০৬. যন্ত্র এবং আবেগ

যন্ত্র এবং আবেগ

যন্ত্র কি আবেগ সমূহকে হত্যা করবে? না আবেগসমূহ যন্ত্রপাতিকে বিনষ্ট করবে? অনেক আগে স্যামুয়েল বাটলার তার (EREWHON) এয়ার হোন-এ প্রশ্নটির অবতারণা করেছেন। যন্ত্রযুগের ব্যাপক প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে এ প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

যন্ত্র এবং আবেগের মধ্যে কোন বিবাদ কেনো থাকবে, আপাতঃদৃষ্টিতে তা ধরা পড়ার কথা নয়। প্রত্যেকটি শিশু স্বাভাবিকভাবে যন্ত্র ভালোবাসে। অত্যাধিক শক্তিধর এবং প্রকাণ্ড যন্ত্রের প্রতি তার আকর্ষণ প্রচণ্ড। জাপানিদের মতো যে জাতির ঐতিহ্য শৈল্পিক বিশেষত্ব আছে, সংস্পর্শে আসা মাত্রই প্রতীচ্যের যন্ত্রের, যান্ত্রিক পদ্ধতির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে এবং যত শিগগির সম্ভব অনুকরণ করার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছে। (ইউরোপ) ভ্রমণ করেছেন এমন একজন শিক্ষিত, এশিয়ান প্রাচ্যের জ্ঞানরাজির প্রশংসা এবং এশীয় সভ্যতার ঐতিহ্যগত উৎকর্ষের কথা শুনতে যত বিরক্ত হবেন, তেমনটি আর কিছুতেই হবেন না। বালককে পুতুলের বদলে খেলনা মোটর দিলে যে পরিমাণ খুশী হয়ে ওঠে, তিনিও আসল মোটর পেলে তার শরীরের উপর দিয়ে চলে যেতে পারে সে কথা উপলব্ধি না করে খেলনা মোটর পাওয়া শিশুর মতো খুশী হয়ে উঠবেন।

প্রতীচ্যে মুষ্টিমেয় কবি এবং নন্দনতাত্বিক ছাড়া অন্য সকলের চোখে প্রথমাবস্থায় যন্ত্র একই রকমের আনন্দদায়ক ছিল। উনবিংশ শতাব্দীকে পূর্ববর্তী শতাব্দীগুলোর তুলনায় যান্ত্রিক উৎকর্ষের জন্য উল্লেখযোগ্য বিবেচনা করা হয়। প্রথম জীবনে পিকক (peacock) gosto giusreo syfaro (Steam intellect society) Pos GT করতেন। তিনি ছিলেন সাহিত্যের মানুষ, তার কাছে গ্রিসিয় এবং লাতিন গ্রন্থকারেরা ছিলেন সভ্যতার প্রতীক। কিন্তু তিনি ছিলেন তার যুগের বহতা ভাবধারার প্রতি অত্যধিক সচেতন, কিন্তু যুগের মানুষের কাছে অপাংক্তেয় হওয়ার ভয়ে তা করেছিলেন। রুশোর শিষ্যদের সঙ্গে হ্রদের তীরের কবিরা মধ্যযুগীয় সমস্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ প্রকৃতিতে ফিরে গেলেন। উইলিয়াম মরিস (William Morris) তার নিউজ ফ্রম নো হোয়ার (News from nowhere) কাব্যগ্রন্থে এমন একটি দেশের বর্ণনা দিয়েছেন (যেখানে সারাবছর জুন মাস, লোকজন পরমানন্দে তাদের কাজকর্ম গুছিয়ে নিচ্ছে) সবকিছুর মধ্যে একটি খাঁটি আবেগময়তা এবং যান্ত্রিকতার ভাব পরিদৃশ্যমান।

স্যামুয়েল বাটলার ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি সর্বপ্রথম নিরুত্তর আবেগে যন্ত্রের বিরোধিতা করেছিলেন, তবে তা তার মধ্যে দ্রুণরূপে বর্তমান ছিল। অন্তরের গভীর শেকড় প্রসার করতে পারেনি। তার সময় থেকে যন্ত্ৰোন্নত জাতিগুলোর কিছুসংখ্যক মানুষ (EREWHONLAN) এরয়ারহোনিয় মতবাদের সমগোত্রীয় একটা মতবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এই মতবাদ শিল্পোৎপাদন পদ্ধতির প্রতি বিদ্রোহ মনোভাবাপন্ন অনেকের দৃষ্টিভঙ্গীতে প্রচ্ছন্ন অথবা প্রকাশ্যে ক্রিয়াশীল। যন্ত্রকে পূজা করা হয়, যেহেতু যন্ত্র সুন্দর, দাম দেয়া হয় শক্তিধর বলে, বিকট ভীষণ বলে ঘৃণা করা হয় এবং দাসত্ব ব্যবস্থা কায়েম করে বলে যন্ত্রের প্রতি বিতৃষ্ণা জ্ঞাপন করা হয়। এর মধ্যে কোন সিদ্ধান্তটা ভালো সে বিষয়ে মন্তব্য করব না, তা করলে মানুষের পা থাকা ভালো, মাথা থাকা খারাপ তাও আমাদের ধারণা করতে হয়। যদিও আমরা সহজে কল্পনা করতে পারি লিলিপুটের মানুষেরা গ্যালিভারের পা মাথা নিয়ে ঝগড়ায় মেতে উঠেছে। যন্ত্র হলো, আরব্যোপন্যাসের সে জ্বীনের মতো প্রভুর কাছে উপকারী এবং সুন্দর, শত্রুর কাছে ভয়াল ভীষণ। কিন্তু আমাদের যুগে কোন কিছুকে উলঙ্গ করে সহজভাবে দেখতে দেয়া হয় না। এটা সত্য যে যেখানে যন্ত্রের ঘর্ঘর শব্দ পৌঁছায়না, অবর্জনার নোংরা স্তূপদৃষ্টিগোচর হয়না, যেখানে দুর্গন্ধ বাতাসে নিশ্বাস নিতে হয় না, যন্ত্রের মালিকেরা তেমনি নিরাপদ ব্যবধানে বাস করেন। যদি কখনো আসেন তাহলে যন্ত্র চালু হওয়ার আগে যখন তিনি যন্ত্রের শক্তির প্রশংসা করতে পারেন, ধূলোবালি আর উত্তাপে অতিষ্ঠ না হয়ে খুঁটিনাটি দেখে মোহিত হতে পারেন। যারা যন্ত্রের সঙ্গে বাস করেন এবং যন্ত্রে কাজ করে তাদের দৃষ্টিতে যন্ত্রকে বিচার করতে চ্যালেঞ্জ করা হলে সব সময় তারা একই রেডিমেড জবাব দেবেন। তারা বলবেন, যন্ত্র চালু থাকার ফলে তারা বেশি পরিমাণে জিনিসপত্র কিনতে পারছেন। সুতরাং তারা তাদের পিতা পিতামহের চেয়ে অনেক অনেক বেশি সুখী। তা যদি সত্য হয়, সব মানুষে করে এমনি একটা ধারণাকে আমাদের স্বীকার করে নিতে হয়।

ধারণাটা হলো বস্তুগত পণ্যদ্রব্যের অধিকারী হতে পারলে জীবনে সুখী হওয়া যায়। এটাও ধারণা করা যায় যে মানুষের দুটো কক্ষ, দুটো বিছানা এবং দুটো করে রুটি আছে সে মানুষটি একটি কক্ষ, একটি রুটি একটি বিছানা যে মানুষটির আছে তার তুলনায় ঢের বেশি সুখী। মানুষ সব সময়ই ভাবে মানুষের সুখ রুজি রোজগারের উপর নির্ভরশীল। মাত্র কিছু সংখ্যক মানুষ, সেও সব সময় আন্ত রিকতার সঙ্গে নয়, ধর্ম এবং নৈতিকতার নামে এ ধারণার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করে থাকেন, আবার তারাও উচ্চ কণ্ঠ প্রচারের মাধ্যমে আয়ের পরিমাণ বাড়াতে পারলে মনে মনে খুব খুশী হন। কোন ধর্ম কিংবা নৈতিকতার বশে নয়, মনস্তত্ত্ব এবং জীবন পর্যবেক্ষণের দৃষ্টিকোণ থেকে আমি এ ধারণার প্রতিবাদ করতে চাই। জীবনের সুখ যদি রুজি-রোজগারের অনুপাতে হয়ে থাকে তাহলে যন্ত্রের বিপক্ষে বলার আমার কিছু নেই। তা যদি সত্য না হয়ে থাকে তাহলে আগাগোড়া সমস্ত প্রশ্নটা পরীক্ষা করে দেখার অপেক্ষা রাখে।

মানুষের যেমন শারীরিক প্রয়োজন আছে, তেমনি তার মধ্যে আবেগ আছে। যেখানে মানুষের প্রথমটির অভাব মিটেনা সেখানে দ্বিতীয় অভাবগুলোই প্রথম এবং প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। শারীরিক প্রয়োজন মিটলে পরে প্রয়োজনের সঙ্গে সম্পর্কহীন আবেগরাশি মানুষ সুখী কি অসুখী তা নির্ধারণ করতে তৎপর হয়ে ওঠে।

আধুনিক শিল্পাঞ্চলসমূহের অনেক মানব-মানবী এবং শিশু প্রয়োজন মতো শারীরিক অভাব মিটাতে পারেনা। আয় বৃদ্ধি হলো তাদের সুখবৃদ্ধির প্রথম সোপান একথা আমিও স্বীকার করি। সেগুলো অতিরিক্ত নয় সংখ্যার সে জন্যে সকলের শারীরিক প্রয়োজনের উপকরণাদি সরবরাহ করা অসম্ভব কিছু নয়। আমি তাদের কথা বলছি না, বলছি তাদের কথা, যাদের বেঁচে থাকার প্রয়োজনের তুলনায় বেশি আছে, প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি যাদের আছে তাদের নয়, সামান্য পরিমাণ বেশি যাদের আছে তাদের কথাও বলছি। আমরা সকলে উপার্জন বাড়াতে চাই, তার কারণটা কী? প্রথম দৃষ্টিতে মনে হতে পারে আমাদের আকাঙ্ক্ষা পরিতৃপ্ত করতে পণ্যদ্রব্যের প্রয়োজন। আদতে আমরা প্রতিবেশীদের উঁট দেখাবার জন্যে পণ্যদ্রব্য কামনা করে থাকি। যখন একজন মানুষ পুরনো খারাপ বাসা ছেড়ে একটি রুচিসম্মত ঘরে উঠে আসে, তখন সে মনে করে এবার উন্নত ধরনের লোকেরা তার স্ত্রীকে নিমন্ত্রণ করবে, বিগত অসচ্ছল দিনের চিহ্ন জীবন থেকে এভাবে বুঝি মুছে যাবে। ছেলেকে ভালো স্কুলের অথবা ব্যয়বহুল বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে বেশি মাইনে দিয়ে সামাজিক মর্যাদার আসন দখল করে নিলো বলে আত্মপ্রসাদ অনুভব করে। ইউরোপ, আমেরিকার বড় শহরে কোন কোন অঞ্চলের ভালো ঘরের ভাড়া অন্যান্য অঞ্চলের ভালো ঘরের ভাড়ার চাইতে অনেক বেশি এ কারণে যে সেগুলো অত্যন্ত সৌখিন। আমাদের মনের গভীরে সম্মানিত এবং প্রশংসিত হওয়ার আকাঙ্খ অত্যন্ত প্রবল। স্বাভাবিকভাবেই ধনীলোকেরা অত্যধিক শ্রদ্ধা এবং সম্মান পেয়ে থাকে। মানুষের ধনী হওয়ার আসল কারণ হলো এটি। টাকা দিয়ে তারা যে সকল জিনিস ক্রয় করে, তার ভূমিকা সেখানে প্রথম নয়, দ্বিতীয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যেতে পারে, যে কোটিপতি এক ছবি থেকে আরেক ছবির পার্থক্য পর্যন্ত বোঝে না সেও বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিয়ে ওল্ড মাষ্টারদের ছবি কিনে আর্ট গ্যালারি রচনা করে। অন্যেরা কত খরচ করেছে তা অবাক হয়ে ভাববে-ছবিগুলো শুধু এই আনন্দই তাকে দিয়ে থাকে। নিজের শ্লাঘা বোধ থেকে এই আনন্দ সে কখনো পেতে পারে না।

এই বোধ বিভিন্নভাবে প্রকাশ পেতে পারে এবং বিভিন্ন সমাজে এর প্রকাশভঙ্গী বিভিন্ন। অভিজাত সমাজে মানুষকে জন্মের জন্যে সম্মান করা হয়। প্যারির কোন কোন মহল মানুষকে, তার জীবন যতই বিচিত্র হোকনা কেনো শিল্পপ্রতিভার জন্যেই সম্মান করা হয়ে থাকে। জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন মানুষ তার জ্ঞানের জন্য সম্মানিত হয়। ভারতে সন্নাসীদের সম্মান করা হয়। চীনদেশে সাধুদের। বিভিন্ন সমাজ পর্যবেক্ষণ আমাদের বিশ্লেষণের যথার্থতাই প্রমাণ করে। সকল সমাজের মধ্যে এমন কতক মানুষের দেখা পাওয়া যায় তারা যতক্ষণ পর্যন্ত টাকা পয়সা ছাড়া বেঁচে থাকা যায় ততক্ষণ পর্যন্ত টাকা পয়সার প্রতি চরম ঔদাসীন্য প্রদর্শন করে। কিন্তু যে গুণটির বলে পরিবেশকে মুগ্ধ করে সম্মানিত হয় সে গুণটির পরিচর‍্যা করে তারা।

এসব বাস্তব সত্যের প্রাধান্য এটা প্রমাণ করে যে সম্পদের প্রতি আধুনিক মানুষের আকাঙ্ক্ষা তার প্রবৃত্তির গভীরে প্রোতিত নয়। ভাসা ভাসা আকাঙ্ক্ষাকে বিভিন্ন সামাজিক সংস্থার মাধ্যমে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়া যায়। যদি আইন করে সকলের আয় সমান করে বেঁধে দেয়া হয়, তাহলে প্রতিবেশীদের চাইতে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করবার জন্য অন্য পথের সন্ধান করতে হবে। পণ্যদ্রব্য হস্তগত করার আকুলি বিকুলির অনেকাংশে নিরসন হবে। যতদিন প্রতিযোগীদের মধ্যে তীব্র আকাক্ষা বিরাজ করবে ততদিন আমরা প্রতিবেশীদের হারিয়ে দিয়ে তাদেরকে যতটুকু বেদনার্থ করতে পারব নিজেরাও ততটুকু পুলকিত হব। সম্পদের বৃদ্ধির ফলে প্রতিযোগিতামূলক কোন সুবিধা যেমন আসেনা, তেমনি দিতে পারে না প্রতিযোগিতামূিলক কোন সুখের সন্ধান। পণ্যদ্রব্য ক্রয় করে উপভোগ করার মধ্যে সত্যিকারের কিছুটা আনন্দ আছে। কিন্তু আমরা দেখেছি, যে বস্তু আকাঙ্ক্ষা করি এ তার কিয়দংশ মাত্র। এতদূর পর্যন্ত যখন দেখা গেলো আমাদের আকাঙ্ক্ষাগুলো প্রতিযোগিতামূলক এবং সে অনুসারে অতিরিক্ত ধনাগমের ফলে মানুষের সাধারণ অথবা বিশেষ কোন সুখের বৃদ্ধি সাধন করেনা।

যন্ত্র মানুষের সুখ বৃদ্ধি করে। এর সমর্থনে যদি যুক্তি দেখাতে হয় তারপরেও যে পরিমাণ উন্নতি বিধান করে থাকে চরম দারিদ্রের নিরোধক হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া ছাড়া এর সমর্থনে যন্ত্র কোন মূল্যমানের প্রতিষ্ঠা করে না। কোন যন্ত্র সেভাবে ব্যবহৃত হবে তার কোনও সংগত কারণ নেই। যেখানে জনসংখ্যা স্থির সেখানে যন্ত্র ছাড়াও দারিদ্রের নিরসন করা যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, ফরাসিদেশে দারিদ্র খুবই কম, যদিও সে দেশে কল-কারখানা আমেরিকা, ইংল্যাণ্ড এবং যুদ্ধপূর্ব জার্মানির তুলনায় অনেক কম,পরোক্ষভাবে কল-কারখানা যেখানে বেশি সেখানে অভাবও বেশি। একশ বছর আগেকার ইংল্যাণ্ডের শিল্পাঞ্চলগুলো এবং বর্তমান জাপানকে তার দৃষ্টান্ত হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। যন্ত্রের সাহায্যে নয় শুধু, অভাব দূর করতে হলে আমাদেরকে অন্যকিছুর উপর নির্ভর করতে হবে। অভাবকে বিজয় করা ছাড়া সম্পদ বৃদ্ধি করার মূল্য তেমন বেশি কিছু নয়।

ইতোমধ্যে যন্ত্র আমাদের দুটো জিনিস থেকে বঞ্চিত করেছে। মানুষকে সুখী হতে হলে তার চরিত্রে এ দুটোর অতীব প্রয়োজন। উপাদান দুটো হলো বৈচিত্র এবং স্বতঃস্ফূর্ততা। কলের নিজস্ব ক্ষুধা আছে এবং ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য নিজস্ব দাবি আছে। যে মানুষ কলের মালিক সে তা অবশ্যই চালু রাখবে। আবেগসমূহের দৃষ্টিকোণ থেকে যন্ত্রের নিয়মতান্ত্রিকতাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় বিপত্তি। যে সব মানুষ নিজেদের সিরিয়াস বলে ধারণা করে তাদের যন্ত্রের সবগুলো বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত বলে প্রশংসাও করা হয়। উদাহরণস্বরূপ তারা বিশ্বাসযোগ্য, সময়নিষ্ঠ, যথার্থ ইত্যাদি ইত্যাদি। এর কারণ হলো যন্ত্র মানুষের চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। একটি খারাপ জীবন এবং একটি অনিয়মিত জীবনে বর্তমানে বিশেষ প্রভেদ নেই। বের্গসঁর দর্শন এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গীর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ। যদিও আমার মনে হয়, তিনি শুধু মানুষকে সর্বতোভাবে যন্ত্রে রূপায়িত হতে দেখে আতংকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। 

জীবনে আমাদের চিন্তার প্রতিকূল বিদ্রোহী প্রবৃত্তিগুলো যন্ত্রের দাসত্বে অস্বীকৃতি জানিয়ে একটি চরম অশুভ দিকে মোড় নিয়েছে। সমাজবদ্ধভাবে জীবনযাপনের শুরু থেকে যুদ্ধস্পৃহা বর্তমান ছিল কিন্তু আমাদের যুগের এত তা ভয়াল ভয়ংকর রূপ ধারণ করেনি কখনো। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে বিশ্বে নেতৃত্ব করার আকাঙ্ক্ষায় ইংল্যাণ্ড এবং ফরাসি দেশের মধ্যে অসংখ্য যুদ্ধ-বিগ্রহ সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু সকল সময়ে তারা পরস্পর পরস্পরকে পছন্দ করত এবং পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধও তাদের অক্ষুণ্ণ ছিল। বন্দী অফিসারেরা সামাজিক ক্রিয়াকাণ্ডে যোগদান করতেন এবং ডিনার পার্টিতে সম্মানীয় অতিথি বলে গণ্য হতেন। ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দের প্রারম্ভে যখন আমাদের সঙ্গে হল্যাণ্ডের যুদ্ধ হয় তখন ওলন্দাজলের নিষ্ঠুর কার্যকলাপের গল্পসহ একজন মানুষ এলেন আফ্রিকা থেকে। আমরা বৃটিশ দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীরা উৎসাহিত হয়ে ধারণা করেছিলাম যে গল্পগুলো অলীক, তাকে শাস্তি দিয়েছিলাম এবং ওলন্দাজদের অস্বীকৃতি ছাপিয়ে প্রকাশ করেছিলাম। গতযুদ্ধে হলে আমরা তাকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করতাম এবং তার সত্যনিষ্ঠায় কেউ সন্দেহ করলে আমরা তাকে জেলখানায় পাঠাতাম। যন্ত্রের কারণে আধুনিক যুদ্ধ জঘণ্যভাবে নৃশংস এবং এ নৃশংসতা তিনটি উপায়ে সক্রিয়। প্রথমতঃ যন্ত্র অধিক সংখ্যক সৈন্য রাখার সুযোগ দিয়ে থাকে। দ্বিতীয়তঃ খবরের কাগজের সস্তা প্রচার মানুষের অপকৃষ্ট বৃত্তিসমূহ আগুন ধরিয়ে দেয়। তৃতীয়তঃ মানব চরিত্রের স্বতঃস্ফূর্ত স্বৈরাচারী দিকটি যা অন্তঃশীলা স্রোতে অস্পষ্ট একটা অতৃপ্তির ভাব সৃষ্টি করে, যার ফলে যুদ্ধের আবেদন মানুষের চোখে অতৃপ্তি থেকে রক্ষা পাওয়ার একটা পন্থার এত ঠেকে। এই তৃতীয় পন্থাটিকে ঘিরেই আমাদের আলোচনা। গতযুদ্ধের এত বিরাট একটা রদবদলকে শুধুমাত্র রাষ্ট্রনৈতিকদের দুরভিসন্ধি মনে করা আমাদের পক্ষে ভুল হবে। রাশিয়ার মানুষের মধ্যে এ বোধ পর্যাপ্ত পরিমাণে ছিল বলে তারা বোধ হয় সর্বান্তঃ করণে যুদ্ধ না করে একটা বিপ্লবের মধ্য দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের জার্মানি ইংল্যাণ্ড এবং আমেরিকার কোন সরকার যুদ্ধের জনপ্রিয় দাবিকে ঠেকিয়ে রাখতে পারত না। এরকম জনপ্রিয় দাবির পেছনে অবশ্যই একটা প্রাকৃকিত ভিত্তি আছে। আমার মতে আধুনিক নিয়মনিষ্ট একঘেঁয়ে জীবনের অসন্তোষ, অতৃপ্তি (যা অনেকাংশে অচেতন) এই যুদ্ধপ্রিয় মনোভাবের সহায়ক হয়েছে। 

এটা স্পষ্টতঃ সত্য যে, আমরা যন্ত্রপাতিকে বিদায় করে পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারিনে। এরকমের প্রচেষ্টা প্রতিক্রিয়াশীল এবং সর্বক্ষেত্রে অবাস্তব প্রমাণিত হবে। কল-কারখানা জীবনে যে দুর্বিসহ অভিশাপ বয়ে এনেছে, দুঃসাহসিক অভিযানের অনুপ্রেরণায় বেড়িয়ে পড়ে একঘেঁয়েমী ভঙ্গ করা হলো তা এড়িয়ে যাওয়ার একমাত্র পথ। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যারা আল্পস পর্বতের শিখরে আরোহন করেছে তারা তখনও যুদ্ধকে কামনা কররেব কি? শান্তির একজন উৎসাহী এবং কর্মক্ষম কর্মীর সঙ্গে পরিচিতি হবার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল, যিনি অভ্যাসবশে আল্পসের সবচেয়ে বিপদ-সংকুল শৃঙ্গে আরোহণ করে সারা গ্রীষ্মকাল অতিবাহিত করেন। যদি প্রত্যেক শ্রমজীবী মানুষকে তাদের ইচ্ছানুসারে উড়োজাহাজ চালানো শিক্ষা দেয়া যায় অথবা সাহারায় নীলকান্ত মণির সন্ধানে পাঠানো হয় অথবা তার আবেগে নাড়া দিতে সক্ষম তেমন কোন উত্তেজনাপূর্ণ কাজে পাঠানো হয় তাহলে যুদ্ধের জনপ্রিয় দাবি প্রতিযোগিতায় এসে দাঁড়াবে এবং ধীরে ধীরে সময়-প্রীতি লোপ পেয়ে যাবে। বিবদমান শ্রেণীসমূহকে শান্ত করার কোন পদ্ধতি আমার জানা নেই, একথা আমি স্বীকার করি। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি একটা বৈজ্ঞানিক দর্শনের আঙ্গিকে অন্তরঙ্গভাবে অনুসন্ধান করলে একটা পদ্ধতির সন্ধান অবশ্যই মিলবে। 

যন্ত্র আমাদের জীবনধারায় পরিবর্তন বয়ে এনেছে, কিন্তু প্রবৃত্তিকে নয়। ফলতঃ অসামঞ্জস্য ঘটেছে। আবেগ এবং দর্শন এখন পর্যন্ত শৈশবাবস্থায় রয়ে গেছে। মনঃসমীক্ষা সবেমাত্র সে দর্শনের সূত্রপাত করেছে, কিন্তু তাও আগে যেখানে ছিল বর্তমানেও সেখানে স্থির অনড়ভাবে রয়ে গেছে। মানুষ এমন অনেক কাজ করে, এমন অনেক কিছু চায় যা তার আসল কাম্য নয়। অযৌক্তিক বিশ্বাসের বশে না জেনে মানুষ জীবনের ভিন্নরকম পরিণতি কামনা করে অন্তত আমরা এটুকু মনসমীক্ষা থেকে গ্রহণকরতে পারি। কিন্তু গোঁড়া মনঃসমীক্ষা অন্যায়ভাবে আমাদের সচেতন উদ্দেশ্যেরও সরলীকরণ করে ফেলেছে এবং তা অসংখ্য আর ব্যক্তিতে ব্যক্তিত্বে বিভিন্ন। এটা আশা করা যায় যে শিগগির এমন রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিস্থিতির উদ্ভব হবে যখন এই দৃষ্টিকোণ থেকে মানবচরিত্রের উপর আলোকপাত করা সম্ভব হবে।

শুধু নৈতিক আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং আমাদের বাহ্যিক ক্ষতিকর কাজ বন্ধ করাকে আমাদের স্বৈরাচারী প্রবৃত্তিগুলোর নিরসনের পক্ষে পর্যাপ্ত বলে মনে করা উচিত নয়। এ কারণে নিরসন হয় না যে আমাদের প্রবৃত্তির মধ্যে কতকগুলো মধ্যযুগীয় শয়তানের মতো এমন ছদ্মবেশ ধরতে সক্ষম যে সবচেয়ে সতর্ক তা ফাঁকি দিতে পারে। আমাদের চরিত্রগত প্রবৃত্তিকে পরিতৃপ্তি বিধান করার একমাত্র পন্থা হলো ওগুলোর কিসের প্রয়োজন তা জানা এবং কিভাবে যথাসত্বর কম ক্ষতিকর উপায়ে তার পরিতৃপ্তি বিধান করা যায় তা আবিষ্কার করা। যেহেতু যন্ত্র স্বতঃস্ফূর্ততাকে বিনষ্ট করেছে, একমাত্র সুযোগকেই তার স্থলাভিষিক্ত করতে হবে এবং তা ব্যক্তিক অভিরুচির এখতিয়ারে ছেড়ে দেয়া উচিত। সন্দেহ নেই, এতে বিস্তর খরচ পড়বে, কিন্তু সে খরচ কোনক্রমেই একটা যুদ্ধের ব্যয়ের সঙ্গে তুলনা করা যায় না। মানবচরিত্রের সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞান অবশ্যই মানবজীবনের যে-কোন রকমের উন্নতির ভিত্তি হবে। বহির্বিশ্বের প্রাকৃতিক আইনকে আয়ত্ব করে মানুষ অসাধ্য সাধন করেছে। এ পর্যন্ত আমরা ইলেকট্রোন এবং নক্ষত্রলোক সম্বন্ধে যতটা জানতে পেরেছি নিজেদের চরিত্রের সম্বন্ধে জানাশোনার পরিমাণ তার চেয়ে অনেক স্বল্প। যখন বিজ্ঞান মানবচরিত্র জানতে শুরু করেছে তখন আমাদের জীবনের সুখ সন্তুষ্টি বিধান করতে সক্ষম হবে যা এতকাল প্রকৃতি বিজ্ঞান কিংবা যন্ত্রপাতি দিয়ে বারবার অকৃতকার্য হয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *