০৩-৪. নীলদের পেছনে গোয়েন্দা

০৩. নীলদের পেছনে গোয়েন্দা

বুলগেরিয়ান বন্ধু রিস্টোকে নীল কথা দিয়েছিলো নভেম্বরের চার তারিখে ওর সঙ্গে দেখা করবে। সোফিয়ায় কদিন ধরে রোজই মিটিং মিছিল হচ্ছে। বেশির ভাগ মিটিঙে যদিও দু তিনশর বেশি মানুষ হয় না, বিবিসি, ইটালিয়ান আর অস্ট্রিয়ান রেডিও তাই ফলাও করে বলছে। নাকি ঝিভকভের পতন হতে বেশি দেরি নেই। নীলের বাবার ধারণা এত তাড়াতাড়ি যাওয়ার বান্দা নয় ঝিভকভ। কমিউনিস্ট দেশগুলোতে ঝিভকভই সবচেয়ে বেশিদিন রাজত্ব করছেন। তারপর উত্তর কোরিয়ার কিম ইল সুঙ।

চার তারিখ ছিলো শনিবার। ঢাকায় দূতাবাসের ডাক পাঠাতে হয় এই দিনে। বাবার ফিরতে সাতটা আটটা বেজে যায়। ড্রাইভার তোবারক আলীও ব্যস্ত থাকে। নীল ঠিক করলো বাসেই চলে যাবে।

দুপুরে বাড়িতে খেতে এসেছিলেন বাবা। যাওয়ার সময় রীন চলে গেলো ওঁর সঙ্গে। কাউন্সিলার হাশমত সাহেবের মেয়ের সঙ্গে ও প্ল্যান করছে বিজয় দিবসে কী কী করা যেতে পারে। সোফিয়ায় অনেক বাঙালি ছাত্র আছে। সবাই মিলে এসব দিবসে চমৎকার অনুষ্ঠান করে। নীলের কাজ জিনিসপত্র জোগাড়যন্ত্র করা। ওরা কী করবে ঠিক করলে তারপর ওর কাজ শুরু। রীন বাবার সঙ্গে চলে যাওয়াতে ও উদ্বেগমুক্ত হলো। ভয় হচ্ছিলো রীন যদি শোনে ও ভিতুশা পাহাড়ে যাচ্ছে তাহলে নির্ঘাত ওর পিছু নেবে। বোনটাকে ও এত ভালোবাসে–কোনও কিছু আবদার করলে না বলতে পারে না।

বিকেল তিনটার দিকে নীল বাড়ি থেকে বেরুলো। মাকে বললো, রিস্টোদের ফ্লাটে যাচ্ছে, সন্ধ্যার পর ফিরবে। ওদের বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিট হাঁটলেই ভিতুশা যাওয়ার বাস ষ্ট্যাণ্ড। পাহাড়ের গায়ে ঘোরানো রাস্তা দিয়ে ঘুরে ঘুরে একেবারে চূড়ার কাছে চলে যায় বাস। নীলের অবশ্য বাসে করে ওপরে উঠতে ভালো লাগে না। ঝোলানো কেবল কার-এ মিনিট পনেরো সময় লাগে। তারে ঝোলানো বগিতে ঝুলে ওপর থেকে পাহাড়ের পাইন আর বার্চের বন দেখতে দেখতে পৌঁছে যায় সাড়ে সাত হাজার ফুট উঁচুতে চেরনি ভ্রূ পীক-এ। এখানে চমৎকার কিছু হোটেলও আছে।

গত দুদিনে বাড়ি থেকে বেরোয় নি নীল। ন্যাশনাল লাইব্রেরি থেকে বুলগেরিয়ার বিপ্লবের নেতা দিমিত্ৰভের জীবনী এনেছিলো চার খণ্ডের, সেগুলো পড়ে শেষ করেছে। বাইরে না বেরুলে রোজ সন্ধ্যার পর আলো জ্বেলে তোবারকের সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলে। বয়সে অনেক বড় হলেও তোবারককে বন্ধুর মত মনে হয়। ওর বুলগেরিয়ান ভাষা শেখার প্রথম শিক্ষক ছিলো তোবারক।

ভিতুশা আসার পথে শহরে কোন গোলমাল চোখে পড়লো না। নীলের মনে হলো কাল রাতে বাবা ঠিকই বলেছিলেন, এখানে খুব শিগগির কিছু হবে না। বুলগেরিয়ার জীবন বাইরে থেকে দেখলে একটু ঢিলেঢালা মনে হলেও ঝিভকভের গোয়েন্দা পুলিশের নজর সবখানে। রিস্টো একদিন বলেছিলো, ঝিভকভের গোয়েন্দার সংখ্যা লাখ দশেক হবে। নীল অবাক হলে ও বুঝিয়ে দিয়েছিলো–এই যে বাড়িঘরের দেয়ালগুলো দেখছো না, প্রত্যেকটা দেয়ালের চোখ আর কান আছে। প্রত্যেকটা দেয়াল ঝিভকভের গুপ্তচর।

রিস্টোর বাবা পাওয়ার প্ল্যান্টের একজন ইঞ্জিনিয়ার, নীলের সঙ্গে কয়েকবারই দেখা হয়েছে, বিশেষ কোন কথা হয় নি। ভদ্রলোক কিছুটা চাপা স্বভাবের। রিস্টোর মা একমাথা সোনালী চুলের হাসিখুশি খাঁটি বুলগেরিয়ান মহিলা। সোফিয়া নিউজ এজেন্সিতে কাজ করেন। নীল ওদের বাসায় গেলেই সবজি আর মাংশের পুর দেয়া পিঠে বানিয়ে খাওয়ান। রিস্টো ওঁদের একমাত্র ছেলে, পড়াশোনায় খুবই ভালো। নীলের সঙ্গে ওর প্রথম পরিচয় লাইব্রেরিতে বই নিতে গিয়ে। পরিচয়ের প্রথম দিনই রিস্টো ওকে ওদের ফ্ল্যাটে নিয়ে গিয়েছিলো।

ঝোলানো কেবল কার-এ চেপে নীল যখন ভিতুশা পাহাড়ের চেরনি ক্রু পিক-এ এলো, ঘড়িতে তখন কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে চারটা। আরও আগেই আসতো, নিচের স্টেশনে কি যেন গণ্ডগোল হওয়ায় কেবল কার ছাড়তে পনেরো মিনিট দেরি হয়েছে।

রিস্টোর সঙ্গে এর আগে যে জায়গায় বসে গল্প করেছিলো, সেখানে যেতে আরও পাঁচ মিনিট লাগলো ওর। নীল আশা করেছিলো এসে দেখবে শোয়ানো ওক গাছের ডালে বসে রিস্টো পা দোলাচ্ছে। কাছে গিয়ে কাউকে দেখতে পেলো না। আশে পাশে তাকিয়ে দেখলো, রিস্টো তখনও আসে নি। পাঁচ মিনিট দেরি হওয়ার জন্য ওর একটু খারাপ লাগছিলো। কাউকে কথা দিলে অক্ষরে অক্ষরে সেটা পালন করে নীল। রিস্টোকে না দেখে ও হাঁপ ছাড়লো।

কবে কোন ঝড়ে বহু বছরের পুরোনো বুড়ো ওক গাছটা মাটিতে কাত হয়ে পড়েছিলো। পুরো গাছটাই অক্ষত আছে, শুধু কাণ্ডটা নব্বই ডিগ্রির বদলে চল্লিশ ডিগ্রি কোণ তৈরি করেছে। মাটিতে শোয়ানো মোটা ডালটায় বসে সামনে তাকালো নীল। হেমন্তের সোনাগলা রোদে চকচক করছে গোটা সোফিয়া শহর। ভিতুশা পাহাড়ের গাঢ় সবুজ জমিনে, লাল, কমলা, খয়েরী, সোনালী আর হলুদ রঙের ছোপ লেগে আছে এখানে সেখানে। আর কদিন পর পাহাড়ের বেশির ভাগ গাছের পাতা ঝরে যাবে। শুধু চিরসবুজ পাইন গাছগুলো বর্শার ফলার মত মাথা উঁচিয়ে জানিয়ে দেবে প্রকৃতির জীবনস্পন্দন এখনো থেমে যায় নি।

ওক গাছের সব পাতা উজ্জ্বল কমলা রঙের হয়ে গেছে। দেখে মনে হয় কমলা রঙের কার্পেটের ওপর একই রঙের কাপড়ের বিশাল স্তূপ। ডালে বসে সরু কাঠিতে পাতা গেঁথে একটা কমলা রঙের মুকুট বানালো নীল। রিস্টো এলে ওর মাথায় পরিয়ে দেবে।

সময় গড়িয়ে যেতে লাগলো, রিস্টো এলো না। নীল মনে করার চেষ্টা করলো, আগে কখনো কথা দিয়ে রিস্টো দেরিতে এসেছে কি না। মনে করতে পারলো না। বাতাসের ছোট্ট একটা ঘূর্ণি ওক গাছের পাতা উড়িয়ে বয়ে গেলো। নীল ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো পাঁচটা বাজতে আর সাত মিনিট বাকি। ঠিক করলো এখানে পাঁচটা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে, তারপর ওদের ফ্ল্যাটে যাবে। কোন জরুরি কাজে হয়তো আটকে গেছে রিস্টো। সামনে তাকিয়ে দেখলো দূরে হালকা কুয়াশার নিচে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে সোফিয়ার ঘরবাড়ি। পাহাড়ের ওপর রোদের তেজ মরে গেছে। হেমন্তে এখানে সাড়ে পাঁচটায় সন্ধ্যা নামে। ছটা না বাজতেই ঘুটঘুঁটে রাত। বাড়িতে বলে এসেছে, ফিরতে দেরি হলেও অসুবিধে হবে না।

পাঁচটা বাজার ঠিক দুমিনিট আগে নীল দেখলো একজন মোটাসোটা বয়স্ক মহিলা এদিক ওদিক তাকিয়ে ওর দিকে আসছেন। গাউনের স্কুল নেমেছে গোড়ালির কাছে, জুতো মুজো পরা, মাথায় ফুল ভোলা সিল্কের স্কার্ফ বাঁধা। কাছে এসে চাপা খসখসে গলায় বললেন, বাছা, তুমি কি রিস্টোর বন্ধু?

নীল উঠে দাঁড়িয়ে বললো, হ্যাঁ ম্যাডাম। আমি ওরই জন্যে অপেক্ষা করছি।

রিস্টো আমাকে মালিশা খালা বলে। ওর মা আমার বান্ধবী। দাঁড়ালে কেন বসো। আমিও একটু বসবো। বলে তিনি ঘাসের ওপর বসলেন।

মালিশা খালা, রিস্টো কি আসবে না? উদ্বিগ্ন গলায় জানতে চাইলো নীল।

না বাছা। গলাটা আরেক ধাপ নামিয়ে বিষণ্ণ গলায় তিনি বললেন, রিটো ভারি বিপদে পড়েছে। ওর বাপেরও খুব বিপদ।

কিসের বিপদ?

তুমি কি জানোনা বাছা, ওর বাবা যে ঝিভকভকে সরাবার জন্য আন্দোলন করছে?

জানি, তাতে কী হয়েছে?

রিস্টোকেও এসব গোলমালে জড়িয়েছে ওর বাপ। গোয়েন্দা পুলিশের ভয়ে এখন বাপ ছেলে দুজনই ফেরার হয়েছে।

পুলিশ কি ওদের বাড়িতে এসেছিলো?

যখন তখন আসছে। আত্মীয়-স্বজন সবার বাড়িতে খোঁজ করছে। ওর মা, বেচারি গিয়র্গিয়ে ভয়ে আধখানা হয়ে গেছে।

আপনাকে এখানে কে পাঠিয়েছে?

রিস্টোর মা পাঠিয়েছে। বললো, তোমার সঙ্গে নাকি রিস্টোর আজ এখানে দেখা করার কথা ছিলো। ও আসতে পারবে না। গিয়ার্গিয়ে তোমাকে দেখা করতে বলেছে।

আপনি না এলে আমি এখনই ওদের বাড়ি যাবো ভাবছিলাম।

না বাছা, বাড়ি যেও না। বাড়ির ওপর গোয়েন্দারা সারাক্ষণ নজর রাখছে। তুমি কাল পরশু সকালে শহর থেকে একটু দূরে এক জায়গায় ওর সঙ্গে দেখা করবে।

কোথায়?

তুমি কি বয়ানা চার্চের জাদুঘরে গিয়েছে কখনো?

বয়ানার নাম শুনেছি। জাদুঘরে যাই নি।

এই ফাঁকে তাহলে দেখে নিও। পরশু সকাল এগারোটায় ওই চার্চে তুমি দেখা করবে গিয়গিয়েভার সঙ্গে।

আপনি কি জানেন কিভাবে যেতে হয়?

কেন জানবো না বাছা! বয়ানা আমার বাপের বাড়ি। শোন, তুমি বুলেভার্ড মিহাইলভ থেকে একষট্টি নম্বর বাসে উঠবে। ওটা সোজা বয়ানা যায়।

কতক্ষণ লাগে যেতে? নীলের গলায় উত্তেজনার আভাস।

বেশি হলে চল্লিশ মিনিট লাগতে পারে। দাঁড়াও, তোমাকে লিখে দিচ্ছি, বাস থেকে নেমে কিভাবে যেতে হবে। এই বলে মালিশা খালা হাতব্যাগ থেকে ছোট্ট নোটবই আর কলম বের করে রাস্তাটা এঁকে দেখিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, এই যে ভিতুশা পর্বত দেখছো, বয়ানা গিয়েও এর দেখা পাবে! গির্জাটা ঠিক পাহাড়ের নিচে।

সোফিয়ার আকাশে তখন সন্ধ্যা নেমেছে। ঘরবাড়ি আর রাস্তার আলো সব জ্বলে উঠেছে। ভিতুশা পাহাড়ের চূড়ায় শেষ বিকেলের ম্লান আলো থাকলেও অল্প কিছুক্ষণের ভেতর এখানেও অন্ধকার নামবে। মালিশা খালা উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, তুমি ঝোলানো লিফটে করে নেমে যাও। আমি একটু পরে বাসে নামবো। কে জানে নচ্ছাড় গোয়েন্দারা আমার ওপর নজর রেখেছে কিনা।

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, কষ্ট করে এতটা পথ আমার জন্য। বলে মালিশা খালার সঙ্গে হাত মেলালো নীল।

ওর কপালে চুমু খেলেন মালিশা খালা–ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন বাছা। রিস্টোর জন্য তুমিও কম করছে না। ভালো থেকো। বলে আদর করে বিদায় জানালেন।

কেবল কারকে সোফিয়ার লোকেরা বলে ঝোলানো লিফট। নিচে নামার লিফট অপেক্ষা করছিলো। নীল উঠে বসার পর আরেকজন উঠলো। লিফটে চারজন বসতে পারে। চারজন হতেই লিফটের দরজা বন্ধ করে দেয়া হলো। মোটা তারে ঝুলতে ঝুলতে নিচে নামতে লাগলো ওরা।

নীলের মুখোমুখি যে লোকটা বসেছিলো, যে ঠিক ওর পেছন পেছন উঠেছে, তার চোখে কালো গগলস ছিলো। সন্ধ্যাবেলা গগলস চোখে দেখে নীল ভাবলো হয় গ্রাম থেকে এসেছে লোকটা, গগলসটা আজই কিনেছে, কিম্বা চোখে অসুখ আছে। লোকটার মুখ জানালার দিকে ফেরানো ছিলো। গগলস চোখে দিয়ে আর যাই হোক সন্ধ্যার প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখা যায় না। মনে মনে হাসলো নীল। ও ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারলো না মালিশা খালা যে নচ্ছার গোয়েন্দাদের কথা বলেছিলেন এ লোকটা তাদেরই একজন, আড়চোখে গগলস-এর কালো কাঁচের ভেতর দিয়ে ওকেই দেখছিলো।

সোমবার সকালে নীল মাকে বললো, আমার এক টিচার থাকেন বয়ানায়। ওর কাছে যাবো অংকের কিছু সাজেশন আনতে। দুপুরে নাও ফিরতে পারি। রীন যাতে সঙ্গে যেতে না চায় সে জন্যে মিথ্যে কথা বললো নীল।

রিস্টো বিপদে পড়েছে। এখন ওকে সাহায্য করা দরকার। নীল ভাবলো বয়ানা জাদুঘর যদি ভালো লাগে রীনকে নিয়ে অন্য একদিন দেখিয়ে আনবে। রীনের বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানের মহড়া, তাই নীলের সঙ্গে যাওয়ার বায়না ধরলো না।

নটার সময় বাবার সঙ্গে বেরিয়ে পড়লো নীল। বাবাকে এ্যাসিতে পৌঁছে তোবারক আলী ওকে বুলেভার্ড মিহাইলভের বাস ষ্ট্যাণ্ডে নামিয়ে দিলো। তোবারক অবশ্য বলেছিলো, বয়ানার রাস্তা আমার চিনা আছে নীল বাই। চলেন, নামাই দিয়ে আসি।

না তোবারক ভাই। বাধা দিয়েছে নীল–তুমি তো জানো এম্ব্যাসির গাড়ি নিয়ে বেশি ঘোরাফেরা বাবা পছন্দ করেন না।

বাড়ির কাজের ভেতর বাবার গাড়িতে করে ওরা দুই ভাইবোন শুধু স্কুলে যাওয়া আসা করে। মা বাইরে গেলে ট্যাক্সি নিয়ে যান। কোথাও কোন পার্টিতে ওদের নেমন্তন্ন থাকলে তখন সবাই একসঙ্গে গাড়িতে যায়। নীলের কথা শুনে তোবারক ওকে দ্বিতীয়বার বয়ানা যাওয়ার কথা বলে নি।

সোফিয়ার বাসগুলো খুব সুন্দর, ইউরোপের অন্যসব শহরের মতই। জানালার পাশের আসনে বসে নীল বিপদে পড়া বন্ধুটির কথা ভাবছিলো। বাইরে হেমন্তের চমৎকার সকাল। দূরে ঢেউ খেলানো কালচে নীল পাহাড়ে পাইন, অলিভ আর বার্চের বন। রাস্তার ধারে অনাদরে ঝোপে ঝাড়ে ফুটে আছে অজস্র গোলাপ। সারা বছর বুলগেরিয়ার যেখানে সেখানে রাশি রাশি গোলাপ ফুটে থাকে। অন্য কোন সময় হলে নীল আত্মহারা হয়ে নানা রঙের গোলাপের এই মনকাড়া শোভা দেখতে। পাহাড়ের গায়ে মেঘের আলোছায়ার খেলা দেখতো। রিস্টোর কথা ভাবতে গিয়ে ওর অন্য কিছু দেখার মন ছিলো না। দুটো সিট পেছনে যে ভিতুশা পাহাড়ের গগলস পরা গোয়েন্দাটা লেনিন টুপি মাথায় দিয়ে টুরিস্ট সেজে ওর ওপর নজর রাখছিলো তাও নীলের নজরে পড়ে নি।

মালিশা খালা বলেছিলেন, ওকে নামতে হবে গোল্ডেন ব্রিজ স্টপেজে। বয়ানা সোফিয়ার বাইরে ছোট একটা শহর। বাসের তিনটা স্টপেজ রয়েছে এখানে। গোল্ডেন ব্রিজকে বুলগেরিয়ানরা বলে ফ্লাটনিটে মস্টভে। প্রায় চল্লিশ মিনিট লাগলো আসতে। বাস থামতেই নেমে পড়লো নীল। পেছনে নামলো কালো চশমাধারী গোয়েন্দা এবং কয়জন সত্যিকারের টুরিস্ট। হাল্কা জ্যাকেট পরা তিনজন স্মার্ট আমেরিকান বুড়ি। ওদের সঙ্গে তরুণ বুলগেরিয়ান দোভাষী।

বুড়িদের কিচিমিচি শুনেও নীল ঘুরে তাকালো না। কালো চশমা ছাড়া সবাই সামনের স্ন্যাক বার-এ ঢুকে পড়লো। নীল এগিয়ে চললো স্টোন রিভার-এর দিকে। ভিতুশা পাহাড় থেকে ঝরণার মত নেমে এসেছে ছোট খরস্রোতা নদীটি। ছোট বড় নানা আকারের পাথরের ওপর দিয়ে তীব্র বেগে বয়ে চলেছে। বুলগেরিয়ানরা বলে পাথুরে নদী।

নদী পেরিয়ে পাঁচ মিনিট হেঁটে নীল এলো কপিটোটো নামের এক গ্রামে। রিস্টো বলেছিলো এই গ্রামেই নাকি ওর নানাবাড়ি। গ্রামের এক কালের বয়ানা গির্জা, এখন জাদুঘর। মালিসা খালা বলেছিলেন, আটশ বছরের পুরোনো চমৎকার সব মুরাল নাকি রয়েছে এই জাদুঘরে। চশমাধারী গোয়েন্দা অলস পায়ে একজন টুরিস্টের মত নীলের পেছন পেছন আসছিলো। নীল গতকাল ওর চেহারা ভালো করে লক্ষ্য করে নি। তার ওপর ক্যাপ পরায় আজ ওকে অন্য রকম লাগছে।

মালিসা খালা যেমন বলেছিলেন, ভিতুশা পাহাড়ের ঠিক নিচেই জাদুঘর। আঙিনার পর পাইন, বার্চের জঙ্গলভরা পাহাড় শুরু হয়েছে। ছোট একটা ফলকে জাদুঘরের নাম লেখা। পুভদিভে দেখা সাবেকি আমলের বাড়ির মতো দেখতে। দোতালা ইমারত, ওপরে টালির ছাদ। এক লেভা দিয়ে টিকেট কেটে ঢুকতে হয় জাদুঘরের ভেতরে। খালি কাউন্টারে বসে এক বুড়ো সিনেমার ম্যাগাজিন পড়ছিলো। টিকেট কেটে ভেতরে ঢুকলো নীল। জানলো না ওর পেছনে কে আসছে। রিস্টোর মা ছাড়া আর কাউকে সে আশা করছিলো না। গোয়েন্দাটি এমন বেখেয়াল শিকার পেয়ে বেজায় খুশি। নিশ্চিন্ত মনে ও নীলকে অনুসরণ করছিলো।

জাদুঘরের ভেতরটা নীল যতটা জমকালো ভেবেছিলো তেমন কিছু নয়। দেয়াল জুড়ে সাধুসন্ত আর যীশুখৃষ্টের সহচরদের ছবি। যীশুর লাস্ট সাপার-এর দেয়ালচিত্রও আছে। টিকেট কাটার সময় ইংরেজি আর বুলগেরিয়ান ভাষায় দুপাতার একটা বিবরণী ধরিয়ে দিয়েছিলো কাউন্টারের নির্বিকার বুড়োটা।

নীল চোখ বুলিয়ে দেখলো, বেশির ভাগ ছবিই সাত আটশ বছর আগের আঁকা। এমন কিছু পুরোনো নয়। তবে মজা পেলো সাধুসন্ত আর যীশুর সঙ্গে নাম না-জানা শিল্পী বুলগেরিয়ার রাজারাণীর ছবিও এঁকেছে। নাকি ওরা মোটা চাঁদা দিয়েছিলেন গির্জার তহবিলে।

নিচের তলায় নীল আর গোয়েন্দা ছাড়া আরও চার পাঁচজন টুরিস্ট ছিলো, আর ছিলো সম্ভবত আর্ট স্কুলের কোন ছাত্রী। নীলের বয়সী মেয়েটা দেয়ালচিত্র দেখে দেখে নিখুঁত ভাবে খাতায় কপি করছে।

টুরিষ্টদের মত ছবি দেখতে দেখতে এক ফাঁকে দোতালা থেকে ঘুরে এলো নীল। রিস্টোর মা এখনো আসেন নি। নীলের সঙ্গে কাউকে কথা বলতে না দেখে গোয়েন্দাও হতাশ হলো। ওর বুঝতে অসুবিধে হলো না, শিকার যার জন্যে অপেক্ষা করছে সে এখনো আসে নি। সিগারেটের তেষ্টা পেয়েছিলো ওর। ছোঁড়া এমনভাবে ম্যুরাল দেখছে। মনে হয় সত্যি সত্যি বুঝি এসব দেখার জন্যেই এতদূর এসেছে।

সিগারেট খাওয়ার জন্য বাইরে গেলো গোয়েন্দা। ঠিক তখনই দর্শনার্থীদের ভেতর থেকে কুচকুচে কালো চুলোর মাথায় টুপি পরা দারুণ সাজগোজ করা এক মহিলা মনে হয় গ্রীক অথবা তুর্কী, নীলের গা ঘেঁসে দাঁড়ালেন। দেয়ালের ছবি দেখতে দেখতে ঘাড় না ফিরিয়ে বললেন, পেছনে গোয়েন্দা লেগেছে। কালো চশমা, মাথায় টুপি। তুমি কপিটোটো হোটেলের রান্নাঘরে বাবুর্চি রুসেভের সঙ্গে দেখা করবে। আমি সামনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছি। পেছনের আঙিনায় টয়লেটের পাশ দিয়ে যে রাস্তা আছে ওটা দিয়ে ঘুরে হোটেলে এসো।

মহিলা চলে গেলেন। নীল রীতিমত হতবাক। দারুণ মেকাপ নিয়েছেন রিস্টোর মা। গলা না শুনলে চিনতেই পারতো না। অবশ্য এরকম কালো চুলের কেউ রিস্টোর মা হবেন এমনটা সে আশাও করে নি।

তিনি চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নীল টয়লেটের দিকে গেলো। আড়চোখে দেখলো গির্জার সদর দরজায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতে টানতে গোয়েন্দা সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। নিজের বোকামির জন্য রাগ হলো নীলের। একবারও ওর মনে হয় নি পেছনে গোয়েন্দা লাগতে পারে।

গির্জার পেছনে আঙিনার ওপাশে একসারি ঘর। সম্ভবত মালি আর পাহারাদারেরা থাকে। ওরই একটা ঘরে টয়লেট। তার পাশ দিয়ে হোট কাঠের পাল্লাওয়ালা বাইরে যাওয়ার দরজা।

দেয়ালচিত্রের জাদুঘর বলে পাহারার কোন কড়াকড়ি নেই। কেউ তো দেয়াল তুলে নিয়ে যেতে পারবে না। সামনে একজন ঢিলেঢালা পাহারাওয়ালা চোখে পড়েছে, পেছনে তাও নেই। নীল নির্বিঘ্নে জাদুঘর থেকে বেরিয়ে সরু পাথরের রাস্তা দিয়ে গ্রামের ভেতর হাঁটতে লাগলো।

এখানে আসার পথেই কপিটোটো হোটেল চোখে পড়েছে নীলের। বেশ বড় হোটেল। জায়গাটা টুরিস্ট স্পট। এখান থেকে কেবল কার-এ ভিতুশা পাহাড়ের ভেতর ক্লাঝেভো যাওয়ার ব্যবস্থা আছে। পাহাড়ের ওপর উঠলে বহু দূরে ছবির মত সাজানো সোফিয়া শহর দেখা যায়।

গ্রামের ভেতর পাথরে বাঁধানো সরু রাস্তাটা ঘুরে বড় রাস্তায় উঠেছে। নীল বড় রাস্তায় উঠে দ্রুত হাঁটলো। পেছনে তাকিয়ে দেখলো কালো চশমার নাম নিশানা নেই। মিনিট দশেকের ভেতর ও হোটেলে পৌঁছে গেলো।

রেস্টুরেন্টের একজন মাঝবয়সী ওয়েটারকে নীল বললো, রুসেভের সঙ্গে দেখা করতে চাই। ও রান্নাঘরে আছে।

ওয়েটার মাথা নেড়ে বললো, ও তো রান্নাঘরেই থাকবে। এসো আমার সঙ্গে।

কিচেনের দরজা ফাঁক করে গলা ঢুকিয়ে ওয়েটার ডাকলো রুসেভ, তোমার সঙ্গে একজন দেখা করতে চায়।

ভেতরে পাঠিয়ে দাও। কিচেন থেকে একটা বাজখাই গলা ভেসে এলো।

ওয়েটার দরজা খুলে ইশারায় নীলকে ভেতরে যেতে বললো। নীল ভেতরে ঢুকতেই দরজা বন্ধ করে দিয়ে ওয়েটার চলে গেলো। সাদা এ্যাপ্রন আর টুপি পরা বাবুর্চি রুসেভ ওকে দেখে বললো, তুমি বুঝি আমাদের রিস্টোর বন্ধু?

দু পাশে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো নীল।

গিয়ের্গিয়েভা তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন। এসো আমার সঙ্গে। এই বলে রুসেভ ওকে পেছনের একটা ছোট্ট ঘরে নিয়ে গেলো।

ঘরের অর্ধেকের বেশি জায়গা জুড়ে পুরু ওক কাঠের টেবিল। নীল দেখেই বুঝলো ওটার ওপর রেখে তরকারি কাটা হয়। সারা টেবিলে ছুরির দাগ, এক কোণে বাঁধাকপির কয়েকটা পাতা আর আলুর খোসা পড়ে আছে। রিস্টোর মা টেবিলের পাশে একটা পেটানো লোহার চেয়ারে বসেছিলেন। তার সামনে একই ধরনের আরেকটা চেয়ার। নীলকে দেখে বললেন, এসো বাছা, এখানটায় বসো।

রুসেভ বললো, লিলিয়া গিয়র্গিয়েভা, আমি আপনাদের জন্য কফি পাঠিয়ে দিচ্ছি।

শুকনো হেসে রিস্টোর মা বললেন, ধন্যবাদ রুসেভ। আমাদের কালো কফি দিও।

দরজা বন্ধ করে দিয়ে চলে গেলো রুসেভ। ঠাণ্ডা লোহার চেয়ারে বসে নীল বললো আমি আপনাকে চিনতে পারি নি আন্টি।

ম্লান হাসলেন গিয়র্গিয়েভা–আমার বান্ধবী মালিশাকে তুমি কাল দেখেছে। বললো, তোমার পেছনে গোয়েন্দা লেগেছে। ও থিয়েটারে কাজ করে। ভালো মেকাপ জানে। ওই সব করেছে। এখন বলল, পাজিটাকে ঠিক মত খসাতে পেরেছিলে?

মাথা নাড়লো নীল–আপনি এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। রিস্টোর কথা বলুন। ওর কোনও বিপদ হয় নি তো?

এখনো গোয়েন্দা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে নি। তবে বিপদের তলোয়ারের নিচে মাথা পেতে দিয়ে বসে আছে ওর বাপ আর ও দুজনই।

খুলে বলুন না আন্টি কি হয়েছে?

শহরে প্রথম যেদিন মিটিং মিছিল হলো, তার দুদিন পরই গোয়েন্দা পুলিশ এলো রিস্টোর বাপকে ধরতে। ও তখন বাড়িতে ছিলো না। কোথায় থাকতে পারে জানতাম।পুলিশ চলে যেতেই রিস্টোকে পাঠালাম খবর দিতে। বিকেলে আবার এলো ওরা। রিস্টোকেও খুঁজলো। বললাম, নানার বাড়ি বেড়াতে গেছে। সন্ধ্যায় নিচের ফ্লাটের একজনকে দিয়ে ওদের খবর পাঠালাম কারো ঘরে ফেরার দরকার নেই। পরদিন সন্ধ্যায় আবার এলো। বললো, রিস্টো নানাবাড়ি যায় নি। শুনে আমি কান্নাকাটি করলাম। বললাম, তাহলে তোমাদের কেউ ওকে ধরে নিয়ে গেছে। ওরা কিছু না বলে চলে গেলো। তারপর সকাল নেই, দুপুর নেই, রাত নেই–যখন তখন আসে, ধমকায়। বলে, ওদের খবর না দিলে আমার বুড়ো বাপ মাকে ধরে জেলে পুরে দেবে।

রিস্টোর বিপদের কথা ভেবে নীল উদ্বিগ্ন হলো। ও জানে ধরা পড়া মানে সোজা ফায়ারিং স্কোয়াড। বললো, এভাবে কতদিন ওরা পালিয়ে থাকবে আন্টি?

ভারি গলায় গিয়র্গিয়ে বললেন, যতদিন না ঝিভকভের পতন হচ্ছে।

আপনি কি মনে করেন খুব শিগগির ঝিভকভের পতন হবে?

কিছুই তো বুঝতে পারছি না বাছা। দুদিন খুব মিটিং মিছিল হলো। তারপর থিতিয়ে গেলো। ঘরে ঘরে তল্লাসি চালিয়ে গোয়েন্দা পুলিশের দল কম বয়সী যাকেই সন্দেহ করছে, ধরে নিয়ে যাচ্ছে। বলছেও না কোথায় নিচ্ছে। ওদের যে কি হবে! রুমালে চোখ চেপে ফুঁপিয়ে উঠলেন গিয়র্গিয়েভা।

নীল আস্তে আস্তে বললো, রিস্টো আমার সঙ্গে কেন দেখা করতে চেয়েছিলো আপনি জানেন?

চোখ মুছে মাথা নাড়লেন গিয়র্গিয়েভা পরশু ওদের সঙ্গে কথা হয়েছে। বিদেশে কিছু কাগজ পাঠাতে চায় ওরা। তোমার বাবা একজন রাষ্ট্রদূত। তিনি যদি কিছু ব্যাপারে সাহায্য করেন তাহলে রিস্টোরা খুব খুশি হবে।

কি ধরনের সাহায্য? জানতে চাইলো নীল।

ধরো ফ্যাক্স মেশিনের সাহায্য। কিম্বা ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগে করে দু একটা চিঠি পাঠানো–

এগুলো তো বেআইনি কাজ। বাবা মনে হয় না রাজী হবেন।

শুকনো গলায় গিয়র্গিয়ে বললেন, তুমি ওর সঙ্গে একবার কথা বলে দেখো। দরকার হলে কমিটির কেউ ওঁর সঙ্গে কথা বলবে। এটুকু আশা করি তুমি করবে।

দেখা করার ব্যবস্থা আমি করিয়ে দিতে পারবো।

তাহলেই হবে। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ বাছা।

দরজা খুলে কফির কাপ হাতে ঘরে ঢুকলো রুসেভ। টেবিলের ওপর কাপ দুটো রেখে বললো, একটু আগে কালো চশমাপরা গোয়েন্দাটা এসেছিলো। আমাদের রেস্টুরেন্টে। পেত্রভকে বলে রেখেছিলাম। ও গোয়েন্দাটাকে বলেছে বিদেশী ছেলেটা এসেছিলো। তারপর এক বুড়ো তুর্কীও এসেছিলো। দুজনে বসে কফি খেয়েছে, কথাবার্তা বলেছে, তারপর একসঙ্গে লিফটে চেপে ক্লাঝেভো চলে গেছে।

মৃদু হেসে গিয়র্গিয়ে বললেন, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ রুসেভ। ভালো করেছো গোয়েন্দাকে তাড়িয়ে দিয়ে। নইলে নীলকে অযথা জ্বালাতন করতো।

কফি শেষ করে নীল বললো, এবার যাই তাহলে আপনাকে এ্যাপয়েন্টমেন্টের কথা জানাবো কিভাবে?

আমি তোমাকে ফোন করবো। নাম বলবো ইরিনা। মনে রেখো। তুমি শুধু দিন আর সময় বলে দিও। যদি তোমার বাবা দেখা করতে না চান তাহলে বলবে রং নম্বর।

নীল উঠে দাঁড়ালো–রিস্টোকে আমার শুভেচ্ছা জানাবেন। ওকে বলবেন এম্বাসিকে না জড়িয়ে যদি আমাকে দিয়ে কোন কাজ হয় বলতে। ওর জন্য কিছু করতে পারলে আমি খুশি হব।

নীলের মুখের দিকে তাকালেন গিয়র্গিয়েভা। এই মূহুর্তে ওকে ঠিক রিস্টোর মত মনে হচ্ছে। ওর চেহারায় সেরকম তেজ আর সাহস। পেছনে গোয়েন্দা লেগেছে, তারপরও এতটুকু ঘাবড়ে যায় নি। উঠে দাঁড়িয়ে নীলের মাথাটা বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর কপালে চুমু খেয়ে বললেন, সাবধানে যেও। চারদিকে নজর রেখো। কাউকে সন্দেহজনক মনে হলে সঙ্গে সঙ্গে খসিয়ে ফেলল। তুমি বুদ্ধিমান ছেলে, তুমি পারবে আমার লক্ষ্মী বাছাটি।

কপিটোটো হোটেল থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামার আগে চারপাশে তাকিয়ে কালো চশমাপরা লোকটাকে কোথাও দেখতে পেলোলা না নীল। ভাবলো, পাজিটা এতক্ষণে নিশ্চয় ক্লাজেভোতে ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।

বাস স্ট্যাণ্ডে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়াতে হলো ওকে সোফিয়ার বাস ধরার জন্য। পরে আরেকজন মহিলা এসে দাঁড়ালো ওর পেছনে। দেখে মনে হয় প্রাইমারি স্কুলের খিটখিটে মাস্টারনী। বাস আসতেই ও উঠে পড়লো, পেছনে সেই মহিলাও। নীল খুঁজছিলো কালো চশমাপরা গোয়েন্দাকে। না, দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। ও ঘুণাক্ষরেও জানলো না, যাকে মাস্টারনী ভেবে বসে আছে সেই মহিলাও ঝিভকভের গুপ্ত বাহিনীর একজন গোয়েন্দা।

.

০৪. রোমে রবিনের অভিজ্ঞতা

পলার সঙ্গে সারাদিন কাটিয়ে সন্ধ্যায় যখন রবিন ঘরে ফিরলো, নাফিসা তখন চায়ের পট সাজিয়ে বারান্দায় বসেছিলেন। রবিনকে তিনি বার বার বলে দিয়েছিলেন যেখানেই থাকুক সন্ধ্যার পর যেন ঘরে ফিরে আসে। কতক্ষণই বা দেখেছেন ছেলেটাকে, এরই ভেতর ভীষণ মায়া পড়ে গেছে ওর ওপর। অবিকল ওর বাবার মত দেখতে হয়েছে। সেই ফর্শা রঙ, ধারালো চিবুক, মায়াবি চোখ, এলোমেলো এক গোছা চুল কপালে এসে পড়া–এমন কি চশমার ফ্রেমও ওর বাবার যেমনটি ছিলো, যখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন।

নাফিসা ভাবলেন, রবিনের মতো ওঁর যদি একটা ছেলে থাকতো! বন্ধুরা এখনো বলে, নাফিসা বিয়ে করছে না কেন। তিনি জানেন, বিয়ে করলে তিনি একজনকেই করতেন। সেটা যখন হয় নি তখন বিয়ে করার কথা তিনি ভুলে গেছেন।

সূর্য ডুবে গেছে, তখনও অন্ধকার নামে নি। আকাশে গাঢ় কমলা রঙের মেঘ জমে আছে। তখনই তিনি রবিনকে দেখলেন দূরে, একা হেঁটে আসছে হালকা পায়ে। মৃদু হাসি ফুটে উঠলো তার ঠোঁটের ফাঁকে।

কাছে এসে মেইন গেট-এর পাশে নাফিসার নাম লেখা কলিং বেল টিপলো রবিন। তারপর কলিং বেলের বোতামের পাশে ছোট্ট দেয়াল মাইক্রোফোনে নিজের নাম বললো। খুলে গেলো ভারি লোহার দরজা। লিফটে উঠে পনেরো নম্বরের বোম টিপলো। ইলেকট্রনিক লিফটে হুশ করে উঠে এলো পনেরো তলায়। দেখলো দরজা খুলে নাফিসা দাঁড়িয়ে আছেন। ধবধবে সাদা সুতীর শাড়ি পরেছেন, ব্লাউজও সাদা, পায়ে সাদা স্লিপার। মৃদু হেসে বললেন, এসো রবিন, খুব বেড়িয়েছে রোদের ভেতর!

রবিন হেসে বললো, এই চমৎকার রোদে বেড়াতে দারুণ ভালো লেগেছে।

রবিন ভেতরে ঢোকার পর নাফিসা দরজা বন্ধ করলেন–মুখ হাত ধুয়ে এসো, আমি চা তৈরি করছি।

তিন মিনিটের ভেতর ফ্রেশ হয়ে এলো রবিন। সিঙাড়ার মত মাংশ আর সবজির পুর দেয়া এক ধরনের খাবার বানিয়েছেন বাড়ির যে কাজ করেন ইটালিয়ান মহিলাটি। নাফিসা বললেন, ইটালীর সাউথে এ ধরনের পাস্তা বানায়। এ মহিলাটি সিসিলিয়ান।

একটু টক আর ঝাল ঝাল–খেতে দারুণ লাগলো। খিদেও পেয়েছিলো রবিনের। পর পর কয়েকটা পাস্তা খেয়ে ফেললো। নাফিসা স্নেহভরা চোখে ওর মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন। খাওয়া থামাতেই বললেন, আরও নাও না রবিন। সারাদিন তো কাটিয়েছো দু তিন খানা স্যান্ডউইচ দিয়ে।

আরেকটা পাস্তা তুলে নিয়ে রবিন বললো, জানেন আন্টি, রোমে আসতে না আসতেই চমৎকার এক বন্ধু পেয়ে গেছি। পলার সঙ্গে কিভাবে পরিচয় হলো সবটুকু সে নাফিসাকে বললো। কালও আমরা দুজন সারাদিন ঘুরবো বলে ঠিক করেছি।

মেয়েটা কি খুব সুন্দর দেখতে?

দারুণ! মনে হয় সিসটিন চ্যাপেলের ছবি থেকে উঠে এসেছে। সোনালী চুল, গভীর নীল চোখ–বলতে গিয়ে লাল হলো রবিন।

ওর উচ্ছ্বাস দেখে নাফিসা মৃদু হাসলেন–তুমি কিন্তু আমাকে বঞ্চিত করছে রবিন। এই বলে রহস্যভরা চোখে ওর দিকে তাকালেন।

রবিন একটু অপ্রস্তুত হলো–কিভাবে আন্টি?

আমার সঙ্গে ঘুরছো না। তোমার বাবা বলবেন আমি তোমাকে ঠিকমত ঘুরিয়ে দেখাই নি।

বাবা কখনো এমন কথা বলবেন না। কচি খোকা নাকি হাত ধরে ঘুরিয়ে দেখাতে হবে! আমি যা দেখবো সে সব বহুবার আপনার দেখা।

ঠিক আছে, কাল না হয় চমৎকার বান্ধবীকে নিয়ে ঘুরলে। এখন আমার সঙ্গে ঘুরতে তোমার কেমন লাগবে?

কোথায়?

সমুদ্রের তীরে। পঁচিশ মিনিটের ড্রাইভ।

দারুণ হবে আন্টি।

তাহলে একটা গরম জ্যাকেট পরে নাও। রাতের খাবার আমরা বাইরে খাবো।

ইটালিয়ান নিশ্চয়?

অবশ্যই ইটালিয়ান।

রবিন উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো, ইউ আর রিয়েলি গ্রেট।

পাঁচ মিনিটের ভেতর কাপড় পাল্টে তৈরি হলো রবিন। নাফিসা যে শাড়ি পরেছিলেন তার ওপর সাদা মোটা একটা উলের কার্ডিগান পরলেন আর স্লিপার পাল্টে জুতো পায়ে দিলেন। লিফটে নামতে নামতে রবিন বলেই ফেললো, আন্টি, আজ আপনাকে দেবীর মত লাগছে।

কাল বললে পরি, আজ বলছো দেবী, আগামীকাল কি বলবে অপ্সরী? হালকা গলায় নাফিসা বললেন, তোমাকে যে রূপকথার রাজপুত্রের মত মনে হচ্ছে এ কথা নিশ্চয় আমার মত বুড়ির মুখে শুনতে ভালো লাগবে না?

কক্ষণো আপনি বুড়ি নন আন্টি। বাবার বন্ধু না হলে আমিই আপনার বন্ধু হতে চাইতাম।

গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিয়ে হাসি চেপে নাফিসা বললেন, তুমি একটা পাজি ছেলে রবিন।

রবিন বললো, বাবা আমার বন্ধুর মত।

সহজ গলায় নাফিসা বললেন, আমি জানি রবিন।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে রবিন বললো, বাবা কি আপনাকে চিঠি লেখেন আন্টি?

না। ম্লান এক টুকরো হাসি ফুটে উঠলো নাফিসার ঠোঁটে। গাড়ি তখন শহর থেকে বেরিয়ে হাইওয়েতে পড়েছে। চলছে ষাট মাইল স্পীডে। কথাটা রবিনকে বলা ঠিক হবে কিনা একবার ভাবলেন। তারপর বললেন, তোমার বাবা আমার জন্মদিনটা ছাড়া আর কিছুই মনে রাখেন নি রবিন। মাঝে মাঝে আমি ফোনে কথা বলি।

মনে রাখেন নি এ কথাটা ঠিক নয় আন্টি। আমি বহুদিন থেকে জানি আপনি বাবার একমাত্র বন্ধু।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে নাফিসা আস্তে আস্তে বললেন, আমার কথা বাবা তোমাকে কী বলেছেন?

বলেছেন বাবার কিছু হলে সবার আগে আপনাকে আর মেজোচাচাকে যেন জানাই। দাদী মারা যাওয়ার সময় জোর করে বাবাকে বিয়ে দিয়েছেন আমার মার সঙ্গে। নানির খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন দাদী।

নাফিসা বাধা দিলেন–ওসব কথা আমি জানি রবিন। তোমার মা চমৎকার মানুষ ছিলেন।

রবিন আপন মনে বললো, আমার কাছে মা শুধু দেয়ালে ঝোলানো দুটো ছবি ছাড়া আর কিছু নয়। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলো সে। তারপর বললো, বাবা আমাকে এইচ এসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর বলেছিলেন, বাইরে গিয়ে কোথাও পড়তে চাই কিনা। আপনি সব ব্যবস্থা করে দেবেন।

সেটা আমি এখনও পারি রবিন। আস্তে আস্তে নাফিসা বললেন, তোমাকে বাইরে পাঠাবার কথা আমিই বলেছিলাম। দেশে তখন খুব গোলমাল ছিলো। এরশাদের পুলিশ ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালিয়েছে এখানে বসেই সেসব খবর পেয়েছি।

রবিন একটু গম্ভীর হয়ে বললো, আমরা যদি সবাই বাইরে চলে যাই এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়বে কে?

তোমার বাবাকেও তখন তুমি এ কথা বলেছিলে রবিন। ছাত্র জীবনে তোমার বাবাও রাজনীতি করতেন।

বাবার সঙ্গে এখনও পার্টির যোগাযোগ আছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমেরিকা থেকে আপনি অনেক টাকা তুলে পাঠিয়েছিলেন।

রবিনের বাবার কথা ভাবতে গিয়ে নাফিসার বুকটা ভরে গেলো। ভেবেছিলেন নিজের ছেলেকে পুরোনো বান্ধবীর কথা নাও বলতে পারেন। অনেক কথা মনে পড়লো তার। রবিন একবার বললো, পলার সঙ্গে আপনাকে পরিচয় করিয়ে দেবো। নাফিসা শুনতে পেলেন না।

সমুদ্রের তীর ধরে চলে গেছে পাকা রাস্তা। ডান দিকে দোকানপাট আর ঘরবাড়ি, বাঁদিকে চকচকে কালো সমুদ্র। আলো ঝলমলে রেস্টুরেন্টের পাশে নাফিসা গাড়ি পার্ক করে নামলেন। এক ঝলক কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস রবিনের মুখে ঝাঁপটা মারলো। বুক ভরে সমুদ্রের তাজা বাতাস টানলো। একটা বড় প্ল্যাটফর্মের মত করা হয়েছে সমুদ্রের ভেতরের দিকে। চারপাশে আলোর বন্যা। নানা বয়সী মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে সেখানে। কোন কোন পরিবার রাতের খাবার সেরে নিচ্ছে সমুদ্রের বুকে বসে। রবিন উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো, চমৎকার জায়গা।

নাফিসা বললেন, শীত লাগছে না তোমার?

একটু লাগছে। কথাটা স্বীকার করলো রবিন। তারপরও বললো, এখানে না এলে রোমের চমৎকার সুন্দর একটা জায়গা মিস করতাম।

প্ল্যাটফর্মে কিছুক্ষণ ঘুরে রবিনকে নিয়ে নিরিবিলি একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসলেন নাফিসা। কয়েক রকমের পাস্তা, কাবাব আর সালাদের অর্ডার দিলেন। রবিনকে জিজ্ঞেস করলেন, কখনো ওয়াইন খেয়েছো?

রবিন লাজুক হেসে বললো, বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে কয়েকবার বিয়ার খেয়েছি।

এখানে ষোল বছর হলেই হার্ড ডিংক এ্যালাউ করে। একটু রেড ওয়াইন নাও। এখানকার ওয়াইন পৃথিবীর সেরা।

শুনে উত্তেজিত হলো রবিন। নাফিসাকে খুবই আপনজন মনে হলো। ওয়েটার এসে প্রথমে চমৎকার ক্রিস্টালের ওয়াইন গ্লাসে টলটলে লাল মদ দিয়ে গেলো। নাফিসা রহস্য করে বললেন, তোমার বন্ধু জানে তুমি যে মদ খাও?

কোন বন্ধু? জানতে চাইলো রবিন।

ওই যে বললে, বাবা তোমার একজন ভালো বন্ধু।

তাই বলুন। হেসে ফেললো রবিন—হ্যাঁ, বাবা জানেন। আপনি যে রেড ওয়াইন খাওয়াচ্ছেন এটাও জানবেন। একটু থেমে রবিন বললো, আমি একটা কথা বলবো আপনাকে?

বলে ফেলো।

বাবা যদি বন্ধু হন, তাহলে বাবার একমাত্র বন্ধু তো আমার বন্ধু হতে পারেন।

নাফিসা গম্ভীর হওয়ার ভান করলেন–হ্যাঁ পারি। যদি তোমার বাবার আপত্তি না থাকে।

রবিন গলা খুলে হাসলো–বাবা কক্ষণো অমন নয় আন্টি। আপনি বাবাকে খুব ভালো করেই জানেন।

তাহলে এসো। বলে নাফিসা মদের গ্লাস তুললেন–টোস্ট করা যাক। আমাদের বন্ধুত্বের উদ্দেশে। নিজের গ্লাস তুলে রবিন নাফিসার গ্লাসের সঙ্গে ছোঁয়ালো। হেসে বললো, আমাদের বন্ধুত্বের উদ্দেশে। তারপর গ্লাসে চুমুক দিলো। সামান্য টক, মিষ্টি আর ঝাঁঝালো স্বাদ–দারুণ লাগলো ওর কাছে।

ইটালিয়ান পাস্তাও খেতে খুব মজা লাগলো। কয়েক রকমের পাস্তা দিয়েছে। নাফিসা প্রত্যেকটার আলাদা নাম বলে ওর প্লেটে তুলে দিলেন। অনেকটা নুডল্‌সের মতো, ভেতরটা ফাঁপা, কোনও ডিশে লাল টমাটো সস, কোনওটায় নাম না জানা সাদা সবুজ সস, পনির আর মাংসের কুচি মাখানো। নাফিসা বললেন, ইটালিয়ানদের ভাত হচ্ছে এই পাস্তা। দেড়শ রকমের পাস্তা পাওয়া যায় এখানে। দেখতেও একেকটা একেক রকম।

সত্যি অপূর্ব লাগছে আন্টি। এতটা মজার হবে আমি আশা করিনি।

ইটালিয়ানরা খাবার আর পোষাকের ব্যাপারে খুবই সৌখিন। ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় বিলাসীও বলতে পারো।

রেস্টুরেন্টের দোতালার বারান্দায় বসে খাচ্ছিলো ওরা। মাথার ওপরে ছাদ থাকায় শীত কম লাগছিলো। সামনে সমুদ্রের দিকটা খোলা, মাঝে মাঝে তাজা লোনা বাতাস বয়ে যাচ্ছিলো। মদের গ্লাস যতবার খালি হলো ওয়েটার এসে আবার ভরে দিয়ে গেলো। খাবার দেয়ার সময় টমাটো জুসও দিয়েছিলো লম্বা গ্লাসে।

নিজেকে পালকের মতো হালকা মনে হচ্ছিলো রবিনের। টেবিলে সাদা কাঁচের ঢাকা দেয়া আলোর নরম আভায় নাফিসাকে মনে হচ্ছিলো মোমে গড়া স্বর্গের কোন দেবী। নাফিসা রবিনের ভেতর তাঁর ছাত্রীজীবনের সবচেয়ে কাছের বন্ধুটিকে খুঁজছিলেন।

খাবার শেষ হওয়ার পর ওয়েটার প্লেট ডিশ সব নিয়ে গেলো। দুজনের সামনে লাল মদের গ্লাস। বাবার কথা মনে হলো রবিনের। বাবা ভাবতেও পারবেন না ওঁর বন্ধুর সঙ্গে রোমের এই চমৎকার রাতে সে বন্ধুর মতো কথা বলছে। সামনে তাকিয়ে দেখলো নাফিসা ওকেই দেখছেন। ওঁর দুচোখ গভীর মমতায় ভরা। রবিনকে তাকাতে দেখে নাফিসা মৃদু হাসলেন। জিজ্ঞেস করলেন–কি ভাবছো?

বাবার কথা।

বাবার কথা কি ভাবলে?

কিছুক্ষণ চুপ থেকে অন্য এক জগৎ থেকে রবিন আস্তে আস্তে বললো, আচ্ছা আন্টি, আমি, আপনি, বাবা–আমরা তিনজন কি একসঙ্গে থাকতে পারি না?

এ কথা কেন বলছো রবিন?

বাবার কথা ভাবলে কষ্ট হয় আন্টি। আমি তো আমার পড়াশোনা, বন্ধু বান্ধব আর সংগঠনের কাজে বেশির ভাগ সময় বাড়ির বাইরে থাকি। বাবা সব কিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। আমি যে এখন নেই–বাবার খুব খারাপ সময় কাটছে।

ঠিক আছে রবিন। নাফিসা আস্তে আস্তে বললেন, আজ রাতে তোমার বাবার সঙ্গে ফোনে কথা বলবো।

আপনি কিন্তু আমার কথার জবাব দেন নি।

কী বলবো রবিন! একটু থেমে আপন মনে নাফিসা বললেন, এভাবে আমি কখনো ভাবি নি।

এবার ভাবুন আন্টি। আমি বলছি এতে আমাদের সবার ভালো হবে।

জানি না রবিন। ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নাফিসা বললেন, চলো, ওঠা যাক। রাত অনেক হয়েছে।

সময় কিভাবে কেটেছে কিছুই টের পায় নি রবিন। চারদিকে তাকিয়ে দেখলো রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে এসেছে। রোমে তখন মধ্যরাত। অল্প দূরে বিশাল কালো কার্পেটের মত বিছানো রয়েছে নিঃসঙ্গ ভূমধ্যসাগর।

বাবার সঙ্গে শেষ রাতে নাফিসা আন্টির কি কথা হয়েছে রবিন জানতে পারে নি। ও তখন গভীর ঘুমে ডুবেছিলো। স্বপ্ন দেখছিলো, ওরা তিনজন জাহাজে করে কোথাও যাচ্ছে। একপাশে বাবা, আরেক পাশে নাফিসা আন্টি, মাঝখানে রবিন দাঁড়িয়ে আছে জাহাজের ডেকে রেলিং-এ ভর দিয়ে। সাদা সাদা সিগাল এলোমলো উড়ছে, ঢেউয়ের সাথে লুটোপুটি করছে। হু হু বাতাস ওদের চুল এলোমেলো করে দিচ্ছে। বাবা দারুণ সব হাসির কথা বলছেন, সবাই গলা খুলে হাসছে। হাসতে হাসতে এক সময় নরম সিগাল হয়ে গেলেন নাফিসা আন্টি। ডানা মেলে উড়ে গেলেন গভীর সাগরে।

সকালে ঘুম থেকে উঠে রবিন নাশতার টেবিলে নাফিসাকে দেখলো। হালকা কুয়াশার মত বিষণ্ণতার ছায়া পড়েছে তার মুখে। রবিন উচ্ছ্বসিত হয়ে তাঁকে স্বপ্নের কথা বললো। নাফিসা ম্লান হাসলেন। কোন কথা বললেন না। রাতের ফ্লাইটে চলে যাবে রবিন। কতক্ষণই বা দেখেছেন মা হারা ছেলেটাকে! কাল রাতেই নাফিসা বুঝতে পেরেছেন রবিন ওঁর ভেতর নিজের মাকে খুঁজছে। রবিনের বাবাকে টেলিফোনে এসব কথা তিনি বলেন নি। হয়তো কোন দিনই বলবেন না।

নাশতা সেরে রবিন নাফিসার সঙ্গেই বেরুলো। পলাকে ও ঠিক নটায় রোমের রেল স্টেশন টারমিনিতে আসতে বলেছে। ওর ব্যাগে নাফিসা বেশি করে স্যান্ডউইচ বানিয়ে দিয়েছেন। আপেলও দিয়েছেন কয়েকটা। বোঝা ভারি হবে বলে পানির বোতল নেয় নি রবিন। কালই দেখেছে আড়াই হাজার লিরায় বড় এক বোতল মিনারেল ওয়াটার কিনতে পাওয়া যায়। বাংলাদেশ টাকায় অনেক হলেও নাফিসার দেয়া পঞ্চাশ হাজার লিরার প্রায় কিছুই খরচ হয় নি।

নাফিসা ওকে টারমিনিতে নামিয়ে দিয়ে অফিসে চলে গেলেন। বললেন সন্ধ্যের আগে ফিরতে। ছটায় ওকে এয়ারপোর্ট পৌঁছতে হবে।

ষ্টেশনে ঢোকার পথে দাঁড়িয়েছিলো পলা। রবিনকে ও গাড়ি থেকে নামতে দেখে এগিয়ে এসে মৃদু হেসে সম্ভাষণ জানালে হাই রবিন।

রবিনও হেসে বললো, হাই পলা। তোমাকে কি বেশিক্ষণ দাঁড় করিয়ে রেখেছি?

রবিনের সঙ্গে হাত মেলালো পলা–এখন ঠিক নটা বাজে। আমি পাঁচ মিনিট আগে এসেছি। এই বলে একটু রহস্য হাসলো–দামী গাড়িতে অসাধারণ সুন্দরী এই মহিলার সঙ্গে কোত্থেকে এলে রবিন?

লাজুক হেসে রবিন বললো, তিনি আমার আন্টি। আমি ওঁর বাড়িতেই উঠেছি।

নকল দীর্ঘশ্বাস ফেলে পলা বললো, হে ঈশ্বর, রোমে যদি রবিনের আন্টির মত আমারও একজন আন্টি থাকতো!

ঠিক আছে পলা। আন্টিকে তোমার কথা কালই বলেছি। তুমি তো কদিন রোমে থাকছে। যদিও চাও পরিচয় করিয়ে দিতে পারি।

আমি খুবই আনন্দিত হবো রবিন! উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো পলা।

আজ কোথায় যেতে চাও বলো।

কেন, কলোসিয়াম দেখার কথা না আজ?

হেসে মাথা নেড়ে সায় জানালো রবিন। বললো, চলো পাতাল রেলে যাই। তাড়াতাড়ি যাওয়া যাবে।

স্টেশনের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামার সময় রবিন লক্ষ্য করলো রোম ধনীদের শহর হলেও এখানে গরিব মানুষও কম নয়। টুকটুকে দেড় বছরের বাচ্চা কোলে নিয়ে সিঁড়িতে বসে ভিক্ষা চাইছে কম বয়সী এক মা। বাচ্চাটাকে দেখে মনে হলো ভ্যাটিকান চার্চের দেয়ালে আঁকা দেবশিশু বুঝি। কোঁকড়া সোনালী চুল, স্বচ্ছ নীল বড় বড় চোখ, টুকটুকে গাল দুটো দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে। মেয়েটাও সুন্দরী, যদিও পরনে মলিন পোষাক, জুতোও ঘেঁড়া, রুক্ষ বাদামী চুল আর বিষণ্ণ মুখে ময়লার দাগ। কাছে এসে রবিনের পা আটকে গেলো। এত লোকজন সিঁড়ি বেয়ে ওঠা নামা করছে কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না। বাচ্চাটার গায়ে শুধু সুতির দুটো জামা, খালি ফিডিং বটল নিয়ে মায়ের কোলে বসে খেলছে।

রবিনকে দাঁড়াতে দেখে মেয়েটা কী যেন বললো। রবিন বুঝতে পারে নি দেখে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বললো, আমাকে একটা ডলার দেবে? আমার জন্য নয়, বাচ্চাটাকে দুধ কিনে খাওয়াবো।

পলা চাপা গলায় রবিনের কানে কানে বললো, সব মিছে কথা, মেয়েটা মদ খাওয়ার জন্য ভিক্ষে চাইছে।

রবিনকে নিরুত্তর দেখে মেয়েটা আবার বললো, আজ সকাল থেকে বাচ্চাটা কিছু খায় নি।

মেয়েটার চোখ দেখে মনে হলো বুঝি কেঁদে ফেলবে। রবিনের বুঝতে অসুবিধে হলো না, এভাবে একজন বিদেশীর কাছে ভিক্ষে চাইতে কষ্ট হচ্ছে মেয়েটার। পকেট থেকে পাঁচ হাজার লিরার একটা নোট বের করে মেয়েটাকে দিলো। যা চেয়েছে তার চারগুণ পেয়ে হতভম্ব হয়ে গেলো মেয়েটা। চোখের ভেতর যে পানিটা জমেছিলো ফোঁটায় ফোঁটায় গড়িয়ে পড়লো ওর দুগাল বেয়ে। বাচ্চাটাকে বসিয়ে রেখে ছুটে গেলো পাশের ড্রিংকস-এর দোকানে। এক বোতল দুধ কিনে এনে কিছুটা ঢেলে দিলো বাচ্চার ফিডিং বটলে। রবিনের দিকে তাকিয়ে মেয়েটা কৃতজ্ঞ গলায় বার বার বললো, ধন্যবাদ, ধন্যবাদ।

দুধ পেয়ে বাচ্চাটার চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। বুকের ভেতর তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করলো রবিন। নিজের দেশের কথা মনে হলো। বাংলাদেশে এরকম লক্ষ লক্ষ শিশু রয়েছে সারাদিনে যারা এক ফোঁটা দুধ খেতে পায় না। পলা রবিনের হাত ধরে আস্তে আস্তে বললো, আমি ভুল বুঝেছিলাম রবিন। চলো যাই।

কিছুদূর গিয়ে আবার ঘুরে দেখলো রবিন। মায়ের কোলে দুধ খাচ্ছে বাচ্চাটা, মা গভীর মমতায় চেয়ে দেখছে। গতকাল ভ্যাটিকান চার্চের গায়ে এরকম এক মমতাময়ী মায়ের ছবি দেখেছিলো রবিন।

পাতাল রেলে টারমিনি থেকে কলোসিয়াম আসতে মিনিট দশেক লাগলো। পলা বললো, বাসে এলে আধঘন্টা লাগতো। রাস্তা এ সময় অসম্ভব জ্যাম থাকে।

কলোসিয়ামের বাইরে ছোট ছোট ফেরিওয়ালা ভিউকার্ড, স্লাইড, আর হালকা পেতলের স্যুভেনির বিক্রি করছে। নীল আর রীনের জন্য কিছু স্লাইড আর কলোসিয়ামের দুরকম দুটো মেটালের প্রতিকৃতি কিনলো। পলার পছন্দ হয়েছিলো চ্যারিয়টে জুলিয়াস সিজারের প্রতিকৃতি খোদাই করা চেইনে ঝোলানো লকেট। দশ হাজার লিরা দিয়ে ওটা কিনে পলাকে উপহার দিতেই ওর সারা মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে লকেটটা গলায় পরলো বললো, ভালো লাগছে না দেখতে?

মৃদু হেসে মাথা নেড়ে সায় জানালো রবিন।

কলোসিয়াম দেখার জন্য প্রচুর পর্যটক ভিড় করেছে। রবিনের মনে হলো পৃথিবীর সব দেশের মানুষ পাওয়া যাবে এদের ভেতর। অনেকে এসেছে দল বেঁধে। নানা ভাষায় ইটালিয়ান দোভাষীরা তাদের সব বুঝিয়ে বলছে। নাফিসার দেয়া গাইড বই মিলিয়ে দেখতে এতটুকু অসুবিধে হলো না রবিনের। দুঘন্টা ধরে ওরা ঘুরে দেখলো রোমান সম্রাট আর অভিজাতদের খেলাধূলো দেখার জন্য বানানো সেই ঐতিহাসিক স্থাপত্যের নিদর্শন। ক্লান্ত হয়ে ওরা ছোট্ট একটা বেদির মত উঁচু জায়গায় বসলো। স্টেশন থেকে দুটো কোক-এর ক্যান কিনেছিলো রবিন। কোক খেতে খেতে হালকা গলায় ও দারুণ সাজগোজ করা একটা মেয়ে দেখিয়ে রসিকতা করলো–মনে হচ্ছে ইটালীর মেয়েরা ফরাসী মেয়েদের চেয়ে বেশী সুন্দরী।

পলা রবিনের রসিকতা বুঝতে পেরে বললো, তুমি কী করে বুঝলে ওই মেয়েটা ইটালিয়ান? আমি বাজি ধরে বলতে পারি ও ফরাসী।

ছোট ভাইকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলো ওদেরই বয়সী উলের ছোট স্কার্ট পরা মেয়েটা। একটা উঁচু জায়গা থেকে দশ এগারো বছর বয়সী ভাইটাকে লাফাতে দেখে ধমক দিয়ে কি যেন বললো। পলা শুনে হতাশ হলো–হায় ঈশ্বর, এ যে দেখি জার্মান!

তুমি কটা ভাষা জানো পলা? জানতে চাইলো রবিন।

ফরাসী ছাড়া ইংরেজি আর ডাচ ভালো জানি। জার্মান কাজ চালানোর মত বলতে পারি, লিখতে পারি না। তুমি?

ইংরেজি ছাড়া আর কোন বিদেশী ভাষা জানি না। তবে ভিসি আর-এ হিন্দি ছবি দেখে বুঝতে পারি।

আমার খুব ইণ্ডিয়া দেখার সখ।

চলে এসো। বাংলাদেশে আমার অতিথি হতে পারবে।

পলা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, তোমাকে বন্ধু হিসেবে পেয়ে কী যে ভালো লাগছে রবিন! আজ তোমার সোফিয়া না গেলে হয় না?

আমি দুঃখিত পলা। ঢাকা থেকে কনফার্ম করা টিকেট। তাছাড়া সোফিয়া যাওয়াটাও জরুরি।

তুমি কি সত্যিই আমার কথা মনে রাখবে রবিন?

নরম গলায় রবিন বললো, নিশ্চয় মনে রাখবো পলা।

তুমি আমার জন্য এত কিছু করলে, আমি তোমার জন্য কিছুই করতে পারলাম । বিষণ্ণ গলায় বললো পলা।

রবিন মৃদু হাসলো–বন্ধু হতে গেলে এতসব হিসেব করা চলে না পলা।

বিদেশী ছেলেটার কথায় পলার মন ভরে গেলো। লিয়ঁতে ওর অনেক ছেলে বন্ধু আছে। একদিনের পরিচয়ে রবিন ওর জন্য যতটা করেছে, ওর বহুদিনের পুরোনো বন্ধুরাও কেউ কখনো ততটা করে নি। বললো, তোমার মনটা ফুলের মত নরম। স্টেশনের বাচ্চা মেযেটার দুধ কেনার জন্য তুমি টাকা দিয়েছে, অথচ কেউ ফিরেও তাকাচ্ছিলো না ওর দিকে।

রবিন আস্তে আস্তে বললো, আমি এসেছি পৃথিবীর সবচেয়ে গরিব দেশ থেকে। গরিবদের কষ্ট আমি বুঝি পলা।

ওরা দুজন বিকেল পর্যন্ত পুরোনো রোমে পায়ে হেঁটে ঘুরলো। সাড়ে চারটার দিকে পলাকে নিয়ে ঘরে ফিরলো রবিন। নাফিসা তখনো ফেরেন নি। এ্যাপার্টমেন্ট দেখে পলা মুগ্ধ হয়ে গেলো তোমার আন্টি রীতিমতো বড়লোক মনে হচ্ছে!

রবিন বললো, বড় চাকরি করেন, একা থাকেন, তাই এত সৌখিন জিনিষপত্র কিনতে পেরেছেন।

নাফিসা এলেন ঠিক পাঁচটায়। হাতে একটা প্যাকেট। ইটালিয়ান মহিলাটি এর মধ্যে ওদের কফির সঙ্গে পাস্তা ভেজে দিয়েছেন। নাফিসাও বসে পড়লেন। পলাকে একজন ভালো বন্ধু বলে ওঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো রবিন। নাফিসা খুশি হলেন।

বললেন, তোমার থাকার অসুবিধের কথা রবিন বলেছে। ও আজ চলে যাচ্ছে। তুমি যে কদিন রোমে আছো ইচ্ছা করলে আমার এখানে থাকতে পারে পলা।

রবিন আর পলা উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো, ইউ আর রিয়েলি গ্রেট আন্টি।

নাফিসা লাজুক হেসে বাইরে থেকে আনা প্যাকেটটা খুললেন। রবিনের জন্য চমৎকার স্যুট, টাই, শার্ট আর জুতো এনেছেন। পলা বললো, দেখেই মনে হয় খুব দামী স্যুট।

রবিন একবার বললো এর কী দরকার ছিলো, আবার বললো, মাপ পেলেন কোথায়?

তোমার প্যান্ট জ্যাকেট সবই তো ওয়ার্ডরোবে। মাপ পাওয়া কি কঠিন কাজ। নাফিসা মৃদু হেসে বললেন, রোমে এসে দুনিয়ার সবাই স্যুট বানায়। ইটালীর জুতো

পৃথিবী বিখ্যাত। এই সামান্য জিনিসও কি উপহার দিতে পারবো না আমার লক্ষী ছেলেটাকে!

রবিন লক্ষ্য করলো নাফিসা আন্টি কত সহজে ওকে আমার ছেলে বললেন। পলা অত কিছু বুঝলো না। বললো, আন্টি, আমি কি আপনার সঙ্গে এয়ারপোর্ট যেতে পারি রবিনকে সি অফ করার জন্য?

নিশ্চয় পায়রা পলা। ফেরার সময় হোটেল থেকে তোমার জিনিসপত্র নিয়ে নিও।

নাফিসার কথা রবিন পলাকে বলেছে। পলা খুব অবাক হলো–বন্ধুর ছেলের দুদিনের বান্ধবীকে কত সহজে আপন করে নিলেন এই অপূর্ব সুন্দরী এবং দারুণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মহিলা। ওর মনে হলো বাংলাদেশের সব মানুষ বুঝি এমন মহৎ হৃদয়ের। রবিনকে বললো, ভবিষ্যতে কখনো সুযোগ পেলে সবার আগে আমি বাংলাদেশে যাবো। তোমাদের মত এত সুন্দর হৃদয়ের মানুষ পৃথিবীতে আর কোথাও আছে বলে মনে হয় না।

নাফিসা মৃদু হেসে বললেন, পৃথিবীর সব দেশেই ভালো মানুষ আছে পলা। একমাত্র মানুষই পারে একে অপরকে সাহায্য করতে, বিপদের সময় সাহায্যের হাত বাড়াতে।

পলা বিড় বিড় করে বললো, এই মানুষই আবার যুদ্ধের নামে মানুষকে হত্যা করে, সভ্যতা ধ্বংস করে। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য জঘন্য সব কাজ করে।

রবিন টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। বললো, আমি ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছি। যাবার সময় তো হয়ে এলো।

সাড়ে পাঁচটার আগেই ওরা লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেলো। চেক ইন করে রবিনের স্যুটকেস পাঠিয়ে দিয়ে নাফিসা বললেন, ফেরার সময় তুমি সাতদিন রোমে কাটাবে, আমি তোমার বাবাকে বলে রাখবো রবিন। তুমি রোমে ফেরার টিকেট কনফার্ম করে আমাকে ফোন করবে।

বলকান এয়ারের যাত্রী যারা বুখারেস্ট হয়ে সোফিয়ায় যাবে তাদের ইমিগ্রেশন কাউন্টারে যাবার ডাক এলো। বিদায় জানাতে গিয়ে নাফিসা রবিনকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। পলা হাত মেলাতে গিয়ে রবিনের হাত চেপে ধরে রাখলো কিছুক্ষণ। দুজনেই বললো, ভালো থেকো রবিন। তোমার ফেরার অপেক্ষায় রইলাম। ইমিগ্রেশনের দরজা দিয়ে ঢোকার মূহুর্তে রবিন পেছনে তাকিয়ে দেখলো, নাফিসা আর পলা দাঁড়িয়ে আছে। ওদের দুজনের চোখে ওর জন্য শুধু গভীর মমতা আর ভালোবাসা।