৩-৪. চেহারাটি দেখার মতো

ভদ্রমহিলার চেহারাটি দেখার মতো। বয়স হয়ে গিয়েছে, তবু এখনও কী টকটকে রং। নাক-চোখ-মুখও বেশ কাটা কাটা। বোঝাই যায় একসময়ে দারুণ সুন্দরী ছিলেন। লম্বাও আছেন বেশ, তবে বয়সের ভারে সামান্য কুঁজো যেন। পরনে ঘিয়ে রঙের ঢলঢলে পাজামা, ফুলহাতা লম্বা ঝুল মেরুন কুর্তা। মাথায় কাপড়ের ফেট্টি।

টুপুরদের উলটো দিকের সোফায় বসে র‍্যাচেল বললেন, ডেভিড আপনাদের মাথা ধরিয়ে দিয়েছে তো? সেই একই প্রসঙ্গ কচলাচ্ছে নিশ্চয়ই?

মিতিন বলল, না না, আমি ওঁর কাছে আপনাদের ফ্যামিলির গল্প শুনছিলাম।

তার সঙ্গে এটা এখনও বলেনি, যোশুয়া পরিবার এবার কলকাতা থেকে নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে?

ঠাট্টা কোরো না র‍্যাচেল। ডেভিড রীতিমতো আহত হয়েছেন। গোমড়া গলায় বললেন, কেন মানতে চাইছ না, আব্রাহাম আর ক্যাথলিনের মৃত্যুটা এমনি এমনি হয়নি? মাটুকরা খতম হয়েছে, এবার যোশুয়াদের পালা। এবার নিশ্চয়ই আমাকে মরতে হবে।

ফের ওই কথা?

 একশোবার বলব। হাজারবার বলব। আমি মৃত্যুর সিগনাল পাচ্ছি।

 কে পাঠাচ্ছে? তোমার সেই ভূতুড়ে ফোনটা?

অবশ্যই। আমাকে তিন তিনবার জানিয়েছে, এ বাড়িতে ফের মৃত্যু হানা দিচ্ছে।

আর কলটা এমন একটা নম্বর থেকে আসছে, যা একেবারেই ভুয়ো। তোমায় টেলিফোন কোম্পানি পর্যন্ত বলছে ওই নম্বরটাই নেই।

দাঁড়ান, দাঁড়ান, মিতিন এবার দু’হাত তুলে থামিয়েছে র‍্যাচেলকে, ওই টেলিফোনের কেসটা একটু বুঝে নিতে দিন। সত্যিই কি আপনি থ্রেটনিং কল পেয়েছেন মিস্টার যোশুয়া?

বললাম তো, একবার নয়, তিন তিনবার। দু’বার পুরুষের গলায়, একবার মহিলার গলায়।

আপনার মোবাইলে?

 না। ল্যান্ডলাইনে। আমি মোবাইল ব্যবহার করি না।

ও হ্যাঁ। মিস্টার মজুমদার তো আপনার ল্যান্ডলাইন নম্বরটাই আমায় দিয়েছেন, মিতিন অপ্রস্তুত মুখে হাসল, তা হলে নিশ্চয়ই আপনার ল্যান্ডলাইনে কলার আইডি আছে?

না হলে আর নম্বরগুলো পাচ্ছি কোত্থেকে? কিন্তু কল ব্যাক করলে প্রত্যেকবার একই জবাব। দিস নাম্বার ডাজ নট এগজিস্ট।

তিনটে ফোন নিশ্চয়ই তিনটে আলাদা নম্বর থেকে এসেছে?

ঠিক তাই।

ফোনে এগজাক্টলি কী বলছে?

এ ডেথ ইজ কামিং। বিওয়্যার ডেভিড।

 তিনবারই এক ডায়লগ?

হুবহু এক। মিস্টার মজুমদারকে তো জানিয়েছিলাম। নম্বর তিনটেও দিয়েছি। উনিও তো ট্রেস করতে পারেননি।

পারবেন কোত্থেকে? র‍্যাচেল ফুট কাটলেন, তোমার কলার আইডিটি বোগাস। ফোনগুলোও মনগড়া। তোমার ভীমরতি ধরেছে, বুঝলে?

ডেভিড গোঁজ। মুখে আর বাক্যটি নেই। বৃদ্ধ-বৃদ্ধার কলহের মাঝে পড়ে মিতিনরাও চুপ। টুপুর আড়ে আড়ে তাকাচ্ছে কড়িকাঠওয়ালা সিলিং-এর দিকে। সেখানে চার ডানার লম্বা ডাঁটি ফ্যান ঘুরছে ঘটাং ঘট। পার্থ অবশ্য নিজস্ব কাজে ব্যস্ত। শরবত শেষ করে নিবিষ্ট মনে কাজুবাদাম চিবোচ্ছে।

একটু পর র‍্যাচেলই নিস্তব্ধতা ভাঙলেন। আক্ষেপের সুরে বললেন, কতবার করে ডেভিডকে বোঝাচ্ছি খামোখা এসব ভয়টয় পাওয়ার দরকার কী? ছেলে তো লন্ডন থেকে ডাকছে। এই যক্ষপুরী আগলে না থেকে সব বিক্রিবাটা করে সাইমনের কাছে চলে গেলেই তো হয়।

আপনাদের ছেলে কতদিন লন্ডনে আছেন?

তিরিশ বছর। আগে শেয়ারের বিজনেস করত, এখন স্পোর্টস গুডসের দোকান খুলেছে। আমরা পাকাপাকি ভাবে চলে গেলে সাইমন যে কী খুশি হবে! র‍্যাচেল ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেললেন, কিন্তু ডেভিডের ওই এক গোঁ। আব্রাহামের মতো সেও কলকাতা ছেড়ে নড়বে না। যে শহরে জন্মেছে, সেখানেই নাকি ওকে মরতে হবে। নারকেলডাঙার গোরস্থানে শুতে না পারলে ওর আত্মা নাকি শান্তি পাবে না। অথচ দেখুন, বাড়ি-জমি বিক্রি করে আমরা এখন কত আরামে লন্ডনে গিয়ে থাকতে পারি। ছেলে আছে, ছেলের বউ আছে, নাতি-নাতনি আছে। জানেনই তো, আমরা ইহুদিরা দেশ দেশান্তরে ঘুরে মরা জাত। তাই আত্মীয়স্বজনের মাঝে থাকতে পেলে আমাদের যা আনন্দ হয়, তেমনটা আর কিছুতে নয়। এই ডেভিডের জেদের জন্য সে সুখটুকুও আমার কপালে নেই।

ডেভিড বিরক্ত স্বরে বললেন, আমি তো এবার মরছি। তুমি তারপর যা খুশি কোরো।

করবই তো। সব বিক্রি করে চলে যাব।

পার্থ চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে স্বামী-স্ত্রীর কথা শুনছিল। হঠাৎ বলে উঠল, আচ্ছা, আপনাদের এরকম একটা জায়গায় বাড়ি, প্রোমোটাররা জ্বালাতন করে না?

করে না আবার! ডেভেলপার আর প্রোমোটারদের লাইন তো সেই কবে থেকে লেগে আছে, র‍্যাচেলের গলায় উষ্মা ঝরে পড়ল, আব্রাহাম তো তাদের সোজা হাঁকিয়ে দিত। এখন ডেভিডও সেই রাস্তায় হাঁটছে। আরে শ্যামচাঁদবাবু তো ঘরের লোক। তিনিও তো কবে থেকে হত্যে দিয়ে পড়ে আছেন। তাকেও তো পাত্তা দিচ্ছে না।

মিতিন ঈষৎ ভুরু কুঁচকোল, কে শ্যামচাঁদ?

শ্যামচাঁদ অগ্রবাল। আব্রাহামের খুব বন্ধু। সেই সূত্রে ডেভিডেরও। ভদ্রলোক অগ্রবাল কনস্ট্রাকশনের মালিক।

মিস্টার আব্রাহাম কী করে শ্যামচাঁদের বন্ধু হলেন? উনিও কি বাড়ি তৈরির লাইনে ছিলেন কখনও?।

একেবারেই না। আব্রাহাম সঞ্চয়ের টাকা সুদে খাটাতেন। শ্যামচাঁদ ছিলেন ওঁর ক্লায়েন্ট। এখন শ্যামচাঁদবাবুর বয়স হয়েছে, তিনি আর ব্যবসা দেখেন না, ছেলেদের হাতে সব ছেড়ে দিয়েছেন। এখন এ বাড়িতে এসে তাসের আড্ডা জমান। ওই খেলতে খেলতেই অনেকবার বাড়ি-জমির কথা তুলেছেন।

ও। মিস্টার আব্রাহামের তাসের নেশা ছিল বুঝি?

ডেভিডেরও আছে।

আর কে কে আসেন খেলতে?

আমাদের সমাজের আছেন দু-তিনজন। এ ছাড়া এক বাঙালি প্রোফেসর। আমরা লন্ডন থেকে ঘুরে আসার পর থেকে তো দেখছি ডাক্তারবাবুও আসছেন রোজ।

পার্থ গোল গোল চোখে তাকাল, বাঙালি প্রোফেসর, ডাক্তার, তাঁরা এই পাড়ায় এসে তাস খেলেন?

এতে আশ্চর্য হওয়ার কী আছে? অনেকক্ষণ পর ডেভিডের স্বর ফুটল, প্রোফেসার হিরন্ময় সেন আরবি পড়াতেন। আব্রাহামও ওই ভাষায় যথেষ্ট পণ্ডিত ছিলেন। সেই সূত্রে দু’জনের আলাপ। এবং ফ্রেন্ডশিপ। হিরন্ময়বাবুই তো যতীনকে দিয়েছেন। আর ডাক্তারবাবুর প্র্যাকটিসে তেমন মন নেই। কাছেই তালতলায় থাকেন। বিকেল পর্যন্ত চেম্বার করে চলে আসেন আড্ডায়।

আজ তাঁরা আসবেন না?

উঁহু, শনি-রবি আসর বন্ধ থাকে।

কেন?

শনিবার স্যাবাথ। আমাদের পবিত্র বিশ্রামের দিন। জিহোভা পৃথিবী সৃষ্টি করার সময় ওই দিনটাই অবসর নিয়েছিলেন তো৷ আমরাও ওই দিন তাস টাস ছুঁই না। রোববারটাও আজকাল পুরো রেস্ট নিই, ডেভিডকে এতক্ষণে একটু চাঙ্গা দেখাল, আমরা যে শুধু তাস খেলি তা নয়, সংগীতচর্চাও হয়। আব্রাহাম পিয়ানো বাজাত। আমি অল্পস্বল্প ভায়োলিন জানি। ডাক্তারবাবু বাঁশিতে ওস্তাদ। র‍্যাচেল মাঝে মাঝে গান করে। দিব্যি জমে যায় সন্ধেগুলো। এইসব নেশার টানেই তো পড়ে আছি কলকাতায়। লন্ডনে গেলে এমনটা কি পাব?

থামো তো, র‍্যাচেল ঝামটা দিয়ে উঠলেন, বকতে শুরু করলে তোমার কথা আর ফুরোয় না।

সে তো তোমারও। কথা কি তুমি কম বলো?

তোমার মতো মাত্রাজ্ঞান হারাই না, র‍্যাচেল বিচিত্র মুখভঙ্গি করলেন, জানেন, লন্ডনে গিয়ে কী কাণ্ড করেছিল? ওখানে ইহুদিদের একটা খুদে জমায়েত হয়েছিল। স্পেন, পর্তুগাল, হাঙ্গেরি, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি নানান দেশের ইহুদি এসেছিল সেখানে। সুযোগ পেয়ে তাদের মাঝে ডেভিড এমন একটা আষাঢ়ে গল্প ফেঁদে বসল।

আষাঢ়ে বলছ কেন? আমি মিছে কথা তো কিছু বলিনি।

তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে বলো, এ বাড়িতে গুপ্তধন আছে?

অসম্ভব কী? আব্রাহাম স্বয়ং আমায় বলেছে। তা ছাড়া আমরা ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি, মাটুকদের এ বাড়িতে যা আছে, মূল্য দিয়ে তার হিসেব করা যাবে না, ডেভিড রীতিমতো জোরের সঙ্গে বললেন কথাগুলো। মাথা দুলিয়ে ফের বললেন, আর মাটুকদের ঘরে যে মহামূল্যবান সম্পদ থাকবে, এটা তো খুবই স্বাভাবিক। ওদের বংশের কথাটা ভাবো। যে সে নয়, স্বয়ং শ্যালোম কোহেন ওদের পূর্বপুরুষ।

পার্থ চোখ পিটপিট করল, শ্যালোম কোহেন কে?

আমাদের কলকাতার ইহুদিদের আদি পুরুষ। একজন নমস্য ব্যক্তি। জন্মেছিলেন সিরিয়ার আলেপ্পোয়। মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সে বাগদাদ-বসরা হয়ে ইংরেজদের জাহাজে চেপে মুম্বই এসে পৌঁছেন। ওখান থেকেই মেসোপটেমিয়ায়, এখন যাকে বলে ইরাক, ব্যবসা চালাতেন। মুম্বই থেকে যান সুরাট। তারপর লখনউ। অবশেষে কলকাতায় এসে থিতু হন। এই কলকাতায় বসে উনি হিরে, সিল্ক, নীল আর ঢাকাই মসলিনের বিশাল কারবার ফেঁদেছিলেন। লখনউতে বসবাসের সময়ে শ্যালোম ছিলেন সেখানকার নবাবের খাস মণিকার। হিরেজহরত খুব ভাল চিনতেন কিনা। শোনা যায় লখনউ থেকে চলে আসার সময়ে প্রচুর ধনরত্ন নিয়ে এসেছিলেন শ্যালোম। তাঁর কোনও ছেলে ছিল না, ছিল তিন মেয়ে। একজনের বিয়ে হয়েছিল ডোয়েক পরিবারে, একজনের সদকা, তৃতীয়জনের মাটুক। তিন জামাইকে ধনরত্ন সমান ভাবে ভাগ করে দিয়েছিলেন শ্যালোম। সুতরাং আব্রাহামদের এই বাড়িতে মণিমুক্তো থাকা মোটেই বিচিত্র নয়।

কিন্তু এর মধ্যে গুপ্তধন আসছে কোত্থেকে, পার্থ তর্ক জুড়ল, মণিমুক্তো যাই থাকুক, তা নিশ্চয়ই মিস্টার আব্রাহামের কাছেই…।

না, র‍্যাচেল বলে উঠলেন, আব্রাহামরাও চার-পাঁচ পুরুষ ধরে ওই ধনরত্নের গল্পই শুনে আসছেন। কেউ তেমন কিছু চোখেও দেখেননি, হাতেও পাননি।

সেই জন্যই তো বলা হচ্ছে গুপ্তধন, ডেভিড প্রায় লুফে নিলেন কথাটা। তর্জনী উঁচিয়ে বললেন, শ্যালোম কোহেনের জামাই দানিয়েল মাটুক নিশ্চয়ই কোথাও লুকিয়ে রেখে গিয়েছেন। শুনেছি শ্যালোমের মণিমাণিক্যের মধ্যে একখানা পাথর ছিল বদখশানি চুনি। যার জুড়ি নাকি দুনিয়ায় নেই।

যত্ত সব আজগুবি গপ্পো, র‍্যাচেল ফের বিরক্তি প্রকাশ করলেন, খামোকা তুমি গুজবটাকে উশকে দাও। কী দরকার ছিল লন্ডনের আসরে ওই কাহিনি শোনানোর? বক্তৃতাটা আবার সিডি করে এনে আব্রাহামকে উপহার দিলে।

আহা, আব্রাহাম তো তাতে খুশিই হয়েছিল।

মোটেই না। মজা পেয়েছিল। সিডিটা বন্ধুদের দেখিয়ে কত হাসাহাসি করেছিল মনে নেই?

তুমি ঠিক বলছ না র‍্যাচেল। কেউ হাসেনি। সবাই আগ্রহ নিয়ে দেখেছে।

যদি তাই ভাবো তো তাই। আমার আর কিছু বলার নেই।

র‍্যাচেলের প্রতিবাদে ডেভিড যথেষ্ট ক্ষুণ্ণ হয়েছেন। বসে আছেন ঘাড় ঝুলিয়ে। একটু পরে মাথা তুলে মিতিনকে বললেন, আপনি আমাকে কী ভাবছেন জানি না। হয়তো পাগল টাগলই মনে করছেন। কিন্তু আমার অন্তর যা বলছে, সেটাই আপনাকে জানালাম।

মিতিন মৃদু স্বরে বলল, আমি বুঝতে পারছি মিস্টার যোশুয়া। কিন্তু…

শুনুন ম্যাডাম, মিতিনকে থামিয়ে ডেভিড বলে উঠলেন, যাঁরা চলে গিয়েছেন তাঁদের ব্যাপারে আপনার আর কিছু করার নেই। তবে এখন আপনাকে একটা কাজের আগাম দায়িত্ব দিয়ে রাখতে চাই। যদি অদূর ভবিষ্যতে আমি মারা যাই এবং মৃত্যুটা যদি স্বাভাবিকও হয়, আমি চাই আপনি তার তদন্ত করুন। র‍্যাচেলের সামনেই বলছি, আপনার জন্য একটা পারিশ্রমিক ধার্য করা থাকবে, র‍্যাচেল আপনাকে সেটা দিয়ে দেবে। আশা করি আপনি এই প্রস্তাবে সম্মত?

মিতিন সামান্য থতমত মুখে ঘাড় নেড়ে দিল।

ডেভিড কোর্টের পকেট থেকে একটা সাদা খাম বার করে বাড়িয়ে দিলেন, অনুগ্রহ করে এটা রাখুন।

কী আছে এতে?

 সামান্য কিছু অর্থ।

 কীসের জন্য?

 আপনি যে আমার জন্য সময়টুকু ব্যয় করলেন, তারই পারিশ্রমিক।

এ মা, না না। আমি তো মিস্টার মজুমদারের কথা শুনে আপনার সঙ্গে শুধু আলাপ করতে এসেছিলাম।

মাপ করবেন ম্যাডাম। আমরা ইহুদিরা বিনামূল্যে কোনও কাজ করি না। করাইও না। তবু যদি আপনার বাধোবাধো ঠেকে, টাকাটা অগ্রিম হিসেবে ধরে নিন। ক’দিন পরেই তো আপনাকে তদন্তে নামতে হবে, আমি জানি।

টুপুর থ। জ্যান্ত অবস্থায় নিজের মৃত্যুরহস্য তদন্তের টাকা দিচ্ছেন আগ বাড়িয়ে। এমন আজব মানুষ টুপুর জীবনে দ্যাখেনি।

.

০৪.

রাতে খেতে বসে পার্থ বলল, বুঝলি টুপুর, ভেবে দেখলাম, আমাদের ধারণা ঠিক না-ও হতে পারে।

টুপুর আহারে মন দিয়েছিল। আজ নৈশভোজের পদ একটু অন্যরকম। ডেভিড যোশুয়ার বাড়ি থেকে ফিরে কী যে খেয়াল চাপল মিতিনের, সটান ঢুকে গেল কিচেনে। নিজেই হাত লাগাল রান্নাবান্নায়। সবজি টবজি সেদ্ধ করে গ্রেভিওয়ালা চাউমিন বানাল। সঙ্গে লেমন চিকেন। দুটোই দারুণ হয়েছে। মিতিন মাসির হাতে কী জাদু আছে কে জানে। যাই রাঁধুক, টুপুরের মনে হয় অমৃত। নুন-মিষ্টি-টক-ঝাল সবই যেন নিখুঁত।

একটা চিকেনের টুকরো কাঁটায় গেঁথে টুপুর মুখ তুলল। ভুরু বাঁকিয়ে বলল, কোন ধারণাটা গো?

ওই যে তখন বলছিলাম না ডেভিড যোশুয়া মানুষটা বদ্ধ পাগল? ওঁর মাথার চিকিৎসা হওয়া দরকার?

হ্যাঁ, আলোচনাটা ওই লাইনেই ঘুরপাক খাচ্ছিল বটে। মাকুইস স্ট্রিটের বাড়িটা থেকে বেরিয়েই পার্থমেসোর সে কী হাসি, তোর মাসি আজ কার মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠেছিল রে টুপুর! ফাঁকতালে পাঁচ হাজার টাকাসুদ্ধ একটা খাম মিলে গেল। ডেভিড যোশুয়ার তো মোটেই ডিটেকটিভের প্রয়োজন নেই, ওঁর তো আসলে দরকার একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। যিনি কিনা বৃদ্ধের মন থেকে বিটকেল মৃত্যুভয়টা উপড়ে ফেলতে পারেন। ফোকটে বিপুল সম্পত্তি মিলে গেছে বলে কোথায় উনি ধেইধেই নাচবেন তা নয়, নিজেই একটা আতঙ্ক তৈরি করে সেই জুজুর ভয়ে কাঁপছেন।

টুপুরও মেসোর তালে তাল দিয়েছে সারাক্ষণ। মিস্টার যোশুয়ার কথাবার্তা আগাগোড়াই তার কেমন অসংলগ্ন ঠেকেছে। মাঝখানে কোত্থেকে একটা গপপোও আমদানি করে ফেললেন ভদ্রলোক। ওই উপাখ্যান নিয়েই না টুপুর মাসির সঙ্গে ঠাট্টা জুড়েছিল, ভবিষ্যতে গুপ্তধন উদ্ধার করে মোটা রোজগারের আশা ছেড়ে দাও গো মিতিননাসি! বরং পড়ে পাওয়া পাঁচ হাজার টাকার চটপট সদগতি করে ফেলি চলো! বুমবুমকে তুলে নিয়ে ঘ্যামচ্যাক একটা ডিনারই হোক না কোথাও একটা!

মিতিন অবশ্য জবাব দেয়নি। আলগা হেসেছে শুধু। পার্থর এখনকার মন্তব্যেও তার কোনও ভাবান্তর নেই। চুপচাপ খাইয়ে চলেছে বুমবুমকে।

সেদিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে নিয়ে টুপুর বলল, এখন কী ধারণা হচ্ছে? ভদ্রলোক সুস্থ? যা বলেছেন সব খুব যুক্তিপূর্ণ?

তা হয়তো নয়। তবে কী জানিস? পার্থ খানিকটা চাউমিন চালান করল মুখে। চিবোতে চিবোতে বলল, একেবারে বাতিল করাটাও বোধহয় ঠিক হচ্ছে না।

কেন?

কারণ, ইহুদিদের নেচারটা যে জানি। ওরা খরচের ব্যাপারে খুব টাইট। অবশ্য কারণও আছে। চিরকাল ওদের এমন তাড়া খেয়ে খেয়ে দেশে দেশে ঘুরতে হয়েছে, বেহিসেবি হওয়ার ওদের জো ছিল না। উলটে যখন যেটুকু পেয়েছে, আঁকড়ে থেকেছে প্রাণপণে। আর সেই অভ্যেস থেকেই ওদের হাত থেকে অকারণে জলও গলতে চায় না। ভিনিগারে ডোবানো কুচো লঙ্কা তুলল পার্থ। মুখে পুরে বলল, সুতরাং ডেভিড যোশুয়ার পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে দেওয়াটা একেবারেই ফালতু ভাবা কঠিন।

কিন্তু দুটো মৃত্যুই তো নর্মাল ডেথ। ডাক্তারও তাই বলছে, পোস্টমর্টেমও…।

তবে উৎসবের রাতেই পটপট দু’জন মারা গেলেন, এটা একটু সন্দেহজনক তো বটেই! পার্থ গলা ঝাড়ল। মিতিনকে বলল, কী গো, তুমিও নিশ্চয়ই এই লাইনে ভাবছ?

নাহ। মিতিন ঘাড় নাড়ল, আমি অন্য একটা কথা চিন্তা করছি।

খুবই স্বাভাবিক। আমরা যা ভাবব, তুমি তা ভাববে না। কারণ, তুমি টিকটিকি। তোমার দৃষ্টি তো ঘুরপথেই যাবে।

ব্যঙ্গটা গায়ে না মেখে মিতিন বলল, আমি ভাবছি মিস্টার যোশুয়ার শঙ্কাটা যদি সত্যিই হয়, তা হলে মৃত্যুর ক্রমটাও নিশ্চয়ই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত? সেই উদ্দেশ্যটা কী হতে পারে?

সিম্পল। মিস্টার যোশুয়ার হাতে আব্রাহামদের সম্পত্তি চলে আসা।

কিন্তু মিস্টার যোশুয়াকে সম্পত্তিটা পাইয়ে দিতে কেউ একজন চাইবে কেন? তার কী ইন্টারেস্ট?

এর একটা জবাব আমি দিতে পারি। জানি না তোমার মনঃপূত হবে কিনা, পার্থ দাঁতের ফাঁক থেকে মুরগির কুচি বার করল। থালার কোণে রেখে বলল, আমার মনে হচ্ছে মিস্টার যোশুয়া নিজের প্রয়োজনে তোমাকে ইউজ করতে চাইছেন।

মানে?

ধরতে পারলে না? ইহুদিরা টাকাপয়সার ব্যাপারে বেজায় সাবধানি। যা একবার পায়, কোনও ভাবেই তা হারাতে চায় না।

বারবার ইহুদি চরিত্র সম্বন্ধে জ্ঞান না দিয়ে কাজের কথাটা বলো।

আরে বাবা, ভদ্রলোকের দিদি জামাইবাবুর মৃত্যু স্বাভাবিক হোক কি অস্বাভাবিক, আজ নয় তো কাল নানারকম জল্পনা হবে। মিস্টার যোশুয়াই তো বললেন, অলরেডি আব্রাহামের ভাইপোদের মনে প্রশ্ন জেগেছে। অতএব তিনি গোড়াতেই গোটা প্রসঙ্গে জল ঢেলে দিতে চান। যাতে ভবিষ্যতে ওঁর ছেলেরও ওই সম্পত্তি পেতে কোনও হ্যাপা পোহাতে না হয়। সে কোনও মামলা-মকদ্দমায় না ফাঁসে। তাই ভেবেচিন্তে এই ডিটেকটিভ নিয়োগের পরিকল্পনা।

এতে ডিটেকটিভের কী ভূমিকা?

কিছুই না। তুমি কিছু করবেও না। করার কথাও নয়। তবে ডেভিড যোশুয়ার লাভই লাভ। পুলিশ-ডিটেকটিভ ছুঁইয়ে রেখে, মাত্র পাঁচ হাজার টাকা খসিয়ে, পাকাপাকি লোকের মুখ বন্ধ করে দিলেন।

মিতিন স্থির চোখে তাকিয়ে আছে পার্থর দিকে। যেন ভাবছে কিছু। যেন পার্থর কথাগুলো ঠিক হজম করতে পারছে না।

টুপুরেরও একটু একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। সন্দিগ্ধ স্বরে বলল, মিস্টার যোশুয়া কি এতই প্যাঁচোয়া লোক? দেখে মনে হয় না কিন্তু।

মানুষ চেনা কি অতই সোজা রে? চোখ লাগে। আর সেই চোখ তোর মাসি ছাড়া আরও কারও কারও আছে।

এই বিদ্রূপটাকেও আমল দিল না মিতিন। বুমবুমের ভোজন শেষ, তাকে মুখ ধুতে পাঠিয়ে টুকটুক করে নিজের খাবার নিচ্ছে প্লেটে। মাসির উদাসীন ভাবটাই ভারী রহস্যময় লাগছে টুপুরের। মাসিকে একটু খোঁচানোর জন্য ফের কথা শুরু করল মেসোর সঙ্গে। ঝুঁকে বলল, আর মিসেস যোশুয়াকে তোমার কেমন লাগল? উনিও কি গভীর জলের মাছ? মিস্টার যোশুয়ার মতোই?

না, না। তুলনায় উনি অনেক সাদামাটা। বরকে বকাঝকা করে একটু আনন্দ পান। কথাও একটু বেশি বলেন। দেখলি না, গুপ্তধনের গল্পটা উনিই শুরু করলেন?

উনি আর বললেন কোথায়? বরং উনি তো নিজেই বিশ্বাস করেন না।

করা উচিতও নয়। কবে দুশো বছর আগে কার পূর্বপুরুষ হিরেজহরত বিশেষজ্ঞ ছিলেন, সুতরাং তাঁর বাড়িতে মণিমুক্তো লুকোনো আছে, এমনটা ভাবাই তো মূর্খামি। আমারও তো কোনও এক পূর্বপুরুষ রাজার খাজাঞ্চি ছিলেন। লাখ লাখ টাকা, ঘড়া ঘড়া মোহর নিয়ে তিনি নাকি নাড়াচাড়া করতেন। তা বলে কি আমাদের বাড়িতেও ওসব থাকবে? নাকি আছে?

সরি স্যার। মিতিন এবার নড়ে বসেছে, তোমার সঙ্গে একমত হতে পারলাম না।

তার মানে তুমি গুপ্তধনের গল্পটা খেয়ে গিয়েছ?।

একেবারে নস্যাৎ করে দিচ্ছি না। কারণ, তোমার পূর্বপুরুষের গল্পটির কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। কিন্তু শ্যালোম কোহেন একজন ঐতিহাসিক ফিগার। এবং তিনি মোটেই হেঁজিপেঁজি লোক ছিলেন না। তিনি ছিলেন ভারতের প্রথম আরবিভাষী ইহুদি। মাত্র উনত্রিশ বছর বয়সে তিনি ব্যবসা করে এত টাকা কামিয়েছিলেন, তিনি একজন আর্মেনিয়ানকে পনেরো হাজার টাকা ধার দেন। এবং নিজেও সুরাটে বাইশ হাজার টাকা দিয়ে একটা বাড়ি কিনে ফেলেন। মনে রেখো, তখনকার বাইশ হাজার মানে এখনকার বাইশ কোটির শামিল। শুধু তাই নয়, মিস্টার যোশুয়া যা বলেননি, উনি শুধু লখনউয়ের নবাবেরই মণিকার ছিলেন না। পঞ্জাবের মহারাজা রঞ্জিৎ সিংহের দরবারেও হিরে-জহরতের সমঝদার হিসেবে তাঁর বিপুল খাতির ছিল। আর তাঁর জামাইরাও কম বিখ্যাত নন। তাঁর বড় জামাই মোজেস ডুয়েক ভারতের অনেক রাজা-মহারাজার প্রিয়পাত্র ছিলেন। আরও জেনে রাখো, কলকাতায় ইহুদিদের যে কবরখানাটি আছে সেটিও শ্যালোম কোহেনেরই অবদান। জমিটা ছিল এক নবাবের। তিনি বিনামূল্যে জমিটি দান করতে চেয়েছিলেন কোহেনকে। কিন্তু ইহুদিদের তো দান নেওয়ার প্রথা নেই, তাই জমির বিনিময়ে আঙুল থেকে সোনার আংটি খুলে নবাবকে দিয়েছিলেন শ্যালোম। তাঁর রাশি রাশি ধনসম্পদ নিশ্চয়ই হাওয়ায় মিলিয়ে যায়নি।

পার্থ আশ্চর্য মুখে বলল, তুমি এত জানলে কোত্থেকে?

ইন্টারনেট ঘেঁটেই পেলাম। মার্কুইস স্ট্রিটে যাওয়ার আগে চোখ বুলিয়ে নিয়েছি।

ওখানে মাটুকদের কথা পেয়েছ কিছু? কিংবা যোশুয়া?

সেভাবে কিছু নেই। তবে দুটো পরিবারেরই উল্লেখ আছে। যোশুয়ারা সম্ভবত পুরোহিতের বংশ। কারণ, যোশুয়া নামের অর্থই পুরোহিত।

কেসটা মনে হচ্ছে তোমাকে বেশ আকর্ষণ করেছে? পার্থ খাওয়া শেষ করে জলের গ্লাসে চুমুক দিল। ডাইনিং টেবিল ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল, তুমি কি তা হলে এবার থেকে হার্ট অ্যাটাকেরও তদন্ত করবে?

প্রয়োজন বোধ করলে নিশ্চয়ই করব। ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলার পর আমারও কৌতূহল কিছুটা বেড়েছে, এ আমি অস্বীকার করি কী করে!

কী এত ইন্টারেস্টিং পেলে বলো তো? ওই ঘোস্ট কলের ব্যাপারটা? যে ভুলভাল নম্বরগুলো ট্রেসই করা যায় না?

অবশ্যই সেটা একটা কারণ। র‍্যাচেল যাই বলুন, মিস্টার যোশুয়াকে আমার মোটেই ভীমরতিগ্রস্ত মনে হয়নি। আর একজন আটাত্তর বছর বয়সের মানুষের কাছে বারবার ভুয়ো কল আসাটাও তো কম আশ্চর্যজনক নয়। তারপর ধরো, মিস্টার যোশুয়ার বিচিত্র সঙ্গীসাথী। কেউ ব্যবসাদার, কেউ আবার অধ্যাপক, কেউ ডাক্তার… তাঁরা আবার একদিকে তাসুড়ে, অন্য দিকে সংগীতপ্রেমী। সব কিছু মিলিয়ে আমি যেন কেমন একটা মিষ্ট্রির গন্ধ পাচ্ছি।

পার্থ তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল। টিভির রিমোট হাতে বসেছে সোফায়। পুরনো দিনের হিন্দি ফিল্মের সুরেলা গান চলছে একটা চ্যানেলে, সেখানেই গেঁথে গেল। টুপুরেরও মেসোর পাশে গিয়ে বসার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু সে উপায় নেই এখন। তাকে এবার ছাদে গিয়ে হাঁটতে হবে। মিতিনমাসির রুটিন।

আধ ঘণ্টাটাক পায়চারি করে ফিরল টুপুর। পার্থমেসো তখন চোখ গোল গোল করে বিশ্রী একটা কুস্তি দেখছে টিভিতে। আর মিতিনমাসি নিজস্ব অফিসঘরের খুপরিটায় কম্পিউটারে নিমগ্ন। অগত্যা শুয়ে পড়া ছাড়া টুপুরের আর কাজ কী?

পরদিন থেকে আবার সেই নিস্তরঙ্গ জীবন। মর্নিংওয়াক, ব্যায়াম, অখাদ্য খাওয়া আর গরমের ছুটির হোমওয়ার্ক নিয়ে বসা। ডেভিড যোশুয়াকে নিয়ে আর কোনও উচ্চবাচ্চ্যই করছে না মিতিনমাসি। একটা উত্তেজনার সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনাশ হল ভেবে টুপুর তো রীতিমতো হতাশ। এর মধ্যে মাঝে মাঝেই কলকাতার ইহুদিদের সম্পর্কে পার্থমেশোর জ্ঞান শুনতে হচ্ছে টুপুরকে। ১৮৮১ সালে নাকি কলকাতায় প্রথম ইহুদি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু সেখানে নাকি এখন একটাও ইহুদি ছাত্র নেই। অথচ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কলকাতায় ইহুদিদের সংখ্যা নাকি পৌঁছেছিল ছ’হাজারে। তখন নাকি তারা একটা সমিতি গড়েছিল। খেলাধুলো করার নিজস্ব ক্লাব। ‘সেমা’ নামে একটা মাসিক পত্রিকাও নাকি বের করত তারা। এরকম হাজারও রকম হাবিজাবি তথ্য গিলতে গিলতে টুপুরের তো কান ঝালাপালা।

হঠাৎ পরিস্থিতি বদলে গেল আমূল। এমনিতে প্রতিদিনই সকাল পাঁচটায় উঠে পড়ে টুপুর। সেদিনও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। কিন্তু স্নিকার পরে বেরোনোর আগে হঠাৎ ফোন। মিতিনমাসিই গিয়ে ধরেছে। টুকরো টুকরো কথা বলে ফোন রেখে ধপ করে বসে পড়ল সোফায়। কপাল টিপে ধরেছে।

মাসিকে এতটা বিচলিত বড় একটা দেখেনি টুপুর। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কার ফোন ছিল গো?

মাকুইস স্ট্রিট থেকে, মিতিন শুকনো গলায় বলল, ডেভিড যোশুয়া যে ভয়টা পাচ্ছিলেন প্রায় সেটাই ঘটেছে।

 মানে? উনি মারা গেলেন নাকি?

 না। মৃত্যু হয়েছে র‍্যাচেল যোশুয়ার। কাল রাতে।