১. বিদ্রোহের কারণ-বীজ

বিদ্রোহের কারণ-বীজ

১৮৫৭ সালে সমগ্র হিন্দুস্থানের সেপাইরা বিদেশী ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে মেতে উঠেছিল। এর কারণ কি?

এই সেপাইদের তপ্ত রক্ত বিসর্জনেই তো কলকাতা থেকে পেশোয়র পর্যন্ত কোম্পানীর রাজত্ব বিস্তৃত হয়েছে। এই সেপাইরাই তো ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পর থেকে একের পর এক রাজ্য জয় করে, আসমুদ্র হিমাচলব্যাপী বিরাট ভূখণ্ডের অধীশ্বর করেছে বেনিয়া ব্রিটিশ কোম্পানীকে। হঠাৎ করে তারা এমন করে দাবানলের মত ক্ষেপে উঠলো কেনো? কোন সে কারণ, যা ইংরেজভক্ত সেপাইদেরকে এমন ব্যাপক প্রচণ্ড বিদ্রোহে উদ্দীপিত করেছিলো।

একবাক্যে সকলেই বলবেন, চর্বি মাখানো টোটার প্রবর্তনই বিদ্রোহের সাক্ষাৎ এবং প্রত্যক্ষ কারণ। তাতো বটেই। কিন্তু এতো বড় একটি বিদ্রোহ যা দমন করতে ইংরেজের মতো একটি বিরাট শক্তিকেও এতো হিমশিম খেতে হয়েছে শুধুমাত্র টোটার মতো সামান্য একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে অমন বিরাট একটি বিদ্রোহ তো সংঘটিত হওয়ার কথা নয়।

এই বিদ্রোহের পেছনে সংগুপ্ত ছিলো আরো অনেক কারণ। সেগুলো দীর্ঘদিন ধরে গোপনে গোপনে শক্তি সঞ্চয় করে আসছিলো। অবশেষে অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়ালো যে, সেপাইরা কোম্পানী রাজের উপর বিশ্বাসের রেশটুকুও হারাতে বাধ্য হলো। তারা নিজেদের মধ্যে কানাঘুষা করতে লাগলো। এতোদিন ধরে বৃথাই আমরা রক্ত ঢেলেছি, বৃথাই ইংরেজ রাজ্য বিস্তারের জন্য মরণপণ সংগ্রাম করেছি। বিনিময়ে আমাদের কি দিয়েছে ইংরেজ? তারা আমাদের দেশের দেশীয় রাজ্যগুলো একের পর এক গ্রাস করে চলেছে। রাজন্যবর্গের সম্মান ধরে টান দিয়েছে। সাধারণ মানুষের দুঃখ দুর্দশার সীমা নেই। চৌকিদারির ট্যাক্স চার পাঁচ গুণ বৃদ্ধি করেছে। আগে বাদশাহী আমলে খাজনার দাবি যেখানে ছিল দু’শ টাকা ইংরেজ আমলে তা তিনশ করা হয়েছে। চার’শ টাকা খাজনার স্থলে পাঁচ’শ ধার্য করা হয়েছে। তারপরেও তো কোম্পানী বাহাদুরের খাই মেটে না। তারা এক জেলা থেকে অন্য জেলায় কাজের তালাশে গমনকারী লোকদের ওপর মাথাপিছু ছ’পয়সা করে কর ধার্য করলো। জেলায় সীমানা অতিক্রম করার সময় প্রতিটি গরুর গাড়ি পিছু চার থেকে ছ’আনা কর দিতে হতো ব্যবসায়ীদের। পুরনো সম্ভান্তশ্রেণীর লোকদের আয় একেবারে কমে এলো। এতেই শেষ নয়, কোম্পানীর লোকেরা তাদেরকে দিয়ে চর্বি মেশানো টোটা ব্যবহার করিয়ে পিতৃপুরুষের ধর্ম নাশ করতে চায়। পেটের দায়ে কোম্পানী বাহাদুরের চাকুরি করে বটে কিন্তু ধর্ম তো তাদের প্রাণের চেয়ে কম প্রিয় নয়। বিদেশী শাসকগোষ্ঠির কোন নির্দেশেই তারা ধর্মীয় অনুশাসনের সামান্য খেলাপ করেও পরকাল ঝরঝরে করতে প্রস্তুত নয়। এমন কি প্রাণ গেলেও না। এ ব্যাপারে দিল্লীর সম্রাট লখনৌর ওয়ালী এবং পেশোবার উওরাধিকারীরা তাদের সঙ্গে একমত।

ইংরেজরা কিন্তু সেপাইদেরকে আহত করতে চায়নি। তলোয়ার এবং কূটকৌশলের বলেই ইংরেজ কোম্পানী হিন্দুস্থানের একচ্ছত্র অধিপতি হিসেবে পাকাঁপোক্ত হয়ে বসেছে। কিন্তু তারা এটাও জানতো যে শুধুমাত্র তলোয়ারের ওপর নির্ভর করে চিরকাল হিন্দুস্থান শাসন করা যাবে না। আবার তাদের বিশ্বাস, স্থির বিশ্বাস, জাত হিসেবে তারা হিন্দুস্থানীদের তুলনায় শিক্ষা-দীক্ষা, শিল্প-সংস্কৃতি, বিজ্ঞান-দর্শন এবং রাজ্যশাসন বিষয়ে অনেক উন্নততরো জাতি। প্রাচ্যের অশিক্ষিত সভ্যতা সংস্কৃতিহীন মানুষদের প্রতীচীর সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগী করে তোলার অল্প বিস্তর ইচ্ছাও তাদের মধ্যে ছিলো। ইংরেজরা তাদের দৃষ্টিভঙ্গী অনুসারে এদেশের জনসাধারণকে উন্নত করতে আগ্রহী ছিলো না এ কথাও সর্বাংশে সত্য নয়।

শাসক এবং শাসিতের দৃষ্টিভঙ্গী কিছুতেই এক হতে পারে না। এই দৃষ্টিভঙ্গীর পার্থক্যের কারণে ইংরেজের ভালো কাজগুলোও এদেশবাসীর দৃষ্টিতে খারাপ ঠেকলো। ইংরেজকৃত সামাজিক সংস্কারগুলোকে এদেশের হিন্দু-মুসলমান তাদের খৃস্টানে পরিণত করার দুরভিসন্ধি মনে করলো।

আগের স্বৈরাচারী শাসনের স্থলে ইংরেজ এক ধরনের আইনের শাসন কায়েম করেছিলো। কিন্তু অবস্থার বৈগুণ্যে ইংরেজের সমস্ত ভালো কাজই বিষময় ফল প্রসব করলো।

ইংরেজরা ভুল করেছিলো। একটি ভিন্ন দেশের প্রায় অচেনা অধিবাসীদের সামাজিক রীতিনীতি এবং ধর্মীয় সংস্কারের প্রতি তাদের আত্যন্তিক আগ্রহ পরবর্তীকালে চরম বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে। সংস্কার করতে গিয়ে কোনটা প্রয়োজনীয়, কোনটা অপ্রয়োজনীয় অতোটুকু বাছবিচার করার সময় ইংরেজদের ছিলো না। তাতে করে হিন্দুস্থানের জনসাধারণের মধ্যে ইংরেজের বিরুদ্ধে বিদ্বেষের অনলই দাউ দাউ করে জ্বলে উঠছে।

১৮০৬ সালে স্যার জর্জ বার্লো নামে এক নিরীহ ভদ্রলোক ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ভারতের গভর্ণর জেনারেল। সে সময়েই সেপাইদের মধ্যে সর্বপ্রথম ধর্মীয় বিক্ষোভের সূচনা। তখন তিনটা প্রেসিডেন্সীর প্রত্যেকটিই সামরিক দিক দিয়ে স্বাধীন ছিলো। মাদ্রাজের ইংরেজ অফিসারদের মাথায় একটা নতুন ভাবনা এলো-সেপাইদের শুধু কাজে চটপটে হলে তো চলবে না, দেখতেও তাদের চটপটে হতে হবে। বাস হুকুম জারি হয়ে হয়ে গেলো। হিন্দু সেপাইরা কপালের গোত্রচিহ্ন মুছে ফেলো, মুসলমান সেপাইরা লম্বা দাড়ি কেটে ফেলো। আর গোঁফ রাখতে চাও তো তাহলে কেটেছেটে ছুঁচোলো করে রাখো। ইংরেজ কর্তারা দাড়ি, গোঁফ, তিলক সংস্কারের নির্দেশ দিয়ে ক্ষান্ত হলেন না। বলা হলো, কাপড়ের পাগড়ী বদলে পরতে হবে চর্মনির্মিত মস্তকাবরণ। তাতে থাকবে একটি থোবা। তবেই তো দেখাবে সেপাইর মতো।

আজকের দিনের দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে দেখলে এসব সংস্কারকে কিছুই মনে হবে না। কিন্তু আজ থেকে একশো পঞ্চাশ বছর আগে এদেশের হিন্দু মুসলমানের দৃষ্টিভঙ্গী ছিলো সম্পূর্ণ আলাদা। সেপাইদের মনে ইংরেজদের প্রতি বিদ্বেষ ফেনিয়ে উঠলো। বিদেশী ইংরেজ তাদের চালচলন রীতিনীতি সবকিছু এদেশের হিন্দু-মুসলমানের কাছে ছিলো দুর্বোধ্য। মুসলমানদের দাড়ি রাখা ধর্মীয় কর্তব্য। হিন্দুদের কাছে কপালে গোত্রচিহ্ন ধারণ করাও কম পবিত্র নয়। তদুপরি কাপড়ের পাগড়ীর বদলে চর্মনির্মিত মস্তকাবরণ পরিধান করা। সে চামড়া গরুর কি শূয়রের কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। তার চাইতে হীন কাজ আর পৃথিবীতে নেই। ও যদি মাথায় একবার পরে, তাহলে ধর্ম হারাবে, জাত হারাবে, পরকাল হারাবে। আত্মীয়স্বজনেরা কেউ সমাজে গ্রহণ করবে না। একি আপদ! এর চেয়ে বরং মরণ অধিক শ্রেয়।

ইংরেজেরা শাসক গোষ্ঠি। এসব ভাবনা তারা ভাববে কেননা । নির্দেশ মাত্রই নির্দেশ। দাড়ি রাখলে ভালো দেখায় না, দাড়ি কেটে ফেলো, গোত্র-তিলক মুছে ফেলো। এমন ভালো কাজটা করতে যে কেননা আপত্তি করবে, ইংরেজ অফিসারেরা এ কথা চিন্তা করতে পারে না।

এদিকে সেপাইরা মনে করলো শাসকদের মনে নিশ্চয়ই কোনো বিশেষ দূরভিসন্ধি আছে। আজ বলছে দাড়ি কেটে ফেলো, পাগড়ীর বদলে চামড়ার টুপী পরো। কাল বলবে খ্রীস্টনাম জপ করো। পরশুদিন বলবে তোমার বাপ-দাদা সকলে পাপী… তুমি প্রভু যীশুর মতে দীক্ষা নিয়ে পরিত্রাণ প্রার্থনা করো। যুদ্ধ করা সেপাইদের পেশা। তারা তেজারতি করে না, চাষবাস করে না, আর কোনো হুনুর হেকমত জানে না। যুদ্ধই তাদের চাষবাস, যুদ্ধই তাদের তেজারতি। যুদ্ধ করা সম্মানজনক পেশা… তাতে আয়ও হয় মন্দ না। মনিবের হুকুম মানতে তারা প্রস্তুত। এক জায়গায় থেকে অন্য জায়গায় বদলী করুক, তারা যেতে রাজী আছে। কিন্তু উপর অলার আদেশে পিতৃপুরুষের ধর্মের অবমাননা তারা কখনো করতে পারবে না। এমন কি প্রাণ গেলেও না। এদেশীয় কানুন মতে তারা নিমক হালাল হলেই হলো! তারা কখনও নিমক হারামি করেনি। তারপরেও তাদের পিতৃপুরুষের ধর্মের ওপর হামলা করার অর্থ তাদের অজু, নামাজ, সন্ধ্যা আহ্নিককে অবজ্ঞা করতে পারে। এনিয়ে তারা ঠাট্টা–বিদ্রূপও করতে পারে। কিন্তু এগুলো তাদের কাছে মুক্তির উপায়। ধর্ম বিশ্বাসে অটল থাকলেই সহযোদ্ধার শ্রদ্ধা আকর্ষণ করতে পারে। একজন নিষ্ঠাবান হিন্দু একজন মুসলমানকে শ্রদ্ধা করে। আপন ধর্মের প্রতি নিষ্ঠাহীন লোককে অন্য ধর্মের মানুষও ঘৃণার চোখে দেখে। চামড়ার মস্তকাবরণ পরলে তাদের জাত যাবে, ধর্ম নষ্ট হবে, আত্মীয়স্বজনের চোখে পতিত হবে, চৌদ্দ পুরুষের মুক্তির উপায় থাকবে না। সুতরাং তারা তা পারবে না। কঠোর পণ! কঠিন প্রতিজ্ঞা। দুনিয়ার কোনো শক্তি তাদেরকে চামড়ার মস্তকাবরণ পরতে বাধ্য করতে পারবে না। বেলুড়ে চর্বি মাখানো টোটার প্রবর্তন নিয়ে সহস্র শিখায় মহাবিদ্রোহের যে আগুন জ্বলে উঠেছিলো, পঞ্চাশ বছর আগে চামড়ার মস্তকাবরণ প্রবর্তনের প্রতিবাদে তার প্রথম ফুলকি জাগে।

সেপাইদের অসন্তোষ দেখে ইংরেজ অফিসারেরা বিস্মিত হয়েছিলেন। হ্যাঁ, তাঁদের বিস্মিত হওয়ার কথাই বটে। সেপাইরাও মানুষ, তাদেরও মন আছে। সে মনে আছে ধর্মীয় এবং সামাজিক মূল্যবোধের প্রতি অটুট শ্রদ্ধা! সেপাইদের মনের খোঁজ যারা রাখে না তাদের বিস্মিত হওয়া ছাড়া আর কীই-বা করার আছে। কিন্তু মাথা খারাপ করেনি। সামরিক ঘাঁটির অধ্যক্ষ অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে বিক্ষোভ এবং অসন্তোষ দমন করলেন। বিদ্রোহীদের কঠোর দণ্ডদান করলেন। খবর কিন্তু চেপে রাখতে পারলেন না, দাবানলের মতো অন্য তিনটি কেন্দ্রে ছড়িয়ে পড়লো। সেপাইরা

অতি সহজে পিতৃপুরুষের ধর্মের প্রতি এ অপমান হজম করতে পারলো না। অন্য তিনটি প্রেসিডেন্সীর সেপাইদের মনে প্রতিশোধের আগুন ধিকি ধিকি জ্বলতে থাকে। অবশেষে ইংরেজরা তাদের ভুল বুঝতে পারলো। এ প্রথা রহিত করা হলো। সেপাইদের ধর্মীয় ব্যাপারে ইংরেজরা কোনো রকম হস্তক্ষেপ করবে না এ মর্মে গভর্ণরের নির্দেশ প্রচারিত হলো। তখন বেলুড়ের দুর্গে টিপু সুলতানের ছেলেরা নজরবন্দী অবস্থায় ইংরেজদের প্রদত্ত বৃত্তি ভোগ করে অবস্থান করছিলেন। ইংরেজদের অনেকেই বেলুড়ের সেপাইদের স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহকে রাজনৈতিক রঙ দেবার চেষ্টা করেছে। বিদ্রোহের সঙ্গে টিপু সুলতানের ছেলেদের কোনো যোগাযোগ ছিলো না। সেপাইদের সম্বন্ধে ইংরেজদের অজ্ঞতার কারণেই বেলুড় বিদ্রোহের সূত্রপাত। সরকারের অভিপ্রায়ের প্রতি সেপাইরা সন্দিহান হয়ে না উঠলে কোনো রাজনৈতিক প্ররোচনাই সেপাইদেরকে বিদ্রোহে উদ্বুদ্ধ করতে পারতো না।

বেলুড় বিদ্রোহের আঠারো বছরও অতীত হয়নি। ইংরেজদের প্রতি সেপাইদের আনুগত্য আবার এক মহাপরীক্ষার সম্মুখীন হলো। ভারতের পূর্বৰ্তম সীমান্তে আসাম। আসামের সঙ্গে ব্রহ্মদেশকে সংযুক্ত করা হয়েছে। দুর্যোগ ঘনিয়ে আসছিলো। ১৮২৪ সালে শুরু হয় যুদ্ধ। সেপাইদের ব্রহ্মদেশে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন দেখা দিলো। আসামের ওপর দিয়ে ব্রহ্মদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে যুদ্ধ করতে তাদের আপত্তি ছিলো না। ভারতবর্ষীয়, সুপ্রাচীন হিন্দু প্রথা অনুসারে কালাপানি অতিক্রম করা হিন্দুদের পক্ষে মহাপাপ। তাই বাঙালি পল্টন আপত্তি তুললো। কিন্তু বাঙালি পল্টনকে যেতে হলো না। মাদ্রাজী সেপাইরা কোনো রকমের হাঙ্গামা হুজ্জত ছাড়াই কালাপানি পেরিয়ে যুদ্ধ করতে রেঙ্গুন যাত্রা করলো। বাঙালি পল্টনের ওপর নির্দেশ দেয়া হলো স্থলপথে মার্চ করে চট্টগ্রামের উপর দিয়ে ব্রহ্মদেশের স্থল সীমান্তে গিয়ে জড়ো হতে। কিন্তু সরকার যথাসাধ্য চেষ্টা করেও সেপাইদের জন্য যানবাহন সংগ্রহ করতে পারলো না। ৪৭ নং রেজিমেন্টের সেপাইদের ব্যারাকপুর ছাউনি থেকে মার্চ করতে আদেশ দেয়া হলো। বলা হলো তাদেরকে আপন আপন মালপত্র বহন করার জন্য বলদ এবং গরুর গাড়ি যোগাড় করে নিতে। সেপাইরা হতাশ হয়ে পড়লো। সরকার যেখানে যথাসাধ্য চেষ্টা করে বিফল হয়েছে সেখানে তারা কেমন করে বলদ এবং গরুর গাড়ি যোগাড় করবে? সামান্য সেপাইদের শক্তি কতদূর? তাদের কাছে এ সরকারি নির্দেশ অন্যায্য মনে হলো। এ সময়ে গুজব ছড়িয়ে পড়লো, একবার যদি চট্টগ্রাম গিয়ে পৌঁছে তারা পছন্দ করুক আর না করুক, তাদেরকে শেষ পর্যন্ত যাত্রা করতেই হবে। তারা একজন অফিসারকে দায়িত্ব নেয়ার প্রতিশ্রুতির জন্য আবেদন করলো। কোনো রকম প্রতিশ্রুতি না পাওয়া পর্যন্ত তারা ছাউনি ত্যাগ করলো না। ফিরতি পথে রামুতে এ গুজব শুনবার পর সেপাইদের মধ্যে কি রকম প্রতিক্রিয়া হয়েছিলো, জানবার উপায় নেই। যাহোক, সেপাইরা তাদের জাত, কুল, ধর্মনাশের ভয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়লো। এ সময়ে সর্বাধিনায়ক ছিলেন স্যার এডওয়ার্ড প্যাজেট। তিনি ছিলেন কঠোর মানুষ। সেপাইদের মধ্যে শৃঙ্খলার সামান্য হেরফেরও তিনি বরদাশত করতে পারতেন না। তা ছাড়া কোনো সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা প্রশ্রয় দেয়া যায় না। যুদ্ধের সময়ে তা আরো কঠোরতার সঙ্গে দমন করা হয়। স্যার এডওয়ার্ড এ দেশীয় সেপাইদের কুসংস্কারের প্রতি ছিলেন খড়গহস্ত। অল্পসংখ্যক ইউরোপীয় সৈন্য নিয়ে তিনি ব্যারাকপুর যাত্রা করলেন। সেপাইদের তাদের অপরাধের জন্য তীব্র ভাষায় তিরস্কার করলেন। তাদের হয়তো মার্চ করতে অথবা অস্ত্র সংবরণ করতে আদেশ দিলেন। সেপাইদের কোনো অযৌক্তিক অনুরোধ এ ইংরেজ সন্তানটি কানে তুলতে রাজী ছিলেন না। কিন্তু সৈন্যরা গালাগালি সহ্য করেও শৃঙ্খলার উর্ধ্বে ধর্মকে স্থান দিয়ে ছাউনির ভেতর রয়ে গেলো। তাদের পক্ষে যুক্তি হলো, ধর্মবিশ্বাসে আঘাত আসতে পারে এমন কোনো অভিযানে অংশগ্রহণ করতে তারা চুক্তিবদ্ধ নয়। তারা মনে করলো, সর্বাধিনায়কের আদেশ না মেনে তারা একটুকুও অন্যায় করছে না। তাই বলে কোনো সশস্ত্র বাধাও দেয়নি। আদেশ অমান্যকারী সেপাইদের শাস্তি দেয়ার জন্য বদ্ধপরিকর স্যার প্যাজেটের আদেশে এ হতভাগাদের নিষ্ঠুরভাবে গুলী করে হত্যা করা হলো। অনেকে আতঙ্কে পালিয়ে গেলো। এখানেই শেষ নয়। দলপতিকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো হলো। ৭নং রেজিমেন্টের নাম সম্পূর্ণভাবে তালিকা থেকে বাদ দেয়া হলো। এভাবে ব্রিটিশ শাসকেরা ব্যারাকপুরে এদেশীয় সেপাইদের ধর্মীয় অনুভূতিকে আহত করার আরেকটা নজীর স্থাপন করলো।

এর পাঁচ বছর পরে হিন্দু সেপাইদের মধ্যে গোঁড়া কুসংস্কারাচ্ছন্ন সম্প্রদায় সতীদাহ প্রথা বন্ধ করার মধ্যে ব্রিটিশের ধর্মবিরোধী ভূমিকা আবিষ্কার করলো। সমস্ত মানবিক নীতি বহির্ভূত এ প্রথাটি অনেকদিন আগেই রহিত করার প্রয়োজন ছিলো, এ কথা কে অস্বীকার করবে? প্রথম দিকে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এদেশীয় হিন্দু মুসলমানের ধর্মীয় ব্যাপারে নিরপেক্ষ থাকার কঠোর নীতি গ্রহণ করেছিলো। কারণ তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। এমনকি কোম্পানীর রাজ্যসীমার মধ্যে খ্রীস্টান ধর্ম প্রচারকদের প্রবেশও নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলো। তাই বলে, কোনো সুসভ্য শাসন ব্যবস্থা কি এ প্রথা রহিত না করে পারে? বোর্ডের পরিচালকেরা ধর্মের নামে এভাবে জীবন্ত মানুষ দগ্ধ করার প্রথা বন্ধ করার জন্য তৎপর হয়ে উঠলেন। লর্ড আমহার্স্ট ঠিকই ধরেছিলেন, যে কোনো সংস্কার তা যতোই প্রয়োজনীয় হোক না কেন, তার ফলে অসন্তোষের সৃষ্টি হতে পারে। তাই সতীদাহ প্রথা রহিত করতে তিনি ভয় পেয়েছিলেন। লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কই এ অমানবিক প্রথা বন্ধ করার সবটুকু কৃতিত্বের যোগ্য দাবিদার। তিনি সাহস করে এগিয়ে এসেছিলেন বলেই এ প্রথা বন্ধ হয়েছিলো। লর্ড বেন্টিঙ্ক সতীদাহকে প্রাণদণ্ডনীয় অপরাধ বলে আইন করে দিলেন। তিনি দ্বারকানাথ ঠাকুর, রাজা রামমোহন রায় প্রমুখের সক্রিয় সমর্থন পেয়েছিলেন। তারা সংখ্যায় অত্যন্ত স্বল্প। ধর্মোন্মত্ত মানুষেরা এর পেছনে শাস্ত্রের সমর্থন রয়েছে বলে এ আইনের বিরুদ্ধে প্রচার কাজ চালাতে থাকে। ইংরেজের এ প্রশংসনীয় সংস্কারটিকেও পরবর্তীকালের বিদ্রোহী নেতারা মূলধন করেছিলো। খান বাহাদুর খান তাঁর এক ফরমানে বলেছেন, হিন্দু কুলবধূদের মৃত স্বামীর সঙ্গে একই চিতায় সহমরণে গমন করা একটি সুপ্রাচীন ধর্মীয় প্রথা। ইংরেজরা তা রহিত করে নিজেদের আইন জারী করেছে। সতীদাহ প্রথা বন্ধ করার ফলে হিন্দু প্রজাদের মধ্যে শুধু অসন্তোষের সৃষ্টি হয়নি, মুসলমানেরাও সমানভাবে বিক্ষুব্ধ হয়েছে। আজকে হিন্দুর ধর্মে আঘাত করেছে। আগামীকাল মুসলমানের ধর্মেও আঘাত করতে পারে।

রাত্রে (Rattray) র শিখ সেপাইদলের সুবাদার সর্দার বাহাদুর হেদায়েত আলীর কথাতেই তার সমর্থন পাওয়া যাবে। তিনি ছিলেন রাজভক্ত সেপাই। তার বাবা এবং বাবার বাবাও সেপাই হিসেবে পল্টনে জীবন কাটিয়েছিলেন। সুতরাং তাঁর রাজভক্তি যে সকল রকমের সন্দেহের অতীত এ রকম বিশ্বাস করার সঙ্গত কারণ রয়েছে। সরকারের কাছে তিনি বাঙালি পল্টন এবং বাংলা প্রেসিডেন্সীতে সৈন্যদলের মধ্যে অসন্তোষ, বিক্ষোভ এবং বিদ্রোহের কারণ নির্দেশ করেছেন অল্প কথায়। এর জন্য তিনি আফগান যুদ্ধকেই দায়ী করেছেন। আইনানুগ পদ্ধতিতে সেপাইরা কাবুল যেতে অস্বীকার করতে পারলো না। অথচ তাদেরকে ভারতের বাইরে যেতে হচ্ছে, সেখানে গেলে তাদের জাতকুল রক্ষা হবে কিনা সে কথা ভেবে শঙ্কিত হয়ে উঠলো। কাবুলে হিন্দু সেপাইরা নিয়মিত সন্ধ্যা আহ্নিক এবং স্নান ইত্যাদি করতে পারতো না। দু’বেলা মুসলমানদের দোকান থেকে খাদ্যবস্তু ক্রয় করতে হতো। ভারতে তা ছিলো রীতিবিরুদ্ধ। কাবুলের যুদ্ধে অনেক সেপাই বন্দী হলো এবং জোর করে তাদেরকে মুসলমান বানানো হলো। দেশে ফিরে এসে দেখে তারা জাতিচ্যুত হয়ে গেছে। স্ব সমাজের কোথাও আর তাদের স্থান নেই। অজ্ঞ গ্রামবাসীরা তাদের সঙ্গে এক সাথে বসে তামাক খেতে পর্যন্ত রাজী ছিলো না। শুধু গ্রামবাসী নয়, সেপাই ভাইরাও কেউও তাদের সঙ্গে আহার করতে রাজী হলো না। মুসলমানদের ওসব সংস্কারের বালাই নেই। কিন্তু আপন ধর্মের লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে স্বভাবতঃই তাদের প্রবৃত্তি ছিলো না। হেদায়েত আলী বলেছেন, মুসলমান সেপাই পল্টনে গর্ব করে বেড়াতে কিভাবে ইংরেজের আদেশ অবহেলা করে বন্দুক ছোঁড়া থেকে বিরত ছিলো।

সীতারাম নামে এক হিন্দু সুবাদারকে চরম লাঞ্ছনা ভোগ করতে হয়। তার চাচা ছিলেন জমাদার। সীতারামের নিজের ছেলেও পল্টনে সেপাইর চাকুরি করতো। বিদ্রোহের সময় ছেলে বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দেয়। কিন্তু সীতারাম নিমক হারামি করতে পারেনি। বিদ্রোহ দমন করার পর তার ছেলেকে গুলি করে হত্যা করার আদেশ দেয়া হয়। আপন সন্তানকে বধ্যভূমিতে গুলি করে হত্যা করার ভার পড়ে সীতারামের উপর। পরে অবশ্য এক দয়ালু অফিসার এ অমানবিক কর্তব্য থেকে তাকে রেহাই দেন।

সীতারাম আফগানিস্তানে যুদ্ধ করতে গিয়েছিলেন। তিনি তাঁর হিন্দু সহকর্মীদের মনোভাব সম্বন্ধে যা লিখে রেখে গেছেন, তা অবশ্যই বিশ্বাসযোগ্য। তিনি লিখেছেন, সেপাইদের মধ্যে আফগানিস্তান গমন করার প্রশ্নে প্রচণ্ড আতঙ্কের সঞ্চার হয়। সিন্ধু নদ অতিক্রম করার কথা শুনে তারা অত্যন্ত শঙ্কিত হয়ে উঠে। এমনকি গুজব উঠলো যে, কাবুলে সরকারের সৈন্যরা গো-হারা হারবে। আবার কেউ কেউ বলতে লাগলো ইংরেজরা কাবুল দখল করে নেবে। সে যাকগে, সিন্ধু নদ অতিক্রম করার কথা শুনে সেপাইরা ভীত হয়ে পড়লো। তাহলে তাদেরকে ভারতের বাইরে যেতে হবে এবং তার ফলে তারা জাতিচ্যুত হবে। এ কারণে সেপাইদের অনেকেই চাকুরি ছেড়ে দিলো, অনেককেই বরখাস্ত করা হলো। দুস্তর মরুভূমি পাড়ি দিয়ে তাদের যাত্রা করতে হলো। কান্দাহার গিরিপথের পাশে এক পাপপূর্ণ দেশে তাদের অবস্থান করতে হলো। সেখানে তারা নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে লাগলো। একজন মারা গেলে দাহ করার জন্য কোনা জ্বালানী কাঠ পাওয়া গেলো না এবং ভাসিয়ে দেবার মতো পবিত্র গঙ্গাও সেখানে নেই। কাশীও অনেক দূরে। হিন্দু সেপাইদের দুর্দশার সীমা রইলো না। মৃতদেহ শৃগাল এবং গৃধিনীদের ভক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হলো।

কাবুল যুদ্ধে পরাজয়ের পর হতভাগা সীতারাম শত্রু কর্তৃক বন্দী হলো এবং দাসরূপে তাকে বিক্রয় করা হলো। ইংরেজদের কাবুল পরিত্যাগ করার বহুদিন পরে সীতারাম এক ব্যবসায়ীকে পাঁচশ টাকা দিয়ে তার সাহায্যে পালিয়ে এসেছিলেন। তখনকার দিনে পাঁচশ টাকা কম টাকা নয়। ফিরোজপুরের কমিশনার এ টাকার অর্ধেক দিয়েছিলেন, বাকী অর্ধেক স্টেশনের এক পুরোনো পরিচিত ব্যক্তির কাছ থেকে সে গ্রহণ করেছিলো। সেপাইদের কাছে ফিরে এসে সীতারাম যখন আত্মপরিচয় দান করলো তখন সেপাইদের সকলে একবাক্যে সীতারামকে অশুচি অপবিত্র এবং মুসলমান বলে ঘোষণা করলো। প্রায়শ্চিত্ত না করা পর্যন্ত সীতারামকে ব্রাহ্মণেরা অস্পৃশ্য বলে জানিয়ে দিলো এবং খ্রীস্টান ড্রামবাদক ছাড়া অন্য কোনো হিন্দুর সঙ্গে মেলামেশার অধিকার সীতারামের নেই। ইংরেজ অফিসারেরা সীতারামের এ হেনস্থার কথা জানতেন। তারা তার উপর যথেষ্ট সহানুভূতিসম্পন্ন ছিলেন। তাহলে কি হবে, জাত ফিরে পেতে যতো টাকার প্রয়োজন, তখন সীতারামের হাতে ততো টাকা ছিলো না। সেপাইদের হাতে লাঞ্ছিত হওয়ার পরেও কিন্তু সীতারামের দুর্দশার শেষ হলো না। গ্রামে সীতারামের জন্য আরো অপমান অপেক্ষা করছিলো। সে যে আফগানিস্তানে দাস হিসেবে জীবনযাপন করেছে এ খবর বাতাসের বেগে সীতারামের গ্রামে ছড়িয়ে পড়লো। তাকে পিতৃগৃহে থাকতে দেয়া হলো না। আপন ভাই তার শত্রু হয়ে দাঁড়ালো। তার বাবা জাতে তুলবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করলেন এবং তাকে সেপাইয়ের পেশা ছেড়ে দিতে জোর করতে থাকেন। নিজের স্ত্রী এবং পুত্রের কারণে সীতারাম বাবার প্রস্তাবে রাজী হতে পারেনি।

আফগান যুদ্ধের ফলে সেপাইদের শিক্ষা হলো, বিদেশে অভিযানে গমন করলে তাদের গৌরব তো বাড়ে না, বরঞ্চ স্বার্থ এবং সম্মানের যে ক্ষতি হয় তা পূরণ করা তাদের সাধ্যের সম্পূর্ণ বাইরে। ব্রহ্মদেশে যুদ্ধ করতে সেপাইদের বিদেশে যাওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। বিজয়েই সে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। কিন্তু বিদেশে গোলামী এবং স্বদেশে অস্পৃশ্য হওয়ার যে ক্ষতি তা পূরণ করার জন্য ইংরেজ অফিসারদের সহানুভূতিই যথেষ্ট নয়। এতোকাল ব্রিটিশ সেনাপতিরা অজেয় বলে যে ধারণা পোষণ করে আসছিলো ভারত এবং নেপালের যুদ্ধে এশীয় সেনাপতি কর্তৃক পরিচালিত এশীয় বাহিনীর হাতে তাদের পর্যদস্ত অবস্থা সেনাপতিদের প্রতি পূর্বের সে অটল বিশ্বাসে ফাটল ধরিয়ে দিলো।

১৮৩৯ সালে শাসকদের তাদের নিজেদের ধর্মের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গীর একটি তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। ভারতে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান যাই হোক না কেন, তারা অত্যন্ত নিষ্ঠা সহকারে এ পবিত্র দায়িত্ব পালন করতেন। আওরঙ্গজেবকেও হিন্দুদের সামাজিক বিরোধে রায় দিতে দেখা গেছে। হিন্দু পেশবা একজন রোমান ক্যাথলিক যাজকের অধিকার স্বীকার করে নিয়েছেন। এ সুপ্রাচীন প্রথা অনুসারে মন্দির এবং অন্যান্য ধর্ম স্থানসমূহের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব এসে পড়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর উপর। এমনকি পুরীর জগন্নাথদেবের মন্দিরের দায়িত্ব প্রত্যক্ষভাবে কোম্পানীর ওপর অর্পিত হয়। স্বদেশে খ্রীস্টান মতামত কোম্পানীর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠলো এবং কোম্পানী মূর্তিপূজার পৃষ্ঠপোষকতা করছে বলে গোঁড়া খ্রীস্টান মহলে অভিযোগ উঠতে থাকলো। বস্তুতঃ কোম্পানী মন্দির ইত্যাদি ধর্মস্থান থেকে প্রচুর অর্থ আয় করছিলো। দর্শনার্থীদের প্রদত্ত অল্প টাকাই মন্দির সংস্কারের জন্য ব্যয় করতে হতো তাদের। কিন্তু ধর্মীয় ন্যায়-নীতির সঙ্গে পার্থিব লাভ-লোকসানের কোন সম্বন্ধ নেই। ভারতে হিন্দু-মুসলমান ধর্ম স্থানসমূহের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পরিত্যাগ করার জন্য কোম্পানীর সরকারের ওপর ব্রিটেন হতে চাপ আসতে থাকে। এতোকাল ধরে ইংরেজরা যে ধর্মীয় নিরপেক্ষতা বজায় রেখে আসছিলো হঠাৎ সে মনোভাবের পরিবর্তন দেখা গেলো। ইউরোপ থেকে খ্রীস্টধর্ম প্রচারকের আগমন ঘটতে থাকে। হাট, ঘাট, বন্দর, জেল, হাসপাতাল, স্কুল সর্বত্রই খ্রীস্টধর্ম প্রচারের ভিড় লেগে গেলো।

বাজারে বাজারে খ্রীস্টধর্মের প্রচারকেরা বড়োই উৎপাত শুরু করে দিলো। তাদের নিজেদের ধর্মের গুণ-গান প্রচার তারা তো করলেই সে সঙ্গে এদেশের অধিবাসীদের সামাজিক রীতিনীতি ইত্যাদিকে জঘন্য ভাষায় বিদ্রূপ করা তাদের ধর্ম প্রচারের একটি অঙ্গ হয়ে দাঁড়ালো। মুর্তিপূজক হিন্দু এবং একেশ্বরবাদী মুসলমান উভয় ধর্মের প্রতি সমান তাদের আক্রোশ এবং যীশুখ্রীস্ট যে একমাত্র প্রেরিত পুরুষ তাই জোরগলায় প্রচার করতে লাগলো। বিক্ষুব্ধ জনসাধারণ খ্রীস্টান প্রচারক এবং খ্রীস্টান শাসকদের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখতে পেলো না। এর কারণ, অনেক সময় সঙ্গে পুলিশ নিয়ে খ্রীস্টান প্রচারকেরা ধর্ম প্রচার করতে যেতো।

স্যার সৈয়দ আহমদের ভাষায়, জনসাধারণ বিশ্বাস করতে লাগলো, সরকার ধর্ম প্রচারকদের মাইনে দিয়ে নিয়োগ করেছেন। তিনি আরো বলেছেন, জনসাধারণ যখন মন্দিরে, মসজিদে অথবা বাসগৃহে কোনো ধর্মানুষ্ঠানের আয়োজন করতো সেখানে খ্রীস্টান প্রচারকেরা গিয়ে অত্যন্ত আপত্তিজনক ভাষায় তাদের ধর্মের নিন্দা করতো। সেপাইরাও জানতো যে সেনাবাহিনীর প্রধান পুরোহিতেরা সরকারের কাছ থেকে মাইনে পেয়ে থাকে। সেনাবাহিনীর প্রধান পুরোহিতকে বলা হতো পাদরী লাট।

খ্রীস্টান ধর্ম প্রচারকেরা শিক্ষক হিসেবে সুযোগ্য। তাদের শিক্ষাদান শুধু ছাত্রদের মন উন্নত করার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ রইলো না, তারা ছাত্রদের আত্মা শুদ্ধ করার জন্যও উঠে-পড়ে লেগে গেলো। এর ফলে জনগণের মধ্যে উদ্বেগের সঞ্চার হলো। তারা প্রচার করতে লাগলো-খ্রস্টধর্মই হলো সত্যের একমাত্র পন্থা। শিক্ষিত হিন্দুরা সহিষ্ণু মনোভাব নিয়ে বিচার করতে লাগলো সব ধর্মই ভগবানের কাছে পৌঁছার পথ। কিন্তু মুসলমানেরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, একমাত্র ইসলামই সর্বশেষ সত্য ধর্ম। অপরপক্ষে, অধিকাংশ হিন্দু যারা অশিক্ষিত বিশ্বাস করে যে, সনাতন আচার-অনুষ্ঠান থেকে একটু নড়চড় হলেই তারা ধর্ম থেকে পতিত হবে। সুতরাং এদেশীয় ধর্ম বিশ্বাসের সঙ্গে খ্রীস্টান ধর্ম বিশ্বাসের সংঘর্ষ চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হলো। ভারতীয়েরা মনে করতে লাগলো অন্যায্যভাবে খ্রীস্টধর্ম তাদের পিতৃপুরুষের ধর্মের ওপর আঘাত হানছে। অনেক সময় সরকার প্রকাশ্যে তাতে সহায়তা দান করছে। খ্রীস্টধর্ম প্রচারের আদর্শে অনুপ্রানিত কতিপয় সরকারি এবং সামরিক অফিসার ভাবতে লাগলেন এ ধর্মহীন ভারতীয়দের তারা যদি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সত্য ধর্মের আলোকে দীক্ষিত না করে, তাহলে স্বর্গপ্রাপ্তির মহামূল্য সুযোগ হেলায় হারিয়ে ফেলবেন। আবার অনেকের মনের ধারণা শাসক এবং শাসিতের মধ্যে যে ব্যবধান রয়ে গেছে, দেশীয় অধিবাসীদের খ্রীস্টধর্মে দীক্ষিত করতে পারলেই সে ফাঁক ভরাট হয়ে যাবে। খ্রীস্টান প্রচারকদের পরিচালিত বিদ্যালয়সমূহে তো বটেই অধিকন্তু কতিপয় সরকারি বিদ্যালয়েও বাইবেল শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হলো। হেনরী কেয়ারটুকার নামে একজন প্রচারক এ পদ্ধতির পুরোপুরি সমর্থক ছিলেন। তিনি কানপুরের অবৈতনিক বিদ্যালয় প্রসঙ্গে বলেছেন, বারানসীর জয়নারায়ণ অবৈতনিক বিদ্যালয় সরকারি হলেও পাদরীরা কড়াকড়িভাবে খ্রীষ্ট্রীয় পদ্ধতিতেই তার শিক্ষাদানের ভার গ্রহণ করেছে। স্যার সৈয়দ আহমদ বাইবেল পড়ানোর জন্য ততোটা আপত্তি করেননি, কিন্তু পড়ানোর ধরন সম্বন্ধে ভয়ানক আপত্তি তুলেছেন। তিনি অভিযোগ করে বলেছেন, কোন কোন বিদ্যালয়ে ছাত্রদের জিজ্ঞেস করা হয় তোমাদের প্রভু কে এবং কে তোমাদের মুক্তিদাতা? ছাত্ররা শেখানো খ্রীস্টীয় পদ্ধতিতেই তার উত্তর দিয়ে থাকে। তার মতে, সামরিক পুরোহিত এবং সামরিক অফিসারেরা তাদের অধীনস্থ কর্মচারীদের সঙ্গে ধর্ম বিষয়ে আলাপ করে তাদের প্রলুব্ধ করতে চেষ্টা করতো।”

খ্রীস্টধর্ম প্রচারকদের কর্মতৎপরতা শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো না। রেভারেণ্ড গোপীনাথ নন্দী নামে একজন বাঙালি যাজক ছিলেন ফতেহপুরে। সে সময়ে আর. টি. টুকার ছিলেন ফতেহপুরের জেলা শাসক। তিনি লিখেছেন, প্রত্যেক দিন জেলখানায় একজন খ্রীস্টান যাজক কয়েদিদের মধ্যে খ্রীস্টীয় নীতিমালা প্রচার করতেন এবং আমি প্রতি রবিবার সকাল বেলা তাদের মধ্যে সুসমাচার প্রচার করতাম। আমাদের ধর্মপ্রাণ মেজিস্ট্রেট এ সুবিধা করে দিয়েছেন। প্রশাসক, বিচারক এবং অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মচারিদের সকলেই প্রচারকার্যে সক্রিয় সহযোগিতা দান করেছিলেন। তারা আমাদের প্রার্থনাসভা পরিচালনা, সদুপদেশ এবং আর্থিক সহায়তা দান করেছেন। এ দেশীয় দীক্ষিতদের সংখ্যা যখন বৃদ্ধি পেতে থাকলো, সম্মানীয় মি: কলভিনের পরামর্শে তাঁদের ছ’জনকে কৃষক গেরোস্তে পরিণত করা হলো। এভাবেই ফতেহপুরের জেলা শাসক কয়েদিদেরকে ধর্মান্তরিতকরণে সাহায্য করেছিলেন এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের সহকারী গভর্ণর নিজে এ সকল নবদীক্ষিতদের বৈষয়িক উন্নতির প্রতি যত্নবান হয়ে উঠেছিলেন। সাধারণ মানুষের মনে এ বিশ্বাস বদ্ধমূল হলো যে, সরকার প্রজাদের খ্রীস্টানে পরিণত করার মনোভাব গ্রহণ করেছেন।

১৮৪৫ সালে জেলে খাবার পদ্ধতি নিয়ে নতুন আইন প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে বিশ্বাস তাদের মনে আরো পল্লবিত হয়ে উঠলো। ভারতীয় কারাগারে কতিপয় কয়েদিকে অন্য সকল কয়েদিদের পাঁচকরূপে নিয়োগ করা আজকের দিনের অতি সাধারণ পদ্ধতি। আগেকার দিনে কারাগারের কয়েদিরাও কড়াকড়িভাবে তাদের স্ব স্ব গোত্রের নিয়মকানুন পালন করতো। কয়েদিদেরকে আপন আপন খাবার পাক করতে দেয়া হতো। এ ব্যবস্থায় অসুবিধার অন্ত নেই। সেজন্য সকলের পাক করার জন্যে একজন ব্রাহ্মণকে নিয়োগ করা হলো। তার ফলে বর্ণ হিন্দুরা অত্যন্ত অপমানিত অনুভব করলো। ব্রাহ্মণদের মধ্যেও আবার বহু শ্ৰেণী গোত্র রয়েছে। একের ছোঁয়া অপরে খায় না। সরকার তাদেরকে ধীরে ধীরে খ্রীস্টানে পরিণত করতে চায়, এ বিশ্বাস তাদের মনে শিকড় প্রসারিত করতে লাগলো। জনগণের মধ্যে নয় শুধু সেনাবাহিনীতেও গুজব ছড়িয়ে পড়লো, সরকার সেখানেও সাধারণ মেস প্রথা চালু করবে। তার ফলে ১৮৪৫-৪৬ সালে পাটনা ষড়যন্ত্রের উদ্ভব হয়। তারপরেও কিন্তু কতিপয় কারাগারে নতুন ব্যবস্থা বলবৎ থাকে। জনমত ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলো, খান বাহাদুর খানের কথায় তার প্রমাণ মেলে। “তারা জোর করে কয়েদিদেরকে রুটি খাইয়ে তাদের ধর্মে দীক্ষিত হতে বাধ্য করে।”

গোপীনাথ নন্দী আরো বলেছেন, পাটওয়ারী অথবা গ্রামের হিসেব রক্ষকদের যখন দেবনগরী হরফে হিন্দী শিক্ষা করার প্রয়োজন দেখা দিলো, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে তাদেরকে খ্রীস্টান যাজক পরিচালিত বিদ্যালয়ে যেতে হলো। মুসলমান সহকারী কালেক্টর হিকমত উল্লাহ খানের আপত্তি সত্ত্বেও তাদের শিক্ষা ভাষা কিংবা হরফের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো না। এ তিনশ বয়স্ক মানুষকে সুসমাচার পড়তে হলো, প্রার্থনাসভায় যোগ দিতে হলো। এবং বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্য এক এক খণ্ড নতুন বাইবেল উপহার দেয়া হলো। যাজক কর্ণেল এবং পাদরী লেফটেন্যান্টের আদেশে সেপাইদের মধ্যে দেশীয় যাজকেরা খ্রস্টধর্ম প্রচার করতে থাকে। জেলা শাসকের অনুমতি নিয়ে কারাগারের কয়েদিদের কাছে পাদরীরা দৈনিক হাজির হতে লাগলো এবং পরিশেষে তিন’শ পাটওয়ারীর নতুন বাইবেল নিয়ে ঘরে ফেরা, দেশের জনসাধারণের মনোভাব সরকারের প্রতি পরিপূর্ণভাবে বিষিয়ে তুলেছিলো।

তারপরে ১৮৫০ সালের নতুন উত্তরাধিকারী আইন তাদের বিদ্বেষ বাড়িয়ে। তুললো। প্রকৃত প্রস্তাবে এই আইনের বলে ধর্মান্তরিতরা পূর্বপুরুষের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হওয়ার অধিকার লাভ করে। এই আইনের বিরোধিতা করার মতো কোনো কিছু ছিলো না। দেশের আইনের কোনো ক্ষতি না করলে সত্তাবে দীক্ষিত হওয়ার কারণে, পূর্বপুরুষদের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু হিন্দু এবং মুসলমান উভয় সম্প্রদায় মনে করতে লাগলো, নবদীক্ষিত খ্রীস্টানদের সুবিধা দেয়ার জন্য শাসকগোষ্ঠি এই আইনের সৃষ্টি করলেন। তাদের বিদ্বেষ উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে।

এ পরিস্থিতিতে সরকারের জনহিতকর প্রতিষ্ঠান এবং কাজের মধ্যেও পক্ষপাতমূলক মনোভাবের অনুপ্রবেশ ঘটে। রাস্তা নির্মাণের সময় একটা দুটা মন্দিরকে ভেঙ্গে ফেলা হলো। অশিক্ষিত জনগণ মনে করতে লাগলো তাদের পবিত্র মন্দিরকে ভেঙ্গে ফেলবার জন্যই সরকার রাস্তা নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। সংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের দৃষ্টিতে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন কোন মর্যাদাই পেলো না। একইভাবে ইংরেজের হাসপাতাল প্রতিষ্ঠাও দেশের জনমতকে ইংরেজের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত করে তুলেছিলো। হেদায়েত আলীর অভিজ্ঞতা থেকে জানতে পারি সুপ্রাচীন পর্দা প্রথার ওপর আঘাত এসেছিলো। হাসপাতালে রোগীদের স্থান দেয়ার ব্যপারে ব্রাহ্মণ-শূদ্রের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ করা হতো না। অসহায় শিশুদেরকে অনাথ আশ্রমে নিয়ে গিয়ে তাদেরকে খ্রীস্টান হিসেবে বড়ো করা হতো।

১৮৫২ সালে ব্রহ্মদেশের বিরুদ্ধে দ্বিতীয়বার যুদ্ধ ঘোষণা করতে হলো। সাগরের ওপারে আবার সেপাইদের সাহায্যের প্রয়োজন দেখা দিলো। লর্ড ডালহৌসী বাঙালি সেপাইদেরকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কালাপানি অতিক্রম করতে বাধ্য করলেন না। তবে তাদের স্বেচ্ছাকৃত সাহায্যের জন্য অন্য আমন্ত্রণ জানালেন। প্যাজেটের শিক্ষার কথা ভুলে গিয়ে ৩৮ নং দেশী পদাতিক বাহিনী যুদ্ধে যেতে অস্বীকার করলো। লর্ড ডালহৌসী অত্যন্ত বিজ্ঞোচিতভাবে সেপাইদের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা থেকে বিরত রইলেন। সেপাইদের মনে আফগান যুদ্ধের স্মৃতি এখনো জীবন্ত। সরকার এখানে তাদের ধর্ম বিশ্বাসে আঘাত করার মতলব পরিহার করেনি, এ বিশ্বাস আবার তাদের মনে জাগরুক হয়ে উঠলো।

১৮৫৫ সালে একটি অতর্কিত ঘটনা ঘটে। এ থেকে সরকারের হুঁশিয়ার হওয়া উচিত ছিলো। হায়দরাবাদের নিকটে বেলারাম নামক স্থানে কতিপয় মুসলমান অশ্বারোহী কর্ণেল কলিন মেকেঞ্জীর প্রাণের উপর হামলা চালায়। কারণ তারা মনে করেছিলো, কর্ণেল মেকেঞ্জী মুসলমানদের মুহররমের মিছিলের উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করেছিলেন। ভুলবশতঃ কর্ণেল মেকেঞ্জী এক আদেশ জারী করেছিলেন ২০শে সেপ্টেম্বর তারিখে। নির্দেশের মর্ম হলো ২২শে সেপ্টেম্বর রাত বারটা থেকে পরদিন রোববার রাত বারটা পর্যন্ত কোন মিছিল, শ্লোগান অথবা শোরগোল কেউ করতে পারবে না। ২১শে সেপ্টেম্বর যখন দেখলেন, ২৩ শে সেপ্টেম্বর হলো পরদিন। ঐদিন মিছিল বের না করলে চলে না। তাই তিনি পূর্বে জারিকৃত নির্দেশের সংশোধন করলেন। এ নির্দেশগুলো একটু অস্বাভাবিক ছিলো। প্রথম নির্দেশটি তো রীতিমতো আপত্তিকর। তার ফলে মুহররম এবং রোববারের উপাসনার সংঘর্ষ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পরের দিনই সব নির্দেশ প্রত্যাহার করা হলো। ক্ষতি যা হবার ছিলো ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে। সংশোধিত নির্দেশ ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়নি। শহরের প্রধান প্রধান সড়ক দিয়ে মিছিল পরিক্রমা বন্ধই ছিলো। অশ্বারোহীরা রোষবশত: শনিবারে মিছিল তো বের করলোই শহরে প্রধান প্রধান সড়ক দিয়ে মিছিল পরিক্রমা করিয়ে ক্ষান্ত ছিলো না, এমনকি তারা নিষিদ্ধ সড়ক বেয়ে ব্রিগেডিয়ারের বাঙলোর দিকে ধাওয়া করলো। তখন তিনি বসে বসে কতক অফিসার এবং ভদ্রমহিলাদের সঙ্গে আলাপ করছিলেন। গোলমাল, শোরগোল এবং উচ্চ মাতম শুনে তিনি স্পষ্টত:ই বিরক্ত হলেন। ব্যক্তিগতভাবে কর্ণেল মেকেঞ্জী মিছিলকারীদের বাধা দিলেন । তাদেরকে পেছনে হটতে বললেন। মিছিলকারী জনতার মধ্যে বিক্ষুব্ধ কয়েকজন জানালেন এ রাস্তা তাদের, তারা এর উপর দিয়েই যাবে। রাগে দিশেহারা কর্ণেল হঠাৎ মিছিলকারীর কয়েকজনের হাত থেকে নিশান কেড়ে নিলেন। জনতা পেছনে হটলো, তবে একটু পরে ফিরে এসে শুধু তার উপর নয়, কতিপয় ভদ্রমহিলা এবং অফিসারকেও আক্রমণ করে বসলো। তারা বেরিয়ে ছিলেন সান্ধ্যভ্রমণের জন্য। পরে বিক্ষুব্ধ জনতা কর্ণেল কার্পেন্টারকে জানালো, তারা হচ্ছে সরকারের চাকর, সরকারের জন্য তারা প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন দিতে পারে। কিন্তু ধর্ম তাদের কাছে প্রাণের চাইতে প্রিয়। সে ধর্মকে অপমান করা হয়েছে। ব্রিগেডিয়ার এবং ব্রিগেডিয়ার মেজরের বিচার না হওয়া পর্যন্ত তারা কিছুতেই অস্ত্র সংবরণ করবে না। পরে একটি অনুসন্ধানের ব্যবস্থা করা হলো। সে কমিটি ব্রিগেডিয়ার এবং ব্রিগেডিয়ার মেজরের আচরণের কোনো খুঁতই ধরলো না। তবে ব্যক্তিগতভাবে লর্ড ডালহৌসীর আভিমত হলো তারা অন্যায় করেছেন। দু’জন ছাড়া ৩নং অশ্বারোহী বাহিনীর সমস্ত দেশীয় সেপাইদের বরখাস্ত করা হলো। বিশৃঙ্খল জনতাকে কেননা বাধা দিতে পারেনি, এ অপরাধে হিন্দু সেপাইদের শাস্তি দেয়া হলো।

একই বছরে বোলারামের ঘটনার অব্যবহিতকাল পরে নতুন ঘটনা সংযুক্ত হয়ে ঘটনার বেগকে আবেগ দান করলো। সরকারের জনহিতকর প্রত্যেকটি কাজকে ভারতীয় জনসাধারণ ঘোরতর সন্দেহের চক্ষে দেখতে আরম্ভ করেছে। রেলপথ এবং টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা সরকার তাদের সামাজিক ব্যবস্থার মর্মমূলে আঘাত হানার জন্যই প্রবর্তন করেছে বলে তারা মনে করলো। সৌভাগ্যবশতঃ কলকাতা থেকে মিঃ এডমন্ডের লিখিত এক পত্রে তার নির্দেশ পাওয়া যায়। রেলগাড়িতে বিভিন্ন বর্ণের মানুষদের বসবার জন্য কোনো আলাদা ব্যবস্থা করা হয়নি। উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণকে অস্পৃশ্য শূদ্রের সঙ্গে পাশাপাশি আসনে বসতে হতো। এতে করে তাদের শুচিতা রক্ষার কোনো উপায় ছিলো না। ভ্রমণকালে হয়তো উপোস করতে হতো। নয়তো সামাজিক প্রথা ভঙ্গ করে তাদের দৈনিক ক্রিয়াকর্ম বাদ দিতে হতো। সেজন্য তাদেরকে কড়া রকমের প্রায়শ্চিত্ত করতে হতো। এতেকরে অনেক টাকা পয়সা খরচ হয়ে যেতো। সকলে বলাবলি করতে লাগলো-ম্লেচ্ছ শাসকেরা এদেশে অভিশপ্ত কলিকাল ডেকে আনতে চায়। মি: এডমন্ড তাঁর চিঠিতে উল্লেখ করেছেন দেশের বিভিন্ন অংশ দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থার অধীনে আনয়ন করা হয়েছে। পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রভাবে ধীরে ধীরে সমাজকাঠামোর পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে। এখন দরকার দেশে একটি ধর্ম প্রচার করে সকলের পরিত্রাণের ব্যবস্থা করা। এ হলো গিয়ে ধর্ম প্রচারকদের চরম ঔদ্ধত্য। সকলে বিশ্বাস করলো এ প্রচারপত্রখানা সরকারই সমস্ত অফিসারের কাছে বিলি করেছে। লেফটেন্যান্ট গভর্ণর অস্বীকার করে বলেছেন, এ প্রচারপত্রের সঙ্গে সরকারের কোনো সংযোগ নেই। তারপরেও কিন্তু গণমনের সন্দেহ দূরীভূত হলো না। তার পরের বছরে সরকারের দু’টি ব্যবস্থার ফলে সংস্কারাচ্ছন্ন গণমনে সরকারের প্রতি সন্দেহ আরো ঘণীভূত হলো।

মেয়াদ ফুরালে ১৮৫৬ সালে লর্ড ডালহৌসী ভারত পরিত্যাগ করে। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়ে ভারতে আসেন লর্ড ক্যানিং। নতুন বড়লাট সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায়নি তখনো। ক্ষুরধার বুদ্ধি এবং হৃদয়ের যে ঔদার্যবলে ভারতের জনসাধারণের কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন এবং ভারতবর্ষকে ইংল্যান্ডের জন্য রক্ষা করতে পেরেছেন, সে মহান গুণাবলী তখনো জনসাধারণের কাছে সম্পূর্ণ অবিদিত ছিলো। প্রথমে এসে যে দুটি ব্যবস্থা অবলম্বন করলেন তার জন্য তিনি জনসাধারণের বিরাগভাজন হয়ে পড়লেন। তাতে করে গুজব অনুসারে লোকে বিশ্বাস করলো কোম্পানী তাকে এদেশের হিন্দু-মুসলমানকে খ্রীস্টান ধর্মে দীক্ষিত করার জন্য পাঠিয়েছে বিলাত থেকে। লর্ড ডালহৌসী হিন্দু বিধবা পুনর্বিবাহ আইনের খসড়া তৈরি করেছিলেন। আইনটি লর্ড ক্যানিং-এর অনুমোদন লাভ করে শাসনভার হাতে নেয়ার পয়লা বছরেই চালু করা হয়। সতীদাহ প্রথা বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে এ প্রথাটি চালু হওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক। এ সংস্কারের পুরোভাগে ছিলেন বাঙালি কৃতি পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তাঁর বিধবা বিবাহের যুক্তির পশ্চাতে ছিলো শাস্ত্রের সমর্থন। এতে সংস্কারাচ্ছন্ন ব্যক্তিদের ক্ষুব্ধ হওয়ার কথা নয়। বিধবারা রাজী না থাকলে বিয়ে তো হওয়ার কথা নয়। এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য যে ভারতের বিভিন্ন অংশে অব্রাহ্মণ বিধবারা ইচ্ছে করলে আবার বিয়ে করে নতুন জীবনযাপন শুরু করতে পারে। কিন্তু সাধারণ মানুষের সাথে শাসকগোষ্ঠির কোনো সংযোগ ছিলো না। তারা মনে করতে লাগলো শাস্ত্র থেকে সামান্য রকম বিচ্যুত হওয়ার অধিকারও তাদের নেই। ব্রিটিশ সরকার এ ব্যবস্থা করে দিয়ে তাদের মধ্যে আতঙ্কের সঞ্চার করলো। যেহেতু আগে থেকেই তারা ধরে নিয়েছে ব্রিটিশ সরকার তাদের খ্রীস্টান করার জন্য মতলব আঁটছে। সংস্কারাচ্ছন্ন অংশ শাস্ত্রের ওপর হস্তক্ষেপকারী আইনের অপব্যাখ্যা করতে লাগলো। ধর্ম গুরুতর বিপদের সম্মুখীন, সারাদেশে এবং সেপাইদের ছাউনিতে ছাউনিতে এই গুজব ছড়িয়ে পড়লো।

ঐ বছরের জুলাই মাসে জারীকৃত এক ইশতেহারের ফলে বাঙালি পল্টনে যে সকল শ্রেণী থেকে সৈন্য সংগ্রহ করা হতো, সে শ্ৰেণীসমূহকে সাংঘাতিকভাবে আহত করলো। দু’দুবার উচ্চশ্রেণীর ব্রাহ্মণ সেপাইরা সাগর পাড়ি দিতে অস্বীকার করেছে। কিন্তু মাদ্রাজী সেপাইরা সাগর পাড়ি দিতে কোনো আপত্তি উত্থাপন করেনি… যদিও চাকুরির চুক্তিপত্রে সাগর পাড়ি দেয়ার কথার উল্লেখ নেই, যদিও মাদ্রাজী সেপাইদের মধ্যে ব্রাহ্মণের অভাব নেই, তবু তারা দু’দুবার সাগর পাড়ি দিয়েছে। একই শর্তে বাঙালি পল্টনের ৬নং রেজিমেন্টকে সংগ্রহ করা হয়েছে। ব্রহ্মদেশে গিয়ে যুদ্ধ করতে তাদের কোনো আপত্তি ছিলো না। তাই বলে একই নিয়ম ভবিষ্যতের সকল বাহিনীকে কেননা মেনে নিতে হবে সে কথা তাদের বোধগম্য নয়। লর্ড ডালহৌসী নির্দ্বিধায় ৩৮নং পদাতিক বাহিনীর রাজপুত এবং ব্রাহ্মণদের সঙ্গে চুক্তির শর্ত রক্ষা করেছেন। ব্রহ্মদেশে গমনে অনিচ্ছুক সেপাইদেরকে কঠিন দণ্ড দান করার জন্য স্যার প্যাজেটের মতো কোনো শক্তিশালী সর্বাধিনায়কও ছিলো না। যে সকল সেপাই ব্রহ্মদেশে অবস্থান করছে, তাদেরকে দেশে আসতে দেয়া সরকারের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো। তাই লর্ড ক্যানিং নতুন সংগৃহীত সৈন্যদের কাছে চুক্তির শর্তের ব্যাপারে কোনো রকমের নমনীয়তা প্রদর্শন না করতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। সংশোধিত আইনের ফলে সেপাইদের ধর্মীয় অনুভূতি যে আহত হতে পারে এ ছিলো তাঁর ধারণার সম্পূর্ণ অতীত। কারণ এ শর্তে ভর্তি হবে কি হবে না এ ছিলো সম্পূর্ণ তাদের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু একবার ভর্তি হয়ে গেলেই আফগানিস্থান অথবা ব্রহ্মদেশ অথবা সাগরের পাড়ের যে কোন দেশে যেতে আপত্তি করতে পারবে না। সর্বসাধারণের জন্য জারীকৃত ঢালাও নির্দেশ সেপাইদের সচকিত করে তুললো। তাতে ব্যক্তিগতভাবে সেপাইরা ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও মনে করতে লাগলো তাদের সন্তান-সন্ততির জন্য সামরিক বাহিনীতে চাকুরির দরোজা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেলো। পূর্বপুরুষেরা পেশা গ্রহণ করা ছাড়া সেপাইদের গত্যন্তর নেই। কিন্তু পেশার জন্য পূর্ব পুরুষের ধর্মকে বিসর্জন দিতে হবে। তাদের মনে হলো সরকার ধর্মের প্রতি বিশ্বাসহন্তা ছাড়া আর কাউকে সম্মানজনকভাবে চাকুরিতে বহাল করবে না। ধর্ম বিশ্বাস হত্যা করার বদলে সে দৈনিক ডাল-রুটি সংগ্রহ করবে। তারা যদিও রেহাই পেয়েছে, তাদের ছেলেপিলে, নাতি কেউই এ জঘন্য প্রথা থেকে রক্ষা পাবে না। পাপের অন্নে তাদের জীবন ধারণ করতে হবে। এভাবে ইহকাল এবং পরকাল দুইই তারা হারাতে বাধ্য হবে। উচ্চবর্ণের তরুণেরা আবার তুলনায় অনেক কম সংখ্যায় সামরিক বিভাগে চাকুরির আবেদন করতে আরম্ভ করলো। পঞ্চাশ বছরের অসময়োচিত অসুচিন্তিত শাসনব্যবস্থার ফলে জনগণ ধরে নিলো এ ফিরিঙ্গী শাসককুল না করতে পারে এমন কোনো জঘন্য কাজ নেই।

একজন সামরিক অফিসার যিনি পঁচিশ বছর চাকুরির পর অবসর গ্রহণ করেছেন এবং বাঙালি পল্টনের সেপাইদের ভালোমতে চেনেন বলে দাবি করেছেন তার মতে সরকারের অন্যায় বা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের জন্যই সংঘটিত হয়েছে প্রতিটি বিদ্রোহ। উদাহরণ স্বরূপ জাভার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। সেখানে যখন বিদ্রোহ দেখা দিলো সেপাইরা স্বেচ্ছায় কালাপানি পেরিয়ে বিদ্রোহ দমন করতে রাজি হলো। কিন্তু একটি শর্ত, কিছুকাল পরে তাদের আবার ফিরে আসতে দেয়া হবে। কর্তৃপক্ষ প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে না পারায় গোলমাল দেখা দিলো। বেলুড় বিদ্রোহ, ব্যারাকপুর বিদ্রোহ এ সবের মূল কারণ হলো ধর্মীয় আচারের প্রতি অশ্রদ্ধা। সেপাইদের সুযোগ সুবিধা অবহেলা করা হয়েছিলো। নিম্নস্তরে কর্তৃপক্ষ যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে অথবা পূরণে সরাসরি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছে। সেপাইরা ধরে নিলো তাদের ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। তারা সরকারের সর্বোচ্চ পরিষদ এবং তাদের অধীনস্থ কর্মচারিদের কথার মধ্যে যে কোনো প্রভেদ আছে তা ধরতে পারেনি। তার ফলে তারা উভয়ের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেললো। এ বিশ্বাসহীনতা তাদের নৈতিকতার উপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করলো।

১৮৩৩ এবং ১৮৩৪ সালে যে গোলযোগ মাদ্রাজ এবং বাঙালি পল্টনের মধ্যে দেখা দেয় সরকারের প্রকৃত এবং আরোপিত প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করাই হলো তার কারণ। তার ফলে সেপাইদের চোখে সরকারের মর্যাদা রইলো না। সীমিত দৃষ্টিভঙ্গীর সেপাইরা বিদেশে যেতে স্বভাবত:ই অনিচ্ছুক ছিলো। অপরিচিত পরিবেশে গেলে তাদের যে কষ্টের সম্মুখীন হতে হয় তার জন্য অর্থ আদায় করতে চাইতো। তাদের দৃষ্টিতে ভারতবর্ষ এক দেশ নয়। পাঞ্জাব কিংবা সিন্ধু প্রদেশে যুদ্ধ করা ও বিদেশে যুদ্ধ করা একই কথা। প্রথম আফগান যুদ্ধের সময় সিন্ধু নদ অতিক্রম করলে জেনারেল পোলোক সেপাইদের একটা আলাদা বাট্টা দান করেছিলেন। এ দৃষ্টান্তের উল্লেখ করে যতোবার সিন্ধু নদ অতিক্রম করতো প্রতিবারই সেপাইরা আলাদা অর্থ দাবি করতো। ১৮৪৩ সালে সিন্ধু প্রদেশ ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত হলো এবং ভারতবর্ষের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে দাঁড়ালো। সাধারণ ছাউনি থেকে যতো দূরে হোক

কেন, কোনো একটি ভারতীয় প্রদেশে যুদ্ধ করার সময়ে তারা আলাদা ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারে না। কর্তৃপক্ষের এ যুক্তি সেপাইরা মানবে কেনো? সিন্ধুনদ এখনো আছে। ১৮৪২ সালে সিন্ধুর জীবন যাত্রা যে রকম কঠোর ছিলো, এখনো সে রকম আছে। সুতরাং ১৮৪৪ সালে তারা কেননা ক্ষতিপূরণ পাবে না! সিন্ধু নদ অতিক্রমণ বাট্টা না পেলে ৩৪নং বাঙালি রেজিমেন্ট সিন্ধুনদ অতিক্রম করতে অস্বীকার করলো। ৭নং বাঙালি অশ্বারোহী বাহিনীও একই ধূয়া ধরলো। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তাদের একগুঁয়েমীর শায়েস্তা করা হলো না। গুজব রটলো, ইউরোপীয়ানরা সেপাইদের দাবির প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন, কারণ তারা ন্যায্য পাওনার চেয়ে বেশি কিছু দাবী করছে না। কিছু সময়ের জন্য বিদ্রোহীদেরকে আলাদা থাকতে হলো।

তারপরে ৪র্থ এবং ৬৯নং রেজিমেন্ট ৩৪নং বাঙালি রেজিমেন্টের অনুসরণে সিন্ধু নদ অতিক্রমণ বাট্টা না পাওয়া পর্যন্ত সিন্ধু নদ পার হতে রাজী হলো না। ৬৪নং রেজিমেন্টও একই দাবি তুললো এবং সর্বাধিনায়ক তাদের দাবি সঙ্গত মনে করলেন। সিন্ধু প্রদেশে যে সকল সেপাই যুদ্ধ করবার জন্য যায় তাদের নদ অতিক্রমণ বাট্টা ছাড়া অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা এখনো দেয়া হয়ে থাকে। যে সকল সেপাই সিন্ধুতে চাকুরি করার সময় মারা যায় তাদের উত্তরাধিকারীদের পারিবারিক পেনশন দেয়া, হয়। অবশ্য তার জন্য সেপাইর ভালো আচরণ থাকতে হবে। কিন্তু তাদের সর্বাধিনায়ক মোসৃলি ভরসা দিলেন পোলোক যে বাট্টা দিয়েছিলেন, তারা তারও প্রত্যাশা করতে পারে। প্রধান সেনাপতির কথামতো তারা শিকারপুরে পৌঁছে প্রতিশ্রুত বর্ধিত অর্থ ছাড়া তাদের মাইনে নিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলো। তাদের সাথে যে প্রতারণা করা হয়েছে তার প্রতিবাদে তারা সোচ্চার হয়ে উঠলো এবং সমস্ত ব্যাপারটা এক অপ্রীতিকর রূপ পরিগ্রহ করছিলো। কিন্তু জর্জ হান্টার অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে বিষয়টির মোকাবেলা করলেন। তিনি তাদেরকে শুক্কুরে গিয়ে বাট্টাসহ তাদের মাইনে নেয়ার জন্য প্রলুব্ধ করলেন। সেখানে অন্যান্য ইউরোপীয় অফিসারদের উপস্থিতিতে সেপাইদের শান্ত করা হলো। কারো সম্মানের হানি করা হলো না। কিন্তু যে ক্ষতি সাধিত হলো, তার কোনো তুলনা নেই। সেপাইরা দেখলো, উধ্বতন অফিসারদের তারা আর বিশ্বাস করতে পারছে না। ১৮৫৭ সালের সঙ্কটকালে অফিসারদের গ্যারান্টিতে যে তারা আর বিশ্বাস করতে পারেনি তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিই-বা আছে।

মাদ্রাজী সেনাবাহিনীর অবস্থা আরো ভয়াবহ। বাঙালি রেজিমেন্টের সেপাইদের বালবাচ্চা, স্ত্রী সকলেই গ্রামের অধিবাসী। কিন্তু মাদ্রাজ রেজিমেন্টের সেপাইদের স্ত্রী পুত্র তাদের সঙ্গে সঙ্গে থাকে এবং একই সঙ্গে এগুতে হয়। এক অর্থে দূরদেশে গমন তাদের পক্ষে আরো অসম্ভব। ৬নং মাদ্রাজ অশ্বারোহী বাহিনীকে কাম্পতি থেকে জব্বলপুর যাত্রার আদেশ দেয়া হলো। জব্বলপুর মাদ্রাজের বাইরে। তাদেরকে জানানো হয়েছিলো, সেখানে অল্পকাল অপেক্ষা করার পরে তাদেরকে আবার প্রেসিডেন্সিতে ফিরে আসতে দেয়া হবে। পরে তারা জানতে পেলো, তাদেরকে শুধুমাত্র জব্বলপুরে বদলী করা হয়নি, স্থায়ীভাবে নশ’ মাইল দূরবর্তী আড়কোটেও তাদের চাকুরি করতে হবে। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় নিতান্ত অল্প ভাতাতেই তাদের চাকুরি করতে হবে। স্বভাবতঃই তাদের অসন্তোষ আর রাখাঢাকা রইলো না। এ জন্য রেজিমেন্টের অধিনায়ক মেজর ফিল্ডকে দোষারোপ করতে লাগলো। তারা ডিউটি থেকে ফিরে এলো। অধিনায়কের বিরুদ্ধে তারা প্রচণ্ড বিক্ষোভে মেতে উঠলো। কর্তৃপক্ষের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের আরেকটি তাজা দৃষ্টান্ত হলো জব্বলপুরের ঘটনা।

দুর্ভাগ্যবশত : এ অসন্তোষ শুধুমাত্র সেপাইদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইলো না। পদাতিক বাহিনীরও অভিযোগ ছিলো। সিন্ধু প্রদেশে ছাউনি ফেলতে হবে, অথচ তখন বাঙালি রেজিমেন্টগুলো বিশেষ ভাতা ছাড়া সেখানে যেতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলো। সে সময়ে মাদ্রাজ সরকার দু’রেজিমেন্ট পদাতিক বাহিনী পাঠাতে সিদ্ধান্ত নিলেন। মাদ্রাজের গভর্ণর যিনি, তিনি প্রধান সেনাপতিও ছিলেন, ব্রহ্মদেশে গেলে যে সুযোগ-সুবিধা পেতো সে সুবিধা দেয়ার ব্যবস্থা করলেন সেপাইদের। এই ব্যবস্থা আনুসারে মাদ্রাজের সেপাইরা তাদের পরিবারবর্গকে সেখানে রেখে নিজেদের খরচের অল্পস্বল্প টাকা পয়সা মাত্র সম্বল করে বোম্বাইয়ে এসে হাজির হলো। এখানে এসে তাদেরকে হতবাক হতে হলো। তারা জানতে পারলো ভারত সরকার মাদ্রাজের গভর্ণরের প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে রাজী নন। কারণ তা বেঙ্গল রেগুলেশানের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। তারা সরকারের এ ব্যবস্থাকে চূড়ান্ত নিষ্ঠুর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ বলে মনে করলো। সেপাইরা চরম বিশৃঙ্খলভাবে খাদ্যের দাবি করতে থাকে। কিছু টাকা অগ্রিম দেয়া হলো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে টাকা তারা গ্রহণ করলো। এখানে ব্যাপারটা শেষ হয়ে গেলো।

তবে ভারতের গভর্ণর জেনারেল একটি প্রদেশের গভর্ণরের প্রতিশ্রুতিকে সম্মান করার ফলে সেপাইরা গোটা সরকারকেই অবিশ্বাস করতে আরম্ভ করলো। এর জন্য সেপাইদের কোনো দোষ দেয়া চলে না। তারা শুধু দেখলো, যে সরকারের অধীনে তারা চাকুরি করে, সে সরকারের প্রতিশ্রুতির উপর আর নির্ভর করবার কোনো উপায় নেই। লর্ড এলেনবরোও নিজের ভাবে ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে ইন্ধন জুগিয়েছিলেন।

লর্ড ডালহৌসীর বড়লাট থাকার সময়ে ১৮৪৯ সালে একই ব্যাপার ঘটেছিলো। কতিপয় রেজিমেন্ট রাওয়ালপিণ্ডিতে আলাদা ভাতা দাবি করলো। ভাতা ছাড়া তারা তাদের মাসিক মাইনে নিতে রাজী হলো না। তৎকালীন প্রধান সেনাপতি স্যার চার্লস নেপিয়ের শক্তি প্রয়োগ করে সেপাইদের বিদ্রোহ দমন করলেন। সতর্কমূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করেই তিনি সন্তুষ্ট রইলেন না। তিনি অনুসন্ধানে বের হলেন এবং সেপাইদের মধ্যে অসন্তোষ লক্ষ্য করলেন। ডিসেম্বর মাসে ৬৬নং রেজিমেন্ট গোবিন্দগড়ে বিদ্রোহ করে বসলো। কিন্তু অশ্বারোহী বাহিনীর সহায়তায় সে বিদ্রোহ সম্পূর্ণভাবে দমন করা হলো। নেপিয়ের দেখতে পেলেন যে সেপাইদের সত্যিকারের অভিযোগ রয়েছে। তাদের অসুবিধার ক্ষতিপূরণ না করে নতুন অন্তর্ভুক্ত অঞ্চলে তাদেরকে বদলী করা অসঙ্গত। তাই তিনি গভর্ণর জেনারেলের আদেশ মুলতবী রেখে পুরোনো কায়দা অনুসারে সেপাইদের উচ্চহারে ভাতা দিতে নির্দেশ দান করলেন। লর্ড ডালহৌসী নেপিয়েরের এই কাজকে অনুমোদন করলেন না। তাঁর নির্দেশ অমান্য করার জন্য তিনি নেপিয়েরকে তিরস্কার করলেন। নেপিয়ের এই অপমান হজম করতে না পেরে প্রধান সেনাপতির পদ থেকে ইস্তফা দিলেন। সেপাইদের মধ্যে তার কি রকম প্রতিক্রিয়া হয়েছিলো অনুমান করতে মোটেই অসুবিধা হয় না।

ধর্মীয় ভীতি ছাড়াও সেপাইদের অনেক অভাব অভিযোগ ছিলো। মাইনে এবং ভাতাই হলো সরকার এবং সেপাইদের মধ্যে একমাত্র বন্ধন। কিন্তু তাও এমন কিছু আকর্ষণীয় নয়। পদাতিক সেপাইদের মাইনে ছিলো মাসিক সাত টাকা। অশ্বারোহী সেপাইরা প্রতি মৌসুমের জন্য পেতো সাতাশ টাকা এবং এ টাকা থেকেই খরচ করে আপনাপন ঘোড়া কিনতে হতো। সাদা সেপাইদের তুলনায় তাদের বেতন বেদনাদায়ক ভাবে অল্প ছিলো। হোমস বলেছেন, হায়দার আলীর মতো সামরিক প্রতিভার হলেও একজন সেপাইকে কিছুতেই অধীনস্থ একজন ইংরেজ সেপাইর মাইনে দেয়া হবে না। একজন অবসরপ্রাপ্ত অফিসারের মতে ভারতের মোট সৈন্যসংখ্যা ৩,১৫,৫২০ জন। তাতে খরচ পড়ে ৯৮,০২,৮৩৫ পাউণ্ড। তার মধ্যে ৫১,৩১৫ জন ইউরোপীয় সৈন্য এবং অফিসারের পেছনে ৫৬,৬৮,১১০ পাউণ্ড খরচ হয়ে যায়। কিন্তু ইউরোপীয় সৈন্যরা কোনো কাজ করে না। তারা কীভাবে থাকে, খায় এবং কীভাবে মাইনে দেয়া হয়, অন্যান্য সেপাইদের তা জানা নয়। এই বৈষম্যের কারণে কর্তৃপক্ষের প্রতি সেপাইদের বিশ্বাস ক্রমশ: শিথিল হয়ে আসে।

এটা বিশ্বাস করা হতো যে মাইনে অল্প হলেও সেপাইদের অবস্থা বেশ স্বচ্ছল। তাদের প্রয়োজন অল্প, জীবনযাত্রার মান অনুন্নত। কিন্তু তাদের প্রথম কয় মাসের মাইনে অফিসারদের অন্যায়ভাবে তোষণ করতেই ব্যয় হয়ে যায়। সীতারাম বলেছেন, ড্রিল হাবিলদার এবং তাঁর রেজিমেন্টের ইউরোপীয় সার্জেন্ট তাকে পছন্দ করতো না। কারণ ভর্তি হবার সময়ে তিনি উপযুক্ত ফি দেননি। এই ফির পরিমাণ ছিলো ১৬ টাকা যার অধীনে পয়লা চাকুরি করতে হতো সে ইউরোপীয়ান এ টাকা থেকে ৫ কিংবা ৬ টাকা পেতেন। তিনি আরো বলেছেন, মাসে ৭ টাকা মাইনে দিয়ে একজন পাঞ্জাবী অথবা একজন মুসলমান চলতে পারে না।

বেরিলীর অশ্বারোহী বাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন বাঙালি কেরাণীর বর্ণনা থেকে আমরা জানতে পারি, সেপাইদেরকে সামরিক পোশাকের জন্য টাকা দিতে হতো। রেজিমেন্টের বাজারের বানিয়াদের কাছ থেকে দৈনিক রসদ সংগ্রহ করতে হতো। মাইনের দিন রসদ ইত্যাদির দাম কেটে রাখার পর যা বাকী থাকে সৈনিকদের হাতে তা আসতো। কোনো সেপাই মাসে এক টাকা আট আনা এবং কোনো কোনো সেপাই কয়েক আনার বেশি সঞ্চয় করতে পারতো না। শুধু ডাল রুটি খেয়েই তাদের জীবনধারণ করতে হতো। অল্প মাইনের কারণে কোনো রকমের ভাল খাবার-দাবার তাদের ভাগ্যে জুটতো না বললেই চলে। কঠিন কঠোর জীবনযাপন করতে হতো সেপাইদের। নয় টাকার বেশি কখনো আশা করতো না। সেও পদোন্নতি হলে। উৎকর্ষ বিচার না করে চাকুরির মেয়াদ অনুসারেই পদোন্নতি হতো। অশ্বারোহী সেপাইদের অবস্থাও সাধারণ সেপাইদের চাইতে এমন কিছু ভালো ছিলো না। তারা একুশ থেকে ত্রিশ টাকা পর্যন্ত মাইনে পেতো। তা থেকে অনেকভাবে টাকা কেটে রাখা হতো।

বেতনের পরিমাণ সেপাইদের মনস্তত্বে গভীর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। তারা লক্ষ্য করলে অধিক মাইনেধারী ইউরোপীয় সৈন্যের সংখ্যা নিতান্তই অল্প। সেপাইদেরকে সাগরের পরপারের দেশে যুদ্ধ করতে পাঠালে তাদের খরচা যে কম হয়, এ কথাও বেশ পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারলো। সুতরাং তারা ধর্মের বিরুদ্ধে ব্রিটিশের বর্তমান গুজবকে সত্য বলে বিশ্বাস করলো।

সংখ্যালঘিষ্ঠ শ্বেতকায় এবং দেশীয় সেপাইদের মধ্যে আগে যে ভালো সম্পর্ক ছিলো, এখন তা অতীতের ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। সীতারাম আপন জবানীতে যা বলেছেন, আমি সবসময় ইংরেজ সেপাইদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রক্ষা করতাম। আগে তারা আমাদেরকে অপরিমিত স্নেহ সহানুভূতি দেখাতেন। আমরা কি তাদের সমস্ত কঠিন কাজগুলো করি না? প্রখর উত্তাপ মাথায় নিয়ে আমরা তাঁদের পাহারা দিয়েছি। তাঁদের বাসার সামনে প্রহরীগিরি করেছি, আমাদের খাদ্যদ্রব্যের অংশ দিয়েছি। বর্তমানের সৈন্যদের সকলেই ভিন্ন ধরনের মানুষ। আগেকার সাহেবদের মতো দীর্ঘকায় এবং সুদর্শন নন। গালাগালি ছাড়া আমাদের ভাষায় একটা কথাও বলতে পারবেন না। বস্তুত:, একজন শ্বেতকায় সৈনিক রেগে গেলে মুখ দিয়ে গালাগালি ছাড়া কিছু বের হতো না। সীতারামের মতে আগেকার দিনেও ইউরোপীয়ান সার্জেন্টরা দেশীয় সেপাই বা এ্যডজুট্যান্টের নামে হাজার রকম নালিশ করতেন। তার ফলে সেপাইদের কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হতো না।

উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে বসবাসকারী একজন ইংরেজ ভদ্রলোকের মতে, কমিশন প্রাপ্ত অফিসারদের এবং সেপাইদের মধ্যে সৌহার্দমূলক সম্বন্ধ ছিলো না। একে অন্যের কাছে ছিলো সম্পূর্ণ অচেনা। সেপাইদেরকে তারা মানবেতর জীব বলে মনে করতেন। বিশ্রী গালাগাল দিতেন, শূয়র ছাড়া ডাকতেন না। সম্মানীয় দেশীয় সেপাই বিশেষ করে মুসলমানেরা তা ভয়ংকর অপমানজনক মনে করতো। বুড়ো অফিসারেরা অপেক্ষাকৃত শান্ত ছিলেন; কিন্তু তরুণ অফিসারেরা তাতে বেশ মজা পেতেন। সেপাইদের সঙ্গে মানবেতর জীবের মতো আচরণ করাকে তারা খুবই প্রশংসনীয় কাজ মনে করতেন। ইউরোপীয় সাধারণ সৈন্যটিও সেপাইদের যে মানুষের সম্মান দিতো না, এ কথা বাঙালি পল্টনে লেফটেন্যান্ট কর্ণেল উইলিয়াম হান্টার সাহেবও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় স্বীকার করেছেন।

শুধু সামরিক শক্তির উপর নির্ভর করে একটি বিদেশী সরকার চলতে পারে না। শাসকদেরকে শ্রদ্ধাও আকর্ষণ করতে হয়। সেপাইরা যদি অফিসারদের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে তা হলে সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা নষ্ট হবে, তা একরকম অবশ্যম্ভাবী। আগে অফিসারেরা তাঁদের অধীনস্থ সেপাইদের ছিলেন সহায়। তাঁরা ব্যক্তিগতভাবে সেপাইদের ভালোমন্দ দেখাশোনা করতেন। যখন প্রয়োজন তারা নিঃসংকোচে গিয়ে অফিসারদের সঙ্গে দেখা করতে পারতো। সীতারাম বলেছেন, আগেকার দিনে সাহেবরা নাচের অনুষ্ঠান করতেন রেজিমেন্টে। আগ্রহ সহকারে খেলাধুলা দেখতে আসতেন। শিকারে যাওয়ার সময় সমস্ত সেপাইদের নিয়ে যেতেন। পরবর্তীকালের সাহেবরা যে আগেকার সাহেবদের মতো নন তাঁদের মর্জি-মেজাজ আলাদা সে কথা সীতারাম এবং হেদায়েত আলী দু’জনেই উল্লেখ করেছেন। হেদায়েত আলী বলেছেন, ‘কোনো সেপাই সাহেবদের বাঙলোতে তাদের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তারা ভয়ানক চটে যেতেন। পাদরীরা সাহেবদের উপর প্রভাব বিস্তার করাতেই সাহেবরা সেপাইদের চাইতে দূরে সরে গেছে বলে সীতারামের ধারণা। হেদায়েত আলী সাহেবদের এই ঔদাসীন্যকেই সিপাহী বিদ্রোহের কারণ বলে উল্লেখ করেছেন।

আবার অফিসার এবং সেপাইদের ঘনিষ্ঠতা বেশি হলে শৃঙ্খলার উন্নয়ন সম্ভব নয়। একজন দায়িত্বহীন অফিসার অধীনস্থ সেপাইদের সামনে নিজের অভাব অভিযোগের কথা বলে ফেলে অতি সহজে সরকারের মর্যাদাকে সেপাইদের চোখে অবনমিত করতে পারে। লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংকের অর্থনৈতিক সংস্কারের ফলে ইউরোপীয় অফিসারবৃন্দের মধ্যে মহা-অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। তারা খোলাখুলি ইউরোপীয় এবং ভারতীয় সৈন্যদের সামনে বিদ্রোহের আলাপ করতো। এ বিষয়ে সীতারাম কিঞ্চিৎ আলোকপাত করেছেন। ভারতে যে নতুন লাট সাহেব এসেছেন, অফিসারেরা তাকে মোটেই পছন্দ করে না। তিনি তাদের মাইনে কমিয়ে দিয়েছেন। অফিসারেরা তো বিদ্রোহ করে করে অবস্থা। তারা ঘরে ঘরে অনেক সভা করলো, তাদের মন খারাপ হয়ে গেলো। অনেকে সরকারের অধীনে চাকুরি করবে না বলাবলি করতে লাগলো। কোম্পানী বাহাদুর এই লাট সাহেবকে টাকা বাঁচাবার জন্য পাঠিয়েছেন, কারণ যুদ্ধে অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। তারা বলতে লাগলেন, তাঁরা গরীব হয়ে পড়বে। কিন্তু একথা কে বিশ্বাস করে? কোম্পানী বাহাদুরের আবার টাকার অভাব কিসের? আমি এক রেজিমেন্টের লোকদের বলতে শুনেছি কলকাতা গিয়ে লাটসাহেবকে তাদের হক্তের দাবি মানতে বাধ্য করার জন্য তাদের সঙ্গে যেতে রাজী আছে কিনা। আমাকেও বলা হলো স্বদেশীয় অফিসারদের বাট্টার দাবির বিরুদ্ধে ইউরোপীয় অফিসারেরা কিছুই বলবে না। এ সময়ে সমস্ত অফিসারেরা লাট সাহেবের উপর ভয়ংকরভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো এবং সরকারের বিরুদ্ধে অনেক কথাই বললো। তারা লাট সাহেবকেই দোষারোপ করলেন সবচেয়ে বেশি, তিনি নাকি কোম্পানীর খোশামোদ করতে চান। ১৮৪৩ সালে এবং ১৮৪৯ সালে সশস্ত্র– অভ্যুত্থান করে দাবি আদায় করার পেছনেও একই বোধ সেপাইদের মধ্যে সক্রিয় ছিলো। ইউরোপীয় অফিসারদের তাঁদের লোকজনের ভরণপোষণের কারণে, বেশি মাইনের জন্য বিদ্রোহ করতে যদি নৈতিকভাবে না বাধে-তাহলে দেশীয় সেপাইদের ধর্মের সমর্থনে বিদ্রোহ করতে বাধবে কেনো?

অনেক সময় বাঙালি পল্টনের জুনিয়র অফিসারদের অবিমৃষ্যকারিতা সামরিক আইনের বাইরে চলে যেতো এবং প্রকাশ্যে তারা নিয়ম-শৃঙ্খলা ভঙ্গ করতেন। জন জেকব বেদনাদায়কভাবে অফিসারদের মধ্যে উচ্চ নৈতিকতাবোধ এবং এ্যাংলো স্যাকসন সতোর অভাব দেখেছেন। একজন জুনিয়র অফিসার অনেকগুলো চাকর বাকর রাখতেন। তিনি রৌদ্রে যাবেন না, ঘোড়ার বদলে পাল্কীতে চড়ে ভ্রমণ করবেন। অন্য লোক তাঁকে পায়খানা ও প্রস্রাবখানায় নিয়ে যাবে। তার একজন খানসামা, একজন পরিচারক, একজন সর্দার বেয়ারা এবং অনেকগুলো বেয়ারা না হলে চলবে না। তাছাড়াও তাঁর বহু চাকরের প্রয়োজন। একজন হুঁকো বইবে, একজন বইবে ছাতা, একজন পানপাত্র এগিয়ে দেবে, চেয়ার এগিয়ে দেবে একজন। বলাই বাহুল্য সকল কাজ একজন মানুষের পক্ষে যথেষ্ট। ভারতে বসবাসকারী একজন সাধারণ ইউরোপীয় নিজের পানি উঠাতে পারেন না, নিজের পাক নিজে করতে পারেন না। এমন কি নিজের দাড়িও নিজে কামাতে পারেন না। অফিসারদেরকে সকালবেলা আধো ঘুম, আধো জাগ্রত অবস্থায় নাপিতেরা গিয়ে দাড়ি কামিয়ে দিয়ে আসতো। এ ধরনের আরাম-আয়েসের জীবন ধারণের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয়ের প্রয়োজন পড়তো। জুয়া ইত্যাদি না খেললেও তাদের ন্যায্য মাইনের সাহায্যে এতো খরচ মেটানো সম্ভবপর ছিলো না। জুয়া খেলা ছিলো সামরিক মেসে একটি নিত্যনৈমিত্তিক প্রথা। তাই তাদের সব সময়ে দেনাদার অবস্থাতেই কাটাতে হতো। পাওনাদারদের দাবি মেটানোর জন্য তাদের অন্যায় পথ অবলম্বন না করে উপায় থাকতো না অনেক সময়ে। আরো আগে যে বেরিলীর বাঙালি কেরাণীর কথা উল্লেখ করেছি তিনি সেপাই, অশ্বারোহী এবং ইউরোপীয় অফিসারদেরও চড়া সুদে টাকা ধার দিতেন। ভারতবর্ষে দেনাদারদের প্রতি এক ধরনের অনুকম্পা মিশ্রিত মনোভাব প্রদর্শন করা হয়ে থাকে। অফিসারদের তাঁদের অধীনস্থ দেশীয়দের কাছ থেকে টাকা ধার করে সম্মান হারানোর কোনো ভয় না থাকলেও তাদেরকে কিছু কিছু সুবিধা দেয়া হতো। বাঙালি কেরাণী সরকারি তহবিল থেকে টাকা ধার দিতো না। কিন্তু সীতারামের কথামতো প্রত্যেক পে হাবিলদার অফিসারদের প্রয়োজনের সময় তহবিল থেকে টাকা ধার দিতেন। সীতারাম বলেছেন পে হাবিলদারেরা সাহেবদের টাকা ধার দিতেন। সমস্ত অফিসারের মাইনে তাঁদের হাত দিয়ে বিলি হতো বলে টাকা মারা যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিলো না। কোনো অফিসার মারা গেলে আমরা সে দাবি তুলতাম না। এ ছিলো নিষিদ্ধ প্রথা। একবার শুনলে তার জন্য শাস্তি পেতে হতো। অফিসারেরা যথেষ্ট মাইনে পেলেও তাদের খরচের জন্য সে টাকা যথেষ্ট ছিলো না এবং সকল সময়ে তাঁদের অভাব লেগেই থাকতো। আমাদের রেজিমেন্টে মাত্র দু’জন অফিসার ছিলেন, যারা কোনো কর্জ গ্রহণ করেননি। মাইনের বেশির ভাগ টাকা তারা ভোজানুষ্ঠানে, জুয়াখেলা এবং রেসের পেছনে খরচ করে ফেলতেন। বিবাহিত সাহেবদের প্রায়শ: দেনাদার থাকতে হতো। পে হাবিলদার হিসেবে সীতারাম তাঁর কাছে গচ্ছিত সেপাইদের পাঁচশ টাকা ধার দিয়েছিলেন। একবার এক দুর্ঘটনায় তার কোম্পানীর এক সাহেব সর্বহারা হয়ে পড়েন। তিনি তাঁকে পাঁচ’শ টাকা ধার দিয়েছিলেন। একবার এক দুর্ঘটনায় তার কোম্পানীর এক সাহেব সর্বহারা হয়ে পড়েন। তিনি তাঁকে পাঁচ’শ টাকা ধার দিতে বলেন। কিন্তু সীতারামের সঞ্চিত টাকা ধার দিয়ে ফেলায়, তিনি তাঁর হেফাজতে রক্ষিত সেপাইদের টাকা হাওলাত দিয়ে ফেলেন। সে অফিসারটি যথাসময়ে টাকা ফেরত দিতে পারলেন না। সেপাইরা টাকা চাইলে সীতারাম তাদের দাবি মেটাতে পারলেন না। তার নামে কর্ণেলের কাছে নালিশ করা হলো এবং তাকে কোর্ট মার্শালের সম্মুখীন হতে হলো। কিন্তু সীতারাম সেজন্য ক্যাপ্টেনদের দোষী না করে দেশীয় সেপাইদেরকেই দোষী করেছেন।

ইউরোপীয়ান অফিসারদের হারেম, তাদের এবং তাদের অধীনস্থ সেপাইদের সখ্যতা সূত্র বলে বিবেচিত হতো। ধীরে ধীরে হারেমে দুর্নীতি ভয়ানকভাবে ছড়িয়ে পড়লো। আমাদের অধিকাংশ অফিসার তাদের সঙ্গে হিন্দুস্থানী স্ত্রীলোক রাখতেন। রেজিমেন্টের উপর এর খুব প্রভাব ছিলো। সেপাইরা সব সময়ে এমন ভাব দেখাতো, তাদের কাছে অনেক স্ত্রীলোক আছে যাতে করে অফিসারেরা তাদেরকে ঘুষ দেয়। আবার অনেক সেপাই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে টাকার লালসায় আপন আত্মীয়াদেরকেও সাহেবদেরকে দিয়ে দিত। অবশ্য তাদের অনেকেই ছিলো নিম্নশ্রেণীর।

বলা হয়ে থাকে যে, বেদণ্ড তুলে দেয়ার কারণে সামরিক শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হয়েছিলো। সামরিকশৃঙ্খলা মহৎ, সূক্ষ্ম যা মানুষের উচ্চতরো অনুভূতিতে নাড়া দেয় তার উপরই নির্ভরশীল। শুধুমাত্র শারীরিক নির্যাতনের সাহায্যে সামরিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা যায় না। কিন্তু শৃঙ্খলা বলার বদলে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেই প্রতিষ্ঠা করা যায়। বাঙালি পল্টনের অভিজ্ঞ সেপাইরা ভালোমানুষী ব্যবহারের ফলে উজ্জ্বল হয়ে পড়েছিলো। হেদায়েত আলী কঠোর শাস্তিদানের সুপারিশ করেছেন। বাঙালি পল্টনের সেপাইরা জুনিয়র অফিসারদের খারাপ গালাগালির কারণে মারমুখো হয়ে উঠেছিলো। তারা তাদের দুর্মুখ অধিনায়কদের বিরুদ্ধে সব সময় আপত্তিজনক কথাবার্তা বলতো। সবসময় তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা করতো, যার ফলে তার অধীনস্থ সেপাইদের ওপর যতোদূর অফিসারের নৈতিক প্রভাব ছিলো তা অবসিত হয়ে এলো। বিভিন্ন রকমের পেশাদার সৈন্যের সাহায্যে কোনো বিদেশী একটা দেশ যখন শাসন করে, শীগগির অথবা বিলম্বে তাতে বিদ্রোহ বিক্ষোভ ইত্যাদির উদ্ভব হবেই হবে। শাসকদের যুদ্ধ সেপাইরা এতোকাল ব্যস্ত ছিলো বলে আগে তা ঘটতে পারেনি। অপরিসীম বীর্যবান অধিনায়কদের অধীনে চাকুরি করার পেশাগত গর্বই এতোকাল তাদেরকে রাজভক্ত রেখেছিলো। খারাপ পদ্ধতি নৈতিকতাহীনতা এবং বিশ্বাসহীনতার কারণে বহুকাল আগেই সে গর্ব অন্তর্হিত হয়েছে।

সেনাবাহিনী অত্যন্ত প্রয়োজনের সময় উপযুক্ত অফিসারদের হারালো। রাজনৈতিক এবং শাসনকার্যে অধিক সুবিধা দেয়া হলে প্রতিশ্রুতিশীল তরুণেরা সেদিকে ঝুঁকে পড়লেন। কেউ সেনাবিভাগে বড় একটা আসতে চাইতেন না। রেজিমেন্টগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সমগ্র সেনাবাহিনীতে কখনও প্রতিভার অভাব হয়নি। অনেকেই ছিলেন, যারা ১৯৫৬-৫৭ সালের সঙ্কটে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণিত করেছিলেন এবং কেউ কেউ ফিল্ড মার্শাল হওয়ার সম্মান পর্যন্ত লাভ করেছেন। নতুন শাসনব্যবস্থা অনুসারে তরুণ অফিসারদের উপর রেজিমেন্টগুলোর দায়িত্ব দেয়া হলো, যাদের অনেকেই ছিলেন সেপাইদের কাছে আগন্তুক। সেজন্য সঙ্কটের সময়ে সেপাইদের মতামত ফেরানোর মতো ওজন তাঁদের ছিলো না। ব্রেসিয়ারের মতো অফিসার যখন এলাহাবাদের শিখ সেপাইদের বিদ্রোহ করা থেকে নিরস্ত করতে পেরেছিলেন, এটা বিশ্বাস করা যায় যে, অনুরূপ দক্ষতা এবং প্রাণশক্তিসম্পন্ন অফিসার অন্যান্য স্থানে থাকলেও তারা বিদ্রোহ দমন করতে পারতেন। ভালো ভালো বেসামরিক অফিসারদের নতুন অধিকৃত পাঞ্জাবে বদলী করা হয়। শুধুমাত্র কিছু সংখ্যক ভালো সিভিলিয়ান অযোধ্যা এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে কর্মরত ছিলেন।

শান্তির সময়ে ছাড়া দেশীয় অফিসারদের খুব বেশি কিছু করার ছিলো না। অনেকেই নিমকহারামী করেননি। কিন্তু বেশি বয়সে প্রমোশনের জন্য, তাদের যে পরিমাণ শক্তি, সাহস এবং উদ্দীপনার প্রয়োজন, তা আর তাদের শরীরে ছিলো না। ৪৫ বছর একটানা চাকুরী করার পর ৬৫ বছর বয়সে সীতারাম সুবাদার পদে উন্নীত হন। দেশীয় সেপাইরা এর চেয়ে কোনো উচ্চতরো পদে অধিষ্ঠিত হতে পারতো না। মিথ্যা অর্থনীতির অজুহাত দেখিয়ে ইউরোপীয় এবং দেশীয় সেপাইদের যে বয়সে অবসর গ্রহণ করা উচিত, সে বয়সে অবসর নিতে দেয়া হতো না। তার ফলে, ইউরোপীয়ান অফিসারেরা তাদের অধীনস্থ ভারতীয় সৈন্যদের সঙ্গে মেলামেশা করতে চাইতো না এবং ভারতীয় সেপাইরা শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়তে এবং মানসিক ক্ষিপ্রতা হারিয়ে ফেলতো। সে কারণে অনেক রেজিমেন্টের শৃঙ্খলা ভয়ানকভাবে আহত হতো। অবশেষে পরিস্থিতি এমন জটিল আকার ধারণ করলো যে কালা আদমীরা প্রশ্নকর্তাদের সন্তুষ্ট করার জন্য আসল জবাব না দিয়ে, বানিয়ে বানিয়ে প্রশ্নের জবাব দিতো। অফিসারেরা তাঁদের অধীনস্থ সেপাইদের সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞই রয়ে গেলেন। কারণ জমাদার এবং সুবাদারেরা তাদের অফিসারের সামনে মন খুলে কথা বলতো না। উপরিঅলাকে সন্তুষ্ট করার জন্য পরিকল্পিত পদ্ধতিতে প্রশ্নের জবাব দিতো।

সেপাইদের মধ্যে সরকারের বিরুদ্ধে যখন অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে, জনগণের মনোভাবও তখন সরকারের প্রতি প্রসন্ন নয়। প্রেসিডেন্সী শহরগুলোর মাত্র অল্প সংখ্যক শিক্ষিত লোক সরকারের শাসনব্যবস্থা এবং পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তনকে ভালো বলে গ্রহণ করতে পেরেছেন। উত্তর ভারতের একজন অধিবাসী কলকাতার বাবুদের বিদ্রূপ করে বলেছেন, “তারা শেক্সপীয়র, মিল্টন পড়াবার শিক্ষক এবং এটর্ণি হবারই উপযুক্ত।” এই শিক্ষিতরাও কিন্তু সকলে ইংরেজদেরকে সমর্থন করতো না। বাঙলার একজন শিক্ষিত হিন্দু অভিযোগ করেছেন, “একশো বছরের নির্মম অত্যাচারের দাগ কোনো মহত্বের স্পর্শে মুছে যাবার নয়।” এদেশের হিন্দু এবং ইংরেজরা একশ বছর ধরে পাশাপাশি বাস করলেও তারা বন্ধু কিংবা শান্তিপ্রিয় প্রতিবেশীতে পরিণত হতে পারেনি। শাসক গোষ্ঠির সামাজিক বিচ্ছিন্নতাই বিদ্রোহের সময়ে যে অসন্তোষ বিরাজ করেছিলো তার একটি প্রধান কারণ বলে শানোন-এর লেফটেন্যান্ট কর্ণেল ভার্ণির ধারণা। আমার মনে হলো ইংরেজ অধিবাসীরা এদেশীয়দের প্রতি অনেকটা বিতৃষ্ণ, তা তাদের আচার আচরণেই দেখতে পেলাম। আমার ধারণা, ভারতের প্রতিটি ইংরেজের মনে এদেশীয়দের প্রতি যে গভীর ঘৃণাবোধ ছিলো তা-ই বিদ্রোহের একটি কারণ। এদেশীয়দের প্রতি ইংরেজরা যখন কোনো দয়া করতেন, তখন তাঁদের চোখে-মুখে ঘৃণাবোধটাই সুস্পষ্টভাবে প্রকটিত হয়ে উঠতো। এমনকি যাজক এবং অন্যান্যরা, যারা হিন্দুদের ভালো করতে চেষ্টা করতেন, তারাও আমাকে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন যে, যারা আমাদেরকে অস্পৃশ্য বলে গণ্য করে, তাদের সঙ্গে এমন ব্যবহার করতে হয়। আমাদের ভোলা উচিত নয় যে মুষ্টিমেয় বিদেশী-যারা অসংখ্য বিদেশীর উপর শাসনকার্য পরিচালনা করেন, তারা যদি এদেশের জনস্রোতে মিশে যেতে রাজী না হন, তাহলে তাদেরকে একটি সংঘবদ্ধ একক হিসাবে একটি উন্নত সম্প্রদায় বলে নিজেদের প্রমাণিত করতে হবে। অন্যথা, শুধুমাত্র নিরাপদ ব্যবধানে রেখে তারা শাসিতদের শ্রদ্ধা অর্জন করতে সক্ষম হবে না। শাসক এবং শাসিত দু’শ্রেণী যখন দু’টি বিভিন্ন জাতি তখন জাতিগত কৌলীন্য থেকে উদ্ভূত বিভিন্ন মারমুখী প্রভেদ ঘুচাবার মধ্যপন্থা বের করে নেয়া সত্যিই অসম্ভব। ভারতীয়দেরকে ইংরেজরা সব সময় অবজ্ঞা করতেন। কোম্পানীর বিশ্বস্ত কর্মচারী স্যার সৈয়দ আহমদ খান বলেছেন, প্রথমদিকের বছরগুলোতে জনগণ কোম্পানীর শাসন পছন্দ করেছিলো। তিনি বলেন, “সরকার আপনা থেকেই জনগণের শুভেচ্ছার পথ বন্ধ করে দিয়েছেন এবং সেজন্য সঙ্গত কারণেই জনগণ মনে করে যে তাদের সঙ্গে অসম্মানজনকভাবে আচরণ করা হয়। একজন ডিউকের কাছে একজন সাধারণ অফিসারের মূল্য যতোটুকু একজন এদেশীয় ভদ্রলোককে ঐ অফিসার এতোটুকু মূল্যও দেন না। একথা সরকার ভালোভাবে জানেন না যে অভিজাত দেশীয় ভদ্রলোকদের কোম্পানীর অফিসারের সামনে আসতে হৃদকম্প হতো আতঙ্কে। কিশোরীচাঁদ মিত্র, যিনি নিজেকে অনুগত নাগরিক এবং শিক্ষিত শ্রেণীর প্রতিভূ বলে দাবি করতে পারেন, তিনিও নালিশ করেছেন যে, ইউরোপীয় অফিসারদের রুষ্ট মেজাজই তাদের সাধারণ জনগণের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিলো। তাঁদের মধ্যে তার ফলে আসমান জমিন দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছিলো এবং একে অন্যের মনোভাব বুঝতে পারতো না। ইংরেজরা ভারতীয়দের থেকে অনেক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলো। রাসেল বারানসী যাবার সময় লক্ষ্য করেছেন, কোনো সাদা মানুষের গাড়ির প্রতি জনসাধারণ প্রতিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়নি। তিনি বলেছেন, সে চোখের ভাষা কে পারে ভুল বুঝতে? শুধুমাত্র তা থেকেই আমি জানতে পারলাম আমার জাতকে এক সময়ে অনেকে ভয় করেছে, এখন ঘৃণা করতে শুরু করেছে।

উপযুক্ত দেশীয়দেরকে সরকারি চাকুরি থেকে ধারাবাহিকভাবে বহিষ্কার করার কারণে ভারতীয়দের অসন্তোষ আরো ব্যাপক আকার ধারণ করে। ভারতীয়রা শাসন বিভাগে ডেপুটি কালেক্টর এবং বিচার বিভাগে সদর আমীনের চাইতে কোনো উচ্চতরো চাকুরিতে নিয়োজিত হতে পারতো না। কিন্তু ভারতীয়দের মধ্যে কোনো প্রতিভার অভাব ছিলো না। তাদের পিতা পিতামহরা যে এদেশ শাসন করেছে, সেনাবাহিনী পরিচালনা করেছে, সে স্মৃতি এখনো তাদের মনে জীবন্ত। আইনের চোখে সকলকে সমান করে দেয়ার কারণে, ভারতের অভিজাত সমাজের অভিযোগ ফেনিয়ে উঠলো। ব্রিটিশ আইন ধনী-নির্ধন, উঁচু-নীচ, রাজা এবং প্রজার মধ্যে কোনো ভেদাভেদ রাখেনি। লখনৌর ওয়ালী বিরজিস কাদের তাঁর এক ফরমানে বলেছেন, হিন্দু মুসলমান সকলের কাছেই চারটি জিনিস পরম মূল্যবান। প্রথম হলো ধর্ম, দ্বিতীয় হলো সম্মান, তৃতীয় জীবন, চতুর্থ সম্পদ। দেশীয় শাসকদের অধীনে এ চারটি জিনিস সব সময় নিরাপদ। তিনি আরো বলেছেন, আগের শাসনামলে অভিজাত মুসলমান এবং উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের সম্মান রক্ষা করা হতো। কিন্তু ইংরেজরা উল্লেখিত চারিটি জিনিসের শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে। উচ্চ এবং নীচের সম্মান এবং মর্যাদা তাদের আইনে এক করে ফেলা হয়েছে। নীচ সম্প্রদায়ের তুলনায় উচ্চবর্ণ এবং অভিজাতদের সঙ্গে তারা আরো খারাপ ব্যবহার করে। এ অভিযোগ ভিত্তিহীন নয়। কিন্তু তাতে ইংরেজদের কৃতিত্বই প্রমাণিত হয়। তারা জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কারণেই তা করেছিলেন। সে যাহোক, অনেক ইংরেজ ভদ্রলোক এবং অধিকাংশ ভারতীয় এর বিরোধিতা করেছিলেন। লখনৌ ঘোষণার মধ্যেও একই মনোভাবের প্রকাশ দেখা যায়। রাজা এবং নওয়াবদের যে ইংরেজরা হাজির হতে বাধ্য করে তাদের সঙ্গে চামারের তুলনা করা হয়েছে। আইন লোকের সম্মানের রক্ষক রইলো না। আর, এতোকাল যে সকল লোক আইনের উর্ধ্বে ছিলেন, তাঁদেরকে আইনের আওতায় আসতে বাধ্য করার ফলে তাঁদের মধ্যে অসন্তোষের সীমা রইলো না। তাছাড়া এ আইন জনগণের কাছেও প্রিয় ছিলো না। তার কারণ এ নয় যে, আইন নিষ্ক্রিয় ছিলো, বিচারালয়গুলোর দুর্নীতিই আইনের অপ্রিয় হওয়ার কারণ। তা ছাড়া এদেশের অশিক্ষিত জনগণ ইংরেজদের আইনের অতো ঘোরপ্যাঁচ বুঝতে পারে না। তাদের বক্তব্য পেশ করার জন্য একজন উকিল নিয়োগ করা তাদের অনেকের পক্ষেই সম্ভব ছিলো না। আগেকার প্রথা অনুসারে ধনী-দরিদ্র সকলেরই অবাধে বিচারালয়ে প্রবেশ করতে কোনো বাধা ছিলো না। সকলেই খোলাখুলি আপনাপন অভিযোগ ব্যক্ত করতে পারতো। একজন দরিদ্র কৃষককেও কোনো বাধার সম্মুখীন হতে হতো না। ডেপুটি কমিশনারের বিচারালয়কে খোলা বিচারসভা বলে শোনার পর একবার সীতারাম চাপরাশীর নির্দেশ অমান্য করে বিচার কক্ষে প্রবেশ করেছিলেন এবং সে জন্য দশ টাকা অর্থদণ্ড হয়েছিলো। সীতারাম কিভাবে যে আইন লঙ্ঘন করেছিলেন, এ কথা কোনোদিন বুঝতে পারেননি; পুলিশ এবং ছোটখাট কর্মচারীদের দুর্নীতির কুখ্যাতি এবং মন্দ আচরণের জন্য বিচারালয়গুলো আরো অপ্রিয় হয়ে পড়লো। দেশের মানুষ বিশ্বাস করতে লাগলো অধীনস্থ কর্মচারীরা যে টাকা উৎকোচ গ্রহণ করে তার একাংশ বড়ো সাহেবের কাছেও যায়। সুতরাং বিচারালয় ধনীদের হাতের একটি অস্ত্র হয়ে দাঁড়ালো, বিচারালয়ের মাধ্যমে অত্যাচার করা হতে লাগলো। মিথ্যা সাক্ষ্য দেবার মানুষ কিনতে পাওয়া যেতো এবং মিথ্যা দাবি হাজির করা হতো। জমি বিক্রয়ের আইনটা ছিলো সবচেয়ে অপ্রিয়। প্রাচীন প্রথা অনুসারে জমি বেহাত হতো না। একজন মালিক যদি বকেয়া খাজনা শোধ না করতে পারতো তা হলে, আত্মীয় স্বজনেরা মুক্ত করে না নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত তাদেরকে আটক করে রাখা হতো। তাছাড়া ফসলের মাধ্যমে খাজনা পরিশোধ করতে হতো। তাও পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন ফসলের সময়ে আদায় করা হতো। এ পদ্ধতিটা সেকেলে এবং সংস্কার সাপেক্ষ ছিলো তাতে সন্দেহ নেই। কোম্পানীর সরকার বকেয়াদারদের জমি দখল করে নেয়ার কার্যকরী, সরল এবং দ্রুত পদ্ধতির প্রবর্তন করলেন। থিয়োরীগতভাবে দেখতে গেলে এ পদ্ধতির কোনো দোষ পাওয়া যাবে না। যদি সে খাজনা শোধ করতে না পারে তা হলে স্বত্ব হারাবে। কিন্তু জমির প্রতি তাদের ছিলো অন্তহীন মমতা। খাজনা ছাড়াও জমির মাধ্যমে একটা সম্প্রদায় গড়ে উঠেছিলো। যারা কেউ হয়তো তাদের আত্মীয় নয়, একই গ্রামবাসী কৃষক হয়তো সকলে। জমি হারালে শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি হতো না, সামাজিক মর্যাদাও চলে যেতো।

খাজনার পরিমাণ পরিমিত হলে জমি বিক্রয়ের আইন প্রজা সাধারণের তেমন ক্ষতি করতো না। সরকার খাজনা নিরূপণের স্পষ্ট আইন করে দিয়েছেন। কড়াকড়ি ভাবে আইনানুসারে সবকিছু করা হলে কখনো অঘটন ঘটতো না। মথুরার কালেক্টর মিঃ থর্ণহিল এ সম্বন্ধে বলেছেন, সরকারি আইনের প্রতি নিয়মিত আনুগত্য পোষণ করা হলে, কর্মচারীদের পদোন্নতি হয় না। খাজনা নির্ধারণের জন্য জমি জরীপের ভার ছিলো তরুণ কর্মচারীদের ওপর-যদের চাকুরি জীবনের সম্পূর্ণ ভবিষ্যৎ এর ওপর নির্ভর করছিলো। তারা এমন বেশি খাজনা ধার্য করলো যা জমিদারদের পক্ষে দীর্ঘদিন নিয়মিতভাবে শোধ করা অসম্ভব ছিলো। ভাল ফসলের সময় অল্পস্বল্প খাজনার দাবি মেটালেও অজন্মর বছরে তারা দাবি মেটাতে গিয়ে একেবারে ধ্বংস হয়ে গেলো। উইলিয়াম এডওয়ার্ড নামে এক ব্যক্তি যিনি বদাউনের ম্যাজিস্ট্রেট এবং কালেক্টর ছিলেন তাঁর বক্তব্যেও এর সমর্থন পাওয়া যায়। জমিদার তালুকদার এবং বেশি জমিনের মালিকদের দুর্দশার অন্ত নেই। অন্যদিকে কোম্পানীর শাসনের সুযোগ নিয়ে নতুন গজানো বেনিয়া সম্প্রদায় ফেঁপে ফুলে উঠতে লাগলোলা। সামন্ত এবং দেশীয় রাজন্যবর্গ পেনশনভোগীতে পরিণত হলেন। সুতরাং বিপদের সময়ে সরকারি ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়লে শান্তি এবং শৃঙ্খলা রক্ষা করার জন্য গ্রামাঞ্চলে কেউ সচেষ্ট হননি।

শাহরানপুরের ম্যাজিস্ট্রেট বলেছেন, “কতিপয় সুদখোর মহাজন সম্প্রদায়, যাদের নীতি বলতে কিছু নেই তাদেরকে অজ্ঞ দরিদ্র কৃষক শ্রেণীর উপর জোরজুলুম করার সুযোগ করে দেয়ার কারণেই কৃষিজীবীরা আমাদের শাসনকে মন-প্রাণ দিয়ে ঘৃণা করে। আমি দেখেছি সামান্য জমির মালিকেরাই আমাদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত প্রতিশোধের মননাভাব পোষণ করছে। কারণ বেনিয়ারা আইন এবং আদালতের সাহায্যেই তাদের দখলী স্বত্ব থেকে উচ্ছেদ করেছে।

শুধুমাত্র জমিদার এবং তালুকদার শ্রেণী পিতৃপুরুষের পেশা থেকে বঞ্চিত হয়নি, নতুন আইন কৃষকদেরও চরম সর্বনাশ করেছে। মহাজনদের কাছে তারা সব সময় ঋণের দায়ে আবদ্ধ থাকতো। কুসিদজীবী বেনিয়ারা জাল জুয়াচুরি করে আইনের বলে দখলী জমি আদালতের সাহায্যে নিজেদের দখলে নিয়ে এলো। একই বিপদের কারণে নয় শুধু, সামন্ততান্ত্রিক প্রশ্রয় এবং আনুগত্য ভূমিহারা কৃষক এবং জমিদারের ঐক্য জোরদার করে তুললো। জমিদারেরা বাস করতেন গ্রামে। মাঝে মধ্যে কৃষকদের ওপর অত্যাচার নির্যাতন করলেও কৃষকেরা বিপদের দিনে জমিদারের পক্ষই সমর্থন করতো। বেনিয়ারা হলো বহিরাগত। তারা লাভের আশায় কৃষকের জমির মালিকানা স্বত্ত্ব ক্রয় করতো। সুতরাং তাদের এবং কৃষকদের মধ্যে কোনো আনুগত্য, স্নেহ কিংবা গভীর অনুভূতির বন্ধন সম্ভব ছিলো না। এখনও কৃষকেরা সামন্ত প্রভুদের সমর্থন করতে বাধ্য।

গ্রামের রাত্রিকালীন চৌকিদার, যাদেরকে বলা হতো পাচি, সরকারের বিরুদ্ধে তাদেরও অভিযোগ আছে। ভূমি মালিক শ্রেণীর ন্যায় তারা পিতৃপুরুষের পেশা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। লখনৌর ওয়ালী বিরজিস কাদের আরেক ফরমানে জনিয়েছেন, “প্রতিটি শহর এবং গ্রাম পাহারা দেয়ার প্রহরীরা জেনে রেখো, ইংরেজ সরকার তোমাদের স্থলে বরকন্দাজ বাহিনী নিয়োগ করে তোমাদেরকে পূর্বপুরুষের পেশা থেকে বঞ্চিত করেছে।” এভাবে গ্রামীণ অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবে ওলোট পালোট হয়ে গেলো এবং উৎসাহী ইংরেজ সরকার যে সকল সংস্কার করেছিলো সেগুলো জীবনের সকল ক্ষেত্রে নির্যাতনরূপে দেখা দিলো। ফলে অসন্তোষ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়লো। সময় এবং শিক্ষার প্রভাবে হয়তো ক্ষতি পুরিয়ে নেয়া যেতো। কিন্তু নতুন প্রবর্তিত এ সকল আইনকানুনের একটি ভালো দিকও তারা দেখতে পায়নি।

সীতাপুরের কমিশনার জি. জে. ক্রিশ্চিয়ান সাহেব বিদ্রোহ আরম্ভ হওয়ার পরে রাইক সাহেবের কাছে লেখা এক চিঠিতে আক্ষেপ করে বলেছেন যে সকল গ্রামীণ সংস্কার দারিদ্র্যের দিক দিয়ে যা সকল মানুষকে এক সমান করে ফেলেছে, বিক্ষুব্ধ জেলাসমূহে তারাও এখন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। তাদেরকে বশে রাখতে পারার মতো একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিও সরকারের নেই। সেনাবাহিনীর এই রকম অবস্থা। বলতে গেলে মৃতকল্প। একজনও ভদ্রলোক নেই। সামরিক মর্যাদা ছাড়া তাদের আর কিছুই নেই।

নতুন আইন এবং শাসন ব্যবস্থার ফলে এক শ্রেণীর মানুষের উদ্ভব হলো, যারা আইনের সুযোগ নিলো পুরোপুরি এবং এটাকে তাদের অধিকার মনে করলো। কিন্তু খ্রস্টান ধর্ম প্রচারকদের বাড়াবাড়ির ফলেই বিপত্তি ঘনিয়ে আসতে লাগলো। সৈয়দ আহমদ বলেছেন, ১৮৩৭ সালের দুর্ভিক্ষের সময় অনেকগুলো অনাথ শিশুকে খাবার এবং আশ্রয় দেয়া হয়। পরে তাদেরকে খ্রীস্টান করে ফেলা হয়। দেখে জনগণের মনে গভীর সন্দেহের উদ্রেক হলো, সরকার প্রথমে সমস্ত অধিবাসীদেরকে দরিদ্র করবে এবং পরে তাদেরকে খ্রীস্টান বানাবে। হিন্দুস্থানের বাসিন্দারা ভাবতে লাগলো তাদেরকে গরীব করার জন্য ও তাদের ধর্মনাশ করার জন্যই সমস্ত আইন পাশ করা হয়েছে।

আজমগড় বিদ্রোহীদের ঘোষণায়, স্পষ্টতঃ এ মনোভাবের প্রকাশ দেখা যায়। বিধর্মী ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সকল শ্রেণীর অধিবাসীকে তারা আহ্বান করেছিলেন। জমিদারদের বলা হলো ব্রিটিশ সরকার জমির দাম বেশি দিয়ে থাকে এবং তা আপনাদের জানা কথা। তা ছাড়া আপনাদের বিরুদ্ধে কোনো চাকর কিংবা চাকরাণী নালিশ করলে কোনো রকমের তদন্ত ছাড়াই আপনাদেরকে আদালতে হাজির হতে হবে। এভাবে আপনাদের সম্মান এবং মর্যাদা ধূলায় লুটিয়ে দেয়া হয়েছে। তাদের আদালতে কোনো নালিশ রুজু করতে চাইলে আপনাদের ষ্ট্যাম্প কিনতে হবে, কোর্টে ফি দিতে হবে, এ সব অত্যন্ত জঘন্য প্রথা। তার বাদেও আপনাকে পথ কর এবং স্কুলের শিক্ষা কর দিতে হবে।

ব্যবসায়ীদের বলা হলো, আপনারাও ভালোভাবে জানেন যে বিধর্মী ইংরেজ নীল, আফিম, কাপড় সমস্ত লাভের ব্যবসা দখল করে বসেছে। অলাভজনক ব্যবসাগুলোই আপনাদের জন্য রয়েছে। আপনাদের তাদের আদালতের আশ্রয় নিতে হয়, স্ট্যাম্প ইত্যাদি ক্রয় করে টাকা খরচ করতে হয়। অধিকন্তু তারা জনগণের কাছ থেকে ডাকটিকেট এবং স্কুলের তহবিলের জন্য টাকা আদায় করে। জমিদারদের মতো আপনাদেরও ছোট-লোকেরা নালিশ করলে তাদের আদালতে নিয়ে গিয়ে আপনাদের সম্মানের হানি করে, দণ্ড দিতে বাধ্য করে।

সরকারি কর্মচারীদের সজাগ না হয়ে উপায় নেই, কারণ সামরিক এবং সাধারণ সমস্ত কম মাইনের অসম্মানের চাকুরি ভারতীয়দের আর বেশি মাইনের, মর্যাদার সমস্ত চাকুরিতে ইউরোপীয়রাই বহাল হয়!” কারিগর শ্রেণীর চেয়ে দেখুন, ইউরোপীয়রা সমস্ত রকমের জিনিস ইউরোপ থেকে নিয়ে আসে। আপনাদের হাতের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে, ঘোষণার উপসংহারে বলা হয়েছে, উভয় সম্প্রদায়ের ধর্মবেত্তা পণ্ডিত এবং মৌলানারা ভুলে যাবেন না যে, ব্রিটিশেরা হলো আপনাদের ধর্মের দুশমন। আপনাদের আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহ লাভে ধন্য হওয়া উচিত। নয়তো আপনারা পাপী বলে বিবেচিত হবেন।

শুধুমাত্র রাজপুরুষদের বাদ দেয়া হয়েছে। তাদেরও ধ্বংস এবং রাজ্যহীন করার ভয় দেখানো হয়েছে। ১৮৪৯ সালে ইংরেজরা পাঞ্জাব দখল করে নিলো। পাঞ্জাবের রাজা ছিলেন কোম্পানীর অধীনস্থ মিত্র। মুলতান অভ্যুত্থান, যার ফলে দ্বিতীয় শিখ যুদ্ধের সূত্রপাত, তার সঙ্গে পাঞ্জাবের রাজার কোনো সম্বন্ধ ছিলো না। আসল ওয়ারিশের অভাবে সাতারা, ঝাসী, তাঞ্জোর ইত্যাদি ছোট ছোট রাজ্যগুলো কোম্পানী গ্রাস করে নিলো। পেশবার রাজ্যকে সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করার সময় মারাঠাদের আত্মাভিমান অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য সাতারায় সর্দার প্রথার প্রবর্তন হয়। এই ক্ষুদ্র রাজ্যটিতে পুরোনো অভিজাত বংশের উত্তরাধিকারীরা তখনো সামরিক এবং শাসন বিভাগীয় উচ্চপদে আসীন হওয়ার আশা পোষণ করতেন। ঝাসীর শাসকেরা কোম্পানীর অনুগ্রহে একবার ওয়ারিশ নির্বাচন করেছেন। পুত্রহীন অবস্থায় এক ভাই মারা গেলে আরেক ভাইকে উত্তরাধিকারী করা হয় একবারের বেশি। অনেক দিন ধরে তাঞ্জোর ছিলো কোম্পানীর অধীন মিত্র। রাজবংশ ছিলো মারাঠা। কিন্তু এসব মারাঠা রাষ্ট্র নয় শুধু, বৈধ পুত্র সন্তানহীন অবস্থায় নাগপুরের শেষ রাজা মৃত্যুমুখে পতিত হলে তাঁর রাজ্য কোম্পানীর সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত রাজবাড়ির মহিলাদের আপত্তি সত্ত্বেও এভাবে রাজ্যগ্রাস করার নীতি এবং পদ্ধতি জনগণের মধ্যে অপরিসীম অসন্তোষের সৃষ্টি করে। ভোঁসলার অস্থাবর এবং স্থাবর সম্পত্তি নিয়ে যাওয়া হয়। দুটো রাজকীয় হস্তী, অনেকগুলো ঘোড়া এবং বলদ সিতাবলদীতে পশু ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেয়। রাজবাড়ির আসবাবপত্র সরাতে চাইলে বিদূষী মহিলা রাণী বঙ্ক বাঈ রাজবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেবার ভয় দেখায়। কিন্তু আসবাবপত্র তারা নিয়ে গেলেই গেলো। ভেসলা পরিবারের অলঙ্কার এবং মণি মাণিক্য কলকাতার বাজারে প্রেরণ করা হলো। রাজ্য দখল করার চাইতে স্থাবর অস্থাবর জিনিসপত্র ও অলঙ্কার নিয়ে যাওয়ার প্রতিক্রিয়া খুবই খারাপ হয়েছিলো।

সম্বলপুরের সর্দারের ক্ষুদ্র রাজ্যকে একসময়ে নাগপুরের অধীনে করা হয়েছিলো, পরে সাম্রাজের অন্তর্ভুক্ত করে নিলো। মুর্শিদাবাদের নওয়াবদের মতো কর্ণাটকের নবাবেরাও বহুকাল আগেই রাজ্যশাসন করা ছেড়ে দিয়েছিলেন। ১৮৫৪ সালে নওয়াব খ্যাতিরও অবসান হলো। পরবর্তী বছরে হিন্দুরাজ্য তাঞ্জোরও গেলো। রাজপুত রাজ্য কারৌলীর উপর কোনো জোর প্রয়োগ করা হয়নি। সাতারা এবং ঝাঁসীর মতো যে সকল রাজ্য ব্রিটিশের সৃষ্ট নয় সেগুলো যতোই ক্ষুদ্র হোক না কেনো, গ্রাস করার ব্যাপারে বিচার বিবেচনা করতে পারতেন। বড়লাট ডালহৌসী। আইনের কোনো সুবিধা পেলেই ব্রিটিশ শাসনের কল্যাণে হস্ত প্রসারের ব্যাপারে কোনো রকম বিলম্ব করতেন না। এ জাতীয় সমস্যা দেখা দিলে তার সহকর্মীদের পরামর্শ নেয়ার প্রয়োজনও অনুভব করতেন না। তার উদ্দেশ্যের মধ্যে গলদ আবিষ্কার করা অসম্ভব। রাজ্যসমূহের অন্তর্ভূক্তির ফলেই ভারত সংযুক্ত করতে পেরেছে, যাকে ভারতীয় জাতীয়তার ভিত্তি বলা যেতে পারে। কিন্তু ডালহৌসীর তেমন কোনো আকাক্ষা ছিলো না। ডালহৌসীর নির্জলা সাম্রাজ্যবাদী নীতি কোনো উপকার করেনি। ঝাঁসীর রাণী এ অন্তর্ভুক্তিকে মেনে না নিয়ে সুপ্রীম কোর্টে প্রতিনিধি পাঠালেন। সাঁতারা রাজ্যের পক্ষে ওকালতী করার জন্য রঙ্গ বাপুজী লন্ডন যাত্রা করলেন। সম্বলপুরের রাজবংশীয়েরা যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। কর্ণাটক এবং তাঞ্জোরের এহেন পরিণতিতে ভারতীয় জনমত বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো। কারণ, ও দু’টো রাজ্য সব সময় অনুগত ছিলো এবং দীর্ঘদিন যাবৎ কোম্পানীর সরকারের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রক্ষা করে আসছে। তারপরেও ব্রিটিশের সুবিচার সম্পর্কে যতোটুকু শ্রদ্ধা ছিলো ১৮৫৬ সালে অযোধ্যা গ্রাস করার পর তার তিলমাত্র অবশিষ্ট রইলো না।

সীতারামের মতে, তালুকদার এবং সর্দারেরা মতামত পোষণ করলো, সরকার নওয়াবকে অসম্মান করেছেন, তাঁর প্রতি অবিচার করেছেন। হেদায়েত আলী আরো পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, “অযোধ্যার অন্তর্ভূক্তির সময় হিন্দুস্থানের সকলেই বলাবলি করছিলো ব্রিটিশ সরকার অযোধ্যার নওয়াবের সঙ্গে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে (আমার বিশ্বাস, এরকম একটা সন্ধিপত্র ছিলো) তারা কখনো নওয়াবের রাজ্যদান করেছেন। হিন্দুস্থানের সকলে বলাবলি করতে লাগলো রাজা নওয়াবের, তিনি নিজের সরকারের ব্যাপারে যাই করে থাকুন না কেনো, কোনোক্রমেই ইংরেজদের সঙ্গে বিশ্বাস ভঙ্গ করেননি। এতে অনুগত এতো বিশ্বস্ত নওয়াবের যখন এ অবস্থা, স্বাধীন রাজা এবং নওয়াবদের অবস্থা কি হবে?

অযোধ্যা দখলের সংবাদে ইংরেজ ভদ্রলোক এবং ভদ্রমহিলারাও উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠেছিলো। এ দুঃখজনক ঘটনা তাঁদের বিচলিত করে তুলেছিলো। এটাকে তারা অন্যায় কাজ বলেছেন। মিসেস হ্যারিস লিখেছেন সে সম্বন্ধে, “আজকে ডিনার পার্টিতে অযোধ্যায় অন্যায়ভাবে অন্তর্ভুক্তির কথা আলোচনা হচ্ছিলো, আমরা শাসিতদের প্রতি যে অবিচার করছি তাতে করে জাতীয় মর্যাদাকেই অবনমিত করছি। আমাদের নওয়াবের আপন লালসা এবং লোভের শেষ বলী হতে হলো অযোধ্যাকে।”

বাঙ্গালী পল্টনে উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ এবং রাজপুতদের ভর্তি করানোই বিদ্রোহের কারণ বলা হয়। কর্ণেল হান্টার সে কথা অস্বীকার করেছেন। সাঁওতাল এবং ভীলদের কোন গোত্র নেই, কোনো কোনো অঞ্চলে তারা বিদ্রোহী সেপাইদের সহায়তা করেছে। নিম্নশ্রেণীর যোগানদার সৈন্যরা মীরাটে সশস্ত্র বিদ্রোহ করেছে। উচ্চ শ্রেণীর ব্রাহ্মণ যেমন, তেমনি নিম্নশ্রেণীর পাচিরাও ধর্মযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছে। সুপরিকল্পিত অথচ সুচিন্তিত নয়, এমন কতেক আইন এবং শাসন পদ্ধতি প্রবর্তনের ফলে সেপাইদের মনে অবিশ্বাস এবং সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে। তার ফলে সরকারের প্রতি সেপাইরা সম্পূর্ণ বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। তা ছাড়া পরবর্তী গভর্ণর জেনারেলদের অপ্রিয় শাসনের ফলে জনগণ বিশ্বাস হারাতে থাকে। লর্ড ডালহৌসীকে সাধারণভাবে অভ্যুত্থানের জন্য দায়ী করা হয়। কিন্তু অন্য কোন কারণ না থাকলে তার কোনো কাজের ফলে অভ্যুত্থান হতে পারতো না। এ জন্য লর্ড আমহার্স্ট, লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক, লর্ড অকল্যান্ড, লর্ড এলেনবরো সকলেরই নিজের নিজের অবদান রয়েছে। বিদেশী সরকার জনগণের আনুগত্যের ওপর নয়, সামরিক শক্তির ওপরই প্রতিষ্ঠিত ছিলো। সেপাইরা উপলব্ধি করতে পারলো, এতোকাল তারাই তো বজ্রবাহু দিয়ে এ সাম্রাজ্য রক্ষা করেছে, এখন ইচ্ছে করলে ভেঙ্গে ফেলতে পারে। তবু তারা নিমকহারামী করেনি। কিন্তু যখন দেখতে পেলো যে পিতৃপুরুষের ধর্মের উপর আঘাত আসছে সে আনুগত্যের ভিত্তিমূল বিদীর্ণ হয়ে গেলো। শিক্ষিত সম্প্রদায় জনগণের সঙ্গে সংযোগ করে হয়তো এ অভ্যুত্থান ঠেকাতে পারতেন, সরকার তাঁদের সে সুযোগ দেননি। বিদ্রোহের কারণগুলো অনেকদিন ধরে সঞ্চিত হয়েছিলো-চর্বি মাখানো টোটা বেগকে ত্বরান্বিত করেছিলো মাত্র।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *