০৩. মৌন ব্রতভঙ্গের পাপমোচন

০৩. মৌন ব্রতভঙ্গের পাপমোচন

পরম ধার্মিক রাজা শতধনু পুত্রসম রাজ্য শাসন করেন। রাজ্যে অরাজকতা নেই, তাকে সকলেই সম্মান করে। রাজা হলে কি হবে, তিনি অধিকাংশ সময়টাই পূজার্চনা, নামজপ নিয়েই থাকেন। নিষ্ঠার সঙ্গে বার-ব্রত করেন, উপবাস করেন। রাজমহিষী শৈব্যাও পতির মতই সেবাপরায়ণা। দেবতা ও ব্রাহ্মণগণে তার ভক্তি অটুট।

কার্তিক পূর্ণিমা–এই মহা তিথিতে রাজা রানি দুজনেই মৌনব্রত ও উপবাস করে গঙ্গাস্নান করলেন। তারপর গঙ্গাতীরে উঠে দেখেন পরিচিত একজন দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর সঙ্গে কথা না বললে, তিনি কি মনে করবেন, তাই বাধ্য হয়েই রাজা মৌনব্রত ভঙ্গ করলেন– তাঁর সঙ্গে কথা বলে। কিন্তু রানি সূর্যের স্তব করতে করতে সূর্যের দিকে তাকিয়ে চলে গেলেন। মৌনভঙ্গে রাজার মনে শান্তি নেই। দীর্ঘকাল ধরে এই ব্রত করে আসছেন, কিন্তু আজ তার ব্যাতিক্রম হল। কি আর করবেন–ফিরে গেলেন প্রাসাদে, তারপর যা করণীয় সকলই যথানিয়মে নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করলেন। তারপর দীর্ঘকাল রাজত্ব করার পর বৃদ্ধকালে পরলোকে গেলেন রাজা। মহিষী শৈব্যাও চিতার ওপর সহমৃতা হলেন।

বহুকাল পরে কাশীর রাজকন্যারূপে জন্ম হল রানি শৈব্যার। তাঁর রূপে কাশীরাজের প্রাসাদ হল আলোকিত। রাজা ও রানির মনে খুব আনন্দ হতে লাগল। ধীরে ধীরে রাজকন্যা বড় হল। বাল্যকালে আর পাঁচজনের মত নয় সেই কন্যা। সাধারণ খেলাধূলা নেই, কেবল ঠাকুর দেবতা নিয়েই তার খেলা। নিজের মনের খেয়ালেই থাকে। তার দেব দ্বিজে ভক্তি দেখে রাজা-রানি সহ সকলেই অবাক। এতটুকু মেয়েকে কে শেখাল এমন করে? কেউ ভেবে পায় না।

ক্রমে ক্রমে রাজকন্যার বিয়ের বয়স হল। কাশীরাজ চিন্তিত হলেন। এমন সুন্দরী গুণবতী কন্যার উপযুক্ত রাজপুত্র চাই।

রাজাকে চিন্তিত দেখে মেয়ে জিজ্ঞাসা করল- বাবা, তুমি চিন্তিত কেন? আমার মনে হয় তুমি আমার জন্য পাত্রের সন্ধান করছ? কিন্তু আমার যিনি স্বামী হবেন, আমি তাঁকে চিনি। যথাসময়ে আমাদের বিয়ে হবে, এ বিষয়ে চিন্তা করার দরকার নেই।

মেয়ের কথা শুনে রাজা অবাক। লক্ষ্মীর প্রতিমা এই মেয়ে কেমন করে নিজেই ঠিক করবে নিজের পাত্র, ভেবে পান না তিনি। এখন মেয়ের কথামত চিন্তা না করাই ভালো। যখন যা হবার তা ভগবানই করবেন। তাছাড়া মেয়ে যেভাবে ব্রত করছে, তাতে তার কোনো অমঙ্গল হবে না।

পূর্বজন্মে বিষ্ণুভক্তি ছিল বলে সেই কন্যা এখন জাতিস্মর। পতির কারণে ধ্যানে নিজমন জানতে পারল–পূর্বজন্মে তাঁর স্বামী ছিলেন রাজা শতধনু। কিন্তু একটি বিশেষ দুষ্কর্মের ফলে তিনি কুকুর যোনিতে জন্ম নিয়েছেন। এখন বৈদিশপুরে আছেন, মা-বাবার অনুমতি নিয়ে শৈব্যা চলে গেলেন সেখানে। কুকুর দেখে কন্যা চিনতে পারত পতিকে। বন্দনা করেন ভক্তি ভরে, প্রসাদসহ নানা খাদ্য খাওয়াল তাকে। কুকুরেরা অতি অনুগত স্বভাবত। আহার পেলে তোষামোদ করে।

কুকুররূপী স্বামীকে রাজকন্যা কেঁদে কেঁদে বলল- হে স্বামী, পূর্বজন্মের কথা কী তোমার মনে পড়ে না? একদিন আমরা মৌনব্রত করে গঙ্গায় স্নান করতে যাই। তোমার গুরুর সখা পাষণ্ড একজন, তার সঙ্গে তুমি ব্রত ভঙ্গ করে সম্ভাষণ করেছিলে। তাতে মৌনভঙ্গ হল। সেই দোষে কুকুর জন্ম হল তোমার। কত দুর্দশা ভোগ করেছ। মহারাজ এ সব কি তোমার মনে পড়ে না? শান্ত হয়ে মনে চিন্তা কর। সব জানতে পারবে।

তখন কুকুর জন্মের কারণ বুঝতে পেরে। রাজা মনের আগুনে জ্বলতে লাগলেন। বহু দুঃখ পেলেন মনে। তারপর যে গৃহে এতদিন বাস করতেন সেই গৃহ থেকে বেরিয়ে একটা গিরিশৃঙ্গের উপরে উঠে ঝাঁপ দিল।

তারপর সেই রাজার জন্ম হল শৃগাল যোনিতে। কাশীর রাজকন্যা ধ্যানযোগে জানতে পারলেন। চললেন কোলাহল পর্বতে। দেখলেন– শৃগাল রূপে তাঁর স্বামী ঘুরে বেড়াচ্ছে। মনে দুঃখ ভরে তাঁর কাছে গিয়ে বললেন– হে নাথ, তুমি জন্মান্তরে পৃথিবীর রাজা ছিলে, তোমার কী মনে পড়ে না, ব্ৰতহেতু গিয়েছিলে তুমি স্নান করতে ভাগীরথীতে, সেখানে পাষণ্ডীসনের সাথে কথা বললে সেই পাপে তোমার কুকুর জন্ম। এখন পেলে শৃগাল যোনি। মনে মনে চিন্তা কর- সকল কথা বুঝতে পারবে।

পত্নীর এমন বাক্য শুনে নৃপতির সব মনে পড়ল। সেই চিন্তা করে অনাহারে নিজের প্রাণ ত্যাগ করলেন।

তারপর সেই রাজার জন্ম হল নেকড়ে বাঘ যোনিতে। রাজকন্যা তাঁর কাছে গিয়ে সব জানালো, রাজা সব স্মরণ করে সেই দেহ ত্যাগ করে পরবর্তী জন্মে শকুন দেহ লাভ করল। এভাবে কাক, তারপর ময়ুর জন্ম লাভ করল। রাজকন্যা সকলকে একথা জানাল।

নানান খাদ্য দান করে ময়ূরটিকে যত্নে রাখেন রাজকন্যা শৈব্যা।

এইভাবে কিছুদিন কাটল, তারপর একদিন শুনলো রাজর্ষি জনক এখন যজ্ঞ করছেন। রাজকন্যা ময়ূরকে নিয়ে সেই যজ্ঞে গিয়ে ময়ূরকে স্নান করিয়ে নিজেও স্নান করলো। স্বামীকে পূর্বের কথা মনে করাতে রাজার মনে দুঃখ হল। তারপর সেই ময়ূর যজ্ঞাগারেই দেহত্যাগ করল। রাজকন্যা ফিরে গেল কাশীরাজপুরে।

কিছুকাল পরে সেই রাজা শতধনু রাজপুত্ররূপে জন্ম নিল জনকের ঘরে। অপূর্ব শিশু হয়ে সকলের মনোরঞ্জন করতে লাগল। নানান বিদ্যায় পারদর্শী হলেন, তারপর এল যৌবনকাল।

পাষণ্ডীর সঙ্গে আলাপ করে মৌনব্রত ভঙ্গ করার ফলে রাজা শতধনু বহুবার নীচযোনি লাভ করেছেন। এতদিনে ব্রতভঙ্গ পাপের মোচন হল।

এদিকে কাশীরাজকন্যা পিতাকে বললো–বাবা, এবার আমার বিবাহের ব্যবস্থা কর। স্বয়ম্বর সভার আয়োজন কর। দেশবিদেশের সকল রাজা ও রাজপুত্রদের আহ্বান কর।

কাশীরাজ সকল ব্যবস্থা করলেন। সকলে উপস্থিত হলেন এমনকি পূর্বজন্মে যিনি শৈব্যোর পতি ছিলেন সেই শতধনু যিনি এখন জনক রাজার পুত্র; তিনিও উপস্থিত হলেন।

নানা রত্নে ও আভরণে সজ্জিত হয়ে কাশীরাজকন্যা সেই জনকপুত্রের গলায় বরমালা পরিয়ে নিজের পূর্ব জন্মের পরিচয় দিলো। এইভাবে পুনরায় নিজের পতিকে লাভ করে কাশীরাজকন্যা খুব আনন্দিত।

কিছুদিন পরে জনকরাজার মৃত্যু হল, শতধনু রাজা হলেন।

দশ যজ্ঞাদি করলেন, পুত্র জন্মাল, সুখে থাকতে লাগলেন।