১১. রাজনৈতিক সংশয়বাদের প্রয়োজনীয়তা

রাজনৈতিক সংশয়বাদের প্রয়োজনীয়তা

ইংরেজি ভাষাভাষী জগতের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো তাদের রাজনৈতিক দলের প্রতি সুপ্রচুর আগ্রহ এবং বিশ্বাস বর্তমান। শতকরা বেশীরভাগ ইংরেজি ভাষাভাষী লোক বিশ্বাস করে, যে রাজনৈতিক দলের আদর্শে তারা বিশ্বাসী সে দলের হাতে ক্ষমতা এলে যে সমস্ত অসুবিধায় তারা ভুগছে, নিরসন ঘটবে। ঘড়ির পেন্ডুলামের মত দোদুল্যমানতা থেকে এ অবস্থার সৃষ্টি। একজন লোক বিশেষ পার্টিকে ভোট দেয়ার পরও যখন তার দুঃখের অবসান হয় না, তখন এ সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছোয় যে বিপক্ষ দল হাজার হাজার বছর ধরে যে অন্যায়ের সৃষ্টি করছে তার নাগ পাস থেকে মুক্তি অসম্ভব। এরি মধ্যে সে সবগুলো রাজনৈতিক পার্টির প্রতি অনাগ্রহী হয়ে পড়েছে এবং এখন সে একজন বৃদ্ধ লোক। তার সন্তানেরা তার যৌবনের বিশ্বাসের ধ্বজা উঁচিয়ে ধরে, এভাবে আবর্তন বিবর্তনের মধ্যদিয়ে সময় বয়ে যেতে থাকে।

এস্থলে আমার বক্তব্য হলো, যদি আমরা রাজনীতির মারফত ভালো কিছু করতে চাই আমাদের অবশ্যই রাজনৈতিক প্রশ্নসমূহ আলাদা পদ্ধতিতে বিচার করতে হবে। গণতান্ত্রিক উপায়ে কোন পার্টিকে ক্ষমতায় আরোহণ করতে হলে তাকে জাতির অধিকাংশ নাগরিকের সমর্থন অবশ্যই আদায় করতে হবে। এজন্য প্রচলিত গণতন্ত্রের স্বার্থহানি না করে জনসাধারণের কাছে ব্যাপক অর্থে সফল যুক্তির অবতারণা করতে হবে যা তাদের মধ্যে বিশেষ আবেদন সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে। সুতরাং কোন প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের এমন কোন ভালো কর্মসূচী আছে বলে আমার মনে হয় না যা পার্টি সরকার ছাড়া আর কাউকে দিয়ে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। অন্যান্য যে সকল লোকহিতের যন্ত্র রয়েছে তার সঙ্গে গণতন্ত্রের কিভাবে সমন্বয় ঘটান যেতে পারে তা আমাদের যুগের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, সবচেয়ে প্রয়োজনীয় একটি প্রশ্ন।

বর্তমানে রাজনৈতিক প্রশ্নে দু’জাতীয় আলাদা ধরণের রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ রয়েছে। তার একটি হলো প্রত্যেক রাজনৈতিক দলে সক্রিয় রাজনৈতিক রয়েছে। এবং অন্যটিতে বিশেষজ্ঞ যাদের অধিকাংশই সরকারি চাকুরে অর্থনীতিবিদ, বৈজ্ঞানিক, ডাক্তার ইত্যাদি। এ দু’শ্রেণীর প্রত্যেকের আবার নিজস্ব কলা-কৌশল রয়েছে। রাজনীতিবিদদের কৌশল হলো কীভাবে সুবিধাজনকভাবে জনসাধারণকে নিজেদের দিকে আকর্ষণ করা যায় তা অনুমান করা। বিশেষজ্ঞদের পদ্ধতি হলো জনতার বুদ্ধিবৃত্তিতে সাড়া জাগাতে পারার মত সত্যিকারের সুবিধাজনক কি হবে তা নির্ধারণ করা। (এ শর্তগুলো বিশেষজ্ঞদের অপরিহার্যভাবে চিন্তা করতে হয়, তা না হলে যতই কল্যাণকর হোক না কেননা এর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদের ঝড় উঠতে পারে।) গণতন্ত্রে রাজনীতিবিদদের শক্তি হলো গড়পড়তা জনসাধারণ যে নীতিতে বিশ্বাস করে সে নীতি নির্ধারণ করা। অলোকসম্পন্ন ব্যক্তিরা যা ভালো মনে করে তার স্বপক্ষে সমর্থন করার মত রাজনীতিবিদেরা যে উচ্চ মনোবৃত্তি সম্পন্ন হতে পারে তা প্রত্যাশা করা বৃথা কেননা তা করলে তাদেরকে অন্যদের জন্য ক্ষমতার আসন ছেড়ে দিতে হবে। সুতরাং তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বক্তব্য প্রকাশ করার ব্যাপারে যে কৌশল অবলম্বন করে (নিজস্ব পার্টির দৃষ্টিকোণ থেকে) অনেক সমর্থ রাজনীতিবিদদের বেলায় অধিকাংশ মানুষ যা ভালো বলে গ্রহণ করেছে তারই সৎ প্রকাশ; যদিও বিশেষজ্ঞদের মতে তা ঘোরতর ক্ষতি ডেকে আনবে। নোংড়াভাবে ঘুষ নেয়া ছাড়া যে কোন রকমের নৈতিক অধঃপতন এবং বিচ্যুতির প্রতি রাজনীতিবিদদের অনাসক্ত হলে চলবে না।

যেখানে পার্টিগত রাজনীতি বর্তমান সেখানে একজন রাজনীতিবিদের আবেদন মাত্র একটি শ্রেণীর কাছে। পক্ষান্তরে তার বিপক্ষ রাজনীতিবিদের আবেদন অন্য আরেকটি শ্রেণীর কাছে। নিজস্ব দলকে সংখ্যাগরিষ্ঠ রূপে পরিণত করতে পারলেই তার সাফল্য প্রমাণিত হয়। যে প্রচেষ্টা পূর্ব নির্ধারিত ভাবে সাধারণ ক্ষেত্রে সকল শ্রেণীর কাছে আবেদন সৃষ্টি করে রাজনীতিবিদদের কাছে তার কোন দাম নেই। অধিকন্তু রাজনীতিবিদেরা যে সকল প্রশ্নের ওপর দৃষ্টি সন্নিবেশ করে তা একটা শ্রেণীর বিপক্ষে এবং এ শ্রেণীর বৈরিতা থেকেই তার বিপক্ষ রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের মধ্যে বিরুদ্ধ রাজনীতির প্রাণ সঞ্চার হয়। এ ছাড়াও কোন প্রচেষ্টা তা যতই প্রশংসনীয় হোক না কেননা যদি মঞ্চের বক্তৃতার মাধ্যমে জনসাধারণকে তা বুঝিয়ে তুষ্ট করতে পারা যায়, রাজনীতিবিদদের কাছে তার কানাকড়িও দাম নেই।

পার্টিগত রাজনীতিবিদেরা যে সব বিষয়ের ওপর জোর দিয়ে থাকে তা পূরণ করতে হলে আমাদের সামনে দু’টি ভোলা পথ রয়েছে। (১) তাদের অবশ্যই জাতির একটা সম্প্রদায়ের প্রতি দৃষ্টিশীল হতে হবে (২) তার জন্য তারা যে যুক্তি গ্রহণ করবে তা অবশ্যই সরল হতে হবে। অবশ্য যুদ্ধের সময়ে এ নীতি অচল, কেননা বহিঃশত্রুর সঙ্গে সংগ্রাম করবার জন্যে পার্টিগত কোন্দলকে তখন বন্ধ রাখতে হয়। যে রাজনীতিবিদেরা শান্তির সময়ে সাধারণ ভোটারদের স্বীকৃতির ব্যাপারে সন্দিহান থাকে সে সকল রাজনীতিবিদেরাও যুদ্ধের সময়ে নিরপেক্ষতার মুখোস পরে আহ্বান করে, আমরা যেমন আশা করেছিলাম গত যুদ্ধে তার প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে যে গণতন্ত্র নিরপেক্ষ জনতার কাছে আবেদন করার প্রশংসনীয় ট্রেনিং দান করেছে। এই একমাত্র কারণেই গণতন্ত্র গতযুদ্ধে জয়লাভ করতে পেরেছে। কিন্তু এটা সত্য যে এতে শান্তি বিঘ্নিত হয়েছে। কিন্তু তা আরেকটি ভিন্নতর প্রশ্ন।

কিভাবে সহজে আবেগকে জাগানো যায়, জাগালে তা তার এবং বন্ধুবান্ধবদের না ক্ষতি করতে পারে মতো কিভাবে দমন করা যায় তা জানা হলো রাজনীতিবিদদের সে বিশেষ কৌশল। মুদ্রায় যেমন গ্রেসাম আইন আছে তেমনি রাজনীতি একটি আইন মেনে চলে। যে লোকের একটি উন্নত আদর্শ আছে যা

অন্যান্য সবকিছু থেকে আলাদা, তার জন্যে ঐ দুর্লভ মুহূর্তগুলো (বিশেষতঃ বিপ্লবকালে) যখন আদর্শবাদের সঙ্গে মানুষের স্বার্থপর আবেগের সমন্বয় ঘটে তখন ছাড়া তাকে বারবার নাজেহাল হতে হবে। তাছাড়াও রাজনীতিবিদেরা বিভিন্ন বিরোধী দলে বিভক্ত, তারা রাষ্ট্রকেও বিভিন্নভাবে বিভাগ করতে চায়, তবে মাঝে মাঝে অন্যদেশের সঙ্গে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তারা আবার দেশকে একত্রিত করার সুযোগ লাভ করে। এ সকল লোক সব সময় হুংকার পরিপূর্ণ তাৎপর্যহীন জীবন যাপন করে। তারা জটিল কিছু ব্যাখ্যা করার দিকে মনোযোগ দিতে পারেনা। তারা যার মধ্যে ভাগাভাগি নেই, তেমন কিছু ব্যাখ্যা করতে পারে না (তারা হয়ত দেশ বিভক্ত করে অথবা জাতিতে বিভেদ ডেকে আনে। অবশ্য তারা এমন কিছু ব্যাখ্যা করে না যা শ্রেণী হিসেবে রাজনীতিবিদদের ক্ষমতাকে সীমিত করে ফেলে।

কিন্তু বিশেষজ্ঞরা কৌতূহলোদ্দিপকভাবে ভিন্ন ধরণের। আইন কানুন মত বিশেষজ্ঞরা এমন এক ধরণের মানুষ যাদের রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রতি কোন লোভ নেই। কোন একটা রাজনৈতিক সমস্যা তার ভেতরে যে প্রতিক্রিয়ার সঞ্চার করে তা হলো জনপ্রিয়তার চেয়ে কোনটা অধিকতর উপকারী। কোন কোন ব্যাপারে তার ব্যাপক খুঁটিনাটি জ্ঞান রয়েছে। তিনি যদি সরকারি চাকুরে অথবা কোন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের বড় কর্তা হয়ে থাকেন, তাহলে ব্যক্তি বিশেষ সম্বন্ধে সুপ্রচুর অভিজ্ঞতার অধিকারী এবং তিনি কিভাবে কাজ করেন সে সম্বন্ধেও তিনি ধুরন্ধর বিচারক। এসব হলো তার নিজস্ব বিষয়ে নির্ভরযোগ্য মতামত গঠনের অনুকূল প্রেক্ষিত।

সে যাহোক, নিয়মানুসারে তার কতেক পরস্পর সম্বন্ধশীল দোষ রয়েছে। তার যে জ্ঞান তা হলো বিশেষজ্ঞের জ্ঞান, সে জন্যে নিজের বিভাগের প্রয়োজনীয়তাকে তিনি বাড়িয়ে দেখেন। যদি আপনি ক্রমাগতভাবে কোন দন্ত চিকিৎসক, অথবা বৈজ্ঞানিক, চক্ষু বিশেষজ্ঞ অথবা হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অথবা ফুসফুস বিশেষজ্ঞের কাছে যান, তাদের প্রত্যেকেই আপনাকে তাদের আপন আপন বিষয়ে আরোগ্যের সুন্দর সুন্দর উপদেশ দেবেন। যদি আপনি তাদের সকলের উপদেশ মেনে নিয়ে থাকেন তাহলে চব্বিশ ঘন্টা সময় আপনার স্বাস্থ্য রক্ষার কাজে ব্যয়িত হয়ে যাবে এবং স্বাস্থ্যকে ব্যবহার করবার কোন ফুরসৎ আপনি পাবেন না। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের নিয়েও একই রকমের ব্যাপার হতে পারে। যদি তাদের সকলের কথা মেনে নেয়া হয় তাহলে জাতির সাধারণভাবে বেঁচে থাকবার কোন সুযোগ থাকবে না।

সরকারি চাকুরের আরেকটা বিরাট দোষ হলো পর্দার অন্তরাল অবস্থান করে তিনি প্রভাবিত করার পদ্ধতিকে চালু করেন। তিনি হয়ত অধিক পরিমাণে মানুষকে প্রভাবিত করাকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে থাকেন অথবা চোরা গলির পথ অনুরণ করাকে অধিকতর পছন্দ করেন, যার ফলে রাজনীতিবিদেরা কি করছে না জেনে তাদের সিদ্ধান্ত অনুসারে মত দিতে বাধ্য হন। নিয়মানুসারে তিনি অল্পবয়সে প্রথম ভুল করেন এবং মধ্য বয়সে দ্বিতীয় ভুলটি করেন।

বিশেষজ্ঞদের তৃতীয় দোষ হলো যার হাতে শাসন ক্ষমতা তাকে তিনি জনপ্রিয় আবেগের বিচারক হতে পারেন না। তিনি সাধারণতঃ একটা কমিটি সম্পর্কে ভালো জ্ঞান রাখেন, কিন্তু উন্মত্ত জনতাকে তিনি বুঝতে পারেন না। কতেক সুবিবেচনা সম্পন্ন মানুষ এক সঙ্গে বসে যা ভালো বলে গ্রহন করলেন, তা সাধারন্যে প্রচারিত হলে কতকগুলো প্রভাবশালী লোকের জনতার ভাবাবেগের আগুনে নিহত হওয়ার এমন কি সম্ভাবনা রয়েছে সেকথা তিনি বুঝতে পারেন না। আমেরিকার কর্তাব্যক্তিরা যে সব লোককে না পছন্দ করে তাদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা নিয়োগ করেন এবং যদি সে অত্যন্ত ধূর্ত হয় তা হলে কৌশলে তার সঙ্গে মিটমাট করে ফেলে। তখন থেকে হয়ত সে রাজনৈতিক মত পরিবর্তন করে নয়ত নীতিহীন লোক বলে পত্রিকায় তার নিন্দা করা হয়। ইংল্যান্ডে এ পদ্ধতি এখনো তেমন উল্লেখযোগ্যভাবে বিকাশ লাভ করেনি, কিন্তু তার আর বেশি দেরি নাই। যেখানে মন্দ বলতে কোন কিছুই নেই, সেখানে চেতনাহীন মানুষ জনপ্রিয় আবেগকে অনেক সময় আশ্চর্য বস্তু বলে গ্রহন করে। প্রত্যেকেই কামনা করে যে সরকার ব্যয়ভার লাঘব করুক কিন্তু বিশেষ অর্থনীতি সব সময়েই অপ্রিয় হয়ে থাকে। যেহেতু এর ফলে মানুষ বেকার হয়ে পড়ে এবং বেকারেরা মানুষের সহানুভূতি অর্জন করে।একাদশ শতাব্দতে চীনদেশে ওয়ং এন শি নামে একজন সরকারি চাকুরে ছিলেন যিনি সম্রাটকে রাজি করিয়ে সমাজতন্ত্রবাদ প্রয়োগ করার কাজে আত্ননিয়োগ করলেন। এক কর্মব্যস্ত মুহূর্তে তিনি দেশের পণ্ডিত সমাজকে অপমান করলেন এবং ক্ষমতা থেকে বিচ্যুত হলেন। তখন থেকে আজ পর্যন্ত বিস্মৃতির অন্তরাল থেকে কোন চীনা ঐতিহাসিক তাঁর নাম বের করে আনেননি।

বিশেষজ্ঞের চার নম্বরের দোষ হলো তিনি যাদের শাসন করবেন তাদের মতামতকে বিশেষ দাম দেন না এবং জনসাধারণের অপ্রিয় এমন একটি আইনকে চালু করতে হলে তাকে যে বিপদের সন্মুখীন হতে হবে সে সম্বন্ধে তিনি মোটেই ওয়াকেবহাল নন। ডাক্তারদের হাতে যদি ক্ষমতা দেয়া হয় এবং তাদের কথা প্রতিপালিত হলে সংক্রামক রোগের মার্কা মেরে দেয়ার পদ্ধতি তারা আবিষ্কার করতে পারেন। কিন্তু তাদের প্রবর্তিত আইন যদি জনমতের ওপরের স্তরে চলে যায় তাহলে কৌশলে তা ফাঁকি দেয়া হবে। যুদ্ধের সময়ে শাসনের সুবিধা ছিল কারণ জনতা বেশি পরিমাণে যুদ্ধ জয়ের ব্যাপারে আত্মনিয়োগ করেছিল। পক্ষান্তরে তেমন জোরাল আবেদনের মত কোন লক্ষ্য শান্তির আদালত প্রতিষ্ঠা করতে পারেনা।

কোনো বিশেষজ্ঞ কদাচিত অলসতা এবং উদাসীনতাকে বরদাশত করে। যে সকল বিপদ স্পষ্টতর সম্ভাব্য বলে আমাদের চোখে প্রতীয়মান তা এড়িয়ে যাবার জন্যে কিছু কষ্ট স্বীকার করি, কিন্তু বিশেষজ্ঞের চোখে যে সকল বিপদ সম্ভাব্য সেগুলো পরিহার করার জন্যে মোটেই কষ্ট স্বীকার করি না বললেই চলে। আমরা মনে করি টাকাকে আমরা পছন্দ করি এবং হিসেবের বেলায় দিনের আলোর মত পরিস্কার দেখতে পাই বছরে বছরে লাখ টাকা সঞ্চিত হচ্ছে। তা সত্ত্বেও যদি না সমরাস্ত্র হিসেবে টাকাকে না ভাবতাম আমরা এ নীতিকে গ্রহণ করতে পারতাম না। আমরা আমাদের স্বভাবকে আমাদের আয় এবং অনেক সময় আমাদের জীবনের চেয়ে অত্যাধিক ভালোবাসি। যখন কোন ব্যক্তি আমাদের চরিত্রের কোন কোন দোষত্রুটি দেখিয়ে দেয় তখন আমরা তাকে বিষনজরে দেখে থাকি।

সম্ভবতঃ বিশেষজ্ঞেরা বুঝেন না যে যাদের হাতে শাসন কর্তৃত্ব থাকে অত্যাচার করার দিকে তাদের স্পৃহা দ্রুত বর্ধিত হবে, তারা বর্তমানে যেমন অমায়িক আছেন তেমন উচ্চ মানসিকতা সম্পন্ন থাকতে পারবেন না। খুব অল্পসংখ্যক লোকই তাদের চার দিকের যে প্রভাব তাদের চরিত্রের ওপর পড়ে তা অস্বীকার করতে পারেন।

এ সব কারণে, আমরা শুধু সরকারি চাকুরেদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে বর্তমান রাজনীতিবিদদের কৃত দোষ থেকে বাঁচতে পারিনা। সে যাহোক আমাদের ক্রমবর্ধমান জটিল সমাজে বিশেষজ্ঞদের যে প্রভাব রয়েছে, তার চাইতে বেশি প্রভাব থাকা উচিত। বর্তমানে প্রবৃত্তিগত আবেগ এবং শিল্প ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার মধ্যে এক ঘোরতর সংঘাতের সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের মানসিক এবং বস্তুগত পরিবেশ হঠাৎ শিল্পায়নের ফলে রাতারাতি পরিবর্তিত হয়ে গেছে। কিন্তু তার সঙ্গে তাল রেখে আমাদের প্রবৃত্তির পরিবর্তন হয়নি। পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্যে আমাদের স্বভাবের কিছুই করা হয়নি। কিছুসংখ্যক অজ্ঞলোক এখনো আর্দ্র আবহাওয়ার দিনে লাইব্রেরিতে বীবরের লোম রাখে এবং বীবরের লোমে তাদের লাইব্রেরি ঘর ভরে উঠে। এর কারণ একসময় তারা নদীর তীরে বসবাস করত। আমরাও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এখনো আমাদেরকে হোমারের যুগের জীব বিজ্ঞানের সঙ্গে খাপ খায় মত যে সকল গুণপনা সেগুলোকে প্রশংসা করতে শিক্ষা দিয়ে থাকে; যদিও সেগুলো হাস্যকর এবং চরম ক্ষতিজনক। প্রত্যেকটা সার্থক রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রবৃত্তিগত যে আহ্বান তার মধ্যে হিংসা, ঘৃণা, বিরুদ্ধতার রসায়ন বর্তমান; কখনো পারস্পরিক সহানুভূতির প্রয়োজন নেই। আমাদের প্রাকশিল্পযুগের যে স্বভাব আমরা উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেছি তার সঙ্গে আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক পদ্ধতির মধ্যেও পুরানো সবগুলো স্বভাব আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। এ ব্যাপারে স্বতঃপ্রণোদিত চেষ্টার দ্বারাই আমাদের স্বভাবের মধ্যে পরিবর্তন আসতে পারে।

নিজের দুর্ভাগ্যের জন্য কাউকে ঘৃণা করা আমাদের স্বভাবগত প্রবণতা। যখন দাম বাড়ে তখন আমরা মুনাফালোভীদের দোষ দেই, যখন কমে তখন আমরা পুঁজিপতিদের দোষ দেই। কিন্তু পুঁজিপতিরা যখন দাম বাড়ে তখন কিছু করতে পারেনা কেন এবং দাম কমলে মুনাফলোভীরা কিছু করেন না কেনো, সে খবর পথের মানুষ রাখেনা। সে এটাও নজর করেনা যে মজুরি এবং দাম একসঙ্গে বাড়ে এবং একসঙ্গে পড়ে। যদি সে একজন পুঁজিপতি হয় তাহলে সে চায় মজুরি কমুক এবং দাম বাড়ক। আর যদি সে একজন মজুর হয় তাহলে বিপরীতটাই হবে তার কাঙ্খিত। যখন একজন মুদ্রা বিশেষজ্ঞ বোঝাতে চেষ্টা করেন যে মুনাফাখোর, ট্রেড ইউনিয়ন এবং সাধারণ শ্রমিকদের নাম বড় করার ব্যাপারে খুব বেশি হাত নেই? তখন তিনি জার্মান বর্বরতার প্রতি সন্দেহপরায়ন ব্যক্তির মত সকলেরই নিন্দাভাজন হয়ে পড়েন। আমাদের একজন শত্রুকে কেউ লুণ্ঠন করুক তা আমরা চাইনে। কিন্তু আমরা যখন কষ্ট পাই তখন আমরা কাউকে ঘৃণা করতে চাই। আমরা বোকা বলে কষ্ট পাই, এটা ভাবা খুবই কষ্টকর, কিন্তু সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে তাই-ই আমরা সত্য বলে মেনে নিয়ে থাকি। সেজন্য ঘৃণা ব্যতিত কোন রাজনৈতিক পার্টির চালিকা শক্তি অর্জন করতে পারেনা; তা কাউকে ঘৃণা করবার জন্য অবশ্যই বের করে আনবে। যদি অমুক অমুক আমাদের দুঃখের কারণ হয়ে থাকে তাহলে চলুন অমুক অমুককে শাস্তি দিয়ে আমরা সুখী হই। ভার্সাই চুক্তি হলো এরকমের রাজনৈতিক ধারণার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তা সত্ত্বেও কেউ কেউ জার্মানদেরকে তাদের পূর্বের স্থানে প্রতিষ্ঠিত করা যায় কিনা সে জন্যে পন্থা অনুসন্ধান করেছে।

আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্রবাদের স্বপক্ষে দুটো গ্রন্থের সঙ্গে মিলিয়ে আমার বক্তব্যবিষয়টিকে স্পষ্ট করে তুলবো। একটা হলো কার্ল মার্কসের ক্যাপিটাল (পুঁজি) অন্যটা সালটারের (SALTER) ALLIED SHIPPING CONTROL (মিত্র শক্তির নৌযান নিয়ন্ত্রণ) স্যার আর্থার সালটার নিজেকে আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্রীবাদী বলে ঘোষণা করেননি; তাহলেও তার এ পরিচয় অসংগত নয়।) দুটো গ্রন্থকে আমরা যথাক্রমে রাজনীতিবিদ এবং সরকারি চাকুরেদের পদ্ধতির প্রতিনিধি হিসেবে ধরতে পারি-যারা অর্থনৈতিক পদ্ধতিতে পরিবর্তন কামনা করেন। মার্কসের লক্ষ্য একটা রাজনৈতিক দলের সৃষ্টি করা, যে দল কালে সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করবে। সালটারের লক্ষ্য হলো প্রচারিত আইন কানুনের গণ্ডীর ভেতর থেকে শাসকদের প্রভাবিত করা এবং জনসাধারণের সুবিধার দিকে নজর রেখে জনমতের ওপর প্রভাব বিস্তার করা। মার্কস উপসংহারে প্রমাণ করেছেন যে পুজিবাদী পদ্ধতিতে মজুরেরা ভয়ঙ্কর ভাবে শোষিত এবং নির্যাতিত হয়েছে। কমিউনিজমে যে তারা কম ভুগবে একথা তিনি প্রমাণ করেননি নয় শুধু প্রমাণ করতে চেষ্টাও করেননি; তার বলার ভঙ্গি এবং অধ্যায় বিন্যাসের মধ্যে অন্তর্নিহিতভাবে এ বক্তব্যটুকু ব্যক্ত করা হয়েছে। সর্বহারাদের শ্রেণীসংগ্রামের প্রতি দরদ রেখে পড়ে বলে তার ধারণা পাঠককে প্রভাবিত করে পাঠকও নজর করে দেখেনা যে সে কথা প্রমাণ করা হয়নি। আবার মার্কস পরিষ্কারভাবে সামাজিক বিকাশের ধারা থেকে নৈতিকতার প্রশ্নকে একেবারে বর্জন করেছেন, রিকার্ডো এবং ম্যালথাসের এত তিনিও বলেছেন অর্থনীতির অপ্রতিরোধ্য নিয়মের ধারা অনুসারে সমাজের বিকাশ হয়েছে। কিন্তু রিকার্ডো এবং ম্যালথাস মনে করেছেন যে অপ্রতিরোধ্য অর্থনৈতিক আইন অপ্রতিরোধ্যভাবে ধনিক শ্রেণীর সুখ সম্পদের বৃদ্ধি এবং মজুরদের জন্য অফুরন্ত দুঃখের আমদানি করেছে। পক্ষান্তরে টালিয়ানের (Tertullian) মতো মার্কসের একটি গোপন বক্তব্যময় ভবিষ্যতের কল্পনা ছিল, যে ভবিষ্যতে তার শ্রেণীর লোকেরা সার্কাস দেখবে আর বুর্জোয়ারা চিৎকার করতে করতে মারা যাবে। যদিও মার্কস মানুষকে ভালো অথবা মন্দ হিসেবে না দেখে, শুধুমাত্র অর্থনৈতিক প্রতীক হিসেবে দেখতে ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন তা সত্ত্বেও তিনি বুর্জোয়া সমাজকে নষ্টের মূল এবং তার শানানো আক্রোশ মজুরদের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট করবার জন্যে তিনি কাজ করতে বলেছেন। মার্কসের পুঁজি বা ক্যাপিটাল, ব্রাইস রিপোর্টের মত অনেকগুলো হিংসাত্মক গল্পের সংকলন যেগুলো এমন ভঙ্গিতে রচনা করা হয়েছে যা পড়লে পড়ে শত্রুর বিরুদ্ধে সামরিক চ্যালেঞ্জ করার স্পৃহা জাগরিত হয় এবং অত্যন্ত স্বাভাবিক যে শক্রর সামরিক মনোবৃত্তিতে তা ঘা দেয়। এভাবে তা শ্রেণীতে শ্রেণীতে সংগ্রাম ডেকে আনে, যা আগে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। গভীরতর ঘৃণা এবং জিঘাংসা তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিল বলে কার্ল মার্কস এমন একটা প্রচণ্ড শক্তিধর রাজনৈতিক শক্তির কথা প্রমাণ করতে পেরেছিলেন। বাস্তব উদাহরণ দিয়ে তিনি পুঁজিপতিদেরকে নৈতিকতাবিহীন ঘৃণ্য জীব বলে প্রমাণ করেছিলেন।

সালটার সাহেবের ‘মিত্র শক্তির নৌযান নিয়ন্ত্রন’ গ্রন্থে আমরা সোজাসুজি এর বিপরীত ভাবাদর্শের সন্ধান পাই। সালটার আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্রবাদের একটা পদ্ধতিকে শাসন করার যে সুযোগ পেয়েছিলেন, মার্কসের তা ছিল না। এই পদ্ধতির উদ্ভব হয়েছিল জার্মানদের হত্যা করার জন্য পুঁজিবাদীদের হত্যা করার জন্য নয়। যেহেতু তারা অর্থনৈতিক সমস্যার প্রতি উদাসীন ছিল সে জন্য সালটারের বই তাদের ওপর ভিত্তি করে লেখা হয়েছে। তখন অর্থনৈতিক সমস্যাটি ছিল এ রকম যে সৈন্যেরা, যুদ্ধাস্ত্র নির্মাতারা, যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণের কাঁচামাল সরবরাহকারীরা সকলেই অলসভাবে সময় কাটাচ্ছে এবং বাকি সকলকে সব কাজ করতে হচ্ছে অথবা যেনো হঠাৎ ঘোষণা করা হলো যে আগে যে পরিমাণ কাজ করা হতো, এখন থেকে তার অর্ধেক কাজ করা হবে। যুদ্ধের অভিজ্ঞতা আমাদের এ সমস্যার একটি কারিগরী সমাধান দিয়েছে কিন্তু কোন মনস্তাত্ত্বিক সমাধান এ পর্যন্ত দেয় নি। তার কারণ হলো জার্মানদের প্রতি ঘৃণা এবং জার্মানদের ভয়ের দরুন যুদ্ধের সময়কালীণ বছরগুলোতে যে সহানুভূতি এবং পরস্পর নির্ভরশীলতা দেখা গেছে, শান্তির সময় কী রকম ক্রিয়া করবে তা এখনো পরীক্ষিত হয়নি।

সালটার বলেন (পৃঃ ১৯)

“সম্ভবত পেশাদার অর্থনীতিবিদদের দৃষ্টি আকর্ষন করার মতো এ মুহূর্তে অন্য কোনো কাজ নেই, রাষ্ট্রায়ত্ব করার নীতি পক্ষ অথবা বিপক্ষের প্রতি কোন রকম মোহ না রেখে বর্তমান যুদ্ধের সময়ে প্রকৃত অবস্থা কী তা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি ভঙ্গীসহকারে বিচার করাই তাদের কর্তব্য হয়ে পড়েছে। প্রথমতঃ দৃশ্যমান যে বাস্তব কাজ তাদের করতে হবে, তা এতই মারাত্মক যে অন্ততপক্ষে তার ফলে স্বাভাবিক অর্থনৈতিক জীবনযাত্রার সঙ্গে একটা সংঘাত অনিবার্য। একটি মোহমুক্ত পেশাদার অনুসন্ধান এসব উপাদান এবং অন্যান্য কারণের প্রতি যথেষ্ট প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। যুদ্ধের সময়ে এ সব পদ্ধতির সাফল্য আসলেই যৌক্তিক মতভেদের বাইরে। ব্যক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রে খসড়া হিসাবে দেখা গেছে যে যুদ্ধের আগে যে সকল লোক বেকার ছিল তারা এবং দেশের তিন ভাগের দু ভাগ উৎপাদন শক্তিকে সৈন্য বিভাগে অথবা অন্যান্য যুদ্ধের কাজে নিয়োগ করা হয়েছে। তার পরেও গ্রেটবৃটেন তার সম্পূর্ণ সামরিক শক্তিকে পুষে বেসামরিক জনসাধারণের জন্য যে জীবনযাত্রার মান বজায় রেখেছিল অসহনীয়ভাবে তা নিম্নতর ছিল না এবং কিছুদিনের জন্য কিছু শ্রেণী শান্তির সময়ে যেমন জীবনযাপন করত তেমনি আরামের সঙ্গে জীবনযাপন করেছে। এর জন্য বৃটেন বাইরের কোন দেশ থেকে কোন সাহায্য আনয়ন করেনি, নিজের সংগ্রহ থেকেই চালিয়েছে। ধার করা টাকায় আমেরিকা থেকে যত আমদানি করেছে ঋণ দেয়া টাকায় সে তার চেয়ে বেশি মিত্র দেশ সমূহকে দিয়েছে। তার যুদ্ধসম্ভার এবং জনসাধারণের প্রয়োজন চলতি উৎপাদনের সামান্য অংশমাত্র নিয়োজিত ছিল।” শান্তিকালীন বাণিজ্যনীতি প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেছেন, শান্তির সময়ে অর্থনৈতিক পদ্ধতি কোন উপযুক্ত নিয়ন্ত্রণের অধীন ছিল না। যুদ্ধের সময়ের এ পদ্ধতি ঐ অবস্থাতেই যতই অপ্রচুর এবং দোষাবহ হোকনা কেন, যে ভাবে যুদ্ধের বিচিত্র প্রয়োজন মেটাতে পেরেছে তা স্মর্তব্য। কিন্তু নতুন মান অনুসারে তা অন্ধ এবং অপচয়শীল বলে প্রমাণিত হয়েছে। উৎপাদন করেছে খুবই স্বল্প খারাপ জিনিস এবং খারাপ মানুষের মধ্যে তা বিলি বন্টন করা হয়েছে।” (পৃঃ ১৭)

যে পদ্ধতি যুদ্ধের ফলে ধীরে ধীরে জন্মলাভ করল, ১৯১৮ সালে তা সম্পূর্ণ প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্যসহ আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্রবাদের রূপ পরিগ্রহ করে। মিত্র সরকার যৌথভাবে খাদ্য এবং কাঁচামালের একমাত্র ক্রেতা ছিল এবং তাদের দেশে নয় শুধু ইউরোপের নিরপেক্ষ দেশগুলোতেও কি কি আমদানি করা হবে, তা নির্ধারণ করার একমাত্র বিচারক ছিল তারাই। কাঁচামালের নিয়ন্ত্রন করে উৎপাদনব্যবস্থাকে নিরঙ্কুশভাবে তারাই নিয়ন্ত্রণ করেছিল এবং ফ্যাক্টরির ব্যাপারে পর্যন্ত রেশনিং ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিল। খাদ্য বস্তুর খুচরা বিক্রয়ও তারা নিয়ন্ত্রণ করেছিল। তারা খাদ্যবস্তু বিক্রয়ের পরিমাণ এবং দর বেঁধে দিয়েছিল। সমুদ্র তীরবর্তী পরিবহন সংস্থার মাধ্যমে তাদের আদেশ প্রতিপালিত হতো এবং যুদ্ধের শেষাশেষি তারা বিশ্বের সমস্ত জাহাজ চলাচল ব্যবস্থার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে বসল। সে কারণে আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যের হুকুম দেয়ার অধিকার তারা লাভ করল। পদ্ধতিটি সমস্ত রকমের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত একটি আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্রের মত ছিল, প্রাথমিকভাবে যা বৈদেশিক বাণিজ্যের ব্যাপারে প্রয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু একই পদ্ধতি আবার রাজনৈতিক সমাজতন্ত্রবাদীদের বিরাট অসুবিধার সৃষ্টি করেছিল।

এই পদ্ধতির সবচেয়ে বিদঘুঁটে বৈশিষ্ট্য হলো এই পদ্ধতি ধনিক পুঁজিবাদী, শ্রেণীর কোন বিরুদ্ধাচরণ না করেই প্রবর্তন করা হয়েছিল। যুদ্ধকালীন রাজনীতির একটি উল্লেখ্য বৈশিষ্ট্য হলো কোন রকমেই জনসংখ্যার কোন শ্রেণীকে বিরুদ্ধাচরণ করতে দেয়া হয় না। দৃষ্টান্তস্বরূপ জাহাজ চলাচলের সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে যুক্তি দেখানো হয়েছিল যে সাধারণ মানুষের হাতে অসন্তোষের ভয়ে অস্ত্রশস্ত্র দেয়ার বেলায় খাদ্যের চেয়েও অধিকতর কড়াকড়ি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। পুঁজিবাদীদের হাত থেকে কিছু হস্তান্তর করা খুব বেশি কষ্টকর এবং প্রকৃত প্রস্তাবে পরিবহণ ব্যবস্থা কোন গুরুতর সংঘর্ষ ব্যতিরেকে সার্থকভাবে শেষপর্যন্ত চালু রইল। বিশেষ বিশেষ শ্রেণীর মানুষ দুষ্ট তাদেরকে অবশ্যই শাস্তি দেয়া উচিত এর পেছনে তাদের এ উদ্দেশ্য ছিল না। তাদের উদ্দেশ্য ছিল শান্তিকালীন পদ্ধতি যুদ্ধের সময় সক্রিয় নয়, সুতরাং সবদিক দিয়ে কম পরিশ্রম করে একটি নতুন পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করা। যুদ্ধের সময়ে জাতির যখন দুর্দিন, সরকার যা করা প্রয়োজনীয় মনে করল তাতে জনসাধারণের সমর্থন আদায় শান্তির সময়ে যত কষ্টকর এখন অত কষ্টকর হবে না বিবেচনা করল। কিন্তু শান্তির সময়েও সমর্থন আদায় খুব কষ্টকর হতোনা। যদি শ্ৰেণীবৈরিতা না-দেখিয়ে শাসনতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ হতে উপযুক্তভাবে সবকিছু তুলে ধরা হতো।

যুদ্ধকালীন শাসনের অভিজ্ঞতা হতে দেখা গেছে যে সরকার কাঁচামাল, বৈদেশিক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করলে এবং ব্যাঙ্কসমূহে রাষ্ট্রীয়করণ করলে সমাজতান্ত্রিকীকরণের অনেকগুলো সুবিধা প্রত্যাশিত (Stabilization) স্থিরীকরণের ওপর লয়েড যে মূল্যবান বইখানা লিখেছেন তাতে এ মতবাদের সম্পূর্ণ বিকাশ ঘটেছে, তা সমস্যাকে বৈজ্ঞানিকভাবে বিশ্লেষণের একটি নির্দিষ্ট প্রচেষ্টা বলে আমরা ধরে নিতে পারি, যা পরীক্ষা করার ভার যুদ্ধ সরকারি কর্মচারীদের ওপর চাপিয়েছে।

বাস্তব দৃষ্টিকোণ থেকে স্যার আর্থার সাল্টার এর বইটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো তাতে তিনি আন্তর্জাতিক সহযোগিতার পদ্ধতি সম্বন্ধে যে বিশ্লেষণ করেছেন তার বাস্ত ব প্রয়োগ খুবই ফলপ্রসূ প্রমাণিত হয়েছে যে কোন দেশের পক্ষে আলাদাভাবে কোন সমস্যা বিচার করবার রেওয়াজ তখন ছিল না এবং অন্যান্য শক্তির সঙ্গে দরকষাকষি করে কতো বেশি সুবিধা অর্জন করা যায় সে জন্যে দেশে দেশে কূটনৈতিক সম্বন্ধ স্থাপন করা হয়েছিল। গৃহীত পরিকল্পনার প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি প্রশ্ন বিচার করার জন্যে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ কমিটি নিয়োগ করা হলো, যাতে করে জাতিতে জাতিতে সংঘাত না-বাধিয়ে পণ্যে পণ্যে সংঘাত বাধায়। হুইট কমিশন কয়লা কমিশনের সঙ্গে দরকষাকষি করত এবং অন্য সব ব্যাপারেও এরকম দরকষাকষি চলতো। প্রত্যেক কমিশনের সুপারিশ হলো মিত্র শক্তির দেশগুলোর বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধির আপোষ আলোচনার ফল। প্রকৃতপ্রস্তাবে সর্বোচ্চ যুদ্ধ পরিষদের অপরিহার্য ক্ষমতা ছাড়া সর্বত্র আন্তর্জাতিক শ্রমিকতন্ত্রবাদের মত রূপ পরিগ্রহণ করল। এর তাৎপর্য হলো কোন সার্থক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে প্রত্যেকটা কর্ম অবশ্যই আলাদা আলাদাভাবে সম্পন্ন করবে এবং শুধুমাত্র জাতিভিত্তিক সংগঠনের বিরোধ ফয়সালা করার জন্যে একমাত্র আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান থাকলেও চলবেনা।

যে কেউ সালটারের বই পড়ে জানতে পারবে যে মিত্রশক্তির মধ্যে যুদ্ধকালীন সময়ে যে আন্তর্জাতিক সরকারের প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, শান্তির সময়েও যদি তা করা হতো সর্বত্র, তাহলে পৃথিবীর অধিবাসীদের বাস্তব মানসিক এবং নৈতিক প্রভূত উন্নতি সাধিত হবে। এ ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হলে ব্যবসায়ীদের কোন ক্ষতি হবে না, বরঞ্চ তাদেরকে স্থায়ীভাবে প্রতিশ্রুতি দেয়া যাবে যে গত তিন বছরের মুনাফা পেনশনের মত করে নিশ্চিতভাবে তাদের দেয়া হবে। এর ফলে বেকার সমস্যা, যুদ্ধভীতি, অভাব-দুর্ভিক্ষ কমবে এবং বেশি উৎপাদন সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। মি. লয়েড-এর বইতে এর স্বপক্ষের যুক্তি এবং পদ্ধতি যথাযথভাবে সন্নিবেশিত হয়েছে। এ সকল স্পষ্ট সার্বিক সুযোগ সুবিধা থাকা সত্ত্বেও এ ধরণের প্রতিষ্ঠানের সম্ভাবনা আন্তর্জাতিক বিপ্লবী সমাজতন্ত্রবাদের চেয়েও অনেক কম। বিপ্লবী সমাজতন্ত্রবাদের বিপদ হলো তা প্রবল বিরোধীতার জন্ম দেয় এবং সরকারি চাকুরেদের সমাজতন্ত্রবাদের কোন সমর্থন পাওয়া যাবে না। কোন রাজনৈতিক প্রচেষ্টার প্রতি মানুষ তখন বিরোধিতা করে যখন সে মনে করে তা তাকে ধ্বংস করবে এবং তখনই সমর্থন করবে। (এগুলো সাধারণতঃ মনের অবচেতনে থাকে) যখন সে আশা করে এর ফলে তার শত্রুরা ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। সুতরাং কোন নীতি যদি কাউকে আঘাত না করে তাহলে কারো সমর্থন পাবেনা। যে নীতি অধিকাংশ মানুষের সমর্থন পাবে তাকে প্রবল অসুবিধারও সম্মুখীন হতে হবে। শিল্পতন্ত্রবাদ বিশ্বভিত্তিক সহযোগিতার নতুন প্রয়োজনের জন্ম দিয়েছে এবং সে সঙ্গে একে অন্যকে শত্রুতা করে ধ্বংস করার উন্নত কৌশলেরও জন্ম দিয়েছে। পার্টি রাজনীতিতে একমাত্র প্রতিহিংসার আবেদনই প্রবৃত্তিগত সাড়া জাগাতে সক্ষম; কিন্তু যে মানুষ পারস্পরিক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তার কথা বলে তার হাতে কোন শক্তি নেই। যদি শিক্ষাব্যবস্থাকে পুরুষানুক্রমে নতুন খাতে চালনা না করা হয়, পত্রিকাতে ঘৃণা বিদ্বেষের বাণী ছড়ানো বন্ধ না করা হয়, তাহলে আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক পদ্ধতিতে ক্ষতিকর নীতি প্রয়োগের কখনো অবসান ঘটবে না। তাহলেও শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন করার কোন উল্লেখযোগ্য পন্থা আমাদের জানা নেই, আমাদের রাজনৈতিক পদ্ধতিতে পরিবর্তন না আনা পর্যন্ত সংবাদপত্রে কোন পরিবর্তন আনা সম্ভবপর নয়। এই শখের-করাতের মত অবস্থা থেকে সাধারণভাবে কাজ করে রক্ষা পাওয়ার কোন উপায় নেই। আমার মতে, আমরা যত বেশি লোক পারি; সময়ে অসময়ে যে পার্টির আকর্ষণীয় কর্মসূচী আমাদের সামনে তুলে ধরা হয় তাতে বিশ্বাস স্থাপন না করে রাজনৈতিক সংশয়বাদী হয়ে পড়লেই সবচেয়ে বেশি লাভের সম্ভাবনা। অনেক স্নিগ্ধমস্তিষ্ক বিবেকবান মানুষ, এইচ, জি, ওয়েলসও বিশ্বাস করেছিলেন যে গত যুদ্ধই যুদ্ধের শেষ। তাদের এ বিশ্বাস যে অলীক মরীচিকা তা এখন তারা হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছেন। আবার অনেক বিবেকবান শান্ত মানুষ বিশ্বাস করেন যে মার্কসীয় শ্রেণী সংগ্রমই হবে শেষ সংগ্রাম। যদি সে দিন কখনো আসে তাঁরাও যে অলীক মরীচিকায় বিশ্বাস স্থাপন করেছেন সে সময়ে যদি বেঁচে থাকেন তাহলে বুঝতে পারবেন। কোন সুবিবেচক ব্যক্তি যদি জোড়াল কোন রাজনৈতিক আন্দোলনে বিশ্বাস করেন,তাহলে তিনি সে সুসংগঠিত অমঙ্গলকে দীর্ঘস্থায়ী হতে সাহায্য করছেন যা আমাদের সভ্যতাকে ধ্বংস করেছে। অবশ্য এটাকে আমি চূড়ান্ত আইন বা নিয়ম বলে স্থাপন করতে চাইনে, কারণ আমাদের সন্দেহবাদ সম্বন্ধেও সন্দেহ পরায়ন হতে হবে। কিন্তু যদি একটি রাজনৈতিক পার্টির একটি নীতি থাকে। যেমন অনেকরই আছে তা যখন একটি ভালো করতে গিয়ে অনেক গুলো ক্ষতি করে, তখন রাজনৈতিকদের সন্দেহাত্নক কর্ম সম্বন্ধে সংশয়বাদী হওয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। মনঃসমীক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা খুবই সহজে সন্দেহ করতে পারি যে নীতিকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্যে প্রচুর ক্ষতি করা হয়, প্রকৃত মঙ্গল প্রকৃতিকে বিচারবুদ্ধিসম্মত করে রচনার মধ্যেই নিহিত।

ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক সংশয়বাদ সম্ভবপর। মনস্তাত্ত্বিক দিক দিয়ে জাতি অথবা সামাজিক শ্রেণীর প্রতি বিদ্বেষ না পোষণ করে রাজনৈতিকদের প্রতি আমাদের শত্রুতার দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে। রাজনৈতিকদের সাহায্য ব্যতিরেকে শত্রুতা ক্রিয়াশীল হবে না, যে শক্রতার লক্ষ্য তারা তা হতে পারে কারো মনস্তাত্ত্বিক সন্তষ্টির পরিচায়ক কিন্তু সামাজিকভাবে ক্ষতিকর নয়। উইলিয়াম জেমসের অনুভূত অভাব পূরণ করার জন্য যেমন প্রয়োজন তেমনি নৈতিকতাকে এমন উর্ধ্বে প্রতিষ্ঠিত করা উচিত বলে আমি মনে করি “নৈতিকভাবে যা হবে যুদ্ধের সমার্থক” হতে পারে সত্য, এর ফলে রাজনীতি দুষ্ট লোকদের হাতে পরতে পারে (যে সব লোককে আমি এবং আপনি না পছন্দ করি। কিন্তু তারও একটা সুফল থাকতে পারে। আমি ১৯২৩ সনের ২৬শে সেপ্টেম্বরের ফ্রিম্যান কাগজে একটা গল্প পড়েছিলাম যা রাজনৈতিক বাটপারির প্রয়োজনীয়তার একটা চূড়ান্ত নজির বলে বিবেচিত হতে পারে। একজন ইংরেজ একজন বয়স্ক “জাপানি রাজনীতিবিদের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্বন্ধ পাতানোর পর জিজ্ঞেস করলেন “জাপানি ধনীরা অসাধু এবং চীনারা সাধু কারণ কি? তিনি জবাব দিলেন, কিছুদিন আগে থেকে চীনা রাজনীতিতে ভয়ঙ্কর রকমের দুর্নীতি অনুপ্রবেশ করেছে এবং চীনা আদালতে হঠকারিতা ন্যায়বিচারের স্থান দখল করেছে। সুতরাং তখন থেকে উজ্জ্বলতা এবং ধ্বংসের হাত থেকে ব্যবসাকে রক্ষা করার জন্যে চীনা ব্যবসায়ীরা কঠোর নৈতিকতা বজায় রাখতে বাধ্য হলো। তখন থেকে চীনা ব্যবসায়ীদের মুখের কথা তার হাতে লেখা দলিলের মতো হয়ে দাঁড়াল। কিন্তু জাপানের ব্যবসায়ীরা এরকম কোন অবস্থার সম্মুখীন হয়নি কারণ পৃথিবীতে একমাত্র আমাদেরই সবচেয়ে সৎ আইন ব্যবস্থা রয়েছে। সুতরাং যখন আপনি একজন জাপানির সঙ্গে ব্যবসা করেন হুঁশিয়ার হয়ে করবেন।” এই গল্প থেকে প্রমাণিত হয় যে অসাধু রাজনৈতিকরা সাধু রাজনৈতিকদের চেয়ে বেশি ক্ষতি করে।

একজন সৎ রাজনৈতিক সম্বন্ধে ধারণা পোষণ করা খুব সহজ নয়। সৎ রাজনৈতিকের খুব সহনশীল সংজ্ঞা হলো তিনি ব্যক্তিগত লাভ লোভের বশবর্তী হয়ে কোন রাজনৈতিক কর্মে আত্মনিয়োগ করেন না। এই অর্থে মি. লয়েড জর্জকেও সৎ বলা যায়। তার পরবর্তী পর্যায়ে যে লোকের কথা আসবে সে লোক কেবলমাত্র অর্থনৈতিক লক্ষ্য ছাড়া ক্ষমতা লাভ এবং ক্ষমতা অটুট রাখার জন্য রাজনৈতিক কর্মে আত্মনিয়োগ করেন না। এই অর্থে লর্ড গ্রেকেও একজন সৎ রাজনৈতিক বলে অভিহিত করা যায়। শেষ এবং কঠোর অর্থে তিনি একজন সৎ রাজনৈতিক, যিনি জনসাধারণের কাজ নিস্পৃহতাসহকারে করে থাকেন। কিন্তু সত্যবাদিতা এবং সম্মানের জন্য পরিচিতরা তাকে কখনো নীচ দৃষ্টিতে দেখে না। এই অর্থে স্বৰ্গতঃ লর্ড মর্লি ছিলেন একজন সৎ রাজনৈতিক। সতোর কারণেই রাজনীতি থেকে তিনি বিতাড়িত হয়েছিলেন। কিন্তু যে রাজনীতিবিদ সৎ উচ্চতর অর্থে তিনিও ক্ষতি করেন, তৃতীয় জর্জকে এর দৃষ্টান্ত হিসেবে গণ্য করা যায়। বোকামি এবং অচেতন পক্ষাপাতিত্ব প্রতিহিংসার চেয়েও বেশি ক্ষতি করে। অধিকন্তু একজন সৎ রাজনৈতিক গণতন্ত্র সহ্য করেনা যদি না তিনি ডেভোনশায়ারের ডিউকের মতো ধড়িবাজ হতে না পারেন। কেবলমাত্র ধড়িবাজেরা জাতির অর্ধেক মানুষের কুসংস্কারে অংশগ্রহণ করতে পারে। সুতরাং যে লোক সক্ষম ও জনগণ সম্বন্ধে উৎসাহী তাকে রাজনীতিতে সাফল্য লাভ করতে হলে অবশ্যই কপট হতে হবে। কিন্তু সময়ে তার কপটতা তার প্রতি জনগণের ভালোবাসাকে হত্যা করবে।

গণতন্ত্রের বর্তমানে দোষত্রুটিকে দূরীভূত করতে হলে এখন যে পদ্ধতিটি আমাদের প্রধানতঃ অবলম্বন করা উচিত, তাহলে প্রতিটি বিষয়ে প্রচারের জন্যে সরকারি কর্মচারীদের আরো উৎসাহী হতে হবে এবং এব্যাপারে তাদের আরো উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সময় সময়ে তাদের নিজের নামে বিল পাশ করাবার অধিকার থাকা উচিত এবং জনসাধারণের সামনে তার সমর্থনে যুক্তি পেশ করা তাদের কর্তব্য হওয়া উচিত। অর্থ এবং শ্রমের ওপর আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে এবং তাদের উচিত একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠন করে, তার মাধ্যমে এ পদ্ধতি বিভিন্ন দেশের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করার চেষ্টা করা, যাতে করে পদ্ধতিটি দীর্ঘকালব্যাপী টেকসই হতে পারে। আলোচনার মাধ্যমে একটি সার্বজনীন পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। এইভাবে সব সমস্যার সমাধান করতে হবে। এটা সম্ভব নয় এবং আশা করাও উচিত নয় যে গণতান্ত্রিক পার্লামেন্টে বিতর্ক করে সব সমস্যার সমাধান করতে হবে। কোন চেষ্টাকে ফলবতী করে তুলতে হলে পরিপূর্ণ আলোচনার সঙ্গে বিশেষজ্ঞদের মতামতের সমন্বয় বিধান করে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে তা প্রচার করতে হবে। কিন্তু এখন অনেক ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের সুচিন্তিত মতামত কী তা জনসাধারণ জানতে পারে না, এর কারণ তাদের সমষ্টিগত অথবা অধিকাংশের সমর্থন আলাদা করার মতো কোন যন্ত্র এখন পর্যন্ত সম্পূর্ণভাবে চালু করা হয়নি। বিশেষ করে সরকারি কর্মচারীদেরকে তাদের মতামত বিশেষ বিশেষ অরাজনৈতিক ক্ষেত্র ছাড়া জনসাধারণকে জানতে দেয়া হয় না। আন্তর্জাতিক আলোচনার পর পার্টিগত বিভেদের বিরুদ্ধে তাকে প্রয়োগ করলে পরে যে সকল মতভেদ আমরা এখন স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নিয়েছি তার কড়াকড়ি অনেকটা হ্রাস পাবে। আমি বিশ্বাস করি, আন্তর্জাতিক শ্রম এবং আন্তর্জাতিক অর্থ সম্মেলন যদি জাতিসমূহের পারস্পরিক অবিশ্বাস নিরসন করতে সক্ষম হয় তাহলে এমুহূর্তে এমন একটি সিদ্ধান্ত এরকম হতে পারে যা পার্লামেন্টে চালু করা যাবে। কয়েক বছর পর এবং জগতের প্রভূত উপকার করা যাবে এ সম্মিলিত প্রচেষ্টার বিরোধিতা করা খুবই কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে। •

মানুষের দৈনন্দিন সমস্যা বিভিন্নমুখী এবং গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক যন্ত্র বিভিন্ন পার্টি এবং জাতির ক্ষমতার দ্বন্দ্বে এ সমস্যাকে খুবই লঘু দৃষ্টিতে দেখে। আইনতঃ অথবা সংবিধানগত কোন পরিবর্তন না ঘটিয়ে একটি ভিন্নরকম যন্ত্র সৃষ্টি করা অসম্ভব নয়। যা জাতির অথবা পার্টিগত ভাবাবেগ নিরোধ করে শুধুমাত্র শত্রুদের নিপাত না করে যে সকল প্রচেষ্টা সকলের জন্য উপকারী তার উদ্যোগ গ্রহণ করতে সমর্থ হবে। আমার পরামর্শ হলো, স্বদেশে পার্টি সরকার এবং বিদেশে বৈদেশিক অফিসে কূটনীতির মাধ্যমে না করে, যেমন বলেছি তেমনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনুসন্ধান করলে বর্তমান সভ্যতাকে যা ধ্বংস করেছে, তা নিরোধের একটি পন্থা পাওয়া যাবে জ্ঞান সব সময়েই তাকে, সদিচ্ছাও সবসময়ে থাকে, কিন্তু যে পর্যন্ত না জ্ঞান এবং সদিচ্ছা প্রচারের মধ্যেই শক্তি অর্জন করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *