০৯-১০. লাল পাহাড়ের হৃৎকম্পন

০৯. লাল পাহাড়ের হৃৎকম্পন

নানু সময় বেঁধে দিয়েছেন, রাতের খাওয়া নটার মধ্যে টেবিলে দিতে হবে। আমরা যখন খেতে বসেছি, জাহেদ মামা তখনো আসেন নি। খেতে খেতে নেলী খালাকে নানু জিজ্ঞেস করলেন কদিন ধরে জাহেদ রাত করে ফিরছে–কিছু বলেছে তোমাকে?

নেলী খালা একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, কাজের চাপ বেড়েছে।

রাত নটা-দশটা পর্যন্ত এত কি কাজ?

হঠাৎ করে এদিকটায় সন্দেহজনক লোকের আনাগোনা বেড়েছে। পরশু দুজন ধরাও পড়েছে। ইণ্ডিয়া থেকে নাকি এসেছে।

পলিটিক্যাল এলিমেন্ট না স্মাগলার?

জাহেদ এসব ব্যাপারে আমার সঙ্গে বেশি আলোচনা করে না।

ওকে সাবধানে থাকতে বলল। এই বলে নানু খাওয়া শেষ করে টেবিল ছেড়ে উঠেছেন, তখনই জাহেদ মামা এলেন। বেশ ক্লান্ত মনে হচ্ছিলো ওঁকে। সোজা এসে আমাদের সঙ্গে খেতে বসে গেলেন। বললেন, দারুণ খিদে পেয়েছে। দুপুরের পর এক কাপ চাও জোটে নি। তারপর? আবিরদের গোয়েন্দাগিরির সর্বশেষ খবর কী?

কোন গোয়েন্দাগিরি? আমরা চারজন অবাক হলাম।

কেন, সকালে যে এক গুপ্তচর ধরলে! কার হয়ে ও কাজ করছে, সে সব খবর তদন্ত করে বের করার কথা না?

আমি বললাম, ও কাজটার দায়িত্ব ইটাগঞ্জ টী এস্টেটের ম্যানেজার মুনির সাহেব নিয়েছেন। জেরা করে কিছু পাওয়া যায় নি। সঙ্গে নিয়ে গেছেন, সন্ধ্যেবেলা নজর রাখবেন কেউ ওর কাছে আসে কিনা দেখার জন্য।

আপদ গেছে। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন জাহেদ মামা। তারপর জানতে চাইলেন, মুনির সাহেব কখন এসেছিলেন।

দুপুরের ঠিক পরেই। জবাব দিলেন নেলী খালা। তুমি আমাদের বাড়ি পর্যন্ত নামিয়ে দিতে এলে দেখা পেতে।

টুনি চাপা উত্তেজিত গলায় বললো, কিশোর পারেখও এসেছিলেন।

তাই নাকি! মৃদু হাসলেন জাহেদ মামা। সকালে দু বার আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে। ছবির শ্যুটিং-এর জন্য স্পট খুঁজছিলেন। ভারি অমায়িক লোক।

তিনি আমাদের নুলিয়াছড়ির এ্যাডভেঞ্চার নিয়ে ছবি করবেন। টুনির চেয়ে বাবু কম উত্তেজিত নয়।

টুনি বললো, আমরা সবাই সে ছবিতে অভিনয় করবো।

তবে তো আর কথাই নেই। হাসলেন জাহেদ মামা।

নেলী খালাও থাকবেন সে ছবিতে। টুনি আগের মতো উত্তেজিত।

নাকি! বড়ো বড়ো চোখ করে নেলী খালার দিকে তাকালেন জাহেদ মামা। ঠোঁটের ফাঁকে মিটি মিটি হাসি-–তোমাদের জাহেদ মামার পার্টটা কে করবে শুনি?

নেলী খালা হেসে বললেন, তোমাকে করতে কেউ বারণ করছে নাকি!

পাগল নাকি! এক কথায় উড়িয়ে দিলেন জাহেদ মামা। কাগজে আমাদের ছবি ছাপা পর্যন্ত বারণ।

কথাটা জাহেদ মামা মিথ্যে বলেন নি। নুলিয়াছড়িতে পাকড়াশীর দলবল যখন ধরা পড়লো, তখন শুধু আমাদের চার জনের ছবি খবরের কাগজে ছাপা হয়েছিলো। বাবু বললো, আপনি এ্যাকটিং না করলে কিশোরদা আপনার রোলে এ্যাকটিং করবেন।

ভালো বুদ্ধি বের করেছে তো কিশোর পারেখ! এই বলে জাহেদ মামা আড়চোখে তাকালেন নেলী খালার দিকে।

একটু অপ্রস্তুত হয়ে চাপা গলায় নেলী খালা বললেন, আহ্, ছোটদের সামনে এসব কী কথা।

জাহেদ মামা প্রসঙ্গ পাল্টে একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, আবিররা শোন, তোমরা চার জন যখন একত্র হয়েছে, তোমাদের ঘরে আটকে রাখা যাবে না জানি। তবে এখানে কয়েকটা জায়গা আমরা সিভিলিয়ানদের জন্য রেস্ট্রিকটেড করে দিয়েছি। পুব দিকে মাইল চারেক গেলে ইণ্ডিয়ার বর্ডার। বর্ডারের এক মাইলের ভেতর যাবে না। উত্তর দিকে একটা জিওলজিক্যাল টীম এসেছে সার্ভে করতে, ওদের সার্ভে এরিয়ার দু মাইলের ভেতর যাওয়া নিষেধ। এ ছাড়া আমাদের ক্যাম্প এরিয়ায় সিভিলিয়ানদের ঢোকা বারণ :

নেলী খালা বললেন, কাল সকালে কিশোর পারেখ তোমার অফিসে যাবে।

কেন? জানতে চাইলেন জাহেদ মামা।

শ্যুটিং-এর পারমিশন চাইতে বোধ হয়।

রেন্ট্রিকটেড এরিয়ার বাইরে হলে শু্যটিং করতে পারে।

আমি লক্ষ্য করলাম, খেতে বসে আমাদের সঙ্গে হাসি ঠাট্টা করলেও জাহেদ মামাকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছিলো। খাওয়ার পর জাহেদ মামা ওঁর ঘরে চলে গেলেন। আমরা চার জন বাইরের বারান্দায় গিয়ে বসলাম।

ডিসেম্বরের ঠাণ্ডা হিমেল বাতাস বারান্দায় রেলিং অব্দি ঝোলানো বাঁশের চিকের পর্দার ফাঁক দিয়ে এসে মাঝে মাঝে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছিলো। আমাদের সবার গায়ে মোটা জ্যাকেট আর পুলোভার। ললির গলা ব্যথা করছিলো-সন্ধ্যের পরই ও হাতে-বোনা উলের মাফলার জড়িয়েছে।

বিকেলে আমি আর ললি হাঁটতে হাঁটতে সকালের সেই পুকুরটার কাছে চলে গিয়েছিলাম। সন্ধে পর্যন্ত বসেছিলাম অর্কিড-ভরা গাছটার নিচে। অনেক কথা হয়েছে। ললি ওদের সব কথা আমাকে বলেছে। ওর বাবার কথা বলেছে, মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে যিনি আর ফিরে আসেন নি। ওর মার ধারণা, একদিন তিনি ঠিকই ফিরে আসবেন।

হঠাৎ কিছু করে সবাইকে চমকে দেয়া পছন্দ করতেন ললির বাবা। পোর্টের ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। মার্চে লণ্ডন যাওয়ার কথা ছিলো ট্রেনিং-এ, যান নি। পাকিস্তানী সৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হওয়ার কথা যেদিন রেডিওতে শুনলেন, তার ঠিক বারো দিন পর চলে গেলেন যুদ্ধে। ললি টুনিরা তখন ফাঁইভ সিসে পড়ে। স্কুল বন্ধ ছিলো, বিকেলে মার সঙ্গে ওরা বাগানের লনে বসে আছে, বাবা এসে বললেন, চলি রে মেয়েরা, মার কাছে লক্ষ্মী হয়ে থাকিস।

মা বোধ হয় আগে জানতেন, বাবাকে কথা দিয়েছিলেন কাঁদবেন না, তাই শক্ত হয়ে বসে রইলেন। ললি টুনি বললো, কোথায় যাচ্ছো বাবা, কবে আসবে? বাবা বললেন, যুদ্ধে যাচ্ছি, দেশ স্বাধীন করে ফিরবো। ভয় পাস নে, তোদের মা সব ঠিকমতো সামলাতে পারবেন। আমিও তোদের খোঁজখবর নেবো। গেটের বাইরে বাবার বন্ধু হাবিব চাচা দাঁড়িয়েছিলেন, বাবাকে তাড়াতাড়ি আসতে বললেন। ললি, টুনিকে কোলে তুলে কপালে চুমু খেয়ে আদর করে বাবা চলে গেলেন।

যুদ্ধের নয় মাস ওরা পোর্টের বাংলোতেই ছিলো। মা ফিনলে কোম্পানির একসিকিউটিভ ছিলেন। টাকাপয়সার কোনো অসুবিধে কখনো হয় নি। বাবার কথা কেউ জিজ্ঞেস করলে ওরা বলতো লণ্ডন গেছেন। অফিসও জানতো ওদের বাবা ট্রেনিং-এর জন্য এক বছর লণ্ডন থাকবেন। মাঝে মাঝে অচেনা ছেলেরা বাবার চিঠি আনতো, মার জন্য আলাদা, ললি টুনির জন্য আলাদা।

ওদের আশেপাশের বাড়ির সবাই গ্রামে চলে গিয়েছিলো। গোটা পাড়াটা খাঁ-খা করতো। অফিসের গাড়ি এসে সকালে মাকে নিয়ে যেতো, বিকেলে পৌঁছে দিতো। সারা দিন ললি টুনি ভাবতো, এই বুঝি বাবা এলেন। ওদের বুড়ি দাইঅম্মা লুকিয়ে কাঁদতে বাবার জন্য। বাবাকে নাকি কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে।

সেবার নভেম্বরের শেষের দিকে ছিলো ঈদ। বাবার জন্য সবার মন খারাপ। মা এমনিতে কম কথা বলেন, বাবা চলে যাওয়ার পর আরো চুপচাপ হয়ে গেছেন। ঈদের আগের দিন রাতে–ওরা যখন ঘুমোতে যাবে, এমন সময় ড্রইংরুমের দরজায় টোকা পড়লো। শব্দ শুনেই ওরা বুঝলো বাবার চিঠি এসেছে। মা ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দেখেন বাবা দাঁড়িয়ে।

ওঁকে অন্যরকম লাগছিলো। গালভর্তি দাড়ি, আগের চেয়ে শুকিয়ে গেছেন, গায়ের ফর্সা রং তামাটে হয়ে গেছে–ছুটে এসে ললি টুনিকে কোলে তুলে নিলেন। মা দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে জানালার কাঠের পাল্লা সব টেনে বন্ধ করলেন। সারা রাত ওরা কেউ আর ঘুমায় নি। দাইআম্মা সেই রাতে বাবার জন্য পোলাও, কোর্মা আর পায়েস রান্না করলো। বাবা এমনভাবে খেলেন, যেন কতদিন পেট পুরে খান নি। সারা রাত যুদ্ধের গল্প শুনতে শুনতে শেষরাতে ললি টুনি বাবাকে আঁকড়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। পরদিন ঘুম থেকে উঠে দেখে, বাবা নেই। মা বললেন, এক মাসের মধ্যেই নাকি দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে, বাবা ফিরে আসবেন। মার প্রথম কথাটা সত্যি ছিলো, শেষেরটা নয়। বাবার সঙ্গে যারা যুদ্ধে গিয়েছিলেন তাদের অনেকে ফিরেছেন অনেকে ফেরেন নি। কার কাছে খবর নেবে, হাবিব চাচাও ফেরেন নি। পোর্টের যাঁরা যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন, সরকার তাঁদের পরিবারকে অনেক সাহায্য দিয়েছেন। মা সে সব নেন নি। পোর্টের কয়েকজন বড়ো অফিসার জানতেন, ললিদের বাবা যে লণ্ডন যাওয়ার বদলে যুদ্ধে গেছেন। তারা মাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ওঁর কি প্রয়োজন। মা বলেছেন–বাবা ফিরে না আসা পর্যন্ত এ বাড়িটায় থাকতে চান, আর কিছু নয়। এরপর তিন বছর কেটে গেছে, বাবা ফেরেন নি। মার মতো ললি টুনিও বিশ্বাস করে বাবা সবাইকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ একদিন চলে আসবেন, সেবার ঈদের আগের রাতে যেমন এসেছিলেন।

আমি চুপচাপ বারান্দায় বসে ললির কথা ভাবছিলাম। বাবুকে টুনি কি যেন বললো শুনতে পেলাম না। ও উঠে গিয়ে ললি টুনির জন্য আনা পুতুল আর চকলেটের বাক্সটা এনে ওদের হাতে দিলো : নি চকলেটের বড়ো বাক্সটা দেখে দারুণ উত্তেজিত। বললো, ললিপা, এটা আমরা বাড়ি নিয়ে যাবো। খুব খুশি হবে। কি দারুণ দেখতে, তাই না?

বাবু বললো, পুতুল বুঝি পছন্দ হয় নি? কত খুঁজে খুঁজে আনলাম।

ইস, পছন্দ হবে না কেন? এটা আমার জান! এই বলে পুতুলটাকে চুমু খেলো টুনি।

বাবু করুণ গলায় বললো, বা রে, শুধু পুতুলটাই বুঝি জান হলো। যে এতো কষ্ট করে পুতুলটা আনলো, সে বুঝি একেবারে ফ্যালনা।

বাবুর কথা বলার ধরন দেখে টুনি হেসে ফেললো–তুমিও জান, ললিপাও জান, আবিরও জান। তবে এটা বেশি জান, এই বলে ও আবার চুমু খেলো পুতুলটাকে।

ললিও হাসতে হাসতে বললো, চমৎকার পুতুল এনেছো বাবু।

ললি টুনিকে হাসতে দেখে আমার খুব ভালো লাগলো। টুনি বললো, আবির, আপনার জন্য বাবু কী এনেছে?

একটা কোটপিন আর দুটো বই।

ব্যাস! অবাক হলো টুনি–আর কিছু আনে নি?

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, আমি তো আর ওর জান নই। আমার জন্য আর কী আনবে!

আমার কথা শুনে এবার বাবুর হাসার পালা–দেখো আবির, এভাবে বলছো কেন? তোমার একটা বইয়ের দামে দুটো পুতুল পাওয়া যায়!

নিরীহ গলায় বললাম, আমি কি বলেছি কম দামী বই এনেছো?

আমাদের পুতুলই ভালো, তাই না ললিপা? বলে পুতুলটাকে আরেক দফা চুমু খেলো টুনি।

হঠাৎ বাবু চাপা গলায় চেঁচিয়ে উঠলো–আবির, ওই দিকে দেখো। আঙুল তুলে ও সামনের দিকে দেখালো।

তাকিয়ে দেখি স্টিমারের সার্চ লাইটের মতো একটা আলোর সাদা রেখা কালো অন্ধকারকে চিরে এপাশ থেকে ওপাশে গিয়ে হঠাৎ নিভে গেলো। আমি বললাম, আর্মি ক্যাম্পের কেউ বোধ হয় সার্চ লাইট জ্বালিয়ে দেখছে।

ললি চাপা গলায় বললো, জাহেদ মামাদের ক্যাম্প ওদিকে নয় আবির। ওদিকে বর্ডার। ওটা পুব দিক। ক্যাম্প হচ্ছে আমাদের পশ্চিমে।

বর্ডারে কে সার্চ লাইট জ্বালাবে! ভীষণ অবাক হলাম আমি।

টুনি বললো, কেন, নুলিয়াছড়িতে দেখো নি। গুণ্ডোরা সার্চ লাইট জ্বালিয়ে সিগন্যাল দেয়।

আহ টুনি! ললি ওকে চাপা গলায় ধমক দিলো–এটা নুলিয়াছড়ি নয়। বর্ডারের ওদিকে পাহাড় আর জঙ্গল। জাহেদ মামা বলেছেন, ওদিকে মানুষজন কেউ থাকে না।

তবে আলো দেখালো কে! এই বলে টুনি হঠাৎ ভয় পেয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, ললিপা, তুমি ভয় দেখাচ্ছো কেন, মানুষ না থাকলে আলো কে দেখাবে?

বাবু টুনিকে ভয় দেখাবার সুযোগ পেয়ে বললো, মানুষ ছাড়া আর কেউ বুঝি আলো দেখাতে পারে না? এসব পুরনো জঙ্গলে কত কি থাকে!

টুনি ললির গা ঘেঁষে বসলো–বাবু, ভালো হবে না বলছি।

আমি বললাম, বাবু এটা কোনো মজার ব্যাপার নয়। আলো মানুষই জ্বেলেছে। আমাদের জানা দরকার ওরা খারাপ লোক না ভালো লোক।

বাবু হালকা গলায় বললো, কাল সকালে জাহেদ মামাকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে। হতে পারে ওদের কোনো দল কিছু খুঁজতে বর্ডারের দিকে গেছে।

হতে পারে! তবে অন্য কিছুও হতে পারে।

কাল সকালে আমরা নিজেরা গিয়েও দেখতে পারি। আস্তে আস্তে কথাটা বললো ললি।

দারুণ আইডিয়া! বাবু উত্তেজিত হয়ে সঙ্গে সঙ্গে আবার চুপসে গেলো–জাহেদ মামা যে বলেছেন বর্ডারের ওদিকে যাওয়া বরণ।

অতদূর কে যাচ্ছে। আমরা দুপুরের আগে ফিরে আসবো। এই বলে ললি আমার দিকে তাকালো–আবির কী বলে?

আমিও ঠিক তাই ভাবছি। ললির কথায় সায় দিয়ে বললাম, কিছু যদি নাও পাই, বেড়ানো তো হবে!

সকালে জাহেদ মামার সঙ্গে দেখা হলো না। আমরা ঘুম থেকে উঠেছি আটটায়, তার আগেই তিনি বেরিয়ে গেছেন। নাশতা খাওয়ার সময় নেলী খালা বললেন, টের পেয়েছিলাম অনেক রাত পর্যন্ত তোমরা বারান্দায় বসে গল্প করেছে, তাই ভোরে ঘুম ভাঙাই নি!

নেলী খালা, কাল রাতে আমরা–উত্তেজিত গলায় টুনি আলো দেখার কথা বলতে যাচ্ছিলো, ললির চিমটি খেয়ে ওর মনে পড়লো কাল রাতে আমরা ঠিক করেছিলাম এ কথা কাউকে বলবো না।

নেলী খালা অবাক হয়ে বললেন, কাল রাতে তোমরা কী টুনি?

ললিপা, তুমি বলো। মুখ কালো করে বললো টুনি।

ললি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললো, অনেক রাত পর্যন্ত আমারা কিশোর পারেখের ছবির গল্প করছিলাম।

আমি হাসতে হাসতে বললাম, পাকড়াশীর পার্ট কে করবে কিশোরদাকে জিজ্ঞেস করা হয় নি।

শুধু পাকড়াশী কেন, লরেল হার্ডির মতো ফতে গোবররা আছে না? কম পাজি ছিলো নাকি ও দুটো!

নেলী খালার কথা শুনে আমরা সবাই হেসে উঠলাম। বারান্দায় বসে ছিলো স্ক্যাটরা। কোরাসে হাসি শুনে বললো, ঘেউ।

নাশতা খেয়ে তৈরি হয়ে নেলী খালাকে যখন বেড়াতে যাবার কথা বললাম–শুনে শুধু মুখ টিপে হাসলেন। টুনি ছুটে গিয়ে নেলী খালাকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খেয়ে বললো, তুমি কতো ভালো নেলী খালা!

টুনির দেখাদেখি স্ক্যাটরাও এসে নেলী খালাকে আদর করলো। নেলী খালা বললেন, দুপুরের আগে ফিরে এসো।

আমাদের সঙ্গে বেড়ানোর সুযোগ পেয়ে স্ক্যাটরা মহা উত্তেজিত। কাঠবেড়ালি দেখলেই ও ছুটে যায় ধরতে। প্রজাপতি দেখলেও ওদের পেছনে ছুটবে। ধরতে না পেরে ক্লান্ত হয়ে থোকা মুখ করে চোরের মতো আড়চোখে তাকাবে। ওর কাণ্ড দেখে আমরা হেসে বাঁচি না।

আমরা হাঁটছিলাম বর্ডারের দিকে। প্রথমে ছিলো হালকা গাছপালা আর এখানে সেখানে ছোট বড়ো ঝোঁপঝাড়। তারপর ধীরে ধীরে গাছগুলো ঘন আর বড়ো হতে লাগলো। এক ঘন্টা হাঁটার পর মনে হলো আমরা জঙ্গলের বেশ ভেতরে ঢুকে গেছি। ঘড়িতে দেখি মাত্র দশটা বাজে। এখানে সেখানে ছিটেফোঁটা রোদের কণা। একটা ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা ভাব। শুকনো পাতা মাড়িয়ে আমাদের হাঁটার শব্দ ছাড়া জঙ্গলে আর কোনো শব্দ নেই। এমনকি পাখির ডাকও শোনা যাচ্ছিলো না।

বাবুকে বললাম, লক্ষ্য করেছে, কিছুক্ষণ আগেও অনেক পাখির ডাক শুনেছি। কাঠবেড়ালিদের দেখেছি ছুটোছুটি করতে। এদিকে দেখো, কোনো কিছুর সাড়াশব্দ নেই। বলতে বলতে হঠাৎ মনে হলো বহু দূরে অদ্ভুত ধরনের একটা শব্দ। চাপা গলায় বললাম, একটু দাঁড়াও তো!

আমার কথা শুনে সবাই থমকে দাঁড়ালো। বাবু বললো, দাঁড়াতে বললে কেন, কিছু শুনতে পেয়েছো?

আমি ইশারায় সবাইকে চুপ করতে বললাম। স্ক্যাটরাও কান খাড়া করলো। মনে হলো বহু দূরে আবছা একটা গম্ভীর শব্দ–ধুপ-ধুপ-ধুপ-ধুপ।

ওরা সবাই শুনলো সেই শব্দ। সবার চোখে মুখে প্রশ্ন। স্ক্যাটরা গরুগরু করে উঠলো। ললি অস্তে বললো, গ্রামে ধানের কলে অনেকটা এরকম শব্দ হয়।

বাবু চিন্তিত গলায় বললো, এদিকে গ্রাম কোথায়?

ধানের কলের শব্দ নয় ললি। আমি মাথা নাড়লাম–খেয়াল করে দেখো, বেশ ভারি আর গম্ভীর শব্দ।

বাবু বললো, চলো না, সামনে গিয়ে দেখি। জাহেদ মামা বলছিলেন, কোন জিওলজিক্যাল টীম এসেছে। ওদের সার্ভে করার কোনো মেশিন-টেশিনের শব্দ হতে পারে।

বাবুর কথা মতো আমরা চার জন সামনের দিকে এগুলাম। স্ক্যাটরাও সতর্ক হয়ে কান খাড়া করে হাঁটছে। আমি একটা গাছের শক্ত ডাল ভেঙে হাতে নিলাম। স্ক্যাটরা যতক্ষণ সঙ্গে আছে ততক্ষণ ভয়ের কিছু নেই। তবু বলা যায় না, জঙ্গলের ভেতর সাপ-খোপও তো থাকতে পারে।

আমরা যতো সামনের দিকে হাঁটছিলাম ধুপ-ধুপ শব্দটা ততো জোরালো হচ্ছিলো। গাছপালা একটু ফাঁকা হতেই সামনে তাকিয়ে দেখি উঁচু পাহাড়ের মতো। দূর থেকে মনে হয়েছিলো ঘন জঙ্গল। পাহাড়ের গায়ে ঝোঁপঝাড় ভর্তি, দূরে দূরে একটা দুটো আধমরা গাছ। শব্দের উৎস মনে হলো পাহাড়ের উল্টোদিকে। একটানা ধুপ-ধুপ-ধুপ–ধুপ ভারি আর গম্ভীর শব্দ। যেখান থেকেই আসুক, মনে হচ্ছিলো পাহাড় ফুঁড়ে বেরুচ্ছে।

আমরা শব্দের উৎস খুঁজে বের করার জন্য পাহাড়টাকে ডান দিকে রেখে উত্তর। দিকে হাঁটলাম। হঠাৎ দেখি জঙ্গল শেষ হয়ে গভীর ঢল নেমে গেছে। দেখে মনে হয়ে মাটি কেটে বুঝি চওড়া নালার মতো ঢালটুকু বানানো হয়েছে। আরো কাছে গিয়ে দেখি মাটি কাটা হয়েছে পাহাড়ের গা থেকেও। লালচে কমলা রঙের মাটি। সবুজ পাহাড়ের শরীর আর ঘন জঙ্গলকে কেউ যেন বিশাল এক ছুরি দিয়ে চেঁছে পরিষ্কার করে দিয়েছে। সবুজের ভেতর চেঁছে ফেলা জায়গাটুকু ক্ষতচিহ্নের মতো দগদগ করছে। মাটি খুঁড়ে শব্দ বেরুচ্ছে ধুপ-ধুপ-ধুপ-ধুপ। আমরা চার জন হতভম্ব হয়ে ঢালের কিনারায় দাঁড়িয়ে রইলাম। স্ক্যাটরা পর্যন্ত ভয় পেয়ে গেছে।

বাবু চাপা গলায় বললো, শব্দটা ঠিক পাহাড়ের ভেতর থেকে আসছে।

আমি বললাম, লক্ষ্য করে দেখো, ঠিক হার্টবিটের মতো মনে হচ্ছে।

সবজান্তার মতো বাবু বললো, এগুলোকে বলে জীবন্ত পাহাড়।

জীবন্ত পাহাড় মানে কী? ভয় পাওয়া গলায় ফিসফিস করে জানতে চাইলো টুনি।

এ ধরনের পাহাড়কে আগ্নেয়গিরি বলে। মনে হচ্ছে এখান দিয়ে কখনো লাভার স্রোত নেমেছিলো।

না বাবু! মাথা নাড়লাম আমি। লাভা যদি নামতো তাহলে শক্ত হয়ে জমে থাকতো। যাকে বলে আগ্নেয়শিলা। এখানে পরিষ্কার কাঁচা মাটি দেখা যাচ্ছে।

তাহলে শব্দটা কিসের? কাল রাতে আলোই বা কে দেখালো? জানতে চাইলো বাবু।

বুঝতে পারছি না। এ ব্যাপারে আমি কোনো আলোকপাত করতে পারলাম না।

ললি বললো, কেমন বাজে একটা গন্ধ পাচ্ছি! আবির ফিরে চলো, আমার শরীর খারাপ লাগছে।

ললির কথা শুনে গন্ধটা আমরাও অনুভব করলাম। পোড়া গন্ধকের মতো ভারি আর অস্বস্তিকর একটা গন্ধ বাতাসে মাঝে মাঝে ভেসে আসছিলো। ললির কথা শেষ না হতেই টুনি বললো, আমারও খুব খারাপ লাগছে ললিপা। এখান থেকে শিগগির চলো।

চলো তাহলে। এই বলে আমরা যে, পথ দিয়ে এসেছিলাম সেই পথে বাংলোতে ফিরে এলাম। সারা পথ কেউ কোনো কথা বলে নি। এমনকি স্ক্যাটরা পর্যন্ত ঘাবড়ে গিয়েছিলো। ফেরার পথে এতো প্রজাপতি আর কাঠবেড়ালি–কাউকে ও কিছু বললো না।

.

১০. মনিপুরি দিদিমার আস্তানায়

বিকেলে লনে বসে লাল পাহাড়ের ভৌতিক শব্দের ব্যাপারে কথা বলছিলাম আমরা চার জন। বাবু এক বার বললো, পাহাড়ের ভেতর নিশ্চয় কেউ পাকড়াশীর মতো গোপন আস্তানা বানিয়ে বসে আছে।

আস্তানা যদি গোপন হবে, তাহলে ওরা শব্দ করবে কেন?

ললি বললো, পাহাড়ের ওপাশটায় তো আমরা যাই নি। হতে পারে সেখানে। কোনো যন্ত্র বসিয়েছে সার্ভে টীমের লোকেরা।

আমিও তো তাই বলছিলাম। বাবু ওর মতের সমর্থন পেয়ে উৎসাহিত হয়ে বললো, জাহেদ মামা এলেই জিজ্ঞেস করবো, কাল আমরা ওদের কারো সঙ্গে কথা বলতে পারি কিনা।

জাহেদ মামা দুপুরে খেতে আসেন নি। নেলী খালার মনও যে ভালো নেই টের পেলাম–যখন তার বদলে বড়িবি এলো আমাদের চা নিয়ে। বড়িবিকে দেখেই কথাটা মনে পড়লো আমার। ওকে জিজ্ঞেস করলাম বডিবি, এখানকার লোকজনদের কারো সঙ্গে তোমার পরিচয় হয়েছে?

বড়িবি বললো, কিছু কিছু আদমির সাথে বাতচিত হয়। সভরে দুধ দেয় বাসন্তী গোয়ালিনী। তার বাদে ধোবি আসে। হামার খাসির জন্য বাসন্তী মণিপুরি দিদিমার কবচ এনে দেবে। বলে জাদুর মাফিক কাজ করে।

কাল ওরা এলে জিজ্ঞেস করবে তো, এখানকার পুরনো লোক কারা। আমি তোমার কাশির জন্য ভালো একটা দাওয়াই দেব।

ঠিক আছে ছোটে সাব। দাওয়াই কখুন দিবে?

দাঁড়াও তাহলে। এই বলে আমি এক দৌড়ে ঘরে গিয়ে আমার ব্যাগ থেকে চারটা স্টেপসিল লজেন্স বের করলাম। মা বলেছেন, গলা খুশখুশ করলে খেতে। বড়িবি ওর কাশির জন্য এমন কোনো ওষুধ নেই যে খায় নি। এখন তাবিজ কবচ পরতে চাইছে বেচারা।

ওষুধ পেয়ে ও খুব খুশি। বললো, কখুন খাবো? পানিতে গুলে না গিলে খাবো?

যখন কাশি আসবে লজেন্সের মতো চুষে খেও, ভালো লাগবে।

আল্লা তোমার ভালো করবেন। তোমার দিলে বহুত রহম আছে ছোট সাব। এই বলে বড়িবি চলে গেলো।

পুরোনো লোক দিয়ে কি করবে তুমি? জানতে চাইলো বাবু।

হয়তো বলতে পারবে পাহাড়ে কেউ কখনো মাটি কেটেছিলো কিনা, কিম্বা শব্দটা কেন হয়।

আমাদের চা খাওয়া শেষ না হতেই কিশোরদা আর মণিদা এসে হাজির। স্ক্যাটরা কাল ওদের চিনে ফেলেছিলো, তাই কিছু বললো না। কিশোরদা হালকা গলায় বললেন, আমরা বোধ হয় একটু দেরি করে ফেলেছি আবির!

কিসের দেরি? আমি একটু অবাক হলাম।

একটু আগে এলেই চা-টা পাওয়া যেতো।

আমি এক্ষুণি চায়ের কথা বলছি। এই বলে টুনি একছুটে রান্নঘরের দিকে গেলো।

বাবু ব্যস্ত গলায় জানতে চাইলো, কালকের সেই লোকটার ব্যাপারে কিছু জানা গেলো মণিদা?

ন্‌না! মাথা নাড়লেন মণিদা–সন্ধ্যের আগে ওকে রাস্তার ওপর ছেড়ে আরো দশ টাকা দিয়ে বলেছি, যে লোকটা ওকে টাকা দিয়েছিলো সে এলে যেন মাথা চুলকে ইশারা করে। আমরা একটু দূরে আড়ালে বসে আছি। লোকটা এক ঘন্টা পায়চারি করলো, কেউ এলো না। তারপর অন্ধকার হতেই লোকটা হাওয়া হয়ে গেলো।

আমি বললাম, তার মানে, যে টাকা দিয়েছে সে নিশ্চয়ই জেনে গেছে লোকটা যে আমাদের হাতে ধরা পড়েছে।

ভীষণ ধড়িবাজ লোক। মণিদা বললেন, কাল ওর বাড়ির যে-ঠিকানা দিয়েছিলো, সকালে আমার এক চৌকিদার পাঠিয়েছিলাম সেখানে। চৌকিদার বললো, ওখানে ওই নামে কেউ থাকে না।

কিশোরদা সামান্য অভিযোগের গলায় বললেন, তুমি লোকটাকে আণ্ডার এস্টিমেট করেছিলে মণি।

যা ঘটেছে এর জন্য মণিদাকে দায়ী করা যায় না। আমরা থাকলেও একই ঘটনা ঘটতে পারতো। স্ক্যাটরা থাকলে তার কথা অবশ্য আলাদা। তবে লোকটার চেয়ে আমি বেশি ভাবছিলাম পাহাড়টার কথা। মণিদাকে জিজ্ঞেস করলাম আপনি কখনো বর্ডারের ওদিকে গিয়েছিলেন?

ন্‌না। কেন?

আজ সকালে গিয়েছিলাম। পাহাড়ের ভেতর অদ্ভুত শব্দ শুনেছি। গুরুগম্ভীর একটা ধুপ-ধুপ শব্দ। অনেকটা হার্টবিটের মতো।

মনিদা ভুরু কুঁচকে মাথা নাড়লেন–এরকম কোনো শব্দ শুনি নি তো!

কিশোরদা বললেন, এডগার এ্যালান পোর সেই গল্পটার কথা মনে হচ্ছে। একটা লোক খুন করে একজনের হার্টটাকে মাটির নিচে পুঁতে রেখেছিলো। পরে শুনতে পেলো মাটির তলা থেকে হার্টবিটের শব্দ আসছে। গিয়ে দেখে বিটের সঙ্গে সঙ্গে সে জায়গার মাটিও ওপরে উঠছে আর নামছে।

বাবু শুকনো গলায় বললো, আমরা পাহাড়ের কোথাও মাটি ওঠানামা করতে দেখি নি।

কাষ্ঠ হেসে কিশোরদা বললেন, আমি তোমাদের গল্পের কথা বলেছি। সত্যি সত্যি এরকম হয় নাকি!

মণিদা চিন্তিত গলায় বললেন, পাঁচ বছর ধরে ইটাগঞ্জ বাগানে আছি, এমন কথা তো কখনো শুনি নি! তোমরা সত্যি শুনেছো?

এমন সময় নেলী খালা এলেন কিশোরদা আর মণিদার জন্য চা নিয়ে। বললেন, খুব সিরিয়াস আলোচনা মনে হচ্ছে! ডিসটাব করলাম না তো?

কিশোরদা বললেন, আবির বাবুরা বলছিলো ওরা কোন এক পাহাড়ের নাকি হার্টবিট শুনেছে।

সকালের কথা নেলী খালাকে বলি নি। তিনি পিটপিট করে তাকালেন আমার আর বাবুর দিকে–পাহাড়ের হার্টবিট! বড়োদের সঙ্গে ঠাট্টা ইয়ার্কি করতে তোমাদের বারণ করেছি না! দিন দিন ফাজিল হচ্ছে। এরপর কিশোরদাকে বললেন, ছেলেরা মাঝে মাঝে আজগুবি গপ্পো করতে ভালোবাসে। আপনি ওদের সব কথা বিশ্বাস করবেন না।

কিশোরদা আর মণিদা হা হা করে হাসলেন। তাই বলুন! আমরা তো মহা চিন্তায় পড়ে গেছি পাহাড়ের হার্টবিটের কথা শুনে। দারুণ ইমাজিনেশন! যে শুনবে তার হার্টবিট ডবল হয়ে যাবে। কিশোরদার কথা শুনে মনে হলো এমন হাসির কথা তিনি বুঝি আর শোনেন নি। আমাদের সবার চোখে চোখে ইশারা হয়ে গেলো। এ নিয়ে আমরা আর কথা বাড়ালাম না।

রাতে ঠিক খাওয়ার সময় এলেন জাহেদ মামা। হাত-মুখ ধুয়ে টেবিলে বসার পর নানু বললেন, কদিন ধরে তুমি বেশ অনিয়ম করছো জাহেদ। তোমাকে যথেষ্ট ক্লান্ত মনে হচ্ছে।

একটু ঝামেলার ভেতর আছি আব্দু। বিচলিত গলায় বললেন জাহেদ মামা।

খাওয়াটা অন্তত সময় মতো করতে পারো!

জাহেদ মামা মাথা নেড়ে সায় জানালেন। তারপর নেলী খালাকে বললেন, কাল রাতে, প্রফেসর ইরফান হাবিবকে খেতে বলেছি।

কে তিনি?

এদেশের এতো বড়ো এক জন জিওলজিস্ট, কত পাবলিকেশন! নাম শোনো নি?

মৃদু হেসে নেলী খালা বললেন, না, শুনি নি। প্রথম কারণ, জিওলজি আমার সাবজেক্ট নয়। দ্বিতীয় কারণ, দেশে ফিরেছি মাত্র দেড় বছর হলো। তোমার সঙ্গে ওঁর পরিচয় কিভাবে?

আজ আমার অফিসে এসেছিলেন। ওঁর ধারণা পাথারিয়াতে বড়ো একটা তেলের রিজার্ভ আছে। এখানে আর্মি সিকুরিটি আরো কড়া করা দরকার। বললেন, স্যাবোটাজ হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

কারা স্যাবোটাজ করবে? অবাক হয়ে জানতে চাইলেন নেলী খালা।

ইতস্তত করে জাহেদ মামা বললেন, তিনি সব কথা খুলে বলেন নি। চাপা স্বভাবের মানুষ, কম কথা বলেন।

আমাদের চারজনের চোখে অনেক প্রশ্ন থাকলেও নানুর জন্য কিছুই জিজ্ঞেস করা হলো না। চুপচাপ খাওয়া শেষ করে আগের রাতের মতো বারান্দায় এসে বসলাম। উদ্দেশ্য যদি কোনো আলোর সঙ্কেত দেখা যায়!

বাবু বললো, আলোর কথাটা জাহেদ মামাকে জিজ্ঞেস করলে ক্ষতি কি?

একটু ভেবে বললাম, দেখো, এমনিতে জাহেদ মামা অনেক ঝামেলায় আছেন। এ সময়ে আমরা বাড়তি কোনো ঝামেলায় জড়াই, এটা তিনি পছন্দ করবেন না।

ললি আস্তে আস্তে বললো, ব্যাপারটা জানলে জাহেদ মামাদের উপকারও তো হতে পারে। মনে করো ওরা যদি আর্মির লোক না হয়!

ঠিক এই সময়ে নেলী খালা ভেতর থেকে ডাকলেন, আবির একটু কথা শুনে যাও তো।

নানুর শোবার ঘরের পাশে ছোট্ট একটা ঘরকে নেলী খালা স্টাডি রুম বানিয়েছিলেম। সেখানে বসে তিনি কি যেন লিখছেন।

আমি ঘরে ঢুকতেই নিচু গলায় বললেন, দরজাটা বন্ধ করে দাও।

কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমার বুকের ভেতরটা উত্তেজনায় ঢিবঢিব করতে লাগলো। অনেকটা পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে স্কুলের সেরা ছাত্রের নাম ঘোষণার আগে যেরকম হয়। অনুমান ঠিকই করেছিলাম। নেলী খালা বললেন, অপুর চিঠি পেয়েছি।

কোত্থেকে লিখেছে? চাপা উত্তেজিত গলায় জানতে চাইলাম আমি।

ও চিটাগাঙেই আছে। আমাকে একটা ঠিকানা দিয়েছিলো শহরের। আমি এখানে এসে ঠিকানা জানিয়ে ওকে লিখেছিলাম।

ভাইয়া কেমন আছে নেলী খালা? কি লিখেছে চিঠিতে?

নেলী খালা কথা না বলে চিঠিটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। স্কুলের খাতার রুলটানা কাগজে ভাইয়া লিখেছে–

নেলী খালা, চিঠিতে তোমার বিয়ের খবর জানতে পেরে দারুণ খুশি হয়েছি। তোমরা আমার অভিনন্দন জেনো। বাবা, মা, আবির, সবাই ভালো আছে জেনেও খুশি হয়েছি। এরকম খুশির খবর কদাচিৎ পাই। জানো তো, সরকারের লোকেরা কিভাবে হন্যে হয়ে আমাদের খুঁজছে। পালাতে পালাতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। তোমার দু মাসের টাকা একসঙ্গে পাওয়াতে খুব উপকার হয়েছে। শিগগিরই আমাকে সিলেট যেতে হতে পারে। সময় পেলে দেখা করবো। কিছু পুরনো গরম কাপড় আর ওষুধ জোগাড় করে রেখো। তোমরা চলে আসার পর পাকড়াশী আবার জমিয়ে বসেছে। তবে তোমার বাড়ি ঠিকই আছে। ওকে বলেছি বাড়ির দিকে নজর দিলে ওর কপালে দুঃখ আছে। ওর উড়ো চিঠি নিয়ে ভেবো না। মিছেমিছি ভয় দেখিয়েছে। তোমরা ভালো থেকো। ইতি-–অপু

চিঠি পড়া শেষ করে ভাইয়ার কষ্টের কথা ভেবে বুকটা টনটন করে উঠলো। ঠিকমতো খেতে পায় না, শীতে গরম কাপড় নেই, হুলিয়া মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়ায়–দেশের জন্য কাজ করা সত্যি বড়ো কষ্টের। অথচ ভাইয়া মুক্তিযুদ্ধের আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সেরা ছাত্র ছিলো। ম্যট্রিক আর ইন্টারমিডিয়েটে প্রথম দশ জনের ভেতর নাম ছিলো, ফিজিক্‌সে অনার্সে ফাস্ট ক্লাস সেকেণ্ড হয়েছে এক নম্বরের জন্য। নেলী খালাকে বললাম, তোমাকে আগে বলার সুযোগ পাই নি। গতবার তোমাকে বলেছিলাম না, আমার স্কলারশিপের বেশ কিছু টাকা জমেছে। ভাইয়াদের জন্য আমি এক হাজার টাকা এনেছি।

মিষ্টি হেসে আদর করে আমার কপালে চুমু খেলেন নেলী খালা–তুই সত্যি তাহলে অপুদের জন্য ভাবিস!

আমার বুকের ভেতর থেকে কান্না উঠে এসে গলার কাছে দলা পাকিয়ে গেলো। ঢোক গিলে বললাম, ভাইয়ার কথা আমি সব সময় ভাবি নেলী খালা। তোমাকে আমার এতো ভালো লাগে তুমি ওদের সাহায্য করে বলে।

ঠিক আছে আবির, এবার যাও, ওরা বসে আছে। জানো তো, এসব কথা যে। কাউকে বলতে হয় না। ওরা জিজ্ঞেস করলে বলবে সুয়েটারের মাপ নেয়ার জন্য ডেকেছিলাম।

জানি নেলী খালা। বলে আমি বারান্দায় এসে ললিদের সঙ্গে যোগ দিলাম।

নেলী খালা ডেকেছিলেন কেন আবির? জানতে চাইলো বাবু।

সুয়েটারের মাপ নিতে ডেকেছিলেন।

কথাটা কেউ অবিশ্বাস করলো না। টুনি বললো, আমরা ফিরে যেতে যেতে মা আমাদেরগুলো বোনা শেষ করে ফেলবেন।

বাবু একটু পরে বললো, আমার জন্য কেউ বুনবে না।

বা রে, তোমার তো সুটকেস বোঝাই গরম কাপড়! আমি বুঝি দেখি নি?

টুনির কথার কোনো জবাব দিলো না বাবু। ও যখন খুব ছোট তখন মেজো কাকী মারা গিয়েছেন। মায়ের স্নেহ বলতে যা বোঝায় বাবু কখনো তা পায় নি। ওকে বললাম, নেলী খালা শুধু আমার জন্য বুনছেন কে বললো! তোমার আর আমার এক মাপ বলে তোমাকে ডাকেন নি।

এটা তুমি বানিয়ে বলছো আবির। নেলী খালা আমার জন্য কেন সুয়েটার বানাবেন?

কেন বানাবেন সেটা আমি কী করে বলবো?

জিজ্ঞেস করবো নেলী খালাকে? চ্যালেঞ্জের গলায় বললো বাবু।

জিজ্ঞেস করো। আমি একটু বিব্রত বোধ করলাম। বাবুকে খুশি করার জন্য কথাটা বলেছিলাম। আসলে নেলী খালা আমাদের কারো জন্যেই সুয়েটার বুনছেন না।

বাবু একছুটে ভেতরে গেলো। আমি রীতিমতো প্রমাদ গুনলাম। নেলী খালা যদি মানা করেন, কি লজ্জার ব্যাপার হবে! একটু পরেই দৌড়ে এলো বাবু। উত্তেজিত গলায় বললো, নেলী খালা সত্যি সত্যি আমার জন্য সুয়েটার বুনছেন। কি দারুণ ব্যাপার, তাই না?

নেলী খালার মতো মানুষ হয় না। আস্তে আস্তে বললো ললি।

আমার মনের কথাটি বলার জন্য মনে মনে ললিকে ধন্যবাদ জানালাম। নেলী খালার জন্য আবারও গর্বে বুকটা ভরে গেলো।

আমরা কাল–টুনি কি যেন বতে যাবে, হঠাৎ ওকে থামিয়ে দিয়ে চাপা উত্তেজিত গলায় বাবু বললো, ওই দেখ, আবার–!

তাকিয়ে দেখি, কাল যেখানটায় ছিলো আজও ঠিক সেখান থেকে সার্চ লাইটের আলোর সঙ্কেত পুব দিকের কালো আকাশে দুবার জ্বলে উঠে হঠাৎ নিভে গেলো।

আমরা চারজন কয়েক মুহূর্ত কোনো কথা বলতে পারলাম না। কে পাঠাচ্ছে এই আলোর সঙ্কেত? কার জন্য? ওরা কি ভালো লোক না খারাপ লোক? এমনিতরো অনেক প্রশ্ন আমাদের সবার মনে। উত্তর কারো জানা নেই। কোনো সূত্র নেই। জাহেদ মামাকে বলা যেতে পারে। তিনি যদি বলেন ওটা আর্মির কাজ নয়, তাহলে? অন্ধকারে ঠিক বোঝাও যাচ্ছিলো না ওটা কত দূরে। হতে পারে ভারতের সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনী কোনো রুটিন সিগনাল পাঠাচ্ছে ওদের কাউকে।

অনেক রাতে আমরা ঘুমোত গেলাম। ঘুমের ভেতর স্বপ্নে দেখলাম পাকড়াশী একটা টর্চ জ্বালিয়ে নেলী খালাদের বাংলোটাকে দেখছে আর খি-খি করে হাসতে হাসতে বলছে, মজা টের পাওয়াচ্ছি।

সকালে বড়িবি বললো, ছোটে সাব, তুমার খাসির দাওয়াই বহুত উমদা আছে। হামার খুব আরাম হয়েছে।

যে জন্যে ওকে কাশির ওষুধ দেয়া, সে কথাটা জানতে চাইলাম–তোমাকে একটা খবর নিতে বলেছিলাম, নিয়েছো?

কেন নিবে না ছোটে সাব! বাসন্তী বললো, এখানকার সব থেকে পুরানা আদমী আছে মণিপুরি দিদিমা। সও সাল উমর আছে। তুমরা কি যাবে তার কাছে?

আমি বেশি আগ্রহ না দেখিয়ে বললাম দেখি, সময় পেলে না হয় ঘুরে আসবো। কোথায় থাকেন তোমাদের দিদিমা?

তিনার একটা আশ্ৰম আছে বড়লেখা স্কুলের কাছে। ইখান থেকে দো-তিন মিল দূর আছে।

নাশতা খাওয়ার পর নেলী খালাকে বললাম, এখানে একটা স্কুল আছে, তুমি গিয়েছিলে কখনো?

এখানে কোথায়? ভুরু কুঁচকে বললেন নেলী খালা-সে তো বড়লেখায়। স্কুলে আমি গিয়ে কী করবো!

আমি হাসতে হাসতে বললাম কেন, মেজরের বউদের বুঝি স্কুলের ফাংশনে দাওয়াত দেয় না?

ফাংশনের জন্য সারকেল অফিসারের বিবি আছেন। নেলী খালা হেসে ফেললেন–স্কুলে কী কাজ?

কাজ আবার কী! এমনি দেখতে ইচ্ছে করছে।

দুপুরে জাহেদ এলে ওর সঙ্গে যেতে পারো।

ঘড়িতে যখন ঠিক একটা বাজলো-জাহেদ মামা খেতে এলেন। খাওয়ার টেবিলে নেলী খালা বললেন, যাওয়ার পথে আবিরদের স্কুলের পথে নামিয়ে দিও।

জাহেদ মামা খেতে খেতে কি যেন ভাবছিলেন। নেলী খালার কথার জবাবে শুধু মাথা নেড়ে সায় জানালেন।

আমরা খেয়ে উঠে জাহেদ মামার জীপের পেছনে উঠে বসলাম। আশ্রমে যাবো, তাই স্ক্যাটরাকে রেখে গেলাম। ব্যাপারটা ও মোটেই পছন্দ করলো না। ড্রাইভার ছিলো জীপে। জাহেদ মামা সামনের সিটে বসে গম্ভীর হয়ে ড্রাইভারকে বললেন, আগে স্কুলের দিকে যাও।

নেলী খালা বারান্দা থেকে বললেন, তোমরা সন্ধ্যের আগে ফিরবে।

বড়লেখায় যাওয়ার পথে স্কুল। জীপে আসতে সময় লাগলো মিনিট সাতেকের মতো। আমাদের নামিয়ে দিয়ে জাহেদ মামা বললেন, আশা করি তোমরা পায়ে হেঁটে ফিরে যেতে পারবে?

কেন পারবো না? ব্যস্ত টুনি বললো, এইটুকুই তো পথ!

জাহেদ মামা আর কোনো কথা না বলে ধুলো উড়িয়ে চলে গেলেন। খেয়ালও করলেন না, যে স্কুলের সামনে আমরা নেমেছি সেটাতে কোনো ক্লাস হচ্ছে না। মাঠে শুধু দুটো ছাগল চরছে।

টুনি বললো, এ কী, স্কুল যে বন্ধ!

বাবু বললো, তাতে কী, আমরা সত্যি সত্যি স্কুল দেখতে এসেছি নাকি?

নেলী খালা যদি জিজ্ঞেস করেন?

বলবে স্কুল দেখেছি। সেখান থেকে আশ্রমে গেছি।

ললি বললো, আশ্রমটা কোথায় দেখছি নাতো!

আমাদের দেখতে পেয়ে স্কুলের ভেতর থেকে ছাগুলে দাড়িওয়ালা মালিগোছের একটা লোক নিড়ানি হাতে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো, আফনারা কই যাইতায়?

লোকটার কথা শুনে ললির আড়ালে গিয়ে টুনি হাসি চাপলো। আমি বললাম, মণিপুরি দিদিমার আশ্রমে যাবো।

আশ্রমে নি যাইতায়? দিদিমা এই সময় কারো লগে মাতে না।

আশ্রমটা কোথায়? গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলো বাবু।

লোকটা আঙুল তুলে দেখালো–ওই তালগাছের নিচে তারার আশ্রম। আফনারা হিন্দু না মোসলমান?

আমরা মানুষ। এই বলে ছাগুলে দাড়ির অবাক চোখের সামনে দিয়ে আমরা আশ্রমের পথে এগিয়ে গেলাম।

স্কুল থেকে আশ্রম বেশি দূরে নয়। বড়ো একটা আমবাগানের মাঝখানে ঝকঝকে নিকোনো উঠোন, তিন পাশে তিনটা মাটির ঘর, খড়ের চালে কুমড়োল বেয়ে উঠেছে। মস্তো বড়ো কয়েকটা চালকুমড়ো চালের ওপর পড়ে আছে। এক পাশে গাদা ফুলের ঝোঁপ, অল্প দূরে লাউয়ের মাচার পাশে দুটো লঙ্কাজবার গাছ। বেশ ছিমছাম শান্ত পরিবেশ।

এক জন বুড়ো লোক আমাদের দেখে ঘর থেকে বেরুলেন। কপালে চন্দনের তিলক, চোখে রিমের চশমা, মুখে প্রসন্ন হাসি। বললেন, এসো বাছারা, বসো এখানে।

ঘরের বারান্দায় মাদুর পাতা ছিলো। আমরা সেখানে বসলাম। বুড়ো বললেন, আমার নাম হরেকৃষ্ণ গোস্বামী। সবাই ডাকে গোঁসাইদা। তোমাদের পরিচয় কী বাছারা? কোত্থেকে আসা হলো?

আমরা আমাদের নাম বললাম। জাহেদ মামার পরিচয় দিয়ে বললাম, এখানে বেড়াতে এসে মণিপুরি দিদিমার আশ্রমের কথা শুনেছি। ওঁর বয়স নাকি এক শ বছর? নিশ্চয়ই অনেক কথা জানেন?

গোঁসাইদা মৃদু হেসে বললেন, এক শ নয়, দিদিমার বয়স এই মাঘে একশ তিন হবে। পুরনো দিনের কথা সব মনে আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেবার সিলেট এলেন, দিদিমার ভজন শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন। আমার আবছা আবছা মনে পড়ে। খুব ছোট ছিলাম তখন।

আপনারা এখানে কবে এসেছেন?

আমার প্রশ্ন শুনে গোঁসাইদা মনে মনে হিসেব করে বললেন, তা ধরো পঞ্চাশ বছরের ওপর হবে।

কার সঙ্গে কথা বলছিস হরেকেষ্ট? বলতে বলতে পাশের ঘর থেকে বেরুলেন টকটকে ফর্সা এক বুড়ি। এই বুঝি মণিপুরি দিদিমা! দেখে মনে হয় না এতো বয়স।

আমাদের ভুল ভাঙলো গোঁসাইদার কথায়–এরা দিদিমাকে দেখতে এসেছে রাধা মাসি। ছাউনির বড়ো সায়েবের কুটুম্ব। আমাদের বললেন, ইনি হলেন রাধা মাসি, দিদিমার ছোট মেয়ে।

রাধা মাসি এক গাল হেসে বললেন, এসো তোমরা, ভেতরে এসো।

আমরা ওঁকে অনুসরণ করে ঘরের ভেতর ঢুকলাম। এক কোণে তক্তপোষের ওপর বালিশে হেলান দিয়ে বসে আছেন মণিপুরি দিদিমা। কিছুটা চীনা ধাঁচের চেহারা, কাঁচা সোনার মতো গায়ের রঙ, গেরুয়া রঙের থান পরনে, গায়ে মোটা খদ্দরের চাদর। রাধা মাসি আমাদের পাশের তক্তপোষে বসিয়ে দিদিমার কানের কাছে মুখ নিয়ে জোরে বললেন মা, এরা তোমাকে দেখতে এসেছে। মস্ত লোকের ছেলেমেয়েরা।

দিদিমা মাথা নাড়লেন। মৃদু হাসলেন। সারা মুখে বয়সের রেখাগুলো কেঁপে উঠলো–আজ তোরা কেন বেরিয়েছিস? আজ না অমাবস্যা!

অমাবস্যায় বেরুলে কী হয়? নিরীহ গলায় জানতে চাইলাম আমি।

রাধা মাসি আগের মতো চেঁচিয়ে বললেন, ওরা জানতে চাইছে অমাবস্যায় বেরুলে কী হয়?

অভিশাপ, অভিশাপ! চাপা কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন মণিপুরি দিদিমা–অমাবস্যার রাতে পাহাড় থেকে নেমে আসে অতৃপ্ত আত্মারা। আজ একটা অঘটন ঘটবে।

কাদের আত্মা? আবার প্রশ্ন করলাম আমি। রাধা মাসি আগের মতো কথাটা দিদিমাকে শোনালেন।

বাগানের কুলিদের আত্মা, মাটি-কাটা মজুরদের আত্মা। আহ্ ওরা কেউ বাঁচে নি। ওদের আত্মা এখনো গুমরে কাঁদে। আমি সব শুনতে পাই। সব শুনি, সব দেখি। এই বলে দিদিমা চোখ বুজলেন।

রাধা মাসি ভয়পাওয়া শুকনো গলায় বললেন, তোমরা এখন যাও। বহু দিন পর মার ঘোর লেগেছে। আবার এসো তোমরা।

আমরা ঘর থেকে বেরুতেই রাধা মাসি গোঁসাইদাকে ডাকলেন–হরেকেষ্ট শিগগির যাও, সবাইকে খবর দাও, আজ সারারাত নামগান হবে। মার ঘোর লেগেছে। আজ রাতে ভীষণ অঘটন ঘটতে পারে।

মণিপুরি দিদিমার আশ্রম থেকে যখন বেরুলাম, তখন মাত্র তিনটা বাজে। বিপদের কোনো লক্ষণ কোথাও দেখলাম না। শীতকাল বলে বিকেল বিকেল মনে হচ্ছিলো। এদিকে শীতও পড়েছে বেশ। সূর্যটা পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কনকনে উত্তুরে বাতাস বইতে থাকে। বিকেলের রোদ পিঠে নিয়ে হাঁটতে বেশ ভালোই লাগছিলো আমাদের।

টুনি বললো, স্ক্যাটরা নিশ্চয়ই মনে মনে আমাদের গাল দিচ্ছে।

মনে মনে কেন? বাবু বললো, জোরে জোরে দিলেও কি বুঝবে কিছু?

খুব বুঝবো!

কী জানি বাবা! বাবু কাঁধ নাচালো–যার ভাষা সে বুঝবে!

টুনি প্রথমে কিছু বোঝে নি। আমাকে আর ললিকে দেখে বললো, তোমরা হাসছে কেন ললিপা!

বাবু তোমাকে কী বলেছে টুনি? হাসতে হাসতে বললো ললি।

কেন, কী বলেছে? টুনি বাবুর দিকে তাকালো। বাবু তখন হাসি চাপতে ব্যস্ত। হাঁটছিলো একটু দূরে দূরে।

তোমাকে কুকুর বলেছে।

বা রে, কখন বললো? কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে টুনির মনে পড়লো বাবু আসলে কী বলেছে। সঙ্গে সঙ্গে–কি অসভ্য! বলে বাবুর পিঠে কিল মারার জন্য ছুটলো। বাবু ততোক্ষণে অনেক এগিয়ে গেছে।

ললি হাসতে হাসতে বললো, বাবু, টুনি, দুটোই ছেলেমানুষ।

বলতে যাচ্ছিলাম, আমি কী ললি–ঠিক তখনই নজরে পড়লো দূরে হঠাৎ জঙ্গল ফুড়ে বেরুলেন কিশোরদা আর তার বন্ধু মণিদা। ললিও আমার সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পেলো ওদের। বাবু টুনি উল্টোদিকে দৌড়াচ্ছিলো বলে কিছু দেখতে পেলো না।

ললি বললো, কিশোরদা আর মণিদাও বেড়াতে বেরিয়েছেন। যাবে ওদিকে?

একটু দাঁড়াও। ললিকে আমি একটা গাছের আড়ালে টেনে নিয়ে এলাম। কিশোরদা আর মণিদার চলাফেরার মধ্যে একটা সতর্ক সন্ত্রস্ত ভাব। ভালো করে লক্ষ্য করো ললি। ওরা লুকিয়ে কিছু করেছেন কিম্বা করতে চাইছেন।

ললি বললো, আমার মনে হচ্ছে ওঁরা ভয় পেয়েছেন। কাল আমাদের কথা শুনে। ওঁরা নির্ঘাত পাহাড়ের হার্টবিট শুনতে গিয়েছিলেন।

বাবু টুনি ছুটতে ছুটতে আবার আমাদের কাছে এলো। মনে হলো ওদের কিল মারার পর্ব আপাতত শেষ হয়েছে। কিশোরদা আর মনিদার ভয়-পাওয়া চলাফেরা ওদেরও দেখালাম।

বাবু উত্তেজিত হয়ে বললো, চলো, ওদের ফলো করি।

টুনির গলা শুকিয়ে গেলো-–ললিপা, আমার ভয় করছে। শোনো নি মণিপুরি দিদিমা কী সব আত্মা আর অভিশাপের কথা বলেছেন? আজ নাকি কী সব ঘটবে!

টুনির কথা শেষ না হতেই কিশোরদারা আবার জঙ্গলের ভেতর হারিয়ে গেলেন। আমরা বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম জঙ্গল থেকে তারা কখন বের হন দেখবার জন্য। সাড়ে চারটা বেজে গেলো–ওঁরা এলেন না। টুনি কাঁদো-কাঁদো গলায় বললো, নেলী খালা বলেছেন, সন্ধ্যের আগে ফিরতে। তোমরা আর কতক্ষণ এভাবে বসে থাকবে?

আমি বললাম, ঠিক আছে, চলো। কিশোরদাদের সঙ্গে দেখা হলে জানতে দেব ওদের যে আমরা দেখেছি। নিজে থেকে কী বলেন দেখা যাক।

নেলী খালা আমাদের জন্য চা নিয়ে লনে অপেক্ষা করছিলেন। স্ক্যাটরা দূর থেকে আমাদের দেখতে পেয়ে ছুটে এসেছে। নেলী খালা বললেন, ওর ভারি মন খারাপ, তোমরা ওকে সঙ্গে নাও নি।

বললাম, স্কুল থেকে আমরা মণিপুরি দিদিমার আশ্রমে গিয়েছিলাম।

বড়িবি যার কথা বলে, সেই বুড়ি? সত্যি সত্যি ওর বয়স এক শ, না সব বানানো গপ্পো? জানতে চাইলেন নেলী খালা।

গোঁসাইদার মতো করে বললাম, এক শ নয়, দিদিমার বয়স এই মাঘে এক শ তিন হবে। ওঁর মেয়ের বয়সও আশির কাছে!

বাবু জিজ্ঞেস করলো, আজ কিশোরদারা আসেন নি?

না। মুখ টিপে হাসলেন নেলী খালা–কিশোর পারেখ দেখি ছবি করার কথা বলে সবাইকে ওর ভক্ত বানিয়ে ফেলেছে।

টুনি বললো, মণিপুরি দিদিমা কী সব আত্মা আর অভিশাপের কথা বলেছে। আজ নাকি কী ঘটবে!

ওসব ওদের ভড়ং। শান্ত গলায় বললেন নেলী খালা–উদ্ভট কথা না বললে লোকে ওদের অলৌকিক ক্ষমতা বিশ্বাস করবে কেন?