০৩-৪. হোটেলে ফিরে নিজের ঘরে

হোটেলে ফিরে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করল তপন। শরীর এখন ঠিক আছে, বরং বমি হবার পর বেশ ঝরঝরে লাগছে, পেটের ব্যথা একটুও নেই। তবু দুটো ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে নিল। টাইয়ের গিট খুলতে বুকটা অনেকটা হালকা হয়ে এল। এক এক করে সমস্ত পোশাক খুলে, ঘরের তাপটা একটু বাড়িয়ে ঢুকে পড়ল কম্বলের মধ্যে। আলো নেবাতে যাবে–ঠিক সেই সময় মাথার কাছে টেলিফোন বেজে উঠল। তপন অলসভাবে রিসিভারটা তুলে বলল, হ্যালো–

অ্যালিসের উদগ্রীব কণ্ঠ, টপন, আর য়ু অল রাইট? ব্যথা কমেছে? সত্যি করে বলো–

অ্যালিসের ঘরে টেলিফোন নেই। সারাবাড়িতে একটাই মাত্র টেলিফোন দোতলার বারান্দায় রাখা। ওদের ল্যাণ্ডলেডি রাত দশটার পর টেলিফোন করা একেবারেই পছন্দ করে না– অ্যালিস আগেই বলেছে তপনকে। অ্যালিসের ল্যাণ্ডলেডির ধারণা–ভয়ংকর কোনো দুর্ঘটনা বা বিপদ হলেই মানুষ বেশি রাতে টেলিফোন করে–সুতরাং দশটার পর টেলিফোন শুনলেই তার বুক ধড়ফড় করে। তবু অ্যালিস লুকিয়ে টেলিফোন করতে এসেছে, কথা বলছে। ফিসফিস করে।

তপন বলল, হ্যাঁ ডার্লিং, এখন প্রায় ভালো হয়ে গেছি। খুব ঘুম পাচ্ছে। ফিলিং, ভেরি শ্লিপি।

টপন, সত্যি করে বলো, ব্যথা কমেছে কি না! আমার এমন ভয় করছিল, তুমি চলে যাবার পর

কিছু ভয় নেই। যাও, গিয়ে শুয়ে পড়ো–বি আ গুড গার্ল অ্যাণ্ড গেট সাম স্লিপ। কাল রাত্রেও ভালো ঘুম হয়নি তোমার। গভীর ঘুম হোক তোমার, কোনো স্বপ্ন দেখো না।

না। আমি তোমাকে স্বপ্নে দেখতে চাই।

উঁহু। স্বপ্ন দেখা স্বাস্থ্যের পক্ষে তেমন ভালো নয়। কাল দেখা হবে। ও রেভোয়া—

টেলিফোন রেখে তপন আলো নেবাল, কম্বলটা টেনে দিল মাথা পর্যন্ত।

সম্পূর্ণ অন্ধকার। এইরকম অন্ধকারে অনেক কিছু দেখা যায়।

তপন মনে মনে কাতরভাবে উচ্চারণ করল, না অ্যালিস, গল্পটা ও-রকম নয়–অন্য রকম। দুর্ঘটনা নয়, মুহূর্তের পাগলামি নয়। আমার বাবা পনেরো বছর বয়েস থেকে ঠিক করে রেখেছিলেন তিনি কোনো ইংরেজকে খুন করে প্রতিশোধ নেবেন। গল্পের আরম্ভ উনিশ-শো আটত্রিশে নয়, উনিশে–

তপন তখনও জন্মায়নি। কিন্তু চোখ বুজলেই সব ছবির মতন স্পষ্ট দেখতে পায়। কতবার সে শুনেছে সেসব দিনের কথা, মায়ের মুখে, ছোটোকাকার মুখে, ঠাকুমার মুখে। তার বাবার কোনো ভালো ছবি ছিল না বাড়িতে, একখানা গ্রুপ ফোটোর মধ্যে আঠারো জনের ভিড়ের মধ্যে মিশে থাকা বাবার মুখখানা শুধু তপন দেখেছে, আর আছে চন্দন দিয়ে তোলা তার বাবার একখানা পায়ের ছাপ। তবু, বাবার যুবা বয়সের সম্পূর্ণ চেহারা তপন কল্পনায় স্পষ্ট দেখেছে। তাই ওই ছবি চিনতে তার একটুও দেরি হয়নি।

…উনিশ-শো উনিশ, ১৩ এপ্রিল জালিয়ানওয়ালাবাগের ভয়ংকর হত্যাকান্ড ঘটে গেছে, সারা ভারতবর্ষের হৃৎপিন্ড তার পরদিন থেমেছিল, সেদিন ঢাকা শহরে হরতাল। সেই প্রথম প্রকাশ্য মিছিলে পূর্ববঙ্গের নারীরাও যোগ দিয়েছিল, বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে সবাই, তুমুল কণ্ঠে বন্দেমাতরম ধ্বনিতে কান্নার আভাস, গান উঠেছে দিবে প্রাণ দিবে না মান কভু ভারত সন্তান এবং সময় হয়েছে নিকট এবার বাঁধন ছিড়িতে হবে। শহর তোলপাড় করা সেই শোভাযাত্রার পুরোভাগে নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে আছেন প্রিয়নাথ–তপনের জ্যাঠামশাই। প্রিয়নাথ তখন সাতাশ বছরের যুবা, অশ্বিনীকুমার দত্তের শিষ্য, বুকে অসীম সাহস, কণ্ঠে বজ্রের গর্জন, তাঁরই হাতে তেরঙা পতাকা। তপনের বাবা দেবনাথের তবু যা হোক একটা ছবি অন্তত আছে কিন্তু প্রিয়নাথের কোনো ছবিই নেই।

নবাবগঞ্জ ধরে এগোচ্ছিল মিছিল, পুলিশবাহিনী আসার আগেই মুখোমুখি পড়েছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল নর্থব্রুক। ঘোড়ায় চড়ে তিনি প্রাতঃভ্রমণ সেরে ফিরছিলেন। প্রত্যেকদিন সকালে তিনি কুড়ি-পঁচিশ মাইল ঘোড়া ছুটিয়ে ব্যায়াম করতেন। বেপরোয়া কর্নেল সাহেবের বুকে একটুও ভয় নেই, মিছিল দেখে তিনি অধর দংশন করে বক্র হাস্য করেছিলেন। গম্ভীরভাবে হুকুম দিয়েছিলেন, হাটো পথ ছাড়!

কথা ছিল হিংসার আশ্রয় নেওয়া হবে না। শুধু শুধু পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধিয়ে রাইফেলের গুলিতে আরও কয়েকটি অমূল্য প্রাণ নষ্ট হতে দেওয়া হবে না। নেতারা এগিয়ে এসে করজোড়ে জানালেন, সাহেব, এ মিছিল ভাঙা যাবে না, আপনি দয়া করে অন্য পথে যান।

সাহেব বললেন, ননসেন্স! মাই হর্স ইজ টায়ার্ড! পথ ছাড়ো, নইলে আমি গায়ের ওপর দিয়ে ঘোড়া ছোটাতে বাধ্য হব।

সাহেব, এই লক্ষ লক্ষ লোকের মিছিল এখন ভাঙা যাবে না। আমরা কোনো অবৈধ কাজ করছি না, আমরা শুধু শোক জানাতে বেরিয়েছি।

দিস মার্চ ইজ আন ল ফুল–ডিসপার্স ইমিডিয়েটলি।

নেতারা কিংকর্তব্যবিমূঢ়, তখন পতাকা হাতে সাহেবের দিকে এগিয়ে এলেন প্রিয়নাথ। ঘোড়ার ওপর বসা বিশাল চেহারার কর্নেল সাহেব গর্জন করে উঠলেন, স্টপ ওয়েভিং দ্যাট স্টিংকিং আগলি ব্যানার নিয়ার মি! রাস্তা মানুষের চলাচলের জন্য, তোমাদের দঙ্গল মিলে হল্লার করবার জন্য নয়! ক্লিয়ার আউট! অ্যাণ্ড ইউ, উইথ দ্যাট ব্যানার-গেট দা হেল আউট অব হিয়ার!

প্রিয়নাথ পতাকা নামালেন না, শান্তভাবে বললেন, সাহেব এটা আমাদের দুঃখের মিছিল। শুধু তোমার ঘোড়ার জন্য এ মিছিল ভাঙা যাবে না। তুমি অন্য রাস্তা দিয়ে যাও।

তোমরা মিছিল ভাঙবে না।

তোমার জন্য অন্য পথ খালি আছে–

নর্থব্রুক সাহেব আর তর্কের মধ্যে যাননি। অসীম সাহস লোকটার–সঙ্গে পুলিশবাহিনী নেই, একা, কোমরে পিস্তল থাকলেও-অতগুলো লোক শুধু নখ দিয়েই ওকে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে দিতে পারে–কিন্তু সেসব পরোয়া করেন না, হাতের চাবুকটা তুলে শপাং করে মারলেন প্রিয়নাথের মুখে। কপাল, বাঁ-চোখ আর গালে আড়াআড়ি ভাবে পড়ল চাবুকটা, চোখের ভেতর পর্যন্ত কেটে গিয়ে ঝর ঝর করে রক্ত পড়তে লাগল।

কিন্তু প্রিয়নাথ তেমন বিচলিত হলেন না–পতাকায় যাতে রক্ত না লাগে–সেইজন্য সেটা অন্য একজনের হাতে তুলে দিলেন। তারপর রক্তমাখা অস্বাভাবিক মুখ তুলে সাহেবকে প্রশ্ন করেছিলেন, কী? তুমি কী চাও? তুমি মারতে চাও? আমাদের কতজনকে তুমি মারবে? মারতে মারতেও আমরা শেষ হব না, আমরা রক্তবীজের ঝাড়

কর্নেল তখন এলোপাথাড়ি চাবুক চালাচ্ছেন। তিন-চার ঘা চাবুক খাবার পর প্রিয়নাথ আর ধৈর্য রাখতে পারলেন না, শূন্য পথেই একবার চাবুকটা ধরে এক হ্যাঁচকা টান দিলেন। সাহেবের হাত থেকে চাবুক চলে এল তাঁর হাতে। সেই চাবুক হাতে ভয়ংকর রক্তমাখা মুখে দাঁড়িয়ে প্রিয়নাথ তীব্রভাবে চেঁচিয়ে বলেছিলেন, তোমাকে অন্য পথে যেতে বলেছিলাম। যদি না যাও, আমি যেতে বাধ্য করব।

নর্থব্রুক প্রিয়নাথের হ্যাঁচকা টানে প্রায় পড়ে যাচ্ছিলেন। কোনোক্রমে সামলে নিয়ে পিস্তলে হাত দেবার আগেই প্রিয়নাথ শপাং শপাং করে চাবুক কষালেন ঘোড়ার মুখে। বিশাল ওয়েলার ঘোড়া লাফিয়ে উঠল দু-পায়ে ভর দিয়ে তারপর উলটো দিকে ফিরে প্রাণপণে ছুটতে লাগল, হঠাৎ ঝাঁকুনিতে একেবারে হেলে পড়েছিলেন নর্থব্রুক–কোনোক্রমে ঘোড়ার গলা আঁকড়ে ধরে ঝুলে রইলেন। সেই দুঃখের মিছিলেও সেদিন এক মুহূর্তের জন্য শোক ভুলে হাজার হাজার মানুষ হেসে উঠেছিল নর্থব্রুকের অবস্থা দেখে।

পুলিশবাহিনী অবশ্য প্রায় তক্ষুনি এসেছিল। বেপরোয়া লাঠি এবং গুলি চলে তারপর, সাতাশ জন আহত হয়, তিন জন প্রাণ হারায়। কিন্তু ঘটনা সেখানেই শেষ নয়।

পরদিন ভোর বেলা প্রিয়নাথদের বাড়িতে পুলিশ হানা দিয়েছিল। প্রিয়নাথ তখন জ্বরে বেহুশ। সবাই জানত, প্রিয়নাথের খোঁজে পুলিশ আসবেই। কিন্তু প্রিয়নাথকে অন্য কোথাও সরাবার উপায় ছিল না। কোনো বাড়িই তাঁকে লুকিয়ে রাখতে ভরসা পায়নি, প্রিয়নাথেরও পালাবার সামর্থ্য ছিল না। ঘোড়ার বিষাক্ত চাবুক কেটে কেটে বসেছিল তাঁর শরীরে, চোখের মধ্যে ঢুকেছিল–সেই দিনে সন্ধ্যে বেলাই প্রিয়নাথের সমস্ত মুখ-চোখ ফুলে প্রচন্ড জ্বর এসেছিল–ব্যথায় আর কোনো আর্তনাদ করেননি প্রিয়নাথ, শুধু মা মা বলে ডাকছেন– সুতরাং প্রিয়নাথের মা ছেলেকে বাড়িতেই রেখেছিলেন নিজের কাছে।

পুলিশ এসে বিছানা থেকে হেঁচড়ে তুলে এনেছিল প্রিয়নাথকে। বন্দুক হাতে বারো জনের পুলিশ পার্টি–পুরোভাগে নর্থব্রুক স্বয়ং। নর্থব্রুকের হাতে চাবুক। চার জন জোয়ান পুলিশ দেয়ালের সঙ্গে ঠেসে ধরল প্রিয়নাথকে, আর নর্থব্রুক চাবুক চালাতে লাগলেন।

প্রিয়নাথের তখন এক-শো চার ডিগ্রি জ্বর, বাঁ-দিকের চোখ ঢেকে ব্যাণ্ডেজ, ডান চোখটা অস্বাভাবিক লাল, সারারাত ধরে প্রলাপ বকেছেন। সোজা হয়ে দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই, বার বার ঢলে ঢলে পড়ে যাচ্ছেন–আর হ্যাঁচকা মেরে তুলে ধরছে চার জন পুলিশ। সাপের মতন হিসহিসে গলায় বলেছিলেন নর্থব্রুক, ইউ ডার্টি স্কাম। তুই আমার হাত থেকে চাবুক কেড়ে নিয়েছিলি! এই নে! এই নে! শপাং–শপাং করে প্রচন্ড শক্তিতে চাবুক কষাতে লাগলেন কর্নেল সাহেব। মায়ের সামনে, বৃদ্ধ পিতার সামনে, স্ত্রীর সামনে জ্বরগ্রস্ত আহত অশক্ত প্রিয়নাথকে চাবুক মেরেছিলেন তিনি–পেশোয়ার আর নেপাল যুদ্ধের ব্রিটিশ বীরপুরুষ নর্থব্রুক। প্রিয়নাথের মা আছড়ে পড়েছিলেন সাহেবের পায়ে, দয়া করো, দয়া করো সাহেব, প্রাণে মেরে ফেলো না ছেলেটাকে, দয়া করো–এই বলে মা মাথা কুটছিলেন। যেন পায়ে একটা শুকনো গাছের ডাল জড়িয়ে গেছে–সেইরকম বিরক্তিতে সাহেব বুটজুতোপরা পায়ে এক লাথি কষালেন মায়ের মুখে–মা ছিটকে পড়ে গেলেন–ফের চাবুক কষাতে লাগলেন শপাং-শপাং।

প্রিয়নাথ একবারও দয়া চাননি, একবারও ব্যথায় চেঁচিয়ে ওঠেননি, শুধু জ্বরের ঘোরে বিকৃত গলায় বার বার বলেছিলেন, মারবে? মারো, কত মারবে? যতই মার–তবু আমি মরব না-রক্তবীজের ঝাড়–আরো মারো-একদিন এর শোধ নেব-সাহেব, প্রতিশোধ নেব-তোমাদের দিন শেষ

দো-তলার জানালা থেকে দেবনাথ দেখছিল। দেবনাথের বয়েস তখন মাত্র পনেরো দাদার সঙ্গে সেও মিছিলে ছিল আগের দিন। প্রিয়নাথের তুলনায় দেবনাথ অনেক শান্ত প্রকৃতির ছেলে–ছেলেবেলা থেকেই নানা অসুখে ভুগেছে বলে তার শরীরে তেমন জোর ছিল না– তবুও ওই বীভৎস অত্যাচারের দৃশ্য দেখে সেও শান্ত থাকতে পারছিল না। কিন্তু তার নীচে যাবার উপায় ছিল না–তাকে একজন জোর করে ধরে রেখেছিল। তাদের বাড়িতে একজন বুড়ো পিসেমশাই থাকতেন–পিসিমা মারা গেছেন, তবু পিসেমশাই আশ্রিতের মতো থেকে গিয়েছিলেন তিনি জোর করে চেপে ধরেছিলেন দেবনাথকে। পুলিশ দেবনাথকেও ধরতে চাইবে, কিন্তু বাড়ির দুটো জোয়ান ছেলেই যদি পুলিশের হাতে পড়ে তা হলে মা বাবা বাঁচবে কী নিয়ে–এই ভেবে তিনি দেবনাথকে আটকে রেখেছিলেন। অবস্থা যখন চরমে পৌঁছোল–তখন পিসেমশাই জোর করে দেবনাথকে টানতে টানতে নিয়ে এলেন বাড়ির পিছনের দরজায়, দেবনাথকে ধাক্কা দিয়ে বার করে দিয়ে বললেন, যা, পালিয়ে যা, নারায়ণগঞ্জে যা কিংবা যেখানে ইচ্ছে। বোকা ছেলে, আর এক মাসের মধ্যে এবাড়ি আর আসিসনি। শিগগির যা।

দৈত্যের মতন চেহারা নর্থব্রুকের, তার প্রত্যেক চাবুক কেটে কেটে বসছিল প্রিয়নাথের শরীরে। সতেরো ঘা-র বেশি আর সইতে পারলেন না প্রিয়নাথ, তাঁর মাথা ঘাড়ের পাশে ঢলে পড়ল। তারপর পুলিশ সারাবাড়ি লন্ডভন্ড করে সব জিনিসপত্র ভাঙা শেষ করে প্রিয়নাথের হাত বেঁধে চ্যাংদোলা করে নিয়ে গেল থানায়। থানার বারান্দায় কিছুক্ষণ ফেলে রাখা হল তাঁকে–যাতে শহরের সব লোক বুঝতে পারে কর্নেল নর্থব্রুকের সঙ্গে ধৃষ্টতার কী প্রতিফল পেতে হয়। দুপুরের দিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল প্রিয়নাথকে। কিন্তু হাসপাতালে নেওয়ার দরকার ছিল না। হাসপাতাল থেকে জানানো হল–অন্তত ঘণ্টা তিনেক আগেই প্রিয়নাথ মারা গেছে।

ঢাকার গুপ্ত বিপ্লবী সমিতি থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে নর্থব্রুককে হত্যা করা হবে। প্রিয়নাথের সমবয়সি তিনজন যুবক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, প্রিয়নাথের আত্মার তৃপ্তির জন্য যতদিন-না নর্থব্রুককে খুন করে প্রতিশোধ নেওয়া যায়–ততদিন তাঁরা বিছানার বদলে মাটিতে খড় বিছিয়ে শোবেন। কিন্তু নর্থব্রুককে কিছুই করা যায়নি। নর্থব্রুক আর বেশিদিন এদেশে থাকেননি। জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনার পর তখন দেশব্যাপী উত্তেজনার ফলে ব্রিটিশ সরকার কয়েকটা কমিশন বসিয়েছিলেন। কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, অতিরিক্ত নিষ্ঠুরতা প্রদর্শনের জন্য নর্থব্রুক সরকারের কাছ থেকে সামান্য ভর্ৎসনা পেয়েছিলেন। কিন্তু এতেই তার মানে আঘাত লাগে, তিনি চাকরি ছেড়ে বিলেতে চলে যান। বিপ্লবী সমিতি ঠিক করেছিল, তাদের একজন সদস্যকে বিলেতে পাঠানো হবে এবং সেখানেই নর্থব্রুককে খুন করা হবে। কিন্তু সেটাও সম্ভব হয়নি। একবছর বাদেই খবর আসে, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে শৃগাল শিকার করতে গিয়ে আকস্মিক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন নর্থব্রুক। তখন নর্থব্রুককে সাহায্য করেছিল থানার যে দারোগা–সেই হরিপদ সামন্তর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয় সন্ত্রাসবাদীরা। এরপর ঢাকা-চট্টগ্রাম জুড়ে আরও সব এমন ঘটনা ঘটতে থাকে যে প্রিয়নাথের কথা আর অনেকেরই মনে থাকে না। লেফটেন্যান্ট গভর্নরের ওপর আক্রমণ, চট্টগ্রামে অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের চেষ্টা–এর মধ্যে হারিয়ে গেলেন প্রিয়নাথ, তার একটা ছবিও কোথাও নেই।

দেবনাথকে দেখে কিছুই বোঝা যেত না। রোগা, ছোটোখাটো চেহারা, ফর্সা মুখে শুধু টিকোলো নাকটাই বেশি চোখে পড়ে। খুব শান্তস্বভাবের লোক ছিলেন, শুধু শান্ত নয়–বড়ো বেশি গম্ভীর মানুষ ছিলেন। পারতপক্ষে কোনো কথা বলতে চাইতেন না, লেখাপড়ায় খুব মেধাবী, সংস্কৃত ও অঙ্কে বরাবর ভালো নম্বর পেয়েছেন, কিন্তু এফ এ পাস করার পর আর পড়া হল না। জেলা স্কুলে মাস্টারি নিলেন। প্রিয়নাথকে হারাবার শোক সামলে উঠলেন মা বাবা কয়েক বছরের মধ্যে, তারপর দেবনাথকেই ওঁরা আঁকড়ে ধরলেন। ছোটো ছেলে অবনীন্দ্রনাথ তখন নেহাই বাচ্চা।

দেবনাথকে দেখে কেউ বুঝতেই পারেনি, তার বুকের মধ্যে সবসময় প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে। তাঁর জীবনের আর কোনো উদ্দেশ্য ছিল না, বেঁচে থাকার আর কোনো কারণ ছিল না, তাঁর জীবনটা তছনছ হয়ে গিয়েছিল ওই প্রতিশোধের সদা জাগ্রত বাসনায়। দেবনাথ শুধু সুযোগ খুঁজছিলেন।

সুযোগ এল অনেক বছর বাদে। ঢাকার ডি এম হয়ে এসেছিলেন মার্ক উডল্যাণ্ড। অ্যালিস তার বাবার চরিত্র জানে না। মার্ক উডল্যাণ্ড সংস্কৃত শোনায় আগ্রহী ছিলেন ঠিকই; তিনি নেটিভদের সঙ্গে মিশতে চাইতেন, হিন্দুদের মন্দিরে গিয়ে পুজো দেখতে ভালোবাসতেন। কিন্তু নেটিভদের স্বাধীনতা পাবার সামান্য চেষ্টা দেখলেই উগ্রমূর্তি হয়ে উঠতেন। তাঁর দৃঢ় ধারণা ছিল ব্রিটিশ শাসন ভারতীয়দের সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে রেখেছে, তাদের জীবনে আইন-শৃঙ্খলা এনে দিয়েছে, তাদের ধর্ম-সংস্কৃতির উন্নতি ঘটাচ্ছে। এ সত্ত্বেও যেসব ভারতীয় স্বাধীনতার জন্য চেষ্টা করে তারা নিতান্তই অকৃতজ্ঞ, তারা ভারতেরই শত্রু। স্বদেশিওয়ালাদের প্রতি তিনি ছিলেন নৃশংস, সামান্য ব্যাপারে কঠিন শাস্তি দিতেন, শুধু বন্দেমাতরম উচ্চারণ করার জন্য তিনি বহুলোককে পাঁচ-সাত বছরের জেল দিয়েছেন। অধ্যাপক সতীকান্ত ভট্টশালী যখন থানার সামনে সত্যাগ্রহ করতে গিয়েছিলেন বুটসুদ্ধপায়ে তাঁর মুখে লাথি মেরেছিলেন মার্ক উডল্যাণ্ড। উডল্যাণ্ড যখন কোনো উৎসবে কিংবা পূজাপ্রাঙ্গণে আসতেন–সবাই সন্ত্রস্ত হয়ে উঠত। উডল্যাণ্ড কারুর সঙ্গে হেসে কথা বলতে গেলে সে ভয়ে কাঁপত–কথায় কথায় উডল্যাণ্ড কী খুঁত ধরে ফেলবে কে জানে! এক বাড়িতে দুর্গাপূজার সময় অসুরের মূর্তিটা মিলিটারির মতন করা হয়েছিল–উডল্যাণ্ড সেটা দেখেই রেগে গেলেন, ব্রিটিশ সেনাবাহিনীকে বিদ্রূপ করা হয়েছে এই হিসেবে তিনি কর্কশ কন্ঠে বললেন, তোমাদের ধর্মাচরণে আমি হাত দিতে চাই না-না হলে, এই মূর্তি এখুনি আমি ভেঙে ফেলার হুকুম দিতাম। যাই হোক, পর্দা দিয়ে ওই মূর্তি ঢেকে রেখে পূজা করা হোক।

উডল্যাণ্ডের অত্যাচার যখন চরমে ওঠে, তখন অনুশীলন সমিতি তাকে খুন করার জন্য পরামর্শ আটতে থাকে। সেসময় এসব কাজের ভার নিতে অনেকেই রাজি ছিল–এমনই ছিল উন্মাদনা। কিন্তু দেবনাথের কথা কারুরই মনে আসেনি। গুপ্ত বিপ্লবীরা দেবনাথের কোনো খবরই রাখত না।

দেবনাথের বয়েস তখন তেত্রিশ। একমাত্র ছেলে তপন জন্মেছে চার-পাঁচ বছর আগে। প্রিয়নাথের ভাই বলে তাঁকে মনেই হয় না। ইস্কুলে মাস্টারি করেন আর বাড়িতে চুপচাপ বসে থাকেন–কোনো রাজনৈতিক দলে কিংবা সভাসমিতিতে তাঁকে কখনো দেখা যায়নি। প্রিয়নাথের মৃত্যুর পর অনেকদিন কেটে গেছে। এতকাল ধরে মনের মধ্যে ক্রোধ ও হিংসার দাহ পুষে রাখা কষ্টকর। দেবনাথ ভোলার চেষ্টা করেছিলেন, শাস্ত্রগ্রন্থ পড়ে মনে নিবৃত্তি আনার চেষ্টা করেছিলেন, বছর কয়েক আগে গান্ধীজির শিষ্যত্ব নিয়ে অহিংসাব্রতে বিশ্বাসী হতেও চেয়েছিলেন, কিন্তু কিছুতেই মন শান্ত হয়নি, বার বার মনে পড়েছে সেই দৃশ্য– দেয়ালে ঠেসে ধরা প্রিয়নাথকে চাবুক মারছে নর্থব্রুক–আর জ্বরতপ্ত, এক চোখ অন্ধ প্রিয়নাথ চিৎকার করছেন, মারবে? আরও মারো! আমি মরব না! আমি প্রতিশোধ নেব।

দেবনাথ নিজেই কৌশল করে–মার্ক উডল্যাণ্ডের সংস্কৃত শেখার বাতিকের কথা জেনে তাঁর কাছে মাস্টারি জোগাড় করেছিলেন, না আকস্মিকভাবেই মার্ক উডল্যাণ্ড দেবনাথকে মাস্টার রেখেছিলেন, তা জানা যায় না। তবে, বছর খানেক আগে আন্তঃজেলা সংস্কৃত কাব্য প্রতিযোগিতা যখন হয়, তখন দেবনাথ তাতে হঠাৎ অংশগ্রহণ করেছিলেন বলে অনেকেই অবাক হয়েছিল। দেবনাথ কোনোদিনই পুরস্কার কিংবা আত্মপ্রচারের লোভ করেননি। তা ছাড়া, কাব্যের বিষয়বস্তু ছিল, ব্রিটিশ সম্রাটের প্রশস্তি। ঢাকা জেলায় দেবনাথের রচনাই প্রথম পুরস্কার পেয়েছিল, সেই সূত্রে মার্ক উডল্যাণ্ডের সঙ্গে প্রথম পরিচয়।

অ্যালিস ঠিক জানে না, কিংবা ইচ্ছে করেই বীভৎসতা কমিয়ে নরম করে বলেছে। পিস্তল ছিল না, পিস্তল কোথায় পাবেন দেবনাথ, সে-আমলে একটা পিস্তল জোগাড় করা বড় সহজ কথা ছিল না। একটা ন-ইঞ্চি ছুরি দেবনাথ রোজ আচকানের মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে যেতেন। ফিতে বাঁধা আচকান এবং মুগার একখানি চাদর ছিল দেবনাথের প্রত্যেক দিনের পোশাক। কিন্তু সাড়ে চার মাস ধরে প্রত্যেকদিনই আঘাত হানার সংকল্প নিয়ে গিয়েও কিছু না করে ফিরে এসেছেন। মার্ক উডল্যাণ্ড তখন ঢাকা জেলায় সন্ত্রাসবাদীদের এক নম্বর শত্রু দলে দলে যুবকদের তিনি জেলে পুরে রাখছেন। কিন্তু দেবনাথ সারাজীবনে একটা পাখিও মারেননি, পাঁঠাবলির দৃশ্য দেখে একবার এমন কষ্ট পেয়েছিলেন যে, সারাজীবনে আর মাংসই খাননি। সেই দেবনাথ ছুরি সঙ্গে নিয়ে গেলেও ছুরি চালাবার ঠিক মুহূর্তটা কিছুতেই খুঁজে পেতেন না। মার্ক উডল্যাণ্ড অবশ্য তাঁর সঙ্গে ভালোই ব্যবহার করতেন সংস্কৃত শেখায় সত্যিই আগ্রহ ছিল, তবে ভাবখানা অনেকটা এইরকম ছিল, যেন সংস্কৃত শিখে তিনি ভারতবর্ষকে ধন্য করে দিচ্ছেন। কথায় কথায় বলতেন, নেটিভরা আমায় কিছুতেই ফাঁকি দিতে পারে না, আই নো অল অ্যাবাউট দেম।

জেলা হাই স্কুলের সামনে ট্রেজারির গাড়ি লুঠের চেষ্টা হয় সেই সময় একদিন। গাড়ির সঙ্গে দু-জন সঙ্গিনধারী প্রহরী ছিল, তাদের আক্রমণ করে মুখোশপরা একদল লোক। একজন প্রহরীর বন্দুকও কেড়ে নিয়েছিল তারা কিন্তু বোঝাই যায় তারা বন্দুক চালাতেও জানে না– শেষপর্যন্ত টাকা লুঠ করতে পারেনি। তবু পুলিশি অত্যাচারে একটা ত্রাসের রাজত্ব শুরু হয়ে যায়–সবসুদ্ধ এগারোজনকে গ্রেপ্তার করা হয়, তার মধ্যে তিন জন ছিল স্কুলের ছাত্র। আসল অপরাধীদের ধরার জন্য তাদের ওপর কতরকম অত্যাচার করা হচ্ছে–সমগ্র ঢাকা শহর সেই উত্তেজিত আলোচনায় সরগরম। সেদিনও দেবনাথ পড়াতে গিয়েছিলেন উডল্যাণ্ডকে। কুমারসম্ভব-এর শ্লোক ব্যাখ্যা করে শোনাচ্ছিলেন, পাইপ মুখে মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন উডল্যাণ্ড, হঠাৎ বই থেকে মুখ তুলে মৃদুস্বরে দেবনাথ বললেন–সাহেব, স্কুলের ছেলেদের ওপর যারা অত্যাচার করে, তাদের কি আত্মা আছে?

মুখের হাসিটুকু না সরিয়েই সাহেব বলেন, স্কুলের ছেলে বটে, দে আর ইয়ং ডেভিলস।

 কিন্তু সবাই জানে, ওরা নির্দোষ।

যদি নির্দোষ হয় খুব ভালো কথা। কিন্তু তাহলে, যারা আসল কালপ্রিট, তাদের নাম ওরা বলে দিচ্ছে না কেন? জান পন্ডিত, ব্রিটিশ শাসন তোমাদের কতখানি উপকার করছে–তা তোমার দেশের সব লোক যদি বুঝত-তাহলে আমরা আরও অনেক কিছু করতে পারতুম। ভেবে দেখো, আমরা আসার আগে তোমাদের কতখানি দুরবস্থা ছিল, আইন-শৃঙ্খলা ছিল না, শিক্ষাব্যবস্থা ছিল না।

কিন্তু ছাত্রদের বিনাবিচারে আটকে রেখে অত্যাচার করার মধ্যে আইন কিংবা শিক্ষাব্যবস্থার কোনো গৌরব নেই।

ওয়েল, পন্ডিত, লেটস গো ব্যাক টু কুমারসম্ভব–আমি তোমার সঙ্গে এ-বিষয়ে আলোচনা করতে চাই না। ছাত্রদের এখনো কোনো অত্যাচার করা হয়নি। কাল কয়েক ঘা চাবুক খেলেই সুড়সুড় করে সব বিগ ব্রাদারদের নাম বলে দেবে!

হয়তো চাবুক মারার কথাতেই দেবনাথ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েছিলেন। মনে পড়েছিল প্রিয়নাথের রক্তাক্ত মুখ। উঠে দাঁড়িয়ে দেবনাথ গর্জন করে বলেছিলেন, না, চাবুক মারবে না, কিছুতেই মারবে না—।

মার্ক উডল্যাণ্ড একটুও বিচলিত না হয়ে এক ধমক লাগিয়ে দিলেন, শাট আপ। ব্লাডি ফুল, ডোন্ট রিস্ক ইওর নেক।

দেবনাথ এক ঝটকায় চাদর খুলে ফেলে ছুরি হাতে রুদ্র মূর্তিতে দাঁড়িয়েছিলেন সোজা হয়ে।

ঘরে আর একজন উপস্থিত ছিল, মার্ক উডল্যাণ্ডের জহুরি ব্রজ হালদার। বুড়ো ব্রজ হালদারই পরে সবাইকে ঘটনাটা বর্ণনা করেছিল। ব্রজ হালদার বলতে বলতে শিউরে উঠত, উঃ না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না সে দৃশ্য! অমন ঠাণ্ডা ছেলে দেবনাথ, মুখ তুলে কথাটা বলতে জানত না, হঠাৎ সে কী চেহারা তার। চোখ দুটো যেন আগুনের ভাটা, হাতে লকলক করছে ছুরি। যেন প্রিয়নাথের আত্মা এসে ভর করেছিল তার ওপর। সেই ছুরি দেখে সাহেব যত না ভয় পেয়েছিল, তার চেয়েও বেশি ভয় পেয়েছিল দেবনাথের সেই চেহারা দেখে। দেবনাথ চেঁচিয়ে শুধু বলেছিল, না–পারবে না, না, না, না—।

মার্ক উডল্যাণ্ড হাত তুলে বাধা দেবার আগেই দেবনাথ ছুটে এসে তাঁর পিঠে ছুরি ঢুকিয়ে দিলেন। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এসে লেগেছিল তার গায়ে, সেই অবস্থাতেও উডল্যাণ্ড সাঁড়াশির মতন দু-হাতে গলা টিপে ধরেছিলেন দেবনাথের। দেবনাথ ছুরিটা টেনে বার করে আবার চালাতে লাগলেন এলোপাথাড়ি ভাবে, কতবার ছুরি মেরেছিলেন তার ঠিক নেই উডল্যাণ্ডের পেট বুক ফালাফালা করে ফেলেছিলেন–তখনও তাঁর গলায় উডল্যাণ্ডের দু হাত চেপে ধরা। সেই ভয়ংকর দৃশ্য দেখে ব্রজ হালদার ভয়ে পালিয়ে যায়। সেই বীভৎস নারকীয় দৃশ্য অ্যালিস দেখেছে কি না কে জানে, শুনেছে নিশ্চয়ই, কিন্তু অ্যালিস নরমভাবে কমিয়ে বলেছে। মৃত মার্ক উডল্যাণ্ডের দু-হাত গলা টিপে ধরেছিল দেবনাথের, সেইজন্য দেবনাথ পালাতে পারেননি। কিছুতেই গলা থেকে সেই কঠিন মুঠি ছাড়াতে পারেননি–সেই অবস্থায় সাহেবের আর্দালিরা পিছন থেকে বাঁশ দিয়ে পেটায় দেবনাথকে-শেষ মুহূর্তে দেবনাথ নিজের গলায় ছুরি চালিয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। সম্পূর্ণ সফল হননি, তারপরেও তিন দিন অজ্ঞান অবস্থায় বেঁচে ছিলেন হাসপাতালে। তিন দিন তিন রাত্রি ঢাকা শহরের অর্ধেক লোক জেগে অপেক্ষা করেছিল হাসপাতালের বাইরে-দেবনাথের খবর জানার জন্য। দেবনাথের আর জ্ঞানে ফেরেনি।

অ্যালিস নিজের ছেলেবেলার দুঃখের কথা বলছিল। কিন্তু ইংল্যাণ্ডে বসে সে কত আর দুঃখ পেয়েছে; যদি জানত তপনের ছেলেবেলার কথা! দেবনাথের ঘটনা শোনামাত্রই তাঁর বাবা-মা আর শোক করারও সময় পাননি, তক্ষুনি সপরিবারে ঢাকা শহর ছেড়ে পালিয়েছিলেন। দুই ছেলে গেছে, আর একটি মাত্র ছেলে বেঁচে-সে তখন মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র–পুলিশ তাকে ছাড়বে না। কোথাও আশ্রয় পাননি তখন, মাসের পর মাস–

সমস্ত মুখখানা কুঁকড়ে গিয়েছিল তপনের। চোখ দুটো জ্বালা করছে। তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে উঠে সিঙ্কের কাছে গিয়ে কল খুলে চোখ-মুখ ধুল। ঢকঢক করে জল খেল পুরো এক গ্লাস। একটা সিগারেট ধরাল, টানতে ভালো লাগল না, ফেলে দিল। কিন্তু কেন এইসব। দুঃখের কথা তার আবার মনে পড়ল; এই উনিশ-শো পঁয়ষট্টি সালে, লণ্ডনের এই শীতের রাতে। তপন তো সব ভুলে গিয়েছিল! সে তো আর এইসব দুঃস্বপ্ন জাগিয়ে তুলতে চায়নি।

ঢাকা থেকে পালিয়ে ওরা গিয়েছিল মৈমনসিং-এ, মুক্তাগাছার জমিদার বাড়িতে কাজ করতেন ঠাকুরদার বৈমাত্রেয় ভাই। ওরা তাঁর বাড়িতে আশ্রয় চেয়েছিল। কিন্তু তিনি ভরসা পাননি–এ-রকম একটা পরিবারকে বাড়িতে রেখে তিনি পুলিশের বিষ নজরে পড়তে চাননি–ঠাকুরদা, ঠাকুরমা, মা, কাকা আর তপন–তখন তপন নেহাৎই শিশু-তবু যেন তার সব কথা মনে আছে, মাসের পর মাস তারা হন্যে হয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় আত্মীয়স্বজনের কাছে আশ্রয় ভিক্ষে করেছে, কোথাও জায়গা পায়নি–সামান্য যা টাকাকড়ি ঠাকুরদা সঙ্গে আনতে পেরেছিলেন–তা দু-এক মাসেই ফুরিয়ে যায়–বরিশাল শহরে এক মন্দিরের চত্বরে দু-তিন দিন থাকতে হয়েছিল ভিখারি পরিবারের মতন–ঠাকুমার তখন ঘন ঘন ফিট হত। শেষপর্যন্ত ওরা এসে ঠেকল কলকাতায়। ঠাকুমার এক ভাই খুব বড়োলোক ছিলেন–তিনি দয়া করে থাকতে দিলেন বাড়ির এক কোণে। ঠাকুরদার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছিল, ঠাকুমার ফিটের অসুখ–একমাত্র মা-ই খুব শক্ত ছিলেন–তিনিই ওদের সবাইকে সামলে রাখলেন কোনোরকমে–সেই বাড়িতে মা ঝি-গিরি করেছেন বছরের পর বছর তপন এখনও স্পষ্ট দেখতে পায়–ভবানীপুরে সেই চকমেলানো বাড়ির উঠোনের এক কোণে বসে মা ডাঁই-করা বাসন মাজছেন–তাঁর ফর্সা সুন্দর মুখখানা শুকিয়ে ছোট্ট হয়ে গেছে আর বারান্দায় ঠাণ্ডা মেঝের ওপর বই-শ্লেট নিয়ে পড়তে বসে তপন অনবরত ঘ্যানঘ্যান করে কেঁদে মাকে জ্বালাতন করছে। মা-র বয়েস তখন চব্বিশ-পঁচিশ বছর–কিন্তু অল্প বয়েসেই বুড়ি হয়ে গিয়েছিল মা-ঠাকুমা আর মাকে দেখাতে দুই বোনের মতন। তপনের কাকা অবনীনাথ তখন একুশ বছরের যুবক-ডাক্তারি পড়তে পড়তে ছেড়ে আসতে হয়– কলকাতায় আবার মেডিক্যাল কলেজে ভরতি হবার কোনো সামর্থ্য ছিল না। তিনি চুপিচুপি শিয়ালদহ স্টেশনে গিয়ে কুলিগিরি করে পয়সা রোজগার করতেন। তাঁর দুই দাদার পরিণাম দেখে অবনীনাথ আর ওই মারাত্মক পথে পা বাড়াননি–তিনি শুধু চাইতেন– কোনোক্রমে উপার্জনের পথ খুঁজে পরিবারের সকলকে বাঁচাতে। শিয়ালদা স্টেশনে তাঁকে ওই অবস্থায় দেখে ফেলে একদিন ঠাকুরদা বাড়ি ফিরে কী কান্না কেঁদেছিলেন!

না, তপন আর ওসব ভাবতে চায় না! কিছুতেই ভাববে না। তার সঙ্গে তো সব সম্পর্ক চুকেই গেছে। সে আর দেশে ফিরবে না-আবার তো যাচ্ছে নিছক বেড়াতে–তার বাবা নেই, মা নেই, দেশ নেই, সুতরাং অতীতেরও কোনো মূল্য নেই আর! সে এখন নিঃসঙ্গ– তার কাছে মানুষের কোনো জাত নেই–সব মানুষই তার কাছে সমান–তবু লণ্ডনের একটি সাধারণ মেয়ের ঘরে কেন চোখে পড়ল ওই ছবি–-কেন তাকে জিজ্ঞেস করতে হল, ওই ছবি কার!

আঃ, অসহ্য লাগছে তপনের। ঘুমের ওষুধ খেয়েও একছিটে ঘুমের দেখা নেই। বেড সাইড টেবলটার ড্রয়ার খুলে তপন আবার একটা হুইস্কির বোতল বার করল।

.

০৪.

পরদিন বিকেল বেলা অ্যালিসের সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল, কিন্তু তপন গেল না। সেদিন সারাদিন হোটেল থেকে বেরোলই না। সকাল নটা আন্দাজ ঘুম ভেঙেছিল–কিন্তু বিছানা থেকে ওঠেনি, মুখ ধোয়নি, দাড়ি কামায়নি–রুম সারভিসের টেলিফোন তুলে বেকন-টোস্ট মার্মালেড পোচ আর এপ্ৰিকটের রস আনিয়ে নিয়েছিল। বিছানায় শুয়ে শুয়েই সেগুলো খেল –মাথা এত ভারী যে উঠতে ইচ্ছে করছে না। তপন আবার ঘুমিয়ে পড়ল। এমন গভীর লম্বা ঘুম হল তখন যে দুপুরে লাঞ্চ খাওয়াই হল না।

দুপুর পেরিয়ে বিকেলের কাছাকাছি এসেও ঠিকমতন ঘুম ভাঙল না–এক-একবার চোখ মেলে আচ্ছন্ন অবস্থায় একটু তাকিয়ে থেকে আবার ঘুমিয়ে পড়তেই ভালো লাগছিল। নেশার মতন ঘুম-এ নেশা ভাঙতে ইচ্ছে করে না–এ নেশায় কোনো বিপদের ঝুঁকি নেই–অন্য কোনো নেশায় তপন এত তৃপ্তি পায়নি কখনো।

প্রায় সন্ধ্যের কাছাকাছি বিছানা ছেড়ে উঠল তপন। মুখ থেকে অ্যালকোহলের বিশ্রী স্বাদটা কেটে গেছে–পেটের ঠিক মাঝখানে খিদের জ্বালা থাকায় শরীরটা বেশ দুরস্ত লাগছে। মাথার ওপর দু-হাত তুলে তপন দু-চার বার লঘু ব্যায়াম করে নিল। গতকাল রাত্রের সব ঘটনাই যেন সে ভুলে গেছে এমনকী অ্যালিসের কথাও তার মনে পড়ছে না। তপন হঠাৎ ঠিক করে ফেলল আজ সে খুব সাজগোজ করবে। দুটো কল খুলে ঠাণ্ডা আর গরম জল মিশিয়ে বাথটবটা ভরতি করতে লাগল কুসুম-কুসুম জলে। ততক্ষণে দাঁত মেজে নিল ভালো করে। নতুন ব্লেডে দাড়ি কামাল।–আমেরিকায় তার শেষ বান্ধবীর নাম ছিল আইরিন–বিদায়ের দিন সে তপনকে একটা আফটার-শেভ লোশন উপহার দিয়ে বলেছিল–এটা যখন তুমি গালে মাখবে–তখন আমার কথা নিশ্চয়ই মনে পড়বে তোমার। সেটা আজই প্রথম খুলল তপন গন্ধটা এত সুন্দর–যেন হালকা কুয়াশার মতন সারাঘরে ছড়িয়ে পড়ল গন্ধটা তপনের মনটা তাতে খুশি হয়ে গেল। ভাবল, আইরিন মেয়েটা সত্যিই খুব ভালো ছিল– ওকে বিয়ের প্রস্তাবটা করে ফেললেই হত চোখ-কান বুজে। বাথটবে অনেকক্ষণ গা ডুবিয়ে বসে থেকে সাবানের ফেনা নিয়ে খেলা করতে লাগল ছেলেমানুষের মতন।

শুকনো তোয়ালে দিয়ে গা মুছে তপন বেশ সময় নিয়ে চুলে ক্রিম মেখে পরিপাটি করে আঁচড়াল। সুটকেশ খুলে তার সবচেয়ে দামি ধপধপে সাদা সার্টটা বার করল, নিখুঁত ভাঁজের ট্রাউজার্স ও জ্যাকেট, এমনকী মুক্তো বসানো বোতাম ও টাইপিন নিল, মোজা ও টাইয়ের রং মেলাবার জন্য অনেকক্ষণ বাছাবাছি করল। জুতো পালিশ করার জন্য কাল রাত্রে দরজার বাইরে জুতো রাখতে ভুলে গিয়েছিল কিন্তু তপনের কাছে আমেরিকা থেকে আনা ইনস্ট্যান্টপালিশ ছিল–সেই কাগজ জুতোয় ঘসে নিতেই জুতো ঝকঝকে হয়ে গেল।

পুরো পোশাক পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছে তপন। টাইয়ের গিট সঠিকভাবে মাঝখানে পয়েছে–চুল নিপাট, পোশাকে কোনো খুঁত নেই, শরীরে একটুও জড়তা নেই। নিজের দিকে তাকিয়ে তপন একটু হাসল। সাজগোজের আরও বাকি আছে। আবার সুটকেশ খুলে প্যারিসের বিখ্যাত বসন্ত নামের দোকানের আরও বিখ্যাত কালো বিড়াল নামে সেন্টের শিশিটা বার করে জামার কলারে আর রুমালে ঢেলে নিল একটু। রুমালটার ত্রিকোণ ভাঁজ গুঁজল বুক পকেটে। আজ রেনকোট নিলে বড়ো জবড়জং দেখাবে। না, আজ রেনকোট থাক–তার বদলে খুব সরু করে পাকানো স্মার্ট চেহারার স্টিলের ছাতাটা নিয়ে ঘোরাতে ঘোরাতে খাঁটি ফুলবাবুর মতন লঘুচিত্তে হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়ল তপন। এমনকী সে আলতোভাবে শিষ দিচ্ছে পর্যন্ত।

পিকাডেলি সার্কাসে এরসের মূর্তির কাছে অ্যালিসের দাঁড়িয়ে থাকার কথা ছিল। সেসময় অনেকক্ষণ পেরিয়ে গেছে, তবু তপন সেদিকে গেল না, উলটো দিকে, অক্সফোর্ড সার্কাস ধরে হাঁটতে হাঁটতে অবিলম্বে পৌঁছে গেল হাইড পার্ক কর্নারে। সেখানে খুব বক্তৃতার তোড় ছুটেছে। খিদেয় চন চন করছে তপনের পেট, তবু তক্ষুণি তার খেতে ইচ্ছে করল না। ইচ্ছে করেই খিদেটা জিইয়ে রাখছিল, খিদের সময় শরীরটা খুব হালকা লাগে। বক্তৃতা শুনলেই তপনের খিদে আরও বেড়ে যায়–তাই তপন একটু সেখানে দাঁড়াল ভিড়ের মধ্যে।

তিন জন বক্তাকে কেন্দ্র করে তিনটে গোল ভিড়। তপন প্রত্যেকটাই একটু একটু করে শুনল–এক জন ধর্ম নিয়ে খুব মাতামাতি করছে–বেঁটে, খুব গোল চেহারার টাক মাথার বক্তাটি বোঝাতে চাইছে পৃথিবীতে রবিবারের বদলে শনিবারই পূর্ণ ছুটির দিন হওয়া উচিত–কারণ শনিবার আসল সাবাথ ডে। যিশু সেইদিনেই। তপনের মনে হল লোকটি বদ্ধ পাগল। আর এক জায়গায় একটি আফ্রিকান ছেলে চোস্ত ইংরেজিতে ব্রিটিশ জাতটার বাপ-মা তুলে গালাগাল দিচ্ছে। তপন সে-বিষয়েও কোনো উৎসাহ বোধ করল না। অতই যদি তোর স্বদেশপ্রেম আর ব্রিটিশদের ওপর রাগ–তাহলে এদেশে পড়ে আছিস কেন? যা না দেশে ফিরে? তপনের কোনো দেশ নেই–সে ও বিষয়ে মাথা ঘামাতেও চায় না। তৃতীয় বক্তা কী বলছে সেটা বোঝার আগেই তপন বাধা পেল।

একটু দূরেই দুটি বাঙালি ছেলে অনেকক্ষণ ধরে তপনকে লক্ষ করছিল। ওদের মুখ আর কাঁধের আড়ষ্ট ভঙ্গি দেখলেই বোঝা যায় যে ওরা এদেশে নতুন এসেছে। এখনও চালু হয়ে ওঠেনি। ওরা তপনের দিকে চোখাচোখি করছিল, তপন চোখ সরিয়ে নিচ্ছিল বারবার। এইসব ছেলেদের তপন খুব ভালোভাবেই চেনে। তার একটুও ভালো লাগে না এদের সঙ্গে মিশতে। বাঁধাধরা এদের কথাবার্তা। প্রথমেই জিজ্ঞেস করবে, আপনি কি বাঙালি? যেন বাঙালি হলেই হাতে স্বর্গ পাবে। তারপরই জিজ্ঞেস করবে পরপর প্রশ্ন–কবে এসেছেন? পড়ছেন না চাকরি? তাদের অফিসে কালার কমপ্লেক্স আছে কি না! ভারতীয় বলে বাড়িভাড়া পেতে অসুবিধে হয়েছে কি না। কত ভাড়া তাও জেনে নেবে। কতদিন ইলিশ মাছ কিংবা ভাত খাইনি বলে হা-হুঁতাশ করবে–অথচ প্রায়ই পাকিস্তানি হোটেলগুলোতে মাছ-ভাত খেতে যায়। আর দাদা, বাংলা কথা বলতে না পারলে দম আটকে আসে–আপনার কাছে রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ড আছে? দৈনিক পত্রিকা রাখেন? বাংলা বই-টই কিছু আসে?

তপনের এসব একটুও ভালো লাগে না। বাঙালি কী রাজস্থানি কী মিশরি কী ইংরেজ এতে তার কিছু আসে-যায় না- সে শুধু জানতে চায়–মানুষটার সঙ্গে কথা বলে সে আনন্দ পাযে কি না। শুধু বাঙালি বলেই কিংবা নিছক বাংলায় কথা বলার জন্যই সে বিদেশে এসে একজন মূর্খ কিংবা বদরসিকদের সঙ্গে কথা বলে সময় নষ্ট করতে চায় না। তা ছাড়া, তপন ভাবে, সে বাঙালি কিনা তাতে কী আসে-যায়–সে বাংলাদেশ ছেড়েছে জন্মের মতন, তার সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক নেই, কোনো বন্ধন নেই, সারাজীবন সে থাকবে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে। এখন আর, সে কোথায় জন্মেছে কিংবা কোথা থেকে এসেছিল এগুলো অবান্তর–বাংলাদেশ বা আফ্রিকা-কোনো তফাত নেই। এখন সে ইচ্ছে মতন বন্ধু বেছে নেবে। বাঙালি খোঁজার তার কোনো দরকার নেই। কিন্তু তার চেহারাটা বদলানো যাবে না কিছুতেই–যেখানে-সেখানে ওই প্রশ্ন শুনতে হবে, আপনি কি বাঙালি? আর কোথায় নেই, এই রক্তবীজের ঝাড় বাঙালিগুলো?–সব জায়গায় ছড়িয়ে আছে। মেক্সিকোয় একটা ছোট্ট শহরেও তপন দেখেছিল–এক বাঙালি ডাক্তার বাসাবেঁধে আছে-সতেরো বছর ধরে আছে –মেক্সিকান মেয়ে বিয়ে করে ঘরভরতি ছেলেপুলে নিয়ে পুরোপুরি ল্যাটিন বনে গেছে–তবু তপনকে দেখে তার বাংলাদেশের জন্য শোক উথলে উঠেছিল, সেই এক প্রশ্ন, আপনি কি বাঙালি? কতদিন বাংলায় কথা বলিনি। সেই একই ইলিশ মাছ আর রবীন্দ্রসংগীতের জন্য হা-হুঁতাশ। ওদের কিছুতেই এড়াতে পারবে না তপন, যদি-না নিজের চেহারাটা বদলাতে পারে। এই লণ্ডনেও তাকে পদে পদে ওদের সামনে পড়তে হবে, এমনকী নিজে থেকেই দেখা করতে হবে কয়েকজনের সঙ্গে–কাকা লিখেছেন, তাঁর এক বন্ধুর ছেলে এখানে এসে নাকি বকে গেছে-বাড়িতে কোনো চিঠিপত্র লেখে না–তার খোঁজ নিতে হবে তপনকে। আর দিবাকর, ওর সঙ্গে সায়েন্স কলেজে পড়েছে, রিসার্চ করেছে অনেক বছর একসঙ্গে তার সঙ্গেও দেখা না করে পারা যাবে না।

ছেলে দু-টি তপনের কাছে এগিয়ে এসে প্রথমে ইংরেজিতেই জিজ্ঞেস করল, মাপ করবেন আপনি কি বাঙালি? ঠিক মনে হচ্ছে–

তপন মুহূর্তে মনস্থির করে ফেলল। প্রশ্ন শোনার পরও এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল যেন সে ওদের কথা কিছুই বুঝতে পারেনি। ছেলে দু-টি ওই কথা আবার ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করতেই তপন ইচ্ছে করেই জিভটা খানিকটা মোটা করে বলল, আর য়ু আস্কিং মিঃ নো। আমি আসছি সিংহল থেকে। আমি একজন সিংহলী।

ছেলেটি থতোমতো খেয়ে বলল, মাপ করবেন। মাপ করবেন। আপনাকে দেখে আমাদের ভুল হয়েছিল–আপনাকে ঠিক বাঙালির মতন দেখতে।

তপন বিনীত ও চওড়া হাস্যে বলল, বাঙালি হতে পারলে নিশ্চয়ই আমি খুশি হতুম। কিন্তু আমি বাংলাদেশ কোনোদিন চোখেই দেখিনি। শুনেছি খুব সুন্দর আপনাদের দেশ। আপনারা কি ক্যালকাটা থেকে আসছেন?

ছেলেটির কিন্তু আর কথা বলার কোনো উৎসাহ নেই। বাঙালি না হলে আর কথা বলে সময় নষ্ট করবে কেন? ওরা দু-একটা হুঁ-হাঁ করে সরে পড়ল।

তপন আর সেখানে দাঁড়াল না। একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোহো স্কোয়ারের একটা স্প্যানিশ হোটেলে এসে পেট ভরে ডিনার খেল। স্প্যানিশদের ঝাল ঝাল রান্না খেতে ওর ভালো লাগে। দামের জন্য পরোয়া না করে তপন ওয়াইন দিয়ে সিদ্ধ করা শামুকেরও অর্ডার দিয়ে দিল। হোটেলটা বেশ বড়ো। একা একা খেতে এলে তপন বেশ বড়ো হোটেল কিংবা কন্টিনেন্টাল হোটেল ছাড়া অন্য কোথাও যায় না। ছোটোখাটো ব্রিটিশ রেস্তোরাঁয় গেলে অপমানিত হবার সম্ভাবনা থাকে। ঠিক হয়তো ঢুকতে বাধা দেবে না–কিন্তু ওয়েটাররা অবহেলা করবে, ডাকলেও শুনবে না, আশেপাশের লোকগুলো সরু চোখে তাকাবে। তপনের তখন ভয়ংকর রাগ হয় অথচ কিছুই করার থাকে না।

খেতে খেতে একটা কথা ভাবছিল তপন। আজ থেকে দশ বছর বাদে, যখন সে পুরোপুরি আমেরিকান নাগরিক হয়ে যাবে বাইরে কোথাও বেড়াতে গেলে তার কাছে থাকবে আমেরিকান পাসপোর্ট–তখন এই লণ্ডনে সে বেড়াতে এলে তাকে কেউ আমেরিকান বলে মানবে? ওই লালমুখো লম্বাচওড়া দৈত্যগুলোকে ডলারের জন্য সবাই খাতির করে–তার পকেটেও ডলারের গোছা থাকলে কি তাকেও সমান খাতির করবে? ক্যালিফোর্নিয়ায় তার একজন অধ্যাপক, ইয়োতো নিশিমা–জাপান ছেড়ে এসেছেন একত্রিশ বছর আগে পুরোপুরি আমেরিকার নাগরিক-ওখানে তাঁর নিজস্ব বাড়ি আছে–তবু কেউ তাঁকে আমেরিকান বলে না–সবাই জাপানি বলে। দক্ষিণ কোরিয়ায় একবার তিনি বক্তৃতা দিতে গিয়েছিলেন–সেখানে ছাত্ররা তাঁর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখায়–তিনি আমেরিকান বলে নয়, জাপানি বলে। দক্ষিণ কোরিয়া এখন আমেরিকার তাঁবেদার হয়েছে, কিন্তু জাপানের ওপর রাগ ভুলতে পারেনি। তপন বুঝতে পারল, তারও সারাটা জীবন ছন্নছাড়া হয়েই কাটবে পুরোনো পরিচয় হারাবে কিন্তু নতুন পরিচয়ের প্রতিষ্ঠা পাবে না, স্বদেশ ছাড়বে কিন্তু আর অন্য কোনো দেশই স্বদেশ হবে না। তা হোক, সে ওসব গ্রাহ্য করে না–স্বদেশপ্রেম কিংবা স্বাজাত্যবোধ-ওসব নিছক ভাবালুতা।

হোটেলের খাবারগুলো প্রত্যেকটাই সুস্বাদু, তবু তপনের ঠিক তৃপ্তি হল না। এইরকম কোনো বিশাল শহরের হোটেলে একা বসে ডিনার খেতে কীরকম যেন অস্বস্তি লাগে। মনে হয় যেন, আশেপাশের সব টেবিল থেকেই তাকে লক্ষ করা হচ্ছে। সবাই মনে মনে বলছে, আহা, লোকটা একা। অন্য কোনো টেবিলে কেউ একা বসে নেই।

দাম মিটিয়ে বেরিয়ে আসার পরই দেখল আবার বৃষ্টি নেমেছে। সঙ্গে সঙ্গে তপনের আবার মেজাজ খারাপ হতে শুরু করল। সরু করে পাকানো ছাতাটাকে ছড়ির মতন নিয়ে হাঁটতে ভালো লাগে, কিন্তু খুললেই বিশ্রী, তার ওপর ভেজা ছাতা একটা বিরক্তিকর ব্যাপার, যখন তখন ঝিরঝিরে বৃষ্টি লেগেই আছে। লণ্ডন আর একটুও ভালো লাগছে না। টেডের কথা শুনে কেন যে সে লণ্ডনে আসতে গেল। প্যারিস থেকে সোজা জেনিভায় চলে গেলেই হত। এই নাকি সুইংগিং লণ্ডন! পাঁচ বছর আগে দেখা লণ্ডনকে এখন তার আরও নোংরা আর জঘন্য লাগছে। প্যাঁচপেঁচে রাস্তা, লোকগুলোর মুখ আরও গোমড়া হয়েছে, মেয়েগুলো আরও বেহায়া, সবসময় ছাই রঙের আকাশ, লাল ইটের একঘেয়ে বাড়িগুলোর ওপর ময়লা ছায়া। আগে এরা গর্ব করে বলত, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে কখনো সূর্য অস্ত যায় না। এখন তপনের মনে হচ্ছে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে কোথাও সূর্য ওঠেই না। দৈবাৎ লণ্ডনের আকাশে রোদ উঠলে এরা হাভাতের মতো তাই নিয়ে আহ্লাদ করে। রাস্তায় কালো সুট পরা মানুষের শোভাযাত্রা—সবসময় ব্যস্ত, মুখ দেখলে মনে হয়–ওরা এইমাত্র কোনো শোকসভা থেকে ফিরল। মাঝে মাঝে এক-একটা মানুষের মুখ ভরতি অহংকার। ওসব মুখ দেখলে হঠাৎ তপনের মাথায় খুন চড়ে যায়। ফোতো কাপ্তেন সব, তবু অত অহংকার কীসের?

একটাই ভালো জিনিস লণ্ডনের, ঘন ঘন ট্যাক্সি পাওয়া যায়। ট্যাক্সি ডেকে তপন তার ট্রাভেল এজেন্টের অফিসের দিকে চলল, যদি টিকিট পাওয়া যায়-কাল-পরশুই সে রোম কিংবা মিউনিখে চলে যাবে। আর একদিনও এখানে থাকার ইচ্ছে নেই তার।

ট্রাভেল এজেন্সি তখন বন্ধ হয়ে গেছে। তারপর সারা সন্ধ্যে ও অনেক রাত পর্যন্ত তপন একা একা ঘুরল। টেড থাকলে তার সঙ্গে আড্ডা মারা যেত, কিন্তু টেড এখন লণ্ডনে নেই, তপনের কিছুই করার নেই। রাস্তায় এত মানুষ–তবু এর মধ্যে তপনের নিঃসঙ্গতাবোধ আরও বেড়ে যায়। এক পাব থেকে আরেক পাব বদলেও তার মন ভালো হল না। এমনকী স্ট্রিপটিজ নাচ দেখে সময় কাটাতে গিয়েও একটু বাদে বিরক্ত হয়ে উঠে এল।

হোটেলে ফিরল অনেক রাত্রে। অ্যালিস বহুক্ষণ অপেক্ষা করেছিল তার জন্য। চলে গেছে একটু আগে প্রচুর বিস্ময়সূচক চিহ্ন দিয়ে চিঠি লিখে রেখে গেছে–কী ব্যাপার তপন? আমি পিকাডেলিতে আধঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিলুম, তুমি এলে না। আমি ভাবলুম, তোমার শরীর খারাপ, তাই হোটেলে এলুম, তুমি নেই। কোনো মেসেজ রেখেও যাওনি। এত রাত্রেও ফিরলে না। কী? হঠাৎ কোনো জরুরি কাজ? আমি বাড়িতে থাকব–ফেরা মাত্র ফোন কোরো। আমিও চেষ্টা করব তোমাকে টেলিফোন করতে। তোমার সঙ্গে দেখা না হলে, একদম ভালো লাগছে না। ইতি অ্যালিস। পুনশ্চ: অনেকগুলো চুমু ও ভালোবাসা। আবার অ্যালিস!

অ্যালিসের চিঠিটা তপন বার দুয়েক পড়ল। তপনের সঙ্গে অ্যালিসের বেশি ঘনিষ্ঠতা অ্যালিসের প্রতিবেশী এবং বন্ধুবান্ধবরা ভালো চোখে দেখেনি। যেসব ব্রিটিশ মেয়ে একবার কোনো ভারতীয় বা আফ্রিকান ছেলের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করে–তারা মার্কামারা হয়ে যায়, আর কোনো ব্রিটিশ ছেলে সেইসব মেয়েকে পাত্তা দেয় না। যেসব ব্রিটিশ মেয়ে শ্বেতাঙ্গ প্রেমিক পায়তারা কখনো কোনো আফ্রিকার কালো ছেলেদের দিকে ফিরেও তাকায় না। অ্যালিসের একবার ডিভোর্স হয়ে গেলেও এখনও সে যথেষ্ট সুন্দরী–মোটামুটি ভালোই চাকরি করে এবং একা নিজস্ব অ্যাপার্টমেন্টে থাকে–সুতরাং তার প্রতি তার নিজের জাতের ছেলেদের আকর্ষণ থাকাই স্বাভাবিক।

অ্যালিসদের লাইব্রেরির একজন ছোকরা অ্যাকাউন্ট্যান্ট কয়েকদিন অ্যালিসের সঙ্গে ডেট করেছিল–অ্যালিস নিজেই বলেছে যে আগে প্রতি শনিবার সে সেই ছেলেটির সঙ্গে বাইরে সিনেমা দেখেছে ও ডিনার খেয়েছে। কেনসিংটনে একদিন অ্যালিস ও তপন পাশাপাশি যাচ্ছিল–সেসময় সেই ছেলেটি মুখোমুখি পড়ে। ছেলেটি ভাবতেই পারেনি যে তপন অ্যালিসের সঙ্গে আছে–তপনকে সে ভেবেছিল অন্য একজন–সে উদ্ভাসিত মুখে ডেকেছিল, অ্যালিস। অ্যালিস কিন্তু তেমন কোনো উত্তেজনা দেখায়নি। নিস্পৃহ গলায় বলেছিল, হ্যালো ডনাল্ড। আলাপ করিয়ে দিচ্ছি–মিট মাই ফ্রেণ্ড টপন রায়চৌদ্রি–হি ইজ আ সায়েন্টিষ্ট, আর এ হচ্ছে আমার অফিসের কলিগ মি. ডনাল্ড স্মার্ট। ডনাল্ড তপনের সঙ্গে হ্যাণ্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়েছিল ঠিকই, কিন্তু মুখখানা তার নিভে গিয়েছিল খানিকটা বিমূঢ় অবস্থা তার–অ্যালিসের সঙ্গে তপনের বন্ধুত্ব যেন সে বিশ্বাসই করতে পারছিল না। সে অ্যালিসের সঙ্গে নীচু গলায় দ্রুতবেগে কিছু কথা বলতে লাগল–তপন সব কথা বুঝতে পারেনি–কিন্তু এটুকু বুঝেছিল যে ছেলেটি তার সম্পর্কেই প্রশ্ন করছে। মাঝে মাঝেই ভুরু কুঁচকে যাচ্ছে ছেলেটির। ছেলেটির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কিছুদূর আসার পর তপনই কৌতুকভরে অ্যালিসকে বলেছিল, ইস, মি. স্মার্ট খুব হতাশ হয়ে পড়েছেন মনে হচ্ছে। তুমি ওকে বাদ দিয়ে একজন কালার্ড ইণ্ডিয়ানের সঙ্গে ঘুরছ।

অ্যালিস বলেছিল, যাঃ, ও কথা বোলো না! ডনাল্ডকে আমার ভালো লাগে না। ওর সঙ্গে আমার কোনো মিল নেই, ওর সঙ্গে আমি কথা বলার বিষয় খুঁজে পাই না! কোথায় কোন জিনিসটা সস্তা–ডনাল্ড এসব খুব খোঁজ রাখে। কীরকম ভাবে ইনসিওরেন্স করলে বেশি লাভ হয়, কী করে ইনস্টলমেন্টে বাড়ি কেনা যায়–ও এসব নিয়েই কথা বলতে ভালো পারে, আমার দিনরাত ওসব ভালো লাগে না। তার চেয়ে তোমার কালারফুল কথাবার্তা শুনতে আমার দারুণ ভালো লাগে।

আমি আর কী কথা বলি? আমি তো শুধু বকবক করি।

তা হোক। তোমার মধ্যে একটা রহস্য আছে, অনেক ছেলেদের মধ্যেই এটা থাকে না। মেয়েরা এটাই খুব ভালোবাসে।

সত্যি! মাইরি বলছ?

অ্যালিস হকচকিয়ে বলেছিল, ওটা আবার কী? ওটা কী শব্দ?

তপন হাসতে হাসতে উত্তর দিয়েছিল, ওটা কিছু না। একটা ইয়ার্কি!

পিকাডেলির ওই ভিড়ের চৌরাস্তায় একা এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল অ্যালিস, নিশ্চয়ই ঘন ঘন ব্যাকুল উদবেগে তাকিয়েছে। মেয়েদের পক্ষে ওই ভঙ্গিটা ভালো নয়, লোকে অন্যরকম মনে করে–কোনো ভদ্র মেয়ে পথের ওপর বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে না। তপনও লক্ষ করেছে, ঠোঁটে দগদগে লিপস্টিক মাখা কয়েকটি মেয়ে পথের ওপর ঈষৎ কোমর বেঁকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে-তাদের চোখে চোখ পড়লেই তারা এক চোখ টিপে ইঙ্গিত করে। অনেক লোক তাদের পাশে গিয়ে ফিসফিস করে কথা বলে পাশপাশি হাঁটে। অ্যালিসকেও যদি কেউ ও রকম ভেবে থাকে? হয়তো অ্যালিসের পাশে এসেও কেউ অভদ্র ইঙ্গিত জানিয়েছে, ফিসফিসিয়ে বলছে, হ্যালো সুইটি–মেয়েদের এ-সময়টা দারুণ অসহায় লাগে।

সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে তপন ভাবল, লাগুক! তাতে আমার কিছু যায়-আসে না! অ্যালিসের চিঠিটা গুলি পাকিয়ে ছুঁড়ে দিল বাথরুমের দিকে। এবার কী করা যায়? এক্ষুনি শুয়ে পড়ব? সারাদিন ঘুমোবার পর এখন নিশ্চয়ই সহজে ঘুম আসবে না। অথচ, করারও তো কিছু নেই! টেড থাকলে কোনো সমস্যাই হত না।

তপন পুরো পোশাক পরেই কিছুক্ষণ লম্বা হয়ে শুয়ে রইল বিছানায়–একটা পত্রিকার পাতা ওলটালো, আর ভালো লাগল না। তারপর, অ্যালিস তাকে যেকোনো মুহূর্তে ফোন করতে পারে–এই কথা মনে পড়ায় তপন ধড়মড় করে উঠে বসল। নিজেই টেলিফোনের রিসিভার তুলে অপারেটরের কাছে একটা নম্বর চাইল। সংযোগ পেয়ে, তপন বেশ কৌতুকের সুরে বলল, হ্যালো? বারবারা? আমি তপন। ঘুমোতে যাওনি নিশ্চয়ই! কী করছিলে? সঙ্গে কেউ নেই! একা? আমারও খুব একা একা লাগছে।

বারবারা খানিকটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার? হঠাৎ আমাকে এত রাত্রে টেলিফোন?

এমনিই! তোমাদের ল্যাণ্ডলেডি আবার রাত্তির বেলা টেলিফোন এলে বিরক্ত হয় না তো? তোমার ঘরেই টেলিফোন? বা:! চমৎকার! কী করবে এখন? এসো না, বাইরে কোথাও মিট করি দুজনে।

এত রাত্রে? কাল অফিস আছে আমার

হেল উইথ ইওর অফিস! না, না, অফিসে যাবে, ঠিকই যাবে–আজ কিছুক্ষণ একটু একসঙ্গে গল্প করা যাক না–কী আর এমন রাত হয়েছে! রাত্রি তো এখনও যথেষ্ট তরুণী! আসবে?

অ্যালিসের কী হল? অ্যালিস কোথায়?

জানি না।

সে কী? অ্যালিস কোথায় তুমি জানো না?

কী করে জানব? দু-তিনদিন ওর সঙ্গে আমার দেখাই হয়নি। ডনাল্ড না ডেভিড–কী যেন একটা ছেলের সঙ্গে অ্যালিস এখন খুব ব্যস্ত!

যাঃ মিথ্যে কথা বোলো না!

সত্যি বলছি।

শোনো দুষ্টু ছেলে, অ্যালিস আজ লাঞ্চের সময় আমার অফিসে এসেছিল। আমাকে সব বলেছে।

কী বলেছে?

তুমি কি তা শোনার মতন অবস্থায় আছ? খুব বেশি নেশা করোনি তো? আমি ঠিক আছি, তুমি বলো না। অ্যালিস আজ আমার কাছে কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেছিল। পুয়োর গার্ল, ওর মনটা বড্ড নরম–টপন, তুমি ওর সঙ্গে রুক্ষ ব্যবহার করছ কেন? বোকা, তুমি দেখতে পাও না –অ্যালিস ওর মাথা-কান জড়িয়ে তোমার প্রেমে পড়েছে? ও সত্যি তোমাকে ভালোবাসে।

ভালোবাসে?

তপন যেন এ-রকম হাসির কথা আর কখনো শোনেনি, হো-হো হা-হা করে বাংলা ইংরেজি দু-রকমের হাসি হাসল অনেকক্ষণ। হাসির চোটে দম আটকে আসছে যেন, সেইরকমভাবে বলল, ভালোবাসে? কী বললে, ভালোবাসে? মাত্র দশদিনের আলাপ, আর সাত-আট দিন পর আমি চলে যাব–তাও আগে থেকে বলা আছে, এর মধ্যেই ভালোবাসা? সিলিয়েস্ট পসিবল থিং আই হ্যাভ এভার হার্ড!

ইয়ার্কি কোরো না, টপন! সব জিনিস নিয়ে ইয়ার্কি চলে না!

আমি মোটেই ইয়ার্কি করছি না। আই অ্যাম সিরিয়াস!

টপন, ভালোবাসা কি কোনো শর্ত মানে? একদিনের আলাপেও কি ভালোবাসা আসতে পারে না?

তুমিও যে এ-রকম ড্যাম রোমান্টিক, আমি তো আগে জানতুম না।

চালাকি কোরো না, তুমি নিজেকে লুকোচ্ছ। সবাই মনে মনে রোমান্টিক।

বল্ডারড্যাস! তুমি আজ রাত্রে আসবে কিনা বলো! জীবন সংক্ষিপ্ত, যেটুকু সময় পাওয়া যায়, সেটুকু সময় উপভোগ করে নেওয়াই তো ভালো।

না, আমি যেতে পারি না–অ্যালিস আমার বন্ধু, সত্যিকারের বন্ধু। আমি সত্যিই ওর জন্য অনুভব করি। আমি ওর মনে কোনো আঘাত দিতে চাই না।

এতে আঘাত পাবার কি আছে? তুমি আজ রাত্তিরে আমার সঙ্গে একটু গল্প করলে অ্যালিস আঘাত পাবে কেন?

বাঃ, তুমি বুঝতে পারছ না? তোমাদের ভারতবর্ষে বুঝি এসব চলে?

আমাদের ভারতবর্ষে কি না চলে। সেখানে রাস্তায় রাস্তায় বাঘ ঘুরে বেড়ায়, মানুষ সবসময় সাপ নিয়ে খেলা করে–সেখানে প্রত্যেকদিন লাখ খানেক লোক পটাপট মরে যাচ্ছে অনাহারে–সেখানে মেয়েরা স্বামীর সঙ্গে এখনও চিতায় পুড়ে মরে–সেখানে কি না হয়– ভারতবর্ষের কথা ছেড়ে দাও।

দুঃখিত টপন, আমি তোমাকে হার্ট করতে চাইনি–সত্যি ভারতবর্ষ সম্পর্কে আমার জ্ঞান এতই কম।

কী সম্বন্ধে যে তোমার জ্ঞান বেশি, তা এখনও আমি টের পাইনি, বারবারা। যাকগে, জ্ঞান নিয়ে কি ধুয়ে খাব? আমি ভেবেছিলাম, তুমি একা আছ, আমিও একা আছি–সুতরাং আমরা দেখা করে কিছুটা সময় আনন্দে কাটাতে পারি। এর মধ্যে অ্যালিসের মনে করা-করি, কিংবা তোমার দ্বিধার কোনো প্রশ্ন আসবে, তা ভাবিনি। কিছুক্ষণ আনন্দ করার জন্য এত চিন্তা করছ কেন?

বাঃ ব্রিটিশ মেয়েদের সম্পর্কে এই বুঝি তোমার ধারণা? তারা শুধু আনন্দ করতেই চায়?

আমি মেয়েদের ব্রিটিশ মেয়ে কিংবা আফ্রিকান মেয়ে–এই হিসেবে ভাবি না। আমি মেয়েদের মেয়ে হিসেবেই ভাবি।

অত্যন্ত দুঃখিত, টপন, আমার পক্ষে আজ যাওয়া সম্ভব নয়। আমার মনে হচ্ছে এতে অ্যালিসের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে।

ও কে, ও কে-তোমার সঙ্গে এতক্ষণ কথা বলে যে আনন্দ পেলাম, তার জন্যেই ধন্যবাদ। চিয়ারিও। গুড নাইট, বারবারা।

টেলিফোনের রিসিভারটা রেখেই আবার সেটা তুলল তপন। এবার হোটেলের কাউন্টারের নাইট ক্লার্ককে ডেকে বলল, শোনো, আমার ঘরের নম্বর তিপ্পান্ন, আমার নাম রয়। টি. রয়, আমি আজ রাত্রে আর বিঘ্নিত হতে চাই না। আমি আর কোনো টেলিফোনের ডাক পেতে চাই, কোনো নারী বা পুরুষ অতিথির সঙ্গে দেখা করতে চাই না, বুঝলে? বাবা কিংবা মায়ের মৃত্যুসংবাদের মতন জরুরি গুরুত্বপূর্ণ খবর ছাড়া, কিছুতেই আজ রাত্রে আমাকে আর ডাকা চলবে না। এবং দুঃখের বিষয়, আমার বাবা কিংবা মা বেঁচে নেই, সুতরাং ওরকম কোনো খবর আসার সম্ভাবনাও নেই। বুঝলে? সুতরাং, কোনোক্রমেই আমি আজ রাত্রে আর কোনো ডাক পেতে চাই না। আমি পরিষ্কারভাবে বোঝাতে পেরেছি তো? আচ্ছা, ধন্যবাদ এবং শুভরাত্রি! ঝনাৎ!

সে-রাত্রে আর শ্লিপিং পিল খেতে হল না, হুইস্কির বোতল খুলতে হল না, জামাকাপড় ছেড়ে শুয়ে পড়ার একটু বাদেই তপন এমনিতেই ঘুমিয়ে পড়ল। কোথাকার কী এক অনির্দিষ্ট রাগে সে সারাক্ষণ জ্বলছিল। রাগ মানুষকে বড়ো ক্লান্ত করে দেয়। সেই ক্লান্তিতে তপন এখন ঘুমোচ্ছে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *