৩-৪. টুপুরের আক্কেল গুড়ুম

পরদিন স্কুলে গিয়ে টুপুরের আক্কেল গুড়ুম। শালিনী যেন আচমকাই বদলে গিয়েছে। কাল তো মেয়েটার সঙ্গে দিব্যি পটে গিয়েছিল টুপুরের। টিফিনের পর ক্লাসেও কথা বলছিল টুকটাক, ছুটির পরও কত গল্প করল…ই-মেল আইডি, মোবাইল নম্বর আদানপ্রদান সবই হল হাসিমুখে। কিন্তু আজ যেন টুপুরকে চিনতেই পারছে না শালিনী। নাকি চিনতে চাইছে না? চোখে চোখ পড়লে দৃষ্টি সরিয়ে নিচ্ছে। যেচে কথা বলা তো দূরস্থান, প্রশ্ন করলেও এড়িয়ে যাচ্ছে উত্তর।

হলটা কী শালিনীর? কাল গোটা টিফিনটা সাবড়ে দিয়েছিল বলে আর সে টুপুরের কাছাকাছি ঘেঁষতে রাজি নয়! নাকি স্বপ্নের ঘটনাটা পুরো গুলগাপ্পি। পাছে স্বপ্নটা নিয়ে টুপুর ফের জেরা শুরু করে এবং বানানো গল্পটি ধরা পড়ে যায়, তাই শালিনী দূরে দূরে থাকছে? মিতিনমাসি একটা রহস্যের গন্ধ পর্যন্ত পেয়েছিল, একদিনে সবই চৌপাট হয়ে গেল?

কিন্তু টুপুর অত সহজে হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নয়। শেষ না দেখে সে ছাড়বেই না।

স্কুল ছুটির ঘণ্টা বাজতেই টুপুর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল শালিনীর উপর। গেট পর্যন্ত পৌঁছোনোর আগেই ধরেছে শালিনীকে। ক্ষুব্ধ গলায় বলল, তোর কেসটা কী রে? তুই কোনও কারণে আমার উপরে রাগ করেছিস?

শালিনী সামান্য থতমত খেয়ে বলল, কই, না তো।

তা হলে আমাকে আজ দেখতেই পাচ্ছিস না যে বড়?… জানিস, তোর স্বপ্নটা নিয়ে কাল আমি বাড়ি গিয়েও কত ভেবেছি, ইনফ্যাক্ট স্বপ্নটার কী অর্থ হতে পারে তাই নিয়ে আমি…

আহ, ঐন্দ্রিলা, থাক না, শালিনী থামিয়ে দিল টুপুরকে, আমি এই জন্যই তোর থেকে তফাতে আছি।

মানে?

ওই স্বপ্নটা নিয়ে আর আলোচনার ইচ্ছেই নেই আমার।

কেন রে?

অত কৈফিয়ত দিতে পারব না, শালিনী এবার যেন একটু বিরক্ত, ধরে নে, আমি কোনও স্বপ্নটপ্ন দেখিইনি।

যাঃ বাবা, কাল যে তুই অত কিছু বললি?

ধর, আমি মজা করছিলাম…

উঁহু, তুই কাল খুবই সিরিয়াস ছিলি, টুপুর ভুরু কোঁচকাল, হঠাৎ চেপে যেতে চাইছিস কেন?

আহ, ঐন্দ্রিলা আমায় বোর করিস না। আমার ভাল লাগছে না।

কেন রে? স্বপ্নটা নিয়ে কিছু হয়েছে নাকি?

শালিনী একটুক্ষণ নীরব। তারপর আচমকাই ফুঁপিয়ে উঠল, আমায় কিছু জিজ্ঞেস করিস না, প্লিজ।

টুপুর হতভম্ব। কী বলবে ভেবে পেল না। ন যযৌ ন তস্থৌ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

হঠাৎ শালিনী খপ করে টুপুরের হাত চেপে ধরল। নাক টেনে বলল, এই স্বপ্নটা নিয়ে বাড়িতে কাল খুব অশান্তি হয়েছে রে।

কীরকম? টুপুর ফের কৌতূহলী।

স্কুলে বন্ধুদের কাছে গল্প করেছি শুনে ছোড়দাদু খুব রাগ করলেন। বললেন, এতে নাকি আমার অমঙ্গল ঘটতে পারে। শুনে অমনি বাবাও…

দাঁড়া দাঁড়া, টুপুর হাত তুলে শালিনীকে থামাল, ছোড়দাদুর কথা তো কাল বলিসনি। উনিও কি তোদের বাড়িতে থাকেন?

না না, উনি তো সবে গত রবিবার কলকাতায় এসেছেন।

 মিতিনমাসি কি এরকমই কারও আগমনের সম্ভাবনা আন্দাজ করেছিল কাল? কথাটা মনে হতেই টুপুর প্রশ্ন করে ফেলল, উনি থাকেন কোথায়?

ওঁর কোনও ঠিকঠিকানা ছিল না। সন্ন্যাসী মানুষ, পথে পথেই নাকি থাকতেন। আমার জন্মের ঢের আগেই তো উনি ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। এখন রাজস্থানে এক আশ্রমে বাস করেন। রনকপুরে। কলকাতা ফিরলেন বোধহয় টোয়েন্টি ইয়ার্স পরে।

ও। তা উনি বুঝলেন কী করে স্বপ্নটা অন্যদের বললে তোর ক্ষতি হতে পারে?

আমি কী করে বলব? বাবাও ওঁর কথা মেনে নিলেন যে, শালিনীর গলা ধরাধরা শোনাল, ফেসবুকে স্বপ্নটা পোস্ট করেছিলাম তো, সেটা জানতে পেরে বাবা আরও রেগে গিয়েছিলেন। এখন বাবার কড়া হুকুম, আমি যেন স্বপ্নটা নিয়ে কারও সঙ্গে আর ডিসকাস না করি।

টুপুর আহত স্বরে বলল, অদ্ভুত হুকুম। একটা স্বপ্ন কী এমন হাতিঘোড়া যে, তাই নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গেও কথা বলা নিষেধ?

আমি জানি না রে। ছোড়দাদু বারণ করলেন বলেই হয়তো… শালিনীর স্বর এবার যথেষ্ট করুণ, অথচ কাল রাতেও আমি স্বপ্নটা দেখেছি।

তাই নাকি? একই স্বপ্ন?

ছাড়, ভুলে যা, শালিনী ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলল, ওই স্বপ্ন দেখতে দেখতেই হয়তো কোনওদিন হার্টফেল করে যাব। হয়তো সেটাই আমার নিয়তি।

ভারী দুঃখী দুঃখী দেখাল শালিনীর মুখখানা। স্কুলবাস হর্ন দিচ্ছে, বাসের পানে দৌড় দিল শালিনী। টুপুরের বাড়ি কাছেই। হাঁটতে শুরু করল মন্থর পায়ে। মেজাজটা যেন বিগড়ে গিয়েছে হঠাৎ। শালিনীর স্বপ্নটা নিয়ে আর এগোনো যাবে না জেনে একটা অক্ষম ক্ষোভও জ্বালা ধরাচ্ছে বুকে। মিতিনমাসিও নিশ্চয়ই বিরক্ত হবে টুপুরের উপর। ভাববে মেয়েটা অকম্মাই রয়ে গেল। পার্থমেসো অবশ্যি মজা পাবে খুব। মাসি-বোনঝি একসঙ্গে হতাশ হলে মেসো তো তালি বাজাবেই।

বাড়ি এসে আর বেরোতে ইচ্ছা করছিল না টুপুরের। সহেলি দইবড়া বানিয়েছেন দুপুরে। খুব একটা পছন্দের খাবার না হলেও নির্বিবাদে খেয়ে নিল আজ। এবার বাবার ল্যাপটপখানা খুলে বসলে হয়। মা-বাবাকে না জানিয়ে সম্প্রতি একটা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলেছে টুপুর। ছোট্ট একটা বন্ধুবৃত্ত তৈরি হয়েছে ফেসবুকে। বিকেলবেলাটাই তাদের সঙ্গে খানিক বৈদ্যুতিন গল্প আড্ডা চালানোর আদর্শ সময়।

ল্যাপটপ চালু করতে গিয়েও থমকাল টুপুর। শিয়রে সমন। কাল ক্লাস টেস্ট আছে, ইতিহাসের। পর্তুগিজ, ডাচ, ইংরেজ, ফরাসিদের ভারতে আগমন, তাদের ব্যবসাবাণিজ্য, পলাশির যুদ্ধ এইসব নিয়েই পরীক্ষা। সাল, তারিখ, ঘটনাপ্রবাহ একদম স্মরণে থাকে না টুপুরের, বড় গুলিয়ে যায়। কিন্তু যদি সে ধ্যাড়ায় পরীক্ষায়, মা তাকে কাঁচা চিবিয়ে খাবে। মিতিনমাসির শাগরেদি করার যেটুকু যা ছাড় মেলে, তাও হয়তো জুটবে না আর। সুতরাং মানে মানে বইপত্র খোলাটাই এখন বেশি জরুরি।

এইসব সাতপাঁচ ভেবে সবে টুপুর পড়ার টেবিলে বসেছে, অমনি মোবাইল ফোনটা ঝনঝন। টুপুরদের স্কুলে মোবাইল ফোন নিয়ে যাওয়া বারণ, তাই দিনভর বাড়িতেই পড়ে থাকে ফোনটা। এখন হঠাৎ সচল হল যে বড়? স্কুলের কেউ ডাকাডাকি করছে? শালিনীর সঙ্গে টুপুরের গুজগুজ নিয়ে কৌতূহল? নাকি পাড়ার কোনও বন্ধু?

মনিটরে দৃষ্টি পড়তেই ঈষৎ অস্বস্তি। মিতিনমাসি! কী বলবে এখন সে মাসিকে? একটু গলা ঝেড়ে টুপুর স্বর ফোটাল, হ্যাঁ, বলো।

বলবি তো তুই, তোকে যা জানতে বলেছিলাম…

ওসব জেনেটেনে কোনও লাভ নেই গো মাসি। শালিনী স্বপ্নটাকে পুরো গিলে নিয়েছে বাড়ির লোকজনের গুঁতোয়।

আহ, তোকে যা করতে বলেছিলাম সেটা করেছিস কি?

মাসির গলায় উষ্মার আভাস। টুপুর চটপট শালিনীর ছোড়দাদুর উপাখ্যানটা শুনিয়ে দিল। কয়েক সেকেন্ড ওপ্রান্তে কোনও সাড়াশব্দ নেই। তারপর ফের মাসির কণ্ঠ, আমার আন্দাজটা তা হলে ভুল নয়। গড়বড় একটা তা হলে সত্যিই আছে।

মানে?

এককথায় তো মানে বোঝানো যাবে না। শুধু এইটুকু জেনে রাখ, শালিনী তার বাবার কাছে বকুনি খেয়েছে রাতে খাওয়ার সময়। সম্ভবত খেতে বসে উৎসাহ নিয়ে বলছিল, তখনই প্রথমে ওর ছোড়দাদু ওকে ধমকায় এবং তারপর ওর বাবা।

টুপুর অবিশ্বাসের সুরে বলল, তুমি কী করে শিয়োর হচ্ছ?

কারণ শালিনী কাল সন্ধেবেলায় স্বপ্নটা পোস্ট করেছিল ফেসবুকে। তখন ঘড়িতে আটটা ছয়। রাত দশটার পর স্বপ্নটা ফেসবুক থেকে মোছা হয়েছে।

টুপুরের গলা থেকে বিস্ময় ঠিকরে এল, তুমি হঠাৎ শালিনীর ফেসবুকে গেলে কেন?

ওর স্বপ্নটা আমায় খুব হন্ট করছিল যে। তাই মনে হল মেয়েটার নেচারটা একটু স্টাডি করি।

কী বুঝলে ওর ফেসবুক ঘেঁটে?

মেয়েটা খুব চাপা ধরনের। খুব বাচ্চাবেলা থেকেই ওর মধ্যে একটা ভয় বাসা বেঁধে আছে। নিজের কোনও ফোটো দেয়নি ফেসবুকে, ওর বয়সি একটা মেয়ের ক্ষেত্রে যা রীতিমতো অস্বাভাবিক। বন্ধুর সংখ্যাও খুব কম, সেটাও ওর ফেসবুক করা নেচারের সঙ্গে ঠিক খাপ খায় না।

হ্যাঁ গো মাসি, মেয়েটা একটু আজব ধরনের। নইলে রোজ রোজ এক স্বপ্ন দ্যাখে!

এবং এমন স্বপ্ন যেটা তার বাড়ির লোক জনসমক্ষে চাউর করতে রাজি নয়, মিতিনের স্বর সামান্য উত্তেজিত, না রে টুপুর, ব্যাপারটা তলিয়ে দেখতেই হবে। আমার মনে হচ্ছে পরিবারটায় কিছু গোপন ঘটনা আছে। ওই স্বপ্নটা তারই একটা মূল্যবান সূত্র।

… স্বপ্ন…সূত্র… টুপুর বিড়বিড় করল, কীভাবে?

সেম ড্রিম রিপিট হচ্ছে…অর্থাৎ মেয়েটার মনে এমন কোনও ছবি আঁকা আছে যেটা ফিরে ফিরে আসছে। আর এটা ঘটছে ওই ছোড়দাদুর আবির্ভাবের পরেই। উঁহু, দিস ইজ নট কাকতালীয়।

কিন্তু মাসি আমরা এগোব কী করে? শালিনীর বাবা মোটেই আমাদের অ্যালাউ করবেন না।

তার জন্য উপায় ঢুঁড়তে হবে। তুই শুধু আপাতত শালিনীর উপর ওয়াচ রেখে যা।

কিন্তু তুমি…।

পরে কথা হবে, টুপুরের প্রশ্নটা থামিয়ে দিল মিতিন। বলল, কাজ আছে, রাখছি।

এমন আচমকা ফোন কেটে দিল মাসি, টুপুর হতভম্ব। খুব গভীর চিন্তায় থাকলে মাসি এরকম করে দেখেছে টুপুর। কিন্তু চিন্তাটা যে কেন, সেটাই মগজে ঢুকছে না।

কী এমন আছে শালিনীর স্বপ্নটায়। স্মরণ করল টুপুর। একটা দানব টাইপ লোক শালিনীকে নিয়ে লোফালুফি খেলছে! একটা লোক থেকে দুটো লোক।! দু’নম্বর লোকটি নাকি দেওয়ালে ঝোলে! কোত্থেকে একটা লাঠি বেরিয়ে আসে। তারপর লাঠি, দেওয়াল, গর্ত…এসবের মানে কী? তবে মিতিনমাসি কেসটা নেওয়ার জন্য যেভাবে উতলা হয়ে পড়েছে, নির্ঘাত একটা অর্থ বের করে ফেলেছে স্বপ্নটার। সেই অর্থটি অবশ্যই রোমাঞ্চকর। খামোকা মিতিনমাসির মগজের সঙ্গে পাল্লা টানার দরকার কী টুপুরের? কেসটা মিতিনমাসি টুপুরের মাধ্যমেই তো পাচ্ছে, সুতরাং টুপুর তো অনুসন্ধানে থাকবেই।

কিন্তু কী নিয়ে অনুসন্ধান, সেটাই তো ছাই আঁধারে। কোনও মানে হয়!

ধুৎতেরি, বলে ল্যাপটপখানা অন করল টুপুর। ফেসবুকে গিয়ে দেখল দু-তিনজন বন্ধু উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে জানলায়। আড্ডা জুড়তে গিয়েও কী মনে করে খুঁজতে লাগল শালিনীকে। কী কাণ্ড, মিলছে না কেন? ভুস করে উবে গেল যে। শালিনীর বাবা কি মেয়ের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে তালা ঝুলিয়ে দিলেন? ভারী অন্যায়, ভারী অন্যায়। বাবা ভদ্রলোকটি নিজে কি আছেন ফেসবুকে?

খুঁজতে না খুঁজতেই মিলেছে সন্ধান। হ্যাঁ, বহাল তবিয়তে মজুত। আকাশচাঁদ শেঠ। প্রোফাইলটা তো বিটকেল। শখ, পেশা কিচ্ছু দেননি আকাশ। তার বদলে রয়েছে একটা হেঁয়ালিমার্কা ঠিকুজি।

নাগৌর-পটনা-রাজমহল-মুর্শিদাবাদ-মহিমাপুর-ওংগঙ্গা। হীরামানিক ফতেস্বরূপ-ওংগঙ্গা। এটা কি কোনও পরিচয় হতে পারে?

নাহ এই পাগল পরিবার নিয়ে মগজকে ট্যাক্স করে লাভ নেই। বরং ইতিহাস বইটা খুললে খানিকটা কাজ হয়।

ল্যাপটপকে ঘুম পাড়িয়ে এবার টুপুর পাঠে মনোযোগী। তারই মধ্যে টের পেল বাবা ফিরলেন কলেজ থেকে। ইতিহাসটা বাবার কাছে পড়তে মন্দ লাগে না খুব একটা। ঘটনার পর ঘটনা এমন সুন্দর করে বুঝিয়ে বলেন অবনী, পুরনো সময়টা যেন চোখের সামনে দেখতে পায় টুপুর। কিন্তু বিপদও আছে। কোর্স, সিলেবাসের কথা মাথায় থাকে না বাবার, ইতিহাসে ডুবে গিয়ে এক প্রসঙ্গ ছেড়ে চলে যান আর-এক প্রসঙ্গে, তখন তাঁকে বইয়ের পাতায় ফেরানোই মুশকিল। এই তো গত সপ্তাহেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতে পাড়ি দেওয়ার বিবরণ দিতে গিয়ে ঢুকে পড়লেন ইউরোপের ইতিহাসে, ফ্রান্স-ইংল্যান্ডের যুদ্ধে। ভারত তখন অবনীর মন থেকে কোথায় হাওয়া।

তবু টুপুর বাবার কাছে যাওয়ার জন্য উশখুশ করছিল। পলাশীর যুদ্ধের বিশদ ইতিহাসটা মগজে পুরে নিতে পারলে হাফ-ইয়ার্লি, অ্যানুয়ালের প্রস্তুতিটাও হয়ে যাবে একবারে। উঠতে যাচ্ছিল টুপুর, আবার মোবাইল ঝনঝন এবং মিতিনমাসি।

টুপুর উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ার আগেই মিতিনের নিরুত্তেজ স্বর, সোমবার তোদের ছুটি আছে না? জন্মাষ্টমীর? শনিবার স্কুল থেকে ফিরে তৈরি থাকিস।

কেন গো? কোথাও যাবে নাকি?

মেসো তোকে এখানে নিয়ে আসবে। রোববার আমরা শালিনীর বাড়ি যাব।

কত যে প্রশ্ন ভুসভুস করছে টুপুরের পেটে। কিন্তু গলার স্বর ফুটছে না কেন!

.

০৪.

বাড়িটার নাম ‘সাদার্ন হাই’। রবীন্দ্র সরোবরের একেবারে সামনেই। গেটের সামনে সবুজ বুলেভার্ডশোভিত রাস্তার ধারে গাড়িখানা পার্ক করল মিতিন। ইশারা করল টুপুরকে, আয় এবারে ঢুকেই পড়ি।

টুপুরের বুক ধুকধুক করছিল। কাল স্কুলে পাখি পড়ার মতো করে বুঝিয়েছে শালিনীকে। বলেছে, তোর কোনও চিন্তা নেই, আমার মাসি ভুলেও নিজে থেকে স্বপ্নের কথা তুলবে না। শুধু তোর বাবার সঙ্গে আলাপ পরিচয় করেই চলে আসবে।

টুপুর যে স্বপ্নটা শালিনীর মুখে শুনেছে, সেটা পর্যন্ত প্রকাশ হবে না, কথা দিয়েছে টুপুর।

অবশ্য মিতিনের যাওয়ার জুতসই একটা কারণ বানাতে হয়েছে। মাসিই তৈরি করে দিয়েছে গুছিয়ে। মিতিন আজ গোয়েন্দা নয়, একজন ইতিহাসবিদ। কলকাতার জৈনদের উপর গবেষণা করছে। ওই বিষয়ে তথ্যসংগ্রহ করতে আকাশচাঁদের বাড়ি যাচ্ছে সে। শালিনীও তাই জানে। আকাশচাঁদও। মাসি যা ওস্তাদ অভিনেতা, স্বচ্ছন্দে ঐতিহাসিকের ভূমিকায় মানিয়ে নেবে। কিছুতেই ধরা পড়বে না। টুপুর স্থির নিশ্চিত।

তবু যে কেন নার্ভাসনেসটা কাটছে না! শালিনীকে ঠকাচ্ছে বলে? নাকি মাসির প্রকৃত উদ্দেশ্য ঠাহর করে উঠতে পারছে না তাই? কাল মাসির বাড়িতে পা রাখার পর না হোক পনেরো-ষোলো ঘণ্টা তো কেটেইছে, একবারও কি মাসি বলল স্বপ্নটায় কী রহস্য থাকতে পারে? পার্থ মেসো কত খ্যাপাল, তবু মাসির ঠোঁটে কুলুপ। কী যে হতে চলেছে বুঝতে না পারলে অস্বস্তি তো থাকবেই।

উর্দিধারী রক্ষীর খাতায় নাম, ঠিকানা লিখে লিফটে চড়েছে মাসি-বোনঝি। দশতলায় বেরিয়ে সামনেই পিতলের নেমপ্লেট জ্বলজ্বল করছে, আকাশচাঁদ শেঠ।

আজ শাড়ি পরেছে মিতিন। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। কাচে পাওয়ার নেই বটে, কিন্তু ওই চশমার দৌলতে বেশ একটা অধ্যাপিকাসুলভ ব্যক্তিত্ব এসেছে মিতিনের চেহারায়। শাড়ির আঁচল গুছিয়ে মিতিন বেল টিপল। পাল্লা খুলে গিয়েছে। দরজায় এক বছর পঁয়তাল্লিশের ভদ্রলোক। ধবধবে ফরসা, মাঝারি হাইট। পরনে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি। মাথার সামনের দিকটা প্রায় ফাঁকা। তবে স্বাস্থ্যটি ভারী মজবুত। একঝলক মিতিনকে দেখলেন ভদ্রলোক। পরক্ষণে টুপুরকেও। তারপর স্মিত মুখে আহ্বান জানালেন দু’জনকে। বসিয়েছেন প্রকাণ্ড লিভিং রুমের নরম সোফায়। আলাপ সাঙ্গ হতেই বিনম্র স্বরে মিতিনকে জিজ্ঞেস করলেন, একটু চা খাবেন তো দিদিভাই, নাকি কফি?

কিছু না হলেও চলবে, মিতিন সহজ গলায় বলল, আপনি ব্যস্ত মানুষ। বেশি সময় নষ্ট করব না আপনার। কাজের কথাটুকু সেরেই চলে যাব।

তা বললে চলে, আকাশ জোরে জোরে ঘাড় নাড়লেন, আপনি আমার মেয়ের বান্ধবীর মাসি। একটু অতিথি সৎকারের সুযোগ তো দিতেই হবে।

বেশ, তা হলে কফিই হোক। তবে শুধুই কফি, দুধ-চিনি ছাড়া।

আমারও ঠিক ওটাই পছন্দ, টুপুরের দিকে ফিরলেন আকাশ, আর তুমি? দুধ খেতে পারো। ওই দ্রব্যটি আমাদের বাড়িতে অঢেল পরিমাণে মজুত থাকে।

দুধের নাম শুনলেই গা গুলিয়ে ওঠে টুপুরের। ঢোক গিলে টুপুর বলল, পেট ভরতি, একটু ঠান্ডা জল পেলেই যথেষ্ট।

আমরা তো ঠান্ডা জল রাখি না, আকাশকে একটু অপ্রস্তুত দেখাল, ঠান্ডা জলে নানা ধরনের ব্যাকটেরিয়া জন্মায় তো, তাই পারতপক্ষে..।

জানি, মিতিন মৃদু হাসল, আপনারা সাধ্যমতো প্রাণীহত্যা এড়িয়ে চলেন। জৈন ধর্মে জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে অহিংসাকে সব থেকে বেশি মান্যতা দেওয়া হয়।

আপনি তো জানবেন বটেই। আমাদের ধর্ম নিয়েই তো আপনি… আকাশ একমুহূর্ত থামলেন। ঈষৎ কুণ্ঠিত স্বরে বললেন, তবে আমি খুব ধার্মিক মানুষ নই। আজকালকার দিনে যেটুকু মানা সম্ভব, সেইটুকুই কোনওমতে পালন করি।

টুপুর অনেকক্ষণ ধরেই ছটফট করছিল। চোখ ঘুরিয়ে ঘরের দেওয়াল দেখার ছলে উঁকি দিচ্ছিল আকাশচাঁদের অন্দরমহলে। থাকতে না পেরে বলেই ফেলল আচমকা, শালিনী কোথায়? ও বেরোচ্ছে না কেন?

শালিনী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে।

সে কী? কাল দুপুরে স্কুল ছুটির সময়েও তো ও ঠিক ছিল। বলল, কাল এখানে এলে আমার সঙ্গে কত গল্প করবে।

ও কাল সন্ধে থেকেই কাহিল। শেষ শ্রাবণের কড়া রোদ্দুরে ভাজা ভাজা হয়ে ফিরল। ফিরেই ঘরে এসি চালিয়েছিল। ব্যস, ঠান্ডা লেগে গিয়েছে।

একবার কি ওকে দেখে আসব?

 উপায় নেই, রাত থেকেই ধুম জ্বর। এখন ও ঘুমোচ্ছে।

 টুপুর বেজায় হতাশ। শালিনীর সঙ্গে মাসির যদি দেখাই না হয়, তা হলে আজ আসাটাই তো বৃথা। যাঃ, সকালটাই মাটি হল আজ। পার্থমেসো খুব খ্যাপাবে।

কিন্তু কী আশ্চর্য! মাসির কোনও হেলদোল নেই। দিব্যি কথা শুরু করে দিয়েছে আকাশচাঁদের সঙ্গে। হাসিহাসি মুখে বলছে, আপনার বাংলাটি ভারী চমৎকার।

স্বাভাবিক। সাত-আট পুরুষ বাংলায় আছি, আকাশচাঁদের স্বরে গর্ব ঝরে পড়ল, আমাদের এক পূর্বপুরুষ পটনা ছেড়ে ঢাকা হয়ে মুর্শিদাবাদে বসবাস শুরু করেন। তারপর তো আমরা আর আমাদের আদি বাসস্থানে ফিরিইনি।

পটনা থেকে যিনি এসেছিলেন, তার নাম কি হীরানন্দ শাহ?

কেন বলুন তো? আকাশ ঈষৎ থমকেছেন, তার নাম জেনে কী লাভ?

আমি একটা হিসেব মেলাতে চাইছি, মিতিন টানটান হয়ে বসল, আপনাদের আদি বাসস্থান কি রাজস্থানের ওসনগরে? আপনারা কি জাতে ওসওয়াল?

ঠিক, একদম ঠিক। চুরাশি ঘর মারোয়াড়ি বণিকের মধ্যে আমরাই ছিলাম অগ্রগণ্য। তবে এখন আমরা বাঙালিই হয়ে গিয়েছি।

হুম। দুয়ে-দুয়ে চারই হচ্ছে।

কীভাবে?

আমার ডেটা অনুযায়ী বিখ্যাত বণিক জগৎশেঠদের কোনও বংশধর এই শহরেই বাস করছেন, মিতিন আকাশচাঁদের চোখে চোখ রাখল, এবং অনুমান যদি ভুল না হয়, আপনি ওই জগৎশেঠ পরিবারেরই একজন।

পলকের জন্য চোখজোড়া উদ্ভাসিত হয়ে উঠল আকাশচাঁদের। পরক্ষণেই যেন নিভে গেল মণিদুটো। ম্রিয়মাণ স্বরে বললেন, থাক না প্রসঙ্গটা। আমরা কি অন্য টপিক নিয়ে আলোচনা করতে পারি না?

মিতিনের ভুরুতে পলকা ভাঁজ, আপত্তির কারণটা জানতে পারি?

কবে ঘি খেয়েছি এখনও তার ঢেকুর তুলব, এ আমার ভাল লাগে না ম্যাডাম, আকাশ হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন, একটু বসুন। আমি কফির বন্দোবস্তটা সেরে আসি। বলেই দ্রুত এল শেপের লিভিং রুমটা ছেড়ে অন্দরে মিলিয়ে গেলেন আকাশ।

টুপুর ফিসফিস করে বলল, মূল কথাটা তো আসছেই না মাসি। স্বপ্ন, রহস্য সব ভোঁ ভাঁ হয়ে গেল নাকি?

মিতিন নিরুত্তর। নির্বিকার। ভাবলেশহীন মুখে দেখছে হলখানা। দূরে দেওয়ালে গাঁথা শ্বেতপাথরের ছোট্ট সিংহাসনে কোন এক ঠাকুরের মূর্তি। পদ্মাসনে বসা দুধসাদা মূর্তিটার চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে। সম্ভবত দামি কোনও পাথর। একদৃষ্টে সেইদিকেই তাকিয়ে আছে মিতিন। মূর্তির একপাশের দেওয়ালে একটা বাঁধানো ফোটো। গোঁফওয়ালা, টাকমাথা এক প্রৌঢ়। মিতিন ছবিটাও দেখছে যেন।

ফিরেছেন আকাশচাঁদ। সামান্য কাঠ কাঠ স্বরে বললেন, আপনি কলকাতার জৈন সম্প্রদায়ের মানুষদের সম্পর্কে প্রশ্ন করুন না? যতটুকু যা জানি, অবশ্যই বলব।

মিতিন একটু চিন্তা করে বলল, তথ্য জোগাড় করাটা তো আমার লক্ষ্য নয়। ইন্টারনেট ঘাঁটলেই তো ভুরি ভুরি ইনফরমেশন মিলবে। আসলে আমি কলকাতার জৈনদের একটু অন্য ভাবে জানতে চাই। তাদের পারিবারিক কাঠামো, কীভাবে সেটা বদলাচ্ছে কিংবা আদৌ বদলাচ্ছে কিনা, রাজস্থান-উত্তরপ্রদেশের জৈনদের সঙ্গে তাদের কতটা ফারাক, এইসব আমার গবেষণার বিষয়। তার জন্য আমি এক-একটা জৈন পরিবার বেছে তাদের পরিবারের কাহিনি বিশদে নোট ডাউন করছি। আমি তাদের নাম, পরিচয় সম্পূর্ণ গোপন রাখব, এটুকু গ্যারান্টি দিতে পারি।

একটু যেন সহজ হলেন আকাশচাঁদ, আমি তো আপনাকে হেল্পই করতে চাই।

হাতের মুঠোয় ধরা মোবাইলটা সেন্টার টেবিলে রেখে মিতিন সোফায় হেলান দিয়ে বলল, কলকাতায় আপনাদের অরিজিনাল বাড়ি কোথায়?

উত্তর কলকাতায়। মানিকতলার কাছে গৌরীবাড়ি নামে একটা জায়গা আছে…

আমি চিনি। আপনাদের পরেশনাথের মন্দিরটা তো ওখানেই।

পরেশনাথ মন্দিরের খুব কাছেই আমাদের বাড়ি ছিল। অনেকদিনের পুরনো, তা অন্তত দেড়শো বছর তো হবেই।

অর্থাৎ মোটামুটি পাঁচ পুরুষ আগের। তখন আপনারা যৌথ পরিবারে ছিলেন নিশ্চয়ই। এখন তো পরিবার টুকরো-টুকরো। বাকিরা কোথায় কোথায় ছড়িয়ে আছেন?

এক-দু’জন চলে গিয়েছেন রাজস্থানে। নাগৌরে। ওয়েস্ট বেঙ্গলে মুর্শিদাবাদ জেলার জিয়াগঞ্জ, লালগোলার দিকে থাকেন কয়েকজন। কেউ বা কলকাতাতেও আছেন।

কলকাতার কোথায়?

ওই পরেশনাথ মন্দিরের কাছে। বদ্রিদাস টেম্পল স্ট্রিট। আমাদের পুরনো বাড়িতে।

ও। তার মানে বাড়িটা এখনও আছে?

ভেরি মাচ। দোতলাটা অবশ্য পুরো ভেঙে রেনোভেট করেছিলেন আমার পিতাজি। সেও প্রায় চল্লিশ বছর আগে। আমার ছেলেবেলায়।

ও। তা এখন সেখানে থাকেন কে? আপনার নিকটাত্মীয় কেউ?

 খুবই আপনজন। আমার বড়ে ভাই। মানে আমার দাদা।

আপনারা দুই ভাই পৃথক হয়ে গিয়েছেন বুঝি?

অনেকদিন। আমার মেয়ে তখন বছরখানেকের। সে এখন থার্টিন প্লাস।

মধ্যবয়সি এক কাজের লোক মিতিনের কফি এনেছে। সঙ্গে বড় প্লেটভরতি কাজু-কিশমিশ। পাশে গ্লাসে কী এক পানীয়। আকাশচাঁদের অনুরোধে টুপুরকে গিলতে হল পানীয়টা। স্বাদটা অবশ্য মন্দ নয়, দুধের মধ্যে সম্ভবত পেস্তাবাদামবাটা মিশিয়ে বানানো। তবু ওই দুধ আছে বলেই পেটটা যেন কেমন কিরকির করছে। তাড়াতাড়ি একমুঠো কাজু মুখে পুরে দিল টুপুর।

মিতিন কালোবরণ কফিতে চুমুক দিচ্ছে। কাপটা নামিয়ে রেখে হঠাৎ বলল, যদি একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি, জবাব মিলবে কি?

আগে প্রশ্নটা শুনি!

বারো-তেরো বছর আগে আপনার বয়স ছিল বড়জোর ত্রিশ-বত্রিশ। আপনার মেয়ে তখন প্রায় কোলে। ওইরকম একটা সময়ে ভাইয়ে ভাইয়ে আলাদা হওয়াটা খুব একটা স্বাভাবিক ঘটনা নয়। বিশেষত আপনাদের মারোয়াড়ি সমাজে, মিতিন অল্প ঝুঁকল, দাদা-ভাইয়ে একেবারেই বনিবনা ছিল না বুঝি।

আমরা একেবারেই অন্য ধরনের মানুষ। দাদা গোড়া প্রাচীনপন্থী, ভীষণ রক্ষণশীল ধরনের। সেই ছোটবেলা থেকেই। বাবা যদ্দিন ছিলেন, কোনওরকমে মানিয়ে চলেছি। উনি গত হওয়ার পর আর একত্র বাস সম্ভব হয়নি।

এই ফ্ল্যাটখানা কিনে উঠে এসেছিলেন? নাকি এটি পরে কেনা?

কোনওটাই নয়। ফ্ল্যাটটা কিনেছিলেন আমার বাবা। অ্যাসেট হিসেবে। ভাল দাম পেলে বেচে দেবেন বলে। কিন্তু হঠাৎ তার মৃত্যু হয়। দাদা আর আমি আপসে সম্পত্তি ভাগাভাগি করে ফেলি। দাদা আমাদের পুরনো বাড়িটা নেয়, আমি পাই সাদার্ন হাইয়ের এই অ্যাপার্টমেন্ট।

টুপুরের অসহ্য লাগছিল। মাসির এই একঘেয়ে প্রশ্নমালার কোনও মাথামুন্ডুই খুঁজে পাচ্ছিল না। আকাশচাঁদের পারিবারিক সম্পত্তির খবর জেনে লাভ আছে কোনও? অবশ্য মাসির মনের গতিপথ ঠাহর করা অসম্ভব। উদ্দেশ্য একটা আছে হয়তো, পরে বোঝা যাবে। তখন হয়তো মনে হবে মাসির মতো ভাবতে শেখা কতটা জরুরি।

একই খাতে চলেছে মিতিনের জিজ্ঞাসা, আপনার দাদা তা হলে গোটা বাড়িটাই পেয়ে গেলেন? সঙ্গে অনেকটা জমিও আছে নিশ্চয়ই?

তা আছে। প্রায় এক বিঘা মতো, আকাশচাঁদের ঠোঁটে আবছা ধূর্ত হাসি, কিন্তু বাড়িটা মেনরোড থেকে অনেকটা ভিতরে। সামনের রাস্তা তেমন চওড়া নয়, সুতরাং প্রোমোটার ছোঁবে কিনা সন্দেহ। ঘরগুলো পেল্লাই পেল্লাই, ইয়া ইয়া থাম আছে একঝাড়ি, বিশাল বিশাল দরজা-জানলা, ওসব মেনটেন করা কি কম ঝকমারি? তা ছাড়া…

তা ছাড়া কী? মিতিনের স্বরে একটু ব্যগ্রতা ফুটল, কোনও বখেড়া আছে বুঝি?

ঠিক তা নয়। তবে মালিক তো দাদা একা নয়। ভাগীদার আছে, আকাশচাঁদ মুচকি হাসলেন, সেই ভাগীদার এসেও গিয়েছে।

মানে?

জমিবাড়ির মালিক তো ছিল দু’জন। আমার বাবা আর কাকা। কাকা বহুকাল আগে সংসার ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। তাই বাবা, তারপর দাদা, বাড়িটা একাই ভোগ করছিলেন। কিন্তু গত সপ্তাহে সেই কাকা ফিরে এসেছেন। উনি নিজের অংশ হিসেবে একতলাটা চাইছেন। এখন কী সব নাকি করবেন, আকাশচাঁদের হাসি চওড়া হল, দাদা এখন মহা ক্ষিপ্ত। রোজ দু’বেলা আমার উপর চোটপাট করছে।

কেন? আপনি কী দোষ করেছেন?

কাকা এসে প্রথমে আমার বাড়িতেই উঠেছিল যে। দাদা তাই ভেবে নিয়েছে… হঠাৎ আকাশচাঁদের স্বর থেমে গেল। চোখ সরু করে বললেন, জৈনদের নিয়ে গবেষণা করতে গেলে এইসব তথ্যও কি আপনার কাজে লাগবে?

না না, আপনি গল্পের মতো করে বলছিলেন, শুনতে বেশ লাগছিল, মিতিনের ঠোঁটে অমায়িক হাসি, বাই দ্য বাই, আপনারা তো শ্বেতাম্বর সম্প্রদায়ের জৈন, তাই তো?

হ্যাঁ। কলকাতার বেশির ভাগ জৈনই শ্বেতাম্বর। এখানে দিগম্বর সম্প্রদায় অনেক কম।

আপনারা সকলেই কি ব্যবসা-বাণিজ্য করেন?

মোটামুটি। তবে অনেকেই তো আজকাল উচ্চশিক্ষা নিচ্ছে, তারা চাকরিবাকরিও করছে। আমাদের মধ্যে এখন ডাক্তার, অ্যাডভোকেটও কম নেই। আমার মেয়েকেই তো ভাবছি কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার বানাব, যাতে ও আমার ব্যবসাটা দেখতে পারে।

আপনিও কি কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার?

নট অ্যাট অল। আমি টেনেটুনে বি কম। কম্পিউটার ছিল আমার নেশা। নিজে নিজেই শিখে এক্সপার্ট হয়েছি। আগে একা একাই ওয়েব ডিজাইন করতাম। এখন ওই লাইনেই কারবার ফেঁদে বসেছি। বাপ-ঠাকুরদার মতো শেয়ার মার্কেটে আমার আগ্রহ নেই।

আপনার দাদা বুঝি শেয়ার লাইনেই?

হুঁ।

ওঁকে আপনি গোঁড়া বললেন কেন? উনি বুঝি খুব ধর্ম ধর্ম করেন?

সেটা এমন কিছু খারাপ কাজ নয়। দাদার অনেক অন্ধবিশ্বাস আছে। যেমন, অ্যালোপ্যাথি ওষুধ খেলে নাকি ধর্ম নষ্ট হয়, সন্ধের পর কিছু খাওয়া মানেই প্রাণীহত্যার সম্ভাবনা… জানেন আমার ভাবিজিকে প্রায় চিকিৎসা না করেই মেরে ফেলল। সাধে কি আমার ভাইপো বিদেশ পালিয়ে বেঁচেছে, আবার হোঁচট খেলেন আকাশচাঁদ। ঈষৎ বিরক্ত সুরে বললেন, আপনি বারবার আমার পারসোনাল ব্যাপারে ঢুকে পড়ছেন কেন বলুন তো?

যাঃ বাবা, আপনি তো নিজে থেকেই বলছেন, মিতিন মৃদু হেসে মোবাইলটা তুলে সময় দেখল, আজ তা হলে চলি। দরকার পড়লে আবার যোগাযোগ করব।

আকাশচাঁদ অল্প ঘাড় নাড়লেন। মিতিন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আপনার কাকার সঙ্গে আলাপ হলে ভাল লাগত। তা তিনি তো বোধহয় এখন এ বাড়িতে নেই…

কাকা কোনও বাড়িতেই নেই। উনি আছেন জৈন ধর্মশালায়। বড়বাজারে।

ওখানে গিয়েই ওঁর সঙ্গে দেখা করেন?

উনিও আসেন। প্রায় রোজই।

আপনি কাকার কথা খুব মেনে চলেন, তাই না?

আচমকা একটা বেলাইনের প্রশ্নে আকাশচাঁদ কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। টুপুরও কম অবাক হয়নি। কী যে বলতে চায় মিতিনমাসি!