০১-২. একটি দুঃসংবাদ এবং তারপর

সীমান্তে সংঘাত – কিশোর উপন্যাস – শাহরিয়ার কবির

০১. একটি দুঃসংবাদ এবং তারপর

মাঝরাতে টুটুলের ঘুম ভেঙে গেলো। তাকিয়ে দেখলো জানালা গলিয়ে আসা রাস্তার লাইট পোস্টের এক টুকরো আলো মেঝের উপর শুয়ে আছে। বালিশের তলা থেকে হাত-ঘড়িটা বের করলো। দুটো বাজতে দশ মিনিট বাকি। স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার এক মাস আগে বাবা ওকে এই সিটিজেন ঘড়িটা কিনে দিয়েছেন। মুহূর্তের জন্য টুটুল ওটা হাতছাড়া করে না। কানের কাছে এনে সেকেণ্ডের কাঁটার টিকটিক শব্দ শুনলো। আবার বালিশের তলায় রেখে দিলো।

টুটুলদের পরীক্ষা শেষ হয়েছে একুশ দিন আগে। বাকি ছিল প্র্যাকটিক্যাল। সেটাও গতকাল হয়ে গেছে। সবচেয়ে সুন্দর অবসর এখন। বাদল, মন্টু আর পনিরের সঙ্গে কথা হয়েছে কক্সবাজার বেড়াতে যাবে। কবে যাবে এখনো বাবাকে বলেনি টুটুল। জানে, বাবা কখনো বাধা দেবেন না। বাবার সঙ্গে ও সব ব্যাপারে বন্ধুর মতো কথা বলে। শেষ পরীক্ষা দিয়ে এসে বাবাকে শুধু বলেছিলো, দূরে কোথাও যদি বেড়াতে যাই। আপত্তি করবে না তো বাবা?

বাবা তখন অফিস থেকে ফিরে ইজিচেয়ারে শুয়ে খবরের কাগজ দেখছিলেন। মুখ টিপে হেসে একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, নির্ভর করছে কত দূরে!

বাবার কথা বলার ধরন দেখে টুটুলও হাসলো–বেশি দূরে নয় বাবা। ধরো সুন্দরবন কিংবা চিটাগাং। সিলেটের দিকেও যেতে পারি।

দেশের ভেতরে হলে আপত্তি নেই। বাবা হাঁপ ছাড়লেন–আমি ভেবেছিলাম দেশের বাইরে বুঝি কোথাও যেতে চাইছে।

তাও ভেবেছিলাম। বিজন আর হারুনরা ইণ্ডিয়া ট্যুরের ব্যবস্থা করছে। ওরা ধরেছিলো খুব। টাকার কথা শুনে ঘাবড়ে গেছি। আসলে তোমাকে বেশি ট্যাক্স করতে চাই না বাবা।

নাকি! বাবা আবার মুখ টিপে হাসলেন। কথাটা তোমার মার মুখ থেকে শুনলে আমি বেশি খুশি হতাম।

চা নিয়ে ঢুকতেই মার কানে গেলো বাবার কথা। সব আমি শুনেছি। মা হেসে চায়ের কাপ দুটো টেবিলে নামিয়ে রেখে বিছানার ওপর গ্যাঁট হয়ে বসলেন। তুমি কি বলতে চাও আমি তোমাকে বেশি ট্যাক্স করি?

না, ঠিক তা বলি নি। তাড়াতাড়ি চা খেতে গিয়ে বিষম খেলেন বাবা।

এমন সময় দিদা ঢুকলেন ঘরে। বাবাকে কাশতে দেখে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ওকি হাবু, অমন কছিস কেন? কি হলো বৌমা, তুমি মুখে আঁচল চাপছো কেন? ওরে ঘোড়া, বাপটাকে একটু ধর না!

বাবা কাশি থামিয়ে বললেন, কিছু হয় নি মা, তুমি খামকা ব্যস্ত হচ্ছে। এরা এমন সব হাসির কথা বলছিলো, তাই বিষম খেয়েছি।

বলিহারি বৌমা! চা খাবার সময় হাসির কথা কি না বললেই নয়! আর এই ছেঁড়া তো তখন থেকে বাপের সঙ্গে বসে গুজগুজ ফুসফুস করছে।

মা কোনোমতে হাসি থামিয়ে আদুরে গলায় বললেন, আপনার জন্য বেলের শরবত করেছি মা। এখন কি এনে দেবো?

বেলের শরবত দিতে বারণ করি নি বাছা। বারণ করছি খাওয়ার সময় মানুষকে না হাসাতে।

বিছানায় শুয়ে দিদার কথা ভেবে টুটুল মৃদু হাসলো। দিদার বকুনি থেকে কারো রেহাই নেই। অথচ দিদা যখন মাঝে-মাঝে জানু ফুপির বাসায় বেড়াতে যান, তখন টুটুলদের গোটা বাড়িটা ফাঁকা মনে হয়। ওর ছোট বোন চার বছরের ঝুমা শুকনো মুখে ঘুরে বেড়ায়। ঝুমার বড় ক্লাস ফাইভের মিতুল দিনের ভেতর দশবার দিদাকে ফোন করে–তুমি আসছো না কেন দিদা–বলে। পরদিন দিদা এসেই সারা বাড়ি মাথায় তোলেন–তোরা আমায় পেয়েছিস কী? মেয়ের বাড়িতে দুদিনের জন্য বেড়াতে যাবো–তাও কি পারবো না? আমাকে বুঝি কেউ নানি ডাকে না!

ঝুমা আর মিতুল দিদার দুপাশে ঝুলতে-ঝুলতে বলে, তুমি আগে আমাদের দিদা, তারপর রুমকিদের নানি। ওদের বাড়িতে তো আরেকটা দিদা আছে।

এ কথা বললেই দিদা জব্দ। রুমকিদের দিদার সঙ্গে দেখা হলে তো হবেই, না হলে দিনের ভেতর টেলিফোনে একবার হলেও ঝগড়া করবেন দিদা। টুটুল মাঝে-মাঝে টেলিফোনে দিদার কথা শোনে–বললেই তো হলো না বেয়ান। গরুর মাংসে চলতে পারে, মুরগির মাংসে কখনো ধনেবাটা চলে না। … ওসব হলো ছোটলোকি রান্না … আপনাকে নয়, রান্নাকে ছোটলোকি বলেছি … বলেছি তো বেশ করেছি। এই বলে ঠকাস করে রিসিভার রেখে এদিক-ওদিক তাকিয়ে হঠাৎ টুটুলকেই ধমকানো শুরু করেন, কাজকম্ম আর লেখাপড়া ফেলে মুরুব্বিদের কথা শুনছিস? তোদের জ্বালায় একটু প্রাইভেট কথাও বলতে পারবো না বেয়ানের সঙ্গে?

টুটুল গত জানুয়ারিতে পনের পেরিয়ে ষোলয় পা দিয়েছে। স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা শেষ করেছে, অনেক কিছু দেখেছে, স্কুলের বইয়ের বাইরে পড়েছেও অনেক। ক্লাসে বরাবর ফার্স্ট না হলে সেকেণ্ড হয়েছে, ক্লাস এইটে একবার খালি থার্ড হয়েছিলো। স্কুলের ফুটবল টীমে গত দুবছর ধরে ক্যাপ্টেনশিপ করেছে, টেবিল টেনিসে ইন্টার স্কুল চ্যাম্পিয়ন। অনেক বন্ধু ওর, অনেকের বাড়ি গিয়েছে। তবু নিজেদের বাড়ির মতো এত আনন্দের পরিবেশ আর কোথাও দেখে নি টুটুল। দিদা, বাবা, মা, মিতুল, ঝুমা আর মার ছোটবেলার হিন্দুস্থায়ী আয়া বড়িবি–এই কজন নিয়ে ওদের এই পুরনো আমলের জমিদার বাড়িটা সারাক্ষণ হাসিখুশিতে ভরে থাকে।

না, বাড়িটা ওদের নিজের নয়, সরকারি। দুর্গাপুরের জমিদারদের রিকুইজিশন করা বাড়ি। নিচের তলাটা গুদাম, ওপরে ছোট-বড় আটটা কামরা জুড়ে টুটুলের বাবা সড়ক বিভাগের অ্যাসিস্টেন্ট চীফ ইঞ্জিনিয়ার হাবিবুল বাশারের সংসার। টুটুলের ভালো লাগে এই বাড়িটাও। বিশ ইঞ্চি পুরু দেয়াল, উঁচু ছাদ, বড়-বড় সব দরজা-জানালা। মাঝখানের বড় হলঘরটায় পুরু সেগুন কাঠের পাটাতন, নাকি জমিদারদের নাচঘর ছিলো।

সামনে টানা বারান্দা, তার সামনে ঝুল-বারান্দা। ছাদে উঠলে বুড়িগঙ্গা দেখা যায়। সারা দিন প্রচুর আলো আর বাতাসের মাতামাতি সারা বাড়িতে। টুটুলের বন্ধুরা এলে ঝুল-বারান্দায় বেতের চেয়ার টেনে বসে। বাবার গোলাপের শখ। শীতের সময় ঝুল-বারান্দার চারপাশে চল্লিশ রকমের গোলাপ ফোটে। বন্ধুরা দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়। বিজন তো এসেই মাকে বলবে–স্বর্গে তো এলাম মাসিমা। এক কাপ চা পেলে অমৃত ভেবে খেতাম। দিদা আবার চায়ের কথা শুনলে বিরক্ত হন–ােন ছেলের কথা! চায়ের মতো হতকুচ্ছিৎ জিনিস বুঝি অমৃত হলো? খেলেই তো অম্বল হয়! বৌমা, ওদের বেলের শরবত আর চিড়ে ভেজে দাও। মা বেলের শরবত দেন, পরে দিদাকে লুকিয়ে ওদের ছাদে যেতে বলে চাও পাঠিয়ে দেন। সবকিছু মিলিয়ে টুটুলদের দিনগুলো চমৎকার কেটে যাচ্ছিলো। তবে সবদিন কারোরই সমান যায় না। শেষ বসন্তের এক মাঝরাতে টুটুলের হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর থেকেই জীবন অন্যরকম হয়ে গেলো।

প্রথম দিকে টুটুল কিছু টের পায় নি। মাঝে-মাঝে এমন হয়। কখনো স্বপ্ন দেখে, কখনো-বা এমনি কোনো রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। টুকরো-টুকরো কথা মনে পড়ে। সবকিছুই সুন্দর, আনন্দের। ভাবতে-ভাবতে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। বাইরে নারকেল গাছের পাতায় শব্দের কাঁপন তুলে নদীর তাজা বাতাস বয়ে যায়।

সেই রাতে বাতাস ছিলো না। জানালার বাইরে নারকেল গাছটা চুপচাপ বিষণ্ণ এক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। ঘরের ভেতর ফ্যানের মৃদু শব্দ। বেশ কিছুক্ষণ পর টুটুলের চোখের পাতা ঘুমে যখন আবার ভারি হয়ে এলো, তখন বারান্দায় চাপা গলায় কথা শুনলো। টানা বারান্দার এক মাথায় ওর ঘর। কান খাড়া করে শুনলো, বারান্দায় কারা যেন কথা বলছে।

ভূতের ভয় টুটুলের কখনোই ছিলো না। চোর-ডাকাতের ভয়ও না। বারান্দায় কথা শুনে অবাক হলো সে। চোর-ডাকাতের কোনো ভয় এ বাড়িতে নেই। নিচে দুজন দারোয়ান থাকে। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে গেলে দুটো ভারি দরজা পেরুতে হয়। রাতে বাবা নিজ হাতে দরজা বন্ধ করেন। বন্ধ থাকলে কারো সাধ্যি নেই সেই দরজা ভাঙে। কথা শুনে টুটুল একবার ভাবলো, রাতে হয়তো কোনো আত্মীয়স্বজন এসেছেন, গরমের জন্য বারান্দায় এসে বসেছেন। তবু সে উঠে বসলো। খাট থেকে নেমে দরজা খুলতে যাবে, তখন বাবার গলা শুনলো। মার সঙ্গে কথা বলছেন বাবা। দরজা খুলতে গিয়েও খুললো না টুটুল। দাঁড়িয়ে রইলো, কিছুটা অবাক হয়ে।

মাঝে-মাঝে বাবা সবাইকে নিয়ে বারান্দায় বসেন। ছোটবেলার গল্প করেন আর সুযোগ পেলে দিদা পান চিবুতে-চিবুতে ভুল ধরেন–তুই বানিয়ে বলছিস হাবু, এতো ছোটবেলার কথা তোর মনেই থাকতে পারে না। মা হেসে দিদাকে বলেন, আপনি না থাকলে আরো যে কত গল্প ও বানাতো! হা মা, দশ বছর বয়সে ও নাকি ছ হাত লম্বা একটা গোখরো সাপ মেরেছিলো? দিদা নির্বিকার গলায় বলেন, তোকে কতবার বলেছি হাবু ওটা গোখরো ছিলো না, তেঁড়া ছিলো। লম্বার কথা বলছো বৌমা? তা হাত দুয়েকের মতো হতে পারে। টুটুল তখন বাবার পক্ষ নেয়–দশ বছর কারো পক্ষে দু হাত লম্বা একটা টোড়া সাপ মারা কম কথা নয় দিদা! দিদাকে তবু দমানো যায় না–কম না বেশি সে কথা তো আমি বলি নি বাছা। তোদের বাপ মাঝে-মাঝে একটু বাড়িয়ে বলে। বাবা লাজুক হেসে বলেন, ছোটদের কল্পনাশক্তি একটু বেশি থাকে মা। আমি দশ বছরের একটা ছেলের গল্প বলছি। ও যদি তেঁড়াকে গোখরো ভেবে আনন্দ পায়, পেতে দাও না।

বাবার সব কথাতেই আমোদর ছোঁয়া থাকে। তবে সেই রাতে বাবার কথা ছিলো একেবারে অন্যরকম। দরজার এপাশে দাঁড়িয়ে টুটুল বাবাকে বলতে শুনলো, এত বড় অপমান আর অপবাদ সহ্য করতে পারি নি বলেই চাকরি ছেড়েছি। জানি, তোমাদের সবার খুব কষ্ট হবে। ছেলেমেয়েদের এতটুকু কষ্ট হবে ভাবতেও বুকটা ভেঙে যেতে চায়। তবু আমার কোনো উপায় ছিলো না নীনা।

বাবার কথা শুনে পাথরের মতো জমে গেলো টুটুল। একবার মনে হলো ও বুঝি ঘুমের ভেতর ভীষণ এক দুঃস্বপ্ন দেখছে। একুশ বছরের চাকরি বাবার। আর কয়েক বছর পরই চীফ ইঞ্জিনিয়ার হবেন। বাবার আর চাকরি নেই, একথা কি বিশ্বাস করার মতো!

মা আস্তে-আস্তে বললেন, সম্মান হারানোর চেয়ে বেশি কষ্ট আর কিছু হতে পারে হাবিব। আমার তো মনে হয় তুমি ঠিকই করেছে। চাকরি করার চেয়ে স্বাধীনভাবে কিছু করা অনেক বেশি আনন্দের।

বাবা আবার বললেন, টুটুল বড় হয়েছে। ক্যারিয়ার নিয়ে এখনই ও ভাবে। আমার চেয়ে বড় ইঞ্জিনিয়ার হতে চায় ও। ওদের এখন স্বপ্ন দেখার বয়স। এই সময় এত বড় আঘাত কিভাবে সামলাবে তাই ভাবছি।

সবকিছু টুটুলের কাছে ভীষণ অনিশ্চিত আর ভয়ের মনে হলো। বাবার জন্য কষ্ট হলো। মা বললেন, টুটুলকে আমরা আর দশটা সাধারণ ছেলের মতো মানুষ করি নি। বলবে, এটা একটা চ্যালেঞ্জের মতো। যদি ও সাহসী না হয় তাহলে জানু আপার কাছে থেকে লেখাপড়া করবে। তুমি মন খারাপ কোরো না হাবিব। আমরা ঠিকই সামলে নেবো।

বাবা আর কোনো কথা বললেন না। টুটুল দরজার পাশে দাঁড়িয়ে রইলো। এভাবে বাবা-মার কথা শোনা যে ওর উচিত হচ্ছে না একবারও মনে হলো না সে কথা। দরজা খুলে বাইরে যাবারও সাহস হলো না। দূরে দমকল অফিসের পেটাঘড়িতে রাত তিনটার ঘণ্টা বাজলো। মাকে শেষবার বলতে শুনলো, ঘরে গিয়ে শোবে চলো। কাল সবাইকে জানাবো।

বাবা-মা উঠে ঘরে গেলেন। টুটুল বিছানায় এসে শুয়ে-শুয়ে আকাশ-পাতাল অনেক কিছু ভাবতে-ভাবতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লো।

.

পরদিন দিদার ডাকে টুটুলের ঘুম ভাঙলো। দিদা মশারি তুলতে-তুলতে বললেন, কী হলো রে! অন্যদিন এতক্ষণে তোর ডন-বৈঠক দেখতে-দেখতে হয়রান হয়ে যাই, আজ যে বড় ঘুমিয়ে আছিস? রাত জেগে নভেল পড়েছিস বুঝি!

টুটুল হাই তুলে সামান্য হাসলো। রাতে ঘুমাবার আগে ঠিক করেছে বাবা ওকে যত বড় চ্যালেঞ্জের কথাই বলুন না কেন, ও পিছিয়ে আসবে না। এ কথাটা ভাবার পরই ও নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছিলো।

দিদা বেরিয়ে যেতেই ধুপধাপ করে ব্যায়ামগুলো সেরে বাইরে এলো। দেখলো, বাবা টবের গোলাপ গাছে পানি দিচ্ছেন। ওকে দেখে হেসে বললেন, দেখেছিস, কী চমৎকার ব্লু মুন ফুটেছে।

টুটুল কাছে গিয়ে দেখলো, বড় দুটো হালকা বেগুনি রঙের গোলাপ। বড়-বড় পাপড়ি, হাইব্রিড টি জাতের। শুঁকে দেখলো হালকা গন্ধ রয়েছে। বাবা যশোরের এক নার্সারি থেকে এনেছিলেন এই গাছটা।

টুটুল বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো, রোজকার মতোই ঝারি দিয়ে টবে পানি দিতে দিতে পাইপটা দাঁতে চেপে অল্প-অল্প ধোয়া ছাড়ছেন, গায়ে ড্রাগন আঁকা স্লিপিং গাউন। বাতাসে গোলাপের হালকা গন্ধের সঙ্গে থ্রী নান তামাকের মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে আছে। একবার মনে হলো, কাল রাতে ও স্বপ্ন দেখে নি তো!

নাশতার টেবিলে কথাটা পাড়লেন বাবা। মার কথামতো বড়িবি আগেই মিতুল আর ঝুমাকে নিয়ে ওদের ঘরে চলে গেছে। মিতুলের সেদিন স্কুল বন্ধ ছিলো। বড়িবি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে বাবা বললেন, মা শোন, টুটুলও শোন। একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে চাই।

দিদা একটু অবাক হয়ে একবার টুটুলের দিকে একবার তার বৌমার মুখের দিকে তাকালেন। বাবা বললেন, আমি কাল চাকরি থেকে রিজাইন করেছি।

দিদার চোখ দুটো গোল হয়ে গেলো। চাপা উত্তেজিত গলায় বললেন, একেবারে করেই ফেলেছিস? না করবি বলে ঠিক করেছিস?

বাবা কাষ্ঠ হাসলেন না মা, করেই ফেলেছি। সামান্য কেশে গলা পরিষ্কার করে একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, তোমাদের অবশ্য আগে বলি নি, তবে নীনাকে বলেছি। আমাদের অফিসের চীফ ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে বছর খানেক ধরেই আমার সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিলো না। ভদ্রলোক ঘুষ খাবেন, অফিসসুদ্ধ সবাইকে নিয়ে। আমি এটা পছন্দ করি না। এ নিয়েই গণ্ডগোলের শুরু। অফিসে তিনি নোংরা পলিটিক্স শুরু করেছেন। অন্য অফিসার আর কর্মচারীদের দিয়ে আমাকে নানাভাবে অপমান আর নাজেহাল করছেন। অফিসের অনেক অনিয়ম আমার ওপর চাপানোর চেষ্টা করেছেন। অনেক ভেবে দেখেছি। ওপরঅলাদের সঙ্গেও কথা বলেছি। সব জায়গায় চীফ ইঞ্জিনিয়ারের লোক রয়েছে। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েছি চাকরি ছাড়তে।

বাবার কথা শেষ হওয়ার পর বেশ কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বললো না। মা একসময় আস্তে-আস্তে বাবাকে বললেন, তোমাকে আরেক কাপ চা দেবো?

বাবা বললেন, দিতে পারো।

টুটুল বললো, আমাকেও দিও মা।

টুটুল বড়দের সামনে চা খাবে জেনেও দিদা কিছু বললেন না। তাঁর মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিলো ভেতরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। অনেক কষ্ট করে মানুষ করেছেন টুটুলের বাবাকে। সব কটা পাসের পর বিলেত পাঠিয়েছিলেন। প্রত্যেকবার পরীক্ষার ফল দেখে আহ্লাদে আটখানা হয়ে যেতেন। পাড়ার সবাইকে ডেকে মিষ্টি খাওয়াতেন। অন্যায়ের কাছে কোনোদিন মাথা নোয়াতে দেখেন নি তার ছেলেকে। দিদার মনে হলো টুটুলের বাবা ঠিকই করেছেন। তবু বললেন, চাকরি না ছেড়ে কোথাও বদলির চেষ্টা করলে হতো না হাবু?

ম্লান হেসে বাবা বললেন, সে চেষ্টাও করেছিলাম মা। আসলে ওপরে নিচে সবাই মিলে আমার পেছনে লেগেছিলো। বলতে পারো চাকরি ছাড়তে আমাকে বাধ্য করা হয়েছে।

টুটুল বললো, কামাল কাকার মতো নিজে একটা ফার্ম করো না বাবা?

দিদা বললেন, তুই কিছু ভেবেছিস, কী করবি?

বাবা টুটুলকে বললেন, প্রাইভেট ফার্মের কথাও একবার ভেবেছিলাম। পরে দেখলাম, এ ধরনের লোকের কাছে যেতেই হবে। নিজের অফিসে তো দেখেছি কাজের জন্য, বিলের জন্য কত খোসামুদি করতে হয়। কত ঘুষ দিতে হয়। ঘুষ ছাড়া আজকাল কোনো কাজই হবার নয়। অথচ ঘুষ নেয়া বা ঘুষ দেয়া কোনোটাই আমাকে দিয়ে হবে না। একটু থেমে বাবা আবার বললেন, খাগড়াছড়ির কাছে আমাদের যে জমিটা আছে, ওখানে চাষবাস করবো ঠিক করেছি। ফার্ম করবো, তবে সেটা কৃষি ফার্ম। শহর থেকে দূরে হলেও জায়গাটা চমৎকার।

দিদা কাষ্ঠ হেসে বললেন, চাষবাস করার জন্য এতগুলো পাস দেয়ার কি দরকার ছিলো,তা তুমিই জানো বাছা। তাও কোন মগের মুলুকের জঙ্গলে গিয়ে।

বাবার প্রস্তাব দিদার মনমতো না হলেও টুটুলের রোমাঞ্চ হলো। বাবার কথায় এ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ খুঁজে পেলো সে। ওয়েস্টার্ন অ্যাডভেঞ্চারের কমিক পেলে এখনো টুটুল নাওয়া-খাওয়া ভুলে যায়। মনে হলো, ঝরনার ধারে পাহাড়ের নিচে জঙ্গল-ঘেরা

এক কাঠের বাড়িতে ওদের দিনগুলো দারুণ রোমাঞ্চকর হবে। উত্তেজনায় টুটুলের চোখ দুটো চকচক করে উঠলো।

বাবা টুটুলের দিকে তাকিয়ে বুঝলেন ও কী ভাবছে। মৃদু হাসলেন। দিদাকে বললেন, মা, পড়াশোনা মানে তো কিছু জানা। কোনো জানাই বিফলে যায় না। আধুনিক খামার করতে গেলে আমার যেটুকু বিদ্যে আছে, অনেক কাজে লাগবে।

দিদা কাঠ কাঠ গলায় বললেন, তোমারটা থাক। ছেলেদের পড়াশোনার কী হবে শুনি?

ওদের কথাও আমি ভেবেছি। খাগড়াছড়িতে হাই স্কুল আছে, মিতুলের অসুবিধে হবে না। টুটুলের দুটো বছর নষ্ট হবে। নিজের পায়ে শক্তভাবে দাঁড়ানোর জন্য আমার দু বছর সময় লাগবে। টুটুল যদি পড়াশোনা নষ্ট করতে না চায় তাহলে ও জানুর কাছে থাকবে।

টুটুল বললো, দুবছর এমন কিছু সময় নয় বাবা।

মা চা এনে দিলেন বাবা আর টুটুলকে। দিদা কটমট করে তাকালেন টুটুলের দিকে। বাবাকে বললেন, কবে যাওয়া হবে ঠিক হয়েছে?

এদিকে সব গোছগাছ করে যত তাড়াতাড়ি পারি। আগে আমি আর টুটুল যাবো। পরে ওদিকটা গুছিয়ে তোমাদের নিয়ে যাবো। কিছুদিনের জন্য তোমরা জানুদের বাসায় থাকতে পারো।

না। দিদা মাথা নাড়লেন–বৌমা থাকতে চাইলে থাকতে পারে, আমি তোমাদের সঙ্গে যাবো। জামাইর বাড়িতে থাকা আমার পোষাবে না। তাছাড়া যে বাড়িতে …… বলেই তার বেয়ানের কথা বলতে গিয়ে টুটুলকে দেখে থামলেন।

মা দিদাকে বললেন, আমি না গেলে রান্না করবে কে মা? আপনার পায়ে বাতের। তেল মালিশ করবে কে? বেলের শরবত বানিয়ে দেবে কে?

দিদা খরখরে গলায় বললেন, যেতে চাইলে যাবে। তবে মালিশের ভয় দেখিও না বাছা। বেলের শরবতের লোভও দেখিও না। নিজের মালিশ আমি নিজে করতে পারি। আর ওই মগের মুলুকের জঙ্গলে আমার জন্য যে কত বেল গাছে-গাছে ঝুলছে, সে তো এখানে বসেই দেখতে পাচ্ছি।

মা তবু বললেন, রান্নাঘরে গেলে আপনার মাথা ধরে মা!

বাবা এতক্ষণে সহজভাবে হাসলেন। ঠিক আছে মা, আমরা সবাই একসঙ্গে যাবো।

দিদাও হাসলেন–এ বয়সে আরো কত কী যে দেখবো! শেষকালে মগদের হাতে বেঘোরে না জানটা খোয়াই! যাই, বেয়ানকে খবরটা দিইগে। তুই নিজে ওদের বাড়ি থেকে একবার ঘুরে আয় হাবু। খাট, পালং, আলমারি, সোফা তো আর এখন নেয়া যাবে ্না। ওগুলো আপাতত জানুদের বাড়িতেই থাকবে। বৌমা, গোছানোর কাজ শুরু করে দাও। তোমরা আবার ছোট পাজি দুটোকে রেখে যাবার মতলব কোরো না। ওদের ফেলে আমি থাকতে পারবো না।

বাবা বললেন, তুমি না থাকলে কবে যে আমি ভেসে যেতাম মা!

অত পটিও না বাছা, বুঝেছি, আরেক কাপ চা চাইবার মতলব। উঠে পড়ো, আর চা হবে না। তাই তো বলি, সকাল থেকে বৌমা তোমাকে এত ঘন-ঘন চা দিচ্ছে কেন?

দিদার কথা শুনে সবাই একসঙ্গে হেসে উঠলো। বাবা উঠে ঘরে গেলেন। টুটুল বললো, মা, আমি একটু বেরুচ্ছি।

মা বললেন, দুপুরে বাসায় খাবে।

বাবা বললেন, আমি তাহলে জানুদের বাসা থেকে ঘুরে আসি। টুটুল আমার সঙ্গে আসতে পারিস। তোকে যাওয়ার পথে নামিয়ে দেবো। জানি তো, বিজনদের বাড়িতে যাবি!

টুটুল উঠে চটপট কাপড় বদলে বাবার সঙ্গে বেরুলো। বিজনদের বাড়িতে যাওয়ার পথে বাবা বললেন, পড়াশোনা নষ্ট হবে বলে মন খারাপ করছে, না টুটুল? ওখানে তো বন্ধুদেরও মিস করবি।

টুটুল একটু চুপ থেকে ভাবলো কথাটা বাবাকে বলবে কি না। ইতস্তত করে বলেই ফেললো, তুমি রাগ করো না বাবা। আমি কাল রাতে তোমার আর মার কিছু কথা শুনেছি। তোমরা তখন বারান্দায় বসে কথা বলছিলে। মন খারাপ করেছিলো শুধু তোমার কষ্টের কথা ভেবে। আমি কাল রাতেই ঠিক করেছি, যা কিছু হোক না কেন, আমি তোমার সঙ্গে থাকবো।

বাবা মৃদু হাসলেন। প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন, আমাদের এই মরিস অক্সফোর্ডটা পাল্টে কামালের কাছ থেকে ওর ল্যাণ্ড রোভারটা নেবো।

টুটুল বললো, দামের দিক দিয়ে তুমি খুব একটা জিততে পারবে বলে মনে হচ্ছে না।

বাবা হাসলেন–সব সময় কি সব কিছুতে জেতা যায় টুটুল? জীবনে চলতে গেলে হারজিতের বহু চড়াই-উতরাই পেরুতে হয়।

.

০২. বিপদভরা পথে

রামগড় পেরুবার পর শুরু হলো পাহাড়ী পথের চড়াই আর উতরাই। টুটুলদের গাড়ি দুপুরের কিছুক্ষণ পরই রামগড় ছেড়েছে। আকাশ মেঘলা। একটু আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। কাঁচা রাস্তায় খুব সাবধানে গাড়ি চালাচ্ছিলেন বাবা। এতটুকু স্লিপ করলে চার-পাঁচশো ফুট নিচে খাদে পড়তে হবে। সামান্য স্পীড বাড়ালেই চাকা পিছলে যাচ্ছিলো।

কামাল কাকার জীপ-এর সামনে বাবার পাশে বসেছেন মা আর দিদা। মার কোলে ঝুমা। পেছনে টুটুল, মিতুল আর বড়িবি।

কিছুতেই বড়িবিকে রেখে আসা গেলো না। কাল রাতে ওকে যখন দিদা বললেন, তুমি জানুর বাড়িতে থাকো। ওর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আমরা কোন চুলোয় থাকবো তার কোনো ঠিক আছে। আমার এই শাড়ি কখানা আর শালটা তুমি নাও। যাওয়ার সময় আবার ফাঁচ-ফাঁচ করে কেঁদো না।

দিদার কথা শেষ না হতেই বডিবি কান্না শুরু করলো হামারে ফেলিয়া যাবেন না গো। মিতুল বেটা আর ঝুমা বেটিকে কে দেখবে গোয় হামি অনেক কাজ করতে পারবো গো মিসিবাবা। হামারে সঙ্গে লিয়ে যান। আমার সাড়ি-কাপড়া নাহি লাগবে রে।

সে কি হাউমাউ কান্না বডিবির! শেষে দিদাকে বিরক্ত হয়ে বলতেই হলো–আ মোলো! এ যে দেখি মড়াবাড়ির কান্না জুড়েছে! থাম তো বাছা। দেখি হাবুকে বলে রাজি করাতে পারি কি না। আমার কপালে বিস্তর ভোগান্তি আছে এ আমি পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। সুখে থাকলে তোদের ভূতে কিলোয়।

দুদিন আগে নাশতার টেবিলে বাবা যখন খাগড়াছড়ি আসার কথা বললেন, তখন থেকেই দিদার ভোগান্তি শুরু হয়েছে। ভেবেছিলেন রয়েসয়ে হিসেবমতো গোছগাছ করে কিছু জিনিসপত্র বিক্রি করে, কিছু তাঁর মেয়ের বাড়িতে রেখে দিব্যি গুছিয়ে রওনা দেবেন। তা আর হলো না। সেদিন বিকেলেই বাবার অফিস আর এ. ডি. সি.র অফিস থেকে আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে বাড়ি ছেড়ে দেয়ার নোটিশ এলো। বাবা ভীষণ রেগে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন মামলা করবেন। দিদাই বুঝিয়েছেন, কাজ নেই বাবা মামলায় গিয়ে। এমনিতে শতেক ভোগান্তি। তার ওপর মামলার ভোগান্তি সইবে না। তোকে যারা হেনস্তা করেছে ওদের গায়ে শকুনে মুতুক। মামলা করতে গেলেই ওদের ইবলিশি চেহারা দেখতে হবে। থাক বাবা, একদিনের ভেতরই আমি গুছিয়ে নিতে পারবো।

খবর পেয়ে তখনই জানু ফুপি চলে এসেছেন ওঁদের দুজন আদালী নিয়ে। ফেঁত-ফোঁত করে খানিক কেঁদে বললেন, দাদা, আমি কি এতই পর যে কটা দিন আমার বাড়িতে থেকে সব ঠিকঠাকমতো গুছিয়ে যাওয়া যেতো না! মাও যে কেমন, দাদার মতো তোমারও কী মাথা খারাপ হলো মা!

দিদা বিরক্ত হয়ে জানু ফুপিকে ধমক দিয়েছেন–নাকী কান্না না কেঁদে তোমার আদালীগুলোকে বলো ভারী জিনিসপত্রগুলো নিচে নামাক, ট্রাক ডেকে মাল তুলুক। ভালো করেই তো জানো আমি জামাইবাড়ি থাকি না। অনেক কাজ আছে বাছা। আমরা আগে যাই, তারপর মনের সুখে যদ্দিন ইচ্ছে কেঁদো, কেউ তোমাকে বারণ করবে না।

ধমক খেয়ে জানু ফুপি আঁচলে কান্না চেপে মার সঙ্গে কাজে লেগেছিলেন। সব কিছু তদারক করেছেন দিদা। কাউকে ধমকে কাউকে আদর করে দিদা ম্যাজিকের মতো কাজ আদায় করে নিতে পারেন।

সবাইকে কাঁদতে বারণ করলেও দিদা কিন্তু বাড়ি ছাড়ার সময় কান্না সামলাতে পারেন নি। শুধু দিদা কেন–খারাপ সবারই লেগেছে। টুটুলের জন্ম হয়েছে এ বাড়িতে। গাড়িতে ওঠার আগে টুটুলের মনে হলো প্রচণ্ড শূন্যতা বুকে নিয়ে বাড়িটা হাহাকার করছে।

আগের দিন মালপত্র সব জানু ফুপিদের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। সঙ্গে দুটো ট্রাঙ্কে অতি দরকারি জিনিসপত্র, দুটো হোল্ডলে বিছানা-বালিশ, আর হাত-ব্যাগে সবার নিজেদের কাপড়চোপড়–এ নিয়েই টুটুলরা ভোররাতে ল্যাণ্ড রোভারে উঠেছে। গাড়ি ছাড়ার মুহূর্তে মিতুল আর ঝুমাকে আদর করতে গিয়ে নিচের তলার দারোয়ানরাও হাউমাউ করে কেঁদেছে।

বাবা বলেছেন, আপাতত ওদের জমির কেয়ারটেকার করমালিরা যে ঘরে থাকে সেখানে উঠবেন। তারপর ঘরদোর বানিয়ে প্রয়োজনমতো জিনিসপত্র আনিয়ে নেবেন। মার কুড়ি বছরের সংসার-জীবনে দরকারি-অদরকারি জিনিসপত্র কম জমে নি। বাবা জানু ফুপিকে বলেছেন, খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে বাড়তি সোফা, আলমারি, টেলিভিশন, ফ্রীজ, ফ্যান সব বিক্রি করে দিতে।

খাগড়াছড়ির যেখানে ওদের জমি, সেখানে আগামী দশ-পনের বছরে ইলেকট্রিসিটি যাবে না। আটষট্টি সালের গোড়ার দিকে তিরিশ একরের পাহাড় আর জঙ্গলের এই জমিটুকু লিজ নিয়েছিলেন বাবা। গত বার বছরে তিনি ছাড়া আর কেউ এ জমি দেখে নি। গোড়া থেকে করমালিই দেখাশোনা করছে। বাবার ইচ্ছে ছিলো অবসর নেয়ার পর এখানে খামার করবেন। এখন বাধ্য হয়ে সময়টা দশ বছর এগিয়ে আনতে হয়েছে। রামগড় থেকে গোলাবাড়ির পথে সাবধানে গাড়ি চালাতে-চালাতে বাবা মাকে বললেন, ঘাবড়িয়ো না নীনা। ফার্মটা একটু জমে উঠলেই আমরা জেনারেটর বসাবো। গভীর জঙ্গলে দিব্যি টেলিভিশনও দেখতে পাবে।

মা মৃদু হাসলেন। দিদা বললেন, টেলিভিশন দেখতে না পেয়ে যেন কারো ঘুম হচ্ছে না! মগের মুলুকে এনে উনি টেলিভিশনের লোভ দেখাচ্ছেন!

মিতুল দিদাকে বললো, তুমি না দেখ আমরা দেখবো টেলিভিশন। দাদা, তত দিন কি টার্জান আর স্টারট্রেক থাকবে?

শেষের কথাটা টুটুলকে বলা। টুটুল হেসে বললো, টার্জান না থাকলেও অন্য কোনো মজার সিরিজ নিশ্চয়ই থাকবে।

দিদা টুটুলকে বললেন, তুই অত মজা মজা করে লাফাস নে। সামনের বছর তোকে হোস্টেলে দেবো।

মা বললেন, করমালিকে আসার আগে একটা টেলিগ্রাম করা উচিত ছিলো।

বাবা বললেন, করা যেতো। তবে সেটা রিসিভ করতে হতো আমাদের। তত দিন ঘরদোরও বানানো হয়ে যেতো।

মা হাসলেন–ভালো জায়গাই খুঁজে বের করেছিলে!

দামের কথাটা একবার ভাবো।

রামগড় পেরুবার পর থেকে মিতুল সারাক্ষণ বড়িবিকে এটা কি, ওটা কেন প্রশ্ন করছিলো। বড়িবিও নিজের মতো করে গম্ভীর হয়ে মিতুলের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলো। একটা বাঁশঝাড়ের দুটো বাঁশ রাস্তার ওপর অনেকখানি নুয়ে পড়েছে দেখে মিতুল বললো, বাঁশ দুটো এরকম কেন বড়িবি?

বডিবি বললো, কাল রাতে বুঝি কোনো ভূত-পেরেত বসেছিলো।

তুমি ভূত দেখেছো বড়িবি?

খোদা মাপ করে! না বাপ, হামি ভূত কখনু দেখি নাই।

জঙ্গলে কি অনেক ভূত থাকে?

ভূত তো জঙ্গুলেই থাকে। হাড়িয়া ভূত, কালিয়া ভূত, মছলি খোর …।

ঝুমা চোখ গোল গোল করে ঘাড় ফিরিয়ে বডিবির কথা শুনছিলো। বললো, হাড়িয়া ভূত কী করে?

হাঁড়ি থেকে ভাত চুরি করে খায়।

কালিয়া ভূত কি করে?

কাওয়ালি গায়।

মা হাসি চেপে বললেন, বড়িবি, ছোটদের ভূতের গল্প বলতে বারণ করি নি তোমাকে?

বাবা হাসতে-হাসতে বললেন, যেসব ভূত হাঁড়ি থেকে ভাত চুরি করে আর কাওয়ালি গায় মিতুল-ঝুমা কি ওদের দেখে ভয় পাবে?

মিতুল আর ঝুমা একসঙ্গে বললো, না বাবা।

বড়িবি গম্ভীর হয়ে বললো, আদমিলোক ভালো হলে ভূত তাদের কুছু করে না।

সন্ধ্যে হতে তখনো অনেক দেরি। তবে আকাশে মেঘ থাকার জন্য মনে হচ্ছিলো এই বুঝি ঝুপ করে অন্ধকার নামবে। টুটুল ঘড়িতে দেখলো সাড়ে তিনটা বাজে। রামগড় বাজারে কিছুক্ষণের জন্য নেমেছিলো ওরা। সোয়া দুটো নাগাদ আবার যাত্রা শুরু করেছে। রামগড় থেকে লোকজন সারাদিনে দুবার কি তিনবার খাগড়াছড়ি যাওয়া-আসা করে। টুটুলরা রামগড় বাজারে এসে দেখেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার একটা জীপ পনের ষোলজন লোক নিয়ে বিকট আওয়াজ তুলে প্রচুর ধোয়া ছাড়তে-ছাড়তে খাগড়াছড়ির পথে রওনা হয়েছে। এরকম গোটা তিন-চারেক জীপ সারাদিন এভাবে যাওয়া-আসা করে। একটা জীপে যোজন লোক কীভাবে বসে এটা না দেখলে কোনোদিন হিসেব করে বের করতে পারতো না টুটুল। বাজারের এক দোকানদারকে জিজ্ঞেস করে জেনেছে রাস্তা ভালো থাকলে, ঝড়-বৃষ্টি না হলে ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে খাগড়াছড়ি পৌঁছতে পারবে।

টুটুলরা অবশ্য খাগড়াছড়ি পর্যন্ত যাবে না। ওরা যাবে কমলছড়ি। খাগড়াছড়ি থেকে মাইল সাতেক দূরে। দিদা মাঝে-মাঝে বিড়বিড় করে বুঝি দোয়া-দরুদ পড়ছিলেন আর বলছিলেন, ভালোয়-ভালোয় সন্ধের আগে জায়গামতো পৌঁছতে পারলে বাঁচি।

কাঁচা রাস্তা বৃষ্টি হয়ে কাদা-কাদা আর পিছল হয়ে গেছে। খুব সাবধানে গাড়ি চালাচ্ছিলেন বাবা। অথচ ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম আসার পথে ষাট মাইল পর্যন্ত স্পীড তুলেছিলেন। দিদাকে বললেন, তুমি ঘাবড়িয়ো না মা। এ রাস্তা আমার ভালোমতোই চেনা। আর দুটো চড়াই-উতরাই পেরুলেই গোলাবাড়ি এসে যাবো। গোলাবাড়ি থেকে কমলছড়ি এক ঘন্টার ড্রাইভ। দেখো না ….।

কথাটা শেষ না হতেই গাড়িটা খকখক করে কাশতে শুরু করে দিলো। বাবা বিরক্ত হলেন। ভুরু দুটো কুঁচকে গেলো। কপালে কয়েকটা ভাঁজ পড়লো। সেদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ না করে গাড়িটা কাশতে-কাশতে রাস্তার একটা বাঁকে এসে থেমে গেলো। বেশ কিছুক্ষণ স্টার্ট নেবার চেষ্টা করলেন। মনে হলো এ গাড়িটা আর কখনো বুঝি স্টার্ট নেবে না। বাবার চেহারা দেখে সবার মুখ ততক্ষণে কালো হয়ে গেছে।

হ্যান্ডব্রেক টেনে গাড়ি থেকে নেমে পড়লেন বাবা। পেছনে-পেছনে টুটুলও। বনেত খুলে বাবা ইঞ্জিন দেখতে লাগলেন। মাকে একবার বললেন স্টার্ট দিতে। খসখস শব্দ ছাড়া কিছুই হলো না। দিদা দোয়া-দরুদ পড়ার মাত্রা বাড়িয়ে দিলেন। মার মুখও শুকিয়ে গেছে। রামগড় বাজারের দোকানদার ওদের পইপই করে বলে দিয়েছে গোলাবাড়ি যাবার পথে কোথাও যেন না থামে।

চারপাশে ভালো করে তাকিয়ে দেখলো টুটুল। ডান দিকে উঁচু পাহাড়। পাহাড়ে ঘন জঙ্গল। বাঁ পাশে পাহাড় নেমে গেছে প্রায় পাঁচশ ফুট নিচে। পাহাড় কেটে বানানো হয়েছে রাস্তাটা। মাঝে-মাঝে বনের ভেতর দুএকটা পাখির ডাক ছাড়া কোথাও কোনো শব্দ নেই। রামগড় পেরুবার পর মাইল দুয়েক পর্যন্ত লোকজন কিছু দেখা গিয়েছিলো। পাহাড় আর সমতলের মানুষ চেহারা দেখলেই বোঝা যায়। পাহাড়ের উপজাতিদের চেয়ে রামগড়ে সমতলের মানুষ খুব একটা কম নয়। টুটুল খেয়াল করে দেখলো পেছনে কয়েক মাইলের মধ্যে কোনো লোকজন দেখে নি। ঘড়িতে তখন কাঁটায় কাঁটায় চারটা। বাঁ দিকে তাকিয়ে দেখলো দূরে বৃষ্টি নেমেছে। পুবের আকাশ থেকে পাহাড়ের গায়ে কে যেন ফিনফিনে সাদা একটা চাদর ঝুলিয়ে দিয়েছে।

বাবা তখনো উপুড় হয়ে ইঞ্জিন দেখছেন। কাজের সময় কথা বললে খুব বিরক্ত হন তিনি। সবাই অপেক্ষা করছে কখন বাবা নিজে মুখ খুলবেন। মিতুল ফিসৃফিস্ করে কথা বলছে বডিবির সঙ্গে। জঙ্গলের পাখির ডাক বাড়ছে। ঘরে ফিরছে ছোট-ছোট পাখির ঝাঁক। ওদের ভেতর শুধু টিয়া, ময়না আর মুনিয়া চিনতে পারলো টুটুল। জঙ্গলের গাছের ভেতর কয়েকটা স্বর্ণচাপার গাছ দেখলো। অজস্র ফুল ফুটেছে। মাঝে-মাঝে বাতাসে মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছিলো।

মার সঙ্গে ফ্লাস্কে চা ছিলো। টুটুল কাছে গিয়ে আস্তে করে বললো, এক কাপ চা দাও না মা!

ইঞ্জিনের ওপর থেকে মাথা তুললেন বাবা। টুটুলের কথা শুনতে পেয়েছেন তিনি। বললেন, আমাকেও এক কাপ চা দাও।

দিদা ব্যগ্র হয়ে বললেন, ইঞ্জিনের কি হয়েছে হাবু? গাড়ি চলবে তো?

বাবা কাষ্ঠ হাসলেন–প্লগে কারেন্ট পাস করছে না। ডায়নামো কমজোর হয়ে গেছে। ব্যাটারি বসে গেছে।

দিদা কাঁদো-কাঁদো গলায় বললেন, কি বললি কিছুই বুঝলাম না হাবু। কি করলে গাড়ি চলবে তাই বল।

মা টুটুল আর বাবাকে ফ্লাস্কের কাপে করে চা ঢেলে দিয়েছেন। বাবা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, একটু কষ্ট করতে হবে আমাকে আর টুটুলকে। গাড়িটা ঠেলে গোলাবাড়ি পর্যন্ত নেবো আমরা। মাইল খানেকের মতো পথ। ওখানে একটা গ্যারেজের মতো আছে। ব্যাটারিটা চার্জ করতে হবে।

তোরা দুজনে পারবি? আঁতকে উঠে ভাঙা গলায় প্রশ্ন করলেন দিদা।

টুটুল বললো, পারতে হবে দিদা। মা, তুমি স্টিয়ারিং ধরো।

বাবা বললেন, খুব সাবধান নীনা, ব্রেকে পা রেখো।

মিতুল বললো, বাবা, আমিও গাড়ি ঠেলবো।

বাবা হাসলেন–ঠিক আছে, নেমে এসো।

দিদা বললেন, গাড়ি ঠেলতে না পারি, গাড়ি থেকে নেমে তো ভার কমাতে পারি।

এবার টুটুলও হাসলো–তোমার কিইবা ওজন দিদা! তবে নামার ইচ্ছে হলে নামতে পারো।

দিদা ঝুমাকে নিয়ে নেমে পড়লেন। পেছন-পেছন বড়িবিও হামি কেননা বোসে থাকবো, বলে খচমচ করে নেমে গেলো।

মা স্টিয়ারিং ধরে বসলেন। দিদা বললেন, বৌমা গাড়ি চালাবে, সেই গাড়িতে আমি বসবো! শুনেই আমার জান আদ্দেক বেরিয়ে গেছে।

দিদার কথা শুনে সবাই হেসে উঠলো। মা লাজুক হেসে বললেন, কেন মা, ঢাকায় কি আমি গাড়ি চালাই না?

দিদা নির্বিকার গলায় বললেন, সে তো মা ঢাকা শহরে আয়নার মতো সমান পাকা রাস্তায়, তাও হালকাপলকা গাড়ি। পাহাড়ের ওপর এরকম আজরাইলের মতো গাড়ি তুমি কখনো চালাও নি এ আমি হলপ করে বলতে পারি।

হাসতে-হাসতে টুটুলরা রেডি বলে গাড়িতে ধাক্কা লাগালো। দিদা মিথ্যে বলেন নি। যথেষ্ট ভারি গাড়ি। কিছুক্ষণের মধ্যে টুটুলের দুবেলা ব্যায়াম করা পেটা শরীরেও খবর হয়ে গেলো। বাবা বললেন, এই চড়াইটার পরে আর একটা পেরুতে হবে।

চড়াইয়ে উঠতে ওদের পুরো পঞ্চাশ মিনিট লাগলো। আর ঠিক তখনই শুরু হলো ঝমঝম বৃষ্টি। বাবা বললেন, টুটুল ছাড়া সবাই গাড়িতে উঠে যাও।

দিদা কোনো কথা না বলে ঝুমাকে নিয়ে গাড়িতে উঠলেন। মিতুল আর বড়িবিও উঠে পড়লো। মা বাবাকে বললেন, ঢালু রাস্তায় আমার ভয় করছে। এখানে তো ঠেলতে হবে না। তোমরাও ওঠো না।

টুটুল বাবার দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসলো। মার ভয়ের কোনো কারণ নেই। আসলে তিনি চান না ওরা দুজন বৃষ্টিতে ভিজুক। বাবা মৃদু হেসে টুটুলকে বললেন, তোর মা ভয় পেলে কি আর করা যাবে! চল উঠে পড়ি। খেয়াল রাখিস, মাটি কাটা মজুররা এসময় ঘরে ফেরে। ওদের সাহায্য পেলে আর কোনো সমস্যা থাকবে না।

বাবার অনুমান ঠিকই ছিলো। একটু পরেই দেখা গেলো উল্টো দিক থেকে তিনজন লোক আসছে। পরনের কাপড়, কাঁধে কোদাল, আর বড় দা দেখে মজুরই মনে হলো। সমতলের মানুষ নয়–উপজাতি। কাছে আসতেই বাবা বললেন, এই যে শুনুন। আমরা একটু বিপদে পড়েছি। আমাদের গাড়িটা …।

বাবার কথা শুরু করার সময় ওরা দাঁড়িয়েছিলো। বিপদ শুনেই ওরা কোনো কথা বলে নির্লিপ্ত মুখে হেঁটে চলে গেলো। বাবার কথা পর্যন্ত শেষ হলো না।

দিদা কাঁপা-কাঁপা গলায় বললেন, তোর আক্কেল বুঝি কোনো কালেই হলো না হাবু! দেখেই বোঝা যায় খুনে ডাকাত না হয়ে যায় না, তুই অমনি সাহায্য চেয়ে বসলি! বৌমা দেখেছিলে, দা টা কীরকম শান দেয়া ছিলো!

বাবা বললেন, এ দা দিয়ে ওরা মানুষ কাটে না, জঙ্গলে বাঁশ কাটে।

থাম তুই। দিদা ধমক দিলেন–ডাকাতের জন্য বাঁশ কাটার চেয়ে মানুষ কাটা ঢের সোজা।

বাবা তবু বললেন, এ তোমার ভুল ধারণা মা। এখানকার মানুষ খুবই সরল। খারাপ কাজ যদি তারা শিখেও থাকে, সেটা আমাদের দেশি ভাইদের কাছ থেকে শিখেছে। তুমি জানো না মা, বাঙালিরা এদের ওপর কী রকম অত্যাচার করে।

দিদা কি যেন বলতে যাবেন–টুটুল তখনই বললো, বাবা দেখ, আরো দুজন লোক আসছে।

লোক দুটো কাছে এলে দেখা গেলো ওরা সমতলের মানুষ। এরাও মাটি কাটার মজুর। দিদা চাপা গলায় বললেন, হাবু, তুই কথা বলিস না। যা বলার আমি বলবো।

বাবা আড়চোখে একবার টুটুলের দিকে তাকালেন। টুটুল মুখ টিপে হাসলো। দিদার সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। লোক দুটোকে মোলায়েম গলায় ডাকলেন–হ্যাঁ গো বাছা, তোমাদের বাড়ি কোথায়?

লোক দুটো ভয় আর লজ্জা মিশিয়ে হাসলো। একজন বললো, এই তো সামনের গ্যারাম। আমনেরা কোনায় যাইবেন?

দিদা আরো মোলায়েম গলায় বললেন, আমরা বাছা ঢাকায় থাকি। গাড়িটা বিগড়ে গেছে। তোমরা যদি একটু গোলাবাড়ি পর্যন্ত ঠেলে দাও পাঁচ টাকা করে দেবো দুজনকে।

দুজনে একগাল হেসে বললো, একশবার দিইয়ুম মা-জি।

দিদা গর্বের সঙ্গে গাড়ির ভেতর সবাইকে দেখলেন। মুখ টিপে হাসা ছাড়া কেউ কোনো কথা বললো না।

আবার চড়াইতে ওঠা শুরু হলো। ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেছে। জঙ্গলের ভেতর পরতে-পরতে অন্ধকার জমছে। সারা বন জুড়ে ঘরে-ফেরা পাখিদের বিচিত্র সব শব্দ। বৃষ্টিতে ভিজে চাপার গন্ধ আরো গাঢ় হয়েছে। টুটুলের ঘড়িতে তখন ছটা বাজতে সাতের মিনিট।

আগের চড়াইয়ের চেয়ে এটা বেশি খাড়া। টুটুল দেখলো, গাড়ি ঠেলতে লোক দুটোর বেশ কষ্ট হচ্ছে। নেমে গিয়ে ওদের সঙ্গে যোগ দিলো। একটু পরে মার হাতে স্টিয়ারিং দিয়ে বাবাও নেমে এলেন। অন্ধকার হবার আগে যেভাবেই হোক গোলাবাড়ি

পৌঁছতে হবে। দিদা ব্যাগ থেকে তসবি বের করে গোনা শুরু করলেন।

গোলাবাড়ি স্কুলের সামনে যখন টুটুলদের গাড়ি এসে থামলো তখন প্রায় সাড়ে ছটা বাজে। সেদিন হাট নেই বলে বেশির ভাগ দোকান বন্ধ। দিদা লোক দুটোকে দশ টাকার বদলে পনেরো টাকা দিলেন। একগাল হেসে দিদাকে মস্ত এক সালাম ঠুকে একজন বললো, ইশকুলের হ্যাডমাস্টর সাবরে খবর দিমু নি?

বাবা বললেন, দিলে তো ভালো হয়। চলো, আমিও যাই তোমাদের সঙ্গে।

টুটুলকে খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছিলো। মা বললেন, হ্যাঁরে, এক কাপ চা দেবো তোকে?

দিদা কটকট করে উঠলেন–একটু আগে চা খেয়েছে। তারপর এতখানি মেহনত। এখন আবার চা খেলে পিত্তশূল হবে যে! ঝুমার ফ্লাস্ক থেকে ওকে বরং দুধ দাও।

টুটুলের আসলে চা খেতেই ইচ্ছে করছিলো। মা ওর দিকে তাকিয়ে অসহায় হাসলেন। টুটুলও হেসে বললো, কি আর করা যাবে বলো! দিদা চিরকাল আমাকে দুগ্ধপোষ্য বানিয়ে রাখতে চান।

টুটুল, মিতুল, ঝুমা সবাই দুধ খেলো। মা দিদাকে বললেন, আপনাকে এক কাপ দুধ দেবো মা?

মুখ তেতো করে দিদা বললেন, তুমি তো জানো বৌমা, দুধ আমার পেটে সয় না। আমাকে যদি দিতে চাও মিছরি দিয়ে এক গ্লাস পানি দাও।