০৩-৪. খাগড়াছড়ির আসল ভয়

০৩. খাগড়াছড়ির আসল ভয়

দূরে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। ঠাণ্ডা ভেজা বাতাসে টুটুলের সব ক্লান্তি জুড়িয়ে গেলো। ভাবলো, রাতের ভেতর কমলছড়ি পৌঁছতে পারলে বেশ হতো। হেডমাস্টার বললে গ্যারেজঅলারা নিশ্চয়ই ব্যাটারি বদলে দেবে।

মাঝবয়সী হেডমাস্টারের সঙ্গে কথা বলতে-বলতে বাবা এলেন। হেডমাস্টার বার-বার বলছিলেন, না, না, হাবিব সাহেব, কোনো কথা শুনবো না। গরিবের বাড়িতে খুঁদকুঁড়ো যা আছে চাট্টি খেয়ে রাতটুকু থেকে যেতে হবে। এই রাতে আমি কিছুতেই আপনাদের কমলছড়ি যেতে দেবো না।

বাবা কি যেন বলতে গেলেন, বাধা দিয়ে হেডমাস্টার বললেন, জানি বড়য়াকে বললে এখনি আপনার ব্যাটারি পাল্টে দেবে, তবু এই অমাবস্যার রাতে আপনাকে কিছুতেই যেতে দেবো না। ঠিক আছে, মাকে বরং আমি বুঝিয়ে বলবো।

কাছে এসে বাবা হেডমাস্টারের সঙ্গে সবার পরিচয় করিয়ে দিলেন। হেডমাস্টার দিদা আর মাকে হাত তুলে সালাম করে মিতুল, কুমার থুতনি নেড়ে আদর করে টুটুলের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। তারপর দিদাকে বললেন, কি যে খুশি হয়েছি মা! হাবিব সাহেব কিছুতে রাজি হচ্ছেন না। আপনি একটু বুঝিয়ে বলুন, এই অমাবস্যার রাতে কমলছড়ি যাওয়া মোটেই উচিত হবে না।

পথে কোথাও থাকা দিদার পছন্দ নয়। তবে অমাবস্যার কথা আলাদা। হেডমাস্টার মা ডাকাতে দিদা খুশিও হলেন। তবু কাষ্ঠ হেসে বললেন, পথে কারো গাড়ি বিগড়ে গেলে কেউ খুশি হয় এই প্রথম জানলাম। তবে থাকতে যখন বলছেন, আমার আপত্তি নেই। বরং আমাদের খুশি হওয়া উচিত এ জন্য।

হেডমাস্টার বললেন, আপনি ভুল বুঝেছেন মা। আমি খুশি হয়েছি আপনার সেবা করতে পারবো বলে।

দিদা একগাল হেসে বললেন, তাহলে চলো বাছা, তোমার বাড়ি গিয়ে সেবা খাই।

ভারি ট্রাঙ্ক দুটো গাড়িতে রেখে সবাই হাতব্যাগগুলো নিয়ে হেডমাস্টারকে অনুসরণ করলো। মিতুল আর ঝুমাও দুটো ছোট ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়েছে। তবে ঝুমা ছিলো হেডমাস্টারের কোলে।

স্কুলঘর থেকে হেডমাস্টারের বাড়ি পাঁচ মিনিটের পথ। হেডমাস্টার-গিন্নি একটা হারিকেন হাতে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হেডমাস্টার ডাকলেন, কইগো, দেখ ইঞ্জিনিয়ার সাহেবরা এসেছেন। বিদ্যুৎ কোথায়, এসে ধর না।

হেডমাস্টার-গিন্নির পেছন-পেছন টুটুলের বয়সী একটি ছেলে বেরিয়ে এলো। মা আর দিদার হাত থেকে ব্যাগ দুটো নিয়ে লাজুক হেসে বললো, ভেতরে আসুন।

হেডমাস্টার বললেন, আমার একমাত্র ছেলে। ক্লাস নাইনে পড়ে।

হেডমাস্টারের ঘরের দেয়াল বাঁশের শক্ত বেড়ার, ওপরে টিন, মেঝে পাকা। পাহাড়ের ওপর যারা থাকে, তাদের ঘর বেশির ভাগই বাঁশের মাচার ওপর। বাবা বলেছেন, পাহাড়ী ঢল আর বন্য জন্তুর উৎপাত থেকে রেহাই পাবার জন্য এদিকের ঘরবাড়ি সব এরকম।

বেড়ার ঘর হলেও পরিপাটি করে সাজানো। টুটুল বসার ঘর থেকেই পাশের শোবার ঘরে শুনলো মা হেডমাস্টার-গিন্নিকে বলছেন, এত সুন্দর ক্রসস্টিচের কাজ করেছেন টেবিল-ক্লথে আর কুশনে, দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। ডিজাইন পেলেন কোথায়?

হেডমাস্টার-গিন্নি লাজুক গলায় বললেন, কলকাতা থেকে নকশার বই আনিয়েছিলাম।

দিদা বললেন, তুমি তো আমার হাতের কাজ দেখো নি বৌমা। জানু কিছু দেখেছে। আমাদের সময় হাতের কাজ ভালো না হলে মেয়েদের কপালে ভারি দুঃখ ছিলো।

হেডমাস্টার বাবাকে বললেন, চলুন হাত-মুখ ধোবেন।

বিদ্যুৎ টুটুলকে ওর নিজের ঘরে নিয়ে গেলো। ছোট ঘর। একটা বড় চৌকি, পড়ার টেবিল, আর বেতের বইয়ের তাক–এতেই ঘর প্রায় ভরে গেছে। বেড়ার সঙ্গে দড়িতে বিদ্যুতের কাপড়চোপড় রাখা। টুটুল, চৌকির ওপর বসে বললো, আমার নাম টুটুল, এবার স্কুল ফাইনাল দিয়েছি।

বিদ্যুৎ একটু লাজুক হেসে বললো, আপনার বাবা বলছিলেন, এখন থেকে কমলছড়িতে থাকবেন আপনারা।

টুটুল হাসলো–সে খবরও পেয়ে গেছো!

বিদ্যুৎ বললো, আপনি যদি কিছু মনে না করেন আপনাকে আমি টুটুলদা বলবো।

টুটুল গম্ভীর হয়ে বললো, মনে করবো।

বিদ্যুৎ অপ্রস্তুত হয়ে তাকালো টুটুলের দিকে।

আমাকে তুমি টুটুলদা বলবে, আবার আপনিও বলবে–সেটা হবে না। তুমি বলতে হবে।

হারিকেনের মৃদু আলোতেও টুটুল দেখলো বিদ্যুতের ফর্সা, ছেলেমানুষি মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। কোনোরকমে বললো, টুটুলদা, মুখ-হাত ধোবে না?

টুটুল হেসে বললো, চলো।

বিদ্যুৎ দড়ির ওপর থেকে গামছা নিয়ে টুটুলকে বললো, এসো টুটুলদা।

রান্নাঘরের পাশ দিয়ে পুকুরে যাবার সময়ে টুটুল শুনলো, মা আর দিদা হেডমাস্টার-গিন্নির সঙ্গে গল্প করছেন। শব্দ শুনে টের পেলো রান্নার আয়োজন চলছে।

পুকুরের ঠাণ্ডা পানিতে হাত-মুখ ধুতে-ধুতে টুটুল বললো, পুকুরে নেমে গোসল করতে ইচ্ছে হচ্ছে।

বিদ্যুৎ ঘাটের ওপর বসেছিলো। বললো, ঠাণ্ডা লেগে যাবে টুটুলদা।

টুটুল মৃদু হাসলো। বিদ্যুৎকে ওর ভালো লেগে গেলো। ভাবলো, বন্ধুর অভাবে ওকে কষ্ট পেতে হবে না।

হেডমাস্টার-গিন্নির রান্না সারতে দেরি হওয়ার কারণ বোঝা গেলো খাওয়ার সময়। বসার ঘরে মাদুর পেতে ওদের খেতে ডাকলেন। বললেন, মিতুল আর ঝুমাকে খাইয়ে দিয়েছি। ছেলেরা এখানে বসবে। আমরা মেয়েরা ভেতরে বসবো।

ছেলেদের দলে বাবা আর হেডমাস্টারও আছেন। বাবা বসেই বললেন, এত রাতে এত কিছু রান্না করতে গেলেন কেন?

হেডমাস্টার-গিন্নি লাজুক হেসে বললেন, আমি কি একা করেছি! চারজনে মিলে করেছি।

লাল-লাল পেঁকিছাটা চালের ভাত, বড়-বড় কই মাছ ভাজা, কই মাছের ঝোল, ঘন মুগডাল আর দুরকমের আচার। যত্ন করে হেডমাস্টার-গিনি সবার পাতে খাবার তুলে দিচ্ছিলেন। যদিও বাবা বার-বার বলছিলেন, আমরা নিতে পারবো–সেদিকে তিনি কানই দিচ্ছিলেন না।

হেডমাস্টার বাবাকে বললেন, আপনাকে যা বলছিলাম, আমি নিরীহ মাস্টার মানুষ, আমাকে ওরা কিছু বলে না। তবে বাজারে যে দোকানপাট দেখলেন, সবাই ওদের খাজনা দেয়। জঙ্গলের ঠিকাদার তো মোটা টাকা না দিয়ে ঢুকতেই পারে না। গত বছর দুজন নতুন এসেছে, খাজনা দিতে যেই অস্বীকার করলো, ব্যস, বেঘোরে পৈতৃক প্রাণটি খোয়ালো।

টুটুল অবাক হয়ে বললো, ওরা কারা? কাদের খাজনা দিতে হয়?

হেডমাস্টার একবার টুটুলের বাবার দিকে তাকালেন। ইতস্তত করছিলেন তিনি, টুটুলকে বলাটা ওর বাবা পছন্দ করবেন কি না ভেবে। বাবা ওর কথার জবাবে শুধু বললেন, শান্তিবাহিনী।

শান্তিবাহিনী মানে?

এখানকার উপজাতিদের একটা দল।

ওদের খাজনা দিতে হবে কেন?

বাবা হঠাৎ বিষম খেলেন। কয়েকবার কেশে পানি খেয়ে টুটুলকে বললেন, পরে বলবো।

হেডমাস্টার বললেন, বাঙালিরা অবশ্য এর শোধ নিচ্ছে নিরীহ লোকদের ওপর অত্যাচার করে। সুযোগ পেলেই ছাগলটা, মুরগিটা ধরে খেয়ে ফেলে। জমিতে কাজ করিয়ে ঠিকমতো পয়সা দেয় না। জমির ধান নিয়ে যায়। আড়-চোখে এবার টুটুলকে দেখে বললেন, আরো অনেক রকম অত্যাচার করে।

আর্মি কি করছে? জানতে চাইলেন বাবা।

সেই তো বিপদ! গলা একধাপ নামিয়ে হেডমাস্টার বললেন, যখন থেকে খাগড়াছড়িতে ক্যাম্প বসেছে, তখন থেকে এ এলাকায় ওদের উৎপাতও বেড়ে গেছে। ভারি তো এক আর্মি! বলে দরজার কাছে তাকিয়ে দেখলেন কেউ ওখানে আড়ি পেতেছে কি না। তারপর গলা আরো এক ধাপ নামালেন–আর্মির যত চোটপাট সব দিনে। রাতে হাজার ডাকলেও ওরা ক্যাম্প থেকে বেরুবে না। নিরীহ লোকদের ওপর অত্যাচার ওও কম করছে না। এই তো গত মাসে আমাদের স্কুলের ড্রিল মাস্টার যতীন লারমার ছটা ছাগল ধরে নিয়ে গেছে ক্যাম্পের লোকেরা। দেখুন তো, কি অত্যাচার!

ওপরে বলে দেখেছেন?

বলেন কি! এলাকায় বাস করতে হবে না! তা ছাড়া ওপরঅলারা এসব খবর পায় না কে বললল! নিশ্চয়ই পায়।

বাবা কোনো কথা বললেন না। টুটুল দেখলো, বাবার ঠোঁটের ফাঁকে মুহূর্তের জন্য একটুকরো তিক্ত হাসি ফুটে উঠে মিলিয়ে গেলো। বাবার কি নিজের অফিসের কথা মনে পড়েছে? টুটুল ভাবলো, অবস্থা সব জায়গাতে একই রকম। বাবা হয়তো আশা করেছিলেন আর্মির লোকেরা ভালো হবে।

হেডমাস্টার প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন, মিতুলকে আমার স্কুলে দিয়ে দিন। ওকে আমি ক্লাস ফাইভে নিয়ে নি। অবশ্য আপনি বললে সিক্সেও নিতে পারি। ঢাকার স্টান্ডার্ড পড়া তো আর এখানে হয় না।

বাবা আনমনে বললেন, না থাক, ফাইভেই পড়ক।

খাওয়া শেষ হলে টুটুলকে নিয়ে বিদ্যুৎ ওর ঘরে চলে এলো। টুটুল বিদ্যুতের সঙ্গে শোবে। বাবা আর হেডমাস্টারের ব্যবস্থা হয়েছে বসার ঘরে বিছানা পেতে। দিদা মিতুল আর ঝুমাকে নিয়ে ভেতরের বড় খাটে শোবেন। অন্যরা ফ্লোরে বিছানা করেছে।

মেয়েদের খাওয়ার পর্ব শেষ হওয়ার পর সবাই শুয়ে পড়লো। টুটুল ঘড়িতে দেখলো সোয়া এগারটা বাজে। বিদ্যুৎ বললো, টাটুলদা, শোবে এখন?

টুটুল বললো, শুতে পারি, তবে তোমার ঘুম না পেলে কিছুক্ষণ গল্প করবো।

বিদ্যুৎ মৃদু হেসে বললো, তোমার সঙ্গে সারারাত গল্প করলেও আমার ঘুম পাবে না।

টুটুলও হাসলো–তাহলে হারিকেনটা সরাও। আলোটা চোখে লাগছে। বিদ্যুৎ হারিকেনের আলো কমিয়ে দরজার আড়ালে নিয়ে রাখলো। বাইরে তখন ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। দূরে জঙ্গল থেকে মাঝে-মাঝে বুনো কুকুরের ডাক ভেসে আসছে আর বিরামহীন শব্দ করছে রাতজাগা ঝিঁঝি পোকারা। এ ছাড়া কোথাও কোনো শব্দ নেই। টুটুলের পাশে বিদ্যুৎ নিচু গলায় বললো, ভেতরে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে।

টুটুল বললো, শান্তিবাহিনীর ব্যাপারটা কি তুমি কিছু জানো বিদ্যুৎ?

জানবো না কেন? এখানে সবাই জানে। আমি ওদের কাগজও পড়েছি।

কি পড়েছো কাগজে?

ওরা স্বাধীনতা চায়।

কার কাছ থেকে?

ওরা মনে করে বাঙালিরা ওদের শোষণ করছে। অত্যাচার করছে। সেজন্য ওরা আলাদা হতে চায়।

টুটুল চুপ থেকে বললো, সব বাঙালি কি খারাপ বিদ্যুৎ? তোমরা কি ওদের ওপর অত্যাচার করো?

না, সবাই কেন খারাপ হবে?

ওরা কি সেটা বোঝে না?

ওরা আর্মির বিরুদ্ধে বেশি ক্ষেপেছে। আর্মির সঙ্গে প্রায়ই ওদের যুদ্ধ হয়!

বলো কি! সত্যি-সত্যি যুদ্ধ?

হ্যাঁ, সত্যি-সত্যি যুদ্ধ। ওরা যুদ্ধ করে গেরিলা কায়দায়, যেজন্য আর্মি ওদের সঙ্গে পারে না। ওরা হামলা করে গভীর বনে পালিয়ে যায়।

বিদ্যুতের কথা শুনতে-শুনতে টুটুলের সামনে ধীরে-ধীরে এক নতুন জগতের দরজা খুলে যাচ্ছিল। রীতিমতো উত্তেজিত বোধ করছিলো সে। বললো, আচ্ছা, আর্মির মধ্যে কি ভালো লোক নেই?

আছে নিশ্চয়ই।

আর্মির লোকেরা ওদের সঙ্গে কথা বলে বোঝায় না কেন?

ওরা কথা শুনলে তো! তা ছাড়া ওদের পাবেই-বা কোথায়?

তুমি জানো ওরা কোথায় থাকে?

না, মাঝে-মাঝে দেখা হয়। যতীন স্যারের ভাইপো আছে শান্তিবাহিনীতে। আগে আমাদের স্কুলে পড়তো। ওর কাছ থেকেই কাগজপত্র পাই। দু-তিন মাসে হঠাৎ করে একবার দেখা হয়।

এরপর যখন দেখা হবে তখন বোলো আমি ওদের সঙ্গে কথা বলতে চাই।

ঠিক আছে, বলবো।

তুমি কি মনে করো? ওরা যে স্বাধীনতা চায় সেটা কি ঠিক?

বাবা বলেন, স্বাধীনতা চাইলেই তো হয় না। স্বাধীন দেশ হিসেবে টিকে থাকতে পারবে কি না সেটা আগে দেখতে হবে। তবে ওদের ওপর অনেক অত্যাচার হয়েছে। এখনো হচ্ছে। ওরা চিরকাল মুখ বুজে সইবে কেন? ওরা জাতি হিসাবে ছোট হতে পারে, তবে ওদের চেয়েও ছোট জাতি স্বাধীন দেশে বাস করছে।

তোমাকে এসব কথা কি যতীন স্যারের ভাইপো বলেছে?

হ্যাঁ, ফণী আরো অনেক কথা বলে। ওর কাঁধে চকচকে স্টেনগান ঝোলানো থাকে। ওর কাছে আমি যুদ্ধের গল্পও শুনেছি।

টুটুল প্রসঙ্গ পাল্টে বললো, বড় হলে তুমি কি হবে বিদ্যুৎ?

এতটুকু ইতস্তত না করে বিদ্যুৎ বললো, বাবার মতো হবো।

টুটুল চুপ করে রইলো। কিছুক্ষণ পর বিদ্যুৎ বললো, তুমি কি হতে চাও টুটুলদা?

টুটুল অন্ধকারে মৃদু হাসলো–আগে তো ইঞ্জিনিয়ার হতে চাইতাম। এখন অন্য কিছু ভাবছি।

কি ভাবছো?

এখনো কিছু ঠিক করি নি। কিছুক্ষণ চুপ থেকে টুটুল বললো, তোমরা এখানে কদ্দিন ধরে আছো?

বিদ্যুৎ বললো, মুক্তিযুদ্ধের পরের বছর। সেবছরই আমি এই স্কুলে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হলাম। জানো টুটুলদা, আমাদের স্কুলের তিনজন স্যার শান্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছেন।

টুটুল শান্তিবাহিনীর কথাই ভাবছিলো। বললো, তুমি যে বললে যতীন স্যারের ভাইপোর কাঁধে চকচকে স্টেন। জিজ্ঞেস করো নি ওরা অস্ত্র কোথায় পায়?

ওরা অনেকগুলো থানা লুট করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও অনেক অস্ত্র পেয়েছিলো। সেই অস্ত্র কেউ জমা দেয় নি। কেউ-কেউ বলে ইণ্ডিয়া থেকে অস্ত্র আসে।

ইণ্ডিয়া কেন ওদের অস্ত্র দেবে?

বাংলাদেশের সঙ্গে ইণ্ডিয়ার সম্পর্ক এখন ভালো নয় বলে।

তুমি অনেক জানো বিদ্যুৎ। টুটুলের গলায় প্রশংসা।

বিদ্যুৎ লজ্জা পেলো –আমাদের স্যারের কাছে শুনি। ফণীও অনেক কথা বলে।

ফণী তোমাকে খুব বিশ্বাস করে, তাই না?

বারে, ফণী তো জানে ও ছাড়া আমার কোনো বন্ধু নেই।

টুটুল একটু ইতস্তত করে বললো, আমাকে বন্ধু ভাবতে পারবে না বিদ্যুৎ?

বিদ্যুৎ টুটুলের একটা হাত ধরে বললো, বন্ধু না ভাবলে কি এতসব কথা তোমাকে। বলতাম টুটুলদা!

কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বললো না। একসময় বিদ্যুৎ বললো, টুটুলদা ঘুমোলে?

না, বলো।

তোমরা হঠাৎ ঢাকা ছেড়ে কমলছড়িতে কেন থাকতে এসেছো?

বারে, এখানে আমাদের জমি আছে যে!

তোমার বাবা আমার বাবাকে বলছিলেন, চাকরিটাকরি ছেড়ে চলে এলাম। এত বড় চাকরি হঠাৎ ছেড়ে দিলেন কেন?

টুটুল ওর বাবার চাকরি ছাড়ার সব কথা বিদ্যুৎকে বললো। সব শেষে বললো, বাবা অন্যায়ের কাছে কখনো মাথা নোয়ান নি।

বিদ্যুৎ বললো, তুমি কি তোমার বাবার মতো?

টুটুল একটু ভাবলো। তারপর বললো, আমিও বাবার মতো হতে চাই। অন্যায়কে আমিও ঘৃণা করি। তুমি?

আমিও তাই। আস্তে-আস্তে বললো বিদ্যুৎ, সেজন্য এখানকার কোনো বাঙালি ছেলের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয় নি। ওরা উপজাতিদের দুচোখে দেখতে পারে না।

টুটুল বললো, শান্তিবাহিনী সম্পর্কে আমি আরো জানতে চাই। ওদের স্বাধীনতার ব্যাপারটা আমি ঠিক সমর্থন করতে পারছি না।

ঠিক আছে। ফণীর সঙ্গে তোমার আলাপ করিয়ে দেবো।

অনেক রাত পর্যন্ত বিদ্যুতের সঙ্গে কথা বললো টুটুল। তবু শান্তিবাহিনীর ব্যাপারটা ওর কাছে রহস্যময় মনে হলো। বাঙালিদের ওরা নাকি একেবারেই পছন্দ করে না। সমতল থেকে বাঙালিরা দলে-দলে এসে ওদের পাহাড় দখল করে এখান থেকে তাড়িয়ে দিতে চাইছে। এজন্য বাঙালিদের ওপর উপজাতিদের রাগ। তার মানে টুটুলরাও ওদের রাগের আওতায় পড়ছে। বিপদ এখানেও কম নয়। যে-কেউ এসে জোর করে খাজনা চাইতে এলে বাবা নিশ্চয়ই দেবেন না। সেক্ষেত্রে ওদের কমলছড়ি থাকতে হবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। এটাকে আরো বড় চ্যালেঞ্জ মনে হলো টুটুলের। ভাবতে-ভাবতে কখন যে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো টেরও পেলো না।

সকালে বিদ্যুতের ডাকে টুটুলের ঘুম ভাঙলো–আর কতত ঘুমোবে? ওদিকে সবার এক দফা চা হয়ে গেছে। আরেক দফার আয়োজন চলছে।

টুটুল ঘুম-ঘুম চোখে তাকালো আমাদের দিদা একবারের বেশি দুবার কখনোই চা খেতে দেবেন না।

বড়য়া বাবু এসে তোমাদের গাড়ির ব্যাটারি পাল্টে দিয়েছেন। গাড়ি ঠিক হয়ে গেছে।

টুটুল খুশিতে উঠে বসলো–তাই নাকি! বাবা নিশ্চয়ই যাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন!

বিদ্যুৎ ম্লান হাসলো–তুমি চলে যাবে ভাবতেই খারাপ লাগছে টুটুলদা।

টুটুলের কপালে ভাঁজ পড়লো। কয়েক মুহূর্ত ভাবলো। ঠোঁটের ফাঁকে দুষ্টুমির হাসি। চোখ দুটো চকচক করে উঠলো–একটা বুদ্ধি বের করেছি বিদ্যুৎ। তুমি কয়েকদিনের জন্য আমাদের সঙ্গে থাকবে চলো।

বিদ্যুৎ বললো, বাবাকে কে বলবে?

আমি আমার বাবাকে বলবো। কথাটা বলেই টুটুল ঘর থেকে বেরুলো।

বাবা আর হেডমাস্টার বাড়ির সামনে ঘাসের উঠোনে হাঁটছিলেন। ভোরের হালকা নোম রোদে সবকিছু ঝলমল করছে। টুটুল ঘড়ি দেখলো, আটটা বাজে। বাবাকে গিয়ে বললো, বাবা, তুমি হেডমাস্টার কাকাকে বলো না বিদ্যুৎ আমাদের সঙ্গে থাকুক কয়েকদিনের জন্য। আমরা তো এদিকে কিছুই চিনি না। ও গেলে আমাদের অনেক উপকার হবে।

বাবা হেডমাস্টারকে বললেন, টুটুল একটা দরকারি কথা বলেছে চৌধুরী সাহেব। আপনার যদি আপত্তি না থাকে বিদ্যুৎ আমাদের সঙ্গে চলুক না। আমি নিজে ওকে পৌঁছে দেবো।

হেডমাস্টার ব্যস্ত হয়ে বললেন, না, না, আপত্তির কী আছে! ওকে দিয়ে যদি আপনাদের উপকার হয় সে তো আমাদের জন্য খুশির খবর। যে কদিন ইচ্ছে রাখুন। স্কুলও এখন বন্ধ।

টুটুল একছুটে বিদ্যুতের ঘরে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলো–ঠিক হয়ে গেছে। জামাকাপড় গুছিয়ে নাও শিগগির।

নাশতা খেয়েই ওরা রওনা হলো। দিদা গাড়িতে ওঠার সময় বার-বার বিদ্যুতের বাবা-মাকে বললেন, ঘর-দোর গুছিয়ে তোমাদের নিয়ে যাবো বাছা। কদিন থাকতে হবে। নইলে একা এই জঙ্গলে দম বন্ধ হয়ে আমি মরে যাবো।

রাতে বৃষ্টি না হওয়াতে রাস্তা শুকিয়ে গেছে। এবার গাড়ি চালাতে বাবার কোনো কষ্ট হলো না। বিদ্যুৎ উৎফুল্ল হয়ে টুটুলকে সবকিছু চেনাচ্ছিলো। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় কোনটা তেলসুর গাছ আর কোনটা চাপালিশ ও তাও দিব্যি বলে দিচ্ছিলো। মিতুল আর বড়িবিও হাঁ করে গিলছিলো বিদ্যুতের কথা। টুটুল মৃদু হেসে বললো, তুমি অনেক জানো বিদ্যুৎ।

ভোরের আলোয় বিদ্যুতের মুখ আরো লাল হয়ে গেলো।

.

০৪. কমলছড়ির বাড়ি

কেয়ারটেকার করমালি টুটুলদের দেখে যেমন অবাক হলো তেমনি খুশিও হলো। থুতনির ছাগুলে দাড়ি নেড়ে উত্তেজিত হয়ে খাস নোয়াখালীর ভাষায় বাবাকে বার-বার বললো, আঁরে এ্যাক্কানা খবরও দিলেন না হুজুর। আরো আঁরগো লগে থাইকবেন, কি কোয়াল লই আইছিলাম।

দিদা ভুরু কুঁচকে চাপা গলায় মাকে বললেন, লোকটা কোনো খারাপ কথা বলছে তো বৌমা? চেহারাটা বাপু সুবিধের মনে হচ্ছে না।

মা হেসে বললেন, না, ও যে খুশি হয়েছে, সে কথাই বলছে।

কি জানি বাছা। কে কি ভেবে খুশি হয় বলা কঠিন। এই বলে দিদা করমালির ঘরে ঢুকলেন।

করমালির বাড়িটা একটু অদ্ভুত ধরনের। একরকম পাথরের বাড়ি বলা যেতে পারে। বুদ্ধিটা বাবারই। জমিটা কেনার পর গাছ কাটতে গিয়ে একটা পাহাড়ে নুড়িপাথর পাওয়া গিয়েছিলো। সেখানকার ছোট-ছোট পাথরের সঙ্গে সিমেন্ট মিশিয়ে বড়-বড় স্ল্যাব বানানো হয়েছে। সেই পাথরের স্ল্যাব বসিয়ে মেঝে আর দেয়াল গাঁথা হয়েছে। ওপরে খড়ের ছাউনি। পাশাপাশি দুটো ঘর, সামনে চওড়া বারান্দা। বারান্দার ওপরও খড়ের ছাউনি! বেশ একটা ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা ভাব। পাশে দুটো বড় করুই গাছ অনেকখানি জায়গা জুড়ে ছায়া ফেলেছে।

করমালির বৌ লম্বা একটা ঘোমটা টেনে বারান্দায় চাটাই পেতে দিলো। করমালি ট্রাঙ্কগুলো নামিয়ে ঘরে রেখে দা হাতে ছুটলো ডাব পাড়তে। বাবা যত বারই এসেছেন প্রত্যেকবার কিছু চারা এনে দিয়েছেন করমালিকে। নারকেল গাছই লাগানো হয়েছে এক শর ওপর। গত তিন-চার বছর ধরে নারকেল ধরছে। আগে করমালিকে টাকা পাঠাতে হতো। গত দুবছর ধরে নারকেল বেচা টাকা দিয়েই ওর দিব্যি চলে যাচ্ছে। এক মেয়ে, ছিলো, বিয়ে হয়ে গেছে। এখন ওরা দুজন থাকে এখানে। নিজের জন্য খানিকটা জমিতে ধানের চাষও করে। চারপাশে তাকিয়ে টুটুল বাবাকে বললো, আমাদের করমালি বেশ আছে, তাই না বাবা?

বাবা বললেন, সব কিছু নিজের পরিশ্রমে করেছে করমালি। এমনকি গত বছর গরু কেনার টাকাও আমার কাছ থেকে নেয় নি।

বিদ্যুৎ বললো, অনেক জায়গা তোমাদের।

টুটুল ওর বাবার মতো বললো, তুমি সারাদিন হেঁটেও পুরো জায়গা দেখে শেষ করতে পারবে না।

বিদ্যুতের বাবা বলে দিয়েছিলেন, হাট থেকে চাল-ডাল আর দরকারি জিনিসপত্র কিনে নিয়ে যেতে। ওরা গোলাবাড়ির হাট পেয়েছে। কমলছড়ির হাট সপ্তায় মাত্র একদিন বসে।

করমালির বৌকে নিয়ে রান্নার আয়োজন করতে বসলেন মা। আর দিদা ঘরের জিনিসপত্র গোছানো শুরু করলেন বড়িবিকে নিয়ে। মিতুল, ঝুমা গরুর বাছুরের সঙ্গে সারা মাঠজুড়ে ছুটোছুটি করছে। ধরতে গেলে তিড়িং-তিড়িং করে লাফিয়ে বাছুরটা পালাচ্ছিলো, আর তাই দেখে ওরা দুজন হেসে কুটিকুটি।

করমালি ডাব এনে মুখ কেটে সবার হাতে একটা করে ধরিয়ে দিলো। শুধু মিতুল আর ঝুমাকে ডাবের পানি গ্লাসে ঢেলে দেয়া হলো। টুটুল বললো, ভারি মিষ্টি তো ডাবের পানিটা! ঢাকায় কেমন পানসে মনে হয়।

বিদ্যুৎ মুখ টিপে হাসলো–তোমাদের ঢাকায় ডাবের পানিতেও তাহলে ভেজাল দেয়।

বাবা হেসে বললেন, ভেজাল না হলেও এত ফ্রেশ তো ওখানে পাওয়া যাবে না। গাছ থেকে কাটার কত দিন পর আমরা খাই আল্লা মালুম।

করমালি বিগলিত হয়ে বললো, আমনের গোরে আরিকা করি কাডি দি?

টুটুল ব্যস্ত হয়ে বললো, না না, এখন আর লাগবে না। পরে খাবো।

ডাবের পানি খাওয়া শেষ হলে করমালি ওগুলো কেটে দুভাগ করে ভেতরের মিষ্টি শাঁস খেতে দিলো।

টুটুল খেতে-খেতে বললো, সত্যিই বাবা, দারুণ ডেলিশাস।

বিদ্যুৎ বললো, ডাবের শাঁসের সঙ্গে ডেলিশাসের মিল দিয়ে কবিতা লিখে ফেলতে পারো টুটুলদা।

টুটুল হেসে বললো, দেবো এক থাপ্পড়।

মা ঘরের ভেতর থেকে বললেন, তোমরা এখন কেউ চা খেতে চাইলে বলো। পরে পাবে না।

টুটুল চেঁচিয়ে বললো, রাখো মা তোমার চা। ডাবের এত মজার স্বাদটাই তুমি নষ্ট করে দিতে চাইছে।

দিদা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে টুটুলের চিবুক নেড়ে আদর করে বললেন, এইতো একটা কথার মতো কথা শুনলাম তোর মুখে।

বিদ্যুতের সামনে দিদার আদর খেতে লজ্জা লাগলো টুটুলের– কি যে বলো দিদা! কথা বলতে না পারলে যেন এমনি-এমনি ডিবেটে প্রাইজ পাই।

বাবা বললেন, টুটুল, তোমার নোট বই বের করো। আমরা এখন দরকারি কাজে বসবো।

বিদ্যুৎ একটু অপ্রস্তুত হয়ে টুটুলের দিকে তাকালো। ও জানতে চাইছিলো দরকারি কথার ভেতর ওর থাকা চলবে কি না। বাবা বিদ্যুৎকে বললেন, তোমার সাহায্যও দরকার হবে। করমালি, তুমিও এসে বসো।

করমালি এসে সিঁড়ির ওপর বসলো। বাবা ওদের সবার মুখের ওপর চোখ বুলিয়ে বললেন, আমি আজ থেকেই কাজ শুরু করে দিতে চাই। প্রথমে আমার লাগবে গাছ কাটা আর চেরাই করার লোক। তারপর লাগবে ঘরামি। আমরা এখন যে বাড়িটা বানাবো সেটা পুরোটাই কাঠের হবে। দশ দিনের ভেতর বাড়ির কাজ শেষ করতে চাই আমি। দুদিন গাছ কেটে গুঁড়ি বের করতে লাগবে। দুদিন সময় দেবো তক্তা আর খুঁটি বানাতে, দুদিন ফ্রেম বানাতে। দুদিন দরজা-জানালা বানাতে আর একই সঙ্গে তক্তা ফিট করতে। শেষ দুদিন যাবে দরজা-জানালা লাগিয়ে ফিনিশিং দিতে। এখন বলল কত লোক লাগবে?

টুটুল অবাক হয়ে বললো, দশদিনে কীভাবে সম্ভব বাবা?

বাবা মৃদু হেসে বললেন, বেশি লোক পেলে আরো কম দিনে সম্ভব। এখানে কি পরিমাণ মিস্ত্রি পাবো সেটা বলতে পারবে বিদ্যুৎ আর করমালি।

বিদ্যুৎ বললো, এখানে গাছ কাটার মজুর পেতে পারেন। কাঠ চেরাই আর ঘর বানাবার লোক আনতে হবে খাগড়াছড়ি থেকে।

করমালি বললো, হুজুর আমনে যে কিসিমে কইলেন, চল্লিশ জন খালি কাঠ-ম্যাস্তরিই লাইগবো।

চল্লিশ নয় পঞ্চাশই ধরো। আমি পঞ্চাশ জন কাঠমিস্ত্রি আর পঞ্চাশ জন হেলপার চাই। গাছ কাটতে দুদিনের জন্য আরো পঞ্চাশ জন মজুর। পাওয়া যাবে করমালি?

করমালি থুতনির দাড়ি চুলকে বললো, তালাশ করুন লাইগবো।

আমার কিন্তু হাতে সময় নেই। বলে বিদ্যুতের দিকে তাকালেন বাবা।

বিদ্যুৎ বললো, খাগড়াছড়িতে একটা কাঠপট্টি আছে। তিরিশ-চল্লিশ ঘর কাঠমিস্ত্রি ওখানে পাওয়া যাবে। গোলাবাড়িতেও দশ-পনের জন পাওয়া যেতে পারে। আমাদের স্কুলের বুড়ো দারোয়ানের দুই ছেলে কাঠমিস্ত্রির কাজ করে।

চমৎকার! বাবা বিদ্যুতের পিঠ চাপড়ে দিলেন–তোমাদের ওই দুই মিস্ত্রির ওপর অন্য সব মিস্ত্রি জোগাড় করার দায়িত্ব দিতে পারি তাহলে!

তা পারেন। বিদ্যুৎ সায় জানালো–কাজের জন্য ওরা খাগড়াছড়ি রামগড় সব জায়গায় যায়।

টুটুল বললো, একটা কথা তুমি বোধহয় ভাবো নি বাবা। এক শ দেড় শ লোক বাইরে থেকে এখানে এসে থাকবে কোথায়?

করমালি বললো, হুজুরে কইলে আঙ্গো হেরাইমারি ইশকুলে রাইতছা ঘুমাইতো হাইরবো।

কত দূরে স্কুল? টুটুল জানতে চাইলো।

বেশি দূরে ন। মাইলখানিকের মতন ওইবো। ইশকুল অন বন্দ আছে। হ্যাডমাস্টর আফইত্য কইরত ন।

কথাটা আমি যে ভাবি নি তা নয়। বাবা বললেন, দুপুরে খেয়েই আমরা বেরুবো। গোলাবাড়ি হাটে আমি বাঁশ আর বেড়ার দোকান দেখেছি। করমালির জন্য কালকের মধ্য ঘর বানাতে হবে। একটু বড় করেই বানাব। মিস্ত্রিদের জিনিসপত্র থাকবে। দু-একজন রাতে এখানেও থাকতে পারবে। বিদ্যুতের মিস্ত্রিদেরও আজ লোকজন জোগাড় করতে পাঠিয়ে দেবো। ওদের সঙ্গে কথা বলে গোলাবাড়ি থেকে কিছু কেনার থাকলে কিনে নেবো, কি বলিস তোরা?

টুটুল মাথা নেড়ে সায় জানালো–মনে হচ্ছে পারবে।

এরপর বাবা বললেন, আজ রাতে আমি বাড়ির নকশাটা এঁকে ফেলবো। রান্নাঘর আর বাথরুম আলাদা করবো। আমাদের বেশ কিছু পাথরের স্ল্যাব রয়ে গেছে। ওগুলো কাজে লাগাতে হবে।

টুটুল বললো, তার মানে রান্নাঘর আর বাথরুম পাকা হবে।

হ্যাঁ, এটার মতো। মেঝে আর দেয়াল পাকা হবে। পাথরেরও বলতে পারো।

মা এসে বললেন, তোমরা করমালিকে একটু ছাড়বে? টিউবওয়েল থেকে পানি তুলতে হবে।

করমালি জিব কাটলো–আঁর এ্যাক্কেরে মনে আছিল না। এই বলে গলা তুলে ওর বৌকে ডাকলো জিরার মা, কলসি দোনগা দেওত। হানি লই আই।

টুটুল আর বিদ্যুৎও করমালির সঙ্গে গেলো। একটু নিচু জায়গায় বসানো হয়েছে টিউব ওয়েল। করমালি টুটুলকে বললো, আমনেরা চাপকলে গোসল কইরবেন না

হইরে যাইবেন?

টুটুল ভুরু কুঁচকে বললো, হইর কি?

হইর বুইজলেন না? করমালি অপ্রস্তুত হয়ে দাড়ি চুলকালো। তারপর তার মনে পড়লো–হইর মানি হুইস্করণি। মাইনষে গোসল করে, মাছ ধরে।

বুঝেছি। পুকুর বলল।

জ্বী, হুকুর।

টুটুল আর বিদ্যুৎ হাসলো। সেই সঙ্গে করমালিও। টুটুল বললো, পুকুর কত দূরে? অনেক মাছ আছে?

না, বেশি দূর ন। এই টিলা আর অইলেই। মাছ বহুৎ। ধরে কনে? খালি শনশনার।

টুটুল উঞ্ছন্ন হয়ে বিদ্যুৎকে বললো, দারুণ, মাছ ধরা যাবে!

 বিদ্যুৎ মুখ টিপে হেসে বললো, জাল মারতে পারো?

টুটুল চুপসে গেলো–না, জাল মারতে পারি না। তবে বড়শি দিয়ে মাছ ধরেছি।

ঠিক আছে, শিখিয়ে দেবো টুটুলদা।

তুমি অনেক জানো বিদ্যুৎ!

এই নিয়ে তিনবার বললে কথাটা।

আমার চেয়ে বেশি জানলে নিশ্চয়ই বলবো।

তুমিও অনেক কিছু আমার চেয়ে বেশি জানো।

আমার জানা যে এখানে কোনো কাজেই লাগছে না।

টুটুলের কথার অসহায় ভঙ্গিতে হেসে ফেললো বিদ্যুৎ–এখন না লাগলেও পরে লাগবে। জানাগুলো শানিয়ে রাখো, দেখো যেন মরচে পড়ে না যায়।

বিদ্যুতের কথায় টুটুলও হেসে ফেললো।

দুপুরে খাওয়া হলো খুবই সাধারণ। খিচুড়ি আর বেগুন ভাজা। খিচুড়িতে মা আলুর টুকরো আর আস্ত পেঁয়াজ দিয়েছিলেন। দিদা যে ঝোলায় করে আচার নিয়ে এসেছেন কেউ সে কথা জানতো না। বের করতেই কাড়াকাড়ি পড়ে গেলো। মা বাবাকে বললেন, হাটে যখন যাচ্ছো, মাছ মুরগি যা পাও এনো। বিদ্যুৎদের ওখানে এত খেয়ে এলাম আর এখানে বেচারাকে শুধু বেগুন ভাজি খেতে হচ্ছে।

বিদ্যুৎ লাল হয়ে বললো, আমার জন্য আলাদা কিছু হলে আমি যে খেতেই পারবো না কাকিমা।

টুটুল বললো, আহা বিদ্যুৎ, বোঝ না কেন! উপলক্ষ তুমি হলে কি হবে, খাবো তো আমরা সবাই।

খাওয়া শেষ করে বাবা মাকে বললেন, আর দেরি করবো না। হাটে তোমাদের আর কিছু লাগবে কি না বলল।

মা বললেন, তোমার কিছুই মনে থাকবে না। করমালির কাছে ফর্দ লিখে দিয়েছি।

দিদা বললেন, আমার পানের কথা লিখেছো বৌমা?

লিখেছি। মা হাসলেন–বেল পাওয়া গেলে তাও আনতে বলেছি।

দিদা একগাল হেসে বাবাকে বললেন, এমন গোছানো বৌ পেয়েছিস বলে তুই আজো টিকে আছিস হাবু।

বাবা মুখ টিপে হেসে বললেন, মা, তুমি নীতিভঙ্গ করছো। তুমি না বলতে কারো সামনে প্রশংসা আর পেছনে নিন্দা করতে নেই।

মা বাবার দিকে তাকিয়ে চোখ পাকিয়ে হেসে ঘরে ঢুকলেন, বাবা গাড়িতে উঠে বসলেন। টুটুল আর বিদ্যুৎ সামনে বসলো, পেছনে করমালি।

টুটুলদের বাড়ি থেকে সদর রাস্তায় উঠতে মাইলখানেকের মতো আঁকাবাঁকা জঙ্গুলে পথ পেরুতে হয়। কোনোরকমে এইটুকু পেরিয়ে সদর রাস্তায় উঠে বাবা গাড়িতে স্পীড তুললেন, যতটা এই কাঁচা রাস্তায় তোলা যায়। ইট বিছানো না হলেও বেশ মসৃণ রাস্তায়। বৃষ্টি হলেই যা অসুবিধে। তবে পাহাড়ের বাঁকগুলো খুবই বিপজ্জনক। একটু অসাবধান হলেই গভীর খাদে গড়িয়ে পড়তে হবে। চেনা রাস্তা বলেই বাবার কোনো অসুবিধে হলো না। চল্লিশ মিনিটের ভেতর ওরা গোলাবাড়ি পৌঁছে গেলো। সোজা বিদ্যুৎদের বাড়িতে গিয়ে গাড়ি থামালেন বাবা।

গাড়ির শব্দে বিদ্যুতের বাবা-মা দুজনই বেরিয়ে এলেন। ওদের দেখে অবাক হলেন তাঁরা। কোনো বিপদ আপদ দেখা দেয় নি তো? উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন করলেন হেডমাস্টার।

না, না, বিপদ টিপদ ঘটে নি। আমরা বেরিয়েছি কাঠমিস্ত্রি খুঁজতে। বাবা ওঁকে আশ্বস্ত করলেন।

তার জন্য আর ভাবনা কি। আমাদের বলু, ধলুকে নিয়ে যান। ভালো কাজ জানে।

বলু, ধলুকে তো লাগবেই। তবে দুজনে হবে না। আমাদের শখানেক মিস্ত্রি দরকার।

বলেন কি! হেডমাস্টারের চোখ কপালে উঠলো–তাজমহল বানাবেন নাকি?

না না, অত পয়সা কোথায়! তা ছাড়া ওটার জন্য লোক লাগবে বিশ হাজার, সময় লাগবে বাইশ বছর। আমার হলো দিন দশেকের ব্যাপার।

তাই বলুন। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন হেডমাস্টার বেশি লোক লাগিয়ে তাড়াতাড়ি ঘরের কাজ শেষ করতে চান। তা আইডিয়াটা খারাপ নয়, বৃষ্টি-বাদলা আসার আগে বাড়ি শেষ করতে পারলে ভালোই হয়। বিদ্যুৎ, তুমি তাহলে ওদের খবর দাও। আপনারা ঘরে এসে ততক্ষণে একদফা চা খান।

বিদ্যুতের সঙ্গে-সঙ্গে টুটুলও গাড়ি থেকে নামলো–বাবা, তুমি চা খাও, আমি বিদ্যুতের সঙ্গে যাচ্ছি। বলে দুজন একসঙ্গে দৌড় লাগালো।

বিদ্যুতের মা মৃদু হেসে বললেন, দুটিতে বেশ ভাব হয়েছে।

বাবা সায় জানালেন–টুটুলকে নিয়ে আমার একটু ভয়ই ছিলো। ঢাকায় ওর এতো বন্ধু, এখানে একা কীভাবে থাকবে–এখন মনে হচ্ছে অসুবিধে হবে না।

হেডমাস্টার বললেন, বিদ্যুতেরও খুব একটা বন্ধু নেই। আমাদের যতীন বাবুর ভাইপোটার সঙ্গে যা একটু বন্ধুত্ব ছিলো, ছোঁড়াটা শান্তিবাহিনীতে ঢোকার পর বিদ্যুৎ একেবারে একা হয়ে পড়েছিলো।

চা শেষ করার আগেই বলু, ধলুকে নিয়ে টুটুলরা এসে হাজির। আসার পথেই বিদ্যুৎ বলেছে, কি জন্য ওদের ডাকা হয়েছে। বড় বলু বাবাকে বললো, আমরা সব ব্যবস্থা কইরে দেবানে। আইজ রাইতের মইধ্যে গোলাবাড়ির ব্যাকগুলারে ঠিক করবানে। কাইল যাবানে খাগড়াছড়ি। ওইখানে না পাইলে যাবানে রামগড়। আপনের চিন্তার কিছু নাই।

বাবা হেসে বললেন, চিন্তা করতে চাই না বলেই তো তোমাদের হাতে ভার দিচ্ছি। সবাইকে বলবে, যে-কদিন কাজ হবে সে-কদিন রাতেও থাকতে হবে। মজুরি পুষিয়ে দেবো। সবাই যেন বিছানা বাসন হাঁড়ি পাতিল সঙ্গে নেয়। রান্নাও নিজেদের করে খেতে হবে।

একগাল হেসে বলু বললো, হে আমাগো জানা আছে।

হেডমাস্টার বললেন, আমার নিজের কাজ মনে করে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের কাজ করবে। পরে তিনি তোমাদের দিয়ে অনেক কাজ করাবেন।

বলু, ধলু দুজনেই বললো, হে আমাগো কওন লাগতো না। সাবে এই দ্যাশে থাকলে আমরা মোনে জোর পাবানে কত!

ঠিক আছে তাহলে। তোমরা একজন কালই চলে এসো গাছ কাটার মজুরদের নিয়ে। আরেকজন কাঠ চেরাই আর মিস্ত্রিদের নিয়ে পরশু এসো। কাল যে কটা গাছ কাটবে পরশু সেগুলো দিয়েই কাজ শুরু হবে। এই বলে বাবা বলুর হাতে এক শ টাকার তিরিশখানা নোট দিয়ে বললেন, মিস্ত্রিদের যাদের অগ্রিম দিতে হয় দিও আর গজাল পেরেক যা লাগে কিনে নিও। গজাল ছইঞ্চির আর পেরেক নিও তিন আর দুই ইঞ্চির। আমার বাইরের দেয়ালের তক্তা দু ইঞ্চি পুরু হবে, ভেতরে হবে এক ইঞ্চি। রামগড় কিংবা খাগড়াছড়ি থেকে দু-একটা ট্রাক যদি আনতে পারো তাহলে তোমাদের কাজ অনেক সহজ হবে। তক্তার কাঠ করাতকল থেকে চেরাই করে আনা যাবে। কি বলো তোমরা?

বলু বললো, টেরাক আনা যাবে নে। আর করাতকলে কাঠ চেরাই করলে দ্যাখতেও সান্দর লাগবে।

মিস্ত্রিদের বিদায় দিয়ে বাবা বললেন, এবার তাহলে হাটে যাওয়া যাক।

হেডমাস্টার বললেন, চলুন, আমিও যাই। এই সুযোগে তোকজনের সঙ্গেও পরিচয় হবে আপনার।

স্কুলের অল্প দূরেই হাট। দোকানদার প্রায় সবাই সমতলের মানুষ। যারা ঝকা নিয়ে পথের ওপর বসেছে তাদের ভেতর আবার বেশির ভাগ উপজাতি। নাম না জানলে কে চাকমা, কে মুরং আর কে টিপরা বোঝার উপায় নেই। সবার চেহারা অনেকটা চীনাদের মতো, বেশির ভাগের গায়ের রং ফর্সা, কেউ আবার তামাটে।

বাবা হাট থেকে মাছ-মুরগি দুই কিনলেন, তরকারি কিনলেন কয়েক রকমের। দিদার পান কেনা হলো, তবে বেল পাওয়া গেল না।

পাহাড়ী এক মেয়ের কাছ থেকে বাঁশের কোড় কিনলেন বাবা। টুটুলকে বললেন, চাইনীজ রেস্টুরেন্টে ব্যাম্বু ট খাস নি? এ হলো সেই জিনিস। হিল ট্র্যাক্টের লোকেরা খুব খায়।

হেডমাস্টার ভুরু কুঁচকে বললেন, খেয়ে-খেয়ে বাঁশঝাড়গুলো সব নির্বংশ করছে। বিরাট এক ফর্দ দিয়েছেন মা। ফর্দ মিলিয়ে জিনিসপত্র কিনতে-কিনতে গাড়ি বোঝাই হয়ে গেলো।

বেড়ার দোকান থেকে করমালির ঘর বানাবার জন্য বাঁশ, আর বেড়া কিনলেন বাবা। গাড়ির ওপরের ক্যারিয়ারের সঙ্গে ওগুলো শক্ত করে বাঁধা হলো। দড়ি কিনলেন। দুটো বড় আর দুটো ছোট বালতি কিনলেন। চারটা হারিকেন আর কেরোসিন কিনলেন। দেড় ঘণ্টার মধ্যে গাড়ির ছাদ পর্যন্ত বোঝাই করে কমলছড়ির দিকে ছুটলেন। যাবার পথে হেডমাস্টারকে তার বাড়িতে নামিয়ে দিলেন।

হেডমাস্টার সঙ্গে থাকাতে অনেক উপকার হয়েছে। বাবা যে দোকানে ঢুকেছেন তিনি সঙ্গে-সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। শেষে বলেছেন, ইনি পাকাপাকিভাবে থাকতে এসেছেন।

প্রতিক্রিয়া হয়েছে দুরকম। সমতল থেকে আসা বাঙালিরা খুশি হয়েছে একজন। গণ্যমান্য ব্যক্তি ওদের ভেতর থাকবেন জেনে। আর পাহাড়ীরা কিছু না বললেও মুখ দেখে বোঝা গেছে খুশি হয় নি। দুজন অবশ্য কাষ্ঠ হেসে আপ্যায়ন করেছে, তবে সেটা একেবারেই ভদ্রতার খাতিরে।

সন্ধে হবার আগেই টুটুলরা কমলছড়ি ফিরে এলো। সবাই মিলে ধরাধরি করে জিনিসপত্র নামালো। মালপত্র সব একটা ঘরে নিয়ে মা টুটুল আর বিদ্যুৎকে নিয়ে গুছিয়ে রাখলেন।

বাবা আর করমালি দুজনে মিলে বেড়ার ঘরটা বাঁধার আয়োজন করলেন। ঘরের কাজ শেষ করে টুটুল আর বিদ্যুৎও যোগ দিলো তাঁদের সঙ্গে। বাবা বললেন, ভিটে বাঁধার ঝামেলা করে কাজ নেই। সিমেন্টের যে স্ল্যাবগুলো আছে ওগুলো বিছিয়ে নিলেই চমৎকার মেঝে হয়ে যাবে।

বাঁশের খুঁটো পোঁতার জন্য শাবল দিয়ে গর্ত খুঁড়তে-খুঁড়তে করমালি বললো, এত দিন আমরা দুগা মানুষ একলা থাইকতাম, মনে ওইতো কবরস্তানে আছি। অন মনে অর বয়স অদ্দেক কমি গেছে।

বেশি সময় লাগলো না। ঘণ্টা তিনেকের ভেতর তৈরি হয়ে গেলো করমালির ঘর। অন্ধকার হয়ে যাবার পর টুটুলরা হারিকেল জ্বেলে কাজ করেছে। বাবা বললেন, কাল জানালা কাটিয়ে নিও। তার বদলে আজ দরজার জায়গাটা খোলা থাক।

বিদ্যুৎ বললো, দেখতে কিন্তু বেশ হয়েছে।

টুটুল বাবার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে বললো, এত বড় ইঞ্জিনিয়ার বানিয়েছে, ভালো না হয়ে উপায় আছে।

বাবা হেসে বললেন, জীবনে এই প্রথম নিজ হাতে ঘর বানালাম।

করমালি আহ্লাদে আটখানা হয়ে বৌকে ডাকলো–ও জিরার মা, দেই যম, কত সোন্দর ঘর বানাইছি।

জিরার মা দৌড়ে এসে ঘর দেখতে গিয়ে বাবাকে দেখে একহাত ঘোমটা টেনে জিভ কাটলো। বাবা মৃদু হেসে বললেন, বিদ্যুৎ, টুটুল, চলো আমরা বারান্দায় গিয়ে বসি। 

মা ওদের মুড়ি ভেজে চা দিলেন। বললেন, ভাত হতে দেরি হবে।  

দেরি হলো মার মুরগি রান্নার জন্য। সেই সঙ্গে ঘন মুগডাল বেঁধেছেন, ভাজিও করেছেন এক পদ। মেঝেতে মাদুর পেতে খেতে-খেতে টুটুল বললো, দিদা যেভাবে মগের মুলুকের ভয় দিচ্ছিলো, মনে হয়েছিলো শুধু ঝরনার পানি আর বুনো ফল খেয়ে থাকতে হবে।

দিদা বললেন, অত তড়পিও না বাছা। মগের মুলুক দেখার দিন শেষ হয়ে যায়

খেয়ে উঠে বাবা টুটুল আর বিদ্যুৎকে নিয়ে বারান্দায় বসলেন বাড়ির নকশা আঁকার জন্য। বললেন, দক্ষিণে আর পুবে পাহাড় দেখে কাল একটা সাইট খুঁজে বের করতে হবে। আমার মনে হয় টিউব ওয়েলের কাছে এরকম জায়গা পাওয়া যাবে।

টুটুল বললো, একদম পাহাড়ের ওপর কর না বাবা। চিটাগাং বাটালি হিলে দেখো নি কী সুন্দর বাঙলো?

উঁচু পাহাড়ে ঝড়ের ভয় আছে। পানিরও প্রব্লেম হবে। কোনোদিন যথেষ্ট পয়সা হাতে এলে ওসব কথা ভাবা যাবে।

বাবা মোল শ বর্গফুটের দেড় তলা কাঠের বাঙলোর নকশা আঁকলেন। তিনটি শোবার ঘর, বসা আর খাবার জায়গা একটা বড় ঘরের ভেতর, সামনে চওড়া বারান্দা, ড্রইং রুমের ভেতর দিয়ে সিঁড়ি লাগিয়ে বারান্দার ওপর একটা ঘরের নকশা আঁকলেন মিতুল আর কুমার জন্য। বড়িবিও ওদের সঙ্গে থাকবে। পুরো নকশা দেখে বিদ্যুৎ আর টুটুল. এমনই উচ্ছ্বসিত হলো যে লজ্জা পেয়ে বাবাকে বলতেই হলো, ঠিক আছে এখন ঘুমোনো যাক। কাল থেকে প্রচণ্ড কাজ শুরু হবে।

দিদা মেঝেতে বিছানা করে এক ঘরে ছেলেদের, আরেক ঘরে মেয়েদের শোবার ব্যবস্থা করেছেন। শোবার সঙ্গে-সঙ্গে টুটুল আর বিদ্যুৎ গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো। শুধু বাবা জেগে রইলেন অনেক রাত পর্যন্ত। যে প্রচণ্ড জেদ আর ক্ষোভ তাকে এখানে তাড়া করে এনেছে শেষ পর্যন্ত মাথা উঁচু করে টিকে থাকতে পারবেন তো? নিজের সঞ্চয়ের কথা ভাবলেন। আগামী এক বছরে বড়-বড় খরচ কি হতে পারে ভাবলেন। কয়েকবার হিসেব মিললো না। শেষে অতি কষ্টে যখন হিসেব মেলালেন তখন ঘুমে তার চোখের পাতা ভারি হয়ে এসেছে।