০১-২. এক নতুন ধরনের ক্যাম্পিং

নিকোলাস রোজারিওর ছেলেরা – কিশোর উপন্যাস – শাহরিয়ার কবির

০১. এক নতুন ধরনের ক্যাম্পিং

আমাদের মিশনারি স্কুলের বড়দিনের লম্বা ছুটিগুলো হরেক রকম অনুষ্ঠান আর উৎসবে ঠাসা থাকতো। প্রাইজ দেয়ার দিনের অনুষ্ঠান ছাড়াও কোনও বছর সায়েন্স ফেয়ার, কোনও বছর আনন্দ মেলা আবার কোনও বছর হতো নাটকের প্রতিযোগিতা। এ ছাড়া পিকনিক তত বাঁধা ছিলো প্রত্যেক বছরই। এসব উৎসবে এত মজার মজার ঘটনা ঘটতো যে, তা বলে শেষ করা যাবে না।

নবেম্বরের গোড়াতেই শেষ হয়ে যেতো বছর শেষের পরীক্ষাগুলো। বড়দিনের ছুটি শুরু হতো পরীক্ষার পর। তবে বাইরে থেকে দেখে কারো বোঝার সাধ্যি ছিলো না স্কুলে তখন ছুটির মাস। পরীক্ষার ফল বেরুনো পর্যন্ত রমরম করতো গোটা স্কুল। কোথাও নিখিল স্যার ছেলেদের নিয়ে গানের মহড়া দিচ্ছেন, কোথাও নিকোলাস স্যার নাটক কিম্বা ভ্যারাইটি শোর মহড়া নিয়ে মেতে আছেন আবার কোথাও রহমতুল্লা স্যার পিকনিকের আয়োজন নিয়ে সারা স্কুলে তোলপাড় করছেন।

এসব উৎসবের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি উৎসাহী ছিলেন ব্রাদার ফিলিপ্স আর ব্রাদার পিটার। তাদের সঙ্গে থাকতেন গানের টিচার নিখিল সূত্রধর আর স্কাউট টিচার নিকোলাস রোজারিও। রহমতুল্লা স্যার পিকনিক ছাড়া অন্য কিছুতে নাক গলাতেন না।

ব্রাদার ফিলিপ্স আর ব্রাদার পিটারকে স্কুলের সবাই আড়ালে ডাকতো ব্রাদার লরেল আর ব্রাদার হার্ডি বলে। সিনেমার লরেলের মতো লিকলিকে ছিলেন ব্রাদার ফিলিপ্স আর তার উল্টো-মোটাসোটা গোলগাল হলেন ব্রাদার পিটার। দুজনেরই সারাক্ষণ হাসি হাসি মুখ, গলায় গলায় ভাব আবার সুযোগ পেলে একজন আরেকজনকে খোঁচাতেও ছাড়েন না। মাঝে মাঝে ঝগড়া করে দুজন গোমড়া মুখে ঘুরে বেড়ান। ছোটদের আড়ি দেয়ার মতো কথা বলাও বন্ধ থাকে। তখন বুড়ো হেডমাস্টার ব্রাদার জেমসকে নাক গলাতে হতো। তারপর আবার দুজন মানিকজোড় হয়ে ঘুরে বেড়াতেন।

এঁদের ঠিক উল্টো ছিলেন নিকোলাস স্যার আর নিখিল স্যার। সুযোগ পেলেই ঝগড়া করতেন দুজন। শুনেছি নিখিল স্যার নাকি ছোটবেলায় ব্রতচারী করতেন। স্কুলে নতুন এসে ব্রতচারী নাচ-টাচ চালু করতে চেয়েছিলেন। নিকোলাস স্যার শুধু বলেছেন–ছেলেরা স্কাউটিং করবে, না একধামা চাল, একটা পটল নাচবে? ব্যস সেই থেকে শুরু।

এ কথা বলতেই হবে নিকোলাস স্যারের জন্য স্কাউটিং-এ আমাদের সুনাম দেশের বাইরে অব্দি ছড়িয়েছিলো। স্কাউটদের ইন্টারন্যাশনাল জাম্বুরিতে আমাদের একজন হলেও যাবে। গেলোবার জোসেফ যেমন গেলো এথেন্সের ওয়ার্ল্ড জাম্বুরিতে।

স্কুলের যে কোনও বিচিত্রানুষ্ঠানে নিকোলাস স্যার তার দলবল নিয়ে ঢুকে পড়তেন। নিখিল স্যার যখন জোরেশোরে মহড়া শুরু করেছেন, তখন তিনি গিয়ে বলতেন আমার ছেলেরা এটা করবে, ওটা করবে–এইসব। আমার ছেলেরা মানে কাব আর স্কাউট মিলিয়ে গোটা স্কুলের শ দুয়েকের মতো ছেলে। কোরাসের জন্যে হলেও এদের বার দুই তিন স্টেজে তুলবেন। আর ও ছেলেরাও তেমনি নিকোলাস স্যার বলতে অজ্ঞান।

নিখিল স্যার আমাদের পাইকারি দরে গান শেখাতেন। একেবারে বাঁধাধরা গান। ক্লাস টুতে খরবায়ু বয় বেগে, থ্রিতে মেঘের কোলে রোদ হেসেছে, ফোরে আমি ভয় করবো না, তা ফাইভে চল চল চল। সারা বছর এবং বছরের পর বছর একই গান। সপ্তায় একদিন গানের ক্লাস। তিনি এক লাইন গেয়ে শোনান আর ক্লাস শুদ্ধো সবাই গলা মেলায়। তবে বিচিত্রানুষ্ঠানের জন্য তিনি ছেলে বাছাই করে বাছাই করা গান শেখাতেন। নিকোলাস স্যারের ছেলেদের এসব ব্যাপারে দল বেঁধে নাক গলানো তিনি মোটেই পছন্দ করতেন না। যদিও তার বাছাই দলে স্কাউটের সংখ্যা কম থাকতো না।

সেবার প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী আর পুরস্কার বিতরণী উৎসব একই দিনে হবে। সারাদিন লম্বা অনুষ্ঠান। নিখিল স্যার ওপরের ক্লাস থেকে গোটা পঁচিশেক ছেলে বাছাই করে কাউকে গান, কাউকে গিটার, কাউকে জলতরঙ্গ, কাউকে আবৃত্তি শিখিয়ে তৈরি করছেন–দেখা গেলো নিকোলাস স্যারের জন্য তার মনমতো কিছু হওয়ার জো নেই। কারণ, নিকোলাস স্যারও তাঁর ছেলেদের নিয়ে তুমুল মহড়া দিচ্ছেন।

ফাংশনের আর মাত্র দিন দশেক বাকি। আমরা স্কাউট আর কাব-রা পাল্লা দিয়ে নাটকের মহড়া শুরু করে দিয়েছি। গোটা চারেক কোরাসের গান ঠিক করেছি, নাইন টেনের বড়রা যন্ত্রসঙ্গীতের মহড়া দিচ্ছে, পেট্রল লিডার জোসেফ ডি কস্টা ওয়ার্ল্ড জাম্বুরির অভিজ্ঞতা বলবে; সব ঠিক করে নিকোলাস স্যার গেলেন নিখিল স্যারের কাছে। পেছনে ফেউয়ের মতো আমরা কজন।

নিখিল স্যার তখন কোরাসে আবৃত্তি শেখাচ্ছিলেন। নিকোলাস স্যারকে দেখে হঠাৎ–হয়নি, হয়নি, এখানটায় সলো হবে, ফটকে সব গুলিয়ে ফেলেছে, বলে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

নিকোলাস স্যার বেশ গম্ভীর গলায় বললেন, আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিলো নিখিল স্যার।

কী কথা বলুন। তোরা থামলি কেন? আবার শুরু থেকে–। হাবলা তোর গলা এত চড়াবি না–বলে নিখিল স্যার আবার আবৃত্তি নিয়ে ব্যস্ত হলেন। 

আমি প্রোগ্রাম নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। নিকোলাস স্যার আরো গম্ভীর হয়ে বললেন।

নিখিল স্যারের ছেলেরা ততক্ষণে কোরাসে ভগবান তুমি যুগে যুগে দূত–শুরু করে দিয়েছে। নিখিল স্যার একটু বিরক্ত হয়ে নিকোলাস স্যারকে বললেন, কী বলবেন ঝটপট বলুন। তারপর গলা তুলে আমানুল্লাকে ধমক লাগালেন,-কী হলো তোর, গলায় কি ব্যাঙ আটকেছে, অমন গাক গাক করছিস কেন?

ওদের সঙ্গে কথা বললে আপনি আমার কথা শুনবেন কিভাবে? নিকোলাস স্যার চেষ্টা করেও নিখিল স্যারের মুখ ফেরাতে পারলেন না।

আরো বিরক্ত হয়ে নিখিল স্যার বললেন, আমি কান দিয়ে কথা শুনি। সাপের মতো জিব দিয়ে কথা শুনি না। কী বলবেন বলে আমায় রেহাই দিন।

আমার ছেলেরা একটা একাঙ্ক নাটক করবে, চারটা কোরাস রেডি করেছে, যন্ত্রসঙ্গীতের একটা আইটেমও আছে ওদের। আর জোসেফ বলবে এথেন্সের অভিজ্ঞতা। গড় গড় করে ফিরিস্তি শুনিয়ে একটু থামলেন নিকোলাস স্যার–আশা করি কোন আইটেমের পর কী হবে আপনি ঠিক করে দেবেন।

তোরা একটু থাম তো।–বলে নিখিল স্যার মুখ ফিরিয়ে নিকোলাস স্যারের দিকে তাকালেন। ভুরু কুঁচকে বললেন, আমার ধারণা ছিলো ভ্যারাইটি শো-তে কে কী করবে, প্রোগ্রাম কী হবে, সেটা ঠিক করার দায়িত্ব আমার। আপনি কি বলবেন নিকোলাস স্যার, কখন থেকে এ দায়িত্ব আপনাকে দেয়া হয়েছে?

দায়িত্ব আপনারই। শান্ত গম্ভীর গলায় নিকোলাস স্যার বললেন, প্রত্যেক বছর আমার ছেলেরা অনুষ্ঠান করে। অন্যান্যবার আপনি বলেন। এবার বলেননি দেখে আমার ছেলেরা কী করবে সেটা আমি ঠিক করেছি।

যা খুশি একটা ঠিক করলেই তো হয় না। মিহি গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন নিখিল–স্যার আমার ছেলেরা কি ঘাস কাটার জন্য এক মাস ধরে মহড়া দিচ্ছে?

আমার ছেলেরা এক মাস নয়, সারা বছর মহড়া দেয়। এবার রেগে গেলেন নিকোলাস স্যার–ঢের শুনেছি আপনার ওসব প্যানপ্যানে গান। ওগুলো মেয়েদের স্কুলেই ভালো মানায়। আমার ছেলেরা গাইবেই।

বললেই হলো! আরো সরু গলায় চ্যাঁচালেন নিখিল স্যার–স্কুলে কি কোনও ডিসিপ্লিন নেই? আমি আজই ব্রাদার ফিলিন্সকে বলবো।

ব্রাদার পিটার নিশ্চয়ই স্বর্গে যান নি। তিনি খুব ভালো করেই জানেন আমার ছেলেরা কেমন গায়।

এ ধরনের পরিস্থিতিতে ব্রাদার ফিলিপ্স সব সময় নিখিল স্যারের পক্ষ নিতেন আর ব্রাদার পিটার সমর্থন করতেন নিকোলাস স্যারকে। সেবার নিকোলাস স্যারের কপাল মন্দ। কদিন আগেই ব্রাদার পিটার গিয়েছেন বান্দুরা। আর ব্রাদার ফিলিন্স ঠিক তখনই কোথায় যেন যাচ্ছিলেন। নিখিল স্যারের গলা শুনে এদিকে এলেন।

রেগে গেলে ফর্শা গোলগাল নিখিল স্যারের চেহারাটা দেখে হাসি চেপে রাখা দায়। গোল গাল চোখ দুটো মার্বেলের মতো ঘুরতে থাকে, ঘন ঘন মাথা নাড়েন। আমরা সবই জিভ কামড়ে হাসি চাপতে ব্যস্ত। ব্রাদার ফিলিপ্স ঠোঁটের ফাঁকে হাসি চেপে ভুরু কুঁচকে কাছে এসে বললেন, কী হইয়াসে নিখিল স্যার। আপনি এত রাগিয়ে গিয়াসেন ক্যান?

আপনিই বলুন ব্রাদার! ভ্যারাইটি শো-র প্রোগ্রাম ঠিক করব আমি। ষোল আনা দায়িত্ব আমার ওপর, কিছু হলে হেডমাস্টার আমাকে ধরবেন। মাঝখান থেকে নিকোলাস স্যার এসে বলছেন তাঁর ছেলেরা দু ঘন্টা স্টেজ জুড়ে কি সব ছাইপাশ করবে।

দুঘন্টা নয়, সব মিলিয়ে এক ঘন্টা দশ মিনিট হবে। তিন ঘন্টার ভিতর এই সময় টুকু আমার ছেলেদের জন্য চেয়েছি। ওরা ছাইপাশ করে–একথা নিখিল স্যারের মুখে আমি প্রথম শুনলাম।

এ্যদ্দিন বলিনি তা করে। নিখিল স্যার চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, একশটা ছেলে কোরাস গায়, একটারও যদি গলা মেলে। ওসব ভোলা মাঠের হট্টগোলে চলতে পারে। অডিটোরিয়ামের ভেতর গার্জেন আর গণ্যমান্য গেস্টদের সামনে স্টেজে দেয়ার জিনিস নয়। তারপর হুঙ্কার দিলেন–ওসব হবে টবে না।

ব্রাদার ফিলিন্স হাসি চেপে আকাশের দিকে তাকিয়ে নিকোলাস স্যারকে বললেন, আপনার ভালো না লাগিলেও একথা আমাকে বলিতেই হইবে নিকোলাস স্যার, ভ্যারাইটি শো-এর বিষয়ে নিখিল স্যার যা বলিবেন উহা সকলকে মানিয়ে চলিতে হইবে। একটু থেমে যোগ করলেন, ব্রাদার পিটার থাকিলে তিনিও এই কথা বলিতেন।

নিখিল স্যার যুদ্ধে জেতা সেনাপতির মতো চিবুক উঁচিয়ে তাকালেন নিকোলাস স্যারের দিকে। গর্বিত গলায় বললেন, আপনার ছেলেদের আমি দুটো কোরাস গাইতে দিতে পারি। তাছাড়া জোসেফ আর কজন তো আমার নাটকেই আছে।

নিকোলাস স্যারের নরোম কালো মুখ বেগুনি রঙের হয়ে গেলো। কালো মোটা ফ্রেমের চশমার ভেতর মায়াভরা নিষ্পাপ চোখ দুটো মলিন মনে হলো। আমরাও ব্রাদারের কথা শুনে ভারি দুঃখ পেলাম। বলার কিছুই নেই। কারণ, তিনি সত্যি কথাই বলেছেন। ব্রাদার ফিলিপ্স নিরীহ গলায় নিকোলাস স্যারকে বললেন, আপনার পোলারা ক্যাম্পিং-এ যাউক না। উহারা নিখিল স্যাররে বিরক্ত করিতে আসে ক্যান। তারপর মুখ টিপে হেসে চোখ মটকালেন–উহাদের গান ক্যাম্প ফায়ার না হইলে জমে না।

ব্রাদারের কথা শুনে নিখিল স্যার খিক খিক করে ভুড়ি দুলিয়ে হাসলেন আর আমরা সবাই চটেমটে একাকার। না হয় আমরা একটু বেসুরো গাই। কোরাসে একশ ছেলেরা গলা মেলানো চাট্টিখানি কথা তো নয়।

ব্রাদার ফিলিপ্স চলে যেতেই ক্লাস নাইনের প্যাট্রিক বললো, আমাদের বাদ দিলে ফাংশনে যে কুকুর বেড়াল ডাকবে। ওসব কি নিখিল স্যার সামলাতে পারবেন?

প্যান্থার পেট্রলের শিবলী বললো, আমরা ফাংশন বয়কট করবো।

না । নিকোলাস স্যারের মুখে রহস্যের হাসি। আমরা ব্রাদার ফিলিন্স-এর পরামর্শ মতো ক্যাম্পিং-এ যাবো। এই বলে তিনি আমার দিকে তাকালেন–যাও আরিফকে বলো, পেট্রল লিডারদের কাউন্সিলের জরুরি মিটিং ডাকতে।

নিকোলাস স্যার কী ভেবে অমন রহস্যময় হেসে ক্যাম্পিং-এর কথা বললেন, তখন কিছুই বুঝিনি। এমন কি একগাল হেসে ব্রাদার ফিলিন্সকে যখন আমাদের অতিথি হয়ে সঙ্গে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন তখনও বুঝিনি সেই হাসির রহস্য। তবে ব্রাদার ফিলিন্সকে বলা মাত্রই তিনি অবশ্যই যাইব, অবশ্যই যাইব, বলে আহ্লাদে আটখানা হলেন।

স্কাউটদের ক্যাম্পিং-এ যাওয়া মানে দল বেঁধে জঙ্গলে গিয়ে তাঁবুর তলায় থাকা। নিজেদের রান্না আর সব কাজ নিজেরা করা–সেই ফাঁকে নানারকম ট্রেনিং, যেগুলো যুদ্ধের সময় ছোটদের দরকার হতে পারে। কে না জানে স্কাউটদের যুদ্ধের সময় কী রকম ঝুঁকি নিয়ে চিঠিপত্র আনা নেয়া করতে হয়, শত্রু শিবিরের খবর আনতে হয় আর গোপন সব সংকেত পাঠাতে হয় নিজেদের লোকদের। ক্যাম্পিং-এ যাওয়ার কথা শুনে বলা বাহুল্য সবারই রোমাঞ্চ হলো।

আমাদের ফিফথ ঢাকা ট্রপে তখন সব মিলিয়ে বারোটা পেট্রল। প্রত্যেক পেট্রলে আটজন করে স্কাউট, যার একজন হচ্ছে পেট্রল লিডার। আমি তখন ক্লাস নাইনে উঠেছি, উলফ পেট্রলের এসিসটেন্ট পেট্রল লিডার। আমাদের লিডার ছিলো ক্লাস টেনের এনামুল হাসান। বেশির ভাগ পেট্রল লিডার ক্লাস টেনের ছাত্র। পাঁচজন ছিলো ক্লাস নাইনের। সিক্সে না উঠলে স্কাউট হওয়া যেতো না। আমার পেট্রলে শুধু পনির ছিলো ক্লাস সিক্সের।

নিকোলাস স্যারের কথা মতো টুপ লিডার আরিফ চৌধুরীকে বললাম মিটিং ডাকতে। আমার কথা ওর বিশ্বাস হলো না। কাল বিকেলেই তো মিটিং ডাকলাম। আজ আবার কী হলো?–এই বলে ছুটলো নিকোলাস স্যারের কাছে।

একটু পরেই হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে এলো আমাদের টুপ লিডার। আমাকে ডেকে বললো, হ্যাঁরে নিখিল স্যারের সঙ্গে নিকোলাস স্যারের কী হয়েছে রে। তুই নাকি সব শুনেছিস?

যা শুনছি সব বললাম। আহ্লাদে আটখানা হয়ে টুপ লিডার বললো, এবারের ক্যাম্পিংটা জমাতে হয় তাহলে! জো কোথায়? ওকে ডেকে দিয়ে তোরা বাড়ি যা। খেয়ে দেয়ে বিকেলে আসিস।

পেট্রল লিডারদের ভেতর ক্লাস টেন-এর জোসেফ ডি কস্টা ছিলো সবচেয়ে রাশভারি। এরই ভেতর এথেন্স ছাড়া ইস্তাম্বুল, লাহোর আর কলম্বো ঘোরা হয়ে গেছে তার। নিকোলাস স্যার পর্যন্ত ওর সঙ্গে সমীহ করে কথা বলতেন। খুঁজে দেখি গির্জার সিঁড়িতে বসে দুজন কথা বলছেন। নিকোলাস স্যার গম্ভীর হয়ে বলছিলেন, এবারের ক্যাম্পিং স্পট হিসেবে মৌচাক সম্পর্কে তোমার কি ধারণা জোসেফ? নাকি শালনা যাবো?

নাকের ডগায় নেমে আসা চশমাটা ঠিক করে জোসেফ গম্ভীর গলায় বললো, নতুন কোন জায়গার কথা ভাবলে হয় না? আমি অন্য একটা ট্রেনিং-এর কথা ভাবছিলাম।

আমি বললাম, জো ভাই, তোমাকে আরিফ ভাই ডাকছে।

নিকোলাস স্যার মাথা নেড়ে সায় জানালেন–এ বিষয়ে আমরা পরে কথা বলবো জোসেফ। তুমি বরং আরিফের সঙ্গেও এ নিয়ে কথা বলো। এই বলে নিকোলাস স্যার উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসলেন–ক্যাম্পে যাওয়া নিশ্চয়ই নিখিল স্যারের ফাংশনের চেয়ে ভালো হবে।

আমি আহাদে গলে গিয়ে বললাম, অনেক মজা হবে।

এবার তাহলে তোমরা ঘুরঘুর না করে বাড়ি চলে যাও। মোলায়েম গলায় বললেন নিকোলাস স্যার–তোমার ভাই নিখিল স্যারের সঙ্গে রিহার্সাল দিচ্ছে দেখলাম।

দুপুরে ভাইয়া আর আমি বাড়ি এসে খেয়ে যাই। ভাইয়া ম্যাট্রিক দেবে। গিটার বাজাতে জানে বলে নিখিল স্যার ওকে ভারি আদর করেন। সিক্স-সেভেনে থাকতে কিছুদিন স্কাউটিং করেছিলো। ভালো লাগেনি বলে ছেড়ে দিয়েছে। ওর ওই স্বভাব। কোন কিছু বেশিদিন করতে পারে না। স্কাউটিং ছেড়ে কিছুদিন গান শেখার জন্য বাফায় গিয়েছিলো। গান ছেড়ে এখন গিটার ধরেছে। দিদা বলেন, গিটার ছাড়তে আর ছ মাস বাকি।

ভাইয়াকে খুঁজতে নিখিল স্যারের মহড়ার ঘরে এলাম। কেউ নেই সেখানে। রাগ করে সবাই বোধ হয় বাড়ি চলে গেছে। আমিও একা বাড়ির পথে পা বাড়ালাম।

স্কুল থেকে আমাদের রূপচঁদ লেনের বাড়িটা মাত্র দশ মিনিটের পথ। আসার পথে হাজারীর কেবিনে দেখি ভাইয়া ওদের ক্লাসের কটা বখাটে ছেলের সঙ্গে বসে চা খাচ্ছে। জানতাম আজ ওকে ওখানে দেখবো। ক্লাস নাইনে দুবার ফেল করা ফেলু মাস্টার খনুদা আমাকে দেখে বললো, এই যে গুড বয়, খাবে নাকি এক কাপ চা। নিখিল স্যারের প্যাদানি কেমন লাগলো?

ভাইয়া ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকালো। বয়ে গেছে ওদের সঙ্গে চা খেতে। আমি কোন কথা না বলে চলে এলাম। জানি আজও ভাইয়ার কপালে বাবার পিটুনি আছে। দিদা যখন সন্ধ্যের পর বাবাকে বলেন ভাইয়ার সারাদিনের ফিরিস্তি–দুপুরে খেতে আসেনি, কিম্বা রাস্তার ছেলেদের সঙ্গে মার্বেল আর লাট্ট খেলেছে, বাবা তখন খড়ম দিয়ে ওর পিঠের ওপর দুঘা বসাবেনই। ওই দুঘা খেয়েই ও এমন জোরে চেঁচায় কেউ না জানলে ভাবে বাড়িতে বুঝি ডাকাত পড়েছে।

দিদা আমাকে খেতে দিয়ে বললেন, বড় কর্তা বুঝি এলেন না! নিশ্চয়ই হোটেলের বাসি পচা খেয়ে পেট ভরাচ্ছেন?

আমি অম্লান বদনে বলে দিলাম, হাজারীর কেবিনে বসে সিঙাড়া খাচ্ছে।

খাওয়াবো ভালো করে। দিদা চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, আজ আমি নিজে ওর পিঠে আস্ত খড়ম ভাঙবো।

ছোটবেলায় মা মারা যাওয়ার পর গ্রামের বাড়ি থেকে দিদা এসে আমাদের তিনজনের ছোট সংসারটির ভার নিয়েছেন। বাবা সকালে কাজে যান। সন্ধ্যের পর বাড়ি ফেরেন। তখন তাঁর মেজাজ থাকে চড়া। ভাইয়ার কথা দিদা যে সব সময় বাবাকে বলেন তা নয়। তবে হোটেলে খাওয়ার কথা শুনলে তিনি নিজেই মেজাজ ঠাণ্ডা রাখতে পারেন না। তাই না বলে পারেন না। আর আমিও হাজারীর কেবিনে ভাইয়াকে দেখলেই দিদাকে এসে বলে দিই। কারণ যেদিন ও কেবিনে আড্ডা দেয়, বুঝতে হবে সেদিন সকালে স্কুলে যাওয়ার পথে আমার মাথায় গাট্টা মেরে টিফিনের পয়সাগুলো নিয়ে গেছে। ওর মার্বেল কেনার পয়সাও আমাকে জোগাতে হয়। আমার কোনও কথাই শুনবে না। ওর গায়ে জোর বেশি বলে এসব ব্যাপারে দিদাকে জানানো ছাড়া আমার কিছুই করার থাকে না।

দুপুরে খাওয়ার পর দিদা ওঁর ঘরে বিছানায় শুয়ে রোজকার মতো ফর ফর করে নাক ডাকা আরম্ভ করেছেন। আমিও সুযোগ বুঝে পা টিপে বেরিয়ে এলাম। সন্ধ্যে বেলা দিদার ঘুম থেকে জেগে ওঠার আগেই ফিরে আসা যাবে।

চারটায় স্কুলে এসে দেখি আমাদের পেট্রল লিডার আর এ্যাসিসটেন্টরা সবাই এসে গেছে। শুধু নিকোলাস স্যারকে কোথাও দেখলাম না। সবাই মিলে টেনিস কোর্টে বসলাম গোল হয়ে। টিটকিরি মারার জন্য নিখিল স্যারের ছেলেদের কাউকে আশেপাশে দেখা গেলো না।

ট্রপ লিডার আরিফ বললো, আমরা ক্যাম্পিং-এ যাচ্ছি তোমরা সবাই এরই মধ্যে নিশ্চয়ই জেনেছে। এ বিষয়ে জো তোমাদের বিস্তারিত বলবে।

নাকের ডগায় নেমে আসা চশমাটা ওপরের দিকে ঠেলে দিয়ে জোসেফ বললো, তোমরা এর আগে কয়েকবারই ক্যাম্পিং-এ গিয়েছে। গতবার যাওয়া হয়েছিলো মৌচাকে, তার আগের বার জয়দেবপুরে, একবার শালনাও যাওয়া হয়েছে। তোমরা যারা টেণ্ডারফুট বা সেকেণ্ড ক্লাস স্কাউট তারা জঙ্গলের ভেতর ট্র্যাকিং করতে জানো কিন্তু লোকালয়ে ট্র্যাকিং ফলো করে কিভাবে কোথায় যেতে হয় সেটা জানো না। যুদ্ধের সময় ট্র্যাকিং যদি ঠিক মতো ফলো করতে না পারো তাহলে দেখা যাবে একজনের ভুলের জন্য একটা গোটা কোম্পানি বা রেজিমেন্ট ধ্বংস হয়ে গেছে। তাই এবারে ক্যাম্পিং-এর ট্রেনিং শুরু হবে ব্যস্ত লোকালয়ে ট্র্যাকিং ফলো করার ভেতর দিয়ে। গোটা টুপ এবার এক সঙ্গে যাবে। তবে ক্যাম্প লাইফের অন্যান্য ট্রেনিং আগের মতোই থাকবে। যাতে করে যুদ্ধ বা জরুরি অবস্থার জন্য আমরা সব সময় তৈরি থাকতে পারি।

সামরিক বাহিনীর একজন যোগ্য অধিনায়কের মতোই বক্তৃতা দিচ্ছিলো জোসেফ। শেষ করে জানতে চাইলোকারো কোনো প্রশ্ন আছে?

পেট্রল লিডার শওকত বললো, যাবো কিভাবে, বাসে না অন্য কিছুতে?

হেঁটে। এক কথায় জবাব দিলো জোসেফ।

জার্নি টেস্ট না হলে সাধারণত পুরো রাস্তাটা আমরা বাসে যাই। ক্যাম্পিং স্পটের কাছে পাঁচ ছয় মাইলের ভেতর এনে আমাদের নামিয়ে দেয়া হয় বাস থেকে। তখন পেট্রলগুলো আলাদাভাবে ট্র্যাক অনুসরণ করে বিভিন্ন দিক দিয়ে আসল জায়গায় পৌঁছোয়। পুরো রাস্তা হেঁটে আগে কখনো ক্যাম্পিং-এ যাইনি।

জোসেফের কথা শুনে আমরা একে অপরের মুখের দিকে তাকালাম। শহরের আট দশ মাইলের ভেতর কোন ক্যাম্পিং স্পট আছে বলে তো শুনিনি কখনো। সাধারণত কোন বনের পাশেই ক্যাম্প করা হয়। এ বার হচ্ছেটা কী? টুপ লিডার আরিফের দিকে তাকালাম। মুখ টিপে হেসে ও আকাশ দেখতে লাগলো। জোসেফকেও ততোটা গম্ভীর মনে হলো না। বললো, আমরা পরশু ভোরে রওনা দেবো। কাল পেট্রল লিডার আর এ্যাসিস্টেন্ট লিডাররা এসে ডেন থেকে জিনিসপত্র বের করে গুছিয়ে রাখবে। সঙ্গে কী কী নিতে হবে ছেলেদের বলে দেবে।

.

০২. একের পর এক শুধু বাধা

পিকনিকে যাওয়া নিয়ে অনেক সময় আপত্তি করলেও বাবা ক্যাম্পিং-এ যেতে কখনো বাধা দেন না। তার হিসেব খুব সোজা। বলেন, পয়সা অত সস্তা নয়, ফুর্তি করার জন্য একদিনে পাঁচ টাকা ওড়াতে হবে। ক্যাম্পে দশ টাকা লাগলেও ওখানে কিছু শিক্ষা হয়।

তখন পাঁচ দশ টাকাতেই ক্যাম্প, পিকনিক হয়ে যেতো। হবে না কেন? একটা বড় মুরগির দাম দুটাকার বেশি ছিলো না। ভালো বাসমতি চাল বারো আনা সের। স্কুলে টিফিনের জন্য ক্লাস সেভেনে ওঠার পর রোজ দুআনা করে পেতাম, তাই দিয়ে দুটো বড় বড় পেয়ারা নয় তো এক ছটাক নকুলদানা কিনে খেতাম মিয়ার দোকান থেকে। ভোলানাথের দোকানে নারকেলের সন্দেশ পাওয়া যেতো দুপয়সা দামে।

বাবা কাগজিটোলার এক ছাপাখানায় ম্যানেজারের কাজ করতেন। বেশি বড় ছাপাখানা নয়, দুটো মেশিন আর বারো-চোদ্দজন কর্মচারী। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সেখানে থাকতে হতো বাবাকে। কাজের চাপ বেশি থাকলে রাতও হতো। আমাদের বাড়ি থেকে দুই গলি দূর হলেও দুপুরে খাবার জন্যে পর্যন্ত তাঁর বাড়ি ফেরা হতো না। দিদা সকালের রুটি আর ভাজি টিফিন বাক্সে ভরে দিতেন।

রাতে খেয়ে-দেয়ে শোবার আগে বাবা যখন পান চিবুতে চিবুতে দিদার সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন ক্যাম্পিং-এ যাওয়ার কথাটা পাড়লাম। একটু গম্ভীর হয়ে বাবা বললেন, আজ মাসের কতারিখ খেয়াল আছে?

ভয়ে ভয়ে বললাম, একুশ।

মাসের শেষে হঠাৎ ক্যাম্প করার বুদ্ধি গজালো কার মাথায়?

হঠাৎ করে ঠিক হয়েছে। আজই ব্রাদার ফিলিপ্স বললেন….।

তোমাদের ব্রাদাররা তো সুখেই আছেন। মাসের শেষে উটকো খরচের টাকা কোত্থেকে আসে শুনি?

বাবার কথা শুনে সারাদিনের উত্তেজনা আর রোমাঞ্চ ফুটো বেলুনের মতো চুপসে গেলো। মাসের শেষে আমাদের সংসারে এটা যে বাড়তি বোঝা হতে পারে–কথাটা একবারও ভাবিনি।

পরশু আমাদের সবাই নতুন ধরনের ক্যাম্পিং-এ যাবে এক অজানা জায়গায়, আর আমি ঘরে বসে ভাইয়ার টিটকিরি শুনবো, কথাটা ভাবতেই বুকের ভেতর কী যেন দলা পাকিয়ে গলা ঠেলে উঠে আসতে চাইলো। এর মানে দাঁড়াচ্ছে এ বছরে স্কুলের কোনো ফাংশনেও আমি স্টেজে উঠবো না। নিকোলাস স্যার নাটক আর কোরাস দুটোতেই আমাকে রেখেছিলেন। নাটকের পার্টটা কম বড় নয়, সাড়ে চার পৃষ্ঠা ডায়ালগ মুখস্ত করতে হয়েছে। নিখিল স্যারের নাটকের ছেলেরা যখন দেখবে আঁক করে ক্যাম্পিং-এ যাবো বলে যাইনি, তখন কী পরিমাণ হাসাহাসি করবে দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পেলাম। কান্নায় গলা বুজে আসতে চাইছিলো, চৌকাঠ ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম।

বাবা সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, দশ টাকা মানে বোঝ তো, আমাদের পাঁচ দিনের বাজার খরচ। আমার বেতন পেতে তিন-চার তারিখ হবে। যাও, মন খারাপ করো না। বন্ধুদের কাছে শুনে নিও ক্যাম্পে এবার নতুন কী শিখিয়েছে।

আমি তবু দাঁড়িয়ে থাকলাম। বাবাকে তো বোঝানো যাবে না এবারের ক্যাম্পিং একেবারে অন্য ধরনের। নিকোলাস স্যার আর জোসেফের কথা শুনে মনে হয়েছে এটা একটা মস্তো চ্যালেঞ্জের মতো।

দিদা আমার মনের অবস্থাটা বুঝতে পারলেন। বাবাকে বললেন, আমি একটা কাজ করতে পারি। কাল বরং পুরোনো খবরের কাগজ আর খালি শিশি বোতল কিছু বিক্রি করে দিই। কি বলিস সালু?

দিদার কথা শুনে আমার বুকের ভেতরটা উত্তেজনায় টিব টিব করতে লাগলো।

পুরোনো কাগজ বেচে ক পয়সাই বা পাবে! বাবার গলাটা বিষণ্ণ মনে হলো। আমি আবার চুপসে গেলাম।

দিদা উৎসাহভরা গলায় বললেন, গত দুমাস কাগজ বেচিনি। আর ওষুধের শিশি বোতলও কিছু জমেছে। আট দশ টাকা হয়ে যাবে। কিছু কম পড়লে এই ছোঁড়ার ব্যাংক ভাঙবো।

আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম, আমার ব্যাংক দুটাকার বেশি জমেছে।

তবে আর যেতে বাধা কোথায়? শুকনো গলায় কথাগুলো বলে খবরের কাগজে মুখ ঢাকলেন বাবা।

ঘরে এসে দেখি বাবার ভয়ে ভাইয়া বসে অংক করছে। ক্লাসে আমি সব সময় প্রথম তিনজনের ভেতর থাকি বলে পরীক্ষার পর আমাকে পড়তে হয় না। ভাইয়া থাকে শেষ দশজনের ভেতরে। প্রায়ই অংকে ফেল করে। বাবা ওকে বলে দিয়েছেন ছুটির দেড় মাসের ভেতরে পাটিগণিত, এ্যালজেব্রা আর জ্যামিতির সবগুলো অনুশীলনী শেষ করে তাকে দেখাতে।

আমি আর ভাইয়া পার্টিশন দেয়া ঘরের এক পাশে থাকি। আরেক পাশে বসার জায়গা। বাবা আর দিদা এক ঘরে থাকেন। খাবার জন্য আমাদের কোন আলাদা ঘর নেই। সবাই রান্নাঘরে মাদুর পেতে খাই। পুরনো দিনের একতলা বাড়ি। আগে নাকি চৌধুরী বাড়ির সহিস আর মালিরা থাকতো এখানে। সামনে এক চিলতে রোয়াকের মতো। এরই ভাড়া মাসে ষাট টাকা।

ঘরের দরজা বন্ধ করে আমি আমার টিনের সুটকেসটা খুলে স্কাউটিং-এর ইউনিফর্ম, হ্যাভারস্যাক, রোফ, নাইফ, ক্যান্টিন সব বের করলাম। দেখলাম মোজা জোড়া ধুতে হবে। জুতো রং করতে হবে। আর সব ঠিক আছে।

ভাইয়া এতক্ষণ আড় চোখে দেখছিলো। আমি ওর দিকে না তাকিয়ে সব কিছু গুছিয়ে রেখে আমার বিছানায় উঠে শুয়ে পড়লাম। ভাইয়া চাপা গলায় বললো, নিকোলাস স্যার বুঝি ভেবেছেন, তোদের বাদ দিয়ে আমরা ফাংশন করতে পারবো না?

কেন পারবে না। লেপের বাইরে মুখটা বের করে বললাম, তুমি একাই তো একশ। তার ওপর খনুদা আছে পটলবাবু আছে, কম কী! কথা না বাড়িয়ে আমি লেপ টেনে মুখ ঢেকে শুয়ে পড়লাম।

ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলাম কেনিয়াতে ওয়ার্ল্ড জাম্বুরি হচ্ছে। আমরা সবাই গিয়েছি সেখানে। ঘন জঙ্গলের ভেতর তাঁবু টানিয়েছি। রাতে বাইরে সিংহের ডাক শোনা যাচ্ছে। সবাই আগুন জ্বেলে গোল হয়ে বসে ক্যাম্প ফায়ার করছি। নইম গিটারে গ্লোরি গ্লোরি হালালুজার সুর বাজাচ্ছে। আমরা সবাই ওর বাজানোর সঙ্গে সঙ্গে গাইলাম–এ্যাজ উই গো মার্চিং অল। হঠাৎ নিকোলাস স্যার কোত্থেকে এসে বললেন, আমাদের টুপ এবার বেস্ট পারফরমেন্স এ্যাওয়ার্ড পাচ্ছে। সবাই হুররে–বলে চীৎকার করে উঠলাম।

ঠিক তখনই ঘুম ভাঙলো দিদার ডাকে–আর কতো ঘুমোবি? তোর বাবা প্রেসে চলে গেলো। উঠে নাশতা খেয়ে আমাকে একটা পুরোনো কাগজঅলা ডেকে দে।

এক লাফে উঠে তিরিশটা বুকডন দিয়ে মুখ হাত ধুয়ে রান্নাঘরে খেতে বসেছি, এমন সময় বাইরে শুনি–আছে-এ পুরানা শিশি বোতল কাগ-অ-জ। মনে হলো জীবনে এত সুন্দর ডাক শুনিনি।

ছুটে গিয়ে কাগজওয়ালাকে ডেকে আনলাম। দিদা বসলেন দর ঠিক করতে। অনেক কাগজের লোভ দেখিয়ে দিদা দশ আনায় রফা করলেন। মেপে হিসেব করে দেখা গেলো মোটে চার টাকা ছ আনা হয়েছে।

আমি একটু দমে গিয়ে বললাম, দিদা শিশি বোতলগুলো আনবো?

ইশারা পেয়েই স্টোর রুম খালি করে যত শিশি বোতল কৌটা ছিলো এনে দিদার সামনে রাখলাম। দিদা একটা একটা করে দর করতে লাগলেন। শিশি বোতল বিক্রি করে দুটাকা বারো আনা হলো। কাগজঅলা বললো পুরানা খাতা বই নাই?

আমার ক্লাস এইটের বইগুলো পরীক্ষার পরই ভাইয়া নিয়ে বাংলা বাজারের পুরোনো বইয়ের দোকানে বিক্রি করে দিয়েছে। খাতা যে কটা ছিলো আনলাম। মলাটওয়ালা খাতা চার আনা করে সের। মাত্র দেড় সের হলো। দশ টাকা হতে আরো আড়াই টাকা বাকি। দিদাকে বললাম, ব্যাংক ভেঙে দেখবো?

তুই থামতো। আমাকে ধমকে দিদা কাগজঅলাকে বললেন, আর কী নাও তোমরা?

পুরান কাপুড় লই। এ্যালমুনিয়ামের ভাঙা হাড়ি পাতিল লই। তামা পিতলের জিনিস লই। আছেনি গো দাদিজান?

দিদা বাবার পোকায় খাওয়া একটা কোট, আমার ছোট হয়ে যাওয়া দুটো প্যান্ট আর একটা শার্ট আনলেন। তাতেও যখন হলো না, এ্যালমুনিয়ামের ফুটো ঘটি আর একটা ছোট পাতিল দিলেন। সব হিসেব করে দশ টাকা পাঁচ আনা নিয়ে কাগজঅলাকে বিদায় করলেন। বললেন, এই দশ টাকা তোর। সাবধানে রাখ : পাঁচ আনা দিয়ে বাজার থেকে একটা নারকেল আর একপো গুড় এনে দে। কাল সকালে চিতই পিঠা বানাবো। তোর বাবা খুব পছন্দ করে।

সুত্রাপুরের বাজার থেকে দিদাকে নারকেল গুড় এনে দিয়ে ছুটলাম স্কুলে। পথে দেখি হাজারীর কেবিনে খনুদা আর লতু বসে আছে। ভাইয়া সকালে গিটার শিখতে গেছে ডালপট্টির সুরঙ্গনা একাডেমিতে। বাবা বলেছেন যত ভাল বাজাতে শিখুক না কেন পরীক্ষার রেজাল্ট দশের ভেতরে না থাকলে গিটার কিনে দেবেন না। অগত্যা ওর এক বন্ধুর গিটার দিয়ে শিখছে। ও নিজেও জানে এ জন্মে দশের ভেতরে থাকতে পারবে না।

স্কুলে গিয়ে দেখি নিকোলাস স্যার দলবল নিয়ে ডেন খুলে জিনিসপত্র সব বের করছেন। জিনিস বলতে, তাঁবু, হাড়ি পাতিল, বালতি, দড়ি, বাঁশ এই সব। আমিও হাত লাগালাম। প্যান্থার পেট্রলের এ্যাসিসটেন্ট শিবলী চাপা গলায় বললো, নিখিল স্যার রেগে বাখারি হয়ে আছেন!

তাঁবু ভাঁজ করতে করতে বললাম, কেন, আবার কী হলো?

আমরা সবাই ক্যাম্পে যাচ্ছি বলে।

আমরা কি ক্যাম্পেও যেতে পারবো না?

চুপ! আসছেন!

শিবলীর কথা শুনে আড় চোখে তাকিয়ে দেখি গোল মুখটা আরো গোল করে নিখিল স্যার হন্তদন্ত হয়ে এ দিকে আসছেন। কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা এসে বললেন, আপনি এসব কী করছেন নিকোলাস স্যার?

কী করছি দেখতেই তো পাচ্ছেন! ক্যাম্পিং-এ যাচ্ছি। নিকোলাস স্যার গম্ভীর হয়ে বললেন।

তা তো দেখতেই পাচ্ছি। মিহি গলায় পেঁচিয়ে উঠলেন নিখিল স্যার–আমাকে এভাবে জব্দ না করলে বুঝি চলছিলো না?

আপনাকে কেন জব্দ করবো?

কেন করবেন আপনি সেটা ভালো জানেন।

আমি আপানার কথা বুঝতে পারছি না নিখিল স্যার।

খুব পারছেন! আমাকে কচি খোকা ভাববেন না নিকোলাস স্যার। আপনি ক্যাম্পে যাবার কথা বলে আমার নাটকের দল ভেঙে দিয়েছেন। জো-কে ছাড়া আমি লাইট করবো কাকে দিয়ে? জগৎশেঠ, ক্লাইভ, ওয়াট আর লুঙ্কার পার্ট করবে কে শুনি? সব কটাকে তো আপনি নিয়ে যাচ্ছেন!

আমি কেন আপনার জগৎশেঠ, লুৎফা নিতে যাবো?

আমি এখনো পাগল হইনি নিকোলাস স্যার। আপনি আরিফ, শওকত, নীলু, বান্টি সবাইকে নিয়ে যাচ্ছেন। কেন নিয়ে যাচ্ছেন–ভেবেছেন কিছুই বুঝি না?

আপনার কাছে ওদের কেউ হয়তো জগৎশেঠ, ওয়াট, ক্লাইভ, লুত্যা হতে পারে। তবে আমার কাছে ওরা ট্রপ লিডার, পেট্রল লিডার আর এসিসটেন্ট পেট্রল লিডার। ওদের বাদ দিয়ে ক্যাম্পিং-এ যাওয়া সম্ভব নয়। আপনি যদি ওদের কাছে জানতে চান কোনটা ওরা বেশি পছন্দ করবে-লুঙ্কা, জগৎশেঠ হয়ে আপনার স্টেজে ওঠা না পেট্রল আর ট্রপ লিডার হয়ে ক্যাম্পিং-এ যাওয়া–আমার মনে হয় ওর শেষেরটাই পছন্দ করবে।

তাতো বলবেনই। আপনাকে দেড় ঘন্টা সময় দেইনি বলে আমার এত বড় সর্বনাশ করবেন আপনি?

নিখিল স্যারের চেঁচাননা শুনে দোতালা থেকে নেমে এলেন ব্রাদার ফিলিপ্স। বললেন, আইজ আবার কী হইসে নিখিল স্যার?

কী আর হবে! নিকোলাস স্যার আমার সর্বনাশ করবেন বলে পণ করেছেন। আমার নাটকের ছেলেদের তিনি ক্যাম্পে নিয়ে যাচ্ছেন। দুমাস ধরে আমি মহড়া দিচ্ছি। দশদিন পর ফাংশন, এর ভেতরে আমি কোথায় পাবো জগৎশেঠ আর ক্লাইভ? কোথায় পাবো ওয়াট আর লুৎফাকে?

ভুরু কুঁচকে অবাক হয়ে ব্রাদার জিজ্ঞেস করলেন, কোন ক্লাইভের কথা কইতাসেন?

শান্ত গলায় নিকোলাস স্যার বললেন, ইতিহাসে ক্লাইভ একজনই আছেন। পলাশীর যুদ্ধে যিনি ইংরেজদের সেনাপতি ছিলেন।

লুৎফা কে?

নবাব সিরাজউদ্দৌলার বেগম।

এদের সঙ্গে আপনার কী সম্পর্ক?

ওরা আমাদের ট্রপের স্কাউট। টুপ লিডার আর পেট্রল লিডার।

আমি কিছু বুঝতাসি না। অবাক হয়ে ব্রাদার বান্দুরার বাবুর্চি লিস্টারের কাছে শেখা বাংলায় প্রশ্ন করলেন–আপনি এসব কি কইতাসেন নিকোলাস স্যার? নবাবের বেগম আর ইংরেজের সেনাপতি আপনাগো স্কাউট হয় ক্যামনে? হ্যারাত দুইশ বছর আগে স্বর্গে গেছেন।

সব সময় আপনার ঠাট্টা ইয়ার্কি ভাল লাগে না নিকোলাস স্যার। গলা সপ্তমে তুলে নিখিল স্যার বললেন, আমি সিরাজউদ্দৌলা নাটক করছি। আপনার কটা ছেলে সেই নাটকে এ্যাকটিং করছে, আপনি তাদের ভাগিয়ে নিচ্ছেন–কথাগুলো পষ্ট করে ব্রাদার ফিলিন্সকে বললে কী হয়?

এই কথা আগে কইবেন তো! বলে হা হা করে হাসলেন ব্রাদার ফিলিপ্স। আমি তো ডর পাইসিলাম। দুশ বছরের পুরান নবাবের বেগম আর ইংরেজের সেনাপতি আমাগ স্কুলে স্কাউটিং করে হা—হা–হা।

নিখিল স্যার বিরক্ত হয়ে বললেন, আমার নাটকের কী হবে শুনি?

হাসি থামিয়ে ব্রাদার বললেন আপনার পছন্দ হইলে আমি ক্লাইভের পার্টে এ্যাকটিং করতাম পারি। ছোটবেলায় আমি ম্যালা নাটক করসি।

আপনার এই বাংলা ক্লাইভ বললে আমাকে সবাই পচা ডিম ছুঁড়বে। .

হায়, হায়, তাইলে আমি কী করতাম পারি? আমি যে তাগোরে ক্যাম্পিং-এ যাইবার কইসি।

নিকোলাস স্যার বললেন, আজ সকালে কমিশনারের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তিনি শেষ দিন উপস্থিত থাকবেন। আরিফ পারমিশনের জন্য চলে গেছে। জো গেছে বাজার করতে। এই অবস্থায় কাম্পিং-এ যাওয়া বন্ধ করা সম্ভব নয়।

ভাঙা গলায় নিখিল স্যার আবার বললেন, আমার নাটকের কী হবে?

নিকোলাস স্যার বললেন, খনুকে বলুন লুঙ্কার পার্ট করতে। একবার তো করেছিলো।

সে তো পাঁচ বছর আগে। এখন যে ওর গোঁপ দাড়ি গজিয়েছে, ষাড়ের মতো গলা আর তালগাছের মতো ঢ্যাঙা হয়েছে কিছুই বুঝি নজরে পড়েনি?

ব্রাদার আপোসের গলায় বললেন, ওইন্য নাটক করেন না নিখিল স্যার। সিরাজউদ্দৌলাত দুইবার দেখাইসেন।

হ্যাঃ! দশ দিনে আমি নতুন নাটক করবো! বললেই হলো! বলে দুমদাম পা ফেলে চলে গেলেন নিখিল স্যার।

ক্যাম্পিং-এ যাওয়ার কথায় কাল নিকোলাস স্যার কেন রহস্যময় হেসেছিলেন এতক্ষণে আমাদের কাছে পরিষ্কার হলো। আমরা সবাই হাসি চাপবার জন্য কাজে ডবল মনোযোগ দিলাম। ব্রাদার ফিলিপ্সও মুখ টিপে হেসে চলে গেলেন।

জিনিসপত্র গোছাতে গোছাতে যখন দুপুর একটা বাজে টুপ লিডার আরিফ শুকনো মুখে এসে নিকোলাস স্যারকে বললো, বাগানবাড়ির পারমিশন পাওয়া গেলো না। এক সিনেমা কোম্পানি নাকি সুটিং-এর জন্য ভাড়া নিয়েছে।

অবাক হয়ে নিকোলাস স্যার বললেন, কমিশনারের সঙ্গে সকালে আমার কথা, হয়েছে। তখন তো কিছু বলেননি?

তিনি নাকি আগে জানতেন না। ম্লান মুখে টুপ লিডার বললো, তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন, ওখানে জানুয়ারির আগে ক্যাম্পিং-এ যাওয়া যাবে না।

জানুয়ারিতে তো আমাদের ক্লাস শুরু হয়ে যাবে?

বলেছি। তিনি বললেন, মৌচাক যেতে। আমরা যে ধরনের ক্যাম্পিং-এর প্ল্যান করেছি সেটা যে মৌচাকে সম্ভব নয়, বলো নি?

বলেছি। তিনি বললেন, এর জন্য উচিত ছিলো পনেরো দিন আগে ওঁকে জানানো।

নিকোলাস স্যার হতভম্ব হয়ে ঘাসের ওপর বসে পড়লেন। আমরা কান খাড়া করে ওঁদের কথা শুনলেও নিবিষ্ট মনে আমাদের কাজ করে যাচ্ছিলাম। কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিকোলাস স্যার বললেন, কারা এই সিনেমা কোম্পানি–কিছু জানো আরিফ?

কোম্পানির নাম ফাইভ স্টার মুভিজ। যে ছবির সুটিং হচ্ছে ওটার নাম রাজনতর্কী।

নিকোলাস স্যার কিছুক্ষণ চুপ থেকে কি যেন ভাবলেন। তারপর কাষ্ঠ হেসে বললেন, ক্যাম্পিং-এ আমরা যাবোই আরিফ। স্পট আমি আজ বিকেলের মধ্যেই ঠিক করবো। তুমি ছেলেদের এখন বাড়ি যেতে বলে দাও। সবাই যেন বিকেল চারটায় উপস্থিত হয়। ওদের কম্বলগুলো ডেনে জমা দিতে বলে। নিজেরা এতোটা পথ বইতে। পারবে না।

নিকোলাস স্যারের কথা শুনে বোঝা গেলো যাওয়ার ব্যাপারে জিদ মোল আনা থাকলেও উৎসাহে কোথায় যেন ভাটা পড়েছে। একবার আমরা আরমানিটোলার মাঠে একদিনের জন্য ক্যাম্প করেছিলাম। কে জানে শেষ পর্যন্ত হয়তো তাই হবে। আমরাও বেশ কিছুটা দমে গেলাম।

বাড়িতে গিয়ে দুপুরের খাওয়াটা নাকে মুখে গুঁজে স্কুলে আসতে যাবো বাইরে, রোয়াকে দেখি ভাইয়া বসে আছে। একগাল হেসে বললো, কিরে তোদের নাকি ক্যাম্পিং-এ যাওয়া হচ্ছে না?

তোমাকে কে বললো?

সদানন্দর কাছে শুনলাম। সত্যি নাকি! আহ্লাদে গদ গদ হয়ে ওর গলা বুজে এলো।র

ক্যাম্পে আমরা যাবোই। পারলে লুফা আর ক্লাইভের পার্টি মুখস্থ করো গে, নইলে নিজের চরকায় তেল দাও। এই বলে আমি হন্ হন্ করে চলে এলাম।

স্কুলে এসে দেখি মোটে তিনটে বাজে। এর ভেতরে অর্ধেকের বেশি ছেলে চলে এসেছে। আমাকে দেখে শিবলী আর বান্টি এগিয়ে এলোখবর কিছু পেলি?

কিসের খবর?

পারমিশন পাওয়া গেলো কি-না?

আমি কী করে জানবো? স্যার কিম্বা আরিফ ভাই আসুক।

বান্টি বেশ আস্থার গলায় বললো, আমার মন বলছে নিকোলাস স্যার ঠিকই একটা ব্যবস্থা করবেন।

শিবলী গলা নামিয়ে বললো, নিখিল স্যার আবার কমিশনারকে কিছু বলেননি ততা?

আমাদের এইসব জল্পনার ভেতরে চারটে বেজে গেলো। সবার শেষে এলো পেট্রল লিডার জোসেফ ডি কস্টা। তখনও নিকোলাস স্যার বা টুপ লিডার কেউ আসেননি। জোসেফ পেট্রল লিডার আর এ্যাসিসটেন্টদের ডেকে বললো, তোমরা তো জানো আমরা এবার নতুন ধরনের ক্যাম্পিং-এ যাচ্ছি। যে কারণে এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না আমরা কোথায় যাবো।

 একটু হিন্টস দে না জো। জোসেফের ক্লাসমেট শওকত তেলমাখা গলায় অনুনয় করলো।

না কোন হিন্টস নয়। কাল সকালে বাবুর্চি লিস্টারের কাছে আমাদের নির্দেশ পাবে। জোসেফ গম্ভীর হয়ে বললো, সবাই ভোর সাতটায় এখানে আসবে। লিস্টার এনামুলকে একটা চিরকুট দেবে।