০৫-৬. তপন সেজেগুজে হোটেলে

সকাল সাড়ে আটটার সময় তপন সেজেগুজে হোটেলের কাঠের দরজা ঠেলে বেরোতে যাবে, দেখল রাস্তার উলটো দিকে অ্যালিস দাঁড়িয়ে আছে। সে তক্ষুনি রাস্তা পার হবার জন্য এখানে দাঁড়িয়েছে কিংবা অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে, তা ঠিক বোঝা যায় না। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে, প্যারাসোলের নীচে অ্যালিসের স্তব্ধ মূর্তি। অ্যালিসের সুন্দর মুখখানা এখন একটু ফোলাফোলা, ঠোঁট দুটো শুকনো। বোধ হয় সর্দি লেগেছে, তাই ঘন ঘন রুমাল দিয়ে মুখ মুছছে।

অ্যালিসকে দেখার প্রথম মুহূর্তেই তপন ভাবল, সে যেন ওকে দেখতে পায়নি, এই ভঙ্গি করে দ্রুত হেঁটে যাবে। কিন্তু পরমুহূর্তেই তপন নিজের অজান্তেই আবার তাকাল অ্যালিসের দিকে, এবার স্পষ্ট চোখাচোখি–এখন আর কিছুতেই চলে যাওয়া হয় না। তপন থমকে দাঁড়াল। কে আগে রাস্তা পার হবে? তপন না অ্যালিস? ট্রাফিকের সবুজ আলো জ্বলতেই হুড় হুড় করে গাড়ির স্রোত বয়ে গেল রাস্তা দিয়ে, সট সট করে এক-একটা গাড়ি যাচ্ছে–তার মাঝখানে সামান্য সামান্য ফাঁকে তপন দেখল অ্যালিস একদৃষ্টে তার দিকে চেয়ে আছে। লাল আলো জ্বলতে–অ্যালিসই রাস্তা পেরিয়ে এল।

মাত্র একটা দিন অ্যালিসের সঙ্গে দেখা হয়নি। পরশু রাতে অ্যালিসের ফ্ল্যাট থেকে চলে আসার সময় তপন তো তার সঙ্গে কোনো খারাপ ব্যবহার করেনি। তবু অ্যালিস যেন সব বুঝতে পেরেছে। কাল বিকেলে তপন দেখা করতে যায়নি তার সঙ্গে, রাত্রে টেলিফোন করেনি–অ্যালিস নিজেই বোধ হয় দু-তিন বার টেলিফোন করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে, বারবারাও হয়তো তাকে টেলিফোন করে সব বলেছে। অ্যালিস হাসল না, কোনো অভিযোগ জানাল না, শুকনো গলায় বলল, টপন তোমার সঙ্গে আমার একটা কথা আছে।

তপন খানিকটা হেসে সহজ হবার চেষ্টা করে বলল, কী ব্যাপার অ্যালিস, অফিস যাবে? এই সকাল বেলাতেই এসেছ?

যাব। তার আগে তোমার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।

আমার সঙ্গে? সকাল বেলাতেই বলতে হবে? আচ্ছা এসো-তপন আবার হোটেলের দরজা ঠেলে ঢুকল। অ্যালিস লিফটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল–সে খুব স্বাভাবিকভাবেই ধরে নিয়েছিল, তপন নিজের ঘরে ফিরে যাবে–কিন্তু তপন ডেকে বলল, এসো এখানেই বসা যাক!

লাউঞ্জে কয়েকটা সোফা সাজানো রয়েছে, সবগুলোই এখন ফাঁকা। অনেক কথা আছে যা এ রকম প্রকাশ্যে, সার্বজনীন আসনে বসে ঠিক বলা যায় না। কিছুটা নিরালায় একটু নরমভাবে বলা উচিত। কিন্তু তপন ওসবের ধার ধারে না। অ্যালিসকে সেখানেই বসতে ইঙ্গিত করে তপন নিজে ধপ করে বসে পড়ে কোটের পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করল। ঠুকে ঠুকে একটা সিগারেট উঁচু করে অ্যালিসের দিকে হাত বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, ইউ কেয়ার ফর আ স্মোক?

নতমুখী অ্যালিস কোনো উত্তর দিল না। তপন নিজেই ধরিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে, যেন অফিসের অধঃস্তন কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলছে, এই সুরে আরম্ভ করল, শোনো, অ্যালিস–

অ্যালিস একটা হালকা গোলাপি রঙের স্কার্ট পরে আছে, কোথাও কোথাও সেটা কোঁচকানো। আজ সে লিপস্টিক মাখেনি–দেখলেই বোঝা যায়, আজ সে শুধু চুলে দ্রুত চিরুনি চালিয়ে আর মুখে হালকা পাউডার বুলিয়ে বেরিয়ে এসেছে। ঠোঁট দুটো চেপে বিবর্ণ মুখে বসে আছে অ্যালিস।

তপন বলল, শোনো অ্যালিস, তুমি যা বলতে চাও আমাকে, সেটা আমি শুনব, নিশ্চয়ই শুনব। কিন্তু তার আগে, আমি একটা কথা বলতে চাই। তোমার সাহচর্যে একদিন আমি অত্যন্ত আনন্দ পেয়েছি। অত্যন্ত সুন্দর কেটেছে আমার সময়। সেজন্য আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু

অ্যালিস মুখ নীচু করে বসেছিল, এবার মুখ তুলে স্পষ্টভাবে তাকাল। তপন তবুও দ্বিধা না করে বলে চলল, কিন্তু, এবার আমাদের ছাড়াছাড়ি হওয়াই ভালো। তা ছাড়া আর ক-দিন বাদে আমি তো চলেই যাব–সুতরাং, আমাদের সম্পর্কের এখানেই শেষ, আমি আজই হয়তো লণ্ডনের বাইরে যাব।

অ্যালিস যেন জানতই, তপন একথা বলবে। সে একটুও চমকাল না, মুখের একটা রেখাও কাঁপল না, সোজা তপনের চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে রইল। শুধু আস্তে আস্তে উচ্চারণ করল, কেন?

সেসব কথা না তোলাই ভালো। মেয়েরা তো এসব কথা জিজ্ঞেসও করে না।

তবু আমি করছি। কেন? এত শিগগিরই কেন?

আমি তা বলতে চাই না।

আই ইনসিস্ট–।

তুমি নিশ্চয়ই আমার মুখ দিয়ে বলাতে চাও-না যে, তোমাকে আর আমার ভালো লাগছে না? সেকথা আমি বলতে চাই কিনা–সে-সম্পর্কেও আই অ্যাম নট সিওর! তা ছাড়া, মেয়েদের একটা ডিগনিটি থাকে–আমি তাতে আঘাত করতে চাই না। শুধু এইটুকু বলাই তো যথেষ্ট যে, যতদিন আমরা দুজনে একসঙ্গে কাটিয়েছি–আমরা খুব উপভোগ করেছি, আমরা প্রচুর আনন্দ পেয়েছি। এখন আমি এই সম্পর্ক শেষ করতে চাইছি। আমরা দুজনে দু-জনের কাছ থেকে ভালো মনে বিদায় নিতে চাই, যাতে আর কোনো তিক্ততা না থাকে।

অ্যালিস তপনের চোখ থেকে নিজের চোখ সরাতে ভুলে গেল। একদৃষ্টে মন্ত্রমুগ্ধের মতন চেয়ে আছে, স্পষ্টত তার মুখখানা আরও ফ্যাকাশে হয়ে আছে। নিজের ঠোঁটটা কাঁপছে একটু একটু। আচ্ছন্ন গলায় বলল, তার মানে তুমি বলতে চাও আমাদের আর দেখা হবে না?

হ্যাঁ। আমাদের আর দেখা হবে না!

কিন্তু টপন, তোমার সঙ্গে যে আমার একটা বিশেষ কথা ছিল।

আর কোনো কথাবার্তার কি দরকার আছে এরপর?

আমাকে যে বলতেই হবে।

ঠিক আছে, এখনই বলে ফেলো না!

এখানে বলা যাবে না।

তাহলে তো

টপন, আমরা অন্য কোথাও গিয়ে একটু বসতে পারি না?

তপন চরম অভদ্রতা দেখাতে জানে। সাহেবদের দেশে এসে এই ভদ্রবেশি অভদ্রতাগুলোকে খুব ভালো শিখে নিয়েছে, তেরছা চোখে ঘড়ি দেখে নিয়ে তপন নীরস গলায় বলল–বাট, আই অ্যাম অ্যাফ্রেড, আমার হাতে এখন বেশি সময় নেই। ন-টার সময় আমার এক জায়গায় দেখা করার কথা আছে।

 টপন, তোমার সঙ্গে আমি যেতে পারি না?

না। গিয়ে সেখানে কোনো লাভ নেই। আমাকে অনবরত ঘুরতে হবে। ট্র্যাভেল এজেন্টের কাছে যাব, লণ্ডন ইউনিভার্সিটিতে ড এঙ্গেলের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে, বি ই এ অফিসে গিয়েও একবার চেক করতে হবে–যদি একটা সিট দেয়–আমি কালই সম্ভব হলে এদেশ ছেড়ে চলে যেতে চাই।

কাল?

হ্যাঁ। তোমাদের এই জঘন্য শহর আমার আর একটুও ভালো লাগছে না।

কিন্তু টপন, তোমাকে যে একটা কথা বলতে চাই, সেটা না বললে আমার চলবেই না।

ঠিক আছে। বললুম তো, এখানেই বলে ফেলো চটপট।

এখানে?

অ্যালিস অসহায়ভাবে চারপাশে তাকাল। মাঝে মাঝে লিফট নেমে আসছে নিঃশব্দে, সুবেশ নারী-পুরুষ বেরিয়ে এল, কাউন্টারে চাবি রেখে কাচের দরজা ঠেলে বেরিয়ে যাচ্ছে টক টক বা গট গট করে জুতোর শব্দ তুলে। কেউ কেউ বাইরে থেকে আসছে, লিফটে ঢুকে বোতাম টিপছে, কোনো কথা নেই, মাঝে মাঝে শুধু নীরস দু-একটা গুড মর্নিং–সবাই আড়চোখে দেখে যাচ্ছে ওদের দুজনকে। কাউন্টারে সকালের শিফটের ম্যানেজার মাথা ঝুঁকিয়ে লম্বা কাগজ পেনসিল দিয়ে যোগ-বিয়োগ করে যাচ্ছে–ওদের উপস্থিতি সম্পর্কে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই যেন। এই ব্যবসায়িক হাওয়ায় এই রূপহীন পরিবেশে তাকে বলতে হবে? প্রতীক্ষিত তপন নির্লিপ্ত গলায় বলল, ইয়েস।

একটা ছোটো দীর্ঘশ্বাস ফেলে, অ্যালিসও যথাসম্ভব নির্লিপ্ত হবার চেষ্টা করে বলল, কীভাবে কথাটা আমি বলব জানি না। কিন্তু তুমি যদি কালই চলে যাও, কিংবা তোমার যদি আর না সময় থাকে তাহলে আমাকে এখানেই বলতে হবে। আমি প্রত্যেকবার নিজেই নিজের বিপদ ডেকে আনি, এবারও বোধ হয় বিপদে পড়তে যাচ্ছি–নিজেকে রক্ষা করার কোনো ক্ষমতাই নেই আমার–তবু বলতে আমাকে হবেই-টপন আমি মনে মনে গভীরভাবে বুঝতে পারছি, আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে ছাড়া আমার আর কোনো উপায় নেই–আমার ভালোবাসা এইরকম–ডাজ দ্যাট মিন এনিথিং টু ইউ?

তপন যেন অন্য অনেক কিছু আশা করেছিল। সামান্য এই কথাটা শুনে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচল। সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে বলল, আমাকে ভালোবেসেছ? হাঃ

প্লিজ টপন, তুমি আমাকে এ নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ কোরো না। আজ অন্তত আমি কোনো ব্যঙ্গবিদ্রূপ সইতে পারব না। বিশ্বাস করো—

ছেলেমানুষী কোরো না অ্যালিস! আমাদের তো এ-রকম কোনো কথা ছিল না। আমি তো তোমাকে বলেই দিয়েছিলাম–

আমি নিজেও তো জানতাম না। এটা যেন একটা মিরাকল। কতদিন ধরে আমার মনটা শুকনো হয়েছিল-হঠাৎ

শোনো অ্যালিস, সাতদিন-দশদিনের ভালোবাসা, এ-রকম অনেক অভিজ্ঞতা আমার আছে। আমি কাঁচা ছেলে নই। তোমারও একবার ডিভোর্স হয়ে গেছে, তুমিও কাঁচা মেয়ে নও–সুতরাং এসব বাজে কথা বলে সময় নষ্ট করার কোবো মানে হয় না।

 টপন তুমি আমাকে আর একটু সময় দেবে? আমি প্রথম বিয়ে করেছিলাম যখন, তখন আমার উনিশ বছর বয়েস। আমি এই পৃথিবীতে একা, কখনো কারুর কাছ থেকে একটুও স্নেহ, ভালোবাসা পাইনি–তাই এডমাণ্ডের সঙ্গে যখন পরিচয় হল, ওর মমতা মাখানো কথা শুনে আমি মুগ্ধ আর অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম, আমার মনে হয়েছিল–আমার জীবনেরও মূল্য আছে–আমার জন্য কেউ খুশি হয়, আমার কথাও কেউ ভাবে–আমি এডমাণ্ডের কাছে নিজেকে সম্পূর্ণ সঁপে দিয়েছিলাম–কত স্বপ্ন দেখেছি ওকে নিয়ে–কিন্তু এডমাণ্ড আমার সব স্বপ্নকে দুঃস্বপ্ন করে দিয়েছে–ও আমার ভালোবাসার একটুও মূল্য দেয়নি আমাকে কী কষ্ট দিয়েছে তুমি জান না–এডমাণ্ড ছিল জুয়াড়ি, ও সব কিছু নিয়ে জুয়া খেলতে চায়–মানুষের ভালোবাসা, শরীর, স্বপ্ন–এ সবই ও জুয়ার এক একটা দান মনে করে–আর কিছুদিন একসঙ্গে থাকলে আমি পাগল হয়ে যেতাম–আমার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে হত রোজ–এডমাণ্ডের হাত থেকে উদ্ধার পাবার পর অনেকদিন আমি পুরুষ দেখলেই ভয় পেতাম–মনে হত পুরুষ মাত্র জুয়াড়ি–বিবাহবিচ্ছেদের পর অন্তত পাঁচ-ছয় বছর আমি সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ অবস্থায় কাটিয়েছি–তারপর আস্তে আস্তে সেই দুঃস্বপ্ন কেটে যায়, তবুও, কোনো পুরুষকেই আমি আমার প্রাণের মানুষ বলে ভাবতে পারিনি–দু-এক জনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়েছে–তাদের কারুর কারুর সঙ্গে অনেকদূর পর্যন্ত এগিয়েছি–কিন্তু শেষ মুহূর্তে আমার সবকিছু আবার ফাঁকা ফাঁকা লেগেছে–আমি ভেবেছিলাম আমি আর জীবনে কখনো ভালোবাসতে পারব না–কিন্তু হঠাৎ, আমি নিজেই বুঝতে পারিনি, তোমাকে দেখার পর–আমি আবার নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি–তোমার রুক্ষ ব্যবহার, নিষ্ঠুরতা– এসব কিছুই আমার গায়ে লাগে না–আমার মনে হয় তোমার মধ্যে একটা অভিমানী শিশু লুকিয়ে আছে, তুমি শিশুর মতোই আঘাত করতে চাও-কিন্তু সে-আঘাতে ব্যথা লাগে না–টপন, পরশু রাত থেকে আমি অনবরত তোমার কথা ভাবছি–এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারছি না তোমাকে–এ যদি ভালোবাসা না হয়—

অ্যালিস কথা বলছিল প্রায় ফিসফিস করে, তবু বোঝা যায় তার বুকের অনেক ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে কথাগুলো। কোলের ওপর রাখা হাত দু-খানি বড়ো বেশি সাদা আর করুণ, আঙুলের ডগাগুলো একটু একটু কাঁপছে–ঘন ঘন নিশ্বাসে দুলে উঠছে তার বুক দু টি। কথা বলার সময় সে একবারও তপনের মুখ থেকে চোখ ফেরায়নি। তপন একটার-পর একটা সিগারেট ধরিয়ে যাচ্ছে। অ্যালিসের আবেগ যেন তাকে একটুও স্পর্শ করল না, নিছক হালকাভাবে বলল, প্রায় ন-টা বাজে, এবার তাহলে উঠতে হয়। তুমিও যদি অফিস যেতে চাও–

সেই নির্মম অসৌজন্যে অ্যালিসের মুখখানা যেন কুঁকড়ে গেল। এর চেয়ে, কেউ একখানা চাবুক দিয়ে শপাং করে তার মুখে মারলে সে কম আহত হত। তবুও সে ভিখারিনির মতন বলল, টপন তুমি বলেছিলে আমেরিকা থেকে তোমাকে দু-বছরের জন্য বাইরে অন্য কোনো দেশে থাকতে হবে–কানাডার বদলে তুমি ইংল্যাণ্ডে থাকতে পার না? তুমি তো ইচ্ছে করলে চাকরি পেতে পার।

কিন্তু আমি লণ্ডনে চাকরি নিতে যাব কেন?

তুমি এখানে চেষ্টা করলেই চাকরি পেতে পার না? তোমার যা ডিগ্রি আছে—

সেকথা পরে, কিন্তু এই গড ড্যাম লণ্ডনে আমি চাকরি নিতে যাব কেন?

কানাডার চেয়েও কি লণ্ডন ভালো জায়গা নয়? তুমি যদি এখানে থাক–আমি তোমাকে কাছে পেতে পারি। টপন আমি তোমাকে

তপন হঠাৎ খুব রেগে গেল। অ্যালিসের কথার মাঝখানেই কথা থামিয়ে দিয়ে কর্কশ গলায় বললে, অলরাইট, তুমি আমাকে ভালোবাস–এই কথাই আবার বলবে তো? সো হোয়াট? তোমাদের ওসব ভালোবাসার ন্যাকামি আমার ঢের ঢের জানা আছে! তুমি আমাকে ভালোবাস আর যাই করো, আমি তো তোমাকে একটুও ভালোবাসি না। দেন! আমাকে মাস এক হাজার পাউণ্ড মাইনে দিলেও আমি লণ্ডনে কিছুতেই থাকতে পারব না তোমাকে খুশি করার জন্য। আমি তোমাকে কখনো কোনো প্রতিশ্রুতি দিইনি–সুতরাং তুমি কোনো অভিযোগ করতে পারবে না আমার নামে। তোমাকে আমার এই ক-দিন বেশ ভালো লেগেছিল–এখন আর ভালো লাগে না–ব্যস! এর মধ্যে ভালোবাসা-টালোবাসার কোনো ব্যাপার নেই! এখন আমাদের সব সম্পর্ক শেষ হয়ে যাওয়াই ভালো, তাইনা?

অ্যালিস বিহ্বলভাবে তাকিয়ে আছে, যেন তপনের সব কথা সে বুঝতে পারছে না। কিন্তু একটুক্ষণের মধ্যেই সে তার সমবোধ ফিরে পেল। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, হ্যাঁ, ভালোবাসা যদি না থাকে, তাহলে সম্পর্ক শেষ হয়ে যাওয়াই ভালো। সেটাই তো স্বাভাবিক। তুমি ঠিকই বলেছ টপন। তাহলে, আর আমাদের দেখা হবে না। না?

না।

তপনও উঠে দাঁড়িয়েছে। শেষ বিদায়টুকু যথাসম্ভব গ্লানিহীন করার চেষ্টায় সে অ্যালিসের দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিল। অভিভূতের মতন অ্যালিস তার হাতে হাত রাখল। তপন তার গালে ঠোনা মারার মতন একটা চুমু দিয়ে আজ সকালে এই প্রথম বার ঠোঁট ফাঁক করে হাসল। হাসি মুখেই বলল, গুড বাই অ্যালিস।

গুড বাই টপন।

ওরা একসঙ্গেই বেরিয়ে এল হোটেল থেকে। অনেকদিন বাদে আজ লণ্ডনের আকাশে রোদ দেখা দিয়েছে। এই সামান্য রোদ পেয়েই রাস্তার অধিকাংশ মেয়ে-পুরুষের মুখ খুশি।

খুশি। শুধু অ্যালিসেরই মুখ নীচু, যেন তার খুব শীত করছে–শরীরটা সেইরকম আড়ষ্ট। রোদের জন্যই বোধ হয় তপনও বেশ খুশি হয়ে উঠল–বেশ বড়ো বড়ো পা ফেলে সে হেঁটে চলল অক্সফোর্ড সার্কাসের দিকে। অ্যালিসও হাঁটছে তার পাশে পাশে কেউ আর কোনো কথা বলছে না। তপন জানে অ্যালিসের লাইব্রেরি সেই ওয়েস্ট এণ্ডে–এ রাস্তায় নয়। তবু অ্যালিস তার সঙ্গে এদিকে আসছে কেন? তপন চুপচাপ অনেকখানি হেঁটে গেল, মাঝে মাঝে আড়চোখে তাকিয়ে দেখতে লাগল অ্যালিসকে। অ্যালিস আর তার দিকে চাইছে না– তবু হাঁটছে তার সঙ্গে সঙ্গে। তপন একজায়গায় থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল, জিজ্ঞেস করল, অ্যালিস, তুমি আজ লাইব্রেরিতে যাবে না?

অ্যালিসও দাঁড়াল, খানিকটা চিন্তা করে নিয়ে বলল, হ্যাঁ, যাব—

 তাহলে এদিকে যাচ্ছ কেন?

এদিকে? ও, তাইতো, ভুল দিকে এসেছি—

 ঠিক আছে, আমি চলি–

তারপর, তপন যেন দয়া করছে–সম্রাট যেন তাঁর চাকরানিকে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন–এই ভঙ্গিতে অ্যালিসের দিকে চেয়ে আবার হাসল, নিজেই হাত বাড়িয়ে অ্যালিসের নরম, দুর্বল ইচ্ছাশক্তিহীন হাত তুলে নিয়ে সামান্য ঝাঁকুনি দিয়ে বলল–গুড বাই অ্যালিস।

একটা নীল রঙের ডবল ডেকার এসে থামতেই তপন তাতে উঠে পড়ল আর পিছনে তাকাল না। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে একটা খালি আসন পেয়ে বসে পড়ল। তৎক্ষণাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে রাস্তার দিকে তাকাল। অ্যালিস সেখানেই মূর্তির মতন চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। অ্যালিস বাসের জানলার দিকে চেয়ে নেই।

.

০৬.

তপনের কলেজ-জীবনের বন্ধু দিবাকর এখানে বেশ ভালো চাকরি পেয়েছে। স্ত্রী এবং দু বছরের বাচ্চাকেও আনিয়ে নিয়েছে কিছুদিন আগে। দিবাকরের সঙ্গে অনেকদিন একসঙ্গে পড়েছে তপন, একসঙ্গে রিসার্চও করেছে। দিবাকর বেশ বড়োলোকের ছেলে, অনেক সন্ধ্যে বেলা দিবাকর তপনকে জোর করে বাড়িতে টেনে নিয়ে গিয়ে খাইয়েছে। দিবাকরের বোন অরুণার সঙ্গে তপনের ভালো করে ভাব জমে ওঠার আগেই বিয়ে গেল একজন কংগ্রেসি এম পির ছেলের সঙ্গে। দিবাকরের বউদিও তপনকে খুব স্নেহ করতেন। তপন আর দিবাকরকে একসঙ্গে দেখলেই তিনি ঠাট্টা করে বলতেন আজ এক আকাশে দুই সূর্য উঠেছে দেখছি! এম এসসি-তে দিবাকর ফার্স্ট ক্লাশ ফার্স্ট হওয়ায় তপন খুব স্বস্তি বোধ করছিল। সে ফার্স্ট হলে যদি দিবাকরের হিংসে হত কিংবা দিবাকরের বাড়ির লোকজন দুঃখ পেয়ে তপনের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করে দিত তাহলে সেটা খুব পরিতাপের ব্যাপার হত।

দিবাকর ছেলেবেলা থেকেই বিলেত যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছে। বড়োলোকের ছেলে, চিরকাল দু-তিনটি প্রাইভেট টিউটর রেখে পড়েছে, পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করবে, বিলেত যাবে, বিলেত থেকে ফিরে এসে কোনো কোম্পানির ডিরেক্টর হবে–এই তার বাঁধাধরা পথ, সেই পথেই ঠিক এগোচ্ছে–তপনের মতন তার জীবন ছন্নছাড়া নয়।

দিবাকরের স্ত্রী ললিতা এখনও ইংরেজিটা তেমন রপ্ত করতে পারেনি বলে বাইরে বিশেষ বেরোয় না। তার বদলে, স্বামীকে যতদূর সম্ভব বাঙালি রান্না খাইয়ে তৃপ্তি দেয়। স্বামীকে মদ ছুঁতে দেয় না, মেমসাহেবদের সঙ্গে মিশতে দেয় না, স্বামীর মাইনের টাকা নিজের কাছে রেখে স্বামীকে শুধু হাত-খরচ দেয়। এসব দেখলেই বোঝা যায়। আরও বোঝা যায়, দিবাকর তার বউকে বেশ ভয় করে। অনেকদিন বাদে কোনো বাঙালি দম্পতির সংস্পর্শে এল তপন এবং অবাক হয়ে লক্ষ করল দিবাকর অনেক বদলে গেছে। খুব খোলামেলা স্বভাব, সবসময়ই খানিকটা অন্যমনস্ক ধরনের ছেলে ছিল দিবাকর, এখন সে বেশ দায়িত্ববান, সংসারী মানুষ। দিবাকরকে দেখে তার পরিবর্তনের কথাটা প্রথমেই বলবে ভেবেছিল তপন, কিন্তু বলল না এইজন্য যে, তাহলে দিবাকরও নিশ্চয়ই তপনকে বলত, তুইও অনেক বদলে গেছিস! তপনকে কিছু বলতে হল না-দিবাকরই সেকথা বলল খানিক বাদেই।

দিবাকর নিয়মিত চিঠি লেখে তপনকে। তপনের লণ্ডনের আসার খবর পেয়ে সে প্রথম দিনই এয়ারপোর্টে দেখা করতে গিয়েছিল। কিন্তু একটা ব্যাপারে তপনের খটকা লেগেছিল– দিবাকর কিংবা ললিতা তপনকে একবারও বলেনি–তাদের সঙ্গে গিয়ে থাকতে।–ওরা তপনকে হোটেল পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিল হোটেল আগে থেকেই বুক করা ছিল–তবু তপন প্রতি মুহূর্তে আশা করছিল–ওরা তাকে হোটেল ছেড়ে ওদের সঙ্গে থাকার জন্য পীড়াপীড়ি করবে। একথা ঠিক, তপন কিছুতেই থাকত না–একা থেকে তার এমন অভ্যেস হয়ে গেছে যে, কিছুতেই আর সে কারুর সাথে বেশি মাখামাখি পছন্দ করে না। বিশেষত ওদের বাড়িতে বাচ্চা ছেলে আছে–বাচ্চাদের তপন একেবারেই ম্যানেজ করতে পারে না–একটু বাদেই তার রাগ হয়। কিন্তু দিবাকররা যে তাকে একবারও অনুরোধ করল না– এতে তপন বেশ অবাক হয়েছিল।

দিবাকরদের বাড়িতে এসে তপন কারণটা বুঝতে পারল। কলকাতায় দিবাকরদের প্রকান্ড বাড়ি টালিগঞ্জে, বনেদি আমলের ঘরগুলো বিরাট বিরাট–তাও অনেক ঘর খালি পড়ে থাকে বাড়ির সামনে বাগান। লণ্ডনে দিবাকরের যেরকম ঘরে আছে, কলকাতায় ওদের বাজার সরকারও তার চেয়ে ভালো জায়গায় থাকে। এখানে তপনকে এনে ওরা জায়গা দিত কোথায়? ছোট্ট একটা ঘর–সেটাই শোবার ঘর, বসবার ঘর, সব কিছু জিনিসপত্রে ঠাসা পা ফেলার জায়গা নেই পর্যন্ত–পাশে একচিলতে একটা রান্নার জায়গা। মশলা দিয়ে মাছের ঝোল রান্না করার সময় বিশ্রী একটা গন্ধ বেরোয় বলে পাশের ভাড়াটেরা অভিযোগ করেছে।–ললিতা তাই ভয়ে ভয়ে থাকে। বিদেশে এসে তে কষ্ট করে থাকার কোনো প্রয়োজন ছিল না দিবাকরের–কলকাতায় তাদের অত সম্পত্তি, এম এসসি-তে ভালো রেজাল্ট করেছে– কলকাতাতেই সে সুখে থাকতে পারত–কিন্তু গায়ে একটা বিলেত-ফেরত পালিশ না লাগালে বুঝি চলছিল না। বিলেতের মোহে ললিতাও সব কষ্ট বেশ সহ্য করছে। দেশে তো কেউ তাদের এ অবস্থার কথা জানতে পারবে না। তারা মাঝে মাঝে পিকচার পোস্টকার্ড পাবে –তাতে কত সব সুন্দর সুন্দর দৃশ্যের ছবি। এইসব ব্যাপার দেখলে তপনের আজকাল খুব হাসি পায়।

ললিতা তপনকে পুরোপুরি বাঙালি রান্না খাওয়াবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে–দেশ থেকে পাঠানো মুসুরির ডাল যে এতদিন কৃপণের মতন জমিয়ে রেখেছিল–আজ তপনের সম্মানেই সেটা বেঁধে ফেলল। অনেকগুলো ডিম ফেটিয়ে তার মধ্যে চিংড়ি মাছ ডুবিয়ে ডুবিয়ে বড়া ভাজছে এখন, ছ্যাঁক ছ্যাঁক করে শব্দ হচ্ছে। আগুনের আভায় ললিতার ফর্সা মুখখানা আরও উজ্জ্বল দেখাচ্ছে এখন, তপন আর দিবাকর রান্নাঘরেই দাঁড়িয়ে গল্প করছে তার সঙ্গে।

আমেরিকান কায়দা অনুযায়ী তপন পকেটে করে হুইস্কির পাঁইট নিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু দিবাকরকে দেখেই বুঝেছে, এ বাড়িতে এসব চলে না। তবুও ওদের রাগাবার জন্যই তপন বোতলের মুখ খুলে কাঁচা হুইস্কিই খানিকটা ঢেলে নিল গলায়, তারপর বোতলটা দিবাকরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নে খা!

ললিতা আড়চোখে তাকিয়ে আছে, দিবাকর বলে উঠল, না, না, আমি ওসব খাই না। কখনো।

কখনো খাস না, আজ খেয়ে দেখ। আমি তোকে দীক্ষা দিচ্ছি!

না, না, পাগলামি করিস না!

তপন ললিতার দিকে তাকিয়ে বলল, ললিতা, আজ আমি তোমার বরের জাত মেরে দেব। আমি ওর ঠোঁটে জোর করে হুইস্কি ছোঁয়াবই!

ললিতা ঠিক প্রাণখুলে হাসতে পারছে না, তবু হাসবার চেষ্টা করে বলল, ওসব অখাদ্য কুখাদ্য খান কেন? কী লাভ হয়?

তুমিও একটু খেয়ে দেখো না! খেলেই বুঝতে পারবে।

ইস। গন্ধতেই আমার বমি আসে। দাঁড়ান না, আপনার বিয়ে হোক আগে, তখন আপনার বউই আপনাকে ওসব খাওয়া ছাড়াবে।

আমার ব্যাপারে আপত্তি করবে তেমন মেয়ে আমি বিয়েই করব না।

তবে বুঝি আপনি ওইসব বেড়ালমুখো মেমসাহেবদের একটাকে বিয়ে করবেন। মি. চ্যাটার্জি একটাকে বিয়ে করেছেন, কী দুরবস্থা তাঁর–দেখছি তো নিজের চোখে।

মাথা খারাপ। আমি যদি বিয়ে করি, তাহলে মেম-ফেম না। তোমার মতন কোনো সুন্দরী বাঙালিনিকেই বিয়ে করব নির্ঘাৎ।

দিবাকর বলল, তপনটা কীরকম চালাক দেখছ। এই ফাঁকে তোমাকে সুন্দরী বলে নিল। ললিতা ভ্রূভঙ্গি করে স্বামীকে বলল, কেন, তোমার আপত্তি আছে নাকি তাতে?

তুমি কথাটা আমার মুখ থেকেও আবার শুনতে চাও?

 তপনবাবু, কোনো বাঙালি মেয়ে কিন্তু আপনার ওসব সহ্য করবে না।

আমার কীসব?

এই যে ঢোক ঢোক করে মদ খাওয়া–কী বিশ্রী যে দেখায় মানুষকে সেসময়।

সে কী! এই-যে আমি শুনেছিলাম বাঙালি মেয়েরা আজকাল অনেক স্মার্ট হয়েছে, তারাও সিগারেট খায়, মদ খায়, বিয়ের আগেই ছেলেদের সঙ্গে ইয়ে-টিয়ে–

মোটেই না! বাঙালি মেয়েরা এখনও অধঃপাতে যায়নি। আপনার এইসব সিগারেট-খাওয়া মদ-খাওয়া মেমরা বাঙালি মেয়েদের পায়ের ধুলোরও যোগ্য নয়।

সর্বনাশ। সব বাঙালি মেয়েই এ-রকম সতী-সাবিত্রীর পরাকাষ্ঠা? তাহলে আমার ভাগ্যে একটাও জুটবে না দেখছি। আমার আর তাহলে বিয়ে করা হল না। যাকগে, দরকার কী। বেশ তো চলছে, নিউ লাভ ইন এভরি উইক এণ্ড।

দিবাকর একটু শঙ্কিত হয়ে উঠেছিল। সে জানে, তার স্ত্রী, এই ধরনের লুজ কথাবার্তা মোটেই পছন্দ করে না। তপনটা চিরকালই চ্যাংড়া ধরনের। আরও কী বেফাঁস বলে ফেলবে, তাই প্রসঙ্গ বদলাবার জন্য সে বলল, চল তপন, কাল আমরা সবাই মিলে মাদাম টুসোর মিউজিয়াম দেখে আসি।

তপন অবাক হয়ে বলল, মাদাম টুসো? এক্ষুনি কী। আরও দু-তিন বছর তো থাকবি তোর ছেলেটা আর একটু বড়ো হোক, তখন ওই মোমের পুতুলগুলো তোর ছেলেকে দেখিয়ে আনিস–তার ভালো লাগবে। আমরা কী দেখব?

ললিতা বলল, আমাদের একবার দেখা হয়ে গেছে। আমার কিন্তু খুব ভালো লেগেছে, জানেন এবার ওখানে নেহেরুজিরও মূর্তি বসানো হয়েছে।

তপন কোনো উত্তর দিল না। আকস্মিকভাবে সে একটু দুঃখিত বোধ করল। সে বুঝতে পারল, দিবাকর আর ললিতার সঙ্গে তার আর ঘনিষ্ঠতা থাকবে না। ওদের সঙ্গে তার কোনোই মিল নেই, এমন কোনো বিষয় নেই–যা নিয়ে ওদের সঙ্গে সে বেশিক্ষণ কথা বলতে পারে। তার স্বভাবটাই এখন এমন হয়ে গেছে যে মোমের পুতুল নিয়ে বেশি কথা তার পক্ষে আর কিছুতেই সম্ভব নয়। ওরা নিশ্চয়ই স্টেট গ্যালারি দেখেনি। ভাগ্যিস ওদের ছোটো ছেলেটা ঘুমোচ্ছে–নইলে হয়তো তার আধো আধো গলায় আবৃত্তিও শুনতে হত।

দিবাকর বলল, তাহলে চল আমরা উইণ্ডসর ক্যাসল কিংবা টাওয়ার অব লণ্ডনে যাই।

তপন আলগাভাবে উত্তর দিল, রে, আমার ভিড়ের মধ্যে লাইনে দাঁড়িয়ে ওসব দেখতে একেবারেই ভালো লাগে না।

অন্তত সবাই মিলে কোনো একদিন বেড়াতে যাই কোথাও।

 তার চেয়ে ঘরে বসে আড্ডা মারাই তো ভালো।

ললিতা রান্না করুক, আমরা পাশের ঘরে বসি আয়। আমরা এখানে থাকলে ওর রান্না শেষ হবে না।

তপন মদের বোতল ও গ্লাস নিয়ে উঠে এল। দিবাকরদের শোওয়ার ঘরে দেয়ালে মহাত্মা গান্ধী, সুভাষ বসু ও রবীন্দ্রনাথের ছবি ঝুলছে। আলমারিতে ইংরেজি গীতাঞ্জলি ও উপনিষদ এর বাঁধানো সেট। কলকাতায় থাকতে তপন কোনোদিনও দিবাকরের গীতাঞ্জলি কিংবা উপনিষদ সম্পর্কে আগ্রহের কথা টের পায়নি। দিবাকর তপনের মদের বোতলটার দিকে বেশ ঘৃণার চোখে তাকিয়ে যথেষ্ট দূরে গিয়ে বসল, তারপর বলল, তোর ব্যাপার কী বলতো? তুই দারুণ বদলে গেছিস!

হাসতে গিয়ে বিষম খেয়ে ফেলল তপন। সে জানত, দিবাকর ওকথা বলবেই! সবাই বদলায়। একমাত্র আয়নার সামনে দাঁড়ালেই কোনো বদল টের পাওয়া যায় না।

কী বদল দেখলি আমার? তুই তো ঠিক আগের মতোই আছিস।

তুই একবারে বেপরোয়া হয়ে গেছিস তপন। তোর চেহারার মধ্যেও একটা রুক্ষ ভাব এসেছে। চোখের নীচে কালি।

বড্ড খাটতে হয় রে।

যা যা, খাটুনি দেখাস না। তবু তো আমেরিকায় সপ্তাহে দু-দিন ছুটি। আমার এখানে সপ্তাহে সাড়ে ছ-দিন হাড়ভাঙা খাটুনি–তুই এত মদ খাস কেন?

এত তো খাই না। মাঝে মাঝে একটু-আধটু।

দেশে থাকতে তো তোকে কোনোদিন এক ফোঁটাও খেতে দেখিনি।

 দেশে থাকতে তো অনেক কিছুই করিনি। অনেকদিন দু-বেলা পেট ভরে খেতেই পাইনি। ওসব কথা বাদ দে। কলকাতার খবর বল, ড. সিংহ এখনও হেড অব দি ডিপার্টমেন্ট আছেন?

না, রিটায়ার করেছেন। হ্যাঁ, ভালো কথা, সুবীর ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে, তুই শুনেছিস? তুই যাকে পড়াতিস, সুবীর–তোকে চিঠি লেখেনি?

আমায় কেউ চিঠি লেখে না। লিখলেও আমি উত্তর দিই না।

কেন?

কেন আবার কী! আমার স্বভাবের দোষ।

দময়ন্তীও তোকে চিঠি লেখে না?

দময়ন্তী?

তপন ভ্রূ কুঁচকে একটু ভাবল। এমন নয় যে সে দময়ন্তীর নাম শুনে চিনতে পারেনি। কিন্তু দময়ন্তী তাকে পাঁচ বছর ধরে চিঠি লিখে যাবে–এটা দিবাকর ভাবল কী করে। সুবীর গুপ্ত বলে একটা ছেলেকে কিছুদিন পড়িয়েছিল তপন, তার দিদি দময়ন্তী। প্রায়ই এসে তার সঙ্গে গল্প করত, দু-একদিন রাস্তাঘাটেও দেখা হয়েছে–অনেক অনেক ভিড় সরিয়ে দময়ন্তী তার কাছে এসে বলেছে, কোথায় যাচ্ছেন? সবসময় আপনার ভুরু কুঁচকে থাকে কেন? কী এমন চিন্তা করেন সবসময়?

শিল্প প্রদর্শনীর দু-একটি দুর্লভ সংগ্রহ থাকে–যেখানে লেখা থাকে হাত দেওয়া নিষেধ, দময়ন্তী সেই ধরনের মেয়ে। দূর থেকে দেখতেই ভালো লাগে–কাছাকাছি গেলেই কিছু একটা ভেঙে যাবার আশঙ্কা থাকে। তপন তবু-খানিকটা কাছাকাছি গিয়েছিল–কিছুই ভেঙে যায়নি, কোনো অভ্রান্ত জ্যোতিষীর গণনায় নির্দিষ্ট দিনটাতেই নিজেকে ভাঙবে-দময়ন্তী যেন সে-রকম ঠিক করে রেখেছিল।

তপন বলল, দময়ন্তী আমাকে চিঠি লিখবে কেন?

সবাই তো বলে তুই দময়ন্তীর ওপর অভিমান করেই দেশ ছেড়ে চলে এসেছিস।

পাগল নাকি। আমি কারুর ওপর অভিমান করেই দেশ ছাড়িনি। তুই কেন এসেছিস?

আমার কথা আলাদা। আমি তোর মতন বাউণ্ডুলে হয়ে যাইনি। দময়ন্তীর খবর জানবার জন্য তোর আগ্রহ হয় না?

না।

খবর জানিস, দময়ন্তীর বিয়ে হয়েছে কি না?

আমার কোনো আগ্রহ নেই।

তুই নাকি আর দেশে ফিরবি না ঠিক করেছিস? কানাডা বা আমেরিকায় সেটল করবি?

হুঁ।

কোনো মানে হয়? তুই এমন একটা ভালো বংশের ছেলে।

তপন স্বচ্ছ কৌতুকে এবার হেসে ফেলল। হাসতে হাসতেই বলল, বংশ? অনেকদিন পর শুনলাম কথাটা। আমাদের কী এমন ভালো বংশ? তুই কী জানিস তার সম্বন্ধে?

তোরা তো বিক্রমপুরের রায়চৌধুরি।

তপনের হাসি পায়, থামে না। বিক্রমপুরের রায়চৌধুরী। হাঃ-হাঃ-হাঃ–সবাই তো কোথাও-না- কোথাও জন্মেছে–কেউ এঁড়েদার ঘোষাল, কেউ বর্ধমানের পততুন্ডি, কেউ ফরিদপুরের সরখেল, তোরাও তো টালিগঞ্জের সরকার–কী এল গেল? বিক্রমপুরের রায়চৌধুরি বড়ো কীসে?

সব কিছু হেসে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ট্র্যাডিশনকে অস্বীকার করে মানুষ বেশি দূর পৌঁছোতে পারে না।

মাইরি বলছি দিবাকর, আমি ঠাট্টা করছি না। তুই বংশের কথা তুললি তো–আমাদের বংশ মোটেই কোনো কারণে উল্লেখযোগ্য নয়। তুই বোধ হয় জানিস না, আমার মা একসময় ঝি-গিরি করতেন, আমার বুড়ো ঠাকুরদার কাজ ছিল ঠোঙা বিক্রি করা।

বাজে কথা বলিস না।

বিশ্বাস হল না? এই দেখ আমার বাঁ-হাতটা–চেটোতে একটা কালো দাগ দেখছিস? কীসে হয়েছে জানিস? ল্যাবরেটরিতে কোনো অ্যাক্সিডেন্ট নয়–আমার তখন সাত বছর বয়েস, আমরা তখন এক বাড়িতে আশ্রিত ছিলাম–খাওয়া-থাকার বদলে আমার মা সে বাড়িতে ঝি-গিরি করতেন, আমার ঠাকুরদার টিবি হয়েছিল, পাছে সে-কথা জানাজানি হলে আমাদের সবাইকে সে-বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়–তাই ঠাকুরদার কোনো চিকিৎসা করারও চেষ্টা হয়নি। আমাকে যা খাবার দিত, তাতে আমার পেট ভরত না, সবসময় খিদের জ্বালায় ঘ্যান ঘ্যান করতাম। একদিন লোভ সামলাতে না পেরে রান্নাঘর থেকে এক টুকরো ইলিশ মাছ চুরি করেছিলাম, কিন্তু সামলাতে পারিনি–ধরা পড়ে গেছি–বাড়ির গিন্নি আমাদের হাভাতের বংশ বলে গালাগাল করেছিলেন। তবু দয়া করেছিলেন তিনি, সেই অপরাধে আমাদের তাড়িয়ে দেননি–শুধু একটা শাস্তি দিয়েছিলেন, আমার মার সামনেই সে-বাড়ির গিন্নি–সাত বছরের ছেলের চুরির অপরাধে গরম হাতা দিয়ে আমার হাতে ছেকা দিয়ে দিয়েছিলেন। আমি হাত পেতে দাঁড়িয়েছিলাম আর গিন্নিমার দয়া পাবার জন্য বেশি বেশি করে ডুকরে কেঁদে বলেছিলাম, আর করব না, আর কোনোদিন করব না। কিন্তু ঠিক তার পরদিন, মাছ কোটার সময় কারচুপি করে আমার মা দু-খানা মাছভাজা চুরি করে এনে আমাকে খাইয়েছিলেন। সুতরাং, শুধু আমি চোর নয়, আমার মা-ও চোর ছিলেন।

মা-র নামে এসব কথা বলতে তোর মুখে আটকায় না?

আমি বিজ্ঞানের ছাত্র, সত্যি কথা বলতে তো আমার মুখে আটকাবার কথা নয়।

তুই ভুলে যাসনি তপন, বিজ্ঞানের প্রয়োগ শুধু ব্যাবহারিক। শুধু ব্যাবহারিক প্রয়োগ নিয়েই মানুষের জীবনটা বিচার করা চলে না। মানুষ এখনও এতটা বস্তুতান্ত্রিক হয়নি। অত সত্যি কথা বলবার বড়াই করিস না– তোর যদি সত্যিকারের জ্ঞান হত–তাহলে তোর মায়ের দুঃখের আড়ালে যে সত্য ছিল–সেটাও তুই বুঝতে পারতিস। তুই যে ঘটনাটা বললি, সেটা সত্যিই খুব মর্মান্তিক–কিন্তু সেটা তোর দেশ ছাড়ার কোনো যুক্তি হতে পারে না। একজন বা কয়েকজন মানুষ কী খারাপ ব্যবহার করেছে, তা নিয়ে দেশের বিচার হয় না, দেশ তার চেয়ে অনেক বড়ো। খারাপ মানুষ কোন দেশে নেই।

দেখ দিবাকর, লেকচার ঝাড়িসনি। ওসব আমাকে কোনো অ্যাপিল করে না। ওসব সেন্টিমেন্টাল দেশপ্রেম-ফ্রেমের কথা শুনতে শুনতে আমার কান পচে গেছে। যে দেশে জন্মেছি সেটাই আমার দেশ–আর সেই দেশটাই পৃথিবীতে সবচেয়ে ভালো–ওসব ন্যাকা কথার কোনো মানে হয় না। আমি তো জন্মেছিলুম ঢাকা শহরে–সেটা এখন বাংলাদেশ, অন্য দেশ। ভারতবর্ষও তো আমার কাছে অন্য দেশ–ঢাকা ছেড়ে যদি অন্য কোথাও থাকতেই হয়, তাহলে ভারতবর্ষ কেন, বার্মা, জাপান, আমেরিকা, রাশিয়া যেকোনো দেশকেই আমার দেশ করে নিতে পারি। আমি সেটাই চেষ্টা করছি–কিংবা কোনো দেশই নিজের দেশ হবে না-সারাজীবন নানান দেশে কাটাব।

তুই নিজেই জানিস–তোর কথায় অনেক যুক্তির ভুল আছে। যেখানে তোর মা-বাবা

আমার যুক্তি খুঁজে দরকার নেই। আমার বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই, সব বন্ধন চুকে গেছে।

অত সহজে বন্ধন চোকানো যায় না। ভারতবর্ষ তোর ভালো লাগে না?

না।

তাহলে আমেরিকা-কানাডাই তোর ভালো লাগে?

মাথা খারাপ। ভালো লাগে কে বলেছে? জঘন্য লাগে। যত রাজ্যের চাষা, গোঁয়ার আর হিপক্রিটে ভরতি-ভালো লোক যে কটা, তারা খড়ের গাদায় আলপিনের মতন লুকিয়ে আছে–রাস্তাঘাট দিয়ে কখনো সহজভাবে হাঁটা যায় না।

তাহলে আছিস কেন? ওখানেই ফিরে যাবি কেন?

জানিস না? কেন যাব, জানিস না?

না।

তপন আবার মেজাজ খুশি করে একগাল হাসল। বিচিত্র সেই হাসির ভঙ্গি। বুড়ো আঙুলের ওপর তর্জনী রেখে টুসকি দেওয়ার ভঙ্গি করে বলল, এইজন্য।

দিবাকর বলল, টাকা?

হ্যাঁ, মাইরি। তুই যেটা জিজ্ঞেস করলি-তার উত্তরটাও সবাই জানে, তবু ন্যাকা সেজে থাকে। তবু জিজ্ঞেস করে। নিজেরা উত্তর দেবার সময় মিথ্যে কথা বলে! এই ইংল্যাণ্ডে কিংবা আমেরিকায় যে হাজার হাজার ভারতীয় ছেলে আছে, তুই তাদের জিজ্ঞাসা কর, কেন তারা এসব দেশে পড়ে আছে? চিনিতো আমি ওদের, সব শালা মিথ্যে কথা বলবে। বলবে, দেশে কাজ করার সুযোগ নেই, ল্যাবরেটরি নেই, গভর্নমেন্টের সাহায্য নেই, হ্যাঁন নেই, ত্যান নেই। কিন্তু আমি ওসব মিথ্যে কথা বলতে চাই না। টাকা জিনিসটা বড় মিষ্টি ঝনঝনে টনটনে কী সুন্দর আওয়াজ। পকেটে টাকা থাকলে শীতকালেও গরম লাগে, গরমকালে গা ঠাণ্ডা হয়–সেই টাকা ভারতবর্ষের থেকে অন্তত পাঁচ গুণ বেশি পাওয়া যায় এসব দেশে। সেইটাই আসল কথা। টাকা থাকলে যেকোনো আরাম।

কিন্তু টাকায় কেনা আরামেরও তো একটা সীমা আছে। মনের সুখ যদি না থাকে।

সুখ? সকলের মনের সুখ একরকম নয়। রবীন্দ্রনাথ পড়িসনি, সুখ চাই নাই, মহারাজ, জয় চেয়েছিনু, জয়ী আমি আজ-আমাকে মাসে ন-শো ডলার মাইনে দিচ্ছে, টাকায় হিসেব করলে সাড়ে ছ-হাজার টাকা। তোর ভারতবর্ষে কেউ দেবে? এইভাবে আমি আমার মায়ের ঝি-গিরির শোধ নিচ্ছি!

তপন, তোর কথাবার্তা কেমন যেন অস্বাভাবিক লাগছে। তুই যেন সবসময় বেশি উত্তেজিত, হাই স্ট্রং-তুই ঠিক সুস্থ আছিস তো?

আমি চমৎকার আছি রে, দিবাকর।

 দিবাকর একটা বড়ো রকমের নিশ্বাস ফেলে বলল, কী জানি। ভালো থাকলেই ভালো। তবু তোর কথা আমি প্রায়ই ভাবি রে তপন। বিশ্বাস কর, আমার মনে হয়, তুই বড়ো অসুখী!

মাইরি বলছি, আমি একটুও অসুখী নই। ফাইন আছি!

তোর বাবা জ্যাঠামশাই কত বড়ো বিপ্লবী ছিলেন, আমি সব জানি, তাঁরা দুজনেই দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন। আর তোর এই পরিণতি! তাঁরা কি এইজন্য প্রাণ দিয়েছিলেন? দেশের ছেলে বিদেশে গিয়ে থাকবে বলে?

আবেগে দিবাকরের গলা প্রায় কেঁপে যাচ্ছে, সে সত্যিকারের অনুভূতির সঙ্গে কথা বলতে চাইছে। কিন্তু তপন এবার হেসে ব্যাপারটাকে হালকা করে দিতে দ্বিধা করল না। বেশ খানিকটা সময় ধরে সে দিবাকরের দিকে চেয়ে রইল, হাসল, হুইস্কির গেলাসে চুমুক দিল, সিগারেট ধরাল। তারপর ধীরেসুস্থে বলল, তাঁরা প্রাণ দিয়েছিলেন, তখন প্রাণ দেবার একটা নেশা ছিল। নেশা কিংবা ফ্যাশান–যাই বলিস! তখন যেকোনো শক্তসমর্থ যুবকই যদি দেশের ব্যাপার নিয়ে না মাততো– তা হলে লোকের কাছে শ্রদ্ধা পেত না। এটা মস্তবড়ো নেশা–এই নেশার ঝোঁকে প্রাণ পর্যন্ত দিয়েছে অনেকে। আমার বাবা-জ্যাঠাকে ঠিক বোকা যদি নাও বলি, তা হলেও হঠকারী এবং ভাববিলাসী নিশ্চয়ই বলা যায়। এখন বেঁচে থাকাটাই একটা মস্ত বড়ো নেশা। আমি ভাই সেই বেঁচে থাকার নেশাতেই মজে আছি।

সেই বেঁচে থাকা মানে কি পশুর মতন শুধু আত্মসুখের জন্য বেঁচে থাকা?

তাও বলতে পারিস! পশুর সঙ্গে মানুষের কতখানিই-বা তফাত! দেশের জন্য প্রাণ দেওয়া বলছিস? আর একটা ঘটনা বলছি শোন। আমার ঠাকুরদা ধুঁকতে ধুঁকতেও বেঁচে থেকে দেশের স্বাধীনতা পর্যন্ত দেখে গিয়েছিলেন। শেষ কটা দিন ওঁকে একটু শান্তি দেবার জন্য টি বি হাসপাতালে একটা সিটের জন্য গিয়েছিলুম এক মন্ত্রীর কাছে। সাহেবি আমলের চেয়েও এখানকার মন্ত্রীদের সঙ্গে দেখা করা আরও অনেক শক্ত। আমার জ্যাঠামশাই প্রিয়নাথ রায়চৌধুরি ঢাকার যে মিছিলে সাহেবের হাত থেকে চাবুক কেড়ে দিয়েছিলেন–এখনকার এই স্বাস্থ্যমন্ত্রীমশাইও সেদিন সেই মিছিলে ছিলেন। সমস্ত ঘটনাটা তিনি নিজের চোখে দেখেছিলেন–সুতরাং আমার জ্যাঠামশাইকে অন্তত তিনি চিনতে পারবেন ভেবে বিস্তৃতভাবে আমার বাবা-জ্যাঠামশায়ের কথা লিখে ওঁর কাছে পাঠানো হয়েছিল। আমি আর কাকা দু-জনে দিনের-পর-দিন ধর্না দিয়েছি–শেষপর্যন্ত একদিন দেখা পেলাম, উনি ভীষণ ব্যস্ত–একটা ইলেকশন ট্যুরে বেরোবেন, দু-এক দিনের মধ্যে কথা বলার সময় নেই পর্যন্ত–তবু উনি দয়া করে ব্যবস্থা করলেন।-সরকারি কী একটা ফাণ্ড থেকে ঠাকুরদাকে মাসে পঁয়তাল্লিশ টাকা সাহায্য করা হবে এবং উনি ইলেকশন ট্যুর থেকে সপ্তাহ তিনেক বাদে ফিরে এসেই হাসপাতালে ঠাকুরদাকে একটা সিট দেবার খুব চেষ্টা করবেন। সরকারি সাহায্য একবারও আসবার আগে, সেই তিন সপ্তাহ পূর্ণ হবার আগেই অবশ্য ঠাকুরদা রক্তবমি করতে করতে মারা যান!–এসব শুনে কী মনে হয় না, প্রাণ দেবার বদলে আমার বাবা জ্যাঠারও উচিত ছিল বেঁচে থেকে মন্ত্রী হওয়া?

এইসব সামান্য বিচ্যুতির কথা তুলে তুই অত বড়ো আদর্শের বিচার করছিস? ওঁরা কোনো প্রতিদানের কথা ভেবে তো প্রাণ দেননি! দেশকে ভালোবাসাই একমাত্র ভালোবাসা–যার বিন্দুমাত্র প্রতিদান নেই। সেইজন্যেই সব ভালোবাসার চেয়ে এই ভালোবাসা এত তীব্র। একটা মেয়েকে ভালোবেসে ক-জন আর প্রাণ দিতে পারে, কিন্তু দেশের জন্য প্রাণ দেয় হাজার হাজার মানুষ।

হু, যারা বেশি সুযোগসন্ধানী, তারাই অন্যের কাছে দেশপ্রেমের বুলি বেশি কপচায়। তুই শালা, বিলেতে বসে দেশপ্রেম নিয়ে এত বুকনি ঝাড়ছিস কেন আমার কাছে? তুই এখানে কী করছিস?

ডিস ভরতি চিংড়ির বড়া নিয়ে ঘরে ঢুকে ললিতা বলল, কী, এত ভালোবাসার গল্প হচ্ছে কীসের? দুই বন্ধুতে সব গোপন কথা বলা হচ্ছে বুঝি?

দিবাকর তাড়াতাড়ি জবাব দিল, এমনি ভালোবাসা নয়, আমরা দেশপ্রেমের কথা নিয়ে আলোচনা করছিলাম।

তপন হালকাভাবে বলল, দেখো তো ললিতা, দুই বন্ধুতে বসে কোথায় একটা নিরিবিলিতে মেয়েদের গল্প করব, আমাদের সব পুরোনো প্রেমের ঘটনা নিয়ে আলোচনা করব—তা নয়। দিবাকর যতসব দেশপ্রেম-টেশপ্রেমের মতন গুরুগম্ভীর ব্যাপার তুলেছে।

ললিতা আরক্ত মুখে বলল, আপনি ভালোবাসা সম্পর্কে কিছু বোঝেন নাকি? আপনাকে দেখলে তো মনে হয়, মেয়েদের সম্বন্ধে আপনার কোনো অভিজ্ঞতাই নেই।

চেহারা দেখে মনে হয়? দিবাকরের চেয়েও আমার চেহারা খারাপ বলতে চাও?

আমি চেহারার কথা বলছি না! চেহারা আপনার তো বেশ ভালোই, কিন্তু মেয়েরা শুধু চেহারা দেখে ভোলে না কখনো।

তপনের হঠাৎ মনে হল, ললিতা মেয়েটি কীরকম যেন অস্বাভাবিক। আজ গোড়া থেকেই ললিতা ওর সঙ্গে একটু তির্যকভাবে কথা বলছে। যেন তপন ওর প্রতিপক্ষ। অথচ-কিংবা এমন হতে পারে-ললিতার মতন মেয়েরাই স্বাভাবিক বাঙালি মেয়ে। তপন তো অনেকদিন নিজে এ-রকম কোনো মেয়ের সংস্পর্শে আসেনি, তাই বুঝতে পারছে না। ললিতা যেন শালীনতার প্রতিমূর্তি। ললিতা আর দিবাকর দু-জনেই পবিত্র প্রেম কিংবা পবিত্র দেশপ্রেম ছাড়া আর কিছু জানে না। এসব ব্যাপার নিয়ে ঠাট্টা-ইয়ার্কি একেবারেই পছন্দ করে না। তপন একবার ভাবল, সে চুপ করে যাবে। তারপর আবার ভাবল, এদের খুশি করার কোনো দায়িত্ব তো তার নেই। তার যা খুশি সে তাই বলবে। সেইরকম ঠাণ্ডা কৌতুকের সুরেই তপন বলল, তবু জানো ললিতা, আমার এই চেহারা দেখেই অনেক মেয়ে আমার প্রেমে পড়েছে। অনেক ভালো ভালো মেয়ে! এক সপ্তাহ–দু-সপ্তাহের জন্য তারা খুব গভীরভাবে ভালোবেসেছে আমাকে।

এক সপ্তাহের ভালোবাসা! ছি ছি! ওকে ভালোবাসা বলে না। ওর নাম বিকৃত লালসা। আপনি এ-রকম কথা বলবেন, আমি ভাবতেও পারিনি। সত্যিকারের ভালোবাসা মানুষের জীবনে শুধু একবারই আসে, একজনের কাছ থেকে–এদেশের যেসব মেয়েদের আপনি দেখছেন-~~~

সত্যিকারের ভালোবাসা কিনা তা জানি না। জীবনের সত্য বড় ঘন ঘন বদলায়। আজ যা সত্যি কাল সেটা মিথ্যে হয়ে যায়। এদেশের মেয়েদের মধ্যে একটা জিনিস দেখেছি, মিথ্যে হলেও, ক্ষণস্থায়ী হলেও তারা সেই মিথ্যে ভালোবাসাও খুব মধুরভাবে ব্যবহার করতে জানে! শরীরটাকে তারা একটা লজ্জার ব্যাপার মনে করে না, সৌন্দর্য যে শুধু একটা দেখবার জিনিস না–সম্পূর্ণ সত্তাকে ডুবিয়ে উপভোগ করবার–তা তারা জানে–মিথ্যে হলেও এইরকম ভালোবাসাই আমার ভালো লাগে–এর বদলে বাঙালি মেয়েদের প্যানপ্যানানির কোনো মূল্যই নেই আমার কাছে!

আপনি এ-রকম ক-জন মেয়ের ভালোবাসা পেয়েছেন?

 ঠিক গুনিনি, দশ-বারো জন হবে। সবার নামও এখন মনে নেই।

আপনি এসব মেয়ের সঙ্গে–আপনি–আপনি–

ললিতা যেন স্তম্ভিত হয়ে গেছে, তপনের প্রত্যেকটা কথাই যেন তার গায়ে তিরের মতন ফুটছে। তবু এই প্রসঙ্গ চাপা দেবার কোনো আগ্রহই তার দেখা গেল না। আরও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সে তপনের এইসব ক্ষণস্থায়ী ভালোবাসার কাহিনি শুনতে চাইছিল। কিন্তু দিবাকর তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, অদ্ভুত পরিবর্তন! পাঁচ বছর আগে যাকে চিনতাম, সে যেন অন্য তপন! বিদেশের যা-কিছু সবচেয়ে খারাপ, তপন ঠিক সেগুলোরই মোহে পড়েছে! মদের নেশা, মেয়েদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলা, সব কিছুর প্রতি শ্রদ্ধা–অথচ এদেশের লোকদের মধ্যে অনেক ভালো গুণও আছে–সেগুলো তার চোখে পড়েনি-তোর জন্যে আমার দুঃখ হয় রে তপন।

তপন হা-হা করে হেসে বলল, তুই তো একটা সিগারেটও খাস না–আশা করি তুই খুব ভালো আছিস! এইরকম ভালো থেকেই ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে গিয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করিস! আমার মতন একটা-আধটা ছেলে যদি বখে যায়–তাতে অত বড়ো দেশের কিছু আসে-যায় না!

এরপর আর গল্প জমতে পারে না! খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকল বিনা আড়ম্বরে, দু-একটা মামুলি কথা ছাড়া কেউ আর কিছুই বলল না। তপন ললিতার রান্নার প্রশংসা করল–তাতেও ললিতার বিশেষ কোনো ভাবান্তর হল না- সে সবসময় তপনকে লক্ষ করছে অথচ চোখাচোখি হলেই চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। তপন স্পষ্ট বুঝতে পারল দিবাকর অপেক্ষা করছে তপন কখন বিদায় নেবে। একসময় গভীর বন্ধুত্ব ছিল দু-জনের। এখন সুর কেটে গেছে। পাঁচ বছরের মধ্যেই ওদের মধ্যে দুটি মহাসমুদ্রের ব্যবধান। বাকি হুইস্কিটুকু শেষ করে তপন উঠে পড়ল। তপন কলকাতায় যাবে শুনে ললিতা তার ভাই-বোনের জন্য জামাকাপড় তপনের হাত দিয়ে পাঠাবে বলে একটা প্যাকেট তৈরি করে রেখেছিল–শেষ মুহূর্তে সেটা দিতে ললিতা যেন একটু দ্বিধা করতে লাগল। তপনই সেটা চেয়ে নিল আগ্রহ করে। এবং তপনের এইটুকু উপকারের কৃতজ্ঞতা দেখাবার জন্যই যেন দিবাকর ওকে টিউব স্টেশন পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এল।

রাস্তায় বেরিয়ে দিবাকর ললিতা সম্পর্কে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল–তপন সেটা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে দিবাকরের কাজ নিয়ে প্রশ্ন করতে লাগল। দিবাকরকে শুধু চাকরি করতে হয় না, রিসার্চ করার সুযোগ পায়–বিখ্যাত অধ্যাপক বেন্টলির কাছ থেকে দিবাকর কোনো সাহায্য পাচ্ছে কিনা–এইসব সম্পর্কে তপন এমন আগ্রহী হয়ে পড়ল যেন-সেই মুহূর্তে সে বিজ্ঞান ছাড়া পৃথিবীর আর কিছুই জানে না। বিদায় দেবার আগে দিবাকর জিজ্ঞেস করল, তোর বেশি নেশা হয়নি তো–তুই পারবি তো একা যেতে?

তপন বিমূঢ়ভাবে তাকাল দিবাকরের কাছে। এ প্রশ্ন শোনার জন্য যেন সে একটুও প্রস্তুত ছিল না। নেশা সম্পর্কে কী অদ্ভুত ধারণা। এতক্ষণ সে একসঙ্গে দিবাকরের সঙ্গে হেঁটে আসছে, কথা বলছে–এর মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। তবু মদ খেয়েছে বলেই ওর নেশা হবে, দিবাকর এই ধারণা নিয়ে বসে আছে। তপনের হঠাৎ মনে পড়ল, ফিজিক্স-এর বদলে দিবাকরের ফিলজফি পড়া উচিত ছিল। মুখে শুধু বলল, না, ঠিক আছি।

দিবাকর তার গলায় মাতৃস্নেহের মতন আকুতি এনে বলল, তপন, আর যাই করিস, শরীরটার ওপর অন্তত যত্ন নিস!

পুরুষমানুষের কাছ থেকে এ ধরনের কথা শোনা তপনের একেবারেই অভ্যেস নেই–সেইজন্য ওর খুবই অস্বস্তি হতে লাগল। খুব বিব্রতভাবে বলল, না, না, তুই কী ভাবছিস আমার সম্বন্ধে, সব ঠিক আছে।

যেন জীবনের মতন শেষ বিদায় নিচ্ছে–এইভাবে দিবাকর তপনের কাঁধে হাত রাখল খুব মমতায়। সেই হাত সরে যাবার আগেই–হঠাৎ তপনের সমস্ত শরীরটা কঠিন হয়ে এল, চট করে দাঁড়িয়ে পড়ে সে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল।

রাস্তা জনবিরল হয়ে এসেছে। পথচারীর সংখ্যা খুব কম, গাড়িগুলো এইসময় ছোটে অত্যন্ত দ্রুতবেগে। হলোয়ে রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে এসে ওরা কিংসস-এ ট্রেন ধরবে ঠিক করেছিল। টিউব স্টেশনের সিঁড়ির মুখে গোটা পাঁচেক ছোকরা দাঁড়িয়ে আছে, রেলিং-এর ওপর পা তুলে নীচু গলায় গান গাইছে। তপনের শ্রবণশক্তি খুব সজাগ–সে এক ঝলক শুনেই গানটা চিনতে পারল :

হু উইল হ্যাং আপ দা নিগারস ফ্রম দা নিয়ারেস্ট অ্যাপল ট্রি
উইল হ্যাং আপ দা নিগারস ফ্রম দা নিয়ারেস্ট অ্যাপল ট্রি

হিংস্র জন্তুর মুখোমুখি পড়লে মানুষের প্রত্যেকটা ইন্দ্রিয় যেমন সজাগ হয়ে যায়–তপন সেইরকম দাঁড়িয়ে আছে। দিবাকর ঠিক বুঝতে পারেনি, কিন্তু ছোকরাগুলোর দিকে তাকিয়েই সে বিপদ আঁচ করে বলল, দাঁড়ালি কেন, চল, এর পর আর ট্রেন পাবি না। তপন আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে ওদের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল, মৃদু স্বরে বলল, এক্সকিউজ মি, পথ ছাড়ো

ওরা তপনের কথায় কান দিল না, গান গাইতেই লাগল, এবার একটু জোরে।

তপন আবার বলল, পথ ছাড়ো, আমরা স্টেশনে যাব।

তপনের কথায় ওরা কান দিল না, একজন শুধু গান থামিয়ে আরেকজনকে বলল, ডিডনচাই টেল ইয়া এরিক? দে স্মেল ডিফরেন্ট! দে স্মেল টু স্টিংকিং প্যাকিস্তানিজ। যাকে বলা হল, সেই গলায় রুমাল বাঁধা ছোকরা বলল, না, আমি বাজি ফেলতে পারি–পাকিস্তানি নয়, ইণ্ডিয়নস!

বাট দে স্মেল ডিডনচাই টেল ইয়া?

তপন তখনও ধীরভাবে বলল, রাস্তা ছাড়ো, আমাদের যেতে চাও।

চেঁচাসনি! চেঁচাসনি! তোরা নিগাররা কবে শিখবি যে ইংল্যাণ্ড একটা সভ্য দেশ, এখানে চেঁচিয়ে কথা বলে না কেউ।

আমি চেঁচাইনি! তোমাদের নিশ্চয়ই কানের অসুখ আছে।

দিবাকর তপনের হাত ধরে টেনে বলল, কথা বলিসনি, ওদের সঙ্গে কথার বলিসনি!

তপন দিবাকরের দিকে চেয়েও দেখল না–স্থির দৃষ্টিতে ওদের দিকে চেয়ে রইল! ওদের মধ্যে একটা ছেলে এগিয়ে এসে চিবিয়ে চিবিয়ে নকল মিষ্টি গলায় তপনকে জিজ্ঞেস করল, এন ইট রাইট মিস্টার, ইয়ু স্মেল ডিফারেন্ট টু আস?

তপনও ঠিক সমান সুরে উত্তর দিল, হতে পারে। কিন্তু তোমার গা থেকেই দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে। ইটস দা আদার ওয়ে অ্যাবাউট!

ছেলেটা অপমান যেন গায়ে মাখল না, বিকট ভাবে হেসে উঠে বলল, তা হলে তোরা দেশে ফিরে যাচ্ছিস না কেন? ডার্টি সোয়াইনস–ব্রিটেন ফর দা ব্রিটিশ-ইউ।

দিবাকর ব্যাকুলভাবে তপনের হাত জোর করে টানতে টানতে বলল, তপন, এখান থেকে চলি চ–এরা গুন্ডা, আমরা অন্য স্টেশন থেকে উঠব। তপন অনড়ভাবে দাঁড়িয়ে রইল। ততক্ষণে ওদের দু-জন দিবাকরকে ঘিরে ধরেছে। দিবাকর একটা হাঁটু পর্যন্ত ঝোলানো কোট পরে ছিল, ভারতীয়রা যাকে ল্যংকোট বলে–গলাবন্ধ লম্বা কোট। একজন দিবাকরের সেটার গায়ে হাত বুলিয়ে বলল, গাছে উঠে ঝোলার পক্ষে এই পোশাকটাই মানায়, তাই না? সেই চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলা ছেলেটা আবার মিষ্টিভাবে বলল, হেই মিস্টার ডু য়ু ওয়্যার এনি ড্রয়ারস অর এনিথিং আণ্ডার ড্যাট গিয়ার? টেল মি–।

দিবাকর অসহায়ভাবে তাকাচ্ছে, তপন এগিয়ে এসে তাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে কঠিন গলায় বলল, তোমরা কী চাও? শুধু শুধু ঝামেলা পাকাতে চাও? আমরা স্টেশনে ঢুকব, আমাদের যেতে দাও।

লাল রুমাল বাঁধা ছেলেটা বলল, হেঁটে যা, হেঁটে যা! ব্রিটিশ ট্রেন তোদের জন্য না! ব্লাডি ইণ্ডিয়ানস! বাস্টার্ডস!

তপনও সমান গলায় বলল, ইয়ু বাস্টার্ডস! ওয়ান্ট সাম লিটল স্পোর্ট?

ওয়াচ আউট!

লাল রুমাল বাঁধা ছেলেটাই তপনকে প্রথম ঘুসিটা মারল। তপন শিগগিরই চলে আয় আর্ত গলায় পেঁচিয়ে দিবাকর তখন ছুটতে শুরু করেছে। নাকে লেগেছে ঘুষিটা–সঙ্গে সঙ্গে গরম রক্ত বেরিয়ে এসেছে, হাত দিয়ে সেই রক্ত ছুঁয়েই তপন হিংস্র হয়ে উঠল। বুনো শুয়োরের মতন ছুটে গিয়ে ওদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল, লাল রুমাল বাঁধা ছেলেটার থুতনির তলায় প্রকান্ড একটা ঘুসি মেরে তাকে শুইয়ে ফেলল রাস্তায়, একজন তার কাঁধে মারতেই তপন সেদিকে ফিরে চেঁচিয়ে বলল, আজ তোদের শেষ করব, সব কটাকে।

মারামারিটা বেশিদূর এগোল না। কাছেপিঠেই আপাদমস্তক বর্ষাতিতে ঢাকা একজন পুলিশম্যান ছিল, হঠাৎ সে কোথা থেকে উদয় হল। দু-পাঁচ জন দর্শকও জমে গেল। পুলিশ দেখেই ছেলেগুলো নিরীহ সেজে গেল–সমস্বরে তারা তপনের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে লাগল, ইণ্ডিয়ান থাগ, আমাদের কাছ থেকে টাকা কেড়ে নেবার চেষ্টা করছিল, ইয়ু নো, হোয়াট দিজ ইণ্ডিয়ানস আর–

সাদা ধপধপে দাঁতের পাটি বার করে হাসল পুলিশটা। তপনকে সে এক হাতে ধরে আছে। ছেলেগুলোকে বলল, ওসব চলবে না, ওসব চলবে না, বিগ মাসলস, এ? একটা ইণ্ডিয়ান তোমাদের পাঁচ জনকে আক্রমণ করেছিল? তোরা ব্রিটিশ নোস? এ-রকম মিথ্যে কথা বলতে লজ্জা করে না? গেট গোয়িং, গেট গোয়িং–তপনের দিকে ফিরে বলল, আর য়ু অল রাইট স্যার? আপনি কোনো অভিযোগ জানাতে চান?

তপন বলল, না।

দিবাকর আবার কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল, তপন হাত নেড়ে তার কাছে বিদায় জানিয়ে স্টেশনে এসে ঢুকল। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ট্রেন পেয়ে গেল। একটা অকারণ, অনির্দিষ্ট রাগ সবসময়ই তপনের মধ্যে জ্বলে–সেটা আরও হু-হু করে জ্বলে উঠল, তপনকে পোড়াতে লাগল। তপনের চোখ-মুখ এখন টকটকে লাল। সিগারেট শেষ করে টুকরোগুলো মাটিতে ফেলে যখন পা দিয়ে সেগুলো পিষছে–তখন মনে হচ্ছে সে যেন কোনো জীবন্ত প্রাণীকে জুতো দিয়ে থেতলাচ্ছে। সে নিজে যতটা মার খেয়েছে, সেই তুলনায় ওদের, সে কম মার দেয়নি–তবু তার রাগ একটুও কমছে না।

ট্রেন থেকে নেমে আবার ওপরের রাস্তায় এসে কয়েক পা হাঁটার পরই তপন বুঝতে পারল কেউ তাকে অনুসরণ করছে। পেছন ফিরে কাউকে দেখতে পেল না–তবু এ ব্যাপার ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করা যায়। আরও কিছুটা হাঁটার পর আবার ঝট করে পিছন ফিরে সেই গলায় লাল রুমাল বাঁধা ছেলেটাকে এক পলকের জন্য দেখতে পেল। তপন আমেরিকায় থাকার সময় কিছু জুডোর প্যাঁচ শিখে নিয়েছিল–আত্মরক্ষার ব্যাপারে সে খুব বেশি ভীত না–কিন্তু লণ্ডনের রাস্তায় মারামারি করে সে যে কিছুতেই সুবিধে করতে পারবে না–তাও বুঝতে পারল। আর মিনিট তিনেক হাঁটলেই হোটেলে পৌঁছোনো যায়। তপন দ্রুত পা চালিয়ে দিল সেদিকে।

হোবার্ন স্ট্রিটের মোড় ঘোরার আগেই কোণ থেকে তিন জন ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর। সেই লাল রুমাল বাঁধা ছেলেটা তার দু-জন সঙ্গী ট্রেনে তপনকে অনুসরণ করে এসেছে। তপন বাধা দেবার সুযোগ পেল না–প্রথমেই বাঁ-চোখের ওপর একটা প্রচন্ড ঘুসি পড়ায় সে যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল, এলোপাথাড়ি ঘুসি চালাতে লাগল ওদের ওপর, এক জনের দাঁতের ওপর তার মুষ্টি পড়ায় কেটে গেল আঙুলতলপেটে একটা লাথি লাগতেই তপন অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল মাটিতে। অজ্ঞান হবার ঠিক আগের মুহূর্তে তপনের মনে হল, একটা রিভলবার কিংবা ছুরি থাকলে সে শেষ করে দিত সব কটাকে।

এবারও একটা পুলিশম্যানই তপনকে বাঁচাল। দূর থেকে তাকে আসতে দেখেই ছিটকে সরে গেল ছোকরারা। শিষ দিতে দিতে তারা পুলিশকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল, পেভমেন্টে অন্ধকারে পড়ে রইল তপন, পুলিশটি তাকে দেখতে পায় না।

মিনিট দশেকের মধ্যেই তপনের জ্ঞান ফিরে এল এবং প্রথমেই সে ভাবল, যাক, তা হলে মরে যাইনি। আমি কিছুতেই মরতে চাই না। মুখে-চোখে হাত বুলিয়ে দেখল–কোথাও বিশেষ রক্তারক্তি হয়নি, বাঁ-চোখটায় শুধু অসম্ভব ব্যথা। আস্তে আস্তে হাঁটুতে ভর দিয়ে সে উঠে দাঁড়াল, দেয়ালে ঠেস দিয়ে রইল কিছুক্ষণ, ক্রমে দৃষ্টি ও চিন্তা পরিষ্কার হয়ে এল। এর আগে আর একবার মাত্র এই ধরনের মারামারিতে জড়িয়ে পড়েছিল তপন, সেবারও দেখেছে, এবারও লক্ষ করল, খুব মার খেলে শরীরটা বেশ হালকা লাগে। এখন সে যেন লাফিয়ে অনেক দূর শূন্যে উঠে যেতে পারে। আর, এরকম মার খাবার ঠিক পরেই শরীরে আর তেমন রাগ থাকে না–মনটা হঠাৎ যেন শান্ত হয়ে যায়, আহত জায়গার জন্য যত না যন্ত্রণা–তার চেয়ে একটু বেশি হাসি পায় যেন। সেইরকম হালকা শরীর ও মন নিয়েই তপন এদিক-ওদিক তাকিয়ে প্যাকেটটা খুঁজল-ললিতা কলকাতার নিয়ে যাওয়ার জন্য যে প্যাকেটটা তপনকে দিয়েছিল। প্যাকেটটা আশেপাশে কোথাও নেই। তপনের স্পষ্ট মনে আছে, প্রথম মারামারির পর দিবাকর সেটা কুড়িয়ে তার হাতে দিয়েছিল। ট্রেন থেকেও সেটা নিয়ে সে নেমেছিল ঠিকই। তাহলে কোথায় গেল? এদিক-ওদিক খানিকটা খোঁজাখুঁজি করেও তপন সেটার চিহ্ন দেখতে পেল না। মাটিতে থুতু ফেলে তপন ভাবল, শালারা শুধু গুন্ডাই নয়, চোরও। এখন ললিতা কী মনে করবে? হয়তো সে ভাববে, মাতাল অবস্থায় তপন সেটা হারিয়ে ফেলেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *