০৭-৮. মানালি যাচ্ছি

সে কী রে! আমরা মানালি যাচ্ছি না?

তাই বললাম নাকি? হাতে তো এখনও অঢেল দিন, পরে যাব। বেড়াতে বেরিয়ে শুধু হুটোপুটি করে ছোটাটা তো কোনও কাজের কথা নয়। নজ্ঞরে যখন এলামই, একটা রাত কাটাতে দোষ কী! দেখতেই তো পাচ্ছ, জায়গাটা অসম্ভব সুন্দর। আজ চতুর্দশী, চাঁদের আলোয় আরও অপূর্ব লাগবে।

আমি মিতিনের দলে। এক রাত কেন, তিন রাত্তিরও এখানে থাকতে পারি। আদৌ মানালি না গেলেই বা কী এসে যায়! মানালিও পাহাড়, নজ্ঞরও তাই। ওখান থেকেও বরফে ঢাকা হিমালয় দেখবে, এখান থেকেও।

অ্যাই, তুমি চুপ করো তো, শুধু আয়েশ করার ধান্দা।

বটেই তো। ছুটি কাটাতেই তো এসেছি। আরাম করব না কেন!

সহেলি আর অবনীতে ফের ঝগড়া বেধে যাচ্ছিল, পার্থ থামিয়েছে হাত তুলে। হেসে সহেলিকে বলল, দেখাই যাক না দিদি, যদি এখানে একটা ভাল হোটেল পাওয়া যায়। বিকেলে নয় কালটা ঘুরে আসব।

অবনী ঘাড় নাড়লেন, হ্যাঁ, ওখানে আর একটা মিউজিয়ামও আছে।

 আমি আর মিউজিয়ামে নেই। একটা দেখেই আমার ঠ্যাং ব্যথা করছে।

তুমি লোকাল মার্কেটে যেয়ো। দরাদরি করে মেমেন্টো কেনো।

বিচিত্র মুখভঙ্গি করলেন সহেলি। দেখে সকলে হেসে ফেলল। হাসতে হাসতেই আবার দুপুরের আহারে মন দিয়েছে। নজ্ঞরের এই ভোজনালয়টি একান্তই নিরামিষ। খাবার দাবারের পদও খুব বেশি নেই। ফুলকপির একটা ঝাল ঝাল তরকারি, বেগুনভর্তা আর তড়কা ডাল। গরমাগরম পরোটার সঙ্গে তাই হাপুসহুপুস খাচ্ছে সকলে। এমনকী, ঝালের কষ্ট ভুলে বুমবুমও। পেটে যখন ছুঁচো ডন দেয়, তখন সব খাবারই তো অমৃত।

টিঙ্কুও খাচ্ছিল পাশের টেবিলে। পরোটা ছিঁড়তে ছিঁড়তে পার্থ তাকে জিজ্ঞেস করল, এখানে পছন্দসই হোটেল কোথায় আছে, জানো?

বহুত মিলেগা। উপরের কাসলেই থাকতে পারেন, ওখানে তো এখন হোটেল হয়ে গিয়েছে।

ভাল?

বহুত বড়িয়া। লেকিন বহুত মেহেঙ্গা।

মাঝামাঝি কিছু নেই?

পেয়ে যাবেন। এই বাজারেই ঢুঁড়লে।

হোটেল থেকে হিমালয়ের চুড়ো দেখা যাবে তো?

জরুর।

খাওয়া সেরে টিঙ্কুকে নিয়ে বেরিয়ে গেল পার্থ। বিল মেটাতে গিয়ে মিতিন আলাপ জুড়েছে হিমাচলি হোটেলমালিকের সঙ্গে। মৌরি চিবোতে চিবোতে প্রশ্ন করল, এখন তো নজ্ঞরের পিক সিজন, তাই না?

কোথায় আর মরশুম ম্যাডাম! নজ্ঞরে তো তেমন টুরিস্টই আসে না।

কেন? এখানে তো অনেক কিছু দ্রষ্টব্য আছে? রোয়েরিখ সাহেবের গ্যালারি!

পাহাড় বেড়াতে এসে কত জন আর তসবির পসন্দ করে বলুন। সকলে তো কুলু-মানালি ছোটে। হয় কিছু বিদেশি আসে, নয় দু-চারটে খ্যাপা মানুষ।

খ্যাপা?

 নয়তো কী! পিঠে বোঝা চাপিয়ে এ-পাহাড় ও-পাহাড় চরে বেড়াচ্ছে।

ও, আপনি ট্রেকারদের কথা বলছেন?

হাঁ জি। ওরাই সবথেকে বেশি আসে। নজ্ঞর থেকে অনেক স্পটে যাওয়া যায় কিনা।

যেমন?

চন্দ্ৰখনি পাস যেতে পারেন। মালানা গ্রাম যদি পায়ে হেঁটে যান, তিন দিন লাগবে। চাইলে মালানা দিয়ে মণিকরণ যাওয়া যায়, পথে পড়বে রসোই পাস। আবার মণিকরণ পেরিয়ে ক্ষীরগঙ্গা যেতে পারেন। সব ক’টাই খুব ফেমাস ট্রেকিং রুট, বলতে বলতে ভদ্রলোক একবার মিতিনদের দলটাকে দেখে নিলেন। হেসে বললেন, আপনারা নিশ্চয়ই ট্রেক করতে আসেননি?

একেবারেই নয়। আমরা ছবি দেখার পার্টি।

ঢুকতে দিল? ওখানে তো আজ অনেক পুলিশ। রাতে নাকি চোর টোর এসেছিল!

আপনি জানেন?

ছোট জায়গা ম্যাডাম, খবর কানে এসেই যায়। তবে একটা কথা আপনাকে গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি ম্যাডাম। এই পাহাড়ের লোকেরা কেউ রোয়েরিখ সাহেবের গ্যালারিতে চুরি করতে যাবে না। সবাই এখনও ওঁকে ভক্তি করে।

চোর তা হলে বাইরের কেউ?

বিলকুল।

তা বাইরের লোক রাতদুপুরে এসে চুরি করবেই বা কী করে? অত রাতে পালাবেই বা কোথায়?

কে জানে! হয়তো পয়দল চন্দ্ৰখনি পাসের দিকে চলে গেল। কিংবা এখান থেকে কাতরেইন যাওয়ার একটা শর্টকাট রাস্তা আছে, পথে বিপাশা পড়ে। নদী টপকালেই পাতলিখুল, তারপর কাতরেইন আর কতটুকু!

পার্থ ফিরেছে। এসেই মিতিনকে তাড়া লাগাতে শুরু করল, চলো চলো, হোটেলরুমে আগে বডি ফেলি। তারপর বেরিয়ে যার সঙ্গে খুশি বকর বকর কোরো।

হোটেলটা কাছেই। বাজার পেরিয়ে ছোট্ট টিলার মাথায়। পিছনে উত্তর দিক পুরো খোলা এবং সত্যি সত্যি সেখান দিয়ে বরফে ঢাকা হিমালয়ের একটা ফালি দৃশ্যমান। ঘর দু’খানাও চলনসই। কুলুর কটেজের মতো বাহারি না হলেও খাট, আলমারি, ড্রেসিংটেবিল, ওয়ার্ড্রোব, সবই আছে। একটা করে ছোট টিভিও।

বিছানা পেয়ে সহেলির হাঁটু-কোমরের ব্যথা যেন বেড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে শুয়ে পড়েছেন। অবনী বসলেন বই খুলে। বুমবুম যথারীতি টিভিতে।

টুপুরের চোখ জড়িয়ে আসছিল। ঘুম কাটাতে পাশের কামরায় এল। এ ঘরেও পার্থ টিভি খুলবে খুলবে করছে। হাতে রিমোট। টুপুরকে দেখে বলল, কী রে, মাসির ল্যাজ, এবার তোদের কী প্ল্যান?

মিতিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে। টুপুরের হয়ে জবাব দিল, আপাতত নজ্ঞর দর্শন।

নো টুপি প্লিজ। খোলসা করে বলো তো, কেন রয়ে গেলে নজ্ঞরে?

বুঝতে পারছ না? চুরির কিনারা করতে গেলে এই নজ্ঞরে একটু থাকা দরকার। অর্থাৎ কিনা অকুস্থল থেকে খুব একটা দূরে যাওয়া সমীচীন নয়।

কোমর বেঁধে নেমেই পড়লে তা হলে?

 ছাড়তে পারছি না যে। পরপর এমন সব ক্লু এসে যাচ্ছে!

যেমন?

সেই পেনড্রাইভ থেকে তো শুরু হয়েছে। তারপর বৈজনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ, ছবি কপি, ছবি চুরি…

তো?

আরও আছে। এখনই ভাঙছি না।

যা ইচ্ছে করো। শুধু মাথায় রেখো, এ কেসে তোমার কিন্তু এক পয়সাও রোজগার নেই।

প্রজ্ঞাপারমিতা মুখোপাধ্যায় অর্থ ছাড়াও কেস করে স্যার। মগজের খিদে মেটানোর বাসনাও তো থাকে মানুষের, নয় কি?

পার্থ লাগসই একটা জবাব দিতে যাচ্ছিল, অকস্মাৎ বুমবুম হাজির। তিড়িংবিড়িং লাফাতে লাফাতে বলল, টিভিতে ছবি চুরির খবরটা দেখাচ্ছে গো মা?

চোখ সরু করে পার্থ বলল, তুই কী করে জানলি?

 চ্যানেল চেঞ্জ করতে গিয়ে চোখে পড়ল। চালাও না টিভি, দ্যাখো।

হ্যাঁ, বুমবুমের সংবাদ সঠিক। স্থানীয় চ্যানেলে এক মহিলা গম্ভীর মুখে পরিবেশন করছেন ছবি চুরির এপিসোড। নবীন তারকুণ্ডে আর সুখদেব ভাটিয়া নামে দুই ব্যক্তি নাকি সম্ভাব্য চোর। গোটা উপত্যকা জুড়ে খোঁজ চলছে ওই দুই ব্যক্তির। তল্লাশি করা হচ্ছে মান্ডিগামী এবং রোটাংগামী প্রতিটি যানবাহন। লোক দুটোর সন্ধান দিতে পারলে হিমাচল প্রদেশ সরকার পুরস্কার প্রদান করবে বলেও ঘোষণা করা হল।

টুপুর তারিফের সুরে বলল, এস পি সাহেব দারুণ প্রম্পট তো!

 পার্থ অবজ্ঞাভরে বলল, কিন্তু ব্রেনে ঘিলুটা একটু কম।

 কেন?

চুরির বিষয়টা জানানোই তো কাফি ছিল। সঙ্গে বড়জোর লোক দুটোর নাম আর অ্যাওয়ার্ড, ব্যস। পুলিশ কী অ্যাকশন নিচ্ছে, তা সর্বত্র চাউর করা তো বোকামি।

চোর সাবধান হয়ে যাবে বলছ?

অফ কোর্স। তারা আর গাড়িঘোড়া ধরবেই না। অন্য কোনও উপায়ে পালানোর তাল করবে।

কীভাবে? পায়ে হেঁটে? নাকি উড়ে? আকাশপথে? জানো কি, দুপুর বারোটার পরে কুলু থেকে আর কোনও প্লেন ছাড়ে না?

জানার প্রয়োজন নেই। তবে কাজটা যে উচিত হয়নি, এ আমি জোর গলায় বলব।

আমার কিন্তু উলটোটাই মনে হয়, এবার মিতিনের ঠোঁট নড়েছে, অ্যানাউন্সমেন্টে হয়তো সুফলই মিলবে।

কীরকম?

লোক দুটো যদি টিভি দেখে, আমার ধারণা, দেখবেই, তা হলে তাদের দু’তরফা বিপদ। ঘাপটি মেরে থাকতেও ভয় পাবে, দুম করে বেরিয়ে পড়ারও সাহস হবে না। এরকম মুহূর্তেই অপরাধীরা ভুলভাল কাজ করে বসে।

সবটাই কিন্তু নির্ভর করছে একটা অনুমানের উপর, টুপুর টুপুস মন্তব্য জুড়ল, আমরা ধরেই নিচ্ছি, লোক দুটো এখনও কুলু ভ্যালিতে আছে। অথচ প্রকৃতপক্ষে ওরা হয়তো বহু আগেই পগার পার।

অসম্ভব। কুলুর আশপাশে দুই মক্কেলকে থাকতেই হবে।

 কেন?

সে আর একটা অঙ্ক। আমি অলরেডি কষে রেখেছি, মিতিন ঠোঁট চেপে হাসল, দাঁড়া, আশুতোষ শাহকে একটা ফোন লাগাই।

মোবাইলে নম্বর খুঁজে টিপল মিতিন। ইচ্ছে করেই বুঝি মাইক্রোফোন অন করল, যাতে পার্থ টুপুর শুনতে পায়।

বারকয়েক রিং বাজার পর ওপারে আশুতোষের মার্জিত কণ্ঠস্বর, ইয়েস ম্যাডাম? পৌঁছে গিয়েছেন মানালি?

না মিস্টার শাহ। আজ আমরা নজ্ঞরে থাকাটাই মনস্থ করলাম, মিতিনের মুখ হাসিহাসি, হোটেলে এন্ট্রি নিয়েই আপনার কর্মকুশলতা দেখছি। টিভিতে জোর প্রচার চলছে তো!

হা হা। আমি আরও অনেক দূর এগিয়েছি। বৈজনাথ রাই এখন আমার সামনে। লোক দুটোর স্কেচ বানাচ্ছেন।

দ্যাটস গ্রেট! কেমন বুঝলেন বৈজনাথকে?

সম্ভবত ইনোসেন্ট। বাট নো প্র্যাকটিক্যাল সেন্স। শিল্পীরা যেমন হয় আর কী, আশুতোষ অল্প থেমে থেকে বললেন, কেসে আর একটা ব্রেক থ্রু হয়েছে ম্যাডাম। পাজি দুটো যে গাড়িতে কুলু থেকে বেরিয়েছিল, সেই মারুতি ভ্যানটিকে ট্রেস করা গিয়েছে।

তাই নাকি?

ওরা কুলু ছেড়ে সোজা মানালি গিয়েছিল। সেখানে উঠেছিল মানাল নদীর ধারে একটি গেস্টহাউসে। নাম, দা গোল্ডেন মুন।

জানলেন কী করে?

আরে, গাড়ির ড্রাইভার তো আমাদের জিম্মায়। মানালি থানায় জবানবন্দি দিয়েছে। তার বক্তব্য, লোক দুটো নাকি গেস্টহাউসে উঠেই গাড়ি ছেড়ে দিয়েছিল। লোকটার স্টেটমেন্টও আমি ক্রসচেক করে নিয়েছি গোল্ডেন মুনে টেলিফোন করে। ওখানকার ম্যানেজারই জানাল, গেস্টহাউসে ওরা নাকি মোটে একটা দিন ছিল। সোমবার দুপুরে লাঞ্চ সেরে মালপত্র নিয়ে বেরিয়ে যায়।

অন্য কোনও গাড়ি নিয়ে?

না। গাড়ি ছাড়াই। সঙ্গে নাকি বিশেষ মালপত্র ছিল না। জাস্ট দু’জনের দুটো হ্যাভারস্যাক আর দুটো হ্যান্ড-লাগেজ। এবার আমি পতা লাগাচ্ছি, ওরা মানালি থেকে অন্য কোনও গাড়ি নিয়েছিল কিনা।

চমৎকার! আপনি তো ঝড়ের গতিতে ছুটছেন!

হা হা হা।

চালিয়ে যান। গ্যালারির পাহারাদার প্রসাদের কী সমাচার?

কাস্টডিতে এনেছি। কুলুতে। বৈজনাথের স্কেচ আঁকা শেষ হোক, তারপর প্রসাদকে নিয়ে পড়ছি।

ছাড়ি তা হলে। মাঝে মাঝে ফোনে বিরক্ত করব কিন্তু।

আরে না। আপনি হলেন গিয়ে ডিটেকটিভ। মাঝে মাঝে আপনার কাছ থেকেও তো ইনপুট পেতে পারি।

থ্যাঙ্ক ইউ।

 টেলিফোনটা অফ করে একটুক্ষণ চোখ বুজে রইল মিতিন। ফের মোবাইলে আর একটা নম্বর টিপছে। আবার মাইক্রোফোন চালু। এবার অপর প্রান্তে বিভব শর্মা। হাউমাউ করছেন, আমার তো সর্বনাশ হয়ে গেল ম্যাডাম!

মিতিন নির্বিকার, কেন? কী হল?

আপনি কেন এস পি সাহেবকে আমার নাম্বার দিলেন ম্যাডাম? উনি তো আমাকে বহুত আঁখ দেখাচ্ছেন। প্রাইভেট কটেজ চালাই, পুলিশ নজর দিলে বেওসা চালাব কী করে? কাঁহা কাঁহাসে গেস্ট আসে আমার কটেজে, তাদের কে যে কেমন আমি কীভাবে জানব?

তা তো বটেই।

কিন্তু এস পি সাহেব তো ও কথা মানছেন না। রোয়েরিখ গ্যলারিতে কোন পেন্টিং চুরি হয়েছে, ওই তারকুণ্ডে আর ভাটিয়া নাকি কালপ্রিট। তা এতে আমার কী কসুর বলুন? অথচ এস পি সাহেব আমাকেও ওদের সঙ্গে জড়িয়ে দিতে চাইছেন। বিজনেস তো আমার চৌপাট হয়ে যাবে।

আহা, লোক দুটো ধরা পড়লেই তো আপনি…

পুলিশ কি আসলি ক্রিমিনালকে ধরতে পারে কখনও? তারা কোথায় ভেগেছে কৌন জানে! মাঝখান থেকে আমি ফালতু ফালতু… বিভব শর্মার স্বরে তীব্র ক্ষোভ, টাইমটাই আমার খারাপ যাচ্ছে। এমন একটা ভরা মরশুমে আমার কটেজ বিলকুল খালি!

দুঃখ করছেন কেন? কালই তো একজন আসছেন!

না ম্যাডাম। ওতেও গড়বড়। এই তো দুপুরে সাহেবের মেসেজ এল, ভিসা নিয়ে কী প্রবলেম বেধেছে, একদিন পর উনি দিল্লিতে নামছেন। অতএব কাল নয়, উনি কুলু আসবেন পরশু। ভাবুন, অলরেডি বুকিং ফিরিয়ে দিয়েছি, এখন কালও হোল-ডে যদি ফাঁকা যায়…।

 আফশোস করবেন না শর্মাজি। সব ঠিক হয়ে যাবে।

আপনি প্লিজ এস পি সাহেবকে একটু বলে দিন, আমি বুরা আদমি নই।

কী আশ্চর্য! আমি বললেই বা তিনি মানবেন কেন?

এস পি সাহেবের মুখে সব শুনেছি ম্যাডাম। আপনার পরিচয়, পেশা…। মনে হল, উনি আপনার কথাকে ওজন দেবেন, বিভব শর্মা ক্ষণিক চুপ থেকে বললেন, কিছু মনে করবেন না ম্যাডাম, আমার এই অপদস্থ হওয়ার পিছনে আপনারও কিছুটা দায়িত্ব আছে।

কীভাবে?

রুমে যে একটা পেনড্রাইভ পেয়েছিলেন, সেটা কি আমায় জানানো উচিত ছিল না? আমি তো ওটাকে থানায় জমা করতাম।

করতেন কি?

 চান্সই তো পেলাম না। নিজেকে প্রমাণ করব কী করে!

আর কথা না বাড়িয়ে মিতিন কুট করে লাইনটা কেটে দিল। পার্থ, টুপুর মন দিয়ে শুনছিল ফোনালাপ, ব্যঙ্গের সুরে পার্থ বলল, শর্মা একটু বেশি ঘ্যানঘ্যান করছেন না?

যা বলেছ, টুপুর সায় দিল, পেনড্রাইভ হাতে পাননি বলে কেন এত হাহুতাশ? তারকুণ্ডেদের সঙ্গে ওঁর যোগসাজশ থাকা মোটেই বিচিত্র নয় মিতিনমাসি৷

বিভব শর্মাকে একদম ভিলেন ঠাউরে ফেললি? মিতিন দু’দিকে মাথা নাড়ল, না রে, লোকটার একটাই গলদ। বড্ড লোভী। হয়তো তার জন্যই ওকে আরও সাফার করতে হবে।

শেষ বাক্যটি পুরোপুরি বোধগম্য হল না টুপুরের। আর কী দুর্ভোগ থাকতে পারে বিভব শর্মার?

.

০৮.

নজ্ঞরে আঁধার নেমেছে বহুক্ষণ। কুলুর মতো জমজমাট নয় নজ্ঞর, বরং সন্ধে হতেই চতুর্দিকে যেন কেমন ঘুমঘুম ভাব। অল্পস্বল্প দু’-চারজন টুরিস্ট ঘুরছে। ইতস্তত, সবই প্রায় শ্বেতাঙ্গ। বাজারে দোকানপাটেরও ঝাঁপ পড়ে গেল ঝপাঝপ। দূরে, খাড়া উত্তরে, এক পাহাড়ে টিপটিপ আলো। ওই জায়গাটার নাম নাকি জগৎসুখ। একদা ওখানেই নাকি রাজধানী ছিল কুলুরাজ্যের। নজ্ঞরেরও আগে।

গায়ে শাল জড়িয়ে হোটেলের কাচঘেরা বারান্দা থেকে পাহাড়টাকে দেখছিল টুপুর। বিরস মেজাজে। বিকেল থেকে সময়টা আজ বিচ্ছিরি কাটছে। টুপুরদের হোটেলে বসিয়ে রেখে কোথায় যে গায়েব হল মিতিনমাসি, এখনও তার পাত্তা নেই। গাড়িটাও নেয়নি, অর্থাৎ কাছেপিঠে আছে নির্ঘাত। আবার বোধহয় গ্যালারিতেই গিয়েছে, একে-ওকে-তাকে জেরা করছে। অথবা চুরির জায়গাতেই অনুসন্ধান চালাচ্ছে নতুন করে। টুপুরকে ছাড়াই। কোনও মানে হয়? মাঝখান থেকে টুপুরকে কিনা বেরোতে হল বাবা-মা-পার্থমেসোদের সঙ্গে। বড্ড নীরস ঘোরাঘুরি। বাবা তো সারাক্ষণ উরুসবতী মিউজিয়ামের গল্প শুনিয়ে গেলেন টুপুরকে। ওখানে নাকি শুধু শিল্পকলা নয়, বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণাও চলে। হিমালয়ের গাছপালা আর শিকড়বাকড় থেকে একসময় যে ওষুধ-বিষুধ তৈরি হত, তা নিয়ে নানা পরীক্ষা, বায়োকেমিস্ট্রি, জ্যোতির্বিজ্ঞান, আবহাওয়াবিজ্ঞান…। চমৎকার একখানা লাইব্রেরিও আছে নাকি সেখানে। পার্থমেসো তো আরও একপ্রস্থ গল্পের ঝাঁপি। ব্রিটিশরা নাকি কুলু উপত্যকার দখল নিয়েছিল মাত্র পৌনে দুশো বছর আগে। তারও পরে নজ্ঞরে অনেকটা জমিজমা কেনেন এক ব্রিটিশ কর্নেল। নাম রেনিক। তার হাতেই নাকি কুলুতে আপেল চাষের শুরু। রোয়েরিখ সাহেবের বাড়ি কাড়ি নাকি সেই কর্নেল সাহেবেরই বানানো। এক সময় মান্ডিরাজাকে সব বেচেবুচে দিয়ে রেনিক ইউরোপ চলে যান। রাজা বাড়িঘর দেখভাল করার ভার দেন আর এক সাহেবকে। তা সাহেবের কপাল মন্দ। তাঁরা স্বামী-স্ত্রী নাকি একই দিনে বিষাক্ত ব্যাঙের ছাতা খেয়ে মারা যান। তারও পরে আসেন রোয়েরিখরা। মান্ডিরাজার কাছ থেকে বাড়িঘর সমেত গোটা সম্পত্তিটা কিনে ফেলেন এবং ধীরে ধীরে তারা কুলুরই মানুষ বনে যান।

কিন্তু এত সব জেনে টুপুরের কী লাভ? মিতিনমাসি বলে, হাবিজাবি তথ্য ঢুকিয়ে মস্তিষ্ক ভারাক্রান্ত করিস না। তাতে দরকারের সময়ে আসল বিষয়টি খুঁজতে অসুবিধে হবে। রোয়েরিখদের বাড়ির ইতিহাস জেনে কি চোর ধরার ক্লু মিলবে? ফুঃ।

নজ্ঞরের চূড়ায় রাজা জগৎ সিংহের দুর্গ-কাম-প্রাসাদটা অবশ্য মন্দ লাগেনি টুপুরের। পাথরের দুর্গটায় পা রাখলেই কেমন গা ছমছম করে। প্রাসাদ থেকে নীচের উপত্যকার দৃশ্যও ভারী মায়াময়। আজ বিকেলে ওটুকুই যা টুপুরের প্রাপ্তি।

তারপর থেকে তো হোটেলে ফিরে ঠুটো জগন্নাথের মতো বসে থাকা। বাইরে নেমে যে একটু হাঁটবে টুপুর, তারও কি জো আছে? একে কনকনে ঠান্ডা, তায় শনশন হাওয়া! ভালই বেগ আছে বাতাসের, ছুরির মতো কেটে কেটে লাগে গায়ে। বোঝাই যায়, নজ্ঞর কুলুর চেয়ে অনেকটা উঁচুতে।

ভিতর থেকে হঠাৎ পার্থ ডাকছে, অ্যাই টুপুর! টুপুর!

টুপুর অনিচ্ছাভরে সাড়া দিল।

দেখে যা, কী আনিয়েছি। ঠান্ডা হয়ে যাবে, আয় চটপট।

রুমে ফিরে মুখচোখ সামান্য উজ্জ্বল হল টুপুরের। প্রকাণ্ড প্লেটে রাশিখানেক পেঁয়াজি আর আলুর চপ। মা খেতে আরম্ভ করেছেন, বুমবুম তুলব তুলব করছে, পার্থমেসোর মুখ চলছে কচকচ। একটা পেঁয়াজি তুলে কামড় দিল টুপুর। বসেছে সহেলির পাশে। ভুরু নাচিয়ে বলল, এই পাণ্ডববর্জিত জায়গায় এমন মুখরোচক খাদ্যবস্তু মিলল কোত্থেকে?

বইয়ে নিমগ্ন ছিলেন অবনী। তবু ঠিক শুনতে পেয়েছেন। ভারিক্কি গলায় বললেন, পাণ্ডবরা এই অঞ্চল এড়িয়ে গিয়েছেন, তাই বা বলি কী করে? লোকাল হিস্ট্রি অনুযায়ী মানালির জঙ্গলে হিড়িম্ব রাক্ষসকে মেরে তার বোন হিড়িম্বাকে বিয়ে করেছিলেন ভীম। শুধু তাই নয়, মহাভারতের এককাড়ি ঋষি এই লোকালিটিতে থাকতেন। এমনকী মহাভারতের লেখক বেদব্যাসও। ইনফ্যাক্ট, বিপাশা নদীর নামও…

আমি শুনতে চাই না। আমি শুনতে চাই না, সহেলি দু’কান চাপলেন, জ্ঞান বিতরণ থামিয়ে এবার আলুর চপ খাও তো।

খেপেছ? আপেলের দেশে এসে ওই সব কুখাদ্য গিলব? একে ভাজাভুজি, তায় কী তেল তার ঠিক নেই!

উঁহু। মেটিরিয়াল তেমন খারাপ নয়, পার্থ অবনীকে আশ্বস্ত করতে চাইল, আমি এই হোটেলের রন্ধনশালায় নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ভাজিয়েছি দাদা।

টুপুর তামাশা জুড়ল, তোমার তো হেভি ক্যালি!

অবশ্যই। রাতে কী মেনুর বন্দোবস্ত করলাম জানিস তো?

কী?

কষা মুরগি, হাতে গড়া রুটি, পাঁপড়, চাটনি, আচার। ব্রয়লার নয়, বিশুদ্ধ কুলু চিকেন।

টুপুর উল্লাসধ্বনি করতে যাচ্ছিল, তখনই মঞ্চে মিতিন। ঘরে ঢুকেই হালকা সুরে বলল, বাহ, দিব্যি সাঁটাচ্ছ তো তোমরা!

প্রায় চেঁচিয়ে উঠে টুপুর বলল, ছিলে কোথায় এতক্ষণ?

বলছি বলছি। আগে পেটে একটু দানাপানি পুরি। প্রচুর হেঁটেছি, হাই ডোজের ক্যালরি চাই এখন।

কাঁধের ব্যাগ টেবিলে রেখে নির্বিকার মুখে চপ খাচ্ছে মিতিন। তর সইছিল না টুপুরের, ছটফট করছে। ফের বলল, কোথায় গিয়েছিলে, জানাতে আপত্তি আছে নাকি?

আদৌ না, মিতিন মিটিমিটি হাসছে, এখানেই এদিক-ওদিক করছিলাম। দু-চারজনের সঙ্গে কথাও বলতে হল।

অভিযানটা কি খুবই গোপনীয়?

সঙ্গে নিইনি বলে বড় চটে আছিস দেখছি। ওরে বোকা, কোথাও কোথাও আমায় একাই ছুটতে হয়। ওতে মুভমেন্টটা ইচ্ছেমতো করা যায় রে।

পার্থ বলল, ভাঁজ না মেরে পয়েন্টে এসো। পাক্কা সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা কোন রাজকার্যে ছিলে, অ্যাঁ?

একের পর এক সূত্র জোগাড় করলাম। এবার তাদের জোড়া লাগাব।

 যেমন?

 বিশদেই বলি তা হলে। অবনীদা, বোর হবেন না কিন্তু, মিতিন গুছিয়ে বসল, দুপুর থেকে আমায় একটা প্রশ্ন তাড়া করছিল। লোক দুটো কীভাবে পরপর স্টেপ ফেলেছে? কুলু থেকে মানালি পৌঁছে তারা তো গাড়ি ছেড়ে দিল। তারপর কী করল? তারপর কী করল?

ভেবে কিছু পেলে?

একটা আউটলাইন খাড়া করলাম। আমার যুক্তি বলল, লোক দুটো নিশ্চয়ই আর গাড়িভাড়া করবে না। কারণ, ড্রাইভারসহ গাড়ি সব সময়ই একটা প্রত্যক্ষ প্রমাণ হিসেবে থেকে যাবে। অতএব তারা নজ্ঞর আসার জন্য মানালি থেকে নির্ঘাত বাস ধরেছে। মানালি থেকে নজ্ঞরে লাস্ট বাস আসে রাত আটটায়।

টুপুর বলল, তারকুণ্ডেরা আটটার সময় নজ্ঞরে পৌঁছে গিয়েছিল?

সম্ভবত।

কিন্তু চুরি তো হয়েছে গভীর রাতে! সেই দুটো-তিনটেয়!

কারেক্ট। এই ছ’-সাত ঘণ্টা তারা তা হলে ছিল কোনখানে? নজ্ঞরের পথে পথে তো নিশ্চয়ই ঘোরেনি! অথচ তারা নজ্ঞরেই ছিল! কীভাবে তা সম্ভব?

তুমিই বলো।

তারা যদি এমন কোনও ভেক ধরে, যাতে লোকজনের চোখে পড়লেও সন্দেহ না জাগে! এক্ষেত্রে ট্রেকার সাজা সবচেয়ে সোজা। পিঠে একটা হ্যাভারস্যাক থাকলেই যথেষ্ট। সঙ্গে টুপি, গ্লাভস, লাঠি। হ্যাভারস্যাকে ট্রেকিং-এর সরঞ্জাম আছে, না ডাকাতির, তা কে আর বুঝছে!

তেমন কোনও ছদ্মবেশীর সন্ধান পেলে?

নিখুঁত ভাবে কেউ বলতে পারল না। তবে এখানে একটা ধাবা সাড়ে দশটা পর্যন্ত খোলা থাকে। সেখানে দু’জন শিখ নাকি আহার সেরেছিল এবং তাদের পোশাক-আশাক দেখে ট্রেকারই মনে হচ্ছিল।

তারকুণ্ডেরা সর্দারজি সেজেছিল?

 হ্যাঁ। এনকোয়্যারির পরের ধাপে সেটাই প্রমাণিত হয়েছে।

 কীরকম?

আসছি সে প্রসঙ্গে। ধাপে ধাপে, মিতিন আর একখানা পেঁয়াজি তুলল প্লেট থেকে। চিবোতে চিবোতে বলল, রাতের খাওয়া সেরে তারকুণ্ডে আর ভাটিয়া পাড়ি জমাল গ্যালারিতে। সামনে দিয়ে ঢুকল না, নীচের সমাধিস্থল থেকে উঠে এল উপরে, বাড়ির পিছনে। সিকিওরিটি গার্ড প্রসাদকে ওরা আগেই হাত করে রেখেছিল।

কেমন করে শিয়ের হলে?

কারণ, টেনে হিঁচড়ে ঝোপ অবধি নিয়ে যাওয়ার গল্পটা বানানো। যেখানে প্রসাদ পড়েছিল, তার আশপাশে এমন কোনও চিহ্ন পাইনি, যা দেখে মনে হয় লোকটাকে হিঁচড়োতে হিঁচড়োতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তা ছাড়া ভেবে দ্যাখ, লোকটা কিন্তু খাদের ধারে ছিল, অথচ খাদে পড়েনি! অর্থাৎ হাত-মুখ বাঁধার ঘটনাটা পুরো সাজানো। ঝোপে তাকে রাখাও হয়েছে সাবধানে, মিতিন সামান্য দম নিয়ে ফের বলল, তবে হ্যাঁ, প্রসাদ কিন্তু নাটকটার জন্য সাংঘাতিক কিছু পয়সাকড়ি পায়নি। হয়তো দু-চারশো, বা বড়জোর হাজার। এবং যে ছবিগুলো বদল হতে চলেছে, তাদের প্রকৃত মূল্য সম্পর্কে প্রসাদের এখনও কোনও আন্দাজ নেই।

বুঝলাম। লোকটা বোকা পাপী।

কতকটা তাই। এ ছাড়া লোকটাকে তারকুণ্ডেরা ভয় দেখিয়েও থাকতে পারে। হয়তো প্রসাদ ভেবেছে, বাধা দিলেও তো প্রাণের আশঙ্কা, তার চেয়ে বরং ক’টা টাকা নিয়ে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় নয় পড়েই থাকি। আমার বিশ্বাস, পুলিশের রুলের গুঁতোয় তার মুখ থেকে সত্যিটা এতক্ষণে বেরিয়েও গিয়েছে।

মিস্টার শাহকে ফোন করে তা হলে জেনে নাও।

কোনও প্রয়োজন নেই। কারণ, এই ডিডাকশানের ভুল-ঠিকে কিছু যায় আসে না, মিতিন মৃদু হাসল, এবার আমি পরের ধাপে। চুরির পর তারকুণ্ডেরা গেল কোথায়?

পার্থ বিজ্ঞের সুরে বলল, নজ্ঞর-কুলুর ত্রিসীমানা ছেড়ে পালাবে, এটাই স্বাভাবিক।

হ্যাঁ। যদি তারা নিজেদের জন্য চুরি করে। আই মিন, তারা নিজেরা যদি ছবি তিনটে বেচার প্ল্যান করে থাকে।

নিজেরাও সংগ্রহে রাখতে পারে।

নো চান্স। ওই ছবি যারা কালেকশানে রাখে, তারা মারুতিভ্যান ভাড়া করে না। তারা অনেক রইস হয়।

ওরা তো কুলুতে রইসি চালেই ছিল!

কারণ, তাদের কেউ একজন ওভাবে থাকতে বলেছিল। ভিড়ভাট্টা থেকে দূরে। নির্জনে। এবং বিভব শর্মারই কটেজে।

কেন? কেন? কেন?

সব কেনর জবাব এক্ষুনি মিলবে না স্যার। শুধু এটুকু জেনে রাখো, এত দামি ছবি ছুটকো-ছাটকা ক্রিমিনালরা মার্কেটে বেচতে পারে না।

কেন পারে না?

কারণ, তাদের সেই বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। যারা এই ধরনের ছবি কেনে, ওরা নিয়ে গেলে ছবিগুলোকে আসল বলে মানবেই না। ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটে নামীদামি পেন্টারের অরিজিনাল ছবি কেনাবেচার জন্য আলাদা কিসিমের চিড়িয়া থাকে। তারকুণ্ডে আর ভাটিয়া ওই রকমই এক মক্কেলের হয়ে কাজটা করেছে।

কে সে?

পরে জেনো। যাই হোক, আবার তারকুণ্ডে-ভাটিয়ায় ফিরি। মেঘের আড়ালের মেঘনাদটির হাতে চুরির জিনিস তুলে দিতে হবে বলেই কুলু ভ্যালিতে থেকে যেতে হয়েছে জোড়া বজ্জাতকে। কিন্তু কোথায় তারা থাকতে পারে? কুলুতে যাওয়ার ঝকমারি আছে। যে-কোনও মুহূর্তে বৈজনাথের মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা। তা ছাড়া কুলুতে এখন যা ভিড়, হোটেল পাওয়ার সম্ভাবনাও কম।

আশ্চর্য, বিভব শর্মার কটেজেই তো উঠতে পারে!

দুটো অসুবিধে। এক, যদি ছবি বদল ধরা পড়ে যায়, তা হলে তো পেনড্রাইভটি দেখে বিভব শৰ্মাই ওদের পুলিশের হাতে তুলে দেবেন। দ্বিতীয় ঝামেলা, স্বয়ং বৈজনাথ। যিনি ছবির কপি করেছেন, কিন্তু পুরো টাকা পাননি।

তা বটে। ছ্যাঁচড়া অপরাধীদের এটাই হচ্ছে মুশকিল, এমন কিছু কিছু গন্ডগোল পাকিয়ে ফেলে!

অবনী অনেকক্ষণ বই মুড়ে রেখেছেন। মন দিয়ে শুনছিলেন আলোচনা। খানিকটা অধৈর্য ভাবে বলে উঠলেন, বুঝেছি বুঝেছি। তারা কুলুতেও যাবে না, নজ্ঞরেও থাকবে না। তা হলে যাবে কোথায়?

এটাই মিলিয়ন ডলার কোয়েশ্চেন, মিতিন গালে আঙুলের টোকা দিল, আমার মন বলছিল, কুলু, নজ্ঞর, মানালি, কোথাও না গিয়ে চতুর্থ একটা জায়গা বেছে নেবে। যেখানে রাত্তিরেই বা কাকভোরে তাদের পক্ষে পৌঁছোনো সম্ভব। কোনও যানবাহন ছাড়াই।

কোথায় সেটা?

কাছাকাছির মধ্যে কাতরেইন আছে। যেখানে হোটেল টোটেল পাওয়া যায়। ব্যস, মনে হওয়া মাত্র চলে গেলাম কাতরেইন।

সে তো সাত-আট কিলোমিটার দূর! গেলে কীভাবে? তুমি তো গাড়িও নাওনি? পায়ে হেঁটে?

পাহাড়ি রাস্তায় অতটা হাঁটা কি সহজ কথা! একটা অটো ধরে নিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি, কাতরেইনে হোটেল খুব বেশি নেই। যেতে যেতে ভাবছিলাম, ওরা যদি হেঁটে কাতরেইন গিয়ে থাকে, তা হলে নিশ্চয়ই শর্টকাট রুটটা ধরেছে। কিন্তু তার জন্য তো পাথর বেয়ে বেয়ে বিপাশা পেরোতে হয়। আমি বিপাশার নিয়ারেস্ট হোটেলটাতেই প্রথমে খোঁজ নিলাম। এবং কী কপাল, লেগেও গেল।

মানে? ওখানে পেলে লোক দুটোকে?

উঁহু। পাখি উড়ে গিয়েছে। শুধু জানা গেল, দুই সর্দারজি ট্রেকার ভোর চারটেয় এসেছিল হোটেলটায়। তারা নাকি কুলু ভ্যালিতে হিচহাইকিং করে বেড়াচ্ছে। হেঁটে হেঁটেই নাকি তারা হিমালয়ের এই অঞ্চলটা চষে ফেলবে।

কী গুলবাজ রে বাবা! সহেলি আর নীরব শ্রোতা হয়ে থাকতে পারলেন না, চোখ বড় বড় করে বললেন, জিভে মিথ্যে কথার খই ফোটে!

চোর-ডাকাতরা সত্যবাদী যুধিষ্ঠির হলে পুলিশ ডিপার্টমেন্ট তো আর থাকত না রে দিদি। আমাকেও বসে বসে আঙুল চুষতে হত।

টুপুর অধীর হয়ে বলল, আহা, আসল খবরটা শোনাও না। ওরা কখন কাতরেইন ছেড়েছে? সকালেই?

তা হলে কি আগাম টাকা দিয়ে হোটেলে উঠত? আর পাঁচটা হিচ হাইকারের মতো পথের ধারেই বসে থাকত দু’জনে, মিতিন কেটে কেটে বলল, তারা হোটেল থেকে ভেগেছে বিকেল সাড়ে তিনটেয়।

পার্থ বলল, অর্থাৎ টিভিতে ঘোষণা শুরু হওয়ার পর?

ইয়েস স্যার। টিভি দেখে ওরা নিশ্চয়ই নার্ভাস হয়ে পড়েছিল এবং বোধহয় তাদের নাটের গুরুর সঙ্গে যোগাযোগও করে এবং তার নির্দেশ অনুসারেই তড়িঘড়ি ওই পলায়ন, মিতিন গাল ছড়িয়ে হাসল, শুনে খুশি হবে, ওরা কোথায় যাচ্ছে তাও বলে গিয়েছে হোটেল-মালিককে।

পার্থ, টুপুরের গলা কোরাসে বেজে উঠল, কোথায়?

মানালি। যাওয়ার আগে নাকি একটা হোটেলের নাম-ধামও বলেছে। সস্তার জায়গা। শিবালিক লজ।

এ তো দারুণ খবর রে! সহেলির হাসি আর ধরে না, চল, আমরাও তা হলে কাল সকালে মানালি রওনা দিই।

অবনী বললেন, না। আগে পুলিশকে জানাও। পুলিশ ক্যাঁক করে ধরুক, তারপর নয় তুমি সিনে হাজির হোয়ো৷

আমি একটা অন্য প্রস্তাব দেব, অবনীদা? মিতিনের হাসি চওড়া হল, শুনলেই অবশ্য দিদি ফায়ার হয়ে যাবে।

কী?

আমরা বরং কাল আবার কুলুতেই যাই।

সহেলি চেঁচিয়ে উঠলেন, কেন?

কারণ, ওরা মানালি যায়নি। পুলিশকে মিসলিড করার জন্য মানালির কথা বলেছে, মিতিনের স্বর দৃঢ় হল, ওরা কুলুর আশপাশে থাকবে। থাকতেই হবে। অন্তত কালকের দিনটা।