র-নগরের আজব সার্কাস

র-নগরের আজব সার্কাস

নবেম্বরের শুরু থেকেই হিমালয়ের কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস উত্তরের ঝাউবন কাঁপিয়ে র-নগরের ওপর দিয়ে বয়ে যেতো। নবেম্বরের মাঝামাঝি আমাদের স্কুলের বছর শেষের পরীক্ষাটি হয়ে যাওয়ার পর একটানা দুমাস বড়দিনের ছুটি। ডিসেম্বর শুরু না হতেই পৌষমেলার দল আসা শুরু করতে র-নগরে। পাহাড়ী পথ ধরে দূর-দূরান্ত থেকে হরেক-রকম লোকজনেরা ঘোড়া, গরু আর মোষের গাড়িতে ডিং ডং ঘন্টা বাজিয়ে র-নগরের মড়াখেকোর মাঠে এসে জড়ো হতো। মেলার একমাস নিজেদের খেয়ালখুশি মতো চলতে কেউ আমাদের বারণ করতো না। করলেই-বা শুনছে কে! বড় জেঠু নিজেই তো অপেরা পার্টির তাঁবুতে পড়ে থাকেন সারাদিন। ছোটবেলায় নাকি বড় জেঠু যাত্রা দলে রাণি সাজতেন।

সেবার পৌষমেলায় নতুন এক সার্কাস পার্টি এসেছিলো। পাঁচটা ঘোড়ার গাড়ি আর চারটা মোষের গাড়িতে বড় বড় বাক্স, খাঁচা আর হরেক রকমের মালপত্র বোঝাই হয়ে সার্কাসের দল যখন সেন্ট জন স্ট্রিট ধরে র-নগরে ঢুকলো, তখন ওদের দেখার জন্যে গোটা শহরটাই যেন ভেঙে পড়লো। দলের সবার আগে হাতির পিঠে রঙচঙে এক লিকপিকে জোকার টিনের চোঙা কুঁকে বলছিলো–

আসিতেছে! আসিতেছে!! আসিতেছে!!! আপনাদের শহরে এই প্রথম! এই প্রথম!! এই প্রথম!!! দি গ্রেট বনমালী সার্কাস (তিনবার)। সপরিবারে আসুন এবং উপভোগ করুন (তিনবার)।

এরপর জোকারটা হাতির পিঠে নেচে-কুদে ডিগবাজি খেয়ে চোঙা কুঁকে একনাগাড়ে বলে গেলো সার্কাসে কী কী খেলা দেখানো হবে।

আমি, বিজু, আর রামু ছাদের উপর থেকেই দেখতে পেয়েছিলাম। সার্কাসের দল যখন সেন্ট জন স্ট্রিটের মোড় ঘুরে দামপাড়া দিয়ে মড়াখেকোর মাঠের দিকে এগিয়ে গেলো, তখন আমরা তিনজন তীরের বেগে সেদিকে ছুটলাম। আমাদের মতো অনেকেই মিছিল করে সার্কাস পার্টির সঙ্গে মড়াখেকোর মাঠের দিকে যাচ্ছিলো। সবাই বলাবলি করছিলো র-নগরে আগে কখনও এত বড় সার্কাস পার্টি আসেনি।

মড়াখেকোর মাঠে তখন মেলার জন্যে দোকানপাট বানানো হচ্ছিলো। এরই মধ্যে মোহিনীমায়া বায়স্কোপ কোম্পানি, ভাণ্ডারী অপেরা পার্টি আর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুতুল নাচের দল এসে গেছে। ওদের ঝরঝরে গাড়ি, পেটমোটা বেতো ঘোড়া আর রোগা ডিগডিগে গরুদের পাশে বনমালী সার্কাসের তেজী টগবগে ঘোড়া, খাঁচার ভেতর ডোরাকাটা আস্ত বাঘ, জমকালো তাঁবু, গণ্ডাগণ্ডা পোষাক আর সরঞ্জামের বাক্স দেখে ঠিক করলাম এবার আর বায়স্কোপ নয়, বায়স্কোপের পয়সা দিয়ে সার্কাস দেখবো আমরা।

সার্কাসের মালিকের নাম দেখেছিলাম হ্যাঁণ্ডবিলে রঙিন কালিতে ছাপানো আসিতেছে, আসিতেছে, ইত্যাদির নিচে মোটা হরফে লেখা ছিল?

শ্ৰী বনমালী বাড়ুরী
ম্যানেজার প্রোপ্রাইটার
দি গ্রেট বনমালী সার্কাস

প্রথমদিনই তার সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো। সার্কাসের কেউ তাঁকে ডাকছিলো বাড়ুই বাবু আর কেউ স্যার স্যার বলে হন্তদন্ত হয়ে ছুটোছুটি করছিলো। মোেটাসোটা থলথলে শরীর, সারাক্ষণ হাসি হাসি মুখ, ভোঁতা চ্যাপটা নাক আর কুতকুতে মার্বেলের মতো দুটো চোখ। হাসিমুখে অনবরত পান চিবুচ্ছিলেন বাড়ুই মশাই।

বাঘের খাঁচার পাশে আমাদের দেখে বাড়ুই মশাই মোমের মতো মোলায়েম গলায় বললেন–হ্যাঁ গো বাছা, তোমরা কাদের বাড়ির ছেলে গো?

আমি বড় জেঠুর নাম বললাম। শুনে বাড়ুই মশাই একগাল হাসলেন–ওমা, তাই নাকি গো! তার কথা আমি ভগবতী সার্কাস পার্টির কাছে কত শুনেছি! ভারি সদাশয় ব্যক্তি তিনি। তাঁকে বোলো, দয়া করে একবারটি যেন আমার তাবুতে পায়ের ধুলো দেন। এরপর বাড়ুই মশাই আমাদের হাতে একতাড়া হ্যাঁণ্ডবিল খুঁজে দিয়ে বললেন, এগুলো বাছা তোমাদের পাড়ার জন্যে। ছোটদের হাফ টিকেট। দেখতে এসো কিন্তু।

মেলা শুরু হতে আরও সাতদিন। বনমালী সার্কাসের তৈরি হতে দিন পাঁচেক লাগবেই। সারা বিকেল মড়াখেকোর মাঠে কাটিয়ে সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফেরার পথে বিজু বললো, সার্কাসের মালিকটা কি ভালো মানুষ দেখেছিস? ভগবতী সার্কাস পার্টিকে এত বলার পরও কখনও কি হাফ টিকেট দিয়েছে? বলে কিনা অর্ধেকের বেশি মানুষকে তাহলে হাফ টিকেট দিয়ে আমাদের লালবাতি জ্বালতে হয়। এর জন্যেই তো বায়স্কোপ দেখা। নইলে যাই বলিস আমার কিন্তু সার্কাস দেখতে বেশি ভালো লাগে।

বিজুর কথাগুলো মিথ্যে নয়। বায়স্কোপের চেয়ে চোখের সামনে জলজ্যান্ত বাঘের সার্কাস ঢের ভালো। বাড়ি গিয়ে জেঠুকে বনমালী বাড়ুইর কথা বললাম। আমাদের ভীষণ রাগী বড় জেঠু তাঁর প্রশংসার কথা শুনে গলে গিয়ে বললেন, বাড়ুই মশাইকে বলিস কাল আমার অন্য একটা কাজ আছে, পরশু যাবো।

আমাদের চিলেকোঠার ঘরে ঢুকে রামু বললো, বড় জেঠুর ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে এবার বোধহয় তিনি বাড়ুই মশাইর তাঁবুতে আড্ডা জমাবেন। ভাণ্ডারী অপেরার আড্ডা মাঠে মারা গেল।

আমি মুখ টিপে হেসে বললাম, আসলেই মাঠে, মড়াখেকোর মাঠে!

শুনে রামু আর বিজু একসঙ্গে হেসে উঠলো।

সার্কাস শুরু হওয়ার আগেই বাড়ুই মশাই র-নগরের বুড়োদের সঙ্গে চমৎকার ভাব জমিয়ে ফেললেন। দিদা বললেন, এসব হলো সার্কাসে লোক জমানোর ফন্দি। র-নগরের ছেলেরা যদি এরপর রোজ সার্কাস দেখতে চায় বড়োরা আর বারণ করতে পারবে না। আমি বাছা তোমাদের বলে রাখলাম, একবারের বেশি দুবার সার্কাসের তাঁবুতে তোমরা ঢুকতে পারবে না। ওদের দলে অনেক অসভ্য মেয়েছেলে থাকে।

বিজু ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে বললো–বা রে নিজের ছেলেকে বারণ করতে পারছো না? বাড়ুই মশাই যদি বিনে পয়সায় সার্কাস দেখায় তাহলেও বুঝি দেখতে পারবো না?

দিদা হেসে বললেন, ওরে বোকারাম, বিনে পয়সায় কেউ কি কখনও দেখায়! দেখবি তোমাদের দিয়ে এটা-সেটা করিয়ে নেবে। তারপর হয়তো একদিন দেখাবে।

রামু আমার কানে কানে বললো, বিনে পয়সায় সার্কাস দেখার জন্যে এটা-সেটা করতে আমাদের আপত্তি থাকা উচিত নয়।

আমি মাথা নেড়ে সায় জানালাম।

.

২.

লোক বটে বনমালী বাড়ুই! কয়েকদিনের মধ্যেই র-নগরের সবাইকে মাতিয়ে ফেললেন। শুরু হওয়ার প্রথম দিনই আমরা সার্কাস দেখেছিলাম। কী দারুণ সব দড়ির খেলা। এসব খেলা আগে শুধু বায়স্কোপে দেখেছিলাম। চোখের সামনে জলজ্যান্ত মানুষকে অত উঁচুতে শূন্যে ডিগবাজি খেতে দেখে মাথার চুল খাড়া হয়ে গেলো। মিস শকুন্তলার দড়ির ওপর ছাতা দোলানো নাচ দেখে চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইলো। শেরালী নামের দশাসই লোকটা তেজী বাঘটাকে পোষা বেড়ালের মতো বানিয়ে ওটাকে দিয়ে যা খুশি তাই করালো। আর প্রত্যেক খেলার শেষে সেই লিকপিকে জোকারটা পুরো খেলা আবার নকল করে সবাইকে হাসাতে পেটে খিল ধরিয়ে দিলো। সব খেলা শেষ হবার পর সবাই একবাক্যে বললো–সার্কাস যদি দেখতে হয় তা এমনটিই দেখা উচিত। ভগবতী সার্কাস পার্টি এত বছর ধরে কী সব রদ্দি মাল চালিয়ে গেছে! প্রাণ জুড়োনো সার্কাস দেখিয়েছে বনমালী বাড়ুই।

কথাগুলো মোটেই বাড়িয়ে বলা নয়। রাতে লেপের নিচে শুয়ে আমরা সার্কাসের কথা ভেবে ঘুমোতে পারিনি। বিজু একসময় বললো, হ্যাঁরে, দিদা যে বললো, ওদের এটা-সেটা করে দিলে নাকি বিনে পয়সায় সার্কাস দেখাবে? কাল গিয়ে বলবি নাকি!

আমি বললাম, ওদের নিজেদেরই কতো লোক রয়েছে। বাড়ুই মশাইর বয়ে গেছে। তোকে দিয়ে কাজ করাতে।

রামু একটু বিরক্ত হয়ে আমাকে বললো, তুই সবটাতেই বাগড়া দিস আবু। চেয়ে কাজ নেয়ার কী দরকার। রোজ তাঁবুর পাশে ঘোরাফেরা করলে কিছু একটা কাজ দিয়েও

তো ফেলতে পারে! আমরা তো হ্যাঁণ্ডবিল বিলি করতে পারি।

বিজু বললো, মোদ্দা কথা আবার সার্কাস দেখতে হবে।

পৌষমেলাতে আগে যারা আসতো তাদের ভেতর ভগবতী সার্কাস পার্টি ছাড়া এবার আর সবাই এসেছে। হাজার বাতির আলোয় মড়াখেকোর মাঠ বরাবরের মতোই ঝলমল করছে। র-নগরের বাইরে থেকে দূর-দূরান্তের লোকজন মেলা দেখতে আসছে। জিনিসপত্রও প্রচুর বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু আমাদের তিনজনের মন কেড়ে নিয়েছিলো বাড়ুই মশাইয়ের সার্কাস পার্টি। রাতে ঘুম হলো খুবই সামান্য। ঘুমের ভেতরও আমরা তিনজন সার্কাসের স্বপ্ন দেখলাম।

পরদিন সকাল থেকেই আমরা দি গ্রেট বনমালী সার্কাসের তাঁবুর আশপাশে ঘুর ঘুর করতে লাগলাম। বাড়ুই মশাই আমাদের দেখে একবার মুচকি হেসে বললেন, সার্কাস কেমন দেখলে গো বাছারা?

আমরা সবাই কোরাসে বললাম, দারুণ মজার।

রামু বললো, আপনার কোনো তুলনাই হয় না।

বিজু বললো, বার বার শুধু দেখতে ইচ্ছে করে।

বাড়ুই মশাই একগাল হেসে বললেন, বেশ বলেছো! একেই বলে প্রাণ জুড়ানো কথা। সায়েবদের ইস্কুলে তোমাদের কী সুন্দর কথা বলতে শিখিয়েছে! আমার দলের ছোঁড়াদের দেখো না, কি চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলে। শুনলে পিত্তি জ্বলে যায়। এই বলে হঠাৎ বাড়ুই মশাই গলা তুলে চিৎকার করে উঠলেন, এই ফড়ে হারামজাদা! আবার ঘোড়ার দানা চুরি করে খাচ্ছিস! দাঁড়া তোর পিঠে আমি আস্ত খড়ম ভাঙবো।

বাড়ুই মশাই তার বিশাল বপু নিয়ে খড়ম পায়ে চেঁচাতে চেঁচাতে ছুটে গেলেন ঘোড়াদের আস্তাবলের দিকে। আমরা তিনজন হাসি চেপে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখি সেই লিকপিকে জোকারটা বাড়ুই মশাইকে আসতে দেখে চোখের পলকে কোথায় যেন কর্পূরের মতো উবে গেলো।

জোকারটার নাম তাহলে ফড়ে। বেচারার দুঃখ দেখে আমাদের ভারি মায়া হলো। বাড়ুই মশাই তখনও ছুটছিলেন।

রামু বললো, আহা বেচারা, ঘোড়ার দানা খেয়েছে বলে এভাবে বকতে আছে? খিদে না পেলে ওসব রাবিশ যেন কেউ খায়!

বাড়ুই মশাইর ওপর আমারও রাগ হলো। বললাম, যতটা ভালো মনে করেছিলাম–

আমার মুখের কথা মুখেই রইলো। কথা শেষ হবার আগেই দেখি বাড়ই মশাই আস্তাবলের কাছে দড়াম করে আছাড় খেয়ে পড়েছেন। আর সঙ্গে সঙ্গে চারদিক থেকে সার্কাসের লোকেরা–ওরে ধর ধর, গেল গেল, আহা কেমন করে হলো, এসব বলতে বলতে আস্তাবলের দিকে ছুটতে লাগলো। আমরাও কোনো রকমে হাসি চেপে বাড়ুই মশাইকে দেখতে গেলাম।

ততোক্ষণে শেরালী আর তার একগণ্ডা দশাসই পার্টনার মিলে বাড়ুই মশাইকে টেনে তুলেছে। সারা গায়ে কাদার ছড়াছড়ি। মুখখানা দারুণ দেখাচ্ছিলো। সেই অবস্থাতেই বাড়ুই মশাইর মুখ দিয়ে তুবড়ির মতো গালি বেরুচ্ছে–আসুক ফড়ে হারামজাদা। ওকে আমি শূলে চড়াবোয় ফাঁসিতে ঝোলাবো–অ্যাঁ! আমার সঙ্গে মামদোবাজি।

হঠাৎ গালি থামিয়ে তিনি শেরালীকে ধমক দিলেন–আমাকে এভাবে ধরে রেখেছিস কেন? আমাকে তোরা ডাকাত ভেবেছিস নাকি। সব কটা আমাকে পাগল করে ছাড়বে। নাহ, এই আমার শেষ। আমি আর এসবের মধ্যে নেই। এবারই কাজে ইস্তফা দিয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাবো। ওস্তাদকে তখনই বলেছিলাম বেতো শরীরে আমাকে আর–এই বলে হঠাৎ চারপাশে বাইরের লোকজন দেখে বাড়ুই মশাই ওদেরকে নিয়ে পড়লেন–অ্যাঁ, এসব কি? আমাকে কী বাছা সার্কাসের সঙ পেয়েছো! এখানে এত ভিড় কিসের? অ্যাঁ, এতে ভিড় কিসের?

আমরা তিনজন পেছন থেকে চুপি চুপি সরে গিয়ে একছুটে বায়স্কোপ কোম্পানির তাঁবুর কাছে এসে হেসে হেসে গড়িয়ে পড়লাম। রামু বললো–বাড়ুই মশাই যা দেখালো, তা এর পাশে ফড়ের জারিজুরি সব পানসে মনে হচ্ছে।

বিজু হি হি করে হাসতে হাসতে বললো, আজ ফড়েকে না পাওয়া গেলে বাড়ুই মশাইকেই জোকার সাজতে হতে পারে। কি দারুণ রিহার্সেল দিলেন!

.

৩.

দুপুরে বাড়ি ফেরার পথে দেখি আমাদের পাঁচিলের পাশে দেবদারু গাছের তলায় বসে ফড়ে ফোৎ ফোঁৎ করে কাঁদছে। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ও ফড়ে, তুমি কাঁদছো কেন?

পকেট থেকে নোংরা রুমাল বের করে চোখ, মুখ, নাক ঝেড়ে ফড়ে ধরা গলায় বললো, কেন বাছা, নিরালায় বসে দু দণ্ড কাঁদবো, নাকি তাও শান্তিতে পারবো না?

আমি বললাম, আহা ফড়ে তুমি অতো চটছো কেন? আমরা তো তোমার ভালোর জন্যেই বলছি। তুমি তো দেখো নি। বাড়ুই মশাই তোমাকে মারতে গিয়ে আস্তাবলের কাছে কেমন আছাড়টাই না খেলেন! সাতদিন আর বিছানা ছেড়ে উঠতে হচ্ছে না।

তাই নাকি! আহ্লাদে আটখানা হয়ে ফড়ে বললো, কী সুখের কথা শোনালে ভাই! তোমাদের মুখে ফুলচন্দন পড়ুক!

রামু বললো, বাড়ুই মশাই তোমার ওপর দারুণ চটেছেন। বললেন, তোমাকে নাকি ফাঁসিতে ঝোলাবেন।

ফড়ে রেগে গিয়ে বললো, কী? আমাকে ফাঁসিতে ঝোলাবে? দেখা যাবে কে কাকে ফাঁসিতে ঝোলায়। ওই চর্বির পিপেটা সারা জীবনে যত পাপ করেছে দশ বার ফাঁসিতে ঝোলালেও ওর সাজা পুরো হবে না।

অবাক হয়ে বললাম, সে কি ফড়ে! বাড়ুই মশাই আজ যদি তোমাকে না বকতেন, তাহলে তো আমরা ধরেই নিয়েছিলাম তার মতো ভালো লোক আর হতে পারে না।

ফড়ে গম্ভীর হয়ে বললো, তোমরা তো বলবেই। ওকে কতটুকুই-বা চেনো। ওর মতো পাজি লোক সারা ভূ-ভারতে আর দ্বিতীয়টি নেই। আমার বাপকে ঠকিয়ে ও।

এটুকু বলে ফড়ে আমাদের জুলজুলে চোখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেলো। নোংরা রুমালে চোখটা ভাল করে মুছে দাঁড়িয়ে হঠাৎ বিরক্ত হয়ে বললো, তোমরা তো বাপু কম নও! পটিয়ে পটিয়ে আমার কাছ থেকে সব কথা বের করে নিতে চাও? তোমরা যে ওর সঙ্গে ভাব জমিয়েছে সেটা বুঝি আমি জানি না ভেবেছো? এই বলে ফড়ে চলে যাবার জন্যে পা বাড়ালো।

আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, ও ফড়ে, বাড়ুই মশাইর ওখানে যাচ্ছো নাকি! শেরালীরা যে তোমাকে দুরমুশ পেটা করবে।

ফড়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে বিরক্ত হয়ে বললো, বাছা, গরিব হয়ে যখন জন্মেছি তখন বড়লোকদের লাথি ঝাঁটা খেয়েই তো আমাদের বাঁচতে হবে। কত আর পেটাবে! নুলো করে দিতে তো আর পারবে না! তাহলে খেলা দেখাবে কে? মার খাওয়া আমার সয়ে গেছে। বাপটা যেদিন চোখ বুজেছে, সেদিন থেকেই আমার দুর্ভোগের শুরু। কী করে খাবো বলো?

ফড়ের কথা শুনে আমার দুঃখ হলো। যে লোকটা সার্কাসে হাজার হাজার লোককে হাসায়–দেখে মনে হয় যার কোন দুঃখ থাকতে পারে না, অথচ বেঁচে থাকার জন্যে তাকেই কিনা এতো অত্যাচার সইতে হয়! আমি ফড়েকে বললাম, আজ দুপুরে তুমি আমাদের বাড়িতে খেয়ে যাও ফড়ে। বিকেলে বরং জেঠুকে বলবো তোমাকে না মারার জন্যে যেন বাড়ুই মশাইকে বলেন।

ফড়ে ফিক করে হাসলো–তাহলে তো ভালোই হয়। বাড়িতে কেউ বকবে না তো!

রামু বললো, কেউ বকবে না। আমরা দিদাকে বলবো।

ফড়ে খুশি হয়ে বললো, প্রাণটা বাঁচালে ভাই। যাই বলো শেরালীর শরীরে মায়াদয়া বলতে কিছুই নেই। যখন পেটায় তখন আর কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। বাড়ুই বাবু তো ওকে প্রায়ই বলেন, অমন করে পেটাসনে রে। হাড়টাড় ভেঙে গেলে সঙের খেলা কে দেখাবে!

আমরা তিনজন বাড়ির ভেতরে গিয়ে দিদাকে ফড়ের সব কথা খুলে বললাম। দিদা শুনে ভারি দুঃখ পেলেন। বললেন, বনমালী বাড়ুই দেখছি একটা আস্ত চামার। ওকে একটা গামছা দিয়ে বল পুকুর থেকে নেয়ে আসুক। ততোক্ষণে আমি ভাত বাড়ছি।

রান্নাঘরের দাওয়ায় মাদুর পেতে দিদা ফড়েকে খেতে দিলেন। খেতে খেতে ফড়ে বললো, বাপের জন্মে এতো ভাল খাবার খাই নি মা।

দিদা বললেন, সার্কাসের লোকেরা বুঝি খেতে দেয় না?

ফড়ে বললো, কিলটা, চড়টা, লাথিটা হরদমই খেতে দেয়। নইলে কি আর ঘোড়ার দানা চুরি করে খাই! এমনি খাওয়ার সময় বাড়ুই বাবু বারণ করে দিয়েছেন, আমাকে যেন বেশি খেতে না দেয়। বেশি খেলে নাকি আমার গায়ে চর্বি জমবে। তখন নাকি আমি আর খেলা দেখিয়ে তোক হাসাতে পারবো না।

দিদা বিরক্ত হয়ে বললেন, কী বে-আক্কেলে কথা, শুনলে গা জ্বলে যায়। তুমি বাছা লজ্জা কোরো না। যেটা খেতে ইচ্ছে করে নিজ হাতে তুলে নিয়ে খাও।

খেয়ে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে নোংরা রুমালে মুখ মুছে হেউ হেউ করে ঢেকুর তুলতে তুলতে ফড়ে দিদার কাছ থেকে পান সুপুরি চেয়ে নিয়ে খেলো।

দিদা বললেন, তোমার এই ফড়ে নামটি বাছা কে রেখেছে?

ফড়ে হেসে বললো, জ্ঞান হবার পর থেকে তো সার্কাস পার্টিতেই আছি। বাপ-মা কী নাম রেখেছিলো কী করে বলি। সার্কাসের সবাই এ নামেই ডাকে। আমার জন্মের তিন চার বছরের মধ্যে বাপ-মা দুজনেই পটল তুলেছেন।

দিদা মৃদু ধমক দিয়ে বললেন, ছিঃ বাছা! বাপ-মা সম্পর্কে ওভাবে বলতে নেই।

ফড়ে বললো, রাগ যে সামলাতে পারি না মা। নিজেরা যখন সগৃগে গেলেন, তখন আমাকে নিয়ে গেলে এত জ্বালা আর সইতে হতো না।

দিদা ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তোমার তো বাছা কিছুই বয়স হয়নি। খুব বেশি হলে আমাদের পন্টুর সমান হবে। মরার কথা তোমার ভাবা উচিত নয়। এই বলে দিদা ওকে বিশ্রাম নিতে বলে চলে গেলেন। যেতে যেতে দিদা বললেন, হাবুকে আমি বলে দেবো বাড়ই যাতে তোমাকে মারধোর না করে।

ফড়ে হাই তুলে বললো, তোমাদের দিদার মতো ভালো মানুষ আর হয় না।

.

৪.

খাওয়া দাওয়ার পর পান চিবোনো ফড়েকে বেশ খুশি খুশি দেখাচ্ছিলো। সুযোগ বুঝে আমি আসল কথা পাড়লাম–ফড়ে, তখন একটা কথা বলতে গিয়ে চেপে গিয়েছো। তুমি বাড়ুই মশাইর কোন পাপের কথা বলতে যাচ্ছিলে? তোমার বাবাকে তিনি কিভাবে ঠকিয়েছেন?

ফড়ে বললো, তোমরা আমাকে খেতে দিয়ে বলতে গেলে প্রাণে বাঁচিয়েছে। বাড়ুইর পাপের কথা তোমাদের বলতে পারি। আমি নিজে তো আর কিছুই দেখি নি। আমাদের সার্কাসের বুড়ি দাই কামরাঙার মা-র কাছে শুনেছি, এই সার্কাস পার্টি নাকি আমার বাপই গড়েছিলো। বনমালী বাড়ুই আমার বাপের কোম্পানির ম্যানেজার ছিলো। আমার বাপ নাকি ওর পাপের কথা জানতো। তাই বাড়ুই বাবু একদিন বিষ খাইয়ে আমার বাপকে মেরে ফেলে নিজেই মালিক হয়ে বসেছে। আমার তখন তিন বছর বয়স। তার এক বছর পর একটা দুর্ঘটনায় আমার মা-ও মরলো। মা নাকি খুব ভালো দড়ির খেলা দেখাতে পারতো। ওই দুর্ঘটনাও নাকি বাড়ই বাবুর কারসাজিতেই হয়েছে। কামরাঙার মা অবশ্য এসব কথা এখন আর বলে না।

আমি বললাম, বাড়ুই মশাইয়ের পাপের কথা তুমিও তো জানো। সেই পাপের কথা বললে না যে!

ফড়ে বার বার ঘাড় নেড়ে বিষণ্ণ গলায় বললো, না বাছা, ওটি মাপ করতে হবে। যতই লাথি ঝাঁটা খাই-জীবনের ওপর আমার কম মায়া নেই। তোমাদের ওসব বলে মা-বাপের মতো অসময়ে জীবনটি খোয়তে রাজি নই।

ফড়ের কথা শুনে ভারি দুঃখ পেলাম। ও আমাদের এখনও বিশ্বাস করতে চাইছে না। রামু বললো, ফড়ে, আমরা তোমার ভালো চাই।

ঈশ্বর তোমাদের মঙ্গল করুন। এই বলে ফড়ে আবার ঘাড় দোলাতে লাগলোকিন্তু এর বাইরে আমি একটা কথাও বলতে পারবো না। আমার বাপের কথাও তোমরা ভুলে যাও। আমিও তো ভুলে গেছি। পেটের দায় বড় দায়। প্রাণের দায় আরও বড় দায়। এই বলে ফড়ে ফোৎ কেঁৎ করে খানিকটা কেঁদে নিলো।

ফড়ের হাব-ভাব দেখে বুঝলাম ও কিছুতেই মুখ খুলবে না। মনে মনে ঠিক করলাম, ওকে আর বিরক্ত করবো না। আমার নিজেরাই এর রহস্য উদ্ঘাটন করবো।

বিকেলে দিদার কথামতো জেঠু ফড়েকে সঙ্গে করে বাড়ুই মশাইর কাছে নিয়ে গেলেন। জেঠু আমাদের শুনিয়ে শুনিয়ে দিদাকে বললেন, ছোটদের এসবের মধ্যে থাকার কোনো দরকার নেই।

ছোটরা যেন এমনই সুবোধ বালক যে, বড়রা যা বলবে তাই শুনবে। আমাদের কতো কাজ! জেঠু চান পৌষমেলার দিনেও আমরা ঘরে বসে হাতের লেখা মকুশ করি।

জেঠুরা চলে যাবার কিছুক্ষণ পর আমরাও পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বায়স্কোপ কোম্পানির তাঁবুর কাছে এসে দেখি, বাড়ুই মশাই লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে হেসে হেসে জেঠুকে কি যেন বলছেন। জেঠু হা হা করে হাসছেন আর ফড়ে লাজুক লাজুক মুখ করে গোবেচারা ভঙ্গিতে বাড়ুই মশাইর পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কী একটা কথা বলে বাড়ুই মশাই ফড়ের পিঠ চাপড়ে দিলেন। আর তখনই ফড়ে তিড়িং বিড়িং লাফ মেরে সার্কাসের বড় তাবুতে ঢুকে গেলো। জেঠু আর বাড়ুই মশাই হাঁটতে হাঁটতে গল্প করতে লাগলেন।

বিজু বললো, জেঠু তাহলে ফড়েকে মার খাওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে দিলো।

রামু বললো, বাড়ুই মশাই কিভাবে হাঁটছে দেখো। সাতদিনের আগে কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারবে না।

আমার মাথায় তখন ঘুরছিলো বাড়ুই মশাই কী এমন কাজ করেছেন বা করেন যা বললে ফড়েকে জীবন দিতে হবে! রামুকে বললাম, একটা গুরুতর বিষয় নিয়ে আলাপ করবো। চল কোথাও গিয়ে বসি।

রামু বললো, আমি জানি তুই কী বলবি।

লোকজনের ভিড় থেকে একটু দূরে ঘোড়ানিম গাছের নিচে বসে আমি বললাম, সকালে আছাড় খাওয়ার পর বাড়ুই মশাই কতগুলো কথা বলেছেন খেয়াল করেছিলি? আমার কিন্তু স্পষ্ট মনে আছে কাজে ইস্তফা দিয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাবো। ওস্তাদকে তখনই বলেছিলাম–এসব কথা তিনি বলেছেন। আমার কথা হচ্ছে হ্যান্ডবিলের ছাপা অনুযায়ী দি গ্রেট বনমালী সার্কাসের মালিকই তো বাড়ুই। তিনি আবার কার কাছে কাজে ইস্তফা দেবেন? কথা শুনে এটাই তো মনে হয় যে বাড়ুই মশাইর একজন ওপরওয়ালা ও আছে। তিনি যাকে ওস্তাদ বলে মানেন।

আমার কথা শুনে রামু বিজু দুজনেই ভীষণ গম্ভীর হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পর রামু বললো, তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে সার্কাস কোম্পানির আসল মালিক বনমালী বাড়ুইকে সামনে রেখে নিজে কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে আড়ালে থাকছে। আমাদের জানতে হবে উদ্দেশ্যটা কী।

বিজু বললো, কিন্তু ফড়ের কথামতো সার্কাসের এখনকার মালিক তো বাড়ুই।

আমি বললাম, তোর কথার ভেতর দুটো প্রশ্ন রয়ে গেছে। এক ফড়ে আসল ঘটনা কতদূর জানে, আর দুই, ফড়ে আমাদের সত্যি কথা বলেছে কিনা।

ফড়ের কথা যদি বিশ্বাস না করবি তো অযথা কেন বাড়ুইর পেছনে লাগছিস।

আমি বললাম, ফড়ের কথা একেবারে বাদ দিলেও আজ সকালে তিনি যতটুকু বলেছেন, পেছনে লাগার জন্যে সেটাই যথেষ্ট।

রামু বললো, আবু ঠিক বলেছিস, এর ভেতর একটা দারুণ রহস্যময় ব্যাপার রয়েছে। আমরা যদি বাড়ই মশাইর পাপের রহস্যটা জানতে পারি, তাহলে ওকে ঠিকই পুলিশে ধরিয়ে দেয়া যাবে। তখন ফড়েই দি গ্রেট বনমালী সার্কাস পার্টির মালিক হবে।

বিজু হাসলো–তখন ওটার নাম পাল্টে দি গ্রেট ফড়ে সার্কাস পার্টি রাখতে হবে।

রামু মৃদু হেসে বললো, ফড়ে তখন নিশ্চয়ই নিজের নাম পাল্টাবে।

.

৫.

সেদিন আমরা আর বেশিদূর এগোলাম না। পরদিন সকালবেলা আবার সার্কাসের তাঁবুর আশেপাশে ঘোরাফেরা আরম্ভ করলাম। লক্ষ্য রাখলাম সন্দেহজনক কিছু ঘটে কিনা। নিজেদেরকে তখন খুব গুরুত্বপূর্ণ আর দায়িত্বসম্পন্ন মনে হলো। অথচ আগের দিন আমরা সেখানে ঘুর ঘুর করছিলাম বাড়ুই মশাইর অনুগ্রহের জন্যে, তিনি বিনে পয়সায় সার্কাস দেখাবার বদলে যদি কিছু একটা কাজ করতে দেন।

মেলার লোকজনের ঘুম তখনও ভাঙেনি। অথচ ভোরের কুয়াশা কেটে গিয়ে মড়াখেকোর মাঠ মিষ্টি সোনালি রোদে ঝলমল করছিলো। বাড়ুই মশাই অন্যদের মতো তাবুতে থাকেন না। চার ঘোড়ায় টানা একটা বড় কৌচে তিনি থাকেন। একদিন আমরা উঁকি মেরে দেখেছিলাম ভেতরটা দিব্যি ছিমছাম সাজানো ছোট্ট একটা ঘরের মতো। আমাদের নজর ছিলো বাড়ুই মশাইর কৌচের দিকে।

এ সময় হঠাৎ আমাদের চমকে দিয়ে একটা শুটকো লোক বিড়বিড় করে বকতে বকতে হন্তদন্ত হয়ে পাশ দিয়ে ছুটে গেলো। হেঁটেই যাচ্ছিলো লোকটা, কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি হাঁটছিলো, দেখে মনে হলো যেন ছুটছে। বিড়বিড় করে কি বলছিলো সব বোঝা না গেলেও একটা কথা আমাদের তিনজনের কানে চাবুকের মতো আছড়ে পড়লো–কত্তা আস্ত রাখবেন না।

লোকটা ততোক্ষণে সার্কাসের তাঁবুর দিকে অনেকখানি এগিয়ে। আমরা তিনজন একে অপরের দিকে অবাক চোখে তাকালাম। রামু তড়াক করে দাঁড়িয়ে বললো, চল পেয়ে গেছি! এই লোকটাকে ফলো করলে নির্ঘাত কিছু জানে যাবে।

আমরা তিনজন লোকটার পিছু পিছু হাঁটতে লাগলাম। লোকটা এতই হন্তদন্ত হয়ে হাঁটছিলো যে, কোনো দিকে তাকাবার সময়ই পাচ্ছিলো না! নইলে মড়াখেকোর নির্জন মাঠে আমাদের এভাবে আসতে দেখে সন্দেহ করতো। যা ভেবেছিলাম তাই হলো। লোকটা গিয়ে সটান বাড়ুই মশাইর কৌচে গিয়ে ঢুকলো।

সার্কাসের কারও তখন ঘুম ভাঙেনি। অনেক রাত অব্দি খেলা দেখিয়েছে। আমরা জানি বেলা দশটা এগারোটার আগে কেউ উঠবে না। আমরা তিনজন চুপি চুপি গিয়ে বাড়ুই মশাইয়ের কৌচের গায়ে কান পাতলাম। আর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ুই মশাই-র গলা শুনলাম–দাঁড়া, দাঁড়া, অত ব্যস্ত হোনে। হড়বড় করে কি বলছিস কিছুই বুঝতে পারছি না। এক গেলাস জল খেয়ে সুস্থির হয়ে বোস।

একটু পরে ঢক ঢক করে পানি খাওয়ার শব্দ শুনলাম। লোকটা একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বললো, সুস্থির হওয়ার কি সময় আছে কত্তা! বড় কত্তা রেগে টং হয়ে আছেন।

বাড়ুই মশাই বললেন, এখন বল তাহলে বড় কত্তা কী কী বলেছেন। তুই বলছিস মাল না পাঠানোর জন্যে কত্তা চটেছেন?

লোকটা বললো, শুধু কী চটেছেন! ঘটাকে তো এই খবর দেয়ার জন্যে বেধড়ক পেটালেন। আমাকে বললেন, সূয্যি ওঠার আগে তুই বাড়ুইর কাছে যাবি। ওকে বলবি মড়াখেকোর মাঠে ওকে ঘোড়ার ঘাস কাটার জন্যে পাঠাই নি। আমায় ঘেসেড়ার অভাব নেই। দশদিন ধরে ও বসে আছে মড়াখেকোর মাঠে। অথচ বর্ডারের ওপারে পার্টিকে বসিয়ে রেখে রোজ হাজার টাকা গুনোগার দিতে হচ্ছে। বারো ঘন্টার মধ্যে যদি মাল না যায় বলিস বড় কত্তা কাউকে আস্ত রাখবে না। মনে হচ্ছে বাড়ুই মেলা নিয়ে বেশি জমে গেছে। আজ রাতের মধ্যে মাল না পাঠালে ওকে আমি মাথা মুড়িয়ে সার্কাসের সঙের চাকুরি দেবো। সবার ওজন বুঝে কাজ করা উচিত।

বাড়ুই মশাই সব শুনে বিষণ্ণ গলায় বললেন, বড় কত্তার সবটাতেই কেবল তাড়াহুড়ো। সার্কাস একটু না জমলে কি এসব করা যায়। এমনিতেই নতুন এসেছি এই এলাকায়। ভগবতী সার্কাস পার্টির পাঁচটি হাজার টাকা দিয়ে তার জায়গায় দখল নিয়েছি। এলাকার লোকজনকে একটু হাত করতে সময় লাগবে না? তা মাল কে নেবে, তুই?

লোকটা বললো–আমাকে বড় কত্তা অন্য কাজ দিয়েছে। শেরালী আর পীরালীই তো নিতে পারবে।

বাড়ুই মশাই বিরক্ত হয়ে বললেন, তা তো পারবোই। সবে সার্কাসটা জমে উঠেছে। এ সময় বাঘের খেলাটা বন্ধ রাখলে কেলেঙ্কারি কাণ্ড হবে না?

লোকটাও বিরক্ত হয়ে বললো, তাহলে কি বড় কত্তাকে বলবো মাল যাবে না? বাড়ুই মশাই সার্কাসের চিন্তাতেই মগ্ন আছেন?

তুইও তো বেশ লোক দুগগগা। বাড়ুই মশাই গলায় বিরক্তি আর অভিমান মিশিয়ে বললেন, আমি কখন বললাম মাল যাবে না? আসলে তোরাই আমার নামে বড় কত্তার কাছে যা তা লাগিয়ে কান ভারি করিস। যা বলগে মাল যাবে। আজ রাত ঠিক আটটার সময় রামনাঙ্গা পাহাড়ের নিচে যেন—

.

৬.

বাড়ুই মশাইর কথা শুনে উত্তেজনায় আমাদের তখন দমবন্ধ হয়ে আসছিলো। কিন্তু কথার শেষটুকু শোনার আগেই পেছন থেকে কে যেন সাঁড়াশির মতো আমার গলা ধরে শূন্যে ঝুলিয়ে কৌচের পাশ থেকে সরিয়ে আনলো। শূন্যে হাত-পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে তাকিয়ে দেখি, রামু আর বিজুর দশা ঠিক আমারই মতো। কখন যে শেরালী আর তার চ্যালা-চামুণ্ডারা আমাদের দেখতে পেয়েছে টেরই পাইনি।

শেরালী মোলায়েম গলায় বললো, কত্তার গাড়িতে আড়ি পেতে কী শোনা হচ্ছিলো?

বিজু পীরালীর মুঠোর ভেতর চিৎকার করছিলো, ছেড়ে দাও বলছি। ভালো হবে না। তোমাদের সব খবর নইলে ফাঁস করে দেবো।

এমন সময় কৌচের দরজা খুলে বাড়ুই মশাই বেরিয়ে এলেন। কী হলো, এখানে এত গণ্ডগোল কিসের? এই বলে বাড়ুই মশাই আমাদেরকে শূন্যে ঝুলতে দেখে অবাক হয়ে গলেন। ও কিরে শেরালী! চৌধুরীদের ছেলেদের এভাবে ধরেছিস কেন?

শেরালী বললো, ধরেছি কি আর সাধে কত্তা। কেউটের বাচ্চা সব। এতক্ষণ তোমার গাড়ির গায়ে কান লাগিয়ে এই তিন ছোঁড়া অনেকক্ষণ ধরে আড়ি পেতে কী যেন শুনেছে।

পীরালী ওর হাতে-ধরা বিজুকে দেখিয়ে বললো, এই ছোঁড়া বলে কিনা আমাদের সব খবর ফাঁস করে দেবে।

শেরালী আর পীরালীর কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ুই মশাইর চেহারার মোলায়েম ভাবটুকু কর্পূরের মতো উবে গেলো। ঠাণ্ডা গলায় বললেন, ওগুলোকে আমার ঘরে নিয়ে আয়।

মেলার লোকজনরা তখনও কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি। শেরালীরা আমাদের তিনজনকে শক্ত করে ধরে বাড়ুই মশাইর কৌচে গিয়ে ঢুকলো। দরজাটা বন্ধ করে বাড়ই মশাই আমাদের বললেন, তোমাদের তো বাপু ভদ্দর লোকের ছেলেপুলে বলেই জানতাম। এসব ঘোটলোকের স্বভাব কেন? ভদ্দর লোকের ছেলেরা কি কখনও আড়ি পাতে?

রাগে তখন রামুর ফর্সা চেহারা পাকা টম্যাটোর মতো লাল হয়ে গিয়েছিলো। ও বললো, আপনার কাছ থেকে আমরা ভদ্রতা শিখতে চাই না।

বাপ-মা যখন শেখাতে পারেনি তখন আমার কাছ থেকেই বা শিখবে কি করে? তবে আমি তোমাদের একটু অন্য ধরনের শিক্ষা দিতে চাই। তোমরা অনেক কিছুই জেনে গেছো। বেশি জানা যে ভালো নয় এই শিক্ষাটা তোমাদের দেয়া দরকার। এই বলে বাড়ুই মশাই একটু থামলেন। গলা ঝেড়ে সেই শুটকো লোকটাকে বললেন, দেখলি তো কত ঝামেলার মধ্যে কাজ করতে হয়। তারপর শেরালীদের বললেন, ছোঁড়াগুলোকে পাঁচ নম্বরে নিয়ে মুখ, হাত-পা বেঁধে রেখে আয়। রাতে মালের সঙ্গে বস্তা ভরে পাচার করে দেবো।

শেরালীরা আমাদের আগের মতো শক্ত করে ধরে পাঁচ লেখা একটি নোংরা কৌচের ভেতর এনে ঢোকালো। শক্ত দড়ি দিয়ে পিছমোড়া করে হাত বাঁধলো, পা দুটো একত্র করে বাঁধলো, নোংরা দুর্গন্ধঅলা গামছা দিয়ে মুখ বাঁধলো। তারপর তিনজনকে তিন কোনায় তিনটে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে গেলো।

বিজু এতক্ষণ চুপ করে ছিলো। ওরা বেরিয়ে যেতেই ও ঝরঝর করে কাঁদতে শুরু করলো। রামুর মুখটা দেখলাম থমথম করছে।

বিজুকে ওভাবে কাঁদতে দেখে আমারও প্রথমটায় কান্না পাচ্ছিলো। পরে ভেবে দেখলাম, কেঁদে কোনো লাভ হবে না। বরং এদের কবল থেকে কিভাবে উদ্ধার পাওয়া যায় সে চিন্তাই করা উচিত। একবার যদি বেরোতে পারি তাহলে আর আমাদের পায়। কে! বাড়ুই মশাইকে–আর মশাই বলি কেন, বদমাশ বাড়ুইকে দেখিয়ে দেয়া যাবে কে কাকে শূলে চড়ায় আর ফাঁসিতে ঝোলায়!

বিজুটা ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে। বাড়িতে দুপুরে না ফিরলেও কেউ খুঁজতে বেরোবে না। সবাই জানে এখন পৌষমেলা। এই একমাস আমরা স্বাধীন। রাতে যখন বাড়িতে খেয়াল হবে আমরা নেই–ততক্ষণে কোথায় চলে যাবো কে জানে। এরকম অবস্থায় বিশ্ব গোয়েন্দা সিরিজের নায়করা কী করতে ভাবতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু অনেক ভেবেও এতখানি বেকায়দা অবস্থায় পড়েছে তেমন কাউকে খুঁজে পেলাম না। আমাদের মতো এভাবে কোনো সিরিজের কোনো ডিটেকটিভই কখনও বাঁধা পড়ে নি। আমাদের জুতোর হিলের ভেতর যদি ছুরিও লুকানো থাকতো এ অবস্থায় বের করা কারও পক্ষেই সম্ভব হতো না।

আরও কিছুক্ষণ পর সার্কাসের লোকজনদের ঘুম ভাঙতে শুরু করলো। রোজকার মতো হাসি-ঠাট্টা, গালাগালি আর চেঁচামেচির ভেতর দিয়ে দিনের কাজকর্ম আরম্ভ হয়েছে। আস্তাবলে ঘোড়াদের দানাপানি খাওয়াতে গিয়ে শেরালী নোংরা সব রসিকতা করছে। ওর গলা শুনে পিত্তি জ্বলে গেলো। মাঝে মাঝে পাজি বাড়ুইয়ের মোলায়েম গলাও শোনা যাচ্ছিলো।

একসময় গলায় কয়েক ভাঁড় দরদ ঢেলে বাড়ুইকে বলতে শুনলাম–হ্যাগা কামরাঙার মা, বুড়ো বয়সে কোথায় দু দণ্ড বসে আরাম করবে আর পরকালের কথা ভাববে, তা না তুমি থালা-বাসন মাজতে বসেছো। শরীরে আর কত সইবে বলো! শকুন্তলাকে বলো না বাসনগুলো মেজে দিক।

থালা-বাসনের ঝনঝন শব্দ মেশানো কামরাঙার মা-র গলা শুনলাম–সাতসকালে কানে অত মধু ঢালছো ক্যানে বাড়ুই মশাই? আমি কিন্তু বুড়ো বয়সে তোমাদের মাল-টাল নিয়ে কোথাও যেতে পারবো না। তারচে বাসন মাঝ ঢের সোজা।

বাড়ুই একটু বিরক্ত হয়ে ব্যস্ত গলায় বললো, আহ্ কামরাঙার মা! এত বয়সেও তোমার জ্ঞানগম্যি কিছু হলো না। এভাবে চেঁচিয়ে কথা বলছো কেন? রোজ-রোজ তো আর তোমাকে কেউ নিতে বলছে না। বুড়ো বয়সে বেঘোররা চাকরিটি খোয়াতে চাও নাকি!

বাড়ুইর কথা শেষ না হতেই কামরাঙার মা চেঁচিয়ে উঠলোচাকরির খোঁটা আর আমাকে দিওনি বাড়ুই মশাই। আমি তোমাদের খাই না পরি? কোন ড্যাকরা আমার চাকরি খাবে শুনি! হাটে হাড়ি ভেঙে দেবো না?

কামরাঙার মা-র চেঁচানি শুনে বাড়ুই ব্যস্ত গলায় বললো, আমার ঘাট হয়েছে বাপু, নাও, থামো এবার। নাটক করে লোক জড়ো কোরো না। সারাদিন তুমি যতো খুশি বাসন মাজো, আমি চললাম। থপ থপ করে আমাদের কৌচের পাশ দিয়ে বাড়ুই হেঁটে চলে গেলো।

বাসন মাজতে মাজতে কামরাঙার মা গজগজ করে পরে আরও কী বললো বুঝতে পারলাম না। রামুর দিকে তাকিয়ে দেখলাম কামরাঙার মা-র হাতে বাড়ুই-এর হেনস্তা ও বেশ উপভোগ করেছে।

সার্কাসের দলের এসব টুকরো টুকরো কথার ভেতর দিয়ে এটা আরো স্পষ্ট হচ্ছিলো যে, বনমালী বাড়ুই আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা সার্কাস পার্টির আড়ালে দিব্যি জমিয়ে স্মাগলিং চালাচ্ছে।

দুপুরের দিকে একটু ঝিমুনি এসেছিলো। খুট করে শব্দ হতে দেখি শেরালী দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো। হাতে করে থালা-বাটিতে খাবার আর জগ ভরে পানি এনেছে। একগাল হেসে শেরালী বললো-আমাদের ছোট কত্তার এমনই দয়ার শরীর যে, পাঠাকে বলি দেয়ার আগ মুহূর্তেও খাওয়াতে ভোলেন না। এই বলে প্রথমে সে বিজুর বাঁধন খুলে দিলো। আদুরে গলায় বললো-একজন একজন করে খাও। চেঁচাবে তো কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করবে না। ভোজালি দিয়ে এখানেই পেটটা ফাঁসিয়ে দেবো।

বিজুর চেহারা দেখে মনে হলো ওর খুব খিদে পেয়েছে। খিদে আমারও পেয়েছিলো। বিজু আমার দিকে তাকালো। ইশারায় ওকে খেতে বললাম।

বিজুর খাওয়া শেষ হবার পর শেরালী ওকে আগের মতো শক্ত করে বেঁধে রামুর বাঁধন খুলে দিলো। রামু বললো, আমার পেচ্ছাব পেয়েছে। বাইরে যাবো।

শেরালী পিটপিট করে রামুর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মোলায়েম গলায় বললো, মামদোবাজি, না? তোমাকে আমি পেচ্ছাব করানোর জন্যে বাইরে নিই আর তুমি চেঁচিয়ে মেলার সব লোক জড়ো করো! না বাছা! সেটি হচ্ছে না। ওই কোণে গিয়ে সেরে আসো, বাইরে যেতে পারবে না।

রামু আর কোনো কথা না বলে গম্ভীর মুখে খাওয়া আরম্ভ করলো। শেরালী তাই দেখে একগাল হেসে বললো, সারাদিন একফোঁটা দানাপানি পেটে পড়েনি, বলে কিনা পেচ্ছাব করবো। আসল কথা বাইরে যাব! এইটুকুন বুদ্ধি নিয়ে ছোট কত্তার পেছনে লাগতে গেছো! ধন্যি ছেলে বাপু!

রামুর পর আমার পালা। আমার শুধু হাতের আর মুখের বাঁধনই খুললো শেরালী। বললো, বার বার ভোলা আর বাধা ভালো লাগে না। কত্তা বলেছিলেন, খাওয়ানোর সময় বাঁধন খুলে দিস। তা বাপু পা দিয়ে তো আর খাচ্ছে না। পায়ের বাঁধন থাকলেও খেতে অসুবিধা হবে না।

রামুর পেচ্ছাব করার কথা শুনে আমারও মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছিলো। শেরালী আমাদের খেতে দিয়েছে রুটি আর ডাল। আমি ভাবছিলাম ডালটা ওর চোখে ছুঁড়ে মেরে একছুটে বাইরে চলে যাবো। মেলার অনেকে এরই মধ্যে আমাদের চিনে ফেলেছে। বায়স্কোপ কোম্পানীর তাঁবুর কাছে গিয়ে প্রাণপণে একটা চিৎকার করতে পারলেই হলো। কিন্তু পায়ের বাঁধনটাই সব বানচাল করে দিলো।

সুবোধ বালকের মতো খাওয়া শেষ করতে হলো। খাওয়ার পর শেরালী আমাকে বাঁধতে বাঁধতে বললো–এই তো লক্ষ্মী ছেলের মতো ব্যবহার। টু শব্দটি পর্যন্ত নেই। রাত পর্যন্ত থাকো এভাবে। তারপর আবার দেখা হবে।

সবার বাঁধন আরেকবার ভালো করে দেখে শেরালী থালা-বাটি হাতে করে বেরিয়ে গেলো। যাবার সময় দরজার বাইরে তালা লাগাতে ভুললো না।

দেখতে দেখতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হবার পথে। অথচ বাড়ি থেকে কেউ খুঁজতে এলো না। পালাবারও কোনো পথ খুঁজে পেলাম না। সার্কাসের লোকজনদের বিশেষ কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছিলাম না। ওরা সবাই তখন দূরের বড় তাবুতে খেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিজুটা আবার ফোৎ ফোৎ করে কান্না শুরু করেছে। দূরে বসেও ওর কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম। শব্দ শুনতে পেয়েই আমার মাথায় আরেকটা প্ল্যান এলো।

দূরে কোথাও বসে ফড়ে বেসুরো গলায় ঠুংরী গাইছিলো–কোয়েলিয়া মৎ পুকারো। সারাদিনে এই প্রথম ফড়ের গলা শুনলাম। ফড়ের গান শুনে দুঃখের ভেতরও হাসি পেলো। কিন্তু ফড়েকে আমাদের কৌচের কাছে পাই কী করে! ও কাছে না এলে সব প্ল্যানই যে ভেস্তে যাবে।

তখনই আমাদের কৌচের কাছে কামরাঙার মা-র গলা শুনলাম–হ্যাঁরে ফড়ে, সেই দুপুর থেকে তোকে খুঁজে মরছি। ছিলি কোথায়?

ফড়ে কাছে এসে বললো, ছিলাম আর কোথায়? শেরালীর পিটুনির ভয়ে বায়োস্কোপ কোম্পানির তাঁবুতে বসেছিলাম। খুঁজছিলে কেন?

কামরাঙার মা এরপর চাপা গলায় ফড়েকে যা বললো শুনে উত্তেজনায় আমার বুকের ভেতর ঢিব টিব শব্দ হতে লাগলো। কামরাঙার মা ফড়েকে বলছিলো, দুপুরে দেখলাম, শেরালী খাবার নিয়ে এই পাঁচ নম্বরে কাদের যেন খাইয়ে গেলো। আমার কাছ থেকে তিনটা থালাও চেয়ে নিয়েছে।

.

৮.

কামরাঙার মা-কে সেই মুহূর্তে মনে হলো, সে যেন বাড়ুইদের বাসন মাজা বুড়ি দাই নয়, স্বর্গ থেকে নেমে এসেছে কোনো দেবদূত আমাদের উদ্ধার করার জন্যে।

ফড়ে উত্তেজিত গলায় বললো, সে কি কামরাঙার মা? চৌধুরীদের ছেলেরা নয় তো? আমি দু বার ওদের বাড়িতে গিয়েছি, বললে মেলায় আছে। মেলায় কোথাও খুঁজে না পেয়ে ভাবছিলাম কোথায় গেলো। একটা জরুরী খবর, ওরাই শুধু পারতো থানায় জানিয়ে আসতে। আমি ঠিক করেছি কামরাঙার মা, যা হয় হবে, আমি আর এসব সহ্য করবো না।

আমি তখন ফড়ের মনোযোগ আকর্ষণের জন্যে নাকি স্বরে হু হু শব্দ করতে লাগলাম। শব্দ শুনে মনে হল ফড়ে যেন আঁতকে উঠেছে–এই তো শব্দ পাচ্ছি কামরাঙার মা! তোমরা কি ভেতরে আছো? উত্তেজনায় ফড়ের গলা দিয়ে কথা বেরুতে চাইছিলো না।

আমি আবার জোরে হুঁ শব্দ করলাম।

পেয়ে গেছি কামরাঙার মা! ফড়ে আহ্লাদে আটখানা হয়ে বললো, ওরা বলছিলো বাড়ুইর পাপের কিনারা করে ছাড়বে। নির্ঘাত বাড়ুই বুঝতে পেরে ওদের আটকে রেখেছে। আমি ঠিক জানি।

কামরাঙার মা ওকে বাধা দিয়ে বললো, ওসব ব্যাখান আমাকে পরে শোনাস ফড়ে। এখন ঘোড়াগুলোকে বের করবি কী করে সেটাই বল? চাবি তো শেরালীর কাছে।

ফড়ে খানিক ভেবে বললো, এ আর এমন কী কঠিন কাজ। তুমি শকুন্তলাকে এ কাজে লাগিয়ে দাও। তোমার কথা শকুন্তলা ফেলতে পারবে না। শেরালীকে কয়েকটা মিঠে কথা বলে ভাব জমিয়ে এক ফাঁকে চাবিটা পকেট থেকে তুলে নেবে।

কামরাঙার মা ছুটতে ছুটতে বললো, তুই ধারে কাছেই থাকিস।

ফড়ে কৌচের গায়ে মুখ লাগিয়ে চাপা গলায় বললো, ভেবো না আবুরা। এক্ষণি তোমাদের বের করে আনছি।

ভেতরে অন্ধকারে আমি রামু, বিজুর মুখ দেখতে পেলাম না। বিজু অনেক আগেই কান্না থামিয়েছে। শেষ পর্যন্ত ফড়ে আর কামরাঙার মা-ই আমাদের বাঁচালো! ভাবতে গিয়ে বার বার রোমাঞ্চিত হচ্ছিলাম।

প্রায় আধঘন্টা পরে কামরাঙার মা এসে চাপা গলায় ডাকলো–ফড়ে কোথায় গেলি?

অল্প দূরে কোথাও ছিলো ফড়ে। কামরাঙার মা-র ডাক শুনে ছুটে এলো।

কামরাঙার মা বললো, এই নে চাবি। জলদি কর। তোকে আবার চোঙা ফোকার জন্যে ওরা খুঁজছে।

ফড়ে চাবি নিয়ে ঝটপট দরজা খুললো। কোমর থেকে ছুরি বের করে বাঁধন কাটতে কাটতে বললো, তখনই বুঝেছিলাম মুখ-হাত-পা সব বেঁধে রেখেছে।

তিনজনের বাঁধন কাটার পর ফড়ে বললো, পেছন দিয়ে এক্ষুণি বেরিয়ে যাও। জেঠুকে বলল রাত আটটার সময়–।

আমি বাধা দিয়ে বললাম, আমরা সব জানি, তুমি সার্কাস চালিয়ে যাও। দরজাটা বন্ধ করে চাবিটা শেরালীর পকেটে রাখার ব্যবস্থা কোরো–যাতে এক ঘন্টার আগে ওরা টের না পায়।

.

৯.

পরের একটি ঘন্টা যে কিভাবে কেটেছিলো সে আর বলার নয়। আমরা ছুটে গিয়ে জেঠুকে সব বললাম। শুনে জেঠু-বলিস কী? এখনই থানায় চল। এই বলে দুহাতে আমাদের হিড়হিড় করে টানতে টানতে খড়ম পায়েই থানার দিকে ছুটলেন।

পথে বুড়ো হালদার দাদুর সঙ্গে দেখা। তিনি আমাদের ওভাবে ছুটতে দেখে বললেন, কী হলো, কোথায় যাচ্ছে তোমরা? তাঁর কথার জবাব না পেয়ে তিনি পেছনে ছুটতে ছুটতে বার বার জেঠুকে ডেকে বলতে লাগলেন–ও হাবু, কোথায় যাচ্ছিস? কী হয়েছে? বল না?

জেঠু একবার শুধু বললেন, থানায় এসো হালদার কাকা, সব বলছি।

থানায় বিশ্বাস দারোগা সব শুনে ছিটকে বেরিয়ে এলেন। তখনই লোকজন সব ডেকে একদলকে সাদা পোশাকে মড়াখেকোর মাঠে আরেক দলকে রামনাঙ্গা পাহাড়ে পাঠিয়ে দিলেন। জেঠু আর হালদার দাদুকে বললেন, আপনারা ঘরে ফিরে যান। এরা আমার সঙ্গে থাকুক। রাতে আমি নিজে গিয়ে পৌঁছে দেব।

এরপরের ঘটনা আর বাড়িয়ে লাভ নেই। সার্কাসের দলে বনমালী বাড়ুই ছাড়া আরও তিনজন ছিলো এক বিরাট চোরাচালানীর দলের সঙ্গে জড়িত। সেই তিনজন শেরালী, পীরালী আর নুরালী ছাড়া আর কেউ নয়। অন্য সবাই ফড়ের বাপের আমলের লোক।

সেদিনের সার্কাসের খেলা ভণ্ডুল হয়ে গেলো। কামরাঙার মা কখনও হেসে কখনও কেঁদে বিশ্বাস দারোগাকে বললো, কিভাবে বাড়ুই তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে দলের সঙ্গে জুটেছে আর ফড়ের বাবা-মাকে ষড়যন্ত্র করে মেরেছে। কামরাঙার মা-র কথা শুনে সার্কাসের সবাই ফড়েকে বুকে জড়িয়ে ভেউ ভেউ করে কাঁদলো। ফড়েও কান্নায় কোরাসে গলা মেলালো। এক ফাঁকে আমাদের জড়িয়ে ধরে–আজ থেকে তোমরাই আমার বাপ। পায়ের ধুলো দাও বাপ–এই বলে আমাদের পা ধরতে এসে দারুণ হাসির কান্ড ঘটালো।

বনমালী বাড়ুই আর তার দলবলকে আগেই থানায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিলো। রামনাঙ্গা পাহাড়ের নিচে থেকে দলের আরো দুটো লোক ধরা পড়লো। ধমক খেয়ে ওরা বড় কত্তার নাম ঠিকানাও বলে দিয়েছে।

বিশ্বাস দারোগা বললেন–এখন থেকে তাহলে সার্কাসের মালিক হচ্ছে ফড়ে!

ফড়ে লাজুক হেসে জিব-টিব কেটে বললো, তা কী করে হয় দারোগা মশাই! আমরা সবাই মিলে সার্কাসের মালিক হবো। লাভের বখরা আমরা সবাই সমান ভাগ করে নেবো।

একথা শোনার পর সার্কাসের লোকেরা ফড়েকে কাঁধে তুলে, শূন্যে ছুঁড়ে শিস বাজিয়ে লাফ ঝাঁপ দিয়ে রীতিমতো সার্কাসের খেলা দেখিয়ে ছাড়লো।

পরদিন ফড়ে নিজেই র-নগরে চোঙা ফুঁকে বললো–নতুন সার্কাস… নতুন সার্কাস… নতুন সার্কাস। আজ থেকে দি গ্রেট বনমালী সার্কাসের নাম পাল্টে রাখা হলো সবার সার্কাস। আসুন, দেখুন, উপভোগ করুন, সবার সার্কাস।

সেই রাতে ফড়ে বাঘের খেলা থেকে শুরু করে এমন সব কাণ্ড করলো, দেখে র-নগরের সবার চোখ ট্যারা হয়ে গেলো। ফড়ে সব খেলাই নকল করতে পারতো! কিন্তু সেদিন ও এমন কিছু খেলা দেখালো যা একেবারেই ওর নিজস্ব কায়দার। দেখে সবাই এক বাক্যে বললো, ফড়ের কাছে শেরালীরা নস্যির মতো।

এরপর থেকে সার্কাস দেখতে আমাদের কোনো পয়সা লাগেনি। বরং দূর-দূরান্ত থেকে যারা মেলা দেখতে আসতো তারা আমাদের তিনজনকেও দেখে যেতো। একবার তো ফড়ে বলেই ফেললো-তোমাদের দেখার জন্যে টিকেটের ব্যবস্থা করলে দিব্যি দু পয়সা কামানো যেতো।

আমাদের বাড়ুই-এর খপ্পর থেকে উদ্ধার করার জন্যে কামরাঙার মা-ও রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলো। সার্কাসের সবাই বললো, এখন থেকে কামরাঙার মা আমাদের সবার মা। ওই আমাদের ম্যানেজার, ও না থাকলে বাড়ুইর বদমাইশির কথা কিছুই জানা যেতো না।

আমাদের বাড়িতে দিদার সঙ্গে সার্কাসের নতুন ম্যানেজার কামরাঙার মা-র গলায় গলায় ভাব হয়ে গেলো। কামরাঙার মা অবশ্য নিজের কৃতিত্বের কথা কখনও স্বীকার করেনি। বলতো, আমি তো আজীবন সয়েই ছিলাম। আবুরা যদি নাক না গলাতে তাহলে হয়তো বাকি জীবনটাও মুখ বুজে কাটিয়ে দিতাম।

কামরাঙার মা আর ফড়ে যাই বলুক না কেন আমরা তো জানি ওরা না থাকলে আমরা তিনজন সেই রাতেই স্বর্গে চলে যেতাম। ফড়ে তবু বার বার বলবে, তোমরা আমায় নতুন জীবন দিয়েছে।

পৌষমেলার শেষে যাবার সময় ফড়ে আর কামরাঙার মা আমাদের বুকে জড়িয়ে ধরে এমন হাউমাউ করে কাঁদলো যে বিজু ও ওদের সঙ্গে গলা না মিলিয়ে পারলো না। আমাকে আর রামুকে অবশ্য কান্না চেপে রাখার জন্যে যথেষ্ট কসরত করতে হয়েছিলো।