০৫-৮. দড়াম করে দরজা বন্ধ

দড়াম করে দরজা বন্ধ করল নরমান। হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটল বাড়ির দিকে। রক্ত আর জলে মাখামাখি হয়ে গেছে জামা কাপড়। তবে এগুলো পরে পরিষ্কার করলেও চলবে। অনেক কাজ পড়ে আছে সামনে। সবার আগে দেখতে হবে মার অবস্থা এখন কেমন। তীব্র ভয় আর আতঙ্কের মধ্যেও দ্রুত আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতে লাগল নরমান। নিজেকে সম্পূর্ণ আলাদা একজন মানুষ বলে মনে হতে লাগল।

তাড়াতাড়ি পা চালাল নরমান। বাড়ি পৌঁছে দেখল সামনের দরজা খোলা। বারান্দায় এখনও আলো জ্বলছে, কিন্তু ওখানে কেউ নেই। দ্রুত একবার চারদিকে চোখ বোলাল, তারপর সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করল সে।

মার ঘরের দরজা হাট করে খোলা, আলো জ্বলছে ভেতরে। পা বাড়াল নরমান, এগোল বেডরুমের দিকে। ভেতরে ঢুকেই ধাক্কা খেলো সে। বেডরুম খালি। মা নেই! ঘরের প্রতিটি জিনিস ঠিকঠাক আছে, শুধু আসল মানুষটা নেই।

পোশাকের আলমারির দিকে এগোল নরমান। হ্যাঁঙারে সার বাঁধা সব পোশাক। কেমন বিশ্রী গন্ধ। বমি এসে যায়। কিন্তু এই গন্ধটাকে ছাপিয়ে আরেকটা গন্ধ এসে ঝাঁপটা মারল ওর নাকে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একটা কাপড়ে পা বেঁধে আছাড় খেতে যাচ্ছিল ও। মেঝেতে তাকাল ও। মার একটা স্কার্ফ। দলামোচড়া হয়ে পড়ে আছে। ঝুঁকে স্কার্ফটা তুলে নিল নরমান। সঙ্গে সঙ্গে খাড়া হয়ে গেল গায়ের রোম। স্কার্ফের গায়ে রক্ত।

তার মানে মা কাণ্ডটা ঘটাবার পর এখানে ফিরে এসেছে, পোশাক পাল্টেছে, তারপর আবার উধাও হয়ে গেছে।

এখন নরমান কি করবে? পুলিশ ডাকবে? না, পুলিশে খবর দেয়া যাবে না। মা তো আর ইচ্ছে করে কাজটা করেনি। সে অসুস্থ। এজন্য তাকে দায়ী করা চলে না। ঠাণ্ডা মাথায় খুন এক জিনিস আর অসুস্থতা অন্য জিনিস। বিশেষ করে মাথার গোলমাল থাকলে তাকে নিশ্চই খুনের অপরাধে ফাঁসী দেয়া যায় না, দ্রুত ভাবছে নরমান। তবে আদালতের রায় তার মার বিরুদ্ধে যেতেও পারে। কিন্তু তারা যদি জানতে পারে মা অপ্রকৃতিস্থ, তাহলে নিঃসন্দেহে তাকে পাগলা গারদে পাঠাবে। আর মা ওখানে হয়তো মরেই যাবে।

মার ঘরের চারদিকে দ্রুত একবার চোখ বোলাল নরমান। প্রাণ থাকতে সে মাকে তার এই ঘর থেকে সরাতে পারবে না। তাছাড়া এখন পর্যন্ত কেউ জানেই না যে তার মা এখানে থাকে। মেয়েটাকে মার কথা বলেছিল কারণ তার সঙ্গে নরমানের আর কোনদিন দেখা হওয়ার চান্স ছিল না। আর এখন তো সে মরেই গেল। সুতরাং মার অস্তিত্ব যেভাবে গোপন ছিল সেভাবেই থেকে যাবে। পুলিশের কাছে যাবে না ঠিক করল নরমান। তারপর মেরিকে নিয়ে ভাবতে শুরু করল।

মেয়েটা তাকে বলেছিল সারাদিন সে গাড়ি চালিয়েছে। ফেয়ারভেলের রাস্তাও তার চেনা ছিল না। কাছাকাছি কারও সঙ্গে দেখা করাও তার উদ্দেশ্য ছিল না নিশ্চই। আর যদি এমন কেউ থাকে যে তার জন্য অপেক্ষা করছে তাহলে সেই লোক নিঃসন্দেহে আরও দূরে রয়েছে। তার মানে স্থানীয় কেউই তার পরিচিত নয়।

যদিও পুরো ব্যাপারটাই অনুমানের তবু যুক্তিগুলো একেবারে ফেলনা নয়। এর ওপর ভিত্তি করেই তাকে এখন থেকে এগোতে হবে।

মেয়েটা রেজিস্টারে সই করেছিল। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। কেউ যদি ওর ব্যাপারে কখনও খোঁজ নিতে আসে তাহলে নরমান বলবে হ্যাঁ, এরকম একটি মেয়ে এখানে এসেছিল বটে কিন্তু রাত কাটিয়ে পরদিন আবার চলে গেছে।

এখন তার মূল কাজ হচ্ছে লাশ এবং গাড়িটাকে সরিয়ে ফেলা। তারপর সমস্ত চিহ্ন লোপাট করতে হবে। কাজটা সুখকর নয়, কিন্তু মাকে পুলিশের হাত থেকে বাঁচাতে হলে এটা তাকে করতেই হবে।

কাজে লেগে গেল নরমান বেটস।

মার জামাকাপড়গুলো একত্র করে একটা বলের মত করল সে, তারপর নিয়ে চলল নিচে। রান্নাঘরে গিয়ে নিজের পোশাক পাল্টাল, অন্য কাপড় পরল। কাপড়গুলো কোথাও রাখার মত একটা পাত্র খুঁজল সে। পরে পুড়িয়ে ফেলবে। বেসমেন্টে চলে এল ও। ফ্রন্ট সেলারের দরজা খুলতেই যা খুঁজছিল পেয়ে গেল। পুরানো, বড় একটা ঝুড়ি। জামাকাপড়গুলো সব ছুঁড়ে ফেলল নরমান ঝুড়িতে। সেলারের সিঁড়ির কাছের টেবিল থেকে পুরানো অয়েলক্লথটা! টেনে নিল। তারপর ফিরে এল রান্নাঘরে। এক এক করে রান্নাঘর এবং হলঘরের সব বাতি নেভাল। ঝুড়ি আর অয়েলক্লথ নিয়ে অন্ধকার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল সে।

মাকে কোথায় খুঁজবে নরমান এত রাতে? কোথায় যেতে পারে সে? রাস্তার দিকে যায়নি তো? রাস্তার দিকে যদি সে সত্যি যায় আর কোন লোকের গাড়ি থামিয়ে উঠে পড়ে তাহলে কি হবে? সবচেয়ে মারাত্মক ব্যাপার মা অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় সেই লোককে যদি সব কথা বলে দেয়? অবশ্য এমনও হতে পারে সে এখন ওদের বাড়ির পেছনের জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওদিকে আবার একটা জলাও আছে। সে কি ওদিকটাতেই মাকে খুঁজবে?

দীর্ঘশ্বাস ফেলল নরমান। বুঝে উঠতে পারছে না কি করবে। ওই জিনিসটাকে ওভাবে বাথরুমে ফেলে রেখে মাকে খুঁজতে যাওয়া ওর কাছে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ মনে হচ্ছে। যদিও সে অফিসের সব আলো নিভিয়ে এসেছে, কিন্তু তবুও এত রাতে যে কোন খদ্দের আসবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? অনেক সময় রাত দুটোতেও খদ্দের এসেছে তার হোটেলে। তাছাড়া পুলিশের পেট্রল কারও আসতে পারে। যদিও আগে কখনও আসেনি, কিন্তু ঝুঁকিটা থেকেই যাচ্ছে।

পিচের মত অন্ধকারে হোঁচট খেতে খেতে মোটেলের দিকে এগোল নরমান। বাড়ির পেছনদিকের নুড়ি বিছানো পথটায় বৃষ্টির কারণে মাটি নরম হয়ে আছে। চিন্তায় পড়ল নরমান পায়ের ছাপ রেখে যাচ্ছে সে। এ নিয়ে পরে আবার কোন ঝামেলা না হয়।

মেয়েটার ঘরে পৌঁছে যেন হাঁপ ছাড়ল নরমান। দরজা খুলল। ঝুড়িটাকে মাটিতে রাখল। তারপর আলো জ্বালল। চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল সে। একটু পরেই যে দৃশ্য দেখতে হবে ভেবে ভয়ে বুক ধড়ফড় করছে। কিন্তু উপায় নেই। লাশটাকে সরাতেই হবে। নইলে মাকে বাঁচাতে পারবে না সে। অনেক কষ্টে মনে সাহস আনল নরমান। এগোল বাথরুমের দিকে। রক্তাক্ত শরীরটার নিচে ধারাল ছুরিটার দিকে একপলক তাকাল সে। পরক্ষণে ওটাকে তুলে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলল ঝুড়ির মধ্যে। ঝুড়ি থেকে একজোড়া মোজা বের করল, পরে নিল হাতে। তারপর অয়েলক্লথ দিয়ে মেরির প্রায় বিচ্ছিন্ন শরীরটাকে পেঁচাল, ঠেসেঠুসে ঢোকাল ঝুড়ির মধ্যে। বন্ধ করল ঢাকনা।

এবার বাথরুমটা পরিষ্কার করতে হবে। কিন্তু আগে এই জিনিসটাকে এখান থেকে সরানো দরকার। ভারী ঝুড়িটাকে টেনে নিয়ে এল নরমান শোবার ঘরে। এই সময় মেরির পার্স চোখে পড়ল ওর। ওটা খুলে গাড়ির চাবিটা বের করল ও। তারপর ঝুড়িটাকে টানতে টানতে নিয়ে এল গাড়ির কাছে। সাবধানে দরজা খুলল। মনে মনে প্রার্থনা করল কেউ যেন না আসে এদিকে।

দরদর করে ঘামছে নরমান। গাড়ির পেছনের বনেট খুলে ঝুড়িটাকে রাখল ভেতরে। তারপর আবার এসে ঢুকল বেডরুমে। মেরির জামাকাপড়গুলো এক করে বড় সুটকেস এবং ব্যাগটায় ভরল। ব্রা এবং প্যান্টি ছোঁয়ার সময় পেট মোচড় দিয়ে উঠল, যেন বমি আসবে।

মেরির চুলের কাঁটা ইত্যাদি সহ একটি মেয়ের ব্যবহার্য যা যা থাকে সব খুঁজে এক জায়গায় জড় করল নরমান। পার্সের টাকায় হাত দিল না। চোখের সামনে থেকে এগুলোকে এখন চিরতরে দূর করতে পারলেই সে বাঁচে।

সামনের সীটে ব্যাগ দুটো রাখল নরমান। মেরির রুমের দরজা বন্ধ করে গাড়িতে ওঠার আগে একবার সতর্ক দৃষ্টিতে এদিক ওদিক চাইল। নাহ্, রাস্তা ক্লীয়ার।

গাড়িতে উঠে বসল নরমান, চালু করল ইঞ্জিন। হেডলাইট জ্বালল। আলো জ্বালানো খুবই বিপদজনক জানে সে, কিন্তু করার কিছুই নেই। মাঠের মধ্য দিয়ে গাড়ি চালাবে সে, আলো জ্বালা না থাকলে এগোতেই পারবে না।

মোটেলের পেছনের ঢাল বেয়ে ঝাঁকি খেতে খেতে গাড়ি চালাতে লাগল নরমান। প্রথমদিকে ঘাসের ওপর দিয়ে গাড়িটা ভালই চলল। কিন্তু মাঠে নামতেই আবার লাফালাফি শুরু হলো। এদিকে একটা সরু রাস্তা আছে। রাস্তাটা নরমানের চেনা। মাঝে মাঝে এই রাস্তা ধরে সে জঙ্গলে যায়, জ্বালানি কাঠ নিয়ে আসে। কালকেই কাঠ আনতে যেতে হবে, ঠিক করল নরমান। তাহলে চাকার দাগ মুছে যাবে। আর কাদার মধ্যে যদি পায়ের দাগ থেকেও যায় তাহলে কাঠ আনার কৈফিয়ৎটা কাজে লেগে যাবে।

জলায় পৌঁছুতে অনেক সময় লাগল নরমানের। গাড়ির হেডলাইট এবং টেইললাইট নিভিয়ে দিল। ইঞ্জিন চালু রেখে লাফিয়ে নামল ওটা থেকে। চালকবিহীন গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে কর্দমাক্ত ঢাল বেয়ে ঠোক্কর খেতে খেতে নামতে লাগল জলার দিকে। জলাটা কতটা গভীর জানা ছিল না নরমানের। কয়েক মিনিট ওকে অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যে রেখে অবশেষে পুরো যান্ত্রিক কাঠামোটা অদৃশ্য হয়ে গেল থকথকে পকে। বিরাট স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল নরমান। গাড়িটা লাশ, জামাকাপড়সহ এখন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে চোখের সামনে থেকে। আপাতত আর কোন দুশ্চিন্তা নেই। কিন্তু কাজ বাকি রয়ে গেছে এখনও।

নরমান ফিরে এল অফিস ঘরে। বাথরুমের প্রতিটি কোণ ইঞ্চি ইঞ্চি করে সাবান আর ব্রাশ দিয়ে ধুয়ে মুছে সাফ করল সে। তারপর আবার চেক করল বেডরুম। এই সময় মেয়েটার কানের একটা দুল চোখে পড়ল ওর। বিছানার নিচে পড়ে আছে। মেয়েটা যে কানে দুল পরেছিল সন্ধ্যাবেলায় তা লক্ষই করেনি নরমান। সম্ভবত খোঁপা খোলার সময় দুলটা খুলে গেছে। কিন্তু জোড়াটা গেল কোথায়? অনেক খুঁজল নরমান। পেল না। হয়তো বাকি দুলটা মেয়েটার ব্যাগে বা কানেই রয়ে গেছে, ভাবল সে। খোঁজাখুঁজি বাদ দিল। এই দুলটাকেও কাল জলায় ফেলে আসবে ঠিক করল ও।

রান্নাঘরে ঢুকল নরমান। সিঙ্ক পরিষ্কার করতে করতে ঘুমে দুচোখ বুজে এল বারবার। গ্রান্ডফাদার ক্লক ঢংঢং শব্দে জানিয়ে দিল রাত দুটো বাজে। কাদামাখা জুতো, জামা, প্যান্ট, মোজা সব ধুলো নরমান প্রচণ্ড ক্লান্তি নিয়ে। গোসল করল। পানি বরফের মত ঠাণ্ডা। কিন্তু কোন অনুভূতি জাগল না ওর মধ্যে। শরীর যেন অসাড় হয়ে গেছে।

ক্লান্ত শরীরটা টানতে টানতে শোবার ঘরে এল নরমান। রাতের পোশাক পরতে গিয়ে মনে পড়ল আরে, মা তো এখনও বাড়ি ফেরেনি। তার মানে তাকে আবার জামাকাপড় পরে খুঁজতে যেতে হবে। খোদা জানে এই নিশুতি রাতে কোথায় এখন ঘুরঘুর করছে এই মহিলা।

হঠাৎ নরমানের মনে চিন্তাটা এল। কি দরকার তার মাকে খোঁজার? যে কাজ সে করেছে তারপর তাকে আবার কষ্ট করে খুঁজতে যাওয়ার কোন মানে হয়? হয়তো এতক্ষণে মাকে রাস্তা থেকে কেউ তুলে নিয়ে গেছে এবং মা খুনের কথা হড়বড়িয়ে তাকে বলে দিয়েছে। কিন্তু মার কথা কি কেউ বিশ্বাস করবে? শুধু বললেই তো হয় না। এর জন্য চাই প্রমাণ। আর নরমানের কাছে কেউ প্রমাণ চাইতে এলে সে পুরো ব্যাপারটাকেই অস্বীকার করে বসবে। অবশ্য তার বোধহয় দরকার হবে না, কারণ মাকে দেখে এবং তার গল্প শুনে যে কেউ বুঝতে পারবে এই মহিলা বদ্ধ উন্মাদ। তারপর তারা তাকে নির্ঘাত লকআপে পুরে দেবে। যেখান থেকে মা জীবনেও বেরিয়ে আসতে পারবে না।

মার পরিণতির কথা ভেবে নরমান মনে মনে খুবই দুঃখ পেল। কিন্তু তার মা যে পাগল হয়ে গেছে এই সত্যকে সে অস্বীকার করবে কিভাবে? পাগল না হলে কি কেউ একটা নিরীহ মেয়েকে অকারণে এমন ভয়ঙ্করভাবে খুন করতে পারে? মার কপালে যা আছে ধরা পড়লে তাই হবে। অন্যের নিরাপত্তা এবং তার নিরাপত্তার জন্যও মাকে লকআপে পুরে রাখাই উচিত, ভাবল সে।

কিন্তু পরক্ষণে নরমান আবার উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল। মা যেতে পারে কোথায়? বড় রাস্তায় নাও যেতে পারে। খুব সম্ভব বাড়ির আশপাশেই কোথাও রয়েছে সে। কে জানে তাকে অনুসরণ করে মা জলার ধারেই গেল কিনা। মা তো সবসময়ই, সব জায়গায় তার পিছনে ছায়ার মত লেগে আছে। আর মাথাটা যদি সত্যি খারাপ হয়ে থাকে তাহলে সে জলার ধারে যেতেও পারে। আর অন্ধকারে হয়তো পা পিছলে জলার মধ্যে পড়ে গেছে, ডুবে গেছে চোরাবালিতে। নরমানের চোখের সামনে চোরাবালিতে গাড়ি অদৃশ্য হওয়ার দৃশ্যটি ভেসে উঠল। স্পষ্ট দেখতে পেল তার মা ডুবে যাচ্ছে জলার মধ্যে। হাঁসফাঁস করছে বাঁচার জন্য। চেষ্টা করছে কোন কিছু ধরে মাটিতে ওঠার। কিন্তু পারছে না। তার হাঁটু ডুবে গেল, ডুবে যাচ্ছে নিতম্ব, পরনের পোশাক ঊরুতে ইংরেজী ভি আকৃতি নিয়ে চেপে বসেছে, ক্রমশ; তলিয়ে যাচ্ছে মা জলার পাঁকে। মায়ের উরুর দিকে তাকাতে নেই। কিন্তু তবুও তাকিয়ে আছে নরমান, উন্মাদিনী বুড়ীর এই সলিল সমাধি যেন তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছে সে। মনে হচ্ছে উপযুক্ত সাজাই পেয়েছে তার মা।

নরমান মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কারণ এতদিনে রেহাই পাওয়া গেছে ডাইনীটার হাত থেকে। মুক্তি পাওয়া গেছে ওই মেয়েটার হাত থেকেও। খুনী এবং তার শিকার দুজনেই ডুবে গেছে একই নোংরা জলার নিচে। ওরা দুজনেই নোংরা। আসলে মেয়েমানুষ মাত্রেই নোংরা।

হঠাৎ নরমান নিজেকে আবিষ্কার করল জলার মধ্যে। শ্বাস নেয়ার জন্য হাঁক পাঁক করছে সে। মাকে দেখল জলার পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে। দ্রুত ডুবে যাচ্ছে নরমান। নোংরা পাক এসে ঠেকেছে ঘাড়ে। মা ছাড়া এই মুহূর্তে আর কেউ নেই ওকে বাঁচাবার। ও মরতে চায় না, চায় না ওই খচ্চর মেয়েটার মত অন্ধকার জলার অন্তহীন নরকের মধ্যে ডুবে যেতে। হঠাৎ নরমানের চিন্তার মোড় ঘুরে গেল। মনে পড়ল মেয়েটা খুন হয়েছে কারণ সে ছিল পাপী, অপরাধী। সে শরীর দিয়ে তাকে লোভ দেখাচ্ছিল, তাকে নোংরা পথে যেতে প্ররোচিত করছিল। কিন্তু নরমান জানে ওটা পাপ। মা তাকে এসব শিখিয়েছে। এবং পাপীদের যে বেঁচে থাকতে নেই এটাও মা তাকে বলেছে। এই জন্যই মা ওই মেয়েটাকে খুন করেছে। খুন করেছে নরমানকে রক্ষা করার জন্য। তারমানে মা যা করেছে, ভুল করেনি কোন। মাকে সে এতক্ষণ অযথাই দোষারোপ করেছে। মাকে ছাড়া সে যেমন অচল, মা-ও তাকে ছাড়া এক পা চলতে পারবে না, আবার উপলব্ধি করল নরমান। হতে পারে মার মাথা খারাপ। কিন্তু পাখি মায়ের মত সে-ই তো নরমানকে সমস্ত বিপদ থেকে রক্ষা করে চলেছে। কিন্তু মার সাহায্য তার এখন বড় দরকার। জলার পাক…ক্রমশ গলার কাছে এসে পৌঁছুল, ঠোঁটে স্পর্শ পেল কুৎসিত, দুর্গন্ধময় জিনিসটার, মুখ হাঁ করল নরমান, তীব্র আকুতি বেরিয়ে এল গলা থেকে, মা মাগো আমাকে বাঁচাও!

ঘুম ভেঙে গেল নরমান বেটসের। ঘামে সমস্ত শরীর ভিজে জবজবে। ও তাহলে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল! হঠাৎ কপালে নরম, ঠাণ্ডা হাতের ছোঁয়া পেল নরমান। ভয় নেই, বাবা! মায়ের কণ্ঠ ভেসে এল বিছানার পাশ থেকে। এই তো আমি।

চোখ মেলতে চাইল নরমান। বলল, মা তোমাকে আমি–

কিন্তু মা ওর চোখের ওপর হাত বুলিয়ে বলল, সব জানি আমি। সবই দেখেছি। তুমি কি ভেবেছিলে তোমাকে এভাবে ফেলে চলে যাব আমি? তুমি যা করেছ ঠিকই করেছ, নরমান। এখন আর কোন চিন্তা নেই।

মায়ের আশ্বাসবাণী শুনে নিশ্চিন্ত হলো নরমান। আবার ঘুমের মধ্যে তলিয়ে যেতে যেতে ভাবল, সত্যিই তো, আর কোন চিন্তা নেই। তাকে রক্ষা করার জন্য মা তো রয়েইছে। নরমান সিদ্ধান্ত নিল আজ রাতের ঘটনা নিয়ে সে আর কোনদিন কোন কথা বলবে না। মাকে পাগলা গারদে পাঠানোর চিন্তাটাও বাদ দিল সে। মা যাই করুক নরমানের কাছেই সে থাকবে, এখানেই তার একমাত্র জায়গা। মা পাগল হোক আর যাই হোক নরমানের সবকিছু বলতে একমাত্র সে-ই। তার দুনিয়া বলতে আছেই তো এই মা। মা তার কাছেই আছে, এই অনুভূতি পরম নিশ্চয়তা দিল নরমানকে। গভীর ঘুমের অন্ধকারে তলিয়ে গেল।

.

০৬.

শুক্রবার সন্ধ্যায় একটি আশ্চর্য ঘটনা ঘটল ফেয়ারভেল শহরের একমাত্র হার্ডওয়্যারের দোকানে। মৃত অত্তোরিনো রেসপিগি ফিরে এলেন দোকানের মালিক স্যাম লুমিসের কাছে। তার বিখ্যাত ব্রাজিলিয়ান ইমপ্রেশন গানটি গাইতে লাগলেন। স্যাম মুগ্ধ হয়ে তাঁর গান শুনতে লাগল।

গান বাজনা ভালবাসে স্যাম। ক্ল্যাসিক গানগুলো একা শুনে মজা নেই, সবাইকে নিয়ে শুনতে হয়। কিন্তু ফেয়ারভেলের নাগরিকরা ধ্রুপদ সঙ্গীতের মর্যাদা বোঝে না, জুক বক্সে পয়সা ফেলে ধুমধাড়াক্কা গান শোনা কিংবা টেলিভিশন খুলে তার সামনে বসে থাকাই তাদের কাছে চিত্তবিনোদন। সুতরাং রেডিওতে অত্তোরিনো না কে কি গান গাইল তা নিয়ে তাদের কোন মাথা ব্যথা নেই।

স্যাম লুমিস তার প্রতিবেশীদের কথা ভেবে মনে মনে হাসল। অবশ্য এ জন্য সে ওদের কাউকে দোষারোপ করে না, বরং ওরা তাকে নিজের মত করে থাকতে দিচ্ছে বলে সে ওদের প্রতি কৃতজ্ঞ। সে নিজেও ওদের পছন্দ অপছন্দের ব্যাপারে কখনও নাক গলায় না। যে যারটা নিয়ে ভালই আছে।

এইসব ভাবতে ভাবতে আর গান শুনতে শুনতে স্যাম তার বড় খতিয়ান বইটি নিয়ে বসল।

দোকানের পেছনদিকে ছোট্ট, খুপরির মত একটা ঘর। এখানেই থাকে স্যাম। থাকতে খুব অসুবিধে হয়, কিন্তু বাস্তবতাকে বাধ্য হয়ে মেনে নিয়েছে। সে। রান্না-বান্নার কাজটাও এখানেই সেরে নেয় সে। কষ্টগুলোকে খুশি মনেই মেনে নিয়েছে স্যাম। জানে, আর বেশিদিন তাকে এভাবে কষ্ট করতে হবে না। দিন তার শিগগিরই ফিরবে। খতিয়ান বইতে চোখ বোলাতে বোলাতে এ রকমই মনে হলো স্যামের। এ মাসেই সে আরও এক হাজার ডলারের দেনা থেকে মুক্ত হতে পারবে। আর সামনের দিনগুলোতে ব্যবসাপাতি আরও জমে উঠবে বলে আশা করছে সে। একটা কাগজে হিসেব নিকেশ করতে করতে মেরির কথা খুব মনে পড়ল স্যামের। মেরি তার ব্যবসার ক্রমাগত উন্নতির কথা শুনলে খুব খুশি হয়ে উঠত। ওকে নিয়ে বেচারীর বড় চিন্তা। বেশ কিছুদিন ধরে ওর মন খারাপ। তার ইদানীংকার চিঠিতে প্রায়ই হতাশার সুর লক্ষ করেছে স্যাম। বেশ কয়েকদিন ধরে মেরির কোন চিঠিও পাচ্ছে না সে। গত শুক্রবারও সে একটি চিঠি লিখেছে। কিন্তু এখনও জবাব আসেনি। হয়তো অসুস্থ হয়ে পড়েছে ও। কিন্তু মেরির অসুখ হলে তো ওর ছোট বোন, লিলা না কি যেন নাম, সে অন্তত একটি খবর দিত। খুব সম্ভব মেরি হতাশজনিত কারণেই লিখছে না। অবশ্য সে জন্য স্যাম তাকে দোষ দেয় না। কারণ অনেকদিন ধরে যুদ্ধ করতে করতে মেরি ক্লান্ত। কিন্তু যুদ্ধ তো স্যামও করছে। যুদ্ধ না করে বেঁচে থাকার অন্য কোন উপায় নেই। মেরি এটা জানে। আর জানে বলেই সে তাদের সুখের দিনের জন্য অপেক্ষা করতে রাজি হয়েছে।

মেরির কথা মনে পড়তেই মন খারাপ হয়ে গেল স্যামের। ওকে দেখার জন্য বুকটা হুঁ হুঁ করে উঠল। ববকে এখানকার চার্জে দিয়ে কয়েকদিনের জন্য মেরির কাছ থেকে ঘুরে এলে মন্দ হয় না। যাওয়ার কথা আগে থেকে জানাবে না সে, হঠাৎ উপস্থিত হয়ে চমকে দেবে তার প্রেমিকাকে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল স্যাম। মাঝে মাঝে ওর মনে হয় মেরির সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে সে হয়তো ভুলই করেছে। পরস্পরকে ওরা কতটুকুই বা চেনে অথবা জানে? গত বছর মেরি এখানে এসেছিল দিন দুয়েকের জন্য। তারপর থেকে আর কাছাকাছি হওয়ার সৌভাগ্য হয়নি কারও। শুধু চিঠি লেখালেখিই চলছে এখন পর্যন্ত। চিঠিতে অন্য এক মেরিকে আবিষ্কার করেছে সে। অস্থির, মুডি। তার পছন্দ, অপছন্দের ব্যাপারগুলো কখনও কখনও বাড়াবাড়ি মনে হয়েছে জনের।

কাঁধ ঝাঁকাল স্যাম। ওর আজ হয়েছেটা কি? কি সব উল্টোপাল্টা ভাবছে। আসলে সুরের বিষণ্ণ ছোঁয়া হঠাৎ ওকে আবেগপ্রবণ করে তুলেছে। চেয়ারটা পেছনে ঠেলে উঠে দাঁড়াল ও।

এই সময় আওয়াজটা কানে এল স্যামেরর। শব্দটা আসছে সামনের দরজা দিয়ে। কে যেন দরজার হাতল ধরে টানছে।

আজকের জন্য দোকান বন্ধ করে দিয়েছিল স্যাম। তবে যে-ই আসুক না কেন সে অচেনা কেউ হবে। কারণ স্থানীয় লোকজনের জানা আছে স্যাম কখন তার দোকান বন্ধ করে। তাদের কিছু দরকার হলে আগে ফোন করত, তারপর আসত।

খদ্দের যে-ই হোক না কেন ব্যবসা বলে কথা। তাছাড়া আগন্তুক যেভাবে দরজা ধরে টানাটানি করছে তাতে ওটার হাতল খুলে না যায়। দ্রুত পায়ে দোকানঘরের দিকে এগোল স্যাম। পকেট থেকে চাবি বের করতে করতে বলল, দাঁড়ান, ভাই, দাঁড়ান, খুলছি আমি দরজা। তালায় চাবি ঢুকিয়ে একটানে সে খুলে ফেলল দরজা।

চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আছে সে। রাস্তার আলো তির্যক ভাবে পড়েছে তার ওপর। ছায়ামূর্তিকে চিনতে পেরে বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেল স্যাম। পা বাড়াল সামনে, পরক্ষণে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল তাকে।

মেরি! ফিসফিস করে বলল স্যাম। চুমু খাওয়ার জন্য মুখ নামাল সে, টের পেল আলিঙ্গনাবদ্ধ শরীরটা শক্ত হয়ে উঠেছে, হাত দিয়ে তাকে ঠেলতে শুরু করল সে, কিন্তু স্যাম আরও জোরে চেপে ধরায় দমাদম ঘুসি মারতে লাগল সে জনের চওড়া বুকে। স্যাম অসম্ভব রকম বিস্মিত হলো এই অপ্রত্যাশিত আচরণে।

আমি মেরি নই! হাঁপাতে হাঁপাতে বলল মেয়েটি, আমি লিলা।

লিলা? স্যাম পিছিয়ে গেল এক পা। মানে মেরির ছোট বোন?

লিলা মাথা আঁকাল। এবার স্যাম ভাল করে দেখতে লাগল লিলাকে। মেয়েটির চুল মেরির মতই বাদামী, তবে আরও হালকা। চ্যাপ্টা নাক, চওড়া চোয়ালের লিলা তার বোনের চেয়ে উচ্চতায়ও সামান্য খাটো লক্ষ করল সে। আর ফিগারও অনেক স্লিম।

দুঃখিত, বিড়বিড় করে ক্ষমা প্রার্থনা করল গ্যাম, আমি আসলে আবছা আলোতে তোমাকে চিনতে পারিনি।

ঠিক আছে, বলল লিলা। ওর কণ্ঠও মেরির চেয়ে নরম আর নিচু।

এসো, ভেতরে এসো।

ইয়ে- মানে, লিলা পায়ের কাছে ওর সুটকেসটার দিকে তাকিয়ে ইতস্তত করছে দেখে স্যাম বলল, ওটা আমি নিচ্ছি। তুমি ভেতরে এসো। পেছনদিকে আমার ঘর।

লিলা নীরবে স্যামকে অনুসরণ করল। স্যাম তার ঘরে ঢুকে রেডিও বন্ধ করার জন্য হাত বাড়াল, বাধা দিল লিলা।

না থাক, বলল সে। সুরটা চেনার চেষ্টা করছি। ভিলা লোবোস?

রেসপিগির ব্রাজিলিয়ান ইমপ্রেশন।

ওঃ আচ্ছা। ওটা আমাদের স্টকে নেই। স্যামের মনে পড়ল লিলা একটি রেকর্ড শপে কাজ করে।

তুমি গান শুনবে নাকি কথা বলবে?

ঠিক আছে, বন্ধ করেন ওটা। তাহলে ভালভাবে কথা বলা যাবে।

রেডিও বন্ধ করে লিলার সামনে দাঁড়াল স্যাম। বসো। কোটটা খুলে আরাম করে বসো।

ধন্যবাদ। আমি বেশিক্ষণ বসার জন্য আসিনি। আমাকে আবার ঘর খুঁজতে বেরুতে হবে।

ঘুরতে এসেছ?

শুধু আজ রাতের জন্য। কাল সকালেই চলে যাব। আমি মেরিকে খুঁজতে এসেছি।

কাকে খুঁজতে এসেছ? বিস্মিত হয়ে লিলার দিকে তাকাল স্যাম। কিন্তু ও এখানে আসবে কি করতে?

সেটাই তো আপনার কাছে জানতে চাই আমি।

আরে, আমি তা কি করে বলব? মেরি এখানে আসেনি তো!

আগে এসেছিল? মানে হপ্তাখানেক আগে?

না তো! ওর সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়েছে গত গ্রীষ্মে। কিন্তু কি ব্যাপার লিলা? মেরির কি হয়েছে?

জানি না। আমি কিছু জানি না।

কোলের ওপর রাখা হাত দুটোর দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল লিলা। ঘরের উজ্জ্বল আলোতে স্যাম লক্ষ করল লিলার চুল আসলে বাদামী নয়, বরং সোনালীই বলা চলে। আর মেরির সঙ্গে ওর চেহারায় বলতে গেলে কোন মিলই নেই।

প্লীজ, অনুনয় করল স্যাম, আমাকে সব খুলে বলো।

মুখ তুলে চাইল লিলা, বাদামী চোখ দুটো স্যামের চোখে রেখে বলল, মেরি এখানে আসেনি আপনি ঠিক জানেন তো?

অবশ্যই। বেশ কিছু দিন ধরে ওর কোন চিঠিপত্রও পাচ্ছি না। আমি খুবই চিন্তায় পড়েছিলাম। কিন্তু তুমি এসে হঠাৎ এসব কি বলছ, লিলা?

ঠিক আছে। আপনার কথা আমি বিশ্বাস করলাম। কিন্তু মেরি সম্পর্কে খুব বেশি কিছু খবর বোধহয় আপনাকে দিতে পারব না।

গভীর করে শ্বাস টানল লিলা, তারপর বলতে শুরু করল, এক হপ্তা ধরে মেরির সঙ্গে আমার কোন যোগাযোগ নেই। আমি ডালাসে গিয়েছিলাম দোকানের জন্য কিছু মালপত্র কিনতে। অফিসের কাজ শেষ করে সোমবার ভোরে বাড়ি পৌঁছি আমি। কিন্তু দেখি মেরি বাসায় নেই। প্রথমে ভেবেছি অফিসের কাজে ও হয়তো আজ একটু সকাল সকাল বেরিয়েছে, পরে আমাকে ফোন করবে। কিন্তু দুপুরেও ওর ফোন এল না দেখে চিন্তা হয় আমার। ওর অফিসে ফোন করলাম আমি। মেরির বস্ মি. লোরি বললেন মেরি নাকি সকালে অফিসেই যায়নি। শুক্রবার বিকেলে অফিস থেকে বেরুবার পর থেকে তার কোন খোঁজ নেই।

এক মিনিট, বলল স্যাম। ব্যাপারটা ভাল করে বুঝতে দাও আমাকে। তুমি বলতে চাইছ এক হপ্তা ধরে মেরি নিখোঁজ?

হ্যাঁ।

তাহলে আমাকে আগে কেন খবর দেয়া হয়নি? রাগের চোটে উঠে দাঁড়াল স্যাম, কর্কশ সুরে বলল, আমাকে ফোন করোনি কেন তুমি? পুলিশে

জানিয়েছ?

স্যাম, আমি- 

এসবের কিছুই তুমি করোনি। সারা হপ্তা ধরে মেরির জন্য একঠায় অপেক্ষা করেছ, তারপর আমার কাছে জানতে এসেছ ও এখানে এসেছে কিনা। আশ্চর্য!

আমি ভেবেছি মেরি বোধহয় আপনার এখানে এসেছে। আপনারা দুজনে মিলে প্ল্যান করেছেন- 

কিসের প্যান?

সেটাই তো আমি জানতে চাই। দরজার কাছ থেকে ভেসে এল নরম একটা কণ্ঠ। চমকে তাকাল ওরা। লম্বা, রোগা একটি লোক দাঁড়িয়ে আছে চৌকাঠে। তার মাথায় ছাই রঙের স্টেটসন হ্যাট। বরফের মত শীতল, নীল একজোড়া চোখ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে।

আপনি কে? ছোটখাট একটা গর্জন ছাড়ল স্যাম। এখানে এলেন কি করে?

সামনের দরজাটা খোলা ছিল। একটা খবর জানার জন্য আপনার কাছে এসেছিলাম। কিন্তু মিস ক্রেন দেখি আগে ভাগেই আমার প্রশ্নটা আপনাকে করে ফেলেছেন। অবশ্য তাতে কোন অসুবিধে নেই। জবাবটা আপনি আমাদের দুজনকেই দিতে পারেন।

কিসের জবাব? বিস্মিত হলো স্যাম।

বলছি, লম্বা লোকটি ভেতরে ঢুকল, ছাই-রঙা জ্যাকেটের মধ্যে হাত ঢুকাল। স্যাম ভাবল সে বুঝি পিস্তল বের করতে যাচ্ছে। আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে তার হাত ওপরে উঠে গেল, কিন্তু পকেট থেকে আগন্তুককে ওয়ালেট বের করতে দেখে শরীরের পাশে হাত দুটো আবার স্কুলে পড়ল। ওয়ালেট খুলল ছাই-রঙা জ্যাকেট। একটা আইডেন্টিটি কার্ড জনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, আমার নাম অ্যারবোগাস্ট। মিলটন অ্যারবোগাস্ট। প্যারিটি মিউঁচুয়ালের লাইসেন্সপ্রাপ্ত গোয়েন্দা। বর্তমানে লোরি এজেন্সীর পক্ষে কাজ করছি, যেখানে আপনার গার্লফ্রেন্ড চাকুরি করেন। আমি জানতে এসেছি। আপনি এবং আপনার বান্ধবী মিলে চল্লিশ হাজার ডলার দিয়ে কি করেছেন।

.

০৭.

ছাই-রঙা স্টেটসন হ্যাটটি টেবিলের ওপর, জ্যাকেটটি ঝোলানো চেয়ারে। মিলটন অ্যারবোগাস্ট তার তৃতীয় সিগারেটটি অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিয়ে চতুর্থটি ধরাল।

আচ্ছা, বলল সে, আপনি তাহলে দাবি করছেন যে গত হপ্তায় ফেয়ারভেলের বাইরে যাননি। কিন্তু আমি খবর নেব, স্যাম। মিথ্যা বললে কিন্তু ধরা পড়ে যাবেন। স্থানীয় লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই আমি জানতে পারব আপনি সত্য কথা বলেছেন কিনা। সিগারেটে একটা টান দিয়ে আবার শুরু করল সে। কিন্তু মেরি আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন কিনা এতে তা প্রমাণিত হয় না। রাতে আপনার দোকান বন্ধ হওয়ার পর তিনি আসতে পারেন। যেমন মিস ক্রেন আজ এসেছেন।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল স্যাম। কিন্তু সে আসেনি। দেখুন, লিলার কাছে আপনি সবই শুনেছেন। মেরির কাছ থেকে অনেকদিন ধরে কোন চিঠিপত্রও পাচ্ছিলাম না। গত শুক্রবার তার কাছে আমি একটি চিঠি লিখি। আর ওই দিনই সে নিখোঁজ হয়ে যায়। ও আমার কাছে আসছে জানলে কি আর ওকে চিঠি লিখতে যেতাম?

পুরো ঘটনাটাকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য আপনি ওটা করে থাকতে পারেন। খুবই বুদ্ধিমানের মত কাজ এটা।

আড়ষ্ট ঘাড় ঘষতে ঘষতে স্যাম বলল, অত বুদ্ধিমান আমি নই। টাকার ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। আপনার কথা শুনে মনে হয়েছে এমন কি মি. লোরিও জানতেন না ওই দিন বিকেলে তিনি চল্লিশ হাজার ডলার পাবেন। সেক্ষেত্রে মেরিরও টাকার কথা জানার প্রশ্নই ওঠে না। তাহলে আমরা কিভাবে দুজনে মিলে টাকা মেরে দেয়ার প্ল্যান করলাম?

টাকা মেরে দেয়ার পর তিনি আপনাকে কোথাও থেকে ফোন করে থাকতে পারেন ওই রাতেই। এবং আপনাকে তার কাছে চিঠি লেখার কথাও বলতে পারেন।

এখানকার ফোন কোম্পানিতে তাহলে খোঁজ নিয়ে দেখুন, বিরক্ত হলো গ্যাম। গত এক মাসে আমার কাছে লং-ডিসট্যান্সের কোন ফোন আসেনি।

মাথা দোলাল অ্যারবোগাস্ট। তাহলে উনি হয়তো আপনাকে ফোন করেননি। কিন্তু তিনি সোজা গাড়ি চালিয়ে আপনার কাছে এসেছেন, সব কথা খুলে বলেছেন এবং পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হওয়ার পর আপনার সঙ্গে মিলিত হওয়ার পরিকল্পনা করেছেন।

ঠোঁট কামড়াল লিলা। আমার বোন চোর নয়। তার সম্পর্কে ওভাবে কথা বলার কোন অধিকার আপনার নেই। সে সত্যি টাকা নিয়েছে কিনা এ ব্যাপারে আপনার হাতে কোন প্রমাণ নেই। হয়তো মি. লোরি নিজেই টাকাটা নিয়ে এখন মেরিকে দোষী করে এই আজগুবী গল্পটি তৈরি করেছেন

দুঃখিত, ক্ষমা প্রার্থনার সুরে বলল মিলটন অ্যারবোগাস্ট। বুঝতে পারছি আপনার খুব লেগেছে। কিন্তু আপনি মি. লোরিকে এভাবে অভিযুক্ত করতে পারেন না। চোর ধরা পড়ে টাকা উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত আন্দাজে কারও সম্পর্কে নেতিবাচক উক্তি করা ঠিক নয়। তাছাড়া দেখুন মিস মেরিকে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে। টাকাটা তার হাতে আসার পর থেকে তিনি লাপাত্তা। বাড়িতেও তিনি ওই টাকা রাখেননি। ওটা একদম উধাও। তাঁর গাড়িটিও উধাও। সেই সঙ্গে তিনিও। সিগারেটটা শেষ হয়ে এসেছিল, ওটা অ্যাশট্রেতে ফেলে দিল অ্যারবোগাস্ট। সব মিলে আপনার বোনকে সন্দেহ করা যায় বৈকি।

চোখে জল এসে গেল লিলার। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, না, যায় না। আমি যখন পুলিশে খবর দিতে যাচ্ছিলাম তখন আপনি আর মি. লোরিই আমাকে বারণ করেছেন। আপনি বলেছিলেন পুরো ব্যাপারটা গোপন রেখে কয়েকদিন অপেক্ষা করতে। মেরি নাকি এর মধ্যে মনস্থির করে টাকাটা ফেরত দেবে। আপনাকে আমি যা বলেছিলাম তার একটা কথাও আপনি বিশ্বাস করেননি। কিন্তু আমি জানি মেরি টাকা চুরি করেনি। কেউ হয়তো টাকার ব্যাপারটা জানত, সেই হয়তো ওকে কিডন্যাপ করেছে।

অ্যারবোগাস্ট শ্রাগ করল, চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, এগিয়ে গেল লিলার দিকে। তার কাঁধে হাত রেখে বলল, শুনুন, মিস ক্রেন, আপনার বোন কিডন্যাপড হননি। তিনি বাড়ি গিয়ে জিনিসপত্র গুছিয়ে গাড়ি করে বেরিয়ে পড়েছিলেন। একা। আপনাদের বাড়িওয়ালি তাঁকে যেতে দেখেছে। সুতরাং যুক্তিতে আসুন।

আমি যুক্তি নিয়েই কথা বলছি। কিন্তু আপনি অযৌক্তিক কথা বলছেন। আমাকে এখানে অনুসরণ পর্যন্ত করেছেন

এদিক ওদিক মাথা নাড়ল অ্যারবোগাস্ট। কিভাবে বুঝলেন আমি আপনাকে এখানে অনুসরণ করে এসেছি?

তাহলে আপনি এই সময়ে এখানে কেন? মেরি এবং স্যামের সম্পর্কের কথা আপনার জানার কথা নয়। আমি ছাড়া এ কথা কেউ জানে না। এমনকি স্যাম লুমিস নামে কেউ একজন আছেন তাও আপনার জানার কথা নয়!

ভুল বললেন। আপনার বোনের টেবিলে যে খামটা দেখেছিলাম ওতে মি. স্যামের ঠিকানা লেখা ছিল। পকেট থেকে একটা খাম বের করল সে।

আমার চিঠি! লাফিয়ে উঠল স্যাম। খামটা কেড়ে নেয়ার জন্য হাত বাড়াতেই অ্যারবোগাস্ট ওটাকে ওর নাগালের বাইরে ঠেলে দিল।

এটার আপনার কোন প্রয়োজন নেই, বলল সে। এটার মধ্যে কোন চিঠি ছিল না। খামটা আমি নিয়েছি কারণ মিস মেরির হাতের লেখা আমার চেনার দরকার ছিল। অবশ্য আমি গত বুধবার সকালে এখানে পৌঁছার পর থেকে এটাকে নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছি।

লিলা রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলল, আপনি বুধবার এখানে এসেছেন?

জ্বী। সুতরাং বুঝতেই পারছেন আমি আপনার পিছু নিইনি। আপনার আগেই এখানে চলে এসেছি। আপনার বোনের বিছানার পাশে মি. স্যামের একখানা ছবিও ছিল। ফলে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে নিতে আমার অসুবিধে হয়নি। আমি চল্লিশ হাজার ডলার হাতে পেলে কি করতাম? প্রথমেই শহর ছেড়ে পালাতাম। কিন্তু কোথায় যেতাম? কানাডা, মেক্সিকো, ওয়েস্ট ইন্ডিজ? উঁহু, বেশি ঝুঁকি হয়ে যায়। তাছাড়া, অনেক দূরে যাওয়ার মত বিশেষ পরিকল্পনা না থাকলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই আমি আমার প্রিয়জনের কাছে চলে যেতাম। মেরিও তাই করেছেন। চলে এসেছেন তাঁর প্রেমিকের কাছে।

স্যাম দুম করে ঘুসি মারল টেবিলের ওপর। অ্যাশট্রে থেকে সিগারেটের বাটগুলো লাফিয়ে উঠল। অনেক হয়েছে! রেগে গেল সে, তখন থেকে খালি একতরফা ভাবে অভিযোগ করে চলেছেন, অথচ প্রমাণ করতে পারেননি কিছুই। এভাবে ফালতু অভিযোগ করার অধিকার আপনার নেই।

মিলটন অ্যারবোগাস্ট আরেকটি সিগারেট ধরাল। আপনি প্রমাণ চাইছেন, তাই তো? আপনার কি ধারণা বুধবার সকাল থেকে এখানে বসে আমি ঘোড়ার ঘাস কাটছি? আপনার প্রেমিকার গাড়ির খোঁজ আমি পেয়েছি।

আপনি আমার বোনের গাড়ির খোঁজ পেয়েছেন? লাফিয়ে উঠল লিলা।

জী। আমি ধারণা করেছিলাম তিনি গাড়ি বদল করবেন। তাই আমি শহরের সমস্ত ডিলারদের কাছে খোঁজ নেই। পুরানো গাড়ির ডিলাররা তখন মিস ক্রেনের গাড়ির বর্ণনা এবং লাইসেন্স নম্বরটা আমাকে দেয়। টাকা তিনি পুরোটাই পেইড করে দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় গাড়িটা তিনি যেখান থেকে চেঞ্জ করেছেন সে জায়গাটাও আমি আবিষ্কার করলাম। তিনি তুলসা থেকে গত শনিবার হাইওয়ে ধরে আসছিলেন। এবং এদিকেই আসছিলেন। ষোলো ঘণ্টা টানা গাড়ি চালিয়েছেন। দুবার গাড়ি পাল্টেছেন। পথে যদি কোন দুর্ঘটনা না ঘটে থাকে তাহলে মিস ক্রেনের শনিবার রাতে এখানে পৌঁছে যাওয়ার কথা।

হয়তোবা, বলল স্যাম। কিন্তু সে আসেনি। দেখুন, আপনি প্রমাণ চাইলে আমি দিতে পারি। গত শনিবার রাতে আমি লিজিয়ন হলে ছিলাম। তাস খেলছিলাম। অনেকেই এ ব্যাপারে সাক্ষী দেবে। রোববার সকালে আমি চার্চে যাই। বিকেলে ডিনার করি–

হাত তুলে বাধা দিল অ্যারবোগাস্ট। আপনার ব্যাপারে আমি খোঁজখবর আগেই নিয়েছি। তাহলে দেখা যাচ্ছে আপনার সঙ্গে সত্যিই মিস ক্রেনের সাক্ষাৎ হয়নি। তবে নিশ্চই কিছু একটা গোলমেলে ব্যাপার ঘটেছে। আমাকে আবার নতুন করে কাজ শুরু করতে হবে।

পুলিশে জানালে কেমন হয়? জানতে চাইল লিলা। আমার মনে হয় আপনার পুলিশে খবর দেয়াই উচিত। যদি সত্যিই কোন দুর্ঘটনা ঘটে থাকে, জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট চাটল সে, তাহলে তো তুলসা থেকে শুরু করে এখানকার সমস্ত হাসপাতালে একা আপনার পক্ষে খবর নেয়া সম্ভব হবে না। কে জানে মেরি এখন কোথায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে-  বলতে বলতে গলা ধরে এল লিলার।

স্যাম লিলার কাঁধে চাপ দিয়ে বলল, অলক্ষুণে কথা বোলো না তো! ওরকম কিছু হলে তুমি খবর পেয়ে যেতে। মেরি ঠিকই আছে। লিলার কাঁধের ওপর দিয়ে সে অ্যারবোগাস্টের দিকে তাকাল। আপনি তো একা একা সমস্ত কাজ করতে পারবেন না। পুলিশে খবর দিচ্ছেন না কেন? মেরি নিখোঁজ হয়েছে, পুলিশের কাছে এভাবে রিপোর্ট করলে ওরা হয়তো ওকে খুঁজে বের করতে পারবে।

অ্যারবোগাস্ট তার স্টেটসন হ্যাটটি তুলে নিল। পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা জানেনই তো। আমরা চাইছি যতদূর সম্ভব গোপনে কেসটার সুরাহা করতে। কোম্পানির গুডউইল রক্ষা করাই আমাদের উদ্দেশ্য। তাহলে মিস মেরিরও লোক জানাজানির ভয় থাকবে না। অবশ্য যদি আমরা তাঁর এবং টাকাগুলোর সন্ধান পাই, তাহলেই।

কিন্তু আপনার কথা মত মেরি যদি এতদূর এসেই থাকে তাহলে আমার সঙ্গে দেখা করল না কেন? আপনার মত আমিও এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চাই।

আপনি আর চব্বিশটা ঘণ্টা অপেক্ষা করতে পারবেন? জিজ্ঞেস করল অ্যারবোগাস্ট।

কেন? নতুন কোন পরিকল্পনা এসেছে নাকি মাথায়?

আরও চেক করব, তবে তুলসাতে আর যাব না। হাইওয়ের রেস্টুরেন্ট, ফিলিং স্টেশন, কার ডিলার, মোটেল ইত্যাদি জায়গাগুলোয় ভালমত খোঁজ নেব। হয়তো মিস ক্রেনকে কেউ দেখে থাকতেও পারে। কারণ আমার এখনও বিশ্বাস তিনি অবশ্যই এদিকে এসেছেন। হয়তো এখানে পৌঁছার পর তিনি মন পরিবর্তন করে অন্য কোথাও চলে গেছেন। কিন্তু আমি নিশ্চিত হতে চাই।

কিন্তু যদি চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কোন খবর না পান-?

তাহলে পুলিশের কাছে গিয়ে নিখোঁজ রিপোর্ট করব, ঠিক আছে?

স্যাম লিলার দিকে ফিরল। তোমার কি মত?

জানি না। আমার মাথায় কিছু আসছে না। আপনি যা ভাল মনে করেন তাই করুন।

অ্যারবোগাস্টের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল স্যাম। ঠিক আছে, তবে তাই হোক। তবে আপনাকে একটা কথা স্পষ্ট বলে দিচ্ছি, কালকের মধ্যেও যদি মেরির কোন খোঁজ না পান, এবং পুলিশে খবর না দেন, তাহলে আমি কিন্তু নিজে যাব পুলিশের কাছে।

জ্যাকেটটি তুলে নিল অ্যারবোগাস্ট। হোটেলে বোধহয় আমি রুম পেয়ে যাব, কি বলেন? কিন্তু, মিস লিলা, আপনি কি করবেন?

লিলা স্যামের দিকে তাকাল। আমি ওর ব্যবস্থা করব, বলল স্যাম। কাল কিন্তু এখানে আমরা আপনার জন্য অপেক্ষা করব মনে রাখবেন।

এই প্রথম হাসল মিলটন অ্যারবোগাস্ট। তা আমি জানি, বলল সে। আপনাদের কষ্ট দেয়ার জন্য দুঃখিত। কিন্তু আমার কর্তব্য তো আমাকে করতেই হবে। লিলার উদ্দেশ্যে নড় করল সে। আমরা আপনার বোনের খোঁজ পেয়ে যাব। কিছু ভাববেন না।

বেরিয়ে গেল সে। সামনের দরজা বন্ধ হওয়ার আগেই লিলা স্যামের কাঁধে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে শুরু করল। স্যাম! কাঁদতে কাঁদতে বলল সে। আমার খুব ভয় করছে। মেরির যদি সত্যি কিছু হয়ে যায়?

আরে বোকা মেয়ে, কাঁদে না, ওর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল স্যাম। আমার ওপর বিশ্বাস রাখো, সব ঠিক হয়ে যাবে।

হঠাৎ লিলা সরে গেল স্যামের কাছ থেকে, তার অশ্রুসজল চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠল, নিচু কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে বলল, আপনাকে আমি বিশ্বাস করব কেন, স্যাম? আপনি তো অ্যারবোগাস্টের কাছে মিথ্যা কথাও বলতে পারেন। শপথ করে বলুন মেরি সত্যিই এখানে আসেনি? আপনি টাকার ব্যাপারে কিছুই জানেন না!

মাথা নাড়ল স্যাম। আমি শপথ করেই বলছি, লিলা, টাকার ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না।

দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়াল লিলা। আপনি হয়তো সত্যি কথাই বলছেন। মেরি তো আমাদের যে কারও সঙ্গে দেখা করতে পারত, তাই না? কিন্তু সে তা করেনি। আমি আপনাকে বিশ্বাস করছি, স্যাম, কিন্তু এটা ভাবতেও কষ্ট হয় যে নিজের বোন এমন- 

এসব কথা বাদ দাও তো, বাধা দিল ওকে স্যাম, তোমার এখন কিছু খাওয়া দরকার। তারপর লম্বা ঘুম দেবে। দেখবে, কাল সবকিছু আবার ঠিক হয়ে গেছে।

আপনার তাই মনে হয়, স্যাম?

হ্যাঁ, মনে হয়।

জীবনে এই প্রথম কোন মেয়েকে মিথ্যে আশ্বাস দিল সে।

.

০৮.

অসহ্য প্রতীক্ষার পর রাত ভোর হলো। শনিবার এল। স্যাম তার দোকান থেকে লিলার হোটেলে ফোন করল। লিলা জানাল সে কিছুক্ষণ আগে নাস্তা সেরেছে। তবে মিলটন অ্যারবোগাস্টের সঙ্গে তার দেখা হয়নি। সম্ভবত সে আগেভাগেই কাজে বেরিয়েছে। অ্যারবোগাস্ট আমার জন্য একটা মেসেজ রেখে গেছে। বলেছে আজ কোন এক সময় সে ফোন করবে! বলল লিলা।

রুমে একা একা বসে থেকে কি করবে? বলল স্যাম। তারচে আমার এখানে চলে এসো। আমরা লাঞ্চ করার পর হোটেলে খবর নিতে পারব। অ্যারবোগাস্ট ফোন করেছিল কিনা, অথবা অপারেটরকে বলব কোন ফোন এলে কলটা আমার এখানে ট্রান্সফার করে দিতে।

লিলা রাজি হলো। স্যাম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। লিলা একা থাকবে এটা তার মনঃপূত নয়। একা থাকলে বোনের কথা ভেবে মেয়েটা আবার কেঁদে কেটে অস্থির হতে পারে।

মেরিকে নিয়ে কোন অশুভ চিন্তা মনে ঠাঁই দিতে চায় না স্যাম। কিন্তু অ্যারবোগাস্টের যুক্তিও একেবারে ঠেলে ফেলে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। টাকাটা নেয়ার পর মেরি নিশ্চই এখানে আসার প্ল্যান করেছিল, অবশ্য যদি সে সত্যি টাকাটা নিয়ে থাকে, তাহলে।

মেরি চোর, এ কথা ভাবলেই গা গুলিয়ে আসে স্যামের। তার মত মেয়েকে কিছুতেই এই ভূমিকায় মেনে নেয়া যায় না। কারণ মেরির স্বভাবচরিত্র সে ভাল করেই জানে।

আসলেই কি সে মেরিকে ভাল করে জানে? নিজেকে প্রশ্ন করল স্যাম। কাল সারারাত মেরিকে নিয়ে ভেবেছে সে। আবিষ্কার করেছে যতটা মনে করে তারচে অনেক কম জানে সে তার প্রেমিকা সম্পর্কে। আসলে, ভাবল স্যাম, পরস্পরকে আমরা কতটুকুই বা চিনি, কতটুকুই বা জানি। মানুষের মন বোঝা বড় দায়। ওদের শহরের বুড়ো টমকিনসের কথাই ধরা যাক। স্কুলের সুপারিনটেন্ডেন্ট ছিল সে, রোটারি ক্লাবের হোেমড়াচোমড়া ব্যক্তি। কিন্তু সেই বুড়োই যে তার বৌ এবং ষোলো বছরের মেয়েটাকে ঘর থেকে তাড়িয়ে দেবে তা কে ভেবেছিল? আর জুয়ারী মাইক ফিশার যে তার সমস্ত জীবনের সঞ্চিত সম্পদ প্রেসকাইটেরিয়ান অরফ্যান হোম-এর এতিম শিশুদের জন্য দান করবে কল্পনাও করেছিল কেউ? জনের কর্মচারী বব সামারফিল্ড সৈন্য বাহিনীতে কাজ করার সময় পিস্তলের বাঁট দিয়ে তাদের পাদ্রীর মাথা ফাটাতে গিয়েছিল, দীর্ঘ এক বছর ওর সঙ্গে কাজ করার পর সেদিন মাত্র ঘটনাটি জেনেছে সে। অথচ ববের মত শান্ত, ভদ্র, নির্বিরোধী ছেলেই হয় না। স্যাম দেখেছে বিশ বছর সুখে ঘর করার পর প্রৌঢ়া স্ত্রী তার স্বামী, সংসার ছেড়ে ছেলের বয়সীদের হাত ধরে ভেগে গিয়েছে। দেখেছে অত্যন্ত সৎ বলে পরিচিত ব্যাংক কেরানীকে তহবিল তছরুপের দায়ে গ্রেফতার হতে। সুতরাং ভবিষ্যতে কে কি করবে না করবে তা কেউ বলতে পারে না।

অতএব মেরি টাকা চুরি করলে করতেও পারে। হয়তো সে তার দেনা শোধ করার জন্য অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল, তারপর নিজেকে আর সামলাতে পারেনি। স্যামের জন্যই হয়তো সে চুরি করেছে, ভেবেছে এখানে পৌঁছে টাকার ব্যাপারে একটি বিশ্বাসযোগ্য গল্প তাকে বানিয়ে বলবে, স্যাম ওটা বিশ্বাসও করবে। হয়তো মেরি চেয়েছিল এই টাকা নিয়ে তারা দুজনে মিলে দূরে কোথাও চলে যাবে। টাকাটা যদি মেরি নিয়েই থাকে তাহলে এ কারণেই সে নিয়েছে। কিন্তু তারপরও প্রশ্ন থেকেই যায়। টাকা নিয়ে সে জনের সঙ্গে দেখা করল না কেন? তুলসা থেকে সে আবার কোনদিকে গেল? তাহলে কি কোনও অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে? নাকি কোন বদলোকের পাল্লায়–

নাহ, আর ভাবতে পারছে না স্যাম। চিন্তাগুলো বার বার জট পাকিয়ে যাচ্ছে। দুদিন আগেও সে ভাবতে পারেনি মেরিকে নিয়ে এমন অবিশ্বাসের কথা ভাবতে হবে। লিলা যেন তার এই সন্দেহের ব্যাপারটা কিছুতেই টের না পায়, নিজেকে সতর্ক করল গ্যাম।

ফ্রেশ মূড নিয়ে লিলা ঢুকল. স্যামের দোকানে। তাকে এখন উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। লাইট ওয়েট সুটে লাগছেও চমৎকার। বব সামারফিল্ডের সঙ্গে লিলার পরিচয় করিয়ে দিল স্যাম। তারপর লাঞ্চ করার জন্য বেরিয়ে পড়ল।

খেতে খেতে লিলা অনিবার্যভাবে মেরি এবং মিলটন অ্যারবোগাস্টের প্রসঙ্গ তুলল। অ্যারবোগাস্ট কোন খবর পেল কিনা এ নিয়ে বারবার প্রশ্ন করল স্যামকে। সব প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত জবাব দিল স্যাম। বেশি কথা বলল না যদি মুখ ফস্কে মেরি সম্পর্কে কোন অপ্রীতিকর মন্তব্য বেরিয়ে আসে সেই ভয়ে। লাঞ্চ করে হোটেলে ঢুকল স্যাম। বিকেলের দিকে লিলার কোন ফোন এলে সেটা তার দোকানের নাম্বারে ট্রান্সফার করার ব্যবস্থা করল। তারপর ফিরে এল দোকানে।

খদ্দের সামলাল বব, দোকানের পেছনের ঘরে বসে লিলার সঙ্গে কথা বলতে লাগল স্যাম। মাঝে মাঝে অবশ্য দুএকজন খদ্দেরের সঙ্গে কথা বলার জন্য ওকে উঠতে হলো। কিন্তু বব মোটামুটি ভালই ম্যানেজ করল সবকিছু।

স্যামের সাহচর্যে ধীরে ধীরে সহজ হয়ে এল লিলা। রেডিও খুলে গান শুনতে শুনতে তন্ময় হয়ে গেল সে। চমক ভাঙল জনের ডাকে।

বার্টকের কনসার্টো ফর অর্কেস্ট্রা, তাই না? ঘরে ঢুকে জানতে চাইল সে।

ওর দিকে তাকাল লিলা। হাসল। ঠিক ধরেছেন। আপনি দেখছি গানবাজনা সম্পর্কে অনেক খবর রাখেন!

এতে অবাক হওয়ার কি আছে? এই বয়সটাই হাই-ফাই মিউজিক শোনার, জানোই তো। মফস্বলে বাস করি বলে গানবাজনা, শিল্পকলা, বই পড়া ইত্যাদির প্রতি আগ্রহ থাকবে না ভাবো কি করে? আমি এসব খুব পছন্দ করি এবং গান-বাজনার জন্য প্রচুর সময়ও ব্যয় করি। বুঝলে?

লিলা বলল, বুঝলাম। আপনি লোহালক্কড়ের ব্যবসা করলেও রসকষহীন নন। কিন্তু এদিকে তো চারটে বাজতে চলল, অথচ মিলটন অ্যারবোগাস্টের এখনও কোন খবর নেই।

খবর হবে। ধৈর্য ধরো। সময় হলে সে ঠিকই খবর দেবে।

কিন্তু আমি আর ধৈর্য ধরতে পারছি না। আমার খুব চিন্তা হচ্ছে। আপনি চব্বিশ ঘণ্টা সময় দেয়ার কথা বলেছেন, তারপর কিন্তু পুলিশে যাবেন কথা দিয়েছেন।

অবশ্যই যাব। কিন্তু সেই চব্বিশ ঘণ্টা শেষ হতে এখনও চার ঘণ্টা বাকি। তবে আমার ধারণা এর মধ্যে অ্যারবোগাস্ট ফোন করবে।

হয়তো করবে। কিন্তু স্যাম, সত্যি করে বলুন তো আপনি আমার মত নার্ভাস ফিল করছেন না?

করছি। আমিও বুঝতে পারছি না অ্যারবোগাস্ট ফোন করতে এত দেরি করছে কেন। এই এলাকায় চেক করার মত খুব বেশি জায়গা নেই। রাতের খাবার খাওয়ার মধ্যে যদি সে কোন খবর না দেয় তাহলে আমি চেম্বারসের কাছে যাব।

কে সে?

চেম্বারস। এখানকার শেরিফ।

স্যাম, আমি

কথা শেষ করতে পারল না লিলা, তার আগেই স্টোরে ফোন বেজে উঠল। এক লাফে স্টোরে গিয়ে হাজির হলো স্যাম। বব সামারফিল্ড রিসিভার এগিয়ে দিয়ে বলল, আপনার ফোন।

স্যাম কানে রিসিভার লাগাতে লাগতে লক্ষ করল লিলা ওর পিছু পিছু বেরিয়ে এসেছে ঘর থেকে।

হ্যালো- স্যাম লুমিস বলছি।

অ্যারবোগাস্ট। আপনারা বোধহয় আমার জন্য খুব চিন্তায় পড়ে গেছেন, না?

অবশ্যই। লিলা এবং আমি সেই দুপুর থেকে এখানে বসে আছি আপনার ফোনের জন্য। কোন খবর পেলেন?

কয়েক সেকেন্ডের জন্য নীরবতা নেমে এল। তারপর অ্যারবোগাস্ট বলল, বলার মত এখনও কিছু জানতে পারিনি।

তাহলে সারাদিন কি করলেন? কোথায় ছিলেন এতক্ষণ?

কোথায় ছিলাম না, বলুন? পুরো এলাকা চষে বেড়িয়েছি, এখন আমি পায়নাসাস থেকে কথা বলছি।

শহরের একেবারে শেষ প্রান্তে জায়গাটা, তাই না? মাঝের হাইওয়েটা দেখেছেন?

হ্যাঁ। তবে আরেকটা রাস্তা নাকি আছে শুনলাম।

ঠিকই শুনেছেন। পুরানো হাইওয়ে। তবে ওটা এখন আর কেউ ব্যবহার করে না। একেবারেই খারাপ রাস্তা। এমন কি কোন ফিলিং স্টেশন পর্যন্ত নেই।

কিন্তু এখানকার এক রেস্টুরেন্টে এক লোক আমাকে বলল ওই রাস্তায় নাকি একটা মোটেল আছে।

ও, হ্যাঁ, হ্যাঁ। একটা পুরানো বাড়ি আছে বটে। কিন্তু ওটা এখনও চালু আছে কিনা আমি জানি না। ওখানে গিয়ে আপনার কোন লাভ হবে বলে মনে হয় না।

ওটাই আমার লিস্টের শেষ জায়গা। যখন ফিরেই আসছি তখন একবার ঢুঁ মেরেই যাই। আপনার ওদিকের খবর কি? মেয়েটার কি অবস্থা?

গলা নামাল স্যাম। ও আমাকে পুলিশের কাছে যাওয়ার জন্য তাড়া দিচ্ছে।

আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন না।

কতক্ষণ লাগবে আপনার আসতে?

বড় জোর এক ঘণ্টা। যদি ওই মোটেলে কিছু না পাই। একটু ইতস্তত করে অ্যারবোগাস্ট বলল, দেখুন, আমরা তো পরস্পরের সঙ্গে সমঝোতা করেই কাজে নেমেছি। আমি ফিরে আসা পর্যন্ত অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। তারপর দরকার হলে আমিও আপনাদের সঙ্গে পুলিশের কাছে যাব। একসঙ্গে কাজ করলে কাজটা আমাদের জন্য আরও সহজ হয়ে উঠবে।

ঠিক আছে। আপনাকে এক ঘণ্টা সময় দেয়া গেল, বলল স্যাম। আমরা দোকানেই আছি।

রিসিভার রেখে ঘুরে দাঁড়াল সে।

কি বলল লোকটা? জিজ্ঞেস করল লিলা। কোন খবর জোগাড় করতে পেরেছে, নাকি পারেনি?

না, পারেনি। তবে সে এখনও হাল ছাড়েনি। চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আরও একটা জায়গায় ঢু মারবে বলল।

মাত্র একটা জায়গা বাকি?

হতাশ হয়ো না। হয়তো ওখান থেকেই সে কোন খবর পেয়ে যেতে পারে। আর না হলে সে এক ঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসবে বলেছে। আমরা শেরিফের কাছে যাব।

বেশ। আমরা অপেক্ষা করব। তবে এক ঘণ্টার বেশি কিছুতেই নয়।

পরবর্তী ঘণ্টাটা যেন দুঃসহ যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে কাটল। জনের ভাগ্য ভাল শনিবারের সন্ধ্যাতেও দোকানে হঠাৎ করেই লোকজনের ভিড় বেড়ে গেল। কিন্তু কাজ করতে করতেও মনের মধ্যে একটা কাঁটা ঠিকই খচখচ করতে লাগল। বারবার মন বলল মেরির কোন দুর্ঘটনা ঘটেছে।

স্যাম!

ঘুরে তাকাল স্যাম। লিলা। ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। হাতঘড়ির দিকে নির্দেশ করল সে। স্যাম, এক ঘণ্টা পার হয়ে গেছে!

তাই তো! কিন্তু ওকে আর কয়েক মিনিট সময় দেয়া যায় না? তাছাড়া আমাকে দোকানও বন্ধ করতে হবে।

ঠিক আছে। কিন্তু কয়েক মিনিটের চেয়ে বেশি কিছুতেই নয়। আপনি তো জানেন আমার মনের অবস্থা- 

জানি, লিলা। লিলার নরম বাহুতে হাত রাখল স্যাম, চাপ দিল। হেসে বলল, অত চিন্তা কোরো না। ও কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে।

কিন্তু মিলটন অ্যারবোগাস্ট এল না।

স্যাম এবং বব তাদের শেষ খদ্দেরটিকে বিদায় করল সাড়ে-পাঁচটা নাগাদ। রেজিস্ট্রি চেক করল স্যাম। বব দোকানের শাটার নামাল। কিন্তু এখনও অ্যারোগাস্টের কোন পাত্তা নেই। আলোটালো নিভিয়ে সে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, স্যাম দরজা বন্ধ করার জন্য এগিয়ে গেল।

এখন, বলল লিলা। এখন চলুন যাই। আপনি যদি না যেতে চান তাহলে আমি–

দাঁড়াও, বলল স্যাম কথা বোলো না। ফোন বাজছে। ঝাঁপিয়ে পড়ল সে ফোনের ওপর।

হ্যালো?

অ্যারবোগাস্ট বলছি।

কোত্থেকে বলছেন? আপনি বলেছিলেন- 

কি বলেছিলাম ভুলে যান, অ্যারবোগাস্টের কণ্ঠ নিচু কিন্তু উত্তেজিত।

আমার হাতে একদম সময় নেই, মোটেলের বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলছি। শুনুন, আপনার বান্ধবী এই হোটেলে ছিলেন। গত শনিবার রাতে।

মেরি? আপনি শিওর?

একশোবার শিওর। আমি রেজিস্টার বই চেক করার সময় কৌশলে মিস মেরির হাতের লেখার সঙ্গে মিলিয়ে দেখেছি। জেন উইলসন নামে তিনি এখানে উঠেছিলেন ভুয়া একটা ঠিকানা দিয়ে। নাম দুটো হলেও হাতের লেখা এক। সন্দেহ নেই জেন উইলসনই আমাদের মেরি ক্রেন। তবে প্রমাণের জন্য রেজিস্ট্রি এন্ট্রি ফটোস্ট্যাট করতে হলে আদালতের অনুমতি লাগবে।

আর কি খবর জেনেছেন?

গাড়ির বর্ণনা। যে গাড়িতে মিস মেরি এসেছিলেন তার বর্ণনা আমি জানি। মোটেলের মালিকও একই বর্ণনা দিচ্ছে।

এত সব খবর জানলেন কি করে?

লোকটাকে আমার ব্যাজ দেখাতেই কাজ হয়ে গেল। আর গাড়িটার কথা বলতেই সে কেমন উত্তেজিত হয়ে উঠল। নরমান বেটস নামের এই লোকটা কেমন টাইপের। আপনি চেনেন ওকে?

না চিনি না। নাম শুনেছি শুধু।

লোকটা বলছে শনিবার রাতে আপনার বান্ধবী তার মোটেলে আসে ছটার দিকে। অ্যাডভান্স টাকা পে করে দেয়। ওই দিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। মিস মেরিই একমাত্র কাস্টমার ছিলেন। তিনি নাকি পরদিন ভোরেই চলে যান। নরমান বেটস বলছে ঘুম থেকে উঠে সে নাকি মেরিকে দেখেনি। এই লোক তার মাকে নিয়ে মোটেলের পেছনে একটা বাড়িতে থাকে।

ও কি সত্যি কথা বলছে?

বুঝতে পারছি না ঠিক।

মানে?

লোকটাকে ভয় দেখিয়েছিলাম যে মেরির গাড়িটা চোরাই। ওটাকে নিয়ে গোলমাল হয়েছে। তার মুখ দিয়ে হঠাৎ অসাবধানে বেরিয়ে পড়ল যে সে মিস মেরিকে তার বাড়িতে দাওয়াত করে নিয়ে গিয়েছিল রাতের খাবার খেতে। ব্যস, তারপর আর কিছুই সে জানে না। আমার সন্দেহ ওর মা বোধহয় কিছু জানে।

আপনি তার সঙ্গে কথা বলেছেন?

না। কিন্তু এখন কথা বলতে যাচ্ছি। তবে নরমান বেটস বারবার বলছে তার মা নাকি খুব অসুস্থ। কারও সঙ্গে দেখা করার মত অবস্থা তার নেই। কিন্তু আমি ভদ্রমহিলাকে তার বেডরুমের জানালার পাশে বসে থাকতে দেখেছি। লোকটাকে বলেছি সে আমাকে যতই জোর করুক না কেন আমি তার মায়ের সঙ্গে দেখা করবই।

কিন্তু জোর করে দেখা করা কি ঠিক হবে?

দেখুন, আপনি আপনার প্রেমিকার খবর জানতে চান, তাই না? আর নরমান বেটসের সার্চ ওয়ারেন্ট সম্পর্কে কোন ধারণা আছে বলে মনে হলো না। একটু ঝাড়ি দিতেই সে বাড়ির ভেতর সুড়সুড় করে ঢুকে পড়েছে। বলেছে তার মাকে রেডি হতে বলার জন্য যাচ্ছে সে। এই ফাঁকে আপনার কাছে ফোন করেছি। সুতরাং খবর জানতে চাইলে অপেক্ষা করুন। ওই তো লোকটা এদিকেই আসছে। তাহলে রাখলাম, কেমন?

ফোন ছেড়ে দিল মিলটন অ্যারবোগাস্ট। স্যাম সব কথা খুলে বলল লিলাকে।

এখন একটু ভাল লাগছে? জানতে চাইল সে।

হ্যাঁ। কিন্তু যদি জানতে পারতাম–

জানব। কিছুক্ষণের মধ্যেই জানতে পারব। আপাতত অপেক্ষা করা ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *