০৭-৮. রহস্যের হাতছানি

০৭. রহস্যের হাতছানি

মাঝরাতে বাইরে চোর চোর চিৎকার আর হট্টগোল শুনে চমকে উঠলাম। হঠাৎ সব কিছু আবার চুপ হয়ে গেলো। উঠে দেখি সবাই জেগে গেছে। এনামুল বললো কী হলো, দেখা দরকার।

আমি আর এনামুল ঝটপট পোশাক পরে বেরিয়ে এলাম। অন্যদের বললাম, জেগে থেকে তাঁবু পাহারা দিতে।

নিকোলাস স্যারের তাঁবুতে দেখি আলো জ্বলছে। একটা ছোটখাট জটলার মতো সেখানে। কাছে যেতেই শুনলাম যেন চাপা গলায় বললো, এই তো উলফ পেট্রলও এসে গেছে।

আরিফকে সামনে পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে আরিফ ভাই? হঠাৎ চোর চোর শুনলাম, তারপর সব চুপচাপ।

মুখ টিপে হেসে আরিফ বললো, চোর ধরা পড়ে গেছে।

কোথায় চোর?

আরিফ ভাই আঙুল তুলে তাঁবুর ভেতর ইশারা করলো।

ভেতরে দেখি কাচুমাচু হয়ে বসে আছেন ব্রাদার ফিলিপ্স। পাশে নিকোলাস স্যার হাসি চেপে জিজ্ঞেস করছেন–বেশি লেগেছে ব্রাদার?

আপনের পোলারা আমার হাড়ডি ভাইঙ্গা ফালাইসে। অভিযোগ করলেন ব্রাদার।

শওকত চাপা উত্তেজিত গলায় আমাকে বললো, ধরেছি আমি আর ফারুক। জাগুয়ার পেট্রলের বালতি চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছেন ব্রাদার। প্রথমে আমরা টের পাইনি। হঠাৎ গাছতলায় সাদা মতো কি দেখে আমি তো ভয়েই বাঁচি না। মনে হলো সুটিং কোম্পানি যে ভূতের কথা বলেছিলো ওদের কেউ নাকি। ফারুকদের ইশারা করে দেখলাম। ভয়ে কথা বলতে পারছিলাম না। দেখি আস্তে আস্তে বাগানের ঝোঁপের দিকে যাচ্ছে। ফারুক হঠাৎ বললো, হাতে দেখ তো, বালতির মতো কি যেন মনে হচ্ছে। তখনই খটকা লাগলো, অতৃপ্ত আত্মা বালতি দিয়ে কী করবে! দুজন পেছন থেকে গাছের আড়াল দিয়ে পা টিপে টিপে কাছে গিয়ে চোর বলেই পিঠের ওপর বাঁশের বাড়ি মেরেছি। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার-আমারে মাইরা ফালাইল। শুনে হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেলো–আর এতো ব্রাদার ফিলিপ্স। ধরে এনে মাপটাপ চেয়ে স্যারের তাঁবুতে এনে বসিয়েছি।

নিকোলাস স্যার তাঁবু থেকে বাইরে এসে মুখ টিপে হেসে বললেন, ছেলেদের এ নিয়ে কিছু বোলো না। ব্রাদার ভারি লজ্জা পেয়েছেন। এরপর শওকত আর ফারুকের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন, এবার কাদের ডিউটি?

শওকত লাজুক বললো, প্যাট্রিক আর রইসের।

ঠিক আছে তোমরা তাহলে ঘুমোতে যাও। এই বলে নিকোলাস স্যার আবার তাঁবুতে গিয়ে ঢুকলেন।

তাঁবুতে ফেরার পথে শওকত কানে কানে বললো, কাল তোর সঙ্গে অবজারভেশনে যাবো। কথা আছে।

পরিদিনের রুটিন মতো বিউগলের শব্দে ঘুম ভাঙলো। নাশতা সেরে পিটি করে, টেণ্ডারফুট কটাকে ফ্ল্যাগ আর নটিং-এর ট্রেনিং দিয়ে পুকুরে গিয়ে সাঁতার প্রতিযোগিতায় যোগ দিলাম। সাঁতারে কেউ শওকতকে হারাতে পারে না। বেশ কিছুক্ষণ দাপদাপি করে উঠে এসে দুপুরের খাওয়া সারলাম। কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর শিবলীকে নিয়ে আগের দিনের মতো অবজার্ভেশনে বেরুলাম। টুপ লিডারকে বলে শওকত এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলো।

জমিদার বাড়ির সিংদরজা পেরিয়ে শওকতকে জিজ্ঞেস করলাম, কাল রাতে যে বলেছিলে কথা আছে?

আমার কথার জবাব না দিয়ে শওকত বললো, শিবলী, তোর মনে আছে পরশু বিকেলে ইরফান ভাইর ওখানে যে গিয়েছিলাম ওদের প্রোডাকশন ম্যানেজার কী বলেছিলো?

শিবলী বললো, মনে থাকবে না কেন?

রান্টুকে বলেছিস?

বলেছি।

আর কাকে কাকে বলেছিস?

আর কাউকে বলিনি। কেন, কী হয়েছে?

আমি স্যারকে বলেছিলাম স্যার বললেন, ছেলেদের এসব কথা না বলতে, মিছেমিছি ভয় পাবে।

আমি বললাম, তুমি কী এসব গপ্পো বিশ্বাস করো শওকত ভাই?

তখন করিনি। শওকত আস্তে আস্তে বললো, কাল রাতে যা দেখলাম মনে হচ্ছে বাড়িটায় কিছু একটা আছে।

কী দেখেছো? আমি আর শিবলী প্রায় এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলাম।

তোরা আবার কাউকে বলবি না তো?

শিবলী ব্যস্ত গলায় বললো, কাউকে বলবো না। বলো কী দেখেছে।

জমিদার বাড়ির ঝুল বারান্দায় একটা আলো হেঁটে বেড়াচ্ছে দেখলাম। ব্রাদার ফিলিন্সকে ধরার আগে। ফারুক পেচ্ছাব করতে গিয়েছিলো। ও দেখেনি। একটু পরে দেখলাম বারান্দার আলোটা নিভে গেলো। পুব দিকের বাগানের ভেতর তেমনি একটা আলো কয়েক পা হেঁটে নিভে গেলো।

তারপর? রুদ্ধশ্বাসে জানতে চাইলো শিবলী।

পুকুরের ওপারের ঘাটে দেখলাম, সাদা কাপড়ে ঢাকা দুটো মানুষের মতো কী যেন কিছুক্ষণ ঘাটে দাঁড়ালো। তারপর বাগানের অন্ধকারের দিকে হেঁটে গেলো।

অন্ধকারে দেখলে কী করে?

তেমন ঘুটঘুঁটে অন্ধকার ছিলো না। আকাশে চাঁদ ছিলো।

আর কিছু দেখোনি? শিবলীর গলায় ভয় মেশানো উৎকণ্ঠা।

না। এর কিছুক্ষণ পর ব্রাদার ফিলিপ্সকে দেখে প্রথমটায় তাই ভয় পেয়েছিলাম। আমার মাথায় তখন পুকুর ঘাটের ছবিটা ভাসছিলো।

শওকতের কথা শেষ হওয়ার পর শিবলী কিছু বলার জন্য উসখুস করছিলো। শেষে থাকতে না পেরে আমার অনুমতি চাইলো–বলবো?

কী? শওকত ভুরু কুঁচকে আমাদের দিকে তাকালো। আমি শিবলীকে বললাম, বল।

শিবলী প্রথম দিন পাহারা দেয়ার সময় আলো দেখার কথা বললো। শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো শওকত। তারপর বললো, তোরা এখন কোথায় যাচ্ছিস?

আমি বললাম, কাল অবজার্ভেশনে বেরিয়ে একটা ভাঙা মন্দির দেখেছিলাম। আশে-পাশে কোনো লোকালয় নেই। তবু মনে হলো মন্দিরে লোকজন যাওয়া আসা করে। আজ ওটা ভালোভাবে দেখবো।

তোরা আলোর ব্যাপারে কিছু ভেবেছিস?

কাষ্ঠ হেসে শিবলী বললো, ভাবাভাবির কী আছে? আমার তো মনে হয় শুধু জমিদার বাড়িতে নয়, গোটা গ্রামটাতে অশরীরী আত্মার ঘুরে বেড়াচ্ছে। কালও দাগু বাবু পথে সাবধান করে দিলেন। নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছে রাস্তায় লোক চলাচল খুব কম।

শওকত মাথা নেড়ে সায় জানালো, তা ঠিক। আগেকার দিনের জমিদাররা সাধারণ লোকদের ওপর ভীষণ অত্যাচার করতো। কে জানে কত লোককে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মেরেছে, নয়তো মাটিতে পুঁতে ফেলেছে। বাড়িঘরে আগুন জ্বালিয়েও মানুষদের পুড়িয়ে মারতো তারা।

সে কথাই তো আমি রান্টুকে বোঝাতে পারছি না। শুভদারঞ্জন স্যার বলেননি, অপঘাতে কেউ মারা গেলে তাদের আত্মা মুক্তি পায় না?

আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললাম, আমরা যদি গোড়াতেই ধরে নিই সব কিছু অদৃশ্য আত্মার কাজ তাহলে এর ভেতর যদি কোন রহস্য থাকে সেটা অজানা থেকে যাবে।

শওকত ভুরু কুঁচকে বললো, রহস্য কোথায় পেলি?

ইরফান ভাইদের ঘোড়া দুটো কোথায় গেলো এটা একটা রহস্যজনক ঘটনা। সিংদরজায় তালা ছিলো। দেয়াল টপকেও যাওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া আত্মারা নিশ্চয়ই ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়ায় না।

শিবলী মুখ বাঁকিয়ে বললো, সব সময় তুই শুধু ঠাট্টা করিস।

ঠাট্টা নয়। আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, অবজার্ভেশনের পরীক্ষা দিচ্ছিস তুই। সব কিছু লক্ষ্য কর ভালো করে। ঘোড়া চুরির একটা হদিস পেয়েও যেতে পারি।

শওকত আমাকে সমর্থন করলো–রা ঠিকই বলেছে শিবলী। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। সব কিছুর ওপর নজর রাখতে হবে। কোনো কিছু অস্বাভাবিক মনে হলে নোট করতে হবে।

জমিদার বাড়ি থেকে কোথাও না থেমে সোজা হাঁটলে পুরোনো মন্দিরটা আধ ঘন্টার পথ। আমরা যখন এলাম সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। কোথাও কোনো শব্দ নেই, শুধু শুকনো পাতা মাড়িয়ে আমাদের পায়ে চলার খস খস শব্দ ছাড়া।

সাবধানে কাঁটা ঝোঁপ থেকে গা বাঁচিয়ে আমরা মন্দিরের বাইরের ঘরগুলোর কাছে গোলাম। দূর থেকে মনে হয়েছিলো ধসে পড়া ইটের স্তূপ বুঝি কাছে গিয়ে দেখি এক সারিতে ছটা ঘর। দুটো একেবারে ছাদসুদ্ধো ধসে পড়েছে, দুটোর দরজা জানালা নেই কিন্তু ছাদ আছে। অবাক হয়ে দেখলাম বাকি দুটো ঘরের অবস্থা শুধু ভালোই নয়, একটা ঘর রীতিমতো তালা দিয়ে বন্ধ করা, যদিও তালাটা অনেক পুরোনো, মর্চে পড়া। অন্যটার দরজা খোলা। ভেতরটা বেশ অন্ধকার। ওটার ভেতরে ঢুকতেই সঁতসেঁতে ভ্যাপসা গন্ধ নাকে ধাক্কা মারলো।

কয়েকবার বাতাসে নাক কে বললাম, ঘোড়ার গায়ের গন্ধ পাচ্ছি।

শওকত পকেট থেকে দেয়াশলাই বের করে জ্বালালো। মেঝের ওপর ঘোড়ার নাদি ছাড়ানো। একটু হলেই শিবলী প্রায় পা দিয়ে ফেলেছিলো। লক্ষ্য করে দেখলাম খুব বেশি হলে দুদিনের বাসি হবে।

বললাম, নিখোঁজ ঘোড়ার হদিস তাহলে পাওয়া গেলো।

শওকত হেসে বললো, ঘোড়ার হদিস কোথায় পেলি? পেয়েছিস তা ঘোড়ার নাদি।

শিবলী বললো, আমাদের রহস্যভেদী রান্টু এই নাদি দিয়েই নিখোঁজ ঘোড়ার রহস্য ভেদ করবে।

ইয়ার্কি মারছিস কেন? হেসে শিবলীকে বললাম, তুই না বলেছিলি তোর জানামতে ওগুলো পক্ষিরাজ ঘোড়া ছিলো না। এখানে এসব এলো কী করে?

শিবলী বললো, তুই তাহলে ধরেই নিয়েছিস এগুলো ইরফান ভাইদের ঘোড়ার নাদি। আমি শার্লক হোমসেরও কোনো গল্পে পড়িনি নাদি দেখে ঘোড়া চেনা যায়। নাল দেখে বললে না হয় বুঝতাম।

শুধু নাদি দেখে কেন, তার সঙ্গে মাথাও ঘামাতে হয় যে। এ গ্রামে ঘোড়া আসার কোনো কারণই থাকতে পারে না। সুটিং কোম্পানির ঘোড়া চুরি গেছে। যেখানে সাধারণত মানুষের যাওয়া-আসা নেই গ্রামের এমন একটা জায়গায় পাওয়া গেলো ঘোড়ার নাদি। হিসেব খুব সোজা। এখানে এনে ওগুলো রাখা হয়েছিলো।

আর খুঁজে বের করার আগেই ওগুলো পাচার করে ফেলেছে। কথাটা শেষ করলো শিবলী।

ঠিক ধরেছিস। অন্তত দুদিন আগে পাচার করেছে। এখন খুঁজতে হবে পায়ের ছাপ। আমাদের দেখতে হবে ওগুলো কোথায় গেছে। বলতে বলতে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।

শওকত বললো, এসব জায়গায় পায়ের ছাপ কোথায় পাচ্ছিস? শুকনো পাতার ওপর দিয়ে হেঁটে গেছে। বাতাসে পাতা উড়িয়ে নিয়ে নিশানা মুছে দিয়েছে। এতে আর মরুভূমি কি কাদামাটি নয় যে পায়ের ছাপ দেখে চোর ধরবো।

কথাটা মিথ্যে বলেনি শওকত। মন্দিরের চাতালে আর যেদিক দিয়ে যেতে পারে বলে অনুমান করলাম কোথাও ঘোড়র পায়ের ছাপ, নাদি কিম্বা গাছের গুঁড়িতে আটকে থাকা লোম কিছুই খুঁজে পেলাম না। গোটা মন্দির আর আশেপেশের বর্ণনা কয়েক পৃষ্ঠা ধরে দেয়া যাবে, যা কিনা ট্রুপের অন্যাদের নজরে পড়ার কথা নয়।

ফেরার পথে শিবলী বললো, চল, একটু ঘুরে যাই। ওদিকে যে ঘরগুলো আছে ওরা হয়তো কিছু বলতে পারে।

গতকাল যেখানে দাগুবাবুর সঙ্গে দেখা হয়েছিলো রাস্তার সেই বাঁক থেকে একশ গজের মতো পুব দিকে একটা বড় ভিটে নজরে পড়লো। গোটা তিনেক ঘর। মাটির দেয়াল, ওপরে টিন। পুরোদস্তুর ইউনিফর্ম পরা লাঠি হাতে আমরা তিন স্কাউট সেখানে গিয়ে বাইরে থেকে ডাকলাম, বাড়িতে কেউ আছেন?

দুবার ডাকতেই ইজের পরা নিমা গায়ে সাত-আট বছরের একটা মেয়ে বেরিয়ে এলো। আমাদের দেখে হকচকিয়ে ভয় পাওয়া গলায় ডাকলো, অ মাসি, জলদি আহ। পুলিশ আইছে।

ভেতর থেকে খনখনে গলায় ওর মাসি বললো, ক্যা, পুলিশ আইছে ক্যা? ক, কত্তা বাড়ি নাই।

শওকত তাড়াতাড়ি মেয়েটাকে বললো, আমরা পুলিশ না। স্কুলে পড়ি। তোমার মাসিকে বলো, ভয় পাওয়ার কিছু নেই।

মেয়েটা আগের মতো চেঁচিয়ে বললো, মাসি পুলিশগুলা কয় হ্যারা বলে ইস্কুলে পড়ে। তুমি আহ না।

ভেতর থেকে আধময়লা থান পরা গোবর মাখা হাতে একজন মহিলা বেরিয়ে এলো। আমাদের ভালো করে দেখে বললো, হ, পুলিশের কাপড় পিন্দনে ইশকুলের ছাত্র মনে অয়। তোমরা ক্যাঠা, সিনিমায় পাট করতে আইছ নিহি?

আমি বললাম, আমরা স্কাউট। আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে এসেছি। কি কাউট কইলা? মহিলা ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করলো।

স্কাউট। মানে মানুষের উপকার করি, বিপদে-আপদে সাহায্য করি। বাড়িতে পুরুষ মানুষ কেউ নেই?

আমাগো কোনো বিপদ অয় নাই। পুরুষ মাইনষেরা কামে গ্যাছে। হ্যগরে দিয়া কী ওইবো?

আমি বললাম, আপনাদের বাড়ির উত্তর পশ্চিম দিকে একটা পুরোনো মন্দির দেখলাম। ওখানে কি পূজো টুজো হয়?

ওমা, কয় কি! ওইহানে পূজা দিবো ক্যাঠা? ওইডা তো আছিল শ্মশানকালীর মন্দির। আমাগো বাপ ঠাকুদ্দার আমলেও ওইহানে পূজা দিছে বইলা হুনি নাই।

লোকজনও কেউ যায় না মাসি?

ক্যাঠায় যাইবো! আমাগো ঠাকুরের জোয়ান পোলাডা একবার ঘুরতে গিয়ে কী দ্যাখল ভগমান জানে, মুহে রক্ত উইঠা মইরা গেল গা এক রাইতের মইদ্যে। না বাবারা, ওইহানে কেউ যায় না।

শওকত কোনও কথা না বলে যেন সব বুঝে গেছে এইভাবে মাথা নাড়লো।

মাসি বললো, তোমরা ভিতরে গিয়া বহ না। এইহানে উঠছ কই?

হালুটিয়ার জমিদার বাড়িতে। বলে কী প্রতিক্রিয়া হয় দেখার জন্য মাসির মুখের দিকে তাকালাম।

ভয় পাওয়া গলায় মাসি বললো, কও কী তোমরা? হেইডাও তো ভূতুইড়া বাড়ি!

আপনারা কেউ সেখানে ভূত দেখেছেন?

আমরা দেহুম কোই! মাইনষে কয়, হুনি।

শওকত বললো, এবার ফেরা যাক। তিনটা কুড়ি বাজে!

তোমরা কি উবগার করতে চাইছিলা! আমদের দুগা নিমপাতা পাইরা দিবা?

নিশ্চয়ই দেবো। আমরা খুশি হয়ে সামনের বড় নিমগাছটায় উঠে মাসিকে পাতা পেড়ে দিলাম। মাসিও খুশি হয়ে বললো, তোমরা কাউটরা বড় ভালা!

মন্দির সম্পর্কে আমরা যা ভেবেছিলাম তার কিছুটা সমর্থন পাওয়া গেলো মাসির কথায়। মন্দিরে গ্রামের সাধারণ লোকজন যায় না। আরেকটা খবর জানা গেলো, জমিদার বাড়ির ভূতের খবর গ্রামের লোকেরাও রাখে। ভারি কৌতূহল হলো–জমিদার বাড়ির ভেতরটা যদি দেখতে পেতাম!

কিছুক্ষণের মধ্যেই সুযোগ পেয়ে গেলাম। জমিদার বাড়ির সিংদরজা দিয়ে ঢুকতেই কানে এলো হুইসেলের একটা পিপ-পিপ শব্দ; যার অর্থ হচ্ছে লাইনে এসে দাঁড়াও। বোঝা গেলো নিকোলাস স্যার নতুন কোনো খেলার কথা ভেবেছেন।

আমরা বেশ পা চালিয়ে এসেছিলাম। তখনো চারটা বাজেনি। তিনজন দৌড় লাগালাম তাঁবুর মাঠে। দেখি জঙ্গলে ভরা বাগানের ভেতর থেকে ছেলেদের অনেকে দৌড়ে আসছে। পেট্রল অনুযায়ী লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম। সামনে হুইসেল হাতে টুপ লিডার, পাশে নিকোলাস স্যার। এ পাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে সবাইকে দেখলেন তিনি। মুখে মৃদু হাসি, যেমনটি সব সময় থাকে। বললেন, তোমরা জানো আমাদের ক্যাম্পিং-এর বড় একটা ট্রেনিং হচ্ছে অবজার্ভেশন। টেণ্ডারফুট আর সেকেন্ড ক্লাস যারা–আশা করি এর ভেতর জেনে গেছো অবজার্ভেশন কিভাবে করতে হয়। আজ একটা খেলা হবে। আমাদের তিনদিকে যে বাগানটা দেখছো এর বয়স একশ বছরের বেশি। গত পঁচিশ-তিরিশ বছরে কোন যত্ন নেয়া হয়নি। অনেক গাছ মরে গেছে, অনেক জংলী গাছ আর ঝোঁপঝাড় গজিয়েছে। তোমরা এই বাগানটা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করবে। কী কী গাছ আছে পাতাসহ নোট করবে। অনেক রকম পাখির ডাক শুনতে পাচ্ছো। কী কী পাখি আছে, নাম আর বর্ণনা লিখবে। তাছাড়া আরেক ধরনের পর্যবেক্ষণ করবে। বাগানে থাকা উচিত নয় অথচ আছে এমন কোনো জিনিস দেখলে তোমরা নোট করবে, যদি আনা সম্ভব হয় সঙ্গে করে নিয়ে আসবে। একটু থেমে হাসি মুখে আবার বললেন, কী, খটকা লাগছে বুঝি! ধরো একটা জামার বোতাম কুড়িয়ে পেলে, কিম্বা সিগারেট বা বিড়ির টুকরো, কাপড়ের সুতো, জুতোর পেরেক অর্থাৎ মানুষের উপস্থিতি বোঝা যায় এমন কিছু যদি নজরে পড়ে সংগ্রহ করবে। পুকুরটাকে সেন্টার করে যদি পারো নোট করবে কোন দিকে, কত দূরে জিনিসটা পেলে। মনে হয় টেণ্ডারফুটরা এতোটা পারবে। তবু চেষ্টা করো। যে বেশি আইটেম নোট করবে সে ফার্স্ট হবে। কারো প্রশ্নে আছে?

টেণ্ডারফুট বান্টি বললে, আমাদের পেট্রল লিডাররা সঙ্গে থাকবে তো?

মৃদু হেসে নিকোলাস স্যার বললেন, এটা তোমাদের খেলা। পেট্রল লিডারদের সঙ্গে আমার অন্য কাজ আছে। তোমাদের ভেতর উলফ পেট্রলের রান্টু আর প্যান্থার পেট্রলের শিবলীকে আমি অন্য একটা অবজার্ভেশনের কাজ দেবো। ওরা ছাড়া বাকি সবাই খেলা শুরু করে দাও। এক ঘন্টা সময়।

নিকোলাস স্যারের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ট্রুপ লিডার পর পর চারবার পি-ই-ইপ, পি-ই-প করে টানা হুইসেল বাজালো; যার অর্থ–ছড়িয়ে পড়ো, এগিয়ে যাও।

নতুন ধরনের খেলা পেয়ে সবাই আহ্লাদে আটখানা হয়ে ছুটলো নিজেদের তাঁবুতে নোট বই আর থলে নেয়ার জন্য। বাগানে খেলার কথা শুনে আমিও দারুণ উৎসাহ বোধ করেছিলাম। এরপর নিকোলাস স্যার আমাদের থাকতে বলায় প্রথমে একটু দমে গিয়েছিলাম, যদিও জানি মন খারাপ হতে পারে এমন কিছু তিনি কখনোই করতে দেবেন না। তবে আমাকে আর শিবলীকে তিনি আলাদা দায়িত্ব দেবেন শুনে নিজেদের বেশ গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো।

বারোজন পেট্রল লিডার, আমরা দুজন এ্যাসিসটেন্ট আর টুপ লিডারকে নিয়ে নিকোলাস স্যার তার তাবুর সামনে বসলেন। কোন রকম ভূমিকা না করেই বললেন, দুপুরে ইরফান বললো, জমিদার বাড়ি থেকে রোজ নাকি দামী জিনিসপত্র চুরি হচ্ছে। ওদের প্রোডাকশনেরও কিছু জিনিস চুরি হয়েছে। শওকত আর শিবলী নিশ্চয়ই জানো ওদের দুটো ঘোড়া চুরি হয়েছে?

শিবলী বললো, রান্টুও জানে। আজ অবজার্ভেশনে গিয়ে আরো কিছু জেনেছি, আমরা।

কী জেনেছো? অবাক হয়ে উত্তেজিত গলায় জানতে চাইলেন নিকোলাস স্যার। ভাঙা মন্দিরের সিঁড়ির নিচে সিগারেটের টুকরো আর পাশের পরিত্যক্ত ঘরে ঘোড়ার নাদি দেখার বিবরণ দিলাম আমি। শওকত বললো, রাতে দেখা ছায়ামূর্তির কথা।

নিকোলাস স্যার এক কথায় শুধু বললেন, চমৎকার।

আমরা ভারি লজ্জা পেলাম। নিকোলাস স্যার এবার গম্ভীর হয়ে বললেন, ইরফানের ধারণা–আমিও সব শুনে ওর সঙ্গে একমত, এগুলো ছিঁচকে চুরি নয়। কোনো অর্গানাইজড গ্যাং এটা করছে। জানো তো পুরনো নবাব বাড়ি আর জমিদার বাড়ির জিনিসপত্র আজকাল ভীষণ চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে। বিদেশীরা কিনে বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। কাল রাতে ইরফানদের দুটো সিংহ চুরি হয়েছে। না, আসল সিংহ নয়, প্লাস্টার অব প্যরিসের বানানো। দেখলে মনে হতে পারে বুঝি শ্বেতপাথরের। তবে আসল যে জিনিস চুরি হয়েছে সেটা হলো নাচঘরের ঝাড়বাতি। ষাটটা বাতি জ্বলানো যায়–এত বড় ঝাড়বাতি। খুবই দামী জিনিস। ইরফান ভীষণ দামে গেছে। এ বাড়িতে সুটিং-এর পারমিশনের জন্যে ওকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। পুলিশে খবর দিলে ওরা প্রথমে ইউনিটের লোকদের সন্দেহ করবে। চাই কি দুএকজনকে হয়তো অযথা ধরে নিয়ে যাবে। যার সোজা মনে হচ্ছে আর স্যুটিং করা চলবে না। আবার চোর ধরতে না পারলে চুরির দায়টা ওদের ওপরই আসবে।

এইটুকু বলে নিকোলাস স্যার থামলেন। আমাদের সবার মুখের ওপর একবার চোখ বুলিয়ে বললেন, ইরফান আমাদের সাহায্য চেয়েছে। আমি ওকে কথা দিয়েছি আমাদের পক্ষে যতটুকু সাহায্য করা সম্ভব আমরা করবো। তবে আমি চাই না গোটা টুপ এসব কথা জানুক। আমার ধারণা চোর আশে পাশেই আছে। ট্রপের সবাই জেনে গেলে চোররা সেটা বুঝে ফেলবে। আগে থেকে আমি চোরদের সাবধান করতে চাই না। রান্টু আর শিবলী, অবজার্ভেশন ট্রেনিং নিচ্ছো–এমনভাবে গোটা জমিদার বাড়িটা দুজনে মিলে ঘুরে দেখবে। পেট্রল লিডাররা বাইরে অবজার্ভেশন গেম নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। যাতে বাইরের লোকের নজর তোমাদের দিকে থাকে। আমি ক্যাম্প থেকে অবজার্ভ করবো। আমাদের ছেলেরা ফিরে এলে জানতে পারবো বাগানের ভেতরে সন্দেহজনক কিছু আছে। কি-না। তোমরা কাজ শুরু করে দাও। শিবলীরা আগে ইরফানের পারমিশন নিও। ওকে নিচের বারান্দায় পাবে।

আমি আর শিবলী নিকোলাস স্যারের কথা মতো বেরিয়ে পড়লাম। দুজনই মহা উত্তেজিত। শিবলী বললো, রাতে যে আলো দেখা গেছে ওটা নিশ্চয়ই চোরদের কোনো সংকেত ছিলো।

হতে পারে।

আমি ভাবছিলাম অন্য কথা। চোর যদি ইরফান ভাইদের ইউনিটের বাইরের কেউ হয় তাহলে ঘোড়া চুরি করলো কিভাবে? আর যদি ভেতরের কেউ হয় প্লাস্টরের সিংহ চুরি করে কী করবে? ইউনিটের লোকদের তো জানার কথা ওটার দাম খুব বেশি হলে শখানেক টাকা হবে। আবার ইউনিটের নাকের ডগা দিয়ে বাইরে থেকে চোর এসে ঝাড়বাতি চুরি করবে এটাও তো অসস মনে হয়। সব কিছু ভারি গোলমেলে মনে হলো।

ঝুল বারান্দার নিচে ইরফান ভাই একা বসেছিলেন। শিবলী বললো, স্যুটিং প্যাক আপ হয়ে গেছে।

মানে?

মানে আজ আর স্যুটিং হবে না।

ইরফান ভাই আমাদের দেখে বললেন, এই যে তোমরা। স্যুটিং দেখতে এসেছো বুঝি। আজ তো স্যুটিং হবে না। আমাদের নায়কের মাথা ধরেছে।

শিবলী বললো, আমাদের অবজার্ভেশন টেস্ট হচ্ছে। আমরা দুজন জমিদার বাড়ির ভেতরটা একটু দেখবো।

ইরফান ভাই মুখ টিপে হাসলেন–নিকোলাস তো চমৎকার বুদ্ধি বের করেছে। ঠিক আছে তোমরা ঘুরে দেখো। আমি ইউনিটের একটা ছেলেকে সঙ্গে দিচ্ছি। কয়েকটা ঘরে যাওয়া বারণ আছে। ও বলতে পারবে। এই বলে তিনি গলা তুলে ডাকলেন, পিচ্চি।

আইতাছি। সরু গলায় সাড়া দিয়ে আমাদের বয়সী একটা ছেলে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো।

ইরফান ভাই বললেন, এরা আমার ছোট ভাই। বাড়ির ভেতরটা দেখবে। সঙ্গে যা।

আহেন আমার লগে। একগাল হেসে পিচ্চি আমাদের পথ দেখিয়ে বাড়ির ভেতর নিয়ে গেলো।

একতলা থেকে দেখা শুরু করলাম আমরা। পিচ্চি বললো, নিচের তলায় গর ওইচে সতেরোটা আর উপরের তলায় তেরটা।

ওপরে ঘর কম কেন? আমি জানতে চাইলাম।

উপরে নাচগর আচে। ওইটা নিচের চাইর পাঁচ গরের সোমান ওইবো।

নিচের তলায় গেস্ট রুম, ড্রইং রুম, বিলিয়ার্ড রুম, ডাইনিং রুম, এন্টিক রুম, রান্নাঘর এইসব। গেস্ট রুমগুলোতে ইরফান ভাইদের উইনিটের লোকজনরা সব রয়েছে। এন্টিক রুমটা তালা বন্ধ। ঘরগুলো বেশ পরিপাটি করে সাজানো। কোনো কোনো আসবাবের গায়ে হালকা ধূলোর প্রলেপ থাকলেও এত বছরের পুরনো জিনিসপত্র অক্ষত রাখার কৃতিত্বটা কেয়ার টেকারদের দেয়া উচিত।

নোট বইতে প্রত্যেকটা ঘরের আসবাবপত্র কোনটা কোথায় নোটের সঙ্গে ডায়গ্রামও এঁকে নিচ্ছিলো শিবলী। আমি পিচ্চিকে জিজ্ঞেস করলাম, ওপরে ইউনিটের কেউ থাকে না?

না। মাথা নাড়লো পিচ্চি। তয় স্যুটিং অয় উপরে। হিরো, হিরোইনদের লয়া চাইর দিন স্যুটিং ওইচে উপরে। কাইল বি ওইচিলো।

কাল কতক্ষণ স্যুটিং হয়েছিলো? জানতে চাইলাম আমি।

বিয়ানের নয়টায় সুরু ওইচে, স্যাস ওইচে রাইত নয়টায়। সাড়ে নয়টায় প্যাকাপ কইরা সবতে নিচে গেছি।

নিচের তলায় গেস্টরুমগুলো ছাড়া অন্য সবগুলো ঘর দেখে আমরা দোতলায় উঠলাম। সিঁড়িগুলো দেখার মতো, সেগুন কাঠের, রোলিং-এ আঙুরলতার নকশা কাটা। দোতলার উঠতেই দাগুবাবুর সঙ্গে দেখা-হাতে এক গোছা চাবি, নিচে নামবে আমাদের দেখে মুহূর্তের জন্য তার কপালে ভাঁজ পড়লো–কী ব্যাপার, তোমরা?

বললাম, আজ আমাদের অবজার্ভেশন পরীক্ষা। আমাদের দুজনের দায়িত্ব হচ্ছে। জমিদার বাড়ির ওপর একটা নোট লেখা।

তা বেশ তো! কাষ্ঠ দাগুবাবু বললো, তবে দেখার মতো তেমন কিছু নেই। আজ তো সন্ধ্যেও প্রায় হয়ে এলো। আজ স্যুটিং প্যাক আপ বলে ডায়নামোও বন্ধ করে দিয়েছি। ওপরে আলোর পাবে না। তোমরা বরং কাল এসো।

আমরা একঝলক দেখেই চলে আসবো।

আমার কথা শুনে দাগুবাবু কিছুটা আশ্বস্ত হলো–দেরি করো না, জানোই তো বাড়িটার অনেক দুর্নাম। দিনে এলে ভালো করতে। এই বলে দাগুবাবু নিচে নেমে গেলো।

সূর্য তখন প্রায় ডুবে যাওয়ার পথে। পাখিরা সব ঘরে ফিরছে পশ্চিম দিকে বড় গাছপালা না থাকতে শেষ বিকেলের কমলা রঙের রোদ টানা বারান্দা পেরিয়ে বড় হলঘরটায় এসে শুয়ে আছে। বারান্দার পাশে মস্ত লম্বা হলঘর। মেঝে পুরু সেগুন কাঠের। পিচ্চি বললো, এইটা ওইচে নাচের গর। ওই দিকের গরে যাইবার পারবেন না। তালা দিয়া রাখছে। আমাগোরে খালি দুইটা গর দিচে স্যুটিং করবার লাইগা। হেই দুইটাও দাগুবাবু তালা দিয়া দিচে। একটু থেমে পিচ্চি আবার বললো, এই নাচের গরের জাড়বাত্তিটা ক্যাঠায় জানি চুরি কইরা লয়া গেছে। কি সোন্দর বাত্তি আচিলো। আমরা একদিন জ্বালাইছিলাম।

ছাদ বেশ উঁচুতে। ঝাড়বাতি খুলতে হলে মই দিয়ে উঠতে হবে। পিচ্চিকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের ইউনিটের কি মই আছে?

মই কারে কয়? অবাক হয়ে জানেত চাইলো পিচ্চি।

মই মানে সিঁড়ির মতো, বাঁশ নয় তো কাঠ দিয়ে বানায়, বেয়ে ওপরে ওঠা যায়।

অ বুজচি, চঙ্গ! আপনে চঙ্গের কতা জিগাইতাচেন? চঙ্গ থাকবো না ক্যান? দুইখান চঙ্গ আচে আমাগো। লাইট-উইট ফিট করন লাগে ত!

শিবলী বললো, একবার ছাদে উঠলে হয় না?

পিচ্চি বললো, লন, যাই।

পিচ্চিকে অনুসরণ করে আমরা ছাদে উঠলাম। মস্ত বড় ছাদ। ফুটবল খেলার মাঠের মতো। চারপাশে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। মাত্র সিকি মাইল দক্ষিণে

অবাক হয়ে গেলাম মাত্র ৫ মাই, বুড়িগঙ্গা নদী। আমাদের তাঁবুর দক্ষিণের গাছপালা নদীর তীর পর্যন্ত ছড়ানো। আমি পুবদিকে মন্দিরটা দেখার চেষ্টা করলাম। গাছপালার জন্য দেখা গেলো না। ওপর থেকে আমাদের তাঁবুগুলো ভারি সুন্দর দেখাচ্ছিলো।

অবজার্ভেশন করে শেষে ছেলেরা আসতে শুরু করেছে। আরিফকে নিয়ে নিকোলাস স্যার মাঠে বসে আছেন। সূর্য আরো নেমে গেছে। নিচে গাছের তলায় ছায়া ছায়া অন্ধকার।

হঠাৎ হু হু করে এক ঝলক দমকা বাতাস উঠে এলো নদীর থেকে। গায়ে কাঁপন ধরিয়ে বসে গেলো। চিলেকোঠার দরজার কপাট দুটো জোরে বাড়ি খেলো। পিচ্চি বললো, সাইজার কারে এ সব জায়গায় থাকন ঠিক না। হুনচেন ত দাগুবাবু কী কইছে?

মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে শিবলীকে বললাম, চল ফিরে যাই।

এক মিনিট। বলে শিবলী ছাদ দেখে পুরো বাড়িটার একটা নক্সা এঁকে ফেললো দ্রুত হাতে।

আমি বললাম চারপাশের পাচিল, দক্ষিণের নদী আর পূর্ব দিকের মন্দিরটা ম্যাপে দেখাতে হবে। ভালো করে মনে গেঁথে নাও।

আরেক বার চারদিকে চোখ বুলিয়ে আমরা নিচে নেমে এলাম। পিচ্চি চিলেকোঠার দরজা বন্ধ করতেই সব অন্ধকার হয়ে গেলো। পকেট থেকে ও দিয়াশলাই বের করে জ্বালালো। বললল, নামবার পারবেন ত ঠিক মতন, না ধরণ লাগবো?

শিবলী বললো, লাগবে না। তুমি আগে নামো।

পর পর কয়েকটা কাঠি জ্বেলে পিচ্চি আগে নামলো। আমরা কোনও কথা না বলে ওকে অনুসরণ করলাম। সারা বাড়ি তখন থম থম করছে,–কোথাও এতটুকু আলো বা শব্দ নেই। শেষ কয়েক ধাপ নামার বাকি হঠাৎ দেখি সাঁৎ করে সাদা মতো কি যেন একটা সিঁড়ির নিচের কামরা থেকে ভেতরের দিকে গেলো। পিচ্চি সিঁড়ি দেখে দেখে পা ফেলছিলো বলে দেখতে পায়নি। তবে শিবলী আমার হাত চেপে ধরে মুখের দিকে তাকালো। ওর দু চোখে প্রশ্ন। বুঝলাম আমার মতো জিনিসটা শিবলীও দেখতে পেয়েছে। এক ঝলক দেখাতেই মনে হলো সাদা কাপড়ে মোড় একটা মানুষ, যেন কাফন পরানো লাশ।

পিচ্চি যখন শেষ সিঁড়িতে পা রাখলো–বললাম, এদিকের ঘরটা একটু দেখবো। তুমি দেয়াশলাইর আলোটা এদিকে ধরো।

পিচ্চি অবাক হয়ে বললো, ওইদিকে তো মালখানা, তালাবন্ধ, গরে যাইবার পারবেন না। শিবলীর গলার জোর ছিলো। পিচ্চি কথা না বাড়িয়ে সেদিকে আলো ধরলো। সরু একা প্যাসেজের মতো চলে গেছে মালখানা অর্থাৎ এন্টিক রুমের দিকে। প্যাসেজের দুপাশে দুটো ঘর, দুটোতেই তালা দেয়া। হঠাৎ ধুপ করে মাটিতে তাল পড়ার মতো একটা শব্দ হতেই কোত্থেকে একটা কালো বেড়াল কা–ও–বলে আমাদের পাশ দিয়ে ছুটে গেলো।

পিচ্চি কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, আমি আর যাইবার পারুম না। আপনেরা ফিরা চলেন।

শিবলী বললো, ওখানে কিসের যেন শব্দ শুনলাম!

পিচ্চি একটা কাঠি জ্বালিয়ে বললো, রাইতের কালে ওইরকম বহুত আওয়াজ আমরা বি হুনচি, আপনেরা চলেন, আমার ডর–

পিচ্চির কথা শেষ না হতেই দোতলায় একটা শব্দ হলো। মনে হলো কেউ ভারি কোন জিনিস টানছে। পিচ্চি ভয় পেয়ে পিছিয়ে এসে আমার হাত ধরলো।

ওকে নিয়ে আর এগুনো যাবে না দেখে আমরা ওর পেছন পেছন ঝুল বারান্দার নিচে এলাম। বাইরে তখনো গোধূলির আলো। ইরফান ভাইর কাছে আমাদের রেখে পিচ্চি চলে গেলো।

কী, সব দেখা হলো? জানতে চাইলেন ইরফান ভাই।

শিবলী বললো, সিঁড়ির কামরার পাশে কিসের যেন শব্দ শুনলাম। পিচ্চিকে বললাম, ওদিকেটা দেখবো, ও রাজি হলো না।

ইরফান ভাই কাষ্ঠ হেসে বললেন, এ বাড়িতে অদ্ভুত সব শব্দ ইউনিটের সবাই শুনেছে। আমিও শুনেছি। কখনো ঘুঙুরের শব্দ, কখনো কান্নার শব্দ, কখনো দোতলায় কাঠের মেঝেতে হাঁটার শব্দ–গিয়ে দেখেছি, কেউ কোথাও নেই। আমরা ছাড়াও এখানে এমন কেউ আছে যাদের চোখে দেখা যায় না।

আমি একটু দমে গিয়ে বললাম, আপনিও কি বিশ্বাস করেন এ বাড়িতে জমিদারদের অতৃপ্ত আত্মারা ঘুরে বেড়াচ্ছে?

আগে করতাম না। প্রথম প্রথম ইউনিটের লোকেরা যখন বলেছে তখনও করিনি। পরে নিজের কানে শুনেছি। সাদা ছায়ামূর্তি হেঁটে গিয়ে বাতাসে মিলিয়ে যেতে দেখেছি। অনেক টাকার ক্ষতি হবে বলে এখনো সুটিং চালিয়ে যাচ্ছি। নইলে অনেক আগেই চলে যেতাম।

আমি বললাম, খারাপ লোকেরা ভয় দেখাবার জন্যেও তো এসব করতে পারে।

নিকোলাস তাই বলেছিলো বটে। আমি যদুর বুঝেছি চুরির সঙ্গে এসবের কোনো সম্পর্ক নেই। চুরি তো আমরা থাকতেও হচ্ছে। বরং চোরদের সুবিধে হয়েছে চুরির দায় আমাদের ওপর পড়বে বলে। আমাদের তাড়িয়ে চোরদের কী লাভ বলো! আমরা তো জমিদার বাড়ির জিনিস পাহারা দিতে আসিনি। খারাপ লাগছে ঘোড়া দুটোর জন্য। পাই পাই করে ক্ষতিপূরণ আদায় করবে ঘোড়াওয়ালা।

শিবলী বললো, সন্ধ্যে হয়ে গেছে, আমরা এখন যাই ইরফান ভাই।

তাঁবুতে ফেরার পথে ইরফান ভাইর কথাগুলো ভাবছিলাম। তাঁর কথায় যুক্তি আছে। চোররা কেন তাদের ভয় দেখাতে যাবে, যখন স্যুটিং কোম্পানি থাকাতে ওদের চুরির সুবিধে হচ্ছে? তবে কি শুভদারঞ্জন স্যারের কথাই সত্যি? বিশাল নির্জন জমিদার বাড়িটাকে দেখে মনে হয় হতেও পারে। কে না জানে আগেকার দিনের জমিদাররা কী রকম পাজি আর অত্যাচারী হতো! কত মানুষের অভিশাপ পড়েছে ওদের ওপর। ওদের আত্মা কি এত সহজে মুক্তি পাবে?

.

০৮. মধ্যরাতের নাটক

নিকোলাস স্যারের তাঁবুর কাছে যেতেই বেশ হইচই কানে এলো। বান্টি আর রনির গলা শোনা যাচ্ছিলো বেশি। রনির কি কথার জবাবে বান্টিকে বলতে শুনলাম, বারে, সিগারেটের টুকরোটা তো আমিই প্রথম দেখলাম। তুই কুড়িয়ে নিয়ে ব্যাগে ঢোকালি । ওটার জন্যে তো আমি পয়েন্ট পাবো।

ঠিক আছে, এর জন্যে দুজনেই পয়েন্ট পাবে। এই বলে নিকোলাস স্যার আমাদের দিকে তাকালেন। মুখ টিপে হেসে বললেন, তোমরা দুজন তোমাদের অবজার্ভেশন রিপোর্ট নিয়ে ক্যাম্প ফায়ারের শেষে আমার সঙ্গে বসবে।

ক্যাম্প ফায়ারে আমাদের আইটেম কী হবে আমাকে না পেয়ে এনামুল আগেই ঠিক করে ফেলেছে। তাঁবুতে গিয়ে দেখি গানের মহড়া হচ্ছে। আমাকে দেখে লাজুক হেসে এনামুল বললো, আজ আমরা দুটো গান গাইবো। একটা নিকোলাস স্যারের, একটা আমার।

তুমি আবার কবে গান কম্পোজ করলে এনামুল ভাই? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি।

করেছি। কেমন হয়েছে তাই বলো। সবাই শুরু করো।

কোরাসে সবাই গাইলে, মোদের এই ভাবুর জীবন ভাইরে কতই না মজার। সুরটা নেয়া হয়েছে আমার নাম দয়াল বাইদা থেকে। শুনতে বেশ মজা লাগলো। স্কাউটিং-এর ওপর নিকোলাস স্যার বেশ কিছু গান লিখেছেন। অন্য স্কুলের স্কাউটদের দেখেছি জাম্বুরিতে গিয়ে তাঁর লেখা গান গাইতে। কতদিন আমাদের এসে বলেছে নিকোদার নতুন গানটা লিখে দেবে? সেদিন আমরা গাইলাম ওঁর ক্যাম্প ফায়ারে মোরা মিলি একসাথে–গানটা।

ক্যাম্প ফায়ারে আমাদের গান জমেছিলো এতে কোনও সন্দেহ নেই। এনামুলের গানের সুর গ্রামের লোকদের পরিচিত হওয়াতে ওরা খুব জমা পেলো। তবে জানা কথা নিকোলাস স্যারের গান গেয়েছি বলে তিনি আমাদের কখনোই ফার্স্ট প্রাইজ দেবেন না। ক্যাম্প ফায়ারের শেষে ব্রাদার ফিলিপ্স পর্যন্ত বললেন, তমাগো গান আমার বেশি পসন্দ ওইসে। জোসেফরা কী শক্ত গান গাইয়া ফার্স্ট ওইলো–আমি বুঝতে পারলাম না।

আমি হেসে ব্রাদারকে ধন্যবাদ দিলাম। জোসেফরা গেয়েছিলো দুর্গম গিরি। সঙ্গে গ্রুপ ড্যান্সও ছিলো।

ক্যাম্প ফায়ার শেষ করে ব্রাদার ফিলিন্স স্কুলে চলে গেলেন তাঁর হোণ্ডায় করে। পরদিন সকালে নাকি জরুরি কাজ আছে। বলে গেলেন একবারে গ্র্যান্ড ক্যাম্প ফায়ারে আসবেন। ছেলেরা সবাই তাঁবুতে ফিরে যখন ঘুমোবার আয়োজনে ব্যস্ত–এনামুল এসে বললো, রান্টু, তোমাকে নিকোলাস ডাকছেন।

এই ডাকের অপেক্ষাতেই ছিলাম। স্যারের তাঁবুতে গিয়ে দেখি সেখানে শিবলী, জোসেফ আর আরিফ বসে। আমি শিবলীর পাশে গিয়ে বসলাম। স্যার বললেন, রান্টু, তোমার অবজার্ভেশন রিপোর্ট শুরু করে। কিছু মিস করলে শিবলী ধরিয়ে দিও।

ইরফান ভাইর সঙ্গে দেখা করে পিচ্চির সঙ্গে জমিদার বাড়িতে ঢোকার পর থেকে যা যা দেখেছি একের পর এক সব বললাম। দোতলার সিঁড়িতে আমাদের দেখে দাগুবাবুর কপালে যে কয়েক সেকেন্ডের জন্য ভাজ পড়েছিলো সে কথাও বললাম। পিচ্চির সঙ্গে কী কী কথা হয়েছে তাও বললাম। শেষ করলাম ইরফান ভাইর কথা দিয়ে।

আমার কথা শুনে নিকোলাস স্যারের মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো। কিছুক্ষণ কী যেন ভাবলেন। তারপর আপন মনে বললেন, ইরফানও তাহলে মনে করে জমিদার বাড়িতে ভূত আছে!

শিবলী ঢোক গিলে বললো, মনে করার কারণও আছে।

নিকোলাস স্যার শিবলীর আঁকা নকশাগুলো ভালো করে দেখলেন। সিঁড়ির ঘরে গুণ চিহ্ন দিলেন। কপালে ভাঁজ পড়লো তাঁর।

শেষ ডিসেম্বরের সেই রাতে হালুটিয়ার জমিদার বাড়ির মাঠে নিকোলাস স্যারের তাঁবুর ভেতর মিটমিটে একটা হারিকেনের চারপাশে আমরা কজন বসে। স্যারের ছেলেরা সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। চারপাশের বাগানের একশ বছরের পুরানো গাছগুলো কাঁপিয়ে নদী থেকে উঠে আসা ঠাণ্ডা বাতাস বয়ে যাচ্ছে। বাতাসের হা হা শব্দ ছাড়া কোথাও কোন শব্দ নেই। আমরা কেউ জানি না জমিদার বাড়ির ভেতর কী ভয়ঙ্কর সব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, কিংবা কারা ঘটাচ্ছে এইসব।

নিকোলাস স্যার বললেন, ভূতের কথা এখন থাক। গত কদিন ধরে জমিদার বাড়িতে যে চুরি হচ্ছে সে বিষয়ে আমরা আলোচনা করতে পারি। আমাদের ছেলেরা আজ বাগানে অবজার্ভেশনে গিয়ে সেখানে মানুষের উপস্থিতির প্রমাণ পেয়েছে। যা যা বলেছিলাম সবই পেয়েছে ওরা। বিড়ি আর সিগারেটের টুকরো, গাছের পাতায় পানের পিকের দাগ, ছেঁড়া বোতাম, একখানা ছেঁড়া রুমাল–কোনও কিছু বাদ নেই। অথচ কেয়ারটেকার জবেদ মুন্সী আমাকে বলেছে ঘরদোর সামলে রাখতে গিয়েই ওরা নাকি হিমসিম খাচ্ছে, বাগানের ধারে কাছে যাবার সময় নেই ওদের। তার মানে ওরা জানে না বাগানে যে লোকজন ঘোরফেরা করে, কিংবা ওদের সেটা জানা থাকলেও বাইরে কারো কাছে প্রকাশ করতে চায় না।

আমি বললাম আপনি কি কেয়ারটেকারকে সন্দেহ করছেন?

সন্দেহ করার মতো আর কাউকে পাচ্ছি কোথায়? আজ দুপুরে কেয়ারটেকার এসেছিলো ঝাড়াবাতি চুরি যাওয়ার খবর শুনে। আমি যখন পুলিশে খবর দিতে বললাম, ও বললো, পুলিশ এলে সবার আগে স্যুটিং কোম্পানিকে ধরবে। তখন আমিই বলিলাম ঠিক আছে আমরা নিজে আগে খুঁজে দেখি। না পেলে পুলিশে খবর দেয়া যাবে। এ কথা শুনেই ইরফানের চেয়ে বেশি খুশি হল মুন্সী । ও বললো, দাগুবাবু লোকটা নাকি সুবিধের নয়। ওর ওপর নজর রাখা দরকার।

আমি বললাম, ভূতের ব্যাপারে কেয়ারটেকার কী বলে?

নিকোলাস স্যার মৃদু হেসে বললেন, এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই। ও বার বার ইরফানের সাহসের প্রশংসা করছিলো। বলল, লাখ টাকা দিলেও নাকি রাতে এ বাড়িতে থাকবে না। আমি অবশ্য বলেছি, কার দায় পড়েছে আপনাকে লাখ টাকা দিয়ে এ বাড়িতে রাখবে। রান্টু, এ প্রশ্ন কেন করলে?

দাগুবাবুকে সন্দেহ করার কারণ এটা হতে পারে–তিনি সব সময় আগ বাড়িয়ে সবাইকে ভূতের গল্প শোনাচ্ছেন। যাতে এ বাড়ির ধারে কাছে কেউ না আসে। কাউকে সন্দেহজনক ভাবে চলাফেরা করতে দেখলে সবাই যেন ভূত টুত কিছু ভাবে।

আমার কথা শেষ হতেই শিবলী বললো, সন্দেহ করার আরো কারণ আছে। প্রোডাকশন ম্যানেজারদের সঙ্গে সিনেমার জিনিসপত্র যারা সাপ্লাই দেয় তাদের খাতির বেশি থাকে। মেজদার প্রোডাকশন ম্যানেজার একবার স্যুটিং-এর জন্য আমাদের বাড়ি থেকে গ্র্যাণ্ড ফাদার ক্লাকটা নিয়ে পরে বিক্রি করে দিয়েছে। যাকে বিক্রি করেছে সে দুবছর পর মেজদার এক ডিরেক্টার বন্ধুকে ওটা ভাড়া দিতে গিয়ে ধরা পড়েছে। ভেতর থেকে ঘোড়া পাচার করা দাগুবাবুর জন্য খুবই সোজা কাজ। রাতে কেউ দেখলেও ভূতের ভয়ে কাছে আসবে না। ঘোড়া তো যাকে তাকে বিক্রি করা যায় না। যারা সাপ্লাই দেয় তাদের কেউ হয়তো কিনেছে–যদি এর মধ্যে সেগুলো বিক্রি হয়ে থাকে।

নিকোলাস স্যার মাথা নেড়ে সায় জানালেন–চমকার বলেছো। তবে একটা খটকা এখানেও আছে। কমদামী প্লাস্টারের সিংহ দুটো দাগুবাবু কেন চুরি করতে যাবে। বেচতে গেলে ও দুটোর জন্য পঞ্চাশ টাকাও পাওয়া যাবে না।

আমি বললাম, এটা আমার কাছেও খটকা লেগেছে। ও দুটো যে চুরি করেছে সে নিশ্চয়ই জানে না ওগুলো এত কমদামী জিনিস। চোর হয়তো ভেবেছে ওগুলো দামী পাথরের হবে, এ ধরনের জমিদার বাড়িতে যেমনটা দেখা যায়।

তার মানে তুমি বলতে চাইছে চোর বাইরের কেউ?

আমার তাই মনে হয়। আর তাদের আখড়া মনে হয় ভাঙা মন্দিরের পাশের ঘরে।

জোসেফ এতক্ষণ চুপচাপ আমাদের কথা শুনছিলো। বললো, আজ রাতে আমরা এক কাজ করতে পারি। খুব সাবধানে জমিদার বাড়ির ভেতরটা দেখতে পারি। বিশেষ করে ওরা যখন রাতে বেরোয় তখন রাতেই ওদের সঙ্গে বোঝাঁপড়া করা দরকার।

জোসেফের কথা শুনে শিবলী ভয়ে সকলের অগোচরে আমার হাত চেপে ধরলো। নিকোলাস স্যার উৎসাহিত হয়ে বললেন, চমৎকার বলেছে জো। আরিফ কী বলে?

আরিফ একটু আমতা আমতা করে বললো, রাতে এভাবে যাওয়াটা কি উচিৎ হবে? স্যুটিং কোম্পানির কেউ হয়তো ভাবতে পারে আমরা খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে গেছি।

শিবলী বললো, কাল দিনে গেলে হয় না স্যার, যেভাবে আজ গিয়েছি? দিনে ওরা স্যুটিং নিয়ে ব্যস্ত থাকবে, তখন ঘুরে ফিরে দেখারও সুবিধে হবে।

নিকোলাস স্যার বললেন, আমার মনে হয় রাতেই যাওয়া উচিত। কারণ এ সময় কেউ আমাদের জমিদার বাড়িতে আশা করবে না। আমি ইরফানকে বলেই ঢুকবো। এতে হবে তো আরিফ?

আরিফ কাষ্ঠ হেসে বললো, বলে নিলে যেতে অসুবিধে কী!

নিকোলাস স্যার বললেন, ভেতরে ঢুকবো আমি, রান্টু আর শিবলী। তোমরা দুজন বাইরে একটা আড়ালে বসে বসে ওয়াচ করবে। সন্দেহজনক বা বিপদজনক কিছু দেখলেই হুইসেলে ডেঞ্জার সিগন্যাল দেবে। আমাদের গার্ডদেরও বলে যাবো এ্যালার্ট থাকতে। ভয়ের কিছু নেই শিবলী।

শিবলী ঢোক গিলে, না ভয় কিসের!

সত্যি কথা বলতে কি প্রথমে আমিও ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। পরে নিকোলাস স্যার যখন বললেন তিনি আমাদের সঙ্গে থাকবেন তখন ভয়টয় সব কর্পূরের মতো উবে গোলো। মায়া হলো আরিফের কথা ভেবে। ভেতরে যেতে হবে না শুনে আরিফকেও খুশি মনে হলো।

তাঁবু থেকে বেরিয়ে দেখি ঘন কুয়াশায় ঢাকা পড়েছে সারা মাঠ আর পুকুর। যদিও জমিদার বাড়ির ওপর আধখান হলদেটে চাঁদ আকাশে ঝুলছিলো, তাতে খুব একটা আলো ছিলো না।

আরিফ আর জোসেফকে দুটো থুজা ঝাউ গাছের পাশে বসিয়ে রেখে আমরা তিনজন জমিদার বাড়ির ঝুল বারান্দার থামের পাথে দাঁড়ালাম। কম পাওয়ারের একটা বাল্ব জ্বলতে দেখেছিলাম। প্রথম দিন, আজ সেটাও নেই। না থাকাতে আমাদের জন্য ভালোই হয়েছে। অন্ধকারে গা মিশিয়ে নিকোলাস স্যার ইরফান ভাইর জানালায় টোকা দিয়ে ওঁকে জাগালেন। চাপা গলায় বললেন, দরজা খুলে দিয়ে শুয়ে পড়তে।

নিঃশব্দে ড্রইংরুমের দরজা খুলে দিয়ে ইরফান ভাই নিজের ঘরে চলে গেলেন। নিকোলাস স্যার একটা পেন্সিল টর্চ এনেছিলেন। খুব সামান্য আলো হয় ওতে। একবার জ্বালিয়ে ঘরের জিনিসপত্রের অবস্থান আর দরজাগুলো দেখে নিয়ে ওটা নিভিয়ে ফেলেন। ফিস্ ফিস্ করে বললেন, সিঁড়ির ঘরে চলো।

পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে বেড়ালের মতো নিঃশব্দে হেঁটে আমরা সিঁড়ির ঘরে এলাম। কয়েক সেকেন্ডের জন্য টর্চ জ্বলিয়ে নিকোলাস স্যার সব দেখে নিলেন। আবার ফিস্ ফিস্ করে বললেন, চলো, ওপরটা আগে দেখে আসি।

আগের মতো পা টিপে টিপে আমরা ছাদে এলাম। ছাদের ওপরটা মায়াময় চাঁদের আলো। ফুটফুটে জোৎস্না না হলেও জিনিষপত্র দেখা যায়। নিকোলাস স্যার বললেন, চমৎকার জায়গা তো!

স্যারকে পুব দিকে আঙুল তুলে দেখালাম–মন্দিরটা এখান থেকে মাইল খানেক দূরে হবে।

হঠাৎ মনে হলো সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। আমরা প্রমাদ গুণলাম। এত বড় ছাদে আড়াল হওয়ার কোনো জায়গা নেই। চাপা গলায় নিকোলাস স্যার বললেন, একেবারে রেলিং ঘেঁসে মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ো।

আমরা মুহূর্তের ভেতর তাই করলাম। উপুড় হয়ে শুয়ে আমি চোখের কোণ দিয়ে দেখলাম সাদা কাপড়ে পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঢাকা একটা লোক হারিকেন হাতে ওপরে উঠে এসেছে। একটু পরে দেখি–কি বিপদ, লোকটা যে আমাদের দিকে আসছে। কিছুটা এগিয়ে এসে থমকে দাঁড়ালো লোকটা। ওর মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম না। শুধু দেখলাম দুপা এগিয়ে এসে থমকে দাঁড়িয়েছে কয়েক মুহূর্তের জন্য তারপর দ্রুত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেলো।

আমরা তিনজন ঝটপট উঠে পড়লাম। নিকোলাস স্যার বললেন, এখানে থাকা ঠিক হবে না। লোকটা নিশ্চয়ই এবার দলবল নিয়ে আসবে। চলো ওকে ফলো করি।

লোকটার তখন পেছন আমরাও দ্রুত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এলাম। নামার সময় কাঠের সিঁড়িতে লোকটার পায়ের শব্দে হচ্ছিলো। তবে আমাদের সবার শব্দ না করে হাঁটার প্র্যাকটিস থাকাতে সামনে নেমে যাওয়া লোকটা কিছুই টের পেলো না। পেছন থেকে আমরা দেখলাম, হারিকেন হাতে লোকটা এন্টিক রুমের দিকে গেলো।

আমি ভেবেছিলাম নিচে নেমে নিকোলাস স্যার বুঝি লোকটার পেছনে যাবেন। কিন্তু না, তিনি আমাদের দুজনকে দুহাতে ধরে সিঁড়ির নিচের কোণটাতে ঢুকলেন। বাইরে থেকে কেউ উঁকি না মারলে বুঝতে পারবে না আমরা যে এখানে আছি। কানের কাছে মুখ এনে ফিফিস্ করে বললেন, লোকটা এখনই দলবল নিয়ে ওপরে যাবে।

দুমিনিটের মধ্যে নিকোলাস স্যারের কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেলো। চার পাঁচজন লোক হন্তদন্ত হয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো। সামনের লোকটার হাতে হারিকেন ছিলো। হারিকেনের আবছা আলোত আমরা অবাক হয়ে দেখলাম, ওদের তিনজনের পরনে পা পর্যন্ত ঢাকা সাদা আলখাল্লা, মুখে সাদা কঙ্কালের মুখোশ। দূর থেকে দেখে কেউ জ্যান্ত কঙ্কাল বলে ভুল করবে। আমরা তিনজন দেয়ালের সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে নিঃশ্বাস একরম বন্ধ করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। বাইরে আরিফ বা জোসেফ কল্পনাও করতে পারবে না আমাদের চোখের সামনে কী ঘটছে।

পাঁচ মিনিট পর আবার সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনলাম। বুঝলাম লোকগুলো নেমে আসছে। হারিকেনওয়ালার পেছন পেছন লোকগুলো নেমে যেদিক থেকে এসেছিলো সেদিকেই চলে গেলো। মৃদু ঘর্ঘর শব্দ হলো দু সেকেন্ডের মতো, তারপর সব কিছু আগের মতো নিঃশব্দ।

আমাদের হাত ধরে সিঁড়ির তলা থেকে এলেন নিকোলাস স্যার। এবার তিনি লোকগুলোকে অনুসরণ করতে বেরোলেন। কিন্তু কী আশ্চার্য, করিডোরে রেখে কোথাও ওদের দেখা পেলাম না। যেন মুহূর্তের ভেতর কর্পূর হয়ে উবে গেছে। অন্ধকারে আমারে কারো মুখ দেখা না গেলেও বুঝলাম প্রত্যেকই আমরা হতভম্ব হয়ে গেছি। কয়েক মুহূর্ত কি করবো বুঝতে না পেরে দাঁড়িয়ে রইলাম পাথরের মূর্তির মতো। তারপর নিকোলাস স্যার যখন হাত ধরে সামনে টানলেন তখন এগিয়ে গেলাম এন্টিক রুমটার দিকে। বিকেলেও দেখে গেছি এন্টিক রুমে প্রমাণ সাইজের তালা ঝুলছে। করিডোরের শেষ মাথায় এসে নিকোলাস স্যার এক সেকেন্ডের জন্য পেন্সিল টর্চটা জ্বালালেন। করিডোর এখানেই শেষ। এন্টিক রুমের দরজায় আগের মতো তালা দেয়া।

দুপাশের ঘর দুটোর দরজায় টর্চের আলো ফেলা হলো। সেখানেও তালা ঝুলছে। মনে হলো কয়েক মাস এতে কেউ হাত লাগায়নি। কিন্তু গেলো কোথায় লোকগুলো। মাথা ঘামিয়ে প্রশ্নের হদিস যখন খুঁজে পেলাম না, তখন আবার সেই লোকগুলোই তাদের সন্ধান জানিয়ে দিলো।

চমকে উঠে শুনলাম এন্টিক রুমে মানুষের চাপা কণ্ঠস্বর। কাছে গিয়ে দরজার গায়ে খুব সাবধানে কান পাতলাম। উত্তেজিত একটা কণ্ঠ মেয়েলি গলায় বললো, মাইরি, তোর মতো ভীতুর ডিমকে নিয়ে কাজ করতে হলে আমাদের লাল বাতি জ্বালতে হবে ফেকু।

বারে, আমি নিজের চোখে পষ্ট দেখলাম ছাদের কিনারে তিনটা লাশ পড়ে আছে।

তৃতীয় কণ্ঠ বললো, দ্যাখ ফেকু, আমাদের মুর্গা বানাস নে। লাশের নিশ্চয়ই পাখা গজায়নি–তুই নিচে নামার সঙ্গে সঙ্গে ওগুলো উড়ে পালাবে।

আমতা আমতা করে ফেকু বললো, বারে, ওগুলো যদি জমিদার বাড়ির তেনারা হন– হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে কতক্ষণ!

প্রথম কণ্ঠ টিটকিরি মেরে বললে, বেশ বলেছিস! লোকে আমাদের দেখে ওই সব ভাবে আর আমরা তেনাদের ভয়ে সিটিয়ে আছি। কেন যে তেনারা এখনো তোর ঘাড় মটকায়নি তাই ভাবি।

বারে, আমি বুঝি রোজ পাগলা পীরের দরগায় পাঁচ পয়সা মানত দেই না!

দিস তো বেশ করিস! যা এবার ছাদে গিয়ে দেখ, মাল ঠিক মতো যেতে পারছে কি না।

আমি পারবো না, তোমরা কেউ যাও!

মেয়েলি গলা বললো, বললেই হলো তোমরা যাও? আমাদের বুঝি কোনো কাজকম্ম নেই? তুই যদি–

বলার মাঝখানে আগের মতো মৃদু ঘর্ঘর শব্দ হতেই গলার স্বর আরেক ধাপ নামিয়ে বললল, চুপ, ওস্তাদ আসছে।

একটু পরেই ভারি কফজড়ানো গলা শোনা গেলো–কি রে, তোরা যে এখানে বসে বসে গুলতানি মারছিস-কাজকৰ্ম্ম কিছু নেই?

মেয়েলি গলা মিন মিন করে বললো, আমরা তো কাজেই নেমেছিলাম ওস্তাদ ফেকু এসে বললো, ছাদের ওপর নাকি তিনটে লাশ পড়ে আছে। গিয়ে দেখি কিছুই নেই।

ওস্তাদ বললো, এসব মামদোবাজি কবে থেকে শুরু করেছিস ফেকু? চাবুকটা কি নামাতে হবে।

ফেকু হাউমাউ করে বললো, মাইরি বলছি ওস্তাদ, পাগলা পীরের কিরে—

চোপ! চাপা গলায় ধমক দিলো ওস্তাদ–সিনেমা কোম্পানির লোকজনগুলোর ঘুম না ভাঙিয়ে বুঝি শান্তি পাচ্ছিস না! যা বলার আস্তে বল!

হেঁচকি তুলে ফোঁপাতে ফোঁপাতে ফেকু বললো, পীরের কসম ওস্তাদ, মিথ্যে বললে আমার যেন কুষ্ঠ হয়–পোঙ্কার দেখেছি, ছাদের কিনারে তিনটে লাশ পড়ে ছিলো। দেখে আমি খবর দেবার জন্য নিচে এলাম। পাঞ্জুদা আর নওলাদাকে সঙ্গে নিয়ে আবার গিয়ে দেখি লাশগুলো নেই।

ছেলের লাশ না মেয়ের লাশ? জানতে চাইলো ওস্তাদ।

একটু চুপ থেকে ফেকু বললো, একটা ছেলের দুটো মেয়ের।

বলিস কী! অস্ফুট গলায় বললো ওস্তাদ-মুন্সী একদিন বলেছিলো বটে জমিদার, তার বউ আর নর্তকীটা নাকি ভূত হয়ে এ বাড়িতে ঘুরে বেড়ায়। শুনে আমি পাত্তা দেইনি। বলেছি তোমার গাঁজায় দোক্তা কম পড়েছিলো–কী না কী দেখেছে। মুন্সী তাহলে মিছে কথা বলেনি।

মেয়েলি গলা বললো, সন্ধ্যে থেকে ফেকু কম মাল টেনেছে নাকি! ছাদের ঠাণ্ডা বাতাসে মাথা ঘুরে গিয়ে কি-না কি দেখেছে।

কর্কশ গলায় ওস্তাদ বললো, আজ রাতে তুই তাহলে একা ছাদে ডিউটি দে নওলা! ফেকু তোর কাজ করুক!

আমতা আমতা করে নওলা বললো, না, মানে ওস্তাদ–যদি সত্যি হয়–।

সে কথাই আমি বলছি। চিবিয়ে চিবিয়ে ওস্তাদ বললো, কালই গিয়ে পীরের দরগার হুজুরকে বলবি আমাদের সবার জন্য একটা করে তাবিজ দিতে। তেনারা যদি কোন কারণে আমাদের ওপর অসন্তুষ্ট হন তাহলে কাজের ক্ষতি হবে।

ঠিক আছে ওস্তাদ। ফেকু ঝটপট বললো, আমি কাল ভোরেই হুজুরের কাছে যাবো।

হুজুরকে জিজ্ঞেস করিস মালের স্টক কী রকম আছে। শেষ হলে আরও পাঠাবো। একটু থেমে ওস্তাদ আবার বললো, আর পাঞ্জা শোন। কাল তুই একবার থানায় যাবি। ছোট কত্তাকে বলবি সিনেমা কোম্পানির লোকটাকে ডেকে যেন শাসিয়ে দেয়। ম্যালা ঝামেলা পাকাচ্ছে লোকটা। আমার তো সন্দ হচ্ছে ঝাড়বাতি ওই সরিয়েছে।

পাঞ্জা বললো, এদিকে যে আরেক উৎপাত জুটেছে ওস্তাদ। কোত্থেকে স্কাউট কতগুলো এসে বাড়িতে তাঁবু গেঁড়েছে। হাড়বজ্জাত ছোঁড়াগুলো সারাদিন বাগান চষে বেড়াচ্ছে। কাল আবার দুটোকে দেখলাম মন্দিরের পাশে ঘুরঘুর করে কী যেন খাতায় লিখছে।

ওসব তুই বুঝবি না। ইশকুলের ছায়াও তো মাড়াসনি কস্মিন কালে! চাপা গলায় খিক খিক হেসে ওস্তাদ বললো, ওগুলো কোনো ঝামেলা নয়। আমি মুন্সীর কাছে খবর নিয়েছি। ওদের পরীক্ষা, পাঁচ দিনের জন্য তাঁবু গেড়েছে। পাঁচ দিন পরই চলে যাবে। এ কদিন সাবধানে চলাফেরা করিস। গায়ে পড়ে ওদের নজর কাড়ার কী দরকার। যা, এবার তোরা যে যার কাজে যা। আমি বেরুবো।

এন্টিক রুমের নাটক এতক্ষণে শেষ হলো। আমরা তিন শ্রোতা এতক্ষণ রুদ্ধশ্বাসে ভারি দরজার গায়ে কান পেতে শুনছিলাম সেই নাটক। নিকোলাস স্যার হাত ধরে টানতেই চমক ভাঙলো। তিনজন পা টিপে অন্ধকারে করিডোর দিয়ে সিঁড়ির কামরা পেরিয়ে ড্রইং রুমে ঢুকলাম। এক সেকেন্ডের জন্য একবার টর্চ জ্বালালেন স্যার। বাইরের দরজার ছিটকিনি নিঃশব্দে নামিয়ে তিনজন ঝুল বারান্দার নিচে এলাম।

আন্দাজের ওপর থুজা ঝোঁপের কাছে এসে নিকোলাস স্যার চাপা গলায় ডাকলেন–আরিফ।

জোসেফ আর আরিফ বেরিয়ে এলো আড়াল থেকে। নিকোলাস স্যার ফিস্ ফিস্ করে বললেন, চলো কাজ হয়ে গেছে।

অন্ধকারে নিকোলাস স্যারের তাঁবুতে যাওয়ার পথে আমাদের রাত প্রহরীরা চাপা গলায় জিজ্ঞেস করলো, কোনো বিপদ হয়নি তো?

নিকোলাস স্যার ওদের আশ্বস্ত করে বললেন, না, তোমরা সাবধানে থেকো।

আমাদের কাণ্ডকারখানা দেখে অতি রাশভারি জোসেফও উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। তাঁবুতে গিয়ে বসতেই বললো, সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়লো?

পড়লো মানে? বলল কী পড়েনি! মুখ টিপে হেসে নিকোলাস স্যার আমাকে বললেন, পুরো ঘটনাটা পাঁচ মিনিটে ওদের বলো!

আমার বিবরণ শুনে আরিফ আর জোসেফ দুজনের চোখ ছানাবড়া।

জোসেফ বললো, এখন তাহলে আমরা কী করবো?

সেটা ঠিক করার জন্যই তো বসা। নিকোলাস স্যার গম্ভীর হয়ে বললেন, এন্টিক রুমের নাটক থেকে কী কী সূত্র পাওয়া গেলো সেটা আগে আলোচনা করা যাক। তারপর ঠিক করা যাবে কোন পথে আমরা অগ্রসর হবে। প্রথমে রান্টু বলল, তোমার অবজার্ভেশ কী।

কী বলবো মনে মনে গুছিয়ে নিয়ে আমি বললাম, প্রথমেই আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি জমিদার বাড়িকে ঘাটি বানিয়ে একটা বড় গ্যাং সাংঘাতিক কোন কাজে। ব্যস্ত। দ্বিতীয়ত, সিনেমা কোম্পানির কোনো লোককে এরা থানার কোনো অফিসারকে দিয়ে শায়েস্তা করতে চায়। এ থেকে বোঝা যায় থানার সঙ্গে এই দলের একটা ভালো সম্পর্ক আছে। তৃতীয়ত, পাগলা পীরর মাজারে যে হুজুরটা আছে সেও এদের লোক।

চমৎকার। এক কথায় মন্তব্য করলেন নিকোলাস স্যার। এরপর তিনি শিবলীকে বললেন, তুমি কিছু এর সঙ্গে যোগ করতে চাও?

শিবলী বললো, এন্টিক রুমে তালা দেয়া ছিলো। কিন্তু ওরা তালা না খুলে ভেতরে রসে কথা বলেছে। তার মানে এন্টিকে ঢোকার কোনো গোপন পথ আছে। ওরা কঙ্কালের মুখোশ পরে ঘুরে বেড়ায়, যাতে লোক ওদের জমিদার বাড়ির ভূত মনে করে। আবার নিজেরা ভূতের ভয়ে অস্থির হয়ে তাবিজের কথা বলে। তার মানে লোকগুলো যথেষ্ট সাহসী নয়।

আরিফ বললো, আমি অনেক সাহসী লোককে দেখেছি ভূত বিশ্বাস করে।

আমি বললাম, ওদের তুমি সাহসী বলছো কেন?

সাহস এক জিনিস, বিশ্বাস আরেক জিনিস। যা দেখা যায় না তার বিরুদ্ধে তো লড়াই করা যায় না।

আরিফের যুক্তি আমার পছন্দ হলো না। পাল্টা যুক্তি দিতে যাবো, নিকোলাস স্যার বাধা দিলেন–আমরা মূল বিষয় থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। ভূত আছে, কি নেই এ নিয়ে পরে ডিবেট হতে পারে, এখনকার বিষয় আলাদা। আমাদের অবজার্ভেশনে কিছু ফাঁক আছে। রান্টু বোধহয় লক্ষ্য করোনি ওদের ওস্তাদ কয়েকবার মুন্সীর কথা বলেছে। একি কেয়ারটেকার জবেদ মুন্সী? আমরা তা জানি না। জমিদার বাড়িকে ঘাটি বানিয়ে ওরা কি করছে জানি না। ওরা মাল পাচারের কথা বলেছে। কী মাল, কোথায় পাচার করছে জানি না। সিনেমা কোম্পানির কোন লোককে ওরা শায়েস্তা করতে চায়–জানি না। মানে দাঁড়াচ্ছে আমাদের জানা আর অজানার মাঝখানে বড় একটা ফাঁক রয়ে গেছে।

জোসেফ চিন্তিত গলায় বললো, এই ফাঁক ভরাতে হলে আমাদের আরো অবজার্ভ করতে হবে। জমিদার বাড়ির জিনিস কে চুরি করেছে তার একটা হিন্টস ওরা দিয়েছে। রান্টুরা বলছিলো ওদের প্রোডাকশন ম্যানেজার দাগুবাবু নাকি সন্দেহজনক লোক। ওকে আরো যাচাই করে দেখতে হবে। ওর ওপর নজর রাখতে হবে। স্যুটিং কোম্পানিতে সন্দেজনক আর কেউ আছে কি-না সেটাও দেখতে হবে।

আমি বললাম, ভাঙা মন্দিরের পাশের ঘরটা আর পাগলা পীরের মাজারের ওপরও নজর রাখা দরকার।

চমৎকার বলেছো। নিকোলাস স্যারের মুখে প্রশংসার হাসি–আমরা কাজগুলো কিভাবে করবো এখনই তাহলে ঠিক করে ফেলি।

আমরা মাথা নেড়ে সায় জানালাম। নিকোলাস স্যার বললেন, কাল আমাদের ট্রেনিং পিরিয়ডে রান্টু আর শিবলীর কাজ হবে সিনেমার সুটিং দেখা। ইচ্ছে করলে খেলার সময়টাও ওরা স্যুটিং দেখে কাটাতে পারে।

শিবলী লাজুক হেসে বললো, আর যদি দুপুরে ওদের সঙ্গে খেতে বলেন ইরফান ভাই?

তোমাদের ইচ্ছে। হেসে বললেন নিকোলাস স্যার–আরিফ সিনিয়রদের একটা গ্রুপ নিয়ে মন্দির অবজার্ভেশনে যাবে আর জোসেফ যাবে পীরের মাজারে রুটিন অবজার্ভেশনে। এটা যে ভিন্ন ধরনের অবজার্ভেশন, আমি চাই না আমাদের ছেলেরা বা বাইরের কেউ সেটা টের পাক। কাল ক্যাম্প ফায়ারের পর আবার আমরা মিটিঙে বসবো। এবার তাহলে শুতে যাও সবাই।