০১-২. ওই ছবিটা কার

হৃদয়ে প্রবাস – উপন্যাস – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

ওই ছবিটা কার?

আমার বাবার।

 না, ওই পাশে দাঁড়ানো লোকটি?

দ্যাট জেন্টলম্যান কিল্ড মাই ফাদার—

 তপন চুপ করে ছবিটার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। যেন ঘরের আলো কম, তপন এগিয়ে এল ছবিটার আরও কাছে। অনেক কালের পুরোনো ছবি, রং জ্বলে লালচে হয়ে এসেছে, তবু স্পষ্ট চেনা যায়। কত দূরে, এই পৃথিবীর কোথায় যেন বাংলাদেশ বলে এই ভূখন্ড আছে, তার একটা ছোট্ট গ্রাম, সেই গ্রামের স্কুল বাড়ির সামনে একজন বিশাল চেহারার ইংরেজ, তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একজন রোগা ছোটোখাটো চেহারার বাঙালি যুবা। ইংরেজটির হাতে লাল রিবন বাঁধা কয়েকটি বই ও মুখে বদান্যতার হাসি, বাঙালি যুবকটি হাতজোড় করে নমস্কার করে আছে। অন্তত তিরিশ বছর আগে তোলা ছবি, তবু স্পষ্ট এখনও, এখনও দু-জনের মুখের হাসি সম্পূর্ণ ম্লান হয়নি।

তপন দীর্ঘশ্বাস ফেলল না, কিন্তু পা দুটো ভারী হয়ে এল। এক ধরনের বিশ্রী পেট ব্যথা শুরু হল। কখনো বেশি মন খারাপ হলেই তপনের এইরকম চিনচিনে পেট ব্যথা আরম্ভ হয়, বোধ হয় আলসারের সূত্রপাত। প্রথমবার ব্যথার সঙ্গে সঙ্গে মুখ দিয়ে রক্ত উঠেছিল, নিউইয়র্কে থাকবার সময়। ডাক্তার বলেছিল, কখনো পেট খালি রাখবে না, পকেটে বিস্কিট রাখবে সবসময়–মাঝে মাঝে একটা-দুটো খাবে। আর, কখনো বুক খালি করে মনখারাপের দীর্ঘশ্বাস ফেলবে না। মন খারাপ থেকেই পেট খারাপ শুরু হয়।

তপন তো মন খারাপ করতে চায়নি, যেন ডাক্তারের নির্দেশেই সে সবসময় আনন্দ-ফুর্তির মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছে। আজ সন্ধ্যেটাও তো হইহল্লার মধ্যে কাটাবে বলেই সে সেজেগুজে এসেছিল। কিন্তু লণ্ডনের এই স্যাঁৎসেঁতে আবহাওয়া আর বিশ্রী কুয়াশা–তার ওপর, উৎসবের ঠিক আগের মুহূর্তে এইরকম অকল্পনীয় ছবির মুখোমুখি হলে কার-না মন খারাপ হয়!

তপন পকেট থেকে হাত বার করে ছবিটার ফ্রেমে আলতোভাবে আঙুল বোলাতে লাগল। কালো রঙের ভারী কাঠের ফ্রেম। ফ্রেমের গায়ে সোনার জলে কী যেন লেখা ছিল, এখন আর পড়া যায় না। তপনের মনে হল, এ ছবিটা যেন তার দেখার জন্যই এতকাল এখানে আছে। তপন ছাড়া এ ছবি আর কেই-বা দেখবে!

অ্যালিস বলল, তুমি ওভার কোটটা খুললে না? ইস, জুতোও তো একদম ভিজে গেছে। তুমি হিটারে পা সেঁকে নাও বরং

তপন আস্তে আস্তে কোট খুলল, জুতো খুলল, ডিভানের ওপর বসে মোজাপরা পা-দুটো তুলে দিল হিটারের পাশে। তারপর ধীর গলায় জিজ্ঞাসা করল, অ্যালিস, তোমার বাবা বাংলাদেশে ছিলেন? তুমি আগে বলোনি তো!

অ্যালিস টেবিল গোছাতে ভারি ব্যস্ত। বলল, বলিনি বুঝি? হ্যাঁ, আমার বাবা বাংলাদেশে ছিলেন। লং লং টাইম এগো–

উপহারের মোড়কটা তপন আগেই টেবিলের ওপর রেখেছিল। সেটা খুলে শ্যাম্পেনের বোতলটা দেখতে পেয়ে অ্যালিসের চোখ খুশিতে ঝিলমিল করে উঠল। কলস্বরে বলল, শ্যাম্পেন? গস, দিস ইজ ড্যাম এক্সপেন্সিভ! আর য়ু আ মহারাজ অর সামথিং?

অ্যালিস, তোমার বাবা বাংলাদেশে কোন স্থানে ছিলেন? পূর্ববঙ্গে?

ইয়েস, ডাক্কা, তুমি শ্যাম্পেনের বোতল খুলতে জানো তো?

শ্যাম্পেনের বোতল খোলা আর শক্ত কী?

তুমি জান কি না বলো না! আগে খুলেছ কখনো?

এসব ব্যাপারে তপন একটুতেই চটে যায়। নারী-পুরুষ গ্রাহ্য করে না। বলল, অ্যালিস, তুমি জীবনে ক-টা শ্যাম্পেনের বোতল দেখেছ? এই পাঁচ বছরে তার চেয়ে ঢের বেশি শ্যাম্পেন আমি খেয়েছি। আই হোপ য়ু হ্যাভ প্রপার গ্লাসেস?

ডোন্ট বি ফাসি, টপন। ওপন ইট।

তপন এক হাতে শ্যাম্পেনের বোতলটা নিয়ে অন্য হাতের বুড়ো আঙুলে নিপুণভাবে কর্কের ওপর চাপ দিল। একটুক্ষণের মধ্যেই পম করে শব্দ হয়ে হু-স-করে ফেনা বেরিয়ে এল, তপন তার এক ফোঁটাও মাটিতে পড়তে না দিয়ে বোতলটা ঠক করে টেবিলে রাখল। টক-মিষ্টি গন্ধে ভরে গেল ঘর। তপন আবার জিজ্ঞেস করল, তোমার বাবা কোন সময়ে বাংলাদেশে ছিলেন?

অ্যালিস চঞ্চলা গতিতে কাবার্ড থেকে গ্লাস আনতে গেছে, দু-এক মুহূর্তের মধ্যে গ্লাস হাতে ফিরে এসে বলল, আজ আমরা ফিলম দেখতে যাব না, বাইরে বেরোব না, শুধু তুমি আর আমি এখানে

অ্যালিস, তুমি কথার উত্তর দিচ্ছ না কেন?

অ্যালিস চমকে উঠল, তার উচ্ছল ভঙ্গিমা হঠাৎ আহত হল। বিমূঢ়ভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, কী কথা, টপন?

এই-যে আমি জিজ্ঞেস করছি, তোমার বাবা কোন সময়ে বাংলাদেশে ছিলেন? বললে তোমার বয়স বুঝে ফেলব ভাবছ? কিন্তু আমি তো জানিই তোমার বয়েস তিরিশের কম নয়।

অ্যালিস তপনের স্বভাব এই ক-দিনেই খানিকটা জেনে গেছে। তবু বয়েসের খোঁটা শুনে অপমানিত না হয়ে পারল না। অভিমানী শিশুর মতন বলল, বয়েস লুকোব কেন? আমার বয়েস তো সত্যই তিরিশ, তোমাকে আগেই বলেছি। তুমি এত রুড হচ্ছো কেন টপন? আমি ভেবেছিলাম, আজ সন্ধ্যে বেলাটা বয়েস কিংবা পুরোনো ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করার বদলে আরও অন্য ভালো ভালো বিষয় পাওয়া যাবে। আমার বাবা বাংলাদেশে ছিলেন নাইনটিন থারটি সেভেন, থারটি এইট-এ-জাস্ট বিফোর দা সেকেণ্ড ওয়ার্ল্ড ওয়র স্টার্টেড, আমার তখন চার-পাঁচ বছর বয়স।

তুমি তখন কোথায় ছিলে? এখানে না বাংলাদেশে?

আমি বাবার কাছেই থাকতুম, মা তখনও

তোমার বাংলাদেশের কথা মনে আছে একটুও?

স্বপ্নের মতন একটু-একটু, চারদিকে কী গাঢ় সবুজ, কী বিশাল সেখানকার নদীগুলো, পডমা

অ্যালিস, তুমি জানো, আমিও বাঙালি?

অব কোর্স আই নিউ–তুমিই তো বলেছ

 বাংলাদেশের লোক দেখলে কিংবা বাংলাদেশের কথা শুনলে তোমার রাগ হয় না?

 কেন, রাগ হবে কেন? অমন সুন্দর দেশ

 কারণ, বাংলাদেশের লোকই তো তোমার বাবাকে খুন করেছিল।

অ্যালিস হঠাৎ একটু অস্বাভাবিক ভাবে চেঁচিয়ে উঠল, প্লিজ, প্লিজ, ডোন্ট– তপন দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, কী, কী হল?

প্লিজ টপন, ওসব কথা তুলো না। আমি ওসব কথা একদম ভাবতে চাই না কখনো। আমরা দুজনে বন্ধু! তুমি আজ আমাকে এখনও একবারও আদর করোনি। কাম

তপন অ্যালিসের চোখের দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তারপর নিরাসক্তের মতন এগিয়ে এল। সম্পূর্ণ শরীর না-স্পর্শ করে শুধু মুখ এগিয়ে আলতোভাবে অ্যালিসের ওষ্ঠে একটা চুম্বন দিল। অ্যালিস নিজেই ওর উত্তাপময় শরীরটা চেপে ধরল তপনের গায়ে, দু হাতে গলা জড়িয়ে একটা প্রগাঢ় চুমুতে আবদ্ধ হয়ে রইল কয়েক মিনিট। শেষ হলে, তপন রুমাল দিয়ে ঠোঁট থেকে লিপস্টিকের দাগ ও গন্ধ মুছে ফেলার চেষ্টা করল।

গ্লাসে শ্যাম্পেন ঢালার জন্য টেবিলের কাছে সরে গিয়ে অ্যালিস বলল, কুয়াশা সরে গেছে, দেখো এখন কী সুন্দর, ইটস বিউটিফুল আউটসাইড। টপন, এসো জানলার কাছে

গ্লাস হাতে তপন জানলার কাছে এসে দাঁড়াল। অ্যালিস ওর দেহে ঠেস দিয়ে নিজেকে আলগা করে দিল। প্রায় নিজের অজান্তেই তপন একটা হাত রাখল অ্যালিসের কাঁধে, তার নাকের কাছেই অ্যালিসের সোনালি চুল, আনমনে তার মিষ্টি গন্ধ নিয়ে তপন উদাসীনভাবে তাকাল বাইরে। কুয়াশা কেটে গেছে কিন্তু ঝিরঝিরে বৃষ্টি নেমেছে। পথে মানুষ দেখা যায় না, শুধু চলন্ত ছাতা-টুপি আর ওভারকোট। হ্যাম্পস্টেড-এর এ অঞ্চলটা ঘিঞ্জি ধরনের। রাস্তায় মেয়ের থেকে বুড়ি বেশি, প্যারামবুলেটর ঠেলছে ন্যানিরা, নোংরা লণ্ডন, বিষণ্ণ লণ্ডন। পুরুষদের অধিকাংশই কালো সুট পরা, যেন সবাই কোনো শোক মিছিলে চলেছে।

সময় এবং আয়ু কীরকম লুকোচুরি খেলে! লণ্ডনের বান্ধবীর ঘরের জানলা দিয়ে তাকিয়ে তপনের অকস্মাৎ মনে পড়ল তার ষোলো বছর বয়সের একটা দিনের কথা। সিউড়িতে, কাকার বাড়িতে–এইরকমই শুয়ে জানলা দিয়ে তাকিয়েছিল। তখন তার বিষম অসুখ, ডান পায়ের হাঁটুর কাছটা অনেকখানি ফুলে বিষম যন্ত্রণা। কাকা নিজে ডাক্তার তবু অসুখ ধরতে পারেননি, দিন-রাত ব্যথায় চেঁচাত তপন, ঘুমের ওষুধ আর ইঞ্জেকশন দিয়ে রাখা হত তাকে। এরই মধ্যে কোনো-এক আচ্ছন্ন অবস্থায় তপন অস্পষ্টভাবে শুনেছিল- কাকা আর একজন ডাক্তারের সঙ্গে তার সম্বন্ধে আলোচনা করছে। সেই ডাক্তারটি সন্দেহ প্রকাশ করছেন, তপনের ক্যানসার হয়েছে, তপনকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া উচিত। তপন জানত, ক্যানসার হলে মানুষ আর বাঁচে না। সেইদিন বিকেলে ঘুম ভাঙার পর, তপন আর পায়ের যন্ত্রণায় চেঁচায়নি। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিল, কাছেই একটা ছোটো ডোবাপুকুর একদল লোক সেখানে নেমে কচুরিপানা পরিষ্কার করছে, চেঁচামেচি করছে দু-তিনটে ছেলে, একটা কুকুর চুপচাপ বসে, পাকুড়গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে মা কথা বলছেন রামকৃষ্ণ আশ্রমের মহারাজের সঙ্গে–যেন সব মিলিয়ে একটা আঁকা দৃশ্য। নীরব তপনের চোখে জল এসে গিয়েছিল–সে আর বাঁচবে না, এইসব কিছু ছেড়ে যেতে হবে? সব? সেদিন তপনের ক্ষীণতম কল্পনাতেও ছিল না–একদিন সে সত্যিই এসব জায়গা ছেড়ে যাবে, দাঁড়াবে পৃথিবীর নানান দেশের জানলায়, প্যারিস, নিউইয়র্ক, শিকাগো, রোম, এমনকী বিলেতেও বিলেতের জানলায় কোনো জলজ্যান্ত ইংরেজ ললনার গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়াবে।

অ্যালিস বলল, দেখো, আজ আমাদের জন্যই আবহাওয়াটা এমন সুন্দর হয়ে গেল। কুয়াশা কেটে গেছে।

তপন বলল, কোথায় সুন্দর? বিচ্ছিরি তোমাদের লণ্ডন। কুয়াশা কাটতে-না-কাটতেই বৃষ্টি! এ-সময় নিউইয়র্ক কিংবা বোস্টনে–মেপলগাছের পাতাগুলো টুকটুকে লাল হয়ে এসেছে, ফল এখন, গ্লোরিয়াস ফল, সবার মনে ফুর্তি, আর তোমাদের

অ্যালিস সদ্য শ্যাম্পেনে চুমুক দিয়েছে, মুখভরা সেই অবস্থায় হাসি চাপার চেষ্টা করে বলল, ইস, খুব আমেরিকান হয়ে গেছো! ক-বছর তো মোটে ছিলে!

পাঁচ বছর তিন মাস! একটা দেশকে ভালো লাগবার পক্ষে যথেষ্ট।

তা হোক, নিজের দেশের আবহাওয়াই সবার ভালো লাগে। তোমার বাংলাদেশের– বলতে বলতে অ্যালিস থেমে গেল। আবার বাংলাদেশের প্রসঙ্গ যেন সে তুলতে চায়নি। তপনের মুখটা অন্য দিকে ফেরানো ছিল, বাংলাদেশের কথা শুনেই চোখের পলক ফেরাবার আগে দু-এক মুহূর্ত বাংলাদেশে ঘুরে এল। সাড়ে পাঁচ বছর সে দেশ দেখিনি, তবু কিছুই বদলায়নি, আমি জানি, মনে হল তপনের, আমি বদলে গেছি, তা বলে দেশ বদলাবে?

তপন বলল, বাংলাদেশের আবহাওয়াও তোমাদের লণ্ডনের চেয়ে ঢের ভালো। সেখানকার রোদ-বৃষ্টি-শীত সবগুলোই আলাদা আর স্পষ্ট, তোমাদের মতন এমন জড়াজড়ি করে নেই!

অ্যালিস তর্কে যেতে চায় না। সে স্মৃতিমন্থনের সুরে বলল, বাংলাদেশ–আমার একটু একটু মনে আছে–ব্রাইট সান, আমাদের বাংলোর পাশে একটা পুকুর ছিল, হঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টি, টরেনশিয়াল রেইন–

অ্যালিস, তোমার বাবা কেন খুন হয়েছিলেন?

 প্লিজ টপন আজ ওকথা থাক। আজকের চমৎকার সন্ধ্যে বেলাটা ওসব পুরোনো কথা মনে করে নষ্ট করতে চাই না।

বলো না, আমার শুনতে ইচ্ছে করছে।

কী আর শুনবে বল? নতুনত্ব কিছু নেই, পলিটিক্যাল মার্ডার। তোমাদের দেশ তখন পরাধীন ছিল–আমার বাবা ব্রিটিশ–এ-রকম তো সব দেশেই হয়

অ্যালিস, তুমি এত শান্তভাবে কী করে কথা বলতে পারছ? তোমার নিজের বাবা খুন হয়েছিলেন একজন ভারতীয়ের হাতে–আমাকে ভারতীয় জেনেও তুমি কী করে সহ্য করছ?

অ্যালিস অপলকভাবে তপনের দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, আমি ভারতীয় কিংবা ব্রিটিশ কিংবা আমেরিকান–এইভাবে মানুষকে দেখি না। আমি মানুষকে মানুষ হিসেবেই শুধু দেখি!

তপন অ্যালিসের কথায় খুব গুরুত্ব দিল না। হালকাভাবে বলল, বাঃ, আমি একটা কালো রঙের লোক–আমার সঙ্গে তুমি এত মিশছ–তোমার নিন্দে হয়ে যাবে।

অ্যালিস ছোট্ট মুঠো তুলে তপনকে একটা কিল মেরে বলল, আবার বাজে বকছ! তা ছাড়া তুমি মোটেই কালো নও, তোমার গায়ের রং ব্রাউন–ঠিক পাকা জলপাইয়ের মতন–এই রংটাই আমি সবচেয়ে ভালোবাসি।

ঠিক আছে, ঠিক আছে, এবার বলো।

কী বলব?

তোমার বাবা কী করে খুন হলেন?

তুমি আবার ওই কথা শুনতে চাইছ? কেন?

 স্রেফ কৌতূহল!

 বিশ্বাস করো টপন, সেসব কথা আমার মনে নেই। আমি তখন ছোটো, সে-বয়সের কথা কি কারুর মনে থাকে? শুধু মা-র মুখে যেটুকু শুনেছিলুম

সেটাই বলো

প্লিজ, প্লিজ, ওকথা আমি মনে করতে চাই না– কতবার তোমাকে একথা বলব? আজ আমার জন্মদিন–আজ আমার আনন্দ করার কথা, আজ ছেলেবেলার কথা ভেবে মন খারাপ করার কথা তো নয়!

জন্মদিনেই তো ছেলেবেলার কথা ভাবতে বেশি ভালো লাগে।

কিন্তু টপন, আমার ছেলেবেলাটা যে বড়ো দুঃখে কেটেছে। একটাও সুন্দর-মধুর স্মৃতি নেই। বাবা হঠাৎ খুন হবার পর আমাদের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে পড়ে। হিজ ম্যাজেস্টিস গাভমেন্ট অবশ্য মা-কে একটা পেনশন দিত, কিন্তু দেশে ফিরে আসার দু-বছরের মধ্যেই মা আবার বিয়ে করল। মা আমাকে কোনোদিন ভালোবাসেনি, মানুষকে ভালোবাসার ক্ষমতাই নেই মা-র; মা শুধু নিজেকে ভালোবাসত–যাই হোক, আমার মায়ের দ্বিতীয় স্বামী-আই হেটেড টু কল হিম ফাদার-আমার বাবার তুলনায় সে ছিল নেহাৎই অতি বাজে লোক–মা কী দেখে তাকে বিয়ে করেছিল কী জানি–সে আমার সঙ্গে মোটেই ভালো ব্যবহার করত না, সে আমায় ঘৃণা করত। আমার ধারণা হয়েছিল, সে বোধ হয় আমাকে মেরে ফেলতে চায়। মা আমাকে তখন স্কটল্যাণ্ডে এক মাসির বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন। আমার সেই মাসি– তাকে ডাইনি বললেও কম বলা হয়, আমাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাথরুমে আটকে রেখে শাস্তি দিত, আমাকে খেতে দিত না–মা আর টাকা পাঠাত না–পৃথিবীতে আমাকে ভালোবাসার কেউ ছিল না–আমার ছেলেবেলাটা বড়ো দুঃখে কেটেছে তপন–।

তপন অন্য দিকে তাকিয়ে ছিল। নীরসভাবে বলল, ছেলেবেলা অনেকেরই দুঃখে কাটে। আমি তোমার ছেলেবেলার সব গল্প শুনতে চাইনি ডার্লিং–আমি শুধু তোমার বাবার মৃত্যুর ঘটনাটা জানতে চেয়েছিলাম।

অ্যালিস বিমূঢ়ভাবে তপনের দিকে তাকাল। সিগারেটের ধোঁয়ার কুন্ডলির মধ্যে অস্পষ্ট হয়ে আছে তপনের আসীন ঋজু শরীর। প্রায় ছ-ফুটের কাছাকাছি লম্বা, ধারালো ঝকঝকে শরীর তপনের, মনে হয় সারাগায়ে এক ছিটেও চর্বি নেই। খেলাচ্ছলে ফুঁ দিয়ে সে ধোঁয়া সরাবার চেষ্টা করছে, ধোঁয়া সরে গেলে দেখা যায় তার নির্লিপ্ত মুখ, যেন ছেলেবেলার দুঃখের কাহিনিকে সে ওইরকম ফুঁ দিয়ে ওড়াল।

অ্যালিস দম-চাপা গলায় শুধু ডাকল, টপন—

তপন অ্যালিসের মুখের দিকে তবুও তাকাল না, ওর কণ্ঠস্বরের বদল লক্ষ করল না, আপন মনেই বলল, তোমার এদেশের ছেলেবেলার গল্প নয়, তোমার বাংলাদেশের ছেলেবেলার গল্প বলো—

চোখের জল লুকোবার জন্য অ্যালিস মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে চোখ বুজল। একটুক্ষণের মধ্যেই নিজেকে সামলে নিয়ে আস্তে আস্তে বলল, টপন, তোমার এই রুক্ষতা, তোমার এই পৌরুষের জন্যই তোমাকে আমার এত ভালো লাগে। কিন্তু আজ আমাকে এত বেশি কষ্ট দিচ্ছ কেন? কেন আমার দিকে তাকাচ্ছ না? আমার আজকের পোশাক তোমার পছন্দ হয়নি? আমাকে আগলি দেখাচ্ছে? তুমি আজ একবারও আমার পোশাক সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করনি। আমার ঘরটা তোমার ভালো লাগছে না? অন্য দিনে তুমি আমাকে কত আদর করো–আজ তোমার মুখ এত শুকনো কেন? কেন? বলো, বলো, আই ফিল লাইক ক্রায়িং–

তপনের মন যেন বহুদূরে চলে গিয়েছিল, কোনো নির্দিষ্ট দেশে নয়–সম্পূর্ণ শূন্যতার মধ্যে। আবার ফিরে এল অ্যালিসের ঘরে, তাড়াতাড়ি সচকিত হয়ে উঠল। পর মুহূর্তে হাসিমুখে তাকাল অ্যালিসের দিকে। বিদেশে এসে মুহুর্মুহু অভিব্যক্তি বদলানো সে ভালো রপ্ত করে নিয়েছে। একটু আগে তার ভ্রূকুঞ্চিত মুখ ছিল–এখন সেটা অনাবিল হাসিতে উদ্ভাসিত। দু-হাত বাড়িয়ে অ্যালিসকে বলল, কাম অন ডার্লিং, তুমি সত্যিই রেগে গেছ নাকি? যাঃ–অ্যালিস কোনো সাড়া দিল না। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে শরীর মোচড়াতে থাকে। অ্যালিস কাঁদছে সত্যি সত্যিই।

তপন নিজেই এগিয়ে গিয়ে অ্যালিসের হালকা শরীরটা বুকের মধ্যে টেনে দিল, ওর মুখখানি উঁচু করে তুলে চুমুতে চুমুতে ওর চোখের জল পান করতে লাগল। সাগরপারের মেয়েদের চোখের জল একটু কম নোনতা, তপন বহুবার দেখেছে। পাতলা, বেশি জল মেশানো অশ্রু না হলে ওরা এত ঘন ঘন কাঁদতে পারে কী করে? তপন নরমভাবে অ্যালিসকে আলিঙ্গন করে থাকে–উঁচু স্তন জোড়ার ফাঁকে গরম নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলে, য়ু আর আ সুইট লিটল থিং! কিউট! উম-উম–তোমার পোশাকটা সত্যিই খুব সুন্দর, আমার আগেই বলা উচিত ছিল, সত্যিই আমার খুব ভালো লাগছে–নতুন কিনলে বুঝি? সে ত্রে শিক, নেস পা!

তপন তার সামান্য ফরাসি জ্ঞানও দেখাতে শুরু করে। অ্যালিস এই সামান্য আদরেই মুগ্ধ হয়ে যায়, তপনের গায়ের সঙ্গে ঘন হয়ে থেকে বলে, সত্যি তোমার পছন্দ হয়েছে? রিজেন্ট থেকে কিনলুম, এই প্রথম ওখানকার দোকান থেকে

আজ কী খাবার তৈরি করেছ?

 তোমার খিদে পেয়েছে বুঝি?

পাবে না! প্রায় সাতটা বাজে, আর কখন ডিনার খাব? কী কী রেঁধেছ বলো!

তুমি স্টেক ভালোবাস, তোমার জন্য ভালো সারলয়েন স্টেক এনেছি–মিডিয়াম রোস্ট, চিকেন-ওনিয়ন সুপ আছে, তুমি বাঙালি তো–তাই ভাতও বেঁধেছি, অ্যাসপারাগাস, স্ট্রবেরি আইসক্রিম আছে ডেসার্ট আর হোয়াইট ওয়াইন–বোর্দো, নাইনটিন ফিফটি সিক্স।

বাঃ চমৎকার, শুনেই খিদে চনচন করছে। আমি বাঙালি ছিলাম অনেককাল আগে এখন আর ভাত-টাত ভালোবাসি না, মাংসই খাব–

সত্যি তুমি ভাত ভালোবাস না?

একদম না।

কেন, আমেরিকাতেও বুঝি চাল পাওয়া যায় না?

খুব ভালো চাল পাওয়া যায়। আমেরিকার চাল খেয়েই তো ভারতবর্ষ দুর্ভিক্ষ থেকে বাঁচল! সেজন্য না, আমি তো আর বাংলাদেশে কোনোদিন ফিরে যাব না–তাই বাঙালি স্বভাবগুলো আমি আস্তে আস্তে ঘুচিয়ে ফেলছি।

ফিরে যাবে না? এই তো কয়েকদিন পরেই যাবে বলছিলে যে?

সে তো মাত্র দু-তিন সপ্তাহের জন্য। বাংলাদেশে আর থাকব না-আমেরিকাতেই আবার ফিরে আসব। ওখানেই সেটল করব। দাও দাও খেতে দাও

তোমার আর তর সইছে না দেখছি! শ্যাম্পেনটা শেষ করো। এত খিদে পেয়ে গেল এর মধ্যে!

হ্যাঁ, দাও, খেতে খেতে তোমার বাবার মৃত্যুর কাহিনিটা শুনব।

আবার? কেন তুমি বার বার ওই কথা তুলছো! তুমি তো বাংলাদেশে আর যাবে না, তাহলে বাংলাদেশের ওই সব পুরোনো ঘটনা জানার জন্য তোমার এত আগ্রহ কেন?

বা:, এটা তো খুব স্বাভাবিক। তোমাকে আমি চিনতাম না আগে, লণ্ডনে এসে প্রথম পরিচয় হল, বন্ধুত্ব হল–আমাদের বন্ধুত্বের মধ্যে কোনো শর্ত নেই। কিন্তু তোমার ঘরে এসে যদি হঠাৎ একটা ছবিতে দেখি–তোমার বাবা আর একজন ভারতীয় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আর সেই ভারতীয়টিই তোমার বাবাকে খুন করেছে–তা হলে পুরো ঘটনাটা শুনতে ইচ্ছে হবে না?

তুমি ওই লোকটাকে চেনো?

 ওকে আমি চিনব? কী করে তুমি আশা কর যে, যেকোনো বাঙালিকেই আমি চিনব?

কিন্তু টপন ডিয়ার, আজ সন্ধ্যে বেলা আমাদের দেশ কিংবা রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করার কথা নয়। ওসব আমি ভালো বুঝিও না। আমি শুধু জানি, আমরা দুজনে বন্ধু

আমরা নিশ্চয়ই বন্ধু, কিন্তু বন্ধু কি বন্ধুর ছেলেবেলার ঘটনা জানতে চায় না? তুমি যতই আপত্তি করছ, ততই আমার কৌতূহল বাড়ছে।

আচ্ছা, তাহলে চুপটি করে বোসো। আমি খাবার টেবিলটা আগে সাজিয়ে নিই।

দেশ ছাড়ার আগে মা বলেছিলেন, তপু, আর-যাই করিস গো-মাংস খাসনি কক্ষনো। শরীরের যত্ন করিস। বিদেশে আসার এক বছরের মধ্যেই মা মারা যান। মা যতদিন বেঁচে ছিলেন, ততদিন তপু মায়ের কাছে প্রতিশ্রুতি মেনে চলেছে। মা মারা যাবার পর আর সেকথা মানার দায়িত্ব নেই। এখন তার মনে হয়, পশ্চিম দেশে এসে যে গোরু খায় না, সে নিজেই একটা গোরু। আজ গোরুর শরীরের সবচেয়ে ভালো অংশ দিয়ে বানানো স্টেক তপনের প্রিয় খাদ্য। এক হিসেবে আজ তপন মায়ের কথা রেখেছে, শরীরের যত্ন নিচ্ছে।

কিন্তু স্টেক তো আমেরিকার মতন বিলেতে এত সস্তা নয়, আহা অ্যালিস নিশ্চয়ই ওর কষ্টে জমানো পয়সা খরচ করে কিনেছে। ফরাসি ওয়াইন কিনেছে–তারও দাম কম নয়। স্টোভে খাবারগুলো গরম করছে অ্যালিস, তপন সেইদিকে লুব্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। হালকা সবুজ রঙের গাউন অ্যালিসের, তার সোনালি চুলের সঙ্গে সত্যিই মানিয়েছে। পাতলা শরীরের গড়ন, কোমরটা এত সরু যেন এক মুঠোতে ধরা যায়, বড়ো বড়ো টানা টানা চোখ –চোখ দুটো দেখলে যেন কার কথা মনে পড়ে–তপন কিছুতেই মনে করতে পারল না। নাচের ভঙ্গিতে ঘোরাঘুরি করছে অ্যালিস–একবার কাবার্ডের কাছে, একবার স্টোভে, মাঝে মাঝে মুখ ফিরিয়ে মৃদু হাস্য দিচ্ছে।

সত্যিই বেশ খিদে পেয়েছে তপনের। খিদের মুখেই ও একটা সিগারেট ধরাল। দেশলাই জ্বালাতে গিয়ে তপন লক্ষ করল, ওর হাত কাঁপছে। পর পর তিনটে কাঠি নিভে গেল–এসব ঘরে তো পাখা নেই যে দেশলাইয়ের কাঠি নিববে। হাত কাঁপছে কেন? তপন নিজের ওপরেই বিরক্ত হয়ে উঠল। এটা তো ভালো লক্ষণ নয়। যদিও অ্যালিস দেখতে পায়নি, তবু তপন বিব্রত বোধ করল। পেটের ব্যথা কমে গিয়ে এখন হাত কাঁপছে। পেটের ব্যথা বাইরে থেকে দেখা যায় না, হাত কাঁপাও অ্যালিস লক্ষ করেনি, তবু তপন ব্যস্ত হয়ে ভাবল, এটা এক্ষুনি চাপা দেওয়া দরকার। খেতে বসে ছুরি-কাঁটা ধরে যদি তার হাত কাঁপে! তপন তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করল, অ্যালিস, তোমার কাছে কোনো হার্ড ড্রিঙ্কস আছে? হুইস্কি কিংবা রাম?

অ্যালিস ঘুরে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলল, আবার ওসবে কী হবে? এখনও তো শ্যাম্পেন আছে।

শ্যাম্পেনে আর শানাচ্ছে না, একটু কড়া কিছু খেতে চাই।

হাউ ডু য়ু এক্সপেক্ট সাচ স্টাফ ইন আ গার্লস রুম?

ঠিক আছে, তুমি রান্নাটা শেষ করে ফেলো, আমি ততক্ষণে বাইরে থেকে কিনে নিয়ে আসছি।

এখন, এই বৃষ্টিতে তুমি আবার বাইরে যাবে?

তাতে কী হয়েছে? এক্ষুনি চলে আসব।

ওয়েট আ মিনিট। তোমাকে যেতে হবে না, আমার কাছে আধ বোতল ব্র্যাণ্ডি আছে, তুমি তো ব্র্যাণ্ডিও ভালোবাস–সেদিন দেখেছি।

ঠিক আছে, ব্র্যাণ্ডিতেও চলবে।

অ্যালিস নিখুঁতভাবে টেবিল সাজিয়েছে। বাংলাদেশের এক অতি-অখ্যাত গরিব পরিবারের ছেলে তপন, আজকাল সে এসব ব্যাপার খুব তারিফ করতে পারে। খাওয়ার টেবিল ভালো করে সাজানো নয় দেখলে বিরক্ত হয়, অথচ তাদের বংশে কেউ আগে কোনোদিনই টেবিলে বসেই খায়নি। অ্যালিস বেশ পরিপাটি করে সাজাতে জানে। কড়া মাড় দিয়ে ইস্ত্রি করা ন্যাপকিন ফুলের মতন সাজিয়ে রেখেছে গ্লাসে। কাঁটা চামচগুলো থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে আলো। প্লেটে সাজানো স্যালাডগুলো যেন কাশ্মীরি শালের ডিজাইন। তপন কেতাদুরস্ত ভাবে প্রত্যেকটা খাবারের প্রশংসা করল, তারপর আইসক্রিমে চামচ ডুবিয়ে বলল, এবার বলো–

অ্যালিসের মুখখানা আবার করুণ হয়ে এল। যেন তার বাবার খুন হওয়াটা তারই অপরাধ। সে মিনতিময় চোখে বলল, মাস্ট য়ু?

তপন কোনো বিনয় বা ভদ্রতার ধার ধারল না, সোজাসুজি বলল, হ্যাঁ, এবার শুনতে চাই। আর ডিলি-ড্যালি কোরো না।

অ্যালিস ন্যাপকিন দিয়ে ঠোঁট মুছল, তারপর সেটাকে আবার সুষ্ঠুভাবে ভাঁজ করে রাখল টেবিলে। সাদা মদের গ্লাসে ছোটো চুমুক দিয়ে মুখ নীচু রেখেই বলল, খুন না বলে ওটাকে দুর্ঘটনাই বলা যায়। ওই লোকটা, ছবির ওই লোকটা, আমি তার নাম ভুলে গেছি

গোড়া থেকে বলো।

আমি যা জানি, তাই বলছি।

ঠিক আছে।

আমার বাবা ভারতবর্ষকে ভালোবাসতেন। নিজের বাবা বলেই বলছি না, তখনকার দিনের অন্যান্য কলোনিয়াল সার্ভেন্টদের থেকে আমার বাবা সম্পূর্ণ অন্য ধরনের ছিলেন। ভারতবর্ষকে তিনি ব্রিটেনের অধীনস্থ দেশ বলেই শুধু মনে করতেন না, তিনি ভারতের প্রাচীন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য, তোমাদের দর্শন, শিল্পকলাকে শ্রদ্ধা করতেন। তাই ভারতবর্ষের লোকও ভালোবাসত আমার বাবাকে। সত্যিই আমার মায়ের কাছে শুনেছি, বাবা আগে পোস্টেড ছিলেন রোডেশিয়াতে–কিন্তু তিনি নিজেই চেষ্টা করে ভারতবর্ষে ট্রান্সফার নেন। বুঝতেই পারছ, আমার মায়ের খুব আপত্তি ছিল–রোডেশিয়া অনেক কাছাকাছি–সেকালে জাহাজে ভারতবর্ষে যেতে সময় লাগত এক মাসের বেশি কিন্তু বাবার এত আগ্রহ ছিল– আমার ঠাকুমা-ঠাকুরদা ছিলেন হোরেস হেম্যান উইলসন–বিখ্যাত ভারততত্ত্ববিদ–হয়তো তুমি নাম শুনেছ।

হ্যাঁ শুনেছি। তুমি বলে যাও।

জান তার সম্বন্ধে? আমার বাবাও সংস্কৃত ভাষা শিখছিলেন। সেই জন্যই ভারতবর্ষে যেতে চেয়েছিলেন। প্রথমে নিউ দিল্লি, তারপর এলাহাবাদ, আমি এলাহাবাদেই জন্মেছিলাম। আমার একটুও মনে নেই এলাহাবাদের কথা। আমার খুব ইচ্ছে করে আবার যাই ওসব জায়গায়। তুমি আমাকে নিয়ে যাবে?

তারপর?

এলাহাবাদ থেকে আমরা গেলাম ডাক্কা–তোমার দেশে

ডাকা নয়, ঢাকা।

ঢাকা? অল রাইট, ও জায়গার কথা আমার একটু-একটু মনে আছে, আমাদের বাংলোটা ছিল ভারি সুন্দর, পাশেই নদী–আর কলাগাছ–কী বিরাট বিরাট পাতা কলাগাছের–আমি আর কখনো এ-পর্যন্ত কলাগাছ দেখিনি–আমার বাবা ব্রিটিশদের সঙ্গেই শুধু না মিশে নেটিভদের, আই মীন বেঙ্গলি জেন্টলম্যানদের সঙ্গে মিশতেই বেশি ভালোবাসতেন–তারাও ভালোবাসত আমার বাবাকে। ওই লোকটি, দ্যাট ম্যান ইন দা ফোটোগ্রাফ ছিলেন আমার বাবার সংস্কৃত শিক্ষক, দু-জনের বেশ বন্ধুত্ব ছিল–ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রত্যেক সন্ধ্যে বেলা অনেক কিছু আলোচনা করতেন, মাঝে মাঝে বেশ তর্কও হত–কিন্তু হঠাৎ একদিন—

অ্যালিস একটু চুপ করতেই তপন মুখ তুলে তাকাল। এতক্ষণ তপন মুখ নীচু করে নিঃশব্দে ব্র্যাণ্ডি পান করে যাচ্ছিল। একটা দীর্ঘ চুমুকে গ্লাস শেষ করে তপন বলল, কী হল তারপর?

ইট ওয়াজ অ্যান অ্যাকসিডেন্ট–হঠাৎ বোধ হয় সেই লোকটির একদিন মাথা খারাপ হয়ে যায়। এ-রকম হয় মাঝে মাঝেই তো শোনা যায়–হঠাৎ কোনো লোক পাগল হয়ে গিয়ে নিজের স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, রাস্তার লোক–যাকে পায় তাকেই খুন করতে ছুটে যায়। সেইরকমই কিছু হয়েছিল নিশ্চয়ই, অমন শান্তশিষ্ট লোকটি হঠাৎ কেনই-বা হিংস্র হয়ে উঠবে! আমার বাবা একটা ডাকাতির কেসে তিনজন বাঙালি যুবককে গ্রেপ্তার করেছিলেন– ওই লোকটি এসে বাবাকে অনুরোধ করে তাদের ছেড়ে দিতে। আমার বাবা বলেছিলেন, ওরা ক্রিমিন্যাল, ওদের ছেড়ে দেওয়ার অধিকার তাঁর নেই, আইন যা করবে তাই হবে। তখন ওই লোকটি চেঁচিয়ে বলল, না, ওরা ক্রিমিন্যাল নয়, ওরা মুক্তিসংগ্রামী। আমার বাবা খুব লম্বা লোক ছিলেন, তিনি ঝুঁকে দাঁড়িয়ে লোকটির কাঁধে হাত রেখে বলেছিলেন, লিসন, বাবু, কোনো ম্যাজিস্ট্রেট তার এলাকার ল অ্যাণ্ড অর্ডারের ব্যাপারে তার সংস্কৃত শিক্ষকের পরামর্শ নেয় না। দুটো আলাদা ব্যাপার। ভবিষ্যতে এ-রকম কোনো অপ্রীতিকর প্রসঙ্গ আর তুলো না। তখন সেই লোকটি হঠাৎ পকেট থেকে একটা পিস্তল বার করে বাবাকে আর কোনো কথা বলারই সুযোগ দেয়নি, খুব ক্লোজ রেঞ্জে পরপর তিন বার গুলি করে–আমি নিজের চোখে দেখিনি–আমার মা নাকি দেখেছিলেন–আমি তখন আয়ার সঙ্গে নদীর পারে বেড়াতে গিয়েছিলাম–গুলির শব্দ পেয়েই ছুটতে ছুটতে এসেছিলাম–বাবার মৃতদেহ আর আমাকে দেখতে দেওয়া হয়নি–শুনেছিলাম, বাবার মুখখানি এমন থেঁতলে গিয়েছিল যে চেনাই যায় না–ঢাকা শহরের বহুলোক কিন্তু আমার বাবার মৃত্যুতে শোকে অভিভূত হয়ে গিয়েছিল, দীর্ঘ শোকযাত্রা হয়েছিল বাবার মৃতদেহ নিয়ে– অনেকে সারভিস অ্যাটেণ্ড করেছিল।

তপন ততক্ষণে বোতলের সবটুকু ব্র্যাণ্ডি শেষ করে ফেলেছে। এখন তার পেটব্যথা নেই, হাত কাঁপছে না, কিন্তু চোখ জ্বলছে। সিগারেট ধরিয়ে দীর্ঘ টান দিতেই তার গলায় যেন ধোঁয়া জড়িয়ে গেল, তপন প্রায় ফিসফিস করে বলল, তারপর, সেই লোকটির কী হল?

আমি ঠিক জানি না। যতদূর মনে আছে, লোকজনের চেঁচামেচি আর ভিড়ের সুযোগ নিয়ে লোকটি পালিয়ে যায়। আর কেউ কোনোদিন তার খোঁজ পায়নি।

এই ছবিটি কখন তোলা হয়েছিল? অ্যালিস যেন এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল। এবার আবার স্ব-কালে ফিরে এল। ছবিটার দিকে এক পলক তাকিয়ে বলল, ওইটা? ওটা আমার মায়ের কাছে ছিল–আমি রেখে দিয়েছি। ছবিটা একসময় খুব বিখ্যাত হয়েছিল, টাইমস-এ ছাপা হয়েছিল–সেইসঙ্গে সমস্ত কাহিনিটাও–নিহত এবং হত্যাকারী পাশাপাশি দাঁড়িয়ে হাসছে–এ-রকম ছবি তো সহজে দেখা যায় না। ওটা একটা প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশানের সময় তোলা। আমার বাবা সেই সেরিমনিতে প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তিনি পুরস্কার তুলে দিচ্ছেন লোকটির হাতে–ছবিতে দু জনে দু-জনের মুখের দিকে হাসিমুখে চেয়ে আছে। অথচ

তপন একটা বড়ো নিশ্বাস ফেলল। তারপর আপন মনেই বিড়বিড় করে বাংলায় বলল, ঘটনাটা এ-রকম নয়, এ-রকম নয়, অন্যরকম, আমি জানি

অ্যালিস তপনের কথা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, কী বলছ টপন? তুমি ও-রকম করছ কেন? তোমার শরীর খারাপ লাগছে? ফিলিং ডিজি?

হ্যাঁ, একটু। আমাকে এক মিনিট ক্ষমা করো, ইয়ে, জায়গাটা কোথায়?

অ্যালিস তাড়াতাড়ি উঠে তপনকে বাথরুম পর্যন্ত নিয়ে এল। প্রায় টলতে টলতেই তপন ঢুকে পড়ে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিল। এবং সঙ্গে সঙ্গে হড় হড় করে বমি করে ফেলল বাথরুমের মেঝেতে। বাইরে থেকে অ্যালিসের উৎকণ্ঠিত প্রশ্ন ভেসে আসতেই তপন কোনোক্রমে নিজেকে সামলে নিয়ে আড়ষ্ট গলায় উত্তর দিল, না, বিশেষ কিছু হয়নি। ডোন্ট ওরি, হানি! এক্ষুনি ঠিক হয়ে যাবে।

ব্র্যাণ্ডি খেয়ে তপনের কোনোদিনও বমি হয়নি, তার লজ্জা করতে লাগল। চোখে মুখে ভালো করে ঠাণ্ডা জল ছেটাতেই অনেকটা সুস্থ মনে হল, বাথরুমের জানলা খুলে দিয়ে কনকনে হাওয়ায় নিশ্বাস নিতে নিতে তপনের মাথার ঝিমঝিমুনি ভাবটা কেটে গেল। আঃ! ঘরের মধ্যে একেবারে বদ্ধ হাওয়া। আঃ! কিন্তু ঘটনাটা ও-রকম নয়, অ্যালিস। মোটেই ও রকম নয়। কিন্তু এই ঘটনাটা শোনার জন্য তপন কেন এখানে এল! না এলেও তো পারত! আজ সন্ধ্যে বেলা লণ্ডনের অন্য যেকোনো জায়গাতে থাকলেই তার সময় ফুরফুরে আনন্দে কেটে যেত, তাকে বমি করতে হত না! তপন নিজেকে অভিশাপ দিল মনে মনে।

বেশ কিছুক্ষণ বাদে বাথরুম থেকে বেরোল তপন। অ্যালিস তখন রেকর্ড প্লেয়ারে হালকা কনসার্ট দিয়েছে। নষ্ট হবার ভয়ে দামি পোশাকটা খুলে রেখে নেগলিজে ধরনের রাত পোশাক পরে নিয়েছে, ঘরের আলো মৃদু। কেউ কিছু মুখে বলেনি, কিন্তু দু-জনেই মনে মনে জানত আজ সারারাত ওরা এক সঙ্গে থাকবে। পাতলা পোশাকের মধ্য দিয়ে অ্যালিসের বরবৰ্ণিনী শরীরের আভাস, চোখে-মুখে লাস্য, তপন স্থিরভাবে তাকিয়ে রইল। তার চোখ দুটো লাল, চুল এলোমেলো হয়ে গেছে, ভুরুতে কপালে লেগে আছে জলের ফোঁটা।

অ্যালিস জিজ্ঞেস করল, এখন কেমন লাগছে? ফিলিং অল রাইট?

না, অ্যালিস আমাকে এক্ষুনি হোটেলে ফিরে যেতে হবে।

কী? হোটেলে ফিরে যাবে? হোয়াই অন আর্থ—

 উপায় নেই অ্যালিস। আমার পেটে বিষম ব্যথা হচ্ছে, ওযুধ আছে হোটেলের ঘরে, ওষুধ না খেলে সারারাত আমি যন্ত্রণায় ছটফট করব।

কী ওষুধ? এখানে কোনো ডিসপেনসারি থেকে কিনে আনছি আমি, তুমি নাম বলো—

না, তুমি পারবে না। লিস্টেড ড্রাগ, প্রেসক্রিপশান ছাড়া বিক্রি করবে না। প্রেসক্রিপশান আমার সঙ্গে নেই, আমাকে যেতেই হবে–

ঠিক আছে, তুমি দু-মিনিট অপেক্ষা করো, আমি পোশাক পরে নিচ্ছি, আমিও তোমার সঙ্গে যাব

না, না, তোমাকে আর যেতে হবে না।

বাঃ, এই অবস্থায় তুমি একা যাবে নাকি?

ঠিক পারব। লক্ষ্মীটি অ্যালিস, তুমি চিন্তা কোরো না, আমার গ্যাসট্রিকের ব্যথা ওষুধ খেলেই কমে যাবে–তারপরেই ঘুম আসবে–তুমি আবার একা একা ফিরবে?

আমি ঠিক ফিরতে পারব। আমার কোনো অসুবিধে হবে না।

সত্যিই তোমার যাবার কোনো দরকার নেই। আমি একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলে যাব

ট্যাক্সিতে এতখানি রাস্তা? তিন-চার পাউণ্ড ভাড়া উঠে যাবে–তার চেয়ে আমি বরং তোমার সঙ্গে টিউবে।

না, তার দরকার নেই। আমি ট্যাক্সিতে যাব।

যদি ওই ওষুধে তোমার ব্যথা না কমে? যদি হাসপাতালে যেতে হয়? এখনও খুব ব্যথা করছে?

খুব। কিন্তু হাসপাতালে যেতে হবে না। আজ বড্ড বেশি অ্যালকোহল খেয়ে ফেলেছি, দুপুর থেকে জিন খাচ্ছিলাম, তারপর তোমার এখানে–

তা হলে কাল কখন দেখা হবে?

–কাল, তোমার অফিস ছুটির পর আমি তোমাকে পিক আপ করে নেব। কাল বিকেল সাড়ে পাঁচটায়–পিকাডেলি সারকাসে, এরসের মূর্তির কাছে–গুড নাইট, অ্যালিস।

.

০২.

টেড-এর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল সানফ্রান্সিসকো থাকার সময়। দু-জনেই তখন বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিউক্লিয়ার ফিজিক্স নিয়ে গবেষণা করছে। আমেরিকায় পৌঁছে প্রথম কিছুদিন তপনের খুব মন খারাপ লাগত। ঠিক যে দেশের জন্য মন কেমন করত, তা নয়। বাংলাদেশের ওপর রাগ করেই তপন বাংলাদেশ ছেড়েছিল, সে-রাগ তখনও একটুও কমেনি। নিজের দেশের জন্যও মন কেমন করে না, অথচ বিদেশেও ভালো লাগছে না–এই অদ্ভুত অবস্থার মধ্যে ছিল তখন তপন।

কলকাতায় যখন তপন পি এইচডি-র থিসিস দিয়েছিল–তখন তার অন্যতম পরীক্ষক ছিলেন বার্কলে ইউনিভার্সিটির ড. লেভিন। ড. লেভিনই তপনের কাজ দেখে খুশি হয়ে লিখেছিলেন যে, তপন যদি আমেরিকায় এসে গবেষণা করতে চায়–তিনি ব্যবস্থা করে দেবেন। কলকাতায় দলাদলি, নোংরামি এবং নীচতা দেখে দেখে সেসময় তপনের বুকভরতি অভিমান, ড. লেভিনের আহ্বানে তৎক্ষণাৎ সাড়া দিয়েছিল। কাজ করবার সুযোগ ছাড়াও মাসে সাড়ে চার-শো ডলার স্কলারশিপ–দু-বছরের মধ্যেই সেটা বেড়ে সাড়ে আট-শো ডলার হয়েছিল–অত টাকা পাবার কথা তপন কখনো কল্পনাই করেনি। কলকাতায় একটা কলেজে সে সামান্য আড়াইশো টাকার একটা লেকচারার পদের জন্য আবেদন করেও পায়নি, তপন ফার্স্টক্লাস সেকেণ্ড হয়েছিল–তবু তাকে ডিঙিয়ে হেড অব দি ডিপার্টমেন্টের অগামারা ভাইপোকে সেটা দেওয়া হয়েছিল।

গরিবের ছেলে তপন, বিদেশে যাওয়ার খরচ জোগাড় করা তার পক্ষে কোনোক্রমেই সম্ভব ছিল না। তখন সিগারেট কিনে খাবারও সামর্থ্য ছিল না তার, বন্ধুবান্ধবরা না খাওয়ালে বিকেলে জলখাবার খাওয়ার বিলাসিতার কথাও ভাবতে পারত না। ড. লেভিনের প্রস্তাবটা পেয়ে তপন যেন আবার বাঁচার স্বাদ ফিরে পেল। প্লেন ভাড়ার জন্য স্কুল ব্রাইট স্কলারশিপ জোগাড় করতে খুব অসুবিধে হল না। মাকে প্রণাম করে তপন যেদিন কলকাতা ছেড়ে আকাশে উড়ল–সেদিনই তপন একরকম ঠিক করে ফেলেছিল–সম্ভব হলে সে আর দেশে ফিরবে না। মা যদি খুব কান্নাকাটি করেন–তবে অবশ্য আলাদা কথা, তখন তাকে ফিরতেই হবে–বিধবা মা নিশ্চয়ই আমেরিকায় গিয়ে তার সঙ্গে থাকতে চাইবে না। কিন্তু মায়ের মৃত্যুর পর তপনের আর কোনো দ্বিধা রইল না।

তপন যখন সানফ্রান্সিসকোয় পৌঁছোয়, তখন বিশ্ববিদ্যালয় খোলেনি, নতুন সেমেসটার আরম্ভ হতে তখনও এক সপ্তাহ দেরি আছে। সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে তপন সম্পূর্ণ একা, ড. লেভিন ছাড়া আর একটা মানুষকেও চেনে না। আসার পথে লণ্ডনে মাত্র দু-দিনের জন্য থেমেছিল–সেখান থেকে সোজা চলে এসেছে সানফ্রান্সিসকোতে–অকস্মাৎ পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। সানফ্রান্সিসকো শহরটা ছবির মতন সুন্দর-অত সুন্দর বলেই নিঃসঙ্গতা আরও বেশি করে মন ভারী করে দেয়। গোল্ডেন গেট ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে সমুদ্রের দিকে চোখ রেখে তপনের মনে হত, তার অতীতকে সে অস্বীকার করে চলে এসেছে, তার সামনে কোনো ভবিষ্যতের ছবিও নেই।

সেই সময়েই টেডের সঙ্গে আলাপ। তখনও ওরা কেউ জানত না যে ওরা দু-জনেই বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগে ভরতি হয়েছে। সেসময় সানফ্রান্সিসকোয় বিটনিকদের ছড়াছড়ি। এই বিটনিকদের বলা যায়, হিপিদের পূর্বপুরুষ। টেডকে দেখে বোঝাই যায়নি, সে বিজ্ঞানের একজন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। টেডও একমুখ দাড়ি রেখেছে, ময়লা ট্রাউজার্সের সঙ্গে একটা বুকখোলা শার্ট, মাথার চুলগুলো রুক্ষ। কলম্বাস অ্যাভিনিউতে একটা বইয়ের দোকানে দাঁড়িয়ে তপন পত্রপত্রিকা দেখছিল, পাশেই টেড একজোড়া যুবক-যুবতীর সঙ্গে তর্কে মত্ত। তর্কের বিষয় শুনে তপন কান খাড়া করেছিল। টেড ও তার বন্ধুবান্ধবীরা শ্রীকৃষ্ণ ও ভগবৎ গীতা নিয়ে খুব গরম গরম আলোচনা জুড়েছে। তপন শাস্ত্র-টাস্ত্র তেমন পড়েনি, কিন্তু সাধারণ জ্ঞান থেকেই সে ওদের জ্ঞানের বহর টের পেয়ে হাসছিল মৃদু মৃদু। টেডের ধারণা, গীতা হচ্ছে বেদেরই একটা অংশ, বেদের চারটে ভাগ–তার চতুর্থ ভাগের নাম গীতা এবং সেটা এমনই উচ্চাঙ্গের বই যে যিশুখ্রিস্টের জন্মের আগে–ইউরোপ যদি ও বইয়ের সন্ধান পেত– তা হলে ইউরোপে আর কেউ খ্রিস্টান না হয়ে সবাই হিন্দু হয়ে যেত।

তপন শুধু শুনছিল, কোনো কথা বলেনি। কিন্তু একবার ও আর সামলাতে পারল না, উপযাচক হয়েই কথা বলে ফেলল। যিশুখ্রিস্টের নাম যেমন যিশাস ক্রাইস্ট, কিন্তু শুধু যিশাস বললেও তাঁকেই বোঝায়, সেইরকম, টেডের ধারণা শ্রীকৃষ্ণকে শুধু শ্রী বলেও ডাকা যায়। শ্রী যেন কৃষ্ণের ডাক নাম। তপন হাসিমুখে ওদের কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বলেছিল, এক্সকিউজ মি, বোধ হয় আপনাদের ভুল হচ্ছে—

সেই থেকে আলাপ। টেড এক নিমেষে মানুষকে বন্ধু করে নিতে জানে। সেইদিনই সন্ধ্যে বেলা তপনকে ডিনার খাওয়ার জন্য নেমন্তন্ন করল টেড। তপনের ব্যক্তিগত কোনো কথা জানতে চাইল না, তপন কেন আমেরিকায় এসেছে সে-সম্পর্কে আগ্রহ দেখাল না–শুধু ভারতবর্ষ আর হিন্দুধর্ম সম্পর্কে ঝুড়ি ঝুড়ি প্রশ্ন করতে লাগল।

কলেজ খোলার পর একই ডিপার্টমেন্টে যখন দু-জনে দু-জনকে আবিষ্কার করল, তখন দু জনেই খুশি হয়ে উঠল। টেড কোনোদিনই কেতাদুরস্ত পোশাক পরে না কিংবা গলায় টাই বাঁধে না। ওর মাথার চুলগুলো একেবারে সোনালি–রোদ্দুর লাগলে মনে হয় জ্বলজ্বল করছে–সেই চুলে বোধ হয় বহুবছর চিরুনি পড়েনি। কথাবার্তার মধ্যে টেড এমন শব্দ ব্যবহার করে–যা শুনলে কিছুদিন আগেও তপন লজ্জায় লাল হয়ে উঠত। টেডের ঘরে তপন একটি মেয়েকে দেখেছিল, দারুণ সুন্দরী মেয়েটি, ছবি আঁকে–টেডের সঙ্গেই এক ঘরে থাকে কিন্তু ওদের বিয়ে হয়নি। টেড অম্লানবদনে সেকথা তপনকে জানিয়েছিল–সেবিষয়ে টেড কিংবা সেই মেয়েটি, জুডিথ–কারুরই কোনো দ্বিধা বা লজ্জা নেই। টেডের চরিত্রে এমন একটা চারুলতা ও পাগলামি ছিল–যা তপনের খুব ভালো লাগত। টেডের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য বন্ধুত্ব হয়ে গেল তপনের। এসব পাগলামি সত্ত্বেও, ছাত্র হিসেবে টেড সাংঘাতিক মেধাবী অধ্যাপকরাও তাকে খাতির করত এইজন্য। টেডের সাহচর্যে তপনের অনেক সংস্কার যেমন কেটে গেল–তেমনি পড়াশুনোর ব্যাপারেও খুব উপকার হল।

তপন প্রথম দিকে বেশ কয়েকমাস জানতেই পারেনি যে টেড জাতে ব্রিটিশ। বছর চারেক আগে একটা স্কলারশিপ পেয়ে টেড ইংল্যাণ্ড থেকে আমেরিকায় এসেছিল–এখন আমেরিকার জীবন তাকে এমন আকর্ষণ করেছে যে, সে আর ইংল্যাণ্ডে ফিরে যেতে চায় না। ব্রিটিশ জাতের প্রতি তপনের বরাবরই একটা বিদ্বেষ ছিল, কিন্তু টেডের মধ্যে সে ব্রিটিশ জাতের অন্য একটা দিক দেখতে পেল। ভারতবর্ষের প্রসঙ্গ উঠলে টেড মাঝে মাঝে একটু চুপ করে যেত। তারপর আস্তে আস্তে বলত, আমার ঠাকুরদা আসামের দুটো চা বাগানের মালিক ছিলেন। চাবুক মেরে কী করে তিনি কুলিদের শায়েস্তা করতেন–সে-গল্প প্রায়ই করতেন সাড়ম্বরে। তুমি ইণ্ডিয়ান, একথা শুনে রাগ হচ্ছে না তোমার? প্রতিশোধ নিতে চাও? ঠিক আছে তপন আমি জামা খুলে দাঁড়াচ্ছি–তুমি আমার পিঠে চাবুক মেরে তার শোধ নিতে পার।

তপন তখন হেসে ওকে একটা ধাক্কা দিয়ে বলত, এ কী টেড, এত সেন্টিমেন্টাল হয়ে যাচ্ছ কেন? আমি জাতে বিশ্বাস করি না, আমি ধর্মে বিশ্বাস করি না–আমার ওসবে কিছু যায়-আসে না। ভারতবর্ষ দুর্বল ছিল–তাই ব্রিটিশরা তার সুযোগ নিয়েছে।

টেড বলেছিল, তুমি সত্যিই ব্যাপারটা ভুলে যেতে পার? আমাকে দেখলে তোমার একটুও রাগ হয় না?

তপন জোর দিয়ে বলেছিল, না রাগ হবে কেন? আমি ওসব ভুলে গেছি।

টেড বলেছিল, তা পার তুমি একজন গ্রেটম্যান। আমি কিন্তু আমার জাতের কলঙ্কের কথা ভুলতে পারি না। ব্রিটিশরা অবশ্য অনেক কলোনিতেই অত্যাচার করেছে কিন্তু আমার বংশের পূর্বপুরুষরা সবাই ভারতবর্ষ থেকেই সম্পদ চুরি করে এনেছে–আমি ভারতবর্ষের কথাই বেশি জানি। তাঁরা যেসব নিয়ে গর্ব করতেন–তা নিয়ে আমার লজ্জা হয়।

তপন বলেছিল, তুমি একজন পদার্থবিদ, তুমি এত পুরোনো ইতিহাস নিয়ে মাথা ঘামাও কেন? আমি ইতিহাসে কোনো ইন্টারেস্ট পাই না। পদার্থ কীভাবে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়– সেই রহস্যই আমাকে বেশি টানে।

আমেরিকায় টেডের সঙ্গেই তপনের সবচেয়ে বেশি বন্ধুত্ব হয়ে গেল। টেডের গাড়িতে চড়ে ও সারা আমেরিকা ঘুরেছে, টেডের সঙ্গে ও নেভাডায় গিয়ে জুয়া খেলেছে, শিকাগোয় নাইট ক্লাবে সারারাত ধরে নেচেছে, লস এঞ্জেলসে গিয়ে সমুদ্রে সাঁতার কেটেছে। সবসময় সঙ্গে দু টি করে মেয়েও থাকত! টেডের মত হচ্ছে যে, সপ্তাহে অন্তত সাত ঘণ্টা মেয়েদের সংসর্গে না কাটালে পুরুষদের বুদ্ধিবৃত্তি ভোঁতা হয়ে যায়। আবার তার চেয়ে বেশি সময় কাটালেও ভোঁতা হয়ে যায়।

তপন আবার লণ্ডনে এসেছে টেডেরই বিশেষ অনুরোধে। তপনের কথা ছিল কানাডায় যাওয়ার। মা মারা যাওয়ার পর ভারতবর্ষে ফেরার ইচ্ছে তার সম্পূর্ণ চলে গিয়েছিল। কিন্তু আমেরিকায় স্থায়ীভাবে ইমিগ্রান্ট হতে হলে প্রথম পাঁচ বছর কাটার পর দু-বছর আমেরিকার বাইরে কাটাতে হয়। সুতরাং কাছাকাছি কানাডাতেই থাকা সবচেয়ে সুবিধের– কুইবেক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের চাকরিও সহজে পেয়ে গেল–মাসে এগারো-শো ডলার মাইনে। সেপ্টেম্বর থেকে কলেজ খুলবে, মাঝখানে দু-মাস ছুটি- তপনের হাতে অনেক টাকা জমে গেছে–ও ভেবেছিল এই দু-মাসে ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলো বেড়িয়ে আসবে–এমন সময় দেশ থেকে চিঠি এল, কাকার মেয়ে টুকুর বিয়ে হচ্ছে, তপনকে আসতেই হবে। তপন না গেলে টুকু মনে আঘাত পাবে-কাকা-কাকিমা কেউই তৃপ্তি পাবেন না।

চিঠিটা পেয়ে তপন একটু হেসেছিল। মা মারা যাবার পর বাড়ি থেকে চিঠি আসা প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু ইদানীং তপন বেশ ভালো চাকরি পেয়েছে ও অনেক টাকা রোজগার করছে-অস্পষ্টভাবে এই খবর পেয়ে কাকা-কাকিমা আবার মহা উৎসাহে তাকে চিঠি লেখালেখি শুরু করেছিলেন। তপন ভেবেছিল, এটাই তো স্বাভাবিক। টাকার তো একটা বিশেষ সম্মান থাকবেই কাকার অবস্থা খুব খারাপ নয়, ডাক্তার হিসেবে ভালো পসার আছে-–ওঁরা হয়তো তপনের টাকার প্রত্যাশা করেন না–কিন্তু বড়োলোক আত্মীয়দের খাতির করাই সামাজিক নিয়ম। নিজে না গিয়ে একটি দামি উপহার পাঠিয়ে দিলেই চলত–কিন্তু তপন হঠাৎ ঠিক করে ফেলল–এই দু-মাসের জন্য সে ভারতবর্ষে ঘুরে আসবে। এ তো আর দেশে ফেরা নয়, টুরিস্টরা যেমন বিদেশে বেড়াতে যায়–এও সেইরকম বেড়ানো। আর দু-এক বছর পর তপন আমেরিকার নাগরিক হয়ে যাবে–ভারতবর্ষ তার কাছে বিদেশ ছাড়া আর কী!

তাও তপন ঠিক করেছিল, যাওয়ার পথে লণ্ডনের রুটে না গিয়ে ফ্রান্স-ইটালি ঘুরে যাবে। লণ্ডন দেখেছে আসার পথে, তার ভালো লাগেনি, তার চেয়ে প্যারিস-রোম দেখাই তার ইচ্ছে! কিন্তু টেডকেও ঠিক এই সময় লণ্ডনে যেতে হল। এক দূর সম্পর্কের পিসিমা মারা যাওয়ার সময় টেড হঠাৎ কিছু সম্পত্তি পেয়েছে–টেড সেটা আনতে যাবে–তপনও সেসময় ভারতবর্ষে যাবে শুনে তপনকে লণ্ডনে থামার জন্য টেড একেবারে মাথার দিব্যি দিয়ে যায়।

অবশ্য টেডের অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও তপন টেডের বাড়িতে ওঠেনি। গ্রাভনার কোর্টের কাছে এক হোটেলে উঠেছে তপন–এখান থেকে পিকাডেলি সার্কাস কিংবা হাইড পার্ক কোনোটাই খুব দূরে নয়। দিনে চার পাউণ্ড ঘর ভাড়া–তবু তপনের গায়ে লাগে না, তার হাতে এত টাকা জমেছে এই পাঁচ বছরে। লণ্ডনে সাতদিন থাকার পর নিউ ক্যাসেলে চলে গেছে টেড। ওই সাতদিন হর্সফেরি রোডে টেডের বাড়িতে প্রত্যেক সন্ধ্যায় পার্টি লেগে থাকত–সেখানে তপন রোজ হাজির হয়েছে।

সেখানেই দু-টি মেয়ের সঙ্গে আলাপ, বারবারা আর অ্যালিস। টেডের পার্টিতে অন্তত চল্লিশ-পঞ্চাশজন নারী-পুরুষ উপস্থিত থাকত, তাদের মধ্যে ওই দু-জনকেই টেডই দেখিয়েছিল আলাদা করে। তপনকে আড়ালে ডেকে টেড বলেছিল, শোনো টপ, লণ্ডনে যে ক-দিন থাকবে–তুমি বোকার মতন একা একা ঘুরবে–তা আমি চাই না। একটা মেয়ে সঙ্গে থাকলে মন ভালো থাকে। ওই যে দুটি মেয়ে, বারবারা আর অ্যালিস–আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি–ওরা দু-জনেই এখন অনেকটা ফাঁকা আছে–ওদের কোনো স্টেডি বয়ফ্রেণ্ড নেই–তুমি ওদের দুজনের যেকোনো একজনকে বেছে নাও–তারপর, তোমার যা খুশি

কিন্তু বেছে নেওয়া অত সহজ নয়। অ্যালিস আর বারবারা– দু-জনের প্রায় একইরকম চেহারা। বারবারা কুমারী-অ্যালিসের চেয়ে দু-তিন বছরের ছোটো, আর অ্যালিসের একবার বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেছে–তবু দু-জনেরই তন্বী শরীর, ভরাট স্তন, ছন্দোময় পদক্ষেপ, সুদৃশ্য দাঁতের পাটি, উপস্থিতিতে একইরকম প্রসাধনের সুগন্ধ। সোহো পল্লির এক রেস্তোরাঁয় পর পর দু-দিন আলাদাভাবে ওদের দুজনকেই নেমন্তন্ন করেছিল তপন। দু জনেরই কথাবার্তা সুন্দর, দু-জনের কারুরই রঙের ব্যাপারে গোঁড়ামি নেই। যেকোনো রসিকতা ওরা দুজনেই চট করে বুঝতে পারে, মধুর ঝংকারে হাসে মাথা দুলিয়ে। তপনের ব্যবহারে ওদের চোখে-মুখে একটা মুগ্ধতা ফুটে উঠেছিল। তপনের সুঠাম স্বাস্থ্য, নিখুঁত আদবকায়দা, সাবলীল ভঙ্গি–তা ছাড়া মেয়েদের কাছে এসে তপন কোনোরকম গদগদ ভাব দেখায় না, প্রায় প্রথম আলাপ থেকেই হুকুমের সুরে কথা বলে-এটাও ভালো লাগে মেয়েদের। তপন টাকাও খরচ করে খোলামকুচির মতো–তাকে দেখে একবারও মনে হয় না সে গরিব ভারতবর্ষের লোক, সে অতি দরিদ্র পরিবারের সন্তান। রেস্তোরাঁয় বিল মেটাবার সময় তপনের কাছে খুচরো পাউণ্ড ছিল না, ম্যানেজারকে ডেকে বলল সে একটা এক-শো ডলার ট্রাভেলার্স চেক ভাঙাতে চায়–টাকাগুলো পেয়ে গুণেও দেখল না পর্যন্ত, অবহেলাভরে তার থেকে আস্ত একটা পাউণ্ড সে বেয়ারাকে বকশিশ দিয়ে দিল! তাই দেখে বারবারা বলেছিল, আমি এ-পর্যন্ত কারুকে চার পাউণ্ডের বিল মেটাতে গিয়ে এক পাউণ্ড বকশিশ দিতে দেখিনি!

বারবারা আর অ্যালিস–যেকোনো একজনকেই সে বেছে নিতে পারত। আঃ, তপন ভাবল, কেন সে বারবারাকে বেছে নেয়নি! তা হলে এই সন্ধ্যেটা কত আনন্দে কাটতে পারত। নিছক একটা দুর্ঘটনা! শুধু একটা নাম, বারবারার আর কোনো দোষ ছিল না–কিন্তু তার নামটা তপনের পছন্দ হয়নি। আর কোনো আলাদা বিশেষত্ব ছিল না অ্যালিসের, শুধু নামটাই তার সুন্দর বারবারার চেয়ে। অ্যালিস নামের মধ্যেই একটা রূপকথার গন্ধ, স্বপ্নের গন্ধ, হঠাৎ শৈশবের কথা মনে পড়ে যায়–শুধু এইজন্যই মনে মনে বেছে নিয়েছিল অ্যালিসকে। আর, সঙ্গে সঙ্গেই পাশার দান পড়ে গেল।

বারবারা তপনের মনের ভাব বুঝতে পেরে নিজে থেকেই সরে গিয়েছিল। তারপর শুধু অ্যালিসের সঙ্গে পার্কে পার্কে ঘোরা, সিনেমা, আর্ট গ্যালারি, প্রত্যেকদিন একসঙ্গে ডিনার আর হোটেলে বহুরাত পর্যন্ত অ্যালিস তাকে সঙ্গ দিয়েছে। অ্যালিসকে তপন কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি, কোনো মিথ্যেকথা বলেনি–স্পষ্টই বুঝিয়ে দিয়েছে, সে মাত্র আঠারো দিন থাকবে ইংল্যাণ্ডে, তারপর চলে যাবে–আর হয়তো সারাজীবন দেখা হবে না অ্যালিসের সঙ্গে। শুধু হালকা উচ্ছল আনন্দের কয়েকটি দিন। কিন্তু উচ্ছলতায় নিবিড় ছায়া পড়ল। দাবির চেয়েও অতিরিক্ত দিতে চায় অ্যালিস, তার অন্য সব পুরুষবন্ধুদের ভুলে শুধু তপনের সঙ্গেই থাকতে চায়। লোভী মেয়ে নয় অ্যালিস, তপনের টাকাপয়সা খরচ করিয়ে ফুর্তি করাই তার উদ্দেশ্য নয়, বরং তপন বেশি খরচ করলে অ্যালিস খুব আপত্তি জানায়। একদিন সামান্য জ্বর হয়েছিল তপনের, সেদিন অ্যালিসের মুখে পড়েছিল জননী বা জায়ার মতো আশঙ্কায় ছায়া।

আজই প্রথম তপন এসেছে অ্যালিসের ঘরে। আজ অ্যালিসের জন্মদিন, শুধু তপনকেই একা নেমন্তন্ন করেছে সে। কেউ মুখে কিছু বলেনি, তবু যেন মনে মনে ঠিক ছিল–আজ সারারাত ওরা একসঙ্গে কাটাবে। অল্প আসবাবেও বেশ সুন্দর ছিমছাম সাজানো অ্যালিসের ঘর। লাইব্রেরিয়ানের চাকরি করে অ্যালিস, মাইনে খুব বেশি পায় না, কিন্তু ঘরে কোনো দারিদ্র্যের ছাপ নেই। পর্দার রঙের সঙ্গে বেডকভার; সোফা আর ড্রেসিং টেবিলের ম্যাটের রং মেলানো। কিন্তু সব কিছু ভালোভাবে দেখবার সুযোগ হয়নি তপনের। ঘরে ঢোকবার কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই চুম্বকের মতন দেয়ালের একটা ছবি তাকে টেনে নিয়ে গেল। ছবিটা থেকে তপন চোখ ফেরাতে পারেনি। আকৃষ্টভাবে জিজ্ঞেস করেছিল, ওই ছবিটা এখানে কেন?

অ্যালিস লঘু হাস্যে বলেছিল, ওটা একটা ছবি। এক সময় টাইমস-এর ক্রিসমাস সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল।

তপন অ্যালিসের সঙ্গে হাসির সৌজন্য বিনিময় করেনি। আরও কাছে গিয়ে ছবিটা পরীক্ষা করেছিল এক দৃষ্টে। তারপর :

ওই ছবিটা কার?

আমার বাবার।

না, পাশে দাঁড়ানো লোকটি?

ওই ব্যক্তি আমার পিতার হত্যাকারী—

কেন টেডের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল? কেন টেডের অনুরোধে লণ্ডনে এসেছিল? কেন সে অ্যালিসের বদলে বারবারাকে বেছে নেয়নি? তা হলে আর তপনের বুকে পুরোনো ক্ষতের ব্যথা জেগে উঠত না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *