০১-৫. গ্রন্থাগারের জানালা দিয়ে

সাইকো ২
মূল : রবার্ট ব্লক
রূপান্তর : মোঃ ফুয়াদ আল ফিদাহ

[স্বনামধন্য আমেরিকান লেখক রবার্ট অ্যালফ্রেড ব্লকের জন্ম ১৯১৭ সালে, শিকাগোতে। তার পিতা, রাফায়েল ব্লক ছিলেন পেশায় ব্যাঙ্কের ক্যাশিয়ার। মা স্টেলা লোয়েব। সোশ্যাল ওয়ার্কার। শতাধিক ছোট গল্প আর বিশটিরও বেশি উপন্যাসের রচয়িতা এই লেখকের পারদর্শিতা রয়েছে সব জনরাতেই–ক্রাইম ফিকশন, সায়েন্স ফিকশন, হরর ইত্যাদি। এইচ পি. লাভক্রাফটের ২ শিষ্য এই লেখক তার সাইকো বইটির জন্য অমর হয়ে আছেন। এছাড়াও তার অন্যান্য রচিত বইয়ের মাঝে আছে সাইকো-২, সাইকো হাউজ, আমেরিকান গথিক, ফায়ারবাগ ইত্যাদি। ১৯৯৪ সালে, ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান এই বিখ্যাত লেখক।]

ভূমিকা

সাইকো-বইটা পড়েছিলাম সম্ভবত বছর দশেক আগে। রবার্ট ব্লকের লেখা ক্লাসিক এই বইটি যে পড়েছে, সে-ই মুগ্ধ আর শিহরিত হতে বাধ্য হয়েছে। প্রথম বইয়ের প্রায় বিশ বছর পর বের হয়েছিল সাইকো ২।

যাই হোক, সাইকো পড়ার পর থেকেই, সাইকো ২ পড়ার আগ্রহ জন্মেছিল মনে। ভাবিনি কখনও নিজেই রূপান্তর করার জন্য পড়ব। সাজিদ ভাইয়ের আগ্রহে সেটাও সম্ভব হলো।

বইটা রূপান্তর করার সময়, সহযোগিতা পেয়েছি বেশ কয়েকজনের। তাদের মাঝে মারুফ আর ওয়াসি আহমেদের নাম বিশেষভাবে না বললেই না। এই দুজনকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।

আশা করি বইটা পড়ে আপনাদের ভালোই লাগবে।

ডা. মোঃ ফুয়াদ আল ফিদাহ
নভেম্বর, ২০১৬

.

০১.

গ্রন্থাগারের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রয়েছে নরম্যান বেটস, চেষ্টা করছে জানালার গরাদটাকে অগ্রাহ্য করে বাইরের দৃশ্য দেখার। ওগুলো যে ওখানে আছে, তা মস্তিষ্ক জানে, কিন্তু পাত্তা দিলে চলবে কী করে? কথায় আছে না, অজ্ঞানতার মাঝেই লুকিয়ে রয়েছে শান্তি!

তবে আজ কেন জানি অজ্ঞানতা ওকে শান্তি দিতে পারছে না। স্টেট হাসপাতালের জানালার গরাদগুলো না চাইলেও নজরে পড়ে যাচ্ছে বারবার। আগে এই জায়গাটার নাম ছিল ভিন্ন-স্টেট হসপিটাল ফর দ্য ক্রিমিনালি ইনসেন। আইনের চোখে অপরাধী যে সমস্ত রোগী মানসিকভাবে অসুস্থ, কেবলমাত্র তাদেরকেই পাঠানো হতো এই হাসপাতালে। তবে যুগ পরিবর্তনের হাওয়া আজ এখানেও লেগেছে, তাই এখন আর অমন নামে ডাকা হয় না এই স্থাপনাকে। কিন্তু পরিবর্তনের হাওয়ার ক্ষমতা নামেই শেষ। জানালার গরাদগুলো এখনও আছে, আর সেই গরাদের পেছনে রয়েছে ও। বাইরের পৃথিবীর এক চিলতে দৃশ্যই কেবল জানালার ফাঁক দিয়ে দেখতে পায়।

কেবল পাথুরে দেয়াল বানায় না জেলখানা, যেমন কেবল-ই গরাদ বানায় না পাখির খাঁচা-কবি রিচার্ড লাভলেস অনেক…অনেক দিন আগে, সতেরশো শতাব্দীতে কবিতাটা লিখেছিলেন। নরম্যান অনেকক্ষণ ধরে জানালার ধারেই বসে আছে। কবি মারা গিয়েছেন তিনশ বছর আগে। নিজে অতটা লম্বা সময় বসে না। থাকলেও, তেমনটাই মনে হচ্ছিল।

চুপচাপ বসে থাকার জন্য গ্রন্থাগারের চেয়ে ভালো আর কোনও জায়গা হয় না। গ্রন্থাগারের পরিচালক হিসেবে কাজও বেশি একটা করতে হয় না তাকে। হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র রোগী বই পড়তে আসে। তাই বলতে গেলে অখন্ড অবসর নরম্যানের হাতে। নিজের ফাঁকা সময়টা বই পড়েই কাটায়। রিচার্ড লাভলেস আর অন্যান্য কবিদের সাথে সেভাবেই পরিচয় হয়েছে লোকটার। কর্তৃপক্ষ ওকে একটা ডেস্ক পর্যন্ত ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছে! বোঝাতে চাইছে, কতটা বিশ্বাস করে এখন তারা নরম্যানকে। আকারে ছোট হলেও, জিনিসটার জন্য কৃতজ্ঞ নরম্যান। কিন্তু মাঝে মাঝে…যখন সূর্য উজ্জ্বল হয়ে ওঠে আর বাইরে যখন। পাখি গান গেয়ে ওঠে, তখন নিজেকে বন্দি বলে মনে হয় তার। পাখিগুলো মুক্ত, আর সে? আটকা পড়া এক হতভাগা!

অবশ্য ডা. ক্লেইবনকে এসব বলেনি নরম্যান। যদি তিনি মন খারাপ করেন তো! কিন্তু অনুভূতিকে তো আর দমিয়ে রাখা যায় না। আসলে পুরো পরিস্থিতিটাই কেমন যেন অযৌক্তিক আর অন্যায্য। যেসব কাজ করার অভিযোগে ওকে এখানে। আটকে রাখা হয়েছে-সে সব যদি সত্য হয়েও থাকে-তবুও তা অনেক আগের কথা। ওসব ঘটেছে অনেক আগে, অন্য কোনও দেশে। আর তারচেয়ে বড় কথা, ডাইনি বুড়িটা মারা গিয়েছে। এখন সে জানে, ওর নাম নরম্যান বেটস। আর এ ও জানে, পাগল নয় ও।

অবশ্য আজকাল কাউকে আর পাগল বলে ডাকা হয় না। কেউ যদি পাগলামী করেও, তাহলে তাকে মানসিক ভারসাম্যহীন আখ্যা দেখা হয়। তবে একগাদা মানসিক ভারসাম্যহীনের সাথে কোথাও আটকে রাখা হলে, কে না পাগল হবে! ডা. ক্লেইবর্ন-ও এখানকার রোগীদের পাগল বলেন না। তাই বলে বোকা বনেনি নরম্যান, উন্মাদ কাউকে দেখতে পেলে সাথে সাথে চিনতে পারে।

আগে সবাই পাগলদের ডাকত পাগল বলেই। কিন্তু টেলিভিশন আজকাল নতুন নাম দিয়েছে তাদেরঃ উন্মাদ, খেপা, পাগলা ইত্যাদি। তাই বলে সহজ সরল রোগের গালভরা নামে ভুলতে রাজি নয় নরম্যান। সত্যকে কেন যেন সবাই বাজে কথা দিয়ে চেপেচুপে রাখতে চায়। এই মৃত্যু শব্দটার কথাই ধরা যাক মহাপ্রয়াণ, দেহত্যাগ, পঞ্চত্বপ্রাপ্তি।

অবশ্য নামে আর কী যায় আসে? গোলাপকে যে নামেই ডাকো না কেন, সে তার সুগন্ধ ছড়াবেই!

কথাটা মা প্রায়শই বলতেন। কিন্তু নাহ, মার কথা চিন্তা করবে না সে। মহিলা মৃত, আর সে জীবিত। জীবিত কিন্তু খাঁচায় বন্দি! এই কথাটা জানা, সত্যের মুখোমুখি হতে পারা-এই দুটোই প্রমাণ করে যে নরম্যান বেটস সম্পূর্ণ সুস্থ। এখন কর্তৃপক্ষ সেটা বুঝলেই হয়।

খুন সে করেছে বটে, কিন্তু সেই সময় তো আর সুস্থ ছিল না। তাই বড়জোর সাত বা আট বছরের জেল হবে। একসময় না একসময় ঠিক বের হয়ে আসবে। তবে কর্তৃপক্ষ সেটা মানলে তো। এখনও ওকে সাইকোটিক বা মানসিকভাবে অসুস্থ বলে এখানে আটকে রেখেছে!

অথচ অসুস্থ তো ওরাই! সুস্থ-সবল একটা মানুষকে পাগল আখ্যা দিয়ে আটকে রেখেছে! উঠে দাঁড়িয়ে জানালার কাছে গেল নরম্যান। গরাদের একদম সাথে মাথা লাগিয়ে দাঁড়ালে, দৃষ্টির সীমায় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না ওগুলো।

এখান থেকে প্রাঙ্গনটা পরিষ্কার দেখা যায়। বাইরের দৃশ্য প্রায়শই ওকে অভিভূত করে তোলে। বসন্তের উজ্জ্বল আলো থাকলে রবিবারের বিকালটা আরও উপভোগ্য হয়ে ওঠে। পাখির গান আরও পরিষ্কারভাবে শোনা যায়, শান্ত করে তোলে মন। সূর্য আর পাখির গান, এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে!

প্রথম প্রথম যখন এখানে আসে, তখন না ছিল সূর্যের আলো…আর না ছিল কোনও পাখির গান! ছিল শুধু অন্ধকার আর চীৎকার! অন্ধকারটা ছিল ওর অন্তরেই, এমন একটা জায়গা ছিল সেটা, যা বাস্তবতা থেকে ওকে আড়াল করে রাখত। আর চীৎকার? চীৎকারটা ছিল ওকে খুঁজতে থাকা দানবদের! ডা. ক্লেইবর্ন কীভাবে কীভাবে যেন সেই অন্ধকার থেকে ওকে বের করে এনেছেন। আর ওই দানবদের এমন জায়গায় পাঠিয়েছেন, যেখান থেকে তাদের আর ফিরে আসার উপায় নেই। ডাক্তারের ভরাট কণ্ঠ যেন নরম্যানের মতিস্থিরতার প্রতিভূ। অন্ধকার থেকে আলোতে আসতে অনেক সময় লেগেছে নরম্যান বেটসের। শান্ত একটা কণ্ঠস্বরের কথা অবশেষে শুনতে পেয়েছে সে। কণ্ঠটা ওকে বলেছে, নরম্যান আসলে নরম্যান। ওর মা নয়। নরম্যান এমন একজন মানুষ, যে অন্যদের ক্ষতি করেছে। কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে না। তাই শুধু শুধু নিজেকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। এই কথাটা মেনে নেয়া ছিল সুস্থ হবার পথে প্রথম ধাপ।

এখন ওকে কোনও জ্যাকেট বা কোনও সেল অথবা ঘুমের ওষুধ আটকে রাখে না। গ্রন্থাগারিক হিসেবে পছন্দের বইগুলো পড়ার সুযোগ পায় সে। টেলিভিশন নতুন এক দুনিয়াকে তুলে ধরে ওর সামনে। চারকোনা ওই বাক্সটা যেন বাইরের দুনিয়া দেখার একটা জানালা। পার্থক্য কেবল এতটুকু, এই জানালায় কোনও গরাদ নেই!

জীবন এখানে আরামদায়ক। এখানে আসার আগেও সে একা একা থাকতে পছন্দ করত। তবে মাঝে মাঝে মানুষের সঙ্গের জন্য লালায়িত হয়ে ওঠে সে। রক্ত-মাংসের মানুষের সঙ্গ। কোনও বইয়ের চরিত্র বা পর্দার ছবি না। ক্লেইবর্ন ছাড়া অন্যান্য ডাক্তার, নার্স বা আর্দালিরা যেন বাতাস দিয়ে তৈরি। তাদের উপস্থিতি টেরই পাওয়া যায় না। তাছাড়া এখন ও প্রায় সুস্থ হয়ে উঠেছে বলে, ডা. ক্লেইবন অন্যান্য রোগীদের নিয়েই ব্যস্ত থাকেন বেশি।

নরম্যান অন্যান্য রোগীদের সাথে মিশতে পারে না। ওইসব পাগল-ছাগলদের বিড় বিড় করে কথা বলা, অর্থহীনভাবে নড়াচড়া দেখতে বিরক্ত লাগে তার। ওদের সাথে মেলামেশা করার চাইতে, নিঃসঙ্গতাই অধিক বাঞ্ছনীয় বলে মনে হয়। ডা. ক্লেইবন অনেক কিছু করেছেন, কিন্তু এই একটা বৈশিষ্ট্যে পরিবর্তন আনতে পারেননি।

চেষ্টা করেছেন অনেক। তিনিই নরম্যানকে বলেছিলেন এখানকার নাটকে অভিনয় করতে। কিছুদিন কাজটা নিয়ে ব্যস্তও ছিল সে। অন্তত স্টেজে ওঠার পর নিজেকে নিরাপদ মনে হয়েছিল। পরিস্থিতি ছিল তার নিয়ন্ত্রণে। দর্শকদের হাসাচ্ছিল, কদাচ্ছিল। চার্লির আন্টি হিসেবে অভিনয় করেছিল, এত ভালো করেছিল যে দর্শকরা হাততালি না দিয়ে পারেনি।

পরবর্তীতে ডা. ক্লেইবর্নের কাছে জানতে পারে, নরম্যানের জন্য নাটকটা ছিল একটা পরীক্ষা। তোমার নিজেকে নিয়ে গর্বিত হওয়া উচিত, বলেছিলেন তিনি। কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝতে পারেননি ডাক্তার ক্লেইবর্ন, নরম্যান তাকে জানায়নি। নাটকের মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল সে। নাহ, ঠিক নাটকের মাঝে না… নাটকের চরিত্রের মাঝে। একদম শেষ মুহূর্তে নরম্যান পরিণত হয়েছিল চার্লির আন্টিতে, যখন তার হাতে পাখা ছিল না। ছিল একটা ছুরি!

এখন…এই মুহূর্তে…জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে গিয়ে সে টের পেল, দিগন্তে সূর্যের পাশাপাশি কালো মেঘের ছায়াও দেখা যাচ্ছে! ঠান্ডা বাতাসে কেঁপে উঠছে পার্কিং লটের গাছগুলোও। একমনে দেখছিল সে, ঘোর ভাঙল পাখির ডানা ঝাঁপটানোতে। এক মুহূর্ত পর, ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে আসতে থাকা আকাশে উড়তে দেখা গেল তাদের। নাহ, আসন্ন ঝড়ের ভয়ে নয়। ওরা উড়ে যাচ্ছে, কারণ অনেকগুলো গাড়ি এগিয়ে আসছে এদিকে।

কিছুক্ষণ পরেই দেখা গেল, পার্কিং লট থেকে গাড়িগুলোর আরোহীরা বেরিয়ে হাসপাতালের দিকে এগোচ্ছে। এই দৃশ্যটা একদম স্বাভাবিক, প্রতি রবিবার বিকালেই তা দেখা যায়। সপ্তাহের এই দিনটাতে হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের দেখতে আসে তার পরিবারের সদস্যরা।

দেখো আম্মু, লোকটা কেমন অদ্ভুত!

বাবু, তোমাকে না বলেছি, ওসব বলতে নেই!

মাথা নাড়ল নরম্যান। এভাবে ভাবাটা ঠিক হচ্ছে না। এই অতিথিরা রোগীদের বন্ধু, পরিবারের সদস্য। ভর্তি রোগীকে ভালবাসে বলেই দেখতে আসে তারা। কিন্তু আফসোস, ওর সাথে দেখা করতে আসে না কেউ।

বহু বছর আগে রিপোর্টাররা আসত, কিন্তু ডা, ক্লেইবন তাদেরকে দেখা করার অনুমতি দিতেন না। এমনকি নরম্যান সুস্থ হবার পরেও দেননি। এখন আর কেউ আসে না। আসবে-ই বা কে? যাদেরকে ও চেনে, তারা এতো দিনে মারা। গিয়েছে। মা, ক্রেন মেয়েটা আর ওই গোয়েন্দা, আরবোগাস্ট-ও। এখন চুপচাপ অপরিচিতদের আসা যাওয়া করতে দেখে শুধু। বিরক্ত লাগে নরম্যানের। এই অতিথিরা এসে কেবল পাখিদেরকে বিরক্ত করে, তাদেরকে তাড়িয়ে দেয়।

খারাপ, খুব খারাপ। আশেপাশে পাখি থাকলে তার খুব ভালো লাগে। অনেক আগে, মৃত পাখি স্টাফ করত সে। যখন ট্যাক্সিডার্মি পছন্দ করত, তখনকার কথা। তখনও পাখি ভালবাসত।

চোখ ছোট ছোট করে পার্কিং লটের দিকে তাকাল সে। এখান থেকে লেখা পড়তেও পারছেঃ স্যারেড অর্ডার অফ দ্য লিটল সিস্টারস অফ চ্যারিটি। ওর চোখের সামনেই পেঙ্গুইনের মতো ভঙ্গিতে হাঁটতে হাঁটতে এদিকে এগিয়ে আসতে দেখল দুজনকে। কে জানে, হয়তো দক্ষিণ মেরু থেকে ওকে অত্যাচার করতেই এসেছে তারা।

নাহ, কী সব পাগলের মতো ভাবছে সে।

অথচ সবাই জানে, নরম্যান পাগল না।

.

০২.

নরম্যানের পেঙ্গুইন দুটো হাসপাতালে প্রবেশ করে রিসেপশনের দিকে এগিয়ে গেল। সামনে সামনে চলা চশমা পরিহিত খাটো মহিলার নাম সিস্টার কুপারটাইন। লম্বা, কম বয়সী জন হলো সিস্টার বারবারা।

সিস্টার বারবারা নিজেকে পেঙ্গুইন ভাবে না। অবশ্য এই মুহূর্তে সে নিজেকে নিয়েই ভাবছে না। এখানকার অধিবাসীদের চিন্তাতেই ব্যস্ত তার মন।

এখানে যারা বাস করে, তারা-ও ওর মতোই মানুষ। সাইকোলজি ক্লাসে এই ব্যাপারটার উপরে সবসময় জোর দেয়া হতো। আর ধর্মীয় সব শিক্ষার ভিত্তিমূল-ই তো এই ধারণা।

তবে নিজের কাছে হলেও সিস্টার বারবারা স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছে যে, এই মুহূর্তে সে খুব একটা স্বচ্ছন্দ্যবোধ করছে না। হাজার হলেও, সিস্টারদের এই দলটার সাথে নতুন যোগ দিয়েছে ও। এর আগে কোনও চ্যারিটি মিশনেও আসেনি, পাগলাগারদে তো দূরে থাক!

সিস্টার কুপারটাইনের কথা মতো আসতে হয়েছে ওকে। বয়স্কা সিস্টার আবার গাড়ি চালাতে পারেন না। বিগত বহু বছর ধরে সিস্টার কুপারটাইন, সিস্টার লরেটাকে সাথে নিয়ে এখানে আসা যাওয়া করছেন। কোনও মাস রাদ পড়ে না। কিন্তু সিস্টার লরেটার ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়েছে। তাই এই মুহূর্তে কোথাও যাবার মতো অবস্থা নেই তার।

ঈশ্বর তাকে দ্রুত সুস্থতা দান করুন। তসবীটাকে হাতে জড়িয়ে নিয়ে প্রার্থনা করল সিস্টার বারবারা। সেই সাথে নিজের শারীরিক সুস্থতার জন্য ধন্যবাদও জানালো।

তোমার মতো এক সুস্থ, সবল মেয়ের স্বামী পেতে কোনও কষ্টই হবে না। মা প্রায়শই বলতেন। কিন্তু ভুল হয়েছিল মার। মেয়েলি সৌন্দর্যের ছিটে ফোঁটাও ছিল না ওর মাঝে। হয়তো সেজন্যই কোনও পুরুষ ওর প্রতি আগ্রহ দেখায়নি। তাই যখন সিস্টারদের সাথে যোগ দিয়ে তাদের দলের একজন হবার সুযোগ এল, সাথে সাথে রাজি হয়ে গেল সে। ঈশ্বরকে সেজন্য ধন্যবাদ।

সিস্টার কুপারটাইনকে সঙ্গি হিসেবে দেবার জন্যও ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। এই মুহূর্তে তিনি ছোট খাটো রিসেপশনিষ্টের সাথে আন্তরিক ভঙ্গিতে কথা বলছেন। এই পাগলাগারদের সুপারিনটেন্ডেন্ট আসার আগে, ওর সাথে মেয়েটাকে পরিচয়ও করে দিলেন। হলের ওমাথায় অবস্থিত অফিস থেকে বেরিয়ে এদিকেই আসছেন সুপারিনটেন্ডেন্ট। পরনে একটা হালকা রঙের কোট আর বাঁ হাতে একটা ব্যাগ।

ডা. স্টাইনার ছোট খাটো, টাক মাথার একজন মানুষ। উপরের দিকে চুলের অভাবটা ঢাকার জন্য, জুলপি বড় করে রেখেছেন। খাটো অবয়বটাকে যেন অতটা খাটো না মনে হয়, সেজন্য সোজা হয়ে হাঁটছেন। অবশ্য সিস্টার বারবারার এসব ভাবা উচিত হচ্ছে না। লোকটাকে কতোটুকুই বা চেনে ও? তার উদ্দেশ্য বা ধারনার ব্যাপারে মন্তব্য করার মতো তো আর না। হ্যাঁ, মনস্তত্বে বিশেষজ্ঞ হলে হয়তো পারত। গত বছর মা মারা যাবার পর, লেখাপড়াই বাদ দিয়ে দিয়েছে।

বেশ আন্তরিক ব্যবহার করলেন ডা. স্টাইনার। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বলে, সিস্টার বারবারার ইতস্ততভাবটা একদম সাথে সাথে ধরে ফেললেন। চেষ্টাও করলেন সেটা দূর করার। তবে কাজটা সফলভাবে করতে পারলেন তার সাথে অফিস থেকে বের হওয়া দ্বিতীয় লোকটা। তাকে দেখামাত্র বেমালুম হাওয়া হয়ে গেল অশান্তিটুকু।

ডা. ক্লেইবর্নকে নিশ্চয় চেনেন আপনি? সিস্টার কুপারটাইনকে জিজ্ঞাসা করছিলেন ডা. স্টাইনার। নড করে সিস্টার জানালেন যে ডাক্তার সাহেবকে তিনি চেনেন। আর ইনি হচ্ছে সিস্টার বারবারা। কোকড়ানো চুলের ডাক্তারের সাথে ওকে পরিচয় করিয়ে দিলেন ডা. স্টাইনার। আর সিস্টার, ইনি আমার সহকর্মী, ডা. ক্লেইবন। কম বয়সী সিস্টারের সাথে হাত মেলালেন ডাক্তার।

দেরি হয়ে যাচ্ছে, রিসেপশন ডেস্কের পেছনে ঝোলানো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন ডা. স্টাইনার। এতক্ষণে বিমানবন্দরের কাছাকাছি থাকার কথা! হাতের ব্যাগটা ডান হাতে নিতে নিতে ঘুরলেন তিনি। আমাকে ক্ষমা করবেন। এই স্টেটের বোর্ডের সাথে আমার সকালে একটা মিটিং আছে। এই বিমানটা ছাড়া যাবে না। তাই আপনাদেরকে ডা. ক্লেইবর্নের হাতে ছেড়ে যাচ্ছি। আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত তিনিই। দায়িত্বে থাকবেন।

কোনও অসুবিধা নেই। মাথা ঝাঁকাতে আঁকাতে বললেন সিস্টার কুপারটাইন। আপনি নিশ্চিন্তে চলে যান।

ডা. স্টাইনারকে এগিয়ে দেবার জন্য, সাথে গেলেন কম বয়সী ডাক্তার। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকটা কথা বিনিময় হলো তাদের মাঝে। দ্রুত লয়ে কয়েকটা কথা বলে বিদায় নিলেন ডা. স্টাইনার। তাকে বিদায় দিয়ে সিস্টারদের কাছে ফিরে এলেন যুবক ডাক্তার।

আপনাদেরকে দাঁড় করিয়ে রাখতে হলো বলে দুঃখিত। বললেন তিনি।

ওসব নিয়ে ভাববেন না তো। গলায় আন্তরিকতার সুর থাকলেও, চশমার পেছনের চোখ জোড়ায় তিরষ্কার দেখতে পেল সিস্টার বারবারা। আমরা নাহয় পরে কোনও একদিন আসি। এমনিতেই অনেক কাজ আছে বলে মনে হচ্ছে।

কোনও অসুবিধা নেই। জ্যাকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা ছোট নোটপ্যাড বের করে আনতে আনতে বলল ডা. ক্লেইবর্ন। ফোনে কয়েকজন রোগীর ব্যাপারে জানতে চেয়েছিলেন। এই যে তাদের সব তথ্য। বলে একদম উপরের কাগজটা ছিঁড়ে ফেললেন ডাক্তার। এগিয়ে দিলেন বয়স্কা সিস্টারের দিকে।

নামগুলো পড়তে পড়তে চোখ থেকে তিরষ্কার হাওয়া হয়ে গেল কুপারটাইনের। টাকার, হফম্যান আর শ-কে তো চিনলাম। কিন্তু এই জ্যান্ডার কে?

নতুন এসেছে। প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে, ইনভোলিউশনাল মেলানকোলিয়া-এর রোগী।

মানে কী, তা ঈশ্বর-ই জানেন! নিজেকে সামলে নেবার আগেই, সিস্টার বারবারার কণ্ঠ যেন নিজে থেকেই বলে উঠল, তীব্র মন খারাপ। সেই সাথে অপরাধবোধ, দুশ্চিন্তা, শারীরিক কিছু অসুবিধা- নিজের উপর ডা. ক্লেইবর্নের কৌতূহলী দৃষ্টি টের পেয়ে থেমে গেল সে।

তার সঙ্গিনী ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে হাসলেন। সিস্টার বারবারা সাইকোলজি নিয়ে লেখা পড়া করত।

ভালো ছাত্রী ছিলেন বলেই তো মনে হচ্ছে—

কথাটা শোনামাত্র লজ্জা পেল বারবারা। আসলে তা না। মানুষজনের মানসিক অবস্থার এই হেরফের আমাকে সবসময় আকর্ষণ করেছে। এতো এতো সমস্যা–

কিন্তু এতো অল্প সমাধান। নড করতে করতে বললেন ডাক্তার। সেজন্যই আমি এখানে। চেহারা শক্ত করে বললেন সিস্টার কুপারটাইন। কম বয়সী নানের মনে হলো, মুখ না খুললেই মনে হয় ভালো করত।

যা বলছিলাম, বলেই চলছেন বয়স্কা নান। সেজন্যই আমি এখানে এসেছি। সাইকোলজির ব্যাপারে আমি অনেক কিছু জানি, তা বলব না। কিন্তু আমার ধারনা, কখনও কখনও দয়ালু কণ্ঠে বলা কয়েকটা বাক্য অনেক কাজে আসতে পারে।

অবশ্যই, ডা. ক্লেইবর্নের হাসি বয়স্কা মহিলার কঠিন চেহারাটাকে নরম করে তুলল। আপনার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। মাঝে মাঝে বাইরে থেকে আসা মানুষ এখানকার রোগীদের উপর এমন প্রভাব ফেলেন, যা আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা খেটেও পারি না। সেজন্যই চাচ্ছিলাম, যদি পারেন তো একটু জ্যান্ডারকে দেখে যাবেন। চাইলে ওর রোগ সংক্রান্ত সব ইতিহাসও দেখতে পারেন।

তার আর দরকার পড়বে না। এখন হাসছেন সিস্টার কুপারটাইন। ওর মুখ থেকেই সব শুনে নেব। আছে কোথায়?

চোদ্দ নাম্বারে, টাকারের ঘরের ঠিক উল্টোপাশের ঘরটায়। ওখানকার নার্সকে বললেই নিয়ে যাবে।

ধন্যবাদ, কাপড় দিয়ে ঢাকা মাথাটা ঘুরে গেল। এসো, সিস্টার।

ইতস্তত করল সিস্টার বারবারা, কী বলতে চায় তা জানে ও। এখানে আসার পথে অনেকবার মনে মনে আউড়ে নিয়েছে। কিন্তু সিস্টার কুপারটাইনকে খেপিয়ে তোলাটা কি বুদ্ধিমানের মতো কাজ হবে? না হলে না হোক, এমন সুযোগ তো আর বারবার মিলবে না। আমি যদি ডা. ক্লেইবর্নের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলি, তাহলে কি খুব অসুবিধা হবে? এখানে কীভাবে থেরাপি দেয়া হয়, তা জানার আমার খুব আগ্রহ–

সিস্টার কুপারটাইনের চোখে তিরষ্কার দেখে, সাথে সাথে থেমে গেল ও। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জবাব এল, শুধু শুধু ভদ্রলোকটার ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ কী? অন্য কোনও দিন হবে। দেখছ না, তিনি কতটা ব্যস্ত?

আরে না, ডা. ক্লেইবর্ন মাথা নাড়লেন। ভিজিটিং আওয়ারটায় আমরা সবাই ফাঁকাই থাকি। আপনি অনুমতি দিলে, সিস্টার বারবারাকে সময় দিতে আমার কোনও আপত্তি নেই।

সে তো আপনার দয়া, বললেন সিস্টার কুপারটাইন। কিন্তু তাই বলে—

আমার ভালোই লাগবে। ডাক্তার সাহেব তাকে থামিয়ে দিলেন। আর যদি আপনাকে উপরের তলায় খুঁজে নাও পান সিস্টার বারবারা, তাহলে পাঁচটার সময় নাহয় লবিতেই অপেক্ষা করবেন।

ঠিক আছে। বলে ঘুরে দাঁড়ালেন সিস্টার। কিন্তু তাই বলে সিস্টার বারবারাকে তীরষ্কার মিশ্রিত দৃষ্টিটা দেখিয়ে দিতে ভুললেন না। বোঝালেন, এতো সহজে এই ঘটনার সমাপ্তি ঘটছে না।

এক মুহূর্তের জন্য সিস্টার বারবারা ভাবল, ঝামেলা করে লাভ কী! কিন্তু পরমুহূর্তেই ডা. ক্লেইবর্নের বলা কথাটা তাকে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করল, তাহলে সিস্টার, ঘুরিয়ে দেখাব? নাকি সরাসরি কাজের কথায় চলে যেতে চান?

কাজের কথা?

আহা, শুরুতেই নিয়ম ভাংলেন তো! হেসে বললেন ডাক্তার সাহেব। এখানে। প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন কেবলমাত্র একজন সার্টিফিকেটধারী মনোবিদই করতে পারবেন।

দুঃখিত। সিস্টার বারবারা, বয়স্কা নান এলিভেটরে না ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করল। এরপর নিজেও হাসল।

দুঃখ পাবার মতো কিছু হয়নি। যে প্রশ্নটা করতে চান, সেটা করে ফেলুন?

আমি যে আপনাকে বিশেষ একটা প্রশ্ন করতে চাই, সেটা জানলেন কী করে?

প্রশিক্ষণের ফল বলতে পারেন। আরও চওড়া হয়ে উঠল হাসিটা। বলে ফেলুন।

আবারও ইতস্তত করল সিস্টার বারবার। প্রশ্নটা কী করবে? উচিত হবে? এরপর বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে বললেন। আপনার এখানে নরম্যান বেটস নামের এক রোগী আছে না?

আপনি সে খবর রাখেন? অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে হাসিটা। অধিকাংশই অবশ্য ব্যাপারটা জানে না, সেজন্য আমি খুশি।

খুশি?

কথার কথা। যাগ করলেন ডাক্তার ক্লেইবর্ন। আসলে সত্যি কথা বলতে কি, নরম্যান আমার বইতে একটা বিশেষ জায়গা ধারণ করে আছে। তাই…

আপনি ওকে নিয়ে বই লিখছেন?

লিখছি বলতে, লেখার ইচ্ছা আছে। ডা. স্টাইনারের কাছ থেকে ওর চিকিৎসার দায়ভার বুঝে নেবার পর, নানা তথ্য-উপাত্ত জোগাড় করে চলছি।

কথা বলতে বলতে লবি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে ওরা। এই মুহূর্তে ডা. ক্লেইবর্ন সিস্টারকে পথ দেখিয়ে ডান দিকে করিডর ধরে এগোচ্ছে।

কোন ধরনের চিকিত্সা চালাচ্ছেন ওর উপর? বৈদ্যুতিক শক?

মাথা নাড়লেন ডা. ক্লেইবন। ডা. স্টাইনারের অবশ্য তা-ই ইচ্ছা ছিল। আমি রাজি হইনি। রোগী যখন প্রায় ক্যাটাটোনিয়ায় চলে গিয়েছে, তখন আর শক দিয়ে লাভ কী?

তাহলে নরম্যানকে সুস্থ করার নতুন পথ আবিষ্কার করেছেন আপনি?

নরম্যানকে ঠিক সুস্থ বলা যাবে না। তবে আমরা রোগের উপসর্গগুলোর একটা ব্যবস্থা করতে পেরেছে। তা-ও কোনও ধরনের কড়া ওষুধ-পত্র ব্যবহার না করেই! প্রশ্ন করেছি, উত্তর শুনেছি। বিগত কিছু দিনে মনোরোগের ব্যাপারে আমাদের জ্ঞানও অনেক বেড়েছে। বিশেষ করে মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার-এর ব্যাপারে।

আপনি বলতে চাচ্ছেন, নরম্যান এখন আর নিজেকে ওর মা ভাবে না?

নরম্যান…নরম্যান-ই। আমার ধারনা, কথাটা ও নিজেও এখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। খুন সে করেছে। কিন্তু প্রত্যেকটার ক্ষেত্রেই নিয়ন্ত্রণে ছিল ওর মায়ের সত্ত্বাটা। মেয়েদের মতো কাপড় পড়েই সে খুনগুলো করেছে। আগে ব্যাপারটা মানতে পারেনি, কিন্তু এখন মানতে রু করেছে। ঘটনাগুলো ও কখনওই মনে করতে পারবে না। আসলে এখন আর নরম্যান বাস্তবতাকে অস্বীকার করে না। ক্যাথাসিস যাকে বলে।

ক্যাথাসিস…তবে অ্যাবরিঅ্যাকশন ছাড়া, তাই না?

ঠিক, তীক্ষ্ণ চোখে সিস্টারের দিকে তাকালেন ডা. ক্লেইবন। আসলেই দেখি আপনি মনোযোগী ছাত্রী ছিলেন।

নড করল মেয়েটা। শেষ পর্যন্ত কী হবে বলে আশা করছেন?

আগেই বলেছি আপনাকে। আমরা এখন আর কল্পনাতীত কোনও কিছু করার আশা নিয়ে কাজ করছি না। নরম্যানকে বেঁধে রাখতে হচ্ছে না, স্বাভাবিক মানুষের মতোই আচরণ করতে পারছে সে-আপাতত এতোটুকুই যথেষ্ট। ওকে আমরা বাইরে বেরোতে দিব না। তবে এখানকার গ্রন্থাগারিকের দায়িত্বে রাখা হয়েছে তাকে। কিছুটা স্বাধীনতা আর দায়িত্ব পেয়েছে। বেশিরভাগ সময় এখন বই পড়েই কাটিয়ে দেয়।

একাকীত্বে ভরা জীবন বলে মনে হচ্ছে।

তা ঠিক। কিন্তু এর চাইতে বেশি কিছু ওর জন্য করা সম্ভব না। নরম্যানের কোনও আত্নীয় নেই, নেই কোনও বন্ধু-বান্ধব। এখন রোগীর চাপ বেশি হওয়ায়, আমি নিজেও আগের মতো ওর সাথে সময় কাটাতে পারি না।

তসবীর দানা চেপে ধরে ফস করে প্রশ্নটা করেই বসল সিস্টার বারবারা, আমি কি ওর সাথে দেখা করতে পারি?

থমকে দাঁড়ালেন ডা. ক্লেইবর্ন। কেন?

আপনি-ই কেবল বললেন, ওর জীবনটা একাকীত্বে ভরপুর। কারণ হিসেবে কি এটাই যথেষ্ট না?

মাথা নাড়লেন ডাক্তার। বিশ্বাস করুন, আপনার সহমর্মিতাটুকুর প্রতি সম্মান আমার আছে–

শুধু সহমর্মিতা ধরে নিলে ভুল করবেন। আমার আর সিস্টার কুপারটাইনের জীবনের উদ্দেশ্যই এটা। অসহায়দের সাহায্য করা, বন্ধুহীনদের বন্ধু হওয়া।

বুঝলাম, কিন্তু তাই বলে আমার রোগীদেরকে কোনও-

রোগী? বানের জলের মতো কথা বেরিয়ে এলো সিস্টারের মুখ দিয়ে। আপনার মাঝে যদি কোনও সহমর্মিতা থেকে থাকত, তাহলে আপনি নরম্যান বেটসকে রোগী ভাবতেন না! সে একজন মানুষ-এক হতভাগা, একাকীত্বে ভোগা বিভ্রান্ত মানুষ! যে কিনা কেন তাকে একা থাকতে হবে, তা-ও বোঝে না! শুধু জানে, ওকে নিয়ে কেউ ভাবে না।

আমি ভাবি!

আসলেই কী ভাবেন? তাহলে ওকে একটা সুযোগ দিন, নরম্যান যেন বুঝতে পারে যে অন্য মানুষও ওকে নিয়ে ভাবে।

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ডা. ক্লেইবন। ঠিক আছে, চলুন। নিয়ে যাচ্ছি।

ধন্যবাদ!

কিছুক্ষণের মাঝেই দুজনে গ্রন্থাগারের সামনে এসে দাঁড়ালেন।

একই দিনে, তৃতীয়বারের মতো দীর্ঘশ্বাস ফেলল সিস্টার বারবারা। বদ্ধ, আর্দ্র বাতাস প্রবেশ করল তার ফুসফুঁসে। ঘোড়ার গতিতে ছুটতে রু করেছে হৃদপিন্ড।

আপনি ঠিক আছেন তো? জানতে চাইলেন ডাক্তার।

একদম। বলল বটে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে নিজেকে অসুস্থ বলে মনে হচ্ছে সিস্টার বারবারার। এতো চাপাচাপি করার কী দরকার ছিল? আসলেই কি সহমর্মিতার কারণে এসেছে ও? নাকি অহংকার বসত?

দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। আশ্বস্ত করলেন ক্লেইবন। আমি সাথে থাকব। বলতে বলতেই নব ঘুরিয়ে খুলে ফেললেন দরজাটা। ভেতরের সারি সারি তাকে সাজিয়ে রাখা বইয়ের প থেকে বারবারার মনে হলো, মাকড়সার জালের ভেতরে চলে এসেছে!

পথ দেখাবার জন্য এগিয়ে গেলেন ডা, ক্রেইবর্ন, পিছু নিল বারবারা।

কয়েক পা এগোতেই দেখা গেল, ডেস্কের উপর একটা বাতি জ্বালিয়ে বসে আছে এই বিশাল মাকড়সার জাল সৃষ্টিকারী মাকড়সাটা।

আবার শুরু হলো সিস্টার বারবারার হৃদয়ের ধুকপুকানি। এতো জোরে যে তার মনে হলো, আওয়াজটা বাইরে থেকেও শোনা যাচ্ছে!

আর সেই আওয়াজ ভেদ করে সে শুনতে পেল ডা, ক্লেইবর্নের কণ্ঠ।

সিস্টার বারবার-এই যে নরম্যান বেটস।

.

০৩.

ঘরে দুই পেঙ্গুইনের একজনকে প্রবেশ করতে দেখে নরম্যানের মনে হলো, আসলেই আবার পাগল হয়ে যেতে চলেছে ও। কিন্তু কেবলমাত্র এক মুহূর্ত স্থায়ী হলো অনুভূতিটা। সিস্টার বারবারা যে পাখি নয়, তা দেখেই বুঝতে পারল ও। সেই সাথে তো ডা. ক্লেইবন আছেন-ই। তিনি নিশ্চয় ওর মানসিক সুস্থতা নিয়ে ঠাট্টা করবেন না! নিশ্চয় এরা ওর সাথে দেখা করতে এসেছেন।

দয়া করা বসুন। একেবারে আদর্শ গৃহস্থের মতো অনুরোধ করল নরম্যান। যদিও একটা পাগলাগারদে, কোনও পাগল গৃহস্থ হতে পারে না। ওর অনুরোধ মেনে বসলেন দুজনেই। বিব্রতকর এক নীরবতা ভর করল উপস্থিত সবার মাঝে।

আচমকা নরম্যান বুঝতে পারল, আগন্তুক দুজন-ও ওর মতোই ইতস্তত বোধ করছে। কীভাবে কথা শুরু করবে, তা নিজেরাও বুঝে উঠতে পারছে না! আবহাওয়ার উপর দিয়েই চালিয়ে দেই, ভাবল নরম্যান।

একটু আগে কত আলো ছিল, আর এখন! ঝড় আসবে মনে হচ্ছে!

বসন্তের দিনে যা হয়। আগে থেকে কিছুই আঁচ করা যায় না! বললেন ডা. ক্লেইবন। কিন্তু নান মেয়েটা তখনও চুপ করে রইল।

আবহাওয়ার প্রতিবেদন তো শেষ হলো, এবার কী নিয়ে কথা বলা যায়? ভাবল নরম্যান।

ঠিক তখনই কথা বলে উঠল সিস্টার বারবারা। টেবিলে রাখা বইয়ের দিকে ইঙ্গিত করে জানতে চাইল, আশা করি বিরক্ত করছি না!

একদম না, সময় কাটাচ্ছিলাম কেবল। বইটা বন্ধ করে সরিয়ে রাখল নরম্যান।

কী পড়ছিলেন?

মরেনোর জীবনী?

মরেনো? রোমানিয়ার সেই মনোবিদ?

সিস্টার বারবারার মুখ থেকে এই প্রশ্নটা আশা করেনি নরম্যান। আপনি তার নাম শুনেছেন?

শুনেছি মানে! তিনি-ই তো সাইকোড্রামা পদ্ধতির উদ্ভাবক!

মুচকি হেসে নড করল নরম্যান। ঠিক বলেছেন। তবে এখন আর ওসব প্রাচীন পদ্ধতি ব্যবহার হয় না।

ঠিক বলেছে নরম্যান। প্রায় সাথে সাথেই বলে উঠলেন ডা. ক্লেইবর্ন। এখন আর আমরা ওসব পদ্ধতি খাটাই না। তবে কেউ যদি তার কল্পনাকে নাটকে অভিনয় না করে মুখে বলতে চায়, তাহলে আমাদের আপত্তি নেই।

এমনকি কোনও রোগীকে স্টেজে তুলে তাকে বোকা বনতে দিতেও আপত্তি নেই। একটু খোঁচাই দিল নরম্যান।

ওসব কথাও এখন অতীত। হাসলেন ডাক্তার, কিন্তু চেহারায় কিছুটা দুশ্চিন্তার ছাপ পরিষ্কার দেখতে পেল ও। তবে এখনও বলি, তোমার অভিনয় কিন্তু দারুণ হয়েছিল।

অবাক চোখে দুজনের দিকে তাকালো সিস্টার বারবারা। আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না।

আমাদের এখানে নাটক অনুষ্ঠিত হয়। মেয়েটাকে বোঝাবার চেষ্টা করল নরম্যান। বলতে পারেন, ডা. ক্লেইবর্ন মরেনোর প্রস্তাবনাকে একটু ঘষামাজা করে এই পদ্ধতি খাঁটিয়ে থাকেন। যাই হোক, তিনি আমাকে প্রায় ধরে বেঁধে একটা নাটকে অভিনয় করিয়েছেন।

ধরে বেঁধে? কীভাবে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। সিস্টার বারবারার কথার মাঝে বাঁধা পড়ায়, বিরক্তির সাথে চোখ তুলে বিরক্তির উৎসের দিকে তাকালো নরম্যান। ওটিস, চতুর্থ তলার ছেলে নার্সদের একজন ঘরে এসে প্রবেশ করেছে। ডা. ক্লেইবর্নের কাছে গিয়ে দাঁড়াল সে।

বলো, ওটিস? বললেন ডাক্তার সাহেব।

ডা. স্টাইনারের জন্য একটা লং ডিসট্যান্স কল এসেছে।

ডা. স্টাইনার তো শহরেই নেই। মঙ্গলবার সকালের আগে তাকে পাওয়া যাবে না।

আমি তো তা বলেইছি। কিন্তু যে লোক ফোন করেছে, সে আপনার সাথে কথা বলতে চাইছে। খুব নাকি জরুরী ব্যাপার।

নাম জিজ্ঞাসা করেছ?

মি. ডিসকল।

নাম-ই শুনিনি কখনও।

বলছে, সে নাকি হলিউডের কোন স্টুডিওর প্রযোজক।

চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালেন ডা. ক্লেইবর্ন। ঠিক আছে, আমি আসছি। সিস্টার বারবারার দিকে তাকিয়ে হাসলেন তিনি। হয়তো আমাদের দিয়ে কোনও সাইকোড্রামা করাতে চায়। মেয়েটার একদম কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি, উঠতে সাহায্য করতে চান। আজকের মতো তাহলে এতোটুকুই থাক।

থাকতেই হবে? অনুনয়ের সুরে জানতে চাইল সিস্টার বারবারা। আপনি আসা পর্যন্ত নাহয় আমি এখানেই থাকি।

নরম্যান টের পেল, একটু আগের সেই বন্দির মতো অনুভুতিটুকু আবার ফিরে আসছে ওর মাঝে। কিন্তু কোনও কথা বলল না সে। আসলে ভেতর থেকে উঠে আসা একটা কণ্ঠ ওকে মুখ খুলতে নিষেধ করছে।

চাইলে থাকতে পারেন। আমার বেশিক্ষণ লাগবে না। এই বলে ওটিসকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি। কিন্তু নরম্যান বুঝতে পারল, দরজার ওপাশে গিয়েই লোকটাকে নিচু গলায় কয়েকটা নির্দেশ দিলেন ডাক্তার। কিছুক্ষণ এক হয়ে থাকার পর, আলাদা হয়ে গেল ছায়া দুটো। একটা এগোল করিডরের দিকে, অন্যটা দরজার ওপাশেই দাঁড়িয়ে রইল।

অর্থাৎ, ওটিস দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে!

হালকা একটা আওয়াজ শুনে, সিস্টার বারবারার দিকে মনোযোগ ফিরিয়ে আনল নরম্যান। মেয়েটা তসবী টানছে।

আচ্ছা, এই নান থাকতে চাইল কেন?

আপনি সাইকোড্রামা সম্পর্কে কী করে জানেন, সিস্টার?

কলেজে একটা কোর্স ছিল।

বুঝলাম। কলেজেই কি আমার ব্যাপারে জানতে পেরেছেন?

বন্ধ হয়ে গেল তসবী টানার আওয়াজ। মনে মনে খুশী হয়ে উঠল নরম্যান। মেয়েটার পুরোপুরি মনোযোগ দখল করতে পেরেছে সে। পুরো পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ এখন ওর হাতে। অনেক…অনেক বছর পর পরিস্থিতি নিজ নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে সে। অসাধারণ এক অনুভুতি। এতো দিন অন্যের হাতের পুতুল হয়ে থাকতে হয়েছে ওকে। এখন নিজেই বানিয়েছে অন্যকে তার হাতের পুতুল! সামনে বসা মেয়েটা দশাসই হতে পারে, হতে পারে মেয়েলি সৌন্দর্য বিবর্জিত। কিন্তু মানুষ তো!

মানুষ! নারাও মানুষ! হঠাৎ ওই আপাদমস্তক ঢেকে রাখা কাপড়ের নিচে যে দেহটা আছে, সেটা দেখার সুতীব্র ইচ্ছা জেগে উঠল ওর মনে। নানরা মাথার চুল কামায়। কিন্তু নিচে? নিচের দিকটাও কি কামিয়ে রাখে?

হ্যাঁ। বলল সিস্টার বারবারা।

চমকে উঠল নরম্যান। এই নান আবার মন পড়তে সক্ষম না তো! পরমুহূর্তেই বুঝতে পারল, একটু আগে করা প্রশ্নটার উত্তর দিচ্ছে সিস্টার। কী শিখেছেন আমার ব্যাপারে?

নিজের চেয়ারে নড়ে চড়ে বসল সিস্টার বারবারা। বেশি কিছু না। আমাদের পাঠ্য বইয়ের একটা ফুটনোটে আপনার নাম ছিল।

পাঠ্য বইয়ে? হুম। আমার কেসটা তাহলে একদম সাধারণ।

আমি…আমি আসলে আপনাকে বিব্রত করতে চাইনি–

কী ভেবেছিলেন? কথাটা শুনে আমি কেমনবোধ করব? অন্য কাউকে সঠিক উত্তর খুঁজে বের করার কাজে হাবুডুবু খেতে দেখে ভালোই লাগছে নরম্যানের।

মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলে সে জানতে চাইল, এখানে এসেছেন কেন সিস্টার? রবিবার কি চিড়িয়াখানা বন্ধ থাকে?

চোখ তুলে চাইল সিস্টার বারবারা। ভেবেছিলাম, আপনার সাথে কথা বলার সুযোগ পাব। আসলে আপনার নাম ওই বইতে পড়ার পর, আমি অনেকগুলো খবরের কাগজ ঘেঁটে দেখেছি। আগ্রহ জন্মেছে আমার মনে-।

আগ্রহ? নরম্যানের কণ্ঠ যেন বিদ্রোহ করে বসল। ভয় পাননি? ঘৃণা জন্মায়নি মনে? মনে হয়নি, নরকের কোনও কীটের ব্যাপারে পড়ছেন?

ফিসফিসিয়ে জবাব দিল সিস্টার বারবারা, হয়েছে। যেসব অনুভূতির কথা বললেন, তার প্রত্যেকটাই হয়েছে। আপনাকে মনে হয়েছে কোনও দানব। মনে হয়েছে, প্রতিটা অন্ধকার ছায়ার আড়ালে ছুরি হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন আপনি। পরবর্তী কয়েকটা মাস আমি আপনাকে মন থেকে সরাতে ব্যর্থ হয়েছি। বারবার আমার দুঃস্বপ্নে হানা দিয়েছেন আপনি। কিন্তু এখন? এখন পরিবর্তন হয়েছে সেসব

কীভাবে?

ব্যাখ্যা করে বোঝাতে পারব না। কিন্তু এই অর্ডারের সদস্য হবার সাথে সাথে যেন আমার মাঝে অদ্ভুত এক শক্তি এসে ঠাঁই নিয়েছে। সদস্য হবার আগে আমাদেরকে আলাদাভাবে ধ্যান করতে হয়। নিজেদের গোপন চিন্তা, গোপন পাপ নিয়ে চিন্তা করতে হয়। হয়তো সেজন্যই।

সাইকিয়াট্রিক কিন্তু পাপে বিশ্বাস করে না।

কিন্তু নিজের কৃতকর্মের দায়ভার নেয়ায় তো বিশ্বাস করে? অনেক দিন ধরে চিন্তা করার পর, আমি একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি। আপনি সজ্ঞানে কোনও অপরাধ করেননি। তাহলে কীভাবে আপনাকে সেসব অপরাধের জন্য দায়ী বলা যায়? বরঞ্চ আপনাকে না বুঝেই অপবাদ দেবার অপরাধে আমি অপরাধী। পরে। যখন জানতে পারলাম যে আজ এখানে আসছি, ঠিক সেই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম, আপনার সাথে দেখা করব-ই করব।

ক্ষমা চাইতে? নরম্যান মাথা নাড়ল। সত্যি কথাটা অন্তত নিজেকে বলুন। আপনি এখানে এসেছেন কৌতূহলবশত। আপনি এসেছেন দানবটাকে দেখার জন্য। কষ্ট করে এসেছেন যখন, তখন মন ভরে দেখে নিন।

বাতির আলোয় দীর্ঘক্ষণ নরম্যানের দিকে তাকিয়ে রইল সিস্টার বারবারা। তারপর আপ্লুত কণ্ঠে বলল, আমি ধূসর হতে শুরু করা চুল দেখতে পাচ্ছি, দেখতে পাচ্ছি কপালের ভাঁজ। এই চেহারা যার, সে বড় অশান্তির মাঝে দিন কাটাচ্ছে। তুমি কোনও দানব নও, আবেগে প্রায় বন্ধ হয়ে এল গলা। তুমি…তুমি একজন পুরুষ।

শুনে ভালো লাগল?

মানে?

এর আগে কেউ কখনও আমাকে পুরুষ বলেনি। বলল নরম্যান। এমনকি আমার মা-ও না। সে ভাবত, আমি দুর্বল, মেয়েলি এক মানুষ। আর অন্য ছেলেদের কথা কী বলব- বুজে আসতে চাইল নরম্যানের কণ্ঠ।

বলো, প্লিজ বলো। আমি শুনতে চাই। সিস্টার বারবারা আবার ওর দিকে চেয়ে আছে।

আসলেই শুনতে চায় এই মেয়েটা!

আমি জন্ম থেকেই ভঙ্গুর স্বাস্থ্যের ছিলাম। কণ্ঠ ফিরে পেল যেন নরম্যান। এই কয়েক বছর আগেও, বই পড়ার জন্য চশমা ব্যবহার করতে হতো। খেলাধুলাতেও ভালো ছিলাম না। স্কুলের পড়া শেষ হলে, মাঠে বেসবল খেলতে যেতাম। বয়স্ক ছেলেরা ক্যাপ্টেন হতো। একজন একজন করে নিজের দলের জন্য ছেলেদের বাছতো তারা। আমি সব সময় শেষে… ঢোক গিলল সে। বাদ দাও, তুমি বুঝবে না।

এতক্ষণ এক দৃষ্টিতে ওর চেহারার দিকে তাকিয়ে ছিল সিস্টার বারবারা। এবার নড করল। আমার সাথেও ঠিক এমনটা হয়েছে।

তোমার সাথেও?

হ্যাঁ, তসবীর উপর থেকে কখন যেন হাত সরিয়ে নিয়েছে সিস্টার। আমি বাঁ হাতি। মেয়েরাও তো বেসবল খেলে। বাঁ হাতি হবার জন্য বল খুব ভালো ছুঁড়তে পারতাম আমি। তাই আমাকে সব সময় সবার প্রথমে বেছে নেয়া হতো।

তাহলে মিল হলো কোথায়? পুরো উল্টো হলো না?

উল্টো, কিন্তু একদম মিলে যায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলল বারবারা। তোমাকে সময়ে মেয়েমানুষ মনে করা হতো। আর আমাকে? পুরুষালী। শেষে বেছে নেবার জন্য তোমার যে কষ্ট হতো, প্রথমে বেছে নেবার জন্য সেই একই কষ্ট হতো আমারও!

বদ্ধ, আঠালো হয়ে এসেছে। জানালা দিয়ে যেন ভেতরে প্রবেশ করতে চাইছে। ছায়ারা। নাকি বাইরে বেরোতে? কে জানে!

সম্ভবত আমার অনেক সমস্যার একটা ছিল এটা, বলল নরম্যান। অন্য সমস্যার কথাও তো জানো। আমি…আমি ট্রান্সভেস্টাইট, বিপরীত লিঙ্গের পোশাক পরতাম। অন্তত তোমার তো নিজের সত্ত্বাকে হারাতে হয়নি। ভুলে যেতে হয়নি নিজ লিঙ্গকে!

হয়নি? হাত থেকে তসবীটাকে ছেড়ে দিল সিস্টার বারবার। নান-এর লিঙ্গ কী জানো? ক্লীব! এমনকি আমার আসল নামটাও আমার কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে। হাসল মেয়েটি। আমার অবশ্য তাতে কোনও আপত্তি নেই। যাই হোক, যেটা বলছিলাম। তোমার আমার মাঝে তেমন কোনও পার্থক্য নেই কিন্তু!

নরম্যান তীব্রভাবে চাইছিল মেয়েটার কথা বিশ্বাস করতে। কিন্তু না, বাতির আলোয় দুজনের মাঝে পার্থক্য টেনে দেয়া বস্তুটার ছায়া পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিল। ও। জানালার গরাদের ছায়া।

একটা পার্থক্য আছে। বলল সে। তুমি এখানে আসতে চেয়েছ বলে এসেছ। যখন চলে যেতে চাইবে, চলে যাবে। কিন্তু আমি? আমার ইচ্ছার কোনও মূল্য নেই!

ইচ্ছা? মাথা নাড়ল সিস্টার বারবারা। মানুষের ইচ্ছার আবার কী মূল্য? আমি এসেছি, কারণ ঈশ্বর আমাকে এখানে পাঠিয়েছেন। চলে যাব, যখন ঈশ্বর। আমাকে এখানে আর রাখতে চাইবেন না, তখন। আচমকা একটা ঝলক আলো ঘরের ভেতরে প্রবেশ করায় থেমে গেল সিস্টার।

জানালার দিকে তাকিয়ে এই আচমকা এসে পড়া আলোর উৎস খুঁজতে চাইল নরম্যান, পরমুহূর্তেই বজ্রপাতের শব্দে কেঁপে উঠল জানালার গরাদ।

ঝড় এসে পড়েছে বলে মনে হচ্ছে। –কুঁচকে সিস্টারের দিকে তাকাল নরম্যান। কী হলো?

উত্তরের অপেক্ষা করতে হলো না ওকে, নিজেই সেটা বুঝতে পারছে। বাতির আলোয় কাগজের মতো সাদা দেখাচ্ছে মেয়েটার চেহারা। ভয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। ঐশ্বরিক আভা, এমনকি পুরুষালীভাবটাও উধাও হয়ে গিয়েছে চেহারা থেকে। ভয় জায়গা করে নিয়েছে সেখানে।

তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল নরম্যান। জানালার কাছে গিয়ে সবুজাভ পর্দাটা টেনে দিল। এখন ঠিক আছে?

হ্যাঁ, ধন্যবাদ। ভয়ের চোটে অবচেতন মনেই কখন যেন তসবীটা হাতে তুলে নিয়েছিল সিস্টার বারবারা। এখন আবার সেটা হাত গলে খসে পড়ল।

তসবীর গুটিগুলো বাড়ি খেল একটা আরেকটার সাথে। একদৃষ্টিতে সেদিকে চেয়ে রইল নরম্যান। এসব সাইকোলজির বুলি কপচানো, ঈশ্বরের গুণগান গাওয়া-সব ভাঁওতাবাজি। বজ্রপাতের আওয়াজ শোনার সাথে সাথে ওসব হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে। ওর সামনে বসে থাকা মেয়েটা আর দশটা মেয়ের মতোই। এমনকি নিজের ছায়াকেও ভয় পাচ্ছে এখন।

ছায়া…ওদের চারপাশে এখন শুধু ছায়াবাজি চলছে। হঠাৎ দরজার দিকে নজর গেল ওর, সাথে সাথে বুঝতে পারল-সামনের করিডরটা একদম খালি পড়ে আছে। কারণটাও বুঝতে পারল। ঝড় শুরু হলে, উপরের উন্মাদগুলোর উন্মাদনা আরও বেড়ে যায়।

ঈশ্বর নিশ্চয় ওটিসকে উপরে পাঠিয়েছেন।

সিস্টার বারবারার দিকে তাকালো নরম্যান। ঠিক আছে তো?

একদম ঠিক আছি। বলল বটে মেয়েটা, কিন্তু গলার কম্পন থামাতে ব্যর্থ হলো।

বজ্রপাতের ভয়ে কাঁপছে মেয়েটা, আর দশটা সাধারণ মেয়ের মতোই।

সাধারণ মেয়ে-শব্দ দুটো মাথায় আসার সাথে সাথে নরম্যানের মনে হলো, শরীরের সব রক্ত যেন নিজের দিকে ধাবিত হয়েছে। দুর্বল…সাধারণ এক মেয়ে। নিজেকে সামলাবার একটা মাত্র উপায়ই জানে সে। সেটাই খাটালো, তিক্ত কথা উচ্চারণ করল, আমাকে একটু আগে কী বললে, তা মনে আছে তো? ঈশ্বর যদি তোমাকে এখানে পাঠিয়ে থাকে, তাহলে নিশ্চয় ঝড়টাকেও তিনিই পাঠিয়েছেন।

মুখ তুলে চাইল সিস্টার বারবারা। এসব কথা বলতে নেই। তুমি কী ঈশ্বরের ইচ্ছায় বিশ্বাস রাখো না?

মুহূর্মুহু বজ্রপাত হচ্ছে, সেই শব্দগুলো যেন সরাসরি ধাক্কা মারছে নরম্যানের মস্তিষ্কে। আচমকা উজ্জ্বল হয়ে উঠল চারপাশ। ঈশ্বরের ইচ্ছা! ঈশ্বরের কাছে। প্রার্থনা করেছিল ও, সেই প্রার্থনার ফল মিলেছে।

করি, বিশ্বাস করি।

উঠে দাঁড়াল নান। যেতে হয় এখন। সিস্টার কুপারটাইন নিশ্চয় দুশ্চিন্তা করবেন।

দুশ্চিন্তার কিছু নেই। বলল বটে নরম্যান, কিন্তু নিজেকে উদ্দেশ্য করে। বহুবছর আগে…যখন সব কিছুর শুরু…তখনও এমন বৃষ্টিপাত হচ্ছিল। এখন আবার হচ্ছে। নিশ্চয় স্বর্গ থেকে আসছে এই বারিধারা।

ঈশ্বরের ইচ্ছাই আদেশ।

আবারও বজ্রপাতের আওয়াজে কেঁপে উঠল চারপাশ। কিন্তু সে শব্দ নরম্যানের কানে ঢুকলে তো! ওর শ্রবণ ইন্দ্রিয়ের সবটা জুড়ে এখন কেবল সিস্টার বারাবারার তসবী থেকে আসা শব্দ!

মেয়েটার পিছু পিছু বইয়ের তাকের ছায়ায় অদৃশ্য হয়ে গেল নরম্যান বেটস।

.

০৪.

নতুন রোগীর সাথে দেখা করার সুযোগ হয়ে ওঠেনি সিস্টার কুপারটাইনের। টাকারের রুমে থাকা অবস্থায় ঝড় শুরু হয়ে গেল বলে, আর দেরি করেননি তিনি। যখন নিচে নেমে এসেছেন, তখন অবিরাম বর্ষণ শুরু হয়ে গিয়েছে!

যতটা দ্রুত সম্ভব, করিডরের গোলক ধাঁধাঁ পার হয়ে যাবার প্রয়াস পেলেন তিনি। তার সাথে যোগ দিয়েছে রোগীদের আত্নীয় স্বজনও। পঞ্চম তলার এলিভেটরের সামনে এসে দেখতে পেলেন, দরজার সামনে ভিড় জমে গিয়েছে। এলিভেটর থামার সাথে সাথে হুড়মুড় করে ভেতরে প্রবেশ করল সবাই। সিস্টার কুপারটাইন ঢুকে পড়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন। কিন্তু ভেতরে এমন অবস্থা হয়েছে যে এক চুল নড়ার অবকাশ নেই! বয়স্কা সিস্টারকে পাত্তাই দিল না কেউ! যারা উঠতে পারল না, তাদের মাঝেও কোনও ভ্রূক্ষেপ দেখা গেল না।

নেই, এখন আর সম্মান নেই। মানীকে সম্মান দেবার মতো মানসিকতা সম্পন্ন মানুষও নেই। কী যে দিন কাল এল!

মি. টাকারও আজ কেমন যেন অন্যরকম আচরণ করছিলেন। একসাথে প্রার্থনা করার আহ্বানে কান তো দেনইনি, উল্টো বাজে সব গালাগাল দিয়ে বসেছেন। অবশ্য মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষের কাছ থেকে এমন আচরণ পেলে তাতে অবাক হবার কিছু নেই। যেখানে সিস্টার বারবারা সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ হয়ে তাকে অসম্মান করেছে, সেখানে অসুস্থ মি. টাকারের আচরণ তো কিছুই না! কনভেন্টে ফিরেই মাদার সুপেরিয়রের সাথে এ ব্যাপারে আলাপ করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন সিস্টার।

এলিভেটরটা ফিরে আসতে আসতে আরও কয়েকবার বজ্রপাত হলো। এবার সিস্টার কুপারটাইন সবার প্রথমেই ঢুকে পড়লেন। চতুর্থ তলা…আর তৃতীয় তলাতেও উঠল কয়েকজন। সবার চাপে এলিভেটরের একদম পেছনের দিকে চলে গেলেন সিস্টার কুপারটাইন। লবিতে এসে যখন থামল ওটা, তখনও সবার বের হবার জন্য অপেক্ষা করতে হলো তাকে।

এলিভেটর থেকে নেমে, চারপাশে একবার নজর বুলালেন তিনি। রিসিপশন এলাকা প্রায় জনশূন্য। সিস্টার বারবারা-কেও দেখা যাচ্ছে না। ডেস্কের পেছনে রাখা দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালেন তিনি। পাঁচটা বেজে দশ। বাইরে অন্ধকার রাজত্ব করছে। এমনভাবে বৃষ্টি পড়ছে, যেন বহুদিন সে মাটিকে স্পর্শ করার সুযোগ পায়নি।

হে ঈশ্বর, ভ্যানে যাবার আগেই তো ভিজে একসা হয়ে যাব! মেয়েটা গেল কোথায়?

ডেস্কের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি, সাথে সাথে চোখ তুলে চাইল রিসিপশনিষ্ট মেয়েটা। আমি কীভাবে আপনাকে সহায়তা করতে পারি?

কোনওক্রমে হাসলেন সিস্টার কুপারটাইন। আমি আসলে সিস্টার বারবারাকে—

বজ্রপাতের শব্দে ঢাকা পড়ে গেল সিস্টারের প্রশ্ন আর রিসিপশনিস্টের জবাবের অংশবিশেষ।

-এক মিনিট আগেই বেরোতে দেখলাম।

বের হয়ে গিয়েছে! আপনি নিশ্চিত?

জ্বি, সিস্টার। চিন্তিত মনে হলো মেয়েটাকে। কেন, কোনও অসুবিধা?

না, না। অনেক অনেক ধন্যবাদ। শুধু শুধু মেয়েটাকে দুশ্চিন্তায় ফেলে দেবার কোনও মানে হয় না। কিন্তু অসুবিধা তো আছেই! এমনভাবে আদেশ অমান্য করার সাহস সিস্টার বারবারা পেল কোথায়! রাত পোহাবার আগেই, মাদার সুপেরিয়র এই ঘটনার ব্যাপারে শুনতে পাবেন।

অবশ্য যদি সহি-সালামতে কনভেন্টে পৌঁছাতে পারেন তবেই। এমন ভয়াবহ ঝড়ের মাঝে অতটা পথ পাড়ি দিতে হবে, ভাবতেই ভয় লাগছে!

এক মুহূর্তের জন্য থেমে দাঁড়িয়ে, দরজার কাঁচ লাগানো অংশটা দিয়ে বাইরে তাকালেন সিস্টার কুপারটাইন। ঠিক সেই মুহূর্তেই যেন ঈশ্বর পাঠিয়ে দিলেন আরেকটা বজ্রপাত। এক ঝলক আলোয় পার্কিং লটের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ভ্যানটা পরিষ্কার দেখা গেল। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ! সেই সাথে মাথার ভারী কাপড়টার জন্যও ধন্যবাদ!

দরজা খুলে বাইরে বের হলেন তিনি। পানির ধারা এসে তার ভারী জুতা আর দেহের পোশাক ভিজিয়ে দিল। ভ্যান পর্যন্ত অর্ধেক দূরত্ব পাড়ি দেবার আগেই দেখা গেল, পানির ফোঁটা তার চশমার কাঁচ একদম ভিজিয়ে দিয়েছে। বলতে গেলে প্রায় অন্ধ তিনি এখন! কাঁচ পরিষ্কার করার জন্য চশমা খুলতেই, হোঁচট খেলেন নান। তীব্র এক ঝলক ব্যথা তার মুখ দিয়ে চিৎকার বের করে আনল। ব্যথার ঝলকটা শেষ হয়ে যেতে সিস্টার কুপারটাইন বুঝতে পারলেন, চোখের উপরে নেই সেই চশমা। অন্ধকারের মাঝে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব জেনেও, চেষ্টা চালালেন। কিন্তু না, মিলল না সেগুলো। ঈশ্বরের কৃপায় অবশ্য কনভেন্টে আরেক জোড়া আছে। তাই এই মুহূর্তে আর সময় নষ্ট না করে, বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার ব্যাপারে চিন্তা করা উচিত।

অন্ধের মতোই এগিয়ে গেলন তিনি। কয় পা এগিয়েছেন বলতে পারবেন না, আচমকা একটা ইঞ্জিন চালু হবার আওয়াজ কানে এল তার। চোখ তুলে দেখতে পেলেন, ভ্যানটা এগোতে শুরু করেছে! মানে কী! সিস্টার বারবারা কি ওকে এখানেই ফেলে রেখে যেতে চায়?

দাঁড়াও! আলোর উৎসের দিকে চিৎকার করতে করতে এগোলেন তিনি। ভ্যানটা দাঁড়িয়ে গেলে, হাচড়ে পাঁচড়ে সিস্টার প্যাসেঞ্জার সীটে উঠে এলেন।

ইঞ্জিন আবার গর্জন করতে শুরু করার সাথে সাথে কথার বড়ি ছোটালেন বয়স্কা নান। কোথায় ছিলে তুমি? লবিতে দেখলাম না যে? বিচারবুদ্ধি এখনও জন্মায়নি? গাড়ির কাছে যদি একা একা আসতেই হতো, তাহলে তো এটা দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে আমাকে তুলে নিতে পারতে?

আমি দুঃ–তার সঙ্গিনীর কণ্ঠস্বর বজ্রপাত্রে আড়ালে তলিয়ে গেল। অবশ্য না গেলেও তেমন কিছু যেত-আসত না। কেননা সিস্টার কুপারটাইনের কথা এখনও শেষ হয়নি।

ভিজে একসা হয়ে গিয়েছি! চশমাটা যে কই পড়ল, ঈশ্বর জানেন! কী আর বলব…এই, দেখে শুনে চালাও!

ভ্যানটা আরেকটু হলেই খাদে পড়ে যেত, শেষ মুহূর্তে সামলে নিল সিস্টার বারবারা।

দয়া করে দেখে চালাও- বলতে বলতে থেমে গেলেন বয়স্কা নান। তার বকাঝকা যে এই মুহূর্তে কেবল সঙ্গিনীর মনঃসংযোগে শুধু সমস্যাই সৃষ্টি করবে, তা এতোক্ষণে বুঝতে পারলেন। চুপ হয়ে গেলেন সাথে সাথে।

বৃষ্টির পানি মুছে সুবিধা করতে পারছে না ওয়াইপার দুটো। সামনের রাস্তা একদম আবছা দেখা যাচ্ছে। সিস্টার বারবারা তার দিকে একবার তাকাল বটে, কিন্তু কিছু বলল না। অন্ধকারে কমবয়সী সঙ্গিনীর মনের ভাব একদম বুঝতে পারলেন না সিস্টার কুপারটাইন। এক মুহূর্ত পরেই, সামনের দিকে নজর দিল সিস্টার বারবারা। ভেজা, পিচ্ছিল রাস্তায় গাড়িটার নিয়ন্ত্রণ রাখতে কষ্ট হচ্ছে!

সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে আছেন সিস্টার কুপারটাইন। একগাদা গাছের অবয়ব নজরে পড়ল তার, ওগুলোর পাশ দিয়ে একটা পার্শ্ব-রাস্তা চলে গিয়েছে। সেই পার্শ্ব-রাস্তা দিয়েই ভ্যানটাকে ঢুকিয়ে দিল সিস্টার বারবারা!

ভুল পথে যাচ্ছ তো! ঝড়ের আওয়াজ ছাপিয়ে বলে উঠলেন বয়স্কা নান। কিন্তু সিস্টার বারবারা শুনতে পেয়েছে বলে মনে হলো না, বা শুনলেও পাত্তা দিল না। ভ্যানটা আঁকা বাকা হয়ে থাকা গাছের নিচ দিয়ে এগিয়ে নিয়ে গেল।

শুনতে পাচ্ছ না? সঙ্গিনীর পোশাকের হাত ধরে টান দিলেন সিস্টার কুপারটাইন। ভুল পথে যাচ্ছ তো!

এবার নড করল সিস্টার বারবারা, গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল সে। ডান হাতে ইগনিশন থেকে চাবীটা তুলে নিয়ে, বাঁ হাত চালিয়ে দিল ভ্যানের ফ্লোরের দিকে। এক মুহূর্তের জন্য সিস্টার কুপারটাইনের মনে হলো, চোখের সামনে যেন কোনও শিকারী পাখি এসে উপস্থিত হয়েছে!

কেবলমাত্র এক মুহূর্তের জন্য মেঝের দিকে ঝুঁকে রইল সিস্টার বারবারার অবয়ব। এরপরই সোজা হয়ে বসল সে। আর ঠিক সেই ক্ষণটাতেই দুনিয়া আলোকিত হয়ে উঠল বিদ্যুত চমকে!

সেই আলোতে অদ্ভুত দর্শন, বিকৃত চেহারাটা দেখতে পেলেন সিস্টার কুপারটাইন। সেই সাথে সামনের থাকা মানুষটার হাতে ধরা লোহার রডটাও! এমনকি তার দিকে ওটার তীব্রগতিতে এগিয়ে আসাও পরিষ্কার বুঝতে পারলেন! তবে বজ্রপাতটার আওয়াজ আর শোনা হলো না তার!

.

০৫.

হাঁপাতে হাঁপাতে কোমর দুলিয়ে চলছে নরম্যান। ভ্যানের পেছন দিকটায় অনেকটুকু ফাঁকা জায়গা। পোশাকের আবরণ সরিয়ে, মৃত পা জোড়াকে খুব সহজেই ছড়িয়ে দেয়া গেছে। অন্য নান, মানে সিস্টার বারবারার নিচের দিকটা নির্মল ছিল। কিন্তু এর আবার অভ্যাস অন্য। ওই কমবয়সীটাকেই মনে মনে চাচ্ছিল নরম্যান। তবে আফসোস, কিছু করার সময় পায়নি। এমনকি ভালোভাবে যে দেখবে, সে সুযোগও হয়নি।

এই মালটা আবার বয়স্ক, কিন্তু এখন তার হাতে সময় আছে। অবশ্য চোখ মুদলে যখন কিছু দেখা যায় না, তখন অনুভূতিটাই আসল হয়ে দাঁড়ায়।

ঈশ্বর…হায়, ঈশ্বর…

হাঁপাতে হাঁপাতেই একদিকে সরে বসল নরম্যান। সারা দেহ ঘামে ভিজে চুপসে আছে। কিন্তু শেষ হয়েছে কাজটা। ঈশ্বর…ঈশ্বরই ওকে শয়তানের হাত থেকে বাঁচাতে এই নানদেরকে পাঠিয়েছেন। ঈশ্বরের স্ত্রী এখন তার স্ত্রী। অনেক বছর আগে যেমন নরম্যান জাতি ইংল্যান্ড জয় করেছিল, আজ তেমনি নরম্যান বেটস জয় করে নিয়েছে ঈশ্বরের স্ত্রীকে!

অন্ধকারে মুচকি হাসতে হাসতে মাথার কাপড়টা জায়গামতো বসিয়ে নেয়ার চেষ্টা করল ও। নিখুঁত ছদ্মবেশ। সিস্টার কুপারটাইনকে সে বোকা বানিয়েছে। শুধু তাকেই না, সবাইকেই বোকা বানাতে সক্ষম হয়েছে ও। অবশ্য মেয়ে মানুষের চরিত্রে অভিজ্ঞতার ঝুলি কম ভারী নয় তার।

বিশ্বটাই একটা রঙ্গমঞ্চ। এখানে নানা চরিত্রে অভিনয় করে যেতে হয়।

এই যেমন আজ রাতেই প্রথমে একবার নারীর চরিত্রে, আর পরে আবার পুরুষের চরিত্রে অভিনয় করতে হয়েছে ওকে। আপনমনেই হাসছিল সে, কিন্তু বজ্রপাতের আওয়াজে সম্বিত ফিরল। আরেকবার যখন বিদ্যুত চমকালো, পাশে শুয়ে থাকা ভূতুড়ে দেহটার দিকে তাকিয়ে ভয়ে কেঁপে উঠল বেচারা। তাড়াতাড়ি লাশটার স্কার্ট নামিয়ে উরু আর পা ঢেকে ফেলল। এই দেহের আর কোনও দরকার নেই ওর, এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এর একটা ব্যবস্থা করতে পারলে হয়।

কিন্তু ব্যবস্থা করবে কী ভাবে?

বৃষ্টিস্নাত উইন্ডশিল্ড দিয়ে বাইরে তাকালো নরম্যান। রাস্তার আর গাছের মাঝখানে একটা ছোট গর্ত মতো আছে। ওখানে লাশটাকে পাতা-পুতা দিয়ে ঢেকে রাখা যায়। কিন্তু বেশিক্ষণ লুকিয়ে রাখা যাবে না। অতিসত্ত্বর কেউ না কেউ এদিকে এসে জিনিসটাকে আবিষ্কার করে ফেলবে। তবে যদি কবর খোঁড়া যায় তো…

ঘুরে তাকাল নরম্যান। আরেকটা বিদ্যুত চমকের আলোয়, ভ্যানে কী কী জিনিস আছে তা পরিষ্কার দেখতে পেল। লোহার রডটা তো আছেই, কিন্তু কোনও বেলচা নেই, থাকার কথাও না। এদিকে খালি হাতে তো আর কবর খোঁড়া সম্ভব না! চমকে উঠে নরম্যান টের পেল, কাঁপছে ও! এর জন্য ঠান্ডার সাথে সাথে, আরও অন্য কিছুও দায়ী।

আরেকটা উপায় নিশ্চয় আছে। হে ঈশ্বর…থাকতেই হবে!

ভ্যানের সামনের দিকে এগোল নরম্যান, হঠাৎ ওর পাশে কিছু একটা যেন নড়ে উঠল। হাত বাড়িয়ে দিতেই, ধাতব একটা কন্টেইনারের স্পর্শ পেল ও। চোখের কাছে ওটাকে তুলে ধরতেই ভেতর থেকে ভেসে আসা আওয়াজে বুঝতে পারল, তরল কিছু একটা দিয়ে ভর্তি ওটা। কন্টেইনারের গাঁয়ে লেখা কাগজটা পড়ার আগেই নরম্যানের নাক জানিয়ে দিল, গ্যাসোলিন হাতে ধরে রেখেছে সে। নিশ্চয়। জরুরী অবস্থায় ব্যবহারের জন্য এটাকে রাখা হয়েছে।

সমস্যার সমাধান পেয়ে গিয়েছে নরম্যান।

লাশটাকে পুড়িয়ে ফেলতে হবে, সেই সাথে ভ্যানটাকেও। এরচাইতে ভালো বুদ্ধি আর হয় না!

অন্ধকারেই হাতড়াতে শুরু করল ও, ম্যাচ বাক্স খুঁজছে। কিন্তু না, একটাও নেই! ভ্যানের ভেতরে কোনও ম্যাচ বাক্স নেই। অস্বাভাবিক না ব্যাপারটা। সাধারণত, বেলচার মতো ম্যাচ বাক্সও নানদের ভ্যানে রাখার মতো জিনিস না। তবে গ্লোভ কম্পার্টমেন্টে থাকলেও থাকতে পারে।

কোনওমতো ড্রাইভিং সীটে পৌঁছে, কম্পার্টমেন্টটা খুলে ফেলল নরম্যান। ভেতরের জিনিসগুলো ওর কোলে গড়িয়ে পড়ল। একটা খালি টিস্যু বক্স, ছোট স্কু ড্রাইভার, রাস্তার ম্যাপ, ছোট ফ্ল্যাশ লাইট। কিন্তু ম্যাচ বাক্স নেই! আবারও কাঁপতে শুরু করল লোকটা। সেই দানবীয় কন্ঠস্বর গুলো ফিরে আসতে শুরু করেছে।

সাহায্য…কেউ আমাকে সাহায্য করো! নিজের কণ্ঠটা নিজের কানেই বড় অপরিচিত ঠেকল।

শান্ত হও, কোত্থেকে যেন ডা. ক্লেইবর্নের শান্ত, সমাহিত কণ্ঠ ভেসে এল। মনে রেখো, আমি তোমার হয়ে কাজ পুরো করে দিতে পারব না। শেষ পর্যন্ত তোমার নিজেকেই শেষ করতে হবে। নিজেকে সাহায্য করা শিখতে হবে।

বড় করে শ্বাস নিল নরম্যান। যেটাকে দানবীয় কণ্ঠস্বর বলে মনে করেছিল, সেটা আসলে ভ্যানের ছাদে পড়তে থাকা বৃষ্টির ফোঁটার আওয়াজ! ঠিক বলেছেন, ডা, ক্লেইবন। নিজেকে ওর নিজের-ই সাহায্য করতে হবে। শান্ত থাকতে হবে এখন। সামনে যে যে কাজ করতে হবে, তার জন্য চাই শান্ত মন আর নিষ্কল্প হাত।

ওর মনে পড়ে গেল, পেছনে একটা কম্বল দেখেছিল। অতিরিক্ত চাকাটা ঢেকে রাখা হয়েছে ওটা দিকে। ফিরে চলল নরম্যান। ভেতরে পড়ে থাকা জিনিসটাকে ওই নান জিনিসটাকে ভয় পাচ্ছে কেন জানি। অথচ কয়েক মুহূর্ত আগে…

চোখ বন্ধ করেই হাত বাড়িয়ে দিল সে, কোনওক্রমে কম্বলটা দিয়ে লাশটাকে ঢেকে দিল। আবার যখন চোখ খুলল, তখন অপার্থিব লাশটা কম্বল দিয়ে ঢাকা। ওটার নিচে যে কিছু আছে, তা বলে না দিলে কেউ আন্দাজই করতে পারবে না। আর যদি কেউ নাক গলাতে চায়, তাহলে…।

ড্রাইভিং সিটের পেছনে ছুঁড়ে দেয়া লোহার রডটা আঁকড়ে ধরল নরম্যান। সীটে বসে জিনিসটাকে দুই পায়ের ফাঁকে ফেলে দিল। বিপদে পড়লে, আত্মরক্ষা করা যাবে।

তবে সাবধানে কাজ করতে পারলে সম্ভবত তার আর দরকার হবে না। এই যে…হাতের কাঁপাকাঁপি থেমে গিয়েছে। এখন আবার গাড়ি চালানো যায়। এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দূরে চলে যেতে হবে ওকে। ইগনিশনে চাবি ঢোকাতেই, খকখক করে কেশে উঠল যন্ত্রটা। সাবধানতার সাথে গাড়িটাকে আবার রাস্তায় ফিরিয়ে আনল নরম্যান। এই ছোট একটা কাজই, ওকে শান্ত করে তুলল। ভ্যানটাকে যখন নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে, তখন নিশ্চয় নিজের জীবনকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, সেই সাথে নিজের ভবিষ্যতকেও। এখন দরকার সাবধানতার সাথে পরিকল্পনা করা।

সামনে নিশ্চয় কোনও স্টোর বা কোনও সার্ভিস স্টেশন পড়বে। ওখানে ম্যাচ। পাওয়া যাবে। তবে বাইপাস ধরে এগোলে, রাস্তার পাশে ওই দুই ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মিলবে বলে মনে হয় না। হাইওয়েতে থাকাই ভালো।

যেই ভাবা সেই কাজ।

হাইওয়েতে উঠে আরেকটু শান্ত হয়ে এলো সে। এই রাস্তায় দোকানপাট পাবার সম্ভাবনা বেশি। মনটা ফুরফুরে হয়ে উঠল নরম্যানের। কিন্তু স্টিয়ারিং হুইলের সাথে ওর হাতার ঘষা খাবার শব্দ সেই ফুরফুরে ভাবটাকে নিমিষে হাওয়া করে দিল। হাসপাতাল থেকে বেরোবার সময়, এই পোশাকটা ওকে অনেক সাহায্য করেছে। কেউ দ্বিতীয়বার ফিরেও তাকায়নি। কিন্তু এখন এই পোশাকটাই ওর জন্য শাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই বেশে কোনও গ্রাম্য দোকানে প্রবেশ করা সম্ভব না। সিস্টার বারবারা নিজে ঢুকলেও, দোকানের সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করত। আবার কোনও সার্ভিস স্টেশনে এভাবে ঢোকাও বিপদজনক। ঢুকলে কী হতে পারে, সেই দৃশ্য খেলা করে গেল ওর মনে :

বৃষ্টিস্নাত এক রবিবারের সন্ধ্যা। রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়া নেই বললেই চলে। অফিসে নিজের বাবার সাথে বসে আছে কোনও কমবয়সী ছেলে। হয়তো কমিক দেখছে, আর নয়তো শুনছে রেডিওর গান। হঠাৎ ওকে বিরক্ত করে দিয়ে একটা হর্ন বেজে উঠল।

হায় ঈশ্বর! এ যে দেখি এক নান! আর সে কিনা গ্যাস না, ম্যাচ কিনতে চাচ্ছে! ম্যাচ দিয়ে নান কী করবে? নিশ্চয় কোথাও কোনও ঘাপলা আছে। এই, বাবা, বাইরে গিয়ে দেখতো!

নরম্যান নিশ্চিত, এভাবেই ঘটবে ঘটনা!

এখন উপায়? শান্ত হও, নিজেকেই বলল। এগোতে থাকো।

কিন্তু এগিয়ে যাব কোথায়?

পোশাক যে খুলে ফেলবে, সে উপায়ও নেই। নিচে পরে থাকা হাসপাতালের নীল ইউনিফর্ম দেখা মাত্র সবাই বুঝে ফেলবে যে ও পাগলাগারদ থেকে পালিয়েছে!

ম্যাচের চাইতে, সাধারণ পোশাক এখন বেশি দরকারী হয়ে পড়েছে।

এদিকে বজ্রপাত কিন্তু থেমে নেই, প্রতি মুহূর্তে যেন ওকে বিদ্রূপ করে যাচ্ছে। বজ্রপাত নাকি ঈশ্বরের কণ্ঠ। কিন্তু ঈশ্বর ওকে বিদ্রূপ করবেন কেন? তা-ও আবার এতো দূর নিয়ে এসে? আরে নাহ, চিন্তার কোনও কারণ নেই। তিনি এতো দূর নিয়ে এসেছেন, তিনিই উপায় বাতলে দিবেন।

ঠিক সেই মুহূর্তেই বিদ্যুৎ চমকের আলোয়, হাইওয়ের পাশে দাঁড়ানো একটা অবয়ব দেখতে পেল নরমান। মানুষটা গাছের সাথে হেলান দিয়ে আছে। একটা কার্ডবোর্ডে রুক্ষ হাতে একটা শব্দ লিখে সেটা উঁচু করে ধরে আছে।

কী করতে হবে, ঈশ্বর সেই কার্ডবোর্ডের লেখার মাধ্যমে সেটা বুঝিয়ে দিয়েছেন।

কেননা বড় বড় করে ওতে লেখা-–

ফেয়ারভিল

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *