০১-২. জলপাই সবুজ চিঠিতে বিপদের সংকেত

পাথারিয়ার খনি-রহস্য – কিশোর উপন্যাস – শাহরিয়ার কবির

০১. জলপাই সবুজ চিঠিতে বিপদের সংকেত

নবেম্বরের ঠিক মাঝামাঝি আমাদের স্কুলের বছর শেষের পরীক্ষাটি হয়ে গেলো। বড়দিনের লম্বা দেড় মাস ছুটি কিভাবে কাটাবো ভাবছি–এমন সময় মিসৌরি থেকে বাবু অবাক-করা এক চিঠি লিখলো। বাবু আমার মেজো কাকার একমাত্র ছেলে, আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুদের একজন। ছমাস আগে ও ছিলো একমাত্র বন্ধু। এখন আমার আরো বন্ধু আছে তবু বাবুর কথা আলাদা। মেজো কাকা ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ এ্যাম্বেসির কাউন্সিলার। বাবু মিসৌরির এক বোর্ডিং স্কুলে পড়াশোনা করে। মাসে কম করে হলেও দুটো চিঠি লেখে আমাকে। গত মাসে অবশ্য একটা চিঠি লিখেছে। এ নিয়ে আমি কিছু মনে করি নি। তার আগের মাসে আমিও ওকে একটা চিঠিই লিখেছিলাম।

বাবু ওর চিঠিতে লিখেছে, মেজো কাকাকে নাকি জাপানে বদলি করা হয়েছে। আর জাপান যাওয়ার আগে দুমাস তিনি দেশে কাটাতে চান। বাবুদের এবার বড়দিনের ছুটি ডিসেম্বরের আগেই শুরু হবে। গত চিঠি লেখার সময়ে ও ভাবতেই পারে নি এবারের বড়দিনের ছুটি দেশে কাটাবে। ভাববে কী করে, চার মাস আগেই তো ও গরমের ছুটি আমাদের সঙ্গে কাটিয়ে গেলো। সেবার নেলী খালার নুলিয়াছড়ির রহস্যময় বাড়িতে কী মজার সময়ই না কেটেছিলো! ভাবলে এখনো রোমাঞ্চ হয়। বাবু ওর চিঠিতেও সে সব কথা লিখেছে। গত চার মাসে ও যে কটা চিঠি লিখেছে, সবগুলোতে নুলিয়াছড়ির কোনো না কোনো ঘনটার কথা থাকবেই। এবারের চিঠি ও শেষ করেছে এভাবে–

নেলী খালার সঙ্গে জাহেদ মামার বিয়ে তো ডিসেম্বরেই হওয়ার কথা। বাবাকে যারা বদলি করেছেন, কি বলে যে তাঁদের ধন্যবাদ দেবো ভেবে পাই না। যদিও এই বদলিটা বাবার পছন্দ হয় নি। তুমি, ললি আর টুনি আমাকে ফেলে নেলী খালার বিয়েতে মজা করছে–যতোবার কথাটা ভেবেছি ততোবার পৃথিবীটা অসার মনে হয়েছে। টুনির সঙ্গে চিঠিতে এ নিয়ে কয়েক দফা ঝগড়াও হয়ে গেছে। ওরা ধারণা আমেরিকায় আমি খুব আনন্দে আছি। আর কেউ না জানুক, তুমি তো জানো আবির, এখানে আমার কি রকম বিচ্ছিরি সময় কাটে! টুনি এ কথা বুঝতেই চায় না। ওর সঙ্গে বড় রকমের একটা ঝগড়া আছে–আপাতত তুলে রেখেছি। তোমাদের সঙ্গে আবার এভাবে দেখা হবে ভাবতেই পারি নি। চিঠির উত্তর দেয়ার দরকার নেই। আমরা দিন দশেকের মধ্যে আমেরিকা ছাড়ছি। আমি পরশু ওয়াশিংটন চলে যাচ্ছি। মিসৌরিতে বোধ হয় আর ফেরা হবে না। এ নিয়ে দুঃখও করি না। হতচ্ছাড়া এই জায়গাটা কখনো আমার ভালো লাগে নি। যদিও আমার রুমমেট ল্যারি একটু আগে দুঃখ দুঃখ মুখে বলছিলো, আমাকে নাকি ও মিস করবে। ভালো করে জানি জেনি সঙ্গে থাকলে পৃথিবীর কারো কথা ওর মনে থাকে না। বলতে হয় তাই বলা, আমিও বলেছি। অনেক কথা জমে আছে। দেখা হলে সব বলবো। ভালোবাসা জেনো। ইতি–বাবু।

চার পাতার চিঠিটা কয়েক বার পড়ে মেজো কাকার খবরটা মাকে দেয়ার জন্য আমার চিলেকোঠার ঘর থেকে এক ছুটে দোতালার শোয়ার ঘরে এসে দেখি জলপাই রঙের এক খানা চিঠি হাতে মা উদাস হয়ে খাটের ওপর বসে আছেন। নেলী খালাকে দেখেছি মাকে জলপাই রঙের রেডিও বণ্ড কাগজে চিঠি লিখতে। ওতে আবার জুই ফুলের গন্ধ থাকে। মাকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে বুঝতে অসুবিধে হলো না, নিশ্চয়ই নেলী খালা কোনো ‘উদভুট্টি কাণ্ড’ ঘটিয়েছেন। ছোটবেলা থেকে নেলী খালা বিদেশে ছিলেন। বহু বছর পর দেশে ফিরে নতুন যা কিছু করতে যান মা বলেন, ‘উদভুট্টি কাণ্ড’–যা নাকি কেউ কখনো দেখে নি। নেলী খালা কখন কি ‘উদভুট্টি কাণ্ড’ ঘটান এই ভেবে মা সারাক্ষণ শঙ্কিত থাকেন। আর তেমন কিছু ঘটার সম্ভাবনা দেখলেই পাতার পর পাতা চিঠি লিখে ‘ইহা কদাচ করিও না’ কিম্বা ‘অবশ্যই আমার কথা মানিয়া চলিবে, মামার সহিত পরামর্শ মোতাবেক কাজ করিবে’–ধরনের গম্ভীর সব উপদেশ দেবেন।

মাকে উদাস, গম্ভীর, শঙ্কিত, বিরক্ত মুখে জলপাই রঙের চিঠি হাতে বসে থাকতে দেখে মনে হলো নেলী খালার এবারের উদভুট্টি কাণ্ড নিশ্চয় গুরুতর কিছু হবে। আমি যে ঘরে ঢুকেছি মা ফিরেও তাকালেন না। নেলী খালার চিঠিতে কী লেখা আছে দেখার জন্য মনটা আঁকুপাকু করছিলো। কথাটা মাকে কিভাবে বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। জানি, ভূমিকা ছাড়া বলতে গেলেই মার ধমক খেতে হবে। ঠিক এই সময় বাবা এসে আমাকে রেহাই দিলেন।

কলেজ ফেরত বাবা প্রথমে ইজি চেয়ারে বসে জুতো-মুজো খুললেন। আলনাব পাশে দাঁড়িয়ে জামা কাপড় বদলালেন, বাথরুমে ঢুকে মুখ-হাত ধুয়ে তোয়ালে হাতে বেরুলেন, মার কোনোদিকে নজর নেই। খবরের কাগজটা নিয়ে বিছানার ওপর বসে মাকে বললেন, অতো গম্ভীর হয়ে কী ভাবছো শানু? নেলী আবার কোনো অঘটন ঘটিয়েছে নাকি!

মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাবার দিকে তাকালেন। আমাকে যেন দেখতেই পান নি–তুমি তো ওকে লাই দিয়ে মাথায় তুলেছে। মেয়েমানুষ হয়ে এসব পুরুষের কাজে কি না জড়ালেই নয়? নেলীর জন্য মামার কপালে যে কতো দুর্ভোগ আছে আমি শুধু তাই ভাবি। ভারি গলায় কথাগুলো বলে মা আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

বাবা মৃদু হাসলেন–দুর্ভোগ তো তোমারও কম নয়। নেলী কী করেছে বলবে তো?

মা শুকনো গলায় বললেন, আমার দুর্ভোগ কে আর দেখছে বলো। ফি হপ্তায় এতো যে লিখি, ও কি আমার কথা গ্রাহ্যি করে? তুমি বলছো কী করেছে? কী করে নি তাই বলো না! ওই হানাবাড়িটা কেনার পর থেকে অঘটন লেগেই আছে। এবার সর্বনাশের আর কিছু বাকি নেই।

বাবা হাল ছেড়ে হাই তুললেন। খবরের কাগজের ওপর চোখ বোলাতে বোলাতে বললেন, সর্বনাশের কী হলো না বললে বুঝবো কী করে?

মা গম্ভীর হয়ে একবার আমার দিকে তাকালেন। তারপর বাবাকে বললেন, তোমার গুণধর ছেলে দলবল নিয়ে গরমের ছুটিতে নুলিয়াছড়িতে গিয়ে কতগুলো পাজি গুণ্ডোর পেছনে লেগে, খবরের কাগজে ছবি ছেপে ভেবেছে জানি কী দিগ্বিজয় করেছে। ওদিকে পাকড়াশী না টাকড়াশী নেলীর জান কয়লা করে দিচ্ছে। শয়তানটার সঙ্গে নাকি সরকরের ওপর মহলের যোগসাজস আছে। থানার হাজত থেকে বেরিয়ে নেলীর পিছনে লেগেছে। ওর দলের লোকেরা যখন-তখন বাড়িতে এসে যা খুশি বলে যাচ্ছে। গোয়ালা দুধ দেয়া বন্ধ করেছে। তিন মাস নাকি কোনো গেস্ট আসে নি। আরও কত কী যে করছে চিঠিতে নেলী সব লিখেছে।

মার কথা শুনে বাবা গম্ভীর হয়ে হাতের খবরের কাগজটা একপাশে ভাঁজ করে রেখে বললেন, চিঠিটা আমাকে একবার দেখতে দেবে?

মা বসেই ছিলেন। ইশারায় আমাকে বললেন, চিঠিটা বাবাকে দিতে। নেলী খালার চিঠি পড়ার প্রচণ্ড ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমি সেটা মার হাত থেকে নিয়ে বাবাকে দিলাম। চিঠি পড়তে গিয়ে বাবার কপালে ভাঁজ পড়লো। পড়া শেষ করে বললেন, আমার মনে হয়, নুলিয়াছড়িতে থাকা নেলীর আর উচিত হবে না।

মা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন–চিঠির গুরুত্বটা তাহলে তুমিও বুঝতে পেরেছো! আমি তো ভেবেছিলাম প্রত্যেকবার যা করো–এবারও হেসে উড়িয়ে দেবে। এই বলে মা বিছানা ছেড়ে উঠলেন–তোমাদের তাহলে চা দিতে বলি।

নেলী খালাকে নিয়ে ভাবনার দায়িত্বটা বাবার কাঁধে তুলে দিয়ে মা নিশ্চিন্ত মনে রান্নাঘরের দিকে গেলেন।

আমি বাবাকে বললাম, নেলী খালার চিঠিটা একবার পড়তে দেবে?

বাবা আমার দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবলেন। তারপর চিঠিখানা হাত বাড়িয়ে দিলেন। মাকে নেলী খালা লিখেছেন

ভেবেছিলাম কথাগুলো তোমাকে বলবো না। কিন্তু জাহেদ বললো, বিষয়টা তোমাদের জানানো দরকার। লিখতে গিয়েও ভেবে পাচ্ছি না কিভাবে লিখবো। আসলে গণ্ডগোলটা শুরু হয়েছে সেই স্মাগলারটাকে ধরার পর থেকে। বদমাশ পাকড়াশী যে মন্ত্রীর পেয়ারের লোক তখন কি ছাই জানতাম! জামিনে ছাড়া পেয়ে সে আমাকে তুর্কি নাচন নাচাচ্ছে। ভেবেছিলাম বাড়িতে কিছু পেইং গেস্ট রেখে কেনার খরচ কিছুটা তুলবো। তুমি তো জানো আলুর পেনশনের টাকায় আমি হাত দিতে চাই না। আবিররা দেখে গেছে গেস্ট একজন দুজন করে আসা শুরুও করছিলো। অথচ গত চার মাস ধরে বাড়িতে কোনো গেস্ট আসছে না। শয়তান পাকড়াশী আবোল-তাবোল কথা বলে গোয়ালা, ধোপা, পিয়নদের আসা পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছে। সেদিন তোমার চিঠি দিতে এসে হরলাল পিয়নের সে কি কান্না! বলে, দিদিমণি, বউ ছেলেপুলে নিয়ে সংসার করি। পাকড়াশী মশাই বলেছেন, আপনার বাড়ির তল্লাটে দেখলে নির্বংশ করবে। আমায় মাফ করে দেবেন দিদিমণি। মাস্টার সাহেবকে বলেছি, চিঠি এলে তুলে রাখতে। আপনি বডিবিকে পাঠিয়ে এনে নেবেন। হরলালের কি দোষ বলো! ভাগ্যিস পোস্ট মাস্টার ভালো মানুষ। নইলে পৃথিবীর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ থাকতো না। শুধু হরলাল আর গোবিন্দ গোয়ালা নয়, ভয় দেখিয়ে আমাদের বুড়ো মালিটাকেও তাড়িয়েছে। আলু, আমি আর বড়িবি ছাড়া বাড়িতে এখন আর কেউ নেই। এতো বড়ো বাড়িটা সারাদিন খা খা করে। পাকড়াশী শেষ পর্যন্ত জাহেদকেও বদলি করে ছেড়েছে। সিলেটের কোনো জঙ্গলে না পাহাড়ে নাকি ওর পোস্টিং হয়েছে। পাকড়াশীর হাতে এভাবে অপদস্থ হয়ে আমার মনের অবস্থা যে কি দাঁড়িয়েছে বলে বোঝাতে পারবো না। জাহেদ চলে গেলে এ বাড়িতে থাকা একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়বে। আলু বলেছেন, বিক্রি করে দিতে। পাকড়াশী বদমাশটা তাও করতে দেবে না। শয়তানি করে লোক পাঠিয়ে বলেছে, শখানেক টাকায় যদি বেচি তাহলেও কিনবে। কতো বড়ো ধড়িবাজ একবার ভেবে দেখ!

জাহেদ বলছে ওর সঙ্গে যেতে। আবুও রাজি হয়েছেন। জাহেদ চায় যাওয়ার আগে বিয়েটা সেরে ফেলতে। এই দুঃসময়ে কোনো অনুষ্ঠানের আমি মোটেই পক্ষপাতি নই। তোমাদের শুভেচ্ছা পাবো এ বিশ্বাস আমার আছে। বিয়েতে নেমন্তন্ন করছি না বলে আবির যেন রাগ না করে। ওর বন্ধু ললি টুনির মা মীরাবুকেও আমি চিঠি দিয়েছি। বলেছি সিলেটে গিয়ে একটু গুছিয়ে বসে সবাইকে। নেমন্তন্ন করবো।

যাই বলো শানুপা, এতো সুন্দর করে সব কিছু গুছিয়েছি ছেড়ে যেতে একটুও মন চাইছে না। আরো একটা কারণে আমি এ বাড়ি ছেড়ে যেতে চাই না, যা তোমাকেও বলতে পারবো না। আজ এখানেই শেষ করছি। ইতি–তোমাদের নেলী।

বার দুয়েক পড়ে নেলী খালার চিঠিটা বাবাকে ফেরত দিলাম। বললাম, নেলী খালাকে আমাদের এখানে আসতে লিখে দাও না বাবা।

বাবা মৃদু হেসে বললেন, আমিও তাই ভাবছিলাম। দেখি তোমার মা কী বলেন! তোমার মাকে–।

বাবার কথা শেষ না হতেই মা নিচের তলার রান্নাঘর থেকে আমাদের জন্য চা আর নারকেল কোরার সঙ্গে চিনি দিয়ে চিড়েভাজা মাখিয়ে আনলেন। বাবা বললেন, তুমি আবার কষ্ট করে ওপরে আসতে গেলে কেন? আমরাই তো নিচে যেতে পারতাম।

বাবার কথায় কান না দিয়ে মা বললেন, নেলীকে বরং এখানে আসতে বলি। ও ছেলেমানুষ, বাড়ি বিক্রি করা কি চাট্টিখানি কথা!

বাবা চিড়েভাজা চিবুতে চিবুতে বললেন, বিক্রির চেয়ে কেনা আরো বেশি ঝামেলার। নেলী একাই তো বাড়ি কিনেছে।

বাবার কথা শুনে মা বিরক্ত হলেন–তার মানে নেলীকে তুমি তোমার বাড়িতে আসতে বলবে না, এইতো? তাহলে আমাকেই নেলীর কাছে যেতে হবে। ওর এই বিপদে আমি–এই বলে মা চোখে আঁচল চাপা দিলেন।

বাবা ব্যস্ত হয়ে বললেন, সে কি! ওকে আমি আসতে বলবো না কেন? তোমার ছেলেকে জিজ্ঞেস করো। একটু আগে বরং আমিই বলছিলাম, তোমার সঙ্গে পরামর্শ করে নেলীকে আসতে বলবো।

মা এক গাল হেসে বললেন, পরামর্শের আর কি আছে! আসতে লিখে দিলেই তো হয়। ও এলে বরং পরামর্শ করা যাবে।

মার মুখে হাসি দেখে বাবার মুখেও হাসি ফুটলো–ও মানে ও তো আর একা নয়। মামাও নিশ্চয়ই সঙ্গে আসবেন।

শুধু মামা কেন! মা বললেন, বড়িবিও আসবে। একা ওই ভূতুড়ে বাড়িতে থাকলে বুড়ি একদিনেই পটল তুলবে।

আমি বললাম, স্ক্যাটরাকে তোমরা বাদ দিচ্ছো কেন?

স্ক্যাটরা হলো নেলী খালার আদরের কুকুর। ওর বাবা ছিলো গ্রে হাউণ্ড, মা স্প্যানিয়েল। এতো বড়ো কুকুর, অথচ দেখলে মনে হবে সারাক্ষণ যেন হাসছে। স্ট্যাটরার কথা শুনে বাবা-মা দু জনেই হেসে ফেললেন। মা বললেন, তুই কি ভেবেছিস নেলী ওটাকে ফেলে আমার এখানে আসবে?

বাবা-মার মন ভালো দেখে আমি বাবুর চিঠির কথা বললাম। বাবা বললেন, জামি আমাকে কদিন আগে জানিয়েছিলো ওকে জাপান বদলি করা হতে পারে। কবে দেশে আসবে সে সব কথা লেখে নি।

মা বললেন, তোমার ভাইয়ের তো আবার সায়েবি স্বভাব। সেবার এসে উঠলেন হোটেলে। এবার আমাদের এখানে উঠতে হবে, বলে দিও।

বাবা মৃদু হেসে বললেন, তুমি বরং জামিকে আজই একটা চিঠি দাও।

আমি বললাম, বাবু লিখেছে, চিঠি লিখলে পাবে না। ওরা অল্প কয়েক দিনের ভেতর এসে পড়বে।

মা বাবাকে বললেন, রাতে ট্রাংকলে কথা বলল না। কোন ফ্লাইটে আসছে জানলে আমরা এয়ারপোর্ট থেকে ওদের এখানে নিয়ে আসতাম।

আমি মার দিকে তাকালাম। মাকে দুহাতে জড়িয়ে আদর করতে ইচ্ছে হলো। মা আমার দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসলেন। বললেন, বড়দিনের ছুটিটা মনে হচ্ছে আবিরের ভালোই কাটবে।

.

০২. বাবুর সঙ্গে অনেক কথা

মার সঙ্গে টেলিফোনে মেজো কাকার কথা হয়েছে তিন দিন আগে। তারপরই শুরু হলো বাড়িতে চুনকাম আর রঙের ধুন্ধুমার কাণ্ড। কাল মেজো কাকাদের আসবার কথা। কদিন ধরে বাড়িতে কাজের অন্ত নেই। রোজকার মতো কাজশেষে মা রঙ মিস্ত্রিদের কাজের হিসেব নিয়ে বসেছেন। কারা ভালো কাজ করেছে, কারা ফাঁকি দিয়েছে, মিস্ত্রিদের এসব বোঝাচ্ছেন। আমি ক্ষেন্তির মাকে নিয়ে ড্রইং রুম গোছাচ্ছি। এমন সময় দরজায় কলিং বেলের শব্দ।

মা বললেন, অসময়ে কে এলো দেখো তো।

ক্ষেন্তির মা ঘর মুছতে মুছতে বিরক্ত হয়ে বললো, কেউ না মা, আজকাল ফকিরগুলোন পর্যন্ত বেলের বোতাম ধরে টেপে।

আমি উঠে গিয়ে দরজা খুলোম। তাকিয়ে দেখি, মেজো কাকা আর বাবু সামনে দাঁড়িয়ে। অবাক হয়ে বললাম, এ কি, তোমরা!

নেলী খালার ভাষায় ক্ষুদে ওমর শরীফের মতো দেখতে বাবুর মুখে ওর সেই বিশ্বজয়ী হাসি। মেজো কাকাও মৃদু হাসছিলেন।

কার সঙ্গে কথা বলছিস? বলতে বলতে মা এসে আরো অবাক হলেন–তোমাদের না কাল আসার কথা। আমরা সবাই এয়ারপোর্ট যাবো, গাড়ি ঠিক করেছি–

মেজো কাকা বিব্রত হেসে বললেন, ফ্লাইটের একটা বিশেষ সুবিধে পেয়ে গেলাম–আজ এসে তোমাদের অসুবিধেয় ফেলি নি তো!

মা রাগ দেখিয়ে বললেন, ও কি কথা জামি! এ বাড়িতে বাপু তোমার বিলেতি দ্রতা চলবে না। এসব আদিখ্যেতার ভূত আমি নেলীর ঘাড় থেকে নামিয়ে দিয়েছি।

মেজো কাকা শব্দ করে হাসলেন–তুমি সবই পারো শানু ভাবী। এই বলে তিনি আমার দিকে তাকালেন। বললেন, বাহ্ আবির দেখছি বাবুর চেয়েও লম্বা হয়ে গেছে! বাবুর কাছে শুনলাম ক্লাসের ফার্স্ট প্লেসের দখলিস্বত্বটা তুমি এখনো ছাড়ো নি!

তোমরা এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলবে নাকি?

মার তাড়া খেয়ে সবাই মিলে মেজো কাকাদের বাক্সপত্র সব ঘরে আনলাম। মেজো কাকা ড্রইং রুমে বসে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেললেন–আহ্, কতদিন পর দেশে ফিরলাম বলো তো শানু ভাবী!

বাবু আমাকে বললো, ওপরে চলো আবির, তোমার জন্য কী এনেছি দেখবে। জেঠিমা, আমি আবিরের ঘরে থাকছি তো?

মা হেসে বাবুর চিবুক নেড়ে আদর করে বললেন, তোমার যেখানে ভালো লাগে সেখানেই থাকবে।

আমরা দুজন দুদ্দাড় করে সিঁড়ি ভেঙে চিলেকোঠার ঘরে এলাম। দোতালায় চারটা ঘর খালি পড়ে থাকলেও আমার ভালো লাগে চিলেকোঠার ঘরে থাকতে। চারপাশের বাড়িগুলো নিচু হওয়াতে ও ঘরটাকে মনে হয় জাহাজের কেবিনের মতো। জাহাজের এই কেবিনে বসে আমি সারা বছর ঘুরে বেড়াই সাগর থেকে মহাসাগরে, অজানা অচেনা সব দ্বীপ আর বন্দরে। ভাইয়া বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর বাড়িতে আমি আরো একা হয়ে গেছি। স্কুলেও কোনো বন্ধু নেই। বাবু ছাড়া আমার নতুন বন্ধু ললি, টুনি থাকে চট্টগ্রামে। জাহাজে আমার উদগ্রীব সময় কাটে ওদের চিঠির অপেক্ষায়।

বাবু ঘরে ঢুকে চারপাশে তাকিয়ে বললো, ঘরটা চমৎকার সাজিয়েছে তো! চে-র পোস্টারটা সুন্দর মানিয়েছে।

বাবুর সঙ্গে গতবার ভাইয়াদের গোপন দলের কথা আলোচনা করতে গিয়ে ও চে গুয়েভারার কথা বলেছিলো। তারপর আমেরিকায় ফিরে গিয়ে চে-র মস্তো বড়ো একটা পোস্টার পাঠিয়েছে। ওকে আমি লিখেছিলাম চে-র পোস্টারটা আমার ঘরের চেহারা পাল্টে ফেলেছে।

বাবু বললো, এবার তোমার জন্য আমি এনেছি মাও সেতুঙের ছবি খোদাই করা কোটপিন, ল্যাটিন আমেরিকার বিপ্লবীদের ওপর লেখা কয়েকটা বই আর বাবা এনেছেন জামাকাপড়।

আমি হেসে বললাম, তুমি দেখছি আমাকে বিপ্লবী বানিয়ে ছাড়বে!

চে-র ছবি দেয়ালে ঝোলালেই বিপ্লবী হওয়া যায়, এ কথা তোমাকে কখন বললাম! গতবার তুমি জানতে চেয়েছিলে, তাই আনলাম!

ললি, টুনির জন্য কিছু আনো নি?

গতবার গরমের ছুটিতে নুলিয়াছড়ি বেড়াতে গিয়ে আমাদের দুজনের সঙ্গে নেলী খালার বান্ধবীর দুই মেয়ে ললি টুনির সঙ্গে চমৎকার বন্ধুত্ব হয়েছিলো। বাবুর সঙ্গে খাতির বেশি ছিলো টুনির, যদিও দুজন সারাক্ষণ একে অপরের পেছনে লেগে থাকতো। ওদের দুজনের স্বভাবই অমন। আমার কথা শুনে বাবু একটু লাল হয়ে বললো, টুনিকে আমি লিখেছিলাম কী আনতে হবে। ও লিখেছে কিছুই লাগবে না, শুধু পিঠের চামড়াটা একটু পুরু করে আনতে হবে, যাতে ওরা দুই বোন মনের সুখে চিমটি কাটতে পারে।

আমি হেসে ফেললাম–টুনি ওভাবেই চিঠি লেখে। জানো না তো, আমাকে গত চিঠিতে লিখেছে–ললিপা বলে আপনি নাকি নিজেকে ভীষণ একা ভাবেন, মনে ভারি দুঃখ। আপনার দুঃখে দুঃখিত হয়ে একটা ছবি পাঠালাম। পড়ার টেবিলে গ্লাসের নিচে রেখে দেবেন আর ভাববেন এরা আমার বন্ধু। তাহলে সব দুঃখ-টুঃখ চলে যাবে। চিঠি পড়ে কাগজে মোড়ানো ছবিটা দেখে ভাবলাম ওদের দুজনের ছবি বুঝি। খুলে দেখি কী কাণ্ড, মুখ কালো দুটো হনুমানের ছবি, মুখোমুখি বসে আছে গালে হাত দিয়ে।

বাবু হেসে বিছানায় গড়িয়ে পড়লো, তাহলে দেখছি, তোমাকেও জব্দ করতে পেরেছে! চিঠির জবাব দাও নি?

দিয়েছি। আমি লিখেছি–টুনি, তোমাদের দুই বোনের ছবি দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেছে। আমার যতদূর মনে আছে তোমাদের চেহারা এরকম বাদুরে আর কুচকুচে কালো ছিলো না। এতো বড়ো লেজটা কিভাবে প্যান্টের ভেতর লুকিয়ে রাখতে ভেবে কোনো কুলকিনারা পেলাম না। নাকি তখন ওটা এতো বড়ো ছিলো না? আশা করি পরের চিঠিতে জানাবে। তোমার কথা মতো ওটা গ্লাসের নিচে রেখেছি, বন্ধুও ভাবছি, তবু মনটা খারাপ হয়ে আছে। দুঃখ আরো বেড়েছে তোমাদের অবস্থা দেখে। এ ব্যাপারে আমার কিছু করার থাকলে জানাবে। হাসতে হাসতে আমি বললাম, জবাব পছন্দ হয়েছে?

বাবু চোখ বড়ো করে বললো, তুমি দেখছি ওর চেয়ে কম নও! তারপর একটু ভেবে আবার বললো, আসলে আমি তোমার মতো লিখতে পারি না। তাই আমাকে প্রত্যেক চিঠিতে জব্দ করে।

তাই বলে ওদের জন্যে কিছু আনো নি বুঝি!

ব্যস্ত হচ্ছো কেন। বাবুর মুখে আবার হাসি ফুটলোওদের জন্য দুটো পুতুল এনেছি। একটা চাইনীজ আরেকটা জাপানী। তুমি তো জানো, পুতুল পেলে ওরা আর কিছু চায় না। মজার চকলেটও এনেছি দুবাক্স।

ছেলেমানুষ। হাসতে হাসতে আমি বললাম, আজকাল তুমিও ছেলেমানুষ হয়ে যাচ্ছো। বাবু। টুনিকে তুমি চিঠিতে কী কী লিখেছো সব ললি আমাকে লিখেছে।

বাবু আমার পিঠ চাপড়ে বললো, তুমি হলে মস্তো এক গুরুমশাই। ললিকে তুমি চিঠিতে কী লেখো টুনি বুঝি আমাকে জানায় নি ভেবেছো?

গম্ভীর হতে গিয়ে আমি হেসে ফেললাম–কী পাজি মেয়েরে বাবা! এবার থেকে দেখছি সাবধানে লিখতে হবে।

বাবু হাসতে হাসতে বললো, আমাকেও তাহলে সাবধান হতে হয়!

আমরা দুজন চিলেকোঠার ঘরে সারা দুপুর, সারা বিকেল, সারা সন্ধ্যা, এমনকি প্রায় সারা রাত গল্প করলাম।

রাতে খাবার টেবিলে মেজো কাকা বললেন, তোমাদের কথার থলে কি কখনো খালি হবে না?

মা হেসে বললেন, ওরা এমনই। কত রাজ্যির কথা যে ওদের জমে থাকে, আল্লাই জানেন!

বাবু প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্য বললো, মুড়িঘন্টটা চমৎকার হয়েছে।

মা তক্ষুণি বড়ো এক চামচ মুড়িঘন্ট বাবুর পাতে তুলে দিলেন। আমি শব্দ করে হেসে উঠতে গিয়ে বাবুর চোখ পাকানো আর মার ভুরু কোঁচকানো দেখে হাসি চাপলাম।

রাতে বিছানায় শুয়ে বাবুকে নেলী খালার বিপদের কথা জানালাম। চিঠিতে কী লিখেছেন সবই বললাম। সবশেষে বললাম, দু-এক দিনের মধ্যেই নেলী খালা এসে যাবেন।

নেলী খালার বিপদের কথা শুনে বাবু চিন্তিত হলো। আসবেন শুনে খুশিও হলো। বললো, কিস্যু ভেবো না আবির। আমরা ঠিকই পাজি পাকড়াশীটাকে জব্দ করবো। মনে হচ্ছে শয়তানটার যথেষ্ট শিক্ষা হয় নি।

বাবুর উৎসাহ আর মনের জোর আমার ভালো লাগলো। তবে ব্যাপারটা ও যতোটা সহজ ভেবেছে ততোটা সহজ নয়। বললাম, বাবাকে আমি এ রকম কথাই বলেছিলাম। বাবা শুনে গম্ভীর হয়ে বলেছেন, এটা তোমাদের নুলিয়াছড়ির এ্যাডভেঞ্চারের মতো মজার কোনো ব্যাপার নয়। অনেক জাঁদরেল লোকজন এর সঙ্গে জড়িত।

আমার কথা শুনে বাবু কিছুক্ষণ কোনো কথা বললো না। মনে হলো নেলী খালা কতখানি বিপদে পড়েছেন বোঝার চেষ্টা করছে। বিছানা থেকে উঠে ও টেবিলে রাখা বোতল থেকে পানি খেলো। তারপর আমার পাশে বসে বললো, তুমি যে সেবার অপু ভাইর কথা বলেছিলে তাঁর সঙ্গে কি নেলী খালার যোগাযোগ আছে?

ভাইয়ার সঙ্গে নেলী খালার যোগাযোগ আছে একথা আমি ছাড়া আর কেউ জানে । তিন বছর আগে ভাইয়া বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়ে বিপ্লবীদের গোপন দলে যোগ দিয়েছে। নেলী খালা বারবার বারণ করে দিয়েছেন ভাইয়ার কথা যেন কাউকে না বলি। বাবুর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলাম, একথা কেন জিজ্ঞেস করছো?

বাবু গম্ভীর হয়ে বললো, আমি ল্যাটিন আমেরিকার বিপ্লবীদের ওপর কিছু ছবি দেখেছি। ওখানকার অনেক দেশের অবস্থা আমাদের মতো। পুলিশরা কোনো কাজ করে না। ভালো লোকদের দুর্ভোগের শেষ নেই। খারাপ লোকদের অত্যাচারে সবাই অতিষ্ঠ হয়ে থাকে। সেখানে বিপ্লবীরা খারাপ লোকদের বিচার নিজেরা করে, সাজাও দেয় নিজেরাই। যে জন্যে গ্রামের সাধারণ মানুষ বিপ্লবীদের ভালোবাসে, পুলিশের হামলা থেকে ওদের বাঁচায়।

তুমি বলতে চাইছে নেলী খালাকে ভাইয়াদের দল সাহায্য করতে পারে?

যদি সত্যিকারের বিপ্লবীদের দল হয়, তাহলে নিশ্চয়ই এ ধরনের বিপদের সময়ে তাদের এগিয়ে আসা উচিত।

বাবুর কথা শুনে অনেকখানি ভরসা পেলাম। নেলী খালা ভাইয়াদের দলকে নানাভাবে সাহায্য করেন, এটা গতবার নুলিয়াছড়ি গিয়ে বুঝতে পেরেছিলাম। তবে নেলী খালা চিঠিতে যেভাবে লিখেছেন, মনে হয় ভাইয়াদের তিনি কিছু জানান নি। হয়তো এসব ব্যাপারে ওদের তিনি জড়াতে চান না। নেলী খালার সঙ্গে দেখা হলেই সব জানা যাবে। বাবুকে মিথ্যে কথা বলতে খারাপ লাগলো। তবু বললাম, অনেকদিন ভাইয়ার কোনো চিঠিপত্র পাচ্ছি না। কোথায় আছেন তাও জানি না।

চিটাগাঙেই তো আছেন? জেরা করলো বাবু।

বোধ হয়। শেষ চিঠি ওখান থেকেই পেয়েছিলাম।

গোপন পার্টির কাজের জন্য জায়গাটা খুবই ভালো।

আমি চুপ করে রইলাম। বাবু অত্যন্ত বুদ্ধিমান ছেলে। কোন কথা থেকে কী বুঝে ফেলবে, এ নিয়ে বেশি না বলাই ভালো। কিছুক্ষণ পর বাবু বললো, তোমার কি কখনো ইচ্ছে করে না বিপ্লবীদের গোপন দলে যোগ দিতে?

বাবুর এ কথার যে জবাব আমি জানি, সেটা ওকে বলা উচিত হবে কিনা এ নিয়ে একটু ভাবলাম। ও চায় আমি হা বলি। তারপর ও বলবে, চলো অপু ভাইদের খুঁজে বের করি। প্রসঙ্গটা চাপা দেয়ার জন্য বললাম, এ নিয়ে আমি কিছু ভাবি নি। একটু থেমে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, টুনি তোমাকে ললির কথা কী লিখেছে বাবু?

বাবু মুখ টিপে হাসলোতোমার চিঠি কম করে হলেও ললি দশবার পড়ে।

আর?

টুনি ওকে সব সময় তোমার কথা বলে খেপায়।

আর?

ললি আমাকে বলে ছেলেমানুষ।

আর?

তুমি ওর সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। ব্যস, আর কিছু নেই।

আমি ললির কথা ভাবলাম। আমার এক ক্লাস নিচে পড়ে অথচ মাঝে মাঝে মনে হয় ও আমার চেয়ে বেশি ভাবে। ওর হার্টে কী একটা শক্ত অসুখ আছে, আমাকে এখনো খুলে বলে নি। ডাক্তার ওকে খুব সাবধানে চলাফেরা করতে বলেছে। রাশান পুতুলের মতো ফর্সা মিষ্টি চেহারা চশমা পরা বিষণ্ণ চোখের মেয়েটাকে দেখলেই মনে হয় অনেক দুঃখ ওর।

বাবু কিছুক্ষণ পর বললো, আবির কি ঘুমিয়ে পড়েছো?

না, কেন? তোমার কি ঘুম পাচ্ছে?

তো! চুপচাপ কি ভাবছো?

তুমি যা ভাবছো আমিও তাই ভাবছি।

আমি কী ভাবছি জানলে কিভাবে?

না জানলে বন্ধু কেন?

এখন তো ললিও তোমার বন্ধু।

ললি কি তোমার মতো?

বাবু একটু চুপ করে কী যেন ভাবলো। তারপর বললো, এই চার মাসের মধ্যে আমাদের দুজনের মাঝখানে দুটো মেয়ে বন্ধু এসে গেছে। কী অদ্ভুত, তাই না?

অদ্ভুত কেন?

নুলিয়াছড়ি যাওয়ার আগে কখনো ভাবতে পেরেছিলে?

নুলিয়াছড়িতে বন্ধু পেয়ে যাবো ভাবি নি। তবে তুমিই তো বলতে আমাদের দুজন মেয়ে বন্ধু থাকলে বেশ হয়।

ওখানে আমার সঙ্গে যারা পড়ে তাদের সবারই মেয়ে বন্ধু আছে। ওরা জানতে চাইতো আমার নেই কেন।

ওখানে কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব করলেই তো পারতে।

তোমাকে তো আগেও বলেছি আবির, ওখানকার মেয়েদের আমার ভালো লাগে না।

টুনিকে ভালো লাগে?

লাগে, তবে ও খুবই ছেলেমানুষ। একটু চুপ থেকে বাবু আবার বললো, জানো, একদিন চিঠিতে লিখেছে ওর নাকি ভারি ইচ্ছে আমার মাথাটা ন্যাড়া করলে কেমন লাগে তাই দেখবে। চার্লি ব্রাউনের একটা ছবি পাঠিয়েছে। নিচে লিখেছে আমার নাম।

আমি হাসলাম–টুনি আসলেই খুব ছেলেমানুষ।

বাবু আস্তে আস্তে বললো, ওর এই ইনোসেন্ট ছেলেমানুষি স্বভাবটাই আমার ভালো লাগে।

হঠাৎ কেমন যেন ঈর্ষামতে হলো টুনির ওপর। বললাম, আমার কী ভালো লাগে তোমার?

বাবু একটু গম্ভীর হয়ে বললো, তোমার ম্যাচিউরিটি আমার ভালো লাগে। তুমি খুব সেনসিটিভ। এটাও আমার ভালো লাগে।

আমি একটু পরে ওর কাছে আবার জানতে চাইলাম, ললির কোন দিকটা ভালো লাগে?

ললিও তোমার মতো সেনসিটিভ। বয়সের তুলনায় অনেক বেশি বোঝে। তোমার খুব ভালো বন্ধু হবে ও।

আমি মৃদু হেসে বললাম, ললির জন্য হিংসা হয় না?

হিংসা কেন হবে? বাবু একটু অবাক হলো।

তোমার বন্ধুত্বে ভাগ বসাচ্ছে বলে?

বাবু মৃদু হাসলো–আমার বন্ধুত্বে কেউ ভাগ বসাতে পারবে না। ললি থাকবে ললির জায়গায়, আমি থাকবো আমার জায়গায়, যেখানে এতোদিন ধরে আছি।

বাবুর কথাগুলো আমার খুব ভালো লাগলো। বললাম, তুমি এতো সুন্দর বলতে পারো বাবু!

তোমার মতো সু লিখতে যদি পারতাম!

ললিও আমার লেখার খুব প্রশংসা করে। ওর ধারণা বড়ো হলে আমি নাকি নামকরা লেখক হবো। এদিকে বাবা ঠিক করে রেখেছেন আমাকে ইঞ্জিনিয়ার বানাবেন। যদিও ইলেকটিভ ম্যাথ আমার দুচোখের বিষ, ফার্স্ট ডিভিশন নম্বর তুলতে ঘাম ছুটে যায়। তবু কিছুই করার উপায় নেই। বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও ভাইয়া চলে যাওয়াতে বাবা ভেতরে ভেতরে অনেক ভেঙে পড়েছেন। ভাইয়া যখন মুক্তিযুদ্ধে গেলেন তখন বাবা রীতিমতো গর্বিত ছিলেন। অথচ এখন ভাইয়ার কথা উঠলে ভীষণ গম্ভীর হয়ে যান। যে জন্য বাবা কষ্ট পাবেন বলে ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও আমি সায়েন্স পড়ছি। ক্লাসে ফার্স্ট হওয়াটাকে আমি মোটেই বাহাদুরির কাজ মনে করি না। অন্য ছেলেরা ফার্স্ট হতে না চাইলে আমি কী করবো!

বাবু অবশ্য পড়াশোনায় অনেক শার্প। ওখানকার স্ট্যাণ্ডার্ডই আলাদা। ওর কাছে আমাদের ফিজিক্স কেমিস্ট্রি আর ম্যাথ পানির মতো সোজা। ভাগ্যিস বাবু আমার সঙ্গে পড়ে না। তাহলে ক্লাসে আমার জারিজুরি সব ফাঁস হয়ে যেতো। শুধু বাংলা দিয়ে ওকে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হতো না।

বাবু আবার জিজ্ঞেস করলো, কী ভাবছো আবির?

আমি কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকলেই বাবু এটা জানতে চাইবে। বললাম, তুমি যদি আমাদের ক্লাসে পড়তে, ফার্স্ট হওয়া আমার কপালে জুটতো না।

এক সাবজেক্ট ফেল করলে কি তোমাদের এখানে প্লেস দেয়?

কেন, ফেল করবে কেন?

বাংলায় আমি কোনোকালেই পাশ করতাম না।

বললেই হলো!

তুমি নিশ্চিন্ত থাকো আবির। আমি তোমার সঙ্গে এক ক্লাসে পড়লেও ফার্স্ট প্লেস তোমার থাকতো।

পড়াশোনায় তুমি যে আমার চেয়ে অনেক শার্প, এটা অস্বীকার করছো কেন?

বাবু হেসে বললো, তোমার সঙ্গে আমি কম্পিটিশনে যাবো এটা তুমি ভাবতে পারলে কী করে আবির?

বাবুর কথার ধরনে আমিও হেসে ফেললাম–তোমার সঙ্গে কথায় আমি পারবো না।

আমাকে নকল করে বাবু বললো, তোমার সঙ্গে লেখায় আমি পারবো না।

দূরে দমকল অফিসের পেটাঘড়িতে রাত বারোটার ঘন্টা বাজলো। আমি বললাম, বাবু, এবার ঘুমোনোর চেষ্টা করা দরকার। অনেক লম্বা জার্নি করেছে। এখন না ঘুমোলে শরীর খারাপ করবে।

ঘুম আসছে না, বললেও বাবু কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লো। আমি ঘুমোবার আগে পেটাঘড়িতে রাত সাড়ে চারটার ঘন্টা শুনেছিলাম।