সব ভালো যার শেষ ভালো

সব ভালো যার শেষ ভালো

আমাদের পাড়ার ঠিক মোড়েই ছিলো শুটে হালদারের পানের দোকান। বুড়োরা বলে, গুটের মতো চমৎকার পান সাজতে পারে এমন লোক এ তল্লাটে দ্বিতীয়টি নেই। তাই সারাদিন মাছির মতো ভিড় জমে থাকতো গুটের দোকানে। তবে সবই ছিলো বুড়ো মাছি।

বুড়োরা গুটেকে যতই ভালো বলুক না কেন, আমাদের কিন্তু ওকে একেবারেই ভালো লাগতো না। লাগবেই বা কেন বলল! গুটে তার দোকানে পান আর বিড়ি-সিগারেট ছাড়া কিছুই রাখবে না। একদিন গিয়েছিলাম লাটু ঘোরাবার লেত্তি কিনতে–অমনি গুটে খেঁকিয়ে উঠে বললো, ওসব আজেবাজে জিনিস আমি রাখি না।

বললেই হলো বাজে জিনিস! ভারি তো এক দোকান! গজবন্ধু স্টোর্স এর চেয়ে কতো ভালো! সেখানে লাটু, লেত্তি, বড়শি, টোপ, ঘুড়ি–সব পাওয়া যায়। একটু দূরে বলেই না গুটের দোকানে যাওয়া!

যেমনি গুটের দোকানের ছিরি, তেমনি বাহারে তার নিজের চেহারা! কুচকুচে কালো রঙ সারাক্ষণ ঘামে জবজব করছে, যেন এই মাত্তর একঘড়া আলকাতরা মাথায় ঢেলে এসেছে। মুখের একপাশে সুপুরির মতো বড় এক আঁব। তার ওপর কয়েকগাছি দাড়ি। চোখ দুটো পিটপিটে, থ্যাবড়া নাক, কদম ছাঁট চুল–সব মিলিয়ে গুটে এক যাচ্ছেতাই লোক।

গুটের আরেক বিচ্ছিরি স্বভাব হলো আমাদের ওপর খরবদারি করা। ধরো, স্কুলে খেলতে সন্ধ্যে হয়ে গেলো। বাড়ি ফেরার পথে জেঠুর বকুনির কথা ভেবে এমনিতেই আমি, বিজু আর রামু আধখানা হয়ে আছি। তার ওপর গুটে বাজখাই গলায় পেঁচিয়ে বলবে, রাত করে কোত্থেকে আসা হলো?

শুটের কথার জবাব দেয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তখন থাকে না। সবাই তখন চুপিচুপি পড়ার টেবিলে বসে আঁক কষতে পারলে বাঁচি। জেঠু এলে বলে দিতে পারবোবারে, সেই কখন থেকে আঁক কষছি! আঁক কষতে দেখলে জেঠুও ভারি খুশি হন। বলেন–বেশ বেশ, শোবার আগে কদ্দূর করলি দেখিয়ে নিস।

জেঠুর এমন খুশি খুশি ভাবটা এক সেকেণ্ডে ভয়ঙ্কর রাগে পরিণত হয়, যদি শোনেন আমরা দেরি করে ফিরেছি। সেদিন বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যও পার হয়ে গেছে। গুটের দোকানে একগাদা ভিড়। তার ভেতর থেকে ও ষাঁড়ের মতো চেঁচিয়ে উঠলো, ফের দেরি করেছ?

রোজ রোজ এমন চেঁচানো আর কার ভালো লাগে বলো! তার ওপর এমনি লোকজনের সামনে অপমান করা। আমিও বললাম, তোমার এতো খবরদারি কেন গুটে? নিজের চরকায় তেল দাও!

এমন চমৎকার একখানা কথা বলতে পেরে বাহাদুরি নেবার জন্যে রামু আর বিজুর দিকে তাকালাম। রামুর ভাবখানা–বেশ হয়েছে! কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সবাই ফুটো বেলুনের মতো চুপসে গেলাম যখন গুটে খেঁকিয়ে উঠলো-খুব যে কথা শেখা হয়েছে। দাঁড়াও, জেঠুকে বলে শায়েস্তা করতে হবে।

মুখ কালো করে তিনজন বাড়ি ফিরে আঁক কষতে বসলাম। বিজু মিনমিন করে বললো, আসলে তোর অমন করে বলাটা ঠিক হয় নি।

আমি ধমকে বললাম, মেলা বকিসনি বিজু। দেবো এক গাট্টা।

কথাটা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই দেখি আমার আর রামুর কান দুটো জেঠুর দুহাতে ধরা। খুব আয়েশ করে কান ঝাঁকাতে জেঠু বললেন, ইস্কুলে এতক্ষণ কী করছিলি?

কথার জবাব দেবো কি, আমাদের মাথার তালু অবধি ঝিঁঝিম্ করছিলো। সবাই ট্যারা চোখে তারা দেখছি। বিজু তো আমাদের অবস্থা দেখে ভ্যাক করে কেঁদেই দিয়েছে। ভাগ্যিস কেঁদেছিলো। আর তাই শুনে ভেতরে থেকে দিদা বেরিয়ে এলেন। জেঠুর আয়েশ তখনও কাটে নি। দিদা দেখে তো এক ধমক-তোর আক্কেল আর কোনো কালেই হলো না হাবু। একশো দিন তোকে বারণ করেছি, ছেলেদের ওভাবে কান ধরে ঝাঁকাসনে, মাথার মগজ নড়ে যায়, স্মরণশক্তি কমে যায়। সে কথা আর মনে থাকে না।

জেঠিমা পাশের ঘর থেকে ফোঁড়ন কাটলেন–মনে আর থাকবে কী করে মা, আপনারা যে ছোটবেলায় কান ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে দিয়ে স্মরণশক্তিটি লোপ পাইয়ে দিয়েছেন। সেজন্যেই তো এখন সবার….

জেঠু রেগেমেগে পাশের ঘরে গিয়ে জেঠিমাকে বললেন, তুমি বুঝি খুব দেখে এসেছিলে?

জেঠিমা বললেন, তা নাহলে কথা কেন মনে থাকে না? কবে থেকে বলছি আমার দোক্তা ফুরিয়ে গেছে, পশারীদের কাছ থেকে দুআনার বচ আর জষ্ঠিমধু এনো–।

জবাবে জেঠু গাঁইগুঁই করে কি যেন বললেন শুনতে পেলাম না। দিদা আমাদের খেতে ডাকলেন।

খেয়ে-দেয়ে সবাই লেপের নিচে গুটিসুটি মেরে শোবার পরও কানের ভেতর প্রজাপতি উড়তে লাগলো। রামু বললো, আমার কানটা অবশ হয়ে গেছে।

বিজু বললো, আসলে গুটেকে অমন করে না বললেই পারতি।

আমি বললাম, দাঁড়া না, এর শোধ যদি না নিই!

রামু অবাক হয়ে বললো, কার ওপর শোধ নিবি? জেঠুর?

আমি শক্ত হয়ে বললাম, না, গুটের ওপর।

দুদিন ধরে ভাবলাম, গুটেকে কেমন করে জব্দ করা যায়। অনেক ভেবে ঠিক করলাম, গুটের বারোমেসে পেয়ারা গাছটাকেই ধরবো। এক এক করে ওর পোষা কবুতরের ঝাঁক, খেদী নামের ন্যাড়া কুত্তাটা–কাউকেই বাদ দেবো না।

রামু আর বিজুকে বললাম, সব কটা পেয়ারা পেড়ে ফেলবো। খেদীকে দেখলেই গুলতি দিয়ে তাক করবো। আর ঝুঁটি ওয়ালা কবুতর ধরে ইভুকে দিয়ে তার বদলে স্ট্যাম্প নেবো।

ওরা শেষ দুটো পছন্দ করলো। কিন্তু পেয়ারা চুরির বেলায় খুঁত খুঁত করতে লাগলো। কবুতর যেখান থেকে খুশি ধরা যাবে। খেদীকে যখন-তখন তাক করা যাবে। কিন্তু পেয়ারা পাড়তে হলে যে ওর বাড়িতে যেতে হবে।

আমি বললাম, তাতে কি, মন্টিদের চালের ওপর দিয়ে ওর পাঁচিল টপকাবো।

এতেও ওদের পছন্দ হলো না। আমি তখন চটে গিয়ে বললাম, তাহলে ঘরে গিয়ে সেজদির আঁচলের তলায় বসে থাকো গে। ভীতু কোথাকার!

রামু শুনে ভয়ানক ক্ষেপে গেলোভীতু ভীতু করিস নে বলে দিলাম। গাট্টা মেরে মাথায় সুপুরি বানিয়ে দেবো। দরকার হলে তুই ঘরে বসে পচা পচা ডিটেকটিভ বই পড় গে!

আমি বললাম, যা জানো না তাতে নাক গলিও না। এখন তোমরা যাবে কিনা তাই বলো। গেলে এসো আমার সঙ্গে।

এই বলে আমি হন্ হন্ করে হাঁটতে শুরু করলাম। হাফ-স্কুল ছিল সেদিন। শেষ দুপুরে বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে। গুটের দোকানটাও এ সময়ে ফাঁকা থাকে। সে বসে বসে হিসেব লেখে–কাকে কত বাকি দিলো, কোন দিন কাকে পয়সা দেবার জন্যে বলবে, কাকে আর বাকি দেবে না–এমনি সব বাজে কাজ।

রামু আর বিজু সঙ্গেই আসছিলো। গুটের দোকানের সামনে দিয়ে যেতে আড়চোখে তাকিয়ে দেখি গুটে পেন্সিলের শিষটা বার বার জিভে লাগিয়ে গম্ভীর হয়ে হিসেব লিখছে। আমাদের দিকে তাকিয়েও দেখলো না।

চুপিচুপি মন্টিদের পাঁচিল টপকে তিনজনেই পেয়ারা গাছটায় উঠে পড়েছি। মস্তবড় কাশীর পেয়ারা। বিজু বললো, আসলে পকেটে তো দুটোর বেশি রাখতে পারছি না।

আমি বললাম, মন্টিদের পাঁচিলের বাইরে যে ড্রামে ওরা ময়লা ফেলে ওটাতে ফেল। খুব টিপ করে মারিস, ড্রামের গায়ে যেন না লাগে।

বিজুকে বলাটাই সার হলো। ওর যে এমন যাচ্ছেতাই টিপ সে-কি আর আগে জানতাম! ভেবেছিলাম আমাদের সাথে থেকে ওর কিছু হয়েছে। কিন্তু সে গুড়ে বালি। ঠং করে মস্ত এক পেয়ারা গিয়ে ড্রামের গায়ে লাগলো।

ভাগ্যিস এ দিকটা নোংরা বলে লোকজন চলাফেরা করে না। বিজুকে খুব করে ধমকে দিলাম। রামু হঠাৎ ডেকে বললো, খেদীকে দেখেছিস? দেবো নাকি মাথা ফাটিয়ে?

খেদী ঠিক পাঁচিলের গা ঘেঁষেই বসেছিলো। লেজে ওর উকুন হয়েছে। তাই বার বার তিড়িং তিড়িং করে লেজের ডগা কামড়াতে চাইছিলো। রামু তাকে একটা পেয়ারা ছুঁড়ে মারলো।

টিপ বটে রামুর। ছোট সাইজের একটা ঠাস করে ফেঁদীর পিঠে গিয়ে পড়লো। আর তখনই খেদী এমন বিকট চিৎকার করে উঠলো, যেন কেউ চোখের সামনে থেকে তার লেজখানা কেটে নিয়ে গেছে।

বেশ কিছুক্ষণ চেঁচিয়ে খেদী যখন দেখলে কেউ আদর করে তার উকুনঅলা পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে না, তখন চেঁচাতে চেঁচাতে গুটের দোকানের দিকে গেলো।

রামু বললো, একেই বলে এক ঢিলে দুই পাখি মারা।

আমরা সবাই কোরাসে হাসতে যাবো তখনই শুনি গুটের বাজখাই গলা–গাছে কে উঠেছে র‍্যা? বলেই খটাস খটাস খড়ম বাজিয়ে এদিকে আসতে লাগলো।

আমি তখনই–পালা বলে তিন লাফে গাছ থেকে পাঁচিল টপকে একছুটে একেবারে মড়াখেকোর মাঠে।

খানিক পরে হাঁপাতে হাঁপাতে রামুও এলো। বললো, একটু হলেই ধরা পড়েছিলাম আর কি!

আমি বললাম, গুটে দেখতে পায়নি?

রামু মাথা নেড়ে বললো, ও আসার আগেই আমি পাঁচিল টপকেছি।

বিজুটা আবার দেরি করছে কেন?

রামু পকেট থেকে একটা পেয়ারা বের করে বললো, এখনও মন্টিদের পাঁচিল টপকাচ্ছে হয়তো। ও তো বার বার ফেল না মেরে পাঁচিল টপকাতে পারে না।

রামু চকাম চকাম করে পেয়ারা খেলেও আমার কিন্তু বিজুর জন্যে ভাবনা হচ্ছিলো। অনেকক্ষণ কেটে গেলো। বিজু এলো না। রামু বললো, ওকি জানে আমরা মড়াখেকোর মাঠে থাকবো! দ্যাখগে বাড়ি বসে চার বানাচ্ছে।

তাই তো! আমি শুধু ভেবে মরি। বললাম, চল বাড়ি যাই।

যাবার পথে রামু মন্টিদের পাঁচিলের ধার থেকে পাকা পেয়ারাগুলো তুলে নিলো। বাড়ি এলে দিদা দেখে ভারি খুশি–কোথায় পেলি রে? চমৎকার জেলী হবে।

রামু দিব্যি মিথ্যে কথা বলে দিলো–ইভুদের বাগানে অনেক পেয়ারা পেড়েছে। তার থেকে কটা আনলাম।

দিদা বললেন, ওরা আবার কবে কাশীর পেয়ারা লাগালো? গেল আষাঢ়ে ওর মাকে বললাম, দুটো কলম বাঁধার জন্যে। দিব্যি বলে দিলো আমাদের বাগানে তো পেয়ারা গাছ লাগাইনি। দাঁড়া, ওর সাথে বোঝাঁপড়া করতে হবে। না দেবার হলে না। দিত। মিথ্যে বলার কী দরকারটা ছিলো।

দিদা বলেই যাচ্ছিলেন। রামু তাড়াতাড়ি সামনে থেকে সরে পড়লো। কে জানে কখন বেফাঁস কথা বেরিয়ে পড়ে। একটা মিথ্যের ধাক্কা সামলাতেই এতো!

দূর হোকগে ছাই দিদা আর কাশীর পেয়ারা। এদিকে যে বিজুকে কোথাও দেখছি । সব ঘরে তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম। মা বললো, অমন ঘুরঘুর করছিস কেন? বিকেলে কোথায় একটু বাইরে ঘুরে আসবি তা নয়, ঘরের ভেতর শুধু ঘুর ঘুর করা!

বাইরে বেরিয়ে দেখি রামুরও মুখ কালো বললো, বিজুকে বাড়ির কেউ কোথাও পাঠায় নি।

আমি বললাম, নির্ঘাত গুটে হতচ্ছাড়া ওকে ধরে রেখে দিয়েছে।

রামু বললো, সাহস তো কম নয় থ্যাবড়ামুখোর!

আমি বললাম, ধাড়ি শয়তান!

রামু বললো, পাজির পা ঝাড়া!

তারপর দুজনে অকা সরকারের পুকুর ঘাটে বসে ওকে মনের সুখে গালি দিলাম। সব শেষে ঠিক করলাম গুটের কাছে যাওয়া উচিত। জেঠুকে যাতে না বলে সেরকম একটা ব্যবস্থা করতে হবে। দরকার হলে না হয় পয়সা দিয়ে দেবো। কত পেয়ারা তো বাদুড়েও খায়। আমরা নিলেই যেন দোষ!

গুটেকে গিয়ে ভাল মানুষের মতো বললাম, গুটে, বিজু কোথায়?

গুটে ভুরু কুঁচকে বললো, আমি কী করে বলবো?

রামু বললো, কেন, ও তোমার পেয়ারা পাড়তে আসেনি?

গুটে বললো, সে তো এসেছিলো দুপুরবেলা। তখন তো তোমরাও ছিলে।

আমার তখন মনে হল গুটে ভারি ভয়ানক এক চাল চালছে। গম্ভীর হয়ে বললাম, দেখ গুটে, তুমি ওকে মার খাওয়ানোর জন্যে বেঁধে রেখেছে। এ আমরা জানি। ওকে ছেড়ে দাও। আর কখনও ও পেয়ারা পাড়তে আসবে না।

গুটে বিরক্ত হয়ে বললো, কী জ্বালা, পেয়ারা খাবার জন্যে বেঁধে রাখবো কেন? আমি তো আরো ধরে ওকে গাছ থেকে নামিয়ে দিয়েছি। বললাম, দুদিন পর একঝুড়ি তোমাদের বাড়িতে রেখে আসবো। তখন ফেলে-ছড়িয়ে ইচ্ছেমতো খেয়ো। এখনও সব পাকে নি।

আমি ঠিক জানি গুটে মিথ্যে কথা বলছে। তাই বললাম, তাহলে বিজু কোথায় গেলো?

গুটে বললো, কেন বাড়িতে নেই?

আমি রেগে বললাম, থাকলে কি আর তোমার সাথে তামাশা করছি।

তাহলে দেখ কোনো বন্ধু-টন্ধুর বাড়ি গেছে কি না। আমার এখানে ভিড় জমিও না। খদ্দের আসার সময় হলো।

রামু বললো, চল ইভুদের বাড়ি দেখে আসি।

আমি যেতে যেতে বললাম, ইভুদের বাড়ি কেন যাবে?

রামু পেয়ারা চিবুতে চিবুতে সবজান্তার মতো জবাব দিলো–ও হয়তো ভেবেছে আমরা পেয়ারা বদলে স্ট্যাম্প নেবো বলেছি।

বিজুকে আমরা ইভুদের বাড়িতেও পেলাম না। কেন্দুদের বাড়িতেও খুঁজলাম। সেখানেও নেই। আমি তখন গুটের ওপর ভীষণ রেগে গেলাম। ও ছাড়া আর কেউ বিজুকে লুকিয়ে রাখেনি। রামু ওর সবজান্তা ভাবটা ভুলে গেলো। করুণ মুখে বললো, বিজুকে যদি না পাওয়া যায় তাহলে কী করবি?

আমি বললাম, ওকে খুঁজে বের করবোই।

রামু বলল, বাড়িতে কী বলবি?

আমি চুপসে গেলাম। তাই তো, বাড়িতে কি বলবো! রামু ভেবে বললো, আমি বলি কী বাড়িতে কাউকে বলে কাজ নেই। ওরা থানাতে খুঁজুক। আমরা আমাদের মতো খুঁজবো।

মাথা নেড়ে বললাম, তাই হবে।

বাড়িতে ঢুকে চুপচাপ পড়ার টেবিলে গিয়ে বসেছি। দিদা এসে বললেন, হারে, বিজু গেলো কোথায়?

আমি চুপ।

রামু বললো, আমরা কী জানি। ও তো আমাদের সঙ্গে যায় নি।

দিদা অবাক হয়ে বললো, সে কি রে! তাহলে গেলো কোথায়?

রামু বললো, দেখো গে কেউ হয়তো কোথাও পাঠিয়েছে।

দিদা ভেতরে গেলেন। আমি উঠে এক গ্লাস পানি খেলাম। বার বার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। ঠিকমতো কথা বলতেও পারছিলাম না।

দিদা ভেতরে যাবার পাঁচ মিনিট পরেই সারা বাড়িটা ব্যস্ত হয়ে উঠলো। বিজু কোথায়? সবাই শুধু এক প্রশ্ন। কেউ বললো, দুপুরে তো দেখলাম চিলেকোঠায় আচার চুরি করে খাচ্ছে। কেউ বললো, সেই বিকেল থেকেই দেখছি না, ভাবলাম সেজদি কোথাও পাঠালো বুঝি।

সেজদি সবাইকে খুব গালি দিলো–কিছু হারালে অমনি সেজদি। আমি ছাড়া যেন এ বাড়িতে আর কেউ থাকে না।

জেঠু সেজকাকে থানায় পাঠিয়ে নিজেও ছড়ি হাতে বেরিয়ে পড়লেন। আমাদের বলে গেলেন ওর বন্ধুদের বাড়িতে দেখে আয়। আমি আর রামু সটান গুটের দোকানে। ওকে বাইরে ডেকে বললাম, বিজু হারিয়ে গেছে।

শুনে গুটের মার্বেলের মতো চোখ দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইলো। আমি বললাম, অমন করে তাকিয়ো না গুটে। তুমি ওকে বকেছিলে?

গুটে বললো, আল্লার কিরে বলছি–ওকে আমি নিজে ধরে গাছ থেকে নামিয়েছি। বকবো কেন বলো? কত ফল বাদুড়-ভামে খেয়ে যায়। তাই বলে চৌধুরীদের ছেলেদের বকবো! তোমার বাবা যদি আমাকে টাকা না দিতো তাহলে এ দোকান করতে পারতাম? তোমরাই বলো, বিজুকে আমি বকতে পারি?

তবু আমার বিশ্বাস হলো না। গুটের চেহারা দেখে মনে হয় ও খুনও করতে পারে। নির্ঘাত ও বিজুকে লুকিয়ে রেখে ছেলেধরাদের কাছে বিক্রি করবে। আমি শক্ত হয়ে বললাম, গুটে, তুমি জানো বিজু কোথায়। তুমি বলছো না। তবে আমরা ওকে খুঁজে বের করবোই।

গুটেকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে রামুকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। আমাদের শুকনো মুখ দেখে সবাই বুঝলো বিজু বন্ধুদের বাড়ি নেই। ভেতরে মা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। শুনে আমারও কান্না পেতে লাগলো। দাঁতে দাঁত কান্না চেপে ভাবতে লাগলাম, বিজুকে কী করে উদ্ধার করা যায়।

সে রাতে আমরা কেউ খেলাম না। খিদেও ছিলো না। লেপ মুড়ি দিয়ে আমি আর রামু শুয়েছিলাম। টের পেলাম রামু ঘুমুতে পারছে না। অনেক রাতে জেঠু এলেন। জেঠিমাকে বললেন, দুপুরে শেষবার গুটের বাড়ি গিয়েছিলো পেয়ারা খেতে।

হঠাৎ রামু ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। আমি বললাম, কাঁদছিস কেন রামু? আমার ভারি খারাপ লাগছে।

রামু ভেজা গলায় বললো, আজ ওকে পেয়ারা পাড়তে না নিলে তো এমন হতো না। বলে আবার ফুঁপিয়ে উঠলো।

আমি বললাম, চুপ কর রামু। নির্ঘাত গুটে ওকে চুরি করেছে। আজ না করলে আরেক দিন করতো।

রামু চুপ করলো। অনেক রাত অবধি আমরা জেগে রইলাম। শুধু বিজুর কথা ভাবলাম।

সকালে খবর পেয়ে থানা থেকে দারোগা এলেন। পাড়ার সবাইকে ডেকে জেরা করলেন। শেষে শুটকো রামধনিয়াকে ধরে নিয়ে গেলেন। ও নাকি ঠিকমতো কথার জবাব দিতে পারেনি।

আমরা ইস্কুলে যাবার নাম করে মড়াখেকোর মাঠে গিয়ে বসে রইলাম। অনেকক্ষণ ভেবে ঠিক করলাম–গুটের উপর কড়া নজর রাখতে হবে। চিলেকোঠা থেকে ওর দোকান দেখা যায়। রাতে আমরা সেখানে থাকবো।

বাড়িতে কেউ কিছু বললো না। সবাই মন খারাপ করে বসে আছে। আমরা চিলেকোঠায় বিছানা পাতলাম।

সারাটা বিকেল অচেনা কাউকে গুটের দোকানে দেখতে পেলাম না। তবে সন্ধ্যের দিকে কালো, মোটা, গোঁফঅলা একটা লোক এদিক-সেদিক চেয়ে গুটেকে কী যেন বললো। গুটে কিছুক্ষণ কথা বলে আমাদের বাড়িটা ইশারা করে দেখালো। ও জানতেই পারলো না যে, আমরা ওকে দেখছি।

মুশকো লোকটা গুটের দোকান থেকে আমাদের বাড়ির দিকে এলো। রামু কার্নিসে মাথা গলিয়ে দেখছিলো। আমি বললাম–অমন করে তাকিও না। লোকটা টের পেয়ে যাবে।

রামু মাথা সরিয়ে নিলো। একটু পরে দেখি লোকটা আবার গলির মাথায় গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো। আমাদের বাড়িটা দেখলো। তারপর হন্ হন্ করে হেঁটে চলে গেলো।

রামু উত্তেজনায় কাঁপছিলো। বললো, কী করবি?

আমি বললাম, কাল সকালে দেখা যাবে।

দেখলি তো ব্যাপারটা?

হুঁ। আমি মাথা নাড়লাম।

সকালে ইস্কুলে যাবার পথেই গুটেকে বললাম, কাল যে লোকটা তোমার সঙ্গে কথা বললো, সে কে?

গুটে অবাক হয়ে বললো, কখন?

সন্ধ্যের ঠিক পরে।

সন্ধ্যের পরে তো কত লোকই আমার দোকানে আসে।

যারা আসে সবাইকে চিনি। ও লোকটা নতুন।

নতুন লোকও যে অনেক আসে।

গুটের ভণ্ডামি দেখে গা জ্বলে গেলো। বললাম, চালাকি কোরো না গুটে। সন্ধ্যের পর একটি মাত্র লোককে তুমি আমাদের বাড়ি দেখিয়েছিলে।

গুটে একটু ভাবার ভান করে বললো, তাই বলল। লোকটা এসে জানতে চাইলে চৌধুরীর বাড়ি আমি চিনি কিনা। বললাম, খুব চিনি। আমি না চিনলে আর কে চিনবে। বলে বাড়িটা দেখিয়ে দিলাম। কিন্তু তাতে কী হলো?

আমি বললাম, কিছু না।

বিকেলে বাড়ি এসে যা শুনলাম, তা শুধু বিশ্ব গোয়েন্দা সিরিজের বইতেই ঘটতে পারে। নিজ চোখে না দেখলে আমি বিশ্বাসই করতাম না।

সেজদি বললো, কোন সবুজ থাবা নামের কারা চিঠি পাঠিয়েছে–বিজুকে যদি অক্ষত অবস্থায় পেতে চাই তাহলে মড়াখেকোর মাঠের ঘোড়ানিম গাছের ফোকরে যেন এক হাজার টাকা রেখে আসে কেউ। নইলে ওকে সিঙ্গাপুরের এক ইন্টারন্যাশনাল চাইল্ড লিফটারের কাছে বিক্রি করে দেয়া হবে। থানা-পুলিশ করলে কোনো লাভ নেই। ওদের লোক সব লক্ষ্য করছে। রাজি থাকলে আজই যেন নিমতলায় কেউ গিয়ে ঠিক রাত বারোটার সময় তিনবার টর্চের বোতাম টেপে।

শুনতে শুনতে আমাদের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। সেজদি জেঠুর পকেট থেকে চিঠিটা চুরি করে এনে দেখালো। সেজদি যা বললো সেসব কথাই লেখা। শেষে ইতির জায়গায় সবুজ একটা হাতের ছাপ আঁকা।

আমি সেজদিকে বললাম, জেই কী বলেছে?

সেজদি বললো, বলবে আবার কী! থানায় গিয়েছিলো, দাবোগা বলেছে টর্চ জ্বালাতে। পুলিশের লোকরা সাদা কাপড়ে আশপাশে ঘোরাফেরা করবে।

থানা-পুলিশের ব্যাপারটা আমার ভাল লাগলো না।

ওদের শুধু তম্বি করাই সার। কবে যে ওরা আসল চোর ধরেছিলো সেটা আমি কেন কেউই জানে না। আমার শুধু মনে হচ্ছিলো গুটের উপর নজর রাখলেই বিজুকে পাওয়া যাবে। ও ছাড়া আর কেউ বিজুকে সরায় নি। এখন দেখতে হবে ও দূরে অন্য কোথাও সরিয়ে ফেলেছে কিনা।

কদিন আগে গুটে অকা সরকারকে বলেছিলো, ওর নাকি হাজার খানেক টাকা দরকার। কোথায় নাকি চালান আটকা পড়েছে। তাছাড়া দোকানও বড় করবে। এখন বিজুকে লুকিয়ে রেখে যদি টাকাটা পাওয়া যায়–মন্দ কি। ও ভাল করেই জানে, আমাদের গেঁয়ো শহরটার রহস্যভেদী কিরীটি রায় কিংবা ব্যোমকেশ বক্সী কেউ বিজুকে উদ্ধার করতে আসবে না। দুদিন লাফিয়ে দারোগাও চুপ মেরে যাবে। তখন মায়ের কান্নার ঠেলায় সুড় সুড় করে জেঠু গিয়ে এক হাজারটি টাকা গুনে গুনে ঘোড়ানিম গাছের ফোকরে রেখে আসবেন। বুদ্ধিখানা মন্দ নয়। তবে ও হয়তো জানে না, আমি নিয়মিত রহস্যলহরী আর বিশ্ব গোয়েন্দা সিরিজ পড়ি।

তখনও সন্ধ্যে হয়নি, গুটেকে গিয়ে বললাম, কাল যে লোকটা আমাদের বাড়ি দেখতে চেয়েছিলো, সে সবুজ থাবার একখানা চিঠি রেখে গেছে।

আমি শুধু গুটের ভাবখানা দেখছিলাম।

গুটে কপালে চোখ তুলে বললো, সবুজ থাবা কে?

ভাবলাম এ-ও এক ন্যাকামো। বললাম, কোনো ছেলেধরার দল হবে। ওরা টাকা চেয়েছে।

গুটের চোখ যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসবে–বিজুকে তাহলে ছেলেধরা ধরেছে? আমি মাথা নাড়লাম। গুটে অনেকক্ষণ চুপ থেকে বললো, বাড়ি যাও, আমি দেখছি।

গুটের কথায় আমি বাড়ি যাবোয় একটু দূর থেকে ওর দোকানটার ওপর নজর রাখলাম। গুটে দেখতে পেয়ে খেঁকিয়ে উঠলো, বাড়ি যেতে বলিনি তোমাকে? এখানে বসে গোয়েন্দাগিরি করা হচ্ছে? ভেঁপো ছেলে!

আমি চটে-মটে বাড়ি এসে ছাদে গিয়ে বসে রইলাম। রামুও উঠে এলো। বললো, পুলিশ মড়াখেকোর মাঠের চারপাশে থাকবে। যদি কাউকে সন্দেহ করে তাকে ধরবে।

আমি কোনো কথা না বলে গুটের দোকানটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। অনেকক্ষণ বসেছিলাম। মাঝখানে একবার দিদা এসে খেতে নিয়ে গেলেন। খাবার পর আবার চিলেকোঠায় লেপ মুড়ি দিয়ে বসে রইলাম।

অনেক রাতে সেই লোকটা এলো। রাত তখন দশটা কি এগারোটা। গির্জার ঘন্টাটা ঠিক শুনতে পারি নি। লোকটা এসে গুটের দোকানের সামনে দাঁড়ালো। তারপর যখন দেখলো লোজন কেউ নেই, তখন মুখটা গুটের কানের কাছে নিয়ে কী যেন বললো। শুটেও কিছু বললো। বেশ কিছুক্ষণ ওদের ভেতর কথাবার্তা হলো। তারপর দেখি, গুটে দোকানের ঝাঁপ নামিয়ে লোকটার সঙ্গে বেরিয়ে এলো।

উত্তেজনায় আমি তখন রীতিমতো কাঁপছিলাম। রামুকে বললাম, দরজাটা বন্ধ করে দাও ভেতরে থেকে। আমি আসছি।

রামুর খুব বেশি ঘুম পেয়েছিলো। কোনো কথা না বলে দরজাটা বন্ধ করে দিলো। আমি চুপি চুপি বাইরে এসে একছুটে সদর রাস্তায়। দেখি গুটে আর সেই লোকটা হ হন্ করে লাহিড়ীপাড়ার দিকে যাচ্ছে। আমি বেশ দূর থেকে ওদের পিছু নিলাম।

লাহিড়ীপাড়ায় তেমন আলো নেই। বেশিরভাগ ল্যাম্পপোস্টেরই চিমনি ভাঙা। তাতে আমার সুবিধে হলো। ওরা আমাকে দেখতে পেলো না।

লাহিড়ীপাড়ার মাথায় একখানা ঘোড়ায় টানা পালকি গাড়ি দাঁড়িয়েছিলো। হঠাৎ দেখি সেই লোকটা পকেট থেকে একখানা কালো কাপড় বের করে গুটের চোখ দুটো বেঁধে দিলো। তারপর দুজনে পালকি গাড়িটায় উঠে বসলো। একছুটে আমিও পেছনের আসনটা ধরে ঝুলে পড়লাম।

আমি ভাবছিলাম, লোকটা গুটের চোখ বেঁধে দিলো কেন। এর কারণ দুটো হতে পারে। এক, ওরা দলের বিশ্বস্ত লোক ছাড়া অন্যদের আড্ডা চেনায় না। দুই, তা না হলে গুটে ওদের দলের লোক নয়। এই প্রথম যাচ্ছে।

লাহিড়ীপাড়ার পর আর কোনো আলো নেই। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। তবু এসব রাস্তা আমার মুখস্ত। কতবার হাজারীদের পুকুরে মাছ ধরতে গিয়েছি এখান দিয়ে। গাড়িটা লাহিড়ীপাড়া ছাড়িয়ে বকশীতলায় এলো। তারপর সেই অন্ধকারের চেয়েও অন্ধকার একটি ভাঙা বাড়ির সামনে এসে থামলো। যেটাকে আমরা সবাই পোদ্দারদের পোড়োবাড়ি বলেই জানি।

আমি কালো গাড়িটার গায়ের সাথে সেঁটে রইলাম। লোকটা গুটেকে ধরে নামালো। তারপর বাড়িটার ভেতরে নিয়ে গেলো। কিছু না ভেবে আমিও ওদের পিছু নিয়ে ঢুকে পড়লাম। তাড়াহুড়ো করে খালি পায়ে এসেছি বলে এতক্ষণ নিজের উপর ভারি রাগ হচ্ছিলো। এখন দেখি এটাই ভালো হয়েছে। যেভাবে পা টিপে টিপে হাঁটছিলাম তাতে মনে হলো মানুষ নই ভূত! একটুও শব্দ হচ্ছিলো না।

তেতলায় একটা ঘরে আলো জ্বলছিলো। লোকটা শুটের বাঁধন খুলে সে ঘরে নিয়ে গেলো।

দরজার ফুটো দিয়ে তাকিয়ে দেখি দুজন লোক ভেতরে বসে। বিচ্ছিরি চেহারার প্রতিযোগিতায় কে যে প্রথম হবে বলা মুশকিল। একজনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আরেকজনের গোঁফ গজিয়েছে। চোখ সবারই সমান–যেন দুটো করে লাল অঙ্গার বসানো। থ্যাবড়া নাক। দলের ভেতর যার গোঁফ সবচে বড়, আর যার মুখ সবচেয়ে থ্যাবড়া, তাকে গিয়ে লোকটা বললো, এরই কথা বলেছিলাম কত্তা। কাজে দেবে। বেশ চটপটে আছে। বাজিয়ে দেখেছি।

থ্যাবড়ামুখো গুটেকে ভাল করে দেখলো। গুটের চেহারাও ওদের চেয়ে কম নয়। তাই দেখে মাথা নাড়লো। বললো, হবে।

যে লোকটা ঘুঁটেকে এনেছিলো, সে বললো, বলতেই রাজি হয়ে গেছে। আরও বললো, আগে নাকি কালু শেখের দলে ছিলো।

শুটে একগাল হেসে বললো, কত্তা নিজেই বিবেচনা করুন। বাঘকে যদি দশদিন উপোস রেখে কেউ ঘাস খেতে দেয়, তাহলে যে অবিচার হয়। আমাদের রক্তে কি আর ঘাস খাওয়া আছে!

শুনে থ্যাবড়ামুখোর সে কি হাসি। বললো, বেড়ে বলতে পারিস তো! তা তোকে এখন ঘাসই খেতে হবে। আমাদের ও-বাড়িটার ওপর নজর রাখা দরকার। ওরা নাকি পুলিশে খবর দিয়েছে। পুলিশের যা বুদ্ধি! আমাদের লোক মনে করে মড়াখেকোর মাঠ থেকে পোদ্দারদের খোট্টা বামুনটাকে ধরে নিয়ে গেছে। ওই আমাশার রোগীটা কিনা আমাদের লোক! হেসে বাঁচি নে। যাকগে শোন, তুই ছোঁড়াটাকে নিয়ে নবীগঞ্জ চলে যা। আমাদের গাড়িতেই যাবি। সেখানে আমাদের লোক আছে। গাড়োয়ান চেনে। ওর হাতে তুলে দিবি। পালাবার চেষ্টা করো না বাপু। আমি শুখা গাড়োয়ান রেখেছি। ওর প্রাণে দয়ামায়া নেই। ভোজালি দিয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেবে।

শুটে মুখ কালো করে বললো, কী যে বলেন কত্তা। এত অবিশ্বাস হলে কাজ চলে!

থ্যাবড়ামুখো ঠা ঠা করে হেসে বললো, এমনি বললাম। কিছু মনে করিস নে। কেলে, ছোঁড়াটাকে নিয়ে আয়।

কেলে নামের আরেক মুশকো বেরিয়ে গেলো। এত অন্ধকার ছিলো তবু যে কী করে পথ দেখে আমি ভেবেই পেলাম না। তবু রক্ষা আমাকে দেখতে পায়নি।

কিছুক্ষণ পর কেলে বিজুকে আনলো। বিজুর চেহারা দেখে আমি চমকে উঠলাম। মুখ শুকিয়ে আমসি হয়ে গেছে। নির্ঘাত সারাদিন ওকে খেতে দেয়নি। বিজু ফোঁপাচ্ছিলো। গুটেকে দেখে ভ্যাক করে কেঁদে ফেললো।

গুটের মুখটা মুহূর্তের জন্যে কেমন হয়ে গেলো। তারপরই এক ধমক-চুপ কর ছেঁড়া!

থ্যাবড়ামুখো হেসে বললো অমন করে ধমক দিসনে। তোর যা গলা! কখন আবার ছোঁড়াটা ভয়ে হার্টফেল করে বসবে! কালুর দলের লোক না হলে কি এমন হয়। তুই তাহলে এখনি চলে যা। কাল থেকে দোকানে বসি। যাবার সময় ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে যা।

শুটে বিজুকে নিয়ে বাইরে এলো।

দরজাটা টেনে বন্ধ করলো। তারপর খুব আস্তে করে শেকলটা নামিয়ে দিলো। বুঝলাম গুটে ওদের দলের লোক নয়। তখনই আমি ওর সামনে এলাম। গুটে কি যেন বলতে যাবে, আমি ঠোঁটে আঙুল দিলাম।

এরপর যে কটা দরজা পড়লো, সবকটায় শেকল তুলে বন্ধ করে আমরা তিনজন এক তলায় নেমে এলাম।

গুর্খা গাড়োয়ান গাড়ি নিয়ে বসেছিলো। গুটে ফিসফিস করে বললো, এখান দিয়ে গেলে টের পেয়ে যাবে।

আমি বললাম, কি করবে তাহলে?

তোমরা এখানে দাঁড়াও। এই বলে গুটে বাইরে গিয়ে গাড়োয়ানকে ডাকলো–এই যে, এদিকে আসতে একটু আজ্ঞা হোক। কত্তা ডাকছেন।

গাড়োয়ানটা যেই কাছে এলো অমনি গুটে ওর ঘাড়ের ওপর আড়াইমণি এক রদ্দা মারলো।

গাড়োয়ান টাল সামলে পড়তে পড়তে উঠে দাঁড়ালো। গুটে বোধহয় এতটা ভাবতে পারেনি। তারপরই ও ঝাঁপিয়ে পড়লো গাড়োয়ানকে নিয়ে। দুজনে ভীষণ যুদ্ধ লেগে গেলো। কখনও গাড়োয়ান গুটের উপর, কখনও গুটে গাড়োয়ানের উপর।

আমি কি করবো, সহসা ঠিক করতে পারলাম না। হঠাৎ দেখি গাড়োয়ান গুটের ওপর বসে একখানা ভোজালি টেনে ওর বুকে বসাতে চাইছে আর গুটে প্রাণপণে ঠেকিয়ে রেখেছে। তক্ষুণি একখানা বড় ইট তুলে ঠকাশ করে গুখা গাড়োয়ানের মাথায় মারলাম। গাড়োয়ান সঙ্গে সঙ্গে দুহাত উপরে তুলে–আইবাপ, বলে গড়িয়ে পড়লো।

শুটে উঠে দাঁড়ালো। তার হাতে ভোজালির আঁচড়। দরদর করে রক্ত পড়ছে। আমাকে বললো, বিজুকে নিয়ে বাড়ি যাও। আমি থানায় যাচ্ছি।

বিজুকে নিয়ে যখন বাড়ি এলাম, তখন সবার সে কি আনন্দ। আমাদের দুজনকে কখনও জেঠু, কখনও দিদা টেনে হেঁচড়ে নাজেহাল করে ছাড়লেন। তারপর যখন বললাম, ঘুম পাচ্ছে–তখন দিদা সবাইকে ধমক দিয়ে সরিয়ে আমাদের কপালে চুমু খেয়ে বললেন, তাহলে শুতে যা।

শুয়ে শুয়ে বিজু বললো, কেমন করে থ্যাবড়ামুখো ওর পেয়ারা কিনবে বলে ভুলিয়ে পোড়া বাড়িতে নিয়েছিলো আর একটা ঘরে নিয়ে বেঁধে রেখেছিলো। সেসব কথায় রামু

এত উত্তেজিত হয়েছিলো যে, ওর মুখ দিয়ে একটা বাক্যও বেরলোলা না।

ঘুম থেকে উঠে সোজা গুটের বাড়িতে গেলাম। দেখি গুটে হাতে পট্টি বেঁধে শুয়ে আছে! বললাম, কেমন আছো গুটে?

একগাল হেসে গুটে বললো, ভালো। ওদের সব কটা ধরা পড়েছে। পুলিশ নিয়ে গিয়ে দেখি সবকটা তাস পিটাচ্ছে। শেকল বন্ধ যে টেরই পায়নি। দারোগা বললো, এদের ধরার জন্যে গরমেন্ট পুরস্কার ঘোষণা করেছিলো এক বছর আগে। ভারি শয়তান এই সবুজ থাবার দল। কি মজা, এক হাজার টাকা পাচ্ছি আমি।

বিজু বললো, সে টাকা দিয়ে তুমি লাটু, লেত্তি, বড়শি সব কিনে দোকানে রাখবে।

শুটে বললো, তা তো রাখবোই। তোমরা আমার কম ওবগার করোনি। তোমাদের জন্যেই তো টাকাটা পেলাম।

রামু বললো, তোমার জন্যে আমরা বিজুকে পেলাম। অথচ আগে তোমাকে কত কিছু ভেবেছিলাম।

বিজু বললো, তুমি কতো ভালো!

গুটে বললো, তোমরা আরও ভালো। আসলে সব ভালো যার শেষ ভালো।

সবাই কোরাসে গলা মিলিয়ে হেসে উঠলাম। হাসি থামিয়ে একসময় আমি বললাম, এবার বলো গুটে, সত্যি সত্যি তুমি কালু শেখের দলে ছিলে?

গুটে বললো, হায় কপাল! আমি কেন কালু শেখের দলে থাকবো? ও তো বানিয়ে বলেছিলাম। তারপর হেসে বললো, গোয়েন্দাগিরিতে তুমি এখনো কাঁচা রয়ে গেছো আবু।