ভাগবত পুরাণ – ০৮ম স্কন্ধ

ভাগবত পুরাণ – অষ্টম স্কন্ধ
প্রথম অধ্যায়
মন্থত্বরাণু বর্ণন ও যজ্ঞাবতার কথন

শ্রী পরীক্ষিৎ বললেন–হে গুরুদেব, আপনার নিকট হতে স্বায়ম্ভুব মনু বংশ বিস্তৃতরূপে শ্রবণ করলাম। ঐ বংশেই মনুকন্যা সকলে বিশ্বস্রষ্টা মরীচি প্রভৃতির পুত্র পৌত্রাদির উৎপত্তি হয়েছে। এক্ষণে অন্যান্য মনুর বংশ–বিবরণ বর্ণনা করুন। হে ব্রাহ্মণ, যে যে মন্বন্তরে অতি মহান ভগবান হরির জন্ম ও কর্মসমূহ পণ্ডিতগণ কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে, আমরা শ্রবণেচ্ছুক আমাদের নিকট সে সকল বর্ণনা করুন। বিশ্বভাবন (জগৎ কর্মা) ভগবান অতীত মন্বন্তরে যা যা করেছেন, আগামী ভবিষ্যৎ মন্বন্তরে যা যা করবেন এবং বর্তমান মন্বন্তরে যা যা–করছেন এবং সর্বক্ষণ মন্বন্তরে যা যা করছেন এ সমস্তই আপনি বর্ণনা করুন। ঋষিবর শুকদেব বললেন– রাজ, এই কল্পে স্বয়ম্ভুবাদী ছয় মনু অতীত হয়েছে তার মধ্যে স্বয়ম্ভুর মনু প্রথম। আমি তার কথা এবং ঐ মন্বন্তরের দেবতা প্রভৃতির উৎপত্তির কথা তোমার নিকট বলেছি। ভগবান শ্রীহরি ধর্ম ও জ্ঞানের উপদেশ দানের জন্য স্বায়ম্ভু মনুর দুহিতা–আকৃতি ও দেবহূতির গর্ভে যথাক্রমে যজ্ঞ ও কপিলরূপে আবির্ভূত হয়ে তাদের পুত্রত্ব প্রাপ্ত হয়েছিলেন। হে কুলনন্দন, ভগবান কপিলের বৃত্তান্ত পূর্বে (তৃতীয় স্কন্ধে) বর্ণনা করেছি, সম্প্রতি ভগবান যজ্ঞ যা যা করেছিলেন তা বলব। শতরূপার প্রতি স্বায়ম্ভুব মনু বিষয়াভাগে বিরক্ত হয়ে রাজ্য পরিত্যাগ পূর্বক পত্নীর সহিত তপস্যার জন্য বনে গমন করেছিলেন। হে ভরতনন্দন, তিনি সুনন্দা নদীর তীরে একপদে ভূমি স্পর্শ করে শত বৎসর দুশ্চর তপস্যা করতে করতে বিস্মিতের ন্যায় এরূপ বাক্য বলেছিলেন।

মনু বললেন–স্বয়ং চৈতন্যস্বরূপ বলে যিনি এই বিশ্বকে চৈতন্যযুক্ত করেন কিন্তু যাঁকে এই বিশ্বচেতন করতে পারে না। আর এই ব্যক্তি (জীব) শয়ান হলে, যিনি জাগ্রত (অর্থাৎ সাক্ষী স্বরূপে বর্তমান) থাকেন বলে তাকে এই জনগণ জানে না–কিন্তু তিনি সকলকে জানেন। এ জগতে যা কিছু স্থাবর, জঙ্গমাত্মক বস্তু রয়েছে–সে সকলই ঈশ্বরের সত্ত্বা ও চৈতন্য দ্বারা ব্যপ্ত। অতএব ঈশ্বর যা কিছু দান করেন তা দিয়েই ভোগ্যবস্তুর ভোগ করবে। (অথবা ভোগ্য বস্তু মাত্রই ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে অর্পণ করে ভোগ করবে)। নিজের ভোগের জন্য অপর কারই বা ধন আছে যে, তা আকাঙ্ক্ষা করবে? তিনি সকলকে দেখছেন কিন্তু কোন লোক অথবা করোর চক্ষু তাকে দেখতে পায় না কারণ তিনি চক্ষুরাদির বিষয় নন। যাঁর জ্ঞান কখনও বিনষ্ট হয় না। (অর্থাৎ ঘটাদি নাস দেবদত্তাদির তত্ত্ববিষয়ক চাক্ষুস জ্ঞান বিনাসের ন্যায় দর্শনকারী সেই ঈশ্বরের চাক্ষুস জ্ঞান বিনষ্ট হয় না, অর্থাৎ তত্ত্বৎ আকারে উৎপন্ন বৃত্তিরই নাশ হয়ে থাকে। স্বতঃজ্ঞানের বিনাশ হয় না। কারণ প্রকাশ্যে স্বয়ম্ভু নাশে সূর্যের প্রকাশ কখনও বিনষ্ট হয় না)। অতএব সকল ভূতের অন্তর্যামী প্রসঙ্গ সেই ঈশ্বরের ভজন কর।

যাঁর আদি, অন্ত, মধ্য এবং আত্মীয়-পর এবং অন্তর বা বাহির কিছুই নেই, কিন্তু বিশ্বের ঐ সকল আদি, অন্ত প্রভৃতি যাঁহা হতে হচ্ছে এবং এই বিশ্ব যার স্বরূপ, তিনি সত্য ও পরিপূর্ণ ব্রহ্ম, তিনি জগতের ঈশ্বর জন্মরহিত, সত্য, স্বপ্রকাশ ও নির্বিকার স্বরূপ। এই বিশ্ব তার শরীর এবং তার অনেক নাম। তিনি নিজশক্তি মায়ার দ্বারা এই বিশ্বের সৃষ্টি প্রভৃতি সাধন করেন এবং তিনিই নিজের নিত্যসিদ্ধ। বিদ্যার (অর্থাৎ জ্ঞানের) দ্বারা মায়াকে নিরস্ত করে নিষ্ক্রিয়ভাবে বিরাজ করছেন। এইরূপে ঈশ্বর কর্ম করে পরে পরিত্যাগপূর্বক নিষ্কর্মা থাকাতে ঋষিগণও অকর্মার্থ (অর্থাৎ মুক্তির নিমিত্ত, কিংবা কর্মনাশের জন্য) অগ্রে কর্ম করেন। যেহেতু কর্ম চেষ্টারত পুরুষই প্রায় কর্মে অনিশ্চেষ্টতা লাভ করেন। (চেষ্টাকারী পুরুষ কর্মসকল দ্বারা অবগুণ্ঠিত হয়ে কোষকার কীটের ন্যায় বদ্ধ হয়, এরূপ আশঙ্কা করতে পারা যায়, যেহেতু ভগবান ঈশ্বর চেষ্টা করে থাকেন। অথচ তাতে আসক্ত হন না। যে সকল ব্যক্তি তার অনুবৃত্তি করেন, তাঁরাও আত্মলাভ দ্বারা চরিতার্থ হবেন। কখন আসক্ত হবে না। যিনি নিখল ধর্মের প্রবর্তক বলে রাম, কৃষ্ণাদি নানা অবতারের অনুরূপ নিজবক্সে সম্যকরূপে অবস্থিত হয়ে, নিজ আচরণ দ্বারা মানবগণের শিক্ষা দানের জন্যই বেদোক্ত কর্মের আচরণ করেন এবং যিনি জ্ঞানময় বলে অহংকার সম্পর্কশূন্য যিনি পূর্ণ (সর্বদা আত্মলাভে পরিপূর্ণ) বলে নিষ্কাম ও যিনি প্রভু বলে অন্য কর্তৃক অপরিচালিত, আমি সেই ঈশ্বরের শরণ গ্রহণ করছি। শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে মহারাজ, স্বায়ম্ভুব মনু সমাধিমগ্ন হয়ে এরূপ মন্ত্র উচ্চারণ করছিলেন বলে অসুরগণ তাকে বিবশ মনে করে ক্ষুধাবশতঃ ভক্ষণ করার জন্য তার দিকে ধাবিত হল। সেই অসুর ও রাক্ষসদের ঐরূপ উদ্যোগ যজ্ঞরূপী দেখে সর্বগত শ্রীহরি নিজ পুত্ৰ যাম নামক দেবগণের দ্বারা পরিবৃত হয়ে তাদের ধত্র করেন এবং স্বয়ং ইন্দ্র হয়ে স্বর্গ পালন করতে লাগলেন। দ্বিতীয় মনুর নাম স্বারোচিষ তিনি অগ্নির পুত্র। দুমান, সুষেণ, রোচিস্ম্য প্রভৃতি তাঁর পুত্র। ঐ মন্বন্তরে রোচন নামক ইন্দ্র, তুষিত প্রভৃতি দেবতা এবং ঊর্জ ও স্মভপ প্রভৃতি সাতজন ব্রহ্মবাদী ঋষি ছিলেন। বেদশিরা ঋষির তুষিতা নামে পত্নী ছিলেন, তার গর্ভে ঐ ঋষির বিভু নামে বিখ্যাত দেব উৎপন্ন হন।

..ঐ বিভুর অসাধারণ চরিত্র, তিনি কৌমার ব্রহ্মচারী হওয়ায় অস্পস্পীতি সহস্র ধৃতব্রত মুনি তার নিকট ব্রত শিক্ষা করেন। তৃতীয় মনুর নাম উত্তম, তিনি প্রিয়ব্রতের সন্তান, তার তনয়গণ–পবন, সৃঞ্জয় এবং যজ্ঞহোত্রাদি; এই মন্বন্তর বশিষ্ঠ পুত্র প্রমদ প্রভৃতি সপ্তর্ষি হন এবং সত্য, বেদাত্ত্বত ভদ্রগণ দেবতা এবং সত্যজিৎ ইন্দ্র হয়েছিলেন। এই মন্বন্তরেই ভগবান শ্রীহরি ধর্মের ভার্য্যা সুনৃতার গর্ভে সত্যব্রত গণের সহিত উৎপন্ন হয়ে সত্যসেন নামে বিখ্যাত হয়েছিলেন। এই সত্যসেন সত্যজিৎ নামক পূর্বোক্ত ইন্দ্রের সখা হয়ে মিথ্যারত, দুঃশীল, দুষ্ট যক্ষ ও রাক্ষসদের এবং নিরীহ প্রাণীগণের পীড়াদানকারী হিংস্র প্রাণীদের সংহার করেছিলেন।

চতুর্থ মনুর নাম তামস, তিনি তৃতীয় মনু উত্তমের ভ্রাতা, পৃথু, স্যতি, নর ও কেতু প্রভৃতি দশজন তাঁর পুত্র–এই তামস মন্বন্তরে সত্যক, হরি এবং বীরনামে দেবগণ, ত্রিস্মি ইন্দ্র এবং জ্যোতিধাম প্রভৃতি সপ্ত ঋষি হয়েছিলেন। হে মহারাজ, উক্ত মন্বন্তরে বিবৃতির পুত্র বৈধৃতিআশু দেবতা হয়েছিলেন এবং তারা কালক্রমে বিনষ্ট বেদসমূহকে নিজ নিজ তেজোবলে ধারণ করেছিলেন, এই মন্বন্তরকেই হরিমেধস হতে তার পত্নী হরিণীর গর্ভে ভগবান হরি আবির্ভূত হয়ে হরি’ নামে বিখ্যাত হন এবং ইনিই কুম্ভীরের গ্রাস হতে গজেন্দ্রকে মুক্ত করেছিলেন।

মহারাজ পরীক্ষিত বললেন–হে ব্যাসনন্দন মুনিবর, হরি যেরূপে কুম্ভীর গ্রস্ত গজেন্দ্রকে মুক্ত করেছিলেন, তা আমরা আপনার নিকট হতে শুনতে ইচ্ছা করি। হে ব্ৰহ্মণ, যে যে কথার উত্তমশ্লোক ভগবান হরি গীত হন, সে কথা অতিশয় পবিত্র ধন্য, শুভ এবং পরম মনোবর। শ্রীসূত বললেন–হে বিপ্র, ব্যসনন্দন শ্রীশুকদেব প্রয়োজনবশত মহারাজ পরীক্ষিত কর্তৃক–ভগবকথা বর্ণনে প্রার্থিত হয়ে, শ্রবণকারী মুনিগণের সভার হৃষ্টচিত্ত রাজার প্রতি অভিনন্দন প্রকাশ পূর্বক বলতে লাগলেন।

.

দ্বিতীয় অধ্যায়
ক্ষীরোদ সমুদ্রের বর্ণনা

শ্ৰীশুকদেব বললেন–মহারাজ, চারিদিকে ক্ষীরোদ সমুদ্রের দ্বারা পরিবেষ্টিত, দশ সহস্র যোজন উন্নত ত্রিকূট নামে প্রসিদ্ধ একটি রমণীয় পর্বত আছে। ঐ পর্বতের চারিদিকেও দশ সহস্র যোজন বিস্তৃত এবং সেই পর্বত রৌপ্য, লৌহ ও সুবর্ণময় তিনটি প্রধান সূর্যের দ্বারা সাগর ও দিক সকলকে বেষ্টিত করে আছে, এই জন্যই তার নাম ত্রিকূট হয়েছে, ঐ পর্বতের অন্যান্য সৃষ্টি রত্ন ও ধাতুর দ্বারা চিত্রিত, সেই সরস শিখরও বিবিধ বৃক্ষ, লতা, গুল্ম এবং নিঝর সমুদ্রের জলপতনের শব্দের দ্বারা আলো দিকের শোভা করছে।

ক্ষীরোদ সমুদ্রের তরঙ্গরাজির দ্বারা চারিদিক হতে সেই ত্রিকূটে পর্বতের পাদমূল ধৌত হচ্ছে এবং সেই পর্বতটি সবুজবর্ণ মরকত প্রস্তররাশির দ্বারা নিকটস্থ ভূমিভাগের শ্যামলতা সম্পাদন করছে, ক্রীড়ারত সিদ্ধ, চারণ, গন্ধর্ব, বিদ্যাধর, মহাসর্ত; কিন্নর এবং অপ্সরাগণ–এই পর্বতের গুহা সমূহের সেবা করে থাকেন। উক্ত পর্বতের গুহাসমূহ কিন্নর প্রভৃতির সংগীতরবে প্রতিধ্বনিত হলে দৃপ্ত সিংহগণ ঐ সাদরে প্রতিপক্ষ সিংহের গর্জন মনে করে অসহিষ্ণুতাপ্রাপ্ত নিজেরাও গর্জন করতে থাকে।

নানাবিধ বন্য পশুগণের দ্বারা উত্তপ্ত পর্বতের সন্ধিস্থল সুশোভিত এবং উক্ত পর্বতে বিবিধ বিচিত্র বৃক্ষরাজি সম্বন্বিত ও দেবগণের বিহারযোগ্য উদ্যানসমূহে কলরবকারী পক্ষীদল অবস্থান করছে, সেই পর্বতটি স্বচ্ছ জলপূর্ণ নদী ও সরোবর সমূহ, মণিতুল্য উজ্জ্বল বালুকাময় এবং দেবরমণীগণের অবগাহনহেতু সৌরভময়। জলের ও বায়ুপ্রবাহ দ্বারা নিরন্তর যুক্ত রয়েছে, ঐ পর্বতের শ্রেণীতে মহাত্মা ভগবান বরুণের একটি উপবন আছে। তার নাম ঋতুমান, ঐ উপবন দেবরমণীগণের ক্রীড়াস্থান, সেখানকার দিব্য দ্রব্যসকলে সবকালেই পুষ্প ফল ধরে থাকে, তার ঐ উদ্যান সব সময় সর্বতোভাবে শোভমান।

ঐ পর্বতে যে কত প্রকার বৃক্ষ আছে, তা বলা দুঃসাধ্য। মন্দার, পারিজাত, পারুল, অশোক, চুত, পিয়াল, আম্র, গুবাক, নারিকেল, মসুর দাড়িম্ব, মধুক্ত শাল, তাল, তমাল, পীত শালে, অর্জুন, অরিষ্ঠ (রিঠা, ডুমুর অশ্বত্থ, বট, পলাশ, চন্দন, নিম, বৃক্ষ) সরল, দেবদারু, দ্রাক্ষা, ইক্ষু, রম্ভা, জম্বু (জাম), বদরী, বহেড়া, হরীতকী, আমলকী, বিশ্ব কপিন্থ (কয়েত বেল), হম্বীর, ভালাতক (ভলা) প্রভৃতি অসংখ্য তরুতে ঐ পর্বত পরিবৃত।

ঐ ত্রিকূট পর্বতে একটি সুবিশাল সরোবর আছে, তাতে কাঞ্চনবর্ণ পঙ্কজসকল সতত শোভামান। ঐ সরোবর কুমুদ, উৎপল, কহ্বার সমূহের শোভায় সুসমৃদ্ধ। মধুপানে মত্ত হয়ে ভ্রমরগণ সব সময় সেখানে গুঞ্জন করে। কলরবকারী বিবিধ পক্ষী, বিশেষতঃ-হংস, কারগুব, চক্রবাক, সারস, জলকুসুম টিট্রিভ ও সত্যুহ (ডাহুক) পক্ষীগণের শব্দে ঐ সরোবরটি সর্বদা মুখরিত, মৎস্য ও কচ্ছপগণের সন্তরণ হেতু চঞ্চল পদ্ম-পরাগ রাশির দ্বারা ঐ সরোবরের জলরাশি সবসময়ে পরিব্যপ্ত হয়ে থাকে। উক্ত সরোবরকে কদম্ব, কেস, নল, কলিগতম্ব ও চৈত্য-লতার দ্বারা পরিবেস্টিত এবং উহ্য কন্দ, কুরুবক, অশোক, শিরীষ, কুঞ্জ, ইহুদি, কুজকে, স্বর্ণযূথিকা, নাস, পুন্মগ, জাতি, মল্লিকা, শতপত্র, মাধবী, লতাঞ্জলি ও সকল ঋতুর নিত্য সমাবেশে ফলপুস্পমালী তার জাত অন্যান্য বৃক্ষরাজির দ্বারা সুশোভিত রয়েছে।

সেই ত্রিকুট পর্বতে একদিন ঐ পর্বতের অরণ্য প্রদেশবাসী এক হস্তি যুথ পতি হস্তিনীগণের সাথে বিচরণ করতে করতে কাটত (বংশবিশেষ), বেণু ও বেত্রবিশিষ্ট বাল্কক, বিশাল গুল্মরাজি এবং বৃক্ষসকল ভগ্ন করছিল, এটির গন্ধ মাত্রেই সিংহ, হস্তী, গণ্ডার, কীচক, ব্যাঘ্র প্রভৃতি হিংস্র পশু, গৌর ও কৃষ্ণবর্ণ সরৎ এবং চমরীগণ ভয়ে ইতস্ততঃ পলায়ন করতে লাগল। কিন্তু বৃক (নেকড়ে বাঘ), শূকর, মহিষ, ভাল্লুক, গোপুচ্ছ (মৃগবিশেষ), বন্য কুক্কর, বানর, হরিণ এবং শশক প্রভৃতি ক্ষুদ্র জন্তুগণ তার অনুগ্রহে ঐ অরণ্যের অপরভাগে নির্ভয়ে বিচরণ করত। এক সময় নিদাঘসন্তপ্ত ঐ গজেন্দ্র বহু তৃষ্ণার্থ হস্তী ও হস্তিনীগণে পরিবেষ্টিত হয়ে সেই সরোবরের নিকট গমন করল। সে এমন গুরুতর দলবদ্ধ হয়ে নির্গত হচ্ছিল যে তার গাত্রভারে ত্রিকূট পর্বত যেন কম্পিত হয়ে উঠল। গজেন্দ্রের গণ্ডস্থল হতে মদবারি ক্ষরিত হওয়ায় মদজলরপায়ী অহিকূল তার সেবা করছিল–পদ্মরেণু যুক্ত ঐ সরোবরকে সুবাসিত বায়ুর আঘ্রাণ পেয়ে তার নয়নদ্বয় মদে বিহ্বল হয়েছিল।

তারপর সেই গজরাজ ঐ সরোবরে অবগাহন পূর্বক কাঞ্চন পদ্ম ও উৎপল রেণুরঞ্জিত নির্মল অমৃত জল শুণ্ড দ্বারা উদ্ধৃত করে যথেষ্ট নাম করল; পরে ঐ জল দ্বারা নিজেকে স্নান করিয়ে ক্লান্তি দূর করতে লাগল। তারপর সুদ্ধেত শীতল জল দ্বারা দয়ালু গৃহী পুরুষের ন্যায়, নিজের স্ত্রী ও সন্তানকে স্নান ও পান করাতে আরম্ভ করল। পরন্তু ভগবানের মায়ায় মোহিত হয়ে দুর্মদ গজরাজ নিজের উপস্থিত দুঃখ লক্ষ্য করতে পারল না।

হে মহারাজ, ঐ সরোবরে এক মহাবলশালী কুম্ভীর দৈব প্রেরিত হয়েই সক্রোধে সেই গজরাজের পদ আক্রমণ করল। তখন মহাবলবান গজরাজ অকস্মাৎ এরূপ বিপদগ্রস্ত হয়ে নিজ শক্তি অনুসারে বিক্রম প্রকাশ করতে লাগল। বলবান কুম্ভীর কর্তৃক বেগভরে আকৃষ্ট ও কাতর গজরাজকে লক্ষ্য করে হস্তিনীগণ দীনচিত্তে কেবল চিৎকার করতে লাগল। আর অন্যান্য হস্তিগণ তার উদ্ধারের জন্য চেষ্টা করেও তাকে উদ্ধার করতে সমর্থ হল না।

হে রাজন, এইরূপে গজেন্দ্র ও কুম্ভীরের তুমুলযুদ্ধ হতে লাগল। এতে অপরকে যথাক্রমে জলের বাইরে ও ভেতরে আকর্ষণ করতে করতে এক সহস্র বৎসর অতিক্রান্ত হল। এই সুদীর্ঘ কালমধ্যে কারও প্রাণবিয়োগ ঘটল না। এ দেখে দেবগণ অত্যন্ত আশ্চর্যবোধ করেছিলেন। অনন্তর কুম্ভীর কর্তৃক দীর্ঘকাল জলমধ্যে আকর্ষণহেতু গজরাজ অবসন্ন হয়ে পড়লে, তার উৎসাহ শক্তি, দেহবল ও ইন্দ্রিয়শক্তির প্রভূত ক্ষয় হয়েছিল। অপরদিকে, জলবাসী কুম্ভীরের উৎসাহ শক্তি, দেহবল, ও ইন্দ্রিয়শক্তি অতিশয় বৃদ্ধি পেতে লাগল।

সেই যূথপতি দেহধারী, এই হেতু ঐ প্রকারে যখন প্রাণের সঙ্কট উপস্থিত হল, কোন প্রকারে নিজেকে মুক্ত করতে পারল না, তখন সে অনেকক্ষণ চিন্তাকুল হয়ে রইল। তারপর তার এইরূপ মতি উদিত হল। –আমি অতিশয় আতুর হয়ে পড়েছি, আমার জ্ঞাতি এই সকল হস্তিগণ আমাকে মুক্ত করতে পারল না, আমি নিজেও সমর্থ হলাম না, এতে এই হস্তিনীগণ উদ্ধার করতে পারবে সম্ভাবনা কি? আমি গ্রহরূপ বিধাতার পাশে আবৃত হয়েছি এতে যদিও কেউই এ হতে আমাকে উদ্ধার করতে সমর্থ হবে না, তথাপি যিনি ব্রহ্মাদি দেবগণের আশ্রয়, সেই শুদ্ধ পরমেশ্বরের শরণাপন্ন হই, যে অনির্বচনীয় পরমেশ্বর অতিশয় ধাবমান প্রচণ্ড বেগশালী কালরূপ সর্পের কবল হতে ভীত শরণাগত জীবকে রক্ষা করেন এবং স্বত মৃত্যুও যাঁর ভয়ে পলায়ন করে; আমি তারই আশ্রয় গ্রহণ করছি।

ব্যাসনন্দন শুকদেব বললেন,–হে মহারাজ, বুদ্ধির দ্বারা এইরূপ নিশ্চয় করে সেই গজেন্দ্ৰ হৃদয় মধ্যে মনকে সমাহিত করল এবং (ইন্দ্রদ্যুম্ন নামক নিজের) পূর্বজন্মের শিক্ষিত জপযোগ্য এই উত্তম স্তোত্র জপ করতে লাগল। যাহা হতে এই দেহ প্রভৃতি সচেতন হয়, যিনি প্রকৃতি ও পুরুষস্বরূপ, যিনি দেহাদি পুরীমধ্যে কারণরূপে প্রবিষ্ট এবং স্বতন্ত্র পরমেশ্বর, সেই ভগবানকে প্রণাম ও ধ্যান করি। যাঁহাতে এই বিশ্ব অধিষ্ঠিত, যাঁহা হতে ইহা উৎপন্ন, যাঁহা কর্তৃক ইহা সৃষ্ট এবং যিনি স্বয়ং এই বিশ্বের স্বরূপ, অথচ যিনি এই কার্য- নিয়ামক ও তার কারণ পদার্থ হতে ভিন্ন; আমি সেই স্বতঃসিদ্ধ বিভুর শরণ গ্রহণ করছি, যিনি নিজের মধ্যে নিজমায়া কর্তৃক অর্পিত (স্বয়ংকল্প মাত্রে বিরচিত), অথচ সৃষ্টিকালে অভিব্যক্ত ও প্রলয় কালে (সূক্ষ্মকারণরূপে) বিলীন প্রাপ্ত, সেই কার্যকারণাত্মক এই বিশ্বকে শক্তিরূপে দর্শন করছেন, যাঁর দৃষ্টি কখনও লুপ্ত হয় না, সেই স্বপ্রকাশ পরাৎপর (অর্থাৎ যিনি চক্ষু প্রভৃতি প্রকাশক পদার্থ সমূহেরও প্রকাশক), পরমেশ্বর আমাকে রক্ষা করুন।

কালক্রমে এই লোকসমূহ, লোকপালগণ এবং কারণ বস্তুসমুদয় সম্পূর্ণরূপে লয়প্রাপ্ত হলে, যে দুর্ভেদ্য অল্প অন্ধকাররাশি বিদ্যমান থাকে, সেই অন্ধকারের পরপারে যিনি বিভুরূপে বিরাজ করেন, যিনি নটের ন্যায় নানা আকারে লীলা করেন বলে দেবতা ও ঋষিগণও যাঁর স্বরূপ জানতে পারেন না সুতরাং অর্বাচীন মনুষ্যাদি কোন প্রাণীই যাঁর স্বরূপ জানতে বা বর্ণনা করতে সমর্থ হয় না, সেই দুজ্ঞেয় চরিত্র পরমেশ্বর আমাদের রক্ষা করুন, সকল প্রাণীতে আত্মদর্শী ও সকলের সুহৃদ, বিষয়াসক্তিরহিত পরম সাধু-মুনিগণ যাঁর সুমঙ্গল পদ (স্বরূপ) দর্শন বাসনায় বনবাসী হয়ে অক্ষুণ্ণরূপে ব্রহ্মর্যোদি ব্রত পালন করেন, সেই পরমাত্মা আমার মত হউন। যাঁর জন্ম-কর্ম নেই, নাম-রূপ নেই, গুণ-দোষ নেই, তথাপি লোকসমূহের উৎপত্তি ও বিন্যাসের জন্য নিজ মায়ার দ্বারা জন্মাদি স্বীকার করেন, আমি তাকে নমস্কার করি। যাঁর কর্মসমূহ আশ্চর্যজনক বলে, যিনি প্রাকৃত রূপরহিত হয়েও বহু রূপে বিরাজমান। অনন্ত শক্তিশালী সেই পরমেশ্বর ব্রহ্মবস্তুকে আমি প্রণাম করি।

যিনি সাক্ষী অর্থাৎ স্বপ্রকাশ বলে তার প্রকাশকরণে অন্য কোন বস্তু নেই এবং যিনি পরমাত্মা অর্থাৎ জীবের নিয়ন্তা, তাকে নমস্কার। যিনি বাক্য, মন ও চিত্তবৃত্তির অপ্রাপ্য, তাঁকে নমস্কার করি বিদ্বান ব্যক্তি সন্ন্যাস ও বিশুদ্ধ সত্ত্বগণ (অথবা বিশুদ্ধ চিত্ত) দ্বারা তাকে প্রত্যক্ষভাবে লক্ষ্য করে থাকেনি, সেই মোক্ষনন্দানুব স্বরূপ কৈবল্যৎ (অর্থাৎ প্রকৃতিসম্বন্ধ রহিত মোক্ষ দাতাকে) আমি প্রণাম করি। যিনি শান্ত, ঘোর ও মূঢ়রূপে যথাক্রমে সত্ত্ব, রজঃ ও তমোগুণের অনুকরণ করেন, অথচ বস্তুতঃ সর্বদা নির্বিশেষ, সম্ভাবনার জ্ঞানমভ স্বরূপ, তাকে নমস্কার করি।

.

তৃতীয় অধ্যায়
প্রভুর বন্দনা সূচক নিবেদন

হে দেব, আপনি ক্ষেত্রজ্ঞ (আত্মা, মক্ষি ও সর্বাধ্যক্ষ, আপনি সকলের অন্তরে পূর্ণরূপে বিরাজমান বলে জীবগণের মূল কারণ ও বিশ্বপ্রকৃতির উৎপত্তির হেতু, আপনাকে নমস্কার করি : আপনি সকল ইন্দ্রিয়ের ও তার গুণ বিষয়সমূহের একটা, ইন্দ্রিয়ের বৃত্তিসমূহই জগতের অনেকেরই আত্মা জ্ঞাপক হয় (অর্থাৎ চেতনার অধিষ্ঠান ব্যতীত জড় ইন্দ্রিয়–বৃত্তি সমূহের প্রবণতা হতে পারে না। এই যুক্তিবলেই ইন্দ্রিয়বৃত্তি সমূহ তাদের অধিষ্ঠাতা প্রকাশরূপে সর্বলোকের অগোচরে আপনার সত্য জ্ঞাপন করে), প্রতিবিম্ব যেরূপ অসৎ হলেও তার দ্বারা তার মূলীভূত সৎ বিম্ব পদার্থের অস্তিত্ব জানা যায়, সেরূপ জাগতিক অহংকার প্রভৃতি অসৎ পদার্থের দ্বারা আপনার তত্ত্ব সূচিত হয়ে থাকে। কারণ, অসৎ বিষয়সমূহের মধ্যে আপনার সংরূপ আভাস বিদ্যমান থাকে, আপনাকে প্রণাম করি।

হে প্রভু, আপনি সকল জগতের কারণ-স্বরূপ অথচ আপনার কোন কারণ নেই। কিন্তু আপনি কারণ হলেও মৃত্তিকাদির ন্যায় আপনার বিকার নেই, অর্থাৎ আপনি অদ্ভুত কারণ, আপনাকে নমস্কার। নদীসমূহের যেরূপ সমুদ্রে পরিসমাপ্তি ঘটে, সেরূপ পঞ্চরাপ্রাদি সমস্ত আগমশাস্ত্র এবং নিমিল আপনাতেই পরিসমাপ্ত হয় অর্থাৎ আপনার তত্ত্ব প্রতিপাদ নেই তাদের পরিসমাপ্তি ঘটে। আপনি মোক্ষ স্বরূপ এবং ব্রহ্মাদি উত্তম পুরুষগণের ও একমাত্র আশ্রয়, আপনাকে প্রণাম করি। আপনি চৈতন্যময় অগ্নিস্বরূপ। সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ–এই ত্রিগুণস্বরূপ অরণির (অর্থাৎ মন্থন কাষ্ঠের) মধ্যে আপনার স্বরূপ প্রচ্ছন্ন রয়েছে; গুণসমূহ সৃষ্টি কার্যে উন্মুখ হলে আপনার চিত্ত ও বহির্মুখ হয় (অর্থাৎ বহুরূপ ধারণের সংক্রান্ত গ্রহণ করে)। আর যাঁরা আত্মতত্ত্বের ভাবনাহেতু বিধি নিষেধরূপ-শাস্ত্র-নির্দেশ অতিক্রম করেছেন, তাদের নিকট আপনি স্বপ্রকাশ অর্থাৎ স্বয়ম্ভুই প্রকাশিত হন। এরূপ আপনাকে নমস্কার করি।

প্রভু, আপনি প্রভূত করুণাশালী, স্বয়ং মুক্ত ও করুণাবিতরণ বিষয়ে আপনার কোনো আলস্য নেই বলে আমার মত শরণাগত পশুর পাস (অবিদ্যরূপে বন্ধন) ছেদন করতে সমর্থ হন, আপনাকে প্রণাম করি। আপনি অন্তর্যামীরূপ নিজ অংশ দ্বারা সকল প্রাণীগণের চিত্তে জ্ঞানরূপে প্রতীত হলেও আপনি পরিচ্ছিন্ন নহেন, স্বরূপতঃ অপরিচ্ছন্ন ও সকল প্রাণীর নিয়ন্ত্রণে সমর্থ, আপনাকে নমস্কার করি। আপনি সকলের অন্তর্যামী হলেও গুণাসক্তিরহিত বলে দেহ, পুত্র, আত্মীয়, গৃহ ও পরিজনবর্গ প্রতি আসক্ত চিত্ত ব্যক্তিগণের নিকট (আপনি) দুর্লভ কিন্তু যাঁদের চিত্ত দেহাদিতে অনাসক্ত, তারাই আপনার চিন্তা করে থাকেন।

আপনি জ্ঞানাত্মা (সচ্চিদানন্দ বিগ্রহ) ভগবান ও ঈশ্বর, আপনাকে নমস্কার করি। ধর্ম, অর্থ, কাম ও মুক্তিকামী পুরুষগণ যাঁর ভজন করে কেবল নিজ নিজ অভিলাষিত ধর্মাদিই প্রাপ্ত হন না, তাদের প্রার্থনার অতিরিক্ত অন্যান্য অতিশয় এবং অব্যয় দেহও হয় (নিত্য শরীর) যিনি স্বয়ং প্রদান করে থাকেন, সেই দয়াবান্ (অর্থাৎ প্রভূত করুণাময়) ভগবান আমাকে কেবল মাত্র করে দিন, আমি অধিক প্রার্থনা করি না।

আমি ভক্তি সুখে অনভিজ্ঞ এজন্য এরূপ প্রার্থনা করলাম, কিন্তু যারা তার একান্ত ভক্ত, মুক্ত পুরুষদের সেবা করে নিষ্কাম হয়েছেন, অতএব ভগবানের অদ্ভুত সুমঙ্গল চরিত্র গান করে আনন্দ সমুদ্রে মগ্ন থাকেন ও তারা ভগবানের নিকট কোন বস্তুই প্রার্থনা করেন না। সেই পরমেশ্বর অক্ষয়, পরমব্রহ্ম, আধ্যাত্মিক যোগের দ্বারা লভ্য, সূক্ষ্মপদার্থ অতীন্দ্রিয়, বাহ্য দৃষ্টিতে সকলের অতি দূর অনন্ত, আদ্য ও পরিপূর্ণ স্বরূপ। আমি তার স্তব করছি। যাঁর অত্যল্প অংশ মাত্রের দ্বারা বিবিধ নাম ও বিবিধরূপ বিভাগযুক্ত ব্রহ্মাদি দেবগণ, বেদরাশি এবং চরাচর লোকসমূহ রচিত হয়েছে।

যেমন অগ্নি হতে শিখা ও সূর্য হতে কিরণসমূহ উদগত এবং তাতেই লীন হয়, তেমনি যাঁরা হতে গুণপ্রবাহ (অর্থাৎ বুদ্ধি, মন এবং শরীর সকল) নির্গত এবং যাতে বিলীন হচ্ছে। তিনি দেব নহেন, দানব নহেন, তির্যক (পশুপক্ষী) নহেন, স্ত্রী নন, পুরুষ নন, নপুংসক নয় এবং নিষ্ক্রিয় শূন্য প্রাণিমাত্রও নন, অপর গুণ নন, কর্ম নন, সৎ নন, অসৎ নন, সকল পদার্থে নিষেধের অবধত্বরূপে–অর্থাৎ নেতি নেতি বিচারক্রমে পূর্বোক্ত (সর্বভাবের সীমারূপে) যা অবশিষ্ট থাকে, তাই তিনি, পরন্তু মায়ার দ্বারা আহুত হয়ে থাকেন, সেই ভগবান আমার দুঃখ মোচনের জন্য আবির্ভূত হন।

আমি কেবলমাত্র এই কুম্ভীরের গ্রাস হতে মুক্ত হয়েই বেঁচে থাকতে চাই না, কারণ অন্তরে ও বাইরে অজ্ঞানের দ্বারা আচ্ছন্ন এই হস্তি জন্মের কি প্রয়োজন? পরন্তু আমি আত্মা প্রকারের আবরনস্বরূপ অজ্ঞানেরই মোচন (ধ্বংস) ইচ্ছা করি, যেহেতু (সেটাই জীবের মোক্ষ)–তার আর নাশ নেই। যাঁর কাছে এই প্রার্থনা করছি, আমি তাকে জানি না। তিনি বিশ্বের আত্মা, অজ, ব্ৰহ্ম ও পরমপদস্বরূপ, আমি কেবল তাঁকে প্রণাম করছি।

এসব ধর্মরূপ যোগ দ্বারা যাঁদের সকল কর্ম দগ্ধ হয়েছে এরূপ যোগীগণ যোগ বিভাবিত হৃদয় মধ্যে যাঁকে দর্শন করেন, আমি সেই যোগেশ্বরকে নমস্কার করছি; হে ভগবন্ শক্তিস্বভবা, অথচ বাইরে যিনি সকল ইন্দ্রিয়ের গুণরূপে প্রতীয়মান হন এবং যাদের ইন্দ্রিয়বর্গ কুৎসিত (অর্থাৎ বিষয়াভিমুখী যাদের ইন্দ্রিয়বর্গ), তারা যাঁর পথ জানতে পারে না, দুরন্ত শক্তিশালী, শরণাগত সেই আমাকে প্রণাম করি। যাঁর মায়াবশতঃ অহংবুদ্ধির দ্বারা আবৃত হয়ে তোকসমূহ নিজ আত্মাকে জানতে পারে না, দুরতিক্রম মহাত্মাশালী সেই ভগবানের আমি শরণাগত হয়েছি।

শ্রী শুকদেব বললেন,–গজরাজ এইরূপ নির্বিশেষভাবে (অর্থাৎ কোনরূপ মূর্তি বিশেষের উল্লেখ করে) পরমাত্মতত্ত্বের বর্ণনা করায়, বিভিন্ন মূর্তিবিশিষ্টরূপে আত্মভিমানী ব্রহ্মাদি দেবগণ যখন তাকে উদ্ধারের জন্য এলেন না, তখন অখিলের আত্মা সর্বদেবময় ভগবান হরিই স্বয়ং সেখানে আবির্ভূত হলেন। জগন্নিবাস (জগতের আধার) সুদর্শনচক্রধারী ভগবান শ্রীহরি গজেন্দ্রকে এরূপ পীড়িত লক্ষ্য করে তার কৃত স্তব শুনে গরুড়ে আরোহণপূর্বক স্তুতিকারী দেবগণের সাথে গজরাজের নিকট উপস্থিত হলেন। গজেন্দ্র সরোবরের অভ্যন্তরে মহাবল গ্রাহ কর্তৃক গৃহীত হওয়ায় অতিশয় আর্ত হয়েছিল, আকাশে গরুড়ের পৃষ্ঠে চক্রধারী শ্রীহরিকে দর্শন করে, পদপুষ্পবীর শুন্ডটি ঊর্ধ্বদিকে প্রসারণপূর্বক অতিকষ্টে- হে নারায়ণ, হে অখিল গুরু, হে ভগবান, আপনাকে নমস্কার-–এরূপ বাক্য উচ্চারণ করেছিল।

ভগবান তাকে অত্যন্ত পীড়িত দেখে দয়ার্দ্র হওয়ায় মন করলে, গরুড় মন্দগতি শীঘ্র যেতে পারবে না। অতএব গরুড়ের পৃষ্ঠ হতে সহসা অবতীর্ণ হয়ে, মহাবেগে গজেন্দ্রের নিকট গমন করে, বাম করে শুন্ড ধরে চক্রের সাথেই তাকে সরোবর হতে উদ্ধার করলেন। তারপর দর্শনকারী দেবগণ সমক্ষে দক্ষিণ করে চক্র দ্বারা সেই গ্রহের বদন বিদারিত করতঃ গজেন্দ্রকে মুক্ত করলেন।

শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে মহারাজ, সে সময় ব্রহ্মা, মহেশ প্রভৃতি দেবগণ, ঋষিগণ, গন্ধর্বগণ শ্রীহরির সেই অদ্ভুত কর্মের প্রশংসা করতে করতে কুসুমবর্ষণ করলেন। স্বর্গে দুন্দুভি বাদ্য হল, গন্ধর্বগণ নৃত্যসহকারে গান করছিলেন, এবং ঋষি, চারণ ও সিদ্ধগণ সেই পুরুষোত্তমের স্তব করতে লাগলেন। সে সময়ে সেই কুম্ভীরও তৎক্ষণাৎ দেবল ঋষির সাপ মুক্ত হয়ে পরম আশ্চর্য রূপ ধারণ করল। সে পূর্বে হ্হ্ নামক শ্রেষ্ঠ গন্ধর্ব ছিল। (এক সময় ঐ হুহু-গন্ধর্ব স্ত্রীগণের সাথে সরোবরের মধ্যে ক্রীড়া করছিলেন। এমন সময় দেবল ঋষি ঐ সরোবরে স্নান করতে নামলে, গন্ধর্বরাজ আমোদহেতু ঐ ঋষিবরের চরণ ধরে জলের মধ্যে আকর্ষণ করতে লাগলেন। তাতে মুনিবর কূপিত হয়ে শাপ প্রদানপূর্বক বললেন–”আরে দুষ্ট’, গ্রহ হয়ে জন্মগ্রহণ কর।’ এ শুনে ঐ গন্ধর্ব মুনিকে প্রসন্ন-করলে পরে মুনি বললেন–তুমি গজেন্দ্রের চরণ ধারণ করো, ভগবান শ্রীহরি গজেন্দ্রের উদ্ধার করার সময় তোমাকেও মুক্ত করবেন)

এখন ঐ গ্রহে (কুম্ভীর) শাপ থেমে মুক্ত হয়ে নিজ আশ্চর্য গন্ধর্বরূপ ধারণ করতঃ উত্তম-শ্লোক অব্যয় অধীশ্বর ভগবানকে মস্তক দ্বারা প্রণাম করে, তার গুণগান করতে লাগলেন। ভগবান বিষ্ণু পরম যশের আশ্রয়, অতএব তার গুণী কীর্তনীয় এবং তার কর্মসকল উকৃষ্ট কাহিনীর। তারপর পরমেশ্বর শ্রীহরির অনুকম্পা লাভ করে সেই গন্ধর্ব শাপমুক্ত হয়ে ভগবানকে প্রণাম ও প্রদক্ষিণ করে, সকল লোকের দৃষ্টির সম্মুখেই নিজ গন্ধর্বলোকে গমন করল।

আর, সেই গজেন্দ্র স্পর্শে অজ্ঞানরূপ বন্ধন হতে মুক্ত হয়ে পীতবসন ও চতুর্ভুজ ধারণ পূর্বক ভগবানের শারণ্য (সমান রূপে) প্রাপ্ত হল। রাজন, ঐ গজেন্দ্র পূর্বজন্মে ইন্দ্রদ্যুম্ন নামে বিখ্যাত প্রান্তদেশীয় রাজা ছিলেন, সেই নরপতি বিষ্ণু-পরায়ণ হয়ে কালযাপন করতেন। তিনি জিতেন্দ্রিয় মৌনব্রত, জটাধর তাপস হয়ে মলয়াচলে গিয়ে সেখানে আশ্রম নির্মাণ করলেন। একদিন আরাধনার সময় স্নান করে ভগবান হরির পূজা করতে বসলেন। . সেই সময় যদৃচ্ছাক্রমে মহাভাগ অগস্ত্যমুনি শিষ্যগণের সাথে তার আশ্রমে এসে উপস্থিত হলেন। কিন্তু রাজা ঐ প্রকার ভগবৎ আরাধনার নিমগ্ন থাকায় অগস্ত্য মুনির অভ্যর্থনাদি কিছুই করলেন না, নির্জনে উপবেশনপূর্বক যেমন মৌনব্রতী ছিলেন, তেমনিই থাকলেন। এ দেখে তাঁর প্রতি ঋষি অগস্ত্য অতিশয় ক্রুদ্ধ হলেন। অনন্তর ঋষির অগস্ত্য তাকে এরূপ অভিশাপ প্রদান করলেন–অশিক্ষিত বুদ্ধি ও ব্রাহ্মণের অবমাননাকারী এই অসাধু দুরাত্মা নরকে প্রবেশ করুক। যেহেতু এই রাজা হস্তির ন্যায় জড়বুদ্ধি, অতএব হস্তীই হোক।

শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে মহারাজ, ঋষি অগস্ত্য এরূপ অভিশাপ দিয়ে অনুচরগণের সাথে প্রস্থান করলেন। রাজর্ষি ইন্দ্রদ্যুম্নও ঐ ঘটনাকে–দৈবপ্রাপ্তি মনে করে আত্মবিস্মৃতিজনক হস্তিজত্ম প্রাপ্ত হলেন বটে, কিন্তু শ্রীহরির আরাধনার প্রভাবে পূর্বজন্মের কথা তার স্মৃতিপথে জাগ্রত ছিল। ভগবান পদ্মনাভ এইরূপে গজরাজকে মুক্ত করে, তার নিজ পার্ষদত্ব প্রদান করলেন। তারপর গন্ধর্ব, সিদ্ধ ও দেবতাগণ তার এই অদ্ভুত কর্মের প্রশংসা করতে আরম্ভ করলে, তিনি গরুড়ে–আরোহণপূর্বক সেই গজেন্দ্রের সাথে নিজ ধামে গমন করলেন। হে মহারাজ, এই গজেন্দ্রমোক্ষন নামে শ্রীকৃষ্ণানুভাব তোমার নিকট বর্ণনা করলাম। হে কুরুবর্ষ, যে সকল ব্যক্তি এই বৃত্তান্ত শ্রবণ করে, তাদের স্বর্গ ও যশ লাভ হয় এবং কলিকলুষ ও দুঃস্বপ্ন নাশ হয়। মঙ্গলকামী দ্বিজাতিগণ দুঃস্বপ্নদির শান্তি নিমিত্ত প্রাতঃকালে শয্যা হতে উখিত ও পবিত্র হয়ে যথাবিধি এটি পাঠ করে থাকেন, হে কুরুসত্তম, সর্বতময় ভগবান শ্রীহরি প্রীত হয়ে শ্রবণকারী সকল প্রাণীর সম্পর্কে গজেন্দ্রকে এরূপ বলেছিলেন।

শ্রীভগবানকে বললেন–হে গজেন্দ্র, যারা রাত্রিশেষে উত্থানপূর্বক সংযত হয়ে একাগ্রচিত্তে আমাকে, তোমাকে, এই সরোবর, পর্বত, গুহা ও অরণ্যকে, নেত্র ও বংশগুল্মরাজিকে এবং দেবতরুসমূহ, ব্রহ্মা, শংকর ও আমার অধিষ্ঠান এই পর্বত শৃঙ্গসমূহ, আমার প্রিয় আবাসস্থান ক্ষীরোদসাগর অত্যুজ্জ্বল শ্বেতদীপ, শ্রীবৎসর, কৌস্তুভ, বনমালা, আমার গজ-কৌমদকী, সুদর্শন চক্র, পাঞ্চজন্য শঙ্খ, পক্ষিরাজ গরুড়, শেষনাগ ও আমার সূক্ষ্ম কালরাগিনী ও হৃদয়াপ্রিয়া লক্ষ্মীদৈবী, ব্রহ্মা, মহেশ, দেবর্ষি নারদ, প্রহ্লাদ, মৎস্যকূর্ম বরাহাদি অবতারে আমার অনুষ্ঠিত অনন্ত পুণ্যজনক কর্মসমূহ, সূর্য, চন্দ্র, অগ্নি, প্রণব, সত্য, মায়া, গো-ব্রাহ্মণ, ভক্তিরূপ অক্ষয় ধর্ম, ধর্মপত্নী, সোম ও কাশ্যপের পত্নী দক্ষ কন্যাগণ, গঙ্গা, সরস্বতী, নন্দা, যমুনা, ঐরাবত হস্তী, ধ্রুব, সপ্ত ব্রহ্মর্ষি এবং পুণ্যকীর্তি মানবগণকে আমার বিভূতিরূপে স্মরণ করে, তারা সকল প্রকার পাপ মুক্ত হয়, হে বৎস, যারা রাত্রিশেষে জাগ্রত হয়ে এই বৃত্তান্ত পাঠ দ্বারা আমার স্তুতি করে, আমি তাদের মৃত্যুকালে উত্তম গতি দান করে থাকি।

শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে মহারাজ, ভগবান ঋষিকেশ এই প্রকার আদেশ করে শঙ্খধ্বনি করলেন, পরে দেবতাগণকে-হর্ষোৎফুল্ল করে গরুড়ে আরোহণ করেছিলেন।

.

চতুর্থ অধ্যায়
রৈবত মন্বন্তরের কথা

শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে মহারাজ, আমি তোমার নিকট শ্রীহরি গজেন্দ্রমোণরূপ নানা শ্লোক ও পুণ্যজনক কর্ম বলেছি, এমন রৈবত মন্বন্তরের কথা শোন; পঞ্চম মনুর নাম ‘বৈরত’ তিনি চতুর্থ মনু তামসের সহোদর ভ্রাতা। অর্জুন, বলি, বিন্ধ্য প্রভৃতি তাঁর পুত্র উক্ত মন্বন্তরে বিভু, ইন্দ্র, ভূতক প্রভৃতি দেবতা এবং হিরণ্যগোমা, বেদশিরা ও ঊর্ধ্ববাহু প্রভৃতি ব্রাহ্মণগণ সপ্তর্ষি হয়েছিলেন। আর শুভ্রের বৈকুণ্ঠা নামে যে পক্ষী ছিলেন, তার গর্ভে শুভ্রের ঔরসে স্বধ্য ভগবান ‘বৈকুণ্ঠ’ বৈকুণ্ঠবাসী সুরগণের সাথে নিজ অংশে জন্মগ্রহণ করেন।

ঐ বৈকুণ্ঠই রমাদেবীর প্রার্থনায় তার প্রীতি সম্পাদনের জন্য লোকনমস্কৃত বৈকুণ্ঠলোক নির্মাণ করেন। তার প্রভাব (নিজ পার্ষদদ্বয়ের হিরণ্যাক্ষ ও হিরণ্যকশিপু নামক দৈত্যজন্ম প্রাপ্তি, বরাহ ও নৃসিংহরূপে তাদের সাথে যুদ্ধাদি) গুণ (ব্রাহ্মণ্যতাদি) ও মহা সমৃদ্ধি সমূহ তৃতীয় স্কন্ধান্ত কিছু বর্ণনা করেছি। বস্তুতঃ যে ব্যক্তি তার গুণসমূহ বর্ণনা করতে পারে, সে পৃথিবীর ধূলিকণার সংখ্যা করতে সমর্থ হয় (অর্থাৎ তার গুণ বর্ণনা অসম্ভব)।

এক্ষণে ষষ্ঠ মনুর বিবরণ বলছি। চক্ষুর পুত্র ‘চাক্ষুষ’, ইনি ষষ্ঠ মনু হয়েছিলেন। পুরু, পুরুষ ও সুদ্যুম্ন প্রভৃতি তাঁর পুত্র। ঐ মন্বন্তরে মন্ত্রম ইন্দ্র, আপ্য প্রভৃতি দেবতা এবং হৰ্য্যম্মান ও বীরক প্রভৃতি সপ্তর্ষি হয়েছিলেন। ঐ মন্বন্তরেই বৈরাজের ঔরসে দেবসস্তৃতির গর্ভে জগৎপতি ভগবান বিষ্ণু নিজ অংশে জন্মগ্রহণ করে ‘অজিত’ নামে বিখ্যাত হন। এই অভিজ্ঞ সমুদ্র অজিত মন্থন পূর্বক দেবতাদের জন্য সুধা সংগ্রহ করেছিলেন এবং মন্থনদণ্ড মন্দার পর্বত জলমধ্যে বিচলিত হলে তিনি কূর্মরূপে তাকে পৃষ্ঠে ধারণ করেছিলেন,

মহারাজ পরীক্ষিৎ বললেন–হে ব্রাহ্মণ, ভগবান বিষ্ণু যে প্রকারে ক্ষীরসাগর মন্থন করেন, যে কারণে কূর্মরূপে পৃষ্ঠে মন্দার পর্বত ধারণ করেছিলেন, দেবগণ যে প্রকারের অমৃত প্রাপ্ত হন এবং তৎকালে অন্য যা যা ঘটেছিল, আপনি–ভগবানের সে সকল পরমাশ্চর্য কর্ম আমাদের নিকট বলুন।

হে মুনিবর, আপনি জগৎপতি শ্রীহরির মহিমা সম্যকভাবে বর্ণনা করলেও উহার দ্বারা আমার চিরকালের সন্তাপ তাপিত চিত্ত কোনরূপইে পরিতৃপ্ত হচ্ছে না (বরং শ্রাবণের ইচ্ছা উত্তরোত্তর বর্ধিতই হচ্ছে), শ্রীসূত বললেন–হে ঋষিগণ দ্বৈপায়ন আর শুকদেব এই প্রকারে দ্বিজাতিগত হয়ে তার অভিনন্দনপূর্বক শ্রীহরির পরাক্রমসমূহ বর্ণনা করতে আরম্ভ করলেন।

শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে মহারাজ, যখন দেবগণ যুদ্ধে অসুরগণ কর্তৃক তীক্ষ্ণ অস্ত্রসমূহের দ্বারা আহত হয়ে প্রাণত্যাগপূর্বক রণক্ষেত্রে পতিত হয়েছিল এবং তাদের অনেকেই আর পুনরায় উখিত হলো না, আর যে সময়ে দুর্বাসা স্মরিত অভিশাপে ইন্দ্রের সাথে ত্রিভূবন নিষ্প্রদীপ (লক্ষ্মীশূন্য) হল। তারপর তারা সকলে সুমেরু উপরিভাগে অবস্থিত ব্রহ্মার সভায় উপস্থিত হয়ে প্রণতিসহকারে ব্রহ্মার নিকটে সকল কথা নিবেদন করলেন।

পরমেষ্ঠী ব্রহ্মা, ইন্দ্র, বায়ু, প্রভৃতি দেবগণকে বলহীন ও নিষ্প্রভ এবং লোকসকলকে প্রায়। আর অসুরদের বলবান ও ক্লান্তিযুক্ত লক্ষ্য করে, একাগ্রচিত্তে পরমপুরুষ শ্রীহরিকে স্মরণ করত উৎফুল্লবদনে সেই দেবতাদের বলতে লাগলেন–ওহে দেবগণ, আমি (ব্রহ্মা), ভগবান ভব, তোমরা অসুর প্রভৃতি জীবগণ এবং মনুষ্য, তির্যক প্রাণী, বৃক্ষ ও স্বেদজ প্রাণীগণ এ সকল যাঁর অবতাররূপ পুরাণের ত্যাগ অব্যয় পরমেশ্বরেরই শরণাপন্ন হব। যদিও তার বধ্য বা রক্ষণীয়, উপেক্ষাযযাগ্য বা আদর যোগ্য কেউ নেই, তথাপি তিনি সৃষ্টি, স্থিতি ও সংহাবের জন্য যথাসময়ে রজঃ, সত্ত্ব ও তমোগুণ আশ্রয় করেন। দেহীগণের কল্যাণের জন্য সত্ত্বগুণধারী ভগবান হরির ইহা স্থিতি রক্ষার কাল বলে, আমরা সেই জগদ্গুরুর স্থান গ্রহণ করব। তিনি দেবতাপ্রিয় অতএব তার নিজ জন আমাদের মানসসাধন করবেন।

.

পঞ্চম অধ্যায়
ব্রহ্মা কর্তৃক বিষ্ণুর স্তুতি

শ্ৰীশুকদেব বললেন,–হে শত্রুনাশন মহারাজ, ভগবান ব্রহ্মা দেবতাদের এরূপ বলে, তাদের সাথে তমোগুণের পরবর্তী যে স্থান হরির সাক্ষাৎ অধিষ্ঠানক্ষেত্র, সেই ক্ষীরোদ সাগরে গমন করলেন। ব্রহ্মা সেখানে উপনীত হয়ে সাবধানচিত্তে বৈদিক বাক্যে দ্বারা, অদৃষ্টরূপ কিন্তু শ্রুতপূর্ব ভগবান হরির স্তব করতে আরম্ভ করলেন। শ্রীব্রহ্মা বললেন–হে ভগবৎ, আপনি মন অপেক্ষা বেগবান বলে মন দ্বারা বিচারের অযোগ্য, উপাধিমুত বলে সর্বত্র অনুপ্রবিষ্ট আদ্যন্তরহিত বলে নির্ধিদ্ধায়। অতএব যাদের অগোচর বরেণ্য শ্রেষ্ঠ দেবতা। আমরা আপনাকে প্রণাম করি।

যিনি প্রাণ, মন, বুদ্ধি ও আত্মার (অহংকারের বা দেহের) আপনাকে উদ্গাতা, যিনি বিষয় ও ইন্দ্রিয়রূপে প্রকাশিত হন। অথচ যিনি স্বপ্নদ্রষ্টার ন্যায় অজ্ঞানরহিত আর যাঁর দেহ নেই, যিনি অক্ষয় ও আকাশের মত সর্বব্যাপী এবং যাঁতে জীবপশুপতিনী অবিদ্যা অথবা অগ্নিবর্তিকা বিদ্যা কিছুই থাকে না, তিনি তিন যুগেই আবির্ভূত হন, আমরা তার শরণাপন্ন হই। জীবের দেহাদি চক্রতুল্য, উহা মায়ার দ্বারা ঘূর্ণিত হচ্ছে। মন এই চক্রের প্রধান অংশ; দশ ইন্দ্রিয় ও পন্নত প্রাণ–এই পঞ্চদশটি ঐ চক্রের অরা (অর্থাৎ চক্রের মধ্যভাগে গ্রথিত ও চারদিকে প্রান্তভাগে সংলগ্ন এলাকা) সত্ত্বাদি তিনটি গুণ উহার নাভি (মধ্যভাগ, উহা বিদ্যুতের মত ছঞ্চল, প্রকৃতি, মহতত্ত্ব, অহংকার ও শব্দাদি পঞ্চতন্মাত্র–এই আটটি এই চক্রের নেমি (অর্থাৎ প্রান্তভাগের ন্যায় আবরন স্বরূপ)। যিনি এই চক্রের অক্ষ (অর্থাৎ অধিষ্ঠান বা অবলম্বন) সেই সত্যস্বরূপ পরাশ্বরের শরণাগত হচ্ছি।

তিনি ভক্তদের রক্ষার জন্য গরুড়ের উপর উপবিষ্ট, কিন্তু জ্ঞানৈক্যস্বরূপ ও প্রকৃতির পর, আরা যিনি অদৃশ্য ও অব্যক্ত এবং যাঁর পরিচ্ছেদ হয় না, বীরগণ যোগরূপ উপায়ের দ্বারা যার উপাসনা করেন, সেই পরমেশ্বরকে আমরা প্রণাম করি। কোন ব্যক্তি যার মায়াকে অতিক্রম করতে সমর্থ হয় না, যে মায়ার প্রভাবে তোক নিজ স্বরূপকেও জানতে পারে না, অথচ যিনি আত্মশক্তি মায়া ও মায়িক গুণসমূহকে জয় করেছেন। সর্বভূতে সমানরূপে বিচরণশীল, আমরা সেই আপনাকে প্রণাম করি। আমরা এই দেবতা ও ঋষিগণ যাঁর প্রিয়মূর্তি সত্ত্বগুণ দ্বারা সৃষ্টি হয়েও, বাইরেও অন্তরে সত্তা ও প্রকাশ দ্বারা সাক্ষাৎ প্রকাশমান যাঁর সূক্ষ্ম গতি (অর্থাৎ নিরপাধি স্বরূপ) জানতে পারি না, রজঃ ও তমোগুণ প্রধান অসুরাদি জীবগণ কিরূপে তাকে জানতে পারব? অতএব আমরা তাকে প্রণাম করি।

যে পৃথিবীতে জরায়ুজ, অন্তজ, স্বেদজ ও উদ্ভিজ্জ রূপ চার প্রকার প্রাণী সৃষ্টি হয়, নিজ রচিত সেই পৃথিবী যাঁর পদযুগল; মহাবিভূতিশালী অচ্যুত স্বরূপ সেই স্বতন্ত্র মহাপুরুষ ব্রহ্মা আমাদের প্রতি প্রসন্ন হোন, যে জল হতে অখিল নোক ও লোকপাল সকল উৎপন্ন, জীবন্ত বর্ধিত হয়, সেই উদার শক্তিযুক্ত জল, যাঁর রেতঃ স্বরূপ, সেই মহৈশ্বর্যাশালী পরমেশ্বর আমাদের প্রতি প্রসন্ন হোন। যে সোম দেবতাদের আত্ম বল ও আয়ু স্বরূপ, আর যিনি বৃক্ষসকলের প্রকৃষ্ঠরূপে বৃদ্ধির কারণ, পণ্ডিতগণ সেই সোমকে যাঁর কর্ম বলে থাকেন,–সেই মহাবিভূতিশালী পরমেশ্বর আমাদের প্রতি প্রসন্ন হন। যাহা হতে বেদরূপ ধন উৎপন্ন হয় এবং বেদপ্রতি পাদ্য যজ্ঞাদি ক্রিয়ানুষ্ঠানের জন্য যাঁর জন্ম, আর যিনি সমুদ্রে বাড়বানল রূপে অবস্থানপূর্বক জল প্রভৃতির পাক মত করে। জীবের উদরে থেকে পরিপাকযোগ্য অন্নাদি পরিপাক করেন, সেই অগ্নি যাঁর মুখ স্বরূপ; সেই মহাবিভূতিনাশী পরমেশ্বর আমাদের প্রতি প্রসন্ন হোন।

যে সূর্য দেবযান অর্থাৎ অর্চিরাদি বত্মের দেবতা, ত্রয়ীময় (বেদত্রয় স্বরূপ), ব্রহ্মের উপাসনার স্থান (অর্থাৎ যার মধ্যে অধিষ্ঠিত ব্রহ্মের উপাসনা করা হয়) এবং দেবযানত্বহেতু মুক্তির দ্বার স্বরূপ ও পুণ্যধাম বলে অমৃতময় ও কালরূপী বলে মৃত্যুরূপে গণ্য হন, সেই সূর্য যাঁর চক্ষুঃ, সেই মহা বিভূতিশালী পরমেশ্বর আমাদের প্রতি প্রসন্ন হোন। ভৃত্যগণ যেমন সম্রাটের অনুবর্তন করে, তেমনি বুদ্ধি প্রভৃতির অধিষ্ঠাতা আমরা দেবতাগণ যে মুখ্য প্রাণের অনুবর্তন করছি, চর অচর-সকল ভূতের তেজঃ বল ও সামর্থ্যাদি ধর্মবিশিষ্ট সেই প্রাণবায়ু যাঁর প্রাণ হতে উৎপন্ন হয়েছে, সেই মহৈশ্বর্যশীল পরমেশ্বর আমাদের প্রতি প্রসন্ন হোন।

যাঁর বল হতে ইন্দ্র, প্রসন্নতা হতে দেবগণ, ক্রোধ হতে রুদ্র, বুদ্ধি হতে ব্রহ্মা, দেহচ্ছিদ্র হতে বেদ ও ঋষিগণ এবং লিঙ্গ হতে প্রজাপতির উৎপত্তি হয়েছে, সেই মহাবিভূতিশালী পরমেশ্বর আমাদের প্রতি প্রসন্ন হোক। যাঁর বক্ষস্থল হতে মন্ত্রী (লক্ষ্মী), ছায়া হতে পিতৃগণ, স্তন হতে ধর্ম, পৃষ্ঠ হতে অধর্ম, মস্তক হতে স্বর্গ এবং জিহ্বা হতে অপ্সরাগণ উৎপন্ন হয়েছে। সেই মহাবিভূতিশালী পরমেশ্বর আমাদের প্রতি প্রসন্ন হোন। যাঁর মুখ হতে বিপ্র ও পরমগুহ্য (অর্থাৎ অতীন্দ্রিয়ার্থ অববোধক) বেদ, ভূজদ্বয় হতে ক্ষত্রিয় ও বল উরুযুগল হতে বৈরাগ্য ও নৈপুণ্য এবং চরণ হতে শুদ্র ও সুশ্রষার উৎপত্তি হয়েছে, সেই মহাবিভূতিশালী পরমেশ্বর আমাদের প্রতি প্রসন্ন হোক। যার অধর হতে লোভ, উত্তবোষ্ঠ হতে প্রীতি। নাসিকা হতে কান্তি, স্বর্গ হতে পশুদের হিতকর কাম, হৃদয় হতে যম এবং পক্ষম (চোখের পাতা) হতে কাল উৎপন্ন হয়েছে, সেই মহাবিভূতিশালী পরমেশ্বর আমাদের প্রতি প্রসন্ন হোক।

জ্ঞানীগণ বিচার দ্বারা যার বাস্তবত্ব নিরশন করে থাকেন অথচ বস্তুতঃ যা দুজ্ঞেয়। সেই পঞ্চভূত কাল, কর্ম গুণ ও এই ভৌতিক প্রশস্ত যাঁর যোগমায়ার মহিমারূপে বর্ণিত হয়, সেই বিভূতি স্বামী পরমেশ্বর আমাদের প্রতি প্রসন্ন হোন; যার মধ্যে মায়াশক্তি সমূহ উপশান্ত (অর্থাৎ নিষ্ক্রিয়) রয়েছে, স্বরাজ্য লাভ হেতু যাঁর স্বরূপ পরিপূর্ণ। যিনি দর্শনাদি বৃত্তি দ্বারা মায়া বিরচিত গুণসকলে আসক্ত হন না এবং যাঁর শরীর বায়ুর ন্যায় অপ্রতিহত, আমরা তাকে নমস্কার করি। হে ভগবান, আমরা শরণাপন্ন হয়ে আলোর সম্মত মুখপদ্ম দর্শন করতে ইচ্ছা করছি। আমাদের চক্ষুরাদি ইন্দ্রিয় গোচর সেরূপে হয়, সেইরূপে আপনার নিজ স্বরূপ প্রদর্শন করান। প্রভু, যে যে কর্ম আমাদের অনন্য, আপনি ভক্তজনের ইচ্ছানুবর্তী হয়ে কালে কালে স্বেচ্ছাকৃত বিভিন্ন অবতার রূপে নিজেই যে সকল কর্মসম্পন্ন করে থাকেন,–

হে ভগবন, বিষয়াসক্ত ব্যক্তিদের বিষয়ানুসন্ধানমূলক কর্মসমূহে প্রচুর ক্লেশ এবং অতি অল্প ফলই জন্মে থাকে, আবার পরে ঐ সকল কর্ম সম্পূর্ণভাবে নিষ্ফল হয়। কিন্তু ভক্তগণের আপনাতে অর্পিত কর্ম সেরূপ কখনও হয় না (অর্থাৎ তা নিষ্ফল না হয়ে গরম মহাফলই প্রদান করে), অত্যল্প কর্মাভ্যাসও ঈশ্বরে অর্পিত হলে, তা কখনও বিফল হয় না, কারণ ঈশ্বরই জীবের আত্মা, প্রিয় ও হিতকারী। প্রিয় হিতকারী আত্মাতে যা অর্পণ করা যায়, তা কি নিষ্ফল হতে পারে? যেমন বৃক্ষের মূলে জল সেচন করলেই স্কন্দ সামা প্রভৃতি সকল অবয়বের মেনে করা হয়, তেমনি ভগবান বিষ্ণুর আরাধনা করলে সকল স্থাবর-জঙ্গমাত্মক প্রাণীগণের এবং (আরাধনাকারীর) নিজেরও আরাধনা হয়ে থাকে। হে ভগবান, আপনার স্বভাব ও কর্মসমূহ বিতর্কের (বিচারের) অযোগ্য। আপনি নির্গুণ গুণেশ্বর সত্ত্বগুণে অধিষ্ঠিত ও জ্বরাপতঃ অনন্ত (অর্থাৎ দেশ, কাল ও বস্তুর পরিচ্ছেদ রহিত)। আমৃত্যু সম্প্রতি আপনার উদ্দেশ্যে কেবলমাত্র প্রণতি জ্ঞাপন করছি।

শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে মহারাজ, দেবগণের দ্বারা এরূপ স্তুত হয়ে, সহস্র সূর্যের উদয়ে যেরূপ দ্যুতি হয়, সেরূপ দ্যুতি সম্পন্ন ভগবান ঈশ্বর তার সমক্ষে আবির্ভূত হলেন। সেই দীপ্তির দ্বারা দেবতাদের দৃষ্টি প্রতিহত হলে, তারা আকাশ, দিক, পৃথিবী এবং নিজেদেরও দেখতে পেলেন না। আর সেই বিভুকে কিরূপে দেখতে সমর্থ হবেন? কিছুক্ষণ পর দেবশ্রেষ্ঠ ভগবান ব্রহ্মা-অন্ধকারের সাথে সেই মূর্তি দর্শন করে, ভূতলে দন্ডবৎ প্রণত হয়ে অন্যান্য দেবগণের সহিত সেই পরমপুরুষের স্তুতি করেছিলেন। ভগবানের সেই মূর্তি সুনির্মল মরকত মুনির ন্যায় শ্যামবর্ণ, তার নয়নযুগল পদ্মপুঞ্জের অভ্যন্তরভাগের ন্যায়, সর্বাঙ্গ তপ্ত কাঞ্চনের ন্যায় পীতবর্ণ, মনোহর কৌষেয় বস্ত্রেও দ্বারা আবৃত ছিল। তার অবয়বসমূহ প্রসন্ন ও সুন্দর, মুখমণ্ডল ও ভ্রুযুগল সুশোভন, মস্তক মহামণিয় মুকুটশোভিত, বাহুদ্বয় কেয়রমণ্ডিত, শ্রীমুখমণ্ডল কুণ্ডলযুগলের দ্বারা উদ্ভাসিত গণ্ডদ্বয়ের শোভায় রমণীয়, নানা অঙ্গ চন্দ্রহার, বলায়, হার ও নুপূর দ্বারা অলংকৃত এবং গলদেশ কৌস্তভমণি ও বনমালা দ্বারা বিভূষিত হয়েছিল। তিনি বক্ষঃস্থলে লক্ষ্মীদেবীকে ধারণ করেছিলেন এবং সুদর্শন প্রভৃতি নিজেরে অস্ত্রসমূহ–মূর্তিমান হয়ে তার উপাসনা করেছিলেন।

ব্রহ্মা বললেন–হে ভগবন্ শ্রীমূর্তির এ আবির্ভাব মাত্র, আমাদের মত আপনাকে জন্মদি নেই, কারণ আপনার জন্ম, স্থিতি ও বিনাশ–এ তিনটিই উৎপন্ন হয় না। তার হেতু আপনি নিগুণ, এই জগৎ-ও জ্ঞানীগণ আপনাকে নির্বাণসুখের সমুদ্র বলে থাকেন। আপনি ঐরূপ হলেও দুজ্ঞেয় বলে সূক্ষ্ম হতেও অতিসূক্ষ্ম, বস্তুতঃ আপনার মূর্তির ইয়ত্তা নেই। আপনার অনুভব অসত্য, অতএব আপনাকে বারবার প্রণাম করি। হে পুরুষোত্তম, আপনার এই মূর্তি শ্রেয়স্কামী পুরুষগণ কর্তৃক বৈদিক ও তান্ত্রিক ও তান্ত্রিক সাধনের দ্বারা চিরকাল পূজিত হয়ে আসছে, অতএব ইহা সনাতন। হে বিধাতঃ এই নিখিল বিশ্ব আপনার মধ্যে অবস্থিত বলে, আপনার মধ্যে আমরা ত্রিলোকসহ আমাদের সকলকেই দর্শন করছি, অতএব এই মূর্তি পরিচ্ছন্ন নহে।

হে ভগব আপনি আত্মতন্ত্র (অর্থাৎ সব কিছুর আশ্রস্বরূপ), এই বিশ্ব সৃষ্টির পূর্বে আপনাতেই ছিল, মধ্যেও রয়েছে এবং অন্তেও আপনাতেই থাকবে। মৃত্তিকা যেমন ঘটের আদি, অন্ত ও মধ্য আপনিও তেমনি। এই জগতের আদি, অন্ত ও মধ্য কারণ আপনি প্রধান (প্রকৃতি) হতেও পর (শ্রেষ্ঠ)। আপনি নিজ অধীন মায়ার দ্বারা এই বিশ্ব নির্মাণ করে, তাতে প্রবিষ্ট হয়েছেন। শাস্ত্রজ্ঞ বিবেকী যোগীগণ মন দ্বারা; গুণসমূহের পরিণামের মধ্যেও আপনাকে অগুণরূপে (অর্থাৎ গুণ সম্পর্ক শূন্যরূপে) দর্শন করে থাকেন, মনুষ্যগণ–যেমন মন্থন দ্বারা কাষ্ঠের মধ্যে অগ্নি, দোহনাদির দ্বারা গাভীর মধ্যে ঘৃত, কৰ্ষণাদির দ্বারা পৃথিবীর মধ্যে ধান্যাদি খাদ্য এবং বাণিজ্যাদির দ্বারা পুরুষকারের মধ্যে জীবিকা প্রাপ্ত হয়, তেমনি মনীষীগণ বুদ্ধির দ্বারা গুণসমূহের মধ্যে আপনাকে লাভ করেন এবং উহা বলে থাকেন।

হে নাথ, হে পদ্মনাভ, দাবানল পীড়িত হস্তিগণ গঙ্গার জলরাশি প্রাপ্ত হয়ে যেরূপ শান্তি–লাভ করে, আমরাও আমাদের চিরকালের পরমপুরুষার্থরূপ আপনাকে সাক্ষাৎ আবির্ভূত হতে দেখে সেরূপ শান্তি লাভ করছি। আমরা সমস্ত লোকপালগণ যে কাজের জন্য আপনার পাদমূলে সমবেত হয়েছি, আপনি তা সম্পাদন করুন–হে অন্তরাত্মান আপনি; জগতের সকল বিষয়ই প্রত্যক্ষ করছেন, আপনাকে অন্যে কি বিজ্ঞাতল করবে। হে ভগবান, আমি শংকর, ইন্দ্রাদি দেবগণ এবং দক্ষ প্রভৃতি প্রজাপতিগণ অগ্নির স্ফুলিঙ্গের আপনা হতে পৃথক হয়ে নিজেদের মঙ্গল কি রূপেই বা জানব? অতঃপর আপনিই ব্রাহ্মণ ও দেবগণের কর্তব্য বিষয়ে উপদেশ দিন।

শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে মহারাজ, এই প্রকারে ব্রহ্মাদি দেবগণ স্তব করলে ভগবান শ্রীহরি তাদের মনোগত অভিপ্রায় জানতে পেরে, কৃতাঞ্জলি হয়ে সম্মুখে অবস্থিত ও সংযতেন্দ্রিয় দেবতাদের উদ্দেশ্যে মেঘগম্ভীর স্বরে এরূপ বলে ছিলেন। যদিও সকল দেবগণের অধীশ্বর।–ভগবান শ্রীহরি একাকীই দেবতাদের কার্যসাধনে সমর্থ, তথাপি সমুদ্র মন্থাদির দ্বারা বিহার করতে অভিলাষ করে তাদের এরূপ বলতে লাগলেন।

শ্রীভগবান বললেন–হে ব্রাহ্মণ-হে দেবগণ এবং গন্ধর্বগণ, তোমরা সকলে অবহিত হয়ে আমার কথা শোন। হে সুরসঙ্, যে প্রকারে তোমাদের মঙ্গল হবে, তা বলছি শোন। সম্প্রতি তোমরা যাও, যে পর্যন্ত নিজেদের বৃদ্ধিসাধন না হয়, ততকাল শুক্রাচার্যের অনুগ্রহপুষ্ঠ দানব ও দৈত্যগণের সাথে সন্ধি স্থাপন কর (অর্থাৎ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হলে বিদ্রূপ করবে)। হে দেবগণ, কর্তব্য বিষয়ের গুরুত্ববোধে কার্য মার্গে প্রবৃত্ত ব্যক্তিগণের পক্ষে কালসর্প ও মূষিকৈর ন্যায় (অর্থাৎ দৈবাৎ গোষ্ঠি পেটিকা মধ্যে নিবদ্ধ সর্প যেমন নির্গমদ্বার বিধানার্থ প্রথমে মুষিকের সঙ্গে সন্ধি করে, পরে ঐ মূষিককেই ভক্ষণ করে, সেরূপ)। শত্রুর সঙ্গেও সন্ধি করতে হয়। তোমরা দৈত্যদের সাথে সন্ধি করে, অমৃত উৎপাদনের জন্য যত্ন কর। কারণ অমৃত পান করলে মৃত্যুগ্রস্ত জীবও অমর হয়।

হে দেবগণ, তোমরা ক্ষীরোদ সাগরে তৃণলতা, গুল্ম ও ওষধিসমূহ নিক্ষেপপূর্বক মন্দর পর্বতকে মন্থন দণ্ড ও বাসুকিকে রজ্জ্ব করে আমার সাহায্যে সমুদ্র মন্থন কর। এতে দৈত্যগণ ক্লেশভোগী ও তোমরা ফলভোগী হবে। হে দেবগণ, বলবান সহকারীর দ্বারা কোনো প্রয়োজন সাধন করতে হলে; তাদের অনুসরণ করা আবশ্যক। অতএব অনুসরণ যা যা ইচ্ছা করবে, তোমরা তাতেই সম্মত হবে। যেহেতু সাম মার্গের দ্বারা যেরূপ অনায়াসে সকল কার্য সুসিদ্ধ হয়, ক্রোধের দ্বার সেরূপ সিদ্ধ হয় না। সমুদ্র মন্থনে কালকূট বিষ উৎপন্ন হলে তাতে ভয় করো না। আর, মন্থন করতে করতে অন্যান্য যে সকল লোভ্য বস্তু উঠবে, তার জন্য লোভ ও কামনা, কিংবা তা না পেলে ক্রোধও করবে না।

শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে রাজন, স্বচ্ছন্দগতি ঈশ্বর ভগবান পুরুষোত্তম দেবতাদের এই প্রকার আদেশ করে তাদের সম্মুখেই অন্তর্ধান করলেন। ভগবান অন্তর্হিত হলে লোকপিতামহ ব্রহ্মা ও ভব ভগবানের উদ্দেশ্যে নমস্কার করে, নিজ নিজ ধামে চলে গেলেন এবং দেবগণ দৈত্যরাজ বলির নিকট গমন করলেন। তৎকালে শত্রু দেবতাদের যুদ্ধসজ্জাহীন দেখেও বলিরাজের সেনানায়কগণ আঘাত করতে উদ্যত হলে, সন্ধি ও বিগ্রহের সময় বিষয়ে অভিজ্ঞ যশস্বী বলি তাদের নিষেধ করেছিলেন। তারপর দেবগণ অসুর সেনাপতিগণ কর্তৃক সুরক্ষিত এবং পরম সমৃদ্ধিশালী ত্রিলোকবিজয়ী বলিরাজের নিকট গমন করলেন। তাদের মধ্যে মহামতি মহেন্দ্র মনোজ্ঞ বচনে সান্ত্বনা করে বলির নিকট সমুদ্র মন্থনাদি সেই সমস্ত বিষয়ের প্রস্তাব করলেন। ভগবান পুরুষোত্তম যা যা শিখিয়ে দিয়েছিলেন। দেবরাজ ইন্দ্রের সেই সকল বাক্য দৈত্যরাজ বলির এবং তথায় উপস্থিত শম্বর, অরিষ্টনেমি ও স্থিরবাসী সকল দৈত্যনায়কদেরই সম্মতি হয়েছিল।

হে শত্রুনাশন, তারপর শপথপূর্বক সৌহার্দবন্ধনে আবদ্ধ সেই দেবতা ও অসুরগণ অমৃত লাভের জন্য পরম উদ্যম প্রকাশ করতে লাগলেন। পরিখের ন্যায় বিশাল বাহু, শক্তিশালী সেই দুর্মদ দেবতা ও অসুরগণ মহাপরাক্রমে মন্দর পর্বত উৎপাটনপূর্বক সিংহনাদ করতে করতে তাকে সমুদ্রের দিকে নিয়ে চললেন। কিন্তু ইন্দ্র ও বলি প্রভৃতি দেবাসুরগণ দীর্ঘপথ সেই গুরুতর ভারবহনে শ্রান্ত ও বিবশ হয়ে আর ভার বহন করতে না পারায় পথিমধ্যেই উহা পরিত্যাগ করেছিলেন। সুবর্ণময় সেই মন্দর পর্বত যখন ভূতলে পতিত হল, তার গুরুতর ভারে বহু দেবতা ও দানবদের চূর্ণ করে ভূমিশায়ী করল।

তারপর ভগবান গরুড়ধ্বজ, দেব ও দানবদের ভগ্নবাহু ও ক্ষুণ্ণমনা জানতে পেরে তৎক্ষণাৎ সেখানে এসে উপস্থিত হলেন এবং পর্বত পতনে দেব ও দানবদের নিস্পেশিত নিরীক্ষণ করে, ঈক্ষন দ্বারা সুস্থ করতঃ পুনর্জীবিত করলেন। তারপর তিনি এক হস্ত দ্বারাই অনায়াসে পর্যতটিকে গরুড়ের উপর স্থাপন করে, নিজেও তার পৃষ্ঠে আরোহন করলে ভ্রষ্ট দেবতা ও অসুরগণ কর্তৃক বেষ্টিত হয়ে ক্ষীর সমুদ্রের নিকট যাত্রা করলেন। তারপর পক্ষিরাজ গরুড় নিজ স্কন্ধ হতে সেই পর্বতটিকে নামিয়ে জলের প্রান্তভাগে স্থাপন করলে ভগবান তাকে অন্যত্র পাঠিয়ে দিলেন। (গরুড় সেখানে থাকলে বাসুকির আসা সম্ভব হবে না বলেই ভগবান শ্রীহরি তাকে বিদায় দিয়েছিলেন)।

.

ষষ্ঠ অধ্যায়
সমুদ্র মন্থনের বর্ণনা

শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে কুরুশ্রেষ্ঠ, “সমুদ্রমন্থনে যে অমৃত উৎপন্ন হবে, তাতে তোমারও ভাগ থাকবে”–এরূপ বলে দেবতা ও অসুরগণ বাসুকিকে মন্থনরঙ্কু করে মন্দর পর্বতে বেষ্টন করলেন। পরে অমৃত লাভের জন্য অতি বত্মে হর্ষ ভরে সমুদ্র মন্থন আরম্ভ করলেন (বাসুকির মুখ বিষদন্তে অতিশয় তীব্র, এজন্য কৌশলে তাই অসুরদের গ্রহণ করবার ইচ্ছায়) ভগবান শ্রীহরি প্রথমে মন্থন রঞ্জুর (বাসুকির) মুখের দিক ধারণ করলেন এবং অন্যান্য দেবগণও তাই ধারণ করলেন (তা দেখে দৈত্যপতি মনে করল–উহা পৌরুষের কাজ, অতএব তারা দেবতাদের মুখের দিক ধরতে দিতে চাইল না, তারা আপত্তি করে বলল)–আমরা বেদ অধ্যয়ন ও শাস্ত্র শ্রবণসম্পন্ন, জন্ম ও কর্ম দ্বারা সর্বত্র বিখ্যাত, সর্পের পুচ্ছভাগ অমঙ্গল, আমরা উহা গ্রহণ করব না, এ বলে তারা মৌনভাবে অবস্থান করল। দৈত্যদের ঐ সকল কথা শুনে পুরুষোত্তম শ্রীহরি মৃদু হাস্য করে, দেবগণের সাথে বাসুকির অগ্রভাগ পরিত্যাগ করে পুচ্ছভাগ ধারণ করলেন! এরূপে কশ্যপানন্দন দেবতা ও অসুরগণের স্থান বিভাগ হলে, তারা অমৃত লাভের জন্য অতিশয় যত্ন সহকারে সমুদ্র মন্থন করতে লাগলেন; হে পাণ্ডুনন্দন, এইরূপে সমুদ্রমন্থন আরম্ভ হলে, সেই মন্দার পর্বতটি বলশালী দেবাসুরগণ কর্তৃক এইরূপ নিজেদের পৌরুষ বিনষ্ট হলে, দেবতা ও অসুরগণের চিত্ত অতিশয় বিষাদগ্রস্ত এবং মুখোনি মলিন হয়ে গেল। অপার শক্তিশালী সত্যবত্মকল্প ভগবান শ্রীহরি তৎকালে বিঘ্নেশ্বর কর্তৃক এরূপ বিঘ্ন লক্ষ্য করে অদ্ভুত ও বৃহৎ কচ্ছপ মূর্তি ধারণ করলেন এবং সমুদ্রমধ্যে প্রবেশ করে পৃষ্ঠ দ্বারা পর্বতটিকে উত্তোলন করেছিলেন।

তখন দেবতা ও অসুরগণ মন্দার পর্বতকে উত্থিত হতে দেখে পুনরায় মন্থন কার্যে উদ্যত হলেন এবং অপর একটি মহাদ্বীপের ন্যায় কূর্মরূপী ভগবান লক্ষ্যযোজন বিস্তৃত নিজ পৃষ্ঠদ্বারা মন্দর পর্বতকে ধারণ করে রইলেন, হে মহারাজ, অতুলনীয় প্রভাবশালী আদি কচ্ছপমূর্তি শ্রীহরি তৎকালে শ্রেষ্ঠ দেবতা ও অসুরগণ কর্তৃক পরিচালিত ও ঘূর্ণনরত সেই মন্দরগিরি নিজ পৃষ্ঠ ধারণ করে, তার সেই ঘূর্ণনকে নিজ অঙ্গ-কন্য়নের ন্যায় মনে করছিলেন।

তৎকালে ভগবান শ্রীহরি অসুরদের বলবীর্য বর্ধন করার জন্য তাদের মধ্যে অসুররূপে, দেবতাদের মধ্যে দেবরূপে এবং বাসুকির মধ্যে অবোধরূপে আবিষ্ট হলেন, অর্থাৎ তাদের দেহে অদৃশ্যভাবে শক্তিসঞ্চার করেছিলেন। তারপর সহস্রবাহু ভগবান শ্রীহরি দ্বিতীয় মন্দর পর্বতের ন্যায় অবস্থিত হয়ে নিজ হস্ত উপরিভাগ আক্রমণ করে রইলেন। তা দেখে স্বর্গবাসী ব্রহ্মা, শঙ্কর ও ইন্দ্রাদি সকলে স্তব ও পুষ্পবৃষ্টি করতে লাগলেন।

ভগবান হরি উপরে, নীচে এবং আত্মাতে অর্থাৎ দেব ও দানব মধ্যে, পর্বতে ও মন্থনরঙ্কু বাসুকিতে আবিষ্ট হলে, মদ্যোকষ্ট দেব ও দানবগণ সমেধিত হয়ে মহাদ্রি মন্দর দ্বারা বেগে এ প্রকার মন্থন আরম্ভ করলেন যে, ক্ষণকালের মধ্যে জল মধ্যস্থিত কুম্ভীরসমূহ অতিশয় আকুল হয়ে উঠল, তখন নাগরাজ বাসুকির অসংখ্য নেত্র, মুখ ও নিঃশ্বাস হতে অগ্নি ও ধূম নির্গত হতে থাকলে, তার দ্বারা পৌলোম, কালেয়, বলি, ইম্বল প্রভৃতি অসুরদের তেজ পরাহত হল।

অতএব তারা শীঘ্র দাবানল দগ্ধ সরল বৃক্ষ সমূহের ন্যায় নিষ্প্রভ হয়ে পড়ল। বাসুকির শ্বাসাগ্নি শিখায় দেবতারাও হতভ হলেন। তাদের আনন, ভূষণ, বস্ত্র-মাল্য বর্মাদি ধূমবর্ণ হলে, ভগবানের বশীভূত মেঘসমূহ তাদের উপর জল বর্ষণ করেছিল এবং সমুদ্রতরঙ্গজাত শীতল বায়ু তাদের অভিমুখে প্রবাহিত হয়েছিল। এইরূপে শ্রেষ্ঠ দেবতা ও অসুরগণ সমুদ্রমন্থন করলেও যখন সুধার উৎপত্তি হল না, তখন ভগবান শ্রীহরি নিজেই মন্থন করতে লাগলেন। যার বর্ণ মেঘের ন্যায় শ্যাম, পরিধানে পীত বসন, কর্ণদ্বয়ে বিদ্যুতের মত উজ্জ্বল কুণ্ডলযুগল, মস্তকে আলুলায়িত কেশরাশি। গলদেশে বনমালা, নয়নদ্বয় রক্তবর্ণ, সেই শ্রীহরি মন্দর পর্বত ধারণপূর্বক, জগতের অভয়দাতা, জয়শীল নিজ চতুর্বাহু দ্বারা মন্থন করতে করতে প্রতিদ্বন্দ্বী অপর একটি পর্বতের ন্যায় শোভিত হলেন। ঐ প্রকারে সমুদ্র মথ্যমান হতে থাকলে জলমধ্যে অবস্থিত মৎস্য, মকর, কচ্ছপ, সর্প প্রভৃতি উপরে ভেসে উঠল এবং সর্বত্র জলরাশি তিমি, জলহস্তী, কুম্ভীর ও তিমিগণের দ্বারা আন্দোলিত হতে লাগল।

তখন সমুদ্র হতে প্রথমে হলাহল নামে তীব্র বিষ উত্থিত হল। তৎকালে সমুদ্রের উপরিভাগে উখিত ও চারিদিকে বিস্তৃত, প্রতিকারের অযোগ্য ও অসহ্য সেই বিষ দর্শন করে, লোকপালদের সাথে ত্রিলোকবাসী সকলে ভীত হল, অন্য কাউকে রক্ষক দেখতে না পেয়ে ভগবান সদাশিবের শরণাপন্ন হলেন। তৎকালে দেবদেব সদাশিব ত্রিলোকের সমৃদ্ধির জন্য দেবী ভগবতীর সহিত কৈলাস পর্বতে অধ্যাসীন হয়ে মুনিগণের মুক্তির জন্য তাঁদের অভিমত তপস্যায় মগ্ন ছিলেন। এ অবস্থায় প্রজাপতিগণ তার নিকট গিয়ে স্তুতিসহ প্রণাম করলেন।

.

সপ্তম অধ্যায়
মহাদেবের গুণকীর্তন

প্রজাপতিগণ বললেন–হে দেবদেব, হে মহাদেব, হে ভূস্মন, হে ভূতপালক, ত্রিলোক দগ্ধকারী–এই বিষ হতে শরণাগত আমাদের রক্ষা করুন। আপনিই সকল জগতের বন্ধন ও মোচনের ঈশ্বর, নিপুণ জ্ঞানীগণ, শরণাগতের আর্তিহারী পরমগুরু, আপনারই অর্চনা করে থাকেন; হে বিভো, আপনি গুণময়ী নিজ সবিস্তর দ্বারা যেমন এই জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয় করেন, তখন স্বতঃসিদ্ধ জ্ঞানময় এক আপনিই ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব–এই তিন নাম ধারণ করেন। বস্তুতঃ আলো ব্যতীত অন্য কোন সৃজ্য বস্তু নেই,–আত্মরূপী আপনিই নানা শক্তির দ্বারা জগঞ্জপে পরিণত হয়েছেন, অতএব আপনিই ঈশ্বর। (এখানে বিষ্ণুর মহিমার দ্বারা শিবকে স্তুতি করায় হরি ও হরের অভিন্নতা দেখানো হয়েছে)।

হে ভগবন্‌, আপনা হতেই বেদসমূহ উৎপন্ন হয়েছে বলে আপনার জ্ঞান স্বতঃসিদ্ধ। আপনি জগতের আদি অর্থাৎ মহত এবং আপনিই সাত্ত্বিক, রজস ও তামস এই ত্রিবিধ অহংকার–যে অহংকারে গুণসমূদয় হতে প্রাণ এবং ইন্দ্রিয়শক্তির সৃষ্টি হয়েছে। আপনিই স্বভাব, কাল ও সংকল্প এবং সত্য ও ঋতস্ব রূপ যে ধর্ম, তাও আপনি, যেহেতু ত্রিগুণাত্মক যে প্রধান (প্রকৃতি) জ্ঞানীগণ আপনাকে তার আশ্রয় বলে থাকেন (অর্থাৎ প্রকৃতিও আপনারই আশ্রিতা)।

হে লোকভাবন, অমিল দেবগণের আত্মা সর্বদেবতাস্বরূপ অগ্নি আপনার মুখ, ক্ষিতি আপনার পাদপদ্ম, কাল আপনার গমন, দিক্ সকল আপনার বল, বরুণ আপনার রসনা এবং আপনি সর্বদেবময়। হে ভগব–আকাশে আপনার নাভি, বায়ু আপনার নিঃশ্বাস, সূর্য আপনার চক্ষু এবং জল আপনার শুক্র। আপনার অহংকার উত্তম ও অধম সকল জীবের আশ্রয়, চন্দ্র আপনার মন এবং স্বর্গ আপনার মস্তক।

হে বেদমূর্তি ভগব; সমুদ্র আপনার কুক্ষি, পর্বতসকল আপনার অস্থিসমষ্টি, সর্বপ্রকার ওষধি ও । লতারাজি আপনার রোম, বেদসমূহ আপনার সপ্ত ধাতু এবং বেদোক্ত প্রসিদ্ধ ধর্মই আপনার হৃদয়। হে ঈশ্বর, পঞ্চউপনিষদ, অর্থাৎ তৎপুরুষ, অঘোর, সদ্যোজাত, বামদেব ও ঈশান–এই পঞ্চপ্রকার মাত্রই আপনার পঞ্চমুখ এবং তা হতেই আটত্রিশটি মন্ত্র আবির্ভূত হয়েছে। হে দেব, শিব নামক স্ব-প্রকাশ যে পরমাত্মতত্ত্ব, উহাই আপনার শান্ত অবস্থা।

হে দেব, আপনার ছায়া অধর্মেরতরঙ্গরূপী দম্ভ, লোভ প্রভৃতিতে বর্তমান রয়েছে। এ তরঙ্গরাজির দ্বারা জগতের সংহার সাধিত হয়। সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ–এই তিনগুণ আপনার তিন নেত্র। আপনি শাস্ত্রকর্তা, সাংখ্য জ্ঞানই আপনার আত্মা বা স্বরূপ। বেদরূপ পুরান ঋষি আপনার ঈক্ষণ (অর্থাৎ সৃষ্টি শতরূপে প্রসিদ্ধ)। হে প্রভু যার মধ্যে রজঃ, তমঃ ও সত্ত্ব–এই গুণের সংসর্গ নেই, আপনার সেই পরমজ্যোতিঃ নিখিল লোকপাল, ব্রহ্ম বিষ্ণু ও ইন্দ্রেরও অগম্য, উহা নির্ভেদ পরব্রহ্ম স্বরূপ।

হে ভগবন্‌, আপনি কন্দর্প, দক্ষযজ্ঞ, ত্রিপুর কালকূট প্রভৃতি বিবিধ ভূজদ্রাহির বিনাশ করেছেন; সত্য কিন্তু এই সকল কর্ম আপনার পক্ষে অতি ক্ষুদ্র বলে, উহা আপনার স্তুতির কারণ হতে পারে না, যেহেতু প্রলয়কালে আপনার নয়নাগ্নির একটি স্ফুলিঙ্গের দ্বারা প্রত্যক্ষ পরিদৃশ্যমান স্বরচিত এই প্রকাণ্ড ব্ৰহ্মাণ্ড ভস্মীভূত হলেও আপনি তা লক্ষ্য করেন না অর্থাৎ আলোচনা করেন না। (এখানে কালকূট ভক্ষণ অবশ্যম্ভাবী বলে, অতীত কার্যাবলীর মধ্যে ধরা হয়েছে বিশ্বরে। হিতোপদেশকারী আত্মারাম জ্ঞানীবর্গ আপনার পাদপদ্মযুগল হৃদয়ে ধ্যান করেন এবং আপনি নিজেও কঠোর তপস্যায় নিমগ্ন রয়েছেন। এ অবস্থায় যারা উমাদেবীর সহিত বিচরণকারী, আপনাকে কামুক এবং সম্মানচারী, আপনাকে ক্রুর ও হিংস্র বলে প্রলাপ করেন, সেই নির্লজ্জগণ নিশ্চয়ই আপনার লীলা জানে না। (বস্তুতঃ আত্মারাম পুরুষগণ যাঁর পাদপদ্ম ধ্যান করেন, তার কামুকত্ব এবং যিনি স্বয়ং কঠোর অপস্যারত তার ক্রুরতা ও হিংস্রতা সম্ভবপর নয়।)

হে দেব, সৎ ও অসৎ হতে ভিন্ন এবং পরমপুরুষ যে আপনি, আপনার যথার্থ স্বরূপ জানতে ব্রহ্মাদি দেবগণও সমর্থ নহেন, এতে তারা আপনার স্তুতি করতে কিরূপে সমর্থ হবে? আর, আমরা ঐ ব্ৰহ্মাদির সৃষ্টিমধ্যে অত্যন্ত অর্বাচীন, আমরাই বা কি প্রকারে আপনার স্তুতিকার্যে সমর্থ হব, তথাপি এই যে স্তুতি করলাম, তা আমাদের নিজশক্তির পরিমাণ অনুসারেই রচিত হল। হে মহেশ্বর, আমরা কেবল আপনার এই দৃশ্যমান প্রকট রূপই দেখছি, এছাড়া আপনার অন্য (সর্বকারণভূত সূক্ষ্ম) স্বরূপ আমরা দেখতে পাই না। তথাপি এই মূর্তি দর্শনেই আমরা কৃতার্থ হয়েছি, যেহেতু আপনার কর্ম অব্যক্ত হলেও আপনার আবির্ভাব লোকসকলের সুখনিমিত্তেই হয়ে থাকে। শ্রীশুকদেব বললেন–হে মহারাজ, সকল ভূতের সুহৃৎ ভগবান সদাশিব প্রজাগণের সেরূপ বিপদ দেখে কৃপাবশতঃ অতিশয় পীড়িত হয়ে প্রিয়া সতীকে এরূপে বললেন।

শ্রীশিব বললেন–হে ভবানী, হায় কি কষ্ট, ক্ষীরোদ সমুদ্রের মন্থনে উৎপন্ন কালকূট বিষ হতে প্রজাগণের যে মহাবিপদ উপস্থিত হয়েছে, তা দেখ। এই সকল প্রজা প্রাণরক্ষার ইচ্ছায় কাতর হয়েছে, এদের অভয়দান করা আমার অবশ্য কর্তব্য। যেহেতু বিপন্ন দীনগণের রক্ষাই শক্তিমান পুরুষের একমাত্র কার্য। পরমাত্মার মায়ায় মুগ্ধ প্রাণীগণ পরস্পর বৈরভাবাপন্ন হলেও কৃপালু সাধুগণ নিজের ক্ষণভঙ্গুর প্রাণের দ্বারা প্রাণীদের রক্ষা করে থাকেন। হে কল্যাণী, কৃপাকারী পুরুষের প্রতি সর্বাত্মা ভগবান শ্রীহরি প্রীত হন এবং ভগবান হরি প্রসন্ন হলে চরাচরসহ আমি প্রীতি লাভ করে থাকি। অতএব আমি এই বিষ ভক্ষণ করব, আমার প্রজাদের মঙ্গল হোক।

শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে মরাহাজ, বিশ্বপালক ভগবান শিব ভবানীকে এরূপ বলে কালকূট বিষ ভক্ষণে প্রবৃত্ত হলেন এবং দেবী ভবানীও তার প্রভাব জানেন বলে, তার বিষভক্ষণ অনুমোদন করলেন। তারপর ভূতপালক মহাদেব প্রাণীগণের প্রতি কৃপাপূর্বক সর্বত্র বিস্তৃত সেই কালকূট বিষ নিজ করতলে গ্রহণ করে ভক্ষণ করেছিলেন। কিন্তু জলের পাপ কালকূট বিষও মহাদেবকে নিজের প্রভাব দেখিয়েছিল। যেহেতু তাতে শঙ্করের কণ্ঠদেশ তৎক্ষণাৎ নীলবর্ণ হল, কিন্তু তা করুণাময় ঈশ্বরের ভূষণস্বরূপ হয়েছে। সাধু পুরুষগণ প্রায় পরের দুঃখে পীড়িত হয়ে থাকেন, পরের দুঃখবোধে প্রাণের এই যে কাতরতা, ইহা সর্বাত্মা ভগবানের পরম আরাধনাস্বরূপ। দেবাদেব ভক্তের কামনাপূরক শম্ভুর সেই বিষপানরূপে অদ্ভুত কর্ম অবগত হয়ে প্রজাগণ, দাক্ষায়ণী (সতী) ব্রহ্মা এবং বিষ্ণু সকলে প্রশংসা করেছিলেন। সেই কালকূট পান করার সময় মহাদেবের হস্ত হতে যে অত্যল্পমাত্র বিষ ভূতলে পতিত হয়েছিল, বৃশ্চিক, সর্প বিষময় ঔষধিসমূহ এবং অন্যান্য বিষধর প্রাণীগণ উহা গ্রহণ করেছিল। (এর দ্বারা ঐ বিষের তীব্রতা উক্ত হল)।

.

অষ্টম অধ্যায়
সমুদ্র হতে অন্যান্য রত্নসকলের উৎপত্তি, লক্ষ্মীদেবীর আবির্ভাব ও বিষ্ণুকে বরণ। পরে অসুরগণ অমৃতকলস হরণ করলে শ্রীভগবানের মোহিনীরূপ ধারণ।

শ্ৰীশুকদেব বললেন–ভগবান শঙ্কর কালকূট বিষ পান করলে দেব ও দানবগণ অতিশয় প্রীত হয়ে আবার মহাবেগে মন্থন আরম্ভ করলেন। তাতে প্রথমতঃ যজ্ঞীয় হবির আধার সুরভিধেনু উত্থিত হল। হে মহারাজ, ব্রহ্মবাদী ঋষিগণ ব্রহ্মলোক প্রাপক যজ্ঞের উপযোগী ঘৃতের জন্য অগ্নিহোত্র সম্পাদনকারিণী সেই ধেনুটিকে গ্রহণ করলেন। তারপর চন্দ্রের ন্যায় শুক্লবর্ণ উচ্চৈঃশ্রবা নামক অশ্ব উত্থিত হলে দৈত্যরাজ বলি উহা পাবার ইচ্ছা করলেন, কিন্তু ভগবান হরির শিক্ষানুসারে দেবরাজ ইন্দ্র তার প্রতি অভিলাষ করলেন না। এরপর ঐরাবত নামক শ্বেতবর্ণ গজরাজ গিরিশৃঙ্গতুল্য চারটি দণ্ডের দ্বারা ভগবান শঙ্করের কৈলাসপর্বতের শোভা হরণ করে সমুদ্র মধ্য হতে বহির্গত হয়েছিল। হে নৃপ, তারপর ঐরাবতাদি আটটি দিগহন্তা এবং অভ্রমূ প্রভৃতি আটটি দিহস্তিনী উত্থিত হল। তারপর মহৌষধি হতে কৌস্তভ নামক পদ্মরাগমণি উত্থিত হলে, ভগবান শ্রীহরি নিজ বক্ষঃস্থলের অলংকার করার জন্য তার প্রতি আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছিলেন।

এরপর স্বর্গের ভূষণস্বরূপ পারিজাত বৃক্ষ উত্থিত হল। হে মহারাজ, আপনি যেরূপ ধরাতলে অভীষ্ট অর্থদ্বারা প্রার্থীগণের মনোরথ পূর্ণ করেন, ঐ পারিজাতও সেরূপ প্রার্থিত বস্তুর দ্বারা সর্বদা প্রার্থিগণের বাসনা পূর্ণ করে। তারপর অপ্সরাগণ উত্থিত হল। তাদের কণ্ঠদেশে স্বর্ণপদক, পরিধানে শোভন বসন। তারা মনোহর গতিভঙ্গী, বিবিধ লীলা ও বৃষ্টিপাত দ্বারা স্বর্গবাসীদের অনুরাগ উৎপাদন করেছিল। এরপর সুদামা পর্বতে আবির্ভূত বিদ্যুতের ন্যায় নিজ কান্তিদ্বারা দশদিক্‌ উদ্ভাসিত করে ভগবৎপরায়ণা লক্ষ্মীদেবী সাক্ষাৎ আবির্ভূত হলেন। তৎকালে তার রূপ, ঔদার্য বয়স, বর্ণ ও মহিমা দর্শনে সুর, অসুর, গণের সকলেরই চিত্ত আকৃষ্ট হল, সুতরাং সকলেই তাকে পাবার জন্য আকাঙ্ক্ষা করলেন।

দেবরাজ ইন্দ্র লক্ষ্মীদেবীর অভিষেকের জন্য ব্যস্ত হয়ে অদ্ভুত আসন আনয়ন করলেন। প্রধান প্রধান নদীসকল মূর্তিমতী হয়ে স্বর্ণকলস দ্বারা পবিত্র জল আহরণ করল। ভূমি অভিষেকের যোগ্য ঔষধিসকল আনয়ন করে দিল। আর গাভীসকল পঞ্চগব্য এবং বসন্ত ঋতু চৈত্র-বৈশাখোদ্ভব ফল-পুষ্প আনয়ন করল। পরে ঋষিগণ যথাবিধি তার অভিষেক ক্রিয়া সম্পাদন করলেন। তৎকালে গন্ধর্বগণ, মঙ্গলগণ, নর্তকীগণ নৃত্যগীত এবং মেঘসমূহ তুমুল ধ্বনিযুক্ত মৃদঙ্গ, প্রণব, মুরবা, অনেক গোমুখ এবং শঙ্খ, বেণু ও বীণা বাজিয়েছিল। তারপর দিগহস্তিগণ পূর্ণ কলস এবং ব্রাহ্মণগণের উচ্চারিত সূক্ত বাক্য (বৈদিক মন্ত্র) সমূহের দ্বারা পদ্মহস্তা সতী লক্ষ্মীদেবীর অভিষেক করেছিল। এ সময়ে সমুদ্র তাকে পীতবর্ণ কৌশেয় বস্ত্রদ্বয় (অধোবসন ও উত্তরীয়) বরুণ মধুমত্ত ভ্রমরগণের আশ্রয় বৈজয়ন্তী মালা, প্রজাপতি বিশ্বকর্মা নানারূপ বিচিত্র অলংকার, সরস্বতী হার, ব্রহ্মা পদ্ম এবং নাগসকল দুটি কুণ্ডল উপহার দিলেন।

এইরূপে মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান সম্পাদনের পর সেই লক্ষ্মীদেবী নিজ হস্তদ্বারা ভ্রমরগুঞ্জিত উৎপলমালা গ্রহণ করেন, গণ্ডদ্বয়ে কুণ্ডলযুগলের শোভাযুক্ত ও সলজ্জ হাস্য বিমণ্ডিত সুরম্য মুখমণ্ডলের শোভা বিস্তারপূর্বক চলতে আরম্ভ করলেন। তৎকালে অতিকৃশোদরী লক্ষ্মীদেবী ইতস্ততঃ চন্দন ও কুঙ্কুমলিপ্ত, সুগোল, পরস্পর সংলগ্ন স্তনযুগলের শোভা ধারণ করে, মনোরম নূপুরধ্বনি বিস্তারপূর্বক ইতস্ততঃ পাদবিক্ষেপ আরম্ভ করলে, চঞ্চলা হেমলতার ন্যায় তার শোভা হল। তৎপরে তিনি আপনার নিরবদ্য আশ্রয় নিমিত্ত চারদিকে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন, কিন্তু যাতে নিত্য সদগুণ সকল বিরাজমান, এতাদৃশ আশ্রয় কি গন্ধর্ব, সিদ্ধ, অসুর, যক্ষ, চারণ, কি স্বর্গবাসী দেবগণ–এ সকলের মধ্যে কাকে দেখতে পেলেন না, সকলেরই একটা না একটা দোষ প্রকাশ পেতে লাগল।

তিনি বিচার করে দেখলেন–কারও তপস্যা আছে, কিন্তু তিনি ক্রোধ জয় করতে পারেন নাই (যেমন–দুর্বাসা প্রভৃতি), কারও জ্ঞান আছে, কিন্তু সেই জ্ঞান আসক্তিশূন্য নহে (যেমন–বৃহস্পতি, শুক্রাচার্য প্রভৃতি)। কেহ মহত্ত্বশালী, অথচ কামজয়ী নহেন (যেমন–ব্রহ্মা, চন্দ্র প্রভৃতি)। এইরূপ কেহ বা পরের আশ্রিত, অতএব তিনি কিরূপে ঈশ্বর হতে পারেন (যেমন–ইন্দ্রাদি দেবগণ। কারও মধ্যে ধর্মানুষ্ঠান আছে, অথচ তিনি প্রাণীগণের প্রতি দয়ালু নহেন (যেমন–পরশুরাম প্রভৃতি)। কারও মধ্যে ত্যাগ আছে, অথচ তা মুক্তির কারণ নহে (যেমন–শিব প্রভৃতির)। কারও মধ্যে বীরত্ব আছে, কিন্তু তা। কালের প্রভাব হতে মুক্ত (অর্থাৎ চিরস্থায়ী) নহে (যেমন-কার্তবীর্য প্রভৃতির)। এই যিনি প্রকৃত গুণের সংসর্গ থেকে মুক্ত, তিনিও সমাধিনিষ্ঠ বলে আমার সহচর হতে পারেন না (যেমন-সনকাদি)।

কোন্ কোন্ ব্যক্তি (যেমন–মার্কণ্ডেয়াদি) চিরজীবী সত্য, কিন্তু তাদের ইন্দ্রিয়াদমনশীলতা হেতু শীল ও মঙ্গল (অর্থাৎ (ভাগ) নেই, কোন কোন ব্যক্তিতে (হিরণ্যকশিপু প্রভৃতিতে) শীল ও মঙ্গল আছে, কিন্তু বিষ্ণুবিদ্বেষহেতু আয়ুর স্থিরতা নেই। এক ব্যক্তিতে (রুদ্র) শীল ও মঙ্গল এবং আয়ুর স্থিরতা কিন্তু বিষ্ণুবিদ্বেষহেতু আয়ুপ্রভৃতি অমঙ্গল আচারণ যিনি স্বভাবতঃ সু

কিন্তু এরূপ এক পুরুষ আছেন, (অর্থাৎ শ্রীমুকুন্দ) যিনি স্বভাবতঃ সুমঙ্গল এবং সর্বদোষ হতে বিমুক্ত, অথচ আত্মারাম বলে আমার আকাঙ্ক্ষা করেন না। লক্ষ্মীদেবী এরূপ বিচার করে অবশেষে ধর্মজ্ঞান প্রভৃতি একনিষ্ঠ স্থায়ী গুণসমূহের সমাবেশ হেতু নিজের একমাত্র আশ্রয় ও সর্বোত্তমরূপে গুণনীয়, প্রকৃত গুণাতীত শ্রীহরিকেই নিজের পতিরূপে বরণ করলেন। যদিও শ্রীহরি আত্মারাম বলে কারও অপেক্ষা করেন না, তথাপি অনিমাদি সিদ্ধিসমূহ তাকে বরণ করায় ইনি লক্ষ্মীদেবীরও ঈপ্সিত হয়েছিলেন। (লক্ষ্মীদেবী মনে করলেন–ইনি নিরপেক্ষ হয়েও যেহেতু অনিমাদি সিদ্ধিসমূহকে উপেক্ষা করেন না, আমি ইহাকে আশ্রয় করলে, তেমনি আমাকেও উপেক্ষা করবেন না, তাতে আমি ইহার সেবা করে কৃতার্থ হতে পারব, অন্য প্রাকৃত দেবাদিতে কি হবে?–এরূপ বিবেচনা করে নারায়ণকেই বরণ করলেন।)।

তারপর তিনি নিজ হস্তস্থিত মত্ত ভ্রমরগণের গুঞ্জনরবে মুখরিত নূতন পদ্মপুষ্পের মনোরম মালাটি শ্রীহরির স্কন্ধদেশে সমর্পণপূর্বক নিজের আশ্রয়স্বরূপে তদীয় বক্ষঃস্থল লাভের প্রতীক্ষায় সলজ্জ হাস্যমুক্ত উফুল্ল নয়নে মৌনভাবে নিকটে অবস্থান করতে লাগলেন। তারপর ত্রিজগতের জনক শ্রীহরিও নিজ বক্ষঃস্থলকে পরম বৈভবশালিনী ত্রিলোকজননী লক্ষ্মীদেবীর স্থিরতর বাসস্থান করে দিলেন। হে রাজন, ভগবানের বক্ষঃস্থলে স্থানপ্রাপ্ত হয়ে লক্ষ্মীদেবী সকরুণ নিরীক্ষণ দ্বারা স্বীয় প্রজা ও লোকপালসমূহ ত্রিলোককে বর্ধিত করতে লাগলেন। এ সময় দেবতাদের অনুচরগণ সস্ত্রীক নৃত্য, গীত আরম্ভ করলে, তাদের শঙ্খ, ভেরী ও মৃদঙ্গ প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রের তুমুল ধ্বনি উত্থিত হয়েছিল। আর ব্রহ্মা, রুদ্র, অঙ্গিরা প্রভৃতি বিশ্বস্রষ্টা পুরুষগণ পুষ্পবর্ষণ করতে করতে বিষ্ণুর মহিমা প্রতিপাদক যথার্থ মন্ত্র উচ্চারণ করে ভগবানের স্তুতি করতে লাগলেন। লক্ষ্মীদেবীর কৃপাদৃষ্টি লাভ করে প্রজাপতিগণের সাথে সকল প্রজাগণ শীলাদি গুণসম্পন্ন হয়ে পরম সুখভাগী হলেন। কিন্তু লোলুপ দৈত্য ও দানবগণ লক্ষ্মী কর্তৃক উপেক্ষিত হওয়ায় নিঃসত্ত্ব ও নিরুদ্যম হতে লাগল।

তারপর সমুদ্র হতে বারুণী (অর্থাৎ বরুণদেবের ভোগ্য অন্নময়া সুরা) কমলনয়না দেবকন্যারূপে আবির্ভূত হলে শ্রীহরির অনুমতিক্রমে অসুরগণ তাকে গ্রহণ করল। অনন্তর অমৃতলাভের আকাঙ্ক্ষায় দেবতা ও দানবগণ আবার সমুদ্র মন্থন করতে থাকলে তথা হতে পরম অদ্ভুত এক পুরুষ আবির্ভূত হলেন। তাঁর বাহুযুগল দীর্ঘ ও স্থূল, গ্রীবা শঙ্খের নাভির ন্যায় রেখায়যুক্ত, নয়নযুগল অরুণবর্ণ, দেহকান্তি শ্যামল, তিনি বয়সে যুবা এবং মাল্য ও সর্বপ্রকার অলংকার বিভূষিত ছিলেন। তাঁর পরিধানে পীতবসন, বক্ষঃস্থল সুপ্রশস্ত ও কর্ণদ্বয় সুমার্জিত মণিকুন্তলে অলংকৃত। কেশের প্রান্তভাগ স্নিগ্ধ, কুঞ্চিত ও শোভাবর্ধক ছিল। তার বিক্রম সিংহের তুল্য তিনি বলয়ালংকৃত হয়ে অমৃতপূর্ণ কলস ধারণ করেছিলেন। তিনি ভগবান বিষ্ণুর অংশের অংশ হতে উদ্ভূত হয়ে ধন্বন্তরি নামে বিখ্যাত হয়েছিলেন। ইনি আয়ুর্বেদশাস্ত্রে বিশারদ এবং যজ্ঞসমূহের অংশভাগী।

তৎকালে অসুরগণ তাকে এবং তাঁর হস্তস্থিত সুধাপূর্ণ কলসটি দর্শন করে, অমৃতের সমস্ত ভাগ অধিকারের লোভে সত্বর ঐ কলসটি হরণ করল। অসুরগণ অমৃতপূর্ণ কলসটি নিয়ে গেলে, দেবগণ বিষঃচিত্তে শ্রীহরির শরণাপন্ন হলেন।

ভৃত্যবাঞ্ছাপূর্ণকারী ভগবান শ্রীহরি তাদের এই দৈন্যদশা লক্ষ্য করে বললেন–হে দেবগণ, তোমরা খেদ করো না, আমি নিজ মায়ার দ্বারা এদের পরস্পরের মধ্যে কলহ উৎপাদন করে তোমাদের অভীষ্ট সাধন করব। হে রাজন, তার পরেই অমৃতের জন্য তৃষ্ণার্তচিত্ত সেই অসুরদের মধ্যে কলহ উপস্থিত হল। তখন তারা “আমি পূর্বে পান করব, আমি পূর্বে, তুমি নও, তুমি নও–এরূপ বলতে লাগল। দৈত্যদের মধ্যে যারা দুর্বল, তারা বলপূর্বক গ্রহণে অসমর্থ হলেও, যারা অমৃতকলস অধিকার করেছে, সেই বলবান অসুরদের প্রতি মাৎসর্যবশতঃ বারবার নিষেধ করতঃ এরূপ বলতে লাগল–”এই সমুদ্রমন্থন কার্যে দেবগণও সমান পরিশ্রম ও অর্থাদি ব্যয় করেছেন, সত্রযাগে যেরূপ সকলেই সমভাবে ফলভাগী হয়, সেরূপ এস্থলেও তাদের নিজ অংশের অধিকার রয়েছে এবং ইহাই সনাতন ধর্ম।”

হে মহারাজ, এই অবসরে সকল উপায়াভিজ্ঞ ঈশ্বর ভগবান বিষ্ণু পরম আশ্চর্য অবর্ণনীয় এক স্ত্রীরূপ ধারণ করলেন। ঐ স্ত্রীরূপ দর্শনীয় উৎপলের ন্যায় শ্যামবর্ণ, তার সকল অবয়ব সুন্দর, কর্ণদ্বয় সমান ও মনোহর আভরণে ভূষিত, বদনে সুকোমল কপোলদ্বয় ও সুন্দর নাসিকা। নবযৌবনবশতঃ স্তনভারে উদর অতিশয় কৃশ হয়েছিল, মুখসৌরভ দ্বারা আকৃষ্ট ভ্রমরগণের ঝঙ্কারে লোচনদ্বয় যেমন সচিকত হয়ে রয়েছিল। আর, কেশকলাপে উৎফুল্ল মল্লিকার মালা, সুন্দর গ্রীবাদেশে কণ্ঠাভরণ এবং সুরম্য ভুজদ্বয় অঙ্গদ শোভা পেয়েছিল। তার নিতম্বরূপ দ্বীপ নির্মল বসনে আচ্ছাদিত, তাতে কমণীয় কাঞ্চি আর বিচরণশীল চরণদ্বয়ে নূপুর ছিল। সেই কামিনী সলজ্জ হাস্যসহ যে ভঙ্গি করছিলেন, তার বিলাসযুক্ত অবলোকন দ্বারা মুহুর্মুহুঃ প্রধান প্রধান দৈত্যগণের চিত্তে কামোদ্দীপন হতে লাগল।

.

নবম অধ্যায়
মোহিত দানবগণ কর্তৃক মোহিনীমূর্তির হস্তে অমৃতভাণ্ড অর্পণ এবং দানবদের বঞ্চনা করে দেবতাদের অমৃত দান

শ্ৰীশুকদেব বললেন––হে রাজন, তৎকালে পরস্পর সৌহার্দ পরিত্যাগ করে দস্যধর্মী সেই অসুরগণ একে অন্যের নিকট হতে সুধাভাণ্ড হরণ এবং পরস্পরে নিন্দাবাক্য উচ্চারণ করতে করতে নিজেদের অভিমুখে সেই স্ত্রীমূর্তিকে আসতে দেখল। তারপর সেই অসুরগণ কামাতুর হয়ে–অহো, কি মনোহর রূপ, কি চমৎকার কান্তি, কি সুন্দর নবীন বয়স–এরূপ বলে তাঁর নিকট গিয়ে জিজ্ঞাসা করতে লাগল–হে পদ্মপলাশাক্ষি, তুমি কে? কোথা হতে এসেছ, কি করতে ইচ্ছা করছ? তুমি কার কন্যা,–এসকল বল। হে কমোরু, তুমি আমাদের মন ক্ষুব্ধ করছ? হে সুন্দরী, আমরা জানি যে–দেব, দানব, সিদ্ধ গন্ধর্ব, চারণ, অথবা লোকপালগণ কেউ তোমাকে পূর্বে স্পর্শ করেন নাই, অতএব মনুষ্যগণ স্পর্শের সম্ভাবনা কোথায়? হে শুভ্র করুণাময় বিধাতা প্রাণীগণের সকল ইন্দ্রিয় ও চিত্তের প্রীতিবিধানের জন্যই কি তোমাকে পাঠিয়েছেন, হে ভামিনি, হে সুমধ্যমে, আমরা জ্ঞাতিগণ সকলে একই বস্তু লাভের জন্য পরস্পর বিবাদ করতঃ বদ্ধবৈর হয়েছি, তুমি আমাদের বিবাদ মিটিয়ে দিয়ে কল্যাণ কর। আমরা সকলেই কশ্যপের পুত্র বলে পরস্পর ভ্রাতা এবং সকলেই এই অমৃত লাভের জন্য বিক্রম প্রকাশ করেছি। এই অমৃত কলস নিয়ে তুমি যথোচিতভাবে ভাগ করে দাও, যাতে আমাদের মধ্যে বিবাদ না হয়।

মায়ায় স্ত্রীমূর্তিধারী ভগবান শ্রীহরি দৈত্যগণ কর্তৃক এরূপ প্রার্থিত হয়ে হাস্য করলেন এবং মনোহর কটাক্ষে নিরীক্ষণ করতে করতে এরূপ বলতে লাগলেন। শ্রীভগবান বললেন–ওহে কশ্যপনন্দনগণ, আমি পুংশ্চলী (বেশ্যা)। আমাতে তোমরা কি প্রকারে বিশ্বস্ত হলে? পণ্ডিত ব্যক্তি কখন কামিনীগণের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেন না। হে অসুরগণ, বানর ও স্বৈরিণীগণের প্রণয়কে পণ্ডিতগণ অনিত্য বলে থাকেন, যেহেতু তারা প্রত্যহ নূতন নূতন প্রণয়ীর অন্বেষণ করে থাকে।

শ্ৰীশুকদেব বললেন–অসুরগণ সেই মোহিনী রমণীর ঐ প্রকার সশ্লেষ পরিহাস বচনে আশ্বস্তচিত্ত হয়ে, ভাবগম্ভীর হাস্য করত তাঁর হস্তে সুধাভাণ্ড অর্পণ করল। তখন মোহিনীরূপী হরি সেই অমৃতভাণ্ড হাতে নিয়ে মৃদুহাস্যে বললেন–”আমি যা করব, তা ভালই হোক বা মন্দই হোক–তোমরা যদি স্বীকার করে নিতে পার, তবেই আমি এই অমৃত ভাগ করে দিতে পারি।” শ্রেষ্ঠ অসুরগণও সেই মোহিনীমূর্তির লীলাদির ইয়ত্তা না জেনে তার সেই কথা শুনে তৎক্ষণাৎ “তাই হোক”-বলে সম্মত হল। তারপর অসুরেরা উপবাসপূর্বক স্নান ও হবির দ্বারা অগ্নিতে হোম, গো, ব্রাহ্মণ ও ভূতসকলকে নমস্কার করল। পরে ব্রাহ্মণগণ তাদের শুভার্থে স্বস্ত্যয়ন করলেন। এরপর সকলে নিজ নিজ রুচি অনুসারে নূতন বস্ত্র পরিধানপূর্বক যথাযথভাবে অলংকৃত হয়ে পূর্বাগ্র কুশরাশির উপর উপবেশন করল। হে রাজন, যে গৃহে অমৃত বন্টন হবে, সেই গৃহ ধূপাদিতে আমোদিত ও মাল্য দীপাদিতে অলংকৃত হয়েছিল। দেব ও দাবনগণ সেই গৃহমধ্যে পূর্বমুখ হয়ে উপবেশন করলেন। পরে সেই মোহিনীমূর্তি অমৃতকলস হস্তে করে তন্মধ্যে প্রবেশ করলেন। তার উরুদ্বয় করভ-সদৃশ, শ্রোণীতট কৌশেরবস্ত্রে আচ্ছাদিত, গমন নিতম্বভারে সমন্দ, চক্ষুদ্বয় মদবিহব্বল এবং স্তনদ্বয় কুম্ভসমান। তিনি কনকময় নূপুরে সিঞ্চন ধ্বনি বিস্তার করছিলেন।

তৎকালে তার স্তনাবরণ বস্ত্রের প্রান্তভাগ স্থলিত হয়ে পড়েছিল। এ অবস্থায় স্বর্ণময় কুণ্ডলযুগল, মনোহর কর্ণ, নাসিকা, গণ্ডযুগল ও বদনমণ্ডলের শোভাসম্পন্না এবং লক্ষ্মীদেবীর সখীরূপা পরম দেবতা লক্ষ্মীনাম্নী সেই মোহিনীকে দর্শন করে দেবতা ও অসুরগণ তার সাহস দৃষ্টিভঙ্গীতে অতিশয় মোহগ্রস্ত হয়েছিলেন। তারপর শ্রীহরি, নৃশংসজাতি অসুরগণকে সুধাদান করা, সর্পগণকে দুগ্ধদান করার ন্যায় নীতিবিরুদ্ধ–এরূপ বিচার করে তাদের সুধার ভাগ দান করলেন না। তখন তিনি দেবতা ও অসুরদের পৃথক পৃথক পংক্তি রচনা করে তাদের নিজ নিজ পংক্তিতে উপবেশন করালেন। মোহিনীমূর্তি ভগবান শ্রীহরি এ অবস্থায় সুধাভাণ্ড নিয়ে, সমাদার ও প্রিয় বাক্যালাপাদির দ্বারা দৈত্যগণকে অতিক্রম করে দূরস্থিত দেবতাগণকে জরামৃত্যুনাশক অমৃত পান করালেন।

হে মহারাজ, তৎকালে সেই মোহিনীমূর্তি দৈত্যদের প্রতি স্নেহ প্রকাশ করছিলেন এজন্য, বিশেষতঃ স্ত্রীলোকের স্বার্থে বিবাদ করা নিন্দনীয় বলে, তারা পূর্বকৃত শপথ রক্ষা করা মৌনভাবেই অবস্থান করল। বস্তুতঃ দৈত্যগণ সেই মোহিনীমূর্তির প্রতি অতিশয় প্রণয়ী হওয়ায় প্রণয়ভঙ্গের আশঙ্কায় কাতর ছিল এবং মোহিনীমূর্তিও নানাপ্রকার সমাদর প্রকাশ করে তাদের অনুরক্ত করায় তারা কোনরূপ অপ্রিয় বাক্য বলে নাই। তৎকালে অসুর রাহু দেবতার চিহ্নদ্বারা নিজের স্বরূপ গোপন করে দেবগণের পঙক্তিতে চন্দ্র ও সূর্যের মাঝখানে প্রবেশপূর্বক অমৃত পান করলে, চন্দ্র ও সূর্য তার স্বরূপ প্রকাশ করে দেন। তখন ভগবান শ্রীহরি অমৃতপানকারী রাহুর মস্তকটি নিজের তীক্ষ্ণধার চক্রের দ্বারা ছেদন করলে তার মুণ্ডুহীন দেহটি সুধাসিক্ত না হওয়ায় ভূতলে পতিত হল। কিন্তু ছিন্ন মস্তকটি অমৃতস্পৃষ্ট হওয়ায় তা অমরত্ব প্রাপ্ত হল। পরে ব্রহ্মা তাকে গ্রহত্ব প্রদান করলেন। ঐ রাহু বৈরবুদ্ধি করে আজও পর্বে পর্বে অর্থাৎ (অমাবস্যা ও পূর্ণিমায়) চন্দ্র ও সূর্যের প্রতি ধাবিত হয়ে থাকে। যা হোক, দেবগণের অমৃতপান প্রায় শেষ হলে, লোকপালক ভগবান শ্রীহরি অসুরশ্রেষ্ঠদের দৃষ্টির সম্মুখেই পুনরায় নিজ রূপ ধারণ করলেন।

হে মহারাজ, সমুদ্রমন্থনকার্যে দেবতা ও অসুরগণ উভয়েরই দেশ, কাল, হেতু (মনদরাত্রি), অর্থ (সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত লতা ঔষধাদি) কর্ম ও বুদ্ধি যদিও সমান ছিল, তথাপি ফলোভে উভয়ের মধ্যে বৈচিত্র্য ঘটল। অমধ্যে যাঁর পাদপদ্মের রেণুর আশ্রয়হেতু দেবগণ সমুদ্রমন্থনের ফল অমৃতভোগ করেছিলেন, পক্ষান্তরে অসুরগণ তা আশ্রয় না করায় অমৃতপানে বঞ্চিত হল। অতএব সেই শ্রীহরিই সকলের সেবনীয়। হে মহারাজ, ধন, প্রাণ, কর্মত, মন এবং বাক্যের দ্বারা দেহ ও পুত্রাদির নিমিত্ত যা কিছু করে, ভেদাশ্রয়হেতু মূল ত্যাগ করে শাখা সেচনের ন্যায় তা অসৎ (অর্থাৎ ব্যর্থ) হয়, কিন্তু ঐ সকল ধনাদির দ্বারা ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে যা অনুষ্ঠিত হয়, তা সৎ অর্থাৎ সার্থক হয়। কারণ ঈশ্বর সর্বগত বলে তার তর্পণের দ্বারা দেহাদি সকল পদার্থেরই তৃপ্তি হয়ে থাকে। যেমন বৃক্ষের মূলে জলসেচন করলে, উহা কাণ্ড শাখা প্রভৃতি সকল অবয়বকেই সিক্ত করে, তেমনি ঈশ্বরোদ্দেশে কর্ম করলে, তাতে অন্যেরও প্রীতি জন্মে থাকে। (কিন্তু কেবল কাণ্ড বা শাখায় জলসেচন করলে, বৃক্ষের সকল অংশের সেচন হয় না।)

.

দশম অধ্যায়
দেব ও দানবগণের যুদ্ধ, দানবগণের মায়া অবলম্বন
এবং ভগবান বিষ্ণুর আবির্ভাব তার নিরসন

শ্ৰীশুকদেব বললেন– হে রাজ, দৈত্যগণ মন্থনকার্যে নিযুক্ত এবং যত্নবান হয়েও বাসুদেব পরাঙ্খ হওয়ায় অমৃতলাভে বঞ্চিত হল। ভগবান বিষ্ণু অনুগত দেবতাদের তা পান করিয়ে সকলের দৃষ্টির সম্মুখেই গরুড়বাহনে নিজ ধামে প্রস্থান করলেন। তখন সেই দৈত্যগণ শত্রুগণের পরম সমৃদ্ধিদর্শনে অসহিষ্ণু হয়ে, অস্ত্র শস্ত্র উত্তোলন পূর্বক দেবতাদের প্রতি যুদ্ধের জন্য অগ্রসর হলেন। তারপর সুধাপানে শক্তিসমৃদ্ধ এবং শ্রীহরির পদাশ্রিত সেই দেবগণ সকলে মিলিত হয়ে অস্ত্র-শস্ত্রদ্বারা অসুরদের বিরুদ্ধে সমরে প্রবৃত্ত হলেন। এইরূপে ক্ষীরোদ সমুদ্রের তীরে উভয় পক্ষের মধ্যে রোমাঞ্চকর তুমুল সংগ্রাম হয়েছিল। ঐ যুদ্ধ “দেবাসুর যুদ্ধ নামে সুপ্রসিদ্ধ।” সেই যুদ্ধে শত্রুভাবাপন্ন ও ক্রুদ্ধচিত্ত দেবতা ও অসুরগণ পরস্পর নিকটে গিয়ে খঙ্গ, বাণ ও অন্যান্য নানা অস্ত্রের দ্বারা পরস্পরকে আঘাত করতে লাগল। সেই স্থানে শঙ্খ, তুর্য, মৃদঙ্গ ভেরী এবং ডমরু বাদ্যে, তথা হস্তী অশ্ব, রথ ও পদাতির শব্দে অতিশয় কোলাহল হল। তারপর সেখানে রথীগণের সাথে, পদাতিকগণ পদাতিকগণের সাথে, অশ্বগণ অশ্বগণের সাথে এবং হস্তিগণ হস্তিগণের সাথে সংগ্রামে প্রবৃত্ত হয়েছিল।

হে মহারাজ, দেবতা ও অসুর ওই উভয়পক্ষের সৈন্যগণের মধ্যে কতক যোদ্ধা উষ্ট্র দ্বারা, কতক সেনা হস্তির দ্বারা, আবার অপর সৈন্য গর্দভ দ্বারা প্রতিযোদ্ধার দিকে ধাবমান হল। কোন কোন যোদ্ধা গৌরমুখ (বানর বিশেষ), কেহ কেহ ভল্লুক, কেহ কেহ ব্যাঘ্র, কেহ কেহ বানর, কেহ কেহ বা গৃধ্র কল্ক, বক, শ্যোন ও ভাস, কেহ কেহ তিমঙ্গিল (জলজন্তু বিশেষ), শরভ, মহিষ, গণ্ডার, বৃষ, গবয়, শৃগাল, মূষিক, কৃকলাস, শশক, মানুষ, ছাগল, কৃষ্ণসার, হংস ও শূকর নিয়ে যুদ্ধ করেছিল। আবার কতগুলি যোদ্ধা জলচর ও স্থলচর পক্ষিগণ এবং বিকৃতদেহ অন্যান্য প্রাণীগণের সহিত উভয় পক্ষের সৈন্যগণের অগ্রভাগে প্রবেশ করেছিল।

হে মহারাজ, তৎকালে জলজন্তুগণের দ্বারা বিশেষ শোভাপ্রাপ্ত দুটি সমুদ্রের ন্যায় দেবতা ও অসুর পক্ষীর বাহিনী দুটি ও পতাকার বিচিত্র বস্ত্র, শুভ্র নির্মল ছত্র মহামূল্যে হীরক দন্ডযুক্ত ময়ূরপুচ্ছ– রচিত ও চমরীপুচ্ছ রচিত ব্যজন বায়সঞ্চালিত উত্তরীয় বস্ত্র, উষ্ণীয়, সূর্যকিরণ সংস্পর্শে সমুজ্জল বর্ণ, বিবিধ ভূষণ, সমুজ্জ্বল শাস্ত্রসমূহ এবং বীরগণের বিশেষ শোভা ধারণ করেছিল। হে রাজ, বিরোচনের পুত্র মহারাজ বলি ঐ সময় অসুরদের সেনাপতি ছিলেন, তিনি বৈহায়াস নামক আকাশযানে আরোহণ করেন। উদয়গিরির শিখরস্থ চন্দ্রের মত দীপ্তি পেতে লাগলেন। বলির ঐ যান ময়দানবের নির্মিত, উহা কামগ এবং সমগ্র সাংগ্রমিক সামগ্রী পরিপূর্ণ ছিল। সেই যান আশ্চর্যময়, উহা কি বস্তু, কেউ তর্কের দ্বার নিশ্চয় করতে পারত না, তা কখনো দৃশ্য, কখনো বা অদৃশ্য হত। বলিরাজ উক্ত বিমানে উপবিষ্ট হয়ে সেনাপতিগণ কর্তৃক পবিত্র অবস্থায় চামরব্যজন ও উত্তম রাজত্রে সুশোভিত হয়েছিলেন।

তৎকালে নমুচি, শম্বর, বান, বিপ্রচিত্ত, আয়োমুখ, দ্বিমূর্ধা, কালেনাভ, প্রহেতি, হেতি, ইশ্বল, শকুনি, ভূতসন্তাপ, বজ্রদংষ্ট্র, বিরোচন, হরগ্রীব, শহকুশিরা, কপিল, মেঘদুন্দুভি, তরিক, চন্দ্র, শুম্ভ, নিশুম্ভ, জম্ভ, উৎকল, আবিষ্ট, অরিষ্টন্মেময়, ত্রিপুরাধিপ এবং পেছলাম, কালেয় ও নিবাতকবচ প্রভৃতি অন্যান্য যুথাপতি অসুরগণ যথোচিত যানে আরোহণ করে বলিরাজের চারিদিকে অবস্থান করছিল। এরা সকলেই সমুদ্র মন্থনের ক্লেশতভাগ করেছিল, কিন্তু অমৃতের ভাগ পায় নি। এরা সংগ্রামের উপক্রমেই অনেক দেবতাদের পরাজিত করে সিংহনাদ সহকারে প্রচণ্ড শব্দযুক্ত শঙ্খবাদ্য করেছিল। এ সময় দেবরাজ ইন্দ্র ঐ সকল গর্বিত শত্রুদের দেখে অতিশয় ক্রুদ্ধ হলেন। তিনি ঐরাবত নামক দিকুহস্তীর পৃষ্ঠে আরোহণ করে প্রস্রবণ ধারাযুক্ত উদয় পর্বতের উপরিস্থিত সূর্যের ন্যায় শোভা পেতে লাগলেন। তখন বিবিধ বাহন, ধ্বজ ও অস্ত্রধারী দেবগণ এবং নিজ নিজ গণের সাথে বায়ু, অগ্নি ও বরুণ প্রভৃতি লোকপালগণ ইন্দ্রের চারদিকে অবস্থান করলেন। দ্বন্দ্বযোদ্ধা দেবতা ও অসুরগণ পরস্পর অভিমুখী হয়ে নাম উচ্চারণপূর্বক পরস্পরকে আহ্বান ও তিরস্কার করতে করতে সম্মুখে গিয়ে দ্বন্দ্বযুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়েছিল।

ইন্দ্রের সহিত বলি যুদ্ধে প্রবৃত্ত হল, তারকাসুরের সঙ্গে কার্তিকেয়ের সমর হল, হেতির সহিত বরুণ যুদ্ধ করলেন, প্রহেতির সঙ্গে মিত্রের সংগ্রাম হল, এইরূপ কালনাভের সাথে যম, ময়ের সাথে বিশ্বকর্মা, ত্বষ্টার সাথে শম্বর, বিরোচনের সাথে সবিতা, অপরাজিতের সাথে নমুচি, বৃস্পবার সাথে অশ্বিনীকুমারদ্বয়, বান প্রমুখ একশত বলিপুত্রের সহিত সূর্যদেব, রাহুর সাথে চন্দ্র, পুলোমার সাথে বায়ু, নিশুম্ভ ও শুম্ভের সাথে প্রচণ্ডবেগা দেবী ভদ্রকালী, জম্ভের সাথে বৃপি (বিষ্ণু), মহিষাসুরের সাথে অগ্নি, কামদেবের সাথে দুম, মাতৃগণের সাথে উৎকল, শুক্রাচার্যের সাথে বৃহস্পতি, নরকাসুরের সাথে শনি, নিবাতকবচগণের সাথে মরুদগণ, কালকেয়গণের সাথে বসুগণ, পৌলমগণের সাথে বিশ্বেদেবগণ এবং ক্রোধবশগণের সাথে রুদ্রগণ যুদ্ধ করেছিলেন।

এইরূপে সেই যুদ্ধক্ষেত্রে অসুর ও দেবগণ দ্বন্দভাবে অর্থাৎ দুজন দুজন মিলিত হয়ে যুদ্ধ করতে করতে জয়লাভের আকাঙ্ক্ষায় পরস্পরকে আক্রমণপূর্বক প্রবল শক্তি সহকারে তীক্ষ্ণ বাণ, খঙ্গ ও গদার দ্বারা আঘাত করতে লাগল। এরূপে তারা ভুশুন্ডি, চক্র, গদা, ঋষ্টি, পটিশ, শক্তি, উন্মুক, প্রাস, কুঠার, ত্রিস্ত্রিংশ, ভল্ল, পরিখ, মুদগর ও ভিন্দিপাল দ্বারা পরস্পর শিরচ্ছেদ করেছিল। হস্তী, অশ্বরথ, পদাতিক ও আরোহীগণের সাথে অন্যান্য বাহনগণ অস্ত্রাঘাতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। উভয়পক্ষের বীরগণেরই বাহু, গ্রীবা ও পদ এবং ধ্বজ, ধনু, বর্ম ও ভূষণসমূহ ছিন্ন হয়েছিল। তৎকালে দেবতা ও অসুরদের পদাঘাত ও রথচক্র দ্বারা রণক্ষেত্রের মৃত্তিকা চূর্ণ-বিচূর্ণ হলে, সেখান থেকে উত্থিত রেণুসমূহ ক্রমশঃ দিগমণ্ডল, আকাশ ও সূর্যকে আচ্ছন্ন করে, পরে যোদ্ধৃগণের রক্তস্রাবে সিক্ত হওয়ায় উত্থানে বাধা পেয়ে নিবৃত্ত হয়েছিল। সেই রণভূমি ভূরি ভূরি যোদ্ধার ভূষণে ভূষিত, ছিন্ন ভুজে, করভসদৃশ ঊরুতে এবং সমুকুট মস্তকে আচ্ছন্ন হয়ে বিচিত্র আকার ধারণ করেছিল। ঐ সকল ছিন্ন মুণ্ডু তদবস্থায়ও দন্তসকল দ্বারা ওষ্ঠভাগ দংশন করছিল, তাদের নয়নে ক্রোধের চিহ্ন প্রকাশ পেয়েছিল এবং ঐ সকল মুণ্ডের মুকুট ও কুণ্ডল স্থানচ্যুত হয়েছিল। তারপর উভয়পক্ষের মৃত সৈন্যদের কবন্ধ (মস্তকহীন দেহসকল) ভূপতিত নিজ নিজ মুণ্ডস্থিত নেত্ৰদ্বারা দর্শন করতে করতে উদ্যত অস্ত্রদারী বিশাল বাহুসমূহ উত্তোলন পূর্বক যুদ্ধক্ষেত্রে বিপক্ষের সৈন্যগণের প্রতি ধাবিত হতে লাগল।

তারপর দৈত্যরাজ বলি দশটি বাণে ইন্দ্রকে, তিনটি বাণে ঐরাবত হস্তীকে, চারটি বাণে ঐরাবতের পারক্ষক চারটিকে এবং একটি বাণে হস্তীর মাহুতকে বিদ্ধ করল। কিন্তু ঐ সকল বাণ লক্ষ্যস্থলে আসার পূর্বেই দেবরাজ ইন্দ্র তৎসংখ্যক (আঠারোটি) ভল্লাস্ত্রের দ্বারা ত্বরিতবিক্ৰমে আগমনপথেই ঐ বাণগুলিকে হাসতে হাসতে যেন ছেদন করেছিলেন। দেবেন্দ্রের এই প্রশংসনীয় কর্ম দেখে বলি ঈর্ষায় অসহিষ্ণু হলেন, তৎক্ষণাৎ ক্রোধে শক্তি গ্রহণ করলেন কিন্তু সেই শক্তি তার হস্তে থেকে মহতী উল্কার ন্যায় যখন জ্বলছিল, সেই সময়েই ইন্দ্র নিজ শস্ত্রদ্বারা ছিন্ন করে ফেললেন। বলি তারপর শূল, ত্রাস, যষ্টি যা যা গ্রহণ করতে লাগল, দেবরাজ সে সকলই ছিন্ন করে ফেললেন। তারপর ঐ অসুর সহসা অন্তর্হিত হয় আসুরী মায়া সৃষ্টি করল, তাতে সুরসৈন্যদের উপরে হঠাৎ বৃহদাকার একটা পর্বত প্রাদুর্ভূত হল। তারপর দাবানলে প্রজ্বলিত বৃক্ষ সকল পড়তে লাগল এবং পাষাণছেদক অস্ত্রের ন্যায় তীক্ষাগ্র শিলাখণ্ড পতিত হয়ে দেবসৈন্যদের চূর্ণ করতে লাগল। এরপর মহাসর্প (অজগর প্রভৃতি), দন্দক (বিষধর সর্প), বৃশ্চিক, সিংহ, ব্যাঘ্র, বরাহ এবং বৃহৎ বৃহৎ হস্তিগণ এসে দেবসৈন্যদের বিদলিত করছিল। এরপর শত শত নগ্নমূর্তি রাক্ষস ও রাক্ষসী শূল হস্তে “মার মার, কাটু কাটু” এমন করতে করতে দেবতাদের নিকট উপস্থিত হল।

এরপর আকাশমণ্ডলে গম্ভীর ও কঠোর শব্দকারী অতি গাঢ় মেঘরাশি উদিত হয়ে বায়ুর আঘাতে অঙ্গাররাশি বর্ষণ করতে আরম্ভ করল। তারপর মহাসুর বলি মায়াযোগে যে অগ্নির সৃষ্টি করল যার সারথি বায়ু, তা প্রলয়কালীন অগ্নির ন্যায় উগ্রমূর্তি ধারণ করে দেবসেনাদের দগ্ধ করতে লাগল। তারপর দেবসৈন্যগণের চারদিকে উদ্বেল সমুদ্রের আবির্ভাব হল এবং প্রবল বায়ুরাশির আঘাতে ক্ষুব্ধ, হয়ে তরঙ্গ ও আবর্ত (ঘূর্ণী) সমূহের দ্বারা ভয়ংকর রূপ ধারণ করল। এইরূপে রণক্ষেত্রে অলক্ষ্যগতি মহামায়াবী দৈত্যগণ বিবিধ মায়া সৃষ্টি করতে আরম্ভ করলে দেবসৈন্যগণ বিষণ্ণ হয়ে পড়ল। হে মহারাজ, ইন্দ্রাদি দেবগণ যখন চিন্তা করে এই সকল মায়ার কোনরূপ প্রতিকারের উপায় দেখতে পেলেন না, তখন বিশ্বপালক ভগবান শ্রীহরির ধ্যান করায় তিনি সেখানে প্রাদুর্ভূত হলেন।

তারপর যাঁর পরিধানে পীতবস্ত্র, নয়নযুগল নবপ্রস্ফুটিত কমলসদৃশ, বক্ষঃস্থলে উজ্জ্বল শ্রী ও কৌস্তভ মণি, মস্তকে মহামূল্য কিরীট, নিজ হস্তে অষ্ট প্রকার অস্ত্র ধারণপূর্বক সকলের দৃষ্টিগোচর হলেন। হে মহারাজ, জাগরণ অবস্থা উপস্থিত হলে, স্বপ্ন যেমন লয় হয়ে যায়, তেমনি মহাপ্রভাবশালী ভগবান শ্রীহরির রণক্ষেত্রে প্রবিষ্ট হওয়া মাত্র তার মহিমায় অসুরদের কূটমন্ত্রাদি জনিত সমস্ত মায়া বিনষ্ট হল। কারণ হরিস্মৃতিই সকল বিপদের বিনাশক। সিংহবাহন কলেনেমি গরুড়বাহন শ্রীহরিকে দেখেই একটি শূল ঘূর্ণিত করে তার দিকে নিক্ষেপ করল। ঐ শূলটি গরুড়ের মস্তকে পতনোন্মুখ হলে ত্রিগুণাধীশ ভগবান শ্রীহরি অবলীলাক্রমে তা ধারণ করে, তা দিয়েই বাহনের সঙ্গে শত্রু কালনেমির প্রাণসংহার করলেন। তারপর মহাবলশালী মালী ও সুমালী শ্রীহরির চক্রাঘাতে ছিন্নমুণ্ড হয় যুদ্ধক্ষেত্রে পতিত হলে, মাল্যবান, প্রচণ্ড গদার দ্বারা তাদেরকে করে গরুড়কে আঘাত করা মাত্রই আদিপুরুষ শ্রীহরি চক্ৰদ্বারা সেই গর্জনকারী শত্রুর মুণ্ডছেদন করলেন।

.

একাদশ অধ্যায়
দৈত্যরাজ বলির পরাজয়, দৈত্যদের বিনাশ, নারদের বাক্যে। যুদ্ধ সমাপ্তি এবং দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য কর্তৃক মৃত দানবদের পুনর্জীবন

শ্ৰীশুকদেব বললেন–তারপর ইন্দ্র, বায়ু প্রভৃতি দেবগণ পরমপুরুষ ভগবানের অনুকম্পায় চৈতন্য লাভ করে, পূর্বে যারা তাদের যুদ্ধে আঘাত করেছিল, সেই সকল অসুরদের প্রচণ্ড আঘাত করতে লাগলেন। দেবরাজ ইন্দ্র যখন ক্রুদ্ধ হয়ে বিরোচনপুত্র বলির প্রতি বত্র উত্তোলন করলেন, তখন প্রত্যেকে হাহাকার করে উঠল। দৈত্যরাজ বলি অস্ত্রশস্ত্রাদিতে সুসজ্জিত হয়ে রণক্ষেত্রে বিচরণ করছিলেন। ইন্দ্র বজ্রহস্ত হয়ে সম্মুখস্থিত সেই শত্রুকে তিরস্কারপূর্বক এরূপ বলতে লাগলেন- হে মূঢ় কপটবৃত্তি দস্যু যেমন বালকদের চক্ষু আবদ্ধ করতঃ তাদের জয় করে তাদের ধন-সম্পত্তি হরণ করে, তেমনি তুমিও মায়াসমূহের দ্বারা মায়ার অধীশ্বর আমাদের জয় করতে ইচ্ছা করছ। আর, আমার প্রভাব শ্রবণ কর–যারা মায়ার দ্বারা স্বর্গে আরোহণ করতে ইচ্ছা করে, কিংবা স্বর্গ অতিক্রম করে মুক্তিপদ লাভে ইচ্ছুক হয়, আমি সেই মূঢ় দস্যগণকে তাদের পূর্বপদ অপেক্ষাও নিম্ন স্থানে নিক্ষেপ করে থাকি। হে দৈত্যপতিগণ, আমি সম্প্রতি শতপর্বযুক্ত এই বজ্রের দ্বারা তোমার শিরচ্ছেদ করছি, তুমি জ্ঞাতিগণের স্বার্থে এর প্রতিকারের চেষ্টা কর।

বলি বললেন– হে দেবরাজ, এত গর্ব করছ কেন? যে সকল ব্যক্তি সংগ্রামে প্রবৃত্ত হয়, তারা কালপ্রেরিত, তাদেরই ক্রমানুসারে বিজয় ও কীর্তি এবং পরাজয় ও মৃত্যু ঘটে থাকে। পণ্ডিতগণ এই জগৎকে কাল-নিয়ন্ত্রিত বলেই মনে করেন। অতএব তারা হর্ষ বা শোক করেন না, কিন্তু তোমরা এ বিষয়ে অজ্ঞ। এই জয়-পরাজয় বিষয়ে তোমরা নিজেকেই কারণ মনে করো বলে তোমরা বস্তুতই শোকের পাত্র, অতএব তোমাদের মর্মপীড়াজনক বাক্য আমি গ্রাহ্য করিনা। শ্ৰীশুকদেব বললেন– হে মহারাজ, বীরমদন বলি এভাবে দেবেন্দ্রকে তিরস্কার করে অস্ত্র দ্বারা আঘাত করল। দেবরাজ তার তিরস্কারেই আহত হয়েছিলেন, নারাচ আঘাতে আবার আহত হলেন। যদিও দেবেন্দ্র ঐ প্রকারে যথার্থবাদী বৈরি কর্তৃক নিরাকৃত হলেন, তথাপি অঙ্কুশাহত হস্তীর মত ঐ দানবের তিরস্কার সহ্য করতে পারলেন না। তারপর শত্রুদমনকারী ইন্দ্ৰ আমোঘ বজ্র দিয়ে তার উপর প্রহার করলেন, তাতে সেই দানব ছিন্নপক্ষ পর্বতের ন্যায় বিমানসহিত ভূমিতলে পতিত হল।

তখন বলির সখা ও সুহৃৎ জম্ভাসুর নিজ সখার পতন লক্ষ্য করে মৃত সখার সৌহাদ্য রক্ষার জন্য ইন্দ্রের দিকে অগ্রসর হল। তারপর সিংহবাহন মহাবল জম্ভাসুর নিকটে এসে মহাবেগে গদা উত্তোলনপূর্বক ইন্দ্র ও ঐরাবতের জত্রে (স্কন্ধ ও বক্ষের সন্ধিস্থলে) আঘাত করল। ঐরাবত ঐ গদার প্রহারে পীড়িত ও বিহ্বল হয়ে জানুদ্বয় দ্বারা ভূমি স্পর্শ করে অচেতন হল। তা দেখে ইন্দ্ৰসারথি মাতলি সহস্র অশ্বযুক্ত রথ নিয়ে এলে, ইন্দ্র ঐরাবতকে পরিত্যাগ করে রথে আরোহণ করলেন। দানবশ্রেষ্ঠ জম্ভ ইন্দ্ৰসারথির ঐ কর্ম দেখে প্রশংসা করতে লাগল, কিন্তু পরক্ষণেই গর্বপ্রকাশপূর্বক সমরক্ষেত্রে জ্বলন্ত শূলদ্বারা মাতলিকে প্রহার করল। মাতলি ধৈর্য অবলম্বনপূর্বক সেই দুঃসহ পীড়া সহ্য করলে, ইন্দ্ৰ ক্রুদ্ধ হয়ে বজ্ৰদ্বারা জম্ভাসুরের মুণ্ড কেটে ফেললেন।

তৎকালে জম্ভাসুরের জ্ঞাতি নমুচি, বল ও পাক নামক অসুরত্রয় দেবর্ষি নারদের মুখ হতে জম্ভাসুরের নিধনবার্তা শ্রবণ করে সত্বর সেখানে উপস্থিত হল। তারা কর্কশ বাক্যে প্রথমতঃ ইন্দ্রের মর্মস্থল পীড়িত করল, তারপর মেঘমালা যেমন বারিধারার দ্বারা পর্বতের চারদিক আচ্ছন্ন করে, তেমনি বাণ-বর্ষণের দ্বারা দেবরাজকে আচ্ছন্ন করল। তারপর বল নামক অসুর দ্রুতহস্তে একসহস্র বাণদ্বারা একসঙ্গেই যুদ্ধক্ষেত্রে ইন্দ্রের রথের এক সহস্র অশ্বকে আহত করল। পাক নামক অসুর দুইশত বাণ একবারেই ধনুকে যোজনা ও নিক্ষেপপূর্বক পৃথকভাবে সারথি মাতলি এবং অবয়বসহ রথটিকে আঘাত করলে সংগ্রামে এই কার্যটি আশ্চর্যজনক হয়েছিল। এ সময়ে নমুচি পশ্চাদভাগে স্বর্ণবদ্ধ পনেরোটি বৃহৎ বাণ দ্বারা ইন্দ্রকে আহত করে রণক্ষেত্রে সজল মেঘের ন্যায় গর্জন করছিল। মেঘরাশি যেরূপ বর্ষাকালীন সূর্যকে চারদিকে আচ্ছন্ন করে, সেরূপ অসুরগণও বাণরাশির দ্বারা ইন্দ্র, তার সারথি মাতলি এবং তার রথকে আচ্ছাদিত করল।

সমুদ্রমধ্যে নৌকাভঙ্গ হলে বণিকগণ যেমন কাতর হয়, তেমনি দেবগণ ইন্দ্রকে দেখতে না পেয়ে অনুচরবর্গের সহিত বিহ্বল হয়ে চীৎকার করতে লাগলেন। তাদের মনে হল আমরা নায়কশূন্য হয়ে শক্তহস্তে পড়লাম। তারপর ইন্দ্র অসুরদের বাণাবদ্ধ পঞ্জর হতে ধ্বজা, রথ, অশ্ব ও সারথির সাথে নির্গত হয়ে নিশাপগমে উদিত সূর্যের ন্যায় নিজ তেজদ্বারা দিগমণ্ডল, আকাশ ও পৃথিবী উজ্জ্বল করে শোভা পেতে লাগলেন। তৎকালে তিনি নিজ সেনাদলকে সংগ্রামে শত্রুগণ কর্তৃক পীড়িত দেখে শত্রুবধের জন্য ক্রোধে বজ্র উত্তোলন করলেন। হে রাজন, তারপর তিনি অষ্ট ধারামুক্ত সেই বজ্র দ্বারাই দর্শনকারী জ্ঞাতিগণের ভয় উৎপাদন পূর্বক তাদের সম্মুখেই বল ও পাক নামক অসুরদ্বয়ের শিরচ্ছেদন করলেন। তাদের বিনাশ দেখে দানব নমুচি শোক, অসহিষ্ণুতা ও ক্রোধযুক্ত হয়ে ইন্দ্রকে বধের জন্য প্রতিজ্ঞা করে অত্যন্ত যত্ন করতে লাগল। সে ঘণ্টাযুক্ত এবং হেমভূষণে ভূষিত লৌহময় শূল গ্রহণ করে ক্রোধভরে “আর হত হলি’’–এরূপ বলে তর্জন করতে করতে দেবরাজের প্রতি সেই অস্ত্র নিক্ষেপ করল।

হে নৃপ, তখন ত্রিদশধিপতি ইন্দ্র আকাশমার্গে আগত সেই মহাবেগবান্ শূলটিকে বাণ সমূহের দ্বারা সহস্রভাবে ছেদন করে ক্রোধভরে নমুচির শিরচ্ছেদের জন্য তার গ্রীবাদেশে বজ্রের দ্বারা আঘাত করলেন। কিন্তু ইন্দ্র কর্তৃক মহাবলে নিক্ষিপ্ত হয়েও সেই তেজস্বী বজ্ৰ নমুচির চর্মমাত্রও ভেদ করতে পারল না। যে বজ্ৰ অতিবীর্য বৃত্রাসুরকে বিদীর্ণ করে, তা যে নমুচির স্কন্ধের চর্মে কেন কুণ্ঠিত হল, এটা পরম আশ্চর্যের বিষয়। হে রাজ, বজ্র যার নিকট হতে প্রতিহত হয়ে আসত, দেবরাজ তাকে অতিশয় ভয় করতেন; অতএব ঐ ব্যাপার অবলোকন করে সুরপতি বিস্ময়চিত্তে নিজে নিজেই বলতে লাগলেন–দৈবযোগে লোকবিমোহন এ কি ঘটল? পুরাকালে পর্বতসমূহ পক্ষ দ্বারা বিচরণপূর্বক অতিশয় ভারের সহিত ভূতলে পতিত হলে অনেক প্রজানাশ হত বলে, আমি এই বজ্ৰদ্বারাই তাদের পক্ষচ্ছেদন করেছিলাম। ত্বষ্টার তপস্যার সারস্বরূপ বৃত্রাসুর যাতে বিপাটিত হয়েছে এবং অন্যান্য যে সকল বলবান শুরের চর্ম কোনপ্রকার শস্ত্রে ক্ষত হয় নাই, তারাও যার দ্বারা বিদারিত হয়েছে, সেই এই বজ্র, আজ এই ক্ষুদ্র অসুরের প্রতি নিক্ষিপ্ত হয়ে প্রতিহত হল? অতএব আর লগুড়তুল্য নগণ্য এই বজ্র ধারণ করব না। অহো, সম্প্রতি দধীচির তেজ (অর্থাৎ সামর্থ্যও) নিষ্ফল হল।

ইন্দ্র ওইরূপে বিষাদগ্রস্থ হলে, তাঁকে লক্ষ্য করে এরূপ দৈববাণী উচ্চারিত হয়েছিল–হে দেবরাজ, এই দানব শুষ্ক অথবা আর্দ্র কোন বস্তুর দ্বারা বধযোগ্য নহে। কারণ আমি ইহাকে এরূপ বরদান করছি যে, আর্দ্র বা শুষ্ক পদার্থ দ্বারা এর মৃত্যু সংঘটিত হবে না। অতএব হে ইন্দ্র, এই শত্রুর বধের জন্য তোমাকে অন্য কোন উপায় চিন্তা করতে হবে। তখন ইন্দ্র সেই দৈববাণী শ্রবণ করে একাগ্রচিত্তে ধ্যান করতে করতে ফেনাকেই অভীষ্ট উপায়রূপে প্রাপ্ত হলেন–যা কেবল আর্দ্র বা কেবল শুষ্ক না হয়ে আর্দ্র-শুষ্ক উভয়াত্মক। তারপর তিনি শুষ্কও নহে, আর্দ্রও নহে– এরূপ সমুদ্র ফেনার দ্বারা নমুচির শিরচ্ছেদ করলে, মুনিগণ তার স্তব করে পুষ্পবর্ষণ করেছিলেন। তখন বিশ্বাবসু ও পরাবসু নামে প্রধান গন্ধর্বদ্বয় গান করতে লাগল, দেবতাদের দুন্দুভি বাদিত হল এবং নর্তকীসকল আহ্লাদে নৃত্য আরম্ভ করল।

হে মহারাজ, সিংহগণ যেমন মৃগগণকে সংহার করে, তৎকালে বায়ু, অগ্নি ও বরুণ প্রভৃতি দেবগণও তেমনি প্রতিদ্বন্দ্বী অসুরদের সংহারে প্রবৃত্ত হলেন। কিন্তু সেই সময় ব্রহ্মার নির্দেশে দেবর্ষি নারদ দেবতাদের কাছে এসে উপস্থিত হলেন এবং দানবক্ষয় দর্শন করে তাদের নিবারণ করলেন। নারদ বললেন–অহে দেবেন্দ্র, তোমরা ভগবান নারায়ণের ভুজবল আশ্রয় করে অমৃত লাভ করেছ এবং সকলেই লক্ষ্মীদেবীর অনুগ্রহে সমৃদ্ধিশালী হয়েছ, অতএব যুদ্ধ হতে বিরত হও।

. শ্ৰীশুকদেব বললেন–দেবর্ষির বাক্য মান্য করে দেবগণ নিজ নিজ ক্রোধ সম্বরণ করলেন এবং অনুচরগণ কর্তৃক সংস্তুত হয়ে স্বর্গরাজ্যে গমন করলেন। রণক্ষেত্রে দানবদের যে সকল দৈত্য অবশিষ্ট ছিল, তারা নারদের অনুমতিক্রমে বিপন্ন বলিকে নিয়ে অস্ত পর্বতে প্রস্থান করলেন। হে রাজন, রণাঙ্গনে পতিত যে যে দানবের অবয়ব একেবারে বিনষ্ট হয় নাই এবং যাদের মস্তক বিদ্যমান ছিল, দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য নিজ সঞ্জীবনী বিদ্যার দ্বারা তাদের পুনর্জীবিত করলেন। অসুররাজ বলিও শুক্রাচার্যের করস্পর্শে পুনরায় ইন্দ্রিয় ও স্মরণশক্তি প্রাপ্ত হলেন এবং তিনি লোকতত্ত্ব বিষয়ে অভিজ্ঞ ছিলেন বলে পরাজয় সত্ত্বেও বিষাদগ্রস্ত হন নাই।

.

দ্বাদশ অধ্যায়
শ্রীহরির মোহিনীরূপ দেখে শঙ্করের মোহ

শ্ৰীশুকদেব, বললেন–হে মহারাজ, ভগবান শ্রীহরি রমণীমূর্তি ধারণপূর্বক দানবদের মোহিত করে দেবগণকে অমৃত পান করিয়েছিলেন–এই ঘটনা শ্রবণ করে বৃষধ্বজ মহাদেব বৃষে আরোহণ করতঃ নিজ অনুচরসকল ভূতগণে পরিবৃত হয়ে দেবীর সাথে সেখানে গেলেন, যেখানে ভগবান মধুসূদন অবস্থান করছিলেন। তখন ভগবান শ্রীহরি উমার সাথে শংকরকে সাদরে অভিনন্দন জ্ঞাপন করলে,ভগবান শংকরও উপবেশনপূর্বক শ্রীহরির পূজা করে সহাস্যে এরূপ বলতে লাগলেন। শ্রীমহাদেব বললেন–হে দেবদেবী, হে বিশ্বব্যাপক, হে জগদীশ, হে জগন্ময়, আপনি স্থাবর জঙ্গমাত্মক সকল পদার্থের আত্মস্বরূপ (উপাদান), হেতু (নিমিত্তকরণ) এবং ঈশ্বর অর্থাৎ পালক, নিয়াকম ও সংহার কর্তা)। আপনি জগন্ময় হলেও জগতের ন্যায় অসত্য ও জড় বস্তু নহেন, যেহেতু– যে ব্রহ্ম হতে এই জগতের আদি, অন্ত ও মধ্য অবস্থা (অর্থাৎ সৃষ্টি, লয় ও স্থিতি) সাধিত হয়, অথচ যিনি অব্যয় বলে স্বয়ং সৃষ্টি-স্থিতি প্রলয়রহিত এবং যিনি “ইদং– শব্দের বাচ্য দৃশ্য প্রপঞ্চস্বরূপ হয়েও অহংকারের আশ্রয় দ্রষ্টা পদার্থ এবং যিনি বাহিরে ভোগ্য বস্তুরূপে প্রকাশমান, অথচ অন্তরে ভোক্তা বলে প্রসিদ্ধ, আপনি সেই সৎ ও চিৎস্বরূপ, ব্রহ্ম। শ্রেয়স্কামী মুমুক্ষু মুনিগণ নিষ্কাম হয়ে ইহলোক ও পরলোকের আসক্তি পরিহারপূর্বক আপনারই পাদপদ্মের উপাসনা করেন।

হে ভগবান, যদিও আপনি সাক্ষাৎ ব্রহ্ম, তথাপি উদাসীন নহেন। আপনি এই জগৎ প্রপঞ্চের সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের কারণ এবং প্রপঞ্চোপধি জীবসকলের ঈশ্বর (অর্থাৎ তত্ত্ব ফলদাতা)। রাজা যেরূপ, প্রজাগণের নিকট হতে কর প্রভৃতি লাভের অপেক্ষা করেন, আপনি সেরূপ জীবগণের নিকট হতে কোন বস্তু লাভের অপেক্ষা করেন না, যেহেতু আপনি নিরপেক্ষ। জীবগণই বিভিন্ন ফলোভের জন্য আপনার অপেক্ষা করে, ইহাই আপনার ঈশ্বরত্বের সার্থকতা। বস্তুতঃ আপনি পূর্ণ, সুখস্বরূপ, নিত্য, আনন্দময়, অগুণ এবং অশোক। আপনা হতে অতিরিক্ত আর কোন পদার্থই নাই, অথচ আপনি সকল পদার্থ থেকে ভিন্ন। আপনি এতাদৃশ সুখাত্মক ব্রহ্মস্বরূপ, সুতরাং আপনার অন্য বস্তুতে অপেক্ষা নেই, আপনার ঐশ্বর্য কেবল ভক্তগণের প্রতি অনুগ্রহ প্রকাশের জন্যই, নিজের জন্য নহে।

স্বর্ণ যেমন এক হয়েও কুণ্ডলাদি অলংকাররূপে অনেক হয়, তেমনি এক আপনিই কারণরূপে সৎ ও অদ্বিতীয় এবং কার্য জগরূপে অসৎ ও দ্বৈতভাবাপন্ন হন, এতে বস্তুগত কোন ভেদ নেই। আপনি স্বরূপতঃ উপাধিমুক্ত হলেও গুণসমূহ দ্বারাই ভেদ উপস্থাপিত হয়, সেজন্য জীবগণ অজ্ঞানবশতঃ আপনার ভেদ কল্পনা করে থাকে। হে ভগবান্, অজ্ঞানহেতু লোকে বহু প্রকারে আপনার বর্ণনা করে। কেউ তত্ত্ব অবগত নহে, কেহ (বৈদান্তিকগণ) আপনাকে ব্রহ্ম বলে মান্য করেন, কেহ কেহ (মীমাংসকগণ) ধর্ম বলেন; কতকগুলি ব্যক্তি (সাংখ্যবেত্তাগণ) প্রকৃতি পুরুষের পর পুরুষ বলে বর্ণনা করেন, অন্যেরা (পঞ্চরাত্রজ্ঞ ব্যক্তিরা), নব শক্তিযুক্ত (বিমলা, উৎকর্ষিনী, জ্ঞানা, ক্রিয়া, যোগা, প্রন্ত্রী, সত্যা, ঈগানা ও অনুগ্রহ) পরতত্ত্ব বলে নির্দেশ করেন, অপরেরা (পাতঞ্জমতাবলম্বীগণ) স্বতন্ত্র, অব্যয় পরম পুরুষ বলে থাকেন। হে ঈশ, আমি, ব্রহ্মা এবং মারীচি প্রভৃতি ঋষিগণ সত্ত্বগুণে সৃষ্ট হয়েও আপনার মায়ায় মোহিত হয়ে আপনার স্বরূপ দূরের কথা আপনার রচিত এই বিশ্বের তত্ত্বই জানতে পারি না, এ অবস্থায় যাদের উৎপত্তি ও আচার সর্বদা রজঃ ও তমোগুণাশ্রিত, সেই দৈত্য ও মনুষ্য প্রভৃতি জীবগণ যে, আপনার স্বরূপ জানতে পারে না, এ বিষয়ে আর বক্তব্য কি?

হে ভগবান, আপনি জগতের সৃষ্টি, স্থিতি, নাশ, প্রাণীসকলের চেষ্টা এবং জগতের সংসার বন্ধন ও মোচন সকলই জানেন। বায়ু যেমন চর, অচর দেহসমূহ এবং আকাশের মধ্যে সর্বত্র প্রবিষ্ট রয়েছে, তেমনি আপনি আত্মতত্ত্বরূপে সমুদয় চরাচর ব্যপিত আছেন, আপনি জ্ঞানস্বরূপ, সুতরাং সকলের আত্মা। প্রভো, আপনি-গুণদ্বারা রমণ করতঃ যে যে অবতার গ্রহণ করেছেন, আমি সে সকল পূর্বে দর্শন করেছি। সম্প্রতি আপনি যে স্ত্রীমূর্তি ধারণ করেছিলেন, তা দেখতে ইচ্ছা করি, যা মোহিনীরূপে দুর্মদ দৈত্যগণকে মোহিত করে, দেবতাদের অমৃত পান করালেন, সেই মূর্তি দর্শনে ইচ্ছুক হয়েই আমরা এখানে এসেছি। এ বিষয়ে আমাদের পরম কৌতূহল রয়েছে।

শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে রাজন, শূলপানির এ প্রকার অভ্যর্থনায় ভগবান ভাবগম্ভীর হাস্য করে তাকে বললেন–হে দেবদেবী, অমৃতপাত্র অসুরদের হস্তগত হলে, আমি বিবেচনা করলাম, “যোষিবেশেই সুরকার্য হবে”– অর্থাৎ উন্মত্ত দৈত্যদের বঞ্চনা করে দেবতাদের অমৃত দিতে হবে। কিন্তু রূপান্তর আশ্রয় ব্যতিরেকে ঐরূপ বৈষম্য করা যেতে পারে না। অতএব দানবদের কৌতূহলের জন্য বঞ্চনমোহনাদির সার-স্বরূপ কামিনীরূপ ধারণ করেছিলাম। আপনি সম্প্রতি সেইরূপ দেখতে ইচ্ছা করছেন বলে আমি আপনাকে কামুকগণের আদরণীয় ও কামোদ্দীপক সেই রমণীরূপ দর্শন করাব।

শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে মহারাজ, ভগবান শ্রীহরি একথা বলতে বলতে সেখানেই অন্তর্হিত হলেন। তখন মহাদেব উমার সঙ্গে সব দিকে চক্ষু সঞ্চারণ করতঃ সোৎসুক– চিত্ত হয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ পর মহাদেব বিচিত্র কুসুম ও অরুণবর্ণ পল্লবশালী তরুরাজিমণ্ডিত উপবনে কন্দুকক্রীড়ারত এক পরমা সুন্দরী রমণীকে দেখতে পেলেন। তাঁর নিতম্বদেশে উজ্জ্বল কৈশেয় বসন এবং তদুপরি মেখলা শোভা পেতেছিল। ক্রীড়াকালে কন্দুকটির ঊর্ধ্বগতি ও নিম্নগতি সহিত সেই রমণীও দেহটিকে একবার উন্নত ও অবনত করায় কম্পিত স্তনযুগল ও হারসমূহের গুরুভারে প্রতিপদক্ষেপেই দেহের মধ্যভাগ যেন ভগ্ন হতেছিল। এইরূপে তিনি চঞ্চল পল্লবের ন্যায় কোমল চরণ ইতস্ততঃ চালনা করছিলেন। তৎকালে ককটি চারদিকে চঞ্চলভাবে ভ্রমণ করায় তাঁর সুদীর্ঘ লোল লোচনদ্বয়ের তারকা-দুটিও উদ্বিগ্ন ও চঞ্চল হয়েছিল। তাঁর মুখমণ্ডল কর্ণস্থিত উজ্জ্বল কুণ্ডলযুগলের দীপ্তিযুক্ত গন্ডস্থল ও নীলবর্ণ অলকারাজির দ্বারা শোভিত হয়েছিল।

সেই রমণীমূর্তি শিথিল পরিধেয় বস্ত্র ও স্থলিত কেশবন্ধনটিকে মনোহর বাম হস্তদ্বারা আবদ্ধ করতে করতে দক্ষিণ হস্তদ্বারা ককক্ষেপণ সহকারে নিজ মায়ার দ্বারা জগতের মোহ উৎপাদন করছিলেন। এরূপ কন্দুকক্রীড়াজনিত ঈষৎ লজ্জাবশতঃ সেই রমণীমূর্তি পরিস্ফুট হাস্যসহকারে কটাক্ষপাত দ্বারা মহাদেবের চিত্ত হরণ করলেন। অতএব শ্ৰীশংকর তাঁর প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে বিনিময়ে সেই রমণীমূর্তিও তার প্রতি বার বার কটাক্ষ নিক্ষেপ করায় তিনি ব্যাকুলচিত্ত হয়ে নিজেকে এবং নিকটবর্তিনী উমাদেবী ও নিজ অনুচরগণকে পর্যন্ত ভুলে গিয়েছিলেন। এক সময় সেই ককটি মোহিনীমূর্তির হস্ত হতে দূরে চলে গেলে কখন তিনি তা ধরার জন্য পশ্চাৎ পশ্চাৎ ছুটছিলেন, তখন মহাদেবের দৃষ্টির সম্মুখেই বায়ু সেই। সুন্দরীর সূক্ষ্ম বস্ত্রটি চন্দ্রহারের বন্ধনসহ হরণ করল। মহাদেব দণ্ডায়মান হয়ে অনিমেষ নয়নে তা দেখতে লাগলেন।

সে সময় সেই রমণী কুঞ্চিত কটাক্ষ নিক্ষেপ করে মহাদেবকে নিরীক্ষণ করায় মহাদেব সেই সুদৃশ্যা মনোরমা সুনয়নার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়লেন। এইরূপে মোহিনীমূর্তি মহাদেবের জ্ঞান হরণ করলে, তিনি সেই সুন্দরী কর্তৃক উৎপাদিত কামাবেশে বিহ্বল হওয়ায় উমাদেবীর দৃষ্টির সম্মুখেই নির্লজ্জ হয়ে মোহিনীর নিকট গমন করলেন। মহাদেবকে নিকটে আসতে দেখে তখন সেই বিবস্ত্রা মোহিনীমূর্তি অতিশয় লজ্জিত হয়ে, হাসতে হাসতে বৃক্ষরাজির মধ্যে আত্মগোপন করার উদ্দেশ্যে আর সেখানে অপেক্ষা করলেন না। যূথপতি হস্তী কামপীড়িত হয়ে যেমন হস্তিনীর অনুগমন করে, মোহিনী কর্তৃক চিত্ত আকৃষ্ট হওয়ায় মহাদেবও তেমনি কামবশ হয়ে ঐ সুন্দরীর পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করতে লাগলেন। অনন্তর মহাদেব অতিবেগে তার দিকে ধাবিত হয়ে নিজ সঙ্গবিষয়ে অনভিলাষিনী সেই মোহিনীকে কেশগ্রহণপূর্বক নিকটে এনে দুটি বাহুদ্বারা আলিঙ্গন করলেন।

হে মহারাজ, হস্তী কর্তৃক আলিঙ্গনাবদ্ধা হস্তীনীর ন্যায় তৎকালে ভগবান শংকর কর্তৃক আলিঙ্গিতা সেই মোহিনীমূর্তিও ইতস্ততঃ চলতে আরম্ভ করলেন, এ অবস্থায় তার কেশরাশি ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হতেছিল। তারপর দেবমায়া রচিতা বিশাল নিতম্বশালিনী সেই মোহিনীমূর্তি অতিশয় কষ্টে মহাদেবের ভুজবন্ধন হতে নিজেকে মুক্ত করে পুনরায় দৌড়তে লাগলেন। তৎকালে মহাদেব নিজ শত্ৰু কন্দর্প কর্তৃক পরাভূত হয়েই যেন বিচিত্রকর্মা ভগবান বিষ্ণুর গতিপথের অনুসরণ করতে লাগলেন। ঋতুমতী হস্তিনীর অনুসরণকারী কামমত্ত হস্তীর মত মোহিনীর পশ্চাদ্ধাবনকারী অব্যর্থবীর্য মহাদেবের বীর্যস্খলন হয়েছিল। হে মহারাজ, মহাপ্রভাবশালী রুদ্রের বীর্য পৃথিবীর যে যে স্থানে পতিত হয়েছিল, সেই সেই স্থান রুদ্রের (পাঠান্তরে রৌপ্যের) এবং সুবর্ণের ক্ষেত্র হয়েছে। ভগবান হর ঐ প্রকারে মোহিনীর পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হওয়ায় নদী, সরোবর, শৈল, বর্ণ ও উপবন এবং অন্যান্য যে সকল স্থানে ঋষিগণ থাকেন, সর্বত্রই সন্নিহিত হয়েছেন। হে নৃপশ্রেষ্ঠ, শুক্র স্থলিত হওয়ার পর ভগবান শঙ্কর দেবমায়ার দ্বারা বশীকৃত নিজেকে লক্ষ্য করলেন এবং ঐ মোহ হতে নিবৃত্ত হলেন। তারপর তিনি দুয়ে মাহাত্ম্যশালী জগদাত্মা শ্রীহরির মাহাত্ম্য অবগত হয়ে নিজের তাদৃশ মোহ জড়তা আশ্চর্যজনক মনে করেন নাই। তৎকালে ভগবান শ্রীহরি মহাদেবের কোনরূপ বিহ্বলতা বা লজ্জা না দেখে পরমপ্রীত হয়ে নিজ পুরুষমূর্তি ধারণ পূর্বক এরূপ বলেছিলেন।

শ্রীভগবান বললেন–হে দেবশ্রেষ্ঠ, আপনি আমার স্ত্রীরূপা মায়ার দ্বারা মোহিত হয়েও যে পুনরায় নিজের প্রকৃতি (স্বাভাবিক অবস্থা) প্রাপ্ত হলেন, তা পরম ভাগ্য। আপনি আত্মাতে অবস্থিত, কোন সন্দেহ নাই। হে দেব, আপনি ভিন্ন অপর কোন বিষয়াসক্ত পুরুষ, সংসারে অনির্বচনীয় ভাবসমূহের সৃষ্টিকর্তী এবং অজিতেন্দ্রিয় ব্যক্তিগণের অলঙঘনীয়া আমার মায়াকে অতিক্রম করতে পারে? এই গুণময়ী মায়া সৃষ্টি প্রভৃতির কারণস্বরূপ কালরূপী আমার সহিত রজঃ প্রভৃতি অংশের দ্বারা মিলিত হয়ে আমারই অধীনা রয়েছে। তা আপনাকে আর কখনও অভিভূত করতে পারবে না।

শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে রাজন, শ্রীবৎস ভগবান এই প্রকার সৎকার করলে, দেবদেব সম্ভাষণপূর্বক তাকে প্রদক্ষিণ করলেন, পরে নিজের অনুচরগণের সাথে স্বস্থানে প্রস্থান করলেন। তারপর ভগবান শংকর নিজের অংশরূপা এবং শ্রেষ্ঠ মুনিগণের পূজিতা মহামায়া ভবানীকে প্রীতি সহকারে এরূপ বলেছিলেন–হে প্রিয়ে, তুমি জন্মরহিত পরম দেবতা পরম পুরুষ শ্রীহরির মায়া দর্শন করলে তো? আমি ভগবানের অংশ সমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হয়েও ঐ মায়ার বশে মুগ্ধ হয়েছিলাম, আর অন্য অস্বতন্ত্র পুরুষগণ যে তার দ্বারা মোহিত হবে, এ বিষয়ে আর বক্তব্য কি? হে সতী, সহস্র বছর পরে আমি যোগ থেকে বিরত হলে, তুমি যাঁর কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলে, এই শ্রীহরিই সাক্ষাৎ সেই পুরাণপুরুষ। কাল তার ইয়ত্তা নির্ণয় করতে পারে না, কিংবা বেদশাস্ত্রও তার স্বরূপ বর্ণনে সমর্থ হয় না। শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে তাত, যিনি সমুদ্র মন্থনের সময়ে নিজ পৃষ্ঠে মহাগিরি মন্দর ধারণ করেছিলেন, সেই ভগবান শ্রীহরির বিক্রমের কথা তোমার নিকট কথিত হল। যে ব্যক্তি ভক্তিপূর্বক এই বিষয় কীর্তন ও শ্রবণ করবে, তার কখনও উদ্যম ভঙ্গ হবে না, কারণ উত্তমঃ শ্লোক ভগবানের গুণানুকীর্তন সাংসারিক সমস্ত ক্লেশের বিনাশকারী। কপট যুবতী বেশধারী যিনি দানবদের মোহিত করে, অসজ্জনের অপ্রাপ্য ও ভক্তিলভ্য নিজ পাদপদ্মের শরণাগত শ্রেষ্ঠ দেবগণকে সমুদ্রমন্থনজাত অমৃত পান করিয়েছিলেন, আমি আশ্রিতজনের কামনা পূর্ণকারী সেই ভগবান শ্রীহরিকে প্রণাম করছি।

.

ত্রয়োদশ অধ্যায়
ভবিষ্যৎ সপ্ত মন্বন্তরের পৃথক পৃথক বর্ণনা

শ্ৰীশুকদেব বললেন– হে মহারাজ, বিবস্বানের পুত্র শ্রাদ্ধের নামে বিখ্যাত সপ্তম মনু, যিনি বর্তমান কালে বিদ্যমান রয়েছেন, তার সন্তানদের বিবরণ বলছি, আমার নিকট শোন। ইক্ষাকু, নভগ, ধৃষ্ট, শর্যাতি, নরিষ্যন্ত, নাভাগ, দ্বিষ্ট, বারণ, পৃষ ও বসুমান–ওই দশ জন বৈবস্বত মনুর পুত্র। হে শত্রুনাশন, ঐ মন্বন্তরে আদিত্যগণ, বসুগণ, রুদ্রগণ, বিশ্বদেবগন, মরুদগণ, অশ্বিনীকুমার দ্বয় এবং . ভৃগুগণ, দেবতা, পুরন্দর তাদের ইন্দ্র, আর কশ্যপ, অত্রি, বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র গৌতম, জমদগ্নি এবং ভরদ্বাজ–এই সপ্ত ঋষি। এই মন্বন্তরেও প্রজাপতি কশ্যপ হতে আদিতির গর্ভে ভগবান বিষ্ণু আবির্ভূত হন। বিবস্বান্, অর্যমা, পূষা ইত্যাদি দ্বাদশ আদিত্যগণের সর্বকনিষ্ঠ বামনরূপী বিষ্ণু। সপ্তম মন্বন্তরের বিবরণ পূর্বে সংক্ষেপে বলেছি, বিষ্ণুর অবতারযুক্ত ভবিষ্যৎ সাতটি মন্বন্তরের কথা পরে বলব।

হে মহারাজ, বিবস্বানের দুই পত্নী সংজ্ঞা ও ছায়া। দুই জনই বিশ্বকর্মার কন্যা। আমি পূর্বে তোমার নিকট এ দুজনের কথা বলেছি। কেউ কেউ সূর্যের বড়বা নামে তৃতীয় পত্নীর কথা বলেন। (কিন্তু সংজ্ঞাই এক সময় বড় হয়েছিলেন বলে তিনি সংজ্ঞা থেকে পৃথক নন।) সংজ্ঞার দুই পুত্র যম ও শ্রাদ্ধদেব এবং এক কন্যা যমী (যমুনা)। এরপর ছায়ার পুত্রগণের কথা বলছি, শোন। ছায়ার এক পুত্র, নাম সাবর্ণি, আর কন্যা তপতী, যিনি সংবরণের ভার্যা। শনিও ছায়ারই পুত্র– ইনি যম ও যমীর পর তৃতীয় সন্তান। বড়বা নামে বিবস্বানের ভার্যার গর্ভে অশ্বিনীকুমারদ্বয় জন্মগ্রহণ করেন।

হে নৃপ, অষ্টম মন্বন্তর উপস্থিত হলে, সূর্যপুত্র এই সাবৰ্ণি মনু হবেন। নির্মোক ও বিরজস্ক প্রভৃতি ঐ সাবর্ণির পুত্র। এই মন্বন্তরে সুতপা, বিরজা ও অমৃতপ্রভা– এই সকল দেবতা এবং বিরোচন– পুত্র বলি তাদের ইন্দ্র হবেন। ঐ বলি সামান্য নন, (সপ্তম মন্বন্তরে) ভগবান বিষ্ণু তার নিকট (বামন রূপে) গিয়ে ত্রিপাদ-মাত্র ভূমি যাঞ্ছা করলে, তিনি সমগ্র পৃথিবী দান করেন এবং (অষ্টম মন্বন্তরে) ভগবানের প্রসাদে লব্ধ ইন্দ্রত্ব পদ পরিত্যাগ করে সিদ্ধি প্রাপ্ত হবেন। ভগবান, বামনরূপী বিষ্ণু সেই বলিকে পরাস্ত করেন, পরে প্রীত হয়ে পুনর্বার পাতালে স্থাপন করেছিলেন, তাতে বলি স্বর্গ অপেক্ষাও উৎকৃষ্ট সেই স্থানে এক্ষণে স্বর্গাধিপতির ন্যায় বাস করছেন। এই মন্বন্তরে গালব, দীপ্তিমান, পরশুরাম, অশ্বত্থামা, কৃপ, ঋষ্যশৃঙ্গ এবং আমাদের পিতা ভগবান বাদরায়ণ (ব্যাস)– এই সাতজন ঋষি হবেন, তাঁরা এক্ষণে যোগবলম্বন করে স্ব স্ব আশ্রমে অবস্থান করছেন। হে মহারাজ, এই অষ্টম মন্বন্তরে ভগবান বিষ্ণু দেবগুহ্য হতে সরস্বতীর গর্ভে সার্বভৌম নামে আবির্ভূত হয়ে পুরন্দরের নিকট হতে ইন্দ্ৰত্ব হরণপূর্বক বলিকে ইন্দ্রপদ প্রদান করবেন।

এরপর নবম মনুর বিরবণ বলছি, শোন। নবম মন্বন্তরে, মরীচিগর্ভ প্রভৃতি দেবতা, উদ্ভূত তাদের ইন্দ্র এবং দ্যুতিমান প্রভৃতি সপ্তর্ষি হবেন। এই মন্বন্তরে আয়ুষ্মন হতে অষুধারার গর্ভে ভগবানের অংশস্বরূপ ঋষভদেবের আবির্ভাব হবে, যিনি তৎকালীন অদ্ভুত নামক ইন্দ্রকে সমৃদ্ধশালী ত্রিলোকের আধিপত্য ভোগ করাবেন। দশম মনুর নাম ব্রহ্মসাবর্ণি, তিনি উপশ্লোকের পুত্র। ভূরিষেণ প্রভৃতি ঐ মনুর সন্তান। ঐ মন্বন্তরে হবিষ্মন্ প্রভৃতি ব্রাহ্মণ অর্থাৎ হবিষ্মন, সুকৃত সত্য, জয়, মূর্তি ইত্যাদি সপ্তর্ষি, সুবাসন ও বিরুদ্ধ প্রভৃতি দেবতা এবং তাদের প্রভু শম্ভ নামক ইন্দ্র, এই দশম মন্বন্তরে ভগবান্ বিভু বিশ্বসৃক বিপ্রের গৃহে বিসুচির গর্ভে অংশাংশে জন্মগ্রহণ করে বিষষেণ নামে বিখ্যাত হবেন এবং তৎকালীন দেবরাজ শুম্ভর সাথে তার সখ্য হবে।

মনস্বী ধর্মসাবণি একাদশ মনু হবেন এবং সত্য, ধর্ম, প্রভৃতি দশ জন তাঁর পুত্র হবেন। ঐ মন্বন্তরে বিহঙ্গম, কালগম, নির্বানরুচি, প্রভৃতি দেবতা, বৈধৃত তাঁদের ইন্দ্র এবং অরুণ প্রভৃতি সপ্তর্ষি হবেন। তৎকালে শ্রীহরির অংশ হতে বৈধৃতার গর্ভে আবির্ভূত আর্যকপুত্র ধর্মসেতু ত্রিলোকের পরিপালন করবেন। হে মহারাজ, দ্বাদশ মনুর নাম রুদ্রসাবর্ণি। দেবগণ, উপদেব ও দেবশ্রেষ্ঠ প্রভৃতি তার পুত্র। উক্ত মন্বন্তরে ঋতধামা ইন্দ্র, হরিত প্রভৃতি দেবতা এবং তপোমূর্তি, তপস্বী ও আগ্নী প্রভৃতি সপ্তর্ষি হবেন। এ সময়ে সত্যসৃহা হতে সুনৃতার গর্ভে অংশতঃ অবতীর্ণ ভগবান শ্রীহরি স্বধামা নামে প্রসিদ্ধ হয়ে উক্ত মন্বন্তরকে সুসমৃদ্ধ করবেন।

মনস্বী দেবসাবৰ্ণি ভাবী ত্রয়োদশ মনু এবং চিত্রসেন, বিচিত্র, প্রভৃতি তার পুত্র। সেই মন্বন্তরে সুকর্মা, সুত্রামা প্রভৃতি দেবতা, দিবস্পতি নামক ইন্দ্র এবং নির্মোক ও তত্ত্বদর্শ প্রভৃতি সপ্তর্ষি হবেন। তৎকালে ভগবান শ্রীহরি এক অংশে বৃহতীর গর্ভে দেবহোত্রের পুত্র যোগেশ্বর নামে আবির্ভূত হয়ে ইন্দ্রের কার্য সম্পাদন করবেন। চতুর্দশ মনুর নাম ইন্দ্রাবৰ্ণি উরু, গম্ভীর, ধ্রর (বুদ্ধি) প্রভৃতি তাঁর পুত্র। ঐ মন্বন্তরে পবিত্র, চাক্ষুষ প্রভৃতি দেবতা, শুচি নামক ইন্দ্র এবং অগ্নিবাহ, শুচি, শুদ্ধ, মগধ প্রভৃতি সপ্তর্ষি হবেন। তৎকালে ভগবান শ্রীহরি বিনতৃর (বিতানার) গর্ভে সত্ৰায়ণের পুত্র বৃহদ্ভানু নামে আবির্ভূত হয়ে লোককল্যাণকর ক্রিয়াসমূহের বিস্তার করবেন। হে রাজন, ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান,– এই কালয়ের অনুগত চতুর্দশ মনুর বিবরণ তোমার নিকট বর্ণন করলাম। এই চতুর্দশ মন্বন্তরে পরিমিত কল্পকালের পরিমাণ এক সহস্র যুগ।

.

চতুর্দশ অধ্যায়
মন্বদির পৃথক পৃথক কর্ম নিরূপণ

রাজা পরীক্ষিৎ বললেন– হে ভগবান, এই মনুগণ নিজ নিজ মন্বন্তরে যে যে কর্ম যে প্রকারে যার দ্বারা নিযুক্ত হন, তা আমাকে বলুন। শ্ৰীশুকদেব বললেন– হে মহারাজ, মনুগণ, মনুপুত্রগণ, মুনিগণ, ইন্দ্রগণ ও দেবতাগণ সকলেই যজ্ঞাদি অবতাররূপী পরমপুরুষ বিষ্ণু কর্তৃক নিজ নিজ কার্যে নিয়োজিত হন। হে মহারাজ, আমি পূর্বে তোমার নিকট মহাপুরুষ বিষ্ণুর যজ্ঞাদি যে সকল মূর্তির কথা বলেছি, তাদের দ্বারা পরিচালিত হয়েই মনু প্রভৃতি সকলে জগতের কার্য নির্বাহ করেন। চতুর্যুগের অবসানে বেদসকল কালগ্রস্ত হলে, আবার সৃষ্টির প্রারম্ভে ঋষিগণ তপোবলে ঐ সকল দেবকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করেন। সেই সমস্ত বেদ হতেই সনাতন ধর্ম পুনরায় প্রবর্তিত হয়। হে নৃপ, তারপর ভগবানের আদেশে মনুগণ নিজ নিজ কালে সংযত হয়ে পৃথিবীতে চতুষ্পদ ধর্ম প্রবর্তন করেন। এইরূপ প্রজাপালক মনুপুত্রগণ, যজ্ঞভাগভোগী দেবগণ এবং স্বর্গ ও পৃথিবীতে যজ্ঞকর্মের ফলভোগী মনুষ্যাদির সঙ্গে মিলিতভাবে সেই মন্বন্তরের অবসান কাল পর্যন্ত পুত্র-পৌত্রাদি ক্রমে এই ধর্ম পালন করে থাকেন। ঐ সময় দেবরাজ ইন্দ্র ভগবানের প্রদত্ত ত্রিলোকের মহাসম্পদ ভোগ করে ত্রিলোকের পরিপালন এবং লোকমধ্যে ইচ্ছানুরূপ বারিবর্ষণ করেন।

ভগবান হরি প্রতিটি যুগে সনকাদি সিদ্ধরূপ ধারণ করে জ্ঞানোপদেশ, যাজ্ঞবল্কাদি ঋষিরূপ ধারণ করে কর্মোপদেশ এবং দত্তাত্রেয় প্রভৃতি যোগেশ্বররূপে যোগের উপদেশ করেন। এইরূপ তিনি মরীচি প্রভৃতি প্রজাপতিরূপে প্রজাসৃষ্টি, নরপতিরূপে দস্যুদের সংহার এবং শীতোষ্ণাদি বিবিধ গুণযুক্ত কালরূপে সৃষ্টির লয় করে থাকেন। লোকেরা নানা শাস্ত্রের দ্বারা সেই হরির তত্ত্বনিরূপণ করতে যত্ন করে, কিন্তু নামরূপাত্মিকা মায়ার দ্বারা বিমোহিতচিত্ত হওয়ায় বহুল যত্নেও তাকে দেখতে পায় না। হে মহারাজ, আমি এইরূপে তোমার নিকট কল্প ও অবান্তর কল্পের প্রমাণ উল্লেখ করলাম। পুরাতত্ত্বজ্ঞগণ এই কল্পকেই চতুর্দশ মন্বন্তর বলে থাকেন।

.

পঞ্চদশ অধ্যায়
দৈত্যরাজ বলির স্বর্গজয় এবং দেবগণের পলায়ন

মহারাজ পরীক্ষিৎ জিজ্ঞাসা করলেন –হে ব্রাহ্মণ, ভগবান হরি সকল প্রাণীর ঈশ্বর হয়েও দীন ব্যক্তির মত বলির নিকট ত্রিপাদ ভূমি কি জন্য প্রার্থনা করেছিলেন? আর যাঞ্ছিত অর্থ লাভ করেও কেনইবা তাকে কচ্ছন করলেন? পূর্ণ স্বরূপ ঈশ্বরের যাঞ্ছা এবং নিরপরাধ বলির কছন–এটি অতিশয় আশ্চর্যজনক বলে আমরা এই রহস্য জানতে ইচ্ছা করি, যেহেতু এ বিষয় জানতে আমাদের মহৎ কৌতূহল হয়েছে। শ্রীশুকদেব বললেন– হে রাজন, যুদ্ধে বলির পরাজয় এবং ইন্দ্র হতে প্রাণনাশ হয়েছিলেন, কিন্তু শুক্রাচার্যের অনুগ্রহে তিনি পুনরায় জীবিত হন। তারপর উদারচিত্ত মহাত্মা বলি শিষ্য হয়ে সমস্ত অর্থ সমর্পণের দ্বারা সর্বতোভাবে শুক্রাচার্য প্রমুখ ভৃগুবংশীয় ব্রাহ্মণদের উপাসনা করতেন। তারপর ভৃগুবংশীয় মহাপ্রভাবশালী ব্রাহ্মণগণ সন্তুষ্ট হয়ে স্বর্গজয়ের অভিলাষী বলিকে মহাভিষেক বিধি (অর্থাৎ বহুচ ব্ৰহ্মণগ্রন্থে প্রসিদ্ধ ঐন্দ্রাভিষেক) অনুসারে অভিষিক্ত করে বিশ্বজিৎ যজ্ঞ করালেন।

তারপর যজ্ঞে হবির দ্বারা আহুত অগ্নির মধ্য হতে স্বর্ণময় পট্টবস্ত্র-ভূষিত রথ, ইন্দ্রের অশ্বের মত হরিদ্বর্ণ কতগুলি অশ্ব এবং সিংহ– চিহ্নিত একটি রথধ্বজ আবির্ভূত হন। এরূপে সেই অগ্নি হতেই স্বর্ণদ্ধ বিদ্যধনু, অক্ষয়বাণে পরিপূর্ণ দুটি তূণ (বাণাধার) এবং দিব্য কবচ উত্থিত হল। তারপর তার পিতামহ প্রহ্লাদ তাঁকে অম্লান পুষ্পমাল্য এবং শুক্রাচার্য একটি শঙ্খ প্রদান করলেন। ভৃগুবংশীয় ব্রাহ্মণগণ এই প্রকারে বলির যুদ্ধসামগ্রী সম্পাদন করে দিয়ে তার স্বস্ত্যয়ন (মঙ্গলবাচনাদি) করলেন। এরপর বলি প্রদক্ষিণ পূর্বক ব্রাহ্মণদের প্রণাম করে, পিতামহ প্রহ্লাদকে সম্ভাষণ ও প্রণাম করলেন। তারপর মহারথ বলি ভৃগু-প্রদত্ত দিব্য রথে আরোহণ করে সুরম্য মাল্য, কবচ ধনুঃ খড়গ ও তৃণযুগল ধারণ করলেন। তৎকালে তার ভূজযুগল স্বর্ণময় কেয়ুরদ্বয় এবং কর্ণদ্বয় মকরাকৃতি উজ্জ্বল কুন্তল যুগলে শোভিত ছিল। এ অবস্থায় বলি রথারূঢ় হয়ে কুন্ডস্থিত অগ্নির ন্যায় দীপ্তি পেতে লাগলেন। তারপর বলির সমান ঐশ্বর্য, বল ও শোভাযুক্ত দৈত্যযূথপতিগণ নিজ নিজ যূথ-সহ দৃষ্টির দ্বারা যেন আকাশমণ্ডলকে পান করতে করতে এবং দিমণ্ডলকে দগ্ধ করতে করতে গিয়ে বলির সাথে মিলিত হল। বলি তাদের দ্বারা পরিবৃত হয়ে মহতী আসুরী সেনা আকর্ষণ পূর্বক সুসমৃদ্ধ ইন্দ্রপুরীর প্রতি যাত্রা করলেন। তাঁর গমনকালে স্বর্গ ও পৃথিবী যেন কম্পমান হতে লাগল।

ঐ ইন্দ্রপুরীতে নন্দনকানন প্রভৃতি সুরম্য উপবন ও উদ্যানসমূহ অতিশয় রমণীয়, সেই সকল উপবন ও উদ্যানে বিহঙ্গমিথুন কলরব এবং মত্ত ভ্রমরগণ সুস্বরে গান করছিল। সেখানে যে সকল অমর দ্রুম ছিল, তাদের শাখাসকল প্রবাল ও ফল– পুষ্পের গুরুভাবে নত হয়ে পড়েছিল। সেখানে সরোবর সকলে সুরসেবিত প্রমাদগুণ পরম কৌতুকে ক্রীড়া করছিল। ঐ সকল সরোবরে যে সমস্ত পদ্মিনী ছিল, হংস, সারস, চক্রবাক্ এবং কারভুব প্রভৃতি জলচর পক্ষীসমূহে সে সকল আকুল হতেছিল। ইন্দ্রপুরী চারদিকে পরিখাতুল্য আকাশগঙ্গায় বেষ্টিত, তার চারপার্শ্বে অগ্নিবর্ণ, অতি উচ্চ প্রাচীর, সেই প্রাচীরের উপরে যুদ্ধস্থান সকল বিরচিত। ঐ পুরী বিশ্বকর্মার নির্মিত ও পৃথক পৃথক রাজপথে সুশোভিত। ঐ ইন্দ্রপুরীর গোপুর (পুরদ্বার) সমূহ স্ফটিকময় এবং দ্বারসকলের কপাট-সকল স্বর্ণময় পট্ট (পাল্লা) সংযুক্ত রয়েছে। উপবেশন স্থান, প্রাঙ্গণ উচ্চ পথ ও অসংখ্য বিমানের দ্বারা সুশোভিত সেই ইন্দ্রপুরীতে হীরক ও প্রবালের বেদিযুক্ত বেণুধ্বনি এবং গন্ধর্বাদি উপদেবতাগণের নৃত্য, গীত ও বাদ্য দ্বারা মনোরম হয়ে নিজ কান্তিদ্বারা কান্তির অধিষ্ঠাত্রী দেবতাকেও জয় করেছে। অধার্মিক, খল, প্রাণী হিংসক, শঠতামানী, কামী ও লোভী ব্যক্তিগণ সেই স্বর্গপুরে যেতে পারে না, কেবল ঐসকল দোষবর্জিত ব্যক্তিগণই গমন করেন।

সেনাপতি বলি সেই দেবপুরী গমন করে সৈন্য দ্বারা তার বহির্ভাগ সর্বতোভাবে রুদ্ধ করলেন এবং দেবাঙ্গনাদের ভয় উৎপাদন পূর্বক শুক্রাচার্যের প্রচণ্ড শব্দকারী শঙ্খের ধ্বনি করতে লাগলেন। বলির ঐ প্রকার পরম যুদ্ধোদ্যম অবগত হয়ে দেবরাজ ইন্দ্র দেবতাদের সাথে গুরু বৃহস্পতির নিকট গিয়ে নিবেদন করলেন। ভগবান, আমাদের পূর্বশত্রু বলির পুনরায় গুরুতর উদ্যম দেখছি, মনে হয়, মণিময় চতুষ্পথ সমূহ শোভা পেত।

সেই ইন্দ্রপুরীতে নিত্যরূপযৌবনশালিনী, সুনির্মল বসনা, রূপবতী শ্যামা রমণীগণ শিখাপ্রদীপ্ত অগ্নির ন্যায় বিরাজ করত। সেখানে সুরস্ত্রীগণের কেশভ্রষ্ট সুগন্ধি মাল্যের সৌরভ গ্রহণ করে বায়ু পথে পথে প্রবাহিত হত। সেই পুরীর পথসমূহ সুবর্ণ– খচিত গবাক্ষপথে নির্গত অগুরু গন্ধযুক্ত শুক্লবর্ণ ধূমরাশির দ্বারা আচ্ছন্ন হয় এবং অপ্সরাগণ সেই পথে বিচরণ করেন। সেই পুরী সর্বদা মুক্তাময় চন্দ্রাতপ, সুবর্ণ ও মণিময় ধ্বজা এবং বিচিত্র পতাকাযুক্ত বলভী সমূহের (গৃহের পুরোভাগে উপরে রচিত উপবেশন স্থান বিশেষের) দ্বারা পরিব্যাপ্ত রয়েছে। সাঙ্গীতিক রমণীগণের মধুর মাঙ্গলিক গীতে সেগুলি মুখর হয়ে থাকে। ঐ পুরী মৃদঙ্গ, শঙ্খ, ঢক্কা, দুন্দুভি, তালবাদ্য, বীণা, মৃদঙ্গ তার এই উদ্যম আমরা সহ্য করতে পারব না। সে আজ কোন্ তেজে এরূপ বলবান হয়েছে? সে যেন মুখদ্বারা এই বিশ্ব পান করছে, জিহ্বার দ্বারা যেন দশ দিক্ লেহন করছে এবং নেত্ৰদ্বারা দিমণ্ডল দগ্ধ করছে, বস্তুত সে যেন প্রলয়াগ্নির ন্যায় উত্থিত হয়েছে। আমার মনে হয়, সম্প্রতি কোনো ব্যক্তি কোনো উপায়ে তার প্রতিক্রিয়া করতে সমর্থ হবে না। গুরুদেব, আমাদের ঐ শত্রুর এরূপ দুর্ধর্ষ হবার কারণ কি বলুন। তার এ প্রকার সামর্থ, সাহস ও তেজ কিসে হল? সামর্থ্যাদির জন্যই এরূপ যুদ্ধোদ্যম হয়েছে, সন্দেহ নাই।

দেবগুরু বৃহস্পতি বললেন– মহেন্দ্র, তোমার এই শত্রুর উন্নতির কারণ আমি জানি। ব্রহ্মবাদী ভৃগুবংশীয় ব্রাহ্মণগণ শিষ্য বলির মধ্যে এরূপ তেজ সঞ্চয় করেছেন। অতএব একমাত্র ঈশ্বর শ্রীহরি ব্যতীত, তুমি অথবা তোমার মত অপর কেউ সম্প্রতি তেজস্বী বলিকে জয় করতে সমর্থ হবে না। বলি এখন ব্রহ্মতেজে সমেধিত (সম্যকরূপে বর্ধিত) কে তাকে জয় করবে? জীবগণ যেমন যমের সম্মুখে থাকতে পারে না, তেমনি কেউ এখন এর সন্মুখে অবস্থান করতে সমর্থ হবে না। বলি এখন ব্রহ্মতেজে সমোধিত (সম্যকরূপে বর্ধিত), কে তাকে জয় করবে? জীবগণ যেমন যমের সম্মুখে থাকতে পারে না, তেমনি কেউ এখন বলির সম্মুখে অবস্থান করতে সমর্থ হবে না। অতএব তোমরা সকলে এখন স্বর্গপুরী ত্যাগ করে অন্যত্র লুক্কায়িত হও এবং যে পর্যন্ত শুক্রর বিপর্যয় দেখা না যায়, ততকাল অপেক্ষা কর। ব্রাহ্মণগণের বলেই এর উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি ঘটেছে এবং সেই জন্যই সে সম্প্রতি প্রবল পরাক্রমশালী হয়ে উঠেছে, কিন্তু সেই ব্রাহ্মণদের অপমান করলে স্বয়ং সবংশে বিনষ্ট হবে, সন্দেহ নেই।

হে রাজন, কার্যদশী গুরু বৃহস্পতি এই প্রকারে কর্তব্য বিষয়ে সৎ পরামর্শ দিলে, কামরূপী (ইচ্ছানুরূপ মূর্তিধারী) দেবগণ স্বর্গ পরিত্যাগপূর্বক অন্যত্র প্রস্থান করলেন। দেবগণ অদৃশ্য হলে বিরোচনপুত্ৰ বলি ইন্দ্রপুরী অধিষ্ঠানপূর্বক জগ-ত্রয় বশীভূত করলেন। তৎকালে শিষ্যবৎসল ভৃগুবংশীয় ব্রাহ্মণগণ বিশ্ববিজয়ী অনুগত শিষ্য বলি রাজাকে একশত অশ্বমেধ যজ্ঞ করালেন। সেই শতাশ্বমেধের প্রভাবে বলি দশ দিকে কীর্তি বিস্তার করতঃ নক্ষত্ররাজ চন্দ্রের ন্যায় বিরাজ করতে লাগলেন। তৎকালে মহামতি বলি নিজেকে কৃতার্থে ন্যায় মনে করে ব্রাহ্মণগণ কর্তৃক প্রাপিত অতি সমৃদ্ধিশালী স্বর্গসম্পদ ভোগ করতে লাগলেন।

.

ষোড়শ অধ্যায়
দেবমাতা অদিতিকে মহামুনি কশ্যপের পয়োব্রত
মহামুনি কশ্যপের পয়োব্রত উপদেশ।

শ্ৰীশুকদেব বললেন– হে মহারাজ, এইরূপে নিজপুত্র দেবগণ অদৃশ্য এবং দৈত্যগণ কর্তৃক স্বর্গরাজ্য হৃত হলে দেবমাতা অদিতি অনাথার ন্যায় নিরন্তর পরিতাপ করছিলেন। তাঁর পতি প্রজাপতি কশ্যপ দীর্ঘকালের পর সমাধি থেকে বিরত হয়ে একদিন অদিতির নিরুৎসব ও নিরানন্দ আশ্রমে উপস্থিত হলেন। হে কুরুদেবহ, তিনি অদিতি কর্তৃক যথাবিধি পূজিত হয়ে আসনে উপবেশন পূর্বক ম্লানবদনা পত্নীকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন- হে ভদ্রে, সম্প্রতি লোকমধ্যে ব্রাহ্মণগণের কোন অমঙ্গল হয়নি তো? ধর্মেরও কোন অভদ্র হয়নি তো? আর মৃত্যুবশবর্তী জনগণের কোন অমঙ্গল হয়নি তো? হে গৃহধর্মপরায়ণে, অথবা যে গৃহস্থাশ্রমে যোগহীন ব্যক্তিগণেরও স্বীয় ধর্মের আচরণাদির দ্বারা যোগফল লাভ হয়, তোমার সেই গৃহস্থাশ্রমে ধর্ম, অর্থ এবং কাম–এই ত্রিবর্গের কোন বিঘ্ন ঘটে নি তো? অথবা তুমি কখনও পোষ্যবর্গের পরিচর্যায় আসক্ত থাকাকালে অতিথিগণ এসে তোমার নিকট হতে অভ্যর্থনা না পেয়ে চলে যান নাই তো?

যে সকল গৃহে অতিথিগণ অন্ততঃ জলদ্বারাও অর্চিত না হয়ে ফিরে যায়, সে সকল গৃহ শৃগালরাজের বিবরতুল্য। হে সতী, তোমার বিমনস্কতার কারণ কি? আমি প্রবাসে থাকাকালে, চিত্তের উদ্বেগহেতু তুমি কি কোনদিন যথাকালে হবির দ্বারা অগ্নিয়ে হোম করতে বিস্মৃত হয়েছ? গৃহস্থ ব্যক্তি যাঁর পূজার দ্বারা পুণ্য লোকসমূহে গমন করে, সেই ব্রাহ্মণ ও অগ্নিই সর্বদেবময় বিষ্ণুর মুখ। হে মনস্বিনী, তোমার পুত্রদের সকলের কুশল তো? মুখমালিন্য প্রভৃতি লক্ষণের দ্বারা মনে হচ্ছে, তোমার অন্তঃকরণ যেন প্রকৃতিস্থ নয়।

অদিতি বললেন– হে ব্রাহ্মণ, গো, ব্রাহ্মণ, ধর্ম, এবং সকল লোকেরই মঙ্গল। হে গৃহমেকি যে গৃহ ধর্ম, অর্থ ও কাম– ত্রিবর্গের উদ্ভবস্থান তারও কুশল (অর্থাৎ ধর্মাদি ত্রিবর্গ যথাবৎ নির্বাহ হয়েছে।) হে ব্রাহ্মণ, আমি অনুক্ষণ আপনার ধ্যান করি বলেই অগ্নি, অতিথি, ভৃত্য, ভিক্ষুক অথবা অন্নাদিলিন্দু কারও যথোচিত সকার ক্ষুণ্ণ হয়নি। হে ভগবান প্রজাপতি আপনিই, যার ধর্মোপদেশক, সেই আমার মানসিক কোন কামনা অসম্পূর্ণ থাকতে পারে? হে মরীচি নন্দন, প্রজাসকল আপনারই মন ও শরীর হতে উৎপন্ন হয়ে সত্ত্ব, রজঃ অথবা তমোগুণ অবলম্বন করে। অসুরাদি সকল সন্তানের প্রতি যদিও আপনার সমান ভাব, তথাপি মহেশ্বর ভক্তগণের প্রতিই বিশেষ অনুগ্রহ করে থাকেন। হে প্রভো, আমি আপনারই ভজন করি, অতএব আপনি আমার কল্যাণ চিন্তা করুন। আমার সপত্নী-পুত্র দৈত্যগণ আমার পুত্রদের স্ত্রী ও স্থান অপহরণ করে নিয়েছে, আপনি তাদের রক্ষা করুন। আমি শত্রুগণ কর্তৃক নির্বাসিত হয়ে বিপত্তি-সারে নিমগ্না হয়েছি, প্রবল শত্রুগণ আমার ঐশ্বর্য, যশ ও স্থান–সকলই হরণ করেছে। হে সাধো, হে কল্যাণকারীণ, আমার পুত্রগণ যাতে সেই হৃত ঐশ্বর্যাদি পুনরায় পেতে পারে, আপনি বুদ্ধি দ্বারা সেই কল্যাণ বিধান করুন।

শ্ৰীশুকদেব বললেন– হে মহারাজ, অদিতি কর্তৃক এরূপ অভ্যর্থিত হয়ে প্রজাপতি কশ্যপ যেন বিস্মিতের ন্যায় হয়ে বললেন– অহে, ভগবান বিষ্ণুর মায়া কি বলবো। কি আশ্চর্য– এই জগৎ স্নেহপাশে বদ্ধ হয়েছে। পঞ্চভৌতিক অনাত্মা এই দেহ কোথায়, আর প্রকৃতির অতীত আত্মাই বা কোথায়? এইরূপ কারাই বা কার, পতি-পুত্ৰাদি? মোহই এ সকলের একমাত্র কারণ। হে সতী, তুমি সকল জীবের হৃদয়গুহায় বিরাজমান জগদগুরু জনার্দন পরমপুরুষ ভগবান বাসুদেবের আরাধনা কর। দীনজনের প্রতি কৃপালু সেই শ্রীহরিই তোমার কামনাসহ পূর্ণ করবেন। ভগবানের সেবাই সর্বত্র অব্যর্থ, তাছাড়া অন্য কিছুই অব্যর্থ নহে–ইহাই আমার নিশ্চিত এটাই মতি।

অদিতি বললেন–ব্রাহ্মণ, কি প্রকার বিধির দ্বারা জগদগুরু ভগবানের উপাসনা করব? যেরূপে সত্যসংকল্প সেই হরি আমার মনোরথ পূর্ণ করেন এবং পুত্রদের সাথে অবসন্না আমার প্রতি আশু প্রীত হন, সেরূপ তার উপাসনার বিধি উপদেশ করুন। কশ্যপ বললেন– ভদ্রে, পূর্বে প্রজা কামনা করে আমি ভগবান পদ্মযোনিকে এ বিষয় জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি আমাকে কেশবতোষণ যে ব্রত উপদেশ করেন, তোমাকে সেই ব্রত বলছি। ফাল্গুন মাসের শুক্লপক্ষে পরম ভক্তি সহকারে দ্বাদশ দিন পয়োব্রত অবলম্বন করে ভগবান কমললোচন শ্রীহরির অর্চনা করতে হবে। যদি পাওয়া যায়, তবে বন্য বরাহের দ্বারা উৎখাত মৃত্তিকার দ্বারা গাত্র লেপন করে অমাবস্যা তিথিতে স্রোতজলে স্নান করবে এবং স্নানকালে এই মন্ত্র উচ্চারণ করবে।

“হে দেবি মৃত্তিকে, স্থান ইচ্ছা করে আদিবরাহ তোমাকে রসাতল থেকে উদ্ধার করেছিলেন। আমি তোমাকে নমস্কার করছি, আমার পাপ বিনাশ কর।” তারপর নিত্য নৈমিত্তিক নিয়ম সমাপন করে সমাহিত মনে প্রতিমায়, স্থন্তিলে (কুশাচ্ছাদিত ভূমিতে), সূর্যে, জলে অথবা অগ্নিতে, কিংবা গুরুতে ভগবান হরির অর্চনা করবে। প্রথমতঃ আবহানাদি ক্রিয়ার নয়টি মন্ত্র বলছেন–হে ভগবান্ বাসুদেব, মহত্তম পুরুষ, সকল প্রাণীর নিবাসস্থান, সর্বসাক্ষী, আপনাকে নমস্কার। হে দেব, আপনি ব্যক্ত (স্কুল) অথচ সূক্ষ্ম (অব্যক্ত), আপনি প্রধান পুরুষ (অর্থাৎ পুরুষোত্তম), অথবা সাংখ্যোক্ত প্রকৃতি ও পুরুষ, আপনি চতুর্বিংশতি তত্ত্বজ্ঞ এবং সাংখ্যশাস্ত্রের প্রবর্তক-আপনাকে নমস্কার করি। আপনি যজ্ঞের ফলদাতা অথচ যজ্ঞস্বরূপ। যজ্ঞের আরম্ভকালীন কর্ম আপনার দুটি মস্তক, যজ্ঞকালীন তিনবার স্নান (ত্রিবসন)। আপনার তিনটি পদ, চারটি বেদ আপনার চারটি শৃঙ্গ সাতটি ছন্দ আপনার সাতটি হস্ত এবং আপনি মন্ত্র, ব্রাহ্মণ ও কল্প–ত্রিবিধ শাস্ত্রে আবদ্ধ রয়েছেন, আপনাকে নমস্কার।

আপনি শিব, আপনিই রুদ্র, আপনিই শক্তিধর, সর্ববিদ্যার অধিপতি এবং ভূতপতি, আপনাকে প্রণাম করি। আপনি হিরণ্যগর্ভ, আপনিই জগতের সমষ্টিভূত প্রাণ এবং আপনিই জগতের আত্মা। যোগৈশ্বর্যই আপনার দেহ এবং আপনিই যোগের প্রবর্তক, আপনাকে নমস্কার করি। আপনি আদিদেব, সকলের সাক্ষি-স্বরূপ, নর ও নারায়ণ দুই ঋষি এবং আপনিই শ্রীহরি, আপনাকে নমস্কার। আপনি কেশব, আপনার শরীর মরকতের ন্যায় শ্যামবর্ণ, আপনার বসন পীতবর্ণ, আপনি সকল সম্পদ বা লক্ষ্মীকে লাভ করেছেন, আপনাকে বারবার নমস্কার করি। হে বরেণ্য, হে বরদুশ্রেষ্ঠ, আপনি সকলের সর্ব বরদাতা, অতএব বিবেকিগণ শ্রেয়ঃ প্রাপ্তির জন্য আপনার পাদরেণুর উপাসনা করেন। নিখিল দেবগণ এবং স্বয়ং লক্ষীদেবীও পাদপদ্মের সৌরভ স্পৃহা করে যাঁর অনুসরণ করে, সেই ভগবান আমার প্রতি প্রসন্ন হোন।

এই নয়টি মন্ত্রের দ্বারা ভগবান হৃষীকেশের আবাহন করবে, শ্রদ্ধাসহকারে পাদ্য ও আচমনীয়দির দ্বারা অর্চনা করবে। তারপর গন্ধ ও মাল্যাদির দ্বারা পূজা করে দুগ্ধের সেই বিভুকে স্নান করাবে। পরে দ্বাদশাক্ষর মন্ত্রের দ্বারা বস্ত্র, উপবীত, আভরণ, পাদ্য, আচমন, গন্ধ ও ধূপাদি দ্বারা অর্চনা করবে। যদি বিভব থাকে, তা হলে দুগ্ধে শাল্যন্ন পাক করে পায়েসের নৈবেদ্য করবে। পরে ঘৃত ও গুড়ের সহিত পায়েস নিবেদনপূর্বক মূলবিদ্যা অর্থাৎ দ্বাদশাক্ষের মন্ত্রের দ্বারা হোম করবে। এরপর আচমন দিয়ে অর্চনা পূর্বক তাম্বুল নিবেদন করতে হবে। তারপর অষ্টোত্তর শতবার (১০৮ বার) মূল মন্ত্র জপ ও স্তবসমূহের দ্বারা স্তুতি করে, প্রভুকে প্রদক্ষিণপূর্বক হৃষ্টচিত্তে ভূমিতে দণ্ডবৎ প্রণাম করবে। পরে নিজ মস্তকে নির্মাল্য ধারণ এবং দেবতাকে বিসর্জন দেবে। তারপর অন্ততঃ দুইজন ব্রাহ্মণকে পায়েস দ্বারা যথোচিত ভোজন করাবে।

এরপর পূজিত ব্রাহ্মণদের অনুমতি নিয়ে নিজে বন্ধু-বান্ধবদের সাথে শেষান্ন ভোজন করবে। সেদিন রাতে ব্রহ্মচারী থেকে পরবর্তী প্রথম দিনে স্নান করে শুদ্ধ হয়ে যথাযথ বিধি অনুসারে সংযতচিত্তে আরাধ্য দেবতাকে দুগ্ধ দ্বারা স্নান করাবে। যতদিন ব্রত সমাপ্ত না হয়, ততদিন পর্যন্ত এরূপ আচরণ করতে হবে। হে দেবী, একমাত্র দুগ্ধ ভক্ষণ করতঃ বিষ্ণু পূজনে কৃতদার হয়ে ঐ প্রকারে ব্রত করবে এবং পূর্বের মত অগ্নিতে হোম ও ব্রাহ্মণ ভোজন করাবে। এইরূপে দ্বাদশ দিন পর্যন্ত প্রত্যহ পয়োব্রত করবে (অর্থাৎ দুগ্ধপান, শ্রীহরির আরাধনা, হোম, পূজা এবং ব্রাহ্মণগণের ভোজনাদির দ্বারা সন্তোষ বিধান করবে)। প্রতিপদ দিন হতে শুক্লা ত্রয়োদশী পর্যন্ত ব্রহ্মচর্য ভূতলে শয়ন এবং প্রত্যহ তিনবার স্নান করতে হবে। এই ব্রতৎকালে একমাত্র ভগবান বাসুদেবে আত্মসম্পৰ্পণ করে হিংসা, অসদালাপ এবং বিবিধ ভোগ পরিত্যাগ করবে।

অনন্তর ত্রয়োদশী তিথিতে শাস্ত্রবিধানজ্ঞ ব্রাহ্মণগণের দ্বারা শাস্ত্রদৃষ্ট বিধি অনুসারে পঞ্চামৃত দ্বারা ভগবান বিষ্ণুর স্নান করাবে। আর বিত্তসাধ্য বিসর্জন পূর্বক (অর্থাৎ বিত্ত থাকতে শঠতা হেতু তার ব্যয় বিষয়ে কুণ্ঠা না করে) উত্তমরূপে মহতী পূজা করবে। দুগ্ধে চরুপাক করে শিপিবিষ্ট (অর্থাৎ জীবগণের অন্তর্যামী) বিষ্ণুকে তা নিবেদন করবে এবং উত্তমরূপে সমাহিত হয়ে পূর্বোক্ত মন্ত্র দ্বারা পরম পুরুষের অর্চনা করবে। অপরে যাতে পরমপুরুষের তুষ্টি হয়, তাদৃশ গুণবৎ অত্যুৎকৃষ্ট নৈবেদ্য প্রদান করবে। তারপর বস্ত্র, অলংকার ও ধেনু দিয়ে জ্ঞানবান আচার্য ও পুরোহিতদের সন্তুষ্ট করবে। হে সতী, ঐ সকলের সন্তোষ উৎপাদনই শ্রীহরির আরাধনা। অতএব ঐ সকল ব্যক্তিকে এবং তথায় সমাগত অন্যান্য ব্রাহ্মণগণের সকলকেই যথাশক্তি উত্তম গুণযুক্ত অন্ন দ্বারা ভোজন করাবে। তারপর আচার্য এবং ঋত্বিগণকে যথাযোগ্য দক্ষিণা দিবে। পরিশেষে সমাগত আচণ্ডাল সকল লোককে অন্নাদির দ্বারা তৃপ্ত করবে। দীন, অন্ধ ও দুর্গত প্রভৃতি সকলের ভোজন হলে তা বিষ্ণুর সন্তোষজনক মনে করে পশ্চাৎ বান্ধবগণের সহিত নিজে ভোজন করবে। এইরূপে ব্রতকালমধ্যে প্রতিদিনই নৃত্য, বাদ্য, গীত, স্বস্তিবাচন ও ভগবানের গুণকীর্তন দ্বারা তার পূজার অনুষ্ঠান করবে।

এই পয়োব্রত ভগবান বিষ্ণুর পরম আরাধনাস্বরূপ। পিতামহ ব্রহ্মা আমাকে এইকথা বলেছিলেন, এখন আমি সেইবাক্য তোমার নিকট বর্ণনা করলাম। হে মহাভাগে, তুমি সংযতচিত্তে বিশুদ্ধভাবে যথাযথভাবে অনুষ্ঠিত এই ব্রতের দ্বারা অব্যয় পুরুষ শ্রীহরির আরাধনা কর। হে ভদ্রে, এরই নাম সর্বজ্ঞ, এটাই সর্বব্রত, এটাই ঈশ্বরের তর্পণ বলে প্রসিদ্ধ। আর যাতে ভগবান অক্ষেজের সন্তোষ হয়, তাই নিয়ম, তাই উত্তম সংযম, তাই তপস্যা, তাই দান, তাই ব্রত এবং তাই যজ্ঞ। হে ভদ্রে, অতএব তুমি সংযতা হয়ে শ্রদ্ধাপূর্বক এই ব্রতের আচরণ কর। তা হলে ভগবান পরিতুষ্ট হয়ে শীঘ্রই তোমাকে অভিলষিত বর প্রদান করবেন।

.

সপ্তদশ অধ্যায়
অদিতির পয়োব্রত আচরণে তুষ্ট ভগবানের বরদান

শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে রাজন, নিজ পতি কশ্যপের দ্বারা এরূপ উপদিষ্টা দেবমাতা অদিতি সংযতা হয়ে দ্বাদশ দিবস এই পয়োব্রতের অনুষ্ঠান করেছিলেন। তিনি নিজ বুদ্ধিকে সারথি করে ইন্দ্রিয়রূপ দুষ্ট অশ্ব- সকলকে নিগ্রহ করতঃ (অর্থাৎ নিজ নিজ বিষয় থেকে নিবৃত্ত করে) একচিত্তে মহাপুরুষ ঈশ্বরের চিন্তায় প্রবৃত্ত হলেন এবং একাগ্রবুদ্ধির দ্বারা অখিলাত্মা ভগবান বাসুদেব মন স্থির করে পয়োব্রত করতে লাগলেন। হে তাত, অদিতির ব্রতচারণে ভগবান আদিপুরুষ পরিতুষ্ট হয়ে পীতবসন পরিধান এবং চার হস্তে শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম ধারণপূর্বক তার সামনে আবির্ভূত হলেন। সহসা তাকে নয়নের সামনে উপস্থিত দেখে গাত্রোত্থান করে, প্রীতিবিহ্বল হয়ে সাদরে দেহদ্বারা ভূমিতে দণ্ডবৎ প্রণাম করলেন। তারপর ভূমিতল থেকে উত্থানপূর্বক স্তুতি করার জন্য বদ্ধাঞ্জলি সহকারে দণ্ডায়মান হয়েও নয়নযুগল আনন্দাশ্রু ধারায় প্লাবিত হওয়ায় তিনি স্তুতিবিধানে সমর্থ হলেন না, কিন্তু ভগবানের সাক্ষাৎ দর্শনহেতু অতিশয় হর্ষোৎসব বশতঃ সর্বাঙ্গে কম্প ও পুলকারাশির উদয় হলে, তিনি মৌনভাবে অবস্থান করতে লাগলেন। হে কুরুবর, সেই যজ্ঞপতি জগৎপতি রমাপতিকে নিরীক্ষণ করে দেবমাতা অদিতি চক্ষুদ্বারা যেন পান করতে করতে অনেকক্ষণ পরে প্রীতিভরে ধীরে ধীরে গদগদ বাক্যে তাঁর স্তুতি করতে আরম্ভ করলেন।

অদিতি বললেন–হে যজ্ঞেশ্বর, হে যজ্ঞপুরুষ, হে অচ্যুত, হে জগদীশ্বর, হে ভগবান, আপনার পাদপদ্মে পুণ্যতীর্থ গঙ্গাদেবীর উৎপত্তি হয়েছে। আপনার কীর্তি পরম পবিত্র, আপনার নাম শ্রবণেই জীবের মঙ্গল হয়। শরণাগত জনের পাপনাশের জন্যই আপনার আবির্ভাব হয়ে থাকে। আপনি দীননাথ, হে আদ্যা, হে ঈশ, সম্প্রতি আমাদের মঙ্গল বিধান করুন। হে দেব, যদিও আপনি বিশ্বস্বরূপ এবং বিশ্বের সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের কারণ, স্বেচ্ছায় মহাশক্তি মায়ার গুণসমূহ গ্রহণ করেন, তথাপি আপনি স্বস্থ অর্থাৎ আপনার স্বরূপের বিচ্যুতি ঘটে না। যেহেতু আপনি নিরন্তর প্রবৃদ্ধিশীল পরিপূর্ণ জ্ঞানবলে সর্বদাই নিজের নিকট হতে মায়াকে অপসারিত করে রেখেছে। শ্রীহরি রূপে বিরাজমান সেই আপনাকে আমি প্রণাম করি। হে অনন্ত, আপনি পরিতুষ্ট হলে আপনার নিকট হতে জীবের ব্রহ্মার তুল্য পরমায়ু, অভীষ্ট দেহ, স্বর্গ, মর্ত্য ও রসাতলের অতুল্য লক্ষ্মী অনিমাদি যোগসিদ্ধিসকল, ধর্ম, অর্থ ও কাম এই ত্রিবর্গ এবং মোক্ষপ্রাপক কৈবল্য জ্ঞান পর্যন্ত লাভ হয়ে থাকে, শত্রু–জয়াদি বাসনা যে সিদ্ধি হবে, তার আর কথা কি?

শ্ৰীশুকদেব বললেন– হে ভরতকুলশ্রেষ্ঠ মহারাজ, অদিতি ঐপ্রকার স্তব করলে সর্বভূতের অন্তর্যামী ভগবান কমলনয়ন শ্রীহরি এরূপ বলেছিলেন। শ্রীভগবান বললেন–হে দেবমাতঃ, শত্রু দৈত্যগণ তোমার পুত্রদের সম্পদ হরণ করে তাদের নিজ স্থান স্বর্গপুরী থেকে বিতাড়িত করায়, তাদের জন্য তুমি অনেক দিন হতে যা অভিলাষ করছ, তা আমি বিশেষ ভাবেই অবগত আছি। দুর্মদ সেই শ্রেষ্ঠ অসুরদের যুদ্ধে পরাজিত করে, তোমার পুত্রগণ বিজয় ও সম্পদ লাভ করলে। ইন্দ্র প্রভৃতি তোমার পুত্রগণ যুদ্ধে শত্রুদের বধ করলে, তাদের পত্নীগণ মৃত স্বামীর নিকট গিয়ে রোদন করবে–এটাও তুমি দেখতে চাও। আর, তোমার পুত্রগণ আবার নিজেদের যশ ও সম্পদ লাভ করে, সমৃদ্ধিশালী হয়ে স্বর্গরাজ্য অধিকারপূর্বক সেখানে বিহার করবে– ইহাও তুমি দেখতে ইচ্ছা করছ।

হে দেবী, আমার মনে হচ্ছে সম্প্রতি সেই অসুর-যুথপতিদের অতিক্রম করা প্রায় সম্ভব হবে না। কারণ অনুকুল কালের আশ্রয়ে ব্রাহ্মণগণ তাদের রক্ষা করছেন, সুতরাং সেখানে পরাক্রম প্রকাশ করতে গেলে, তা সুখের কারণ হবে না। তথাপি হে দেবী, তুমি ব্রতচারণ দ্বারা আমার সন্তোষ বিধান করেছ, আমি অবশ্য এ বিষয়ে কোনরূপে উপায় চিন্তা করব। আমার আরাধনা ভজনকারীর ইচ্ছানুরূপ ফল জন্মায় বলে, তোমার অনুষ্ঠিত এই আরাধনা কখনই বিফল হতে পারে না। তোমার পুত্রগণের রক্ষার জন্য তুমি পয়োব্রত দ্বারা আমার যে অর্চনা ও গুণানুরূপ স্তুতি করেছ, তাতে আমি পরিতুষ্ট হয়েছি। অতএব আমি কশ্যপের তপস্যা আশ্রয়পূর্বক নিজ অংশ দ্বারা তোমার পুত্রত্ব প্রাপ্ত হয়ে তোমার পুত্রদের রক্ষা করব। হে ভদ্রে, অতএব আমি তোমার পতির মধ্যে এই রূপে অবস্থান করছি–এই প্রকার চিন্তা করে তুমি নিজপতি নিষ্পাপ কশ্যপের ভজনা কর (অর্থাৎ তার নিকট হতে গর্ভধারণ কর)। হে দেবী, কেউ জিজ্ঞাসা করলেও কোনরূপেই তা অপরের নিকট বলবে না। কারণ দেবতাদের সকল রহস্য সম্যভাবে গুপ্ত হলেই সুসিদ্ধ হয়।

শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে মহারাজ, অদিতিকে এই সকল কথা বলে, ভগবান শ্রীহরি সেখানেই অন্তর্হিত হলেন। অদিতিও নিজের মধ্যে ভগবান শ্রীহরির দুর্লভ জন্মের বরপ্রাপ্ত হয়ে, নিজেকে কৃতার্থের ন্যায় মনে করে পরম ভক্তিসহকারে, পতি কশ্যপের নিকট গমন করলেন। সত্যদর্শী কশ্যপও সমাধিযোগে জানতে পারলেন–নিজের মধ্যে শ্রীহরির অংশ প্রবিষ্ট হয়েছে। বায়ু যেমন বনের বৃক্ষসমূহের মধ্যে সংঘর্ষ সৃষ্টি করে তন্মধ্যে বনদাহক অগ্নির সঞ্চার করে, তেমনি তিনিও একাগ্রচিত্তে অদিতির মধ্যে চির তপস্যা-সঞ্চিত বীর্য স্থাপন করলেন। অদিতির মধ্যে সনাতন ভগবান শ্রীহরি গৰ্ভরূপে অধিষ্ঠিত হয়েছেন জানতে পেরে ভগবান ব্রহ্মা তার গোপনীয় নামসমূহের আরাধনা করতে আরম্ভ করলেন।

ব্রহ্মা বললেন–হে উরুগায়, আপনি জয়যুক্ত হোন। হে ভগবান উরুম, আপনাকে নমস্কার। আপনি ব্রহ্মণ্যদেব ও ত্রিগুণস্বরূপ (ত্রিযুগ-স্বরূপ), আপনাকে নমস্কার করি। হে ভগবান, এই অদিতির নাম পূর্বজন্মে পৃশ্নি ছিল, আপনি তারা গর্ভে পুত্র হয়ে জন্মেছিলেন, আপনাকে নমস্কার। হে প্রভো, আপনি বিধাতা, বেদসমূহ আপনা হতেই প্রকাশিত হয় এবং আপনার তত্ত্বও বেদসমূহেই প্রকাশিত রয়েছে, আপনাকে নমস্কার। স্বর্গ, মর্ত, পাতাল–এই লোকত্রয় আপনার নাভিদেশে বর্তমান, আপনি ত্রিলোকের উপরে অবস্থিত এবং আপনি শাপবিষ্ট অর্থাৎ সকল জীবের অন্তর্যামী, তথাপি সর্বব্যাপী আপনাকে নমস্কার করি, হে ঈশ, আপনি এই ভুবনের আদি, অন্ত ও মধ্য, পন্ডিতগণ আপনাকে অনন্তশক্তি পুরুষ বলে থাকেন। গভীর স্রোত যেরূপ নিজের মধ্যে পতিত তৃণাদিকে আকর্ষণ করে, কালরূপী আপনিও সেরূপ এই বিশ্বকে নিজের মধ্যে আকর্ষণ করছেন। হে দেব, আপনি স্থাবর জঙ্গম সমুদায় প্রজা ও প্রজাপতিদেরও উৎপাদক, আপনার জন্মদি নেই। জলনিমগ্ন ব্যক্তির পক্ষে নৌকার ন্যায় আপনি স্বর্গচ্যুত দেবগণের পরম আশ্রয়। অতএব দেবকার্য সাধনের জন্য আপনার এই অবতার, আপনি সম্প্রতি স্বর্গচ্যুত দেবতাদের পুনরায় স্বর্গে স্থাপন করুন এই প্রার্থনা।

.

অষ্টাদশ অধ্যায়
শ্রীভগবান বামনদেবের আবির্ভাব ও বলির যজ্ঞশালায় গমন

শ্ৰীশুকদেব বললেন– হে রাজন, ব্রহ্মা এই প্রকারে ভগবানের কার্য ও প্রকারের স্তুতি করলে, জন্ম মৃত্যুরহিত, চতুর্ভুজ, শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম-ধারী, পীতবসন, কমললোচন সেই শ্রীহরি অদিতির মধ্যে আবির্ভূত হলেন। তার বর্ণ শ্যাম অথচ উজ্জ্বল, মুখমল কর্ণস্থিত মকরাকৃতি কুণ্ডলযুগের দীপ্তিতে উদ্ভাসিত, তার বক্ষঃস্থল শ্রীবৎস চিহ্ন দ্বারা সুশোভিত এবং বলয়, কেয়ুর, মুকুট, চন্দ্রহার ও মনোরম নূপুর্যুগল দেহমধ্যে নিজ নিজ স্থানে উল্লাসিত হতেছিল। তার কণ্ঠদেশে কৌস্তভমণি শোভা পেতেছিল এবং তৎকালে শ্রীহরি মধুকরগণের গুঞ্জনযুক্ত নিজ বর্নমালার দ্বারা বিভূষিত হয়ে নিজ দীপ্তির দ্বারা প্রজাপতি কশ্যপের গৃহের অন্ধকার বিনাশ করছিলেন। শ্রীভগবানের প্রাদুর্ভাবকালে দিমণ্ডল ও। জলাশয় সমূহ প্রসন্ন প্রজাবর্গ প্রহৃষ্ট এবং সমুদয় ঋতু স্ব স্ব গুণে (ফল-পুষ্পদিতে) শোভিত হল, আর স্বর্গ, আকাশ, পৃথিবী, দেবগণ, ব্রাহ্মণগণ, গোসল ও পর্বতগণ হর্ষযুক্ত হয়েছিল।

ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষের দ্বাদশী তিথিতে চন্দ্র শ্রবণের প্রথম অংশে অভিজিৎ নক্ষত্রে ভগবান আবির্ভূত হয়েছিলেন। তৎকালে অশ্বিনী প্রভৃতি সমস্ত নক্ষত্র এবং গুরু, শুক্রাদি সমুদায় গ্রহ অনুকূল থেকে তার জন্ম উদার করেছিল অর্থাৎ তার জন্ম-মুহূর্তে গ্রহ-নক্ষত্রাদি সকলই শুভাবহ হয়েছিল। হে মহারাজ, যে দ্বাদশীতে ভগবান বামনদেবের আবির্ভাব হয়, সেই দ্বাদশী বিজয়া বলে প্রসিদ্ধ। ঐ তিথিতে যখন ভগবানের আবির্ভাব হয়েছিল, তখন সূর্য দিবসের মধ্যভাগে অবস্থান করছিলেন। সে সময়ে শঙ্খ, দুন্দুভি, মৃদঙ্গ, পণব, পটই এবং অন্যান্য বিচিত্র বাদ্য ও তুর্যসমূহের তুমুল ধ্বনি উখিত হয়েছিল। তখন অপ্সরাগণ প্রীত হয়ে নৃত্য করতে লাগল, গন্ধর্বগণ সঙ্গীতে প্রবৃত্ত হল এবং মুনিগণ স্তব আরম্ভ করলেন। পরে দেববৃন্দ, মুনিবর্গ, পিতৃগণ, অগ্নিগণ ও দেবগণের অনুসরণক্রমে সিদ্ধগণ, বিদ্যাধরগণ, কিরুষগণ, কিন্নরগণ, চারণগণ, যক্ষগণ, রাক্ষসগণ, গরুড়াদি পক্ষীগণ ও শ্রেষ্ঠ নাগগণ নৃত্য, গীত ও স্তুতি সহকারে কুসুমবর্ষণের দ্বারা কশ্যপের আশ্রমপদ আচ্ছন্ন করলেন।

হে রাজন, নিজ গর্ভ-সস্তৃত সেই পরম পুরুষকে নিরীক্ষণ করে অদিতির বিস্ময় ও হর্ষ জন্মিল। কশ্যপ সেই ভগবানকে নিজ যোগমায়াবলে দেহ ধারণ করতে দেখে বিস্ময়ে– “আপনি জয়যুক্ত হোন” এরূপ বলেছিলেন। আরও বিস্ময়ের কথা এই যে– অব্যক্ত, চৈতন্যস্বরূপ শ্রীহরি প্রথমতঃ তৎকালে সমুজ্জ্বল দীপ্তি, অলংকার ও অস্ত্র সহযোগে সুস্পষ্টরূপে যে মূর্তি ধারণ করেছিলেন, পরে অদিতি ও কশ্যপের দৃষ্টির সম্মুখেই বিচিত্র লীলাময় ভগবান সেই মূর্তি দ্বারাই নটের ন্যায় বামনাকৃতি ব্রাহ্মণকুমার হলেন। ঐ বামন বটুকে অবলোকন করে মহর্ষিগণ আনন্দ প্রকাশ করতে করতে প্রজাপতি কশ্যপের গৃহে এসে তাকে অগ্রবর্তী করে জাতকর্মাদি সংস্কার করালেন।

হে মহারাজ, ঐ বামন বটুর উপনয়নকালে ভগবান সূর্যদেব স্বয়ং সাবিত্রী (গায়ত্রী) বৃহস্পতি যজ্ঞসূত্র এবং কশ্যপ মেখলা পরিধান করিয়ে দিলেন। এইরূপে ধরিত্রী তাকে কৃষ্ণাজিন, বড় সকলের পতি সোমদন্ড এবং মাতা অদিতি কৌপীন আচ্ছাদন ও স্বর্গলোক সেই জগৎপতিকে ছত্র দান করলেন। হে মহারাজ, বেদগর্ভ ব্রহ্মা কমণ্ডলু, সপ্তর্ষিগণ কশু এবং সরস্বতী সেই অব্যয়াত্মা পুরুষকে অক্ষমালা প্রদান করলেন। এইরূপে উপনয়ন হলে যক্ষরাজ কুবের সেই উপনীত ব্রহ্মচারীকে ভিক্ষাপাত্র এবং ভগবতী সতী অম্বিকা উমা সাক্ষভাবে তাকে ভিক্ষা দিলেন। এইরূপে সমাদৃত হয়ে সেই সর্বশ্রেষ্ঠ, ব্রহ্মচারী বামন বটু নিজ ব্ৰহ্মতেজ দ্বারা ব্রহ্মর্ষিগণ সেবিত সেই সভাক্ষেত্রকে জয় করে অতিশয় শোভা পেতে লাগলেন। তারপর সেই উপনীত বামন বটু উপনয়নকালে স্থাপিত অগ্নিকে যথাযথ প্রদীপ্ত করে, পরিসমূহ ও পরিস্থরণ (ঋজু করে কশুশু আস্তরণ) কর্মের পর যথোচিত অর্চনা করতঃ সমিধরাশির দ্বারা হোম করলেন।

তারপর তিনি শুনলেন–ভৃগুবংশীয় ব্রাহ্মণদের উপকল্পিত (প্রবর্তিত) বহুতর অশ্বমেধ দ্বারা বলবান বলি যজ্ঞ করছেন। অতএব অখিল বলে সম্পূর্ণ হয়ে প্রতি পদক্ষেপে নিজ ভারে অবনীমণ্ডল অবনত করতঃ সেই বামনদেব বলির যজ্ঞস্থানে গমন করলেন। হে রাজন, নর্মদার উত্তর তটে ভৃগুকচ্ছ। নামক ক্ষেত্রে বলির যে সকল ভৃগুবংশীয় ঋত্বিক ঐ শ্রেষ্ঠ যজ্ঞের কার্য করছিলেন, তাঁরা নিকটে উদিত সূর্যের ন্যায় ঐ বামনদেবকে দেখতে পেলেন। হে মহারাজ, সে সময় ঋত্বিকল, যজমান বলি এবং সদস্যগণ সকলে বামনদেবের তেজে নিষ্প্রভ হয়ে বিচার করতে লাগলেন– যজ্ঞদর্শন বাসনায় কি। সূর্যদেব আসছেন? কিংবা অগ্নিদেব অথবা সনৎকুমারই কি আগমন করছেন? শিষ্যগণসহ ভৃগুবংশীয়গণ এরূপ নানা প্রকার বিতর্ক করছিলেন, এমন সময় ভগবান বামনদেব ছত্র, দণ্ড ও সজল কমণ্ডলু ধারণ করে অশ্বমেধ যজ্ঞশালায় প্রবেশ করলেন।

কটিদেশ মুঞ্জাতৃণ নির্মিত মেখলার দ্বারা বেষ্টিত এবং উপবীতের ন্যায় অহিনরূপ উত্তরীয়ধারী, মায়িক ব্রহ্মচারী, জটিল, বামনাকৃতি ব্রাহ্মবেশী শ্রীহরিকে যজ্ঞক্ষেত্রে প্রবেশ করতে দেখে, অগ্নিসহ সশিষ্য ভৃগুবংশীয় ব্রাহ্মণগণ সমকালে তাঁর তেজে অভিভূত হয়ে গাত্রোত্থানপূর্বক তার অভ্যর্থনা করলেন। যজমান বলিও প্রমূদিত হয়ে দর্শনীয় মনোহর রূপের অনুরূপ অবয়ব বিশিষ্ট সেই বামনদেবকে অবলোকন করামাত্র ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে আসন প্রদান করলেন। তারপর বলি স্বাগত প্রশ্ন দ্বারা অভিনন্দনপূর্বক ভগবানের পদযুগল ধৌত করে, মুক্তসঙ্গ মনোরম (সর্বতোভাবে বিরক্ত যোগীদের মনে ক্রীড়ারত) সেই, ভগবান বামনদেবের অর্চনে প্রবৃত্ত হলেন। হে মহারাজ, চন্দ্রমৌলি মহাদেব শঙ্কর পরম ভক্তিসহকারে (গঙ্গারূপে) যাহা নিজ মস্তকদ্বারা ধারণ করেছিলেন, ধর্মজ্ঞ বলি জীবের কলুষ নাশক ও পরম মঙ্গলজনক সেই ভগবৎ– পাদোদক মস্তকে ধারণ করলেন।

বলি বললেন– হে ব্রাহ্মণ, আপনার সুখে আগমন হয়েছে তো? আপনাকে নমস্কার করি, আপনার কোন্ কার্য করব, আদেশ করুন। হে আর্য, আমার মনে হচ্ছে আপনি ব্রহ্মর্ষিদের মূর্তিমান তপস্যা, আপনি আমার গৃহে এসে উপস্থিত হয়েছেন, আজ আমার পিতৃগণ তৃপ্ত হলেন, আজ আমার এই যজ্ঞ সুসম্পন্ন হল। আজ আমার অগ্নিসকল যথাবিধি হুত হলেন। হে দ্বিজনন্দন, আপনার পাদপ্রক্ষলন জলে আমার সমস্ত পাপ বিধূত এবং আপনার ক্ষুদ্র পদবিন্যাসে এই ধরণীও পবিত্র হয়েছে। হে বিপ্রনন্দন, আপনাকে প্রার্থী বলে মনে হচ্ছে, অতএব, আপনি যা যা ইচ্ছা করেন, আমার নিকট হতে তাই গ্রহণ করুন। হে পূজ্যতম, গো, সুবর্ণ, উত্তম গৃহ, সুমিষ্ট অন্ন, বিপ্রকন্যা, সমৃদ্ধিশালী গ্রামসমূহ অশ্ব, হস্তী অথবা রথ– যা আপনার অভিলষিত তাই গ্রহণ করুন।

.

ঊনবিংশ অধ্যায়
বলির নিকট বামনদেবের ত্রিপাদ ভূমি যাঞ্ছা এবং

শ্ৰীশুকদেব বললেন– হে রাজন, বিরোচনপুত্র বলির ঐ প্রকার ধর্মযুক্ত সত্যপ্রিয় বচন শ্রবণ করে, ভগবান বামনদেব প্রীত হয়ে তাঁকে অভিনন্দনপূর্বক বললেন। শ্রীভগবান বললেন– হে জনদেব, তোমার এ সকল বাক্য অতিশয় সুনৃত, ধর্মযুক্ত, যশস্কর এবং তোমার কুলোচিত। তা হবার কার্যই বটে, “যেহেতু ঐহিক ব্যবহার বিষয়ে ভৃগুবংশীয় ব্রাহ্মণগণ এবং পারলৌকিক ধর্ম বিষয়ে কুলবৃদ্ধ প্রশান্তচিত্ত প্রহাদ মহারাজকে তুমি প্রমাণস্বরূপ পেয়েছ, (অর্থাৎ তাদের নির্দেশেই তোমার ধর্মকর্মাদি অনুষ্ঠিত হয়) । হে রাজন, তোমাদের এই বংশে এমন নিঃসত্ত্ব বা কৃপণ কোনও পুরুষ জন্মে নি, যিনি যাচক ব্রাহ্মণকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, কিংবা দিতে অঙ্গীকার করে পরে দান করেন নি। হে নৃপ, দানকালে যাচকের দান প্রার্থনায় কিংবা যুদ্ধকালে প্রতিপক্ষের যুদ্ধ-প্রার্থনায় পরাজুখ হয়, এমন হীনচিত্ত ব্যক্তি তোমাদের বংশে কেউ উৎপন্ন হয়নি। এর প্রমাণ দেখ, আকাশে যেমন নক্ষত্রপতি চন্দ্র দীপ্তি পায়, তেমনি তোমাদের এই বংশে নির্মল যশঃসম্পন্ন শ্রীপ্রহাদ মহারাজ বিরাজ করছেন।

আর, তোমাদের এই বিখ্যাত বংশে মহাবীর হিরণ্যাক্ষ জন্মগ্রহণ করে গদা ধারণপূর্বক দিগ্‌বিজয়ের জন্য একাকী সমগ্র পৃথিবী পর্যটন করে কোথাও কোন প্রতিযোদ্ধা লাভ করেননি। বরাহরূপী বিষ্ণু রসাতল হতে পৃথিবীর উদ্ধারকালে নিকটে আগত ঐ হিরণ্যাক্ষকে অতিকষ্টে পরাজিত (নিহত) করে, নিরন্তর তার প্রভূত বীর্যের কথা স্মরণ করতে করতে নিজেকে জয়ী মনে করেছিলেন। পুরাকালে হিরণ্যকশিপু ভ্রাতার নিধনবার্তা শ্রবণ করে ভ্রাতৃহন্তার প্রাণবধার্থ ক্রুদ্ধ হয়ে হবীর নিলয়ে গমন করেন। তিনি ভাবলেন, আমি যেখানে যেখানেই যাই এই দৈত্যও প্রাণীদের মৃত্যুর ন্যায় সেই সেই স্থানেই গমন করছে, অতএব আমি এখন বহিদৃষ্টি সম্পন্ন এই দৈত্যের হৃদয় প্রবেশ করি। হে অসুররাজ, ভগবান হরি ঐরূপ নিশ্চয় করে, নিজের অভিমুখে দ্রুতবেগে নাসিকারন্ধ্রের দ্বারা তার শরীরমধ্যে প্রবেশপূর্বক নিজ অতিসূক্ষ্ম দেহটিকে তারই শ্বাসবায়ুর মধ্যে লুক্কায়িত রেখে উদ্বিগ্নচিত্তে অবস্থান করছিলেন।

তারপর হিরণ্যকশিপু বিষ্ণুর শূন্য নিবাসস্থান অন্বেষণপূর্বক তাকে দেখতে না পেয়ে ক্রোধভরে গর্জন করেছিল। এভাবে সে পৃথিবী, স্বর্গ, দশ-দিক্‌, আকাশ পাতালসমূহ এবং সমুদ্র সকল অন্বেষণ করে কোথাও বিষ্ণুকে দেখতে পেল না। বিষ্ণুর দর্শন না পেয়ে হিরণ্যকশিপু এরূপ বলেছিল– আমি সমস্ত জগৎ অন্বেষণ করেছি, আমার নিশ্চয় বোধ হতেছে- আমার ভ্রাতৃহন্তা সেই স্থানে গিয়েছে, যে স্থান থেকে কোনো লোক আর ফিরে আসে না। যদিও হিরণ্যকশিপু বিষ্ণুকে মৃত্যুলোকগত মনে করেই এরূপ বলেছিল, তথাপি তার কথার বাস্তব অর্থ সত্য, যেহেতু বিষ্ণু সর্বদা যে ব্রহ্মপদে অধিষ্ঠিত, সেখান হতে কাউকে আর সংসারে প্রত্যাগমন করতে হয় না। দেহাভিমানী পুরুষদের ইহলোকে মৃত্যুপর্যন্ত বৈরানুবন্ধ (অর্থাৎ শত্রুতার স্থায়িত্ব) ঘটে থাকে। এইরূপ অজ্ঞানপ্রসূত ক্রোধও অহংকার দ্বারা বর্ধিত হয়ে তৎকালেই স্থায়ী হয়। (বস্তুতঃ অজ্ঞান নিবৃত্তির পূর্বে পৌরুষ ত্যাগ মূর্খত, মাত্র, এই কারণেই হিরণ্যকশিপু শত্রুর অনুসন্ধানে বিরত হয় নি।)

হে অসুররাজ, তোমার পিতা প্রত্যুদনন্দন বিরোচন এরূপ দ্বিজবৎসল ছিলেন যে– নিজ শত্রু দেবগণকে চিনতে পেরেও যাচিত হওয়ায় ব্রাহ্মণবেশধারী দেবতাদের নিজের পরমায়ু দান করেছিলেন। তুমিও গৃহধর্মপরায়ণ ব্রাহ্মণগণ নিজ বংশের পূর্বজাত বীরগণ এবং অন্যান্য উদারকীর্তি পুরুষগণের অনুষ্ঠিত ধর্মসমূহ অবলম্বন করেছ। হে দৈত্যেন্দ্র, অতএব আমি শ্রেষ্ঠ বরদাতা তোমার নিকট কিঞ্চিৎ ভূমি প্রার্থনা করি। আমার পদের পরিমাণে তিন পদ মাত্র ভূমিই আমার প্রার্থনা। হে রাজন, তুমি অসামান্য বদান্য এবং এই জগতের ঈশ্বর সত্য, কিন্তু আমি তোমার নিকট এর অধিক আর কিছুই প্রার্থনা করি না। কারণ– বিদ্বান্ ব্যক্তি যাবৎ বিষয়ে প্রয়োজন, তাবন্মাত্র প্রতিগ্রহ করলে, তাতে পাপভাগী হন না।

এই সমস্ত শ্রবণে বলি বিস্ময় প্রকাশপূর্বক বলতে লাগলেন– কি আশ্চর্য, হে ব্রাহ্মণনন্দন, তোমার কথাগুলি বৃদ্ধজনের সম্মত বটে, কিন্তু তুমি বালক, তোমার বুদ্ধিও অজ্ঞের মত, স্বার্থ বিষয়ে, তোমার বোধমাত্র নাই। ত্রিলোকের অদ্বিতীয় অধিপতি এবং দ্বীপ-দানে সমর্থ আমাকে বাক্যদ্বারা প্রসন্ন করে, যে ব্যক্তি ত্রিপাদ ভূমিমাত্র প্রার্থনা করে, সে বস্তুতঃ বুদ্ধিমান নয়। কোন ব্যক্তিকেই আমার নিকট একবার যাত্রা করলে জীবনে আর যাত্রা করতে হয় না। অতএব হে ব্রহ্মচারি, তুমি আমার নিকট হতে যথেচ্ছ জীবিকার উপযোগী বিপুল ভূমি গ্রহণ কর।

শ্রীভগবান বললেন– হে রাজ, ত্রিলোকমধ্যে যত যত প্রীতিকর বিষয়সমূহ রয়েছে, সে সকল একত্র হয়েও অজিতেন্দ্রিয় ব্যক্তিকে পরিতৃপ্ত করতে পারে না। যে ব্যক্তি ত্রিপাদ পরিমিত ভূমিতে অসন্তুষ্ট, দ্বীপ পেলেও তার আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয় না, কারণ একটা দ্বীপ লাভ করলে, নববর্ষ সমেত সপ্তদ্বীপ লাভের আকাঙ্ক্ষা হবে। আমরা শুনেছি, সপ্তদ্বীপের অধিপতি পৃথু, গয় প্রভৃতি নরপতিগণও যথেচ্ছ অর্থ ও কামের দ্বারা তৃষ্ণার অন্ত প্রাপ্ত হন নি। যিনি যদৃচ্ছালব্ধ বিষয়ে সন্তুষ্ট তিনিই সুখে থাকেন, অসন্তুষ্ট অজিতাত্মা ব্যক্তি ত্রিভুবন লাভ করেও সুখী হতে পারে না। অর্থ ও কাম বিষয়ে অসন্তোষই পুরুষের সংসারের কারণ এবং যদৃচ্ছালব্ধ বিষয়ে সন্তোষই মুক্তির হেতু বলে কথিত হয়েছে। যদৃচ্ছালাভে সন্তুষ্ট হলেই ব্রাহ্মণের তেজ বর্ধিত হয়, তা না হলে, জল দ্বারা যেমন অগ্নির বিনাশ হয়, তেমনি অসন্তোষে বিপ্রতেজ শান্ত হয়ে বিলুপ্ত হয়ে থাকে। অতএব হে বরদর্ষভ, আমি ত্রিপাদ মাত্র ভূমিই তোমার নিকট প্রার্থনা করি, এতেই আমি কৃতার্থ হব। যেহেতু প্রয়োজনানুরূপ বিত্তই সুখজনক, অতিরিক্ত ধন ক্লেশের কারণ হয়ে থাকে।

শ্ৰীশুকদেব বললেন– এই প্রকার উক্ত হয়ে বলি হাসতে হাসতে বললেন– তবে, তোমার যা ইচ্ছা, তাই গ্রহণ কর। এই বলে বামনকে ভূমিদানের জন্য জলপাত্র গ্রহণ করলেন। অসুররাজ বলি ভগবান বিষ্ণুকে ভূমি দান করতে উদ্যত হলে, জ্ঞানিশ্রেষ্ঠ শুক্রাচার্য বিষ্ণুর অভিপ্রায় জানতে পেরে শিষ্য বলিকে এরূপ বললেন। শুক্রাচার্য বললেন– হে বিরোচন-নন্দন, এই বামন ব্রাহ্মণবালক সাক্ষাৎ অব্যয় ভগবান বিষ্ণু, ইনি দেবগণের কার্যসাধনের জন্য কশ্যপ হতে অদিতির গর্ভে আবির্ভূত হয়েছেন। তুমি নিজের অনর্থ না বুঝে এর নিকট যে ভূমিদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছ, উহা আমি সমীচীন বোধ করি না। কারণ তা দৈত্যগণের পক্ষে অতিশয় অন্যায় উপস্থিত হল। ইনি তোমার স্থান, ঐশ্বর্য, শ্রী, তেজ, যশ, বিদ্যা, সমুদয় কৌশলে হরণ করে ইন্দ্রকে প্রদান করবেন। ইনি মানব নহেন, ভগবান হরি, মায়াযোগে বামন হয়েছেন। তুমি ত্রিপাদমাত্র ভূমি দিতে প্রতিশ্রুত হলে সত্য, কিন্তু ইনি তিন পদেই সমুদায় লোক আক্রমণ করবেন। কারণ ইনি বিশ্বমূর্তি। (তারপর ক্রোধ প্রকাশ করে বলতে লাগলেন)– আরে মূঢ় বিষ্ণুকে সর্বস্ব দান করে নিজে কিরূপে জীবন ধারণ করবে?

বিশেষতঃ ইনি বিরাট দেহ দ্বারাই আকাশমণ্ডল পরিপূরণ করবেন, তারপর প্রথম পদবিন্যাস দ্বারা পৃথিবী ও দ্বিতীয় পদবিন্যাসদ্বারা স্বর্গলোক অধিকার করলে, তৃতীয় পদবিন্যাসের স্থানই বা কোথায় হবে? এইরূপে তুমি প্রতিশ্রুত ত্রিপাদ ভূমি প্রদান করতে অসমর্থ হবে, অতএব প্রতিশ্রুত বিষয় প্রদান না করার জন্য পরিমাণে তোমার নরকেই স্থিতি হবে– এই আমি মনে করি। যে দানের দ্বারা নিজের বৃত্তি বিপন্ন হয়, পণ্ডিতগণ সে দানের প্রশংসা করেন না; যেহেতু লোকে বৃত্তিশালী (জীবিকা-বিশিষ্ট) ব্যক্তিরই দান, যজ্ঞ, চিত্তের একাগ্রতা বা পূর্তাদি কর্ম সম্ভবপর হয়। যে ব্যক্তি ধর্ম, যশ, অর্থলাভ, সুখভোগ ও স্বজনগণের জন্য নিজ বিত্তকে পাঁচভাগে বিভাগ করেন, তিনিই ইহলোকে ও পরলোকে সুখী হন। যা হোক, এখন প্রতিশ্রুত হয়ে কি প্রকারে মিথ্যা বলব, এ ভাবনা ত্যাগ কর। . হে অসুরপ্রবর, সত্য মিথ্যার ব্যবস্থা বিষয়ে বোচ শ্ৰত্বতিতে যা উক্ত হয়েছে, তা আমার নিকট শোন। সাধারণতঃ “হ্যা” –এইরূপ অঙ্গীকারই সত্য এবং “না”–এইরূপ অস্বীকারই মিথ্যা বলে উক্ত হয়।

সত্যকে দেহরূপ বৃক্ষের পুষ্প ও ফলস্বরূপ জানবে, যেহেতু শ্ৰষ্কৃতিতে ঐরূপ উক্ত হয়েছে। কিন্তু দেহরূপ বৃক্ষ জীবিত না থাকলে, ঐ পুষ্প রূপ ফল কিসে হবে? (অর্থাৎ সত্যেরও উৎপত্তি বা স্থিতি সম্ভবপর নয়।) অতএব মিথ্যাই দেহবৃক্ষের মূল। (সর্বতোভাবে সত্যনিষ্ঠ হলে যে স্থলে জীবন রক্ষাই অসম্ভব হয়ে পড়ে, সেখানে জীবন রক্ষার জন্য কিঞ্চিৎ অসত্যের আশ্রয় দোষাবহ নহে। ইহাই বাক্যের তাৎপর্য। এস্থলে অঙ্গীকৃত ত্রিপাদ ভূমি দান করতে গেলে বলির জীবিকা নির্বাহই সম্ভবপর হয় না)। বৃক্ষের মূল উৎপাটিত হলে যেমন সেটি শুষ্ক হয়ে অচিরেই ভূপতিত হয়, তেমনি মিথ্যার নাশ হলে, দেহও শীঘ্রই শীর্ণ হয়ে পড়ে। দানের স্বীকৃতিরূপে “হ্যা”–এই অক্ষরটি দাতার অর্থকে দূরে নিয়ে যায়, সুতরাং পুরুষকে ধনশূন্য করে ফেলে অথবা দাতার অপূর্ণতা আনয়ন করে (অর্থাৎ যাচকের আশার অন্ত নাই, সুতরাং তা পূর্ণ করা যেতে পারে না। অতএব প্রার্থীর প্রতিদানের প্রতিশ্রুতিরূপে “হ্যাঁ”–এইরূপ বললে দাতা এর দ্বারা রিক্তই হয়ে থাকে। আর ভিক্ষুকের প্রতি সর্বদা “হ্যাঁ” বলতে গেলে দাতা নিজে ভোগ করতে সমর্থ হয় না।

অতএব “না”–এইরূপ মিথ্যা বচনই পূর্ণ (পূর্ণতর সাধক) এবং নিজের দিকে অপরের অর্থ আকর্ষণ করে, ওহে দৈত্য, আমার কথায় এরূপ মনে করো না যে অমৃতের মত সর্বদাই অমৃত সেবনীয়, কারণ যে ব্যক্তি সর্বদা “না”– এরূপ বলে, সে দুষ্কীর্তিভাগী ও মৃততুল্য বলেই গণ্য হয়। কতকগুলি বিষয়ে মিথ্যা দোষাবহ নহে- যেমন, স্ত্রীলোককে উৎসাহ দ্বারা বশীভূত করতে হলে, কিংবা পরিহাস ব্যাপারে, বিবাহ ব্যাপারে, জীবিকার জন্য, প্রাণসংকট উপস্থিত হলে, গো– ব্রাহ্মণের হিতার্থে, কিংবা দস্যু প্রভৃতির দ্বারা কারও হিংসা উপস্থিত হলে (তার রক্ষার জন্য) মিথ্যাভাষণ নিন্দনীয় হয় না।

.

বিংশ অধ্যায়
বলি কর্তৃক বামনদেবকে ত্রিপাদ ভূমি দান এবং শ্রীভগবানের বিরাটুরূপ গ্রহণ

শ্ৰীশুকদেব বললেন– হে মহারাজ, কুলগুরু শুক্রাচার্য এরূপ বললে, গৃহপতি যজমান বিরোচন পুত্র বলি ক্ষণকাল মৌন থেকে, পরে অবহিতচিত্তে গুরুকে এরূপ বলেছিলেন। বলি বললেন– হে গুরুদেব, আপনি সত্যই বলেছেন– যাতে কখনও অর্থ, কাম, যশ ও জীবিকার বাধা না হয়, তাই গৃহস্থগণের ধর্ম। আমি মহাত্মা প্রহ্লাদের পৌত্র তাই একবার “দিব”–বলে প্রতিশ্রুত হয়ে, সামান্য বিত্তলোভে কিতবের ন্যায় আবার কি প্রকারে, প্রত্যাখ্যান করব? এই পৃথিবী দেবীও বলেছেন–অসত্য অপেক্ষা গুরুতর অধর্ম আর নেই, মিথ্যাবাদী মানব ভিন্ন মরু–মন্দরাদি সব কিছুই আমি বহন করতে সমর্থ বলে মনে করি। মিথ্যা কথা বলে ব্রাহ্মণের প্রবঞ্চনা থেকে আমি যত ভয় পাই, নরক, অধন্য, দারিদ্র্য, দুঃখসমুদ্র, স্থানচ্যুতি এবং মৃত্যু হতেও তত ভয় পাই না। আর, এই পৃথিবীতে ভূমি প্রভৃতি যে সকল ধনসম্পদ রয়েছে, তা মৃত ব্যক্তিকে (অর্থাৎ মরণের পর আমাকে) অবশ্যই ত্যাগ করবে, অতএব জীবিত থেকে নিজেই তা দান করি না কেন? যদি বলেন, সর্বস্ব দানের পর নিজের জীবিকা-সঙ্কট হবে। এজন্য অর্ধেক দান বিচারসম্মত তা হলে বলছি, যা দান করলে ব্রাহ্মণের তুষ্টি হবে না, সেরূপ দানের ফল কি? দধীচি, শিব প্রভৃতি সাধুপুরুষেরা দুস্ত্যজ প্রাণী দিয়েও প্রাণীগণের উপকার করেছেন, তবে ভূমি প্রভৃতি সামান্য বিষয় পরিত্যাগের বিচার কি?

হে ব্রাহ্মণ, যুদ্ধে অপরাজুখ যে, সকল দৈত্য পূর্বে এই পৃথিবী ভোগ করেছেন, করাল কাল তাদের ইহলোক ও পরলোক উভয়ই গ্রাস করেছে। কিন্তু তারা এই ভূমণ্ডলে যে যশ অর্জন করেছেন, তা কালগ্রস্ত হয় নি, অতএব যশ সাধন করাই বিধেয়। হে বিপ্রর্ষে, যুদ্ধক্ষেত্র হতে পরাজুখ না হয়ে যুদ্ধে দেহত্যাগ করেছেন এরূপ লোকমধ্যে সুলভ। কিন্তু সৎপাত্র উপস্থিত হলে শ্রদ্ধার সহিত ধন ত্যাগ করেন– এরূপ পুরুষ সুলভ নয়। হে গুরুদেব, সামান্য যে, কোন প্রার্থীর অভিলাষ পূরণ করতে গিয়ে যদি দুর্গতি হয়, তা সদয় মনস্বী পুরুষের শ্রেয়ঃ এ অবস্থায় আপনাদের মত ব্রহ্মজ্ঞ ব্রাহ্মণের অভিলাষ পূরণের যদি আমার দৈন্যদশা উপস্থিত হয়, তা শ্রেয়ঃ বলে গণ্য না হবার কি? অতএব আমি এই ব্রহ্মচারীর প্রার্থিত বস্তু নিশ্চয়ই দান করব। হে মুনিবর, বেদোক্ত বিধানে কুশল আপনারা সাদরে যাগযজ্ঞাদির দ্বারা যার অর্চনা করে থাকেন, ইনি যদি সেই বরদাতা বিষ্ণুই হন, অথবা আমার শত্রুই হন, তথাপি আমি তাকে প্রার্থিত ভূমি অবশ্যই দান করব। আমি নিরপরাধ, যদি তিনি অধর্মের আশ্রয় নিয়ে আমাকে বন্ধন করেন, তবুও আমি ভীত ব্রাহ্মণবেশধারী এই শত্রুকে হিংসা করব না। আর ইনি যদি সত্যই উত্তমঃ শ্লোক ভগবান বিষ্ণুই হন এবং যদি নিজের যশ ত্যাগ করতে ইচ্ছা না করেন, তা হলে যুদ্ধে আমাকে বধ করে এই ভূমি হরণ করবেন, অথবা আমার কর্তৃক নিহত হয়ে ভূমিশায়ী হবেন।

শ্ৰীশুকদেব বললেন– নিজ শিষ্য বলি এই প্রকারে অশ্রদ্ধ হয়ে আদেশ পালনে পরাজুখ হলে যেন দৈবপ্রেরিত হয়ে শুক্রাচার্য ক্রোধপূর্বক সত্যপ্রতিজ্ঞ উদারচিত্ত ঐ অসুর শ্রেষ্ঠকে এই বলে শাপ দিলেন- তুমি অজ্ঞ হয়েও নিজেকে পণ্ডিত বলে মনে করছ। আমাকে উপেক্ষা করায় নিজ গর্বেরও পরিচয় দিয়েছ। অতএব আমার আজ্ঞা লঙ্নহেতু তুমি অচিরেই শ্রীভষ্ট হবে। মহাত্মা বলি নিজ গুরু কর্তৃক ঐরূপ অভিশপ্ত হয়েও সত্য হতে বিচলিত হলেন না। বামনকে অর্চনা করে জল স্পর্শপূর্বক ভূমিদান করলেন। বলিপত্নী বিন্ধ্যাবলী মুক্তাভরণ ও মাল্যে অলংকৃতা হয়ে তৎকালে সেখানে এসে পাদপ্রক্ষালনের উপযোগী জলপূর্ণ একটি স্বর্ণকুম্ভ আনয়ন করলেন। তারপর যজমান বলি সেই জল দিয়ে পরম হর্ষে স্বয়ং বামনদেবের পদযুগল প্রক্ষালনপূর্বক নিখিল বিশ্বের পবিত্রকারী সেই জল নিজ মস্তকে ধারণ করলেন।

হে রাজন, সেই সময় স্বর্গস্থিত দেবগণ এবং গন্ধর্ব, বিদ্যাধর, সিদ্ধ ও চারণগণ সকলেই বলির সেই কর্ম ও সরলতার প্রশংসা করতঃ পরম হর্ষে তার উপর পুষ্পবৃষ্টি করতে লাগলেন। আর, সহস্র সহস্র দুন্দুভি মুহুর্মুহু বাদিত হতে লাগল। তখন গন্ধর্ব কিশুরুষ কিন্নরেরা এই বলে গান করলেন—”মনস্বী বলি অতি দুষ্কর কর্ম করলেন, যেহেতু জেনেও নিজের শত্রুকে ত্রিভুবন দান করলেন।” বলি অগ্রে “যাহা বাঞ্ছা হয়, গ্রহণ করুন”–এই কথা বলাতে, তারপর হরির ঐ বামনরূপ অদ্ভুতরূপে বর্ধিত হল। ঐ মূর্তির আত্মায় গুণত্রয় বর্তমান থাকায়, পৃথিবী, আকাশ, দিমণ্ডল, স্বর্গলোক বিষয়সমূহ (পাতাল প্রভৃতি), সমুদ্রসকল, তির্যক প্রাণীগণ, মনুষ্যগণ, দেবগণ ও ঋষিগণ– তাতে অবস্থিত ছিল। সে সময়ে ঋত্বি, আচার্য ও সদস্যগণের সাথে মহারাজ বলি, মহাবিভূতিশালী ভগবানের সেই গুণময় দেহমধ্যে আকাশাদি পঞ্চভূত, ইন্দ্রিয়বর্গ শব্দাদি বিষয়, অন্তঃকরণ ও জীবসহ এই ত্রিগুণাত্মক বিশ্ব দেখতে পেলেন।

ইন্দ্রসেন (অর্থাৎ) ইন্দ্রসেনাই যাঁর সেনা, অথবা ইন্দ্রসেন বলি, মহারাজের একটি নাম। বলি বিশ্বমূর্তি হরির পদতলে রসাতল, চরণদ্বয়ে পৃথিবী, জঙ্খদ্বয়ে পর্বতরাজি, জানুদেশে পক্ষিগণ এবং ঊরুযুগলে মরুদগণ দর্শন করলেন। এইরূপ তিনি ঊরুক্ৰম ভগবানের বস্ত্রমধ্যে সন্ধ্যা, গুহ্যদেশে প্রজাপতিগণ, জঘনদেশে নিজসহ অসুরগণ, নাভিস্থলে আকাশ, কুক্ষিদেশে সপ্তসমুদ্র এবং বক্ষঃস্থলে নক্ষত্ররাশি দেখতে পেলেন। বলি সেই মুরারির হৃদয়ে ধর্ম, স্তনদ্বয়ে ঋত ও সত্য, মনোমধ্যে চন্দ্র, বক্ষঃস্থলে পদ্মহস্তা পদ্মা, কণ্ঠদেশে সামবেদ ও সমস্ত শব্দরাশি দর্শন করেছিলেন। এইরূপে বাহুসকলে ইন্দ্রাদি দেবগণ, কর্ণদ্বয়ে দিল, মস্তকে স্বর্গ, কেশরাশির মধ্যে মেঘমালা, নাসিকায় বায়ু, চক্ষুদ্বয়ে সূর্য, বদনে বহ্নি, বাক্যে ছন্দোরাশি, জিহ্বায় বরুণ, ভূযুগলের মধ্যে বিধি ও নিষেধ, নেত্রলোমে দিবা ও রাত্রি, ললাটে ক্রোধ এবং অধরে লোভের অবস্থান লক্ষ্য করেছিলেন।

হে মহারাজ, এইরূপ তিনি সেই পরমপুরুষের স্পর্শে কাম, শুক্রমধ্যে জল, পৃষ্ঠদেশে অধম, পদবিন্যাসে যজ্ঞ, ছায়ামধ্যে মৃত্যু, হাস্যে মায়া, রোমরাজির মধ্যে ঔষধিসমূহ, নাড়ীসমূহে নদীসকল, নখসমূহে শিলারাশি, বুদ্ধিমধ্যে ব্রহ্মা, প্রাণমধ্যে দেবগণ ও ঋষিগণ এবং গাত্রদেশে স্থাবর-জঙ্গম ভূতসমষ্টি দেখতে পেলেন। হে রাজন, তৎকালে সকল অসুরগণ সর্বাত্ম সেই ভগবান বামনদেবের দেহে নিখিল ভুবন দর্শন করে ভীত হয়ে পড়ল। সে সময় অসহ্য তেজঃশালী সুদর্শন চক্র, মেঘের ন্যায় ধ্বনিযুক্ত শাঙ্গ নামক ধনুঃ, গম্ভীর ধ্বনিযুক্ত পাঞ্চজন্য নামক শঙ্খ, বেগশালিনী কৌমুদীকী গদা, শতচন্দ্রযুক্ত বিদ্যাধর নামক অসি, অক্ষয় বাণপূর্ণ তৃণযুগল এবং লোকপালগণের সহিত প্রধান পার্ষদগণ নিজ প্রভু ভগবানের চারদিক হতে স্তুতি করছিলেন। এ অবস্থায় ভগবান সমুজ্জ্বল কিরীট, অঙ্গদ, মকরাকৃতি কুণ্ডলযুগল, শ্রীবৎস চিহ্ন, কৌস্তভ রত্ন, মেখলা এবং মনোরম বস্ত্রে বিভূষিত হয়ে বিরাজ করছিলেন।

হে মহারাজ, তৎকালে ভগবান ঊরুম ভ্রমরপংক্তি শোভিত বর্ণমালায় আবৃত হয়ে অতিশয় শোভা পেতে লাগলেন। তারপর এক পদদ্বারা বলির অধিকৃত সমস্ত ভূভাগ, শরীর দ্বারা আকাশ মণ্ডল ও বাহুসমূহ দ্বারা দিমণ্ডল পরিব্যাপ্ত করলেন। এরপর দ্বিতীয় পদবিন্যাস কালে স্বর্গলোক কোনরূপে তার স্থান হল বটে, কিন্তু তৃতীয় পদবিন্যাসের বলির আর অণুমাত্র স্থানও ছিল না। তখন উরুক্রম শ্রীহরির সেই পদ ক্রমশঃ ঊর্ধ্বভাগে মহলোক, জনতোক ও তপোলোকের উপরে সত্যলোকে গিয়ে উপনীত হল।

.

একবিংশ অধ্যায়
বলির বন্ধন এবং শ্রীভগবানের বাক্য

শ্ৰীশুকদেব বললেন– হে মহারাজ ভগবান ঊরুমের দ্বিতীয় চরণ সত্যলোকে উপস্থিত হলে তাঁর নখচন্দ্রের কিরণে ব্রহ্মার নিজ ধর্মের দীপ্তি অন্ধকার দ্বারা আচ্ছন্ন হলেন। তা দেখে পদ্মযোনি ব্রহ্মা, মরীচি প্রভৃতি বৃহদুব্রতধারী ঋষিগণ এবং সনন্দনাদি যোগীগন সকলে তাঁর (চরণের নিকট গমন। করলেন।

তখন বেদ, উপবেদ, যম, নিয়ম, তর্ক, ইতিহাস, বেদাঙ্গ, পুরাণ ও সংহিতাসমূহ এবং যাদের যোগরূপ বায়ুর দ্বারা উদ্দীপিত জ্ঞানরূপ অগ্নি কর্তৃক কর্মফল ভস্মীভূত হয়েছে, তারা সকলে সেই পাদপদ্মের বন্দনা করেছিলেন তারা ভগবানের এই পাদপদ্মের স্মরণপ্রভাবেই কর্মদ্বারা আজীবন এই ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত হয়েছিলেন। তখন বিমলকীর্তি ব্রহ্মাও যাঁর নাভিকমল হতে উৎপন্ন হয়েছে, সেই বিষ্ণুর ঊর্ধ্বগত চরণে কমণ্ডলুর জল সমর্পণ করলেন এবং ভক্তিপূর্বক অর্চনা করে স্তব করতে লাগলেন।

হে নরেন্দ্র, তৎকালে ব্রহ্মার কমণ্ডলুর জল ঐ ঊরুক্রমের পাদস্থলনে পবিত্র হয়ে স্বর্গ গঙ্গারূপে পরিণত হয়েছিল এবং উহাই অদ্যাবধি আকাশমার্গে প্রবাহিত হয়ে ভগবানের নির্মল কীর্তির ন্যায় ত্রিভুবন পবিত্র করেছে।

তারপর অনুচরগণের সহিত ব্রহ্মাদি লোকপালগণ ত্রিবিক্রম মূর্তি সংক্ষেপ করে পূর্বের ন্যায় বামনরূপে অবস্থিত নিজ প্রভু শ্রীহরিকে সাদরে পুজোসহ আহরণ করলেন। শীত জল, সুন্দর মাল্যদিব্য গন্ধদ্রব্য ও বিবিধ অনুলেপন সুবসিত ধূপ ও দীপ এবং লাজ (খৈ), আতপ তণ্ডুল ও ফলরাশির দ্বারা অর্চনা করে স্তব এবং তার বীর্য ও মহিমাযুক্ত জয়ধ্বনি নৃত্যগীত, বাদ্য এবং শঙ্খ ও দুন্দুভি নিনাদ এই সমস্তের দ্বারা উৎসব করলেন। পরে মনের মত দ্রুতগামী ভল্লুকরাজ জাম্ববান্ ভেরীধ্বনি করে সকল দিকে ঐ বিজয় মহোৎসব ঘোষণা করতে লাগলেন।

বামনদেব ত্রিপাদ ভূমি যাঞ্জার ছল করে যজ্ঞ দীক্ষিত নিজ প্রভু বলির সমস্ত পৃথিবী হরণ করেছেন দেখে, তৎকালে অসুরগণ মহাক্রোধে এরূপ বলতে লাগল। এ ব্যক্তি নিশ্চয়ই ব্রাহ্মণ-সন্তান নয়, কিন্তু মায়াবিগণের প্রধান বিষ্ণুই ব্রাহ্মণবেশে আত্মগোপন করে দেবতাদের কার্যসাধনের ইচ্ছা করছে। আমাদের প্রভু সম্প্রতি যজ্ঞকালে শাসনদণ্ডটি কুশের উপর রেখে দিয়েছেন (অর্থাৎ হিংসা থেকে বিরত হয়েছেন)।

সেই সুযোগেই বটুরূপী ও শত্ৰু ভিক্ষুক হয়ে আমাদের প্রভুর সর্বস্ব হরণ করেছে। সর্বদা সত্যনিষ্ঠ, বিশেষত সম্প্রতি যজ্ঞে দীক্ষিত ব্রাহ্মণহিতৈষী ও দয়াশীল প্রভুর পক্ষে মিথ্যা কথা (অর্থাৎ এই যাচককে প্রত্যাখান করা) সম্ভবপর নয়। অতএব এখন কপট এই ব্রাহ্মণ বেশধারী বিষ্ণু বধ করাই আমাদের ধর্ম এবং এর দ্বারা প্রভুর সেবা করতে হবে। এইরূপ বলে বলির অনুচর অসুরগণ অস্ত্রধারণ করল। হে মহারাজ, তৎকালে বলির অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেই অসুরগণ সকলে ক্রুদ্ধ চিত্তে বামনদেবের বধের জন্য শূল ও পরিখ নামক অস্ত্র হাতে নিয়ে তার দিকে ধাবিত হল।

হে মহারাজ, সেই দৈত্য সেনাপতিদের বামনদেবের অভিমুখে ধাবিত দেখে, বিষ্ণুর অনুচরগণ হাস্য করতে করতে অস্ত্র উদ্যত করে তাদের বাধা দিতে লাগলেন। তৎকালে অযুত হস্তীর তুল্য বলশালী নন্দ, সুনন্দ, জয়, বিজয় প্রবল, বল, কুমুদ, কুমুদাক্ষ, বিস্বকৃমেন গরুড়, জয়ন্ত, শত্রুদের পুষ্পদণ্ড ও সাত্বত এরা সকলে অসুর সৈন্যদের বধ করতে লাগলেন। কাল বিষুর অনুচরগণ কর্তৃক এইরূপে নিজ সৈন্যদের হত হতে দেখে শুক্রাচার্যের অভিশাপ স্মরণপূর্বক ক্রুদ্ধ দৈত্যদের, যে কাল সকল প্রাণীর সুখ দুঃখ প্রদানে প্রভু, কোন ব্যক্তিই পৌরুষ দ্বারা তাকে অতিক্রম করতে সমর্থ নয়। যে কালরূপী ভগবান পূর্বে আমাদের উন্নতি এবং দেবগণের অবনতির কারণ ছিল, সেই ভগবান এখন তার বিপরীত হয়ে উঠেছেন। আরও শোন অমাত্য, বল, বুদ্ধি, দুর্গ, মন্ত্র, ঔষধাদি ও সম্পাদি উপায় দ্বারা কিছুতেই লোকে কাল অতিক্রম করতে সমর্থ হয় না। হে দৈত্যগণ, পূর্বে তোমরা দৈববলে বলবান হয়ে শ্রীহরির এই অনুচরগণকে বহুবার যুদ্ধে পরাজিত করেছ, আর এখন তারাই যুদ্ধে আমাদের জয় করে গর্জন করছে। যদি দৈব পুনবায় আমাদের প্রতি প্রসন্ন হন, তাহলে তখন আমরা এদের জয় করব। অতএব সময়ান্তরে যে কাল আমাদের অনুকূল হবে, তোমরা এখন সেই কালেরই অপেক্ষা করতে থাকুন।

শ্ৰীশুকদেব বললেন– হে রাজন, প্রভু বলির ঐরূপ বাক্য শ্রবণ করে, সেই দৈত্য ও দানবগণের যুথাতিগণ বিষ্ণুর পার্ষদগণ কর্তৃক তাড়িত হয়ে রসাতলে প্রবেশ করেছিল। তারপর পক্ষীরাজ গরুড় ভগবানের গতি প্রায় অর্থাৎ প্রভু পূর্বে কলির সর্বস্ব হরণ করে এর মমতা দূর করেছেন, এখন দেহ গ্রহণ করে এর সহং করও ত্যাগ করিয়ে পরম অনুগ্রহ করতে ইচ্ছা করছেন, আর এর তুল্য অন্য কোন সত্যপ্রতিজ্ঞ বীর নেই–এই যশ ঘোষণা করতে চাইলে সোমাভিষবের দিন বাকল পাশদ্বারা বলিকে বন্ধন করলেন। প্রভাবশালী ভগবান বিষ্ণু অসুররাজ বলিকে এই রূপে বন্ধনপূর্বক নিগ্রহের উপক্রম করলে স্বর্গ ও মর্ত্যলোকে সকলদিকে অতিশয় হাহাকার ধ্বনি উত্থিত হল।

হে মহারাজ, তৎকালে ভগবান বামনদেব বরুণপাশে আবদ্ধ, নষ্ট সম্পদ অথচ স্থিরবুদ্ধি সেই উদারকীর্তি বলিকে এরূপ বলেছিলেন–ত্রিপাদ পরিমিত ভূমি দান করতে প্রতিশ্রুত হয়েছ, তার মধ্যে দুই পদে সমগ্র ভূমিভাগ অধিকার করেছি, এখন তৃতীয়পদ বিন্যাসের স্থান দাও।

ঐ সূর্য কিরণরাশির দ্বারা যতদূর পর্যন্ত তাপ দেয়, নক্ষত্ৰজনের সাথে চন্দ্র যতদূর এই রাশি পায় এবং যে পর্যন্ত মেঘ বারিবর্ষণ করে, সেই পর্যন্ত ভূমিসম্পদ তোমার। তার মধ্যে আমি এক নদে সমুদায় ভূর্লোক আক্রমণ করেছি। আমার শরীর দ্বারা আকাশ ও দিক সকল ব্যাপ্ত হয়েছে দেখ না তোমার দৃষ্টির সম্মুখেই দ্বিতীয় পদে স্বর্গলোক আক্রান্ত হল, এভাবে আমি তোমার সর্বস্ব অধিকার করেছি।

তৃতীয় পদবিন্যাসের তোমার কোন স্থান নেই। প্রতিশ্রুত বিষয় দান না করার জন্য তোমার নরকবাসই উচিত। অতএব তোমার গুরুর অনুমতি নিয়ে নরকে প্রবেশ কর। যে ব্যক্তি প্রতিশ্রুতি বস্তু দান না করে যাচকারে বঞ্চনা করে, তার মনোরথ বৃথা, স্বর্গ তার অতিদূর, সে অধঃপতিত হয়। তুমি নিজেকে ঐশ্বর্যশালী বলে অভিমান কর, অথচ দানের প্রতিশ্রুতি দিয়েও তোমাকে প্রতারিত করলে, অতএব এই মিথ্যার ফলস্বরূপ কয়েক বৎসর নরক ভোগ কর।

.

দ্বাবিংশ অধ্যায়
বলিকে ভূতলে পাঠিয়ে, ন্যূনতম বোধে বলির প্রতি বরদান পূর্বক ভগবানের দ্বারা অঙ্গীকার

শ্ৰীশুকদেব বললেন– হে রাজন, ভগবান বামনদেব এই প্রকার (বন্ধন ও বাক্যের দ্বারা) বলির অপকার করে, তাকে সত্যভ্রষ্ট করার উপক্রম করলেও অসুররাজ বলি অবিচলিত চিত্তে এরূপ অরিপু বাক্য বলেছিলেন। বলি বললেন– হে উত্তমঃশ্লোক, হে সুরবর্ষ, আমার কথিত বাক্য অসত্য নয়। আপনিই পূর্বে কপটতাপূর্বক বামনরূপে ভিক্ষা করে, এক্ষণে রূপান্তর প্রকাশ করেছেন। যা হোক, ঐ প্রকারেও যদি আপনি আমার কথা মিথ্যা বলে মনে করেন, তথাপি আমি নিজ অঙ্গীকার পূর্ণ করছি, আমার প্রতিশ্রুতি বাক্য ব্যঞ্জনাময় না থোক। আপনি দুই পদ পরিমিত স্থান পেয়েছেন, তৃতীয় পদের স্থান পান নি, ঐ চরণ আমার মস্তকে স্থাপন করুন। (দুই চরণে বিশ্ব আক্রমণকারী আপনার একটি চরণের পক্ষে আমার মস্তক পর্যাপ্ত হবে না– এটা মনে করবেন না, কারণ বিত্তের দ্বারাই যদি দুই চরণের স্থান হয়ে থাকে, তা হলে আমার মস্তক এক চরণের পক্ষে অধিক যেহেতু বিত্ত অপেক্ষা বিত্তবানেরই অধিকত্ব।)

হে ভগবান, আমি সম্প্রতি নিজ পদ হতে বিচ্যুত হয়েছি তবুও আমি অপকীর্তিতে যেরূপ ভয় করি, নরকপাশ বন্ধন দূরতিক্ৰমণীয় ব্যসন (বিপত্তি) অর্থকৃচ্ছ্বতা অথবা আপনার কৃত নিপীড়ন হতেও সেরূপ ভয় করি না। ব্রাহ্মণ, আপনার কৃত এই নিগ্রহ আমার অপকীর্তি জনক নয়, যেহেতু পরম পূজনীয় জন যে দণ্ড অর্জন করেন, তা পুরুষদের পক্ষে শ্লাঘ্যতম বলেই গণ্য হয়ে থাকে। বস্তুতঃ মাতা-পিতা-ভ্রাতা অথবা সুহৃদজনও ঐরূপ দণ্ড দিতে পারেন না, অতএব আপনি আমার হিতৈষী হয়ে এই নিগ্রহ করাতে আমি শ্লাঘ্যই হয়েছি। হে ভগবান, আপনি প্রভূত মদমত্ত আমাদের (অসুরগণের) মত্ততা বিনাশক জ্ঞানদৃষ্টি প্রদান করায় নিশ্চয়ই আপনি আমাদের পরোক্ষে পরম গুরু। অহো, যাঁর এত নিরবিচ্ছিন্ন বৈরীভাব পোষণ করে ইতঃপূর্বে বহু অসুর সিদ্ধিলাভ করেছে; যে সিদ্ধি কেবলমাত্র একনিষ্ঠ যোগীগণই লাভ করে থাকেন সেই ভূরিকর্মা পরম গুরু আপনার কর্তৃক আমি নিগৃহীত ও করুণাপাশে বদ্ধ হয়েছি, এতে আমি লজ্জা বা ব্যথা বোধ করছি না।

ভগবান, আমার প্রতি আপনার দণ্ডরূপ এই যে অনুগ্রহ হল, এরও আমি পাত্র নহি, আপনি নিজ ভক্তের পৌত্র বলে এই অনুগ্রহ করলেন। আপনার নিজ জনগণ কর্তৃক সমাদৃত এবং তাদের নিকট হতে প্রশংসাপ্রাপ্ত আমার পিতামহ প্রহ্লাদ আপনার শত্রু নিজ পিতা হিরণ্যকশিপুর দ্বারা নানাভাবে উৎপীড়িত হয়েও একমাত্র আপনারই শরণাগত হয়েছিলেন।

আয়ুর অবসানে যে দেহ অবশ্যই জীবকে পরিত্যাগ করে মর্ত্য (মরণশীল) ব্যক্তির সেই দেহের আর কি প্রয়োজন? আর বিত্তহরণকারী স্বজন-সখায় পুত্রাদি দস্যুগণেরই বা কি প্রয়োজন? এইরূপ সংসার বন্ধনের কারণস্বরূপ আত্মীয় দ্বারাই বা কোন্ ইষ্টসিদ্ধি হতে পারে? আর, যে গৃহে কেবলমাত্র আয়ুক্ষয়ই হয়ে থাকে, সেরূপ গৃহেরই বা কি প্রয়োজন? হে সত্তম এইরূপ নিশ্চয় করে, অগাধবোধ সম্পন্ন আমার সেই মহান পিতামহ, যদিও আপনি তার নিজপক্ষের ক্ষয়কারী ছিলেন, তথাপি স্বজন হতে ভীত হওয়ায়, যাতে কোথা হতে ভয়ের সম্ভাবনা নাই এবং ধ্রুব সেরূপ আপনার পাদপদ্মের আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন।

হে ভগবন্‌, আমিও সেই প্রহ্লাদ মহারাজের পুণ্যভাবেই নিজ শত্রু আপনার পদপ্রান্তে আনীত হয়েছি এবং পুরুষ যে সম্পদের মোহে মুগ্ধমতি হয়ে নিয়ত মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত নিজ জীবনকে কখনও অনিত্য মনে করতে পারে না, প্রহ্লাদ মহারাজের সৌভাগ্যই আমাকে সেই সম্পদ ত্যাগ করিয়েছে।

শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে কুরুশ্রেষ্ঠ, বলি যখন এরূপ বলেছিলেন, তখনই উদিত পূর্ণচন্দ্রের ন্যায় ভগবৎ প্রিয় শ্রীপ্রহ্লাদ মহারাজ সেখানে উপস্থিত হলেন। তখন দৈত্যপতি বলি সৌন্দর্যশালী, পদ্মের মত বিশাল নেত্র, উন্নতকায় পিঙ্গল বসনধারী শ্যামবর্ণ সুদীর্ঘবাহু এবং সর্বলোকপ্রিয় নিজ পিতামহ প্রহ্লাদকে দেখতে পেলেন। কিন্তু বারুণনাশে বদ্ধ থাকায় পূর্বের মত উপহার দিয়ে পূজা করতে তার সামর্থ্য হল না, অশ্রুপূর্ণলোচনে কেবল মস্তক আনত দ্বারা প্রণাম করলেন।

পরে ভগবৎ সমীপে নিজের অহংকারাদি অপরাধ মনে পড়ায় লজ্জায় মুখ নত করে রইলেন। মহামতি প্রহ্লাদ সেখানে সুনন্দাদি পার্ষদগণের দ্বারা সেবিত সজ্জনপালক শ্রীহরিকে উপবিষ্ট দেখে পুলকও অশ্রুধারায় বিহ্বল হয়ে অবনত মস্তকে তাঁর নিকট গেলেন এবং মস্তকদ্বারা ভূতলে প্রণাম করলেন।

শ্রী প্রহ্লাদ বললেন–হে ভগব আপনিই বলিকে পূর্বে সমৃদ্ধিশালী ইন্দ্রপদ প্রদান করেছিলেন এবং অদ্য আপনিই তা হরণ করলেন। (বস্তুতঃ এর ইন্দ্রপদ আপনি হরণ করলেন না, নিজ পদই পুনরায় গ্রহণ করলেন।) বলির ভালই হয়েছে, আমি মনে করি, বলির প্রতি আপনার পরম অনুগ্রহ যেহেতু ঐশ্বর্য সম্পত্তি, আত্মার মোহজনক। যে সম্পদ লাভ করলে বিদ্বান্ এবং সংযত পুরুষও মুগ্ধ হন, সে সম্পদ বর্তমান থাকতে অপর কোন ব্যক্তিই তা যথাযথভাবে আত্মতত্ত্ব দর্শন করতে পারে? আপনি বলির সম্পত্তি হরণ করে তার প্রতি মহতী করুণা প্রকাশ করলেন। আপনি মহাকারুণিক, জগদীশ্বর, অখিল লোকের নাথ, নারায়ণ আপনাকে নমস্কার।

শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে রাজন, অনন্তর হিরণ্যগর্ভ ভগবান ব্রহ্মা কৃতাঞ্জলি হয়ে অবস্থিত সেই প্রহ্লাদের সমক্ষেই বামনরূপী মধুসূদনকে কিছু বলার উপক্রম করলেন। হে মহারাজ, সেই সময় বলির পত্নী সতী বিন্ধ্যাবলি পতিকে আবদ্ধ দেখে ভয় বিহ্বল ও কৃতাঞ্জলি হয়ে বামনদেবকে প্রণাম পূর্বক নতমস্তকে এরূপ বলেছিলেন। বিন্ধ্যাবলি বললেন– হে ঈশ, আপনি ক্রীড়ার্থে এই ত্রিজগৎ রচনা করেছেন, কিন্তু দুর্বুদ্ধি জনগণ এতে নিজ নিজ স্বামিত্ব কল্পনা করে থাকে। বস্তুতঃ আপনি জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও সংহারকারী বলে আপনি যাদের প্রতি কেবলমাত্র কর্তৃত্ববাদ আরোপ করেছেন, সেই নির্লজ্জ তাই আপনাকেই কোন বস্তু দান করতে পারে কি? (বিন্ধ্যাবলির রাজ্যের তাৎপর্য এই যে–আমার স্বামী, “তোমাকে লোকত্রয় অর্পণ করলাম, তৃতীয় চরণের জন্য দেহ অর্পণ করে প্রতিশ্রুতি সত্য করছি”, এই প্রকারে দেহাদিতে স্বামিত্ব জ্ঞান করতঃ যা বললেন, তাতে তার নির্লজ্জতাই প্রকাশ পেয়েছে, যেহেতু আপনি সর্বব্যাপী। অতএব কৃপা করে মন্দবুদ্ধি এই ব্যক্তিকে শাপমোচন করে পালন করুন।)

শ্রীব্রহ্মা বললেন–হে ভূতভাবন (জগতের সৃষ্টিকর্তা), হে ভূতেশ, হে দেবদেব, হে জগন্ময়, আপনি হৃতসর্বস্ব এই বলিকে বন্ধনমুক্ত করুন। যেহেতু ইনি নিগ্রহের যোগ্য নহেন। ইনি আপনাকে সমগ্র ভূমি ও কর্মার্জিত মস্তক লোক দান করেছেন এবং অবশেষে ‘অকাতর চিত্তে সর্বস্ব স্বরূপ আত্মাকে পর্যন্ত নিবেদন করেছেন। হে শুভ, লোকে শাঠ্য পরিত্যাগপূর্বক আপনার যে পাদপদ্মে জলমাত্র সমর্পণ এবং দুর্লভ বস্তুর দ্বারাও উত্তম পূজার অনুষ্ঠান করে পরম গতি লাভ করে, আর এই বলি আপনাকে অকাতরে ত্রিলোক দান করল, এতেও কি এ ব্যক্তি নিগ্রহ হবার যোগ্য? অর্থদ্বারা মত্ততা জন্মে? তাতে পুরুষ সমগ্র হয়ে সকল লোককে, এমনকি আমাকে পর্যন্ত অবজ্ঞা করে।

অতএব মদস্তম্ভ হেতু অর্থসকলের অপহরণই আমার অনুগ্রহ। জীবাত্মা সর্বদা পরতন্ত্র হয়ে নিজ কর্মদ্বারা কৃমি-কীটাদি নানা যোনিতে ভ্রমণ করতে করতে সৌভাগ্যক্রমে কদাচিৎ পুরুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করে। সেই পুরুষজন্মে যদি জীবের উত্তমকুলে জন্ম, সৎকর্ম, যৌবন, সৌন্দর্য, বিদ্যা, প্রভুত্ব ও ধনাদির দ্বারা মত্ততার সৃষ্টি না হয়, তা হলে উহাই তার প্রতি আমার অনুগ্রহ বলে মনে করতে হবে। আমি স্বয়ং ধ্রুবাদিকে যে সম্পদ প্রদান করেছি, তার কারণ–যারা আমার ভক্ত, তারা সমগ্রতাদির নিমিত্ত ভূত ও সর্বপ্রকার শ্রেয়ের প্রতিকূল পূর্বোক্ত জন্মাদি সত্ত্বেও কখনও মুগ্ধ হয় না। অতএব আমি ভক্তের ইচ্ছায় সম্পদ প্রদান করি, অভক্ত জনসম্পদে মুগ্ধ হয়, এজন্য তাদের সম্পদ হরণ করে অনুগ্রহ করি।

হে ব্রাহ্মণ, এই বলি দৈত্য ও দানবের অগ্রণী এবং কীর্তিবর্ধন, এ ব্যক্তি দুর্জয় মায়া জয় করেছে, এজন্য অবসন্ন হয়েও মুগ্ধ হয়নি। এই বলি সম্প্রতি ধনহীন, স্থানভ্রষ্ট শত্রুগণ কর্তৃক তিরস্কৃত ও বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে, আর এর জ্ঞাতিগণ একে পরিত্যাগ করে নানাপ্রকার যাতনা দিয়েছে। অধিকন্তু এর গুরু (শুক্রাচার্য) একে কত ভৎর্সনা করেছে, কত শাপ দিয়েছে, তথাপি এই ব্যক্তি নিজের সত্য পরিত্যাগ করেনি, আমি ছলপূর্বক যে ধর্মের কথা বলেছি, সত্যবাদী বলি যে ধর্মকেও লঙ্ঘন করে নাই। অতএব এই নিষ্ঠার জন্য আমি একে দেবগণের দুর্লভ স্থান দান করছি। সাবৰ্ণি মন্বন্তরে এই বলি ইন্দ্র হবে এবং তার পালক রূপে বিরাজ করবে।

উক্ত মনুপদ লাভের পূর্ব পর্যন্ত বলি বিশ্বকর্মার বিনির্মিত সুতলে গিয়ে বাস করুক। আমার দৃষ্টির প্রভাবে সুতলের অধিবাসীগণের মনঃপীড়া, ব্যাধি, ক্লান্তি, তন্দ্রা, পরাভাব অথবা কোনপ্রকার উপসর্গ হবার সম্ভাবনা নেই। ব্রহ্মাকে এরূপে বলে করুণাময় হরি সাক্ষাৎ বলির প্রতি বললেন– হে মহারাজ, ইন্দ্রসেন, তোমার মঙ্গল হোক। সম্প্রতি তুমি জ্ঞাতিজনের পরিবৃত হয়ে স্বর্গর্বাসিদেরও প্রার্থিত সুতলে গমন কর। লোকপালগণও তোমাকে পরাভূত করতে পারবে না, অপরের আর কথা কি? যে সকল দৈত্য তোমার আদেশ লঙ্ঘন করবে, আমার সুদর্শন চক্র তাদের বিনষ্ট করবে। হে বীর, আমি অনুচরবর্গ ও পরিচ্ছদ সহ সর্বত্র তোমায় রক্ষা করব এবং তুমি সেই সুতলপুরে সর্বদাই আমাকে সন্নিহিত দেখতে পাবে। সেখানে দৈত্যাদানবগণের সঙ্গ হেতু তোমার আসুরভাব উৎপন্ন হয়েও আমার প্রভাব দর্শনে তৎক্ষণাৎ তা কুণ্ঠিত হয়ে বিনষ্ট হবে।

.

ত্রয়োবিংশ অধ্যায়
পিতামহ সহ বলির সুতলে গমন এবং স্বর্গলোকে উপেন্দ্রপদে বামনের অভিষেক

শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে রাজন পুরাতন পুরুষ ভগবান বামনদেব ঐরূপ বললে, সাধুসম্মত মহানুভব বলির লোচনদ্বয় আনন্দাশ্রু কলায় আকুল হল। তিনি ভগববশতঃ হয়ে অঞ্জলি বন্ধনপূর্বক গদগদ স্বরে বলতে লাগলেন। বলি বললেন–হে ভগবান, আপনার প্রতি প্রণামে কি আশ্চর্য মহিমা। আমি আপনার উদ্দেশ্যে প্রণাম না করে তার উপক্রম মাত্রই করেছিলাম, তথাপি সেই উপক্রমেই আমার মত অভক্তের সম্বন্ধেও শরণাগত ভক্তজনের প্রাপ্য বিষয় সম্পাদন করতে সদা তৎপর রয়েছ, সেহেতু আপনার প্রতি নমস্কারের উদ্যম এই অধম অসুরকে লোকপালগণের অলব্ধপূর্ব আপনার অনুগ্রহভাজন করল। হে ভগবান, আপনি পরমেশ্বর, আমি অতি ক্ষুদ্র, আমি আপনাকে ত্রিলোকে দান করব কী? আপনাকে সম্যকরূপে প্রণামও করি নাই। তার জন্য উদ্যমমাত্র করেছি, তারই এত মহিমা! কোটি কোটি তপোদানাদির দ্বারাও যে অনুগ্রহ লভ্য হয় না তাই সম্পাদিত হল। এটাই আপনার প্রণামের অত্যাশ্চর্য মাহাত্ম।

শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে মহারাজ, বন্ধনমুক্ত বলি এইরূপ বলে শ্রীহরি, ব্রহ্মা ও শংকরকে প্রণাম করে সন্তুষ্টচিত্তে অসুরদের সাথে সুতলে প্রবেশ করেছিলেন। এইরূপে ভগবান হরি পুনরায় ইন্দ্রকে স্বর্গলোক সমর্পণপূর্বক অদিতির কামনা পূর্ণ করতঃ স্বয়ং উপেন্দ্ররূপে সকল জগৎ পালন করেছিলেন।

এদিকে নিজ বংশধর পৌত্র বলিকে বন্ধনমুক্ত এবং ভগবানের প্রসাদ লাভ করতে দেখে, ভক্তিনারায়ণ প্রহাদ মহারাজ ভগবানকে এরূপ বলেছিলেন। প্রহ্লাদ বললেন–হে ভগবান বিশ্বের বন্দনীয় পুরুষগণও যার পাদপদ্মের বন্দনা করেন, সেই আপনি, সর্বতোভাবে রক্ষা করব বলে আমাদের অসুরগণের যে দুর্গপালক হলেন, আপনার এ প্রসাদ অতি দুর্লভ। ব্রহ্মা, মহেশ্বর এবং লক্ষ্মী দেবীও এরূপ প্রসাদ প্রাপ্ত হন নাই, অপরের কথা কি বলব? হে শরণপদ, ব্রহ্মাদি দেবগণ যাঁর পাদপদ্মের মধু পান করায় এববিধ ঐশ্বর্য ভোগ করেছেন, আমাদের মত দুবৃত্ত উগ্রজাতি অসুরগণ কিরূপে সেই আপনার উদার দৃষ্টিমার্গে উপনীত হল? ভগবন্‌, আপনার চেষ্টা অতি বিচিত্র। যেহেতু অচিন্ত্য যোগমায়ার দ্বারা অবলীলাক্রমে ত্রিভুবন সৃষ্টি করেছেন বলে আপনিই সর্বাত্মা এবং আপনি সর্বজ্ঞ বলে সমর্দশী, অথচ আপনার স্বভাব এরূপ বৈষম্যমুক্ত যে ভক্তগণই আপনার প্রিয় বলে আপনি কল্পতরুর ন্যায় কেবলমাত্র তাদেরই কামনা পূর্ণ করে থাকেন।

শ্রীভগবান বললেন–বৎস প্রহ্লাদ, তোমার কল্যাণ হোক। তুমি সুতলস্থ আলয়ে গমন কর এবং নিজ পৌত্র বলির সহিত হৃষ্টচিত্তে জ্ঞাতিগণের সুখবর্ধন কর। তুমি আমাকে সর্বদা সুতলে গদাহস্তে অবস্থিত দেখতে পাবে এবং আমার দর্শনজনিত আনন্দে তোমার অজ্ঞানতা বিনষ্ট হবে। শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে রাজন, তারপর বিশুদ্ধ বুদ্ধি ও সকল অসুরসেনার অধিপতি প্রহাদ বলির সহিত, তাই করছি’ বলে ভগবানের আদেশ স্বীকার করলেন এবং কৃতাঞ্জলিপুট হয়ে সেই আদি পুরুষকে প্রদক্ষিণ ও প্রণাম করে, তার অনুমতিক্রমে মহাবলি সুতলে প্রবেশ করলেন। হে মহারাজ, তারপর ভগবান নারায়ণ শ্রীহরি অদূরে ব্রহ্মবাদিদের সভায় ঋত্বিকগণের মধ্যে অধ্যাসীন শুক্রাচার্যকে সম্বোধন করে বললেন–হে ব্রাহ্মণ, আপনার শিষ্য বলির যজ্ঞকর্মে যে ন্যূনতা ঘটেছে, সম্প্রতি আপনি তা পূর্ণ করুন। (যজমান উপস্থিত না থাকলেও) ব্রাহ্মণের দর্শন মাত্রেই কর্ম সমূহের বৈষম্য সমতাপ্রাপ্ত হয়।

শুক্রাচার্য বললেন–ভগবন্ সকল কর্মের প্রবর্তক মঙ্গলদাতা ও যজ্ঞময় পরমপুরুষ আপনি যকর্তৃক সর্বতোভাবে পূজিত হয়েছেন। তার আর কর্মবৈষম্য কোথা হতে হবে? কোন কর্মে মন্ত্র হতে (স্বৈরাদি ভ্রংশদ্বারা) তন্ত্র হতে (ক্রমঃ বৈপরীত্য দ্বারা) ও দেশ, কাল, পাত্র এবং বস্তু হতে (দক্ষিণাদি দ্বারা) যে যে ন্যূনতা হয়, আপনার নাম সংকীর্তন মাত্রই সে সকলকে পূর্ণ করে। হে ভূম, আপনি আদেশ করায় আমি অবশ্যই তা পালন করব। আপনার আজ্ঞা পালনই পুরুষদের পরম শ্রেয়ঃ । মহাপ্রভাবশালী শুক্রাচার্য এইরূপে হরির নির্দেশে উল্লাস প্রকাশ করে ঋষিবৃন্দের সহিত বলির যজ্ঞের ত্রুটি পূর্ণ করলেন।

শ্ৰী শুকদেব বললেন–হে রাজন, পরীক্ষিৎ ভগবান হরি বামনরূপে অবতীর্ণ হয়ে এইরূপে বলির নিকট হতে ভূমি ভিক্ষা করে শত্রুগণ কর্তৃক হৃত স্বর্গলোক ভ্রাতা ইন্দ্রকে আবার প্রদান করলেন। তারপর প্রজাপতিগণের অধিপতি ব্রহ্মা–দেবগণ, ঋষিগণ, পিতৃগণ, মনুগণ, দক্ষ, ভৃগু ও আঙ্গিরা প্রভৃতি এবং সনকুমার ও শঙ্করের সহিত মিলিত হয়ে, কশ্যপ ও অদিতির প্রীতি এবং সর্বশ্রেণির কল্যাণের নিমিত্ত ভগবান বামনদেবকে লোকসমূহ ও লোকপাল গণের অধিপতি করেছিলেন, (যদিও ইন্দ্রই লোকদের প্রতি তথাপি) সকল বেদ, সর্বদেব, ধর্ম, যশ এবং সর্বপ্রকার মঙ্গল ব্ৰত ইত্যাদির পালনে ধনপূর্ণ সেই বামনদের সর্ব প্রাণীর ঐশ্বর্যের জন্য উপেন্দ্র বলে বন্দিত হলেন। হে নৃপ, তখন সকল প্রাণীই অতিশয় আনন্দিত হয়েছিলেন।

তারপর ব্রহ্মার অনুমোদন ক্রমে লোকপালদের সাথে দেবরাজ ইন্দ্র বামনদেবকে বিমানযোগে স্বর্গলোকে নিয়ে গেলেন। এইরূপে উপেন্দ্রের ভূজবলে রক্ষিত ইন্দ্র ত্রিভুবন লাভ করে পরম ঐশ্বর্যশালী ও নির্ভয় হয়ে আনন্দ উপভোগ করতে লাগলেন। হে মহারাজ, তারপর ব্রহ্মা, মহেশ্বর, ভৃগু প্রভৃতি মুনিগণ পিতৃগণ নিখিল ভূতবর্গ সিদ্ধ ও বৈমানিকগণ সকলে ভগবান বিষ্ণুর ঐ অদ্ভুত সুমহৎ কর্মের প্রশংসা করতে করতে নিজ নিজ স্থানে প্রস্থান করলেন এবং তৎকালে তারা অদিতির প্রশংসা করেছিলেন, হে কুরুকুল নন্দন পরীক্ষিৎ উরুক্ৰম ভগবানের এই চরিত্র মোহগণের বিনাশক ইহা সম্পূর্ণরূপে তোমার নিকট বর্ণনা করলাম।

যে মানব পার্থিব ধূলিকণা সমূহ বর্ণনা করতে পারে, সে ব্যক্তিই অনন্ত বিক্রমশালী বিষ্ণুর মহিমার অন্ত নির্ণয় করতে পারে (অর্থাৎ পার্থিব রেণুসমূহ গণনা করা যেমন অসম্ভব, বিষ্ণুর গুণগানও তেমনি অসাধ্য) মন্ত্র ও মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি বশিষ্টও স্পষ্ট বলেছেন–জায়মান ও জাত মানবজাতির মধ্যে কোন্ ব্যক্তি পূর্ণস্বরূপ পুরুষের মহিমায় প্রাপ্ত হয়েছে? (অর্থাৎ কেহই তার মহিমার অন্তরায় নাই।) অদ্ভুত কর্ম দেবদেব ভগবান শ্রীহরির এই অবতার চরিত্র বর্ণনা যে ব্যক্তি শ্রবণ করেন, তার পরমগতি সে সকল কর্মই যথাযথ অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে পণ্ডিতগণ মনে করেন।

.

চতুর্বিংশ অধ্যায়
নৃপবর সত্যব্রতের উপাখ্যান

মহারাজ পরীক্ষিৎ বললেন–হে মুনিবর আমি শুনতে ইচ্ছা করছি সেই অদ্ভুতকর্মা হরির আদি অবতারের কথা, যাতে মায়ার দ্বারা মৎস্য রূপের অনুকরণ নির্ণীত হয়েছে। স্বয়ং ঈশ্বর কলি কর্মাদির নিয়ন্তা হয়েও কর্মাধীন জীবের মত যেজন্য লোক নিন্দিত তমং প্রকৃতি ও দুঃসহ মৎস্য রূপ ধারণ করেছিলেন, এ সমস্ত বিষয় যথাযথ আমাদের নিকট বলুন। ভগবান উত্তম শ্লোকেরই সুখাবহ। সূত বললেন–মহারাজ পরীক্ষিতের দ্বারা এরূপ জিজ্ঞাসিত হয়ে ভগবান শুকদেব বিষ্ণু মৎস্যরূপে যা করেছিলেন, সেই চরিত্র বলতে আরম্ভ করলেন। শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে মহারাজ, ভগবান স্বতন্ত্র হয়েও গো, বিপ্র, দেবতা, সাধুগণ বেদসমূহ এবং ধর্ম ও অর্থের রক্ষা করতে ইচ্ছুক হয়ে সময়ে সময়ে অবতার মূর্তি ধারণ করে থাকেন, ঈশ্বর স্বয়ং নির্গুণ বলে, মায়ার গুণযোগে দেবতা, মনুষ্য, তির্যক্ প্রভৃতি বিভিন্ন উৎকৃষ্ট প্রাণীর মধ্যে অন্তর্যামীরূপে বায়ুর মত বিচরণ করেও বিভিন্ন ভাব প্রাপ্ত হন না। (আর শুদ্ধ সত্ত্বময় মৎস্যাদি, রূপের উকৃষ্ট বা নিকৃষ্টত্বাদির শঙ্কা কোথায়?)

হে মহারাজ, অতীত কল্পের অবসানে ব্রহ্মার নিদ্রাকাল উপস্থিত হলে যে নৈমিত্তিক বলয় হয়, তৎকালে ভূবাদি সমস্ত লোক সাগরসলিলে নিমগ্ন হয়েছিলেন। যে সময় কালবেশে নিদ্রায় আরেশ হেতু ব্রহ্মা শয়নের ইচ্ছা করলে বলবান হয়গ্রীব তার মুখ নিঃসৃত বেদসমূহকে হরণ করেছিল। দানবেন্দ্র হয়গ্রীবের ঐ বেদগ্রহণ রূপ কর্ম জানতে পেরে ভগবান জগদীশ্বর হরি শফুরী রূপ (মৎস্যমূর্তি) ধারণ করলেন। সে সময় সত্যব্রত নামে নারায়ণ ভক্ত কোন রাজর্ষি সলিলে উপবেশন পূর্বক ত্যাগ করছিলেন। সেই রাজর্ষি সত্যব্রতই এই মহাকল্পে সূর্যের পুত্র শ্রাদ্ধদেব নামে বিখ্যাত এবং তিনি হরি কর্তৃক মনুক্ষেত্রে স্থাপিত হয়েছেন।

একদিন রাজর্ষি সত্যব্রত কৃতমালা নদীতে জলের দ্বারা তর্পণ করছিলেন, এ অবস্থায় তার অঞ্জলিস্থিত জলের মধ্যে একটি শরী (পুঁটি মাছ) দৃষ্ট হল। হে মহারাজ, দ্রাবিড় দেশের অধিগতি সত্যব্রত তৎকালে অঞ্জলির মধ্যে প্রাপ্ত সেই শারীকে জলের সাথে নদীর জলেই নিক্ষেপ করতে উদ্যত হলেন। তখন সেই শরী পরম দয়ালু নৃপতিকে অতি কাতর বাক্যে বলল-হে রাজ, হে দীনবৎসল, আমি জ্ঞাতি হিংসাপরায়ণ জলজন্তুগণ হতে ভীতা ও দীনা, অতএব আপনি আমাকে কীরূপে এই নদীর জলে ত্যাগ করছেন? ভগবান হরি তার নিজের প্রতিই প্রীতিবশতঃ অনুগ্রহ প্রকাশের জন্য মৎস্যরূপ ধারণ করেছেন–এই সত্য না জেনে মহারাজ সত্যব্রত সেই শারীকে রক্ষার জন্য মনস্থির করলেন, সেই শরীর অতি কাতর বাক্য শুনে দয়ালু রাজর্ষি সত্যব্রত সেই শারীকে কমণ্ডলুর মধ্যে স্থাপন করে নিজের আশ্রমে নিয়ে আসলেন।

সেই শরী এক রাতেই এরূপ বৃদ্ধি পেল যে সেই কমণ্ডলুতে স্থান না পেয়ে রাজাকে এরূপ বলেছিল–হে মহারাজ, আমি আর এই কমণ্ডলুর মধ্যে অতি কষ্টে বাস করতে পারছি না। অতএব আমি যেখানে সুখে থাকতে পারি, সেরূপ একটা সুবৃহৎ স্থান নির্দিষ্ট করে দিন। তখন রাজা কমণ্ডলু থেকে তাকে নিয়ে একটা সুবৃহৎ জলাধারে রেখে দিলেন, কিন্তু সেখানেও সে মুহূর্তকাল মধ্যে তিন হাত বর্ধিত হল। তখন শরী আবার বলল–হে মহারাজ, এই জলাশয়টিও আমার সুখে বাস করার পক্ষে উপযুক্ত নয়, অতএব আমাকে আরও বৃহৎ স্থান দিন। যেহেতু আমি আপনার শরণাগত। হে রাজন, তারপর রাজা সত্যব্রত তাকে একটি সরোবরে নিক্ষেপ করলেন, কিন্তু সেখানেও প্রক্ষিপ্ত হওয়া মাত্র সেই শ্যারী নিজ শরীর দ্বারা সরোবর আবৃত করতঃ মহামীনরূপে বর্ধিত হল, তখন সে পুনরায় রাজর্ষি সত্যব্রতকে বলল–হে মহারাজ, এই সরোবরের জল ও জলবাসী আমার পক্ষে সুখকর হচ্ছে না, অতএব আমার রক্ষার উপায় হয় সেরূপ কোন হ্রদে নিক্ষেপ করুন, যার জল কখনও ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না। শরী এরূপ বললে, সত্যব্রত তাকে জলক্ষয় শূন্য অনেক বড় বড় হ্রদে নিয়ে গেলেন, কিন্তু সকল জলাশয়েই তার দেহ তদনুরূপ বর্ধিত হলে, অবশেষে তাকে সমুদ্রের জলে নিক্ষেপ করতে উদ্যত হলেন। এ অবস্থায় সেই মৎস্য রাজাকে বলল–হে বীর, আপনি আমাকে এই সমুদ্রজলে ত্যাগ করবেন না। এখানে অতি বলবান মকরাদি জলজন্তুগণ আমাকে খেয়ে ফেলবে।

তারপর মৎস্যের ঐরূপ মধুর বচনে রাজর্ষি সত্যব্রত অতিশয় মোহিত হয়ে বললেন–আপনি কে? মৎস্যরূপে আমাদের মোহিত করেছেন। আপনি একদিনেই শত যোজন পরিমিত সরোবরকে নিজ দেহদ্বারা ব্যাপ্ত করলেন, আমরা এরূপ জলচর কোনকালে কখন দেখিনি, বা তার কথা কখনও শুনতেও পাই নি। আমার বোধ হচ্ছে আপনি নিশ্চয়ই ভগবান নারায়ণ অব্যয় শ্রীহরি প্রাণীদের প্রতি অনুগ্রহদের জন্য এই জলচর (মৎস্য) রূপ ধারণ করেছেন। হে পুরুষশ্রেষ্ঠ, আপনাকে নমস্কার, আপনি সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের অধীশ্বর। প্রভো, আপনি আমাদের শত শরণাগত ভক্তগণের বাস্তব আত্মা ও আশ্রয়। আপনার সকল লীলাবতারই প্রাণীদের মঙ্গলের কারণ হয়ে থাকে, অতএব আপনি যে প্রয়োজন সাধনের জন্য এই মৎস্যমূর্তি ধারণ করেছেন তা জানতে ইচ্ছা করি। হে অরবিন্দাক্ষ দেবাদিতে আত্মভিমানী অমর শ্রেষ্ঠ পুরুষগণের পদাশ্রয় গ্রহণ যেরূপ ব্যর্থ হয়, সকল প্রাণীর সুহৃৎ প্রিয় ও আত্মরূপী আপনার পাদপদ্মের শরণাগত সেরূপ বিফল হয় না, যেহেতু আমি কেবল আপনার ভক্ত বলেই আপনি আমাদের এই অদ্ভুত মূর্তি দর্শন করালেন।

শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে রাজন, নৃপবর সত্যব্রত এরূপ বললেন, যুগান্ত সময়ে প্রলয়ানীরে বিহাররত মৎস্যরূপধারী সেই জগৎপতি ভগবান শ্রীহরি জগতের প্রিয়কার্য সম্পাদনের ইচ্ছাহেতু সত্যব্রতকে এরূপ বলেছিলেন। কারণ একান্ত ভক্তজন তার অতিশয় প্রিয়পাত্র। শ্রীভগবান বললেন– হে রাজন, আজ থেকে সপ্তম দিবসে ভূঃ, ভুবঃ ও স্বর্গ এই তিন লোক প্রলয় সমুদ্রে নিমগ্ন হবে। তৎকালে ত্রিলোক প্রলয় সমুদ্রে লীন হবার উপক্রম হলে, আমার প্রেরিত একটি বিশাল নৌকা তোমার নিকট উপস্থিত হবে। তুমি সপ্তর্ষিগণ কর্তৃক পরিবেষ্টিত এবং সকল প্রাণীবর্গের সহিত মিলিত হয়ে সকল প্রকার ওষধি (ধ্যানাদি) ও ছোট বড় বিবিধ বীজসমূহ সঙ্গে নিয়ে সেই বিশাল নৌকায় আরোহণ করবে। তৎকালে প্রলয়সমুদ্রে আলোকশূন্য হবে সত্য, কিন্তু তুমি ঋষিদের দেহের আলোকের সাহায্যেই অকাতরে বিচরণ করতে সমর্থ হবে। তখন আমি নিকটে গিয়ে উপস্থিত হব। তখন রজ্জ্বতুল্য মহাসর্প বাসুকির দেহ দ্বারা নৌকাটিকে আমার শৃঙ্গে আবদ্ধ করবে। হে রাজন, যতকাল ব্রহ্মার রাত্রি থাকবে, আমি ততকাল সপ্তর্ষিগণের সহিত নৌকাসহ তোমাকে আকর্ষণ করে প্রলয় সমুদ্রে বিচরণ ০.ব। পরব্রহ্ম শব্দবাচ্য যে আমার মহিমা, তৎকালে তোমার প্রশ্নে আমি তা বিবৃত করব। তুমি আমার অনুগ্রহরূপে লব্ধ সেই মহিমা প্রত্যক্ষভাবে নিজের হৃদয়ে অনুভব করবে। ভগবান শ্রীহরি রাজাকে এরূপ আদেশ করে সেই স্থান হতে অন্তর্ধান হলেন।

তারপর ঐ রাজর্ষি অবহিত হয়ে সেই কালের প্রতীক্ষা করতে লাগলেন। ভগবান যা আদেশ করেছিলেন, রাজর্ষি সত্যব্রত মৎস্যরূপী শ্রীহরির পদযুগল ধ্যান করতে করতে পূৰ্বাভিমুখে কুশ সমূহ বিস্তৃত করে পূর্বোত্তর মুখ হয়ে তার উপর উপবেশন করলেন। তারপর দেখা গেল–সমুদ্র বেলাভূমি অতিক্রম করে চারদিকে পৃথিবীকে প্লাবিত করতে আরম্ভ করছে এবং মহামেঘরাশির জলবর্ষণে সেইজলরাশি ক্রমশ বর্ধিত হচ্ছে। রাজর্ষি সত্যব্রত ভগবানের আদেশ চিন্তা করতে করতে দেখতে পেলেন, একটি নৌকা নিকটে এসে উপস্থিত হল। মৎস্যমূর্তি ভগবানের নির্দেশ স্মরণ করে তিনি সকলপ্রকার ওষধি ও লতাদি গ্রহণপূর্বক সপ্তর্ষিগণের সাথে সেই নৌকায় আরোহণ করলেন। তখন সপ্তর্ষিগণ সন্তুষ্ট হয়ে সত্যব্রতকে বললেন–রাজন, ভগবান কেশবের ধ্যান কর, তিনি আমাদের এই সঙ্কট হতে উদ্ধার করে কল্যাণ বিধান করবেন। তারপর রাজা সত্যব্রত ভগবানের ধ্যান করলে তিনি একশৃঙ্গ বিশিষ্ট ও নিযুত যোজন পরিমিত স্বর্ণময় মৎস্যরূপে সেখানে আবির্ভূত হলেন। তখন সত্যব্রত শ্রীহরির পূর্ব নির্দেশ অনুসারে নৌকাটিকে রক্ষ্ম রূপী বাসুকির দেহদ্বারা উক্ত মৎস্যমূর্তির শৃঙ্গে আবদ্ধ করে, সন্তুষ্ট চিত্তে ভগবান মধুসূদনের স্তুতি করতে লাগলেন।

রাজা সত্যব্রত বললেন–ভগবন্‌, যে সকল ব্যক্তির আত্মসম্বিৎ (আত্ম তত্ত্বজ্ঞান) অনাদি অবিদ্যায় আবৃত, অতএব যারা অবিদ্যামূল সংসার পরিশ্রমে নিরন্তর কাতর, তারাও এই সংসারে যাঁর অনুগ্রহে শরণাগত হয়ে যাঁকে লাভ করে, আপনি আমাদের সেই মুক্তিদাতা পরম গুরু। এ সংসারে নিজ কার্যবন্ধনে আবদ্ধ, অজ্ঞ লোক সুখের ইচ্ছায় ‘দুঃখজনক কার্যের আচরণ করে। কিন্তু যাঁর সেবার দ্বারা সেই সুখের ইচ্ছা পরিহার করতে পারা যায়, তিনিই আমাদের হৃদয়রূপ গ্রন্থি (অর্থাৎ দেহীব্যায়রূপ বন্ধন) ভেদ করুন, যেহেতু সেই ভগবানই আমাদের গুরু, অগ্নির সংস্পর্শে রৌপ্য ও স্বর্ণ যেরূপ নির্মল হয়ে স্বাভাবিক বর্ণপ্রাপ্ত হয়, সেরূপ যার সেবার দ্বারা জীব নিজ মল রূপ তামসভাব পরিত্যাগ পূর্বক নিজ স্বরূপ লাভ করে। সেই অব্যয় জগদীশ্বর আমাদের গুরু হোন, যেহেতু তিনি গুরুরও পরম গুরু। অন্যান্য দেবগণ, গুরুগণ এবং মহাজনগণ সকলে মিলিত হয়েও স্বতন্ত্রভাবে যাঁর অনুগ্রহের অযুত ভাগের লেশমাত্রও সম্পাদন করতে সমর্থ হন না, আমি জীবের ঈশ্বর সেই আপনারই শরণাপন্ন হলাম।

অন্ধের প্রথপ্রদর্শক অন্ধ যেমন, অজ্ঞজনের দক্ষ অর্বুদ গুরুও তেমনি হয়। কিন্তু আপনার জ্ঞান সূর্যের প্রকাশের মত স্বতঃসিদ্ধ বলে আপনি জীবগণের সকল ইন্দ্রিয়ের প্রকাশক, অতএব নিজ গতি জানতে ইচ্ছা করে, আমরা আপনাকেই গুরুরূপে বরণ করছি। প্রকৃত গুরু কেবল অনর্থের হেতু, তারা লোককে অর্থ-কামাদি–বিষয়ক উপদেশ করে, তাতে লোক দূরত্যয় সংসার প্রাপ্ত হয়, আর আপনি অক্ষয় অব্যর্থ জ্ঞানেরই উপদেশ করেন–যার দ্বারা লোক যথার্থরূপে সত্বর নিজপদ লাভ করতে পারে। হে দেব, যদিও আগনি সকল লোকেরই সুহৃৎ, প্রিয়, ঈশ্বর আত্মা গুরুজ্ঞান ও অভীষ্ট সিদ্ধিস্বরূপ, তথাপি কামনাগ্রস্ত জীব বাহ্যবিষয়ে চিত্তের আসক্তি হেতু নিজ হৃদয়স্থিত আপনাকেও জানতে পারে না। আমি তত্ত্বজ্ঞান উপদেশের জন্য আপনার শরণাপন্ন হলাম। আপনি দেববর, বরেণ্য এবং ঈশ্বর। হে ভগবান আপনি পরমার্থ প্রকাশক বাক্য সকলের দ্বারা আমার হৃদয়োৎপন্ন অহংকারাদি গ্রন্থিকে ছেদন করে নিজ রূপ প্রকাশ করুন।

শ্ৰীশুকদেব বললেন–হে রাজন রাজর্ষি সত্যব্রত এইরূপ স্তব করলে আদিপুরুষ মৎস্যরূপী ভগবান প্রলয় মহাসাগরে বিহার করতে করতে তাকে তত্ত্ব উপদেশ দান করেছিলেন, তৎকালে সেই ভগবান রাজর্ষি সত্যব্রতকে সংখ্যা ও যোগক্রিয়ার উপদেশযুক্ত দিব্য মৎস্যপুরাণ এবং গোপনীয় আত্মতত্ত্বের উপদেশ করেছিলেন।

রাজা সত্যব্রত নৌকায় বসে সপ্তর্ষিগণের সহিত ভগবানের কথিত সনাতন ব্রহ্মসূত্র সেই আত্মতত্ত্ব শ্রবণ করছিলেন, তাতে তাদের সংশয়মাত্র জন্মে নাই। অতীত প্রলয়ের অবসানে ব্রহ্মা উত্থিত হলে, মৎস্যরূপী হরিহর গ্রীব অসুরের প্রাণ সংহার করে ব্রহ্মাকে পুনরায় বেদসকল প্রত্যর্পণ করেন। আর সেই রাজা সত্যব্রত ভগবানের প্রসাদে জ্ঞান ও বিজ্ঞান সম্পন্ন হয়ে বর্তমান কল্পে বৈবস্বত মনু হয়েছেন।

হে মহারাজ, যদি রাজর্ষি সত্যব্রত এবং মৎস্যরূপী ভগবান হরির সংসার রূপ মহৎ আখ্যান শ্রবণ করলে যেকোনো ব্যক্তি শাপ হয়ে মুক্ত হয়। যে মানব প্রত্যহ ভগবান শ্রীহরির এই মৎস্যাবতারের কথা কীর্তন করেন, তাঁর সংকল্প সিদ্ধি হয়, এবং জীবন অন্তে তিনি পরম গতি লাভ করেন। প্রলয়পবোধি জলে সুখমুক্ত অতএব শক্তিশূন্য ব্রহ্মার বদন হতে বিনির্গত বেদসকল যে দানব হরণ করে, যিনি মৎস্যরূপী হয়ে তাকে সংহার করতঃ সেই সমস্ত বেদ ও বেদ প্রতিপাদক পুরাণ সত্যব্রত ও সপ্তর্ষিদের উপদেশ করেছিলেন, সেই অখিলকারণ মায়ামৎস্যরূপী ভগবানকে প্রণাম করি।