ভাগবত পুরাণ – ০৪র্থ স্কন্ধ

ভাগবত পুরাণ – চতুর্থ স্কন্ধ
প্রথম অধ্যায়
মনুকন্যাদের পৃথক পৃথক বংশ বর্ণনা

মৈত্রেয় বললেন– হে বিদুর। স্বায়ম্ভুব মনুর ভার্য্যা শতরূপার গর্ভে তিনটি কন্যার জন্ম হয়। তারা হলেন–আকৃতি, দেবাহুতি এবং প্রসূতি। এছাড়াও তাদের দুই পুত্রের জন্ম হয়।

মহারাজ মনু তার পত্নী শতরূপার সম্মতি নিয়ে আকূতিকে তার ভ্রাতা বর্তমানেও পুত্রিকা ধর্মের আশ্রয় নিয়ে রুচির হস্তে সমর্পণ করেন।

পুত্রিকা ধর্ম অনুসারে সমর্পণের অর্থ হল- আমার এ কন্যা ভ্রাতৃহীনা। একে সালঙ্কারে প্রদান করছি। এর গর্ভে যে পুত্রের জন্ম হবে সে পুত্র আমার– এরকম শর্তপূর্বক সম্প্রদানই পুত্রিকা বর্ণ। এখানে মনু পুত্র-বাহুল্য কামনায় ভ্রাতৃমতী কন্যাকেও পত্রিকা নিয়মে সম্প্রদান করেন।

প্রজাপতি রুচি ছিলেন ব্রহ্মতেজের অধিকারী। তিনি পরমেশ্বরের ধ্যানের মাধ্যমে এই শক্তির অধিকারী হয়েছিলেন।

তিনি আকৃতির গর্ভে মিথুন অর্থাৎ একটি পুত্র এবং এক কন্যার জন্ম দেন।

এই দুই স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে পুরুষটি হলেন সাক্ষাৎ বিষ্ণু। তিনি যজ্ঞমূর্তি ধারণ পূর্বক জন্মগ্রহণ করেছিলেন। স্ত্রী অংশটি হলেন দক্ষিণা। তিনি লক্ষীর অংশরূপা বিষ্ণুর নিত্যশক্তি। অতএব তাদের পরস্পর বিবাহ বিরুদ্ধ হয়নি।

স্বায়ম্ভব মনু অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে আকূতি পুত্র অতীব তেজস্বী যজ্ঞকে স্বীয় গৃহে আনয়ন করলেন। প্রজাপতি রুচি কেবলমাত্র কন্যা দক্ষিণাকে নিয়ে সন্তষ্ট থাকলেন।

এরপর যজ্ঞ যিনি সাক্ষাৎ ভগবান শ্রীবিষ্ণু স্বরূপ তিনি দক্ষিণাকে বিবাহ করলেন। কারণ দক্ষিণা তাকেই বিবাহ করতে অভিলাষিণী ছিলেন।

অতঃপর যজ্ঞরূপী স্বীয় পত্নী ও অনুরাগবতী তুষ্টার দক্ষিণার গর্ভে দ্বাদশ সন্তানের জন্ম দেন। তাদের নাম হল–তোষ, প্রতোষ, সন্তোষ, ভদ্র, শান্তি, ইড়স্পতি, ইদ্ম, কবি, বিভু, স্বাহ্ন, সুদেব ও রোদন।

স্বায়ম্ভুব মন্বন্তরে এই দুইজন পুত্র, পৌত্র ও দৌহিত্রদের বংশ বিস্তারের মাধ্যমে ঐ মন্বন্তর ব্যপ্ত হয়েছিলেন।

প্রতিটি মন্বন্তরে এক মনু, দেবতা, ইন্দ্র, সপ্তর্ষি ও ভগবান বিষ্ণুর অবতার রূপ অংশ– এই ছয় প্রকার সৃষ্টি হয়।

বৎস বিদুর, মনু তার নিজ কন্যা দেবাহুতিকে ঋষি কর্দমের হাতে সমর্পণ করেছিলেন। তাদের আখ্যানের প্রায় সমস্ত কাহিনিই তুমি শ্রুত হয়েছ। তবে দেবাহুতির বংশবিস্তার সম্পর্কে এখনও তোমায় কিছু বলিনি।

ভগবান মনু তার প্রসূতি নামক কনিষ্ঠা কন্যাকে ব্রহ্মপুত্র প্রজাপতি দক্ষের হাতে সম্প্রদান করেছিলেন। ঐ প্রসূতির কৃত সৃষ্টিই ত্রিভুবনে বিরাজ করছে। কর্দম ঋষির নয়জন কন্যার সঙ্গে নয়জন ব্রহ্মর্ষিক বর্ণনা পূর্বেই করেছি। এবার তাদের পুত্র-পৌত্রাদি ক্রমে বংশ বিস্তারের কথা বর্ণনা করছি, তুমি মনোযোগ সহকারে শ্রবণ কর।

কর্ম কন্যা যিনি, মরিচীর সঙ্গে বিবাহে সম্বন্ধিত হয়েছিলেন। তার গর্ভে কশ্যপ ও পূর্ণিমা নামে দুটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়েছিল। তাদের বংশধরগণে জগৎ পরিপূর্ণ হয়েছিল।

হে বিদুর। পূর্ণিমা বিরজ এবং বিশ্বগ নামে দুইপুত্র এবং দেবকুল্যা নামে একটি কন্যার জন্ম দিয়েছিলেন। এই দেবকুল্যাই জন্মান্তরে শ্রীহরির পদ প্রক্ষালন থেকে জগতে পুণ্যসলিলা গঙ্গারূপে বহমানা হয়েছিলেন।

অত্রিমুনির পত্নী অনসূয়া বিষ্ণু, রুদ্র ও ব্রহ্মার অংশভূত মহাযশস্বী ও তেজস্বী–দত্ত, দুর্বাসা ও সোম নামক তিনটি পুত্র প্রসব করেছিলেন। বিদুর জিজ্ঞাসা করলেন –হে গুরুদেব, ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও রুদ্র তিন সুর শ্রেষ্ঠ বিশ্বের সৃষ্টি স্থিতি ও প্রলয়ের নিয়ন্তা। তারা কি অভিপ্রায়ে অত্রিগৃহে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তা আমার নিকট বর্ণনা করুন।

মৈত্রেয় বললেন– প্রজা সৃষ্টির বিষয়ে ব্রহ্মার আদেশ পেয়ে ব্রহ্মবিদগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ অত্রিমুনি পত্নী অনসূয়ার সাথে ঋক্ষ নামক কুল পর্বতে গমন করে তপস্যায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন।

সেই ঋক্ষ পর্বতের এক প্রদেশে একটি মনোহর উদ্যান ছিল। সেখানে পলাশ ও অশোক বৃক্ষরাজিতে স্তবকে স্তবকে পুষ্প শোভিত ছিল। এর নিকটবর্তী বহমান নদীর নাম ছিল নির্বিন্ধ্যা। এই নদীর জল প্রবাহের মধুর শব্দে চতুর্দিক মুখরিত থাকত।

মুনিবর অত্রি সেই উদ্যানে তপস্যায় রত ছিলেন। তিনি প্রাণায়াম দ্বারা মনকে সংযত করে, মনে মনে উচ্চারণ করলেন”যিনি এই জগতের ঈশ্বর, সেই প্রভুর শরণ নিলাম। তিনি আমাকে আত্মতুল্য প্রজা দান করুন, এই চিন্তা মনে মনে করে শতবর্ষব্যাপী একপদে দণ্ডায়মান হয়ে তপস্যা করলেন। এই সুদীর্ঘ সময়ের মধ্যে তার শীত-উষ্ণ-বর্ষা প্রভৃতি দ্বন্দ্ব জনিত দুঃখ অনুভূত হয়নি। সেই সময় তিনি শুধুমাত্র বায়ুসেবন করে জীবন ধারণ করতেন।

অত্রিমুনির মস্তক থেকে নির্গত প্রাণায়াম রূপ ইন্ধনের যোগে উদ্দীপ্ত বহ্নিদ্বারা ত্রিভুবনে সন্তপ্ত হল। এই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে অপ্সরা, গন্ধর্ব, বিদ্যাধর ও নাগ গণের সঙ্গে প্রথিত যশ। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর সে আশ্রমে গমন করলেন।

তাঁদের আর্বিভাব হওয়া মাত্রই মহর্ষি অত্রি উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। তিনি পূর্বাবস্থায় অবস্থানরত হয়েই অর্থাৎ একপদে দণ্ডায়মান অবস্থাতেই সেই শ্রেষ্ঠ দেবগণকে দর্শন করতে থাকলেন। মহাদেব ছিলেন বৃষপৃষ্ঠে আরোহনকারী, তার হস্তে ত্রিশূল বর্তমান ছিল।

ব্রহ্মা ছিলেন হংসারুঢ়, তাঁর হস্তে ধৃত কমণ্ডলু ও শ্রীমুখে প্রসন্ন দৃষ্টি।

বিষ্ণু গরুড়ের স্কন্ধোপরি আরোহণ পূর্বক আগমন করেছিলেন। তার হস্তে শোভিত ছিল সুদর্শন চক্র। এই দেবত্রয়ীর প্রত্যেকের শ্রীমুখে ছিল করুণাপূর্ণ দৃষ্টি ও মৃদু হাসি।

তখন অত্রি ভূমিতে প্রণিপাত করে পুস্পাঞ্জলি দিলেন, দেবগণের সুতীব্র তেজে অত্রিমুনির নয়নদ্বয় মুদিত হল। তিনি মুদিত আঁখিতে তাঁদের প্রণাম করলেন। তাদের প্রতি একাগ্রভাবে মনঃ সংযোগ করে কৃতাঞ্জলি পুটে সর্বলোক পূজিত দেবত্রয়কে মধুর অথচ গভীর অর্থদ্যোতক বাক্য দ্বারা স্তব করতে লাগলেন।

অত্রি বললেন– ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, আমি আপনাদের প্রণাম জানাচ্ছি। আপনারা প্রতি কল্পে এই জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের নিয়ন্তা। মায়া গুণ বিভাগ পূর্বক আপনারা এই পবিত্র দেহ ধারণ করেছেন।

আমি আপনাদের মধ্যে কাকে, আহ্বান করেছিলাম, তা আপনারা জ্ঞাত আছেন। আমি পুত্র লাভের নিমিত্তে বিবিধ পুজোপ্রকারে একমাত্র দেবশ্রেষ্ঠ ভগবানকে চিত্তমধ্যে স্মরণ করেছিলাম। দেহধারীগণের মনেরও অগোচর আপনারা ত্রয়ী এখানে কীসের নিমিত্ত আগমন করলেন? একজনের চিন্তায় তিনজনের আগমন আমার হৃদয়ে পরম বিস্ময়ের উদ্রেক হয়েছে। এ বিষয়ে আপনাদের আগমনের কারণ বলুন।

মৈত্রেয় বললেন– বৎস বিদুর। অত্রিমুনির এরূপ নিষ্কপট বাক্যাবলী শুনে দেবশ্রেষ্ঠ ত্রয়ী তাঁকে সহাস্যবদনে উত্তর দিলেন। তাঁরা বললেন– হে ব্রাহ্মণ, তোমার সংকল্প অতি সৎ। তোমার সংকল্প অনুসারেই অভীষ্ট লাভ করবে। তার অন্যথা হবে না।

তুমি যে এক জগদীশ্বরাখ্য তত্ত্বের চিন্তা করছিলে– আমার ত্রয়ী সেই এক তত্ত্ব। আমাদের পরস্পরিক ভেদ নেই। হে মুনি, তোমার কল্যাণ হোক। আমাদের প্রত্যেকের অংশে তোমার বিখ্যাত তিনটি পুত্র জন্মগ্রহণ করবে। তাদের দ্বারা তোমার যশ ত্রিলোক ব্যাপ্ত হবে। এভাবে মুনির অভীষ্ট বর তারা প্রদান করলেন। মুনি পত্নী অনসূয়া তাদের ভক্তিভরে ও বিবিধ উপাচারে পূজা করলেন।

ঋষি দম্পতি দ্বারা সম্যকভাবে পূজিত হয়ে সুর ঈশ্বর ত্রয়ী সেখান থেকে প্রস্থান করলেন। অত্রির পত্নী অনসূয়ার গর্ভে ব্রহ্মার অংশে সোম, বিষ্ণুর অংশে যোগশাস্ত্রবেত্তা দত্ত ও শংকরের অংশে দুর্বাসা জন্মগ্রহণ করলেন।

এবারে তোমরা ব্রহ্মার তৃতীয় পুত্র অঙ্গিরা এবং কর্ম কন্যা শ্রদ্ধার কথা শ্রবণ কর। অঙ্গিরার পত্নী শ্রদ্ধা চারটি কন্যাসন্তান প্রসব করেন। তারা সিনীবালী (কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী অভিমানিনী) অনুমতি (শুক্ল পক্ষের চতুর্দশী অভিমানিনী), কুহু (অমাবস্যা অভিমানিনী) এবং রাকা হলেন (পৌর্ণ মাসীর অভিমানিনী)।

চার কন্যা ছাড়াও তাদের আরও দুই পুত্র ছিল। তারা হলেন সাক্ষাৎ ভগবানের অবতার। স্বারোচিষ মন্বন্তরে তারা সাক্ষাৎ ভগবানের অবতার উতথ্য ও ব্রহ্মজ্ঞ বৃহস্পতি নামে বিখ্যাত ছিলেন। কর্দম কন্যা হবির্ভু ও ঋষি পুলস্ত্যের দাম্পত্যে, অগস্ত্য নামে এক পুত্রের জন্ম হয়। এই অগস্ত্যই অন্য জন্মে জঠরাগ্নি রূপে আর্বিভূত হন।

প্রজাপতির পুলস্ত্যের আর একটি পুত্র ছিল, তাঁর নাম ছিল বিশ্রবা। তিনি তপস্বী হিসাবে খ্যাত ছিলেন। বিশবার পত্নী ছিলেন ইলবিলা। তার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন যক্ষপতি কুবের। বিশবার অপর পত্নীর নাম ছিল কেশিনী। তাঁর ছিল তিনটি পুত্র। তাদের নাম ছিল–রাবণ, কুম্ভকর্ণ ও বিভীষণ। পুলহ ঋষির পত্নীর নাম ছিল গতি। তার তিন পুত্রের নাম ছিল কর্মশ্রেষ্ঠ, বরীয়ান ও সহিষ্ণু।

প্রজাপতি ক্রতুর পত্নীর নাম ছিল ক্রিয়া। তিনি ব্রহ্মতেজে বলীয়ান, বালখিল্য নামে ষাট হাজার ঋষির জন্মে দিয়েছিলেন।

হে শত্রুনাশন বিদুর, বশিষ্ঠের এক পত্নী ঊর্জা গর্ভে চিত্রকেতু প্রভৃতি সাত জন পুত্রের জন্ম হয়। তারা পবিত্রচিত্ত সপ্তর্ষি নামে পরিচিত। তাঁদের নাম হল–চিত্রকেতু, সুরোচি, বিরজা, মিত্র, উন্বণ, বসুভূদ্যান এবং দ্যুম্ন।

এছাড়াও বশিষ্ঠের অপর একজন পত্নীর গর্ভে শক্তি প্রভৃতি পুত্রাদির জন্ম হয়। অথবা ঋষির পত্নীর নাম ছিল চিত্তি। তার গর্ভে দধীচি নামক এক পুত্র জন্মায়। তার আর এক নাম ছিল অশ্বশিরা। তিনি তপস্যায় সিদ্ধ ছিলেন।

এরপর আমার কাছ থেকে ভৃগুমুনির বংশবিস্তার শোন, ভৃগু ঋষির ঔরসে তার পত্নী খ্যাতির সঙ্গে ধাতা ও বিধাতা নামে দুই পুত্র জন্মায়। তার একটি কন্যাও ছিল। তার নাম ছিল শ্রী। তিনি অত্যন্ত ভগবৎ পরায়ণা ছিলেন। ঐ কন্যা ভগবান নারায়ণকে পতিরূপে বরণ করেছিলেন। সুমেরু পর্বতাভিমনী দেবতা মেরু তার আয়তি ও নিয়তি নামক দুই কন্যাকে ধাতা ও বিধাতার হাতে সম্প্রদান করেন। ঐ দুই কন্যার গর্ভে ধাতা ও বিধাতার ঔরসে মৃক ও প্রাণ নামে দুটি পুত্রের জন্ম হয়। ঐ মৃকণ্ডের পুত্র। মার্কণ্ডেয় এবং প্রাণের সন্তান হল বেদশিরা। ভৃগুমুনির কবি নামে আর একটি পুত্রের জন্ম হয়। তার পুত্রের নাম হল ভগবান উশনা বা শুক্রাচার্য।

হে বিদুর। ঐ মুনিবৃন্দ প্রজাসৃষ্টির নিমিত্তে বংশবৃদ্ধি ঘটিয়েছেন। তোমার কাছে এতক্ষণ কর্ম ঋষির দৌহিত্র বংশের কীর্তন করলাম। শ্রদ্ধাপূর্বক ইহা শ্রবণ করলে সকল পাপের উপশম হয়।

ব্রহ্মার পুত্র দক্ষ মনুর তৃতীয় কন্যা প্রসূতির সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন। তিনি প্রসূতির গর্ভে ষোলোটি কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন নির্মল লোচনা। প্রজাপতি দক্ষ তাদের মধ্যে তেরোজনকে ধর্মের হাতে সমর্পণ করেন। এক মেয়েকে তিনি অগ্নির হাতে, একজনকে সম্মিলিত পিতৃগণকে, অপর কন্যাটিকে মহাদেবের হস্তে সমর্পণ করেন।

শ্রদ্ধা, মৈত্রী, দয়া, শান্তি, তুষ্টি, পুষ্টি, ক্রিয়া, উন্নতি, বুদ্ধি, মেধা, তিতিক্ষা স্ত্রী ও মূর্তি– এই ত্রয়োদশ কন্যা ধর্মের পত্নী ছিলেন। শ্রদ্ধার সন্তানের নাম ছিল শুভ। মৈত্রীর গর্ভে যে সন্তানের জন্ম হয়, তাঁর নাম ছিল প্রসাদ। দয়ার গর্ভজাত সন্তানের নাম ছিল অভয়। শান্তির সন্তান ছিলেন সুখ। তুষ্টি যে সন্তানটি প্রসব করেন তার নাম ছিল হর্ষ।

পুষ্টি গর্ব নামক সন্তানের জন্ম দেন। ক্রিয়ার সন্তানের যোগ। উন্নতি জন্ম দিয়েছিলেন দর্পের। বুদ্ধি প্রসব করেছিলেন অর্থকে, মেধার গর্ভে জন্ম হয় স্মৃতির। তিতিক্ষার সন্তানের নাম ছিল মঙ্গল এবং হ্রী (লেজ্জা) সন্তান রূপে প্রসব করেন বিনয়কে।

সকল গুণের উৎপত্তি রূপিণী ছিলেন মুর্তি। তিনি নর ও নারায়ণ নামে দুজন ঋষিকে প্রসব করেছিলেন। এঁদের আবির্ভাবে সাধুগণের মন, দিক সমূহ, বায়ু, নদী পর্বতাদি প্রসন্ন হয়েছিল। সমগ্র বিশ্ব অত্যন্ত আনন্দমনে তাঁদের স্বাগত জানিয়েছিল। স্বর্গ থেকে তখন তুর্যধ্বনি ও পুষ্পবৃষ্টি হয়েছিল। আর মুনিসকল হৃষ্ট চিত্তে স্তব করেছিলেন। গন্ধর্ব ও কিন্নরগণ আনন্দিত মনে গান ধরেছিলেন। দেবরমণীকুল পরম কৌতুকে নৃত্যে রত হয়েছিলেন। সে সময় আকাশে বাতাসে প্রসন্ন ও কল্যাণময়। আবহ রচিত হয়েছিল।

হে বৎস, বেশি আর কি বলব। ব্রহ্মাদি দেবগণও নানাবিধ স্তবের দ্বারা ওই শিশুদ্বয়ের উপাসনায় ব্রতী হয়েছিলেন।

দেবতাগণ এভাবে স্তব করেছিলেন-গগনে খচিত গন্ধর্বগণের ন্যায় যিনি স্বয়ী মায়ার প্রভাবে এই বিশ্বকে নিজ অধিষ্ঠানে পরিণত করেছেন, সেই পরম পুরুষকে আমরা প্রণাম জানাই। তিনি নিজ আত্মপ্রকাশের নিমিত্তে অধুনা এই ধর্মসদনে ঋষিমূর্তিরূপে প্রকাশিত। তার অবিস্মরণীয় তত্ত্বাদি আমরাও প্রত্যক্ষ করতে পারি না। কেবল মাত্র শাস্ত্র দ্বারা অনুমান করতে পারি।

সেই পরমাত্মা ভগবান জগতের নিয়মাদিসমূহ যথাযথ ভাবে পালনের উদ্দেশ্যেই আমাদের সত্ত্বগুণের দ্বারা দেবতারূপে সৃষ্টি করেছেন। তাঁর নয়নযুগল অপরিসীম সৌন্দর্যের আবাসস্থল। তাঁর মনোহর শোভার কাছে কমলের সৌন্দর্যও ম্লান হয়ে যায়। সেই কৃপাপূর্ণ নয়নে তিনি আমাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করুন।

বৎস বিদুর, এভাবে দেবগণ কর্তৃক সম্যকভাবে স্তুত ও পূজিত হয়ে সেই নর-নারায়ণ ঋষিদ্বয় গন্ধমাদন পর্বতাভিমুখে গমন করলেন। ভগবানের অংশদ্ভুত, দুই ঋষিই দ্বাপরযুগের শেষার্ধে অর্জুন ও শ্রীকৃষ্ণরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তার নর অংশে অর্জুন ও নারায়ণ অংশে স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভূ ভার হরণের জন্য আর্বিভূত হয়েছিলেন।

বিদুর, এবার দক্ষের অপর তিন কন্যার নাম ও বংশের কথা বর্ণনা করছি, শ্রবণ কর।

অগ্নি অর্থাৎ অগ্ন্যাভিমানী দেবতার পত্নী হলেন স্বাহা। তাঁদের পুত্ররা হলেন–পাবক, পবমান ও শুচি। তারা সকলেই হুতভোগি। সেই পাবক পবমান ও শুচি নামক অগ্নি থেকে পয়তাল্লিশটি অগ্নির উৎপত্তি হয়। তাঁরা পিতৃত্রয় ও পিতামহ সহযোগে মোট উনপঞ্চাশটি অগ্নিরূপে বিরাজিত। বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণগণেরা বৈতানিকে অর্থাৎ বেদ প্রতিবিহিত যজ্ঞাদি কার্যে এদের নাম উল্লেখপূর্বক আহুতি দান করেন।

অগ্নিদাত্ত, বহিষদ, সোমপ, আজ্যপ– এদের পিতৃগণ বলা হয়। এঁদের মধ্যে যাদের অগ্নিমধ্যে কর্মনিহিত আছে, অর্থাৎ যাঁদের উদ্দেশ্যে অগ্নিতে হোম করা হয়। তাদের সাগ্নিক বলে বাকীদের অনগ্নি বলে অভিহিত করা হয়। দক্ষের পঞ্চদশ কন্যা স্বধা, এই সন্মিলিত পিতৃগণের পত্নী। তাদের ঔরসে স্পর্ধার গর্ভে বুয়না ও ধারিণী নামে দুটি কন্যার জন্ম হয়। এই দুই কন্যাই ব্রহ্মবাদিনী এবং জ্ঞান বিজ্ঞানে অতি পারদর্শিনী ছিলেন।

হে কুরুশ্রেষ্ঠ, দক্ষকন্যা সতী ছিলেন ভগবান মহাদেবের পত্নী। কিন্তু তিনি পিতা দক্ষের প্রতি রোষবশতঃ যৌবনে যোগবলে প্রাণত্যাগ করায় পুত্রহীনা ছিলেন। পিতা দক্ষ তুচ্ছ কারণে তার স্বামীকে অপমান করায় সতী প্রাণত্যাগ করেন।

.

দ্বিতীয় অধ্যায়
(শিব ও দক্ষের পরস্পর বিদ্বেষের সূত্রপাত)

বিদুর বললেন– হে মৈত্রেয়। দুহিতাদের প্রতি স্নেহশীল দক্ষ, কেনই বা নিজ কন্যা সতী ও তাঁর পতি মহাদেবের বিরুদ্ধাচারণ করেছিলেন? হে মুনি, ঐ দেব তো কারও প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করেন না। তাঁর প্রতিও কারও কোনও ক্ষোভ থাকার নয়। কারণ তিনি এই মহাজগতের গুরু, মহান দেবতা। আত্মাতেই তাঁর রতি, তাই তার দেহ শান্তিময়।

তবে প্রজাপতি দক্ষ কেন কন্যার প্রতি বিদ্বিষ্ট হয়েছিলেন? হে ব্রাহ্মণ, যে কারণে শ্বশুর ও জামাতার মধ্যে বিদ্বেষ জন্ম নিয়েছিল, তার কারণ আমায় বলুন। এমন কী সেই বিদ্বেষের কারণের জন্য দক্ষকন্যা সতীকে প্রাণ পর্যন্ত দিতে হল?

মৈত্রেয় বললেন– প্রথম কল্পে স্বায়ম্ভুব মনুর মন্বন্তরে বিশ্ব সৃষ্টিকারী মরীচি প্রভৃতিদের যজ্ঞে বশিষ্ঠ, নারদ প্রভৃতি ঋষিগণেরা সমবেত হয়েছিলেন।

এছাড়াও নিজ নিজ অনুচরবর্গকে সঙ্গে নিয়ে দেবরাজ ইন্দ্রসহ সমস্ত দেবগণ মুনিগণ ও অগ্নিরা উপস্থিত ছিলেন।

প্রজাপতি দক্ষ সূর্যের ন্যায় উজ্জ্বল আলোক ও তেজরাশিতে দীপ্যমান হয়ে সভা মধ্যে প্রবিষ্ট হলেন। দক্ষের অঙ্গপ্রভায় ঐ মহৎসভা অন্ধকার শূন্য হয়। তাঁকে সভা মধ্যে উপনীত হতে দেখে ব্রহ্মা ও মহাদেব ভিন্ন সমস্ত সভাসদেরা নিজ নিজ আসন থেকে উঠে দাঁড়ালেন। কারণ দক্ষের উজ্জ্বল অঙ্গপ্রভার উদ্ভাস তাদের চিত্তকে আক্ষিপ্ত করেছিল। তারা যক্ষের যথার্থ সৎকার করার পরে তিনি লোক গুরু ব্রহ্মাকে প্রণাম করে তার অনুমতি পূর্বক আসনে উপবিষ্ট হলেন।

দক্ষের আসন গ্রহণের পূর্ব থেকেই ভগবান ভব নিজ আসনে উপবিষ্ট ছিলেন। দক্ষ বারংবার এই ব্যাপারে ভবের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলেও মহাদেব যথাপূর্বক আসলে থেকে গাত্রোত্থান করে দক্ষকে সম্মান প্রদান করলেন না। দক্ষ এই অপমান সহ্য করতে না পেরে সভাস্থ দেবতা সহ সকলের উপস্থিতিতে ভবের উদ্দেশ্যে বিষেদাগার করতে উদ্যত হলেন–

আমি অজ্ঞানতা বা বিদ্বেষহেতু বলছি না, তবে এই শিব অতি লজ্জাহীন ও লোকপালদের যশ বিনাশ কারী। কারণ তিনি এ যথোচিত ক্রিয়া পালন না করে সাধুগণের আচরণীয় পথকে কলুষিত করেছেন। একে একভাবে আমরা শিষ্য বলা যেতে পারে কারণ এই মূঢ়, ব্রাহ্মণ ও অগ্নি সাক্ষী রেখে আমার কন্যার পানি গ্রহণ করেছে। এই মর্কট লোচনের সঙ্গে দৈবক্রমে আমার কন্যার বিবাহ হয়েছে। সেহেতু আমাকে এর গাত্রোত্থান পূর্বক সম্মান প্রদর্শন কর্তব্য। কিন্তু এ তো সামান্য সম্মানজনক বাক্যেও আমায় শ্রদ্ধার্পণ করল না।

শূদ্রকে বেদবিদ্যা দান করার ন্যায় অত্যন্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি ব্রহ্মার আদেশে কন্যা সতীকে এই শিবের হাতে সম্প্রদান করেছি। এঅতি অপবিত্র, অভিমানী, ধর্মমহাত্ম ও ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে নেহাৎ অজ্ঞ। এই ব্যক্তি বিকীর্ণ কেশে বস্ত্রহীন অবস্থায় শ্মশানে শ্মশানে ভয়ংকর ভূতপ্রেতদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। আপন মনে কখনও হাসে কখনও কাঁদে। সর্বাঙ্গে চিতাভস্ম মেখে, মাথায়, গলায় মৃত মানুষের অস্থিকেই ভূষণরূপে পরিধান করে শ্মশানচারীর মতো জীবন কাটায়। নামে মাত্র শিব, বস্তুত এ নিজে অশিব। সততঃ মাদক সেবন করে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে থাকে। তমোগুণ স্বভাব প্রমথনাথদের পতি এই শিব। মাদক-সেবনে মত্তজনেরা এর অতি প্রিয় পাত্র।

হায়, হায়! আমি অত্যন্ত ভুল করেছি। ব্রহ্মার কথায় আমি অতি উন্মাদ, দুরাশয়, শৌচাচার বর্জনকারী, দুষ্টচিত্ত শিবের হাতে আমার পরম সাধ্বী কন্যাকে সমর্পণ করেছি। মৈত্রেয় বললেন– হে বিদুর, প্রতিকূল আচরণ শূন্য শিবকে স্থিরভাবে উপবেশনরত দেখে দক্ষ তাকে এভাবে নিন্দা করলেন। রাগে অন্ধ হয়ে তিনি শিবকে জলস্পর্শ করে অভিশাপ দিতে উদ্যত হলেন।

দক্ষ অভিশাপ দিয়ে বললেন– “দেবতাগণের যজ্ঞকালীন সময়ে দেবগণের অধম এই শিব কখনই ইন্দ্রাদি দেবগণের সঙ্গে যজ্ঞের ভাগ পাবে না।

–হে কুরুশ্রেষ্ঠ। তখন সভামধ্যে উপস্থিত বিশিষ্ট সভাসদেরা দক্ষকে নানা প্রকারে নিরস্ত করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু দক্ষ কারো নিষেধ না মেনে এভাবে অভিসম্পাত দিয়ে নিজে সভাস্থল পরিত্যাগ করলেন ও নিজ গৃহে গমন করলেন।

তারপর গিরীশ অনুচরদের অগ্রণী নন্দীশ্বর এই অভিশাপের বিষয়টি জ্ঞাত হলেন। প্রচণ্ড রাগে রক্তচক্ষু হয়ে তিনি দক্ষকে ও শিবনিন্দা সমর্থক সকল ব্রাহ্মণদের অভিশাপ দানে প্রবৃত্ত হলেন। নন্দীশ্বর বললেন–অজ্ঞ ও ভেদস্পশী ব্যক্তি এই দক্ষ-স্বশরীরকে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান পূর্বক ভগবান ভবের বিরোধিতা করলেন। কখনই তাঁর পরমার্থ লাভ হবে না। ভগবান মহাদেব কারও প্রতি বিদ্বেষী মনোভাব পোষণ করেন না। তাই যাঁরা তাঁর প্রতি দ্রোহপূর্ণ আচরণ করবে তারা পরমার্থ থেকে পরিভ্রষ্ট হবে।

সেই অজ্ঞ ব্যক্তি বেদের অর্থবাদে ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সুখের প্রত্যাশায় জটিল ধর্ময় গার্হস্থ্য ব্যাপারে অনুরক্ত হয়ে কর্মকাণ্ড বিস্তারে ব্যাপ্ত হোক। এই দক্ষ দেহাভিমান বশতঃ আত্মার প্রকৃত তত্ত্ব বিস্মৃত হয়েছে। তাই এই ব্যক্তি নারী– কামী হোক, শীঘ্রই এর মুখ ছাগলের মতো হোক। এই এই দক্ষ কর্মময়ী অবিদ্যাকে তত্ত্ব বিদ্যা বলে মনে করেছে। অতএব এ প্রকৃতই ছাগ।

যে সকল ব্যক্তি শিবনিন্দাকারী দক্ষের আচরণ সমর্থন করেছে তারা বারে বারে এ সংসারে পতিত হয়ে জন্ম-মরণাদি দুঃখ ভোগ করুক। বেদ বর্ণিত কর্মকাণ্ডসকল বহুল পুষ্পলতার মতো আপাত ভাবে অতি মনোহরা। কিন্তু ঐ শ্রুতিবাক্যের মনোঃক্ষোভ উৎপাদক নানারকম প্ররোচনা দ্বারা শিব-বিদ্বেষীরা বিবেকজ্ঞান শূন্য হোক। তারা কোনও রকম বিচার বিবেচনা না করে সর্বভোজী হোক। জীবিকা নির্বাহের জন্য তারা বিদ্যাভ্যাস, তপস্যা ও ব্রত আচরণ করুক। তারা বিত্ত, দেহ ইন্দ্রিয়াদির সুখে আসক্ত হোক। যাচকরূপে তারা এই পৃথিবীতে বিচরণ করুক।

ব্রাহ্মণকুলের প্রতি নন্দীশ্বরের এরূপ অভিসম্পাত শুনে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন মহর্ষি ভৃগু। তিনি ব্রহ্মদণ্ডরূপ দূরত্যয় প্রতিশাপ দিতে উদ্যত হলেন। ভৃগু বললেন– “যারা শিবের ব্রত পালন করবে। বা তার অনুগমন করবে তারা সৎশাস্ত্রের প্রতি কুলচারী হয়ে পাষণ্ডী রূপে পরিচিত হবে। ঐ মূঢ় বুদ্ধি শিব ভক্তরা শৌচ-আচার করবে না। তারা জটা, ভস্ম ও অস্থি সকল ধারণ করবে। শিবদীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে সেখানে গৌড়ি পৈষ্টী ও মাধ্বী সুরা অর্থাৎ তালাদি জাত মদ্য পরম সমাদরে গৃহীত হবে।

অহো, ব্রাহ্মণগণ, তোমরা শাস্ত্রের মর্যাদাপূর্ণ ও বর্ণাশ্রমের আচরণ বিশিষ্ট পুরুষদের ধারণকারী বেদাদি ও বেদ প্রবর্তক ব্রাহ্মণগণের নিন্দায় রত হয়েছ, তাই তোমাদের পাষণ্ডাশ্রিত বললাম। প্রাচীন ঋষিগণ এই বেদকে অবলম্বন করেছেন। স্বয়ং ভগবান নারায়ণ এই বেদের মূলস্বরূপ। সেই বেদ সর্বলোকের চিরন্তন ও কল্যাণময় পথ। সাধুগণের পরম পবিত্র চিরন্তন পন্থাস্বরূপ সেই বেদকে তোমরা নিন্দা করছ। যে ধর্মে তোমাদের তামস ভূতপতির আধিপত্য আছে, সেই পাষণ্ডধর্মে তোমার দীক্ষিত হও।

মৈত্রেয় বললেন– মহর্ষি ভৃগু এরূপ অভিসম্পাত দানে প্রবৃত্ত হলে ভগবান মহাদেব একটু যেন বিমনা হয়ে সে স্থান ত্যাগ করলেন। তিনি ভাবলেন, এভাবে পরস্পর অভিশাপ পর্ব চলতে থাকলে তা উভয়ের পক্ষেই ক্ষতিকর। এ কারণেই তিনি নিজ অনুচরদের নিয়ে সেখান থেকে গমনোদ্যত হলেন।

বৎস বিদুর, তারপরে বিশ্বস্রষ্টাগণ সহস্র বৎসরব্যাপী যজ্ঞানুষ্ঠান সম্পাদন করলেন। এই যজ্ঞের মাধ্যমে ভগবান বিষ্ণুর উপাসনা করা হয়। তারপর তারা গঙ্গা-যমুনার সঙ্গমস্থল প্রয়াগে স্নান করে পবিত্র নির্মল হৃদয়ে স্বীয় গৃহে গমন করলেন। যজ্ঞ সমাপন অন্তে এই স্নানকে বলা হয় অবyথ। এর ফলে দেহ মন নির্মল ও শুচি হয়।

.

তৃতীয় অধ্যায়
সতীর দক্ষালয়ে গমন প্রার্থনা।

মৈত্রেয় বললেন– এভাবে পারস্পরিক বিদ্বেষরত হয়ে শ্বশুর ও জামাতা অর্থাৎ দক্ষ ও শিব বহুকাল কাটালেন। পরমেষ্ঠী ব্রহ্মা ইতিমধ্যে দক্ষকে সকল প্রজাপতির অধিপতি হিসেবে নির্বাচন করলেন। তখন দক্ষ মনে মনে অতি আনন্দিত ও গর্বিত বোধ করলেন।

দর্পিত দক্ষ এবারে শিব ও তৎপক্ষীয় ব্রহ্মিষ্ঠদের অপমান করে বাজপেয় যজ্ঞের সমাপন করে বৃহস্পতি নামক উৎকৃষ্ঠ যজ্ঞের সূচনা করলেন। দক্ষের আর সেই যজ্ঞে সকল ব্রহ্মর্ষি, দেবর্ষি পিতৃ ও দেবগণ পূজিত হলেন। তৎসঙ্গে তদীয় পত্নীরাও যজ্ঞে আমন্ত্রিত ছিলেন। আকাশ পথে উড়তে পাখিরা এই যজ্ঞবিষয়ে আলাপচারিতা করতে লাগল। দক্ষকন্যা সতী তাদের মুখে নিজ পিতার এই বিপুল যজ্ঞোৎসবের কথা শুনলেন। তিনি আরও দেখতে পেলেন চতুর্দিক থেকে গন্ধর্বকন্যাদের নিজ নিজ পতির সমভিব্যাহারে বিমানে আরোহণ পূর্বক যজ্ঞস্থলে গমন করেছে। তাদের কণ্ঠে পদক শোভিত, পরিধানে সুবস্ত্র, তারা শোভন রূপে সজ্জিত। এসব দেখে সতীরও ঐ যজ্ঞাৎসবে যাওয়ার ইচ্ছে জাগল।

তিনি নিজ পতি ভূতনাথকে সম্বোধন করে বললেন– হে নাথ, আপনার শ্বশুর ও আমার পিতা প্রজাপতি দক্ষের যজ্ঞোৎসব সম্প্রতি শুরু হয়েছে। তা এখনও চলছে। কারণ ঐ যে দেখুন দেবগণ সেথায় গমন করছেন। আপনার যদি ইচ্ছা বা অনুমতি হয় তবে চলুন। আমরাও সেখানে গমন করি। নিশ্চয়ই সেখানে আমার ভগিনীরাও এতক্ষণে এসে উপস্থিত হয়েছেন। তাদের পতিরাও নিশ্চয়ই উপস্থিত হয়েছেন। আমিও সেখানে উপস্থিত হতে ইচ্ছুক। তৎসঙ্গে মাতা পিতার প্রদত্ত অলংকারাদি গ্রহণের ইচ্ছাও আমার হয়েছে। সেখানে আমি উপস্থিত হলে ভর্তৃর্সহ ভগিনীদের এবং আমার স্নেহময়ী মাতার দর্শন পাব। হে প্রভু, ভগিনীদের তাদের দর্শনের জন্য বহুদিন আমার মন অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে রয়েছে। হে মৃঢ় (সর্বসুখদাতা), মহর্ষিগণ কর্তৃক প্রবর্তিত পিতৃযজ্ঞে যে ধ্বজা উত্থিত হয়ে থাকবে, তাও দেখার সুযোগ হবে।

হে অজ, ত্রিগুণ স্বরূপা, এই জগত সংসার আপনার নিজ মায়ার দ্বারা প্রকাশিত। জানি আপনার কাছে কিছুই বিস্ময়কর নয়, তবু আমি তো যোষিৎ। আমি স্বভাবতই কৌতূহল প্রবণ। আমি আপনার তত্ত্ব সম্পর্কেও জ্ঞাত নই। সুতরাং আমি জন্মভূমি দর্শন করার জন্য অতিশয় ব্যাকুল হয়েছি। হে প্রভু, আপনি তো জন্মাদি রহিত। আত্মীয়-বন্ধু-বিচ্ছেদ যন্ত্রণা আপনি তো বুঝতে পারবেন না।

দেখুন, পিতা দক্ষের সঙ্গে সম্বন্ধহীন যোষিগণও অলংকারে সজ্জিত হয়ে নিজ নিজ পতির সঙ্গে আমার পিতৃগৃহে গমন করেছেন। দেখুন তাঁদের কলহংসতুল্য পাণ্ডুবর্ণ গতিশীল বিমানশ্রেণীতে আকাশ কেমন সুশোভিত! হে নীলকণ্ঠ, আপনি তো অপরের প্রতি অনুগ্রহ বশতঃ বিষও ভক্ষণ করেছেন, তাহলে পিতৃগৃহে গমনের জন্য আমাকে দয়া করে অনুমতি দিন প্রভু।

হে সুরশ্রেষ্ঠ, পিতার গৃহে উৎসবের সংবাদে কন্যার মন কি বিচলিত হয় না? যদি বলেন বিনা নিমন্ত্রণে যাওয়া সমুচিত নয়। তাহলে বলি প্রভু বন্ধুজন, পতি, শ্বশুরাদি গুরুজন ও জন্মদাতা পিতার গৃহে বিনা আমন্ত্রণেও যাওয়া যায়। হে দেব, আমার প্রতি দয়া করুন। আপনি তো দয়াশীল। আমার এ অভিলাষ পূর্ণ করুন দেব। পরম জ্ঞানের অধিকারী হয়েও যখন আমাকে নিজ অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে স্বীকার করেছেন, আমার এ প্রার্থনা মঞ্জুর করুন প্রভু।

মৈত্রেয় বললেন– ভগবান গিরিত্র (গিরিশ) প্রিয়তমা পত্নীর এই আকুল প্রার্থনা শুনে মৃদু হাস্য করলেন। তার পিতা দক্ষ সমস্ত অভ্যাগত ঋষি, মুনি, দেবাদিগণের সম্মুখে শিবের প্রতি যে মর্মবিদারক তীব্র কটু বাক্য প্রয়োগ করেছিলেন তা তিনি সতীকে মনে করিয়ে দিলেন। বললেন– হে শোভনে, অনাহূত হয়েও পিতৃগৃহে অনায়াসে গমন করা যায় একথা সত্য।

তবে সেই বন্ধুবর্গ যদি দেহাদিতে প্রবল অভিমানী ও ক্রোধের ফলে বৃথা দোষ দৃষ্টি সম্পন্ন না হয়। বিদ্যা, তপস্যা, ধন, দেহ, বয়স ও কুল এই ছয়টি সজ্জনগণের গুণ ঠিকই। কিন্তু এগুলিই অসাধুজনে প্রযুক্ত হলে দোষরূপে পরিণত হয়ে বিবেক নষ্ট করে। তখন তারা “আমি বিদ্বান” আমি তপস্বী, প্রভৃতি অভিমানে গর্বিত হয়ে এমন কী মহাত্মাদের স্বরূপ বুঝতে অক্ষম হয়।

এবিধ বন্ধুদের গৃহে যাওয়া তো দূরস্থান, তাদের গৃহের প্রতি দৃষ্টিপাত করাও অনুচিত। তারা অতিশয় অব্যবস্থিত চিত্তের অধিকারী। তাঁদের গৃহে যখন কোনও ব্যক্তি উপস্থিত হয় তারা ভুভঙ্গি সহযোগে রোষ কষায়িত নয়নে কুটিল মনে তাদের নিরীক্ষণ করতে থাকে।

হে প্রিয়ে, ঐ সকল কুটিলমনা আত্মীয় বন্ধুজনের কটুক্তি থেকে যে মর্মপীড়া অনুভূত হয়, তার জন্য প্রচুর মনঃস্তাপ ভোগ করতে হবে। শত্রু নিক্ষেপিত বাণ দ্বারা শরীরে আঘাতও সে তুলনায় অতি সামান্য। কারণ কিছুকাল পরেই সেই দৈহিক যাতনার উপশম হয়।

হে সুভ্র, প্রজাপতি দক্ষ অত্যন্ত মর্যাদার পাত্র। তুমিও তার সর্বাপেক্ষা স্নেহময়ী কন্যা, এ কথা সত্য। তবু জানিয়ে রাখি যেহেতু তুমি আমার পত্নী, সে কারণেই তুমি পিতার সমাদর পাবে না। কারণ ব্রহ্মাকে আমার সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত হওয়ার কারণে পরিতাপ ভোগ করতে হয়েছে। শোনো প্রিয়ে, আমি কিন্তু তোমার পিতা দক্ষের কাছে কোনও অপরাধ করিনি। অহংশূন্য ব্যক্তিবর্গের সমৃদ্ধিতে তার হৃদয় অতি সন্তপ্ত হয়। তাই তিনি দুঃখিত বোধ করেছেন।

পুণ্যার্জনের দ্বারা বা সুকীর্তির দ্বারা তিনি কিন্তু কোন ভাবেই ঐ সকল মহত্তম ব্যক্তির সমতুল্য স্থান প্রাপ্ত হতে পারবেন না। অসুরাদি যেমন ভগবান শ্রীহরির চিরবিদ্বেষী, তোমার পিতাও তেমনি আমার প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব পোষণ করেন।

হে সুমধ্যমে, লোকে যে পরস্পর প্রত্যুৎগমন, বিনয় প্রকাশ পূর্বক অভিবাদন করে থাকেন, কিন্তু জ্ঞানী পুরুষেরা সে সমস্ত ক্রিয়া মনে মনে অন্তর্যামী ভগবানের উদ্দেশ্যে সম্পাদন করলেও দেহাভিমানী পুরুষের উদ্দেশ্যে করেন না।

আমি অন্তর্যামী দৃষ্টিতে ভগবান বাসুদেবের প্রতি শ্রদ্ধাপূর্বক প্রত্যুত্থানাদি ক্রিয়া করেছিলাম। কাজেই বুঝতে পারছ দক্ষকে কোনও রূপ অবমাননা বা অপমান আমি করিনি। বাসুদেব শব্দ উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে বিশুদ্ধ সত্ত্ব গুণে পরম পুরুষ বাসুদেব প্রকাশমান। তাই শুদ্ধ সত্তরূপ কিন্তু ইন্দ্রিয়ের আগোচর ভগবান বাসুদেবকে আমি নিত্যই প্রণাম করি।

হে প্রিয়তমা, প্রজাপতি দক্ষের যজ্ঞস্থলে সমস্ত সভাসদদের সম্মুখে দক্ষ আমাকে তীব্র কটুবাক্যে তিরস্কার করেন। তাঁর কটুক্তিতে আমি অত্যন্ত অপমানিত হয়েছি। তাই তিনি আমার মিত্র বা সুহৃৎ নন। জানি তিনি তোমার জন্মদাতা, তোমার অতি প্রিয় শ্রদ্ধার জন। তবু তার বা তার প্রতি সমর্থনশীল ব্যক্তিগণের সমীপে গমন তোমার পক্ষে সমুচিত কাজ হবে না। যদি আমার উপদেশ লঙঘন করে সেখানে অভিগমন কর, তা হলে তোমার তো বটেই কারও পক্ষেই সুখকর হবে না।

সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যক্তির যদি কখনও স্বজন দ্বারা অপমানিত হতে হয়, তবে তা মৃত্যুর সমান। কারণ বলে কল্পনা করা যায়।

.

চতুর্থ অধ্যায়
সতীর দেবত্যাগ

মৈত্রেয় বললেন– ভগবান শঙ্কর মনে মনে ভাবলেন, উভয় ক্ষেত্রেই সতীর অঙ্গনাশের সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। পিত্রালয়ে গেলেও অমঙ্গল হবার আশঙ্কা আবার না গেলেও অকল্যাণের সম্ভাবনা। তাই তিনি সতীকে দক্ষালয়ে গমনে অনুমতি দিলেন না, বারণও করলেন না। উপরোক্ত উপদেশাবলী দিয়েই ক্ষান্ত হলেন।

এদিকে সতীও অস্থির হয়ে পড়লেন। এদিকে বন্ধু ও পিতা মাতার সন্দর্শনে যাবার বাসনায় ঘর থেকে বাইরে যান, আবার ভবের ভয়ে পুনরায় ঘরে প্রবেশ করেন। তাঁরও চিত্ত দুভাবে বিক্ষুব্ধ হল। বন্ধুবর্গের সঙ্গে মিলন বাসনা চরিতার্থ হল না দেখে অতি দুর্মনা ও ক্রন্দনশীল হয়ে উঠলেন তারপর অতুল্য পুরুষ ভগবান ভবকে যেন নয়নাযাগ্নিতে দগ্ধ করার বাসনায় তাঁর দিকে সক্রোধে কটাক্ষপাত করলেন। তখন রাগে উত্তেজনায় তার সমস্ত শরীর কম্পিত হচ্ছিল। সাধারণ রমণীর ন্যায় হিতাহিত বিবেচনারহিত হয়ে শোক ও ক্রোধে আকুল হলেন তিনি। তারপরে ক্রমাগত দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করে পিতৃগৃহের অভিমুখে গমনোদ্যত হলেন।

সতী একাকী দ্রুত পদক্ষেপে গমন করতে উদ্যত হলেন। তখন পার্ষদ ও যজ্ঞগণের সহিত সহস্রাধিক রুদ্রের অনুচরগণ তৎক্ষণাৎ শিবজায়া সঙ্গে নিয়ে তাঁর পশ্চাৎগমন করলেন। রুদ্রানুরদের মধ্যে মণিমান এবং মদ প্রভৃতিও ছিলেন।

তারা সতীকে ঐ বৃষরাজের পৃষ্ঠে আরোহণ করালেন। তাকে উপযুক্ত সজ্জায় সজ্জিত করলেন। সারিকা, কন্দুক, দর্শন, পদ্ম, প্রভৃতি ক্রীড়া উপকরণ এবং শ্বেতছত্র, ব্যজন, মালা প্রভৃতি রাজোচিত বিভূতি সতীকে তারা প্রদান করলেন। তাছাড়া সঙ্গীতের নানাবিধ উপকরণ, শঙ্খ, দুন্দুভি, বাঁশি প্রভৃতিও তাঁর শোভা বৃদ্ধি করল। রুদ্র অনুচরেরা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সতীর দক্ষালয়ে গমন করতে লাগলেন।

তারপর সতী এসে উপস্থিত হলেন পিতার আলয়ে। তার মনে ক্ষোভ প্রশমিত হয়ে শুধু অপার তৃপ্তি, প্রগাঢ় আনন্দ। তিনি যজ্ঞস্থানে এসে উপস্থিত হলেন। সেখানে তিনি দেবতা ও ব্রহ্মর্ষিদের স্থানে স্থানে উপবিষ্ট দেখতে পেলেন। বেদ পাঠের মন্ত্রধ্বনির সঙ্গে যজ্ঞের পশুবধের কোলাহল মিশ্রিত হয়ে যাচ্ছিল। সেই স্থানে মাটি, কাঁচ, লোহা, সোনা ও চর্মের বিভিন্ন ধরনের ও বিভিন্ন আকৃতির পাত্র সজ্জিত ছিল। এগুলির মধ্যে যজ্ঞের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখা হয়েছিল। দক্ষ সতীকে যেন দেখেও দেখতে পেলেন না।

তিনি সতীকে কোনরকম আদর-আপ্যায়ন না করায় যজ্ঞস্থলে উপস্থিত অন্য কোনও ব্যক্তিই সতীর সমাদর করল না। কিন্তু তার জননী ও ভগিনীরা সতীকে দেখে অতি আনন্দিত হলেন। তাঁকে বক্ষলগ্ন করে আনন্দাশ্রুতে স্নান করিয়ে দিলেন। আবেগে তাঁদের কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল। কিন্তু সতীর হৃদয়ে ঘোর অসন্তোষ জাগ্রত হল। পিতা অবজ্ঞা করায় যে অপমান তার হল তা তিনি কিছুতেই বিস্মৃত হলেন না। সেই জ্বালার ক্ষতে মাতৃস্নেহ ও ভগ্নিপ্রেম প্রলেপ লাগাতে ব্যর্থ হল। মাতা ও মাতৃস্বসাদের প্রদত্ত অলংকারাদি তিনি প্রত্যাখান করলেন।

সতী বুঝতে পারলেন তাঁর পিতার আয়োজিত এই যজ্ঞে রুদ্রের কোনও স্থান নেই। মহাদেবকে এখানে আহ্বান না করে দক্ষ তাকে চূড়ান্ত অবজ্ঞা করেছেন। সতীও এখানে অনাদৃতা। এরূপ মনে করায় তাঁর কর্ণে মাতা ও ভগ্নীগণের কুশল প্রশ্নাদি ও প্রেমপূর্ণ বাক্য কিছুই প্রবেশ করল না। ক্রোধ যেন তাঁর সর্বশরীর দগ্ধ করতে লাগল। মনে হল তিনি যেন এই বিশ্ব সংসার নিমেষে ভস্ম করে ফেলবেন। তাঁর সেই তেজ থেকে আবির্ভূত ভতাদিকে নিয়ন্ত্রণ করে সতী রোষপূর্ণ স্থলিত বাক্যে অতিথি অভ্যাগতদের সামনেই পিতা দক্ষের নিন্দা করতে শুরু করলেন। দক্ষ ছিলেন কর্ম মার্গে বহুধা পরিশ্রমী, দর্পিত ও শিব বিদ্বেষী।

সতী বলতে থাকেন– পিতা, ইহলোকে শিব অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ অন্য কিছুই নেই। তাঁর প্রিয় বা অপ্রিয় বলেও কিছু নেই, তিনি আত্মাদির কারণ স্বরূপ। দেহধারীগণের অত্যন্ত প্রিয় হল এই আত্মা। তিনি মুক্ত এবং কারও প্রতি তিনি শত্রুতাভাবাপন্ন নন। অজাতশত্রু সেই ভগবান মহাদেবের প্রতি আপনি ব্যতীত আর কোনও ব্যক্তিই প্রতিকূল আচরণ করতে অক্ষম।

হে দ্বিজ, আপনার মতো কোনও কোনও ব্যক্তি অপরের চরিত্রে কেবল দোষ অনুসন্ধান করেন। তারা অসাধু কর্ম করেন না। তারা অন্যের যৎসামান্য গুণকেও সবিস্তারে কীর্তন করেন এবং স্বীকার করেন। আপনি তাদৃশ সর্বোত্তম ভবেরও দোষ অনুসন্ধান করেছেন।

একথা ঠিক, যারা এই জড়দেহকেই সারবস্তু বলে মনে করে তাদের পক্ষে ঈর্ষা পরায়ণ হওয়া কিছু আশ্চর্য নয়। দেহাত্মাভিমানী দুজন পুরুষের পক্ষে মহৎজনের নিন্দা কখনই আশ্চর্যের তো নয়ই। বরং তাদের পক্ষে অতি স্বাভাবিক কর্তব্য। কারণ সাধু ব্যক্তিরা নিজ নিন্দা সহ্য করলেও তাদের পাদরেণু তা সহ্য করে না।

নিজে অমঙ্গলস্বরূপ হয়ে আপনি কিনা তার প্রতি বিদ্রোহী হতে চাইছেন? আপনারা বোধ হয় শিব নামে সেই অশিব দেবের তত্ত্ব সম্পর্কেও অজ্ঞাত। যে শিব জটাধারণ পূর্বক, ভস্ম মেখে শ্মশানে-ঘাটে বিচরণ করেন, শিবের সেই চরণ–বিগলিত নির্মাল্য মাথায় ধারণ করে নিজেদের ধন্য মনে করেন ব্রহ্মাদি দেবগণ।

কোন ব্যক্তির যদি বিশেষ ক্ষমতা না থাকে, তাহলে স্বামীনিন্দা না শুনে সে স্থান থেকে প্রস্থান করা কর্তব্য। যদি সামর্থ্য থাকে তবে নিন্দাকারীর জিহ্বা বলপ্রয়োগ দ্বারা ছেদন করে আপনার প্রাণ বিসর্জন দেওয়া শ্রেয়। আপনি আমার পিতা, আমার স্বামী শিবের নিন্দাকারী। মোহবশতঃ কোনও নিষিদ্ধ দ্রব্য ভক্ষণের একমাত্র প্রায়শ্চিত্ত তা বমন করে দেওয়া, আপনার থেকে উৎপন্ন এই দেহ আমি ধারণ করব না। আমি প্রাণ বিসর্জন দেব।

যিনি আত্মাতেই রমমাণ ও সম্যকভাবে বিরক্ত, তার বুদ্ধি কখনও বেদ-প্রবর্তিত বিধিনিষেধের অনুগামী হয় না। দেব ও মনুষ্য উভয়ের গতি পৃথক। দেবতাদের আকাশে গতি মনুষ্য কুলের গতি পৃথিবীতে প্রবৃত্তি মার্গ বা নিবৃত্তি মার্গ যে দিকেই হোক না কেন, ভিন্ন ধর্মাস্থিত ব্যাক্তির কখনই অন্য ধর্ম ও ধর্মাশ্রিত পুরুষের নিন্দা সমীচিন নয়। বিশেষ বিবেচনাপূর্বক বেদে এই দুই প্রকার কর্মের বিধান দেওয়া আছে। প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি দুই–ই সত্য। কিন্তু ঐ দুই কর্ম একই সময়ে। একই কর্তাতে প্রযুক্ত হলে তাকে নিষ্কর্ম বলা হয়। পরম ব্রহ্মস্বরূপ ভগবান শঙ্করের তাই কোনো কর্মী উপস্থিত হয় না।

হে পিতা, আপনি মহাদেবের যে দোষগুলি উল্লেখ করেছেন যথা– চিতা ভস্মমর্দিত অঙ্গ, নগ্নতা প্রভৃতি কিন্তু তাঁর ভোগসম্পত্তির অভাব কি করে বললেন? আমাদের যে অনিমাদি ঐশ্বর্য আছে তা আপনি কখনও চোখেও দেখেন নি। আপনাদের যাবতীয় ঐশ্বর্য তো কেবল যজ্ঞশালাতে অবস্থিত। যজ্ঞের অন্নে যাদের পরিতুষ্ঠি হয়, কর্মকাণ্ড পথ আশ্রিত পুরুষেরা তা ভক্ষণ করে থাকে।

আমাদের ঐশ্বর্যাদি সে রূপ নয়, ইচ্ছামাত্র তা অব্যক্ত ব্রহ্মজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ তার সেবা করে যাবেন। আপনি ভগবান মহাদেবের প্রতি বিদ্বেষ মনোভাবাপন্ন। তাই আপনার থেকে জন্ম হয়েছে বলে আমার অতিশয় লজ্জা বোধ। যে ব্যক্তি মহতের অভিপ্রায়কারী নয়, তাকে জন্মদাতা পিতা হিসাবে ভাবতে আমার মনের ধিক্কার জন্মাচ্ছে।

ভগবান মহাদেব যখন পরিহাসছলে আমাকে দাক্ষায়ণী নামে সম্বোধন করেন। আপনার সঙ্গে সম্বন্ধবাচক নাম শুনে আমার যাবতীয় হাস্য অন্তর্হিত হয়। মনে মনে অত্যন্ত দুঃখিত বোধ করি। সে কারণে আপনার অঙ্গজ এই দেহ আমি এখনই পরিত্যাগ করব।

মৈত্রেয় বললেন– হে বিদুর, যজ্ঞস্থলে পিতার উদ্দেশ্যে এরূপ ক্ষোভ ও নিন্দাবাক্য বলে সতী মৌনী হয়ে উত্তরমুখে ভূমিতে উপবেশন করলেন। তারপরে পীতবস্ত্রে নিজ দেহ আবৃত করে আচমণ করলেন। তারপর নয়ন মুদ্রিত করে যোগপথ অবলম্বন করলেন। অনিন্দনীয় চরিত্রের অধিকারীনী সতী সুস্থিত হয়ে ঊর্ধ্বাঙ্গে বৃত্তি যুক্ত প্রাণ ও আপন বায়ুকে নাভিচক্রে সমান বা একরূপ করলেন। তারপর সেই নাভিচক্র থেকে উদান বায়ুকে উত্তোলন করে বুদ্ধির সঙ্গে হৃদয়ে, অনাহত চক্রে স্থাপন করলেন।

এবার হৃদয়স্থ সেই বায়ুকে কণ্ঠনালী দ্বারা ক্রমশ ভুযুগলের মধ্যে নিয়ে এলেন। মনস্বিনী সতী নিজ পিতার প্রতি অভিমানে ও ক্রোধে সর্বাঙ্গে বায়ু ও অগ্নির প্রাদুর্ভাব করতে লাগলেন। তারপর তিনি নিজ পতি জগৎগুরু মহাদেবের চরণপদ্মের মকরন্দ চিন্তা করতে লাগলেন। তখন ভজনানন্দ অনুভূত হওয়ায় তার দেহ থেকে সমস্ত কলুষ দূরীভূত হল। দক্ষকন্যা বলে তার মনে যে অভিমান রূপ কলুষ ছিল তা বিনাশিত হয়ে সমাধি সমুৎপন্ন বহ্নিতে প্রজ্জলিত হল। মহৎ দেবাদিগণের ও পরম পুজণীয় মহাদেবের অতি আদরিণী, সতী, নিজ দেহত্যাগ করলেন।

বৎস বিদুর– এইরূপ অভাবিত এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা দর্শনে আকাশে ও ভূ-তলে হাহাকার রব উঠল। সকলে বিষণ্ণ হয়ে পড়ল। হায় হায়! সর্বদেব শ্রেষ্ঠ শিবের প্রিয়তমা সতীকে আজ পিতা দক্ষ কর্তৃক প্রকোপিত হয়ে প্রাণত্যাগ করতে হল। হায় রে মহাদেবের ক্রোড় আজ একেবার শূন্য। বিশ্বচরাচরের পিতা দক্ষের দুর্বিনীত আচরণ দেখ। মনস্বিনী সতী তো তারই কন্যা। সর্বদা, সর্বত্র তিনি সমাদরণীয়া, তিনি কিনা নিজ পিতৃগৃহে পিতা দক্ষ কর্তৃক অপমানিত হয়ে প্রাণত্যাগ করেছেন।

এই দক্ষ অতি কঠিন প্রাণ। সে শিব বিদ্বেষী, ব্রহ্মদ্রোহী, এ ব্যক্তি জগতে অসকীর্তি ও পরলোকে নরকগামী হবে। তারই অপরাধে নিজকন্যা সতীকে প্রাণদানে উদ্যত দেখেও তিনি একবারের জন্যও তাকে নিবারণ করার চেষ্টা করলেন না।

সতীকে এভাবে প্রাণত্যাগ করতে দেখে উপস্থিত সকল লোক ‘হায় হায়’ করতে থাকেন। তখন সতীর পার্ষদেরা নিজ নিজ আয়ুধ উত্তোলন করে দক্ষকে বিনাশ করতে গেলেন। তাদের প্রবলবেগে ধাবমান দেখে ভীত হল উপস্থিত সকলে।

ভগবান ভৃগু তখন যজ্ঞবিনাশকারীদের বিনাশের উদ্দেশ্যে মন্ত্রাচ্চারণ করে দক্ষিণাগ্নিতে আহুতি দিলেন। ভৃগু ছিলেন অধ্বর্য অর্থাৎ তিনি যৰ্যৰ্বেদজ্ঞ হোতা ছিলেন। তার আহুতি প্রদানের সঙ্গে সঙ্গেই অতি আশ্চর্য ঘটনা গেল। ঋভু নামে যে দেবগণ তপস্যায় সিদ্ধ হয়ে সোেমলোক প্রাপ্ত হয়েছিলেন, তারা হাজারে হাজারে দলবদ্ধ হয়ে উত্থান করলেন।

তারা ব্রহ্মতেজে দীপ্যমান ছিলেন। সেই ব্রহ্মতেজে দীপ্যমান ঋভু দেবগণ যজ্ঞাগ্নি থেকে উত্থিত হয়ে যজ্ঞের জ্বলন্ত কাঠ দিয়ে প্রমথ ও গুহ্যকদের প্রহারে উদ্যত হলেন। তার ফলে প্রথম ও গুহ্যকগণ হতমান হয়ে পলায়নে তৎপর হল। যজ্ঞক্ষেত্রে এক চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হল।

মৈত্রেয় বললেন– হে বিদুর, নারদ মহাদেবের কাছে গিয়ে বর্ণনা করলেন, দক্ষ কর্তৃক অপমানিত হয়ে সতী যজ্ঞভূমিতে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। এও শ্রবণ করলেন যে দক্ষ আয়োজিত যজ্ঞাগ্নি থেকে ঋভু নামক দেবগণ উৎপন্ন হয়ে সতীর পার্ষদ সৈন্যদের বিতাড়ন করেছে।

তৎক্ষণাৎ মহেশ্বরের প্রচণ্ড ক্রোধ জন্মাল। ধূর্জটি প্রচন্ড ক্রুদ্ধ হয়ে নিজের ওষ্ঠদ্বয় দংশন করতে করতে মস্তকের একটি জটা উৎপাটন করলেন। সেই জটা বিদ্যুৎ ও অগ্নিশিখার ন্যায় অত্যন্ত উগ্রভাবে দীপ্তমান হল। প্রায়ন্মেত্ত মহাদেব গাত্রোত্থান করে গম্ভীর শব্দে অট্টাহাস্য করে সেই জটা মাটিতে ফেলে দিলেন।

ভূমিক্ষিপ্ত সেই জটা থেকে মহাকায় দীর্ঘদেহী বীরভদ্রের উৎপত্তি হল। তার দেহ যেন আকাশ স্পর্শ করতে চাইছিল। তার সহস্র বাহু মেঘের মতো কৃষ্ণবর্ণবিশিষ্ট, প্রজ্জলিত ত্রিনয়ন যেন তিনটি প্রখর সূর্য, অতি করাল দন্ত ও মাথায় কেশগুলি অগ্নিশিখার মতো প্রজ্বলিত ছিল। তার গলায় নরকরোটির মালা ও হস্তে নানাবিধ অস্ত্র সজ্জিত ছিল।

বীরভদ্র কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন–প্রভু, আদেশ করুন। তখন ভগবান ভূতনাথ বললেন– ওহে রুদ্রভট, তুমি অতিশয় রণনিপুণ, আমার সৈন্যদের অগ্রণী হয়ে ঐ যজ্ঞের হোতা দক্ষকে বিনাশ কর। তুমি স্বীয় অংশ থেকে উদ্ভূত। ব্রহ্মতেজে দুর্জয় বলে ভীত হয়ো না। মহাক্রোধী ভগবানের আদেশ শিরোধার্য করে, বীরভদ্র দেবাদিদেবকে প্রণতি করে, প্রদক্ষিণ করলেন। তখনি তার মধ্যে অপ্রতিহত বেগের সঞ্চার হলো। তিনি নিজেকে অতীব বলবান ব্যক্তির বল সহ্য করতে সমর্থ অনুভব করলেন।

.

পঞ্চম অধ্যায়
রুদ্রের রুদ্র লীলা

ভগবান রুদ্রের আদেশ অনুসারে তার পার্ষদেরাও সিংহনাদ করতে করতে বীরভদ্রের অনুগামী হল। বীরভদ্র নিজ শূল উত্তোলন করে ভয়ানক গর্জন করলেন। জগতের অন্তসাধক যমেরও অন্তকাল ঘটাতে পারে এই শূল। প্রবল বেগে তিনি যজ্ঞশালার দিকে গমনোদ্যত হলেন। তার চরণের নূপুরের শব্দ অতি ভীষণ শব্দে বেজে উঠল, চলার বেগে উড়ন্ত ধূলরাশিতে দিকসমূহ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেল।

তখন দক্ষ আয়োজিত যজ্ঞসভায় উপবিষ্ট ঋত্বিক, জজমান, দ্বিজ ও দ্বিজপত্নীগণ ও বাকী সভাসদেরা বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে ভাবতে থাকলেন, অকস্মাৎ এই আঁধারের কারণ কী? বুঝতে পারে ধূলারাশিতে সমাচ্ছন্ন হয়েছে উত্তরদিক। এত ধুলির আর্বিভাব হলো কোথা থেকে? এখন তো বায়ু প্রবল বেগে বইছে না। কেউ তো গণকে দ্রুতবেগে চারণ করাচ্ছে না। দস্যুদের আক্রমনেও ভয় এমন নেই কারণ উগ্রদন্ত রাজা প্রাচীনবৰ্হি এখনও জীবিত। তবে কী হলো? তবে কি মহা প্রলয়ের সূচনা হল?

দক্ষের পত্নী প্রসূতি তখন উদ্বেগ সহকারে বলতে থাকেন প্রজাপতি দক্ষ অন্য কন্যাদের সামনে সতীকে অবজ্ঞা করার জন্যই এটা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। অপমান যে শুধুমাত্র সতীকে করা হয়েছে। তাও নয়, ভগবান রুদ্রকেও অপমান করার অপচেষ্টা করা হয়েছে। এই সমস্ত অমঙ্গলজনক ঘটনাবলী সেই পাপেরই ফল। প্রলয় কালে যে রুদ্রের জটাজাল বিকীর্ণ হয়ে তদীয় ত্রিশূলের অগ্রভাগে দিতেন্দ্রগণকে বিদ্ধ করেন। এটা তাকে অবজ্ঞা করার কুফল। সেই তিনি নানাবিধ অস্ত্রভূষিত বাহু বিস্তার করে প্রলয়নাচনে তাণ্ডবলীলায় মত্ত হন।

তাঁর প্রচণ্ড অট্টহাস্যে মেঘগর্জনের মতো দশদিক বিদীর্ণ হয়ে যায়। তিনি অসহ্য তেজের অধিকারী। তার ভ্রুকুটি নিরীক্ষণ সহ্য করা সাধ্যের অতীত কার্য। সহজেই তিনি রোষান্বিত হন। যাঁর বিকট দর্শন নক্ষত্ররাজিকেও বিক্ষিপ্ত করে সেই ভগবান রুদ্রকে কুপিত করলে ব্রহ্মারও নিস্তার নেই। উদ্বেগ আশঙ্কায় বিহ্বল সভাস্থিত জনও এরূপ বাক্য বলতে থাকলেন। একইসঙ্গে আকাশে ও ভূতলে চতুর্দিক থেকে সহস্রাধিক উৎপাত অকল্যাণজনক ঘটতে শুরু করল। তখন অতি স্থিতধী প্রজাপতি দক্ষের হৃদয়ে ভীতির সঞ্চার হলো।

বৎস বিদুর, এরূপ আশংকা ও উদ্বেগপূর্ণ পরিস্থিতিতে খর্বাকৃতি রুদ্রানুচরদের প্রবেশ ঘটাল যজ্ঞস্থলে। নিজ নিজ অস্ত্রধারণ পূর্বক তারা চতুর্দিক থেকে যজ্ঞস্থানটি ঘিরে ফেলল। তার মধ্যে কেউ অতি খর্বাকৃতি কেউ বা পিঙ্গলবর্ণ, কেউ কেউ পীতবর্ণ বিশিষ্ট, আবার কারও উদর এবং মুখ মকরের ন্যায়। তারা এসেই ঘোরতর তাণ্ডব শুরু করল। কেউ এসে যজ্ঞশালার প্রাস্কংশ অর্থাৎ পূর্ব-পশ্চিমে সংস্থাপিত কড়িকাঠ ভেঙে দিল। আবার তাদের মধ্যে কেউ কেউ পশ্চিমে অবস্থিত পত্নীশালা ধ্বংস করল। এখানে যজমান পত্নীদের অবস্থান ছিল। যজ্ঞশালার সমুখস্থ মণ্ডপ একেবারে বিনষ্ট হয়ে গেল।

একে একে মণ্ডপের অগ্রবর্তী হবিধান ও তার উত্তরে অগ্নিপ্রশালা, যজমানগৃহ, পাক ও ভোজনশালা বিধ্বংস হল। যজ্ঞপাত্র গুলি সমস্ত চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে বিনষ্ট হল। রুদ্রানুচরদের কেউ কেউ যজ্ঞাগ্নি নির্বাপিত করল। কেউ বা যজ্ঞকুণ্ডের সীমাসূত্র ছিঁড়ে দিল। কেউ বা যজ্ঞকুণ্ডে মূত্রত্যাগ করে তাকে অপবিত্র করে দিল। অপরাপর কেউ কেউ মুনিদের ওপরে আক্রমণ করল। রমণীদের ওপরেও ভীষণ তর্জন-গর্জন শুরু করল। কেউ পলায়ণরত নিকটস্থ দেবগণকে ধরতে গেল। মনিন ভৃগু মুনিকে বন্দী করলেন। বীরভদ্রের হাতে ধরা পড়লেন দক্ষ, চন্তেশ সূর্যদেবকে বন্দি করলেন, নন্দীশ্বরের হাতে বন্দি হলেন ভগ।

এই চরম তাণ্ডবলীলা চলাকালীন সমস্ত বিষয় দেখে শুনে ঋত্বিকগণ, দেবগণ ও অন্যান্য সভাস্থ জনগণ যেমনভাবে সম্ভব পলায়ন করতে উদ্যত হলেন। রুদ্রানুচরণ তাদের উদ্দেশ্য প্রস্তরখণ্ড নিক্ষেপ করছিল। পূর্বে-প্রজাপতির যজ্ঞসভায় ভৃগু তার শ্মশ্রু দেখিয়ে মহাদেবকে পরিহাস করেছিলেন। তাই তিনি যখন সুব-নামক যজ্ঞপাত্র হাতে ধারণ পূর্বক হোম করেছিলেন। বীরভদ্র তার শ্মশ্রু উৎপাটন করলেন।

এরপরে বীরভদ্র ক্রোধান্বিত হয়ে ভগদেবকে ভূমিতে নিক্ষেপ করে তার চোখ দুটি উৎপাটন করলেন। কারণ দক্ষ যখন পূর্বে শিবকে নিন্দা ও তিরস্কার করেছিলেন তখন তিনি অক্ষিকোণ দিয়ে সংকেত করেছিলেন। তারপরে বীরভদ্র পূষার দন্তসমূহ উৎপাটন করলেন। যে ভাবে বলরাম অনিরুদ্ধের বিবাহের সময়ে কলিঙ্গরাজ দন্তবক্রের দন্তসকল উৎপাটন করেন সেরূপে। কারণ দক্ষ যখন ভগবান শংকরের নিন্দায় রত ছিলেন, তখন এই পূষা অর্থাৎ সূর্যদেব দন্তপ্রদর্শন করে হাস্য করেছিলেন।

সর্বশেষে রুদ্রের অংশোদ্ভুত বীরভদ্র দক্ষের বক্ষঃস্থলে আরোহণপূর্বক তার মস্ত ছেদনে উদ্যত হলেন। তীক্ষ্ণ খড়গ দ্বারা উপর্যুপরি তার মস্তকে আঘাত করতে লাগল। কিন্তু বারংবার আঘাত করে, ও শিরচ্ছেদন সম্ভব হল না।

রুদ্রের অনুচরগণের অগ্রণী বীরভদ্র এবারে বিস্মিত হলেন। নানাবিধ অস্ত্র ও শস্ত্র প্রয়োগ করেও দক্ষের ত্বক বিদীর্ণ হচ্ছে না। এবারে চিন্তারত অবস্থায় ইতস্ততঃ দৃষ্টিপাত করে বীরভদ্র যজ্ঞক্ষেত্রে যেমন পশুবলি দেওয়া হয়, তেমন করে হাড়িকাঠের সাহায্যে যজমান দক্ষের মস্তক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করল।

পশুতুল্য দক্ষ হত্যা দর্শন করে ভূত-প্রেত-পিশাচেরা ‘সাধু-সাধু’ রবে আনন্দ রোল করল। কিন্তু দক্ষের পক্ষপাতিগণ এতে বীরভদ্রের অতিশয় নিন্দা করল। এবারে দক্ষের ছিন্ন মস্তকটি বীরভদ্র দক্ষিণাগ্নিতে হোম করে যজ্ঞশালাকে দগ্ধ করলেন। তারপরে কিছুটা শান্ত হয়ে রুদ্রানুচরদিগের সঙ্গে কৈলাস পর্বতাভিমুখে গমন করলেন।

মৈত্রেয় বললেন– হে বিদুর, রুদ্রানুচরবর্গ দেবতাদের পরাস্ত করে শূল, পট্টিশ, নিস্ক্রিংশ গদা, পরিখ ও মুদগর দ্বারা তাদের সর্বাঙ্গে আঘাত করে ক্ষত বিক্ষত করে দিল। তখন দেবগণ ভীত সন্ত্রস্ত্র হয়ে ঋত্বিক ও সদস্যদের সঙ্গে ব্রহ্মার নিকট গমন করলেন। তাকে সসম্মানে প্রণিপাত করে তারা দক্ষ যজ্ঞের সবিস্তার বিবরণ দিলেন। দক্ষযজ্ঞের এই পরিণতি সম্পর্কে পূর্বেই অবহিত ছিলেন ভগবান পদ্মযোনি ও বিশ্বাত্মা নারায়ণ। তারা একারণে দক্ষ আয়োজিত যজ্ঞে গমন করেন নি। দেবগণের কাছ থেকে সমস্ত বিষয় শ্রুত হলেন ব্রহ্মা।

তিনি বললেন– যাঁর প্রতি অপরাধ করা হয়, সেই ব্যক্তি যদি অতি তেজস্বী হন তবে অপরাধকারীর বাঁচবার আশা প্রায়শই কল্যাণজনক হয় না। ভগবান মহাদেব যজ্ঞের অংশভাগের অধিকারী। তাঁকে বঞ্চনা করে প্রভূত অপরাধ সাধিত হয়েছে। তোমরা যেহেতু অপরাধী, তাই বিশুদ্ধ হৃদয়ে আশুতোষের পাদপদ্মে স্মরণ নিয়ে তাকে তুষ্ট কর।

যিনি ক্রুদ্ধ হলে লোকপালগণের সঙ্গে সকল লোকের বিনাশ হয়, তার হৃদয় দক্ষের কটুক্তিতে বিদ্ধ হয়েছে। তদুপরি, সম্প্রতি তাঁর প্রিয়তমা পত্নীর প্রাণবিয়োগ ঘটেছে। এমত পরিস্থিতিতে অতি শীঘ্র তোমার যজ্ঞের পুনরুদ্ধার কামনা কর। সত্ত্বর তার নিকটে গিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা কর। আমি (ব্রহ্মা), যজ্ঞরূপী ইন্দ্র, তোমরা সকল দেবগণ, মুনিগণ ও অন্যান্য দেহধারী জীব কেউ তাঁর তত্ত্ব ও বল বিক্রমের পরিসীমা জানি না। এ অবস্থায় সেই স্বতন্ত্র ভগবান ভবের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা ব্যাতীত অন্য কোনও উপায়ে প্রতিবিধান আশা করতে পারি না।

.

ষষ্ঠ অধ্যায়
ব্রহ্মার কৈলাসে আগমন

ব্রহ্মা দেবগণকে এরূপ আদেশ দিলেন। তারপরে তিনি পিতৃ ও প্রজাপতিগণকে সঙ্গে নিয়ে স্বীয় বাসস্থান পরিত্যাগ করে ত্রিপুরারি মহাদেবের অতিপ্রিয় বাসভূমি গিরিশ্রেষ্ঠ কৈলাসে গমন করলেন। এই কৈলাস পর্বত ওষধি, তপস্যা, মন্ত্র ও যাগাদি বিষয়ে সিদ্ধ দেবগণের নিত্য আবাসভূমি। ঐ স্থানকে সর্বদা কিন্নর, গন্ধর্ব ও যোগাদি অপ্সরাগণ পরিবৃত করে রাখেন। ঐ পর্বতের শৃঙ্গ নানাবিধ মণিমাণিক্যে পরিপূর্ণ।

নানাবিধ ধাতুতে চিত্রিত ঐ পর্বতে নানান বৃক্ষ, লতা, গুল্ম, মৃগ সকল শোভিত ছিল। ঐ পর্বতে বহুপ্রকার নির্মল প্রস্রবণ, বিবিধ গুহাকন্দর ও স্থান থাকার কারণে পতি সঙ্গে বিহার পরায়ণ সিদ্ধ পত্নীগণের কাছে অত্যন্ত রমণীয় ও রতিপ্রদ ছিল। সেখানকার পরিবেশ ময়ুরগণের কেকারবে, মধুমত্ত ভ্রমরের গুঞ্জনে, কোকিলের কুহুস্বরে ও অন্যান্য পক্ষীকুলের কাকলিতে মুখরিত ছিল।

সেই কৈলাস পর্বতে বহুসংখ্যক কল্পবৃক্ষ অবস্থান করায় তাদের শাখা-প্রশাখায় আন্দোলন যেন পর্বত হস্তচালনা করছে বলে প্রতীয়মান হত। পর্বতেই বুঝি সঞ্চারণশীল ঝরণার ছলছল কলধ্বনিতে মনে হত পর্বতই বুঝি কথা বলছে। পারিজাত, মন্দার, সরল, তমাল, মশাল, তাল, রক্ত কাঞ্চন, জীবক, অর্জুন প্রভৃতি বৃক্ষরাজিতে ঐ পর্বত অত্যন্ত সুশোভিত ছিল। এ ছাড়াও আ, কদম্ব, নাগ, নীপ, পুন্নাগ, চম্পক, পল, অশোক, বাবুল, কুন্দ, কুরুবক, স্বর্ণবর্ণশতপত্র, করবী, রেণুকে, যাঁতি কুজ্বক, মল্লিকা, মাধবী প্রভৃতি বৃক্ষ ও লতায় ঐ পর্বতের সৌন্দর্য বৃদ্ধি হয়েছিল।

পনস (কাঁঠাল), ডুমুর, অশ্বত্থ, প্ল, হিঙ্গু, ভুর্জ, মজার, আমড়া ইত্যাদিতে ঐ পর্বত শোভিত ছিল। বিবিধ ওষধি বৃক্ষ, পূগ, রাজপৃগ, জম্বু, পিয়াল, মটুক, উজুদ, রেণু ও বীচক বৃক্ষ ঐ কৈলাসে বিরাজিত ছিল।

সরোবরস্থিত কুমুদ, উৎপল, কর, শতপত্রাদির সমারোহে সেখানে পাখীদের কলকাকলিতে মধুময় আবহধ্বনি সৃষ্টি হত। সেখানে মৃগ, ক্রোড় শুকর, সিংহ, হস্তী, ভল্লুক, শালক, বন্যগরু, রুরু, মৃগ, শরভ, ব্যাঘ্র, মহিষ, একপদ অশ্ব, নেকড়ে, কস্তুরী মৃগ, কর্নোন অর্থাৎ মনুষ্যাকৃতি বিশিষ্ট মৃগসকল বিচরণ করত। বৃক্ষশাখায় বানরকুলের বসবাস ছিল। কদলীবৃক্ষ দ্বারা সরোবরতীরস্থ ভূমি আবৃত ছিল।

নন্দা নামক নদী ঐ পর্বতের চতুর্দিক বেষ্টন করে প্রবাহিত ছিল। সতীর স্নানপুণ্যে তা অতি পবিত্র ছিল। ভগবান মহাদেবের ঐ মনোহর বাসস্থান কৈলাসগিরি দর্শন করে দেবগণ বিস্ময়ে হতবাক হলেন। ঐ পর্বতের উপরিস্থিত অলকাপুরী ও সৌগন্ধিক বনের দর্শন পেলেন।

ঐ অলকাপুরীর বহির্দিকে নন্দা ও অলকানন্দা নামে দুটি নদী বহমান। তার তীর্থপাদ ভগবান শ্রীহরির পাদপদ্মরেণু দ্বারা অতি পবিত্র। বিদুর, দেব কন্যারা স্বীয় স্থান থেকে অবতরণ করে ঐ দুটি নদীতে অবগাহন করেন এবং কান্তগণের অঙ্গ জল সিঞ্চন করে প্রমোদক্রীড়ায় মেতে ওঠেন। দেবরমণীগণের স্নানের সময় তাঁদের গাত্রভ্রষ্ট নবকঙ্কুযেমের কারণে ঐ নদীর জল পীতাভ মধুর বর্ণ ধারণ করে।

হস্তিগণ হস্তিনীদের ঐ জল পান করানোর সময়ে নিজেরা পিপাসার্তক না হলেও ঐ জলপান করে। সৌগন্ধিক নামক বনানীতে সৌগন্ধিক নামে একটি বিশেষ পদ্ম প্রস্ফুটিত থাকে।

দেবতাগণ রৌপ্য, স্বর্ণ ও মহারত্নখচিত শতাধিক বিমানে এবং বিদ্যুৎ ও মেঘমুক্ত আকাশের ন্যায়। যক্ষ রমনীগণে পরিবৃত যক্ষপুরী অতিক্রম করে সৌগন্ধিক বন দর্শন করলেন। ঐ বনে কামদুধ বৃক্ষসমূহে নানাবিধ পুষ্প ফল ও পত্রাদি শোভিত ছিল। সেখানে ভ্রমরের গুঞ্জন ও কোকিলের মধুর ধ্বনিতে বাতাস ভারী হয়েছিল। ঐ বনের জলাশয় সমূহে যে পদ্ম প্রস্ফুটিত থাকত তা রাজহংসগণের অতি প্রিয়। ঐ বনস্থিত চন্দন বৃক্ষ সমূহে হস্তী-হস্তিনীগণ গাত্র মার্জনা করায় অপূর্ব দ্রুম নির্গত হয়। তার সৌরভে সেখানে উপবিষ্ট যক্ষ রমণীদেরও মন-প্রাণ বারে বারে উন্মমিত হয়।

সেখানকার বাদীগণের সোপান শ্রেণী বৈদুর্যমণি দ্বারা বিরচিত ও তাতে পদ্মের মাল্য বিরাজিত। বিপুরুষগণ সেখানে বিলাসের নিমিত্ত অধিষ্ঠান করতেন। এরপরে দেবতাসকল একটি বিশাল বটবৃক্ষের দর্শন পেলেন। সেটির শত যোজন উচ্চতা, পঞ্চসপ্ততি যোজন বিস্তৃত শাখাসমূহ দ্বারা বিস্তৃত ছায়া দেখে দেবগণ বিস্মিত হলেন।

আশ্চর্যের বিষয় এই বৃক্ষে কোন পক্ষী ছিল না, এটি সর্বপ্রকার তাপশূন্য ছিল। দেবগণ সেখানে তার নিকট গমন করলেন। বিশাল সেই বটবৃক্ষের নিকট উপস্থিত হয়ে তারা দেখলেন সেই তরুমূলে স্বয়ং ভগবান ভব অধ্যাসীন। মহাযোগী মহাদেবের ক্রোধ তখন শান্ত হয়ে এসেছিল, এতে দেবগণের বোধ হল যেন সাক্ষাৎ বৃত্তান্ত ক্রোধ ত্যাগ করে মুমূর্ষজনের আশ্রয়রূপে সেখানে উপস্থিত আছেন। সে সময় অতি প্রশান্ত মূর্তিতে শিব অধিষ্ঠিত ছিলেন। সনন্দন প্রভৃতি মহাসিদ্ধ ঋষিবৃন্দ ও যক্ষ অধিপতি কুবের তার সেবায় রত ছিলেন। উৎপত্তি স্থিত ও সংহার কর্তা, জগতের অধীশ্বর মহাদেব তখন উপাসনা, তপস্যা ও সমাধি আশ্রয় করে উপবেশন করেছিলেন। শংকর নিজে সমগ্র বিশ্বের সুহৃদ বলে স্নেহবশতঃ জগত কল্যাণার্থে তপস্যায় রত ছিলেন। সান্ধ্য মেঘের ন্যায় রক্তাভ গৌরবর্ণ দেহে ভস্ম, অজিন, জটা, দণ্ড, প্রভৃতি তপস্বীজনের অভিলাষ পূর্ণ চিহ্নাদি ও কপালে চন্দ্রলেখা অঙ্কিত ছিল।

তিনি যোগীগণের উপযুক্ত কুশাসনে উপবেশন করে ছিলেন। তাঁর সম্মুখে সনন্দনাদি সাধুজন উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের সম্মুখে তিনি জিজ্ঞাসু নারদকে সনাতন ব্রহ্ম বা বেদ বিষয়ে উপদেশ প্রদান করেছিলেন।

বাম চরণপদ্ম ডান উরুতে ও বাম বাহু বাম জানুতে স্থাপন পূর্বক অবস্থান করেছিলেন। ডান বাহুর মণিবন্ধে, অক্ষমাল্য ধারণপূর্বক তর্জনী ও অঙ্গুষ্ঠার অগ্রভাগদ্বয় সংযোজিত ছিল। অপর তিনটি আঙ্গুলি প্রসারণ করে তর্কমুদ্রা বিশিষ্ট হয়ে তিনি বীরাসনে অবস্থান করেছিলেন। ব্রহ্মানন্দে সমাধিস্থ ছিলেন অর্থাৎ একগ্রতা অবলম্বন করেছিলেন। তখন লোকপালগণের সঙ্গে মুনিগণ সেখানে গিয়ে ভগবান ভবনে কৃতাঞ্জলি পুটে প্রণিপাত করলেন।

দেব ও অসুরগণ যাঁর চরণ বন্দনা করেন সেই মহাদেব ব্রহ্মার আগমন বুঝতে পেরে আসন থেকে উত্থিত হলেন। ভগবান বিষ্ণু বামনরূপে যেমন প্রজাপতি কশ্যপকে অভিবাদন জানিয়েছিলেন। শংকর তেমনি মস্তক নত ব্রহ্মাকে প্রণাম করলেন। মহর্ষিদের সঙ্গে নারদ ও সিদ্ধ ঋষিগণ ও ব্রহ্মাকে প্রণাম করলেন। এইভাবে অভিবন্দিত হয়ে সহাস্যবদনে ব্রহ্মা প্রণত মহাদেবকে কিছু বলতে উদ্যত হলেন।

ব্রহ্মা বললেন– হে ভব, আপনি যদিও আমাকে নমস্কার জানাচ্ছেন, তবু আমি জানি আপনিই এ বিশ্বের নিয়ামক। এ জগতের যোনি ও বীজ। যে প্রকৃতি পুরুষ তাকে শিব ও শক্তি বলে। ঐ দুইয়ের কারণ যে নির্বিকার ব্রহ্ম তা আপনারই স্বরূপ।

হে ভগবান্ আপনিই ঊর্ণনাভির ন্যায় অবিভক্ত শিব ও শক্তিতে ক্রীড়াশীল হয়ে এই ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি, স্থিতি, ও প্রলয়ের রূপ দর্শন করাচ্ছেন। ধর্ম ও তার্থপ্রদ বৈদিক কর্মপদ্ধতি প্রবর্তনের জন্য আপনি নিজেই দক্ষকে সূত্র করে অবতারণা করেছিলেন। ইহলোকে ব্রাহ্মণগণ ব্রত ধারণপূর্বক শ্রদ্ধার সঙ্গে যে সব ধর্মাচরণ করে, আপনি স্বয়ং সেই বর্ণাশ্রম-ধর্ম-মর্যাদা নির্ধারণ করছেন।

হে মঙ্গলময়, আপনি শুভ কর্মফলযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য স্বর্গ অথবা মোক্ষের সন্ধান দেন কিন্তু অশুভ কর্মফল যুক্ত ব্যক্তিদের ঘোর নরকে নিক্ষিপ্ত করেন। কিন্তু দেব কোনও কোনও ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই নিয়মের ব্যত্যয় হয় কেন?

যে সকল ব্যক্তি আপনার শ্রীচরণে নিজেকে সমর্পণ করে সর্বভূতে নিজেকে উপলব্ধি করে তাদের প্রতি কখনই আপনার রোষ জন্মায় না। যারা ভেদদশী নয়, অভেদরূপে আপনাকে সকল প্রাণীতে উপলব্ধি করে, তাদের কখনই দক্ষের মতো পশুতুল্য অন্তদশায় পতিত হতে হয়না। যে সকল ব্যক্তিবর্গ ভেদদশী আশায় দুষ্ট, শুধুমাত্র কর্মে যারা আসক্ত, অপরের উন্নতিতে যাদের হৃদয়ে দুঃখবোধ হয়। বাক্য দ্বারা যারা অপরের মর্ম পীড়ার কারণ হয়। দেব তাদেরই দণ্ডবিধান করে। আপনার মতো সাধু ব্যক্তির তাদের বধ করা সমুচিত বলে মনে করেন না।

যে সকল মনুষ্যগণ ভগবান পদ্মনাভের দুরতায় মায়ায় বিমোহিত হন, সাধুগণ তাদের প্রতি অনুকম্পা প্রদর্শন করেন। কোনো দেশে কোনো কালে ভেদ বুদ্ধি সম্পন্নতার কারণে যদি তারা সাধুদের প্রতি ভুলক্রমে অপরাধ্য সম্পন্ন করে পরদুঃখ সহিষ্ণুতার গুণে মহৎ ব্যক্তিবর্গ তাতে অনুকম্পা প্রকাশ করেন। দৈববশে সংঘটিত বিষয়ে নিজ পরাক্রম প্রকাশ করেন না।

হে প্রভু, আপনি পরম পুরুষ ভগবানের অচিন্ত্য প্রভাবশালী মায়ায় বিমোহিত হন । আপনি তো সর্বজ্ঞ। তাই যারা ঈশ্বরের মায়ায় প্রভাবিত হয়ে জড়কর্মেই আসক্ত। তাদের প্রতি তো আপনার অনুগ্রহ করাই সমুচিত কার্য।

হে প্রভু। আপনি যজ্ঞের ফলদাতা ও যজ্ঞভাগ ভোগী। কুৎসিৎ যাজ্ঞিকেরা আপনাকে যজ্ঞের প্রাপ্যভাগ থেকে বঞ্চিত করায় দক্ষের যজ্ঞ স্বাভাবিক ভাবেই বিনষ্ট হয়ে অসামপ্ত আছে। কৃপাপূর্বক আপনি সেই যজ্ঞ উদ্ধার করুন। ভগদেবের উৎপাটিত চক্ষুদ্বয় পুনরায় দান করুন, পূষার দণ্ড আবার উৎপন্ন হোক।

হে রুদ্র, আপনার অনুচরদের দ্বারা নিক্ষেপিত অজস্র প্রস্তরখণ্ডের আঘাতে ভগ্নদেহী দেব ও পুরোহিতগণ শীঘ্র আরোগ্য লাভ করুক।

হে রুদ্র, এই আপনার অংশ রইল। এরপর যজ্ঞের অবশিষ্ট বস্তু সকলই আপনার হবে। হে যজ্ঞনাশক আপনার ভাগ গ্রহণ করে যজ্ঞকার্য সমাধা করুন।

মৈত্রেয় বললেন– হে মহাবাহু বিদুর, ব্রহ্মার এরূপ অনুনয়ে পরিতুষ্ট হলেন ভগবান ভব, তার প্রসন্ন বদনে স্মিত হাসির রেখা পরিস্ফুট হল। তিনি বললেন– হে প্রজেশ, আমি দেব মায়ায় বিমোহিত মূর্খ বালকদের কোন কর্তব্য বলে মনে করি না। তবে দক্ষ যজ্ঞের শুধুমাত্র ধর্মের মর্যাদা রক্ষার্থে দণ্ডের বিধান করেছি।

প্রজাপতি দক্ষের মস্তক দগ্ধ হয়েছে, তাকে ছাগের মুণ্ড প্রদান করা হোক। ভগদেব মিত্রদেবের . চক্ষুর সাহায্যে নিজ যজ্ঞ অংশ দর্শন করুন। পূষ পিষ্ট ভোজী হোক ও যজমানের দন্তর সাহায্যে ভক্ষণ করতে সক্ষম হোক। যে যে দেবতাগণ আমাকে যজ্ঞের অংশ প্রদান করেছে। তাদের ভগ্ন-অঙ্গাদি পূর্বাবস্থা প্রাপ্ত হোক। যে যে ঋত্বিকগণের অঙ্গ সম্পূর্ণ রূপে বিনষ্ট হয়েছে, তারা অশ্বিনী কুমারদ্বয়ের বাহুর সাহায্যে অঙ্গযুক্ত হোক।

সূর্যের হস্ত দ্বারা তারা হস্তযুক্ত হোক। দূর্গের শ্মশ্রু ভৃগুর শ্মশ্রু হোক।

মৈত্রেয় বললেন– বিদুর, প্রণতজনের অভিষ্টদাতা মহাদেবের এরূপ বচন শ্রবণ করে, সকলে হৃষ্টচিত্তে ‘সাধু সাধু’ বলতে লাগলেন। তারপরে দেব ও ঋষিগণ মহাদেবকে আমন্ত্রণ করে তাঁকে যজ্ঞস্থলে নিয়ে গেলেন। যজ্ঞ সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে ব্রহ্মা ও মহাদেব দক্ষের অসম্পূর্ণ যজ্ঞসভার দিকে অগ্রসর হলেন।

ভগবান ভবের নির্দেশানুসারে সমস্ত কার্য সম্পন্ন করে যজ্ঞীয় ছাগ-পশুর মস্তক দক্ষের মুণ্ডহীন দেহে সংস্থাপন করলেন। তখন ভগবান রুদ্রদেব তার প্রতি দৃষ্টিপাত করামাত্র নিদ্রোথিত ব্যক্তির মতো দক্ষ জেগে উঠলেন। চক্ষু উন্মিলিত করামাত্র তিনি সমুখে মহাদেবকে দর্শন করলেন।

.

সপ্তম অধ্যায়
দক্ষের অনুশোচনা ও ক্ষমা প্রার্থনা

পূর্বে শিবের নিন্দা করায় কুলষিত চিত্ত দক্ষের হৃদয় মহাদেবের কৃপাদৃষ্টিতে এখন নির্মল ও পবিত্র হল। তিনি মহাদেবকে স্তব করতে ইচ্ছুক হলেন। তখনই তার মৃতকন্যা সতী তাঁর মানসপটে উদিত হল। উৎকণ্ঠা ও অনুতাপে তাঁর কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে উঠল। প্রেমবশতঃ তার চিত্ত আকুল হওয়ায় তিনি মহাদেবের স্তব করতে অসমর্থ হলেন। অনেকক্ষণ পরে অতিকষ্টে নিজেকে সুস্থিত করে নিষ্কপট চিত্তে মহাদেবকে স্তব করতে লাগলেন।

দক্ষ বলতে থাকেন– হে ভগবান্ আপনাকে তিরস্কার করা সত্ত্বেও আপনি আমার প্রতি দণ্ডবিধান পূর্বক মহৎ অনুগ্রহ প্রকাশ করেছেন। আপনি ও ভগবান বিষ্ণু তো অধার্মিক ব্রাহ্মণকেও উপেক্ষা করেন না। আমি তো যজ্ঞ প্রভৃতি ব্রতে দীক্ষিত, আপনি আমার মতো ব্যক্তিদের কীভাবে অবজ্ঞা করবেন?

হে প্রভু পরমেশ্বর। আপনি নিজতত্ত্ব রক্ষার্থে ব্ৰহ্মরূপে বিদ্যা, তপস্যা ও ব্রতসম্পন্ন ব্রাহ্মণদের মুখমণ্ডল থেকে সৃষ্টি করছেন। পশুপালকেরা দণ্ড হাতে নিয়ে পশুদের রক্ষা করে। আপনিও তেমনি সর্ববিপদে ব্রাহ্মণদিগকে রক্ষা করে থাকেন।

আমি আপনার তত্ত্ব সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলাম। সেজন্য সভামধ্যে আপনার উদ্দেশ্যে দুর্বাক্যবাণ প্রয়োগ করেছিলাম। আপনার ন্যায় পূজ্যতমের নিন্দা করার কারণে আমার চূড়ান্ত অধঃপতন হয়েছিল। সে কটুক্তি বিস্মৃত হয়ে আপনি আমাকে রক্ষা করলেন। হে ভগবান, নিজগুণে আপনি নিজেই সন্তুষ্ট হোন, আমার কোনো ক্ষমতা নেই।

মৈত্রেয় বললেন– প্রজাপতি দক্ষ এভাবে কামবর্ষী ভগবানের ক্ষমা উৎপাদন করলেন। তারপরে ব্রহ্মার আদেশে উপাধ্যায় ও ঋত্বিকগণের সাহায্যে যজ্ঞের পুনঃপ্রবর্তন করলেন। শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণগণ যজ্ঞের বিস্তার করলেন। রুদ্র পার্ষদেরা প্রমথ প্রভৃতির সঙ্গে সংসর্গজনিত দোষ মুক্তি উদ্দেশ্যে বিষ্ণু সম্বন্ধীয় ত্ৰিকপাল হবির দ্বারা হোম করলেন।

হে বিদুর, যজমান দক্ষ যজ্ঞবেদজ্ঞ পুরোহিতের সাথে যজ্ঞের হবি গ্রহণ পূর্বক শুদ্ধি বুদ্ধি সহযোগে ধ্যান মগ্ন হলেন। তখন ভগবান নারায়ণ সেখানে আবির্ভূত হলেন। তিনি দশদিক উজ্জ্বলকারী স্বীয় তেজ দ্বারা ব্রহ্মাদি দেবগণের তেজ বিনষ্ট করে গরুড়ের স্কন্ধে আরোহণ করে সেখানে আবির্ভূত হলেন। বেদের বর্ণনা অনুযায়ী বৃহদখণ্ডের নামক স্তোত্র দুটিকে গরুড়ের পক্ষ বলে স্বীকার করা হয়। হরির সেই মূর্তির গাত্রবর্ণ শ্যামলা, কটিতটে হিরণ্যতুল্য রশনা বা স্বর্ণ কিঙ্কিনী, মস্তকস্থিত কিরীট সূর্যের মতো অতি উজ্জ্বল কুণ্ডল।

মুখ মণ্ডল ভ্রমরের ন্যায় কৃষ্ণবর্ণ কেশকলাপে পরিব্যাপ্ত। বাহুতে কেয়ুর প্রভৃতি স্বর্ণলঙ্কার সুশোভিত। ধাতুগুলিতে শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম, ধনু, শর, বাণ, মর্গ ও চর্ম শোভিত। তার বক্ষদেশে বিরাজিত লক্ষ্মীদেবী গলায় বনমালা প্রশান্ত হাস্য ও প্রসন্ন দৃষ্টিতে তিনি বিশ্বকে অবলোকন করছিলেন। উভয় পার্শ্বে ভ্রাম্যমান ব্যজন ও চামরের ন্যায় রাজহংস শোভিত ছিল। মস্তকের উপরে পূর্ণচন্দ্র বিরাজিত ছিল। সমগ্ররূপে তিনি অতিশয় সুন্দর শোভা বিস্তার করেছিলেন।

শ্রীহরিকে দর্শন করামাত্র ব্রহ্মা, ইন্দ্র, মহাদেব প্রমুখ দেবগণের প্রভা স্তিমিত, ভয়ে চিত্ত ক্ষুব্ধ হলেও মাথায় হাত তুলে করজোড়ে তার স্তব করেছিলেন।

একথা সত্য যে ব্রহ্মাদি দেবগণের পক্ষে ভগবানের মহিমা অনুধাবন করা অসম্ভব। তবুও তারা স্বীয় বুদ্ধি অনুযায়ী ভক্তদের প্রতি অনুগ্রহ করার জন্য শ্রীহরির প্রকাশিত মূর্তির উদ্দেশ্য স্তব করতে লাগলেন।

প্রথমেই দক্ষ উত্তম পাত্রে, আসন প্রভৃতি পূজার উপকরণ গ্রহণ করে করজোড়ে হৃষ্টচিত্তে তার স্তব করতে লাগলেন। ভগবান বিষ্ণু তখন সুনন্দাদি অনুচরদিগের দ্বারা পরিবৃত ছিলেন। দক্ষ তার উদ্দেশ্য বললেন– হে প্রভু, আপনি নিজ স্বরূপেই অবস্থানরত। শুদ্ধ চৈতন্যঘন সেই স্বরূপে সকল বুদ্ধ্যবস্তাই নিবৃত্ত হয়েছে। আপনি এক অদ্বিতীয় এবং অভয়স্বরূপ। শুদ্ধ চৈতন্যরূপ, আপনি মায়াকে পরাভূত করে স্বীয় মায়ায় তার দ্বারাই আপনি নিজ ইচ্ছানুসারে মনুষ্যভাব ধারণ করেন। এর ফলে আপনি রাগ-দ্বেষাদি বিশিষ্ট যত মায়াতে অবস্থিত বলে প্রতীয়মান হয়ে যাবেন।

ঋত্বিকগণ বললেন– হে নিরঞ্জন, নন্দীশ্বরের অভিসম্পাতে আমাদের বুদ্ধি শুধুমাত্র কর্ম অনুষ্ঠানেই আসক্ত। আপনার প্রকৃত তত্ত্ব সম্পর্কে আমরা অজ্ঞ। কিন্তু ধর্মের জনস্বরূপ ধর্মোপেক্ষা বেদ প্রতিপাদ্য যজ্ঞ নামক মূর্তিটি আমরা অবগত হলাম। যে যজ্ঞসিদ্ধির নিমিত্ত আপনি ইন্দ্রাদি অধিদেবতারূপ বিশেষরূপ আশ্রয় করেছেন।

সদস্যগণ বললেন– হে আশ্রয়পদ, তুমি ভিন্ন এই সংসার পথে কোনো বিশ্রাম যোগ্য স্থান নেই। অবিদ্যা, অস্মিতরাগা দ্বেষ ও অভিনিবেশরূপ পথও ক্লেশকর। দুর্গম স্থানে পরিব্যপ্ত অন্তঃকরণ বিষধর সর্প সর্বদা একে লক্ষ্য করছে। ক্ষুধা, পিপাসা, শীত, উষ্ণতা, সুখ-দুঃখ প্রভৃতি দ্বন্দ্বসমূহ এখানে। শর্তস্বরূপ। খলরূপী ব্যাঘ্রের ভয় এখানে অহরহ বিদ্যমান এবং শোকরূপ দাবানল এখানে নিয়ত প্রজ্বলিত রয়েছে। এই সংসারমার্গ পথে বর্তমান থেকে বিষয়-মরীচিকায় বিভ্রান্ত দেহ ও গৃহরূপ ভারে আক্রান্ত কামদগ্ধ ও জীবগণ আপনার চরণ কমলে আশ্রয় লাভ করতে সক্ষম হবে।

রুদ্রদেব তখন বললেন– হে বরদ, আপনার শ্রীচরণ সকাম জনগণের নিখিল কাঙ্খিত ফলপ্রদানে সমর্থ। নিষ্কাম মুনিবৃন্দ ও পরম আদরে তার অর্চনা করেন। আমার চিত্ত ঐ পাদপদ্মে নিবিষ্ট রয়েছে। এরফলে অজ্ঞ লোকেরা আমাকে আচার ভ্রষ্ট বলে কল্পনা করে তা আমি গন্য করি না, আপনার পরশ অনুগ্রহ করে মনে মনে তুষ্ট থাকি।

মহর্ষি ভৃগু বললেন– আপানার গহন মায়াজালে ব্রহ্মাদি সকল জীবগণই আত্মজ্ঞানে নিজের ও ভগবানের জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হয়ে অজ্ঞানের তিমিরে শায়িত আছেন। আপনি তাঁদের অন্তরে অবস্থান। করলেও তারা আজও আপনার স্বরূপ অনুধাবন করতে পারে নি। আপনি প্রণতজনের আত্মা ও বন্ধু। আমি আপনাকে প্রণাম করছি। আপনি দয়া করে আমার প্রতি প্রসন্ন হোন।

ব্রহ্মা বললেন– সাধারণ লোকসকল পদার্থের ভেদগ্রাহক ইন্দ্রিয়াদি দ্বারা যা যা দর্শন করে তা আপনার প্রকৃত স্বরূপ নয়। আপনি অধিভূত, আধ্যত্ম ও অধিদৈবের আশ্রয় সত্য। তবে মায়াময় অধিভূত প্রভৃতি অসৎ পদার্থ থেকে আপনি ভিন্ন। ইন্দ্র বললেন– হে অচ্যুত, সুরবিদ্বেষী দৈত্যদের বিনাশক উদ্যত আয়ুধ দ্বারা সংযুক্ত আটটি ভূজদন্ডে শোভিত। আপনার এই শ্রীমূর্তি পরম সত্য বিশ্বপালক। মন ও আনন্দের প্রদায়ক এই মূর্তি।

ঋত্বিক পত্নীগণ বললেন– হে পদ্মনাভ! আপনার যজনের পূর্বে ব্রহ্মা এই যজ্ঞের সূচনা করেছিলেন। অদ্য ভগবান পশুপতি দক্ষের প্রতি রোষান্বিত হয়ে সেই যজ্ঞ বিনাশ করেছেন। তাতে যজ্ঞের উৎসব নিবৃত্ত হয়েছে। হে যজ্ঞমূর্তি, সম্প্রতি আপনার কৃপাবলোকন দ্বারা এই যজ্ঞ পবিত্র করুন।

ঋষিগণ বললেন– হে ভগবান, আপনার আচরণ সাধারণের বোধগম্য নয়। আপনি নিজে কর্ম করেও তাতে লিপ্ত হন না। অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ যে সম্পদের নিমিত্ত ঈশ্বরীয় ভজনা করে সেই লক্ষীদেবী আপনার সেবায় সতত নিয়োজিত। তথাপি আপনি তাঁকে আদর করেন না। ভক্তজনের প্রতিই আপনার প্রেম সদা বর্ষিত হয়।

সিদ্ধগণেরা বললেন– হে ভগবান, ক্লেশরূপ দাবাগ্নিতে দগ্ধ ও বিষয় তৃষ্ণায় পীড়িত আমরা। আমাদের এই দুর্দমনীয় মন মাতঙ্গের ন্যায় আপনার কথারূপ বিশুদ্ধ অমৃত সাগরে অবগাহন করে পরব্রহ্মের সাথে ঐক্য প্রাপ্ত হয়ে পরমানন্দ লাভ করে। তার ফলে আমরা সংসারের দুঃখ-ক্লেশাদি আর অনুভব করি না এবং সেখান থেকে নিষ্ক্রান্ত হতেও চাই না।

দক্ষপত্নী প্রসূতি বললেন– হে ইশ, আপনার সুখে আগমন হয়েছে তো? মস্তকহীন কবন্ধ পুরুষ হস্ত-পদাদি অবয়ব যুক্ত হলেও শোভা পায় না। হে অধিশ্বর, তেমনি আপনাকে ছাড়া প্রজাদি অঙ্গযুক্ত হলেও যজ্ঞ শোভা পায় না। হে ঈশ্বর আপনাকে প্রণাম, আপনি আমাদের ওপর প্রসন্ন হোন। হে শ্রীনিবাস, নিজ কান্তা লক্ষীর সাথে আমাদের রক্ষা করুন।

লোকপালগণ বললেন– হে ভূষণ, এই অখিল ভুবনের স্রষ্টা হচ্ছেন আপনি। আপনিই সর্বজীবের সাক্ষীরূপ। আমাদের ইন্দ্রিয়সকল কেবলমাত্র মায়াময় বস্তু দর্শনে সমর্থ, এতদ্বারা প্রত্যাগাত্মা আপনার প্রকৃত স্বরূপ দ্রষ্ট হয় না। পঞ্চভূত থেকে পৃথক ষষ্ঠ স্বরূপে আপনার প্রকাশ আপনার এক মায়ামাত্র।

যোগেশ্বরগণ বললেন– যে ব্যক্তি বিশ্বাত্মা পরম ব্রহ্মস্বরূপ আপনাতে নিজেকে অভেদরূপে দর্শন করে, সে ব্যক্তিই আপনার কৃপার পাত্র। তবুও ভক্তবৎসল মহাপ্রভু যে সকল ব্যক্তি নিজেদের ভৃত্যজ্ঞানে আপনাকে প্রভুজ্ঞানে ভজনা করে আপনি যেন তাদের অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত না করেন এই কামনা করি। হে ভগবান, জগতের উৎপত্তি, স্থিতি ও লয় প্রভৃতি নিমিত্ত আপনার মায়ার গুণ জীবগণের ভাগ্যবশতঃ বহু প্রকার বিভিন্ন রূপে প্রকাশিত হয়। সেই মায়ার গভীর প্রভাবে জীবের ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব প্রভৃতি নানাবিধ ভেদবুদ্ধি হয় আবার কেবলমাত্র স্বরূপে অবস্থান পূর্বক তাদের ভেদবুদ্ধি ও তার কারণাদি নিবর্তিত করেন।

আপনাকে প্রণাম করি। শব্দব্রহ্ম অর্থাৎ বেদ বললেন– আপনি সত্ত্বগুণ স্বীকার করে অবতার দেহ ধারণ করে ধর্ম প্রভৃতি উৎপন্ন করে থাকেন। আবার আপনি নিগুণও বটে। যদিও একই ব্যক্তিতে স্বত্তানত্ত্ব ও নিগুণত্ব অসম্ভব হলেও আপনার ক্ষেত্রে সবই সম্ভব। আমি আপনার তত্ত্ব সম্পর্কে অজ্ঞাত, ব্রহ্মাদি দেবগণও তা সম্পর্কে অজ্ঞ। অগ্নিদেব বললেন– তোমার তেজ দ্বারা আমার তেজ সুষ্টরূপে প্রদীপ্ত হয়ে থাকে। তোমার প্রশান্ত মৃত্যুক্ত হবি দেবগণের উদ্দেশ্যে আমি বহন কুরে থাকি। যজ্ঞপালক যজ্ঞমূর্তি তুমি! তোমাকে নমস্কার। অগ্নিহোত্র, পৌর্ণমাস, চাতুর্মাস্য দর্শ ও পশু– সোম এই পঞ্চবিধ যজ্ঞ তোমার স্বরূপ। এই পাঁচপ্রকার যজ্ঞীয় মন্ত্রে তুমিই সম্যক রূপে পূজিত হয়ে থাক।

দেবগণ বললেন– প্রলয়কালে আপনি কার্যসকল উদরের মধ্যে ধারণ করে জলধিমধ্যে অনন্তশয্যায় শায়িত ছিলেন। তখন জনলোকের অধিবাসী সিদ্ধপুরুষেরা আপনার আধ্যাত্মপদবী হৃদিমধ্যে চিন্তা করে থাকেন। সেই আদিপুরুষ আপনি আমাদের নয়নপথে বিচরণ করে চলেছেন, আমরা সবাই আপনার ভৃত্য, আপনি আমাদের রক্ষাকর্তা।

গন্ধর্ব ও অপ্সরাগণ বললেন– হে দেব, মরীচি প্রভৃতি প্রজাপতিগণ, রুদ্র প্রমুখ ব্রহ্মা ও ইন্দ্রাদি দেবগণ সকলেই আপনার অংশ। হে নাথ, চতুর্দশ ভুবনাত্মক বিশ্ব আপনার ক্রীড়ার সামগ্রী। আপনাকে প্রণাম।

বিদ্যাধরগণ বললেন– পুরুষার্থ সাধনার যোগ্য এই দেহ লাভ করে আপনার মায়াবশত এতে– দেহভিমানী হয়েও আপনার কথারূপ অমৃত পান করে, শুধুমাত্র তার পক্ষেই ঐ মোহ ত্যাগ সম্ভব হয়, অন্য কারও পক্ষে তা সম্ভব নয়। উৎপথগামী পুত্ৰাদি দ্বারা তিরস্কৃত হলেও কোন ব্যক্তির গুরুতর দুঃখ উপস্থিত হওয়া সত্ত্বেও মোহভঙ্গ হয় না। কারণ অনিত্য বিষয়াদিতে তার মন প্রবিষ্ট থাকে।

ব্রাহ্মণগণ বললেন– হে ভগবান, আপনিই যজ্ঞ আপনিই হবি। আপনিই হুতাশন, আপনি মন্ত্র, সমিধ, যজ্ঞপাত্র, সদস্য, ঋত্বিক, যজমান– পত্নী, দেব, অগ্নিহোত্র, স্বহা, সোমরস, ঘৃত ও যজ্ঞীয় পশু সমস্ত কিছুই আপনার রূপ। হে বেদমূর্তি, পূর্বে স্বায়ম্ভুব মন্বন্তরের প্রথম ভাগে বরাহরূপে অবতীর্ণ হয়ে অবলীলায় আপনি ধরিত্রীকে রসাতল থেকে উদ্ধার করেছিলেন। হস্তিনী যেমন দন্তাগ্র দ্বারা পদ্মিনীতে জল থেকে উত্তোলন করে, তেমনি আপনি নিজ দন্তাগ্র দ্বারা উদ্ধার করেছিলেন। আপনার ঐ কার্য প্রত্যক্ষ করে যোগীপুরুষেরা আনন্দিত মনে স্তব করেছিলেন। যজ্ঞই আপনার কর্ম।

হে যজ্ঞেশ্বর, আমাদের যজ্ঞকার্য নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আপনার দর্শন লাভের জন্য উন্মুখ হয়েছিলাম। আমাদের প্রতি প্রসন্ন হোন। আমাদের যজ্ঞকার্যটি উদ্ধার করে দিন। আপনার নামকীর্তন করলে যজ্ঞবিঘ্নকারীরা সকল বিষয়ের বিনাশ হয়। আপনার চরনে আমরা প্রণিপাত করছি।

মৈত্রেয় বললেন– হে বিদুর, এইরূপে ভগবান নারায়ণের গুণকীর্তন করতে থাকলে, প্রজাপতি দক্ষ, রুদ্ররোষে বিনষ্ট যজ্ঞের পুনঃপ্রবর্তন করলেন।

হে অনঘ, ভগবান বিষ্ণু সকলের আত্মা– স্বরূপ। তিনি সততঃ আত্মানন্দে পরিতৃপ্ত হলেও ঐ যজ্ঞে তার নিজ অংশ দিকপাল পুরোহিত গ্রহণ করে অতি আনন্দিত হলেন। তিনি মহানন্দে দক্ষকে সম্বোধন করে বললেন– আমি জগতের পরম কারণ আমিই আত্মা, ঈশ্বর ও সর্বজীবের সাক্ষী স্বরূপ। আমি স্বপ্রকাশ ও উপাধিশূন্য। সেই আমিই শংকর, আমাদের মধ্যে কখনও ভেদ দর্শন করে না।

হে দ্বিজ, আমিই ত্রিগুণময়ী মায়ার প্রভাবে এ বিশ্বের সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের কারণ স্বরূপ। আমি অদ্বিতীয় শুদ্ধ পরম ব্রহ্মস্বরূপ। অজ্ঞ ব্যক্তিরা আঘাতে ব্রহ্মা, রুদ্র ও সাধারণ জীবমাত্রকেই বিভিন্ন মনে করে। সাধারণ লোকে যেমন মস্তক, হস্ত প্রভৃতি নিজ নিজ অঙ্গ– প্রত্যঙ্গ কখনও পরকীয় বুদ্ধি করে না, তেমনি আমার প্রকৃত ভক্তজনেও চরচরাত্মক কোনও প্রাণীকে আমার অপেক্ষা ভিন্ন জ্ঞান করে না। আমাদের তিনজনের স্বরূপ এক ও অভিন্ন আমরা সর্বজীবের আত্মা। যে সকল ব্যক্তি আমাদের তিনজনের মধ্যে ভেদদর্শন না করে, সে পরম শান্তি লাভ করে।

মৈত্রেয় বললেন– বিদুর, ভগবান বিষ্ণুর উপদেশ শ্রবণ করে প্রজাপতি দক্ষ বিশেষ যজ্ঞ সহযোগে ভগবান বিষ্ণুর উপাসনা করলেন। তারপরে তিনি অঙ্গ ও প্রধান যজ্ঞের মাধ্যমে অন্য দেবগণের অর্চনা করলেন। পরে সমাহিত চিত্তে শিবে ভেদবুদ্ধিশূন্য হয়ে রুদ্রের অংশ তাকে সমর্পণ করে পূজা করলেন। যজ্ঞসমাপ্তি ক্রিয়া দ্বারা সোমপায়ী ও অন্য দেবতাদের পূজা করলেন।

সকল কর্মের সমাধা হলে দক্ষ ঋত্বিকগণের সঙ্গে শুভ স্নান করলেন। দক্ষের নিজ মাহাত্ম দ্বারা সিদ্ধি লাভ হলেও, দেবগণ তাঁকে ধর্মোপদেশ প্রদান করে স্বর্গর্যাত্রা করলেন।

হে বিদুর– আমরা এরূপ জানি যে, দাক্ষায়ণী সতী এভাবে পূর্ব কলেবর ত্যাগ করে হিমালয় পত্নী মেনকার গর্ভে পার্বতীরূপে জন্মগ্রহণ করেন। প্রলয়কালীন সুপ্তশক্তি পুনর্বার ঈশ্বরকেই লাভ করে। তেমনি অম্বিকা পুনরায় প্রিয়তম শিবকেই পতিরূপে লাভ করেছিলেন।

অনন্যস্বভাবা ব্যক্তিবর্গের একমাত্র গতি ভগবান ভব। দক্ষযজ্ঞ বিধ্বংসকারী ভগবান রুদ্রের এই কর্মাবলী, আমি বৃহস্পতি শিষ্য উদ্ধবের নিকট শ্রবণ করেছি। হে কৌরব্য, ভগবান মহেশ্বরের এই চরিত্র পরম পবিত্র, যশস্কর ও আয়ু বর্ধনকারী। ইহা শ্রবণ বা কীর্তনে সকল পাপের উপশম হয়। শ্রবণকারী ও কীর্তনকারীগণের সংসারে দুঃখ দূর হয়।

.

অষ্টম অধ্যায়
ধ্রুবের তপস্যা

মৈত্রেয় বললেন– বিদুর, সনকাদি এই চারজন এবং নারদ ঋভু, হংস অরুণি ও যতি এই পাঁচজন ব্রহ্মপুত্রেরা জন্মাবধি নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী ছিলেন। এঁরা কখনই গৃহাশ্রম আশ্রয় করেন নি। সেজন্য এঁদের কোন বংশ নেই।

হে শত্রুনাশন বিদুর, ব্রহ্মার পুত্র অধর্মের এক ভার্য্যা ছিলেন মিথ্যা। ঐ মিথ্যার গর্ভে দম্ভ ও মায়া নামক দুটি সন্তান জন্ম নেয়। নিখুঁতি নামক রাক্ষস নিঃসন্তান হওয়ার কারণে তাদের দত্তক গ্রহণ করে। সহোদর হওয়া সত্ত্বেও দম্ভ ও মায়া স্ত্রী-পুরুষ সম্পর্কযুক্ত ছিল।

হে মহামতি বিদুর, সেই দম্ভ ও মায়ার পুত্র ও কন্যার নাম ছিল লোভ ও নিকৃতি (শঠতা)। লোভ ও শঠতার পতি-পত্নীর মিলনের ফলে শঠতার গর্ভে ক্রোধ নামক পুত্র ও হিংসা নামে এক কন্যার জন্ম হয়। অধর্মের বংশোদ্ভূত হওয়ার কারণে এরাও পতি-পত্নীরূপে মিলিত হয়। ক্রোধ ও হিংসার সন্তানদ্বয় হল কাল ও দুরুক্তি।

কাল ও দুরুক্তি প্রকৃতপক্ষে ভাই-বোন হলেও তারা স্ত্রী-পুরুষ রূপে সম্পর্কিত হয়। কাল তার ভগ্নী ও ভার্য্যা দুরুক্তির গর্ভে ভীতি নামক কন্যা ও মৃত্যু নামক পুত্রের জন্ম দেয়। তাদের উভয়ের দাম্পত্যের ফলে নরক নামে পুত্র ও যাতনা নামে এক কন্যার উৎপত্তি হয়। হে নির্দোষ বিদুর, আমি তোমার কাছে অধর্মের বংশ পরিচয় সংক্ষেপে বিবৃত করলাম। অধর্ম প্রলয়ের কারণ আবার ইহা পুণ্যেরও কারণ। অধর্ম বর্জনে পুণ্যলাভ সম্ভব হয়। যে সকল ব্যক্তিরা এ বৃত্তান্ত তিনবার শ্রবণ করবেন তাদের সকল পাপ দূরীভূত হবে।

হে কুরুবংশোদ্ভূত বিদুর, অনন্ত ভগবান হরির অংশাংশ থেকে জন্মগ্রহণ কারী স্বায়ম্ভুব, পবিত্র কীর্তি মনুর বংশ বিষয়ে আমি এবার বর্ণনা করছি, তুমি শ্রবণ করো।

স্বায়ম্ভুব মনুর স্ত্রী শতরূপার গর্ভে দুই পুত্রের জন্ম হয়। তাদের নাম ছির প্রিয়ব্রত ও উত্তানপাদ। এঁরা নারায়ণের অংশে জন্ম নিয়েছিলেন বলে জগতের রক্ষণকার্যে নিযুক্ত ছিলেন। তাঁদের নাম ছিল সুনীতি ও সুরুচি। এঁদের মধ্যে সুরুচি, উত্তানপাদের, প্রিয়পাত্রী ছিলেন। কিন্তু সুনীতি পতির প্রিয়পাত্রী হতে পারেন নি। এই সুনীতির পুত্রের নাম ছিল ধ্রুব।

একদিন রাজা উত্তানপাদ সুরুচির পুত্র উত্তমকে ক্রোড়ে বসিয়ে আদর করছিলেন এসময়ে ধ্রুব সেখানে এসে উপস্থিত হয়। সেও তখন পিতার কোলে উঠতে আগ্রহী হয়। কিন্তু রাজা উত্তানপাদ ধ্রুবকে কোলে নিলেন না, পাছে সুরুচির অভিমান হয়।

তখন সুরুচি, সপত্নী সুনীতির পুত্রকে কোলে উঠাতে ইচ্ছুক দেখে রাজার সামনেই তাকে ভৎর্সনা করতে লাগলেন– বৎস ধ্রুব, তুমি রাজার ছেলে হলেও, রাজার কোলে বা রাজাসনে ওঠবার যোগ্য তুমি নও। কারণ তুমি আমার গর্ভে জন্মগ্রহণ করো নি। তুমি নেহাৎই বালক। তাই তুমি হয়তো জানোনা, তুমি রাজার অন্য স্ত্রীর গর্ভজাত, সেজন্যই এরূপ দুলর্ভ বিষয়ে তোমার ইচ্ছা হয়েছে। তুমি যদি রাজাসন লাভে ইচ্ছুক হও, তবে তপস্যার দ্বারা পরম পুরুষ ভগবানের আরাধনা করো। তাঁর অনুগ্রহে তুমি আমার গর্ভে জন্ম নিতে পারবে। তবেই তোমার ঐ অভিলাষ সিদ্ধ হবে।

মৈত্রেয় বললেন– বিদুর, বিমাতার এরূপ দুর্বাক্যরূপ বাণ বিদ্ধ হয়ে দণ্ডাহত সাপের মতো বিষান্বিত হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে কাঁদতে লাগলেন বালক ধ্রুব। পিতার সামনেই সুরুচি তাঁকে এসব কথা বলেছিলেন। কিন্তু পিতা কোনও কথা বলেন নি। তাই সে পিতাকে পরিত্যাগ করে দৌড়ে মায়ের কাছে গেল। বালকটি দীর্ঘশ্বাস ফেলছে এবং তার অধরোষ্ঠ তিরতির করে কাঁপছে দেখে সুনীতি ব্যস্ত হয়ে ধ্রুবকে কোলে তুলে নিলেন।

অন্তঃপুরস্থ লোকেদের মুখে সুরুচির দুর্বাক্য ও দুর্ব্যবহারের কথা শুনে অত্যন্ত ব্যথাতুর হলেন সুনীতি। দাবাগ্নি মধ্যগতা লতার ন্যায় শোকাগ্নি দ্বারা দগ্ধ হয়ে সুনীতি ধৈর্য হারিয়ে কাঁদতে লাগলেন। সপত্নীর বাক্যবাণ মনে পড়লেই, তাঁর পদ্মলোচন দুটি থেকে অশ্রুবারি বিগলিত হতে লাগল। দুঃখের পার দেখতে পেলেন না। সুনীতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুত্র ধ্রুবকেই সান্ত্বনা পূর্বক বলতে থাকলেন– বৎস, এ বিষয়ে অপরের কোনও দোষ মনে কর না, যে অপরকে কষ্ট দেয় সে নিজপ্রদত্ত সেই দুঃখই ভোগ করে থাকে। সুরুচি ঠিকই বলেছে, কারণ রাজা উত্তানপাদ আমাকে ভার্য্যা এমনকী দাসী বলে স্বীকার করতেও লজ্জিত হন। আমি এমনই হতভাগ্য রমণী। তুমি আমার গর্ভে জন্মেছ এবং আমারই স্তন্যপানে বড় হয়েছ। তাই রাজাসনে আরোহণের ইচ্ছা তোমার পক্ষে অনুচিতই বটে।

হে বৎস, তোমার বিমাতা যে কথা তোমায় বলেছেন, তা অতি সত্য। তুমি যদি সত্যই রাজসিংহাসনে আরোহণ করতে চাও, তবে মাৎসর্য্য পরিত্যাগ করো, কায়মনোবাক্যে ভগবান অর্ধেক্ষজের চরণকমলে আরাধনা কর।

বৎস জগতের প্রতিপালন করার জন্য যিনি সত্ত্বগুণের অধিষ্ঠান স্বীকার করেন তিনিই ভগবান নারায়ণ। যোগীপুরুষেরা মন-প্রাণ এক করে তার সাধনায় নিয়োজিত থাকেন। সেই ভগবান হরির পাদপদ্ম আরাধনা করেই ব্রহ্মা সর্বোক্তৃষ্ট ব্রহ্মপদ লাভ করেছেন। তোমার পিতামহ ভগবান মনু, প্রচুর দক্ষিণাপূর্ণ যজ্ঞের সাহায্যে একাগ্রমনে সেই হরির উপাসনা করেন। অন্যের দুর্লভ দিব্য ও ভৌম সুখ ও অন্তে অপবর্গ তিনি লাভ করেছিলেন।

হে বৎস, মুক্তিকামী পুরুষবর্গ যাঁর চরণপদ্ম লাভের পথ অন্বেষণ করেন, তুমিও তার ভজনা কর। অনন্যভাবে নিজ ভক্তি ধর্ম শোধিত হৃদয়ে ভক্তবৎসল হরিকে সংস্থাপতি করে, তাঁর উপাসনা কর।

হে বৎস ধ্রুব, ব্রহ্মাদি দেবগণ, লক্ষ্মীদেবীর অনুসন্ধানে ব্যস্ত থাকেন, স্বয়ং লক্ষ্মীদেবী দীপতুল্য পদ্ম নিয়ে শ্রীহরির সেবায় রত থাকেন, তুমি সেই শ্রীহরির শরণ নাও। কারণ পদ্মপলাশ নয়ন শ্রীহরি ব্যতীত অন্য কেউ তোমার দুঃখ-কষ্ট নিবারণ করতে পারবেন না।

মৈত্রেয় বলে চললেন– জননীর মুখে এরূপ বিলাপ ও উপদেশ শ্রবণ করে বালক ধ্রুব ধীরে ধীরে সংযত হলেন। বুদ্ধি দ্বারা মনকে সংযত করে তিনি পিতৃগৃহ থেকে বহির্গত হলেন। এদিকে যদৃচ্ছাক্রমে নারদ তা শ্রবণ করলেন। ধ্রুবের মনের অভিপ্রায় জানতে পেরে মনে মনে ভাবলেন- অহো, ক্ষাত্ৰতেজ কী বিষম! এরা সামান্য মানহানি সহ্য করতে পারে না। ধ্রুবের মস্তকোপরি তিনি নিজের পাপ বিনাশক হাত রাখলেন। এই ধ্রুব নিতান্ত বালক হলেও বিমাতার কটুবাক্য একে এখনও বিদ্ধ করছে।

নারদ বললেন– বৎস ধ্রুব, এখন তুমি নেহাতই বালক। তোমার এখন খেলাধুলোয় মত্ত থাকার সময়, এ সময়ে তোমার সন্মান বা অপমান কিছুই আমাদের লক্ষ্য হয় না। যদি একান্তই তোমার মান অপমান বোধ হয়ে থাকে তা হলেও লোকের মোহ ব্যাতীত অন্য কোনো অসন্তোষের কারণ নেই। কারণ এ জগতে সুখ বা দুঃখ নিজ নিজ কর্মফল অনুযায়ী প্রাপ্ত হয়। বৎস, ঈশ্বরের আনুকূল্য ব্যাতীত কোনও উদ্যম ফলপ্রসূ হয় না। এটা ভেবে দৈব্যবশে যা উপস্থিত হয় বুদ্ধিমান ব্যক্তির তাতেই সন্তুষ্ট থাকা উচিত।

আর মায়ের উপদেশ শুনে তুমি অনন্তনারায়ণের প্রসাদ লাভে উদ্যোগী হয়েছ! কিন্তু তিনি সাধারণ মানুষের দুরারাধ্য। মুনিবৃন্দ সর্বপ্রকার সঙ্গ ত্যাগপূর্বক তীব্র যোগসমাধি অবলম্বন পূর্বক অনুসন্ধান করেও বহু বহু জন্মেও তার প্রকৃত পদবী জানতে সক্ষম হন না। তুমি তো বালক, তায় কামনা যুক্ত, তুমি কিভাবে তাকে উপলব্ধি করতে পারবে?

অতএব, তুমি এ নিষ্ফল আগ্রহ ত্যাগ কর। যখন বার্ধক্য উপস্থিত হবে, তখন এ বিষয়ে যত্ন করো। দৈব নির্দেশ অনুযায়ী সুখ ও দুঃখ যেভাবে আসে, তাতে যে ব্যক্তি সন্তুষ্ট থাকতে পারে, তার মুক্তি সম্ভব। অদৃষ্টবশতঃ সুখ এলে তাতে বুঝতে হবে পুণ্যক্ষয় হচ্ছে। অদৃষ্টবশতঃ দুঃখ এলে তাতে পাপক্ষয় হয়েছে বলে মনে করা উচিত। যে ব্যক্তি অধিক গুণবান পুরুষের প্রতি প্রীতিভাবাপন্ন, গুনাধর্ম লোকের প্রতি কৃপাবান ও সমগুণসম্পন্ন ব্যক্তিতে মিত্ৰতা স্থাপন করে, সে সময় সুখের অধিকারী হয়।

ধ্রুব বললেন– হে মহাত্মা, সুখ-দুঃখে হতমান পুরুষদের প্রতি কৃপাপূর্বক যে চিত্ত বিক্ষেপ নিবৃত্তির উপায় অর্থাৎ শখ আপনি প্রদর্শন করলেন, তা আমার মতো ক্ষুদ্র ব্যক্তির পক্ষে একান্ত দুজ্ঞেয়। ঘোর ক্ষত্রিয় স্বভাব প্রাপ্ত হওয়ায় আমি অতি দুর্বিনীত। তদুপরি বিমাতার বাক্যবাণে আমার হৃদয় বিদ্ধ হয়েছে। সেই বিদ্ধ হৃদয়ে আপনার উপদেশ স্থানপ্রাপ্ত হচ্ছে না।

হে ব্রহ্মণ্‌! আমার পিতৃ-পিতামহগণ এবং অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ যে পদের সন্ধান পান নি, আমি সেই ত্রিভুবনের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট সেই পদ জয় করতে ইচ্ছুক। আপনি কৃপা করে তার উপযোগী উত্তম পথ বলে দিন। আপনি ভগবান ব্রহ্মার পুত্র। তাই জগৎপাল বাসুদেবের পরম ভক্ত। জগতের কল্যাণার্থে বীণাবাদন করতে করতে আপনি সূর্যের ন্যায় ত্রিভুবন পরিক্রমা করেন।

মৈত্রেয় বললেন– ধ্রুবের এই প্রকার কথা শুনে দেবর্ষি নারদ পরম প্রীত হলেন। দয়া করে তাঁর মনোরথ সাধনের উপযোগী সাক্য বললেন। নারদ বললেন– তোমার জননী যেরূপ বলেছেন, তাই তোমার অভীষ্ট সিদ্ধির পথ। তুমি একাগ্রমনে সেই বাসুদেবের ভজনা কর। যে ব্যক্তি ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষরূপ নিজের মঙ্গল আকাঙ্ক্ষা করেন, তিনি সে বিষয়ে শুধুমাত্র হরির পদসেবাই করবেন। কারণ ভগবানের চরণপদ্মের উপাসনা করলে সকলের সকল বাসনা পূর্ণ হয়। অতএব হে বৎস, তোমার কল্যাণ হোক। তুমি ভগবানের আরাধনার জন্য যমুনা তটস্থিত পরম পবিত্র মধুবনে অভিগমন কর। সেখানে হরি নিত্যই অবস্থান করছেন। সেখানে গমন করে, তুমি কালিন্দীর পুণ্যশীতল সলিলে ত্রি-সন্ধ্যা অবগাহন করে, নিজ কর্তব্য দেবপ্রণাম করবে। তারপর কুশ, স্বস্তিকা প্রভৃতি দ্বারা আসন রচনা করে উপবেশন করবে। পরে পূরক, কুম্ভক ও রেচকযুক্ত প্রাণায়ামের সাহায্যে প্রাণ, ইন্দ্রিয় ও মনের মালিন্য দূর করে, স্থির চিত্তে ক্রমে ক্রমে পরমগুরু ভগবান শ্রী বিষ্ণুর ধ্যান করবে।

সেই হরি ভক্তদের অনুগ্রহ করার জন্যে সর্বদাই উদ্যত। তাঁর মুখমণ্ডল সদাপ্রসন্ন, দৃষ্টি প্রশান্ত। নাসিকা, ভু ও গন্ডদেশ অতি রমণীয়, তিনি সর্বদা দেবগণের মধ্যে পরম সুন্দর। তিনি তরুণ। তার অঙ্গসকল রমণীয় ওষ্ঠদ্বয় ও চক্ষু লোহিত বর্ণ। তিনি দীনপ্রণতজনের পরম আশ্রয়। সকলের সুখকর শরণাগতের রক্ষক এবং দয়ার সাগর। তিনি শ্রীবৎস লাঞ্ছিত, নবদলশ্যামবর্ণ, পুরুষকার, বনমাল্যধারী, শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম দ্বারা তাঁর চতুর্ভুজ-রূপ সুচারুরূপে অভিব্যক্ত। তার মস্তকে কিরীট, কর্ণে কুণ্ডল, বাহুতে কেয়ূর ও বলয়, গলদেশে কৌস্তুভমণি ও পরিধানে পীতকৌশেয় বস্ত্র। তার নিতম্বদেশে শোভিত মেখলা। চরণদ্বয়ে কাঞ্চননূপুরের নিক্কনে মধুর শব্দ উৎপন্ন হচ্ছে। তিনি অতীব দিব্যকান্তি দর্শনীয় পুরুষ। তার প্রশান্তমূর্তি মন ও নয়ন আনন্দ-বর্ধন করে। ভক্তিভরে অর্চনাকারী ভক্তমণ্ডলীর হৃদপদ্মের মধ্যস্থলে তার অধিষ্ঠান। তাঁর পুণ্য চরণযুগল তার নিজ নামরূপ মণিসমূহে উদ্ভাসিত।

ভগবানের এই মধুর মূর্তি মনের মধ্যে ধারণ করে, সুস্থিত ও একাগ্রচিত্তে বরশ্রেষ্ঠ ভগবানের ধ্যান করবে। প্রসন্ন মনে ঈষৎ হাস্যমুখে ও অনুরাগযুক্ত হয়ে তার ধ্যান করাই বিধেয়। এভাবে ভগবানের কল্যাণময় রূপ ধ্যান করতে করতে তোমার চিত্ত শীঘ্রই শান্ত ও ধীর হবে। তার চরণ থেকে আর নিবৃত্ত হবে না।

হে রাজপুত্র ধ্রুব, তোমাকে আমি পরম গুহ্য মন্ত্র প্রদান করলাম। এই মন্ত্র সাতরাত্রি জপ করলে পুরুষ গগনচারী সিদ্ধপুরুষদের দর্শন লাভ করে। ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়–এই সেই মন্ত্র।

দেশ ও কালের বিভাগ বেত্তা ব্যক্তি নানাবিধ উপচারের দ্বারা ভগবান বাসুদেবের পূজো করবে। এসময়ে তাঁকে পবিত্র জল, মাল্য, বন্য-ফলমূলাদি, প্রশস্ত দুর্বা, বন্যবসন অর্থাৎ ভূর্জত্বক ইত্যাদি দ্বারা তাঁর অর্চনা করা কর্তব্য। উপাসনাকালে ভগবানের সর্বাধিক প্রিয় তুলসী-পত্র দ্বারা অর্চনা অবশ্য কর্তব্য।

যদি দ্রব্যময়ী অর্চা অর্থাৎ শিলাদি নির্মিত প্রতিমা পাওয়া যায়, তবে তাতেই পূজো করবে। তার অভাবে মৃত্তিকা ও জলেও পূজা প্রশস্ত। অর্চনাকারীকে ধৃতচিত্ত মননশীল, সংযতবা এবং পরিমিত ফলমূলাহারী হওয়া প্রয়োজন। শ্রীধর-স্বামীপদ পরিমিত আহার বিষয়ে যা নিয়ম বলেছেন–তা হল, দুই-ভাগ অন্ন অর্থাৎ খাদ্য দ্বারা পূরণ, একভাগ জলের দ্বারা পূরণ ও চতুর্থভাগ বায়ুর প্রচারের জন্য খালি রাখা বাঞ্ছনীয়।

তারপর উত্তমশ্লোক ভগবান, নিজ অচিন্ত্য মায়াশক্তির অধিষ্ঠানে ইচ্ছাপূর্বক অবতার পরিগ্রহণ করে আচরণীয় বিষয়াদির চিন্তা করবে। ভগবানের যত-প্রকার পরিচর‍্যা পূর্বে কর্তব্যরূপে বিহিত হয়েছে, সে সকল উপচারাদি মনে মনে কল্পনা করে পূর্বোক্ত মহামন্ত্র দ্বারা অর্থাৎ দ্বাদশাক্ষক বাসুদেব মন্ত্র দিয়ে মন্ত্রমূর্তি ভগবানের পূজা করবে। এভাবে ভগবানের মনোগত করে, একমনে ভক্তিযুক্ত পরিচর‍্যা পূর্বক উপাসনা করবে। এতে ভগবান হরি সন্তুষ্ট হয়ে ভজনকারী জনগণের মনস্কামনা পূর্ণ করেন। তিনি ধর্ম, অর্থ, কাম প্রভৃতির মধ্যে সাধকের উপযোগী অভিমতই প্রদান করে থাকেন। যে ব্যক্তি সাক্ষাৎ মুক্তিলাভের অভিলাষী তার পক্ষে ইন্দ্রিয়ভোগ্য বিষয়ে বিরক্তি পূর্বক প্রগাঢ় ভক্তিযোগ দ্বারা নিরবিছিন্নভাবে ভজন করা আবশ্যক।

দেবর্ষি নারদের এই উপদেশাবলী শ্রবণপূর্বক রাজপুত্র ধ্রুব তাঁকে প্রণাম ও প্রদক্ষিণ করলেন। এরপর শ্রীহরির চরণাঙ্কিত পুণ্যতম মধুবনে গমন করলেন। ধ্রুব প্রস্থান করলে, দেবর্ষি নারদ রাজা উত্তানপাদের অন্তঃপুরে প্রবেশিত হলেন। সেখানে রাজা তাকে পাদ্য অর্ঘ্য দিয়ে অভ্যর্থনা করলেন। অভ্যর্থনা গ্রহণ পূর্বক তিনি রাজাকে প্রশ্ন করলেন, হে রাজন, আপনি ম্লান মুখে দীর্ঘকাল যাবৎ কী চিন্তায় মগ্ন রয়েছেন, আপনার ধর্ম, অর্থ, কাম কিছু কি বিনষ্ট হয়েছে?

রাজা উত্তানপাদ বিমর্ষ বদনে উত্তর দিলেন– হে ব্রাহ্মণ, আমি অত্যন্ত অন্যায় করেছি। এক স্ত্রীর বশীভূত হয়ে নিষ্ঠুরের মতো নিজপুত্রের প্রতি অবজ্ঞা করেছি। মাত্র পঞ্চমবর্ষীয় সুবোধ বালক ধ্রুবকে, তার মায়ের সঙ্গে নির্বাসনে দিয়েছি। আহা, ক্লান্তিতে তার মুখটা এতক্ষণে শুষ্ক হয়ে গেছে। ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর হয়ে বৃক্ষতলে নিদ্রিত হয়ে পড়লে কী জানি কোন্ হিংস্র জন্তু তাকে আক্রমণ করে থাকবে, হায়, হায়! আমি স্ত্রীপরতন্ত্র, আমার দৌরাত্ম্য বিবেচনা করুন। সেই বালক শুধুমাত্র আমার কোলে উঠতে ইচ্ছুক ছিল। এমন পাষাণহৃদয় আমি তাকে একটু আদর পর্যন্ত করিনি।

নারদ বললেন– মহারাজ, দেবতাদের দ্বারা আপনার পুত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে। তার যশ সমগ্র জগতে পরিব্যাপ্ত হবে। সে বিষয়ে অবগত না হয়ে কেন মিছে শোকগ্রস্ত হচ্ছেন, মহারাজ, আপনার পুত্র লোকপালগণেরও দুঃসাধ্য কর্ম সম্পাদন করে, আপনার কীর্তি বিস্তারপূর্বক অতি শীঘ্র আপনার কাছে ফিরে আসবে।

মৈত্রেয় বললেন–হে বিদুর, রাজা উত্তানপাদ দেবর্ষি নারদের কাছ থেকে এ বৃত্তান্ত শ্রবণ করলেন। তিনি রাজ্যলক্ষ্মীকে অনাদর করে সমস্ত সময় শুধুমাত্র পুত্রের বিষয়ে চিন্তা করতে লাগলেন।

এদিকে ধ্রুব মধুবনে গমন করলেন। সেখানে কালিন্দী নদীতে স্নান করে, পবিত্র সেই রাত্রি উপবাস করলেন। তারপর দেবর্ষির উপদেশ অনুযায়ী ভগবান পুরুষোত্তম হরির পরিচর্যায় প্রবৃত্ত হলেন। প্রতি তৃতীয় দিনে ধব কেবলমাত্র দেহরক্ষার্থে কপিঙ্খ ও বদরীফল আহার করে, ঈশ্বরের আরাধনায় প্রথম মাস নির্বাহ কলেন, তারপরে দ্বিতীয় মাসে তিনি প্রতি ষষ্ঠ দিবসে শুষ্ক তৃণ-পত্রাদি আহার করতেন। প্রতি নবম দিবসে শুধুমাত্র জলগ্রহণ করে সমাধি অর্থাৎ তদগতচিত্ত হয়ে পুর্ণশ্লোক ভগবানের আরাধনায় রত হয়ে তৃতীয় মাস অতিবাহিত করলেন। তারপরে প্রতি দশ দিবসে শুধুমাত্র বায়ুভক্ষণ ও প্রাণায়াম দ্বারা শ্বাস জয় করে ধ্যানযোগে ভগবানের চিন্তা করতে হয়ত চতুর্থ মাস অতিক্রান্ত হল। চতুর্থ মাসের পর ধ্রুব শ্বাসজয় করে পরব্রহ্মের চিন্তা করতে করতে একপদে স্থানুর মতো দণ্ডায়মান হয়ে রইলেন।

এরপর শব্দাদি বিষয়, চক্ষুরাদি ইন্দ্রিয়গণের আশ্রয় মনকে সকল বিষয় থেকে আকর্ষণ করে হৃদিমধ্যে কেবল ভগবানের রূপ চিন্তা ধ্যান করতে লাগলেন। তখন অন্য কোনও পদার্থ তার দৃষ্টিগোচর হয় নি। এভাবে ধ্রুব মহদাদির আধার ও শ্রম প্রকৃতি– পুরুষের ঈশ্বর পরব্রহ্মের ধ্যান করতে শুরু করলেন।

ত্রিভুবন তাঁর তেজে থরথর করে কম্পিত হতে লাগল। রাজপুত্র ধ্রুব যখন একপদে দণ্ডায়মান হয়ে ধ্যানমগ্ন ছিলেন, তখন তাঁর পদভারে পৃথিবীর অর্ধাংশ নুইয়ে পড়েছিল। গজরাজি নৌকায় আরোহণ করলে তার বাম ও ডান প্রতি পদভারে নৌকা হেলে যায়। তেমনি রাজপুত্র তপস্বী ধ্রুবের পদাঙ্গুষ্ঠভারে পৃথিবী নত হল।

ধ্রুব তখন প্রাণ ও তার দ্বারা-বন্ধন পূর্বক নিজের সাথে অভেদরূপে বিশ্বমূর্তি নারায়ণের ধ্যানপরায়ণ হলেন। তখন সমস্ত লোক ও লোকপালগণ শ্বাসরুদ্ধ হয়ে অত্যন্ত পীড়িত হলেন। তারা উপায়ান্তর না দেখে ভগবান বিষ্ণুর শরণাগত হলেন।

দেবগণ বললেন– হে ভগবান, চরাচর সমস্ত প্রাণীর শরীরে, এই প্রকার শ্বাসরোধ কখনও দেখিনি। এই দুর্বিষহ অবস্থা থেকে আমাদের পরিত্রাণ করুণ, আপনি প্রণম্য, আমরা আপনার শরণাগত হলাম।

ভগবান বললেন– হে দেবগণ, তোমরা ভীত হয়ো না, যে বালকের তপস্যা জনিত কারণে তোমাদের প্রাণবায়ু রুদ্ধ হয়েছে, সে হল রাজা উত্তানপাদের পুত্র ধ্রুব। ভয় নেই, দুষ্কর তপস্যা থেকে তাকে আমি নিবৃত্ত করছি। এখনি সে ধ্যানযোগে বিশ্বরূপ আমার সঙ্গে একতা লাভ করেছে। তোমরা নির্ভয়ে নিজ নিজ স্থানে গমন করো।

.

নবম অধ্যায়
বরলাভের পর ধ্রুবের প্রত্যাগমন ও পিতৃদত্ত রাজ্যপালন

মৈত্রেয় বললেন–ভগবানের এই রূপ বাক্য শ্রবণ করে দেবতাগণ আশ্বস্ত হলেন। তাদের মনের যাবতীয় ভীতি দূরীভূত হল। তারা ভক্তি পূর্বক ভগবানকে প্রণাম করে স্বর্গে অভিগমন করলেন। অতঃপর সহস্ৰশীর্ষ ভগবান নিজ ভক্ত ধ্রুবকে দর্শন দানের উদ্দেশ্যে গরুড়ের স্কন্ধে আরোহণপূর্বক মধুবনের উদ্দেশ্যে গমন করলেন।

এদিকে ধ্রুব তখন সুদৃঢ় ধ্যানযোগে নিশ্চল হয়েছিলেন। নিজ হৃদয়কমলাসনে অধিষ্ঠানরত ভগবানের বিদ্যুৎপ্রভার ন্যায় উজ্জ্বল মূর্তি দর্শন করছিলেন। আচম্বিতে সে মূর্তি তিরোহিত হল। ধ্রুব চক্ষু উন্মীলিত করলেন। বিস্মিত হয়ে তিনি দেখলেন, এতক্ষণ অন্তরমধ্যে যে রূপের ধ্যানে তিনি মগ্ন ছিলেন সেই শ্রীমূর্তি ভগবান তার সম্মুখে উপস্থিত। ভগবান দর্শনে ধ্রুব অভিভূত আনন্দে ভূমিষ্ঠ হয়ে সাষ্টাঙ্গে তাকে প্রণাম করলেন। ধ্রুব যেন দু’চোখ ভরে তার রূপসুধা পান করতে লাগলেন। মনে মনে তিনি ভগবানকে সহস্রবার চুম্বিত করলেন। তিনি যেন নিজ দু’বাহু দ্বারা ভগবানকে আলিঙ্গন করতে থাকলেন। এ সবই অন্তর্যামী ভগবান হরি বুঝতে পারলেন। তিনি বুঝতে পারলেন যে, ধ্রুব তার গুণে অভিভূত হয়ে স্তব করতে ইচ্ছুক। কিন্তু সে কিভাবে স্তব করতে হয়, তা জানে না। তাই সে পরম ভক্তিভাবে জোড়হাত করে দণ্ডায়মান। কৃপাপরবশ হয়ে ভগবান বেদময় শঙ্খ দিয়ে তার দু’গাল স্পর্শ করলেন।

ভগবানের শঙ্খস্পৃষ্ট হওয়া মাত্রই ধ্রুবের ভগবৎ বিষয়িণী বাকশক্তির জন্ম হল। তার পরমাত্মা ও জীবের তত্ত্ববিষয়ক জ্ঞান জন্মিল। তখন ধ্রুব ধীরভাবে বিশ্বস্রষ্টা ভগবানের স্তবকীর্তনে প্রবৃত্ত হলেন। বৎস বিদুর, এভাবেই ধ্রুব অখিললোক প্রাপ্ত হলেন।

ধ্রুব বললেন– অখিল শক্তির যিনি ধারক, সেই ভগবানকে আমি নমস্কার করি। তিনি আমার অন্তরমধ্যে প্রবেশিত হয়ে স্বীয় চিদশক্তি দ্বারা আমায় প্রসুপ্ত করেছেন। তিনিই আমার হস্ত, চরণ, শ্রবণ, ত্বক প্রভৃতি ইন্দ্রিয়াদি এবং প্রাণের সঞ্জীবনকারী সেই পরমারাধ্য পুরুষ ভগবানকে আমি প্রণাম করি।

হে ঈশ্বর, আপনিই নিজ শক্তি ত্রিগুণময়ী মায়ার সাহায্যে এই মহাদাদি অশেষ জগৎ সৃষ্টি করেছেন। সেই মায়ার প্রভাবেই আবার অন্তর্যামীরূপে তার অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছেন। অগ্নি বস্তুতঃ এক হওয়া সত্ত্বে কাঠের বিভিন্ন ধর্মের কারণে ভিন্নভাবে প্রকাশিত হয়। তেমনি আপনি মূলত এক হলেও বিবিধরূপে প্রকাশিত হন। বস্তুতঃ আপনি ব্যতীত অপর কেউই জ্ঞান-ক্রিয়া শক্তিধারী নয়।

হে নাথ, স্বয়ং ব্রহ্মা আপনার প্রদত্ত জ্ঞানের সাহয্যে সুপ্তোত্থিত ব্যক্তির ন্যায় এই বিশ্ব দর্শন করেছিলেন। হে আর্তবন্ধু, আপনার চরণমূল মুক্ত পুরুষদেরও আশ্রয়স্থল। আপনার ভক্তজন ও উপকৃত জনেরা কখনই আপনার পাদপদ্ম বিস্মৃত হতে পারে না। আপনি জন্ম মৃত্যুর নিবারণতা। কল্পতরুর ন্যায় আপনি সবার বাসনা পূরণ করেন। যারা আপনার সেবা ব্যতীত কাম প্রভৃতি অন্যান্য ফলের আরাধনায় রত থাকেন, তারা নিশ্চয়ই আপনার মায়ার দ্বারা বিমোহিত প্রাণ। কারণ শবতুল্য। জড়দেহের ভোগ্য সুখ যা তাদের কাম্য, সেই বিষয় সম্বন্ধজনিত সুখ প্রাণীগণের নরকেও লভ্য হয়।

হে নাথ, আপনার পদযুগলের ধ্যানের দ্বারা দেহধারী জীবাদির যে আনন্দলাভ হয় আত্মানন্দরূপ ব্ৰহ্ম সাক্ষাৎকারেও সে সুখ লাভ হয় না। আপনার ভক্তজনের কথা শ্রবণ বা কীর্তনে যে আনন্দ লাভ হয়, তার সঙ্গে অপর কিছুই তুলনীয় নয়।

আর অন্তরের কালরূপ অসির আঘাতে কর্তিত হয়ে যে সকল লোক বিমান থেকে পতিত হয়, তাদের কথা আর কি বলার আছে? অতএব, ঐ জাতীয় লোকেদের সেই পরমানন্দ লাভের কোনও সম্ভাবনা নেই।

হে অনন্ত, আমার এই একমাত্র প্রার্থনা– আপনাতে নিরন্তর ভক্তিরত অমলাশয় মহৎ ব্যক্তিবর্গের প্রকৃষ্ট সান্নিধ্য যেন আমি লাভ করতে পারি। যে মহৎ ব্যক্তিদের হৃদয়ে বিষয়-বাসনা স্বরূপ মলমূল, তাদেরকেই অমলাশয় বলা হয়। যে মহৎজনের সঙ্গে আমি আপনার গুণগাথা শ্রবণপূর্বক অতি দুঃখময় এই ভয়ানক বিশ্ব-সাগর উত্তীর্ণ হতে পারি। হে ঈশ, হে পদ্মনাভ, আপনার পাদপদ্মের সৌরভে প্রলুব্ধ ভক্তজনের সঙ্গে, সঙ্গতকারী ব্যক্তিরা অতি ভাগ্যবান। কারণ তারা এই মর্তদেহ, ও দেহানুবর্তী গৃহ, বিত্ত, পুত্র, মিত্র, কলত্রাদি কিছুই স্মরণ করেন না।

হে অজ, তির্যক, নগ বিহগ, সরীসৃপ, দেব, দৈত্য, মর্ত্য ইত্যাদিতে ব্যাপ্ত, সৎ ও অসৎ বিশিষ্ট এই যে বিরাট রূপ সম্পর্কে আমি জ্ঞাত আছি। কিন্তু মহদাদি বস্তুসকল যার কারণ সেই বিরাট রূপ ব্যতীত ঈশ্বর — স্বরূপ সম্পর্কে আমি অবগত নই। এমনকি তার সন্ধানও আমার অজানা। যা আমার অভিমান নিবৃত্ত হয়নি। সেজন্য আমি শুধুমাত্র সৎসঙ্গের অভিলাষী। তেমনই যেন ধ্রুব ঈশ্বরের অনুকম্পায় অজ্ঞাত রূপ দুটি সম্পর্কে জ্ঞাত হয়ে প্রণাম করেছেন। কল্প-অন্তে পুরুষ অনন্ত– নাগ শয্যায় শয়ন করে এই নিখিল জগতকে নিজ উদরে ধারণ করে যোগনিদ্রায় মগ্ন ছিলেন। তিনি আপনার প্রতি দৃষ্টিপাত করে ঐ শেষনাগের অঙ্কররূপ পর্বঙ্কে শায়িত হন। তার নাভিসরোবরে উৎপন্ন স্বর্ণময়। লোকপদ্মের কর্ণিকায় অতীব তেজস্বী ব্রহ্মা উদ্ভূত হন। আমি সেই পরম পুরুষ ভগবানকে প্রণিপাত করছি।

আপনি নিত্যমুক্ত পুরুষ, অর্থাৎ অবিদ্যার বন্ধনরহিত। আপনি রাগ-দ্বেষ প্রভৃতি মলহীন পরিশুদ্ধ, বিরুদ্ধ পুরুষ। আপনিই আদিপুরুষ ভগবান। সত্বগুণএর অর্থাৎ সত্ত্ব, রজঃ ও তমো এই ত্রিবিধ মায়াগুণের এবং ভূত, ভবিষ্যত ও বর্তমান এই ত্রিকাল নিয়ন্তা।

আপনি স্বীয় অখণ্ডিত দৃষ্টির সাহায্যে বুদ্ধির সমস্ত অবস্থাকেই দর্শন করে থাকেন। তবুও আপনি এই বিশ্বকে প্রতিপালনার্থে যজ্ঞমূৰ্ত্তি শ্রীনারায়ণ প্রকাশিত হন, সুতরাং আপনি সকল জীবের থেকে সর্বপ্রকারে বিভিন্ন।

জীব নিত্যমুক্ত নয়। সে আপনার প্রসন্নতা ব্যাতীত মুক্তিলাভ করতে পারে না। জীব শুদ্ধ নয়, সে মলিন। জীব অজ্ঞ, জড় ও বিকারগ্রস্ত জীবের কোনও ঐশ্বর্যাদি নেই, সে আদি বিশিষ্ট। জীব গুণত্রয়ের অধীন। এরূপ জীব ভগবানের অংশ থেকে উদ্ভূত হলেও তার থেকে ভিন্ন, অণু-চিৎ-কণা মাত্র।

আমি সেই পরমব্রহ্ম ভগবানের চরণে আশ্রয় প্রার্থী। তিনিই এ বিশ্বের কারণ, অখণ্ড, অনন্ত অনাদি, আনন্দময়। তাঁর কোনওরূপ বিকার হয় না, বিদ্যা ও অবিদ্যা প্রভৃতি পরস্পর বিরোধী শক্তি তার থেকে নিরন্তর উদ্ভূত হয়ে চলেছে।

হে ভগবান, আপনার মূর্তি পরম আনন্দস্বরূপ। যে সকল পুরুষেরা নিষ্কাম হয়ে আপনাকেই পুরুষার্থ জেনে ভজনা করে, তাদের কাছে আপনার পাদপদ্মই পরমার্থবোধক। তবুও হে স্বামীন, আপনি কৃপা করে আমার ন্যায় আর্ত সকাম ব্যক্তিদের রক্ষা করে থাকেন।

মৈত্রেয় বললেন– বিদুর, সৎসংকল্প ধীমান ধ্রুব কর্তৃক স্তুত হয়ে ভগবান অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে যা যা বলেছিলেন, তা শ্রবণ কর।

ভগবান বললেন–হে রাজনন্দন, তোমার মঙ্গল হোক। তোমার মনোবাসনা সম্পর্কে আমি অবহিত আছি। তুমি যে সর্বোৎকৃষ্ট স্থান প্রাপ্তির অভিলাষী, তা অন্যের দুষ্প্রাপ্য হলেও, তোমার কুক্ষীগত হবে।

হে সুব্রত, সত্যই সে স্থান সদা দীপ্তিশালী নিত্যস্থায়ী সেখানে গ্রহ-নক্ষত্রাদি ও তারকাখচিত শিশুমার নামক জ্যোতিশ্চক্র সংযুক্ত রয়েছে। হে ভদ্র, পূর্বে সে স্থানে অপর কেহই অধিষ্ঠান করতে পারে নি, ধান মাড়াইয়ের জন্য গোরু ও মহিষ বাঁধবার মোধ-স্তম্ভে বদ্ধ বলীবদের মতো, কল্পের অন্তকাল পর্যন্ত জীবিত ব্যক্তিদের বিনাশ হলেও ঐ স্থান অক্ষত থাকবে। ধর্ম, অগ্নি, কশ্যপ, ইন্দ্র, এবং সপ্তর্ষি বর্গ তারকাগণের সঙ্গে নিরন্তর ঐ স্থানকে প্রদক্ষিণ পূর্বক ভ্রমণ করছেন।

যে স্থান তোমাকে প্রদান করলাম, তা তুমি রাজ্যভোগান্তের দ্বারা প্রাপ্ত হবে। সম্প্রতি তোমার পিতা তোমাকে রাজ্যভার অর্থাৎ সমগ্র পৃথিবী অর্পণ করবেন। তৎপরে তিনি বনে গমন করবেন। তুমি তখন অবশ্যই ধর্ম আশ্রয়ে থেকে ষট্‌ত্রিংশৎ সহস্র বছর রাজ্যের প্রতিপালন করবে। এই দীর্ঘকাল সময়েও তোমার কোনও ইন্দ্রিয়ের কোনরূপ বৈকল্য দেখা দেবে না। তোমার ভ্রাতা উত্তম মৃগয়ার্থে বনে বনে গিয়ে ধ্বংস হবে। তার অনুসন্ধানার্থে তোমার বিমাতা সুরুচি আনমনা হয়ে বনে বনে থাকাকালীন দাবাগ্নিতে দগ্ধ হবে। হে বৎস, তোমার ঐরূপ ক্ষতিসাধনের কোনো অভিপ্রায় নেই, তা আমি জানি, তবু আমার ভক্তগণের প্রতি দ্রোহ আচরণের এরূপ ফল অবশ্য ভোগ্য।

হে বৎস, যজ্ঞই আমার প্রিয় মূর্তি। তুমি প্রচুর দক্ষিণাসহযোগে যজ্ঞ দ্বারা আমার আরাধনা করবে। ইহলোকের সকল কাম্য বস্তু ভোগসাধনের পর আমাকে স্মরণ করবে। তারপর তুমি আমার ধামে গমন করবে। যে ধাম সর্বলোক পূজিত। সে ধাম ঋষিগণের অধিষ্ঠানস্থলেরও উপরে। ঐ স্থানে যতিগণ গমন করেন। সে স্থান থেকে আর পুনর্জন্ম হয় না।

মৈত্রেয় বললেন– এইভাবে ভগবান ধ্রুবকে নিজের পদযুগলের দর্শন দিলেন, বালক ধ্রুবের সামনেই তিনি গরুড়ে আরোহণ করে পুনরায় নিজ ধামের উদ্দেশ্যে গমন করলেন। ধ্রুবও তারপর হরির পদসেবা পূর্বক সকল সংকল্পের সমাপ্তিরূপ মনোরথ লাভ করলেন। তিনি ধীরে ধীরে পিতার ভবনাভিমুখে গমন করতে লাগলেন। তবু তার মনে যেন কিসের অতৃপ্তি রয়ে গেল।

বিদুর মৈত্রেয়কে প্রশ্ন করলেন– ব্রাহ্মণ, ভগবান নারায়ণের পদযুগল, মায়াচ্ছন্ন বিষয়াবিষ্ট সকাম পুরুষের পক্ষে অতি দুর্লভ। তাঁর চরণারাধনা দ্বারাই তা উপার্জিত হতে পারে। কিন্তু, পুরুষাৰ্থবেত্তা ধ্রুব এক জন্মেই ভগবানের সেই পরমপদ লাভ করেও কেন ভগ্ন মনোরথ প্রায় হয়েছিলেন?

মৈত্রেয় বললেন–বিমাতার বাক্যবাণ ধ্রুবের মনে বিদ্ধ হয়েছিল। তা স্মরণে থাকায় তিনি মুক্তিপ্রদ ভগবানের কাছে মুক্তি প্রার্থনা করেন নি। একথা অনুধাবন করে ধ্রুবের অত্যন্ত মনস্তাপ হয়েছিল। ধ্রুব তখন ব্যাকুল হয়ে অনুতাপ করতে লাগলেন। “হায়, হায়! কি কষ্ট! সনন্দ প্রমুখ উৰ্দ্ধরেতা মহর্ষিগণ বহু জন্মের অভ্যস্ত সমাধিতে যে পরমার্থ বা পরম পদ লাভ করেন, আমি তা ছয়মাসের মধ্যে জ্ঞাত হলাম। কিন্তু তার চরণচ্ছায়ায় উপস্থিত হয়েও ভেদদৃষ্টির কারণে আমি অধঃপতিত হলাম। আহা কতই না দুর্ভাগা আমি। আমি — সংসারছেদক শ্রীহরির পদতলে উপনীত হয়েও বিনশ্বর বস্তু কামনা করেছি।

বোধহয়, দেবতারা আমার বুদ্ধিনাশ করেছিলেন। তাদের অধিষ্ঠান ধাম থেকে ঊর্ধ্বে আমি অবস্থান করব, এই ভেবে হয়তো তারা অসহিষ্ণু হয়ে আমার বুদ্ধিকে অস্থির করে তুলেছিলেন। নতুবা আমার মতো অসত্ম ব্যক্তির পক্ষে নারদের হিতকর বাক্যাবলী অগ্রাহ্য করা কিভাবে সম্ভব? নিদ্রিত ব্যক্তির স্বপ্নদর্শনের মতো আমিও বস্তুতঃ অভিন্ন নিজ ভ্রাতাকে শত্রু বোধ করেছি। দেবীমায়ার প্রভাবে আমার এই ভেদসৃষ্টির উদ্ভব হয়েছিল। হায়, হায়! তপস্যা দ্বারাও যাঁকে প্রসন্ন করা দুঃসাধ্য। সেই ভববন্ধন মোচনকারী জগদাত্মা পরমেশ্বরকে প্রসন্ন করেও দুর্ভাগা আমি, তার কাছে তুচ্ছ সংসার সুখ প্রার্থনা করেছি। গতায়ু ব্যক্তির চিকিৎসার মতো; আমার প্রার্থিত বিষয়ও ব্যর্থ হয়েছে। নির্ধন ব্যক্তিরা রাজার কাছেও তুষযুক্ত তন্ডুলকণা প্রার্থনা করে। আমিও এতই পুণ্যহীন যে আত্মানন্দ প্রদানে উদ্যত ভগবানের কাছে মূঢ়তাবশতঃ উচ্চপদরূপ অভিমান প্রার্থনা করেছি।

মৈত্রেয় বললেন– বৎস বিদুর, তোমার মত যে ব্যক্তিসকল ভগবান মুকুন্দের পাদপদ্ম পরাগরেণুর সেবায় রত থাকেন, তার কেবলই ভগবানের সেবার অনুমতি চান। তার ইচ্ছায় যা লভ্য হয় তাতেই তারা পরম সন্তোষ লাভ করেন।

এদিকে রাজা উত্তানপাদ দূতের মুখে শ্রবণ করলেন, যে ধ্রুব প্রত্যাগমন করছে, কিন্তু মৃত ব্যক্তির আগমন সংবাদ যেমন কেউ বিশ্বাস করে না, তেমনি রাজাও ধ্রুবের আগমন সংবাদ বিশ্বাস করেন না। তার মনে হল, আমি অভদ্র। আমার মঙ্গল হবার কোনো আশা নেই। তৎক্ষণাৎ দেবর্ষি নারদের বাক্য স্মরণ করে রাজা আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠলেন। খুশীতে তিনি সংবাদ-বাহককে একটি বহুমূল্য হার উপহার হিসেবে প্রদান করেন।

দীর্ঘ অদর্শনের পর রাজা পুত্রের দর্শনের ইচ্ছায় উন্মুখ হলেন। তিনি ব্রাহ্মণ কুলবৃদ্ধ ও অমাত্যবৃন্দকে সঙ্গে নিয়ে, উত্তম অশ্বযুক্ত স্বর্ণমণ্ডিত রথে আরোহণ করলেন। পুরবাসীগণ মঙ্গল শঙ্খ বাজাতে লাগলেন। দুন্দুভি, বংশীধ্বনি ও ব্রাহ্মণগণের বেদপাঠের শুভ ধ্বনির সঙ্গে অতি ব্যগ্র হয়ে নগর থেকে বেরিয়ে ধ্রুব দর্শনে অভিগমন করলেন। রাজমহিষী সুনীতি ও সুরুচি বহুমূল্য অলংকারে ভূষিত হয়ে পুত্র উত্তমের সঙ্গে শিবিকায় আরোহণ করলেন।

তারপরে উপবনের দিক থেকে ধ্রুবকে অগ্রসর হতে দেখলেন। রাজা তাকে দর্শনমাত্রই স্নেহে বিগলিত হয়ে রথ থেকে অবতরণ করে, অতি দ্রুত তার কাছে গমন করলেন। ভগবানের পাদস্পর্শে সর্বপাপ মুক্ত ধ্রুবকে রাজা স্নেহভরে বাহুদ্বয় দ্বারা আলিঙ্গন করলেন। তারপর পুত্র প্রাপ্তিরূপ মনোবাসনা পূর্ণ হওয়ায় বারংবার তার মস্তক চুম্বন করলেন, যুগপৎ আনন্দ ও অনুতাপে তাঁর চক্ষু থেকে বিগলিত অশ্রুধারায় তিনি পুত্রকে স্নান করালেন।

ধ্রুব প্রথমে পিতার চরণদ্বয় বন্দনা করে তাঁকে প্রণাম করলেন। পিতা তাঁকে আশীর্বাদ ও সম্ভাষণ করলেন। তার পরে অতি সজ্জন ধ্রুব মাতা ও বিমাতাকে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করলেন। সুরুচি নিজ চরণতলে প্রণত সেই বালককে স্নেহভরে ওঠালেন। তাকে স্নেহভরে আলিঙ্গন করে বাষ্প গদগদ বাক্যে বললেন–বৎস, চিরজীবি হও। সুরুচির এমত আচরণের কারণ এই যে, যাঁর মৈত্যাদি গুণে ভগবান হরি প্রসন্ন হন, জলের নিম্নগামী ধর্মের ন্যায় সমস্ত লোক তার নিকট অবনত থাকে।

তারপর দু’ভাই উত্তম এবং ধ্রুব আনন্দে, প্রেমে বিহ্বল হয়ে পরস্পরকে আলিঙ্গন করলেন। তাদের উভয়ের গাত্র আনন্দে কন্টকিত হল। তাদের দু’চোখ দিয়ে আনন্দের অশ্রু বিগলিত হতে থাকল। তারপর ধ্রুব তাঁর মাতা সুনীতির কাছে গেলেন। সুনীতি প্রাণাধিক প্রিয় নিজ পুত্রকে ক্রোড়ে নিয়ে, তার অঙ্গস্পর্শে অত্যন্ত আনন্দিত বোধ করলেন। সুদীর্ঘকালের মনঃকষ্ট তার দূরীভূত হল।

হে বিদুর, তখন বীরপ্রসবিণী সুনীতির আনন্দাশ্রুতে তার স্তনযুগল সিক্ত হয়ে দুগ্ধ ক্ষরিত হতে লাগল। প্রজাগণ সুনীতির উচ্চ প্রশংসা করতে লাগলেন। তারা বলতে লাগল–দীর্ঘকাল পর আপনার পুত্র আবার ফিরে এসেছে। ইনি আপনার দুঃখহরণ করবেন ও ভূ-মণ্ডলের রক্ষা করবেন।

যে ভগবানের ধ্যান করে বীর ব্যক্তিরা দুর্জয় মৃত্যুকেও জয় করতে সক্ষম হয়, আপনি নিশ্চয়ই তার আরাধনা করছিলেন। তিনি সত্যই প্রণতজনের আর্জি শোনেন। এভাবে পুরবাসীগণ ধ্রুবের প্রশংসা করতে লাগলেন। রাজা উত্তানপাদ একটি হস্তিনীর পৃষ্ঠে ভ্রাতা উত্তমের সঙ্গে ধ্রুবকে আরোহণ করিয়ে আনন্দিত মনে রাজপুরীতে প্রবেশ করলেন। এখন জনগণ তার প্রশংসা করতে লাগলেন।

রাজপুরীতে প্রত্যেক দ্বারে দ্বারে ফল– মঞ্জরীযুক্ত কদলীস্তম্ভ ও নবীন স্তবকে শোভিত গুবাক বৃক্ষ স্থাপিত ছিল। মকরাকৃতি তোরণের উপরিভাগে পুস্পমালা সজ্জিত ছিল। আম্রপল্লব, নববস্ত্র, মাল্য ও লম্বিত মুক্তা-দাম, শোভিত প্রদীপ সহ জলপূর্ণ কলস দ্বারা প্রতিটি দ্বার সুশোভিত। সেই পুরীর প্রাচীর, গোপর (ফটক), ও আগার (পুরদ্বার), সমস্ত কাঞ্চনময় পরিচ্ছদে বিভূষিত ছিল। তাদেরকে সুন্দর বিমানশিখরের সঙ্গে তুলনীয় মনে হচ্ছিল। সেই পুরাঙ্গন রাজপথ, উচ্চ হর্মোপরি নির্মিত রম্য ভ্রমণস্থান ছিল, সেখানে সাত সমুদ্র মার্গসমূহ সম্মার্জিত ও চন্দনজলে সিক্ত ছিল। তাতে লাদ অর্থাৎ মৈ, অক্ষত অর্থাৎ যব ফল ও তর্ভুল ও নানাবিধ পূজার উপাচারে সুসজ্জিত ছিল। সাধ্বী পুরস্ত্রীগণ সেই সেই পথে ধ্রুবকে আসতে দেখলেন। তারা স্নেহভরে তাকে আশীর্বাদ করতে করতে শ্বেতসর্ষে, যব, দধি, ফল, ফুল ও দূর্বা প্রভৃতি উপহার নিক্ষেপ করতে লাগলেন। তাদের মধুর সুরে গুণগান শুনতে শুনতে ধ্রুব রাজভবনে প্রবেশ করলেন।

দেবতারা যেমন স্বর্গে সুখে বসবাস করে থাকেন, ধ্রুব তেমনি রাজপুরীতে সুখে বাস করতে লাগলেন। সেখানে ধ্রুব মহামূল্যবান মণিমুক্ত খচিত উত্তম গৃহে পিতামাতা কর্তৃক লালিত-পালিত হতে লাগলেন। সেখানে হস্তীদন্ত দ্বারা নির্মিত পালঙ্কে স্বর্ণ পরিচ্ছদে শোভিত দুগ্ধফেনতুল্য শয্যা রচিত ছিল। কাঞ্চনময় গৃহের উপকরণাদি ও মহামূল্য আসনসহ বিদ্যমান ছিল। স্ফটিক ও মরকতময় ভিত্তিতে মণিময় প্রদীপগুলি সুন্দরী রমণীদের করস্থিত অলংকারাদির সঙ্গে দীপ্যমান ছিল। সেই মনোরম পুরীতে উদ্যানগুলি বিভিন্ন অমল তরুতে অতি রমণীয় ছিল। সে সকল বৃক্ষের উপরে বিহঙ্গ-মিথুন সুমধুর স্বরে কূজন করছিল। মৌমাছি ও ভ্রমরাদি সেথায় গুণগুণ রবে গুঞ্জরিত হচ্ছিল।

উদ্যানে বাপীসকলে বৈদুর্যমণি নির্মিত সোপান ছিল, জলমধ্যে বিভিন্ন বর্ণের পদ্ম শোভিত ছিল। আর সেখানে হংস, কারক, চক্রবাক ও সারসাদি প্রভৃতি পক্ষীগণ জলক্রীড়ায় রত ছিল। রাজা উত্তানপাদ নিজ পুত্রের ঐরূপ প্রভাব দর্শন ও শ্রবণ করে পরম বিস্ময়ে আবিষ্ট হলেন।

তারপরে ধ্রুব ধীরে ধীরে বয়ঃপ্রাপ্ত হয়ে যৌবনপ্রাপ্ত হলেন। প্রজা সকলে তার প্রতি অত্যন্ত অনুরক্ত ছিল। আমত্যবর্গেরও তিনি অতি প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলেন। উত্তানপাদ এসব দেখে অত্যন্ত প্রীত হলেন। তিনি আমত্যগণের সঙ্গে পরামর্শক্রমে ধ্রুবকে রাজ্যের অধীশ্বররূপে নির্বাচন করলেন। সমগ্র পৃথিবীর প্রতিপালক হিসেবে ধ্রুবর রাজ্যাভিষেক হল। রাজা উত্তানপাদ বেশ কিছুদিন পরে বুঝলেন তার বার্ধক্য উপস্থিত হয়েছে। তখন তিনি পরমাত্মা শ্রীহরিকে প্রাপ্তির পথের অনুসন্ধান করতে করতে বনে গমন করলেন। সেখানে তিনি বিষয়-সংসারে বিযুক্ত হয়ে শ্রীহরির কথা চিন্তা করতেন।

.

দশম অধ্যায়
যক্ষগণ কর্তৃক ভ্রাতা উত্তম নিহত হয়েছে শুনে ধ্রুবের একাকী অলকাপুরী গমন ও যক্ষদের সাথে তার যুদ্ধ বিক্রম বর্ণনা

মৈত্রেয় বললেন– বিদুর, ধ্রুব প্রজাপতি শিশুরমারের প্রসিদ্ধ কন্যা ভ্ৰমিকে বিবাহ করেছিলেন। তার গর্ভে কল্প ও বৎসর নামে দুটি পুত্রের জন্ম হয়। ধ্রুবের অপর পত্নীর নাম ছিল ইলা। তিনি ছিলেন বায়ুর কন্যা। ইলার গর্ভে উকল নামক পুত্র ও যোষিগণের মধ্যে রত্নস্বরূপাতি মনোহরা একটি কন্যার জন্ম হয়।

ইতিমধ্যে অকৃতদার উত্তম একদিন হিমাচলে মৃগয়া করতে গিয়ে কোনো বলবান যক্ষ কর্তৃক নিহত হয়েছিলেন। পুত্রহারা সুরুচি তাকে অনুসন্ধান করতে করতে ঐ পর্বতের কাছে এসে দাবানলে দগ্ধ হন। এদিকে উত্তমের মৃত্যুসংবাদ ধ্রুবের কানে পৌঁছাল। তিনি ক্রোধ, ক্ষোভ ও শোকে অভিভূত হলেন। তৎক্ষণাৎ তিনি জয়শীল রথে আরোহণ করে যক্ষালয় বা অলকাপুরী অভিমুখে গমন করতে উদ্যত হলেন। ধ্রুব উত্তরাভিমুখে গমন করে রুদ্রানুচর ভূত, প্রেত ও পিশাচ অধিষ্ঠিত হিমালয়ের উপত্যকায় যক্ষগণ পরিব্যাপ্ত অলকাপুরী দেখতে পেলেন। সেখানে গিয়ে মহাবাহু ধ্রুব আকাশ ও দিক-সমূহ প্রতিধ্বনিত করে শঙ্খনাদ করলেন।

হে বিদুর, সেই উচ্চ শঙ্খনাদে যক্ষপত্নীগণ অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ও ভীত হলেন। তারপরে মহাবলশালী যক্ষবীরগণ সেই আওয়াজে সচকিত হয়ে অস্ত্রধারণপূর্বক পুরীর থেকে বহির্গত হলেন। তাঁরা সকলে ধ্রুবের দিকে যুদ্ধের জন্য অগ্রসর হলেন। মহাধনুর্ধর ধ্রুব সেই সব যক্ষদের এক একজনের প্রতি তিনটি বাণ নিক্ষেপ করতে লাগলেন। এভাবেই সকলকে তিনি আহত করতে লাগলেন। ধ্রুব কর্তৃক নিক্ষিপ্ত বাণে, সেসকল যক্ষ– বীরগণের ললাটবিদ্ধ হওয়ায় তারা নিজেদের পরাজিত মনে করলেন। ধ্রুবের বীরত্বের প্রশংসা করতে লাগলেন।

সর্প যেমন কারও পদাঘাত সহ্য করতে পারে না, যক্ষ সেনানীরাও তেমনি প্রবের ঐ বাণবর্ষণ সহ্য করতে পারে না। তারা দ্বিগুণ প্রতিশোধের ইচ্ছায় উন্মত্ত হয়ে উঠল। সকলে ছটি করে বাণ দিয়ে ধ্রুবকে আঘাত করতে উদ্যত হল।

ধ্রুবের কর্মের প্রতিবিধান করার ইচ্ছায় তেরো অযুত যক্ষ সেনারা ক্রুদ্ধ হয়ে পুরিখ নিস্ত্রিংশ, প্রাস, শূল, কুঠার, শক্তি, যস্টি, ভুষন্ডী ও বিচিত্র পক্ষবিশিষ্ট বাণ দ্বারা ধ্রুবকে আঘাত করতে লাগল। প্রবলবেগে বারিপাতের সময় পর্বর্তও দৃষ্টিগোচর হতে পারে না, তেমনি ক্রমাগত শরবর্ষণে ধ্রুবও সাময়িক অদৃশ্য হলেন। আকাশমার্গে বিচরণ করে সিদ্ধপুরুষেরা এই যুদ্ধ দর্শন করছিলেন। তারা ধ্রুবের এই অবস্থা দেখে হাহাকার করতে শুরু করলেন। তারা এই বলে আক্ষেপ করতে লাগলেন যে, ‘হায় হায়’ সূর্যের মতো অতি তেজস্বী মানব ধ্রুব কিনা যক্ষসেনাদের প্রতিরোধে বিনষ্ট হল।

তখন যুদ্ধক্ষেত্রে যক্ষদের প্রবল জয়োল্লাস শোনা গেল। তখনই, নীহারবিদারী সূর্যদেবের মতো, ধ্রুবের রথ শত্রুর অস্ত্রজাল ছিন্ন করে পুনরায় দৃষ্টিগোচর হল। ধ্রুব তখন নিজ ধনুতে বাণ প্রযুক্ত করে শত্রুগণকে আক্রমণ করতে উদ্যত হলেন। বায়ু প্রবলবেগে বহমান হলে যেমন মেঘরাশি ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় তেমনি ধ্রুবের বাণসমূহ যক্ষসেনাদের অস্ত্রকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করল। ধ্রুবের ধনু থেকে নির্গত তীক্ষাগ্র শরসকল, যক্ষগণের বর্ম ভেদ করে তাদের দেহ বিদ্ধ করল। ইন্দ্ৰকর্তৃক নিক্ষিপ্ত বর্জ্য যেমন সুকঠিন পর্বতকেও বিদীর্ণ করে দেয়, তেমনি এই শরাদি যক্ষদের বিদীর্ণ করছিল। হে বীর, ধ্রুবের ভল্ল–অস্ত্র দ্বারা যক্ষগণ আহত ও ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। তাদের মনোহর কুন্তলশোভিত মস্তক, স্বর্ণময় উরু, বলয় প্রভৃতিতে সজ্জিত বাহু, হার, কেয়ুর, মুকুট, উষ্ণীষ– সেই রণক্ষেত্রে ইতস্ততঃ ছড়িয়ে ছিল। এতে সেই যুদ্ধভূমি অতি উজ্জ্বল রূপে শোভিত হল। ক্ষাত্র শ্রেষ্ঠ ধ্রুব কর্তৃক নিক্ষিপ্ত বাণে, প্রায় সব যক্ষসেনার অঙ্গাদি ছিন্নভিন্ন হল। বাকী আহত যক্ষবীরেরা সিংহ তাড়িত হস্তীর মতো রণক্ষেত্র থেকে অপসৃত হলেন।

তারপর মনুবংশের সর্বোত্তম ধ্রুব যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্রপানি কাউকে দেখতে পেলেন না। তখন ধ্রুব প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও যক্ষপুরীর অন্তঃস্থলে প্রবেশ করলেন। মায়ার খেলা সম্যক অনুধাবন করার ক্ষমতা কোনো মানুষেরই করায়ত্ত নয়। ধ্রুব নিজ সারথীর কাছে তা স্বীকার করলেন। তিনি বললেন– “মায়াবীগণের কার্য মনুষ্যের বোধগম্য নয়।” মনে মনে ধ্রুব যখন তখন শত্রুর অতর্কিত আক্রমণের প্রতীক্ষা করছিলেন।

হঠাৎ সেসময় সমুদ্রগর্জনের ন্যায় ঘোরতর নির্ঘোষ শোনা গেল। প্রবল বায়ুপ্রবাহে চতুর্দিকে ধূলিতে সমাচ্ছন্ন হয়ে গেল। ক্ষণিকের অবকাশে, গগনে ঘন মেঘ সঞ্চারিত হ’ল। ঐ মেঘে বিদ্যুৎ স্ফুরিত হচ্ছিল এবং ভয়ানক শব্দে বজ্রপাত মুহুর্মুহু হয়ে চলেছিল।

হে নিষ্পাপ বিদুর, তখনই ধ্রুবেরই চতুষ্পর্শে রক্ত, শ্লেষ্ম, পূ, বিষ্ঠা, মূত্র ও মেদ বর্ষণ হতে লাগল। ক্রমে আকাশতলে এক বিরাট পর্বতের উদ্ভব হল। সেই পর্বতগাত্র থেকে শিলা, গদা, পরিখ, নিস্ত্রিংশ ও মুষল বৃষ্টি হতে শুরু করল। চতুর্দিকে মস্তকহীন দেহসকল পতিত হতে লাগল। বহুসংখ্যক সর্প যেন হঠাৎ জাগ্রত হয়ে ভয়ংকর নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে রোষান্বিত নয়ন থেকে অগ্নি উদগীরণ করতে লাগল। সিংহ, ব্যাঘ্র, হস্তী প্রভৃতি উন্মত্ত হয়ে উঠল। তারা ইতস্ততঃ যুথে যুথে ধাবমান হল। সমুদ্রের তরঙ্গ ভয়ংকর রূপ ধারণ করল। প্রবল তরঙ্গের আকারে তা তটভূমি প্লাবিত করে ভূমিকে ছাপিয়ে গেল। প্রলয়কালীন জলোচ্ছ্বাসের মতো সমুদ্র যেন প্রচন্ড বেগে ধ্রুবকে গ্রাস করতে এগিয়ে এল।

হে বিদুর, যক্ষগণ ক্রুর চেষ্টায় আসুরী মায়া বিস্তার করেছিল। তার প্রভাবেই এসকল অমঙ্গলজনক ঘটনার প্রকাশ হয়েছিল। তবুও এসকল উৎপাতে যে কোনও অধীর ব্যক্তির মনেই আশংকার ছায়া ঘনিয়ে আসা সম্ভব।

যক্ষগণ ধ্রুবের প্রতি ঐরূপ আসুরী মায়া বিস্তার করেছিল। এ কথা জ্ঞাত হয়ে ঋষিগণ ধ্রুবের কাছে উপনীত হলেন। পরম শ্রদ্ধা ও প্রেমভরে তারা ধ্রুবকে আশ্বস্ত করলেন। তারা ধ্রুবকে বললেন–হে উত্তানপাদ নন্দন ধ্রুব, যাঁর নামোচ্চারণ বা শ্রবণেই মৃত্যুকে জয় করা যায়, তুমি তাঁর আশীর্বাদ ধন্য। প্রণতজনের আর্তিহরণকারী ভগবান শ্রীহরি তোমার শত্রুদের বিনাশ করুন। তোমার মঙ্গল হোক।

.

একাদশ অধ্যায়
স্বায়ম্ভুব মনুর তত্ত্বপোদেশ দ্বারা ধ্রুবের রণ হতে নিবৃত্তিকরণ

মৈত্রেয় বিদুরকে সেই ঘটনাবলীর বিবরণ দিতে লাগলেন। ঋষিগণের পূর্বোক্ত উপদেশাবলী স্মরণ করে ধ্রুব মনঃস্থির করলেন। প্রথমে আচমন দ্বারা নিজেকে শুদ্ধ করে নিজ ধনুতে নারায়ণাস্ত্র সন্ধান করলেন। হে বিদুর, জ্ঞানের উদয় হওয়া মাত্র যেমন রাগ ক্লেশ প্রভৃতি বিনষ্ট হয়, তেমনি নারায়ণাস্ত্র সন্ধান করামাত্র গুহ্যক নির্মিত মায়াসমূহের বিনাশ হল। ধ্রুব শরাসনে নারায়ণাস্ত্র সন্ধান করার সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে বহুসংখ্যক শর নিঃসৃত হল। ময়ুরগণ যেমন ভীষণ রবে. ডাকতে ডাকতে বনমধ্যে প্রবেশ করে, শরগুলি তেমনি যক্ষ সেনানীদের ব্যুহে প্রবেশ করতে লাগল।

ঐ শরগুলির রূপ ছিল অতি অপূর্ব। তাদের মুখের দুই প্রান্ত স্বর্ণমণ্ডিত তাদের পক্ষগুলি কলহংসের ডানার মতো মনোহর দর্শন, যুদ্ধভূমিতে সেই শরসমূহ যক্ষসেনাদের পীড়িত করায় তারা অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। সর্পসকল যেমন ফণা তুলে গরুড়কে আক্রমণ করতে উদ্যত হয়েছিল তেমনি তারা স্বীয় অস্ত্র ধারণ করে ধ্রুবের দিকে ধাবিত হল।

ধ্রুব রণভূমিতে সেই যক্ষগণকে আক্রমণোদ্যত দেখে তাদের দিকে বাণবর্ষণ করতে লাগলেন। তাঁর অবিরাম শরবর্ষণের দ্বারা যক্ষদের বাহু, উরু, গ্রীবা, উদর প্রভৃতি ছেদিত হল। ঊর্ধরেতা সন্ন্যাসীরা সূর্যমণ্ডল ভেদ করে যে লোকে গমন করেন সেই লোকে ধ্রুব কর্তৃক আক্রান্ত যক্ষগণ গমন করলেন।

মহাবীর ধ্রুব, অজস্র নিরপরাধ যক্ষকে বধ করতে উদ্যত হয়েছেন দেখে পিতামহ স্বায়ম্ভুব মনু দয়াপূর্বক সেখানে উপনীত হলেন। ঋষিগণের সাথে মনু সেখানে উপস্থিত হয়ে ধ্রুবকে বলতে লাগলেন যে- ধ্রুব, তুমি অন্যায় ক্রোধের বশবর্তী হয়ে নিরপরাধ যক্ষদের প্রতি অন্যায় করছ। এই ক্রোধ নরকের দ্বার-স্বরূপ ও পাপপূর্ণ। এই প্রকার ক্রোধ সদা বর্জনীয়। তুমি এ নিন্দিত কর্ম থেকে নিবৃত্ত হও।

বৎস ধ্রুব, তুমি এই যে নিরপরাধ যক্ষদের নিধন করতে শুরু করেছ এটা অতি নিন্দিত কর্ম। এটা আদপেই আমাদের কুলোচিত কর্ম নয়। ভ্রাতৃবৎসল ধ্রুব তোমার ভ্রাতার শোকে অভিতপ্ত হয়ে তুমি অধীর হয়েছ। একজন মাত্র যক্ষের অপরাধে, তার সঙ্গে বহু নিরপরাধ যক্ষের হত্যালীলায় মত্ত হয়েছ। এই প্রত্যক্ষ পরিদৃশ্যমান দেহকে আত্মারূপে অনুভব করে পশুর ন্যায় পরস্পরের প্রতি দ্বেষমূলক। আচরণ লিপ্ত হয়েছ। তুমি এই যে প্রতিহিংসায় মেতে উঠেছ, তা কখনই ভগবান হৃষীকেশের অনুগামীদের কাম্য নয়।

তুমি সর্বভূতে আত্মজ্ঞান করত সবর্ভূতময় শ্রীহরির উপাসনা করেছ। তাতেই তুমি নিরন্তর শ্রীহরির ধ্যান করতে থাক। তুমি ভগবানের ভক্তগণেরও অতি প্রিয়পাত্র। সাধুগণের আচরণীয় পথের দিশা পেয়েছ। তবু এরূপ নিন্দিত কর্ম তোমার দ্বারা কিভাবে আচরিত হল?

বৎস, শত্রুর ঔদ্ধত্য সহ্য করা, নীচ ব্যক্তির প্রতি করুণা, সমান ব্যক্তির সঙ্গে মিত্রতা ও সকল প্রাণীতে সমান দর্শন- এই সকল গুণের অধিকারী ব্যক্তি ভগবানের প্রসন্নতা লাভ করেন। ভগবান প্রসন্ন হলে জীবের প্রকৃত গুণত্রয় অর্থাৎ সত্ত্বঃ, রজঃ ও তমো গুণের বিমোচন হয়। তিনি তখন গুণের কার্য-স্বরূপ লিঙ্গ শরীর থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত হয়ে সুখরূপ ব্রহ্ম লাভ করেন। (তুমি যদি আত্মতত্ত্ব বিচার করতে পার দেখবে তোমার ভাইয়ের কোনও অস্তিত্বই নেই। সুতরাং, তাকে কেউ বধ করে তোমার ক্ষোভের কারণ হতে পারে না।)

এই পৃথিব্যাদি পঞ্চভূত দেহাকারে পরিণত হয়ে স্ত্রী এবং পুরুষ রূপে সৃষ্টি হয়। একথা প্রচলিত যে, স্ত্রী-পুরুষের পরস্পরের সহায়তায় এ সংসারে অপরাপর স্ত্রী ও পুরুষের জন্ম হয়। হে রাজন, এভাবে পরমাত্মার মায়ার প্রভাবে গুণসকলের বৈষম্যের কারণে সৃষ্টি, স্থিতি ও সংহার কার্য প্রবর্তিত হয়। সত্ত্বগুণের আধিক্যহেতু, স্থিতি, রজগুণের অধিক্যের কারণে সৃষ্টি ও তমোগুণের আধিক্যজনিত কারণে সংহার ক্রিয়া সাধিত হয়। নির্গুণ ঈশ্বর এই সৃষ্টি প্রভৃতির কারণ স্বরূপ।

অয়স্কান্ত মণির প্রভাবে যেমন লৌহ ভ্রমণ করে, তেমনি ঈশ্বরকে নিমিত্ত করেই এই কার্য –কারণস্বরূপ বিশ্ব পরিবর্তিত হচ্ছে। পরমপুরুষ ঈশ্বর কালশক্তির সাহায্যে গুণত্রয়কে ক্ষোভিত করেন। এভাবে তিনি সৃষ্টাদি শক্তিকে বিভক্ত করেন। অকর্তা হয়েও তিনি এই বিশ্বের সৃষ্টি কর্তা! আবার হন্তা না হয়েও তিনি হত্যাকারী। মহত্তম ভগবানের লীলা অর্থাৎ কালশক্তি অচিন্ত্যনীয়। (কালশক্তি কি কারণে একত্রে গুণসমূহকে ক্ষোভিত করেন না, তা অজ্ঞাত)। কালরূপী ভগবান অনাদি (জন্মরহিত), অব্যয় (ক্ষয়াদি রহিত) এবং অনন্ত (অবিনাশী)। তিনি পিত্রাদির পুত্র প্রভৃতির জন্ম দিয়ে থাকেন, তাই তিনি জন্মদাতা বা সৃষ্টিকর্তা। আবার রাজা প্রভৃতিকে দিয়ে তিনি দুর্জন ও চৌরাদির মৃত্যু ঘটিয়ে থাকেন তাই তিনি বিনাশকর্তা। তাঁহার দ্বারাই সৃষ্টি ও সংহার সাধিত হয়। তিনি পিত্রাদির দ্বারা উৎপন্ন করেন একথা সত্য হলেও তারাও আবার অন্য থেকে উদ্ভূত হয়েছেন। অতএব, তাদের সৃষ্টি বিষয়ে কোনো স্বাতন্ত্র নেই। এই ভগবান মৃত্যুরূপে সমানভাবে সকল প্রাণীর অভ্যন্তরে প্রবিষ্ট হন। তার স্বপক্ষ বা বন্ধু কেউ নেই। আবার বিপক্ষ বা শত্রু বলেও কিছু নেই। প্রবাহমান বায়ুতে অনুগামী ধুলিরাশির ন্যায় সকল প্রাণী স্বীয় কর্মের অধীন থেকে নিজ নিজ কর্ম পরতন্ত্র হয়ে ঈশ্বরের অনুগামী হয়ে থাকে।

ঈশ্বর সর্বনিয়ন্তা, এ বিষয়ে সকলে একমত। কিন্তু তার বিষয়ে শুধুমাত্র নাম-মাত্রে বিবাদ বর্তমান। তাঁকে মীমাংসকগণ কর্ম বলে অভিহিত করেন। জ্যোতিষীরা তাকে গ্রহাদি দেবতা বলে ভক্তি করেন। বাৎসায়ণ প্রভৃতিরা তাঁকে কাম বা বাসনা বলে বর্ণনা করেন।

হে বৎস, ঈশ্বর অব্যক্ত, তাকে বল ও বুদ্ধি দ্বারা ব্যক্ত করা যায় না। তিনি অপ্রমেয় অর্থাৎ প্রত্যক্ষ প্রমাণাদির ঊর্ধ্বে। তার থেকে নানাবিধ মহত্তত্ত্বাদি শক্তির উদয় হয়। তার ইচ্ছা সকলের অজ্ঞাত। সুতরাং স্বয়ম্ভ সেই ভগবানের ইয়ত্তা করতে কেউ পারে না।

হে বৎস ধ্রুব, এই কুবেরের অনুচরবৃন্দ তোমার ভ্রাতৃহত্যার কারণ নয়। বৎস, কর্মফলদাতা হলেন শ্রীভগবান। সেই পরমেশ্বরই জীবের সৃষ্টির কারণ। সেই ভগবানই বিশ্বের সৃষ্টি, পালন ও সংহার করেন। তা সত্ত্বেও তার এ বিষয়ে কোনো অহংকার নেই। এজন্য তিনি সদা নির্লিপ্ত কারণ তিনি গুণ ও কর্মের দ্বারা লিপ্ত হন না। এই ভগবান সর্বভূতের অন্তর্যামী, সর্বভূতের নিয়ন্ত্রক ও সর্বভূতের প্রতিপালক। তিনি স্বীয় মায়াশক্তির প্রভাবে প্রাণীগণের সৃষ্টি পালন ও সংহার করে থাকেন। হে তাত, নাসিকাতে রজ্জবদ্ধ বলীবদের মতো বিশ্বস্রষ্টা মহাপুরুষেরাও তাঁর নিমিত্ত পুজোপহার বহন করেন। তিনিই ভক্তগণের নিকট অমৃত-স্বরূপ। আবার অভক্তদের মৃত্যুর কারণও তিনিই। তিনি পরমেশ্বর এবং বিশ্বের সকলের সর্বশ্রেষ্ঠ আশ্রয়। অতএব তুমি সর্বান্তকরণে সেই ভগবানেরই আশ্রয় গ্রহণ কর।

হে বৎস, তুমি মাত্র পাঁচ বৎসর বয়সে বিমাতার কুবাক্য শ্রবণে মর্মাহত হয়েছিল। তখনই তুমি নিজ জননীকেও পরিত্যাগ করে বনে গমন করেছিলে। তুমি কঠোর তপস্যা দ্বারাই ইন্দ্রিয়বৃত্তি জয় করেছ। সেভাবে ঈশ্বরের আরাধনা করে তুমি ত্রিলোকের উপরিস্থিত স্থান লাভ করেছ। সেই তুমি আবার তাঁর স্মরণ গ্রহণ করো। বৎস ধ্রুব, এখন তুমি আত্মদর্শী হয়ে সেই নিষ্ঠুণ অবিনশ্বর আত্মার অন্বেষণ কর। তিনি সর্বদাই বিমুক্ত নির্বিরোধী অন্তঃকরণে সততই বিরাজ করেন। ভগবানের থেকে পৃথক কিছু নেই। ভেদজ্ঞানের কারণে তাতেই এই অসৎ বিশ্ব প্রতীয়মান হচ্ছে। হে তাত, এভাবে ঈশ্বর, সর্বশক্তিমান সর্বজনের অন্তর্যামী, আনন্দরূপ ও অনন্ত ভগবানরূপে আরাধনা কর তার অসীম কৃপায় তোমার সুদৃঢ় অহংকার গ্রন্থিরূপ “আমি আমার এই ভাব দূর হয়ে যাবে।

ধ্রুব তুমি ক্রোধ সংবরণ কর। তোমার মঙ্গল হোক। হে রাজন, ঔষধ দ্বারা কঠিন ব্যাধিরও উপশম হয়। তুমি তেমনি প্রচুর উপদেশ বাক্য শ্রবণের মাধ্যমে কল্যাণের একান্ত প্রতিকূল বিষয়ের শান্তি কর। ক্রোধে অভিভূত ব্যক্তি জনগণের উদ্বেগের কারণ, নিজ কল্যাণকামী, জ্ঞানী ব্যক্তি তুমি। তুমি সেই ক্রোধের বশীভূত হতে যাবে কেন?

বৎস, ধনাধিপ কুবের হলেন ভগবান গিরিশের ভ্রাতা, তুমি তাকে অবজ্ঞা করছ। কারণ, তুমি বহুসংখ্যক নিরপরাধ যক্ষকে নিজ ভ্রাতৃহন্তা বোধ করে হনন করেছ। হে তাত, মহৎ ব্যক্তির তেজ অতীব ভয়ংকর, তার প্রবল তেজ আমাদের বংশকে অভিভূত করলে, সর্বনাশ হয়ে যাব। তার আগেই তুমি শীঘ্র ধনপতি কুবেরকে প্রণতিপূর্বক প্রসন্ন কর।

স্বায়ম্ভুব মনু, এভাবে নিজ পৌত্রকে উপদেশ প্রদান করলেন। ধ্রুব তাকে ভক্তিভরে প্রণাম করলেন। তার দ্বারা অভিনন্দিত মনু, ঋষিগণের সাথে আনন্দিত মনে নিজ ভবনে প্রত্যাগমন করলেন।

.

দ্বাদশ অধ্যায়
(ধ্রুবের স্ব-পুরে প্রত্যাগমন যজ্ঞানুষ্ঠান ও সশরীরে হরিধামে গমন)

মুনিবর মৈত্রেয় বললেন– বিদুর, ধনপতি কুবের যখন শ্রবণ করলেন যে ধ্রুব পিতামহ মনুর উপদেশে ক্রোধ পরিত্যাগ করেছে, তিনি অত্যন্ত প্রীত হলেন। তিনি চারণ যক্ষ ও কিন্নরগণ দ্বারা কুবে’র বললেন– হে নিষ্পাপ ক্ষাত্ৰকুমার, আমি তোমার প্রতি তুষ্ট হয়েছি। কারণ তুমি শ্রদ্ধেয় ভগবান মনুর আদেশে দুস্ত্যজ বৈরীভাব ত্যাগ করেছ। হে বৎস, তুমি যেমন যক্ষদের বধ করোনি, যক্ষরাও তেমনি তোমার ভাইকে বধ করেনি। কারণ প্রাণীগণের জন্ম ও মৃত্যুর নিয়ন্তা কেবলমাত্র কাল। পুরুষের আত্মস্বরূপের অজ্ঞানবশত, আত্মব্যতিরিক্ত দেহাদিতে আত্মবুদ্ধির ফলেই স্বপ্নকালীন, জ্ঞানের মতো ‘আমি’ ‘তুমি’ ভেদ হয়। ঐ ভেদবুদ্ধি দ্বারা দেহানুসন্ধান করার ফলেই কষ্ট ও দুঃখাদি লাভ হয়ে থাকে।

হে ধ্রুব, তোমার কল্যাণ হোক। তুমি প্রজা প্রতিপালনার্থে নিজ রাজ্যে গমন কর। তুমি সর্বভূতে পরমাত্মাদর্শন পূর্বক সংসারহারী ভগবানের ভজনা কর। তাঁর চরণপদ্ম জীবের একমাত্র আরাধনীয় বস্তু। তাই তিনি সংসারনিবর্তক। তিনি ইন্দ্রিয়ের অগোচর। তিনি কখনও শক্তিরূপা গুণময়ী আত্মমায়াতে যুক্ত হন। আবার কখনও বা বিরহিত হয়ে থাকেন।

হে উত্তানপাদ নন্দন, ধ্রুব! তোমার অন্তরের বাসনা কী? নিঃসঙ্কোচে আমার কাছে তা ব্যক্ত কর। তুমি বরলাভের উপযুক্ত। কারণ আমরা শ্রুত হয়েছি, যে তুমি ভগবান শ্রীহরির পদযুগলের অতি নিকট স্থান লাভ করেছ।

মৈত্রেয় বললেন– পরমভাগবত ধ্রুবকে কুবের বর প্রার্থনার জন্য অনুরোধ করলেন। ধ্রুব তখন, ভগবান হরির প্রতি অচলা ভক্তি প্রার্থনা করলেন। কারণ ভগবানের করুণার সাহায্যে অনায়াসে, দুস্তর সংসার–সাগর অতিক্রম করা যায়।

তারপর কুবের প্রীতিপূর্ণ হৃদয়ে ধ্রুবকে সেই বরদান করলেন। তারপর কুবের ধ্রুবের সম্মুখেই অন্তর্হিত হলেন।

ধ্রুব নিজ পুরীতে প্রস্থান করলেন। সেখানে তিনি বহু উপচারে প্রচুর দক্ষিণা সহযোগে যজ্ঞানুষ্ঠান করে শ্রীহরির অর্চনা করলেন। তিনি তখন সর্বজীবের আত্মা সর্বোপাধি বর্জিত শ্রীভগবানে মনপ্রাণ সমর্পণ করলেন। ঐকান্তিক ভক্তিযোগের দ্বারা ধ্রুব নিজ আত্মাতে ও সকল প্রাণীতে সেই বিভুকে দর্শন করতে লাগলেন।

বৎস বিদুর, ধ্রুবের এই শীলতা, দীনের প্রতি দাক্ষিণ্য, ধর্মানুচরণ দেখে প্রজাগণ তাঁকে পিতার ন্যায় মান্য করতেন। এভাবে ধ্রুব ভোগের দ্বারা পুণ্যক্ষয় করলেন। তিনি অভোগ অর্থাৎ যজানুষ্ঠান ও ব্রত পালানাদির দ্বারা পাপসকল বিনাশ করে ত্রিশ হাজার বছর পৃথিবী শাসন করলেন। সংযতপ্রাণ মহাত্মা ধ্রুব, বহু বৎসর ত্রিবর্গ সাধন করার পরে, সিংহাসনে নিজ পুত্রকে অভিষিক্ত করলেন।

সেসময় তার মনে হল, স্বপ্নে যেমন অবিদ্যা দ্বার গন্ধবনগর বিরচিত হয়, তেমনি এই দেহ প্রভৃতি ও সমগ্র জগৎ ঐশ্বরিক মায়ায় আত্মাতে বিরচিত হয়েছে। তখন ধ্রুবের দেহ, পুত্র, মিত্র –কলত্র, সমৃদ্ধ ধনাগার প্রভূত রাজ সম্পদের প্রতি তীব্র বৈরাগ্য জন্মাল। তিনি আসমুদ্র হিমাচলের মায়ারচিত ও অনিত্য বিবেচনা করলেন। এরপরে তিনি তপস্যার জন্য বদরিকাশ্রমে গমন করলেন।

ধ্রুব, বদরিকাশ্রমের পুণ্যজলে স্নান করে শম–দমাদি দ্বারা বিশুদ্ধন্দ্রিয় হলেন। অতঃপর আসন রচনা করে তাতে উপবিষ্ট হলেন। প্রাণায়াম করে তিনি প্রাণবায়ুকে বশীভূত করলেন। মন দ্বারা ইন্দ্রিয়াদিকে বিষয় থেকে প্রত্যাহার করে বিরাট মূর্তি ভগবানের স্থূলরূপে ঐ মনের ধারণা করলেন। তারপরে ধ্যানে নিবিষ্ট হলেন। ক্রমে তিনি ধাতৃধ্যেয় ভেদশূণ্য হয়ে সমাধিস্থ হলেন, তখন তার স্থলরূপের ধ্যান পরিত্যাগ হল। এই প্রকারে ধ্রুব ভগবান হরি প্রতি অবিচ্ছিন্ন ভক্তিভাব বহন করতে লাগলেন। তাঁর দু’চোখ দিয়ে ক্রমাগত আনন্দাশ্রু প্রবাহিত হতে লাগল। তিনি আত্মবিস্মৃত হলেন। (অর্থাৎ তিনি যে ধ্রুব, এরূপ বোধ আর রইল না।) তিনি অহংকারাদিস্বরূপ সাংসারিক অভিমান থেকে মুক্ত হয়েছেন।

তারপর ধ্রুব দেখলেন পূর্ণিমার চন্দ্রের মতো দশদিক আলোকিত করে আকাশপথ বেয়ে একটি রথ নীচে নেমে আসছে। তারপরেই তিনি রথে উপবিষ্ট দু’জন শ্রেষ্ঠ দেবতা দর্শন করলেন। তাঁদের উভয়ের গাত্রবর্ণ শ্যামলা, লোচন অরুণবর্ণ তারা চতুর্বাহু ও তরুণ। তারা গদা হস্তে দণ্ডায়মান ছিলেন। তাদের অতি মনোহর বদন, উজ্জ্বল কুন্তলাবৃত অপূর্ব হার, অঙ্গদ ও কিরীটে সজ্জিত রূপে ধ্রুব বুঝতে পারলেন যে তারা ভগবানের কিঙ্কর। অতি ব্যগ্র হয়ে উত্থান করলেও যথবিধি পূজার্চনা করতে বিস্মৃত হলেন। তিনি শুধুমাত্র কৃতাঞ্জলিপুটে ভগবানের নাম উচ্চারণ করতে করতে পার্ষদদ্বয়কে প্রণাম করলেন। তারা দুজন ছিলেন, পদ্মনাভের অতি প্রিয় দুজন সহচর, সুনন্দ ও নন্দ।

তারা দেখলেন ধ্রুবের চিত্ত সদাই শ্রীকৃষ্ণের চরণকমলে অভিনিবিষ্ট রয়েছে। তিনি আমাদের অভ্যর্থনার জন্যই– শুধুমাত্র কৃতাঞ্জলি ও বিনয়ে অবনত হয়ে দণ্ডায়মান রয়েছেন।

সুনন্দ ও নন্দ বললেন–হে রাজন, তোমার মঙ্গল হোক। তুমি সশরীরে বিষ্ণুপদে আরোহণ করবে। এখন আমাদের বাক্য শ্রবণ করো। আমরা অমিল জগতের নিয়ন্তা শাঙ্গন্ধ ভগবানের কিঙ্করদ্বয়। যে ভগবান পঞ্চমবর্ষীয় বালক, তোমার সাধনায় তুষ্ট হয়েছিলেন, তোমাকে সেই ভগবানের ধামে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের এখানে আগমন।

হে ধ্রুব, তুমি দুর্জয় বিষ্ণুপদ জয় করেছ। তা সপ্তর্ষিগণেরও অগম্য। তারাও অধঃস্থলে অবস্থান করে, কেবল সেই ধাম দর্শন করে থাকেন। চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্রেরা যাকে অহরহ প্রদক্ষিণ করছে, তুমি সেস্থানে অধিষ্ঠান করবে।

হে অঙ্গ, তোমার পিতৃপুরুষ অথবা অপর কোনও ব্যক্তি এখনও পর্যন্ত সেখানে গমন করতে সক্ষম হননি। এজগতের পরম পূজনীয় বিষ্ণু পদেই তুমি অবস্থান করবে। হে আয়ুষ্মন, পুণ্যশ্লোক শিখামনি ভগবান তোমারই জন্য এই শ্রেষ্ঠ বিমানটি দিয়েছেন। তুমি সশরীরে আরোহণ কর বৎস।

মৈত্রেয় বললেন–হে বিদুর, ভগবানের অত্যন্ত আদরণীয় ধ্রুব, তার পার্ষদগণের কথা শ্রবণ করলেন। তিনি প্রথমে স্নান, নিত্যকর্ম সম্পন্ন করে মুনিদিগকে ভক্তিভরে প্রণাম করলেন। তাঁদের নিকট থেকে আশীর্বাদ গ্রহণ করে প্রীত মনে বিমানের নিকট গমন করলেন। শ্রেষ্ঠ বিমানটিকে প্রদক্ষিণ ও বন্দনা করে ভগবানের পার্ষদদ্বয়কে অভিবাদন করলেন।

তারপরে ধ্রুব বিমানে আরোহণ করতে উদ্যত হলেন। তখনই তার শরীর হিরন্ময় অর্থাৎ তেজোময় হল। ধ্রুবের পূর্বের স্বাভাবিক রূপই শুধুমাত্র হিরন্ময় হয়ে গেল। তখন চতুষ্পর্শে দুন্দুভি, মৃদঙ্গ-প্রভৃতি বাদ্য মঙ্গলরবে বাজতে লাগল। শ্রেষ্ঠ গন্ধর্বগণ সংগীত গাইতে লাগলেন। আকাশ থেকে পুষ্পবৃষ্টি শুরু হল।

বিষ্ণুলোকে আরোহণের পূর্বমুহূর্তে ধ্রুবের মাতা সুনীতির কথা স্মরণে এল। তিনি মনে মনে ভাবতে লাগলেন, মাতাকে বিরহ যন্ত্রণা দিয়ে একাকী আমি কিভাবে এই দুর্লভ বিষ্ণুলোকে গমন করব। সুনন্দ ও নন্দ, ধ্রুবের মনোভাব বুঝতে পারলেন। মাতা সুনীতি যে আগেই বিমানে আরোহণ করে বিষুধামে গমন করছেন সে দৃশ্য তারা ধ্রুবকে দর্শন করালেন। গগনপথে পরিভ্রমণকালীন সময়ে, বৈমানিক দেবগণ ধ্রুবের প্রশংসা করে পুষ্পবৃষ্টি করতে লাগলেন। ক্রমশঃ তিনি গ্রহাদি দর্শন করলেন।

ধ্রুব এইভাবে বিমানযোগে ত্রিলোক ও সপ্তর্ষিমণ্ডল অতিক্রম করলেন ক্রমশঃ তাদেরও ঊর্ধ্ববর্তী বিষ্ণুলোকে উপনীত হলেন। যে বিষ্ণুলোক স্বীয় জ্যোতিতে সদাই দীপ্যমান। তার প্রভাবেই এ ত্রিভুবন রচিত হয়েছে। জীবের প্রতি দয়াহীন লোকেরা, কখনই সে লোকে যেতে সমর্থ হয় না। নিরন্তর মঙ্গলাচরণকারী লোকেরাই সেখানে যেতে সমর্থ হয়। যে সকল ব্যক্তিবর্গ শান্ত বা ভোগবাসনা রহিত, সর্বত্র সমদর্শী পবিত্র হৃদয় এবং ভগবান অচ্যুতের প্রিয়ভক্ত তারা অনায়াসে বিষ্ণুপদ লাভ করতে পারেন।

এভাবেই রাজা উত্তানপাদের পুত্র কৃষ্ণপরায়ণ ধ্রুব ত্রিলোকের নির্মল চূড়ামণির তুলনীয় ছিলেন। হে কুরুশ্রেষ্ঠ বিদুর, ধ্রুব যে পরম আকাঙ্ক্ষিত স্থান লাভ করলেন, সেখানে জ্যোতিশ্চক্র নিরন্তর গগণের মেধি– ভ্রমণের ন্যায় ভ্রাম্যমান। ভগবান নারদ ঋষি কুবের মহিমায় আর্ভিভূত হয়ে প্রচেতাদের ব্রহ্মযজ্ঞে বীণাবাদন করতঃ শ্লোক গান করেছিলেন। সেখানে তিনি ধ্রুবের মহিমা প্রতিপাদক তিনটি শ্লোকের গায়ন করেছিলেন।

দেবর্ষি নারদ বললেন– পতিনিষ্ঠা সুনীতির পুত্র ধ্রুব তপস্যাবলে যে ফল লাভ করেছে, তা অতি শ্লাঘনীয়। বেদবিদ ব্রহ্মর্ষিগণেরও তা সহজলভ্য নয়, রাজাদের কথা আর কি বলব? মাত্র পঞ্চবর্ষীয় বালক ধ্রুব, আমার আদেশে ভগবান হরির সাধনায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। বিমাতার কুবাক্য তার হৃদয়ে যে বেতনার উদ্রেক ঘটায় তা উপশমার্ধে সে কঠোর তপস্যার ব্রতী হয়। অজিত ভগবান হরিকে সে প্রগাঢ় ভক্তিতে বশীভূত করেছিল।

ভগবান শুধুমাত্র নিজ ভক্তগণের গুণেই বশীভূত হন। অতি অল্প বয়সে, মাত্র ছয়মাসের তপস্যায় ধ্রুব বৈকুণ্ঠনাথ শ্রীহরিকে তুষ্ট করে তার পদরেণু লাভ করতে পেরেছেন। সমগ্র পৃথিবীর অপর কোনো ক্ষত্রিয় পুরুষ বহু চেষ্টাতেও সেই পদে আরোহণের সংকল্প করতেও পারে না।

মৈত্রেয় বললেন–বিদুর, তুমি আমাকে যা যা প্রশ্ন করেছিলে আমি তোমাকে বললাম। হে কৌরব্য, পরম ভাগবত ধ্রুব অতি যশস্বী তার চরিত্র সাধুজনসম্মত। এই ধ্রুব চরিত্র ধন-সম্পদ প্রাপ্তির কারণ তার চরিত্র-কথা শ্রবণ যশোবর্ধক, আয়ুবর্ধক, পুণ্যসাধক, পাপনাশক ও মনঃশোধক। অচ্যুতপ্রিয় ধ্রুবের এই চরিতকথা শ্রবণে সকল ক্লেশের উপশম হয়। এই ধ্রুবচরিত্র মহত্ত্বকামীর মহত্ত্বপ্রাপ্তি। এই কাহিনি শ্রবণ বা বর্ণনে শীলাদি গুণের জন্ম হয়। তেজস্বী ব্যক্তিগণের সভায় পুণ্য শ্লোক ধ্রুবের এই মহৎ চরিত্র কীর্তন করবে। অমাবস্যা, পূর্ণিমা, কৃষ্ণচতুর্দশী, দ্বাদশী, শ্রবণানক্ষেত্র, ত্র্যহস্পর্শ, ব্যতিপাত যোগ, সংক্রান্তি ও রবিবারে এটি ভক্তিভাবে পাঠ করবে। নিষ্কাম ও ভগবানের চরণকমলে শরণাপন্ন হয়ে শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তিদের পাঠ করাবে। তাহলে আত্মাই আত্মার প্রতি প্রসন্ন হবেন। এভাবেই সিদ্ধিলাভ হবে। তত্ত্বজ্ঞানহীন ব্যক্তিকে ভগবন্মার্গের অমৃতরূপ জ্ঞানপ্রদানকারী ব্যক্তিদের প্রতি দেবতাগণ অনুগ্রহ ও অনুকম্পা প্রকাশ করেন।

হে কৌরব্য বিদুর, যে ধ্রুব বাল্যকালে মাতৃস্নেহ ও ক্রীড়াপকরণ ত্যাগ করে ভগবান বিষ্ণুর শরণাপন্ন হয়েছিলেন, আমি এতক্ষণ সেই মহৎ বিশুদ্ধকর্মা ব্যক্তির চরিত্র বর্ণনা করলাম।

.

ত্রয়োদশ অধ্যায়
ধ্রুবের বংশে পৃথুর জন্মকথনার্থ বেন–পিতা অঙ্গের বৃত্তান্ত বর্ণন

সূত বললেন–মুনিবর মৈত্রেয়ের কাছে ধ্রুবের সশরীরে স্বর্গ গমনের কাহিনি শ্রবণ করলেন বিদুর। বিদুর পুনরায় অতি ভক্তিভরে ভগবান অবোজকে প্রশ্ন করলেন। তিনি বললেন– হে সুব্রত, আপনি বললেন, দেবর্ষি নারদ প্রচেতাদের যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হয়ে ধ্রুবের মহিমা– ব্যাঞ্জক তিনটি শ্লোকগান করেন, কিন্তু ঐ প্রচেতাগণ কারা? তারা কোন্ বংশে ও কাদের ঔরসে জন্মগ্রহণ করে বিখ্যাত হন? তাদের জন্মস্থলই বা কোথায় অবস্থিত ছিল? হে মুনিবর, আমরা জানি দেবর্ষি নারদ হলেন মহাভাগবত। দেবতুল্য নারদের দর্শন অতীব পুণ্যকর। তিনি ভগবানের পরিচর‍্যা বিষয়ক ক্রিয়াযোগ পঞ্চরাত্রে বলেছিলেন।

আমরা শুনেছি যে, স্বধর্মশীল প্রচেতাগণ তাদের আয়োজিত যজ্ঞে ভগবান যজ্ঞমূর্তি নারায়ণের আরাধনা করেছিলেন। তৎকালে দেবর্ষি নারদ নম্র বিনীত বচনে ভগবানের স্তবগান করেছিলেন। হে মুনিবর, দেবর্ষি নারদ বর্ণিত ভগবকথা শুনতে আমার মন বড়ই উৎসুক হয়েছে। আপনি আমাকে দয়া করে সকল লীলাকথাই বর্ণনা করুন।

মৈত্রেয় বললেন– মহাত্মা ধ্রুবের পুত্র ছিলেন উকল। পিতার বনে গমনকালের পরে, সকল ভূমির আধিপত্য লাভ করলেন তিনি। রাজ্যশাসনের ভারও তার উপরে ন্যস্ত হল। তিনি আজন্ম শান্তচিত্ত নিঃসঙ্গ অর্থাৎ বিষয়ে নিরাসক্ত ছিলেন। সমস্ত প্রাণীকে তিনি নিজ আত্মায় অনুভব করতেন। আবার নিজ আত্মা অর্থাৎ ভগবানকে সকল প্রাণীর অভ্যন্তরে অধিষ্ঠিত জ্ঞান করতেন। নিজেকে তিনি নির্বিকার ব্রহ্মস্বরূপ দেহাভিমান রহিত, পরমাত্মার সঙ্গে অভিন্নরূপে উপলব্ধি করতেন। নিরন্তর যোগাগ্নির দ্বারা তার সকল বাসনারূপ কর্মফল দগ্ধ হয়েছিল।

তাই তিনি নিজেকে পরমপুরুষ পরমাত্মার সঙ্গে অভিন্ন বলে মনে করতেন। তিনি তখন ভগবান ব্যতীত অপর কিছু দর্শন করতে পারতেন না। অজ্ঞজনের কাছে তিনি জড় অন্ধ, মূক ও বধিররূপে প্রতীয়মান হলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি তা ছিলেন না। তাঁর প্রকৃত সত্ত্বা ভস্মাচ্ছদিত অগ্নির ন্যায় অপ্রকাশিত ছিল।

রাজ্যের কুলবৃদ্ধ ও অমাত্যগণ উকলকে জড় ও উন্মত্ত বিবেচনা করে, তাকে রাজ সিংহাসনের অনুপযুক্ত বিবেচনা করলেন। তারা তখন ভূমির পুত্র বৎসরকে সিংহাসনে বসালেন। রাজা বৎসরের সর্বাপেক্ষা প্রিয় মহিষী ছিলেন সুবীথী। সুবীথীর গর্ভে তার ছয়টি সন্তানের জন্ম হয়। তাঁদের নাম ছিল পুষ্পর্ন, তিগ্নকেতু, হষ, ঊর্জ, বসু এবং জয়। পুষ্পর্নের আবার দুই পত্নী ছিলেন। তারা হলেন প্রভা ও দোষা– প্রভার তিনটি পুত্রের নাম ছিল –প্রাতঃস মধ্যন্দিন এবং সায়ং। দোষার তিন পুত্র ছিল–

প্রদোষ, নিশীথ ও বুষ্ট। বুষ্টের পত্নীর নাম ছিল পুষ্করিণী। তার একমাত্র পুত্রের নাম ছিল সর্বতেজা। সর্বতেজার পত্নী ছিলেন আকুতি। তার গর্ভে যে পুত্রের জন্ম হয়, তার নাম ছিল চাক্ষুষ মনু। ঐ মনুর ঔরসে দ্বাদশ পুত্রের জন্ম হয়। তারা সকলেই নির্মল ও শুদ্ধচিত্ত সম্পন্ন ছিলেন। তাদের নাম হল পুর, কৃৎস্ন, ঋত, দ্যুম্ন, ত্রিত, সত্যবান, ব্রত, অগ্নিষ্টোর্ম, অতিরাত্র, প্রদ্যুম্ন, শিবি এবং উন্মুক। উন্মুকের পত্নী পুষ্করিনঈর গর্ভে দুটি পুত্রের জন্ম হয়। তারা হলেন — অঙ্গ, সুমনা, স্বাতি, ক্রতু, অঙ্গিরা ও গয়।

অঙ্গের পত্নীর নাম সুনীথা। তার গর্ভজাত পুত্রের নাম বেন। বেন ছিলেন অতি উগ্র স্বভাবা ও দুশ্চরিত্র। তার দুঃশীলতায় পীড়িত হয়ে পিতা অঙ্গ রাজপুরী পরিত্যাগ করেন। বৎস বিদুর, মুনিগণের বাক্য বজ্রসম অমোঘ, মুণিদের অভিসম্পাতে বেন অবশেষে মৃত্যুমুখে পতিত হয়।

রাজ্য তখন রাজাহীন হয়ে পড়ল। দস্যুরা নিরীহ প্রজাদের ওপর পীড়ন করতে শুরু করল। তখন নিরূপায় দেখে মুনিগণ পুত্র উৎপাদনাৰ্থে বেনের দক্ষিণ হস্ত মন্থন করলেন। তখন তাতে নারায়ণের অংশে আদিরাজ পৃথুর জন্ম হয়।

বিদুর প্রশ্ন করলেন, হে মুনিবর, অতিশয় সুশীল রাজা অঙ্গ, তিনি অতি মহান, সাধু ও ব্রাহ্মণগণের অনুবর্তী ছিলেন। তাঁর ঐরূপ কুসন্তান কিরূপে উৎপন্ন হল? যার জন্যে তিনি বনগমনে বাধ্য হলেন, আবার বেনও রাজা হয়ে স্বয়ং দণ্ডব্ৰত ধারণ করেছিলেন। তবু মুনিগণ তার ওপরে কুপিত হয়ে ব্রহ্মশাপ দিলেন কেন? প্রজাপালক রাজা যদি অপরাধীও হন, তবু তিনি প্রজাগণের অবজ্ঞেয় নন। কারণ স্বীয় শক্তির প্রভাবে রাজা ইন্দ্রাদি লোকপালগণের তেজ ধারণ করেন। হে ব্ৰহ্মণ, আপনি সর্বজ্ঞ পরমেশ্বর বেত্তাদের মধ্যে অন্যতম। আমাকে কৃপাপূর্বক আপনি সুনীথা পুত্র বেনের চরিত্র বর্ণনা করুন।

মৈত্রেয় বললেন– বিদুর, রাজর্ষি অঙ্গ মহাক্রতু অশ্বমেধ যজ্ঞানুষ্ঠান করেছিলেন। সেখানে ব্রহ্মবাদী ঋত্বিকগণ মন্ত্রপাঠ ও আরাধনা করেছিল। তাদের যথাবিধি পূজাতেও দেবগণ সেই যজ্ঞের হবি গ্রহণ করলেন না।

পুরোহিতরা তখন বিস্মিত হয়ে যজমানকে বলতে থাকেন, দেবগণ কেন এ যজ্ঞে আহুত হয়েও এলেন না, তা বুঝতে পারছি না। হে রাজন, আপনার যজ্ঞীয় হবির কোনও দোষ হয় নি। আপনি অত্যন্ত শ্রদ্ধাসহকারে সকল দ্রব্যই আহরণ করেছেন।

এই যজ্ঞে মন্ত্র প্রয়োগকর্তা ছিলেন ধৃতব্রত ঋত্বিকগণ। দেবগণের প্রতি কোনরূপ অবহেলা তো এখানে করা হয় নি স্বয়ং দেবতাগণই তো কর্মের সাক্ষী। তাঁরাই কর্মের দোষগুণের দ্রষ্টা তবু কেন তারা যজ্ঞস্থলে উপনীত হয়ে, নিজ ভাগ গ্রহণে অনিচ্ছুক, তা আমাদের হৃদয়ঙ্গম হচ্ছে না।

মৈত্রেয় বললেন– বিদুর, ব্রাহ্মণদের এই কথা শুনে যজমান রাজা অঙ্গ অতি দুর্মনা হলেন। তিনি যজ্ঞকালীন মৌনব্রত অবলম্বন করেছিলেন। কিন্তু এরূপ ঘটনায় তার চিত্তচাঞ্চল্য ঘটল। তিনি সমবেত সদস্যদের অনুমতি ক্রমে মৌনভঙ্গ করলেন।

হে সদস্যগণ দেবতাগণ যথাবিধিত পূজ্য ও আহুত হয়েও এই যজ্ঞে এলেন না। নিজ ভাগ, সোমপাত্র গ্রহণ করলেন না কেন–তা আপনারা বলুন। আমি কি অপরাধ করেছি, তা আপনারা বলুন।

সদস্যগণ বললেন– হে রাজন, এ জন্মে আপনার বিন্দুমাত্র অপরাধ নেই। তবে পূর্বজন্মের পাপের ফলে আপনি এ জন্মে ধর্মশীল হয়েও পুত্রহীন। আপনি পুত্রলাভের চেষ্টা করুন। তাতে আপনার মঙ্গল হবে। পুত্র প্রার্থী হয়ে আপনি যজ্ঞেশ্বর হরির উপাসনা করুন। তিনি নিশ্চয়ই আপনার মনস্কামনা পূর্ণ করবেন।

আপনি অপত্যনিমিত্ত যজ্ঞমূর্তি শ্রীনারায়ণকে বরণ করলে অন্যান্য দেবতারাও নিশ্চয়ই নিজ নিজ অংশ গ্রহণ করবেন। উপাসক ব্যক্তি ভক্তিপূর্ণ হৃদয়ে যা যা কামনা করে, হরি সমস্ত প্রদান করেন। যে যে ভাবে হরি পূজিত হন সেই ভাব অনুসারে ফল লাভ হওয়া সম্ভব।

ঋষিগণ এভাবে মনস্থির করে অঙ্গের পুত্র লভ্যার্থে পূজা শুরু করলেন। তারা অপত্যনিমিত্ত শিপিবিষ্ট বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে পুরোজশ আহুতি প্রদান করলেন। তখনই সেই যজ্ঞাগ্নি থেকে একজন সুদর্শন পুরুষ উথিত হলেন। তার গলায় স্বর্ণমাল্য এবং হস্তে পায়েসপূর্ণ স্বর্ণপাত্র ধৃত ছিল। নির্মলকান্তি সেই পুরুষের কাছ থেকে অঙ্গ অঞ্জলি ভরে সেই সুপক্ক পায়েস গ্রহণ করলেন। আনন্দিত মনে তার আঘ্রাণ নিজে গ্রহণ করলেন। পরে ব্রাহ্মণদের অনুমতিক্রমে তা সুনীথাকে ভোজন করতে বললেন। পুত্রহীনা মহিষী সুনীথা সন্তানোৎপাদক ঐ পায়েস ভক্ষণ করে গর্ভধারণ করলেন। যথাসময়ে তিনি একটি পুত্র প্রসব করলেন। সুনীথা ছিলেন মৃত্যুর কন্যা। তার গর্ভজাত সন্তান ছেলেবেলা থেকেই মাতামহের অনুগামী ছিল। অঙ্গ ও সুনীথার পুত্রের নাম ছিল বেন। মাতামহ মৃত্যু, স্বয়ং অর্ধমাংশ প্রভব, তার অনুবর্তী হওয়ায় অঙ্গরাজ তনয় বেন ক্রমশঃ অধর্মের অনুসারী হয়ে উঠল।

অধার্মিক বেন বনমধ্যে অসহায় মৃগদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করত। বাল্যকালে খেলার সঙ্গীদের সে হঠাৎ অতি নির্দয়ভাবে খেলতে খেলতে মেরে ফেলত। তার নিষ্ঠুরতায় প্রজাসকল অত্যন্ত ভীত ছিল। তাকে দূর থেকে দেখতে পেলেই আতঙ্কিত হয়ে “ঐ বেন আসছে” বলে চিৎকার করত। মহারাজ অঙ্গ নানাভাবে শাসন করেও তাকে সংযত করতে পারলেন না। বেনের এরূপ নির্দয়তা, কলস্বভাব, রাজা অঙ্গকে অত্যন্ত বিমর্ষ করে তুলল। তার মনে হল, যে সকল গৃহস্থ পুত্রহীন ও যারা দুশ্চরিত্র পুত্রের অধিকারী নন, তারা অতি সৌভাগ্যবাণ। তারা নিশ্চয়ই ভক্তিভাবে ভগবান বিষ্ণুর আরাধনা করেছেন।

কুপুত্র দ্বারা যেকোনো ব্যক্তির অশেষ মানসিক ব্যথা উৎপন্ন হয়। এর ফলে যাবতীয় পাপ, অধর্ম ও সকলের সঙ্গে বিরোধিতার সম্ভাবনা থাকে। যে কুপুত্ৰ সংসারের সকল দুঃখের কারণ, তাকে আর কে ভালবাসতে পারে। সে নামেমাত্র পুত্র, প্রকৃতপক্ষে আত্মার বন্ধন মাত্র। এরূপ পুত্রের গৃহাশ্রম ক্লেশকর ভিন্ন সুখকর কখনও সম্ভব নয়।

তবে প্রেমাস্পদ সৎপুত্রের চেয়ে বরং কুপুত্র ভালো। কারণ কুপুত্রের কারণে সংসার– দুঃখ অনুভূত হয় বলে মনুষ্যগণ সংসারে নিরাসক্ত হয়। তাদের মনে বৈরাগ্যের জন্ম হয়।

এরূপে রাজা অঙ্গের নির্মোহ জন্মাল, রাত্রিকালে তাঁর ভালোভাবে নিদ্রা হত না। গভীর রাতে তিনি পত্নী সুনীথাকে নিদ্রামগ্ন দেখে শয্যা ত্যাগ করে রাজগৃহ থেকে নিষ্কান্ত হলেন। অতুল ঐশ্বর্যাদি পরিত্যাগ পূর্বক বৈরাগ্য প্রাপ্ত রাজন অঙ্গ গৃহত্যাগ করলে, অমাত্য ও পুরোহিতগণ তাকে যত্রতত্র অনুসন্ধান করলেন। তিনি নিজপুরেই গূঢ়ভাবে অবস্থিত ছিলেন। তাই তারা কেউই পৃথিবীর অন্য কোথাও তাকে খুঁজে পেলেন না। হতোদ্যম হয়ে তারা রাজপুরীতে প্রত্যাগমন করে সমবেত ঋষিদের রাজার নিরুদ্দেশ সংবাদ প্রদান করলেন। তখন সকলে অশ্রুপাত করতে লাগলেন।

.

চতুর্দশ অধ্যায়
দ্বিজগণ কর্তৃক বেনের রাজ্যে অভিষেক ও রোষবশতঃ তার বধ

মৈত্রেয় ঋষি বললেন– হে বিদুর, রাজ্য পরিত্যাগ করে মহারাজ অঙ্গ প্রবজ্যা গ্রহণ পূর্বক বনে গমন করলেন।

তখন লোকসকলের মঙ্গলকামী মুনিগণ বিবেচনা করে দেখলেন যে রাজাহীন রাজ্যে দস্যুদলের হাতে প্রজাগণের পীড়ন অবশম্ভাবী। তখন বেদবেত্তা ব্রাহ্মণগণ সুনীথাকে আহ্বান করলেন। তার নিকটে তারা বেনকে রাজ্যে অভিষিক্ত করার প্রস্তাব করলেন। অমাত্যগণের প্রবল অসম্মতি সত্ত্বেও অনুপযুক্ত বেন তখন সিংহাসনে আসীন হলেন। উগ্রস্বভাবা, প্রচণ্ডশাসন বেনের সিংহাসনে আরোহণের সংবাদে দস্যুগণ সর্পভয়ে ভীত হয়ে মুষিকের ন্যায় আত্মগোপন করল।

রাজসিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে বেনের ঔদ্ধত্য দিনে দিনে বর্ধিত হতে লাগল। লোকপালগণের কোষাদি অর্থ-ঐশ্বর্যের দ্বারা সমৃদ্ধ বেন, নিজেই নিজেকে প্রধান মনে করতে শুরু করল। “আমিই শূর, আমি পণ্ডিত” — এরূপ সত্ত্বেও সে পূজ্য ও মহৎ ব্যক্তিগণেরও অমর্যাদা শুরু করল।

এভাবে ঐশ্বর্য মদমত্ত বেন অন্ধ ও দর্পিতভাবে নিরঙ্কুশ হস্তীর ন্যায় রথে আরোহণ পূর্বক স্বর্গমর্ত কম্পিত করে বিচরণ করতে লাগল। তারপর চারদিকে ভেরী বাজিয়ে সে ঘোষণা করল ব্রাহ্মণগণের যজ্ঞ, দান, হোম ও কোনও প্রকার ধর্মাচরণ রাজ্যে নিষিদ্ধ।

এসময়ে সত্র নামক এক যজ্ঞে মুণিগণ সমবেত হয়েছিলেন। তারা সকলে বেনের এরূপ অসদাচরণ লক্ষ করে অতিশয় চিন্তান্বিত হলেন।

লোকসকলের দুর্দশার কথা ভেবে তারা ‘হায় হায়’ করতে লাগলেন। তারা বলতে লাগলেন যে, কাষ্ঠমণ্ডের দুটি প্রান্তদেশে অগ্নিপ্রজ্জ্বলিত হলে যেমন পিঁপড়েদের দুর্দশা হয়, তেমনি অবস্থা এই রাজ্যের প্রজাগণের। একদিকে দস্যুদলের ভয়, অপরদিকে স্বয়ং রাজার দ্বারাই তারা ভয়ানক বিপদের মধ্যে পতিত হয়েছে।

রাজাহীন রাজ্যের অরাজক অবস্থার কথা চিন্তা করে আমরাই বেনকে রাজাসনে অধিষ্ঠিত করেছিলাম। কিন্তু সেদিক থেকেই অধিক বিপদ সমুপস্থিত হয়েছে। এখন প্রজাদের কল্যাণসাধন কিভাবে সম্ভব? দুগ্ধ কলা সহযোগে পুষ্ট সর্প তার পোষক ব্যক্তিরও অনিষ্ট করে তেমনি যে বেনকে আমরাই রাজা নিরূপণ করেছিলাম, সে এখন সমগ্র প্রজাদের বিনাশ করতে উদ্যত হয়েছে, এই বেন স্বভাবত মল সুনীথার গর্ভজাত সন্তান। আমরা তবুও চেষ্টা করব তাকে সুযুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে সৎপথে নিয়ে আসার। তাতে যদি বেনকৃত পাপ আমাদের রেহাই দিতে পারে। কারণ আমরা তার অসততা জ্ঞাত হয়েও তাকেই রাজা নির্বাচন করেছিলাম। যদি– অধার্মিক বেন, আমাদের সদুপদেশ গ্রহণ করে তো ভাল, নতুবা লোকগণের ধিক্কারে অর্ধদগ্ধ বেনকে আমরাই স্বীয় তেজ দ্বারা দগ্ধ করব।

এই রূপে মনস্থির করে মুণিগণ নিজেদের ক্রোধ সংবরণ করলেন। তারা বেনের কাছে উপনীত হয়ে বলতে লাগলেন –হে নৃপশ্রেষ্ঠ, আমাদের হিতোপদেশ শ্রবণ কর। এতে তোমার আয়ু, বল, ঐশ্বর্য ও যশ বৃদ্ধি পাবে। কায়মনোবাক্যে সম্পাদিত ধর্ম-কর্মের আচরণের ফলে মনুষ্যের স্বর্গলাভ হয়। নিষ্কাম কর্ম দ্বারা ভগবানের সাধর্ম বা মোক্ষলাভ হয়ে থাকে।

হে বীর, তোমার কাছে শ্রেষ্ঠ আচরণীয় ধর্ম হল প্রজাপালন। তা তুমি নষ্ট কোরো না, কারণ এই ধর্ম থেকে বিচ্যুত হলে রাজা তার ঐশ্বর্য থেকে ভ্রষ্ট হয়। হে রাজন, যে নৃপতির শাসনে প্রজাগণ দুষ্ট অমাত্য ও দস্যুদের হাত থেকে রক্ষিত হন, তিনি ইহলোক ও পরলোকে সুখলাভ করতে পারেন।

মহারাজ, যে রাজার রাজ্যে ও পুরমধ্যে প্রজাগণ নিজ নিজ আচরণীয় ধর্মদ্বারা ভগবানের অর্চনা করেন, সেই রাজার প্রতি স্বয়ং ভগবানও পরিতুষ্ট হন। ব্রহ্মাদিগণেরও ঈশ্বর ভগবান নারায়ণ পরিতুষ্ট হলে, সকল বস্তুই প্রাপ্য হয়। লোকপালাদির সঙ্গে সমস্ত লোক তার জন্যই পরমাদরে পুজোপ্রচার আহরণ করে।

হে রাজন, তিনি চতুর্দশ ভুবনাত্মক সকল লোক দেবগণ ও যজ্ঞসমূহের অধিষ্ঠাতা। তিনিই দেবাত্মক, যজ্ঞীয় দ্রব্যাত্মক ও তপস্যাত্মক। সেই ভগবান বিষ্ণুকে যারা নিজ নিজ ধর্মমতে নানাবিধ যজ্ঞোপচারে আরাধনা করেন, প্রজাদের সেই সেই কর্মে প্রবৃত্ত করা তোমার কর্তব্য। এতে তোমারই কল্যাণ হবে। ব্রাহ্মণগণ তোমার রাজ্যে অধিষ্ঠিত হয়ে নানাবিধ যজ্ঞ, হোম সহযোগে হরির অংশরূপ দেবতাদের অর্চনা করেন, তারা তুষ্ট হলে বাঞ্ছিত ফললাভ সম্ভব হয়। সেজন্য ব্রাহ্মণগণকে তুমি কখনও অবজ্ঞা কোরো না।

বেন তাচ্ছিল্যভরে বলল– ওহে তোমরা বড়ই মূর্খ। আমার ভজনা ত্যাগ করে তোমরা নারায়ণের আরাধনা করতে চলেছ। কুলটা নারীর মতো তোমাদের জীবিকাদ পতি আমাকে পরিত্যাগ করেছে। জরাতুল্য কম্পিত পতি শ্রীবিষ্ণুর আরাধনায় মেতে উঠেছ। নৃপরূপ ঈশ্বরকে যারা অবজ্ঞা করে, তারা ইহলোক বা পরলোক– কোথাও সুখী হয় না। প্রতিপ্রেমহীনা কুলটা রমণীগণের উপপতিতে অনুরাগের মতো, তোমাদের যার প্রতি এত ভক্তি সে কে? কে সেই যজ্ঞপুরুষ? ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, ইন্দ্র, বায়ু, যম, সূর্য, কুবের, চন্দ্র, পৃথিবী, অগ্নি বরুণ ও অন্য দেবাদিগণ সকলেই এই রাজদেহে বর্তমান, অতএব রাজা সর্বদেবময়।

আমি ছাড়া অন্য অগ্রভুক পুরুষ কে থাকতে পারে? হে ব্রাহ্মণগণ মাৎসর্য ত্যাগ করে নিজ নিজ কর্ম দ্বারা আমার অর্চনা কর। আমার উদ্দেশ্যে পুজোপকরণ প্রদান করলেই তোমাদের সকল অভীষ্ট সিদ্ধ হবে।

মৈত্রেয় বললেন– এইরূপ ভ্রষ্ট বুদ্ধি, ধর্মচ্যুত, পাপাচারী বেন বারংবার ঋষিগণকে অবজ্ঞা করতে লাগল। তাঁদের সদুপদেশে কর্ণপাত না করে, উপর্যুপরি তাদের প্রত্যাখ্যান করল। এতে মুণিগণ অতীব ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন। তারা বলতে লাগলেন –এই বেন পাপাত্মা, অতি দুরাচারী, অতি শীঘ্র একে বিনাশ করা প্রয়োজন। কারণ এই দুরাত্মা জীবিত থাকলে, এর পাপের আগুনে সমগ্র জগৎ বিধ্বংস হবে। এই বেন যজ্ঞেশ্বর হরির নিন্দায় প্রবৃত্ত। যে হরির কৃপায় সকল ঐশ্বর্য লাভ সম্ভব, একমাত্র অশুভবুদ্ধি বেন ছাড়া অপর কেউ তাকে অবজ্ঞা করতে পারে না। এই পাপাচারী, রাজাসনে আরোহণের যোগ্য নয়। মুণিগণ এতক্ষণ ক্রোধকে সম্বরণ করে ছিলেন। এবার তারা ক্রোধ প্রজ্জ্বলিত করে ভয়ংকর হুঙ্কার দিয়ে বেনকে বধ করলেন। এই দুরাচারী বেন, ভগবান অচ্যুতের নিন্দায় আগেই হত ছিল। তারপর ঋষিগণ নিজ নিজ আশ্রমের উদ্দেশ্যে গমন করলেন। পুত্র শোকগ্রস্তা জননী সুনীথা যোগবিদ্যা দ্বারা নিহত পুত্রের মৃতদেহ রক্ষা করে রইলেন।

একসময় ঐ মুনিসকলে সরস্বতী নদীতে অবগাহনপূর্বক যথানিয়মে অগ্নিহোমাদি করলেন। এরপর তারা নদীতটে সমবেত হয়ে ভগবৎ কথার আদান-প্রদানে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন, হঠাৎ তারা দেখতে পেলেন, চতুর্দিকে কিছু অমঙ্গলজনক উৎপাত উপস্থিত হয়েছে। তাঁরা বলাবলি করতে লাগলেন –রাজাহীন রাজ্য কি কোনও দস্যুর হস্তে নিপীড়িত?

এমন সময়ে তারা দেখলেন, সকল দিক থেকে ধাবমান ধনলুণ্ঠনকারী দস্যুদের পদক্ষেপে সমাচ্ছন্ন চারপাশ! রাজাহীন রাজ্যে নির্ভয়ে দস্যুরা গৃহস্থদের ধন লুণ্ঠনে ব্যস্ত। একে অন্যের প্রতি হিংসায় রত। জনপদকে দুর্বল ও দস্যুদের আক্রমণে ত্রস্ত হতে দেখেও ঋষিগণ কিছুই করলেন না। যদিও তারা এই প্রকার অরাজক অবস্থার প্রতিবিধানে সক্ষম, তবু এক্ষণে হিংসার আশ্রয় নেওয়া অনুচিত বিবেচনা করলেন।

তারপর তারা মনে মনে ভাবলেন যে, সমদর্শী, শান্ত ব্রাহ্মণেরা যদি বিপন্ন ব্যক্তিদের রক্ষার্থে সচেষ্ট না হন, তাহলে সমূহ বিপদ! এমনকি ছিদ্র পাত্র থেকে যেমন দুধ বেরিয়ে যায়, তেমনি ধীরে ধীরে ব্রাহ্মণগণের পবিত্র তপোবনও বিনষ্ট হতে পারে। তারা এও ভাবলেন যে, রাজর্ষি অঙ্গের বংশ একেবারে বিলুপ্ত হওয়া ঠিক নয়। বহু বীর ও ভগবদভক্ত ব্যক্তি এই বংশে জন্ম নিয়েছেন।

এরূপ বিবেচনা করে তারা মৃত বেনের ঊরু সবলে মন্থন করতে লাগলেন। সেখান থেকে এক ঘোর কৃষ্ণবর্ণ খর্বকায় পুরুষ উত্থিত হল। তার অঙ্গাদি অতি হ্রস্ব এবং বাহুদ্বয় ক্ষুদ্র। তার কপালের দুই প্রান্তভাগ বৃহৎ, নিম্ন নাসা, লালবর্ণ চক্ষু ও তাম্রবর্ণ কেশ।

সে অতি দীনভাবে, নত হয়ে ঋষিগণকে প্রশ্ন করল–তার কী করণীয়? মুণিগণ তাকে বললেন–“নির্ষীদ”। অর্থাৎ বোসো, এই মাত্র বললেন। হে বিদুর, মুণিগণ নির্ষীদ বলায় উদ্ভূত ব্যক্তির নাম

“নিষাদ” হল। তার যে বংশ হল, তার নাম হল নৈষাদ। ঐ পুরুষ জন্মেই বেনের অতি উগ্র পাপসমূহ নিজ দেহে ধারণ করল। তার বংশধরগণ নিষাদজাতি হয়ে গিরি ও কাননে অর্থাৎ বনে-জঙ্গলে বসবাস করতে লাগল।

.

পঞ্চদশ অধ্যায়
পৃথুর উৎপত্তি ও রাজ্যভিষেক

মৈত্রেয় বললেন– বিদূর অনন্তর ব্রাহ্মণবর্গ মৃত ও অপুত্রক বেনের বাহুদ্বয় মন্থন করতে শুরু করলেন। এর ফলে একজন স্ত্রী ও একটি পুরুষের উদ্ভব হল। ব্রহ্মবাদী মুনিগণ সেই জাত মিথুন অর্থাৎ স্ত্রী পুরুষকে অবলোকন করলেন। তখনি তারা বুঝতে পারলেন এরা স্বয়ং ভগবানের অংশ। মিথুনের মধ্যে এই পুরুষ ভগবান বিষ্ণুর ভুবনপালন অংণ ও স্ত্রী অংশ হলেন সহজাত লক্ষ্মীদেবীর অংশ। এই পুরুষ ক্রমে জগতের শ্রেষ্ঠ রাজা হিসেবে বিবেচিত হবেন। তাই ইনি বিপুলকীর্তি অর্থাৎ পৃথুশ্রবা পৃথু নামে পরিচিত হবেন। যে দেবীমূর্তি উদ্ভূত হলেন, তিনি শোভন দন্তযুক্তা ও ভূষণগণের মধ্যে ভূষণরূপা। এঁর নাম অর্চি। ইনি পৃথুকেই পতিরূপে বরণ করবেন।

এই ব্যক্তি সাক্ষাৎ ভগবৎ-অংশ হয়েও লোকপালনের জন্য জন্মগ্রহণ করেছেন। স্ত্রী হলেন স্বয়ং লক্ষ্মীদেবী। ইনি ভগবৎপরায়ণা অর্থাৎ ভগবান ছাড়া অন্য কোথাও তিনি অবস্থান করেন না। এজন্য তারা একসঙ্গে জন্মগ্রহণ করেছেন।

মৈত্রেয় বললেন– বিদূর, ভগবানের অংশরূপী পৃথুর জন্মলগ্নে মঙ্গলজনক ঘটনাবলী ঘটতে লাগল। ব্রাহ্মণগণ তার স্তব করতে লাগলেন। আকাশ থেকে পুষ্প বৃষ্টি হতে লাগল। শঙ্খ, তুর্থ, মৃদঙ্গ ও দুন্দুভি ধ্বনিতে চতুর্দিক মুখরিত হয়ে উঠল। শ্রেষ্ঠ গন্ধর্বগণ গীত গায়ন ও শ্রেষ্ঠ অপ্সরাগণ নৃত্যের মাধ্যমে তাকে অভ্যর্থনা জানাল। দেবতা ঋষি ও পিতৃগণ সকলেই সেখানে উপস্থিত হলেন।– ইন্দ্রাদি দেবগণের সঙ্গে ব্রহ্মা সেখানে এলেন। তিনি বেনপুত্র পৃথুর দক্ষিণ করে চক্র ও চরণদ্বয়ে পদ্ম চিহ্ন দেখতে পেলেন। যাঁর চক্ররেখা রেখান্তরে প্রতিহত হয় না, তিনি সাক্ষাৎ পরমেশ্বরের অংশ। এই বুঝে ব্রহ্মজ্ঞ ব্রাহ্মণেরা তার অভিষেক-ক্রিয়া শুরু করলেন। তখন চতুর্দিক থেকে প্রজাগণ অভিষেকের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি নিয়ে আগমন করতে লাগল। নদী, সমুদ্র, পর্বত, নাগ, গো, পশু পক্ষী, স্বর্গ, পৃথিবীর ও অন্য সকল প্রাণীও নানাবিধ উপহার তাকে প্রদান করল। তারপর উত্তম বসন ভূষণে সজ্জিত হয়ে পৃথু সালঙ্কৃতা পত্নী অর্চিকে সঙ্গে নিয়ে রাজপদে অভিষিক্ত হলেন। তিনি তখন দ্বিতীয় অগ্নির ন্যায় দীপ্যমান হলেন।

হে বীর বিদূর, ধনপতি কুবের তাঁকে কাঞ্চনময় উত্তম আসন প্রদান করলেন, জলাধিপতি বরুণ দিলেন সততঃ সলিল ক্ষরণকারী চন্দ্রবর্ণ ছত্র। বায়ু উপহার দিলেন দুটি ব্যজন। ধর্ম দিলেন কীর্তিময়ী অম্লান পুষ্পহার। ইন্দ্র দিলেন উৎকৃষ্টতম কিরীট। ধর্মরাজ যম তাঁকে শাসনদণ্ড প্রদান করলেন। ব্রহ্মা তাকে দিলেন বেদময় বর্ম, সরস্বতী উত্তম হার, হরি দিলেন সুদর্শন চক্র এবং তার পত্নী লক্ষ্মী অক্ষয় সম্পদ প্রদান করলেন। ভগবান রুদ্র তাকে প্রদান করলেন দশটি চন্দ্রাকার প্রতিবিম্ব খচিত কেশযুক্ত অসি, অম্বিকা দিলেন শত চন্দ্র অঙ্কিত চর্ম।

চন্দ্র তাঁকে দিলেন বলবান অশ্রান্ত অশ্ব। সুন্দর একটি রথ পৃথু উপহার পেলেন বিশ্বকর্মার কাছ থেকে। অগ্নি তাকে দিলেন ছাগ ও গো-শৃঙ্গ নির্মিত ধনু। সূর্য দিলেন রশ্মিময় বাণ। ভূমি তাঁকে উপহার দিলেন যোগময়ী পাদুকা। স্বর্গ থেকে প্রতিদিন পুষ্পবৃষ্টি হতে লাগল। আকাশচারী সিদ্ধ-গন্ধর্বগণ তাঁকে নাট্য, গীত, বাদ্য ও অন্তর্ধাণ বিদ্যা সমর্পণ করলেন। সমুদ্র তাঁকে দিলেন নিজের সলিলোৎপন্ন শঙ্খ। সমুদ্র, পর্বত ও নদীরা তার রথ চলাচলের জন্য পথ দিলেন। ঋষিগণ তাকে আশীর্বাদ করলেন। তারপর সূত, মাগধ ও বন্দিগণ এই সমস্ত স্তবপাঠক স্তব করার জন্য এসে উপস্থিত হল।

মহাপ্রতাপান্বিত বেনপুত্র পৃথু তাদের স্তবপাঠে উদ্যত দেখে হাস্য করলেন। তিনি জলদগম্ভীর কণ্ঠে বললেন–হে সৌম্য সূত, মাগধ ও বন্দিগণ, আমার কোননারূপ গুণই তো এখনও প্রকাশিত হয় নি। তোমরা কি অবলোকন করে আমার স্তব করবে? তোমাদের স্তুতিবাক্য মিথ্যায় পর্যবসিত হোক, এমন আমি চাই না। হে মধুরকণ্ঠী স্তবগায়কগণ, যথাকালে আমার গুণাবলী প্রকাশিত হবে। তখন আমার গুণগান কোরো। অথবা পবিত্র কীর্তি ভগবান হরির লীলাকথা থাকতে সভ্যগণ অতি অর্বাচীনের স্তব অর্থাৎ আমার স্তব করতে যাবেন না।

ভবিষ্যতে অপ্রকাশিত গুণাবলীর প্রকাশ সম্ভবনায় কে স্তাবকতা দ্বারা তার গুণকীর্তন করাতে যাবে? যে ব্যক্তি মিথ্যা গুণস্তবে শ্লাঘান্বিত হয়, সে অতি মূঢ়। সে লোকের উপহাস বুঝতেও অক্ষম। “শাস্ত্রাভ্যাস করলে তোমার বিদ্যা হত”–এই বাক্যেও সে স্তুত হয়। অতি উদারচেতা ব্যক্তিগণ বিত কীর্তি ও বহু গুণের আধার হলেও নিজ প্রশংসা শ্রবণে লজ্জিত হন। তারা নিজের স্তুতিবাদকে নিন্দিত পুরুষকারের মতো নিজের গুণকীর্তন করায় অনুমতি দিতে পারি?

.

ষোড়শ অধ্যায়
বন্দিজন-কৃত মহারাজ মৃধুর স্তুতি

মৈত্রেয় বললেন–হে বিদূর, পৃথুর এইমত বাক্যে সন্তুষ্ট হলেন সুতাদি গায়কগণ। মুনিগণের প্রেরণায় তারা পৃথুর স্তবগানে প্রবৃত্ত হলেন। সূতগণ বলতে লাগলেন — আপনি দেবশ্রেষ্ঠ বিষ্ণু, স্বীয় মায়ার প্রভাবে দয়াপরবশ হয়ে এই অবতার রূপে জন্মগ্রহণ করেছেন। দেবশ্রেষ্ঠ নারায়ণের মহিমা বর্ণনার ক্ষমতা আমাদের নেই। স্বয়ং ব্রহ্মাদিও আপনার গুণকীর্তনে অভিভূত হয়ে পড়েন। আমরা তা কিভাবে যথাযথরূপে ব্যাখ্যা করতে পারি? বেনরাজার অঙ্গজাত আপনার মহাত্ম্য বর্ণনায় আমরা অপরাগ।

তবুও মুনিদের দ্বারা প্রেরিত হয়েছি আমরা। তাদের উপদেশ মত আপনার প্রশংসীয় মুখ্য কর্মকথা বিস্তার করব। আপনি হরির বংশ, উদারকীর্তি পৃথুর কথামৃতের প্রতি আমরা অতিশয় আগ্রহী।

এই পৃথু ধর্মাচারী জনগণের অগ্রণীরূপে লোকসকলকে ধর্মের অনুবর্তী করবেন। তিনি ধর্মের সেতুসকলের রক্ষক এবং ধর্মদ্বেষীগণের বিরোধী হবেন। এক হরিহর পৃথুরূপে জন্ম নিয়ে নিজদেহে ইন্দ্রাদি লোকপালগণের মূর্তি ধারণ করবেন। এভাবেই তিনি যথাসময়ে প্রজাপালনের মাধ্যমে স্বর্গ ও মর্ত্য–উভয়লোকেরই হিতসাধনে সক্ষম হবেন। যজ্ঞাদি প্রবর্তনের মাধ্যমে তিনি স্বর্গলোকের মঙ্গলসাধন করবেন। আবার ব্রহ্মাদি সম্পাদন করে তিনি মর্ত্যলোকের কল্যাণ সাধনে ব্রতী হবেন।

এই মহাত্মা পৃথু সকল প্রাণীতে সমদর্শী ও রাগদ্বেষাদি বর্জিত হয়ে প্রভাব বিস্তার করবেন। সূর্য সবার প্রতি সমানভাবে তাপ বিতরণ করে আটমাস জল আকর্ষণ করেন। তারপর বর্ষাকালে তা প্রদান করেন। এই পৃথু তেমনি নিজ প্রতাপ বিস্তার করে প্রজাদের কাছ থেকে কর আদায় করে অসময়ে তাদের রক্ষা করবেন।

তিনি সর্বংসহা। পৃথিবীর ন্যায় সবার অপরাধ তিনি মার্জনা করে থাকেন। যদি কোনও অপরাধী ব্যক্তিও তাঁর কাছে অনুগ্রহপ্রার্থী হয়, পৃথু তার প্রতি অনুকম্পা প্রদর্শন করেন। দয়ার্দ্র হৃদয়ে পৃথু সবার অপরাধ ক্ষমা করবেন। যথাসময়ে বর্ষণ না হলে তিনি ইন্দ্রের ন্যায় বর্ষণ করবেন। কারণ তিনি লোকহিতৈষী মানবদেহ ধারণকারী স্বয়ং শ্রীহরি।

মহারাজ পৃথু নিজের অনুরাগপূর্ণ দৃষ্টি ও নির্মল হাস্যময় বদনের সাহায্যে সমস্ত লোকের মনোরঞ্জন করবেন। তিনি জলাধিপতি বরুণের ন্যায় দুৰ্জেয় গতি, গুপ্তকর্মা এবং গভীর উদ্দেশ্যে গুপ্তকর্মাবলী সম্পন্ন করবেন। তার ঐশ্বর্য সম্পদ সমস্ত অতি সুরক্ষিত থাকবে। সংযত মনা পৃথু ভগবানের গুণাবলীর আশ্রয়রূপে পরিচিত হবেন।

পৃথু কোরূপ কাষ্ঠ থেকে উৎপন্ন অগ্নিস্বরূপ। তার তেজ দুর্বিষহ। শত্রুরা কেবলমাত্র মনের দ্বারাও ইহাতে প্রাপ্ত হবেন না। ইনি নিকটস্থ হলেও দূরবর্তীর। কেউ তাকে পৌরুষ দ্বারা অভিভূত করতে পারবে না।

গুপ্তচরদের দ্বারা তিনি সকল প্রাণীর ভিতর ও বাইরের সকল কর্মের খোঁজখবর রাখবেন। প্রাণবায়ুর ন্যায় নির্লিপ্ত থেকে প্রভুর মতো আচরণ করবেন। স্বধর্মপথে এই পৃথু নিরপরাধীর প্রতি সহানুভূতিশীল হবেন। আবার নিজপুত্র অপরাধী হলে তার প্রতি সমুচিত দণ্ডবিধান করবেন। যতদূর পর্যন্ত ভগবানের সূর্যদেবের কিরণ উত্তাপ বিকীরিত হয়, ততদূর পর্যন্ত তার শাসন ব্যাপ্ত থাকবে। ইহার শাসন বা রথচক্রের প্রতি সে অঞ্চলে কখনও প্রতিহত হবে না। তাঁর মনোরঞ্জক কার্যাবলীতে সকল প্রজা তুষ্ট হয়ে তাকে রাজা বলে। তিনি দৃঢ়চেতা, সত্যনিষ্ঠ দীনদের প্রতি সহানুভূতিশীল। তিনি সকল প্রাণীর আশ্রয়স্বরূপ বিবেচিত হবেন। তিনি ব্রাহ্মণসহ সকলের প্রতি সম্মানজনক আচরণে ব্রতী থাকবেন।

ইনি পরস্ত্রীকে মাতৃসদৃশ ভক্তি করেন। নিজ পত্নীকে স্বীয় অঙ্গীভূত বলে অনুভব করেন। প্রজাগণের প্রতি তিনি পিতার ন্যায় স্নেহশীল, বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের প্রতি তার আচরণ সেবকের ন্যায় বিনত ও বিনম্র।

সকল দেহধারী প্রাণীর কাছে পৃথু আত্মতুল্য প্রিয়। বন্ধুগণের অনিন্দ বর্ধনে তিনি সহায়তা করবেন। তিনি বিষয়ে বিরক্ত ব্যক্তিগণের সঙ্গলাভে প্রয়াসী হবেন। দুষ্কৃতিকারীর প্রতি তিনি কঠিন দণ্ডবিধান করতে ভীত হবেন না।

তিনি ত্রিগুণের অধীশ্বর। নির্বিকার ও আত্মরূপ, ভগবানের অংশে অবতার রূপে তিনি অবতীর্ণ। অবিদ্যার নানাবিধ তত্ত্ব যথা দেব-মনুষ্যাদি প্রকারভেদে তার মধ্যে রচিত হয়ে প্রতীত হয়। তবে পণ্ডিতগণ তাকে অর্থশূন্য অবস্তুরূপে দর্শন করেন। এই রাজাধিরাজ পৃথু ধরাধামে অদ্বিতীয় বীররূপে আত্মপ্রকাশ করবেন। এভাবে তিনি মনসাচল থেকে উদয়াচল অবধি বিস্তৃত ভূমণ্ডলের শাসনকর্তা হবেন। সেজন্য জয়শীল রথে আরোহণপূর্বক শর শরাসন গ্রহণ করে সমগ্র ভূমণ্ডলকে সূর্যের ন্যায় প্রদক্ষিণ করবেন। এখন পথিমধ্যে স্থানে স্থানে তাকে রাজন্যগণ নানারূপ উপহার প্রদান করবেন। তাদের স্ত্রীগণ পৃথুকে চক্র ও অস্ত্রসমন্বিত দেখে তার যশোকীর্তনে অভিভূত হয়ে তাঁকে আদিরাজ রূপে মান্য করবেন।

প্রজাহিতৈষী মহারাজ পৃথু পৃথিবীকে দোহন করে প্রজাসকলের জীবিকা বিধান করবেন। দেবরাজ ইন্দ্র যেমন বজ্র দ্বারা পর্বত বিদীর্ণ করেছিলেন পৃথুও তেমনি নিজ ধনুকের সাহায্যে গোরূপধারী পৃথিবীকে বিদীর্ণ করে সমতল করবেন। পশুরাজ সিংহের দৃপ্ত সঞ্চারণে যেমন ক্ষুদ্র পশুরা ভীত হয়ে পলায়ন করে তেমনি বীরবর পৃথুও যখন নিজ অজগর ধনুর্বাণ (অজশৃঙ্গ ও গোশৃঙ্গ দ্বারা নির্মিত) উত্তোলন করে পৃথিবীপৃষ্ঠে বিচরণ করবেন তখন অসৎ লোকেরা তার তেজে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে লুকিয়ে পড়তে উদ্যত হবে। মহারাজ পৃথু সরস্বতী নদীর উৎসস্থলে একশত অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠানে ব্রতী হবেন। কিন্তু যজ্ঞ শেষ হবার মুহূর্তে ইন্দ্র তার অশ্ব অপহরণ করবেন।

স্বীয় বাসস্থানের সন্নিকটস্থ উপবনে স্থিত হয়ে এই পৃথু ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করবেন। সেখানে তিনি জ্ঞানীশ্রেষ্ঠ ভগবান সনৎকুমারের সঙ্গে একত্রে পরম ভক্তিভরে পরমাত্মার আরাধনা করবেন। তাতেই তার পরম ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হবে। এই প্রবল পরাক্রমী মহীপতি পৃথুর বিক্রম অতি বহুদূর পর্যন্ত বিখ্যাত হবে। দিক বিজয়কালে তিনি দেশে দেশে নিজ প্রশংসা ও নিজগুণ সম্বন্ধীয় কথকথা শ্রবণ করবেন। তার রথচক্রের গতি কোথাও, কখনও প্রতিহত হবে না। নিজ শক্তিবলে তিনি দিগ্বিজয়ী হয়ে পৃথিবীর কণ্টকরূপ দুষ্টদের পরাহত করবেন। সুর ও অসুরগণ তার মহিমা কীর্তন করবেন। এই পৃথু সমগ্র ভূমণ্ডলের অধীশ্বর হবেন।

.

সপ্তদশ অধ্যায়
পৃথুর অভিষেক ও পৃথিবী কর্তৃক তার স্তব

মৈত্রেয় বললেন–এইভাবে সূতাদি কোপুত্র পৃথুর গুণকীর্তন করলেন। তারা পৃথুকে সুমধুর বাক্যে অভিনন্দিত করলেন। নানাবিধ মূল্যবান অলংকার ও পারিতোষিক প্রদান করে পৃথু তাদের সন্তুষ্ট করলেন। তারপর তিনি ব্রাহ্মণাদি বর্ণসকলকে এবং অমত্য, পুরোহিত ও ভৃত্যগণকে যথোচিত অভ্যর্থনা করলেন। পুরবাসী, দেশবাসী, তৈলিক, তম্বুল–বারসায়ী ও আপামর কর্মচারীগণকে আদর ও অভ্যর্থনায় সম্মানিত করলেন।

বিদূর জিজ্ঞাসা করলেন–হে ঋষিবর বহুরূপধারিণী পৃথিবীর গোরূপ ধারণের কারণ কী? একথা আমরা শুনেছি, মহারাজ পৃথু পৃথিবী দোহন করেছিলেন। সেই দোহনকালে দোহনপাত্র কী ছিল। তখন কেইবা বৎস হয়েছিল? পৃথিবী স্বভাবতঃ বৃষণপৃষ্ঠ বা অসমতল, পৃথু কেন তাকে সমতল করতে উদ্যত হয়েছিলেন। দেবরাজ ইন্দ্র কী কারণে তার যজ্ঞীয় অশ্ব অপহরণ করেছিলেন? রাজর্ষি পৃথু ব্রহ্মবিত্তম ভগবান সনৎকুমারের কাছে অপরোক্ষ ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করে কিরূপ গতি প্রাপ্ত হয়েছিলেন? হে মুনে, ঐ বিষয়সকল আপনি আমাকে ব্যক্ত করুন। ভগবান বিষ্ণুর পৃথু অবতার রূপে কীর্তিত কাহিনী ও যশোকথা সম্পর্কে আমাকে অবহিত করুন। ব্ৰহ্মণ, আমি আপনার ও ভগবান অক্ষেজের ভক্ত। স্বয়ং ভগবান কোপুত্ররূপে এই পৃথিবীর দোহনকর্তা। তার বৃত্তান্ত শুনতে আমি শ্রদ্ধাবনত চিত্তে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।

সূত বললেন– হে শৌনক, বিদূরের অধীর আগ্রহ দেখে প্রীত হলেন মহামুনি মৈত্রেয়। তিনি হর্ষিত চিত্তে বিদুরের প্রশংসা করলেন।

মৈত্রেয় বললেন–হে বিদূর, ব্রাহ্মণগণ পৃথুকে রাজপদে অভিষিক্ত করলেন। তারা পৃথুকে। বললেন–’অদ্যাবধি আপনিই জনগণের রক্ষক ও প্রতিপালক।

তখন পৃথিবীতে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। ক্ষুধার্ত প্রজাগণ দীর্ন শীর্ণ হয়ে পৃথুর কাছে উপনীত হল। তারা বলতে থাকে–হে রাজন, বৃক্ষাদি যেমন অভ্যন্তরস্থ অগ্নি দ্বারা সন্তপ্ত হয়, তেমনি আমরাও জঠরাগ্নিতে সন্তপিত হচ্ছি। আপনিই আমাদের রক্ষক, তাই আমরা আপনার শরণাপন্ন হয়েছি। ক্ষুধাক্লিষ্ট প্রজাগণের অন্নসংস্থানের ব্যবস্থা করুন। আমরা যেন অন্নাভাবে বিধ্বংস না হয়ে যাই। হে নরদেব, দেব, আপনিই সকলের পালক। প্রভু আপনিই সকলের অন্নদাতা।

মৈত্রেয় বললেন–হে কুরুশ্রেষ্ঠ বিদূর, প্রজাদের এমত কাতর অনুনয়ে অত্যন্ত বিচলিত হলেন মহারাজ পৃথু। বহুক্ষণ চিন্তা করে তিনি অন্নাভাবের কারণ নির্ণয় করলেন। তিনি বুঝতে পারলেন যে পৃথিবীর ওষধি বীজ গ্রাস করার ফলেই শস্যাদির ফলন হচ্ছে না।

অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে তিনি পৃথিবীকে লক্ষ্য করে ধনুকে বাণ যোজনা করলেন। অস্ত্রোদ্যত পৃথুকে দেখে পৃথিবী ব্যাধতাড়িত হরিণীর মতো গোরূপ ধারণ করে পলায়ন করতে লাগলেন। পলায়নপর পৃথিবীর প্রতি ক্রুদ্ধ দৃষ্টিপাত করে পৃথুও ধনুর্বান হাতে তার পশ্চাৎগমন করলেন। পৃথিবী দিক্‌বিকি স্বর্গ, মর্ত্য, অন্তরীক্ষ সকল স্থানেই উদ্যতায়ুধ পৃথুকে দেখতে পেলেন। পৃথিবী বুঝতে পারলেন যে মৃত্যু থেকে যেমন ভীত মনুষ্যগণের পরিত্রাণ নেই, তেমনি পৃথুর হাত থেকেও তার নিস্তার নেই। ভীত সন্ত্রস্ত পৃথিবী তখন পলায়নের চেষ্টা থেকে নিবৃত্ত হলেন।

তারপরে পৃথিবী পৃথুর উদ্দেশ্যে বললেন, হে মহাভাগ, আপনি আপত্রবৎসল, আপনি সকল প্রাণীর প্রতিপালক ও রক্ষাকর্তা। আপনি তবে আমাকেও রক্ষা করুন। আপনি কেন নিরপরাধীকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছেন? ধর্মজ্ঞ আপনি, কী কারণে আমার ন্যায় আর্ত স্ত্রীলোককে হননেচ্ছা পোষণ করছেন? হে মহারাজ, সাধারণ লোকেরাও স্ত্রীলোকের অপরাধ মার্জনা করে তাদের প্রহার করেন না। আপনাদের মতো দয়াপরবশ ও কৃপাবৎসল ব্যক্তির কথা আর কি বলব? হে রাজন, আমি এই ব্রহ্মাণ্ডের দৃঢ়তর তরণীস্বরূপ, আমার ওপরেই এই বিশ্ব প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। আমাকে বিনাশ করলে কেমনভাবে আপনি নিজেকে ও বিশ্বকে সলিলমধ্যে ধারণ করবেন।

মহারাজ পৃথু বললেন–হে বসুন্ধরে, তুমি দেবতারূপে যজ্ঞে নিজবাগ গ্রহণ সত্ত্বেও রাজ্যে ধান্যাদি শস্য উৎপাদন করছ, না। আমার আজ্ঞা লঙ্ঘনের জন্য আমি তোমার শাস্তি বিধান করব। যে গাভী প্রত্যক্ষ তৃণ ভক্ষণ করেও দুধ দেয় না, তার প্রতি দণ্ডবিধান করা রীতিসম্মত। ব্রহ্মা জগৎসৃষ্টির সময়ে ওষধি বীজসমূহ সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু আমার আদেশ অমান্য করে, তুমি সেই বীজসকল নিজের মধ্যে আবদ্ধ রেখেছ। আমি তাই বাণের সাহায্যে তোমার দেহ খণ্ডবিখণ্ড করব। তোমার মাংস আমার প্রজাগণের মধ্যে আহাররূপে বিতরণ করব। ক্ষুধার্ত প্রজাগণের করুণ বিলাপ এতে প্রশমিত হবে। যে অধম ব্যক্তি প্রাণীগণের প্রতি নির্দয় হয়ে শুধুমাত্র নিজেকে পোষণ করে স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে তাকে হত্যা করা পাপ নয়। নৃপতিগণ সেইরূপ ব্যক্তিকে বধ করলে তাদের হত্যাজনিত পাপ স্পর্শ করে না। তুমি উদ্ধত-স্বভাব, অহংকারী। উপরন্তু তুমি কপট গোরূপধারিণী অর্থাৎ মায়াবিনী। আমি এখনই তোমার দেহ ছিন্নভিন্ন করে প্রজাদের বুভুক্ষা দূর করতে চাই।

কৃতান্তের ন্যায় পৃথুর রাগে অগ্নিশর্মা মূর্তি দর্শন করে ভয়ে কম্পিত হতে থাকল পৃথিবীর সমস্ত দেহ। ভীতস্বরে পৃথুকে প্রণাম করে সে বলতে থাকে–স্বীয় মায়ার প্রভাবে স্বেচ্ছায় বহুরূপধারী ত্রিগুণেশ্বর পরম পুরুষকে আমি নমস্কার করি। তাঁর সচ্চিদানন্দাতমক স্বরূপ অনুভবের কারণে দ্রব্য, ক্রিয়া ও কারকে অর্থাৎ অধিভূত, আধ্যাত্ম ও অধিদেবাদিতে অহংকার ও তন্নিমিত্ত রাগদ্বেষাদি কিছুই নেই। আপনি সেই ভগবান বিষ্ণু। আপনাকে আমি বারংবার প্রণাম করছি।

আপনিই আমাকে জীবাদির আধার রূপে নির্মাণ করেছেন। যাতে আমি ভূতসকল ধারণ করে আছি। সেই স্বতন্ত্র পুরুষ আপনিই যদি অস্ত্রোদ্যত হয়ে আমাকে বধ করতে চান তাহলে আমি কার শরণাপন্ন হতে পারি? আপনিই নিজ অচিন্ত্য মায়ার প্রভাবে এই বিশ্বের সৃজন করেছেন। সেই আপনিই আবার বিশ্ব রক্ষার্থে পৃথুরূপে জন্ম নিয়েছেন। তদ্রূপ ধর্মাত্মা পুরুষ আজ কীভাবে আমাকে বধ করতে ইচ্ছা করছেন?

ঈশ্বর স্বয়ং এক হলেও তিনি মায়ার দ্বারা বহুরূপ ধারণ করেন। তারপরে ব্রহ্মার সাহায্যে এই বিশ্বের নির্মাণ করেন। তার কার্যাবলী অনুধাবন করা সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব কাৰ্য। তিনি প্রকৃতি, ইন্দ্রিয়, দেবতা, অন্তঃকরণ জীব প্রভৃতি নিজ শক্তির সাহায্যে সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়াদি কাৰ্য্য সাধন করেন। তিনি সর্বশক্তির আধার ও এই বিশ্বের নিয়ামক। সেই অন্তর্যামী পরম পুরুষকে আমি প্রণিপাত করি। হে বিভু, আপনিই সেই বিশ্বচরাচরের সৃজনকর্তা, হে অজ, আপনি স্বনির্মিত ভূত, ইন্দ্রিয় ও অন্তঃকরণরূপী বিশ্বচরাচরকে আমার উপর স্থাপন করেছেন, এই কাৰ্য্য সাধনের জন্য আপনি আদি বরাহমূর্তি ধারণ করে, জলময় রসাতল থেকে আমাকে উদ্ধার করেছেন।

আপনি সেই ধরাধর বরাহ, সলিল সাগরে তরণীরূপ আমাতে অধিষ্ঠানরত প্রজাগণের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সম্প্রতি বীরমূর্তি পৃথুরূপে অবতীর্ণ হয়েছেন। কী আশ্চর্য। সেই আপনি এখন আমার মধ্যে লুক্কায়িত ওষধি বীজ সকল উদ্ধারের জন্য আমাকে বধ করতে উদ্যত হয়েছেন।

হে প্রভু, আমাদের মতো জনগণের চিত্ত ঈশ্বরের গুণসৃষ্টিরূপী মায়ার দ্বারা বিমোহিত, তাই আমরা ভগবান ভক্তজনেরই চেষ্টা জানতে সমর্থ হই না। পরমেশ্বরের গূঢ় কর্মের রহস্য উদ্ঘাটন আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। অতএব আমরা পরমেশ্বরের প্রণাম করি। তেমনি তার প্রতি ভক্তগণকেও প্রণিপাত করি। আপনি বীরগণের যশবিস্তারের নিয়ন্ত্রক। তাদের ফল বিস্তার করুন। আপনাকে প্রণাম জানাই।

.

অষ্টাদশ অধ্যায়
পৃথিবী দোহন

মৈত্রেয় বললেন–হে বিদুর, পৃথিবী কতৃক এভাবে স্তুত হয়েও ক্রোধে পৃথুর অধর কম্পিত হচ্ছিল। অতএব পৃথিবী আবার নিজেকে প্রস্তুত করে পৃথুর উদ্দেশ্যে নিজ কথা নিবেদন করতে উদ্যত হল। পৃথিবী বলতে থাকে–হে মহারাজ, ক্রোধ সংবরণ করুন। আমার নিবেদন শ্রবণ করুন। পণ্ডিতগণ মধুকরের ন্যায় সকল বিষয় থেকেই সার সংগ্রহ করেন। তত্ত্বদর্শী মুনিগণ মনুষ্যগণের শ্রেয়সিদ্ধির জন্য ইহলোক ও পরলোকের উপায়সমূহ প্রদর্শন করেছেন। আপনারা তা পালন করুন। অতি অর্বাচীন কোন ব্যক্তি যদি শ্রদ্ধাপূর্ণ চিত্তে মুনিগণ প্রবর্তিত উপায়ে সম্যক্ অনুষ্ঠান করেন তিনি অনায়াসে ইঙ্গিত ফললাভ করেন। কিন্তু মহাজ্ঞানী কোনো ব্যক্তিও যদি ঐ সকল উপায়ের অনাদর করেন, তাঁর কাৰ্য্যের বারংবার চেষ্টা সত্ত্বেও বিফল হয়।

হে মহারাজ, সৃষ্টিসময়ে ব্রহ্মা আমার পৃষ্ঠে ব্রীহি, যবাদি, ওষধি সকল সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু আমি দেখলাম যে অসংযত দুষ্ট ব্যক্তিরাই তা ভোগ করছে। আপনাদের মত লোকপালকেরা তাদের হাত থেকে আমাকে রক্ষা করলেন না। এমনকি যজ্ঞাদি প্রবর্তন না করে আমার অনাদর করতে লাগলেন। পৃথিবীতে চোর-দস্যুদের প্রাদুর্ভাব ক্রমশঃ বৃদ্ধি পেতে লাগল। এজন্য আমি যজ্ঞ রক্ষার্থেই ওষধিসমূহ গ্রাস করেছিলাম। দীর্ঘদিন আমার মধ্যে সুপ্ত থাকার কারণে নিশ্চয়ই তারা ক্ষীণ হয়ে গেছে। যদি আপনি সেসব পেতে ইচ্ছুক হন, তবে তোক প্রসিদ্ধ উপায়ে অবলম্বন করুন। হে মহাভাবো, হে ভূতভাবন, আপনি যদি প্রাণীগণের ইঙ্গিত বলকারক অন্ন আকাঙ্ক্ষা করেন, তাহলে আমায় দোহন করার ব্যবস্থা করুন, গোরূপিণী আমার অনুরূপ বৎস, দোহনপাত্র ও দোহকর্তার ব্যবস্থা করুন। তবেই আমি আপনার অভীষ্ট দুগ্ধরূপ ওষধিগুলি প্রদান করতে সক্ষম হব।

হে রাজন, বর্ষার আগমনেও যাতে আমার মধ্যে সর্বত্র সমানভাবে বৃষ্টির জল থাকতে পারে, তার ব্যবস্থা করুন। মহারাজ, আমাকে সমতল করুন, তবেই আপনার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে।

মহারাজ পৃথু পৃথিবীর এইরূপ প্রিয় ও মধুর বচন স্বীকার করলেন, তিনি মনুকে বৎস করে নিজ হস্তরূপ পাত্রে ধান্যাদি ওষধিসমূহ দোহন করলেন। পৃথু ছিলেন সারগ্রাহী জ্ঞানী পুরুষ। এই প্রকার ব্যক্তিরা জগতের সকল বিষয়ের সারকেই গ্রহণ করে থাকেন। তারপর ঋষি প্রভৃতি অন্যান্য সকলেই পৃথুর বশীভূত পৃথিবীকে নিজ নিজ ইচ্ছা অনুসারে দোহন করতে শুরু করলেন।

বৃহস্পতিকে বৎস কল্পনা করে ঋষিগণ নিজ বাক্য, মন ও শ্রোত্রাদিরূপ পাত্রে বেদময় পবিত্র দুগ্ধ দোহন করলেন।

এরপরে দেবগণ ইন্দ্রকে বৎসরূপে কল্পনা করে হিরন্ময় পাত্রে অমৃত, মানসিক শক্তি, ইন্দ্রিয় শক্তি ও দেহশক্তিরূপ পয়ঃদোহন করলেন।

তারপরে দৈত্য ও দানবেরা লৌহময় পাত্রে সুরা ও তালদি মদ্য অর্থাৎ আসব দোহন করলেন। এসময় তারা অসুরশ্রেষ্ঠ প্রহ্লাদকে বৎস কল্পনা করেছিলেন।

গন্ধব ও অপ্সরাগণ বিশ্বাবসুকে বৎসরূপে কল্পনা করেন। তাঁর সাহায্যে গন্ধর্বরা গান্ধর্ব-বিদ্যায় (গীত, বাদ্য ও নৃত্য) মাধুর্য ও সৌন্দর্য দোহন করলেন।

হে মহাভাগ বিদুর, শ্রাদ্ধের অধিকর্তা পিতৃগণ সূযতকে বৎস করে, কাঁচা মৃৎপাত্রে বা আমপাত্রকে দোহন পাত্ররূপে স্থির করেন। এতদ্বারা ভক্তিপূর্ণ চিত্তে তারা পৃথিবী পিতৃপুরুষের অন্ন বা কব্যরূপ দুগ্ধ দোহন করলেন।

সিদ্ধগণ ভগবান কপিলকে বস করে সংকল্পময়ী সিদ্ধি দোহন করলেন।

বিদ্যাধররা ঐ কপিলকেই বৎস কল্পনা করে আকাশরূপ দোহনপাত্রে খেচরাদি বিদ্যারূপ দুগ্ধ দোহন করলেন।

কিম্পুরুষেরা এবং অন্য মায়াবীরা ময়দানবকে বৎস করলেন। যে মায়ার প্রভাবে ইচ্ছামাত্র অন্তর্ধান করা যায় ও বহুরূপ ধারণ করা সম্ভব, সেই মায়ারূপ দুগ্ধ দোহন করলেন।

যক্ষ, রক্ষ, ভূত ও পিশাচ প্রভৃতি মাংসভোজীগণ কর্তৃক রুদ্রদেব বৎসরূপে নিযুক্ত হন। এইভাবে নরকপালি পাত্রে রুধিররূপ মদ্য দোহন করা হল।

ফণাযুক্ত ও ফণাহীন সর্পকুল বৃশ্চিকাদি তক্ষককে বৎস করে নিজ নিজ মুখে বিষরূপ দুগ্ধ দোহন করলেন।

পশুগণ রূদ্ৰবাহন বৃষকে বস করেছিলেন। অরণ্যরূপ পাত্রে তারা পৃথিবী হতে তৃণরূপ দুগ্ধ দোহন করল।

বৃহৎ দন্তযুক্ত মাংসাশী প্রাণীরা সিংহকে বৎস করে নিজ নিজ দেহে মাংসরূপ দুগ্ধ দোহন করল।

পক্ষীগণ গরুড়কে বৎস কল্পনা করল। নিজ দেহরূপ পাত্রে তারা চর ও অচর অর্থাৎ কীটাদি ও বৃক্ষগণ বটবৃক্ষকে বৎস করে নিজ দেহে নানাবিধ রসরূপ দুগ্ধ পৃথিবী থেকে দোহন করল।

পর্বতাদি হিমালয়কে বৎস করে নিজেদের সানুদেশরূপ পাত্রে (স্বর্ণ, রৌপ্যাদি) নানারূপ ধাতু দোহন করল।

বিদূর, এভাবে অন্যান্য সকলেই নিজ নিজ জাতিপ্রধানকে বৎস কল্পনা করে পৃথুর বশীভূত এবং সর্বকামদায়িনী পৃথিবী থেকে অভীষ্ট বস্তু দোহন করল। এভাবে মোট পঞ্চদল জন পৃথিবীকে দোহন করেছিল।

হে কুরুবংশজাত বিদূর, পৃথু প্রভৃতি অন্নভোজীগণ এভাবে ভিন্ন ভিন্ন দোগ্ধা দোহনপাত্র ও বৎস কল্পনা করে পৃথিবী থেকে নানাবিধ অনুরূপ দুগ্ধ দোহন করলেন। যা কিছু ভক্ষণ করা যায়, তাকেই অন্ন বলা হয়েছে। এমনকি ছন্দ-বিদ্যাকেও অন্নের সাধন বলে অন্ন বলে গণ্য করা হয়েছে।

তারপর দুহত বৎসল মহারাজ পৃথু সর্বকামপ্রদা পৃথিবীকে নিজ কন্যারূপে গ্রহণ করলেন। কোপুত্র পৃথু ধনুর অগ্রভাগ দ্বারা পর্বতের শৃঙ্খসমূহকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করলেন।

তৎপরে প্রজাগণের জীবিকা প্রদানকারী মহাপরাক্রমী পৃথু সেখানে তাদের যথাযোগ্য বাসস্থান নিরূপণ করলেন।

সেখানে হট্টাদিশূন্য জনস্থান বা গ্রাম নির্মিত হল।

পুর অর্থাৎ হট্টাদি বিশিষ্ট লোকালয়, পত্তন বা বৃহৎ পুর, বিবিধ দুর্গ বা গড়, গোপজাতির বাসস্থান বা ঘোষ, গোসকলের নিবাসস্থান ব্রজ প্রভৃতি নির্মিত হল।

রাজাধিরাজ পৃথু এছাড়াও সৈন্যশিবির আকর অর্থাৎ স্বর্ণাদি ধাতুস্থল, কৃষক পল্লী বা ক্ষেত, পর্বত প্রান্তবর্তী গ্রাম অর্থাৎ খবট প্রতিষ্ঠা করলেন।

ভগবান পৃথুর আগে এই ভূমণ্ডলে এই প্রকার পুর গ্রামাদি সন্নিবেশ ছিল না। মহারাজ পৃথু এসকল সংস্থাপন করলেন।

এর ফলে প্রজাসাধারণ নির্ভয়ে নিজ নিজ স্থানে পরম সুখে ও শান্তিতে বসবাস করতে লাগল।

.

ঊনবিংশ অধ্যায়
যজ্ঞের অশ্ব অপহরণ করাতে ইবধে উদ্যত পৃথুকে ব্রহ্মার নিবারণ

মৈত্রেয় ঋষি বললেন–হে বিদূর, অনন্তর রাজর্ষি হয়ে পৃথু স্বায়ম্ভব মনুর ক্ষেত্রে অর্থাৎ ব্রহ্মাবর্তে শত অশ্বমেধ যজ্ঞের সংকল্প করলেন। সেই স্থলের পূর্বদিকে সরস্বতী নদী প্রবাহিত ছিল।

দেবরাজ ইন্দ্র ইতিপূর্বে শত অশ্বমেধ যজ্ঞ করে শতক্রতু নামে পরিচিত হন।

স্বীয় কর্ম অপেক্ষাও পৃথুর কর্ম সংকল্প অধিক সমারোহ পূর্ণ জ্ঞাত হয়ে অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন ইন্দ্র।

পৃথুর সেই মহাযজ্ঞে সর্বাত্মা, সর্বলোক পূজ্য, সর্বেশ্বৰ্য্য পূর্ণ শ্রীহরি সাক্ষাৎ দৃষ্টিগোচর হয়েছিলেন। ব্রহ্ম, রুদ্র ও লোকপালগণ তাদের অনুচরবৃন্দ পরিবৃত হয়ে ভগবান হরির সঙ্গে সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন।

গন্ধর্ব, মুনি ও অপ্সরাবৃন্দ ভগবান বিষ্ণুর গুণগান করেছিলেন। সিদ্ধ, বিদ্যাধর দৈত্য, দানব, গুহ্যক প্রভৃতি সকলে সেই যজ্ঞে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। নন্দ, সুনন্দ প্রভৃতি শ্রীহরির শ্রেষ্ঠ পর্ষদগণ ও কপিল, নারদ, দত্তাত্রেয়, সনকাদি যোগীশ্বর ও ভগবদ্ভক্ত সকলেই সেই যজ্ঞে ভগবানের সঙ্গে আগমন করেছিলেন।

হে বিদূর, ঐ যজ্ঞে সকল কামনা প্রদায়িণী পৃথিবী যজ্ঞীয় ঘৃত প্রদানকারিণী ধেনু রূপধারণপূর্বক যজ্ঞমান পৃথুর সকল অভিলাষিত বস্তু প্রদান করেছিলেন। বিবিধ প্রকারের রস, দুগ্ধ, দধি, অন্ন, ঘৃত, ঘোল প্রভৃতি বহনকারী নদী সেখানে প্রবাহিত ছিল। বড় বড় বৃক্ষগুলি মধুবর্ষী হয়ে নানাপ্রকার ফল উৎপন্ন করেছিল।

সমুদ্র উপহার দিয়েছিলেন বিবিধ রত্নসমূহ।

পর্বতাদি দিয়েছিলেন ভক্ষ, ভোজ্য, লেহ্য ও চুষ্য এই চতুর্বিধ অন্ন।

লোকপালগণের সঙ্গে লোকসমূহ নানাবিধ উপহার প্রদান করে।

হে বিদূর, রাজর্ষি পৃথু ভগবান অধোক্ষজকে আশ্রয় করায় তার যজ্ঞকার্য্যের এরূপ অত্যাশ্চর্য বৃদ্ধি হয়। কিন্তু ইন্দ্রর কাছে তা অসহ্য বলে প্রতীয়মান হল। তিনি তখন যজ্ঞকার্যে ব্যাঘাত ঘটাতে, উদ্যোগী হলেন। পৃথু যখন শেষ অশ্বটি দ্বারা শ্রীহরির উপাসনা করছেন, তখন ইন্দ্র সেই যজ্ঞীয় অশ্বটিকে সকলের অলক্ষ্যে অপহরণ করলেন।

দেবরাজ ইন্দ্র যখন যজ্ঞীয় অশ্বশক্তি আকাশপথে ধাবমান, অত্রিমুনি তাকে চিনতে পারলেন। দেবরাজ ইন্দ্র তখন লোকসমূহের মতিবিভ্রম ও অধর্মকে ধর্মপ্রদর্শনকারী রক্ষাকবচের ন্যায় পাষণ্ড বেশ ধারণ করেছিলেন।

অত্রিমুনি তখন পৃথুর পুত্রকে ইন্দ্রকে বধ করতে প্ররোচনা দিলেন। মুনির অত্রি প্রেরণায় পৃথুপুত্র অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে তার পশ্চাৎগমন করলেন এবং “চেতিষ্ঠ” “তিষ্ঠ” উচ্চারণ করলেন।

কিন্তু জটাধারী, সর্বাঙ্গে, ভস্মলেপিত ইন্দ্রকে তিনি সাক্ষাৎ ধর্মমূর্তি মনে করলেন। তাঁর প্রতি বাণ নিক্ষেপ করলেন না। পৃথুপুত্রকে বিরত হতে দেখে অত্রিমুনি পুনরায় তাকে ইন্দ্রবধে প্ররোচিত করতে লাগলেন। অত্রিমুনি তাকে বললেন– হে বৎস, দেবাধম ইন্দ্র তোমার পিতার যজ্ঞবিনাশকারী, একে বধ করা তোমার কর্তব্য। পৃথুপুত্র এভাবে প্ররোচিত হয়ে অতীব ক্রুদ্ধ হলেন। গৃধরাজ জটায়ু যেমন রাক্ষসাধম রাবণের পশ্চাৎগমন করেছিলেন তেমনি তিনিও আকাশপথে ইন্দ্রের পশ্চাতে ধাবিত হলেন। দেবরাজ ইন্দ্র তখন ভীত হয়ে সেই পাষণ্ডবেশ পরিত্যাগ করলেন। নিজরূপ ধারণ করে তিনি পৃথুপুত্রকে যজ্ঞীয় অশ্ব ফিরিয়ে দিলেন। বীরবর রাজপুত্র নিজ অশ্ব গ্রহণপূর্বক পিতার যজ্ঞস্থলে উপবিষ্ট হলেন। মহর্ষিগণ এই কর্ম দর্শন করে পৃথুপুত্রকে “বিজিতা’ নাম প্রদান করলেন।

অতঃপর সেই অশ্বকে ঘূপবদ্ধ করা হল। কিন্তু দেবরাজ পুনরায় সে অশ্বকে অপহরণে উদ্যত হলেন। তিনি ঘোরতর আঁধার সৃষ্টি করে নিজেকে আচ্ছন্ন করলেন। এই অশ্বটি কাষ্ঠময় কণ্টকযুক্ত যুপে, স্বর্ণশৃঙ্খলে আবদ্ধ ছিল। দেবরাজ ইন্দ্র শৃঙ্খল ছেদন করতে অসমর্থ হলেন। তিনি শৃঙ্খল সমেত অশ্বটিকে উত্থান করে আকাশপথে পলায়ন করলেন।

আকাশপথে শৃঙ্খলিত অশ্বসহ ইন্দ্রকে দেখতে পেলেন অত্রিমুনি। পূর্ববৎ তিনি পৃথুর পুত্রকে তা দেখালেন। ইন্দ্রকে নিরস্ত্র করে অশ্বটিকে আনয়নের জন্য অত্রি পৃথুর পুত্রকে অনুরোধ করলেন।

দেবরাজ তখন কপাল ও খটাঙ্গ ধারণপূর্বক গমন করছিলেন। পৃথুপুত্র তাকে আবার ধর্ম মনে করলেন। পুনরায় অত্রি বাক্যে তিনি বান নিক্ষেপ করতে উদ্যত হলেন। তৎক্ষণাৎ ইন্দ্র অশ্বটিকে প্রত্যর্পণ করে ছদ্মবেশ ত্যাগ করে অন্তর্হিত হলেন। পৃথুপুত্র অশ্বটিকে নিয়ে যজ্ঞস্থলে প্রত্যাগমন করলেন। অজ্ঞজনেরা ইন্দ্রের সেই পাষণ্ডবেশ গ্রহণ করেছিলেন।

দেবরাজ ইন্দ্র পৃথুর যজ্ঞীয় অশ্ব অপহরণের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন রূপধারণ করেন। সেসকল রূপ বা বেশ পাপের ষণ্ড বা চিহ্নস্বরূপ।

(অন্যত্র কথাটি সমূহ-বাচক হলেও এখানে পাষণ্ড শব্দটি ষণ্ডশব্দ চিহ্নবাচক)।

মহারাজ পৃথুর যজ্ঞে বিঘসৃষ্টির উদ্দেশ্যে ইন্দ্র অশ্ব অপহরণের পরিকল্পনা রূপায়ণের পথে যে যে রূপ ধারণ ও পরিত্যাগ করেন তাকে উপধর্ম বলা যায়। কিন্তু বুদ্ধিবিভ্রম বশতঃ অজ্ঞব্যক্তিরা তাকেই ধর্ম মনে করে তাতে আসক্ত হয়ে পড়েন। জৈন, বৌদ্ধ ও কাঁপালিকগণের আচরণীয় এই সকল উপধর্ম আপাত রমণীয়। এই কারণেও বাকচাতুর্য হেতু এই সকল উপধর্ম অজ্ঞব্যক্তিগণের বুদ্ধিবিভ্রম ঘটিয়ে থাকে।

মহাবিক্রমশালী মহারাজ পৃথু যখন ইন্দ্রের অপহরণের সংবাদ জ্ঞাত হলেন, তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন। ধনুর্বাণ উত্তোলন করে তাতে বাণ যোজনা করলেন। ক্রোধে তখন তিনি উন্মত্ত হয়েছিলেন।

ঋত্বিক সকলে তখন পৃথুকে ঐ কাৰ্য্য থেকে নিবৃত্ত হতে বললেন। তারা পৃথুকে বললেন–হে রাজন, এই যজ্ঞস্থলে শাস্ত্রবিহিত পশু ব্যতীত অপর কিছুই বধ্য নহে। যে ইন্দ্র আপনার কীর্তি প্রভাবে নিষ্প্রভ, তাকে আমরা এখানে আহ্বান করছি। তারপরে তাকে আমরাই যজ্ঞে আহুতি দেব। এইভাবে ঋত্বিক সকলে পৃথুর ক্রোধ প্রশমিত করলেন। তারা স্বয়ং অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে মৃদু হস্তে হোম করতে উদ্যত হলেন। ব্রহ্মা তখন তাদের নিকটে আগমন করলেন।

ব্রহ্মা বললেন–হে ব্রাহ্মণ, আপনারা যাঁকে বধ করতে উদ্যত, তিনি তো আপনাদের বধ্য নহেন। তিনি ভগবান বিষ্ণুর অবতার এবং ইনি স্বয়ং যজ্ঞ নামে অভিহিত। যজ্ঞে পূজিত দেবগণ ইন্দ্রের দেহস্বরূপ, ঋত্বিকগণ, মহারাজ পৃথুর যজ্ঞে বিঘ্ন ঘটানোর জন্য ইন্দ্র কিভাবে নিন্দিত হচ্ছেন, তা আপনারা দর্শন করুন। তিনি ধর্মনাশক পাষণ্ড পথের প্রবর্তন করেছেন, সে তো আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন। ইন্দ্র অতীব বলশালী, তার সঙ্গে মিত্রতাই সঠিক পন্থা, নতুবা তিনি আরও পাষণ্ড পথ সৃষ্টি করতে পারেন। অতএব মহাকীর্তিমান পৃথুর যজ্ঞই সম্পূর্ণ হয়েছে।

ব্রহ্মা অতঃপর পৃথুকে সম্বোধন করে বললেন–হে রাজা, মোক্ষধর্ম আপনি জানেন। আপনার এবিধ যজ্ঞানুষ্ঠান বা সকাম কর্মের কোন প্রয়োজন নেই, আপনার কল্যাণ হোক। আপনি কেন ইন্দ্রের প্রতি রুষ্ট হচ্ছেন? আপনারা দুজনেই ভগবানের মূর্ত বিগ্রহ। হে মহারাজ, আপনার যজ্ঞের বিঘ্ন বিষয়ে আর চিন্তা করবেন না। আমার কথা শ্রবণ করুন। যে কর্ম দেববলে বিনষ্ট হয়, তাকে স্বতন্ত্র করা অনুচিত। যে ব্যক্তি এই প্রচেষ্টা করে বা চিন্তা করে, তার মন অতীব ক্রুদ্ধ হয়ে ঘোরতর মোহপথে প্রবেশিত হয়। হে মহারাজ, দেবরাজ ইন্দ্র দুষ্ট আগ্রহযুক্ত দেবতা, যজ্ঞ বিনাশার্থে তিনি, যে যে পাষণ্ড পথ প্রবর্তন করেছেন, তার ফলে ধর্মের গ্লানি হবে। অতএব এই যজ্ঞ নিবৃত্ত হোক। হে রাজর্ষি, আপনার যজ্ঞবিনাশকারী ও অশ্ব অপহরণকারী ইন্দ্র কর্তৃক রচিত পাষণ্ড পথ লোকসকলকে ধর্মে বিমুখ করে তুলছে। হে মহারাজ, আপনি স্বয়ং নারায়ণের অংশ, আপনার পিতা বেনের অত্যাচারে লুপ্তপ্রায় ধর্ম রক্ষার্থে আপনাকে তার দেহ থেকে জন্ম দিয়েছেন। এই বিশ্বের মঙ্গলার্থে, যারা বেনের অঙ্গমন্থন করে আপনাকে আনয়ন করেছেন, সেই ভৃগু প্রভৃতি মহর্ষির সংকল্প পরিপূর্ণ হোক, হে বীর, দেবরাজ ইন্দ্রের প্রবর্তিত অধর্মের মূল এই পাষণ্ড পথ আপনি বিনাশ করুন।

মৈত্রেয় বললেন–জগতগুরু ব্রহ্মার বাক্যে পৃথুর ক্রোধ প্রশমিত হল, তিনি শতাশ্বমেধ যজ্ঞ অসমাপ্ত রাখলেন। দেবরাজ ইন্দ্রের সাথে তার সখ্যতা তৈরী হল। তারপর যজ্ঞান্তে অবভূত স্নান করে পৃথু উপবেশন করলেন। তার যজ্ঞে তর্পিত দেব ও ঋষিগণ স্বয়ং বরদরূপে তাকে বরদান করলেন।

হে বিদূর, ব্রাহ্মণদের আশীর্বাদ অব্যর্থ। তারা যজ্ঞে যথার্থভাবে পূজিত ও দক্ষিণাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। তুষ্ট ব্রাহ্মণগণ পৃথুকে আশীর্বাদ করে বললেন–হে মহারাজ, আপনার যজ্ঞে দেবগণ, পিতৃগণ, ঋষিগণ ও মানবকুল, সকলেই যথার্থভাবে সম্মানিত হয়েছেন।

.

বিংশ অধ্যায়
পৃথুকে ভগবান বিষ্ণুর সাক্ষাৎ উপদেশ প্রদান

মৈত্রেয় বললেন–যজ্ঞভুক যজ্ঞেশ্বর সর্বব্যাপী ভগবান বিষ্ণুও ইন্দ্রের সঙ্গে পৃথুর যজ্ঞেও আগমন করলেন। বিবিধ উপাচারে সুন্দররূপে পূজিত হলেন তিনি। তুষ্টচিত্তে তিনি পৃথুকে বললেন–হে রাজন, এই ইন্দ্র তোমার অশ্বমেধ যজ্ঞের বিনাশকারী, এখন তিনি ক্ষমাপ্রার্থনা করছেন।

হে নরদেব, এ জগতে সুবুদ্ধি লোকগণ প্রাণীদের প্রতি দ্রোহসুলভ আচরণ করেন না, কারণ শরীর যে আত্মা নয়, তারা এই মহাজ্ঞানের অধিকারী, তোমার ন্যায় বিবেচক পুরুষ যদি দেবমায়ায় বিমোহিত চিত্ত হয়ে হিংসাদি কাৰ্যে উদ্যত হয়, তবে প্রকৃতপক্ষে কোনও পুরুষার্থ লভ্য হয় না, বিজ্ঞজনেরা এই দেহকে অবিদ্যা অর্থাৎ স্বরূপের অজ্ঞান ও অজ্ঞানমূলকে কামনার দ্বারা আরব্ধ বলে জানেন। সুতরাং আত্মজ্ঞান হওয়ায় তাদের আর দেহে আসক্তি হয় না। শরীরের প্রতি আসক্তি পরিত্যাজ্য হলে তার দ্বারা উৎপন্ন গৃহ, সম্পদ ও পুত্রাদিতেও নিরাসক্তি জন্মায়।

আত্মা দেহ থেকে পৃথক, তিনি এক শুদ্ধ স্বপ্রকাশিত। তিনি নির্গুণ কারণ ভূতাদির আধার, সর্বগত ও সর্বত্র অনাবৃত সাক্ষীরূপ। দেহ কখনও এরূপ নহে। বলে যুবাদি ভেদে অনেক। দেহ মলিন ও স্বগুণ। কারণ ভূতগণের আশ্রত পরিচ্ছন্ন এবং গৃহাদি দ্বারা আবৃত এবং দৃশ্য। এপ্রকারে দেহস্থ আত্মাকে যিনি উপলব্ধি করেন, তিনি দৈহিক বিকারপ্রাপ্ত হন না। তিনি জানেন পরমেশ্বর তন্মধ্যে অবস্থিত। হে রাজন, যে ব্যক্তি মনস্কাম ও শ্রদ্ধান্বিত হয়ে স্বধর্মের অনুবর্তী হয়ে আমার ভজনা করেন, তার মন ক্রমে প্রসন্ন হয়, চিত্ত প্রসন্ন হলে সে সংসারে নিরাসক্ত হয়, তত্ত্বদর্শীরূপে তিনি আমার মধ্যে অবস্থানপূর্বক ভগবদ ভাব প্রাপ্ত হন। উদাসীনরূপে অবস্থিত সাক্ষীরূপ, নির্বিকার এই আত্মাকে যিনি দেহ, জ্ঞান, কর্মেন্দ্রিয় ও মনের নিয়ন্তারূপে জ্ঞাত হন, তিনি মোক্ষলাভের উপযুক্ত বলে গণ্য হন।

আত্মা, অবিনশ্বর, আত্মা থেকে ভিন্ন পঞ্চত্তভূতাদি ইন্দ্রিয়াদির সমবিধরূপ লিঙ্গদেহের গুণপ্রবাহ ঘটে। অর্থাৎ দেহের জন্ম মরণাদি বিকার ঘটলেও আত্মার কোনও ক্ষয় হয় না। জ্ঞানী পুরুষেরা এ বিষয়ে জ্ঞাত, তাই বিপদে, হর্ষশোকে তাদের বিকার হয় না। তারা আমার মধ্যে সৌহার্দ্যবদ্ধ করে নিস্পৃহ, থাকেন। হে বীর, তুমি দুঃখ-সুখে সমভাবাপন্ন হয়ে সকলের প্রতি সমবুদ্ধি ও সমদর্শী হয়ে ইন্দ্রিয় ও মন জয়পূর্বক প্রজাপালন কর। প্রজাপালন রাজার পালনীয় পরম মঙ্গলকাৰ্য। পরলোকে প্রজাঅর্জিত পুণ্যের এক ষষ্ঠাংশের অধিকারী হন রাজা। যে রাজা প্রজাদের রক্ষক না হয়ে শুধুমাত্র কর গ্রহণ করেন সেই রাজা পরলোকে প্রজাদের পাপের অংশ ভোগ করেন।

হে পৃথু, এভাবে তুমি ব্রাহ্মণগণের অনুমোদিত রাজধর্মকে প্রধান পালনীয় রূপে গ্রহণ কর, অর্থ ও কামকে তার আনুষঙ্গিকরূপে গণ্য করে পৃথিবীর পালন কর। তাহলেই সর্বলোক তোমার প্রতি অনুরক্ত হবে। অতি শীঘ্র তুমি সনকাদি সিদ্ধ মহর্ষিদের নিজগৃহে দর্শন করবে। এই ধর্মপালনে তোমার অনায়াস মোক্ষলাভ হবে। হে নরদেব, আমি তোমার সমস্ত গুণ ও স্বভাবে তুষ্ট হয়েছি, আমার নিকট বর প্রার্থনা কর। হে রাজন, আমি যজ্ঞ বা তপস্যা বা যোগ দ্বারা লব্ধ নই। সমচিত্ত লোকেদের মধ্যেই আমি বর্তমান।

মৈত্রেয় বললেন–হে বিদূর, বিশ্বজয়ী পৃথু লোকগুরু ভগবান নারায়ণের এরূপ বচনে আপ্লুত, হলেন। তিনি তার আদেশ শিরোধার্য করলেন। এমন সময়ে ইন্দ্র নিজ কর্মে লজ্জিত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনার উদ্দেশ্যে পৃথুর চরণদ্বয় স্পর্শ করলেন। তিনি প্রেমপূর্ণ হৃদয়ে ইন্দ্রকে আলিঙ্গন করলেন ও তার সঙ্গে সখ্যতা স্থাপন করলেন। তারপর মহারাজ পৃথু বিবিধ উপাচারে হরির পূজায় প্রবৃত্ত হলেন। উদ্বেলিত ভক্তিপূর্ণ হৃদয়ে তিনি ভগবানের শ্রীচরণযুগল ধারণ করলেন। তখন বিশ্বাত্মা ভক্তবৎসল শ্রীহরি গমনেচ্ছু হলেও ভক্তের প্রতি অনুগ্রহ করে শীঘ্র গমন করতে পারলেন না। পদ্মপলাশ নয়নযুগল পৃথুর দিকে নিক্ষেপ করে তিনি অবস্থান করলেন। আদিরাজ পৃথু দর্শন ও স্তব করতে ইচ্ছুক হলেন। তিনি কৃতাঞ্জলি হয়ে মৌনভাবে হরিকে হৃদয়মধ্যে আলিঙ্গন করলেন। কারণ আনন্দাশ্রুতে তার নয়নযুগল পরিপূর্ণ ছিল। ফলে, তিনি হরিকে ভালোভাবে দর্শন করতে পারলেন না। প্রেমাবেগে তার কথা রুদ্ধ হওয়ায় তিনি স্তব করতে পারলেন না। এরপর স্থিত হয়ে নয়নজল মার্জনা করে হরিকে দর্শন করলেন। শ্রীহরি দয়াপরবশ হয়ে ভূমি স্পর্শ করলেন। দেবতারা কখনও ভূমি স্পর্শ করেন না একথা তিনি বিস্মৃত হলেন। পতনের আশঙ্কায় গরুড়ের স্কন্ধে নিজ করতল বিন্যস্ত করে রাখলেন।

এইভাবে ভগবান হরি পৃথুর দৃষ্টিগোচর হলেন। পৃথু অভিভূত হৃদয়ে বললেন–হে বিভু, আপনি ব্রহ্মাদি দেবগণেরও বরপ্রদ। কিভাবে আপনার নিকট আমি বর প্রার্থনা করব? কোন বুদ্ধিমান লোকই দেহাভিমানীদের ভোগ্য বর প্রার্থনা করবে না। কারণ এ সকল ভোগ্য বস্তু নরকবাসী শরীরিরাও প্রাপ্ত হয়। হে ঈশ, আমি সেরূপ বর প্রার্থনা করি না। হে প্রভু, মহতের অন্তঃস্থল থেকে উত্থিত মুখনিঃসৃত আপনার চরণপদ্মের কীর্তিরূপ সূচীহীন বস্তু আমার প্রার্থিত নয়। আমার একমাত্র প্রার্থনা এই যে আপনার কীর্তন শোনার জন্য আমাকে অযুত কর্ণ প্রদান করুন। হে ভগবান, মহৎ-ব্যক্তিগণের মুখনিঃসৃত আপনার চরণযুগলের কীর্তিরূপ সুধাকনাবাহক বায়ু, তত্ত্ব-মার্গ বিস্মৃত কুযোগী আমাদের তত্ত্ব বিতরণ করে। অতএব আমার অন্য বরের প্রয়োজন নেই। ভক্তিপূর্ণ হৃদয়ে যাতে আপনার লীলাকথা শ্রবণ করতে পারি আপনি তাই করুন। হে মঙ্গলকীর্তি, আপনার যশ পরম মঙ্গলস্বরূপ। সাধুসঙ্গ দ্বারা কোনও ব্যক্তি যদি একবার তা শ্রুত হয়, গুণজ্ঞ হলে আর তা থেকে বিরত হয় না। স্বয়ং লক্ষ্মীদেবী সকল পুরুষার্থ একত্র সংগ্রহেচ্ছায় আপনার লীলাশ্রবণকে বরণ করেছেন।

আমিও সেরূপ উৎসুক হয়ে অনন্ত গুণাধার আপনার সেবায় নিয়োজিত থাকব। একই কর্মে প্রবৃত্ত হলেও যেহেতু আমরা উভয়েই আপনার চরণে একাগ্রচিত্ত আমাদের বিরোধ ঘটবে না।

হে জগদীশ, তবে যদি আপনার সেবায় নিয়োজিত হওয়ার কারণে লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে আমার বিরোধ হয় তাও কাম্য, কারণ আপনি দীনবন্ধু, আমার সামান্য সেবাও আপনি গ্রহণ করবেন। আপনি স্বয়ং নিজ মহিমায় পরমানন্দ স্বরূপে প্রতিবিম্বিত। আপনি লক্ষ্মীদেবীকেও উপেক্ষা করেন। শরণাগত ভক্তকেই আদর করে থাকেন।

হে ভগবান, আপনি দীনবৎসল, মায়ার প্রভাব আপনাতে নেই। সেজন্য সাধুগণ জ্ঞানার্জনের পরেও আপনার উপাসনা করেন। সজ্জনগনেরা শুধুমাত্র চরণকমলের স্মরণপ্রার্থী। আপনার বরদারূপে জগতের সকল প্রাণীই মোহাবিষ্ট হয়। আপনার বেদবাক্যরূপ রঞ্জুতে আবদ্ধ জনগণ বারংবার ফলের প্রত্যাশায় মুগ্ধ হয়ে কর্মে প্রবৃত্ত হয়।

হে ঈশ্বর, আপনি সত্যস্বরূপ। লোকগণ আপনার মায়াবলে খণ্ডিত হয়ে নিজ হতে দূরে অবস্থান করে। আপনাকে না পেয়ে তারা পুত্ৰাদি ভিন্ন বস্তুর কামনা করে। পিতার ন্যায় নিজ হতে বালকের মঙ্গলচিন্তা করেন। আপনিও তেমনি প্রার্থিত না হয়েও আজও আমাদের হিতাকাঙ্ক্ষা করবেন।

মৈত্রেয় বললেন–বিদুর, আদিরাজ পৃথুর দ্বারা এভাবে স্তুত হয়ে ভগবান তুষ্ট হলেন। তিনি বললেন–হে রাজন, তোমার ভক্তি জাগ্রত হোক, যে ভক্তি দ্বারা আমার দুরাতিক্রম্য মায়া অনায়াসে অতিক্রম করা সম্ভব, তুমি সৌভাগ্যবলে তা অর্জন করেছ। হে নরপতি, তুমি বিষয়ে আসক্ত হয়ে আমার আজ্ঞা পালন কর। আমার আদেশ পালনকারী ব্যক্তি সর্ববিষয়ে মঙ্গললাভ করে। ভগবান হরি রাজর্ষি পৃথুর এইরূপ বচনের প্রশংসা করলেন। পৃথু কর্তৃক সম্যকভাবে পূজিত হয়ে তাকে আশীর্বাদ করে ভগবান প্রস্থান করলেন।

তৎপরে মহারাজ পৃথু দেব, ঋষি, গন্ধর্ব, সিদ্ধ, চারণ, অঙ্গরা, কিন্নর, নাগ, মানব, খেচর, প্রভৃতি সকল প্রাণীকে সম্মান প্রদর্শন করলেন। যজ্ঞস্থলে আসীন ভগবানের পার্ষদগণকে ভগবৎ বুদ্ধিতে স্তব করে বসন-ভূষণ প্রদান করলেন। তারা সন্তুষ্ট হয়ে প্রস্থান করলেন।

ভগবান হরিও যেন পৃথুর চিত্ত হরণপূর্বক ঋত্বিকগণের সঙ্গে নিজ ধামে গমন করলেন। পৃথু করজোড়ে তাদের গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর ভগবান শ্রীবিষ্ণু দৃষ্টির অতীত হলে পৃথু সেই দেবাদিদেব বাসুদেবকে প্রণাম করলেন। এরপর তিনি নিজ পুরীতে প্রত্যাগমন করলেন।

.

একবিংশ অধ্যায়
প্রজাগণের প্রতি পৃথুর অনুশাসন

মৈত্রেয় বললেন–হে বিদূর, যজ্ঞ সমাপ্ত করে পৃথু পুরমধ্যে প্রবেশ করলেন। সেই পুরীর বিভিন্ন জায়গা মুক্তো, ফুল-মালা বস্ত্র ও স্বৰ্গতোরণে সুশোভিত ছিল।

সেগুলি সুগন্ধী মহাধূপ দ্বারা সুবাসিত হয়েছিল। সেখানকার রাজপথ, প্রাঙ্গণ ও অভ্যন্তরস্থ পথগুলি চন্দন ও অগুরুমিশ্রিত জলে ধৌত হয়েছিল। ফল-পত্র সমন্বিত কলাগাছ, ও গুবাক গাছ এবং পল্লব মালা দিয়ে সমস্ত জায়গাগুলি অলঙ্কৃত করা হয়েছিল।

প্রজাগণ এবং উজ্জ্বল মণিকুন্তলে ভূষিতা কুমারীগণ দীপমালা, দই প্রভৃতি নানাবিধ উপহারসমূহ পৃথুকে অভ্যর্থনা করলেন।

শঙ্খ, দুন্দুভি-নাদ এবং ঋত্ত্বিকগণের উচ্চারিত বেদধ্বনির দ্বারা স্তুত হয়ে পৃথু নিজ ভবনে প্রবেশ করলেন।

এবিধ বিপুল ঐশ্বর্যের অধিকারী হলেও পৃথুর কোনওরূপ অহঙ্কার ছিল না। নিজ গৃহে প্রত্যাগমনের সময়ে মহা যশস্বী মহারাজ পৃথু বিভিন্ন স্থানে পুরবাসীগণের দ্বারা পূজিত হয়েছিলেন। এতে তিনি সন্তুষ্ট হয়ে তাদের মনোমত বর প্রদান করেন।

মহারাজ পৃথুর চেষ্টা পরম উৎকৃষ্ট, তিনি মহৎ। সেজন্য তিনি সকলের পূজ্যতম ছিলেন। তিনি পৃথিবীর দোহন প্রভৃতি বিবিধ কর্ম সম্পাদন করে, নিজ যশ বিস্তার করেন।

দীর্ঘদিন সুষ্ঠুভাবে ভূমণ্ডল শাসন করে তিনি পরমধামে গমন করেছিলেন।

সূত বললেন–হে সভাপতে শৌনক, পরম ভাগবত বিদূর, মহর্ষি মৈত্রেয় কর্তৃক আদিরাজ পৃথুর যশ ও কীর্তি শ্রুত হলেন। পৃথুর কাহিনী শ্রবণ করে মহামুনি মৈত্রেয়কে পূজা করলেন।

হে মুনিসত্তম, পৃথুর যশ অসামান্য। তা বিশেষ গুণ দ্বারা অর্জিত হয় এবং গুণশীল ও গুণগ্রাহী ব্যক্তিরা সর্বদা তার সমাদর করেন।

তারপরে বিদুর মুনিবর মৈত্রেয়কে প্রশ্ন করলেন–হে মহামুনি, পৃথু মুনিগণ কর্তৃক রাজ্যে অভিষিক্ত হয়েছিলেন। যে বাহুদ্বয়ের শক্তিতে তিনি পৃথিবী দোহন করেছিলেন, সেই বাহুদ্বয়ে বিষ্ণুতেজ ধারণ করে সমগ্র দেবমণ্ডলীর নিকট বিশেষ সম্মান প্রাপ্ত হন। এরপরে তিনি আর কি কি বিশেষ কাজ করেছিলেন?

যে মহান পুরুষের পৃথিবী দোহন রূপ বিক্রমের উচ্ছিষ্টতুল্য কাম উপলক্ষ্য করে বহু ভূপতি এবং লোকপালগণ আজও জীবনধারণ করছেন, তার কীর্তি আমায় বলুন।

হে মুনিশ্রেষ্ঠ, আপনি আমাকে সে সকল বিশুদ্ধ কর্মকাণ্ডের কথা বিবৃত করুন।

মৈত্রেয় স্মিত হেসে বলতে শুরু করলেন। মহারাজ পৃথু তখন গঙ্গা ও যমুনা মধ্যবর্তী ভূভাগে বসবাস করতে লাগলেন। তিনি ভোগ দ্বারা পুণ্য ক্ষয়ের উদ্দেশ্যে প্রাক্তন কর্মানুযায়ী বিষয় ভোগ করতে লাগলেন। সাতটি দ্বীপের মধ্যে একমাত্র তিনিই দণ্ডধর ছিলেন।

ব্রাহ্মণকুল, এবং ভগবান অচ্যুত যে ব্যক্তিগণের গোত্র প্রবর্তক-তুল্য, সে সকল বৈষ্ণবগণ ছাতা সর্বত্র পৃথুর আদেশ প্রচলিত ছিল।

কালক্রমে, একদিন মহারাজ পৃথু এক মহাযজ্ঞে দীক্ষিত হলেন। সেই যজ্ঞে দেবতা, ব্রহ্মর্ষি ও রাজর্ষিগণ সমাগত হয়ে সভ্য হলেন।

যজ্ঞস্থলে সমবেত পূজনীয় সভাসদগণের যথাযোগ্য অর্চনা শেষে নক্ষত্র পরিবৃত শশধরের ন্যায় তিনি দণ্ডায়মান ছিলেন।

তাঁর দেহ ছিল সমুন্নত ও গৌরবর্ণ, বাহুদ্বয় ছিল দীর্ঘ ও বলিষ্ঠ, সুগঠিত নাসিকা, সুস্পষ্ট স্কন্দদ্বয়। রক্তাভ লোচনে তার মুখশ্রী সুন্দর মৃদু হাস্যযুক্ত প্রশান্ত মূর্তিতে তিনি স্মিত নয়নে চতুর্দিকে দৃষ্টিপাত করলেন।

তাঁর বক্ষস্থল প্রশস্ত, কটিদেশ বিস্তীর্ণ, উদরে ত্রিবলি শোভিত ছিল। উদরের নিম্নাংশে অশ্ব পল্লবের মতো উপরের দিকে বিস্তৃত ও নিম্নাংশে সঙ্কুচিত ছিল। নাভিদেশ জলাবর্তের গর্তের ন্যায় গভীর, উরুদ্বয় কাঞ্চনতুল্য উজ্জ্বল ও চরণের অগ্রভাগ উন্নত ছিল।

তার কেশবেনি ছিল সূক্ষ্ম, কুটিল ও ঘনকালো সুস্নিগ্ধ। গলায় কম্বুর মতো তিনটি রেখা অঙ্কিত। মহামূল্যবান পট্টবসন তাঁর পরিধান ও উত্তরীয়। যজ্ঞের নিয়মানুসারে তিনি ভূষণ পরিত্যাগ করেছিলেন। এর ফলে তার স্বাভাবিক গাত্রশোভা প্রকাশিত হয়েছিল।

কৃষজিনধারী ও কুশ হস্তে তিনি যজ্ঞক্রিয়া সম্পাদন করছিলেন। সেসময় তাকে অপূর্ব শ্রীমণ্ডিত দেখাচ্ছিল।

তার চক্ষুতারকা ছিল স্নিগ্ধ ও সন্তাপহারিণী। চতুর্দিকে প্রসন্ন দৃষ্টিপাত করে তিনি শ্রুতিমধুর বাক্যে বলতে লাগলেন।

তার বাচনভঙ্গী ছিল খুব সুন্দর। ভাষণের এক একটি পদ ছিল বিচিত্র, প্রশস্ত, শুদ্ধ, গম্ভীর, গূঢ় অর্থ ব্যাপক ও প্রাঞ্জল। সকলের মঙ্গলসাধনের উদ্দেশ্যেই তিনি স্বীয় অনুভূত তত্ত্বগুলি আবার বলতে শুরু করলেন।

মহারাজ পৃথু বলতে শুরু করলেন, হে সভাবৃন্দ, এই স্থানে মহাত্মাদিগেরও আগমন হয়েছে। আপনারা আমার কথা শ্রবণ করুন, আপনাদের মঙ্গল হবে। ধর্মাগ্রহী ব্যক্তিদের উচিত, সাধুদিগের কাছে নিজ নিজ চিন্তা ব্যক্ত করা। আমি প্রজাশাসনের ছলে আপনাদের জিজ্ঞাসা করছি।

প্রজাগণের জীবিকা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য জগদীশ্বর আমাকে দণ্ডধররূপে নিযুক্ত করেছেন। আপনাদের নিজ নিজ বর্ণাশ্রম ধর্মে নিযুক্ত করাই আমার কর্তব্য কর্ম।

প্রাক্তন কর্মসাক্ষী ভগবান শ্রীহরি যাঁদের প্রতি পরিতুষ্ট হন, ব্রহ্মবাদীরা যাদের গুণকীর্তন করেন, তারাই আমার এই লক্ষ্য। সেসব ব্যক্তিরা সামান্য নন, তাঁরা সর্বাভিলাষ পূর্ণ।

যে রাজা প্রজাদের স্ব-স্ব ধর্মশিক্ষা না দিয়ে কর গ্রহণ করেন, তিনি প্রজাগণের পাপের ভাগী হন। নিজ ঐশ্বর্য থেকে সেই রাজা ভ্রষ্ট হয়ে থাকেন।

অতএব প্রজাগণ! আমি তোমাদের প্রভু। আমার প্রজাগণের পাপের ভাগী হন।

নিজ ঐশ্বর্য থেকে সেই রাজা ভ্রষ্ট হয়ে থাকেন।

অতএব প্রজাগণ। আমার পিণ্ডদান ও নরলোকের মঙ্গলের জন্য তোমরা ভগবান হরিতে মতিস্থির কর। এভাবেই যদি তোমরা নিজ নিজ ধর্মাচারণ কর, তবেই আমাকে অনুগ্রহ করা হবে।

হে অম্লান চিত্ত পিতৃগণ, দেব ও ঋষিবৃন্দ, যদি আপনারা মনে করেন যে আমি সাধুবাক্য বলেছি, তাহলে তা অনুমোদন করুন। কারণ কর্মের কর্তা শিক্ষাদাতা অনুমোদনকারী– তিনজনেরই পরলোকে সেই ধর্মানুষ্ঠানের জন্য সমান ফল লাভ হয়।

হে পূজ্যতম বৃন্দ! কারও মতে যজ্ঞেশ্বর নাথ একজন পরমেশ্বর আছেন। আবার কারও কারও মতে ইহকাল ও পরকাল–উভয় কালেই ভোগের ভূমি শরীর সকল দৃশ্য হয়।

মহীমতি মনু, উত্তানপাদ, ধ্রুব, প্রিয়ব্রত, রাজর্ষি অঙ্গ ও এরূপ ব্যক্তি এবং ব্রহ্মা, শিব, প্রহ্লাদ ও বন্দি সকলের মতে কর্মফল প্রদাতা পরমেশ্বর অবশ্যই আছেন। ধর্ম বিষয়ে বিমূঢ়, নিন্দনীয় মৃত্যুর দৌহিত্র বেণ প্রভৃতি কয়েকজন ছাড়া সবাই মনে করেন ভগবান আছেন। তিনিই ত্রিবর্গ, স্বর্গ ও মোক্ষের অদ্বিতীয় কারণ।

কর্ম জড়, তাই ফল প্রদানে অক্ষম। এমনকি দেবতারাও স্বাধীন নয়। তারাও ফলদানে সক্ষম নন। শ্রুতি বলেন, তাঁদেরও অন্তর্যামী আছেন। কর্ম কোথাও সিদ্ধ হয়, কোথাও অসিদ্ধ হয়। অতএব, সর্ববিষয়ে ক্ষমতাবান পরমেশ্বর অবশ্যই আছেন। তাতেই কর্মফল সিদ্ধি সম্ভব হয়।

হে প্রজাগণ, যাঁর পদাঙ্গুষ্ট বিনিঃসৃত গঙ্গার ন্যায় সর্বদা বৃদ্ধি পায়, তার ভজনা কর।

এভাবেই অন্তঃস্থলের বহু জন্ম সঞ্চিত মালিন্য বিনাশিত হয়। যাঁর চরণশূল আশ্রয় করলে পুরুষের মানসিক দীনতা দূরীভূত হয় এবং বৈরাগ্য দ্বারা বিজ্ঞান সাক্ষাৎকার হয়, তার উপাসনা কর।

যাতে সংসার ক্লেশে পুনর্বার জর্জরিত হতে না হয়। সেজন্য শ্রীহরির ভজনা কর। তাহলে নিজ নিজ অধিকার অনুযায়ী পুরষার্থ সিদ্ধি অবশ্যই হবে। এই বিশ্বাস নিয়ে তোমরা নিজ নিজ উপযোগী যজ্ঞাদি, কর্ম দ্বারা ভগবানকে বন্দনা কর।

ধ্যান, ঈশান, পূজা, সেবাদি দ্বারা এবং নিজ নিজ বৃত্তি দ্বারা ভগবান হরির ভজনা কর। তার পাদপদ্মে সব অভীষ্ট প্রদান করে।

ভগবান স্বরূপতঃ নিরপাধি, চৈতন্যঘন এবং নির্বিশেষে। কিন্তু তিনি কর্মমার্গে বিবিধ দ্রব্য, গুণ, ক্রিয়া ও মন্ত্রাদি দ্বারা প্রকাশিত হন। অর্থ, সংকল্প, লিঙ্গ, ও নাম দ্বারা নানান বিশেষণ বিশিষ্ট হয়ে কর্মমার্গে যজ্ঞরূপে আত্মপ্রকাশ করেন।

সুতরাং তাবৎ যাগযজ্ঞ ও তাদের অঙ্গাদিতে ভগবৎ দৃষ্টি রেখে কর্মসম্পাদনা আবশ্যিক। যাগযজ্ঞের মত ঐ সকলের ফলও ভগবানের স্বরূপ। তিনি বিভু। তিনি পরমানন্দ স্বরূপ হয়েও শরীরের অভ্যন্তরে বিষয়কারী বুদ্ধিপ্রাপ্ত হন।

আগুন যেমন কাঠের মধ্যে অবস্থান করে কাঠের ধর্ম দৈর্ঘ্য হ্রাস্বাদি বিশিষ্ট হয়ে প্রকাশিত হয় তেমন ক্রিয়া ও ফলরূপে প্রতীয়মান হয়। এই দেহ প্রধান (অব্যক্ত), কান (ক্ষোভক), আশায় (বাসনা), ধর্ম (অদৃষ্ট) এই সকলের সাথে উৎপন্ন হয়েছে। এতে বিষয়কারী বুদ্ধি হওয়া বিচিত্র নয়।

অর্থাৎ ভগবান শরীর মধ্যে চেতনা-বুদ্ধিতে অধিষ্ঠান-পূর্বক কর্মফলরূপে প্রতীয়মান হন। যজ্ঞভাগী দেবগণের–অধীশ্বর সর্বপূজ্য ভগবান হরিকে পৃথিবীতে যে সকল একাগ্রচিত্তে সাধুবৃন্দ স্বধর্ম পালন দ্বারা অবিরত আরাধনায় রত, তারা আমার প্রিয়লোক। তারা আমাকে সর্বদা অনুগ্রহ করেছেন।

ক্ষমা, সাধনা ও বিদ্যা এই বিবিধ মহাসম্পদের বলে বলীয়ান ব্রাহ্মণ ও বৈষ্ণবকুল স্বততঃ উজ্জ্বল। আমার প্রার্থনা এই যে কখনও কোনও রাজবংশ যেন এদের প্রতি প্রভাব বিস্তার না করে। ক্ষত্রিয়গণ যেন কখনোই ব্রাহ্মণগণ ও বৈষ্ণবদের প্রতি দণ্ডবিধান না করেন।

মহত্তমদের অগ্রণী পুরাতন পুরুষ ব্রাহ্মণদের শ্রীহরি নিত্য যাঁদের চরণ বন্দনা করেন, তারা ব্রাহ্মণ। এই ব্রাহ্মণদের কৃপায় তিনি অচলা লক্ষ্মীকে অর্জন করেছেন। এঁদের কৃপায় তিনি জগতের পবিত্রকারী যশ লাভ করেছেন। তাদের সেবায় সর্বান্তযামী, স্বপ্রকাশ, বিপ্রপ্রিয় বিভু পরম প্রীতি লাভ করেন।

তোমার বিনীত ও লোকসংগ্রহ রূপ ভগবৎ ধর্মে তৎপর হয়ে সর্বান্তকরণে সেই ব্রাহ্মণ কুলের সেবা করবে। যে ব্রাহ্মণগণের নিত্য সেবার দ্বারা লোকের অনতিবিলম্ব স্বভাবতই চিত্তশুদ্ধি এবং জ্ঞানাভ্যাস ছাড়াই পরম শান্তি অর্থাৎ মোক্ষলাভ হয়।

ব্রাহ্মণ সেবা দ্বারা সমস্ত যজ্ঞ ও জ্ঞানের ফল সিদ্ধ হয়।

উপনিষদে যাঁকে জ্ঞানার্জন বলে উল্লেখ করা হয় তিনিই ভগবান অনন্ত।

তত্ত্ববেত্তা প্রভৃতি ইন্দ্রাদি দেবতার নামোচ্চারণ পূর্বর্তক শ্রদ্ধাসব ব্রাহ্মণ মুখে অর্পিত হরি শ্রীভগবান প্রসন্নমনে গ্রহণ করুন। অবচেতন অগ্নিতে প্রক্ষিপ্ত বস্তু গ্রহণে তিনি সেভাবে প্রসন্ন হন না।

বেদে আদর্শের ন্যায় এই বিশ্ব প্রকাশিত। ব্রাহ্মণগণ, শ্রদ্ধা, তপস্যা, মঙ্গল, মৌন, ইন্দ্র, সংযম এ সমাধি দ্বারা সেই নিমতল সনাতন বেদকে প্রকৃত অর্থ গ্রহণার্থে নিত্য ধারণ করেন।

হে আর্যগণ, আমি যেন আজীবন সেই ব্রাহ্মণদের পদরেণু নিজ মুকুটে ধারণ করতে পারি। ব্রাহ্মণদের চরণধূলি যে পুরুষ নিত্য গ্রহণ করেন তার পাপ বিনষ্ট হয়।

সকল প্রকার গুণরাশি তাকে আশ্রয় করে। ব্রাহ্মণসেবী পুরুষ সুশীল, কৃতজ্ঞ, ও বৃদ্ধজনের আশ্রয় হয়, তাতে সম্পত্তি স্বয়ং তাকে বরণ করে। এজন্য আমি সর্বদা প্রার্থনা করি ব্রাহ্মণকুল, গোসকল ও অনুচরসহ ভগবান বিষ্ণু আমার প্রতি সততঃ প্রসন্ন হন।

মৈত্রেয় বললেন–বিদুর, নৃপতি পৃথুর এইরূপ ভাষণের পরে পিতৃ, দৈব ও ব্রাহ্মণগণ ও অন্যান্য সাধু পুরুষগণ হৃষ্টমনে তাঁর সাধুবাদ করতে লাগলেন।

তারা পৃথুকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলেন–পুত্র দ্বারা পিতা উত্তম লোকসকল লাভ করে, এই শ্রুতি সত্য। ব্রহ্মাশাপদগ্ধ পাপিষ্ঠ বেনও অন্ধতম নরক অতিক্রম করল।

ভগবানের নিন্দা করে নরকে প্রবেশাম্মুখ হিরণ্যকশিপুও ভগবৎ ভক্ত নিজপুত্র প্রহ্লাদের প্রভাবে তার থেকে পরিত্রাণ পান।

হে বীরোত্তম, হে পৃথিবীর পিতৃরূপ রাজা পৃথু! তুমি শত শত বৎসর রাজত্ব করো। দীর্ঘজীবি হও। সর্বলোকের একমাত্র ভর্তা অচ্যুতের প্রতি তোমার এরকম একনিষ্ঠ ভক্তি, সাধু! সাধু!

হে পবিত্রকীর্তি মহারাজ, তুমি আমাদের নাথ। তোমাকে পেয়ে আমরা মুকুন্দনাথ হলাম। অর্থাৎ মুকুন্দকে নাথ হিসাবে লাভ করলাম। আমাদের মনে হচ্ছে তুমি ভগবান সুদৃঢ়ভাবে ভগবানকে নাথরূপে আশ্রয় করেছ। তাই তুমি ব্ৰহ্মণ্যদেরও উত্তম শ্লোক ভগবান বিষ্ণুর কথা এভাবে বিশ্লেষণ করতে পারছ।

হে নাথ, আমরা তোমার আশ্রিত। তুমি যে আমাদের এভাবে সদুপদেশ দেবে তাতে কিছুই আশ্চর্য নেই। দয়াশীল ব্যক্তিরা স্বভাবতই প্রজানুরঞ্জন করে থাকেন। হে প্রভু, আজ আমরা তোমার কৃপায় অন্ধকারের পার প্রাপ্ত হলাম।

এতকাল দৈব নামক প্রারব্ধ কর্ম দ্বারা নষ্ট চেতন হয়ে সংসারে বিবিধ যোনিতে ভ্রমণ করছিলাম। যিনি ক্ষত্রিয় জাতির রক্ষণাবেক্ষণ করেন, তাকে আমরা প্রণাম করি।

যিনি ক্ষত্রিয় জাতিতে অধিষ্ঠিত হয়ে ব্রাহ্মণদের বন্দনা করে, সেই তিনিই উভয় জাতিতে অধিষ্ঠিত হয়ে স্বমহিমায় ঐ বিশ্বের রক্ষণাবেক্ষণ করেন, তাকে আমরা নমস্কার করি।

তিনিই বিশুদ্ধ সত্ত্বময় মহীয়ান পুরুষ। তার কাছে আমরা প্রণত হই।

মৈত্রেয় বললেন–বৎস বিদুর, সভাসদবৃন্দ যখন প্রবল পরাক্রান্ত মহারাজ পৃথুর প্রশংসায় রত ছিলেন, তখন সূর্যতুল্য তেজস্বী চারজন মুনি সেখানে প্রবেশ করেন।

রাজা ও তাঁর অনুচরবৃন্দ দেখলেন যে, ঐ মুনিগণ স্বীয় জ্যোতি দ্বারা লোকসকলকে নিষ্পাপ করতে আকাশ থেকে অবতীর্ণ হচ্ছেন। ঐ মুণিগণ হলেন সনকাদি ঋষি।

তাদের দর্শন পাওয়া মাত্র সদস্য ও অনুচরসহ পৃথু শশব্যস্ত হয়ে উত্থিত হলেন। ঋষিদের গৌরব স্মরণে তৎক্ষণাৎ বশীভূত রাজা পৃথু সবিনয়ে তাঁদের অভ্যর্থনা করলেন।

এতদ্বারা এটাই প্রকাশিত হল তিনি স্বয়ং শীলবান ব্যক্তিদের আচার অনুসরণ করেন। ভগবান রুদ্রদেবের অগ্রজ সনকাদি-ঋষিগণ কুণ্ডমধ্যস্থ অগ্নির ন্যায় স্বর্ণময় আসনে উপবেশন করলেন। রাজা পৃথু তখন শ্রদ্ধা ও সংযমের সঙ্গে প্রীতমনে তাদের স্তুতি করতে শুরু করলেন।

পৃথু বলতে শুরু করলেন-হে মঙ্গলাস্পদ মুণিগণ, আহো, আমি নিশ্চয়ই কোনও মঙ্গলকর্ম করেছিলাম। সেজন্যই যোগিগণের দুর্দর্শ আপনাদের দর্শন লাভ করলাম।

যার প্রতি ব্রাহ্মণগণ প্রসন্ন হোন, তার অপেক্ষা ভাগ্যবান আর কেউ নেই। সপরিষদ শিব ও বিষ্ণু যার প্রতি প্রসন্ন হয়ে থাকেন। ইহলোকে ও পরলোকে তার দুর্লভ বস্তু কিছুই থাকে না। আপনারাও সকল ভুবন পর্যটন করলেও আপনাদের কোন ব্যক্তি দর্শন করতে পারে না।

পূজ্য ব্যক্তিগণ যাঁদের গৃহে উপস্থিত হয়ে জল, তৃণ, গৃহস্বামী ও ভৃত্যদের স্বীকার করেন, সেসকল সাধু গৃহস্থগণ নির্ধন হলেও ধন্য অর্থাৎ কৃতার্থ।

যে সকল গৃহ সাধু বৈষ্ণবদের পাদতীর্থে অর্থাৎ চরণোদকে বর্জিত, সেগুলি মূল্যহীন। সম্পদে পরিপূর্ণ হলেও তা সর্পকুলের আবাস–বৃক্ষের ন্যায় তুলনীয়।

হে দ্বিজশ্রেষ্ঠগণ, আপনাদের আগমন সুখের হয়েছে তো? অবশ্য আপনাদের এরকম জিজ্ঞাসা করার কোনও প্রয়োজন নেই। কারণ আপনারা বাল্যকাল থেকেই ধীর এবং মুক্তির জন্যই শ্রদ্ধার সঙ্গে মহৎ আচরণ করেছেন।

হে নাথগণ। এই সংসার সকল ব্যাপনের বপন ক্ষেত্র। আমরা স্বীয় কর্মবশতঃ এখানে পতিত হয়েছি, এবং ইন্দ্রিয়ভোগ্য বিষয়াবলীকে পরম পুরুষার্থ বলে মনে করছি।

এখানে কি তোমাদের কোন কুশল সম্ভাবনা আছে? আপনাদের মত আত্মারামগণের কুশল ও অকুশলের বুদ্ধিবৃত্তি নেই। এজন্য আপনাদের কুশল জিজ্ঞাসা সঙ্গত নয়।

আমি আপনাদের কাছে আমার নিজের কুশলই জিজ্ঞাসা করি। এই সংসারে সহজে কল্যাণলাভ কিভাবে হতে পারে? আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, আপনারা সংসার তপ্ত ব্যক্তিগণের পরম বন্ধু।

আপনারা বিশুদ্ধ মনের ব্যক্তিদের আত্মস্বরূপ, আত্মপ্রকাশকারী নিত্য সুন্দর ভগবান ভক্তজনের প্রতি অনুগ্রহ বিতরণের জন্য সিদ্ধরূপে ভুবনে বিচরণ করে থাকেন।

মৈত্রেয় বললেন–পৃথুর এইরূপ ন্যায়সঙ্গত, স্বল্পদৈর্ঘ্য শ্রুতিমধুর বাক্যে মুনিগণ অতীব প্রীত হলেন।

ব্রহ্মর্ষি সনত কুমার আনন্দিত মনে ঈষৎ হাস্য করলেন। তিনি স্মিত মুখে এইসব প্রশ্নের উত্তর দিতে লাগলেন।

তিনি পৃথুকে বললেন–মহারাজ আপনি পরম জ্ঞানী হয়েও উত্তম প্রশ্ন করেছেন। প্রাণীদের মঙ্গল সাধনের জন্য সাধুগণের এরূপ মতিই হয়েই থাকে। সাধুসঙ্গ বক্তা ও শ্রোতা উভয়ের পক্ষেই মঙ্গলকর। তাঁদের পরস্পরের প্রশ্নোত্তর শ্রবণে সবারই সুখলাভ হয়।

হে রাজন, ভগবান শ্রী –হরির গুণকীর্তন দ্বারা অন্তরাত্মার মালিন্য, কামনা ও কষায় প্রভৃতির নাশ হয়। এই দুর্লভ নৈতিক রীতি আপনার মধ্যে বর্তমান।

সকল শাস্ত্রের সম্যক্‌ বিচার করে এটাই নিশ্চিত হয়েছে যে, আত্মভিন্ন পদার্থে আসক্তি ত্যাগ ও নির্গুণ আত্মায় দৃঢ় রতিই লোকের যথার্থ মঙ্গলের কারণ। শ্রদ্ধা, ভগবৎ কর্মের আচরণ, তত্ত্ব-জিজ্ঞাসা, আধ্যাত্মিক যোগনিষ্ঠা, যোগেশ্বরগণের উপাসনা এবং সর্বদা পুণ্যকীর্তি হরির পবিত্র কথা আলোচনা দ্বারা সেই রতি হয়ে থাকে।

যে ব্যক্তিগণ অর্থপ্রিয় তাপস এবং কামপ্রিয় রাজস, তাদের সংসর্গে বিতৃষ্ণা ও তাদের অভিমত অর্থ-কামাদি ভোগে নিবৃত্ত থাকা বাঞ্ছনীয়।

সেখানে হরিগুণামৃত পানের সম্ভাবনা রয়েছে সেরকম নির্জন স্থানে অবস্থানের ইচ্ছা এবং আত্ম চিন্তায় পরিতৃপ্তি লাভ প্রভৃতির মাধ্যমে আত্মরতি ও আত্মভিন্ন সঙ্গ ত্যাগের ইচ্ছা জন্মাতে পারে।

অহিংস, নিবৃত্তিপরায়ণতা, আত্মহিতানুসন্ধান, ইন্দ্রিয়দমন, কামশুন্যতা, শাস্ত্রীয় মার্গান্তরের অনিন্দ্য, এসকল বিষয়ের চর্চায় আত্মরতি জন্মায়।

হরিভক্তগণের কর্ণালঙ্কার স্বরূপ শ্রীহরির গুণগাথা বারংবার উচ্চারণ এবং পরিবর্তিত ভক্তি দ্বারা কার্যকারণাত্মক দেহাদির প্রতি বৈরাগ্য ও নিগুণ ব্রহ্মস্বরূপ পরমাত্মায় প্রকৃষ্ট অনুরাগ অনায়াসে উৎপন্ন হয়ে থাকে।

যখন পুরুষের পরব্রহ্ম নৈষ্ঠিকী রতির জন্ম হয়, তখন সে আচার্যবান হয়ে ব্রহ্মানিষ্ঠ গুরুকে লাভ করে।

আগুন যেমন নিজের উৎপত্তিস্থল অরণিকাষ্ঠকে দগ্ধ করে, তেমনি জ্ঞান বৈরাগ্য দ্বারা বাসনাশূন্য হৃদয়কে অর্থাৎ অহংকারাত্মক লিঙ্গ-শরীরকে দগ্ধ করে।

অহঙ্কার স্বরূপ লিঙ্গ শরীরই জীবের আবরক এবং পৃথিবী প্রভৃতি পঞ্চভূত তার প্রধান অংশ।

পুরুষ স্বপ্নে বহু বিষয় দর্শন করলেও স্বপ্নভঙ্গে তার কিছু দেখতে পায় না। জীবের অহঙ্কার রূপ লিঙ্গ শরীর বিনষ্ট হলে, সে কতৃত্বাভিমান থেকে নিষ্কৃতি পায়।

তখন যে আত্মা ভিন্ন কোন বিষয়ই দেখতে পায় না। অন্তঃকরণরূপ উপাধি থাকাতেই পুরুষ জাগ্রত ও স্বপ্নবস্থানেতে আত্মা ও ইন্দ্রিয়ের দর্শন পায়।– আত্মা ও ইন্দ্রিয়ের পারস্পরিক সম্বন্ধের কারণ যে অহঙ্কার, তাকে জীব এই সময়েই দেখতে পায়।

অন্য অবস্থায় অর্থাৎ সুষুপ্তি বা সমাধিকালে দেখতে পায় না। এক উপাধি বশতঃ আত্মাতে দৃশ্যাদিভেদ প্রতীয়মান হয়।

জল, দর্পণ প্রভৃতি ভেদের কারণ পদার্থ সকল থাকলেই পুরুষ আত্মার ও প্রতিবিম্বস্বরূপ অন্য একটির ভেদ দেখতে পায়।

কিন্তু জল, দর্পণের অনুপস্থিতি ঐরকম ভেদ দর্শন হয় না। অসঙ্গ ও আত্মরতির দ্বারা যে প্রকারে মুক্তি লাভ সম্ভব তা বর্ণনা করে, অনাত্ম বস্তুতে আসক্তির কারণে যেভাবে সংসার-বন্ধন ঘটে, তা বলছেন।

যে সকল পুরুষ বিষয়ের ধ্যান করে, তাদের ইন্দ্রিয় সেই বিষয় দ্বারা আকৃষ্ট হয়। সেই বিষয় অভিভূত ইন্দ্রিয় মনকে বিষয়ে আসক্ত করে তোলে।

নদী-হ্রদ তীরবর্তী কুশাদি স্তম্ভমূল দ্বারা নদী-হ্রদ থেকে জল আকর্ষণ করে। তেমনভাবে বিষয়াসক্ত মন, বুদ্ধির কাছ থেকে তার বিচারক্ষমতা অর্থাৎ তার ধর্ম, তার চেতনা হরণ করে নেয়।

অবিবেকী পুরুষ এসব কিছুই দেখতে পায় না। চেতনা অপহৃত হলে স্মৃতিও বিনষ্ট হয়। স্মৃতি নষ্ট হলে স্বরূপজ্ঞানেরও বিনাশ হয়। জ্ঞানের বিনাশকেই পণ্ডিতবৃন্দ আত্মকৃত আত্মবিলোপ বলে থাকেন।

শ্রুতিতে বলা হয়েছে, আত্মার নিমিত্ত সকল বস্তুই প্রিয় প্রতিপন্ন হয়। যে আত্মাকে আশ্রয় করে অন্যান্য বস্তুসমূহ প্রিয় হয়, সেই আত্মার আত্মস্বরূপ বিনষ্ট হলে তা জীবেরই পক্ষে সর্বাধিক ক্ষতিকর।

অর্থ ও ইন্দ্রিয়ভোগের ঐকান্তিক চিন্তার দ্বারাই মানুষের সমস্ত কিছু নষ্ট হয়ে যায়। ঐ দুটি বিষয় চিন্তা করেই শোকে জ্ঞান ও বিজ্ঞান থেকে বিচ্যুত হয়ে স্থাবরতা প্রাপ্ত হয়। যে সকল ব্যক্তি এ ঘোর সংসার সমুদ্র পার হতে ইচ্ছা করেন, তাদের পক্ষে ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষের বিঘাতক বস্তুতে আসক্তি করা অনুচিত।

হে মহারাজ, ধর্মাদি চতুষ্টয় পুরুষার্থ বলেও গণ্য হয়ে থাকে। ধর্মাদি ত্রিবর্গে সবসময়ই কালভয় আছে।

ব্রহ্মাদি দেবগণ এবং আমরা সকলেই কালক্ষোভের পরে উৎপন্ন হয়েছি। কাল সবারই মঙ্গল বিনাশ করেছে, তাদের আর কল্যাণের সম্ভাবনা নেই।

হে নরেন্দ্র, যে ভগবান এইসকল স্থাবর, জঙ্গম ও দেহ, ইন্দ্রিয় প্রাণ বুদ্ধি ও অহঙ্কার আবৃত এবং এদের হৃদয়ে যে ভগবান সর্বত্র অন্তর্যামীরূপে প্রকাশিত সেই ভগবানকে ‘আমি তদাত্মক’ বলে জানুন। ভগবানই স্থাবর, জঙ্গম সকলের হৃদয়ে প্রকাশিত হন।

এরকম মনে করা উচিত নয়, যে ঈশ্বর ব্যতীত অন্য বস্তু আছে, এবং তৎসম্বন্ধে ঈশ্বরেরও মালিন্য হতে পারে।

ভগবান সততস্বরূপ, সুতরাং পরিশুদ্ধ ও নিত্যমুক্ত। যে প্রকৃতি কর্ম দ্বারা মলিন তা তার নিকট অভিভূত হয়।

মাল্যতে যেমন সর্পভ্রম হয়, তার মতো এই বিশ্ব, কাৰ্য্যকারণভাবে সেই ভগবানেই প্রকাশ পাচ্ছেন। বিবেকের উদয় হলে, যেমন মালাতে সর্পভ্রম বিগত হয়, তেমন ভগবানের মধ্যে এই বিশ্বের প্রকাশও অপগত হয়।

কর্মমলিন প্রকৃতিকে যিনি অভিভূত করেন, সেই নিত্যমুক্ত নির্মল, বিশুদ্ধ-সত্ত্ব শ্রীভগবানের কারণাগত হওয়া বাঞ্ছনীয়।

ভগবান শ্রীবিষ্ণুর পাদপদ্মের পত্রসদৃশ অঙ্গগুলিসমূহের শান্তি স্মরণ মাত্রেই তাঁর ভক্তগণের কর্ম দ্বারা গ্রথিত হৃদয় গ্রন্থি অনায়াসে ছেদিত হয়।

বিষয় নির্লিপ্ত জিতেন্দ্রিয় যতিগণ অতি স্বল্প আয়াসে ঐ কর্ম করতে সক্ষম হন না।

অতএব সেই পরম ও চরম শরণ্য ভগবান বাসুদেবের ভজনা কর। শ্রীহরির স্মরণ ব্যতীত যতিগণের পক্ষে এই ভবার্ণব উত্তীর্ণ হওয়া অতি ক্লেশসাধ্য। তাঁর কর্মগ্রন্থি ভেদ করে কামাদি ছয়টি কুম্ভীরসঙ্কুল ভবসাগর পার হতে চান, কিন্তু তা অতি কষ্টকর।

এজন্য তুমি ভগবান হরির ভজনীয় পাদপদ্মকে ভোলারূপে অবলম্বন করে দুস্তর উদকরূপ ব্যসন সকল উত্তীর্ণ হও।

মৈত্রেয় বললেন–হে কুরুশ্রেষ্ঠ বিদুর, ব্রহ্মপুত্র আত্মজ্ঞানী সনৎকুমার এভাবে আত্মস্থ সম্যক প্রকাশ করলেন।

মহারাজ পৃথু তখন তাঁকে স্তব করে বলতে লাগলেন–হে ব্রাহ্মণ, হে ভগবান, দীনার্তের প্রতি করুণাশীল ভগবান শ্রীহরি পূর্বেই আমার প্রতি যে অনুগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন, তাকে সম্পূর্ণ করতেই আপনাদের আগমন হয়েছে।

যেজন্য আপনারা আগমন করেছেন তা সমস্তই সম্পূর্ণ হয়েছে। এখন আমি আপনাদের কি গুরুদক্ষিণা দেব? আমার দেহ ও রাজ্যের প্রতি আমার কোনও সত্তাধিকার নেই।

কারণ সাধুপুরুষেরা সেগুলি যজ্ঞান্তে স্বীকার করে, উচ্ছিষ্টের ন্যায় তা আমাকে প্রদান করেছেন। তথাপি, ভৃত্য যেমন প্রভুকে তাম্বুলাদি অর্পণ করে তেমনি আমার প্রাণ, স্ত্রী, পুত্র, গৃহ, রাজ্য, পৃথিবী, সৈন্য, রাজকোষ এসবই আপনাদের নিবেদন করলাম।

সেনাপতিত্ব, রাজ্য, দণ্ডদানের কর্তৃত্ব এবং সর্বলোকের উপর আধিপত্যের অধিকারী একমাত্র বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণেরা। ব্রাহ্মণগণ নিজেদের স্বত্ত্ব বিশিষ্ট দ্রব্য ভোজন, পরিধান ও দান করে থাকেন। তাদের অনুগ্রহে ক্ষত্রিয় প্রভৃতি লোকে অন্ন ভোজন মাত্র করিয়া থাকে।

তাদের দান করার স্বতন্ত্র অধিকার নেই।

আপনারা বেদবত্তা, অধ্যাত্মবিচার দ্বারা ভগবানের প্রতি ভক্তিই পরম গতি আমাদের তা বুঝিয়ে দিলেন।

আপনারা পরম দয়ালু, নিজেদের কর্ম দ্বারাই সব সময় তুষ্ট থাকেন। একমাত্র অঞ্জলি বন্ধন ছাড়া কোন্ ব্যক্তি আপনাদের কৃত উপকারের প্রত্যুপকার করতে গিয়ে নিজেদের হাস্যাস্পদ করবে?

মৈত্রেয় বললেন–আদিরাজ পৃথু সেই চারজন আত্মজ্ঞানী মুনিগণের যথাবিধি পূজা করলেন। তারপরে তারা প্রীতমনে পৃথুর শীলতাগুণের প্রশংসা করতে করতে আকাশপথে গমন করলেন।

বেনপুত্র পৃথুও সাধুপুরুষদের অগ্রগণ্য ছিলেন। আধ্যাত্ম শিক্ষা দ্বারা তাঁর চিত্তের একাগ্রতা জন্মালে আত্মাতেই অবস্থিত হয়ে নিজেকে পূর্ণ মনোরথ বোধ করলেন।

দেশ, কাল, অনুযায়ী যে যে কর্ম করা সমীচিন, তাঁর যেমন বিত্ত, যেমন শক্তি এবং যেরকম অনুষ্ঠান করা উচিত, সেই অনুসারে পরব্রহ্মে সমর্পণ-পূর্বক সমুদয় কর্ম করতে লাগলেন।

তৎপরে, মহারাজ পৃথু রাজ-সম্পদযুক্ত হয়ে গৃহাশ্রমে থাকলেন। তবুও সঙ্গ-পরিত্যাগ করে সমাহিত হয়ে থাকতেন এবং সমস্ত কর্মফল পরব্রহ্মে সমর্পণ করতেন। অতএব, অহঙ্কার শূন্য ও সূর্যের মতো নির্মল প্রাণ হবার কারণে ইন্দ্রিয়াদি বিষয়ে তার কোনও আসক্তি হল না।

বৎস বিদূর এইপ্রকার আধ্যাত্মযুক্ত হয়ে পৃথু কর্ম করতে লাগলেন। কালক্রমে অর্চি নাম্নী পত্নীর গর্ভে পাঁচ পুত্রের জন্ম হয়। তাদের নাম হল যথাক্রমে বিজিতা, ধূম্রকেশ, হর্ষ, দুরিণ এবং বৃক।

মহারাজ পৃথু একাকী হওয়া সত্ত্বেও অচ্যুতাত্মা হওয়ায় জগতের রক্ষণাবেক্ষণের পৃথক পৃথক গুণ ধারণ করতেন।

উদার মন, প্রিয় বাক্য ও মনোহর মূর্তিধারী রাজা পৃথু, তার সর্বোত্তম গুণাবলী দ্বারা প্রজাদের মনোরঞ্জন করতেন।

এভাবে তিনি দ্বিতীয় চন্দ্রের ন্যায় “রাজা” নাম সার্থক করেছিলেন।

সূর্যদেব যেমন পৃথিবী থেকে রস গ্রহণ করেন, তারপরে পুনরায় বর্ষণ দ্বারা সে রস পৃথুত্ত প্রজাদের কাছ থেকে সম্বৎসর কর গ্রহণ করতেন। আবার তাদের তা প্রত্যর্পণ করতেন। তিনি নিজ প্রতাপ দ্বারা অন্যদের তাঁর আজ্ঞা পালন করতে বাধ্য করতেন।

অগ্নির দুর্ধর্ষ তেজস্বী মহেন্দ্রর মতো দুর্জয় ছিলেন। মহারাজ পৃথুর সহিষ্ণুতা ছিল ধরণীর সঙ্গে তুলনীয়। মনুষ্যের বাঞ্ছিত ফল প্রদানে তিনি স্বর্গের ন্যায় দানশীল ছিলেন। তিনি মেঘের ন্যায় তৃপ্তি বিধান করে সকলের অনুরূপ ধর্ম প্রদান করতেন।

মহারাজ পৃথু ছিলেন সমুদ্রের ন্যায় দুর্বোধ এবং সুমেরুর মতো স্থিতধী। শিক্ষায় তিনি ধর্মরাজ সদৃশ ও বিস্ময় উৎপাদনে হিমালয়ের সমান ছিলেন।

পৃথুর ধনভাণ্ডার ছিল কুবেরের তুল্য এবং বরুণদেবের মতো আত্মগোপন করতেন। বায়ুর মতো তিনি সর্বত্র গমন করতে পারতেন। তাঁর ইন্দ্রিয় মন ও দৈহিক সামর্থ্য ছিল পবনতুল্য।

রাজা পৃথুর অত্যুগ্র-স্বভাবের জন্য তাকে সাক্ষাৎ ভগবান রুদ্র বলে মনে করা হত।

তিনি কন্দর্পের ন্যায় সৌন্দর্যবানে ও মৃগেন্দ্রর ন্যায় প্রশস্ত মনের অধিকারী ছিলেন।

মহারাজ পৃথু প্রজা– বাৎসল্যে মনুর মতো ছিলেন। তার মানুষের প্রতি প্রভুত্ব করার ক্ষমতায় তিনি স্বয়ং ব্রহ্মার সঙ্গে তুলনীয় ছিলেন।

বেদবাদে তিনি ছিলেন বৃহস্পতি তুল্য এবং স্বয়ং শ্রীহরির জিতেন্দ্রিয়।

গো, ব্রাহ্মণ, গুরু এবং বিষ্ণু ভক্তদের প্রতি ভক্তি, লজ্জা, বিনয়, সচ্চরিবতা এবং পরার্থপরতায় একমাত্র নিজের সঙ্গেই তুলনীয় ছিলেন।

ত্রিভুবনের সকল স্থানে পুরুষেরা তাঁর যশকীর্তন করত।

মহারাজ পৃথু নিজের কীর্তি দ্বারা সীতাপতি রামচন্দ্রের মতো সাধু ও কুলাঙ্গানাদের কর্ণকুহরে প্রবেশিত হতেন।

.

ত্রয়োবিংশ অধ্যায়
পৃথুর বৈকুণ্ঠ গমন

মৈত্রেয় বলতে থাকেন– বেনপুত্র পৃথু সবসময়ে একনিষ্ঠ থাকতেন। তিনি অন্নাদি দান এবং পুর ও গ্রামাদির উৎসর্গ অশেষভাবে বাড়িয়ে তুলেছিলেন।

ক্রমে তার বয়স বাড়তে লাগল, এবং তিনি নিজেকে বয়ঃবৃদ্ধ ভাবতে শুরু করলেন। তখন তার মনে হল পৃথিবীর যাবতীয় স্থাবর এবং জঙ্গমের বৃত্তি বিধান ও সাধু পুরুষের ধর্ম প্রতিপালন সম্পন্ন হয়েছে।

যে প্রজাদের পালনার্থে জগদীশ্বর এই পৃথিবীতে আমার জন্ম দিয়েছেন, তার আদেশও সুষ্ঠুভাবে নিষ্পন্ন হয়েছে।

তখন তিনি নিজ পুত্রী স্বরূপ পৃথ্বীকে পুত্রের হাতে সমর্পণ করে নিজ ভার্য্যা অর্চিসহ তপোবনে গমন করলেন।

তার প্রস্থানে সমগ্র ধরণী অত্যন্ত শোকাগ্রস্ত ও বিমর্ষ হয়ে রোদন করতে লাগল। যখন পৃথু ভুবনের রাজা ছিলেন, তখন তিনি ধরামণ্ডল বিজয়ে অতি যত্নশীল ছিলেন।

এখন বাণপ্রস্থে গমন করে তিনি সেই সম্মত কঠোর তপস্যায় প্রবৃত্ত হলেন। কখনও তিনি কন্দমূল ও ফল আহার করতেন।

কখনও বা শুষ্ক পাতা খেয়ে কাটিয়ে দিতেন। এরপরে কিছুকাল শুধুমাত্র জলপান করতে লাগলেন। এরও পরবর্তী পর্যায়ে কেবল বায়ু সেবন করে দেহ ধারণ করেছিলেন।

শ্রীকৃষ্ণের যথোচিত আরাধনার জন্য তিনি মৌনব্রত পালন করতেন। আবার প্রচণ্ড শীতে আকণ্ঠ জলে নিমজ্জিত হয়ে অবস্থান করতেন এবং ভূমিতে শয়ন করতেন।

এভাবেই জিতেন্দ্রিয়, সহিষ্ণু, বাক্ সংযমী ও ঊর্দ্ধরেতা হয়ে নিজ প্রাণবায়ুকে সংযত করে তিনি অত্যুৎকৃষ্ট তপস্যা আচরণ করতে লাগলেন।

তপস্যাবলে তার সমস্ত ক্রমে ক্রমে ক্ষয়প্রাপ্ত হতে লাগল। তার চিত্ত ক্রমে নির্মল হয়ে উঠল। এরপরে তিনি প্রাণায়াম দ্বারা ষড়রিপুরে নিরুদ্ধ করে বাসনাবন্ধন থেকে নির্মুক্ত হলেন।

তারপরে পুরুষশ্রেষ্ঠ পৃথু ভগবান সনৎকুমার যে আধ্যাত্মিক ভক্তিযোগ উপদেশ করেছিলেন, তদনুসারে পরমপুরুষ শ্রীহরির উপাসনায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন।

সাধু ও ভাগবৎনিষ্ঠ পৃথু পরম শ্রদ্ধা সহকারে যত্ন করার ফলে অচিরেই পরব্রহ্মা শ্রীভগবানে তাঁর ঐকান্তিক ভক্তির সৃষ্টি হল।

শ্রীহরির পরিচর‍্যা দ্বারা তার হৃদয়ে বিশুদ্ধ সত্ত্বের আবির্ভাব হল।

শ্রীভগবানের অনুস্মরণে প্রাপ্ত ভক্তির প্রভাবে তাঁর চিত্তে জ্ঞান বৈরাগ্যের উদয় হল।

তীক্ষ্ম সেই জ্ঞানবলে পৃথু সংশয়ীভূত নিজ হৃদয়- গ্রন্থি বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে সক্ষম হলেন।

তত্ত্ব জ্ঞানের সাহায্যে পৃথু এই হৃদয়-গ্রন্থির উচ্ছেদ করতে সমর্থ হলেন। দেহে আত্মবুদ্ধি রূপ মিথ্যাজ্ঞান সম্পন্ন হবার ফলে এবং ভগবৎ-স্বরূপের প্রকৃত অনুভূতি হবার কারণে তিনি সিদ্ধিতেই স্পৃহহীন হয়ে রইলেন। তখন তিনি পরম তত্ত্বজ্ঞানও পরিত্যাগ করলেন।

শ্রীহরির কথায় যতক্ষণ না রতি হয়, ততক্ষণ যোগপতি বিশিষ্ট যতির অপ্রমত্ত হওয়া সম্ভব নয়। এভাবে বীর প্রবর পৃথু পরমাত্মাতে আত্মা অর্থাৎ মন সংযুক্ত করে ব্রহ্মস্বরূপ হতে পেরেছিলেন। তারপরে নির্দিষ্ট কাল উপস্থিত হলে তিনি নিজ কলেবর পরিত্যাগ করলেন।

মৈত্রেয় এবারে পৃথুর দেহত্যাগ কিভাবে হয়েছিল, তা বর্ণনা করতে লাগলেন।

পৃথু নিজ চরণযুগলের পাপিষ্ণ সাহায্যে গুহ্যদেশ নিপীড়িত করলেন। এবারে তিনি মূলাধার অর্থাৎ গুহ্য ও লিঙ্গ মধ্যবর্তী দু-অঙ্গুলি পরিমিত স্থান থেকে ওপরে উত্তোলন করে স্বাধিষ্ঠান চক্রে স্থাপন করলেন।

তারপরে ঐ বায়ুকে নাভিস্থানে অর্থাৎ মণিপুর চক্রে নিয়ে গেলেন।

তারপরে কোষ্ঠসমূহে অর্থাৎ হৃদয়ে অনাহতচক্র, বক্ষে বিশুদ্ধ চক্র, কণ্ঠের অধোভাগে বিশুদ্ধ চক্রের অগ্রদেশ কণ্ঠে ও দুটি ভুর মধ্যবর্তী আজ্ঞাচক্রে উত্তোলন পূর্বক স্থাপন করলেন।

এবারে সেই দেহস্থ বায়ুকে দেবের কঠিন অংশকে ক্ষিতিতে, দৈহিক তেজরাশিকে তেজ, দেহস্থ ইন্দ্রিয় ছিদ্রকে আকাশে এবং দেহের রসভাগকে জলে সংযোজিত করলেন।

এভাবে উদ্ভব ক্রমানুসারে তিনি তেজকে, বায়ুকে আকাশে মিশিয়ে দিলেন।

মনকে ইন্দ্রিয় এবং পঞ্চইন্দ্রিয়কে পঞ্চতন্মত্রে বিলীন করলেন। তারপর ভূতাদিকে ক্ষেপণ করে মহর্তত্ত্বে সংযুক্ত করলেন।

সর্বগুণের স্থিতিস্থান মহাতত্ত্বকে মায়াময় জীবে যোজিত করলেন। পৃথু পূর্বে অনুশয়যুক্ত অর্থাৎ লিঙ্গ শরীরাভিমানী জীব ছিলেন।

এক্ষণে জ্ঞান ও বৈরাগ্যের প্রভাবে স্বরূপে স্থিত হলেন। এভাবে তিনি অনুশয়োপধি জীবেরও পরিত্যাগ করলেন।

মৈত্রেয় বললেন– হে বিদূর, পৃথুর পত্নী মহারাণী অর্চি ছিলেন অতীব সুকুমারী। যে অর্চিতর কখনও চরণযুগল ভূমি –স্পর্শ করার যোগ্য নয়, সেই তিনি পত্নীর সঙ্গে বনে গমন করলেন।

স্বামীর প্রতি তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠাবতী ছিলেন। তাই স্বামীর ব্রতার্থে সহযোগী হয়ে স্বামীসেবা ও মুনিগণের উপযোগী জীবনযাত্রা নির্বাহ করতেন।

এর ফলে অত্যন্ত কৃশ হলেও তার ক্লেশ অনুভূত হত না। মহারাজ পৃথুর করস্পর্শ ও সঙ্গলাভেই তিনি পরমানন্দ লাভ করতেন।

রাজা পৃথুর দেহত্যাগের পর পতিব্রতা অর্চি যখন দেখলেন, পৃথুর দেহে চেতনাদি বিনষ্ট হয়েছে; তখন বিলাপ করতে লাগলেন। কিছুক্ষণ বিলাপ করে, পরে পর্বতের সানুদেশে চিতা রচনা করে, স্বামীর দেহ তাতে আরোপণ করলেন।

তারপরে তৎকালোচিত অন্যান্য ক্রিয়াদি নির্বাহ করে, নদীর জলে স্নান করে পতির তর্পণ করলেন। তারপরে আকাশের দেবগণকে প্রণাম করে তিনবার চিতা প্রদক্ষিণ করলেন।

এরপরে তিনি পতির পদযুগলের ধ্যান করতে করতে অগ্নিমধ্যে প্রবেশ করলেন।

হে বিদুর, পতিব্রতা অর্চিকে বীরবর পৃথুর সঙ্গে সহমরণে গমনোদ্যত দেখে আকাশপথে দণ্ডায়মানা বহু বরদাত্রী দেবীগণ দেবগণের সাথে মিলিত হয়ে তাঁর স্তব করতে লাগলেন।

এরপরে দেবগণের দুন্দুভি বেজে উঠল, দেব পত্নীগণ ঐ পর্বতের জানুদেশে পুষ্পবৃষ্টি করতে লাগলেন।

তারা এও বলতে লাগলেন– আহা, এই বধূ অর্চি ধন্যা। যজ্ঞেশ্বর বধূ লক্ষ্মীর ন্যায় ভূপতিগণের পতি স্বীয় পতিকে সর্বান্তঃকরণে ভজনাপূর্বক দুর্বিভাব্য আত্মকর্ম দ্বারা ঊর্ধ্বলোকে গমন করছেন।

এই পৃথিবীতে চঞ্চল পরমায়ু প্রাপ্ত হয়েও যে ব্যক্তিগণ এমন দুষ্কর্ম সাধন করে, যাতে ভগবানকে পাওয়া যায়, তাদের পদ্মে কি দেবপদ দুর্লভ হতে পারে?

হায়, হায়, জন্ম-জন্মান্তরের বহুবিধ কৃচ্ছ্বসাধনের ফলে সেসকল ব্যক্তি এই পৃথিবীতে মুক্তি সাধন যোগ্য মনুষ্য জন্মলাভ করেও অনিত্য বিষয়ে আসক্ত হতে পারে সে আত্মদ্রোহকারী ও বঞ্চিত বলে প্রতিপন্ন হয়।

মৈত্রেয় বললেন– বৎস বিদুর, অমর নারীগণ ঐরকম স্তব করতে লাগলেন। পৃথুপত্নী অর্চি পতিলোকে গিয়ে উপনীত হলেন। আত্মজ্ঞশ্রেষ্ঠ অচ্যুতশ্রেয় কোপুত্র পৃথু যে পরমলোক প্রাপ্ত হোক, পত্নী অর্চিও সেই লোকে উপস্থিত হলেন।

বৎস মহাভাগবৎ পৃথু অতি মহানুভব ও উদ্দমচরিত্র, তাঁর চরিত্র এতক্ষণ তোমার কাছে বর্ণনা করলাম।

যে ব্যক্তি অবহিত হয়ে শ্রদ্ধাপূর্বক এই সুমহান আখ্যান পাঠ করে, সে পৃথুর পদবী লাভ করবে।

এই চরিত্র পাঠ করলে ব্রাহ্মণগণ ব্রহ্মতেজ প্রাপ্ত হবে। ক্ষত্রিয়গণ পৃথিবীর প্রভুত্বপ্রাপ্ত হবে। বৈশ্য বংশের অধিনায়ক এবং শূদ্র সাধুশ্রেষ্ঠ হবে।

পুরুষ বা নারী শ্ৰদ্ধাপরায়ণ হয়ে এই চরিত্র যদি তিনবার শ্রবণ করে, তা অতিশয় পূণ্যের কাজ।

তাহলে অপুত্রক পুত্রলাভ করে, নির্ধনের ধনলাভ হয়, কীর্তিহীন ব্যক্তি মহাকীর্তিমান হয় এবং মুখও পাণ্ডিত্য লাভ করে।

এই পবিত্র চরিত্র স্বস্ত্যয়ন রূপ সকল অমঙ্গল দূরীভূত করে। এটা ধন, কীর্তি ও স্বর্গলাভের সহায়ক। কলির যাবতীয় পাপনাশে তা সহায়তা করে।

ধর্ম, অর্থ, কাম, ও মোক্ষের সম্যক্ সিদ্ধিকামী পুরুষের পক্ষে শ্রদ্ধাপূর্ণ হৃদয়ে এই চরিতামৃত শ্রবণ অবশ্যকর্তব্য। কারণ ইহা চুতর্বর্গ সিদ্ধির সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়।

বিজয়কালে কোনও রাজা এই আখ্যান শ্রবণ করে, যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করবেন, তারা তাকে বহু কর ও উপহার প্রদান করবেন।

এই চরিত্রে বহুবিধ ফল লাভ হয়। অন্য সকল বিষয়ে আসক্তি পরিত্যাগ করে ভগবান শ্রীহরির চরণে শ্রদ্ধাভক্তি সহকারে পৃথুর চরিত্রকথা শ্রবণ করবেন বা অপরকে শ্রবণ করাবেন এবং নিজে পাঠ করবেন।

মৈত্রেয় বললেন– হে বিচিত্রবীর্য বিদুর! আমি এতক্ষণ তোমার কাছে ভগবানের মাহাত্ম্যসূচক এই পৃথু চরিত্র বর্ণনা করলাম, এই চরিতামৃতে মনোনিবেশ করলে যে-কোনও মরণশীল মানব পৃথুর মতো গতি লাভ করতে সক্ষম হবে।

অন্য সঙ্গ পরিত্যাগ করে এই বিশুদ্ধ চরিত্র পৃথুর অমৃত কথা সাদরে প্রতিদিন শ্রবণ ও কীর্তন করা আবশ্যিক।

এর ফলে এই দুস্তর ভাবসমুদ্র থেকে নিস্তার লাভ সহজ হবে। এর ফলে ভবসাগর থেকে পরিত্রাণের ভেলাস্বরূপ শ্রীভগবানের পাদপদ্মে নিশ্চলা রতি লাভ সম্ভব হবে।

.

চতুর্বিংশ অধ্যায়
পৃথুর প্রপৌত্র প্রাচীনবৰ্হি হতে প্রচেতাদের উৎপত্তি ও তাদের নিমিত্ত রুদ্রগীত বর্ণন

মৈত্রেয় বিদুরকে সম্বোধন করে বললেন–হে বৎস! মহার্যশস্বী ভ্রাতৃবৎসল পৃথুপুত্র বিজিতা সমগ্র ভুবনের অধীশ্বর হলেন। তিনি তাঁর কনিষ্ঠ ভাইদের এক একটি দিক প্রদান করলেন।

হর্ষক্ষকে বিজিতাশ্ব পূর্বদিক এবং বৃককে পশ্চিমদিক দান করলেন। ধূম্রকেশ দক্ষিণদিকের আধিপত্য লাভ করলেন, দ্রবিণ পেলেন উত্তরদিকের দায়িত্ব।

পিতা পৃথুর অশ্বমেধ যজ্ঞের জয়ের অবসরে বিজিতাশ্ব ইন্দ্রের কাছ থেকে অভ্যর্থনা বিদ্যা লাভ করেছিলেন। সেকারণে পরে বিজিতাশ্বের নাম হয়েছিল অন্তর্ধান।

বিজিতাশ্ব নিজ ভার্য্যা শিখণ্ডিনীর গর্ভে আত্মতুল্য তিন পুত্রের জন্ম দেন। বশিষ্ঠ প্রদত্ত পূর্বশাপগ্রস্ত হবার কারণে পাবক, পামান ও শুচি নামক অগ্নিত্ৰয় বিজিতাশ্বের পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করেন। পরে তারা আবার যোগপতি অর্থাৎ অগ্নিত্ব পুনপ্রাপ্ত হন।

ইন্দ্রকে পিতৃযজ্ঞের অশ্ব অপহরণকারীরূপে চিহ্নিত করলেও যিনি তাকে বধ করেন নি; সেই অন্তর্ধান, নভস্বতী নামে অপর স্ত্রীর গর্ভে হবির্ধান নামে পুত্রের জন্ম দেন।

অন্তর্ধান কর আদায়, দণ্ডবিধান ও শুল্কগ্রহণ প্রভৃতি রাজবৃত্তিকে পরপীড়নকারী মনে করতেন। সেজন্য সুদীর্ঘকাল ব্যাপী একটি যজ্ঞ করার অছিলায় ঐ রাজবৃত্তি পরিত্যাগ করেন।

সেই যজ্ঞে আত্মদর্শী হয়ে, ভক্তজন ক্লেশহারী পরম পুরুষ শ্রীহরির অর্চনা করতে করতে নিপুণ সমাধি দ্বারা বিষ্ণুলোক লাভ করলেন।

হে বিদূর, অন্তর্ধানের পুত্র হবির্ধানের ঔরসে তার পুত্র হরিধানী, বহিষদ, গয়, শুক্ল, সত্য ও জিতব্রত এই ছয়টি পুত্র প্রসব করেন।

হে কুরু বংশধর বিদূর হবির্ধান পুত্র বহিষদ মহা ভাগ্যবান ও প্রজাপালক ছিলেন। তিনি সবসময়ে বিভিন্ন ক্রিয়া কান্ত ও প্রাণায়ামাদি যোগে রত থাকতেন।

তিনি যেস্থানে একটি যজ্ঞ করতেন, তার নিকটবর্তী স্থানে পুনরায় যজ্ঞ করে বসুধাতলকে যজ্ঞবেদীময় করেছিলেন।

তার পূর্বাগ্র কুশ দ্বারা সমগ্র ধরণীতল আচ্ছাদিত হয়েছিল। এজন্য, লোকে এখনও তাকে “প্রাচীনবৰ্হি” বলে থাকে।

তিনি দেবাদিদেব ব্রহ্মার উপদেশে সমুদ্রকন্যা শতদ্রুতিকে বিবাহ করেছিলেন। শতদ্রুতি ছিলেন সর্বাঙ্গ সুন্দরী কিশোরী।

সম্যক ভূষণে সজ্জিতা সেই অপরূপা তন্বী যখন বিবাহকালে অগ্নি শুকীর ন্যায় তাঁকে কামনা করেছিলেন।

এর পূর্বে সপ্তর্বিদের যজ্ঞে তাঁদের পত্নীদের দর্শন করামাত্র অগ্নি কামাতুরা হন। তখন অগ্নিপত্নী স্বাহা সপ্তর্ষি পত্নীদের রূপ ধারণ করে অগ্নিকে তুষ্ট করেন।

পরে তিনি শুকী-রূপিণী হয়ে অগ্নির রেত শারস্তম্ভে রেখে আসেন।

অগ্নি যেমন সপ্তর্ষি ভার্যা- ভ্রমে শুকীতে উপগত হন, তেমনি সত্ৰদ্রুতিতেও কামাতুর হয়েছিলেন।

নব বিবাহিতা বধূ শতদ্রুতি চতুর্দিকে নূপুরের নিক্কন ধ্বনিতে দেব, অসুর, গন্ধর্ব, মুনি, সিদ্ধ, নাগ ও নর সকলকেই ভস্মীভূত করেছিলেন।

কালক্রমে শতদ্রুতির গর্ভে প্রাচীনবৰ্হির দশ পুত্রের জন্ম হয়। তাদের সবার নাম প্রচেতা।

তারা সকলেই সমান ব্রতধারী এবং ধর্মপরায়ণ ছিলেন। পিতা কর্তৃক প্রজা সৃষ্টি করতে অদিষ্ট হয়ে তাঁরা তপস্যার্থে সমুদ্রে প্রবিষ্ট হলেন।

দশ হাজার বছর তপস্যা দ্বারা তপঃ গতি ভগবান বিষ্ণুর আরাধনা করেছিলেন।

অতঃপর পথমধ্যে গিরিশের সাথে দর্শন লাভ হয়। গিরিশ প্রচেতাদের প্রসন্ন হয়ে যে যে উপদেশাবলী দিয়েছিলেন, সংযত দেহ মনে তারা তাঁর ধ্যান, তপ এবং তারই আরাধনা করতে লাগলেন।

বিদূর বললেন– হে ব্রাহ্মণ, পথিমধ্যে প্রচেতাগণের সাথে শিবের যেরূপ সাক্ষাৎকার হয়, তিনি সন্তষ্ট হয়ে তাদের যে সকল উপদেশ প্রদান করেন তা আমাদের বলুন।

হে বিপ্রর্ষে, মুনিগণ সর্বসঙ্গ পরিত্যাগ করে অভীষ্ট শিবের ধ্যান করলেও তার সাক্ষাৎ দর্শন লাভ করেন না। এই সংসারে সেই শিবের সঙ্গে শরীরী পুরুষদের মিলন নিশ্চয়ই দুর্লভ, প্রচেতাগণ কিভাবে তার সাক্ষাৎ লাভ করলেন?

ভগবান শিব আত্মারাম হলেও আত্মকৃত লোক রচনার প্রতিপালনের জন্য সংহারময় মূর্তি ধারণ করে বিচরণ করেন।

মৈত্রেয় বললেন– সদাচার নিষ্ঠ প্রচেতাগণ পিতৃবাক্য শিরোধার্য করে তপস্যার জন্য পশ্চিমদিকে যাত্রা শুরু করলেন।

কিয়ৎ দূরে গিয়ে তারা সমুদ্রের নিকটে এক বিস্তীর্ণ সরোবর দেখতে পেলেন। ঐ সরোবরকে তাঁদের মহৎ হৃদয়ের ন্যায় নির্মল ও প্রসন্ন জলে পূর্ণ বলে মনে হল।

সেই সরোবরে নীলপদ্ম, রক্তপদ্ম, শ্বেতপদ্ম প্রস্ফুটিত ছিল। সেখানে হংস, সারস, চক্রবাক, কারন্তব প্রভৃতি পাখিরা বসবাস করায়, তাদের কাকলীতে ঐ স্থান মুখরিত হয়েছিল।

মৃদুমন্দ বাতাসে পদ্মপরাগ চতুর্দিকে বিক্ষিপ্ত হওয়ায়, এক সুন্দর মহোৎসবের পরিবেশ রচিত হয়েছিল। সেখানে ঐ প্রচেতাগণ মৃদঙ্গপণবাদি বাদ্যের পর মধুর গীত শ্রবণ করে বিস্ময়াভিভূত হয়েছিলেন।

সেই সময়ে ভগবান গিরিশ নিজ পার্যদগণের সঙ্গে ঐ সরোবর থেকে উত্থান করছিলেন। তাঁর গাত্রবর্ণ তপ্ত কাঞ্চনতুল্য। কণ্ঠ নীলাভ এবং লালচে ত্রিলোচন শোভিত

দেবগণ তাঁর চতুর্দিকে বেষ্টন করে স্তব করছিলেন। প্রচেতাগণ সেই প্রসন্ন বদন রুদ্রদেবকে দর্শন করে অভিভূত হয়ে তাঁকে সশ্রদ্ধ প্রণাম করলেন।

ভগবান রুদ্র প্রপত্ৰজনের আর্তি হরণ করেন। প্রণেতাগণের প্রতি তুষ্ট হয়ে ধর্মবৎসল ভগবান ভব তাদেরকে আশীর্বাদ করলেন।

তিনি বললেন– হে বৎস্যগণ, তোমরা বহিষদের পুত্র। তোমরা অতি সুশীল, ধর্মজ্ঞ ও প্রতিমান। তোমাদের অভিপ্রায় আমার কাছে অবিদিত নেই।

তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ প্রকাশের জন্য আমি এইরূপে দর্শন দিলাম। যে ব্যক্তি প্রকৃতি ও পুরুষের নিয়ন্তা ভগবান বাসুদেবের শরণাগত, সেই ব্যক্তি আমার অতি প্রিয়।

স্বধর্মনিষ্ট পুরুষ বহুজন্মের সাধনায় ব্রহ্মত্ব প্রাপ্ত হয়। তারপরে আমাকে লাভ করে। কিন্তু যে ব্যক্তি ভগবৎ ভক্ত, তাঁর দেহান্তেই প্রপঞ্চাতীত বৈষ্ণবপদ লাভ হয়।

এই ব্রহ্মাদি দেবগণ ও আমি, আমাদের অধিকার কাল গত হলে ঐ বৈষ্ণবপদের সন্ধান পাব। তোমরা পরম ভাগবৎ। ভগবান বাসুদেব যেমন আমার প্রিয়, তেমনি আমার প্রতি প্রীতি করবে, এটাই স্বাভাবিক।

অতএব মঙ্গলজনক, পরম পবিত্র ও মোক্ষপ্রদগণের কথা তোমাদের বলছি। এই জল অসংকীর্ণরূপে সাধন করতে হবে।

মৈত্রেয় বললেন– ভগবান রুদ্র এভাবে করুণাঘন চিত্তে তার সামনে প্রণত রাজপুত্রগণকে নারায়ণ পরবাক্য উপদেশ করলেন। রাজপুত্র অর্থাৎ প্রচেতাগণ কৃতজ্ঞলিবদ্ধ হয়ে সশ্রদ্ধ মনে তার বাক্যাবল শ্রবণ করলেন।

রুদ্রদেব স্তব করে বললেন– হে ভগবান, আত্মজ্ঞ-শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিগণের সানন্দলাভের জন্য তোমার উৎকর্ষ সাধিত হয়। অতএব আমার স্বানন্দ লাভ হোক।

তোমার সানন্দরূপতা নিত্য সিদ্ধ। তুমি সর্বদাই নিরতিশয় পরমানন্দ রূপে অবস্থান করছ। অতএব আত্মা এবং সর্ব স্বরূপ। তোমাকে আমরা প্রণাম করি।

হে ভগবান, তুমি পদ্মনাভ। তুমি পঞ্চভূতি পঞ্চত্র ও পঞ্চইন্দ্রিয়ের নিয়ন্তা। তোমাকে নমস্কার করি।

হে প্রভু, তুমি নির্বিকার, শান্ত ও স্বপ্রকাশ, তোমায় আমরা প্রণাম জানাই।

তুমি অহঙ্কারের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা সংকর্ষণ এবং অব্যক্ত, অনন্ত ও অন্তক অর্থাৎ মুখাগ্নি লোকদাহক। তোমাকে আমরা প্রণতি করি।

তুমি নিখিলের প্রকৃষ্ট জ্ঞানদাতা ও বুদ্ধির অধিষ্ঠাত্রী দেবতা প্রদ্যুম্ন। তোমাকে আমরা প্রণিপাত করি।

হে ভগবান, তুমি অনিরুদ্ধ, তুমি ইন্দ্রিয় মনের স্বরূপ, তোমাকে প্রণাম করি।

তুমি পরমহংস অর্থাৎ সূর্যরূপী, তুমি পূর্ণ ও ক্ষয়বৃদ্ধিশূন্য।

তুমি স্বৰ্গমোক্ষের দুয়ারে পবিত্র হৃদয়ে নিত্য বিরাজিত। তোমাকে প্রণাম জানাই।

তুমি অগ্নিরূপী চতুহোত্র কর্মের সাধনভূত। তোমার থেকেই ঐ কর্মের বিস্তার সম্ভব হয়।

তুমিই পিতৃলোকের তন্নউর্জ। তুমিই দেবলোকের অন্ন– ঈষ।

তুমিই ভগবান সোমের স্বরূপ ও দেবলোক ও পিতৃলোকের অন্নরূপ ত্রয়ীপতি। তোমাকে প্রণাম জানাই।

তুমি জলরূপী! তাই সকল জীবের সরস –স্বরূপ তৃপ্তিদান করতে সক্ষম। হে ভগবান, তোমার চরণে প্রণিপাত করি।

হে ভগবান, তুমি পৃথিবীরূপ, তুমি বিরাট মূর্তিস্বরূপ। সমস্ত প্রাণীর আত্মসমূহের দেহরূপী। তুমি ত্রিভূবনপালনকারী। (প্রাণবায়ু-স্বরূপ) তোমাকে প্রণাম করি।

তুমি পিতৃলোক ও দেবলোক প্রাপ্তির নিয়ন্তা, অর্থাৎ প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি কর্মের স্বরূপ, তুমি অধর্মের ফলরূপী দুঃখদায়ক মৃত্যুস্বরূপী, তোমাকে প্রণাম জানাই।

হে ঈশ, তুমি সর্বকর্মের ফলদাতা। তুমিই জ্ঞান ও কর্মের প্রবর্তক। তুমিই সর্বজ্ঞ মন্ত্রময়! তোমাকে প্রণাম করি।

হে প্রভু! পরম ধর্মাত্মা শ্রীকৃষ্ণ, আকুণ্ঠ মেধাবী, পুরাণ পুরুষ এবং সাংখ্যযোগের অধিকর্তা, তোমাকে প্রণাম করি।

তুমি অহংকারীস্বরূপী রুদ্র। তুমি (সত্ত্ব, রজ ও তমঃ) এই ত্রিশক্তির সমন্বয়ের অধিকারী।

তুমিই জ্ঞান ও কর্মের প্রবর্তক। তুমিই বিবিধ বেদবাক্যের প্রকাশক ব্রহ্মরূপী। তোমাকে নমস্কার।

প্রভু, আমরা তোমার রূপ দর্শন করতে ইচ্ছুক। যে রূপ তোমার নিজ ভক্তগণের প্রিয়তম। তোমার যে রূপ ভাগবতগণের পূজিত, তোমার চতুর্বাহুযুক্ত মূর্তি আমাদের নয়নাগোচর হোক। হে ভগবান, তোমার সেই দিব্যকান্তি রূপ আমাদের দৃষ্টিগোচর হোক।

যেখানে পদ্মমধ্যস্থ পত্ৰতুল্য সুন্দর নয়নদ্বয় অবস্থিত। সুন্দর সু, সুন্দর গণ্ডদেশ, সমান কর্ণদ্বয় শোভিত অনিন্দ্যকান্তি রূপ আমাদের সম্মুখে প্রকাশিত হোক।

হে ভগবান, যে রূপ, অপাঙ্গে প্রীতি মধুর হ্যস্যযুক্ত এবং চাঁচর কেশে সুশোভিত তা আমাদের প্রত্যক্ষ হোক।

হে ভগবান, তোমার যে নয়নভিরাম মূর্তি উজ্জ্বল মুকুট, বলয়, হার, নূপুর ও মেখলা দ্বারা সুসজ্জিত এবং শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম, মালা এবং মণিতে সুশোভিত তা আমাদের প্রত্যক্ষ হোক।

তোমার যে রূপে কণ্ঠদেশে সিংহ স্কন্ধতুল্য রমণীয় কান্তি ও কৌস্তভমণি সুশোভিত সেই রূপ আমাদের নয়ন সমুখে প্রকাশিত হোক।

তোমার যে রূপে তুমি লক্ষ্মীদেবীকে বক্ষঃস্থলে ধারণ কর, আমরা সেই পবিত্ররূপের দর্শন চাই।

তোমার যে রূপ, শ্বাস– প্রশ্বাসের গতিতে চঞ্চল বলিসমূহ দ্বারা রমণীয়, ও অশ্বত্থ পত্রতুল্য প্রকাশমান উদর ও গভীর আবর্তযুক্ত নাভি দ্বারা স্ব-সৃষ্ট বিশ্বকে যেন, অভ্যন্তরে প্রবিষ্ট বলে মনে হয়, সেই রূপ আমাদের দেখাও।

তোমার যে অনিন্দ্যসুন্দর শ্যামমূর্তি দীপ্তমান পীতবসনে আচ্ছাদিত ও স্বর্ণময় চন্দ্রহার দ্বারা সুশোভিত, সে রূপের প্রকাশ হোক। তোমার ভূবন মনোহর মূর্তি আমাদের সম্মুখে প্রকাশিত হোক, যেখানে সমাকৃতি চরণদ্বয়, উরু ও অনুন্নত ভানুদেশ বর্তমান।

হে গুরু! তুমি তমোগুণাবলম্বী অজ্ঞ ব্যক্তিদের পথ প্রদর্শক মহাগুরু। তোমার যে রূপ শরতের পদ্ম পাপড়ির মতো চরণদ্বয় দ্বারা শোভিত, যার নখের দীপ্তিতে আমাদের অন্তরের সমস্ত অন্ধকার দূর হয়ে যায়, সেই রূপ আমাদের দেখাও।

যে চরণযুগল ভক্তজনের ভীতি দূর করে, সেই শ্রীচরণকমলের দর্শন দাও।

হে ঈশ, তোমার এই রূপ অতীব দুর্লভ। যে সকল ব্যক্তি আত্মশুদ্ধির ইচ্ছা করেন, তাঁরা সমর্থ হলেও, প্রত্যক্ষ করতে পারেন না।

এই রূপের প্রতি ভক্তিযোগ থাকলে, স্বধর্ম অনুষ্ঠানকারী পুরুষদের অভয় লাভ হয়।

হে প্রভু, যে ব্যক্তি ভক্তিমান, সেই তোমাকে লাভ করতে সমর্থ। কিন্তু তুমি অন্যান্য সফল দেহীর পক্ষে অতি দুর্লভ, দুষ্প্রাপ্য। স্বর্গরাজ্যে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিও তোমার দর্শন লাভে উন্মুখ হয়ে থাকেন।

আবার যে মানব আত্মজ্ঞানী, তিনিও তোমার দর্শন অভিলাষী। সেজন্য আমি তোমার অর্চনা ছাড়া, কোনো কিছুর প্রাপ্তি আশা করি না।

বাস্তবিকই তুমি সাধুপুরুষদেরও দুরারাধ্য। একান্ত ভক্তির দ্বারা আরাধনা করলে কোনো ব্যক্তিই বা তোমার পদতল ছাড়া অন্য সুখাদি অভিলাষ করবে?

হে ভগবান্ ভগব্দভক্তের অতি ক্ষণিকের জন্য সঙ্গের সাথে স্বর্গ এমনকি মোক্ষেরও তুলনা করা অসমীচিন। সুতরাং মরণশীল, মানুষের আশীর্বাদ-রূপ রাজ্যাদি বিষয়ের কথা আর কি বলার আছে?

তোমার চরণদ্বয় সংসারের কারণে গঠিত সকল অনর্থের নিবারক। তোমার কীর্তি– যশ ক্ষরণ– কীর্তন করে, এবং তীর্থে স্নান করে পুরুষের অন্তর ও বাহিরের সকল পাপ বিধৌত হয়। সেইসব সাধুগণের সঙ্গে আমাদের দেখা হোক।

যে ব্যক্তিগণের হৃদয়ে দয়া, সরলতা, গুণ বর্তমান, যারা রাগহীন তাদের সঙ্গে আমাদের দেখা হোক। তাহলেই আমাদের প্রতি তোমার মহৎ অনুগ্রহ প্রকাশিত হবে।

প্রভু, তোমার ভক্তগণের প্রতি ভক্তির মাধ্যমে যার চিত্ত অনুগৃহীত ও বিশুদ্ধ হয়েছে, সে বাহ্যিক বিষয়ে অনুরক্ত বা বিভ্রান্ত হয় না। তার কখনোই তমো গর্তে পতিত হয় না। সেই মননশীল ভক্ত অনায়াসে তোমার স্বরূপ দর্শন করতে পারে।

যার মধ্যে এই দৃশ্যমান বিশ্ব প্রকাশিত এবং বিশ্বমধ্যে যিনি প্রকাশিত, তিনিই পরম ব্রহ্ম। যিনি আকাশের ন্যায় নির্লিপ্তভাবে সর্বত্র ব্যাপ্ত তিনিই পরম জ্যোতি স্বরূপ–তিনিই ব্রহ্ম–পরম তত্ত্ব।

হে ঈশ, যার মায়া অন্যান্য ব্যক্তিদের ভেদবুদ্ধির জন্ম দেয়, তোমাতে ভেদবুদ্ধি জননে অসমর্থ সেই বহুরূপী মায়ার দ্বারা তুমি অবিকৃত থেকেও সমগ্র বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করে চলেছ। আমরা যেন তোমাকে সেই স্বাতন্ত্র পুরুষ বলে জানতে পারি। তুমিই এই বিশ্বের সৃষ্টি, পালন ও সংহার এই তিন কর্মের নিয়ন্ত্রক।

যোগীগণ শ্রদ্ধান্বিত হয়ে সিদ্ধিলাভের উদ্দেশ্যে ভজন– পূজন ইত্যাদি বিভিন্ন ক্রিয়ায় রত থাকেন। তারা এভাবেই ভূত ইন্দ্রিয়াদি অন্তঃকরণ দ্বারা উপলক্ষিত তোমার সাকার রূপের সম্যক্ আরাধনা করে থাকেন।

বেদে ও তন্ত্রে বা আগমে তাঁরাই সুপণ্ডিত।

হে ভগবান্ তুমিই একমাত্র আদিপুরুষ। তোমারই সুপ্ত মায়াশক্তির প্রভাবে রজঃ, সত্ত্ব ও তমঃ– এই ত্রিগুণের বিভিন্নতা উপলব্ধ হয়।

ঐ গুণত্রয় হতে মহতত্ত্ব, অহংকারতত্ত্ব, আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল, পৃথিবী, দেব, ঋষি, ভূতাদি এবং সমুদাত্মক এই বিশ্ব উৎপন্ন হয়ে থাকে। যিনি স্বীয় মায়াশক্তির সাহায্যে চতুর্বিধ শরীর সৃষ্টি করে নিজ অংশ দ্বারা জীব ও অন্তর্যামী এই বিবিধরূপে ঐ সকল মধ্যে প্রবিষ্ট হয়ে থাকেন।

তাকে পুর অর্থাৎ শরীরের অভ্যন্তরে শয়ন হেতু পণ্ডিতগণ দ্বিবিধ পুরুষরূপে কল্পনা করেন। মৌমাছিরা যেমন নিজেদের সৃষ্ট মধুই পান করে থাকে, তেমনি অবিদ্যা আবৃত সংসারী জীব মধু সদৃশ ক্ষুদ্র বিষয়ক সুখ ভোগ করে।

অভোক্তা, সর্বজ্ঞ, ও জীবের সর্বক্রিয়া ও অক্রিয়ায় নিয়ন্তাকে ভগবান বলা হয়।

হে অধীশ, তুমি অলক্ষ্য, অসহ্য, ও প্রচণ্ড বেগশালী কালের ন্যায় ভূতাদি দ্বারা সকল ভূতগণকে সঞ্চালনা কর।

বায়ু যেমন প্রবলবেগে সঞ্চালিত হয়ে মেঘপুঞ্জকে বিচলিত করে, তুমিও এভাবে ভূতাদিকে সঞ্চালিত করে সংহার করে থাকো। লোকগণ বিষয়ের জন্য লোলুপ হয়ে থাকে। এজন্য বিষয় প্রাপ্ত হলেও তাদের ধর্ম লাভ বর্ধি হয় না।

বরং তারা ক্রমবর্ধিত হয়ে ওঠে। তাই তারা কর্মের প্রকার নিয়ে, অর্থাৎ এভাবে কর্ম করব, এই চিন্তায় প্রমত্ত থাকে।

ক্ষুধায় কাতর হয়ে লেলিহান জিহ্বাযুক্ত সর্প মূষিককে আক্রমণ করে, তুমিও স্বয়ং অপ্রমত্ত থেকে ঐ সকল লোভী বিষয়কৃষ্ট ব্যক্তিকে আক্রমণ করে থাকো।

তোমার প্রতি অনাদরে এই শরীর বৃথা ব্যয়িত হচ্ছে, এরকম যাঁর ধারণা আছে, তারা কখনোই তোমার চরণকমল ত্যাগ করবে না। তারা অতি সুপণ্ডিত, মহান ব্যক্তি।

কান দ্বারা বিনাশের আশঙ্কায় আমাদের পূজ্য ব্রহ্মা, তোমার পাদপদ্মের শরণ নিয়ে থাকেন। দৃঢ় বিশ্বাস করে চতুর্দশ মানবও তোমার অর্চনায় নিয়োজিত থাকেন।

হে ব্রাহ্মণ, এই বিশ্ব রুদ্রভয়ে বিনষ্ট হতে বসেছে। তুমি আমাদের গতি হও। হে পরমাত্মন, তুমি আমাদের আশ্রয় হলে অপর কোনো কিছু থেকেই আমাদের ভয়ের কোনো কারণ থাকবে না।

ভগবান রুদ্র এই প্রকারে উপাস্য বস্তুর বর্ণনা করলেন। অতঃপর তিনি স্থির করে এই স্তোত্র জপ করতে থাকেন। তোমাদের কল্যাণ হোক।

যে হরি সর্বভূতে অবস্থান করেন এবং তোমাদের হৃদয়েও অবস্থান করেন, তাকে নিরন্তর জপ, স্তুতি ও ধ্যান কর।

হে রাজপুত্রগণ, তোমাদের আমি এই “যোগাদেশ” নামক স্ত্রোত্র উপদেশ করলাম। এখন তোমরা একে মনোমধ্যে ধারণ করে একাগ্র চিত্তে অভ্যেস কর।

হে প্রচেতাগণ, আমি যে স্তোত্র তোমাদের কাছে উপদেশ করলাম, তা ব্রহ্মাকথিত, ভগবান ব্রহ্মা যখন সৃষ্টিকার্যে উৎসাহিত হয়েছিলেন, তখন আমাদের কাছে এবং সৃষ্টিকার্যে সমপরিমাণে আগ্রহী ভৃগু প্রভৃতি সৃষ্টিকার্যে উৎসাহী হয়েছিলেন, তখন আমাদের কাছে এবং সৃষ্টিকাৰ্য্যে সমপরিমাণে যোগাদেশ করেছিলেন।

সৃষ্টিকার্যে নিযুক্ত হয়ে বহুবিধ সকল প্রজাপতিবৃন্দ এই স্তোত্র পাঠ করেছিল। এর ফলে অজ্ঞানস্বরূপ অন্ধকার বিনাশিত হয়ে বহুবিধ প্রজার উৎপত্তি রয়েছে।

অতএব, বাসুদেব পরায়ণ এবং অবহিত হয়ে, একাগ্রচিত্তে এই স্তোত্র জপ করলে, অচিরেই শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করা সম্ভব।

এই সংসারে সমস্ত শ্রেষ্ঠ বিষয়ের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ও পরম মঙ্গলময় বিষয় হল জ্ঞান। যিনি জ্ঞানরূপ ঐশ্বর্য লাভ করতে পেরেছেন, তিনি অনায়াসে সুখে দুরভিক্রম্য বিপদসঙ্কুল ভবসাগর থেকে উত্তীর্ণ হতে পারেন।

হে প্রচেতাগণ, আমার এই স্তোত্রগান, যে বা যারা শ্রদ্ধাপূর্ণ ভক্তি সহযোগে অধ্যয়ন করবে, তাদের এতেই বিষ্ণুর আরাধনা হবে।

আমি এই যে স্তোত্ৰগান করলাম, এতে ভগবান শ্রীহরি স্তুত হয়ে অতি প্রীত হন। সকল জাগতিক, মহাজাগতিক কল্যাণের একমাত্র কারণ তিনিই।

সেই ভগবানকে তুষ্ট করতে পারলে সকল ইঙ্গিত বস্তু লাভ করা সম্ভব হয়। যে ব্যক্তি ঊষাকালে নিদ্রাভঙ্গ মাত্র শ্রদ্ধাপূর্ণ হৃদয়ে এই স্তোত্র শ্রবণ বা কীর্তন করেন, তিনি বিনা অনায়াসে সংসার বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারেন।

হে নরদেব –নন্দনেরা, পরম পুরুষ পরমাত্মার যে স্তব আমি কীর্তন করলাম, তোমরা তা একাগ্র চিত্তে জপ করে একাগ্র চিত্তে শ্রদ্ধার সঙ্গে মহৎ তপস্যা আচরণ কর। সেই তপস্যা সমাপন হলে তোমাদের অভীষ্ট লাভ হবে।

.

পঞ্চবিংশ অধ্যায়
পুরঞ্জনের কথাচ্ছলে বিবিধ সংসারের বর্ণনা

মৈত্রেয় বললেন–ভগবান রুদ্র এই প্রকারে উপদেশ করলে, প্রচেতাগণ তাকে প্রণাম করলেন। এরপরে তারা ভগবান রুদ্রকে যথাবিধি পূজা করলেন, তাদের আশীর্বাদ করে ভগবান ভব সেখানেই, তাদের চোখের সামনেই অন্তর্ধান করলেন।

তারপর সেই প্রচেতাগণ রুদ্রদেব কর্তৃক গীত ভগবৎ স্তোত্র জপ করতে লাগলেন। দীর্ঘ দশ বছর ধরে তারা এই মন্ত্র জপ করতে করতে জলমধ্যে নিমগ্ন হয়ে তপস্যা করতে লাগলেন।

বৎস বিদুর, এ সময়ে সেই প্রচেতাগণের পিতা প্রাচীনবৰ্হি যাগাজি-কর্মে আসক্ত ছিলেন। আত্মাত্মযোগ দেবর্ষি নারদ তখন তার কাছে উপস্থিত ছিলেন। দেবর্ষি মহারাজকে প্রবোধ দিয়ে তাকে কিছু প্রশ্ন করলেন।

নারদ জিজ্ঞাসা করলেন-হে রাজন, এই কাম্য কর্মের অনুষ্ঠান দ্বারা তুমি আত্মার কিরকম মঙ্গল কামনা করছে। দুঃখ নিবৃত্তি এবং সুখপ্রাপ্তি এই দুই-ই শ্রেয়। কিন্তু তোমার প্রবৃত্তিমার্গে এই কর্মের দ্বারা উহা কখনই লাভ করা সম্ভব নয়।

রাজা প্রাচীনবৰ্হি বললেন– হে মহাভাগ, আমার বুদ্ধি কর্ম দ্বারা, বিক্ষিপ্ত বলে আমি মুক্তিকে পরম শ্ৰেয় রূপে অনুভব করতে পারিনি। আমাকে আপনি নির্মল জ্ঞান উপদেশ করুন, যাতে কর্মসকল থেকে মুক্ত হতে পারি।

কুটিল ধর্মপূর্ণ গৃহে বাস করে জীব, স্ত্রী, পুত্র। ও দনাদিকেই পুরুষার্থ বলে মনে করবে, তাতে মূঢ় ব্যক্তি সংসার পথে ভ্রমণ করে বেড়ায়, পরমার্থ লাভ করতে পারে না।

এরপরে নারদ নিজ যোগবলে যজ্ঞে নিহত পশুদের জীবিত করে তুললেন। তাদের দেখিয়ে নারদ রাজাকে বললেন– হে রাজন, তুমি নিষ্ঠুরভাবে যজ্ঞভূমিতে যে সহস্রাধিক জীব হনন করেছ, এরাই তারা! এরা তোমার মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে। তুমি মরলেই, এদের প্রতি তুমি যে হিংসা করেছ তা স্মরণ করে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে উঠবে। এদের লৌহময় শৃঙ্গের আঘাতে তোমার দেহ ছিন্নভিন্ন হবে। এই সংসার দুঃখ নিস্তারের উপায় বিষয়ে পুরঞ্জনের চরিত্রঘটিত একটি পুরাতন ইতিহাস তোমাকে বলছি, শ্রবণ করো।

হে রাজা, পুরঞ্জন নামে এক মহা যশস্বী রাজা ছিলেন। তার একজন সখা ছিলেন, যাঁর নাম ও কর্ম সকলের অজ্ঞাত ছিল।

পুরঞ্জন– নিজ কর্ম দ্বারা পুর ও শরীরের জন্ম দেন, তিন জীব।

সখা–যাঁর নাম ও কর্ম কেউ জানতে পারে না, তিনি ঈশ্বর।

সেই রাজ পুরঞ্জন উপযুক্ত বাসস্থান অন্বেষণ করতে সমগ্র পৃথিবী পর্যটন করতে লাগলেন।

কিন্তু নিজের পছন্দমতো স্থান অন্বেষণে ব্যর্থ হলেন। এতে তার উদ্বেগ জন্মাল। সেই রাজা বিষয়ভোগের ইচ্ছা করে, সেই কামনা সিদ্ধির নিমিত্ত পৃথিবীতে যত পুর দেখলেন, কোনওটিকেই তাঁর অভিলাষ সিদ্ধির উপযুক্ত বলে মনে করলেন না।

তারপরে পুনরায় ভ্রমণ করতে করতে একদিন হিমালয়ের সানুদেশে (কর্মক্ষেত্র ভারতবর্ষে) সেই সেই বিষয়ভোগের উপযুক্ত চিহ্নবিশিষ্ট ন-টি দ্বারে শোভিত একটি পুর অর্থাৎ মনুষ্য শরীর দেখতে পেলেন।

ঐ পুরী, প্রাচীর, উপবন, অট্টালিকা, পরিখা, গবাক্ষ এবং বর্হিদ্বার মুক্ত। উহা, সর্বত্র স্বর্ণ রৌপ্য ও লৌহনির্মিত শিখরযুক্ত গৃহ সকলে পরিশোভিত ছিল।

ঐ পুরীর বহির্ভাগে একটি দিব্য বৃক্ষলতা-পূর্ণ উপবন ছিল। তার মধ্যে যে জলাশয় ছিল, তা জলচর-পক্ষীগণের কলরবে এবং ভ্রমর ফুলের গুঞ্জনে মুখরিত ছিল। জলাশয়ের তীরবর্তী বৃক্ষাদির শাখা ও পল্লব, শীতল সুরভিত বাতাসে আন্দোলিত হচ্ছিল।

বিভিন্ন অরণ্য জন্তুসকল পরস্পর হিংসা পরিত্যাগ করে সেখানে অবস্থান করাতে, তাদের দ্বারা কোনো উপদ্রবের আশঙ্কা নির্মূল হয়েছিল। ঐ উপবনে কোকিলেরা তাদের কুহুরবে যেন পথিকদের সাদরে অভ্যর্থনা করত।

পুরঞ্জন সেই উপবনে প্রবেশ করলেন। সেখানে তিনি স্বেচ্ছায় আগত এক উত্তমা প্রমদাকে দর্শন করলেন।

সেই প্রমদা ছিলেন বিষয়-বিবেকবর্তী বুদ্ধি-স্বরূপা। সেই যুবতীর সাথে দশজন জ্ঞান ও কর্মেন্দ্রিয় রূপ ভৃত্য ছিল। তারা প্রত্যেকে শত শত বৃত্তিরূপী নায়িকার পতি।

ঐ প্রমদা ছিলেন যুবতী ও কামরূপিণী। পঞ্চমস্তকযুক্ত একটি প্রাণরূপ সর্প তার দ্বারপাল ছিল।

সে সর্বদা ঐ প্রমদার রক্ষণাবেক্ষণ করত। নিজ স্বামীকে অন্বেষণ করতে তিনি ঐ উপবনে আগমন করেছিলেন।

ঐ রমণীর নাসিকা ও দন্ত ছিল অতি সুন্দর। মনোহর কপোলদ্বয়ে অপূর্ব শ্রীমণ্ডিত বদনে সমাকৃতি দুটি কর্ণ দ্বারা তিনি কুন্তলের শোভা ধারণ করেছিলেন।

শ্যামাঙ্গী ঐ তন্বীর কটিদেশে পিঙ্গলবর্ণ বস্ত্র ছিল। সুশোভন নিতম্বের শোভা বৃদ্ধিতে তিনি স্বর্ণময় চন্দ্রহার পরিধান করেছিলেন। তার চরণদ্বয়ের সঞ্চারণে অপূর্ব নিক্কন ধ্বনি শ্রুত হচ্ছিল।

দেবাঙ্গনার ন্যায় তিনি ইতস্ততঃ উদ্যানে বিচরণ করেছিলেন। তার নবেদ্ভিন্ন স্তনদ্বয়ে যৌবনক্রম প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি লজ্জায় সমবৃত্ত ব্যবধানহীন দুটি স্তনকে বারবার আচ্ছাদিত করে ধীরে ধীরে বিচরণ করছিলেন।

ঐ রমণীর স্নিগ্ধ অপাঙ্গদৃষ্টিতে লাজুক স্মিত হাসিতে অপূর্ব শোভা উদ্ভাসিত হয়েছিল। রাজা পুরঞ্জন ঐ যুবতীর স্নিগ্ধ কটাক্ষবাণে বিদ্ধ হয়ে সুললিত হয়ে তাকে প্রশ্ন করলেন।

রাজা বললেন– হে পদ্ম পলাশ-নয়না, হে সতী, কে তুমি? তুমি কার কন্যা? এখানে কোথা হতে তোমার আগমন হয়েছে? হে ভয়শীলে, এই পুরীর সমীপস্থ উপবনে কিসের প্রত্যাশায় তোমার আগমন?

হে সুন্দরী, তোমার সঙ্গে আগত এই একাদশ মহাবলীজন কারা? এই রমণীগণ এবং তোমার অগ্রবর্তী এই সর্প–এরাই বা কারা?

হে সাধ্বী– তুমি কে? তুমি কি লজ্জা? না কি ভবানী? না বাণী? না কি রমা? মুনিগণের ন্যায় সংযত মনে এই বনমধ্যে কি নিজ পতির অন্বেষণে তোমার আগমন হয়েছে? তোমার হস্তধৃত সেই লীলা কমল কোথায় গেল?

হে সুন্দরী! না, তুমি তো দেবরমণী নও। কারণ তোমার পদতল ভূমি স্পর্শ করে রয়েছে। দেবতারা তো কখনও ভূমি স্পর্শ করে থাকেন না। স্বয়ং লক্ষ্মীদেবী যজ্ঞপুরুষ বিষ্ণুর সঙ্গে অবস্থান করে বৈকুণ্ঠপুরীর শোভা বর্ধন করেছেন। তুমিও তেমনি আমার মত বিপুলকৰ্মা বীর শ্রেষ্ঠর সঙ্গে এই পুরীর উল্লাসিত ভ্রাম্যমাণ ভু-দ্বয় প্রেরিত কামদেব, আমাকে অত্যন্ত পীড়ন করছে।

অতএব আমার প্রতি করুণা কর। হে চারুবাসিনী, তোমার মুখমণ্ডল, শোভন ভুদ্বয়ে ভূষিত লোচনদ্বয় মনোহর কারুকার্য অলঙ্কৃত।

তোমার সুদীর্ঘ নীলবর্ণ কেশরাশি অপূর্ব মুখমণ্ডলের শোভা বর্ধন করছে। লজ্জাবনত সুন্দর আনন, আমার অভিমুখ হচ্ছে না, মুখ তুলে একবার আমার দিকে দৃষ্টিপাত কর।

পুরঞ্জন এভাবে অধীর হয়ে ঐ রমণীকে প্রার্থনা করতে লাগলেন। তখন ঐ প্রমদা সহাস্যে বীরবর পুরঞ্জনকে সাদরে সম্ভাষণ করে বাক্যলাপ শুরু করলেন।

তিনি বলতে লাগলেন, হে পুরুষশ্রেষ্ঠ, আমার ও অন্যের কর্তার সন্ধান আমি জানি না। নাম ও গোত্র বিষয়েও আমি কিছু জানি না।

হে বীর, আজ এখানে কোন আত্মা উপস্থিত তা আমার জানা নেই। আমার আশ্রয়স্বরূপ এই পুরীর নির্মাতা কে তাও আমার জানা নেই।

হে মানব, এই নরগণ আমার সখা, এই নারীগণ সকলে আমার সখী। আমার অগ্রভাগে যে পঞ্চশীর্ষ নাগ, সে এই পুরীর রক্ষাকর্তা। আমি যখন নিদ্রিত থাকি তখন এই সর্প জাগ্রত থাকে।

হে অরিন্দম, এ আমার অত্যন্ত সৌভাগ্যের বিষয় যে আপনি এখানে এসেছেন। আপনার কল্যাণ হোক। আপনি যে সকল গ্রাম্যভোগ অভিলাষ করেন, আমি, আমার সখা ও সখীগণের সাহায্যে সেগুলি সম্পাদন করব।

হে প্রভু, আপনি এই নটি দ্বারবিশিষ্ট পুরীতে শত বৎসর অধিষ্ঠান করুন। আমি আপনার অভীষ্ট বস্তু আহরণ করে দিচ্ছি, আপনি তা গ্রহণ করুন।

হে বীর, আমি তোমাকে রতিরসে অনভিজ্ঞ, শাস্ত্রবিহিত সুখভোগে বিমুখ, ইহকাল– পরকালের চিন্তাশূন্য অন্য কোন পশুকুল্য পুরুষের সাথে রমণ করব?

এই গৃহাস্থাশ্রমে ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ, পুত্ৰসুখ, যশ ও লোকশূন্য পবিত্র লোক সিদ্ধ হয়।

সন্ন্যাসীগণ সেসবের নামও জানে না। হে মানব, পণ্ডিতেরা বলে থাকেন, সংসারে যে গৃহস্থাশ্রম, তা পিতৃ, দেব, ঋষি, মানব ও সকল প্রাণীদিগের ও আত্মার কল্যাণকর আশ্রয়।

হে বীর, এই গৃহাশ্রমে আমার মত যুবতীরা না আপনার মতো যশস্বী, মধুরভাষী, প্রিয়দর্শন, স্বয়ং উপস্থিত প্রিয় পুরুষকে পতিত্বে বরণ করতে সদাই আগ্রহী হবে।

হে মহাবাহু, আপনার স্মিত নয়ন কটাক্ষে নিরাশ্রিত ব্যক্তিদের মনের কষ্ট চিরতরে দূরীভূত হয়। একারণেই আপনি সদা ভ্রমণ করতে থাকেন।

নারদ বললেন– হে রাজন, এই প্রকারে সেই দম্পতি পরস্পরের প্রতি ইতিবাচক সঙ্কেত করে পুরীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন। সেখানে প্রবেশ করে তারা শত বৎসর আমোদ প্রমোদ করতে লাগলেন।

পুরীর স্থানে স্থানে গায়কের মনোরম গীত দ্বারা স্কুয়মান ও স্ত্রী– মনে পরিবৃত হয়ে ক্রীড়ারত পুরঞ্জন গ্রীষ্মকালে হৃদিনী প্রবেশ করলেন।

বিভিন্ন বিষয় অনুভবের জন্য ঐ পুরীর ঊর্ধ্বভাগে সাতটি এবং অধোভাগে দুটি দ্বার আছে। পূর্বদিকে একত্রে দ্বার দুটির নাম খাদ্যোতা (অল্প প্রকাশযুক্ত বামনেত্র ও আবিমুখী বহু প্রকাশযুক্ত দক্ষিণনেত্র) এই দুটি দ্বার দিয়ে পুরঞ্জন জ্যমৎ নামক সখার সঙ্গে রূপ– বিষয়ক বিভ্রাজিত দেশে গমন করেন।

এইরূপ-নলিনী ও নালিনী নাম পূর্বদিকের অপর দুটি দ্বারও একত্রে সংলগ্ন। এই দ্বার দুটি প্রকৃতপক্ষে অল্প ছিদ্রবিশিষ্ট বাম নাসা, এবং অধিক ছিদ্রযুক্ত দক্ষিণ নাসা।

পুরঞ্জন এই দুটি দ্বার দিয়ে গন্ধ বিষয়ক দেশ সৌরভে গমন করেন। তার সঙ্গে থাকেন সখা বিধৃত, যিনি ঘ্রাণেন্দ্রিয় সহায়ক জীব। ঐ পুরীর সম্মুখে অবস্থিত পূর্ব দিকের অপর দ্বারটি হল মুখ্যা বা মুখ। এটি প্রধান দ্বার। পুরীস্থিত জীব পুরঞ্জন, এখান দিয়ে আপন ও বহুদিন দেশে গমন করেন। তখন তার সঙ্গে থাকেন রসঞ্জ ও বিপন। তারা যথাক্রমে রসনেন্দ্রিয় ও বাহিন্দ্ৰিয়র সহায়ক জীব।

হে নৃপ, ঐ পুরীর দক্ষিণে পিতৃহু বা দক্ষিণ কর্ণ নামে একটি দ্বার আছে। রাজা পুরঞ্জন শ্রুতধন বা শ্রবণেন্দ্রিয়ের সহায়ক জীবের সঙ্গে ঐ দ্বার দিয়ে দক্ষিণ পচাল রাজ্য, কর্মকাণ্ডে গমন করেন। এই পুরীর পশ্চিমদিকের দ্বারের নাম আসুরী বা শিশ্ন। রাজা পুরঞ্জন, দুর্মদ নামক সখার সঙ্গে মিলিত হয়ে গ্রামক নামক দেশে গমন করেন। গ্রাম্য বিষয়, মৈথুন সুখ বিষয়ক দেশই হল গ্রামক। আবার পশ্চিমদিকেই অবস্থিত অপর একটি দ্বারের নাম নির্ঘাতি বা গুহ্যদ্বার।

রাজা পুরঞ্জন লুব্ধক বা পায়ু নামক সখার সঙ্গে মিলিত হয়ে বৈশাস নাম দেশে গমন করেন। ঐ দ্বারযোগে মলত্যাগ হয়।

হে মহারাজ, এই পুরীমধ্যে যতদ্বার অর্থাৎ ইন্দ্রিয় বর্তমান, তাদের মধ্যে হস্ত ও পদ দুটি অন্ধ। কারণ তাদের কোনও ছিদ্র বা জ্ঞানেন্দ্রিয় নেই। কিন্তু, ইন্দ্রিয়বর্গের অধিষ্ঠাতা পুরঞ্জন, ঐ দুই ইন্দ্রিয় দ্বারা গমন ও কার্য সম্পাদন করেন।

সেই পুরঞ্জন যখন অন্তঃপুরে প্রবেশ করেন, তখন বিমুচীন নামক সখা তার সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে মোহ, প্রসন্নতা, হর্ষ প্রাপ্ত হন। পুত্র ও কত্রের সঙ্গজনিত আসক্তি কামাসক্ত চিত্ত পুরঞ্জনকে অঞ্জের মতো প্রতারত জ্ঞান করে। তখন তিনি রাণীর অনুবর্তী হয়ে পড়েন।

রাণী যখন মদ্যপান করেন, তিনিও তখন তাই করতে থাকেন। রাণী ভোজন করলে, তিনি ভোজন করেন, কোথাও গমন করলে গমন করেন, কোথাও অবস্থান করলে, তিনিও অবস্থান করেন। ঐ মহিষী গান করলে রাজাও গান গাইতে থাকেন। তিনি হাস্য করলে রাজারও মনে পুলক জাগে, তিনি হাস্য করেন। আবার মহিষী রোদন করলে পুরঞ্জনও আকুল হয়ে রোদন করতে থাকেন। রাণী গল্প করলে রাজাও নিজে গল্প করতে থাকেন। তিনি অবস্থান করলে, রাজা অবস্থান করেন। তিনি শয্যাগ্রহণ করলে, রাজাও শয্যাগ্রহণ করেন। তিনি উপবেশন করলে, উপবেশন করেন, শ্রবণ করলে, শ্রবণ করেন, আঘ্রাণ করলে, আঘ্রাণ করেন, দর্শন করলে রাজাও দর্শন করেন।

রমণী শোকাকুল হলে রাজাও শোক করতে থাকেন। ভার্যার আনন্দে রাজার মনে আনন্দ হয়, তিনি মুদিতা হলে নিজে মুদিত হন। রাণীর এবিধ সকল কার্যে অনুবর্তী হয়ে পড়েন।

হে রাজন্ পুরঞ্জন এভাবে মহিষী কর্তৃক প্রতারিত হয়ে নিজের অসঙ্গত্বদি স্বভাব হারিয়ে ফেললেন। যদিও তার পরতন্ত্র হবার ইচ্ছা ছিল না, তবু তিনি ক্রীড়ামৃগ অর্থাৎ বানরের মতো নিজ পত্নীকে অনুসরণ করতে লাগলেন।

জড় প্রকৃতিতে আসক্ত জীব নিজেকে প্রকৃতির গুণ ও কার্যের কর্তা ও ভোক্তা বোধ করে, সকল কর্মে নিয়োজিত হয়।

.

ষড়বিংশ অধ্যায়
পুরঞ্জনের মৃগায়চ্ছলে স্বপ্ন ও জাগ্রদাবস্থা কথনের দ্বারা সংসার বর্ণনা

নারদ বললেন– একদিন মহাধনুর্ধর পুরঞ্জন পাঁচটি অশ্বযুক্ত অতি দ্রুতগামী রথে আরোহণ করে বনের উদ্দেশ্যে গমন করলেন।

এই পাঁচটি অশ্ব ছিল পঞ্চ ইন্দ্রিয় এবং দ্রুতগামী রথ ছিল পুরঞ্জনের স্বপ্নদেহ। সেই রথের দুটি দণ্ড হল অহন্তা ও মমতা।

দুটি চক্র হল পাপ এবং পুণ্য একটি প্রধান তম। সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই তিনটি ধ্বজা ছিল।

পাঁচটি বন্ধন ছিল, যেগুলি প্রাণাদি পঞ্চবায়ু। সেই রথের একটি মহরূপ লাগাম ছিল।

একজন সারথী ছিল– বুদ্ধি। রথীর উপবেশন স্থান ছিল রথী। দুটি যোগ বন্ধন স্থান ছিল শোক এবং মোহ।

পাঁচটি প্রক্ষিপ্ত বস্তু শব্দটি হল শব্দাদি। সাতটি চর্মময় আবরণ হল সপ্তধাতু এবং পাঁচ রকমের গতি অর্থাৎ পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় ছিল।

পুরঞ্জন স্বর্ণালংকৃত রথে আরোহণ করে পাঁচটি সানুবিশিষ্ট বনে অর্থাৎ ভজনীর দেশে গমন করলেন। স্বর্ণধর্ম অর্থাৎ রজোগুণে দেহ আবৃত করে তিনি অক্ষয় তৃণীর গ্রহণ করেছিলেন। সে তুণীর সর্বদা বাণপূর্ণ বাসনাময় ছিল। তিনি অহংকারোপধি মনকে সেনাপতি করে বন গমন করেছিলেন।

সে সময় পুরঞ্জনের মৃগয়া বিষয়ে অত্যন্ত আসক্তির জন্ম হয়েছিল। তখন তিনি অত্যন্ত দম্ভের সঙ্গে ধনুর্বান হাতে নিয়ে ত্যাগের অযোধ্যা পত্নী বিবেকবতী বুদ্ধিকেও পরিত্যাগ করে মৃগয়ায় লিপ্ত হলেন।

যেহেতু তিনি তখন আসুরী বৃত্তি আশ্রয় করেছিলেন, সেজন্য ভীষণ নিষ্ঠুরভাবে বনে বহু পশু হত্যা করলেন।

শাস্ত্রে উল্লিখিত আছে যে, রাজা মৃগয়াপ্রবৃত্তির বশীভূত হলে, বিশেষ বিশেষ শ্ৰাদ্ধ নিমিত্ত অরণ্যে যতটা আবশ্যক কেবলমাত্র তত পশু নিধন করতে পারবেন।

হে রাজন, ঐ বনে মৃগয়ার সময়ে পুরঞ্জন বিচিত্র পক্ষবিশিষ্ট শর দ্বারা অসংখ্য পশুদের দেহ ছিন্নভিন্ন করে দিলেন।

তখন তারা কাতর হয়ে করুণ বিলাপ করতে শুরু করল। সেই নির্মম দৃশ্য দয়ালু ব্যক্তিদের কাছে অত্যন্ত হৃদয়বিদারক মনে হয়েছিল

এভাবে পুরঞ্জন শশক, শূকর, মহিষ, গরু, সজারু এবং বহু পশু হত্যা করেছিলেন। দীর্ঘসময় ধরে মত্ত অবস্থায় মৃগয়ায় লিপ্ত হওয়ায় এক সময়ে তিনি অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। তার শরীরে ক্লান্তি এল, ক্ষুধা তৃষ্ণায় তিনি কাতর হয়ে পড়লেন।

হে রাজন, তখন পুরঞ্জন শিকারে নিবৃত্ত হয়ে গৃহে প্রত্যাগমন করলেন। সেখানে গিয়ে স্নান করে, আহার গ্রহণ করলেন।

এরপরে শয্যায় শায়িত হলেন। এরপরে ধূপ, গন্ধলেপন ও মাল্যাদি গ্রহণ করে নিজেকে সুসজ্জিত করলেন।

এভাবে হৃষ্টপুষ্ট ও পরিতৃপ্ত হয়ে তার মন কামাতুরা হয়ে উঠেছিল।

তখন তিনি স্বীয় মহিষীকে স্মরণ করলেন। কিন্তু কোথাও তাকে দেখতে পেলেন না। সাত্ত্বিকী বুদ্ধিস্বরূপা ভার্যাকে কোথাও দেখতে না পেয়ে পুরঞ্জন অন্যমনস্ক হয়ে অন্তঃপুরবাসিনী সখীদের ডেকে পাঠালেন।

পুরঞ্জন তাদের প্রশ্ন করলেন– তোমাদের স্বামিনীর সঙ্গে তোমাদের সব কুশল তো? আমার পুরস্থিত সম্পদ আগের মতো রুচিকর মনে হচ্ছে না, কেন?

যে গৃহে মাতা বা পতিব্রতা স্ত্রী অবর্তমান, সেখানে কোনও পণ্ডিতই দীনভাবে বাস করতে চান না। সে গৃহ চক্রবিহীন রথের ন্যায় অচল।

যিনি প্রতি পদে স্বীয় বুদ্ধিতে আমাকে চালনা করতেন, আমি বিপদে পড়লে আমাকে চালনা করতেন তিনি কোথায়?

সেই বুদ্ধিমতী নিষ্ঠাবতী ললনাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন? অন্তঃপুরবাসিনী বামাগণ উত্তর দিলেন– হে নরশ্রেষ্ঠ! আপনার প্রেয়সীর অভিপ্রায় আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না, হে রাজা! ঐ দেখুন তিনি ভূতলে নিতান্ত অনাদরে শায়িত আছেন।

নারদ বললেন– হে রাজন! পুরঞ্জন সেদিকে দৃষ্টিপাত করে নিজ মহিষীকে দর্শন করলেন। কিন্তু প্রিয়াকে দেহের প্রতি অনাদরে ভূমিতে শয়ান দেখে তার সঙ্গলাভের জন্য পুরঞ্জন অত্যন্ত অধীর হয়ে উঠলেন।

তিনি পত্নীর নিকটে গমন করলেন। ব্যথিত চিত্তে মধুর বাক্য দ্বারা প্রেয়সীকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন।

কিন্তু প্রণয়কোপের কোনো কারণ দেখতে পেলেন না।

তখন বীরপুঙ্গব পুরঞ্জন, ধীরে ধীরে অনুনয় করে প্রেয়সীর মানভঞ্জন করতে লাগলেন।

রাজা স্বীয় পত্নীর পাদস্পর্শ করলেন, পরে তাকে কোলে নিয়ে ধীরে ধীরে বলতে লাগলেন– হে শোভনে, অপরাধ করা যে সকল ভৃত্যকে প্রভু শাস্তি দেন না, আমার মনে হয় তারা অতি দুর্ভাগা। কারণ প্রভু নিশ্চয়ই তাদের নিজের লোক বলে মনে করেন না।

হে প্রিয়ে, ভৃত্যদের প্রতি প্রভুর দণ্ডবিধান তো দণ্ড নয়, তা পরম অনুগ্রহ। কিন্তু অবোধ ক্রোধী বালক তা বুঝতে পারেন না।

প্রভু যে পরমাত্মীয়ের কাজ করেছেন তা বুঝতে সে সক্ষম হয় না। হে সুদতি, হে মনস্বনি, তুমি আমাদের প্রভু, আমরা তোমার আত্মীয়।

আমাদের প্রতি করুণা করে একবার তোমার বদনকমলের দর্শন দাও।

এখন তোমার লজ্জিত অনুরাগে আনিত বদনে সহাস্য দৃষ্টি ঝলসিত হচ্ছে। ঐ মুখকমলে অলকাদি অলির ন্যায় শোভিত হয়েছে। অনুগ্রহ করে তোমার সুন্দর নাসিকাযুক্ত, মধুর বাক্য প্রকাশনী ও মুখখানি আমার দিকে দেখাও।

হে সুন্দরী, একবার বলো, কে তোমার কাছে কি অপরাধ করেছে? সে যদি ব্রাহ্মণ ও ভগবান না। ষড় রিপুর দাস না হয়, তাহলে এখন তার দণ্ডবিধান করব।

কিন্তু ত্রিভুবন মধ্যে বা বাহিরে এমন তো কোনও নির্ভয় লোক দেখছি না, যে কিনা আমার দণ্ডের ভয় করে না। এমন কোনো ব্যক্তি আছে, যে, হৃষ্টচিত্তে অবস্থান করতে পারে?

হে সুন্দরী, একবার বলো, কে তোমার কাছে কি অপরাধ করেছে? এরকম তো আগে কখনও দেখিনি। কেন তুমি এরকম তিলকহীন, কোপাবেশ, ভয়ঙ্কর হয়েছ? কেন তোমার এমন স্নেহহীন ও অনুজ্জ্বল রূপ লক্ষ্য করছি?

তোমার এই সুস্নাত স্তনদ্বয় অশ্রুতে সিক্ত কেন? হে সুন্দরী, তোমার এই বিম্বলাকৃতি অধর তাম্বুলারাগে রঞ্জিত করোনি কেন?

তোমাকে না জানিয়ে আমি মৃগয়ায় গিয়েছিলাম। আমি তোমার কাছে অপরাধী প্রিয়ে। তবু আমার প্রতি তুমি প্রসন্ন হও। আমি তোমার বন্ধু।

হে কান্তে, যে কান্ত বশবর্তী এবং অনঙ্গবাণে যার দৈর্ঘ্য বিধ্বংস হয়, সেরূপ স্বামীকে কোনো রমণী যথোচিত বিষয়ে ভজনা করে কি থাকতে পারে?

হে প্রিয়ে, অনুগ্রহ করে আমার প্রতি অভিমান পরিত্যাগ কর।

.

সপ্তবিংশ অধ্যায়
পুরঞ্জনের আত্মবিস্মরণ

নারদ বললেন–হে মহারাজ প্রাচীনবৰ্হি, সেই পুরঞ্জনী এভাবে হাবভাব বিলাস দ্বারা নিজ পতি পুরঞ্জনকে সম্যভাবে বশীভূত করে ফেললেন।

এভাবে তিনি রাজার সঙ্গে ক্রীড়ায় লিপ্ত হলেন।

হে রাজন, সুস্নাতা, মনোহর বসন পরিহিতা, কুমকু সিন্দুরাদি দ্বারা কৃতমঙ্গলা মহিষী রাজার কাছে উপস্থিত হলেন। পান-ভোজন দ্বারা পরিতৃপ্ত হয়ে মহিষীকে রাজা পুরঞ্জন তাঁকে সাদরে অভিনন্দিত করলেন।

রাজা পুরঞ্জন স্ত্রৈণের মতো মহিষীর স্কন্ধদেশ ধারণ করে, তার সঙ্গে রহস্য কথা বলতেন, এতে তার যাবতীয় বিবেকবুদ্ধি লোপ পেল। দুর্জয় কাল যে তার আয়ু হরণ করছে, দিনরাত চলে যাচ্ছে, তাও তিনি বুঝতে পারলেন না। যদিও পুরঞ্জন মহামনা ছিলেন, তবুও মান্ধ হওয়ায় মহার্ঘ শয্যায় স্ত্রীর ভূজে শায়িত হয়ে তাকেই পরম পুরষার্থ বলে মনে করতে লাগলেন।

এভাবে তিনি নিজ স্বরূপ, এমনকি পরমাত্মার স্বরূপও বিস্মৃত হলেন।

হে রাজেন্দ্র, এভাবে কামাসক্ত চিত্তে নিজ স্ত্রীর সাথে ক্রীড়ারত অবস্থায়, তার নবীন বয়স ক্ষণার্ধের ন্যায় অতিক্রান্ত হয়ে গেল। অতঃপর পুরঞ্জন নিজ মহিষীর গর্ভে একশো দশ পুত্রের জন্ম দিলেন। এতে তার পরমায়ুর অর্ধাংশ বিনষ্ট হল।

তারপরে পুরঞ্জনের একশো দশটি কন্যার জন্ম হল। পুরঞ্জনের কন্যা বলে তারা পৌরঞ্জিনী নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁরা প্রত্যেকেই সচ্চারিত্র ও উদার ছিলেন। তার পিতামাতার যশ বহুগুণে বর্ধিত করেছিলেন। সেই পাঞ্চালপতি পুরঞ্জন নিজ পুত্রদের উপযুক্ত ভার্যাদের সঙ্গে বিবাহ দিলেন। পুরঞ্জন নিজ কন্যাদেরও উপযুক্ত পাত্র দেখে বিবাহ দিলেন।

হে রাজ, পুত্রদের প্রত্যেকের শত শত পুত্রের জন্ম হয়েছিল। এর ফলে পাঞ্চালরাজ্যে পুরঞ্জনের বংশবিস্তার হল।

হে রাজন, সেই পুত্র, পৌত্র, গৃহে ঐশ্বর্য ও পালিতগণের প্রতি পুরঞ্জনের প্রগাঢ় মায়ার জন্ম হল। সেই বিষয়ী মায়ার প্রভাবে পুরঞ্জন বিষয়ে আবদ্ধ হলেন।

তিনি তখন বিভিন্ন পশু হননকারী যজ্ঞে দীক্ষিত হলেন। এভাবেই পুরঞ্জন নানাবিধ কামনায় দেবতা, পিতৃ ও ভূপতিগণের আরাধনা করতে লাগলেন।

এইরকম কুটুম্বাসক্তচিত্ত পুরঞ্জন আত্মাহিত বিষয়ে অনবধান থাকা অবস্থায় তার বার্ধক্য উপনীত হল। এই বার্ধক্যকাল কর্মবীর ব্যক্তিদের অত্যন্ত অপ্রিয়।

হে রাজ, চণ্ডবেগ নাচন এক বিখ্যাত গন্ধর্বপতি আছেন। তাঁর তিনশো ষাট জন বলবান গন্ধর্ব। বা দিবস আছে। ঐ চণ্ডবেগের তিনশো ষাট জন গান্ধর্বীও আছে। যথাক্রমে তারা শুক্লবর্ণা ও কৃষ্ণবর্ণা। ঐ গন্ধর্বগণ মিথুন হয়ে অবস্থান করে এবং পরিভ্রমণ দ্বারা সকল কাম– সহ পুরী অর্থাৎ দেহকে অপরহণ করে।

হে রাজন, চণ্ডবেগের অনুচর ঐ গন্ধর্বগণ পুরঞ্জনের পুরী বা দেহ পূরণ করতে শুরু করল, সেখানে অধিষ্ঠিত প্রজাগণ সর্প, তাদের প্রতিহত করতে লাগল।

কিন্তু গন্ধর্ব ও তাদের ভার্যাদের মোট সংখ্যা হল সাতশো বিশ। তবু পুরঞ্জনের পুরী রক্ষক তাদের সঙ্গে বীর বিক্রমে যুদ্ধ করতে লাগল। সে এক শতবর্ষ পর্যন্ত সংগ্রাম করার পরে, শেষে ক্ষীণ হয়ে পড়ল।

পুরঞ্জন নিজ পুরাধ্যক্ষের প্রাণকে ক্ষীণ হতে দেখে অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তিনি নিজে পুরী, রাষ্ট্র ও আত্মীয়দের চিন্তায় অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে পড়লেন।

পুরঞ্জন ছিলেন স্ত্রী পরায়ণ, তাই তিনি তুচ্ছ সুখে আবিষ্ট হয়ে সংগৃহীত বস্তুসকল নিজ পুরীতেই গ্রহণ করতেন। তিনি ভয় বলে কিছু জানতেন না।

হে বহিৰ্মান, পূর্বে যে কালের কথা আপনাকে বলেছি, তার একটা কন্যা আছে। তার নাম জরা। সে নিজ পতির অন্বেষণে ত্রিলোক পরিভ্রমণ করেছিল। কিন্তু কেউ তাকে বিবাহ করতে স্বীকৃত হয়নি।

এই দুর্ভাগ্যের কারণে সেই কন্যা লোকমধ্যে দুভার্গা’, বলে পরিচিত হয়েছিল। পূর্বকালে রাজর্ষি পুরু তার পাণিগ্রহণে রাজী হয়েছিলেন। এতে জরা তুষ্ট হয়ে তাঁকে রাজ্য পাইয়ে দিয়েছিলেন।

একদিন ঐ কন্যা ভ্রমণ করতে করতে আমাকে দেখতে পেল। আমি যখন সদ্য ব্রহ্মলোক থেকে মর্ত্যলোকে আগমন করেছিলাম। আমাকে দেখেই সে নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী হিসাবে জানা সত্ত্বেও কামমোহিত হয়ে আমাকে বরণ করল।

আমি তাকে প্রত্যাখান করাতে সে আমার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়ে অভিশাপ দিল। দুঃসহ বিরাট সে অভিশাপ। সে আমাকে বলল– “হে মুনিবর, তুমি আমার প্রার্থনা পূর্ণ করতে পরাজুখ হলে, সেজন্য তুমি কোনদিন এক জায়গায় সুস্থির হয়ে থাকতে পারবে না।”

বিফল মনোরথ সেই কন্যাকে আমি যবনেশ্বর ভয়ের কাছে যেতে বললাম। যবনেশ্বরের কাছে গিয়ে সে বলল– হে বীর! তুমি যবনদের সর্বশ্রেষ্ঠ। বীর! তুমি আমার বাঞ্চিত পতি। আমি তোমাকে বরণ করলাম, প্রাণীগণের কৃত সঙ্কল্প তোমাকে কখনও বিফল হবেনা। হে বীর! লোকে ও শাস্ত্রে যে বস্তু প্রদেয় ও গ্রাহ্য বলে না স্বীকৃত, প্রার্থনা করলে যে না দেয়, এবং কেউ দিলে গ্রহণ না করে, সেই দুপ্রকার ব্যক্তিই অজ্ঞ। তাদের জন্যই লোকে শোক করে থাকে। অতএব হে ভদ্র, আমি আপনার পাণিগ্রাহী। দয়া করে আমাকে গ্রহণ করুন আর্ত ব্যক্তিকে অনুকম্পা করাই পুরুষের শ্রেষ্ঠ কর্তব্য কর্ম।

হে রাজন, কালকন্যা জরার মুখে এই উক্তি শুনে যবনেশ্বর মৃত্যু তাকে স্বীকার করলেন। হাস্যমুখে প্রসন্ন হয়ে তিনি বললেন– আমি জন্মান দৃষ্টির সাহায্যে ইতিমধ্যেই তোমার ভোগস্থান নিরূপন করেছি।

তুমি সকলকে প্রার্থনা করছ বটে, কিন্তু কেউই তোমাকে গ্রহণ করতে রাজী নয়। তারা তোমাকে অভদ্রা ও অম্লতা বলে জানে। তুমি অদৃশ্যভাবে গমন করে কর্মফল লব্ধ লৌকগমকে উপভোগ করো। এভাবেই সকলকে তুমি পতিত্বে গ্রহণ করতে পারবে। তোমাকে প্রতিকুল্য দেখে লোকে বধ করবে, এরকম আশঙ্কা কোরো না।

বরং আমার অসংখ্য যবন সেনারা তোমার সঙ্গে যাবে। তারা হল আধি-ব্যাধি স্বরূপ। এই আধি– ব্যাধি রূপ যবন সৈন্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তুমিই প্রজানাশ করে আসবে। এ বিষয়ে আমি নিঃসংশয়।

এই দেখ, এই হলো আমার ভ্রাতা। তুমিও আজ থেকে আমার ভগ্নী হও, জরা! আমি স্বয়ং ভয়ঙ্কর যবন সৈন্যদল সঙ্গে নিয়ে তোমাদের সঙ্গে যাব। সকলের অলক্ষ্যে মর্ত্যলোকে বিচরণ করতে থাকব।

.

অষ্টাবিংশ অধ্যায়
পুরঞ্জনের স্ত্রীত্ব-প্রাপ্তি ও মুক্তিলাভ

নারদ বললেন–হে বৰ্হিহ্মণ, ভয় নামক যে সকল সেনা মৃত্যুর আদেশকারিণী, তারা প্রজ্বার ও কাল কন্যার সঙ্গে সমগ্র পৃথিবীতে বিচরণ করতে লাগল।

হে রাজন, ঐ সৈন্যগণ একদিন পার্থিব ভোগ্যবস্তু পূর্ণ পুরঞ্জনের পুরীতে আক্রমণ করল। তখন এ পুরী জীর্ণ সর্প দ্বারা রক্ষিত ছিল। কালকন্যা দ্বারা অভিভূত হলে পুরুষ নিঃসার হয়ে পড়ে। সেই কালকন্যা বল প্রয়োগ করে পুরঞ্জনের পুরী ভোগ করতে লাগল।

যবন সেনানীরা দ্বারসকল দিয়ে সর্বত্র প্রবেশ করে কালকন্যা দ্বারা উপভোগরত পুরীকে প্রচণ্ড, পীড়া দিতে লাগল। পুরীতে এই রকম পীড়া আরম্ভ হলে আত্মীয় –কুটুম্বাদির প্রতি মমতায় আকুল ও অভিমানী পুরঞ্জন নানাবিধ তাপ ভোগ করতে লাগলেন। পরে ঐ কালকন্যা গিয়ে পুরঞ্জনকে আলিঙ্গন করল।

তখন তার শরীরের শ্রী নষ্ট হয়ে গেল। তিনি অতি দীন –হীন হয়ে পড়লেন। তারপরে গন্ধর্ব ও যবনগণ বলপ্রয়োগ করে তার সমস্ত ঐশ্বর্য হরণ করে নিল। কিন্তু, তিনি উত্থান শক্তি রহিত হওয়ায় কোনও প্রতিকার করতে অসমর্থ হলেন।

তারপরে পুরঞ্জন নিজ পুরীকে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখতে পেলেন। তিনি দেখলেন পুত্র, পৌত্র সকল অনুচরবৃন্দ ও অমাত্যগণ তাঁর প্রতি প্রতিকূল, অনাদরকারী পত্নী স্নেহবন্ধন ছিন্ন করেছে। স্বয়ং কালকন্যার কবলে পড়েছেন এবং পাঞ্চাল দেশও শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে।

এবিধ ঘটনাবলী দেখে তিনি দুস্তর চিন্তায় আচ্ছন্ন হলেন। কিন্তু এই দুঃখের প্রতিকারের কোনও উপায় দেখতে পেলেন না। জরাহত ক্ষুধামান্দ্যর কারণে ভোগ্যবস্তুর নিঃসার হওয়া সত্ত্বেও তাকেই কামনা করতে লাগলেন। যদিও আত্মার পারলৌকিক গতি ও ঐহিক পুত্রাদি সন্তান স্নেহ বিগত হয়েছিল, তবুও পুত্র কলের লালন পালনে তিনি ব্যস্ত হয়ে রইলেন।

তারপরে নিজ পুরীকে গন্ধর্ব ও যবন সেনার হাতে আক্রান্ত এবং জরার হাতে নিপীড়িত দেখে নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঐ পুরী ত্যাগের উপক্রম করলেন। তখন ভয়ের অগ্রজ ভাই প্রজ্বার বা বৈষ্ণব জর তাঁর নিকটে আগমন করল। ভাইয়ের প্রিয়কার্য সম্পাদনের সঙ্গে পুরী সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দিল।

হে রাজন, ঐ পুরী দগ্ধ হতে থাকলে কুটুম্বাদির সঙ্গে ক্রীড়ারত পুরঞ্জন, পুরবাসী, ভৃত্যবর্গ, পুত্রাদি ও পত্নীর সঙ্গে অতি সন্তাপিত হলেন।

কালকন্যা জরা পুরঞ্জনের পুরীকে গ্রাস করলে, ঐ পুরীর পালক প্রাণ প্রজার কর্তৃক সংস্পৃষ্ট হয়ে সন্তপ্ত হতে লাগল।

যবনেরা তার আয়তন রুদ্ধ করে দেওয়ায় সে মহাসঙ্কটে পতিত হয়েছিল। ঐ পুরীর দ্বার– রক্ষকবৃন্দ অত্যন্ত কষ্ট ও গুরুতর কম্প প্রাপ্ত হল। তারা পুরী রক্ষা করতে সমর্থ হল না।

সর্প যেমন বৃক্ষ, কোটরে অগ্নি-সংযুক্ত হলে, সেস্থান পরিত্যাগ করে, তিনিও তেমনি পুরঞ্জনের পুরী ত্যাগ করতে ইচ্ছা করলেন। এভাবে যখন গন্ধর্বগণ পুরঞ্জনের পৌরুষ হরণ করে নিল। তার অঙ্গাদি শিথিল হয়ে এল।

শত্রু যবন সেনারা তাঁর কণ্ঠরুদ্ধ করল তখন তিনি রোদন করতে লাগলেন। তার সেই ক্রন্দন ধ্বনি ঘর ঘর ধ্বনির মতো শ্রুত হয়েছিল।

কুমতিগ্রস্ত পুরঞ্জন কন্যা, পুত্র, পৌত্র, পুত্রবধূ ও জামাতা পার্ষদগণ এবং অন্য বস্তুসামগ্রী যেমন, গৃহ, ধনাগার, পরিচ্ছদ ইত্যাদিতে “আমি” ও “আমার” ইত্যাদিতে মমতাবশতঃ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন।

পরে প্রমদার সঙ্গে বিযোগ উপস্থিত হলে, নিতান্ত দীনভাবে চিন্তা করতে লাগলেন যে, তিনি লোকান্তর গমন করলে তার প্রিয়জনের কি দুর্দশা হবে!

নিজ পত্নীর বিষয়ে তিনি চিন্তা করতে লাগলেন– আমি এই দেহত্যাগ করলে আমার স্ত্রী তো অনাথ হয়ে পড়বেন। পুত্রকন্যাদের দুরবস্থা দর্শন করে, তার শোকের অন্ত থাকবে না।

আহা, যে নারী আমার অগ্রে ভোজন করেননি, কোনদিন আমি ক্রুদ্ধ হলে তিনি ভীতা হতেন। যখন আমি ভর্ৎসনা করেছি, নীরব থেকেছেন, প্রত্যুত্তর করেননি। আমার বিবেক নষ্ট হলে, ইনি প্রবোধ দিতেন, আমি বিদেশে গেলে, আমার অদর্শনে কৃশাঙ্গী হয়ে পড়তেন; তিনি এখন বীর প্রসবিণী হয়েও আমার বিরহে কাতর হয়ে পড়বেন। তখন তিনি এবিধ গৃহকর্মে আর প্রবৃত্ত হবেন কি?

আমি মারা গেলে, আমার এই পুত্রকন্যাকণ পর-প্রত্যাশী হয়ে, কিভাবে জীবন-ধারণ করবেন? মাঝসমুদ্রে নৌকা বিপর্যস্ত হলে, মাঝির অভাবে আরোহীগণ যেমন বিপদগ্রস্থ হয়, তাদের সেরূপ অবস্থা হবে।

হে রাজন, পুরঞ্জনের পুরীমধ্যে যে ভুজঙ্গম আবদ্ধ ছিল, সে পুরী ত্যাগ করে চলে গেল। তখন ঐ

পুরী বিশীর্ণ হয়ে অতি অল্পকালের মধ্যেই প্রকৃতিতে বিলীন হয়ে গেল।

হে মহারাজ, বলবান যবন সেনারা যখন পুরঞ্জনকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন তিনি অজ্ঞান অন্ধকারে আচ্ছন্ন ছিলেন।

সে সময় তিনি তার পূর্বসখা ও পরম হিতকারী পরমেশ্বরকে স্মরণ করতে পারেননি। তিনি নির্দয়ভাবে যজ্ঞস্থলে যে সমস্ত পশুকে হনন করেছিলেন, তারা অতি ক্রুদ্ধ হয়ে পুরঞ্জনকে আক্রমণ করল।

পুরঞ্জনের নিষ্ঠুরতা স্মরণ করে তারা কুঠার দিয়ে তাকে ছিন্নভিন্ন করতে লাগল। স্ত্রী সঙ্গ দোষে– অসীম অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে পুরঞ্জনের পূর্বস্মৃতি নষ্ট হয়ে গেল।

সে অবস্থায় তিনি বহু বছর যাতনা ভোগ করতে লাগলেন।

পুরঞ্জন স্ত্রী চিন্তা করতে করতে দেহত্যাগ করেছিলেন। সেজন্য যমালয়ে স্বীয় কৃতকর্মের যোগ্য ফল ভোগ করার পরে, তিনি বিদর্ভ- কাজের প্রমদা হয়ে জন্মগ্রহণ করলেন।

তারপর পণ্ডাশোধিপতি শত্রুর পুরী বিজয় মলয় ধ্বজ যুদ্ধে সমবেত ক্ষত্রিয়দের পরাস্ত করে বীর্যশুল্কা বিদর্ভরাজকন্যাকে বিবাহ করেন।

মলয় ধ্বজ কথাটির অর্থ–মলয়োপলক্ষিত দক্ষিণদেশে ধ্বজতুল্য দর্শনীয় অর্থাৎ ঐ দেশ বিষ্ণুভক্তি প্রধান। সেই অঞ্চলের প্রধান ব্যক্তি ছিলেন মলয়ধ্বজ, তার নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি ছিল। সেজন্য পুরঞ্জন স্ত্রীজন্ম হওয়া সত্ত্বেও ঐ ব্যক্তির সঙ্গলাভ করে, ভাগবত– সঙ্গলাভ করতে সমর্থ হলেন।

মহাভাগবত মলয়ধ্বজ এবং বিধর্ভ রাজকন্যার গর্ভে এক কন্যার জন্ম হল। সে কন্যা ছিলেন অসিতেমনা, অর্থাৎ তাহা হতে শ্রীকৃষ্ণের দর্শন হয়।

মলয়ধ্বজের পত্নীর গর্ভে সাত পুত্রের জন্ম হয়। তাঁরা হলেন শ্রবণ, কীর্তন, স্মরণ, পদসেবন, অর্চন, বন্দন ও দাস্যরূপ এই সাত প্রকার ভক্তি। এই সাত পুত্র, সাতটি দ্রাবিড় দেশের অধিপতি হন।

হে রাজন, ইহা লোক প্রসিদ্ধ যে সপ্তভক্তির দ্বারাই দ্রাবিড় দেশটি সুরক্ষিত আছে।

হে রাজন, এই সাত পুত্রের প্রত্যেকের অবুদ অর্বুদ সন্তান হয়। তাঁদের বংশধরগণ নিখিল বিশ্বকে মন্বন্তরকাল এবং তার পরেও ভোগ করবে। শ্রবণাদি ভক্তির প্রকার থেকেই বিধি সম্প্রদায় প্রবৃত্ত হয়। তারা অবিদ্যা, কাম, কর্ম থেকে পৃথিবীর লোকসকলকে রক্ষা করবে।

অগস্ত্যমুনির সঙ্গে মলয়ধ্বজের প্রথমা কন্যার বিবাহ হয়। সেই কন্যার গর্ভে দৃঢ়চ্যুত নামে এক মুনির জন্ম হয়। তার থেকে আবার ইক্ষবাহু নামক সন্তানের জন্ম হয়।

অগস্ত্য শব্দের অর্থ হল মন। অতএব পুরঞ্জনের মন কৃষ্ণ সেবারুচিকে গ্রহণ করল। অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণে আসক্ত হল।

অনন্তর রাজর্ষি মলয়ধ্বজ পুত্রগণকে রাজ্যবিভাগ করে দিয়ে শ্রীকৃষ্ণ আরাধনার বাসনায় কলাচলে গমন করলেন। অর্থাৎ তিনি শ্রবণাদি ভক্তিবেদ ব্যবস্থা করে ভগবৎ সেবার্থে যাত্রা করলেন।

স্ত্রী সুলোচনা বৈদভী, তাঁকে অনুগমন করলেন। জ্যোৎস্না যেমন সর্বদা চন্দ্রকে অনুসরণ করে, বৈদভীও তেমনি পন্ডদেশাধিপতি মলয়ধ্বজের অনুগমন করলেন।

হে রাজন, মলয়ধ্বজ তপস্যার জন্য একটি নির্জন স্থানে গমন করলেন। সেখানে চন্দ্ররসা, তাম্ৰপর্নী ও বটোদকা নামে তিনটি নদী প্রবাহিত ছিল।

তিনি ঐ পুণ্য নদীজলে প্রত্যহ স্নান করতেন। কন্দ, বীজ, ফল, মূল, পুষ্প, পত্র, তৃণ ও জল দ্বারা নিজ জীবনধারণ করতেন।

ধীরে ধীরে যাতে তাঁর শরীর ক্ষয় হতে পারে, তিনি এরূপ ব্যবস্থা তপস্যায় প্রবৃত্ত হলেন।

শৈত্য, উষ্ণতা, বাত, বর্ষ, ক্ষুধা, তৃষ্ণা, প্রিয়, অপ্রিয়, সুখ-দুঃখ এই সমস্ত দ্বন্দ্বকে তিনি জয় করেছিলেন। সর্বত্র তার সমান দৃষ্টি ছিল।

তিনি তপস্যা, উপাসনা বিবিধ নিয়ম ও শদমাদির দ্বারা কামনা বাসনাকে দগ্ধ করলেন। ইন্দ্রিয়, প্রাণ ও মনকে জয় করে পরমাত্মাতে তার চিত্ত সমাহিত হল।

তিনি স্থানের মতো একস্থানে স্থিরভাবে দিব্য শত বছর অবস্থান করলেন।

সেই সময় তিনি ভগবান বাসুদেব রতি নিযুক্ত করায়, তাঁর দেহাদি প্রভৃতি কোনো বিষয়ের জ্ঞান ছিল না।

স্বপ্নে শিরচ্ছেদ হলে যেমন আত্মাকে দেহ অপেক্ষা ভিন্ন বলে বোধ হয়, সে রকম পরমাত্মাকে দেহাদি-প্রকাশক এবং দেহাদি থেকে পৃথক বোধ করে তিনি অপর সমস্ত বৃত্তি থেকে বিরত হলেন।

সাক্ষাৎ ভগবান হরি, গুরুরূপে তাকে বিশুদ্ধ জ্ঞান উপদেশ করাতে তার সেই জ্ঞান সর্বতোভাবে দীপ্তিমান হয়ে উঠল। মৃত্যুকালে তিনি পরব্রহ্মে নিজেকে এবং আপনাতে

পরব্রহ্মকে অবলোকন করে। এবং সংসার দর্শন পরিত্যাগ করলেন। সংসার থেকে মুক্তিলাভ করলেন।

তার স্ত্রী পতিব্রতা বৈদভী। তিনি যাবতীয় ভোগ্যবস্তু পরিত্যাগ করলেন এবং ভক্তিভরে পরম ধর্মজ্ঞ পতি মলয়ধ্বজের সেবা করছিলেন।

তিনি জীর্ণ বসন পরিত্যাগ করেছিলেন। নানাবিধ ব্রত আচরণের ফলে তার শরীর কৃশ হয়েছিল। সংস্কার ও পরিমার্জনার অভাবে তার সুমধুর কেশ জটাবদ্ধ বেণীর মতো হয়েছিল। পতিব্রতা স্ত্রী, পরলোকগত স্বামীর পাশে প্রশান্ত অনলের পার্শ্ববর্তিনী শিখরের ন্যায় শোভিত হয়েছিলেন।

সুস্থির আসনে উপবিষ্ট পতিকে, প্রথমে বেশ কিছুক্ষণ বৈদভী মৃত বলে বুঝতে পারেননি। ততক্ষণ তিনি স্বামীর কাছে অবস্থান করে নিষ্ঠাভরে সেবা– পরিচর‍্যা করছিলেন। এভাবে বৈদভী পতির চরণ স্পর্শ করে উষ্ণতা অনুভব করতে পারলো না। তখন তিনি সূর্যভ্রষ্টা হরিণীর ন্যায় অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে পড়লেন। তিনি নিজেকে পতি-বিরহিত ও দীন জ্ঞান করে শোকগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। অশ্রুজলে তার স্তনদ্বয় সিক্ত হল।

সেই নির্জন বনে বৈদভী করুণ কাতর স্বরে বিলাপ করতে লাগলেন। তারপর বৈদভী বিলাপ করতে করতে বলতে লাগলেন– মহারাজ গাত্রোত্থান করুন দস্যু ও অধার্মিক ক্ষত্রিয় পুরুষের হাত থেকে স্ত্রস্ত সসাগরা ধরিত্রীকে রক্ষা করুন।

সেই নির্জন অরণ্যে পতির অনুগামিনী বৈদভী পতির জন্য এভাবে বিলাপ করতে লাগলেন। স্বামীর পদতলে লুণ্ঠিত হয়ে তিনি ক্রন্দন করতে লাগলেন।

তারপর তিনি কাঠদ্বারা চিতা রচনা করলেন। তার মধ্যে মৃত স্বামীর দেহ স্থাপন করে অগ্নি সংযোগ করেলেন। তারপর বিলাপ করতে করতে তিনি সহমরণে যাবার সংকল্প করতে লাগলেন।

হে রাজন, সেই স্থানে এক আত্মবান ব্রাহ্মণ ছিলেন। তিনি মলয়ধ্বজের সখা ছিলেন। সখার প্রিয়তম পত্নীকে সহমরণে উদ্যত হতে দেখে তিনি বৈদভীকে মধুর বচনে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। ব্রাহ্মণবেশী ভগবান বৈদভীর উদ্দেশ্যে বললেন– হে সুন্দরী! তুমি কে? কার কন্যা? কার জন্যই বা অশ্রু বিসর্জন করছ? হে মহীয়সী! আমাকে চেন কি? গতজন্মে তুমি আমার সঙ্গে সখ্যসুখ অনুভব করেছিলে। তারপর তিনি বৈদভীকে তার পুর্বতন পুরুষরূপ স্মরণ করিয়ে দিলেন।

তারপর সেভাবেই তাঁকে সম্বোধন করে বলতে লাগলেন, সখে, তোমার নিজেকে কি মনে পড়ে? কোন ব্যক্তির সঙ্গে তোমার সখ্য ছিল, মনে পড়ছে?

তুমি আমাকে পরিত্যাগ করে স্ব-উপযুক্ত স্থানের খোঁজে বেড়িয়ে সংসার-ভোগে রত হয়েছিলে। হে আর্য, আমরা দুজন তখন সরোবরে একত্রে দুটি হংসরূপে বাস করতাম। আমরা দুজনেই প্রাকৃত স্থূল শরীর বা গৃহ ব্যতিরেকেই সহস্র বছর অর্থাৎ মহাপ্রলয়ে পর্যন্ত বাস করতাম।

তারপরে তুমি ভোগের অভিলাষী হয়ে আমাকে ভুলে গিয়ে প্রপঞ্চে গমন করলে। লিঙ্গ শরীরের উপযুক্ত কামনা পূরণের উপযুক্ত স্থূল শরীরের অন্বেষণ করতে করতে কোনো স্ত্রী বিনির্মিত পুরী দর্শন করেছিলে সেই বাসস্থানে পাঁচটি উপবন, নয়টি দ্বার, একটি রক্ষক, তিনটি কোষ্ঠ, ছয়টি ফুল ও পাঁচটি হাট আছে। মেনুলি পাঁচটি উপাদানে নির্মিত এবং বুদ্ধিরূপা এক স্ত্রী তার কত্রী ছিলেন।

হে সখে। মনুষ্যদেহই সেই বাসস্থান। পঞ্চ-জ্ঞানেন্দ্রিয়ের শব্দাদি পঞ্চ–বিষয় উমার উপবন, নয়টি ইন্দ্রিয় ছিদ্র হল, নয়টি দ্বার। একমাত্র রক্ষাকর্তা হল প্রাণ। এর তিনটি প্রকোষ্ঠ হল পৃথিবী, জল এবং তেজ। পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় ও মন–এরা ছয়জন কুল অর্থাৎ অভিষ্ট বিষয় প্রাপক। পঞ্চ- কর্মেন্দ্রিয় উহার হাট, মহাভূত সমূহ অক্ষয় উপাদান এবং উহার অধীশ্বরী হল বুদ্ধি।

এই শক্তিরূপা বুদ্ধির বশীভূত হয়ে পুরুষ ঐ শরীরে প্রবেশ করে। নিজেকে ও আমাকে উপলব্ধি করতে পারে না। হে সখা, তুমি ঐ বুদ্ধিস্বরূপা নারী কর্তৃক অভিভূত হয়ে তার সাথে ভোগবিহারে মত্ত হয়েছিলে। সে সময়ে তুমি নিজ স্বরূপ অর্থাৎ তুমি যে ব্রহ্মার অংশ তা বিস্মৃত হয়েছিলে। ঐ নারী সঙ্গের কারণেই তোমার এমন পাপীয়সী দশা উপস্থিত হয়েছে।

হে সখা তুমি বিদর্ভরাজকন্যা নয়। গতজন্মে তুমি সে পুরঞ্জনীর দ্বারা নবদ্বার পুরীতে আবদ্ধ হয়েছিল, তুমি তারও পতি ছিলে না। সে জন্য তুমি গতজন্মে নিজেকে পুরুষ মনে করেছিলে এবং এজন্মে নিজেকে স্ত্রী বলে মনে করছ, তা আমারই সৃষ্ট মায়ার বিলাস।

জীবাত্মা ও পরমাত্মা উভয়েই আমরা শুদ্ধ। আমাদের স্বরূপ বর্ণনা করি।

দর্শন কর তুমি আমরা স্বরূপ। আমার থেকে ভিন্ন নও। আমিও তোমারই স্বরূপ। ভালো করে বিবেচনা করে দেখ।

পণ্ডিতেরা আমাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র প্রভেদ দেখতে পান না। পুরুষ যেরকম একদেহ থেকেই দর্পণ ও পরপুরুষের চোখে দুই দেহ দর্শন করে। সেরূপ আমাদেরও প্রভেদ জানবে।

এইরূপে সেই মানান হংস, (অসর্বঞ্জ জীন) অপর হংস (সর্বজ্ঞ ঈশ্বর) কর্তৃক প্ররোচিত হলেন তখন তিনি তাঁর স্বামী অর্থাৎ ঈশ্বরের বিয়োগেও সুস্থির হয়ে রইলেন। তাঁর পূর্বস্মৃতি উদিত হল।

হে রাজন, আমি পুরঞ্জনের কথার ছলে তোমাকে এই অধ্যাত্মজ্ঞান উপদেশ করলাম। যেহেতু ভগবান বিশ্ব-কারণ পরোক্ষ কথায় অতিশয় প্রীত হন।

.

উনত্রিংশ অধ্যায়
পুরঞ্জন-পুরের ব্যাখ্যা

রাজা প্রাচীনবহি বললেন–হে ভগবান, আপনার কথার প্রকৃত ব্যাখ্যা আমরা অনুধাবন করতে পারলাম না। সম্ভবতঃ বিবেকবলে পণ্ডিতগণই তা জানতে পারেন। আমরা সাধারণ কর্মাসক্ত লোক, তা বুঝতে পারছি না।

নারদ বললেন– হে রাজা, আমি যাকে পুরঞ্জন বলে বর্ণনা করলাম, তাকে পুরুষ অর্থাৎ জীব বলে ধরতে হবে। তিনি ঐ পুর বা দেহকে নিজকর্ম অনুসারে প্রকটিত করেন, এজন্য তার নাম পুরঞ্জন। ঐ পুর, একপদ, দ্বিপদ, ত্রিপদ, চতুষ্পদ, বহুপদ বা পদহীন হয়ে থাকে।

যাঁকে অবিজ্ঞাত বলে বর্ণনা করেছি, তিনি ঐ পুরুষের সখা– ঈশ্বর।

কোনও জীব তাকে নাম ক্রিয়া অথবা গুণের দ্বারা জানতে পারে না। তাই তিনি অবিজ্ঞাত।

জীব যখন প্রকৃতির গুণাবলী সমগ্রভাবে উপভোগ করতে ইচ্ছুক হয়, তখন পূর্বোক্ত দেহকালের মধ্যে নরদ্বার বিশিষ্ট দেহকে সর্বোত্তম বলে মনে করে। সেটি হল মনুষ্যদেহ। তার মধ্যে দুটি হস্ত ও দুটি পদ বর্তমান।

পুরঞ্জনের ‘প্রমদা’ হল বুদ্ধি। এই বুদ্ধি দ্বারাই জীবের আত্মাভিমান, অর্থাৎ “আমি ও আমার এই বোধ জন্মায়।

ইন্দ্রিয় সমূহ দ্বারা জীব রূপ– রসাদি ভোগ করে থাকে।

সকল ইন্দ্রিয় তার সখা এবং ইন্দ্রিয়াদির বৃত্তি হল তার সখী। জ্ঞান ও কর্ম তাদের দ্বারাই সম্পন্ন হয়ে থাকে। প্রাণ, আপন, সমান উদ্যায়া ও ব্যাস– এই পঞ্চবৃত্তি সম্পন্ন নাগ বলে বর্ণিত হয়েছে।

একাদশতম ব্যক্তিকে যে নায়ক বলা হয়েছে, তাকে জ্ঞান ও কর্ম এই দুই ইন্দ্রিয়ের অধীশ্বর মহাশক্তিশালী মন বলে বুঝতে হবে। পাঞ্চাল দেশ রূপ ও রসাদি পাঁচটি বিষয়, এবং ঐ পাঁচটি বিষয়ের মধ্যে নটি দ্বারযুক্ত পুর’ বর্তমান থাকে। নেত্ৰদ্বয়, নাসিকাদ্বয়, কর্ণদ্বয়, মুখ, শিশ্ন ও পায়ু– এই নটি হয় নবধার ইন্দ্রিয় “নবদ্বার” রূপে বর্ণিত হয়। জীব ঐ সকল দ্বারের সাহায্যে বৰ্হিদেশে গমন করে অর্থাৎ বাহ্য বিষয়ের সংস্পর্শে আসে। এই নটি দ্বারের মধ্যে দুটি চক্ষু, দুটি নাসিকা বদ্ধ ও মুখাবিবর এই পাঁচটি পূর্বভাগে অবস্থিত দক্ষিণ কর্ণকে দক্ষিণ দ্বারা এবং বামকৰ্ণকে উত্তর দ্বার বলা হয়। পায়ু ও উপস্থ দুটি অধোদ্বার পশ্চিম ভাগে অবস্থিত। খদ্যোতা ও আবর্মুখী এই দুটি দ্বার হল দুটি নয়ন।

“বিভ্রাজিত জনপদকে রূপ বলে জানতে হবে। জীব চোখের দ্বারা দর্শন করে থাকে। নলিনী’ ও ‘পালিনী’ এই দুটি দ্বার হলো নাসিকাদ্বয়। গন্ধকেই “সৌরভ” দেশ বলে বর্ণনা করা হয়।

ঘ্রানেন্দ্রিয়কে ‘অবধূত’ মুখকে মুখ্যদ্বার বাগিন্দ্রিয়কে “বিপন” ও রসেনেন্দ্রিয়কে ‘রসক্ত” বলা হয়।

এই দেহে বাক্যপ্রয়োগ অর্থাৎ ভাষাই “আপন” দেশ। নানাবিধ অন্নকে “বহুদন দেশ বলা হয়।

কর্ণকে “পিতৃহু” এবং বামকৰ্ণকে “দেবহু” বলা হয়েছে।

প্রবৃত্তিশাস্ত্র কর্মকাণ্ডকে “দক্ষিণ পাঞ্চাল” নিবৃত্তিশাস্ত্রকে বা জ্ঞানকাণ্ডকে “উত্তর পাঞ্চাল” বলে।

শ্রুতিধর বলতে শ্রবণেন্দ্রিয়কে বোঝান হয়েছে।

জীব শ্রোত্র দ্বারা শ্রবণ করে, কর্মকাণ্ডে ও জ্ঞানকাণ্ডের অনুষ্ঠান করে, যথাক্রমে “পিতৃসান” ও “দেবযান” মার্গে গমন করে থাকে।

মহারাজ, পশ্চিমদিকের “আসুরী” দ্বারটি ‘স্মেট’ ইন্দ্রিয়ের স্থান।

গ্রামকে স্ত্রী অঙ্গ দুর্মদ’কে উপস্থি এবং নিঋতি শব্দের অর্থ পায়ু ইন্দ্রিয়।

‘বৈশম’কে নরক বলা হয়।

‘পায়ু’ ইন্দ্রিয়কে “লুব্ধক” বলা হয়েছে।

যে দুটি অন্ধ দ্বারের কথা বলা হয়েছে, তারা হস্ত ও পদ। এদের কোনো ছিদ্র নেই। এদের সাহায্যে পুরুষ গমন ও কর্ম করে থাকে।

হৃদয়কে “অন্তঃপুর” এবং মনকে “রিমুচিন” বলা হয়। জীব ঐ শরীরের মধ্যে সত্ত্ব, রজঃ ও তমোগুণের সাহয্যে প্রাণতা আনন্দ ও মোহ প্রাপ্ত হয়।

পূর্বোক্ত প্রমদা হলেন বুদ্ধি। এই বুদ্ধি স্বপ্ন ও জাগ্রত অবস্থায় নানাবিধ বিকারের কারণ হয়। বুদ্ধির গুণে লিপ্ত আত্মা তবে বৃত্তি সকলের উপদ্রষ্টা হয়ে তাকে অন্ধভাবে অনুকরণ করে থাকে।

মৃগয়া প্রসঙ্গে যে রথের কথা বলা হয়েছে, সেই দেহই হল রথ। উহার অশ্বস্বরূপ হল ইন্দ্রিয়াদি। সংবৎসরের বেগের মত তার বেগ। পাপ ও পুণ্য ঐ রথের চক্রস্বরূপ। গুণত্রয় তার ধ্বজা। ঐ রথের পাঁচটি বন্ধন হল পঞ্চবাণ। মন হল তার রশি, সারথি হল বুদ্ধি। হৃদয়ে সেই সারথির উপবেশন স্থান নিদিষ্ট। যুগবন্ধনের দুটি স্থান হল শোক ও মোহ।

ইন্দ্রিয়ের শব্দ স্পর্শাদি এই এই পঞ্চবিষয় প্রক্ষিপ্ত হয়। আর সাতটি ধাতু হল ঐ রথের সাতটি আবরণ পুরুষ ঐ রথে আরোহণ করে মৃগয়ায় গমন করে, পঞ্চকর্ণেন্দ্রিয় তার বিক্রম।

মৃগয়াকারী পুরুষের লোপ হল একাদশ ইন্দ্রিয়। তন্মধ্যে পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়ের সাহায্যে তিনি বিষয়াদির সেবা করেন। তাকেই মৃগয়া বলে।

‘চণ্ডবেগ’ নামক যে কালের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তা হল সংবৎসর তার দিবসকাল হল ‘গন্ধর্ব, এবং রাত্রিসকল গান্ধবী’ তিনশো ষাট দিবস নিরন্তর ভ্রমণ করে পুরুষের পরমায়ু হরণ করে।

হে রাজন কালকন্যা জরাকে কেউ স্বেচ্ছায় গ্রহণ করে না। স্বয়ং যবনেশ্বর মৃত্যু সকল ক্ষয়ের জন্য তাকে ভগিনীরূপে গ্রহণ করেছে।

মানসিক ও দৈহিক পীড়া সমূহকেই যবনযোন বলা হয়। শীত ও উষ্ণবেদে দু’রকম জ্বরকে ‘প্রজ্বার’ বলা হয়। এই জ্বর প্রাণীগণের মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করে।

হে রাজন, দেহী অজ্ঞান আবৃত হওয়ায় এইভাবে ঐ দেহে বহু আধিভৌতিক, আধিদৈবিক ও আধ্যাত্মিক ক্লেশ ভোগ করে। এইভাবে শত শত বৎসর তাকে নিপীড়িত হতে হয়।

তার আত্মা নির্গুণ, তবুও মোহান্ধ হয়ে প্রাণ ও মনের ধর্ম আত্মাতে আরোপ করে সামান্য বিষয় সুখ অনুভব করে। প্রাণের ধর্ম–ক্ষুধা, পিপাসা এবং ইন্দ্রিয়ের ধর্ম হল–কামাদি। মনের ধর্ম সংকল্প।

জীব স্বরূপতঃ স্বপ্রকাশ স্বভাব। আত্মাকে ও পরম গুরু ভগবানকে জানতে না পারায় যে প্রকৃতির গুণসকলে আসক্ত হয়। তখন প্রকৃতির গুণে অভিমান হেতু সেই পুরুষ অবশ হয়ে কর্মে লিপ্ত হয়। এই কর্মসম্পাদনের সময়ে যেরূপ কর্ম হয় তদুনুসারে পরজন্মে জন্মলাভ হয়। অর্থাৎ সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক যে রকম কর্ম হয় সেরকম জন্ম হয়। তার সাত্ত্বিক কর্ম হলে প্রকাশবহুল দেবাদি লোকপ্রাপ্ত হয়।

রাজসিক হলে দুঃখ বহুল তোক ও তামসিক হলে উকট শোক ও মোহ প্রাপ্ত হয়। এভাবে অজ্ঞ জীব কখনও স্ত্রী, কখনও নপুংসক হয়ে জন্মগ্রহণ করে। কর্ম ও গুণ অনুসারেই তার বিভিন্ন যোনিতে যেমন দেব, মনুষ্য বা তির্যক যোনিতে জন্ম হয়।

জীবের আশয় কামে ব্যাপ্ত হওয়ায় সে তদনুসারে উচ্চ ও নীচ পথে ভ্রমণ করে। তাতে কখনো ঊর্ধে, কখনো মধ্যে, কখনো বা অধোলোকে তার গতি হয়। এবং নিজ অদৃষ্ট অনুসারে প্রিয় বা অপ্রিয় (সুখ বা দুঃখ) ভোগ করে থাকে।

আধিভৌতিক, আধিদৈবিক ও আধ্যাত্মিক– এই তিনরকম দুঃখের মধ্যে যদি সকলেরই প্রতিক্রিয়া থাকে, তবুও যে-কোনো একটির সঙ্গে জীবের একান্ত বিচ্ছেদ ঘটে না। কারণ ঐ প্রতিকারও দুঃখ স্বরূপ। এজন্য কোনো না কোনো ক্লেশ তাকে ভোগ করতেই হয়।

পুরুষ মস্তক দ্বারা গুরুতর ভার বহন করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে, স্কন্ধে স্থাপন করে। কিন্তু তাতে একেবারে দুঃখের প্রতিকার হয় না। অন্যান্য প্রতিক্রিয়াতেও দুঃখ আছে।

মহারাজ জ্ঞানরহিত কর্ম দ্বারা কখনও শবাসন কর্মাবলীর প্রতিকার হওয়া সম্ভব নয়। বাসনান্বিত ও জ্ঞানরহিত এই দুই প্রকার কর্মই অবিদ্যার দ্বারা সংঘটিত হয় এর ফলে পরস্পর নির্বত্য ও নিবর্তক কিভাবে হওয়া সম্ভব–স্বপ্নাবস্থায় যে স্বপ্ন দৃষ্ট হয় জাগরণ ভিন্ন কখনই তার সম্পূর্ণ প্রতিকার হতে পারে না।

বস্তু না থাকলেও সংসার নিবর্ত হয় না স্বপ্নে ভ্রমণকারী পুরুষের ন্যায় উপাধিকৃত মন দ্বারা উহা বর্তমান থাকে। আত্মতত্ত্ব উপদেশ দ্বারা দেহাত্মাভিমান নিবৃত্ত হলেও নানাবিধ বাসনার মূল ও সংসারের কারণ মনের অধীনে থাকলে জীবের সংসারে নিবৃত্তি হয় না।

যে মনের কারণে পুরুষার্থস্বরূপ জীবাত্মার অনর্থবহুল সংসার পরস্পরা চলছে, একমাত্র পরমগুরু বাসুদেব ভক্তির দ্বারা সেই মনকে উচ্ছেদ করা যেতে পারে।

ভগবান বাসুদেবের প্রতি ভক্তিযোগ প্রযোজিত হলে, তা বৈরাগ্য জ্ঞানের জন্ম দেয়।

হে রাজর্ষি, যে ব্যক্তি শ্রদ্ধা সহকারে নিত্য শ্রীকৃষ্ণ কথা শ্রবণ ও অধ্যায়ন করে তার ভক্তিযোগের উৎপত্তি হয়।

হে রাজন, যে স্থানে নির্মল হৃদয়যুক্ত ভগবৎ– ভক্ত সাধুগণ ভগবানের সকল গুণাবলীর কথন ও শ্রবণের উদ্দেশ্যে ব্যাকুল হয় অবস্থান করেন, ঐ মহতের মুখ– নিঃসৃত মধুসূদনের চরিত্র কথা অমৃত বারির ন্যায় চতুর্দিকে প্রবাহিত হতে থাকে।

যাঁরা অসংবুদ্ধি-শুন্য হয়ে সমুৎসুকভাবে ঐ চরিত্রকথা শ্রবণ করেন, তাদের ক্ষুধা –তৃষ্ণা, শোক, ভয়, মোহ, স্পর্শ করতে পারে না।

মানুষের যদি সৎসঙ্গ লাভ না হয়। এবং নিজে ভগবৎ কথা চিন্তনে উৎসাহী না হয় তাহলে তারা নিত্য ক্ষুধা-তৃষ্ণাদির চিন্তায় নিত্য উৎপীড়িত হয়। এজন্য ভগবানের কথা রূপ সমুদ্রে তার রতি হয় না।

প্রজাপতিগণের পতি ব্রহ্মা, স্বয়ং ভগবান মহাদেব স্বায়ব মনু, দক্ষাদি প্রজাতিগণ, মনকাদি নৈষ্টিক ব্রহ্মচারীগণ, মরীচি, অত্রি, আঙ্গিরা, পুলস্ত, পুলহ, ক্রতু, ভৃগু, বশিষ্ঠ এবং আমিও এখনও পর্যন্ত সর্বসাক্ষী পরমেশ্বরকে জানতে পারিনি।

কর্মীগণ অতি বিশাল ও দুষ্পর বেদভাগে অবস্থান করে এবং বেদের মন্ত্রানুযায়ী ইন্দ্রাদি দেবতাগণের ভজনা করে পরমেশ্বরের তত্ত্ব জানতে পারে না।

ভগবান বাসুদেব আত্মাতে ভাবিত হয়ে যখন যার প্রতি অনুগ্রহ করেন, তখন লোকব্যবহারে ও কর্মমাগে তার পরিনিষ্ঠিতা বুদ্ধি ত্যক্ত হয়।

হে বর্হিষ্মান অজ্ঞানতাহেতু পরমার্থরূপে প্রতীয়মান শ্রুতিমধুর কিন্তু বাস্তবিক অন্তঃসারশূন্য বস্তুর সঙ্গে সম্পর্কহীন কর্মে লিপ্ত না হওয়াই ভাল।

যে ব্যক্তিসকলের বুদ্ধি মলিন, তারাই বেদকে কর্মপর বলে। তারা বেদের প্রকৃত তাৎপর্য বুঝতে অপারগ। ভগবান যে বৈকুণ্ঠলোকে বিরাজমান, তারা সেই বৈকুণ্ঠলোককে স্বরূপের প্রাপ্য লোক বলে জানতে পারে না।

হে রাজন, প্রগিগ্র কুশসমূহের দ্বারা ক্ষিতিমণ্ডল আস্তীর্ণ হয়েছে। তুমি বহু পশু হনন করে সততানুষ্ঠান করে নিজেকে মহাজ্ঞানী বলে অহংকার করছ। কর্মদ্বার প্রাপ্য লোকের সন্ধান জানলেও বিদ্যাস্বরূপ পরম বস্তুর সন্ধান পাওনি।

কর্ম ও বিদ্যা বলতে কি বোঝায়, আমি তোমায় বলছি, শ্রবণ কর। যার দ্বারা ভগবান, হরির পরিতুষ্টি হয়, তাই কর্ম।

যার দ্বারা ভগবানে মতি হয় তাই বিদ্যা।

ভগবান হরি দেহধারী সকল প্রাণীর আত্মা ও নিয়ন্তা তিনিই নিরপেক্ষভাবে সকল জগতের কারণ। এই সংসারে তাঁর পাদমূলই জীবগণের আশ্রয়।

শ্রীহরির চরণ আশ্রয়েই জীবের সকল মঙ্গল সাধিত হয়, অর্থাৎ কালাদি ভয়ের নিবৃত্তি হয়। ভগবান হরিই প্রিয়তম তিনিই আত্মা। তাঁর সম্পর্কে কোনো ভীতির কারণ নেই।

যে ব্যক্তিরই এই জ্ঞান আছে, তিনিই বিদ্বান। যিনি বিদ্বান তিনিই গুরু। এই গুরুকে শ্রীহরি থেকে অভিন্ন বলে জ্ঞান করা উচিত।

দেবর্ষি নারদ বললেন– হে পুরুষশ্রেষ্ঠ, তোমার জিজ্ঞাসার উত্তরে এইসব কথা বললাম। এখন একটি গূঢ় বিষয় বলছি শ্রবণ কর। একটি হরিণ একদিন ফুলের বাগানে, এক হরিণীর সঙ্গে ক্ষুদ্র সুখে ক্রীড়ামত্ত। তার কানে ভ্রমর গুঞ্জন ছাড়া কিছুই শ্রুত হচ্ছে না। বৃকগণ তাদের সামনে দিয়ে এগিয়ে চলেছে। যে-কোনো সময়ে তার পিঠে ব্যাধের তির এসে প্রাণ কেড়ে নিতে পারে কিন্তু তবু সেই হরিণের কোনো দিকে হুঁশ নেই। তুমি সেই হরিণের কথা চিন্তা কর।

হে রাজন, — ব্যাধহস্তে নিহত মৃগের ন্যায় নির্ভিন্ন হৃদয় এই আত্মাকে দর্শন কর।

যিনি অগ্রে সুখদায়ক কিন্তু পরিণামে দুঃখপ্রদ পুষ্পের ন্যায় সমান ধর্মশালী ঘোষিৎ-গণের সঙ্গে গ্রহে কাম্য- কর্মদতে পুষ্প-মধুগন্ধের মতো অতি সামান্য কামজ সুখ অম্বেষণ করছেন। যিনি স্ত্রীর সঙ্গে মিথুন হয়ে একমাত্র তার প্রতি মনোনিবেশ করছেন।

পুত্র কলত্রাদির আলাপ কোলাহলে যার দুটি কান লুব্ধ, “কাল” যে তাঁর আয়ু হরণ করেছে এ বিষয়ে তার কোনও খেয়াল নেই।

তিনি কোনও বিষয়ে মনোযোগ না দিয়ে গৃহমধ্যে বিহার করছেন। আর কৃতান্ত যার পশ্চাতে বা পরোক্ষে অবস্থান করে দূর থেকে তার উদ্দেশ্যে শরসন্ধান করছেন, সেই মৃগের ন্যায় মরণোন্মুখ আত্মার বিষয় বিচার কর।

হে রাজন– তুমি নিজ হৃদয়ে আত্মার মৃগতুল্য চেষ্টার বিষয় বিচার করে হৃদয়ের মধ্যে চিত্তকে বন্ধ কর। বহিরিন্দ্রিয়ের বৃত্তিগুলিতে অন্তর্মুখী করে চিত্তমধ্যে নিরুদ্ধ কর।

কামুকগণের গৃহাশ্রম পরিত্যাগ করে সফল জীবের আশ্রয় ঈশ্বরের চরণে সংস্থাপিত কর। ক্রমে ক্রমে সকল কর্ম থেকে বিরত হও।

মহারাজ প্রাচীনবৰ্হি বললেন– হে ব্রাহ্মণ, আপনি যা বললেন–আমি তার সম্যক্‌ বিচারের চেষ্টা করলাম। মনে হয় আমার উপদেশক উপাধ্যায়গণ এই বিষয়ে অজ্ঞাত ছিল।

হে ব্রাহ্মণ, এই আত্ম– তত্ত্ব– বিষয়ে উপাধ্যায়গণের বাক্যের সঙ্গে আমার বিরোধ হওয়ায় যে অসম্ভবনারূপ মহৎ সংশয় ছিল, আপনি তা ছিন্ন করলেন। কিন্তু, এখনও আমার ঐ বিষয়ে আরও সংশয় আছে।

এই আত্মতত্ত্বে ইন্দ্রিয় বৃত্তিসমূহের অপ্রবৃত্তিহেতু ঋষিগণও মুগ্ধ হয়ে থাকেন।

জীব যে দেহ দ্বারা ইহলোকে কর্মত্যাগ করে, সেই দেহ এখানেই পরিত্যাগ করে যায়। এই লোকে যে কর্ম করে তার ফলেই পরলোকে অপর দেহপ্রাপ্তি হয়। সেই দেহ দ্বারা বারংবার ঐ সকল কর্মের ফলভোগ করে। বেদবিদগণের এইরূপ বাক্য, তত্ত্বৎ প্রসঙ্গে শোনা যায়।

কিন্তু এটাই কি সংগত বলে মনে হয় কি? এক দেহের কৃতকর্ম, অপর দেহে ফলভোগ, ঐ আবার কেমন কথা? এর ফলে কৃত– নাশ এবং অকৃতের অভ্যাগম– রূপ দোষ হয়। আর লোকে বেদোক্ত যে কর্ম করে, পরক্ষণেই তা অদৃশ্য হয়। বিনষ্ট কর্মের ফল কিভাবে ভোগ করা সম্ভব?

নারদ বললেন, হে রাজন, জীব ইহলোকে যে মনঃপ্রধান লিঙ্গশরীর কার্যের কারণ হয়, পরলোকেও ঐ শরীর দ্বারা স্বর্গ নরকাদি ভোগ হয়। স্কুল দেহ বিনষ্ট হলেও, মনঃপ্রধান লিঙ্গ দেহের বিনাশ হয় না, অতএব তার দ্বারাই যে ফলভোগ হবে, এতে আশ্চর্যের কি আছে?

জাগ্রত অবস্থায় এই যে দেহ বর্তমান এতদভিমানী জীব শায়িত অবস্থায় স্বপ্নে জাগ্রতদেহ পরিত্যাগ করে মনোমধ্যে স্থিত কর্মসমূহকে স্বপ্নদেহ দ্বারা ভোগ করে। সে রকমই স্বপ্নদেহের মতো কর্মজন্য পশ্চাদি দেহ অথবা অন্য কোন দেহ- দ্বারা লোকান্তরে ফলভোগ করবে, এতে আশ্চর্যের কি আছে?

“এরা আমার পুত্র” “আমি ব্রাহ্মণ” “আমি ক্ষত্রিয়” এইরূপ অভিমান করে জীব মনস্ক প্রধান লিঙ্গ দেহ দ্বারা থেকে দেহপ্রাপ্ত হয়, সেই দেহ হতে সিদ্ধ কর্ম পুনঃপ্রাপ্ত হয়। সেই সমস্ত কর্ম অহংকার দ্বারা পরিগৃহীত হওয়ায় তার দ্বারাই পুনর্জন্ম হয়ে থাকে।

এতদ্বারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, যে মনোবিশিষ্ট অভিমানকারীই কর্তা, যে দেহ অভিমানের বিষয়, তা দ্বারা মাত্র।

কর্মসকল পরক্ষণেই নষ্ট হয়ে যায়, এতে পরকালে সে সকলের ভোগ কেমন করে সম্ভব সে বিষয়ে তুমি সংশয় প্রকাশ করছ।

এ বিষয়ে আমার বক্তব্য হচ্ছে- যেমন ইন্দ্রিয়াদির জ্ঞান ও কর্মরূপ দ্বিবিধ প্রবৃত্তি দ্বারা চিত্তের অনুমান করা হয়, তেমনি হৃদয়বৃত্তির সাহায্য পূর্বদেহ জন্য কর্মসমূহের অনুমান হয়ে থাকে। বর্তমান দেহের দ্বারা জীব কোথাও কখনও যে বস্তুর উপভোগ, দর্শন বা শ্রবণ করেনি, স্বপ্ন বা মনোরথ ইত্যাদিতে কদাচিত সেই ধরনের বস্তুর তদ্রূপ উপলব্ধি হয়।

অতএব বাসনাময় লিঙ্গ দেহাশ্রয়ী, জীবের উক্ত অনুভবাদি– যুক্ত পূর্বদেহের উৎপত্তি বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপন কর। কারণ কোনো বিষয় কদাচিত অনুভূত না হলে, তা কখনও চিত্তে স্ফুরিত হতে পারে না।

মনই, মানুষের ভবিষ্যতে উন্নতিপ্রাপ্তি বা নিচত্বপ্রাপ্তি হলে যেমন রূপ হবে, তা ঔদার্য ও কার্পণ্যাদি বৃত্তির দ্বারা জানিয়ে দেয়।

অতএব কারও ঔদার্য ও কার্পণ্যাদি দেখলেই লোকে বলে থাকে, এ ব্যক্তি পূর্বজন্মে এরূপ ছিল, পরেও এ প্রকার হবে।

অদৃষ্ট ও অশ্রুত বিষয় কখনো কখনো স্বপ্নবস্থায় মনে দেখা যায়, যেমন পবর্তাগ্রে সমুদ্র, দিবসে নক্ষত্র দর্শন, নিজের শিরচ্ছেদন তার কারণ, সুখ-দুঃখ জনিত প্রাচীন কর্মদ্বারা অথবা দেশ, কাল ও ক্রিয়াকে আশ্রয় করে, নিদ্রাদি দোষবশতঃ দৃষ্ট হয়ে থাকে।

সকল মানুষেরই মন আছে, সকল বস্তুই ক্রমানুসারে মন ও ইন্দ্রিয়ের গোচর হয়। এই মনের দ্বারাই যে-কোনো অবস্থায়, যে-কোনো বস্তুর অনুভব হওয়া অস্বাভাবিক নয়।

অতএব স্বপ্নে রাজা নিজেকে যেমন দরিদ্ররূপে দর্শন করতে পারেন, আবার দরিদ্র নিজেকে রাজারূপে দর্শন করতে পারেন।

রাহু চন্দ্রের সঙ্গে সংযুক্ত অবস্থাতেই দৃষ্ট হয় অন্য সময়ে তাকে দেখা যায় না। যোগী পুরুষদের সত্ত্বে কনিষ্ট ভগবৎ– ধ্যানপরায়ণ মনে এই জগৎ যেন সংযুক্ত হয়েই প্রকাশিত হয়। একথা প্রসিদ্ধ যে, শুদ্ধ মনের মধ্যে বিষয়ের যে স্ফুরণ ঘটে, তা যোগীদের প্রত্যক্ষ সিদ্ধ।

বুদ্ধি, মন, ইন্দ্রিয়, বিষয় পেঞ্চ তন্মাত্র্য ও গুণসকলের পরিণাম লিঙ্গদেহে যে পর্যন্ত বর্তমান থাকে, সে পর্যন্ত জীবের “আমি” “আমার” –এই অভিমান সদ্ভূত স্থূলদেহের সাথে লিঙ্গদেহের সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন হয় না। অতএব কদাচিৎ কর্তৃক ভোক্তৃত্ব বিরহে মুক্তি প্রসঙ্গ হয়, এমন আশংকা কোরো না।

সুষুপ্তি, মূর্খ, ইষ্ট-বিয়োগজনিত দুঃখ, মৃত্যু ও উৎকট জুরাদির অবস্থায় “আমি মননকর্তা “আমি শ্রোতা” ইত্যাদি অভিমান ইন্দ্রিয় ব্যাপার একান্ত সঙ্কুচিত হওয়ায় উহা প্রকাশিত হয় না। কিন্তু অধ্যাসে নয়, মনের বৃত্তি সূক্ষ রূপে থাকে।

যুবাপুরুষের একাদশ ইন্দ্রিয় দ্বারা লিঙ্গ-দেহ বা অহঙ্করণ যেমন সুব্যক্ত হয় গর্ভকালে বা বাল্যকালে সেই ইন্দ্রিয়াদি অসম্পূর্ণ থাকার কারণে প্রকাশিত না হলেও তার অধ্যাস থাকে।

যেমন স্বপ্নাবস্থায় বিষয়াদির অভাব থাকলেও বিষয় গ্রহণরূপ অনর্থের উদয় হয়, তেমনি জীবের যতক্ষণ দেহাভিমান থাকে, ততক্ষণ তার মুক্তি ঘটে না।

পঞ্চতন্মাত্র, ত্রিগুণ ও ষোড়শ বিকার বিস্তৃত এই লিঙ্গদেহ এইভাবে চেতনার সঙ্গে সংযুক্ত হলে, তাকে জীব বলা হয়। এই লিঙ্গদেহ দ্বারাই পুরুষ স্থূলদেহ সকল গ্রহণ ও পরিত্যাগ করে থাকে। এই লিঙ্গদেহ দ্বারাই পুরুষ হর্ষ, শোক, ভয়, দুঃখ, সুখ, অনুভূত হয়।

তৃণ জলৌকা বা জোঁক অন্য তৃণ অবলম্বন করেই পূর্বধৃত তৃণ পরিত্যাগ করে, তার আগে নয়। পুরুষ ম্রিয়মান হলে পূর্বদেহের আরম্ভক কর্মসকলের সমাপন দ্বারা অন্যদেহ অবলম্বন না করা যাবৎ, পূর্বদেহাভিমান পরিত্যাগ করে না।

হে নরনাথ, বস্তুত মনই প্রাণীসকলের সংসারের কারণ, ইন্দ্রিয়সকলের দ্বারা উপযুক্ত বিষয়সমূহের ধ্যান করেই পুরুষ পুণঃ পুণঃ কর্ম থাকলেই অবিদ্যা থাকে।

এই অবিদ্যার কারণেই দেহাদির কর্মে বন্ধন হয়। অতএব ঐ বিদ্যায় নিবারণার্থে সর্বান্তকরণে ভগবান হরির ভজনা কর। এই বিশ্বের সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের কারণ তিনিই।

মৈত্রেয় বললেন, বৎস বিদুর, ভগবৎ– প্রধান ভগবান নারদ এইভাবে জীব ও ঈশ্বরের স্বরূপ উপদেশ করে সিদ্ধলোকে গমন করলেন।

রাজর্ষি প্রাচীনবর্হিও মন্ত্রীদের উদ্দেশ্যে বললেন– আমার পুত্রদের প্রজাসৃষ্টির রক্ষণাবেক্ষণ করতে বলবে। একথা বলে তপস্যার জন্য কপিলাশ্রমে গমন করলেন।

সেই আশ্রমে সঙ্গ পরিত্যাগ করে একাগ্রচিত্ত হয়ে ভগবান গোবিন্দের চরণের আরাধনা করেছিলেন। তার প্রতি ভক্তি-প্রভাবে অচিরেই তাঁর ভাগবৎ সাম্য লাভ হল।

অর্থাৎ তিনি সারূপ্য মুক্তি লাভ করলেন। হে অনঘ, দেবর্ষি নারদ কর্তৃক ব্যথিত এই পরোক্ষ আধ্যাত্মতত্ত্ব শ্রবণ এবং কীর্তন করলে লিঙ্গ দেহ থেকে বিমুক্তি সম্ভব।

হে বৎস, দেবর্ষি নারদের মুখ– নিঃসৃত এই আধ্যাত্ম –তত্ত্ব ভগবান মুকুন্দের সঙ্গে ত্রিভুবন পবিত্র করে। ইহা চিত্তশুদ্ধিকর এবং পরমাত্মাপ্রদ প্রাপক।

মহগণের কীর্তমান এই আখ্যান যিনি হৃদয়ে ধারণ করেন, তিনি সকল বন্ধন থেকে মুক্তিলাভ করেন। এই পুরঞ্জনের উপাখ্যান পরোক্ষভাবে বর্ণিত অদ্ভুত আধ্যায়তত্ত্ব। আমি শ্রীগুরুদেবের কৃপায় লাভ করেছিলাম। এর দ্বারা বুদ্ধিযুক্ত আত্মার অহংকার ছিন্ন হয়।

.

ত্রিংশ অধ্যায়
প্রাচীনবৰ্হির পুত্রগণকে বিষ্ণুর বরদান

বিদুর প্রশ্ন করলেন– হে ব্রাহ্মণ আপনি রাজা প্রাচীনবহির যে পুত্রদের কথা বললেন, তারা রুদ্রগীত দ্বারা ভগবান হরিকে তুষ্ট করে কিভাবে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন?

হে বৃহস্পতি শিষ্য মৈত্রেয় ঐ প্রচেতাগণ অযাচিত ভাবে কৈবল্যনাথ প্রিয় দেবাদিবের মহাদেবের দর্শনপ্রাপ্ত হয়ে ও অনুগ্রহভাজন হয়ে নিশ্চয়ই মোক্ষ লাভে সমর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু তার আগে ইহলোকে ও পরলোকে কি কি লাভ করেছিলেন?

মৈত্রেয় বললেন– নিজ প্রজা সৃষ্টির কামনায় প্রচেতাগণ সমুদ্রমধ্যে নিমজ্জিত হয়ে রুদ্রগীত জপ, যজ্ঞ ও তপস্যার দ্বার ভগবান শ্রীহরির তুষ্টি বিধান করেছিলেন।

দশ হাজার বছর পরে সনাতন পুরুষ ভগবান বিষ্ণু তাদের সামনে আবির্ভূত হলেন। ভগবান বিষ্ণুর অপরূপ কান্তি অবলোকন করা মাত্র তাদের তপঃক্লেশ নিমেষে দূরীভূত হয়ে গেল।

জলপূর্ণ কৃষ্ণমেঘ যেমন সুমেরু শৃঙ্গে আরোহণ করে, তেমনি তিনি গরুড়ের স্কন্ধে আরোহণ করেছিলেন। তাঁর পরিধানে পীতবসন গলদেশে কৌস্তুভমণি ছিল। তাঁর অঙ্গের দীপ্তিতে সকল দিক উদ্ভাসিত হয়েছিল।

উজ্জ্বল কণকময় ভূষণ দ্বারা কপোলদেশ ও বদন শোভিত হয়েছিল মস্তকে কিরীট ও এবং অষ্টভূজে আট প্রকার আয়ুধ সকল শোভিত ছিল। মুনি ও দেবগণ তার সেবায় নিয়োজিত ছিল। গড়র কিন্নরের ন্যায় পক্ষের দ্বারা তাঁর গুণকীর্তন করছিল। তার বক্ষোস্থলে লক্ষ্মীদেবী অবস্থান করছিলেন।

এইপ্রকার ঐশ্বর্যশালী আদিপুরুষ শ্রীহরি সদয় দৃষ্টিপাত করলেন। জলদ গম্ভীর শান্ত স্বরে তিনি শরণাগত প্রচেতাগণের উদ্দেশ্যে আশীর্বাণী উচ্চারণ করলেন। তারা কৃতাঞ্জলী হয়ে তাঁর বাণী শ্রবণ করতে লাগলেন।

ভগবান বললেন– হে রাজনন্দনেরা পরস্পরের প্রতি সৌহার্দ্য হেতু তোমরা একই ধর্মে অবস্থান করছ। তোমাদের সৌহার্দ্যে আমি পরিতুষ্ট হয়েছি। তোমাদের মঙ্গল হোক। আমার নিকট অভীষ্ট বর প্রার্থনা কর।

যে মানব সন্ধ্যায় তোমাদের স্মরণ করবে ভ্রাতৃগণের প্রতি তার আত্মতুল্য স্নেহ ও সকল প্রাণীর প্রতি সৌহার্দ্য হবে। যারা সমাহত হয়ে সকাল সন্ধ্যা রুদ্রগীতির দ্বারা আমার স্তব করবে তাদের অভীষ্ট লাভ হবে। আমি তাদের নির্মল প্রজ্ঞা প্রদান করব।

যেহেতু তোমরা হৃষ্টচিত্তে পিতার আদেশ পালন করেছ, সেজন্য সমস্ত লোকে তোমাদের কীর্তি পরিব্যাপ্ত হবে। তোমাদের ব্রহ্মার তুল্য এক গুণবান পুত্রের জন্ম হবে। তবে সন্তানগণের সাহায্য এই ত্রিভুবন পরিপূর্ণ হবে।

হে রাজপুত্রেরা ইন্দ্রপ্রেরিতা এক অপ্সরা প্রশ্লোচা, কুণ্ডু নামক ঋষির ঔরসে এক পদ্মলোচনা কন্যার জন্ম দিয়েছিলেন। তারপর তিনি সেই কন্যাকে ত্যাগ করে চলে যান। তখন বৃক্ষরাজি তাকে গ্রহণ করে। ঐ শিশুকন্যা যখন ক্ষুধায় কাতর হয়ে ক্রন্দন করছিল তখন বনস্পতি– অধিপতি চন্দ্র দয়াপরবশ হয়ে নিজ অমৃতবর্ষিনী অঙ্গুলী তর্জনী প্রদান করেছিলেন।

তোমাদের পিতা প্রাচীনবৰ্হি আমার অনুববৃত্তি করে তোমাদের প্রজা সন্তুষ্টি করতে আদেশ দিয়েছিলেন। সেই উদ্দেশ্য পালনের জন্য তোমরা অবিলম্বে প্রশ্লোচা কন্যার পাণিগ্রহণ করো। সকলেই তোমার সমধর্মা ও সমচরিত্র, অতএব ঐ কন্যাও তোমাদের সঙ্গে অভিন্ন ধর্ম ও চরিত্র আশ্রয় করে, তোমাদের প্রতি তুল্যরূপে অন্তঃকরণ স্থাপন করে তোমাদের পত্নী হবে। ধর্ম ও শীলের ঐক্য এবং আমার অনুমতির কারণে তোমাদের সকলের একপত্নী গ্রহণে কোনো দোষ হবে না।

আমার অনুগ্রহে তোমরা অপ্রতিহত বলশালী হয়ে দেবপরিমাণ হাজার বছর পার্থিব ও স্বর্গীয় ভোগ লাভ করবে। তারপরে আমার প্রতি তোমাদের অচলা ভক্তির উদয় হবে, তার সাহায্যে অন্তঃকরণে কামাদি মন দগ্ধ হবে। বৈরাগ্য জ্ঞান বলে এই নরকরূপ পার্থিব ও দিব্যভভাগে বিরক্ত হয়ে শেষে আমার ধামে আগমন করবে।

গৃহাস্থমে প্রবেশিত হলেই তোমাদের বন্ধন হবে, তাহলে ভক্তি ও নির্বেদ হবে না। এরূপ আশংকা অমূলক।

যাবতীয় কর্মফল আমাকে অর্পণ করে যারা কালযাপন করে, গৃহস্থাশ্রম তাদের পক্ষে বন্ধনের কারণ হয় না। আমার কথা শ্রবণ করলে, সর্বজ্ঞ আমি নব নব রূপে আবির্ভূত হয়ে থাকি। তাতে তাদের ব্রহ্মসাক্ষাৎ লাভ হয়।

মৈত্রেয় বললেন– প্রচেতাগণ শ্রী ভগবানের রূপ-দর্শনে তমোগুণ ও রজোগুণের মালিন্য থেকে মুক্তিলাভ করে ঐ প্রকার বাক্য প্রয়োগকারী ভগবান নারায়ণকে কৃতজ্ঞলীপুটে বিনীত বাক্যে স্তব করতে লাগলেন।

প্রচেতাগণ বললেন– হে ভগবান্ তুমি নিখিল ক্লেশ বিনাশক। তোমাকে নমস্কার করি। বেদ সকল তোমার উদার গুণ ও মহৎ নামকে পরম মঙ্গলজনক বলে মনে করেন।

তুমি মন ও বাক্যের অগোচর, ইন্দ্রিয়াদির পক্ষে তোমার গতিপথ অনুধাবন করা অসম্ভব।

হে ভগবান, তোমাকে প্রণাম। তুমি সদাই স্বরূপে অবস্থান কর। শুদ্ধ ও শান্তাভাবাপন্ন, তোমাকে নমস্কার জানাই। মন– নিমিত্ত বিস্ফুরিত এই প্রপঞ্চময় জগৎ তোমাতে ব্যর্থ হয়েছে।

তুমি জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের জন্য, নিজ মায়াবলে ব্রহ্মাদি মূর্তি ধারণ কর। তোমার চরণে আমরা প্রণিপাত জানাই।

হে বিশুদ্ধ সত্ত্ব, তোমাকে জানতে পারলে, এই সংসার থেকে মুক্তিলাভ করা সম্ভব, তোমাকে প্রণাম করি। তুমি বাসুদেব, তুমিই কৃষ্ণ, তুমি সকল ভক্তজনের পালক। তোমাকে নমস্কার জানাই।

হে প্রভু, তোমার নাভিদেশ থেকে উত্থিত হয়েছে পরমাশ্চর্য ব্রহ্মাণ্ডকল। গলদেশে কমলমাল্য শোভিত, চরণদ্বয় পদ্মকোমল।

হে পদ্মলোচন পদ্মনাভ, তোমাকে নমস্কার। হে পীতবসনধারী, তোমাকে প্রণাম জানাই।

তুমি সকল প্রাণীর নিবাসভূমি ও সর্বসাক্ষী, তোমাদের নমস্কার। তোমার এই রূপ হতে অশেষ ক্লেশের সংক্ষয় হয়, ক্লেশক্লিষ্ট আমাদের নিমিত্ত তুমি এই মূর্তি প্রকটিত করেছ, তাতেই আমাদের প্রতি তোমার দয়ার প্রকাশ ঘটেছে।

হে দুঃখ হরণ, দীন ব্যক্তিদের যদি সেবাকালে কিয়ৎক্ষণ নিজের বলে স্মরণ করেন, তাতেই যথেষ্ট অনুকম্পা প্রকাশ পায় কারণ ঐরূপ স্মরণ করলেই দীন ব্যক্তিগণের সুখলাভ হয়। তুমি ক্ষুদ্র– তুচ্ছ প্রাণীদের হৃদয়ে অন্তর্যামী– রূপে বিরাজমান।

হে প্রভু, আমরা তোমার সেবক। আমাদের প্রার্থিত মনোরথও তুমি অবশ্যই জান। তবু যদি বর প্রার্থনা করতেই হয়–

তোমার কাছে এটাই কামনা, আমাদের প্রতি প্রসন্ন হও, তুমি আমাদের একমাত্র আশ্রয়। তুমিই মোক্ষপ্রদর্শক গুরু! তবুও পরাৎপর তোমার নিকট একটি বর প্রার্থনা করছি। তোমার ঐশ্বর্যের অন্ত নেই, তাই তুমি অনন্ত বলে কীর্তিত।

অনায়াসে পারিজাত লাভ হলে ভ্রমর অন্য কোনও ফুলগাছের প্রতি ধাবিত হয় না। তেমনি আমরাও তোমার পাদমূল প্রাপ্ত হয়ে, অন্য কি প্রার্থনা করব?

যতকাল আমরা তোমার মাথায় মোহিত হয়ে কর্মানুসারে এই সংসার-পথে ভ্রমণ করব ততকাল যেন তোমার ভক্তগণের সান্নিধ্য লাভ করি। কারণ অতি অল্পসময় ভগবভক্ত সাধুসঙ্গের কাছে স্বর্গ বা মোক্ষও অতি তুচ্ছ।

সাধুসঙ্গে যে পবিত্র কথার আলাপচারিতা হয়, তার ফলে বিষয় তৃষ্ণা নিবৃত্ত হয়, সকল জীবের প্রতি সমদৃষ্টি হয়।

মুক্তসঙ্গ সাধুগণের দ্বারা ঐ স্থানে সৎকথার অবসরে সন্নাসীদের একমাত্র গতি সাক্ষাৎ ভগবান নারায়ণের কথা বারংবার কীর্তিত হয়।

হে প্রভু, তোমার ভক্তগণ দুষ্টজনের সংসর্গে অপবিত্র হয়ে যাওয়া তীর্থসমূহের পবিত্রসাধনের জন্য পদব্রজে তীর্থ ভ্রমণ করে থাকেন। তাদৃশ সাধুগণের সমাগম সংসার ভয়ে ভীত কোন্ ব্যক্তির রুচিকর না হবে?

হে ভগবন, সৎসঙ্গের ফল আমরাই অনুভব করছি। তোমার প্রিয়সখা ভগবান শঙ্করের সাথে ক্ষণকাল সঙ্গ হওয়ায়, আজ তোমাকে আমরা আশ্রয়রূপে পেয়েছি। আমরা উত্তমরূপে যে বেদ অধ্যয়ন করেছি, অনুবৃত্তি দ্বারা গুরু, বিপ্র ও বৃদ্ধদের প্রসন্ন করেছি। মান্যগণ সুখী ও ভ্রাতৃগণকে প্রণাম করেছি। অসূয়া পরিত্যাগ করে সন্তুষ্ট করেছি। নিরন্ন অবস্থায় বহু বৎসর জলমধ্যে নিমজ্জিত থেকে তপস্যার আচরণ করেছি।

এই সকল কর্ম, তোমার পরিতোষের জন্য গৃহীত হোক, এই প্রার্থনা করে; মনু, ব্রহ্মা, ভগবান মহাদেব, এবং অন্যান্য তপস্যা ও জ্ঞান দ্বারা বিশুদ্ধচেতা যোগীগণ তোমার অপার মহিমার সন্ধানার্থে স্বীয় শক্তি অনুযায়ী স্তব করে থাকেন।

অতএব, আমরাও যথাসাধ্য তোমার স্তব করলাম। তুমি সর্বত্র সমান এবং পরিশুদ্ধ পরম পুরুষ তোমাকে প্রণাম। হে ভগবান, তুমি সত্ত্বমূর্তি বাসুদেব, তোমাকে নমস্কার করি।

মৈত্রেয় বললেন– হে বিদুর, প্রাচীনবহির পুত্র প্রচেতাগণের স্তব শুনে শরণাগত বৎসল ভগবান প্রীত হলেন।

তিনি বললেন–তোমরা যা প্রার্থনা করলে, তাই হোক। এই বলে তিনি সেই মুহূর্তে প্রচেতাগণের চোখের সামনে অন্তর্হিত হলেন।

অনন্তর প্রচেতাগণ জলতল থেকে উত্থান করলেন। তারা দেখলেন, রাজ্যে চূড়ান্ত অরাজক অবস্থা। কৰ্ষণাদির অভাবে সমস্ত ভূমি বিধি বৃক্ষে আচ্ছাদিত। এসকল বৃক্ষ উন্নত হয়ে স্বর্গরোধ করতে উদ্যত হয়েছে।

অতএব বৃক্ষরাজির প্রতি তাদের অতিশয় ক্রোধের জন্ম হল। প্রলয়কালীন কালাগ্নির মতো অনল দ্বারা ভূ-তলকে বৃক্ষহীন করার মানসে রোষাভরে তাদের মুখ থেকে অগ্নি, মরুৎ নির্গত হতে লাগল। তাতে পৃথিবীর সমস্ত বৃক্ষ ভস্মসাৎ হতে লাগল।

পিতামহ ব্রহ্মা এই ঘটনায় স্থির থাকতে পারলেন না। তিনি সত্ত্বর সেখানে এসে যুক্তিযুক্ত বাক্যদ্বারা প্রচেতাদের ক্রোধ প্রশমিত করলেন।

আক্রান্ত সেই বৃক্ষরাজির মধ্যে যেসকল বৃক্ষ অবশিষ্ট ছিল তারা ভীত হয়ে পড়ল।

ব্রহ্মার উপদেশে তারা প্রচেতাগণকে কমুনিজাত প্রশ্লোচার গর্ভে উৎপন্ন কন্যাটিকে প্রচেতাদের হাতে সমর্পণ করল।

ব্রহ্মার আদেশে প্রচেতাগণ বৃক্ষপালিতা সান্ধি নাম্নী ঐ কন্যাকে বিবাহে সম্মত হল। দক্ষ, ব্রহ্মার পুত্র হলেও, পূর্বে মহাদেবকে অপমান করায়, ইহার গর্ভে তার জন্ম হয়েছিল।

চাক্ষুষ মন্বন্তরে কাল-প্রভাবে পূর্বদেহ বিনষ্ট হলে, যিনি ঈশ্বর কর্তৃক প্রেরিত হয়ে প্রজাসৃষ্টি করেন, তিনিই এই দক্ষ।

তার প্রভাবে সমস্ত তেজস্বীর তেজ আচ্ছন্ন হয়েছিল। তার কর্মানুষ্ঠান দক্ষতার কারণে জনগণ তাকে দক্ষ বলে অবহিত করেছিল। এই দক্ষই ব্রহ্মা কর্তৃক অভিষিক্ত হয়ে, প্রজাসৃষ্টি রক্ষার বিষয়ে নিযুক্ত হন। দক্ষ আবার পরবর্তীকালে মরীচি প্রভৃতি অন্যান্যদের প্রজাসৃষ্টি বিষয়ে নিযুক্ত করেন। সেজন্য তারা প্রমাপতরূপে পরিচিত হয়েছিলেন।

.

একত্রিংশ অধ্যায়
গৃহ হতে প্রব্রজিত প্রচেতাগণের নারদের উপদেশে মুক্তিলাভ

মৈত্রেয় বললেন–বৎস বিদুর, তারপর দেবপরিমাণ বহু সহস্র বছর অতীত হলে প্রচেতাগণের দিব্যজ্ঞানের উদয় হল। তারা তখন ভগবানের ধামে আমন্ত্রণের বাণী স্মরণ করে পুত্রের ওপরে পত্নীর ভার অর্পণ করলেন।

নিজেরা প্রব্রজ্যা গ্রহণ করলেন। তারপরে তারা পশ্চিমদিক দেশে সমুদ্র উপকূলে জাজ্বলি ঋষির সিদ্ধস্থানে উপনীত হয়ে সর্বান্তর্যামী ভগবানের পরমতত্ত্ব উপলব্ধির জন্য কৃতসংকল্প হয়ে সাধনে প্রবৃত্ত হলেন।

তারা সেখানে শান্ত মনে, ঋজুদেহে সিদ্ধাসনে উপবেশন করে প্রাণ, মন, বাক্য ও দৃষ্টি সংযম– পূর্বক জ্যোতিঃস্বরূপ পরব্রহ্মে চিত্ত সংস্থাপিত করলেন।

সেই অবস্থায় সুরাসুর বন্দিত দেবর্ষি নারদ তাদের দেখতে পেলেন। দেবর্ষি নারদ সেখানে উপস্থিত হলে, প্রচেতা আসন থেকে উত্থান করলেন। তারা নারদকে প্রণাম ও সাদরে সম্ভাষণ করলেন।

প্রচেতাগণের কাছ থেকে যথাবিধি পূজায় সন্তুষ্ট হয়ে নারদ সুখাসনে উপবিষ্ট হয়ে বলতে শুরু করলেন।

প্রচেতাগণ বললেন– হে দেবর্ষি, আপনার শুভাগমন হয়েছে তো? সৌভাগ্যবশতঃ আজ আমরা আপনার দর্শন লাভ করতে সমর্থ হয়েছি।

হে ব্রাহ্মণ, সূর্য যেমন অন্ধকার বিদূরিত করতে করতে ভ্রমণ করে, তেমনি আপনি লোকগণের ভয়ে অভয়ের জন্য তাদের অজ্ঞান– মোহ বিদূরিত করার উদ্দেশ্যে পর্যটন করে থাকেন।

হে প্রভো, ভগবান বিষ্ণু ও শিব আমাদের যে তত্ত্বজ্ঞান উপদেশ করেছিলেন, সংসার মোহে আসক্তচিত্ত আমরা তা প্রায় ভুলে গেছি। অতএব, ভগবৎ স্বরূপতত্ত্ব প্রকাশক জ্ঞান উপদেশের দ্বারা আমাদের উজ্জীবিত করুন, যাতে আমরা অনায়াসে দুস্তর ভবসাগর পার হতে পারি।

মৈত্রেয় বললেন–বিদুর, প্রচেতাগণ এইরূপ বললে, ভগবান নারদ ঋষি পরমপুরুষ ভগবান শ্রীহরিতে মন সমাহিত করে রাখলেন।

দেবর্ষি নারদ বললেন–হে রাজকুমারগণ, মনুষ্যগণের সেই জন্মকে সার্থক জন্ম, সেই কর্মকেই যথার্থ কর্ম বলে ধরা হয় যার দ্বারা সর্বনিয়ন্তা ভগবান অবধিত হয়ে থাকেন। এই জগতে মনুষ্যগণের ত্রিবিধ জন্মের দ্বারাই বা কি লাভ? উচ্চকুলে প্রথম জন্ম হয় মাতা-পিতা থেকে, দ্বিতীয় জন্ম হয় উপনয়ন সংস্কার দ্বারা, তৃতীয় জন্ম হয় ব্রাহ্মী দীক্ষার সাহায্যে।

বেদবিহিত কর্মকরণে এবং দেবতাদের ন্যায় দীর্ঘায়ুতেই বা কি ফললাভ হয়?

যদি না এই সমস্ত দ্বারা শ্রীহরি আরাধিত হন; বেদান্ত, শ্রবণ তপস্যা, বাক্-বিভূতি, ক্ষুরধার বুদ্ধি, শারীরিক বল, ইন্দ্রিয়পটুতা-এসবের কোনো প্রয়োজন নেই, যতক্ষণ না এগুলি ভগবৎ সাধনার সহায়ক হতে পারে।

অষ্টাঙ্গ যোগ, আত্ম-অনাত্মার বিবেক-জ্ঞান, সন্ন্যাস, ব্রহ্মার্থে, ব্রতপালন এবং অন্যান্য পুণ্যকর্মের বা কি ফল, যদি না এগুলি দ্বারা আত্মপদ শ্রীহরি আরাধিত হন?

সর্বমঙ্গলের মধ্যে পরমাত্মাই, শ্রেষ্ঠ মঙ্গলস্বরূপ। সমস্ত প্রাণীগণের আত্মাও শ্রীহরি। জীবের হৃদয়ে অধিষ্ঠানকারী এই আত্মাই সকলের প্রিয়।

বৃক্ষমূলে জল সিঞ্চন করলে তার শাখা-প্রশাখা সব পুষ্ট হয়। ভোজন করলে সমস্ত ইন্দ্রিয়ের তৃপ্তি ঘটিত হয়, তেমনি ভগবান অচ্যুতের অর্চনাতেই সকল দেবতার পুজো হয়ে থাকে।

জল বর্ষাকালে সূর্য থেকে উৎপন্ন হয়ে, গ্রীষ্মে আবার সেখানেই পুনঃপ্রবেশ করে। স্থাবর ও মঙ্গল ভূতাদি ভূমি থেকে উৎপন্ন হয়ে আবার ভূমিতেই বিলীন হয়।

সৃষ্টিকালে ত্রিগুণান্বিত চেতন এবং অচৈতনাত্মক প্রপঞ্চ, শ্রীহরি থেকে উৎপন্ন হয়ে, প্রলয়কালে তাতেই লয়প্রাপ্ত হয়। অতএব, ভগবানই সকলের মূল।

স্বরূপে সূর্যপ্রভার ন্যায় শ্রীহরি জগদাত্মক হয়েও ভিন্ন বলে বোধ হয়। জাগ্রত অবস্থায় যেমন ইন্দ্রিয়াদি সক্রিয় এবং সুষুপ্তি অবস্থায় নিষ্ক্রিয় থাকে। সৃষ্টিকালে জগত প্ৰকাশিত থাকে এবং প্রলয় কালে অপ্রকট হয়।

দ্রব্য, ক্রিয়া, জ্ঞান– এদের ভেদাত্মক ভ্রমের যেখানে বিলীন হয়, তিনিই ভগবান। অর্থাৎ দেহ– গেহপিতে, আমির আমিত্ব বোধ, কাম্য কর্মে পরম পুরুষার্থ বোধ, তর্কস্থলে নিজ সিদ্ধান্তকেই একমাত্র সত্যবোধ–এইরকম ভ্রান্ত ধারণার নিষ্পত্তি শুধুমাত্র শ্রীহরির আরাধনাতেই হওয়া সম্ভব।

হে রাজপুরুষগণ, আকাশে মেঘ, অন্ধকার, আলো, উৎপন্ন হয়ে আবার সেখানেই বিলীন হয়ে যায়। তেমনি পরব্রহ্ম থেকে রজঃ, তমঃ ও সত্ত্ব এই গুণত্রয়ের শক্তি সমূহও সৃষ্টি হয় আবার তাতেই লয়প্রাপ্ত হয়।

এই জগতের সৃষ্টি সংহারাদি প্রবাহের উৎপত্তি এবং লয়স্থানও তিনি, তিনিই সকল প্রাণীর আশ্রয়। তিনিই সকলের নিয়ন্ত্রণকর্তা, কলি, প্রকৃতি ও পুরুষরূপে তিনি বহুমধ্যে প্রকাশিত। তার মহিমায় জগতের সকল ভ্ৰম, সকল অন্ধকার দূরীভূত হয়। তোমরা সেই অনন্ত শ্রীহরির অর্চনা কর।

সর্বভূতে দয়া, যদৃচ্ছলাভে সন্তোষ, সকল ইন্দ্রিয়ের দমন– এইসব কর্মের দ্বারা ভগবান জনার্দন সহজেই সন্তুষ্ট হয়ে থাকেন।

চিদাকাশ যেমন কখনও হৃদয় অন্তর্হিত হয় না, তেমনি কামনাশূন্য সাধুগণের মন থেকেই ভগবান হরি কখনও অপসারণ করেন না।

পার্থিব ধনহীন হয়েও সশরা ভগবানকেই শ্রেষ্ঠ ধন মনে করেন সেই সকল সাধুব্যক্তিগণ শ্রীভগবানের অতি প্রিয়জন। তিনি ভক্তরসে সদাই তৃপ্ত থাকেন।

বিদ্যা, ধন, কুল এবং যজ্ঞাদি কর্ম অহংকারে মত্ত হয়ে যে সকল ব্যক্তি ভগবানের ভক্তদের প্রতি অসৎ আচরণ করে, তিনি তাদের পুজোও গ্রহণ করেন না।

শ্রীহরি স্বয়ং পূর্ণকাম, তার অনুবর্তিনী লক্ষীদেবী, ঐশ্বর্যপরায়ণ ব্যক্তি রাজন্যগণ এবং দেবতাদেরও বশ্যতা স্বীকার করেন না। তথাপি তিনি ভক্তদের অধীন। কৃতজ্ঞ ব্যক্তি কিভাবে এই হরিকে ত্যাগ করবেন?

মৈত্রেয় বললেন– বিদুর ব্রহ্মপুত্র নারদ এরূপ অমৃতকথা বিবৃত করে ব্রহ্মলোকে গমন করলেন। প্রচেতাগণ তাঁর মুখ-নিঃসৃত ভগবৎ কথা শ্রবণ করে তার পাদপদ্মের স্মরণ নিয়ে বিষ্ণুলোকে গমন। করলেন। হে বিদুর, তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে আমি প্রচেতাগণের কাছে নারদ কিভাবে শ্রীহরির গুপ্তকথা বর্ণনা করেছিলেন, তা শুনলাম।

শ্ৰী শুকদেব বললেন– হে পরীক্ষিৎ, স্বায়ম্ভুব মনুর পুত্র উত্তানপাদের বংশাবলী তোমাকে বললাম। এক্ষণে প্রিয়ব্রতের বংশাবলী বর্ণনা করছি, শ্রবণ কর :

প্রিয়ব্রত দেবর্ষি নারদের নিকট আত্মজ্ঞান অবগত হয়ে বেশ কিছুকাল রাজ-সুখ ভোগ করলেন। তারপর পুত্রগণকে রাজ্যসম্পদ ভাগ করে দিয়ে ভগবৎপদ লাভ করলেন।

হে মহারাজ, কুশারু-পুত্র মৈত্রেয় কর্তৃক বর্ণিত শ্রীবিষ্ণুর এই গুপ্তকথা শ্রবণ করে বিদুর ভাবাবেগে বিহ্বল হয়ে পড়লেন। তার দুচোখ দিয়ে অবিরাম অশ্রুপাত হতে লাগলো।

বিদুর মৈত্রের চরণে পতিত হয়ে তাঁকে প্রণাম করলেন। মনে মনে তিনি শ্রীহরির চরণকমলের ধ্যান করতে লাগলেন।

তারপর বিদুর বললেন– হে মহাযোগী, করুণাত্মা আপনি অনুগ্রহ করে আমাদের তমোগুণের পথ দর্শন করালেন, যেখানে অকিঞ্চন ভক্তদের একমাত্র গতি, ভগবান শ্রীহরি বর্তমান রয়েছেন।

শ্ৰী শুকদেব বললেন– হে মহারাজ, বিদুর এভাবে মৈত্রেয়মুনিকে সশ্রদ্ধ প্রণাম করে, জ্ঞাতিগণের দর্শন প্রত্যাশায় হস্তিনাপুরে গমন করলেন।

হে রাজন, ভগবান হরির চরণে সমর্পিতপ্রাণ প্রচেতাকে কাহিনী শ্রবণ ও কথনে আয়ু ধর্ম, ঐশ্বর্য, কল্যাণ ও সদগতি লাভ হয়।