০৯. ভালো মানুষদের কথা

ভালো মানুষদের কথা

একশ বছর আগে জেরেমি বেনথাম নামে একজন দার্শনিক সর্বসাধারণের কাছে মন্দলোক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ছোটবেলা যেদিন সে নামটির সঙ্গে আমার সর্বপ্রথম পরিচয় হয় সেদিনটির কথা এখনো আমার খেয়াল আছে। রেভারেণ্ড সিডনি স্মিথ বলেছিলেন। বেনথামের মতে মৃতা মাতামহীর মাংস দিয়ে স্যুপ তৈরি করা উচিত। নীতিগতভাবে এ ধরণের ব্যঞ্জন তৈরি করার কাজকে তখন আমার কাছে রীতিমতো বিগর্হিত ঠেকেছিল। সুতরাং আমার মনেও বেনথাম সম্পর্কে খারাপ ধারণা বদ্ধমূল হলো। এর অনেক পরে আমি আবিষ্কার করলাম, যেভাবে প্রচলিত পদ্ধতি অনুসারে শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিরা সতোর সুফল ভোগ করার জন্যে যে ধরণের বেপরোয়া মন্তব্য করে থাকে, উক্ত মন্তব্যটিও ছিল সেরকমের একটি। তার বিরুদ্ধে সাংঘাতিক অভিযোগের কারণও আমি অনুধাবন করতে সমর্থ হলাম। তাহলে তার প্রদত্ত সংজ্ঞা সেখানে তিনি বলেছেন, সেই-ই ভালো মানুষ যে ভালো কাজ করে। সৎ পাঠকের মনে সংজ্ঞাটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে যে ধারণা জন্মাবে তা সকল রকমের বিশুদ্ধ নৈতিকতার পরিপন্থী। যেখানে কান্ট বলেছেন, শুধুমাত্র উপকৃত জনের প্রতি স্নেহাধিক্যবশত কৃতকর্মসমূহ ধর্মীয় আখ্যা পেতে পারেনা, সেখানে তিনি কিরকম অভিভূত। কিন্তু নৈতিক নিয়মের প্রেরণায় কৃতকর্মসমূহ অপ্রিয় হলেও ধর্মীয়। এও আমরা সকলে জানি যে, ধর্মই ধর্মের শেষ পুরস্কার: কিন্তু গভীরভাবে অনুসন্ধান করলে তেমনি এটাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যেমন একজন রোগী নিজেই নিজের শাস্তি ভোগের কারণ। সুতরাং কান্ট বেনথামের চেয়ে আরো একজন বিনম্র চিন্তাবিদ এবং তিনি তাদেরই কল্যাণ কামনা করেন যারা ধর্মকে ধর্মের কারণেই ভালোবাসেন।

বেনথাম ভালো মানুষের পুরোপুরি সংজ্ঞায়ন করে প্রভূত কল্যাণ করেছেন। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী চল্লিশটি বছর বাস্তব বুদ্ধিবৃত্তিক এবং নীতির দিক দিয়ে অবিশ্বাস্য রকমে উন্নততর যুগ। এই সময়েই হয়েছিল সংস্কার আইন, যার ফলে পার্লামেন্ট সদস্যপদের আসন অধিকার করল মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়, পূর্বের মতো অভিজাত শ্রেণী নয়। এই আইনটি ছিল ইংল্যাণ্ডে গণতন্ত্রের প্রবর্তন করার পদক্ষেপসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক এবং এরই সঙ্গে সঙ্গে উল্লেখযোগ্য সংস্কারও সাধিত হলো! যেমন উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে জ্যামেইকার দাস বৃত্তির অবসান। এ সময়ে ছাৈটখাট চুরির অপরাধেও মানুষকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো হতো, কিন্তু অতি অল্প সময়ের মধ্যে মৃত্যুদণ্ডকে শুধু খুন অথবা অনুরূপ অপরাধের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ করা হলো। যে শস্য-আইনের ফলে খাদ্যবস্তু দুর্মূল্য হয়ে গেল এবং দুর্ভিক্ষ ভয়াবহ আকার ধারণ করল, ১৮৪৬ সালে তা রহিত করা হলো। ১৮৭০ সালে বাধ্যতামূলক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তিত হলো। ভিক্টোরিয় যুগের নিন্দা করা এখন প্রায় ফ্যাশনে দাঁড়িয়েছে; কিন্তু আমার ধারণা সে যুগের মহৎ গুণাবলীর যে প্রমাণ আমরা পেয়ে থাকি, আমাদের যুগে তার অর্ধেকও বিরল। সে যা হোক, তার আলোচনা এখানে অপ্রাসঙ্গিক কিন্তু আমার যা বলবার বিষয়, তাহলো ঐ বছরগুলোতে যে উন্নতি সাধিত হয়েছিল তার অধিকাংশ অবশ্যই বেনথামের প্রভাবে হয়েছিল। এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই যে শতাব্দীর শেষভাগে ইংল্যাণ্ডের জনসাধারণ যে রকম সুখ-সন্তষ্ট দিন যাপন করত তেমনটি আর কখনো ছিল না। বেনথামের দর্শন এত অগভীর ছিল যে, সে অগভীরতাকে তিনি তার সাফল্য জ্ঞান করতেন। আমাদের আলোকিত যুগে অনায়াসে বলে দিতে পারি যে, ও জাতীয় মতবাদ কিংবা ধারণা অবিশ্বাস্য এবং অযৌক্তিক হলেও বেনথামের মত আমাদের উপযোগবাদ পরিহার করার ক্ষেত্রে আবিষ্কার করতে সাহায্য করবে।

ভালোমানুষ বলতে কি বোঝায় তা আমরা সকলেই জানি। আদর্শ ভালোমানুষ মদ খান না, ধুমপান করেন না, খারাপ বাক্য পরিহার করেন, ভদ্রলোকের সঙ্গে এমন সংযতভাবে আলাপচারী করেন যেন সেখানে ভদ্র মহিলা আছেন। নিয়মিত গির্জায় যান এবং সব বিষয়ে সঠিক ধারণা রাখেন। অন্যায় করার ব্যাপারে তার হৃদয়ে প্রবল ভীতি বিরাজিত এবং তিনিও জানেন যে, পাপ বাঁচিয়ে জীবন ধারণ করা হলো আমাদের বেদনার্ত কর্তব্য, তার পরেও পাপের ব্যাপারে তার আতঙ্কিত মনোভাব থেকে যায়। মধ্যবয়স্ক নাগরিকেরা যে সকল মতামত অবলম্বন করে সাফল্যের স্বর্ণশিখরে আরোহণ করেছেন, যখন তাদের জ্ঞানের পরিপক্কতা সম্বন্ধে প্রশ্ন করে বসেন কেউ তাদের অজ্ঞতা থেকে তরুণদেরকে রক্ষা করাকে নিজেদের পবিত্র কর্তব্য বলে মনে করেন। পেশাগত কঠোর পরিশ্রম ছাড়াও ভালো লোকেরা ভালো কাজে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। যেমন তিনি দেশকে সামরিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার উৎসাহ দিতে পারেন, কারখানার উন্নতি বিধান করতে পারেন। কারখানার মজুর এবং তাদের সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে সহনশীলতা এবং ধর্মের বাণী প্রচার করতে পারেন, যাতে তারা আসল পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে শাস্তি ভোগের কারণ না হয়। অথবা তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি হয়ে বিপরীত আদর্শের অধ্যাপক নিযুক্ত করে জ্ঞানের উদ্দেশ্য প্রণোদিত পক্ষপাতমূলক শ্রদ্ধার নিরসন করতে পারেন, সর্বপরি তার নৈতিকতা সংকীর্ণ হলেও অবশ্যই অক্ষত থাকা চাই।

উল্লিখিত অর্থে একজন ভালো লোক একজন মন্দ লোকের তুলনায় অধিকতর ভালো করতে পারে কিনা, সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। আমি মন্দ বলতে যা বুঝি তা এতক্ষণ যা বলে আসছি তার বিপরীত। একজন মন্দ লোক মদ খায়, ধুমপান করে, তার কাজে ব্যাঘাত ঘটালে মন্দ কথাও উচ্চারণ করে এবং তার কথোপকথন সবসময় ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হবার উপযুক্ত নয়। রোববারে গির্জায় যাওয়ার পরিবর্তে অন্য কোথাও গিয়ে সে বেশ মজা করে কাটায়। তার কতকগুলো মতামত খুবই মারাত্মক। যেমন, ধরুন, সে মনে করে, আপনি যদি শান্তি কামনা করেন তাহলে আপনাকে শান্তির প্রস্তুতি নিতে হবে, যুদ্ধের নয়। মন্দকাজ করার ব্যাপারে সে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে যেমন সে করে, থাকে তার মোটর গাড়ির কলকজা বিগড়ে গেল তার যুক্তি হলো খোতবা এবং কারাগার ফাটা টায়ার মেরামত করার চেয়ে পাপের বিশেষ কিছু করতে পারে না। মন্দ চিন্তা করার ব্যাপারেও সে অধিকতর বিকৃত রুচির পরিচয় দিয়ে থাকে। তার মতে মানুষ স্বাভাবিকভাবে যে সব চিন্তা করে তাকে বলা হয় মন্দ চিন্তা। আর যেগুলোকে সৎ চিন্তা বলা হয়ে থাকে, তা তোতা পাখির মতো এক বুলিকে বারবার আওড়ানো ছাড়া আর কিছু নয়। এরই ফলে কতকগুলো অনভিপ্রেত বদ্ধমূল ধারণার প্রতি সহানুভূতি আকর্ষিত হয়। তার কাজের সময়ের বাইরের কার্যাবলী তার কাছে খুবই উপভোগ্য হতে পারে অথবা ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর গায়ে আঁচড় লাগেনা এমন কতকগুলো প্রতিকারসাপেক্ষ অপরাধের আধিক্যবশতঃ চরম অসন্তেষের মধ্যে জীবন কাটায়। আবার এটাও খুব সম্ভব যে, একজন ধার্মিক যেমন করতে পারে তেমনিভাবে সে নৈতিক বিচ্যুতিগুলো গোপন করে উঠতে পারে না। বরঞ্চ বিকৃত মানসিকতার উপর নির্ভর করে কিছু দৃষ্টান্ত স্থাপন করার চাইতে সৎ হওয়াটাকে অনেক বেশি ভালো মনে করেন। একজন লোক যখন এক বিশেষ কোন অথবা কতকগুলো দিকে কৃতকার্যতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়, তখন সম্মানীয় নাগরিকেরা তাকে জজ ম্যাজিষ্ট্রেট, ইত্যাদি পদ এমনকি মাস্টারের চাকুরি পর্যন্ত অধিকার করতে দেয় না। এসকল পদ শুধুমাত্র ভালো মানুষের জন্যই অবারিত।

এ সকল ব্যাপার কমবেশি আধুনিক। অনুরূপ ব্যবস্থা ক্রমওয়েলের সময়ে পিউরিটানদের অল্পসময় কালীন রাজত্বকালে ইংল্যাণ্ডে স্বল্পকালের জন্য বিদ্যমান ছিল এবং পরে তাদের দ্বারা ঐগুলো আমেরিকাতে প্রবর্তিত হয়। ফরাসি বিপ্লবের পরে যখন জেকোবিনবাদের বিরোধিতা (Jacobinism) করা আজকের যুগের বলশেভিকদের বিরোধিতা করার মতো ভালো কাজ বিবেচিত হতো, তখন সারা ইংল্যাণ্ডে এর পুনরাবির্ভাব হয়নি। ওয়ার্ডসওয়ার্থের জীবনে এ পরিবর্তনকে সুস্পষ্টভাবে প্রত্যক্ষ করা যায়। যৌবনে তিনি ফরাসি বিপ্লবকে সমর্থন করে ফরাসিদের চলে গেলেন, কন্যা সন্তাটিকে পরিত্যাগ করলেন, সুনীতি অনুসরণ করে জীবন অতিবাহিত করতে থাকেন এবং খারাপ কবিতা লিখতে থাকেন। কোলরিজের জীবনেও অনুরূপ পরিবর্তন ঘটে, যখন তিনি খারাপ ছিলেন তখন ‘কুবলা খান কবিতা লিখেন, পরে ভালো হয়ে লিখলেন ধর্মতত্ত্ব।

ভালো থাকার সময় ভালো কবিতা লিখছেন, এমন দৃষ্টান্ত কোন কবির জীবনে খুঁজে পাওয়া একরূপ অসম্ভব। রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারণার দায়ে দান্তেকে নির্বাসনে যেতে হয়েছিল। শেক্সপিয়রকে তার সনেট দ্বারা বিচার করা হলে আমেরিকার স্বরাষ্ট্রবিভাগের কর্মচারীরা সেগুলোকে নিউইয়র্ক শহরে ঢুকবার অনুমতি দিতো না। ভালোমানুষের আসল পরিচয় হলো তিনি সরকারকে সমর্থন করেন। সুতরাং ক্রমওয়েলের সময়ে মিলটন ভালো মানুষ ছিলেন, তার আগে কিংবা পরে নয়, কিন্তু এই পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সময়েই তিনি অধিকাংশ কবিতা রচনা করেছেন। প্রকৃত প্রস্তাবে তার তখনই অধিকাংশ কবিতা লিখিত হয়েছে যখন তিনি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে ফাসী থেকে অল্পের জন্য রেহাই পান। কবি ডান সেন্টপলের ডিন হওয়ার পরে ধার্মিক হয়ে যান, কিন্তু তার অধিকাংশ লেখা হয় তার আগে। সে সকল কবিতা লিখেছেন বলে তার নিয়োগকে কেন্দ্র করে প্রচুর কেলেংকারীর সৃষ্ট হয়েছিল। যৌবনে সুইনবার্নও ছিলেন মন্দ লোক, তখনই তিনি স্বাধীনতার জন্য যারা সংগ্রাম করে, তাদের উদ্দেশ্যে’ দ্য সংস বিফোর সানরাইজ (The songs before) সূর্য উঠার আগের গান লিখেছিলেন। বুড়ো বয়সে তিনি ধার্মিক হয়ে গিয়েছিলেন এবং তখনই তিনি বোয়ারদের উপর বর্বরোচিত আক্রমনের প্রতিবাদের কলম ধরেছিলেন এবং তাদের স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপের নিন্দা করেছিলেন। আর দৃষ্টান্ত বাড়িয়ে কোন লাভ নেই। ভালো সম্বন্ধে যে ধারণার মানের কথা সমাজে প্রচলিত রয়েছে তা যে ভালো কবিতা জন্ম দিতে পারেনা, সে সম্বন্ধে অনেক কিছুই বলা হয়েছে।

অন্যদিক দিয়ে দেখতে গেলেও ব্যাপারটা সত্যি। আমরা সকলে জানি যে ডারউইন এবং গ্যালিলিও উভয়ে মন্দ লোক ছিলেন। মৃত্যুর পর একশ বছর অতীত না হওয়া পর্যন্ত স্পিনোজাকেও মন্দ লোক ভাবা হতো। নির্যাতনের ভয়ে দেকার্তে বিদেশ চলে যান। রেনেসাঁ যুগের সকল শিল্পী ছিলেন খারাপ লোক। সাধারণভাবে বলতে গেলে, যারা দমন করা যায় এমন সব দোষের বিরোধিতা করতেন তাদেরকেই মন্দ লোক ভাবা হতো। আমি লণ্ডনের এমন এক অংশে বাস করি যার অংশবিশেষ ধনী এবং অংশবিশেষ দরিদ্র। শিশু মৃত্যুর হার অস্বাভাবিক ভাবে বেশি এবং ধনীরা দুর্নীতি এবং জোরের মাধ্যমে স্থানীয় সরকারকে (Local Government) নিয়ন্ত্রণ করে। তারা শিশুকল্যাণ এবং জনস্বাস্থ্যের খাতে ব্যয় কমিয়ে দেবার জন্যে ক্ষমতা ব্যবহার করে। একজন চিকিৎসককে কম দামেই এ শর্তে নিয়োগ করা হয়েছে যে তিনি শুধু অর্ধেক সময়ের জন্য রোগীদের দেখবেন। গরীবের ছেলের জীবনের চাইতে ধনীদের জন্য ভালো ডিনারকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে না করলে কেউ স্থানীয় প্রভাবশালী লোকদের শ্রদ্ধাভাজন হতে পারে না। একই ব্যাপার আমার পরিচিত পৃথিবীর সর্বত্রই সত্য। এ থেকে আমরা ভালো লোকের গুণাগুণ কি তা অতি সহজে বুঝতে পারি, ভালো লোক হলেন তিনি যার মতামত এবং কার্যাবলী সরকারের কাছে প্রিয়।

অতীতের যে সকল খারাপ মানুষ দুর্ভাগ্যবশত প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন, তাদের সহ্য করা ভয়ঙ্করভাবে বেদনাদায়ক। সুতরাং ভালো লোকদের ভালো ধ্যান-ধারণার দিকে নজর দেয়া যাক।

স্বভাবতই তৃতীয় জর্জ ছিলেন একজন ধার্মিক ব্যক্তি। পিট যখন তাকে দিয়ে ক্যাথেলিকদের মুক্তি ঘোষণা করাতে চেষ্টা করলেন। (তখন ক্যাথোলিকদের ভোটের অধিকার ছিলনা) তখন এ অজুহাতে তার সঙ্গে একমত হননি যে তা করলে তিনি রাজ্যাভিষেকের সময় যে শপথ করেছেন তা ভঙ্গ করবেন। ন্যায়ত তিনি তাদের মুক্তি ঘোষণার দ্বারা ভালো হবে, এ যুক্তি দ্বারা পরিচালিত হতে চাননি! তা ভালো হবে কিনা তার চাইতে তা ন্যায় কিনা এই বিমূর্ত প্রশ্নই তাকে আলোড়িত করেছিল বেশি। প্রধানতঃ রাজত্বের জন্যই তাকে রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল, যে কারণে আমেরিকা স্বাধীনতার দাবি করতে লাগলো। কিন্তু তার হস্তক্ষেপ সবসময় সর্বোচ্চ লক্ষ্যের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। ভূতপূর্ব কাইজার সম্বন্ধেও একই কথা বলা যায়, তিনি ছিলেন খাঁটি ধার্মিক, পতনের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত ভগবান তার পক্ষে ছিলেন। এবং (আমি যতটুকু জানি) ব্যক্তিগত কোন পাপ থেকে তিনি সম্পূর্ণ রূপে মুক্ত ছিলেন না। তা সত্ত্বেও আমাদের যুগে এমন একজন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি মানুষের এত বেশি দুর্ভাগ্যের কারণ হয়েছেন।

রাজনৈতিকদের মধ্যে ভালো লোকের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, যাতে করে নামের ধুম্রজালের আড়ালে অন্যেরা তাদের কাজ নিঃসন্দেহে চালিয়ে যেতে পারে। একজন ভালো লোক তার বন্ধুদেরকে নোংড়া কাজের জন্য কখনো সন্দেহ করে না এবং এটাই হচ্ছে তার ভালোত্বের একটা অংশ। জনসাধারণ কখনো ভালো লোকের কার্যকলাপের অন্তরালে যে খারাপ মানুষের খারাপ কাজ থাকতে পারে তা কখনো সন্দেহ করেনা, এটাই হলো ভালো মানুষের প্রয়োজনীয় যোগ্যতা। এটা সুস্পষ্ট যে এ সকল গুণের সমন্বয়ের ফলে জনসাধারণের কাছে প্রিয় বিবেচিত হন এবং ধনী হতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের তুলনায় তাদের কাছে জনসাধারণের তহবিল গচ্ছিত রাখা উপযুক্ত মনে করেন। যদিও আমি কোনক্রমে মেনে নিতে পারছিনে, তবু আমাকে বলা হয়েছে, খুব বেশি দিনের ইতিহাস নয়, আমেরিকাতে একজন প্রেসিডেন্ট ছিলেন, যিনি এ উদ্দেশ্য সাধন করেছিলেন। ইংল্যাণ্ডের হুইটটেকার (Whittaker) যখন তার যশের মধ্যগগনে অবস্থান করছিলেন, তখন তিনি অকলঙ্ক ওমরাহগণ কর্তৃক পরিবেষ্টিত হয়েছিলেন, তার ধার্মিকতার কারণে তারা তার অঙ্কজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত লাভ করতে পারেনি অথবা পরিচয় থাকলেও তার অঙ্ক সম্পর্কে উচ্চবাচ্য কিছুই করেননি।

ভালো মানুষদের আরেকটা ব্যবহারযোগ্যতা হলো কাদা ঘাটাঘাটির কারণে অনভিপ্রেত ভদ্রলোকদেরকে রাজনীতির বাইরে রাখা যায়। শতকরা নিরানব্বই জন মানুষ নৈতিক আইন ভঙ্গ করে, কিন্তু সাধারণ্যে প্রকাশ পায়না। নিরানব্বই জনের বেলায় যখন তা প্রকাশ পায় কোন ব্যক্তির সম্বন্ধে, একশর মধ্যে যে একজন মানুষ নির্দোষ তিনি প্রচণ্ড রাগে ফেটে পড়েন এবং অন্যান্য আটানব্বই জন নিজ নিজ অপরাধ প্রকাশ পাবার ভয়ে তার অনুসরণ করে। যখন কোন জঘণ্য মতামতের মানুষ রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ করেন, তখন যারা আমাদের প্রাচীন মতামতে মনে প্রাণে বিশ্বাসী তাদেরকে তার ব্যক্তিগত জীবনের কার্যাবলীর প্রতি এমনভাবে নজর রেখে অপেক্ষা করতে হবে যে পর্যন্ত না তারা এমন কিছু আবিষ্কার করতে পারে যা প্রকাশ পেলে তার রাজনৈতিক জীবন ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। তারপরে তাদের জন্য তিনটি পথ খোলা রয়েছে। তার ব্যক্তিগত জীবনের জঘণ্য কার্যাবলী প্রকাশ করে দিয়ে তাকে বিস্মৃতির অতলে ডুবিয়ে দেয়া অথবা প্রকাশ করার ভয় দেখিয়ে তাকে অবসর গ্রহণ করতে বাধ্য করা অথবা তাকে ব্ল্যাকমেইল করে প্রচুর অর্থোপার্জন করা-এ তিনটির যে কোন একটি পথ সে অনুসরণ করতে পারে। এ তিনটির মধ্যে প্রথম দু’টি জনসাধারণকে রক্ষা করে এবং তৃতীয়টি যারা জনসাধারণকে রক্ষা করে তাদেরকে রক্ষা করে থাকে। সুতরাং এই তিনটি পথের কথা বলা যায় এবং ভালো মানুষদের দ্বারা ত্রয়ীপন্থানুসারে ইস্পিত ফল লাভ সম্ভব হয়।

আবার বিবেচনা করে দেখতে গেলে এ সকল ব্যাপার হলো যৌন-রোগের মতো, পূর্বাহ্নে উপযুক্ত নিরোধক ব্যবহার করলে সমূলে ধ্বংশ হয়ে যায়, কিন্তু ভালো লোকদের জন্য এই জ্ঞান খুব অল্পই বিতরণ করা যায় এবং তার সাফল্যের পথে সব রকমের বাধা-বিপত্তির সৃষ্টি করা হয়েছে। বাইবেলের ধারণা অনুসারে পাপ এখনো তার প্রকৃতিক দণ্ড ভোগ করে থাকে। পিতামাতার পাপের কারণে সন্তানকে কষ্ট দেয়া হয়। এরকম না হয়ে অন্যরকম হলে কি ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করত। যদি পাপীকে শাস্তি দেয়ার ব্যবস্থা না থাকতো তাহলে মানুষ পাপ বলে কিছু নেই মনে করত এবং যদি নির্দোষেরা শাস্তি ভোগ না করত তা হলে তা ভয়ঙ্কর হতো না। সুতরাং সে ভালো মানুষদের প্রতি যারা বৈজ্ঞানিকদের ধর্মবহির্ভূত জ্ঞানকে অস্বীকার করে এখনও তারা প্রাকৃতিক আইনের প্রতি আত্মসমর্পনের নামে অজ্ঞানতাকে চালু রাখতে চান, আমাদের কি রূপ কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। সৎ চিন্তাকারী ব্যক্তি মাত্রই জানে যে কষ্ট দেয়া অথবা না দেয়ার সঙ্গে খারাপ কাজের কোন সংযোগ নেই। যেহেতু সব মানুষকে বিশুদ্ধ নৈতিক আইনানুসারে পরিচালিত করা যায় না বলে এ সিদ্ধান্তে আসা যায় যে দুঃখের আগুনে পাপকে শুদ্ধ করে পূণ্য অর্জন করতে হয়। প্রাক বৈজ্ঞানিক যুগে যেভাবে পাপাত্মক কাজের শাস্তি বিধান করা হতো ঠিক সেভাবে এখনো করা হয় এবং মানুষ যাতে এড়িয়ে যেত না পারে সেজন্য তাদেরকে অজ্ঞানতার অন্ধকারে রাখার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। আমাদের ভালো মানুষেরা মেহেরবানী করে যে বিপদজনক জ্ঞান আমাদের মধ্যে বিতরণ করেন, তা থেকে আত্মরক্ষা করে মানবিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য কি পরিমাণ জ্ঞান আবশ্যক তা ভাবতেও আমি কেঁপে উঠি।

আরেক উপায়ে ভালো লোকেরা কাজে আসতে পারে, তাহলে খুন হয়ে। দু’জন যাজক খুন হওয়ার সুবাদে জার্মানি চীনের কাছ থেকে সানতুং প্রদেশ কেড়ে নিয়েছিল। সারাজেভোতে যে আর্কডিউক নিহত হয়েছিলেন, আমার বিশ্বাস তিনিও ছিলেন ভালো মানুষ, তার প্রতি আমরা অসীম কৃতজ্ঞ। তিনি মারা না-গেলে যুদ্ধ লাগত না, যুদ্ধ না-লাগলে জঙ্গীবাদকে কখনো সরানো যেত না; তাহলে একদিকে গণতন্ত্রকে যেমনি নিরাপদ করা যেতনা তেমনি অন্য দিক দিয়ে ইটালি, স্পেন, বুলগেরিয়া, রাশিয়া এবং হাঙ্গেরিতে সামরিক কর্তৃত্বও প্রতিষ্ঠিত হতো না।

প্রকৃত প্রস্তাবে, সাধারণত জনমত যে ধরণের ভালোত্বের মান নির্ধারণ করেছে তা পৃথিবীকে অধিকতর সুখকর বাসস্থান হিসেবে গড়ে তোলার এত সুপরিকল্পিত মানবিক গুণাবলী নয়। এর সর্বপ্রধান কারণ হলো ঐতিহ্য এবং দ্বিতীয় প্রধান কারণ হলো পবিত্রতা এবং বিধি-নিষেধের নিরিখেই আদিম নৈতিকতার উৎকর্ষ ঘটেছে। বলতে গেলে আগে যা ছিল কুসংস্কার, তাতে কতক নিরাপদ কাজকেও নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হয়েছে। যেমন সর্দারের থালা হতে খাওয়ার পেছনে তাদের কাল্পনিক বিশ্বাসের ভিত্তি ছিল, তা করলে যাদুর প্রভাবে প্রচণ্ড বিপদ ঘটতে পারে। এভাবে তাদের মধ্যে নিষেধগুলো শিকড় গেড়ে বসলো। তারা কাল্পনিক বিশ্বাসের কথা কালক্রমে ভুললো বটে কিন্তু ওগুলো তাদের চেতনায় অস্পষ্ট স্বাক্ষর রেখে গেলো। প্রচলিত নৈতিকতার অনেকগুলিই এ জাতীয়। বিশেষ বিশেষ আচরণ, কার্যকলাপ অথবা উক্ত কার্যকলাপের ফলশ্রুতি মানুষের মধ্যে উদ্দাম আবেগের সঞ্চার করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই আরেগজনিত উদ্দাম ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এটা যদি না হয়ে থাকে, নৈতিক মানদণ্ডকে পুখানুপুঙ্খভাবে বিচার করা হলে তা জনসাধারণের স্বীকৃতি আদায় করতে সমর্থ হবে।

উদাহরণস্বরূপ বলতে গেলে সভ্য সমাজে কখনো খুনকে বরদাশত করা হয় না, তা সত্ত্বেও খুন নিষিদ্ধ ঘোষণার মর্মমূলে রয়েছে কুসংস্কার। এই বিশ্বাস তখন প্রবল ছিল যে খুনী ব্যক্তির রক্ত অথবা প্রেতাত্মা প্রতিশোধের নেশায় শুধু ঘাতককে নয়, তার প্রতি যারা করুণা প্রদর্শন করে তাদেরকেও শাস্তি দিতে পারে। খুন নিষিদ্ধ করার মূলেও যে ছিল কতক কুসংস্কারমূলক অন্ধ অনুপ্রেরণা কতক বাস্তব বিষয়ে নজর দিলে তা স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। যেমন কতকগুলো গোত্রগত উৎসবের মাধ্যমে ঘাতককে ছদ্মবেশ পরালে বা নিহত ব্যক্তির প্রেতাত্মা না চিনতে পারে মতো রক্ত ধুয়ে দেয়া হতো। স্যার জে, জি ফ্রেজার তার থিয়োরিতে অন্তত এটুকু বলেছেন। রক্তের দাগ মুছে ফেলার জন্য প্রাচীনকালে যে অনুষ্ঠান করা হতো তাকে আমরা রূপক হিসেবে অনুতাপ এবং পাপ ধৌত করার প্রতীক হিসেবে এখনও গ্রহণ করে থাকি। এবং অপরাধ বোধের অন্তরালে রয়েছে অতীতের পূঞ্জীভূত কুসংস্কার। এমনকি একটা খুনের ব্যাপারেও বিবেক বুদ্ধি সম্পন্ন নৈতিকতা ভিন্নতর মতামত দিয়ে থাকে যা অপরাধ, শাস্তি এবং প্রায়শ্চিত্তের চাইতে আরোগ্য এবং প্রতিকারের সঙ্গে অধিকতর সম্পর্কশীল।

আমাদের বর্তমান নৈতিকতা কুসংস্কার এবং বিচার-বুদ্ধির সমাহারে সৃষ্ট। খুন করা হলো একটি প্রাচীন অপরাধ যা আমরা যুগান্তরের সঞ্চিত কুসংস্কারের ধুম্রজালের মধ্য দিয়ে অবলোকন করে থাকি। আমরা জুয়াচোরদেরকে শাস্তি দিয়ে থাকি বটে কিন্তু খুনীদের এত তাদের আলাদা করে রাখি না। থিয়োরিতে আমরা যাই বলি না কেন, এখনো আমাদের কাজকর্ম সামাজিক রীতিনীতির নিরিখেই করে থাকি। আমাদের ধর্ম আমরা যা করি তার চেয়ে আমরা যা করিনা তার মধ্যেই বহুলাংশে নিহিত। একজন মানুষ অন্য একজন মানুষের কোন উপকার না করেও পাপ বলে কথিত এক শ্রেণীর কাজ করা থেকে বিরত থেকেও ভালোমানুষ আখ্যা পেতে পারে; কিন্তু তা হলেও খ্রিস্টের প্রচলিত বাণী, প্রতিবেশীকেও নিজের এত ভালোবাসো এ ধারণাতে সে সত্যেরই সমর্থন মেলে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় সমগ্র খ্রিস্টান বিশ্বে যিনি এ ধারণা মেনে চলেন তার উপর চালানো হয় সবচেয়ে বেশি নির্যাতন। তাকেই দারিদ্রের আগুনে জ্বলতে হয় বেশি, সময়ে, অসময়ে কারাবরণ এমন কি মৃত্যুদণ্ড বরণ করতে হয়।

পৃথিবীটা অবিচার পরিপূর্ণ, যারা এ অবিচারের দ্বারা লাভবান হয় তাদের হাতেই পুরস্কার এবং শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা সংরক্ষিত। যারা এ অসাম্য এবং অবিচারকে চালু রাখার উপায় উদ্ভাবন করে তাদের ভাগ্যে জোটে শিরোপা এবং যারা প্রতিকার করতে আসে তাদেরকে সইতে হয় কঠোরতম নির্যাতন। আমি এমন একটা দেশও জানিনে যে দেশের মানুষ কুটিলতা পরিহার করে দীর্ঘকালের জন্য প্রতিবেশীদের সঙ্গে সদ্ভাব রক্ষা করেছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার অব্যবহিত পূর্বে ফরাসি দেশের শ্রেষ্ঠ নাগরিক জ্যা জ্বরসকে হত্যা করা হয় এবং হত্যাকারী জনসাধারণের জন্য কি একটা কাজ করেছে এ সুবাদে তাকে হত্যার দায় হতে অব্যাহতি দেয়া হয়। এ জাতীয় ঘটনা পৃথিবীর সব জায়গায় অহরহ ঘটছে।

যারা ঐতিহ্যাশ্রয়ী নৈতিকতার স্বপক্ষে তারাও মাঝে মাঝে বলেন যে তা সম্পূর্ণ নিখুঁত নয়, কিন্তু তারাই আবার কোনোও সমালোচনা উঠলে নৈতিকতার ভিত্তিভূমি রসাতলে গেল বলে হায় হায় করেন। প্রত্যক্ষ এবং গঠনমূলক আলোচনা হলেও তাতে কিছু হবেনা যদি ক্ষণিকের আনন্দের উল্লম্ফনে হয়ে থাকে। আমরা এখন বেথামে ফিরে আসি, যিনি সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের জন্য যে সুউচ্চ নৈতিকতার প্রয়োজন তার জীবন যে মানুষ প্রচলিত অর্থে জীবন ধারণ করে তার চেয়ে ঢের বেশি পরিশ্রমের। স্বভাবতঃই তিনি বঞ্চিত এবং হতাশার দলের সর্বাগ্রগণ্য হবেন এবং মহত বৃহৎদের কোপদৃষ্টিতে পতিত হবেন। শাসকেরা যেসব ঘটনা গোপন করতে চায় তিনি সে সব তারস্বরে জানিয়ে দেন। তার সহানুভূতি যাদের কাম্য তাদেরকে দূরে সরানো মিথ্যাচার থেকে তিনি স্বভাবতঃই বিরত থাকেন। এ জাতীয় জীবন ধারার আসল নৈতিকতা কখনো ধ্বংশপ্রাপ্ত হবে না। শাসক সম্প্রদায় নৈতিক দিক দিয়ে সব সময়ে অত্যাচারী এবং বিয়োগাত্মক হয়ে থাকে। তারা সবসময় বলে যে, যা কিছু নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে তার বিরুদ্ধে কষ্ট করে অনুসন্ধান করে তুমি কিছু বলবেনা। এই ধরণের নৈতিকতার বিরুদ্ধে অতীন্দ্রয়বাদীরা বৃথাই প্রতিবাদ করেছেন, তাদের শিষ্যেরা প্রচারিত বাণীর সার সত্যকেই উপেক্ষা করে গেছেন। তাদের প্রচলিত পদ্ধতি অনুসারে কোন স্থায়ী কল্যাণ আসতে পারে, একথা আশা করাও অন্যায় এবং অযৌক্তিক।

আমার মনে হয়, বিজ্ঞান এবং প্রগতির কাছ থেকে আমরা অনেক বেশি কিছু আশা করতে পারি। ধীরে ধীরে মানুষ হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হবে যে পৃথিবীর ভিত্তিভূমি যেখানে হিংসা, বিদ্বেষ এবং অত্যাচারের মধ্যে প্রোথিত সেখানে সুখের আশা করাই অযৌক্তিক। অতি অল্প সংখ্যক মানুষের মনে গত মহাযুদ্ধ এ শিক্ষা দিয়ে গেছে। যদি আরো বেশি মানুষকে তা প্রভাবিত করত তাহলে এতদিনে তার আবেদন ম্লান হয়ে যেত। আমাদের এখন এমন একটা নীতির প্রয়োজন যা জীবনের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা থেকে উদ্ভূত এবং যা প্রসারতা এবং প্রত্যক্ষ কীর্তির আনন্দবোধ বেড়ে ওঠে, নিষেধ এবং অত্যাচারের ভিত্তিভূমিতে নয়। অন্যেরা সুখে থাকলে যে মানুষের আনন্দ হয়, অর্থ ব্যয় করতে দ্বিধা করেনা, মনের দিক দিয়ে এমনিতর উদার মানুষকেই আমাদের ভালো মানুষ বলা উচিত। যদি তাই হয়ে থাকে পৃথিবীতে অল্পসংখ্যক সুখী ব্যক্তির কোন দাম নেই। যে মানুষ অপরকে প্রতারিত করে অথবা নির্দয়তার মাধ্যমে সৌভাগ্যের স্বর্ণ তোরণে আরোহণ করেছে বর্তমানে আমাদের নীতিজ্ঞানহীন লোক বলতে তাদেরই বলা উচিত। যদিও তারা রীতিএত গির্জায় যায় এবং অসদুপায়ে অর্থের কিছু অংশ জনসাধারণের তহবিলে দান করে, তবুও তারা নীতিজ্ঞানহীন মানুষ ছাড়া আর কিছু নয়।

এই দৃষ্টিভঙ্গীকে প্রসারিত করতে হলে আমাদের নৈতিকতাকে কুসংস্কার এবং নির্যাতন যা এখনো আমাদের সমাজের দিকপালদের কাছে ধর্মীয় অনুশাসনের এত তা থেকে মুক্ত করতেই হবে এবং শাণিয়ে তুলতে হবে আমাদের বিচারবুদ্ধিকে। আজকালকার যুগে বিচারবুদ্ধি খুবই সীমিত হলেও আমি সবসময় অননুতপ্তচিত্তে বিচারবুদ্ধিকেই সমর্থন করে যাবো। হতে পারে বিচারবুদ্ধির শক্তি অল্প কিন্তু তা স্থির এবং একমূখী। অন্যদিকে বিচারবুদ্ধি বহির্ভূত শক্তিগুলো একটা আরেকটাকে নির্মূল করে। সুতরাং প্রত্যেক রকমের বিচারবুদ্ধি বহির্ভূত গুপ্ত উপাসনা এবং সমধর্মী প্রবৃত্তিগুলোর সহায়ক হয় এবং উজ্জ্বলভাবে দেখিয়ে দেয় যে ওসবই বিচারবুদ্ধির পরম সুহৃদ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *