০৮. সুখের আদর্শ ও প্রাচ্য-প্রতীচ্য

সুখের আদর্শ ও প্রাচ্য-প্রতীচ্য

ওয়েলস এর ‘টাইম মেশিন’ এর কথা সকলেই জানে-যার সাহায্যে ঐ যন্ত্রের অধিকারী ইচ্ছে করলে সময়ের সামনে পিছে ভ্রমণ করে অতীত ভবিষ্যত সম্পর্কে ওয়াকেবহাল হতে পারে। বর্তমান পৃথিবীতে ভ্রমণ করেও ওয়েলস সাহেবের উদ্ভাবিত যে যান্ত্রিক পদ্ধতি তার অনেকগুলো সুফল ভোগ করা যায়, একথা মানুষ সকল সময় হৃদয়ঙ্গম করতে পারে না। একজন ইউরোপিয় নিউইয়র্কে গিয়ে অর্থনৈতিক বিপত্তি এড়িয়ে গেলে ইউরোপের যে সম্ভাব্য পরিণতি তা দেখতে পাবেন। এশিয়াতে গেলে তিনি ইউরোপের অতিভ্রান্ত অতীতকেই দেখতে পাবেন। আমাকে বলা হয়েছে ভারতে তিনি প্রাচীন যুগ এবং চীন দেশে অষ্টাদশ শতাব্দীর দেখা পাবেন। জর্জ ওয়াশিংটন যদি আবার পৃথিবীতে ফিরে আসেন তাহলে তার সৃষ্ট দেশটি তাকে এক্কেবারে হতবুদ্ধি বানিয়ে দেবে। ইংল্যাণ্ডকে দেখে তিনি অপেক্ষাকৃত কম আশ্চর্যান্বিত হবেন, ফ্রান্সকে দেখে আরো কম। চীনে না-পৌঁছা পর্যন্ত তিনি পরিপূর্ণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারবেন না। একমাত্র চীনেই তার প্রেতাত্মা যে সব মানুষের দেখা পাবে যারা জীবন, স্বাধীনতা এবং সুখের আদর্শে এখনো বিশ্বাসী। আমেরিকানরা স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় যে সকল আদর্শ আকড়ে ধরেছিল, চীনারাও সে আদর্শসমূহকে আকড়ে ধরে আছে। আমার ধারণা চীনা প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট তিনি না হওয়া পর্যন্ত চীনারা সে অধিকার অর্জন করতে পারবে না।

পশ্চিমা সভ্যতাকে উত্তর-দক্ষিণ আমেরিকা, রাশিয়াসহ ইউরোপ এবং বৃটিশ শায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চলগুলো বরণ করে নিয়েছে। এ ব্যাপারে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র কাফেলার পুরোভাগে রয়েছে। প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মধ্যে যত রকমের পার্থক্য, তার সবগুলো আমেরিকাতেই সর্বাপেক্ষা সুস্পষ্ট এবং চূড়ান্তভাবে বিকশিত হয়েছে। আমরা কোনরকমের সন্দেহ ব্যতিরেকে স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে প্রগতিকে মেনে নিয়েছি, আরো মেনে নিয়েছি গত একশ বছরের মধ্যে যেসকল পরিবর্তন হয়েছে, ভালোর জন্যই হয়েছে, অধিকতর অনির্দিষ্ট পরিবর্তন অবশ্যই অধিকতর সুফল প্রসব করবে। গত প্রথম মহাযুদ্ধ এবং মহাযুদ্ধের আনুষঙ্গিক ফলাফল ইউরোপ মহাদেশের মানুষের এ নির্ভরশীল বিশ্বাসে প্রচণ্ডতর আঘাত করেছে। সম্প্রতি ইউরোপের মানুষ ১৯১৪ সনের পূর্ববর্তী বছরগুলোতে ইতিহাসে পরবর্তী শতাব্দী ধরে পূনরায় ফিরে পাওয়া অসম্ভব জ্ঞান করে স্বর্ণযুগ হিসেবে ভাবতে আরম্ভ করেছে। ইংল্যান্ডে আশাবাদীতা ভয়ংকরভাবে মার খায়নি। আমেরিকাতে আঁচড়ও লাগেনি। আমাদের মধ্যে যারা প্রগতিকে স্বতঃসিদ্ধ বলে ভাবতে অভ্যস্ত তাদের উচিত বিশেষ করে চীনের মতো একটি দেশে ভ্রমণ করা, যারা আমাদের থেকে তুলনামূলকভাবে একশ পঞ্চাশ বছর পিছিয়ে আছে। তাদের দেখে বিচার করা, যে সকল পরিবর্তন আমাদের দেশে ঘটেছে তাতে করে পৃথিবীর সত্যিকার কোন উন্নতি সাধিত হয়েছে কিনা।

সকলেই জানে কনফুসিয়াসের শিক্ষার উপর চীনা সভ্যতার বুনিয়াদ প্রতিষ্ঠিত। তিনি যিশুখ্রিস্টের জন্মের পাঁচ হাজার বছর আগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। গ্রিক রোমানরা যেমন ভাবতো মানব-সমাজ স্বভাবতঃই প্রগতিশীল তিনি তা ভাবতেন না। পক্ষান্তরে তার ধারণা সুদূর অতীতে শাসনকর্তারা ছিলেন জ্ঞানী এবং মানুষ এমন এক পর্যায়ের সুখী ছিল যা শ্রদ্ধাহীন বর্তমানকে প্রসংশা করলেও সে সুখ ভোগ করতে সমর্থ হবে না। আসলে এটা এক প্রকারের মোহ। কিন্তু এর প্রত্যক্ষ ফল হলো দূর অতীতের অন্যান্য শিক্ষকের মতো কনফুসিয়াসও সব সময় নতুন সাফল্যের পানে ধাবিত না হয়ে নৈতিকতার উৎকর্ষের উপর একটি স্থায়ী সমাজ গঠন করতে চেয়েছিলেন। এতে তিনি অন্যান্যের চেয়ে অধিক সাফল্য লাভ করেছেন। তার ব্যক্তিত্ব চীন সভ্যতার উপর এমনভাবে ছাপ মেরেছে যা তার কাল থেকে আমাদের কাল পর্যন্ত প্রসারিত সময়ে অটুটভাবে সংরক্ষিত আছে। তার জীবদ্দশায়, চীনারা বর্তমান চীনের সামান্য ভূখণ্ড মাত্র দখল করেছিলেন এবং কয়েকটা বিবদমান রাষ্ট্রের মধ্যে তা বিভক্ত ছিল। পরবর্তী তিনশ বছরের মধ্যে বর্তমান চীনের সবটুকু তারা দখল করে নিলো এবং আয়তন বিস্তৃতির দিক দিয়ে এমন এক বিশাল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করল গত পঞ্চাশ বছর বাদ দিলে বাদবাকি সময়ের মধ্যে তার কোন জুড়ি ছিল না। বর্বর জাতির আক্রমণ, মোঙ্গল এবং মানচু সাম্রাজ্যের মধ্যে ক্ষণস্থায়ী এবং দীর্ঘস্থায়ী বিরোধ ও গৃহযুদ্ধ সত্ত্বেও কনফুসিয় শিল্পকলা এবং সাহিত্য সমৃদ্ধ দ্র জীবন যাপন পদ্ধতি অক্ষতভাবেই বর্তমান ছিল। একমাত্র আমাদের কালে পশ্চিমা এবং পশ্চিমাদের অনুকারক জাপানিদের সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে এ জীবন যাপন ব্যবস্থায় ভাঙন ধরতে আরম্ভ করেছে।

যে জীবন যাপন পদ্ধতি এত দীর্ঘকাল ধরে টিকে থাকবার অসম্ভব শক্তি রয়েছে তার মধ্যে অবশ্যই এমন কোন উৎকর্ষ আছে যা আমাদের শ্রদ্ধা এবং সুবিবেচনার দাবি রাখে। ধর্ম বলতে আক্ষরিক অর্থে যা বুঝি কনফুসিয়াসের শিক্ষা সঠিক অর্থে তা নয়। যেহেতু এর সঙ্গে অতিলৌকিক অথবা কোন মরমি বিশ্বাস সম্পর্কশীল নয়। এ হচ্ছে খাঁটি নৈতিক একটা পদ্ধতি। কিন্তু এর নীতিমালা খ্রিস্টান ধর্মের অস্পষ্ট নীতিমালার মতো সাধারণ লোকের পক্ষে মেনে চলা মোটেই অসম্ভব নয়। সূক্ষ অর্থে। বলতে হলে কনফুসিয়াস যা শিক্ষা দিয়েছেন তা অষ্টাদশ শতাব্দীর সেকেলে মনোভাবসম্পন্ন ভদ্রলোকের আদর্শের এত অনেকটা। তার একটা বক্তব্যের মধ্যে এর প্রমাণ পাওয়া যাবে। আমি লায়নেল গিলস (Lionel giles) এর কনফুসিয়াসের বাণী থেকে উদ্ধৃত করছি। “সত্যিকারের ভদ্রলোক কখনো কলহপরায়ন হতে পারে না। একমাত্র বন্দুক ছোঁড়ার প্রতিযোগিতা ছাড়া আর কোথাও বিবাদ বিসম্বাদ ঘটতে পারে না। সেখানেও তিনি স্থান বেছে দাঁড়াবার পূর্ব প্রতিদ্বন্দ্বীকে অভিবাদন করেন যাতে তিনি, প্রতিযোগিতার সময়েও সত্যিকারের ভদ্রলোক থাকতে পারেন।”

নৈতিক শিক্ষকের পক্ষে যা অবশ্য করণীয়, তিনি কর্তব্য নীতি এবং ধর্ম সম্পর্কে প্রচুর বলেছেন। কিন্তু মানুষের বিরুদ্ধেও স্বাভাবিক স্নেহ প্রদর্শনের বিপক্ষে কোন কিছুর সীমারেখা নির্দেশ করে দেননি। নিম্নোক্ত কথোপকথনের মধ্যে তার যথাযথ প্রমাণ পাওয়া যাবে।

শিল্প অঞ্চলের সামন্ত কনফুসিয়াসকে সম্বোধন করে বললেন, আমাদের দেশে একজন সাহসী মানুষ আছেন। তার বাবা একটি ভেড়া চুরি করেছিলেন, তিনি বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদান করেন। কনফুসিয়াস বললেন, আমাদের দেশের সাহসিকতার ধরন ভিন্নতর। পিতা পুত্রের দোষ ঢেকে রাখে এবং পুত্র পিতার গোপনীয়তা রক্ষা করে। এ-ধরনের আচরণের মধ্যেই সত্যিকারের সাহসিকতার সন্ধান মিলবে।

কনফুসিয়াস ছিলেন সব ব্যাপারে, এমনকি নীতির দিক দিয়েও সহনশীল। খারাপ ব্যবহারের বদলে আমাদের ভালো ব্যবহার দেখানো উচিত, একথা তিনি বিশ্বাস করতেন না। তাকে এক সময় প্রশ্ন করা হয়েছিল, “খারাপ ব্যবহারের বদলে ভালো ব্যবহার প্রদর্শনের নীতি সম্পর্কে আপনার কী অভিমত”? তিনি জবাবে বলেছিলেন, “তাহলে ভালো ব্যবহারের বদলে কী রকম ব্যবহার করা হবে? বরঞ্চ তোমরা অবিচারের বদলে সুবিচার এবং ভালোর বদলে ভালো ব্যবহার করবে।” তার সময়ে তাওপন্থিরা মন্দের বদলে সুবিচার এবং ভালো ব্যবহার এবং প্রদর্শনের শিক্ষা প্রচার করতেন যা কনফুসিয়াসের শিক্ষার চেয়ে খ্রিস্টধর্মের সঙ্গে অধিকতর সাদৃশ্যাত্মক। তাওবাদের প্রতিষ্ঠাতা লাওসে (অনুমান করা হয়ে থাকে তিনি কনফুসিয়াসের সমসাময়িক ছিলেন) বলেন, “আমি ভালো ব্যবহার করবো, যারা ভালো নয় তাদের সঙ্গেও আমি ভালো ব্যবহার করব, যেন আমি তাদেরকেও ভালো করতে পারি। অবিশ্বাসীদের সঙ্গেও আমি বিশ্বাস রক্ষা করব, যেন আমি তাদের বিশ্বাসী করতে তুলতে পারি। যদি একজন মানুষ খারাপও হয়ে থাকে তাকে পরিত্যাগ করা কি এমন ভালো কাজ। আঘাত পেলে হাসিমুখে সহ্য করব।” লাওসের কিছু কথা আশ্চর্যভাবে পর্বত থেকে প্রদত্ত বক্তৃতার এত। যেমন তিনি বলেছেন,”যে ব্যক্তি বিনয়কে রক্ষা করে, সে অক্ষতভাবে রক্ষিত হবে। যে (শ্রদ্ধায়) নুয়ে পড়তে জানে তাকে সোজা করা হবে। যে খালি আছে তাকে ভর্তি করা হবে। যার অল্প আছে সে সফলতা অর্জন করবে এবং যার বেশি আছে সে কুপথে গমন করবে।”

চীনের বৈশিষ্ট্য অনুসারে লাওসে নয়, কনফুসিয় চীনের জাতীয় ঋষি বলে স্বীকৃতি অর্জন করেছেন। যাদুমন্ত্র হিসাবে অশিক্ষিত মানুষদের মধ্যে তাওবাদ স্থায়িত্ব লাভ করেছিল। তার নীতিসমূহ সাম্রাজ্য শাসনকারী বস্তুতান্ত্রিক রাজপুরুষদের কাছে কাল্পনিক বলে প্রতিভাত হয়েছিল। পক্ষান্তরে কনফুসিয়াসের নীতিগুলো বিবাদ বিসংবাদ এড়িয়ে যাবার এত অধিকতর নির্ধারিত এবং স্থিরিকৃত ছিল। লাওসে নিষ্ক্রিয়তার নীতিকেই প্রচার করেছেন। তিনি বলেছেন, “ঘটনাপ্রবাহের সুযোগ গ্রহণ করে যারা সাম্রাজ্য দখল করে তারা সব সময়ে সাম্রাজ্য রক্ষার জন্য নিজেদের অসমর্থন করে। কিন্তু চীনের রাজপুরুষবৃন্দ স্বভাবতঃই কনফুসিয়াসের আত্মনিয়ন্ত্রণ, উপচিকীর্ষা এবং সে সঙ্গে ভদ্রতার মিশ্রিত নীতির অনুসরণে কল্যাণধর্মী সরকার যে ভালো কাজ করতে পারে তার উপর সর্বাধিক গুরুত্ব প্রয়োগ করতেন।

শ্বেতাঙ্গ জাতিসমূহের ন্যায় চীনা জাতি কখনো থিয়োরিতে এক নীতি ব্যবহারিক জীবনে আরেক নীতিকে গ্রহণ করেনি। আমি এ কথার মানে এ বলতে চাই না যে তারা সবসময়ে থিয়োরি অনুসারে জীবন ধারণ করেছে। তা না-হলেও তাদের লক্ষ্য ছিল সে দিকে, থিয়োরিকে বাস্তবায়িত করার চেষ্টা তারা করে থাকে। অন্যদিকে দেখতে গেলে খ্রিস্টিয় নীতিশাস্ত্রের অধিক সংখ্যক নীতিই এ মন্দ জগতের জন্য অত্যন্ত উপকারী বলে সর্বজনীন স্বীকৃতি লাভ করেছে।

মোদ্দা কথায় আমাদের মধ্যে পাশাপাশি দু’রকমের নীতিবোধ বর্তমান। একরকম হলো, যা আমরা প্রচার করি কিন্তু পালন করি না। অন্যটি আমরা দৈনন্দিন জীবনে মেনে চলি কিন্তু কদাচিৎ প্রচার করি। খ্রিষ্টধর্ম ও ধর্ম ছাড়া অন্যান্য এশীয় ধর্মের মতো ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবোধ এবং পারলৌকিক বিষয়ে প্রথম দিকের শতাব্দীগুলোকে তারা সর্বাধিক গুরুত্ব দান করত। অন্য জগতের প্রতি গুরুত্ব দান করাই হলো এশীয় মরমীদের বৈশিষ্ট্য। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে বাধ্যবাধকতার মূলনীতি বুদ্ধি গ্রাহ্যতা অর্জন করেছিল। কিন্তু খ্রিস্টান ধর্ম যখন ইউরোপের অত্যুৎসাহী রাজপুরুষদের আনুষ্ঠানিক ধর্ম হিসেবে বর্ধিত হলো, তখন তারা এর কতকগুলো নীতি আক্ষরিক অর্থে বর্জন করার প্রয়োজনিয়তা অনুভব করল, পক্ষান্তরে অন্য কতেক নীতি যেমন ‘সিজারের প্রাপ্য সিজারকে দাও’ ইত্যাদি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। আমাদের প্রতিযোগীতামূলক শিল্পায়নের যুগে বাধা না দেয়ার সামান্যতম আবেদনকেও ঘৃণা করা হয় এবং মানুষকে জীবিকা বিজয়ে সমর্থ বলে ধরে নেয়া যায়। বাস্তবে আমাদের কার্যকরী নৈতিকতাবোধ হলো সংগ্রাম করে যে পরিমাণ বাস্তব সাফল্য অর্জন করা যায় তারই নিরিখে ব্যক্তিবিশেষ এবং জাতিবিশেষের পরিচয়। এর বাইরে কোমল কিছু থাকলে তা আমাদের কাছে। বোকামি বলে মনে হয়।

চীনারা আমাদের থিয়োরিগত অথবা ব্যবহারিক কোন নৈতিকতাকে গ্রহণ করেনি। চীনারা থিয়োরিগতভাবে বিশ্বাস করে যে এমনও সময় আসে যখন যুদ্ধ করা যুক্তিযুক্ত, কিন্তু বাস্তবে সে সময় আসে কদাচিৎ। আর আমরা থিয়োরিতে বিশ্বাস করি, কোন অবস্থাতেই যুদ্ধ করা যুক্তিযুক্ত নয়, কিন্তু বাস্তবে প্রায়ই যুদ্ধে লিপ্ত থাকি। চীনারা মাঝে মাঝে যুদ্ধ করে, তবে যুদ্ধা জাতি তারা নয়, যুদ্ধে জয়লাভ অথবা ব্যবসায়ে সফলতাকে খুব প্রশংসার চোখে তারা দেখে না। ঐতিহ্যগতভাবে জ্ঞানকে তারা সব কিছুর চেয়ে বেশি প্রশংসা করে। তারপরে প্রায়শঃ এর সঙ্গে সঙ্গে তারা নাগরিকতা এবং ভদ্রতাকে প্রশংসার চোখে দেখে। যুগযুগ আগে চীনদেশে শাসনবিভাগীয় পদগুলো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ফলাফলের উপর নির্ভর করেই প্রদান করা হতো। দু’হাজার বছর ধরে চীনদেশে একমাত্র কনফুসিয়াসের পরিবার, যার প্রধান ছিল একজন সামন্ত তিনি ব্যতীত আর কোন বংশগত আভিজাত্যের রেওয়াজ ছিল না। সামন্ততান্ত্রিক ইউরোপে ক্ষমতাবান সামন্তদেরকে যেরকম শ্রদ্ধা সম্মান দেখানো হতো, চীনদেশ জ্ঞানবানদের একই রকম শ্রদ্ধা সম্মান নিজস্ব পদ্ধতিতে নিবেদন করত। প্রাচীন জ্ঞান যার পরিধি খুবই সীমিত শুধুমাত্র অসমালোচিত চীনের ধর্মীয় জ্ঞান এবং স্বীকৃতি প্রাপ্ত ভাষ্যকারদের টীকা-ভাষ্যের মধ্যেই সীমবিদ্ধ ছিল। পাশ্চাত্যের সংস্পর্শে এসে ভূগোল, অর্থনীতি, প্রাণীবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা শিক্ষা করছে চীনারা, যা বিগত যুগের নীতি শিক্ষার চেয়ে বাস্তব প্রয়োজন মিটাতে অনেক বেশি সক্ষম। নতুন চীনা-তার মানে যারা ইউরোপিয় পদ্ধতিতে শিক্ষা দীক্ষা পেয়েছে, আধুনিক প্রয়োজনের সম্পর্কে সবিশেষ ওয়াকেবহাল বোধ হয়। তাদের প্রচীন ঐতিহ্যের প্রতি তেমন বিশেষ শ্রদ্ধাবোধ নেই। তারপরেও কিছু বাদ দিলে অত্যাধুনিকেরাও সহনশীলতা, ভদ্রতা এবং মেজাজের স্নিগ্ধতা রক্ষা করে চলছে। পাশ্চাত্য এবং জাপানিরা তাদের যে হারে প্রভাবিত করেছে, তাতে করে এ বৈশিষ্টগুলোও আগামী কয়েক দশক পর্যন্ত অক্ষত অটুট রাখতে পারবে কিনা সন্দেহ। চীনা এবং আমাদের মধ্যে যে পার্থক্য তা যদি একটি মাত্র বাক্যের মধ্যে আমাকে বলতে হয়, তাহলে আমি বলবো, তারা প্রধানতঃ আনন্দের প্রতি আগ্রহশীল আর আমরা মুখ্যতঃ ক্ষমতার প্রতি লালায়িত। আমরা আমাদের সমধর্মীমানুষের উপর ক্ষমতা বিস্তার করতে চাই, ক্ষমতাবলে প্রকৃতিকে দাস করতে চাই। মানুষের উপর ক্ষমতার শাসন চালু রাখার জন্যে আমরা বিজ্ঞানকে উন্নত করেছি। এসব ব্যবহারে চীনারা ভয়ঙ্কর অলস, এবং অত্যধিক খোসমেজাজী। রাশিয়ানরা যে অর্থে অলস চীনারা সে অর্থে অলস নয়। তারা জীবন ধারণের জন্য কঠোর পরিশ্রম করে। শ্রমিক মালিকদের চোখে তারা কঠোর পরিশ্রমী। আমেরিকান কিংবা পশ্চিম ইউরোপের লোকেরা যে অর্থে পরিশ্রমী তারা সে অর্থে পরিশ্রমী নয়। কাজ না করলে মেজাজের প্রফুল্লতা হারিয়ে ফেলবে বলেই তারা কাজ করে, অনাবশ্যক তাড়াহুড়া পছন্দ করে না। জীবন ধারণ করার মতো অপর্যাপ্ত ব্যবস্থা তাদের থাকলে তারা তার উপর নির্ভর করে। সঞ্চয়ের জন্য তারা কঠোর পরিশ্রম করে না। অবসর সময়ে চিত্তবিনোদনের জন্য তাদের অবিশ্বাস্য ক্ষমতা রয়েছে। থিয়েটারে গিয়ে, চা খেতে খেতে গল্প-গুজব করে, প্রাচীন চীনা শিল্পকলার প্রশংসা করে অথবা সুন্দর সুন্দর দৃশ্যাবলীর উপর দিয়ে পায়চারী করতে করতে তারা সময় কাটায়। আমদের চিন্তাধারা অনুসারে জীবনকে এভাবে খরচ করার মধ্যে একরকমের অহেতুক নিশ্চেষ্ট শিষ্টতার সন্ধান পাওয়া যাবে। যে লোক প্রত্যেকদিন ঠিক সময়ে তার অফিসে যায়, সেখানে যা করে সব ক্ষতিকর হলেও আমরা তাকে শ্রদ্ধান্বিত দৃষ্টিতে দেখে থাকি।

প্রাচ্যদেশে বাস করলে সাদা মানুষদের চরিত্র বোধহয় প্রাচ্যের ক্ষতিকর প্রভাবে প্রভাবিত হয়। কিন্তু চীন সম্বন্ধে জানার পর আমি অবশ্যই বলব যে, অলসতা মানুষের শ্রেষ্ঠতম গুণসমূহের একটি, যা মানুষকে সমষ্টিগত জীবনে অভ্যস্ত করে তোলে। আমরা অত্যুৎসাহী হয়ে কিছু অর্জন করতে পারি, কিন্তু প্রশ্ন করা যেতে পারে-যা আমরা অর্জন করি তা সত্যিকারের কোন মূল্য বহন করে কিনা। আমরা উৎপাদনব্যবস্থার অত্যাশ্চর্য পরিবর্তন সাধন করেছি যার অংশবিশেষ জাহাজ, মোটরগাড়ি টেলিফোন এবং সৌখিনভাবে বেঁচে থাকার বিভিন্ন উপায় উদ্ভাবন করেছি। আমাদের নিখুঁত উৎপাদনব্যবস্থার অপরাপর হুনুর হেকমত আমরা বন্দুক, বিষাক্ত গ্যাস, উড়োজাহাজ এবং পরস্পরকে পাইকারি হারে হত্যার অভিপ্রায়ে নিয়োজিত করেছি। আমাদের প্রথম শ্রেণীর শাসনব্যবস্থা এবং ট্যাক্স আদায়ের ব্যবস্থা রয়েছে, যার অংশবিশেষ শিক্ষা, স্বাস্থ্যরক্ষা প্রভৃতি হিতকর কাজে ব্যয়িত হয়, কিন্তু বাকিটুকু যুদ্ধের জন্য ব্যয় করা হয়। বর্তমান ইংল্যাণ্ডের জাতীয় রাজস্বের বেশীর ভাগ যুদ্ধের ঘাটতি পূরণের অথবা ভাবী যুদ্ধের সম্ভাবনায় ব্যয়িত হয়। তাছাড়া বাদবাকি যা থাকে তাই জনহিতকর কাজে ব্যয় করা হয়। মহাদেশের অধিকাংশ দেশে লোকহিতকর কাজে ব্যয়িত অর্থের অনুপাত অনেক ক্ষেত্রে ইংল্যাণ্ডের চেয়েও কম। আমাদের পুলিশব্যবস্থার যোগ্যতার তুলনা নেই কোথাও। তার অংশবিশেষ অপরাধ অনুসন্ধান এবং অপরাধ বন্ধ করার কাজে তৎপর; বাকি অংশ কারো কোন নতুন গঠনমূলক রাজনৈতিক আদর্শ থাকলে তাকে কারারুদ্ধ করার কাজে নিয়োজিত। সাম্প্রতিক কাল ছাড়া চীনদেশে এসবের কিছুই ছিলনা। তাদের কারখানা তাদের জন্য মোটর গাড়ি এবং বোমা তৈরি করতে পারত না রাষ্ট্র নিজস্ব নাগরিককে পরদেশের নাগরিক হত্যার জন্য শিক্ষিত করে তুলতে অক্ষম ছিল। তাদের পুলিশে বলশেভিক অথবা ডাকাত পাকরাও করার কাজে সম্পূর্ণরূপে অযোগ্য ছিল! এর ফল হলো চীনদেশে শ্বেতাঙ্গ মানুষের দেশসমূহের তুলনায় ঢের বেশি স্বাধীনতা ভোগ করত এবং অল্প সংখ্যক মানুষ ছাড়া প্রায় দারিদ্র লাঞ্ছিত মানুষও একধরনের পরিব্যাপ্ত সুখের আস্বাদ পেত।

গড়পড়তা চীনাদেশের সঙ্গে গড়পড়তা পশ্চিমাদের আসল দৃষ্টিভঙ্গীর মধ্যে দু’জাতীয় উল্লেখ্য পার্থক্য বর্তমান। প্রথমতঃ চীনারা কোন লোকহিতকর উদ্দেশ্য সাধিত না হওয়া পর্যন্ত কোন কাজকে প্রশংসা করেনা। দ্বিতীয়তঃ তারা মনে করে নিজস্ব প্রবৃত্তি দমন করা এবং অন্যের ব্যাপারে নাক গলানোর মধ্যে নৈতিকতার মৌল পরিচয় নিহিত নয়। এ দু’রকমের পার্থক্যের মধ্যে প্রথমটা প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে দ্বিতীয় পার্থক্যটা সম্পর্কে আলোচনা করাটাও সমানভাবে প্রয়োজনীয়। খ্যাতনামা চীনা পণ্ডিত অধ্যাপক গাইলস তার কনফুসিয়াস এবং তার বিরুদ্ধবাদীদের উপর গিফোর্ড বক্তৃতার উপসংহারে বলেছেন, আদি পাপের নীতিই (The doctrine of original sin) চিনদেশে খ্রিস্টান প্রচারক মণ্ডলীর প্রধান প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দূর প্রাচ্যে এখনো গোড়া প্রচারকেরা প্রচার করে তাকে যে আমরা সকলে পাপী হিসেবে জন্ম গ্রহণ করেছি, যে পাপের কারণে আমাদেরকে চিরন্তন শাস্তি ভোগের অধিকারী হতে হবে। যদি শ্বেতাঙ্গ মানুষদের জন্যও এ নীতি কার্যকরী হতো তাহলে সম্ভবতঃ চীনাদের খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণে কোন আপত্তি থাকত না। কিন্তু যখন তাদেরকে বলা হয় তাদের পিতামাতা এবং প্রপিতামহেরা দোজখের আগুনে জ্বলছে। তখন তারা ক্ষিপ্ত না হয়ে পারে না। কনফুসিয়াস শিক্ষা দিয়েছেন মানুষ পবিত্র হিসেবে জন্ম গ্রহণ করে। একমাত্র খারাপ দৃষ্টান্তের শক্তি অথবা দুর্নীতিপূর্ণ ব্যবহার তাদেরকে কুপথে নিয়ে যায়। পাশ্চাত্যের ঐতিহ্যিক গোঁড়ামির সঙ্গে এ-পার্থক্য চীনাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।

আমাদের মধ্যে যাদেরকে নৈতিকতার উজ্জ্বল নিদর্শন বলে গণ্য করা হয়, তারা জীবনের ছোটোখাটো আনন্দ ভুলে গিয়ে অন্যের আনন্দ নিয়ে অধিকতর মাথা ঘামান। আমাদের মধ্যে গুণ সম্পর্কে যে ক্রিয়াশীল ধারণা রয়েছে তা হলো কোন মানুষ যদি নিজেকে খুব বেশি সংখ্যক মানুষের ক্ষতির কারণ না হতে পারে, তাহলে তাকে আমরা খুব বেশি ভালো মানুষ বলে স্বীকৃতি দেইনা। পাপের ধারণা থেকে আমাদের মধ্যে এ মনোভাবের উদয় হয়েছে। তার ফলে শুধু অন্যের স্বধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করতে হয় না, কপটতার আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়, যেহেতু চিরাচরিত পদ্ধতিতে জীবনধারণ করা অধিকাংশলোকের পক্ষে অসম্ভব। চীনের ব্যাপারে কিন্তু আলাদা। নৈতিক ধারণাগুলো না-বাচক নয়, হাঁ বাচক। সেখানে এটা আশা করা হয়ে থাকে যে একজন মানুষ তার মা বাপের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, সন্তান সন্তুতির প্রতি স্নেহশীল, দরিদ্র প্রতিবেশীর প্রতি দয়ার্দ্র এবং সকলের প্রতি দ্র হবে। এ সকল খুব কষ্টকর কর্তব্য নয়, আসলে বেশি কর্যকরী।

আদিপাপের বোধ না থাকার আরেকটা সুফল হলো মানুষেরা তাদের বিভিন্নতা যুক্তির আলোকে যাচিয়ে নিতে অধিকতর আগ্রহশীল হয়ে উঠতে পারে প্রতীচ্যের তুলনায়। আমাদের মধ্যে মতের বিভিন্নতা খুব শিগগির নীতির প্রশ্ন হয়ে দেখা দেয়। পরস্পর পরস্পরকে দোষী সাব্যস্ত করে আমাদের মধ্যে তিক্ত সম্পর্কের সৃষ্টি হয় যার বাস্তব সমাধান খুঁজতে হলে শক্তি প্রয়োগ ছাড়া আর কোন খোলা পথ থাকেনা। চীনে যদিও অতীতে সামরিক নায়ক ছিল কিন্তু তাদের কেউ অত সাংঘাতিক মনে করত না এমনকি তাদের নিজস্ব সৈনিকরাও না। তারা যুদ্ধ করত, কিন্তু সে সব যুদ্ধে বলতে গেলে একেবারে রক্তপাত হতো না। পাশ্চাত্যের কঠোর শক্তির সংঘাতের যে অভিজ্ঞতা আমাদের আছে সে তুলনায় তারা অল্পস্বল্প ক্ষতি করত। সৈন্যাধ্যক্ষের অবর্তমানেও অধিকাংশ নাগরিক বেসামরিক পদ্ধতিতে আপন আপন কাজকর্ম চালিয়ে যেত। সাধারণতঃ ঝগড়া বিবাদ তৃতীয় ব্যক্তির বন্ধুত্বপূর্ণ সালিশের মাধ্যমে নিস্পন্ন করা যেত। আপোষে মিটমাট করা ছিল চীনের নির্ধারিত নীতি, যদিও বিদেশীর হাসি উদ্রেক করে, তবু এ এমন একটা পদ্ধতি যা সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে আমাদের এত ভাঙন সৃষ্টি করেনা।

চীনা জীবন যাপন পদ্ধতির গুরুতর দোষ হলো একটি; তা চীনাকে কলহপরায়ণ জাতিগুলোর বিরুদ্ধে বাধা দেবার মতো শক্তিশালী করেনি। সমগ্র পৃথিবী চীন দেশের মতো হলে আরো সুখময় হতে পারত। যে পর্যন্ত অন্যান্য জাতিসমূহ যুদ্ধপ্রিয় এবং উৎসাহী থাকবে সে পর্যন্ত চীনদেশ যা এখন আর বিচ্ছিন্ন নয়, তাদের জাতীয় স্বাধীনতা অটুট রাখতে চাইলে আমাদের কিছু দোষের অনুকরণ করতে হবে। এ অনুকরণ যে উন্নতি তা ভেবে আমাদের আত্মপ্রসাদ লাভ করা একদম অনুচিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *