১১-১৫. সেপ্টেম্বর মাসের সাতাশ

আজ সেপ্টেম্বর মাসের সাতাশ তারিখ। চার অক্টোবরের আর কত দিন বাকি? দিনগুলো অসম্ভব রকম মন্থর এবং ভারি। কিছুতেই পার হতে চায় না। আমার প্রতীক্ষার যন্ত্রণা তীব্র থেকে তীব্র হয়ে উঠছে। কন্যা শামারোখ অক্টোবরের চার তারিখে আসবে বলেছে। কিন্তু ঐ তারিখটাই তাকে আঁকড়ে থাকতে হবে এমন কোনো কারণ আছে? চলে আসুক না যে কোনোদিন এবং সুন্দর একটা কৈফিয়ৎ হাজির করুক। বলুক না কেন আমার দিন-তারিখের ভীষণ গোলমাল হয়ে যায়। দেখতেই পাচ্ছেন কি রকম একটা খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছি। যেসব মানুষের সঙ্গে আমার কোনোদিন চাক্ষুষ পরিচয় পর্যন্ত ঘটে নি, তারা একজোট হয়ে আমার শত্রুতা করছে। আমি বেচারি দিন-তারিখ কেমন করে মনে রাখি? আমি আসলে ভেবেছিলাম, সাতাশ তারিখেই আসব। ভুল করে অক্টোবরের চার তারিখ লেখা হয়ে গেছে। সেপ্টেম্বরের সাতাশ তারিখে চলে এসেছি বলে আমি কি আপনাকে অসুবিধায় ফেলে দিলাম? দয়া করে মাফ করে দেবেন, আমি কি করতে গিয়ে কি করে বসি নিজেও বলতে পারিনে। ভীষণ ভুলো মনের মহিলা আমি।

শিশুর মতো নিজেকেই প্রশ্ন করি । জগতে তো এখনো অনেক আশ্চর্য কাণ্ড ঘটে থাকে। আশ্চর্য কাণ্ড ঘটানোর দেবতা অন্তত আরেকটিবার প্রমাণ করুন এখনো তিনি এমন কাণ্ড ঘটিয়ে তুলতে পারেন, মানুষের বুদ্ধি-বিবেচনা যার কোনো তল পায় না। তিনি তার অঘটনঘটনপটীয়সী ক্ষমতা বলে পঞ্জিকার সেপ্টেম্বর মাসের সাতাশ তারিখকে অক্টোবরের চার তারিখে রূপান্তরিত করুন। উৎকণ্ঠাটা বেশি হলো, তার একটা কারণ আছে। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কারো জানতে বাকি নেই কন্যা শামায়োখের চাকরির বিষয় নিয়ে ঝুনো সব শিক্ষককে আমি ক্ষেপিয়ে তুলেছি। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলে দিচ্ছিল, কন্যা শামায়োখ আমার কাছে আসছে, এই সংবাদটা অন্য কাউকে জানালে ফল ভাল হবে না। তাই তার আগমন-সংবাদ আমি কাক-পক্ষিকেও জানাইনি। কাউকে জানাইনি সেটা যেমন আমার গহন আনন্দের ব্যাপার, তেমনি তার বেদনাও অপরিসীম।

অক্টোবর মাসের চার তারিখে আমার কাছে কন্যা শামারোখ আসছে। এই সম্ভাব্য ঘটনা আমার মনে একটা তোলপাড় লাগিয়ে দিয়েছিল। আমি যখন একা একা রাস্তায় চলাফেরা করি, আমার হৃৎস্পন্দনের মধ্যে তার নামটি বেজে উঠতে থাকে। নিজের ভেতরে এতটা ডুবে থাকি যে, কেউ কিছু জানতে চাইলে, হঠাৎ করে জবাব দিতে পারিনে। আমি প্রশ্নকর্তার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকি। বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরির তিনতলায় আমার একটা রুম আছে। একেবারেই নির্জন। মাঝে-মধ্যে কার্নিশে দুটো চড়াই এবং কয়েকটা শালিক উড়ে এসে নিজেদের মধ্যে আলাপ সালাপ করে। আমি সারাদিন সেই নির্জন রুমেই কাটাই। শুধু দুপুরের খাবার সময় একবার হোস্টেলে আসি। রাত নটায় লাইব্রেরী বন্ধ হলে ঘরে এসে খেয়ে একেবারে সরাসরি বিছানায় গা এলিয়ে দিই। কিছুতেই ঘুম আসতে চায় না। শান্ত সরোবরে ফুটে থাকা নিটোল পদ্মের মতো কন্যা শামারোখের সুন্দর আনন আমার মানসদৃষ্টির সামনে ফুটে থাকে। ভাল ঘুম হয় না। আধো ঘুম, আধো জাগরণের মধ্যে সারারাত কাটাতে হয়। সকালবেলা অসম্ভব ক্লান্তি নিয়ে জেগে উঠি। কিছুই ভাল লাগে না। আকুল চোখে ক্যালেন্ডারের দিকে তাকাই। এখনো দুদিন বাকি। আজ দুতারিখ। মাত্র দুদিন পর কন্যা শামারোখ এই ঘরে আসছে।

ঘরের যা চেহারা হয়েছে দেখে আমি আঁতকে উঠলাম। আমার একটি মাত্র চেয়ার। সেটারও একটা পায়া বুড়ো মানুষের দাঁতের মতো অবিরাম নড়বড় করছে। সাবধানে না বসলে উপবিষ্ট ব্যক্তিকে প্রপাত ধরণীতল হতে হয়। দেয়ালগুলোতে অসংখ্য গর্ত। প্রত্যেক গর্তে টিকটিকি বাহাদুরেরা স্থায়ী নিবাস রচনা করেছে। সপরিবারে। মশারির রঙ উঠে গেছে এবং জায়গায় জায়গায় ছিঁড়ে গেছে। গিঁট দিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। বালিশ দুটো মোটামুটি মন্দ নয়। বিছানার ওটা নিয়ে আমি নিজে খানিকটে গর্ব করে থাকি। আমার এক বন্ধু সিঙ্গাপুর থেকে এই চাদরটা এনে দিয়েছিল। বহু ব্যবহারে রঙটা উঠে গেলেও চাঁদরের জমিনের ঠাস বুনুনি এখনো চোখে পড়ে। আমার ঘরের সবচাইতে দর্শনীয় জিনিস হলো একটা হিটার। প্রথম স্কলারশিপের টাকা উঠিয়ে নিউমার্কেটের দোকান থেকে ওটা কিনেছিলাম। অনেকদিনের ব্যবহারে টিনের শরীরটাতে মরচে ধরেছে। নাড়াচাড়া করলে হিটার সাহেবের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো ঝরে পড়তে থাকে। একদিন চা বানাতে গিয়ে প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খেলাম। আমি ছিটকে পড়ে গেলাম। স্পৃষ্ট হওয়া আঙুল দুটো ঢাকের কাঠির মতো নেচে নেচে উঠছিল। হিটার সাহেব ধাক্কা দিয়ে পেছনে ঠেলে দিয়েছিল। যদি সামনের দিকে টেনে নিয়ে যেত, তাহলে সেদিনটাই হতো আমার হোস্টেলবাসের অন্তিম দিন। বুঝলাম এই জিনিসটা দিয়ে আর চলবে না, একে বিদেয় করতে হবে। কিন্তু হিটার ছাড়া আমার চলবে কেমন করে! আমি যে পরিমাণ চা খাই, বাইরে থেকে কিনে খেতে হলে ভাত খাওয়া বন্ধ করতে হবে। মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। বাইরে একেবারে দেয়ালের গোড়ায় দেখি একটা ভাঙা টব পড়ে আছে। আমার কেমন কৌতূহল জন্মে গেল। সেটা নিয়ে এলাম এবং তার মধ্যে হিটারের প্লেটটা বসিয়ে দিলাম। তারপর একপাশের দেয়ালে একটা ফুটো করে হিটারের তারটা বাইরে নিয়ে এসে প্ল্যাকের সঙ্গে জুড়ে দিলাম। সুইচ অন করে দেখি বেশ কাজ করে। আমার মাথা থেকে একটা দুর্ভাবনা চলে গেল। শক লাগার কোনো সম্ভাবনা নেই। মাটি বিদ্যুৎ পরিবাহী নয়। একটা বিকল্প হিটার তৈরি করতে পেরে গর্বে আমার বুকটা ফুলে উঠল। বন্ধু-বান্ধব সবাইকে নিজের উদ্ভাবিত জিনিসটা দেখিয়ে ভীষণ আনন্দ পেয়েছি। ভাবখানা এমন, আমি নতুন একটা জিনিস বুদ্ধি খাঁটিয়ে আবিষ্কার করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে আমার ওই নতুন আবিষ্কার বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল। ভেবে দেখলাম, কন্যা শামারোখকে আমার এই অপূর্ব আবিষ্কারটা ছাড়া দেখাবার কিছু নেই। সে হয়তো আমার উদ্ভাবনী প্রতিভার তারিফ করবে। অবাক হওয়ার ভঙ্গি করে বলবে, ওমা তলে তলে আপনার এত বুদ্ধি! আপনাকে তো শুধু লেখক হিসেবেই জানতাম। এখন দেখতে পাচ্ছি, আপনি একজন পুরোদস্তুর বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ। কল্পনা করে সুখ। আমিও কল্পনা করলাম আমার অভাবনীয় কীর্তি দেখে তার সুন্দর দ্বিতীয়ার চাঁদের মতো ললাটে কুঞ্চিত রেখা জেগে উঠবে। মুখের ভাবে আসবে পরিবর্তন।

নিজের অবস্থার কথা যখন বিবেচনা করলাম, চারপাশ থেকে একটা শূন্যতা বোধ আমাকে আক্রমণ করে বসল। ওই অনিন্দ্য সুন্দরী যখন দেখবে আমি কত গরিব, তার মুখমণ্ডলে যে একটা তাচ্ছিল্যের ভাব জেগে উঠবে, সে কথা আগাম কল্পনা করে আমি শিউরে উঠলাম। কন্যা শামারোখ সারা ঘরে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে হয়তো ফেরত চলে যাবে এবং বলবে, না ভাই আমি ভুল করে ভুল ঠিকানায় চলে এসেছি। এখন চলোম, আমার কাজ আছে। আমার ভীষণ আফসোস হতে থাকল, তাকে চিঠি লিখে আসতে নিষেধ করি নি কেন? আমার মনে ভিন্নরকম একটা চিন্তা ঢেউ দিয়ে গেল। আমার বন্ধুর বোনের বাড়িতে গিয়ে যদি সুন্দর চাদর, বালিশ, মশারি একদিনের জন্য ধার করে নিয়ে আসি! আমার ভেতরে পরক্ষণেই একটা বিদ্রোহের ঢেউ খেলে গেল। আমি গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। আমার ঘরের অবস্থা যত করুণই হোক না কেন আমি ছদ্মবেশ ধারণ করতে পারব না। যা আমার নয়, আমার বলে প্রদর্শন করতে পারব না। কন্যা শামারোখ যদি ওয়াক থু বলে একদলা থুথু আমার মুখে ছুঁড়ে দিয়ে অনুতাপ করতে করতে চলে যায়, তাই সই। শামারোখ ঘরে বসুক অথবা চলে যাক, কিছু যায় আসে না, আমি আমিই।

অবশেষে আকাঙ্ক্ষিত অক্টোবরের চার তারিখটি এসে গেল। আমি সূর্য ওঠার অনেক আগে উঠে ঘরের মেঝেটা পরিষ্কার করলাম, দেয়াল এবং ছাদের স্কুল ঝাড়লাম। যতই ভদ্রস্থ করার চেষ্টা করিনে কেন বিশ্রী চেহারাটা আরো বেশি করে ধরা পড়ে। এক সময় গৃহ সংস্কার-কর্মে ক্ষান্তি দিয়ে বারান্দার রেলিংয়ের গোড়ায় এসে দাঁড়ালাম। আমার মনে হচ্ছিল আজ সকালে সূর্য নতুন কিরণধারা বিতরণ করছে। পাখি সম্পূর্ণ নতুন সুরে গাইছে। তরুলতার পত্রমর্মরে একটা অঞতরাগিণী বেজে যাচ্ছে। আমার মনের তারে তার সূক্ষ্ম সুর অনুভব করছি। আমার জীবনে এমন সকাল কোনোদিন আসেনি।

ক্যান্টিনে গিয়ে নাস্তা করে রেলিংয়ের গোড়ায় বসে রইলাম। প্রতিটি রিকশা, বেবিট্যাক্সি হোস্টেলের দিকে আসতে দেখলে আমি চমকে উঠতে থাকি। আমি বসে আছি। একে একে রিকশা-ট্যাক্সি চলে যাচ্ছে, কন্যা শামারোখের টিকিটিরও দেখা নেই। ঘন ঘন ঘড়ি দেখছি। দশটা বাজার মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি আছে। আমার ভেতর থেকে ফোঁস করে একটা দীর্ঘনিশ্বাস বেরিয়ে এল। কন্যা শামারোখ কেন আমার ঘরে আসবে? তার কি অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই? দশটা বেজে যখন পাঁচ মিনিটে দূর থেকে রিকশায় শাড়ির আভাস লক্ষ্য করে মনে করলাম, আমার দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে কন্যা শামায়োখের আবির্ভাব ঘটল। কিন্তু রিকশাটা যখন কাছে এল, লক্ষ্য করলাম, আলাউদ্দিনের বেগম নিউমার্কেটের কাঁচাবাজার থেকে তরিতরকারি নিয়ে ফিরছেন। ধরে নিলাম, আজ আর কন্যা শামারোখের আগমন ঘটবে না। এমন করে বসে থেকে রাস্তা জরিপ করে কী লাভ! নিজের ওপরেই আমার ভীষণ রাগ হচ্ছিল। আমি একজন রাম বোকা। সবাই আমাকে ঠকায়। কন্যা শামারেখও আমাকে ধোঁকা দিয়ে গেল। তার ব্যাপারে জড়িয়ে যাওয়ার জন্য আমি নিজেকে ধিক্কার দিতে থাকি। সাত-পাঁচ চিন্তা করতে করতে একরকম আনমনাই হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ করে আমার দৃষ্টি একটা রিকশার দিকে আকৃষ্ট হলো। প্রথমে দেখলাম শাড়ির আঁচল। তারপর ঢেউ খেলানো চুলের রাশি। আমার শরীরের অণু-পরমাণু হঠাৎ গুঞ্জন করে উঠল। এ কন্যা শামারোখ ছাড়া অন্য কেউ হতে পারে না। নিশ্চয়ই অন্য কেউ নয়। রিকশাটা হোস্টেলের গেটে এল এবং নামল। আমার বুকের ভেতরে রক্ত ছলকাতে আরম্ভ করেছে। ইচ্ছে হলো কন্যা শামারোখ যেখানে চরণ রেখেছে, সেখানে আমার বুকটা বিছিয়ে দিই না কেন? কিন্তু বাস্তবে আমি সেই তিন ঠেঙে চেয়ারে স্থাণুর মতো বসে রইলাম। আমার পা দুটো যেন দেবে গেছে। কন্যা শামারোখ একতলার সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠে আমার ঘরের দিকে এগিয়ে আসছে। যেখানেই পদতল রাখছে, যেন গোলাপ ফুটে উঠছে। আমার কাছাকাছি যখন এল, আপনা থেকেই একটা সুন্দর হাসি তার ওষ্ঠাধরে ফুটে উঠল। তার সাদা সুন্দর দাঁতগুলো ঝিলিক দিয়ে জেগে উঠল। আমার মনে হলো আমাদের হোস্টেলের ব্যালকনিতে সুমেরুরেখার ওপর সূর্য শিখা ঝলক দিয়ে জাগল।

আমি তাকে আমার ঘরে নিয়ে গেলাম। কন্যা শামারোখ এক নজরে সমস্ত ঘরের চেহারাটা দেখে নিল, তারপর প্রথম বাক্য উচ্চারণ করল, জাহিদ, আমি যে আপনার ঘরে এসেছি সেজন্য আপনার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। আমি যেমনটা আকাঙ্ক্ষা করেছিলাম, কন্যা শামায়োখ অবিকল সে কথাই বলেছে। অনুভব করলাম, কন্যা শামারোখ সুন্দরী বটে, কিন্তু তার মনে কোনো দয়া নেই। দরিদ্রের অক্ষমতাকে কেউ যখন অবজ্ঞা করে, সেটা হাজার গুণ নিষ্ঠুর হয়ে বাজে।

আমি উঠে দাঁড়ালাম। আমার চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল। কন্যা শামায়োখকে বললাম, আপনি যে রিকশায় চেপে এসেছেন, সেটা এখানে দাঁড়িয়ে আছে। শামায়োখ বলল, রিকশা দাঁড়িয়ে থাকলে আমি কি করব? আমি বললাম, সেটাতে চড়ে ফেরত চলে যাবেন। আপনি নিজের ইচ্ছেয় আমার ঘরে এসেছেন। আমি গরিব বটে কিন্তু আমাকে অপমান করার কোনো স্পর্ধা থাকা আপনার উচিত নয়।

আমার কথা শুনে কন্যা শামারোখ খিলখিল করে হেসে উঠল। সে যখন হাসে যেন ঝরনার কলধ্বনি বেজে ওঠে। তারপর বলল, আপনি ভীষণ বদরাগী মানুষ। আপনার নাকটা ভয়ানক ছুঁচোলো। মানুষের ওই ধরনের নাক থাকলে ভয়ানক বদরাগী হয়। আর তাছাড়া…। আমি বললাম, তাছাড়া আবার কি? আপনার লেখাগুলোও রাগী। একটু একটু করে আশ্চর্য হচ্ছিলাম। আমি জানতে চাইলাম, আমার লেখা আপনি পড়েছেন? সে বলল, সব পড়ে উঠতে পারিনি। ইব্রাহিম সাহেবের কাছ থেকে দুটো বই ধার নিয়েছিলাম। বাকি লেখাগুলো আপনার কাছ থেকেই ধার করব।

তারপর সে তিন পেয়ে চেয়ারটা বসার জন্য টেনে নিল। আমি হা-হা করে। উঠলাম, ওটাতে বসবেন না। সে জিজ্ঞেস করল, ওটাতে বসলে কি হয়? আমি বললাম, পড়ে যাবেন যে, ওটার একটা পায়া নেই। কন্যা শামারোখ চেয়ারটা টেনে নিয়ে টেবিলের সঙ্গে ঠেস দিল। তারপর বসে পড়ল এবং বলল, এই বসলাম, আমার পড়ে যাওয়ার ভয় নেই। তারপর আমার চোখে চোখ রেখে বলল, আপনার ভেতরে যত রাগের কথা আছে একটা একটা করে বলতে থাকুন। আপনার বিষয়ে মানুষ আমার কাছে অনেক কথা বলেছে। তাই আপনার কথা শুনতে এসেছি। আমি বললাম, দেখছেন না কী এক হতশ্রী ঘরে আমাকে ছন্নছাড়ার মতো বাস করতে হয়। সে বলল, আপনি যে ছন্নছাড়া সে কথা নিজের মুখে বলতে হবে না। আমি দেখা মাত্রই বুঝে ফেলেছি। অন্য কথা বলুন। আমি বললাম, অন্য কি কথা বলব, শামারোখ জিজ্ঞেস করে বসল, আপনার বাবা বেঁচে আছেন? আমি বললাম, না, যে বছর আমি কলেজে ভর্তি হই, সে বছরই তিনি মারা যান। মৃত্যুর সময় বাবাকে আমি দেখতেও পাইনি, তখন জেলে ছিলাম কিনা। কন্যা শামারোখ আমার কথা শুনে আরো বেশি মনোযোগী হয়ে উঠল, বারে, আপনি জেলেও ছিলেন? আমি বললাম, হ্যাঁ। কতদিন? বললাম, বেশি নয়। বছরখানেক। সে কথা বাড়ালো না জানতে চাইল, আপনার মা আছেন? আমি বললাম, মাও নেই। মারা গেছেন এই তিন মাস হয়। মাকেও আমি দেখতে পাইনি। মা যখন মারা গেছেন তখন রাজশাহীতে একটা রাজনৈতিক সভায় বক্তৃতা দিতে গিয়েছিলাম। কন্যা শামায়োখ চুকচুক করে আফসোস করল। তারপর বলল, আপনার ভাইটাই কেউ নেই? জবাব দিলাম, ভাইটিও পাঁচ বছর আগে গত হয়েছেন। তার একপাল নাবালক ছেলেমেয়ে আছে। আমাকে তাদের দেখভাল করতে হয়। বোন নেই? আমি বললাম, চারজন। একজনের বর মোলই ডিসেম্বরের দিনেই পাকিস্তানি সৈন্যের হাতে গুলি খেয়ে মারা গেছে। সৈন্যরা কক্সবাজারের দিক থেকে জিপে করে আত্মসমর্পণ করতে ছুটে আসছিল। আমার দুলাভাই মজা দেখতে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। একজন পাকিস্তানি সৈন্য গুলি করে তাকে চিরদিনের জন্য নীরব করে দেয়। অন্য বোনেরাও গরিব। ওদের সবার খবরা-খবর আমাকেই রাখতে হয়। আমি এক নিশ্বাসে আমার সমস্ত কথা বলে গেলাম। কন্যা শামারোখ তার আয়ত চোখ দুটো আমার চোখের ওপর স্থাপন করল। মনে হলো, অশ্রু চিকচিক করছে। তার চোখ দুটো যেন চোখ নয়, থরোথরো কম্পিত হৃদয়। তারপর সে বলল, আপনার এখানে খাওয়ার কিছু নেই? আমি বললাম, মুড়ি ছিল। গতকাল শেষ হয়ে গিয়েছে। যদি খালি চা খেতে চান তো বানিয়ে দিতে পারি। তবে আমার এখানে দুধ নেই। সে বলল, আপনার লাল চা-ই বানান দেখি। আমার চায়ের তেষ্টা লেগেছে। আমি চা করার জন্য যেই অভিনব হিটারের গোড়ায় গিয়েছি, শামারোখ কথা বলে উঠল, দেখি দেখি আপনার হিটারটা। তখন আমাকে তার কাছে হিটারের জন্ম বৃত্তান্তটা বলতে হলো। চা বানিয়ে তার সামনে টেবিলে রাখলে সে পেয়ালাটা তুলে নিয়ে একটা চুমুক দিয়েই বলে ফেলল, আপনি চমৎকার চা তৈরি করেন। আর ভীষণ মজার মানুষ। আমি ঠিক করেছি, আপনাকে আমার লেখা কবিতাগুলো পড়তে দেব। আমি বললাম, আপনি কবিতা লেখেন না কি? হ্যাঁ, একটা পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছি। আপনার সেই প্রবীণ বটের অনুসরণ করে আমি একটা কবিতার গোটা একটা বই লিখে ফেলেছি। নাম রেখেছি ‘কালো মানুষেরা কসিদা’। একটা মজার জিনিস দেখবেন? আমি বললাম, দেখান। কন্যা শামারোখ মোটা মলাটের খাতাটা খুলে দেখালেন, প্রবীণ বটের কবি জনাব জাহিদ হাসানের নামে উৎসর্গ করা হলো। আমি মনে করলাম, আশ্চর্য কাণ্ড ঘটিয়ে তোলার দেবতা মারা যান নি, এখনো বহাল তবিয়তে তিনি বেঁচে রয়েছেন। আমার এমন আনন্দ হলো, হঠাৎ করে কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেললাম। এই বিস্ময়বোধ কাটিয়ে ওঠার জন্য কন্যা শামারোখকে বললাম, প্রথমদিকের লেখা পড়ন। কন্যা শামারোখ ঘাড়টা সুন্দরভাবে দুলিয়ে বলল, না, সেটি হচ্ছে না। আমি আপনার কাছে গোটা খাতাটা রেখে যাব। আগামী শুক্রবার বিকেলবেলা এসে আপনার মতামত শুনব। সে আস্ত খাতাটা আমার হাতে তুলে দিল। তার হাতে আমার হাত লেগে গেল।

এই সময় আমার বন্ধু আলতামাস পাশা ঘরে ঢুকল। দেখলাম, তার ছায়াটা লম্বা হয়ে পড়েছে। আজ তার আসার কথা নয়। তবে এটা ঠিক যে, আলতামাসের জন্য শনি-মঙ্গলবারের বাছ-বিছার নেই। যখন খুশি সে আসতে পারে। ইকনমিক্সের মেধাবী শিক্ষক আলতামাসকে আমি বিলক্ষণ পছন্দ করি। ঘরে ঢুকেই সে কন্যা শামারোখকে দেখে থতমত খেয়ে গেল। কন্যা শামারোখ শীতল চোখে তার দিকে তাকালো। কারো মুখে কোনো কথা নেই। আলতামাস নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, সরি জাহিদ ভাই, আমি না হয় অন্য সময় আসব। আপনার বোদলেয়ারটা দিতে এসেছিলাম। বইটা টেবিলের ওপর রেখে আমাকে দ্বিতীয় কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সে ঘরের বাইরে চলে গেল।

আলতামাস চলে যাওয়ার পর কন্যা শামারোখ সরাসরি আমার চোখের ওপর চোখ রাখল, এ লোককে আপনি চেনেন কী করে? আমি বললাম, তিনি ইকনমিক্সের ব্রিলিয়ান্ট শিক্ষক এবং আমার বিশেষ বন্ধু। কন্যা শামারীখের চোখ দুটো বাঁকা ছুরির মতো বেঁকে গেল, রাখুন আপনার ব্রিলিয়ান্ট শিক্ষক। এত বাজে লোকের সঙ্গে আপনার বন্ধুত্ব হয় কেমন করে? আমি বললাম, তাকে তো আমি ভাল রুচিবান ভদ্রলোক বলেই জানি। আপনি তার সম্পর্কে ভিন্ন রকম কোনো ধারণা পোষণ করেন নাকি? কন্যা শামারোখ চিৎকার দিয়ে উঠল, রাখুন আপনার রুচিবান ভদ্রলোক, ওই ব্ল্যাকশিপটা লন্ডনে আমার জীবনটা নরক বানিয়ে ছেড়েছিল। জানেন, প্রতি সপ্তাহে আট-দশটা করে কবিতা পাঠাতো আমার কাছে। সবগুলোতে থিকথিকে যৌন চেতনার প্রকাশ। পড়লে ঘেন্নায় আমার শরীর রি-রি করে উঠত। আগামীবার যখন আপনার কাছে আসব, সেগুলো নিয়ে আসব। পড়ে দেখবেন বানচোত কাকে বলে। আমি বললাম, অন্যায় তো কিছু করেনি। আপনি যে রকম সুন্দরী, আলতামাসের জায়গায় আমি হলেও কবিতা না পাঠিয়ে হয়তো পারতাম না। তারপর কন্যা শামারোখ আমার কাঁধে হাত রেখে অত্যন্ত মৃদুস্বরে বলল, বাট দ্যা ফ্যাক্ট ইজ আপনি আমার কাছে সেরকম কিছু পাঠান নি। আমি নিজে উদ্যোগী হয়েই আপনার কাছে এসেছি। আমি মনে মনে চিন্তা করলাম, এর বেশি আমার আর কি চাই! এই মুহূর্তে যদি আমার মৃত্যু ঘটে যেত, সেটাই হতো সবচেয়ে সুন্দর।

আমার ঘরে কন্যা শামায়োখের শুভাগমন ঘটেছে এই সংবাদ হোস্টেলের সর্বত্র চাউর হয়ে গেছে। একতলা থেকে দোতলা, তিনতলা-চারতলা থেকে বোর্ডাররা নেমে এসে আমার দরজায় উঁকি দিয়ে চলে যাচ্ছে। অবিশ্রাম লোক আসছে এবং ট্যু দিয়ে চলে যাচ্ছে। কেউ কেউ সালেহ আহমদের ঘরে গিয়ে আড্ডা জমিয়ে বসেছে। সালেহ আহমদের সঙ্গে আমার সম্ভাব নেই। তাদের কলকল হাসি-তামাশা আমাদের কানে এসে লাগছে। কন্যা শামারোখ ফুঁসে উঠল, এই মানুষগুলো আমাকে পেয়েছে কি? একের পর এক এসে উঁকি দিয়ে চলে যাচ্ছে। আমি কি চিড়িয়াখানার কোনো আজব চিড়িয়া নাকি! কন্যা শামারোখ যত জোরে চিৎকার করে কথা বলছে, নির্ঘাৎ সবারই কানে যাচ্ছে। আমি আতঙ্কিত হয়ে উঠলাম। যদি সবাই দল বেঁধে এসে আজেবাজে কথা বলে কন্যা শামায়োখকে অপমান করে বসে! আমি তো তাকে রক্ষা করতে পারব না। তাই বললাম, ছেড়ে দিন, কুকুরওতো ঘেউ ঘেউ করে। সে কণ্ঠস্বর আরেক ধাপ চড়িয়ে বলল, আসল কুকুর আর মানুষ-কুকুরে অনেক তফাত আছে। আমি মনে মনে প্রমাদ গুণলাম। এখুনি যে কোনো একটা অঘটন ঘটে যেতে পারে। কিন্তু কন্যা শামারোখ চড়া গলায় কথা বলে যাচ্ছে এবং তার কথা সবাই শুনতেও পাচ্ছে। কোনোরকম চিন্তা-ভাবনা না করেই হঠাৎ করে একটা সাহসের কাজ করে বসলাম। একহাত মাথার ওপর এবং একহাত তার মুখের ওপর রেখে মুখটা চেপে ধরলাম। বাধা পেয়ে তার মুখ বন্ধ হলো, কিন্তু চোখ দিয়ে পানির ধারা ঝরতে থাকল। আমি বললাম, চলুন, আপনাকে রেখে আসি। সে কাপড়-চোপড় সামলে ব্যাগটা তুলে নিয়ে বলল, আমি নিজেই যেতে পারব। কি মনে করেন আমাকে! আগামী শুক্রবার আমি আসব, মনে রাখবেন।

.

১২.

কন্যা শামারোখের অপ্রকাশিত কবিতা গ্রন্থ ‘কালো মানুষের কসিদা’র ভেতর আমি আমুণ্ডু ডুবে গেলাম। তার এই কবিতাগুলো গ্রন্থাকারে প্রকাশ করলে পাঁচ ফর্মা অর্থাৎ আশি পৃষ্ঠার মতো একটা বই দাঁড়াবে। ভদ্রমহিলা গ্রন্থের নামকরণ কালো মানুষের কসিদা রাখল কেন, সেটাও আমাকে ভাবিয়ে তুলল। অনেক তরুণ কবিই স্টান্ট দেয়ার জন্য কবিতার বইয়ের জমকালো নাম রাখে। এই ধরনের বেশিরভাগ কবির রচনায় কদাচিৎ সার পদার্থ পাওয়া যায়। আর কন্যা শামারোখকে কবিতা লিখতে আসতে হলো কেন তাও আমার চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ালো। সে অত্যন্ত অপরূপ মহিলা, তাকে নিয়ে অন্যদের কবিতা লেখার কথা। কিন্তু তিনি এই বাড়তি কষ্টটা মাথায় তুলে নিলেন কেন?

একজন প্রাচীন সংস্কৃত কবির একটা সুন্দর মন্তব্য মনে পড়ে গেল। কবির নাম বলতে পারব না। কালিদাস না ভারবী না বাণভট্ট। কোনো মাহফিলে যখন চুলচেরা দার্শনিক বিতর্ক চলে, সেই সময় কেউ যদি উদাত্ত গম্ভীর কণ্ঠে বিশুদ্ধ উচ্চারণে একটি উৎকৃষ্ট কবিতা পাঠ করে, শ্রোতারা দার্শনিক বিতর্কের কথা ভুলে যায়। কবিতাই তাদের মনোযোগের বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। আর এই কবিতা পাঠের আসরে কোনো সুকণ্ঠ গায়ক যদি তাল-লয় রক্ষা করে গান গেয়ে ওঠে, শ্ৰোতাসাধারণ কবিতার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে গানের মধ্যে মজে যায়। গানের আসরের পাশ দিয়ে কোনো সুন্দরী যদি নীরবেও হেঁটে যায়, সবাই গান ভুলে সেই মহিলার দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে থাকবে। সংস্কৃত কবির এই পর্যবেক্ষণটির মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে সত্য রয়েছে। একথা নির্দ্বিধায় কবুল করে নিতে পারি।

কন্যা শামারোখের লেখাগুলো পড়ে আমি একটা ধাক্কা খেয়ে গেলাম। সুন্দর মহিলাকেও নিজের গভীর বেদনার কথা প্রকাশ করার জন্য কবিতার আশ্রয় নিতে হয়। আমি কবিতার ভাল-মন্দের বিচরক নই। আমি অত্যন্ত সরল নিরীহ পাঠক। পাঠ করে যখন প্রীত হই, ধরে নিই লাভবান হলাম। চিত্রকল্প, উপমা, বিচার করে বিশুদ্ধ কবিতার রস বিচারের ক্ষমতা আমার কস্মিনকালেও ছিল না। আর কবিসত্তার গভীরে ডুব দিয়ে অঙ্গীকার শনাক্ত করার কাজও আমার নয়। আমি শুধু একজন মামুলি পাঠক। একটা কবিতা যখন ভাল লাগে, বার বার পাঠ করি। খারাপ লাগলে আবার মনে একটা সহানুভূতির ভাব জেগে ওঠে। হায় বেচারি ব্যর্থ কবি! ছাপা বাঁধাই, কাগজ-মলাটে তোমার কত টাকা চলে গেল! অথচ মানুষ তোমাকে কবি বলে মেনে নেবে না। শেক্সপিয়র একবার একজন কবিকে অপকবিতা লেখার জন্য হত্যা করার বিধান দিয়েছিলেন। এ কাজ শেক্সপিয়রকেই মানায়। কারণ ঈশ্বরের পরে তিনিই সবচাইতে বড় স্রষ্টা। আমি শুধু একজন কবিতার পাঠক, কবি নই । যখন কোনো উৎকৃষ্ট কবিতা পাঠ করি লতায়িত জলের মতো কবিতার নিরঞ্জন সুন্দর-স্বরূপ সমস্ত সত্তা আচ্ছন্ন করে ফেলে। নির্মেঘ শরৎ রাতে নক্ষত্রের ভারে নত হয়ে নেমে আসা আকাশের মতো আমার হৃদয়-মনে সন্নত ভাব সৃষ্টি হয়। তখন আমার মনে এমন একটা চেতনা তরঙ্গিত হয়ে ওঠে, আমি মেনে নিতে বাধ্য হই, ক্ষুদ্র তৃণাঙ্কুর থেকে আকাশের কম্পমান নক্ষত্র সমস্ত কিছুর সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছি। আমি। আমার সঙ্গে সৃষ্টি জগতের কোনো অন্তরাল নেই। পৃথিবীর ধুলোমাটিও আমার অনুভবে মূল্যবান হীরক চূর্ণের মতো দ্যুতিমান হয়ে ওঠে।

কন্যা শামারোখের লেখাগুলো কবিতা হয়ে উঠেছে এমন কথা বলার দুঃসাহস আমার নেই। তবে একটি কথা বলব, শামারোখের লেখার মধ্যে এমন একটা জ্বালা, এমন একটা যন্ত্রণাবোধের সাক্ষাৎ পেয়ে গেলাম পুরো দুটো দিন তা-ই আমাকে অভিভূত করে রাখল। মনে মনে আমি প্রশ্ন করলাম, সুন্দরী শামারোখ, তোমার মনে কেন এত বেদনা! সেই সময়, যখন আমি কবিতাগুলো পড়ছিলাম, কন্যা শামারোখ যদি আমার কাছে থাকত, আমি তার সারা শরীরে শীতল বরফের প্রলেপ দিয়ে তার মনের যন্ত্রণা হরণ করবার চেষ্টা করতাম। তাতেও যদি যন্ত্রণার উপশম না হতো, আমি আমার শরীর তার শরীরে স্থাপন করে তার সমস্ত বেদনা শুষে নেবার চেষ্টা করতাম। যতই পড়ছি আটশ আশি ভোল্টের বৈদ্যুতিক শক্তির ধাক্কা লাগছে আমার মনে।

কন্যা শামারোখ মাত্র একটি কবিতায় পুরো একটি বই লিখে ফেলেছে। সে যদি সাধারণ অর্থে কবি যশোপ্রার্থী একজন হতো, এ কাজটা কখনো করত না। টুকরো টুকরো কবিতায় মনের ভাব প্রকাশ করার চেষ্টা করত। শামারোখ ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী। কবিতা কী করে সুমিত আকার পায়, সেটা তার না জানার কথা নয়। তবু প্রকাণ্ড এক দীর্ঘ কবিতায় তার মনের সমস্ত যন্ত্রণা ঢেলে দিতে চেষ্টা করেছে। অসহ্য কোনো যন্ত্রণা তাকে দিয়ে ওই কাজটি বোধহয় করিয়ে নিয়েছে। আমি ওই অশোধিত বেদনার কাছে মনে মনে আমার প্রণতি নিবেদন করলাম।

কন্যা শামারোখের কবিতাগুলো পাঠ করতে গিয়ে আরো একটা জিনিস আমার চোখে ধরা পড়ল। কবিতার ঠিক ঠিক মাত্রা সে বসাতে পারে না। মাত্রা বেশি অথবা কম হয়ে যায়। তার ছন্দের ব্যবহারও নিখুঁত নয়। দীর্ঘদিন ধরে যদি কবিতা লেখার অভ্যাস করত, আমার ধারণা এসব ত্রুটি সে কাটিয়ে উঠতে পারত। তার আশি পৃষ্ঠার দীর্ঘ কবিতা এক আবহ থেকে অন্য আবহে যখন পৌঁছয়, চলনের মধ্যে একটা অসংলগ্নতা অত্যন্ত প্রকট হয়ে চোখে পড়ে। এই কবিতা যেভাবে লেখা হয়েছে সেভাবে যদি পাঠিয়ে দেয়া হয়, আমার ধারণা, কোনো সাহিত্য সম্পাদক সেটা তাদের কাগজে প্রকাশ করতে কখনো রাজি হবেন না। কিন্তু আমার কাছে সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে এই লেখাগুলো মূল্যবান হয়ে উঠল। এ একজন অনিন্দ্যসুন্দর নারীর অত্যন্ত গভীর মর্মবেদনার দলিল। মহিলা এই কবিতার বইটি আমাকে উৎসর্গ করেছেন এবং আমাকে পড়তে দিয়েছেন। ব্যাপারটাকে অত্যন্ত বিরল একটা সৌভাগ্য বলে ধরে নিলাম। এই দীর্ঘ অগ্নিগিরি লাভাস্রোতের মতো অশোধিত আবেগের ফিরিস্তি পাঠ করতে গিয়ে কোথাও কোথাও এমন কিছু জমাট অংশ পেয়ে গেলাম, পড়ে ধারণা জন্মালো, মহিলার সবটাই যন্ত্রণা নয়, যন্ত্রণা অতিক্রম করার ক্ষমতাও তার জন্মে গেছে। দুটো খণ্ড কবিতা উদ্ধৃত করছি, যেগুলো তার লেখায় গানের আকারে ধরা পড়েছে। প্রথমটি এ রকম:

কমল হীরের দীপ্তি ভরা
তোমার এমন কঠিন অহংকার
ইচ্ছে করে গলায় পরি
গড়িয়ে অলংকার, আহা যদি পারতাম!
যদি পারতাম আমি মন খেলিয়ে
বানিয়ে নিতাম, মনের মতো
উজ্জ্বলতা লজ্জা দিত
রাজ-রানীদের হার।
আমি তাদের সভায় যেতাম
দুলিয়ে শাড়ির পাড়
দেখত লোকে অবাক চোখে
কেমন শোভা কার।
কঠিন চিকন প্রাণ গলানো
তীক্ষ্ণ হীরের ধার
মনের মতো কাটবে এমন
পাই নি মণিকার।
তাইতো থাকি ছায়ার মতো
বই যে তোমার ভার
পাছে এমন রতন মানিক
কণ্ঠে দোলাও কার।

পরের কবিতাংশটির আবেদন একটু অন্যরকম। একটা কথা বলে রাখি। কন্যা শামারোখের এই উদ্ধৃতাংশগুলো কবিতা হয়েছে এমন জোর দাবি আমি করতে পারব না । কিন্তু পাঠ করতে গিয়ে আমার ভেতরটা বেজে উঠেছিল বলে উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারলাম না।

তোমার এ প্রেম সকল দিকে গেছে
যদি ডাকি।
ডানা মেলে আকাশ আসে নেচে।
আমার আপন জীবন ভরা
তুচ্ছ আবিলতা
আমার যত কলুষ গ্লানি
আমার বিফলতা
তোমার প্রেমের স্নিগ্ধ ধারা
সকল দেবে কেচে।
পারিজাতের গন্ধ ভরা
মন হারানো বাঁয়ে
নীলাঞ্জনের রেখার নিচে
শ্যামল তরুর ছায়ে
তোমার নামে হাত বাড়ালো
দলে দলে বন দেবতা
হৃদয় দেবেন যেচে।

কন্যা শামারোখের ভাবে উদ্বেল হয়ে সারাক্ষণ যদি মগ্ন থাকতে পারতাম, আমার সেটাই হতো সবচাইতে আনন্দের। কিন্তু আমরা তো মাটির পৃথিবীতে বাস করি। নিতান্ত অনিচ্ছায় হলেও দৈনন্দিন কিছু প্রয়োজনীয় কাজ সারতে হয়। এটা-সেটা কত কিছু করতে হয়। মানুষের সমাজে মানুষের মতো বাস করতে হলে কত দায় উপরোধ রক্ষা আর কর্তব্য-কর্ম করে যেতে হয়। একদিন আমাকে বিকেলবেলা আবু সাঈদ এসে বলল, চলো দোস্ত নিউমার্কেট ঘুরে আসি। আবু সাঈদ সেজেগুজে এসেছে। আমার মনে হলো না, আমি তাকে নিবৃত্ত করতে পারব। কারণ গেল মাসে আমি তার কাছ থেকে পাঁচশ’ টাকা ধার করেছি। সে টাকা এখনো শোধ করা হয়নি। আমি বললাম, হঠাৎ করে তোমার নিউমার্কেট যাওয়ার এমন কি দরকার পড়ল? সাঈদ বলল, দোস্ত স্যুট বানাবো, তোমাকে কাপড় পছন্দ করে দিতে হবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এ অসময়ে তোমার স্যুট বানাবার দরকার পড়ল কেন? এখনতো সবে শরঙ্কাল। শীত আসতে দাও। সে বলল, দোস্ত ভুলে যেয়ো না এটা আমার বিয়ের বছর। আমি বললাম, বিয়ের বছর তাতে কি, সেজন্য তোমাকে স্যুট বানাতে হবে কেন? স্যুট তো তুমি শ্বশুর বাড়ি থেকেই পাবে। সাঈদ প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে টেবিলে ঠুককে ঠুকতে বলল, হ্যাঁ, শ্বশুর বাড়ি থেকে একটা স্যুট পাওয়া যাবে, সে কথা ঠিক বটে। তারপরও আমার একটা স্যুট বানানো প্রয়োজন। কারণ, বিয়ে করলে তো আমি ভীষণ খাই-খরচের তলায় পড়ে যাব । তখন স্কলারশিপের বারোশ টাকায় দুজনের চলবে না। এখন থেকে আমাকে চাকরির চেষ্টা করতে হবে। অফিসে অফিসে ইন্টারভিউ দেয়ার জন্যও একটা স্যুট প্রয়োজন। চলো দোস্ত, দেরি করে লাভ নেই । রাত হয়ে গেলে কাপড়ের রঙ বাছাই করতে অসুবিধে হবে।

সাঈদের স্যুটের কাপড় বেছে দিতে এসে আমি মহা মুশকিলে পড়ে গেলাম। আমি যে কাপড় পছন্দ করি, সেটা সাঈদের মনে ধরে না। সে যে সমস্ত কাপড় পছন্দ করে, দেখলে আমার পিত্তি জ্বলে যায়। আমি এই প্রথম অনুভব করলাম রুচির দিক দিয়ে সাঈদের সঙ্গে আমার কত পার্থক্য! চার-পাঁচটা দোকান ঘোরার পর আমার ধারণা হলো সাঈদের সঙ্গে না আসাই ঠিক হতো। কারণ আমার জন্য সে তার পছন্দমতো কাপড় কিনতে পারছে না। এই অনুভবটা আমার মনে আসার পর বললাম, ঠিক আছে, তুমি বেছে ঠিক করো, আমি কিছু বলব না। সাঈদ একটা রঙচঙে কাপড় পছন্দ করল। মনে মনে আমি চটে গেলাম। কোনো রুচিবান মানুষ কী করে এত রঙচঙে কাপড় পছন্দ করে!

দরজির দোকানে গিয়ে বিরক্তি আরো বাড়ল। স্যুট কিভাবে বানাতে হয়, তার কত রকম পরিভাষা আছে, এই প্রথম জানতে পারলাম। কোট ডাবল কি সিঙ্গেল ব্রেস্ট হবে, প্যান্টের ঘের কতদূর হবে, স্ট্রেইট পকেট থাকবে কি না, হিপ পকেট একটা না দুটো হবে, পকেটের কভার থাকবে কি থাকবে না, দর্জি মহাশয়ের এবংবিধ প্রশ্নের মোকাবেলায় সাঈদ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। প্রতিবারই সে বলছিল, দোস্ত তুমি বলে দাও। সুতরাং নিতান্ত আনাড়ি হওয়া সত্ত্বেও আমি জবাব দিতে থাকলাম। দর্জি যখন জানতে চাইল, কোট সিঙ্গেল কি ডাবল ব্রেস্ট হবে, আমি বললাম, ডাবল ব্রেস্ট। প্যান্ট কোমরের ওপরে কি নিচে পরা হবে জানতে চাইলে আমি বললাম, ওপরে। হিপ পকেট একটা কি দুটো হবে, এ প্রশ্নের উত্তরে আমি বললাম, অবশ্যই দুটো । সে জিজ্ঞেস করল, কভার থাকবে? আমি বললাম হ্যাঁ। আমি স্যুট বানানোর প্রক্রিয়া-পদ্ধতির ব্যাপারে কিছুই জানি নে। তারপরও দর্জির প্রশ্নের জবাব এমনভাবে দিলাম যেন হামেশাই স্যুট বানিয়ে থাকি। সাঈদ আমার ওপর ভীষণ খুশি হয়ে গেল। দর্জির দোকান থেকে বেরিয়ে এসে সে আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, দোস্ত, তোমার মনের খুব জোর আছে। আমিও স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম, একটা ফাড়া কাটল।

নিউমার্কেট থেকে বেরিয়ে দুজন রাস্তা পার হলাম। সাঈদকে বললাম, দোস্ত তুমি যাও। আমি পুরনো বইয়ের দোকানগুলো একটু দেখে যাব। অন্য সময় হলে সে ঠাট্টা-তামাশা করত। জীবনের প্রথম স্যুট বানাতে দেয়ার কারণে আজকে তার মেজাজটা খুব ভাল। সে বলল, না দোস্ত, দুজন এক সঙ্গে এসেছি, এক সঙ্গেই যাব। তুমি পুরনো বই দেখতে থাক। আমি ওই ম্যাগাজিনের দোকানে আছি।

পুরনো বইয়ের দোকানে এলে আমার একটা আশ্চর্য অনুভূতি হয়। পুরনো বই নাড়াচাড়া করে দেখার কী আনন্দ, সেটা প্রকাশ করা যাবে না। একেকটা বই কত হাত ঘুরে এসব দোকানে এসেছে। প্রতিটি পুরনো বইয়ের ভেতরে প্রাক্তন গ্রন্থ মালিকের একটা ব্যক্তিগত সান্নিধ্য অনুভব করি। যিনি এ বই কিনেছিলেন, নরম কোনো সন্ধ্যের নির্জনে একাকী সেটা পাঠ করে কিভাবে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছিলেন, সে কথা অনুভব করার চেষ্টা করি। বইয়ের জগতে সমস্ত মনোযোগ ঢেলে দিয়ে আধারাত কাবার করে দিয়ে কিভাবে জীবনের একটা অর্থ খুঁজতে চেষ্টা করেছিলেন, সে কথাও মনে ঢেউ দিয়ে জেগে ওঠে। এ বই কিভাবে মালিকের ব্যক্তিগত সংগ্রহের ভাণ্ডার থেকে বেরিয়ে এসে পুরনো বইয়ের দোকানে ঠাঁই করে নিল, সে বিষয়েও নানা ভাবনা আমার মনে আসে। গ্রন্থ মালিক বৃদ্ধ বয়সে জীবনধারণের কোনো অবলম্বন না পেয়ে ব্যক্তিগত সংগ্রহের গ্রন্থগুলো কি বেচে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন? নাকি তার চাকর বিড়ির পয়সা জোগাড় করার জন্যে ফেরিঅলার কাছে হাজার টাকার বই পাঁচ-দশ টাকায় বেচে দিয়েছে! ইদানীং যে কথাটা বেশি মনে হয়, গ্রন্থ মালিকের অপোগণ্ড নেশাগ্রস্ত ছেলেটি তার বাপের বুকের পাজরের মতো আদরের ধন বইগুলো পুরনো দোকানে বেচে প্যাথেড্রিন কিংবা হোরোইন কেনার পয়সা সংগ্রহ করেছে কিনা। একবার এই পুরনো বইয়ের দোকান থেকে আমি মহাকবি গ্যোটের ‘সাফারিংস অব ইয়ং ভেরথার’-এর ইংরেজি অনুবাদের প্রথম সংস্করণেরও একটি কপি সংগ্রহ করেছিলাম। বইটা খুলে মালিকের সীলমোহরাঙ্কিত নাম-ঠিকানা দেখে চমকে উঠেছিলাম। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, ৪০ মসজিদ বাড়ি লেন, কলকাতা। নিজেকেই প্রশ্ন করেছিলাম ওই মসজিদ বাড়ি লেনের সত্যেন্দ্রনাথ ভদ্রলোকটি কি কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত? আমি আবেগে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছিলাম। আমার মনে হয়েছিল, স্বয়ং মহাকবি গ্যোটে কবি সত্যেন্দ্রনাথ মারফত ওই বইটি আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। দান্তের রচনাবলির একটা ইংরেজি অনুবাদ দোকানে এসেছে। এ ধরনের বই ধরে দেখতে কী যে আনন্দ! আমি ঝুঁকে পড়ে বইটার ঘ্রাণ নিচ্ছিলাম। ঠিক এই সময় আবু সাঈদ পেছন থেকে আমার জামা ধরে টান দিল, দোস্ত, দেখে যাও একটা মজার জিনিস।

আবু সাঈদ আমাকে হিড়হিড় করে ম্যাগাজিনের দোকানটায় টেনে নিয়ে এল। তারপর পাক্ষিক চিত্রিতা পত্রিকাখানা টেনে নিয়ে দেখিয়ে বলল, এই যে দোস্ত, কভার দ্যাখো, তোমার প্রিয়তম মহিলার পুরো পাতা জোড়া তিন রঙের ছবি। আমি দেখলাম, কভারে সত্যি সত্যি কন্যা শামারোখের ছবি। তিন রঙে ছাপা হয়েছে। মনে মনে একটা চোট পেয়ে গেলাম। আমার মুখ দিয়ে হঠাৎ করে কোনো কথা বের হলো না। সাঈদ তার বড় বড় দাঁত দেখিয়ে হেসে বলল, দোস্ত, আমি বলি নি, ওই মহিলা দুই নম্বরী জাল মাল । তুমি শুধু শুধু ধূর্ত এই মহিলার পক্ষ নিয়ে, অকারণে লোকজনের শত্রুতে পরিণত হচ্ছ। দোস্ত, ওকে প্লেগ রোগের জীবাণুর মতো বর্জন কর। নইলে তুমি অনেক বিপদে পড়ে যাবে। তার অনেক বৃত্তান্ত আমি জানি। কাল সকালে আমার ঘরে এসো। সব কথা জানাবো। সাঈদের কথার কোনো জবাব দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব হলো না। আমার মনের এখন এমন এক অবস্থা তার সঙ্গে কোনোরকম বাদানুবাদ করতে ইচ্ছেও হলো না। কন্যা শামারোখের যতই ক্রটি বা কলঙ্ক থাকুক না কেন, সেটা নিয়ে সাঈদের সঙ্গে কোনো কথা বলতে আমার মন রাজি হলো না। আমি কিছুই বললাম না। হোস্টেলের দিকে হাঁটতে আরম্ভ করলাম। সাঈদ বলল, একটু দাঁড়াও। একটা ম্যাগাজিন কিনে নিই, পরে কাজে আসতে পারে।

সে রাতে হাজার চেষ্টা করেও আমি দুচোখের পাতা এক করতে পারলাম না। কন্যা শামারোখ সম্বন্ধে হাজার চিন্তা করেও কোনো স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারলাম না। মহিলা কেমন? যার হৃদয়ে এমন তীব্র যন্ত্রণা, জীবন জিজ্ঞাসা যার এমন প্রখর, সে কি করে একটি আধাপর্নো ম্যাগাজিনে নিজের ছবি ছাপতে পারে? বার বার ঘুরেফিরে একটা কথাই আমার মনে জেগে উঠতে থাকল, আমি একটা বোকা। কিন্তু আমি যে বোকা সে কথাটা নিজেই জানিনে। আমি সব ব্যাপার এমন দেরিতে জানতে পারি কেন? সবাই আমাকে ঠকিয়ে যাবে এই কি আমার ভাগ্য, নিজের গভীর দুর্ভাগ্যের কথা চিন্তা করতে করতে এক সময়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

পরের দিন ঘুম ভাঙে অনেক দেরিতে। প্রাতঃকৃত্য সেরে ক্যান্টিনে গিয়ে দেখি ক্যান্টিন খালি। আমি ঘড়ি দেখলাম। সাড়ে নটা বাজে। ইস্ এতক্ষণ আমি ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলাম! কোনোরকমে নাস্তা খেয়ে নিলাম। দোতলায় উঠব বলে সিঁড়িতে পা দিয়েছি, এমন সময় মনে পড়ে গেল, সাঈদ আমাকে গতকাল সন্ধ্যেবেলা বলেছিল, আমি যদি জানতে চাই তাহলে কন্যা শামারোখ সম্বন্ধে সে অনেক গোপন সংবাদ জানাতে পারে। আমি চরণে চরণে তিনতলায় উঠে ভেজানো দরজা ঠেলে সাঈদের ঘরে প্রবেশ করলাম। কিন্তু ঘরে ঢুকে দেখি, সাঈদ বিছানার ওপর উপুড় হয়ে রয়েছে। পরনের লুঙ্গি খোলা। তার বিছানার চাদরটার একটা বিরাট অংশ ভিজে গেছে। বালিশের কাছটিতে কন্যা শামারোখের ছবিসহ ম্যাগাজিনটা পড়ে আছে। এই দৃশ্য দেখার পর আমার বুঝতে বাকি রইল না সাঈদ হারামজাদা কন্যা শামারোখের ছবির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে মাস্টারবেট করেছে। আমাকে দেখামাত্রই সাঈদ চমকে উঠল। তাড়াতাড়ি বালিশ টেনে চাঁদরের ভেজা অংশ ঢেকে ফেলল। সে আমার চোখের দিকে তাকাতে পারছিল না। আমি কিছু না বলে তার ঘর থেকে বেরিয়ে চলে এলাম। আমার মনে কন্যা শামারোখ সম্বন্ধে একটা নির্বেদ জন্ম নিল। যে ভদ্রমহিলা আধাপর্নো ম্যাগাজিনে ছবি ছাপতে দেয় এবং সে ছবি দেখে মানুষ মাস্টারবেট করে, তার নামের সঙ্গে কিছুতেই কন্যা যুক্ত হতে পারে না। শামারোখ এখন থেকে শুধু শামারোখ, কন্যা শামারোখ নয়।

শামারোখের সঙ্গে কন্যা শব্দটি যুক্ত রাখতে আমার মন আর সায় দিচ্ছে না। শামারোখ বিবাহিতা, এক সন্তানের জননী এবং স্বামীর সঙ্গে অনেকদিন হলো সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। তার বয়স হয়েছে, আমি তার কানের গোড়ায় বেশ কটা পাকা চুল দেখেছি। যদিও সে আশ্চর্য কৌশলে সেগুলো আড়াল করে রাখতে জানে। প্রচলিত সংজ্ঞা অনুসারে তাকে কুমারী বলা কিছুতেই সঙ্গত নয়। তারপরও এ পর্যন্ত তাকে আমি কুমারী বলেই প্রচার করে আসছি। শামারোখের সৌন্দর্যের মধ্যে আমি সন্ধান পেয়েছিলাম এমন এক বস্তুর, যা অত্যন্ত নিরীহ এবং সরল বন্য হরিণীকে মানায়, ঋতুবতী হওয়ার আগে কিশোরীর শরীরকে যা আলোকিত করে রাখে। আমি মনে করেছিলাম, শারীরিক বিবর্তনের মধ্যেও সেই মৌলিক জিনিসটি শামারোখ ধরে রেখেছিল। এখন দেখছি আমার সেই ধারণা সঠিক নয়। আধাপর্নো ম্যাগাজিনে সে ছবি ছাপিয়ে আনন্দ পায় এবং সেই ছৰি দেখে দেখে ইতর মানুষেরা মনের সুখে মাস্টারবেট করে । নিশ্চয়ই তার গহন মননে এমন এক কামনা কাজ করে, সে চায়, ইতর মানুষেরা তার ছবির সঙ্গে যৌন সঙ্গম করতে থাকুক। আমি নিজে শামারোখ সম্পর্কিত যে ভাবমূর্তি তৈরি করেছিলাম তার ওপরের নিকেলগুলো ঝরে গেল এবং কন্যা শামারোখের অর্ধেক অস্তিত্ব আমার মন থেকে মুছে গেল। লোকে আমাকে বোকা মনে করতে পারে। আসলে আমি তো বোকাই। কিন্তু শামারোখের সঙ্গে কন্যা যোগ করাটাকে যদি কেউ বোকামো মনে করেন, আমি মেনে নেব না। তাহলে পঞ্চ স্বামীর ঘরণী দ্রৌপদীকে মানুষ সতী বলবে কেন? খ্রিস্ট জননীকেও-বা কেন কুমারী বলবে? আমার বেদনা হলো আমার কন্যাত্বের ধারণাটা শামারোতের বেলায় বেজায় রকম মার খেয়ে গেছে।

শামারোখকে আর কন্যা শামারোখ বলতে পারছিনে। তারপরও আমার কাছে তার একটা বিশেষ মূল্য রয়েছে। কারণ শামারোখ কবিতা লেখে। অবশ্য এ কথা ঠিক, যারা কবিতার ভাল-মন্দ বিষয়ে মতামত প্রদান করেন, তারা শামারোখের লেখাগুলো কবিতা হয়েছে বলে মেনে নিতে চাইবেন না। শামারোখ যদি দীর্ঘকাল চর্চা করে ছন্দ, মাত্রা এইসব ঠিকমতো বসাতে শিখত, তাহলে তারা ভিন্নরকম ধারণা পোষণ করতে বাধ্য হতেন। তার মনে ভাবনাগুলো যেভাবে এসেছে, অদলবদল না করে সেভাবেই প্রকাশ করেছে কবিতায়। তার শক্তি এবং সততা নিয়ে আমি অণুমাত্র সন্দেহও পোষণ করি নে। আমার মনে হলো তারপরও শামারোখের সঙ্গে একটা সম্পর্ক রক্ষা করতে পারব। কারণ, নিজেকে, সে যা নয়, তেমন দেখাতে চায় না। আমি অপেক্ষা করছিলাম, শামারোখ আগামী শুক্রবার এলে তার সঙ্গে নানা বিষয়ে কথাবার্তা বলা যাবে। একটা ব্যাপার তার সঙ্গে আমি স্পষ্ট করে নিতে চাই।ড. শরিফুল ইসলাম চৌধুরী তার চাকরির ব্যাপারটার সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে ফেলেছেন। আমি জানি, আমি নিতান্তই তুচ্ছ এবং আদনা মানুষ। এই আদনা মানুষটাকেই তিনি ঘুম থেকে জাগিয়ে অফিসে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন। তার ডিপার্টমেন্টে শামায়োখ যাতে না আসতে পারে, সেজন্য আমার সাহায্য কামনা করেছিলেন। নেহায়েত ঘটনাক্রমে বাংলা একাডেমীতে আমার সঙ্গে শামারোখের সাক্ষাৎ হয়েছিল। ওই সাক্ষাৎক্টাই আমার বিপদের কারণ হয়েছে। ড. শরিফুল ইসলাম চৌধুরী, ড. মাসুদের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঘা বাঘা কর্তা আমার শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছেন। এই সমস্ত মানুষ এলাকায় আমাকে আর কোনোদিন মাথা তুলতে দেবেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে আমাকে এমনভাবে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবেন, আত্মহত্যা করেও আমি আত্মরক্ষা করতে পারব না। এক কাজ করি না কেন, যে শামারোখের চাকরিকে কেন্দ্র করে আমার ওই দুর্গতির শুরু, শামারোখকে সেটা পাইয়ে দেবার লড়াইটা আমি করিনি কেন? সেটা আমার অযোগ্য কাজ হবে না। কিছু মানুষ আমার শত্রু হবে বটে, অধিকাংশই তারিফ করবে। বলবে, ছেলেটার বুকের পাটা আছে, সুন্দর মহিলার জন্য বিপদ ঘাড়ে নিতে একটুও ভয় পায় না। আমার দুর্বলতা এবং আমার শক্তির কথা আমি জানি। দুর্বুদ্ধি এবং কূটকৌশলে আমি পণ্ডিতদের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারব না। কিন্তু সাহস এবং ধৈর্যবলে এদের সবাইকে পরাজিত করতে পারি। মনে মনে স্থির করে নিলাম, শুক্রবারে শামারোখ এলে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে ঢুকিয়ে দেয়ার একটা সুরঙ্গ পথ তৈরি করার কলাকৌশল নিয়ে আলোচনা করা যাবে।

.

১৩.

শামারোখ শুক্রবার ঠিক বেলা তিনটের সময় আমার ঘরে এল। আমি ভেবেছিলাম সে চারটেয় আসবে। আজকে তার পোশাকের সামান্য পরিবর্তন দেখলাম। সে হাতের কনুই অবধি লম্বা ব্লাউজ পরেছে। চুলগুলো বেঁধেছে টেনে খোঁপা করে। তার দোল-দোলানো খোঁপাটা প্রতি পদক্ষেপে আন্দোলিত হচ্ছে। শামায়োখ যাই পরুক না কেন, তাকে সুন্দর দেখায়। রোদের ভেতর দিয়ে আসায় তার মুখটা লাল হয়ে উঠেছে। সে আমার তিনপায়া চেয়ারটা টেবিলে ঠেস দিয়ে বসতে বসতে বলল, বুঝলেন জাহিদ সাহেব, আপনার বিষয়ে একটা মাত্র পাস পয়েন্ট আমি আবিষ্কার করতে পেরেছি। নইলে আপনার সবটাই নেগেটিভ। আপনি একটা বিশ্রী ঘরে থাকেন। নোংরা জামা-কাপড় পরে ঘুরে বেড়ান। আর দেখতেও আপনি সুন্দর নন। আমি বললাম, নেগেটিভ দিকগুলো তো জানলাম। এখন প্লাস পয়েন্টটার কথা বলুন। সে বলল, আপনি শুনলে আবার চটে যাবেন না তো? বললাম, না চটব কেন? সে কপালের ঘাম ছোট রুমালে মুছে নিয়ে বলল, শুধু লিকার চিনি দিয়ে চা-টা আপনি এত ভাল বানান যে আপনার অন্যসব অপূর্ণতা ক্ষমা করে দিতে ইচ্ছে করে। আমি খুব খুশি হয়ে গেলাম। বললাম, আপনাকে কি এক কাপ বানিয়ে দেব? শামায়োখ বলল, আপনি হিটারে পানি গরম করতে থাকুন, আমি টয়লেটে গিয়ে হাত-মুখটা ধুয়ে আসি। আমি কেতলিটা পরিষ্কার করে হিটারটা জ্বালালাম। শামারোখ হাত-মুখ ধোয়ার জন্য টয়লেটে ঢুকল। টয়লেট থেকে বেরিয়ে বলল, হাত-মুখ মোছার মতো আপনার ঘরে কিছু আছে? আমি গামছাটা বাড়িয়ে দিলাম। সে হাত-মুখ মুছতে মুছতে বলল, এইমাত্র আপনার আরো একটা প্লাস পয়েন্ট আমি আবিষ্কার করলাম। আমি বললাম, বলে ফেলুন। শামারোখ বলল, আপনার টয়লেটটিও ভারি খড়খড়ে। একটু হাসলাম। চা-টা বানিয়ে তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। সে কাপটা হাতে তুলে নিয়ে বলল, আমার বইটা পড়েছেন? আমি বললাম, পড়তে চেষ্টা করেছি। কিছু বলবেন? হ্যাঁ আমার লেখাগুলোর ব্যাপারে কথা বলতেই তো এলাম। আমি বাক্স খুলে তার কবিতার খাতাটা হাতড়ে বের করলাম। শামারোখ চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল, এখন নয়, এখন নয়। এই বদ্ধ ঘরে, এমন গুমোট গরমের মধ্যে কি কবিতা আলোচনা চলে? রোদটা একটু পড়ক। আপনাকে নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়ে বসব। তখন কবিতা পড়ে শোনাব। আমার এক বন্ধুও আসবে।

শামায়োখ আমাকে নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাবে এবং কবিতা পড়ে শোনাবে শুনে ভেতরে ভেতরে খুবই উল্লসিত হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু তার একজন বন্ধুর আসার সংবাদে আমার উৎসাহে ভাটা পড়ে গেল। তবে শামারোখকে সেটা জানতে দিলাম না। সে আমার কাছে জানতে চাইল, আচ্ছা জাহিদ সাহেব, আপনি কি কাজ করেন? আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি জানেন না? সে জবাব দিল, আপনি তো আমাকে বলেন নি, জানব কেমন করে? আমি বললাম, পলিটিক্যাল সায়েন্স ডিপার্টমেন্টে রিসার্চ স্কলার হিসেবে নামটা রেজিস্ট্রেশন করেছি। এবং মাসে মাসে সামান্য স্কলারশিপ পেয়ে থাকি। শামারোখ চা শেষ করে কাপটা টেবিলে রাখল, তারপর বলল, আপনি এত ট্যালেন্টেড মানুষ হয়েও এমন পোকা বাছার কাজটি নিলেন কেন? আমি বললাম, আর কি করতে পারতাম, সংবাদপত্রের চাকরি? হঠাৎ করে শামারোখ জিজ্ঞেস করল, আপনার সিগারেট আছে? আমি একটুখানি হকচকিয়ে গেলাম, আপনি সিগারেট খান? সে বলল, কেন সিগারেট খেলে দোষ কি? গ্রামে দেখেন নি, মেয়েরা সবাই ঘরে হুঁকো টানে। আসলে আপনাদের পুরুষদের চিন্তাগুলো এমন একপেশেভাবে বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে, মনে করেন সবটাতেই আপনাদের একচেটিয়া অধিকার। আমি জবাব দিতে পারলাম না। পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে সবাই এমন উঠে পড়ে লেগেছে, মাঝে মাঝে মনে হয়, পুরুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করে মস্ত অপরাধ করে ফেলেছি। জন্মগ্রহণ করাটা যদি আমার ইচ্ছের ওপর নির্ভর করত, আমি নারী হয়েই জন্মগ্রহণ করতাম। ঘরে সিগারেট ছিল না। দোকানে গিয়ে এক প্যাকেট স্টার সিগারেট কিনে আনলাম। প্যাকেটটা খুলে তাকে একটা দিলাম এবং নিজে একটি ধরালাম। শামারোখ সিগারেটে টান দিয়ে খক খক করে কেশে ফেলল এবং কাশির বেগটা কমে এলে বলল, আপনি বাজে সিগারেট খান কেন? বললাম, আমার ক্ষমতা যা তাতে ওই স্টারই কিনতে পারি। শামারোখ আধপোড়া সিগারেটের বাটটি এ্যাশট্রেতে রাখতে রাখতে বলল, আমি আপনাকে এক কার্টন ভাল সিগারেট গিফ্ট করব। আমি বললাম, তারপর কি হবে? সে বলল, আপনি অমন করে কথা বলছেন কেন? আপনি আপনার দারিদ্র্য নিয়ে বড় বেশি বাড়াবাড়ি করেন। দারিদ্রকে গ্লোরিফাই করার মধ্যে মহত্ত্ব কিছু নেই।

আমি শামারোখকে কিছুতেই আসল বিষয়ের দিকে টেনে আনতে পারছিলাম না। যে কথাগুলো ভেবে রেখেছি কি করে তার প্রকাশ করা যায়, তার একটা উপলক্ষ সন্ধান করছিলাম। সে বার বার পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল। এভাবে কিছুক্ষণ কাটিয়ে দেয়ার পর আমি কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। শামারোখ জানতে চাইল, আপনি এখন লিখছেন না? আমি বললাম, লেখা আসছে না। বেশ কিছুদিন থেকে একটা নাটক লেখার কথা ভাবছি। বিষয়টা আমার মনে ভীষণ ধাক্কা দিচ্ছে। শামায়োখ বলল, আপনি কিছু মনে করবেন না, আমি পা দুটো আপনার বিছানায় একটু টেনে দিচ্ছি। তারপর পা দুটো প্রসারিত করে টেবিলের ওপর রাখল। কী সুন্দর ফরসা শামায়োখের পা। আমার ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছে প্রবল হয়ে উঠল। খুব কষ্টে সে ইচ্ছেটা দমন করলাম। সে বলল, আপনার নাটকের থিমটা বলুন দেখি। আমি বললাম, একটুখানি কমপ্লিকেটেড। গল্পটা আমি মডার্ন মাইন্ড’ বলে একটা। সাইকোলজিক্যাল রচনার সংকলনে পেয়েছি। শামারোখ বলল, বলে যান। আমি বলে যেতে লাগলাম: খোদা বক্স নামে একটি তরুণ ছাত্র কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে থার্ড ইয়ারে পড়ছিল। অত্যন্ত গরিব। একটি বাড়িতে খাওয়া-পরার জন্য তাকে জায়গির থাকতে হতো। সেখানে সে একটি মেয়েকে পড়াতো। মেয়েটি স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। মেয়েটির প্রতি খোদবক্সের মনে এক ধরনের উষ্ণ অনুরাগ জন্ম নিয়েছিল। খোদা বক্স একদিন কলকাতা ময়দানে একটি জাদুকরকে খেলা দেখাতে দেখে। জাদুকর শূন্য টুপি থেকে কবুতর উড়িয়ে দিল। ঘুঁটে থেকে তাজা গোলাপ ফুল বের করে আনল। এরকম আরো নানা আশ্চর্য জাদুর খেলা দেখার পর খোদা বক্সের মনে একটা বড় রকমের পরিবর্তন এল। সে চিন্তা করল অস্থি ঘেঁটে আর মড়া কেটে কি ফল? জাদু যদি না শিখতে পারি তো জীবনের আসল উদ্দেশ্যই মাটি হয়ে গেল। সে কাউকে কিছু না বলে জাদুকরের সাগরেদ হয়ে শহরে শহরে ঘুরতে আরম্ভ করল।

গল্প বলার মাঝখানে শামারোখ আমাকে থামিয়ে দিল, আপনি বলেছেন যে, সে এক বাড়িতে জায়গির থাকত। সে বাড়ির মেয়েটিকে ভালোবাসত। সেই মেয়েটির কি হলো? আমি বললাম, একটু অপেক্ষা করুন, বলছি। বলতে আরম্ভ করলাম । খোদা বক্স জাদুকরের সঙ্গে ভারতবর্ষের নানা শহর ঘুরতে ঘুরতে পেশোয়ার চলে এল। জাদুকরের কাছ থেকে সব খেলা শেখার পর বলল, আপনি এখন আমাকে আসল জাদু শেখান। জাদুকর বলল, আমার যা জানা ছিল সব শিখিয়ে দিয়েছি তোমাকে, আমি এর বেশি আর কিছু জানিনে। খোদা বক্স বলল, আপনি যা শিখিয়েছেন সব তো হাতের চালাকি। আমি আসল জাদু শিখতে চাই। জাদুকর বলল, আসল বলতে কিছু নেই। এই হাতের চালাকির ওপর দিয়েই জগৎ চলছে । খোদা বক্সের মন প্রতিবাদ করে উঠল। এত বিশাল জগৎ এর সবটা চালাকির ওপর চলতে পারে না। নিশ্চয়ই এক অদৃশ্য শক্তি এই জগৎকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমি সেই শক্তির সঙ্গে পরিচিত হব এবং সেই শক্তি আমার মধ্যে ধারণ করব। জাদুকর বলল, হীরের মতো কঠিন তোমার জেদ এবং আকাশস্পর্শী তোমার উচ্চাকাঙ্ক্ষা। তুমি হিমালয়ের জঙ্গলে গিয়ে সন্ধান করে দেখতে পার। প্রাচীনকালের জ্ঞানী মানুষদের খাঁটি শিষ্য এক-আধজনের সঙ্গে, ভাগ্য ভাল থাকলে, দেখা হয়েও যেতে পারে।

তারপর খোদা বক্স হিমালয়ের জঙ্গলে সন্ধান করতে আরম্ভ করল। অনেক সন্ন্যাসী-ফকিরের সঙ্গ করল। কিন্তু খোদা বক্সকে অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে এই সত্য মেনে নিতে হলো যে, তারা ঝুটা এবং জাল। সে আশা একরকম ছেড়েই দিয়েছিল। ভুটানের এক গুহায় সে একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর দেখা পেয়ে গেল। সন্ন্যাসী তার পিঠে হাত দিয়ে বলল, তুমি যা সন্ধান করছ, কারো কাছে পাবে না। তোমাকে নিজের ভেতর ডুব দিয়ে সে জিনিসটা বের করে আনতে হবে। তারপর খোদা বক্স কিছুটা তার মন থেকে এবং কিছুটা প্রাচীন যোগশাস্ত্রের সংস্কৃত পাণ্ডুলিপি ঘেঁটে ধ্যান করার একটা নতুন পদ্ধতি তৈরি করল। দীর্ঘদিন ধ্যান করে সে একটা আশ্চর্য শক্তির অধিকারী হয়ে গেল। এই শক্তিটা পুরোপুরি রপ্ত করার পর মানুষের সমাজে ফিরে আসে। তখন ওই শক্তির খেলা দেখিয়েই সে জীবিকা নির্বাহ শুরু করে। সে বিনা চোখে দর্শন করারও একটা পদ্ধতি বের করেছে। লোমকূপ দিয়েই খোদা বক্স সবকিছু দেখতে পায়। চোখ বেঁধে দেয়ার পরও সে গাড়ি-ঘোড়া-পূর্ণ জনাকীর্ণ রাজপথে সাইকেল চালিয়ে যেতে পারে। একটি বদ্ধ ঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে একটিমাত্র আঙুল বের করে বাইরে কি আছে বলে দিতে পারে। খোদা বক্সের বক্তব্য হলো, মানুষ লক্ষ লক্ষ বছর ধরে চোখকে দেখার কাজে ব্যবহার করে আসছে বলেই চোখ দিয়ে সে দেখতে পায়। একইভাবে মানুষ কানকে শোনার কাজে লাগিয়েছে। বলেই সে কান দিয়ে শুনতে পায়। আসলে মানুষের দেখার ক্ষমতা চোখে নয়, শোনার ক্ষমতা কানে নয়, ক্ষমতা ভিন্ন জায়গায় অধিষ্ঠান করেছে। যেমন পুলিশ চোর ধরে এটা পুলিশের ক্ষমতা নয়, সে একটা বিশেষ ক্ষমতার নির্দেশ পালন করছে। আমাদের গল্পের খোদা বক্সের সঙ্গে ওই বিশেষ ক্ষমতার পরিচয় হয়েছে । এতদূর পর্যন্ত শোনার পর শামারোখ বলল, বাহ ভয়ংকর কমপ্লিকেটেড এবং একেবারে ওরিজিন্যাল আইডিয়া। দিন, আপনার পচা সিগারেট আরেকটা। আমি সিগারেট ধরিয়ে দিলাম। শামারোখ টানতে থাকল। আমি বললাম, আমার কাহিনীতে এখনো শেষ হয় নি। শামারোখ বলল, বলে যান।

আমি বলে যেতে থাকলাম: ওই আশ্চর্য শক্তি অর্জন করার জন্যে খোদা বক্সকে চূড়ান্ত মূল্য দিতে হয়েছে। এখন খোদা বক্স ফুলের রঙ দেখতে পায় না, সঙ্গীত তার চিত্ত চঞ্চল করে না, শিশুর হাসি তার মনে সুখানুভূতি সৃষ্টি করে না, নারীর যৌবন তাকে উদ্দীপিত করে না। নিজের ভেতর আশ্চর্য শক্তি ধারণ করে ঈশ্বরের মতো একা বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করে। খোদা বক্সের এই যে সবরকমের অনুভূতির লুপ্তি ঘটল, এটাই হলো তার ট্র্যাজেডি। আসলে সে এখন আর মানুষ নেই। খোদা বক্সের কাহিনীর ভেতর দিয়ে আমি আধুনিক মানুষের জীবনের ট্র্যাজিক দিকটি তুলে ধরতে চাই। আধুনিক মানুষ তার জ্ঞাত-অজ্ঞাতসারে সেই আশ্চর্য শক্তির সন্ধান করে যাচ্ছে, ফলে সে আর মানুষ থাকছে না। শামারোখ তার বড় বড় চোখ দুটো মেলে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তার দৃষ্টি থেকে প্রশংসা ঝরে পড়ছে। সে বলল, সঠিক ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে গোটা বিষয়টা যদি পরিস্ফুট করে তুলতে পারেন, ফাউস্টের মতো একটা চমৎকার দৃষ্টান্ত তৈরি হবে। আমি বললাম, রাতের স্বপ্ন যদি দিবসে কোনোদিন আকার লাভ করে, হয়তো একদিন এই নাটক আমি লিখব । শামারোখ বলল, আপনি লিখতে পারেন-বা না পারেন সেটা পরের ব্যাপার। এরকম একটা উজ্জ্বল আইডিয়া আপনার মনে এসেছে, সে জন্যে আপনাকে আমি ধন্যবাদ জানাবো। এরপর আরেক কাপ চা হয়ে যাক। এবার আমিই বানাই। আমি বললাম, আমার হিটারটা অত্যন্ত খেয়ালি। অনভিজ্ঞ মানুষকে পছন্দ নাও করতে পারে। সুতরাং আমি রিস্ক নিতে পারব না। শামায়োখ বলল, আচ্ছা আপনি হিটারে পানি বসান, আমি কাপগুলো ধুয়ে নিয়ে আসি। শামারোখ বেসিনে কাপ ধুতে গেল ।

এই সময় আমার ঘরে একজন দীর্ঘকায় ভদ্রলোক প্রবেশ করে বললেন, আচ্ছা, এই ঘরে কি জাহিদ হাসান থাকেন? ভদ্রলোক চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলেন। দীর্ঘদিন বিলেত আমেরিকায় থাকলে বাঙালির উচ্চারণ পদ্ধতির মধ্যে যে একটা ধাতবতা জন্মায় এবং টেনে টেনে নাসিক্যধ্বনি সহকারে বাংলা বলেন, এই ভদ্রলোকের কথা বলার ঢঙে তার একটা আভাস পাওয়া গেল। আমি বললাম, আমার নামই জাহিদ হাসান। ভদ্রলোক এবারে আমার দিকে হাতের অর্ধেকটা বাড়িয়ে দিলেন। আমি বিরক্ত হলাম, তবু পাঁচ আঙুলের সঙ্গে করমর্দন করে বিলেত ফেরতের মর্যাদা রক্ষা করলাম। ভদ্রলোকের মেরুদণ্ডটি একেবারে সোজা, মনে হয় বাঁকাতে পারেন না। চোখ দুটো ঘোলা ঘোলা। তিনি তার ইঙ্গ-বঙ্গ উচ্চারণে জানালেন, আমার নাম সোলেমান চৌধুরী। আপনার এখানে শামারোখ বলে এক মহিলার আসার কথা ছিল, আমি তার খোঁজেই এসেছি। এই সময় কাপগুলো হাতে করে শামারোখ বেরিয়ে এল। সোলেমান চৌধুরীকে দেখে সে বলল, তোমার চিনতে অসুবিধে হয় নি তো? সোলেমান চৌধুরী বললেন, অসুবিধে হবে কেন, আমি কি ঢাকার ছেলে নই, চলো, সবাই অপেক্ষা করছে। শামারোখ বলল, এত গরমের মধ্যে যাব কোথায়? বসো, চা খাও, বেলা পড়ে আসুক। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাব এবং জাহিদ হাসান সাহেবকে আমার কবিতাগুলো পড়ে শোনাব। নিতান্ত অনিচ্ছায় সোলেমান চৌধুরী সাহেব আমার খাটে তার দামি নিতম্বের একাংশ স্থাপন করে বললেন, কবিতা পড়ে শোনাবে, তা হলে তো হয়েছে। আমার পুরনো মাথা ব্যথাটা আবার নতুন করে জেগে উঠবে। তোমার যখন মাথা আছে, ব্যথাও আছে এবং সে ব্যথা জেগেও উঠতে পারে, কিন্তু আমি জাহিদ সাহেবকে কবিতা না শুনিয়ে কোথায়ও যেতে চাইনে, একথা বলে শামারোখ চেয়ারটা টেনে বসতে গেল, অমনিই সে উল্টে মেঝের ওপর পড়ে গেল। আঘাতটা তার লেগেছে, যদিও সে মুখে কিছু বলল না, কিন্তু মুখের ভাবে সেটি প্রকাশ পেল। সোলেমান চৌধুরী শ্লেষ মিশিয়ে বললেন, কবিতা শোনাতে গেলে মাঝে মাঝে এমন আছাড় খেতে হয়। দুজনের বাদানুবাদের মধ্যে আমার বলার কিছু খুঁজে পেলাম না। অবশ্য আমার বুঝতে বাকি রইল না, ইনিই সেই সোলেমান চৌধুরী, যার কথা আবুল হাসানাত সাহেব আমাকে বলেছিলেন। শামারোখকে নিয়ে তিনিই হাসানাত সাহেবের কাছে চাকরির ব্যাপারে অনুরোধ করেছিলেন। শামারোখ একটা চমৎকার গোলাপ, কিন্তু তার অনেক কাঁটা কথাটা আমার মনে ছাঁৎ করে ভেসে উঠল। হাতে ময়লা লেগে যাবে এই ভয়ে অতি সন্তর্পণে সোলেমান চৌধুরী কাপটা হাতে নিয়ে আমার তৈরি আশ্চর্য চায়ে চুমুক দিয়ে কাপটা রেখে দিলেন। বুঝলাম তার রুচিতে আটকে যাচ্ছে।

আমরা চা খেয়ে হেঁটে হেঁটে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চলে এলাম । শরতের অপূর্ব সুন্দর বিকেল । ঝিরিঝিরি হাওয়া বইছে। চারপাশের প্রকৃতি জীবন্ত। যেদিকেই চোখ যায়, মনে হবে কোথাও শূন্যতা, কোথাও অপূর্ণতা নেই। সর্বত্র প্রাণ যেন তরঙ্গিত হয়ে উঠছে। আমরা উদ্যানের পুকুরের পশ্চিম দিকের পুকুর পাড়টির কাছে ঘাসের ওপর বসলাম। এত সুন্দর জাজিমের মতো নরম ঘাস যে আমার শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছিল। সোলেমান চৌধুরী ইতস্তত করছিলেন, তিনি জুতোর ডগা দিয়ে পরীক্ষা করে দেখছিলেন, ঘাসের তলা থেকে পানি-কাদা উঠে এসে তার প্যান্টটা ময়লা করে দেবে কিনা। অগত্যা তাকেও বসতে হলো। শামারোখ সোলেমান চৌধুরীকে বলল, এবার তুমি একটা সিগারেট জ্বালাও এবং একটু টেনে আমাকে দাও। সোলেমান চৌধুরী সিগারেট ধরালেন এবং শামারোখ কবিতার খাতাটার পাতা ওল্টাতে লাগল। তারপর চুলের গোছাটা টেনে পেছনে ফিরিয়ে কবিতা পড়ার জন্য প্রস্তুত হলো। তার মুখের ভাবেই সেটা বোঝা যাচ্ছে। সোলেমান চৌধুরী জ্বালানো সিগারেটটা শামারোশের হাতে ধরিয়ে দিল। সে তাতে কটা নিবিড় টান দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে কবিতা পড়তে আরম্ভ করল।

শামায়োখের কণ্ঠস্বরটি মার্জিত। উচ্চারণে কোনো জড়তা নেই। এত তন্ময় হয়ে পাঠ করে যে অভিভূত না হয়ে পারা যায় না। প্রতিটি পঙক্তি মনের ভেতর গেঁথে যায়। যেখানে আবেগ দেয়ার প্রয়োজন, সেখানে এমন সুন্দরভাবে এমন একটা গাঢ় আবহ সৃষ্টি করে, তার মাথায় হাত দিয়ে আদর করে দেয়ার ইচ্ছে জেগে ওঠে। কোনো কোনো অংশ পড়ার সময় তার স্বর জলতরঙ্গের মতো বেজে ওঠে। আমি নিজে নিজে যখন ওই কবিতাগুলো পাঠ করেছিলাম, তখন অনেক জায়গায় ছন্দের ভুল, এবং মাত্রায় বেশ-কম ধরতে পেরেছিলাম। কিন্তু শামারোখ যখন পড়ে গেল, মাত্রা দোষ এবং ছন্দের ভুল হয়েছে একথা একবারও মনে হলো না। একসঙ্গে পাঁচটি ছোট-বড় কবিতা পড়ল সে। আমি না বলে পারলাম না আপনার পড়ার ভঙ্গিটি এতই চমৎকার যে ছন্দের ভুল, মাত্রা দোষ এগুলো একেবারেই কানে লাগে না। শামারোখ বলল, আমার ছন্দ, মাত্রা এসব ভুল হয়, আমি জানি। এই বড় কবিতাটি যখন পড়ব আপনি দেখিয়ে দেবেন, কোথায় কোথায় ত্রুটি আছে। এবার সোলেমান চৌধুরী বললেন, শামারোখ, তুমি বড় কবিতাটাও পড়বে নাকি? শামারোখ বলল, অবশ্যই। সোলেমান চৌধুরী বললেন, তাহলে তো সন্ধ্যে হয়ে যাবে। আমার বন্ধুরা অপেক্ষা করে আছে। শামারোখ জবাব দিল, থাকুক, তোমার বন্ধুদের তো আর নতুন দেখছি নে। সোলেমান চৌধুরীও ক্ষেপে গিয়ে বললেন, তুমিও তো আর নতুন কবিতা পড়ছ না। এ পর্যন্ত কত মানুষকে শোনালে । শামারোখ জবাব দিল, আমার যত লোককে ইচ্ছে তত লোককে শোনাব। তোমার মাতাল বন্ধুদের কাছে রোজ রোজ হাজিরা দিতে আমার প্রাণ চায় না। তোমার তাড়া থাকে যাও। আমি জাহিদ সাহেবকে সবগুলো কবিতা পড়ে শোনাব। সোলেমান চৌধুরী উত্তেজনাবশত উঠে দাঁড়িয়ে শামারোখের দিকে কটমটে চোখে তাকালেন। তারপর এক পা এক পা করে চলে গেলেন। শামায়োখ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল ।

সোলেমান চৌধুরী তো চলে গেলেন। আমি চরম বেকায়দার মধ্যে পড়ে গেলাম। আমার মনে একটা অস্বস্তিবোধ পীড়া দিচ্ছিল। শামারোখ এবং সোলেমান চৌধুরীর সম্পর্কের রূপটা কেমন, সে বিষয়ে আমি বিশেষ জ্ঞাত নই। হাসানাত সাহেবের কথা থেকে শুধু এটুকু জানতে পেরেছি, বিলেতে সোলেমান চৌধুরী এবং হাসানাত সাহেব একই ফ্ল্যাটে থাকতেন। এই সোলেমান চৌধুরীই একবার শামারোখের চাকরির তদৃবির করতে হাসানাত সাহেবের কাছে এসেছিলেন। সোলেমান চৌধুরী এবং শামারোখের ভেতরকার সম্পর্কের ধরনটা কেমন, সেটা নিয়ে হাসানাত সাহেব কোনো কথা বলেন নি। মনে মনে আমি নানা কিছু কল্পনা করলাম। এমনও হতে পারে সোলেমান চৌধুরী শামারোখের বন্ধু। আবার নারী পুরুষের বন্ধুত্বেরও তো নানা হেরফের রয়েছে। বিয়ে না করেও হয়তো তারা একসঙ্গে একই ছাদের তলায় বাস করেছে। অথবা এমনও হতে পারে বিয়ে করবে বলে উভয়ের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা রয়েছে। দুজনের সম্পর্কের মাঝখানে আমি কেমন করে এসে গেলাম। এই কথাটা চিন্তা করে আমি মনে মনে ভীষণ কষ্ট পাচ্ছিলাম। আমি যদি এ জায়গায় না আসতাম, তাহলে দুজনের মধ্যে এমন একটা খাপছাড়া ব্যাপার ঘটতে পারত না। আমার সম্পর্কে সোলেমান চৌধুরী কি জানি ধারণা নিয়ে গেলেন। আমি তো আর বাচ্চা ছেলে নই। প্রথম থেকেই ভদ্রলোক যে আমাকে অপছন্দ করেছেন, সেটা বুঝতে কি বাকি আছে? ভদ্রলোক হাত মেলাবার সময় হাতের পাঁচটি আঙুল মাত্র বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। নিতান্ত অনিচ্ছায় তার মহামূল্যবান নিতম্বের একটি অংশমাত্র আমার খাটে রেখেছিলেন। মুখে দিয়েই আমার বানানো চায়ের কাপটি সরিয়ে দিয়েছিলেন। এই রকম একটি মানুষ, যিনি প্রতিটি ভঙ্গিতে আমার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছেন, তার সঙ্গে বিকেলবেলায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এলাম কেন? আমাকে এখানে না আনলে কি শামারোখের চলত না? ভদ্রমহিলা আমাকে নিয়ে কি করতে চান? আমি শামারোখের দিকে তাকালাম। সে চুপটি করে বসে আছে। মুখে কোনো কথা নেই। হাত দিয়ে টেনে টেনে পেছন থেকে চুলের গোছাগুলো মুখের ওপর ছড়িয়ে দিচ্ছে। কালো চুলে তার মুখের অর্ধেক ঢাকা পড়ে আছে। আলুলায়িতা শামারোখকে এই গোধূলিবেলায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পটভূমিকায় একটি সুন্দর ধাঁধার মতো দেখাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে আমার মনে একটা আতঙ্কের ভাব জাগল। এই মহিলা তার অপরূপ সৌন্দর্যের সঙ্গে জড়িয়ে আমাকে কোথায় টেনে নিয়ে যেতে চাইছে! হঠাৎ ঝালমুড়ি বিক্রেতা, সফট ড্রিঙ্কঅলা এবং অন্য হকারদের চিৎকারে আমাকে উঠে দাঁড়াতে হলো। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বিশেষ সুবিধের জায়গা নয়। এখানে যে-কোনো অঘটন যে-কোনো সময় ঘটে যেতে পারে। দশ বারোজন কিশোর চিৎকার করছে সাপ সাপ বলে এবং ইটের টুকরো, মাটির ঢেলা হাতের কাছে যা পাচ্ছে ছুঁড়ে মারছে। সাপের কথা শুনে আমার শিরদাঁড়া বেয়ে আতঙ্কের একটা শীতল স্রোত প্রবাহিত হলো। শামারোখকে বললাম, তাড়াতাড়ি উঠে আসুন। সে সামনের চুলগুলো পেছনে সরাতে সরাতে বলল, কেন কি হয়েছে? আমি বললাম, ফেরিঅলারা সাপ সাপ বলে চিৎকার করছে শুনতে পাচ্ছেন না। যেন কোথাও কিছু হয়নি, শামায়োখ এমনভাবে ধীরেসুস্থে উঠে দাঁড়িয়ে শাড়ি ঠিক করতে করতে বলল, অত ভয় পাচ্ছেন কেন? সাপতে অত্যন্ত সুন্দর জিনিস। তার ঠোঁটে একটা রহস্যময় হাসি খেলে গেল। ফিরিঅলারা ইট পাটকেল ছুঁড়তে ছুঁড়তে মার মার বলে এগিয়ে আসছে। আমরা পলায়মান সাপের মাথাটি দেখতে পেলাম। লিকলিকে শরীরটা ঘাসের জন্য দেখা যাচ্ছে না। মাথাটা অন্তত আধ হাত খানেক তুলে ধরে দ্রুতবেগে পালিয়ে প্রাণে বাঁচতে চাইছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঘনায়মান অন্ধকারেও দেখা গেল সাপের মাথা থেকে একটা সোনালি রেখা শিরদাঁড়ার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে। শরীরের রং ঘাসের মতো সবুজ। শামায়োখ অনুচ্চস্বরে চিৎকার করে উঠল, দেখছেন সাপটা কী সুন্দর! পিঠের ওপর সোনালি রেখাঁটি দেখেছেন? শামারোখ অবাক হয়ে ভয়তাড়িত সাপটাকে দেখছে। আমি তাকে হাত ধরে টানতে টানতে উদ্যানের বাইরে নিয়ে এলাম।

বাংলা একাডেমীর গোড়ায় এসে বললাম, কোথায় যাবেন বলুন, আপনাকে রিকশা ডেকে দিই। সে বলল, এক কাজ করুন, আমাকে আপনার হোস্টেলে নিয়ে চলুন। গল্প করে একটা রাত কাটিয়ে দেয়া যাবে। আমার মনে হলো, শামারোখ আমার সঙ্গে রসিকতা করছে। তাই আমি জানতে চাইলাম, আমি হোস্টেলে নিয়ে গেলে আপনি থাকতে পারবেন? সে বলল, কেন নয়, আমাকে তার চাইতেও আরো অনেক খারাপ জায়গায় রাত কাটাতে হয়েছে। আমি বললাম, আমাদেরটা ছেলেদের হোস্টেল, মহিলারা সেখানে থাকতে পারে না । শামারোখ ফের জিজ্ঞেস করল, আপনাদের হোস্টেলে রাতে কোনো মহিলা থাকতে পারে না? আমি বললাম, কোনো কোনো মহিলা লুকিয়ে চুরিয়ে থাকে কিন্তু তারা ভাল মহিলা নয়। তার ঠোঁটে আবার সেই রহস্যময় হাসিটা খেলে গেল, আমাকে আপনি ভাল মহিলা মনে করেন তাহলে? তার কথা শুনে ক্ষেপে গেলাম। আমি বললাম, আপনি ভাল কিংবা খারাপ, সে আপনার ব্যাপার, কিন্তু এখন যাবেন কোথায় বলুন, রিকশা ঠিক করে দিই। এবার শামারোখের উত্তপ্ত কণ্ঠস্বর শুনলাম, আপনার কি কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই? একজন ভদ্রমহিলাকে শুধু রিকশায় উঠিয়ে দিয়ে মনে করবেন মস্ত একটা দায়িত্ব পালন করেছি। ঢাকা শহরের রাস্তাঘাটের যা অবস্থা এই ভর সন্ধ্যেবেলা একেবারে একাকী কোথাও যাওয়ার জো আছে! রাস্তাঘাট চোর-ছ্যাচড় এবং হাইজাকারে ভর্তি। আমি তো মহা-মুশকিলে পড়ে গেলাম। ভদ্রমহিলাকে নিয়ে আমি কি করি! শেষ পর্যন্ত বলতে বাধ্য হলাম, আপনি বলে দিন, আমাকে এখন কি করতে হবে? শামারোখ আমার চোখে চোখ রেখে সেই রহস্যময় হাসি হাসল। তার ওই হাসিটি দেখলে আমার বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পেয়ে যায় । কি করব স্থির করতে না পেরে আচাভুয়োর মতো দাঁড়িয়ে রইলাম।

শামারোখ হাতের ইশারায় একটা রিকশা ডেকে চড়ে বসল। আমাকে বলল, আপনিও উঠে আসুন। আমার তো ভাবনা-চিন্তা লোপ পাওয়ার যোগাড়। আমতা আমতা করে বললাম, আপনার সঙ্গে আমি আবার কোথায় যাব? শামারোখের ধৈর্যচ্যুতির লক্ষণ দেখা দিল, আপনি তো কম ঘাউরা লোক নন। বলছি উঠে আসুন । অগত্যা উঠে বসতে বাধ্য হলাম। নিজেকে যথাসম্ভব সংকুচিত করে রিকশার একপাশে আড়ষ্ট হয়ে বসলাম। শামারোখ বলল, আপনাকে নিয়ে আর পারা গেল না, অমন চোরের মতো হাত-পা গুটিয়ে আছেন কেন? আমরা যে রিকশায় উঠেছি, তার খোলের পরিসর নিতান্তই সংকীর্ণ । যদি আমি শরীরটা মেলে দিই, শামারোখের শরীরে আমার শরীর ঠেকে যাবে। তার স্তনের সঙ্গে আমার কনুইয়ের সংঘর্ষ লেগে যাবে। রিকশা যখন চলতে আরম্ভ করল আমি শামারোখের শরীরের ঘ্রাণ পেতে আরম্ভ করলাম। হাল্কা হাওয়ার টানে এক ধরনের মৃদু সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ছিল । ফুরফুরে নরম এক ধরনের ইন্দ্রিয়-অবশ-করা সুগন্ধি মেখেছে শামারোখ । আমার খুবই ইচ্ছে করছিল, হাত দিয়ে তার অনাবৃত কাঁধ দুটো স্পর্শ করি, তার আন্দোলিত স্তন দুটো ছুঁয়ে দেখি। কিন্তু বাস্তবে ভিন্নরকম কাজ করে বসলাম । রিকশাঅলাকে বললাম, ভাই, একপাশে নিয়ে রিকশা দুমিনিট রাখবে? শামারোখ জিজ্ঞেস করল, কেন রাখবে রিকশা? আমি বললাম, সিগারেট জ্বালাবো। শামারোখ ঝংকার দিয়ে উঠল, এই আপনার সিগারেট খাওয়ার সময়? আমি বললাম, সিগারেট খেলে আপনার অসুবিধে হবে? সে তেমনি ঝঙ্কৃত গলায় বলল, আমার সুবিধে-অসুবিধের কথা আপনি কি বুঝবেন? ঠিক আছে জ্বালিয়ে নিন আপনার সিগারেট।

রিকশাঅলাকে কোথায় যেতে হবে সে কথা আমরা দুজনের কেউ বলিনি। শাহবাগের কাছাকাছি এসে সে জানতে চাইল, কোথায় যেতে হবে? আমি বললাম, মেম সাহেবের কাছে জেনে নাও। শামারোখ ধমকের স্বরে বলে বসল, মেম সাহেব ডাকলেন কেন? বললাম, কি ডাকতে হবে আপনি বলে দিন। সে বলল, আপনার সঙ্গে কথা বলে লাভ নেই। আপনি একটা গ্রামীণ কুষ্মাণ্ড, বোধশক্তি কিছুই জন্মায়নি। আমি হেসে উঠতে চাইলাম, এতক্ষণে ঠিক করে ফেলেছেন, আমি একটা গ্রামীণ কুণ্ডই বটে। শামারোখ বলল, ঢের হয়েছে, আর পাকামো করবেন না। রিকশাঅলাকে বলল, ভাই গ্রিন রোড চলল।

রিকশা যখন এলিফেন্ট রোড ছাড়িয়ে যাচ্ছে শামারোখ আমার গায়ে আঙুলের গুতো দিয়ে বলল, সব ব্যাপারে তো আপনার হে হে করার অভ্যেস। মহিলার কথা শুনে আমার পিত্তি জ্বলে গেল। বললাম, আপনার সঙ্গে এক রিকশায় যাওয়া আমার সম্ভব হবে না। রিকশাঅলাকে বললাম, ভাই আমাকে এখানে নামিয়ে দিয়ে যাও। শামারোখ আমার হাত দুটো ধরে ফেলে বলল, নামতে চাইলেই কি নামা যায়? আপনি তো অদ্ভুত মানুষ। একজন ভদ্রমহিলাকে রাস্তার মাঝখানে ছেড়ে দিয়ে বললেই হলো, আমি চলোম। আশ্চর্য বীরপুরুষ। আমি বললাম, আপনার সঙ্গে আমার বনছে না, সুতরাং আমার নেমে যাওয়াই উচিত। ভদ্রমহিলা বললেন, আমার কথা শুনুন, তবেই বনবে। আমি বললাম, বলুন আপনার কথা। সে বলল, যে বাড়িতে যাচ্ছি ওরা হচ্ছে এমন মানুষ, যাদেরকে বলা যায় ফিলথিলি রিচ। টাকা ছাড়া কিছু বোঝে না। সুতরাং আপনার পরিচয় করিয়ে দেয়ার সময় বলব আপনার বাবার তিন কোটি টাকার সম্পত্তি আছে, সাহিত্যচর্চা করেন বলেই এমন ভাদাইমার মতো থাকেন। আমি চিন্তাও করতে পারছিনে, মহিলা আমাকে কোন্ ফাঁদে জড়াচ্ছেন! আমি বললাম, আমার বাবাও নেই, টাকাও নেই। আপনি আমাকে তিন কোটি টাকার মালিকের পুত্র এই পরিচয় দেবেন কেন? শামারোখ জবাব দিল, আপনি আমার সঙ্গে এক রিকশায় যাচ্ছেন, আমার একটা ইজ্জত আছে না? সুন্দরী মহিলার সঙ্গে এক রিকশায় চড়ে এই এতদূর এসেছি, তার শরীরের ঘ্রাণে বুকের বাতাস পর্যন্ত আলোড়িত হয়ে উঠেছে, শরীরের স্পর্শে সুপ্ত সব বাসনা জেগে উঠেছে। এই মহিলা আমাকে বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়ে জল্লাদের হাতে তুলে দিতে চাইলেও আমি অমত করার মতো কিছু পেলাম না। যা আছে কপালে ঘটবে।

রিকশাটা এসে গ্রিনরোডের একটা বাড়ির সামনে দাঁড়ালো। জমকালো বাড়ি। বদ্ধ গেটের সামনে একজন বুড়োমতো দারোয়ান টুলের ওপর বসে আছে। শামারোখকে দেখে দারোয়ান অত্যন্ত সম্ভ্রমের সঙ্গে উঠে দাঁড়ালো, বেগম সাহেবা আপনি? শামারোখ জিজ্ঞেস করল, আদিল সাহেব আছেন? দারোয়ান বলল, জি। ভেতরে ঢুকে দেখলাম, বাড়ির প্রাঙ্গণে লোহার রড এবং বালুর স্তূপ। দুখানি বড়সড় ট্রাক একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। এতসব লোহালক্কড় পেরিয়ে আমরা বাড়ির সামনে চলে এলাম। শামারোখ কলিংবেল চাপ দিতেই দরজা খুলে গেল। দোহারা চেহারার একজন ফরসাপনা ভদ্রলোক সামনে দাঁড়িয়ে। শামায়োখকে দেখে ভদ্রলোক উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন, আরে আরে শামারোখ, এতদিন পরে, পথ ভুলে এলে নাকি? শামারোখের পেছন পেছন আমিও ড্রয়িংরুমে পা রাখলাম। আমাকে দেখামাত্রই ভদ্রলোকের উচ্ছ্বাস আপনা থেকেই থেমে গেল। জানতে চাইলেন, ইনি কে? শামারোখ বলল, উনার কথা পরে বলছি, বাড়িতে ফরিদা আপা আছেন? ভদ্রলোক বললেন, হ্যাঁ আছে। শামারোখ বলল, চলুন তার সঙ্গে আগে দেখা করি। ভদ্রলোকের পেছন পেছন শামারোখ সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে আরম্ভ করল। আমাকে বলল, জাহিদ সাহেব, আপনি একটু অপেক্ষা করবেন, আমি ওপর থেকে আসি।

ড্রয়িংরুমে বসে আমি একটা সিগারেট জ্বালালাম। এই বাড়ির সমস্ত কিছুতে কেবলই টাকার ছাপ, চোখে না পড়ে যায় না। সোফাসেটগুলো বড় এবং মোটাসোটা। দেয়ালে আট-নয়টা ফ্রেমে বাঁধানো ছবি । মনে হলো ওগুলো কোনো বিদেশী ক্যালেন্ডার থেকে কেটে বাঁধানো হয়েছে। একপাশে আরবিতে আল্লাহ এবং মুহম্মদ লেখা ক্যালিগ্রাফি। অন্যদিকে কাবাশরিফের আদ্ধেক দেয়াল জোড়া একটা ছবি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এই ছবিগুলো দেখলেই বাড়ির মালিকের রুচির একটা পরিচয় পাওয়া যাবে। বিদেশী ক্যালেন্ডার থেকে কেটে নেয়া অর্ধনগ্ন নারীদের ছবি গৃহস্বামী যেমন পছন্দ করেন, তেমনি ধর্মকর্মেও তার মতি। আল্লাহ, মুহম্মদ এবং কাবাশরিফের অর্ধেক দেয়ালজোড়া সোনালি ফ্রেমে বাঁধাই ছবি থেকে তার পরিচয় মেলে। ঘরের যেদিকেই তাকাই, মনে হচ্ছিল, সবখানে কাঁচা টাকা হুংকার দিচ্ছে। এই ধরনের পরিবেশের মধ্যে এসে আমি ভয়ানক অসহায়বোধ করতে থাকি। আমার অস্তিত্বের অর্থহীনতা বড় বেশি পীড়ন করতে থাকে। এই ঘরের হাওয়ার মধ্যে এমন কিছু আছে, যা আমার স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়ার মধ্যে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। আরেকটা সিগারেট ধরাবো কিনা চিন্তা করছিলাম। এমন সময় দেখি সেই দোহারা ভদ্রলোক ওপর থেকে নেমে এসে আমার উল্টোদিকের সোফায় বসলেন। তারপর আমার চোখ-মুখের দিকে খুব ভাল করে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার নাম? জবাব দিলাম, জাহিদ হাসান। ভদ্রলোক মনে হয় একটি

কুটি করলেন। আমার মনে হলো নামটা তার পছন্দ হয় নি। তারপর তিনি জানতে চাইলেন, কোথায় থাকি? বললাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ওখানে কি করেন? আমি বললাম, একজন রিসার্চ ফেলো। ভদ্রলোক এবার আরো নাজুক একটা প্রশ্ন করে বসলেন, শামায়োখের সঙ্গে আপনার কি সম্পর্ক? আমি মনে মনে একটুখানি সতর্কতা অবলম্বন করলাম। শামারোখ আসার সময় রিকশায় আমাকে বলেছিল, এই বাড়িতে আমার বাবা যে তিন কোটি টাকার মালিক আমার এই পরিচয় প্রকাশ করবে। মনে হলো, ভদ্রলোক প্রশ্ন করে আমি সত্যি সত্যি তিন কোটি টাকার মালিকের ছেলে কিনা, সেই জিনিসটি যাচাই করে নিতে চাইছেন। এবার আমি ভাল করে ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম। তার মাথার সবগুলো চুল পেকে যায়নি আবার চুল কাঁচাও নেই। তার গলার ভাঁজের মধ্যে তিনটি সাদা রেখা দেখতে পেলাম। বুঝতে পারলাম ভদ্রলোক নিয়মিত ঘাড়ে-বগলে এবং গলায় পাউডার মেখে থাকেন। গলার মধ্যে সাদা তিনটি রেখা, ওগুলো পাউডারেরই দাগ। আমি এবার ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়েই জবাব দিলাম, শামারোখ আমার বন্ধু। তিনি ফের জানতে চাইলেন, কি ধরনের বন্ধু? আমি বললাম, কি ধরনের বন্ধু বললে আপনি খুশি হবেন?

এই সময় পর্দা ঠেলে শামারোখ ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করল। তার হাতে একটি ট্রে । ট্রেতে চায়ের সরঞ্জাম এবং প্লেটে দুটো রসগোল্লা আর দুখানা নিমকি। আমি বললাম, এককাপ চা ছাড়া কিছুই খাব না। কারণ এখনই হোস্টেলে ফিরে ভাত খেতে হবে। শামারোখ আমাকে চা বানিয়ে দিল। আমি চায়ে চুমুক দিতে থাকলাম। সে রসগোল্লা এবং নিমকির প্লেটটা সেই দোহারা চেহারার ভদ্রলোকের সামনে বাড়িয়ে ধরে বলল, আদিল ভাই এগুলো আপনিই খেয়ে ফেলবেন। ভদ্রলোক অত্যন্ত জোরের সঙ্গে জানালেন, আমি মিষ্টি খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। কিছুদিন হয় ডায়াবেটিসের লক্ষণ দেখা দিয়েছে। তারপর কথাটা ঘুরিয়ে নিতে চেষ্টা করলেন, মানে ডাক্তার বলছিলেন, সময়-অসময়ে মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিস হয়ে যেতে পারে। তাই আগে থেকে সতর্কতা অবলম্বন করছি। আমার মনে হলো, ভদ্রলোকের ডায়াবেটিস হয়েছে, কিন্তু সেটা শামারোখের কাছ থেকে গোপন করতে চান।

আমি চা শেষ করে উঠে দাঁড়ালাম। ভদ্রলোক সম্পর্কে আমার মনে একটা বিশ্রী ধারণা জন্ম নিয়েছে। আসার সময় তাকে ভদ্রতা দেখাবার কথাও ভুলে গেলাম। শামারোখ আমার পেছন পেছন গেট অবধি এল। সে জানালো, আজকের রাতটা সে– এখানেই কাটাবে। কারণ আদিল ভাইয়ের স্ত্রী ফরিদা আপা তাকে খুবই স্নেহ করেন। দেখা দিয়েই চলে গেলে ফরিদা আপা ভীষণ রাগ করবেন। তারপর আমাকে বলল, পরশুদিন বিকেলবেলা আমি যেন তাদের বাড়িতে যাই। আমার সঙ্গে তার নাকি অনেক কথা আছে। সে একটা ভাজ করা কাগজ আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল এর মধ্যে ঠিকানা লেখা আছে। গেটের বাইরে চলে এসেছি। শামায়োখ আবার আমাকে ডেকে বলল, শান্তিনগর বাজারে গিয়ে আবুলের হোটেলের তালাশ করবেন। হোটেলের বাঁ দিকের গলিতে আমাদের বাড়ি। গ্রিন রোডের সেই বাড়ি থেকে আসার পর আমি মস্ত দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়ে গেলাম। শামায়োখের সঙ্গে সোলেমান চৌধুরীর সম্পর্কের ধরনটা কি? সেদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে রাগারাগি করে তিনি চলেও বা গেলেন কেন? শামারোখ আমাকে গ্রিনরোডের বাড়িটায় নিয়ে গেল কেন, আমার বাবা তিন কোটি টাকার মালিক- ও-বাড়িতে এই পরিচয়ই-বা দিতে হবে কেন? আমার মনে হচ্ছে আমি একটা অদৃশ্য জালের মধ্যে জড়িয়ে যাচ্ছি। একাধিকবার এ চিন্তাও আমার মনে এসেছে। কোথাকার শামায়োখ, কদিনেরই-বা পরিচয়, এখনো তাকে ভাল করে জানিনে-শুনিনে, তার ব্যাপারের মধ্যে আমি জড়িত হয়ে পড়ছি কেন? আমার কি লাভ? বেরিয়ে আসতে চাইলেই পারি। কিন্তু আসব কেন? অজগরের শ্বাসের মধ্যে কোনো প্রাণী যখন পড়ে যায় এবং আস্তে আস্তে চরম সর্বনাশের দিকে ছুটতে থাকে, আমার রক্তের মধ্যেও সর্বনাশের সে রকম নেশাই এখন কাজ করতে আরম্ভ করেছে।

.

১৪.

দুদিন পর শান্তিনগরে শামারোখদের বাড়িতে গেলাম। বাড়ি চিনে নিতে বিশেষ কষ্ট হয়নি। আবুলের হোটেলের সামনের পানের দোকানটিতে যখন জিজ্ঞেস করলাম, দোকানদার আমার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়েই বলল, যে বাড়িতে তিনজন সুন্দরী। মাইয়া মানুষ আর একটা বুইড়া মানুষ থাকে, হেই বাড়ি তালাশ করতাছেন? নাক বরাবর সিধা যাইবেন, তারপর বামে ঘুইরবেন, গেইটের সামনে দেখবেন একটা জলপাই গাছ, সেই বাড়ি। জলপাই গাছ দেখে আমি ভেতরে ঢুকলাম। এক বিঘের মতো জমির মাঝখানে একটা ছোট একতলা ঘর। আর জমির চারপাশে বাউন্ডারি দেয়াল দেয়া আছে। একপাশে তরিতরকারির বাগান। এক ভদ্রমহিলা প্লাস্টিকের পাইপ দিয়ে পানি দিচ্ছেন। অনিন্দ্যসুন্দরী মহিলা, চোখ ফেরানো যায় না। মুখমণ্ডলটা ভাল করে তাকালে শামায়োখের সঙ্গে একটা মিল খুঁজে পাওয়া যাবে। এই ধরনের ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা বলতে গেলে হঠাৎ করে মুখ দিয়ে আওয়াজ বেরিয়ে আসতে চায় না। আমি ডান হাতটা তুলে সালাম দেয়ার ভঙ্গি করলাম। ভদ্রমহিলা আমার দিকে মুখ তুলে তাকালে আমি জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা এটা কি শামারোখদের বাড়ি? মহিলা কথা শুনে বিরক্ত হলেন মনে হলো। আঙুল দিয়ে সামনের দরজা দেখিয়ে বললেন, ওদিক দিয়ে ঢোকেন।

ঘরের দরজা খোলা ছিল। আমি জুতো না খুলেই ভেতরে প্রবেশ করলাম। দেখলাম একেবারে সাধারণ একটি তক্তপোশের ওপর একজন প্রবীণ ভদ্রলোক ঝুঁকে পড়ে কি সব লিখছেন। চারপাশে ছড়ানো অজস্র ধর্মীয় পুস্তক। ভদ্রলোকের মুখের দাড়ি একেবারে বুকের ধার অবধি নেমে এসেছে এবং সবগুলো পেকে গেছে। ভদ্রলোককে আমি সালাম দিলাম। তিনি হাত তুলে আমার সালাম নিলেন এবং কড়া পাওয়ারের চশমার ভেতর দিয়ে আমার আপাদমস্তক ভাল করে লক্ষ্য করলেন। ভদ্রলোক খুবই নরম জবানে জানতে চাইলেন, আমি কেন এসেছি? আমি বিনয় সহকারে বললাম, শামারোখ আমাকে আসতে বলেছিল। এবার ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে খুব সুন্দর করে হাসলেন। গামছা দিয়ে ঝেড়ে একটা কাঠের চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বললেন, বসুন। আমি বসলাম। কিন্তু বাড়ির ভেতরে শামায়োখের উত্তপ্ত চিৎকার শুনতে পেলাম। আরেক মহিলার সঙ্গে শামায়োখ চেঁচিয়ে ঝগড়া করছে। দুজনে কেউ কাউকে ছেড়ে কথা কইছে না। এমন সব খারাপ শব্দ তাদের মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে, শুনলে কানে আঙুল দেয়ার প্রয়োজন হয়। ভদ্রলোক টুলু টুলু বলে কয়েকবার ডাকলেন। ঝগড়ার আওয়াজের মধ্যে ভদ্রলোকের ডাক চাপা পড়ে গেল। আমার দিকে তাকিয়ে করুণ হাসি হেসে বললেন, আজ সকালবেলা থেকে আমার মেয়ে এবং পুত্রবধূ তুমুল ঝগড়াঝাটি করছে। এই প্রচণ্ড চিল্কারের মধ্যেও ভদ্রলোককে নির্বিকার পড়াশোনা করে যেতে দেখে আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি লিখছেন? তার চোখে-মুখে একটা লজ্জার আভাস খেলে গেল। বললেন, আমি কোরআন শরিফের ইয়াসিন সুরাটা বাংলায় অনুবাদ করার চেষ্টা করছি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি আরবি জানেন? তিনি বললেন, এক সময় তো ভালই জানতাম। পঁচিশ বছর সরকারি চাকরি করেছি। ভাবছিলাম রিটায়ার করার পর শান্তমনে আল্লা-রসুলের কাজ করব। তা আর হচ্ছে কই! সব সময় অশান্তি। দেখছেন না মেয়ে এবং ছেলের বউ কিভাবে ঝগড়া করছে। ভদ্রলোককে আমার মরুভূমির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা মসজিদের নির্জন গম্বুজের মতো মনে হলো। ভদ্রলোক অনুবাদের কিছু অংশ আমাকে দেখালেন। পড়তে আমার বেশ লাগল। তিনি বললেন, কোরআনের ভাষা-রীতির মধ্যে একটা কবিত্ব আছে। সেই জিনিসটা ফুটিয়ে তুলতে না পারলে অনুবাদ সঠিক হয় না। আমি ভাষার অর্থটা বুঝি, কিন্তু সুপ্ত কবিত্ববোধটুকু বাংলা ভাষায় আনতে পারিনে, আল্লাহ আমাকে সে শক্তি দান করেন নি।

তরকারি বাগানে যে ভদ্রমহিলা পানি দিচ্ছিলেন, তিনি এসে বললেন, আল্লুজান, আজ বিকেলে আমি মেজো আপার কাছে চলে যাচ্ছি। এই জাহান্নামের মধ্যে আমার থাকা সম্ভব হবে না। ভদ্রলোক বললেন, আজ বিকেলেই যেতে চাও? তিনি বললেন, হা। ভদ্রলোক বললেন, আচ্ছা। ভদ্রমহিলা কেঁদে ফেললেন, তার আয়ত চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল, আপনি যে যাই করুক সব সময়ে আচ্ছা বলে পাশ কাটিয়ে যান। আম্মাজান বেঁচে থাকলে এরকম আচ্ছা বলে চোখ বন্ধ করে থাকতে পারতেন? ভদ্রলোক কোনোরকম উচ্চবাচ্য না করে চুপ করে রইলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার ছোট মেয়ে বানু।

ভেতরের ঘর থেকে আর কোনো আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না। মনে হয় দুজনেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আমি চলে আসব কিনা চিন্তা করছিলাম। শামারোখের বাবা বললেন, আপনি একটু বসুন, আমি ভেতরে গিয়ে দেখে আসি কি অবস্থা। ভদ্রলোক ভেতরে গেলেন। অতর্কিতে শামায়োখ বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে বলল, এই যে জাহিদ সাহেব, কখন এসেছেন? সহসা আমি কোনো কথা বলতে পারলাম না। শামারোখকে এই অবস্থায় না দেখলে আমাদের দুজনের জন্যই ভাল হতো। শামারোখ বলল, আপনি এসেছেন, খুবই ভাল হয়েছে। আমাকে থানায় নিয়ে চলুন। আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম, থানায় কেন? শামারোখ তার ডান বাহুটা আমার সামনে তুলে ধরে দেখালো, দেখছেন, হারামজাদি কামড়ে আমার কি দশা করেছে। আমি দেখলাম শামায়রাখের সুন্দর বাহুর মাংসের ওপর মনুষ্য দন্তের ছাপ। মাংস কেটে ভেতরে প্রবেশ করেছে এবং দরদর করে রক্ত বেরিয়ে আসছে। আমি কি করব ঠিক করে উঠতে পারলাম না। বললাম, বাড়িতে ডেটল জাতীয় কিছু থাকলে লাগিয়ে আগে রক্তপাত বন্ধ করুন। শামারোখ বলল, না, না, রক্তপাত বন্ধ করলে থানা কেস নিতে চাইবে না। আগে হারামজাদিকে অ্যারেস্ট করাই, তারপর অন্য কিছু।

শামায়োখের ছোট বোন বানু এসে আমাকে সরাসরি বলল, আমাদের বাড়ির ব্যাপারে আপনি নাক গলাবার কে? আমার বোন, আমার ভাবির সঙ্গে ঝগড়া করেছে, সেও আমার চাচাতো বোন। আমাদের পারিবারিক ব্যাপারে আপনি বাইরে থেকে এসে বাগড়া দেবার কে? বানুর কথায় কোনোরকম কান না দিয়ে আমি শামায়োখকে নিয়ে আমার এক পরিচিত ডাক্তারের ডিসপেনসারিতে ছুটলাম।

শামারোখ আমাকে মস্ত একটা গোলক ধাঁধার মধ্যে ছুঁড়ে দিয়েছে। তার ব্যাপারে আমি কোনো ধারণা নির্মাণ করতে পারছি নে। তার কবিতা পড়ে মনে হয়েছে সে খুবই অসহায় এবং দুঃখী মহিলা। এই দুঃখবোধটাই তার কবিতায় অগ্নিশিখার মতো উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে ওঠে। প্রস্ফুটিত পদ্মফুলের পাপড়িতে শেষ রাতের ঝরে-পড়া শিশিরের মতো সূর্যালোকে দীপ্তিমান হয়। তার মুখমণ্ডলের অমলিন সৌন্দর্যের প্রতি যখন দৃষ্টিপাত করি, পিঠময় ছড়িয়ে পড়া কালো কেশের দিকে যখন তাকাই, যখন নিশি রাতের নিশ্বাসের মতো তার আবেগী কবিতা পাঠ শ্রবণ করি, আমার মনে ঢেউ দিয়ে একটা বাসনাই প্রবল হয়ে জেগে ওঠে, এই নারীর শুধু অঙ্গুলি হেলনে আমি দুনিয়ার অপর প্রান্ত পর্যন্ত ছুটে যেতে পারি।

এই সময়ের মধ্যে শামায়োখের বিষয়ে আমার কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতাও হয়েছে। শামারোখ আমার ঘরে সোলেমান চৌধুরীকে নিয়ে এসেছিল। এই চৌধুরীর সঙ্গে আমাকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত যেতে হয়েছে এবং একসঙ্গে বসে শামারোখের কবিতা পাঠ শুনতে হয়েছে। শামারোখ এবং সোলেমানের সম্পর্কটি কি ধরনের? শামায়োখ যদি আমাকে টেনে না নিত, এই ধরনের নাসিক্য উচ্চারণে কথা বলা বঙ্গীয় ইংরেজের সঙ্গে কখনো আমি সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অবধি যেতাম না। তারপর শামারোখ আমাকে কি কারণে সেই গ্রিন রোডের উদ্ধত অর্থবান আদিলের বাড়িতে নিয়ে গেল, তাও আমার বোধবুদ্ধির সম্পূর্ণ বাইরে। একবার সোলেমান, একবার আদিল, এই ধরনের মানুষদের সামনে শামারোখ আমাকে উপস্থিত করছে কেন? তার কি কোনো গোপন মতলব আছে? মাঝে মাঝে মনের কোণে একটা সন্দেহ কালো ফুলের মতো ফুটে উঠতে চায়। শামারোখ আমাকে এসব মানুষকে আটকাবার জন্য টোপ হিশেবে ব্যবহার করতে চায় কিনা।

শামারোখদের শান্তিনগরের বাড়িতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হলো, তাতে মহিলার মানসিক সুস্থতার ব্যাপারে আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে। ক্যামব্রিজ থেকে পাস করে আসা একজন মহিলা কী করে তার আপন ভাইয়ের বউয়ের সঙ্গে জন্তুর মতো কামড়াকামড়ি করে থানা-পুলিশ করার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করতে পারে! মনে মনে ভেবে দেখতে চেষ্টা করি, এই মহিলা আমাকে কতদূর নিয়ে যেতে পারে। এই দুই বিপরীতমুখী ভাবনায় আমার ভেতরটা দুটুকরো হয়ে যাচ্ছে।

শামারোধের মুখটা যখন আমার স্মরণে আসে, সমগ্র শরীরের মধ্য দিয়ে একটা আবেগ প্রবাহিত হয়। আমি থর থর করে কেঁপে উঠতে থাকি। আমার ইচ্ছে হয়, এই সুন্দর নারী, প্রতি চরণপাতে যে পুষ্প ফুটিয়ে তোলে, তার জন্য জীবন মনপ্রাণ। সবকিছু উজাড় করে দিই। আবার যখন তার বিবিধ অনুষঙ্গের কথা চিন্তা করি এক ধরনের বিবমিষা আমার সমস্ত চেতনা আচ্ছন্ন করে ফেলে। এই মহিলাকে প্রাণের ভেতরে গ্রহণ করা যেমন অসম্ভব, তেমনি প্রাণ থেকে ডালেমূলে উপড়ে তুলে বিষাক্ত আগাছার মতো ছুঁড়ে ফেলাও ততধিক অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তার সম্পর্কে চোখ বন্ধ করে চিন্তা করলে কখনো অনুভব করি সে অমৃতের পেয়ালা হাতে দাঁড়িয়ে আছে, আবার কখনো মারাত্মক প্লেগের জীবাণুর মতো অস্পৃশ্য মনে হয়। এই দোলাচলবৃত্তির মধ্যেই আমি দিন অতিবাহিত করছিলাম।

.

১৫.

আমার গ্রামের এক ভদ্রলোকের সঙ্গে বায়তুল মোকাররম গিয়েছিলাম। ভদ্রলোক গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছে। পরিবার-পরিজনের কাপড়-চোপড় কেনার জন্য আমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন। বাজার থেকে কাপড়-চোপড় কেনার কাজটি আমি অপছন্দ করি। অথচ মানুষ সেই অপছন্দের কাজটি করার জন্য আমাকে বার বার ধরে নিয়ে যায়। এ-দোকান সে-দোকান ঘুরে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। ঘোরার চাইতে পাঁচমিশেলি মানুষের ভিড়ই হয়রান করেছে বেশি। গ্রামের ভদ্রলোককে বিদেয় করার পর ভাবলাম, যাক বাঁচা গেল!

আমি বায়তুল মোকাররমের সামনে এসে মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিলাম। সন্ধ্যের বাতি জ্বলে উঠেছে। গাড়ি-ঘোড়ার আওয়াজ, মানুষের আওয়াজ, বিচিত্র বর্ণের আলোর উদ্ভাস সবকিছু মিলিয়ে আমার মনে হলো, সন্ধ্যেবেলার ঢাকা যেন ভূতপ্রেতের বাগানবাড়ি। এখানে সবকিছুই ভুতুড়ে। আমি পথ দিয়ে হেঁটে আসছিলাম। একা একা পথ চলার সময় মনে নানারকম ভাবনার উদয় হতে থাকে। জেনারেল পোস্টাফিস ছাড়িয়ে আমি আব্দুল গনি রোডে চলে এলাম। এই রাস্তাটিতে রিকশা চলে না। সুতরাং অল্পস্বল্প ফাঁকা থাকে। হঠাৎ করে পেছন থেকে কে একজন আমার শরীরে হাত রাখল। আমি চমকে উঠলাম। হাইজ্যাকারের পাল্লায় পড়ে গেলাম না তো! এ মাসের স্কলারশিপের পুরো টাকাটা এখনো আমার পকেটে। যদি নিয়ে যায় সারা মাস আমার চলবে কেমন করে? পেছনে তাকিয়ে দেখি অর্থনীতি বিভাগের প্রফেসর তায়েবউদ্দিন সাহেব। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন। অদূরে তার সাদা ফিয়াটখানা দাঁড়িয়ে। তিনি বললেন, কি ভায়া, তোমার ভাবনার ব্যাঘাত ঘটালাম নাকি? বেশ হেলতে-দুলতে যাচ্ছে একাকী। আমি একটুখানি লজ্জিত হলাম। বললাম, না স্যার, এই সন্ধ্যেবেলায় এই ফাঁকা রাস্তায় হাঁটতে ভাল লাগে। তিনি বললেন, তুমি তো আবার ভাবুক মানুষ। গাড়িতে উঠতে বললে রাগ করবে? আমি বললাম, রাগ করব কেন স্যার। আমি গাড়ির পেছনে বসতে যাচ্ছিলাম। তায়েবউদ্দিন সাহেব তার পাশের সিটটি দেখিয়ে বললেন, এখানেই বসো, কথা বলতে সুবিধে হবে। গাড়ি চলতে আরম্ভ করল। তিনি বনানীর স্কাইলার্ক রেস্টুরেন্ট-কাম বারের গেটের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে বললেন, তোমাকে পেয়ে খুবই ভাল হলো। আজকে তোমার সঙ্গেই চুটিয়ে আড্ডা দেব। এত ব্যস্ত থাকতে হয় শিল্প-সাহিত্য সম্বন্ধে কোনো খবরাখবর রাখাই সম্ভব হয় না। তোমার মুখ থেকেই এ বিষয়ে কিছু শুনব। প্রফেসর তায়েবউদ্দিন লিফটে উঠে বোতাম টিপলেন। আমার কেমন বাধোবাধো ঠেকছিল। একজন নামকরা প্রফেসরের সঙ্গে রেস্টুরেন্টে এসে আড্ডা দেয়া, এরকম কিছু আমাদের দেশে সচরাচর ঘটে না।

রেস্টুরেন্টে ঢুকে আমি অবাক হয়ে গেলাম। দেশী-বিদেশী নারী-পুরুষ জোড়ায় জোড়ায় বসে আছে। প্রায় প্রত্যেক টেবিলের সামনেই গ্লাস। কোনোটা ভর্তি, ফেনা উঠছে। কোনোটা অর্ধেক শেষ হয়েছে। এ ধরনের জায়গায় আমি আগে কোনোদিন আসি নি। রেস্টুরেন্টটিতে প্রবেশ করার পর আমার মনে হলো আমি অন্য কোনো দেশে এসে গেছি। তায়েবউদ্দিন সাহেব উত্তর-পশ্চিম কোণার দিকের একটা খালি টেবিলের সামনে এসে বসলেন। আমাকে তার বিপরীত দিকের চেয়ারটি দেখিয়ে বললেন, ওখানেই বসো। আমি যখন বসলাম, তিনি জানালার দিকে আঙুল প্রসারিত করে বললেন, এই জায়গাটা খুবই ভাল। এখান থেকে ঢাকা শহরের স্কাই লাইন খুব স্পষ্টভাবে দেখা যায়। প্রফেসর তায়েবের পর্যবেক্ষণ শক্তির তারিফ করতে হয়। সত্যিই, এই জানালার সামনে দাঁড়ালে ঢাকা শহরের একটা সুন্দর ছবি চোখে পড়ে। এই সন্ধ্যেবেলায় রাজপথের ছুটন্ত গাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে হলো যেন দ্রুতগামী গবাদিপশুর সারি। ধাতব আওয়াজ, কর্কশ চিত্তার, ট্রাক ড্রাইভারের খিস্তি কোন্ মায়াবশে যেন উধাও। এয়ারকন্ডিশন্ড রেস্টুরেন্টের কাঁচের জানালা দিয়ে গমনাগমনের মৃদুমন্দ ছন্দটিই শুধু ধরা পড়ছিল। ইউনিফর্ম পরা বেয়ারা সামনে এসে দাঁড়ালে তায়েবউদ্দিন সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি একটু হুইস্কি খাব। তুমি কি খাবে বলো? আমি বললাম, আমি এক কাপ চা খেতে চাই। তিনি বললেন, চা খেতে গেলে নিচের তলায় যেতে হবে। আমি বললাম, তাহলে স্যার আমি কিছুই খাব না। তিনি বললেন, তা কি করে হয়, অন্তত একটা বিয়ার খাও। বেয়ারাকে বললেন, আমাকে চার পেগ হুইস্কি দাও, সঙ্গে সোডা। আর এই সাহেবকে একটা বিয়ার। সঙ্গে খাবার কি আছে? বেয়ারা কাছে এসে বলল, বটি কাবাব এবং হাঁসের ফ্রাই করা মাংস আছে। তায়েবউদ্দিন সাহেব বললেন, হাঁসের ফ্রাই-ই দাও।

তায়েবউদ্দিন সাহেব চেয়ার থেকে উঠে বললেন, তুমি বসো। আমি একটু টয়লেট থেকে আসি। বেয়ারা গ্লাসে হুইস্কি ঢেলে দিল। সোডার গ্লাসটি পাশে রাখল। তারপর বিয়ারের টিনটি আমার সামনে রেখে ভেতরে চলে গেল। অল্পক্ষণের মধ্যেই ড্রাগন আঁকা সোনালি বর্ডার দেয়া চীনেমাটির প্লেটে ফ্রাই করা হাঁসের মাংস অত্যন্ত তরিবৎ সহকারে বসিয়ে দিল। তায়েবউদ্দিন সাহেব ন্যাপকিনে হাত মুছতে মুছতে চেয়ারে বসে বললেন, বাহ্ হাঁসের মাংসের গন্ধ তো ভারি চমৎকার! আমার মুখ দিয়ে কথা বেরুলো না। কারণ এই স্বপ্নপুরীর রেস্টুরেন্ট, এই তরল হুইস্কির গ্লাস, ড্রাগন আঁকা প্লেটে ধূমায়িত হাঁসের মাংসের ফ্রাই, বুকে সোনালি তকমা আঁটা বেয়ারা- সবকিছুই আমার কাছে নতুন এবং অপরিচিত। এই পরিবেশে আমার আসার কথা নয়। যদিও আমি টেবিলের সামনে হাজির আছি, আমার একটা অংশ মনে হচ্ছে আব্দুল গনি রোডে রেখে এসেছি। প্রফেসর তায়েব হুইস্কিতে সোডা মিশিয়ে চুমুক দিলেন এবং কাঁটা চামচ দিয়ে এক টুকরো হাঁসের ফ্রাই মুখের মধ্যে পুরে দিলেন। তার মুখ থেকে আহ্ শব্দটি বেরিয়ে এল। বোঝা গেল মাংসের স্বাদ তার ভাল লেগেছে। তার দেখাদেখি আমিও কাঁটা চামচ দিয়ে একখণ্ড হাঁসের ফ্রাই মুখে ঢুকিয়ে দিলাম। প্রফেসর সাহেব হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দেয়ার ফাঁকে ফাঁকে আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন। গ্লাসটা টেবিলে রেখে হঠাৎ তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করে বসলেন, ওকি, তুমি বিয়ারের টিনটা খোল নি কেন? আমি চুপ করে রইলাম। বিয়ারের টিন কি করে কোনদিক দিয়ে খুলতে হয়, তাও আমি জানি নে। তিনি সেটা বুঝে গেলেন এবং নিজেই টিনটা খুলে আমার হাতে তুলে দিলেন। আমি টিনটা কাত করে গ্লাসে ঢালতে গিয়ে দেখি ভুসভুস করে ফেনা বেরিয়ে এসে টেবিলে ছড়িয়ে যাচ্ছে। আমি রীতিমতো অপ্রস্তুত বোধ করতে থাকলাম। প্রফেসর তায়েব বললেন, ও কিছু না, এক মিনিটের মধ্যেই কেটে যাবে। আমি যখন বিয়ারের গ্লাস তুলে সামান্য পান করলাম, এক ধরনের তেঁতো স্বাদে আমার জিভ একরকম অসাড় হয়ে গেল। বমি বমি ভাব অনুভব করছিলাম। অন্য জায়গায় অন্য পরিবেশে হলে হয়তো হড়হড় করে বমি করে ফেলতাম। কিন্তু এই রেস্টুরেন্টে আসার পর থেকেই একটা ভীতি আমার শরীরে ভর করেছে, সেই কারণেই বমি করে সবকিছু উগড়ে দেয়া সম্ভব হলো না। থেমে থেমে আমি বিয়ার গলায় ঢেলে দিচ্ছিলাম।

প্রফেসর তায়েব একটা সিগারেট জ্বালিয়ে বললেন, তোমরা যারা শিল্প-সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত আছ, মাঝেমধ্যে এসব জায়গায় আসা উচিত। মানুষ কিভাবে লাইফ এনজয় করে, সেটাও তোমাদের জানা উচিত। অভিজ্ঞতা না থাকলে ইনসাইট জন্মাবে কেমন করে? হুইস্কির ঘোরেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তা তুমি এখন কি লিখছ? আমি বললাম, কিছুদিন থেকে লিখতে পারছিনে। মনে মনে আমি প্রফেসর তায়েবকে ধন্যবাদ দিলাম। তিনি আমার নিজের বিষয়ে বিশেষ ধারণা পোষণ করেন। আমি বললাম, স্যার, আমার মাঝে মাঝে এমন হয়। চেষ্টা করেও একলাইন লিখতে পারি নে।

প্রফেসর হাতের ইশারায় বেয়ারাকে ডেকে তার গ্লাসে আরো তিন পেগ হুইস্কি দেয়ার নির্দেশ দিলেন। তারপর আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, কিন্তু বাজারে তোমার নামে একটা দুর্নাম রটেছে যে আজকাল তুমি কিছুই করছ না, লিখছ না এবং গবেষণার কাজও করছ না। সকাল-সন্ধ্যে এক সুন্দরী মহিলাকে নিয়ে নাকি কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে!

তার মুখে এই কথা শোনার পর আমার ভেতরে প্রচণ্ড একটা ঝাঁকুনি খেলে গেল। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলে দিল, প্রফেসর তায়েব আমাকে গাড়িতে চড়িয়ে এই রেস্টুরেন্টে নিয়ে এসেছেন শুধু এই একটি কারণে। শামারোখ সম্পর্কে সব ধরনের খবরাখবর সংগ্রহ করাই তার অভিপ্রায়। এবার আমি তার দিকে ভাল করে তাকালাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সম্পর্কে যতগুলো গল্প চালু আছে একে একে আমার মনে পড়তে লাগল। প্রফেসর তায়েবের স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে গেছেন এবং তিনি আলাদা বাড়িতে বাস করেন। তার বাড়িতে স্থায়ীভাবে কোনো কাজের মেয়ে থাকতে পারে না। কোনোটাকে তায়েব সাহেব নিজে তাড়িয়ে দেন, কোনোটা আপনা থেকেই চলে যায়। কোনো কোনো কাজের মেয়েকে আবার ভীষণ জমকালো সাজপোশাকে সাজিয়ে রাখেন। অন্য শিক্ষকদের বেগমেরাও সেটা লক্ষ্য না করে পারেন না। এতদিন আমি বিশ্বাস করে এসেছি এই প্রতিভাবান শিক্ষকের খোলামেলা স্বভাবের জন্য ঈর্ষাপরায়ণ শত্রুরা তার নামে অপবাদ রটিয়ে দিয়েছে। এখন আমার মনে হলো, তার নামে যেসব গুজব রটেছে, তার সবগুলো না হলেও অনেকগুলো সত্যি। তার সম্পর্কে যে শ্রদ্ধার ভাবটি এতদিন পোষণ করে আসছিলাম, ভেঙে খান খান হয়ে গেল। আমার সারা শরীর থেকে ঘাম নির্গত হচ্ছিল। নিজের অজান্তেই গ্লাসের বিয়ার কখন শেষ করে ফেলেছি, টেরও পাইনি।

প্রফেসর তায়েবের দিকে তাকিয়ে দেখি, তিনি এখনো আমার দিকে তাকিয়ে উত্তরের প্রতীক্ষা করছেন। এই প্রথমবার তার বাঁকা নাকটা দেখে আমার শকুনের কথা মনে পড়ে গেল, আমাদের দেশে বিশেষ সাপ এবং শকুনের বিশেষ প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে- এই সংবাদ কোনো একটা প্রাণীবিষয়ক ম্যাগাজিনের মাধ্যমে জেনে গিয়েছিলাম। তায়েব সাহেবের মুখের দিকে ভাল করে তাকিয়ে মনে হলো, পৃথিবী থেকে সাপ এবং শকুনের বিশেষ প্রজাতি বিলুপ্ত হলে কোনো ক্ষতি-বৃদ্ধি হবে না, একেক টাইপের মানুষের মধ্যে এই সাপ-শকুনেরা নতুন জীবনলাভ করে বেঁচে থাকবে।

তায়েব সাহেব আমাকে আব্দুল গনি রোড থেকে এই এতদূরে নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে স্বপ্নপুরীর মতো এই রেস্টুরেন্টে নিয়ে এসেছেন। তার পয়সায় জীবনে প্রথমবার বিয়ার চেখে দেখার সুযোগ পেলাম। সুতরাং, শামারোখ সম্পর্কিত তথ্যাদি যদি তার কাছে তুলে না ধরি, তাহলে নেমকহারামি করা হবে। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে রেখে ঢেকে শামারোখের গল্পটা তার কাছে বয়ান করলাম। সব কথা প্রকাশ করলাম । যেটুকু না বললে গাড়িতে চড়া এবং বিয়ার পান হালাল হয় না, সেটুকুই বললাম।

শরীফুল ইসলাম চৌধুরী সাহেব আমাকে ডেকে নিয়েছিলেন সে কথা জানালাম। বাংলা একাডেমিতে শামারোখের সাক্ষাৎ তারপর প্রফেসর হাসানাত প্রসঙ্গ এবং ড. মাসুদের বাড়ি থেকে আমার না খেয়ে চলে আসা- এ সব কিছুই তায়েব সাহেবকে জানালাম। তিনি শুনে ভীষণ রেগে উঠলেন। বললেন, জাহিদ, শোনো, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্বর এবং স্যাডিস্ট মানুষেরা রাজত্ব করছে। একবার অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়ে আবার নাকচ করা, এই নোংরা প্রাকটিস আমাদের দেশেই সম্ভব। ইউরোপ আমেরিকার কোথাও হলে সব ব্যাটাকে জেল খাটতে হতো। শামায়োখ কষ্টে পড়েছে সেজন্য তিনি চুক চুক করে আফসোস করলেন।

প্রফেসর তায়েব আমার কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, জাহিদ, আই মাস্ট ব্যাংক ইউ । তোমার উদ্দেশ্য মহৎ। তোমার নামে যা কিছু শুনেছি, এখন বুঝতে পারছি সেসব সত্য নয়। ভদ্রমহিলা কষ্টে পড়েছেন। তার চাকরির ব্যাপারটা অত্যন্ত জেনুইন। কিন্তু তুমি তাকে সাহায্য করবে কিভাবে! বিশ্ববিদ্যালয়ে তোমার কাজটাও তো হয় নি। তোমার কথা শুনবে কে? এক কাজ করো, তুমি ভদ্রমহিলাকে আমার কাছে নিয়ে এসো।

সোনা চোরাচালানির পেছনে গোয়েন্দা লাগলে যেমন হয়, আমারও এখন সেই দশা। আমার অনুভব শক্তি যথেষ্ট প্রখর নয়। তবু বুঝতে বাকি রইল না প্রফেসর তায়েব প্রক্রিয়াটির সূচনা করে দিলেন। আরো অনেক মহাপুরুষ শামারোখকে সাহায্য করার জন্য উল্লাসের সঙ্গে এগিয়ে আসবেন। তখন শামারোখকে তাদের ঠিকানায় পৌঁছে দেয়াই হবে আমার কাজ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *