০৩-৪. কঠিন পরীক্ষা শুরু

০৩. কঠিন পরীক্ষা শুরু

খুব কম কথার মানুষ জোসেফ। সব সময় কড়া ডিসিপ্লিন মেনে চলে। ওর প্রাণের বন্ধু প্যান্থার পেট্রলের শওকত এত পটালো কোথায় যাওয়া হবে জানবার জন্য–জো মুখ থেকে টু শব্দটি বের করলো না। শওকত বারবার বলছিলো, একটু হিন্টস দে দোস্ত, এত সাসপেন্স-এ রাখিস না, টেনশনের চোটে পেট ফেটে যাবে।

জো গম্ভীর গলায় বললো, তোর লজ্জা করা উচিত শওকত। পেট্রল লিডার হয়ে আমাকে তুই ডিসিপ্লিন ভাঙতে বলছিস।

আহা, ডিসিপ্লিন ভাঙতে কখন বললাম! তুই সব সময় আমার কথার উল্টো মানে। করিস। ডিসিপ্লন কি কাঁচের ফুলদানি–একটু হিন্টস দিলে ভেঙে যাবে! মুখ ভার করে বললো শওকত।

জো তখন ফর্দ মিলিয়ে শেষবারের মতো জিনিসপত্র দেখে নিচ্ছিলো। শওকতের কথার কোন উত্তরই দিলো না। প্যাট্রিক চেঁচিয়ে বললো, বারোটা এ্যাক্স? জো বললো, বারোটা এ্যাক্স। রঞ্জিত বললো, ষাটটা বাঁশ? জো বললো, ষাটটা বাঁশ। চেক করে দেখো, ফাটা যেন না থাকে। প্যাট্রিক বললো, চব্বিশটা হাঁড়ি আর চব্বিশটা ঢাকনি। জো বললো, ঠিক আছে।

ফর্দ মেলানো শেষ হলে শওকত আবার বললো, আচ্ছা দোস্ত, আরিফ ভাই তখন কোন্ বাগান বাড়ির কথা বলছিলো তুই জানিস?

না।

ওখানে তো যাওয়া হচ্ছে না। বললে দোষ কী?

হচ্ছে না কে বললো? হতেও পারে।

আচ্ছা অন্য কিছু না বল, পূর্ব-পশ্চিম কোন দিকে সেটা তো বলতে পারিস।

কাল সকালেই জানতে পারবি।

আমাদের উলফ পেট্রলের লিডার এনামুল আমার এক ক্লাস ওপরে পড়ে। খুবই নিরীহ ভালো মানুষ। শওকতকে বললো, তুই জোকে এত বিরক্ত করছিস কেন। তোর ছেলেদের দ্যাখ, কে কে যাচ্ছে, জিনিসপত্র সব ঠিক মত নিচ্ছি কি-না।

শওকত হাঁড়ির মতো মুখ করে বললো, তুমি তোমার ছেলেদের সামলাও। আমার ছেলেরা ঠিক আছে।

ডেন থেকে জিনিসপত্তর বের করে গুছিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেলো। সামনের রোয়াকে বসে ভাইয়া আর খনুদা গুলতানি মারছিলো। দুচোখে দেখতে পারি না খনুদাটাকে। গুণ্ডোদের মতো মাসল ফুলিয়ে বেড়ায়, পড়াশোনায় লবডঙ্কা। দিদা বলেন, ভাইয়া নাকি ওর সঙ্গে মিশে উচ্ছন্নে গেছে। আমাকে দেখে খনুদা হেঁড়ে গলায় বললো, এতোক্ষণে বুঝি ফেরা হলো নিকোলাস স্যারের বাছুরের। তাও ভালো খোয়াড়ে যেতে হয় নি।

আমি যখন কাব ছিলাম তখন থেকে নিখিল স্যারের পেয়ারের এই পেয়াদাটি আমাকে নিকোলাস স্যারের বাছুর বলে ডাকে। কাব মানে যে বাচ্চা বাঘ, সিংহ, নেকড়ে এ কথাটা বহুবার বলার পরও ওর মাথায় ঢোকেনি। ঢুকলে কি আর ক্লাস নাইনে দুবার ফেল করে!

ভাইয়া ওর কথায় হি হি করে হেসে বললো, যা বলেছিস খনু, ফাংশনে চান্স না পেয়ে বেচারারা মনের দুঃখে বনবাসী হবে বলে ঠিক করেছে।

খনুদা বললো, নিখিল স্যার সব কটার নামের পাশে লাল কালির দাগ দিয়েছে। এ জন্মে আর স্টেজে উঠতে হবে না। তোদের মতো গরু বাছুর ছাড়াই আমরা ফাংশন করবো দেখিস।

বললাম, তুমি তো পারো শুধু স্টেজে উঠে মাসল দেখাতে আর ভাইয়া তিন বছর ধরে গিটারে কেবল খরবায়ু বয় বেগে বাজিয়ে যাচ্ছে। তাই দিয়ে না হয় তিন ঘন্টার ফাংশন কোরো। আমরা তো বাগড়া দিচ্ছি না।

ভারি তো এলেন এক লটবর! ভাইয়া ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো, খনু ম্যাজিক শিখেছে। এবার ও ম্যাজিক দেখাবে।

সেই সাথে এথেন্স সফরের অভিজ্ঞতাও শুনিয়ে দিও। ধরে নাও ম্যাজিক কার্পেটে এথেন্স ঘুরে এসেছে। জো যখন নেই…..।

ম্যালা ফাঁচ ফাঁচ করিস না ছেঁড়া। খনুদা গাক গাঁক করে বললো, দুদিন মাথায় গাট্টা মারিনি বলে তেজ বেড়েছে।

কে কাকে মারছে শুনি! ঘর থেকে বেরুলেন দিদা। আমাকে দেখে বললেন, কোন চুলোয় যাবে সাতে সকালে উঠে তার ঠিক নেই। দয়া করে চারটি খেয়ে আমাকে উদ্ধার করো। তারপর ভাইয়াকে নিয়ে পড়লেন, সেই দুপুর থেকে এত কী কথা তোদের শুনি। এক কেলাশে কি করে দুবছর থাকতে হয় তাই বুঝি জ্ঞান দিচ্ছে ফেলু মাস্টার খনু!

যতো মাসলওয়ালা হোক না কেন খনুদা, দিদাকে পাড়ার সবাই ভয় পায়। না মানে–ঘাড় চুলকে কি যেন বলতে যাচ্ছিলো, দিদা ওকে থামিয়ে দিলেন–থাক, বানিয়ে বানিয়ে মিছে কথা বলতে হবে না। বাড়ি গিয়ে পুরনো পড়াগুলো নিয়ে বসো গে।

যেভাবে এসেছিলেন সেভাবেই ভেতরে গেলেন দিদা। আমিও পেছন পেছন ঘরে ঢুকলাম। মা যে সেই কবে হাসপাতালে গিয়ে মরে গেছেন মনেও নেই। দিদা কোনোদিন টেরও পেতে দেননি সেই অভাবটুকু।

খেতে বসে দেখি দিদা আমার পাতে এক খানার বদলে দুখানা মাছ তুলে দিলেন। বললেন, গতবার বাইরে গিয়ে তো আধখানা হয়ে এসেছিলে। এবারও কি নিজেদের বেঁধে খেতে হবে নাকি!

সেটাই তো নিয়ম। তুমি তো জানো না দিদা, গতবার ক্যাম্প থেকে ফেরার পর রান্নায় ভালো করার জন্য আমাকে ব্যাজ দেয়া হয়েছে।

তবে আর কি! খিদে পেলে ওই ব্যাজ পানিতে গুলে খেয়ে নিও। তা এবার কদিন থাকা হবে শুনি?

পাঁচ দিনের কম নয়। সাত দিনও হতে পারে। খেতে খেতে বললাম, তুমি যে কাগজ বেচে আমাকে এতগুলো টাকা দিলে বাবা রাগ করেনি তো!

রাগের কী আছে! দিদা কাষ্ঠ হাসলেন। বুঝিস তো, অভাবের সংসার, হিসাবের বাইরে এক পা ফেলা যায় না। একটু থেমে দিদা বললেন, তবে এটা জেনে রেখো, এবার পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছে বলেই আমি ওভাবে সুপারিশ করছি। নইলে কী হতে আমি জানি না।

সেকেন্ড হলে নিশ্চয়ই পিঠে খড়ম ভাঙতে না! মোটে তো তিন নম্বরের জন্য ফাস্ট।

নাও, ওঠো এবার, কাপড় চোপড় গুছিয়ে নাও গে।

ভোরে আমি কিন্তু সাতটায় বেরুবো দিদা।

মৃদু হেসে দিদা বললেন, সে জন্যেই সকালের নাশতা এখন বানিয়ে রাখছি। দেখিস সারা রাত রসে ভিজে পিঠেগুলো মোমের মতো নরোম হয়ে থাকবে।

একটুও বাড়িয়ে বলেননি দিদা। ভোর ঠিক সাড়ে ছটায় খেতে দিলেন। ভাইয়া তখনও ঘুম থেকে ওঠেনি। স্কুল বন্ধ বলে আজকাল বাবা এ নিয়ে অন্য সময়ের মতো বকাবকি করেন না। আমাদের দুজনকে একসঙ্গে খেতে দিয়েছেন দিদা। বাবা খেতে খেতে বললেন, এখনো তুমি আগের মতো বানাতে পারো মা। আমি তো ভেবেছিলাম, কতদিন বানাওনি, বুঝি ভুলে গেছো!

দিদা মাটির হাঁড়ি থেকে রসে ভেজা আরেকটা পিঠা বাবার পাতে তুলে দিয়ে বললেন, এসব কি ভোলা যায় কখনো! পেট ভরে খা।

আমাকে আর দিও না। পেট ভরে গিয়েছে। রান্টু এটা খা। বলে পাতের পিঠাখানা বাবা আমাকে তুলে দিলেন।

বাবা কোনদিন এভাবে আমাদের পাতে কিছু তুলে দিয়েছেন বলে মনে পড়ে না। বুঝলাম আমাদের বদমেজাজী বাবার মনেও একটু নরোম জায়গা আছে। সব বাবারই থাকে। শুধু জানা ছিলো না আমাদের বাবার আছে। বাবার আদর পেয়ে কান্নার মতো কী যেন গলার কাছে দলা পাকালো। আমার আগেই বাবা উঠে গেলেন। যাবার সময় বললেন, সাবধানে থাকিস। একা পুকুরে নামবি না। ঠাণ্ডা লাগাবি না। আমার বাঁদর টুপিটা নিয়ে যাস। মা, হাত খরচের জন্য ওকে একটা টাকা দিও।

ঘরে গিয়ে ইউনিফর্ম পরে হ্যাঁভারস্যাকটা পিঠে নিয়ে যেই বেরোতে যাবো–-ভাইয়া লেপের ভেতর থেকে মুখ বের করে–যাচ্ছিস বুঝি, যা যা, পথ হারিয়ে আবার বাড়িতে ফেরত আসিস না। বলে উদ্দেশ্যপূর্ণ হেসে লেপের তলায় মুখ লুকোলো।

ওর কথায় কান না দিয়ে শীতে হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে সাতটায় স্কুলে এসে পৌঁছলাম। দেখি বেশির ভাগ ছেলেই এসে গেছে। তবে কয়েকজন বাদও পড়েছে। কারো শরীর খারাপ, কেউ গ্রামের বাড়িতে, কেউ টাকা যোগাড় করতে পারেনি বলে অন্য অজুহাত দিয়েছে। দিদা যদি কাল খবরের কাগজ আর বাকি সব জিনিস বেচে টাকা না দিতেন আমিই কি যেতে পারতাম! ঠিকই মুখ কালো করে পেট্রল লিডার এনামুলকে বলতে হতো, পেট খারাপ যেতে পারবো না। যেমন কি-না আমাদের পেট্রলের সদানন্দ কাল বলে গেছে। সদানন্দ কখনো ক্যাম্পিং বা পিকিনিকে যায় না। ওর বাবা সুবল ডাক্তারের ডিস্পেন্সারিতে কম্পাউণ্ডারের কাজ করেন।

নিকোলাস স্যার ডেনের জিনিসপত্র নিয়ে এবার আগেই চলে গেছেন। সঙ্গে আরিফ আর জোসেফ।

গোটা দলের নেতৃত্ব দেবে পেট্রল লিডারদের ভেতর সবচেয়ে সিনিয়র আমাদের উলফ পেট্রলের এনামুল। প্যান্থার পেট্রলের শওকত হচ্ছে টু. আই. সি অর্থাৎ সেকেণ্ড ইন কমাণ্ড। সব কিছুতেই শওকত অতি উৎসাহী। সাড়ে সাতটা বাজার আগেই এনামুলকে বললো, আমরা অপেক্ষা করছি কেন? লিস্টারের কাছ থেকে কাগজটা নিয়ে দেখি না কী আছে?

এনামুল ঘড়ি দেখে বললো, সোয়া সাতটা বাজে। আরো পনেরো মিনিট অপেক্ষা করবো। ছেলেরা সবাই এখনো আসেনি।

কাগজ নিয়ে তোমাকে আর আমাকেই ভাবতে হবে। পনেরো মিনিট এগিয়ে থাকলে ক্ষতি কী। যাই, লিস্টারের কাছ থেকে ওটা নিয়ে আসি। এই বলে অধৈর্য শওকত বাবুর্চিদের কোয়ার্টারের দিকে গেলো।

এনামুল ওর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। শওকতের পেট্রলের এ্যাসিস্টেন্ট লিডার শিবলী ছিলো পাশে দাঁড়িয়ে। বললো, হাসছো কেন এনামুল ভাই?

লিস্টারকে ঘরে পেলে তো! এনামুলের মুখের রহস্যের হাসি।

একটু পরেই শওকত এলো গজরাতে গজরাতে–কাণ্ড দেখেছো লিস্টারের? কোনো পাত্তা নেই। ঘর তালা বন্ধ। ধনাই, পরেশ কেউ জানে না কোথায় গেছে।

মৃদু হেসে এনামুল বললো, এতো অধৈর্য হচ্ছে কেন? সাড়ে সাতটা এখনো বাজেনি! সবাইকে পেট্রল ওয়াইজ লাইনে দাঁড় করাও।

অন্য সময় হলে শওকত এ নিয়ে নির্ঘাত কিছুক্ষণ তর্ক করতো। যাবার সময় ঘনিয়ে এসেছে, তাছাড়া ক্যাম্পে না পৌঁছানো পর্যন্ত এনামুল পুরো ট্রপের লিডার, তাই আর কথা বাড়ালো না।

এনামুল লাইনে নেই বলে আমি লিডারের জায়গায় দাঁড়ালাম। আমাদের উলফ পেট্রলের সদানন্দ আর পনির যাচ্ছে না। এনামুলকে নিয়ে যাচ্ছি আমরা ছজন। শাহেদ, মুন্না, ফারুখ আমার সঙ্গে পড়ে। শেখর পড়ে এক ক্লাস নিচে, আমাকে রান্টুদা বলতে অজ্ঞান। মস্ত বড় লোকের ছেলে–এতটুকু অহংকার নেই। ভালো গান গায়। অথচ শাহেদের বাবা পুলিশের কী যেন-দেমাগের জন্য ওর সঙ্গে কথা বলা দায়। সব ওর বাবা আর মামাদের গল্প। মামাদের নাকি জাহাজের ব্যবসা আছে। মুন্না আর ফারুকের বাড়ির অবস্থা আমাদের মতো, তবে দুজনে মিলে জিমনাসিয়ামে গিয়ে ব্যায়াম শেখে, স্কুল টিমে ফুটবল খেলে।

লাইন করার পর কাউন্টিং-এ দেখা গেলো শেষ নম্বর এইটি সেভেন। মানে এনামুল আর শওকতকে নিয়ে আমরা উননব্বই জন যাচ্ছি এবারের ক্যাম্পিং-এ। এরকমই হয়। কোনবার কোনবার একশর ওপর যাওয়া হয় নি।

গোনার সময় বার বার হাতের ঘড়ি দেখছিলো শওকত। গোনা শেষ হতেই সাড়ে সাতটা বাজলো। দেখা গেলো বাবুর্চি লিস্টার আমাদের দিকে আসছে। শওকত আমাদের এ্যাট ইজ-বলে ছুটলো লিস্টারের দিকে।

লিস্টার বুক পকেট থেকে একটা মুখবন্ধ সাদা খাম শওকতকে দিলো। শওকত অভিযোগের গলায় বললো, তুমি কোথায় গিয়েছিলে লিস্টার? কখন থেকে খুঁজছি তোমাকে?

লিস্টার মুখ টিপে হেসে বললো, পাইবা ক্যামনে। আমি তো নিকোলাস স্যারের কথা মতো নাই হইয়া আছিলাম। সাড়ে সাতটা বাজনের আগে তো আমারে পাওনের কথা আছিল না।

সাদা খামটা এনামুলের হাতে দিয়ে শওকত জুলজুল করে ওটার দিকে তাকিয়ে রইলো, পারলে যেন গিলে খাবে।

মৃদু হেসে এনামুল খামটা খুললো। ভেতর থেকে ভাঁজ করা এক টুকরো কাগজ বের করলো। আস্তে আস্তে ওর মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো। গম্ভীর হয়ে কাগজটা বাড়িয়ে দিলো শওকতের দিকে।

অবাক হয়ে শওকত কাগজটা হাতে নিলো। ওটা দেখার পর ওর মুখটা লম্বা হয়ে গেলো। এনামুলের দিকে প্রশ্নভরা চোখে তাকালো। এনামুল গম্ভীর হয়ে বললো, পেট্রল লিডারদের দেখতে দাও ওটা।

দশজন পেট্রল লিডারের হাত ঘুরে কাগজটা আমার কাছে এলো। ততক্ষণে কারো চোখ ছানাবড়া, কারো মুখ এনামুলের মতো গম্ভীর, কারো চোয়াল ঝুলে পড়েছে।

কাগজের ওপর চোখ বুলিয়ে আমারও খাবি খাওয়ার দশা হলো। কতোগুলো ইংরেজি সংখ্যা আর অক্ষরের ভেতর শুধু একটা শব্দ পড়তে পারলাম। কাগজটায় লেখা ছিলো

Start 21 9 12 14T 19 22 S 12 6 T 19 20 AT 22
A 13 21 12 15. 15 124 T 1922 tra 24 16 S

স্টার্ট তো বুঝলাম, বাকি সব কি! কাগজ উল্টে দেখলাম কোথাও কোন সংকেত পর্যন্ত নেই। আমার হাত থেকে শিবলী নিলো কাগজটা। ওর বিস্ময়ভরা মুখটা কয়েক সেকেণ্ডের ভেতর বোকা বোকা হয়ে গেলো। তারপর ওটা বাড়িয়ে দিলো প্যাট্রিকের দিকে।

একে একে সবার হাত ঘুরলো কাগজটা। শুধু মুখ চাওয়া-চাওয়ি আর গুনগুন করতে করতে সাতটটা চল্লিশ হলো। সবার দেখার পর ওটা আবার এনামুলের হাতে গেলো। এনামুল গম্ভীর হয়ে বললো, এতে কী লেখা আছে আমরা যদি বের করতে না পারি–ক্যাম্পিং-এ যাওয়া হবে না।

শওকত আপন মনে বললো, কোনো সূত্রটুত্র দেবে তো!

আমি বললাম, এনামুল ভাই এভাবে সময় নষ্ট না করে আমরা বরং ড্রইং ক্লাসে গিয়ে বসি। আমাদের ব্ল্যাকবোর্ড আর একটা চক দরকার হবে।

ঠিক বলছো রান্টু। প্রশংসা ভরা গলায় এনামুল কথাটা বলে সবাইকে ড্রইং ক্লাসে যেতে বললো।

ড্রইং ক্লাস হচ্ছে স্কুলের ক্লাসরুমগুলোর ভেতর সবচেয়ে বড়। শ খানেক ছাত্র অনায়াসে বসতে পারে সেখানে। শওকত গিয়ে ধনাইর কাছ থেকে চক আর ডাস্টার নিয়ে এলো।

চিরকুটে লেখাটা যেভাবে ছিলো এনামুল ঠিক সেভাবে ব্ল্যাক-বোর্ডের ওপর লিখলো। শওকতকে বললো, শব্দ করে পড়ো তো, সাউণ্ড এফেক্টে কিছু বোঝা যায় কি-না দেখি।

শওকত নামতা পড়ার মতো একঘেয়ে ভঙ্গিতে পড়তে শুরু করলোস্টার্ট টু ওয়ান নাইন ওয়ান টু ওয়ান ফোর টি ওয়ান নাইন টুটু এস্ ওয়ান টু সিক্স টি ওয়ান নাইন টু ও এটি টুটু এ ওয়ান থ্রি টু থ্রি টু ওয়ান ওয়ান টু ওয়ান ফাইভ ওয়ান টুফোর টি ওয়ান নাইন টু টু টি আর এ টু নাইন ওয়ান সিক্স এস।

আমাদের ভেতর শিবলী কবিতা লেখে। শওকতের পড়ার সময় ও মাথা দোলাচ্ছিলো। থামার পর বললো, বেশ একটা রিদম পাওয়া যাচ্ছে।

এনামুল ভুরু কুঁচকে বললো, রিদম কোথায় পেলে?

এই যে দেখোনা মাত্রা গুণে। টু টু এস ওয়ান, টু সিক্স টি ওয়ান–কেমন চার মাত্রার ছন্দ পাচ্ছো না?

শওকত হা করে শিবলীর কথা শুনছিলো। বললো, কবিতার ক্লাস পেয়েছিস নাকি! ছন্দ মাত্রা এসব দিয়ে কী করবো?

এনামুল বললো, আমি ভেবেছিলাম ধ্বনি থেকে কিছু বেরোতে পারে। আমার কানে কিছুই স্ট্রাইক করেনি। শওকতের পড়াটা আমার কাছে ডডনং পড়ার মত মনে হয়েছে।

ডডনং পড়া কাকে বলে? জানতে চাইলো শওকত।

সেই গল্প জানো না বুঝি! ঠিক মতো প দিয়ে না পড়লে যে গোলমাল হয়–তাকে উড়নং পড়া বলে।

গল্পটা কী? সব কিছুতেই শওকতের কৌতূহল।

এক দোকানের সাইনবোর্ডে সাইনবোর্ড লিখিয়ে কাগজে লেখা কথা পড়ার সময় শব্দগুলো ভেতর ঠিক মতো ফাঁক দিতে না পেরে পড়লো–হরে করকম বা জিওবা রুদেরদো কান ডডনং। পরে কথাগুলো এইভাবে সাইনবোর্ডে লিখলো। এই বলে

এনামুল সাইনবোর্ডের কথাগুলো বোর্ডে লিখেলো।

শওকত বললো, কথাটা কী হবে? এনামুল মৃদু হেসে বললো, কথা তো এখানেই সব রয়েছে। ঠিক মতো পয্‌ দিয়ে পড়তে হবে। আমি পযের জায়গায় দাগ দিয়ে দিচ্ছি। এবার পড়ো।

শওকত এবার গড়গড় করে পড়লো, হরেক রকম বাজি ও বারুদের দোকান। ছেষট্টি নং।

ক্লাস সুদ্ধো সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। শওকত সবার সঙ্গে গলা মেলালো।

এনামুল সাইনবোর্ডের লেখা বোর্ড থেকে মুছে বললো, আমাদের আসল কথায় এসো। শওকত, যেখানে ফাঁক আছে সেখানে প্যু দিয়ে পড়ো। টু ওয়ান একসঙ্গে আছে। ওটাকে টুয়েন্টি ওয়ান পড়ো।

এনামুলের কথামতো শওকত আবার পড়লো। এনামুল শুনে এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়লো। শিবলী বললো, এবার আর আগের মতো রিদম পাওয়া গেলো না।

এনামুল বললো, আমরা রিদম খুঁজছি না শিবলী। তোমরা সবাই ভাবো কী হতে পারে।

আমি বললাম, তুমি যে পযের কথা বললে এনামুল ভাই, সেভাবে কিছুটা এগুনো যাবে।

থামলে কেন, বলো।

লক্ষ্য করে দেখো। কতগুলো সংখ্যা বা অক্ষরের ভেতর ফাঁক একটু বেশি। বেশি ফাঁকটাকে বড় পর্য্য ধরা যাক। তাহলে দাঁড়াচ্ছে এখানে স্টার্ট বাদ দিয়ে আটটা সাংকেতিক ইউনিট আছে। এই ইউনিটগুলো এক একটা বাক্য হতে পারে কিম্বা এক একটা শব্দ হতে পারে।

দারুণ বলেছে। উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো এনামুল।

শওকত বললো, রান্টুর কথা যদি ঠিক হয় তাহলে দেখা যাচ্ছে একটা ইউনিট দুবার আছে। একটা বাক্য দুবার ব্যবহার করার যুক্তি নেই। কিন্তু একটা শব্দ দুবার ব্যবহার করা যেতে পারে। আমি টি নাইন্টিন টুয়েন্টিটুর কথা বলছি।

শাহেদ বললো, নাইনন্টি টুয়েন্টিটুতে ঘটেছে এমন কোন ঘটনার কথা বলা হতে পারে।

এনামুল মাথা নাড়লো, ঘটনা হবে না। শওকত ঠিক ধরেছে। কোনও ওয়ার্ড হবে। রান্টু, প্যাট্রিক, তোমরা সবাই মাথা ঘামাও। আটটা কুড়ি বাজে।

প্যাট্রিক বললো, শওকত আর রান্টুর কথা ধরে যদি এগুতে চাও তাহলে আরেক ধাপ এগুনো যেতে পারে। লক্ষ্য করে দেখো প্রথম শব্দ হচ্ছে স্টার্ট। এস টি এ আর–এই চারটে অক্ষর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে শব্দগুলোর ভেতর।

মাথা নেড়ে সায় জানালো এনামুল। কিছুক্ষণ সারা ক্লাস একেবারে চুপ। গভীরভাবে ভাবছে সবাই। ইউরেকা, ইউরেকা বলে লাফিয়ে উঠলো শওকত। হঠাৎ উত্তেজিত গলায় বললো, বোর্ডে এ থেকে জেড পর্যন্ত লেখো তো এনামুল!

এনামুলের লেখা শেষ হতেই শওকত বললো, এবার এর নিচে ওয়ান, বির নিচে টু, সির নিচে থ্রি-এভাবে ফিগারগুলো পর পর বসিয়ে দাও।

এনামুল জেড-এর নিচে টুয়েন্টি সিক্স লিখে থামলো। শওকত আগের মতো উত্তেজিত গলায় বললো, এবার আমাদের সংকেতের ফিগারগুলোর জায়গায় এলফাবেট বসিয়ে দাও নম্বর মতো।

এনামুল বোর্ডে সংকেত উদ্ধার করতে গিয়ে লিখলো—

UILNTSV SLFTS

না হচ্ছে না। বাধা দিলো ডিয়ার পেট্রলের লিডার দিলীপ। বললো, এগুলো কোনো শব্দ হচ্ছে না। তাছাড়া শব্দের ভেতর এস থাকলে শওকতের থিওরি মতো সেটা ফিগারে লেখার তো কথা নয়, এখানে ফিগারেও এস আছে দেখা যাচ্ছে।

চুপসে গিয়ে বসে পড়ল শওকত। হঠাৎ আমার মনে হলো শওকতের সূত্রটা উল্টো করে দেখলে কেমন হয়। উত্তেজনা চেপে বললাম, এনামুল ভাই, ওয়ান টু থ্রিগুলো এ বি সি-র নিচে না লিখে উল্টো দিকে জেড ওয়াই এক্স-এর নিচে লেখো তো!

এনামুল দ্রুত হাতে লেখা শেষ করতেই আমি বললাম, স্টার্ট এর পর লেখো এফ আর ও এম।

ক্লাস সুঘদ্ধা সবাই একসঙ্গে চেঁচিয় উঠলো, ফ্রম! স্টার্ট ফ্রম। হুররে–। মুখের হাসি কান পর্যন্ত ছড়িয়ে দিয়ে এনামুল লিখলো

START FROM THE SOUTH GATE AND FOLLOW THE TRACKS.

আমার একপাশে শিবলী আরেক পাশে শেখর বসেছিলো। ফুটবলের মাঠে গোল দেয়ার পর বেচারা গোলদাতার যে দশা হয়, মুহূর্তের ভেতর আমার দশাও তাই হলো। ইউনিফর্মের ভাঁজ টাজ নষ্ট হয়ে একাকার কাণ্ড।

আমাদের চিৎকার শুনে ঘন্টা বুড়ো ভিনসেন্ট ছুটে এলোওয়া কি! ওয়া কি!। পোলাডারে তো মাইরা ফালাইবা। দম আইটকা মরবো তো। ওয়া কোন দেশি আহ্লাদ!

ভিনসেন্ট-এর কথায় ওরা আমাকে নামালো। শিবলী চেঁচিয়ে বললো, ঠিকানা পেয়ে গেছি ভিনসেন্ট দাদু।

তাইলে কাউ কাউ না কইরা বাইর ওইয়া পড়। কোনহানে যাইতে ওইবো হেইডা তো জান না। বলে মিট মিট করে হাসতে লাগলো ভিনসেন্ট। ..

রেন্টু ছুটে এসে ওর গলা জড়িয়ে বললো, তুমি তো জানো ভিনসেন্ট দাদু। বলে দাও না কোথায় যেতে হবে!

জানি, কিন্তুক কমু না! হাসি থামিয়ে এবার গম্ভীর হয়ে বললো ভিনসেন্ট, এইডা না তোমাগো পরীক্ষা! আমারে যে বড় উত্তর কইতে কও! ব্রাদার পিটার হুনলে তোমাগো কী কইবো জানো?

এনামুল ব্যস্ত হয়ে বললো, না, না তোমাকে বলতে হবে না। রেন্টু তোমার সঙ্গে ঠাট্টা করছে, বোঝো না কেন! ট্রপ, গেট রেডি।

বুঝি! তয় কতা ওইলো পরীক্ষা নিয়া ঠাট্টা মশকরা করন ঠিক না। এই বলে ভিনসেন্ট চলে গেলো।

আমাদের চ্যাঁচামেচিতে ওপর থেকে কখন যে ব্ৰদার ফিলিপ্স নেমে এসেছেন টের পাইনি। সুইং ডোরের ওপর দিয়ে গলা বাড়িয়ে এত চিল্লাইতাস ক্যান, কি হইসে–বলে বোর্ডের লেখা পড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে বুঝে নিলেন ঘটনাটা। মুখ টিপে হেসে বললেন, এত ফুর্তি করনের কিসু নাই। সামনে ম্যালা শক্ত পরীক্ষা রইসে। সব পরীক্ষায় পাস করবা কি-না সন্দ আছে।

ব্রাদার ফিলিন্স-এর কথা শুনে সবাই হট্টগোল জুড়ে দিলো–বললেই হলো পাস করবো না। ক্যাম্পিং-এ বুঝি আগে কখনো যাইনি। এসব শুনে ব্রাদার পালিয়ে বাঁচলেন। তখন পর্যন্ত আমরা কেই আঁচ করতে পারিনি, আমাদের সামনে বিপদের কত বড় খাঁড়া ঝুলছে।

.

০৪. বখাটেদের বাধা পেরিয়ে

সেদিন ছিলো রোববার। ছুটির দিন। বেশির ভাগ দোকানপাটই বন্ধ। রাস্তায় লোজন আর গাড়ি-ঘোড়া চলাচলও অন্য দিনের চেয়ে অনেক কম। নইলে আমাদের মিছিলের বহর দেখে রাস্তায় ভিড় জমে যেতো। পাশাপাশি দুই সারিতে ঠিক মার্চ করে

হলেও বেশ ডিসিপ্লিন মতো হাঁটছিলাম। সবাই ইউনিফর্ম পরা, গলায় আমাদের ট্রপের নীল-সাদা স্কার্ফ। পিঠে হ্যাঁভারস্যাক, হাতে বাঁশের লাঠি। সবার সামনে এনামুল আর শওকত। শওকতের হাতে আমাদের ট্রপের ফ্ল্যাগ।

রাস্তায় লোকজন কম হলেও বাড়ির জানালা থেকে মেয়েরা কিংবা রোয়াকে বসে রোদ পোহানো বুড়োরা আমাদের দিকে প্রশংসা ভরা চোখে তাকাচ্ছিলো। ছেলেদের সবার মুখ শেষ ডিসেম্বরের সকাল আটটা নটার সূর্যের মতো ঝলমল করছিলো।

স্কুলের সাউথ গেট মানে পেছনের দরজা। সেই দরজা দিয়ে বেরিয়ে আমরা ডালপট্টির দিকে যাচ্ছিলাম। ট্র্যাক শুরু হয়েছে স্কুলের গেট থেকেই। নানা রকমের দিক সংকেত। কোথাও কয়েক টুকরো ইট দিয়ে কোথাও কোন বাড়ির পাচিলের গায়ে চক দিয়ে নির্দেশ ছিলো এদিকে যাও কিংবা এদিকে যেও না। কোথাও ট্র্যাক ফলো করে চিঠিতে নির্দেশ পেলাম–দশ গজ সামনে গিয়ে বাঁয়ে মোড় নাও। না জানা থাকলে দেয়ালে আঁকা সংকেত বোঝার কারো সাধ্য নেই। আমাদের স্কুলের পিছনে আট দশটা গলি এমনভাবে জড়াজড়ি করে জট পাকিয়ে ছিলো যে, ট্র্যাক খুঁজে বের করার জন্য বার বার থামতে হচ্ছিলো।

ডালপট্টির মোড়ের কাছে এসে আমরা হঠাৎ ট্র্যাক হারিয়ে ফেললাম। খুঁজতে গিয়ে দেখি ফেলুমাস্টার খনুদা পাড়ার কটা বখাটে ছেলেকে নিয়ে হাজারীর কেবিনের সামনে আড্ডা মারছে। আমাদের দেখেই খনুদা ষাঁড়ের মতো গলায় বললো, ওই যে এলেন নিকোলাস স্যারের এঁড়ে বাছুরের দল।

ওদের মধ্যে একজন হেঁড়ে গলায় গান ধরলো, রাজার দুলালী সীতা বনবাসে যায় গো, বনবাসে যায়।

খনুদা নাটুকে গলায় বললো, পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ।

আরেকজন বেসুরো গলায় গাইলো, পথ হারাবো বলে এবার পথে নেমেছি-ই-ই।

মুন্না ওদের দিকে এমনভাবে তাকালো যেন পারলে তখনই নুন লঙ্কা দিয়ে কাঁচা আমের মতো চিবিয়ে খায়। কিছুদূর গিয়ে দেখলাম একটা ইটের টুকরোর সংকেত এদিকে যাও। অর্থাৎ যেদিক থেকে আমরা এসেছি সেই দিকের ইঙ্গিত। এই ট্রাকে কোনো গণ্ডগোল নেই। আবার ফিরে এলাম। রাগে দুঃখে আমাদের তখন মাথায় চুল ছেঁড়া বাকি।

এভাবে এলোপাথাড়ি খুঁজলে চলবে না। এই বলে এনামুল আমাদের তিন গ্রুপে ভাগ করে তিন দিকে পাঠালো। আমাদের গ্রুপে শওকত, শিবলী, শেখর, মুন্নাকে নিয়ে জনা বারো ছিলো।

পঞ্চাশ গজের মতো গিয়ে আমরা আরেকটা ট্র্যাক দেখলাম। এটাও ইট দিয়ে–এদিকে যাও। তার মানে এখানেও কোন ভুল হয়নি। ভুলটা তাহলে হলো কোথায়। মুন্না আর শেখরকে বললাম, তোরা দুজন দুদিকের দেয়াল ভালো করে দেখ, কেউ কোন চিহ্ন মুছে ফেলেছে কি-না খেয়াল করিস।

আমরা তন্ন তন্ন করে রাস্তার দুপাশে এমন এমনভাবে ট্র্যাক খুঁজতে লাগলাম যে রোয়াকে বসা এক বুড়ো বলেই ফেললেন, টাকা পয়সা হারিয়েছো বুঝি! তাঁর সঙ্গী বললেন, কত টাকা ছিলো?

শওকত বললো, ট্র্যাক হারিয়েছি।

বুড়ো দুজন অবাক হয়ে নিজেদের ভেতর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। আমরা কিছুটা পিছিয়ে এলাম। হঠাৎ দূর থেকে রিনরিনে গলায় চেঁচিয়ে উঠলো শেখর–শিবলী এদিকে এসো।

পেছনে তাকিয়ে দেখি একটা দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ও। কাছে যেতেই উত্তেজিত হয়ে বললো, দেখো, দেখো! কিছু আঁকা ছিলো, কেউ মুছে দিয়েছে।

মুন্নার সঙ্গে আমিও গেলাম। কাঠের পুল যাওয়ার গলিটার মুখে যে দেয়ালে ট্র্যাক আঁকা ছিলো পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। চক দিয়ে আঁকা ছিলো। কেউ এমনভাবে সেটা মুছে দিয়েছে যে, কিছুই বোঝার উপায় নেই। কাজটা কাদের, বুঝতে কারো অসুবিধে হলো না। সামনে থেকে দাশু ডাকলো, মুন্না, দেখে যাও।

ডালপট্টির মোড় থেকে হেমেন্দ্র দাস রোডের দিকে ট্র্যাক ছিলো। সেখানকার সব চিহ্ন নিমর্মভাবে মুছে ফেলা হয়েছে। খনুদার চ্যালা তখন গাইছে …..পথে পথে দিলাম ছড়াইয়ারে–এ….।

মুন্না আমাদের কাউকে কিছু না বলে সোজা খনুদার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো–দেয়ালের ট্র্যাক মোছা হয়েছে কেন?

মুন্নার রাগ দেখে খনুদা একটু চুপসে গেলেও তাচ্ছিল্য দেখিয়ে বললো, বয়ে গেছে তোদের ট্র্যাক মুছতে।

ততক্ষণে আমরা দশ বারো জন স্কাউট ওদের ঘিরে দাঁড়িয়েছি। মুন্না আবার বললো, কোন্ দিকে কোন্ ট্র্যাক ছিলো দেখিয়ে দাও। নইলে–

নইলে কী করবি। খনুদার গলায় ভয়ের আভাস।

মুন্না খনুদার চোখে চোখ রেখে বেল্টের হুক থেকে ভাঁজ করা ছুরিটা বের করে খুললো। খনুদার চোখ কপালে উঠলো। আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো কোথাও দয়ামায়ার লেশমাত্র নেই। কাষ্ঠ হেসে বললো, নিকোলাস স্যার বুঝি আজকাল তোদের ছুরি মারামারি শেখাচ্ছেন? ব্রাদার পিটার জানতে পারলে কী খুশিই না হবেন!

মুন্না বললো, শেষবার বলছি, ট্র্যাক কিরকম ছিলো এঁকে দেখাও।

খনুদার পেছন থেকে একজন মিনমিনে গলায় বললো, বারে, দ্যালে কি আঁকা ছিলো আমাদের মনে আছে বুঝি?

খনুদা কী ভেবে উঠে দাঁড়ালো–ঠিক আছে দেখাচ্ছি। চান্দু, এক টুকরো ইট আন।

খনুদার সঙ্গী ইট আনতে গেলো। মুন্নার মুখে জয়ের হাসি। খনুদা রাগ দেখিয়ে গট গট করে হেঁটে গেলো। তরপর হঠাৎ চান্দু, পালা-বলে বাঘের তাড়া খাওয়া ছাগলের মতো চোখের পলকে ছুটে পালিয়ে গেলো। আমরা সবাই হতভম্ব। মুন্নার চাপা হাসি মিলিয়ে গেছে। পেছনে তাকিয়ে দেখি খনুদার বাকি দুই চ্যালা চুপিসারে হাজারীর কেবিনের পেছনের রাস্তা দিয়ে কেটে পড়েছে।

ঠিক তখনই ছাতা বগলে লুঙ্গি পরা একজন বুড়ো পাশ দিয়ে যাবার সময় মৃদু তিরস্কারের গলায় বললেন, স্কাউটরা বুঝি কাউরে ছুরি দিয়ে ডর দেখায়!

মুন্না অপরাধীর মতো সামান্য হাসলো। কী লজ্জার কথা, রাস্তার লোকজন পর্যন্ত দেখে ফেলেছে।

দোকানের ভেতর থেকে বুড়ো হাজারী রেরিয়ে এসে আমাদের লজ্জা ভেঙে দিলেন–তোমরা ওই বদ ছোঁড়াগুলোকে তাড়িয়েছে দেখে ভারি খুশি হয়েছি বাছারা। পিকনিকে যাচ্ছো বুঝি? একটা করে কুকিজ খেয়ে যাও।

শিবলী বললো, সে কি! না, না–

না বললে তো শুনবো না বাছা! আদুরে গলায় বুড়ো বললেন, তোমরা আমার কম উপকার করোনি। ওই ছোঁড়াদোর জ্বালায় দোকানে কোন ভদ্দরলোক আসতে পারে না। কইরে গেদু, কুকিজের টিনটা দিয়ে গেলি না? কাল রাতেই বানিয়েছি। তোমরা খেলে ভারি শান্তি পাবো।

কাউকে কোনো কথা বলতে না দিয়ে বুড়ো হাজারী বকবক করতে করতে সবার হাতে একটা করে কুকিজ ধরিয়ে দিলেন। একগাল হেসে বললেন, কিছু মনে করো না, তোমাদের এতজনকে বসতে দিতে পারলাম না। কী সুন্দর সব ছেলে, দেখলে চোখ জুড়োয়। আঁটা মারো ওই বখাটেদের মুখে। তোমাদের পথের নিশেন বুঝি পাজীগুলো মুছে দিয়েছে?

শওকত বললো, পথ আমরা ঠিকই খুঁজে বের করবো।

হাজারীর কেবিনের সামনের রোয়াকে বসে কুকিজ খেতে খেতে পনেরো মিনিটের মধ্যে আমরা ট্র্যাক পেয়ে গেলাম। এনামুল সামনে সূত্রাপুরের দিকে দশ মিনিট হেঁটে এসে জানালো ওদিকে কোনো চিহ্ন নেই। ও হেমেন্দ্র দাস রোডের দিকে গিয়েছিলো অমিরা। ওরাও মিনিট পনেরো পরে এসে একই কথা বললো।

তাহলে আমাদের কাঠের পুলের দিকেই যেতে হবে। এই বলে শওকত সবার আগে কলুটোলার গলির দিকে এগিয়ে গেলো। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমরা পরের ট্র্যাক পেয়ে গেলাম। খনুদা আর তার চ্যালারা কখনো স্কাউটিং করেনি। তাদের জানার কথা নয় কোনটা সত্যিকারের ট্র্যাক কিংবা কোন ট্র্যাকের কী মানে। বুঝলাম এর পেছনে ভাইয়ার হাত আছে। লজ্জায় মাথা কাটা গেলো। কথাটা কাউকে বলতে পারলাম না। মুন্না আমার পাশে ছিলো। বললো, মুখ ভার করে কী ভাবছিস?

মুন্নার মুখের দিকে তাকালাম। ওকেও বেশ চিন্তিত মনে হলো। আমি বললাম, যাই বলিস, ওভাবে তোর ছুরি বের করা উচিত হয়নি।

মুন্না ম্লান হেসে বললো, আমি একবারও বলেছি কাউকে ছুরি মারবো! আমি শুধু ধারটা পরীক্ষা করেছি। বুড়ো লোকটা ভেবেছে আমি বুঝি সত্যি সত্যি ছুরি মারবো।

খনুদা যদি নিখিল স্যারকে বলে ভারি কেলেঙ্কারী হবে।

বলুক না! ও যে অপকর্ম করেছে তার জন্যেও ওকে শাস্তি পেতে হবে। কেউ ওকে কিছু বলার সাহস পায় না বলে মাথায় উঠেছিলো। শুনলি তো হাজারী মশাই কী : বললেন? আমার মনে হয় এটাও একটা গুড টান।

স্কাউটদের গুড টার্ন হলো দিনের মধ্যে একটা ভালো কাজ করতেই হবে, বিশেষ করে যদি কেউ ইউনির্ফম পরে। গলায় স্কার্ফ বাঁধার সময় নিচে একটা গুড টার্ন নট দিতে হয়–ভালো কাজ না করলে ওটা খোলার নিয়ম নেই।

ট্র্যাক ধরে কাঠের পুল পেরিয়ে ধুপখোলার মাঠ বাঁয়ে রেখে আমরা দীননাথ সেন। রোডে ঢুকলাম। শওকত হাতের ঘড়ি দেখে চেঁচিয়ে বললো, দশটা বাজতে দশ মিনিট।

পথে খনুদাদের পেজোমির জন্য দেরি হলেও খানিকটা বিশ্রাম হয়েছে। নিচের ক্লাসের ছেলেদের মুখেও এতটুকু ক্লান্তি নেই।

পনেরো মিনিট পর আমরা সতীশ সরকার রোড ধরে গেণ্ডারিয়া স্টেশনে এলাম। স্টেশনে এসে মনে হলো ট্রেনে করে কোথাও যাবার সংকেত পাবো। সবাই মিলে ট্র্যাক খুঁজতে লাগলাম। প্ল্যাটফর্মের শেষ মাথায় দেখি গেন্ডারিয়া লেখা ফলকের নিচে তিনটে পাথর আমাদের পূর্ব দিকে হাঁটার নির্দেশ করছে।

আর পাকা রাস্তা নয়। দুধারে ধান ক্ষেত, মাঝখান দিয়ে কাঁচা রাস্তা। এবার পাথর আর চকের দাগের বদলে গাছের ডাল আর ঘাসের ট্র্যাক।

লম্বা ধানক্ষেত পেরোতে পথে পড়লো একটা গ্রামের মতো। গ্রামের শেষ মাথায় বটগাছের নিচে ছোট একটা মুদি দোকান। সামনে বাঁশের বেঞ্চে বসে কয়েকজন আধবুড়ো লোক হুঁকো টানছিলো। আমাদের দেখে একজন আরেকজনকে বললো, মনে অয় বায়স্কোপ কোম্পানির পাট করবার লাইগা যাইতাছে।

আরেকজন বললো, হ, সইন্যের পাট করবো। দ্যাহ না সৈন্যের পোশাক। এত কুট্টি সৈন্য?

বায়স্কোপে কুট্টি মাইনষেরেও ডাঙ্গর মনে অয়।

আমরা হাসি চেপে গম্ভীর মুখে এগিয়ে গেলাম। শিবলী বললো, কাছাকাছি নিশ্চয় এ কোনো সিনেমার সুটিং হচ্ছে। আহা যদি ওটা ফাইভ স্টার কোম্পানির রাজনৰ্তকী হতো।

শিবলীর এক ভাই ছবি বানায়। তাই ও বেশ খোঁজখবর রাখে। ওর ভাই ছবির জন্যে ফ্রি পাস দেয় আমাদের।

গ্রাম পেরিয়ে আবার ধানক্ষেত। পরের গ্রামে ঢোকার মুখে একটা মসজিদ চোখে পড়লো। সামনে গাছের ছায়া ঢাকা পুকুর। শানবাঁধানো ঘাট। পথের ধারে গাছের গোড়ায় ট্রাক ফলো করে একটা চিঠি পেলাম। লেখা আছে মসজিদের মাঠে পনেরো মিনিট বিশ্রাম। তারপর রাস্তা ধরে পঞ্চাশ গজ পূর্বদিকে।

শওকত বললো, আমিও বিশ্রামের কথা ভাবছিলাম। মাইল পাঁচেকের মতো হাঁটা হয়ে গেছে।

ঘড়িতে তখন এগারোটা বাজে। আমরা পুকুরের ঘাটে এসে বসলাম। বেশ চুপচাপ জায়গা। একটা দুটো পাখি ডাকছে অলস গলায়। পুকুরের ওপাশে গোরস্থান। তারপর আবার ধানক্ষেত।

ভেবেছিলাম ছোটরা বুঝি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। কয়েকজন এখানে-সেখানে বসলেও বেশির ভাগ ছেলে পিঠের হ্যাঁভারস্যাক খুলে রেখে ছুটোছুটি শুরু করেছে। কয়েকজন টিউবওয়েলের ধারে লাইন দিয়েছে পানি খাবার জন্য। মুন্না সবাইকে পানি তুলে খাওয়াচ্ছে।

আমি বললাম, জায়গাটা ভারি সুন্দর। এখানে ক্যাম্প হলে মন্দ হতো না।

শিবলী কাষ্ঠ হেসে বললো, গোরস্থানের পাশে ক্যাম্পের আইডিয়াটা খারাপ নয়।

এতোজন একসঙ্গে থাকবো, ভয় কী!

সবাই তো আর রাত জেগে পাহারা দেবে না। পাহারা একজন দুজনই দেয়।

আমি ভেবেছিলাম আমাকে বুঝি রাতে ক্যাম্প পাহারা দিতে হবে না।

শিবলীর কথা শুনে এরকম জায়গায় ক্যাম্প করার আইডিয়াটা বাতিল করে দিলাম।

এটা ঠিক যে রাতে ক্যাম্প পাহারা দেয়াটাও আমাদের ট্রেনিং-এর একটা অংশ। সাধারণত ওপরের ক্লাসের ছেলেরা পালা করে ক্যাম্প পাহারা দেয়। শিবলীর মতো আমারও গোরস্থানে রাত জাগার সাহস নেই। মনে মনে ভাবলাম ক্যাম্পের জায়গাটা মাইল খানেকের মধ্যে না হলে বাঁচি। যদিও বাইরে বলি ভূত-টুত আমি বিশ্বাস করি না।

পনেরো মিনিট বিশ্রামের পর আবার উঠলাম। পেট্রল লিডাররা সবাই নিজ নিজ পেট্রলের ছেলেদের গুছিয়ে নিলো। পুব দিকের পথে হাঁটা শুরু হলো আবার। গ্রামের পথে এই একটা সুবিধে। শহরের হতো দুমিনিট পর পর ডাইনে বাঁয়ে গলি ছড়িয়ে নেই। গেন্ডারিয়া স্টেশন ছাড়ার পর পথে মাত্র দুটো রাস্তার ক্রসিং পড়েছে।

ধানক্ষেত পেরিয়ে যে গ্রামটায় ঢুকলাম–রাস্তার একটা বাঁক পেরিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। শিবলী ঠিকই ভেবেছিলো। সামনে পুরনো দিনের বিরাট এক জমিদার বাড়ি। কয়েক জায়গায় পাচিল খানিকটা ভেঙে পড়েছে। দুপাশে থামের ওপর দুটো সিংহ বসানো বড় গেটের পাশে করুই গাছের ছায়ার নিচে দুটো মাইক্রোবাস আর একটি জিপ। জমিদার বাড়ির ঝুল বারান্দার নিচে একটা এক্কা গাড়ি। জমিদারি পোশাক পরা একজন সেই গাড়িতে বসে। চারপাশে লোকজন ব্যস্ত হয়ে ছুটাছুটি করছে। বুঝলাম সিনেমার স্যুটিং হচ্ছে। শিবলীর কল্যাণে আমাদের অনেকেরই স্যুটিং দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে।

জমিদার বাড়ির সিংদরজার দিকে কয়েক পা এগিয়েছি–হঠাৎ ভেতর থেকে নিকোলাস স্যার ছুটে এসে–এসে গেছে, এসে গেছে, বলে আমাকে আর শিবলীকে সামনে পেয়ে জড়িয়ে ধরলেন। তাকিয়ে দেখি দূরে জমিদার বাড়ির আঙিনার ভেতরই আমাদের ট্রপের পতাকা পতপত করে উড়ছে।

নিকোলাস স্যারের গলা শুনে আমাদের টুপ লিডার আরিফ ছুটে এলো হাসি মুখে। এমন কি সিনেমা কোম্পানির কয়েকজনও এগিয়ে এলো আমাদের দেখতে। শুধু জোসেফকে আশেপাশে দেখলাম না।