১. বৈশাখের শেষ

সূর্য তুমি সাথী – উপন্যাস – আহমদ ছফা

উৎসর্গ
ড: মফিজুদ্দীন আলী মুহাম্মদ চৌধুরী
শ্ৰদ্ধাস্পদেষু

বৈশাখের শেষ। আধা বছর জুড়ে বিশাল নীলাকাশে সূর্যের রূপোলী আক্রোশ সহস্র শিখায় শ্যামল পৃথিবীতে আগুন ঢেলেছে। অগ্রহায়ণের শেষাশেষি একদিন আসমানের চার কোণে জমাট বাঁধা কালো মেঘ কালো গাইয়ের ওলানের বরণ ধরেছিলো। বজ্রেরা চীৎকার করে ফেটে পড়েছিলো। মেঘের বুক চিরে চিরে বিজুলীর শাণিত ছুরি ঝিকঝিকিয়ে জেগেছিলো। লোকজন আতঙ্কে ফরিয়াদ করেছিলো অগ্রহায়ণ মাস পাকা সোনারঙ ধান ঘরে আসার মৌসুম। এমনি সময়ে যদি বৃষ্টি নামে। কথায় বলেঃ

‘যদি বিষ্টি আগনত
মানুষ যায় মাগনত’
(অগ্রহায়ণে যদি বৃষ্টি হয় মানুষ ভিক্ষে করতে বেরোয়।)

লোকজনের ভাগ্য ভালো। আসমানের আল্লাহর উদ্দেশে শোকর গুজার করেছিলো। অগ্রহায়ণে বিষ্টি হয় নি। পৌষে না। মাঘে না। ফাঙ্গুন-চৈত্র গেলো। বৈশাখও যাই যাই; আর কয়দিনই বা বাকী। এরি মধ্যে আকাশ একবারও করুণায় সজল হয়ে ওঠেনি। গনগনে সুর্যের হতাশনে রবিশস্যের ক্ষেত জ্বলে গেলো। ঢোড়া সাপের মতো তরমুজ লতার লক্লকে প্রসারিত ডগা মিইয়ে এলো। খরায় গাছের পাতারা তামাটে রঙ ধারণ করলো। আসমানের বিশাল ভয়ঙ্কর শুভ্র শিখার কুণ্ড লক্ষ লক্ষ আগুনে রসনার তাপে পলকে পলকে ধরিত্রীর রূপরস শুষে নিচ্ছে; গোলাকার প্রসারিত খোলের তলায় গলানো রূপোর মতো শিখারা ঝিলিমিলি খেলা করে। ডাইনে-বাঁয়ে-সামনে-পিছে যতদূর যায় চোখ–আগুন, আগুনের হলুদ শিখা। মাঠে আগুন, গাছে আগুন ফসলে আগুন, প্রকৃতির শিখাহীন নীরব প্রদাহের মতো মানুষের অন্তরে উদরেও আগুন, আগুনের কণা। সহস্র শ্রাবণের অক্লান্ত বর্ষণের ঝিকিমিকি বহ্নিমান, অনিভন্ত।

আগুনের জোয়ার ফোলা সাগর সাঁতরে যেনো এলো হাসিম। তার বুকে-পেটে, চোখে-মুখে আগুন। ধুকে ধুকে বন্যা পুকুরের বটতলায় এসে কাঁধের লাকড়ির ভারখানা নামালো। বটগাছ যেখানে শীতল ছায়া মেলে দিয়েছে, সেখানেই ছায়ার কোলে আধা সেদ্ধ শরীরখানা এলিয়ে দিলো। মাটির ভাপে শুকিয়ে যাওয়া ঘাসের ওপর বাদবাকী শরীরখানা রেখে চোখ বুজে রইলো। কিছু ভাবতে পারে না হাসিম। ভাবনার সূত্র জ্বলে গেছে। বন পেরিয়ে বিলে নামার পর থেকে এ বটগাছ স্নেহময়ী জননীর মতো ছায়াভরা হাতছানি ডেকে ডেকে পাক্কা চার মাইল পথ গরম তাজা বালুর ওপর দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে এসেছে তাকে। চোখ বুজে থাকতে পারে না। আগুনে পোড়া অর্ধগ্ধ শরীরের চেতনায় কি এক অনুভূতি জেগে উঠতে চায়। সূর্যের ধারালো নখর বুকের ভেতর যেখানে কজে, সেখানে তপ্ত গরম ছ্যাকা দিয়েছে।

লুঙ্গিটা বদলে গামছাখানা কোমরের গিঠ খুলে পরে নিলো। তারপর তালগাছের পিছল ঘাটের ওপর বসে দু’হাত পানিতে ডুবিয়ে আঁজলা ভরে এক আঁজলা পানি তুলে নিলো। ফেলে দিলো। পুকুরের পানিতেও আগুন। এক পা, দুপা করে ধীরে ধীরে গলা পানিতে নেমে এলো। ঝুপ করে একটা ডুব দিলো, আরেকটা ডুব দিলো। ধুলোয় ধুসরিত গা ডলতে ডলতে অনেকগুলো ডুব দিলো। পানির ওপরে কালো মাথা জাগিয়ে খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। হাসিমের দেহের উত্তাপ শীতল পানি শুষে নিচ্ছে। লোমকূপের গোড়ায় কাঁপছে স্নিগ্ধ শীতল অনুভূতি। তার প্রাণ, অনুভূতি ফিরে এলো দেহে। কেমন শান্ত, নিবিড়, মেহঘন ছোঁয়া।

একটা কক্সবাজারের বাস হর্ণ বাজিয়ে দক্ষিণে ছুট দিলো। দু’টো রিক্সা আঁকাবাঁকা রোডের ওপর ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে চলছে। ধীর মন্থর গতি। টুং টাং ঘন্টাধ্বনি বাতাসে ভেসে চলে যায় অনেক দূর। আকাশের বুকে তীক্ষ্ণ তেরছা একটা রেখা টেনে একটা পাখি উড়াল দিলো। সূর্যের আলো বাদামী রঙের পাখনায় চিকচিক করে ঝলসে ওঠে। একটা চিল দিকচক্ৰবালে চক্রাকারে ক্কর খেলছে। পানির সমতলে পড়ছে ছায়া। রোদজ্বালা দুপুরের তপ্ত নির্জনতাকে ফালি ফালি করে কেটে চিহি স্বর বেজে উঠছে। চোখ-জ্বলা রোদে চিলের মর্মন্তুদ চিহি ডাক বুকে আগুন জ্বালিয়ে দেয়… আলোড়নের মতো ছড়িয়ে পড়ে।

গা ধোয়া সেরে পুকুর থেকে উঠে আসে। গামছা বদলে আবার লুঙ্গি পরে নিলো। চিপে চিপে ঝেড়ে ফেললো সমস্ত পানি। তারপর গামছাখানা মাথায় মেলে গিয়ে বসে বটগাছতলায়। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। বাতাসের তোড়ে ছোটো ছোটো প্রশাখাগুলো দুলে উঠে। নির্জনতার ভেতর থেকে শরশর শব্দ আসে। বটগাছ যুগ যুগান্তরের উত্থান-পতনের সাক্ষী। হাতির গুঁড়ের মতো বিরাট বিরাট ঝুড়িগুলো তৃষ্ণার টানে মাটিতে নেমে এসেছে। ডালপালা পত্র-পল্লবে আকাশখানা কিছুদূর অদৃশ্য করে ফেলেছে। মৃত্তিকার অন্তরের সংগোপন রসে পাতাগুলো সবুজ, সরস। হাওয়ার ঘায়ে কেঁপে কেঁপে ওঠা প্রাণময় প্রসারিত ছায়ার মধ্যে মৃত্তিকার সংগোপন মমতাকেই মেলে ধরেছে।

একটু ভালো লাগছে হাসিমের। সারা শরীরে টলছে ঘুম ঘুম ঝিমানি। পাতার ফাঁকে ফাঁকে ঘোরাফেরা করে চোখ। ওই হোথা মগডালে বাসা বেঁধেছে দুটো কাক। কোকিল একটা ডাকছে কু…কু। পাতার ফাঁকে অস্বাভাবিক জ্যোতির্ময় কালো দু’চোখ দেখা যায়। কতো কালো আর কণ্ঠস্বর কি মধুর! অন্তরের ভেতরটা পর্যন্ত ঠান্ডা করে দেয়। সবচে’ নীচের ডালটার দিকে চোখ পড়তে চমকে ওঠে।

এখনো যেন দাঁড়িয়ে আছে মানুষটা। পরনে শতচ্ছিন্ন হাঁটু ধুতি। গায়ে বুক চেরা ফতুয়া। সারা শরীরখানা গাব রাঙানো জালের উজ্জ্বল তুলিতে ছাপানো। কালীনাগের মতো চকচকে কালো। সাপের ফণার মতো পেশীগুলো। অভ্যন্তরে লুকিয়ে আছে শক্তি যে শক্তি দিয়ে পাহাড় পাথর চুরমার করা যায়। দাঁড়িয়ে আছে স্থির নিস্পন্দ, নিষ্পলক। চোখজোড়া দুরূহ জিজ্ঞাসায় বিষণ্ণ। তেলীপাড়ার তেজেন। চিনতে এতোটুকু কষ্ট হয়নি হাসিমের। দাঁড়িয়ে আছে মাটি থেকে একহাত ওপরে। ঘরের গাইয়ের শক্ত পাকানো নতুন দড়িখানা গলায় কষে লেগেছে। কিছু দূর কেটে গেছে। দড়িতে ক’ফোঁটা রক্ত। হাসিমই তো পয়লা দেখেছিলো। সে যাচ্ছিলো পাহাড়ে। ভোর রাত। মোরগ বাগ দেয়নি। পৌষালী কুয়াশার জমাট আস্তরণের ভেতরেই দেখেছিলো। চিনেছিলো তেলীপাড়ার তেজেনদার না হলে শিশুকাঠের মতো অমন সবল শরীর আর কার? তাই ডাক দিয়েছিলোঃ

“তেজেনদা, এত রাতিয়া কিল্লাই বাইর অইয়স যে”। (তেজেনদা, এতো রাতে কেন বেরিয়েছো?)

তেজেনদা কোনো জবাব দেয়নি বার বার ডাকার পরও। কাছে এসে গায়ে ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলো হাসিমঃ

“কি তেজেনদা রাগ অইয়স যে না কথা ন কস ক্যা?” (কি তেজেনদা, রাগ করছো, কথা বলছো না কেন?)

গাছের ডালে ঝুলন্ত শরীর তেজেনের দুলেদুলে জবাব দিয়েছিলো। হা, সে রাগ করেছে, সমগ্র পৃথিবীর ওপর তার রাগ। সমস্ত মানুষের ওপর অভিমান। তাই সে কথা বলবে না; কোনো দিন কথা বলবে না। সকাল হলে পরে হাসিম ঝুলেপড়া জিহা, রক্তের স্বাক্ষর আঁকা রঞ্জু আর তেজেনদার দু’চোখে সে একটি উদ্ধত জিজ্ঞাসাই দেখেছিলো, আরো সকলে দেখেছিলো। কেউ কোন কথা বলে নি। কেবল ছতুর বাপ তসবীহ্ টিপতে টিপতে মন্তব্য করেছিলো।

“আত্নহত্যা মহাপাপ। কাফের এনে তো যাইত দোযখ। একই কথা। ফি নারে জাহান্নামে হালেদিনা।” (কাফের এমনিতেও নরকে যেতো, একই কথা, তার জাহান্নাম নরকে স্থান)

কোনো হিন্দু মরলে তাকে জাহান্নামের আগুনে জ্বালাবার অনুরোধ করাটাই বিধি। অভাব, দুঃখ, নির্যাতন, উপবাস থেকে মুক্তি পাবার আশায় শীতজর্জর পৌষের এক কুয়াশাচ্ছন্ন রাতে গাছের ডালের সঙ্গে এক মাথা, দড়ির আরেক মাথা নিজের গলায় পরিয়ে ধাক্কা দিয়ে মইটা ফেলে ঝুপ করে ঝুলে ছিলো মুক্তির আশায়। হাসিমের এখনো চোখের সামনে ভাসে তেজেনদার চিরতরে নির্বাক হয়ে যাওয়া চোখের সে প্রশ্নিল দৃষ্টি।

বুকের সমস্ত বেদনা মথির করে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে। হায়রে! আল্লাহ, এতো অত্যাচার তোর রাজ্যে। হাতির মতো বলবান তেলীপাড়ার তেজেনদাকেও গলায় দড়ি দিয়ে মুক্তি খুঁজতে হলো। শ্বাস নিতে পারে না হাসিম। বুকের ভেতর তেজেনদার সে জিজ্ঞাসা যেন সূচীমুখ কোনো তীক্ষ্ণতম যন্ত্রণার মতো বাজে। সে নড়েচড়ে বসে। 

বেলা পড়ে এসেছে। সূর্য হেলেছে পশ্চিমে। পেটের ক্ষুধাটাও চাড়া দিয়ে উঠেছে। সেই কবে সাত সকালে দু’টো পানি ভাত খেয়ে বেরিয়েছে। আজকাল একভার লাকড়ির জন্যও বাঁশমুরায় (জঙ্গলে) না গিয়ে উপায় নেই। শালার কন্ট্রাকটারেরা ধারে কাছে কিছু রাখেনি। এ পাহাড়, সে পাহাড় কতো পাহাড়ে ঘোরাঘুরি করতে হয়েছে। একেকটাতে উঠতে বুকের লহু গেছে পানি হয়ে। যাওয়া আসায় বারো মাইলের কম পথ তো তাকে হাঁটতে হয়নি। অন্যদিন কলাপাতায় ‘মোচা বেধে ভাত নিয়ে যায়। গতকাল বাজার থেকে চাল, তরকারী কিছু আনতে পারেনি বলে ভাতও নিতে পারেনি। পেটের ক্ষুধাটা যতোই চাড়া দিচ্ছে, ততই তার উঠতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু ঘরের কথা মনে হতেই ওঠবার শক্তি আপনা থেকে হারিয়ে ফেলে। পা দুটো মাটির মতো হয়ে মাটির সঙ্গে লেপ্টে থাকে। 

ঝম্‌ ঝম্ শব্দ করে রেলের গাড়িখানি বরগুইনীর লোহার পুলের ওপর দিয়ে চলে গেলো। পড়ন্ত সূর্যের আলোতে চিকচিক্ জ্বলে। হাসিমের মনে চিন্তা… একমুঠো ভাতের চিন্তা। পোড়া চোখ ধায় রূপের দিকে, কিন্তু…। 

বিল কোণাকোণি পথে বানা্যা পুকুরের পাড়ে উঠে এলো অধরবাবু। পেছনে ছেলেটা। ছেলেটার হাতে মাছ রাখার ডুলা। অধরবাবুর হাতে জাল। জালের পাক খুলে এদিকে সেদিকে কয়েকটা খেপ দিলো। একটা মাছও আসেনি। তারপর অগ্নিকোণ বরাবর জালটা সড়ত করে আমগাছে নিবিড় ছায়া যেখানে ছড়িয়ে পড়েছে, সেখানেই ছুঁড়ে মারলো। জাল মাটিতে লাগার সঙ্গে সঙ্গেই ওপর দিকে ঠেলে লাফ দিলো চওড়া বালিশের মতো একটা মস্ত রুই। লাল মুখ লাল পাখনা দেখা গেছে পরিষ্কার। সাদা আঁশগুলো রূপোর টাকার মতোন ঝিলমিল করে জ্বলে উঠলো। ছিঁড়ে যেতে পারেনি। রেশম সুতোর জাল, খেপের তলায় যক্ষ পড়লেও বেঁধে রাখে। লুঙ্গিটা মালকোঁচা দিয়ে গলা জলে নেমে এলো অধরবাবু। ডুব দিয়ে জালটাকে মাছের শরীরের সঙ্গে আচ্ছা করে জড়িয়ে কোমর জলে আসে। মাছের হেঁচকা টানে অধরবাবুর লিকলিকে শরীর বার বার বাঁকা হয়ে যাচ্ছে ধনুকের মতো। শেষ পর্যন্ত মাছ জড়ানো জাল একেবারে পারের সমতলে এনে রাখলো। বিরাট রুইটা শুকনো ডাঙার ওপর দাপাদাপি লাফালাফি করছে। পুচ্ছ তাড়না আর বাতাসে খাবি টানছে। অধরবাবুর মুখে বিজয়ীর হাসি। নিজের জালে ধরা মাছ কিনা, দেখতেও সুখ।

হাসিম ধড়ফড়ানো রুইটার কছেল্লা দেখে পায়ে পায়ে একেবারে অগ্নিকোণে চলে এলো। ইঃ বাবা, কতো বড়ো রুই! লেজ পাখনা লাল হয়ে গেছে। কতো বছরের পুরানো কে জানে। বড়ো চালাক মাছ। পানি কমে গেছে, তাই ধরা পড়লো। মাছটার পুচ্ছ তাড়না তার স্মৃতিতে তেজেনদাকে ডেকে আনে। হয়ত তেজেনদাও ঝুলে পড়ে এমনি করে ধড়ফড় করছিলো। হঠাৎ মনে হয় এই মাছটি তেজেনদা, আর তার ভাগ্য যেন একসুত্রে বাঁধা পড়ে গেছে। আরো কতো ভাবনার উদয় হয় মনে। আকারহীন অবয়ভহীন সব ভাবনা।

হাসিমের দিকে চোখ পড়াতে অধরবাবুর হাসি-হাসি মুখখানা গম্ভীর হয়ে যায়। কপালে স্পষ্ট ঘৃণার কুঞ্চিত রেখা জাগে। থু করে একদলা থুথু হাসিমের পানে ছুঁড়ে দেয়। তারপর জালের সংগে মাছটা জড়িয়ে চোখের কোণে তাকে বিদ্ধ করে বিলে নেমে হাঁক দিলোঃ 

“আয়, গণেশ্যা চলি আয়।” (আয়, গণেশ চলে আয়।)

এতোক্ষণে হাসিমের চেতনা হয়। ছোটলোকের চাইতেও ছোটলোক সে। অধরবাবু মুখের ওপর থুথু ছুঁড়ে দিলো? একটা চাপা নিঃশ্বাস হাওয়ার শরীরে বিধে গেলো। ভাগ্য বিরূপ না হলে সেও এ পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরতে পারতো। বাপের ওপর তীব্র আক্রোশ জাগে। কি দরকার ছিল মুসলমান হওয়ার। অবশ্য শেষ বয়সে বুড়ো বলতো, ধন সম্পদ কিছুর লোভে নয়, শুধু বেহেস্তের খাতিরে আমি মুসলমান হয়েছি। কিন্তু তার কণ্ঠস্বরটা বড়ো শুষ্ক; বড়ো করুণ শোনাতো। নিজের গলার স্বরে নিজেই চমকে উঠতো। নিজেকে যেমন পরকেও তেমনি লোকটা ফাঁকি দিয়েছে। হৃদয়ের সঙ্গে চিরটা জীবন কেবল মিথ্যা কথাই কয়ে গেলো। কোন বেহেস্তের মায়া! তা কি হাসিমের অজানা? কাজী সাহেবের মেয়েকে কি একটিবার পেয়েছিলো? তামাম জীবন এ পরিবারের দাসীর সঙ্গে ঘর করে মরতে হলো।

বাপের মৃত্যু-পাণ্ডুর বিবর্ণ-শ্লান মুখচ্ছবিটা মনে পরতেই মনটা তার নরম হয়ে এলো। অলিগলি করুণার রসে আর্দ্র হয়ে আসে। বাপের সীমাহীন বেদনা তার চেতনায় সঞ্চারিত হলো। বেলা পড়ে এলো লাকড়ির ভারটা আবার কাঁধে ফেলে বিলের মাঝ দিয়ে পায়ে পায়ে সৃষ্ট দূরের চিকন রেখা পথটা বেয়ে ঝিমে ঝিমে ঘরের দিকে পা বাড়ায়। মাটির তাপ এখনো কমেনি। সূর্য নিঃশেষ হলেও কামানের ভাতির মতো জ্বলতে থাকবে। 

উঠোনের কাঁঠাল গাছটার সঙ্গে লাকড়ির ভারটা হেলিয়ে রেখে ঝাঁপ খুলে ঘরের ভেতর ঢোকে। এক ছিলিম তামাক খাওয়ার ইচ্ছা জাগে। কল্কির ঘেঁদাটা খুঁচিয়ে তামাক ভরে। আগুন তোলার হাতলওয়ালা মালাটা নিয়ে চুলোর ধারে গিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে। আগুন নেই। একরাশ মরা ছাই। একটু উত্তাপও নেই। সুফিয়া কি তা হলে আজও রান্না-বান্না করে নি! ফোরম্যানের বউ একভার লাকড়ি নিয়েছিলো। আজ টাকা দেবার কাথা। টাকা দিলে চাল কিনে ভাত রান্না করতো। টাকা দেয়নি, রান্নাও চড়ে নি। তামাকের নেশা আর তার নেই। দু’হাতে মাথা ঢেকে চুলোর ধারে বসে পড়ে। ক্ষুধাটা দ্বিগুণ মালুম হয়। রান্না ঘরের হাঁড়ি-পাতিল তাকে দেখে যেনো বিদ্রূপ করছে। 

এমনি সময়ে ঘরে ঢুকলো সুফিয়া। মুখখানা থমথমে, চোখ দুটো রক্তজবার মতো লাল। সে কঠিন মুখমন্ডলে আরো কঠিন ছাপ এঁকেছে উপবাস। হাসির অনুমান না করেও বুঝতে পারে, তার মতো সুফিয়াও সারাদিন কিছু খায় নি। নিজের অস্তিত্ব সুফিয়ার উদ্ধত দৃষ্টির সামনে কেমন সঙ্কুচিত হয়ে আসে। পাহাড়-পাথর কেটে যে মানুষ জীবন চালায়, তেমনি মানুষ হাসিম। তার কাঠিন্য সুফিয়ার দৃষ্টির তাপে কুপূরের মতো উড়ে যায়। এ বোবা অগ্নিফলার মতো দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে কি কথা বলতে হয়, হাসিম জানে না। উপবাস আর অভাবের যন্ত্রণার চইতেও এ এক তীব্র যন্ত্রণাময় হৃদয় খচখচ্‌ করা অনুভুতি। এ বোধ জন্মাবধি তাকে তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে সুফিয়াকেঃ

“ফোরম্যানের বউয়ে টেঁয়া ন দ্যায়?” (ফোরম্যানের বউ কি টাকা দেয় নি?) সুফিয়া জবাব দেয় না। কঠিন মুখ তুলে লাল চেখের দৃষ্টি উচিয়ে ধরে। হাসিম সে চোখকে ডরায়। কেন জানে না। সুফিয়ার এ চোখ দেখলে তার মনে উথাল-পাথাল ঢেউ ভেঙে যায়। আবার জিজ্ঞেস করেঃ

“টেয়া ন দ্যায়?” (টাকা দেয় নি?)।

টাকার নামে সুফিয়া জ্বলে ওঠে। মেজাজে আগুন লেগে যায়। হাসিমের উদ্দেশে যা বলার নয়, তাই বলে ফেলে।

“টেয়ার নামে কাঁইচ কেলা দিব, নিষ্কর্মা মরদ, ভাত দিত ন পাইরলে বিয়া গইরত কনে কইয়ে?” (টাকার নামে কাঁচ কলা দেবে, নিষ্কর্মা মরদ, ভাত দিতে না পারলে কে বলেছে বিয়ে করতে?)

রাগের তোড়ে বাম হাতখানা হাসিমের মুখের কাছে এনে নানারকম ভঙ্গী সহকারে নানা অশ্লীল, অশালীন মন্তব্য করে। ফুটন্ত তেলে ছিটকার মতো এসে হাসিমের স্নায়ুতে আঘাত করে একেকটি কথা। ধারালো কাঁচের কুচির মতো হৃৎপিন্ড কেটে কেটে বসে যায়। ঠাস করে প্রবল হাতের একটা চড় দিয়ে বসে হাসিম সুফিয়ার মুখে। সুফিয়ার রক্তজবার মতো রক্তবর্ণ দু’চোখ ফেটে বেরোলো আগুন নয়, ঝরঝর চোখের পানির ধারা। সুফিয়া চড় খেয়ে ঘুরে পড়লো। উঠে সে আসমানের আল্লাকে ডেকে বললোঃ

“আল্লা, তুই আঁরে নে, এই দুনাই বিষ অই গেইয়ে।“ (আল্লা, তুমি আমাকে নাও, এই পৃথিবী আমার জন্য বিষ হয়ে গেছে।)

গরীবের ঘরে ঝগড়া–কাজিয়া এসব নতুন নয়। ঘরেতে অভাব, তাই ঝগড়া-কাজিয়ার সঙ্গেও করতে হয় ঘর।

হাসিম ঘরের বাইরে চলে আসে। সুফিয়া ঘরের দাওয়ায় পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসে। অন্তরপোড়া দুঃখে অভিসিক্ত সে কান্নার সুর। আকাশ জুড়ে ধীর-মন্থর গতিতে সন্ধ্যা নামছে। আসমানে তারা ফুটছে। হাসিমের ঘর অন্ধকার।

উঠোনে বার হয়ে হাঁটতে থাকে হাসিম। পেটে ক্ষুধা আর হৃদয়ে অনুতাপ। হাঁটতে পারে না। মগজে চিককুত চিককুত ব্যথা। ভাবছিলো বটতলায় গিয়ে এক কাপ চা নবীর দোকান থেকে বাকীতে খেয়ে নেবে। চেনা-জানা দিলদার কেউ সামনে পড়লে এক আধসের চালও ধার চাইবে। অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে হাঁটতে সে নবীর দোকানেই চলে এলো। কিন্তু অবস্থা দেখে মুখটা তার শুকিয়ে এলো। শ্যামল বিশাল মুখমন্ডলে সন্ধ্যার চেয়েও গাঢ় হয়ে একটা কৃষ্ণছায়া নামে। আজ বাকী চাওয়া যাবে না। পয়সার জন্য জইল্যা চোরার সঙ্গে ঝগড়া করছে নবী।

“অ জলিল ভাই, তুই আজুয়া কিছু ন দিলে চইল কিনিত পাইত্যাম নয়, পোয়া মাইয়াম উয়াস থাইবো। দুয় টেঁয়া দ্য, বাকী টেঁয়া পরে দিয়।” (জলিল ভাই, তুমি আজ যদি কিছু না দাও চাল কিনতে পারবো না, ছেলেমেয়েরা উপোস থাকবে। আজ দুটি টাকা দাও, বাকী টাকা পরে দিও ।)

“আরে অজিয়া কন পরকারে সামালি ল, অমাবস্যার যো আইয়ুক… বেবাক টেয়া শোধ গরি দিয়ম।” (আজ কোনরকমে সামলে নাও, অমাবস্যার সময় আসুক সব টাকা এক সঙ্গে শোধ করে দেবো।)

কথাগুলো বলে তিন ব্যাটারী টর্চটা হাতে নিয়ে কাঁধে মাফলার জড়াতে জড়াতে বেরিয়ে যায় জইল্যা চোরা। জোয়ান সদ্য বিধবা মতির মার ঘরের কাছে গিয়ে ‘বন্ধু… রে’ বলে গানে টান দেয়। দাঁতে দাঁত চেপে উচ্চারণ করলো নবী, ‘আলা ডাহাইত’ কিন্তু চোখদুটো তার ছল ছল করে।

হাসিম দোকানে ঢুকে সুপারী গাছের ফালিতে তৈরি বেঞ্চির মতো আসনে চুপচাপ বসে থাকে। অনেকক্ষণ! মাগরেবের আজান শেষ হয়ে গেছে। নামাজও শেষ প্রায়। একজন দু’জন করে দোকানে মানুষ জমতে থাকে। ছতুর বাপ তসবীদানা টিপে টিপে দোকানে ঢুকে বেঞ্চিটা ঝেড়ে বসলো। তার মুখ দিয়ে দোয়া দরুদ ঝরছে। এক সময় তসবীহর ছড়া লম্বা কোতার পকেটে রেখে তার দিকে দৃষ্টি ফেরায়। সে দৃষ্টিতে এমন কিছু আছে যা রহস্যময়, ভয়ঙ্কর, দুর্বোধ্য তাকে ভয় ধরিয়ে দেয়। দৃষ্টির শরে বিদ্ধ হয়ে বুকটা তার দুরু দুরু করে। রহস্যময় দুটো চোখের শিখা হাসিমের চোখের ওপর রেখে হিমশীতল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে সে শীতলতার স্পর্শে বুকের রক্ত জমে যায়ঃ

“বান্যিয়ারপুত, তুই এডে ক্য? নমাজ-কালাম কিছু নাই, শুক্কুরবারেও জুমাত ন আইয়স ক্যা?” (বেনের ছেলে, তুমি এখানে কেন? নামাজ কালাম কিছু নেই, শুক্রবারেও মসজিদে এসো না কেন?)

হাসিম জবাব দেয় না। জবাব না পেয়ে ছতুর বাপের শান্ত শীতল কণ্ঠস্বরে একটু উত্তাপ জাগে। অধিকতররা দৃঢ়কণ্ঠে বললোঃ

“কাইলখুন মসজিদ ন দেখিলে পাড়াত থাকিত ন পারিবি। সময় থাকতে কই দিলাম। মুসলমানের পাড়া।” (কাল থেকে মসজিদে না দেখলে পাড়ায় থাকতে পারবে না, আগে থাকতে বলে দিলাম, মুসলমানের পাড়া।) সাদা দাড়িতে হাত বুলিয়ে আবার রহস্যময় দৃষ্টিরেখায় হাসিমকে বিদ্ধ করে লাঠি ঠক ঠক করতে করতে চলে যায়।

ছতুর বাপ চলে যাওয়ার পর কথা বললো, নাজিমঃ

“বেড়ার পুতে দুনিয়ার হক্কল কুকাম করে হেই খেয়াল নাই। পরের খুঁতা পাইলে তাঁই কাজী, তাই মাঝি। আর মাইয়ারে যা একখানা বানাইয়ে।” (তার ছেলে পৃথিবীর সকল কুকর্ম করে বেড়ায়, সেদিকে কোনো খেয়াল নেই, পরের খুঁত পেলেই তিনিই কাজী, তিনিই মাঝি বনে যান। আর মেয়েটিকে যা বানিয়েছে না।)

পাশের একজন নাজিমের মুখে তাড়াতাড়ি হাত চাপা দিলো। নাজিম চমকে উঠে। ছতুর বাপের বড় ছেলে সুলতান দোকানে ঢুকছে। নাজিম তার মুখের দিকে তাকায়। মন্তব্য শুনতে পেয়েছে কিনা মুখের প্রকাশিত ভাবের মধ্যে সন্ধান করে দেখে। নিশ্চিত হয় সে। সুলতানের থমথমে কালো মুখমন্ডলে বসন্তের অনেকগুলো বড়ো বড়ো গর্ত। চার পাঁচটা ব্রণ পেকে পুঁজের রসে পুষ্ঠ হয়েছে। ঢেঙা মতো নাকটা। কথা বলার সময় তার সারা মুখে লোলুপতা প্রকট হয়ে উঠে। বাঁ পাশের বিশ্রী দাগটা দেখা যায়। দোকানে একথা সেকথা নানা কথা হয়। বেশির ভাগ অভাব, দুঃখময় দৈনন্দিন জীবনের সমস্যার কথা ঘরে চাল না থাকার কথা, বউয়ের পিঠে কাপড় না থাকার কথা, বৃষ্টির অভাবে অকর্ষিত মাঠের কথা। আউশ ধান ছড়ানো হয় নি। অনাবৃষ্টিতে মাঠ ফুটি-ফাটা হয়ে আছে। লাঙলের হল ফোঁটায় তেমন সাধ্য কোন বাপের বেটার নেই।

“নারে নারে নাটুয়ার দিঘির পারে, সুন্দরীরে দেখতে দেখতে বাড়াইল মেলা মারে!”

গাইতে গাইতে আরেকজন দোকানে পা দিয়ে হাসিমকে দেখামাত্রই কলকন্ঠে চীকার করে উঠললাঃ

“এই যে সুলতান, চিন্তার কারণ নাই আর, বান্যিয়ার পুতরে পাইলাম। যামিনী ন আইলে ন আইয়ুক। বানিয়ার পুতে গাইত ন পারিব? কি কস?” (এই যে সুলতান, চিন্তার কারণ নেই। বেনের ছেলেকে পেয়ে গেলাম। যামিনী না আসলে না আসুক, বেনের ছেলে গাইতে পারবে না, কি বলিস?)

“মন্দ কি!”

জবাব দিলো সুলতান।

ঘাড়ের তেল মুছে তর্জনী নেড়ে নেড়ে বলতে থাকে আগত লোকটিঃ

“হুন বানিয়ার পুত, সাতবাড়িয়ার, ছিদ্দিক আর ধলঘাটের যামিনীর পাল্টা গান অইবার কথা আছিল জাহেদ সাবির বাড়ীত। যামিনী খবর দিয়ে আইত পাইরত নয়। হেই কথার লাই তোর গান গাহনের লাই থাহন পড়িব।” (শোন বেনের ছেলে, সাত বাড়িয়ার সিদ্দিক আর ধলঘাটের যামিনীর পাল্টা গান হওয়ার কথা ছিলো জাহেদ সাহেবের বাড়ীতে। যামিনী খবর দিয়েছে আসতে পারবে না। সেজন্য তোমাকে গান গাইতে থাকতে হবে।)

মানিব্যগ খুলে দু’খানা একটাকার কাগজের নোট তার হাতে গুঁজে দিয়ে বলেঃ

“এই দুই টেয়া দিলাম বাকী দুই টেয়া পরে পাবি।” (এই দুই টাকা দিলাম। বাকী দু’টাকা পরে দেবো।

হাসিমের হাতে টাকা দুটো শুয়ে থাকে। ওরা দু’জন পরস্পরের দিকে চেয়ে অর্থপূর্ণ হাসি হাসে। কেন হাসে হাসিম জানে। সিদ্দিকের সঙ্গে গান গাইতে হলে তিরিশ টাকার কম কেউ রাজি হবেনা। তাকে চার টাকাতে রাজী করালো। সুলতান দোকান থেকে বেরিয়ে হাঁক দিলোঃ

“আয় গণ্যা আয়”। (আয় গণি আয়।)

গণি মাথার টেরছা টেরী ঠিক করতে করতে বললোঃ

“যা বানিয়ার পুত, সারিন্দাখানা লই আগই। খানাপিনা হেডে হইব।” (যাও বেনের ছেলে সারিন্দাখানা নিয়ে এসো। খাওয়া দাওয়া ওখানে হবে।)

ওরা চলে গেলো। দোকানে চাপা গুঞ্জন উঠলো। কে একজন মিনমিনে গলায় বলেলোঃ

“দেশের মানুষ ভাতে মরের, জাহেদ বকসুর মনে খুসির অন্ত নাই।” (দেশের মানুষ ভাতে মারা যাচ্ছে, জাহেদ বকসুর মনে খুশির অন্ত নাই। “ন ক্যা অইতো খুশি সুদের টেয়া, টেয়ায় টেঁয়া বিয়ায়।” (খুশি হবে না কেন, সুদের টাকা তো, টাকায় টাকা বাড়ায়।)

কথা আর বাড়ে না। কেন বাড়ে না হাসিম জানে। লণ্ঠনের আলোতে যে সকল মুখ দেখছে, তাদের অনেকেই সুদে জাহেদ বকসুর টাকা ধারে। দোকানের মানুষগুলোর চোখমুখে হাসিম তেলীপাড়ার তেজেনের সে উচিয়ে ধরা প্রশ্নটিকেই দেখলো। আশ্চর্য, একটা মাত্র প্রশ্নের ভারে সকলে কেমন পশুর মতো বোবা হয়ে গেছে। তেজেনদা নিজের গলায় ফাঁসি লাগিয়ে হৃদয়ের রক্তে জীবনের জীবিকায় লীন সে প্রশ্নটিকে দিনের নিলাজ আলোতে তুলে ধরেছিলো। তেজেনদাকে এ সকল মানুষের তুলনায় অনেক সাহসী মনে হয় হাসিমের।

দোকান থেকে বেরিয়ে রসিদ আহমদের মুদী দোকানে গিয়ে দু’টাকার চাল-ডাল কিনে ঘরে চলে গেলো। এখনো সুফিয়া ঘরের দাওয়ায় বসে আছে। সাঁঝবাতিও জ্বালে নি। হাসিম জ্বালবে কিনা ভাবলো। যদি কেরোসিন না থাকে তা হলে খিটিমিটি লাগতে পারে। চাল-ডালগুলো সুফিয়ার সামনে রেখে সারিন্দাখানা হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসে। কতোদূর এসে পিছনে ফিরে তাকায়। সমাচ্ছন্ন অন্ধকারে সুফিয়াকে ভূতের মতো লাগে।

জাহেদ বকসুর বাড়ীতে সামিয়ানা টাঙানো হয়েছে। কড়া আলোকের প্যাটোম্যাক্স শোঁ শোঁ শব্দে জ্বলছে। দশ গেরামের মানুষ গান শুনতে ভেঙে পড়ছে। অভাব দুঃখ, অর্থনৈতিক অন্তদাহ… গাঁয়ের মানুষের সবটুকু প্রাণ শুষে নিতে পারে নি। গান দুঃখের রাজ্য থেকে, অভাবের রাজ্য থেকে এক বিচিত্র রাজ্যে নিয়ে যায়। সে এক বিচিত্র অনুভূতির রূপ-রাঙা জগত।

খাওয়া-দাওয়ার পর শুরু হলো গান। উপস্থিত মানুষেরা ঠিক করে দিলো সিদ্দিক গাইবে পুরুষের ভুমিকায়। নারী হবে হাসিম। আসরে প্রথম উঠেই সিদ্দিক হাসিমকে বেপরোয়া ভাবে খোঁচাতে থাকে। সুরটুকু বাদ দিলে যা থাকে, নির্জলা গালাগালি ছাড়া আর কিছু নয়। প্রত্যেক গানের মধ্যে ঘৃণা, অবজ্ঞা, বিদ্রূপ হাসিমের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিচ্ছে। ছাগল দিয়ে হাল চাষ করতে পারলে মানুষ কেন গরু কেনে? হাসিম ছাগল আর সে গরু। এমন কি তার বাপকেও টেনে এনেছে। তার মা দাসী। বাপ বেনে। জন্মসূত্রে কপালে যে শীলমোহর পড়েছে তার থেকে এ জন্মে আর নিষ্কৃতি নেই। তাকে লোকে ঘৃণা করবে, বিদ্রূপ করবে, অবজ্ঞা করবে। মানুষের মর্যাদা তার ভাগ্যে নেই। কোনোদিন উদার চোখে পড়ার মানুষ তার দিকে চাইবে না। তেমন বিরাট প্রসারিত মন এদের কই? শেষে মিল দিয়ে গানের আকারেই গালিগালাজ করে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে তবলায় তাল ফুটছে। বেহালার করুণ রাগিণী কেঁদে কেঁদে এ অশ্লীতার প্রতিবাদ করছে। আর মানুষ… উঠোন ভর্তি মানুষ বীভৎস উল্লাসে হাত তালি দিচ্ছে। কে একজন উৎসাহের অতিশয্যে বলে উঠলো, “বাঃ বাঃ সিদ্দিক, বানিয়ার জাতরে ধুই ফেলা, বাপের বেড়া।” (বাঃ সিদ্দিক, বেনের জাতকে ধুয়ে ফেলো বাপের বেটা।)

এসব ঠাট্টা-বিদ্রূপ বিছুটি পাতার মতো লাগে এসে হাসিমের শরীরে। জ্বালা করে। চেতনায় সীসার বলের মতো আঘাত করে।

সিদ্দিক বলে পরে কম্পিত কলেবরে হাসিম সারিন্দা হাতে উঠে দাঁড়ায়। সারা শরীর তার কাঁপছে। চোখ ফেটে বার বার কান্না বেরিয়ে আসতে চায়। সিদ্দিকের স্কুল রসিকতায় যাদের মন ভরেছে তারা কি তার বিনম্র আবেদন, অন্তরের স্বগতোক্তি কান ভরে শুনবে। কাঁপা কাঁপা স্বরে গানের কলি উচ্চারণ করে। পয়লা আল্লাহর নাম, রসুলের নাম দেবী সরস্বতীর বন্দনা করে ওস্তাদ গুরুর নাম স্মরণ করলো। সভার দশজনকে সালাম নিবেদন করে শুরু করলোঃ

“দয়া করো প্রভু তুমি দয়ার মহিমা
দীনহীন সন্তানে ডাকে পুরাও বাসনা গো।”

সারিন্দার তারে মৃদু আঘাত করলো। মুহুর্মুহুঃ ঝঙ্কারে নিপুণ হাতের স্পর্শে নাগেশ্বর কাঠের সারিন্দা বেজে উঠলো গুন গুন। নাগেশ্বর কাঠের কুঁদানো সারিন্দায় বুকের ভেতরের দুঃখে দুঃখে, বেদনায় বেদনায় ফোঁটা রক্তপদ্ম কণ্ঠভরা রক্তাক্ত সুষমায় জেগে উঠলো। ফুলের স্তবকের মতো ফুটে উঠতে থাকলো গানের কলি। প্রথমে ধীরে, খুব ধীরে, তারপর উঁচুতে আরো উঁচুতে চড়তে লাগলো গলার স্বর । হৃদয়ের ফেনিল কান্না, উদ্বেল বেদনা বাসনা পুস্পল গানের আকারে ঝেড়ে ফেলতে চায় হাসিম। বারংবার সারিন্দার কম্পমান তারে টুংটাং কেঁদে যাচ্ছে একখানি অভিমানী নারী-হৃদয় যেন। কোন দংশন, কামড় নয়, অশ্লীলতা, অপবাদ নয়; ব্যথা, শুধু ব্যথাই সভাজনের কাছে করুণ মিনতির উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ছে।

লোকগুলো শুনছে কেবল শুনছে। হাততালি দিচ্ছে না কেউ, টিপ্পনী কাটছে না কেউ, অবাক হয়ে মুগ্ধ হয়ে শুনে যাচ্ছে। বুকের সীমান্ত অবধি হাতড়ে দেখে গানের সুরে সুরে। তাদের ঘরের নারীদেরও এমনি স্বপ্ন-কল্পনা অভাবের আগুনে মাঠের ফসলের মতো পুড়ে যাচ্ছে। তাদের রক্তের ঢেউ ফোঁটা আকাঙ্ক্ষার কাহিনী নির্মম বাস্তবতার আঘাতে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। সুর সারিন্দায় মন্দ্রিত ধ্বনিতে, অনর্গল হাসিমের কণ্ঠ দিয়ে বেরিয়ে আসছে। নিস্তব্ধ সভার মধ্যে থেমে থেমে কাঁদছে। সারিন্দার ধ্বনি। সে দরদে অবাক তারার দৃষ্টি মিটি মিটি কাঁপছে।

গান যখন শেষ হলো তখন অনেক রাত। চাঁদের আলো নিভে গেছে। বুকের সূচীমুখো সুতীক্ষ্ণ যন্ত্রণার শিখার মতো আসমানে কম্পিত, শিহরিত অসংখ্য তারা জেগে আছে। সুলতান কিংবা গণি কারো দেখা পেলো না। দু’টো টাকা তার উসুল হলো না।

আর উসুল হবে না। সারিন্দাখানা মরা লাকড়ির মতো কাঁধে ফেলে ঘরে ফিরছে হাসিম। অসম্ভব ক্লান্ত।

কামারের হাঁপরের মতো বুকের ভেতরটা অসম্ভব উত্তপ্ত মনে হয়। নিঃশ্বাসে রক্ত ঝরে যায়। যে সারিন্দা হৃদয়ের প্রিয়তম দোসরের মতো সাড়া দিয়ে কেঁদেছে, এখন বড়ো বেশি বেদরকারী আর বড়ো বেশী ভারী মনে হয়।

মসজিদ ভিটা পেরিয়ে যেতে পাশাপাশি তার বাপ-মার কবর জোড়া চোখে পরে। আপনা আপনি চোখের পানি বেরিয়ে গন্ডদেশ ভিজিয়ে দিয়ে যায়। এর উৎস কোথায় জানে না হাসিম। বরগুইনির পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে এই বরগুনিতে তির তির ধারার একটি প্রবাহ ছিলো। বর্ষার পানি খেপা বাদ্যানীর মতো মাঠে মাঠে খেলা করতো। এখন স্রোতহীন, প্রবাহহীন বরগুইনি অনন্ত তৃষ্ণার একখানি লকলকে জিহ্বার মতো লোকালয়গুলোকে জড়িয়ে পেচিয়ে পড়ে আছে। এখন তার বুকে রেতী বালু চর খচ খচ করে। ধু ধু বালুকাময় বরগুইনির বুকের মতো হাসিমের বুক। ব্যাথা টন টন করে। অনেক রাত হয়ে গেলো। কালকেও পাহাড়ে যেতে হবে।

কবরস্থান ছাড়িয়ে বাঁ দিকে বাঁক ঘুরবার সময় আচমকা থমকে দাঁড়ায়। বড় আমগাছটার ধার ঘেঁষে কে একজন দাঁড়িয়ে আছে। শাড়ির আঁচলের একপ্রান্ত কলার পাতার মতো বাতাসে অল্প অল্প দুলছে। আবছা অন্ধকারে কেমন ছায়ামূর্তির মতো মনে হয়। সারা গা ছমছম করে। ভীত-বিহ্বল হাসিম ধীরে ধীরে পা বাড়িয়ে এগিয়ে যায়। ভয়ে ভয়ে পাশ দিয়ে চলে যাওয়ার সময় ছায়ামূৰ্তি কথা কয়ে উঠেঃ

“হাসিম বাই, তাড়াতাড়ি আইও। আঁর ডর লাগের দে।” (হাসিম ভাই তাড়াতাড়ি এসো, আমার ভয় করছে।)

“জোহরা এতো রাইতে তুই?” হাসিম জিজ্ঞেস করে।

“হ হাসিম বাই, তোঁয়ার গীত হুনিবার লয় আসিলাম দে। গোয়াল ঘরের পিছদি লুকাই হুন্যি। শেষ অইবার আগে চলি আস্যি। যাইতে ডর লাগে দে” (হাঁ হাসিম ভাই, তোমার গান শোনার জন্য এসেছিলাম। গোয়াল ঘরের পিছনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছিলাম। শেষ হবার আগেই চলে এসেছি। এখন যেতে ভয় করছে।)

তারা দুজন পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। হাসিমের চেতনার গভীরে একটা খুশি খুশি ভাব জেগে উঠে। সে সঙ্গে ভয়ও। রক্তের সঙ্গে এমন কিছু পদার্থ জড়িয়ে থাকে, কাউকে দেখলে আপনা থেকেই নেচে উঠে। খলু মাতুব্বরের ভাতিঝি জেহরা। রাতের অন্ধকারে পাশাপশি হাঁটছে। কেউ যদি দেখে ফেলে! সুফিয়ার মুখখানা মনে পড়ে। এ মুহূর্তে সে সব কিছু ভুলে থাকতে চায়! আনন্দের অঙ্কুর তার স্নায়ুকেন্দ্রে। হাসিম এ অনুভূতিটুকু শিল্পীমনে সঞ্চয় করে রেখে দিতে চায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *