১-২. দূরপাল্লার ট্রেনের কামরা

টিকরপাড়ায় ঘড়িয়াল – মিতিনমাসি – সুচিত্রা ভট্টাচার্য

দূরপাল্লার কোনও ট্রেনের কামরা যে এত ফাঁকাও যায়, টুপুরের ধারণা ছিল না। হাওড়া থেকে ছাড়ছে গাড়ি, যাবে সেই অন্ধ্রপ্রদেশের তিরুপতি। অথচ টুপুরদের টু টিয়ার এসি কোচের খান পঞ্চাশেক বার্থে যাত্রীসংখ্যা কিনা সাকুল্যে দশ! ওঠার সময়ও দেখেছে টুপুর, গোটা ট্রেনটাতেই লোকজন নেই বিশেষ।

এত নির্জন গাড়িতে রাতদুপুরে ডাকাতি ফাকাতি হবে না তো? অবশ্য তেমন একটা কিছু ঘটলে তো টুপুরেরই পোয়াবারো। ডাকাতরা আর তাদের কাছ থেকে কী-ই বা নেবে? দু’খানা মোবাইল ফোন, ঘড়ি, কিছু টাকাপয়সা আর পার্থমেসোর দামি ডিজিটাল ক্যামেরাটা। ওই ক্যামেরাখানা পার্থমেসোর প্রাণ। ওটা খোয়া গেলে বেচারা খুব দুঃখ পাবে। তবে ডাকাতরা তো ওইটুকু নেবেই। নইলে তাদেরই বা পোষাবে কেন! তবে ডাকাতদের সঙ্গে যদি মিতিনমাসির মুখোমুখি টক্কর হয়, যে অভিজ্ঞতা টুপুরের ভাঁড়ারে জমবে, তার দাম তো ওই ক্যামেরার চেয়ে ঢের ঢের বেশি। পেশাদার গোয়েন্দা হওয়ার সূত্রে মিতিনমাসির কাছে আজকাল রিভলভার তো থাকেই। অস্ত্রটা যদি বের করে, কী প্রতিক্রিয়া হবে ডাকাতদলের? পালাবে দুড়দাড়িয়ে? নাকি জোর ফাইট হবে একখানা?

উফ, ভাবতেই রোমাঞ্চ! একটা কাল্পনিক ডাকাতির আশঙ্কায় ফুরফুরে মেজাজ আরও তর হয়ে গেল টুপুরের। জঙ্গল পাড়ি দেওয়ার পথে এমন একটা শিহরন জাগানো চিন্তা মনটাকে যেন টনকো করে দেয়।

জুলজুল চোখে সঙ্গীদের এক ঝলক দেখে নিল টুপুর। মিতিনমাসির হাতে লেটেস্ট মডেলের আই ফোন, কাকে যেন মেসেজ পাঠাচ্ছে টুকুস টুকুস। বুমবুম কমিকসে বিভোর। হাওড়া স্টেশনের স্টল থেকে খান তিনেক ‘ছোটা ভীম’ কিনে দেওয়া হয়েছিল, তারই একখানা গিলছে গোগ্রাসে। ট্রেন ছাড়ার আগে পর্যন্ত বেজায় ব্যস্ত ছিল পার্থমেসো। ট্রলি সুটকেসগুলো নীচের বার্থের তলায় চালান করে, চেন-তালা লাগিয়ে এখন সে অনেকটাই নিশ্চিন্ত। বাথরুমে গিয়ে পোশাক বদলে এল। প্যান্টশার্ট ছেড়ে পরে নিয়েছে পাজামা-পাঞ্জাবি। এত রাতেও কফি খেল তারিয়ে তারিয়ে। চলন্ত ট্রেন থেকে মন দিয়ে দেখছে বাইরের অন্ধকার।

হঠাৎ ঘুরেছে পার্থমেসো। ভুরু নাচিয়ে টুপুরকে জিজ্ঞেস করল, কিছু বলবি মনে হচ্ছে?

টুপুর হাসি হাসি মুখে বলল, ট্রেনটা বড্ড চুপচাপ! রাত্তিরে একটা এক্সাইটিং কিছু হলে দারুণ লাগবে, তাই না?

কীরকম উত্তেজনা চাইছিস তুই?

এই ধরো, ডাকাতি, রাহাজানি গোছের কিছু।

যত্ত সব ক্যাডাভ্যারাস চিন্তা, পার্থ ঠোঁট ওলটাল। তার চেয়ে বরং ভাব, ট্রেন খড়গপুর পৌঁছেলে নেমে ডিমসেদ্ধ খাব, সঙ্গে একটু পুরি সবজিও চলতে পারে।

এক্ষুনি খাওয়া খাওয়া করছ? এই না হাওড়া স্টেশনে একপ্লেট বিরিয়ানি সাঁটালে?

সে তো অলরেডি হজম হতে শুরু করেছে। স্পেসটা আবার ভরাট করতে হবে যে, বলেই পার্থর একগাল হাসি, কাল থেকে তো জঙ্গলে বাস। পেটে কী পড়বে কে জানে! তার আগে উদরে যতটুকু যা ভালমন্দ লোড করে নেওয়া যায় আর কী।

আমরা কোন ফরেস্টে যাচ্ছি, সেটা কিন্তু এখনও আমায় বলোনি মেসো!

আরে, সে তো জানতেই পারবি। এখন একটু সাসপেন্সে থাক না।

টুপুরের ভিতরের ছটফটানি যেন আরও বেড়ে গেল। সন্ধে থেকে এই এক ডায়ালগ আওড়ে চলেছে পার্থমেসো। কোনও কথা নেই, বার্তা নেই, আগাম কোনও জানান দেওয়া নেই, আচমকা আজ বিকেলবেলা টুপুরদের হাতিবাগানের বাড়িতে হাজির। গিয়েই তাড়া লাগাচ্ছে, তিন-চার দিনের জাঙ্গল টুর। আজই রাত সাড়ে এগারোটায় ট্রেন, চটপট জামাকাপড় গুছিয়ে নে। কিন্তু জঙ্গলটা যে কোথায়, হঠাৎ যাওয়াই বা হচ্ছে কেন, কিছুই ঝেড়ে কাশল না এখনও। তবে হ্যাঁ, স্কুলে সবে ফাস্ট টার্মিনাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে। পড়াশোনার চাপ কম, এসময়ে মিতিনমাসির সঙ্গে ছোট্ট একটা ভ্রমণ তো টুপুরের কাছে পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা। সুতরাং, আর কথা বাড়ায়নি টুপুর। পাঁচ মিনিটে তৈরি হল। বাবা-মাকে টা টা করে অবিলম্বে পার্থমেসোর সঙ্গে ফুড়ুৎ।

কিন্তু ট্রেনে চড়ার পরেও এই হেঁয়ালির কী অর্থ?

মেসোকে ছেড়ে মাসিকে ধরল টুপুর। আদুরে গলায় বলল, কী গো, তুমিও আমার সঙ্গে লুকোছাপা করবে?

মিতিন মোবাইল থেকে চোখ তুলল। হাসছে মিটিমিটি। বলল, কৌতূহলে ফুটছিস তো?

বুমবুম ফস করে বলে উঠল, আমি জানি আমরা কোথায় যাচ্ছি। কটকে।

টুপুরের গুলিয়ে গেল। বিড়বিড় করে বলল, কটকে তো জঙ্গল নেই।

জানিস তা হলে? মিতিন ঠোঁট টিপল, এবার তো তা হলে তোর জিয়োগ্রাফির ফান্ডাটা একটু পরখ করতে হয়। কটকেই আমরা নামব। তবে জঙ্গলটা সেখান থেকে আরও শ’খানেক কিলোমিটার দূরে।

সিমলিপাল?

তুত, সিমলিপাল হলে থোড়াই ট্রেনে চাপতাম! কলকাতা থেকে বম্বে রোড ধরে গাড়িতে চলে যেতাম।

তা হলে কি কেওনঝাড়?

উঁহু, কেওনঝাড় তো যায় জাজপুর থেকে।

বুঝেছি, নন্দনকানন যাওয়া হচ্ছে।

তোর মাথা। ওটা একটা জঙ্গল নাকি? জাস্ট ওপেন এয়ার চিড়িয়াখানা। তা ছাড়া নন্দনকানন তো ভুবনেশ্বরে।

নাহ, আর কোনও জঙ্গলের নাম মনে আসছে না টুপুরের। কাঁচুমাচু মুখে বলল, আমি পারব না।

আর একটু ক্লু দিই? পার্থ গলাখাকারি দিল। জঙ্গলটা মহানদীর পারে। নদীর ওপারে ফুলবনি জেলা, এপারে আঙুল।

ফুলবনি নামটা শোনা শোনা বটে, তবে আঙুল টুপুরের একেবারেই অচেনা। হতাশ মুখে টুপুর বলল, সরি। ওড়িশার ম্যাপ আমার মুখস্থ নেই৷

তুই একটি লেডিজ ফিঙ্গার। সাতকোশিয়ার নাম শুনেছিস?

না।

ভূগোলে তুই লাড্ডু পাবি। অত বড় একটা ফরেস্ট। বাঘ, ভালুক, হাতি, বাইসন, লেপার্ড, কী আছে, আর কী নেই!

আসলটাই তো বললে না, পার্থ মন্তব্য জুড়ল, ওখানে ঘড়িয়াল সংরক্ষণের চমৎকার বন্দোবস্ত আছে।

ঘড়িয়াল? টুপুর চোখ কুঁচকাল, মানে যে কুমিরগুলো মাছ খায়?

অনেকটা ঠিক বলেছিস। ঘড়িয়াল মাছই খায়। দেখতেও প্রায় কুমিরেরই মতো। তবে ওরা পুরোপুরি কুমির নয়, প্রজাতিটা আলাদা।

ও! তা সাতকোশিয়ার জঙ্গলটা কেমন? খুব ঘন?

গেলেই দেখতে পাবি। মিতিন এবার একটু তাড়া লাগাল, এখন শুয়ে পড় তো দেখি, অনেক রাত হয়েছে।

আহ, খড়্গপুরটা যাক না, পার্থ নড়েচড়ে বসল, ডিমসেদ্ধটা খেয়ে তারপর না হয়…।

উঁহু, বাকি রাতটুকু উপোসই থাকো।

হুকুম জারি করে বুমবুমের হাত থেকে কমিকসের বই কেড়ে নিল মিতিন। রেলের কর্মচারী চাদর, বালিশ, তোয়ালে কম্বল রেখে গিয়েছে। উপরের বার্থে পাতা হল বুমবুমের বিছানা। পার্থও চড়েছে আপার বার্থে, তোড়জোড় করছে নিদ্রার।

টুপুর বাথরুমে গিয়েছিল। ফিরছে পায়ে পায়ে। ফাঁকা কুপগুলো দেখতে দেখতে। হঠাৎ গতি শ্লথ হল সামান্য। একটা কুপে দুটো গাঁট্টাগোট্টা লোক এখনও জেগে। তাস খেলছে দু’জনে। টুপুর থমকানো মাত্রই দু’জোড়া চোখ মুহূর্তে তেরচা। দৃষ্টিটা যেন কেমন কেমন। আর পাঁচটা সাধারণ যাত্রীর মতো নয়। দু’জনেরই চুলে কদমছাঁট, হাতে মোটা স্টিলের বালা। এই চৈত্র মাসেও একজনের গায়ে চামড়ার জ্যাকেট, অন্যজনের ফ্ল্যাপ-হাতা বুশশার্ট। একজনের গোঁফজোড়া রীতিমতো তাগড়াই, অন্যজনের নিখুঁত কামানো মুখে চোরা হিংস্রতার ঝিলিক।

গুঁফো লোকটি সহসা দাঁত ছড়িয়ে বলে উঠল, কী খুকি, এখনও ঘুমোওনি যে?

গলাটা মোটেও বাজখাঁই নয়, বরং যেন ভাঙা ভাঙা, ফ্যাসফেসে। তবু তার স্বর শুনে বুকটা ধক করে উঠেছে টুপুরের। তাড়াতাড়ি সরে এল। সিটে ফিরে হাঁপাচ্ছে অল্প অল্প। খানিক দম নিয়ে মিতিনকে বলল, দুটো অদ্ভুত লোক আছে কিন্তু কামরায়। আমাদের পাশের পাশের কুপটায়।

জানি, গলা অবধি কম্বলে ঢেকে শুয়ে ছিল মিতিন। চোখ বুজে। বোজা চোখেই বলল, একজনের নাম কর্মবীর ঘোষ, অন্যজন শক্তিধর সমাদ্দার।

তুমি ওদের চেনো নাকি?

প্যাসেঞ্জার লিস্টে নাম দেখেছি।

 দু’জনকেই বেশ সন্দেহজনক মনে হল।

 কেন? রাতে পেঁয়াজ-লঙ্কা দিয়ে রুটি-তড়কা খেল বলে?

তুমি জানলে কী করে?

 কিছুই তো দেখিস না। আমরা যখন রেলওয়ে ক্যান্টিনে বিরিয়ানি খাচ্ছিলাম, ওরা পিছনের টেবিলেই ছিল। দু’জনেই খুব খাইয়ে। দশটা বারোটা করে রুটি নিয়েছে।

ও। তবু, লোক দুটো…

আর যাই হোক, তুই যা ভাবছিস তা নয়। এখন নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড় দেখি।

মিতিনমাসির কথায় টুপুর খানিকটা আশ্বস্ত হল বটে, কিন্তু পুরোপুরি স্বস্তি পাচ্ছে কই। মাঝে মাঝেই টুকরোটাকরা আওয়াজ ভেসে আসছে গলার। একজন বোধহয় উঠল সিট ছেড়ে, টুপুরদের কুপের সামনে দিয়ে জুতো মশমশিয়ে গেল দূরের বাথরুমটায়। কেন গেল ওদিকে? পুরো কামরা সরেজমিন করতে? যাক, ফিরছে লোকটা। আর কোনও সাড়াশব্দ নেই। শুয়ে পড়ল? নাকি কোনও মতলব ভাঁজছে?

ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘুমিয়েও পড়ল টুপুর। কত মাঠঘাট, কত নদনদী পেরিয়ে ছুটছে ট্রেন, দাঁড়াচ্ছে, আবার চলছে ঝমঝমিয়ে, টুপুর তখনও গভীর নিদ্রায়।

নাহ, ডাকাতি লুঠতরাজ কিছুই হয়নি। টুপুরের ঘুম ভাঙল মিতিনমাসির ঠেলাঠেলিতে, কী রে, ওঠ। মুখটুখ ধুয়ে নে। কটক তো এসে গেল, এবার নামতে হবে।

ওমা, তাই তো! সকাল তো হয়ে গিয়েছে। টুপুর প্রায় লাফিয়ে উঠল। ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে দৌড়োল বেসিনে। মুখে-চোখে জল ছিটিয়ে ফিরছে, তখনই ফের চমক। কর্মবীর আর শক্তিধর ব্যাগ গুছিয়ে তৈরি। ওঁরাও কটকে নামছেন?

হয়তো ওঁদের নামাটা স্রেফ কাকতালীয়। টুপুর জোরে জোরে মাথা নাড়ল। তবু মনটা যেন কেমন খচখচ করছে!

.

০২.

জঙ্গলের দোরগোড়ায় পৌঁছোতে বিকেল গড়িয়ে গেল। টুপুররা কটকে নেমেছিল সকাল সাড়ে আটটায়। তারপর সাকুল্যে একশো কিলোমিটারও আসেনি, তবু যে কীভাবে চলে গেল গোটা দিনটা!

প্রথম সময় নষ্ট হল গাড়ি ভাড়া করতে গিয়ে। কটকের বাদামবাড়ি বাসস্ট্যান্ডে বেশ কয়েকখানা জিপ দাঁড়িয়ে, কিন্তু কোনওটাই পার্থমেশোর পছন্দ হয় না। চেহারা মনোমতো হলে দরে বনে না, দর ঠিক হলে চালককে দেখে নাক সিঁটকোয়। শেষমেশ যে গাড়িটাকে মনে ধরল তার চালকটির একমাত্র গুণ, তিনি ভাল বাংলা বলতে পারেন। পার্থমেসোর সাফ কথা, তিন-তিনটে দিন প্রায় অষ্টপ্রহর থাকব, তার সঙ্গে আমি সারাক্ষণ ওড়িয়া, হিন্দি চালাতে রাজি নই। বলব এক, সে বুঝবে আর-এক। এতে নাকি বেড়ানোর আনন্দই অর্ধেক মাটি হয়ে যায়।

যাই হোক, বিভূতি নামের সেই ড্রাইভারটিকে নিয়ে যাত্রা শুরু। কিন্তু এন এইচ ফাইভ ধরে বারো তেরো কিলোমিটার গিয়ে এন এইচ বিয়াল্লিশে পড়ার পরই টের পাওয়া গেল, বিভূতিবাবু অত্যন্ত সাবধানি চালক। বাহনের গতি তিনি তিরিশ কিলোমিটারের উপরে ওঠাতেই চান না। মসৃণ রাজপথ ধরে অমন ঢিকুর ঢিকুর করে চলা যে কী দুঃসহ! গোদের উপর বিষফোঁড়া হয়েছে পার্থমেসোর সাম্প্রতিক নেশাটি। শুধু দামি ডিজিটাল ক্যামেরাই নেয়নি, সঙ্গে আছে একগাদা টেলিলেন্স। চলতে চলতে কোনও দৃশ্য চোখে লাগল তো ব্যস, ওমনি গাড়ি থামাও। নেমে ফোটো তুলছে তো তুলছেই। পথে পড়ল ঢেঙ্কানল, ছুটল রাজবাড়ির ছবি নিতে। এই করতে করতে গাড়ি যখন আঙুলের বনদফতরের সামনে এসে দাঁড়াল, তখন দুপুর প্রায় শেষ। কলকাতা থেকেই বনবাংলোর বুকিং করে রেখেছিল মিতিনমাসি, তবু সরকারি দফতরে গিয়ে কাগজপত্র তৈরি করে আনতে খানিকটা সময় তো খরচ হয়ই।

তবে মধ্যাহ্নভোজটি চটপটই সারা হয়েছিল আজ। খুবই সরল মেনু। আঙুলের এক পঞ্জাবি রেস্টুরেন্টে তন্দুরি রুটি আর কষা মাংস। কিন্তু আহার সেরে আর-একটি অভিযানে নামতে হল যে পার্থমেসোকে! সাতকোশিয়ার জঙ্গলে নাকি খাওয়াদাওয়ার কোনও বন্দোবস্ত নেই, নিজেদের রেশন নিজেদেরই বয়ে নিয়ে যেতে হয়। ফর্দ বানানোই ছিল পার্থমেসোর, ঘুরে ঘুরে বাজার করতে লাগল আঙুলে। চাল, ডাল, নুন, ঘি, তেল, চা, চিনি, আলু, পটল, ঝিঙে, ঢেঁড়শ, বেগুন, প্যাকেট প্যাকেট মশলা, বিস্কুট, পাউরুটি, আটা, ময়দা, এমনকী কেজিখানেক বেসনও। সকাল-বিকেল বেগুনি, পেঁয়াজি খেতে হবে যে! জ্যান্ত মুরগি কেনারও ইচ্ছে ছিল, মিতিনমাসি আর টুপুরের প্রবল আপত্তিতে বাতিল হয়ে গেল প্ল্যানটা। অগত্যা ডিমই ভরসা। ড্রাইভার সমেত পাঁচজন মানুষের জন্য পার্থমেসো প্রায় শ’খানেক ডিম কিনে ফেলল। ওমলেট খাবে, পোচ খাবে, ডালনা হবে, ডিমের খিচুড়ি হবে। কত কী যে তার ইচ্ছে! বিভূতিবাবু আগাগোড়াই ভাবলেশহীন ছিলেন, তিনি পর্যন্ত পার্থমেসোর ভোজনের পরিকল্পনা শুনে হাসছেন খুকখুক।

এভাবেই এগোতে এগোতে টুপুররা অবশেষে পৌঁছেছে পম্পাসারে। এখান থেকেই সাতকোশিয়া জঙ্গলের শুরু। রয়েছে বনবিভাগের চেকপোস্ট, সেখানে জাবেদা খাতায় যাত্রীদের নাম, ঠিকানা, গাড়ির নম্বর, সব লেখার পর জঙ্গলে ঘোরার অনুমতি মেলে।

লেখালিখির কাজটা মিতিনমাসিই সারছিল। টুপুর আর বুমবুম ঘুরে ঘুরে দেখছিল চারদিকটা। এখনও তেমন একটা জঙ্গল জঙ্গল ভাব আসেনি। তবে সামনেই যে গভীর অরণ্য, এখানেই যেন তার আভাস মিলছে অল্প অল্প। চতুর্দিক বেশ নির্জন, পাখির কিচিরমিচির ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। বসন্তের গাছগাছালি লালে লাল হয়ে আছে ফুলে ফুলে। একটা বুনো গন্ধও আসছে যেন।

হঠাৎই টুপুরের চোখ গিয়েছে চেকপোস্টে টাঙানো সাইনবোডর্টায়। জ্বলজ্বল করছে জঙ্গলের নাম, সাতকোশিয়া গর্জ ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি।

নিজের মনে টুপুর অস্ফুটে বলল, স্যাংচুয়ারি মানে তো অভয়ারণ্য। কিন্তু গর্জ ব্যাপারটা কী?

বুমবুম বিজ্ঞের মতো বলল, এখানে বাঘের গর্জন শোনা যায় তো, তাই নাম হয়েছে গর্জ।

ক্যামেরা কাঁধে পার্থ শাটার টিপছিল এলোমেলো। ছেলের জবাব শুনে হা হা হেসে উঠেছে, বেড়ে বলেছিস তো! তোর হেডে মনে হচ্ছে ব্রেন আছে!

টুপুর সন্দিগ্ধ চোখে বলল, গর্জন থেকে গর্জ?

আরে, না রে না। গর্জ তো ইংরিজি শব্দ, মানে গিরিখাত।

ওড়িশার জঙ্গলে আবার গিরিখাত আসে কোত্থেকে?

 উঁহু, জঙ্গলে গিরিখাত নয়। গিরিখাতে জঙ্গল।

 মানে?

আমরা এখন আর সমতলে নেই। প্রায় হাজার ফিট উঠে এসেছি। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে চলতে চলতে আরও খানিকটা ওঠানামা হবে। এটা পূর্বঘাট পর্বতমালার একটা অংশ। সেই পূর্বঘাটেরই কয়েকটা পাহাড়ের মধ্যে গিরিখাতে গড়ে উঠেছে এই জঙ্গলটা। ম্যাপ যা বলছে, জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বয়ে গিয়েছে মহানদী।

বিভূতি খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে পার্থর বর্ণনা শুনছিলেন। এগিয়ে এসে বললেন, হ্যাঁ স্যার, জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে সাত ক্রোশ পথ গিয়েছে মহানদী। মানে, চোদ্দো মাইল। আর ওই সাত ক্রোশ থেকেই জঙ্গলের নাম সাতকোশিয়া।

পার্থ ঘাড় নাড়ছে। জিজ্ঞেস করল, এখানে নাকি আগে তিনখানা জঙ্গল ছিল?

সে তো মহানদীর এপার-ওপার মিলিয়ে। এখন সবক’টা একসঙ্গে নিয়ে সাতকোশিয়া। তবে এপারের জঙ্গলটি বেশি ঘন। জন্তুজানোয়ারও এপারেই বেশি।

দেখা যায় কাউকে? নাকি সবাই জঙ্গলে ঘাপটি মেরে থাকে?

কপালে থাকলে চোখে পড়বে স্যার। হরিণ তো পাবেনই, বাইসনও মিলতে পারে। এখন তো মহুয়াফুল ফোঁটার সময়। ভল্লুক মহুয়া খেতে খুব ভালবাসে, তাই তাদেরও হয়তো দেখা পেতে পারেন।

বুমবুম চেঁচিয়ে উঠল, আর বাঘ? হাতি?

ওরা একটু দূরে দূরে থাকাই ভাল, বুঝলে খোকা। বিশেষ করে হাতি।

কেন? হাতি তো খুব ভাল। লোকে তো হাতির পিঠে চড়ে।

 জঙ্গলের হাতি মোটেই সেরকম শান্তশিষ্ট নয়, খুব রাগী। সামনে পড়লে খেপে গিয়ে আমাদের আস্ত জিপগাড়িখানা উলটে দিতে পারে, বিভূতি চোখ ঘোরালেন, তবে বাঘ এ জঙ্গলে বেশি নেই। যা আছে বেশিরভাগই চিতা। তারাও বড় মারাত্মক। কাউকে যদি জঙ্গলে একা পেয়ে যায়, বিশেষ করে বাচ্চাদের…

বুমবুমের মুখ শুকিয়ে আমসি। ছেলের ভাবান্তর নজরে পড়েছে পার্থর। এগিয়ে এসে হাত রাখল ছেলের মাথায়, আহা, ঘাবড়াচ্ছিস কেন? বনজঙ্গলে তুই একা একা ঘুরবি নাকি? আমরা তো থাকব সঙ্গে।

অমনি বুমবুমের মুখে হাসি ফিরেছে। সগর্বে বলল, আমি ভয় পাইনি তো। লেপার্ড এলে আমি ঢিল মেরে তাড়িয়ে দেব।

বটে? চল তো ভিতরে, দেখব তোর কত সাহস। ঘরে বসে একবার বাঘের ডাক শুনলেই তো আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে যাবে।

শুনেই বুমবুমের মুখ ফের কাঁচুমাচু। বিভূতি তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, না গো খোকা। তোমরা যেখানে থাকবে, মানে টিকরপাড়া বনবাংলোয়, ওদিকটায় বাঘ, চিতাবাঘ আসে না বড় একটা। লবঙ্গির জঙ্গলেই ওদের বেশি উপদ্রব। আর টুলকায়।

টুপুর অবাক মুখে বলল, সেগুলো আবার কোথায়?

সাতকোশিয়ার ভিতরেই।

আমরা সেখানে যাব না?

নিশ্চয়ই যাব, পার্থ বলল, বিভূতিবাবুর সঙ্গে আমার কথা হয়ে গিয়েছে। উনি আমাদের গোটা জঙ্গলটাই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাবেন। এই ফরেস্ট তো আপনার হাতের তালুর মতো চেনা। তাই না বিভূতিবাবু?

হ্যাঁ স্যার, পুরোটাই আমার নখদর্পণে। প্রতি বছরই পাঁচ-ছ’বার করে আসি কিনা। এই তো পরশু দু’জনকে পৌঁছে দিয়ে গেলাম। কলেজের এক মাস্টারমশাই, আর তাঁর ছাত্র। সাতদিন পর ফিরবেন। কথা হয়েছে, ফোন করে ডাকলে আমি এসে নিয়ে যাব।

জঙ্গলে ওঁরা গাড়ি ছাড়াই ঘুরবেন?

অনেকেই ওরকম ঘোরে স্যার। অ্যাডভেঞ্চার করতে ভালবাসে।

টুপুর জিজ্ঞেস করল, তা হলে টিকরপাড়ায় আমরা কী দেখতে পাব? শুধুই কুমির? মানে ঘড়িয়াল?

হ্যাঁগো দিদিভাই। ঘড়িয়াল তো ওখানে কিলবিল করছে। নদীতে, পাশের খাঁচায়, রোগাসোগা ছোটোখাটো চেহারা বিভূতির মুখে চিলতে হাসি দেখা গেল। কাঁচাপাকা গোঁফে আঙুল চালাতে চালাতে বললেন, মাঝে মাঝে ভারী বিপদ ঘটায় ঘড়িয়ালগুলো। বনবাংলোর বারান্দায় পর্যন্ত চলে আসে। দরজায় ঠকঠক করে।

দৃশ্যটা মোটেই মজার বলে মনে হল না টুপুরের। ঘরের সামনে কুমির ঘুরে বেড়াবে, এ কেমন জঙ্গল রে বাবা? মাছ খায় বলে মানুষের হাত-পা চেখে দেখবে না, এমন তো কোনও গ্যারান্টি নেই।

টুপুরের বুকে একটা হালকা কাঁপুনি শুরু হয়েছিল, তখনই মিতিন ফিরেছে। কাগজপত্র ব্যাগে ঢোকাতে ঢোকাতে বলল, চল চল, বাংলোয় ঢুকতে সন্ধে না হয়ে যায়।

ঝটিতি জিপে উঠে যে যার সিটে। গাড়ি স্টার্ট দিয়েছেন বিভূতি। সরু পিচের রাস্তা ধরে চলেছেন নিজস্ব গতিতে। শেষ বিকেলের আলো মেখে শাল-সেগুনের জঙ্গল ভারী মায়াবী এখন।

বাইরেটা দেখতে দেখতে মিতিন পার্থকে বলল, তোমার ক্যামেরার ডিটেলটাও চেকপোস্টে এন্ট্রি করাতে হল। ভিডিও না স্টিল, তাও নোট ডাউন করল।

তাই নাকি? পার্থ কাঁধ ঝাঁকাল, দারুণ কড়াকড়ি তো!

ছাই কড়াকড়ি, স্টিয়ারিং থেকে বিভূতি বলে উঠলেন, একে বলে বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো।

কেন? কেন?

সাধারণ টুরিস্টের উপর খুব নিয়মকানুন ফলায়। ওদিকে চোরা শিকারিরা গার্ডদের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিব্যি নিজেদের কাজ হাসিল করে যাচ্ছে।

কীরকম?

এই তো গত বছরেই দু-দুটো চিতাবাঘ মারা পড়ল। তিনটে হরিণও।

খবরটা পড়েছি, মিতিন মাথা নাড়ল, চামড়া ছাড়িয়ে বডিগুলো ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল। মোটামুটি এই সময়েই ঘটেছিল, তাই না? কেউ বোধহয় ধরাও পড়েনি?

আপনি তো অনেক খবর রাখেন ম্যাডাম, বিভূতির স্বরে তারিফ। আপনমনেই বললেন, সত্যি, তখন কত হইহল্লা হল। পুলিশের বড় বড় অফিসার এসে কী হয়রানিই না করল টুরিস্টদের। কিন্তু পাজিগুলোর টিকিও ছুঁতে পারল না। ওড়িশার পুলিশ একেবারে অপদার্থ।

সব রাজ্যের পুলিশই প্রায় সমান বিভূতিবাবু, পার্থর গলায় পলকা ব্যঙ্গ, এই তো, দু’-তিন সপ্তাহ আগেই দেখলাম আমাদের সুন্দরবনে চোরাশিকারিরা ঢুকে একটা বাঘ মেরেছে এবং চামড়াটি ছাড়িয়ে ভাগলবা। বন দফতর, পুলিশ কেউ কিছু করতে পারল?

টুপুর করুণ মুখে বলল, ওইসব লোক কী খারাপ! জন্তুজানোয়ার মেরে তাদের ছাল ছাড়িয়ে নেয়।

টাকার জন্য মানুষ কী না করে! একটা রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চামড়ার দাম তো কম নয়। পার্থ সামনের সিট থেকে মিতিনের দিকে ঘুরে তাকাল, মিনিমাম তিন-চার লাখ, কী বলো?

জানি না। গবেষণায় আমার স্পৃহাও নেই, মিতিন অল্প হাসল। তবে তোমায় একটা অন্য খবর দিতে পারি। জঙ্গল টুরে নিউজটা বোধহয় আমাদের কাজে লাগবে।

কী?

 টিকরপাড়া ফরেস্ট বাংলোর চৌকিদারটি নাকি গতকাল সকাল থেকে হাওয়া। চেকপোস্টের গার্ডরা জানাল।

পার্থ চোখ পিটপিট করল, তো? আমাদের তাতে কী এল গেল?

ওই চৌকিদারটিই টুরিস্টদের রান্নাবান্না করে দিত।

অ্যাঁ? পার্থ এবার জোর ঝাঁকুনি খেয়েছে। ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে বলল, সর্বনাশ! আমাদের খাওয়াদাওয়ার কী হবে তা হলে?

এত তুমি ভোজনরসিক, মিতিন টুপুরের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল, কদিন তুমিই না হয় আমাদের রেঁধেবেড়ে খাওয়াবে।

সে তো আমি পারিই। কুকিং কী এমন কঠিন কাজ? তবে কিনা, বেড়াতে এসে ভেবেছিলাম ঘুরে ঘুরে একটু ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফি করব, বলতে বলতে হঠাৎ কী ভেবে স্টিয়ারিং-এর দিকে ঘাড় ঘুরিয়েছে, বিভূতিবাবু, আপনি রান্নাবান্না জানেন না?

জঙ্গল হালকা হয়েছে খানিকটা। ছোট্ট একটা গ্রাম পেরোচ্ছে গাড়ি। ডান দিকে একটি স্কুল। সামনের মাঠে ফুটবল পেটাচ্ছে জনাকয়েক কিশোর। সেদিকে একবার দেখে নিয়ে বিভূতি মৃদু স্বরে বললেন, পারি স্যার। অল্পস্বল্প।

ভাতের ফ্যান গালতে পারেন?

হ্যাঁ।

রুটি সেঁকতে পারেন? লুচি, পরোটা ভাজা?

তাও পারি। তবে একটু তেড়াবেঁকা হয়।

নো প্রবলেম। ওড়িশার ম্যাপের মতো হলেও চলবে, পার্থকে বেশ খুশিখুশি দেখাল, ডাল, ভাজা, ডিমের ডালনাও পারেন নিশ্চয়ই?

করেছি মাঝে মাঝে। খুব ভাল না হলেও মুখে তোলা যাবে।

আর পকোড়া টকোড়া?

চেষ্টা করলে হয়তো পারব। ওই বেসনে ডুবিয়ে তেলে ছেড়ে দেওয়া তো?

ইয়েস। দ্যাটস অল উই নিড! উচ্ছ্বাসে ইংরিজি বেরিয়ে গেল পার্থর। বত্রিশ পাটি দন্ত বিকশিত করে বলল, রান্নার দায়িত্বটা তা হলে আপনিই নিন। আমরাও থাকব, হেল্পটেল্প করব। সবাই মিলে ক’দিন ধরে বেশ একটা বনভোজন বনভোজন চলবে। কী বিভূতিবাবু, রাজি তো?

ছোট্ট করে ঘাড় নাড়লেন বিভূতি। নীরব সম্মতিটুকু পেয়ে পার্থ আহ্লাদে আটখানা। ঘুরে টুপুরকে বলল, তোর মাসি আমায় জব্দ করবে ভেবেছিল। কেমন একটা ব্যবস্থা করে ফেললাম দ্যাখ। হা হা হা।

বুমবুম খলখল হেসে উঠল কিছুই না বুঝে। টুপুরও হাসছে মিটিমিটি। গ্রাম ছাড়িয়ে আবার ছেঁড়া ছেঁড়া জঙ্গলে ঢুকেছে গাড়ি। যেতে যেতেই বাঁয়ে একখানা বনবাংলো। পুরানাকোট ফরেস্ট রেস্ট হাউস। কোনও লোকজন নেই, শুনশান পরিবেশে যেন ঝিমোচ্ছে বাংলোটা। তার একটু পরেই এসে গিয়েছে টিকরপাড়া।

পাশাপাশি তিনখানা বাড়ি। একটায় বনবিভাগের অফিস কাম ফরেস্ট অফিসারদের ইনস্পেকশন বাংলো। মন্ত্রীসান্ত্রিরাও এসে থাকেন সেখানে। অন্য দুটো বাংলো সাধারণ ভ্রমণার্থীদের জন্যে। বাংলোর সামনে একটা বড়সড় লন। সেখানে গাড়ি থামতেই বনবিভাগের কর্মচারী হাজির। টুপুরদের বুকিং-এর কাগজপত্র তিনি দেখলেন খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে। তারপর চাবি এনে খুলে দিলেন একটা দু’কামরাওয়ালা স্যুইট। ভিতরে বন্দোবস্ত মন্দ নয়। বড় বড় খাট, আলমারি, সোফা, ড্রেসিংটেবিল সবই পরিচ্ছন্নভাবে সাজানো। ডাইনিংটেবিল পেতে খাওয়ার জায়গাও করা আছে একখানা। বাথরুম ঝকঝকে, শাওয়ারও মজুত। আরাম করে থাকতে গেলে এর বেশি আর কী-ই বা চাই!

ব্যাগ, সুটকেস ঢোকানো হয়েছে ঘরে। বিছানায় গড়িয়ে পড়েছে পার্থ। হাঁক ছাড়ল, টুপুর, বিভূতিবাবুকে বল তো, আমাদের খাওয়ার জিনিসপত্রগুলো যেন গাড়ি থেকে নামিয়ে নেন। আর এখন একটু চা হলে ভাল হয়।

অমনি মিতিনের ধমক, অ্যাই, নিজে ওঠো তো! বেচারা এতক্ষণ গাড়ি চালিয়ে এসেছেন, তুমি গিয়ে বিভূতিবাবুর সঙ্গে হাত লাগাও। রান্নাঘরগুলো ওই দূরে, জিনিসপত্র নিজেই পৌঁছে দিয়ে এসো।

অগত্যা সুখশয্যা ছাড়তেই হল পার্থকে। টুপুর পায়ে পায়ে বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে লনটায়। দিনের আলো প্রায় মরে এসেছে। ঘরে ফেরা পাখিদের কলকাকলিতে জঙ্গল এখন রীতিমতো মুখর। এত শব্দ যে, কান ঝালাপালা হওয়ার জোগাড়। তাদের বাংলোখানা পাহাড়ের প্রায় শেষ প্রান্তে। অনেকটা নীচ থেকে ভেসে আসছে নদীর আওয়াজ। লন থেকে দেখা যাচ্ছে না নদীটাকে, তাই যেন ওই শব্দে কেমন গা ছমছম করে। খানিকটা দূরে, নদীর ওপারে আবার পাহাড়। সবুজে ছাওয়া। সূর্য বুঝি ওই পাহাড়ের আড়ালে ডুবেছে, ছায়া নেমেছে পাহাড়ে। নদীটাকেও এবার দূরে দেখতে পেল টুপুর। এঁকেবেঁকে চলে যাচ্ছে পাহাড়ের পিছনে। এই ছায়া ছায়া আলোয় দৃশ্যটা যে কী অপরূপ!

হঠাৎই পাশে বুমবুম। তিড়িংবিড়িং লাফাচ্ছে। সঙ্গে মিতিনমাসি। হাতে ইনফ্রারেড বাইনোকুলার। খাঁটি জার্মান যন্ত্র, রাতেও দূরের বস্তু দেখা যায়। বেশ। একটু লালচে ভাবে, তবে মোটামুটি স্পষ্ট।

বাইনোকুলার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারদিক দেখছিল মিতিন। হঠাৎ টুপুরকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, দূরে মাঠটায় ফোকাস কর। চেনা কিছু পাচ্ছিস?

টুপুর চোখে লাগাল যন্ত্রটা। নদীর পারে একটা তাঁবু। তার সামনে দুটো লোক হাত পা ছড়িয়ে শরীরচর্চা করছে।

টুপুরের হৃৎপিণ্ড আচমকা লাফিয়ে উঠল। কী কাণ্ড, ট্রেনের সেই মুশকো লোক দুটো না! কর্মবীর আর শক্তিধর?