১-২. সাত বছরের বনি

মরু শয়তান – কিশোর উপন্যাস – শাহরিয়ার কবির

আম্মু, বিনি আমাকে বকেছে। পড়ার টেবিল থেকে রিনরিনে গলায় চাঁচালো সাত বছরের বনি।

ওদের মা তখন ড্রইংরুম গোছাতে ব্যস্ত। বিকেলে কলকাতা থেকে বিনির বাবার বন্ধু আসবেন তাঁর বউ আর দশ বছরের ছেলেকে নিয়ে। ঘরটা গুছিয়ে তাঁকে ছুটতে হবে রান্না ঘরে। বুয়ার হাতে ভালো কোনও রান্না ছেড়ে দেয়ার জো নেই। অঘটন একটা ঘটাবেই সে। ফুলদানিতে ফুল সাজাতে সাজাতে মা বললেন, বিনি বলবে না বনি। বিনি আপু!

পাঁচ বছরের বড় হলেও বিনিকে দায়ে না পড়ে কখনও আপু বলে না বনি। মার কথা শুনে বিনি ওর পড়ার টেবিল থেকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো। ভাবখানা এই–কেমন জব্দ!

বনি আগের মতো চাঁচালো–বিনি আপু আমাকে বকেছে।

মার হাতে গোলাপের কাঁটা ফুটে রক্ত বেরিয়ে গেছে। জায়গাটা মুখে লাগিয়ে জিভ দিয়ে রক্ত মুছে নিয়ে বললেন, বিনি, বনিকে বকবে না।

এবার বনি গর্বিত ভঙ্গিতে বিনির দিকে তাকালো। বিনির তখন বইয়ের পাতায় গভীর মনোযোগ। বনি পেছন থেকে ওকে জিভ দেখিয়ে দশ পৃষ্ঠা হাতের লেখা লিখতে বসলো। নতুন টিচারকে ও খুব ভয় পায়। কিছুই বলেন না, শুধু শাস্তির পরিমাণ বাড়ান। হাতের লেখা এক পৃষ্ঠা কম লেখা হলে নরম গলায় বলবেন, আজ বুঝি নয় পৃষ্ঠা লিখেছো! ঠিক আছে কাল দশ পৃষ্ঠা আর দু পৃষ্ঠা আজকের, মোট বারো পৃষ্ঠা লিখবে।

বনি বলে, স্যার দশ পৃষ্ঠা আর এক পৃষ্ঠা হবে। আজ এক পৃষ্ঠা কম লিখেছি।

তুমি ভুলে গেছো বনি। আরো মোলায়েম গলায় স্যার বলেন, তোমাকে বলেছি, কোনও দিন এক পৃষ্ঠা কম লেখা হলে পরদিন সেটা ডবল লিখতে হবে! দু পৃষ্ঠা কম যদি লেখো তাহলে পরদিন চার পৃষ্ঠা বেশি লিখতে হবে। আর যদি দশ পৃষ্ঠাই না লেখো তাহলে বলতো পরদিন মোট কত পৃষ্ঠা লিখতে হবে? এই বলে স্যার হাসি হাসি মুখ করে বনির দিকে তাকান, যেন দারুণ মজার এক অঙ্ক কষতে দিয়েছেন ওকে। বনি শুকনো গলায় বলে, তিরিশ পৃষ্ঠা!

এই তো লক্ষ্মী ছেলে! আমি কিন্তু চাই না তুমি রোজ দশ পৃষ্ঠার বেশি লেখো।

সেই থেকে বনি রোজ দশ পৃষ্ঠা হাতের লেখা লিখছে। বিনি লেখে বিশ পৃষ্ঠা। বিনির বেলায়ও একই নিয়ম। তবে বিনিটা পাজী আছে। বিশ পৃষ্ঠা লিখতে ওর কোনও ভুল হয় না। আর সুযোগ পেলেই স্যারের কাছে বনির নামে নালিশ করে। অবশ্য বিনির নামে নালিশ করার সুযোগ পেলে বনিও সেটা হাতছাড়া করে না। তবে এরকম সুযোগ খুব কমই আসে।

বনি আর বিনি শাহীন স্কুলের ক্লাস ফোর আর সেভেনে পড়ে। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়লেও স্যারকে প্রথম দিনই বাবা বলে দিয়েছেন–স্কুলে না পড়ালেও বাড়িতে বাংলা যেন ঠিক মতো পড়ানো হয়।

গত বছর মারা যাবার আগে দাদু একটা হুজুর রেখেছেন সপ্তায় তিন দিন আরবি পড়ানোর জন্য। দাদুর কথা মতো হুজুর শুধু কোরাণ শরিফই পড়ান না, আরবি ভাষাও শেখান। দাদু বলে দিয়েছেন, অঙ্কের মতো কোরাণ শরিফ মুখস্ত করলে চলবে না। আরবি ভাষা শিখে অর্থ বুঝে কোরান শরিফ শিখতে হবে।

দশ পৃষ্ঠা বাংলা লেখা যা-ও সহ্য হয়, হুজুর যখন মিহি গলায় আউযুবিল্লাহ হে মিনাশ শায়তানুর রাজিম …….. শুরু করেন বনির বিরক্তির সীমা থাকে না। তারপরও হুজুরকে সহ্য করতে হয়। কারণ বিনি খুব ভক্তির সঙ্গে মাথায় ওড়না দিয়ে হুজুরের কথা মতো সুরার পর সুরা গড় গড় করে মুখস্ত বলে যায়।

মাঝে মাঝে বিনির এ ধরনের বিশ্বাসঘাতকতায় বনির বুকটা দুঃখে ভরে যায়। কী ক্ষতি হয় একদিন যদি ও হাতের লেখা দু পৃষ্ঠা কম লেখে, কিংবা হুজুরের ক্লাসে সুরা মুখস্ত করতে ভুলে যায়! পরীক্ষায় প্রত্যেক বার ফাস্ট হতে হবে এ-ও বিনির আরেক শয়তানি। এ না হলে বনিকে বকুনি খাওয়াবে কেমন করে? পরীক্ষায় কোনও বারই বনি দশের ওপরে উঠতে পারেনি। ওর রিপোর্ট কার্ড দেখার সময় বাবা মা দুজনেরই কপালে ভাঁজ পড়ে, চোখ ছোট হয়ে যায়, অথচ বিনির রিপোর্ট কার্ড দেখার সময় ওঁদের সব কটা দাঁত গোনা যায়। তবে বাবা মা যতই বিরক্ত হোক, বড় চাচী সব সময় ওকে বলেন, বাব্বা, অংকে তুমি আশি পেয়েছো! ইংলিশে নব্বই পেয়েছো। মা তখন অকারণে গায়ে পড়ে চাচীকে বলেন, অংকে আশি পেলে কী হবে, যে ফার্স্ট হয়েছে সে একশ পেয়েছে। ড্রইংয়ে দেখেছেন কত কম নম্বর পেয়েছে?

একমাত্র বড় চাচীই মনে করেন পরীক্ষায় ফার্স্ট হওয়ার ভেতর বিনির কোনও কৃতিত্ব নেই, আর বনি ইচ্ছে করলেই ফার্স্ট হতে পারে। বড় চাচী মাকে বলেন, বনি অংকে আশি পেয়েছে বলে তোমার মন খারাপ আর খুকুর মাকে দেখো গিয়ে ছেলে পঞ্চাশ পেয়ে পাশ করেছে বলে পাড়ার সবাইকে মিষ্টি খাওয়াচ্ছেন।

বিনির আরও অনেক খারাপ স্বভাব আছে, অন্তত বনি তাই মনে করে। কী দরকার রোজ বিকেলে ওর এক গ্লাস দুধ খাওয়ার? নিজে তো খাবে আবার বনি ঠিক মতো খেলো কি না সেটাও ওর দেখতে হবে। ও যদি এসব শয়তানি না করতো তাহলে বনি ঠিকই ওর দুধটুকু বুয়াকে খাইয়ে দিতে পারতো। বেচারা বুয়া কত কষ্ট করে, অথচ এক ফোঁটা দুধ খেতে পায় না। যেদিন বুয়া ওকে বলেছিলো দুধ খায় না বলে ওর গায়ে শক্তি নেই, এত কাজ করতে পারে না, তখন বনি ওর দুধটুকু জোর করে বুয়াকে খাইয়ে দিয়েছে। বলেছে, এখন থেকে আমার দুধ তুমি খাবে। বুয়া অবশ্য প্রথমে রাজী হয়নি। বলেছে, এইডা কী কন ছোড সাব, আম্মায় হুনলে আমারে আস্ত রাখবো নি! বনি অভয় দিয়ে বুয়াকে বলেছে, সব কথা আম্মাকে শোনাতে হবে কেন? আমার দুধ না খেলেও চলবে। আমার গায়ে অনেক শক্তি!

বেশ কিছুদিন দুধ না খেয়ে আরামেই দিন কাটছিলো বনির। বিনির সেটা সহ্য হলো না। একদিন বুয়াকে ওর দুধ খেতে দেখে বিনি মাকে বলেছে, আম্মা, বনি ঠিক মতো দুধ খায় না। ব্যস, তখন থেকেই মা নিয়ম করে দিয়েছেন, বনির দুধ খাওয়ার সময় বিনি সামনে বসে থাকবে। বিনি যে রকম এক চুমুকে পুরো গ্লাসের দুধ খেয়ে ফেলে, বনির সময় লাগে পনেরো কুড়ি মিনিটেরও বেশি। কখনও বেশিও লাগে। কারণ এক ঢোক দুধ গিলে বনি ও প্রত্যেকবার বিনিকে জিভ দেখাতে ভোলে না। ও মনে করে এটা বিনির প্রাপ্য।

আজও যেমন পড়ার টেবিলে বসার আগে আদর করেই বিনিকে ও বলেছিলো, আপু, আম্মুকে বল না আজ আমরা পড়বো না। বিকেলে অমল কাকু আসবে, রিনা কাকী আসবে, আশীষ ভাইয়া আসবে, আর আমরা বুঝি স্যারের কাছে পড়বো! স্যার যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আজ আবার হুজুরও আসবে!

বিনি ওর কথা কানেই তুললো না। বললো, রোজই তো বাড়িতে মেহমান আসে। আমরা কি রোজ স্যারকে মানা করবো আসতে!

বা রে! রোজ কি কলকাতা থেকে মেহমান আসে? আর কবে বলেছি ভারি যে রোজ রোজ করছিস?

আর কথা নয় বনি! গম্ভীর গলায় বিনি বলেছে, হাতের লেখা শেষ হলে বাকি হোম টাস্ক করে ফেলো।

তখনই বনি চেঁচিয়ে মাকে বলেছে বিনি নাকি ওকে বকেছে। মা-ও সব সময় বিনির পক্ষে। মাঝে মাঝে এক আধটু লোক দেখানো ধমক দিলেও বিনি শাস্তি পাওয়ার মতো বহু কাজ করে, মা দেখেও না দেখার ভান করেন। মা বাবা যখন বিনির পক্ষে কথা বলেন। তখন গোটা পৃথিবীটা অসার মনে হয় বনির। ওর জন্য কারও এতটুকু মায়া দরদ নেই। কথাটা বেশি মনে হয় পড়ার টেবিলে বসলে, আর মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওর কান্না পায়। পড়ার টেবিলে বসলে আরও একটা সমস্যা হয় ওর। সেটা হচ্ছে খালি ঘুম পাওয়া। বিছানায় শুলে ঘুম আসতে ঘন্টা পেরিয়ে যায়, অথচ পড়ার টেবিলে পাঁচ ছয় পৃষ্ঠা হাতের লেখা লিখতে লিখতে ঘুমে চোখের পাতা ভারি হয়ে আসে। তারপরও ওর প্রতি বিনির বিন্দুমাত্র সহানুভূতি নেই।

বিকেলে অমল কাকুরা এলেন হই হই করতে করতে। বনি, বিনি কোথায়, এদিকে এসো। দেখো, তোমাদের জন্য কী এনেছি। অল্পক্ষণের মধ্যেই বাড়িটা মাতিয়ে তুললেন তিনি।

এনেছেন তো অনেক কিছুই! বনির জন্য প্যান্ট শার্ট ছাড়াও ম্যাজিক ফ্লাইং বার্ড এনেছেন। চাবি ঘুরিয়ে ছেড়ে দিলে পত পত করে ডানা নাড়তে নাড়তে উড়ে যায়। আরেকটা গাড়ি বানাবার মেকানো সেট। দশ রকম মডেলের গাড়ি বানানোর সব রকম মিনি যন্ত্রপাতি আর স্পেয়ার। বিনির জন্য শুধু ড্রেস আর একটা বিরাট মোটা চিন্দ্রেনস এনসাইক্লোপিডিয়া।

বিনি না বললেও বনি এক ফাঁকে মাকে বলেছিলো, আজ আমরা টিচারের কাছে পড়বো না মা। টিচার এলে চলে যেতে বলবো।

না বনি! মা পষ্ট বলে দিয়েছেন, বিনি পড়বে আর তুমি পড়বে না–এটা হতে পারে না।

সন্ধ্যেবেলা ড্রইং রুমে বসে সবাই জমিয়ে গল্প করছিলো। রিনা কাকী বলছিলেন, গত সামারে ওয়েলস-এ যখন তারা হলিডে করতে গিয়েছিলেন তখন কত সব মজার ঘটনা ঘটেছে। বনির এটাও এক দুঃখ। গরম হোক আর শীত হোক কোনও ছুটিতেই বাবা মা ওদের বাইরে কোথাও বেড়াতে নিয়ে যান না। সেই ক্লাস ওয়ানে থাকতে একবার কক্সবাজার গিয়েছিলো, তা-ও অলক কাকু জোর করে ধরাতে। তিনি বিরাট বাংলো পেয়েছেন, পাজেরো গাড়ি আছে, থাকার কোনও অসুবিধে হবে না, এসব বলে-টলে রাজী করানো গিয়েছিলো বাবাকে। তারপর কত সামার গেলো, কত উইন্টার গেলো, রোজার বন্ধ, পূজোর ছুটি–কখনও কোথাও যাওয়া হলো না। আশীষ ভাইয়ার দিকে একবার তাকালো বনি । ও তখন নিবিষ্ট মনে ইলেক্ট্রনিক গেম খেলছিলো। বনির দারুণ হিংসা হলো আশীষের ওপর। প্রত্যেক সামারে ওরা ইউরোপের কোথাও না কোথাও বেড়াতে যায়। রাগ হলো বিনির ওপর। এ নিয়ে বিনি কোনও দিন বাবা মাকে একটা কথাও বলেনি।

ঠিক সাড়ে ছটায় ডোর বেল বাজলো। বিনি উঠে গেলো দরজা খুলতে। টিচার এসেছেন। কোনও দিন এক মিনিটও দেরি করেন না। বনিও শুকনো মুখে উঠে দাঁড়ালো। রিনা কাকীর গল্পের আসল মজার জায়গাটাই শোনা হলো না। দারুণ সস্তায় পেয়ে ওঁরা যে পুরোনো দুর্গের মতো মোটেলে উঠেছেন ওটা আসলে একটা হন্টেড প্যালেস–এটুকু শুনেই বনিকে উঠে যেতে হলো।

রিনা কাকী গল্প বলা থামিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করলেন, বিনি বনি কোথায় গেলো?

মা বললেন, ওদের টিচার এসেছেন।

আজ আবার কিসের টিচার বিথি? আমরা দুদিনের জন্য এলাম, সবাই মিলে মজা করবো, আর তুমি বাচ্চা দুটোকে পাঠালে টিচারের কাছে? এটা তোমার ভারি অন্যায় বিথি। তুমি জানো না ওরা তোমাকে কী রকম দয়ামায়াহীন পাষাণ ভাবছে। আমাকে বলতেই হবে বিথি, এটাও এক প্রকার নিষ্ঠুরতা। রিনা কাকী বাংলায় এম এ পড়েছিলেন । এখনও নাকি বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর মতে বাংলার শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক। নিজেও কথা বলার সময় কঠিন কঠিন শব্দ বলেন।

বাবা মৃদু হেসে বললেন, ঠিক আছে বিথি, টিচারকে বলো ওরা আজ পড়বে না।

শুধু আজ নয়, কাল এবং পরশুও। ঘোষণা করলেন রিনা কাকী–কাল আমরা আনন্দ মেলায় যাবো।

বনি তখনও পড়ার ঘরে যায়নি। ড্রইং রুমের দরজার পাশে দাঁড়িয়েছিলো। রিনা কাকীর কথা শুনে মনে হলো আকাশ থেকে বুঝি কোনও পরি নেমে এসেছে ওদের বাসায়।

পরদিন অমল কাকু সবাইকে নিয়ে শেরে বাংলা নগরে গেলেন আনন্দমেলা দেখতে। আশীষ কখনও বাংলাদেশের মেলা দেখেনি। বাবা যখন বললেন মেলায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে পুতুল নাচের দল এসেছে, ফরিদপুরের যাত্রার দল নিউ ভাণ্ডারি অপেরা এসেছে, খুলনার জেমিনি সার্কাস এসেছে অমল কাকু আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন। বললেন, কত বছর হলো যাত্রা দেখিনি! কোন যাত্রা হবে, রূপবান না গুনাই বিবি?

বাবা হেসে বললেন, আজকাল শহরের লোকেরা গুনাই বিবি দেখে না। এরা দেখাবে নবাব সিরাজউদ্দৌলা।

ঠিক আছে মাহমুদ, অমল কাকু বললেন, আজ সবাই মিলে মেলা দেখা যাক। কাল তুই আর আমি সারা রাত যাত্রা দেখবো।

আশীষ অবাক হয়ে বললো, সারা রাত দেখবে? কয়টা শো হবে এক রাতে?

কয়টা নারে বেটা, একটাই। আমাদের দেশে যাত্রার একটা শশা সারা রাত ধরে হয়। চৌষট্টি সালে দাঙ্গার পর অমল কাকুরা ইণ্ডিয়া চলে গেছেন। তারপরও দেশ মনে করেন বাংলাদেশকে।

বাবা বললেন, আজ কাল সারা রাত হয় না। চার পাঁচ ঘন্টার মধ্যেই শেষ হয়ে যায়।

হোক শেষ! তবু দেখবো। যাত্রা বলে কথা!

ঢাকায় প্রায় প্রতি বছরই এরকম আনন্দমেলা হয়। বনির দুর্ভাগ্য কোনো দিন এখানে আসার সুযোগ হয়নি। মেলায় নাকি প্রচণ্ড ধুলো, প্রচণ্ড ভিড়। ছেলেধরা আর পকেটমারের দল নাকি ওঁৎ পেতে বসে আছে সব খানে আরও কত সব কথা। বিনিকে বলেও লাভ হয়নি, ও বলেছে, বাবার কত কাজ! মেলায় যাওয়ার সময় কোথায়?

মেলায় এসে অমল কাকু একেবারে ছেলেমানুষ হয়ে গেছেন। পুতুল নাচ দেখতে গিয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন। বাবাকে উচ্ছ্বসিত গলায় বললেন, কনটেন্টটা মডার্ন হলেও ট্র্যাডিশনাল ফর্মটা এখনও ধরে রেখেছে।

পুতুল নাচ দেখে বনিও কম মজা পেলো না। শুধু আশীষ বললো, কলকাতায় এর চেয়ে অনেক গর্জিয়াস পাপেট শো হয়।

আশীষের কথা বনির ভালো লাগলো না। বিনিকে চুপি চুপি বললো, বিনি আপু, তোর ভালো লাগেনি পুতুল নাচ?

বিনিও স্বীকার করলো যে পুতুল নাচটা দারুণ হয়েছে। অমল কাকু বললেন, এমন জিনিস পৃথিবীর কোথাও পাবে না।

পুতুল নাচের পর মৃত্যু কূপের খেলা দেখে, ফুচকা খেয়ে যখন ওরা সার্কাসের তাঁবুর পাশে দাঁড়ালো তখন হঠাৎ বিনি শক্ত করে বনির হাত চেপে ধরলো। ভয় পাওয়া গলায় ফিশ ফিশ করে বললো, বনি, মা বাবারা সব কোথায়?

বিনির কথা ঠিক মতো শুনতে পায়নি বনি। বললো, কী হয়েছে বিনি আপু? এমন করছিস কেন?

বিনি বললো, বাবা, অমল কাকু, মা, রিনা কাকী–সবাই কোথায়?

বনি বললো, অমল কাকু আর বাবা তো সার্কাসের টিকেট কাটতে গেলেন।

মা, রিনা কাকী আর আশীষ? ওরা কোথায়?

নিশ্চয় এখনও ফুচকা খাচ্ছে।

তুই এখানে দাঁড়া বনি। আমি ফুচকার দোকানটা দেখে আসি।

হঠাৎ বনির বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠলো। কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, আপু, আমি তোর সঙ্গে থাকবো।

ঠিক আছে, বোকা ছেলে! কাঁদছিস কেন? চল, আমরা দুজনে মিলে ওদের খুঁজে বের করি।

বনির হাত ধরে বিনি ফুচকার দোকানে এসে দেখলো মা, রিনা কাকীরা সেখানে নেই। চারপাশে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলো। মানুষের ভিড়ে কিছুই দেখতে পেলো না।

মানুষের এত ভিড়, পেছন থেকে শুধু ধাক্কা দিচ্ছে সামনে যাওয়ার জন্য। লোকজনের ধাক্কা খেতে খেতে বিনি আর বনি নাগরদোলার কাছে এসে গেলো । বিনি পাগলের মতো মাথা উঁচু করে ওর মা বাবাদের খুঁজলো। চারদিকে শুধু মানুষ আর মানুষ–মা বাবা কোথাও নেই।

এতক্ষণে বিনি নিশ্চিত হলো–ওরা মা বাবাকে হারিয়ে ফেলেছে। তবু ও ভয় পেলো না। বনি কিছুতেই কান্না সামলাতে পারছিলো না। বিনি বললো, বনি ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমরা কোনো পুলিসকে বলবো আমাদের বাবা মাকে খুঁজে পাচ্ছি না। বাসার ঠিকানা বললে ওরা ঠিকই পৌঁছে দেবে।

আমাদের যদি এখন ছেলেধরা এসে ধরে নিয়ে যায়!

পাগল হয়েছিস! এত লোক এখানে! কোনো ছেলেধরার সাহস হবে না এখানে আসতে।

.

০২.

ফুচকার দোকান থেকে সার্কাসের তাঁবুর দিকে আসতেই মা হঠাৎ খেয়াল করলেন, বিনি আর বনি ওঁদের সঙ্গে নেই । বিনি সারাক্ষণ ওঁকে ধরে রেখেছিলো। ফুচকার দোকানে ঢোকার আগেও বিনিকে তিনি বলেছিলেন, কক্ষণো যেন তাঁর হাত না ছাড়ে। ভয় পাওয়া গলায় তিনি প্রায় চিৎকার করে উঠলেন–মাহমুদ, বনি বিনি কোথায়?

মার গলা শুনে বাবা চমকে উঠলেন–কেন, তোমার সঙ্গেই তো ছিলো ওরা?

অমল কাকু আর বাবার দুহাত বোঝাই মাটির সব পুতুল, ঘোড়া, হাতি আর ছোট ছোট নকশা করা ফুলের টবে ।

ছিলো তো আমার সঙ্গে। মা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, এখন তো দেখছি না!

তোমরা সবাই এখানে দাঁড়াও। বলে হাতের জিনিসগুলো মাটিতে নামিয়ে রেখে বাবা বললেন, আমি দেখছি। নিশ্চয়ই আশে পাশে কোথাও আছে।

ভিড় ঠেলে এগিয়ে যেতে যেতে বাবা গলা তুলে ডাকলেন বনি, বিনি! তোমরা কোথায়? বনি, বিনি …..

চিৎকার করে বনি বিনিকে ডেকে চারপাশে খুঁজতে খুঁজতে বাবার গলা বসে গেলো, রক্তের চাপ বেড়ে গেলো, বুকের ভেতর ধড়ফড় করতে লাগলো কোথাও ওদের দেখা গেলো না। ফিরে এসে ভাঙা গলায় বললেন, না, আশে পাশে কোথাও ওরা নেই।

মা ফুঁপিয়ে উঠলেন, এখন কী হবে, বলে।

একজন বুড়ো দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক বাবা মার দিশেহারা অবস্থা দেখে বললেন, আপনাদের কি ছেলে মেয়ে হারিয়েছে?

ব্যগ্র হয়ে বাবা বললেন, হ্যাঁ, আমাদের বনি বিনি! কোথায় ওরা?

মেইন গেট এর পাশে তথ্য কেন্দ্র আছে। ওখানে আমি দেখেছি হারিয়ে যাওয়া দুটো ছেলে মেয়ে বসে কাঁদছে।

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। বলে বাবা ছুটলেন তথ্য কেন্দ্রের দিকে। তার পেছন পেছন অন্যরাও ছুটলো। ছুটতে গিয়ে কারও সঙ্গে ধাক্কা লাগলো, কারও হাতের জিনিস পড়ে গেলো। ধাক্কা খেয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন মোটাসোটা এক বয়স্ক মহিলা। চিলের মতো চিৎকার করে উঠলেন তিনি–আঁ এ কি! চোখের মাথা খেয়েছে নাকি– তাঁর কথা শোনার সময় বনি বিনির বাবা-মাদের ছিলো না।

হাঁপাতে হাঁপাতে তথ্য কেন্দ্রে এসে কান্নায় ভেঙে পড়লেন বনি বিনির মা। তথ্য কেন্দ্রে দুটো ছেলে মেয়ে বসে আছে ঠিকই, ওরা বনি বিনি নয়। ছেলেটার বয়স ছয়, মেয়েটার চার। মাইকে ওদের নাম বলে ওদের বাবা মাকে ডাকা হচ্ছে।

অমল কাকু বললেন, বনি বিনির নামও তো এভাবে অ্যানাউন্স করা যেতে পারে। আমি দেখছি।

তিনি ভেতরে গিয়ে একটা কাগজে লিখে দিলেন কী বলতে হবে। পাঁচ মিনিট পর তথ্য কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে তারা শুনলেন, মাইকে বলা হচ্ছে বনি আর বিনি নামের দুটো ছেলেমেয়ে হারিয়ে গেছে। বনির বয়স নয়, বিনির বয়স বারো। ওদের পরনে নীল সাদা প্যান্ট শার্ট আর লাল সাদা ফ্রক। কেউ ওদের পেলে দয়া করে তথ্য কেন্দ্রে পৌঁছে দেবেন। বনি, বিনি, তোমরা যেখানে আছো তথ্য কেন্দ্রে চলে এসো! তোমাদের বাবা মা এখানে অপেক্ষা করছেন।

পর পর কয়েকবার ঘোষণাটা মাইকে প্রচার করা হলো। মিনিট দশেক পরে এক বয়স্ক ভদ্রমহিলা সাত বছরের মেয়ের হাত ধরে তথ্য কেন্দ্রে পৌঁছে দিলেন। এই মেয়েটিও হারিয়ে গেছে। তথ্য কেন্দ্র থেকে বলা হলো–টুম্পা নামের সাত বছরের একটি মেয়ে পাওয়া গেছে। ওর বাবা মাকে বলা হচ্ছে এখনই তথ্য কেন্দ্রে আসা জন্য।

তথ্য কেন্দ্রের সিঁড়ির ওপর বসে মা দুহাতে মুখ ঢেকে অঝোরে কাঁদতে লাগলেন ওঁকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে রিনা কাকীও কাঁদলেন। তারপরও বললেন, মন শক্ত করে বিথি। বনি বিনির কিছুই হয়নি। ওরা এক্ষুণি আসবে।

তথ্য কেন্দ্রের একজন তরুণ কর্মী বেরিয়ে এসে বললো, গেট-এর বাইরে পুলি ক্যাম্প আছে। আপনারা কেউ গিয়ে ওদের অনুরোধ করুন মেলার গেট-এ যেন পুলি: পাহারা বসায়। বাচ্চারা যেন মেলা থেকে বেরিয়ে যেতে না পারে।

অমল কাকু বাবাকে বললেন, তোরা এখানে থাক। আমি পুলিস ক্ল্যাম্পে গিে খবরটা দিয়ে আসি।

বাবা মাথা নেড়ে শুধু সায় জানালেন। কী করবেন, কোথায় যাবেন কিছুই তাঁর মাথা ঢুকছে না। একটু পরে মাকে বললেন, তোমরা এখানে থাকো। মেলার পুরো এলাকাট আমি একবার ঘুরে দেখে আসি।

রিনা কাকী বললেন, তাই যান। অমল এলে আমি ওকেও বলবো এ পাশটায় খুঁজতে

বাবা ভাঙা গলায় বনি, বিনি, ডাকতে ডাকতে ভিড়ের ভেতর মিশে গেলেন। তখনও অঝোরে কেঁদে চলেছেন। আশীষ কী করবে বুঝতে না পেরে গম্ভীর হয়ে সিঁড়ি ওপর বসেছিলো।

মেলার আরেক প্রান্তে বিনি তখন কিছুতেই বনির কান্না থামাতে পারছিলো না। বার বা বলছিলো, ছিঃ ভাইয়া, কাঁদে না। সবাই তোমাকে ছিঃ বলবে। বাবা মা এক্ষুণি এতে যাবেন। কিছুতেই বনির কান্না থামানো যাচ্ছিলো না। ঠিক সেই সময় দাড়িওয়ালা আচকা পরা এক লোক মোলায়েম গলায় এসে ওদের প্রশ্ন করলো–তোমরা বিনি আর বনি না?

বিনি ব্যস্ত গলায় বললো, হ্যাঁ, কেন?

তোমাদের বাবা মা তথ্য কেন্দ্রে বসে আছেন। মাইকে তোমাদের নাম ধরে ডাব হচ্ছে, শোন নি?

চারপাশে যে হারে মাইকে হিন্দি সিনেমার গান বাজছিলো–তথ্য কেন্দ্রের মাইকে শব্দ এদিকে শোনা যাচ্ছিলো না। বনি কান্না থামিয়ে উদ্গ্রীব হয়ে জানতে চাইলে কোথায় তথ্য কেন্দ্র?

আমার সঙ্গে এসো। বলে হাত বাড়িয়ে দিলো দাড়িওয়ালা লোকটা।

বনি লোকটার হাত চেপে ধরলো। বিনি শক্ত ভাবে ধরে রাখলো বনির আরেক হাত ভিড় ঠেলে বেশ কিছু দূর যাওয়ার পর বনি প্রশ্ন করলো, তথ্য কেন্দ্র আর কত দূরে?

এই তো এসে গেছি। বলে আরও কিছুটা পথ এগিয়ে গেলো ওরা। এদিকটা ভিড় কম। বাইরে শেরে বাংলা নগরের ফাঁকা রাস্তা। লোকটা আবার বললো, এই গেট পার হলেই তথ্য কেন্দ্র।

বিনির কেমন যেন মনে হচ্ছিলো। যতক্ষণ ভিড়ের ভেতর ছিলো ততক্ষণ ওর ভ কম ছিলো। ফাঁকা জায়গায় এসে ভয় বেড়ে গেলো। বললো, আপনি ঠিক চেনেন তে . তথ্য কেন্দ্র কোথায়?

কেন চিনবো না? লোকটা নরম গলায় বললো, আমি নিজেই তো তথ্য কেন্দ্রে কাজ করি। তোমাদের খোঁজার জন্য আমাদের লোকজন সব বেরিয়ে পড়েছে।

লোকটা বনির হাত ধরে গেট-এর বাইরে এসে দাঁড়াতেই একটা সাদা মাইক্রোবাস ধাঁ করে ওদের পাশে থামলো। ঝট করে দরজা খুলে গেলো। বিকট দর্শন দুটো লোক ভেতর থেকে নেমে এসে বনি আর বিনির পেছনে দাঁড়িয়ে পিঠে ছুরি ঠেকালো–একদম চুপ! কথা কইলে দুই টুকরা কইরা ফালামু!

দাড়িওয়ালা লোকটা ওদের কোলে করে গাড়িতে তুলে দিলো। গুন্ডা দুটো ওদের পেছন পেছন গাড়িতে উঠে দরজা বন্ধ করলো। ভয়ে বনি বিনির গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। গাড়ি যখন স্পিড় নিয়েছে তখনই পেছন থেকে কে যেন বনি বিনির নাকে ভেজা রুমাল চেপে ধরলো। একটু পরেই ওরা জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লো গাড়ির সিটের ওপর। দাড়িওয়ালা খিক খিক করে হেসে গুন্ডা দুটোকে বললো, মাহমুদ হারামিটা এবার টের পাবে হুজুরের বিরুদ্ধে কথা বলার মজাটা।

সাদা মাইক্রোবাসটা তখন বনি বিনিকে নিয়ে ঘন্টায় সত্তর মাইল স্পিডে ছুটে চলেছে জয়দেবপুরের দিকে।

দাড়িওয়ালা যে লোকটা বনি বিনিকে মিথ্যে কথা বলে গুন্ডাদের হাতে তুলে দিয়েছে ওর নাম আবদুল মালেক। একাত্তর সালে সে ছিলো আলবদরের খুনী। ওদের কাজ ছিলো মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগে দেশের বড় বড় লেখক, শিল্পী, সাংবাদিক, অধ্যাপক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার আর সব জ্ঞানী গুণী মানুষদের বাড়ি থেকে ধরে এনে মেরে ফেলা। আবদুল মালেক নিজের হাতে পনেরো জন নামকরা মানুষকে খুন করেছে। যুদ্ধের পর কয়েক বছর পালিয়েছিলো গ্রামের বাড়িতে। তারপর যেই শুনলো বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলা হয়েছে, নতুন প্রেসিডেন্ট এসে বলেছেন ওরা দল করতে পারবে তখন আবদুল মালেক ঢাকা চলে এসেছে।

ওদের দলে তখন নতুন নতুন লোক নিচ্ছিলো। পুরোনো যারা একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের খুন করেছিলো দলের ভেতর তাদের বড় বড় পদ দেয়া হলো। মোটা বেতন, বাড়ি গাড়ি সব দেয়া হলো। ওরা নতুনদের তৈরি করতে লাগলো–যারা ওদের বিরুদ্ধে কথা বলবে তাদের কীভাবে জবাই করবে, কীভাবে হাত আর পায়ের রগ কাটবে, যাতে কোনো দিন চলাফেরার ক্ষমতা না থাকে। সৌদি আরব থেকে ওদের দলের জন্য কোটি কোটি টাকা পাঠানো হয়। আরব দেশগুলোর সঙ্গে অনেক রকম ব্যবসা আছে ওদের। এসব টাকায় দামী দামী অস্ত্র কিনে, নতুন ছেলেদের ট্রেনিং দিয়ে চট্টগ্রাম আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরীহ ছাত্রদের জবাই করে ভালোই দিন কাটাচ্ছিলো ওরা। মাঝখান থেকে এক ঝামেলা শুরু করেছে কোনো এক শহীদের মা!

জাহানারা ইমাম যখন নির্মূল কমিটি গঠন করে বললেন, একাত্তরের খুনীদের বিচার করতে হবে, তখনই দেশ সুদ্দো মানুষ তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। আবদুল মালেক আর ওর দলের নেতারা ভীষণ ভয় পেয়ে গেলো। ওরা সবাই একাত্তরে হাজার হাজার খুন করেছে। পাকিস্তানী সৈন্যরা মুক্তিযুদ্ধের সময় যে তিরিশ লাখ মানুষকে মেরেছিলো, তাদের চিনিয়ে দিয়েছিলো আবদুল মালেকের দলের লোকেরাই। এখন যদি বিচার শুরু হয় ওদের কেউ রেহাই পাবে না। তাই ওরা ঠিক করেছে জাহানারা ইমামের সঙ্গে যারা থাকবে তাদের শায়েস্তা করতে হবে। ওদের লোক পুলিসের ভেতর রয়েছে, আর্মির ভেতরও রয়েছে। বড় বড় সরকারী চাকুরেও ওদের কম নয়। জাহানারা ইমামের সঙ্গে যারা আছে তাদের যেভাবে পারছে সেভাবেই শায়েস্তা করছে আবদুল মালেকের দল।

বনি বিনির বাবা মাহমুদ হোসেন একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। জাহানারা ইমামের যে ছেলে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন সেই রুমীর সঙ্গে দু নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন। এখন ব্যবসা করেন। জাহানারা ইমাম তাঁকে বলেছেন নির্মূল কমিটিতে কাজ করার জন্য। দু বছর ধরে তিনি তাই করছেন। তাঁকে কীভাবে শায়েস্তা করা যায় এ নিয়ে আবদুল মালেকের দল অনেকে ভেবেছে। ওদের নেতা বলে দিয়েছে, যার দুর্বলতা যেখানে, তাকে সেখানে আঘাত করতে।

অনেক খোঁজ খবর নিয়ে আবদুল মালেকরা জানতে পেরেছে মাহমুদ হোসেনের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে তার ছেলেমেয়ে দুটো। তাই ওরা ঠিক করেছে এ দুটোকে চুরি করে সৌদি আরবে পাচার করে দেবে। আজকাল সেখানে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের খুব চাহিদা। আরব শেখরা এক ধরনের উটের দৌড় উপভোগ করে। উটের দৌড়ের জন্য ওদের ছোট ছোট ছেলেমেয়ে দরকার। অনেক দাম দিয়ে শেখদের দালালরা গরিব দেশগুলো থেকে মানুষের বাচ্চা কেনে। বনির মতো ফুটফুট ছেলে দেখলে লুফে নেবে উটের দৌড়ের দালালরা। বিনিকে অন্য কাজে লাগাবে।

বনি বিনিকে চুরি করার জন্য অনেক দিন ধরে তক্কে তক্কে ছিলে আবদুল মালেক। বনির বাবা মা ধারণাও করতে পারবেন না কিছুদিন ধরে যে নুলো ফকিরটা ওঁদের বাড়ির উল্টো দিকের রাস্তায় বসে ভিক্ষে করে সে আসলে মালেকদের দলের লোক। গত মাসে বনিদের গাড়ির পুরানো ড্রাইভারকে অনেক বেশি বেতন দিয়ে নিয়ে গেছে মালেকদের দলের এক নেতা। নতুন যে ড্রাইভারটা এসেছে সেও ওদের দলের লোক। এখন ওরা রান্নার বাবুর্চিকে বাগাবার তালে আছে। বনির বাবাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে বলে বুড়োকে এখনও পটানো যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে টাকার পরিমাণটা আরও বাড়াতে হবে। নিজের পরিকল্পনায় নিজেই মুগ্ধ হয়ে হা হা করে হাসলো আবদুল মালেক।