০১-৫. তোমার একটি নাম আছে

অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী – উপন্যাস – আহমদ ছফা

তোমার একটি নাম আছে। তোমাকে বাড়িতে ওই নাম ধরে সবাই ডাকে। তোমার মা-বাবা-ভাই-বোন-আত্মীয়স্বজন পাড়ার লোক সবাই।

ক্লাসের হাজিরা খাতায় ওই নামটি লেখা হয়েছে। ওই নামে লোকে তোমার কাছে চিঠিপত্র লেখে। এই পত্র লেখকদের অনেকেই নিজেদের নাম-ধাম উহ্য রেখে মনের গহন কথাটি প্রকাশ করে থাকে। তোমার মা অত্যন্ত সতর্ক এবং সাবধানী মহিলা। তার ঘ্রাণশক্তি অত্যন্ত প্রখর। এই ধরনের চিঠি তার হাতে পড়ামাত্রই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করতে পারেন, ভেতরের কাগজে দাহ্য পদার্থ রয়েছে। তিনি কালবিলম্ব না করে এই উড়ে আসা চিঠিগুলো গ্যাসের চুলোয় জ্বালিয়ে ফেলেন। কখনো-সখনো তোমার মায়ের সতর্ক চোখের ফাঁক দিয়ে কোনো চিঠি তোমার হাতে এসে পড়ে। তুমি অত্যন্ত মাতৃভক্ত মেয়ে। কোনো ব্যাপারে মায়ের অবাধ্য হওয়ার কথা তুমি স্বপ্নেও চিন্তা করতে পার না। তারপরও ওই চিঠিগুলোর প্রতি তুমি মায়ের মতো নিষ্ঠুর হয়ে উঠতে পার না। কারণ, বুঝে ফেলেছ, তোমার এখন চিঠি আসার বয়স। যেসব চিঠি তোমার হাতে পড়ে, তোমার মা যাতে ঘুণাক্ষরেও টের না পান, অত্যন্ত সন্তর্পণে সেজন্যে বাথরুমে গোসল করার সময় মর্ম উদ্ধার করতে চেষ্টা করো। অধিকাংশ আজেবাজে চিঠি, ফাত্রা কথায় ভর্তি। কারা এসব লেখে তাদের অনেককেই তুমি চেন। যাওয়া-আসার পথে অনেকের সঙ্গেই তোমার দেখা হয়। এই ধরনের কুপাঠ্য চিঠি পড়ার পর তোমার নিজের ওপর রাগ বাড়তে থাকে এবং শরীর গুলিয়ে ওঠে। খুব ভাল করে সুগন্ধি সাবান দিয়ে ঘষে ঘষে গোসল করার পরও তোমার মধ্যে একটা অপবিত্র ভাব, একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি কাজ করতে থাকে। একটা পীড়িত ভাব তোমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে।

মাঝে মাঝে এমন চিঠিও আসে, পড়ার পর পুকুরে ঢিল ছুঁড়লে যেমন লহরি খেলে, তেমনি তোমার মনেও তরঙ্গ ভাঙতে থাকে। এই পত্রলেখককে মনে হয় তুমি চেন। কালো কালির অক্ষরে তার চোখের দৃষ্টি, মুখের ভাব দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। তুমি নিজে খুব অসুখী বোধ করতে থাক। সারাটি দিন একটা গাম্ভীর্যের আবরণে নিজেকে অবৃত করে রাখ। তোমার মা কড়া মহিলা হলেও তার মনে এক ধরনের আশঙ্কা দোলা দিয়ে যায়। তিনি মনে মনে প্রমাদ গুণতে থাকেন। কারণ তোমার মতিগতি তার কাছে বড় দুর্বোধ্য মনে হয়। তিনি তোমার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবিত হয়ে পড়েন।

এখন তোমার নামের কথায় আসি। এই নাম দিয়েই তোমাকে সবাই চেনে। যে অফিসটিতে তুমি পার্টটাইম কাজ করো, সেখানে ওই নামেই তোমাকে সবাই জানে। ওই নামেই তোমাকে নিয়োগপত্র দেয়া হয়েছিল। ওই নামেই মাসের শেষে তোমার মাইনের বিল হয়, চেক কাটা হয়। সবার কাছে শুনতে শুনতে তোমার মনে এমন একটা প্রতীতি গাঢ়মূল হয়েছে যে, তোমার নামটি তোমার সত্তার অবিভাজ্য অংশে পরিণত হয়েছে। কেরামুন কাতেবুন নামে যে দুজন ফেরেশতা তোমার কাঁধের ওপর বসে অদৃশ্য কাগজে, অদৃশ্য কালিতে, তুমি সারাদিন ভাল করেছ কি মন্দ করেছ, সমস্ত তোমার নামের পাশে টুকটুক করে লিখে নিচ্ছেন। ওই ফেরেশতা সাহেবেরা তোমার নামের পাশে এমন একটা অদৃশ্য জাল পেতে রেখেছেন, তোমার ভাল-মন্দ সেখানে মাকড়সার জালের মধ্যে মশা-মাছির মতো টুকটুক আটকা পড়ে যাচ্ছে। কোনো সুন্দর যুবা পুরুষ দেখে তোমার মনে যদি একটি মিষ্টি চিন্তা ঢেউ দিয়ে জেগে ওঠে, মনের সেই একান্ত ভাললাগাটুকুও ফেরেশতা সাহেবদের পেতে রাখা রাডারে ধরা পড়বেই পড়বে।

তোমার যখন মৃত্যু হবে, সাদা কাফনে ঢেকে তোমার প্রাণহীন শরীর যখন মাটির গহিনে নামানো হবে, তখনো তুমি নামের জাল ছিঁড়ে পালিয়ে যেতে পারবে না। দুজন ভীষণ-দর্শন ফেরেশতা তরুণ বজ্রের মতো ভয়ংকর শব্দে তোমার নাম ধরে চিৎকার করে ডাক দেবেন। তোমাকে মৃত্যুর নিস্তব্ধতার ভেতর থেকে জেগে উঠতে হবে। এক সময় পৃথিবীতে তুমি মানুষের শরীর নিয়ে বেঁচেছিলে, রক্তের উষ্ণতা এবং হৃদয়ের জ্বর নিয়ে মানুষকে ভালোবাসার চেষ্টা করেছিলে, অপ্রাপ্য সুন্দর বস্তু দেখে তোমার মনে লোভ জন্মেছিল, ফেরেশতা দুজন জেরার পর জেরা করে সব তোমার কাছ থেকে টেনে বের করে ছাড়বেন, কিছুই গোপন রাখতে পারবে না। পৃথিবীতে তুমি চোখ দিয়ে দেখেছিলে, হাত দিয়ে স্পর্শ করেছিলে, ঠোঁট দিয়ে চুমু খেয়েছিলে, এক কথায়, কেন বেঁচেছিলে, কীভাবে বেঁচেছিলে, তার সমস্ত কৈফিয়ত তোমাকে দিতে হবে। ফেরেশতা সাহেবদের প্রত্যাশিত জবাবদিহি যদি তোমার মুখ থেকে বেরিয়ে না আসে, তাহলে কাটাঅলা গদার আঘাতে…। থাক, তোমাকে আগাম ভয় পাইয়ে দিতে চাইনে।

তারপর অনেক বছর (কত বছর আমি বলতে পারব না) ঘুমিয়ে থাকার পর হাশরের দিন ইস্রাফিল ফেরেশতার শিঙার হুংকারে আবার তোমাকে জেগে উঠতেই হবে। আল্লাহতায়ালা যখনই ইচ্ছে করবেন, অমনি, কম্পিউটারের পর্দায় তোমার আমলনামা ভেসে উঠবে। আল্লাহতায়ালা মানুষের পাপ-পুণ্যের সূক্ষ্ম বিচারক। তিনি তোমাকে জাহান্নামে ছুঁড়ে দেবেন কি বেহেশতে দাখিল করবেন, সে তোমার এবং আল্লাহর ব্যাপার।

তোমার নামের প্রশ্নটি তুললাম, তার একটা কারণও আছে। আমি ভেবে দেখেছি নামের চাইতে মাথা ঘামাবার উপযুক্ত বিষয়বস্তু দুনিয়াতে দ্বিতীয় কিছু নেই। আল্লাহতায়ালা তো প্রথম মানব আদমকে নাম শিক্ষাই দিয়েছিলেন। তার মানে নাম শিক্ষা দেয়ার ছলে নামের শৃঙ্খলে তাকে বেঁধে ফেলেছিলেন। নামের বাঁধন ছিঁড়ে আদমের পালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। আদমের বংশধরদেরও কারো নামের বন্ধন ছিন্ন করা সম্ভব হবে না।

তোমার এই নামটির কথা চিন্তা করে দেখো। যখনই এই নামটি তোমার রাখা হয়েছিল, তখন নামের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক অনুভব করার বোধ জন্মায়নি। এখন দেখো ওই নামটি তোমাকে কত কিছুর সঙ্গে বেঁধে ফেলেছে। মা-বাবা আত্মীয়স্বজন, পাড়াপড়শি, এমন কি গোপনে গোপনে যারা তোমাকে ভালোবাসে, সবার মনে ওই নামটি তোমার অস্তিত্বের প্রতীক হিসেবে, স্থান-বিবর্জিত সর্বনামরূপে, এমনভাবে গেঁথে আছে, তুমি ইচ্ছে করলে মুছে ফেলতে পারবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের খাতায়, রেশন দোকানের তালিকায়, অফিসের হাজিরা বইতে, ভোটার লিস্টের পাতায়, পানি-বিদ্যুৎ, গ্যাস বিলের মাসিক খতিয়ানে, পাসপোর্টের সিলমোহরের নিচে এমনভাবে তোমাকে অদৃশ্য রশিতে আটকে রেখেছে, পালিয়ে যাবে তার কোনো উপায় নেই। এমন কি মরে গিয়েও না। মৃত্যুর অপর পারে আল্লাহর বিক্রমশালী ফেরেশতারা নামের রশি নিয়ে তোমাকে গ্রেফতার করার জন্যে প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করছেন। স্বয়ং আল্লাহতায়ালার ঘরেও তোমার নামটি রেকর্ড হয়ে গেছে।

তোমার ওই অতি পরিচিত, অতি ব্যবহৃত নামের আমার প্রয়োজন হবে না। ওই নাম তোমার জন্য একটি কারাগারস্বরূপ। তোমাকে আমি দেখি মুক্তি এবং স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে। তাই ঠিক করেছি আমি একটা নতুন নাম দেব। তোমার মা-বাবার দেয়া নাম তোমাকে চারপাশ থেকে আটকে ফেলেছে, সেই ঘেরাটোপ থেকে তোমার প্রকৃত সত্তা বের করে আনার জন্যে একটা মানানসই নাম আমার চাই। অভিযাত্রীরা অচেনা ভূখণ্ডে পদার্পণকরামাত্রই একটা নাম দিয়ে বসেন। লেখকেরা একটা গল্প লিখলে নতুন নাম দেন, বিজ্ঞানীরা নতুন কিছু আবিষ্কার করলে তড়িঘড়ি একটা নাম দিয়ে ফেলেন। তাদের যুক্তি হলো, যে বস্তুর অস্তিত্ব দুনিয়াতে ছিল না, আমরা তাকে নতুন সত্তায় সত্তাবান করেছি, সুতরাং নতুন একটি নাম দেব না কেন? অত গম্ভীর এবং প্যাঁচালো বিতর্কের মধ্যে আমি যাব না।

শাদা কথায় আমি তোমার একটি নতুন নামকরণ করতে চাই। আমার মনে একটা দুঃসাহস ঘনিয়ে উঠেছে, আমি তোমাকে নতুন করে সৃষ্টি করব। আল্লাহতায়ালার ইচ্ছেতে তোমাকে জন্মাতে হয়েছে, তাই তুমি তার কাছে ঋণী। ওই রক্ত-মাংসের শরীর তুমি মা-বাবার কাছ থেকে পেয়েছ, মা-বাবার কাছেও তোমার এমন কিছু ঋণ রয়েছে যা কোনোদিন অস্বীকার করতে পারবে না। পরিবারের মধ্যে তুমি বেড়ে উঠেছ, রাষ্ট্র তোমাকে নিরাপত্তা দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে, এমন কি বাংলাভাষী মানুষজন তোমার জিভে বাংলা ভাষাটি তুলে দিয়েছে। সবাই তোমাকে দাবি করে, তোমার অস্তিত্বের মধ্যে সবকিছুর অস্তিত্ব সমুদ্রের পানির মধ্যে লবণের মতো মিশে আছে।

আমার কথা বলি। কারো দাবি আমি অস্বীকার করিনে। আমি তোমাকে দু’বেলার অন্ন সরবরাহ করি নি, মাসমাইনের টাকা দিই নি, ঘুমোবার বাসগৃহের ব্যবস্থা করি নি, চলাফেরার নিরাপত্তা নিশ্চিত করি নি, জ্ঞানবিদ্যার ঊধ্বজগতে তুলে ধরি নি, পরকালে বিচার-আচার করার জন্যে উদ্যত মুষল হাতে দাঁড়িয়ে থাকি নি। তারপরও তোমার প্রতি আমার একটা ভিন্নরকম দাবি, একটা অধিকারবোধ হালফিল জন্ম নিতে আরম্ভ করেছে। তোমার সত্তার যে অংশটিতে আল্লাহতায়ালার অধিকার নেই, কোনো মানুষের এখতিয়ার নেই, রাষ্ট্র সমাজ, কারো কাছে দায়বদ্ধতা স্বীকার করে না, যেখানে তুমি শুধু তুমি, তোমার অস্তিত্বের সেই মর্মবিন্দুটি আমি স্পর্শ করতে চাই। যদি আমি সাধক চরিত্রের মানুষ হতাম, সারা জীবনের সাধনায় সেই অপ্রকাশ-বিন্দুটি স্পর্শ করে একটি সুন্দর নাম ধ্যানের উত্তাপে ফুলের মতো ফুটিয়ে তুলতাম। সাধ আর সাধ্য এক জিনিস নয়। আমার যদি সে কামালিয়াত থাকত, একটি নাম, শুধু একটি নামে তোমার সত্তার আসল রূপ বিকশিত করার জন্যে সমস্ত জীবন ধ্যানের আসনে কাটিয়ে দিতাম।

আমার ধৈর্যের পরিমাণ খুবই অল্প। তড়িঘড়ি একটা নাম দিয়ে ফেলতে চাই। যদি তোমার নাম ঈশ্বরী রাখতাম, বেশ হতো। তোমাকে ঈশ্বরের সঙ্গে জড়াবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও আমার নেই। কারণ তুমি একান্ত আমার। সেখানে কারো কোনো অংশ নেই, একেবারে লা শরিক। উপায়ান্তর না দেখে তোমার একটি নাম নির্বাচন করার জন্যে সঙ্গীত শাস্ত্রের শরণ নিলাম।

একমাত্র সঙ্গীতই তো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত অপ্রকাশকে মূর্ত করে তুলতে পারে। সুতরাং তোমার নাম রাখলাম সোহিনী।

সোহিনী রাগের নামে তোমার নামকরণ করলাম। একটু হাল্কা বোধ করছি। নামকরণ তো করলাম। এই রাগটি সম্পর্কে একটা ধারণা দেয়া দরকার। এটি মাড়োয়া ঠাটের অন্তর্গত একটি রাগ। এতে পঞ্চম স্বরটি ব্যবহার হয় না। বলতে হবে এটি একটি ষাড়ব রাগ। আরোহীতে সা গা হ্ম ধা নি সা এবং অবরোহীতে সা নি ধা হ্ম ধা গা, হ্ম গা রে সা অনুসরণ করে গাওয়া হয়। গাইবার সময় রাতের শেষ প্রহর। গুণী গাইয়ে যখন তারপুরার স্বরে তন্ময় হয়ে, কণ্ঠের তড়িতের মধ্য দিয়ে এই রাগের সৌন্দর্য লক্ষণসমূহ প্রকাশ করতে থাকেন, তখন কী যে এক অনির্বচনীয় রূপ-রসের জগৎ মূর্তিমান হয়ে ওঠে, সে আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। সৌন্দর্যের সঙ্গে কষ্টের একটা সংযোগ আছে এটাই সোহিনী রাগের বৈশিষ্ট্য। রাত যতই শেষের দিকে গড়াতে থাকে, এই রাগটির সৌন্দর্য ততই প্রস্ফুটিত হতে থাকে। কিন্তু একটি কথা, সঙ্গীতশাস্ত্রে যে গাইয়ে বিশুদ্ধি এবং নির্ভরতা অর্জন করে নি, তার কণ্ঠে সোহিনী রাগ কখনো গহন সৌন্দর্য নিয়ে ধরা দেবে না।

সেই প্রাচীনকালে সঙ্গীতশাস্ত্র যখন সবে আকার পেতে আরম্ভ করেছে ধ্যানী সাধকদের তন্ময় সাধন দৃষ্টিতে রাগ-রাগিণীগুলো তাদের সৌন্দর্যের ভাণ্ডার উন্মোচিত করে রসমূর্তিতে আবির্ভূত হতো। সাধকের প্রাণ রাগ-রাগিণীর চলার গতি আর অপূর্ব তাললয়ের স্বর্ণ-রেখায় আঁকা হয়ে যেত। তখন পৃথিবী তরুণী ছিল। নিসর্গের ভাণ্ডার থেকে, বিহঙ্গের কাকলি থেকে, প্রাণকুলের ডাক থেকে, হাওয়ার স্বনন থেকে, নদীর গতিধারা থেকে সুর উঠে এসে সাধকের কণ্ঠে নিবাস রচনা করত। তখন মানুষের অনুভূতি ছিল স্বচ্ছ, অকলঙ্ক। হৃৎপিণ্ডের লাল শোণিতের চাইতে তাজা অনুরাগ দিয়ে সুরের সাধনা করতেন সাধকেরা। তাদের নির্মল ধ্যানদৃষ্টিতে যে সুরগুলোর মধ্যে শক্তির প্রকাশ ধরা পড়ত, তাকে বলতেন রাগ, আর যে সুরগুলোতে চলমান সৌন্দর্য প্রত্যক্ষ করতেন বলতেন রাগিণী। আমার ধারণা, সোহিনী রাগ নয়, রাগিণী ।

.

০২.

সোহিনী, তুমি আমার অর্ধেক আনন্দ, অর্ধেক বেদনা। অর্ধেক কষ্ট, অর্ধেক সুখ। অর্ধেক নারী, অর্ধেক ঈশ্বরী। তোমাকে নিয়ে আমি কি করব! তোমার টানা টানা কালো চোখের অতল চাউনি আমাকে আকুল করে। তোমার মুখের দীপ্তি মেঘ-ভাঙা চাঁদের হঠাৎ ছড়িয়ে-যাওয়া জোছনার মতো আমার মনের গভীরে সুবর্ণ তরঙ্গ জাগিয়ে তোলে। দিঘল চিকন কালো কেশরাশি যখন তুমি আলুলায়িত করো, হাওয়া-লাগা চারাগাছের মতো আমি কেমন আন্দোলিত হয়ে উঠি। তোমাকে নিয়ে। আমি যাব কোথায়? সোহিনী তুমি কি নিদারুণ সংকটের মধ্যে আমাকে ছুঁড়ে দিয়েছ? তুমি এসো, এসো বলে কাছে ডাকছ, আবার না-না’ বলে দূরে ঠেলে দিচ্ছ। ওই না-আসা না-যাওয়ার পথের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে কি অবস্থা করেছ আমার! তোমার মনে কি আমার প্রতি একটুও দয়া নেই? কাঞ্চনজঙ্র অমল ধবল সূর্যালোক-চমকানো তুষার চূড়োর মতো আমাকে আকর্ষণ করছ। আমি যতদূর যাই, যতদূর যেতে থাকি, কাঞ্চনজঙ্ঘা ততদূরে পিছোতে থাকে। ক্লান্ত হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে যখন অদৃষ্টকে ধিক্কার দিতে থাকি সোনা-মাখানো কাঞ্চনজঙ্ঘার সমস্ত তুষার মধুর হাসি ছড়িয়ে দিয়ে হাতছানিতে ডাকতে থাকে, এই তো আমি, সেই কতকাল থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তোমার প্রতীক্ষা করছি। তুমি আমাকে কি নিষ্ঠুর অগ্নিপরীক্ষার মধ্যে ফেলে দিয়েছ? নিজের সঙ্গে আমাকে কী কঠিন লড়াইটা না করতে হচ্ছে! আমি যে দাঁড়িয়ে থাকব, তার উপায় নেই, সামনে পা ফেলব, সে শক্তিও পাচ্ছিনে। এই না-চলা না-দাঁড়ানো অবস্থা, তার কী যে যন্ত্রণা!

তোমার সঙ্গে যখন প্রথম দেখা হলো, সেদিন কি বার, কোন্ মাস, দিবসের কোন প্রহর, কিছুই মনে নেই। শুধু মনে আছে তোমার সঙ্গে দেখা হলো। চরাচর চিরে তুমি যখন আবির্ভূত হলে, রজনীগন্ধার বোঁটার মতো যখন ঈষৎ নত হয়ে দাঁড়ালে, আমার শরীরের সমস্ত রক্ত মিছিল করে উজানে চলতে আরম্ভ করল। চেতনার স্তরে স্তরে উৎসবের সাড়া পড়ে গেল। আচমকা আমি বলে উঠলাম, আমি পেয়েছি, পেয়ে গেছি! নিজের উচ্চারণে নিজেই চমকে গেলাম। এ কী বলছি আমি! সামনে তুমি দাঁড়িয়ে। আমার মনে হলো, তুমি আসবে বলে, এসে এমনি করে দাঁড়াবে বলে, কতকাল ধরে তোমার প্রতীক্ষায় আমি অধীর ছিলাম। আজ তুমি এসে গেছ। তোমার এলানো চুলের গোছা ছড়িয়ে পড়েছে। চোখের তারা দুটো থরথর কাঁপছে। শরীর থেকে সুঘ্রাণ বেরিয়ে আসছে। বহুকাল আগে বিস্মৃত একটি স্বপ্ন যেন আমার সামনে মূর্তিমান হয়েছে। শরীরের রেখাঁটি ঘিরে ঘিরে, শাড়িটি কোমর ছাড়িয়ে, বক্ষদেশ ছাড়িয়ে কাঁধের ওপর উঠে এসেছে। আঁচল-প্রান্ত হাল্কা হাওয়ায় একটু একটু করে কাঁপছে। আমি মৃদু খসখস শব্দ শুনতে পাচ্ছি। দুটো গানের কলি ঢেউ দিয়ে মনের মধ্যে জেগে উঠল- সোহাগ ভরে অনুরাগে জড়িয়ে ধীরে ধীরে / বেনারসী প্যাঁচ দিয়েছে শরীর বল্লরীরে।

আমি বিড়বিড় করে বলতে থাকলাম, তুমি আমার জীবন। তোমাকে না পেলে আমি বাঁচব না। তুমি আমার গন্তব্য, আমার মঞ্জিলে মকসুদ। তোমার জন্য, শুধু তোমার জন্যে দুনিয়ার অপর প্রান্ত অবধি আমি ছুটে যাব। দুস্তর সমুদ্র পাড়ি দেব। দুর্লঙ্ পাহাড়ের শীর্ষ চূড়োয় আমি আরোহণ করব। তুমি আমার মৃত্যু। তোমার পেছন পেছন আমি তীর্থযাত্রীর মতো ছুটে যাব। যদি মৃত্যু আমাকে গ্রাস করতে ছুটে আসে শহিদের আবেগ নিয়ে আমি সেই মরণকে আলিঙ্গন করব।

সোহিনী, তুমি আমার বুকে কী এক দুঃসাহসের জন্ম দিয়েছ! কী এক অসম্ভব আশা আমার মনে রক্ত-শতদলের মতো ফুটিয়ে তুলেছ! আমার শরীরের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে কী অপার শক্তির লহরি খেলিয়ে তুলেছ! আমি তোমাকে বারণ করতে পারছিনে। একটা দুর্বার গতিবেগ আমাকে ছুটিয়ে নিতে চাইছে। তুমি আমার পথ, আমার গন্তব্য। আমাকে যেতে হবে, আমাকে যেতে হবে। শরীরের প্রতি লোমকূপ থেকে একটা সিদ্ধান্ত প্রবাহিত হয়ে আমাকে তোমার অভিমুখে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

তোমার অভিমুখে যাওয়া ছাড়া আমার আর কোনো পথ খোলা নেই, যখন বুঝতে পারলাম, মনটা বিষাদে ছেয়ে গেল। মনে হলো জেনেশুনে একটা ফাঁস গলায় পরলাম। এই ফাসই আমাকে টেনে নিয়ে যাবে। ধরে নিলাম আমার মৃত্যুদণ্ড লেখা হয়ে গেছে। কখন কার্যকর হবে শুধু ঘোষণাটা করা হয়নি। ভীষণ ভারি, ভীষণ কষ্টদায়ক ক্রুশের মতো মৃত্যুদণ্ডের আদেশ চেতনায় বয়ে নিয়ে তোমার দিকে পা বাড়াব বলে যখন স্থির করলাম, বুকের ভেতর অনেকগুলো কণ্ঠের চাপা গুমরানো কান্নার শব্দ কান পেতে শুনলাম। আমার বুকের ভেতর কাঁদছে আমার অতীত। অতীতে যেসব নারী আমার জীবনে এসেছিল, এখন দেখছি, তাদের কেউ বিদেয় হয়নি। বুকের ভেতর রাজ্যপাট বিস্তার করে বসে আছে। তোমার দিকে পা বাড়াই কী সাধ্য! তারা কেউ অধিকার ছেড়ে দিতে রাজি নয়। তাদের একেকজন মনের একেকটা অঞ্চল এমনভাবে খামচে ধরে আছে, অধিকার থেকে উপড়ে ফেলি কেমন করে! আমি যখন বাতাসে কান পাতি, বুকের ভেতর থেকে খিলখিল হাসির ধ্বনি, প্রাণ নিংড়ানো কান্নার আওয়াজ, চাপা চাপা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ ভেসে আসতে থাকে। এই সমস্ত রক্ত মাংসের নারী আমার জীবনে এসেছিল। এখন তাদের কেউ নেই। নেই বলে কি একেবারে নেই? মাটির গভীরে দেবে যাওয়া বোমা যেমন সমস্ত তেজস্ক্রিয়তাসহ আত্মগোপন করে থাকে, নাড়াচাড়া লাগলেই বিস্ফোরিত হয়; তেমনি আমিও যতই অতীত থেকে নিজের অস্তিত্ব টেনে আনতে চাই, কেউ হেসে, কেউ কেঁদে, কেউ ধমক দিয়ে বলতে থাকে, না না আমরা তোমাকে এক পাও নড়তে দেব না। অতীত অভিজ্ঞতার মৌমাছি-চক্রে তোমাকে আটকে রাখব। অতীত এসে আগামীর পথ রোধ করে দাঁড়ায়। বুদ্ধত্ব অর্জনের পূর্ব-মূহূর্তে এমন অভিজ্ঞতা হয়েছিল সাধক গৌতমের। ঝাঁকে ঝাঁকে মারকন্যা তার চারপাশে এসে নানা ভঙ্গিমায় নৃত্য করতে থাকে। কেউ গৌতমের কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলে, আমি তোমাকে বিলাসের সমুদ্রে ভাসিয়ে নেব; কেউ বলে, আমি ভোগ-সুখের অপরিমেয় আনন্দে ডুবিয়ে রাখব, কেউ বলে, স্বর্ণ-সম্পদের ভাণ্ডার তোমার বিস্ফারিত দৃষ্টির সামনে মেলে ধরব। তুমি আমার হও, তুমি চোখ মেলে তাকাও। গৌতমের অন্তরে ঘন হয়ে গাঢ় হয়ে নির্বাণের তৃষ্ণা জন্ম নিয়েছিল। নির্বাণের আকাঙ্ক্ষা তাকে বুদ্ধত্ব অর্জনের পথে ধাবিত করে নিয়েছিল।

সোহিনী, প্রেমও তো এক ধরনের নির্বাণ। আমি নিতান্তই সামান্য মানুষ । গৌতমের উচ্চতায় নিজেকে স্থাপন করব, এমন ধৃষ্টতা আমার মতো তুচ্ছাতিতুচ্ছ জীবের কেমন করে হবে! তারপরও আমি সাহস করে বলব, আমার চেতনায় প্রেমের কুঁড়ি ফুটি ফুটি করছে। এই প্রেমের শক্তিতেই এমন শক্তিমান হয়ে উঠেছি, মাঝে মাঝে নিজেকে তরুণ দেবতার মতো মনে হয়। আমার অতীতের দিকে আমি সাহস করে তাকাতে পারি। তার অক্টোপাস-বন্ধন ছিন্ন করে নিজেকে অনন্তের অভিমুখে ছুটিয়ে নিতে পারি। সোহিনী, তুমি ভাল করেই জানো আমার কোনো ধন-সম্পদ নেই। মা-বাবা-আত্মীয়-স্বজন, স্ত্রী-পুত্র-পরিবার আমার কিছুই নেই। যে সজীব বন্ধন একজন মানুষকে নানা কিছুর সঙ্গে সম্পর্কিত করে রাখে, আমার ভাগ্য এমন ফর্সা যে সেসব কিছুই আমার জোটেনি। অতীত দিনের অর্জন বলতে আমার জীবনে যেসব নারী এসেছিল, যারা আমাকে কাঁদিয়েছে, হাসিয়েছে, দাগা দিয়েছে, যারা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে, সেই দুঃখ-সুখের স্মৃতি চক্রটুকুই শুধু আমার একমাত্র অর্জন। এতকাল স্মৃতি নিয়েই বেঁচে ছিলাম। তোমার স্পর্শে আমার সমগ্র সত্তা জেগে উঠেছে। কাদায়-আটকানো হাতি যেমন ডাঙায় ওঠার জন্যে সমস্ত শক্তি দিয়ে চেষ্টা করে, আমিও সেরকম স্মৃতির জলাভূমি থেকে ছুটে বেরিয়ে আসার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছি প্রাণপণ।

কাজটা সহজ নয়, সোহিনী। একজন মানুষের শরীরের একটা হাত কিংবা পা দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হয়ে অবশ হয়ে গেলে মানুষ যেমন স্বেচ্ছায় আপন হাতে সে অঙ্গটি কেটে বাদ দিতে পারে না, সে রকমই অতীতকে বর্তমানে টেনে তুলে তার জীর্ণ অংশ হেঁটে ফেলাও একরকম অসম্ভব। দিব্য চেতনা অর্জন না করলে কেউ তা পারে না। আমি মনে করছি আমার হৃদয়ে প্রেম জন্ম নিয়েছে। অমৃতলোকের হাওয়া। আমার মনে তরঙ্গ জাগিয়ে তুলছে, তীব্রভাবে অনুভব করছি, আমি অমৃতলোকের যাত্রী। আমার যাত্রাপথ যদি অবারিত করতে চাই, আমার জীবনে যেসব নারী এসেছিল, চলে গিয়েছে, স্মৃতির গভীরে খনন করে তাদের লাশগুলো আমাকে বের করে আনতে হবে। স্মৃতিকে যদি অতীতমুক্ত না করি, বর্তমানকে ধারণ করব কোথায়? সোহিনী, আমি জানি, আমার অনেক অশ্রু ঝরবে, বুকের ভেতর তপ্ত শোণিতের ধারা বইবে। কিন্তু উপায় কি? এই এতগুলো নারীর স্মৃতি-ভার বুকে নিয়ে আমি তোমার দিকে অগ্রসর হবো কেমন করে? আমি যদি নির্ধারতা অর্জন না করি, সামনে চলব কেমন করে? তাই স্মৃতির ভাঁড়ার উন্মোচন করে এইসব নারীকে অস্তিত্বহীন করে ফেলতে চাই। তারা ভাল ছিল কি মন্দ ছিল, সে বিচারে আমার কাজ নেই। সবচেয়ে বড় কথা, তারা আমার জীবনে এসেছিল। একেকজন একেক ধরনের বন্ধনে আমার চেতনালোক আচ্ছন্ন করে রেখেছে। এখন আমি সেই বন্ধনের গিঁটগুলো খুলে ফেলতে উদ্যত হয়েছি। মনে হয়, হাতুড়ি দিয়ে পাঁজরে আঘাত হানছি। সমস্ত জীবনের অর্জিত গহন সম্পদ তছনছ করে ফেলতে যাচ্ছি। কী করব! প্রেমপন্থের যাত্রী আমি। স্মৃতির কবর না খুঁড়লে তো আমার যাওয়া হবে না। সবকিছু ঝেড়ে ফেলে দিয়ে কেবল আমার আমিত্বটুকু নিয়েই তোমাকে অনুসরণ করতে চাই।

.

০৩.

প্রিয় সোহিনী, আমি তোমার কাছে দুরদানার কথা বয়ান করব। তার পুরো নাম দুরদানা আফরাসিয়াব। কেমন ফার্সি কিংবা তুর্কি মনে হয় না! লোকে বলত দুর্দান্ত থান্ডার। দুরদানার সঙ্গে থান্ডার শব্দটি বেশ মানিয়ে গিয়েছিল। কেউ কেউ তাকে দুর্দান্ত চক্রযান বলেও ডাকত। কারণ নাখালপাড়ার দিক থেকে দ্রুতবেগে সাইকেল চালিয়ে সে আর্ট ইনস্টিটিউটে আসত। আজ থেকে তিরিশ বছর আগে একটি উনিশ বছরের তরুণী ঢাকার রাস্তায় সাইকেল চালিয়ে কলেজে আসছে-যাচ্ছে, ব্যাপারটা কল্পনা করে দেখো। দুপাশের মানুষ হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখত। খাইবার মেল ছবিতে পাঞ্জাবি হিরোইন নীলুর লড়াকুপনা দেখে তৃতীয় শ্রেণীর দর্শকেরা যেমন শিস্ দিত, অশ্লীল মন্তব্য ছুঁড়ে দিত, তেমনি সাইকেল চালানোরত দুরদানাকে দেখেও রাস্তার লোকেরা তাদের অবদমিত অনুভূতি অশালীন ভাষায় প্রকাশ করতে থাকত। ছেমরির বুক-পাছা-নিতম্ব এসব নিয়ে সরস আলোচনার ঝড় বয়ে যেত। পাঞ্জাবি হিরোইন নীলুর কাজ-কারবার পর্দায় সীমিত ছিল। আর গোটা উন্মুক্ত রাজপথটাই ছিল দুরদানার চলন ক্ষেত্র। রাজহাঁস যেমন পাখা থেকে পানি ঝেড়ে ফেলে, তেমনি দুরদানাও লোকজনের কোনো মন্তব্য গায়ে মাখত না। স্কুলগামী ছোট ঘোট বাচ্চারা হাততালি দিয়ে সাইকেল চালানোরত দুরদানাকে অভিনন্দন জানাতো। দুরদানা খুশি হয়ে হ্যান্ডেল থেকে দুহাত উঠিয়ে নিয়ে শুধু পায়ে প্যাডেল ঘুরিয়ে বাচ্চাদের তাক লাগিয়ে দিত। প্রিয় সোহিনী, আজ থেকে তিরিশ বছর আগে ঢাকার রাস্তায় এত ভিড় ছিল না। অনায়াসে দুরদানা স্কুলের বাচ্চাদের সাইকেলের খেলা দেখাতে পারত।

এই দুরদানার কথা আমি প্রথম শুনেছিলাম কলকাতায়। স্মৃতিকণা চৌধুরীর কাছে। উনিশশ’ একাতুর সালে। তখন তো মুক্তিযুদ্ধ চলছিল। আমরা কলকাতায় পালিয়েছিলাম। তখন স্মৃতিকণা চৌধুরীর সঙ্গে আমার পরিচয়। উপলক্ষ বাংলা সাহিত্য। স্মৃতিকণা আমার কাছে দুরদানার কথা জানতে চেয়েছিল। আমি চিনি না বলায় অবাক হয়ে গিয়েছিল- ঢাকায় থাকি অথচ দুরদানাকে চিনিনে। এ কেমন করে সম্ভব! প্রথম স্মৃতিকণার কাছেই শুনেছিলাম দুরদানা কি রকম ডাকসাইটে মেয়ে। সে সাইকেল চালিয়ে কলেজে আসে। ছেলেদের সঙ্গে মারামারি করতেও তার বাধে না। প্রয়োজনে ছোরাছুরি চালাতেও পারে। স্মৃতিকণার কাছে শুনে শুনে দুরদানার একটা ভাবমূর্তি আমার মনে জন্ম নিয়েছিল। মনে মনে স্থির করে ফেলেছিলাম এই যুদ্ধ যদি শেষ হয়, ঢাকায় গিয়ে দুরদানার তত্ত্বতালাশ করব।

কলকাতা থেকে ফিরে একদিন সন্ধ্যায় আমি আর্ট ইন্সটিটিউটে দুরদানার খোঁজ করতে গিয়েছিলাম। দেখা হয়নি। সেদিন দুরদানা ইন্সস্টিটিউটে আসে নি। আমি একজন ছাত্রকে চিনতাম। তার কাছে আমি একটা চিরকুট রেখে এসেছিলাম। কলকাতার স্মৃতিকণার কথা উল্লেখ করে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাই, একথা লিখে চলে গিয়েছিলাম। তারপরের দিনের কথা বলি। শরিফ মিয়ার ক্যান্টিনে দুপুরবেলা খেতে গিয়েছি। ক্যান্টিনে বিশেষ ভিড় ছিল না। হুমায়ুন একটা টেবিলের সামনে ঝুঁকে পড়ে ডায়েরি থেকে কবিতা কপি করছে। আমি তার পাশে গিয়ে বসতেই সে ডায়েরি থেকে মুখ না তুলেই বলল, জাহিদ ভাই, চিৎকার করবেন না, চুপচাপ খেয়ে চলে যাবেন। আমার কবিতার মাত্রা গড়বড় হয়ে যাচ্ছে। মেলাতে পারছি না। আপনি চেল্লাতে থাকলে লেখার কাজ খতম।

আমি হুমায়ুনের টেবিল থেকে উঠে এসে আরেকটা টেবিলে বসেছিলাম। তখনই চক্কর-বক্কর শার্টপরা ভদ্রমহিলাকে আমার নজরে পড়ে। ভদ্রমহিলার শার্টটা প্যান্টের ভেতর ঢোকানো । ছেলেদের মতো করে মাথার চুল ছাঁটা। গলায় মেশিনগানের গুলির খোসা দিয়ে তৈরি একখানা হার। দূর থেকে দেখলে মনে হবে ভদ্রমহিলা গলায় একটা ছোটখাটো খড়গ ঝুলিয়ে রেখেছেন। এই হারটা না থাকলে তাকে আমি ছেলেই মনে করতাম। তাকে ওই বেশভূষায় দেখে আমার চোখে একটা ধাক্কা লাগল। মনে মনে চটে উঠলাম। ভদ্রমহিলা সহজে দৃষ্টি অকর্ষণ করার জন্য গলায় আস্ত মুক্তিযুদ্ধ ঝুলিয়ে রেখেছেন। তাকে ঘিরে বসে রয়েছে চারজন যুবক। এই অভিনব ফ্যাশনের স্তাবকও জুটে গেছে। যুদ্ধের রকমারি সব উপসর্গ তাতে তরুণ তরুণীদের মধ্যে নানাভাবে প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। তবে আজ যে জিনিস দেখলাম, তখন রীতিমতো ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার যোগাড়। একটা নীরব প্রতিবাদ আমার ভেতরে জন্ম নিচ্ছিল। আমি কাউকে কিছু না বলে শরীফ মিয়াকে খাওয়ার বিল মিটিয়ে দিয়ে মাঠে এসে বসলাম। মনে মনে বললাম, বেশ করেছি। মহিলাকে বুঝিয়ে দিতে পেরেছি, যত উগ্রভাবে তিনি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা করেন, মানুষও তত বিরক্ত হয়ে তাকে পরিহার করতে পারে ।

আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলে থাকতাম। সেদিন রাতে যখন ফিরলাম বুড়ো দারোয়ান হাফিজ জানালো, ছার, আপনের লগে দেখা করনের লাইগ্যা দরদান সাব বইলা একজন আইছিল। আমি কইছি কাউলকা ছকালে আটটা নটার সমে আইলে ছারের লগে দেহা অইব। হাফিজের বাড়ি ঢাকায়। ঢাকাইয়া ভাষা টানটোন আর মোচড়সহ উচ্চারণ করে সে একটা নির্মল আনন্দ পেয়ে থাকে। চিকন-চাকন মানুষটা ভাঙা ভাঙা গলায় যখন ঢাকাইয়া বুলি ঝেড়ে দেয়, তখন হাফিজের মধ্যে একটা ব্যক্তিত্ব ফুটে ওঠে। যা হোক আমি দুরদান বলে কোনো লোককে চিনিনে।

তারপরের দিন সকালবেলা ডাইনিং হলে নাস্তা করছি, এই সময় হাফিজ এসে বলল, ছার কাউলকার হেই ছাব আইছে। আমার চা খাওয়া শেষ হয়ে এসেছিল। আমি বললাম, হাফিজ একটু অপেক্ষা করতে বললো, আমি আসছি। নাস্তার বিল মিটিয়ে হল গেটে এসে দেখি, গতকাল শরীফ মিয়ার ক্যান্টিনে যাকে দেখেছিলাম, সেই মহিলা। শুধু গলায় বুলেটের হারটি নেই। হাফিজ চোখে ঝাঁপসা দেখে। আমি বললাম, হাফিজ তুমি চোখে ভাল দেখতে পাও না। ইনি ছেলে নন, মেয়ে। হাফিজ ভাল করে চোখ ঘষে ভদ্রমহিলার দিকে তাকায়। তারপর বলল, হায় হায় ছাব আমারেতো মুশকিলে ফালাইয়া দিলেন, ভিতরেতো মাইয়া মাইনসের যাওনের অর্ডার নাই।

ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলে কি কারণে মেয়েদের প্রবেশ নিষিদ্ধ কাহিনীটা আমি শুনেছি। একজন শিক্ষক দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার স্ত্রী এবং ছেলে-মেয়েদের অসহায়ত্বের কথা চিন্তা করে তার বেগমকে ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলের ওয়ার্ডেনের কাজটি দিয়েছিল। ভদ্রমহিলাকে তার আসল বয়সের তুলনায় তরুণী মনে হতো এবং চেহারায় একটা আগলা চটক ছিল। নতুন চাকরিতে যোগ দিয়েই তিনি একই সঙ্গে দুজন বিদেশী ছাত্রকে ঘায়েল করে ফেলেছিলেন। একজন মালয়েশিয়ান, আরেকজন প্যালেস্টাইনের। তার চমৎকার ক্রীড়াটি অনেকদিন পর্যন্ত সুন্দরভাবে চালিয়ে আসছিলেন। কিন্তু একদিন গোল বাঁধল। প্যালেস্টাইনের ছাত্রটি এক বিকেলবেলা অফিসের ভেজানো দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখে মালয়েশিয়ান ছাত্রটি ওয়ার্ডেনকে চুমো খাচ্ছে। এই দৃশ্য দর্শন করার পর তার রক্ত চড়চড় করে উজানে বইতে আরম্ভ করল। সে রুমে গিয়ে ছুরি নিয়ে এসে মালয়েশিয়ানটির ওপর চড়াও হলো। আঘাতের লক্ষ্য ছিল বুক, কিন্তু মালয়েশিয়ানটি সরে যাওয়ায় লেগেছিল কাঁধে। তারপর থেকে হোস্টেলে কোনো মহিলা আসা নিষেধ।

গল্পটি আমরা জানতাম। হোস্টেল তৈরি হওয়ার পর থেকে যত মজার ঘটনা ঘটেছে, তার কোনো লিখিত ইতিহাস না থাকলেও, তিন মাস বসবাস করলে সেসব না জানার উপায় থাকে না। বহুকাল আগের একটা নিয়ম আমার বেলায় এমনভাবে কার্যকর হতে দেখে আমি প্রথমত অপ্রস্তুত বোধ করলাম। দ্বিতীয়ত চটে গেলাম। অপ্রস্তুত বোধ করলাম এ কারণে যে, একজন ভদ্রমহিলার কাছে আমার মান-ইজ্জত খোয়া যাচ্ছে। তাকে আমি ঘরে নিয়ে যেতে পারছিনে। আরো চটলাম এ কারণে, এই বুড়ো মূর্খ দারোয়ান একটা বিষয় হিসেবের মধ্যে আনছে না, আমি সদ্য যুদ্ধফেরত একজন মুক্তিযোদ্ধা। সব জায়গায় মুক্তিযোদ্ধাদের সুযোগ-সুবিধে আলাদা। আইনে যা থাকুক আমি একজন ভদ্রমহিলাকে আমার ঘরে নিয়ে যেতে পারব না, তা কেমন করে হয়! কোনো রকমের অপ্রিয় বিতণ্ডা যাতে সৃষ্টি না হয়, সেজন্য দারোয়ানকে বললাম, ঠিক আছে হাফিজ, ভদ্রমহিলা অনেক দূর থেকে এসেছেন, একবার ভেতরে ঢুকতে দাও। তবু তার গোঁ ভাঙল না, না ছাব কানুন ভাঙা যাইব না, ওয়ার্ডেন ছাব আইলেও আওরত নিয়া ভিতরে যাইবার পারব না। ভাইস চ্যান্সেলর ছাব ভি না । আমি দেখলাম ওই ঠ্যাটা লোকটার সঙ্গে তর্ক করে লাভ নেই। আমি বললাম, তুমি ওয়ার্ডেন, ভাইস চ্যান্সেলর যার কাছে ইচ্ছে নালিশ করো গিয়ে, আমি গেস্ট নিয়ে ভেতরে গেলাম। সে বলল, না ছাব সেটাওভি অইবার পারব না। ভদ্রমহিলা যাতে ভেতরে ঢুকতে না পারেন, সেজন্য গেটে ঢোকার পথে দুহাত বাড়িয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আমি ভীষণ ক্ষেপে উঠছিলাম, কিন্তু কি করব, সেটা ঠিক করতে পারছিলাম না।

এতক্ষণ ভদ্রমহিলা একটি কথাও বলেন নি। দাঁড়িয়ে আমাদের বিতর্ক শুনছিলেন। এইবার তিনি হঠাৎ প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে একখানা ছুরি বের করে স্প্রিংয়ে চাপ দিলেন। সাঁই করে সাড়ে পাঁচ ইঞ্চি ফলা বেরিয়ে ঝকঝক করতে লাগল। দারোয়ানকে বললেন, এই বুড়া মিয়া, দেখছ এটা কি? সরে দাঁড়াও। নইলে বুকের মধ্যে বসিয়ে দেব। দারোয়ানের মুখ থেকে ‘ও বাবারে’ শব্দটা আপনিই বেরিয়ে এল এবং তার শরীর ভয়ে শিউরে উঠল। হাফিজ মিয়া শক্ত ধাচের মানুষ। একটা মেয়ে মানুষ ছুরি দেখিয়ে ভেতরে ঢুকবে, তা কেমন করে হয়? তাহলে দারোয়ান হিশেবে তার মানসম্মানের কিছুই থাকে না। অল্পক্ষণের মধ্যে সামনে এগিয়ে গিয়ে দ্বিগুণ দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, আপনি ছুরি মারবার চান মারেন মেমছাব, আমি আপনেরে ভেতরে যাইবার দিমু না। এই কথা শোনার পর দুরদানা ছুরি বন্ধ করে প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে রাখল। তারপর দারোয়ানের একটা হাত ধরে এমনভাবে টান দিল বেচারি একপাশে ছিটকে পড়ে গেল। মহিলা সেদিকে একবারও না তাকিয়ে বললেন, জাহিদ সাহেব, চলুন আপনার ঘরটা দেখে যাই। আমি মহিলার শরীরের জোর দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। স্মৃতিকণা তাহলে তার সম্পর্কে একটা কথাও বাড়িয়ে বলে নি। হাতেনাতে প্রমাণ পেয়ে গেলাম। দারোয়ানের নিষেধ ঠেলে ভদ্রমহিলা তো আমার ঘরে এলেন। যাইহোক, এই ঘটনার জের অনেক দূর গড়িয়েছিল। দারোয়ান রেগেমেগে ওয়ার্ডেনের কাছে নালিশ করেছিল। আইন লঙ্ন করা হয়েছে, তাতে কিছু আসে যায় না। একটা আওরত শরীরের শক্তি খাঁটিয়ে তাকে এমন নাজেহাল করতে পারে, সেই জিনিসটিই হজম করতে তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। চাকরি ছেড়ে দেবে এমন ঘোষণাও সে দিয়েছিল। সেদিনই বিকেলবেলা ওয়ার্ডেন আমার কাছে নোটিশ পাঠিয়ে জানালেন, আমাকে পত্রপাঠ তার সঙ্গে দেখা করতে হবে। আমাদের হোস্টেলের ওয়ার্ডেন দেখতে অত্যন্ত সুপুরুষ ছিলেন। কিন্তু ভেতরটা ছিল একেবারে ফাঁকা। বিশ্ববিদ্যালয় শব্দটি বাংলায় লিখতে তাকে তিনবার ডিকশনারি দেখতে হতো। মাতৃভাষায় যার এমন অগাধ জ্ঞান, বিদেশী ছাত্রদের কাছে ইংরেজিতে চিঠিপত্র লিখে কি করে প্রশাসন চালাতেন এবং চাকরি টিকিয়ে রাখতেন, সে কথা তিনি এবং তার আল্লা বলতে পারবেন। আমি বিকেল পাঁচটায় ওয়ার্ডেনের অফিসে গেলাম। তিনি আমাকে দেখামাত্রই ক্ষেপে উঠলেন, জাহিদ সাহেব, আপনি হোস্টেলে এসব কী শুরু করেছেন?

আমি বললাম, কী শুরু করেছি আপনিই বলুন! তিনি বললেন, এই হোস্টেলের রেসিডেন্ট হিসেবে আপনারই জানা উচিত এখানে কোনো মহিলার প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষেধ। অথচ হোস্টেলের আইন ভেঙে একজন মহিলাকে আপনার রুমে নিয়ে গিয়েছেন। দারোয়ান বাধা দিলে, তাকে ছুরি দিয়ে ভয় দেখানো হয়েছে। আপনি তো আর ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র নন। হোস্টেলের বোর্ডার হিসেবে নিয়ম-কানুন আপনার জানা থাকা উচিত।

আমি বললাম, আপনি ঠিক কথাই বলেছেন, আমি ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র নই। এখন একটা বিষয় আপনার কাছে জানতে চাইব। ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রদের কাছে মহিলাদের যাওয়া-আসায় কোনো বাধা নেই। আমার ছাত্র জীবন শেষ হয়েছে অনেক আগে। আমার রুমে যদি একজন মহিলা আসেন, তাতে বাধা দেয়া হয়, তার কারণ কি?

ওয়ার্ডেন আবদুল মতিন বললেন, সে কথা আপনি ভাইস চ্যান্সেলর সাহেবকে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন। তিনিই আইন করে হোস্টেলে মহিলাদের প্রবেশ বন্ধ করেছেন। আমার কাজ হোস্টেলের নিয়ম-শৃঙ্খলা রক্ষা করা।

আমি জবাবে বললাম, ভাইস চ্যান্সেলর সাহেব যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, সে কৈফিয়ত আমি তাকে দেব। তিনি বললেন, তাহলে ব্যাপারটা আপনি ভি. সি স্যারকে জানাতে বলেন? আমি বললাম, আপনার যাকে ইচ্ছে জানাতে পারেন। তারপর চলে এসেছিলাম।

তারপর থেকে দুরদানা আমার হোস্টেলে আসা-যাওয়া করতে থাকে। কেউ কিছু বলে নি। এমনকি দারোয়ান হাফিজের সঙ্গেও দুরদানা একটা ভাল সম্পর্ক করে নিয়েছে। কিভাবে সেটা সম্ভব হয়েছে, আমি ঠিক বলতে পারব না। সে এসেই জিজ্ঞেস করে, কি বুড়ামিয়া কেমন আছেন? হাফিজ একগাল হেসে জবাব দেয়, মেম ছাব, ভালই। হাফিজ পরিদর্শনের খাতাটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে, মেম ছাব, এইখানে আপনার একটা সাইন লাগান। দুরদানা আসার পর থেকে অন্য বোর্ডারদের রুমেও মহিলাদের আসা-যাওয়া শুরু হয়ে যায়।

মহিলাদের হোস্টেলে আসার বিধিনিষেধ উঠে গেল এবং সে সুযোগটাকে পুরোপুরি কাজে লাগালেন স্বয়ং ওয়ার্ডেন আবদুল মতিন। কিছুদিন পর তিনি দেশের বাড়িতে গেলেন এবং এক মহিলাসহ ফিরে এলেন। পরিচয় দিলেন তার স্ত্রী বলে। ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলের তার নিজের রুমটিতে তারা স্বামী-স্ত্রী একই সঙ্গে বসবাস করতে আরম্ভ করলেন। কিছুদিন পর বলা নেই, কওয়া নেই, হঠাৎ পুলিশ এসে আবদুল মতিন এবং তার স্ত্রীকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল। তখনই আমরা আসল ঘটনাটা জানতে পারলাম। ওয়ার্ডেন স্ত্রীর পরিচয়ে যে মহিলার সঙ্গে বসবাস করছিলেন,সে মহিলা তার বিয়ে করা স্ত্রী নয়। তার এক মামাতো না ফুপাতো ভাই দুবাই কি কুয়েত নাকি সৌদি আরবে থাকত, ভায়ের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে মতিন তার বউটিকে ফুসলিয়ে এনে স্ত্রীর পরিচয় দিয়ে হোস্টেলে একই সঙ্গে বসবাস করছিলেন। জ্ঞাতিভ্রাতা ফিরে এসে মামলা করলে পুলিশ তাদের দুজনকে গ্রেফতার করে। ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলের ভাগ্যই এমন, ওয়ার্ডেন হিশেবে যারাই এখানে আসেন, একটা-না-একটা যৌন কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে যাবেনই।

.

০৪.

সেদিনই সন্ধ্যেবেলা হোস্টেলে এসে একটা চিরকুট পেলাম। পাঠিয়েছেন মাহমুদ কবির সাহেব। তিনি বয়সে প্রবীণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষকদের একজন। আমাদের মতো তরুণদের সঙ্গে মেলামেশা করেন বলে বিশ্ববিদ্যালয়ে তার বদনাম। অনেক বুড়ো বুড়ো শিক্ষকদের বলতে শুনেছি ড. মাহমুদ কবির চ্যাঙড়া পোলাপানদের আশকারা দিয়ে এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছেন, প্রবীণ শিক্ষকদের মান-ইজ্জত নিয়ে চলাফেরা করা একরকম দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আমরা পাঁচ-সাত বছর ধরে মাহমুদ সাহেবের বাড়িতে আসা-যাওয়া করছি। তার কখনো চিরকুট পাঠিয়ে কাউকে বাড়িতে ডাকতে হয়েছে, এমন সংবাদ আমার জানা নেই। আমি একটুখানি চিন্তিত হলাম। নিশ্চয়ই কোনো জরুরি ব্যাপার। জামা কাপড় ছেড়ে গোসল করে ফেললাম। গোসল করার পর বেশ ঝরঝরে বোধ করতে থাকি। তখুনি পেটের খিদেটা টের পেলাম। ড. মাহমুদ সাহেবের বাড়িতে যাওয়ার আগে কিছু খেয়ে নেয়া প্রয়োজন। ক্যান্টিনে গিয়ে দেখলাম, চা ছাড়া খাওয়ার মতো কিছু নেই। অগত্যা শরিফ মিয়ার ক্যান্টিনে যেতে হলো। একটা একটা করে চারটে সিঙারা খেয়ে ফেললাম। চায়ে চুমুক দিয়েছি, এমন সময় দেখতে পেলাম হুমায়ুন কোণার দিকের টেবিলটাতে বসে ঘুসুর-ঘুসুর করে মজিদ মামার সঙ্গে কথা বলছে। মজিদ মামা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নন। কখনো ছাত্র ছিলেন কি না, তাও আমার জানা নেই। সব সময় একখানা সাইকেল নিয়ে ঘোরাফেরা করেন। পাজামার সঙ্গে তিন দিকে পকেটঅলা হাঁটু পর্যন্ত বিস্তৃত একটা নকশা আঁকা শার্ট পরেন। সবসময়ে ওই পোশাকেই তাকে দেখে আসছি। তিনি শার্টের গভীর পকেট থেকে পানের ছোট ছোট বানানো খিলি বের করে মুখের ভেতরে পুরে নেন। তার পান খাওয়ার একটা বিশেষ ভঙ্গি আছে। ঠোঁট ফাঁক না করেই তিনি পানটা চিবিয়ে কিভাবে হজম করে ফেলেন, সেটা আমার কাছে একটা বিস্ময়ের ব্যাপার। অতিরিক্ত পান খাওয়ার জন্যে তার বড় বড় দাঁতগুলো গ্যাটগেটে লাল দেখাতো। প্রথম যেদিন মজিদ মামার সঙ্গে হুমায়ুন পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল তার লাল লাল দাঁতগুলোই আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। আমি ভীষণ রকম অস্বস্তি বোধ করেছিলাম। মজিদ মামা কোথায় থাকেন, কি করেন এবং হুমায়ুনের কি ধরনের মামা, এসব কিছুই জানতাম না। হুমায়ুন মামা ডাকত, আমরাও মামা ডাকতাম। দিনে দিনে মজিদ আমাদের অনেকেরই কমন মামা হিশেবে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন।

আমি বিল পরিশোধ করে বাইরে এসে দেখি, আমার পেছন পেছন হুমায়ুন এবং মজিদ মামাও বাইরে চলে এসেছেন। হুমায়ুন আমাকে জিজ্ঞেস করল, জাহিদ ভাই কোথায় যাচ্ছেন? আমি বললাম, যাচ্ছি এক জায়গায়। একটু বসবেন? আমি বললাম, না, আমার কাজ আছে। আমি দেখলাম হুমায়ুন মজিদ মামার সাইকেলের পেছনে বসে শাহবাগের দিকে কোথায় চলে গেল। নীলক্ষেতের অপরূপ সন্ধ্যে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। এই কেশবতী সন্ধ্যে আমাকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরল, মনে হচ্ছিল, আমি শান্তি সরোবরের ওপর দিয়ে হাঁটাচলা করছি। কলাভবনের চারপাশে অনেকক্ষণ ধরে ঘুরে বেড়ালাম। কঁকড়া ঝাকড়া আবছা অন্ধকারে গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে। তাদের পত্রপল্লবের মধ্যে বিধাতার আশীর্বাদের মতো শান্তি স্থায়ী নীড় রচনা করে আছে। গুরু দুয়ারার ভেতর থেকে শিখ পুরোহিতের কণ্ঠের ভজনের ধ্বনি ভেসে আসছে। প্রার্থনার ভাষা এত সুন্দর! আপনা থেকেই আমার চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। আমি গুরু দুয়ারার পেছনে শিশু গাছটির গোড়ায় বসে পড়লাম এবং অনেকক্ষণ ধরে ভজন শুনলাম। ভজন থেমে যাওয়ার পরও সেই স্তব্ধতার মধ্যে চুপ করে বসে রইলাম। আমার মনে হচ্ছিল অতল স্তব্ধতার ভেতর থেকে জাগ্রত প্রার্থনার ভাষা ছাড়া জীবনের জন্য অন্য কোনো সত্য বস্তু নেই।

এক সময়ে আমাকে উঠতে হলো। ড. মাহমুদ কবিরের বাড়ির দরজার বেল টিপলাম। তার সব সময় মুখ হাঁ-করে-থাকা কাজের লোকটা বাঁ দিকের দরজাটা খুলে দিল। সামনের দরজাটা বরাবরের মতো আজো তালা আটকানো। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পঁচিশে মার্চের ক্র্যাকডাউনের পর থেকেই সামনের দরজায় তালা আটকানোর রেওয়াজ চালু হয়েছে। সামনের দরজার তালা আটকানো মানে কেউ বাড়িতে নেই। এখন বাড়িতে সবাই থাকলেও সামনের দরজার তালা বিদেয় নেয় নি। তার মানে বাড়ির মানুষদের মানসিক ভীতি এবং অনিশ্চয়তার অবসান হয় নি। আমি ভেতরে ঢুকে দেখলাম ড. মাহমুদের বাড়িতে অনেক মানুষ। তিনি আজ বিকেলবেলা দাড়ি কাটেন নি। তার ফরসা মুখমণ্ডলে রসুনের শেকড়ের মতো অজস্র দাড়ি অঙ্কুর মেলেছে। তিনি গড়গড়া টানছিলেন। সবাই মিলে কি নিয়ে আলোচনা করছিলেন বুঝতে পারলাম না। আমাকে দেখামাত্রই ড. মাহমুদ কবির উত্তেজনার তোড়ে একরকম উঠে দাঁড়ালেন। গড়গড়ার নলটা হাত থেকে নিচে পড়ে গেল। কোনোরকম ভূমিকা না করেই তিনি বললেন, তোমার সাহস তো কম নয় হে ছোকরা! তিনি কোথায় কেমন করে আমার সাহসের পরিচয় পেলেন, বুঝতে পারলাম না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, স্যার আমার অপরাধ কি? আমি দাঁড়িয়ে রইলাম, কারণ বসবার জায়গাগুলো অন্য সবাই আগে থেকেই দখল করে আছেন। কেউ আমাকে বসবার জায়গা করে দিলেন না। তিনি গড়গড়ার নলটা কুড়িয়ে নিয়ে টান দিয়ে দেখেন তামাক পুড়ে শেষ। কড়া স্বরে আকবর বলে ডাক দিলেন। সেই মুখ হাঁ-করা মানুষটা সামনে এসে দাঁড়ালে কল্কিটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, তামাক লাগাও। ড. মাহমুদ যেভাবে তামাক এবং চা দেয়ার জন্য হুংকার ছেড়ে কাজের মানুষটিকে ডাক দিয়ে বীরত্ব প্রকাশ করেন, তার সঙ্গে সেনা প্যারেডের কমান্ডিং অফিসারের অনায়াসে তুলনা করা যায়। আকবর ফুঁ দিতে দিতে কল্কিটা হুঁকোর ওপর বসিয়ে দিতেই তিনি লম্বা করে ধোঁয়া ছড়ালেন, তারপর বললেন, সবাই বলছে তুমি ইউনুস জোয়ারদারের ডাকু বোনটির সঙ্গে যত্রতত্র ঘোরাফেরা করছ। ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলের ওয়ার্ডেন আজ সকালবেলা মর্নিং ওয়াকের সময় আমাকে বলেছেন তুমি দুরদানা না ফুরদানা সেই গুণ্ডা মেয়েটিকে নিয়ে দারোয়ানকে ছুরি মারার ভয় দেখিয়েছ। ওয়ার্ডেন মতিন তোমাকে সতর্ক করার জন্য ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন, তুমি উল্টো তাকে হুমকি দিয়েছ। ব্যাপারটা ভাইস চ্যান্সেলরের কান পর্যন্ত এসেছে। তিনি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ এবং বিরক্ত। ওই গুণ্ডা মেয়েকে নিয়ে ঘোরাফেরা করলে তুমি তো বিপদে পড়বেই এবং যাদের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক আছে, তাদের সবাইকেও বিপদে ফেলবে। ওই মেয়ের ভাই ইউনুস জোয়ারদার একজন সন্ত্রাসী, খুনি। সে সব জায়গায় মানুষ খুন করে বেড়াচ্ছে। বোনটাও ভাইয়ের মতো সাংঘাতিক। শুনেছি সবসময় সে ছুরি-পিস্তল সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। তুমি নিরীহ মানুষের সন্তান, তুমি কেন ওসবের মধ্যে নিজেকে জড়াবে! মুজিব সরকার ইউনুসকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেছে, জানো!

ড. মাহমুদ হুঁকোয় টান দেয়ার জন্য একটু বিরতি দিলেন। ওই ফাঁকে মওলানা হান্নান কথা বলতে আরম্ভ করল। বলা বাহুল্য সে পাজামা-পাঞ্জাবির বদলে হাফহাতা সাদা হাওয়াই শার্ট এবং প্যান্ট পরে এসেছে। মওলানা হান্নান যখন একটানা কথা বলে, তার গলা থেকে একটা চিঁহি জাতীয় আওয়াজ বের হয়। সেটাকে মনুষ্য-মুখ নিঃসৃত ধ্বনি বলে মেনে নিতে অনেকেরই আপত্তি হবে। হান্নান সেই চিহি স্বরেই বলে যেতে থাকল, আমি নিজের চোখেই দেখেছি, বলাকা সিনেমার কাছে ওই মেয়েকে বদমাশ পোলাপানরা চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছিল। তাদের ইচ্ছে ছিল তার শরীর থেকে প্যান্ট-শার্ট খুলে নিয়ে উদোম করে ছেড়ে দেবে। মেয়েটি পকেট থেকে পিস্তল বের করে ওপর দিকে গুলি ছুঁড়েছিল। ভয় পেয়ে সবাই সরে দাঁড়ালে এক ফাঁকে মেয়েটি বেবিট্যাক্সিতে চড়ে পালিয়ে যেতে পেরেছিল। কিন্তু তার জামা কাপড় সব ফালা ফালা করে ছিঁড়ে ফেলেছিল। দুরদানার ভয়ংকরী মূর্তির একমাত্র চাক্ষুষ সাক্ষী মওলানা হান্নান। সে যখন বলাকা সিনেমার ঘটনাটা বয়ান করছিল, তার চোখের মণি দুটো কোটর থেকে একরকম বেরিয়েই আসছিল।

দেখা গেল উপস্থিত ভদ্রলোকদের প্রায় সবারই দুরদানা সম্পর্কে বলার মতো একেকটা গল্প জমা হয়ে আছে। ইংরেজি বিভাগের কামরুল চৌধুরী বললেন, তিনি শুনেছেন ওই মেয়েটি ছেলেদের কাঁধে হাত দিয়ে পথে-ঘাটে ঘুরে বেড়ায়। গুণ্ডা বদমাশের মতো শিস দেয়। একটা মেয়ে ওইভাবে এমন বেপরোয়াভাবে যদি ঘুরে বেড়ায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ম-শৃঙ্খলা বলে কিছু থাকবে না। নৈতিকতার প্রশ্নটিও তিনি টেনে আনলেন। আরেকজন বললেন, এই মেয়েটা এক সময় সর্বনাশ ডেকে আনবে। তার কাছে অকাট্য প্রমাণ রয়েছে, মেয়েটি সন্ত্রাসীদের চর। তার মাধ্যমেই ভূতলবাসী সন্ত্রাসীরা একে অন্যের কাছে খবর-বার্তা পাঠিয়ে থাকে। তাদের অস্ত্রশস্ত্র, গোলা-বারুদ লুকিয়ে রাখার দায়িত্বও দেয়া হয়েছে তার ওপর।

ড. মাহমুদের বাড়ি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মনোভাব নিয়ে আমি ফিরলাম । দুরদানা সম্পর্কে যেসব কথা শুনলাম, তাতে করে তাকে একজন দেবী চৌধুরানী জাতীয় নায়িকা বলে মনে হচ্ছিল। ওই রকম অঘটনঘটনপটিয়সী, দুর্দান্ত সাহসী একজন তরুণীর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়েছে, এটাকে আমি ভাগ্যের ব্যাপার বলেই ধরে নিলাম। তাদের কথাবার্তা থেকে যে জিনিসটি বেরিয়ে এসেছে তার মধ্যে দোষের কোনো কিছুই খুঁজে পাইনি। বরঞ্চ আমার মনে হয়েছে, দুরদানা এক অসাধারণ তরুণী। যে মেয়ে একদল বদমাশের ভেতর থেকে শুধু রিভলবারের একটা আওয়াজ করে বেরিয়ে আসতে পারে, তার হিম্মতের তারিফ করার বুকের পাটা কারো নেই। তারা যেগুলোকে দোষের বিষয় বলে বয়ান করলেন, আমি সেগুলোকে গুণ বলে মনে করলাম। এতক্ষণ ড. মাহমুদের বাড়িতে প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদের মুখ থেকে দুরদানা সম্পর্কিত যে অপবাদ আমাকে শুনতে হলো, সেগুলোকে আমি কতৃপ্রয়াসী কতিপয় ঝুনো পণ্ডিতের নিছক অক্ষম কাপুরুষতা বলে ধরে নিলাম।

ড. মাহমুদের বাড়ি থেকে ফিরে আসার পর আমি যেন দুরদানা সম্পর্কে নতুন একটা দিব্যদৃষ্টি লাভ করলাম। মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে আমার নতুন জন্ম হয়েছে। আমি অনেক তথাকথিত পবিত্র মানুষের লোভ-রিরংসা একেবারে চোখের সামনে বীভৎস চেহারা নিয়ে জেগে উঠতে দেখেছি। আবার অত্যন্ত ফেলনা তুচ্ছ মানুষের মধ্যেও জ্বলন্ত মনুষ্যত্বেও শিখা উজ্জল হয়ে জ্বলে উঠতে দেখেছি। আমার চেতনার কেন্দ্রবিন্দুটিতে এমন একটা চুম্বক-ক্ষেত্র তাপে-চাপে তৈরি হয়ে গেছে, সামান্য পরিমাণে হলেও খাঁটি পদার্থ দেখতে পেলে মন আপনা থেকেই সেদিকে ধাবিত হয়। গতানুগতিক নারীর বাইরে দুরদানার মধ্যে আমি এমন একটা নারীসত্তার সাক্ষাৎ পেলাম, সর্বান্তঃকরণে তাকে আমাদের নতুন যুগের প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করতে একটুও আটকালো না । দুরদানা যখন সাইকেল চালিয়ে নাখালপাড়া থেকে আর্ট ইনস্টিটিউটে আসত, আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখতাম। আমার মনে হতো দুরদানার প্রতিটি প্যাডেল ঘোরানোর মধ্য দিয়ে মুসলিম সমাজের সামন্তযুগীয় অচলায়তনের বিধি-নিষেধ ভেঙে নতুন যুগ সৃষ্টি করছে। সেই সময়টায় আমরা সবাই এমন একটা বদ্ধ গুমোট পরিবেশের মধ্যে বসবাস করছিলাম, অনেক সময় নিজের নিশ্বাসের শব্দ শুনেও আতঙ্কে চমকে উঠতে হতো। আমরা পাকিস্তানের আতঙ্ক-রাজ্যের অস্তিত্ব খুঁড়িয়ে দিয়ে নিজেরা সজ্ঞানে-স্বেচ্ছায় আরেকটা আতঙ্ক রাজ্য কায়েম করে তুলেছিলাম। আমাদের জনগণের রক্ত থেকে, মৃত্যু থেকে, আমাদের মুক্তিসেনানীদের মৃত্যুঞ্জয়ী বাসনার উত্তাপ থেকে রাতারাতি কী করে কখন আরেকটা কারাগার আমাদের জাতীয় পতাকার ছায়াতলে তৈরি করে নিলাম, নিজেরাও টের পাইনি। আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের সম্মোহন-মন্ত্রে স্বর্গাদপি গরিয়সী মাতৃভূমিটির যে উদার গগনপ্রসারী ছবি ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করতাম, সেই প্রয়াস বার বার ব্যর্থ হয়ে যেত। দৃষ্টির সামনে বার বার একটা খাঁচা তার চারদিকের দেয়ালের সোনালি কারুকাজসহ দৃষ্টির সামনে উদ্ভাসিত হয়ে উঠত। এই খাঁচার ভেতরেই আমাদের বসবাস। এখানে সবকিছু বিকলাঙ্গ, সবকিছু অসুস্থ, অস্বাস্থ্যকর। এই পরিবেশে, এই পরিস্থিতিতে একজন তরুণী সমস্ত বাধা-নিষেধ অস্বীকার করে প্রবল প্রাণশক্তির তোড়ে চারপাশের সমস্ত কিছু একাকার করে ফেলতে চাইছে, আমি একে জীবনের স্বাধীনতা সৃষ্টির একটা মহৎ প্রয়াস বলে ধরে নিলাম। লোকে দুরদানা সম্পর্কে যত আজে-বাজে কথা বলুক না কেন, সেগুলোকে আমি জমাট-বাঁধা কাপুরুষতা ছাড়া কিছুই মনে করতে পারলাম না। বিকৃত রুচির কিছু মানুষ যেমন এলিজাবেথ টেলর কিংবা সোফিয়া লোরেনের ছবি সামনে রেখে গোপনে মাস্টার্বেশন করে আনন্দ পায়; দুরদানা সম্পর্কে রটনাকারীদেরও তাদের সমগোত্রীয় বলে ধরে নিলাম। মাঝে মাঝে মনে হতো যুগের প্রয়োজনে এই মেয়ে পাতাল-ফুড়ে গোঁড়া মুসলমান সমাজে আবির্ভূত হয়েছে। সে যদি শাড়ি-ব্লাউজের বদলে প্যান্ট-শার্ট পরে বেড়ায়, তাতে কি হয়েছে? তুচ্ছ গয়নাগাটির বদলে ছুরি-পিস্তল নিয়ে যদি ঘোরাঘুরি করে, সেটা অনেক বেশি শোভন, অনেক বেশি মানানসই।

আমি দুরদানার দিকে প্রবলভাবে ঝুঁকে পড়লাম। ঝুঁকে পড়লাম তার প্রেমে পড়েছি বলে নয়। তার মধ্যে প্রাণশক্তির সবল অঙ্কুরণ দেখে তার প্রতি আমি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। লোকে তার নামে যা-তা বলে বেড়ায়, কারণ সে অন্য রকম। কেউ কখনো বলতে পারে নি সে পুরুষ মানুষের সঙ্গে ক্লাবে গিয়ে মদ খেয়ে কখনো মাতাল হয়েছে, টাকা নিয়ে কোনো ধনী ব্যক্তির অঙ্কশায়িনী হয়েছে, কিংবা প্রেমের ছলনা করে সাত-পাঁচটা পুরুষ মানুষকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়ে বেরিয়েছে। লোকে তার নিন্দে করত, কারণ সে ছিল একান্তভাবে সুস্থ এবং স্বাভাবিক। একদিন তার বাবা যখন বললেন, কলেজে আসা-যাওয়ার রিকশা ভাড়া দেয়ার ক্ষমতা তার নেই, তখন সে সাইকেল চালানো শিখে নিয়ে একটা সেকেন্ডহ্যান্ড সাইকেল জোগাড় করে রিকশা ভাড়ার সমস্যার খুব একটা সহজ সমাধান করে নিল। একা একটা মেয়েকে সাইকেলে চলাচল করতে দেখলে সময়-অসময়ে বখাটে ছেলেরা তার ওপর চড়াও হতেও দ্বিধা করত না। এই রকম উৎপাত থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য সম্প্রতি সে নিজের সঙ্গে একটা চাকু রাখতে আরম্ভ করেছে। সাইকেল চালাতে গিয়ে একদিন সে আবিষ্কার করল শাড়ি পরে সাইকেল চালাতে বেশ অসুবিধে হয়। সে শাড়ির পাট চুকিয়ে দিয়ে প্যান্ট-শার্ট পরতে আরম্ভ করল।

তার ভাই চরমপন্থী রাজনীতি করত। রাজরোষ তার মাথার ওপর উদ্যত খড়গের মতো ঝুলছিল। সরকার তার মাথার ওপর চড়া দাম ধার্য করেছে। এমন ভায়ের বোন হিসেবে তার লুকিয়েচুপিয়ে থাকা উচিত ছিল। কিন্তু দুরদানা সে অবস্থাটা মেনে নেয় নি। ভাইয়ের বিপ্লবী রাজনীতি সম্বন্ধে তার অপরিসীম গর্ববোধ ছিল। তাই সবসময় সে মাথা উঁচু করে বেড়াতো। আমাদের সমাজে এই এতখানি স্বাভাবিকতা সহ্য করার খুব বেশি মানুষ ছিল না। কেউ কেউ তাকে পথেঘাটে আক্রমণ করত। যারা তার ওপর হামলা করত দুরদানা তাদের কোনো ক্ষতি করে নি। যারা তার নামে নানা রকম অশ্লীল গল্প রটিয়ে বেড়াতো, তাদের যৌন-যন্ত্রটা আসল জায়গার বদলে মগজের গভীর প্রদেশে অবস্থান করত বলে এমন সুন্দর কাহিনী তারা অনায়াসে রচনা করতে পারত।

দুরদানা আমার ঘরে এসেছে, দারোয়ান হোস্টেলে ঢুকতে বাধা দিয়েছে, সে পকেট থেকে ধারালো চাকু বের করে দারোয়ানের ভুঁড়ি ফাঁসিয়ে দিতে গিয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব দারোয়ান একজোট হয়ে ভাইস চ্যান্সেলরের কাছে বিচার দাবি করেছে এবং ভাইস চ্যান্সেলর আমাকে ডেকে কড়া কৈফিয়ত তলব করেছে, এইসব খবর গোটা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বোমা ফাটানোর মতো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল। আমি খুব অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম আর্ট ইনস্টিটিউটে দুরদানা নামে এক ডাকাবুকো মহিলা আছে এবং সে সব ধরনের অকাণ্ড ঘটিয়ে তুলতে ওস্তাদ, একথা আমি ছাড়া সবাই জানে। ঘটনাটি মওলানা হান্নানকে কি রকম বিচলিত করে তুলেছিল তার উল্লেখ করছি। অবশ্য তার আগে মওলানা হান্নানের বিষয়ে একটা ধারণা দেয়া প্রয়োজন। হান্নান সম্প্রতি ইসলামিক স্টাডিজের লেকচারারের চাকরি পেয়েছে। সে সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পরে ক্লাস করতে আসত এবং দাড়ি রাখার একটা নতুন স্টাইল সৃষ্টি করেছিল। কানের নিচে থেকে শুরু করে থুতনি হয়ে কানের অপর অংশ পর্যন্ত বিস্তৃত দ্বিতীয়ার চাঁদের মতো দাড়িতে তাকে ভাল কি খারাপ দেখাতো, সেটা বড় কথা নয়, কিন্তু চোখে পড়ত।

রোদ বৃষ্টি থাকুক-বা-না-থাকুক সময় সময় ছোট ছাতাটা মাথার ওপর মেলে ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসত। সে সময় গোল টুপিটা মাথার বদলে শোভা পেত হাতে। তার সম্পর্কে আরেকটি মজার সংবাদ হলো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফেরার পর পাজামা-পাঞ্জাবি বদলে শার্ট-প্যান্ট পরত। আমরা তাকে নিয়ে নানারকম মজা করতাম। আমাদের ঠাট্টা-তামাশা সে গায়ে মাখত না। আমরা জিজ্ঞেস করতাম, মওলানা তুমি এরকম করে দাড়ি ঘেঁটেছ কেন? হান্নান গম্ভীর হয়ে জবাব দিত, চাঁদ হলো ইসলামের চিহ্ন। তাই আমার দাড়ি আমি আলহেলালের মতো করে রেখেছি। মওলানা হান্নানের এরকম অনেক ব্যাপার ছিল, যেগুলো চট করে চোখে পড়ে যেত।

ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে বুড়ি বুড়ি শিক্ষিকাদের রুমে রুমে গিয়ে গল্প করতে সে খুব পছন্দ করত। সেদিকে ইঙ্গিত করে কোনো কিছু বললে, পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে জবাব দিত, না না, বেআইনি কিছু নয়। গুলশান আপার সঙ্গে আমি ধর্ম এবং দর্শনের কিছু সমস্যার কথা আলোচনা করে আনন্দ পেয়ে থাকি। তার মুখে একটা লজ্জার ছোঁয়া লাগত। সেটা চাপা দেয়ার জন্যে ‘গুলশান আপার ধর্মতত্ত্ব সম্বন্ধে কত অগাধ জ্ঞান’ বলে একটা নাতিদীর্ঘ লেকচার দিয়ে বসত।

হান্নান এক শুক্রবার বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের সামনে আমাকে আটক করে বসল। সে জুমার নামাজ আদায় করে মসজিদ থেকে বেরিয়েছে। আমি তাকে পাশ কাটিয়ে চলে আসছিলাম। হান্নান আমার কলার ধরে হিড়হিড় করে ছাতিম গাছের গোড়ায় টেনে নিয়ে গেল। আমি আশঙ্কা করছিলাম, হান্নান শুক্রবারে জুমার নামাজ পড়ার ফজিলত সম্পর্কে কিছু হেদায়েত করবে। আমিও একটু ভড়কে গিয়েছিলাম। সে আজ পাঞ্জাবির ওপর আচকান চাপিয়েছে, চোখে সুরমা, কানে আতর মাখানো তুলো গোঁজা। সব মিলিয়ে একটা পবিত্র-পবিত্র ভাব। এই বিশেষ সাজ-পোশাকে আমার সঙ্গে যদি গুলশান আপার সঙ্গে যেমন করে, সেরকমভাবে ধর্মতত্ত্বের আলোচনা শুরু করে, আমি বেকায়দায় পড়ে যাব। তাই তাড়াতাড়ি কাট মারার জন্যে বললাম, হান্নান, কি বলবার আছে তাড়াতাড়ি বলো, খিদেয় প্রাণ বেরিয়ে আসছে। হান্নান আমার কথা গ্রাহ্যই করল না। জামার কলারটা ভাল করে চেপে ধরে বলল, জাহিদ তোমার কাজটা বেআইনি হচ্ছে। আমি বললাম, বেআইনী কাজ তো তুমিই করো। গুলশান আপার মতো মডার্ন মহিলার সঙ্গে ধর্মতত্ত্বের আলোচনা করাটা হলো দুনিয়ার সবচাইতে বেআইনি কাজ। হান্নান আমার কথা মোটেই আমল না দিয়ে মুখ গম্ভীর করে বলল, আমি জানি তুমি দুরদানা বেগমের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে আসছ। আমি বললাম, আড্ডা দিয়ে আসছি ভাল করেছি, তুমি জানলে কি করে? সে বলল, শাহবাগ থেকে আসার সময় তোমাদের দুজনকে দেখেছি। আমি বললাম, দেখেছ বেশ করেছ। মওলানা তুমি মিছেমিছি নামাজ পড়লে । আল্লাহ তোমার জুমার নামাজ কবুল করবে না। তুমি নামাজ পড়তে পড়তে কোন্ ছেলে কোন্ মেয়ের সঙ্গে কি করল এসব চিন্তা করেছ। কলার ছাড়, আমি যাই।

মওলানা হান্নানের মুখের ভাবে একটা পরিবর্তন এল, জাহিদ, আমি তোমার ভালর জন্যেই বলছিলাম, দুরদানা বেগমের সঙ্গে তোমার মেলামেশা ঠিক হচ্ছে না । কথাটা শুনে চটে উঠলাম, হান্নান, হঠাৎ করে আমার ভাল-মন্দ নিয়ে তুমি এমন আগ্রহী হয়ে উঠলে কেন? সে বলল, আহা ভাই চটো কেন? দুরদানা বেগম একটা বিপজ্জনক মহিলা। সে প্যান্ট-শার্ট পরে, গলায় মেশিনগানের বুলেটের হার ঝোলায়, পকেটে এই এ্যাত্তবড় চাকু রাখে, ব্যাটাছেলেদের কাঁধে হাত দিয়ে কথা বলে, ভুস ভুস ধোয়া ছেড়ে সিগারেট খায়, আর সাইকেলে চড়ে যেখানে-সেখানে চলে যায়। বন্ধু হিসেবে বলছি, এই রকম মেয়েছেলের সঙ্গে চলাফেরা করলে তোমার নামে কলঙ্ক রটে যাবে। তার অনেক খবর আমি রাখি। তবে একটা কথা তোমাকে বলি, দুরদানা সত্যিকার মেয়েছেলে কি না আমার সন্দেহ আছে। আমার ইচ্ছে হচ্ছিল দুরদানাকে গিয়ে ডেকে আনি এবং বলি, দুরদানা, তোমার ছুরিখানা মওলানা হান্নানের থলথলে হুঁড়িটার মধ্যে ঢুকিয়ে দাও। সেটি যখন আপাতত সম্ভব হচ্ছে না হান্নানের সঙ্গে রসিকতা করার ইচ্ছেটাই আমার প্রবল হয়ে উঠল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, মওলানা, দুরদানা যে মেয়ে না, কি করে তোমার এ সন্দেহ জন্মাল? হান্নান কানে গোঁজা আতর মাখানো তুলোর টুকরোটি বের করে নিয়ে আমার নাকে চেপে ধরল। তারপর বলল, শুঁকে দেখো, গন্ধ কেমন। উৎকট বোটকা গন্ধে আমার কাশি এসে গেল। সেদিকে খেয়াল না করেই বলল, মেয়ে মানুষের হওয়া উচিত এই আতরের গন্ধের মতো এবং আরো হওয়া উচিত মাখনের মতো তুলতুলে নরম । যে মেয়েমানুষ প্যান্ট-শার্ট পরে, সিগারেট খায়, ব্যাটাছেলের কাঁধে হাত দিয়ে চলাফেরা করে, যখন-তখন সাইকেলে চড়ে জায়গা-অজায়গায় যাওয়া-আসা করে, তার মধ্যে মেয়েমানুষের কি থাকে? আমার কথাগুলো তুমি একটু ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখো। আমি বললাম, মওলানা আতরের ঘ্রাণের মতো, মাখনের মতো তুলতুলে মেয়ে মানুষের কথা তুমি এবাদত করার সময় চিন্তা করতে থাক, আল্লাহ মেহেরবান, মিলিয়েও দিতে পারেন। আমি চলোম। রাগে-ক্ষোভে হান্নানের ছাতিটা দশ হাত দূরে ছুঁড়ে দিয়ে আমি চলে এসেছিলাম।

হান্নান মওলানার কবল থেকে রেহাই পেয়ে আমি তো হোস্টেলে এলাম। কিন্তু তারপর থেকে আমার মনে একটা চিন্তা জন্ম নিল। মওলানার জগৎ বিশ্ববিদ্যালয়, মসজিদ, বাসা এবং নিউমার্কেটের কাঁচাবাজার। এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অথচ দুরদানার সমস্ত সংবাদ তার নখদর্পণে। আমি দুপায়ে সমস্ত ঢাকা শহর চষে বেড়াচ্ছি কিন্তু দুরদানার বিষয়ে কোনো কিছু জানিনে। নিজের সম্পর্কে একটা ধারণা ছিল। সেটা ভেঙে গেল । নিজের ওপর চটে গেলাম। সেদিন দুপুরে খাওয়ার পর সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। কখন রাজ্যের ঘুম এসে আমার সমস্ত চেতনা আচ্ছন্ন করে ফেলল, টেরই পাইনি। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে একটা বিদঘুঁটে স্বপ্ন দেখলাম। আমি একটা মোটরযানের ওপর চড়েছি। গাড়ি, ট্রাক, পিকআপ, এমনকি জিপের সঙ্গেও যানবাহনটির তুলনা চলে না। বাইরে থেকে দেখলে অনেকটা মিলিটারির ট্যাঙ্কের মতো দেখায়। কিন্তু ভেতরের আসন ইত্যাদি সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম। এই যন্ত্রযান তীব্রবেগে সামনের দিকে ছুটে যাচ্ছে। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, শহরের বাঁধানো রাজপথ দিয়ে যানটা চলছে না। ঘরবাড়ি ইলেকট্রিক পোস্ট সবকিছু তছনছ করে অত্যন্ত মসৃণ গতিতে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আর একজন মহিলা ডান হাতে স্টিয়ারিং হুইল ঘোরাচ্ছে এবং বাম হাতে সিগারেট টানছে। ভদ্রমহিলার চেহারা ভাল করে চোখে পড়ছে না। আমি শুধু তার মুখের একটা অংশ দেখতে পাচ্ছি। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে ঘুম ভেঙে গেল। জেগে ওঠার পরও অনেকক্ষণ পর্যন্ত ইঞ্জিনের ভন ভন শব্দ আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। ক্রমাগত নিজেকে প্রশ্ন করতে লাগলাম, এরকম একটা উদ্ভট স্বপ্ন দেখলাম কেন!

.

০৫.

দুদিন বাদে হুমাযুন শরীফ মিয়ার ক্যান্টিনে আমাকে পাকড়াও করে বলল, জাহিদ ভাই, আপনার সঙ্গে কথা আছে। আমি বললাম, বলে ফেল। হুমায়ুন বলল, আপনি চা-টা শেষ করুন, এখানে বলা যাবে না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ভাল, না খারাপ কথা। হুমায়ুন বলল, সে আপনি পরে বিবেচনা করবেন। তারপর সে আমাকে রমনা রেসকোর্সের এক কোণায় নিয়ে গেল। হাজি শাহবাজের মসজিদের উত্তর দিকের ঝাঁকড়া বিলেতি গাব গাছটার গোড়ায় গিয়ে পা ছড়িয়ে বসল। আমাকেও বলল, জাহিদ ভাই, বসুন। তার কথামতো আমিও বসে পড়লাম। ভেবে পাচ্ছিলাম না, হুমায়ুনের এমন কি গোপন কথা থাকতে পারে বলার জন্যে এতদূরে এই নির্জন গাছতলায় টেনে নিয়ে আসার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। হুমায়ুন বলল, আমাকে একটা স্টার সিগারেট দেন। প্যাকেট খুলে একটা নিজে ধরালাম, আরেকটা ওকে ধরিয়ে দিলাম। হুমায়ুন সিগারেটে লম্বা টান দিল, তারপর নাক-মুখ দিয়ে ধোয়া ছেড়ে বলল, জাহিদ ভাই, আপনাকে একটা ব্যাপারে হুঁশিয়ার করে দেয়ার জন্যে এই এতদূরে নিয়ে এসেছি। আমি বললাম, আমি কি তোমার কোনো ক্ষতি করেছি? হুমায়ুন বলল, আপনি সবসময় আমার উপকারই করেছেন। কিন্তু আপনি নিজের ক্ষতি করতে যাচ্ছেন। আমি একটুখানি চমকে গিয়ে বললাম, আমি নিজের ক্ষতি করতে যাচ্ছি! কিভাবে? হুমায়ুন বলল, দুরদানার সঙ্গে আপনি ইদানীং খুব ঘোরাঘুরি করছেন, কাজটা ভাল হচ্ছে না। আমি বললাম, বুঝিয়ে বলল, কেন ভাল হচ্ছে না। হুমায়ুন বলল, মহিলা অসম্ভব রকম ড্যাঞ্জারাস। আমি বললাম, ড্যাঞ্জারাস মহিলাদের আলাদা আকর্ষণ আছে, সেকথা চিন্তা করে দেখেছ? আপনি রসিকতা করে উড়িয়ে দিতে চাইছেন, কিন্তু জিনিসটা খেলা নয়, তার স্বরে একটা চাপা উত্তেজনার আভাস। আমি অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে মনের ভাষা বুঝতে চেষ্টা করলাম। হুমায়ুনের মুখটা লাল হয়ে উঠেছে। সে বলতে থাকল, জানেন, আমরা আপনাকে কি রকম শ্রদ্ধা করি, আপনাকে এমন কাজ করতে দিতে পারিনে, যাতে সে শ্রদ্ধার ভাবটি চলে যায়। একটুখানি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। হুমায়ুন কি বলতে চাইছে, সেটাই আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব হচ্ছিল না। আমি বললাম, তোমরা শ্রদ্ধা করো, ঘৃণা করো, সে তোমাদের ব্যাপার। আমি তোমাকে বলিনি যে আমাকে শ্রদ্ধা করতে হবে। আর যদি শ্রদ্ধাই করো, তোমাকে খুলে বলতে হবে, কি কারণে সেটা চলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। হুমায়ুন বলল, আপনি দুরদানার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখবেন না। আমি বললাম, কেন রাখব না, সেটা বুঝিয়ে বলতে হবে। তোমার সঙ্গে ওই মহিলার হৃদয়ঘটিত কোনো ব্যাপার আছে? হুমায়ুন থু করে একদলা থুথু ফেলল, আমাকে কি এতই বাজে লোক মনে করেন যে, ওই মহিলার সঙ্গে হৃদয়ঘটিত সম্পর্ক তৈরি করব! তার সবটাইতো শরীর, হৃদয় কোথায়? আমি বললাম, মহিলার শরীর মন্দ জিনিস নয়, রোগা ছিপছিপে মহিলাকে নিয়ে ঘর করে আসছ, শরীরের মাহাত্ম বোঝার সুযোগ পাও নি, তাই এ কথা বলছ।

আমার কথা শুনে হুমায়ুনের মেজাজ সপ্তমে চড়ে গেল। সে ঘেরঅলা পাঞ্জাবির পকেট হাতিয়ে একটা পিস্তল বের করে আনল। আমাকে বলল, ধরে দেখেন। দেখলাম এই মারণাস্ত্রটির পিছল শীতল শরীর। সে আমারই সামনে যন্ত্রটি খুলে ছয়টি ছুঁচোলো গুলি দেখাল। তারপর ট্রিগারে হাত দিয়ে বলল, জানেন, এইখানে একবার চাপ দিলে একটা গুলি বেরিয়ে আসবে এবং একটা গুলিই একজন মানুষকে খুন করার পক্ষে যথেষ্ট। আমার হাসি পেয়ে গেল। হুমায়ুন পিস্তল দেখিয়ে দৈনিক বাংলার সাহিত্য সম্পাদককে কবিতা ছাপতে বাধ্য করেছে। সেই টেকনিকটা আমার ওপর প্রয়োগ করতে এসেছে। হুমায়ুন বলল, তাহলে জাহিদ ভাই আপনার সঙ্গে ফাইনাল কথা বলতে চাই। আমি বললাম, বলে ফেল। সে বলল, দুরদানার সঙ্গে মেশামেশি বন্ধ করতে হবে। আমি বললাম, একই কথা বার বার বলছ, আমি যদি তোমার প্রস্তাবে রাজি না হই, কি করবে? সে পিস্তলটা আঁকড়ে ধরে বলল, যদি কথা না রাখেন গুলি করে দেব। আমি বললাম, করে দাও। আমি জামার বোতাম খুলে বুকটা উন্মুক্ত করে দিলাম। সে ট্রিগারে হাত দিয়ে পিস্তলটা তাক করে রেখেছে, কিন্তু তার হাত কাঁপছে। সে বলল, রাজি হয়ে যান, নইলে ট্রিগার টিপে দিচ্ছি। আমার খুব রাগ হলো, দুঃখ হলো। জোরের সঙ্গে বললাম, আমি ভয় পেতে ঘৃণা করি। তুমি ট্রিগার টিপে দাও। তার সারা শরীরে একটা খিচুনি দেখা দিল এবং পিস্তলটা হাত থেকে পড়ে গেল। হুমায়ুন আওয়াজ করে বাচ্চা ছেলের মতো কাঁদতে আরম্ভ করল। আমি হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কাঁদছ কেন? হুমায়ুন বলল, অন্তত আপনি ভয়তো পাবেন। আমি বললাম, ওহ্ তাই বলো।

1 Comment
Collapse Comments

সোহাগ ভরে অনুরাগে জড়িয়ে ধীরে ধীরে / বেনারসী প্যাঁচ দিয়েছে শরীর বল্লরীরে।
এই গানটা কার লেখা বা গাওয়া বলতে পারবেন ?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *