১-২. জঘন্য আবহাওয়া, দারুণ চমক

রাজপ্রাসাদে ষড়যন্ত্র – কিশোর উপন্যাস – শাহরিয়ার কবির

০১. জঘন্য আবহাওয়া, দারুণ চমক

রোজকার মতো জনির আগেই স্কুল থেকে বাড়ি ফিরলো রিনি। ঘড়িতে তখন কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে চারটা। রিনি পড়ে লন্ডনের নামকরা গ্রামার স্কুল হেনরিয়েটা বার্নেটে। স্কুল ছুটির পর গোল্ডার্স গ্রীন থেকে একবার বাস বদলিয়ে উডগ্রীন আসতে এক ঘন্টা লাগে। জনিদের ভ্যালেন্টাইন স্কুল অত দূরে নয়। তবু জনির ফিরতে ফিরতে পাঁচটা সাড়ে পাঁচটা বাজবেই। নাকি ক্লাসের ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেন হয়েছে ও। হবে না কেন! চৌদ্দ বছর পুরো না হতেই শক্ত সমর্থ গড়নের জন্য জনিকে মনে হয় ষোল সতেরো বছরের মতো। লম্বায় ওর বাবাকেও ছাড়িয়ে গেছে। এখনই পাঁচ আট, গেম টিচার বলেছেন ও আরো লম্বা হবে।

জনির দু বছরের বড় রিনি। মার মতোই ছোটখাট গড়নের সুন্দর হয়েছে দেখতে। মা অবশ্য বলেন ও নাকি মার চেয়েও বেশি সুন্দর হবে। মার বয়স আটত্রিশ হতে চললো, অথচ দেখে মনে হয় তিরিশ পুরো হয়নি। আজকাল মার সঙ্গে ও বাঙালী বা ইন্ডিয়ান কারো দোকানে গেলে প্রায়ই মাকে শুনতে হয় আপনার ছোট বোন বুঝি! দোকানের লোকদের দোষ কি, মা আর ও দুজনেই পাঁচ দুই। ওদের বাবাকে বরং বয়সের চেয়ে বেশি বড় মনে হয়। সামনের ফেব্রুয়ারিতে বাবার বয়স হবে বেয়াল্লিশ, অথচ দেখলে মনে হয় পঁয়তাল্লিশের ওপরে। হে মার্কেটের এক ডিপার্টমেন্ট শপের ম্যানেজার হচ্ছেন বাবা। সকাল আটটায় বাড়ি থেকে বেরোন ফেরেন রাত নটায়। মা কাজ করেন এক কনস্ট্রাকশন ফার্মের ডিজাইন সেকশনে। অফিসে যান দশটার দিকে, ফেরেন সাতটা সাড়ে সাতটা নাগাদ।

রিনি জনি যখন স্কুল থেকে ফেরে তখন বাবা মা কেউ বাড়িতে থাকেন না। ওদের দুজনের কাছে দুটো আলাদা চাবি আছে। যাতে কখনো জনি আগে ফিরলে ওর অসুবিধে না হয়। অবশ্য আজ পর্যন্ত চাবিটা ওর কাজে লাগে নি। কে জানে ওর কাছে ওটা আদৌ আছে কিনা!

স্কুল থেকে ফিরে সবার আগে রুটিন মতো লেটার বক্সটা খুললো রিনি। চিঠি দেখলো, বাবার নামে তিনটা, দুটো মার নামে। ওদের ভাই বোনের নামে কোনো চিঠি আসে নি। চার বছর আগে ওরা যখন প্রথম লন্ডন এলো তখন রোজই ঢাকার বন্ধুদের কারো না কারো চিঠি পেতো। কমতে কমতে এখন সপ্তায় এক আধটায় এসে দাঁড়িয়েছে। ওরাও লেখা কমিয়ে দিয়েছে। জনির অবশ্য লেখার অভ্যাস কখনোই ছিলো না। বন্ধুদের দুতিন পাতার চিঠির জবাবে একটা কার্ড পাঠিয়ে দায় সারতো। কিন্তু রিনি জনির মতো নয়। ও যত্ন করে বন্ধুদের চিঠির জবাব দিতো। তবে বন্ধুরা না লিখলে ও কি করবে! গায়ে পড়ে বন্ধুত্ব করার স্বভাব ওর নয়।

মা বাবার চিঠিগুলো ওদের শোয়ার ঘরে লেখার টেবিলে গুছিয়ে রাখলো রিনি। নিজের ঘরে এসে ব্যাগটা জায়গামতো রেখে স্কুল ড্রেস বদলালো। তারপর ও ডাইনিং রুমে এসে রিফ্রিজারেটর থেকে ফুট সালাদের বড় বাটিটা বের করলো। সকালে বেরোবার আগে মা ওদের জন্য একটা কিছু বানিয়ে রেখে যান।

একমুঠো চিজলিং আর এক বাটি সালাদ দিয়ে রাতের খাওয়া সারলো রিনি। খাওয়ার ব্যাপারে দারুণ হিসেবী ও। চার্ট দেখে ক্যালোরি হিসেব করে নিজের ডায়েট ঠিক করে নিয়েছে। সপ্তায় একদিন মাছ আর একদিন মাংশ খাবে, বাকি পাঁচদিন ফল আর সবজি। এত হিসেব করে না খেলে অমন সুন্দর ফিগার আর মাখনের মতো মোলায়েম চামড়া হতো না। জনি এ ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ও যেভাবে চকলেট, মাখন আর পনির খায় রিনি ভয়ে শিউরে ওঠে।

খাওয়া শেষ করে প্লেট আর বাটি ধুয়ে মুছে কাবার্ডে রেখে রিনি ড্রইংরুমে এসে টেলিভিশন অন করে টুডে পত্রিকাটি হাতে নিয়ে বসলো। খবরের কাগজের পাতা ওল্টালে প্রতি দিন কত রোমাঞ্চকর ঘটনা, কত চাঞ্চল্যকর কাহিনী যে চোখে পড়ে, তার কোনো হিসেব কেউ করে নি। চ্যানেল ফোরে তখন বাংলা ছবি দেখাচ্ছে। বাংলা দেখে নড়েচড়ে বসলো রিনি। সত্যজিৎ রায়ের গণশত্রু। শেষ হতে আর বেশি দেরি নেই। মা শুনলে ভারি দুঃখ পাবেন।

ছবিটা শেষ পর্যন্ত দেখলো রিনি। মার মতো ওরও বাংলা ছবি ভালো লাগে। অথচ জনি পছন্দ করে সায়েন্স ফিকশন আর হরর মুভি। জনির পাল্লায় পড়ে দুএকটা ভয়ের ছবি দেখেছিলো রিনি। ভয়ের চেয়ে ওর অস্বস্তি লেগেছে বেশি। কি সব গা ঘিনঘিনে দৃশ্য–পেটের ভেতর থেকে নাড়িভূড়ি বেরিয়ে সাপের মতো কিলবিল করে ঘুরে বেড়াচ্ছে, মানুষের গায়ের চামড়া ফেটে পোকা বেরোচ্ছে, চেহারা বদলে যাচ্ছে। বিভৎসভাবে–দেখাই যায় না। অথচ জনি এসব উদ্ভট ছবি আর যত আজগুবি বই গ্রোগ্রাসে গেলে।

পাঁচটা পঁচিশ মিনিটে ডোর বেল বাজলো। অস্থিরতা দেকে রিনির বুঝতে অসুবিধে হলো না–জনি এসেছে। দরজা খুলতেই হাই আপু, কখন এলি? বলে জনি ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকে রোজকার মতো ওর ব্যাগটা ছুঁড়ে দিলো সোফার এক কোনে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পা থেকে জুতো জোড়া খসিয়ে ছুঁড়ে দিলো ঘরের আরেক কোণে। রিনি বাইরের দরজা বন্ধ করে আসতে আসতে জনি খাবার ঘর থেকে অরেঞ্জ জুস-এর একটা প্যাকেট এনে টেলিভিশনের চ্যানেল ঘোরানো শুরু করেছে সারাক্ষণ তুই চ্যানেল ফোর নিয়ে বসে থাকিস আপু। আউটডেটেড সব ইন্ডিয়ান মুভিগুলো দেখে তুই আর আম্মু যে কি মজা পাস বুঝি না। এই দ্যাখ, চ্যানেল নাইনে ওমেন-এর ফোর্থ পার্ট দেখাবে।

নিশ্চয় হরর মুভি? নিজের জায়গায় বসতে বসতে জানতে চাইলো রিনি।

হরর তো বটেই। তুই ওমেন-এর আগের পার্টগুলো দেখিস নি? অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো জনি।

না দেখি নি।

তুই কি রে আপু! হতাশ হয়ে জনি বললো, এত হইচই হচ্ছে যে ছবিটা নিয়ে তুই একটাও দেখিস নি?

তুই তো জানিস জনি, হরর মুভি দেখতে ঘেন্না লাগে আমার। আরে না। এটা এক্সরসিস্ট-এর মতো নয়। তোর খারাপ লেগেছিলো নাইটমেয়ার অন এম স্ট্রিট। এটা একেবারে অন্যরকম। একটা ছোট্ট বাচ্চাকে এভিল পাওয়ার পসেস করেছে। ভয়ানক সব কাণ্ড ঘটাচ্ছে বাচ্চা আর ওর কুকুরটা। দারুণ ছবি আপু, দ্যাখ না মজা লাগবে।

না দেখে রিনির উপায়ও নেই। জনি ওর পছন্দের ছবিই দেখবে। অথচ চ্যানেল ফোর-এ লোনলিনেস-এর ওপর সুন্দর একটা ম্যাগাজিন প্রোগ্রাম হবে এখন। বললো, এসব উদ্ভট আর গাঁজাখুরি ছবিতে তুই কি মজা পাস বুঝি না জনি। দেশে থাকতে তুই এমন ছিলি না।

দেশে ছবি দেখার সময়ই বা পেতাম কখন? কত জায়গা ছিলো যাবার। অথচ এখানে লাইফ কি রকম ডাল আর বোরিং! স্কুল আর বাসা ছাড়া কোথাও যাবার জায়গা নেই। ক্রিসমাস এসে গেলো, অথচ কি একটা জঘন্য ওয়েদার। পিতপিতে বৃষ্টি হচ্ছে, ঠাণ্ডা বাতাস, নোংরা কাদামাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করে।

ভয়ের ছবি দেখার উপযুক্ত পরিবেশ তাহলে এটা?

কি করবো বল! এই জঘন্য ওয়েদারে বেরোলে মনটাও খারাপ হয়ে যায়। আজ সকাল থেকে কিরকম চিন্ড বাতাস বইছে টের পাচ্ছিস না?

তারপরও তো দেরি করে ফিরলি।

দেরি কোথায় করলাম? কাল তো সাড়ে ছটায় ফিরেছি।

ইচ্ছে করলে চারটায়ও ফেরা যায়।

যায় বললেই কি যায়! আমি কি তোর মতো গুড গার্ল নাকি যে, ছুটির বেল বাজলো আর অমনি বাসে চেপে বসলাম, আর ঘরে বসে বোর হলাম!

ঠিক আছে নটি বয়। এখন তো শুধু অরেঞ্জ জুস খেলে চলবে না। কি খাবি বল?

লক্ষ্মী আপু, আমাকে দুটো বিফ বার্গার দে না টমেটো আর ক্যাবেজ দিয়ে। সঙ্গে দুটো এগ ফ্রাইও দিতে পারিস।

জ্যাকেট পোট্যাটো বাদ দিচ্ছিস কেন?

দিতে চাস? দে তাহলে। তুই যা দিবি তাই খাবো।

মদু হেসে রিনি ওর ভাইয়ের জন্য খাবার তৈরী করতে গেলো। দুবছরের এই ছোট ভাইটাই হচ্ছে ওর সবচেয়ে কাছের বন্ধু। কবছর আগেও বলতো, আপু, তুই আমি কেউ বিয়ে করবো না। বড় হয়ে আমরা এক সঙ্গে থাকবো। লন্ডনে আসার পর অবশ্য দুজনের আলাদা ঘর হয়েছে। ঢাকায় থাকতে ওরা এক ঘরে ঘুমোতে।

জনির খাবার তৈরি করে রিনি ড্রইংরুমে নিয়ে গেলো। ও জানে হাজার ডাকলেও ছবি দেখা থেকে উঠে ডাইনিং রুমে আসবে না জনি।

ছবি দেখতে দেখতেই ও খেলো। রিনি কিছুক্ষণ ছবি দেখে মজা না পেয়ে কসমোপলিটান পত্রিকাটা খুলে বসলো। বাইরে যে কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে, সেন্ট্রাল হিটিং সিস্টেমওয়ালা বাড়িতে বসে টের পাওয়ার কোনো উপায় নেই। আটটার দিকে জনির ছবি শেষ হলো, রিনি তখন ডাক্তার নার্স নিয়ে প্রেমের গল্পটার মাঝখানে এসে পৌঁছেছে।

হরর ছবি শেষ হওয়ার পর টেলিভিশনে শুরু হলো পুরোনো দিনের এক ডকুমেন্টারি। দুর ছাই, বলে জনি একের পর এক নব ঘোরালো। পছন্দ মতো কোনো অনুষ্ঠান না পেয়ে ভিডিও গেম নিয়ে বসলো। একটা চোরকে প্রথমে তিনটা পুলিস তাড়া করে। যে খেলে তাকে চোর হতে হয়। পালাবার যত ফন্দি চোর বের করতে পারবে পয়েন্ট তত বাড়বে। প্রথম ধাপ জিতলে পরে ধাপে চারটা পুলিসের পাল্লায় পড়তে হবে চোরকে। এটা জিতলে পাঁচটা পুলিস–এভাবে পুলিসের সংখ্যা বাড়তে থাকে আর চোরেরও পালাবার পথ কমতে থাকে। জনি ছয় পুলিস পর্যন্ত খেলতে পারে। ওর ক্লাসের ছেলেরা পাঁচের ওপর যেতে পারে নি। ছয় পুলিসে ওর স্কোর এখন ছেচল্লিশ হাজার। আর চারটা ফন্দি বের করে পালাতে পারলে পঞ্চাশ হাজার পুরো হবে। এরপর পড়তে হবে সাত পুলিসের পাল্লায়।

পঁয়ত্রিশ মিনিট গভীর মনোযোগের সঙ্গে খেলে ঊনপঞ্চাশ হাজার করার পরই জনি ধরা পড়ে গেলো পুলিসের হাতে। জলতরঙ্গের শব্দের সঙ্গে স্ক্রিনে বড় বড় করে লেখা উঠলো–কনগ্রাচুলেশন, তুমি জনির আগের রেকর্ড ভেঙে ঊনপঞ্চাশ হাজার করেছে। এটাই সর্বোচ্চ স্কোর। আবার চেষ্টা করো। খেলা শেষ।

হতাশ হয়ে গেম বন্ধ করে জনি আবার টেলিভিশনের চ্যানেল ঘোরালো। কোথাও জাজ, কোথাও আলোচনা, কোথাও রান্না শেখানো হচ্ছে। জনির পছন্দের প্রোগ্রাম একটাও নয়। বিরক্ত হয়ে বললো, আপু দুটো টাকা দে না, ছবি আনি।

দু টাকা মানে দুপাউন্ড। দেশের হিসেবে অনেক টাকা। জনিরা পাউন্ডকে টাকাই বলে। রিনি বললো, একটু আগেই বললি জঘন্য ওয়েদার। এর ভেতর দশ মিনিট তুই হাঁটবি ছবি আনার জন্য?

কি করবো বল! ছবি দেখা ছাড়া সময় কাটানোর কি আছে আমাদের। গত উইন্টারেও আম্মু আব্দুকে বললাম দেশে চলো। না, এত টাকা খরচ করা যাবে না। দুজনে মিলে টাকা জমাচ্ছে আর সামার, ক্রিসমাসের হলিডেগুলো আমাদের ঘরের মধ্যে বসে ঝিমোতে হবে।

রিনি একটু হেসে বললো, আম্বু আম্মু টাকা জমাচ্ছে তো আমাদের জন্যে। আমাদের আর বলি কেন। আমাকে বিয়ে দিয়ে বিদেয় করে সব তো তুইই পাবি!

তোর ভারি বিয়ের শখ দেখছি! কে তোকে বিয়ে দিতে যাচ্ছে? ওসব বিয়ে টিয়ে হবে না। এখন দুটো টাকা বের কর।

প্রতি সপ্তায় ওরা হাত খরচের জন্য বারো পাউন্ড করে পায়। জনির ওতে তিন দিনও যায় না, কিন্তু রিনির প্রায় টুরোটাই জমা থাকে। চার দিনের মাথায় অবধারিতভাবে জনি ওর কাছে ধার চাইবে। বলবে লিখে রাখতে, চাকরি করে সব শোধ করে দেবে। জনিকে টাকা ধার দিতে রিনির কোনো আপত্তি নেই, ও শুধু লক্ষ্য করে টাকাটা খরচ হচ্ছে কিভাবে।

জনি আবার তাড়া লাগালো, কি হলো আপু, টাকাটা দে না। সাড়ে আটটায় আবার দোকান বন্ধ হয়ে যাবে।

রিনি উঠে ওর ঘরে গিয়ে দুপাউন্ডের দুটো কয়েন এনে জনিকে দিলো। বাইরে তখন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। সঙ্গে বইছে হাড় ফুটো করা ঠাণ্ডা ঝড়ো হাওয়া। জনি রেইনকোট, গামবুট পরে বেরিয়ে পড়লো।

টেম্পারেচার যেভাবে নামছে আর কদিনের ভেতর বরফ পড়বে। মাইনাসে গেলে কাদার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে, নইলে এই জঘন্য কাদা পানি মাড়িয়ে হাঁটতে গেলে গা শিউরে ওঠে।

শপিং মল-এর কাছে ইন্ডিয়ানদের এক গ্ৰোশারি শপ-এ সস্তায় ক্যাসেট ভাড়া পাওয়া যায়। এনে তিন চারদিন রাখাও যায়। মল-এর ভেতরে যেসব ভিডিও ক্লাব আছে সেখানে ভাড়া বেশি। জনি সব সময় ইন্ডিয়ানদের দোকান থেকে ক্যাসেট নেয়। দোকানের ভেতর ঢুকতেই হাসিখুশি শিখ যুবক বললো, বোলিয়ে বাবুজি।

নতুন কোনো হরর মুভি এসেছে? অন্য কিছুতে আগ্রহ নেই জনির।

ইধার দেখিয়ে। ইয়ে সব বিলকুল নয়া হ্যায়।

নতুন ক্যাসেটের জ্যাকেটগুলো দেখে পে সিমিট্রি আর হ্যালোয়িন থ্রি পছন্দ হলো জনির। দুপাউন্ডে দুটো ক্যাসেট নিয়ে একরকম দৌড়ে ঘরে ফিরলো জনি।

রিনি তখন রান্নাঘরে ওদের বাবা মার জন্য খাবার গরম করছিলো। মাকে অবাক করে দেয়ার জন্যও কখনো ও নতুন একটা ভাজি না হয় ভর্তা করে রাখে। রাতে ওঁরা ভাত খান। রিনির এই অবাক করা কাজ দুজনেই পছন্দ করেন। কিছুদিন আগে পূরবী আন্টির কাছে ও শিখেছিলো ডিম আর বেগুন দিয়ে চমৎকার দোপেয়াজি রান্না। অন্য কিছু না করে সেটাই বানালো রিনি। চোখে দেখলো দারুণ হয়েছে।

জনি ঘরে ঢোকার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বাবা মাও ফিরলেন কাজ থেকে। বাবা ওঁর টুপি, ওভারকোট, ছাতা সব সিঁড়ির নিচের হ্যাঁঙ্গারে ঝোলাতে ঝোলাতে বললেন, জনি কোথায় গিয়েছিলি? পুলিস তাড়া করেছিলো নাকি!

কি যে বলো আব্দু। জনি মনক্ষুণ্ণ হলো–পুলিস কেন আমাকে তাড়া করতে যাবে? ক্যাসেট আনতে গিয়েছিলাম। তাড়াতাড়ি ঘরে ফেরার জন্য দৌড়ে এসেছি।

তাও ভালো। পুলিস না হোক স্কিনহেড তো তাড়া করতে পারতো।

তা পারতো। সায় জানালো জনি–তবে কাছে এসে আমার স্বাস্থ্য দেখলে গুণ্ডাগুলো কিছু করার আগে দুবার ভাবতো।

খাবার ঘর থেকে রিনি গলা তুলে ডাকলো–আব্ব, আম্মু খেতে এসো। সব ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।

বাব মার খাওয়ার সময় রিনি পাশে থাকে। জনি তখন টেলিভিশনে বিভোর। ঘরে ফিরে ও দেরি না করে পেট সিমিট্রি চালিয়ে দিয়েছে। রিনি ওর বাবাকে বললো, জনির মন ভালো নয়। এবারও শীতের বন্ধে কোথাও যেতে পারবে না।

বাবা খেতে খেতে একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, যাওয়া মানে তো বাংলাদেশে। তোমাদের তো বলেছি নাইন্টি টুর আগে যাওয়া হবে না। দুটো বছর অপেক্ষা করতেই হবে।

মা বললেন, কাছাকাছি বন্ধুদের কারো ওখান থেকে ঘুরে আসুক না কদিন!

ওর সেরকম বন্ধু কোথায়? রিনি বললো, এমনিতে ক্লাসের বন্ধু যারা লন্ডনে থাকে সবাই ক্রিসমাসে ট্রপিক্যাল কান্ট্রিতে যাবে।

দুবছর এমন কিছু বেশি সময় নয়। চার বছর তো কেটেই গেছে। দু বছরও দেখতে দেখতে চলে যাবে।

কথাটা বলার সময় রিনির বাবার খুবই খারাপ লাগছিলো। অথচ করারও কিছু ছিলো না। সবাই মিলে বাংলাদেশে যেতে হবে কম করেও ছয় সাত হাজার পাউন্ড লাগবে। খরচ তো খালি যাওয়া আসার টিকেট নয়। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব অনেক আছে। প্রত্যেকে আশা করবে তার জন্য কি আনা হলো। এত টাকা এখন তরফদার দম্পতির হাতে নেই। বাবার অবস্থা রিনি বোঝে। এ নিয়ে আর কথা বাড়ালো না। বাবা মার খাওয়া শেষ হলে থালা বাটিগুলো ও নিজেই ধুয়ে মুছে রাখলো রোজকার মতো।

বাবাকে ড্রইংরুমে দেখে জনি খুবই অনিচ্ছার সঙ্গে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কি এখন নিউজ দেখতে চাও আব্দু?

তুমি যদি দয়া করে দেখতে দাও। মৃদু হেসে বললেন জনির বাবা।

ঠিক আছে। ছবি দেখা বন্ধ করে জনি বললো, শুধু খবর, কমেন্টস দেখা চলবে না।

ঠিক এমন সময় পাশের ঘর থেকে মা বাবাকে ডেকে বললেন, শুনেছো, ভাইয়ার চিঠি এসেছে ওয়ারস থেকে।

মনু মামা কি লিখেছে? জানতে চাইলো জনি।

রিনি জনির মামা একজনই। বছর পাঁচেক আগে পোল্যান্ড এসেছেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হয়ে। রিনিরা লন্ডন আসার পর থেকে প্রত্যেক সামারে ওদের চিঠি লেখেন

ওয়ারস থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার জন্য। পোল্যান্ডে গণ্ডগোলের কথা বলে ওদের বাবা রাজী হন নি।

এবার লিখেছেন, চার বছরে আমরা দুবার তোদের ওখানে বেড়াতে গেলাম, আর তোরা একবারও এলি না। রিনি জনির ভালো লাগার অনেক কিছু আছে এখানে। সারা পৃথিবী থেকে ট্যুরিস্ট আসছে ঝাঁকে ঝাঁকে, অথচ তোরা আসতে চাস না। শেষবারের মতো বলছি, একবার ঘুরে যা আমি থাকতে থাকতে। জানুয়ারীর পর আমি আর এদেশে থাকছি না। এবার যদি না আসিস তাহলে এ জন্মে আর তোদের পোল্যান্ড দেখা হবে না। এখন কোনো গোলমালও নেই। নিজেদের যদি এতই অসুবিধে, ছেলেমেয়ে দুটোকে পাঠিয়ে দিলেও তো হয়। কবে আসবি জানালে বাধিত হব।

মার চিঠি পড়া শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জনির চোখ দুটো উত্তেজনায় চকচক করে উঠলো বাবা কি বলেন শোনার জন্য কান খাড়া করলো। টেলিভিশনে তখনো খবর শুরু হয় নি। বাবা বললেন, রিনি জনি যদি একা যেতে পারে যাক! কাজ ফেলে আমাদের কি যাওয়া সম্ভব!

মা বললেন, আমিও ছুটি পাবো না। ভাইয়া থাকতে থাকতে ওরা বরং ঘুরে আসুক। ছ দিন পরই তো বড়দিনের ছুটি শুরু হচ্ছে।

রিনি ওর ভাইকে বললো, কি জনি, এবার খুশি তো! তখন তো ঘ্যানঘ্যান করছিলি কোথাও যাওয়া হচ্ছে না বলে।

ইয়াহু, বলে চিৎকার করে আনন্দে আত্মহারা জনি দুহাত ওপরে তুলে এক পাক নাচলো। গত বছর ও স্কুলে পোল্যান্ডের ওপর একটা ডকুমেন্টারি ছবি দেখেছিলো। বার্চ, লাইম আর ওক গাছের বনগুলো হেমন্তের শেষে রঙে রঙে আলো হয়ে যায়। বনের ভেতর গভীব নীল হ্রদ, চারদিকে পাইন আর ফার গাছে ঢাকা পর্বত-এক কথায় সব কিছু স্বপ্নের মতো মনে হয়েছিলো জনির।

বাবা বললেন, এত যে লাফাচ্ছো, একা এতটা পথ যেতে পারবে তো?

বলো কি আব্ব! বাবার কথা শুনে অবাক হয়ে জনি বললো, ঢাকা থেকে তোমাকে ছাড়া আমরা লন্ডন আসতে পারলাম আর এই দেড় দু ঘন্টার পথ একা যেতে পারবো না?

তখন তো তোমাদের আম্মু সঙ্গে ছিলো!

আম্মুরও তো প্রথম দেশের বাইরে আসা! তাছাড়া তখন আমাদের বয়সও অনেক কম ছিলো। তবু তো মস্কো এয়ারপোর্টে দুরাত কাটিয়ে ঠিকই এসেছিলাম।

তুমি একটুও ভেবো না আব্দু।

বাবা মৃদু হেসে বললেন, আমি তাহলে কাল টিকেট করে তোমাদের মামাকে ফোনে জানিয়ে দিচ্ছি কখন যাচ্ছো।

মা বললেন, এত আগে টিকেট কাটার কি দরকার?

আগে কাটলে ডিসকাউন্টের সুযোগ থাকে। জানোই তো পকেটের অবস্থা।

রিনি ওর বাবার পাশে বসেছিলো। বললো, আব্দু, আমার ব্যাঙ্কে কিছু টাকা জমানো আছে। তোমার দরকার হলে নিতে পারো।

বাবা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, তোমার টাকা দিয়ে বরং ওদের জন্য কিছু উপহার কিনে নিয়ে যেও।

জনি বললো, আপু, আমাকে একটা জ্যাকেট কিনে দিবি? ব্লুমিংডেল-এ বিরাট সেল দিচ্ছে। পছন্দ করে এসেছি একটা।

রিনি হেসে বললো, ঠিক আছে জনি।

জনি আর রিনির জন্য গর্ব অনুভব করলেন ওদের বাবা মা। ঠিক এমনই চমৎকার দুটি সন্তান চেয়েছিলেন ওঁরা।

.

০২. আকাশপথে রহস্যময় চিত্রকর

জীবনে প্রথম ওরা বড়দের বাদ দিয়ে অন্য দেশে যাচ্ছে, এ নিয়ে রিনি জনি দুজনেই যথেষ্ট উত্তেজিত ছিলো। ছটা দিন কিভাবে যে কেটে গেলো ওরা টেরই পেলো না। ধকল অবশ্য বাবাকেই পোহাতে হয়েছে। সস্তায় যদিও বা পোলিশ এয়ার লাইন্স লট-এর টিকেট পাওয়া গেলো, ঝামেলা বেঁধেছিলো ভিসা নিয়ে। চৌদ্দ আর মোল বছরের দুটো ছেলে মেয়ে ট্যুরিস্ট হিসেবে ওয়ারস যাবে–এতে পোলিশ দূতাবাসের ভিসা অফিসার সন্তুষ্ট হতে পারছিলো না। ওয়ারস থেকে মনু মামা লন্ডনে পোলিশ রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে ফোনে কথা বলার পর ভিসা পাওয়া গেলো।

সস্তার টিকেট বলেই সরাসরি কোনো ফ্লাইটে দেয়া হয় নি। লন্ডন থেকে যেতে হবে ফ্র্যাঙ্কফুর্ট, তিন ঘন্টা পর সেখান থেকে ওয়ারস। ওদের ফ্লাইট ছিলো ভোর ছটায়। বাবা মা দুজনই তৈরি হয়ে ওদের সঙ্গে হিথরো এলেন। ছেলে মেয়ে দুটিকে লট-এর প্লেনে তুলে দিয়ে তারা কাজে চলে গেলেন। মা বললেন, রাতে ফোন করবেন।

জানালার কাছে সিট নিয়েছিলো ওরা। জনি বসলো একেবারে জানালা ঘেঁষে, ওর পাশে রিনি, তারপর এক হাসিখুশি সুদর্শন বুড়ো। বুড়ো হলেও রিনির মনে হলো শরীরের খুব যত্ন নেন ভদ্রলোক, বয়সটা ধরা পড়ে মাথাভরা টাকের চারপাশের পাকা চুল আর দাড়িতে। মুখে বয়সের ছাপ তেমন পড়ে নি। ওদের পাশে বসে পাঁচ মিনিট পরেই আলাপ জমালেন–ফ্রাঙ্কফুর্ট যাচ্ছো বুঝি!

রিনি সংক্ষেপে বললো, ওয়ারস।

বুড়োর মুখের হাসি আরও প্রসারিত হলো–আমিও ওয়ারস যাচ্ছি। তোমরা নিশ্চয় ভাইবোন? আমার অনুমান মিথ্যে না হলে তোমরা পাকিস্তানী, নয় ইন্ডিয়ান?

কেউ ওদের পাকিস্তানী বা ইন্ডিয়ান বললে রিনির রাগ হয়। শুকনো গলায় বললো, আমরা ভাইবোন, ঠিকই, তবে আমরা বাংলাদেশের। পাকিস্তানেরও নই, ইন্ডিয়ারও নই।

ভারি খুশি হলাম তোমাদের সহযাত্রী হিসেবে পেয়ে। আমার নাম রবার্ট মারাওস্কি। আদি বাড়ি পোল্যান্ডের ক্র্যাকভে। বর্তমানে বৃটিশ নাগরিক। গত তিরিশ বছর ধরে লন্ডনে আছি।

কেউ পরিচিত হতে চাইলে নিজেদের পরিচয় দিতে হয়, এটা রিনি জানে। বললো, আমার নাম রিনি। আমার ভাইয়ের নাম জনি। আমরা লন্ডনে পড়ি। মামার কাছে বেড়াতে যাচ্ছি।

বুড়ো মারাওস্কি বললেন, নিউইয়র্ক থেকে ছঘন্টা এলাম এক তামাকখোরের সহযাত্রী হয়ে। সারাটা পথ আমাকে জ্বালিয়ে মেরেছে। পনেরো মিনিটে একবার করে এক্সকিউজ মি বলে আমাকে ডিঙিয়ে গেছে স্মোক করতে। একবার টপকাতে গিয়ে আমার কফির কাপ উল্টে দিয়েছে। কি উৎপাত দেখো তো! হিথরোতে নেমে ভয়ে ভয়ে ছিলাম আবার বুঝি ওই পাজীটার পাল্লায় পড়লাম। সত্যি বলছি, তোমাদের সহযাত্রী হিসেবে পেয়ে ভারি খুশি হয়েছি।

জনি একমনে বাইরে তাকিয়ে আকাশে মেঘের পাহাড়ে রোদের খেলা দেখছিলো। বুড়োকে প্রথমে ভালো না লাগলেও ওঁর অমায়িক কথায় রিনির বিরক্তি চলে গেলো। ওর ভয় ছিলো সহযাত্রী যদি কোনো পাঙ্ক বা বদমাশ টাইপের লোক হয়, তাহলে প্লেনে চড়ার সব আনন্দ মাটি হয়ে যাবে। লন্ডনে একা রাস্তায় চলাফেরার সময় স্কিনহেড গুণ্ডা আর পাঙ্কদের কাছ থেকে অনেক দূরে থাকে ও। অকপটেই বললো, আমি আশঙ্কা করছিলাম কোনো অসভ্য স্কিনহেডের সহযাত্রী না হতে হয় আমাকে।

খুক খুক করে একচোট হাসলেন মারাওস্কি। তারপর হাসি নামিয়ে বললেন এখন তো স্কিনহেডদের উৎপাত অনেক কমেছে। সেভেনটিয-এ ওদের জ্বালায় লন্ডন শহরে এশিয়ানদের ঘর থেকে বেরোনো মুশকিল হয়ে পড়েছিলো। তবে আফ্রিকান কালোরা সুযোগ পেলেই ওদের বেদম পিটিয়েছে।

লন্ডনে আপনি কি করেন? সহজ গলায় জানতে চাইলো রিনি।

বলতে ভুলে গেছি–আমি ছবি আঁকি। ওয়ারসতে আমারএকটা গ্যালারি আছে। আমাকে আর্ট ডিলারও বলতে পারো।

আমাদের সৌভাগ্য বলতে হবে, একজন শিল্পীর সহযাত্রী হতে পেরেছি আমরা।

মারাওস্কি কাষ্ঠ হেসে বললেন, আমাকে শিল্পী বলার জন্য ধন্যবাদ, যদিও তুমি আমার ছবি দেখো নি। তবে লন্ডনের অর্ধশিক্ষিত সমালোচকগুলো আমাকে শিল্পী বলে না, শুধু আঁকিয়ে বলে।

রিনি একটু গম্ভীর হয়ে বললো, আপনি মন খারাপ করছেন কেন? আমি অনেক বড় বড় শিল্পীর কথা পড়েছি, যারা বেঁচে থাকতে শিল্পী হিসেবে স্বীকৃতি পাননি।

খুশি হয়ে মারাওস্কি বললেন, তোমার সহানুভূতির জন্য অনেক ধন্যবাদ রিনি। তোমার ঠিকানা দিও আমাকে। লন্ডনে ফিরে এসে তোমাকে আমার একটা ছবি উপহার দেবো!

রিনি বিব্রত গলায় বললো, এ আপনি কি বলছেন! আমি নিশ্চয় আপনার ছবি উপহার পাওয়ার যোগ্য নই।

তোমাকে আমার ভালো লেগেছে রিনি। তোমার মতো আমার একটা মেয়ে ছিলো । আঠারো বছর আগে ও ক্যান্সারে মারা গেছে।

আমি দুঃখিত মিস্টার রবার্ট । আপনার আর কোনো ছেলে মেয়ে নেই?

না রিনি। ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মারাওস্কি বললেন, এ পৃথিবীতে আমি একেবারেই একা।

আমার সমবেদনা গ্রহণ করুন। আপনাকে আমি আমি আঘাত দিতে চাইনি।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে বুড়ো বললেন, রিনি, আমি খুশি হবো, যদি আমাকে আঙ্কল মারাওস্কি বলো আর ফ্র্যাঙ্কফুর্টে যদি আমার সঙ্গে লাঞ্চ করো।

লাঞ্চের আমন্ত্রণের জন্য ধন্যবাদ আঙ্কল মারাওস্কি। তবে আমার মনে হয় লাঞ্চটা এয়ার লাইন্স থেকেই দেয়া হবে।

মুখ টিপে হেসে মারাওস্কি বললেন, শোনো ভালো মেয়ে। ইস্ট ইউরোপের এসব এয়ার লাইন্স থেকেই দেয়া হবে।

রিনি হেসে বললো, ঢাকা থেকে আমরা অ্যারোফ্লোটে এসেছিলাম লন্ডন। ফ্লাইটের কি গন্ডগোল হলো, পুরো দুদিন আমাদের মস্কো এয়ারপোর্টে থাকতে হয়েছিলো। খাবার যা দিয়েছিলো একেবারে অখাদ্য।

তবেই দেখ। অন্য এয়ারলাইন্স হলে তোমাদের ঠিকই ভালো কোনো হোটেলে রাখতো। ছ ঘন্টার বেশি দেরি হলে হোটেল দেয়া নিয়ম। কিন্তু এরা কোনো নিয়ম মানে না।

মনে হয় টিকেটটা সস্তায় দেয় বলেই এসব নিয়ম মানতে চায় না।

ঠিক বলেছো। সায় জানালেন মারাওস্কি। তাহলে ওই কথাই থাকলো রিনি, দুপুরে আমরা একসঙ্গে লাঞ্চ করবো। এই বলে তিনি জনির দিকে তাকালেন–মনে হয় তোমার ভাই খুব লাজুক। আমার সঙ্গে কোনো কথাই বললো না।

মারাওস্কির এ কথাও জনির কানে যায় নি। ও ফিরে তাকালো রিনির কনুইয়ের গুতো খেয়ে–এই জনি, ইনি হচ্ছেন আঙ্কল মারাওস্কি। আমাদের আজ দুপুরে ফ্র্যাঙ্কফুর্টে লাঞ্চে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।

জনি ব্যস্ত হয়ে হাত মিলিয়ে বললো, ধন্যবাদ আঙ্কল মারাওস্কি। তারপর চমক ভাঙতেই রিনিকে বাংলায় জিজ্ঞেস করলো, কেমন আঙ্কলরে আপু? আব্দুর বন্ধু বুঝি?

রিনি বললো, না, এখানেই আলাপ হলো। ছবি আঁকেন। খুব ভালো লোক।

ওদের বাংলা কথা শুনে মারাওস্কি চশমার ভেতর দিয়ে গোল গোল চোখে তাকালেন–তোমরা নিশ্চয় তোমাদের মাতৃভাষায় এই বুড়োটাকে গাল দিচ্ছে। আমাকে বঞ্চিত করা কি উচিৎ হচ্ছে?

জনি ব্যস্ত হয়ে বললো কক্ষনো আপনাকে আমরা গাল দেই নি। আমার বোন বলছিলো আপনি খুব ভালো লোক।

মারাওস্কি অমায়িক হেসে বললেন, আমি জানি তোমার বোন আমার সম্পর্কে খারাপ কথা বলবে না। কারণ ও নিজে খুব ভালো মেয়ে।

আর আমি? গম্ভীর হওয়ার ভান করে জানতে চাইলো জনি।

মনে হচ্ছে তুমিও ভালো ছেলে।

শুনে রাখ আপু, আমিও ভালো ছেলে!

মারাওস্কি প্রশ্ন করলেন, রিনির আরেক নাম কি আপু?

হো হো করে গলা খুলে হাসলো জনি–ওকে শুধু আমিই আপু ডাকতে পারি। আর কেউ ওকে এ নামে ডাকতে পারবে না।

আমিও তাহলে আপু ডাকবো। খুব মিষ্টি নাম আপু।

জনির সঙ্গে এবার রিনিও গলা মিলিয়ে হাসলো বললো, বড় বোনকে বাংলায় আপু নয়তো দিদি বলে আঙ্কেল মারাওস্কি। আমি আপনার আপু হতে পারি না।

তাই বলো! বোকার মতো একটু হেসে মারাওস্কি বললেন, আঙ্কেলকে বাংলায় কি বলো তোমরা?

চাচা, মামা, ফুপা, খালু-এরকম আরো আছে।

আমি তাহলে চাচা মারাওস্কি। খুব মজার শব্দ তো চাচা! জানো বোধ হয় সেকেলে একটা ইংলিশ নাচ আছে–চাচাচা বলে।

রিনি বললো, জানি। আপনার কোনটা শুনতে ভালো লাগবে, আঙ্কেল মারাওস্কি মারাওস্কি চাচা?

নিশ্চয় চাচা মারাওস্কি বলবে।

বাংলায় আমরা চাচা বলি নামের শেষে।

ঠিক আছে। নামের শেষে হলেও চলবে।

কথাটা বলেইমারওস্কি আবার খুক খুক করে হাসলেন। রিনি জনি ওঁর সঙ্গে গলা মেলালো। পাশের রোতে বসেছিলেন ইয়া মোটা এক মহিলা। সম্ভবত রাশান। কোরাসে হাসি শুনে কটমট করে তাকালেন ওদের দিকে। মারাওস্কি ভীষণ ভয় পাওয়ার ভান করে হাসি থামালেন। রিনি জনিকে ইশারা করলেন মোটা মহিলার দিকে তাকাতে ওরা মহিলাকে দেখে হাসি চাপতে গিয়ে বিষম খেলো।

এক ঘণ্টা পরই রিনিদের প্লেন ফ্রাঙ্কফুর্টে নামলো। এখানে প্লেন বদল করতে হবে। মারাওকি ওদের দুজনকে নিয়ে এয়ার পোর্টের ভেতরই চারদিক কাঁচে ঢাকা অভিজাত এক রেস্তোরাঁয় নিয়ে গেলেন। বাইরে দুপুরের ঝলমলে রোদ অথচ রেস্তোরাঁর ভেতর পর্দা টেনে টেবিলে মোমবাতির মতো কম আলোর ছোট ছোট টেবিল লাইট জ্বালিয়ে এক মায়াময় পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে।

ওরা ঢুকতেই তরুণী ওয়েট্রেস গুটেনটাখৃ বলে ওদের এক কোণের এক টেবিলে নিয়ে জার্মান ভাষায় বললো, আপনারা কি লাঞ্চ করবেন না হালকা কোনো পানীয় নেবেন?

মারাওস্কি রিনিকে বললেন, খটমটে জার্মান ভাষা বলতেও পারি না, পছন্দও করি না। ওয়েটারকে বললেন, ইংরেজি জানা কেউ আছে?

ওয়েটারের অসহায় ভাব দেখে রিনি তাড়াতাড়ি বললো, মারাওস্কি চাচা, স্কুলে আমাদের জার্মান শিখতে হয়। ওয়েট্রেস জানতে চাইছে আমরা লাঞ্চ করবো না হালকা কিছু নেবো।

দারুণ মেয়ে তো তুমি! বিস্মিত গলায় মারস্কি বললেন, ঠিক আছে, এদেশে তুমি আমার দোভাষী। ওকে লাঞ্চের কথা বলো।

রিনির কথা শুনে ওয়েট্রেস্ এক টুকরো মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে রিনির হাতে মেনু ধরিয়ে দিলেন। মেনুও জার্মান ভাষায় লেখা। রিনি ইংরেজিতে অনুবাদ করে এক এক করে খাবারের নাম বললো। কয়েকটা জার্মান খাবারের অচেনা নাম দেখে ওয়েট্রেসকে জিজ্ঞেস করলো কি আছে ওতে। শেষে ওরা শার্ক ফিনের স্যুপ, কচি ভেড়ার স্টেক আর অনেক রকম সবজির গেমিউযে সালাদ নিলো। রুটি আলুর রোস্ট আর মাখন স্টেক এর সঙ্গেই দেয়া হলো।

মারাওস্কি নিজের জন্য রেড ওয়াইন নিলেন। রিনি জনি নিলো টমেটো জুস।

যদিও মারাওস্কি জনির আগ্রহ দেখে বলছিলেন, একটু রেড ওয়াইন চেখে দেখতে পারতে। রিনি শান্ত গলায় বললো, আমাদের বাবা মা বলেছেন, যাদের বয়স আঠারো হয় নি, তাদের মদ ছোঁয়া উচিৎ নয়।

তোমাদের বাবা মা কি খুব রক্ষণশীল?

আমি তা মনে করি না। বহু ভদ্র ইংরেজ পরিবারে দেখেছি আঠারো বছরের কম বয়সীরা মদ খায় না।

তোমার সততা আমাকে মুগ্ধ করেছে রিনি। বললেন মারাওস্কি।

চমৎকার লাঞ্চ সেরে লাউঞ্জে পা রাখতেই টেলিভিশনের পর্দায় ওরা দেখলো ওয়ারসগামী লট দুঘন্টা দেরিতে ছাড়বে।

মারাওস্কি বললেন, শুরু হলো ভোগান্তি। এর শেষ যে কোথায় ঈশ্বর জানেন। জনি বললো, অ্যারোফ্লোটের দুদিনের তুলনায় এমন কিছু নয়। রিনি বলল, মামার গাড়িকেও এয়ারপোর্টে দুঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে।

তোমাদের জন্য গাড়ি আসবে বুঝি!

হ্যাঁ। চাপা গর্বের গলায় জনি বললো, আমাদের আঙ্কল ওয়ারসতে বাংলাদেশের অ্যাম্বাসাডর।

ভালোই হলো। একগাল হেসে মারাওস্কি বললেন, শহর পর্যন্ত তোমাদের গাড়িতে লিফট নিতে পারবো। কোথায় থাকেন তোমাদের আঙ্কল?

ঠিকানা সঙ্গে। তবে জায়গাটা কোথায় বলতে পারবো না। জবাব দিলো রিনি।

ওরা লাউঞ্জের এক কোনে বসে কথা বলছিলো। বুড়ো মারাওকি ওদের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেক প্রশ্ন করলেন। দেড় ঘন্টা পর আবার ওরা টেলিভিশনের পর্দায় দেখলো, ওয়ারস গামী লট-এর বিমানের আরো তিন ঘন্টা দেরি হবে।

এবার কিছুটা ঘাবড়ালো রিনি। মনে পড়লো মস্কোতে অ্যারোফ্লোটও একবারে বলে নি আটচল্লিশ ঘন্টা দেরির কথা। প্রত্যেকবার সময় দুতিন ঘন্টা করে বাড়িয়েছে। ওর শুকনো মুখ দেখে বুড়ো মারাওস্কি বললেন, ঘাবড়ে গেলে নাকি! আমি আছি তো!

জনি বললো, মস্কোতে দেখেছিলাম, অ্যারোফ্লোটও এভাবে দেরি করেছিলো।

তোমরা একটু বসো এখানে। আমি খবর আনছি। এই বলে মারাওস্কি ব্যস্ত পায়ে চলে গেলেন।

রিনি বললো, পাঁচ ঘন্টা দেরি মানে বুঝতে পারছিস, ওয়ারস পৌঁছতে পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে।

জনি ভয় পাওয়া গলায় বললো, এয়ারপোর্টে নেমে যদি দেখি মামার গাড়ি আসে নি?

ঠিকানা আছে, ট্যাক্সি নিয়ে চলে যাবো।

ট্যাক্সিওয়ালা আমাদের কোথায় নিচ্ছে বুঝবো কিভাবে? যদি টাকাপয়সা সব কেড়ে নিয়ে কোনো জঙ্গলের ভেতর নামিয়ে দেয়!

জনি, তুই এত ভীতু কেন রে? ট্যাক্সিওয়ালা থাকবে একা, আমরা দুজন। এত খাস, ব্যায়াম করিস–এভাবে ভয় পাওয়ার জন্য!

জনি কাষ্ঠ হেসে বললো, একা হলে তো সামলাতে পারবো। যদি গুণ্ডাদের ডেরায় নিয়ে যায়?

হরর ছবি দেখে দেখে ভয়টাকে তুই বাড়িয়ে দেখিস।

তুই ঠিক বললি না আপু। বিজ্ঞ গলায় জনি বললো, বিপদ আসতে পারে জানলে আমি এন্টিসিপেট করি, কি কি ঘটতে পারে। যাতে নিজে সেভাবে তৈরি থাকতে পারি।

ঠিক আছে। তোর সঙ্গে আমিও তৈরি থাকবো। হেসে বললো রিনি।

ঠিক তখনই শুকনো লিকপিকে মাঝবয়সী লম্বামুখ এক লোক সন্দেহজনকভাবে এদিক ওদিক ভালো করে দেখে রিনিদের কাছে এসে চাপা খসখসে গলায় বললো, রবার্ট মারাওস্কি তোমাদের সঙ্গে এতক্ষণ কি কথা বললো?

লোকটার কথা বলার ধরণ রিনির মোটেই পছন্দ হলো না। বললো, আপনি কি মিস্টার মারাওস্কিকে চেনেন।

খুব ভালো করেই চিনি।

চিনলে বরং তাকেই জিজ্ঞেস করবেন আমাদের সঙ্গে তিনি কি কথা বলেছেন।

রিনির এড়িয়ে যাওয়া জবাব শুনে খসখসে গলা বললো, জানো না তো ওর নামে–কথা শেষ না হতেই লোকটা হঠাৎ করে কর্পূরের মতো মিলিয়ে গেলো। সম্ভবত মারাওস্কিকে আসতে দেখেছিলো ও।

লোকটা কোথায় গেলো রিনি দেখতে দিয়ে মারাওস্কির ওপর ওর নজর পড়লো। হন্তদন্ত হয়ে ওদের কাছে এসে ব্যস্ত গলায় বললেন, রিনি জনি শোন। তোমরা ঠিকই অনুমান করেছো। যে প্লেনে আমরা যাবো ওটার ইঞ্জিনে কি গন্ডগোল দেখা দিয়েছে। সারতে আরো সময় লাগতে পারে। বলকান এয়ারলাইন্সের একটা প্লেন একঘন্টা পর ওয়ারস যাচ্ছে। ওখানে কিছু সিট খালি আছে। আমি ঠিক করেছি ওটাতেই যাবো। আজ রাতে আমাকে ওয়ারস পৌঁছতেই হবে। তোমরা যেতে চাইলে ব্যবস্থা করতে পারি।

আমাদের কাছে দুবার টিকেট কাটার মতো বাড়তি টাকা নেই। শুকনো গলায় বললো রিনি।

মারাওস্কি হেসে বললেন, আরে না, টাকা লাগবে কেন। লট-এর কাউন্টারে গিয়ে দুটো কড়া ধমক দিতেই ওরা বললো, এভাবে ফ্লাইট বদলে নেয়া যায়। আরো কয়েকজন এ ফ্লাইটে যাবে। অযথা এখানে অপেক্ষা না করে আমার সঙ্গে চলো।

একটু ইতস্তত করে রাজি হয়ে গেলো রিনি। এসব ব্যাপারে জনির কোনো আলাদা মত নেই। রিনি যা বলবে তাই হবে। খবর আনতে গিয়ে বুড়ো মারাওস্কি ডিউটি ফ্রি শপ থেকে একগাদা জিনিস কিনেছেন। আগে থাকতেই ওর কাঁধে ব্যাগ ছিলো। নতুন ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন। জনি সঙ্গে সঙ্গে না ধরলে ভালোরকম আছাড় খেতেন। জনি ওঁর নতুন শপিং ব্যাগটা নিজে নিলো। প্রথমে আপত্তি করে পরে একগাল হেসে অনেক ধন্যবাদ দিলেন তিনি।

একঘন্টা পর বলকান এয়ারলাইন্সের বোয়িং যখন ওয়ারসর পথে আকাশে উড়লো তখন জনির মনে হলো মারাওস্কির কথা শুনে রিনি ঠিকই করেছে। লাউঞ্জের সন্দেহজনক লোকটার কথা রিনি প্রথমে ভেবেছিলো মারাওস্কিকে বলবে না। প্লেনে ওঠার পর মনে হলো যিনি ওদের এত উপকার করছেন তাঁকে এ ব্যাপারে সাবধান করে দেয়া উচিৎ। শুকনো লোকটার কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে মারাওস্কির চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। ভাঙা গলায় জানতে চাইলেন, নিজের নাম বলেছে লোকটা?

না, বললো আপনাকে চেনে। আপনার নামও জানে।

শেষ কথাটা আবার বলতে কি বলেছে সে?

বলেছে, জানো নাতো ওর নামে–এইটুকু বলার পর সম্ভবত আপনাকে দেখে পালিয়েছে। আপনি কি চেনেন ওকে?

কিছুক্ষণ চুপচাপ কি যেন ভাবলেন মারাওস্কি। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, সম্ভবত মাফিয়াদের কোনো চর হবে।

মাফিয়া কেন আপনার পেছনে লাগবে? অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো জনি। মাফিয়াদের ওপর কদিন আগেই ভয়ঙ্কর একটা ছবি দেখেছে ও। মাফিয়ারা যাদের পেছনে লাগে তাদের সর্বনাশের আর কিছু বাকি থাকে না। ভয়ঙ্কর শক্তিশালী গুণ্ডাদের এই দলটা ইউরোপ, আমেরিকার সব বড় শহরে ছড়িয়ে রয়েছে।

জনির কথার জবাব দেয়ার আগে একটু ইতস্তত করলেন মারাওস্কি। বললেন, তোমরা ছেলেমানুষ ভেবে বলতে চাই নি । কিছুটা যখন জেনেছো তখন বলেই ফেলি। আমার মেয়ের কথা রিনিকে বলেছিলাম ক্যান্সারে মারা গেছে। হয়তো ক্যান্সারেই মারা যেতো। হাসপাতালে ক্যান্সারের জন্য ওকে ভর্তি করেছিলাম। ওর স্বাভাবিক মৃত্যুর আগে মাফিয়ারা ওকে হাসপাতালে গুলি করে হত্যা করেছে।

সে কি! চমকে উঠলো রিনি। কেন হত্যা করলো ওকে?

আমাকে শাস্তি দেয়ার জন্য। রুমালে চোখ মুছে নাক ঝেড়ে মারওস্কি বললেন, মাফিয়াদের একটা প্রস্তাবে রাজী হইনি বলে ওরা আমাকে শাসিয়েছিলো আমার সর্বনাশ করে ছাড়বে।

প্রস্তাবটা কি ছিলো আঙ্কল? নরম গলায় প্রশ্ন করলো রিনি।

আমি তখন ওয়ারসতে রয়েল প্যালেস মিউজিয়ামের অধ্যক্ষ। পাঁচ ছশ বছরের পুরোনো বহু বিখ্যাত শিল্পীর মূল্যবান সব পেইন্টিং রয়েছে। মাফিয়াদের ডন ভিত্তালি আমাকে বললো রাফায়েলের একটা পেইন্টিং ওখান থেকে সরিয়ে এনে ওকে দিতে। আমি বললাম অসম্ভব, আমার প্রাণ থাকতে রয়েল প্যালেসের কুটোটিও কেউ নাড়তে পারবে না। শুনে ডন ভীষণ ক্ষেপে গেলো। এমন এক অবস্থা করলো যে আমাকে পোল্যান্ড ছেড়ে পালাতে হলো লন্ডনে। কিছুদিন সেখানে ভালো ছিলাম। পরে ওরা টের পেয়ে আমার মেয়েকে হত্যা করলো। এই বলে মারাওস্কি আবার চোখ মুছলেন। মাফিয়ারা এখন আপনার কাছে কি চায়? আপনি তো রয়েল প্যালেসে আর নেই। একজন পেশাদার রহস্যভেদীর মতো প্রশ্ন করলো জনি।

এখন চায় আমার ওয়ারস গ্যালারীর দুটো ছবি। অতি পুরোনো দুজন জার্মান পেইন্টারের কাজ রয়েছে গ্যালারির পার্মানেন্ট ডিসপ্লেতে।

না দিলে আপনাকে মেরে ফেলবে?

তাই তো বলছে। তবে ছবি দিলেও ওরা আমাকে ছেড়ে দেবে না। রয়েল প্যালেসের ছবিটা এখনো ওরা বাগাতে পারে নি। ওরা জানে আমি ছাড়া এই অসম্ভব কাজ আর কেউ করতে পারবে না। প্যালেসের দুটো গোপন পথের সন্ধান শুধুমাত্র আমিই জানি।

তাহলে তো রাফায়েলের ছবি না পাওয়া পর্যন্ত আপনাকে ওরা মারবে না।

না মারুক, ধরে নিয়ে যদি ওদের টর্চার চেম্বারে একবার ঢোকাতে পারে, গোপন পথের কথা না বলে পারবো না।

আমাদের সঙ্গে কি কথা বললেন এটা ওরা জানতে চায় কেন?

মৃত্যু ঘনিয়ে এলে মানুষ যাকে বিশ্বাস করে গোপন সব কথা তাকে বলে যায়। ভেবেছে তোমাদের হয়তো রয়েল প্যালেসের গুপ্ত পথের সন্ধান দিয়ে যাবো।

তার মানে মাফিয়ারা আমাদের ওপরও নজর রাখছে? আমি কখন কার সঙ্গে কতক্ষণ কথা বলছি সব কিছু ওরা লক্ষ্য করছে।

রিনি বললো, আমরা যতক্ষণ আছি আপনার কোনো ভয় নেই। এয়ারপোর্টে আমাদের জন্য গাড়ি আসবে। দূতাবাসের গাড়ি কেউ ছুঁতেও সাহস পাবে না।

রিনির কথা শুনে মনে হলো মারাওস্কি কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছেন। ওকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন, তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে আমি এবার একটু নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারবো। এই বলে সত্যি তিনি ঘুমিয়ে গেলেন।

ঘড়ি দেখে রিনি হিসেব করে রেখেছিলো ওয়ারস পৌঁছবে বিকেল চারটায়। তার মানে পরিষ্কার ঝলমলে বিকেল। ওয়ারসতে যখন ওরা নামলো তখন ওর ঘড়িতে চারটা বাজলেও বাইরের আকাশে গোধুলির ছায়া নামছে। টাইম যোনের কথা ওর মনে ছিলো না। লন্ডনের বিকেল চারটা হচ্ছে ওয়ারসর সময় সাড়ে পাঁচটা। মারাওস্কি সঙ্গে থাকাতে ব্যাগ খুঁজে বের করে ইমিগ্রেশনের ঝামেলা মেটাতে ওদের মোটেই বেগ পেতে হয় নি। ওরা প্রমাদ গুনলো বাইরে এসে। ভেবেছিলো মামার গাড়ি অপেক্ষা করবে ওদের জন্য। কোথাও কোন কূটনীতিক নম্বরওয়ালা গাড়ি চোখে পড়লো না।

মারাওস্কি ওদের অসহায় অবস্থা দেখে বিচলিত হলেন। বললেন, রিনি, তুমি বলছিলে তোমার আঙ্কলের ঠিকানা আছে তোমার সঙ্গে। ওটা কি দেখাবে আমাকে?

রিনি ওর ব্যাগ থেকে ঠিকানা বের করে দিলো। দেখে মারাওস্কি বললেন, আমাকে ট্যাক্সি নিতে হবে। যদি চাও আমি তোমাদের নামিয়ে দিতে পারি।

রিনি যেন হাতে চাঁদ পেলো। তবু গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললো, আমাদের ঠিকানা কি আপনার পথে পড়বে?

ঠিক পথে পড়বে না। তবে ট্যাক্সি সামান্য ঘুরিয়ে নিলে কোনো অসুবিধেও হবে না।

কোথায় আমরা আপনাকে লিফট দেবো, উল্টো আপনার কাছ থেকে লিফট নিচ্ছি।

একই কথা। চলো, ট্যাক্সির জন্য আবার লাইন দিতে হবে।

এয়ারপোর্ট থেকে বেরোতেই কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস ওয়ারসতে ওদের স্বাগত জানাতে গিয়ে ওভারকোট, পুলোভার সব ফুটো করে হাড়ে কাপন ধরালো।