ভাগবত পুরাণ – ০৩য় স্কন্ধ

ভাগবত পুরাণ – তৃতীয় স্কন্ধ
প্রথম অধ্যায়
বনবাসী বিদুরের সাথে উদ্ধবের কথোপকথন

মন্ত্রীশ্রেষ্ঠ বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন–মহারাজ সর্বৈশ্বর্য পরিপূর্ণ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যাদের নিজের আত্মীয় বলে গ্রহণ করেছেন, যিনি সর্বদা দেবতা ও ব্রাহ্মণগণ দ্বারা পরিবেষ্টিত, যিনি যদুবংশের প্রধান মহাবীর, সেই শ্রীকৃষ্ণে বিমুখ হয়ে আপনি এখনও মূর্তিমান দোষস্বরূপ আপনার পুত্রকে পোষণ করছেন–এ আপনার অপত্য নয়, পতনের কারণ। আপনি কৃষ্ণ বিমুখ হওয়ায় লক্ষ্মী আপনার গৃহ থেকে বিদায় নিয়েছেন। যদি কুলের মঙ্গল চান তাহলে এখনই দুর্যোধনকে পরিত্যাগ করুন।

একথা শুনে ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে দুর্যোধন বিদুরকে পুরী থেকে নির্বাসন করলেন। পুণ্য সঞ্চয়ের জন্য তিনি বিভিন্ন তীর্থক্ষেত্রে ভ্রমণ করতে করতে হরিতোষণ ব্রত পালন করেছিলেন। এইভাবে ঘুরতে ঘুরতে তিনি ভারতের প্রভাসতীর্থে এসে হাজির হলেন। সেখানে এসে শুনলেন, পরস্পর কলহের ফলে কুরু-পাণ্ডবের বিনাশ হয়েছে। শোকসন্তপ্ত হৃদয়ে যমুনার তীরে উপনীত হলেন বিন্দুর সেখানে পরম ভাগবত উদ্ধবের সঙ্গে দেখা হলো তার।

বাসুদেব অনুচর, বৃহস্পতির প্রসিদ্ধ পূর্ব শিষ্য উদ্ধবকে তিনি আলিঙ্গন করলেন। জানতে চাইলেন –বসুদেব কেমন আছেন? তার গৃহে অবস্থানরত শ্রীকৃষ্ণ এবং বলরাম কেমন আছেন? যদুকুলের সেনাপতি মহাবীর প্রদ্যুম্ন ভালো আছেন কিনা? শ্রীকৃষ্ণের অনুরূপ তনয় শাম্ব কুশলে আছেন তো? ভগবানের শরণাগত নিষ্পাপ, বিদ্বান, অক্রুর কুশলে আছেন তো? ভক্তদের কামপূরক ভগবান অনিরুদ্ধ কুশলে আছেন তো? ধার্মিক যুধিষ্ঠির, কৃষ্ণ ও অর্জুনের সাথে ধর্ম মেনে চলেছেন তো? বহুকাল সঞ্চিত ক্রোধ ভীম কি ত্যাগ করেছেন? গাণ্ডীবধারী অর্জুনের কুশল কেমন?

হে সৌম্য উদ্ধব, যিনি মৃত ভ্রাতা পাণ্ডুর পুত্রদের প্রতি দ্রোহ আচরণ করেছেন, যিনি দুর্জন দুর্যোধনাদির বশীভূত হয়ে জীবিত ভ্রাতা, সুহৃদ আমাকেও রাজ্য থেকে নির্বাসিত করেছেন, সেই অধোগামী ধৃতরাষ্ট্রের জন্য আমার অনুশোচনা হয়।

যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আপন ঐশ্বর্য গোপন করে মনুষ্য লীলার অনুকরণ করে মানবদের চিত্তে ভ্রম জন্মাচ্ছেন, আমি তার প্রসাদে তার মাহাত্ম–অনুসন্ধানে অন্যের অলক্ষিত ভাবে বিস্ময় ও দুঃখ পরিহার করে এই পৃথিবীতে সুখে ভ্রমণ করছি।

দ্বিতীয় অধ্যায়
শ্রীকৃষ্ণের বাল্য লীলা বর্ণনা

উদ্ধব বললেন– সমুদ্রের ভিতরে অবস্থিত মীনগণ যেমন চন্দ্রকে বুঝতে পারেননি, তারা যদুশ্রেষ্ঠ কৃষকে কেবল প্রাণীদের অন্তর্যামী রূপে মনে করত। ব্রজরমণীগণ হাতের কাজ ফেলে রেখে শ্রীকৃষ্ণের অনুরাগরঞ্জিত হাসি, পরিহাস, লীলা অবলোকন করে হয়ে যান। বসুদেব গৃহে করে জন্ম লীলা করেন যে কৃষ্ণ, তিনিই আবার কংসের ভয়ে ব্রজেই অবস্থান করেন। সেই সর্বশক্তিমান ভগবান আবার দেবকী ও বসদেবকে উদ্ধার করে পাদবন্দনা করেন।

যিনি ত্রিভুবনের অধিপতি, নিজের সম্পত্তি চিদানন্দ রূপ রাজ্যলক্ষ্মীর দ্বারা সমস্ত ভোগ লাভ করবেন এবং ইন্দ্রাদি অপ্রাকৃত লোকপালগণ অপ্রাকৃত পুজোপহার আহরণ করে তাদের মস্তকাস্থিত মুকুটের অগ্রভাগ দিয়ে পাদপীঠ স্তুতি করবেন, তিনিই সেই শ্রীকৃষ্ণ।

স্তনে কালকূট বিষ মাখিয়ে সেই বিষমিশ্রিত স্তন্য দান করে শিশু শ্রীকৃষ্ণকে হত্যা করতে উদ্যত দুষ্টা পুতনাকে বধ করে তার প্রতিও তিনি কৃপা বর্ষণ করেন। যমুনাতীরে বাঁশি বাজিয়ে গোপবালকদের সাথে তিনি ক্রীড়া করেন। মথুরাপতি কংস প্রেরিত মায়াবী বকরাক্ষসকে বিনাশ করেন। কালিয়দহের বিষজল পান করে মৃত্যু মুখে পতিত অসংখ্যা গোকুলবাসী গোপবালক ও গাভীদের সঞ্জীবিত করে পুনরায় জীবনদান করেন এবং সপাধিপ কালিয় নাগকে নির্বাসিত করেন। বামহস্তে অঙ্গুলির দ্বারা গোবর্ধন পবর্তকে খেলার ছাতার মতো ধারণ করে তিনি প্রবল বারিবর্ষণের হাত থেকে ব্রজবাসীদের রক্ষা করে।

.

তৃতীয় অধ্যায়
শ্রী কৃষ্ণের কংসবধাদি বর্ণনা

নরকাসুর নিজের শরীরের দ্বারা কৃষ্ণকে গ্রাস করতে গেলে যুদ্ধে শ্রীকৃষ্ণের চক্রে তার মৃত্যু হয়। তিনি নরকাসুরের গৃহে প্রবেশ করেন এবং নরকাসুরের মহিষীদের প্রত্যেকের গর্ভে আত্মতুল্য সর্বগুণযুক্ত দশ দশটি সন্তানের জন্ম দেন। কালয়বন, জরাসন্ধ, শান্থ প্রভৃতি রাজাগণ মথুরাপুরী আক্রমণ করলে শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং তাদের বধ করেন।

স্নিগ্ধ, স্মিত অবলোকন ও অমৃততুল্য বাক্য নির্মল চরিত্র এবং লক্ষ্মীর নিকেতন স্বরূপ। নিজ দেহের দ্বারা এ লোক, স্বর্গলোক ও যদুগণকে আনন্দ দিতে লাগলেন। গোকুল নিবাসী কামিনীদের রাতে অতিশয় সৌহার্দ্য প্রদর্শন করতেন। এইভাবে শ্রীকৃষ্ণ বহু বছর ক্রীড়ায় প্রবৃত্ত ছিলেন। পরে গৃহ, ধর্মে ও কামতভাগাদি সাধনে তাঁর বিরাগ উৎপন্ন হয়।

.

চতুর্থ অধ্যায়
মৈত্রেয়ের কাছে বিদুরের আগমন

ভগবান আত্ম মায়ায় অর্থাৎ নিজ সংকল্পরূপ গতি অবলোকন করে সরস্বতী নদীর জলে স্নান ও আচমনাদি সেরে, একটি কোমল অশ্বথ বৃক্ষে পৃষ্ঠদেশ রেখে বাম উরুর ওপর দক্ষিণ চরণ স্থাপন করে উপবেশন করেছিলেন। সেখানে তখন মহর্ষি বেদব্যাসের সুহৃদ এবং সখা পরাশরের শিষ্য মৈত্রেয় মুনি পৃথিবী পর্যটন করতে করতে এসে উপনীত হয়েছিলেন।

উদ্ধব সেই পরম পুরুষের কাছে অন্তরের অভিপ্রায় ব্যক্ত করলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজের পরমাস্থিতি বিষয়ে উপদেশ দান করেছিলেন। তিনি সেই রাতে যমুনার তীরে অতিবাহিত করে পরদিন প্রাতে বদরিকাশ্রমের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। সেখানে এসে বেদকর্তা ত্রিলোকের গুরু ভগবানের দ্বারা আদিষ্ট হয়ে একাগ্রচিত্তে শ্রীহরির আরাধনা করতে লাগলেন।

এরপর কিছুদিন পর্যন্ত সেখানে মৈত্রেয় মুনি অবস্থান করছিলেন। নির্মল চরিত্র বিদুর সেই ভাগীরথী তীরে এসে উপনীত হলেন।

.

পঞ্চম অধ্যায়
ভগবানের লীলাবর্ণনা

জীবের কল্যাণের আকাঙ্ক্ষী বিদুরের প্রশ্নের উত্তরে মৈত্রেয় মুনি বললেন–তুমি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রিয়জন। তিনি বৈকুণ্ঠে যাবার সময় আমাকে আদেশ করে গেছেন, তোমাকে জ্ঞানোপদেশ দেবার জন্য। বিশ্বের সৃষ্টি-স্থিতি-লয়–এগুলি স্বয়ং ভগবানের লীলার বিষয়ীভূত। সৃষ্টির পূর্বে এই বিশ্ব একমাত্র ভগবত-স্বরূপ ছিল। তিনি মায়াশক্তির দ্বারা এই পরিদৃশ্যমান পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। এরপর তিনি আত্ম-দেহস্থ বিশ্ব প্রকাশ করলেন। সাত্ত্বিক অহংকার বিকার প্রাপ্ত হলে তা থেকে মন উৎপন্ন হল। ইন্দ্রিয়াদির অধিষ্ঠাত্রী দেবতা হলে শব্দ-স্পর্শ-রূপ ও গন্ধ জন্ম নিল। রজস অহংকার বিকার প্রাপ্ত হয়ে জ্ঞানেন্দ্রিয় ও কর্মেন্দ্রিয়ের জন্ম দিল। তামস অহংকার বিকার প্রাপ্ত হয়ে যে শব্দ হল, তা থেকে আকাশের উৎপত্তি যা আত্মার লিঙ্গ অর্থাৎ শরীর। এরপর বায়ু তেজ ও জলের উৎপত্তি হল। আকাশের সাথে বায়ুর সম্বন্ধ থাকায় বায়ুতে স্পর্শ ও শব্দ দুটি গুণ আছে। তেজে আছে তিনটি গুণ — তাঁর নিজের গুণ গন্ধ এবং আকাশ, বাতাস, জল ও তেজ থেকে প্রাপ্ত শব্দ, স্পর্শ, রূপ ও রস আছে।

.

ষষ্ঠ অধ্যায়
বিরাট পুরুষের বিভূতি বর্ণনা

মহদাদি নিজ শক্তিদের পরস্পর অমিলিত হওয়ায়, তারা বিশ্ব রচনায় অসমর্থ জেনে পরমেশ্বর কালাক্ষ শক্তি অবলম্বন করে প্রকৃতির সাথে অন্তর্যামী রূপে বিরাট দেহ ধারণ করলেন এবং তাতেই এই চরাচর লোকসকল অবস্থান করছে। ঐ বিরাট মূর্তি জ্ঞান-শক্তি ক্রিয়া-শক্তি, ও আত্ম শক্তি বিশিষ্ট হয়ে এক, দশ ও তিনপ্রকারে বিভক্ত হল। এই বিরাট পুরুষই সমস্ত প্রাণীর আত্মা এবং তিনি পরমাত্মার অংশ অর্থাৎ জীব। এই বিরাট মূর্তি প্রকাশিত হয়ে দেবতাদের কতপ্রকার আয়তন ভিন্ন ভিন্ন রূপ হল।

ঐ বিরাট পুরুষের মুখ পৃথকরূপে নির্ভেদ হলে অগ্নি প্রভৃতি লোকপাল সকল নিজ নিজ শক্তির সাথে আপনাদের স্থানস্বরূপ ঐ মুখে প্রবিষ্ট হল। ঐ বাক শক্তির দ্বারা জীবগণ শব্দাদি উচ্চারণ করে থাকে। এই ভাবে ঐ বিরাট পুরুষের তালু, নাসিকা, চক্ষু, কর্ণ, হস্ত, পদ হতে গন্ধ, জ্ঞান, শব্দ, জ্ঞান, জীবনী গতিশক্তি জীব প্রাপ্ত হল। ঐ বিরাট পুরুষের মস্তক হল স্বর্গ, পদদ্বয় পৃথিবী এবং নাভি দেশ থেকে আকাশ উৎপন্ন হল। তার মুখ থেকে সৃষ্টি বেদ ও ব্রাহ্মণ কুল, তার বাহু হতে ক্ষত্রিয়, উরুদ্বয় হতে বৈশ্য এবং পাদদ্বয় হতে শূদ্র জাতির উদ্ভব হল।

কালক্রম ও স্বভাব সম্পন্ন তেজোময় ভগবানের বিরাট রূপের বর্ণনা কোনো ব্যক্তিই সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করতে পারে না। পুণ্যকীর্তি ভগবানের গুণকীর্তনই মানুষের বাগেন্দ্রিয়ের একান্তলাভ, না জেনেও ভগবানের পুণ্য কীর্তন বা শ্রবণ করলে অবশ্যই কৈবল্য লাভ হয়।

.

সপ্তম অধ্যায়
বিদুরের প্রশ্নে মৈত্রেয়র উত্তর দান

বিদুর মৈত্রেয় মুনির কাছে জানতে চাইলেন –নির্গুণ অধিকারী চিন্মাত্র ভগবানের লীলার দ্বারা কী করে গুণ ও ক্রিয়ার সম্বন্ধ হল? যিনি ব্রহ্ম স্বরূপ, যাঁর বোধশক্তি বিলুপ্ত হয় না, তিনি কী করে অবিদ্যাযুক্ত হন? জীবগণে সংসারই বা কি প্রকারে হতে পারে?

মৈত্রেয় মুনি বললেন– বিমুক্ত স্বরূপ পরমেশ্বরের অবিদ্যার বন্ধন ও কার্পণ্য সবই তর্কের বিরোধ। ভগবানের মাথা অর্থাৎ অচিন্ত্য শক্তি। তাঁর ইচ্ছা বিনা কিছুই ঘটে না।

বিদুর বললেন–হে মুনি, এই পৃথিবীর উপরে ও নীচে যে সকল লোক আছে, তা কী ভাবে সন্নিবেশিত এবং তাদের পরিমাণ কত? এই ব্রহ্মাণ্ডের আশ্রয়ের স্রষ্টা, ভগবানের উদার বিক্রমও বর্ণনা করুন। জীবের তত্ত্ব ও শিষ্যের প্রয়োজন কী? গুরু ও শিষ্যের প্রয়োজন কী? উপনিষদ সকলের স্থান সম্বন্ধেও জানতে আগ্রহী আমার মন।

.

অষ্টম অধ্যায়
ব্রহ্মার বিষ্ণু দর্শন

প্রলয়কালে জলনিমগ্ন চরাচরে ভগবান নারায়ণ সর্পশ্রেষ্ঠ অনন্তকে শয্যা করে নয়ন যুগল নিমীলিত রেখে শয়ন করেছিলেন। তখন তিনি ছিলেন ক্রিয়াশূন্য। প্রলয়কাল অবসান হলে তিনি আবার সৃষ্টি করার অভিলাষ করেন। কালানুসারে রজোগুণ দ্বারা ক্ষোভিত হয়ে তার নাভিদেশ থেকে পদ্মকোষের উৎপত্তি হল। গর্ভোদশায়ী বিষ্ণু তার মধ্যে প্রবেশ করলেন। তখন ঐ পদ্ম হতে বেদময় ব্রহ্মা উৎপন্ন হলেন। চোখ খুলেই তিনি চারদিকে ঘাড় ঘোরালেন। তার হল চারমুখ। আবির্ভাবের পরই তিনি চিন্তাচ্ছন্ন হলেন–আমি কে? কোথা থেকে এসেছি? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে তার শত পরমায়ু অতিক্রান্ত হল। তিনি হৃদয়ে তাঁকে স্বয়ং প্রকাশমান দেখলেন। সলিলে মৃণালের ন্যায় গৌরবর্ণ অথচ বিস্তীর্ণ অনন্তনাগের শরীর শয্যায় তিনি শয়ন করে আছেন। শেষনাগের ফণারূপ মস্তক সমূহ থেকে মণি কাঞ্চনের প্রভা ঐ জলরাশির অন্ধকার বিদূরিত করছে। ঐ পুরুষের অসীম লাবণ্য যা মরকত শিলাময় পবর্তকে লজ্জা দেয়। প্রচুর সুবর্ণ খচিত পর্বতের চূড়ার থেকেও সেই পুরুষের কিরীটস্থ রত্ন অধিক শোভা বিস্তীর্ণ করছিল। তার দেহ দৈর্ঘ্য ও বিস্তারে অপরিমেয়। তাঁর মধ্যে ত্রিভুবন নিহিত পর্বতাদির মতো দেখে ব্রহ্মা স্থির করলেন ইনিই ভগবান শ্রীহরি।

.

নবম অধ্যায়
ভগবানের স্তুতি

ব্রহ্মা বললেন–হে ভগবান, তোমায় কৃপায় আমি তোমাকে জানতে সক্ষম হয়েছি। তোমার নাভিপদ্ম নিকেতন থেকে আমার সৃষ্টি। আমি তোমার আনন্দময়, ভেদশূন্য ও প্রকটিত মূর্তির আশ্রয় গ্রহণ করলাম।

হে উরুক্রম, যাঁরা বেদরূপ বায়ুর দ্বারা নীত, তোমার চরণ কমলের কোষ গন্ধ কৰ্ণবিবরের দ্বারা গ্রহণ করেছে এবং শ্রেষ্ঠ ভক্তির দ্বারা পাদপদ্ম হৃদয়ে ধারণ করেছে, তাদের কখনও তুমি বিস্মৃত হয়ো না। লোভ জর্জরিত জীব সকল কাম-সুখ-লোভের কামনায় নিরন্তর নিষিদ্ধ কর্মগুলি করে থাকে।

তোমার ভক্তগণ তাদের ইচ্ছামতো তোমার যে যে রূপ মনে ধ্যান করে, তুমি কৃপা করে সেই সেই রূপেই প্রকটিত হও। তুমি ভুবনরূপ বৃক্ষ। তুমি নিজে এর মূল। সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয়ের জন্য সৃষ্টি করেছ। আমাকে অর্থাৎ ব্রহ্মা বিষ্ণু ও শিবকে। ঐ বৃক্ষ ত্রিপাদ হলেও প্রত্যেক পাদে মরীচি প্রভৃতি মুনি ও মনুগণ বহু শাখাপ্রশাখা রূপে অবস্থিত। জগৎ আকার বৃক্ষরূপ ভগবান তোমাকে প্রণাম নিবেদন করি।

.

দশম অধ্যায়
দশবিধ সৃষ্টি

আত্মস্বরূপ, ভগবানের প্রকাশ হতে যে গুণ সকলের মধ্যে দৃষ্ট হয়, তাকে মহৎ বলে, যা প্রথম সৃষ্টি। দ্বিতীয় সৃষ্টি — জ্ঞান ও ক্রিয়ার প্রকাশ হয় যাতে, সেই অহংকার। তৃতীয় সৃষ্টি — পৃথিব্যাদি, শব্দাদি, ভূত সূক্ষ্মের উদ্ভব। চতুর্থ সৃষ্টি — জ্ঞান ও কর্মের কারণে ইন্দ্রিয় বর্গের জন্ম। পঞ্চম সৃষ্টি –বৈকারিক অর্থাৎ ইন্দ্রিয়াধিত্বতা দেব সকল ও মনের সৃষ্টি। ষষ্ঠ — পঞ্চ বৃত্তিস্বরূপা অবিদ্যার সৃষ্টি। সপ্তম –স্থাবর সৃষ্টি। ছয় প্রকারাদি স্থাবর সৃষ্টি, বনস্পতি, ঔষধি, লতা বংশবিবুধ ও বৃক্ষ। অষ্টম –তির্যক যোনিদের সৃষ্টি। নবম –মনুষ্যদের সৃষ্টি এবং জীব ও দেব গণ দ্বারা সৃষ্ট।

.

একাদশ অধ্যায়
কালপরিমাণ নিরূপণ

সংবৎসর পাঁচ প্রকার –সংবৎসর, পরিবৎসর, ইড়াবৎসর, অণুবৎসর এবং বৎসর। বৃহস্পতির দ্বাদশরাশি ভোগকালে পরিবৎসর। তিরিশ সৌরদিনে, যে শ্রাবণ মাস হয় তার বারো মাসে ইড়াবৎসর, চন্দ্রের দ্বাদশ রাশি ভোগাত্মক কালের নাম অণুবৎসর এবং যক্ষ-সম্বন্ধীয় মাসের দ্বাদশ মাসে হয় বৎসর।

সন্ধ্যা ও সন্ধ্যাংশের মধ্যবর্তীকালকে যুগ বলে। সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি। সন্ধ্যা ও সন্ধ্যাংশের সাথে ঐ চারযুগের পরিমাণ –দিব্য পরিমাণে বারো হাজার বছর অর্থাৎ মানুষের পরিমাণে বিশ হাজার তেতাল্লিশ লক্ষ বর্ষে চতুর্যগ হয়।

ত্রিলোকের বাইরে মহলোক প্রভৃতি ব্রহ্মলোক পর্যন্ত স্থানে চতুর্যুগ সহস্র বৎসরে এক দিন হয়। রাতের পরিমাণও দিনের মতো অর্থাৎ মনুষ্য পরিমাণে ৬৪ কোটি অষ্টপদ্ম পরিমিত বৎসরে ব্রহ্মার এক অহোরাত্র হয়। চতুর্দশ মনু যতকাল ব্যপ্ত থাকে, সেই কাল পর্যন্ত ব্রহ্মার দিন। মনুষ্য পরিমাণে যা তিরিশ কোটি সাতষট্টি লক্ষ বিশহাজার বছর।

কাল দ্বারা সৃজৎ জীবগণের পরমায়ু পরিমাণ নির্দেশ করা হয়ে থাকে কিন্তু ভগবতত্ব কাল কৃত পরিচ্ছেদ শূণ্য। পরব্রহ্ম ভগবানের ওপর কাল কোনো প্রভুত্ব করতে পারে না।

.

দ্বাদশ অধ্যায়
ব্রহ্মার সৃষ্টি বর্ণনা

তমঃ, মোহ, মহামোহ, তমিস্র, অন্ধ, তামিস্র –এইসব পাপিয়সী নরকবাসিনী সৃষ্টি দেখে অসন্তুষ্ট ব্রহ্মা সনক, সনন্দ, সনাতন ও সনৎকুমার নামে মুনিদের সৃষ্টি করলেন এবং তাদের প্রজা সৃষ্টির আদেশ দিলেন। কুপিত ব্রহ্মার ভুযুগলের মধ্যবর্তী স্থান থেকে রুদ্রের আবির্ভাব হল। সেই রুদ্র হতে যেসব রুদ্র সৃষ্ট হলেন তারা দলবদ্ধ হয়ে জগৎ গ্রাস করতে উদ্যত হলেন।

শঙ্কিত চিত্ত ব্রহ্মা ভগবানের শক্তি যুক্ত হয়ে সৃষ্টি বিষয়ে চিন্তা করে মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরা, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু, ভৃগু, বশিষ্ঠ, দক্ষ এবং নারদ নামে দশ পুত্র উৎপন্ন করলেন।

ব্রহ্মার ক্রোড় থেকে নারদ, অঙ্গুষ্ঠ–দক্ষ, প্রাণ–বশিষ্ঠ, ত্বক — ভৃগু, হস্ত –ক্রতু, নাভি –পুলহ, কর্ণদ্বয় –পুলস্ত্য, মুখ –অঙ্গিরা, চক্ষু –অত্রি, মন — মরীচি, দক্ষিণ হস্ত –ধর্ম ও হস্তের পৃষ্ঠ ভাগ — অধর্ম, হৃদয় — কাম, ভ্রুকুটি –ক্রোধ, পায়ুর থেকে পাপ উৎপন্ন হল।

ব্রহ্মার চারমুখ থেকে চার বেদ আবির্ভূত হল। পূৰ্বাদি মুখ থেকে চারটি আশ্রম সৃষ্টি করলেন। নিত্যই প্রজাসৃষ্টির ব্যাপারে ব্যাপৃত থাকা সত্ত্বেও প্রজাগণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হচ্ছে না চিন্তা মগ্ন হলেন ব্রহ্মা। তিনি নিজেই দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে স্ত্রী ও পুরুষ হলেন। পুরুষ মূর্তি স্বায়ম্ভুব মনু এবং স্ত্রীর নাম শতরূপা। তারপর তাদের মিথুন ধর্মে প্রজাসকল বৃদ্ধি পেতে লাগল।

.

ত্রয়োদশ অধ্যায়
জলনিমগ্ন ধরিত্রী উদ্ধার

পৃথিবীতে জলাপ্লুত হয়ে রসাতলে তলিয়ে যেতে দেখে ব্রহ্মা চিন্তা করতে লাগলেন –উদ্ধারের উপায়। তিনি ভগবানের দ্বারস্থ হলেন। সে সময় তার নাসাবিবর থেকে আঙুলপরিমাণ এবং সুক্ষ্ম বরাহ নির্গত হল। ক্ষণকালের মধ্যেই তা বিরাট আকার ধারণ করল। সেই বরাহরূপী ভগবান পৃথিবীকে উদ্ধার কল্পে জলের তলে প্রবেশ করলেন। তার পুচ্ছ আকাশ স্পর্শ করল। তার শুভ্র দন্ত, অতিশয় কঠিন শরীর কর্কশ রোমে ত্বক আচ্ছাদিত। তিনি সমুদ্রের জলে লাফিয়ে পড়লে জলরাশির আর্তধ্বনি শোনা গেল। বাণ সদৃশ ক্ষুর দিয়ে অপার সমুদ্রের কুল প্রদর্শন পূর্বক বিস্তীর্ণ জলরাশি বিদীর্ণ করতে করতে রসাতলে গিয়ে পৃথিবীকে দেখতে পেলেন। প্রলয়কালে যখন ভগবান শয়ন করতে ইচ্ছা করেছিলেন, তখন সকল জীবের আধার ভূতা এই পৃথিবীকে নিজের জঠরে ধারণ করেছিলেন। তিনি অনায়াসে স্বীয় দন্ত দ্বারা ধরণীকে ধারণ করে, রসাতল থেকে উত্থিত হলেন। যখন বরাহমুর্তি ভগবান হস্তির ন্যায় লীলা করতে করতে শুভ্র দন্তের অগ্রভাগ দিয়ে ধরণীকে ধারণ করে উধ্বদিকে উত্তোলন করেছিলেন, তখন তার শরীর তমালের ন্যায় নীল বর্ণ হয়েছিল।

ব্রহ্মা প্রভৃতি দেবগণ ঋষিগণ, মনুগণ, ভগবানের স্বরূপ জানতে পেরে তার চরণ বন্দনা করলেন।

.

চতুর্দশ অধ্যায়
দিতির গর্ভোৎপত্তি

দক্ষের কন্যা দিতি একসময় সন্ধ্যাকালে কামতাড়িত হয়ে পুত্রকামনায় ঋষি মরীচির পুত্র নিজপতি কশ্যপের নিকট রতি প্রার্থনা করেন। কশ্যপ বললেন–তোমার অভিলাষ পূর্ণ করব, তবে সন্ধ্যাকাল উত্তীর্ণ পর্যন্ত অপেক্ষা করো। কিন্তু কামোন্মত্তা দিতি সময় দিতে চাইলেন না। কশ্যপ ভার্যার প্রার্থিত বিষয়ে একান্ত আগ্রহ জেনে নির্জন স্থানে তাঁকে নিয়ে চলে গেলেন। ভার্যার সাথে অবস্থান শেষ করে মুনি সমুদ্রে স্নান শেষ করে প্রাণায়াম করলেন। মৌনব্রত হয়ে সনাতন ব্রহ্ম জ্যোতি ধ্যান করে জপ করতে রত হলেন।

দিতি তার নিন্দিত কর্মের জন্য অত্যন্ত লজ্জিত হলেন। সন্ধ্যাকালীন নিয়মভঙ্গ হওয়ায় মহামুনি কশ্যপ অত্যন্ত রুষ্ট হয়েছিলেন। দিতি কম্পিত কণ্ঠে নিজ সন্তানের কল্যাণ কামনা করলে কাশ্যপ মুনি বললেন–তোমার উদরে অভদ্রস্বরূপ দুটি অধর্ম পুত্র জন্ম নেবে। তারা লোকপালনের সাথে তিনলোক বার বার পীড়িত করবে। ভগবান বিশ্বেশ্বর ক্রুদ্ধ হয়ে অবতার রূপে তাদের বিনাশ করবেন, তবে তোমার পৌত্র হবে শ্রীহরির।

.

পঞ্চদশ অধ্যায়
বিষ্ণু ভক্তদ্বয়ের কাছে বিপু-শাপাদির বর্ণনা

প্রজাপতি কশ্যপ দিতির গর্ভে যে বীর্য নিহিত করলেন, তা দিতি শত বৎসর গর্ভে ধারণ করেন। সেই গর্ভের তেজে সূর্যাদি, চন্দ্রাদি, লোকপালগণ নিস্তেজ হয়ে দিক সকল অন্ধকারাচ্ছন্ন হওয়ার কারণ জানতে চাইলেন।

ব্রহ্মা বললেন, এ আমার মানসপুত্র সনকাদি ঋষিগণ লোকমধ্যে বিগত স্পৃহ হয়ে সমস্ত লোক আকাশমার্গে বিচরণ কালে ভগবান বিষ্ণুর লোক বৈকুণ্ঠ ধামে গেলেন। সেখানে বসবাসকারী পুরুষগণ নিষ্কাম ধর্মে শ্রী হরির আরাধনা করে ভগবানের মূর্তির মতো মূর্তি লাভ করেছেন। সেখানে এসে মুনিগণ অতিশয় আনন্দ লাভ করলেন। তারা আত্মতত্ত্ববেত্তা ছিলেন। বৃদ্ধ হলেও তারা ছিলেন পাঁচ বৎসরের বালকের ন্যায় দেখতে। কিন্তু দ্বারপাল দুজন ছিলেন ভগবানের স্বভাবের প্রতিকূল। মুনিদের প্রভাবের অনাদর করে উপহাসপূর্বক বেত প্রহার ও বাজের দ্বারা পুরীতে প্রবেশ নিষেধ করলেন। উপস্থিত দেবগণ এ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করলেন।

মুনিগণ ঐ দ্বারপাল দুজনকে অভিশাপ দিলেন– তোমরা বৈকুণ্ঠলোক থেকে ভ্রষ্ট হয়ে পাপীয়সী যোনিতে গিয়ে জন্মগ্রহণ করো। যেখানে কাম, ক্রোধ ও লোভ আছে।

ব্রহ্মশাপ বুঝতে পেরে দ্বারপাল দুজন মুনিদের পায়ে আছড়ে পড়ে অভিশাপ খণ্ডনের উপায় জানতে চাইলেন।

মহতের প্রতি ভৃত্যদের অপরাধ জেনে ভগবান স্বয়ং লক্ষ্মীর সাথে যেখানে মুনিগণ অবরুদ্ধ ছিলেন, সেখানে এসে হাজির হলেন। ভগবানের বিবিধ সৌন্দর্য দেখে সনকাদি কুমার দুই বললেন– হে ভগবান এর আগে আমাদের কোনো পাপ ছিল না। কিন্তু তোমার অনুচর দ্বয়কে অভিশাপ দেওয়ায় যে পাপ করলাম তার ফলে আমাদের নরক তুল্য নীচ যোনিতে জন্ম হলেও আপত্তি নেই।

তোমার অলৌকিক রূপ দেখে আমাদের নয়ন গুলি অতিশয় পরিতৃপ্ত হল। হে পরশ্বৈর্য ভগবান, তোমাকে আমরা বারে বারে প্রণাম করছি।

.

ষোড়শ অধ্যায়
বৈকুণ্ঠলোক দ্বারপালদ্বয়ের বিতাড়ণ

ভগবান শ্রীহরি বললেন– জয় ও বিজয় নামে আমার দুই পার্ষদ তোমাদের প্রতি যে অপরাধ করেছে, তাতে আমাকেই অবজ্ঞা করা হয়েছে। তোমাদের অবজ্ঞা করা হয়েছে। তোমাদের অপমানের দ্বারা আমাকেই তিরস্কার করা হয়েছে, কারণ ব্রাহ্মণই হল আমার শ্রেষ্ঠ সুখ।

ভগবান ঐ দুই দ্বারপালকে বললেন– তোমারা অসুরযোনি প্রাপ্ত হও। ভয় করো না, তোমাদের মঙ্গল হবে।

ভগবানের এই দুই পার্ষদই এখন কশ্যপের বীর্যে দিতির গর্ভে প্রবেশ করেছে। এই দুই যমজ অসুরের তেজে সূর্য এবং দিক সকল অন্ধকারময় এবং ম্রিয়মান হয়ে উঠেছে।

.

সপ্তদশ অধ্যায়
গর্ভাবস্থা থেকে হিরণ্যাক্ষ ইত্যাদি যমজ

অসুরের জন্ম এবং হিরণ্যাক্ষের দিগ্বিজয়ে গমন। শত বৎসর পূর্ণ হলে কশ্যপ-ভার্য্যা দিতি দুটি যমজ সন্তান প্রসব করলেন। সন্তান দুটি ভূমিষ্ঠ হলে স্বর্গ, মত ও অন্তরীক্ষে নানা অমঙ্গল সূচক উৎপাত দর্শনে লোকের হৃদয়ে মহা ভয় উপস্থিত হল। কশ্যপ পুত্রদ্বয়ের নামকরণ করলেন হিরণ্যকশিপু জ্যেষ্ঠ এবং হিরণ্যাক্ষ তার অনুজ।

হিরণ্যকশিপু নিজ বাহুবলে উদ্ধত এবং ব্রহ্মার বরে অমর হয়ে লোকপালদের সাথে ত্রিলোক অধিকার করলেন। ভাই হিরণ্যাক্ষ ছিল দাদার প্রিয় সহচর। যুদ্ধ বাসনায় সে একদিন স্বর্গে গিয়ে উপস্থিত হল। সেখানে ইন্দ্রসহ দেবগণকে দেখতে না পেয়ে উন্মত্ত হয়ে বারবার গর্জন করতে লাগল। মহাবলশালী হস্তীর ন্যায় জলক্রীড়া করতে উৎসুক হয়ে গম্ভীর গর্জনকারী গভীর সমুদ্রকে বিলেড়িত করতে লাগল, পাতাল লোকের পালক ও জলজন্তুদের প্রধান বরুণদেবকে সে উপহাস করে যুদ্ধে আহ্বান জানাল।

নিজের ক্রোধ নিজ বুদ্ধির দ্বারা সংযত করে বরুণদেব বললেন– ওহে, অসুর শ্রেষ্ঠ অতই যদি যুদ্ধ করার বাসনা তাহলে যাও সেই পুরাতন পুরুষ ভগবানের কাছে। তিনিই তোমার রণবাসনা সন্তুষ্ট করতে পারেন।

.

অষ্টাদশ অধ্যায়
বরাহদেবের সাথে হিরণ্যাক্ষের যুদ্ধ

জলধিপতি বরুণের মুখে শ্রীহরির কথা শুনে এবং স্বয়ং ভগবান শ্রীহরির ক্ষমতা সম্পর্কে অজ্ঞ, দুর্দম অসুর হিরণ্যাক্ষ নারদের কাছ থেকে হরির স্থিতির কথা জেনে দ্রুত রসাতলে প্রবেশ করল। সেখানে সর্বজয়ী প্রকাণ্ড পর্বতাকার দণ্ডের অগ্রভাগ দিয়ে পৃথিবীকে উধ্বে তুলে ধরতেই ভগবান বরাহদেবকে দেখে সে উপহাস করতে লাগল। বরাহদেব তার ক্রুদ্ধ রক্তবর্ণ নেত্রদ্বয়ের দৃষ্টিতে প্রথমে ঐ দৈত্যের তেজ হরণ করলেন।

শুরু হল দুজনের মধ্যে যুদ্ধ। তারা পরস্পরের উপর আঘাত করতে লাগলেন। গদার আঘাতে দুজনেই ক্ষত বিক্ষত হলেন। ঋষিগণ পরিবৃত হয়ে সেখানে উপস্থিত হলেন ব্রহ্মা। ভগবানের দিক থেকে বিক্রমের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই দেখে ব্রহ্মা আদি বরাহ নারায়ণের বন্দনা করলেন। বললেন– অভিজিৎ নামে মঙ্গলময় যোগে ঐ অসুরের বিনাশ না করতে পারলে সমূহ বিপদ। দয়া করে ত্রিভুবনের মঙ্গল বিধান করুন ভগবান।

.

ঊনবিংশ অধ্যায়
আদি বরাহ কর্তৃক হিরণ্যাক্ষ বধ

দেবতারা যাকে অধম দৈত্য বলে বিবেচনা করে ভীত হয়েছিলেন, তিনি বস্তুত ভগবানেরই এক পার্ষদ।

ভগবানের তীক্ষ্ণধার চক্ৰ বারে বারে দৈত্যের মহাস্ত্র শূলকে ছিন্নভিন্ন করে দিল। দৈত্য যোগমায়ার নিয়ন্তা ভগবান হরির ওপর বহু প্রকার মায়া বিস্তার করল। ঐ আসুরি মায়া বিনাশের জন্য ভগবান আদি বরাহ নিজের সুদর্শনাস্ত্র প্রয়োগ করলেন। তারপর নিজের হাত দিয়ে তাঁর কর্ণমূলে আঘাত করলেন। প্রচণ্ড বায়ুবেগে বৃক্ষ যেমন সুমূলে ভূমিতে ধরাশায়ী হয়, তেমনই ভাবে দৈত্য হিরণ্যাক্ষ ভূতলে পড়ে গেল। তারপর সে ভগবান হরির চরণ দ্বারা আহত হয়ে তাঁর মুখমণ্ডল দর্শন করতে করতে দেহত্যাগ করল।

দেবতাগণ আনন্দে উল্লসিত হয়ে ভগবান হরির প্রশস্তি কীর্তন করলেন।

জগতের কারণরূপ বরাহরূপী ভগবানের কর্তৃক এই মহান অসুর হিরণ্যাক্ষ বধ কাহিনি যে শোনে, গান করে এবং অনুমোদন করে, সে অনায়াসে ব্রহ্মপদ লাভ করে।

.

বিংশ অধ্যায়
স্বায়ম্ভব মনুর বংশানুসরণ

লোকস্রষ্টা ব্রহ্মা ভাবময়ী তনু ত্যাগ করে নিজেকে কৃতকার্য মনে করলেন এবং মনের দ্বারা সর্বলোক পালক মনুদের সৃষ্টি করলেন। ব্রহ্মা নিজের সৃষ্ট পুরুষাকার শরীর তাদের সমর্পণ করলেন। যাঁরা আগে সৃষ্ট হয়েছিলেন, তাঁরা ঐ মনুদের দেখে ব্রহ্মার প্রশংসা করতে লাগলেন। বললেন–হে জগস্রষ্টা, আপনি উত্তম কাজ করেছেন। মনু সৃষ্টি হওয়ার ফলে অগ্নিহোত্রাদি সমস্ত কর্ম প্রতিষ্ঠিত হবে। আমরাও এদের সাথে একত্রে সেই যজ্ঞের হবিভাগদি ভক্ষণ করতে পারব।

তপস্যা, উপাসনা, যোগ, বৈরাগ্য এবং অনিমাদি ঐশ্বর্য যুক্ত সমাধি দ্বারা ইন্দ্রিয়গণকে বশীভূত করলেন। পরে বেদষ্টা ব্রহ্মা নিজের অভিমত ঋষিদের সৃষ্টি করলেন।

.

একবিংশ অধ্যায়
কর্দম ঋষির সাথে মনুকন্যা দেবহুতির বিবাহ সম্বন্ধ।

ব্রহ্মার আদেশে প্রজাসৃষ্টি কল্পে ঋষি কর্দম সরস্বতী নদীর তীরে দশ হাজার বছর ধরে তপস্যা করেছিলেন। তিনি ভক্তি সহকারে শরণাগতের বরদাতা ভগবান শ্রী হরির আরাধনা করতে লাগলেন।

ভগবান হরি প্রীত হয়ে বললেন– হে বিপ্র, ধনু রাজর্ষি মনু, মহিষী শতরূপার সাথে তাঁদের রূপ লাবণ্যবতী পরমা সুন্দরী কন্যার জন্য বিবাহ-সম্বন্ধ করতে আসবেন। তোমাকে তাঁর কন্যা সম্প্রদান করবে। ভার্যার জন্য তোমার হৃদয় বহুবৎসর ধরে সমাহিত হয়েছে। এবার সেই রাজকন্যা তোমার অভিপ্রায় পূরণ করবে। তোমার বীর্য ধারণ করে সেই কন্যা নয়টি কন্যার জন্ম দেবে। মরীচি প্রভৃতি ঋষিগণ সেই কন্যাদের গর্ভে পুত্ৰাধান করবেন।

উপদেশ দান করে ভগবান অন্তর্হিত হলেন। বিন্দু সরোবরের তীরে নিজ আশ্রমে ঋষি কর্ম অবস্থান করতে লাগলেন। এই সময় স্বায়ম্ভুব মনু, ভার্য্যা ও নিজ কন্যার সহিত আকাশযানে পৃথিবী পর্যটন করতে করতে ভগবানের নির্দিষ্ট দিনে কর্দম মুনির আশ্রমে এলেন এবং তাঁর আতিথ্য গ্রহণ করলেন।

মহর্ষি কর্দম আদিরাজ মনুর জ্ঞান ও কর্মের উৎকর্ষ দেখে তাঁর প্রশংসা করলেন। সম্রাট মনু নিজের প্রশংসায় লজ্জিত হলেন। তারপর আগমনের হেতু জানিয়ে কন্যা দেবহূতিকে দেখিয়ে বললেন–আমার কন্যা অতীব গুণসম্পন্না। দেবর্ষি নারদের কাছে আপনার কুল, শীল, বিদ্যা ও রূপের প্রশংসা শুনে আপনাকে স্বামীত্বে বরণ করতে অভিলাষী। অতএব আমি শ্রদ্ধা সহকারে উপহার স্বরূপ এই কন্যা আপনাকে সম্প্রদান করতে চাই।

মুনি কদম বললেন– আমি এ বিবাহে রাজি। তবে যতকাল এই কন্যার সন্তানোৎপত্তি না হয় ততকাল আমি গার্হস্থ পালন করব। তারপর ভগবানের আদেশে আমি সন্ন্যাস ধর্ম পালন করতে চলে যাব।

অবশেষে রাজা মনু হৃষ্টমনে বহুগুণশালী সেই কদম ঋষিকে অনুরূপ গুণসম্পন্ন কন্যা সম্প্রদান করে চোখের জল ফেলতে ফেলতে ফিরে গেলেন মহিষ্মতী নামক পুরীতে। সেখানে স্ত্রী-পুত্রদের নিয়ে ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষের সংযুক্তিতে বিবিধ বিষয় ভোগ করতে লাগলেন।

.

দ্বাবিংশ অধ্যায়

?

.

ত্রয়োবিংশ অধ্যায়
আকাশযোগে কর্দম ও দেবাহুতির রতিক্রীড়া

পতির অভিপ্রায় জেনে সাধ্বী দেবাহুতি ভবানীর ন্যায় ঋষি কর্দমের সেবা করতে লাগলেন। তিনি দেব অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ পতির কাছে পরামার্শীবাদ লাভের আকাঙ্ক্ষা করেছিলেন। ব্রতাচরণে তিনি ক্ষীণ হয়েছিলেন। তিনি স্বামীর কাছে পুত্রকামনা করলেন।

পত্নীর প্রার্থনা পূরণ করতে ঋষি কর্ম প্রিয়াকে নিয়ে দিব্য বিমানে উঠে বসলেন। তার আগে ঋষিপত্নী দেবাহুতিকে সরস্বতীর নির্মল জলে স্নান করে আসতে বললেন। জলে প্রবেশ করেই দেবাহুতি আশ্চর্য হলেন। দশশত তরুণ সুন্দরী কন্যা তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে। তার দেবাহূতিকে স্নান করিয়ে নির্মল শুদ্ধ বস্ত্র পরিয়ে সালংকারা সাজে সাজিয়ে দিল।

দেবাহুতি নিজের প্রিয় পতিকে স্মরণ করলেন। দেখলেন– ঋষিশ্রেষ্ঠ কর্ম সহস্র কন্যা পরিবৃত হয়ে উপস্থিত রয়েছেন সেখানেই।

প্রেয়সীর রূপ দেখে মুনিবর হৃষ্টচিত্তে ভার্যার হাত ধরলেন। তারপর স্ত্রীগণ পরিবৃত হয়ে রমণ ক্রীড়া করলেন। দেবাহুতিও সেই বিমানে রতির উৎকৃষ্ট শয্যায় রমণরতা থাকতে থাকতে বহুকাল অতীত হলেও জানতে পারলেন না।

ঋষি কর্দম পত্নীকে গ্রহণ যোগ্যা চিন্তা করে নিজেকে নয় প্রকারে বিভক্ত করে পত্নী গর্ভে বীর্যদান করলেন। কারণ দেবাহুতির বহুসন্তানের বাসনা জেগেছিল। তারপর ঋষি কর্দম প্রবজ্যা আশ্রমে যেতে উদ্যত হলেন।

ঋষি সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাস ধর্ম নিয়ে অন্যত্র চলে যাবেন– এই ভাবনায় দেবাহুতি অন্তরে ব্যাকুল হলেন। কন্যাদের বিবাহ হলে তিনি একাকী হয়ে পড়বেন। নিঃসঙ্গতা অনুভব করবেন। তিনি তাই স্বামীর কাছে প্রার্থনা করলেন, তাঁর এই নিঃসঙ্গতা দূরীভূত করতে।

.

চতুর্বিংশ অধ্যায়
দেবাহুতির গর্ভে কপিলদেবের জন্ম

ভগবানের বাক্য স্মরণ করতে মুনিবর কর্দম বললেন– অমর অর্থাৎ বিনাশাদি শূন্য ভগবান অতি শীঘ্রই তোমার গর্ভে প্রবেশ করবেন। তোমার দ্বারা আরাধিত হয়ে সেই পরমবিশুদ্ধ ভগবান তোমার পুত্ররূপে আবির্ভূত হবেন এবং তোমার হৃদয়ের বন্ধন ছিন্ন করবেন।

মুনিবর কদম তার কন্যাদের ঋষিগণের হাতে সম্প্রদান করলেন। মরীচি-কলা, অত্রি-অনসূয়া, অণিরো-শ্রদ্ধা, পুলস্ত্য-হর্বিভূ, পুলহ-গতি, ক্রতু-ক্রিয়া, ভৃগু-খ্যাতি, বশিষ্ঠ-অরুন্ধতী সমর্পিত হল।

প্রজাপতি কর্দম দেবশ্রেষ্ঠ বিষ্ণুকে নিজগৃহে অবতীর্ণ জেনে তাঁর অনুজ্ঞাত হয়ে তাঁকে প্রদক্ষিণ করতে বলে প্রজ্যা গমন করলেন।

তত্ত্ব সকলের সংখ্যা কর্তা অর্থাৎ সাংখ্য শাস্ত্র-প্রবর্তক ভগবান কপিল দেবহূতির গর্ভে জন্মগ্রহণ করলেন।

.

পঞ্চবিংশ অধ্যায়
মায়ের সামনে ভগবানের উৎকৃষ্ট ভক্তির লক্ষন বর্ণনা

একদিন দেবাহুতি পুত্রের নিকট গিয়ে বললেন– হে পুত্র, আমি অসৎ বাসনা পূরণ করতে অন্ধতম অজ্ঞান অন্ধকারে পতিত হয়েছিলাম। কিন্তু আজ ভগবানের কৃপায় তোমাকে লাভ করেছি। যে ভক্তির দ্বারা তোমার নির্বাণ অর্থাৎ মোক্ষাত্মক পদ প্রাপ্ত হতে পারি, সেই ভক্তিতত্ত্ব আমাকে বলল।

ভগবান কপিলদেব দেবাহুতির ঐ ধরনের সংখ্যা শ্রবণাত্মক অভিপ্রায় জেনে তাকে বললেন–মা, আমিই ভগবান। আমি প্রকৃতি ও পুরুষের দ্বারা উৎপন্ন। আমি সকল প্রাণীর আত্মা, আমি ছাড়া অন্য কারো দ্বারা সংসার ভয় নিবৃত্ত হয় না। আমার ভয়ে বায়ু প্রবাহিত হয়, সূর্য তাপ দেয়, ইন্দ্র বারিবর্ষণ করে, অগ্নি দগ্ধ করে, মৃত্যু প্রাণীর প্রতি ধাবিত হয়। সকলেই নিজ নিজ কাজে সাবধান থাকে। যোগীগণ জ্ঞান বৈরাগ্যমূলক ভক্তি যোগ দ্বারা নিজ নিজ মঙ্গলের জন্য আমার অভয় পদ পাদমূলের সেবা করে যাবেন। দৃঢ় ভক্তিযোগের দ্বারা আমাতে মন অর্পিত হয়ে যদি সুস্থির হয়, তবে তাই জীবগণের পরম পুরুষার্থ।

.

ষড়বিংশ অধ্যায়
সাংখ্যযোগ কথা

মহদাদি সপ্ত পদার্থ পরস্পর মিলিত না হয়ে অবস্থান করলে জগতের আদি ভগবান কাল, কর্ম ও সত্ত্বাদি গুণযুক্ত হয়ে ঐ সপ্ত পদার্থের মধ্যে প্রবেশ করলেন। তার মধ্যে ঐ সকল পদার্থ একাকার হয়ে পরস্পর মিলিত হল। সেই সকল হতে একটি অচেতন অণ্ড উৎপন্ন হল এবং তা ক্রমশ এক বিরাট পুরুষে রূপান্তরিত হল। দেবতারা আবির্ভূত হয়েও ঐ বিরাট পুরুষকে উত্থিত করতে পারলেন না। সমুদ্র ক্ষুধা ও তৃষ্ণার দ্বারা উদর আশ্রয়ে করল। কিন্তু সেই বিরাট পুরুষ উঠলেন না। ব্রহ্মা বুদ্ধির দ্বারা হৃদয়ে প্রবেশ করলেও তিনি উঠলেন না।

অভিমান ভরে রুদ্র সেই হৃদয়ে প্রবেশ করলেও তিনি উঠলেন না। অবশেষে ক্ষেত্রজ্ঞ চিত্ত দ্বারা হৃদয়ে প্রবেশ করার পর সেই বিরাট পুরুষ সলিল হতে উত্থিত হলেন। প্রাণ ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধি এরা যেমন চিত্তাধিষ্ঠাতা পরমেশ্বর বাদে প্রসুপ্ত পুরুষকে জাগরিত করতে সমর্থ হয় না, তেমনই দেবতারা ক্ষেত্রজ্ঞ চিত্ত বাদে সেই বিরাট পুরুষকে ওঠাতে পারলেন না। অতএব যোগযুক্ত বুদ্ধি ভক্তি। বৈরাগ্য ও জ্ঞানের দ্বারা এই জীবাত্মাতে সেই পরমেশ্বরের বিবেচনা পূর্বক চিন্তা করা উচিত।

.

সপ্তবিংশ অধ্যায়
পুরুষ ও প্রকৃতির দ্বারা মোক্ষলাভ বর্ণনা

পুরুষ ও প্রকৃতির মধ্যে আশ্রয়-আশ্রিত ভাবে নিত্য সংযোগ রয়েছে। তবে কী প্রকারে প্রকৃতি মুক্তি পেতে পারে। কী ভাবে পুরুষ মুক্তি পেতে পারে? ভগবান কপিলদেব বললেন–নিষ্কাম কর্ম, নির্মল মন আমার কথা শ্রবণের দ্বারা পরিপুষ্ট মদ্বিষয়ক তীব্র ভক্তি যোগ, তত্ত্বজ্ঞান প্রবল বৈরাগ্য এবং তীব্র আত্মসমাধির দ্বারা প্রকৃতি অহর্নিশ করবার আত্তিভূয়মান হয়ে পুরুষের নিকট হতে তিরোহিত হতে পারে।

তখন প্রকৃতির ভোগ মুক্ত হয়েছে, এরূপ মনে করে পুরুষ সকল সময় তার দোষের প্রতি লক্ষ্য করতে থাকেন। এইভাবে প্রকৃতি পরিত্যক্ত হওয়ায়, নিজ মহিমায় অবস্থিত পুরুষের আর অশুভ জন্মাতে সমর্থ হয় না। পুরুষ যখন তত্তজ্ঞ হয়ে আমার প্রতি মনসংযোগ করে আত্মারাম হন, তখন আর প্রকৃতি তার অপকার করতে পারে না। এই ভাবে বহু জন্মে আমার প্রসাদে আত্মতত্ত্বে অভিজ্ঞ পুরুষ কৈবল্যধামের আশাতেই আশ্রয় পায়।

.

অষ্টবিংশ অধ্যায়
সাংখ্যযোগের বিবরণ কথন

যে বিধির দ্বারা মন বিশুদ্ধ হয়ে সৎপথে অর্থাৎ সৎ-স্বরূপ ভগবানের পথে গমন করে স্থির হয়ে থাকে, তাই হল স্বাবলম্বন যোগ। হিতাসন হয়ে পবিত্র স্থানে উপবেশন করে প্রাণসংযমের জ্ঞান করতে হয়। চিত্তকে শুদ্ধি করবে। তারপর সর্বান্তযামী ভগবানের মূর্তি কল্পনা করে ধ্যান করবে। এইভাবে ধ্যান করার ফলে ভগবান হরির প্রতি যোগীর প্রেম জন্মায় এবং ভক্তিবশত হৃদয় বিগলিত হতে থাকে।

অঙ্গ পুলকিত হয়ে ওঠে। চিত্ত নির্বিষয় হলে আশ্রয় হীন হয়। তার মন তেমন যোগাভ্যাস জনিত অবিদ্যা বর্জিত চরম নিবৃত্তির দ্বারা সুখ-দুঃখাতীত ব্রহ্মরূপ মহিমায় নিষ্ঠালাভ করে। যোগী সর্বভূতে আত্মাকে এবং আত্মাতে সকল ভূতকে অনন্যভাবে দেখে থাকেন। যোগী ব্যাক্তি আত্মপ্রাসাদ দ্বারা জীবের বন্ধকরণ ও বিষ্ণুর শক্তিরূপ সদসদাত্মিকা ঐ দুবিভাজ্য প্রকৃতিতে জয় করে ব্রহ্ম স্বরূপে অবস্থিত হন।

.

ঊনত্রিংশ অধ্যায়
বহুপ্রকার ভক্তিযোগ ও ঘোরর সংসার বর্ণনা

বিশেষ বিশেষ মার্গ দ্বারা ভক্তি যোগের প্রকার। স্বাভাবিক বৃত্তিভেদে পুরুষের ভক্তির ভেদ হয় যেমন–তামস, রাজস ও সাত্ত্বিক। যাঁরা আমার সেবা ব্যতীত কিছুই গ্রহণ করতে চান না। এই প্রকারের ভক্তি যোগ হল তাত্যেন্তিক। এর থেকে পরম পুরুষার্থ আর কিছু নেই। আমার প্রতিমাদির দর্শন, স্পর্শন, পূজা, স্তব, বন্দনা সবই শাস্ত্রবিধি অনুসারে করতে হবে।

সত্যের সঙ্গ নেবে অহংকার দূর করবে। সকল প্রাণীতে আমি বর্তমান। আমি সকলের আত্মা ও ঈশ্বর। যে ব্যক্তি মূর্খত বশতঃ আমাকে পরিত্যাগ করে প্রতিমা পূজা করে তার সবকিছু নিরর্থক হয়। অতএব পুরুষের কর্তব্য, আমাকে সর্বভূতের অন্তর্যামী এবং সকল প্রাণীতে অবস্থিত জেনে দান মান ও সকলের সাথে মিত্রতা ও সমদৃষ্টির দ্বারা সকলকে অর্চনা করা।

সর্বত্যাগী জ্ঞানী পুরুষ সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হলেও ধর্মের ও ফলোভের কোনো আকাঙ্ক্ষা তার থাকে না। যে ব্যক্তি যেমন, কর্ম, সেই কর্মের ফল ও দেহ আমাকে সমর্পণ করে যাবেন। তাই সে আমার সঙ্গে সর্বদা যুক্ত বলে সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।

এই বিশ্ব চরাচর যাঁদের বশে রয়েছে সেই গুণাভিমানী ব্রহ্মাদি দেবগণ যাঁর ভয়ে এই বিশ্বের সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয় কাজ প্রতি কল্পে বারবার প্রবর্তিত হচ্ছেন। সেই কাল পিত্রাদির দ্বারা পুত্ৰাদি উৎপন্ন করে থাকেন। তিনি মৃত্যুর দ্বারা যমকেও বিনাশ করে যাবেন। তিনি সকলের অধিকর্তা। অনন্ত, অনাদি ও অব্যয়।

.

ত্রিংশ অধ্যায়
অধার্মিকদের তামসীগতি বর্ণনা

যে ব্যক্তি সৎসঙ্গরহিত এবং বৃদ্ধসেবায় পরাভুখ, কেবল সংসার, আত্মীয় পরিজনের প্রতি আসক্ত। ভগবান শ্রীহরির আরাধনা করে না, সে তামসী গতি লাভ করে। তারা গুরুতর হিংসার বশবর্তী হয়। সংসার প্রতিপালনের জন্য নানা স্থান থেকে অর্থ সংগ্রহ করে। পরের ধনে স্পৃহা জাগে। পুত্রকন্যাদির ভরণ পোষণ ইত্যাদি দুশ্চিন্তায় তার সর্বাঙ্গ দগ্ধ হয়। এবং সে বৃদ্ধ হলে সংসার প্রতিপালন করার ক্ষমতাও হারায়।

সংসারের কেউ তখন তাকে আগের মতো আদর করে না, কিন্তু তাতেও তার নির্বেদ হয় না। গৃহে অবস্থান কালে জরার দ্বারা আক্রান্ত হয়ে এক সময় তার মৃত্যু হয়। যমদূতরা এসে প্রহার করতে করতে তাকে নিয়ে যায়। ক্ষুধা, তৃষ্ণায় সে কাতর হয়। মূৰ্ছা যায় ঘন ঘন। যমালয়ে আনা হলে মাংসাশী প্রাণীরা তার দেহের মাংস খুবলে খায়।

নরক যন্ত্রণা ভোগ করে। কোথাও পর্বত হতে ফেলে দেওয়া হয়। কোথাও হাতির পায়ের তলায় ফেলে দলিত করা হয়। কখনও পরিপূর্ণ জলে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। এইভাবে সে নরক যন্ত্রণা ভোগ করে। কিন্তু যাদের জন্য সে পাপাঁচরণ করে তাদের নরক স্পর্শ করতে পারে না। কর্মফল ভোগ হলে পাপ ক্ষীণ হবে। তখন সে আবার জন্ম নেয়।

.

একত্রিংশ অধ্যায়
নরকযোনি প্রাপ্তিরূপ জাতির বর্ণনা

মাতৃগর্ভস্থ জীব পরমেশ্বরের স্তব করতে থাকে। সে বহির্গত হতে চায় না। কারণ বাইরে মাতৃজঠরের চেয়েও অন্ধকূপ রয়েছে। তখন প্রসবের মূল কারণ ভূতবায়ু তাকে অধোমুখে প্রসবের জন্য প্রেরণ করে, অতিকষ্টে নির্গত হয়। এই সময় তার নিঃশ্বাস প্রশ্বাস রুদ্ধ থাকে। ভূমিতে পড়ে রক্তাক্ত দেহে কৃমির মতো অঙ্গ সঞ্চালন করতে থাকে। জীব পাঁচ বছর কাল পর্যন্ত শৈশব দুঃখ ভোগ করে।

তারপর হয় অধ্যায় গতি দুঃখ। যৌবনকালে পদার্পণ করে অভীপ্সিত অর্থ লাভ না করায় তার মনে জন্ম নেয় অভিমান, ক্রোধ, শোক। কর্মে আবদ্ধ হয়ে সে সংসারী হয়। সৎপথে থেকেও যদি কোনো অসৎপুরুষের সংসর্গ করে তাহলে আবার নরকে প্রবেশ করতে হয়। আবার অসাধু লোকের সঙ্গ অপেক্ষা যোষিঙসঙ্গ এবং যোষিসঙ্গীর সঙ্গ অতীব অনিষ্টকর। জীবের উপাধি স্বরূপ একটি লিঙ্গদেহ আছে। সেই দেহের সাথে জীব একলোক হতে অন্য লোকে গমন করে এবং ফলভোগ করে নিরন্তর কর্মসমূহ তারপর অভিমান, তাহলে আসঙ্গ অত

.

দ্বাত্রিংশ অধ্যায়
ঊর্ধ্বগতি ও পুনরাবৃত্তি বর্ণনা

অনন্তশায়ী শয্যায় শায়িত হরি সর্পশয্যায় শয়ন করলে গৃহ যোগিদের সমস্ত লোকই লয়প্রাপ্ত হয়ে যায়। সে সকল পুরুষ পরমেশ্বর বুদ্ধিতে হিরণ্যগর্ভের উপাসনা করে। তারাও ক্রমে ক্রমে তৎ প্রাপ্তি হয়। সেই সঙ্গে পরমানন্দ স্বরূপ সর্বোৎকৃষ্ট পুরাণ পুরুষ ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হন। ভগবান সর্ব প্রাণীর হৃদয়ে বাস করেন। তাই ভক্তি ভাবে তারই আশ্রয় গ্রহণ করা উচিত। সকলের অন্তর্যামী ভগবান বাসুদেব ভক্তি যোগ নিরন্তর অনুষ্ঠিত হলে শীঘ্রই বৈরাগ্য ও ব্রহ্মা-সাক্ষাৎকারক জ্ঞান উৎপন্ন হয়।

যে ব্যক্তির মন সমাহিত এবং যিনি সঙ্গরহিত ও সংসারে বিরক্ত। তিনি শ্রদ্ধা, ভক্তি এবং যোগ্যভ্যাস দ্বারা নিত্য ব্রহ্মাকে দেখতে পান, তাঁর ঐ প্রপঞ্চ মান হয় না, বিজ্ঞন জ্ঞান যোগ এবং সদ্বিষয়ব ভক্তিরূপ যে যোগ এই উভয়ের একই প্রয়োজন অর্থাৎ এই দুয়েতেই ভগবান লাভ করা যায়।

.

ত্রিত্রিংশ অধ্যায়
দেবাহুতির জ্ঞানলাভ

পুত্র ভগবান কপিলদেবের ধর্মোপদেশ শ্রবণ করে মাতা দেবাহুতির আত্মার অধ্যাস্বরূপ আবরণ বিদূরিত হল। তিনি সাংখ্যাজ্ঞান প্রবর্তক ভগবান কপিলকে প্রণাম করে স্তব করতে লগলেন।

–হে ভগবান, তোমার এই প্রকটিত বপু, সমস্ত, ভূত, ইন্দ্রিয়, আত্মা ও মন– এ সকল ব্যাপ্ত। তুমি এই মূর্তিতে আপন ইচ্ছায় অঙ্গীকার করছি। তোমারেই তেজে গুণ প্রবাহ বিনষ্ট হয়। প্রলয়কালে তোমার গর্ভে বেদসকল রক্ষিত ছিল। তুমিই কপিল নামধারী শ্রীবিষ্ণু। তোমাকে প্রণাম করি।

ভগবান কপিল বললেন–আপনি আমার ধর্মোপদেশ পালন করে সুখভোগ করুন। এর দ্বারা অচিরেই জীবমুক্তি প্রাপ্ত হবেন। আমার মত ব্ৰহ্মবাদী মুনিগণের অনুষ্ঠেয় কৰ্ম-করুন, যারা আমার মত বিদিত নয়, তারা আবার সংসারে পতিত হয়। এইভাবে কামনীয় আত্মা-লাভের উপায় প্রদর্শন করে ব্রহ্মবাদিনী অনুমতি নিয়ে ভগবান কপিলদেব ফিরে গেলেন নিজ ধামে।

ভক্তি প্রবাহরূপ যোগ ও প্রবল বৈরাগ্য, পরিমিত আহার– বিহারাদির অনুষ্ঠান এবং ব্রহ্মস্বরূপ বিষয়ক জ্ঞান এই সকলদ্বারা বিশুদ্ধ মনে যাঁর মায়া গুন জনিত দেহাত্মবুদ্ধি তিরোহিত হয়। সর্বজ্ঞ সেই আত্মার ধ্যান করতে লাগলেন মুনি কর্দম পত্নী দেবাহুতি। এই ভাবে কপিলক্তো যোগ দ্বারা দেবাহুতি অচিরেই নিত্যমুক্ত পরমব্রহ্মা আত্মস্বরূপ সেই ভগবানকে লাভ করলেন।