১৩-১৭. ওরা আসছে

ওরা আসছে, নরমান বেটস জানে। ওরা দেখতে কেমন, সংখ্যায় কজন এ সম্পর্কে কোন ধারণা যদিও তার নেই, কিন্তু সে নিশ্চিতভাবেই জানে তারা আসছে।

গতকাল রাতে সে যখন শুয়েছিল, এই সময় দরজায় কড়া নেড়ে ওঠে। কিন্তু সে বিছানা ছেড়ে ওঠেনি। লোকটা অনেকক্ষণ দরজা ধাক্কাধাক্কি করে শেষপর্যন্ত হাল ছেড়ে চলে গেছে। নরমান এমনকি জানালার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরেও তাকে দেখেনি। ভাগ্যিস, মাকে সে সেলারে তালা আটকে রেখেছে। নইলে আবার একটা কেলেঙ্কারি হত।

কিন্তু নরমান জানত ঘটনার শেষ ওখানেই নয়। তার অনুমান সত্য প্রমাণ করে বিকেলে শেরিফ চেম্বারস এল। শেরিফকে দেখে সে অবাকই হয়েছিল। মা আর চাচার বিষ খাওয়ার সেই ঘটনার সময় শেরিফের সঙ্গে তার পরিচয়। এই লোকই তাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল, বাড়িতেও নিয়ে এসেছিল। শেরিফ মানে তার কাছে একটা দুঃস্বপ্ন। সেবার খুব কঠিন সময় গেছে নরমানের। কিন্তু তারপরও শেরিফকে বোকা বানাতে পেরেছিল সে। এবারও তাকে বোকা বানানো যাবে যদি সে ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করতে পারে।

চমৎকার ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করল নরমান। শেরিফের সমস্ত প্রশ্নের জবাব দিল ভেবেচিন্তে, তার হাতে মোটেলের চাবি তুলে দিল তল্লাশির জন্য। তবে ভয় ছিল মা আবার সেলার থেকে কোন কারণে চিৎকার না করে ওঠে। কিন্তু মাও বোধহয় ব্যাপারটা কোনভাবে টের পেয়ে গিয়েছিল। তাই সে চুপ থেকেছে। অবশ্য শেরিফ তার মাকে খুঁজতেও আসেনি। কারণ মা তার কাছে অতীত একটা স্মৃতি যে বিশ বছর আগে মারা গেছে।

খুব সহজে নরমান বোকা বানাল শেরিফকে। চেম্বারস মেয়েটা আর মিলটন অ্যারবোগাস্ট সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করল। জানতে চাইল ওদের শিকাগো যাওয়ার ব্যাপারে সে কিছু জানে কিনা। না, বলল নরমান, ফোনে যা বলেছে তারই পুনরাবৃত্তি করল সে। একবার ভেবেছিল বলে মেয়েটা তাকে শিকাগোর একটা হোটেলের কথা বলেছিল। কিন্তু পরক্ষণে নাকচ করে দিয়েছে চিন্তাটা। কারণ বেশি মাতব্বরী করতে গিয়ে আবার কোন্ গেরোয় আটকে যায় কে জানে। তার জবাবে শেরিফকে সন্তুষ্ট মনে হলো। বাড়ি তল্লাশির জন্য বারবার ক্ষমা চাইল নরমানের কাছে। তারপর চলে গেল।

কিন্তু নরমান জানত এখনই তার পরিত্রাণ নেই। শেরিফ নিজ থেকে আসেনি এখানে। কেউ তাকে পাঠিয়েছে। কাল রাতের আগন্তুককে তারাই পাঠিয়েছে। এখন তারা নিজেরাই আসবে। আসবেই।

এসব ভাবতে গিয়ে নরমানের হৃৎপিণ্ড আবার আঁচার সঙ্গে বাড়ি খেতে শুরু করল। খুব ইচ্ছে হলো এক দৌড়ে সেলারে ঢুকে মার কোলে মুখ গুঁজে পড়ে থাকে। কিন্তু তাতে কোন কাজ হবে না। পালিয়ে গিয়েও লাভ নেই। মাকে এই অবস্থায় ফেলে সে পালাতে পারবে না। তার সামনে এখন একটাই পথ খোলা যে-ই আসুক, তার মুখোমুখি দাঁড়ানো। একই গল্প সে শোনাবে আগন্তুকদের, তার আশা, তারপর কিছুই ঘটবে না।

একা অফিসে বসে আছে নরমান বেটস। আলাবামা এবং ইলিনয়ের ট্যুরিস্ট দুজন সকালেই চলে গেছে। এখনও পর্যন্ত নতুন কোন কাস্টমার আসেনি। এদিকে আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। বৃষ্টি শুরু হলে আজ আর নতুন কোন অতিথির আগমন আশা না করাই ভাল। সুতরাং এখন একপাত্র মদ খাওয়া চলে। বুকের ধুকপুকুনিটা অন্তত কমবে।

কাউন্টারের নিচ থেকে মদের বোতল বের করল নরমান। দুই পেগ খাওয়ার পর শরীরটা বেশ চনমনে লাগল। তৃতীয় গ্লাস ঢালার সময় গাড়িটাকে দেখতে পেল সে। এই গাড়িটা আর দশটা গাড়ির মত সাধারণ হলেও নরমানের মন বলল তারা এসে পড়েছে। এক চুমুকে ড্রিঙ্কটা সাবাড় করল সে। একটা পুরুষকে নামতে দেখল দরজা খুলে। খুবই সাধারণ চেহারা। যেরকম আশা করেছিল মোটেই সেরকম নয়। তবে কি আমার ধারণা ভুল, ভাবল নরমান। এই সময় মেয়েটাকে দেখল সে নামতে। সঙ্গে সঙ্গে ভয়ানক চমকে উঠল। বোতলটা মুখের ওপর উপুড় করল সে, ঢক ঢক করে গিলতে লাগল মদ। আসলে মেয়েটাকে আড়াল করতে চাইছে ও।

কে ওই মেয়ে?

ও তো সেই মেয়েটা যাকে সে গত শনিবার কবর দিয়ে এসেছে জলার মধ্যে। সে কি করে ওখান থেকে ফিরে এল? না, না কি করে হয়! মৃত মানুষ কখনও জীবিত হতে পারে! অনিচ্ছাসত্ত্বেও মেয়েটার দিকে আবার তাকা নরমান। না তো, এই মেয়ে সেই মেয়ে নয়। এর চুল লালচে বাদামী। শরীরের গঠনও অনেক পাতলা। কিন্তু মৃত মেয়েটার সঙ্গে এর চেহারায় অদ্ভুত মিল। সম্ভবত বোনটোন হবে। হ্যাঁ, তাই হওয়া স্বাভাবিক। মুহূর্তে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে নিল নরমান। জেন উইলসন নামের মেয়েটা টাকা চুরি করে পালিয়েছিল। তার পিছু পিছু এসেছিল গোয়েন্দাটা। এখন বোনের খোঁজে এসেছে এই মেয়ে।

তার জায়গায় মা হলে এখন কি করত জানে নরমান। কিন্তু সে জীবনেও ওই ঝুঁকি নিতে যাবে না। তৈরি গল্পটাকেই নরমান আবার এদের কাছে। উপস্থাপন করবে। ওরা তখন নিশ্চই চলে যাবে। কারণ সে যদি সবকিছু অস্বীকার করে তাহলে কারও বাবার সাধ্য নেই কোন কিছু প্রমাণ করে। অতএব নো চিন্তা, ডু ফুর্তি।

অ্যালকোহলটা বেশ কাজ দিচ্ছে। নরমান শান্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে কাউন্টারে। পুরুষ লোকটা তার সামনে এসে দাঁড়াতেই সে জিজ্ঞেস করল, আপনার জন্য কি করতে পারি, বলুন?

ঘর পাওয়া যাবে? লোকটা বলল।

নরমান মাথা দোলাল। যাবে। মেয়েটা এদিকেই আসছে। নরমান এবার নিশ্চিত হলো এই মেয়ে জেন উইলসনের বোন না হয়েই যায় না।

আপনারা কি- 

হ্যাঁ, ডবল রুম চাই। কত দিতে হবে?

দশ ডলার! রেজিস্টার খাতাটা লোকটার দিকে ঠেলে দিল নরমান। লোকটা এক মুহূর্ত ইতস্তত করল, তারপর লিখল, স্যাম রাইট, ইনডিপেনডেন্স।

নাম এবং ঠিকানা দুটোই ভুয়া, জানে নরমান। মনে মনে হাসল সে। এরা নিজেদেরকে খুব চালাক ভাবছে নাকি? ঠিক আছে, আমিও চলি পাতায় পাতায়।

মেয়েটা একদৃষ্টিতে খাতার দিকে চেয়ে আছে। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে নরমান বুঝল পুরুষটার লেখার দিকে নয়, সে অন্য কোন নামের ওপর চোখ বোলাচ্ছে। হয়তো জেন উইলসনের নামটাকেই খুঁজছে। সে এবার পুরুষটার হাতে খোঁচা দিল। ব্যাপারটা দেখেও না দেখার ভান করে নরমান বলল, আপনাদের এক নম্বর ঘরটা দিচ্ছি।

কোথায় ওটা? মেয়েটা জিজ্ঞেস করল।

নিচতলার শেষ মাথায়।

ছয় নম্বর রুমটা দেয়া যায় না?

ছয় নম্বর রুম! নরমানের মনে পড়ল সে প্রত্যেকের নামের পাশে ঘরের নম্বরও লিখে রাখে। ছয় নম্বর রুমে এই মেয়েটার বোন ছিল। এই মেয়ে নিশ্চই সেটা লক্ষ করেছে।

কিন্তু ছয় নম্বর রুমটা ভাল নয়। ফ্যানটা ভাঙা। গরমে আপনাদের থাকতে কষ্ট হবে।

কোন কষ্ট হবে না। আমাদের ফ্যানের দরকার পড়বে না। কারণ বৃষ্টি আসছে। এমনিতেই ঠাণ্ডা লাগবে। তাছাড়া ছয় আমাদের খুব লাকি নম্বর। এই মাসের ছয় তারিখে আমাদের বিয়ে হয়েছে কি না।

মিথ্যুক! শালী, মিথ্যা বলার আর জায়গা পাস না! দাঁতে দাঁত চাপল ইরমান। কিন্তু মুখভঙ্গি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক রেখে শ্রাগ করল ও, ঠিক আছে। তাহলে ছয় নম্বরেই যান। কী বোর্ড থেকে ছয় নম্বর রুমের চাবি নিয়ে ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল নরমান। লোকটার হাতে ছোট একটা ব্যাগ। অথচ ব্যাটা বলে কিনা ইনডিপিনডেন্স থেকে এসেছে। শালা!

নরমান দরজা খুলে দিল। ওরা ভেতরে ঢুকল। আর কিছু লাগবে আপনাদের? জানতে চাইল সে।

না, ঠিক আছে। ধন্যবাদ।

দরজা ভিজিয়ে দিয়ে নরমান ফিরে এল অফিসে। কাউন্টারের তলা থেকে মদের গ্লাস এবং বোতলটা আবার বের করল। নিজেকে অভিনন্দন জানাতে ইচ্ছে করছে ওর। একটুও ঘাবড়ায়নি সে। সুতরাং নিজেকে বাহবা দিয়ে একপাত্র গেলা চলে।

এক গ্লাস হুইস্কি শেষ করে নরমান ফ্রেম থেকে লাইসেন্সটা সরাল। ওদের কাণ্ডকারখানা দেখার জন্য আগের মত চোখ রাখল দেয়ালের ফুটোতে। ছয় নম্বর রুমের বাথরুমটা ভেসে উঠল চোখের সামনে।

বাথরুমে নেই ওরা। বেডরুম থেকে ওদের হাঁটাচলার শব্দ শুনতে পেল ইরমান। কি যেন খোঁজাখুঁজি করছে দুজনে। কি খুঁজছে ওরা?

…আসলে কি খুঁজছি আমরা, বলো তো? পুরুষটার গলা। এবার মেয়েটা বলল, …যে কোন কিছু। যেটা ওনার চোখ এড়িয়ে গেছে। ক্রাইম ল্যাবরেটরির গল্প তো জানেনই। (দাঁত বের করে নিঃশব্দে হাসল নরমান। এইবার বাছারা, ধরা পড়ে গেছ। স্বামীকে কেউ কখনও আপনি করে বলে?)…সব সময় কোন ছোটখাট ক্লু থেকেই…।

পুরুষকণ্ঠ আবার বলল, কিন্তু আমরা তো আর ডিটেকটিভ নই। আমার মনে হয়…ওর সঙ্গে সরাসরি কথা বলাই ভাল…ভয়টয় দেখিয়ে…

নরমান আবারও হাসল। আমাকে ভয় দেখাবে? কি পাবে ওই ঘরে? কিছু! এক গোছা চুল পর্যন্ত না।

মেয়েটার কণ্ঠ এবার কাছিয়ে এল, …বুঝলেন? কোন ক্রু খুঁজে পেলেই হয়। ওকে ডর দেখিয়ে আমরা ওর পেট থেকে কথা বের করব।

মেয়েটা এখন বাথরুমের দিকে আসছে, সঙ্গে পুরুষটা।

এমন কোন প্রমাণ যা দেখলে শেরিফের টনক নড়বে, বলল সে।

ওদেরকে এবার দেখতে পেল নরমান। পুরুষটা দাঁড়াল বাথরুমের দরজার গায়ে, মেয়েটা সিঙ্ক পরীক্ষা করতে লাগল।

দেখছেন, সব কেমন ঝকঝকে, তকতকে, বলল সে।

সামনে পা বাড়াল সে, অদৃশ্য হয়ে গেল নরমানের চোখের সামনে থেকে। শাওয়ারের পর্দা সরানোর শব্দ শুনল ইরমান। মাগী, মনে মনে গালাগাল শুরু করল সে। ওখানে গিয়ে কোন কচু পাবি?

…নাহ্… কিছু নেই…

গলা ফাটিয়ে হাসতে ইচ্ছে করল নরমানের। আমি কি এতই গাধা যে তোদের জন্যে ওখানে ক্ল সাজিয়ে রাখব? মনে মনে বলল সে। মেয়েটার হতাশ চেহারা খুব দেখতে ইচ্ছে করছে ওর। আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল কখন সে ওখান থেকে বেরিয়ে আসে। কিন্তু মেয়েটা বেরোল না। বদলে নরমান দুম দুম একটা আওয়াজ শুনতে পেল।

কি করছ তুমি ওখানে? পুরুষটা বলল। সত্যিই তো, অবাক হলো নরমান, কি করছে সে এতক্ষণ ওখানে?

দেখছি স্টলটার পেছনে কিছু আছে কিনা…স্যাম, এই দেখুন আমি কি পেয়েছি! উল্লসিত চিৎকার ভেসে এল মেয়েটার।

মেয়েটা আবার উদয় হলো নরমানের সামনে। উত্তেজিত দেখাচ্ছে, হাত মুঠো করা। কি পেয়েছে ও? টেনশন অনুভব করল নরমান।

স্যাম, একটা কানের দুল। মেরির কানের দুল।

তুমি ঠিক জানো?

অসম্ভব! মনে মনে চিৎকার করে উঠল নরমান। এ হতেই পারে না!

অবশ্যই। গত বছর আমি নিজে ওর জন্মদিনে এই দুলটা ওকে দিয়েছিলাম। ডালাসের একটা দোকানে অর্ডার দিয়ে ওর জন্য এটা বানাই আমি।

পুরুষটা আলোর নিচে দাঁড়িয়ে দুলটা দেখতে লাগল। মেয়েটা কথা বলেই যেতে লাগল, গোসল করার সময় সম্ভবত ওটা ছিটকে স্টলের পেছনে পড়ে গিয়েছিল, তাই না?

লোকটাকে চুপ করে থাকতে দেখে মেয়েটা একটু অবাক হলো।

কি হয়েছে, স্যাম?

আমার মনে হচ্ছে খারাপ কিছু একটা হয়েছে, লিলা। এই জায়গাটা দেখো। মনে হচ্ছে রক্ত শুকিয়ে আছে।

ওহ, নো!

হ্যাঁ, লিলা। তুমি যা ভাবছ ঠিক তাই।

মেয়েটা কাঁপা গলায় বলল, স্যাম, যে করে হোক ওই বাড়িতে আমাদের ঢুকতেই হবে।

কিন্তু ও কাজটা তো শেরিফ করবেন, লিলা।

শেরিফ আমাদের কথা মোটেও বিশ্বাস করবেন না। এমন কি এই দুলটা দেখালেও না। তিনি বলবেন গোসল করার সময় মেরি নির্ঘাত পা পিছলে পড়ে গিয়েছিল, তখন ওটা তার কান থেকে ছিটকে যায়।

হয়তো সে রকমই কিছু একটা হয়েছে।

আপনি তা বিশ্বাস করেন, স্যাম? বলুন করেন?

না, লিলা, আমি বিশ্বাস করি না। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল পুরুষটা। কিন্তু এতেই প্রমাণ হয় না যে নরমান বেটস মেরির কিছু করেছে। তার বিরুদ্ধে যা করার শেরিফই করতে পারেন।

কিন্তু তিনি তা করবেন না। উত্তেজিত হয়ে উঠল মেয়েটা।

আমি জানি আমাদের মুখের কথায় তিনি কিছুই করবেন না। আমাদের এমন কোন প্রমাণ সংগ্রহ করতে হবে যাতে তিনি সত্যি কোন অ্যাকশন নিতে বাধ্য হন। ওই বাড়িতে গিয়ে ঢুকি চলুন। আমার নিশ্চিত ধারণা ওখানে তেমন কিছু পাবই।

কিন্তু এ কাজটা তো খুবই বিপজ্জনক।

তাহলে চলুন নরমান বেটসের কাছে যাই। তাকে এটা দেখাই। চাপ দিয়ে হয়তো ওর মুখ খোলাতে পারব।

নরমানের কাছে এটা নিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু সে এই ব্যাপারটার সাথে সত্যি জড়িত থাকলে সে কিছু স্বীকার করবে ভেবেছ? তারচে এই মুহূর্তে শেরিফের কাছে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

কিন্তু নরমান যদি কিছু সন্দেহ করে বসে? তাহলে তো সে পালাবে।

ও কিছুই সন্দেহ করবে না। কিন্তু তোমার যখন অত চিন্তা তাহলে এসো এখান থেকে শেরিফের কাছে একটা ফোন করি।

ফোনটা লোকটার অফিসে। সে আমাদের সব কথা শুনে ফেলবে। একটু থামল মেয়েটা, তারপর বলল, তারচে একটা কাজ করা যায়, স্যাম। আমি বরং শেরিফের কাছে যাই। আপনি এখানে থাকুন, নরমানের সঙ্গে কথা বলুন।

ওকে চেপে ধরব?

না, না। এমনি সাধারণ কথাবার্তা বলুন। আমি ঔষধ কিনতে যাচ্ছি কিংবা এরকম যাহোক একটা কিছু বানিয়ে বলবেন ওকে যাতে সে কিছু সন্দেহ করতে না পারে।

ঠিক আছে।

দুলটা আমাকে দিন, স্যাম।

আস্তে আস্তে কণ্ঠ দুটো অস্পষ্ট হয়ে এল। ওরা কথা বলতে বলতে অন্য ঘরে চলে গেল। প্রচণ্ড চিন্তিত হয়ে পড়ল নরমান। মেয়েটা নিশ্চিত ভাবেই শেরিফের কাছে যাচ্ছে। তাকে ঠেকানোর ক্ষমতা তার নেই। মা যদি এখন এখানে থাকত তাহলে সে ওকে ঠেকাতে পারত। শুধু ওকেই নয়, একসঙ্গে ওদের দুজনকেই। কিন্তু মা এখানে নেই। সে নিজ হাতে মাকে ফুট সেলারে তালা মেরে রেখেছে।

মেয়েটা যদি শেরিফকে রক্তমাখা দুলটা দেখায় তাহলে শেরিফ নিশ্চই আবার আসবেন। মাকে তিনি খুঁজে না পেলেও তার মাথায় অন্য কোন চিন্তা আসতে পারে। বিশ বছর ধরে তিনি যা সন্দেহ করেননি এবার সেই সন্দেহ করে বসতে পারেন। এতদিন যে ভয়টা দুঃস্বপ্নের মত তাড়িয়ে বেরিয়েছে নরমানকে, শেরিফ হয়তো সেই কাজটাই করতে পারেন। চাচা জো মার্ক যে রাতে মারা গিয়েছিল সেই রাতে আসলে কি ঘটেছিল সেটা তিনি বের করে ফেলতে পারেন। তারচেয়েও ভয়াবহ ব্যাপার শেরিফ কিছু একটা সন্দেহ করে যদি ফেয়ারভেলের গোরস্থানে যান এবং মার কবর খোঁড়েন, তাহলেই সব গোপনীয়তা ফাঁস হয়ে যাবে। শূন্য কবর দেখেই তিনি যা বোঝার বুঝে নেবেন। সবাই জেনে যাবে নরমা মারা যাননি, তাকে তাঁর ছেলে বিশ বছর ধরে লোক চক্ষুর অন্তরালে লুকিয়ে রেখেছে।

.

১৪.

নরমান বেটস তার কাউন্টারের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। দৃস্টি ড্রাইভওয়ের দিকে। এখান থেকে সিকি মাইলের মত রাস্তা স্পষ্ট দেখা যায়। দেখল লিলা গাড়ি স্টার্ট দিল, চলে গেল হাইওয়ের দিকে। স্যাম এসে দাঁড়াল নরমানের সামনে। হালকা গলায় বলল, ও শহরে যাচ্ছে। সিগারেট কিনতে।

কি করবেন বলুন, সায় দেয়ার ভঙ্গিতে বলল নরমান, এখানে সামান্য সিগারেটও পাওয়া যায় না। কিন্তু এই সময় উনি গেলেন। আকাশের যা অবস্থা। এখনই নামল বলে।

এদিকে খুব বৃষ্টি হয় নাকি? স্যাম পুরানো একটা সোফার হাতলে বসল।

তা হয়। নরমান সামান্য মাথা দোলাল। আমাদের এখানে অনেক কিছুই হয়।

এই কথার মানে কি? স্যামের ভ্রু কুঁচকে উঠেই সমান হয়ে গেল। মান আলোতে মোটা লোকটার চশমার আড়ালে চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে না। যেন ওই জায়গাটা ফাঁকা। হঠাৎ নাকে পরিচিত একটা গন্ধ ধাক্কা মারল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তার চোখে পড়ল মদের বোতলটাকে। কাউন্টারের এককোণে দাঁড় করানো। লোকটা মদ খেয়েছে। তাই গন্ধ পাচ্ছে স্যাম। ওকে বোতলের দিকে চাইতে দেখে নরমান জিজ্ঞেস করল, কি, চলবে নাকি এক গ্লাস? আপনি এখানে আসার একটু আগে আমি শুরু করেছিলাম। এখন নতুন করে আবার শুরু করলে মন্দ হয় না।

ইতস্তত করল স্যাম, না। ইয়ে মানে-।

আরে ঠিক আছে। অত কিন্তু কিন্তু করতে হবে না। নিচের দিকে ঝুঁকল সে, দুই সেকেণ্ড পর সোজা হয়ে দাঁড়াল। মদের আরেকটা গ্লাস ঠক করে নামিয়ে রাখল কাউন্টারের ওপর। মদটদ তেমন একটা খাই না আমি, স্যামের মনে হলো লোকটা সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করছে। কোন প্রয়োজন ছিল না, ভাবল সে। আর ডিউটিতে থাকার সময় তো খাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু এমন আবহাওয়ায় অ্যালকোহলটা শরীর চাঙা করে তোলে, তাই না? মদ ঢালল সে গ্লাসে, ঠেলে দিল সামনের দিকে। স্যাম উঠল, দাঁড়াল এসে কাউন্টারের সামনে।

তাছাড়া এই বৃষ্টিতে কোন কাস্টমার আসবে বলে মনে হয় না। স্যাম ঘুরে দাঁড়াল। শুরু হয়ে গেছে বৃষ্টি। মুষল ধারায় পড়ছে। বৃষ্টির বিশাল একটা পর্দা সামনের রাস্তাটাকে ঢেকে ফেলেছে। অন্ধকার হয়ে আসছে দ্রুত। কিন্তু নরমান আলো জ্বালানোর জন্য কোন ব্যস্ততা দেখাল না।

নিন। বলল সে। বসে বসে খান। আমি দাঁড়িয়েই পান করব। এটা আমার অভ্যাস বলতে পারেন।

স্যাম আবার সোফায় গিয়ে বসল। তাকাল হাতঘড়ির দিকে। লিলা গেছে আট মিনিটের মত হলো। এই বৃষ্টিতেও ফেয়ারভেলে পৌঁছুতে তার বিশ মিনিটের বেশি লাগবে না। দশ কি পনেরো মিনিট লাগবে শেরিফের সঙ্গে কথা বলতে। তারপর আবার বিশ মিনিট লাগবে ওর এখানে ফিরতে। প্রায় এক ঘণ্টা! এতক্ষণ কি কথা বলবে সে এই মোটকুর সঙ্গে?

এখানে আপনার একা লাগে না? গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে বলল স্যাম।

তা লাগে, নরমান নিজের গ্লাসে চুমুক দিল। মাঝে মাঝে খুবই একা লাগে।

তবে অনেক লোকজন এখানে আসে। এই ব্যাপারটা উপভোগ করেন না?

তারা আসে আবার চলে যায়। আমি কাজের চাপে কারও প্রতি বিশেষ নজর দিতে পারি না।

এখানে কতদিন ধরে আছেন?

মোটেল চালাচ্ছি বিশ বছরেরও বেশি। কিন্তু এখানে আছি ছোটবেলা থেকে।

একাই চালান সব?

হ্যাঁ। বোতলটা হাতে নিয়ে জনের দিকে এগিয়ে গেল নরমান।

আরেক গ্লাস নিন।

ঠিক আছে। আর লাগবে না।

আরে নিন না, ভাই। ভয় নেই আপনার বৌকে বলব না। হেসে উঠল সে। তাছাড়া একা মদ খেতে মোটেও মজা নেই।

গ্লাস ভরে নরমান আবার নিজের জায়গায় ফিরে এল। বজ্রপাতের শব্দ হলো প্রচণ্ড, তবে বিদ্যুৎ চমকাল না। মদের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে স্যাম লক্ষ করতে লাগল নরমানকে। ওকে এখন নিতান্তই নিরীহ একটা লোক মনে হচ্ছে। এতই সাধারণ যে এই লোক কোন ষড়যন্ত্রের মধ্যে জড়িত থাকতে পারে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করল না স্যামের। মেরির কথা মনে পড়ল ওর। গভীর চিন্তার মধ্যে ডুবে গেল।

মেরি টাকাগুলো চুরি করেছে। এখানে সে একরাত ছিল। শাওয়ারের পেছনে তার একটা দুল পাওয়া গেছে। পা পিছলে পড়ে মাথায় আঘাত পেতে পারে মেরি। তখন দুলটা কান থেকে ছিটকে পড়তে পারে। আর এমনটি ঘটাই স্বাভাবিক। তারপর সে শিকাগো চলে গেছে। মিলটন অ্যারবোগাস্ট এবং শেরিফের ধারণাই আসলে ঠিক। মেরি শিকাগোতেই গেছে। সুতরাং এই নরমান বেটসকে মিছামিছি সন্দেহ করা কি অন্যায় নয়? বৃষ্টির শব্দে বাস্তবে ফিরে এল জন। চুপচাপ বসে থেকে কথাবার্তা চালিয়ে যাওয়া দরকার।

বেশ বৃষ্টি হচ্ছে। বলল সে, কখন থামবে কে জানে?

বৃষ্টির শব্দ আমার ভাল লাগে, বলল নরমান, মুষলধারে বৃষ্টির শব্দ আমি খুব পছন্দ করি। এতে যাহোক আমরা মাঝে মধ্যে উত্তেজনার খোরাক পাই।

আমরা? আপনি একা থাকেন বললেন না?

মোটেল আমি একা চালাই। তবে এটায় দুজনের ভাগই আছে। আমার এবং আমার মার।

আরেকটু হলে বিষম খাচ্ছিল স্যাম। তাড়াতাড়ি গ্লাসটা ঠোঁট থেকে নামাল, মুঠোর মধ্যে শক্ত করে ধরল। ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত হয়ে উঠেছে সে। আমি জানতাম না।

অবশ্য আপনার জানার কথাও নয়। কেউই জানে না। কারণ মা ঘর থেকে কখনোই বের হয় না। অথচ সবাই জানে মা মারা গেছে। শান্ত গলায় বলল নরমান। অন্ধকারে তার মুখটা ভাল করে দেখতে পাচ্ছে না স্যাম, কিন্তু নরমান যখন কথা বলতে শুরু করল উত্তেজনার লেশমাত্র খুঁজে পেল না সে তার আচরণে।

সত্যি বলতে কি আমরা কালেভদ্রে এখানে উত্তেজনার খোরাক পাই। যেমন পেয়েছিলাম বিশ বছর আগে। ওই সময় মা আর জো চাচা বিষ খেয়েছিল। আমি শেরিফকে খবর দিয়েছিলাম। তিনি এসে ওদের দেখলেন। মা একটা চিরকুটে সবকিছু লিখে রেখেছিল তাদের মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয় ইত্যাদি। তারপর এনকোয়ারি টোয়ারি হলো। কিন্তু আমি এনকোয়ারিতে যেতে পারিনি, খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। লোকজন আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। অনেকদিন হাসপাতালে ছিলাম। আমি যে কিছু করব তার উপায় ছিল না। কিন্তু ঠিকই সব ম্যানেজ করে ফেললাম। ম্যানেজ করলেন মানে?

নরমান জবাব দিল না। ঢক ঢক করে মদ গিলে বোতলটা এগিয়ে দিল জনের দিকে। মাথা নাড়ল স্যাম। নেবে না।

আরে নিন তো। কাউন্টার ঘুরে সে জনের সামনে চলে এল। হাত বাড়াল ওর গ্লাসের দিকে। এক পা পিছিয়ে গেল গ্যাম। এখন না। আগে আপনার গল্পটা শেষ করুন।

নরমান আর জোরাজুরি করল না। বলল, ও হ্যাঁ, যা বলছিলাম। মাকে আমি কবর খুঁড়ে বাড়িতে নিয়ে এলাম। ওটাই সবচেয়ে উত্তেজনাকর মুহূর্ত ছিল, বুঝলেন না? রাতের বেলা খুঁড়ে কাউকে বের করা যে কি থ্রিলিং সেটা আপনাকে ব্যাখ্যা করে বোঝাতে পারব না। মা অনেকদিন কফিনে বন্দী ছিল। প্রথমে ভেবেছিলাম বুঝি মরেই গেছে। কিন্তু মরেনি। মরে গেলে কি আর উনি আমার সঙ্গে হাসপাতালে যোগাযোগ করতে পারতেন? আসলে মা সমাধিস্থ অবস্থায় ছিলেন। এটা এক ধরনের যোগ প্রক্রিয়া। আমি জানতাম কিভাবে তাকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যাবে। লোকে এটাকে যাদু বলবে। কিন্তু তাদের ধারণা একেবারেই বোগাস। বিদ্যুতের কথাই ধরুন। লোকে বিদ্যুৎকেও যাদু বলত। কিন্তু আসলে এটা এক ধরনের শক্তি। প্রাণও তেমনি একরকমের শক্তি। ভাইটাল ফোর্স। বিদ্যুতের মতই প্রাণকেও আপনি ইচ্ছে করলে নিভিয়ে দিতে পারেন আবার জাগাতে পারেন। আমি আমার মায়ের প্রাণটাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিলাম। আবার যথাসময়ে জাগিয়েও তুলেছি। কি, আমার কথা বুঝতে পারছেন তো?

হ্যাঁ- খুব ইন্টারেস্টিং ব্যাপার মনে হচ্ছে।

আমি জানতাম ঘটনাটা আপনার কাছে ইন্টারেস্টিং মনে হবে। আচ্ছা, ওই তরুণী মেয়েটি এবং আপনি স্বামী স্ত্রী নন, ঠিক না?

মানে- 

দেখুন, আমার সম্পর্কে আপনি যাই ভাবুন না কেন আমি কিন্তু আপনার চেয়ে অনেক বেশি জানি।

মি. নরমান, আপনার শরীর ঠিক আছে তো? মানে- 

মানে কি বলতে চাইছেন বুঝতে পারছি। ভাবছেন আমি মাতাল হয়ে গেছি তাই উল্টোপাল্টা বকছি, আঁ? ভুল বন্ধু, ভুল। আপনারা যখন এখানে আসেন তখন আমি মাতাল ছিলাম না। আপনারা দুলটা খুঁজে পেলেন, শেরিফের কাছে যাওয়ার ব্যাপারে মেয়েটার সঙ্গে আলাপ করলেন সবই আমি শুনেছি। তখনও কিন্তু আমি মাতাল ছিলাম না।

আপনি কি বলছেন আমি- 

ধীরে, বন্ধু ধীরে। অত উত্তেজিত হওয়ার কিছু নেই। ভয় পাওয়ারও কিছু নেই। আমি কি ভয় পেয়েছি? আমার যদি কোন ভুল হত তাহলে নিশ্চই ভয় পেতাম। কিন্তু আমি জানি আমি কোন ভুল করিনি। ভুল করলে কি আর আপনাকে এসব কথা বলতে যেতাম? একটু থামল নরমান, তারপর বলতে শুরু করল, জানেন, আমি আপনাদের অপেক্ষাতেই ছিলাম। এখানে বসে অপেক্ষা করছিলাম যে কখন আপনি আসবেন আর কখনই বা আপনার সঙ্গিনী রাস্তায় গাড়ি থামাবেন।

রাস্তায় গাড়ি থামাবেন মানে?

মানে খুব সোজা। আপনি জেনেও না জানার ভান করছেন কেন, মশাই? আপনার সঙ্গিনী শেরিফের কাছে যাওয়ার চেয়ে সে আমাদের বাড়িটা খুঁজে দেখার ব্যাপারে বেশি আগ্রহী তা কি আপনি এত সহজেই ভুলে গেলেন? সে তাই করেছে। মাঝ রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে এখন আমাদের বাড়িতে চুপিসারে ঢুকেছে।

কি যা-তা বলছেন! দেখি, আমাকে যেতে দিন।

দাঁড়ান দাঁড়ান, এত অস্থির হচ্ছেন কেন? আমি তো আপনাকে ধরে রাখছি না। তার আগে আরেক গ্লাস খেয়ে যান। আপনার বান্ধবীর বোধহয় এতক্ষণে আমার মার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে। তবে–

নিকুচি করছি আপনার মদের! বিদ্যুৎগতিতে উঠে দাঁড়াল স্যাম, পা বাড়াল দরজার দিকে। ঠিক সেই মুহূর্তে নরক ভেঙে পড়ল ওর মাথায়! খুলির ওপর বোতল ভাঙার শব্দ হলো প্রচণ্ড, দপ করে সাতটা সূর্য জ্বলে উঠল চোখের সামনে, পরক্ষণে নিকষ কালো একটা অন্ধকারের পর্দা গ্রাস করল ওকে। দড়াম করে মাটিতে আছড়ে পড়ল জনের অজ্ঞান দেহ।

তরল অন্ধকারের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে স্যাম, ডুবে যাচ্ছে ও ক্রমশ পাতালে। প্রাণপণে চেষ্টা করছে ভেসে উঠতে। পারছে না। এই সময় কে যেন ওর চুলের মুঠি ধরল, টেনে তুলতে লাগল ওপরে। চোখ মেলে তাকে দেখতে চাইল স্যাম। তীব্র আলোর দ্যুতি ঝলসে দিল ওকে। সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেল চোখের পর্দা। টের পেল একজন ওকে জড়িয়ে ধরেছে, কোলে করে তুলছে, মাথাটা একদিকে ঝুলে পড়ল জনের! তীব্র ব্যথায় মনে হলো ছিঁড়ে যাবে ওটা। হাতুড়ির বাড়ি পড়তে লাগল তালুতে দুমদাম করে। বারকয়েক চোখ পিটপিট করে আলোটা সয়ে নিল ও, তারপর পর্দা দুটো মেলল। শেরিফ চেম্বারস।

নিজেকে মেঝের ওপর বসে থাকা অবস্থায় আবিষ্কার করল স্যাম। ওর পাশের সোফায় বসে আছে শেরিফ। উদ্বিগ্ন মুখে চেয়ে আছে ওর দিকে।

যাক, আপনাকে দেখে নিশ্চিন্ত হলাম, বলল স্যাম। ওই ব্যাটা তাহলে লিলা সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলছিল। লিলা তাহলে আপনার কাছে গিয়েছিল।

শেরিফ জনের কথা শুনেছে বলে মনে হলো না। সে বলল, আধঘণ্টা আগে আমি হোটেল থেকে ফোন পেলাম। ওরা তোমার বন্ধু মিলটন অ্যারবোগাস্টের খোঁজ করছিল। কারণ সে হোটেল ছেড়ে দিলেও মালপত্র নিয়ে যায়নি। বলে গিয়েছিল আবার আসবে। কিন্তু আর আসেনি। আমার তখন খুব চিন্তা হলো। তোমার খোঁজ করলাম। ভাবলাম তুমি এখানেই আসতে পারো। তাই এখানে চলে এলাম। এসে দেখি ভালই করেছি। এই অবস্থা কে করল তোমার?

শেরিফের প্রশ্নের জবাব দিল না স্যাম। দারুণ উৎকণ্ঠিত গলায় জিজ্ঞেস করল, লিলা তাহলে আপনার কাছে যায়নি?

না তো। কেন-

টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল স্যাম, অসংখ্য সূচ ফুটল মাথায়। ফ্যাকাসে মুখে বলল, তাহলে সর্বনাশ হয়েছে, শেরিফ।

সর্বনাশ? কিসের সর্বনাশ? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। নরমানই বা গেল কোথায়?

ওই শয়তানটাই আমার এই অবস্থার জন্য দায়ী, শেরিফ। ও নিশ্চই এতক্ষণে বাড়িতে গেছে। ও আর ওর মা- 

ওর মা? কিন্তু উনি তো মারা গেছেন!

না। মরেনি। বিড়বিড় করে বলল স্যাম। সে এখনও বেঁচে আছে। ওই বাড়িতে এখন লিলা একা। আর ওরা দুজন

জনের কথা শেষ করতে দিল না শেরিফ, হাত ধরে টান মারল। প্রায় ছুটে বেরিয়ে এল বাইরে। হন হন করে ছুটতে লাগল নরমানদের অন্ধকারে ডুবে থাকা বাড়িটার দিকে। কাছাকাছি এসেছে, এই সময় কান ফাটানো শব্দে বাজ পড়ল কোথাও, শব্দটা মিলিয়ে যাওয়ার আগেই অন্ধকার চিরে নারীকণ্ঠের সুতীক্ষ্ণ চিৎকার ভেসে এল।

কণ্ঠটা চিনতে অসুবিধে হলো না কারও।

চিৎকার করছে লিলা।

.

১৫.

দ্রুত পা চালাল লিলা। আকাশের অবস্থা খুবই খারাপ। গুমগুম করে গর্জে উঠছে মেঘ। থেকে থেকে সাপের জিভের মত লকলকিয়ে উঠছে বিদ্যুৎ, সোনালী, তীব্র আলোয় অন্ধকারের বুক চিরে দিচ্ছে মুহূর্তের জন্য। পরক্ষণে আবার গা ছমছমে ভৌতিক অন্ধকার। যে কোন মুহূর্তে কম্যাণ্ডো হামলা চালাতে পারে বৃষ্টি। কিন্তু কম্যাণ্ডো আক্রমণ আসার আগেই বাড়িটার বারান্দার সামনে চলে এল লিলা।

বাড়িটা পুরানো। কাঠের মেঝে কাঁচকোঁচ করে আপত্তি জানাল ওর পায়ের নিচে, বাতাসের ধাক্কায় ওপরতলার জানালাগুলো একযোগে সব কেঁপে উঠল। অন্ধকারে বাড়িটাকে ভয়ানক কুৎসিত মনে হলো লিলার। সে দরজায় দুমদুম করে ধাক্কা দিতে লাগল। কিন্তু ভেতর থেকে কোন সাড়া এল না। আসবে না, জানত লিলা, তবুও রাগের চোটে ধাক্কাতে থাকল।

রাগ ওর সবার ওপর। মেরির জন্য যেন কারও কোন চিন্তাই নেই। মি. লোরি ব্যাকুল কি করে তার টাকা ফেরত পাবেন সেই চিন্তায়, মিলটন অ্যারবোগাস্ট সেই টাকার সন্ধান দিতে পারলেই খালাস, শেরিফ কোন ঝামেলার মধ্যেই যেতে চান না। কিন্তু স্যামের ব্যবহারই লিলাকে সবচে আপসেট করে তুলেছে। সে তার প্রেমিকার জন্য কোন ঝুঁকির মধ্যে যেতে রাজি নয়। এদের সবার এক কথা- ওয়েট অ্যাও সি। অনেক অপেক্ষা করেছে। লিলা। আরও অপেক্ষা করতে তার আপত্তি ছিল না যদি সবাই তার দায়িত্ব ঠিকমত পালন করত। তাহলে এখন তাকে এখানে আসতে হত না। ফোর্থওয়ার্থে বসে থাকত সে নিশ্চিন্ত মনে। কিন্তু তা আর হলো কই? স্যাম কি পারত না নরমানটাকে কয়েক ঘা লাগিয়ে পেট থেকে কথা বের করতে? কিন্তু কি আশ্চর্য, ঝামেলা হতে পারে মনে করে সে তা করেনি। বরং লিলা শেরিফের কাছে যাওয়ার কথা বললে সে তাতে সায় দিয়েছে। মেরির রক্তমাখা কানের দুল দেখেও যদি তার চৈতন্যোদয় না হয় তাহলে লিলার আর কি বলার থাকতে পারে? সে যদি এই মোটেলে আসার জন্য জিদ না ধরত তাহলে স্যাম আদৌ এখানে আসত কিনা সন্দেহ আছে ওর। ভাগ্যিস এসেছিল নইলে কি আর নিশ্চিত হতে পারত যে মেরিকে নিয়ে কিছু একটা যড়যন্ত্র করেছে ওই মোটকু আর তার মা। শেরিফ যাই বলুক লিলার দৃঢ় বিশ্বাস ওই লোকটার মা বেঁচে আছে এবং এই বাড়িতেই সে থাকে। সেদিন মিলটন অ্যারবোগাস্ট হয়তো সত্যি তার মাকে জানালার পাশে বসে থাকতে দেখেছে। আর নারীমূর্তিটি যদি নরমানের মা না হয়, তাহলে সে মেরি হতে বাধ্য। মেরিকে হয়তো ওই শয়তানটা এই বাড়িতেই বন্দী করে রেখেছে। কে জানে মেরি এখনও বেঁচে আছে কিনা।

মরিয়া হয়ে দরজা ধাক্কাতে লাগল লিলা। কিন্তু কোন কাজ হলো না। যে করে হোক তাকে এই বাড়িতে ঢুকতেই হবে। পার্স খুলল লিলা। দরজা খোলার মত কিছু একটা জিনিসের জন্য ভেতরে হাতড়াতে লাগল। একটা নেইল ফাইল উঠে এল হাতে। উঁহু, এতে চলবে না। অন্য কিছু চাই। হঠাৎ মনে পড়ল সে একবার একটা চাবি কুড়িয়ে পেয়েছিল। চাবিটা সে খুচরো পয়সা রাখার জায়গাতে রেখে দিয়েছিল। হ্যাঁ, এই তত পাওয়া গেছে। আচ্ছা, এটাকে সবাই স্কেলিটন কী বলে কেন? লিলা শুনেছে এই চাবি দিয়ে সব রকম তালা খোলা যায়। কখনও পরীক্ষা করে দেখেনি, আজ দেখল। চাবিটা তালায় ঢুকিয়ে মোচড় দিল, প্রায় খাপে খাপ লাগতে গিয়েও কোথায় যেন একটু বেধে গেল। রাগটা আবার মাথায় উঠে গেল লিলার। জোরে মোচড় দিতেই খট করে চাবিটার গোড়া ভেঙে গেল, কিন্তু খুলে গেল তালা। দরজার পাল্লায় ধাক্কা দিল লিলা। হাট করে খুলে গেল ও দুটো। ভেতরে ঢুকল ও।

হলঘরটা অন্ধকার। কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল লিলা। অন্ধকারে চোখ সয়ে আসতে এদিক ওদিক তাকাল। লাইটের সুইচ খুঁজছে। দেয়ালের গায়ে কোথাও ওটা থাকার কথা। দেয়াল হাতড়ে একটু খুঁজতেই পেয়ে গেল সে সুইচটা। টিপে দিল। মাথার ওপর জ্বলে উঠল নগ্ন বাল্ব। নিস্তেজ আলোয় হলঘরটাকে আরও ভৌতিক ঠেকল লিলার কাছে। চারদিকে তাকাল ও। দেয়ালের সঙ্গে লাগানো ওয়ালপেপারগুলো দুএক জায়গায় ছিঁড়ে গেছে, পলস্তারা খসে পড়েছে কোথাও। দেয়ালে আঙ্গুরলতার ডিজাইন, যেন বিগত শতাব্দীর একটা ঘরে ঢুকে পড়েছে লিলা।

বৈঠকখানার ঘরের দিকে একপলক তাকাল সে। ওদিকে পরে গেলেও চলবে। এই ফ্লোরের ঘরগুলোও এখন দেখতে চায় না সে। তার আগ্রহ ওপরতলার প্রতি। অ্যারবোগাস্ট বলেছিল ওপরতলার জানালার ধারে সে একটি নারীমূর্তিকে বসে থাকতে দেখেছে। সুতরাং ওই জায়গাটা তার সবার আগে দেখা দরকার।

সিঁড়িতে কোন আলো নেই। রেলিং ধরে আস্তে আস্তে ওপরে উঠতে লাগল লিলা। ল্যাণ্ডিং-এ পা রেখেছে, ওর পিলে চমকে দিয়ে বিকট শব্দে কাছেপিঠে কোথাও বাজ পড়ল। থরথর করে কেঁপে উঠল পুরো বাড়ি। শিউরে উঠল ও। পরক্ষণে সামলে নিল নিজেকে। দোতলায় উঠে হাতড়ে হাতড়ে হলঘরের আলো জ্বালল। বিমূঢ় হয়ে পড়ল সামনে তিনটে দরজা দেখে। কোনদিকে যাবে সে এখন? কয়েক সেকেণ্ড সময় লাগল সিদ্ধান্ত নিতে। তারপর প্রথম দরজাটির দিকে এগিয়ে গেল।

দরজা খুলতেই বাথরুম চোখে পড়ল লিলার। প্রথম দর্শনেই মনে হলো এরকম জায়গা জাদুঘর ছাড়া অন্য কোথাও দেখেনি সে। কিন্তু জাদুঘরে বাথরুম প্রদর্শিত হয় না, নিজেকে মনে করিয়ে দিল ও। অবাক চোখে বাথরুমটা দেখতে লাগল সে। চার ঠ্যাঙের ওপর উঁচু বাথটাব; ওয়াশস্ট্যাণ্ড এবং টয়লেট সীটের নিচে খোলা পাইপ; ধাতব পুল চেইন নেমে এসেছে ছাদ থেকে। হাতমুখ ধোয়ার গামলার ওপর একটা চিড়খাওয়া ছোট আয়না। কিন্তু কোন মেডিসিন কেবিনেট চোখে পড়ল না লিলার। ক্লজিটের মধ্যে প্রচুর তোয়ালে আর বিছানার চাদর। একটু ইতস্তত করে সে শেলফগুলোয় হাত দিল। ভঁজ করা, পরিষ্কার শিটগুলো দেখেই বোঝা যায় ওগুলো লঞি থেকে ইস্ত্রি করে আনা। আর ঘাঁটাঘাঁটি করল না লিলা, বেরিয়ে এল বাথরুম থেকে।

এবার দ্বিতীয় দরজা খুলল ও, ভেতরে ঢুকে আলো জ্বালল। এই ঘরের আলোও কম কিন্তু এই স্বল্প আলোতেই সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। জিনিসপত্রে ঘরটা ঠাসা। ছোটখাট একটি খাট যেটা বড়দের থেকে বাচ্চাদের মানায় বেশি। সম্ভবত ছোটবেলা থেকে এই খাটেই ঘুমিয়ে আসছে নরমান বেটস, ধারণা করল লিলা। বিছানার চাদর কুঁচকে আছে, যেন কিছুক্ষণ আগেও কেউ এটাতে শুয়ে ছিল। ক্লজিটের কাছে একটা পুরানো আমলের দেরাজ আলমারি দাঁড় করানো। দেরাজগুলো খুলে দেখল লিলা। কিন্তু বিশেষ কিছু পেল না। ওপরের দেরাজ বোঝাই নেকটাই আর রুমালে। বেশির ভাগ কাদামাখা। টাইগুলো বড় বড়, এ যুগে অচল। একটা বাক্সের মধ্যে একটা টাই আর দুজোড়া কাফলিংক দেখতে পেল লিলা। মনে হলো এগুলো বহুদিন ধরে ব্যবহার করা হয় না। দ্বিতীয় দেরাজে শুধু শার্ট আর তৃতীয়টায় মোজা এবং জাঙিয়া। নিচের দেরাজে সাদা রঙের নাইটগাউন। মেয়েদের নাইটি পরে ঘুমায় নাকি লোকটা! অবাক হয়ে ভাবল লিলা।

দেরাজ দেখা শেষ করে এবার দেয়ালের ছবিগুলোর দিকে নজর দিল লিলা। দেয়ালে দুটো ছবি। প্রথম ছবিটায় ছোট একটি ছেলে, একটা ঘোড়ার পিঠে বসে আছে, দ্বিতীয় ছবিতে ওই ছেলেটিকেই দেখা যাচ্ছে একটি স্কুলের সামনে পাঁচটি বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটি যে নরমান বেটস, বুঝতে অনেক সময় লাগল লিলার। বয়সের তুলনায় তাকে খুবই ছোট দেখাচ্ছে।

এই ঘরে এখন ওই ক্লজিট আর কোণার ধারে দুটো বড় বুকশেলফ ছাড়া আর কিছু দেখার নেই। ক্লজিটের পাল্লা দ্রুত খুলে ফেলল লিলা। ভেতরে হ্যাঁঙারে ঝোলানো দুটো সুট, একটি জ্যাকেট, একটি ওভারকোট আর কাদামাখা একজোড়া ট্রাউজার চোখে পড়ল ওর। ওগুলোর পকেট খুঁজল সে। নেই কিছু। দুজোড়া জুতা এবং একজোড়া বেডরুম স্লীপারও দেখল ও।

এখন শুধু বুকশেলফ দুটো দেখা বাকি।

বুকশেলফ দেখতে গিয়ে বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে উঠল লিলার। এ নিউ মডেল অভ দি ইউনিভার্স, দি এক্সটেনশন অভ কনসাশনেস, দি উইচ-কাল্ট ইন ওয়েস্টার্ন ইউরোপ, ডাইমেনশন অ্যাও বিয়িং, এই ধরনের বই একজন গ্রাম্য মোটেল মালিকের ঘরে দেখবে কল্পনাও করেনি সে। শেলফের বইগুলো বের করে দেখতে লাগল ও। প্রায় সবই অতীন্দ্রিয় তত্ত্ব, অলৌকিকবাদ, মনস্তত্ত্ব ইত্যাদির ওপর লেখা। একদম নিচের তাকে টাইটেল ছাড়া কয়েকটি বই। ওগুলোর একটা টেনে নিল লিলা। খুলতেই গা ঘিনঘিন করে উঠল। অসম্ভব অশ্লীল সব ছবিতে বোঝাই। তাড়াতাড়ি বইটা বন্ধ করে আগের জায়গায় রেখে দিল ও। নরমান বেটসের নোংরা মানসিকতার প্রতিচ্ছবি যেন দেখতে পেল এই পর্নোগ্রাফীর মধ্যে। ঘর থেকে বেরিয়ে এল ও।

মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে, ছাদে একটানা ঝমঝম শব্দ। কামানের গোলার মত আওয়াজ করে একটা বাজ পড়ল। তিন নম্বর দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল লিলা। তীব্র, গা গোলানো একটা পারফিউমের গন্ধ ঝাঁপটা মারল নাকে। দরজার পাশের সুইচ টিপে দিতেই আলোয় ভরে উঠল ঘর। সঙ্গে সঙ্গে মুখ হাঁ হয়ে গেল লিলার।

এটাই ফ্রন্ট বেডরুম, সন্দেহ নেই। শেরিফ বলেছিলেন নরমানের মা মারা যাবার পর থেকে সে তার মার ঘরটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখে। কিন্তু এরকম কিছু একটা দেখতে হবে লিলার ধারণার বাইরে ছিল। মনে হলো সে ভুল করে পঞ্চাশ বছর আগে চলে এসেছে।

জাদুঘরে যেমন ব্রোঞ্জের গিল্টি করা ঘড়ি দেখেছে লিলা, সেরকম ঘড়ি ঝুলছে এই ঘরের দেয়ালে। টেবিলের ওপর ছোট ছোট পাথরের মূর্তি, সুগন্ধযুক্ত পিনকুশন, টকটকে লাল রঙের কার্পেট, জানালায় ঝালর দেয়া সুদৃশ্য পর্দা, ছবি আঁকা ভ্যানিটি টপস, বিছানার ওপর চাঁদোয়া টাঙানো। এছাড়াও কাঠের দোলনা, চীনেমাটির বেড়াল, ঘরে তৈরি বিছানার চাদর, শুজনি ঢাকা গদি মোড়া আরামকেদারা ইত্যাদি চোখে পড়ল লিলার।

এই ঘরের প্রতিটি জিনিস অর্ধ শতাব্দীর পুরানো অথচ তারপরও কেমন জীবন্ত! লিলার মাথায় সব যেন কেমন তালগোল পাকিয়ে যায়। একটি হিসাব ও কিছুতেই মেলাতে পারে না। নিচতলাটার অমন ভগ্নদশা, ওপরতলার ঘরগুলোতেও অযত্নের ছাপ সুস্পষ্ট, অথচ এই ঘর কি চমৎকার সাজানো গোছানো। কোথাও ধুলোময়লা নেই, সব আশ্চর্য রকম পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। যেন এই ঘরে কেউ বাস করে। বিশ বছর আগে এই ঘরের একজনের মৃত্যুর পর থেকে এটা আর ব্যবহৃত হয় না এ যেন বিশ্বাস করাই মুশকিল। এই ঘরের জানালা থেকেই এক মহিলাকে উঁকি মারতে দেখা গেছে।

নরমানের মা যদি মারা গিয়ে থাকে তবে কে ছিল ওটা? নরমানের মার ভূত? না, লিলা ভূত বিশ্বাস করে না। তাহলে? সে চিন্তিত মুখে ক্লজিটের দিকে এগিয়ে গেল। ক্লজিটের মধ্যে প্রচুর জামাকাপড়। সবগুলো সুন্দর ভাবে হ্যাঁঙারে ঝুলিয়ে রাখা। কয়েকটি কাপড় কুঁচকে আছে ইস্ত্রির অভাবে। বছর পঁচিশেক আগের ছোট ছোট স্কার্টও দেখতে পেল লিলা। ওপরের শেলফে ঝোলানো কাজ করা টুপি, স্কার্ফ, শাল- গ্রাম্য মধ্যবয়সী মহিলারা যা যা পরে সবই রয়েছে এখানে।

বিছানার দিকে চোখ পড়তেই কপালে ভাঁজ পড়ল লিলার। ঘরে তৈরি বেড কাভারটা খুব সুন্দর, কিন্তু ওটা ঠিকমত গোঁজা হয়নি। কেউ যেন তাড়াহুড়ার মধ্যে ওটা খুঁজেছে। বালিশ বেরিয়ে আছে চাদরের ফাঁক দিয়ে। একটানে বেড কাভারটা উঠিয়ে ফেলল লিলা।

কিছুক্ষণ আগেও যে এখানে কেউ শুয়েছিল তার প্রমাণ বালিশটা দেবে আছে এখনও।

এখানে নিশ্চই কোন ভূত ঘুমায় না। তাহলে কে সে? বোঝাই যাচ্ছে এই ঘরে কেউ একজন থাকে। তবে সে নরমান নয়। কারণ নরমান তার নিজের ঘরেই ঘুমায় তার প্রমাণ পেয়েছে লিলা। এখান থেকেই কেউ জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকে। কে সে? আবারও নিজেকে প্রশ্ন করল লিলা। সে কি মেরি? মেরি হলে কোথায় সে এখন? এখানে নিশ্চই নেই। তাহলে আর কোথায় খুঁজে দেখা যায়? হঠাৎ ওর মনে পড়ল শেরিফ বলেছিলেন নরমান বাড়ির পেছনে জঙ্গলে যায় কাঠকুটো সংগ্রহ করতে। নিশ্চই জ্বালানীর জন্য সে ওগুলো সংগ্রহ করে। তাহলে বাকি রইল চুলিঘরটি। বেসমেন্টের নিচে

ঘুরল লিলা, প্রায় ছুটে নামতে শুরু করল সিঁড়ি বেয়ে। সামনের দরজাটি খোলা। সশব্দে বাতাস আছড়ে পড়ছে ভেতরে। ছুটতে ছুটতে লিলা বুঝতে পারল কেন তখন তার অত রাগ হচ্ছিল। আসলে ভয় পেয়েছিল সে। মেরির জন্য অশুভ আশঙ্কায় ভীত হয়ে উঠেছিল ও, এই ভয় থেকে জেগে উঠেছে। প্রচণ্ড ক্রোধ, সেই ক্রোধ ওকে তীব্র ভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। লিলা এখন নিশ্চিত মেরিকে নরমান সেলারে আটকে রেখেছে। হয়তো ওর ওপর অকথ্য অত্যাচার চালিয়েছে। কে জানে টাকার জন্য হয়তো শয়তানটা মেরির আরও বড় সর্বনাশ করেছে। যে অমন নোংরা বই পড়ে সে সব পারে।

আতঙ্কিত হয়ে ছুটে চলল লিলা। নিচের হলঘর পেরিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে আলো জ্বালতেই সামনের দৃশ্যটা দেখে ভয়ে আত্মা খাঁচা ছাড়ার জোগাড় হলো ওর। ছোট্ট লোমশ একটা জন্তু গুঁড়ি মেরে বসে আছে দেয়ালে, ওর ওপর লাফিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত। পরমুহূর্তে নিজের ভুল বুঝতে পারল সে। ওটা ভয়ঙ্কর কোন জন্তু নয়, একটা কাঠবিড়ালী। আর জ্যান্তও নয়- স্টাফ করা। উজ্জ্বল আলোয় ওটার বোতামের মত চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। চেপে রাখা শ্বাস সশব্দে ফেলল লিলা। চারদিকে তাকাতেই বেসমেন্টের সিঁড়ি চোখে পড়ল ওর। খুঁজে খুঁজে সিঁড়ির আলোটা জ্বালল ও। খুবই কম আলো। অন্ধকারটাকে যেন আরও ঘন করে তুলল। সাবধানে ও নামতে লাগল সিঁড়ি বেয়ে। নির্জন সিঁড়িতে হাইহিলের শব্দ বিস্ফোরণের মত বিধল কানে।

চুল্লিঘরটা বিশাল। একটা শেডবিহীন বা ঝুলছে ওটার সামনে। উনুনটা যেমন বড়, তেমনি বড় তার দরজাটা। লিলা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। ওর খুব ভয় করছে। টের পেল শরীর কাঁপছে। এখানে একা আসা উচিত হয়নি তার, বুঝতে পারছে সে। নিজেকে ভর্ৎসনা করল ও। কিন্তু এসে যখন পড়েছে এখন আর পিছিয়ে যাবে না। মেরির জন্য এর শেষ তাকে দেখতেই হবে। চুল্লির দরজা খুলবে সে, দেখবে ওটার ভেতরে কি আছে। যদি এই মুহূর্তে ওটার ভেতর আগুন জ্বলতে থাকে, তাহলে?

ভয়ে ভয়ে চুল্লির দরজায় হাত রাখল লিলা। অবাক কাণ্ড! এ দেখি ঠাণ্ডা। হাতল ধরে টান দিল সে। অবাকের ওপর অবাক। চুল্লিটা খটখটে পরিষ্কার, সামান্য ছাই পর্যন্ত নেই কোথাও। লিলা নিঃসন্দেহ হলো গত এক বছরেও এটা কেউ ব্যবহার করেনি।

চুল্লির দরজা বন্ধ করে ঘুরে দাঁড়াল সে, চারদিকে চোখ বোলাতে লাগল। পুরানো আমলের একটা লণ্ড্রি টাব, তার পেছনে দেয়ালের কাছে একটা চেয়ার আর একটা টেবিল। টেবিলের ওপর কতগুলো বোতল, ছুতোরদের কয়েকটা যন্ত্রপাতি, কতগুলো ছুরি আর সূচ। কয়েকটা ছুরি বাঁকা ধরনের, আর সূচগুলোর বেশিরভাগ সিরিঞ্জ পরানো। ওগুলোর পেছনে ছড়ানো ছিটানো কয়েকটা কাঠের নেহাই, কিছু মোটা তার, আর সাদা রঙের বড় বড় গোল গোল কি যেন, চিনতে পারল না লিলা। সে বাঁকানো ছুরিগুলোর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, যেন ওগুলো তাকে সম্মোহন করেছে।

এই সময় শব্দটা শুনতে পেল ও।

দরজা খুলছে কে যেন।

বাড়িতে নিশ্চই কেউ ঢুকেছে।

কিন্তু কে হতে পারে? স্যাম? তাহলে সে তার নাম ধরে ডাকছে না কেন?

লিলা শুনল আগন্তুক সেলারের দরজা বন্ধ করল। পায়ের শব্দ ধীরে ধীরে হলঘরের দিকে মিলিয়ে যেতে লাগল। লোকটা তাহলে দোতলার দিকে যাচ্ছে।

সেলারে সে আটকা পড়ে গেছে, বুঝতে পারল লিলা। বেরুবার কোন পথ নেই। কোথাও লুকোবারও জায়গা নেই। সেলারের সিঁড়ি বেয়ে কেউ নামলেই তাকে দেখতে পাবে। এবং ও নিশ্চিত শীঘ্রই কোন অনুপ্রবেশকারী নামবে নিচে।

কোনভাবে যদি লুকোবার একটু জায়গা পেত লিলা তাহলে অনুপ্রবেশকারীর হাত থেকে রক্ষা পেত। দিশেহারার মত এদিক ওদিক তাকাল সে। সিঁড়ির তলাটা বেশ পছন্দ হলো। পুরানো খবরের কাগজ কিংবা কাপড় চোপড় যদি পাওয়া যায় তাহলে ওগুলো গায়ের ওপর চাপা দিয়ে

লাফিয়ে উঠল লিলা কম্বলটা চোখে পড়তেই। দেয়ালের সঙ্গে ঝুলছে ওটা। বড়, ইণ্ডিয়ান কম্বল। বেশ পুরানো। কম্বলটা ধরে টান দিতেই ওটা দেয়ালের গা থেকে খসে এল। খসে এল দরজা থেকেও।

দরজা! ভয়ানক অবাক হলো লিলা দরজাটা দেখে। তারমানে দরজার ওপাশে আরেকটা ঘর আছে, সম্ভবত ওল্ড ফ্যাশনের কোন ফুট সেলার। এসব জায়গা লুকিয়ে থাকা এবং কাউকে লুকিয়ে রাখার জন্য সর্বোত্তম স্থান।

লিলা ফুট সেলারের দরজা খুলল।

সঙ্গে সঙ্গে গলা চিরে বেরিয়ে এল ভয়ার্ত আর্তনাদ।

বা এক মহিলা শুয়ে আছে ওখানে। তার চুল সাদা, বাদামী, কোঁচকানো মুখে ভাঁজ পড়েছে, অশ্লীল হাসছে সে লিলার দিকে চেয়ে।

মিসেস নরমা! যেন খাবি খেল লিলা।

হ্যাঁ।

কিন্তু উত্তরটা ভাজ পরা অশ্লীল মুখ থেকে এল না, এল ওর পেছনে, সিঁড়ির সর্বোচ্চ ধাপে দাঁড়ানো মূর্তিটার কাছ থেকে।

বিদ্যুৎ বেগে ঘুরল লিলা। অদ্ভুত, মোটা চেহারার কে যেন দাঁড়িয়ে আছে ওখানে। তার শরীরের নিচের অংশ বেঢপ, আঁটসাঁট পোশাকে ঢাকা। পোশাকটা সে তলের পোশাকের ওপরেই পরে নিয়েছে। গায়ে শাল। মুখটা ভয়ঙ্কর রকম সাদা, গালে রুজ, ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক। ঠোঁট দুটো নড়ে উঠল তার, উঁচু, কর্কশ একটা স্বর বেরিয়ে এল ফাঁক দিয়ে, আমিই মিসেস নরমা বেটস! শালের নিচ থেকে হাত বেরিয়ে এল তার, কসাইদের মত ছুরি আরপ্রকাশ করল সেই হাতে। নড়ে উঠল সে, অবিশ্বাস্য দ্রুততায় সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল নিচে। মুখ হাঁ হয়ে গেল লিলার, ফুলে উঠল গলার রগ, গগনবিদারী চিৎকার করতে লাগল সে একের পর এক। পৈশাচিক মূর্তিটা লিলার সামনে চলে এসেছে, হাত উঁচু করল সে, কোপ দেবে, এই সময় যেন উড়ে এল স্যাম। পেছন থেকে হাতটা চেপে ধরল সে, সর্বশক্তি দিয়ে মোচড় দিল। খসে পড়ল ছুরিটা মেঝেতে, ঠনঠন আওয়াজ তুলল।

স্যামকে দেখেই লিলার হাঁ করা মুখ বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু চিৎকার বন্ধ হলো না। উন্মাদ এক স্ত্রী কণ্ঠের চিৎকার প্রতিধ্বনি তুলল সেলারে। তবে চিৎকারটা শুয়ে থাকা মহিলার গলা থেকে আসছে না, আসছে মেয়েলী পোশাক পরা, গালে রুজ মাখা বিশালদেহী নরমান বেটসের গলা থেকে।

.

১৬.

শেষ পর্যন্ত সবই পাওয়া গেল। ড্রেজার এবং ক্রেন ব্যবহার করে জলা থেকে লাশ এবং গাড়িগুলো ওঠাল কাউন্টি হাইওয়ে জুরা। মেরির গাড়ির গ্লাভ কম্পার্টমেন্টে চল্লিশ হাজার ডলার ঠিকঠাক মত পাওয়া গেল। অবাক ব্যাপার, টাকাগুলো পানিতেও ভেজেনি কিংবা কাদামাটিও লাগেনি।

ইতিমধ্যে ফুলটনের সেই ব্যাংক ডাকাত ধরা পড়ল ওকলাহোমায়। কিন্তু তার খবর ফেয়ারভেলের উইকলি হেরাল্ড পত্রিকা মাত্র আধা কলাম জায়গায় ছাপল। প্রথম পৃষ্ঠার পুরো জায়গা দখল করল নরমান বেটস কাহিনী। এপি এবং ইউপি ঘটনাস্থল থেকে সমস্ত খবর সংগ্রহ করে পাঠিয়ে দিল টেলিভিশনে। কিছু সাংবাদিক এই ঘটনাকে উত্তরের গেন হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তুলনা করলেন। তারা মোটেলটাকে হানাবাড়ি বানিয়ে ছাড়লেন এবং সবাইকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন নরমান বেটস এই দুটো খুনই কেবল করেনি, বছরের পর বছর ধরে সে এহেন জঘন্য কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছে। গত বিশ বছরে যে সব লোক এই এলাকা থেকে হারিয়ে গেছে তাদের ব্যাপারে জোর তদন্ত করার জন্য তারা প্রশাসনকে চাপ দিতে লাগলেন, বললেন সমস্ত জলা সেঁচে দেখতে হবে আর কোন লাশ পাওয়া যায় কিনা।

শেরিফ চেম্বারসের ছবিসহ সাক্ষাৎকার ছাপা হলো বিভিন্ন পত্রিকায়। কেসের ব্যাপারে পরিপূর্ণ তদন্তের আশ্বাস দিল সে। স্থানীয় জেলা অ্যাটর্নি সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে বললেন তিনি শীঘ্রই নরমান বেটসের বিচারের কাজ শুরু করে দেবেন (সাধারণ নির্বাচন মাস কয়েক পরে তো, তাই) এবং তার বিরুদ্ধে মানুষের মাংস ভক্ষণ, প্রেতচর্চা, অবৈধ যৌন সম্পর্ক এবং ডাকিনি বিদ্যার যে সমস্ত অভিযোগ আনা হয়েছে সেই অভিযোগ প্রমাণ হলে সে যাতে কঠোর এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পায় তার ব্যবস্থাও করবেন। কিন্তু তিনি বলেই খালাস। নরমান বেটসের সঙ্গে কথা বলারও প্রয়োজন অনুভব করলেন না। নরমানকে এখন স্টেট হাসপাতালে সাময়িক পর্যবেক্ষণের জন্য রাখা হয়েছে। গুজব রটনাকারীরাও তার ধারে কাছে ঘেঁষার সুযোগ পেল না। কিন্তু তাতে কি? বিরামহীনভাবে তারা একটার পর একটা উদ্ভট, আজগুবী গল্প বানিয়েই যেতে লাগল। শুধু ফেয়ারভেল নয়, সারাদেশ যেন মেতে উঠল নরমানকে নিয়ে। কেউ কেউ বলল, নরমানকে তো আমি ছোটবেলা থেকে চিনি। একসঙ্গে কত স্কুলে গিয়েছি। কেউ মাথা দোলাতে দোলাতে বলল, হ্যাঁ, নরমানটা ছোটবেলা থেকেই জানি কেমন অদ্ভুত স্বভাবের। কেউ বলল নরমানকে সে প্রায়ই মোটেলের কাছে ঘোরাফেরা করতে দেখেছে। তার আচরণ খুব সন্দেহজনক ছিল। এমন লোক পাওয়া গেল না যে কিনা প্রথম থেকেই মিসেস নরমা এবং জো মার্ককে চিনত না। তারা বলাবলি শুরু করল, আমরা প্রথম দিকেই বুঝতে পেরেছিলাম দুজনের মধ্যে কোথাও মস্ত একটা ভজকট আছে। নইলে দুজনেই একসঙ্গে আত্মহত্যা করবে কেন? কিন্তু নরমানের মা আর জো মার্কের গল্প তেমন জমল না। কারণ বিশ বছর আগের ঘটনার চেয়ে বর্তমানের ঘটনা অনেক বেশি রোমাঞ্চকর, অনেক বেশি মুখরোচক।

মোটেলটা কর্তৃপক্ষের নির্দেশে বন্ধ করে দেয়া হলো। কারণ পিঁপড়ের মত একের পর এক লোক আসছিল এই ভৌতিক এবং খুনী বাড়িটাকে দেখতে। অনেকে এখানে ভাড়া করে থাকার খায়েশও ব্যক্ত করল। কিন্তু স্টেট হাইওয়ে পুলিশ কাউকে ভেতরে ঢুকতে দিল না। পাহারা দিয়ে রাখল তারা বাড়ি এবং মোটেল।

তবে পোয়াবারো হলো স্যামের। কারণ প্রচুর লোক তার দোকানে এসে ভিড় জমাল। জিনিসপত্র কেনার ছলে দোকানের মালিকের সঙ্গে কথা বলাই তাদের আসল উদ্দেশ্য। কিন্তু স্যাম তখন ফোর্থওয়ার্থে লিলার সঙ্গে। ফলে পুরো ধকল একাই সামলাতে হলো বেচারা ববকে। অবশ্য বস্-এর ব্যবসা জমে ওঠায় সে খুশিমনেই এ ঝামেলা মেনে নিল। আর লোকজনকে আশ্বাস দিতে লাগল তার বস্ শীঘ্রই দোকানে এসে বসবে, তখন সব প্রশ্নের জবাব তারা পেয়ে যাবে।

ফোর্থওয়ার্থে লিলার সঙ্গে কয়েকটা দিন কাটিয়ে স্যাম চলে এল স্টেট হাসপাতালে। এখানে তিনজন সাইকিয়াট্রিস্ট নরমানকে পরীক্ষা করে দেখছিলেন।

আরও দিন দশেক পর স্যাম ড. নিকোলাস স্টেইনারের কাছ থেকে তাদের পরীক্ষার ফলাফল জানতে পারল। লিলা সাপ্তাহিক ছুটিতে চলে এল জনের ওখানে। উদগ্রীব হয়ে সব খবর জানতে চাইল সে। প্রথমে স্যাম বিশেষ কিছু বলতে চায়নি, কিন্তু লিলার জেদের কাছে হার মানল ও।

আসল ঘটনা কি ঘটেছিল তা বোধহয় আমরা কোনদিনই জানতে পারব, বলল স্যাম। ড, স্টেইনার বললেন সঠিক ভাবে তিনিও কিছু বলতে পারবেন না, তবে মোটামুটি একটা আন্দাজের ওপর তিনি রিপোর্ট করেছেন। নরমানকে প্রথমে প্রচুর ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়। কিন্তু ঘুম ভাঙার পর সে কারও সঙ্গেই কথা বলতে চাইছিল না। একমাত্র ড, স্টেইনারই তার অনেকটা কাছাকাছি আসতে পেরেছিলেন। তবে গত কয়েকদিন ধরে সে নাকি উদ্ভ্রান্তের মত আচরণ করছে।

কিন্তু ড, স্টেইনার নরমান বেটস সম্পর্কে কি বলেছেন? জানতে চাইল লিলা।

ড. স্টেইনার বললেন নরমান তার মাকে ভীষণ ভালবাসত। তাদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত গভীর। তবে এই গভীরতা কোন অবৈধ সম্পর্কের জন্ম দিয়েছিল কিনা ড. স্টেইনার সে ব্যাপারে নিশ্চিত নন। তবে দৃশ্যত মিসেস নরমাই তার ছেলের ওপর কর্তৃত্ব করতেন। নরমানের বয়স বাড়লেও তার মধ্যে মেয়েলীপনা ছিল পুরোমাত্রায়। ড, স্টেইনারের ধারণা সে অনেক আগে থেকেই ট্রান্সভেস্টাইটদের মত আচরণ শুরু করে। ট্রান্সভেস্টাইট কাকে বলে জানো?

লিলা মাথা দোলাল। যে সব পুরুষ মেয়েদের পোশাক পরে থাকতে ভালবাসে তারাই তো, নাকি?

হ্যাঁ, তারাই। তো এই ট্রান্সভেস্টাইটরা সমকামী হয় বলে অনেকের ধারণা। কিন্তু সবাই যে সমকামী হবে এমন কোন কারণ নেই। অনেক ট্রান্সভেস্টাইটকে সাধারণ মানুষের মত বিপরীত লিঙ্গের প্রতি প্রচণ্ড আকর্ষিত হতে দেখা গেছে। নরমান বেটসেরও তার মার প্রতি তীব্র আকর্ষণ ছিল। একদিকে সে ইচ্ছে করত যেন সে নিজেই তার মা হয়ে ওঠে.অন্যদিকে সে চাইতো মার সঙ্গে তার যেন কখনও বিচ্ছেদ না ঘটে।

স্যাম একটি সিগারেট ধরিয়ে আবার বলতে শুরু করল, নরমান বড় হওয়ার পর সম্ভবত তার মা আবিষ্কার করে তার ছেলের নিজ থেকে পথ চলার কোন ক্ষমতাই নেই। হয়তো তার মা-ই চায়নি ছেলে বড় হোক। নরমানের এই অবস্থার জন্য তার মা কতটা দায়ী সেটা বোধহয় কখনোই জানা সম্ভব হবে না। বাইরে যাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েই হয়তো নরমান আধিভৌতিক ব্যাপারগুলোতে খুব আগ্রহী হয়ে ওঠে। এই সময় রঙ্গমঞ্চে আবির্ভাব ঘটে জো মার্কের।

জো মার্ক সম্পর্কে ড. স্টেইনার নরমানের কাছ থেকে তেমন কিছুই জানতে পারেননি। লোকটার প্রতি, এই বিশ বছর পরও তার ঘৃণা সীমাহীন। জো মার্ককে নিয়ে সে কোন কথাই বলতে চায়নি। ড, স্টেইনার অবশ্য শেরিফের সঙ্গে কথা বলে, পুরানো কাগজপত্র ঘেঁটে মোটামুটি একটা গল্প দাঁড় করিয়েছেন তাঁর সম্পর্কে।

জো মার্কের সঙ্গে মিসেস নরমার যখন পরিচয় হয় তখন তার বয়স চল্লিশ একচল্লিশ হবে। আর মিসেস নরমার বয়স আটত্রিশ-উনচল্লিশ। মিসেস বেটস দেখতে সুন্দরী ছিলেন না। বরং অল্প বয়সে তার চুল পেকে গিয়েছিল, গায়েও মাংসের বালাই ছিল না। মি, বেটস তার প্রেমে পড়েছিলেন তার সম্পত্তির লোভে শেরিফের কাছেই শুনেছ। কিন্তু স্ত্রীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় তিনি বাড়ি ছেড়ে চলে যান এটাও তুমি জানো। এই সুযোগটাকে কাজে লাগান জো মার্ক। তিনি মিসেস নরমার সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেন। মিসেস নরমার মানসিক অবস্থা তখন খুবই খারাপ ছিল। তিনি পুরুষ জাতটাকেই ঘৃণা করতে শুরু করেন। আর এর ধকলটা সইতে হয়েছে ইরমানকে। ধমকে ধমকে তিনি নরমানের ব্যক্তিত্বের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিলেন। যাক যা বলছিলাম, জো মার্ক অনেক কসরতের পর মিসেস নরমার মন গলাতে সমর্থ হন। তাঁকে বিয়ে করতে রাজি হন ভদ্রমহিলা। জো-র ইচ্ছে ছিল মিসেস নরমার ফার্মটাকে বিক্রি করে ওই টাকা দিয়ে একটা মোটেল করার। বর্তমানের পুরানো হাইওয়েটা তখন মোটেল ব্যবসার জন্য খুবই লাভজনক একটি জায়গা ছিল।

মোটেল বানানোর ব্যাপারে নরমান কোন আপত্তি করেনি। প্রথম মাস তিনেক সে এবং তার মা মিলে মোটেল চালিয়েছে। তারপর একদিন তার মা তাকে জানান তিনি জো মার্ককে বিয়ে করতে যাচ্ছেন।

তারপর?

ড, স্টেইনারের ধারণা বিয়ের ব্যাপারটা নরমানকে ভয়ানক আঘাত করে। কারণ এর আগে একদিন সে জো আর তার মাকে বেডরুমে নগ্ন অবস্থায় দেখে ফেলেছিল। সে তার মা আর জো চাচাকে বিষ খাওয়ায়। স্ট্রিকনিন নামের ওই ইঁদুর মারার ওষুধটা সে তাদের কফিতে মিশিয়ে দিয়েছিল। এই বিষে মানুষ অজ্ঞান হয় না, প্রচণ্ড যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে। এক সময় পেশীতে খিচ ধরে, শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যায় ভিক্টিম। নরমান নিশ্চই পুরো ব্যাপারটা চোখের সামনে ঘটতে দেখেছিল।

কি ভয়ঙ্কর! শিউরে উঠল লিলা।

ভয়ঙ্করই বটে। শুধু তাই নয় সে তার মার হাতের লেখা নকল করে আত্মহত্যার স্বীকারোক্তিও লিখেছিল। আর কাজটা সে করেছিল ঘটনার সময়। ওরা মারা যাওয়ার পর সে শেরিফের কাছে ফোন করে।

কেউ সন্দেহ করেনি যে নরমানই খুনী?

না। সবাই বরং এটাকে আত্মহত্যা ভেবেছে। প্রথম কারণ হচ্ছে নরমানের মার ওই স্বীকারোক্তি পত্র। নরমান চিঠিটা এমনভাবে লিখেছিল যে লোকজন বলাবলি শুরু করে তার মা আবার গর্ভবতী হয়ে পড়ার লজ্জায় আত্মহত্যা করেছেন। আর জো মার্ক সম্পর্কে গুজব ছড়াল ওয়েস্ট কোস্টে তাঁর বৌ ছেলেমেয়ে আছে। ওখানে তিনি অন্য নামে পরিচিত ছিলেন। তো তাঁর বৌ আবার তার কাছে স্ত্রীর দাবি নিয়ে ফিরে আসতে চাইলে তিনি অনন্যোপায় হয়ে আত্মহত্যা করেন। আর ওদের দুজনকে খুন করার টেনশন সহ্য করতে না পেরে নরমান পাগল হয়ে গিয়েছিল, সবাই ভেবেছে মাতৃশোকে ছেলের মাথা খারাপ হয়েছে। কেউ অবশ্য স্বীকারোক্তি পত্রটা অত গোলমালের মধ্যে ভাল করে লক্ষ্য করেনি। তাহলে কারও না কারও মনে সন্দেহ জাগতই। কারণ খুনের মত একটা ভয়াবহ ব্যাপারের মধ্যে একজনের হাতের লেখা হুবহু নকল করা খুবই শক্ত ব্যাপার।

লোকজন জানত নরমান পাগল হয়ে গেছে। কিন্তু জানত না চিঠিটা লেখার সময় তার মনের ভেতর কি বিরাট রদবদল হয়ে গেছে। চিঠিটা লিখতে লিখতে নরমান নিজেই হয়ে উঠেছিল তার মা। সবকিছু শেষ হয়ে গেছে মনে হলেও মার বিচ্ছেদ সে কিছুতেই সহ্য করতে পারছিল না। সে চাইছিল তার মা আবার জীবিত হয়ে উঠুক। দুঃখে ও যন্ত্রণায় সে ভয়ানক ভেঙে পড়ে। তার মানসিক অবস্থা এতই খারাপ ছিল যে কেউ তাকে আত্মহত্যার বিষয়ে কোন প্রশ্ন করতে ভরসা পায়নি। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সে হাসপাতালে থাকার সময়ই তার মা আর জো মার্ককে কবর দেয়া হয়।

হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর নরমান তার মাকে কবর খুঁড়ে তোলে, তাই না? বলল লিলা।

দৃশ্যত তাই। মূর্তি স্টাফ করা তার শখ ছিল। মিসেস নরমাকে সে কবর থেকে তুলে স্টাফ করে রেখেছিল।

কিন্তু একটা জিনিস আমি বুঝতে পারলাম না। নরমান যদি নিজেকেই তার মা বলে ভাবত তাহলে- 

ব্যাপারটা আসলে খুবই জটিল। ড. স্টেইনারের মতে নরমানের মধ্যে তিনটি ব্যক্তিত্ব কাজ করত। প্রথমত শিশু নরমান, যে মা ছাড়া অন্যকিছু বুঝত না। তাকে তার মার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে এমন যে কাউকে সে ভয়ানক ঘৃণা করত। দ্বিতীয়ত মিসেস নরমা বেটস, নরমান জানত তার মাকে কিছুতেই মরতে দেয়া যাবে না। আর তিন নম্বর চরিত্রটি পূর্ণবয়স্ক নরমান, এই নরমান কাজে কর্মে স্বাভাবিক এবং সাধারণ। এই তিনটে সত্তাই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভাবে নরমানের মধ্যে কাজ করত।

হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর নরমান বাড়িতে ফিরে আসে। তীব্র অপরাধবোধ তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। প্রবল মানসিক চাপ তাকে বাধ্য করে পরবর্তী কাজগুলো করতে। তার মনে হয় মার ঘর শুধু ঠিকঠাক করে রাখলেই চলবে না তাকেও এখানে এনে রাখতে হবে। তারপর সে কবর খুঁড়ে মিসেস নরমাকে নিয়ে আসে। রাতে সে তাকে বিছানায় শুইয়ে দিত, দিনের বেলা তাকে পোশাক পরিয়ে বেডরুমের জানালার কাছে বসিয়ে রাখত। মিলটন অ্যারবোগাস্ট ওই সময় তাকে দেখে ফেলে।

নরমান প্রায়ই তার মার সঙ্গে কথা বলত। যেভাবে ভেনট্রিলোকুইস্ট তার ডামির সঙ্গে কথা বলে, সেভাবে। তবে এই কথা হত শিশু নরমান এবং তার মার সঙ্গে। সাবালক অবস্থায়, অর্থাৎ নরমান যখন পূর্ণবয়স্ক মানুষের সত্তায় অবস্থান করছে তখন সে সব কিছুই বুঝতে পারত। সে প্রকৃতিস্থ থাকার ভান করত বটে কিন্তু আদৌ সে কতটুকু প্রকৃতিস্থ ছিল তা কে জানে, প্রেতচর্চা, ডাকিনী বিদ্যা ইত্যাদি আধিভৌতিক ব্যাপারগুলোয় নরমানের আগ্রহ ছিল অপরিসীম। এবং সে এগুলো মনে প্রাণে বিশ্বাসও করত। তো এইভাবেই সে এক সঙ্গে তিনটি জীবনযাপন করে চলছিল।

তারপর মেরি ওখানে এল- 

স্যাম ইতস্তত করছে দেখে বাক্যটা লিলাই শেষ করল, এবং সে মেরিকে খুন করল।

না, মা খুন করল তাকে। বলল স্যাম, মিসেস নরমা খুন করেছেন তোমার বোনকে। ড, স্টেইনারের মতে কোন গোলমাল হলেই মিসেস নরমা প্রধান ভূমিকা পালন করতেন। নরমান মদ খেয়ে মাতাল হয়ে যেত, তখন ঘটনার সামাল দিতেন তার মা। মাতাল অবস্থায় নরমান তার মার পোশাক পরত এবং নিজেই মা হয়ে যেত। অবচেতন মনেই সে তারপর খুন করত। সে জানত খুন সে করছে না, করছে তার মা। কিন্তু সে যখন সাবালক অবস্থায় ফিরে আসত তখন মার জন্য তার খুব চিন্তা হত। মাকে বাঁচাতে হবে, এই চিন্তা থেকে সে পরবর্তী কাজগুলো করত। লাশ গায়েব করা, চিহ্ন মুছে ফেলা ইত্যাদি।

কিন্তু ড. স্টেইনারের মতে সে-ই আসলে খুনী?

হ্যাঁ। ড, স্টেইনার নরমানকে সাইকোটিক মনে করেন। আসলেই তো বদ্ধ পাগল সে। তাকে হয়তো সারাজীবন হাসপাতালেই কাটাতে হবে।

বিচার হবে না?

না, দীর্ঘশ্বাস ফেলল স্যাম, বিচার হবে না। তোমার হয়তো খারাপ লাগছে শুনে–

না, এই ভাল হয়েছে, আস্তে আস্তে বলল লিলা, আসলে জীবনে কত অদ্ভুত ঘটনাই না ঘটে। আমি তো কল্পনাও করিনি শেষ পর্যন্ত এমন একটা ব্যাপার আমরা আবিষ্কার করব। জানেন, নরমানের প্রতি আমার এখন কোন রাগ লাগছে না, ঘৃণাও হচ্ছে না। বরং মনে হচ্ছে নিজেদের আমরা যতটা সুস্থ মনে করি আসলে তার বেশিরভাগই ভান।

স্যাম উঠে দাঁড়াল, সঙ্গে লিলাও। দরজার দিকে এগোল ওরা। লিলা তাকাল স্যামের দিকে, যাক, সব তাহলে শেষ হলো। আমি ব্যাপারটা ভুলে যেতে চাই। সম্পূর্ণ ভুলে যেতে চাই।

সম্পূর্ণ? স্যাম বিড়বিড় করে বলল, লিলার দিকে তাকাল না পর্যন্ত। বেরিয়ে গেল দরজা দিয়ে।

কিন্তু সবকিছু কি আসলেই শেষ হলো?

.

১৭.

শেষ ঘটনাটা ঘটল নিঃশব্দে।

পরিত্যক্ত, ছোট ঘরটায়।

এই ঘরে একসময় তিনটে কণ্ঠ সরব হয়ে উঠত, মিশে যেত একসঙ্গে। পুরুষ কণ্ঠ, নারী কণ্ঠ এবং শিশু কণ্ঠ।

কিন্তু এই ঘরে এখন মাত্র একটি কণ্ঠ আছে। একজন মাত্র আছে। আর কেউ নেই। ওরা তাই জানে। তার মুখে নিঃশব্দ হাসি ফুটে উঠল।

এই বাড়িতে একটা খারাপ ছেলে ছিল। ছেলেটা তাকে এবং তার প্রেমিককে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। তার প্রেমিক মরেছে, কিন্তু সে মরেনি। তাকে কবরও দেয়া হয়েছিল। চোখ বুজলে তাকে এখনও কফিনের নরক অন্ধকার তাড়া করে ফেরে। মনে পড়ে সেই রাতের কথা যে রাতে তার কবর খোঁড়া হলো, কফিন খোলা হলো। তারপর…

এই বাড়িতে একটা খারাপ লোকও ছিল। লোকটা খুনী ছিল। সে দেয়ালের ফুটো দিয়ে তাকাত, বোতল বোতল মদ খেত, নোংরা বই পড়ত আর উদ্ভট সব ব্যাপার বিশ্বাস করত। কিন্তু সবচে মারাত্মক ব্যাপার সে দুটি নিরীহ মানুষের মুত্যুর জন্য দায়ী। একটি ছিল ওই সুন্দরী মেয়েটি, যার ফিগার ছিল সত্যি দেখার মত, আর বাকীজন পুরুষ। পুরুষটি মাথায় ছাইরঙা স্টেটসন হ্যাট পরত। সে এই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে সবকিছু জানে। আর জানে বলেই সব নিখুঁতভাবে মনে করতে পারছে। কারণ ঘটনার সময় সে ওখানে উপস্থিত ছিল। সে কিছুই করেনি। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছে।

কিন্তু খারাপ লোকটা নিজে খুন করে সব দোষ তার ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। বলেছে মা খুন করেছে। একেবারেই মিথ্যা কথা।

সে কি করে খুন করবে, তাকে তো স্টাফ করা মূর্তির মত দিনের পর দিন পড়ে থাকতে হয়েছে। স্টাফ করা মূর্তি কি কাউকে কখনও আঘাত করতে পারে?

সে জানে খারাপ লোকটার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। খারাপ লোকটা তার কাছে এখন মৃত। মৃত খারাপ ছেলেটাও। কিংবা ওরা দুজনেই তার দুঃস্বপ্নের একটা অংশ ছিল। দুঃস্বপ্নটা এখন দূর হয়েছে। চিরতরে।

কিন্তু সে ছিল, আছে এবং থাকবে।

থাকবে এই ছোট ঘরটাতে। স্টাফ করা মূর্তির মত। নড়বে না, চড়বে, শুধু স্থির হয়ে বসে থাকবে। তাহলে কেউ তার কথা জানবে না। আর না জানলে কেউ তাকে শাস্তিও দিতে আসবে না।

স্থির হয়ে বসে থাকল সে। তারপর একসময় একটা মাছি ঢুকল জানালার গরাদ দিয়ে। এসে বসল তার হাতের ওপর।

সে এখন ইচ্ছে করলেই মাছিটাকে চাপড় মেরে তাড়াতে পারে।

কিন্তু সে চাপড় মারবে না।

কারণ নড়লেই যদি কেউ দেখে ফেলে!

তাহলেই তো সব জানাজানি হয়ে যাবে।

থাক, মাছিটা যেখানে বসে আছে সেখানেই থাকুক। সে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল মাছিটার দিকে।

.

[উন্মাদ নরমান বেটসকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় চিকিৎসার জন্য। কিন্তু সেখানে এক নার্সকে খুন করে সে পালিয়ে যায়। তারপর শুরু হয় আরেক রুদ্ধশ্বাস কাহিনী। কী সেই কাহিনী? জানতে হলে পড়ুন রবার্ট ব্লচের সাইকো সিরিজের দ্বিতীয় সাইকো-২।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *