটা কোনও আশা? নরম্যান যদি বেঁচে থাকে, তাহলে এখনও….

জোর করে মনোযোগ সামনের রাস্তার দিকে ফেরালেন তিনি। ঠিক সেই মুহূর্তেই রাস্তার বাঁ দিকে কিছু একটা পড়ে থাকতে দেখলেন। গতি কমিয়ে, জিনিসটার একেবারে পাশে এসে গাড়ি থামালেন ক্লেইবর্ন। বেরিয়ে এসে কাছ থেকে ওটাকে পরীক্ষা করতে বেশিক্ষণ লাগল না। রুক্ষভাবে হাতে বানানো একটা সাইন! এমনকী শব্দগুলোও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছেঃ ফেয়ারভিল।

খাপে খাপে মিলে গেল সবকিছু। হ্যাঁ, সম্ভব। এখানে ভ্যানটা থেমেছিল হয়তো…হয়তো নরম্যান তুলে নিয়েছিল কোনও পথচারীকে। তাহলে অবশ্য কাঁদায় চাকার দাগ থাকবে। দাগের খোঁজে আশেপাশে তাকালেন তিনি। কিন্তু পানি ছাড়া আর কিছু দেখা গেল না। যে বৃষ্টি হয়েছে, তাতে রাস্তায় চাকার দাগ থাকবে-তা আসলে দুরাশা। অবশ্য তাতে কিছু যায় আসে না। একমাত্র সত্যটা ছাড়া আসলে আর কিছুই যায় আসে না।

অনুভূতির উপর আস্থা রাখো।

আসলেই তৃতীয়পক্ষের উপস্থিতি ছিল এই ঘটনায়! আর তৃতীয় পক্ষ থাকা মানেই, যেকোনও কিছু ঘটা সম্ভব। হয়তো ভ্যানের সামনে থাকা মৃতদেহটা আসলে এই পথচারীর! সাইনটা তুলে নিয়ে, গাড়িতে চড়ে বসলেন ক্লেইবর্ন।

ঘুরছে গাড়ির চাকা, সেইসাথে ডাক্তারের মস্তিষ্কের চাকাও। ইউ-টার্ণ নিলেন আচমকা, ফেয়ারভিলের দিকে রওনা দিলেন। ভ্যানটা জ্বালিয়ে দেবার পর, নরম্যানের সেদিকেই যাবার কথা। যে মানুষটা অপরিচিতদের এমনভাবে খুন করতে পারে, সে নিশ্চয় পুরনো শত্রুদের ছেড়ে কথা বলবে না। নরম্যান কাকে পুরনো শত্রু ভাবে, সে কথাও জানেন তিনিঃ স্যাম আর লিলা লুমিস, ফেয়ারভিলেই থাকে। এক মুহূর্তের জন্য দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভরে গেল ক্লেইবর্নের মন। তিনি কি বেনিং-কে সবকিছু জানাবেন? কিন্তু লাভ কী তাতে? আবার সেই কথা বলে বলে ক্যাপ্টেনকে বোঝাতে হবে, ফলাফল কী হতে পারে তা তো তিনি জানেন। অবশ্য ক্যাপ্টেনকে দোষ দিয়েই বা লাভ কী? দাবীর স্বপক্ষে কোনও প্রমাণ দিতে পারবেন না ডাক্তার ক্লেইবন।

কিন্তু তিনি জানেন, নরম্যানের মনে কী চলছে, সে কথা বোঝার ক্ষমতা তার আছে। সময় নষ্ট করে তাই লাভ নেই। অ্যাক্সিলেটর দাবিয়ে বসল ক্লেইবর্নের পা। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন তিনি।

এদিকে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সাইনবোর্ড তাকে যেন চিৎকার করে জানাচ্ছে– ফেয়ারভিল : ১২ মাইল।

.

০৯.

নীরব, মৃত্যুর মতো নিস্তব্ধ রাস্তা ধরে এগোচ্ছে নরম্যান। ঝড় খুন করেছে শহরটাকে। এরকম ঝড়…আর প্রতি রবিবার রাতে ফেয়ারভিলের মতো ছোট ছোট শহরের মৃত্যু হয়। রবিবার সূর্য ঢালার সাথে সাথে মৃত্যু এসে হাজির হয়। বন্ধ হয়ে যায় প্রধান সড়কের সবগুলো দোকান, পার্কিং স্পেসগুলো খা খা করতে থাকে। আর যদি কোনও প্রাণ অবশিষ্ট থেকেও থাকে, তাহলে তারা আশ্রয় নেয় বন্ধ জানালার ওপাশে। স্যাম আর লিলাও নিশ্চয় নিজ ঘরে আশ্রয় নিয়েছে। স্যাম, হার্ডওয়্যার স্টোরের মালিক। আর লিলা তার স্ত্রী। সেই সাথে মেরি ক্রেনের বোন-ও। মেরি আচমকা উধাও হয়ে যাবার পর, বোনের খোঁজে ফেয়ারভিলে এসেছিল মেয়েটি। স্যামের সাথে যে বোনের প্রেম আছে, তা জানত বলে সরাসরি লোকটার কাছেই খোঁজ নিতে গিয়েছিল। এই দুজন নাক না গলালে, নরম্যানকে ধরা পড়তে হতো না।

মেরি ক্রেন আর তাকে খুঁজতে আসা গোয়েন্দা, দুজনেরই ব্যবস্থা করে ফেলেছিল ও। তাদেরকে কবর দিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এই স্যাম আর লিলা এসে বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিল সবকিছুর। ওকেই উল্টা আটকা পড়তে হয়েছে এই কররূপী হাসপাতালে। মৃত্যুর চাইতেও ভয়াবহ সেই শাস্তি।

অথচ যে অপরাধে নরম্যানকে আটকে রাখা হয়েছিল, সে অপরাধ তো ও করেইনি! করল মা, আর সাজা পেতে হলো ওকে? মা-ই তো ওর আত্মা আর দেহটাকে দখল করে নিয়ে খুনগুলো করেছে। নরম্যানকে যে দায়ী করা চলে না, সে কথা তো সবাই একবাক্যে স্বীকার করে। কেননা দায়ী হলে ওর বিচার হতো। অথচ বিনা বিচারেই এতোগুলো বছর ওই…ওই…জেলখানায় পচতে হয়েছে ওকে। আর স্যাম এবং লিলা? মুক্ত হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে তারা। বিয়ে করে সুখে দিন কাটাচ্ছে।

অনেক কেটেছে সুখের দিন…

আর না।

আজকেই সুখের দিনের ইতি টানবে নরম্যান।

না, নতুন করে পাগল হয়নি ও। এখন মানসিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ। আর নরম্যান নিজেই-ওর মা না-ওর প্রতি কৃত অপরাধের সাজা দেবে সবাইকে। ঈশ্বরকে…নাহ, ডা. ক্লেইবর্নকে ধন্যবাদ। তিনি না থাকলে, নরম্যান আজ এখানে থাকত না… নিশ্চিত করতে পারত না ন্যায় বিচার।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, ন্যায় বিচারই এটা। প্রতিশোধ না। ওর জায়গায় ডা. ক্লেইবন হলেও নিশ্চয় এমনটাই ভাবতেন। কেননা এই দুজনের সাক্ষ্যের কারণেই হাসপাতালে আটকা থাকতে হয়েছে ওকে। অথচ নরম্যানের ব্যাপারে মন্তব্য করার ওরা কে? মেয়েটা তো বোনের প্রেমিকের বিছানা গরম করতে ব্যস্ত। আর প্রেমিক প্রবর? তার মুখে অন্ন জোটে মানুষ বা পশু খুন করার সরঞ্জামাদি বিক্রি করে। খুনি, কসাই আর মৃত্যুর ব্যবসায়ী তো ওই স্যাম লুমিস। অথচ ভুগতে হচ্ছে। নরম্যানকে! এ কেমন বিচার!

ন্যায় বিচার চাইবার জন্য কি ওকে দোষ দেয়া চলে?

কিন্তু প্রধান সড়ক মৃতপ্রায় আর পার্শ্ব রাস্তাগুলোও অন্ধকারাচ্ছন্ন। স্যাম আর লিলা ওর কাছ থেকে আত্মগোপন করে রয়েছে নিশ্চয়। কে জানে, হয়তো পর্দার আড়ালে লুকিয়ে ঠক ঠক করে কাঁপছে! কিন্তু কোন বাড়িতে? কোন পর্দার পেছনে?

শত্রুদেরকে খুঁজে পাবে কোথায়? প্রতিটা দরজায় তো আর নক করে দেখা সম্ভব না। দুই রাস্তার সংযোগ স্থলে এসে থমকে দাঁড়াল নরম্যান, ভ্রূ কুঁচকে আছে। এখন পর্যন্ত কারও নজরে পড়েনি ও, কিন্তু এই সৌভাগ্য যে কতক্ষণ থাকবে তা বলা মুশকিল। পলাতক এক মানুষ সে, ওকে খুঁজতে খুব শীঘ্রই অনেকের এসে পড়ার কথা। কিছু করতে চাইলে, এখনই করতে হবে। কিন্তু কী যে করবে…

ঠিক সেই মুহূর্তেই রাস্তার ওপাশের ফিলিং স্টেশনের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা ফোন বুথটা নজরে পড়ল ওর। পেয়ে গেছে সমাধান। প্রথমে ফোন ডিরেক্টরি খুঁজল। কিন্তু কপাল মন্দ, যেখানে বইটা থাকার কথা, সেখানে শুধুই শূন্যতা। তথ্যের জন্য এখন অপারেটরকে জিজ্ঞাসা করতে হবে। কিন্তু সমস্যা হলো, আজকালকার দিনে কেউ বাড়ির ঠিকানার জন্য অপারেটরকে ফোন করে না। আর এরকম একটা ছোট শহরে খবর বাতাসের চেয়ে দ্রুত বেগে ছড়ায়। ও ফোন নামিয়ে রাখার এক মিনিটের মাঝে নিশ্চয় অপারেটর সরাসরি স্যাম বা লিলাকে খবরটা জানিয়ে দেবে। তাই মত পাল্টাল নরম্যান।

দুই রাস্তার সংযোগস্থলে ফিরে এলো আবার। এখানে একটা পানশালা আছে। ওটাকে পার হয়েই একদম থমকে দাঁড়াল সে। রবিবারের আইন মেনে বন্ধ হয়ে আছে পানশালাসহ প্রায় সবগুলো দোকান। তবে একটা জানালায় এখনও আলো জ্বলছে। লুমিস হার্ডওয়্যার-জ্বলজ্বল করে ধরা দিল ওর সামনে।

আছে, ভেতরে আছে কেউ একজন। শিকারী বাঘের মতো নিঃশব্দে দোকানের দিকে এগোল নরম্যান বেটস।

.

১০.

ঘটনাটা যখন ঘটে, তখন লিলা লুমিস তার ঘরেই বসে ছিল, অন্ধকার লিভিংরুমে বসে টেলিভিশনে দেখছিল বাজে কোনও একটা গেম শো। নিজ ইচ্ছায় চ্যানেলটা ঘুরায়নি সে। ঝড়ের কারণে রিসেপশন এতোটাই বাজে যে এই চ্যানেল পাঁচ ছাড়া আর কোনও চ্যানেলই আসছে না। অন্তত বাইরের ঘটনা ভুলে থাকার তো একটা উপায় পাওয়া গেল।

গেম শোটা যেমন বাজে, তেমনি বাজে ওতে অংশগ্রহণকারীরা।

লিলা শুনতে পেল, গেম শোর সঞ্চালক বলছে :

এবারের প্রশ্ন আমাদের জ্যাকপটের জন্য! নগদ এক হাজার ডলার, একেবারে নতুন ফোর্ড গ্যালাক্সি আর আকাপুলকো হিলটন হোটেলে দুই সপ্তাহের সম্পূর্ণ ফ্রি অবকাশের জন্য আমাদের প্রশ্ন হলো- জ্যাকি ওনাসিসের কুমারী নাম কী?

মিনি শোয়ার্টজ, বিড়বিড় করল লিলা। টিভিতে চলতে থেকে একটা গেম শোর উত্তর দিয়েছে বুঝতে পেরে আপন মনেই হাসল। এর কোনও মানে হয়? হয় না। অবশ্য আজকাল সবাই এই কাজটা করে, আর কয়েক বছর পর দেখা যাবে-সবাই কেবল টিভির সাথেই কথা বলছে।

উঠে রান্নাঘরে যাবে, এমন সময় সন্ধ্যার খবর শুরু হয়ে গেল। পুনরায় বসে, মন দিয়ে খবর শোনার সিদ্ধান্ত নিল সে। প্রায় পুরোটা জুড়েই ছিল ঝড়ের সংবাদ আর প্রধান সংবাদে পাঠক বলছিল মনট্রোসে ঘটা কোনও বাস অ্যাক্সিডেন্টের কথা। কপাল ভালো, লিলার বিক্ষিপ্ত মনকে আরও বিক্ষিপ্ত করে দেয়ার মতো কোনও দৃশ্য দেখানো হলো না খবরে। তবে খবর পাঠক জানালো, রাত এগারোটার দিকে অ্যাক্সিডেন্টের ভিডিও দেখানো হবে। দেখা যাবে না, মনে মনে ভাবল লিলা। বাচ্চামি হয়ে গেল হয়তো, কিন্তু মৃত্যু আর লাশের ভয়াবহ দৃশ্য আর দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে না।

নাহ, বাচ্চামি না। অন্তত লিলা লুমিসের অধিকার আছে মৃত্যু দৃশ্যকে ঘৃণা করার। হ্যাঁ, ঘটনাটা অনেক বছর আগে ঘটেছে। হ্যাঁ, ওর বোন আর গোয়েন্দাকে যখন খুন করা হয়েছিল, তখন ও সেখানে ছিল না। কিন্তু নরম্যানকে ছোরা হাতে নিজ চোখে দেখেছে সে। আর সেই দৃশ্য ওর মনে যে ভয়ের উদ্রেক করেছিল, তা মিটে যায়নি পরবর্তী অনেক বছরেও। স্যাম লুমিসের আলিঙ্গনে কাঁপতে কাঁপতে অগণিত রাত দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে উঠতে হয়েছে তাকে। ওকে শান্ত করার জন্য কখনও কখনও স্যামের বিছানার পাশে থাকা লাইটটাও জ্বালাতে হয়েছে।

কথাগুলো মনে পড়তেই লিলার মনে হলো, স্যাম এখন ওর পাশে থাকলে বড় ভালো হতো। কিন্তু সাতটা অনেক আগে বাজলেও, লোকটা এখনও ফেরেনি। হার্ডওয়্যার স্টোরে আছে। আসলে থাকতে বাধ্য হয়েছে বলা যায়, ট্যাক্সের কাগজ-পত্র জমা দেবার সময় এসেছে। তাই আয়-ব্যয়ের হিসাবটা করে রাখাও জরুরী। সমস্যা হলো, মন তো আর মানে না। কাজ জরুরী, কিন্তু তা যে এক সাথে রাতের খাবার খাওয়ার সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এমনকী বাইরে বেড়াতে যাবার সম্ভাবনাও। অবশ্য যে ঝড় হয়েছে, তাতে বাইরে যাওয়ার কথা। কল্পনা করাও বোকামি হয়ে যায়। যাক, ঝড়টা অন্তত বন্ধ হয়েছে।

অন্যমনস্কভাবেই খবর পাঠকের কথা শুনছে সে। হঠাৎ ওর কান খাড়া হয়ে গেল, লোকটা স্টেট হাসপাতাল থেকে পালানো কোনও রোগীর কথা বলছে! সেই রোগী আবার নাকি এক অতিথিকে হত্যাও করেছে।

কর্তৃপক্ষের বিশ্বাস, রোগী ভিক্টিমকে হত্যা করে তার ভ্যান নিয়ে পালিয়েছে। ভিক্টিম এক ধর্মীয় সংগঠন, দ্য লিটল সিস্টারস অফ চ্যারিটি-এর সদস্য ছিল। নরম্যান বেটস নামের রোগীটি এখনও ধরা পড়েনি।

নরম্যান বেটস!

জমে গেল যেন লিলা।

খুন করেছে…পালিয়েছে…এখনও ধরা পড়েনি!

আচমকা যেন লিলার দুনিয়া বরফে জমে গিয়েছে। কোনও কিছু শুনতে পাচ্ছে না ও, দেখতে পাচ্ছে না। মনে হলো আরেকটা দুঃস্বপ্ন দেখছে। কিন্তু না, জেগে আছে মেয়েটি। আর নরম্যান

খবর পাঠকের কথায় আবারও চমকে উঠল সে। ওয়েল্যান্ড নার্সারীর গ্রিনহাউজে বজ্রপাতের ফলে আগুন ধরে গিয়েছে- নরম্যানের খবরটা শোনার পর আর মন দিতে পারেনি লিলা। বজ্রপাতের কথা শুনে এক মুহূর্তের জন্য মনোযোগ অন্য দিকে সরে গিয়েছিল বটে, কিন্তু এখন আবার ওকে দখল করে নিয়েছে লোকটা।

নরম্যান বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে!

স্যামের সাথে কথা বলা দরকার। টিভি বন্ধ করতে করতে নিজেকেই বলল মেয়েটি। অন্ধকারে বাতির কাছে গিয়ে হাত বাড়ালো ওটা জ্বালাবার জন্য। কিন্তু সাথে সাথেই থামিয়ে দিল নিজেকে। যদি লোকটা বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকে?

নাহ, কী সব ভাবছে! ও কোথায় থাকে তা নরম্যান জানবে কী করে? আর যদি জেনেও থাকে, তাহলে আসবে কেন? কোনও যুক্তি আছে এই বোকামির? অবশ্য নরম্যানের মতো উন্মাদদের কাছে যুক্তি বলতে কোনও কথা নেই।

শব্দটা যখন লিলার কানে প্রবেশ করল, তখনও বাতির পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সে। আচমকা সতর্ক হয়ে কান খাড়া করে শোনার প্রয়াস পেল। কিন্তু না, আর কোনও শব্দ হলো না। প্রথমবার শব্দ হয়েছিল কি না, সেটা নিয়েই সন্দেহে পড়ে গেল ও। কিছুক্ষণ পর যখন নিশ্চিত হলো যে ভুল করেছে, তখনই আবার হলো শব্দটা। অস্ফুট কোনও ঘষা খাবার শব্দ। পায়ের শব্দ না তো? ঠিক বুঝতে পারল না লিলা। শুধু বুঝতে পারল, আওয়াজটা বাইরে থেকে আসছে।

চুপিচুপি সামনের জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল মেয়েটি। পর্দাটাকে কম্পিত হাতে এক পাশে সরালো। বড়জোর এক ইঞ্চি হবে, সেই ফাঁক দিয়েই তাকালো। বাইরে। নেই…কিছুই নেই।

রাস্তা খালি, লন খালি, এমনকী ওপাশের রাস্তাটাও ফাঁকা।

আবারও হলো আওয়াজটা, বাড়ির পাশে অবস্থিত গাছটা বাতাসে নড়ার ফলে হয়েছে শব্দটা। উপরের ডালগুলো ছাদের সাথে ঘষা খাচ্ছে।

নরম্যান আসেনি।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল লিলা। সবই ওর কল্পনা তাহলে!

আসলেই তো, নরম্যান ওর খোঁজে আসবে কেন? ও তো আর নরম্যানের শত্রু নয়। নাহ, লোকটা আসবে না এখানে।

কিন্তু প্রায় সাথে সাথে সত্যটা উপলব্ধি করতে পারল মেয়েটি, হাত থেকে খসে পড়ল পর্দা। এখানে কেন আসবে নরম্যান? লিলার সাথে তো কোনও বিরোধ নেই, লোকটার আসল বিরোধ তো স্যামের সাথে!

কাঁপতে কাঁপতে টেবিলের কাছে গিয়ে ফোনটা তুলে নিল ও। অন্ধকারে অনেকটা আন্দাজ করেই স্টোরের নাম্বারে ডায়াল করল। রিং শোনার জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও, পেল না। ঝির ঝির আওয়াজ শুনতে পেল কেবল! ফোন বিজি হবার সিগন্যাল বলে মনে হচ্ছে না। নাকি ঝড়ের কারণে ক্ষগ্রিস্ত হয়েছে লাইনটা?

রিসিভার নামিয়ে রাখল লিলা, বাইরের খসখস আওয়াজটা এখনও থামেনি। ওটার উৎস সম্পর্কে জানা থাকলেও, ভয়ে কেঁপে উঠল। হয়তো…হয়তো এবার নতুন আরেকটা শব্দ যোগ হয়েছে। হয়তো আওয়াজটা গাড়ির ইঞ্জিনের, স্যাম চলে এসেছে হয়তো। রেডিওতে যদি নরম্যান বেটসের পালাবার কথা শুনে থাকে, তাহলে চলে আসবার-ই কথা।

কিন্তু না, ভুল হচ্ছে ওর। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে, হাতঘড়ির দিকে তাকাল লিলা। অন্ধকারে জ্বলজ্বল করতে থাকা ডায়ালগুলো ওকে জানাল-আটটা বাজে।

আটটা বেজে গিয়েছে! রেডিওতে কিছু না শুনে থাকলেও তো এতক্ষণে চলে আসার কথা। যদি না…নাহ, ওসব বাজে কথা ভাববেই না লিলা।

এখন দরকার কোনওক্রমে রান্নাঘরে গিয়ে কাউন্টারের উপরে রাখা পার্সটা নেয়া। এরপর বাইরে কেউ দাঁড়িয়ে আছে কিনা দেখে নিয়ে, বেরিয়ে পড়া।

তাই করল লিলা, রাতের হাওয়া এসে ওর মুখে শীতল স্পর্শ বুলিয়ে দিল। যতদূর দেখা যায়, কেউ নেই। পার্সটা আঁকড়ে ধরে, ফুটপাতে উঠে এল সে। প্রতিবেশির বাড়িটার দিকে তাকাল, অন্ধকারে ছেয়ে আছে। ডেম্পস্টারদেরকে জানাবে কি না, ভাবল একবার। পরক্ষণেই মনে পড়ল, বাড়িতে কেউ নেই র‍্যাভেনউডে মেয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছে। রাস্তার ওপাশের ওরাও নেই, লেকের ধারে ছুটি কাটাতে গিয়েছে।

চোখ-কান খোলা রাখো। ভয় পাওয়ার কিছু নেই-নিজেকে বোঝাল। মাত্র তিন ব্লক দূরেই তো যাচ্ছ।

বলল বটে, কিন্তু উপলব্ধি করল-ভয়ের চোটে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। অথচ বুঝতে পারছে, ছায়ার আড়ালে লুকিয়ে নেই কোনও দানব। যে আওয়াজটা কানে দীর্ঘশ্বাস বলে মনে হচ্ছে, সেটা আসলে বাতাস বইবার আওয়াজ। বাড়তি শব্দ বলতে কেবল ভেজা সিমেন্টে ওর নিজের হিলের ঠকাঠক আওয়াজ। প্রধান রাস্তায় ওঠার সাথে সাথে, বাঁ দিক থেকে একটা গাড়ির হেডলাইটের আলো দেখতে পেল। স্যাম নাকি? থমকে দাঁড়াল মেয়েটি, হাত নাড়ার জন্য তৈরি হয়ে রয়েছে।

কিন্তু না, একদম অপরিচিত স্টেশন ওয়াগনটা। ড্রাইভারকেও চেনে না। তবে ভুল করে ফেলেছে, হাত নাড়া উচিত ছিল। চোর পালালে আসলেই বুদ্ধি বাড়ে। এতোক্ষণে গাড়িটা ডানে মোড় নিয়ে দৃষ্টির আড়ালে চলে গিয়েছে। আবার নির্জন হয়ে পড়েছে প্রধান রাস্তাটা এগিয়ে চলল লিলা। আর এক ব্লক মাত্র।

দূর থেকে পরিষ্কার দেখতে পারছে স্টোরটাকে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, আলো। জ্বলছে না স্টোরের কোথাও! চলার গতি কমে এলো ওর। অশুভ আশংকায় কেপে উঠছে বুক।

এতো ভয় পাওয়ার কী আছে? নিজেকেই বকল। হয়তো স্যাম কেবলমাত্র বন্ধ করেছে স্টোর, এই মুহূর্তে পেছন থেকে গাড়ি বের করে আনছে।

ধীর পায়ে এগিয়ে চলল লিলা। সতর্ক হয়ে আছে। কয়েক গজ সামনে এগোতেই নজরে পড়ল, পেছন দিয়ে বেরোবার গলির মুখে পার্ক করা আছে। ওদের স্টেশন ওয়াগনটা। ড্রাইভারের সীটের পাশের দরজাটা বন্ধ। সীটেও নেই কেউ। স্যাম এখনও দোকান থেকে বেরোয়নি! তাহলে আলো জ্বলছে না কেন? ঘুমিয়ে পড়েছে? নাকি

এতোক্ষণ অনেক কষ্ট করে দুশ্চিন্তাটাকে আটকে রাখলেও, আর পারল না সে। গত সপ্তাহের ঘটনাটা মনে পড়ে গিয়েছে। স্যাম ওর ডাক্তার, ডা. রোয়ানের সাথে। দেখা করতে গিয়েছিল। সেখানে ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাম করতে হয়েছে। ডাক্তার অবশ্য বলেছিলেন, দুশ্চিন্তা করার মতো এমন কিছু হয়নি। কিন্তু ডাক্তাররা তো আর সব কিছু জানে না। আর ওসব পরীক্ষার রিপোর্টও সব সময় ঠিক হয় না। হার্ট অ্যাটাকের মতো সিরিয়াস কিছু হয়ে গেল না তো আবার!

ধীর, সাবধানী পায়ে স্টোরের পেছনের দরজায় পৌঁছে গেল লিলা। এপাশের জানালার পর্দা নামানো, দরজাও বন্ধ। নব ধরেই টের পেল, লক করে রাখা। পার্সে একটা চাবি আছে অবশ্য, তবে কেন জানি বের করল না ওটা। সেই গা শিহরানো অভিজ্ঞতা তাকে একটা জিনিস শিখিয়েছে-একা থাকলে, ঝুঁকি নেবার মতো বোকামি করার কোনও দরকার নেই। স্যামের যদি কিছু একটা হয়ে গিয়েই থাকে, তাহলে ওর ঝুঁকি নেয়ায় তার কোনও লাভ বা ক্ষতি হবে না। তবে হ্যাঁ, মাথা ঠাণ্ডা রেখে সাহায্য আনতে পারলে হয়তো উপকার হবে।

তাই করবে, সিদ্ধান্ত নিল। পার্ক করে রাখা স্টেশন ওয়াগনটার কাছে এসে ডানে মোড় নিল এবার। একটু সামনে, স্কয়ারের ওখানে কোর্ট হাউসটা দাঁড়িয়ে আছে। সেদিকেই এগোল সে। দালানটাও অন্ধকার প্রায়, কিন্তু একদিকের একটা দরজা খোলা। ওটা দিয়ে আবছা আলো দেখা যাচ্ছে। দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল ও, সিঁড়ি বেয়ে উঠে আলোর উৎসের দিকে এগোল। ওর মনে হচ্ছিল দেঁ জা ভ্যু হচ্ছে। আরেকটু দ্রুত পা চালানো শুরু করল মেয়েটা।

ছোটোখাট আকৃতির, বয়স্কা আইরিন গ্রোভস্মিথের অফিসে আলো জ্বলছে এখনও। বৃদ্ধা মহিলা ডেস্কে বসে বসে একটা ম্যাগাজিন পড়ছেন। লিলাকে ঢুকতে দেখে, ম্যাগাজিনটাকে সরিয়ে রাখলেন তিনি। লিলা

হ্যালো আইরিন। শেরিফ অ্যাংস্ট্রম কি ব্যস্ত?

তা আর বলতে, পুরু লেন্সের ওপাশে, আইরিনের চোখে বিরক্তি খেলে গেল। তিন ঘন্টার বেশি হলো নেই। বাস অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে না মনট্রোসে? ওখান থেকে এখনও আসেনি। বলে গিয়েছিল যে বড়জোর সাতটা বাজবে, আর দেখ! এখন তো প্রায় সাড়ে আটটা বাজে। বিদ্যুৎ আসছে-যাচ্ছে, ফোনটাও কাজ করছে না। ঠিক করছে শুনলাম, কিন্তু এখনও…

শেরিফের সাথে যোগাযোগ করা দরকার ছিল যে।

কেবলি না বললাম- বলতে বলতেই থেমে গেলেন আইরিন। চশমা খুলে নিয়ে খুক খুক করে কেশে বললেন। আসলে অনেকক্ষণ ধরে বসে আছি তো…যাই হোক, সমস্যা কী?

এতোক্ষণ পর জিজ্ঞাসা করলে? কিছুটা হলেও রেগে উঠল লিলা। কিন্তু মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, স্যামের ব্যাপারে একটু দুশ্চিন্তা হচ্ছে। সারা বিকাল দোকানে কাটিয়েছে। এখনও বাসায় আসেনি। আমি খোঁজ নিতে দিয়ে দেখি, গাড়িটা বাইরে পার্ক করা। দরজা বন্ধ আর আলোও নিভানো।

চাবি আছে না?

আছে, কিন্তু একা যেতে চাইছি না। ইতস্তত করল লিলা, কতোটুকু বলা ঠিক হবে তা বুঝে উঠতে পারছে না। আইরিনকে কিছু বলা আর মাইক হাতে নিয়ে চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে বলা একই কথা। কিন্তু ওসব নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় এখন না, এখন স্যামকে নিয়ে চিন্তা করার সময়। যদি ওর কিছু হয়ে যায়…

খবরে একটা প্রতিবেদন শুনলাম, অবশেষে বলেই ফেলল। বিকালে মানসিক হাসপাতাল থেকে এক রোগী পালিয়েছে।

নরম্যান বেটস?

দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইল লিলার। আপনি শুনেছেন?

নড করলেন আইরিন। আধ ঘন্টা আগে চাক মারউইন শেরিফের খোঁজে এসেছিল। ও তো ফায়ার ডিপার্টমেন্টের সাথে আছে। চেনো ওকে? ডেভের ছেলে, লম্বা

চিনি আমি। কী বলল?

ভ্যানটা ওখান থেকেই এসেছে।

কেন ভ্যান?

লিখে রেখেছি। একটু অপেক্ষা করো… বলতে বলতে ম্যাগাজিনের নিচ থেকে একটা লেখার প্যাড বের করে আনলেন আইরিন। চোখে আবার চশমা গলিয়ে বললেন, চাক বলেছিল, পাগলাটা যে ভ্যানে করে পালিয়েছিল, সেই ভ্যানটা ওরা খুঁজে পেয়েছে। সম্ভবত গাড়িতে আগুন লেগে বিস্ফোরণ ঘটে। ভেতরে দুইটা মরদেহ পাওয়া গিয়েছে। একটি এক মহিলার, ওই হাসপাতালে রোগীদের সাথে দেখা করতে যাওয়া এক নানের। অন্যটা নরম্যান বেটসের।

বেটস মারা গিয়েছে?

পুড়ে ভাজা ভাজা হয়ে গিয়েছে। চাক নাকি ওর পাঁচ বছরের চাকরির ইতিহাসে এমন বাজে ভাবে পোড়া দেহ দেখেনি।

ঈশ্বরকে ধন্যবাদ।

চোখ তুলে চাইলেন আইরিন। এসবের সাথে স্যামের কী সম্পর্ক?

নেই। মাথা নাড়ল লিলা। যাক সে কথা, আমি নাহয় আরেকবার দোকানে গিয়ে দেখি। শেরিফ এলে ওকে কি কষ্ট করে একটু দেখা করে যেতে বলবেন? আমাদের গাড়িটা না থাকলে তো হয়েই গেল, বুঝে যাবেন যে আমরা বাড়ি ফিরে গিয়েছি।

অবশ্যই বলব। লিখে রাখছি।

ফুরফুরে মন দিয়ে দোকানের দিকে ফিরে চলল লিলা। এবার আর হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগোবার কোনও দরকার নেই। নরম্যানের ভয় মন থেকে উধাও হয়ে গিয়েছে। এখন যেটুকু দুশ্চিন্তা, তা স্যামকে নিয়ে। তবে মনে হয় না ভয় করার খুব একটা ভয়ের কারণ রয়েছে। সারা বিকাল কাজ করে, ঘুমিয়ে পড়ার সম্ভাবনাই বেশি।

গলির কাছে এসে স্টেশন ওয়াগনটাকে পার্ক করা অবস্থাতেই দেখতে পেল ও। আশা করেছিল, পাবে না। কিছুটা দ্রুত পায়েই পেছনের দরজার দিকে এগিয়ে গেল সে, চাবীটা হাতে উঠে এসেছে। ক্লিক শব্দ করে খুলে গেল তালা। ভেতরে প্রবেশ করে থমকে দাঁড়াল, বাতি জ্বালাবার সুইচটা কোথায় তা মনে করার চেষ্টা করছে। ডান দিকের দেয়ালে ছিল, নাকি বাঁ দিকের? ডান দিকের দেয়ালটা হাতড়ে হাতড়ে সুইচটা খুঁজে বের কল ও, কিন্তু টিপলেও বাতি জ্বলল না! নষ্ট হয়ে গিয়েছে নাকি?

ভয় পাবার কিছু নেই, হৃদপিন্ডে গতি আচমকা বেড়ে যাচ্ছে টের পেয়ে নিজেকে বোঝাল মেয়েটা। বিদ্যুৎ যে হারে আসা-যাওয়া করছে, তাতে বাতি নষ্ট হয়ে যেতেই পারে। অন্ধকারে চোখ সয়ে আসার জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল সে। আস্তে আস্তে ঘরের বিভিন্ন জিনিসগুলো ওর দৃষ্টিগোচর হওয়া শুরু করল।

ওদিকের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে ফাইল ক্যাবিনেট, ডেস্ক আর চেয়ার ঘরের মাঝখানটা দখল করে আছে। ডেস্কের উপরে আছে একগাদা ফাইল আর কাগজ। কিন্তু চেয়ারটা খালি। স্যাম ডেস্কের অবস্থা এমন অগোছালো করে রেখে যাবার মতো মানুষ না। সম্ভবত দোকানের সামনের দিকে গিয়েছে। সেদিকে এগোল লিলা।

অন্ধকার এখানে যেন আরও জাঁকিয়ে বসেছে। গোবরাটে এসে দাঁড়াল মেয়েটা। স্যাম? স্বামীর নাম ধরে ডাকল।

উত্তর এল না কোনও।

স্যাম? হায় ঈশ্বর-নিশ্চয় ওর সাথে অশুভ কিছু একটা ঘটেছে। আশঙ্কায় ভরে উঠল ওর মন। সামনের দিকে এগিয়ে গেল সে, কাউন্টারটা ঘুরতেই পেয়ে গেল স্বামীকে। উপুড় হয়ে শুয়ে আছে স্যাম, নিপ্রাণ চোখ দুটো ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।

ঠিক ধরতে পেরেছিল লিলা, সমস্যাটা স্যামের হৃদপিন্ডেই। ওই যে, ওখানে গেঁথে আছে ছোরাটা!

তবুও লিলার মনে হলো স্যাম বেঁচে আছে, কেননা শ্বাস ফেলার শব্দ পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে ও।

পরমুহূর্তেই ওর পেছন থেকে বেরিয়ে আসা ছায়াটা সেই ভুল ভেঙ্গে দিল। শব্দ শুনে লিলাও ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

না ঘুরলেই মনে হয় ভালো হতো।

কেননা চোখের সামনে ছোরা ধরা হাতটা দেখতে পেল সে।

ওর বুকের দিকে নেমে আসছে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *